: এই, কী ব্যাপার? মন খারাপ কেন?
: কই, না!
: আচ্ছা, সেদিন কী যেন বলবে বলছিলে, বললে না তো?
: না, কিছু না।
: নিশ্চয় কিছু! এদিকে তাকাও, একদম লুকাবে না, বলো—কী হয়েছে?
: হুম্ম্…ইয়ে…, আমি বাচ্চা চাই।
: ঠিক আছে, নেব। এটা কোনো ব্যাপার?
: কীভাবে নেবে?
: কেন? বাচ্চা নিতে কী সমস্যা? চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসে যাও, ফরম ফিলআপ করো, ব্যস কদিন পরেই বাচ্চা নিয়ে বাড়ি যাও। আমাদের তো সব রকম ক্রেডিট আছে, ফিন্যান্সিয়াল সলভেন্সি আছে এবং প্যারেন্টাল সাইকোলজি টেস্টেও আমরা টিকে যাব: অনায়াসেই, দেখো।
: কী ধরনের বাচ্চা তুমি নিতে চাও, বলো তো?
: ওই তো, লম্বা অ্যাথলেটিক ফিগার হবে, চুল হবে কালো আর গায়ের রং বাদামি।
: হুম, হাজারে ৯৯৯ জনই তাই চায়।
: হাহ্ হাহ্…, কিন্তু তুমি যেন খুশি হলে না?
: না, আমি তোমার থেকে আর একটু ইমাজিনেশন আশা করেছিলাম।
: কী রকম?
: আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের নিজেদের বাচ্চা চাইবে।
: নিজেদের মানে? বাচ্চা নিতে চাইলে সবাইকে যা করতে হয়, আমরাও তো সেভাবেই নেব, না কি?
: না। কোথাও একটা বড় ধরনের ভুল হচ্ছে। আমরা কেউ আজ স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারছি না। কেউ কোনো কিছু ভাবছে না, সবাই মনে করে এসব নিয়ে ভাবার প্রচুর লোক আছে। অথচ আমাদের হয়ে অন্য কেউ সব করে দেবে—এমনটা আশা করা ভুল। কিন্তু একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে গিয়ে অন্যরা যা করে—সবাই তাই করে যাচ্ছে। বিকল্প ভাবনার সময়ও যেন নেই কারও।
: এত ভাবনাচিন্তার কী আছে? শিগগিরই তুমি বাচ্চার মা হবে, যাও।
: না না, ওভাবে আমি চাই না।
: তো, কীভাবে চাও?
: আমি চাই আমাদের নিজেদের বাচ্চা।
: ও, সেটাও তো নিতে পারি আমরা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে হাঙ্গামা কত! প্রথমেই যেটা হবে—নিজেদের শরীরটাকে ল্যাবরেটরির কাছে সঁপে দিতে হবে। তারপর বাচ্চা জন্মানোর পর একেবারে শুরু থেকে আমাদেরই পালতে হবে। তা ছাড়া ওর ফিগার, বুদ্ধিমত্তার লেভেল, ইন্টেলেকচুয়াল হাইট—কোনো কিছুরই কোনো গ্যারান্টি থাকবে না। তার মানে—খারাপ হবে।
: হোক না, সে তো আমাদের হবে।
: হলে লাভটা কী? করা যাবে না কেন, যায় তো। কঠিন তো কিছু না, ওদের বললেই আমাদের শুক্রাণু-ডিম্বাণু নিয়ে বাচ্চা বানিয়ে দেবে। কেউ কেউ নাকি করে ও রকম। কিন্তু…নিজেদের বাচ্চা বানিয়ে কিসের যে আত্মতুষ্টি আসে বুঝি না! আরে বাবা, বাচ্চা তো বাচ্চাই। কদিন পুষতে পারবে ওকে? একটু বড় হলেই কিছুদিন প্লে স্কয়ারে আনা-নেওয়া করার পর স্কুলিংয়ের জন্য অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হাউসে দিয়ে দিতেই হবে, হবে না? মাঝখান থেকে শুধু শুধু কিছু বাড়তি ঝামেলা! তোমাকে কী পুষেছিল কেউ? আমি হাউসেই ছিলাম। ওখানেই আসলে শিশুদের প্রপার যত্নটা হয়। ট্রেইনড লোকজন থাকে তো। খামোখা লোকে তাদের আজগুবি আহ্লাদ মেটাতে বাচ্চা পোষার আবদার করে। না না…তোমাকে বলছি না, তুমি তো অ্যাকসেপশনাল, আমি বলছি সাধারণ পাবলিকের কথা। অবশ্য ওরা ইচ্ছুক প্যারেন্টসদের জন্য বিভিন্ন রকম ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। আমাদেরও করবে নিশ্চয়ই।
২.
: বলো তো, কোথায় হয় মানুষের বাচ্চা?
: কেন, ফ্যাক্টরিতে! ওই যে, এইচ এস আই…মানেটা কী যেন?
: হোমো স্যাপিয়েন্স ইনকিউবেটর। কিন্তু কীভাবে হয়? কে বানায়?
: আরে এ তো সবাই জানে, বিভিন্ন স্কলার, সায়েন্টিস্ট কিংবা অ্যাথলিটদের থেকে স্পার্ম এবং ওভাম কিনে নিয়ে আগেই রেখে দেওয়া হয়েছে, তারপর ইচ্ছুক জনগণ যে যেমন সন্তান চায়, তাকে সেই ক্যাটাগরি থেকে র্যানডম বেসিসে দেওয়া হয়, বোঝার কোনো উপায় থাকে না কোনটা কার। তারপর ওগুলো থেকে কিনে কিংবা কেউ চাইলে তাদের নিজেদেরটা দিলে কালচার করে ওরা ইনকিউবেটরে বাচ্চা বানিয়ে দেয়।
: না। ওরা আসলে কিছুই করে না জিন নকশার পারফেক্টনেস চেক করে ফার্টিলাইজেশন ছাড়া। তারপর ওরা জিনিসটাকে একটা প্রাণীর পেটে ইমপ্ল্যান্ট করে।
: তাই? কোন প্রাণীর?
: কোনো মানুষের না।
: হুম, মানুষের তো না-ই। কিন্তু তাহলে কিসের পেটে?
: গরু।
: কী!
: হুম।
: তুমি বলছ, আমরা সবাই গরুর পেটে হয়েছি?
ঠিক তাই।
: কী বলো! গরুর পেটে মানুষের জাইগোট দিয়ে দিলেই হলো? একটা ফরেন বডি হিসেবে ওর অ্যান্টিজেন এটাকে ডিজেকশন করবে না?
: এটাই হচ্ছে মানুষের একটা বড় সাফল্য, জেশ্চেশনাল সারোগেসির জন্য গরুর প্রজননতন্ত্রের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। গরু নিয়ে গবেষণা অবশ্য অনেক আগে থেকেই চলছিল, প্রায় আড়াই শ বছর আগে, ধরো ২০০০ সালের দিকে, ডাচ সংসদে আইন পাস করে ল্যাবরেটরিতে তৈরি ষাঁড় হারম্যানকে বংশ বৃদ্ধির অনুমতি দিলে পরের বছর সে ৮৩টা বাচ্চার বাপ হয়, সবগুলোই জন্মেছিল মানুষের লেকটোফেরিন জিন-বৈশিষ্ট্য নিয়ে। মানে, তখন থেকেই কিছু জায়গায় বিজ্ঞানীদের বানানো গরু দিত হুবহু মানব-স্তন্য, যেটা সদ্যঃপ্রসূত বাচ্চাদের দরকার।
: তাহলে এসব আমরা জানি না কেন? গোপন রেখেছে কেন?
: রাখেনি, এমনকি লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ তখন এটা নিয়ে শিরোনামও করেছিল। আসলে কেউ জানতে চায় না, তাই জানে না। আর এখন তো বিষয়টা হয়ে গেছে যেন একটা স্বাভাবিক নৈমিত্তিক ব্যাপার।
: সাধারণভাবে কোনো গবেষণায় শুনেছি বানর ব্যবহার করা হতো, এখানে গরু কেন?
: সহজলভ্যতা এবং আকৃতি। ওদের বড় পেটে একসঙ্গে অনেকগুলো বাচ্চা দেওয়া হয়। একটা সময় পরে শুরু হয় বিভিন্ন ধাপের বিভিন্ন টেস্ট, স্ক্যানিং; তারপর সবচেয়ে যেটা নিখুঁত—তাকে রেখে বাকিগুলোকে সরিয়ে ফেলা হয়। এত সব ঝক্কি সামলাতে বড় জায়গা লাগে। নিরীহ হওয়াটাও একটা ফ্যাক্টর।
: এত সব কে বলেছে তোমাকে?
: ডক্টর ওয়াই।
: এ আবার কে?
: আছে, একজন খুব জ্ঞানী মানুষ। আমাদের ইউনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপলজির প্রফেসর, অনেক জানে লোকটা। ‘আনো আদিম পৃথিবী’-র প্রবক্তা।
: কিন্তু এসব জটিল তত্ত্ব দিয়ে আমরা কী করব? আমাদের কথা বলো, আমাদের দরকার একটা বাচ্চা—ব্যাস। এত সব জটিল উদ্ভট চিন্তা করার দরকার কী! যত্তসব বুজরুকি!
৩.
: কি, মাইন্ড চেইন্জ হয়েছে?
: হ্যাঁ।
: গুড!
: নো, ইটস ব্যাড ফর ইয়ু, মেইবি।
: কেন, কেন?
: বাচ্চা নেব, এবং সেটা পুরোপুরি আমাদের হতে হবে।
: সেটা কীভাবে?
: গরুর পেট থেকে নয়, ওটা মাতৃত্ব না। আমি সম্পূর্ণভাবে মা হতে চাই। আমার পেটেই হতে হবে তাকে।
: কী! পেটের ভেতর বাচ্চা? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
: শোনো, আগেকার দিনে লোকেরা এমনকি বাইরের কোনো রকম সহায়তা ছাড়া নিজেই সন্তান জন্ম দিত। কোনো বীজ ফার্ম ছিল না, উন্নত জাতের বাচ্চার বীজ কিংবা কোনো কিছুই তাদের কিনতে হতো না। যে যেমন পারে—নিজেরাই প্রজনন করত। নারীর গর্ভে হুবহু মানুষের মতো একটি শিশু মানুষ জন্ম নিত এবং যথাসময়ে সে এখনকার ফার্মের ঠিক ওই মা-গরুর মতোই সেই বাচ্চাটাকে প্রসব করত। সেই সময়টায় বেশ কিছুদিন কোনো কাজটাজ করতে পারতেন না সেই নারী, ছুটিতে থাকতে হতো।
: কে বলেছে এসব? ওই পাগলা প্রফেসর?
: সবকিছু তাকেই বলতে হবে কেন? ইতিহাস জানতে চাইলে কতভাবেই জানা যায়।
: হুম…, এই ব্যাপারগুলো কি গ্রিকদের সময়কার? নাকি তারও আগের?
: না না, এমনকি এই দু-তিন শ বছর আগেও এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এখন যেমন আমরা সত্যিকারের ফল খাই…।
: মানে? আগে কি আমরা মিথ্যা ফল খেতাম?
: অনেকটা তাই। ধরো, কেউ একটা গাছ লাগাল, কিছুদিন সেটাতে আপেল ধরল। তারপর সে চাইলে সেটা বদলে পেয়ারাগাছ করে নিত। এমনকি একই গাছের বিভিন্ন ডালে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ফল ধরত। প্রথমে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল স্কিন গ্র্যাফটিং করার মাধ্যমে। ধরো, একটা আমগাছ—ভালো ফলন পাওয়ার জন্য ওটার একটা ডালের কিছু অংশের ছাল তুলে ফেলে সেখানে ভালো জাতের আমগাছের ছাল কেটে প্রতিস্থাপন করা হতো, তাতে করে তারপর থেকে ওই ডালের সব শাখা-প্রশাখায় সেই জাতের ভালো আম হতে থাকল। এভাবে কলা, লেবু, কমলা—সবকিছুর জিন-নকশা পাল্টে ফেলা হলো। সবুজ বরই হয়ে গেল আপেলের মতো গোলাপি।
: তারপর?
: তারপর, পানিতে মাছদের আর কোনো প্রাকৃতিক সমাজ রইল না, এক মাছ আরেকটা ছোট প্রজাতির মাছ খেয়ে ফেলবে—এমন কোনো সুযোগই আর থাকল না। সব সভ্য-ভদ্র মাছের জন্য আলাদা খাবার কারখানা থেকে বানিয়ে সরবরাহ করা হতে থাকল, খুঁজে খাওয়ার আর দরকার নেই আগের মতো। মাৎস্যন্যায় বলে একটা কথা ছিল একসময়, অর্থাৎ—বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলত। এবং মানুষের মধ্যে এমন আচরণ দেখলে তাকেও ওই নামে সমালোচনা করা হতো।
: মানে? মানুষও একজন আরেকজনকে খেয়ে ফেলত?
: ঠিক তা নয়, সোজা খেয়ে ফেলা না, গায়ের জোরে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করা-সংক্রান্ত মানসিকতা দেখলে তাকে হেয় করার জন্য ওই শব্দ ব্যবহার করা হতো। তবে অন্য প্রাণীরা কিন্তু খেয়েই ফেলত।
: মানে? কীভাবে?
: ঠিক জানি না, মনে হয় বাঘ-সিংহরা এখনকার মতো শুধু মন্ত্রণালয়ের গরু খেয়ে থাকত না, ওরা নিজেদের মতো যা পাওয়া যায়—জঙ্গল থেকে ধরে খেত।
: কী বলো? জঙ্গলে এত গরু কোথায় পেত? শেষ হয়ে যেত না?
: গরু, ছাগল, হরিণ যখন যা পেত তা-ই খেত। আর হ্যাঁ, শেষ হয়ে যাচ্ছিল বলেই তো রেশনিংপদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। এত বড় বড় জঙ্গলে সব প্রাণীর আলাদা জগৎ নির্মাণ করা নিশ্চয় সহজ ছিল না। তা ছাড়া বিশাল বড় অনেকগুলো গরু-মহিষের খামার করতে হলো বিভিন্ন জায়গায় ওদের খাবার জোগান দিতে।
: তারপর, ওই…ফল খাওয়ার কথা কী যেন বলছিলে? ওখান থেকে আমরা এখানে এলাম কী করে? কেনই বা এলাম?
: একসময় মানুষ তার ভুল বুঝতে পারল। কিছু পাগলাটে লেখক সাংবাদিক—সভ্যতা যাঁদের কাছে ঋণী, যাঁরা বসে বসে শুধু এই সব নিয়ে ভাবতেন, তাঁদের প্রবল চিৎকারে টনক নড়ল সবার। অবশেষে মহা সর্বনাশের ঠিক আগ মুহূর্তে কোনো রকমে সামলে নিতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। সার, কীটনাশক, রঞ্জক, ফলনবর্ধক, বালাইনাশক সুপার অ্যান্টিবায়োটিক এবং আরও অনেক রকম কেমিক্যাল সংযোগে উচ্চফলনশীল সুদর্শন ফলমূল, ফ্যাক্টরিতে বানানো বিভিন্ন জেনেটিক্যালি মডিফায়েড এবং হাইব্রিড বীজের শস্য, মাছ-মাংস—সব বন্ধ হলো। বন্ধ হলো সব রকম সিনথেটিক মুখরোচক রংবেরঙের ফ্যান্সি খাবার। তারপর আস্তে আস্তে বহুদিনের কৃচ্ছ সাধনের ফলে মানুষ পেল আজকের এই পৃথিবী।
: গল্পের মতো লাগছে!
: হুম, কিন্তু তত দিনে হারাতে হয়েছে অনেক কিছু, অনেক প্রজাতির প্রাণী, পাখি, মাছ, ফল আজ আর নেই। সবচেয়ে ক্ষতি হলো মানুষের। বিভিন্ন স্তরে জেনেটিক প্রক্রিয়াজাত খাবার খেয়ে মানুষের দেহাভ্যন্তরে মারাত্মক রকম জিনগত পরিবর্তন হতে থাকল। তাতে করে তার প্রজননক্ষমতা ঝুঁকিতে পড়ল, শিশুরাও জন্মাতে থাকল অদ্ভুত গড়নের, এমনকি অসম্পূর্ণ কিংবা কখনো বর্ধিত প্রত্যঙ্গ নিয়ে। শারীরিক এবং মনোবৈকল্য নৈমিত্তিক হয়ে উঠল। ভয়ে মানুষ বাচ্চা নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। পৃথিবীতে হঠাৎ করেই জনসংখ্যা কমে আসতে শুরু করল ব্যাপক হারে। তখনই আসে ‘শিশুখামার’ প্রতিষ্ঠার চিন্তা। জন্মহার একটা মিনিমাম পর্যায়ে ধরে রাখার জন্যই এটা করা হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে মানুষের অভ্যাস বদলে যেতে থাকল, বিভিন্ন প্রয়োজনে আইন হতে থাকল এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তির…আমি অপব্যবহারই বলব এবং চটকদার বিজ্ঞাপন আর ওষুধ কোম্পানির তুখোড় বিপণন বাহিনীর কার্যক্রমে সভ্যতার সংজ্ঞাই বদলে গেল। এখন মানুষ এভাবেই জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
: মানুষ এতটাই বদলে গেল? কী করে?
: প্রয়োজনে। একটা উদাহরণ দিই, আগে কারও সঙ্গে দেখা হলে বা নতুন পরিচয় হলে তার হাত নিজের হাতে নিয়ে ঝাঁকাত। এটা একটা স্বীকৃত আচরণ ছিল, এভাবে হ্যান্ডশেক না করাটা বরং ছিল অভদ্রতা। কেউ কেউ তো জড়িয়েও ধরত, হাগ করত। কিন্তু তারপর ঘৃণা থেকেই আস্তে আস্তে সেই প্রচলনটা চলে গেল। কারণ, বিদঘুটে কদাকার আকৃতির মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল, যাদের সহজভাবে কারও ছুঁতে ইচ্ছা হতো না। ধরো, কেউ অনেকগুলো বা মাত্র দু-তিনটা আঙুলওয়ালা কিংবা এমনকি ওই হাতে কিছু ধরে থাকলে তৃতীয় আরেকটা হাতের মতো কিছু একটা যদি বাড়িয়ে দেয় করমর্দনের জন্য; তো, সেই শাখা হাত ধরতে কার ভালো লাগবে? এসব কারণেই মূলত ধীরে ধীরে প্রথাটাই বিলুপ্ত হয়ে গেল। এখন যদিও আবার সবাই স্বাভাবিক আকৃতিতে ফিরে এসেছে, কিন্তু সেই প্রাচীন প্রচলন আর ফিরে আসেনি।
: বলো কী!
: একটা পর্যায়ে তো এমন হয়ে গিয়েছিল যে বাচ্চার চোখ-কান, হাত-পা কয়টা হবে বা কোথায় কেমন হবে—তার কোনো ঠিক ছিল না। ভেতরে-বাইরে শতভাগ স্বাভাবিক শিশু জন্মালে সেটা হতো একটা বিস্ময়, দর্শনীয় বস্তু।
: আশ্চর্য! কিন্তু তোমার এসব কথা আমার মোটেও ভালো লাগছে না। আসলে গোটা ব্যাপারটাই পছন্দ হচ্ছে না। কোনটা স্বাভাবিক, কে জানে! কেন যে এত সব জটিল চিন্তা করো!
: ঠিক আছে, চলো আমরা ওয়াই স্যারের কাছে যাই।
ওর কাছে কেন?
: সে হয়তো একটা পরামর্শ দিতে পারবে। তোমারও বুঝতে সুবিধা হবে। আমি তো তোমাকে পরিস্থিতিটা বোঝাতেই পারছি না।
: আরে নাহ্। ও আমাকে কী বোঝাবে, এটা আমাদের নিজেদের বিষয়। আর হ্যাঁ…, তুমিও ওর কাছে আর যেয়ো না। সায়েন্টিস্ট মাত্রই পাগল হয়। আর এ তো দেখা যাচ্ছে একটা আস্ত গর্ধব! আমরা এসব এভাবে চাই না, হ্যাঁ? বোঝো না কেন, সবাই একসঙ্গে ভুল করছে? স্বাভাবিক আচরণ করো, পাগলামি কোরো না। আমরা বিপ্লব ঘটাতে পারব না। নিজেদের গিনিপিগও বানাতে চাই না, বুঝেছ?
৪.
: আরে কী ব্যাপার, তোমার তো পাত্তাই নেই, কোথায় ছিলে এই কদিন? আমাকে তোমার চোখেই পড়ল না—কী এমন ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলে বলো তো? যাচ্ছ কোথায়?
: বাস ধরব, এইচএসআই ক্লিনিকে যাচ্ছি, আমি প্রেগন্যান্ট। রুটিন চেকআপ, তবে আগামী সপ্তাহ থেকে আমাকে ওখানেই থাকতে হবে, ফুলটাইম ক্লিনিক্যাল অবজারভেশনে থাকা দরকার। হি হি হি…মা-গরুদের সঙ্গে হি হি হি…, আমার জন্য অবশ্য আলাদা একটা উইং খুলেছে ওরা। কত ঝামেলা যে হয়েছে ওদের বোঝাতে, অনুমতি নিতে।
: তুমি!…কিহ্?
: গর্ভবতী, মানে আমার বাচ্চা হবে। আমার পেটের ভেতরেই বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে।
: কীভাবে? কবে…আই মিন, ওয়াও! সত্যি সত্যি আমাদের বাচ্চাকে শেষ পর্যন্ত তোমার পেটেই নিয়েছ? কিন্তু কীভাবে নিলে? আমি তো…
: আমার গর্ভেই নিয়েছি। তবে এটা তোমার নয়।
: ওই হলো, তোমার মানেই তো আমাদের।
: ঠিক তা নয়, এটা এমনকি ওই ফার্মের অজানা কোনো অতিমানবীয় দৌড়বিদের জমিয়ে রাখা স্পার্ম নয়, আমি কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নিতে চাইনি, তাই বিকল্প পথ বেছে নিয়েছি। বাচ্চার সরাসরি এবং সত্যিকারের বায়োলজিক্যাল বাবা আসলে ওয়াই। তাকে ব্যাপারটা বোঝাতে মোটেও কষ্ট হয়নি আমার। বরং সে উৎসাহ দিয়েছে আমাকে, বলেছে এটাই আসলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এবং আমরা শিগগিরই একটা ক্যাম্পেইন শুরু করতে যাচ্ছি স্বাভাবিক প্রজননের প্রচলন ফিরিয়ে আনতে। কারণ, এখন ওই সব বিকল্প ব্যবস্থার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন আমরা সবাই সচেতন, স্বাস্থ্যসম্মত সম্পূর্ণ অর্গানিক খাবার খাচ্ছি, তাহলে আর ভয় কিসের? আমার সব রকম জেনেটিক এবং হরমোন-সংক্রান্ত পরীক্ষা করা হয়েছে, ওর নিজেরটাও আমি দেখেছি, সবই একদম পারফেক্ট। আমাকে দিয়েই প্রমাণ করতে চায় ওয়াই, এখন আবার স্বাভাবিক প্রজনন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মে। অনেক কষ্টে সরকারি অনুমোদনও পেয়েছি আমরা। মুচলেকা দিতে হয়েছে যে বাচ্চার সব রকম দায়িত্ব আমরা নেব, যেকোনো আকার-আকৃতি মেনে নেব, তার শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধিতার সব রকম ঝুঁকি এবং খরচ আমরা বহন করব, আজীবন। এবং এত সব কিছুর পর অবশেষে আমি এখন একটা বাচ্চার সত্যিকারের মা হতে যাচ্ছি, ওয়াও!