অঙ্ক কী কঠিন!

অঙ্ক কী কঠিন!

সবেমাত্র কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার অঙ্কের মাস্টারমশাই বিভাস স্যার একদিন রাস্তায় ঘুরতে দেখে চেপে ধরলেন, “কী রে, কী করছিস আজকাল?”

বলি, “একদম বসে আছি স্যার। রেজাল্ট না বেরনো পর্যন্ত কী আর করব!”

বিভাস স্যার বললেন, “বসে থাকবি কেন? টিউশন করবি? একটা মেয়ে, আমার চেনাশুনো, পড়াশুনোতেও বেশ। এই তো এবার এগারো ক্লাসে উঠল। অঙ্ক করানোর জন্য লোক খুঁজছে..।”

কলেজ শেষে কার আর পকেট খরচ চালানোর জন্য বাবার উপর নির্ভর করে থাকতে ইচ্ছে করে? মনে হল, মেঘ না চাইতেই জল পেলাম। স্যারের দেওয়া ঠিকানায় পরদিন বিকেলে পৌঁছে গেলাম। আরেব্বাস, বাড়ি দেখে হৃৎকম্প হওয়ার উপক্রম। এত পেল্লায় বাড়িতে আগে কোনোদিন ঢুকিনি। গেটে গুঁফো মুঙ্গেরি দারোয়ান। আমাকে দেখে গোল গোল চোখ পাকিয়ে আমার আসবার কারণ জানতে চাইল। হাবভাব দেখে মনে হল আমার রোগা টিঙটিঙে চেহারা তার মোটে পছন্দ নয়। শুধু সন্দেহের চোখে তাকায়। এই বাড়ির মেয়েটিকে আমার মতো প্যাংলা ছোঁড়া পড়াতে আসতে পারে এমন আজগুবি কথা তার এতটুকু বিশ্বাসযোগ্য হল বলে মনে হল না। আমার দিকে প্রবল সন্দিগ্ধ দৃষ্টি ছড়াতে ছড়াতে সিকিউরিটি বুথে ঢুকে ইন্টারকমে কথা বলে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে ভিতরে যেতে বলল অনিচ্ছার সঙ্গে। বিশাল লোহার গেট খুলে যেতে প্রাসাদোপম তিনতলাবাড়ির গাড়িবারান্দা পার হতেই খুট করে একতলার বসার ঘরের দরজা খুলে গেল। একজন মধ্যবয়সি ভদ্রমহিলা আমাকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, “আসুন মাস্টারমশাই। বাড়ি খুঁজে নিতে কোনও অসুবিধা হয়নি তো?”

অ্যাঁ, আমি মাস্টারমশাই? সম্বোধন শুনে মনে হল, হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি প্রবেশ করি। সবেমাত্র কলেজের চৌকাঠ পার হয়ে বাইরের পৃথিবীতে পা বাড়ানো এক তরুণ, আচমকা যদি শোনে সে মাস্টারমশাই হয়ে গেছে তাহলে মনের যা অবস্থা হয় আর কি!

এঘর ওঘর পার হয়ে এল পড়ার ঘর। ডিম্বাকৃতি পড়ার টেবিল জোরালো আলোর রোশনাইতে ঝলমল। ঘরের এককোণে সুদৃশ্য পিয়ানো ভেলভেটের কাপড়ে মোড়া। আমাকে বসিয়ে রেখে আমার হবু ছাত্রীর মা অদৃশ্য হলেন। নিঃশব্দ ঘরে আমি একা বসে আছি। হঠাৎ পায়ের পাতায় চাপ পড়তে তাকিয়ে দেখে হাড় হিম হয়ে এল। বাঘের মতো প্রকাণ্ড চেহারার কালো রঙের এক কুকুর, একহাত লাল জিভ বার করে আমার দিকে দুটো জ্বলন্ত চোখ মেলে তাকিয়ে। আমার গলা শুকিয়ে এল। আমি তখন মাদাম তুসোর মিউজিয়ামের স্ট্যাচু হয়ে গেছি। নড়লেই যদি দেহ থেকে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নেয়। কুকুরটি কিন্তু নির্বিকার, লম্বা জিভ থেকে লালা ঝরিয়ে চলেছে। তার মুখের গরম হলকা আমার চোখে মুখে ঝাপটা মারছে। এর খপ্পর থেকে নিজেকে মুক্ত করে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কী কুক্ষণে মাস্টার হবার সাধ জেগেছিল কে জানে! তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিয়ানোর দিকে তাকিয়ে ভয় কাটাবার চেষ্টা করছি। আমার অন্যমনস্কতা আমার নতুন বন্ধুটির বিশেষ পছন্দের হল বলে মনে হল না। তার বাজখাঁই আওয়াজে আমার প্রাণপাখি উড়ে যায় আর কি! আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টায় সেই যে থেমে থেমে, ঘেউ ঘেউ ডাক জুড়ল তা বজ্রপাতের শব্দের চাইতে কোনও অংশে কম ছিল না।

কুকুরের ডাক শুনে আমার হবু ছাত্রীর মা ছুটে এলেন। তার পিছনে পিছনে একটি মেয়ে। বুঝলাম এই-ই আমার ছাত্রী। মা ও মেয়ে দুজনেই আমার নাকাল অবস্থায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না, বরং তাদের ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা আমোদের হাসি আমার অন্তরাত্মাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। ছাত্রীর মা বললেন, “ভয় পাবেন না মাস্টারমশাই, ও কিছু করে না।”

আমার জানা আছে, পৃথিবীর সব কুকুরের মালিকরাই বলে থাকে তাদের কুকুর কিছু করে না। কামড়ানো ছাড়া কুকুরেরা আর কোনও ক্ষতি করে না, তা আমার মতো সদ্য কলেজ ফাইন্যাল দেওয়া তুচ্ছ অর্বাচীনও জানে। সেই কিছুটা করে দিলেই পেটে চোদ্দখানা ইঞ্জেকশন নিতে হবে,  তাও জানি। ছাত্রীর মায়ের ধমক খেয়ে কুকুরটা তার দুই পা আমার পায়ের পাতা থেকে সরিয়ে নিল ঠিকই, কিন্তু তার খুনি চাউনি আমার দিকেই। ক্ষীণ গলায় বললাম, “একটু জল…।”

ছাত্রীর মা শশব্যস্তে হাঁক দিলেন, “সন্ধ্যার মা, মাস্টারমশাইকে জল দাও।” তারপর গলা নামিয়ে আমাকে বললেন, “নিশ্চিন্তে থাকুন, শটি কিছু করে না। আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। আজ আপনাকে প্রথম দেখল তো। আর ওর যা মেমরি, ভাবতে পারবেন না, একবার কাউকে দেখে নিলেআর ভোলে না।” সদ্য মাস্টারিতে প্রমোশন পাওয়া আমি, জ্ঞান জাহির করার জন্য বললাম, “আসলে কুকুরেরা খুব স্মৃতিধর হয়, চোখের দৃষ্টি যতটা ক্ষীণ, ততটাই ঘ্রাণশক্তি প্রবল।”

শুনে ভদ্রমহিলা একেবারেই খুশি হলেন না, বরং কিছুটা বিরক্তির সুর মিশিয়ে বললেন,  “কে কুকুর, কাকে কুকুর বললেন? ও আমাদের বাড়ির একজন সদস্য। ওর নাম শটি। জানেন ও আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে দারুণ ফুটবল খেলে। ফুটবলে দুর্দান্ত শট দেওয়ার জন্য ওর নাম দিয়েছিলাম শটি।”

বিব্রত মুখে জবাব দিই, “বড়ো ভুল হয়ে গেছে কাকিমা। এবার থেকে শটিকে শটি বলেই ডাকব।”

ভদ্রমহিলা আবার রেগে উঠলেন বলে মনে হল, “কাকিমা নয় কাকিমা নয়। বলবে বউদি। তুমি তো কলেজ ফ্যাইনাল দিয়েছ! আমাকে বউদি বলেই ডাকবে। হ্যাঁ, এই হচ্ছে আমার মেয়ে, মিশেল। ডাক নাম মিশু। এবার ও ইলেভেনে উঠল। সায়েন্স নিয়েছে, কিন্তু অঙ্কটা ঠিক…।”

মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “কিচ্ছু চিন্তা করবেন না কা………সরি বউদি। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। আমার অঙ্কে অনার্স। এই জন্যই বিভাস স্যার আমাকে মিশুকে পড়াতে বলেছিলেন।”

আবার একবার সদ্যপ্রাপ্ত বউদির কাছে বকা খেলাম, “আপনি ওকে ডাকনামে ডাকবেন না। বলবেন মিশেল।”

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দেখি টেবিলে চারটে কচুরি আর দুটো রসগোল্লা আমার দিকে তাকিয়ে ফিকফিকিয়ে হাসছে। সকালে দুটো লেড়ো বিস্কুট চা দিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়েছি। খাবার দেখে পেটটা চিনচিন করে উঠল। আমি আবার বরাবরই বড্ড পেটুক। আমার সদ্যপ্রাপ্ত ছাত্রী টেবিলে বই খাতা রাখতে না রাখতে আমি খাবারের প্লেটে হাত যেই না বাড়িয়েছি, শটি তার বিশাল শরীর নিয়ে এগিয়ে এসে দুই পা টেবিলের উপর তুলে দিল। আমি হাঁই হাঁই করতে গিয়েও গুটিয়ে গেলাম। পেটে পিত্ত পাক দিচ্ছে দিক, আমার কী, এই ভেবে বই খুলে অঙ্ক কষতে মন দিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি শটির লেলিহান লাল জিভ দিয়ে লালা ঝরে টেবিল ক্লথ ভিজিয়ে দিচ্ছে। শটির মুখ নিঃসৃত গরম নিঃশ্বাস আমার ডান হাতের কব্জিতে ঝরে পড়ছে। মিশেলের ভ্রূক্ষেপ নেই, আমার কষে দেওয়া অঙ্ক মন দিয়ে দেখছে।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। মিশেলকে অঙ্ক কষতে দিয়ে ঘরের চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখি শটি বাবাজীবন তার সামনের দুই পায়ের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। এই সুযোগ, খাবারের প্লেট সাফ করার। এই ভেবে সবে কচুরির এক কোনায় কামড় দিয়েছি, শটির প্রবল গর্জনে ঘরের টেবিল চেয়ার আলমারি পিয়ানো সব কেঁপে উঠল। মনে হল আমার বুকের সব রক্ত শুকিয়ে কাঠ। মিশেলের মা ছুটে এসে চিৎকার করে উঠলেন, “শটি, বিহেভ ইয়োরসেলফ, কাম অন।”

শটি আমার উপর রেগে গেছে দেখে আমি হাতের কচুরি প্লেটে আবার যথাস্থানে রেখে মোচড়ানো পেটকে সান্ত্বনা জানিয়ে আবার অঙ্কে মনোনিবেশ করলাম। মিশেলের মা বলে উঠলেন, “মাস্টারমশাই, আপনিও তেমনি। শটিকে কচুরি না দিয়ে নিজেই খাচ্ছেন, এটা কি ঠিক হল?”

আমতা আমতা করে বলি, “সত্যিই বড়ো ভুল হয়ে গেছে, প্রথম দিন তো, এরপর থেকে আর হবে না।”

বলেই কচুরির এক টুকরো ভেঙে শটির সামনে মেঝেতে ছুঁড়ে দিলাম। শটি এক শটেই লম্বা জিভ বার করে কচুরির টুকরো পেটে চালান করে দিল। কিন্তু মিশেলের মা বেজায় রেগে গেলেন,“দেখুন মাস্টারমশাই, আপনাকে একটা কথা বলি, শটি টুকরো খেয়ে বেঁচে নেই। মানে বুঝলেন কিছু? বুঝলেন না। ভাঙা কচুরি ছুঁড়ে দিলেন, আজ ও দিব্যি খেয়ে নিল, রোজ কিন্তু এমন হবে না। ভীষণ রেগে যাবে। পরের দিন থেকে পুরো দেবেন, হাতে করে, মেঝেতে ছুঁড়ে নয়।” প্লেটে খাবার ফেলে রেখে সেদিনের মতো অঙ্কের ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে এসে আমার চিলেকোঠার ঘরে শুয়ে ভাবলাম, নিকুচি করেছে টিউশনের। আর যাব না।

আই পি এলের খেলা টিভিতে দেখে আর নিপাট ঘুম দিয়ে দিব্যি সপ্তাহ খানেক কাটিয়ে দেওয়ার পর হঠাৎ একদিন সাতসকালে কলিং বেলের আওয়াজ। রান্নাঘর থেকে মায়ের গলা পেলাম, “মটকা মেরে পড়ে না থেকে দরজাটা খোল না গিয়ে। সক্কাল সক্কাল দেখ কে এল!” শীতের সকালে লেপ ঝাড়া দিয়ে উঠতেই হল। দরজা খুলে দেখি বিভাস স্যার, হাতে বাজারের ব্যাগ। চোখ-টোখ কচলে তাড়াহুড়োয় বলে উঠি, “স্যার আপনি, এত সকালে? বাবা এখন একটু……।”

“আরে তোর বাবাকে দিয়ে কী করব? তোর সঙ্গেই দরকার যে! তোর হলটা কী? একদিন গিয়েই আর ওদের বাড়ি পড়াতে গেলি না যে বড়ো? ওরা আমাকে রোজ ফোন করে বিরক্ত করছে…।”

আমার শ্রীমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “কুকুর স্যার, শটি…।”

বিভাস স্যার হো হো করে হেসে ওঠেন, “কুকুর? ওদের ওই কুকুর দেখে ভয় পেয়ে গেলি? তুই নতুন জমানার ছেলে হয়ে কুকুরের ভয়ে এত সুন্দর টিউশনটা ছেড়ে দিলি? কুকুর দু’দিন ঘেউ করবে, তারপর দেখবি তোর পিছনে পিছনে ল্যাজ নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটোবেলায় রচনা লিখিসনি, কুকুর এক প্রভুভক্ত প্রাণী….।” একসময়ে বিভাস স্যারের অঙ্কের ক্লাসে পড়া না পেরে কানমলা-টলা খেয়েছি, তাই নিজের মুখে কী করে আর বলি যে, স্যার ওরা প্রভু আর আমি ভৃত্য শ্রেণীর। ভৃত্যের প্রতি শ্রীমান সারমেয় প্রসন্ন নাও হতে পারে। টিউশন মাস্টারদের ‘ভৃত্য জাতীয়’ বলে স্যারের কানমলা এ বয়সে আর খাওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই, তাই পায়ের বুড়ো আঙুল দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বিভাস স্যার আমাকে দিয়ে কথা আদায় করে ছাড়লেন যে আমি ওই বাড়ি আবার পড়াতে যাব। স্যার বলে দেবেন পড়ানোর সময় যাতে শটিকে বেঁধে-টেধে রাখা হয়।

       সেদিনই ছাত্রী পড়াতে আবার গেলাম সেই প্রাসাদোপম বাড়িটাতে। এবার দারোয়ান আমাকে দেখেই গেট খুলে দিল। কিন্তু আমার দিকে তার তাচ্ছিল্যজনক দৃষ্টিপাত আমার নজর এড়াল না। বাড়িতে ঢুকে পড়তেই আমার পিছনে সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল কোনও এক অদৃশ্য কোণেশটি তার শ্বদন্ত নিয়ে আমার জন্য প্রতিক্ষারত। হয়তো আগের দিনের পুষে রাখা পুঞ্জীভূত রাগে আমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে তার দু’দণ্ডও লাগবে না। বসার ঘরে বেশ নির্বিঘ্নেই ছাত্রী মিশেলকে অঙ্ক কষিয়ে সেদিনটা কেটে গেল। শটি দেখা দিল না ঠিকই, খাবারের প্লেটও টিকি দেখাল না। বুঝলাম শটির নামে বিভাস স্যারের কাছে নালিশ জানানোয় মিশেলের মা আমার উপর বেশ চটে গেছেন। পড়ানোর শেষে বসার ঘর ছেড়ে সামনের উঠোনে সবে পা দিয়েছি, মনে হল কালো টর্পেডো মতো কী একটা আমার দিকে প্রবল বেগে ছুটে এসে ধাঁই করে তার শরীর নিয়ে আমার গায়ে আছড়ে পড়ল। সেই ধাক্কায় আমি ছিটকে পড়লাম পাশের বাগানে। তারপর যেন জ্ঞান হারালাম। চোখ মেলে দেখি বাগানের পাশে বেঞ্চে শুয়ে আছি। মুখের উপর মুঙ্গেরি দারোয়ান ঝুঁকে পড়ে তার গোঁফে তা দিচ্ছে। একটু দূরে আমার ছাত্রীর মা দাঁড়িয়ে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে বলে উঠলেন, “আর একটু শুয়ে থাকুন মাস্টারমশাই। আসলে কী জানেন, শটি আপনার উপর অভিমান করেছিল, ক’দিন আপনাকে দেখেনি তো! আর হঠাৎ করে এমন কামাই করতে যাবেন না। আর যদি ছুটি নিতেই হয়, একটু আগে থেকে জানিয়ে দেবেন, আমরা শটিকে বুঝিয়ে রাখব। ও ভীষণ সেনসিটিভ, জানেন!”

বুঝলাম, শটিই আমার মালিক, আর আমি তার প্রভুভক্ত ভৃত্য। তাই এখন থেকে শটির সব শটই আমাকে ট্যাকল করে যেতে হবে নিখুঁত খেলোয়াড়ের মতো।

দু-চারদিন মিশেলকে পড়ানোর পর ধীরে ধীরে শটির উপস্থিতি গায়ে সওয়া হয়ে গেল। খাবারেরা প্লেটে চড়ে রোজ সকালে দিব্যি আমার নাকের ডগায় হাজির হতে লাগল। লুচি, কচুরি বা সিঙ্গারা, শটিকে না দিয়ে খাই না। নিজে হাতে করেই খাওয়াই বলে বোধহয় শটি আমার উপর প্রসন্ন হল। লক্ষ করলাম আমার অঙ্কের ক্লাসে শটি আর ঘুমোয় না, বড়ো বড়ো ধূসর চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও যে আমার ক্লাসের বেশ মনোযোগী ছাত্র হয়ে উঠেছে বুঝতে পারলাম একদিন। তিন তিন বার একই ইন্টিগ্রেশন কষে দিয়েও মিশেলের নিরেট মাথায় না ঢুকে চতুর্থবার ভুল করায় আমি মুখে অস্বস্তিসূচক শব্দ করতেই শটি তার হেঁড়ে গলায় মিশেলকে ধমকাতে শুরু করে দিল। প্রথমে তাকে মিশেল নিরস্ত করবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। তারপর পাশের ঘর থেকে মিশেলের মা ছুটে এলেন ব্যগ্র হয়ে। তিনি ফেল মারতে আমি যেই না বলেছি, “শটি, বিহেভ ইয়োরসেলফ। ইটস অলরাইট!” মুহূর্তে শটি চিৎকার থামিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বা ঘুমোবার ভান করল। আসলে আমি এতদিনে বিদেশি কুকুর নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি পেয়ে গেছি! হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছি, বিদেশি কুকুরেরা দেশি ভাষা ও মানুষ একদম সহ্য করতে পারে না।

শটি যে আমার ক্লাসে বসে মন দিয়ে অঙ্ক দেখে দেখে বেজায় বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে, সেটা আরও বোঝা গেল এর কিছুদিন পর। সামনে মিশেলের ফাইনাল পরীক্ষা। অ্যালজেব্রার দুটো চ্যাপটার আর ট্রিগনোমেট্রির তিনটে চ্যাপটার হোমটাস্ক দিয়ে রেখেছিলাম। পড়াতে গিয়ে মিশেলকে বললাম, “হোমটাস্কের খাতা আন। চেক করব।” মিশেলের মুখ শুকনো, চোখে জল এসে যাবে মনে হল। খাতা না এনে টেবিলের উপর আঙুল দিয়ে মিছিমিছি আঁকিবুকি কাটতে লাগল। চাপ দিতেই কান্নাভেজা গলায় বলল, “করে রেখেছিলাম মাস্টারমশাই। কিন্তু খাতাটা শটি..”। কান্নায় স্বর বুজে এল মিশেলের।

আমি ধমক দিলাম, “শটি কী? খেয়ে ফেলেছে না ফুটবল ভেবে লাথি মেরে দূর করে দিয়েছে?”

মিশেলের মায়ের আবির্ভাব হল বসার ঘরে। ভদ্রমহিলা বিপৎকালে কোথা থেকে এসে হাজির হন কে জানে! খাতাটা আমার টেবিলে রেখে বললেন, “আমাদের গুণধর শটি…… খাতাটা দেখুন কেমন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। বড্ড অবাধ্য হয়ে উঠেছে ও আজকাল। আর আপনিও মাস্টারমশাই…… আস্পদ্দা দিয়ে দিয়ে ওকে একেবারে মাথায় তুলেছেন।”

মনে মনে ভাবতে থাকি, এখানেও বেচারা আমি দায়ী। শটি খাতা চিবিয়ে খেল তো আমারই দোষ। যেন ওদের পালিত কুকুরের সঙ্গে মিলে এক বিরাট ষড়যন্ত্র করে ফেলেছি। ছেঁড়া পাতা জুড়ে নিয়ে খাতাটাকে একটু সমান করে মিশেলের কষে রাখা অঙ্ক দেখে চক্ষু চড়কগাছে ওঠার যোগাড় হল। সব ভুল। এতদিন যা শিখিয়েছি, সব জলে গেছে। মনে হচ্ছে কোনোদিন এসব অঙ্ক চোখেই দেখেনি। আমার পায়ের তলায় মাটি সরে গেল। সামনে ফাইন্যাল পরীক্ষা। ছাত্রী ডাহা ফেল মারলে, তার অভিভাবকরা কি আর আমাকে আস্ত রাখবে? দরকার হলে কুকুর লেলিয়ে গায়ের সব মাংস খুবলেও নিতে পারে। পাতার পর পাতা উলটাই আর নিজের অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তায় অসন্তোষে মাথা নাড়াই। হঠাৎ শটি কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে আমার হাত থেকে মুখে টেনে খাতা ছিনিয়ে নিয়ে আবার টুকরো টুকরো করতে লাগল। মিশেলের মা চেঁচিয়ে উঠলেন, “শটি, নো, ডোন্ট ডু দ্যাট। হোল্ড অন…..।” ততক্ষণে যা বোঝার আমার বোঝা হয়ে গেছে। শটি আমার ক্লাসে অঙ্ক শুনে শুনে সব শিখে ফেলেছে। তাই ভুল ধরতে পেরে নিষ্ঠুর মাস্টারমশাইয়ের মতো কুটি কুটি করে খাতা ছিঁড়েছে। মিশেলের মা আর শটির ঘেউ ঘেউয়ের মাঝখানে আমি সুযোগ বুঝে এক লাফে বাইরে। আর যাই পারি না কেন, মিশেলকে অঙ্ক শেখানো আমার কম্ম নয়, বেশ টের পাচ্ছি।

বাড়ি ফিরে আমার ছোট্ট ব্যাগে খান দুয়েক জামাকাপড় ভরে চম্পট দিলাম জামশেদপুর। সেখানে আমার জ্যাঠা থাকে। ক’দিন সেখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকার ইচ্ছে। জামশেদপুরে জেঠির আদর যত্ন, ডিমনা নালা, সুবর্ণরেখা নদীর ধারে মাসখানেক কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেই বাবা বলল, “তোর সেই ছাত্রী অঙ্কে ডিগবাজি খেয়েছে। এখন আর ওদের পাড়ার দিকে বেশি পা মাড়াস না। দিনকাল ভালো নয়। তবে তোর বিভাস স্যারের মুখেই শুনলাম। তারা কিছু বলে-টলেনি। আর যদি কিছু টিউশনির টাকা বাকি থেকে থাকে, আনতে যাওয়ার দরকার নেই। মেয়েটা পাশ-ই যখন করল না।” আমি মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, পৃথিবীতে আমিই প্রথম ব্যক্তি, যে কুকুরকে অঙ্ক শেখাতে সার্থক হয়েছে। কিন্তু সে কথা কাউকে বলা যাবে না, গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক আমার নাম তাদের বইতে লিখবে না। বরং কাউকে জানালে আমার স্থান হবে পাগলা গারদ। চুপিচুপি তোমাদেরই শুধু জানিয়ে রাখলাম। কাউকে বোলো না কিন্তু !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত