কায়াশূণ্যের কায়া

কায়াশূণ্যের কায়া

চিলেকোঠার একফালি ঘরটাই হল অভয়ের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের দরবার। ওদের তিনতলা সেকেলে বাড়িটা শরিকি বিবাদে একেবারে পর্যুদস্ত।

অভয়ের পরিবার স্বাধীনতার ঠিক পরপরই ওপার বাংলা থেকে এদেশে চলে আসে। ওর ঠাকুর্দাকে প্রায় কপর্দকশূণ্য  অবস্থায় এক কাপড়ে এ-দেশে চলে আসতে হয়। ওঁরা দুই ভাই ছিলেন। বড়ভাইয়ের তরফে এক ছেলে আর ওঁর দুই পুত্রসন্তান।

শুরুর দিকে খুব কষ্টে দিন কেটেছিল সবারই। ওদেশের জমিজমার বিনিময়ে এখানে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট সাবডিভিশনের টাকি শহরে ছয়কাঠা জমি কেনেন অভয়ের ঠাকুর্দা। সেখানে তাদের বসত জমানো শুরু। তারপর আস্তে আস্তে পরিবারটি কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখে যখন অভয়ের ঠাকুর্দা সরকারী দপ্তরে কেরানীর চাকরি পান।

অভয়ের বাবা-কাকা দুজনেই স্কুলশিক্ষকতা করতেন। কয়েকবছর আগে সময়ের স্বল্পব্যবধানে তারা অবসর গ্রহন করেছেন। অন্যদিকে অভয়ের বাবার জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছোটোখাটো একটা কাপড়ের দোকান আছে। খুব বড় অবিশ্যি নয়, তবে মফঃস্বল শহরের অনুপাতে বেশ ভাল। সব মিলিয়ে বেশ বড় পরিবার।

ঠাকুর্দার আমলে, দুইভাই তাদের পরিবারকে একান্নবর্তী ধারায় কঠোর অনুশাসনে বেঁধে রেখেছিলেন। বড়ভাই গত হবার পর সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে সব পৃথগন্ন হয়েছে। একতলা বড়ঠাকুর্দার ছেলে এবং তাঁর সন্তানাদির দখলে। দোতলার দুই অংশ জুড়ে অভয়ের বাবা আর কাকার পরিবার বসবাস করে।

তিনতলার ছাদের এককোণে এই চিলেকোঠার ঘরটা  এতদিন স্টোররুম হিসাবেই বরাদ্দ ছিল। অতিসম্প্রতি অভয় টাকি কলেজে ভর্তি হবার পর সেটি সাফসুতরো করে নিজের রাজত্ব বিস্তার করেছে। আসলে বাড়ির নিত্যদিনের কলহবিবাদে অভয়ের পড়াশোনা প্রায় লাটে উঠতে বসেছিল। সারাদিন কলেজে ক্লাসের চাপের পর সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে পারিবারিক এই আবহে কোন সুস্থ মানুষের বইপত্রে মনোনিবেশ করা নিতান্তই দুঃসাধ্য কাজ।

প্রথম দিকে অভয়ের বাবা ছাড়া সবতরফেরই এতে মৃদু আপত্তি ছিল। কিন্তু অভয় লেখাপড়ার দিক থেকে ঠাকুর্দার প্রিয়পাত্র হওয়ায় কোন ওজর আপত্তি ধোপে টেকেনি। ফলত এই ছোটঘরটি আজ অভয়ের অভয়ারণ্য।

অভয়ের মা অবিশ্যি একটু কিন্তু কিন্তু করেছিলেন। আসলে তিনতলার ছাদের ওদিকটা একরকম তার নজরের বাইরে থাকায় তাঁর ধারনা হয়েছিলো যে আনমনা ছেলের তিনি সঠিকভাবে খেয়ালপত্তর রাখতে পারবেন না। আর বয়সের কারণে ঘন ঘন সিঁড়িভাঙা যে সম্ভবপর হবে না এটাও তার মাথায় ছিল।

সত্যি বলতে কি, এ-সব কারণ যে অভয়ের অগোচরে ছিল না তা নয়। সে নিজেও এই একলা রাজত্বের সুখস্বপ্নে বিভোর ছিল। গ্রীষ্মকালে সারাদিনের রোদে ঘরটা তেতেপুড়ে আগুন হয়ে থাকলেও তার কাছে সেটা স্বর্গ বলেই মনে হত। কারণ সন্ধ্যাবেলা তার ঘরে খানিক দূরের ইছামতী নদীর দিক থেকে মিঠে বাতাস বইত। এয়ারকন্ডিশন্ড যন্ত্রের হাওয়া তার কাছে নেহাতই শিশু! পূর্ণিমার রাতে ঘরের জানালা দিয়ে নদীটাকে এক মোহময়ী রাজকন্যা বলে মনে হত তার।

ঠিক সেই সময়েই তার একান্ত প্রিয় গায়িকা বেগম আখতারের গানের লাইনক’টি মনে গুনগুনিয়ে সুর তুলত-“জোছনা করেছে আড়ি, আসেনা আমার বাড়ি, গলি দিয়ে চলে যায়, লুকিয়ে রুপোলি শাড়ি।”

রোজ রাত্রে ঘুম আসা না পর্যন্ত অভয়ের বই পড়া বা গান শোনাটা বরাবরের অভ্যেস। রাত জেগে বই পড়ার মধ্যে বেশ আলাদা একটা আমেজ আছে। আর সাথে রেডিওতে এফ.এম.-এ গানের ভাল ভাল অনুষ্ঠান শোনা, সত্যি এর জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে, পুরনোদিনের গান শুনতে শুনতে সে কতদিন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। রেডিওটা ইলেকট্রিকে চলে।তবে ভাগ্যিস রেডিওটাতে টাইমার সিস্টেম আছে, নাহলে ইলেকট্রিক লাইনের দফারফা কেউ আটকাতে পারত না। রেডিওটা সে এক গানের অনুষ্ঠানের ক্যুইজ প্রতিযোগিতাতেই জিতেছে। তার বড় আদরের সম্পদ এটি।

সেইরাতে খাওয়ার পর বেশ আয়েশ করে বসে রেডিওর নবটা ঘুরিয়ে অন করতেই ভেসে এলো তার প্রিয় রেডিওজকি কবীরের কণ্ঠস্বর, “নমস্কার। আপনাদের একান্ত প্রিয় ‘হৃদয়ের কাছাকাছি’ এফ.এম. চ্যানেলে আমি RJ কবীর আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি সম্পুর্ণ অন্যরকম এক অনুষ্ঠান। আজ আপনারা আমার সাথে গান তো শুনবেনই, তবে কিছুটা ব্যতিক্রমীরূপে।

“আমাদের সাথে আজ উপস্থিত আছেন বিখ্যাত ভূতবিশেষজ্ঞ, শ্রীভূতেশ্বর পাকড়াশী। উনি আজ আমাদের ওঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা শোনাবেন। আপনারা সবাই আমাদের ফোননম্বরে স্টুডিওতে যোগাযোগ করতে পারেন। অশরীরি সম্বন্ধীয় সকল সন্দেহ নিরসন করতে আমরা ভূতনাথবাবুর সাথে আপনাদের ফোনের অপেক্ষায়। সাথে থাকবে পুরনোদিনের ভৌতিক চলচ্চিত্রের অদ্ভুতুড়ে গানের ডালি এবং নির্ভেজাল আড্ডার আবহ।”

অনুষ্ঠানের গৌরচন্দ্রিকা শুনে অভয় মনেমনে বেশ খুশিই হল। যাক আজ তাহলে বইপর্ব তুলে রেখে ভূতুড়ে আড্ডায় মনোনিবেশ করা যাক। বাইরে ঝড়বৃষ্টির জন্য ঝোড়োহাওয়া বইছে। আদর্শ আবহ বটে। এ-ব্যাপারে সে খুব শক্তহৃদয়ের না হলেও অনুষ্ঠানের টানটা অগ্রাহ্য করতে পারল না। এতগু্লো লোক রাতজেগে অনুষ্ঠান শুনবে, ফোন করবে, ভূতের খেয়েদেয়ে কাজ নেই আর কী! উৎপাত করলেই হল!

ইতিমধ্যে RJ কবীর স্বভাবসিদ্ধভঙ্গিমায় ভূতনাথবাবুকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, এই যে আপনি ভূতের খোঁজে দেশবিদেশে এত ভূতুড়েস্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আপনার কি মনে হয় আদৌ তেঁনারা মানুষের প্রতি সদয় হয়ে দেখা দেন? মানুষের সাহচর্য কি সত্যি তেঁনারা এড়িয়ে চলেন?”

গলাখাঁকারি দিয়ে ফ্যাঁশফ্যাঁশে গলায় ভূতনাথবাবু বলে ওঠেন, “মাফ করবেন, আজ গলাটা একটু বিড়ম্বনা দিচ্ছে। আসলে তেনাদের খোঁজে রাজস্থানের ভানগড় ঘুরে সেখান থেকে কাল ফেরার পর……,যাক্গে থাক সে কথা, আপনার কথায় আসি। হ্যাঁ, বহুজায়গায় ঘুরেছি বটে তেনাদের খোঁজে। কতকজায়গায় রাত কাটিয়ে বুঝেছি, নিতান্তই বুজরুকি আরকি। আবার কোনও কোনও জায়গায় মনে হয়েছে সত্যিই কেমন কেমন একটা ব্যাপার সেখানে রয়েছে।

“আসলে চক্ষুকর্ণের অগোচরে যা থেকে যায়, সেটাই আমরা বরাবর অশরীরী তকমা দিয়ে এসেছি। ভূত মানেই আমাদের কাছে রোমহর্ষণকারী বৈদেহিক এক অনস্তিত্বের অস্তিত্ব। একটা কথা আমরা বরাবরই ভুলে যাই যে তেনারা আমাদেরই দেহহীন রূপকল্প। তাই দেহটা না থাকায় খামোখা মানুষদের এড়িয়ে যাবেন, এই তত্ত্বটাই কেমন যেন হাস্যকর। যেমন ‘তেঁনারা’ মানেই চন্দ্রবিন্দু এটা অনৈতিক”।

“বাহ্, বেশ বললেন তো আপনি”, অপরদিক থেকে বললেন RJ কবীর। পরবর্তী প্রশ্ন ধেয়ে এল ভূতনাথবাবুর দিকে, “আচ্ছা সে নাহয় হল, তেঁনাদের অস্তিত্বটা বোঝার কোনও বিজ্ঞানসম্মত উপায় আছে কি আপনাদের মত ভূতবিশেষজ্ঞদের কাছে? ওই মানে, বোঝেন তো আর কি। বিজ্ঞান তো আবার প্রমাণ চায়।”

এবার কিছুটা বিরক্তিসহকারে আওয়াজ করে ভূতনাথবাবু বলে উঠলেন, “আরে থামুন তো মশাই, আপনাদের খালি প্রমাণ আর প্রমাণ। সবেতেই ওই বিজ্ঞান কপচানো এখনকার মানুষের বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবই যদি বিজ্ঞান বলবে, তাহলে বাকিরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে। তবে আপনাদের মত লোকেদের সন্দেহ নিরসনেরও ব্যাবস্থা আছে। এই দেখুন, তাদের তড়িচ্চুম্বকীয় অস্তিত্ব মাপার যন্ত্র”। অপরদিক থেকে RJ কবীরের ভীতস্বর ভেসে আসে, “ওকি ওকি, কাঁটাটা যে নড়ছে”। পরদিন সকালের খবরে বেতারঘোষিকার মন্দ্রস্বর-“কাল বিকেলে প্রখ্যাত রেডিওজকি কবীর এক পথদুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন”। বাইরে থেকে দরজায় অভয়ের মা ধাক্কা দিতে দিতে হাঁক পাড়েন, “ওরে ও অভয়, বাবা আর দেরি করিসনি। আর কতবার তোর চা গরম করে নিয়ে আসব। বুড়োবয়সে আমার হয়েছে যত জ্বালা। কাল রাতে বৃষ্টির পর এদিকে আবার  সারারাত লোডশেডিং। কখন যে বিদ্যুৎদেবতা সদয় হবেন।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত