প্রবল আশঙ্কায় মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে ওর। ছাই-ভস্মের মাঝে
একটা দেহ পড়ে আছে, কোমরে বেল্টঅলা একজন পুরুষ।
ভোরের আলো ফোটার পরপরই, বৃষ্টি শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ড্রাই ক্রীক স্টেশনে পৌঁছল জেফ ক্রেমার। পাইনের সারি পেরিয়ে সিয়েনাগা ক্রীকের পাড়ে উঁচু যে-মালভূমি আছে, ওখানে পৌঁছে দূরে আগুনের লেলিহান শিখার নাচন দেখতে পেল সে।
ক্যাম্প ফায়ারের আগুন এত বড় হয় না, কিংবা এমন খোলা জায়গায় ক্যাম্পও করে না কেউ। উঁহুঁ, কোথাও কোন ঘাপলা আছে। প্রথমে সামান্থার কথাই মনে এল ওর। বিশ মিনিট আগে ওর স্টেজ হোয়াইটওঅটরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা, অথচ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ড্রাই ক্রীক স্টেশন এখন জ্বলে-পুড়ে ছাই হতে বাকি।
ট্রেইল এড়িয়ে সরাসরি ঢাল বরাবর ঘোড়া ছোটাল ক্রেমার, ছড়ানো-ছিটানো পাইনের ফাঁক গলে এগোল। পাইনের কাঁটার খোঁচা খেতে পারে, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করছে না। সরাসরি প্রেয়ারির দিকে, সবচেয়ে সহজ পথে ঘোড়া ছোটাল তুমুল গতিতে।
সরু কাঠির মত কিছু লগ খাড়া আছে বটে, হালকা বৃষ্টির মধ্যেও জ্বলছে লেলিহান শিখায়-স্টেশনে পৌঁছে দেখতে পেল ক্রেমার। বাকি সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পড়ে থাকা ছাইয়ের ¯তূপই বড়সড় স্টেশন ভবনের শেষ নমুনা। কয়লার মত কালো স্টেজের চাকা আর জোয়ালের একটা অংশ চোখে পড়ল ওর, জ্বলছে ওগুলো, তবে শিখাহীন।
প্রবল আশঙ্কায় মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে ওর। দ্রুত রাশ টেনে চারপাশে চকিত দৃষ্টি চালাল ক্রেমার, আগুনের চারপাশে চক্কর মারল। ছাই-ভস্মের মাঝে একটা দেহ পড়ে আছে, কোমরে বেল্টঅলা একজন পুরুষ। একনজর দেখেই বুঝে নিয়েছে ক্রেমার, ওটা স্টেশন এজেন্ট ফ্রেড টলিভারের মৃতদেহ।
সামান্থা কোথায় তাহলে? ড্রাইভার লোকটা, এড কার্টিসই বা কোথায় গেল?
কাদায় বিক্ষিপ্ত কিছু পদচিহ্ন চোখে পড়ল ওর, স্টেবলের দিকে চলে গেছে। হাঁটুর গুঁতোয় ঘোড়াকে আগে বাড়ার নির্দেশ দিল ও, কয়েক গজ এগোতে স্টেবলের ঠিক বাইরে কার্টিসকে দেখতে পেল।
দু’বার গুলি করা হয়েছে ড্রাইভারকে। পেছন থেকে প্রথমবার, কার্টিস তখন স্টেবলের উদ্দেশে ছুটছিল বোধহয়। দ্বিতীয়বার একেবারে কাছ থেকে। সম্ভবত মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর, কাছে এসে ওপর থেকে মাথায় গুলি করে নিশ্চিত হয়েছে ড্রাইভারের মৃত্যু সম্পর্কে। নিরস্ত্র একজন মানুষকে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় খুন।
কোথাও সামান্থার চিহ্নমাত্র নেই। স্যাডলে বসেই পেছন ফিরে তাকাল ক্রেমার, আধ-পোড়া একটা লগ তুলে নিয়ে পোড়া স্টেজের ছাই ছড়িয়ে খুঁজতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরই পুড়ে যাওয়া একটা ব্যাগ দেখতে পেল, যার কিনারা দিয়ে আধ-পোড়া মেয়েলি কাপড় উঁকি দিচ্ছে। চিনল ক্রেমার-সামান্থার কাপড়।
দৃশ্যত এখানে ছিল সামান্থা।
স্থির হয়ে স্যাডলে বসে থাকল ও, তুমুল বৃষ্টি ভ্রুক্ষেপ করছে না। আসলে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছেছিল সামান্থা, স্টেজে ওর ব্যাগটাও তোলা হয়েছিল। হয় ও স্টেজে চাপার পর, কিংবা তার আগের মুহূর্তে ঘটনাটা ঘটেছে।
অ্যাপাচী?
একটা সম্ভাবনা বটে, কিন্তু হালে পানি পায় না। প্রায় বছর খানেক ধরে শান্ত আছে রেডস্কিনরা, তাছাড়া এড কার্টিসের মৃতদেহ বিকৃতও করা হয়নি। ইন্ডিয়ানরা হলে চাঁদির ছাল তুলে নেওয়ার কথা।
সবচেয়ে কাছে, যেখান থেকে সাহায্য মিলতে পারে, সেই হোয়াইটওঅটর প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে। প্রতিটি মুহূর্তে সামান্থাকে নিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে ওরা।
ঘোড়া ঘুরিয়ে স্টেবলের কাছে চলে এল ক্রেমার। সবক’টা স্টল শূন্য। স্যাডল ছেড়ে নেমে এল ও, স্টেবলে ঢুকে মেঝে জরিপ করতে শুরু করল। গতরাতেও বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি শুরুর পর অন্তত একজন লোক এসেছিল এখানে, কারণ ভেজা কাদা লেগে আছে মেঝেয়, শুকায়নি এখনও।
স্টলে সাধারণত চারটে ঘোড়া থাকে। তবে যা নমুনা মিলেছে, তাতে ক্রেমার নিশ্চিত হলো আগের রাতে আটটা ঘোড়া ছিল। নিজেই ঘোড়ার নাল পরায় টলিভার, জানে ক্রেমার, এবং নালগুলো ওর পরিচিত। ঝটপট ট্র্যাক পরখ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
টলিভারের নাল পরানো চারটে ঘোড়ার ছাপ সহজেই আলাদা করা যাচ্ছে। অন্য তিনটে ঘোড়ার ছাপ অপরিচিত হলেও চতুর্থটার অন্তত একটা হুবহু টলিভারের ব্যবহৃত নালের মত। অপরিচিত চারটে ঘোড়া যেসব স্টলে ছিল, সবক’টাই শুকনো, কাদা নেই এক ফোঁটা; তার মানে একটাই-বৃষ্টির আগেই ঘোড়াগুলো স্টলে ঢুকিয়েছে রাইডাররা।
অন্যদের ঘোড়া মাঝে মধ্যে স্টেশনের স্টলে রাখে টলিভার, কিন্তু ওর বিশেষ নাল লাগানো ওই ঘোড়ার উপস্থিতির অর্থ ঘোড়াটা শুধু কালই নয়, বরং আগেও এসেছে এখানে।
দরজার কাছে সরে গেল ক্রেমার, অভ্যস্ত হাতে সিগারেট রোল করল। মাথা গরম করে ছোটাছুটি করলে লাভ হবে না। আগে ভেবে-চিন্তে, পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে।
গতরাতে চারজন মানুষ উপস্থিত হয়েছিল স্টেশনে। সামান্থা সম্ভবত ওদের আগেই পৌঁছেছিল, এবং জলদি ঘুমিয়ে পড়েছিল। দৃশ্যত সকালে হোয়াইটওঅটরের স্টেজ পৌঁছার আগে কোন ঝামেলা হয়নি।
ফ্রেড টলিভার এবং এড কার্টিস দু’জনই ভাল করে চেনে সামান্থাকে। ক্রেমারের বহুদিনের বন্ধু ওরা। সাহসী, সৎ মানুষ। তবে নিরীহ। মেয়েটার কোন ক্ষতি করেনি ওরা, সামান্থা এখানে থাকা অবস্থায় ক্ষতি হতে পারে সেই চিন্তাও ঠাঁই পায়নি ওদের মাথায়, জানে ক্রেমার। এটাই হয়তো পরিস্থিতির নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, অসতর্ক অবস্থায় ছিল ওরা।
সামান্থা বেশ সুন্দরী। বিশ্বস্ত, আন্তরিক এবং সহজ-সরল মেয়ে। যে-কোন পুরুষের মনোযোগ টেনে রাখার মত আকর্ষণীয় ফিগার ওর। ধরা যাক, আগন্তুকদের একজন আগ্রহী হয়ে পড়েছিল ওর প্রতি, হয়তো উত্ত্যক্ত করেছিল ওকে? চোখের সামনে কোন মহিলার অপমান হবে, এমন কিছু সহ্য করবে না টলিভার, জানে ক্রেমার। কার্টিস আরও এক কাঠি বাড়া। বেপরোয়া, জেদী এবং সাহসী লোকটা।
আচমকাই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল জেফ ক্রেমারের কাছে। প্রায় তৎক্ষণাৎ সমস্ত প্রশ্নের জবাবও পেয়ে গেল। বেনিং আর টেনেম্যানদের দল। ওরাই দায়ী।
টেনেসির পাহাড়ে এদের আদি নিবাস। টাফ, বেপরোয়া এবং বিপজ্জনক আউটফিট। কোন বন্ধু নেই ওদের। ঝগড়াটে, নিষ্ঠুর এবং মেয়ে-ঘেঁষা স্বভাবের। সুযোগ পেলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে ছাড়ে না। ছয় মাস আগে হাফ-মুন এলাকায় বসতি করেছে দলটা।
কঠিন চীজ একেকজন। টলিভার একবার বলেছিল ওদের সম্পর্কে: ‘যেখান থেকেই এসে থাকুক, নিশ্চই পালিয়ে এসেছে। বাজি রেখে বলতে পারি, পেছনে কয়েকটা লাশও ফেলে এসেছে ওরা।’
ক্রেমার দেখেছে ওদের। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ শরীরের কাউবয় মনে হতে পারে, দৃঢ় চোয়াল আর কাঁধের অধিকারী। বিশালদেহী লোকটা টিম বেনিং, চওড়ায় গাছের গুঁড়ির মত। বেন টেনেম্যান ততটা সুঠামদেহী নয়, চুপসানো মুখে হনুর হাড়ের কাছে একটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে।
গরু পালে না ওরা, কিন্তু কখনও মাংসের অভাব হয় না ওদের। দিনে কিছুটা হুইস্কি তৈরি করে, এবং রাতে সেটা বিক্রি করে পেশাদার পেড্লারদের মত।
এখানে বসতি গড়ার পর মাস পেরোনোর আগেই সান্টা রিটায় এক লোককে খুন করে ওরা। তিনজনে মিলে নিষ্ঠুর ভাবে পিটিয়েছে লোকটাকে, শেষে গুলি করে মেরেছে। এলাকায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঝামেলা হয় বটে, কিন্তু টেনেম্যানদের কেউ ঘাঁটাতে যায় না। ওদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য-ঝামেলা একজনের হলে সেটাকে দল বেধে মোকাবিলা করে। কে যাবে পাঁচজনের সঙ্গে লাগতে? সুতরাং কেউই পারতপক্ষে ঘাঁটাতে যায়নি টেনেম্যানদের।
বাড়ি থেকে স্টেজ ধরতে সরাসরি স্টেশনে এসেছে সামান্থা, টেবিলে রেখে যাওয়া নোটে তাই লিখে এসেছিল। বেনিং আর টেনেম্যানরা স্টেশনে পৌঁছেছিল ওর পরপরই। এর আগেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় স্টেশনে রাত কাটিয়েছে টেনেম্যানরা, যদিও অতিথি হিসেবে আন্তরিক অভ্যর্থনা বা সেবা তারা কখনও পায়নি, স্রেফ ঝামেলা এড়ানোর জন্যেই ওদের উপস্থিতি মেনে নেয়া হয়েছে প্রতিবার। নিশ্চই ঝামেলা পাকিয়েছিল ওদের কেউ, পরিণতিতে খুন হয়ে যায় টলিভার। পরে কার্টিসকেও খুন করেছে ওরা, স্টেশন ভবন পুড়িয়ে দিয়ে সামান্থাকে নিয়ে কেটে পড়েছে।
টালি-বুক আর পেন্সিল বের করে এক পাতায় ওর ধারণার কথা লিখল ক্রেমার, তারপর জানাল কি করতে যাচ্ছে। পাতাটা ছিঁড়ে স্টেবলের দরজার পাল¬ার সঙ্গে সেঁটে দিল। দরজা ভেতরের দিকে খোলে বলে বৃষ্টিতে ভেজার সম্ভাবনা কম। কামারশালার কাছে চলে এল ও এবার। দেয়ালের আঙ্টার সঙ্গে পুরানো একটা চিৎকার ঝুলছে, ওটা সরিয়ে দিতে গোপন কুঠুরীতে টলিভারের শটগানটা চোখে পড়ল।
এটার জন্যেই ছুটে এসেছিল এড কার্টিস। কিন্তু সফল হতে পারেনি। চার শটের রিভলভিং রোপার-ব্যারেলের কাছে কয়েক ইঞ্চি কাটা। ভেতরে শেল ভরা আছে কিনা, পরখ করল ক্রেমার, তারপর চিৎকারের ভেতরে চালান করে দিল অস্ত্রটা। বেরিয়ে এসে ডানের কাছে চলে গেল।
ধীর, দ্বিধান্বিত পায়ে স্টেবলে ফিরে এল ও। ঘোড়ার জন্যে কিছু দানাপানি প্যাকেটে ভরে বেডরোলের সঙ্গে বেঁধে রাখল। তারপর ডানের লাগাম হাতে বেরিয়ে এসে স্যাডলে চাপল।
হাফ-মুন এখান থেকে বত্রিশ মাইল দূরের পথ। বিকল্প একটা পথের হদিশ জানা আছে ক্রেমারের। ওর ধারণা টেনেম্যানরা এই পথের কথা জানে না, এখনও এলাকায় নতুন ওরা, স্বভাবতই বত্রিশ মাইল পথ পাড়ি দেবে। রেইন ক্রীক আর ওয়েস্ট ফর্ক হয়ে যে শর্টকাট যাওয়া যায়, সেটা ওদের জানার কথা নয়।
ওর দু’জন বন্ধু খুন হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে স্টেজ স্টেশন। ওর স্ত্রী অপহৃতা। স্বভাবতই দয়া বা করুণা নামের সবকিছু উধাও হয়ে গেছে জেফ ক্রেমারের ভেতর থেকে।
সামান্থা পুবের মেয়ে। সুন্দরী, শান্ত, ধীর-স্থির স্বভাবের এবং যথেষ্ট পরিণত। স্ত্রী হিসেবে ওকে পেয়ে সুখীই ছিল ক্রেমার, মেয়েটাও সুখী ছিল। শুধু একটা ব্যাপারে আপত্তি ছিল সামান্থার, ওর অস্ত্র বহন করা মেনে নিতে পারেনি। মেয়েটা শুনেছে কয়েকটা খুন করেছে ক্রেমার। এসব অবশ্য বহুদিন আগের কথা, টেক্সাসের ঘটনা। ওদের দুই বছরের বিবাহিত জীবনে কোন অনভিপ্রেত ঘটনাই ঘটেনি, যদ্দিন না লনি ম্যাসন এখানে এসেছে।
ছেলেটাকে দেখেই ধাত বুঝে নিয়েছে ক্রেমার। দেখতে সুদর্শন, বিশের ঘরও পেরোয়নি, শান্ত চেহারা, অথচ পুরোটাই মেকী। লনি ম্যাসনের ভেতরটা দেখতে পায়নি সামান্থা, যেটা ক্রেমার দেখেছে-ভেতরে ভেতরে সে একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনী।
বেশ কয়েকবারই র্যাঞ্চে এসেছে ছেলেটা, চলার পথে থেমে গল্প করেছে সামান্থার সঙ্গে। ক্রেমারের সঙ্গে দেখা হলে নীরব উস্কানি আর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েছে। জেফ ক্রেমারের কথা শুনেছে সে, টেক্সাসে রেঞ্জার থাকা অবস্থায় কয়েকজনকে খুন করেছে। রেঞ্জার জীবনে ক্রেমারের সুনামকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে ম্যাসন। কিন্তু স্রেফ ঝামেলা এড়ানোর জন্যেই ছেলেটার নীরব উস্কানি অগ্রাহ্য করেছে ক্রেমার।
তবে সবসময়ই ও জানত, কোন একদিন হয়তো এড়ানো যাবে না। সত্যি সত্যিই তাই ঘটল শেষে। ড্রাই ক্রীক স্টেশনের পাশে ছোট্ট একটা বাথান রয়েছে স্টেজ কোম্পানির, ফ্রেড টলিভারই দেখাশোনা করে। ওদের কিছু গরু চুরি হয়ে গেল হঠাৎ। ফ্রেড টলিভারকে নিয়ে গরু খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে ক্রেমার। খুঁজতে খুঁজতে জায়গামত পৌঁছে যায় ওরা। আরও একজনের সঙ্গে লনি ম্যাসনকে আবিষ্কার করে। টলিভারের একটা বাছুরকে শুইয়ে ব্র্যান্ড করছিল ম্যাসন।
কেউ কিছু বোঝার আগেই পিস্তলের দিকে হাত বাড়ায় ম্যাসন। দারুণ ক্ষিপ্র ছিল সে। কিন্তু নসেজে শেখা বিদ্যে তখনও ভুলে যায়নি জেফ ক্রেমার। সেকেন্ড খানেক পরই দেখা গেল বুক চেপে ধরে লুটিয়ে পড়েছে ম্যাসন, হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছে বুলেট। টলিভারের কোমরের বেল্ট ছুঁয়ে চলে গেল অন্য লোকটার গুলি। দ্বিতীয় গুলি করার সুযোগ পেল না সে, নইলে হয়তো ঠিক খুন হয়ে যেত বাতে আক্রান্ত স্টেশন এজেন্ট।
লাশ দুটো নিয়ে হোয়াইটওঅটরের উদ্দেশে রওনা দিল ওরা, ল-অফিসে শেরিফকে লাশ বুঝিয়ে দেবে। বিশ্রাম নিতে ক্রেমারের বাথানে থামল ওরা। সব শুনে দারুণ হতাশা বোধ করল সামান্থা। স্যাডলের ওপর পড়ে থাকা দেহ দুটো দেখে যে-আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল ওর চোখে, তা কখনও ভুলতে পারবে না ক্রেমার।
সবকিছু ব্যাখ্যা করলে হয়তো বুঝত সামান্থা, কিন্তু শোনার আগ্রহ হয়নি ওর। ব্যাপারটা রীতিমত বিস্ময়কর মনে হয়েছে ওর কাছে। খুনী হওয়া দূরে থাক, লনি ম্যাসনের মত তরতাজা একজন যুবক গরুচোর, এটাই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল ওর কাছে। স্রেফ পিস্তলে নিজের কারিশমা দেখিয়েছে জেফ। জানত কোন একদিন এমনই হবে, অস্ত্র বহন করলে কেউ না কেউ মরবেই। ফ্রেড টলিভার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওসব মাথায় ঢোকেনি সামান্থার-একটা ব্যাপারই মন জুড়ে ছিল যে ওর স্বামী দু’জন মানুষ খুন করেছে, এদের একজন শান্ত স্বভাবের স্বল্পভাষী, হাসি-খুশি এক তরুণ।
এ নিয়ে, বেশ কয়েকবারই তর্ক করেছে ওরা। একসময় খেপেই গিয়েছিল ক্রেমার। এমন কথা বলেছে যা বলা ঠিক হয়নি। রাগের মাথায় ঘোষণা করেছে পশ্চিমা কোন মানুষের বউ হওয়ার যোগ্যতা নেই সামান্থার। বোধহয় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলে সামান্থা-পুবে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাগের মাথায় কথাটা বলে পরে অনুতপ্ত হয়েছে ক্রেমার। রেঞ্জ থেকে ফিরে এসেছিল মাফ চাওয়ার জন্যে, কিন্তু ততক্ষণে ড্রাই ক্রীক স্টেশনের পথ ধরেছে সামান্থা। ক্রেমারের জন্যে একটা নোট রেখে গিয়েছিল টেবিলের ওপর।
হে-স্টেক পর্বতশ্রেণীর চূড়ার ওপর ভিড় করেছে ভারী মেঘের দল, প্রায় ছুঁইছুঁই করছে। ঘোড়ার গতি বাড়াল ও, দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে ঢুকে পড়ল রেইন ক্যানিয়নে। উপত্যকা ধরে পানির স্রোত বইছে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে এখন। উঁচু একটা ট্রেইল ধরে পাহাড়ে উঠে এল ও। ডান ঘোড়াটা বুনো ছিল একসময়, এ ধরনের পরিবেশে চলতে অভ্যস্ত। বজ্রপাতের শব্দ ক্যানিয়নের দেয়ালে দেয়ালে এমন ভাবে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে যেন দৈত্যাকার সব বোল্ডার গড়িয়ে পড়ছে মার্বেল পাথরের করিডরে, গম্ভীর শব্দে কাঁপন উঠেছে পাহাড়ে পাহাড়ে।
পাইনের ঝাড় এখন আর সবুজ নেই, বৃষ্টিতে ভিজে কালো দেখাচ্ছে। হালকা চালে ছুটছে ডানটা। চোখ কুঁচকে বৃষ্টির ধোঁয়াটে পর্দা ভেদ করে দেখার প্রয়াস পেল ক্রেমার, ওয়েস্ট ফর্কের শুরুতে উঁচু একটা জায়গা রয়েছে-জায়গাটার নাম স্যাডল-ওটা ধরে যেতে হবে। এড়িয়ে গেলে ঘুরপথে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
ওয়েস্ট ফর্কের স্যাডলের কাছে যখন পৌঁছল ও, ততক্ষণে ধরে এসেছে বৃষ্টি। দু’পাশে ক্লিফের ঢাল প্রায় নুয়ে পড়েছে। দশ হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু দেয়াল। স্যাডলটা আট হাজার ফুট উঁচুতে।
থামল না ক্রেমার, টানা এগিয়ে চলেছে। আকাশে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা। কাঁধে আছড়ে পড়ছে তুমুল বৃষ্টি, একসময় ক্লান্ত বোধ করল ও। বেশ কয়েকবার ট্রেইল ছেড়ে গাছের আড়ালে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ঘোড়াটা, কিন্তু ক্রেমারের তাগাদায় রাস্তায় থাকতে বাধ্য হয়েছে। একসময় স্যাডল পেরোল ওরা, নিচু ঢাল ধরে নামতে শুরু করল।
গাছপালার ফাঁকে খোলা জায়গায় এসে হাফ-মুনের দিকে দৃষ্টি চালাল ক্রেমার। অগুনতি ন্যাড়া ক্যানিয়ন আর পাহাড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সামনের এলাকায়, মাকড়সার জালের মত বিছিয়ে আছে; প্রাকৃতিক একটা গোলকধাঁধা। বৃষ্টিøাত লালচে পাথর আর গ্র্যানিট উজ্জ্বল দেখাচ্ছে; শান্ত স্থবির দাঁড়িয়ে আছে পাইনের ঝাড়, নগ্ন শাখাগুলো রাইফেলের দীর্ঘ ব্যারেলের মত তাক করা ধূসর আকাশ আর ন্যাড়া ক্লিফের দেয়ালের দিকে। ঘোড়ার গতি বাড়াল ক্রেমার, তুলনামূলক সহজ ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে এখন। দারুণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে ঘোড়াটা, বিক্ষত খুর নিয়েও এগিয়ে চলেছে।
সহজ এবং সংক্ষিপ্ত ট্রেইলটা চেনে না বলে ঘুরপথে এসেছে টেনেম্যানরা, স্বভাবতই ওর চেয়ে পিছিয়ে থাকবে ওরা; তাছাড়া এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর অপরিচিত এলাকা বলে সতর্কতার সঙ্গে এগোবে। ক্রেমার আশা করছে টেনেম্যানদের আগেই হাফ-মুনে পৌঁছে যেতে পারবে।
আচমকা ডানদিকে পাহাড়ের একটা গভীর চেরা চোখে পড়ল ওর। ক্রমশ নিচু হয়ে খাদের আকৃতি পেয়েছে চেরাটা। ঘোড়ার গতিপথ বদলে পাইনের সারির ফাঁক গলে এগোল ও, প্রায় হাঁটছে এখন ডানটা, সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ক্যানিয়নের তলা পর্যন্ত নেমে গেছে।
ক্যানিয়নের তলায় জমা পানিতে তুমুল স্রোত উঠেছে। পানির কিনারায় চোখের ভুরুর মত বাঁকা হয়ে গেছে ট্রেইল। নাক সিঁটকে অস্বস্তি প্রকাশ করল ডান, সরে যেতে চাইল, কিন্তু ক্রেমারের হালকা কিন্তু লাগাতার তাগাদায় এগিয়ে যেতে বাধ্য হলো। আধ-ঘণ্টা পর চড়াইয়ের শুরু হলো, দুই পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকার খোলা জায়গা ক্রমশ আরও ওপরে উঠে গেছে।
অনেকক্ষণ এভাবেই চলল ও, কেবলই উঠছে। তারপর একসময় হাফ-মুনের ওপরের এক উপত্যকায়, ঘন পাইনের সারিতে নিজেকে আবিষ্কার করল জেফ ক্রেমার।
কয়েক জায়গায় ঘন হয়ে জন্মেছে কিছু পাইন, তুমুল বৃষ্টিতে সাময়িক আশ্রয় হতে পারে ওর জন্যে, তারই একটার নিচে এসে স্যাডল ছাড়ল ক্রেমার। কিছু দানাপানি নোজ-ব্যাগে ভরে ওটা ঝুলিয়ে দিল ডানের গলায়। পাইনের ফাঁক গলে এগোল ও এবার, দৃষ্টি নিচের পাহাড়ী উপত্যকায়।
পুরানো কেবিনটা আগের মতই আছে, ঠিক যেমন দেখেছিল। দীর্ঘ, নিচু ছাতের কেবিন। স্টেবল আর করাল রয়েছে পঞ্চাশ গজ দূরে। একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসল ক্রেমার, সময় নিয়ে সিগারেট রোল করল। বৃষ্টি ধরে এসেছে, গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে এখন, ক্রমশ ঘনায়মান অন্ধকারের অপেক্ষায় থাকল ও, ট্রেইলের ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রেখেছে।
রাতের অন্ধকার প্রায় জাঁকিয়ে বসেছে, এ সময়ে ওদের আসতে দেখতে পেল জেফ ক্রেমার। ছয়জন রাইডার আর চারটে চুরি করা ঘোড়ার পিঠে প্যাক দেখা যাচ্ছে। পুড়িয়ে দেয়ার আগে স্টেজ স্টেশন লুট করেছে ওরা, মালপত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
ফিল্ড-গ্লাস দিয়ে প্রত্যেকের মুখ জরিপ করল ক্রেমার, সবার আগে অবশ্য সামান্থাকে দেখল। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত এবং ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওকে, কিন্তু এখনও মাথা উঁচু করে স্যাডলে বসেছে, চাপা অহঙ্কার আর অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে আচরণে। রাইডারদের একজন স্যাডল থেকে নামাল ওকে, তারপর কেবিনের ভেতরে নিয়ে গেল। একে একে স্যাডল ছাড়ল অন্যরা, তারপর মালপত্র নামিয়ে ঘোড়াগুলোকে করালে নিয়ে গেল।
কেবিনে একটাই দরজা, জানালা নেই। কিছু পোর্ট-হোল রয়েছে অবশ্য, কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখার উপায় নেই। কেবিনে ঢোকার একমাত্র উপায়-সামনের দরজা।
পাহাড়ের কিনারে বসে পড়ল ক্রেমার, সতর্ক মাপা দৃষ্টিতে সামনের দৃশ্য জরিপ করল। বুঝতে পারছে কি করতে হবে ওর। ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে এবং খুব দ্রুত…
*
আড়ষ্ট হাত ডলার ফাঁকে দীর্ঘ কামরার এদিক-ওদিক নজর চালাল সামান্থা ক্রেমার, একটু আগে ওর হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে বেন টেনেম্যান।
ওপাশে দেয়ালের লাগোয়া কয়েকটা বাঙ্কে জীর্ণ, নোংরা বেডরোল বিছানো। উল্টে রাখা একটা বেঞ্চ রয়েছে একপাশে; কাদামাখা বুট, পরিত্যক্ত ব্রিডল, আধ-ছেঁড়া ল্যারিয়েট ছাড়াও রকমারি জিনিস অবহেলার সঙ্গে মেঝেয় ফেলে রাখা। কেবিনের বাতাস গরম, ভাপসা এবং ঘামের কটু গন্ধে ভরা।
চুলোয় তেল চিটচিটে একটা পাত্র বসিয়ে খাবার গরম করছে বেনিং। ডেভ টেনেম্যান, রোদপোড়া সুদর্শন চেহারার মাঝবয়েসী লোকটি বাঙ্কে বসে বুট খুলতে ব্যস্ত। সামনের দিকে চাঁদি খালি হতে শুরু করেছে তার। দূর থেকে সামান্থার উদ্দেশে সবক’টা দাঁত কেলিয়ে হাসল সে, তারপর বুট খুলে পা তুলে দিল বাঙ্কের ওপর, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল, আঙুল ভাঁজ করে মাথার পেছনে রেখেছে জুত করে বসার জন্যে।
ডেভ টেনেম্যানই ঝামেলা বাধিয়েছিল স্টেশনে। সামান্থার উদ্দেশে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু একটারও উত্তর পায়নি দেখে খেপে যায় সে। কাছে এসে ওর বাহু চেপে ধরেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এসেছিল টলিভার। ঝটকা মেরে টেনেম্যানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে নিজের চরকায় তেল দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল স্টেশন এজেন্ট।
জবাব দিতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি ডেভ টেনেম্যান। ওর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আরেকজন। নির্দয় ভাবে পিটিয়েছে টলিভারকে, এমনকি টলিভার মেঝেয় লুটিয়ে পড়ার পরও সমানে লাথি হাঁকিয়েছে। দু’জনে মিলে, ধীরে ধীরে কিন্তু নিপুণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে পিটিয়েছে। সামান্থার চিৎকার শুনে কি হয়েছে জানতে স্টেশন ভবনের দরজায় ছুটে এসেছিল এড কার্টিস, পলকের জন্যে চোখ চালিয়েই পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছিল। উল্টো ঘুরেই ছুটতে শুরু করল সে। খেয়াল করেনি পিছু নিয়ে দরজার বাইরে চলে এসেছে বেন টেনেম্যান, ঝটিতি পিস্তল বের করেই হান্টারের পিঠে গুলি করল।
কিছুক্ষণ পর আরেকটা গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে সামান্থা।
ততক্ষণে পুরোপুরি নিথর হয়ে গেছে ফ্রেড টলিভার। মেঝেয় পড়ে আছে রক্তাক্ত বিধ্বস্ত দেহ। জীবনের কোন চিহ্নই নেই।
জোর করে সামান্থাকে স্যাডলে তুলে দেয় টেনেম্যানদের একজন। প্যাক-হর্সে লুট করা মাল তুলল দুই টেনেম্যান, অন্য দু’জন শোভেল দিয়ে ফায়ারপ্লেস থেকে জ্বলন্ত কয়লা বের করে ছড়িয়ে দিল সারা মেঝেয়, খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল সামান্থা। হালকা বৃষ্টির মধ্যেও আগুন ধরে গেল কিছ্ক্ষুণের মধ্যে। স্টেবলে গিয়ে ঘোড়ার বাঁধন খুলে দিল একজন, মুহূর্তে শূন্য হয়ে গেল স্টলগুলো। কেবিন থেকে ছুটে বেরোনোর সময় জ্বলন্ত একটা চেলা তুলে নিল ডেভ টেনেম্যান, বেরিয়ে এসে স্টেজের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল সেটা।
জ্বলন্ত কেবিন আর স্টেজকোচের দিকে তাকিয়ে উল¬াসে ফেটে পড়ল সে। ট্রেইলে এসেও ফিরে তাকাল, আমোদ-মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মিনিট খানেক পর দ্রুত পাহাড়ের দিকে ঘোড়া ছোটাল সবাই।
এখন, দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেট রোল করছে বেন টেনেম্যান, আড়চোখে বাঙ্কে বসে থাকা ডেভকে দেখছে। ‘ডেভ,’ ধীর, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল সে। ‘সকাল হওয়ার আগেই সব ঘোড়ার পিঠে স্যাডল চাপিয়ো। যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যাব আমরা।’
মাথার পেছন থেকে হাত সরিয়ে সিধে হয়ে বসল ডেভ। ‘তার কোন দরকার আছে কি, বেন?’ তীক্ষè স্বরে প্রতিবাদ করল সে। ‘কার মাথায় আসবে যে কাজটা আমাদের? প্রমাণই বা করবে কিভাবে? অযথা দুশ্চিন্তা করছ, তোমার যেমন স্বভাব!’
তামাকের দলা একগাল থেকে আরেক গালে চালান করে দিল জুড টেনেম্যান, কোণের টেবিলে বসে সলিটেয়ার খেলছে। তামাকের রসে মুখ ভরে যাওয়ায় ফায়ারপে¬সের উদ্দেশে পিক ফেলল সে। ঠিক ঠিক আগুনে গিয়ে পড়ল। ‘বেন ঠিকই বলেছে, ডেভ। প্রমাণ করার কিছু নেই। ওরা ঠিকই ধারণা করবে কাজটা কাদের। তারপর সত্যি সত্যি এখানে চলে আসবে।’
‘ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে তোমাদের,’ হঠাৎ বলল সামান্থা। ‘আমাকে একটা ঘোড়া দেবে তোমরা, তারপর চলে যেতে দেবে। এখুনি। আমার স্বামী ঠিকই চলে আসবে।’
আলসেমি ভরা চাহনিতে ওকে দেখল ডেভ টেনেম্যান। ‘আমার একবারও মনে হয়নি তুমি বিবাহিতা!’
‘আমাকে চলে যেতে দিলেই মঙ্গল হবে তোমাদের,’ শান্ত স্বরে বলল সামান্থা।
সিগারেট ধরাল বেন টেনেম্যান। ‘কাউকে পরোয়া করি না আমরা। পাঁচজন লোক থাকলে মাত্র একজন মানুষকে পরোয়া করারও কিছু নেই। কিন্তু মেয়েমানুষ মাত্রই ঝামেলা, সবকিছু বদলে যায় ওদের উপস্থিতিতে-সবচেয়ে চালু এবং সৌভাগ্যবান লোকটাও ভজকট করে ফেলে। হোয়াইটওঅটরের লোকজনকে নিয়ে ভাবছি আমি, নাছোড়বান্দা টাইপের মানুষ ওরা।’
স্থির হয়ে বসে থাকল সামান্থা, একটুও নড়ছে না। বেন টেনেম্যান লোকটাই বেশি বিপজ্জনক। কোন ভাবে যদি তাকে বোঝানো যেত…। ‘আমার স্বামী ঠিকই জেনে যাবে যে এখানে এসেছ তোমরা। এলাকাটা ওর পরিচিত। এতক্ষণে হয়তো কাছাকাছিও চলে এসেছে।’
দাঁত কেলিয়ে হাসল ডেভ টেনেম্যান। সামান্থার কথায় প্রভাবিত হওয়া দূরে থাক, বিশ্বাসই করেনি। বাঁকা, কিন্তু তাচ্ছিল্যের হাসিটা ফিরে এল তার ঠোঁটের কোণে। ‘মনে হয় না, হানি। তুমি ওকে ছেড়ে চলে এসেছ, তাই না? টলিভারের সঙ্গে তোমার কথাবার্তা কিছু শুনেছি। মানেটা অবশ্য বুঝিনি তখন, একটু আগে যখন বললে যে তুমি বিবাহিতা, তারপর বুঝেছি।’
‘জেফের জন্যে একটা নোট রেখে এসেছি আমি।’
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে, যেভাবেই হোক আঁচ করতে পেরেছে মিথ্যে বলেনি সামান্থা। ‘তুমি বরং প্রার্থনা করো এখানে যেন না আসে সে!’ গম্ভীর, শীতল সুরে বলল আউটল। ‘এখানে এলে স্রেফ জবাই হয়ে যাবে ব্যাটা!’
হুমকিটা অস্বস্তি ধরিয়ে দিল সামান্থার মনে। ‘টেক্সাসে রেঞ্জার ছিল ও,’ মরিয়া হয়ে বলল ও, ভেতরে ভেতরে হতাশ হতে শুরু করেছে। ‘নিজের চামড়া বাঁচাতে জানে সে।’
আড়ষ্ট হয়ে গেল বেন টেনেম্যানের মুখ, ঝট করে ফিরে তাকাল সে। ‘কি নাম ওর?’
চিবুক উঁচু করল সামান্থা, গর্বের সঙ্গে নামটা উচ্চারণ করল: ‘জেফ ক্রেমার।’
উনুনের দেয়ালের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো একটা ফর্কের, চমকে উঠেছে টিম বেনিং। পাত্র নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল সে। মুখ গম্ভীর, কিন্তু কপালের পাশে তিরতির করে লাফাচ্ছে একটা শিরা। ‘বেন, ওই লোকের কথাই বলছিলাম। এই ব্যাটাই খুন করেছে লনিকে!’
কেউ কিছু বলছে না, অস্বস্তিকর নীরবতা।
কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত টেনেম্যানরা। একজন মানুষ, হোক না সাবেক রেঞ্জার, পাঁচজনের বিরুদ্ধে কিই বা করতে পারবে? কিন্তু একেবারে হেলাফেলা করার মত লোক নয় জেফ ক্রেমার, বেপরোয়া আর জেদী লোক হিসেবে টেক্সাসে দারুণ সুনাম ছিল ওর। পিস্তলে চালু, কিন্তু তারচেয়েও বেশি চালু মাথাটা খাটানোয়। এখানে এলে হয়তো দলবল নিয়েই আসবে সে। কে বলতে পারে সঙ্গে সাহায্য নিয়ে আসবে না?
সমস্ত ভয় বা আশঙ্কার পরও অদ্ভুত এবং অসম্ভব এক প্রত্যাশা করছে সামান্থা। যদি ওকে ছেড়ে দিত এরা! জেফ এখানে এসে পৌঁছার আগেই ওকে ছেড়ে দিলে…আচমকা ও উপলব্ধি করল জেফ আসবেই। বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। শত বিপদের আশঙ্কা থাকার পরও এখানে আসবে সে।
মানসপটে জেফ ক্রেমারের মুখখানা দেখতে পেল ও। ঠাণ্ডা, শান্ত কিন্তু মাপা চাহনি, বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য। ঠোঁটের কোণে মাঝে মধ্যে এক চিলতে হাসি খেলা করে, সেই হাসির ছায়া চোখেও খেলে যায়। আন্তরিক হাসি, সমর্থ সবল দুটো হাতের ছোঁয়া…
‘কাজটা ভালই করেছে ও,’ মন্তব্য করল সাইলেন্ট টেনেম্যান, বেনের পর সে-ই বয়োজ্যেষ্ঠ। খুবই কম কথা বলে সে, এজন্যেই এমন অদ্ভুত নাম। ‘লনি স্রেফ একটা খুনী ছিল, ওর মত জঘন্য নীচ ছেলে আমি আর দেখিনি!’
‘কিন্তু পিস্তলে দারুণ ছিল ওর হাত! তাছাড়া সিড গ্যানন ছিল ওর সঙ্গে।’ উনুন থেকে মাথা তুলে মনে করিয়ে দিল টিম বেনিং।
সিগারেটে টান দিল বেন। ‘মেয়েটা হয়তো ঠিকই বলেছে। ওকে বোধহয় ছেড়ে দেয়া উচিত।’
ঝটিতি উঠে দাঁড়াল ডেভ, রাগে চোখ জ্বলছে। ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?’ কর্কশ স্বরে খেঁকিয়ে উঠল। ‘ওই মেয়ে আমার, তোমাদের কারও নয়! ওকে কোথাও যেতে দেব না আমি!’
ডেভের দিকে ফিরল বেন, চাহনিতে অসন্তোষ। দীর্ঘ একটা মিনিট পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। ‘বোধহয় ভুলে গেছ কার জন্যে আমাদের এই দুরবস্থা?’ শেষে শান্ত কিন্তু শীতল কাঠিন্যের সুরে জানতে চাইল সে। ‘তোমার জন্যে, ডেভ। তুমি যদি ওই মেয়েটার দিকে হাত না বাড়াতে, তাহলে এখানে নিরাপদে থাকতে পারতাম আমরা, কোন ঝামেলা হতো না। তোমার ব্যাপার-স্যাপার ইদানীং ভাল লাগছে না আমার, ডেভ। তোমার জন্যেই মবেটি ছেড়ে আসতে হয়েছে। ওখানেও মেয়েলি ঝামেলায় জড়িয়েছ।’
‘কিন্তু ওকে ছেড়ে দিলে আমাদের কথা বলে দেবে,’ মনে করিয়ে দিল জুড টেনেম্যান। ‘তারচেয়ে কি সকালে ঝামেলা খালাস করে ফেলাই ভাল না? তাহলে কেউই কিছু প্রমাণ করতে পারবে না।’
বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকাল বেন টেনেম্যান। কেউ কিছু প্রমাণ করবে-চিন্তাটাই ত্যক্ত করে তুলছে ওকে। উঁহুঁ, কিছু প্রমাণ করার ঝামেলায় যাবে না লোকজন, স্রেফ সিদ্ধান্ত নেবে এবং তারপর নেক-টাই পার্টির আয়োজন করবে। কষে সিগারেটে টান দিল সে। কোন সম্ভাবনাই নেই…
সপাটে খুলে গেল দরজা, বাতাসের ঝাপটায় নিভু নিভু হয়ে গেল লণ্ঠনটা; তারপর মুহূর্ত খানেক বাদে, দরজা বন্ধ হয়ে যেতে ওরা দেখতে পেল দরজার কবাটের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহী এক লোক। চামড়ার ভেজা চ্যাপস পরনে, কোমরে ক্রস করে দুটো গানবেল্ট বাঁধা। স্নিকারের তলায় কিছু একটা ফুলে আছে, জিনিসটা বেশ বড়সড়। বাম হাতের আঙুল চালিয়ে হ্যাট খানিকটা তুলল সে। অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠল সামান্থা, উল্লাস আর আনন্দে প্রায় বুজে এল কণ্ঠ।
‘তোমাদের খেল খতম, বয়েজ!’ বলল জেফ ক্রেমার।
‘খেল তো তুমিই শুরু করেছ-এখানে এসে,’ চালিয়াতির সুরে বলল বেন টেনেম্যান। ‘তবে শেষ করব আমরা।’
‘সন্দেহ আছে আমার,’ শান্ত স্বরে বলল সে, কথা বলার ফাঁকে সামান্য হাত নাড়ল, চিৎকারের তলা থেকে উঁকি দিল শটগানের ভয়ঙ্কর দর্শন নল। ‘তোমরা কি বাকশট পছন্দ করো?’
হাঁটু গেড়ে বসে আছে বেনিং। অসুস্থ, ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাকে। শটগানের রেঞ্জের মধ্যে আছে সে। বেন আর জুডও তাই। একেবারে চুপসে গেছে জুড। হাত দুটো কোলে রেখেছে সে, শরীর থেকে কিছুটা দূরে।
‘তো, কি করবে তুমি?’ জানতে চাইল বেন, কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছে।
‘কি আর করব, স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাব। বাকিটা তোমাদের আর শহরের লোকজনের ওপর ছেড়ে দেব।’
‘কাউকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছ না তুমি!’ উঠে বসল ডেভ টেনেম্যান, হাতে একটা পয়েন্ট ফোর-ফোর চলে এসেছে। ‘শটগানটা ফেলে দাও!’
স্মিত হাসল ক্রেমার, মাথা নাড়ল সামান্য।
খানিক বিস্ফারিত হলো বেন টেনেম্যানের চোখ। ‘ডেভ, পিস্তল ফেলে দাও!’ নির্দেশ দিল সে ভাইকে।
দাঁত বের করে হাসল ডেভ। ‘বোকামি কোরো না, বেন। এখানে একটা শো-ডাউন হবে।’
‘একজনের বিরুদ্ধে তিনজন,’ শান্ত স্বরে বলল ক্রেমার। ‘আপত্তি নেই আমার।’
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে উঠল ডেভ। ‘তুমি তো আমাকে দেখতেই পারো না, বেন। ঠিক বলেছি না?’
‘ডেভ!’ আতঙ্কিত হয়ে গেল বেনিঙের কণ্ঠ। ‘ওটা নামিয়ে রাখো!’
একই জায়গায় বসে আছে সামান্থা, ডেভ টেনেম্যানকে দেখছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে পিস্তল হাতছাড়া করবে না আউটল। ভাইরা কিংবা বেনিং মরল কি বাঁচল, তাতে পরোয়া করবে না, গুলি করার ঝুঁকিটা সে নেবেই।
বেনও জানে সেটা। হনুর হাড়ের কাছে আড়ষ্ট পেশী আর ফ্যাকাসে চামড়াই তা জানান দিচ্ছে।
শান্ত স্বরে কথা বলল জেফ ক্রেমার। ‘একটা লোক ক’টা গুলি হজম করতে পারে? আমি একজনকে দেখেছি অগুনতি গুলি হজম করতে, ডেভ, কিন্তু বাকশটের একটা গুলি শরীরে লাগার পর সবচেয়ে টাফ লোককেও বেঁচে থাকতে দেখিনি, শুনিওনি। লোড করার ঝামেলায় যেতে হবে না আমাকে, চারটে শেল রয়েছে এটার চেম্বারে। আর পিস্তল তো আছেই। তো, তারপরও চান্স নেবে?’
‘নেব, নিশ্চই নেব!’ এখনও হাসছে সে, তবে সেটা চেষ্টাকৃত।
বেন টেনেম্যানের পেছনে, কিছুটা বাম দিকে সামান্থার অবস্থান, রেঞ্জের বাইরে। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সাইলেন্ট টেনেম্যান, এতটা কাছে যে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে।
হাত বাড়াল সামান্থা, যদি পিস্তলটা হোলস্টার থেকে তুলে নিতে পারে…
কিন্তু তার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠল সে। নিমেষে পিস্তল বের করল। ‘পিস্তল ফেলে দাও, ডেভ,’ কর্কশ স্বরে নির্দেশ দিল ভাইকে। ‘আমাদের সবাইকে খুন করবে তুমি!’
জ্বলে উঠল ডেভের চোখ, সেখানে কেবলই ঘৃণা। ঝট করে সামান্থার দিকে ফিরল। ‘নিকুচি করি! তুমি…’ উঠে দাঁড়াচ্ছে সে, একইসঙ্গে পিস্তলের নলটা ঘুরছে সামান্থার দিকে।
টাশ্শ্!
বদ্ধ ঘরে বোমা ফাটল যেন। সাইলেন্ট টেনেম্যানের গুলি ঠিকানা খুঁজে পেল ডেভের বাহুতে। মুঠি থেকে পিস্তল খসে পড়ল তার, বাহু থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। শূন্য দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল সে, মুখে বিস্ময়, চাহনি এমন যেন এইমাত্র গভীর ঘুম থেকে জেগেছে।
গুলি করেনি জেফ ক্রেমার। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘ভালই হলো তোমাদের জন্যে, বয়েজ,’ শান্ত স্বরে বলল ও। ‘এবার টাইট হয়ে বসো।’ চোখ না সরিয়েই সামান্থার উদ্দেশে পরের কথাগুলো বলল। ‘স্যাম, উঠে দাঁড়াও, এখানে চলে এসো। আমার আর টেনেম্যানদের মাঝখানে পোড়ো না আবার। কাউকে খুন করার ইচ্ছে নেই আমার, কিন্তু নাচার হলে তাই করব আমি।’
দুর্বল, কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াল সামান্থা, অন্য কেউই নড়েনি। স্থির দৃষ্টিতে জিমের দিকে তাকিয়ে আছে বেন টেনেম্যান। ‘ওই জিনিসটা না থাকলে…’ কর্কশ স্বরে আক্ষেপ প্রকাশ করল সে।
বেনকে ঘিরে আধ-চক্কর মারল সামান্থা, আশঙ্কা হলো ওকে ধরতে চেষ্টা করবে সে; কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। জিমের পাশে এসে দাঁড়াল ও।
‘দরজাটা খুলে বেরিয়ে যাও, স্যাম, জলদি…!’
শটগানের পুরোটাই এখন উন্মুক্ত, দু’হাতে সেটা ধরে রেখেছে ক্রেমার। ‘খেল খতম হয়ে গেছে তোমাদের। তোমরা বরং কেটে পড়ো, যত জোরে পারো ঘোড়া ছুটিয়ে দাও। নিশ্চিত বলতে পারি তোমাদের ধরতে পারলে ঝুলিয়ে দেবে পাসি।’
‘অনেক সময় আছে,’ গম্ভীর স্বরে বলল বেন টেনেম্যান। ‘তোমাকে ঠিকই ধরে ফেলব। হোয়াইটওঅটর পর্যন্ত যাওয়ার সময় তুমি পাবে না।’
‘আমি যখন ড্রাই ক্রীক স্টেশন ছেড়ে আসি,’ উত্তরে বলল ক্রেমার। ‘তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হোয়াইটওঅটর থেকে একটা স্টেজ পৌঁছে যাওয়ার কথা। স্টেবলের দরজার সঙ্গে একটা নোট রেখে এসেছি, বুঝতেই পারছ ওটা পেলে কি করবে ড্রাইভার। এতক্ষণে নিশ্চই পঞ্চাশজন লোক রওনা দিয়েছে এখানকার উদ্দেশে। পালাতে পারবে না, তবে চেষ্টা করতে পারো।’
দরজা খুলল সামান্থা, ফের বাতাসের ঝাপটায় নি®প্রভ হয়ে এল লণ্ঠন। ঝটিতি ঘুরেই বেরিয়ে পড়ল ক্রেমার, পেছনে দরজার কবাট টেনে দিল, তারপর হাত বাড়িয়ে সামান্থার কনুই চেপে ধরে ছুটতে শুরু করল। দ্রুত কেবিনের কোনা ঘুরে ছুট দিল বনের উদ্দেশে। করালের সামনে এসে থামল ও। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। সবক’টা ঘোড়াকে বের করে দিল স্টল থেকে, সারাক্ষণ চোখ রেখেছে কেবিনের ওপর। ভেতরে তর্ক করছে ওরা, বেরিয়ে আসবে কি আসবে না, ঠিক করতে পারছে না। আশঙ্কা করছে বেরোতে গেলেই বাইরে থেকে গুলি করবে জেফ ক্রেমার।
দরজা খুলে গেল একটু পর, তারপর একটা চিৎকার শোনা গেল। পরমুহূর্তে ছুটন্ত পদশব্দ। স্টেবলের দরজায় আলো জ্বালল কেউ। আলো বরাবর তিনটে গুলি পাঠিয়ে দিল ক্রেমার। দেয়াশলাইয়ের কাঠি নিভে গেল তৎক্ষণাৎ, অন্ধকার আর নীরব হয়ে গেল জায়গাটা।
ঢাল ধরে ওপরে চলে এল ক্রেমার, যেখানে ঘোড়াটাকে রেখে গিয়েছিল। একই ঘোড়ার স্যাডলে চাপল ওরা। স্টেবল থেকে একটা ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে এসেছে ক্রেমার, ওটার লাগাম রয়েছে হাতে। ফিরতি পথে এগোল ওরা।
পেছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছে সামান্থা, কাঁধে মাথা রেখেছে। কানের কাছে ফিসফিস করল: ‘ওরা কি আমাদের অনুসরণ করবে?’
‘না,’ পঞ্চো বের করে সামান্থার কাঁধে জড়িয়ে দিল ক্রেমার। ‘আগে ঘোড়াগুলো ধরতে হবে ওদের। তাছাড়া এই ট্রেইলটা ওদের কেউই চেনে না।’
‘তাহলে ধরা পড়বে ওরা?’
‘সে-সম্ভাবনাই বেশি।’
মিনিট কয়েক নীরবে কেটে গেল। দূরে পাহাড়ে খুরের শব্দ হলো-অনেক ঘোড়া। তারপর দীর্ঘ নীরবতা। একটা গুলির শব্দ শোনা গেল একটু পর, জবাবে বেশ কয়েকটা গুলি হলো-টানা। তারপর ফের নীরবতা নেমে এল। শেষে মাত্র একটা গুলি হলো আবার।
ক্যানিয়নে পানির উচ্চতা কমে গেছে। মিনিট কয়েক পর, সমতল জমিতে পৌঁছে গেল ওরা। ক্লান্ত সামান্থা প্রায় লেপ্টে আছে ক্রেমারের শরীরের সঙ্গে। ‘হোয়াইটওঅটরে যেতে চাও?’ জানতে চাইল ক্রেমার। ‘ওখানে গেলে স্টেজ ধরতে পারবে।’
‘বাড়ি ফিরে যেতে চাই আমি, জেফ। আমাদের বাড়িতে। আর…আমি সত্যিই দুঃখিত।’
‘বেশ তো।’
বৃষ্টিস্নাত ধূসর আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। দিনের প্রথম আলোয় সতেজ দেখাচ্ছে প্রকৃতি। বিস্তীর্ণ প্রেয়ারি ধরে এগোল ঘোড়া দুটো। মাঝে মধ্যে পানি জমেছে নিচু জায়গায়। হাত বাড়িয়ে সামান্থার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল ক্রেমার, ওভাবেই সারা পথ রাইড করল ওরা।