বিল্ব মঙ্গল

বিল্ব মঙ্গল

“তাইলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো কত্তা?” চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করল কেষ্ট।

কেষ্ট নানান ফিকিরে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, অনেক রকম খবরাখবর রাখে। খাওয়ার কথায় একটু লাগামছাড়া হয়ে পড়লেও ঠান্ডা মাথায় কার্যোদ্ধার করতে ওর জুড়ি নেই। লোকে তাকে ভালোবাসে, দশরকম খুচরো কাজের জন্য ভরসা রাখে তার ওপর।

“পেট নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছি রে! পাকা বেল পাচ্ছি না যে একটু শরবত করে খাব!” বললেন চক্কোত্তিমশাই।

বিদ্যেবুদ্ধি, বিষয়আশয় ইত্যাদি যথেষ্ট আছে মাধব চক্কোত্তি মশাইয়ের। ইংরেজি জানেন, খবরের কাগজ পড়েন নিয়মিত, শহরে যাতায়াত আছে, মানী লোক; শুধু বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর নিয়ে বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আপাততঃ পেটগরম নিয়ে বাড়ি সরগরম করে রেখেছেন, বেলের শরবত চাই-ই চাই। কিন্তু এই অসময়ে পাকা বেল পাওয়া প্রায় অসম্ভব; বড় আতান্তরে পড়ে কেষ্ট-নাম স্মরণ করেছে বাড়ির লোক।

“আপনার সমস্যা ওর নিরেট মাথায় ঢুকবে না,” মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন খগেন পোদ্দার।

বয়সকালে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেলে ঠ্যাঙানো খগেন পোদ্দার জ্ঞানদানের এতটুকু সুযোগ হাতছাড়া করেন না কখনও; মাস্টারি তাঁর হাড়েমজ্জায় মিশে গেছে। কল্পনার রঙ চড়িয়ে গপ্পো বানাতে আর লাগাতার বকবক করতে তাঁর জুড়ি নেই। গাঁয়ের লোকজন তাঁকে একটু এড়িয়ে চলে বটে; কিন্তু তাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।

“একদম নিরেট; রোদে-জলে ঘুরে ঘুরে মাথা বেলের মত শক্ত হয়ে গেছে”, কথাটা মেনেই নিল কেষ্ট।

“তোর মাথা আর বেল! তুলনা হয়?” পোদ্দার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন।

“আজ্ঞে, তা ঠিক। বেল খুব মজার জিনিস; বাইরেটা শক্ত কিন্তু ভেতরে কি সুন্দর নরম শাঁস, কী সুন্দর হলদেপানা রং”, কেষ্ট বলে।

“ভেতরে বাইরে এক হওয়া সহজ নয়, জেনে রাখ!” পোদ্দার দার্শনিক হয়ে যান।

“আজ্ঞে, জানবই বা কী করে? মাত্র দু’রকম তো বেল দেখেছি, এমনি বেল আর কয়েতবেল”, কেষ্ট বলে।

“তবে? বেলে বেলেই এত ফারাক! গাছ পাতা ফল সব আলাদা। একটায় শিবপুজো হয় – শ্রীফল, অন্যটা বাঁদরের আস্তানা – কপিত্থ”, পার্থক্য বুঝিয়ে বেলে লেবেল লাগিয়ে দেন খগেন পোদ্দার।

“তা আর বলতে! একটার শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে, মোরব্বা খেলে পেট পরিষ্কার হয়। অন্যটা একটু কাঁচালঙ্কা চটকে নুন দিয়ে…..” কথা শেষ করতে পারে না কেষ্ট, তার আগেই ঢোঁক গিলে নিজেকে সামলে নেয়।

দিন দুয়েক আগে চক্কোত্তি মশাইয়ের বাড়ি থেকে লোক মারফৎ খবর গিয়েছিল কেষ্টর কাছে, বেলের জন্য। আজ সকালে এদিকে আসার পথে খগেন পোদ্দারকে দেখে কেষ্ট কেটে পড়ার তালে ছিল; কিন্তু ঠিক পাকড়াও করে ফেললেন খগেন পোদ্দার। তারপর জেরায় জেরায় জেরবার করে চক্কোত্তি মশাইয়ের অসুখের কথা কেষ্টর পেট থেকে টেনে বার করলেন। তারপর অসুখ-দাওয়াই-ডাক্তার-বদ্যি-ওষুধ-পথ্য ইত্যাদি নিয়ে বিশদে একপ্রস্থ ভাষণ দিলেন; বেল-আয়ুর্বেদ-জড়িবুটি-টোটকা কিচ্ছু বাদ পড়ল না। কথায় কথায় জানালেন তাঁর কাকাশ্বশুরের ভাইরাভাইয়ের পেটের অসুখের কথা। জানালেন কয়েকটা বেল তাঁরও চাই; আর এই অসময়ে বেল জোগাড়ের ব্যাপারে কেষ্টই একমাত্র ভরসা, সে কথাও বললেন। কেষ্ট হাঁটতে শুরু করায় পোদ্দারও পায়ে পা মেলালেন। হাঁটতে হাঁটতে কেষ্টকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, বেশি কষ্ট করার দরকার নেই; চক্কোত্তিমশাইয়ের জন্য বেলের খোঁজ পেলে সেখান থেকে কয়েকটা দিলেই হবে, শুধু জানাজানি না হলেই হল। কেষ্ট এহেন প্রস্তাবে বিরক্ত হলেও অবাক হয় নি, খগেন পোদ্দারের এই গুণটার কথাও সবাই জানে।

চক্কোত্তিবাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে পোদ্দারের হাঁকডাক শুনে মনে হল কেষ্টকে তিনিই ধরে এনেছেন। চক্কোত্তি মশাইয়ের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পরে আবার শুরু হল একই আলোচনা – পেটের অসুখ, ওষুধপথ্য, বেলের উপকারিতা, আয়ুর্বেদ ইত্যাদি। আলোচনা তো নয়, খগেন পোদ্দারের একতরফা বকবক। মাঝে সবার জিভ-সেবা হয়েছে; কিন্তু কাজের কথা হয়নি। নিজের পেট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত চক্কোত্তি মশাই হুঁ হাঁ করে যাচ্ছেন বিরক্তি চেপে রেখে। সকাল থেকে একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত কেষ্ট জিজ্ঞাসা করেছে – “তাইলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো কত্তা?”

চক্কোত্তিমশাই বললেন, “পেটটা ঠিক রাখতে পাকা বেলের শরবতটা খুব দরকার ছিল।”

“ঠিক, তাই তো পেটকে ‘বেল-ই’ বলে, সম্পর্কটা গূঢ়”, সুযোগ ছাড়লেন না খগেন পোদ্দার।

“বুঝুন তবে; গুড় দিয়ে মোরব্বা বানিয়ে বেল-জারে রেখে দিন, তারপরে বচ্ছরভর খান, আ হা হা”, বলে কেষ্ট।

“তবে নো ভেলি গুড়। বেলির জন্য ভেলি চলবে না”, পোদ্দার সাবধান করে দেন।

“তবে তো চিটেও চলবে না; সব কিছু আটকে রয়ে যাবে পেটে”, কেষ্ট আরও সাবধানী হয়।

“গলে পড়া বেল-বটম কে বেলিতে আটকে রাখার জন্য বেল্ট চাই, বাড়তে থাকা ‘বেলি’কে বাঁধার জন্যও বেল্ট লাগে”, খগেন পোদ্দার বলেন।

“ওসব তত্বকথা বাদ দিয়ে বেল জোগাড় কর দেখি!” – রাশ টানতে চেষ্টা করেন চক্কোত্তিমশাই।

“তাই তো বলছি, এই ‘নো-বেল’ ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে নিয়ে তবে বেলতলায় যাওয়া ভালো, নইলে ‘বেল অন হেড’ হওয়ার ভয় আছে।”

“আজ্ঞে বেলন কি বেল কাঠের হয়? তা হোক না হোক, কাঁঠাল কাঠের বেলন-চাকীতে রুটি বেশ বেলুনের মত গোল আর ফুলকো হয়, গরম গরম খুব জমে”, ফুলকো রুটির কেষ্ট-কল্পনা ফুলেফেঁপে ওঠে।

“বেলুন কিন্তু বাতাসে ওড়ে। বেলের মতো শক্তপোক্ত নয় বলেই ওটা ‘বেল-ঊন’, একটু হীন অর্থে, ঊনত্রিশ, ঊনচল্লিশ এর মতো। আবার বেল ন্যাড়া মাথায় পড়লেও, লোকে ‘বেল-উড়ে’ গিয়ে মাথা ন্যাড়া করে সন্ন্যাসী হয়”, খগেন পোদ্দার ব্যখ্যা দিলেন।

“তবে যাই বলুন, বেলুড়ের প্রসাদ একবার খেলে ভোলা যায় না”, কেষ্ট বলে।

নিজের পেট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত চক্কোত্তিমশাই সকাল থেকে চলতে থাকা এই ‘বেলোয়ারি’ (বেল-ওয়ারি) হিসেবে বিরক্ত হচ্ছিলেন। কি করবেন বুঝতে না পেরে, হাঁক দিয়ে ভেতর বাড়িতে আরেক প্রস্থ চায়ের নির্দেশ দিলেন।

“বেল-চা কি হয়! শহরবাজারে হয়তো হয়…., আমাদের গাঁয়েঘরে…. শুনিনি কখনও…….”,  কেষ্ট বিড়বিড় করে।

“মেদিনীপুরের বেলটি বলে একটা জায়গায় সবাই বেল-টি খায়”, মৃদুস্বরে বলেন খগেন পোদ্দার।

তারপর সবাই চায়ের অপেক্ষায় চুপ করে থাকেন।

চা আসার পরে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে নীরবতা ভাঙে কেষ্ট, “বেলডাঙায় কারও গাছে বেল নেই, পুলিশ ক্যাম্পের ওদিকে গাছই নেই!”

“ওসব ডাঙাবেল, ক্যাম্পবেল ছাড় দেখি তুই,” চায়ে চুমুক দিয়ে খগেন পোদ্দার বলেন।

“ছোটবাবুকে বলে কোলকাতার বড়বাজার থেকে আনিয়ে নিন না,” কেষ্ট জানে চক্কোত্তি মশাইয়ের ছেলে কলকাতায় থাকে, ওখানে বড় বাজার আছে।

“ওরে, বড়বাজারে বেল বললে কাপড়ের গাঁটরি বোঝে”, পোদ্দার বুঝিয়ে দেন।

“খবর দিয়েছি, চেষ্টা করবে বলেছে”, বললেন চক্কোত্তিমশাই।

“পেয়েছে কিনা খোঁজ নিন না একবার, আপনার ওই কথা বলার কলে”, কেষ্টর সহজ পরামর্শ।

“হ্যাঁ, টেলিফোন; গ্রাহাম বেল বানিয়েছিল। আরেক ছিল নোবেল, ওর মেডেলটাই তো রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিল, চুরি হয়ে গেল”, জ্ঞানের গাড়ি গড়গড়িয়ে চলতে থাকে খগেন পোদ্দারের।

“পেলে জানাতো, এই গাঁয়ে-ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না, তো কোলকাতায়….”, বিরক্তি আর হতাশা মিশিয়ে বললেন চক্কোত্তিমশাই।

“একবার বেলদায় খোঁজ নিলে হয়”, চায়ের তলানিতে নজর রেখে কেষ্ট পরামর্শ দেয়।

তাতেও আপত্তি খগেন পোদ্দারের, “বেল দান করার মত বড় মনের মানুষ বেলদায় নেই। সে আমলের দানধ্যানের বহরটাই ছিল আলাদা; বাপ ঠাকুরদার মুখে কত শুনেছি।” কাপ নামিয়ে রেখে পোদ্দারমশাই বলেন, “তাছাড়া দান করার মত অত বেল বেলদায় হয় কোথায়! সে হয় উড়িষ্যার বেলপাহাড়ে। ওঃ একদম পাহাড়ের মত ডাঁই হয়ে থাকা বেল! ঝাড়গ্রামের কাছে অবশ্য বেলপাহাড়ি বলে ছোটখাট একটা আছে। যে কোনো বেলাভূমিতে গেলে দেখবি গাছের মাথা থেকে আভূমি বেল ঝুলে আছে।”

“একবার চলে যাব নাকি কত্তা? যদি পেয়ে যাই”, তলানির চুমুক-অযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে কাপটা নামিয়ে রাখে কেষ্ট।

“সে তো, বেল-উচি-স্থান-এ বেলের স্থান খুব উঁচুতে, বেল-আরুষ-এ সকালের প্রথম আলো গাছ ভর্তি বেলেই পড়ে, বিলেতের বেলফাস্ট-এ বেল দিয়ে লোকে ব্রেকফাস্ট করে, বেলজিয়াম-এ আবার বেল কে জিওল মাছের মত জিইয়ে রাখে, তা বলে বেল আনতে ওসব জায়গায় দৌড়বি নাকি! পাসপোর্ট-ভিসা আছে?” মুখে একটুকরো সুপুরি ফেলে খগেন পোদ্দার বলতে থাকেন, “এদেশেও কর্নাটকে শ্রাবণ বেলগোলা আছে, সেখানে শ্রাবণ মাসে গোলা খুলে গলা তুলে সবাইকে ডেকে ডেকে বলে বেল লে লে, বেল লে লে”

“কত্তা, গিয়ে একবার দেখব নাকি”, প্রস্তাব দেয় কেষ্ট।

“ওরকম বেলেল্লেপনা তো আবার ঠিক নয়। ‘বেল আগাম’ (বে-লাগাম) দান করলে কুবেরের ভান্ডারও শেষ হয়ে যায়, আর এ তো সামান্য বেল; তোর পৌঁছনোর আগেই শেষ হয়ে যাবে”, সুপুরিটা জিভ দিয়ে এ গাল থেকে ও গালে ঠেলে পোদ্দার মশাই বলেন।

“সামান্য বেলের জন্য অত দেশ বিদেশ ছুটতে হবে না”, বিরক্ত হয়ে চক্কোত্তি মশাই বলেন।

“বেল আর সামান্য ব্যাপার নেই চক্কোত্তি মশাই! গেলবার বেলগাছের মালিকানা নিয়ে বেলগাছিয়ায় দুই ভাইয়ের লাঠালাঠি পর্যন্ত হয়ে গেল”, খবর দেন খগেন পোদ্দার।

“জানি। তা সে ঝামেলা মিটেছে? বেল পেয়েছে?” জানতে চান চক্কোত্তি মশাই।

“না কত্তা, বেল কোথায়? গাছটাই তো শুকিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। দুই ভাইই তো গাছটার গোড়ায় খুব সে কুড়ুল মেরেছিল”, কেষ্টও খবর দেয়।

“ওরে এ বেল আদালতের বেল, কথা বুঝে কথা বল।” পোদ্দার গোটা ব্যাপারটা প্রাঞ্জল করে দেন – বিল্বপদ মোটেই এলেবেলে উকিল নয়। ওর চেষ্টাতে এক ভাইয়ের ‘বেল’ (জামিন) যখন প্রায় পেকে এসেছে তখন অন্য ভাই ‘বেল’ (জেলের পাঁচিল) টপকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল। রেগে গিয়ে কাউকেই ছাড়ল না ‘বেলিফ’; বলল – বেল, ‘ইফ’ দুজনেরই হয়, তবেই দুজনে ছাড়া পাবে, নাহলে কেউ নয়।

ধুতির খুঁট দিয়ে চশমা মুছতে মুছতে চক্কোত্তিমশাই বিড়বিড় করে বললেন, “বে ল (বে-law) কাজ করলে, কারও ‘বেল’ (অনিষ্ট) করলে তার ফল ফলবেই।” তারপরে কেষ্টকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “যাকগে, ছাড় ওসব, বেলের জোগাড় কর দেখি।”

কেষ্ট বলে, “আজ্ঞে চেষ্টা তো করছি। এখন দু’ একটা যদিও পাওয়া যায়, পরে কি হবে কে জানে!”

“ঠিক, ভবিষ্যতের কথাটাও ভাবা দরকার। পরের প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাচ্ছি আমরা বলুন দেখি! ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাস্তার ধারে, পুকুর পাড়ে কিছু বেল গাছ লাগানো উচিত।” খগেন পোদ্দারের দূরদৃষ্টি আছে মানতেই হবে, উনি বলেই চললেন, “কত সুবিধা হবে সবার। বিডিও অফিসে কথা বলে চারা বসিয়ে দিতে হবে রাস্তার ধারে। দুরকম গাছই মিলিয়ে মিশিয়ে লাগানো ভালো। গাছগুলো বড় হয়ে গেলেই বেল, বেলপাতা, বেলকাঠ, মোরব্বা, আচার, সব পাওয়া যাবে দরকারে অদরকারে। বেলগাছে গরু ছাগল মুখ দেয় না, তাই বেড়া দেওয়ার ঝামেলা নেই।”

“হু উইল বেল দা ক্যাট? কাজটা করবে কে?” কত্তা সরাসরি প্রশ্ন করলেন।

“কেন পোদ্দারমশাই থাকতে চিন্তা কি! নতুন বিডিও খুব কড়া ধাতের লোক। মুগুর ভাঁজা চেহারা, শুনেছি বাড়িতে ইংরেজি মুগুর আছে, ডামবেল না বারবেল কি যেন বলে। ওনার সঙ্গে কথা বলতে পোদ্দার মশাইকেই চাই”, যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব রাখে কেষ্ট।

হঠাৎ খগেন পোদ্দার সচকিত হয়ে বলেন, “যাঃ, অনেক বেলা হয়ে গেল, বাড়িতে কাজকর্ম সব পড়ে আছে। আজ তাহলে আসি চক্কোত্তিমশাই।”

কেষ্ট বলে, “ওসব কাজ টাজ এখন ছাড়ুন; বেলের ব্যাপারে আজই যা করার করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পাকা বেলের পাকাপাকি সমাধান হয় ততই মঙ্গল; কাকারও মান বাঁচে!” বলেই জিভ কাটে কেষ্ট।

কটমট করে একপলক কেষ্টর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট স্বরে পোদ্দারমশাই বলেন, “‘বেল লিক’ (বেল্লিক) কোথাকার!” তারপর ঝাঁঝিয়ে উঠলেন “বড্ড বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করিস কেষ্ট! চুপ কর; বেল পাকলে কাকের কি?”

“আরে পোদ্দার, ছাড়ো ওর কথা। তুমি ব্যস্ত মানুষ, এগোও এখন”, শান্ত স্বরে বললেন চক্কোত্তিমশাই।

“তাই যাই, পরে আবার এসে খোঁজখবর নিয়ে যাব”, নমষ্কার করে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন খগেন পোদ্দার।

পোদ্দারমশাই চোখের আড়াল হতেই, হাঁটুর নিচে চেপে রাখা একটা ঝোলা বার করে কেষ্ট। তার থেকে গোটা পাঁচেক বেল বের করে চক্কোত্তিমশাইয়ের সামনে রেখে বলে – “এই রইল আপনার জন্য বেল। খবর পেয়ে একদম নিয়েই চলে এলাম। খগেন মাস্টারের সামনে বার করিনি এতক্ষন।”

চক্কোত্তিমশাই আনন্দে বাক্যিহারা হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন মসৃন চকচকে হলদে সবুজ খোলাওয়ালা বেলগুলোর দিকে; ওপরে শক্ত হলেও, ভেতরে অমৃত। ইংরেজিতে বলে ওয়ান অ্যাপল এ ডে, কীপস ডক্টর অ্যাওয়ে; তা উডঅ্যাপলই হোক না! স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন চক্কোত্তিমশাই। পেট ভুটভাট করাও যেন কমে গেছে বেল দেখে।

ততক্ষনে আবার ব্যাগ হাতড়ে ধূসর রঙের দুটি কয়েত বেল বের করেছে কেষ্ট, “এ দুটোও রইল, বাড়ির সবার জন্য।” বাইরেটা দেখেই বোঝা যায় জাত ভালো;  ভেতরটা গাঢ় চকলেট রঙের শাঁস-এ ভর্তি, গজভুক্ত কপিত্থ নয়।

সম্বিৎ ফিরে চক্কোত্তিমশাই বললেন, “জানতাম, তুইই পারবি; এসব ব্যাপারে তোর মত ক্যাপাবেল আর কেউ নেই। তা আনলি কোত্থেকে?”

“আজ্ঞে বেল-অপুর, বেলাপুরের অপু বেলেল-এর গাছে এখনও অনেক আছে। আবার এনে দেব দরকার হলে। আপনি বরং, ঐ যে কি বলে, গরম বেলের কথা বলা কল দিয়ে ছোটবাবুকে একটা খবর দিয়ে দিন, চিন্তায় আছেন হয়তো”, নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়ে কেষ্ট।

“সে হবে’খন। কিন্তু এই অবেলায় চললি কোথায়? এখানেই চাট্টি ডালভাত খেয়ে নে।” তারপর ভেতর বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁক দিলেন – “কইগো শুনছো, কেষ্ট কি এনেছে দেখে যাও; আর ওর একটু খাওয়ার ব্যবস্থা কর দেখি।” খুশি উপচে পড়ছে চক্কোত্তিমশাইয়ের গলায়।

হাঁকডাক শুনে চক্কোত্তিগিন্নি বেরিয়ে এলেন। বেল দেখে দূর্গাপ্রতিমার মত সুন্দর মুখটা আনন্দে ঝকঝক করে উঠল। বেশ কয়েকদিন কত্তাকে শান্ত রাখা যাবে; পেটগরম  আর বাড়ি গরম বন্ধ থাকবে কয়েকদিন। কেষ্ট উঠে গিন্নিমাকে প্রণাম করতেই মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন, “বাঁচালে বাবা, মঙ্গল হোক।” কোঁচড়ে করে সবকটা বেল তুলে নিয়ে স্নেহ ভরা খুশিয়াল গলায় কেষ্টর জন্য লাঞ্চের বেল দিলেন – “এসো বাবা, একটু ঝোলভাত খেয়ে নাও। টিউবেল-এ হাতমুখ ধুয়ে এসো।”

কেষ্ট কলতলার দিকে এগোল। কত্তাগিন্নির খুশিতে ডগমগ মুখ দেখে কেষ্টরও খুব আনন্দ হচ্ছে, শহরের মানুষ হলে কেষ্টর মনটা জিঙ্গল বেল গেয়ে উঠত। সে জানে চক্কোত্তি বাড়ির ঝোলভাত মানে ভোজবাড়ির চেয়ে কম কিছু নয়। আজ আর বেলাবেলি আর বাড়ি ফেরার উপায় নেই, খাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নিতে হবে। হাত মুখ ধুতে ধুতে কেষ্ট ঠিক করল দুয়েকদিনের মধ্যে গোটা দু’তিন বেল খগেন পোদ্দারের বাড়িতেও দিয়ে আসবে। দুটো বেল বই তো নয়, কারও উপকার হলে হোক না; কেষ্টর তো আর ক্ষতি হচ্ছে না।

কলতলার খোলা হাওয়া, জমে থাকা কাদা-মাটি, পৃথিবীর গভীর থেকে উঠে আসা জল, নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদ্দুর সবাই একযোগে যেন বলে উঠল – মঙ্গল হোক, সবার মঙ্গল হোক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত