টিলার মাথায় জাম গাছের ডালে বসে ছোটু টিয়া কান পেতে শুনছে দূরের গ্রাম থেকে ভেসে আসা আওয়াজ। দুদিন ধরে শুনে শুনে শব্দটা ওর কানে গেঁথে গেছে। ‘করকর করকর কর’, ‘ডিম ডিমা ডিম ডিম’, ‘করকর করকর কর’, ‘কাঁই না না কাঁই না না’। দিব্যি ও আওয়াজগুলো করতে পারছে। খানিক পর মা টিয়া একটা লাল রঙের তেলাকুচ ফল ঠোঁটে করে নিয়ে গাছবাড়িতে ফিরে আসতে ছোটু মাকে শুনিয়ে দিল সদ্য শেখা বাজনার আওয়াজ।
মা টিয়া বলল “লক্ষ্মী বেটা, শিখলি কোথা থেকে এত সুন্দর বাজনা?”
ছোটু টিয়া ‘টি, টি’ করে বলল “শুনতে পাচ্ছ না? ওই যে হাওয়ায় ভেসে আসছে?”
“আজ সকালেই আমি উড়ে গিয়ে দেখে এসেছি ওই নিচের গ্রামে পাথ্থর ভগবানের পুজো হচ্ছে, ওখানেই একটা গাছের ওপর বসে আওয়াজটা গলায় তুলে নিয়েছি। আবার শুনবে? কাঁই না না, ‘কাঁই না না।”
“মা, পুজো কী? ভগবান কে?”
মা টিয়া পড়ল মুশকিলে। সত্যিই তো পুজো কী? ভগবানই বা কে?
খানিক চুপ করে থেকে মা টিয়া বলল, “চল বেটা তোকে প্যাঁচাদাদুর কাছে নিয়ে যাই। আমি তো সবকিছু জানি না। প্যাঁচাদাদু অনেক কিছু জানে। উনিই তোকে বুঝিয়ে দেবেন পুজো কী, আর ভগবানই বা কে? তুই এই তেলাকুচোর ফলটা খেয়ে নে তো লক্ষ্মী সোনা! আমাদের অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে যেতে হবে। যেতে যেতে তোর খুব খিদে পেয়ে যাবে।”
অন্য সময় হলে ছোটু ‘এখন খাব না’, ‘এখন খাব না’ বলে চিৎকার জুড়ে দিত। কিন্তু বেড়াতে যাবার নাম শুনে সোনাঠোঁট করে লাল তেলাকুচো ফলটা চট করে খেয়ে নিল। মা টিয়া ঠোঁট দিয়ে বাসার খড়কুটোগুলো ঠিক করতে করতে বলল, “আমি না থাকলে তুই বাসাটার অবস্থা যা করে রাখিস…”
অন্য দিন হলে এই কথা শুনে ছোটু মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে ঘাড়ের পালকে মুখ গুঁজে বসে থাকত। কিন্তু ওর আর বেড়াতে যাবার তর সইছে না। টি টি করে বলে উঠল, “আচ্ছা আচ্ছা আমি আর বাসার ভেতরে বসে খেলব না, এখন তো তাড়াতাড়ি প্যাঁচাদাদুর কাছে চল!”
প্যাঁচাদাদু থাকে দূর পাহাড়ের ওপর এক অতি প্রাচীন ওকগাছের কোটরে। সারাদিন কোটরে বসে ঝিমোয় আর রাত্রি নামলে কোটরের বাইরের একটা ডালে এসে বসে। জ্ঞানী প্যাঁচাদাদুকে সবাই খুব মান্যি করে।
ওকগাছের একদম মগডালে থাকেন পাখিদের রাজা ঈগল। তিনিই প্যাঁচাদাদুর দেখাশোনা করেন। রোজ সাপ না হয় ইঁদুর ধরে প্যাঁচাদাদুর কোটরে দিয়ে যান।
প্যাঁচাদাদু জানেন না এমন কোন বিষয় নেই। পাখিরা তো বটেই, জঙ্গলের বাঘ ভালুক হাতি এরাও কোন সমস্যা হলে প্যাঁচাদাদুর ওকগাছের বাড়ির নিচে এসে হাঁকডাক করে প্যাঁচাদাদুকে কোটরের বাইরে ডেকে এনে মিটিং করে। প্যাঁচাদাদুর কথাই সেখানে শেষ কথা।
মা টিয়া ছোটুকে নিয়ে উড়তে যাবে, তখনি কাকাতুয়া এসে উপস্থিত।
“কী টিয়ামাসি কেমন আছ? ছোটু ভালো করে উড়তে শিখলি? চল দুজনে মিলে খানিক উড়ে আসি।”
অমনি ছোটু ঠোঁট বেঁকিয়ে শুনিয়ে দিল সদ্য শেখা বাজনা “কাঁই না কাঁই না না, ডিম ডিমা ডিম ডিম।”
শুনে তো কাকাতুয়ার গাছ থেকে পড়ে যাবার অবস্থা। বলে, “সে কী রে ছোটু, এই বাজনা তুই শিখলি কোথা থেকে? আমি তো এই জঙ্গলে গানবাজনায় সেরা, আমিও এত সুন্দর করে বাজাতে পারব না। না মাসি, ছোটু একটা প্রতিভা। এই বয়সেই এত! আমি বলছি ও আমাকে ছাড়িয়ে যাবে একদিন, দেখো!”
মা টিয়া বলল, “ছোটু পাহাড়ের নিচের ওই গ্রামের এক গাছের ডালে বসে পুজোর বাজনা শুনে শুনে শিখে ফেলেছে। আমি ছোটুকে প্যাঁচাদাদুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি পুজো আর ভগবান কী বোঝাতে। যাবি নাকি আমাদের সঙ্গে?”
কাকাতুয়া বলল, “যাব না মানে? আমিও তো জানি না ভগবান আর পুজো কী!”
তিনজন মিলে খানিক উড়ে যেতেই দেখে নিচে কয়েকটা ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনজনকে একসঙ্গে উড়তে দেখে একটা ময়ূর কেকা কেকা বলে চিৎকার করে উঠল, “ও টিয়ামাসি, ছোটু আর কাকাতুয়াদাদাকে নিয়ে যাচ্ছ কোথায়?”
অনেকক্ষণ ধরে উড়ে মা টিয়া একটু ক্লান্ত হয়ে গেছিল। তাই সবাইকে নিয়ে বসল ময়ূরগুলোর কাছে একটা গাছে। বলল, “এদের নিয়ে যাচ্ছি প্যাঁচাদাদুর কাছে। ভগবান আর পুজো কী জানতে!”
শুনে একটা ময়ূর বলে উঠল, “আমরাও তো জানি না পুজো আর ভগবান কী। চল আমরাও যাই তোমার সঙ্গে প্যাঁচাদাদুর বাড়ি। তা হঠাৎ পুজো আর ভগবান নিয়ে কেন জানতে চাইছ টিয়ামাসি?”
কাকাতুয়া চুপ করে সব শুনছিল। সে বলে উঠল “ছোটু শোনা তো তোর বাজনা।”
যেই না বলা, ওমনি ছোটু ঘাড় বেঁকিয়ে একটু লজ্জা লজ্জা ঠোঁটে গাইতে শুরু করলো সদ্যশেখা বাজনা। “করকর করকর কর, ডিম ডিমা ডিম ডিম, কাঁই না না কাঁই না না।”
পাশের একটা নিমগাছে একটা কাঠঠোকরা বসেছিল। ছোটুর বাজনা শুনে সেও নিমগাছের গায়ে তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠকঠকিয়ে তাল দিতে শুরু করল। কাকাতুয়াও আর চুপ করে বসে থাকতে পারল না। সেও এক বিদঘুটে গান জুড়ে দিল। “কোঁকা কোঁকা কোঁকাআআআ কোঁ … ।” কনসার্টটা এত জমে গেল যে ময়ূরের দল পেখম তুলে বিশাল ঘাসজমি জুড়ে নাচতে শুরু করে দিল।
দেখতে দেখতে আশপাশের গাছে যত পাখি ছিল টুনটুনি, শালিখ, চড়াই, বুলবুলি, ছাতার, বাবুই, হাঁড়িচাচা, বসন্ত বাউরি, …সব এসে ভিড় জমাল যে-গাছে বসে ছোটু গান গাইছিল তার অন্যান্য ডালে। সবাই গাছের ডালে বসতে পারল না। অনেককে বসতে হল মাটিতে। তারপর সবাই মিলে শুরু করল গান। সে যে কী হট্টগোল শুরু হল!
তখন আসরে নামল এক বদরাগী দাঁড়কাক। বিকটরকম কা কা স্বরে সবাইকে বকেঝকে চুপ করাল। তারপর বলল, “ছোটু টিয়া এই বয়সে যে রকম গান গাইল তাতে করে ও যে কত বড় প্রতিভাবান তা বোঝা গেল। আমাদের ওকে পুরস্কৃত করা উচিৎ।”
সব পাখিরা চিৎকার করে কাকের প্রস্তাব সমর্থন করল। তখন কাক জিজ্ঞেস করল, “তা টিয়ামাসি তুমি ছোটুকে নিয়ে যাচ্ছিলে কোথায়?”
মা টিয়া বলল, “যাচ্ছি প্যাঁচাদাদুর কাছে। পুজো আর ভগবান কী জানতে।”
কাক বলল “পুজো ও ভগবান? ওহো! নিচের গ্রামে পাথ্থর ভগবান পুজো হচ্ছে বটে! আমি তো আজ সকালে ওখানে গেছিলাম, একজন আমাকে একটা লুচি খেতে দিয়েছিল। কী ভালো খেতে! একদম ইয়ামি… । আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে প্যাঁচাদাদুর কাছে পুজো আর ভগবান কী জানতে।”
উপস্থিত সব পাখিরা তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল, “আমিও যাব, আমিও যাব …”
তখন হঠাৎ গম্ভীর গলায় হাঁড়িচাচা বলে উঠল, “প্যাঁচাদাদুর শরীর ভালো না। সবাই মিলে গিয়ে হল্লা করা ঠিক হবে না। তার চাইতে বরং টিয়ামাসি, ছোটু আর কাকাতুয়া গিয়ে পুজো আর ভগবান কী জেনে এসে আমাদের বলুক।”
শুনে এক টুনটুনি বলে উঠল, “আমি প্যাঁচাদাদুর কথা শুনেছি, কিন্তু প্যাঁচাদাদুকে কোনদিন দেখিনি। আমি যাব।”
একথা শুনে আরও অনেক পাখি একসঙ্গে বলতে শুরু করল, “আমিও প্যাঁচাদাদুকে কোনদিন দেখিনি, আমিও যাব।”
আবার চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল।
এমন সময় বিশাল ডানা মেলে পাখিদের রাজা ঈগল পাখি এসে বসল গাছের নিচে। ঈগলকে দেখে পাখির দল একদম চুপ করে গেল।
“বলি এতো গণ্ডগোল কিসের? সবাই একসঙ্গে হয়েছ কেন?”
কাকাতুয়া কোনমতে সাহস করে বলল, “প্রণাম রাজা ঈগল। সবাই একসঙ্গে প্যাঁচাদাদুর কাছে যেতে চাইছে।”
“কেন, প্যাঁচাদাদুর কাছে কেন?”
“সবাই এক সঙ্গে পুজো আর ভগবান কী শুনতে চায় প্যাঁচাদাদুর কাছে,” বলল কাকাতুয়া।
ঈগল রাজা একবার তার তীক্ষ্ণ নখওয়ালা পা দিয়ে মাথাটা চুলকে ভাবল, সত্যিই তো! পাখিদের রাজা হয়ে সে-ও তো জানে না, পুজো কী, ভগবান কে?
“তা হঠাৎ পুজো আর ভগবান নিয়ে পড়লে কেন তোমরা?”
হাঁড়িচাচা তার গম্ভীর গলায় বলল, “রাজা মশাই অভয় দেন তো ছোটু টিয়াকে একটা গান শোনাতে বলি?”
ঈগল রাজা বলল “কোথায় ছোটু টিয়া?”
ছোটু টিয়া ঈগল রাজাকে দেখে ভয়ে মায়ের ডানার তলায় লুকিয়ে বসে ছিল। ঈগল রাজার কথা শুনে আরও ভয় পেয়ে মায়ের ডানার তলায় বসে কাঁপতে লাগল সে।
তখন টিয়া মা বলল, “ভয় পাস না ছোটু, গানটা শোনা।”
মায়ের কথা শুনে সদ্যশেখা বাজনটা গাইতে শুরু করলো ছোটু, “করকর করকর কর, ডিম ডিমা ডিম ডিম, কাঁই না না কাঁই না না।”
ছোটুর বাজনা শুনে মাটি থেকে ডানায় ভর করে খানিক আকাশে উড়ে আবার মাটিতে নেমে এসে বসলেন ঈগল রাজা। বললেন, “এতো বিরল প্রতিভা! পাখিদের সাম্রাজ্যে এত ভালো বাজনা কাউকে গাইতে শুনিনি। তা বাছা এত ভালো বাজনা শিখলে কোথা থেকে?”
উত্তর দিল কাকাতুয়া, “ছোটুদের গাছ বাসার পাহাড়ের নিচের গ্রামে পাথ্থর ভগবানের পুজো হচ্ছে। সেখানেই বাজনা বাজছিল। একটা গাছের ডালে বসে বাজনাটা শিখে নিয়েছে ছোটু। ছোটুই ওর মা টিয়ামাসির কাছে জানতে চায় পুজো কী? ভগবান কে? টিয়ামাসি জানে না, তাই ছোটুকে নিয়ে প্যাঁচাদাদুর কাছে নিয়ে যাচ্ছে পুজো কী, আর ভগবান কে শুনতে!”
“ঈগল রাজা আপনি যদি বলে দেন ভগবান কে, আর পুজো কী তা হলে আমরা পাখিকুল একটু জ্ঞানী হই। এখানে উপস্থিত পাখিদের কেউই জানে না উত্তরটা।” ফুট কাটল বিজ্ঞ হাঁড়িচাচা।
চিন্তায় পড়লেন ঈগল রাজা। তিনি নিজেও এ-সব জানেন না। কিন্তু তিনি হলেন পাখিদের রাজা। জানেন না বলাটা ঠিক হবে না। খানিক ভেবে বললেন, “ঠিক আছে সবাই মিলে চল প্যাঁচাদাদুর কাছে। সবাই নিজের কানে শুনে নেবে ভগবান কে আর পুজো কী? প্যাঁচাদাদুর শরীর ভালো আছে, সবাইকে দেখলে তিনি খুশি হবেন।”
ঈগলের কথা শুনে পাখির দল একসঙ্গে আকাশে উড়ল। শয়ে শয়ে রকমারি পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। সবার আগে আগে উড়ছে ঈগল রাজা।
২
দূর থেকে দেখা গেল সব গাছের মাথা ছাড়িয়ে পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের মাঝে ডালপালা ছড়ানো অতি প্রাচীন ওকগাছটিকে। ঈগল রাজা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলেন, “কেউ আওয়াজ করবে না। চুপ করে গিয়ে দূরের গাছের ডালে বসবে। প্যাঁচাদাদু এখন ঘুমোচ্ছেন। আমি ওঁর সঙ্গে গিয়ে কথা আগে কথা বলে আসি। প্যাঁচাদাদু অন্ধকার না হলে তো ওঁর কোটর ঘরের বাইরে আসতে পারবেন না!”
প্রাচীন ওকগাছটার পাশে রডোডেনড্রন ফুল বোঝাই ঝোপে হাজার হাজার প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছিল। পাখিদের কিচিরমিচির শুনে ওকগাছের কাছে উড়ে এল বেশ কিছু প্রজাপতি। ঈগল রাজার কথা শুনে একটা প্রজাপতি কাকাতুয়ার কানের কাছে গিয়ে বলল, “কোন সমস্যা হয়েছে নাকি ভায়া? প্যাঁচাদাদুকে দিনের আলোয় কোটরের বাইরে আসতে বলছ! ঈগল রাজাকে বলো আমরা প্রজাপতিরা আকাশ ঢেকে অন্ধকার করে দিচ্ছি, প্যাঁচাদাদুর কোন অসুবিধা হবে না।”
বলতে বলতে নিঃশব্দে আকাশ ছেয়ে ফেললো লক্ষ লক্ষ প্রজাপতি আর অন্ধকার নেমে এল ওকগাছ ঘিরে।
ঈগল রাজার ডাকে শুনে ঘুম ভেঙে কোটরের ভেতর থেকে প্যাঁচাদাদু বললেন, “পেন্নাম রাজামশাই এই অসময়ে আমার তলব?”
ঈগল রাজা বললেন, “প্যাঁচাদাদু দেখুন এই জঙ্গলের প্রায় সব পাখি আপনার কথা শুনতে এক সঙ্গে হাজির হয়েছে। এমনকি আপনার যাতে দিনের আলোতে কোটরের বাইরে আসতে অসুবিধা না হয় সেই জন্যে প্রজাপতিরা আকাশে উড়ে আলো আটকে দিয়েছে।”
প্যাঁচাদাদু কোটরের বাইরে এসে বললেন, “অনেক বয়েস হয়েছে। চোখে ভালো দেখতে পাই না। তা আমার কাছে সব পক্ষীকুল একসঙ্গে কেন?”
ঈগল রাজা কোটরের সামনের ডালে বসে হাঁক মারলেন, “টিয়ামাসি, ছোটুকে নিয়ে এস।”
টিয়ামাসি ছোটুকে নিয়ে ঈগল রাজার কাছের একটা ডালে উড়ে গিয়ে বসলেন। ঈগল রাজা বললেন, “ছোটু শোনা তো তোর বাজনা।”
ছোটুর ভয় আগেই কেটে গেছিল। ঈগল রাজার কথা শোনা মাত্র শুরু করে দিল, “করকর করকর কর, ডিম ডিমা ডিম ডিম, কাঁই না না কাঁই না না।”
ছোটুর বাজনা শেষ হতেই প্যাঁচাদাদু হুম হুম করে বলে উঠলেন, “অনেকদিন বেঁচে থাক দাদুভাই। এই বাজনা শিখলে কোথায়? এটা তো কুরকুরি আর কাঁসির আওয়াজ? দোপেয়ে মানুষরা পুজো-পার্বণে এই বাদ্যি বাজায়।”
ঈগল রাজা বললেন, “দাদু ছোটু আজ সকালে ওদের গাছ বাসার কাছে পাহাড়ের নিচের এক গ্রামে পাথ্থর ভগবানের পুজো হতে দ্যাখে। ওখানেই এক গাছের ডালে বসে এই বাজনা শুনে শিখে নেয়।তারপর বাসায় ফিরে ওর মার কাছে জানতে চায় পুজো কী? ভগবানই বা কে? ওর মা টিয়ামাসি উত্তরটা দিতে না পেরে তোমার কাছে নিয়ে আসছিল। তখন কাকাতুয়া টিয়ামাসির বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। সবাই মিলে তোমার কাছে আসছিল। পথে দেখা ময়ূরদের সঙ্গে। সেখানে ছোটুর বাজনা শুনে জড়ো হয় জঙ্গলের সব পাখি। সবাই নাচগান করে ছোটুর উত্তর খুঁজতে তোমার কাছে আসছিল। আমিও ওই সময় ওইখান দিয়ে উড়ছিলাম। অত পাখিদের একসঙ্গে দেখে ছোটুর কথা জানতে পারি। আমরা কেউ জানি না ভগবান কে, পুজো কী? তাই সবাই তোমার কাছ থেকে জানতে এসেছি ভগবান কে? পুজো কী? তুমি হলে পক্ষীকুলের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, তুমি আমাদের বল ভগবান কে? পুজো কী?”
প্যাঁচাদাদু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ভগবান কে তা জানি না। ভগবান বলে একা কেউ হয় না। এই যে পাহাড়, জঙ্গল, হাওয়া, জল, পশু পাখি সবাই ভগবান। ভগবান হল সৃষ্টি। আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ভগবান। প্রতিদিন কোন না কোন ভাবে প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে। এই নতুন সৃষ্টিকারী হলেন ভগবান, ঈশ্বর বা শক্তি। ঈশ্বর আমাদের দিয়ে সৃষ্টি করিয়ে নেন। আমরা হলাম ঈশ্বরের এক-একটা পথ। এই যে ছোটু এত সুন্দর বাজনা গাইতে পারল, শুনে সবাই বলবে ঈশ্বরের করুণা ছাড়া এত ভালো বাজনা কেউ গাইতে পারবে না। তার মানে ছোটু হল ঈশ্বরের একটা মাধ্যম। ওর মধ্যেও ঈশ্বর আছেন। আবার ধ্বংসও শক্তি। পাথর ভেঙে ভেঙে ছোট ছোট বালুকণার সৃষ্টি হয়। বালুকণা ভেঙে পলি। সেই পলিতে গাছপালা জন্মায়।”
“পুজো হল ঈশ্বর বা সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। পশুপাখি, পাথর, গাছপালা, নদী, সমুদ্র, মানুষ… সেই আদিকাল থেকে তাই এদের পুজো হয়ে আসছে ভগবানের বিভিন্ন রূপ কল্পনা করে।”
ছোটু এত কিছু বোঝে না, সে দুম করে বলে বসল, “প্যাঁচাদাদু আমরাও ভগবান পুজো করব!”
উপস্থিত সব পাখির দল একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “আমরাও পুজো করব, পাথ্থর ভগবানের।”
সব পাখির এক হাঁক শুনে ডাল থেকে এক ঝটকায় সুবিশাল দুই ডানা ছড়িয়ে আকাশে উড়ল ঈগল রাজা। আকাশ কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, “তোমাদের বলেছিলাম না চুপ করে থাকতে?”
সব পাখির চিৎকার থেমে গেল মুহূর্তে। ঈগল রাজা আবার প্যাঁচাদাদুর কোটরের সামনের ডালে গিয়ে বসলেন। বললেন, “প্যাঁচাদাদু ছোটুর আবদার মতো আমরা কি পুজো করতে পারি?”
প্যাঁচাদাদু বললেন “সে তো করাই যায়। এই ওকগাছ থেকে খানিক দূরে যে বড় নিমগাছটা আছে ওর কাছে গেলে দেখতে পাবে অনেক ছোটো ছোটো মাটির তৈরি হাতির মূর্তি পড়ে আছে একটা কালো সরু লম্বা পাথরের কাছে। মানুষরা এসে বছরে একবার ওই পাথরটাকে পুজো করে। হাতিরা যেন গ্রামে গিয়ে ফসল নষ্ট না করে তাই প্রার্থনা করতে আসে গ্রামের মানুষ। ওই পাথরটাই হল জঙ্গলের পাথ্থর ভগবানের প্রতীক। ওই নিমগাছটার কাছে অনেক কলাগাছের ঝোপ আছে। বড় লোমওয়ালা সোনালি রঙের হনুমানদের সর্দার থাকে ওই কলাবনে।ওর কাছে গেলে পাথ্থর ভগবান পুজোর কথা আরও ভালোভাবে জানতে পারা যাবে।”
ঈগল রাজা বললেন, “সর্দার হনুমানকে কে চেন? ডেকে আনতে পারবে?”
কাকাতুয়া বলল, “আমি চিনি, আমি ডেকে আনতে যাচ্ছি।”
কাকাতুয়ার কাছে প্যাঁচাদাদু ডেকেছে শুনে লাফাতে লাফাতে এল সর্দার হনুমান। বিশাল চেহারা। গায়ের লোম ঝকঝকে সোনালি। মুখটা কুচকুচে কালো। মাথা ভর্তি বড় বড় লোম ফুলে আছে। লম্বা ওকগাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে বসল প্যাঁচাদাদুর কোটরের সামনে।
“প্যাঁচাদাদু কেমন আছ? হঠাৎ আমার খোঁজ? জঙ্গলের সব পাখিরা এক সঙ্গে হাজির কেন?”
প্যাঁচাদাদু বললেন, “এই ছোটু টিয়া কী বলছে শোন। পাথ্থর ভগবানের পুজো করবে। বেটা, সর্দার হনুমানকে শোনাও তো তোমার বাজনা!”
ছোটু টিয়া বেশ মজা পেয়ে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে শুনিয়ে দিল, “করকর করকর কর, ডিম ডিমা ডিম ডিম, কাঁই না না কাঁই না না।”
ছোটুর গাওয়া বাজনা শুনে সর্দার হনুমান ছোটুকে কাঁধে বসিয়ে নিল। বলল, “অবিকল মানুষদের মতো বাজনা হয়েছে রে ছোটু।এত ভালো বাজনা শিখলি কী করে?”
প্যাঁচাদাদু ছোটুর বাজনা শেখার কাহিনি শোনালেন। বললেন, “মানুষদের দেখে ছোটুর শখ হয়েছে পাথ্থর ভগবানের পুজো করার। সঙ্গে-সঙ্গে সব পাখিরাও পুজো করতে চাইছে। কিছু তো একটা করতেই হয় সর্দার।”
সব পাখিরা আবার একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “পুজো করব, পুজো করব।”
ঈগল রাজা গাছের ডাল থেকে ডানা দুটো মেলে উড়তে গিয়েও আবার ডানা গুটিয়ে বসে পড়লেন।
সর্দার হনুমান বললেন, “অসুবিধা কী? কিন্তু জঙ্গলের অন্য জন্তু জানোয়ারদেরও তো জানানো দরকার। না হলে পরে বলবে আমরাও তো পুজোতে যোগ দিতে পারতাম। সবাইকে বরং খবর দেওয়া হোক কাল সকালে হাজির হবার জন্য।”
সর্দার হনুমানের কথা শেষ হতেই পাখির দল কিচিরমিচির করে বলে উঠল, “আমরা জঙ্গলের সবাইকে খবর দিতে যাচ্ছি।” হাজারো পাখি ডানা মেলে ছড়িয়ে পড়ল জঙ্গলের আকাশে।খালি টিয়া মাসি, ছোটু, কাকাতুয়া, ঈগল রাজা আর সর্দার হনুমান রয়ে গেল প্যাঁচাদাদুর কাছে।
৩
ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই ওকগাছের নিচে হাজির হতে শুরু করেছে হাতি, ভালুক, শেয়াল, বাঘ, খরগোশ, হরিণ, হনুমান, বাঁদর, কাঠবিড়ালি, বাইসন। এমনকি মৌমাছি, বোলতা, ভিমরুলরা পর্যন্ত ঝাঁক বেঁধে উপস্থিত হয়েছে। প্রজাপতিরা তো আছেই। শুধু সাপেদের দেখা নেই। পাখিরা ওদের খবর দিতে পারেনি। ওকগাছের আশপাশে আর জায়গা নেই। এত বড় প্রাণী সমাবেশ এই জঙ্গলে আগে কেউ ভাবেনি, দেখা তো দূরের কথা। সব হচ্ছে ছোটু টিয়ার জন্যে।
ওকগাছের ওপর থেকে চিৎকার করে সর্দার হনুমান বলতে শুরু করল। “প্রিয় জঙ্গলবাসী বন্ধুরা। আমরা প্যাঁচাদাদুর কাছে সময়ে-অসময়ে আসি পরামর্শ নেবার জন্য। আজ প্যাঁচাদাদু আমাদের সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছেন ছোটু টিয়ার এক আব্দার মেটানোর জন্যে। ছোটু টিয়া একটা জিনিয়াস। ছোটু বেটা তুমি একটু ঘুরে ঘুরে শুনিয়ে দাও তো তোমার বাজনা!”
ছোটু টিয়া ফুড়ুৎ করে গিয়ে বসল গিয়ে হাতির দলের বিশালবপু এক হাতির দাঁতে। গাইতে শুরু করলো তার বাজনা “করকর করকর কর, ডিম ডিমা ডিম ডিম, কাঁই না না কাঁই না না।”
বাজনা শেষ হতেই কান খাড়া করে থাকা হাতির দল শুঁড় তুলে জঙ্গল কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলে বলে উঠল, “ওয়া ওয়া, অসাধারণ।”
লাজুক ঠোঁটে আরও খানিকটা উড়ে গিয়ে ছোটু গিয়ে বসল এক হরিণের শিঙে। ছোটুর বাজনা শুরু হতেই হরিণের দল দু পা তুলে নাচতে শুরু করে দিল। তাই না দেখে বাকি সব জন্তুরাও নাচ জুড়ে দিল। গাছের ডালে বসে থাকা পাখির দল ডানা মেলে আকাশ জুড়ে নিজের মতো করে গান করতে লাগল। ওকগাছ ঘিরে সে এক দৃশ্য বটে।
ছোটু টিয়া লাজুক ঠোঁটে এক চক্কর আকাশে উড়ে আবার ফিরে গেল প্যাঁচাদাদুর কোটরের কাছে। আনন্দের হল্লা আর কিছুতেই থামে না। তখন আকাশে নামলেন ঈগল রাজা। উড়ে উড়ে সবাইকে চুপ করতে বললেন। খানিক পর সবাই শান্ত হলে, সর্দার হনুমান বলতে শুরু করলেন, “ছোটু এই বাজনাটা শিখেছে ছোটুদের গাছবাড়ির কাছে পাহাড়ের নিচে এক গ্রামে মানুষদের পাথ্থর ভগবান পুজোর বাজনা শুনে। ছোটুর ইচ্ছে মানুষদের মত পাথ্থর ভগবান পুজো করার।”
“পুজো হবে, পুজো হবে,” বলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল জন্তু-জানোয়ারের দল।
হাত দেখিয়ে সবাইকে শান্ত হতে বললেন সর্দার হনুমান। তারপর বলা শুরু করলেন, “এই ওকগাছ থেকে খানিক দূরে কলাগাছের ঝোপে যেখানে আমি থাকি, তার কাছে যে বড় নিমগাছটা আছে, সেটার নিচে একটা সরু লম্বা কালো পাথর আছে। মানুষরা মাঝে মাঝে এসে ওঁ পাথ্থর ভগবান, ওঁ পাথ্থর ভগবান বলে ওই পাথরটাকে পুজো করে। হাতিরা যাতে ওদের গ্রামে না ঢোকে, জঙ্গলেই থেকে যায় সেই জন্যে মাটির হাতির মূর্তি রেখে যায় ওই পাথরটার কাছে। প্যাঁচাদাদু বলেছেন আমরা চাইলে ওই পাথ্থর ভগবানের পুজো করতে পারি। পাথর না থাকলে এই উঁচু পাহাড়টা হত না, এত সুন্দর উঁচুনিচু জঙ্গল ঘরবাড়ি আমরা পেতাম না।তাই পাথরকে আমরা পুজো করব আমাদের আশ্রয় দেবার জন্য।”
হাতিদের দলপতি এগিয়ে এলেন, “পুজো করার জন্য আমাদের কী করতে হবে সর্দার হনুমান? আদেশ করুন।”
সর্দার হনুমান বললেন, “নিমগাছের জায়গাটা খুব ছোট, ওখানে পুজো করলে সবাই থাকতে পারবে না। তার থেকে ভগবানকে বয়ে এই ওকগাছের নিচে নিয়ে আসতে পারলে ভালো হয়।কিন্তু ভগবানকে বয়ে আনলেই তো হবে না! মানুষদের মতো জল দিয়ে ভগবানকে স্নান করাতেও তো হবে। জল পাব কোথায়?”
হাতিদের দলপতি বললেন, “সর্দার হনুমান ওটা হাতিদের ওপর ছেড়ে দিন। আমি কয়েকজনকে নিয়ে ভগবানকে আনতে যাব। বাকি হাতিরা নদী থেকে শুঁড়ে করে জল নিয়ে আসবে।”
দলপতি গোটা কয়েক লম্বা দাঁতওয়ালা হাতির দল নিয়ে ছুটলেন নিমগাছের দিকে। আর বাকি হাতির পাল ছুটল নদী থেকে শুঁড় বোঝাই করে জল আনতে।
হাতির দল চলে যেতে বাকি সবাই বলে উঠল, “আমাদের কী করতে হবে বলুন সর্দার হনুমান।”
সর্দার হনুমান বললেন “ভগবান পুজোর জন্য ফুল আনতে হবে। সবার জন্য খাবার জোগাড় করতে হবে। চাইলে সবাই মিলে নাচগান করে একটু আনন্দ করা যেতে পারে।”
খাবারের নাম শুনে বাঘ আর শেয়ালের দল জুলজুল করে তাকাল হরিণের দলের দিকে। সামনে এত খাবার হাজির তাহলে আর খাবার জোগাড় করতে হবে কেন? হরিণের সর্দার বাঘ আর শেয়ালের লোভীর মতো তাকান দেখে শিং নেড়ে তেড়ে গেল, ওমনি দুজনের মাঝে এসে দাঁড়ালো এক ভালুক। “ছিঃ বাঘ শেয়াল, সবার সঙ্গে ভগবানের পুজো করতে চেয়েও খাবার নাম শুনে হরিণের দিকে তাকাতে শুরু করেছ? হরিণ তোমরাই বা ভাবলে কী করে আমরা সবাই থাকতে আজকে তোমাদের বাঘ শিয়ালে খাবে? অন্য সময় যার যার খাবার সে বুঝে নেবে। আজ যা জোগাড় হবে সবাইকে তাই মিলেমিশে খেতে হবে।”
লজ্জায় মুখ নিচু করে থাবায় মুখ গুঁজে বসে পড়ল বাঘ ও শেয়ালের দল।
সর্দার হনুমান বললেন, “ময়ূর তোমরা কি আজ নাচ দেখাবে?”
ময়ুরের দল তো একরকম পেখম উঁচিয়েই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল ঘাস জমি জুড়ে পেখম মেলে নাচ প্র্যাকটিশ করতে শুরু করল। টিয়ার ঝাঁক ছোটুর কাছে বাজনা শিখতে বসে গেল। কাঠঠোকররা গাছের গুঁড়িতে গুঁড়িতে টিয়াদের বাজনার তালে তালে ঠকঠকানি শুরু করে দিল। হাঁড়িচাচা, ছাতারে, বসন্তবৌরি সবাই ঢুকে গেল গানবাজনার দলে। শুধু একটা কোকিল মাঝে মাঝে ভুল সময়ে কু কু করে ডেকে তাল কেটে দিচ্ছিল।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শালিক, চড়াই, কাক, টুনটুনি, বাবুই, বুলবুলি এদের নিয়ে আলাদা করে মিটিং-এ বসল কাকাতুয়া। জঙ্গলের সেরা গাইয়ে হলেও নাচগানের দিকে নজর দেবার ফুরসত নেই। অনেক কাজ বাকি, সময় নেই। কাকাতুয়ার নির্দেশে চড়াই আর টুনটুনির দল ছুটল জঙ্গল থেকে ফুল জোগাড় করতে। শালিক, বুলবুলি আর কাকের দল লেগে পড়ল খাবার জোগাড় করতে। বাবুইরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল গাছ পাতা দিয়ে পাথ্থর ভগবানের জন্য চাঁদোয়া বানাতে।
একটু আগেও জায়াগাটা পশুপাখিতে থিক থিক করছিল। আর এখন আলসেমি করে শুয়ে বসে থাকা কয়েকটি বাঘ, শেয়াল , হরিণ আর ভালুক ছাড়া কেউ নেই। এমনকি কাকাতুয়াকে জানিয়ে খরগোশ, কাঠবিড়ালি পর্যন্ত খাবার জোগাড় করতে চলে গেছে।
বাঘ, শেয়াল, হরিণ আর ভালুকদের গোল হয়ে শুয়ে বসে আড্ডা মারতে দেখে ঈগল রাজা ওকগাছের মাথা থেকে সোজা উড়ে এসে বসলেন ওদের মাঝে। তারপর একপায়ে খাড়া হয়ে বিশাল দুই ডানা ছড়িয়ে জানতে চাইলেন, “তোমরা চুপচাপ বসে আছ কেন? তোমরা কি পুজোতে যোগ দেবে না?”
একটা বাঘ বলে উঠল “সরি, আমাদের কী করতে হবে বলুন ঈগল রাজা।”
ঈগল রাজা বললেন “যাও তোমরা গিয়ে ওকগাছের নিচটা ভালো করে খুঁড়ে সমান কর।”
বাঘ, শেয়াল, হরিণ আর ভালুকেরা উঠে গিয়ে পায়ের থাবা আর শিং দিয়ে মাটি খুঁড়ে পরিষ্কার করে সমান করতে শুরু করল। কেউ আর বসে নেই।
সবাইকে কাজে লাগিয়ে ঈগল রাজা গাছে উঠে কী করে পুজো করতে হবে তার আলোচনা করতে শুরু করল হনুমান সর্দারের সঙ্গে। ঠিক হল যেহেতু সর্দার হনুমান গাছের ওপর বসে মানুষদের পুজো করতে দেখেছেন তাই তিনিই পুজো করবেন।
একটু পরে জঙ্গল তোলপাড় করে দুই দাঁতাল শুঁড়ে ধরে পাথ্থর ভগবানকে নিয়ে এসে সোজা করে বসিয়ে রাখল ওকগাছের নিচে বাঘ, শেয়াল, হরিণ আর ভালুকের পরিষ্কার করা জায়গাটায়। শুঁড় তুলে পোঁ পোঁ করে আওয়াজ করে উঠল হাতির দল। দেখাদেখি গর্জন করে উঠল বাঘেরা। শেয়াল ও ভালুকরাও বাদ গেল না। শুধু হরিণের দল জোরে আওয়াজ করতে পারে না বলে দু’পা তুলে নাচতে লাগল। নদী থেকে শুঁড়ে করে জল নিয়ে আসা হাতির পাল সর্দার হনুমানের নির্দেশে পিচকিরির মত জল ছিটিয়ে পাথ্থর ভগবানকে স্নান করিয়ে দিল। চড়াই আর টুনটুনিরা ঠোঁটে করে জঙ্গলের গাছ থেকে ফুল নিয়ে এসে জমাতে লাগল ওকগাছের কাছে। ফুলের সুগন্ধে ভরে উঠল চারদিক।
বাবুই পাখিরা সুন্দর করে গাছের আঁশ আর পাতার চাঁদোয়া বানিয়ে ওকগাছের ডাল থেকে পাথ্থর ভগবানের ওপর ঝুলিয়ে দিয়েছে। শালিক, বুলবুলি আর কাকেরা গাছের ছোট ছোট ফল নিয়ে এসে প্রায় একটা পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে। সর্দার হনুমানের সাকরেদরা একগাদা পাকাকলা জড়ো করেছে। কাঠবেরালিরা জঙ্গল থেকে জোগাড় করেছে রাশিরাশি বাদাম। এমনকি খরগোশরা পর্যন্ত কচি ঘাস নিয়ে এসেছে। যা খাবার জড়ো হয়েছে তাতে জব্বর বুফে হবে। শুধু বাঘ আর শেয়ালের দল করুণ চোখে তাকিয়ে আছে খাবারের দিকে। বাঘ, শেয়াল ফল খেয়েছে শুনলে অন্য জঙ্গলের বাঘ শেয়াল যা বলবে ভাবতেই ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে ওদের।
৪
গাছে গাছে রঙিন পাখির দল বসে জমিয়ে আড্ডা জুড়ে দিয়েছে। হাতির দল ফলের স্তূপের কাছে দাঁড়িয়ে খাবারের ভ্যারাইটি নিয়ে আলোচনা করছে। ময়ূররা নাচের প্র্যাকটিশ করেই চলেছে। খানিক দূরে বাঘ আর শেয়ালরা থাবায় মুখ গুঁজে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মাটি খুঁড়তে গিয়ে এক বুড়ো ভালুকের নখ উপড়ানো রক্তপাত বন্ধ করতে এসে এক বেজি সেখানে পাতার পুলটিশ লাগিয়ে দিচ্ছে। ঘোঁত ঘোঁত, টুঁই টুঁই, পোঁ পোঁ হাজারো শব্দে কানপাতা দায়। চিৎকার করে করে সর্দার হনুমানের গলা ভেঙে গেছে। শিশু পশুপাখিরা খিদে পেয়েছে বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। কেউ কারো কথাই শুনতে পাচ্ছে না ভালো করে।
ঈগল রাজা আকাশে উড়ে তীক্ষ্ণ কিঁ কিঁ শব্দে বলে উঠলেন, “বন্ধুরা, চেঁচিয়ে কথা বলে বলে সর্দার হনুমানের গলা খারাপ হয়ে গেছে। আপনারা লাইন দিয়ে ভগবানের উদ্দেশে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পুজো হয়ে গেলে খাবার খেয়ে নিন। হুড়োহুড়ি করার কোন দরকার নেই। স্বেচ্ছাসেবক পাখি ও হনুমানের দল আপনাদের ফুল ও খাবার পেতে সাহায্য করবে।
“বন্ধুরা, প্যাঁচাদাদুর কাছে জানতে পারলাম মানুষ পশুপাখি যেমন হাতি, হনুমান, প্যাঁচা, ইঁদুর… এমনকি ঈগলকে ভগবানের দূত মনে করে পুজো করে। এমনকি মানুষ মানুষের পুজোও করে। আমরাও মানুষদের থেকে কিছু কম যাই না। আমরাও ভগবানকে শ্রদ্ধা জানাতে জানি।”
লাইন এত লম্বা হয়ে গেছে যে পুজো আর কিছুতেই শেষ হয় না। যারা একটু বৃদ্ধ তারা আস্তে আস্তে চলেছেন। পুজো শেষ হতে হতে সেই সন্ধে হয়ে গেল।অন্ধকারে নাচগানের অনুষ্ঠান হবে কী করে এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন ঈগল রাজা ও সর্দার হনুমান। শত হলেও এঁরাই হলেন পুজোর প্রধান আয়োজক!
দুজনেই আবার ছুটলেন প্যাঁচাদাদুর কাছে। প্যাঁচাদাদু শুনে বললেন, “তোমরা বাবুইপাখিকে ডাক। শুনেছি ওরা ওদের বাসা নাকি জোনাকি পোকাদের দিয়ে আলো করে। কিন্তু খবরদার আজকে যেন একটাও প্রাণী হত্যা না হয়।”
ঈগল রাজা ডাকলেন বাবুই পাখিদের। সব শুনে তারা বলল, আলোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বাবুই পাখিরা ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। ঝোপঝাড় থেকে জোনাকি পোকাদের ডেকে নিয়ে এসে খানিক সময়ের মধ্যে ওকগাছের আশপাশ ছেয়ে দিল হালকা সবুজ আলোতে। আকাশে চাঁদও উঠেছে বড় হয়ে। চাঁদের সঙ্গে জোনাকি পোকার আলো স্বর্গীয় পরিবেশ গড়ে দিল।
অনুষ্ঠান শুরু হল ছোটু টিয়ার বাজনা গান দিয়ে। শেষ হতেই সব পশুদের সমবেত পায়তালি ও পাখিদের চিৎকারে জঙ্গল ভরে গেল। তারপর টিয়ার দল আকাশ জুড়ে উড়ে উড়ে শুরু করল তাদের কনসার্ট, সঙ্গে যোগ দিল অন্যান্য পাখির দল। ময়ূররা পেখম তুলে নাচ শুরু করল ঘাসজমি জুড়ে।
ময়ূররা নাচ শুরু করতে হাতির দল আর নিজেদের সামলে রাখতে পারল না।সামনের দু’পা তুলে মাথা দুলিয়ে পোঁ পোঁ করে আওয়াজ তুলে নাচ শুরু করে দিল। বাঘ শিয়াল ভালুক হরিণ সবাই মিলে নাচতে শুরু করল। জঙ্গল কাঁপতে লাগল সবার সমবেত নৃত্যে। খালি খরগোশের দল হাতি বাঘের পায়ে চাপা পড়ার ভয়ে দূরে সরে গাছের গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল ।
শেয়ালের গান দিয়ে যখন অনুষ্ঠান শেষ হল তখন সূর্য আবার আকাশে দেখা দিতে শুরু করেছে। সারারাত নাচগান করে ক্লান্ত পশু পাখির দল যে যেখানে পারল শুয়ে বসে ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু ঘুম এল না সর্দার হনুমান আর ঈগল রাজার। হাতিদের দলপতির কাছে গিয়ে ঈগল রাজা বললেন পাথ্থর ভগবানকে আবার নিমগাছের তলায় রেখে আসতে হবে।
হাতিদের দলপতি পোঁ পোঁ করে হাঁক দিয়ে উঠলেন। হাঁক শুনে জেগে উঠল সব পশুপাখি। দুই দাঁতাল পাথ্থর ভগবানকে শুঁড়ে জড়িয়ে রওনা দিল নিম গাছের দিকে। পেছন-পেছন লাইন দিয়ে চলল বাকি সকলে। এবার জঙ্গলের যার যার ডেরায় ফেরার পালা ।