চিঠিটা এসেছিল তিনদিন আগে। কলকাতার একটি বিখ্যাত ডিটেকটিভ কোম্পানি অর্জুনকে চাকরির প্রস্তাব পাঠিয়েছে। প্রস্তাব গ্রহণ করলে আগামী মাসের এক তারিখে তাকে ওদের কলকাতার অফিসে রিপোর্ট করতে হবে।
চিঠিটা মাকে দেখিয়েছিল অর্জুন। ছেলে সত্যসন্ধানী বলে মায়ের নিশ্চয়ই গর্ব হয়, কিন্তু যে-কোনও বাঙালি মায়ের মতো ছেলের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে তিনি সবসময় চিন্তায় থাকেন। চিঠি পড়ে বললেন, যেচে তোর কাছে চাকরি এসেছে, মাইনেও ভাল, চাকরিটা নিয়ে নে।
তুমি আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে?
আমি? এই বাড়ি ছেড়ে আমি কী করে যাব?
তা হলে তোমাকে ছেড়ে আমি ওখানে পাকাপাকি থাকব কীভাবে?
বাঃ! চাকরির জন্যে লোকে দূরদেশে যায় না? আমাকে পাহারা দিতে দিতে তোর যখন চুল পাকবে তখন কী হবে?
তিনদিন ধরে অনেক ভেবেছে অর্জুন। শেষ পর্যন্ত মায়ের জন্যে নয়, নিজের জন্যেই সে স্থির করেছে চাকরিটা নেবে না। এইসব গোয়েন্দা সংস্থার কাজ ধরাবাঁধা। যেসব সমস্যার কথা মানুষ পুলিশকে না জানিয়ে সমাধান করতে চায় তাই নিয়ে হাজির হয় সংস্থাগুলোর কাছে। সংস্থাগুলো গোপনে খবর এনে দেয়। এমনকী বিয়ের আগে মেয়ের বাবা ছেলে কেমন জানতে এদের দ্বারস্থ হন। এখানে চাকরি নিয়ে সে-ছেলের সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে যাচ্ছে, দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে হেসে ফেলল। হ্যাঁ, ঠিকই, জলপাইগুড়িতে সত্যসন্ধানীর নিয়মিত রোজগার হওয়া সম্ভব নয়। বিকল্প একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
ধন্যবাদের সঙ্গে প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেবে বলে চিঠি লিখতে বসেছিল অর্জুন, এই সময় ফোনটা এল। টাউন ক্লাবের সন্তুদা বললেন, অর্জুন, একটু আসতে পারবে?
কোথায়?
আমাদের অফিসে। এ পি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়।
কী ব্যাপার?
ফোনে বলা যাবে না, চলে এসো। সন্তুদা হেসে লাইন কেটে দিলেন।
চিঠিটা শেষ করে অর্জুন তার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পোস্ট অফিসের সামনে চারটে ছেলে মোটরবাইকের ওপর বসে আড্ডা মারছে। পোশাক দেখলে বোঝা যায় বাড়ির অবস্থা ভাল। তেইশ-চব্বিশ বছরের ছেলেগুলোর ভাবভঙ্গিতে ঔদ্ধত্য ছিল। জলপাইগুড়িতে ইদানীং এই ধরনের কিছু ছেলেকে দেখা যাচ্ছে।
চিঠি পোস্ট করে বাইকের দিকে এগোতেই জনার্দনকে দেখতে পেল সে। দু হাতে ধূপবাতি নিয়ে এর-ওর কাছে বিক্রির চেষ্টা করছে। ওকে দেখে জনার্দন
এগিয়ে এল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ভাল আছ জনার্দন?
না সার। একদম ভাল নেই। আপনি আমার কী অবস্থা করেছেন দেখুন।
কেন? বেশ সুন্দর ব্যবসা করছ দেখতে পাচ্ছি।
ছাই ব্যবসা। কেউ ধূপ সহজে কিনতেই চায় না। কোনওমতে ডাল-ভাতের জোগাড় হয়। এবার অন্য কিছু না করলে মরে যাব।
অন্য কিছু মানে? তুমি কি আবার পুরনো লাইনে ফিরে যেতে চাইছ?
না সার। ধৰ্মত বলছি, চাইছি না। কিন্তু।
অর্জুন চিন্তা করল, তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে দেখা কোরো।
জনার্দন মাথা নাড়ল, আমি একটা চায়ের দোকান করতে চাই সার। আপনি যদি কোর্টের সামনে দোকানের ব্যবস্থা করে দেন–! যা খরচ হবে আমি প্রতি মাসে শোধ করে দেব। আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, আমি বেইমানি করব না।
অর্জুন মাথা নেড়ে এগোচ্ছিল, জনার্দন পেছন থেকে বলল, সার!
অর্জুন তাকাল। জনার্দনের গলার স্বর নেমে গেল, একটা কথা বলছি সার। দয়া করে আমার নাম কাউকে বলবেন না। ওই যে চারটে ছেলে ভটভটির ওপর বসে আছে, ওরা ভাল নয়।
কী থেকে বুঝলে?
আমি লাইন ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু দু-একজন বন্ধু তো লাইনে আছে এখনও। কাল তাদের একজন বলছিল এরাই নাকি মাঝরাতে আসাম রোডে ছিনতাই করে।
জলপাইগুড়ি শহরের আশপাশে কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পুরনো পাপীদের ধরেও পুলিশ সুরাহা করতে পারেনি। শহরের অবস্থাপন্ন পরিবারের বেকার ছেলেরা যদি ওই কাজে নামে তা হলে পুলিশের পক্ষে প্রথমেই হদিস পাওয়া মুশকিল।
জনার্দনকে ছেড়ে বাইক নিয়ে হেঁটে রাস্তায় আসতেই একটি ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যালো জেক্স বন্ড! আর-একজন বলল, দুর। জেম্স বন্ড বুড়ো হয়ে গিয়েছে। বল, জেম্স বন্ডের নাতি। বাকি দুজন সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আওয়াজ তুলল সিটি বাজিয়ে।
এসব ক্ষেত্রে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে হয়। ওদের চ্যালেঞ্জ করলে সোজা অস্বীকার করবে। বলবে, তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেনি। অর্জুন বেরিয়ে এল।
সদা বললেন, এসো, এসো। কফি খাবে?
নাঃ। এ পি-দা এসেছেন?
হ্যাঁ। কালই এসেছে কলকাতা থেকে। চলো।
সন্তুদা অর্জুনকে এ পি সাহেবের ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। এটা চাবাগানের জেলা অফিস। আসল অফিস কলকাতায়। এ পি সাহেব ড়ুয়ার্সের বেশ কিছু চা বাগানের মালিক। খেলাধুলো ভালবাসেন। টাউন ক্লাবের সঙ্গে তাঁর বাবার আমল থেকে জড়িত। কলকাতার খেলাধুলোর জগতেও ওঁর প্রতিপত্তি আছে।
গুড মর্নিং অর্জুনবাবু। এসো। বোসো। এ পি সাহেব তাঁর চেয়ারে বসে ছিলেন।
সন্তুদা বললেন, আমাকে দরকার আছে?
এ পি সাহেব নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন। সন্তুদা চলে গেলে তিনি হাসলেন, ব্যবসাপত্র কেমন চলছে?
ব্যবসা? অর্জুন অবাক!
বাঃ। তুমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ কদ্দিন তাড়াবে?
বনের মোষ তাড়ানো যাদের স্বভাব তারা বোধ হয় খাওয়ার কথা চিন্তা করে। বলুন, কীজন্য ডেকেছেন? অর্জুন হাসল।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। অনেক আগের এক বাংলা ছবিতে এইরকম একটা সংলাপ শুনেছিলাম। চরকায় তেল দেওয়া যার স্বভাব সে নিজের চরকা পরের চরকা নিয়ে ভাবে না, চরকা পেলেই তেল দেয়। ওয়েল, আমি তোমার সাহায্য চাই। তোমার দক্ষিণা কত বলো৷ এ পি সাহেব বাঁ হাতে পেপারওয়েট নাড়াচাড়া করছেন।
দক্ষিণার কথা প্রথমেই কেন?
আমি তোমাকে বিনাপয়সায় খাটাতে চাই না, তাই।
আপনার যেটা ভাল মনে হবে তাই দেবেন। কাজটা কী তাই বলুন।
পেপারওয়েটটা মুঠোয় চাপলেন এ পি সাহেব। তারপর বললেন, আমি জানি একজন সত্যসন্ধানী হিসেবে আপনি বিষয়টা গোপন রাখবেন। জলপাইগুড়িতে আমাদের বিশেষ সম্মান আছে। আমার বাবার কথা তো আপনার জানাই আছে।
আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।
বেশ। আমার এক মামাতো ভাইয়ের ছেলের নাম সন্দীপ। সেই ভাই হঠাৎ অকালে মারা যায় বলে আমরা তার স্ত্রী আর সন্তানকে দেখাশোনা করতাম। ছেলেটি স্কুলে যখন পড়ত তখন পড়াশুনায় বেশ ভাল ছিল। কিন্তু স্কুল ছাড়ার পর থেকেই ও রেজাল্ট খারাপ করতে শুরু করে। স্কুলের রেজাল্ট ভাল ছিল বলে ওকে কলকাতার কলেজে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ভাল লাগছে না বলে ফিরে এসে এখানকার কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু ইদানীং তার কথাবার্তা, চালচলন দেখে ওর মায়ের সন্দেহ হচ্ছে ও সুস্থ জীবনযাপন করছে না।
কী দেখে মনে হচ্ছে ওঁর?
বেশিরভাগ দিন কলেজে যায় না। দুপুরটা বাড়িতে ঘুমোয়। সন্ধেয় বের হয়ে রাত একটা-দুটোর সময় ফেরে। জিজ্ঞেস করলে বলে, কাজ ছিল।
আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন?
আমার সঙ্গে প্রথমে দেখা করতে চায়নি। এড়িয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত যখন মুখোমুখি হয়েছে তখন একটাই জবাব দিয়েছে, ওর কিছুই হয়নি। কিন্তু মুখচোখ দেখে আমার মনে হয়েছে, আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার জন্যে ছটফট করছে।
এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা কখনও ভাবেনি অর্জুন। কলকাতার যে অফিস তাকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে তারা হয়তো এসব কে নিয়েই ডিল করে। সেটা করতে ইচ্ছে নেই বলেই ওদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে সে।
এ পি সাহেব বললেন, অথচ সন্দীপের কোনও ইচ্ছে অপূর্ণ রাখিনি আমরা।
সন্দীপের বাড়ি কোথায়?
রেসকোর্সে। ওখানে ওকে সবাই চেনে।
ঠিক আছে। আমি দেখছি। আপনি ওর মাকে আমার কথা বলে রাখবেন।
অর্জুন উঠে পড়ল। এ ধরনের কাজ নিতে তার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ পি সাহেবের মুখের ওপর না বলতে পারল না।
চলে যাচ্ছিল অর্জুন, এ পি সাহেব ডাকলেন, অর্জুন!
অর্জুন পেছনে তাকাল। এ পি সাহেব বললেন, জলপাইগুড়ির বদলে তুমি কলকাতায় চলে আসছ না কেন? আমি তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি।
আমার চাকরি করার ইচ্ছে নেই। তাই।
চাকরি কেন, তুমি নিজেই প্র্যাকটিস করবে ওখানে।
বেশ তো। আপনি একটু আগে দক্ষিণার কথা বলছিলেন, সন্দীপের সমস্যাটা যদি জানতে পারি তা হলে আপনার সাহায্য নেব। অর্জুন বেরিয়ে এল।
প্র্যাকটিস! উকিল ডাক্তাররাই এদেশে প্র্যাকটিস করে থাকেন। হ্যাঁ, সেই অর্থে একজন সত্যসন্ধানী তো প্র্যাকটিস করতেই পারেন। অর্জুনের মনে হল এখনও দুপুরের দেরি আছে যখন, তখন সন্দীপবাবুর সঙ্গে দেখা করা যেতেই পারে।
রেসকোর্স পাড়ায় ওদের বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। এখন এই শহরে একটাই মুশকিলে পড়তে হয়। বেশিরভাগ লোক তাকে ঘুরে-ঘুরে দ্যাখে। পোস্ট অফিসেও তাই হয়েছিল। এখানে সন্দীপের বাড়ির খোঁজ করতেই তিনটে ছেলে এগিয়ে এল, সন্দীপের বাড়িতে যাবেন অর্জুনদা, আসুন, নিয়ে যাচ্ছি।
অর্থাৎ এরা তাকে চেনে। একটু এগোতেই একজন জিজ্ঞেস করল, ওদের বাড়িতে কি কোনও রহস্য উদ্ধার করতে যাচ্ছেন?
কেন? ওদের বাড়িতে রহস্য আছে নাকি? সন্দীপ তোমাদের বন্ধু?
না। ও আমাদের সঙ্গে মেশে না।
বাড়িটা চিনিয়ে দিয়ে ছেলেগুলো চলে গেল। সামনে চিলতে বাগান, পেছনে তিনতলা বাড়ি। একটা কাজের লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে জানাল সন্দীপ এখন বাড়িতে নেই। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওর মা আছেন?
এই সময় এক মধ্যবয়সী মহিলা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, কী চাই? অর্জুন ওপরের দিকে তাকায়, আমাকে এ পি সাহেব আসতে বলেছেন।
ওহো, আসুন আসুন। ভদ্রমহিলা চোখের আড়ালে চলে গেলেন।
মিনিট তিনেকের মধ্যে অর্জুন এবং সন্দীপের মা মুখোমুখি। অর্জুনের সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রমহিলা। এ পি সাহেব ইতিমধ্যে টেলিফোনে ওঁকে জানিয়ে দিয়েছেন অর্জুনের কথা।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ওকে কখনও জিজ্ঞেস করেছেন ওর কী সমস্যা?
কতবার। বলতেই চায় না।
আপনার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করে?
ব্যবহার? কথাই বলতে চায় না। আগে টাকাপয়সা চাইত, এখন তাও চায়। আমি যেচে দিতে গেলে বলে, দরকার নেই। এই একটু বাদে ফিরবে। স্নানখাওয়া শেষ করে ঘুমাবে। সন্ধের পর আবার বেরিয়ে যাবে। ফিরবে মাঝরাতে। চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।
ওর বন্ধুদের আপনি চেনেন?
আগে চিনতাম। এখন কে বন্ধু জানি না। কেউ বাড়িতে আসে না।ভদ্রমহিলা বললেন, এর ওপর এক জ্বালা হয়েছে। একটা কালো বেড়াল নিয়ে এসেছে কোত্থেকে। অন্ধকারে বেড়ালটার চোখ জ্বলে। ঘরের ভেতর খাঁচায় পুরে রেখেছে, বাইরে বেরুতে দেয় না। কিন্তু মাঝে-মাঝে রাত্রে ও বেড়ালটাকে নিয়ে বাইরে যায়।
বেড়ালটাকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না?
না। কাজের লোক বলেছে ও নাকি বেড়ালটার সঙ্গে কথা বলে, কীসব ট্রেনিং দেয়। বেড়ালটাকে দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
আপনার ছেলে এখন ফিরবে বললেন। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি?
না, না। এখনই ওর সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। আপনি খোঁজখবর নিন। যদি বাইরে থেকেই খবর পেয়ে যান, তা হলে খুব ভাল হয়।
আপনি ওকে ভয় পাচ্ছেন?
তা পাচ্ছি। আপনাকে ওর পেছনে লাগিয়েছি জানলে প্রচণ্ড অশান্তি করবে। খুব রাগী। আমি একবার দাদাকে ডেকে এনেছিলাম বলে ও শাসিয়েছে, দ্বিতীয়বার ওরকম করলে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।
বেশ। প্রয়োজন না হলে কথা বলব না। ওর একটা ছবি দেখতে পারি?
ভদ্রমহিলা ঘর থেকে একটা ফোটোগ্রাফ এনে দিলেন। ঝকঝকে দেখতে এক তরুণ। কোথাও মালিন্য নেই। ছবিটা ফিরিয়ে দিতে গিয়ে সে আবার দেখল। কীরকম চেনা-চেনা লাগছে ছেলেটাকে।
ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, কদ্দিনের মধ্যে ওর সত্যিকারের খবর দেবেন?
অর্জুন হেসে ফেলল, দেখি। তবে ওই সত্যিকারের খবর শুনে আপনার যদি ভাল না লাগে? যাকগে, ওর বেড়ালিটা কি এখন বাড়িতেই আছে?
হ্যাঁ।
একটু দেখা যেতে পারে?
ভদ্রমহিলা ইতস্তত করলেন, বেড়ালটাকে ও ঘর থেকে বেরুতে দেয় না। ঘর অন্ধকার করে রাখে সবসময়। আমাকে নিষেধ করেছে ওই ঘরের দরজা খুলতে। আপনি কাচের জানলা দিয়ে দেখতে পারেন।
ভদ্রমহিলা অৰ্জুনকে নিয়ে এলেন দোতলার একটি ঘরের সামনে। ঘরের দরজা বন্ধ। তালা দেওয়া নয়, ছিটকিনি তোলা আছে। ওপাশে একটি কাচের জানলা। ভদ্রমহিলা সেখানে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ওই যে, ওই যে।
অর্জুন দ্রুত জানলার সামনে গেল। বন্ধ জানলার ওপাশে ঘরের কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকারে দুটো চোখ জ্বলছে। চোখ দুটো তাদের লক্ষ করছে বোঝা গেল। রাত্রে এমন জুলন্ত চোখ দেখলে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য।
ওকে কি বেঁধে রাখা হয়েছে?
হ্যাঁ। চেন দিয়ে বাঁধা থাকে।
চলুন। অর্জুন পা বাড়াল।
বাইকে চড়ে বাড়ি ফিরছিল অর্জুন। রেসকোর্স ছাড়িয়ে পোস্ট অফিসের মোড়ের কাছে পৌঁছতেই আচমকা মনে পড়ে গেল। বাইক ঘুরিয়ে পোস্ট অফিসের সামনে পৌঁছে দেখল ওই ছেলে চারটে এবং তাদের বাইক নেই। একটু এগোতেই জনার্দনকে দেখতে পেল। একগাল হাসল জনার্দন, আপনি আবার ফিরে এলেন?
ওই ছেলেগুলো কোথায় গেল দেখেছ?
চোখ ঘুরল জনার্দনের, কাদের কথা বলছেন?
ওই যারা বাইক নিয়ে আড্ডা মারছিল। যাদের কথা তুমি–।
অর্জুনকে শেষ করতে দিল না জনার্দন, একটু আগে পাণ্ডাপাড়ার দিকে চলে গেল ওরা আমাকে এর মধ্যে জড়াবেন না সারা।
অর্জুন বুঝতে পারল কেন তার তখন ছবি দেখে মনে হয়েছিল বেশ চেনা-চেনা। তাকে যখন ছেলেগুলো আওয়াজ দিচ্ছিল তখন যে ছেলেটা বলেছিল, দুর জেম্স বন্ড বুড়ো হয়ে গেছে, বল জেম্স বন্ডের নাতি, তার সঙ্গে ছবির খুব মিল রয়েছে। ভুল না করলে ওটা সন্দীপেরই ছবি। অর্জুনের মনখারাপ হয়ে গেল। এ পি সাহেবের আত্মীয় যে কুসংসর্গে পড়েছে তা আবিষ্কার করতে তার কয়েক ঘণ্টাও লাগল না। এই মফস্বল শহরের রহস্যকাহিনী তেমন জোরালো হয় না। সে ঠিক করল সন্দীপের মাকে কিছু জানাবে না। এ পি সাহেবকে বলে দিলেই ল্যাটা চুকে যায়।
বাড়ি ফেরার সময় অর্জুনের মনে হল, এ পি সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। এই শহরে তাঁর আত্মীয় মোটরবাইক নিয়ে তিন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারছে দিনের পর দিন, এ তথ্য নিশ্চয়ই তাঁর অজানা নয়। তিনি নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়ে জেনেছেন সন্দীপের এই বন্ধুদের পরিচয় কী? আর যদি তা জেনে থাকেন তা হলে কেন অর্জুনকে এই দায়িত্ব দিলেন? সে ঠিক করল আজই লাঞ্চের পর সে এ পি সাহেবের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে।
বাড়ি ফেরামাত্র মা বলল, তোর চিঠি এসেছে।
খামটা নিল অর্জুন। বিদেশি খাম।
খাম খুলে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। মেজর চিঠি লিখেছেন। সেই মেজর। কালিম্পং-এর বিষ্টুসাহেব আর মেজর। যে মেজর এখন থাকেন আমেরিকায়। মেজর চিঠি লিখেছেন ইংরেজিতে।
অনেকদিন হয়ে গেল মেজরের সঙ্গে অর্জুনের কোনও যোগাযোগ নেই। সেই যে সুধামাসির সঙ্গে আমেরিকায় গিয়ে মেজরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ওটাই শেষ দেখা। মেজর মানেই রহস্য, ছুটোছুটি। চিঠিটা বাংলায় তর্জমা করলে এমন দাঁড়ায়, কী হে? ব্যাপারটা কী তোমাদের? ভদ্রতা করে দুটো লাইন লিখলেও তো পারো! তোমার বয়সে লেখাটেখার অভ্যেস নেই কিন্তু এটা বলে রাখাই বদ অভ্যাস। তোমার বয়সে কোনও খারাপ অভ্যেস শুরু করা ঠিক নয়। গতকাল তোমার সিনিয়ারকে ফোন করেছিলাম, কোনও সাড়াশব্দই পেলাম না। তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি। বিষ্ণুসাহেব এখন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। তিনি প্রায়ই বলেন কালিম্পঙে যাবেন। তাঁর কুকুরের সমাধির পাশে বসে প্রার্থনা করবেন। বোঝে!
আমরা যাচ্ছি। ইয়েস। জলপাইগুড়িতে যাচ্ছি। সঙ্গে একটি সত্তর বছরের বুবক থাকবে। অতএব তুমি এই জানুয়ারি মাসে জলপাইগুড়ির বাইরে পা বাড়িও না। নতুন শতাব্দীতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে বলে আনন্দে অনেকটা লিখে ফেললাম। পৃথিবীর সব ভালবাসা তোমার ওপর বর্ষিত হোক।-মেজর।
চিঠির তারিখ লক্ষ করল অর্জুন। বারোদিন আগে লেখা। আমেরিকা থেকে জলপাইগুড়িতে পৌঁছতে এই খামটার বারোদিন লেগে গেল। মাস শেষ হতে তো বেশি দেরি নেই। অর্জুনের খুব ভাল লাগছিল।
মেজর একা আসছেন না, সঙ্গে যিনি আসছেন তাঁর বয়স সত্তর। ওঁর স্বভাবমতো সঙ্গীর পরিচয় উনি দেননি। এঁদের সঙ্গে আসছেন কিনা তা লেখেননি মেজর। বিষ্ণুসাহেব খুব ভালমানুষ। প্রায় সাহেব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভালবাসেন।
মাকে খবরটা দিল অর্জুন। মা বলল, আমি ওপাশের ঘরটা ঠিকঠাক করে রাখছি, তুই ওদের বাড়িতেই নিয়ে আয়।
না মা। বাড়িতে ওঁদের ভাল লাগবে না। মেজরের সঙ্গে আর-একজন বৃদ্ধ আসছেন। বোধ হয় তিনি আমেরিকান। আমাদের খাওয়াদাওয়া তাঁর সহ্য হবে না।
জলপাইগুড়ি শহরের কোন হোটেল ওঁদের সাহেবদের খাবার খেতে দেবে? তুই তো বলিস ভাল হোটেলগুলো সব শিলিগুড়িতে।
ঠিক। হয়তো ওঁরা শিলিগুড়িতেই থাকবেন।
এখন দুপুর নয়, আবার বিকেলও নামেনি। অর্জুন বাইক নিয়ে বের হল এ পি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। জীবনদার বই-এর সামনে পৌঁছতেই সে লোকটাকে দেখতে পেল। ঊর্ধ্বমুখী হয়ে একটা গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা দাড়িতে সাদা ছোপ, চিনতে দেরি হল না। বাইকটা পাশে দাঁড় করিয়ে অর্জুন বলল, কেমন আছেন গোরক্ষনাথবাবু?
লোকটা চমকে তাকাল। মাথা নাড়ল, চেনা গেল না তো!
আমি অর্জুন। হাকিমপাড়ার অমল সোমের বাড়ির হারুকে আপনি তিনটে পশুপাখি জোগাড় করতে বলেছিলেন। তারপর গিয়েছিলেন সেনপাড়ার মিত্তিরদের বাড়িতে।
এইবার মনে পড়েছে। সেদিন কত চেষ্টার পর সেনবাবুর আত্মা বিদায় নিয়েছিলেন। তা আপনি তো শেষ পর্যন্ত ওখানে থাকেননি।
আমি ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করি না।
যে ভূতে বিশ্বাস করে না তার ভগবানেও বিশ্বাস করা উচিত নয়। দুজনকেও তো সাদা চোখে দেখা যায় না।
আপনি সেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও?
দেখুন, আপনি আমার বিশ্বাসে আঘাত করছেন।
ঠিক আছে, ওই গাছের দিকে কেন তাকিয়ে ছিলেন?
ওই মগডালে একটা কানা কাক বসে আছে। ব্যাটা জন্ম থেকে কানা কিনা তাই ঠাওর করছিলাম।
আপনি সেটা এত নীচ থেকে বুঝতে পারেন?
দেখে-দেখে মানুষের অভিজ্ঞতা হয়। রুগির মুখ দেখে শুনেছি বিধান রায় বলে দিতেন কী অসুখ হয়েছে। আচ্ছা, নমস্কার। হাতজোড় করল গোরক্ষনাথ।
আপনি কোথায় থাকেন গোরক্ষনাথবাবু?
আজ্ঞে, তিস্তা ব্রিজের কাছে।
আপনার প্রেতাত্মারা কাদের ভয় পায় যেন?
ওই যে বলেছিলাম। একটা কানা কাক, যে জন্ম থেকে কানা; একটা খোঁড়া শকুন, যে জন্ম থেকে খোঁড়া; আর একটা কুচকুচে কালো বেড়াল, যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে। আমাদের চারপাশে সবসময় যেসব আত্মা ঘুরে বেড়ায়, এরা তাদের দেখতে পায়। আপনার বিশ্বাস না হলে পরখ করে দেখতে পারেন। চোখ বন্ধ করল গোরক্ষনাথ।
এ পি সাহেব অফিসে ছিলেন না। জরুরি খবর পেয়ে ড়ুয়ার্সের চাবাগানে চলে গিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হল না কিন্তু কথাগুলো বলা দরকার ছিল। সন্তুদার টেবিলে বসে কিছুক্ষণ ওঁকে কাজ করতে দেখল অর্জুন। একসময় জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাবের নামী ফুটবলার ছিলেন সন্তুদা। এখনও শরীর ঠিক রেখেছেন। কাজ শেষ করে সন্তুদা জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবে?
মাথা নাড়ল অর্জুন, এ পি সাহেবকে বলবেন, উনি যে সমস্যার কথা বলেছেন সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আমি সেটাই বলতে এসেছিলাম।
তাই? ঠিক আছে বলে দেব। সন্তুদা এক মুহূর্ত ভাবলেন, তোমার সঙ্গে সন্দীপের কি দেখা হয়েছে? বোধ হয় হয়নি, তাই না?
ওকে আমি দেখেছি। আচ্ছা চলি।
দাঁড়াও। এ পি সাহেব বলে গিয়েছেন তোমার যদি গাড়ির দরকার হয় তা হলে ব্যবস্থা করে দিতে। অথবা অন্য কোনও সাহায্য-।
না। তার দরকার নেই। ছেলেটা খারাপ সংসর্গে পড়েছে। ওর বন্ধুদের তো সবাই চেনে। খুব বড় কিছু খারাপ করে ফেলার আগে ওকে সরিয়ে ফেলা দরকার, ব্যস, এইটুকু৷ অর্জুন উঠে দাঁড়াল।
সন্তুদা বললেন, তুমি বলছ, আমরাও জানি। কিন্তু ওর বন্ধুরা এই শহরের মানী এবং বড়লোকের ছেলে। তাদের খারাপ ছেলে বলা খুব সহজ নয়।
এই সময় অর্জুন সন্দীপকে অফিসে ঢুকতে দেখল। প্রায় ঝড়ের মতো সে এগিয়ে গেল কর্মরত এক ভদ্রলোকের সামনে। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের মালিক অফিসে নেই?
লোকটি উঠে দাঁড়াল, না, সাহেব বাগানে গিয়েছেন।
কবে ফিরবেন?
আগামীকাল।
ননসেন্স!
সন্তুদা গলা তুলে ডাকলেন, সন্দীপ, এদিকে এসো।
সন্দীপ রাগী চোখে তাকাল, আপনি আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না।
সন্তুদা হাসলেন, কী আশ্চর্য? খামোকা জ্ঞান দিতে যাব কেন? তুমি হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে উঠলে, আফটার অল এটা তো অফিস।
সন্দীপ কয়েক পা এগিয়ে এল, আপনি ওঁকে বলে দেবেন আমার পেছনে লোক লাগিয়ে কোনও লাভ হবে না।
তোমার পেছনে উনি লোক লাগাবেন কেন?
লাগিয়েছেন, সেই লোক মায়ের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। আরে, সব জায়গায় আমার অ্যান্টেনা ফিট করা আছে।
তুমি ভুল করছ। লোক নয়। তুমি কি ওঁকে চেনো না? অর্জুনকে দেখিয়ে দিল সন্তুদা। চোখ ছোট করে অর্জুনকে দেখল সন্দীপ। তারপর হেসে বলল, এঁকে কে না চেনে! ইনি গোয়েন্দা। তা হলে আপনাদের সাহেব আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে। চমৎকার। এই যে, শুনে রাখুন, আপনি যত বড় গোয়েন্দা হন, আমার পেছনে ঘুরে কোনও লাভ হবে না। দ্বিতীয়বার যেন আপনার ছায়াও আমার বাড়িতে না পড়ে। আন্ডারস্ট্যান্ড? কথা শেষ করে হনহন করে বেরিয়ে গেল ছেলেটা।
ওর চলে যাওয়াটা দেখলেন সদ্ভুদা। তারপর বললেন, ভুল হল। তোমার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা ঠিক হল না।
সেটা আজ না হলেও কাল তো জানতেই পারত। আচ্ছা, চলি।
চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্সে অনেকদিন বাদে রামদাকে কাউন্টারে দেখল অর্জুন। ইদানীং অসুস্থতার জন্যে ভদ্রলোক খুব কম বাড়ি থেকে বের হন। এই সময় দোকানে ভিড় নেই। অর্জুনকে দেখে ওঁর পেটেন্ট হাসিটা হাসলেন, কী খবর?
কেমন আছেন রামদা?
এই, চলছে। বসুন। চা চলবে?
বয়সে অনেক বড় তবু ভদ্রলোক তাকে আপনি বলেন। এরকম পরিষ্কার মানুষ খুব কম দেখেছে অর্জুন। কাউন্টারের ভেতরে একটা চেয়ার খালি থাকেই, অর্জুন সেটায় বসল। বিভিন্ন অসুখের জন্যে ওষুধ কিনতে মানুষ আসে উদ্বেগ নিয়ে, দেখতে দেখতে ভাল অভিজ্ঞতা হয়। একজনকে ওষুধ বিক্রি করে রামদা বললেন, আজ সকালে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি।
কীরকম? অর্জুন তাকাল।
ডিসপোজাল সিরিঞ্জ কিনছে লোকে। একসঙ্গে এক ডজন।
শুধু সিরিজ? ইনজেকশনের স্মার্শ্বল?
না। শুধু সিরিঞ্জ। আর যারা বিলছে তাদের এর আগে কখনও দেখিনি। অবশ্য আমি এখন দোকানে বসি না, ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
কত সিরিঞ্জ বিক্রি করেছেন আজ?
আশিটা। স্টকেও বেশি নেই। ভাবছি এর পর শুধু সিরিঞ্জ চাইলে বিক্রি করব না।
প্রেসক্রিপশন ছাড়া সিরিঞ্জ বিক্রি করতে পারেন?
হ্যাঁ। এ নিয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
এত সিরিঞ্জ নিয়ে ওরা কী করতে পারে?
জানি না ভাই। একজন তো কেনেনি, তা হলে বুঝতাম স্টক করছে।
রামদা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন খদ্দের আসায়। অর্জুনের অস্বস্তি হচ্ছিল। টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনের চটি বই খুলে শহরের অন্য মেডিক্যাল স্টোর্সের নাম্বার বের করে তার একটীয় ডায়াল করল, আচ্ছা, আপনার কাছে ডিসপোজাল সিরিঞ্জ কত আছে?
বেশি নেই। আজ হঠাৎ পাবলিক দশ-দশটা করে কিনে নিয়ে গেছে।
টেলিফোন রেখে দিল অর্জুন। রামদার হাত খালি হলে সে বলল, ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয় রামদা। শুধু আপনার দোকান থেকে নয়, শহরের অন্য দোকান থেকেও সিরিঞ্জ কেনা হয়েছে। তার মানে এর পেছনে একটা পরিকল্পনা কাজ করছে। আপনার উচিত পুলিশকে জানানো।
পুলিশকে?
হ্যাঁ। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, তাই না?
তা তো বটেই। কিন্তু পুলিশকে জানানো মানে হাজার ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া। ঠিক আছে, তুমি বলছ, আমি থানায় ফোন করছি। নাম্বার বের করে রামদা থানায় ফোন করলেন। বড়বাবুকে চাইলেন। শুনলেন বড়বাবু এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। মেজবাবু ফোন রেখে তাঁকে ঘটনাটা বলবেন। রিসিভার নামিয়ে রেখে রামদা হাসলেন, কী বলল জানেন? সিরিঞ্জ বিক্রি হয়েছে এতে তো আপনার খুশি হওয়া উচিত। এখন মানুষ আর ট্যাবলেটে ভরসা পায় না, ডাইরেক্ট ইনজেকশন নিয়ে অসুখ সারায়। ডিসপজাবেল সিরিঞ্জ ব্যবহার করছে মানে শরীর-সচেতনতা বেড়েছে। এ নিয়ে আপনি নালিশ করতে চাইছেন?
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আপনি আপনার কর্তব্য করেছেন রামদা। চলি।
বাইকে উঠে এঞ্জিন চালু করতেই অর্জুন দেখতে পেল উদভ্রান্তের মতো হাবু দুপাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। এসময় হাবুর এখানে আসার কথা নয়। অমল নোম ওকে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। বাজার করা ছাড়া ও বাড়ির বাইরে যায় না। তা ছাড়া বোবা এবং কালা বলে পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশাও করতে পারে না। দেখামাত্র হাবু ছুটে এল তার কাছে। তারপর হাত নেড়ে চোখ ঘুরিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করে উত্তেজনা প্রকাশ করল।
এমনিতে হাবুর ইশারা বুঝতে পারে অর্জুন। কিন্তু ও এত উত্তেজিত যে, কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত সে এই অনুমানে পোঁছল যে, বাড়িতে এমন কোনও গোলমাল হয়েছে যে, হাবু তার সাহায্যের জন্যে ছুটে আসতে বাধ্য হয়েছে। সে ইশারায় হাবুকে বাইকের পেছনে উঠে বসতে বলল।
হাবুর মুখ শুকিয়ে গেল। ওর শরীর তাগড়া এবং প্রচুর শক্তি ধরে। কিন্তু বাইকের পেছনে যেভাবে উঠে বসে নড়বড় করতে লাগল তাতে অর্জুন বিপাকে পড়ল। কীভাবে বসতে হবে দেখিয়ে দিয়ে সে বাইক চালু করল। অর্জুন অনেকবার অমল সোমকে প্রশ্ন করতে গিয়েও করেনি। এত লোক থাকতে তিনি হাবুর মতো বোবা কালা মানুষকে কেন বাড়ির পাহারাদার হিসেবে রেখেছেন। অমলদা যখন ছিলেন তখন হাবু রান্নাও করত। সে যে খুব রাগী এবং শক্তিশালী, এটা প্রচারিত হওয়ায় কোনও অবাঞ্ছিত আগন্তুক ওই বাড়িতে ঢোকার সাহস পায় না। হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে হাবু যেভাবে তার বাইকের পেছনে বসে আছে তা দেখে রাস্তার লোকজন হাসছে। কোনওমতে ওকে নিয়ে অর্জুন হাকিমপাড়ায় চলে এল।
বাড়ির সামনে বাইক দাঁড় করানোর পরও হাবুকে নামতে দেখা গেল না। অর্জুন তাকে নামতে বলে নিজে নেমে দাঁড়াল। হাবু বসে আছে চোখ বন্ধ করে। এবং তারপর বোঝা গেল ওর পা অসাড় হয়ে গেছে। ধরে ধরে মাটিতে নামানোর পরও বসে পড়ছিল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকে অর্জুন দেখল বাইরের ঘরের দরজা বন্ধ। বাগানটা আগের মতো সুন্দর হয়ে আছে। তা হলে গোলমাল কীসের।
ততক্ষণে হাবু ধাতস্থ হয়েছে। ওকে ইশারায় ডেকে নিয়ে এল খিড়কি দরজায়। সেটা ঠেলে ভেতরে ঢোকার পর দেখা গেল উঠোন বারান্দা জুড়ে সুটকেস বাক্স প্রায় পাহাড়ের মতো পড়ে আছে। এবং তখনই গর্জন কানে এল। বিকট শব্দে নাক ডাকছে কারও। যেখান থেকে শব্দটা ভেসে আসছে সেটা অমল সোমের শোয়ার ঘর। অর্জুন সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে গেল।
মেজর অমল সোমের খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। তাঁর দাড়ি গোঁফের জঙ্গল থেকে আওয়াজটা প্রচণ্ড জোরে বের হলেও তিনি তা শুনতে পাচ্ছেন না। কোনও হুঁশই নেই তাঁর।
এতক্ষণে পরিষ্কার হল। মেজরকে হাবু চেনে। তিনি মালপত্র নিয়ে এসে পড়ায় দরজা খুলে দিয়ে সে ছুটেছে অর্জুনকে খবর দিতে। আর এই অবসরে মেজর একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছেন।
মেজর যে এত তাড়াতাড়ি এসে পড়বেন, অর্জুন ভাবেনি। আর জলপাইগুড়ি শহরে এলে উনি সোজা অমল সোমের বাড়িতে চলে আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বাড়িতে ওঁর পক্ষে কি থাকা সম্ভব? নিজের বাড়ি বলে অমল সোম যা মেনে নেন তা মেজরের পক্ষে বেশ কষ্টকর হবে। অসল সমস্যা হবে খাওয়াদাওয়া নিয়ে। হাবুর হাতের রান্না উনি খেতে পারবেন বলে মনে হয় না।
মেজরকে নাক ডাকতে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাবু দাঁড়িয়ে ছিল মালপত্তরের পাশে হাত তুলে দুটো আঙুল দেখাল। তারপর একটা আঙুল ঘরের দিকে নির্দেশ করে দুহাত ওঠালো। বুঝতে পারল অর্জুন। দুজন এসেছে বলে হাবু জানাচ্ছে। মেজরের চিঠিতেও তো ওই খবর ছিল। ওঁর সঙ্গে এক বৃদ্ধের আসার কথা। তিনি কোথায় গেলেন? উঠোনের আশেপাশে তিনি নেই। অর্জুন মালপত্তরগুলো দেখল। এতসব সঙ্গে কেন এনেছেন তা মেজরের সঙ্গে কথা না বললে জানা যাবে না। একটা ঢাউস সুটকেসের দিকে নজর গেল। দেখেই বোঝা যায় খুব দামি সুটকেস।
হ্যান্ডেলের সঙ্গে একটা ট্যাগ লাগানো রয়েছে, তাতে লেখা, গোরান সুলম্যান। অর্জুন আবার চারপাশে তাকাল, না, গোরানসাহেবের কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সে ইশারায় হাবুকে ওখানে থাকতে বলে বাগানের দিকে এগোল।
অমল সোমের বাড়ির ভেতরের বাগানটা প্রায় এক বিঘে জমির ওপর। বড় বড় আম কাঁঠাল নারকেল এবং সুপুরি গাছ প্রায় জঙ্গলের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে অমলদার অবর্তমানে হাবু এদিকটায় বেশি নজর দেয়নি।
খানিকটা এগোতেই অর্জুনের কানে এল ওদিকের গাছে গাছে পাখিরা প্রবল স্বরে চেঁচিয়ে চলেছে। এরকম কাণ্ড সাধারণত শত্রু দেখলে ওরা করে থাকে। অর্জুন সেদিকেই এগোল। খানিকটা যেতেই সে মানুষটাকে দেখতে পেল। তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছেন। জিনিসটা লোকটির হাতে ধরা। অর্জুন ডাকল, হ্যালো।
গোরান সুলম্যান ঘুরে দাঁড়ালেন ওঁর বাঁ হাতের মুঠোয় হাত তিনেক লম্বা সাপের মাথা শক্ত করে ধরা মানুষটির বয়স হলেও শরীরে যে ভাল শক্তি আছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। চোখের মণি নীল এবং দৃষ্টি অত্যন্ত শীতল। সাপটা লেজ নাড়ছিল। এটি একটি পরিণত বয়সের শঙ্খচূড়, তা একবার দেখেই বুঝতে পারল অর্জুন। এই বিষধর রাগী সাপটাকে ভদ্রলোক খালি হাতে ধরলেন।
ওয়েলকাম। দিস ইজ অর্জুন।
গোরান, গোরান সুলম্যান।
এরকম একটা বিষধর সাপ আপনি খালি হাতে ধরলেন? ইংরেজিতে প্রশ্ন করল অর্জুন। গোরানসাহেব কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর মুঠোর চাপ বাড়ালেন। হঠাৎ সাপটা স্থির হয়ে গেল এবং ওর মুখ থেকে তরল কিছু বেরিয়ে আসতেই গোরানসাহেব কিছুটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। বাঁ হাতের মুঠোর চাপে একটা প্রমাণ সাইজের শঙ্খচূড় সাপকে মেরে ফেলা সহজ ব্যাপার নয়!
প্রথমে গাছের পাতা ছিঁড়ে আঙুলগুলো মুছলেন গোরানসাহেব। এই সময় গোটা তিনেক কাক উড়ে গিয়ে নামল সাপটার পাশে। ওটা মরে গিয়েছে বুঝতে পেরে শরীরের তিন জায়গায় তিনজন ঠোকর দিচ্ছিল আর ভয়ে ভয়ে দুজন মানুষের দিকে তাকাচ্ছিল। অর্জুন গোরানসাহেবের দিকে তাকাল। ওঁর মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে। জিভ সামান্য বেরিয়ে। চোখ দুটো বিস্ফারিতা দেখলেই অস্বস্তি হয়। কাকেদের সাপ খাওয়া দেখে উনি এরকম উত্তেজিত হলেন কেন?
অর্জুন বলল, আপনারা অনেকটা জার্নি করে এসেছেন, চলুন, ভেতরে চলুন।
গোরানসাহেব ওর দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যাও, আমি একটু পরেই আসছি।
এই কথার পর দাঁড়িয়ে থাকা অসভ্য। অর্জুন ধীরে ধীরে উঠোনে ফিরে এল। কিন্তু কাকের সাপ খাওয়া দেখার সময় গোরান সাহেবের মুখের অভিব্যক্তি তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না।
হাবু দাঁড়িয়ে আছে, যেমন ছিল। ঘরের ভেতর থেকে নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ল। দ্বিতীয়বারের আওয়াজটা তীব্র হওয়ায় আচমকা নাসিকাগর্জন থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মেজরের হাত বিছানার ওপর কিছু খুঁজতে চাইল। চশমাটাকে পাওয়ার পর চোখে এঁটে উঠে বসলেন তিনি, তারপর পরিষ্কার বাংলায় চিৎকার করলেন, কে রে?
আমি, অর্জুন।
তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন মেজর। তারপর অদ্ভুত শব্দ করে দৌড়ে এসে অর্জুনকে জড়িয়ে ধরলেন, ও তুমি? দ্য গ্রেট মধ্যমকুমার। ওঃ, কতদিন পরে তোমার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। কোনও পারফিউম মাখখানি বলে গন্ধটাকে জেনুইন লাগছে। নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রে একধরনের রেয়ার টাইপের সিলমাছের গায়ে এরকম গন্ধ পেয়েছি।
অর্জুন হতভম্ব। কী বলছেন ভদ্রলোক? তার আর সিলমাছের শরীরের গন্ধ এক? সিলমাছের ঘাম হয় নাকি? একে ঠাণ্ডার দেশের প্রাণী, তার ওপর জলে থাকে, মেজর কী করে গন্ধের খবর পেলেন জিজ্ঞেস করলে অন্য কথা বলা যাবে না।
আপনি যে তাড়াতাড়ি এসে যাবেন, ভাবিনি! চিঠি পেয়েছি।
চিঠি লেখার পর এখানে আসার জন্যে উত্তেজনা বেড়ে গেল। তারপর ওই বিষ্টুসাহেব, সকাল দুপুর বিকেলে টেলিফোনে জ্বালিয়ে গেছেন। বুঝলে, জ্বলে গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এখানে এসে দেখি মিস্টার সোম নেই। এ ব্যাটা হাবু ততা কোনও কথাই বোঝে না। আচ্ছা, তুমিই বলো, কোনও বুদ্ধিমান লোক ওইরকম কেয়ারটেকারের ওপর বাড়ির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বাইরে যায়? মেজর কথা বলছিলেন চেঁচিয়ে।
বুদ্ধিমান বলেই বোধ হয় উনি যেতে পারেন।
অ্যাাঁ? ওহো, হো, হো, হো। হাসিতে ফেটে পড়লেন মেজর।
তিনি শান্ত হলে অর্জুন প্রশ্ন করল, বিষ্টুসাহেব এসেছেন?
ইয়েস। বাগডোগরায় নেমে আর তর সইল না। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা কালিম্পং চলে গেলেন। সমাধিতে শুয়ে ওঁর কুকুরটা নাকি কেঁদেই চলেছে, না গেলে শান্ত হবে না। যাক গে, এখন কী করি বলো!
এখানে থাকার ব্যাপারে বলছেন?
ইয়েস। মিস্টার সোম বাড়িতে নেই অথচ আমরা দখল করে বসে রইলাম, এটা তো ভাল দেখায় না। জলপাইগুড়িতে হোটেলের ব্যবস্থা কীরকম?
এখনও এই একটা ব্যাপারে আমরা পিছিয়ে আছি। আসলে এখানে তো টুরিস্ট খুব কম আসে, তাই ভাল হোটেল তৈরি হল না। তবে আমি সার্কিট হাউসে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
এখানে দেখলাম ইন্ডিয়ান স্টাইলের ল্যাট্রিন মিস্টার সোম রোগা মানুষ, তাঁর পক্ষে ব্যায়াম করা সহজ। আমার মধ্যপ্রদেশ যেভাবে বাড়ছে, বুঝেছ। ওই যে গোরান আসছে। তোমাকে লিখেছিলাম ওর কথা। আলাপ করিয়ে দিই। মেজর চটপট চোস্ত আমেরিকান ইংরেজিতে বলে গেলেন, ইনি গোরান সুলম্যান। আত্মাদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। আর ইনি হলেন অর্জুন, এঁর কথা বলেছি।
অর্জুন বলল, আমাদের পরিচয় হয়ে গেছে।
মেজর চোখ বড় করলেন, ও গোরান, এখন থেকে অর্জুন আমাদের গাইড। ও বলছে এখানকার সার্কিট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
কেন? এই জায়গাটা তো ভালই।
ভাল, কিন্তু যার বাড়ি সে তো নেই।
বাড়িতে না থেকে আমরা এই গাছেদের মধ্যে টেন্ট ফেলে থাকতে পারি। যখন পাহাড়ে জঙ্গলে যাব তখন তো এইভাবেই থাকতে হতে পারে।
মরেছে! মেজর বাংলায় ফিরে এলেন। অর্জুন তাকাল। গোরানের ডান হাতে পাতায় জড়ানো বস্তুটি কি শঙ্খচূড় সাপটার মাথা?
শেষ পর্যন্ত সার্কিট হাউসেই ঘরের ব্যবস্থা করতে হল অর্জুনকে। গোরানসাহেবের যুক্তি মনঃপূত হয়নি মেজরের।
পাহাড়ে জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয় বিকল্প ব্যবস্থা নেই বলে। এভারেস্টের পাঁচশো ফুট নীচে যদি একটা বিশ্রী ধর্মশালাও থাকত তা হলে অভিযাত্রীরা সেখানেই গিয়ে উঠতেন, তাঁবু খাটাতেন না। গোরানসাহেব অ্যাডভেঞ্চার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মেজর রাজি হলেন না।
সার্কিট হাউসের ব্যবস্থা করে ওঁদের ওখানে তুলে দিতে-দিতে সন্ধে হয়ে এল। এত লটবহর টানাটানি না করে হাবুর জিম্মায় রেখে দেওয়া হল। গোরানসাহেব জর ঘরের দরজা বন্ধ করলে অর্জুন খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গ তুলল। মেজর ততক্ষণে পাশাক পালটে ফেলেছেন। আলখাল্লায় বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললেন, নো প্রবলেম। প্রথমে বলো, তোমার মা কীরকম আছেন?
ভাল।
তা হলে তো চুকেই গেল। ওঁর হাতের নিরামিষ রান্না খাব। এই ধরো লাউয়ের ঘন্ট, চালকুমড়ো নারকোল দিয়ে, শুক্তো, বড়ির ঝোল। বলতে বলতে খেয়াল হল তাঁর, ওঁকে খাটানো হয়ে যাবে না তো?
মোটেই না। মা এসব রান্না করতে পারলে খুশি হবেন। কিন্তু ওই ভদ্রলোক দিশি রান্না খাবেন?
আলবত খাবে। আমেরিকানরা তো সেদ্ধ ছাড়া কিছুই খেতে জানে না। এবার খেয়ে দেখুক রান্না কাকে বলে! শুধু একটু মিষ্টি দিতে বোলো।
কিন্তু এগুলো তো দিনের খাবার।
তাই তো! আমাদের কাছে কিছু টিনফুড আছে। আজ চালিয়ে নেব। মেজর একটা ব্যাগ খুলে হুইস্কির বোতল বের করলেন। সেটাকে আলোর সামনে ধরে খানিকক্ষণ দেখলেন। ওঁর দাড়িগোঁফের জঙ্গলের মধ্যে দিয়েও তৃপ্তির হাসিটা ফুটে উঠছিল, গুড। তুমি তো এখন সাবালক। চলবে তো?
না। অর্জুন হেসে মাথা নাড়ল।
ছিপি খুলে বোতল থেকে সরাসরি কয়েক ঢোক গলায় চালান করে দিলেন মেজর। তারপর চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্জুনের মনে পড়ল মেজরের মদ্যপান সে প্রথম দিন থেকে দেখে আসছে। অনেক বছর চলে গেল। ইতিমধ্যে মেজরের দাড়ির বেশিরভাগই সাদাটে হয়ে গিয়েছে। অথচ ওঁর স্বভাব বদলায়নি, মদের প্রতি আসক্তি একই রয়েছে।
বোতলটাকে যত্ন করে টেবিলের ওপর রেখে মেজর বিছানায় বসলেন, এবার বলো, গোরান স্যুলম্যানকে তোমার কেমন লাগল।
একটু অন্যরকম।
ঠিক। মাঝে-মাঝে আমারও মনে হয় ও মানুষ নয়, মানুষের শরীরে বাস করা একটা আত্মা। আসলে আত্মা নিয়ে গবেষণা করতে করতে ওর মধ্যে পরিবর্তন এসে গিয়েছে। এমনিতে লোকটা ভাল।
আজ অমলদার বাগানে একটা শঙ্খচূড় সাপকে উনি মুঠোয় চেপে মেরেছেন। পরে সেই সাপটার মাথা কেটে পাতায় জড়িয়ে নিয়ে এসেছেন।
সাপের মাথা? চোখ বড় করলেন মেজর, সাপের মাথার সঙ্গে হয়তো আত্মার কোনও সম্পর্ক আছে। এসব লোকদের বোঝা মুশকিল। আমি আসতে রাজি হলাম, কারণ তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। দ্বিতীয়ত, ভূতপ্রেতে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ড্রাকুলার গল্প পেলেই পড়ে ফেলি। এই সুযোগে যদি জ্যান্ত ড্রাকুলা দেখা যায়, মন্দ কী। বোতলের দিকে হাত বাড়ালেন মেজর।
আপনি চিঠিতে স্পষ্ট কিছু লেখেননি। ব্যাপারটা কী?
গোরান সুলম্যানকে আত্মা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা খুব গুরুত্ব দেন। গোরান বিশ্বাস করে আত্মা আছে। তবে ভালমানুষ মারা গেলে তাঁদের আত্মা মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়। কিন্তু মন্দ মানুষের আত্মা পৃথিবীতে আটকে থাকে, যন্ত্রণা পায়। সেই যন্ত্রণা নাকি মারাত্মক। মানুষ হয়ে থাকার সময় যাদের কামনা-বাসনা মেটে না, লোভের শেষ যাদের হয়নি, তারাই বদ-আত্মা হয়ে যায়। এই আত্মাদের কেউ প্রতিশোধ নিতে, অত্যাচার করতে একটা শরীর বেছে নেয়। এদের বলা হয়। ড্রাকুলা। দিনের বেলায় এদের কোনও ক্ষমতা নেই, কিন্তু রাত্রে এরা ভয়ানক হয়ে ওঠে। গলায় মদ ঢাললেন মেজর।
এসব কথা এখন একটা কিশোরও জেনে গিয়েছে। সেইসঙ্গে এও জানে রাক্ষস-খোক্ষস ড্রাকুলা স্রেফ গাঁজাখুরি গপ্পো। আমি একটা কথা ভেবে পাচ্ছি না, গোরাসাহেবের মতো একজন আধুনিক মানুষ কেন এসবে ইন্টারেস্টেড হলেন?
গাঁজাখুরি! মাই ডিয়ার অর্জুন, পৃথিবীর নানান দুর্গম জায়গায় ঘুরে আমি স্পষ্ট জেনে গেছি আমার জ্ঞানই শেষ কথা নয়। তুমি একটা গোরুকে দেখবে সুন্দর সাঁতার কেটে নদী পার হচ্ছে। ওকে সাঁতার শেখাল কে? কখনও যে-মানুষ জলে নামেনি সে কি সাঁতার কাটতে পারবে? একবার আলাস্কা পেরিয়ে এমন একটা বরফের দেশে গিয়েছিলাম যেখানে আমাদের আগে কেউ যায়নি। তুষারঝড়ে আমরা আটকে পড়ায় খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছিল। একদিন আমি আর একজন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিকার করতে বের হলাম। ওইসব অঞ্চলে সীল পাওয়া যায়। বরফের চুড়োয় একটা বসে ছিল। আমাদের দেখেই সেটা শূন্যে ঝাঁপ দিল। অতবড় চর্বিওয়ালা শরীর নিয়ে ঠিক পাখির মতো অনেকটা উড়ে নীচের বরফের খাঁজে লুকিয়ে পড়ল। সীল উড়তে পারে একথা তুমি বিশ্বাস করবে? অত কথা বলার দরকার কী, এ-দেশে এখনও নিশ্চয়ই তান্ত্রিকদের খুব প্রভাব আছে, আছে তো? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
তা আছে। অর্জুন স্বীকার করল।
শুধু সরল অশিক্ষিত মানুষরাই তাদের কাছে যায়, একথা নিশ্চয়ই বলবে না। শিক্ষিত মানুষ যখন তাদের সামনে মাথা নিচু করে বসে তখন গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতে পারবে? রামকৃষ্ণদেব মা কালীর দর্শন পেতেন। তুমি জানো না?
পড়েছি। কিন্তু–!
ভগবান থাকলে ভূত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
গোরানসাহেব আগে কী করতেন?
ও ডাক্তারি পাশ করে গবেষণা করে গেছে চিরকাল।
কী ব্যাপারে?
ওই একটা প্রশ্ন করলে গোরান খুব রেগে যায়। চলো, অনেকক্ষণ বকবক করে যাচ্ছি। তোমাদের শহরটা একটু ঘুরে দেখি। মেজর আবার বোতলের দিকে হাত বাড়ালেন। অর্জুন বলল, আজকে বিশ্রাম নিলে ভাল হত না? অনেকটা জার্নি করে এসেছেন। তার চেয়ে আপনাদের পরিকল্পনার কথা শুনলে ভাল লাগবে। অর্জুন বলল।
মেজর উঠে একটা ব্যাগ খুলে বড় প্যাকেট বের করলেন। সেখান থেকে ভাঁজ করে রাখা একটা ম্যাপ টেবিলের ওপর বিছিয়ে বললেন, কাম হিয়ার।
অর্জুন কাছে গেল। একটা বড় বিন্দুর ওপর আঙুল রেখে মেজর বললেন, দিস ইজ জলপাইগুড়ি। এখানে আমরা এখন রয়েছি। ঠিক আছে। এটা তিস্তা নদী। সাহেবদের তৈরি ম্যাপ, ভুল থাকলে বলে দেবে তুমি। এই তিস্তা পার হলে হিমালয়ের নীচের পুরো জায়গাটার নাম ড়ুয়ার্স। এই যে রাস্তাটা ড়ুয়ার্স পেরিয়ে সোজা আসামে চলে গিয়েছে।
অর্জুন ম্যাপটাকে লক্ষ করছিল। প্রথমেই চোখে পড়ল তিস্তার ওপর যে দুটো ব্রিজ তৈরি হয়েছে তা ম্যাপে নেই। এখান থেকে ময়নাগুড়ি হয়ে ধুপগুড়ি চলে গিয়েছে রাস্তাটা। এখন যে ময়নাগুড়িতে না গিয়ে বাইপাস হয়ে নতুন তৈরি ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে ধুপগুড়ি যাওয়া যায়, সেই রাস্তাটাও ম্যাপে নেই। অর্থাৎ এই ম্যাপ তৈরি হয়েছিল ষাট সালের আগে। ড়ুয়ার্সের ভূগোল মোটামুটি এক থাকলেও পথঘাট বদলে গেছে।
মেজর বললেন, এই পথ ধরে আমরা সোজা চলে যাব হাসিমারায়। তারপর থেকেই ভুটানের এলাকা। এই হাসিমারার পাশে একসময় ব্রিটিশদের কবরখানা ছিল। গোরান যা তথ্য পেয়েছে এই এলাকায় একশো বছর আগে প্রচুর ব্রিটিশ প্রয়োজনে থাকতেন। চা বাগানের পত্তনের পর এখানে তাঁদের একটা ক্লাবও তৈরি হয়েছিল। সেই ক্লাব ভারতীয় বিপ্লবীরা পুড়িয়ে দিয়েছিল একসময়। তিনজন ব্রিটিশ সেই আগুনে পুড়ে মারা যায়। আমরা ওখানে যেতে চাই।
কেন?
ওই তিনজন ব্রিটিশের মৃত আত্মা এখনও ওইসব অঞ্চলে সক্রিয় বলে গোরানের ধারণা। ও নাকি ওর পরিচিত আত্মার কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়েছে।
অর্জুন হেসে ফেলল। মেজর চোখ ছোট করলেন, তুমি হাসছ কেন?
অর্জুন বলল, ওই আত্মারা এখানে পড়ে আছে কেন? ওরা যখন ব্রিটেন থেকে এসেছিল তখন স্বচ্ছন্দে স্বদেশে চলে যেতে পারে। সেটাই তো স্বাভাবিক। আর চলে যেতে ওদের তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
মেজর মাথা নাড়লেন, ঠিক এই প্রশ্নটাই আমি গোরানকে করেছিলাম।
উনি কী জবাব দিয়েছেন?
খুব ভুল বলেননি। এই আত্মারা বদ-আত্মা। এদের কামনা-বাসনা ড়ুয়ার্সের জঙ্গল এবং মানুষকে নিয়েই জীবিত অবস্থায় ছিল। মারা যাওয়ার পর তাই এরা এখানেই থেকে গেছে। তা ছাড়া দীর্ঘকাল দেশছাড়া হওয়ায় দেশের জন্যে কোনও আকর্ষণ এদের মধ্যে নেই। মেজর বললেন।
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। আপনি এর আগে যেসব অভিযানে গিয়েছেন তার প্রত্যেকটাই বিজ্ঞান-নির্ভর ছিল। কিন্তু এই আত্মা খোঁজার ব্যাপারটা যে-কোনও সুস্থ লোকের কাছেই হাস্যকর শোনাবে।
তুমি ভুল করছ। গোরান যদি শুধু আত্মা খুঁজতে এখানে আসতে চাইত তা হলে আমি ওর সঙ্গী হতাম না। ও এসেছে ড্রাকুলার সন্ধানে। এখানেই আমার ইন্টারেস্ট।
ড্রাকুলা? ওটা তো একটা কাউন্টকে নিয়ে বানানো গল্প।
ঠিক। কিন্তু কাগজে পড়েছি এদেশে এখন ডাইনি সন্দেহে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। আমি তাই দেখতে চাই আসল ব্যাপারটা কী। আর এই কাজে তোমার সাহায্য চাই। মেজর আবার গলায় তরল পদার্থ ঢাললেন।
কীরকম?
এই অভিযানে তুমি আমাদের সঙ্গী হবে।
আপনার বন্ধু কি সেটা চাইবেন?
হ্যাঁ। সেইজন্যে আমরা প্রথমে জলপাইগুড়িতে এলাম।
কিন্তু আপনি বুঝতেই পারছেন আমি ব্যাপারটাকে আজগুবি ভাবছি। তাই প্রতিটি স্তরে আমি প্রমাণ খুঁজব। এটা কি ভাল লাগবে? মানুষ যখন ভক্তিতে নম্র হয় তখন সে অন্ধ হয়ে যায়। সে-সময় কারও সন্দেহ সে সহ্য করতে পারে না।
তোমার আর গোরানের মাঝখানে তো আমি আছি।
কিছুক্ষণ বাদে অর্জুন বেরিয়ে এল মেজরের ঘর থেকে। এখন সন্ধে শেষ হতে চলেছে। গোরান স্যুলম্যানের ঘরের দরজা বন্ধ। একটা সাপের মাথা কেটে ঘরে নিয়ে এসে ভদ্রলোক তখন থেকে দরজা বন্ধ করে কী করছেন তা তিনিই জানেন। হয়তো ঘনিষ্ঠ আত্মাদের ডেকে কথাবার্তা বলছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেবযান বইটা ইংরেজিতে কেউ অনুবাদ করেছে কিনা অর্জুনের জানা নেই, থাকলে ওঁকে পড়তে দেওয়া যেত।
সার্কিট হাউসের সামনে বাইকে উঠতেই অর্জুন শুনতে পেল, কী খবর? এখানে?
সে পেছন ফিরে তাকাতেই অবনীবাবুকে দেখতে পেল। জলপাইগুড়ি থানার ও.সি অবনীবাবু মানুষটি ভাল। অর্জুনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। অর্জুন বাইক থেকে নেমে বলল, বাইরে থেকে দুজন অতিথি এসেছেন, দেখা করতে এসেছিলাম। আপনি?
আরে বলবেন না। ওপরওয়ালা এসেছেন। ডেকে এনে ধমকালেন। কেন এটা হচ্ছে, কেন ওটা হচ্ছে। অবনীবাবুকে একটু বিরক্ত দেখাল।
অর্জুনের মনে পড়ে গেল, তিস্তার ওপাশে হাইওয়েতে নাকি সন্ধের পরে ছিনতাই হচ্ছে? গাড়ি থামিয়ে করছে?
আরে! এই খবর আপনি পেয়ে গেছেন? হ্যাঁ। পরপর কয়েকটা হয়েছে। গাড়িগুলো থেমে যাচ্ছে আর মুখোশপরা ছিনতাইবাজরা যা পাচ্ছে কেড়ে নিচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত খুনখারাপি করেনি।
সেটা কেউ বাধা দেয়নি বলে করেনি। কারা করছে?
কোনও ক্লু পাইনি। পরিচিত ছিনতাইবাজরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, এরা নাকি বলে। দুটো গাড়ির ড্রাইভার একই স্টেটমেন্ট দিয়েছে।
আচ্ছা, ওই সময় হাইওয়ে ফাঁকা থাকার কথা। গাড়িগুলো যাওয়া-আসা করে বেশ দ্রুতগতিতে। এরা ওদের থামায় কী করে?
এটাই মিস্ট্রি। ঠিক ছিনতাইবাজদের সামনে এসে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে যায়। ভাবছি আজ একটু টহলে বের হব।
অর্জুন হাসল, আপনার গাড়ি দেখতে পেলে ওরা ভদ্রলোক হয়ে যাবে। ওরা কি কোনও একটা বিশেষ জায়গায় রোজ ছিনতাই করছে?
না। জায়গা পালটাচ্ছে। তবে তিস্তা ব্রিজের এক মাইলের মধ্যেই ঘটনাগুলো ঘটেছে। ঠিকই বলেছেন, আমার গাড়ি না নিয়ে প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়াই ভাল। আসবেন নাকি আমার সঙ্গে?
কোনও কাজ যখন নেই, তখন যাওয়া যেতে পারে। অর্জুন বলল।
অবনীবাবু ঘড়ি দেখলেন, তা হলে মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে থানায় চলে আসুন। অবনীবাবু তাঁর জিপের দিকে এগোলেন।
বাড়ি ফিরে এ পি সাহেবকে ফোন করল অর্জুন। তিনি মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ফিরেছেন। অর্জুনের গলা পেয়েই বললেন, সন্তু আমাকে বাগানে ফোন করেছিল। তুমি বলেছ কোনও বড় খারাপ কাজ করার আগে ওকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু আজ অফিসে ও তোমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তাতে আমি খুব অপমানিত বোধ করছি। তুমি কি নিশ্চিত ও খারাপ কাজ করছে?
হ্যাঁ।
কী কাজ?
সেটা জানতে হলে ওকে হাতেনাতে ধরতে হয়। আর ধরা পড়লে আইন তার মতো কাজ করবে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
নিশ্চয়ই। ও যদি কোনও অন্যায় করে থাকে তা হলে আমি চাইব শাস্তি হোক। আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হলেও আমি ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করব না। আমি চেয়েছিলাম তেমন কিছু করার আগে ওকে সাবধান করে দিতে। ও যদি ইতিমধ্যেই অপরাধী হয়ে থাকে তা হলে আইন ওর বিচার করুক। থ্যাঙ্কু অর্জুন। এ পি সাহেব টেলিফোন রেখে দিলেন। মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল অর্জুনের।
তিস্তা ব্রিজের ওপর গাড়িটা থামিয়ে অবনীবাবু ড্রাইভারকে পাঠালেন টোল দিতে। এখনও এই ব্রিজ পারাপার করতে টাকা দিতে হয়। সরকারি গাড়ি, বিশেষ করে গাড়ি বদি পুলিশের হয় তা হলে তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কিন্তু অবনীবাবু যেন ইচ্ছে করেই জানাতে চাইলেন তাঁরা সরকারি মানুষ নন! অন্ধকার গাড়ির ভেতর বসে থাকায় টোল যারা সংগ্রহ করছে তারা তাঁকে চিনতে পারল না।
মোড় পর্যন্ত চলে এসে অবনীবাবু বললেন, আমি কিন্তু আমার এলাকার বাইরে চলে এসেছি। এবার ফিরতে হয়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, শেষ ছিনতাই কোথায় হয়েছিল?
গাড়িটা আবার ব্রিজের দিকে ফিরে যাচ্ছিল। রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছে অবনীবাবু বললেন, এখানে।
গাড়ি থামল না। অর্জুন দেখল জায়গাটা বেশ অন্ধকার। দুপাশে লুকিয়ে থাকার মতো চমৎকার পাথরের আড়াল রয়েছে। অর্থাৎ ছিনতাই যারা করছে তারা প্রথমে লুকিয়ে থাকার আড়াল খুঁজবে। একই জায়গায় পরপর দুদিন তারা নিশ্চয়ই ছিনতাই করবে না। করাটা স্বাভাবিক নয়।
খানিকটা যাওয়ার পর রাস্তার দুপাশে গাছ চোখে পড়ল। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বোঝা গেল ওখানে লুকিয়ে থাকলে রাস্তা থেকে দেখা সম্ভব নয়। দূরে ব্রিজের আলো দেখা যাওয়ামাত্র অর্জুন গাড়িটাকে থামাতে বলল। ডানদিকে একটা কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে। সে অবনীবাবুকে বলল, গাড়িটাকে নীচে নিয়ে গিয়ে একটু অপেক্ষা করা যায় না?
কেন? ওহো, আপনি ভাবছেন ঠিক এখানেই ছিনতাই করবে ওরা। কী মশাই, জ্যোতিষী হলেন কবে থেকে? অবনীবাবু হাসলেন।
ছিনতাই করে ওরা চলে যায় কীসে?
কোনও ড্রাইভার বা গাড়ির প্যাসেঞ্জার সেটা দেখেনি। ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে তারা।
ওরা নিশ্চয়ই হেঁটে আসবে না। আমরা এই আড়ালে থেকে লক্ষ করতে পারি কোনও সন্দেহজনক গাড়ি যাচ্ছে কি না!
তা পারি।
অবনীবাবুর নির্দেশে গাড়ি নীচে নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখা হল। এই গাড়িতে এ দুজন ছাড়া আরও তিনজন পুলিশ রয়েছে। এদের সঙ্গে কী অস্ত্র আছে অর্জুন চান না। ছিনতাই যারা করছে তারা নিশ্চয়ই খালি হাতে আসে না।
গাড়ি থেকে নেমে ওরা এমন একটা আড়ালে দাঁড়াল, যেখানে রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ছে না। এখন রাত দশটা। হাইওয়েতে গাড়ি চলাচল কমে এসেছে। যারা যাচ্ছে তাদের গতি স্বাভাবিকের থেকে বেশি। আজ রাত্রে যে ওরা আসবেই তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। এই সময় দূরে মোটরবাইকের আওয়াজ পাওয়া গেল।
দুটো মোটরবাইককে তীব্র গতিতে ছুটে যেতে দেখল অর্জন। হেডলাইটের আলোর পেছনে থাকায় চালকের মুখ দেখা যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রতিটি মোটরবাইকে দুজন বসে ছিল। অর্জুন অবনীবাবুর দিকে তাকাল।
অবনীবাবু মিলিয়ে যাওয়া মোটরবাইকের আলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, এত জোরে চালালে তো অ্যাক্সিডেন্ট হবেই।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি তখন বললেন, যারা ছিনতাই করছে তারা মুখে মুখোশ পরে থাকে। তাই তো?
অবনীবাবু বললেন, হ্যাঁ। কেন বলুন তো?
আপনার ঠিক মনে আছে?
তাই তো বলেছিল। মুখ দেখতে পায়নি, ঢাকা ছিল।
মুখ তো কাপড় দিয়ে ঢাকা যেতে পারে, হেলমেটেও ঢাকা পড়ে।
হেলমেটে? অবনীবাবু যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন।
জায়গাটা সুনসান। ওপাশে কিছু জোনাকি এলোমেলো উড়ছে। মানুষজনের চিহ্ন নেই এদিকে। কিন্তু মশা আছে। তারা সক্রিয় হয়ে উঠতেই সেপাইরা চড় মারতে লাগল নিজেদের শরীরে। অবনীবাবু বললেন, হ্যাঁ, হতে পারে। আমার ঠিক পরিষ্কার মনে পড়ছে না। তা হেলমেট পরা থাকলে ওরা এসেছিল মোটরবাইকে চেপে। একটু আগে দুটো মোটরবাইককে চলে যেতে দেখলে? আমরা কি ওদের চেজ করব?
প্রথমত, এত পরে ধরতে পারা যাবে না। দ্বিতীয়ত, ওরাই যে ছিনতাই করছে। তা প্রমাণ করবেন কী করে? চলুন, এখানে আর কতক্ষণ থাকা যায়?
অবনীবাবু একমত হলেন। গাড়িটা রাস্তার ওপর উঠে আসার পর বললেন, কয়েকবার এই তিনমাইল রাস্তাটা টহল দিয়ে যাই। অন্তত ওপরওয়ালাকে বলা যাবে।
আধমাইলটাক যাওয়ার পর ওরা একটা মারুতি কারকে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এর আগে যখন এই পথে এসেছে তখন মারুতিটা ছিল না। অবনীবাবু গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। হেডলাইট ঘোরাতেই দেখা গেল একটা লোক স্টিয়ারিং-এর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। পেছনেও একজন রয়েছে।
তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ওরা ছুটে গেল। যে গাড়ি চালাচ্ছিল তার জ্ঞান নেই। টর্চের আলোয় দেখা গেল কপালের একপাশ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। পেছনের সিটে যিনি বসে আছেন তাঁর মুখে টেপ লাগানো। হাত দুটো পেছনে বাঁধা। টর্চের আলোয় তাঁর বিস্ফারিত চোখ দেখা গেল। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভদ্রলোককে বন্ধনমুক্ত করতেই তিনি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলেন।
অবনীবাবু বললেন, আরে আপনি? কী হয়েছে?
কী আর হবে? সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম মশাই। ডাকাতি। ডাকাতি হয়ে গেছে।
ভদ্রলোকের নাম নবগোপাল ঘোষ। শহরের নামকরা কন্ট্রাক্টর। তাঁকে শান্ত হতে বলে অবনীবাবু ড্রাইভারকে নিজের গাড়িতে তুলে তখনই হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। পুলিশরাও ওই গাড়িতে ফিরে গেল।
নবগোপালবাবু হঠাৎই ঝিমিয়ে গেলেন। দু হাতে মুখ ঢেকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং সেই অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, ও মরে গেছে?
না। মাথায় আঘাত লেগেছে। কী হয়েছিল বলুন তো?
আমার সব নিয়ে গিয়েছে ওরা। দু-দুলক্ষ টাকা ব্রিফকেসে ছিল।
কী করে নিল?
এই হতচ্ছাড়া কেশব, আমার ড্রাইভার, এত জোরে গাড়ি চালায় যে নাড়িভুড়ি পেট ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বার্নিশের মোড়ে ওকে ধমকাতে এমন আস্তে চালাতে লাগল যে, গোরুর গাড়িকেও হার মানায়। ও যদি আর একটু জোরে চালাতো তা হলে এই জায়গা আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে যেতাম।
তারপর? অবনীবাবু একটু অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করলেন।
ঠিক ওখানে আসামাত্র দেখলাম একটা কালো বেড়াল রাস্তা কেটে দিয়ে ওপাশে চলে গেল। চোখে আলো পড়ায় ওর চোখ ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। কেশব সঙ্গেসঙ্গে গাড়ি থামিয়ে দিল। বেড়াল রাস্তা কাটলে গাড়ি না থামালে নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়। তার ওপর কালো বেড়াল! আরে, তুই যদি আর একটু জোরে চালাতিস তা হলে জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার পর তো বেড়ালটা রাস্তা পার হত। গাড়ি থামাতেই ওরা ছুটে এল দুপাশ থেকে। কেশব বাধা দিতেই ওরা ওকে মারল।নবগোপালবাবু বড় শ্বাস নিলেন।
কী দিয়ে মারল?
দেখিনি। অন্ধকারে আমি তখন ব্রিফকেস আঁকড়ে বসে আছি। নবগোপালবাবুর নাক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের হল, তারপর আমাকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে ওই অবস্থা করে ব্রিফকেস নিয়ে ওরা চলে গেল। এ কী ভয়ঙ্কর অরাজকতা। উঃ।
অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কত টাকা ছিল ওর মধ্যে?
দু লক্ষ, টু লাখস! গোপালবাবু মাথা নাড়লেন। ওদের কারও মুখ দেখেছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল। মুখ? ইয়েস। না, না। দেখিনি। ঢাকা ছিল।
বাঙালি?
কী জানি? ইংরেজিতে কথা বলছিল। আমার কী হবে এখন?
আমি জলপাইগুড়ি থানার ওসি। চলুন, আপনার গাড়িতে আপনাকে এখন একটু থানায় নিয়ে যাচ্ছি। একটা ডায়েরি করতে হবে আপনাকে।
পুলিশ? আমার পুলিশের ওপর কোনও আস্থা নেই।
ঠিক আছে, কিন্তু যা নিয়ম তা তো পালন করতে হবে। আর ইনি হচ্ছেন অর্জুন। পুলিশ নন। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। অবনীবাবু অর্জুনকে দেখালেন।
হঠাৎ অর্জুনের হাত চেপে ধরলেন নবগোপালবাবু, আমি ভাই তোমার কথা শুনেছি। তুমি টাকাটা উদ্ধার করে দাও, আমি তোমাকে টেন পার্সেন্ট কমিশন দেব। আমি এককথার মানুষ। হ্যাঁ।
আপনি বলছেন ডাকাতদের মুখ দেখতে পাননি। ওরা কারা তাই তো খুঁজে বের করা মুশকিল হবে। কীরকম বয়স বলে মনে হয়েছে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল। নবগোপালবাবু তখনও ওর হাত ধরে রেখেছিলেন। প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়লেন প্রবলভাবে, তখন ওসব মাথায় ছিল না ভাই।
ওদের মাথায় হেলমেট ছিল? মনে করে দেখুন?
হেলমেট? ইয়েস। ছিল। হেলমেটে মুখ ঢাকা ছিল বলে চিনতে পারিনি। একজন টর্চ জ্বেলেছিল, তার আলো হেলমেটে পড়ায় চকচক করছিল সেটা। তিনি বেশ জোরেই বললেন, তাই মাথাগুলো গোল-গোল দেখাচ্ছিল।
নবগোপালবাবুর গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলেন অবনীবাবু। ভদ্রলোক পেছনের আসনে বসে ক্রমাগত নাক দিয়ে শব্দ করে চলেছেন। থানায় পৌঁছে ওঁর বিবৃতি লিপিবদ্ধ করার পর ওঁকে যখন বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হল তখন রাত প্রায় বারোটা।
দুজনে একা হওয়ার পর অবনীবাবু বললেন, কী দুর্ভাগ্য বলুন। নাকের ডগার ওপর দিয়ে ডাকাতি করে গেল, অথচ কিছুই করতে পারলাম না।
এখন পর্যন্ত পারেননি, পারবেন না তা তো নয়।
দুর! একটাও ক্ল পাওয়া যাচ্ছে না।
না, যাচ্ছে। প্রথমত, একটা কালো বেড়াল, যে খুব ট্রেইন্ড। এই শহরে নিশ্চয়ই বেশি লোকের কাছে ট্রেইন্ড কালো বেড়াল নেই।
কালো বেড়াল? অবনীবাবু হতভম্ব।
হ্যাঁ। ওটা ঠিক সময়ে রাস্তা পার হয় বলে গাড়ি থেমে যায়।
আপনি বলছেন যারা ডাকাতি করছে তারাই বেড়ালটাকে ব্যবহার করছে?
তাই তো স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, মুখ হেলমেটে ঢাকা ছিল। তার মানে ওরা এসেছিল বাইকে চেপে। বাইকে চাপতে প্রৌঢ়রা তেমন পছন্দ করে না। তৃতীয়ত, ওরা কথা বলেছে ইংরেজিতে। সে ইংরেজি কতটা ঠিকঠাক তা নবগোপালবাবুর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ধরে নিতে পারি একেবারে অশিক্ষিত ডাকাত ইংরেজিতে কথা বলবে না। বলতে বলতে অর্জুন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, একটা টেলিফোন করতে পারি?
নিশ্চয়ই।
যন্ত্রটাকে টেনে নিয়ে নম্বর ঘোরালো অর্জুন। এত রাত্রে জেগে থাকার কথা নয়, রিঙ হয়েই যাচ্ছে। তারপর ঘুম-ঘুম গলা কানে এল, হ্যালো!
অর্জুন বলছি।
ও। এত রাত্রে? কী ব্যাপার?
বাধ্য হয়েই বিরক্ত করছি। আপনি যদিও বলেছেন কোনও অন্যায় করলে সমর্থন করবেন না, তবু মনে হল আপনাকে জানানো উচিত।
তুমি কোত্থেকে কথা বলছ?
থানা থেকে।
ও বুঝতে পারছি। আইন আইনের পথে চলুক, এ বাপারে আমার কিছু বলার নেই। এ পি সাহেব টেলিফোন রেখে দিতেই অর্জুন একটা বাইকের আওয়াজ শুনতে পেল। বাইরে সেপাইয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, তারপর প্রায় জোর করে যে দরজায় এসে দাঁড়াল তাকে এই সময়ে এখানে দেখার কথা চিন্তাই করেনি অর্জুন।
অবনীবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? কী চাই আপনার?
উত্তেজনা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। সন্দীপ উত্তেজিত কিন্তু তাই বলে অর্জুনকে চিনতে পারছে না এখন? একবার তার দিকে চোখ বুলিয়ে অবনীবাবুর সামনে এগিয়ে গেল, আপনি তো ও.সি, আপনার সাহায্য চাই।
কী ব্যাপারে?
আমার বেড়ালটাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কী? অবনীবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, এত রাত্রে ইয়ার্কি মারতে এসেছেন?
মোটেই না। আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি মারার কী দরকার আমার? আমি থানায় এসেছি অভিযোগ জানাতে। এই বেড়ালটা সাধারণ বেড়াল নয়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, আমার প্রিয়। ওকে কেউ চুরি করেছে আমাদের বাড়ি থেকে। সন্দীপ বলল।
অবনীবাবু হতাশায় কাঁধ নাচালেন, দেখুন, এত রাত্রে আমি কোনও বেড়াল নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই। আপনি প্রয়োজন মনে করলে ডায়েরি করে যেতে পারেন। বেড়ালের খোঁজ পেলে জানিয়ে দেওয়া হবে। কথা শেষ করেই বেল বিপলেন তিনি। একজন সেপাই এগিয়ে আসতে তাকে বললেন, এঁকে এস. আই. সাহেবের কাছে নিয়ে যাও, ডায়েরি করবেন।
অর্জুন এগিয়ে গেল, নমস্কার সন্দীপবাবু, আমাকে চিনতে পারছেন?
সন্দীপ চোখ ছোট করল, আপনি? এখানে?
ও.সি সাহেবের সঙ্গে একটু গল্প করছিলাম। আপনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি। বেড়ালটাকে কখন থেকে দেখতে পাচ্ছেন না? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
অবনীবাবু বাধা দিলেন, আমি তো ওঁকে বললাম ডায়েরি করে যেতে।
সেটা নিশ্চয়ই উনি করবেন। কিন্তু ওঁর বেড়াল সাধারণ বেড়াল নয়। নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু বিশেষত্ব আছে। উনি তো বললেন, বুদ্ধিমান বেড়াল। তাই আপনার উচিত ওঁর কথা একটু মন দিয়ে শোনা। সরি, উচিত শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক হল না। কিন্তু ভেবে দেখুন, বাড়ির বেড়ালকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে আমরা কি কেউ রাতদুপুরে থানায় ছুটে আসতাম? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
সন্দীপ মাথা নাড়ল, ঠিক। এটাই আমি ওঁকে বোঝাতে চাইছিলাম।
অবনীবাবু অর্জুনের দিকে তাকালেন, বেশ।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, বেড়ালটাকে শেষবার কখন দেখা গেছে?
সন্ধেবেলায়। ও নিয়ম করে দিনে দুবার বাগানে যায়। আজ পর্যন্ত ঘর নোংরা করেনি। আমিই নিয়ে যাই। কিন্তু আজ একটু তাড়া থাকায় মাকে বলেছিলাম বাগানে নিয়ে যেতে। বলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে। একটু আগে ওর খোঁজ করতে দেখলাম ও নেই।
আপনার মা কী বলছেন?
মা বলছেন বেড়ালটা নাকি বাগান থেকে সোজা সিড়ি দিয়ে উঠে আমার ঘরে চলে গিয়েছিল। ও আমার ঘরেই থাকে।
তারপর?
অথচ ও যায়নি। মা ভুল দেখেছে অথবা ভেবে নিয়েছে।
অবনীবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, বেড়ালটা আপনার কাছে দামি?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। পোষা প্রাণী তো, দামি হবেই। সন্দীপ জবাব দিল।
আপনি বলেছেন ও খুব বুদ্ধিমান ছিল। কীরকম? অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
আমি যা বলতাম, ও বুঝতে পারত। এমনকী যদি বলতাম সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে আয়, ও মুখে করে নিয়ে আসত। কখনও বাগান ছাড়া বাড়ির বাইরে যেত না। আমি ওকে ফেরত চাই অফিসার।
কীরকম দেখতে ছিল?
কালো। একটু বেশি কালো। আমি ওকে চারদিন বয়সে একটা ভুটিয়ার কাছ থেকে এনেছিলাম। মনে হয় ও ভুটিয়া বেড়াল। গায়ের লোমগুলো ঘন আর সাধারণ বেড়ালের চেয়ে বড়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, অন্ধকারে ওর চোখ জ্বলে?
ঝট করে ঘাড় ঘোরালো সন্দীপ, ওই ধরনের যে-কোনও প্রাণীর চোখ অন্ধকারে জ্বলে। কিন্তু তাই বলে আমার বেড়াল মোটেই হিংস্র নয়।
অবনীবাবুর নির্দেশে খাতা এল। সেখানে সন্দীপ তার নাম-ঠিকানা এবং অভিযোগ লিখল। খাতাটা এস, আইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে ডায়েরির জন্য পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
হঠাৎ অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ? বেড়াল চুরি কেউ করবে বলে ভাবিনি। তবে একটা লোক দিনকয়েক আগে এসেছিল। আমার বেড়ালটাকে দেখতে চাইছিল। লোকটার ভাবভঙ্গি ভাল লাগেনি বলে আমি তাকে পাত্তা দিইনি।
কোথায় থাকে সে?
আমি জানি না।
আচ্ছা সন্দীপবাবু, আজ সন্ধেবেলায় বাড়ি থেকে বেরোবার পর আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, কাদের সঙ্গে ছিলেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
তার সঙ্গে বেড়াল চুরির কী সম্পর্ক?
আপনার বলতে আপত্তি আছে?
হ্যাঁ, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
অবনীবাবু বোধ হয় আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। বললেন, আরে ভাই জলপাইগুড়ি শহরে তোমার বয়সী ছেলে সন্ধেবেলা এমন কী করতে পারো, যা বলতে অসুবিধে হচ্ছে?
সন্দীপ এক মুহূর্ত ভাবল, আমরা আড্ডা মারছিলাম।
কোথায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
এটাও বলতে হবে?
আমি বুঝতে পারছি না, আপনি যদি কোনও অন্যায় না করে থাকেন তা হলে বলতে অসুবিধে হচ্ছে কেন?
আমি অন্যায় করেছি বলে মনে হচ্ছে আপনার? সন্দীপ হঠাৎ রেগে গেল, আপনি আমাকে অপমান করছেন।
অবনীবাবু বললেন, দেখুন ভাই, আমরা খুব ডিস্টার্বড হয়ে আছি। আজ সন্ধের পর তিস্তা ব্রিজের ওপাশে ডাকাতি হয়েছে। ড্রাইভার খুব ইনজিওরড। এর আগেও হচ্ছিল কিন্তু কেউ আহত হয়নি।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোথায়?
আমি একবারও বলিনি সম্পর্ক আছে। যারা ডাকাতি করেছে তারা মোটরবাইকে চেপে গিয়েছিল। এই শহরেরই ছেলে।
কী করে বুঝলেন এই শহরের ছেলে?
অনুমান। আপনিও তো মোটরবাইকে এসেছেন।
সন্দীপ হঠাৎ শব্দ করে হাসল, আমি কোন পরিবারের ছেলে তা আপনি জানেন না। তা ছাড়া যদি ডাকাতি করে থাকি তা হলে ভুলেও থানায় আসতাম না।
সেটা ঠিক। আবার বেঠিকও হতে পারে। যাক গে, আপনি যেতে পারেন, যদি খবর পাই তা হলে বেড়ালটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করব।
অবনীবাবুর কথা শেষ হলে সন্দীপ সুবোধ বালকের মতো উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অর্জুন বলল, আজ রাত্রে ঘুমের বারোটা বেজে গেল।
কেন?
ডাকাতরা একটা বেড়াল ব্যবহার করেছে গাড়ি থামাতে। সন্দীপের বেড়াল যদি ওরা চুরি করে নিয়ে যায়, তা হলে সন্দীপ নির্দোষ। আবার ডাকাতির পর যদি বেড়াল চুরি যায়, তা হলে ও এখানে আসবে কেন?
আপনি কী করে মনে করছেন দুটো বেড়াল একই।
হয়তো ভুল হচ্ছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে বেড়ালটা আদৌ চুরি যায়নি। সন্দীপ একটা বাহানা করে গেল। অর্জুন বলল।
উঠুন, বাড়ি যান। কাল সকালে ভাবা যাবে।
দাঁড়ান। অর্জুন টেলিফোনের কাছে গেল। নাম্বার ঘুরিয়ে সাড়া পেতেই বলল, মাসিমা, বেড়ালটাকে পাওয়া গিয়েছে?
পাওয়া যাবে কেন? খোকা যে বলল ওটাকে কোন তান্ত্রিকের কাছে রেখে এসেছে। কে বলছ বাবা? সন্দীপের মা জিজ্ঞেস করল।
সকালে ঘুম ভাঙামাত্র মনে পড়ল মেজরের কথা। কাল অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরেছিল অর্জুন। অবনীবাবু তাকে একা ছাড়েননি। সঙ্গে জিপ নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এসেছিলেন। পুলিশের কিছু অফিসার অবনীবাবুর মতো ভদ্র, বিনয়ী এবং শিক্ষিত বলে মানুষ ভরসা পায়। অবনীবাবু চেয়েছিলেন কাল রাত্রেই সন্দীপদের বাড়িতে যেতে। সন্দীপ যে ওই ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এটা ওঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অর্জুন আপত্তি করেছিল। প্রমাণ হাতে না আসা পর্যন্ত সন্দীপকে গ্রেফতার করলে ভুল করা হবে। লুঠ করা টাকাগুলো নিশ্চয়ই সন্দীপ বাড়িতে রাখেনি। বেড়ালটাকেও সে উধাও করে দিয়েছে। জামিন পেতে তার কোনও অসুবিধে হবে না। কোনও সাক্ষীকে হাজির করানো যাবে না ওকে শনাক্ত করতে।
ডায়েরির সূত্র ধরে অবনীবাবু নিশ্চয়ই ওর বাড়িতে যেতে পারেন। কিন্তু রাতদুপুরে যাওয়াটা অত্যন্ত অশোভন বলে উনি আজ সকালে যাবেন বলে ঠিক করেছেন।
বেরোবার আগে মা বললেন, হ্যাঁ রে, ওরা কি আজ দুপুরে এখানে খাবে?
বলতে পারছি না মা। যদি খেতে চায় তোমায় জানিয়ে দেব।
বেশি বেলা করিস না। অন্তত ঘণ্টা দুই আগে বলিস।
অর্জুন হেসে ফেলল। মেজরকে বেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে, অথচ মা সরাসরি বলতে পারছে না।
সার্কিট হাউসে গিয়ে অর্জুন জানতে পারল মেজর এবং গোরান সুলম্যান বেরিয়ে গেছেন। ওঁরা গিয়েছেন একটা রিকশায়। রিকশাওলার সঙ্গে নাকি সারাদিনের চুক্তি হয়েছে। চৌকিদার জানাল, বলে গেছেন দুপুরে খাবেন না।
জলপাইগুড়ি শহরে সারাদিন ঘুরে দেখার মতো কিছু নেই। অর্জুন একটু ক্ষুণ্ণ হল এই ভেবে যে, মেজর তার জন্যে কোনও খবর রেখে যাননি। গতকাল ওঁরা সমস্ত জিনিসপত্র অমল সোমের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। কোনও কারণে যদি ওই বাড়িতে একবার ওঁদের যেতে হয় ভেবে অর্জুন বাইক ঘোরাল।
হাবু বাগান পরিষ্কার করছিল। অর্জুনকে দেখে দাঁত বের করে হেসে উঠে দাঁড়াল। অর্জুন হাত নেড়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল মেজর এসেছিলেন কিনা। এটা করতে গিয়ে তাকে দুহাতে মেজরের ভুড়ি এবং গালে হাত বুলিয়ে দাড়ি দেখাতে হল।
হাবু সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল। তারপর আঙুলের মুদ্রায় জানাল ওঁরা চলে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছেন জিজ্ঞেস করার কোনও অর্থ হয় না ভেবে অর্জুন গেটের দিকে ফিরে যাচ্ছিল কিন্তু হাবু আঁ আঁ শব্দ করে পেছনে আসতে লাগল। অর্জুন অবাক হয়ে তাকাতে হাবু ইশারায় যা বোঝাতে চাইল তা প্রথমে বোধগম্য হল না। কেউ ওর ইশারায় না বুঝলে খুব চটে যায় হাবু, মুখের অভিব্যক্তি পালটে যায়। তখন থুতু ছিটোয় মুখ থেকে। একটু সরে ভাল করে বোঝার চেষ্টা করল অর্জুন। শেষ পর্যন্ত ধরতে পারল। কেউ শুয়ে আছে আর তার নীচে দেশলাই জ্বেলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, এইরকম বোঝাতে চাইছে হাবু।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেউ মারা গিয়েছে?
হাবু মাথা নাড়ল, না। তারপর হাত নেড়ে বোঝাতে চাইল সেখানেই গেছেন ওঁরা। অর্জুন খুব অবাক হল, শ্মশানে গেছেন?
এবার খুশিতে উজ্জ্বল হল হাবু। ঘন ঘন মাথা নাড়তে লাগল।
মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না অর্জুন। জলপাইগুড়িতে এসে মেজর কেন গোরানসাহেবকে নিয়ে শ্মশানে যাবেন? বোঝাই যাচ্ছে ওঁদের কথাবার্তা হাবু শুনতে পেয়েছে। ও ভুল করতেই পারে তবু শ্মশানটা দেখে এলেই হয়।
জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি শহরে যাওয়ার পথে ডান দিকে যে শ্মশানটা রয়েছে সেটা একসময় শহরের বাইরে বুলে নির্জন ছিল। এখন শহর বাড়তে শুরু করার পর তার আশেপাশে বাড়িঘর হয়ে গেছে। পাশের যে সরু নদীটায় আগে জুল থাকত সেটাও শুকিয়ে গেছে। বাইক থেকে নেমে শ্মশানে ঢুকল অর্জুন। এই সকালে শহরের কাউকে দাহ করতে আনা হয়নি বলে কোনও চিতা জ্বলছে না। মেজর বা গোরানসাহেবকে কোথাও দেখল না সে। শুধু কয়েকটা অকেজো মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে।
বাবু, ডেডবডি আসবে নাকি?
অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দড়ি পাকানো চেহারার একটি প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। সে মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আজ সকালে রিকশায় দুই ভদ্রলোককে এখানে আসতে দেখেছেন? একজন খুব মোটা, গোঁফওয়ালা, আর দ্বিতীয়জন বিদেশি।
সাহেব?
হ্যাঁ। আমরা এককালে সাহেবই বলতাম।
এসেছিল। এই আমাকেই জিজ্ঞেস করল এই শ্মশানে কোনও সাধু আছে কিনা। এখানে সাধু থাকবে কী করে? ওদের বলে দিলাম অন্য শ্মশানের খোঁজ করতে।
কোথায় গেল ওরা?
দেবী চৌধুরানীর কালীমন্দিরের ওপাশে যে শ্মশান আছে, সেখানে চলে গেল। রিকশাওলাটা আজ ভাল কামাবে। লোকটা হাসল।
রিকশাওলাটাকে তুমি চেনো?
চিনব না? এখানে টান মারতে আসে। রিকশার হ্যান্ডেলে চাকা লাগিয়েছে, প্যাডল করলেই বনবন করে ঘোরে। লোকটা বলল।
শ্মশান থেকে বেরিয়ে এল অর্জুন। হঠাৎ মেজর কেন সাধুর খোঁজে শ্মশানে ঘুরছেন? কাল রাত্রে তো এসব কথা বলেননি। আর শ্মশানে তো শুধু সাধুসন্ন্যাসীরাই থাকেন না, বাজে লোকেরও তো এটা আস্তানা। বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কম নয়।
এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রাস্তা ছেড়ে খানিকটা দূরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় শোনটা দেখতে পেল অর্জুন। বাইক থামিয়ে বুঝতে পারল এখানে ওরা নেই। রাস্তা থেকেই জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটি এককালে শ্মশান ছিল কিন্তু এখন শহরের লোকজন এখানে মৃতদেহ দাহ করাতে আসে না। মিছিমিছি না ঘুরে রাজবাড়ির সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে বলে অর্জুন এগোতেই দূর থেকে রিকশাটা দেখতে পেল। খালি রিকশা ছুটে আসছে। গলা খুলে হিন্দি সিনেমার গান গাইছে রিকশাওলা। আর একটু কাছাকাছি হতে দেখা গেল রিকশার হ্যান্ডেলে রঙিন গোলাকার কিছু বনবন করে ঘুরছে। মাথায় কথাটা আসামাত্র অর্জুন বাইক থামিয়ে লোকটাকে থামতে বলে। ব্রেক কষলেও খানিকটা এগিয়ে গেল লোকটা। তারপর চিৎকার করে বলল, আজকে আর রিকশা চালাব না বাবু, আপনি অন্য রিকশা দেখুন।
অর্জুন বাইক ঘুরিয়ে রিকশার পাশে চলে এল, অনেক রোজগার হয়ে গেছে?
হ্যাঁ বাবু। রিকশাওলা হাসল। ওদের দুজনকে কোথায় ছেড়ে এলে?
আপনি—।
আমি ওদের বন্ধু।
অ। ওঁরা গাড়ি ভাড়া করে চলে গেলেন। আমাকে কন্ট্রাক্টের টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আপনি তো এখানেই থাকেন, না?
হ্যাঁ। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওঁরা কোথায় গিয়েছেন?
শ্মশান ঘুরতে। বার্নিশের ওখানে প্রথমে গিয়েছেন।
অর্জুন দাঁড়াল না৷ তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে বার্নিশে পৌঁছে খোঁজ করতে করতে শ্মশানে চলে এল। এসেই বুঝল ওঁরা এখানে নেই, থাকলে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। এখানে শোন মাঠের ওপর। ছন্নছাড়া। কিছু খবর পাওয়ার আশায় সে বাইক থেকে নামতেই গলা শুনতে পেল, বাবু!
অর্জুন গোরক্ষনাথকে এখানে আশা করেনি। গোরক্ষনাথ ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। আজ ওর পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে বিশাল ঝোলা।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এখানে?
এই শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ানোটাই তো আমার কাজ। আপনার তো এসবে ঠিক আস্থা নেই, আপনি কীসের সন্ধানে এলেন?
বিদেশ থেকে দুজন মানুষ এসেছেন। আমার বিশেষ পরিচিত। ওঁরাও শ্মশান ঘুরতে বেরিয়েছেন। ওঁদের খোঁজে এসেছি।
দুজনের একজন কি সাহেব?
হ্যাঁ। এখানে এসেছিলেন ওঁরা?
আমি দেখিনি। একটু আগে শুনলাম, এখানে তান্ত্রিকের খোঁজ করছিলেন। তা বাবু, জলপাইগুড়ির শ্মশানে তো তান্ত্রিকরা নিয়মিত থাকেন না, হঠাৎ হঠাৎ আসেন।
ওঁরা কোথায় গিয়েছেন?
ধুকুয়ামারির শ্মশানে একজন সাধু আছেন, তাঁর কাছে গিয়েছেন বলে অনুমান করি। ধুকুয়ামারির কথা এখান থেকেই ওঁরা জেনেছেন।
সেটা এখান থেকে কতদূরে?
দূর আছে। আপনি যাবেন?
হ্যাঁ।
গোরক্ষনাথ অর্জুনের বাইকের দিকে তাকাল, আমাকে যদি পেছনে বসতে দেন তা হলে সঙ্গে যেতে পারি। সাধুর কথা কদিন থেকে শুনছি, চোখে দেখে আসি৷
বেশ তো। অর্জুন বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। ওটাকে ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে নিয়ে যেতে যেতে সে জিজ্ঞেস করল, কাক, শকুন আর বেড়ালের খবর কী?
আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন বাবু?
আমি তো কিছুই করিনি, শুধু জানতে চাইছি ওদের পাওয়া গেল কিনা?
সহজে কি যায়? দুর্লভ বস্তু। উঠব?
হ্যাঁ।
গোরক্ষনাথ উঠে বসতে অর্জুন বলল, কালো বেড়াল, যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে, তাকে পেতে তো তেমন অসুবিধে নেই। এই শহরেই আছে।
থাকলেই তো হল না, কোথাও না কোথাও খুঁত থাকবেই। হয় চেহারায়, নয় ব্যবহারে। এই তো হয় মুশকিল। গোরক্ষনাথ শক্ত করে হাতল ধরে বলল।
ব্যবহারের খুঁত কীরকম?
সে অনেক ব্যাপার। আমাদের চারপাশে অদৃশ্য হয়ে যাঁরা ঘুরে বেড়ান, তাঁদের জব্দ করা তো সোজা কথা নয়! একটু খুঁত থাকলেই সব শেষ।
অর্জুন বাইক চালু করল, তা তো বটেই। কাক বা শকুনের ব্যাপারটা সত্যি কঠিন, কিন্তু ওই ধরনের বেড়াল তো গতকালই পাওয়া গিয়েছে, তাই না?
মুখ না দেখতে পেলেও অর্জুন বুঝতে পারল গোরক্ষনাথ খুব অবাক হয়ে গিয়েছে। তার গলা বদলে গেল, আপনি কী করে জানতে পারলেন?
দেখুন, কোনও সাধারণ মানুষ, কালো বেড়াল মার চোখ অন্ধকারে জ্বলে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে পুষতে চাইবে না। কালো বেড়ালকে সবাই অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ভাবে। তার ওপর যদি ওটা বাচ্চা না হয় তা হলে তো কথাই নেই। অর্জুন বাইক চালাতে চালাতে বলছিল, গত রাত্রে রেসকোর্সের কাছে একটা বাড়ি থেকে কালো বেড়াল চুরি গিয়েছে, যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে।
কী বলছেন বাবু, চুরি গিয়েছে?
হ্যাঁ। যাঁর বেড়াল তিনি ডায়েরি করেছেন থানায় এসে।
আপনার কি মনে হয় আমি ওটাকে চুরি করেছি?
আমি জানি না। তবে প্রয়োজন পড়লে তো মানুষ অনেক কিছু করে। সামনের রাস্তাটা দুদিকে ভাগ হয়েছে, কোনদিকে যাব?
ডান হাতের রাস্তা। কিন্তু বাবু, আমি চুরি করিনি।
তা হলে শহরে আর-একজন মানুষ আছে, যার কালো বেড়াল প্রয়োজন। অর্জুন বলল, সন্দীপ মিথ্যে ডায়েরি করবে কেন?
সন্দীপবাবুই ডায়েরি করেছেন?
বাঃ, ওর সঙ্গে চেনাশোনা আছে?
না, ঠিক চিনি না।
মিথ্যে বলা কি ঠিক হচ্ছে? গোরক্ষনাথ, ভূতপ্রেত হয়তো তেমন কিছু করলে ভয় পেতে পারে, পুলিশ কিন্তু পাবে না।
পুলিশ আমাকে ধরবে?
সন্দীপের বেড়াল চুরি করলে নিশ্চয়ই ধরবে।
কিন্তু আমি চুরি করিনি। খবর পেয়ে ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। চাকরের কাছে বেড়ালটার যা বর্ণনা পেলাম তাতে মনে হল ওইরকম একটাকেই আমি খুঁজছি। একদিন সন্দীপবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তো আমাকে প্রায় মারতে বাকি রেখেছিলেন। কোথায় থাকি, কী করি, জেনে নিয়ে তাড়িয়ে দিলেন।
তারপর?
দুপাশে তখন জঙ্গল শুরু হয়ে গিয়েছে। কীরকম স্যাঁতসেঁতে গন্ধ বাতাসে। গোরক্ষনাথ বলল, কাল রাত্রে আমি অবাক। উনি, মানে সন্দীপবাবু আমার বাড়িতে আসবেন, আমি ভাবতে পারিনি। বললেন, আমি যেন কয়েকদিন বেড়ালটাকে আমার কাছে রেখে দেখি ও পোষ মানছে কিনা। দশদিন পরে এসে খোঁজ নেবেন। আর বেড়ালটার কোনও ক্ষতি হলে উনি সহ্য করবেন না। বলুন, আমি কি চুরি করেছি?
সন্দীপ যে গিয়েছিল, আপনার সঙ্গে এসব কথা হয়েছে, তার কোনও সাক্ষী আছে?
সাক্ষী? গোরনাথ যেন একটু ভাবল, তারপর বলল, ওই বেড়ালটাই তো আমার কাছে আছে। আমার তো সংসার নেই, যে বুড়িটা দুটো বেঁধে দেয়, সে সব শুনেছে।
বাঁক ঘুরতেই গাড়িটাকে দেখতে পেল। পুরনো অ্যাম্বাসাড়ার গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ড্রাইভার পেছনের সিটে শুয়ে আছে। জঙ্গলে ঘেরা কিছুটা খোলা জমি যে শ্মশান, তা বুঝতে অসুবিধে হল না। ওপাশে দুটো টিনের বাসাওয়ালা ঘর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মেজরদের দেখতে পেল না অর্জুন।
এখানে তেনারা আছেন। গোরক্ষনাথ বাইক থেকে নেমে নাক টানল।
কারা?
তেনার। আমি ঘ্রাণ পাচ্ছি। হ্যাঁ, আছেন। ধুকুয়ামারির এই শ্মশানের নাম শুনেছিলাম। কিন্তু কখনও আসা হয়নি। দুটো হাত মাথার ওপরে তুলে তিন-চারবার কাউকে নমস্কার জানাল গোরক্ষনাথ। অর্জুনের হাসি পাচ্ছিল। গোরক্ষনাথ এমনভাবে কথা বলল, যেন সত্যি ভূতপ্রেতরা এই শ্মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে বলল, চলুন, একটু ঘুরে দেখা যাক। আর হ্যাঁ, সামনে যদি তেনাদের কেউ পড়েন তা হলে আমাকে সতর্ক করে দেবেন, যাতে ধাক্কা না লাগে। অর্জুন পা বাড়াল।
পেছন পেছন আসছিল গোরনাথ, আমি জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, ঠাট্টা করছেন। কিন্তু আপনাকে আমি প্রমাণ দেবই।
ওদের কথা শুনেই হয়তো একটা ঘর থেকে রোগা লিকলিকে এবং খাটো শরীরের মানুষটি বেরিয়ে এল। ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু নেই, একটা হাফপ্যান্ট জাতীয় বস্তু পরনে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
অর্জুনের আগেই গোরক্ষনাথ জবাব দিল, সাধুদর্শনে এসেছি ভাই।
কোত্থেকে আসা হচ্ছে?
জলপাইগুড়ি শহর থেকে।
এখন তার দর্শন পাবেন না।
একটু যদি অনুগ্রহ করেন, অনেকদূর থেকে এলাম–।
ওই যে গাড়ি দেখছেন, এতে করে সেই আমেরিকা থেকে দুজন এসেছেন। বাবা তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। শ্মশানে মড়া না এলে বাবা কাউকে দর্শন দেন না। মড়া নিয়ে আসুন, বাবাও দর্শন দেকেন। কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াল লোকটাও।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, যাঁরা ওই গাড়িতে এসেছেন তাঁরা কোথায়?
লোকটা উলটোদিকের জঙ্গলটা হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। গোরক্ষনাথ বলল, কী সর্বনাশ। মড়া পাই কোথায়?
অর্জুন কোনও কথা না বলে সোজা এগিয়ে গেল। সরু পায়েচলা পথটায় পা দিতে মেজরের গলা শুনতে পেল। বেশ রেগে গিয়েছেন, তুমি তো হে চাণক্যের যমজ ভাই, পাজির পাঝাড়া। আমাকে তুমি চেনো না? আফ্রিকার কতবড় শয়তানকে এক ঘুসিতে শুইয়ে দিয়েছি আর তুমি তো তার তুলনায় একটা আস্ত ছারপোকা দাও, আসলি জিনিস চাই।
অর্জুন কয়েক পা এগোতেই ওদের দেখতে পেল। একটা ডোবার পাশে পাথরের ওপর বসে আছেন মেজর। তাঁর সামনে দুটো বড় মাটির হাঁড়ি নিয়ে বসে আছে একজন বৃদ্ধ আদিবাসী। মেজরের ধমক খেয়ে হাঁড়ি থেকে তরল পদার্থ মাটির গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে ধরল সামনে। খপ করে সেটি নিয়ে মেজর একটু গলায় ঢাললেন। তারপর সোল্লাসে বলে উঠলেন, গ্রেট। এই তো, এই জিনিস চাই। সক্রেটিস যদি তোমাকে পেত তা হলে কক্ষনো ছাড়ত না। আঃ! পুরোটা গলায় চালান করে মাথা নাড়লেন মেজর।
আপনি হাঁড়িয়া খাচ্ছেন? অর্জুনের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।
মেজর মুখ ফেরালেন। চোখ ছোট করে দেখার চেষ্টা করলেন, হু আর ইউ? কে তুমি? কোন সেন্ট?
আমি অর্জুন।
ও, তৃতীয় পাণ্ডব। তাই বলো? এসো এসো। বুঝলে, আমি পৃথিবীর কত জায়গায় গিয়েছি, গিয়ে সেখানকার সেরা জিনিস পান করেছি। কিন্তু এর মতো ভাল পানীয় কোথাও পাইনি। শুধু এই বস্তু ভালভাবে বোতলে ভরে রফতানি করলে তুমি টাকার পাহাড়ের ওপর শুয়ে থাকতে পারবে।
আমি আপনাকে সকাল থেকে খুঁজছি।
হোয়াই? আমি যে তোমার মাকে বলে এলাম দুপুরে খাব, তুমি খবর পাওনি? মেজর চোখ বড় করলেন।
আপনি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?
ইয়েস। তারপর থেকে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছি গোরানের সঙ্গে। সে ব্যাটা গেল কোথায়? মেজর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে সফল হলেন।
এই সময় পাশের জঙ্গল থেকে গোরানসাহেব বেরিয়ে এলেন। তাঁর শার্ট ছিঁড়ে গেছে। ডান হাতে একটা পাখি ছটফট করছে। গোরক্ষনাথের দিকে গোরানসাহেব তাকাতেই সে শিউরে উঠল। অর্জুন শুনল, বাবু, ইনি কে?
কেন?
দেখছেন না শকুন ধরে এনেছেন। বাবু, সাবধান। গোরক্ষনাথ থরথর করে কাঁপছিল।
মেজর চেঁচিয়ে উঠলেন, এ হে হে। তুমি শেষপর্যন্ত একটা শকুন ধরে নিয়ে এলে! বাক্যটি ইংরেজিতে বলা হয়েছিল। গোরানসাহেব হাসলেন। পাখিটাকে ওপরে তুলে দেখলেন, আমি জানতাম না শকুনেরা এত ভিতু হয়। তারপর এ বেচারা খোঁড়া!
খোঁড়া? খোঁড়া শকুন? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
ইয়েস। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল বলে সহজে ধরতে পারলাম। এটার ডানায় বোধ হয় জোর কম। গোরানসাহেব দুচোখ ভরে শকুনটাকে দেখছিলেন।
ছেড়ে দাও। ওটাকে ছেড়ে দাও। মেজর চিৎকার করলেন।
কেন? ওইভাবে চিৎকার করে ছেড়ে দিতে বলছ কেন?
কী করবে ওটা দিয়ে? শকুন পোষ মানে না।
পোষ মানে না?
হ্যাঁ। যে প্রাণীর চোখে পলক পড়ে না, সে কখনওই পোষ মানে না। শকুনের মাংস অত্যন্ত কুৎসিত, কেউ কখনও খেয়েছে বলে জানি না। তা ছাড়া এদেশে সবাই শকুনকে অমঙ্গলের পাখি বলে এড়িয়ে যায়।
অমঙ্গলের পাখি?
তোমার তো আমার চেয়ে ভাল জানা উচিত।
অর্জুন এবং গোরক্ষনাথ চুপচাপ শুনছিল সংলাপগুলো। হঠাৎ গোরক্ষনাথ ফিসফিস করে বলল, ওই শকুনটাকে যেন ছেড়ে না দেয়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেন?
গোরক্ষনাথ বলল, দেতে হবে জন্ম থেকে খোঁড়া কিনা!
গোরানসাহেব মেজরের পাশে পৌঁছে গিয়েছিলেন, এটাকে ঠিক ফরেস্ট বলা যায় না। সাধুটার ব্যাপারে কিছু খবর পেলে?কথা বলার সময় ওঁর হাতে শকুনটা ছটফটিয়ে উঠতেই গোরক্ষনাথ চেঁচিয়ে উঠল, ছেড়ে দেবেন না।
গোরানসাহেব এবার গোরক্ষনাথের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, এ কে?
অর্জুন এগিয়ে গেল, ওঁর নাম গোরক্ষনাথ।
গোরক্ষনাথ দুই হাত কপালে তুলে নমস্কার করল।
মেজর বাংলায় বললেন, এরকম নাম এখনও কেউ রাখে? উচ্চারণ করতে গোরানের দাঁত ভেঙে যাবে। তা বাবা গোরক্ষনাথ, তুমি কী করো?
গোরক্ষনাথ হাত নামাল না কপাল থেকে, আজ্ঞে, শান্তি স্বস্ত্যয়ন।
সেটা কী জিনিস?
আজ্ঞে, তেনারা যাতে মানুষের অপকার না করতে পারে তাই মন্ত্র পড়ে সব শুদ্ধ করে দিই। আমার গুরুর কাছ থেকে এসব শিক্ষা পাওয়া।
তেনারা মানে?
দুষ্ট আত্মা।
আচ্ছা! মেজর গোরানসাহেবের দিকে ঘুরলেন। তাঁকে ইংরেজিতে গোরক্ষনাথের পরিচয়টা দিলেন। গোরানসাহেব পাখিটাকে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, এটাকে তুমি চাও? ইংরেজিতে প্রশ্নটা করা সত্ত্বেও বলার ভঙ্গিতে বুঝে নিয়ে গোরক্ষনাথ দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
গোরানসাহেব কিছুক্ষণ গোরক্ষনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দেখা গেল গোরক্ষনাথও চোখ সরাচ্ছে না। হঠাৎ সাহেবের ঠোঁটে অদ্ভুত একটা বাঁকা হাসি ফুটল। তিনি হাত বাড়ালেন, নাও।
গোরক্ষনাথ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পাখিটাকে ধরল। ওর মাথা নীচের দিকে ঝুলছিল। হাতবদলের সময়ে সেটা তুলে ঠোকরাবার চেষ্টা করেও বিফল হল। ঝোলা থেকে একটা দড়ি বের করে প্রথমে এক হাতেই পাখির পা দুটো বেঁধে ফেলল গোরক্ষনাথ। তারপর মাটিতে শুইয়ে ঠোঁট দুটো শক্ত করে বেঁধে খোঁড়া পায়ের দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ ধরে সেটাকে পরীক্ষা করতে লাগল সে।
মেজর উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, কী দেখছ ওরকম করে?
আজ্ঞে, দেখছি এর পা জন্ম থেকে খোঁড়া কিনা। ঠিক বুঝতে পারছি না। এই হয় মুশকিল। হয়তো জন্মাবার পরে চোট লেগে খোঁড়া হয়েছে, এখন কোনও টাটকা ঘা নেই, গোলমাল হয়ে যাবে।
কীসের গোলমাল?
এই সময় হরিধ্বনি উঠল। বোঝা গেল শ্মশানে মৃতদেহ এসেছে। বেশ সাজ সাজ রব পড়ে গেল যেন। মেজর গোরানসাহেবকে বললেন, তুমি খুব ভাগ্যবান। আজই ডেডবডি নিয়ে এসেছে সকার করার জন্যে।
গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে ওই সাধুটার দেখা পাওয়া যাবে?
তাই তো বলেছে। চলো, ওদিকে যাই। দুপা হেঁটে আবার পেছন ফিরে তাকালেন মেজর, এ, এতক্ষণ কী খেলাম হে! নেশার ন পর্যন্ত হয়নি। অথচ তখন কী স্বাদ লাগছিল। যাঃ, মেজাজটাই চলে গেল।
অর্জুন এবার মেজরের মুখমুখি, কী ব্যাপার বলুন তো?
কোন ব্যাপারের কথা জানতে চাইছ তা না জানলে কী করে বলব?
এই যে আপনারা শ্মশানে শ্মশানে ঘুরছেন, তার কারণটা কী?
তোমাকে বলিনি? আচ্ছা, পরে বলব। আজকাল সব কথা মনে থাকে না। কিন্তু এই লোকটি খুব ইন্টারেস্টিং। কী হে, কী বুঝলে? প্রশ্নটা গোরক্ষনাথকে।
ধরতে পারছি না বাবু। পরীক্ষা করতে হবে।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? অর্থপেডিক ডাক্তার?
না বাবু। তার দরকার নেই। অন্ধকারে চোখ জ্বলে এমন কালো বেড়ালের সামনে নিয়ে গেলে সে ব্যাটা যদি চোখ বন্ধ করে তা হলেই কেল্লা ফতে। পাখিটাকে নিয়ে গোরক্ষনাথ উঠে দাঁড়াল।
গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ও পাখিটাকে নিয়ে কী করবে? তুমি বললে শকুন পোষ মানে না, মাংস খাওয়া যায় না, তোমরা এটাকে অমঙ্গল বলে মনে করো। তা হলে এই লোকটা নিয়ে যাচ্ছে কেন?
অর্জুন ইংরেজিতে জবাবটা দিল, ওর ধারণা আমরা সাদা চোখে যা দেখতে পাই না, জন্ম থেকে খোঁড়া শকুন তা দেখতে পায়। তবে একা শকুন থাকলে হবে না, জন্ম থেকে কানা কাক আর কালো বেড়াল যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে, তাদেরও সঙ্গে থাকতে হবে। এই মিটে প্রাণী দিয়ে গোরক্ষনাথ প্রেতাত্মা তাড়ায়।
মেজর হো হো করে হাসতে লাগলেন। তাঁর বিশাল ভুঁড়ি কাঁপতে লাগল। হাসতে হাসতে তিনি বেঁকে যাচ্ছিলেন। সেটা সামলে বললেন, বিজ্ঞান, তোমার বারোটা বাজিয়ে এরা ছাড়বে। অবশ্য গোরানসাহেব যখন ড্রাকুলা আছে বলে বিশ্বাস করে তখন এদের দোষ কী?
কাল রাত্রে আপনিই কিন্তু বলেছিলেন, আপনার জ্ঞান শেষ কথা নয়।
বলেছিলাম। তবু মাঝে মাঝে যখন হজম করতে অসুবিধে হয় তখন প্রাণ খুলে হেসে নিই। যাকগে, চলো, সাধুর দর্শন পাওয়া যায় কিনা দেখি।
মাঠের মধ্যে ইতিমধ্যেই চিতা সাজানোর কাজ চলছে। মৃতদেহটিকে একপাশে মাটির ওপরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। একজন যুবক তার পা ছুঁয়ে বসে আছে বিমর্ষ মুখে। যে লোকটি মেজরকে দিশি মদ বিক্রি করছিল এখন তার চারপাশে ভিড় জমে গেছে। সেই রোগা লোকটি এখন চিতা সাজানোর কাজটা তদারকি করছে।
ওরা হেঁটে এল মৃতদেহের পাশে। লোকটি প্রবীণ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একটা বড় আঁচিল রয়েছে নাকের ওপর। খুব কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সাহেব দেখেই বোধ হয় শ্মশানযাত্রীদের দুজন পাশে এসে দাঁড়াল।
একজন বলল, কাল বিকেলেও গগনদা গল্প করেছে। সন্ধের পরে তেঁতুলতলায় গিয়েছিল। সেখানেই পড়ে যায় মাটিতে।
তেঁতুলতলা মানে?
আজ্ঞে, আমাদের গাঁয়ের উত্তর দিকে একটা তেঁতুলবন আছে। সূর্য ড়ুবে গেলে ওদিকে কেউ যেতে চায় না। বুঝতেই পারছেন। গগনদা যে কেন গেল! লোকটা নিশ্বাস ফেলল।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের গ্রামটা কতদূরে?
এই তো। আট ক্রোশ হবে। গ্রামের নাম হুতুমপুর।
পুলিশকে জানিয়েছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
পুলিশ?
হ্যাঁ। এঁর মৃত্যুটা তো স্বাভাবিকভাবে হয়নি।
না বাবু। পুলিশ মানেই ঝামেলা। সকালে খবর দিলে বিকেলে আসবে। এসে ওঁকে নিয়ে গিয়ে থানায় ফেলে রাখবে। গাড়ি পেলে সদরে নিয়ে যাবে পরীক্ষা করতে। সেখান থেকে যখন ছাড়িয়ে আনব তখন পচে-গলে যা হবে তাতে গগনদাকে আর চেনা যাবে না। মানুষটা ভাল ছিল, মরার পর অত কষ্ট দিয়ে লাভ কী? পুলিশকে খবর দিলে তো তারা এসে জীবন ফিরিয়ে দেবে না।
কিন্তু এই যে দাহ করতে এসেছেন, ডেড সার্টিফিকেট লাগবে না?
অসুখ হলে ওষুধ দেওয়ার ডাক্তার যেখানে নেই, সেখানে–। লোকটি হাসল।
গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
মেজর তাঁকে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিতেই তিনি উত্তেজিত হলেন, ওদের বলো, আমরা ওই তেঁতুলতলায় যেতে চাই।
ঠিক আছে, এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। গ্রামের নাম তো জেনে নিয়েছি, যাওয়া যাবে। এখন এদের সবার মনখারাপ, সত্ত্বারটা করতে দাও। মেজর কথা শেষ করতেই রোগা লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, লাশটাকে চিতায় ওঠাও।
সঙ্গেসঙ্গে সবাই তৎপর হল। হরিধ্বনি উঠল। গগনকে চিতায় শোওয়ানো হল।
রোগা লোকটা ছুটে গেল বন্ধ ঘরের সামনে। কী বলছে শোনা গেল না এত দূর থেকে। বলাবলির পর সে চিৎকার করল, সরে যাও, চিতার সামনে থেকে সরে যাও। পরমপূজনীয় বাবা ত্রিকালজ্ঞনাথ এখন দর্শন দেবেন।
দরজা খুলে গেল। দীর্ঘকায় একজন প্রৌঢ়, পরনে লাল কৌপীন, হাতে ত্রিশূল, সমস্ত শরীর ছাই-এ ঢাকা, মাথায় বিশাল জটা, ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা চিতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে থাকার পর আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, যাঃ। যাঃ। এখান থেকে দূর হ৷ যা করার তো করেছিস, এবার ওকে যেতে দে। মা, মাগো, এই অভাগাকে পার করে দাও মা।
অর্জুনের পেছনে দাঁড়িয়ে গোরক্ষনাথ ফিসফিস করে বলল, বৈতরণীর কথা বলছে। স্বর্গে যেতে হলে বৈতরণী পার হতে হয়। তিস্তার চেয়েও ভয়ঙ্কর নদী।
এবার ত্রিশূল হাতে বাবা ত্রিকালজ্ঞনাথ চিতা-পরিক্রমা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে শূন্যে ত্রিশূলটাকে এমনভাবে ঘোরাচ্ছেন, যেন কাউকে সরিয়ে দিচ্ছেন। তারপর মৃতদেহের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন, দে, ওর শরীর মাটিতে মিশিয়ে দে।
সঙ্গে সঙ্গে হরিধ্বনি উঠল। সাধুবাবা হাঁটতে লাগলেন তাঁর ঘরের দিকে, পেছন পেছন সেই রোগা লোকটা। গোরান বললেন, চলো, ওর সঙ্গে কথা বলা যাক।
সাধুবাবা ঘরে ঢোকেননি। দরজার পাশে একটা কাঠের টুল এনে দিল রোগা লোকটা, তার ওপর বসে নিবার মা ডাক ছাড়লেন। তারপর অর্জুনদের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই?
মেজর অর্জুনের দিকে তাকাতেই ওর একটু বদমায়েশি করার ইচ্ছে হল। অর্জুন বলল, এঁরা আপনাকে দর্শন করতে আমেরিকা থেকে এসেছেন।
আমেরিকা। সেখানে আমার খবর পৌঁছে গেছে নাকি?
আপনি বাবা ত্রিকালজ্ঞনাথ। তিনকাল একসঙ্গে দেখতে পান। আমেরিকা তো বাড়ির কাছেই।অর্জুন সবিনয়ে বলল।
গোরানসাহেব ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি প্রেতাত্মা দেখেছেন?
সাধুবাবা সন্দেহের চোখে তাকালেন, কী বলছে ও?
মেজর বললেন, আপনি তো এই শ্মশানে থাকেন। তাই সাহেব জানতে চাইছেন আপনার সঙ্গে পরলোকে যাঁরা থাকেন তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ হয় কিনা?
আলবত হয়। একশোবার হয়। কিন্তু তাতে ওর কী এসে যাচ্ছে?
আজ্ঞে, এই সাহেব ওঁদের নিয়ে গবেষণা করেন।
কী শোনা?
আজ্ঞে, শোনা নয়, গবেষণা। পরীক্ষা।
ও মাস্টার। খপ করে এক মুঠো মাটি তুললেন ত্রিকালজ্ঞনাথ, কী আছে আমার হাতের মুঠোয়? মুঠো বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন।
আজ্ঞে, মাটি। মেজর জবাব দিলেন।
বাঃ। তুমি যেভাবে দেখতে পেলে ঠিক সেইভাবেই আমি ওদের দেখতে পাই। যে লোকটা মরেছে তার আত্মা বেচারি চিতার পাশে ঘুরঘুর করছে। পুরনো আত্মারা ওকে দলে নেবে বলে এসেছে কিন্তু যতক্ষণ না ওর শরীর ছাই হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ ওকে একা থাকতে হবে। সাধুবাবা মুঠোর মাটি ছুঁড়ে দিলেন রোগা লোকটার গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে চিকার করে উঠল, আঃ, ওঃ, মারবেন না।
কেন ঢুকেছিস? ওকে ছেড়ে ওই জঙ্গলে গিয়ে দাঁড়া। সাধুবাবা বলমাত্র রোগা লোকটি হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল। সাধুবাবা হাসলেন, ব্যাটারা এত দুষ্টু, একটু সুযোগ পেলেই শরীরে ঢুকে পড়ে। প্রাকৃতিক কাজ করে হাত না ধুলে আর রক্ষে নেই। গলা খুলে বলো সবাই..মা, মা। মা ডাক শুনলে ওরা পালাবে।
একমাত্র রোগা লোকটি কয়েকবার মা মা বলে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরে ঢুকে গেল। মেজর গোরানসাহেবকে বললেন, ইনি ঘোস্ট দেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। কিছু যদি জিজ্ঞেস করার থাকে তো করতে পারো।
গোরানসাহেব বললেন, একটা প্রমাণ দিতে বলো।
মেজর সেটা জানাতে ত্রিকালজ্ঞনাথ খেপে গেলেন, কী? মাস্টার আমাকে পরীক্ষা করতে চাইছে? দেব বাণ মেরে, মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হবে। হুঁ।
আপনি রাগ করবেন না। উনি খ্রিস্টান সাহেব, সহজে বিশ্বাস করেন না।
কেন? একটু আগে আমি একটাকে ওর শরীর থেকে তাড়ালাম, দ্যাখোনি? গোরানসাহেবকে সেটা অনুবাদ করে শোনাতে তিনি বললেন, ওটা তো অভিনয় হতে পারে। সত্যি-মিথ্যে বুঝব কী করে?
মেজর অর্জুনের দিকে তাকালেন, একথা বাংলায় ওকে বলার সাহস হচ্ছে না হে।
অর্জুন বলল, আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন বাবা। উনি একে খ্রিস্টান, তার ওপর সাহেব। আপনি যেমন বাণ মারতে জানেন তা হিন্দুদের ওপর কাজ হলেও হতে পারে, কিন্তু সাহেবদের ওপর নয়।
কী করে সেটা বোঝা গেল?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন সাহেবরা আমাদের দেশে দুশো বছর রাজত্ব করেছিল। তাদের তাড়াবার জন্যে কত আন্দোলন হয়েছিল। সে সময় আপনার মতো কয়েকজন সাধু সাহেবদের ক্ষতি করার জন্যে বাণ ছেড়েছিলেন। কোনও কাজ হয়নি। অর্জুন চটপট বানিয়ে গল্পটা শোনাল।
দ্রুত মাথা দোলালেন ত্রিকালজ্ঞনাথ, তার একটাই কারণ, ওরা ফ্লেচ্ছ ভাষায় কথা বলে। মা, মাগে। এই সময় রোগা লোকটা এক ছিলিম গাঁজা নিয়ে এসে ওঁর হাতে দিতেই তিনি আবার মা মাগো বলে টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রোগী লোকটা হাত পাতল, অনেক কথা হয়েছে। এবার বাবার সেবার জন্যে শখানেক টাকা ছাড়ুন।
গোরানসাহেব ওর হাত বাড়ানো দেখে কিছুটা আন্দাজ করে মেজরকে বললেন, বোধ হয় টাকা চাইছে, ওকে জিজ্ঞেস করুন, এদিকে কোনও ড্রাকুলা আছে নাকি! ঠিকঠাক খবর দিলে অনেক টাকা দেব।
মেজর সেটা বাংলায় বুঝিয়ে বলতেই ত্রিকালজ্ঞনাথ চোখ কপালে তুললেন। লাল টকটকে চোখ। উদ্ভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করলেন, ড্রাকুলা? সেটা কী?
কিছু প্রেতাত্মা আছে যারা মানুষের শরীর ধারণ করে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে। রাত নামলেই তারা সক্রিয় হয়। রক্তচোষা বাদুড়ের মতো মানুষের গলায় দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খায়। ওরা খুব ভয়ঙ্কর এবং নিষ্ঠুর। এদের ড্রাকুলা বলে।
শরীর পাবে কোথায়? নিজের শরীরটাকে তো আত্মীয়রা ছাই করে দেবে। অন্যের শরীরে ঢুকলে ঘুমিয়ে পড়লে বিপদ হতে পারে।
যাদের কবর দেওয়া হয়–
অ। সেটা বলতে পারে হাসিমারার পীর ফকির আলি। ভাল লোক। খুব ধর্মবিশ্বাসী লোক।
ওপাশে হরিধ্বনি হচ্ছিল বারংবার। অর্জুন দেখল চিতা দাউদাউ করে জ্বলছে। গগন নামের মানুষটির আত্মা নিজের জ্বলন্ত চিতা দেখে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হল গোরক্ষনাথ আশপাশে নেই। ত্রিকালজ্ঞনাথের সঙ্গে কথা বলার সময় সে কি সঙ্গে আসেনি?
মেজর একটি একশো টাকার নোট দিলেন রোগা লোকটির হাতে। সে যে খুব খুশি হল না বোঝা গেল মুখ দেখে। ত্রিকালজ্ঞনাথ বললেন, যাচাই করো।
লোকটার যেন মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ। বাবার কাছে তো অনেক মানুষ আসে। কদিন আগে দুজন তিব্বতি এসেছিল। সব জানার পর খুশি হয়ে ওরা একটা জিনিস দিয়ে গিয়েছে। পছন্দ হলে আপনারা নিতে পারেন।
অর্জুন জানতে চাইল, কী জিনিস?
রোগা লোকটা ঘরে ঢুকে এল। ফিরে এল তক্ষুনি, এই যে।
অর্জুন দেখল কালো কষ্টিপাথরের একটি মূর্তি। ভয়ঙ্কর দর্শন। এটি কার মূর্তি তা সে জানে না। গোরানসাহেব হাত বাড়িয়ে নিলেন। হঠাৎ তাঁর মুখে সেই হাসি ফুটে উঠল, যে হাসিটাকে অর্জুন অমল সোমের বাগানে দেখেছিল। শঙ্খচূড় সাপটাকে যখন কাক ঠোকরাচ্ছিল তখন গোরানসাহেবের মুখে এইরকম শিরশিরে হাসি ফুটে উঠেছিল।
মেজর বললেন, বাপরে বাপ। কী ভয়ঙ্কর। কার মূর্তি?
ত্রিকালজ্ঞনাথ বললেন, কালভৈরব। এই মূর্তি সঙ্গে থাকলে কেউ তোর অনিষ্ট করতে পারবে না। হ্যাঁ।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন গোরানসাহেবকে, নেবে?
নিশ্চয়ই। কত দাম?
মেজর অনুবাদ করলেন। ত্রিকালজ্ঞনাথ বললেন, যাঃ তোদের শস্তায় দিয়ে দিলাম। পাঁচ হাজার দিয়ে যা।
অর্জুন চমকে উঠল, পাঁচ হাজার?
দশ বিশ পঞ্চাশ যা চাইব পাবলিক তাই দেবে। এ হল কালভৈরব।
কিন্তু সরকার যদি জানতে পারে তা হলে বিপদে পড়ব। পুলিশ ধরবে।
পুলিশ? এটা কি পুলিশের বাবার সম্পত্তি? এদেশের জিনিসই নয়। এটা আমায় দিয়েছিল তিব্বতিরা আমাকে পুলিশ দেখাচ্ছ তুমি?
কোনও অনুরোধ শুনলেন না তিনি। অগত্যা গোরানসাহেব কড়কড়ে পাঁচ হাজার টাকা গুনে দিয়ে দিল রোগা লোকটাকে।
গাড়ির কাছে ফেরার পথে অর্জুন ইংরেজিতে বলল, ওরকম ভয়ঙ্কর মূর্তির জন্যে পাঁচ হাজার টাকা নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।
গোরানসাহেব বললেন,মূর্তিটার বিশেষত্ব আছে। এর দাম অনেক বেশি হতে পারে। আমি তিব্বতি তান্ত্রিকদের ওপর লেখা একটা বইয়ে মনে হচ্ছে এইরকম এক মূর্তির ছবি দেখেছি।
কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে কোনও মূর্তি বিদেশে নিয়ে যাওয়া বেআইনি।
সেটা আমি জানি না। তবে এটা তো ভারতবর্ষের কোনও মূর্তি নয়। যাকগে, এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। গোরানসাহেব গাড়ির দরজা খুললেন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাবে?
বাড়ি ফিরব। আপনারা?
দেখি গোরান কী বলে? তিনি গোরানসাহেবকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ওই লোকটা কীভাবে মারা গেল তা জানতে চাই। জায়গাটা জেনে নিয়েছ তো?
হুঁ। হুতুমপুর। মেজর ঘুরে দাঁড়ালেন, পড়েছি মোগলের হাতে। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। বুঝলে!
অর্জুন ঘড়ি দেখল। এখন দুপুর। সে বলল, হুতুমপুরের ব্যাপারটা সন্ধের আগে গেলে জানা যাবে না। এখন জলপাইগুড়িতে ফিরে চলুন। বিকেলে আবার রওনা হবেন। এর মধ্যে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেবেন।
মেজরসাহেবকে অনেক বলে রাজি করাতে পারলেন। ওদের গাড়িটা শহরের দিকে বেরিয়ে যেতেই গোরক্ষনাথের দেখা পাওয়া গেল। চোরের মতো এগিয়ে এসে বাইকের পেছনে উঠে বসল।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ। বিরক্ত হল অর্জুন।
যা সন্দেহ করেছিলাম তাই ঠিক। এ ব্যাটা সাধু নয়, ভণ্ড।
কী করে বুঝলে?
আপনারা যখন বাইরে কথা বলছিলেন তখন আমি পেছনের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম। চোরাই জিনিসে ভর্তি। এ, এখানে এসে কোনও লাভ হল না। আপনি তো শহরে ফিরে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। তবে প্রথমে আপনার বাড়িতে যাব।
কেন?
বেড়ালটাকে দেখতে। অর্জুন বাইক চালালো।
জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির পাশ দিয়ে গোরক্ষনাথের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে পিচের রাস্তা ছেড়ে প্রায় মেঠো পথে বাইক নামাল অর্জুন। কিছু গাছগাছালি রয়েছে, টিনের বাড়িটা ভাঙাচোরা, অনেককাল হাত পড়েনি।
বাইক থেকে নেমে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে গোরক্ষনাথ বলল, পেটের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাই, বাড়িটা যে পড়ে যায়নি এই ঢের। আসুন, আসুন।
ভাঙা টিনের দরজা খুলে গোরক্ষনাথ অর্জুনের সঙ্গে একচিলতে উঠোনে ঢুকল। উঠোনের একপাশে একটা পিড়িতে যে মহিলা বসে আছেন তাঁর বয়স অনুমান করা মুশকিল। মাথায় শনের মতো সাদা কিছু চুল, মুখের চামড়ায় মোটা মোটা ভাঁজ। ওদের দেখে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন তিনি।
বেড়ালটাকে মাছ দিয়েছ? গোরক্ষনাথ জিজ্ঞেস করল।
দিয়েছি। খায়নি ওটা। বিদায় কর, বিদায় কর গোরক্ষ।
গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকাল, এই হয়েছে বিপদ। বড়লোকের বাড়িতে দামি মাছ খেয়ে খেয়ে ব্যাটা এমন মুখ করেছে, শস্তার মাছে মন ভরছে না। খাবে, খিদে যখন ছোবল মারবে তখন ওই মাছ গিলতে হবে ব্যাটাকে।
এই সময় বুড়ি চিৎকার করে উঠল, ওটা কী? অ্যাাঁ, ওটা কী?
গোরক্ষনাথ পাখিসুষ্ঠু হাতটা ওপরে তুলল, শকুন। খোঁড়া শকুন।
ছ্যা ছ্যা ছ্যা। যত অমঙ্গল বাড়িতে ঢোকাচ্ছে। আমি থাকব না, এখানে আর কিছুতেই থাকব না। কালো বেড়াল, খোঁড়া শকুন। বুড়ি সমানে চেঁচিয়ে যেতে লাগল।
গোরক্ষনাথ একটা বড় খাঁচা বের করল। তারপর শকুনের একটা পা থেকে দড়ি খুলে মাটিতে রাখতেই সেটা টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। দড়ির অন্য প্রান্ত একটা গাছের ডালে বেঁধে বলল, এটার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
উঠোনের ওপাশে একটা ছোট্ট ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চিৎকার করল গোরক্ষনাথ, এ কী, তুমি গোটাকয়েক মাছ খেয়েছ বলে মনে হচ্ছে? অর্জুন দেখল, বুড়ি মুখ বন্ধ করে মাথা দোলাল অস্বীকারের ভঙ্গিতে।
গোরক্ষনাথ রান্নাকরা দুটো ছোট মাছ নিয়ে বাইরে এসে শকুনটার সামনে ফেলে দিতেই পাখিটা মুখ ঘুরিয়ে দেখল। ওর মুখ এখনও বাঁধা, গোরক্ষনাথ বাঁধন খুলে দিতেই বোঝা গেল শকুনটা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। নিমেষেই মাছ দুটোকে গলায় পুরে দিল পাখিটা। এবার খাঁচাটাকে নিয়ে বড় ঘরটার ভেতর ঢুকল গোরক্ষনাথ। অর্জুন লক্ষ করল ঘরটির দরজা-জানলা ভাল করে বন্ধ করে রাখা আছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোরক্ষনাথ বেরিয়ে এল। ওর হাতের খাঁচার ভেতর একটা কালো বেড়াল বসে আছে। এমন গাঢ় কালো রঙের বেড়াল কখনও দেখেনি অর্জুন। সে এগিয়ে গেল। এবং তখনই নজরে পড়ল বেড়ালের গলায় একটা কালো কাপড়ের বেল্ট লাগানো রয়েছে। লোমের রঙের সঙ্গে মিশে থাকায় দূর থেকে আলাদা করে বোঝা যায়নি। বেড়ালটা চোখ বন্ধ করে আছে, সম্ভবত অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকায় বাইরের আলো সহ্য করতে পারছে না। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এই সেই বেড়াল?
হ্যাঁ বাবু। ওই বুড়িকে জিজ্ঞেস করে, দেখুন। সন্দীপবাবু গতকালই এটাকে আমার হাতে দিয়ে গেছেন। ভীষণ বদমাশ। দাঁড়ান, পরীক্ষা করি। নিজের জামা খুলে খাঁচাটার ওপর চাপিয়ে দিল গোরক্ষনাথ। বেড়ালটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। দড়ি ধরে শকুনটাকে টানতেই ওটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাঁচার দিকে এগিয়ে আসছিল। একেবারে খাঁচার গায়ে নিয়ে আসার পর গোরক্ষনাথ জামাটাকে তুলে নিতেই বেড়ালটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রাগী আওয়াজ গলা থেকে বের করল। ওর চোখ এই দিনের আলোতেও বোঝা গেল, জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে শকুনটা চোখ বন্ধ করল। তারপর ধীরে ধীরে পা মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল। ওটা বসামাত্র বেড়ালটা শান্ত হয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে পা মুড়ে বসল।
হঠাৎ গোরক্ষনাথ দুহাত তুলে নাচতে লাগল, মিল গিয়া। দুটো পেয়ে গেছি। খোঁড়া শকুন আর কালো বেড়াল। খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছিল সে।
বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। পরস্পরকে দেখামাত্র এই প্রাণীদুটো এমন আচরণ করল কেন? বেড়ালটার রেগে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরে এই যে সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব, এটার কারণ কী? শকুনটা যে সেই চোখ বন্ধ করেছে, আর খুলছে না।
অর্জুন হেসে জিজ্ঞেস করল, এবার আপনার কানা কাক দরকার?
হ্যাঁ বাবু। গোরক্ষনাথ গাছগাছালির দিকে তাকাল। সেখানে এখন কোনও কাক নেই। বলল, দেখি এদের টানে সে ব্যাটা যদি এখানে এসে পড়ে–।
অর্জুন বলল, একটা অনুরোধ করছি। আজ সন্ধেবেলায় বাড়িতে থাকবেন।
সন্ধেবেলায়? কেন বাবু?
আপনি যেমন কানা কাকের সন্ধান করছেন আমিও তেমন কিছু করছি। সেটা পেতে আপনার সাহায্য চাই।
ঠিক আছে বাবু, আমি থাকব। গোরক্ষনাথ মাথা নাড়ল।
বাইকে বসে অর্জুনের মনে হল একবার মেজরের খবর নেওয়া দরকার। ওঁরা। খাওয়াদাওয়া করছেন কোথায় সেটা জানা তার কর্তব্য। কিন্তু তার পরেই মনে হল মেজর তো একবারও ওব্যাপারে কথা বলে গেলেন না। সম্ভবত সঙ্গে নিয়ে আসা টিনফুড খেয়ে ওঁদের দিব্যি চলে যাচ্ছে।
বাড়িতে ফিরে এসে সে ফাঁপরে পড়ল। মা একগাদা রান্না করে বড় টিফিন ক্যারিয়ারে ভর্তি করে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। দুপুর শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ ছেলে বাড়িতে ফিরছে না দেখে পাড়ার একটি ছেলেকে দিয়ে সেই টিফিন ক্যারিয়ার সার্কিট হাউসে পাঠিয়ে দিয়েছেন মেজরের লাঞ্চের জন্যে। মা যে নিজে থেকেই ওঁদের জন্যে রান্নাবান্না করবেন তা অৰ্জুন জানত না। তাই যখন বকুনি শুনতে হল, সে চুপচাপ মেনে নিল। স্নান খাওয়া শেষ করে সে ছুটল সার্কিট হাউসে। এখন বেলা তিনটে। মেজর তাঁর ঘরে নেই। ওঁদের পাওয়া গেল ডাইনিং রুমে। সেখানে দুজন মুখোমুখি বসে। মাঝখানে মায়ের পাঠানো টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিগুলো সাজানো।
ওকে দেখামাত্র মেজর চিৎকার করলেন, আমি জীবনে কখনও দুবার লাঞ্চ করিনি। কিন্তু এরকম খাবার পেলে দুশোবার করতে আপত্তি নেই। ওঃ, কী দারুণ রান্না। ড়ু ইউ নো গোরান, একে বড়ি বলে। তোমার চোদ্দ পুরুষ আজ খুশি হবে, কারণ তুমি বড়ি খাচ্ছ।
হঠাৎ গোরানসাহেব উঠে দাঁড়ালেন। উনি ভুলে গেলেন ওঁর ডান হাত এঁটো সেই অবস্থায় অর্জুনের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি খুব ভাগ্যবান মানুষ। তোমাকে খুব হিংসে হচ্ছে আমার। তুমি এই রান্না রোজ খাও! আহা।
গতকাল থেকে এই লোকটিকে অর্জুন গোমড়া হয়ে থাকতে দেখেছে। বরং কিছু কিছু সময়ে ওঁর অভিব্যক্তি দেখে ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এখন ওঁকে এরকম আবেগে আক্রান্ত দেখে বেশ মজা লাগল অর্জুনের। সে বলল, আপনারা বাড়িয়ে বলছেন।
ওঁরা একথা মানতে রাজি নন। চেটেপুটে খাওয়ার পর মেজর বললেন, এখন একটু না গড়িয়ে নিলে অপরাধ হবে ভাই। তুমি জানো, আজ কী করেছি?
কী?
ফিরে এসে এক টিন সার্ডিন মাছ আর পাউরুটি খেয়ে হুইস্কির বোতলটা খুলব খুলব করছি, এই সময় টিফিন ক্যারিয়ার এসে হাজির। ছোকরা বলল, তোমার মা পাঠিয়ে দিয়েছেন। খুলে দেখতে গিয়ে যে চমৎকার গন্ধ নাকে এল, তাতে মনে হল না খেয়ে থাকা যাবে না। কিন্তু গোরান তখন বাথরুমে। হুইস্কি খেতে গিয়ে মনে হল অ্যালকোহল যদি জিভের বারোটা বাজিয়ে দেয় তা হলে রান্নার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হব। তাই তখন থেকে হুইস্কি না খেয়ে বসে ছিলাম। গোরান বের হলে ওকে বললাম, ও প্রথমে যেতে রাজি হচ্ছিল না। তারপর ওর সামনে যখন আমি খাওয়া আরম্ভ করলাম তখন একটু টেস্ট করছি বলে বসে বেশিরভাগটাই মেরে দিল। বুঝলে হে, নিরামিষ রান্না যদি এমন হয় তা হলে হুইস্কি খাওয়ার কোনও মানে হয় না।
অর্জুন হাসল, তা হলে এখন থেকে নিরামিষ শুরু করুন।
আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এই জলপাইগুড়িতে আমি তো সারাজীবন থাকতে পারব না। যাগ গে; তোমার প্রোগ্রাম কী?
ওই যে গোরান রাত্রে হুতুমপুরে যাবে!
গোরানসাহেব হাসলেন, অর্জুন, তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে।
অর্জুন একটু ভেবে নিল। তারপর বলল, আপনারা যে উদ্দেশে যাচ্ছেন সেটার জন্যে রাত একটু গভীর হওয়া উচিত। হুতুমপুরে দশটা নাগাদ পৌঁছলে কোনও আপত্তি আছে? এখান থেকে নটায় বের হওয়া যাবে।
মেজরের যে ঘুম আসছিল তা বোঝা গেল, পাঁচ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না ঘুমোলে শরীর ঠিক বুঝতেই পারছ।
মেজর ঘুমোতে চলে গেলে অর্জুন গোরানসাহেবকে জিজ্ঞেস করল, আপনি এখন একটু বিশ্রাম নেবেন না?
না। আমি একটুও ক্লান্ত নই।
চলুন, নীচের লবিতে গিয়ে বসি।
গোরানসাহেব আপত্তি করলেন না। এখন দ্রুত রোদ বদলাচ্ছে। পাশাপাশি বসার পর অর্জুন সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, আপনি ভূতপ্রেত আছে বলে বিশ্বাস করেন?
গোরানসাহেব বললেন, ওয়েল, অবিশ্বাস করার জন্যে অনেকদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছি, এখনও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।
কেন?
দ্যাখো, এই যে এত মানুষ প্রতিদিন মারা যায়, কোথায় যায়? তোমরা মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেললো, ছাই হয়ে যায়। আমরা সমাধি দিই। মাটিতে মিশে যায়। কিন্তু সেটা তো রক্তমাংসের শরীর। তার? আর কী হয়? যে মানুষটা দীর্ঘকাল পৃথিবীতে হেঁটেচলে বেড়ালো, শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তার সবকিছু শেষ হয়ে গেল? বিজ্ঞান মানছে না বটে, কিন্তু তোমাদের শাস্ত্রগুলো, আমাদের পৌরাণিক কাহিনী, ধর্মীয় গ্রন্থগুলোয় আত্মার উপস্থিতি স্বীকার করেছে অনেকবার। এসব যাঁরা লিখেছেন তাঁরা নির্বোধ মানুষ ছিলেন না। দেখবে, কোনও কোনও বয়স্ক মানুষ বলেন তাঁদের আত্মা দেখার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু তাঁরা প্রমাণ দিতে পারেন না। আমি ওই প্রমাণটার খোঁজে আছি। গোরানসাহেব গুছিয়ে কথাগুলো বললেন।
আপনি এখানে এসেছেন ড্রাকুলার সন্ধানে। কিন্তু ড্রাকুলা কনসেপ্ট ভারতবর্ষে কখনও চালু হয়নি। আপনি কি ভুল জায়গায় আসেননি?
আমি জানি না। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমার হাতে একটা ডায়েরি এসেছিল। একজন স্কটিশ টি-প্ল্যান্টার সেই ডায়েরিতে লিখেছেন হঠাৎই তাঁর এলাকায় ড্রাকুলার আবির্ভাব হয়েছে। প্রায় রাত্রেই মানুষকে আক্রমণ করে তার গলায় দাঁত বসিয়ে রক্তপান করছে। এই ডায়েরির কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। মাসখানেক আগে নিউ ইয়র্ক মিরর কাগজের এশিয়ান নিউজে একটা ছোট্ট খবর ছাপা হয়েছিল। মানুষের শরীর থেকে রক্ত চুষে নিয়ে যাচ্ছে ভ্যাম্পায়ার জাতীয় প্রাণী। যে এলাকায় এটা হয়েছে, মিলিয়ে দেখলাম সেটা ওই স্কটিশ টি-প্ল্যান্টার্সের এলাকা।
সে কী! এরকম কোনও খবর আমি এখানকার কাগজে পড়িনি।
তাই?
হ্যাঁ। এমন ঘটনা ঘটলে নিশ্চয়ই হইচই পড়ে যেত।
তা হলে দুটো ব্যাপার হতে পারে। কেউ ভুল খবর পাঠিয়েছে অথবা তোমাদের এখানকার কাগজগুলো খবরটা পায়নি। যাই হোক, আমি জায়গাটায় কিছুদিন থাকতে চাই।
আপনি এর আগে কোনও ড্রাকুলা দেখেছেন?
না। ড্রাকুলা আছে খবর পেয়ে স্পেনের একটি গ্রামে পৌঁছেছিলাম। যে বাড়িতে ড্রাকুলা বাস করত বলে লোকে ভাবত সেটা একটা পোড়ো বাড়ি। কোনও মালিক ছিল না। আমি পৌঁছবার একদিন আগে সরকারি লোকজন বাড়িটাকে ভেঙে মাঠ করে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম ওই বাড়ির একটা ঘরে কফিনে কঙ্কাল ছিল। গ্রামের লোকজন পেট্রল ঢেলে আগুনে ছাই করে দিয়েছে।
একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
অনায়াসে।
গতকাল আপনি ওই বিষধর শঙ্খচূড়কে খালি হাতে কী করে ধরলেন?
সাপ যখন আক্রমণ করে তখন ভয়ঙ্কর হয়। কিন্তু যেই আত্মরক্ষা করার কথা ভাবে তখনই বোকামি আরম্ভ করে। তা ছাড়া–। কথা শেষ করে হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ করে থেমে গেলেন গোরানসাহেব।
সাপের ওপর আপনার বেশ রাগ আছে, তাই না?
হ্যাঁ। আমি এখনও মনে করি সাপ শয়তানের সঙ্গী। কোনও সাপকে মারতে পারলেই আমি তার মাথা কেটে ফেলি।
কেন?
কারণ মাথা কেটে ফেললে আর কোনও ভয় থাকবে না।
সেই কাটা মাথা কি আপনি সঞ্চয় করেন?
কে বলল তোমাকে?
আমার অনুমান।
হ্যাঁ। আমার বাড়িতে বেশ কয়েকটা জারে সাপের বিভিন্ন ধরনের মাথা ওষুধে ড়ুবিয়ে রাখা আছে। যেখানেই যাই সাপ পেলে মাথা কেটে প্লাস্টিক বাক্সে ঢুকিয়ে ওষুধে ভিজিয়ে রাখি ওই জারগুলোর জন্যে। যাক গে, তুমি আজ কী করছ? প্রোগ্রাম কী?
সন্ধেবেলায় একটা কাজ আছে। বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না।
ঠিক আছে। আমরা নটা নাগাদ এখান থেকে বের হব। ও হ্যাঁ, এর জন্যে কি পুলিশের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে?,
পুলিশকে জানিয়ে যাওয়াই ভাল। আমি আপনাদের হয়ে ওটা জানিয়ে দেব। অর্জুন উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই সার্কিট হাউসের লনের নুড়ির ওপর একটা ছোট সাপকে এঁকেবেঁকে আসতে দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে গোরানসাহেব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখ চকচক করে উঠল। অর্জুন লক্ষ করল ওঁর মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ঝট করে একটা পাথর কুড়িয়ে বৃদ্ধ ছুড়লেন সাপটাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সাপটা দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যেতেই গোরাসাহেবের মুখে হতাশা ফুটে উঠল।
অর্জুন আর কথা না বাড়িয়ে বাইকে উঠে বসল। এই সাপ নির্বিষ, হেলে সাপ। তবু গোরানসাহেব হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন। সাপ দেখলে এই ভদ্রলোক আর স্থির থাকতে পারেন না। মানুষের স্বভাব কত বিচিত্র ধরনের।
সোজা থানায় চলে এল অর্জুন। অবনীবাবু তাঁর চেয়ারে ছিলেন। ঘরে ঢুকতেই বললেন, কোথায় ছিলেন মশাই, সারাদিন দেখা নেই।
কেন? কী ব্যাপার? অর্জুন চেয়ারে বসল।
আর বলবেন না। এমন ধড়িবাজ ছেলে, কোনও ক্লু পাওয়া গেল না।
সন্দীপের কথা বলছেন?
হ্যাঁ, আজ সকালে গিয়েছিলাম তদন্ত করার নাম করে। ওঁর মা সত্যি খুব ভালমানুষ। ছেলের জন্যে চিন্তায় আছেন তা বোঝা গেল। কিন্তু অনেক প্রশ্ন করেও হেলের মুখ থেকে কথা বের করতে পারলাম না। মাকে জিজ্ঞেস করলাম বেড়ালটার কথা। তিনি বললেন ওটা ছেলের ঘরেই বন্দি থাকত। রুই মাছের পেটি রান্না হত বেড়ালটার জন্যে। ভাবুন।
ওর বন্ধুদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন?
হ্যাঁ। স্রেফ বলে দিল, আমার বেড়াল চুরি গিয়েছে আর তার সঙ্গে আমার বন্ধুদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি কার সঙ্গে মিশছি সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। বুঝুন।
অর্জুন ঘড়ি দেখল। সন্ধে হয়ে আসছে। সে বলল, আপনাকে একটু উঠতে হবে। বেশিদূরে যাব না।
আবার কী হল? আটটা নাগাদ এস. পি. সাহেব ডেকেছেন। তাঁকে কৈফিয়ত দিতে যেতে হবে ভাই।
দেবেন। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই হাইওয়েতে ডাকাতির সমাধান চান।
একশোবার। চলুন আমি রেডি।
জিপে উঠে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে কোনও প্রশ্ন না করেই চলে এলেন যে! সময়টা তো অকারণে নষ্ট হতে পারে।
পারে। তবে সারাদিন যখন আপনার দেখা পাইনি তখন একটা কিছু না জেনে বলবেন বলে মনে হয় না। অবনীবাবু হাসলেন।
রাস্তায় আলো জ্বলে উঠতেই ওরা গোরক্ষনাথে বাড়িতে পৌঁছে গেল। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কী ব্যাপার? আসামি এখানে আছে নাকি? আগে বলবেন তো, ফোর্স নিয়ে আসতাম।
না, না। আসামি নেই। সে জিপ থেকে নেমে ভাঙা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল, গোরক্ষনাথবাবু, ও গোরক্ষনাথবাবু।
ভেতর থেকে সেই বুড়ি চেঁচিয়ে বলল, যজমান ডেকে নিয়ে গিয়েছে, এক্ষুনি ফিরে আসবে। দাঁড়াতে বলেছে।
উনি কি কানা কাক পেয়েছেন?
মর, মর। সন্ধেবেলায় যত্তসব অকথা কুকথা। বুড়ি চেঁচাল।
অবনীবাবুকে গল্পটা শোনানো শেষ করা মাত্রই গোরক্ষনাথ এসে গেল। অর্জুনদের দেখে দুটো হাত মাথার ওপর তুলে বলল, অপরাধ মার্জনা করে দেবেন বাবু। আপনাকে কথা দিয়েছি তাই যেতে চাইনি। কিন্তু এমন করে ধরল। বলল, বুড়ি মা আমার সঙ্গে একটু কথা বলবেন।
আপনার যজমান।
ওই আর কি! বাড়ির ঝিটাকে ধরেছে। ধরে আর ছাড়ে। আমাকে গিয়ে শান্তিস্বস্ত্যয়ন করতে হবে। কিন্তু এখনও তো কানা কাক পেলাম না। তিন মাথা এক না হলে তাকে তাড়ানো মুশকিল হবে।
ঠিক আছে। এখন আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
আমাকে? কোথায়?
অবনীবাবু বললেন, সন্দীপ ডায়েরি করেছে তার বেড়াল চুরি গিয়েছে। তুমি অর্জুনকে বলেছ সে নিজে এসে তোমাকে দিয়ে গেছে। বেড়ালটাকে তোমার হেফাজতে পাওয়া গেলে আমার উচিত তোমাকে অ্যারেস্ট করা। তারপর তুমি প্রমাণ করো সন্দীপ মিথ্যে বলেছে।
আপনি বিশ্বাস করুন—। ককিয়ে উঠল গোরক্ষনাথ।
সেটা করব তুমি যদি বেড়ালটাকে নিয়ে আমার গাড়িতে ওঠো।
থানায় নিয়ে যাবেন? কাঁদোকাঁদো গলায় বলল লোকটা।
না। থানায় নয়।
তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে বাঁকের মুখে গাড়ি দাঁড় করালেন অবনীবাবু। এখন চারপাশে ঘন অন্ধকার। জিপের পেছনে বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে গোরক্ষনাথ চুপচাপ বসে আছে। অর্জুন দেখল অন্ধকারে ওটার চোখ জ্বলছে।
অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এই জায়গাটা চলবে?
ঠিক আছে। গাড়িটাকে ওই জঙ্গলের আড়ালে নিয়ে যান।
ওরা নেমে দাঁড়াতে ড্রাইভার নির্দেশ পালন করল।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এটাকে কোলে নিলে কামড়াবে?
বোধ হয়। কাল থেকে ভাব করেছি বলে আমাকে কিছু বলছে না।
অর্জুন বলল, অবনীবাবু, আপনি রাস্তার ওপাশের গাছের আড়ালে চলে যান। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
গোরক্ষনাথকে নিয়ে রাস্তার উলটো দিকে চলে যেতেই হুসহাস গাড়ি বেরিয়ে গেল। অর্জুন গোরক্ষনাথকে বলল, বেড়ালটার গলার কাপড়ের বেল্টের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে ফেলুন তো?
দড়ি! দড়ি কোথায় পাব?
আপনার ঝোলায় দড়ি থাকা উচিত। ঝোলা খুঁজে হাতকতক লম্বা দড়ি বের করে বেড়ালটার গলায় আটকানো কাপড়ের বেল্টের সঙ্গে ওটা বেঁধে মাটিতে নামিয়ে গোরক্ষনাথ উঠে দাঁড়াতেই দড়ির প্রান্ত অর্জুন নিয়ে নিল।
কী করবেন বাবু?
ওপারে যান। ওখানে থানার বড়বাবুর পাশে এমনভাবে গিয়ে দাঁড়াবেন যাতে কোনও গাড়ি থেকে আপনাকে না দেখা যায়।
গোরক্ষনাথ আদেশ পালন করলে অবনীবাবুর চিৎকার ভেসে এল, ওকে?
ঠিক তখনই একটা অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি বার্নিশের দিক থেকে ছুটে আসছিল। হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। গাড়িটাকে দেখামাত্র বেড়ালটা রাস্তার ওপাশে যাওয়ার জন্যে এগোতেই দড়িতে টান পড়ল। অর্জুন দড়ি ছেড়ে দিতে ওটা তীরের মতো রাস্তার মাঝখানে চলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক করে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। বেড়ালটা ক্রুদ্ধ চোখে একবার তাকিয়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে গোরক্ষনাথের সামনে দাঁড়িয়ে ফ্যাঁচ শব্দ করল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে গাড়িটা চলে যেতেই ওরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। অবনীবাবু বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ অর্জুন।
থানায় বসে যখন কথা হচ্ছিল তখন রাত আটটা। একটু আগে যে ঘটনা ঘটে গেল তাতে সবচেয়ে অবাক হয়েছে গোরক্ষনাথ। বাইরের ঘরে সে বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে বসে রয়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অবনীবাবু বললেন, এখন কথা হচ্ছে, বেড়ালটাকে এমনভাবে ট্রেইন্ড কী করে করা হল? ওটা এক ছুটে রাস্তা পার হয়নি। মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাগী চোখে গাড়িটাকে দেখেছিল। অর্থাৎ ড্রাইভার যদি ছুটন্ত বেড়ালকে ভালভাবে না দেখতে পায়, দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখবেই। সন্দীপের পক্ষে কি এই ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব? আমার তো মনে হয় না।
কিন্তু ওটা তো ট্রেনিং পেয়েছে।
ঠিকই। এখন আমার পক্ষে সন্দীপকে অ্যারেস্ট করতে অসুবিধে নেই। ওর বাড়িতে না গিয়ে ওকেই থানায় আসতে বলি।
না। সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না।
কেন?
সন্দীপ যদি বলে তার যে বেড়ালটা হারিয়েছে সেটা এটা নয়, তা হলে আপনি কী করবেন? ও যদি বলে গোরক্ষনাথকে কোনওদিন দ্যাখেনি, তা হলে?
বুঝতে পেরেছি। বেড়ালটাকে নিয়ে ওর বাড়ির সামনে গেলেই সমস্যাটার সমাধান হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু তা তো হল, এই মামলায় বেড়ালটা একটা বড় ভূমিকা নিচ্ছে। যতদিন বিচারক ওকে না দেখছেন ততদিন ওর দেখাশোনা কে করবে?
থানায় রাখা সম্ভব নয়। এখানে তো প্রচুর বেড়াল ঘোরে।
ঘোরে। কিন্তু এব্যাটা যদি পালায়, তা হলে?
এখন যার কাছে আছে, তার কাছেই রাখুন।
হুম অবনীবাবু একটু ভাবলেন। তারপর মুখটা অর্জুনের দিকে এগিয়ে নিয়ে এসে নিচু গলায় বললেন, ওটাকে তো গোরক্ষনাথ কাজে লাগবে।
কাজে মানে?
আরে! ওই যে প্রেতাত্মাদের সঙ্গে সংযোগ করবে। শকুন, বেড়াল, কাক। ওইসব করতে গিয়ে যদি বেড়ালটা কোনও বদ আত্মার হাতে মারা যায়?
হেসে ফেলল অর্জুন, আপনি এসব বিশ্বাস করেন নাকি?
না না। বিশ্বাস নিশ্চয়ই করি না। তবে শুনতে শুনতে কীরকম একটা অবস্থা হয়। মিথ্যে কথা লক্ষবার শুনতে শুনতে মনে হয় সত্যি কথা। তেমন আর কি!
আপনি গোরক্ষনাথকে ডাকুন। ও হ্যাঁ, আর একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। আমার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচিত দুই ভদ্রলোক এসেছেন আমেরিকা থেকে।
জানি। সার্কিট হাউসে রেখেছেন তাঁদের।
হ্যাঁ। ওঁরা আজ রাত্রে একটু হুতুমপুরে যেতে চান।
হুতুমপুর? সেটা কোথায়?
আপনার এলাকার মধ্যে পড়ে না। বার্নিশ পেরিয়ে খুব ভেতরে একটা প্রায় গণ্ডগ্রাম।
এত রাত্রে সেখানে কেন যাবেন ওঁরা?
ভূত দেখতে।
কী দেখতে? পাগল নাকি?
ওঁদের একজনের অভিযান করাটাই নেশা, অন্যজন ভূত-প্রেত-ভ্রাকুলা নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। কিছুই হবে না, তবু হুতুমপুর যে থানার আওতায় পড়ে তাদের যদি একটু জানিয়ে রাখা যায়। অর্জুন কথা শেষ করল না।
অবনীবাবু মাথা নাড়লেন, সাহেবরা যদি এসব নিয়ে মেতে থাকে তা হলে এদেশের অশিক্ষিত মানুষদের দোষ দিয়ে কী হবে। হুতুমপুর বললেন, তাই তো?
অর্জুন মাথা নাড়তে তিনি একটা কাগজে কিছু লিখে রাখলেন।
গোরক্ষনাথ এসে দাঁড়িয়ে ছিল দরজায়, তার কোলে বেড়ালটা।
অবনীবাবু বললেন, বুঝতেই পারছ, তোমার কোলে যিনি আছেন তিনি একটি চিজ। ড্রাইভারদের মনে ভয় ঢুকিয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য করতেন। ডাকাতদের সঙ্গে ওঁকেও তো জেলে পুরতে হবে।
না বাবু, এ অবলা জীব, একে যেমন শেখানো হয়েছে, করেছে?
সেকথা ঠিক। তুমি এই বেড়ালটার দায়িত্ব নিতে পারবে?
হ্যাঁ বাবু।
যদি এটা পালিয়ে বা মরে যায় তা হলে তুমি দায়ী থাকবে?
হ্যাঁ বাবু।
যখনই বলব তখনই বেড়ালটাকে নিয়ে হাজির হবে, তাই তো?
যা বলবেন তাই করব।
কিন্তু যে জন্যে তোমার বেড়ালটাকে দরকার তার যদি গড়বড় হয়?
বুঝতে পারলাম না বাবু।
ওই প্রেতাত্মারা যদি ওর ঘাড় মটকায়?
পারবে না বাবু। শকুন আর কাক ওকে আগলে রাখবে। বললেন যখন তখন বলি, তেনাদের সবচেয়ে বেশি রাগ শকুনের ওপর। তারপর কানা কাক। ওই দুটোকে তেনারা আগে মারতে চাইবেন। কিন্তু এই তিনজন একসঙ্গে থাকলে কিছুতেই পেরে উঠবেন না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
ঠিক আছে, আমার সঙ্গে এক জায়গায় চলো। ফিরে এসে খাতায় সই করে ওটাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। একটু বাইরে গিয়ে বোসো।
গোরক্ষনাথ চলে গেলে অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যাবেন?
কোথায়? অর্জুন উঠে দাঁড়াল। আমি এখনই সন্দীপের বাড়িতে যাব। বেড়ালটাকে বাড়ির গেটের সামনে ছেড়ে দিলে ওটা নিশ্চয়ই ভেতরে ঢুকবে। ব্যস, আমার কাজ সহজ হয়ে যাবে।
সন্দীপের তিন বন্ধুর হদিস নেবেন। আমার মনে হয় ডাকাতির টাকা সন্দীপ তার নিজের বাড়িতে রাখেনি। ওটা ওর বন্ধুদের বাড়িতেই পেয়ে যাবেন। আমার মনে হয় আপনার এই অভিযানে আমার থাকা উচিত নয়। পরে ফোন করে জেনে নেব। অর্জুন পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল, হুতুমপুরের ব্যাপারটা ভুলে যাবেন না যেন।
থানার সামনে যে এসটিডি বুথ রয়েছে সেখান থেকে মাকে ফোন করল অর্জুন। থানা থেকেই করতে পারত, তখন মনে ছিল না।
মা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার রে?
আমার ফিরতে একটু রাত হবে। তুমি শুয়ে পড়ে।
তুই কোত্থেকে বলছিস?
থানার সামনে থেকে।
এক্ষুনি বাড়ি চলে আয়।
কেন?
ওঁরা এসেছেন। মা গলা নামালেন। কারা?
ওই যে, আমেরিকা থেকে যাঁরা এসেছেন।
দুটো টাকা ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অর্জুন বাড়ির দিকে রওনা হল। মেজর এবং গোরানসাহেব তার বাড়িতে? হঠাৎ! ওঁরা কেউ বলেননি যে যাবেন।
দরজা খোলাই ছিল। মেজরের উঁচু গলা গলি থেকেই শোনা যাচ্ছিল। খুব প্রশংসা করছেন তিনি। অর্জুন ঘরে ঢুকতেই মা বললেন, আয়।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ঘুরে বেড়াও বলো তো?
অর্জুন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আপনারা আসবেন বলেননি তো!
মেজর বললেন বাংলায়, আরে। ওই টিফিন ক্যারিয়ার কি সার্কিট হাউসে পড়ে থাকবে? বাড়িতে তো কেউ দশটা ওই জিনিস রাখে না। যদি প্রয়োজন হয় তা হলে তোমার মা কী করবেন?
বোঝ! ওঁরা ওটা ফেরত দিতে এসেছেন। মা বললেন।
কতক্ষণ? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আধঘণ্টা হয়ে গেল। মেজর বললেন।
গোরানসাহেব চুপচাপ শুনছিলেন। বাংলায় কথা হলে তিনি যে কিছুই বুঝতে পারছেন না তা কিন্তু বুঝতে দিচ্ছেন না। এখন ওঁর মুখে সেই বীভৎস অভিব্যক্তি নেই। বেশ শান্তমুখে বসে আছেন এখন।
অর্জুন ঘড়ি দেখল, আপনারা গাড়িটাকে কখন আসতে বলেছেন?
এসে গেছে। তাতে চড়েই তোমাদের এখানে এলাম। বড় রাস্তায় রাখতে বলেছি, গলিতে ঢোকাইনি। আমরা তো ট্রেন ধরতে যাচ্ছি না। কথাগুলো বলে মায়ের দিকে তাকালেন মেজর। মা হেসে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
গোরানসাহেব এবার কথা বললেন, আজকে যদি তেমন কিছু না ঘটে তা হলে আমার মনে হয় কালই রওনা হওয়া ভাল।
ঠিক। মেজর মাথা নাড়লেন, অর্জুন, এখান থেকে হাসিমারায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
রাস্তা ভাল নয়। অন্তত আড়াই-তিন ঘণ্টা ধরে নিতে পারেন।
বাঃ। তা হলে আমরা বেলা বারোটা নাগাদ রওনা হতে পারি।
কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছিল। গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কালকে ওখানে গিয়ে কোনও হোটেল বা গেস্ট হাউসে নিশ্চয়ই ওঠা যাবে?
অর্জুন মাথা নাড়ল, না। ওদিকে হোটেল আছে ফুন্টশলিং-এ। হাসিমারার আধঘণ্টা দূরে। শহরটা ভুটানের বর্ডারে। কিন্তু ডাকবাংলো আছে, ফরেস্ট বাংলো পাবেন। মনে হয় খালি পাওয়া যাবে।
গোরানসাহেব বললেন, না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, আমাদের সঙ্গে টেন্ট আছে। আশা করি টেন্টে থাকতে তোমার অসুবিধে হবে না।
আমার? অবাক হল অর্জুন।
হ্যাঁ। মেজর বলেছেন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। তাই তো?
এটা তো বলার দরকার পড়ে না। উত্তরবাংলায় অভিযান করব আর তুমি সঙ্গে থাকবে না এটা আমি ভাবতেই পারি না। মেজর হাসলেন।
এই সময় মা একটা ট্রে হাতে ঢুকলেন। তাতে বড়বড় চিনেমাটির বাটিতে গাঢ় পায়েস থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পায়েসের বুকে কিশমিশ ফুলে উঠেছে। মেজর চিৎকার করে উঠলেন, গ্র্যান্ডি?
অর্জুন অবাক হয়ে গেল। মায়ের সঙ্গে মেজরের কথা হয়েছে এবং তার ফলে হল এই পায়েস। মেজর তখন গোরানসাহেবকে নিয়ে পড়েছেন, এটাকে বলে পায়েস। অমৃত। তোমাদের দেশে এ-জিনিস পাবে না। এর চেয়ে ভাল ডিনার আমি আর কিছুই আশা করতে পারি না।
মা বললেন,তোরা অনেকদূরে যাবি। ফিরতে রাত হলে তো খাবি না। তাই একটু পায়েস করে দিলাম। নলেন গুড় বাড়িতে ছিল— কেমন হয়েছে কে জানে?
মেজর এবং গোরানসাহেব একসঙ্গে প্রশংসা শুরু করলেন। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেল যে, মা লজ্জা পেয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
বেরোবার সময় মা জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কতদূরে যাচ্ছিস?
হুতুমপুর। অর্জুন জবাব দিল।
সে আবার কোথায়?
এখান থেকে ঘণ্টাখানেক।
কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ।
অর্জুন আর কথা বাড়াল না। গোরানসাহেব যাদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তাদের কথা শুনলে মা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করবেন। জীবনে আর কখনও মেজরদের বেঁধে কিছু খাওয়াবেন না। বাঙালি মায়েরা এখনও বিশ্বাস করেন তেনাদের সঙ্গে মজা করা ঠিক নয়। কখন কী হয়ে যাবে কিছুই বলা যায় না।
অর্জুন ড্রাইভারের পাশে বসে ছিল। হাইওয়ের দিকে যেতে-যেতে ড্রাইভার বলল, এত রাত্রে আপনারা যেতে চাইলেন, আমি টাকার লোভে না বললাম না। কিন্তু–।
কি-কিন্তু? মেজর পেছন থেকে খেকিয়ে উঠলেন।
খুব ডাকাতি হচ্ছে সার। হাইওয়েতে এখন ডাকাতি লেগেই আছে।
অর্জুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, হয়েছে। কিন্তু এখন আর হবে না।
আপনি কী বলছেন সার? কাল রাত্রেও হয়েছে।
বললাম তো, আর হবে না।
আপনি শোনেননি বোধ হয়। একটা বেড়াল এসে রাস্তা কাটে, গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়, আর তখনই ডাকাতরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ড্রাইভার জোর করে বোঝাবেই।
পড়লে পড়বে। আমাদের সঙ্গে আছেটা কী যে, ডাকাতি করবে।
মেজর প্রসঙ্গটা থামাতে চাইলেন, তা ছাড়া আমাকে তুমি ডাকাত দেখিও না। জীবনে কত ডাকাত দেখলাম। সেবার সাহারার বুটে টেন্ট খাটিয়ে বসে সবে হুইস্কিতে চুমুক মেরেছি, সঙ্গে সঙ্গে উটের পিঠে চেপে কালিবান ডাকাতরা এসে হাজির।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী বললেন কথাটা? তালিবান, না কালিবান?
কালিবান। তালিবানরা আফগানিস্তানে, কালিবান সাহারায়। গুলিয়ে ফেলো না। একা, বুঝলে, স্রেফ একা এই হুইস্কির বোতল হাতে নিয়ে এমন বক্তৃতা দিলাম যে, ব্যাটারা হাত পেতে বসে পড়ল। সবাইকে হুইস্কি খাওয়াতে খুশি হয়ে চলে গেল। আমাকে ডাকাত দেখাতে এসেছ?
মেজরের কথা শেষ হতেই অর্জুন বলল, তোমার ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যারা ডাকাতি করছিল তারা একটু আগে ধরা পড়েছে।
আমাদের শহরে?
হ্যাঁ। রেসকোর্স পাড়ার সন্দীপকে চেনো?
আই বাপ! অত বড়লোকের ছেলে ডাকাতি করে?
ওকে তুমি চেনো?
চিনব না? আমাদের পাড়ার কাবুল ওর জিগরি দোস্ত। কাবুলটা খুব ভাল বাইক চালাত। দুবছর আগে অ্যাক্সিডেন্টে ওর পা দুটো উড়ে যায়। ওর কাছেই যায় সন্দীপ। ছেলেবেলার বন্ধু বলেই এখনও টান আছে।
কোন পাড়া তোমাদের?
আদরপাড়া। ড্রাইভার মাথা নাড়ল, আমি ভাবতেই পারছি না।
পেছন থেকে মেজর বললেন, পৃথিবীতে থাকার মজা এটাই। যা ভাবতে পারবে না তাই ঘটতে দেখবে। কত দেখলাম।
ড্রাইভার আর কথা বাড়াল। গাড়ি তিস্তা ব্রিজে উঠল। দুপাশে ঘন অন্ধকার। শুধু ব্রিজের আলোগুলো জ্বলছে। এখন এই হাইওয়েতে গাড়ি খুব কমে গিয়েছে। মাঝে মাঝে লাইন দিয়ে ট্রাক যাচ্ছে।
বার্নিশের মোড়ে এসে দুটো পান-বিড়ির দোকান খোলা পেল ওরা। হুতুমপুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই রাস্তার হদিস পাওয়া গেল। বাইপাস ধরে আর একটু এগিয়ে গেলে ডান দিকে মাটির পথ ধরে দুই ক্রোশ যেতে হবে। অর্জুন জানে এই দুই ক্রোশের কথা স্রেফ আন্দাজে বলল লোকটা।
শেষপর্যন্ত মাটির রাস্তাটা চোখে পড়তেই গাড়িটাকে ডান দিকে ঘোরাতে বলল অর্জুন। নির্জন রাস্তার একপাশে একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি দেখে জিপ থেকে নেমে এলেন দুজন পুলিশের পোশাক পরা মানুষ। হাত নেড়ে থামতে বললেন। ড্রাইভার গাড়ি থামালে একজন সাব ইনস্পেক্টর এগিয়ে এলেন পাশে।
আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
জলপাইগুড়ি। অর্জুন উত্তর দিল। হুতুমপুরে যাবেন?
হ্যাঁ।
আপনাদের নামটা জানতে পারি?
আমি অর্জুন।
নমস্কার সার। এস. পি. সাহেবের কাছ থেকে ফোন এসেছে। আপনারা আমাদের গাড়িটাকে ফলো করুন।
কেন? আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
আপনাদের সঙ্গে থাকতে বলেছেন এস.পি, সাহেব।
আরে না না। আমরা ওখানে যাচ্ছি এই কথাটাই শুধু জানাতে বলেছিলাম লোকাল থানাকে, এসকর্ট চাইনি।
ও। কিন্তু ওখানকার কোনও মানুষকে কি আপনারা চেনেন?
না। আমরা গ্রামে ঢুকব না। গ্রামের পাশে তেঁতুলবন আছে, সেখানে যাব।
তেঁতুলবন? ডেঞ্জারাস জায়গা সারা দিনের বেলাতেই কেউ যায় না সেখানে।
এঁরা তাই যেতে চান।
মুশকিলে পড়লাম। অফিসার চিন্তিত হলেন।
কেন?
রাতবিরেতে আপনাদের ডাকাত বলে ভুল করে গ্রামের লোক যদি হামলা করে? অবশ্য তেঁতুলবনে গেলে ওরা জানতে পারবে না।
এক কাজ করুন। আপনার জিপ এখানে থাক। আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। তেমন হলে গ্রামের লোকদের বোঝাতে পারবেন।
আমি? না না। এই রামরতন, এদিকে এসো। সাহেবদের সঙ্গে যাও।
রামরতনের কানে সম্ভবত তেঁতুলতলার কথা পৌঁছেছিল। সে বলল, সার, আমার মনে হয় আপনার যাওয়াই ভাল। আমার বাঁ পায়ে খুব ব্যথা।
এতক্ষণ তো ব্যথার কথা শুনিনি, অমনি ব্যথা হয়ে গেল? অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তেঁতুলতলার কথা শুনে ভয় পাচ্ছেন কেন?
ভয়? ভয় ঠিক নয়। ঠিক আছে, চলুন।
অতএব অফিসার গাড়িতে উঠলেন। উঠে মেজরদের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারেই নমস্কার করলেন, নমস্কার সার। আমার নাম উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়।
অর্জুন বলল, সর্বনাশ।
আর বলবেন না। মা আমার সর্বনাশ করে গেছেন। অত বিখ্যাত একজন মানুষের নামে কেউ নাম রাখে?
কোনও অন্যায় করেননি তিনি, মেজর বললেন, সার আশুতোষ, সুভাষচন্দ্র, বিধান রায়ের নামে যদি নাম রাখা যায় তা হলে উত্তমকুমারেও দোষ নেই। তা উত্তমকুমারবাবু, তেঁতুলবন কতখানি জায়গা নিয়ে বলুন তো?
প্রায় সিকি মাইল। ভয়ঙ্কর জায়গা সার, দিনের বেলায় গা ছমছম করে।
জায়গাটা যে ভয়ঙ্কর এবং দিনের বেলাতেই যখন সেটা টের পাওয়া যায় তখন রাত্রে তার চেহারা কীরকম হবে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল অর্জুন। কিন্তু উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থামলে ওঁর গলা পাওয়া গেল, আপনারা কিছু শুনতে পাচ্ছেন সার?
শোনা যাচ্ছিল। দূরে কোথাও কোনও প্রাণী যেন আর্তনাদ করছে। মেজর গোরানসাহেবকে ব্যাপারটা বললে তিনি ইন্টারেস্টিং বলে মাথা দোলালেন।
উত্তমকুমার বললেন, সার, আমার কথা শুনুন। দূর থেকে এমন ইন্টারেস্টিং বলা সহজ। কিন্তু আমি পুলিশ অফিসার হিসেবে যেখানে যেতে সাহস পাচ্ছি না, সেখানে আপনারা কেন ঝুঁকি নিচ্ছেন?
ঠিক আছে। আপনি হুতুমপুরে চলুন। সেখানেই থেকে যাবেন। আমরা তেঁতুলতলা থেকে ঘুরে আসছি। আপনি ওরকম একটা নামের মালিক হয়েও এত ভয় পান? মেজর বেশ ধমকে উঠলেন।
গাড়িটা যত এগোচ্ছিল তত শব্দটা বাড়ছিল। অন্ধকার হলেও দূরের আকাশের একটা দিক যে কালো হয়ে আছে তা বোঝা যাচ্ছিল। পুলিশ অফিসার উত্তমকুমার বললেন, সোজা গেলে কমিনিটের মধ্যেই হুতুমপুর গ্রাম। দেখুন, একটাও আলো জ্বলছে না। সবাই এখন ঘুমিয়ে আছে। আর বাঁ দিকে এগোলেই তেঁতুলবন।
গোরানসাহেব ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছে কে?
স্পিরিট সার। ভিলেজ পিপল টোল্ড মি সার।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দেখেছেন?
না সার। আমি দেখতে চাই না। দেখুন কান্নাটা এখন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। উত্তমকুমার অর্জুনের শরীরের ঘনিষ্ঠ হলেন। মেজরের নির্দেশে তেঁতুলবনের দিকে গাড়ি ঘুরল। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর ড্রাইভার জানাল যে, সামনে কোনও রাস্তা নেই, জমিও বেশ উঁচু-নিচু, গাড়ি এগোবে না।
মেজর এবং গোরানসাহেব নেমে দাঁড়াতে অর্জুন বলল, নামুন মশাই।
উত্তমকুমার অদ্ভুত একটা শব্দ করে বললেন, বেশ চলুন। আমি সঙ্গে না গেলে তো পরে কৈফিয়ত দিতে দিতে প্রাণ বেরিয়ে যাবেই, তা হলে সেটা আগেই যাক।
মেজর এবং গোরানসাহেব তৈরি হয়ে এসেছেন। ব্যাগ থেকে লম্বা এবং শক্তিশালী টর্চ বের করে ওঁরা এগোলেন, এবড়োখেবড়ো জমি ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত ওঁরা জঙ্গলের ধারে পৌঁছে গেলেন। সামনে লম্বা লম্বা তেঁতুলগাছ গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে। এতখানি জায়গা জুড়ে কী করে শুধুই তেঁতুলগাছের জঙ্গল জন্মালো, তা নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা করা যায়। গাছগুলোর নীচে লম্বা লম্বা ঘাস আর লতাপাতার জঙ্গল।
মেজর উত্তমকুমারকে জিজ্ঞেস করলেন, এই জঙ্গলের জিওগ্রাফি সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার কোনও আইডিয়া নেই?
না সার। অনেক লম্বা, দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। ওই শুনুন।
অর্জুন খেয়াল করেনি ওরা জঙ্গলের কাছে আসামাত্র ওই কান্না থেমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে হঠাৎ সেই কান্না যেন জঙ্গলময় ছড়িয়ে পড়ল।
মেজর বললেন, এই জঙ্গলে শকুন ছাড়া অন্য কোনও পাখি থাকে বলে মনে হয় না। এগুলো শকুনের বাচ্চার চিৎকার। পাশ দিয়ে হাঁটা যাক, পথ একটা না একটা থাকবেই। চলুন।
প্রথমে গোরানসাহেব হাঁটছিলেন। তাঁর টর্চের লম্বা লম্বা আলো জঙ্গলের শরীরে পথ খুঁজছিল। ওঁর পেছনেই মেজর। উত্তমকুমার দ্রুত অর্জুনের সামনে চলে এলেন। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এঁরা এই জঙ্গলে কী খুঁজছেন?
প্রেতাত্মা। ড্রাকুলা হলে খুব ভাল হয়।
সর্বনাশা
ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এঁরা এব্যাপারে খুব এক্সপার্ট।
কী বলছেন আপনি? বড় বড় ওঝারাও এখানে ঢুকতে চায় না। বছরখানেক আগে দুটো দাগি আসামি এই জঙ্গলে এসে লুকিয়ে ছিল। তিনদিন বাদে খুব শকুন উড়ছে দেখে গ্রামের লোক আমাদের খবর দেয়। দিনদুপুরে দুজন ওঝাকে সঙ্গে নিয়ে দশজনের ফোর্স এসে পচা ডেডবডি উদ্ধার করে। তার অর্ধেকটাই শকুনের পেটে চলে গিয়েছিল বলে পোস্টমর্টেম করতে পাঠানো যায়নি। লোকে বলে ওই দুটো দাগির আত্মাই নাকি এখানে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদে, উত্তমকুমার বললেন।
অসম্ভব নয়। এখানকার ওরিজিন্যাল আত্মারা বোধ হয় ওদের থাকতে দিচ্ছে না।
হতে পারে। গ্রামের লোকরা এই কথাই বলে।
দেখা গেল গোরানসাহেব দাঁড়িয়ে আলোর ইশারা করছেন। তাঁর সামনেই একটা পায়েচলা পথ। ওঁরা সেই পথে ঢুকলেন। পথটা হাঁটার পক্ষে মোটেই আরামের নয়। তেঁতুলগাছের যেসব ডাল নীচে নেমে এসেছে তার ছোঁয়া লাগামাত্র কাঁটা ফুটছিল। ওই কাঁটা এত শক্ত এবং ধারালো যে, উত্তমকুমার বারংবার উঃ আঃ করছিলেন। দেখা গেল, শুধু তেঁতুল নয়, কুলগাছও সঙ্গে মিশে আছে।
বাইরে থেকে যতটা ঘন দেখাচ্ছিল, খানিকটা ভেতরে আসার পর তেমন মনে হল না। মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়েই বোধ হয় শকুনের বাচ্চাগুলো তাদের কান্না থামিয়েছে। অর্জুন মেজরের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনদিকে যাবেন?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
গোরানসাহেব ইংরেজিতে বললেন, ওই জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। চলো, ওখানে গিয়ে আমরা অপেক্ষা করি। শকুনের বাচ্চাগুলো যখন আমাদের কথা টের পেয়ে গেছে তখন তাঁরা কেউ থাকলে জানতেই পারবেন। বলতে বলতে তিনি শক্ত হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ ঘুরতে লাগল। অর্জুন অবাক হয়ে ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে মুখ ফেরাতে দেখতে পেল অন্ধকারে একটা কিছু নড়ছে। মেজরও সেটা বুঝতে পেরে টর্চ জ্বালতেই সাপটাকে দেখা গেল। অন্তত হাতপাঁচেক লম্বা, মোটা, কালো হলুদ রঙের সাপটা মাটি থেকে সোজা হয়ে ফণা তুলে দাঁড়াবার সময় চকিতে ঘটনাটা ঘটে গেল। ওরকম বিদ্যুতের মতো বৃদ্ধ গোরানসাহেব যে ছুটে গিয়ে ওর গলা টিপে ধরতে পারেন, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। বাঁ হাতে টর্চ আর ডান হাতে ভারী সাপটাকে তুলে মাটিতে আছাড় মারছিলেন গোরানসাহেব। তারপর টর্চ এগিয়ে দিলেন অর্জুনের দিকে। অর্জুন সেটাকে ঘুরিয়ে ওঁর ওপর আলো ফেলতেই বাঁ হাতে একটা ছুরি বের করলেন ব্যাগ থেকে। ডান হাতের মুঠোয় ধরা সাপটার মাথার নীচে ছুরি চালাতেই শরীরটা দুটুকরো হয়ে গেল। শরীরটা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। একটা চওড়া ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে মাথাটাকে ভাল করে মুড়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন গোরানসাহেব। এই কর্মটি অবাক হয়ে দেখছিলেন উত্তমকুমার। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে?
অর্জুন বলল, একজন গবেষক।
আঁ! সাপের মাথা নিয়ে গবেষণা করেন নাকি?
বোধ হয়।
সাঙ্ঘাতিক। ওরকম বিষাক্ত সাপকে কীভাবে ধরলেন!
অর্জুন গোরানসাহেবের ওপর থেকে টর্চের আলো সরায়নি। ওঁর মুখে যে বিকৃতি এসেছিল, ঠোঁটে যে বীভৎস হাসিটা ফুটেছিল তা একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে যেতে সে আলো নেভাল।
গোরানসাহেব মেজরের পাশে এসে দাঁড়ালেন, আমার মনে হয় এবার ফিরে গেলেই ভাল হবে। এখানে থাকা মানে সময় নষ্ট করা।
হঠাৎ?
যেখানে এই সাপ থাকে সেখানে ড্রাকুলা থাকতে পারে না।
গোরান, তোমাকে অনেকবার বলেছি এদেশের কেউ ড্রাকুলার নাম বইয়ের বাইরে শোনেনি। ড্রাকুলার কথা অশিক্ষিত মানুষেরাও জানে না। এরা বিশ্বাস করে ভূত, প্রেত, আত্মায়।
ওঃ নো। এরা মনে করে বাজে আত্মা মানুষের শরীরে ঢুকে তাকে দিয়ে খারাপ কাজ করায়। আমি কি ভুল বলছি? গোরানসাহেব প্রতিবাদ করলেন।
হ্যাঁ। তা করে। কিন্তু সেই মানুষ দিনেও জেগে থাকে, ঘুমোয় না। আর সাপের সঙ্গে প্রেতাত্মার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু সাপ আছে বলে তারা এই বন থেকে চলে যাবে কেন? বিরক্ত হলেন মেজর।
দুটো সমান শক্তিশালী শত্রু সাধারণত এক জায়গায় থাকে না।
মেজর হাসলেন, শুনেছি সাপ শয়তানের বন্ধু, তুমি শত্রু বলছ কেন?
শয়তান ড্রাকুলা নয়। প্রেতাত্মা নয়। সে ঈশ্বরের শত্রু।
তর্কটা থেমে গেল, কারণ দূরে গাড়ির এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। ওরা নেমে আসার পরে ড্রাইভার গাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। ভয় পেয়ে সে গাড়ি নিয়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছে না তো?
উত্তমকুমার কান পেতে শুনে বললেন, না সার। এটা আপনাদের গাড়ির আওয়াজ নয়।
তা হলে আপনার জিপটা চলে এসেছে। আমাদের ড্রাইভার মোটা টাকা ভাড়া হিসেবে পাবে, সে না বলে চলে যাবে না। অর্জুন বলল।
না সার। আমার জিপ নয়। এটা একটা ম্যাটাডোরের আওয়াজ। এত রাত্রে হুতুমপুরে ম্যাটাডোর এল কেন?
আওয়াজটা ওদের বাঁ দিকের কোথাও থেমে গেল। অর্জুন মনে করার চেষ্টা করল। ওরা এখানে এসেছে ডান দিক থেকে। অর্থাৎ ওদের গাড়ি রয়েছে ডান দিকে। যদি কেউ এখন গাড়ি নিয়ে আসে তা হলে সে আগের গাড়িটাকে দেখতে পায়নি।
মেজর বললেন, গাড়ির আওয়াজ যখন, তখন মানুষ আসছে। এই যে অফিসার, আপনি বলেছিলেন দিনের বেলাতেই এখানে কেউ আসে না, ভূতপ্রেত নিশ্চয়ই গাড়ি নিয়ে এখানে আসবে না!
হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। অফিসার ধন্দে পড়লেন।
অর্জুন বলল, এখন কেউ কথা না বললে ভাল হয়।
আলো নিভিয়ে ওরা চারজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ক্রমশ জঙ্গলের শব্দগুলো জোরালো হতে লাগল। এতক্ষণ আলো এবং কথাবার্তার কারণে এই শব্দগুলো যেন মিইয়ে গিয়েছিল। একটু পরে রাতের জঙ্গলের শব্দমালা এত প্রবল হয়ে উঠল যে, কোনটা পাখির ডাক কোনটা ডালপাতা নড়ার শব্দ, তা অৰ্জুন আলাদা করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল এখন যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও গাছ থেকেই কেউ একজন নেমে আসবে। যে নামবে সে প্রেতাত্মা ছাড়া অন্য কিছু হলে মানানসই হবে না।
হঠাৎ অন্যরকমের শব্দ কানে এল। কিছু যেন পড়ে গেল। পরপর দুটো। এবং তখনই জঙ্গলের শব্দ আচমকা থেমে গেল। একটু পরে গাড়ির আওয়াজ উঠল। সেটা যে দূরে চলে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে অর্জুন বলল, ওদিকটায় চলুন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
শব্দটা কেন হল দেখতে হবে।
গোরানসাহেবই উদ্যোগী হলেন। বেশ কিছুক্ষণ কুলগাছের ডাল থাকলে এগনোনা যাচ্ছে না। তেঁতুলগাছ আর কুলগাছের অবস্থান এত ঘনিষ্ঠ কী করে হল, তা কে জানে! ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরির পর গোরানসাহেব চিৎকার করে উঠলেন। ওরা কোনওরকমে তাঁর কাছে পৌঁছে চমকে উঠল। দুটো পূর্ণ বয়সের মানুষের শরীর চিত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। দুজনের উধ্বাঙ্গে কিছু নেই।
মেজর বসে পড়লেন পাশে। পরীক্ষা করে বললেন, ডেড।
অর্জুন বলল, দেখুন তো, কোথাও ক্ষতচিহ্ন আছে কিনা। এটা মার্ডার কেস।
উত্তমকুমার বললেন, কী করে বুঝলেন? এই জঙ্গলে।
দুর মশাই। অর্জুন রেগে গেল, শুনলেন গাড়ির আওয়াজ, কিছু ফেলার শব্দ। যারা ওদের খুন করেছে তারা ডেডবডি দুটোকে এখানে ফেলে গেল, কারণ ওরা জানে এখানে পাওয়া গেলে লোকে বা আপনারা বিশ্বাস করবেন ভূতে মেরেছে। আর যখন পাবেন তখন শকুন অর্ধেক খেয়ে ফেলবে।
উত্তমকুমার যেন ঝাঁকুনি খেলেন। দ্রুত গিয়ে মানুষদুটোর শরীর টর্চের আলোয় পরীক্ষা করতে আরম্ভ করলেন। তারপর দুজনেরই ডান হাতের কবজির ওপরে সামান্য ক্ষতচিহ্ন আবিষ্কার করলেন। গোরানসাহেব বললেন, এই দুজনের শরীরে একফোঁটা রক্ত নেই।
মেজর চমকে উঠলেন, তার মানে?
মনে হয় সমস্ত রক্ত শরীর থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে।
কেন? উত্তমকুমার জিজ্ঞেস করলেন?
জানি না। তবে পোস্টমর্টেম করলে আপনারা জানতে পারবেন।
উত্তমকুমার উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু এদের এখান থেকে নিয়ে যাব কী করে? এই জঙ্গলে কেউ সহজে ঢুকতে চায় না।
আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। আপনি আমাদের গাড়ি নিয়ে ফিরে গিয়ে আপনার জিপ আর সেপাইদের নিয়ে আসুন।
আপনারা এখানে একা থাকবেন? উত্তমকুমার ইতস্তত করলেন।
অর্জুন হেসে ফেলল, চলুন, আপনার সঙ্গে আমি যাচ্ছি।
গাড়িতে উঠে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমরা যে পথ দিয়ে এখানে এসেছি সেই পথ ছাড়া এই হুতুমপুরে পৌঁছবার অন্য কোনও পথ আছে?
হ্যাঁ। ধুপগুড়ি দিয়ে একটা পথ আছে।
তা হলে ওই পথ দিয়ে গাড়ি নিয়ে এলে আপনার জিপের লোকজন দেখতে পাবে না। তাই তো?
হ্যাঁ।
আপনার সঙ্গে অয়্যারলেস বা ওয়াকিটকি নেই?
না।
অর্জুন বুঝল, যে গাড়িটা মৃতদেহ ফেলে গেছে তাকে ধরবার কোনও সুযোগ নেই। শরীর থেকে রক্ত বের করে নিয়ে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের অপরাধ কী? সেই রক্ত নিয়ে কী করছে ওরা? চোখের সামনে যদি ঘটনাটা ঘটত, তা হলে গ্রামের লোক বিশ্বাস করত কোনও প্রেতাত্মা এই লোকদুটোর রক্ত চুষে নিয়েছে। এইভাবেই বোধ হয় ড্রাকুলার জন্ম হয়েছিল।
পুলিশের জিপে মৃতদেহ তুলে দিয়ে ওরা হখন শহরের দিকে ফিরে আসছিল তখন মেজর বললেন, ভোর হচ্ছে, এখন কি আর ঘুম আসবে?
অর্জুন হাসল, গেলেন আত্মা খুঁজতে, পেলেন মৃতদেহ।
মেজর বললেন, ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। নইলে এই দুটো মৃতদেহ পচে গলে জঙ্গলে পড়ে থাকত শকুনের খাদ্য হয়ে।
ওরা যখন শহরে পৌঁছল তখন আলো ফুটেছে। অর্জুন বলল, থানার সামনে আমাকে নামিয়ে দিন। খবরটা দিয়ে যাই। অবশ্য এখন অবনীবাবু নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছেন। তবু—।
অবনীবাবু কে? মেজর জানতে চাইলেন।
থানার বড়বাবু।
থানার সামনে পৌঁছে অর্জুন অবাক! এই ভোরে অবনীবাবু চিন্তিত মুখে থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
অবনীবাবু অবাক হয়ে তাকালেন, আরে! এখন এ সময়ে?
অর্জুন বলল, প্রশ্নটা তো আমারই করার কথা। আপনি তো জানেন আমরা ভূত দেখতে গিয়েছিলাম। সারারাত ধরে সেটা দেখে এলাম। আপনি মনে হচ্ছে রাত্রে ঘুমোননি!
আমার কথা বলছি। আগে বলুন, সত্যি সেসব দেখলেন নাকি? অবনীবাবু কৌতূহলী।
দুটো ডেডবডি দেখেছি। সমস্ত শরীরে এক ফোঁটাও রক্ত নেই। কেউ মেরে রক্ত চুষে নিয়ে মাঝরাত্রে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গেল।
সে কী? ফেলে দিয়ে গেল মানে আপনাদের চোখের সামনে কাজটা করল?
চোখের সামনে ঠিক নয়। গভীর জঙ্গলের একপাশে কাণ্ডটা করল। ছুটে গিয়ে ধরার কোনও সুযোগ ছিল না। সঙ্গে একজন অফিসার ছিলেন। তিনি ডেডবডি দুটোকে থানায় নিয়ে গেছেন। পোস্টমর্টেম করতে পাঠাবেন। এবার যদি লোক দুটোর আত্মা ভূত হয়ে ওই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তো বেড়াতে পারে।
কোন অফিসার ছিল আপনাদের সঙ্গে? শ্রীযুক্ত উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়।
ওঃ ওয়ার্থলেস। কোনও কর্মের নয়, লোকটা।
যে কর্মের নয় তার পুলিশে চাকরি থাকে কী করে?
এ-প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।
আপনি জেগে আছেন কেন?
চলুন, রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানটা খুলছে, চা খেতে খেতে কথা বলি। অবনীবাবু এগোলেন। অর্জুন নেমে আসার পর মেজরদের গাড়ি আর দাঁড়ায়নি। এখনও রাস্তা সুনসান। জলপাইগুড়ির ঘুম ভাঙতে একটু দেরি। রিকশাগুলো পথে নামেনি।
চায়ের দোকানদার থানার বড়বাবুকে দেখে তৎপর হল। চায়ে চুমুক দিয়ে অর্জুন বলল, আঃ।
প্রথম চা বেশ ভাল করে। অবনীবাবু চুমুক দিয়ে বললেন, কাল মাঝরাত পর্যন্ত সন্দীপ এবং ওর বন্ধুদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছি। কিন্তু কোনও প্রমাণ পাইনি। এস. পি. সাহেবের অনুমতি নিয়েছিলাম। কিছু না পাওয়ার পর ভদ্রলোক আমাকে এমন ভাষায় তিরস্কার করলেন যে, লজ্জায় মরে যাচ্ছি। সন্দেহ হওয়ায় আমরা যে-কোনও বাড়িতে তল্লাশি করতে পারি কিন্তু—I অবনীবাবুর মন যে ভাল নেই তা বোঝা গেল।
আপনি কী খুঁজতে গিয়েছিলেন?
এতদিন ধরে যেসব টাকা ওরা লুঠ করছিল তা নিশ্চয়ই ওদের হেফাজতে পাওয়া যাবে বলে ভেবেছিলাম। অল্পবয়সী ছেলেরা অত টাকা কোত্থেকে পেল এই কৈফিয়ত দিতে পারত না। থানায় এনে চাপ দিলে ভেঙে পড়ত। কিন্তু হিসেবে কিছু মিলল না।
ওরা কিছু বলেছে?
হ্যাঁ। আজ ওরা কোর্টে যেতে পারে। অবনীবাবু নিশ্বাস ফেললেন, হয়তো এর জন্যে খুব বাজে জায়গায় ট্রান্সফার করে দেবে ওপরওয়ালা। কী করা যাবে?
চায়ের দোকানদার দাম নিচ্ছিল না। অবনীবাবু জোর করে দিতে সে নমস্কার করল।
অর্জুন বলল, আমার মনে হচ্ছে একটা রাস্তা আছে।
রাস্তা?
হ্যাঁ। অবশ্য একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা না নিয়ে কোনও উপায় নেই। আপনার থানায় এখন কজন সেপাই আছে?
কেন?
একটু আদরপাড়ায় চলুন।
আদরপাড়া? খোলসা করে বলুন মশাই। আমার মাথা কাজ করছে না।
থানার দিকে যেতে যেতে অর্জুন অবনীবাবুকে ব্যাপারটা বলতে লাগল।
দুজন লাঠিধারী সেপাই পেছনে বসে ছিল, অবনীবাবু জিপ চালাচ্ছিলেন। পাশে অর্জুন। জিপটা চলে এল আদরপাড়ায়। এখন দু-একজন রাস্তায়। এই ভোরে পুলিশের জিপ দেখে তারা অবাক হয়ে তাকাল। অবনীবাবু বললেন, জিজ্ঞেস না করলে বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অর্জুন বলল, জিজ্ঞেস করলেই ভিড় বাড়বে। দাঁড়ান।
জিপটা দাড়াল। এক ভদ্রলোক মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছিলেন। অর্জুন জিপ থেকে নেমে বলল, শুনুন, আপনি এ-পাড়ায় থাকেন?
হ্যাঁ। ভদ্রলোক পুলিশের জিপ দেখে থমকে গেলেন।
আমরা একটু সমস্যায় পড়েছি। একজন ডাক্তারের কলকাতা থেকে এ পাড়ায় আসার কথা। ওঁর আত্মীয় বামাচরণ দত্তের বাড়িতে উঠবেন। বাড়িটা কোথায় বলবেন?
বামাচরণ দত্ত! ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না তো।
ওপাশে দুজন দাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা এগিয়ে এল বামাচরণ দত্ত? কী করেন?
ব্যবসা।
না। চিনতে পারছি না। আর কিছু বলেছে?
অর্জুন মনে করার ভান করল, হ্যাঁ। উনি কয়েকটি অর্থোপেডিক পেশেন্টকে দেখবেন। তার মধ্যে বামাচরণবাবুর পাশের বাড়ির একটি ছেলে আছে। কী নাম যেন, কাবুল, হাঁ কাবুল।
তিনজনে একটু আলোচনা করে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কাবুল নামের একটি ছেলে আছে। প্রতিবন্ধী। সে থাকে সোজা গিয়ে বাঁ দিকের মোড়ে লাল বাড়িতে। কিন্তু তার আশপাশে বামাচরণ দত্ত বলে কেউ থাকে বলে মনে হয় না। আনারা একটু বেলায় আসুন। পাড়ার মুদির দোকানে খোঁজ করলে জানতে পারবেন।
অশেষ ধন্যবাদ। অর্জুন গাড়িতে ওঠায় ওঁরা যে-যার মতন চলে গেলেন।
অবনীবাবু অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য অভিনয় করলেন তো!
অর্জুন বলল, সোজা চলুন। বাঁ দিকের মোড়ে লাল বাড়ি কাবুলদের। বাড়ির সামনে গাড়ি রাখার দরকার নেই। আগে কোথাও পার্ক করুন। হেঁটেই যাওয়া যাবে।
বাড়িটা চিনতে অসুবিধে হল না৷ বেল বাজালেন অবনীবাবু। দ্বিতীয়বারের পর একটি কাজের লোক দরজা খুলল। অবনীবাবু বললেন, কাবুল আছে?
হ্যাঁ। ঘুমোচ্ছ।
ওঁর বাবা বাড়িতে থাকলে ডেকে দাও।
কাবুলের বাবা মধ্যবয়সী মানুষ। লুঙ্গি পরে গেঞ্জি গ্রায়েই বিছানা থেকে উঠে এলেন, কী ব্যাপার? কী চাই?
অবনীবাবু বললেন, আমি থানার অফিসার-ইন-চার্জ।
ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেলেন, ও। কী ব্যাপার? মানে!
আমরা আপনার ছেলে কাবুলের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
কেন বলুন তো?
ওর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে।
অভিযোগ? সে কী? আপনি কি জানেন দুবছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্ট করায় ওর দুটো পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে?
আমরা জানি। আপনার উত্তেজিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমরা রুটিন কিছু প্রশ্ন করে চলে যাব। ওকে ঘুম থেকে তুলুন।
কিন্তু ওর পক্ষে তো নীচে নামা সম্ভব নয়।
তা হলে আমরাই ওর কাছে যাচ্ছি। বুঝতেই পারছি আপনাদের খুব অসুবিধায় ফেলছি কিন্তু ওর সঙ্গে কথা না বলে চলে যেতে পারছি না। অবনীবাবু হাসলেন, চলুন।
ভদ্রলোককে অনুসরণ করে দোতলায় এল ওরা। ঘরের দরজা খোলা। পরদা ঝুলছে। বাইরে থেকে ভদ্রলোক ডাকলেন, কাবুল!
বলো। সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া এল।
তোমার মুখ ধোয়া হয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ।
দুজন ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন?
কে? কারা?
কাবুলের বাবা জবাব দেওয়ার আগে অবনীবাবু পরদা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। বছর বাইশের এক যুবক হুইল চেয়ারে বসে আছে। সামনে খোলা জানলা। ভোরের রোদ পড়ছে ঘরে। কাবুল অবাক হয়ে তাকাল, কী চাই?
অবনীবাবু বললেন, তোমার নাম তো কাবুল। আমি থানা থেকে আসছি।
কাবুল অবনীবাবুকে দেখল। তারপর অর্জুনের দিকে তাকাল। হঠাৎ তার মুখের চেহারা বদলাল। বলল, আপনি তো অৰ্জুন।
অর্জুন কোনও কথা বলল না। অবনীবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে। তোমার কোন-কোন বন্ধুর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রয়েছে?
সবার সঙ্গেই আছে। ওরা আসে। ফোন করে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন খুব বই পড়ো?
ওর বাবা জবাবটা দিলেন, চিরদিনই পড়ে। ফার্স্ট ডিভিশন ওর বাঁধা ছিল। ওই মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে—। ভদ্রলোক কথা শেষ করতে পারল না।
অনীবাবু বললেন, এখন তো কত আধুনিক সরঞ্জাম বেরিয়েছে, প্রতিবন্ধীরা প্রায় স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারে।
কাবুলের বাবা বলল, সেগুলোর সাহায্য ও নিতে চায় না। আমেরিকায় একটা অপারেশন করে মূল হাড়ের সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে দেয় যে, কোনও পার্থক্য বোঝা যায় না। কিন্তু আমার পক্ষে তা ওখানে নিয়ে গিয়ে এই চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। প্রচুর খরচ।
কাবুলের মুখ শক্ত হয়ে গেল, বাবা। আমি কি তোমাকে খরচটা করতে বলেছি?
না বলিসনি। কিন্তু সেই আশায় তো আছিস।
সেটা আমি বুঝে নেব। কাবুল মুখ ফেরাল।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, সন্দীপ তো তোমার বেস্ট বন্ধু।
কেন?
ও তোমার কাছে শেষ কবে এসেছিল?
পরশু সন্ধের পর। কাবুলের বাবা বলল, খুব ভালবাসে ওকে।
অবনীবাবু অর্জুনের দিকে তাকালেন। তারপর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কাবুলের পাশে দাঁড়ালেন, তোমার বন্ধুরা কি তোমাকে সাহায্য করবে বলেছে?
কাবুল চটপট বলল, নিশ্চয়ই। ওরা আমার জেনুইন বন্ধু।
খুব ভাল কথা।অর্জুন বলল, ওদের তুমি নিশ্চয়ই প্রশ্ন করেছ কীভাবে ওরা টাকা রোজগার করছে? অত টাকা ওরা কোথায় পাচ্ছে?
আমি জানতে চেয়েছিলাম, ওরা উত্তর দেয়নি।
তোমার মনে কোনও সন্দেহ হয়নি? অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
না। ওরা সবাই বড়লোক। ব্যবসা শুরু করেছে বলেছে। হঠাৎ কাবুলের যেন খেয়াল হল, এসব কথা আপনারা কী করে জানলেন?
কেন? অবনীবাবু হাসলেন।
ওরা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল।
কিন্তু কাবুল, টাকাটা যদি সৎপথে ওরা উপার্জন করে এবং তোমার উপকারের জন্যে খরচ করে, তা হলে খবরটা চেপে যাবে কেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আমি জানি না।
টাকাগুলো কোথায়?
একটু ইতস্তত করে কাবুল জবাব দিল, আমার কাছেই আছে।
অবনীবাবু বললেন, তুমি বললে কেন ওরা গোপন করেছে তা জানো না। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি। কিন্তু তোমার উচিত কারণটা জানা।
বেশ। জিজ্ঞেস করব।
অবনীবাবু কাবুলের বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ঘরে ফোন আছে?
উত্তরটা দিল কাবুলই। হাত দিয়ে হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে সেলফ থেকে কর্ডলেস রিসিভার টেনে বের করল। অর্জুন চটপট এগিয়ে গেল। টেলিফোনে বেশি কথা বলার দরকার নেই। তুমি শুধু বলবে ও যেন এখনই এখানে আসে। কথা আছে। জরুরি। ব্যস। সন্দীপকে ফোন করছ ভো?
কাবুল মাথা নাড়ল। ডায়াল করে সন্দীপকে চাইল। তারপর বলল, অ্যাই সন্দীপ, তোর সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। একটু আসতে পারবি? হ্যাঁ, এখনই। আচ্ছা। যন্ত্রটাকে বন্ধ করে বলল, ও আসছে।
অবনীবাবু পাশের দরজাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ ঘরে কে থাকে?
কেউ না। খালি। কাবুলের বাবার গলার স্বর পালটে গিয়েছে, এসব কথা আমি জানিই না। তুই তো কখনও আমাকে বলিসনি যে তোর বন্ধুরা তোকে টাকা দিয়ে যাচ্ছে। কত টাকা দিয়েছে এ পর্যন্ত।
ওরা নিষেধ করেছিল।
কত টাকা দিয়েছে?
একটু ভাবল কাবুল। তারপর সেলফ থেকে একটা ডায়েরি বের করে পাতা ওলটাল, তিন লক্ষ সত্তর হাজার।
অ্যাঁ! অ্যাত্ত টাকা! চিৎকার করে বললেন কাবুলের বাবা, এই ঘরে তুই এত টাকা রেখেছিস জানতে পারলে যে কোনওদিন ডাকাতি হয়ে যাবে।
কেউ জানত না, তোমরা না বললে কেউ জানবে না। কাবুল বলল, আর দু লক্ষ তিরিশ হাজার টাকা জমলেই আমি আমেরিকায় যেতে পারব। মোট ছলক্ষ টাকা লাগবে ওই অপারেশনটা করাতে। চোখ বন্ধ করে বলছিল কাবুল। যেন স্বপ্নটা সত্যি হতে যাচ্ছে, এমন আলো ওর মুখে।
মিনিট পনেরো যেতে-না-যেতেই সন্দীপ পৌঁছে গেল। সঙ্গে আর একটি ছেলে। অর্জুনরা তখন পাশের ঘরে বসে রয়েছে। মাঝখানে পরদাটার আড়াল।
কী ব্যাপার? কী হল? সন্দীপের গলা।
বোস। কাবুল বলল।
তাড়াতাড়ি বল। আর-একটি গলা শোনা গেল, কাল রাত্রে পুলিশ খুব ঝামেলা করেছে। আজ উকিলের সঙ্গে কথা বলে কোর্টে যেতে হবে। যা বলার তাড়াতাড়ি বল।
পুলিশ তোদের সঙ্গে ঝামেলা করেছে?
হ্যাঁ।
কেন?
ও অন্য ব্যাপার। সন্দীপ বলল, চটপট বল কাবুল।
তোরা আমাকে যে টাকা দিয়েছিস তা কোথায় পেয়েছিস?
হঠাৎ একথা? সন্দীপের গলায় সন্দেহ।
তোরা আমাকে বলেছিস কাউকে না বলতে। কেন?
কেন আবার। সবাই জানলে নানান কথা বলবে, তাই।
তাতে কী এসে যায়। তারা আমার উপকার করছিস এটা তো ভাল কথা। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। এখনই আমেরিকায় যেতে চাই।
দুর। এখনও অনেক টাকা জোগাড় করতে হবে।
বাবাকে বললে ধার করেও কিছু জোগাড় করতে পারবে।
না। এখনই তোর কোথাও যাওয়া চলবে না। সন্দীপের গলা। কেন?
বলছি যা, তা তোকে শুনতে হবে।
তোদের কথা আমার ভাল লাগছে না।
দ্যাখ, টাকাটা আমাদের, তোকে রাখতে দিয়েছি, এটা ভুলে যাস না।
কিন্তু টাকাটা তোরা কীভাবে পাচ্ছিস?
সেটা জেনে তোর কী লাভ? আমরা চুরি করি আর ডাকাতি করি, তোর তো টাকাটা পেলেই হল। ফালতু ডেকে আনলি।
না। যদি অন্যায় করে টাকাটা নিয়ে আসিস, তা হলে আমার দরকার নেই। অন্যায়ের টাকায় আমার পা সারালে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকব।
সন্দীপ বলল, মনে হচ্ছে কেউ তোর ব্রেন ওয়াশ করেছে।
কাবুল জবাব দিল না। সন্দীপ জিজ্ঞেস করল, আজকালের মধ্যে তুই বাইরের কার সঙ্গে কথা বলেছিস। কাবুল, জবাব দে।
আমার কিছু বলার নেই। তুই শুধু বল, এটা ব্যবসা করে সৎপথে উপার্জনের টাকা। বল।
দ্বিতীয় গলা বলল, টাকাটা নিয়ে চল সন্দীপ।
হ্যাঁ। সেটাই উচিত। কাবু, টাকাগুলো দে।
কেন?
তোর কাছে রাখা আর ঠিক নয়। যখন ছলক্ষ হবে তখন তোর কাছে আসব। দিয়ে দে। ওই সুটকেসে আছে, তাই তো?
তোরা টাকাগুলো নিয়ে যাচ্ছিস? চিৎকার করে উঠল কাবুল।
অর্জুন ইশারা করতেই অবনীবাবু দ্রুত পরদা সরালেন। সুটকেস থেকে বড়বড় খাম বের করছে সন্দীপ। তার পাশে একটি ছেলে।
অবনীবাবু কথা বললেন, সন্দীপ।
সন্দীপ যেন ভূত দেখল। ওর হাত থেকে খামগুলো পড়ে গেল।
অবনীবাবু বললেন, আশা করি তুমি সুবোধ বালকের মতো থানায় যাবে। সন্দীপ ঘুরে দাড়াল কাবুলের দিকে। তারপর হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল ওর ওপর। অর্জুন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে আটকে দিতেই সে চিৎকার করে উঠল, তুই তা হলে বেইমানি করলি কাবুল। তুই যাতে হাঁটতে পারিস তাই এত টাকা এনে দিয়েছি আর তুই পুলিশকে লুকিয়ে রেখে আমাদের ডেকে আনলি। বেইমান, বিশ্বাসঘাতক।
অর্জুন থানায় ঢুকল না। অবনীবাবু এখন উত্তেজিত। খুশিও। সন্দীপ এবং তার বন্ধু ছাড়াও কাবুলকেও হুইলচেয়ারে বসিয়ে থানায় এনেছেন তিনি। গাড়ি বেরিয়ে গেল সন্দীপদের অন্য বন্ধুদের তুলে আনতে। অর্জুনের খারাপ লাগছিল কাবুলের জন্যে। বেচারার স্বপ্ন আর সত্যি হবে না। কিন্তু সত্যি কি সন্দীপরা ওর উপকারের জন্যে ডাকাতি করছিল? বন্ধুকে ভাল করার জন্যে? এর উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না। এখন বাড়িতে গিয়ে ঘুমোতে হবে। লম্বা ঘুম। দুপুরেই মেজরদের সঙ্গে যেতে হবে ড়ুয়ার্সে। গোরানসাহেব এখনও বিশ্বাস করেন ওই অঞ্চলে ড্রাকুলা আছে। দেখা যাক!
দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিল অর্জুন, মা ঘুম ভাঙালেন, তখন থেকে লোকটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওর সঙ্গে কথা বলে স্নানখাওয়া করে নিয়ে না হয় আবার ঘুমিয়ে পড়।
সারারাত জেগে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েও অর্জুনের ঘোর কাটছিল না। জিজ্ঞেস করল, কে লোক? নাম কিছু বলেছে?
হ্যাঁ, গোরক্ষনাথ।
অর্জুন মায়ের দিকে তাকাল, মা বললেন, লোকটা যেন কীরকম!
অর্জুন ধড়মড়িয়ে উঠে বাথরুমে চলে গেল। একটু ভদ্রস্থ হয়ে যখন বাইরের ঘরের দিকে এগোল তখন মা জিজ্ঞেস করল, চা দেব?
হ্যাঁ। অর্জুন দেখল এখন বারোটা বাজে।
দরজা খুলতেই গোরক্ষনাথকে দেখতে পেল সে। তাকে দেখে ডান হাত মুঠো করে কপালে দুইয়ে নমস্কারের ভঙ্গি করল সে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
একটু কথা ছিল। চারপাশে তাকাল গোরক্ষনাথ।
আসুন।
গোরক্ষনাথ ভেতরে এসে সন্তর্পণে বসল। অর্জুন তাকাল।
গোরক্ষনাথ বলল, সন্দীপবাবুদের পুলিশ ধরেছে, ডাকাতি করত ওরা। মুশকিল হল আমাকেও ওরা জড়িয়ে ফেলবে ওই মামলায়।
কেন? আপনি ওসব করতেন নাকি?
না, না। প্রবল আপত্তি জানাল গোরক্ষনাথ, ওসব করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। সেকেন্ড অফিসার বললেন, ডাকাতির মাল যার কাছে পাওয়া যায় তাকে যেমন শাস্তি দেওয়া হয়, তেমনি যার সাহায্যে ডাকাতি করা হয় তাকে যে হেফাজতে রাখে তাকেও ধরা হয়। আপনি বলুন, আমি কি জেনেশুনে বেড়ালটাকে আমার কাছে রেখেছি! ওরকম বড়লোকি বেড়ালকে এক মাস রাখলে আমি ফতুর হয়ে যাব।
অর্জুন বলল, আপনি অবনীবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
উনি নাকি সারারাত জেগে ছিলেন তাই এখন ঘুমোচ্ছেন, দেখা পাইনি।
তা হলে নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনার কোনও ভয় নেই।
আপনি একটু দেখুন বাবু। ওই বেড়ালটাকে আমি থানায় ফেরত দিতে গিয়েছিলাম, ওনারা বললেন, না। বলেছেন, আমার সঙ্গে ওটাকে আদালতে তুলবেন। তবে একটা কথা বাবু, বেড়ালটা দেখতে পায়। হঠাৎ মুখচোখ পালটে গেল গোরক্ষনাথের।
এই সময় মা চা দিয়ে গেলেন, সঙ্গে বিস্কুট।
মা চলে গেলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, দেখতে পায় মানে?
তেনাদের। কাল রাত্রে আমি প্রমাণ পেয়েছি।
কীরকম?
খাঁচার মধ্যে যেন লড়াই করছিল বেড়ালটা। একা একা।
হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল অর্জুনের। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে আপনার কাজকর্ম এখন কীরকম? খুব চাপ?
চাপ কোথায় বাবু? আগের দিন কি আছে? বেঁচে থাকার এত সমস্যা যে, মানুষের সময় কোথায় তেনাদের নিয়ে ভাবার? দিন পনেরো পরে রায়কত পাড়ায় একটা যজ্ঞ করতে হবে। কেন বাবু?
চা খাব।
মায়ের আপত্তি ছিল স্নানখাওয়া না সেরে বেরনোতে, কিন্তু তাঁকে বোঝাল, মেজরের সঙ্গে একবার দেখা করে আসা উচিত। ওরা বাড়ি থেকে বেরোতেই হাবুকে দেখতে পেল। হন্তদন্ত হয়ে আসছে। হাবু ইশারায় যা বোঝাল তাতে অর্জুন বুঝল এখন সার্কিট হাউসে যাওয়ার দরকার নেই। মেজর এবং গোরানসাহেব অমল সোমের বাড়িতে চলে এসেছেন এবং তাকে খবর পাঠিয়েছেন।
ওদের আগে আগে হাবু যাচ্ছিল। গোরক্ষনাথের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তাকে। জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নেহাত পুলিশের ঝামেলায় সে পড়েছে, নইলে সে কখনওই অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে আসত না।
অমল সোমের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলেন মেজর। তাঁর লক্ষ যার দিকে সেটি যে একটা কাক, তা বুঝে হেসে ফেলল অর্জুন। কাছে গিয়ে বলল, আপনি একটা কাককে ওভাবে ধমকাচ্ছেন?
আরে বিস্তর কাক দেখেছি কিন্তু এমন পাজির পাঝাড়া কাক কখনও দেখিনি। সেই কখন থেকে এসেছি তখন থেকে সমানে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কানের পোকা বের করে ফেলল। ব্যাটা ইঁদুর, ধর্মের গাধা!
অর্জুন মজা পেল, ধর্মের গাধা কী প্রাণী?
কেন? কাশীতে যদি ধর্মের ষাঁড় থাকতে পারে তা হলে জলপাইগুড়িতে ধর্মের গাধা থাকবে না কেন? দেখছ, এখনও থামছে না হাঁড়িচাচাটা। মেজর বারান্দা থেকে নেমে একটা ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে কার্নিসে বসা কাকটার দিকে তার্ক করতে লাগলেন। হঠাৎ ছুটে এল গোরক্ষনাথ, মারবেন না, মারবেন না। একটু দাঁড়ান, ভাল করে দেখি।
এ আবার কী? কাকের জন্যে দরদ উথলে উঠল? ওহে, কাক হল এমন চিজ, যে কখনও পোষ মানে না। হ্যাঁ। মেজর বললেন।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল গোরক্ষনাথ। দুটো হাত মাথার ওপর তুলে নাচতে লাগল পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি বলে। এবং চিঙ্কার কানে যাওয়ামাত্র কাকটা চুপ করে একদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করতে লাগল।
এ এমন চিংড়ির মতো লাফাচ্ছে কেন হে অর্জুন? মেজর অবাক।
গোরক্ষনাথ ছুটে এল অর্জুনের সামনে, বাবু, যে করেই হোক ওটাকে ধরতে হবে। ওই দেখুন ওর এক চোখ কানা। ডান দিকটা দিয়ে দেখতে পায় না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ দিকটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।
কানা কাক? অর্জুনের মনে পড়ে গেল। খোঁড়া শকুন, কালো বেড়াল সংগ্রহে এসে গেছে কিন্তু গোরক্ষনাথ এখনও কানা কাক খুঁজে পায়নি।
মেজরকে ব্যাপারটা বোঝাতে হল। প্রথমে তিনি বললেন, যতসব গ্যাঁজাখোরের কাণ্ড তারপর বললেন, একে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমেরিকাতেও এখন দিন দিন গেঁজেল বেড়ে যাচ্ছে। যাকগে, কাকটাকে ধরতে চাও?
গোরক্ষনাথ সবেগে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ বাবু।
তা হলে ভাত নিয়ে এসো। ভাত ছড়ালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনই কাক ধরতেও সুবিধে হয়। আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে ইগমি নামের একটি উপজাতি থাকে। খুব কম লোকই তাদের দেখা পায়। আমি ওদের কাছ থেকে পাখিরা শিখেছিলাম।
আফ্রিকা একটি বিশাল মহাদেশ। তার কিছুটা নাকি এখনও অনাবিষ্কৃত, সেখানে ইগমি নামের উপজাতি থাকতেই পারে। সন্দেহ প্রকাশ করে কোনও লাভ নেই। হাবুকে বলে কিছুটা শুকনো ভাত জোগাড় করা হল।
কিন্তু মেজর যে কায়দাটা করল তা পশ্চিমবাংলার শিশুরাও জানে। একটা বড় ঝুড়ি খাড়া করে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। ভাত রাখা হল ঝুড়ির সামনে। দড়িটা লম্বা। সেটার প্রান্ত ধরে মেজর আড়ালে চলে গেলেন। কাকটা অনেকক্ষণ একচোখে যাচাই করল। কোনও কাককে অতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে দেখেনি অর্জুন। শেষ পর্যন্ত লোভ প্রবল হওয়াতে কাকটা উঁচু কার্নিস থেকে নেমে এল ঝুড়ির সামনে। এক পা দু পা করে ভাতের কাছে পৌঁছে গিয়ে খপ করে কিছুটা তুলে লাফিয়ে সরে এল ঝুড়ির আওতা থেকে। ঝুড়ি পড়ল না, কোনও বিপদ ঘটল না দেখে বোধহয় কাকটার সাহস বাড়ল। এগিয়ে গিয়ে গপগপ করে ভাত খেতেই মেজরের দড়ির টানে ঝুড়িটা পড়ে যেতেই চিৎকার করে উঠল গোরক্ষনাথ। কাকটা ধরা পড়ে গেছে।
গোরানসাহেব কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কেউ টের পায়নি। এবার তিনি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কী? অর্জুন তাঁকে গোরক্ষনাথের সাধনার জন্যে যেসব সামগ্রীর প্রয়োজন, সেটা ব্যাখ্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ। উজ্জ্বল হয়ে উঠল গোরানসাহেবের। ঝুড়ির পাশে উবু হয়ে বসে লক্ষ করছিল গোরক্ষনাথ, তিনি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, তুমি সত্যি বলছ?
গোরক্ষনাথ মুখ তুলে সাহেবকে দেখে দু হাত নাড়ল, নো ইংরেজি।
মেজর বাংলায় অনুবাদ করলে সে দ্রুত মাথা নাড়ল, ইয়েস ইয়েস।
দেন হি উইল গো উইদ আস।
মেজরের কাছে বাংলা শুনে গোরক্ষনাথের মুখ চুপসে গেল, আমাকে ছেড়ে দিন সাহেব। এত কষ্টে কাকটাকে পেয়েছি, এখন এখানে আমার ডিম্যান্ড বেড়ে যাবে।
কত টাকা রোজগার করো দিনে?
প্রতিদিন তো হয় না। তেমন খদ্দের পেলে সেটা হয়।
গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকাল, ও বাবু, ওঁদের একটু বুঝিয়ে বলুন না!
অর্জুন বলল, কিন্তু গোরক্ষনাথ, আপনার এখানে থেকে কোনও লাভ হবে না।
কেন?
পুলিশ তো বেড়ালটাকে নিয়ে যাবে। আর একটা বেড়াল জোগাড় না করা পর্যন্ত! তার চেয়ে এঁরা যা বলছে শুনুন। পুলিশের চোখের সামনে থেকে চলে গেলে তারাও হয়তো আপনাকে ভুলে যাবে। কদিন বাদে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ফিরে আসবেন।
অর্জুনের কথাটা বোধহয় মনে ধরল গোরক্ষনাথের। তারপর একটু ভেবে বলল, আমার মুশকিল হল ওই বুড়িটাকে নিয়ে। আমি চলে গেলে কে ওকে দেখবে? কে ওর বাজার করে এনে দেবে? আচ্ছা, কদ্দূর যেতে হবে?
হাসিমারার কাছে।
অ। ঠিক আছে, পাড়ার একটা ছেলেকে বলে দেখি। কিছু পয়সা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেতে হবে।
গোরানসাহেব বুঝলেন গোরক্ষনাথ খুশি হয়েছে। উনি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে গোরক্ষনাথের হাতে গুঁজে দিলেন। এবার অর্জুন এগিয়ে এল ঝুড়িটার দিকে, কিন্তু গোরক্ষনাথ, মানলাম এই কাকটা কানা। কিন্তু আপনি বলেছিলেন ওকে জন্মাতে হবে কানা হয়ে। এই কাকটা যে সেই শ্রেণীর তা বুঝলেন কী করে?
দাঁড়ান, দেখাচ্ছি। গোরক্ষনাথ তার জামাটা খুলে ফেলল। ডান হাত জামার ভেতর ঢুকিয়ে ঝুড়িটাকে সামান্য তুলে খানিকটা চেষ্টার পর কাকটাকে ধরে ফেলল। তারপর ঝুড়ি সরিয়ে ওটা বের করতে কাকটা আর্তনাদ শুরু করল। বাঁ হাতে ওর মুখ চেপে ধরে কানা চোখটাকে অর্জুনের সামনে নিয়ে এল সে, দেখুন বাবু, চোখটা একদম সাদা। কোনও খোঁচা খেয়ে কানা হলে আশেপাশের জায়গা ফুলে থাকত। চোখের মণিও অন্যরকম দেখাত। এ একেবারে আমার জন্যই এখানে বসে অপেক্ষা করছিল। তা হলে আমি যাই?
অর্জুন মেজরকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী ঠিক করলেন? আজই যাবেন, না কাল ভোরে রওনা হবেন?
মেজর গোরানসাহেবকে প্রশ্নটা করতে তিনি বললেন, এখানে খামোকা সময় নষ্ট করে কী লাভ?
অর্জুন জানাল, কিন্তু তৈরি হয়ে হাসিমারায় পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। বরং শহরে থেকে আর একটু প্রস্তুতি নিয়ে গেলে ভাল হয়।
সেই সিদ্ধান্ত হল। গোরক্ষনাথ তার সাধনার সামগ্রী নিয়ে সকাল সাতটার সময় জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
গোরক্ষনাথ চলে গেলে অর্জুন মালপত্রগুলো ভাল করে দেখল। মেজর এখান থেকেই চাল ডাল নুন কিনে নিয়ে যেতে চান। যদি জঙ্গলের গভীরে থাকতে হয় টেন্ট পেতে, তখন দরকার হবে। অর্জুন জানতে চাইল, রাঁধবে কে?
কেন? আমি কি মরে গেছি? বছর তিনেক আগে উত্তরমেরুর একটা ইলুতে বসে সিল দ্য মাঞ্চুরিয়ান রান্না করেছিলাম। ওঃ, তোমাকে কী বলব অর্জুন, তাই খেতে এত এস্কিমো জড়ো হয়েছিল যে, ইগলুতে বসে ঘামতে হয়েছিল আমাকে। মনে হয়েছিল ফ্যান থাকলে ভাল হত। মেজর স্বর্গীয় হাসি হাসলেন, যেটা তাঁর গোঁফদাড়ির জঙ্গল ছাপিয়েও দেখা গেল।
ঘামতে হয়েছিল কেন? বেশি ঝাল দিয়ে ফেলেছিলেন?
দুর। একটা বড় ইগলুতে কুড়িজন কোনওমতে আঁটতে পারে, সেখানে একশোজন ঢুকে পড়লে শরীরের গরমেই ভেতরটা তেতে উঠবে। ঘাম তো হবেই।
কিন্তু ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে সিল মাছ তো পাবেন না?
উঃ, জঙ্গলে গিয়ে আমি তোমাকে রাইস দ্য হেন খাওয়াব।
অর্জুন আর কথা বাড়াল না। যত জিনিস যাবে তা একটা গাড়িতে আঁটবে না। বড় সুমো গাড়ির ছাদে চড়ালে একরকম ম্যানেজ হতে পারে। ওঁরা অর্জুনকে দায়িত্ব দিলেন তার ব্যবস্থা করতে। তা ছাড়া জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে হলেও এস. পি. সাহেবের বিশেষ অনুমতি নিতে হবে।
মেজর এবং গোরান আজ কৌটোর খাবার খাবেন। অতএব অর্জুন বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া শেষ করল। বাইরে যাওয়ার কথা বললে আগে মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে যেত। এখন শুধু বলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
কদমতলার মোড়ে একটা সুমো গাড়ি পাওয়া গেল। ওখানেই প্রাইভেট ট্যাক্সিগুলো খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে। সুমো গাড়ির ড্রাইভারের নাম বটা। টাকাপয়সার কথা হয়ে যাওয়ার পর বটা বলল, দাদা, আপনাকে আমি চিনি। আপনি তো জলপাইগুড়ির গর্ব। আমাকে একটা ব্যাপারে মাপ করতে হবে। সন্ধের পর যদি গাড়ি না চালাই তখন আমার খোঁজ করবেন না।
কেন?
এই এমনি।
অর্জুন বুঝল লোকটা তখন নেশা করবে। সে বলল, যদি তোমাকে রাতের জন্যে একেবারে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় তা হলে যা ইচ্ছে করো, নইলে নয়। কথা হল, বটা ভোর ছটায় তার গাড়ি নিয়ে অর্জুনের বাড়িতে চলে আসবে। আর সুমোর ওপরে একটা ক্যারিয়ার লাগিয়ে নেবে আজই।
বিকেলে থানায় এল অর্জুন। অবনীবাবুর চেয়ারে যে ভদ্রলোক বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে এখনও আলাপ হয়নি ওর। এস. পি সাহেব নতুন এসেছেন। অবনীবাবুর উলটোদিকে বসে ছিলেন। অর্জুনকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন। সার ইনি অর্জুন, এঁর কথা আপনাকে বলছিলাম।
এস.পি. সাহেবও উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে বললেন, অনেক, অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য ছাড়া এত বড় ক্রিমিনালদের ধরা একটু কঠিন হত।
অর্জুন বলল, আমার মনে হয় এরা বড় ক্রিমিনাল নয়। কিন্তু কাজটা যে ঠিক করেনি এতে সন্দেহ নেই। যা হোক, আমি আপনার কাছে যাচ্ছিলাম, এখানে দেখা পেয়ে ভাল হল।
বলুন।
আমরা আগামীকাল হাসিমারার দিকে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে একজন বাঙালি এবং একজন ইংরেজভাষী আমেরিকান আছেন। ওঁরা ওদিকের জঙ্গলে কয়েকদিন থাকতে চান। এ ব্যাপারে কোনও অসুবিধে হলে যাতে লোকাল থানা সাহায্য করে তাই অনুরোধ করছি। অর্জুন বলল।
নিশ্চয়ই। আমি জানিয়ে দেব। কিন্তু ফরেস্টে থাকতে হলে আপনাকে ডিএফওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ও। নিশ্চয়ই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব।
অবনীবাবু বললেন, আজ ওদের আমরা কোর্টে তুলেছিলাম। ওদের আত্মীয়রা বেলের জন্যে এসেছিল, একমাত্র সন্দীপের জন্যে কেউ আসেনি। কিন্তু আরও তদন্তের জন্যে কোর্ট ওদের কাউকেই বেল দেয়নি।
অর্জুনের মনে পড়ে গেল, আচ্ছা, গোরক্ষনাথকে কবে লাগবে আপনার?
ও ওই বেড়ালটার ব্যাপার! ওকে লাগবে কেস ওঠার সময়। দেরি আছে।
গোরক্ষনাথ আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে।
সে কী? ওখানে ভূতপ্রেতের ব্যাপার আছে নাকি?
তার চেয়ে একটু ভয়ঙ্কর। ড্রাকুলা। অর্জুন হেসে বেরিয়ে এল।
ঠিক সকাল ছটায় বটা গাড়ি নিয়ে এল। অর্জুন তৈরি ছিল। গতকাল সন্ধেবেলায় সে ডিএফও সাহেবের সঙ্গে দেখা করে লিখিত অনুমতি নিয়ে এসেছে। তিনি তাঁর দফতরকে জানিয়ে দেবেন বলেছেন। মেজর এবং গোরানসাহেবকে তুলে সে চলে এল সুমো নিয়ে অমল সোমের বাড়িতে। কাল বিকেলে মেজর এত বাজার করেছেন যে বটার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। গাড়ির ছাদে মালপত্র তুলে ত্রিপল দিয়ে বেঁধেও যা উদ্বৃত্ত রইল তা পেছনের সিটে রাখতে হল।
সুমো দেখে গোরানসাহেব খুশি। মেজরও। তিনি বললেন, আফ্রিকার জঙ্গলে আমি যে গাড়ি ব্যবহার করতাম সেগুলো হল ব্রিটিশ জিপ। খুব শক্তপোক্ত। পাম্প থেকে গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করে নিয়ে ওরা শহর ছেড়ে যাওয়ার মুখে রাজবাড়ির সামনে দাঁড়াল। সেই ভোরে তিন-তিনটে খাঁচা আর একটা বড় ব্যাগ নিয়ে গোরক্ষনাথ দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন বলল, উঠে আসুন।
খাঁচাগুলো তুলে পেছনের সিটে বসে গোরক্ষনাথ বলল, কাল রাত্রে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাবু। এই তিনটে না থাকলে…!
কেন, কী হয়েছিল? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
তেনাদের কেউ পথ ভুল করে চলে এসেছিলেন। গোরক্ষনাথ বলল।
তিস্তা ব্রিজ ছাড়িয়ে সুমো ডুয়ার্সে ঢুকল। দুপাশে ধানের মাঠ, চওড়া হাইওয়ে, তখনও রোদ কড়া না হওয়ায় বাতাসে ঠাণ্ডা আমেজ, পেছনের খাঁচায় বসে কাকটা কা কা করে উঠল। মেজর দুহাতে কান ঢাকলেন, ওঃ, হাঁড়িচাচাটার মুখ বাঁধা যায় না?
গাড়ি দোমহনি পেরিয়ে বাইপাস ধরল, চারপাশের সবুজের দিকে তাকিয়ে গোরানসাহেব বললেন, বিউটিফুল। অর্জুনের মনে পড়ল, সে যখন আমেরিকায় গিয়ে হাইওয়ে ধরে কোথাও গিয়েছিল তখন দুপাশে একই দৃশ্য দেখেছে, কোথাও দৃশ্যান্তর হয়নি। ফলে একটু বাদেই একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল।
ধুপগুড়ি থেকে বাঁক নিয়ে ওরা রাস্তা সংক্ষেপ করল। ধুপগুড়িতে মেজর ব্রেকফাস্ট করতে চাইলেন। দুটো করে ডিম আর হাতে-গড়া রুটি। এর বেশি অন্য কিছু খেলে নাকি ওঁদের পেট খারাপ হতে পারে। সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে জলের বোতল রয়েছে। এঁরা দুজনেই বাইরের জল খান না। অর্জুন গরম গরম পুরি এবং তরকারি খেল। সঙ্গে জিলিপি। গোরক্ষনাথও তাই। ওদের খাওয়া জুলজুল করে দেখছিলেন মেজর। তারপর বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, এসব আমিও ছেলেবেলায় খেতাম।
এখন অসুবিধে হচ্ছে কেন?
বড়লোকের বাড়ির কুকুরকে দেখেছ? বাছাই করা খাবার ছাড়া খায় না। মাছ বা মাংস কাঁটা বা হাড় বাদ দিয়ে তাদের মুখের সামনে তুলে ধরা হয়। ইনজেকশন, ওষুধ নিয়মিত খাইয়ে তাজা রাখা হয়। গরমের সময় ঠাণ্ডা ঘর, আবার ঠাণ্ডার সময়ে গায়ে কম্বল চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর এইসব করে ওদের স্বাভাবিক প্রতিরোধ শক্তির বারোটা বেজে যায়। রাস্তার কুকুর বা বাড়ির নেড়ি কুকুর যা খেয়ে সহজে হজম করে ফেলে, ওরা তা খেলে মরে যাবে। আমিও তাই হয়ে গেছি বলতে পারো। তেলেভাজা কিছু দেখলেই সন্দেহ করি! মেজর বললেন।
নিজের সঙ্গে একটি নেড়ি কুকুরের তুলনা ভাল লাগার কথা নয়, তবু অর্জুনের মনে হল মেজর তো তাকে আহত করার জন্যে উপমাটা দেননি। এই কথাগুলোর মধ্যে তিনি নিজেকে নিয়েও ঠাট্টা করেছেন। ইচ্ছে করলেই এখন সব কিছু খেতে পারেন না।
ওরা যখন মাদারিহাটে পৌঁছল তখন প্রায় এগারোটা বাজে। ইতিমধ্যে গোরানসাহেব দুবার ম্যাপ দেখেছেন। ড়ুয়ার্সের এই অঞ্চলের বিশদ বিবরণ ছাপা ম্যাপ কী করে আমেরিকায় পাওয়া যায় তা কে জানে! নিজের দেশের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ওরা যত খোঁজখবর রাখে তার এক শতাংশও আমরা নিজেদের দেশ সম্পর্কে রাখি না।
মোড়ের মাথায় এসে গাড়ি থামিয়ে গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাপে বলছে, ডান দিক ধরে কিছুটা গেলেই হলং নামের জঙ্গল পড়বে। রাইট?
অর্জুন মাথা নাড়ল, জঙ্গলটার নাম হলং কিনা জানি না। তবে ওখানে হলং ফরেস্ট বাংলো আছে। আপনি কি ওখানে যেতে চান?
ফরেস্ট বাংলোতে টুরিস্টরা থাকবে, হ্যাঁ, ইয়েস, নাম বলছে জলদাপাড়া।
অর্জুন বলল, হ্যাঁ। খুব বিখ্যাত ফরেস্ট। গণ্ডার দেখা যায়। গোরানসাহেব বললেন, আমরা ওদিকে যাব না। এখানে কোনও হোটেল আছে?
গাড়ি একটু এগোতেই বাজার এলাকা এসে গেল। সেখানে ওরা গাড়ি থেকে নেমে একটা চায়ের দোকানে ঢুকল। গোরক্ষনাথ নামল না। সে তার ব্যাগ থেকে খাবার বের করে পাখি দুটো আর বেড়ালটাকে খাওয়াতে লাগল।
তিন গ্লাস চা নিয়ে বসে দোকানদারের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এখানে কোনও হোটেল নেই। জলদাপাড়ার জঙ্গলের ভেতরে যেমন হলং বাংলো আছে তেমনি জঙ্গলের বাইরে মাদারিহাট টুরিস্ট লজটি এত বড় যে, এখানে আর হোটেল ব্যবসা করার কথা কেউ ভাবেনি। হোটেল আছে হাসিমারায়, ফুন্টশলিঙে।
দুজন ভদ্রলোক চা খাচ্ছিলেন আর ওদের কথাবার্তা শুনছিলেন। তাঁদের একজন উঠে এলেন, আপনারা কোত্থেকে আসছেন?
মেজর জবাব দিলেন, আপাতত জলপাইগুড়ি থেকে আসছি ভাই। ও ওখানে থাকে। ওর নাম অর্জুন। তুমি যেন নিজেকে কী বলো?
অর্জুন বলল, থাক না?
ভদ্রলোক বললেন, অর্জুন! কিছু মনে করবেন না, আপনি কি সেই সত্যসন্ধানী?
মেজর লুফে নিলেন শব্দটা, ইয়েস, ইয়েস! সত্যসন্ধানী!
ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন, আরে ভাই, আপনার গল্প খুব শুনেছি। আপনি তো আমেরিকায় গিয়ে রহস্য উদঘাটন করেছেন। আপনার জন্যে আমরা গর্বিত। তা ছাড়া আপনার গুরু মিস্টার অমল সোমের সঙ্গে আমার একসময় পরিচয় ছিল। খুব ভাল লাগছে।
আপনার পরিচয়টা—? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আমি সামান্য লোক। ব্যবসা করে খাই। আলিপুরদুয়ারে থাকি। তবে এখানে, মাইল কুড়ি দূরে একটি বাড়ি কিনেছি ঝোঁকের মাথায়। একজন ব্রিটিশ বাড়িটা বানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ভদ্রলোক এক চা বাগানের মালিককে সেটা বিক্রি করে দেন। ওঁরা কিছুদিন ব্যবহার করে প্রায় পোড়ো বাড়ির মতো ফেলে রেখেছিলেন। জলের দামে পেয়ে গেলাম বলে নিয়ে নিলাম। আমার নাম লোকনাথ দত্ত।
এই নামের কোনও লোকের কথা অমল সোমের কাছে শুনেছে বলে মনে পড়ল না অর্জুনের। তবে ভদ্রলোক বেশ মিশুকে, এটা বোঝা গেল।
চায়ের দাম দিতে যাচ্ছিল অর্জুন, লোকনাথ বাধা দিলেন। নিজে দাম মিটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এদিকে কেন? বেড়াতে?
একরকম তাই। ওঁরা এসেছেন আমেরিকা থেকে। জঙ্গলে থাকতে চান কিন্তু ফরেস্ট বাংলোতে নয়। অর্জুন জানাল।
তাই নাকি? কিন্তু এদিকের জঙ্গল এখন নিরাপদ নয়।
কেন? মেজর জানতে চাইলেন, ম্যান ইটার আছে নাকি?
জন্তু-জানোয়ার নিশ্চয়ই আছে, তবে তারা মানুষখেকো নয়। প্রায়ই একটা না একটা মানুষের ডেডবডি পাওয়া যাচ্ছে, যার শরীরে রক্ত নেই।
মেজর চট করে গোরানসাহেবের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে খবরটা ইংরেজিতে পরিবেশন করলেন। গোরান কৌতূহলী হয়ে লোকনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, লোকগুলোর শরীরে কোনও দাগ আছে? বিশেষ করে গলার পাশে?
আমি দেখিনি। লোকাল থানার অফিসার বলতে পারবে। যাক গে, আপনারা ইচ্ছে করলে আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। জঙ্গলের গায়ে বাড়ি। মুশকিল হল ওখানে কোনও কাজের লোক থাকতে চায় না। অনেক চেষ্টা করেছি, সবাই থাকতে ভয় পায়।
কেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
পাণ্ডববর্জিত জায়গা তো! অন্তত দশ মাইলের মধ্যে লোকজন নেই। আমার স্ত্রী তো খুব বকাবকি করেছেন ওরকম জায়গায় বাড়ি কিনেছি বলে। তা জঙ্গলে থাকবেন কী করে? তাঁবু আছে? তাঁবুতে থাকলেও নিজের হাতে সব করতে হবে। আমার ওখানে বিছানাপত্র সব পাবেন। কিচেন আছে। গ্যাস রেখে দিয়েছি। দরকার হলে রান্না করে নিতে পারবেন। নইলে গাড়ি পাঠিয়ে খাবার আনিয়ে নেবেন। কদিনের প্রোগ্রাম আপনাদের? লোকনাথ জানতে চাইলেন।
খুব বেশি হলে দিনসাতেক।
তা হলে চলুন। দ্বিতীয় ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছিলেন পাশে। লোকনাথ তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার বন্ধু। প্রদীপ পান্ডে।
ভদ্রলোক নমস্কার করলেন। লোকনাথ বললেন, চলুন আপনারা। ড্রাইভারকে বলুন আমার গাড়িকে ফলো করতে।
সুমোতে উঠে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে মেজর বললেন, এই জিনিসটা আমার জীবনে অনেকবার হয়েছে। চিনি জোগান চিন্তামণি। একবার কালাহারি মরুভূমিতে আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। রাত তখন তিনটে। দিনে বিশ্রাম, রাত্রে চলতে হত। আর ঘণ্টাদেড়েক বাদে সূর্য উঠবে। তখন আর গাড়িতে বসে থাকা যাবে না। কী করা যায়? সঙ্গীরা মতলব বের করল। গাড়ির নীচে বালি সরিয়ে গর্ত করল। বলল, সারাদিন সেখানে শুয়ে থাকবে। মাথার ওপর গাড়ি থাকায় তার ছায়া পাওয়া যাবে। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হল না। তখনও অন্ধকার রয়েছে। একটা টর্চ নিয়ে বাঁ দিক ধরে কিছুটা এগোলাম। যাতে পথ চিনে ফিরে আসতে পারি তার চিহ্ন রেখে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শব্দ কানে এল। একটা ক্যারাভান আসছে। অনেক উট। তাদের সর্দার আমায় দেখে অবাক! ওদের ভাষায় বিপদের কথা জানালাম। ভাগ্য ভাল, ওদের দলে একজন মোটর মেকানিক ছিল। তাকে নিয়ে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম প্রায় আধমাইল পথ হেঁটে। সে এসে দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি চালু করে দিল। এখন কথা হল, আমি যদি আধমাইল না হেঁটে যেতাম তা হলে ওই ক্যারাভান আমাদের চোখের আড়াল দিয়ে বেরিয়ে যেত। ওরাও আমাদের দেখতে পেত না। কাকতালীয় ব্যাপার, কিন্তু আমার জীবনে এটা প্রায়ই হয়।
অর্জুনের মনে হল এই গল্প প্রায় বিশ্বাসযোগ্য। মেজরের অনেক গল্প যেমন মেনে নেওয়া যায় না তেমন এটা নয়। সুমো গাড়ি তখন আবার হাইওয়েতে উঠেছে। দুপাশে এখন জঙ্গল। ঝিঝি ডাকছে। সামনে একটা ব্রিজ পড়বে। তারপর বাঁ দিকে খানিকটা গেলে পার্বতী বরুয়ার বাড়ি, যেখানে তিনি হাতি নিয়ে থাকেন। এসব জায়গা দিয়ে সে অনেকবার গিয়েছে। সুভাষিণী চা বাগানে যখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন, তখন বেশি যাওয়া হত। ভানুদা এখন আর সুভাষিণীতে নেই। তিনি চলে গিয়েছেন বানারহাটের কাছে রেডব্যাঙ্ক বাগানে। অনেকদিন দেখা হয়নি হাসিখুশি মানুষটার সঙ্গে।
রাস্তার পাশে একটা ধাবা। লোকনাথের গাড়িটা দাঁড়িয়ে যেতে বঁটা সুমোকে তার পাশে নিয়ে গেল। লোকনাথ চিকার করে জিজ্ঞেস করলেন, লাঞ্চ করবেন?
মেজর জবাব দিলেন, না। সঙ্গে আছে।
গাড়ি আবার চলল। একটা মেঠো পথ ডান দিকের জঙ্গল ভেদ করে চলে গিয়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ জঙ্গল শেষ হয়ে নদীর শুকনো বুক চোখের সামনে চলে এল। একফোঁটা জল নেই কোথাও। বালি আর নুড়ির ওপর দিয়ে নদীটা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকল ওরা।
গোরানসাহেব বললেন, অদ্ভুত পথ তো! যখন নদী জলে ভরে যায় তখন কী করে যায়?
মেজর বললেন, নিশ্চয়ই অন্য কোনও ঘুরপথ আছে।
এখানকার জঙ্গল বেশ ঘন এবং বুনো। ভেতরে সূর্যের আলো তেমন করে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না। অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছে জঙ্গল থেকে। পথ শেষ হল জঙ্গলের ঠিক বাইরে, যেখান থেকে পাহাড় হাত বাড়াবেই। ড়ুয়ার্সের এই অঞ্চলের পাহাড় বেশি উঁচু নয়। আর তখনই ওরা বাড়িটাকে দেখতে পেল। তারের বাউন্ডারি দেওয়া একতলা বিশাল বাড়ি। লোহার গেট খুলে সোজা বাড়ির সামনে চলে এসে গাড়ি দুটো থামল।
গাড়ি থেকে নামার পর লোকনাথ বললেন, এই বাড়ি এখন আমার। বুঝতেই পারছেন এতদূরে কোনও লোক একা থাকতে চাইবে না। ফলে তালা ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছে। দূরত্বের জন্যেই বোধহয় দরজা-জানলা এখনও চুরি হয়নি। ভেতরটা পরিষ্কার করা আছে। এই নিন চাবি। ঠিক সাতদিনের মাথায় সকাল-সকাল আমি চলে আসব। যদি তার আগে চলে যেতে চান তা হলে মাদারিহাটের যে চায়ের দোকানে আমাদের আলাপ হল, তার মালিকের কাছে চাবিটা রেখে যাবেন। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। অনেকটা দূরে যেতে হবে।
ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গীকে নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে লোহার গেট বন্ধ করে গেলেন। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যাওয়ামাত্র চারপাশ অন্যরকম হয়ে গেল। বাউন্ডারির বাইরে জঙ্গলের শুরু। সেখান থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে। সম্ভবত একদল বাঁদর বাঁদরামি করছে। এই দুপুরেও গাছের ছায়া ঢেকে রেখেছে বাড়িটাকে।
অর্জুন তালা খুলল। বিরাট বসার ঘর। ফায়ার প্লেসও রয়েছে। পুরনো দিনের সব আসবাব। পর্দা নেই ভেতরের দরজায়, কিন্তু জানলায় রয়েছে। গোটা চারেক বড় বেডরুম। কিচেনটা বিশাল। দুটো বাথরুম এবং টয়লেট। জেনারেটার আছে। আছে পাম্পও। সেগুলো চালিয়ে ওপরের ট্যাঙ্কে জল তোলার ব্যবস্থা করল অর্জুন।
মেজর বললেন, তোফা ব্যবস্থা।
গোরানসাহেব বললেন, গুড।
জিনিসপত্র নামাতে হবে। ওরা বাড়ির বাইরে এসে দেখল বটা আর গোরক্ষনাথ সেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ গোরানাহেব এগিয়ে গেলেন। বারান্দার পাশে একটা থামের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে কিছু লেখা আছে। অর্জুন আর মেজর গোরানসাহেবের পাশে গিয়ে দেখল, মিস্টার আর্নল্ড স্টিভেনসন। নাইনটিন থার্টি। অর্থাৎ এই বাড়ির বয়স সত্তর বছর। বাড়িটা বানিয়েছিলেন স্টিভেনসন সাহেব। তিনি কবে জন্মেছিলেন বা মারা গিয়েছিলেন, তা জানা যাচ্ছে না।
গোরানসাহেব দু-দুবার নামটা উচ্চারণ করলেন।
জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার পর ঠিক হল ওরা তিনজন তিনটে বেডরুমে থাকবে। গোরক্ষনাথ আর বটা পেছনের দিকের বেডরুমটা ব্যবহার করবে। সেই ঘর দেখে বটা খুব খুশি। দু-দুটো খাটে বিছানা পাতা আছে। শুধু সে অর্জুনের কাছে এসে নিচু গলায় বলল, সব ভাল সার, শুধু ওই শকুন, কাকের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে হবে, এটা ভাল লাগছে না।
ওরা খাঁচায় থাকবে ওদের মতো, তোমার কী! অর্জুন উড়িয়ে দিল। মেজর তাঁর বিখ্যাত পাইপ বের করলেন। এ-যাত্রায় ওঁকে ধূমপান করতে দেখেছে বলে মনে পড়ল না অর্জুনের। তাঁকে জ্বালাতে দেখে গোরানসাহেব বিরক্ত হলেন। ওঁরা বসে ছিলেন ড্রইংরুমে। অর্জুন বলল, এখন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
মেজর বললেন, ব্যবস্থার তো কিছু নেই, করাই আছে।
কীরকম?
দারুন সার্ডিন মাছের কৌটো আছে আর সঙ্গে পাউরুটি।
সে কী! আপনি বলেছিলেন রান্না করবেন? অর্জুন মনে করিয়ে দিল।
সেটা অন্য সময়ে করা যাবে। এখন কৌটো খাও।
অর্জুন রেগে গেল খুব। বলল, সহ্য হবে না জিভে।
মানে? মেজর বললেন, আরে আগে খেয়ে দ্যাখো। ডাক্তাররা সেন্ট পার্সেন্ট হাইজেনিক বলে সার্টিফাই করেছেন।
আপনি বলেছিলেন নেড়ি কুকুর যা খায় তা বড়লোকের কুকুর খেলে মরে যাবে। আবার ঠিক উলটোটাও হয়। বড়লোকের কুকুরকে যে নির্বিষ খাবার দেওয়া হয় তা নেড়ি কুকুরের সামনে ধরলে মুখ ঘুরিয়ে নেবে।
ব্যাপারটা কীরকম হল?
কেন?
মনে হচ্ছে তুমি আমাকে কথাটা ফিরিয়ে দিলে?
অর্জুন হেসে ফেলল, দেখুন, বিদেশে যখন গিয়েছিলাম তখন কেউ আমাকে কন্টিনেন্টাল ফুড খাওয়ালে বার্লির কথা মনে পড়ত। মনে হত আমার পেট খারাপ হয়েছে বলে খাচ্ছি। দেখি, অন্য চেষ্টা করি।
চার নম্বর ঘরটায় গেল অর্জুন। বটা বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বিড়ি টানছে। গোরক্ষনাথ ইতিমধ্যে লাল লুঙ্গি পরে বাবু হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে পড়েছে। তার সামনে তিনটে খাঁচার প্রাণী, তিনটে চুপচাপ রয়েছে। এখন বোধহয় কোনও পুজো। করছে গোরক্ষনাথ। বটা তাকে দেখে লাফিয়ে উঠল।
অর্জুন তাকে বলল, বটা, রাঁধতে পারো?
সেদ্ধ যা খাবেন, করে দিতে পারি।
তা হলে ভাত, আলু আর ডিমসেদ্ধ করে ফেললা চটপট।
সঙ্গে একটু ডাল, আলুভাজা আর কাঁচা মরিচ।
পারবে?
খুউব। কিন্তু কজনের জন্যে?
তিনজনের জন্যে। ওই সাহেবরা কৌটোর খাবার খাবে।
অর্জুন নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। লম্বা দেওয়াল, বড় ছাদ। ছাদে একটু ফাটল ধরেছে। এই ঘরে কোনও আসবাব নেই, এই খাট ছাড়া। তার সুটকেসটাকেও মাটিতে রাখতে হয়েছে। জল পড়ার শব্দ হল। তারপরেই পাম্প বন্ধ হয়ে গেল। বোধহয় বটাই কাজটা করল। ওকে নিয়ে এসে ভাল হয়েছে।
কিন্তু গোরানসাহেব ঠিক কী চাইছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। এখানে বসে থাকলে ড্রাকুলার দেখা উনি পাবেন কী করে? লোকনাথ বললেন এখানে রক্তহীন মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। ওটাকে ড্রাকুলার কাণ্ড বলে মনে করেন নাকি গোরানসাহেব? তবে স্টিভেনসন সাহেবের বাড়িতে ঢোকার পর মনে হচ্ছে এরকম জায়গায় ড্রাকুলাবাবু এলেও আসতে পারেন। সে জানলার দিকে তাকাল। তারের ওপাশে কাঠের পাল্লা। ঘর গরম হচ্ছে। অর্জুন জানলা খুলে দিতেই জঙ্গলটাকে দেখতে পেল। হাওয়া ঢুকছে এখন।
বটা এসে জানাল, খাবার রেডি। অর্জুন উঠে ডাইনিংরুমে গিয়ে দেখল ভাত ডিমসেদ্ধ আলুভাজা আর ডাল তৈরি। সে ড্রইংরুমে ফিরে গিয়ে দেখল মেজর আর গোরানসাহেব কৌটো আর পাঁউরুটি নিয়ে এদিকে আসছিলেন। ওঁরা ডাইনিং টেবিলে সাজানো খাবার দেখে অবাক হলেন। মেজর গম্ভীর মুখে কৌটো খুলে ফেললেন।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ডিমসেদ্ধ ভাত দিয়ে মেখে খাবেন নাকি?
মেজর জবাব দিলেন না। গোরানসাহেব একটা প্লেটে সামান্য ভাত তুলে নিয়ে কৌটোর সার্ডিন মাছ তাতে উপুড় করে দিলেন। তেল দেওয়া মাছটা দিয়ে ভাত মেখে চামচ দিয়ে খেতে লাগলেন।
সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মেজর বললেন, রোমে যখন থাকব তখন রোমানদের মতো ব্যবহার করব। আমাকে দুটি ভাত আর ডিমসেদ্ধ দাও হে।
বাড়ির সামনের লনে যে বৈঞ্চিটা স্থায়ীভাবে রয়েছে তার বয়স প্রায় বাড়িটার মতন হলেও এখনও মজবুত রয়েছে। অর্জুন সেখানে বসে ছিল।
এখন বিকেল। রোদ রয়েছে বাড়ির পেছনে। এদিকটায় ছায়া ঘন হয়েছে। সামনের জঙ্গলে পাখিরা গলা খুলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সেই আদিম দিনে যখন প্রাণ গলা পেয়েছিল সেদিন থেকেই বোধ হয় সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার সময় অজানা আতঙ্কে এমনি চেঁচামেচি শুরু হয়েছিল। দিন মানেই চারপাশ চোখের সামনে, রাত মানে সমস্ত নিরাপত্তা উধাও। জঙ্গলের আর-এক প্রান্তে এই যে নিঝুম অঞ্চলে স্টিভেনসন সাহেব বাড়ি বানিয়েছিলেন, তার সৌন্দর্য সারাদিন ধরে প্রশংসা পাবে কিন্তু রাত্রে তিনি কী করতেন সত্তর বছর আগে?
হ্যালো, মাই বয়। মেজরের গলা পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল অর্জুন। ইতিমধ্যে তিনি পোশাক পালটেছে। এখন তাঁর পরনে বারমুডা এবং গেঞ্জি। এগিয়ে আসতে আসতে বারমুডার পকেট থেকে পাইপ বের করে একটু পঁড়িয়ে তামাক জ্বালালেন। কাছে এসে বললেন, ফ্যান্টাস্টিক। কী জায়গা! আঃ পাখিগুলো চেঁচাচ্ছে কেন?
সন্ধে হয়ে আসছে, তাই। আপনি তরল থেকে ধোঁয়ায় চলে গেলেন?
নো! আজ একাদশী। দিনের বেলায় আমি ড্রিঙ্ক করি না। শুকনো থাকি। আঃ, এরকম জায়গায় সারাটা জীবন চুপচাপ কাটিয়ে দেওয়া যায়! তাই না?
আমি পারতাম না। কথা বলার লোক নেই, খাবার ফুরিয়ে গেলে এনে দেওয়ার কেউ নেই। পাগল হয়ে যেতাম। কিন্তু আপনার সাহেববন্ধু তো কথাই বলছেন না। তার ড্রাকুলা কোন অঞ্চলে থাকে, কীভাবে সেখানে গিয়ে আলাপ করে আসা যাবে, সেটা না জানলে অস্বস্তি হচ্ছে। অর্জুন বলল।
মেজরের দাড়িগোঁফের জঙ্গল থেকে ধোঁয়া বের হল, আমাদের বাল্যকালে একটা বাংলা ছবি দেখেছিলাম। তাতে সংলাপ ছিল, কৌতূহল থাকা ভাল, তবে তার সীমারেখা থাকা উচিত।আহা! দারুণ কথা। তোমার দেখছি একটু ধৈর্য কম। জলপাইগুড়িতে থাকলে তুমি এই সুন্দর জায়গাটাকে দেখতে পেতে না। তাই না?
এই সময় গোরানসাহেবকে দেখা গেল। গেট খুলে ভেতরে আসছেন। তিনি যে কখন বাড়ির বাইরে গিয়েছেন তা অৰ্জুন জানে না। কাছে এসে বললেন, এই জায়গাটা ভাল নয়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসার সময় আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।
অস্বস্তি? কীরকম? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। ওয়েট! হঠাৎ সোজা হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে অর্জুন দেখল একটা বিরাট সাপ ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে লনের দিকে। লম্বায় অন্তত বারো ফুট এবং বেশ মোটা আর কুচকুচে কালো সাপটা এখনও খানিকটা দূরে।
মেজর চাপা গলায় বললেন, কিং কোবরা!
গোরানসাহেবের গলা হিসহিসে শোনাল, নো। ইটস কুইন।
অর্জুন দেখল গোরানসাহেবের মুখের চেহারা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। অমলদার বাড়ির বাগানে সাপটাকে ধরার সময় এইরকম মুখ হয়েছিল। তিনি এক পা এগিয়ে যেতেই মেজর ওঁর হাত ধরে টানলেন, ডোন্ট।
লেট মি গো মেজর।
না। ওটা কী করে, কোথায় যায়, তা আমাদের দেখা উচিত।
বাট, বাট, আই মাস্ট কিল হার। কুইন কোবরার হেড আমার কালেকশানে নেই। লিভ মি প্লিজ। মেজরের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছিলেন গোরানসাহেব। কিন্তু মেজর ওঁকে ছাড়লেন না। সাপটা ওঁদের দিকে এল না। সে যেন বেড়াতে যাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে লনের একপাশ ধরে বাড়িটার পেছনদিকে যেতে লাগল।
শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলেন গোরানসাহেব। তাঁর মুখ-চোখ স্বাভাবিক হয়ে এল। ওরা তিনজনই ধীরে ধীরে সাপটাকে অনুসরণ করতে লাগল। বাড়িটার পেছনদিকের খোলা জমিতে ওরা প্রথম এল। বুনো ঝোপঝাড় ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। লোকনাথ এই বাড়ি আর লনের সংস্কার করেছেন কিন্তু পেছনদিকে বোধ হয় নজর দেননি। হঠাৎ গোরানসাহেব হাত বাড়িয়ে ইশারায় ওদের থামতে বললেন। জমিটার একপাশে কয়েক হাত দূরত্বে উঁচু উঁচু ঢিবির মতো কিছু রয়েছে। সাপটা তার একটার পাশে গিয়ে স্বচ্ছন্দে ভেতরে চলে যেতে লাগল সরসর করে। কিছুক্ষণ বাদে তাকে আর দেখা গেল না। গোরানসাহেব বললেন, ওইখানে ওর বাসা।
কথাগুলো ইংরেজিতে বলায় গোরানসাহেব মাথা নাড়লেন। তারপর এগিয়ে গেলেন। ওরা সন্তর্পণে অনুসরণ করল। কাছে যাওয়ার পর বোঝা গেল যেগুলোকে টিবি বলে মনে হচ্ছিল সেগুলো একসময় সমাধিবেদি ছিল। অর্থাৎ গত সত্তর বছরের কোনও একসময়ে এ বাড়ির তিনটি মানুষ মারা যাওয়ার পর এখানেই তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছিল। যে বেদির তলায় সাপটা ঢুকেছিল তার ওপরের মাটি সরিয়ে সরিয়ে গোরানসাহেব লেখাটা আবিষ্কার করলেন, আর্নল্ড স্টিভেনসন। বর্ন 1870,এক্সপায়ার্ড 3 June 1938.
বাকি দুটো সমাধিবেদিতে হয়তো কিছু লেখা ছিল কিন্তু এখন সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেদির ওপরের অংশের অনেকটাই নেই।
ওরা ফিরে এল। লনে ফিরতেই বটাকে দেখা গেল একটা ট্রের ওপর চায়ের কাপ নিয়ে আসতে। গোরানসাহেব কাপ তুলে থ্যাঙ্কস বললেন। মেজর বললেন, না হে, এ সময় চা খেলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। অর্জুন কাপ তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, গোরক্ষনাথ কোথায়?
বটা বলল, আসন পেতে বসে ধ্যান করছে।
ওকে একটু এখানে আসতে বলতো?
বটা চলে গেলে গোরানসাহেব বললেন, এই স্টিভেনসন লোকটা তা হলে এখানেই মারা গিয়েছিল। ও তখন এখানে পাকাপাকি থাকত, না আসা-যাওয়া করত, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বাকি দুজন কারা?
মেজর বললেন, ওঁর আত্মীয়স্বজন।
তা হলে তারা ওর আগে মারা গিয়েছিল। ওই সমাধিবেদি দুটো একটু বেশি পুরনো বলে মনে হল। কিন্তু স্টিভেনসন লোকটার শরীর বিশাল ছিল।
মেজর বললেন, তা তো বটেই। নইলে এখানে অত বছর আগে থাকার হিম্মত হত না। সাহসী মানুষ। কিন্তু কী করে বোঝা গেল শরীর বিশাল ছিল?
সমাধিবেদির আয়তন দেখে। আর ওই বড় সাপটা সেই কারণে ওটাকেই নিজের জায়গা বলে বেছে নিয়েছে। গোরানসাহেব কথা শেষ করতেই গোরক্ষনাথ এগিয়ে এল, আদেশ করুন বাবু।
ওইভাবে কথা বলায় একটু অবাক হল অর্জুন। কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে সে জিজ্ঞেস করল, এখানে আপনার কেমন লাগছে গোরক্ষনাথ?
সারাদিন ধরে বড়গুরুকে ডেকে গেলাম। নিজের কথা ভাবিনি।
বড়গুরু?
আমার গুরুর গুরু। ত্রিকাল দেখতে পেতেন।
তোমার সঙ্গী তিনটে কী করছে?
ওরা ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ ওরদিকে নাক তুলে কিছু শোঁকার চেষ্টা করল গোরক্ষনাথ, এই জায়গাটা ভাল নয় বাবু। কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছি।
কীসের? কই, আমরা তো পাচ্ছি না!
নাক টানতে টানতে যেন গন্ধের পিছু নিয়ে গোরক্ষনাথকে এগোতে দেখে অর্জুন তার সঙ্গী হল। গোরক্ষনাথ বাড়িটার পাশ দিয়ে পেছনের জমিতে চলে এসে মাথা নাড়ল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হল?
কেমন আঁশটে, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। এখান থেকেই গন্ধটা উঠছে।
অর্জুন অবাক হয়ে গেল। এই লোকটির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই তার মনে হয়েছিল, আসলে সরল মানুষ, কিন্তু কিছু অন্ধ বিশ্বাস সম্বল করে নির্বোধ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রোজগার করে। কিন্তু এখন ও হেঁটে এল সাপটা যে পথে এসেছিল সেই জায়গা দিয়ে। তা হলে ও কি সাপের গন্ধ পেয়েছে? প্রশ্নটা করল অর্জুন।
সাপ? কী জানি? এর আগে অনেক সাপ দেখেছি কিন্তু তাদের গায়ের গন্ধ তো পাইনি বাবু। কী সাপ? আপনি দেখেছেন?
খুব বড় কোবরা। কুচকুচে কালো।
তা হলে বাস্তুসাপ। তা তেনারা তো একা থাকেন না। জোড়া আছে।
তাদের শরীর থেকে গন্ধ বের হয়
একথা কখনও শুনিনি বাবু! অ তিনি কোথায় গেলেন?
ওই সমাধিবেদির নীচে গর্ত আছে, সেখানে ঢুকেছে।
গোরক্ষনাথ এক পা এগিয়ে গেল, আই বাপ, এ তো কবর। বাস্তুসাপ তো কবরের ভেতরে কখনও টুকবে না। না বাবু, এই জায়গাটা আমার ভাল লাগছে না।
কিন্তু কেন ভাল লাগছে না। সাপের ভয় পাচ্ছ?
গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকলি, বিষধর সাপকে কে না ভয় পায় বাবু। তবে এই জায়গাটা ভাল নয়। এখানে আসার কিছুক্ষণ পর থেকে কাকটা একবারও ডাকেনি।
অর্জুন হেসে বলল, চলো,এদিকটায় না থাকাই ভাল, অন্ধকার হয়ে আসছে।
এখানে সন্ধে বলে কোনও সময়কে চিহ্নিত করা গেল না। দিন শেষ হলেই ঝুপ করে রাত নেমে গেল। এমন নিকষ কালো রাত অর্জুন কখনও দেখেনি। বটা জেনারেটার চালু করায় ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। তার ফলে আর-এক বিপদ। জঙ্গলের যাবতীয় পতঙ্গ ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ছে বাড়িটার ওপর। মেজরের খুব ইচ্ছে ছিল বারান্দায় বসে জঙ্গুলে অন্ধকার উপভোগ করার। কিন্তু পোকার হাত থেকে বাঁচতে ভেতরে এসে সব জানলা-দরজা বন্ধ করতে হল। এখন জানলার শার্সিতে শব্দ হচ্ছে। মাঝে-মাঝেই বড় বড় পোকা আছড়ে পড়ছে সেখানে। আলোর কাছে আসতে চায়। গোরানসাহেবের নির্দেশে শুধু রান্নাঘর ছাড়া সব আলো নিভিয়ে দেওয়ার পর শব্দটা কমে গেল। তিনি তার ঝোলা থেকে ব্যাটারিচালিত একটা বাব বের করলেন, যার মৃদু আলোয় ঘর পরিষ্কার দেখাবে। অর্জুন উঠে রান্নাঘরে চলে এল। সেখানে এখন গোরক্ষনাথ আর বঁটা পাশাপাশি দাড়িয়ে রান্নার আয়োজনে লেগেছে। তাকে দেখে বটা বলল, আপনারা কখন খাবেন? আটটার মধ্যে খেয়ে নেওয়াই ভাল।
কেন?
তা হলে আমরা ছুটি পাই। বঁটা হাসল।
আটটা বাজতে অনেক দেরি আছে। অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর এগিয়ে গিয়ে গোরক্ষনাথদের ঘরে উঁকি মারতেই অন্ধকারে লাল দুটো চোখ দেখতে পেল। চোখ দুটো জ্বলছে। সে আলো জ্বালতেই বেড়ালটা মুখ ফিরিয়ে নিল খাঁচায় বসে। শকুনটা বিরক্ত হয়ে বিশ্রী শব্দ করল, শুধু কাকটা চুপচাপ রইল। আলো নিভিয়ে দিয়ে অর্জুন বাইরের ঘরে এসে দেখল মেজর মদ্যপান শুরু করেছেন। বেশ ঘূর্তি এসে গিয়েছে ওঁর হাবভাবে। অর্জুনকে দেখে বললেন, এইরকম পরিবেশে দু-তিনটে গান হলে মন্দ হয় না। তুমি গান জানো?
না। অর্জুন মাথা নাড়ল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন না?
কী বলছ? গান শুনিয়েই তো ক্যানিবলদের হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছিলাম। মেজর উঠে দাঁড়িয়ে মদের বোতলটাকে গিটার বানিয়ে পা ছুড়তে লাগলেন, একটা বিরাট কাঁকড়া, তার বিশাল দুটো দাড়া, সে দিনের বেলায় ঘুমোয়, রাতে এক পায়ে খাড়া। ও হো, হো হো।
গোরানসাহেব একটা বড় কাগজের ওপর চোখ রেখে মগ্ন ছিলেন। এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, ওঃ মেজর। প্লিজ।
ভাল লাগল না? রেসিকদের ভাল লাগবে কেন? মেজর বসে পড়লেন।
গোরানসাহেব বললেন, আমার অনুমান যদি ভুল না হয় আমরা প্রায় কাছাকাছি জায়গায় চলে এসেছি। ও নিশ্চয়ই কাছাকাছি দশ বারো মাইলের মধ্যে রয়েছে।
মাই গড! ড্রাকুলা এত কাছে?
ইয়েস। অতএব আমাদের এখন থেকে সতর্ক হতে হবে। আজ রাত্রে চাঁদ উঠবে ঠিক দুটোয়। তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়া সবাই। আমি তোমাদের দুটোর সময় ডেকে দেব। তারপর আমরা বেরোব।
বেরোব মানে? মেজরের গলার স্বর বদলে গেল।
যার জন্যে এসেছি সে তো যেচে এখানে এসে দেখা করে যাবে না! তাকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। গোরানসাহেব বললেন, এখানে ভোর হয় পাঁচটায়। আমরা যদি আড়াইটের সময় বের হই তা হলে মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময় হাতে থাকবে। রোজ একটা করে দিক আমরা খুঁজব। ঠিক আছে?
মেজর বলল, গোরক্ষনাথ আর ড্রাইভারও নিশ্চয়ই সঙ্গে যাবে।
অর্জুন বলল, ড্রাইভার কেন যাবে? ও তো ওই কাজের জন্যে আসেনি। এখানে এসে রান্না করে দিচ্ছে, খাবার সার্ভ করছে, এই তো অনেক, ও এসেছে গাড়ি চালাতে। তা ছাড়া মনে হয় ওই সময় ও কোথাও যাওয়ার অবস্থায় থাকবে না।
কেন? খুব ঘুমোয় বুঝি? মেজর তাকালেন।
না। আমরা ডিনার করে নিলে ও একটু নেশা করবে।
নেশা? মাই গড। আমি মদ খাই কিন্তু কখনও নেশা করি না। এটা খুব খারাপ কথা শোনালে হে! ওইটুকুনি ছেলে নেশা করে নিজেকে শেষ করে ফেলবে? মেজর আফসোস করার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে যাচ্ছিলেন।
অর্জুন গোরানসাহেবকে জিজ্ঞেস করল, আপনি য়ে খুঁজতে যাবেন বললেন, কিন্তু কীভাবে খুঁজবেন? চারপাশে জঙ্গল, শুধু পাহাড়ের দিকটা খোলা। আমি শুনেছি ড্রাকুলা সারাদিন ঘুমোয়, অন্ধকার নামলেই বেরিয়ে পড়ে। তখন তাকে খুঁজে পাবেন কী করে?
সে যদি এখানে থাকে তা হলে আমাদের কষ্ট করতে হবে না, দেখতে পেলে সে নিজেই দেখা দেবে। কিন্তু আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
কারণ?
আমরা সেইভাবে তৈরি হয়ে বেরোব না।
অর্জুন হাসল। তার খুব মজা লাগছিল। কিন্তু সেটা গোপন করে সে জিজ্ঞেস করল, মিস্টার গোরান, আপনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন ড্রাকুলা বলে কিছু আছে?
গোরানসাহেব উঠে দাঁড়ালেন, তুমি যদি ভগবানে বিশ্বাস করো তা হলে তোমাকে শয়তানের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে।
দরজায় শব্দ হতেই ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। বাইরে গোরানসাহেবের গলা, তৈরি হতে বলছেন। বিছানা থেকে নামতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না কিন্তু নামতে হল। ঘরে অন্ধকার কিন্তু বাইরের পৃথিবীটা ততটা নয়। কাচের জানলায় চলে এল অর্জুন। পাতলা, খুব পাতলা সরের মতো জ্যোৎস্না নেতিয়ে আছে লনে, জঙ্গলে। অর্থাৎ গোরানসাহেবের হিসেবমতো চাঁদ উঠেছে। কীরকম গা ছমছম করে উঠল অর্জুনের।
তৈরি হয়ে বসার ঘরে আসতেই গোরক্ষনাথকে দেখতে পেল সে। তিন-তিনটে খাঁচা একটা লম্বা লাঠিতে বাঁধছে সে। মেজর ঢুকলেন একেবারে অভিযাত্রীর পোশাক পরে, গুড মর্নিং এভরিবডি। কপালে কী আছে জানি না। ওহে গোরখনাথ।
গোরক্ষনাথ। অর্জুন সংশোধন করে দিল।
আই সি। গোরক্ষনাথ, আমরা বুঝবার আগে তোমার এই প্রাণিগুলো নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে তেমন কেউ সামনে আছেন কিনা?
গোরক্ষনাথ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ সাহেব। তেনাদের কেউ রাত্রে এখানে এসেছিলেন। জিনেই সেটা টের পেয়েছিল।
ড্রাকুলা এই বাংলোয় এসেছিল? মেজর অবাক!
নাম তো জানি না। তবে তিনি আমাদের কোনও ক্ষতি করতে চাননি। এরা আছে বুঝে বাইরে থেকেই চলে গেছেন। গোরক্ষনাথ বাঁধা শেষ করে হাতজোড় করে চোখ বন্ধ করে কোনও মন্ত্র নিঃশব্দে বলে যেতে থাকল। তার ঠোঁট নড়ছিল।
গোরানসাহেব এলেন তৈরি হয়ে। তাঁর হাতে চারটে ক্রশ। সেগুলো চেনে আটকানো। নিজের হাতে প্রত্যেকের গলায় সেই চেন পরিয়ে দিয়ে বললেন, ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করবেন। এখন, চলো বেরিয়ে পড়ি।
মেজর বললেন, ওই ড্রাইভারটি একা পড়ে থাকবে এখানে? ওকে ডাকা যাক, যদি সঙ্গে যেতে চায় চলুক, নইলে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিক।
গোরক্ষনাথ বলল, তার নেশা এখন ভাঙবে না সাহেব। নেশাগ্রস্ত মানুষকে তেনারা কখনওই দর্শন দেন না। খুব অপছন্দ করেন তেনারা।
ওরা বারান্দায় বেরিয়ে এল। গোরক্ষনাথ লাঠিটাকে কাঁধে তুলে নেওয়ায় খাঁচাগুলো তাতে ঝুলছিল কাকটা নড়াচড়ায় বিরক্ত হয়ে দুবার ডাকল। এখন চারদিক ঝাপসা কিন্তু সামনের পথটা দেখা যাচ্ছে।
গোরানসাহেব বললেন, আজ আমরা জঙ্গলের দিকে না গিয়ে পাহাড়ের দিকে যাব। ওদিকটায় হাঁটতে সুবিধে হবে। তিনি টর্চ জ্বালতেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রথমে গোরানসাহেব, তারপরে মেজর, অর্জুন এবং সবশেষে গোরক্ষনাথ হেঁটে চলেছিল। বড় রাস্তা ছেড়ে খোলা মাঠে চলে এল ওরা। মাঠ, কিন্তু মাঝে-মাঝেই বুনো ঝোপ রয়েছে। হঠাৎ একটা রাতের পাখি চিৎকার করে উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। অর্জুন পেছন ফিরে দেখল বাংলোটাকে আর দেখা যাচ্ছে। না।
মেজর বললেন, আমরা বোধ হয় ভুল করছি। এখানে কোনও পোড়োবাড়ি নেই যেখানে তিনি থাকতে পারেন। খোলা মাঠে দিনের বেলায় তিনি ঘুমিয়ে থাকবেন কী করে? ওই পাহাড়টায় যদি তাঁর বাসস্থান হয় তা হলে অতদূরে আমরা ভোর হওয়ার আগে পৌঁছতে পারব না।
এই সময় শকুনটা ডানা ঝাপটাতে লাগল আচমকা। বেড়ালটার লেজ ফুলে উঠল আর কাকটা তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। গোরক্ষনাথ বলল, তিনি এসেছেন!
চাপা গলায় বাক্যটি অনুবাদ করলেন মেজর, যাতে গোরানসাহেব বুঝতে পারেন। তিনটে খাঁচা তিনপাশে রেখে মাঝখানে দাঁড়িয়ে গোরক্ষনাথ মুখে অদ্ভুত আওয়াজ তুলছে। হেই হেই হেই। প্রতিটি শব্দ বলার সময় শরীর এক-একদিকে বাঁকিয়ে ঝাঁকাচ্ছিল। অনেকটাই নাচের ভঙ্গি। অর্জুন অবাক হয়ে দেখল তিনটে প্রাণীর চেহারা বদলে গেছে। বেড়ালটা পিঠ উঁচু করে প্রায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ করছে। শকুনটা দুই ডানা খাঁচার মধ্যে যতটা সম্ভব ছড়াতে পারে ছড়িয়ে বের হওয়ার জন্যে ছটফট করছে। আর কানা কাকটা প্রবল আক্রোশে জালের তার ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরে ভেঁড়ার চেষ্টা করে চলেছে।
কিন্তু সামনে কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ গৌরীনসাহেব এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। মেজর তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে গোরানসাহেব চিৎকার করলেন, আই নো ইউ আর হিয়ার। আর্নল্ড, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
রাতের আকাশ সেই চিৎকার দ্রুত লুফে নিল, ফিরিয়ে দিল না।
আর্নল্ড? আর্নল্ড স্টিভেনসন? যিনি ওই বাংলোর পেছনের কবরের মধ্যে শুয়ে রয়েছেন সেই উনিশশো আটত্রিশ সাল থেকে? এই বাষট্টি বছরেও তাঁর আত্মার কোনও হিল্লে হয়নি? হঠাৎ অর্জুনের চোখে পড়ল, গোরানসাহেবের ঠিক পেছনে, মাত্র হাত তিনেক তফাতে কিছু একটা ঘাসের ওপর দিয়ে সরসর করে চলে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে গেরািনসাহেবকে ডাকতেই তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। আর তখনই ওপাশের গাছের ডাল থেকে প্রচণ্ড বেগে নেমে এল রাতের পাখিটা। তার চেহারা ভাল করে বোঝার আগেই সেটা ছোঁ মেরে তুলে নিল দুফুট লম্বা সাপটাকে, নিয়ে আবার গাছের ডালে ফিরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে গেল খাঁচার প্রাণিগুলো। একেবারে শান্ত এবং অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বেশ ক্লান্ত। অর্জুন বুঝল, ওই সাপটা এই খাঁচাগুলোর কাছাকাছি চলে আসায় এরা এমন আতঙ্কিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।
মেজর খেকিয়ে উঠলেন, তিনি এসেছেন। কী যে বলো তার ঠিক নেই। একটা সাপকে দেখে তোমার বন্ধুরা এমন কাজ করল। ওদের চেয়ে ওই প্যাঁচাটা অনেক সাহসী।
গোরক্ষনাথ মাথা নাড়ল, না সাহেব। আমি ভুল বলিনি। সাপ তো এখানে চারপাশে ঘুরছে। কই তাদের দেখে তো এরা চিৎকার করছে না। ওই দেখুন তিনি নেই। সে গাছের ডালটার দিকে আঙুল তুলল, যেখানে পাখিটা বসে ছিল।
মেজর হাসলেন, তুমি একটা প্যাঁচাকে তিনি বলে চালাতে চাইছ?
গোরক্ষনাথ তীব্র প্রতিবাদে মাথা নাড়ল, না সাহেব, আপনি যদি প্যাঁচা দেখে থাকেন তা হলে তিনি ওই রূপ ধরে এসেছিলেন।
গোরানসাহেব কথাবার্তার বিষয় জানতে চাইলে মেজর সেটা ইংরেজিতে শুনিয়ে দিলেন। গোরানসাহেব একটু ভেবে বললেন, এই লোকটি যা বলছে সেটা সত্যি কিনা তার প্রমাণ সহজেই পাওয়া যেতে পারে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কীভাবে?
প্যাঁচা শিকার ধরেছে তার খাদ্য হিসেবে। সে কিছুতেই সাপটাকে ছাড়বে না। চলো, ওই গাছটার নীচে গিয়ে দেখি সাপটা ওখানে পড়ে আছে কিনা। গোরানসাহেব টর্চ জ্বাললেন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে ওটি যদি তিনি হন তা হলে সাপটাকে ছেড়ে দেবেন, কারণ ওঁর খাবারের দরকার নেই। সেক্ষেত্রে সাপটা গাছের নীচে পড়ে যাওয়ার পর আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে কেন? কখন পালিয়ে গিয়েছে।
গোরানসাহেব কথাটা কানে না তোলায় অর্জুন এবং শেষ পর্যন্ত মেজর ওঁর সঙ্গী হন। গোরক্ষনাথ দাঁড়িয়ে রইল তার খাঁচাগুলো নিয়ে। জঙ্গলের কাছে পৌঁছতে বেশ কিছু বুনো ঝোপ সরাতে হল। গোরানসাহেব মুখে শব্দ করছিলেন এগোবার সময়, যাতে সাপটাপ থাকলে সরে যায়। শেষ পর্যন্ত গ্রাছটার নীচে পৌঁছে গেল ওরা। টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মরা পাতার ওপর সেটাকে স্থির করে রাখলেন গোরানসাহেব। দুফুট লম্বা সাপটা সেখানে প্রায় গোল হয়ে পড়ে আছে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে গোরানসাহেব বাঁ হাতে সাপের লেজ ধরে ওপরে তুলে ডান হাতে ওর শরীরে আলো ফেলে কয়েক সেকেন্ড দেখে চিৎকার করে বললেন, মেজর, এই সাপটার শরীরে একফোঁটাও রক্ত নেই।
সাপটাকে সামনে নিয়ে এলেন গোরানসাহেব। ওর গলার ঠিক নীচটা আধখানা হয়ে ঝুলছে। সাপটাকে জঙ্গলে ছুড়ে ফেললেন তিনি।
মেজর ফিরে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন, এই শ্রেণীর সাপের মাথা বোধ হয় তোমার সংগ্রহে আছে, তাই না?
না। নেই। এবং এটাকে আমার সংগ্রহে রাখার কোনও বাসনা নেই।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে গোরানসাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন, অর্জুন, আমি নিশ্চিত যে, ঠিক জায়গায় পৌঁছেছি।
খোলা আকাশে তখন চাঁদ সরে গেছে অনেকটা। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কীরকম?
ব্যাখ্যা করতে হলে আমাকে আর একটা কি দুটো দিন অপেক্ষা করতে হবে।
অর্জুন বলল, আপনার ধারণাকে আমি আঘাত করতে চাই না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে।
কেন? গোরানসাহেব তাকালেন।
আপনি আমেরিকায় বসে আবিষ্কার করলেন, ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে ড্রাকুলা রয়েছে। কী করে আবিষ্কার করলেন?
তিনটে চিঠি পড়ে। নাইনটিন ফর্টি ওয়ানে জন্ম লিঙ্কন নামে এক টি-প্ল্যান্টার তাঁর লন্ডনের বন্ধুকে চিঠিগুলো লিখেছিলেন। কাল সকালে তোমাকে আমার ডায়েরি দেখাতে পারি, যা দেখলে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে কেন আমি নিশ্চিত যে, ঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি। গোরানসাহেব বললেন।
মেজর বললেন, তা ঠিক আছে। কিন্তু রাতের আঙ্গুলে জায়গায় আর কত এভাবে আমরা তাকে খুঁজে বেড়াবো। আমরা মানুষ, আমাদের দেখলে তো তার নিজেরই চলে আসার কথা। তাই না?
গোরানসাহেবের কানে যেন কথাগুলো ঢুকল না। গোরক্ষনাথের গলা শোনা গেল, বাবু, এখানে তেনাদের কেউ এখন নেই।
অর্জুন এগিয়ে গিয়ে দেখল প্রাণী তিনটে শান্ত হয়ে বসে আছে।
ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। গোরানসাহেব শিক্ষিত, পণ্ডিত মানুষ, তিনি বলেছেন এখানে ড্রাকুলা এসেছিল। গোরক্ষনাথ অশিক্ষিত, সংস্কারাচ্ছন্ন, তার কথায় কান দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই, সে ওই কথা বলতেই পারে। কিন্তু বেড়াল কাক শকুন এমন অদ্ভুত আচরণ করবে কেন? অতদূরে বুকে হাঁটা সাপটাকে কানা কাক দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করবে, এটাও তো ভাবা যায় না।
হঠাৎ হাওয়া বইতে লাগল। ওরা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখল সেটা যেন ঝড়ের চেহারা নিল। ঝড় হচ্ছে অথচ আকাশে একফোঁটাও মেঘ নেই। পাশে এসে দাঁড়িয়ে মেজর বললেন, হচ্ছেটা কী?
সামনের জঙ্গলটা এখন অস্থির। গাছগুলো প্রবলবেগে ডালপালা নেড়ে চলেছে। কয়েক সেকেন্ড এইরকম চলার পর আচমকা প্রকৃতি শান্ত হয়ে গেল। হঠাৎ গোরানসাহেব চিৎকার করলেন, লুক।
অর্জুন দেখল একঝাঁক বাদুড়জাতীয় প্রাণী গাছগুলো থেকে উড়ে আসছে। ওদের উড়ে আসার ভঙ্গিটা খুব হিংস্র। গোরানসাহেব টর্চের আলো ফেলতে চাইলেন ওদের ওপরে। গোরক্ষনাথ তৎক্ষণাৎ লাঠিসুদ্ধ খাঁচাগুলোকে ওপরে তুলে নিল। নিতেই কাক বেড়াল এমনকী শকুনটাও চিৎকার শুরু করে দিল। নীচের দিকে শোঁ শোঁ করে নেমে আসা বাদুড়গুলো ঢেউয়ের মতো ওপরে উঠে গিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যেতেই গোরক্ষনাথের পোষ্যরা শান্তু হল। মেজর তাকিয়ে ছিলেন পাহাড়ের দিকে, বললেন, চশমাটা পালটাতে হবে। মনে হচ্ছে পাওয়ার বেড়েছে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেন?
বাদুড়গুলো আচমকা ঝাপসা হয়ে গেল, দেখতে পেলাম না।
চাঁদ ড়ুবে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপাশে। হঠাৎ জ্যোৎস্না চলে যাওয়ায় অন্ধকার ঘন। হয়ে গেছে বেশ। গোরানসাহেব বললেন, এবার ফিরে যাওয়া যাক। প্রথমদিনের পক্ষে যথেষ্ট হয়েছে।
মেজর খুব খুশি হলেন। পকেট থেকে একটা নি বের করে খানিকটা তরল পদার্থ গলায় ঢেলে বললেন, ফেরা যাক। এখনই ভোর হবে। তোমরা নিশ্চয়ই বাংলোয় ফিরে গিয়ে বিছানায় উঠে বসবে কিন্তু আমি এই জঙ্গলের ভোরটাকে লনে বসে এনজয় করব। আন্ডারস্ট্যান্ড?
কেউ জবাব দিল না। গোরানসাহেবের টর্চের আলো ওদের পথ দেখাচ্ছিল। একটু একটু করে অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে। এবার বাংলোর পেছনটাকে দেখতে পেল ওরা। ছায়া ছায়া, অস্পষ্ট। হঠাৎ অর্জুন দাঁড়িয়ে গেল। সে কি ঠিক দেখছে? কোনও মানুষের ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু লম্বা গাউন পরা কেউ কি ওখানে দাঁড়িয়ে! সে মেজরের হাত ধরে দাঁড় করালো, দেখুন তো, বাংলোর পেছনে কাউকে চোখে পড়ে কিনা?
মেজর দেখলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, না। অবশ্য আমার এই চশমাটাকে পালটাতে হবে। তবু বলছি, না। ওখানে এখন কে যেতে পারে? আমাদের ড্রাইভারটা? ব্যাটার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ওখানে যাবে কেন? সাপের খবরটা কি জানে না বুন্ধুটা?
গোরানসাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন, কী হয়েছে?
মেজর আবার হাঁটা শুরু করে তাঁর কাছে পৌঁছে অর্জুনের কল্পনার কথা বললেন। গোরানসাহেব অর্জুনের দিকে তাকালেন, তুমি কি কোনও লম্বা ফিগার দেখেছ, যার পোশাক কালো? একটু বেঁকে দাঁড়ানো?
অর্জুন বলল, হ্যাঁ, যদিও আমি ঠিক নিশ্চিত নই!
আমিও দেখেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম ওটা একটা সরু গাছ। প্রচুর পাতা থাকায় এতদূর থেকে কালো পোশাক পরা মানুষের মূর্তি বলে মনে হচ্ছে। চলো।
বাংলোয় পৌঁছবার আগেই ভোর হয়ে গেল। রোদ ওঠেনি, সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি কিন্তু তিনি আসছেন জানিয়ে চমৎকার এক আলোয় পৃথিবী আলোকিত হল। এখন অন্ধকার যা আছে তা গাছের পাতার আড়ালে।
বারান্দায় উঠে এসে দেখা গেল বসার ঘরের দরজাটা খোলা। মেজর বললেন, সর্বনাশা দরজা খোলা কেন? কেউ কি ঢুকেছিল?
অর্জুন হেসে বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা চোর এতদূরে জঙ্গলের মধ্যে চুরি করতে অন্তত রাত্রে আসবে না। হাওয়ায় খুলে গেছে। তখন ঝড় উঠেছিল।
মেজর বললেন, আমি চোরের কথা বলছি না। যার সন্ধানে আমরা এখানে এসেছি তিনি যদি ঘুমন্ত ড্রাইভারকে একা পেয়ে চলে আসেন?
অর্জুন বসার ঘরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে এখনও আলো ঢোকেনি। সে দ্রুত চলে গেল চার নম্বর ঘরের দরজায়। দেখল বটা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। ওর শোয়ার ভঙ্গি দেখে ঘাবড়ে গেল অর্জুন। ধীরে ধীরে বিছানার পাশে এসে সে ডাকল, বটা, বটা!
বটা কোনও সাড়া দিল না।
ইতিমধ্যে গোরক্ষনাথ এবং মেজর এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। মেজর চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ডেড?
অর্জুন জবাব দিল না। মেজর বললেন, গলার পাশে দাঁতের দাগ আছে কিনা ভাল করে দ্যাখো তো?
কিন্তু সেটা দেখার আগেই গোরক্ষনাথ বটার পায়ের আঙুল ধরে ঝাঁকুনি দিল। বটাবাবু! ও বটাবাবু?
সঙ্গে-সঙ্গে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বটা। প্রথমে বুঝতে না পারলেও খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, আপনারা ফিরে এসেছেন? যাক বাবা। খুব চিন্তা হচ্ছিল আপনাদের নিয়ে। কারও কোনও বিপদ হয়নি তো?
হঠাৎ হো হো করে হাসতে লাগলেন মেজর, দুহাতে ভুড়ি চেপে। হাসতে হাসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বটা অবাক হল, কী ব্যাপার বাবু?
কিছু না। চা খাওয়াতে পারো? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে করে দিচ্ছি। বটা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল।
বাইরের বারান্দায় তখন মেজর গোরানসাহেবকে প্রবলবেগে হাত নেড়ে বোঝাচ্ছিলেন এই তল্লাটে দু-এক পিস ভূত থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু ড্রাকুলা নেই। তাঁর বক্তব্য, ড্রাকুলা থাকলে বটার ঘুম এ জীবনে ভাঙবে না। এতবড় খালি বাংলোয় ঘুমন্ত বটাকে পেয়েও যখন ড্রাকুলা তার রক্ত খেতে আসেনি তখন প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে তিনি এই অঞ্চলে নেই।
অর্জুন এসে কথাগুলো শুনল। গোরানসাহেব কোনও জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। মেজর অর্জুনকে বললেন, একবার মাছ ধরতে গিয়েছিলাম কঙ্গোতে, ওখানে ব্ল্যাক লেক বলে বিশাল হ্রদ আছে। শুনেছিলাম, আমাদের কাতলা মাছের তিন ডবল সাইজের একটা মাছ, যাকে ওরা কুত্তা বলে, ওখানে পাওয়া যায়। ব্ল্যাক লেক লম্বায় মাইল পাঁচেক, চওড়ায় আধ মাইল। তিনদিন ধরে বোট নিয়ে ছিপ ফেলেছি কিন্তু কুত্তার দর্শন পাইনি। ওরা নাকি দল বেঁধে থাকে। পাঁচ মাইল লম্বা লেকের কোথায় তাঁরা থাকতেন জানি না। হাতে তিনদিনের বেশি সময় ছিল না বলে চলে আসতে হয়েছিল। এও দেখছি সেরকম। গোরান শুনেছে ড়ুয়ার্সের এইদিকে ড্রাকুলা আছে। আরে এইদিক বলতে কোনদিক? আমরা এখানে বসে আছি আর ড্রাকুলা হয়তো কোচবিহারে ঘুমোচ্ছে।
গোরানসাহেব ফিরে এসে অর্জুনের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। ওঁর হাতে একটা মোটা ডায়েরি। তার পাতা ওলটাতে-ওলটাতে একটা জায়গায় থেমে মুখ তুললেন, নাইনটিন ফর্টিওয়ানে ছয়মাসের মধ্যে লেখা হয়েছিল চিঠি তিনটে। আমি এখানে কপি করে রেখেছি। চিঠি লিখেছিলেন জন লিঙ্কন। প্রথম চিঠি, ডিয়ার বব, আশা করি ভাল আছ। আমি এখন ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রভিন্সের নর্থে বিনাহাট চাবাগানের ম্যানেজার। সুন্দর বাংলো, প্রচুর কাজের লোক, যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা আমার আছে। ইন্ডিয়া স্বাধীন হতে চাইছে কিন্তু আমার এখানে কোনও গোলমাল নেই। আমি এই চিঠি লিখছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আমার আগে এই বাগানের ম্যানেজার ছিলেন উইলিয়াম রাইট। তাঁকে একদিন একটি জঙ্গলের মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর গলায় দাঁতের চিহ্ন ছিল। সেই চিহ্ন কোনও পশু করেনি। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বলছেন তিনি নাকি জঙ্গলের গভীরে একটি বাংলোয় একা রাত কাটাতে গিয়েছিলেন। ওই বাংলোটি করেছিলেন একজন ব্রিটিশ টি-প্ল্যান্টার, যিনি কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। এই ব্যাপারটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। ভাল থেকো। শুভেচ্ছা নিও।–জন লিঙ্কন।
দ্বিতীয় চিঠি, ডিয়ার বব, তোমার চিঠি পাওয়ার আগেই আবার লিখছি। মিস্টার রবার্টকে কোনও মানুষ খুন করেনি। যে ব্রিটিশ প্ল্যান্টারের বাংলোয় গিয়ে মিস্টার রাইট খুন হন, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ভদ্রলোক বিয়ে করেননি। ওঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে ওঁর দুভাই লন্ডন থেকে এসেছিলেন। ওই বাংলোয় রাত কাটাতে গিয়েছিলেন তাঁরা। পরের দিন দুজনের মৃতদেহ রক্তশূন্য অবস্থায় পাওয়া যায়। তোমার কাছে অনুরোধ, লন্ডনের যেসব সংস্থা পরলোক নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনাগুলো জানাও। তাঁরা কী বলেন তা জানতে আমি খুব আগ্রহী। শুভেচ্ছা নিও।–জন।
তৃতীয় চিঠি, ডিয়ার বব, তোমার চিঠি পেয়েছি। মনে হচ্ছে তুমি আমার দ্বিতীয় চিঠিটি পাওয়ার আগেই এই চিঠি লিখেছ। যাহোক, আমি খুব চিন্তায় আছি। আমার চা-বাগান হাসিমারা নামক মোটামুটি পরিচিত ব্যবসাকেন্দ্রের কাছে। এখানকার চার্চের ফাদার আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন। ওই জঙ্গলের মধ্যে যে বাংলাটা আছে তার ধারেকাছে আমাকে যেতে নিষেধ করেছেন। বাংলোটা আমার বাগান থেকে অন্তত কুড়ি মাইল দূরে জঙ্গলের শেষে। অথচ সন্ধে হলেই মনে হয়, যাই গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসি। গতরাত্রে একটা ঘটনা ঘটল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল কোনও একটা শব্দে। দেখলাম আমার জানলার তারে একটা বাদুড় ঝুলছে। পোকামাকড় যাতে ঘরে না ঢুকতে পারে তাই তার লাগানো ছিল। এতবড় বাদুড় আমি কখনও দেখিনি। সঙ্গে-সঙ্গে বালিশের নীচ থেকে রিভলভার বের করে গুলি করলাম। বাদুড়টা নীচে পড়ে গেল। গুলির শব্দে কাজের লোকজন ছুটে এল। আলো জ্বেলে বাংলোর পাশে জানলার নীচটা খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও বাদুড়টাকে পাওয়া গেল না। অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি ওর পেটে গুলি লেগেছিল। তুমি অবাক হবে শুনে, জানলার তারে একফোঁটাও রক্ত ছিল না। বুঝতেই পারছ, এসব কারণে আমি একটুও ভাল নেই। ছুটির দরখাস্ত করেছি। পেলেই দেশে চলে যাব কিছুদিনের জন্যে। শুভেচ্ছা নিও–জন।
চিঠি পড়া শেষ করে গোরানসাহেব বললেন, এই বাংলোটির কথাই জন লিঙ্কন তাঁর চিঠিতে লিখেছেন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, জন নিশ্চয়ই ফিরে গিয়েছিলেন?
না। ওঁর বন্ধু চিঠিগুলো পরলোকচর্চার একটি সংস্থার কাছে জমা দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর বন্ধু ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
ম্যালেরিয়া?
হ্যাঁ। গোরানসাহেব উঠে দাঁড়ালেন, অর্জুন, চলো, একটু ঘুরে আসি।
লনে পায়চারি করতে করতে গোরানসাহেব আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর চোখ স্থির। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হল?
তুমি প্যাঁচাটাকে উড়ে যেতে দেখলে?
না তো! এখন তো আলো ফুটে গেছে। এসময় প্যাঁচা উড়বে কেন?
গোরানসাহেব দ্রুত বাড়ির পেছনদিকে চলে যেতে অর্জুন অনুসরণ করল। না, কোথাও কোনও প্যাঁচা নেই, কিন্তু স্টিভেনসনের কবরে ঢোকার গর্তটা কেউ সযত্নে বন্ধ করে দিয়েছে।
গোরানসাহেব বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার! একাজটা কে করল?
অর্জুনও অবাক হয়েছিল। বলল, সাপের গর্তের মুখ বন্ধ করতে হলে সাহস থাকা দরকার। এখানে একমাত্র আপনি আর গোরক্ষনাথ সাপ সম্পর্কে সাহসী। কিন্তু আপনারা কেন এই কাজ করতে যাবেন? তা ছাড়া সন্ধের পরে কেউ তো বাংলোর বাইরে আসেনি।
গোরানসাহেব রেগে গেলেন, তুমি কি পাগল? আমি যদি নিজে এই কাজটি করি তা হলে জিজ্ঞেস করব কেন? না কি তুমি আমাকেও সন্দেহভাজনদের লিস্ট থেকে বাদ দিতে চাওনি? প্রশ্নটা করেই দূরে কিছু লক্ষ করে ফিসফিসে গলায় বললেন, সরে এসো অর্জুন, চটপট সরে এসো।
গোরানসাহেব তৃতীয় কবরটির দিকে দৌড়ে যেতে অর্জুন অনুসরণ করল। এবং খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ করতেই সাপটাকে দেখতে পেল। কাল সন্ধেবেলায় যে সাপটাকে তারা দেখেছিল, বোধ হয় সেটাই। খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে স্টিভেনসনের কবরের দিকে। এখন আরও দীর্ঘ দেখাচ্ছে ওর চেহারা। কবরের পাশে এসে সাপটা থমকে দাঁড়াল। মুখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কিছু খুঁজতে লাগল। পাশে কুঁজো হয়ে দাঁড়ানো গোরানসাহেবকে বলতে শুনল অর্জুন, ঢোকার গর্তটা খুঁজছে।
হঠাৎ ফোঁসফোঁস শব্দ প্রবল হল। সাপটা যে খুব রেগে গেছে, বোঝা যাচ্ছিল। আচমকা ফণা তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এত লম্বা, মোটা সাপকে কখনও ফণা তুলতে দ্যাখেনি অর্জুন। মুখ ফাঁক হওয়ায় সরু জিভ মাঝে-মাঝেই বেরিয়ে আসছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানো ওর মাথা অর্জুনের উচ্চতার সমান হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় ও যদি কাউকে আক্রমণ করে তা হলে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব হবে।
হঠাৎ অর্জুন লক্ষ করল গোরানসাহেবের মুখের চেহারা বদলে যাচ্ছে। সাপ দেখলে ওঁর চোখমুখ যেরকম ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, এখন সেই অবস্থা। অর্জুন শক্ত হাতে ওঁর হাত ধরল। সেটা ছাড়াতে চেষ্টা করলেন গোরানসাহেব, আমাকে যেতে দাও। ওকে আমার চাই। আমার সংগ্রহে ওর মাথাটাকে রাখব।
না। চাপা গলায় বলল অর্জুন, আপনি ওকে মারতে পারবেন না।
হঠাৎ সাপটা নিচু হতে লাগল। এবং প্রবল শক্তিতে ওর মুখ দিয়ে নরম মাটির ওপর আঘাত করল। এক-দুই-তিনবার। তারপরেই ওর শরীরটা তরতর করে ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল। তাই দেখে গোরানসাহেব দৌড়লেন, কিন্তু তিনি গর্তটার কাছে পৌঁছনোর আগেই সাপের শরীর অদৃশ্য হয়ে গেল।
হতাশ হয়েও দমলেন না গোরানসাহেব, অতবড় শরীরটা এত দ্রুত ভেতরে ঢুকল কী করে? না অর্জুন, এই কবর খুঁড়তে হবে।
সেটা কি ঠিক হবে?
মানে?
ওখানে আর্নল্ড স্টিভেনসনের শরীরকে সমাধি দেওয়া হয়েছে। কবরটি খুঁড়লে তাঁকে অসম্মান জানানো হবে না? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
এত বছরে তাঁর শরীরটা নিশ্চয়ই মাটিতে মিশে গেছে। তা ছাড়া ওই সাপটা যদি তাঁর শরীরকে আস্তানা করে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই তাঁর আত্মা শান্তি পাচ্ছে না।
তখন কড়া রোদ। অথচ বেলা এগারোটা বাজে। গোরানসাহেব সবাইকে সতর্ক করে দিলেন সাপটার শক্তি সম্পর্কে। গোরক্ষনাথ তার তিনটে প্রাণীকে নিয়ে এল কবরের কাছে। বেচারারা ঘুমোচ্ছিল, ওখানে নিয়ে আসতেই প্রবল প্রতিবাদ শুরু করে দিল। কাক চেঁচাচ্ছে, শকুন পাখা ঝাপটে চলেছে, বেড়ালটা পিঠ উঁচু করে ফ্যাঁসফাঁস আওয়াজ তুলছে। গোরক্ষনাথ চটপট বলে উঠল, এই জায়গাটা মোটেই ভাল নয় বাবু।
কেন? জিজ্ঞেস করল অর্জুন।
এখানে তেনাদের কেউ নিশ্চয়ই আছেন। নইলে এরা এমন কাণ্ড করবে না। মেজর হাসলেন, তুমি অর্ধেক সাকসেসফুল গোরক্ষনাথ। এখানে প্রেতাত্মা আছে কিনা তা জানি না, তবে কবরে এককালে মৃত মানুষকে শোয়ানো হয়েছিল, এটা অন্তত তোমার প্রাণীরা জানিয়ে দিতে পেরেছে।
গোরক্ষনাথ কবরের কাছে খাঁচা নিয়ে গিয়ে শকুনটার দরজা খুলে দিল। দেখা গেল খোঁড়াতে-খোঁড়াতে পাখিটা বেরিয়ে এসে সাপের গর্তের মুখটায় চলে গেল। তারপর প্রবলবেগে গর্তের মুখ নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল। গোরক্ষনাথ ওর পায়ে বাঁধা দড়ি টেনে কোনওমতে ফিরিয়ে আনতে পারল খাঁচায়। তারপর ওদের তিনজনকে রেখে দিয়ে এল দূরে। এবং সেখানে রাখার পর প্রাণী তিনটে একটু একটু করে শান্ত হয়ে গেল।
মেজর এবং গোরানসাহেব যেসব মালপত্র এনেছিলেন। তার ভেতর থেকে একটি শক্ত জাল বের করে আনা হয়েছে। মাটি খোঁড়ার জন্য বেলচা জাতীয় তিনটি স্টিলের যন্ত্র, লম্বা লাঠি আর এক বোতল অ্যাসিড। মেজর চাইছিলেন গর্তের ভেতরে বোতলটা উপুড় করে দিতে। তা হলে সাপটার আর বেঁচে থাকার কোনও সুযোগ থাকবে না। কিন্তু গোরানসাহেবের তাতে প্রবল আপত্তি। তিনি সাপটার মাথা আস্ত চান। অ্যাসিডে পুড়ে গেলে তাঁর কোনও কাজে লাগবে না।
অতএব গর্ত খুঁড়তে হবে এবং তার ফলে সাপটা নিশ্চয়ই আক্রমণ করবে। আর ওর রেগে যাওয়ার যে চেহারা অর্জুন দেখেছে তাতে স্পষ্ট, ওর মোকাবিলা করা। বেশ শক্ত হবে। গোরানসাহেব বললেন, তিনি তৈরি থাকবেন। সাপটা ফণা। তোলামাত্র তিনি তাকে জালবন্দি করবেন।
এই সময় বটা বলল, বাবু একটা কথা বলব?
অর্জুন তাকাল, শুনেছি শনি-মঙ্গলবার বাস্তুসাপ মারতে নেই। ওটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, আর একটা রাত অপেক্ষা করলে হত না?
মেজর বললেন, যদিও ব্যাপারটা কুসংস্কার তবু আমার প্রস্তাবটা খারাপ লাগছে না। ছেলেবেলায় আমার মায়ের মুখে এমন কথা শুনেছি।
গোরানসাহেবকে ইংরেজিতে ব্যাপারটা বললেন মেজর।
গোরানসাহেব কাঁধ ঝাঁকালেন, দুহাজার সালে এসব কথার কোনও মানে আছে?
মেজর বললেন, নেই। তবে লোকাল মানুষের সেন্টিমেন্ট।
অর্জুনের দিকে তাকালেন গোরানসাহেব, তুমি কী বলো?
অর্জুনের চোখের সামনে রাগী সাপটার ফণা-তোলা শরীর ভেসে উঠল। ভয়ঙ্কর অথচ কী সুন্দর! আর একটা দিনরাতের সুযোগে ও যদি এখান থেকে পালিয়ে যায় তা হলে তো সমস্যার সমাধান হয়। এই যে ওরা এখানে জড়ো হয়ে কথাবার্তা বলছে, সাপটা নিশ্চয়ই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। আর সেকারণেই ও ওর এই আশ্রয় ত্যাগ করতে পারে। অর্জুন হেসে বলল, আজ আর কালের মধ্যে তো কোনও পার্থক্য আমি দেখতে পাচ্ছি না।
বেশ। তবে তাই হোক। গোরানসাহেব অবশ্য খুশি না হয়েই বললেন।
দুপুরটা কেটে গেল ঘুমিয়ে। বিকেলে আবার বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে কথাবার্তা। গোরানসাহেব বললেন, আমার বিশ্বাস, আর কোথাও খুঁজে বেড়াবার দরকার নেই। এখানেই সে আছে। আমরা আজকের রাতটা জেগে থাকব।
বটা ইতিমধ্যে বিষয়টা ভোনে গিয়েছে। সে দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিল, বাবু, আমাকেও কি জাগতে হবে?
তার প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি বাংলোর ভেতরে বসে লক্ষ করব, না বাইরে গিয়ে দাঁড়াব?
প্রথমে আমরা ভেতরে থাকব। রাত বাড়লে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। গোরানসাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমি তখন থেকে লক্ষ করে যাচ্ছি, কিন্তু গতকাল যে সাপটাকে ওখান দিয়ে কবরের দিকে যেতে দেখেছি তাকে এখনও চোখে পড়ছে না। এর মানে ওটা ওর রুটিন নয়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আজ যাকে দেখেছি সে কি গতকালেরটা নয়?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না অর্জুন। গোরানসাহেব বললেন।
সন্ধের সময় দেখা গেল আকাশে মেঘ জমছে আর জঙ্গলের গাছপাতা আচমকা স্থির হয়ে গেছে। একটা পাতাও নড়ছে না। মেজর বললেন, সর্বনাশ!
অর্জুন তাকাতে মেজর হিপ পকেট থেকে ছোট চ্যাপটা বস্তুটি বের করে ছিপি খুলে তরল পদার্থ গলায় ঢেলে বললেন, নাইনটিন এইট্টি ওয়ান। প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। ফিজিতে গিয়েছিলাম লাল ঝিনুক দেখতে। আহা, সমুদ্রের নীচে যখন ওরা পাশাপাশি থাকে তখন চোখ জুড়িয়ে যায়! তা একদিন জঙ্গলে ছিলাম। দুপুরবেলা। আচমকা সূর্যের আলো নিভিয়ে দিল বিশাল বিশাল মেঘ। অমনই গাছের পাতাগুলো ওইরকম স্থির হয়ে গেল। তারপরেই টের পেলাম পায়ের তলায় যেন হইচই শুরু হয়ে গেছে। অথচ আমার জুতোর তলায় শুধু মাটি। একটু এগিয়ে দেখলাম তিনটে গর্ত দিয়ে পিলপিল করে বড় বড় পিপড়ে পাগলের মতো বেরিয়ে আসছে। মাটির নীচে ওদের ছুটে চলার কম্পন আমার জুতো ভেদ করে। পায়ে পৌঁছেছিল। আমার সঙ্গী বলল, তাড়াতাড়ি ফিরে চলো। এখনই বৃষ্টি নামবে। আমরা টেন্টে পৌঁছবার এক মিনিট পরে যে বৃষ্টিটা নামল, তা থেমেছিল সাতদিন পরে। সমুদ্রের জল বেড়ে গিয়েছিল, সেই বৃষ্টিতে।
অর্জুন মুখ ফিরিয়ে নিল। তার মুখে হাসি দেখলে মেজর খুশি হবেন না।
বৃষ্টি নামল! তুমুল বৃষ্টি। অথচ সারাদিন মেঘ ছিল না। বৃষ্টি পড়ছে অথচ হাওয়া বইছে না। জেনারেটার চালিয়ে দিয়েছিল বটা। হঠাৎ সেটা শব্দ করে থেমে যেতেই পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল।
মেজর গলা তুলে বললেন, সবাই এক ঘরে এসে বোসো। মোমবাতি কেউ একজন জ্বেলে দাও।
দেওয়া হল। কেমন একটা গা-থমথমে আবহাওয়া হয়ে গেল। গোরানসাহেবকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। তিনি অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এভাবে বৃষ্টি শুরু হলে কি অনেকক্ষণ ধরে চলে?
অর্জুন মাথা নাড়ল, না। এখন বর্ষাকাল নয়। তখন পাঁচ-সাতদিনেও বৃষ্টি বন্ধ হয় না। সে বলল, এটা বেশিক্ষণ চলবে বলে মনে হয় না।
বটা তাগাদা দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ডিনার করে নিলে ও নিষ্কৃতি পাবে। অতএব সবাই খেয়ে নিল। টিনের খাবার বাদ দিয়ে এখন বটার তৈরি খাবারেই সবাই খুশি। খাওয়া শেষ হলে গোরানসাহেবের ঘরে গেল অৰ্জুন আর মেজর। এখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে। তার আলোয় কাচের জানলার বাইরে পৃথিবীটাকে দেখা যাচ্ছিল মাঝে-মাঝে অস্পষ্ট। এই ঘরটা থেকে বাড়ির পেছনের দিকটা দেখা যায়। বিদ্যুতের আলোয় কবর তিনটে যেন জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছিল।
রাত বাড়ছিল। হঠাৎ বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে আর একটা আওয়াজ কানে এল অর্জুনের। মেজর চেয়ারে বসে চুলছেন। কিন্তু গোরানসাহেব তাকালেন অর্জুনের দিকে। শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। গাড়ির আওয়াজ। গোরানসাহেব বললেন, কেউ আসছে।
ততক্ষণে অর্জুন বুঝতে পেরেছে আওয়াজটা একটা নয়, দুটো গাড়ির এঞ্জিনের। দুটো আওয়াজের ধরন আলাদা। তার মানে দুরকমের গাড়ি আসছে। এই রাত্রে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এমন মারাত্মক বৃষ্টিতে দুটো গাড়ি এদিকে আসছে কেন, বুঝতে পারছিল না অর্জুন। যে ভদ্রলোক এই বাংলোটি কিনেছেন তিনি নিশ্চয়ই এমন সময়ে আসবেন না, তাঁর আসার কথা অনেক পরে।
অর্জুন বলল, যারা আসছে তারা ভাল লোক নাও হতে পারে।
তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু ওরা থাকলে যে জনে এসেছি সেই কাজটায় বাধা হবেই। গোরানসাহেবের কথা শেষ হতেই গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। আলোগুলো ঘুরে বাংলোর সামনে চলে এল। মেজর হকচকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, কে, কে?
অর্জুন দ্রুত উঠে ঘরের বাইরে চলে এল। মাঝখানের প্যাসেজ দিয়ে ও সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। রান্নাঘরের জানলা বন্ধ। কিন্তু সেখানে কোনও গ্রিল বা তারের জানলা নেই এটা সে দুপুরে দেখেছিল। জানলাটাকে খুলল সে। বাড়ির এপাশে কিছু গাছগাছড়া আছে। বৃষ্টি পড়ছে এখনও। বাইরে বেরুলেই ভিতে হবে। হোক। অর্জুন জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র ভিজতে শুরু করল। সে ধীরে ধীরে কার্নিসের নীচ দিয়ে সামনের দিকে এগোল।
বর্ষাতি-পরা চারটে লোক একটা মারুতি থেকে নেমে এল। বটার সুমোটাকে দেখে ওরা যে অবাক হয়ে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছিল। টর্চ ফেলে ভেতরটা দেখল ওরা। তারপর ইশারা করল টর্চ জ্বেলে। সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জিপ থেকে দুটো লোক নেমে এল। ওদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে তা বিদ্যুতের আলোয় বোঝা গেল।
দলবদ্ধভাবে ওরা বারান্দায় উঠে যেতেই অর্জুন আর তাদের দেখতে পেল না। যারা অস্ত্র হাতে এত রাত্রে এখানে এসেছে তাদের মতলব ভাল হতে পারে না।
হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই, ভেতরে কে? বেরিয়ে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে মেজরের গলা শুলল, তুই কে? এতবড় আস্পর্ধা যে, আমাকে তুই বলছিস? মেরে দাঁত ভেঙে দেব শজারুর বাচ্চা!
তারপর ধুপধাপ শব্দ হল। লোকটা চেঁচিয়ে বলল, সবকটাকে বেঁধে ফ্যাল। আমার আস্তানায় এসে জুটেছে আবার আমাকে গালাগাল? কটা আছে এখানে খুঁজে দ্যাখ সবাই।
একটু বাদে উত্তর শোনা গেল অন্য গলায়, চারজন। এদের একজন সাহেব। -কজন সাদা চামড়া।
অর্জুন নিঃসন্দেহ হল। এরা কেউ এই বাংলোর মালিক লোকনাথ দত্তের লোক নয়। লোকনাথ দত্ত তাদের এই বাংলোয় নিয়ে আসার সময় তো স্পষ্ট বলেছিলেন যে, তিনি সাতদিনের মাথায় আসবেন। নিশ্চয়ই এই লোকগুলো এখানে যাওয়াআসা করে, যা লোকনাথ দত্ত জানেন না।
হঠাৎ বটার গলা শুনতে পেল অর্জুন, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি কিছু জানি না। আমি গাড়ি চালাই, এঁরা আমার গাড়ি ভাড়া করে এখানে এনেছেন।
কোত্থেকে এসেছিস?
জলপাইগুড়ি। ওখানকার স্ট্যান্ডে গিয়ে বটা বললে সবাই চিনবে।
এই যে মিস্টার হোঁৎকা! এই সাহেব কে?
কোনও জবাব শুনতে পেল না অর্জুন। সম্বোধনটা নিশ্চয়ই মেজরের উদ্দেশ্যে।
কী হল? কানে যাচ্ছে না কথা?
ভদ্রভাবে কথা বলো ভাই। আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়।
শাবাশ। কেন এসেছ এখানে? এই বিদেশি কে?
আমরা এসেছি ড্রাকুলার সন্ধানে।
ড্রাকুলা? লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল।
হ্যাঁ, যারা রক্ত চুষে মানুষকে মেরে ফেলে।
আচ্ছা! এই ব্যাপার। আমাদের খবরটা তোমরা পেলে কোথায়? তোমরা কি পুলিশের লোক? উত্তর দাও।
না। আমি আর ও আমেরিকা থেকে এসেছি। পাসপোর্ট দেখাতে পারি।
ওসব পকেটে রাখে। ব্যাপারটা যখন জেনেই গেছ তখন আর তোমাদের জ্যান্ত ছেড়ে দিতে পারি না।
এই সময় আর একটি গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। লোকটা বলল, এদের হাত-পা বেঁধে ফ্যাল। বস আসছে মনে হচ্ছে।
কার্নিসের নীচে দাঁড়িয়েও বৃষ্টির ছাঁট এড়াতে পারছিল না অর্জুন। হাওয়া নেই বলে শীত করছে না তেমন। অবশ্য বৃষ্টির তেজ এখন অনেক কমে গেছে। এদের হাত থেকে মেজরদের উদ্ধার করা কীভাবে সম্ভব, ভাবছিল অর্জুন। এই সময় গাড়ির হেডলাইট বাংলোর ওপর পড়ল। অর্জুন দেখল গাড়িতে একজনই মানুষ, তিনিই ড্রাইভার।
দরজা খুলে চটপট বারান্দায় উঠে গেলেন তিনি। অর্জুন শুনতে পেল, সব ঠিক আছে?
না, সার। এখানে এসে দেখি চারটে লোক বাংলো দখল করে আছে। ওদের ওই ঘরে হাত-পা বেঁধে রেখে দিয়েছি। বলল, আমেরিকা থেকে এসেছে।
কেন? কেন এসেছে?
মুখে বলল ড্রাকুলার সন্ধানে। মনে হচ্ছে আমাদের ব্যাপারটা জেনে গিয়েছে।
গোয়েন্দা না পুলিশ?
বুঝতে পারছি না, তবে যা চেহারা আর বয়স, তাতে পুলিশে চাকরি হবে না।
জিপে কজন আছে?
ছজনকে এনেছি।
বাঃ, ছয় প্লাস চার। একে-একে নিয়ে এসো। আমি টেবিল রেডি করছি। কেউ একজন আমাকে সাহায্য করুক। গাড়িতে সব যন্ত্রপাতি আছে।
স্টক আছে সার।
আচ্ছা, ওদের সঙ্গে আর কেউ ছিল না তো?
চারজনকেই তো পেয়েছি।
যদি কেউ পালিয়ে গিয়ে থাকে পেছনের দরজা দিয়ে, নিশ্চয়ই বৃষ্টির মধ্যে বেশিদূর যেতে পারবে না। সাবধানের মার নেই। দেখে এসো।
ওকে সার। বলে লোকটা বারান্দায় বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে বলল, একটা একটা করে ওদের ভেতরে নিয়ে এসো। বাঃ, বৃষ্টি ধরে গেছে, আমি একটু পাক দিয়ে আসছি।
অর্জুন ফাঁপরে পড়ল। এপাশে এলে লোকটা কি তাকে দেখতে পাবে? সে দ্রুত লন পেরিয়ে জঙ্গলের কাছে চলে যেতেই লোকটাকে দেখা গেল। টর্চ নিয়ে বেরিয়ে চারপাশে আলো ফেলছে। বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার জন্যই বোধ হয় রাতের জঙ্গলে পোকামাকড় কম। পাতা থেকে জল পড়ছে ফোঁটা-ফোঁটা। অর্জুন দেখল লম্বা লোকটা আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলোর পেছনদিকে যাচ্ছে। খোলা জানলাটায় তার টর্চের আলো পড়ল। আরও এগোল লোকটা। কবরের কাছে পৌঁছনোমাত্র লোকটা এমন আর্ত চিৎকার করে উঠল যে, অর্জুন কেঁপে উঠল আতঙ্কে।
লোকটা যে মাটিতে পড়ে গেল, এটুকু বুঝতে পারল অর্জুন। জ্বলন্ত টর্চ ওর হাত থেকে ছিটকে কিছুটা দূরে ঘাসের ওপর পড়েছে। তিনবার চেঁচিয়েছিল লোকটা, তারপর একদম চুপ করে গেল। চিৎকারটা বাংলোর ভেতরে পৌঁছেছিল। অর্জুন দেখল তিনজন লোক টর্চ নিয়ে দৌড়ে বাইরে এসে চারপাশে আলো ফেলছে। অর্জুন জঙ্গলের আরও ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই ঝুপ ঝুপ করে ওর শরীরের ওপর ভেজা কিছু পড়তে লাগল। ডান হাতে সেগুলোকে ঘাড় এবং মাথার ওপর থেকে সরাতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু ওগুলো এমন আঁকড়ে আছে যে, সক্ষম হল না। জোঁক। জঙ্গুলে জোঁক। এখন চুপচাপ ব্যথা না দিয়ে তার রক্ত খেয়ে যাবে। এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে বাংলোয় ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। আবার সেটা করতে গেলে ওদের হাতে ধরা দিতে হবে। কিছুক্ষণ জোঁকগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়াই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
লোকগুলো এখন ডাকাডাকি করছে। রাজুভাই, ও রাজুভাই, রাজুভাই। কিন্তু কোনও সাড়া পাচ্ছে না। ওরা এবার বাংলোর পেছনদিকে যাচ্ছিল। আর তখনই ওদের টর্চের আলো মাটিতে পড়ে থাকা রাজুভাইকে আবিষ্কার করল। দৌড়ে কাছে গিয়ে ওরা কী দৃশ্য দেখল অর্জুন বুঝতে পারল না, কিন্তু ওখান থেকেই ওরা এমন হল্লা শুরু করল যে, বাংলোর ভেতর থেকে তিনজন মানুষ বেরিয়ে এল। এদের একজন বেশ প্রবীণ, সাদা দাড়ি আছে। মেঘ সরে যাওয়ায় আকাশ পরিষ্কার। লোকটাকে আবছা আবছা যেটুকু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তাতে বয়স্ক বলেই মনে হল অর্জুনের।
কী হয়েছে?
রাজু মরে গিয়েছে। ওর শরীরটাকে কেউ দুমড়ে দিয়েছে।
কে করল?
জানি না সার। কোনও মানুষের পক্ষে এই কাজ এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব নয়। ওর মাথাটাও ঘুরে গেছে ভেঙে যাওয়ার পর।
তিনটে নোক এগিয়ে যাচ্ছিল রাজুভাই-এর মৃতদেহ দেখতে। অর্জুন দেখল এই তার সুযোগ। বাংলোর সামনে এখন কেউ নেই। প্রথম গাড়িতে চারজন, জিপে দুজন আর পরে একজন মানুষ এখানে এসেছে। মোট সাতজন। তার মধ্যে একজন মারা গেল। বাকি দুজন এখন বাংলোর পেছনে মৃতদেহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৌড়ল।
বারান্দায় উঠেই সে দেখতে পেল বসার ঘরে টেবিলের ওপর একটি লোককে শুইয়ে রাখা হয়েছে। এই লোকটি কোত্থেকে এল? লোকটি যেন ঘুমোচ্ছে। পাশের দরজা বন্ধ। সেটা খুলতেই ও অন্ধকারে কিছুই দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি এই ঘরে আছেন?
মেজরের গলা পাওয়া গেল, হুঁ। চটপট দড়ি খুলে দাও।
কেউ কথা বলবেন না প্লিজ। অর্জুন প্রথমে গোরক্ষনাথকে পেল। তার বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, আমার মাথা ঘাড় বুকে জোঁক পড়েছে। ছাড়িয়ে দিতে পারবে? জলদি!।
বাবু অন্ধকারে কী করে দেখব? জোঁক? আপনি আমার শকুনের কাছে চলে যান। ল্যাংড়া শকুন জোঁক খেতে ভালবাসে।
শকুন? অর্জুনের মাথায় কিছু ঢুকল না। সে দৌড়ল। গোরক্ষনাথদের ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। শকুনের খাঁচাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সেটা একবার অবাক চোখে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল। খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে মাথাটা এগিয়ে নিয়ে গেল অর্জুন চোখ বন্ধ করে। আর তখনই অভাবনীয় ব্যাপারটা ঘটল। চটপট ঠোকর এসে পড়ছে মাথায়, ঘাড়ে, বুকে। শব্দ হচ্ছে কপাৎ কপাৎ করে। কিন্তু জোঁকগুলো সহজে চামড়া ছাড়তে চাইছিল না, রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে তারা। শকুনটাও যেন পাগল হয়ে গেল। শেষ জোঁকটাকে গেলার পর অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠল পাখিটা। অর্জুনের হঠাৎ মনে হল পাখিটার ঋণ শোধ করা উচিত। সে হাত বাড়িয়ে ওর পায়ের দড়ি খোলার চেষ্টা করল। ভয় হচ্ছিল যদি শকুনটা তাকে ঠুকরে দেয় তা হলে এখানে ইনজেকশন নেওয়ারও উপায় নেই। কিন্তু শকুনটা চুপচাপ দেখে যেতে লাগল। ও বাঁধনমুক্ত হওয়ামাত্র ওড়ার চেষ্টা করল। খানিকটা দূরে গিয়ে বসে পড়ল অবশ্য। সম্ভবত খাঁচায় থাকার ফলে ওর ডানার জোর কমে গিয়েছে। শকুনটাকে উড়তে দেখে কাকটা চিৎকার শুরু করল। এই মধ্যরাতে কা কা ডাকটা আরও কর্কশ শোনাচ্ছিল।
বারান্দায় আবার মানুষের গলা পাওয়া গেল। অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে এল। জানলাটা এখনও খোলা। সে শুনল প্রৌঢ় বলছে, রাজু মারা গিয়েছে, ওর বউকে নিশ্চয়ই ক্ষতিপূরণ করে দেওয়া হবে।
কিন্তু ওকে যে মারল তাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
কে মেরেছে? প্রৌঢ়র গলা, বুঝতে পারছ কোনও মানুষ ওকে মারেনি। ওর শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গেছে যে, সে কখনওই মানুষ নয়।
যে কাজটা করেছে সে নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছে। আমরা ওকে খুঁজে বের করব। ওকে শেষ না করে এখান থেকে যাব না। লোকটা মরিয়া।
ঠিক আছে। দুজন বাইরে গিয়ে পাহারা দাও। বাকিরা আমাকে সাহায্য করো। বড় জারটা কোথায়? নিয়ে এসো কেউ।
অর্জুন পা টিপে টিপে এগোল। টেবিলের ওপর শুয়ে থাকা লোকটার ঘাড়ের ওপর নলের মুখটা ঢুকিয়ে দিয়ে প্রৌঢ় ঘড়ি দেখল। নলের চেহারাটা পালটে গেল। প্রৌঢ় পাশে দাঁড়ানো তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, যে চারজনকে আটকে রেখেছ তাদের শরীরে এই ইনজেকশনটা পুশ করে দাও এখনই। তা হলে চমৎকার ঘুমিয়ে থাকবে।
একজন লোক ইনজেকশনের সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে পাশের বন্ধ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বাইরে থেকে চিৎকার ভেসে এল, সাপ, সাপ!
সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ়র পাশে দাঁড়ানো লোকদুটো বাইরে ছুটল। কিন্তু ফিরে এল তৎক্ষণাৎ, ওদের দুজনকেই একটা বিশাল সাপ ছোবল মেরেছে।
ওদের হাতে বন্দুক ছিল না?
ছিল কিন্তু ওরা মাটিতে পড়ে গিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ় পকেট থেকে রিভলভার বের করে বাইরে ছুটল। ওই দুজন তার সঙ্গী হল। এই সময় পাশের ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল লোকটা। ওর হাতমুখ বাঁধা। কয়েক পা হেঁটে কাটা কলাগাছের মতো মেঝের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্থির হয়ে গেল।
অর্জুন ডাকল, মেজর!
ইয়েস মাই বয়। এটা কিছুই নয়। একবার চিনে…!
প্লিজ মেজর, গল্পটা পরে শুনব। এরা ভয়ঙ্কর লোক! অর্জুন কথাগুলো বলতে বলতে দেখল গোরানসাহেব প্রায় দৌড়ে টেবিলের কাছে পৌঁছে শায়িত লোকটির গলা থেকে সিরিঞ্জ লাগানো নল খুলে ফেললেন। মোমবাতির আলোয় দেখা গেল ওর গলা থেকে রক্ত বের হচ্ছে গলগল করে। দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করে সেখানে চেপে ধরে তিনি বলে উঠলেন, আমাদের ফার্স্ট এড বক্সটা নিয়ে এসো মেজর, কুইক। নইলে একে বাঁচানো যাবে না।
তখনই বাইরে গুলির আওয়াজ হল। পরপর দুবার। অর্জুন দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেল। লনের ওপর সাপটার মৃতদেহ পড়ে আছে। সেই বিশাল লম্বা সাপটা। প্রৌঢ় এবং তার দুজন সঙ্গী বাংলোর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওদের দ্যাখো, বেঁচে আছে কিনা। প্রৌঢ় নির্দেশ দিল।
লোকদুটো এগিয়ে গেল লনের পাশে পড়ে থাকা দুটো শরীরের দিকে ঝুঁকে পরীক্ষা করতে লাগল। অর্জুন বুঝতে পারল এবার ওরা ফিরে আসবে। সে দ্রুত ভেতরে ঢুকে দেখল ফাস্ট এড বক্স থেকে তুলো ব্যান্ডেজ বের করে গোরানসাহেব লোকটির ক্ষত বাঁধছেন।
সে বলল, ঝটপট আড়ালে চলুন। ওরা ফিরে আসছে আর ওদের সঙ্গে অস্ত্র আছে।
ওরা আড়ালে আসামাত্র প্রৌঢ় ঘরে ঢুকল, এ কী? নল খুলল কে? ব্যান্ডেজ করেছে দেখছি। কে করল? তোমরা সাবধান হও, এখানে অন্য লোক আছে। প্রৌঢ় চিৎকার করে উঠল।
সার দেখুন, পেছনে আসা লোকদুজনের একজন চেঁচিয়ে উঠল। ওরা মেঝের ওপর পড়ে থাকা ইনজেকশন দিতে যাওয়া লোকটিকে দেখে ছুটে গেল। পরীক্ষা করে প্রৌঢ় বলল, না, মারা যায়নি। অজ্ঞান হয়ে আছে। তোমরা ওই চারটে লোককে ভাল করে বাঁধোনি?
হ্যাঁ সারা শক্ত করে বেঁধেছিলাম।
তা হলে ওরা এর এই দশা করল কী করে? ওই ঘরে গিয়ে দ্যাখো তো?
লোকদুটো একটু ইতস্তত করল। তারপর এগিয়ে গেল দরজার দিকে। উঁকিঝুঁকি মেরে বলল, ভেতরে কেউ নেই সার।
ঠিক দেখেছ?
অন্ধকারে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না।
টর্চ কোথায়?
সবকটা টর্চ তো ওরা নিয়ে গিয়েছিল।
আঃ। সেগুলো তো মাটিতে পড়ে আছে। যাও, নিয়ে এসো।
প্রথমজন দ্বিতীয়জনের দিকে তাকাল, এই, চল আমার সঙ্গে।
তুই যা না!
আমি একা যাব না। চল।
ওরা পা বাড়াতে প্রৌঢ় বলল, দুজনের যাওয়ার দরকার নেই। টর্চ আনতে দুটো মানুষ যাচ্ছে! সাহসী বীরপুরুষ! একজন এখানে থাকো। তুমি যাও।
প্রথম লোকটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন রান্নাঘরে চলে এল। জানলা দিয়ে লাফিয়ে নীচে নামল। লনে কোনও টর্চ জ্বলছে না। যে দুটো লোক সাপের ছোবল খেয়ে মরেছে তারা বোধহয় শেষ মুহূর্তে আলো নিভিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলোর পেছনে রাজুভাই-এর হাত থেকে ছিটকে পড়া টর্চটা এখনও জ্বলছে। অর্জুন লোকটিকে সতর্ক পায়ে এদিকে আসতে দেখল। হঠাৎ হাওয়া বইল। জঙ্গলের গাছগুলো নড়তেই জমে থাকা বৃষ্টির জল ডালপাতা থেকে শব্দ করে ঝরতে লাগল। লোকটা হঠাৎ দৌড়তে লাগল। সম্ভবত ভয় পেয়ে গিয়েছিল আচমকা শব্দ হতে। যেই সে নিচু হল টর্চ তুলতে, অর্জুন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওরে বাবা রে মা রে বলে চেঁচিয়ে উঠেই স্থির হয়ে গেল লোকটা। মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হতে লাগল। অর্জুন টর্চটা তুলে নিল। নিয়ে চারপাশে আলো ফেলতেই স্টিভেনসনের কবরের কাছে কিছু একটার নড়াচড়া অনুভব করল। ও টর্চের আলো হাতে আর একটু এগোতেই দেখতে পেল কবরের নীচ থেকে একটা সাপ একটু একটু করে ওপরে উঠে আসছে। এটা কোন সাপ? যেটা বাইরের লনে পড়ে আছে সেটা কি আলাদা? তা হলে কি ওই কবরে দুটো সাপ থাকত? গোরানসাহেব অবশ্য এইরকম সন্দেহ করেছিলেন। অর্জুন দৌড়ল। জানলা দিয়ে ভেতরে গেলে অনেক কসরত করতে হবে। সে বারান্দায় উঠে এল। এখন ওরা দুজন। বাকি দুজন অজ্ঞান হয়ে আছে। দুজনের সঙ্গে পাঁচজন সহজেই মোকাবিলা করতে পারে।
হ্যান্ডস আপ!
হুকুম শুনে হাত তুলতে তুলতে অর্জুন দেখল প্রৌঢ় দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
তা হলে তুমিই এইসব করছ?
আপনি কে? অর্জুন হাত তোলা অবস্থায় জিজ্ঞেস করল।
আমি যেই হই তোমাদের কাউকে আমি জ্যান্ত ফিরে যেতে দেব না। এখন ভাল ছেলের মতো মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। চটপট। সাপ মেরেছি, তোমাকে মারতে একটুও অসুবিধে হবে না। প্রৌঢ় চমকাল।
অর্জুন বাধ্য হল শুয়ে পড়তে। তৎক্ষণাৎ প্রৌঢ়র সঙ্গী এসে ওর হাত বেঁধে ফেলল। প্রৌঢ় নির্দেশ দিল, ওকে গাড়িতে তোলো।
কেন ঝামেলা করছেন সার। জিপে এখনও অনেক লোক পড়ে আছে। আর একটাকে তোলার কী দরকার? লোকটি যেন প্রার্থনা করল। ওটা এখনও আসছে না কেন? প্রৌঢ় জানতে চাইল।
কী করে আসবে? ও যে টর্চ আনতে গিয়েছিল সেটা এ নিয়ে এসেছে। সার, যদি বাঁচতে চান তো এখান থেকে পালান।
শাট আপ। প্রৌঢ় ঘুরে বাংলোর দরজা টেনে বন্ধ করে দিলেন। লম্বা ছিটকিনি টেনে দিয়ে বললেন, ভেতরে যারা আছে তারা ভেতরেই থাক।
সার, যে টর্চ আনতে গিয়েছিল সে আমার মাসতুতো ভাই। ওর কী হয়েছে না দেখে যেতে পারব না। একবার চলুন।
প্রৌঢ় মাথা নাড়ল, ওকে দরকার। তিনটে গাড়ি নিয়ে এসেছি। আমরা এখন দুজন। চলে গেলে একটা গাড়িকে এখানে ফেলে যেতে হবে। নো। আমি চাই না কোনও প্রমাণ রেখে যেতে। চলো। অর্জুনের আনা টর্চ তুলে নিল প্রৌঢ়।
ওরা এগোতেই অর্জুন উঠে বসল। ওর হাত পেছন মুড়ে বাঁধা কিন্তু পা বাঁধার কথা ভাবেনি ওরা। ও সেই অবস্থায় লনে নামল। কী করে অন্তত একটা গাড়িকে খারাপ করে দেওয়া যায়!
হঠাৎ শুনল প্রৌঢ় চেঁচিয়ে উঠেছে, ওটা কী?
সার, মনে হচ্ছে মানুষ। লম্বা রোগা মানুষ।
অত রোগা মানুষ হতে পারে না।
পারে সার। ওখানে একটা কবর আছে।
আমি বিশ্বাস করি না। তুমি টর্চের আলো ওটার ওপর ফ্যালো তো। হ্যাঁ। প্রৌঢ় গুলি চালালেন। পরপর কয়েকটা।
লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, পড়ে গেল সার, পড়ে গেছে।
এসো। প্রৌঢ় এগিয়ে গেল লোকটিকে নিয়ে। তখনও গোঁ গোঁ করছে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটা। কয়েকবার ডাকার পর সেটা বন্ধ হল। প্রৌঢ় বলল, মুখে জল দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ওকে তুলে নিয়ে এসো।
লোকটা তার মাসতুতো ভাইকে বগলের তলায় হাত ঢুকিয়ে তুলল। প্রৌঢ় ফিরে আসছিল দ্রুত। অর্জুনকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠল, আচ্ছা! এই ব্যাপার। তা হলে তুমি মরো।
রিভলভার উঁচিয়ে গুলি করল প্রৌঢ়। কিন্তু খট করে শব্দ হল, গুলির আওয়াজ হল না। প্রৌঢ় বলল, মাই গড! তারপর দৌড়ে গেল লনের ওপর পড়ে থাকা মৃতদেহের পাশ থেকে বন্দুক তুলে আনতে। সেটাকে তুলে এদিকে ফিরতেই অর্জুন মাটিতে বসে পড়ল। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গাড়িতে লাগল। কাচ ভাঙল। কোনওরকমে গুঁড়ি মেরে অর্জুন গাড়ির পেছনে চলে আসতেই আবার গুলির আওয়াজ হল। আর তখনই একটা আর্তনাদ প্রবলভাবে বেরিয়ে এল প্রৌঢ়ের গলা থেকে। অর্জুন উঁকি মেরে দেখল প্রৌঢ় দুহাতে তার মুখ থেকে কোনও কালো ছায়া সরাবার চেষ্টা করতে করতে মাটিতে পড়ে গেল। সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিল প্রৌঢ়। মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে দিতেও সেটা থামছিল না। অর্জুন উঠে দাঁড়িয়েছিল। ভাইকে বয়ে নিয়ে আসা লোকটা তখন ওই দৃশ্য দেখে থরথর করে কাঁপছে। অর্জুন তাকে ডাকল, বাঁধন খুলে দাও।
ভোর হয়ে এল। মৃতদেহগুলোকে পাশাপাশি শুইয়ে রাখা হয়েছে। যারা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল তাদের বেঁধে রাখা হয়েছে। জিপের ভেতর থেকে আরও পাঁচজন মানুষকে এনে বাইরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আর প্রৌঢ়র সমস্ত মুখে গোরানসাহেব বান্ডেজ বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বটাকে পাঠানো হয়েছে হাসিমারা পুলিশ স্টেশনে খবর দিতে। প্রৌঢ় সমানে যন্ত্রণায় ককিয়ে যাচ্ছে।
অর্জুন বলল, মিস্টার গোরান, এই হল আমার ড্রাকুলা। ড়ুয়ার্সের সরল মানুষদের তুলে নিয়ে এসে এই লোকটা শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বের করে জঙ্গলে ফেলে দিত। সিরিঞ্জ ফোটাত ঘাড়ের পাশে রক্ত বের করে সংরক্ষণ করার কায়দা ও জানে। আমরা এখনও বুঝতে পারছি না এই রক্ত ও ব্ল্যাকে বিক্রি করত না অন্য কিছুতে লাগাত।
মেজর বললেন, তবু আমি গোরানকে ধন্যবাদ দেব। ও যদি এই অভিযানে না আসত তা হলে ওই রক্তচোষা ড্রাকুলাটা আরও কত মানুষের সর্বনাশ করত। ভৌতিক ড্রাকুলা নিশ্চয়ই নেই, কিন্তু মানুষই তো ড্রাকুলা হয়ে গেছে।
গোরানসাহেব গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। এবার বললেন, ভৌতিক ড্রাকুলা নেই একথা আমি এখনও বিশ্বাস করি না।
আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন, আর্নল্ড স্টিভেনসনের কবরে দুটো বড় সাপ বাসা করে থাকত। কোনও ড্রাকুলা নয়। অর্জুন বলল।
ঠিকই। কিন্তু ওরা মারা যাওয়ার পর তুমি ওই লোকটার মুখে একটা কালো ছায়া দেখতে পেয়েছ। এই লোকটাও বলছে, সে দেখেছে ওদের নেতার মুখে ছায়াটা ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর ওটা এসেছে ওই কবর থেকে। ওই ছায়াই যে ওর চোখ তুলে নিয়েছে, মুখ ক্ষতবিক্ষত করেছে তা তোমরা জানো। অথচ আমরা বেরিয়ে এসে কেউ ওই ছায়াটাকে দেখতে পাইনি। তুমি এর ব্যাখ্যা করবে কীভাবে? গোরানসাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
মেজর বললেন, তা হলে স্বীকার করতে হয় স্টিভেনসনের ড্রাকুলা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া জন লিঙ্কন চিঠি লিখেছিল প্রায় ৬০ বছর আগে। সেই চিঠিতেও রক্ত চুষে নিয়ে মানুষকে মেরে ফেলার কথা ছিল অর্জুন। এই বুড়োটা নিশ্চয়ই তখন থেকে কারবার চালাচ্ছে না।
অর্জুন কথা বলল না। লিঙ্কন সাহেব ভুল করতে পারেন, কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু এই কালো ছায়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।
পুলিশ এল। সব কিছু লিখে নিয়ে অফিসার অর্জুনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন। এই প্রৌঢ় একজন ডাক্তার। থাকেন ধুপগুড়ির কাছে। বিনা পয়সায় মানুষের চিকিৎসা করেন। ইনিই যে এই বীভৎস ঘটনার নায়ক তা পুলিশ কল্পনা করতে পারেনি। অর্জুনরা না এলে ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে কতদিন সময় লাগত কে জানে! সবকটা গাড়ি এবং মানুষদের তুলে নিয়ে পুলিশ যখন চলে গেল তখন মেজর বললেন, গোরান, আমরাও তা হলে ফিরে যেতে পারি, কী বলো?
গোরানসাহেব বললেন, আমি আর একটা রাত এখানে থাকতে চাই।
আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সবাই রাজি হল। সাপদুটোকে পুড়িয়ে ফেলল বটা আর গোরক্ষনাথ গোরক্ষনাথের মন খুব খারাপ। অর্জুন কেন তার খোঁড়া শকুনের বাঁধন খুলে দিল। বাংলোর কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিকেলবেলায় অর্জুন একাই বাংলোর সামনের রাস্তায় হাঁটছিল। এরকম জায়গায় অত বছর আগে স্টিভেনসন সাহেব বাংলো করেছিলেন। ভদ্রলোক সত্যি শৌখিন মানুষ ছিলেন। শৌখিন মানুষ কি ড্রাকুলা হতে পারে?
হঠাৎ অর্জুনের নজরে পড়ল পাশের গাছের নিচু ডালে একটা শকুন বসে আছে। অর্জুন দাঁড়াল। এটাগোরক্ষনাথের শকুন নয় তো? সে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শকুনটা নড়ল না। দ্রুত গেটের কাছে ফিরে এসে সে চেঁচিয়ে গোরক্ষনাথকে ডাকতেই গোরক্ষনাথ বেরিয়ে এল। অর্জুনের কাছে খবরটা শুনে ছুটে গেল গোরক্ষনাথ। অর্জুন দেখল গোরক্ষনাথ হাত বাড়িয়ে শকুনটাকে সহজেই ধরে ফেলল। পালাবার কোনও চেষ্টাই করল না পাখিটা।
ওটাকে নিয়ে আসতে আসতে দাঁড়িয়ে পড়ল গোরক্ষনাথ। পাখিটাকে মুখের সামনে ধরে বিড়বিড় করতে লাগল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
এত রক্ত লাগল কী করে এর মুখে, দুপায়ের নখে। ইস। রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কিছু শিকার করেছিল।
কাল রাত্রে দেখা কালো ছায়ার রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল অর্জুনের কাছে।