দাদার বড় ভাই। ভদ্রলোক কলকাতায় থাকতেন। দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন, আর করতেন শিল্পচর্চা। তবে নির্দিষ্ট কোনো শিল্পে আবদ্ধ ছিলেন না। দৈনিক সওগাত পত্রিকায় তাঁর কিছু গল্প ছাপা হয়। শোনা যায়, সেগুলো পড়ে কবি নজরুল তাঁকে ডেকে প্রশংসা করেছিলেন। কলকাতা মিউজিয়ামে তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছে একবার। আর যা করতেন, দাদাকে বড় বড় চিঠি লিখতেন। কয়েকটা চিঠি বাবার ড্রয়ারে আছে। ড্রয়ার পরিষ্কার করতে গিয়ে একদিন বাবার হাতে চিঠিগুলো ঠেকে এবং তাঁর অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। আমি সবগুলো চিঠি পড়েছি। সাধারণ গতানুগতিক কথার মধ্যে হঠাৎই এক-দুটো অদ্ভুত কথা লিখে বসতেন লোকটা। যেমন এক জায়গায় লিখেছেন: ‘বৌমার শরীর এখন কেমন? উহার যত্ন লইও। এখন উহার বিশেষ রূপ যত্ন আবশ্যক। প্রয়োজনে একজন সেবিকা নিযুক্ত করো। অর্থ লইয়া ভাবিত হইও না। কিছু পাঠাইলাম, প্রয়োজন সাপেক্ষে আরও পাঠাইব। অর্থ আমার কোনো কাজে আসে না।’ এরপরেই লিখলেন: ‘পৃথিবীটা সুবৃহৎ একখানা সময়যন্ত্র বিশেষ। আমি সূক্ষ্মতম কাঁটাটির উপর দাঁড়াইয়া পর্যবেক্ষণ করিতেছি। এই ঘড়ি অসংখ্য কাঁটা সম্বলিত। সেকেন্ড, মিনিট আর ঘণ্টা বহির্ভূত অন্য কাঁটাগুলি সনাক্ত করিতে পারিতেছি না। অথচ সেকেন্ডের কাঁটায় উপনীত হইয়া আহ্নিক গতির মতো অচেনা কাঁটাগুলি অতিক্রম করিতেছি। ত্রাসে কম্পমান। আমাকে পরিবেষ্টন করিয়া থাকা অত্র সমাজের মানুষেরা এই কাঁটাগুলি দেখিতে পায় কি না জানি না, তাহাদের কোনো ভাবান্তরও পর্যবেক্ষিত হয় না। তোমার একজন বংশধর দরকার। আমি চাই আমার উত্তরাধিকারী। তুমি বংশধর পাইবে, সে ভবিষ্যতে বংশরক্ষা করিবে। কিন্তু উত্তরাধিকারী কবে আবির্ভূত হইবে? তবে সে আসিবে। আমি হয়তো তখন অস্তিত্বহীন। জানিব ও না যে সে আসিয়াছে। তবু আসিবে। একজনের জন্মের প্রতীক্ষায় বহু প্রজন্মকে জন্ম লইতে এবং দিতে হইবে। সে আসিবে। এই বহুকণ্টক ঘড়ির কাঁটাগুলিকে সে সনাক্ত করিবে অথবা ঊহ্য করিয়া দিবে, যাহা আমি পারিতেছি না। হয়তো জীবদ্দশায় পারিবও না। তবে অনুসন্ধান জারি থাকিবে।’
আরেকটি চিঠিতে লিখেছেন: ‘নিশ্চয় আমাদের বংশের উপর কাহারও কোনো অভিশাপ রহিয়াছে যাহার ফল আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরিয়া বহন করিয়া চলিয়াছি।’
এরপর একদিন বড় দাদা তাঁর ছোট ভাইকে নিজের প্রেমকাহিনি জানিয়ে চিঠি লিখলেন: ‘প্রেমে না পড়িয়া পারিলাম না। যতদূর মনে হয়, মেয়েটিও আমাকে পছন্দ করে। জানি, কনিষ্ঠ ভ্রাতার নিকট নিজের প্রণয়োপাখ্যান জ্ঞাত করা শোভনীয় নহে। বিশেষত আমার এই বয়সে এবং তোমাদের ওই সনাতন পল্লীসমাজে। আমি বিশ্ব দেখিয়াছি। বিশ্বমানবের বাণী এবং আর্তনাদ দুই-ই শুনিয়াছি। কাহাকে কী বলিব আর কে আমায় কী শোনাইবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট মত অদ্যাবধি গড়িয়া তুলিতে পারি নাই। তবে এতটুকু বলিতে পারি, সনাতন বহু বিশ্বাস আমি অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি। যাহা হউক, মেয়েটি প্রখ্যাত বণিক প্রণয়কান্তি রায় মহাশয়ের কনিষ্ঠা কন্যা। হিন্দু রমণীর প্রেমে পড়িয়াছি। কাজেই বুঝিতে পারিতেছ, কতটা প্রথাবিরোধী হইয়া পড়িয়াছি। কলিকাতা শহর বলিয়া এখনো গা বাঁচিতেছে। পল্লীগ্রাম হইলে এতক্ষণে পঞ্চায়েতের দোররা পড়িত। মেয়েটি মৃদুভাষী, কোমলকান্তি। উহার নামও কান্তা। তোমরা সকলেই জানো যে আমি কাহারো দ্বার পরিগ্রহ করিব না, স্থির করিয়াছিলাম। উহা অতিশয় দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে। কলিকাতা নানান দিক হইতে অগ্রসর হইলেও নারী-পুরুষে গঠিত সামাজিক ধারণা অদ্যাবধি পূর্ববৎ জারি রহিয়াছে। কলিকাতায় টাটকা খাবার উহাদের নিমিত্ত, যাহারা পরিণয়পাশে আবদ্ধ হইয়া নাড়ুগোপাল জীবনযাপন করিতেছে। যাহারা অদ্বারপরিগ্রহ করিয়া মেসে থাকে, তিলোত্তমা নগরীর কোথাও তাহাদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা নাই। ইংরাজি “মেস” শব্দের অর্থ জানো তো? “জগাখিচুড়ি”। আমাদের জীবনও ওই উপাদেয় খাবারটি ছাড়া কিছু নহে। অথচ নামের মতো কাজে জোটে না। সাংবাদিকতা করিয়া ক’ পয়সাই-বা পাই? গল্প লিখিয়া, ছবি আঁকিয়া মনের খায়েশ এবং খেদ মিটিতে পারে, বাঙালির অন্ন জোটে কদাচ। অথচ আমার শিল্পীজীবনে এইখানে বাস করাও আবশ্যক। আবার জীবনে নারীর প্রয়োজন অস্বীকার করাও কঠিন। সুস্পষ্ট উপলুব্ধ হইতেছে ইহা মোহ, মোহ বৈ কিছু নহে। তবু ধরা দিতেছি। রবি ঠাকুরের মতে “জেনেশুনে বিষ করেছি পান”। আমি সংসারের ঊর্ধ্বে উঠিতে চাহিয়াছি, কিন্তু ভণ্ড সাধক হওয়াতে বেশি উঠিতে পারি নাই। সংসার আর সন্ন্যাসের মাঝখানে রহিয়াছি। বিশুদ্ধ প্রেমের সাধক আমি, শিল্পীমাত্রই প্রেমিক। সুতরাং, প্রেমে পড়িলাম। ইহা লইয়া আহাজারি কিংবা আয়োজন কিছুই করিবার আবশ্যক নাই। একজন নারী একজন পুরুষ একত্রে থাকিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে, একটি উপযুক্ত বাসস্থানে উহারা বসবাস আরম্ভ করিবে। এই প্রেক্ষাপটে আলোকসজ্জা অর্থহীন। খুব হৈ চৈও নিষ্প্রয়োজন। তোমার অসুস্থ স্ত্রীকে বহন করিয়া আমার বিবাহে উপস্থিত হইয়া হাততালি দিতেও নিরুৎসাহিত করি। ইহার বেশি কিছু বলিতে ইচ্ছা করি না। বৌমার যত্ন লইও।
পুনশ্চ: শুনিতেছি তোমার সহিত আমার বিচ্ছেদ ঘটাইতে কতিপয় রাজনীতিবিদ উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। তোমার সহিত দেখা করিতে হইলে নাকি আমাকে লিখিত অনুমতি লইতে হইবে।’
পরের চিঠি: ‘কান্তা মেয়েটি আমার নিঃসঙ্গ শিল্পীজীবনে ফল্গুধারার সঞ্চার করিয়াছে। দৈনন্দিন জীবনে এক সহজিয়া রাগের সুর বাঁধিয়া দিয়াছে। একতলা একটি বাসার একখানা ঘর আপাতত ভাড়া করিয়াছি। ইদানীং আমি প্রতিনিয়ত একই সময়ে নিদ্রাভঙ্গ করি। খাবার গ্রহণ করি। খানিকটা অর্থকষ্ট ছাড়া মোটামুটি নিশ্চিন্তে আছি বলিতে পারো। মধুচন্দ্রিমার ধাক্কাটা কাটিয়া গেলেই আবার সাংবাদিকতা আরম্ভ করিব। কয়েকটা গল্পের প্রেক্ষাপট মাথায় ঘুরপাক খাইতেছে। গোটা দুয়েক ছবি অসমাপ্ত পড়িয়া আছে।’
মাস সাতেক পরে: ‘তুমি জানিতে চাহিয়াছ নববধূ লইয়া কবে পিতৃভূমিতে আসিব। গ্রামের কেহ ঘুণাক্ষরেও কান্তার ধর্মপরিচয় জানিতে পারিবে না বলিয়া আশ্বস্ত করিয়াছ। তোমার জ্ঞাতার্থে বলিতেছি, ধর্ম পরিচয় যেখানে ধর্মপত্নী হইবার পথে অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায় এবং অযোগ্যতা বলিয়া বিবেচিত হয়, সে আমার পিতৃভূমি বা মাতা নহে। যাহাকে মাতা বলিয়া ডাকিতে চাহি, সে যেন অন্য কাউকে সন্তান করিয়া বসিয়া আছে। তদুপরি কান্তা অন্তঃসত্ত্বা। উহাকে লইয়া এখন দীর্ঘ ভ্রমণে যাওয়া উহার স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক। হৃদয়ে অদ্ভুত আবেগ সঞ্চার হইতেছে। পিতা হইব! কবে কোন মুহূর্তে এই বীজ আমি বপন করিয়াছিলাম, মহাকাল জানে। মহাকালই এই অনাগত অস্তিত্বের জনক। আমি ব্যবহার্য যন্ত্রমাত্র। কান্তার অসুস্থতার প্রথম ধকলটা গেলেই অসমাপ্ত ছবিগুলিতে হাত দিব। অর্ধশিল্প আমাকে অস্থির করে।’
বছর দেড়েকের মধ্যে সন্তান জন্মাবার খবর, চিত্রশালায় তোলা কিছু সাদাকালো ছবি বড় দাদা তাঁর ভাইকে পাঠিয়েছিলেন বলে চিঠিতে জানা যায়। ছবি অবশ্য বাবার সংগ্রহে ছিল না। এরপর হঠাৎ একটি চিঠি আমাদের মনোযোগ কাড়ে। তিন লাইনের চিঠিতে বড় দাদা লিখেছেন: ‘একটু সময় ধার দিতে পারো? বেশি নয়, ধরো তিনটি ঘণ্টা! চব্বিশ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হইবার পরেও যেন আমার হস্তে তিনটি অতিরিক্ত ঘণ্টা থাকে। তুমি ব্যতীত আমার রক্তের তো আর কেহ নাই!’
এই চিঠির পর থেকেই দাদা আন্দাজ করতে আরম্ভ করেন যে বড় দাদার কোনো সমস্যা হয়েছে। বৃত্তান্ত জানতে চেয়ে দাদা চিঠি লেখেন, কোনো উত্তর আসে না। বহুদিন বাদে যে চিঠি আসে, তাতে দাদার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। চিঠিটা আচমকা শুরু এবং আচমকাই শেষ: ‘বইয়ের তাকে সারি সারি কফিন। বুকে ভিজিটিং কার্ডের ছুরি গাঁথিয়া রবি ঠাকুর টেবিলে চিৎপাত। জীবনানন্দের চোখে বিহ্বল দৃষ্টি। এক চোখে, অর্ধজোড়া ঠোঁটে কলিকাতার পতিতার কটাক্ষ।’
এই অসুস্থ অবস্থায় হঠাৎ একদিন জন্মভূমিতে ১৯৪৭ সালে বড় দাদার পা পড়ল। দাদা হতবিহ্বল, গ্রামবাসী কৌতূহলী। মানসিক ভারসাম্য হারানোর পূর্ব মুহূর্তে বড় দাদা তাঁর সৎমায়ের কোলে ফিরে আসতে সক্ষম হলেন। একটি পোশাকে ঢাকা শরীর বাদে যাবতীয় মালিকানা তিনি ত্যাগ করে এসেছিলেন। বাবার মতে, ভাগ্যিস তখনো এপার-ওপার বাংলা একসঙ্গে ছিল, নইলে পাসপোর্ট-ভিসার চক্করে তাঁর জীবন যেত। তাঁর গল্প-ছবি-সংসার-সন্তান-সমাজ-সবই পড়ে রইল কলকাতায়। বাড়ি পৌঁছার পাঁচ দিনের মাথায় বড় দাদা পাগল হয়ে গেলেন। তবে তাঁর পাগলামি নির্দিষ্ট কিছু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল। তাঁর প্রধানতম কাজ হলো ছবি আঁকা—এমন সব জায়গাতে আঁকা, যেখানে কোনো চিহ্ন থাকে না। পুকুরের পানিতে তিনি কালজয়ী চিত্র আঁকেন, ঘাসের ওপর পাটকাঠি চালিয়ে কী গল্প লিখতে চান তিনিই জানেন। স্ত্রী-সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকেন। পুকুরে ছবি এঁকে সেই বিমূর্ত চিত্র তোলপাড় করে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটেন। তত দিনে তাঁর হিন্দু রমণীকে বিয়ে করার কথা গ্রামে রটে গেছে। লোকে বলাবলি করছে, কলকাতায় নাকি দাঙ্গা চলছে, হিন্দু-মুসলিম একে অপরের গলা কাটছে। ধর্ম আগে না স্বামী? ওই হিন্দু মেয়েই দাদাকে জাদুটোনা করেছে। ওদের কত রকম মন্ত্র আছে!
এক রাতে বড় দাদা এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটালেন। হিমালয়ের চূড়া থেকে বাংলাদেশের শীত লম্বা শ্বাস ফেলতে ফেলতে আসছে। সেই নিশ্বাস গ্রামবাসীকে স্পর্শ করছে, স্বয়ং শীতের দেখা অচিরেই মিলবে। গৃহস্থের গোলাভর্তি সরষের বীজ। অনতিবিলম্বেই যে যার জমিতে ওই বীজ বুনে দেবে। বর্গাচাষিরাও বিভক্ত হয়ে ভাড়া খাটতে প্রস্তুত। এমন সময়ের এক রাতে বড় দাদার অনতিবিলম্বও সহ্য হলো না। তিনি বেশ কজন গৃহস্থের গোলাঘরে চুরি করলেন। কেউ তাঁকে বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল কি না জানা যায় না, কিংবা দেখলেও পাগল ভেবে পাত্তা দেয়নি। যেহেতু বড় দাদা তত দিনে পাগল বলে গণ্য, কাজেই গ্রামের পূর্বাঞ্চল জোড়া জমিতে দেশের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের সৃষ্ট বিচিত্র জ্যামিতিক বিভক্তিরেখা তাঁর ভ্রান্তিময় নজরে ধরা পড়ল না। সমস্ত আইল অগ্রাহ্য করে তিনি পুরো প্রান্তরকেই নিজের বলে জ্ঞান করলেন এবং নির্বিচারে সরষে রোপণ করে গেলেন রাতভর। দূর থেকে সেই ফসল রোপণ অত্যন্ত মনোযোগসহকারে পর্যবেক্ষণ করল আরেক নিশাচর পাগল মছলু। মছলু বড় দাদার অবচেতন বিভক্তি মোচনে বাধা দিল না, সাহায্যও করল না। সে শুধু দেখল আর দাঁতে চেপে আধপোড়া বিড়ি টানতে টানতে নিম্নাঙ্গ চুলকাল। গ্রামবাসী জানতে পারল না যে যখন তারা গভীর শীতনিদ্রায় নিজেদের অবচেতন মনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত, তাদের অজান্তে নিভৃতে আপন মনে গ্রামের এই নব্য পাগলটি বিভক্তিরেখা ঢেকে দিচ্ছে অনাগত শস্যের গর্ভবতী বীজে।
রোগ নির্ণয়ের জন্য একবার বড় দাদাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কবিরাজের কাছে নেওয়া হয়েছিল। তবে ওষুধের বোতল ছুড়ে কবিরাজের চোখ প্রায় গেলে দেওয়ার পরই বড় দাদাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বড় দাদা কোনো রকম বাঁধা দেননি। শুধু কাউকে দেখলেই একটানা বলতে থাকতেন, ‘ঘর আছে, শিকল আছে; ঘর আছে, শিকল আছে; ঘর আছে, শিকল আছে…’ তিনি যেন ঘটনা বর্ণনা করছেন; বন্দিত্ব নিয়ে অভিযোগ নেই। শুধু শিকল পরা পা’টা কখনো নাড়তেন না তিনি। নিরস্তিত্বের মতো ওটা এলিয়ে থাকত সামনে। মুক্তির কোনো আকাঙ্ক্ষাও তাঁর মধ্যে গ্রামবাসী দেখেনি। আস্তে আস্তে তিনি অদৃশ্য হতে আরম্ভ করলেন। খুব কাছ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও তাঁকে সহজে দেখতে পেত না। হঠাৎ চোখে পড়লে আঁতকে উঠত আর অমোঘ বাণীর মতো শুনত, ‘ঘর আছে, শিকল আছে; ঘর আছে, শিকল আছে…।’ দাদাও নিত্যনৈমিত্তিক যাপিত জীবনের প্রয়োজনে সিঁড়ি বেয়ে উঠোন-ঘর ওঠা-নামার পরিক্রমায় ভুলেই গেলেন যে সিঁড়ির পাশেই তাঁর শিল্পী ভাই ঝাপসা পড়ে আছে। ঝড়-বৃষ্টি এলে শিকলসহই বড় দাদা বারান্দায় উঠে বসে থাকতেন। তিনবেলা খাবারের থালা অবশ্য শিকলের কাছে পৌঁছে যেত এ বাড়ির অনেক নিয়মের একটি হিসাবে। বড় দাদাকে যে যতটুকু দেখে, খড়কুটো সংগ্রহ করতে দেখে। রাখাল গরুর গোয়ালে খড় নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো দু-গাছ খড় পড়ে গেল, বড় দাদা কুড়িয়ে নিলেন। পেয়ারাগাছ থেকে একটা শুকনো ডাল খসে গেল, নিয়ে সিঁড়ির পাশে রাখলেন। এভাবে মাঝেমধ্যে পোষা ছাগলগুলো আর চমকিত দমকা হাওয়াও তাঁকে খড় দিয়ে যেত। গ্রামবাসীর আর সরষে বোনা হয়নি, চোরও ধরা পড়েনি। নতুন করে শস্যদানা সংগ্রহ করা অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। খেতগুলো বিরান পড়ে পড়ে হিমালয়ের হিমপ্রবাহ বহন করে গ্রামে এনে ফেলতে লাগল। সাত মাস এভাবে বন্দী হয়ে থাকার পর ঘটনা মোড় নিল। একদিন কাজ সেরে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করার সময় দাদা হঠাৎ বড় দাদার কণ্ঠ শুনে আঁতকে উঠলেন, ‘আমারে এট্টা সিগারেট দিবি?’
বহুদিন বাদে দাদা তাঁর ভাইকে চোখে দেখলেন। আগে তাঁকে দেখে পাগল মনে হতো না। কিন্তু বিগত সাত মাস শিকলবন্দী অবস্থায় থেকে রোদ-জল-ঝড়ে আর দাড়ি-গোঁফে তাঁর চেহারাকে আক্ষরিক অর্থেই উন্মাদের মতো করে তুলেছে। দাদা কিছুটা কাছে এগিয়ে শিকলের সীমার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি সিগারেট খাও নাকি?’
গোঁফের ফাঁক দিয়ে দীর্ঘদিনের লুকানো দাঁত বের করে বড় দাদা বলল, ‘কলকাতায় থাকতি চারমিনার খাতাম। পাগল হওয়ার পরে আইজ পেত্থম খাতি মন চালো। দে এট্টা।’
ভাঙচুরের কোনো পূর্ব ইতিহাস না থাকলেও দাদা বড় দাদাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। পাগলকে বিশ্বাস করা আরেক পাগলামি। কাজেই সে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই একটা সিগারেট ছুড়ে দিল। একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিয়ে সেটাকে ঠোঁটে লাগালেন বড় দাদা। গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধরায়ে দে।’ শিকল-সীমায় গেলেন না দাদা। একটু আগে তিনি বড় দাদার যে হলদে শ্বদন্ত দেখেছেন, তাতে কামড়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দূর থেকেই দেশলাই ছুড়ে দিলেন তিনি। খপ করে সেটা হাতে নিয়ে খ্যাঁকখেঁকিয়ে হেসে উঠলেন বড় দাদা, ‘কাপুরুষ! সিগারেট ধরায়ে দেওয়ার সাহস যদি তোর থাকত, আমি এই কাজটা করতাম না। কিন্তু এহন করব। সবাই ক’ল পাগল, তুইও ক’লি পাগল! আমি যে পাগল, তার এট্টা প্রমাণ দে, এট্টা। দিতি পারলি আমি সর্বনাশ করব না। পারলি না তো! এইবার দ্যাখ।’
সাত মাসের জমা করা খড়ের আঁটি দেশলাইয়ের একটি কাঠি দিয়ে জ্বালিয়ে নিলেন তিনি। সেই মশাল খড়ের চালায় ছুড়ে দিলে খড়ের আগুনে খড় গনগনিয়ে জ্বলে উঠল। দাদি তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে কোনোমতে বেরোতে পারলেও ঘর বাঁচানো গেল না। বড় দাদাকে সেই আগুন আর ধোঁয়ার মাঝখানে তান্ত্রিকের মতো দেখা গেল, ঘর পোড়ানো আগুনে সিগারেট ধরিয়ে ধীরেসুস্থে টানছেন। গ্রামবাসী এসে ধোঁয়াশার আড়ালে শুনল উল্লসিত কণ্ঠের উন্মাদনাময় উচ্চারণ, ‘ঘর নাই, শিকল নাই; ঘর নাই, শিকল নাই; ঘর নাই, শিকল নাই…।’ আগুন যতক্ষণে নেভানো গেল, ততক্ষণে বারান্দা আর সামনের ঘর ধসে পড়েছে। গ্রামবাসী বড় দাদাকে পাগল হিসেবে দেখতে চাইলেও তাঁর মৃত্যু চায়নি। সযত্নে তাঁকে উদ্ধার করা হলো। শিকলবাঁধা খুঁটিটা তাঁর গায়ের ওপর পড়ে সামান্য রক্তপাত ছাড়া কোনো ক্ষতি হয়নি। পায়ের শিকল খুলতে অপারগ হয়ে তিনি শিকলের শিকড়ই উপড়ে ফেলেছেন।
নিজের লাগানো আগুন থেকে জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসবেন তিনি, কেউ আশা করেনি। তবে অনতিবিলম্বে চৈত্রের এক উষ্ণ বিকেলে তাঁর স্বরচিত সমাধি হয়। শিকলমুক্ত হয়ে তিনি আবার যথারীতি বিমূর্ত শিল্পচর্চা শুরু করেছিলেন। সেই বিকেলে পুকুরঘাটে একলা বসে একটা বড়শি ভাঙা ছিপ দিয়ে পানিতে ছবি আঁকছিলেন। দাদা এসে বললেন, ‘বউদির সন্ধান পাইছি। তোমার শ্বশুররে সাথে নিয়ে সে রওনা হইছে। ওগো সাথে কলকাতায় যাও। কলকাতায় উন্নত চিকিৎসা নেও।’ একটু থেমে গিয়ে বড় দাদার নির্বিকার শিল্পচর্চা পর্যবেক্ষণ করে দাদা আবার বলল, ‘আমারে নানান কথা শুনতি হতিছে। ঘরে আগুন দিছ, মানষি ভয়ে আছে। আমিই যে তোমার হাতে আগুন দিছি, কেউ জানে না। কাজেই তারা তোমারে জাদুকর ধরনের কিছু মনে করতিছে। তোমার চিকিৎসা দরকার, দাদা।’
বড় দাদা অদৃশ্য চিত্রকর্ম থেকে চোখ না ফিরিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আগুন দিছি আমি, তোর কথা শুনতি হয় কেন? আমার কাজের দায়ভার আমার। মানষি ভুল কিছু কতিছে না। এই গিরামে জাদুকর কেউ থাকলি সে আমি।’
‘তুমি জাদুকর মানে?’
‘আমি এহানে এট্টা ছবি আঁকিছি, দেখতি পারিস? আমি পারি। আমি হয় পাগল, নয় জাদুকর। ছবি শেষ হলিই আমার যা’র সময় হবে।’
ছবি শেষ হওয়া মাত্রই সেই ছবি বরাবর বড় দাদা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবার আর উঠে এলেন না।
বড় দাদাকে কবর দেওয়ার এক মাসের মাথায় গাঁয়ের পূর্বাঞ্চল হলুদ সরষেতে ছেয়ে গেল। কড়া মাথা-ধরানো গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠল গ্রাম। অব্যাখ্যেয় কারণে সে বছর সরষে ফলেছিল চৈত্রে। গ্রামবাসী দলে দলে মন্ত্রপূত মানুষের মতো পুবে যাত্রা করল। অন্ধকারে, দৃষ্টির অন্তরালে, নিভৃতে, উদ্দেশ্যহীনভাবে রোপিত বিভক্তিহীন ফসলের এই বর্ণিল বিস্ফোরণ গ্রামবাসীকে কাঁদাল। হয় পাগল, নয় জাদুকর লোকটাকে স্মরণ করে তারা কাঁদল। হঠাৎ জনতার ভিড় ঠেলে মছলু পাগলা একদৌড়ে গিয়ে সেই ফসলাকীর্ণ আলবিহীন খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং বিলুপ্ত হয়ে গেল। এই ঘটনা গ্রামবাসীর কান্নায় কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারল না এবং আমাদের গ্রামের ইতিহাসে ওই একটি বেলার উদয় হয়েছিল যখন গ্রামের প্রত্যেকে একই সঙ্গে একই সময়ে একই কারণে কেঁদেছিল।
গল্পের বিষয়:
গল্প