হলুদ শয়তান

হলুদ শয়তান

মিঃ চিদাম্বরম তার শয়নকক্ষ থেকে রহস্যজনক ভাবে একরাত্রে অদৃশ্য হবার পর খানাতল্লাশী করতে গিয়ে সিংহল পুলিস তার ডাইরীটা পেয়েছিল। সেই ডাইরীতেই কথাগুলো লেখা ছিল শেষ পৃষ্ঠায়।

স্পষ্ট একটা খসখস্ আওয়াজ। ঘরের মধ্যে কেউ এসেছে নিশ্চয়ই! ঘরের আবছা অন্ধকারে তারই সাবধানী পায়ের মৃদু ক্ষীণ শব্দ। কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় মন মর্মায়িত হয়ে ওঠে। কে?

ঘুম আর হল না। উঠে বসলাম। অন্ধকারে রেডিয়াম-দেওয়া ঘড়ির ডায়ালটা চিকচিক করে জোনাকির আলোর মত জ্বলে।

ঘড়িতে রাত্রি দুটো। আজ তিন রাত্রি ধরে প্রত্যহই ঠিক এমন সময় আমার ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। শুনতে পাই একটা অস্পষ্ট লঘু পায়ে চলার শব্দ যেন ঘরের মধ্যে অন্ধকারে চলে বেড়ায়। ক্ষীণ স্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

আমার গায়ের ভিতরটা সিরসির করে। ভয়ের একটা তরল স্রোত যেন রক্তের নলীতেনলীতে ছড়িয়ে যায়। সমস্ত দেহটাকে অসাড় ও পঙ্গু করে দেয়।

আজ নিয়ে পর পর তিন রাত্রি ঐ শব্দ শুনে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলেছি, তার পর শয্যার উপর বসে থেকেছি। আর আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, হয়ত আমার মনের ভুলও হতে পারে, মশারীটা যেন ক্রমশ নীচের দিকে ঝুলে পড়ছিল। আর ঘুম আসেনি-আজো আমার না জানি—

খালি ঘর। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। দরজার হাতল ধরে টেনে দেখেছি প্রতি রাত্রেই, দরজা পূর্বের মতই বন্ধ।

জানলার নেটের পর্দা দুপাশে টেনে সরিয়ে দেখেছি, কোথাও কিছু নেই—

তবে কি সবটাই আগাগোড়া একটা দুঃস্বপ্ন!

পুলিসের রিপোর্ট থেকে মিঃ চিদাম্বরমের সম্পর্কে যা জানা যায়, মিঃ চিদাম্বরমের বয়স এমন বেশী কিছু নয়, চল্লিশের কোঠা সবে ছাড়িয়েছিলেন। সংসারে আপনার বলতে একটি মাত্র ভাইপো-রূপ। বয়স তার তেইশ কি চব্বিশ। ভারতের দক্ষিণ দেশের লোক, ভাষা তামিল। গত পনের বৎসর ধরে মুক্তা ও রবারের ব্যবসায়ে চিদাম্বরম আজ প্রায় কোটিপতি। সিংহলে মুক্তা ছাড়াও মস্তবড় রবারের কারবার ছিল। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে মুক্তা ও রবার। চালান যেত তাঁর।

স্থানীয় পুলিসের রিপোর্ট থেকে জানা যায় আবার-চিদাম্বরমের শয়ন-ঘরে শয্যাই কেবল খালি ছিল না তা নয়-মশারীটাও ছিল না। আর শয্যার উপর চাদরটা এলোমেলো হয়ে ছিল আর সারা ঘরের বাতাসে যেন একটা কেমন মিষ্টি অথচ উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে ছিল অনেকটা ক্লোরোফরমের মত।

জংলী চায়ের কাপটা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। লেপের ভিতর হতে মাথাটা একটু বের করে কিরীটী বললে, জংলী, আজকের খবরের কাগজটা দিয়ে যাস।

খবরের কাগজ তো অনেকক্ষণ রেখে গেছি বাবু; ঐ যে টি-পয়ের ওপর।

হাত বাড়িয়ে কিরীটী সেদিনকার সংবাদপত্রটা তুলে নিল।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সংবাদপত্রের ভাঁজটা খুলতে খুলতে কিরীটী বললে, সুব্রত আসছে, যা, আর এক কাপ চা নিয়ে আয়।

সুব্রত ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে, উঃ! কী শীত রে বাবা! জমাট বেঁধে গেলাম!

কিরীটী খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললে, গরম গরম চা খেয়ে আবার গলে যাও! তারপর কি হে, সক্কালবেলাতেই!

শীতের বাজারটা একেবারে মন্দা চলছে! এমনি করে আর বেশী দিন বসে থাকলে গেঁটে বাত ধরবে দেখছি!

কিরীটীর দিক থেকে বিশেষ কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। জংলী আর এক কাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।

সুব্রত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, দেখছি তোর রহস্যভেদের ছোঁয়াচ বোধ হয় আমারও লেগেছে, দিনরাত কেবল রহস্যেরই স্বপ্ন দেখছি। রাতের অন্ধকারে জেগে জেগে কান পেতে অশরীরীর পায়ের শব্দ শোনবার জন্য চেষ্টা করি। রাজু তো যেখানে যত ডিটেকটিভ বই আছে সব কিনে এনে একটার পর একটা শেষ করছে।

কিরীটীর কোন সাড়া-শব্দ নেই। চায়ের কাপটা নিঃশেষ করে টি-পয়টার উপর রাখতে রাখতে সুব্রত বললে, কি হে, ব্যাপার কি? স্পিকটি নট যে! নতুন খবর আছে নাকি কিছু সংবাদপত্রের মধ্যে? ওদিকে চা যে ঠাণ্ডা হতে চলল!

তথাপি কিরীটীর দিক থেকে কোন জবাব এল না। চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়াল। তারপর এক সময় খবরের কাগজটা পাশে রেখে চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিতে দিতে বললে, আবার ড্রাগন! এবারে কালো নয়, রক্তমুখী!

ড্রাগন! কোথায় ড্রাগন?

কিরীটী আবার বললে, ড্রাগন!

ড্রাগন-ড্রাগনই তো বলছিস তখন থেকে, কিন্তু কোথায় ড্রাগন?

ড্রাগন! রক্তমুখী ড্রাগন! বিশ্বাস হচ্ছে না? এই কাগজটা পড়ে দেখ—

কিরীটী খবরের কাগজটার একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বললে, পড়।

সুব্রত কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাটার উপর ঝুঁকে পড়ল।

কলম্বোয় রক্তমুখী ড্রাগনের দ্বিতীয় শিকার!!
মুক্তা ও রবার ব্যবসায়ী লক্ষপতি ধনী
মিঃ চিদাম্বরম অদৃশ্য!

গত শনিবার কলম্বোর প্রসিদ্ধ মুক্তা ও রবার ব্যবসায়ী ক্রোড়পতি চিদাম্বরম তার শয়নকক্ষ হতে অদৃশ্য হয়েছেন। তার শয়নঘরে শয্যার উপর একখানি অতি সাধারণ সাদা রংয়ের খাম পাওয়া গেছে। তাতে এক ড্রাগনের প্রতিমূর্তি আঁকা। মূর্তির দেহটা কালো রংয়ের ও মুখটা ঘোর রক্তবর্ণের। মাসখানেক পূর্বে (পাঠক বর্গের মনে থাকতে পারে) বম্বের একজন ধনী মৎস্যব্যবসায়ী তার শয়নকক্ষ হতে একই ভাবে অদৃশ্য হন। তারও শূন্য শয্যার উপর অবিকল ঐরূপ একটি রক্তমুখী ড্রাগনের মূর্তি-আঁকা খাম পাওয়া গিয়েছিল। সমগ্র কলম্বোবাসী, বিশেষতঃ ধনী ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে যিয়মাণ হয়ে পড়েছে। সবাই ভাবছে, না জানি এবার কার পালা! পুলিশ তদন্ত করেও আজ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারেনি। আমরা জনসাধারণের দিক হতে পুলিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের এই বিষয়ে ভালভাবে তদন্ত করে দেখবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আশা করি তারা এদিকে একটু নজর দেবেন।

এক নিঃশ্বাসে সুব্রত আগাগোড়া সবটা লেখা পড়ে ফেললে।

কিরীটী বললে, কি মনে হয়?

বেশ একটা যেন মিস্ত্রির গন্ধ পাচ্ছি–

ঠিক। যাবি?

কোথায়?

সিলোনে।

সে কি!

চল্ না-সিলোনও বেড়ানো হবে-রহস্যটা পরিষ্কার করা যায় কিনা তাও চেষ্টা করে দেখা যাবে।

আপত্তি নেই, কিন্তু–

জানি সেখানে গিয়ে সেখানকার পুলিসের বড়কর্তার কাছ থেকে অবিশ্যি একটা পারমিশন নিতে হবে—এখানকার আই. জি.-র একটা রেকমেন্ডেশন থাকলে সেটা হয়ত কষ্টসাধ্য হবে না।

যদি সত্যি যাস তো বল—

বললাম তো যাব।

ঠিক আছে, আজই আই. জি.-র সঙ্গে দেখা করব।

কিরীটী বাক্স থেকে একটা চুরোট নিয়ে ধরিয়ে নিল এবং নিভন্ত দেশলাইয়ের কাঠিটা অ্যাশট্রের উপর ফেলে দিয়ে, চুরোটটা টানতে টানতে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।

দিনপাঁচেক বাদে এক সন্ধ্যারাত্রে ওরা ট্রেনে উঠে বসল। কিরীটী, সুব্রত ও রাজু। রাজুও সঙ্গে চলেছে।

কলম্বোয় হোটেলে উঠবি তো? সুব্রত শুধায়।

না–

তবে?

আছে–লোক আছে।

কে লোক?

জীবন সেনগুপ্ত-ওখানকার একজন বড় অফিসার। তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি গতকালই। বম্বে থেকে যে জাহাজ যায় তাতে চাপলে তিন দিনের দিন সকালে কলম্বে পৌঁছানো যায়।

কলম্বো।

সাগরের কোল ছুঁয়ে একেবারে দাঁড়িয়ে শহরটি। এখানে সমুদ্র ভারী অশান্ত বলে ৪২০০ ফুট লম্বা এক বাঁধ তৈরী করে সমুদ্রের গতি রোধ করা হয়েছিল। ১৮৭৫ খ্রীঃ প্রিন্স অব। ওয়েলস এই বাঁধের প্রথম প্রস্তরটি স্থাপন করেন। ১৮৮৪ খ্রীঃ সেই বাঁধের গাঁথুনি সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণ কোণ দিয়ে সমুদ্র থেকে বিপদ আসবার তখনও যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেল এবং সেই কারণেই আবার একটি নতুন বাঁধ তৈরী করা হয়। শেষোক্ত বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ৮০০ ফুট ও প্রস্থে ৭০০ ফুট।

কলম্বোয় পৌঁছে ওরা জাহাজ থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিল, ভিক্টোরিয়া পার্কের অল্প দূরে কিরীটীর বন্ধু জীবন সেন থাকেন। সরকারী দপ্তরে তিনি বেশ মোটা মাহিনার চাকরি করেন। কিরীটীরা সকলে সেইখানেই গিয়ে উঠল।

রাজু ও সুব্রতর ইচ্ছা হোটেলেই ওঠে, কিন্তু জীবনবাবু প্রবল ভাবে আপত্তি জানালেন–না, না, সে কেমন করে সম্ভব?

অগত্যা রাজু ও সুব্রতকেও জীবনবাবুর ওখানেই উঠতে হল। জীবনবাবুর সাহায্যেই পুলিস কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে কিরীটী তার একটা পারমিশন নিয়ে নিল ঐদিনই সন্ধ্যায়।

পরের দিন ভোরবেলায়ই সুব্রতকে নিয়ে কিরীটী বেরুলো মিঃ চিদাম্বরমের বাড়ির খোঁজে। মিঃ চিদাম্বরম কলম্বোর একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তার বাড়িটি খুঁজে বের করতে তাদের কিছুমাত্র অসুবিধা হল না।

মিঃ চিদাম্বরমের প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ রামানুজ তাদের পরিচয় পেয়েই মহাসমাদরে অভ্যর্থনা করলেন। কিরীটী তাদের আসবার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বিস্তৃত ভাবে সব কিছু জানতে চাইল।

মিঃ রামানুজম বললেন, তাহলে আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হয়, আমি একবার পুলিস ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়াকে ফোন করে এখানে আনিয়ে নিচ্ছি। ঘটনা সম্পর্কে যা কিছু তদন্ত হয়েছিল, তিনি তা করেছিলেন। আমার মনে হয়, তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অনুসন্ধান করলে সম্ভবতঃ আপনার কাজের সুবিধাই হবে।

কিরীটী বললে, তাহলে তো খুব ভালই হয়।

মিঃ রামানুজ তখনই ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়াকে ফোন করে জানালেন, কলকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দা মিঃ কিরীটী রায় এখানে এসেছেন; তিনি মিঃ চিদাম্বরমের কেসটা সম্পর্কে interested। আপনার সাহায্য তার বিশেষ আবশ্যক। আপনি দয়া করে যদি একবার আসেন, তাহলে বিশেষ খুশী হব।

মিঃ রামিয়া সঙ্গে সঙ্গে রাজী হলেন এবং বললেন, এখুনি আসবেন তিনি।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়ার মোটরবাইক চিদাম্বরমের বাড়ির সামনে। এসে দাঁড়াল। হর্নের আওয়াজ হতেই রামানুজ এগিয়ে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এল। পরস্পর আলাপ-পরিচয় ও আদর-অভ্যর্থনার পর মিঃ রামিয়া বললেন, মিঃ রায়, আমাকে গতরাত্রে কমিশনার আপনার কথা বলেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো এই কেসটার কোন কুল কিনারাই করতে পারিনি। কাজেই এতে আপনার যদি কোন সাহায্য। পাই, তবে সেটা একটা সৌভাগ্য বলে মনে করব।

কতদূর সফল হব জানি না—তবে চেষ্টা করব। কিরীটী বললে।

আপনার কথায় খুবই খুশী হলুম মিঃ রায়। আমি আপনাকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করতে প্রস্তুত। তাহলে চলুন আমাদের অফিসেই যাওয়া যাক। কারণ চিদাম্বরমের এই কেসটার যাকিছু তদন্ত করা হয়েছে, তার সবই সেখানে গেলেই আপনাকে দেখাতে পারি।

বাড়িতে কে কে তখন জবানবন্দি দিয়েছিল, কি ভাবে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন, আর ঐ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত পুলিস যা-কিছু জানতে পেরেছে, সব কিছুই পুলিস-অফিসে ফাইলে দেখতে পাবেন।

ফাইলের কাগজপত্র দেখে-শুনে আপনি যদি আর কোন ভাবে তদন্ত করতে চান, তখন তাই করা যাবে।

কিরীটী বললে, চলুন, তাহলে এখনই একবার আপনার সঙ্গে গিয়ে কাগজপত্রগুলো দেখে আসি।

সকলেই উঠে দাঁড়াল। মিঃ রামানুজ বাড়ির মোটরগাড়িখানা তাদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিলেন।

মিঃ রামিয়ার মোটরবাইক ও মিঃ চিদাম্বরমের গাড়িখানা তাদের নিয়ে হর্ন দিতে দিতে পুলিস অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে গেল।
পুলিস-ফাইল অনুসন্ধান করে দেখা গেল—মিঃ চিদাম্বরমের মাথার ওপর একটা বিপদ যে কয়েকদিন আগে হতেই খাঁড়ার মত ঝুলছিল তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে তার কাছে একখানা চিঠি আসে। চিঠিখানার ওপরেই একটা বৈশিষ্ট্য ছিল—তার খামখানা খুব বড় আকারের, আর ঠিকানাটা খুব বড় বড় লাল কালিতে লেখা।

মিঃ চিদাম্বরমের স্বভাব ছিল—সব চিঠি তিনি নিজেই খুলতেন। খুলে প্রয়োজন বোধ করলে তিনি তার প্রাইভেট সেক্রেটারীর হাতে দিতেন, নতুবা নিজেই সেগুলির জবাব দিয়ে ছিড়ে ফেলে দিতেন।

অন্যদিনের অভ্যাসমত সেদিনের চিঠি তিনি নিজের হাতে খোলেন—সকলের আগেই খুললেন সেই লাল চিঠিখানা। কিন্তু চিঠিখানা পড়ামাত্র তার মুখের ওপর কে যেন একরাশ ছাই ঢেলে দিল-মুখ তার শুকিয়ে গেল।

সেই থেকে সর্বদাই তিনি অন্যমনস্ক থাকতেন, আর একটা দুশ্চিন্তা ও নিরুৎসাহ ভাব যেন তাকে অভিভূত করে রেখে দিত।

এই ভাবে গেল আরও সাত-আট দিন। তারপর এল আরেকখানা চিঠি। এবারকার চিঠিখানার ঠিকানাটা লাল কালিতে লেখা না হলেও কি যেন একটা বৈশিষ্ট্য তার ভিতর থেকে ফুটে বেরুচ্ছিল।

মিঃ চিদাম্বরম্ চিঠিখানা খুলে পড়লেন। পড়তে পড়তে স্পষ্ট বোঝা গেল, তিনি কাপছেন। প্রাইভেট সেক্রেটারী রামানুজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, চিঠিতে কোন দুঃসংবাদ আছে কি?

তিনি সংক্ষেপে জবাব দিলেন, হুঁ।

যাহোক, পড়ে চিঠিখানা তিনি একটি পাথর চাপা দিয়ে টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন, আর তখনই শাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

সেদিন দুবার তিনি কেবল কফি চেয়ে খেয়েছিলেন। রাত আটটার সময় বাবুর্চি শেষবার যখন তাকে কফি দিয়ে যায়, সে গিয়ে মিঃ রামানুজকে বলেছিল, কর্তার ঘরে বেশ মিষ্টি অথচ একটা উগ্র গন্ধ পাওয়া গেল। গন্ধটা কিসের জানি না। কিন্তু কর্তা তো মনে হল জেগেই রয়েছেন। আমার যেন কি রকম মনে হচ্ছে।

সেক্রেটারী মিঃ রামানুজম কেমন যেন একটু সন্দিহান হয়ে ঘরে ঢুকতেই মিঃ চিদাম্বরম তাকে গম্ভীর ভাবে আদেশ করলেন, আমি একটু একা থাকতে চাই, মিঃ রামানুজম। আমাকে একা থাকতে দিন।

তাঁর কথায় তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে তৎক্ষণাৎ সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। রামানুজমের জবানবন্দি থেকে জানা যায়-ঘরের সেই গন্ধটা রামানুজমকেও আকৃষ্ট করেছিল। এবং সেটা কোন দুর্গন্ধ বা আপত্তিকর গন্ধ ছিল না। কাজেই রামানুজম্ পরক্ষণেই তা ভুলে গিয়েছিলেন, মনে রাখবার বা অনুসন্ধান করবার মত প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি।

চিদাম্বরমের পাশের ঘরেই থাকতেন রামানুজম।

অনুমান রাত একটার সময় চিদাম্বরমের শোবার ঘরের ভিতর একবার যেন মৃদু খসখসানি শব্দ শোনা যায়। শব্দ শুনে মিঃ রামানুজম বিছানায় একবার উঠে বসেছিলেন। তারপর কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি ফের শুয়ে পড়েন ও ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক যেতে-না-যেতেই আবার একটা শব্দ শুনে তিনি জেগে ওঠেন। তখন তার মনে হয়েছিল কারা যেন মিঃ চিদাম্বরমের ঘরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন আর কাদের কথাবার্তার চাপা আওয়াজ যেন শোনা যাচ্ছিল।

মিঃ রামানুজ তখনই ঘর থেকে বের হয়ে ব্যাপারটা কি দেখবেন বলে দরজা টানতেই বুঝলেন তার নিজের ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। মিঃ রামানুজ তখন ঘরের ভিতর থেকেই আঁকডাক করতে থাকেন। কিন্তু অত রাত্তিরে সকলেই ঘুমিয়ে ছিল; কাজেই বাড়ির লোকজন ছুটে এসে তাকে বের করতে সময় গেল অনেকটা।

মিঃ রামানুজ মুক্তি পেয়ে তার মনিবের ঘরে এসে দেখেন—ঘর খালি। মিঃ চিদাম্বরম্ কোথাও নেই।

দেখা গেল—ঘরের জিনিসপত্র সবই ঠিক আছে, কিছুই তছনছ হয়নি। সেই উগ্রগন্ধী চিঠিখানার খামটি তখনও টেবিলের ওপরে পড়ে আছে, কিন্তু ভিতরে চিঠিখানি নেই, তার বদলে খামের ভিতরে রয়েছে একটুকরো সাদা কাগজ-তাতে রক্তমুখী ড্রাগনের একটা ছবি আঁকা।

পরের দিন সংবাদ পেয়ে মিঃ রামিয়া তার দলবল নিয়ে অকুস্থানে এসে অনুসন্ধান করে দেখতে পেলেন যে, মিঃ চিদাম্বরমের ঘরখানির উপরদিকের একটা স্কাইলাইট থেকে একগাছা সুতো ঝুলছে আর তার ঘরের দক্ষিণ দিকের দরজার সামনে কতকগুলো পায়ের দাগ রয়েছে। তার মধ্যে একজোড়া পায়ের ছাপ খুবই ছোট ছোট-মানুষের পায়ের ছাপ বলে মনে হয় না। আর পাওয়া গিয়েছিল মিঃ চিদাম্বরমের ডাইরীটা তার লেখার টেবিলের ড্রয়ারে।

পুলিস এরপর এখানে সেখানে নানা জায়গায় খানাতল্লাশ করেছিল এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল; কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়েছে।

সিংহলের পুলিস এর বেশী আর কিছু করতে পারেনি।

পুলিস তো পারেনি, কিন্তু কিরীটী রায় যে পারবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? ব্যাপারটা এত ঘোরালো, আর এমন সুনিপুণ ভাবে কাজটা হাসিল করা হয়েছে যে, তদন্তের সূত্র কোথায়ও যেন কিছুমাত্র নেই।

কি ভাবছেন মিঃ রায়?

দুটো দিন আমাকে ভাবতে দিন মিঃ রামিয়া।

কিরীটী রামিয়ার কাছ থেকে অতঃপর বিদায় নিল।

কিরীটী সুব্রতকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবার পথে গাড়ির মধ্যে বসে তন্ময় হয়ে কেবল তাই ভাবছিল।

হঠাৎ চলতে চলতে গাড়িটা একবার যেন একটু কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার বিদ্যুৎবেগে ব্রেক কষে গাড়িখানা দাঁড় করিয়ে ফেলল, আর চিৎকার করে কাউকে গাল দিয়ে উঠল, এই শুয়ার।

কিরীটীর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ মুখ বাড়িয়ে বলল, কি ব্যাপার ড্রাইভার?

ড্রাইভার তেমনি ঋজালো কণ্ঠে বলল, একটা ছোকরা কোত্থেকে যেন গাড়ির সুমুখে লাফিয়ে পড়েছিল। লোকটা মরতে মরতে বেঁচে গেছে!

কিরীটী তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।

কিন্তু কি আশ্চর্য! যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ছোকরাটা চট করে মাটি থেকে উঠে পড়েই কিরীটীর কাছে এগিয়ে এল। তারপর কিরীটী কোন কিছু বোঝবার আগেই সে হাত বাড়িয়ে তাকে একখানি চিঠি দিয়ে বলল, আপনার একখানি চিঠি স্যার, এই নিন।

চিঠিখানি সে কিরীটীর হাতে একরকম গুঁজে দিয়েই, পরমুহূর্তে রাস্তার অপর পাশে ছুটে গেল যেন।

কিরীটী দেখতে পেল, ছোট একখানা মোটরগাড়ি রাস্তার উল্টোদিকে অপেক্ষা করছিল। ছোকরাটি তাড়াতাড়ি গাড়ির ভিতর উঠে বসতেই গাড়িটা যেন বায়ুবেগে দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কিরীটী আবার নিজের গাড়িতে উঠে বসল, ঐ ঘোট গাড়িখানাকে তাড়া করে অনুসন্ধান করা সম্পূর্ণ বৃথা—এই সহজ সত্যটা স্পষ্ট অনুভব করে ড্রাইভারকে আবার গাড়ি চালাতে বলল।

ড্রাইভার জীবনবাবুর বাড়ির দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল। সুব্রত বললে, চিঠিখানা পড়লে না কিরীটী? কিরীটী জবাব দিল, ও আমি দেখে নিয়েছি তক্ষুনি। চিঠিখানায় আমাকে একটু শাসানো হয়েছে। দেখতে চাও? দেখ।

কিরীটী চিঠির ভাঁজখানা খুলে ফেলল। সুব্রত দেখল, চিঠিতে লেখা রয়েছে–

মিঃ রায়,

তুমি সুচতুর গোয়েন্দা জানি। তবু তোমাকে অনুরোধ করছি—এসব ব্যাপারে তুমি নিজেকে জড়িত করো না। আরো একটা কথা, তোমার বোধ হয় জানা ভাল-তুমি যার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে যাচ্ছ, সে আর কেউ নয়—সে রক্তমুখী ড্রাগন। এর পরেও যদি তুমি চিদাম্বরমের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে যাও, তবে জেনে রেখো রক্তমুখী ড্রাগন তোমাকেও ক্ষমা করবে না।

সুব্রত খানিকটা চিন্তিতভাবে বলল, তাহলে কি করবি?

গাড়ি তখন দোরগোড়ায় এসে পড়েছিল। কিরীটী নামতে নামতে বলল, ভয় পেলি নাকি সুব্রত? তুই তাহলে বাড়ি ফিরে যা!

সুব্রত লজ্জিত হয়ে চুপ করে রইল।

দিনচারেক পরের কথা। রাত তখন প্রায় নটা কি সাড়ে-নটা। জীবনবাবুর বসবার ঘরে কিরীটী

সুব্রত ও রাজু গল্প করছিল, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল—ক্রিং ক্রিং..

জীবনবাবু উঠে গিয়ে রিসিভারটা কানের কাছে তুলে ধরলেন, হ্যালো!…কে, কিরীটী রায়? ..ডেকে দেবো?…ধরুন।….

রিসিভারটা কাত করে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে জীবনবাবু বললেন, ওহে কিরীটী, পুলিস-ইনসপেক্টর মিঃ রামিয়া তোমায় ফোনে ডাকছেন। কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোন ধরল।

মিনিট পনেরো ধরে ফোনে কি-সব কথাবার্তা বলে কিরীটী ফোন রেখে রাজুর সামনে এসে দাঁড়াল।

আমি একবার বাইরে বেরুব জীবন।

ব্যাপার কি বল তো? এত রাত্রে আবার কোথায় যাবে?

কিরীটী বলল, মিঃ রামিয়ার ওখানে।

তারপর রাজুর দিকে ফিরে বলল, সুব্রত থাক, তুই চল আমার সঙ্গে।… কথাটা বলে ওপরে নিজের ঘরে কাপড় বদলাতে চলে গেল কিরীটী।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে চলতে চলতে একসময় কিরীটী বললে, মিঃ সুন্দর দাস এখানকার একজন মস্তবড় মার্চেন্ট। তাকে তার অফিস-ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং তার ঘরের সেক্রেটেরিয়েট টেবিলের ওপরে রক্তমুখী ড্রাগন আঁকা একটা খাম পাওয়া গেছে। মিঃ রামিয়া সেখান থেকেই আমাকে একটু আগে ফোন করেছিলেন।

আমরাও কি সুন্দর দাসের ওখানেই যাচ্ছি?

হ্যাঁ।

বড় রাস্তার উপরেই মিঃ সুন্দর দাসের প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ি-মার্বেল রক।

রাতের অন্ধকার তখন চারিদিকে বেশ ঘন হয়ে এসেছে, রাস্তার দুপাশের ইলেকট্রিক বাতি থাকায় চারিদিক বেশ আলোকিত।

মার্বেল রকের সামনেই দুজন পুলিস মোতায়েন ছিল। কিরীটী ও রাজুকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদেরই একজন জিজ্ঞেস করে, আপনি কি মিঃ কে. রায়?

কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, হ্যাঁ।

আসুন আমার সঙ্গে, ইনসপেক্টর সাহেব ওপরে আছেন। কিরীটী ও রাজু লোকটার পিছু পিছু এগিয়ে যায়। সুন্দর দাসের বাড়িতে অফিস-ঘরটা দোতলায় দক্ষিণ কোণে।

একটা লম্বা টানা বারান্দায় পর পর খান-পাঁচেক ঘর, সর্বশেষের ঘরখানাই সুন্দর দাসের অফিস-ঘর।

অফিস-ঘরের পিছনদিকে, নীচে ছোট একটা গলিপথ, সেই গলির অপর পাশে একটা দোতলা বাড়ি। কিরীটীর নজরে পড়ল।

বাড়িটার দরজায় তালাবন্ধ। জানালা-দরজা সব ভিতর হতে বন্ধ।

দুটো বাড়ির ব্যবধান মাত্র হাত-তিনেক।

পুলিসের পিছু পিছু কিরীটী ও রাজু ঘরে এসে প্রবেশ করল।

মিঃ রামিয়া ঘরের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরকার কাগজপত্রগুলো নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন।

গুড ইভনিং মিঃ রামিয়া—

কিরীটীর কণ্ঠস্বরে মিঃ রামিয়া মুখ তুলে তাকালেন।

গুড ইভনিং, আসুন, এই ঘরের মিঃ সুন্দর দাসের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ঐ সুন্দর দাসের মৃতদেহ!

কিরীটী প্রথমেই একবার নিঃশব্দে চোখ বুলিয়ে ঘরটা দেখে নিল।

অতি আধুনিক কায়দায় ঘরখানি সাজানো-গোছানো। মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো। দেওয়ালে দামী দামী সব ল্যাণ্ডস্কেপ বিদেশী চিত্রকরদের। সিলিং থেকে ঝোলানো সাদা ডিম্বাকৃতি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোয় সমস্ত ঘরখানি ঝলমল করছে।

সেক্রেটারিয়েট টেবিলের একপাশে গদি-মোড়া একখানি রিভলভিং চেয়ার; তারই একপাশে সুন্দর দাঁসের মৃতদেহ মেঝেয় কার্পেটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কিরীটী নীচু হয়ে মৃতদেহটা পরীক্ষা করে দেখল। মৃতদেহে ক্ষতের চিহ্নমাত্র নেই। কোনরূপ গুলির দাগ বা ছোরাছুরি দিয়ে কাটা কোন ক্ষত পর্যন্ত নেই।

মিঃ রামিয়া বললেন, কোন ইনজুরি বা কিছুই মৃতদেহে নেই।

কিরীটী কোন জবাব দিল না।

মৃতদেহের পজিশানটা আর একবার ভাল করে দেখে কিরীটী আবার ঘরের চারিদিকে তাকায়। বেশ প্রশস্ত ঘরটা। ঘরের মধ্যে যাতায়াত করবার মাত্র একটিই দরজা। বারান্দার দিকে দুটো জানালা, তাতে কাঁচের শার্সি আটা।

রাস্তার দিকে গোটা-তিনেক জানালা, তারও দুটো বন্ধ, একটা ভোলা। জানালাগুলোর কোনটাতেই গরাদ নেই। দামী নেটের পর্দা টাঙানো।

গলির দিকে কোন জানালা নেই। শুধু ওপরে দেওয়ালে দুটো স্কাইলাইট। একটায় কাঁচ আটকানো, অন্যটায় কোন কাচই নেই।

কিরীটী এগিয়ে এসে টেবিলটার সামনে দাঁড়াল।

সেই খামটা কই? মিঃ রামিয়া, ফোনে যে খামের কথা বলেছিলেন? ইন্সপেক্টর খামখানা এগিয়ে দিলেন। পার্চমেন্ট-পেপারে তৈরী একখানি চৌকো খাম। সাদা রংয়ের অতি সাধারণ দেখতে। খামটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে কিরীটী বলল, কোন কিছুই তো আঁকা দেখছি নে।

ইনসপেক্টর অল্প একটু হেসে খামের ভাঁজে ভাঁজে খুলে ফেললেন।

খামের ভিতরে একটা অতি বীভৎস ড্রাগনের প্রতিচ্ছবি আঁকা। ড্রাগনের রং কালো, মুখখানা রক্তবর্ণের।

ঘরে ঢোকার পর থেকেই একটা সূক্ষ্ম অস্পষ্ট গন্ধ যেন কিরীটীর নাকে এসে লাগছিল। গন্ধটা যে ঠিক কি ধরণের বলা শক্ত। খুব কটু নয়, অথচ সমস্ত গা-টা ঘিনঘিন করে।

খামটার ভাঁজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধটা যেন আরো স্পষ্ট ও তীব্র হয়ে নাকে এসে লাগল কিরীটীর।

কিরীটী খামটা নাকের কাছে তুলে ধরে শুকলো। রাজু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে জিজ্ঞাসা করল, কি?

শুঁকে দেখ। কিরীটী বলল।

রাজু খামটা শুঁকতে শুঁকতে বললে, কিসের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছি।

খামটা নিতে পারি ইনসপেক্টর? কিরীটী বললে।

স্বচ্ছন্দে। ও খাম কিন্তু মৃত্যুর দূত। রামিয়া হাসতে লাগলেন।

কিরীটী মৃদু হেসে খামখানা পকেটের মধ্যে রেখে দিল। তারপর সমস্ত ঘরটা ঘুরে ঘুরে আবার দেখতে লাগল।

হঠাৎ ওপাশের দেয়ালে একটা সুতোর মত কি কিরীটীর চোখে পড়ল। এগিয়ে এসে হাত দিয়েই কিরীটী বুঝল, অতি সূক্ষ্ম কিন্তু বেশ শক্ত একটা রেশমী সুতো। সূতোটা টান দিয়ে দেখল, সেটা স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে গলে এসেছে এবং সুতোটা টেনে বুঝতে পারল, সেটার অপর প্রান্ত কোথাও আটকানো। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মনে হল সেই চিদাম্বরমের কেসটা।

চলুন ইনসপেক্টর।

কিরীটী ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গেল।

বারান্দার শেষপ্রান্তে এসে নীচের গলিপথ বেশ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।

সুন্দর দাসের প্রাইভেট সেক্রেটারী একজন বাঙালী অল্পবয়সী ছোকরা। নাম-মহিম রায়।

কিরীটী মহিম রায়কে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা মহিমবাবু, গলির ওপারের বাড়িটা কার?

ওটা একজন পাঞ্জাবী ডাক্তারের, মাসখানেক হল উনি সপরিবারে দেশে ভাটিণ্ডায় গেছেন। বাড়িটা বর্তমানে তালা-বন্ধই আছে।

বাড়িতে কেউ থাকে না তাহলে?

বাইরে শুধু দারোয়ান থাকে।

গলির মধ্যে যেতে হলে বড় রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হবে, না?

হ্যাঁ। মহিম বললেন।

চলুন না, একবার গলিটা ঘুরে আসি।

চলুন।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিরীটী জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা মহিমবাবু, সন্ধ্যার পর ঠিক কটা হবে যখন আপনি মিঃ দাসের ঘরে যান?

সাড়ে সাতটা কি পৌনে-আটটা হবে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে ভেজানো ছিল, অল্প একটু ঠেলতেই খুলে গেল। অন্ধকার ঘর। একটু অবাক হলাম। কেননা আমি জানতাম মিঃ দাস ঘরেই আছেন। আমায় তিনি পৌনে আটটার সময় ঘরে গিয়ে ব্যবসা-সংক্রান্ত কয়েকটা আবশ্যকীয় কাগজপত্র চেয়ে নিয়ে আসতে বলেছিলেন; আজ রাত্রে একটা পার্টির সঙ্গে জরুরী কনসালটেশন ছিল, কাগজপত্রগুলো সেই সংক্রান্তই। ঘর অন্ধকার দেখে ভেবেছিলাম প্রথমে, মিঃ দাস হয়ত ঘরে নেই—কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল মিঃ দাস তো কখনও দরজায় চাবি না দিয়ে অফিস-ঘর ছেড়ে যেতেন না। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো। জ্বাললাম। দেখি ঘরের মধ্যে মিঃ দাস উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।

শেষ আপনার কখন মিঃ দাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

বিকেলে তিনটে সাড়ে-তিনটের সময়।

তখন তিনি কোথায় ছিলেন?

তার অফিস-রুমে।

তারপর?

আমি প্রথমটা যেন থমকে গেলাম। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ঠেলা দিয়ে ডাকলাম, স্যার! স্যার! … কিন্তু কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। চিৎকার করে চাকরবাকরদের ডাকলাম। পুলিসেও খবর দেওয়া হল।

আপনি তো সারাটা দুপুর আপনার ঘরেই ছিলেন?

যা, অফিস-রুমের পাশেই আমার বসবার ঘর।

আচ্ছা কোনরকম শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন? কিংবা তিনটে থেকে সাতটার মধ্যে কেউ মিঃ দাসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, বলতে পারেন?

আমি ঠিক পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটার সময় মিনিট পনেরোর জন্য নীচে টিফিন খেতে গিয়েছিলাম, সেই সময় যদি কেউ এসে থাকে তো বলতে পারি না। মিঃ দাসের বেয়ারা সুখলাল বলতে পারে।

কিরীটী লক্ষ্য করে দেখল, গলিতে গ্যাসলাইট থাকলেও বেশ অন্ধকার, আর মিঃ দাসের অফিস-ঘরের পিছনের এ-পাশের বাড়ির একটা ভোলা ছাদ আছে। ছাদের প্রাচীরের ওপর একসার ফুলের ও পাতাবাহারের টব। অন্ধকারে গাছের পাতাগুলো অল্প অল্প হাওয়ায় থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।

রাজুকে ছাদের দিকে নজর রাখতে বলে কিরীটী মহিমবাবুকে নিয়ে ঘুরে ও-বাড়ির গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

রাজু অন্ধকার ছাদটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সহসা কার চাপা কণ্ঠস্বরে চমকে পাশে তাকাল।

বাবু?

বছর বারো-তেরোর একটি ছোকরা। দেখলে ভিখিরী বলেই বোধ হয়।

বাবু?

কি রে?

বাবু, এই চিঠিটা আপনাকে দেবার জন্য একজন বাবু দিয়ে গেলেন।

আমাকে? রাজু বিস্মিত হয়ে শুধাল।

হ্যাঁ, বাবু।

রাজু একটু যেন অবাক হয়েই ছেলেটার হাত থেকে চিঠিটা নিল। ছেলেটা চিঠিটা দিয়েই দ্রুতপদে ওদিককার আঁধার গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দূরের গ্যাসপোস্ট থেকে একটুখানি আলো অস্পষ্ট ভাবে এদিকে এসে পড়েছে। সেই স্বল্পালোকে রাজু খামখানা চোখের সামনে তুলে ধরল।

ঠিক সেই সময় পিছন থেকে একটা অস্পষ্ট চাপা হাসির শব্দে রাজু চমকে পিছন ফিরে তাকাল।

ভয় পেলি? আমি কিরীটী।

না।

খামটা দে। ওটা তোমার জন্য নয়। আমার উদ্দেশে ওটা প্রেরিত হয়েছে।

মানে তোমার কথা তো আমি বুঝতে পারছি না কিরীটী!

ঐ খামখানা রক্তমুখী ড্রাগন-এর কাছ থেকে এসেছে। প্রেরক আমার কাছেই খামখানা পাঠিয়েছে এবং এর থেকে একটা দিক আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। শুঁকে দেখ।

কিরীটী খামখানা রাজুর হাত হতে নিয়ে তার নাকের কাছে তুলে ধরল।

ঠিক সেইরকম তীক্ষ্ণ অথচ অস্পষ্ট বিষাক্ত গন্ধ। গা ঘিনঘিন করে। কিরীটী পরক্ষণেই পকেট থেকে সুন্দর দাসের ঘরে পাওয়া ড্রাগন-চিহ্নিত খামখানি বের করে বলল, দুটোর গন্ধ মিলিয়ে দেখ, একই রকম কিনা!

দুটো খামের গন্ধ মিলিয়ে রাজু বলল, তাই তো?

চল, আর একবার মিঃ দাসের মৃতদেহটা ভাল করে দেখতে হবে।

চল—

ওরা আবার সুন্দর দাসের গৃহে এসে প্রবেশ করল।

স্থানীয় পুলিস-সার্জেন সবে তখন মৃতদেহ পরীক্ষা শেষ করে ইনসপেক্টর রামিয়ার সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। কিরীটীকে ঘরে ঢুকতে দেখে রামিয়া কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ রায়, ডাক্তার বলছেন, মিঃ দাস নাকি হার্টফেল করে মারা গেছেন।

কিরীটী ঝুঁকে পড়ে তীব্র আলোয় আর একবার সমস্ত দেহটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল।

ঐ সময়ই তার নজরে পড়ল মৃতদেহের গলার কাছে কয়েকটা ছোট ছোট রক্তের বিন্দুর মত দাগ। দেখতে অনেকটা উঁচ কিংবা ঐজাতীয় কোন কিছু দিয়ে বিধানোর মত ক্ষত। এছাড়া আর কোথাও তেমন কিছু চিহ্ন পাওয়া গেল না।

মিঃ রায়, আপনার কি মনে হয়? রামিয়া প্রশ্ন করলেন।

আমার? কিরীটী একটা চুবরাট ধরাতে ধরাতে নিভন্ত কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিভুতে নিভৃতে বলল, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, মিঃ দাস হার্টফেল করে মারা যাননি। তাকে খুন করা হয়েছে।

আপনার এ অনুমান মিথ্যাও তো হতে পারে? রামিয়া বললেন।

হতে পারে; কিন্তু সে সম্ভাবনা খুবই কম মনে হয়।

অতঃপর সুখলালকে প্রশ্ন করা হলে সে বললে-বেলা তখন পৌনে-পাঁচটা আন্দাজ হবে, একজন চীনা লোক নাকি বাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসে কি একটা জরুরী চিঠি নিয়ে। চীনাটাকে বাবুর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সে। সুখলাল বলতে লাগল, লোকটা বাবুর সঙ্গে দেখা করে চলে যাবার পর আমি তখনও সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি, এমন সময় হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি, বাবু দরজা খুলে ছুটে বাইরে আসছেন। সমস্ত চোখমুখ জুড়ে যেন একটা ভীষণ আতঙ্ক! আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বাবুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম, এবং বাবুকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে সোফার উপর বসিয়ে দিলাম। বাবু তখন হাঁপাচ্ছেন। আমাকে হাত নেড়ে ঘর থেকে চলে আসতে বললেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, শুনলাম বাবু অস্পষ্ট স্বরে যেন বলছেন, লাল বাঁকা!

আচ্ছা, আজকের সন্ধ্যার এই ঘটনা ছাড়া আর কোনদিন কিছু ঘটেছিল কি সুখলাল?

না, এমন বিশেষ কিছু ঘটেনি। তবে পরশু রাত্রে তখন প্রায় দশটা কি এগারোটা হবে, বাবু অফিস ঘরে কাজ করছিলেন, সেক্রেটারী বাবুও চলে গেছেন—বাবু সাধারণতঃ একটু বেশী রাত পর্যন্ত জেগেই কাজ করতেন। বাবুর কাজ সারা হলে, শোবার পর আমি শুতে যাই-বাইরের বারান্দায় বসে আছি এমন সময় হঠাৎ দরজা খুলে বাবু বেরিয়ে এলেন, মনে হল তিনি যেন খুব ভয় পেয়েছেন। বাবু বললেন-সুখলাল, আমার ঘরটা একটু ভাল করে খুঁজে দেখতে! মনে হচ্ছে কিছু যেন ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আছে।

কিছু জিনিস, না কোন লোক লুকিয়ে আছে তিনি বলেছিলেন? কিরীটী প্রশ্ন করল।

কিছু জিনিস তিনি বলেছিলেন!

তারপর?

আমি ঘরের মধ্যে ঢুকে সব খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না।

মিঃ রামিয়ার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছিল। রামিয়া কিরীটীর দিকে চেয়ে বললেন, রাত্রি অনেক হয়েছে, মিঃ রায়। আপনাকে একটা লিট দিয়ে যাব কি?

কিরীটী বললে, যদি অসুবিধা না হয়

না, অসুবিধা কি। চলুন।

গাড়ির পিছনের সীটে রামিয়া, কিরীটী ও রাজু বসল। গাড়ি তখন চলতে আরম্ভ করেছে।

কিরীটী চাপা স্বরে রাজুকে বলল, পেছনের কাচ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখ তো, কোন গাড়ি আমার পিছু নিয়েছে কি?

রাজু দেখল, একটা কালো রংয়ের মোটরগাড়ি মাত্র হাত পাঁচেক তফাতে নিঃশব্দে রামিয়ার গাড়ির পিছু-পিছু আসছে।

মিঃ রামিয়া বললেন, বটে, আমার পিছু লাগা! দাঁড়াও, আমি দেখাচ্ছি মজা!..বলেই তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতে উদ্যত হলেন।

বাধা দিয়ে কিরীটী বলল, সে চেষ্টা করবেন না মিঃ রামিয়া। তাতে বিপদ হতে পারে।

বিপদ!

হ্যাঁ। মৃদু হেসে কিরীটী বলল, মিঃ রামিয়া, সাধ করে বিপদ ডেকে এনে কোন লাভ নেই। অতি সহজে যদি কার্যোদ্ধার হয়, তাহলে শখ করে বিপদের মুখোমুখি হওয়ার মানেই হচ্ছে একটা গোঁয়ার্তুমি।

মিঃ রামিয়া বললেন, সহজেই কার্যসিদ্ধি। আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথাটা।

কিরীটী বলল, গাড়িটার গতি একটু কমিয়ে দিন। তারপর ঐ গাড়িখানার মাথার ওপর দিয়ে দুটো গুলি ছুঁড়ুন। দেখুন না, ব্যাপারখানা কি হয়!

কিরীটীর কথার কোন প্রতিবাদ না করে মিঃ রামিয়ার পিস্তল দু-দুবার দম দম্ করে গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পেছনের গাড়িটা থেমে গেল; তারপর ক্যাচ করে একটা আওয়াজের সঙ্গে গাড়িখানা পেছনে হটে গেল এবং দেখতে দেখতে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে তীরবেগে ছুটে পালিয়ে গেল।

কিরীটী বলল, দেখলেন মিঃ রামিয়া। ওটা শত্রুর গাড়ি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর উদ্দেশ্য ছিল কেবল অনুসরণ করা। যখন ধরা পড়ে গেল তখন আর বৃথা বিপদের ঝুঁকি ওই বা নেবে কেন? তাই পালিয়ে গেল।

তারপর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।

হঠাৎ কিরীটী নীরবতা ভেঙে বলল, মিঃ রামিয়া, চিদাম্বরমের ব্যাপারটা আপনার মনে। আছে তো?

আছে বৈকি! কিন্তু সে-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন, মিঃ রায়?

কিরীটী বলল, চিদাম্বরমের সেই ঘটনা আর সুন্দর দাসের ব্যাপারটা। দুটো ঘটনার মধ্যে বৈশিষ্ট্য বা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করেছেন কি?

কি বলুন তো!

কিরীটী বলল, দুটো ব্যাপারেই ঘরের স্কাইলাইট থেকে একটা সুতো ঝুলছে, দেখা গেছে।

মিঃ রামিয়া বললেন, হ্যাঁ, সে-কথা ঠিক। কিন্তু–

কিরীটী বলল, এই সুতোর ব্যাপার থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ঐ দুটির নায়ক একই ব্যক্তি সম্ভবতঃ এবং নায়ক যে-ই হোক না কেন, তার এই অপকার্যে তাহাকে সাহায্য করেছে অতি ক্ষুদ্র কোন জিনিস, সে জিনিসটা নির্জীব কোন জড়পদার্থ হতে পারে, অথবা সজীব কোন ক্ষুদ্র প্রাণী—যেমন কোন পোকা-মাকড়ও হতে পারে।

মিঃ রামিয়া বললেন, ঠিক বুঝলাম না—ক্ষুদ্র প্রাণী বা পোকামাকড়-কি বলতে চাইছেন?

মৃদু হেসে কিরীটী বলল, বেশ, তাহলে আরও একটু খুলে বলছি। ওপর থেকে ঘরের ভিতর সুতো ঝুলিয়ে দেওয়াটা-আমার মনে হচ্ছে কোন সজীব বা নির্জীব জিনিস সেই সুতোয় বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল; তারপর যেই কাজ সিদ্ধ হয়ে গেছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিনিসটা তুলে নিয়ে গেলেও সুতোটা থেকে গিয়েছে। হয়ত সুতোটার কথা সে ভাবেনি বা সেটা নিয়ে যাবার কোন প্রয়োজন বোধ করেননি।

বহুক্ষেত্রেই।

আরও একটু খোলসা করে বলুন মিঃ রায়।

কিরীটী বললে, মনে করুন অপরাধী সুতোর সাহায্যে চিদাম্বরমের বেলায় এমন একটা জিনিস,-সজীব বা নির্জীব,-ঘরের ভিতর নামিয়ে দিয়েছিল যে, যার ফলে চিদাম্বরম অজ্ঞান। হয়ে যান, তারপর সেই অচৈতন্য চিদাম্বরমকে কেউ বা কোন একদল লোক চুরি করে নিয়ে গেছে। আর সুন্দর দাসের বেলায় হয়ত সেই সুতোয়-বাঁধা জিনিসটা ঘরে পৌঁছে সুন্দর দাসের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তারপর একটু থেমে বললে, মিঃ রামিয়া এটাও জানেন-ক্লোরোফর্ম জাতীয় জিনিসে লোক অজ্ঞান হয়ে যায়, আর অতি সূক্ষ্ম সাপের কামড়েও লোক মারা যেতে পারে—

মিঃ রামিয়া চিন্তিতভাবে একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, তা অবিশ্যি পারে।

খানিক পরে তিনি সহসা নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মিঃ রায়, তাহলে এই অপরাধীর সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? কোন্ জাতীয় লোক সে?

কিরীটী বলল, এই মুহূর্তে তার সঠিক জবাব দেওয়া শক্ত। তবু যতটা মনে হচ্ছে, বলছি। সাধারণ চোর-ছ্যাচোড় নয় এমন একজন যার রাসায়নিক চিকিৎসা বা বিষ-বিজ্ঞান (Toxicology) সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান আছে। শুধু তাই নয়, লোকটার হয়ত প্রাণিবিজ্ঞান সম্পর্কেও যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি আছে।

ঐ ধারণা কেন আপনার হল বলুন তো? ইন্সপেক্টর মিঃ রামিয়া জিজ্ঞেস করলেন।

কিরীটী বলল, কেন বলছি, শুনুন। পুলিস-রেকর্ডে আপনিই লিখে রেখেছেন যে, চিদাম্বরমের দরজার বাইরে কিছু পায়ের দাগ দেখতে পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই পায়ের দাগগুলোর মাঝে একজোড়া পায়ের দাগ ছিল খুবই ছোট-মানুষের পায়ের দাগ বলে মনে হয় না। তাই না মিঃ রামিয়া?

হ্যাঁ।

বেশ, তাহলে কি এই স্বভাবতঃ মনে হয় না যে, তাদের দলে কোন মানুষ ছাড়াও সেই প্রাণীও আছে। এবং ঘরের ছাদ থেকে সুতো বেঁধে যে জিনিসটা নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে-জিনিসটাও সম্ভবতঃ কোন সজীব জিনিস—অর্থাৎ প্রাণী। কারণ প্রাণী ছাড়া অপর কোন নির্জীব জিনিসের পক্ষে সুন্দর দাসকে হত্যা করা সম্ভব বলে মনে হয় না। বিশেষতঃ সুন্দর দাসের গলার কাছে ছোট ছোট কয়েকটা রক্তবিন্দুর মত দাগও দেখা গেছে। তা থেকে যদি মনে করা যায় যে, ঐ দাগগুলো কোন প্রাণীর দংশনের দাগ, আর ঐ প্রাণীটাকে। নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুতো বেঁধে!

মিঃ রামিয়া আর কোন জবাব দিলেন না। তিনি চুপ করে রইলেন।

গাড়িটা ততক্ষণে জীবনবাবুর বাড়ির দোরগোড়ায় এসে পড়েছিল।

জীবনবাবু তখনও বৈঠকখানায় ওদের অপেক্ষায় জেগে বসে সুব্রতর সঙ্গে গল্প করছিলেন।

কিরীটী ও রাজু ঘরে ঢুকতেই জীবনবাবু বললেন, ব্যাপার কি হে? এর নাম তোমার একটু ঘুরে আসা?

তুমি এখনও আমাদের অপেক্ষায় বসে আছ, জীবন? বড় অন্যায়। কত রাত হয়ে গেছে।

বেশ! অতিথি অভুক্ত, এখনও ফিরল না, আর আমি খেয়ে শুয়ে পড়ব?

চল, আর দেরি করে লাভ নেই।

সকলে খাওয়ার ঘরের দিকে চলল।
পরের দিন রাত্রে।

জীবনবাবুর বাড়িটা রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে।

বাড়ির পেছনদিকে একটা ছোটখাটো সিনামোনের বাগান।

বাগানের দিককার একটা ঘরে কিরীটী ও তার বন্ধুদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে গোটা-চারেক জানলা—প্রত্যেকটাই গরাদহীন। বাইরের দেয়ালটা আইভিলতায় একেবারে ছেয়ে গেছে। চারিদিককার দেয়ালে চারটে স্কাইলাইট।

স্কাইলাইটগুলো রেকট্যাঙ্গুলার সাইজের এবং বেশ বড়, একজন মানুষ অনায়াসেই গলে যাতায়াত করতে পারে।

প্রত্যেক খাটে দুজন করে,-দুটো খাটে চারজন শোয়। ঘরের এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি বইয়ে একেবারে ঠাসা।

এক কোণে ঘোট একটা টেবিল, দুটো সোফা ও গোটা-কয়েক চেয়ার।

সুন্দর দাসের ঘরে কিরীটী যে বিষাক্তগন্ধী খামখানা পেয়েছিল, পকেট থেকে সেখানা বের করে সে টেবিলের উপর রাখল। তারপর সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, আজ রাত্রে এটা এই টেবিলেই রইল—দেখা যাক কিছু ঘটে কিনা।

সুব্রত বলল, কি ঘটবে, কিরীটী?

ঈষৎ হেসে কিরীটী বলল, বলিনি বুঝি তোমাকে? আজ আবার রক্তমুখী ড্রাগন আমাকে শাসিয়ে গিয়েছে।

তাই নাকি?

কিরীটী বলল, হ্যাঁ, রক্তমুখী ড্রাগন আজই দুপুরবেলায় একটা লোক মারফৎ একখানা কিরীটী চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, সেদিন পিস্তলের গুলিতে যদিও আমরা অনুসরণকারীকে নিরস্ত করেছিলাম, তাহলেও সে আমাদের নাম-ধাম-ঠিকানা সব কিছু জানতে পেরেছে।

সে বলে পাঠিয়েছে যে, প্রায় আমারই চোখের উপর, মানে আমার উপস্থিতির সময়েই সে সুন্দর দাসের দফা শেষ করেছে অথচ আমরা তার কিছুই কূলকিনারা করতে পারিনি, পারবও না। কাজেই সে উপদেশ দিয়েছে, আমরা যেন বাড়ি ফিরে যাই; নইলে অতি শীগগিরই সে আমাদেরও দফা শেষ করবে।

তারপর একটু থেমে বললে, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রক্তমুখী ড্রাগন আজই আমাদের উপরে একটা attempt নেবে হয়ত। কারণ এমনি ধরনের খুনেদের স্বভাবই এই যে, তারা শাসানি যাকে দেয়, তাকে সময় দেয় খুবই কম,-কখনও বা একেবারেই সময় দেয় না;শত্রুকে তৈরী হবার সুযোগ দেবার পক্ষপাতী তারা একেবারেই নয়। আজ শাসানি দিয়েছে, হয়ত আজই তা কাজে পরিণত করবার চেষ্টা করবে। কাজেই আমিও আজ পরীক্ষার জন্য তৈরী হয়ে আছি।

কি রকম? কোন পাহারা রাখলে না, কিছুই করলে না-আলোটা পর্যন্ত নিবিয়ে দিলে। অথচ আশঙ্কা করছ, আজই শত্রুপক্ষ কিছু করে ফেলতে পারে! আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে কই?

সুব্রতর কণ্ঠস্বর একটু ক্ষুব্ধ।

একটু হেসে কিরীটী বলল, আছে আছে। এই নাও না আত্মরক্ষার জিনিস!

এই বলে সে পকেট থেকে একটা শিশি বের করে, সেই শিশির আরক প্রত্যেকের হাতের পাতায় ঢেলে দিল। আরকের তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধে বোঝা গেল, সেটা এমোনিয়া সলুশন।

বেশ করে হাতে ঘষে নাও।

সকলে কিরীটীর কথামত কাজ করল।

আবার সুব্রত বলল, আত্মরক্ষার চমৎকার জিনিস বের করেছ তো কিরীটী!

রক্তমুখী ড্রাগন-এর দেওয়া বিষাক্তগন্ধী খামের ষড়যন্ত্র এড়াতে হলে, মনে হয় এই হচ্ছে একমাত্র ওষুধ।

সুব্রত বলল, একটা কথা কিরীটী, অবিশ্যি রক্তমুখী ড্রাগন নামটার মধ্যেই একটা বিভীষিকা ও সেই সঙ্গে রহস্যের ইঙ্গিত আছে এবং চিদাম্বরম ও সুন্দর দাস দুজনেই রক্তমুখী ড্রাগন- এর শিকার। রক্তমুখী ড্রাগন তোকে যে চিঠি দিয়ে শাসিয়েছে তাতে করে যেন আমার মনে হচ্ছে এর সব কিছুর পিছনে একটা দুর্ধর্ষ দল আছে এবং তাদের একটা বিশেষ উদ্দেশ্যও আছে।

কিরীটী বললে, ঠিকই অনুমান করেছিস। আমার তো অনুমান তাই।

একটা কথা কিরীটী—

কি?

ঐ বিষাক্ত গন্ধের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছুর ইঙ্গিত আছে মনে হয়। তাই।

কিন্তু গন্ধটা–

অনেকদিন আগে, মনে পড়ে এক পর্যটকের বইতে পড়েছিলাম, তিনি বর্মার জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় এক ধরনের অদ্ভুত বুনো ফুল দেখেছিলেন, সেগুলো দেখতে অনেকটা সবুজ রংয়ের। সেই ফুলের গন্ধ ভারী অদ্ভুত; যেমন তীব্র, তেমনি ন্যক্কারজনক। সমস্ত শরীরের মধ্যে কেমন যেন এক ঝিম্ ঝিম্ ভাব আনে। এবং ঐ ফুলের গন্ধের এমন একটা আশ্চর্য শক্তি আছে যে, কোন বস্তুতে যদি একবার গন্ধটা লাগে, তার গায়ে যেন একেবারে জড়িয়ে যায়। গন্ধটার একটা অত আকর্ষণী শক্তিও আছে। এই বিষাক্ত গন্ধেই আকৃষ্ট হয়ে এসে মৃত্যুদূত প্রথমে ছুটে যায় সেই বিষাক্তগন্ধী জিনিসটার দিকে। সম্ভবত বিষাক্ত গন্ধের উত্তেজনায় তার রক্তলালসা জেগে ওঠে, তারপর নিকটবর্তী যে কোন লোকের রক্তপান করবার জন্য সে অতি নিঃশব্দে তার গলদেশে বিষ-দত্ত ফুটিয়ে দেয়-মরণের বিষাক্ত-চুম্বনে সে হতভাগ্য আর কোনদিনই জাগে না।

কথা বলতে বলতে শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হয়।

চুরেটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে কিরীটী আবার বলল, মনে পড়ে সুখলাল বলেছিল, দিতিনেক আগে এক রাত্রে মিঃ দাস হঠাৎ ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন?…আমার মনে হয় ভয় পেয়েছিলেন ঐ বিষাক্ত গন্ধলোভী কুৎসিত-দর্শন মৃত্যুদূতকে ঘরে চোখের সামনে দেখে।

মৃত্যুদূত?

হাস্‌-স্‌-স্‌ …চুপ!..

বলেই কিরীটী তার ঠোটের ওপর তর্জনী-আঙুলটা রেখে সবাইকে নীরব হবার জন্য সঙ্কেত করল। সকলেই তার সঙ্কেত মেনে তৎক্ষণাৎ চুপ করে গেল।

বাইরে একটা মৃদু খসখস্ শব্দ। একটা অজানিত আশঙ্কা, একটা অস্বাভাবিক অশরীরী বিভীষিকা যেন অক্টোপাশের মত তার বাহু প্রসারিত করে অন্ধকারে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে।

নীচের বৈঠকখানার ওয়াল-ক্লকটায় ঢং ঢং করে রাত্রি দুটো ঘোষণা করল।

যে টিবিলটার ওপরে কিরীটী সেই বিষাক্ত-গন্ধী খামখানা রেখেছিল, সেই টেবিলটা তুলে নিয়ে সে নিঃশব্দ পায়ে উঠে বাগানের দিকটার দেয়ালে একটু তফাতে রেখে ফিরে এল।

সব চুপচাপ বসে। অন্ধকারে প্রত্যেকের নিঃশ্বাসের শব্দ নিঃশব্দে যেন চাপ বেঁধে উঠছে।

আকাশে চাঁদ উঠেছে, তারই আলো এসে স্কাইলাইটের ফাঁক ও খোলা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

একটা অস্পষ্ট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাগানের দিককার দেয়ালে লতিয়ে-ওঠা আইভিলতার পাতায় পাতায় বুঝি একটুখানি মৃদু শব্দ শোনা গেল। তারপরই অস্পষ্ট একটা আবছা কালো ছায়া স্কাইলাইটের উপরে জেগে উঠল। একটা ফ্যাকাশে রংয়ের বিশ্রী কুৎসিত চ্যাপটা মুখ ধীরে ধীরে স্কাইলাইটের ফাঁকে দেখা দিল।

কিরীটীর একপাশে রাজু, অন্যপাশে সুব্রত।…কিরীটী দুহাতে দুজনকে ইশারায় চুপচাপ থাকতে বললে।

দেখা গেল সরু সরু প্যাঁকাটির মত আঙুল-বিশিষ্ট একটা ছোট হাত ধীরে ধীরে স্কাইলাইটের শিকটা চেপে ধরল।…ক্রমে আরো একটা হাত তারই পাশে, নজরে পড়ল ওদের।

একসময় ডানহাতটা সরে গেল, এবং অল্পক্ষণ পরেই সেই হাতটা আবার দেখা গেল। এবারে দেখা গেল, সে হাতে একটা ছোট চৌকো বাক্স ধরা আছে।

আস্তে আস্তে হাতের উপর ভর দিয়ে সেই নিশাচর মূর্তি, বাঁদরের মত অদ্ভুত কায়দায় পাক খেয়ে, ফাঁক দিয়ে মাথা ও দেহের অর্ধেকটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিল।

তারপরই মেঝের উপরে কিছু যেন পড়ার শব্দ পাওয়া গেল।

ঘরের মাঝে যেটুকু চাঁদের আলো এসেছে, তা কম হলেও যথেষ্ট। সেই আলোয় দেখা গেল, বাক্সটা থেকে বের হয়ে একটা অদ্ভুত কুৎসিত-দর্শন ইঞ্চি ছয়েক লম্বা ঘোর লাল রঙের পোকা তার বাঁকানো রোমশ বড় বড় তারের মত সরু সরু ঠ্যাং দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, টেবিলটার পায়ার গা বেয়ে সেই বিষাক্ত-গন্ধী থামটার দিকে চলেছে।

কিরীটী ক্ষিপ্রহন্তে গায়ের জামাটা খুলে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা লাফ দেওয়ার অস্পষ্ট শব্দ পাওয়া গেল। তারপর কিরীটী ছুটে রাস্তার ধারের জানলার দিকে গেল। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল—একটা কালো রঙের গাড়ি চলে যাচ্ছে।

সুইচ টিপে আলোটা জ্বালতে জ্বালতে কিরীটী বললে, পাখী পালিয়েছে। চল, মৃত্যুদৃতকে ভাল করে দেখা যাক।

বলতে বলতে কিরীটী টেবিলের ধারে এগিয়ে গেল ওবং টেবিলের জামাটির ওপর একটা লাঠি দিয়ে গোটাকয়েক ঘা দিয়ে জামাটা তুলতেই পরিপূর্ণ আলোকে দেখা গেল, লাল রংয়ের একটা পোকা। পোকাটা একটা বড় পিঁপড়ের মত দেখতে। তার মস্ত মস্ত দুটো শুড়। আর সেই শুড়ের গায়ে ছোট ছোট সব লোম। মাথার অনুপাতে দেহটা বেশ বড় এবং অসংখ্য সরু সরু কম্পমান পা।

কিরীটী পোকাটার দিকে চেয়ে বললে, এই তাহলে মৃত্যুদূত। যতদূর মনে হয়, এই পোকাটা Scolopendra গ্রুপের। এখন বুঝতে পারছি-মিঃ দাসের চাকর সুখলাল যে বলেছিল, মিঃ দাস অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, লাল বাঁকা বলে একটা কথা—সেটা তিনি লাল বাঁকা বলেননি, বলেছিলেন লাল পোকা এবং সেটা এই রকম একটা পোকা দেখেই।

তার ঘরে যে সিল্কের সুততা পাওয়া গেছল, সেটা দিয়ে এইরকম একটি পোকাকেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে মারবার জন্য। কিন্তু প্রথমবারের চেষ্টা নিষ্ফল হয়; সেইজন্য বোধ হয় দ্বিতীয় চেষ্টা করতে হয়েছিল।

মিঃ দাসের অফিস-ঘর থেকে মাত্র হাত-তিনেক ব্যবধানে গলির অন্য দিকে ছিল সেই পাঞ্জাবী ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারের বাড়ির দোতলার ছাদে উঠে নিরিবিলিতে স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে এই মরণ-পোকাকে সুতোর সাহায্যে প্রেরণ করা এমন কোন দুরূহ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস আমার হিসাবে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, মিঃ দাসকে হত্যা করার মধ্যে কি এমন কারণ থাকতে পারে? রক্তমুখী ড্রাগন তো ওঁকে হত্যা না করেও অনায়াসেই কাজ হাসিল করতে পারত, যেমন করে মিঃ চিদাম্বরকে লুকিয়ে ফেলে কাজ হাসিল করে নিয়েছে।

তার মানে? কি করে জানলে তা? তাছাড়া চিদাম্বরমকে লুকিয়ে রেখেছে, এখবর কি করে জানলে কিরীটী? আগ্রহে উদগ্রীব হয়ে সুব্রত জিজ্ঞেস করলে।

কিরীটী বললে, মিস্টার রামিয়ার কাছ থেকে আজই সকালে খবর পেয়েছি—চিদাম্বরমের সেক্রেটারীর কাছে রক্তমুখী ড্রাগনের এক পরোয়ানা এসেছে-একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এক লাখ টাকা না দিতে পারলে, চিদাম্বরকে তারা পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে ফেলতেও পশ্চাৎপদ হবে না, এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে টাকা পেলে, চিদাম্বরমকে তারা ফিরিয়ে দেবে অক্ষত দেহে; সে প্রতিশ্রুতিও সেই চিঠির মধ্যে আছে।

পরদিন সকালবেলা কিরীটী, সুব্রত ও রাজু গতরাত্রের ঘটনা সম্পর্কেই আলোচনা করছিল।

কিরীটী বললে, যে কুৎসিত মুখটা স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে দেখা দিয়েছিল সেটা মনে হয় একটা বাঁদরের মুখ।

সুব্রত বললে, আমারও তাই এখন মনে হচ্ছে। মুখখানা আমি ভাল করেই দেখেছি। সেটা বাঁদর-জাতীয় কোন প্রাণীর মুখ বলেই মনে হয়।

কিরীটী বললে, আরেকটা কথা সুব্রত—এই দলের যিনি নেতা, অর্থাৎ যিনি মহামান্য রক্তমুখী ড্রাগন নামে পরিচিত, তিনি আমার মনে হচ্ছে হয়ত একজন চায়নীজ–

চায়নীজ!

কিরীটী বললে, তোদের বলিনি-যে বাক্সটার মধ্যে ঐ পোকাটা ছিল—তার মধ্যে একটা কাগজ ছিল?

কাগজ?

হ্যাঁ, চীনা ভাষায় লেখা কাগজটা—তাই আমি ভেবেছি কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে জানতে হবে—আর তাই চীনা ভাষা পড়তে পারে এমন একজন লোকের কথা রামিয়াকে বলেছি–

তারপর একটু থেমে আবার কিরীটী বললে, ঐ রক্তমুখী ড্রাগন যেই হোক, যতই তার কথা ভাবছি মনে হচ্ছে, লোকটা রসায়নশাস্ত্রে পণ্ডিত, ইংরেজীতে পণ্ডিত, বাঁদর দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে, বিশালকায় পিঁপড়ের মত জীবকে বিষাক্ত গন্ধে মাতোয়ারা করে মানুষের রক্তপানে লোলুপ করতে পারে। হয়ত কোন ক্ষুদ্র জীবকে ঘরের মধ্যে পাঠিয়ে তাকে বিষাক্ত গন্ধে উম্মত্ত করে ফেলে, এবং তারই কামড়ে নিদ্রিত মানুষকে অচৈতন্য করে দিতে পারে।

দুপুরের দিকে মিঃ রামিয়া এসে হাজির হলেন।

কিরীটী তাকে এনে ঘরে বসাল।

কিরীটী বললে, মিঃ রামিয়া, আমি যে একজন শিক্ষিত চীনা লোকের কথা বলেছিলাম, তিনি কোথায়?

তিনি এখুনি আসবেন। কিন্তু তিনি চীনা নন, তিনি একজন জাপানী। চীনা ভাষায়ও তার বেশ দখল আছে। আমাদের পুলিস-স্টাফেরই একজন অ্যাসিস্টান্ট কমিশনারের সঙ্গে তার বেশ হৃদ্যতা আছে।

কিরীটী বললে, ঠিক আছে। কিন্তু দেরি না হয়। আমি এর জন্য খুব বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। একটু অপেক্ষা করেও তাকে যদি সঙ্গে করে–

ঐ সময় মোটরের হর্ন শোনা গেল, সেই সঙ্গে কে একজন চেঁচিয়ে ডাকল, মিঃ রামিয়া। মিঃ রামিয়া এখানে আছেন?

হা হ্যাঁ, আসুন আসুন।

একটু পরেই জাপানী ভদ্রলোকটি এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

কিরীটী কাগজটা ভদ্রলোককে দেখতে দিল।

তিনি কাগজটা পরীক্ষা করে বললেন, এর মধ্যে কয়েকটি নাম আছে-প্রথম দুটি কাটা ও নীচে লেখা ডাঃ ওয়াং।

কাটা নাম।

হ্যাঁ, প্রথমটি চিদাম্বরম্ ও দ্বিতীয়টী সুন্দর দাস—

আর তৃতীয়?

মিঃ ডিবরাজ।

ছাপা কাগজগুলি সাপ্তাহিকি ও মাসিক ইত্যাদি সাময়িক পত্রিকার অংশবিশেষ। এবং নানা ধরনের সংবাদ রয়েছে তার মধ্যে।

জাপানী ভদ্রলোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

কিরীটী মৃদুকণ্ঠে কতকটা আত্মগতভাবে বলতে লাগল, রক্তমুখী ড্রাগনের কাগজে ১নং হচ্ছে-মিঃ চিদাম্বরম; ২নং হচ্ছে-মিঃ সুন্দর দাস। তাদের কেউ আর এখন আমাদের মাঝে নেই—একজন হয়েছেন অপহৃত, অপরজন নিহত। আর ৩নং নাম হচ্ছে-মিঃ ডিবরাজ!

কে তিনি? তাকে জানেন নাকি? কি মিঃ রামিয়া, তিনি এখনও বেঁচে আছেন তো?

আজই সকালে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

হঠাৎ কিরীটী বললে, তাহলে মিঃ রামিয়া, রক্তমুখী ড্রাগনের এই ৩ নং শিকার মিঃ ডিবরাজকে বাঁচাবার চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।

মিঃ রামিয়া বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, কি আপনার কথাটা।

বুঝতে পারছেন না? দেখছেন না, এই কাগজখানা হচ্ছে একটা নামের লিস্ট, যেসব হতভাগ্য রক্তমুখী ড্রাগনের শিকার হবে, এই কাগজখানায় তাদের নাম লেখা রয়েছে। নামের ক্রমিক নম্বর অনুসারে এদের সকলেই রক্তমুখী ড্রাগনের দ্বারা অপহৃত বা নিহত হবে।

এদের প্রথম দুটি তো চলেই গেছে, এখন যদি সম্ভব হয় এই ৩ নং ব্যক্তিটিকে রক্ষা করে, বাকী কটাকেও বাঁচানো হয়ত যেতে পারে।

সুব্রত ও রাজু মুগ্ধভাবে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে রইল, আর মিঃ রামিয়া বললেন, ঠিক বলেছেন।

আমার মনে হচ্ছে ঐ রক্তমুখী ড্রাগন নামধারী ব্যক্তিটি আর কেউ নয়—চীনের ডাঃ ওয়াং।

ডাঃ ওয়া?

হ্যাঁ, ডাঃ ওয়াং।

এই বলে কাগজের টুকরোটা রামিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, এই দেখুন মিঃ রামিয়া। প্রায় প্রত্যেকটা কাগজেই ডাঃ ওয়াং-এর স্বাক্ষর। সম্ভবত নিতান্ত অসতর্কভাবে তার চিন্তকুল মন এমন সাংঘাতিক ইঙ্গিতটা এই কাগজের বুকে লিখে রেখেছে। দেখুন লিস্টটার তলায়ও লেখা রয়েছে-ডাঃ ওয়াং। কলম্বোতে ডাঃ ওয়াং নামে বিখ্যাত কোন লোক আছে কি মিঃ রামিয়া? খোঁজ নেবেন তো, এ শহরে ডাঃ ওয়াং বলে কেউ আছে কিনা?

নিশ্চয়ই খবর নেবো।

আর একটা কথা—

কি?

চীন গভর্নমেন্টের কাছে জরুরী তার করতে হবে। জানতে হবে, এই ডাঃ ওয়াং লোকটির বর্তমান movement সম্পর্কে কিছু জানা আছে কিনা। এবং তার চেহারা, শিক্ষাদীক্ষা, ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি সম্বন্ধে চীন গভর্নমেন্ট যদি কোন সংবাদ দিতে পারেন।

ইন্সপেক্টর রামিয়া একটু নীরব থেকে কি ভাবলেন; তারপর বললেন, তাহলে চলুন একবার আমাদের বড়কর্তার কাছে যাই। তাকে আপনিও সব কথা ভাল করে বুঝিয়ে বলতে পারবেন। তারপর মিঃ ডিবরাজকে পাহারা দেবার বন্দোবস্ত করে আপনাকে আবার এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব।

বেশ, চলুন তাহলে।

অতঃপর ইন্সপেক্টর রামিয়ার মোটর-কার কিরীটীকে নিয়ে পুলিস-সাহেবের কুঠির দিকে বের হয়ে পড়ল।

সুব্রত ও রাজুকে কিরীটী বলে গেল, তোমরা খানিকক্ষণ এখানেই থাক। সব দিকে নজর রেখো ভাল করে। মনে রেখো, রক্তমুখী ড্রাগন বা ডাঃ ওয়াং হয়ত আমাদের খুব নিকটেই আশেপাশে কোথাও ওৎ পেতে লুকিয়ে রয়েছে।

পুলিসের চীফের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওরা গেল ডিবরাজের বাড়ি। কিন্তু তিনি বাড়িতে নেই-বাইরে গিয়েছেন—পনের-কুড়ি দিনের মধ্যেই ফিরবেন তার লোকেরা বললে।

চীন-গভর্নমেন্টের কাছ থেকে তারের জবাব এসে গেল দিন-পনেরোর মধ্যেই।

চীন-গভর্নমেন্ট জানিয়েছেন যে, চীনে দুটো দল ছিল। এক দলের নাম কুয়োমিং-তান, আর এক দলের নাম কমুনিস্ট। আর একটি ছোট দলের নেতা হচ্ছে আঃ ওয়াং। কমুনিস্ট ও কুয়ো-মিং-তান দল দুটো ও ডাঃ ওয়াং-এর দল পরে একত্রে সংঘবদ্ধ হয়; কিন্তু ডাঃ ওয়াং-এর চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের জন্য সে তখন আর তাদের সঙ্গে মিলে-মিশে থাকতে পারল না। সে নিজেই একটা পৃথক দল গড়ে তুলল।

কিন্তু এই দল গড়ার পর থেকেই তার যে মূল উদ্দেশ্য, দেশের সেবা করা, তা থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গেল ডাঃ ওয়াং। সে আরম্ভ করল একের পর এক হত্যাকাণ্ড।

হত্যা করতে লাগল একের পর কে বিরোধী দলের নেতাদের। এবং তাদের মৃতদেহে কোথাও কোন বিশেষ ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, কেবল তাদের গলার চারপাশে কয়েকটা রক্তবিন্দুর মত দাগ দেখা গেছে, আর নিহত লোকদের পকেটে পাওয়া গেছে একখানি করে খাম; তাতে বিষাক্তগন্ধী ভয়ঙ্কর ড্রাগনের ছবি আঁকা ছিল। চীন গভর্নমেন্ট তখন ডাঃ ওয়াং এর দলটাকেই ড্রাগন কোম্পানী নাম দিয়েছিলেন।

চীন গভর্নমেন্ট আরও জানিয়েছে যে, ডাঃ ওয়াং-এর তৎকালীন একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, অর্থ সংগ্রহ করা। এবং বিরোধী দলের নেতারা ছাড়াও দেশের ধনিক সম্প্রদায়ের লোকও কিছু তার হাতে নিহত হয়েছেন। ডাঃ ওয়াং তাদের সকলের কাছ থেকেই ভয় দেখিয়ে বেশ মোটা টাকা রোজগারের চেষ্টা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে সে কৃতকার্য হয়েছিল।

ডাঃ ওয়াং উচ্চশিক্ষিত; রসায়নশাস্ত্র ও প্রাণিবিদ্যায় সে সুপণ্ডিত। চীন গভর্নমেন্টের বিশ্বাস, লোকটা ইচ্ছা করলে হয়ত কাদামাটি দিয়েও কামান-গোলা তৈরী করতে পারে, অথবা কেঁচো বা কৃমিকে দিয়েও অনেক কাজ করিয়ে নিতে পারে।

তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য চীন গভর্নমেন্ট এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সংবাদ পেয়েছে ডাঃ ওয়াং নাকি এখন দক্ষিণে-আরব দেশে অথবা ভারতবর্ষে পাড়ি জমিয়েছে।

চীন গভর্নমেন্ট সর্বশেষে তার চেহারা ও শিক্ষাদীক্ষার বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছে, ডাঃ ওয়াং অতি ভয়ঙ্কর লোক।

ডাঃ ওয়াং-এর সম্বন্ধে এখন সব কিছু জানলেন তো মিঃ রামিয়া? কিরীটী বললে।

একটু হেসে মিঃ রামিয়া বললেন, হ্যাঁ, জানলুম। এখন কি করতে চান মিঃ রায়?

চলুন একবার মিঃ ডিবরাজের বাড়ি যাব,-হয়ত এতদিনে তিনি এসেছেন–

বেশ চলুন–

গাড়িতে যেতে যেতেই মিঃ রামিয়া বললেন, আপনার কথামত মিঃ রায় সেইদিন থেকেই মিঃ ডিবরাজের বাড়ির আশেপাশে পাহারা বসিয়েছি বটে, কিন্তু তিনি তা জানেন না। সাদা। পোশাকে কয়েকটা লোক দিনরাত তার বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখছে।

ডিবরাজ লোকটা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। শহর হতে একটু দূরে নির্জন সমুদ্রের ধারে একটা নির্জন বাগানবাড়ি তৈরী করে সেখানে থাকেন।

দূরে সমুদ্রতীরে কতকগুলো পাম বা সুপারি-জাতীয় লম্বা গাছের সারি দেখা যায় বাড়ি থেকে।

সমুদ্রের কোল ঘেঁষে জুয়েলার ডিবরাজের বাংলো-ধরনের বাগানবাড়ি।

বাড়ির চারপাশে নানাজাতীয় ফল ও ফুলের গাছ। বাড়ির সীমানার চারপাশে প্রাচীর নয়, দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের জালের বেড়া প্রায় মানুষ-সমান। সেই তারের গায়ে গায়ে লতিয়ে উঠেছে ঘন হয়ে আইভিলতা।

মধ্যে মধ্যে ফুল ধরেছে।

গেট পার হয়েই একটু এগুতেই চোখে পড়ল পশ্চিমমুখী বাংলোর পিছন দিকে—দুরে নীল সাগরের অনেকটা। এবং তার সামনেই সার সার নারিকেল গাছ।

বাংলোতে প্রবেশের মুখেই একটিমাত্র লোহার গেট।

গেটের পাঠান দারোয়ান বন্দুকধারী—সে আগে থাকতেই মিঃ রামিয়াকে চিনত বলে কোন বাধা দেয়নি।

এবং তার কাছেই জানতে পেরেছিল ওরা, মিঃ ডিবরাজ গৃহেই আছেন।

বাংলোর সামনে অনেকখানি জায়গা নিয়ে নানা ধরনের ছোট বড় মাঝারি ফুলফলের গাছ-দূরে আউটহাউস।

হঠাৎ একটা কুকুরের ডাক শোনা গেল-তারপরই দেখা গেল বিরাট ধূসর রংয়ের একটা অ্যালসেসিয়ান ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।

ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল।

কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করছে।

হয়ত ওদের আক্রমণই করত কিন্তু তার আগেই বাগানের একাংশ থেকে একটি বাইশতেইশ বছরের তরুণী হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এল।

সিজার-সিজার-স্টপ্‌-স্টপ্‌-

কুকুরটা থেমে গেল।

ওরা নিশ্চিন্ত হয়।

তরুণী আরো একটু এগিয়ে আসে।

রোগা পাতলা চেহারা—গায়ের বর্ণ গৌর—তাতে যেন সামান্য লালচে আভা।

চোখ মুখ যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা।

পরনে সালওয়ার পাঞ্জাবি-বেণীর আকারে মাথার চুল বুকের ওপরে দুলছে। পায়ে চপ্পল।

আপ লোগন কিধার সে আতে হেঁ?

মিঃ ডিবরাজ আছেন? ইংরাজীতে প্রশ্ন করলেন মিঃ রামিয়া।

জী হাঁ-ডাড়ি পারলার মে হ্যায়—

কিরীটী মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল তরুণীর দিকে।

আমি ইনসপেক্টার রামিয়া-মিঃ ডিবরাজের সঙ্গে দেখা করব বলে—

আইয়ে-তরুণী আহ্বান জানাল।

চলিয়ে রায় সারামিয়া ডাকল।

আঁ-হ্যাঁ চলুন—দুজনের চোখাচোখি হল।

মুহূর্তকাল দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে দুজনেই দৃষ্টি নত করল।

আসুন-তরুণী এবারে ইংরাজীতে বললে।

গাড়িবারান্দার সামনে বারান্দা-দুধপ সিঁড়ি-তরুণী আগে আগে চলেছে-সঙ্গে সিজার-আর পিছনে পিছনে মিঃ রামিয়া আর কিরীটী।

পারলারের মধ্যে ওদের নিয়ে তরুণী প্রবেশ করল পর্দা তুলে। ঘরের মধ্যে মিঃ ডিবরাজ একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

তরুণী ডাকল, ড্যাডি–

ইয়েস মাই চাইল্ড—

তোমার সঙ্গে মিঃ রামিয়া পুলিস ইনসপেক্টার দেখা করতে এসেছেন—

মিঃ ডিবরাজ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন, আসুন আসুন ইনসপেক্টার সাহেব—

যার সঙ্গে কথা বলছিলেন তাকে বিদায় দিলেন মিঃ ডিবরাজ।

মিঃ ডিবরাজের বয়স পঞ্চাশের উপরেই হবে।

দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারাটকটকে গৌরবর্ণ। মাথার সামনের দিকে সামান্য টাক–পরিধানে পায়জামা ও পাঞ্চাবি।

চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।

কৃষ্ণা! মিঃ ডিবরাজ ডাকলেন।

ড্যাডি।

ভিতরে গিয়ে কিছু চা-জলখাবার পাঠিয়ে দাও কৃষ্ণা।

কৃষ্ণা যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। কিরীটীর সঙ্গে আবার চোখাচোখি হল। মুহূর্তের জন্য–তারপর ধীরপায়ে সে কক্ষ ত্যাগ করল।

বসুন ইনসপেক্টার–

আলাপ করিয়ে দিই—মিঃ কিরীটী রায়-কলকাতা শহরের একজন নামকরা বেসরকারী গোয়েন্দা-আর ইনিই মিঃ ডিবরাজ।

নমস্তে। ডিবরাজ হাত তুললেন।

নমস্তে। কিরীটী হাত তুলল।

বসুন—be seated please!

ওরা বসল।

মিঃ ডিবরাজ বললেন, আমি ছিলাম না, ব্যবসার ব্যাপারে হংকং গিয়েছিলাম—এসে শুনলাম আপনি আমার খোঁজে এসেছিলেন। অবিশ্যি আপনি আজ না এলেও আপনার ওখানে আজই একটু পরে আমি যেতাম–

মিঃ ডিবরাজ, কিরীটী বললে, কোন চিঠি পেয়েছেন নাকি আপনি? সেই ব্যাপারেই কি–

হ্যাঁ-কিন্তু আপনি জানলেন কি করে মিঃ রায়? কথাটা এখন পর্যন্ত আমি আমার পার্সোন্যাল সেক্রেটারীকেও বলি নি তো!

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, রক্তমুখী ড্রাগনের চিঠি তো?

যা-কিন্তু জানলেন কি করে?

মিঃ রামিয়া বললেন, সেই ব্যাপারেই উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন—যদি ওঁর দ্বারা আপনার কোন উপকার হয়—অবিশ্যি পুলিসের সব রকম সাহায্যও আপনি পাবেন।

তা জানি পাব—কিন্তু আমি ভাবছিলাম—

কিরীটী শুধাল, কি?

ওদের ডিমাণ্ড আমি মিটিয়ে দেব। সুন্দর দাসের মত—

কত ডিমাণ্ড করেছে ড্রাগন আপনার কাছে? কিরীটী শুধাল।

এক লাখ টাকা।

কবে দিতে হবে?

আগামী পরশুর মধ্যে—

টাকা কে কি ভাবে কালেকশন করবে? কিরীটী শুধাল।

আজ সকালে একটা ফোন পেয়েছি-ডিবরাজ বললেন।

ফোন!

হ্যাঁ, তাতে আবারও আমাকে শাসানো হয়েছে-টাকা না দিলে নাকি সুন্দর দাস বা মিঃ চিদাম্বরমের অবস্থাই আমারও হবে। আর টাকা দিতে রাজী থাকলে পরশু রাত বারোটায় তার নোক এসে টাকা নিয়ে যাবে–

আপনি বলেছেন দেবেন?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে-এবারে যা করবার আমরাই করব।

ঐ সময় কৃষ বেয়ারাকে সঙ্গে করে একটা ট্রলির উপরে চায়ের সরঞ্জাম ও প্রচুর জলখাবার নিয়ে পারলারে এসে ঢুকল।

আবার কিরীটী ও কৃষ্ণার চোখাচোখি হল।

কৃষ্ণাই ওদের চা পরিবেশন করল।

কিরীটী খাবারের দিকে হাত বাড়ায়নি, চায়ের কাপেই চুমুক দিচ্ছিল।

কৃষ্ণা প্যাসট্রির সামনে তুলে ধরে বললে, প্যাসট্রি নেবেন না?

কিরীটী তাকাল কৃষ্ণার মুখের দিকে, তারপর একটা প্যাসট্র প্লেট থেকে তুলে নিল।

মিঃ ডিবরাজ কিরীটীর পরিচয় করিয়ে দিলেন কৃষ্ণার সঙ্গে।

মিঃ রায়, আমার মেয়ে—একমাত্র সন্তান কৃষ্ণা। ও বোম্বাইয়ে ওর মামার কাছে থেকে পড়াশুনা করে। ছুটিতে আমার কাছে এসেছে। কৃষ্ণা, উনি মিঃ কিরীটী রায়-মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন মিঃ ডিবরাজ, কলকাতা শহরের একজন

কৃষ্ণা বললে মৃদু হেসে, ওকে চাক্ষুষ না দেখলেও ওঁর পরিচয় আমার জানা আছে ড্যাডি!

কিরীটী তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণার মুখের দিকে।

কৃষ্ণা মৃদু হেসে বললে, আপনাকে আমি জানি—আপনার অনেক কীর্তির কথা আমি জানি।

কিরীটী মৃদু হাসল।

ড্যাডি!

ইয়েস!

মিঃ রায় ও মিঃ রামিয়াকে আজ রাত্রে ডিনারে আসতে বল না?

সে তত ভাল কথা—আসুন না আপনারা।

কিরীটী বললে, মিঃ রামিয়া এলে আমিও আসতে পারি

আসবেন তো তা হলে মিঃ রায়? কৃষ্ণা বললে।

আসব। কিরীটী বললে।

কৃষ্ণা বললে, আর এক কাপ চা দিই আপনাকে মিঃ রায়?

চা!

যা, আপনি তো চা খুব ভালবাসেন।

জানলেন কি করে?

জানি।

বেশ, দিন।

চা ঢেলে দিল আর এক কাপ কৃষ্ণা কিরীটীকে।

ড্যাডি, আমি একটু মার্কেটে বেরুব। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরব—

বেশ তো, যাও।

কৃষ্ণা ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে।

বাংলোর পিছনদিকে পশ্চিমের বারান্দায় মিঃ ডিবরাজ, মিঃ রামিয়া ও কিরীটী বসে গল্প করছিলেন।

কৃষ্ণাও এতক্ষণ ছিল, এইমাত্র ভিতরে গিয়েছে ডিনারের ব্যবস্থা করতে।

পূর্ণিমার রাত বোধ হয়।

মস্ত বড় চাদ উঠেছে।

সামনে যতদূর দেখা যায় চন্দ্রালোকিত সাগর মাতামাতি করছে। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় চাঁদের আলো যেন পিছলে পড়ছে।

কিরীটী বললে, মিঃ ডিবরাজ, পরশু আমরা ঠিক করেছি সন্ধ্যার পরই এখানে আসব।

কিন্তু ওদের ডিমাণ্ড মত টাকা না দিলে—

দিলেও ওদের আপনি নিবৃত্ত করতে পারবেন না। বরং দেখবেন ঐ ড্রাগনের লোভ আরো বেড়েই গিয়েছে। হলুদ শয়তানকে আপনি চেনেন না!—কিরীটী বললে।

হলুদ শয়তান!

হ্যাঁ, ডাঃ ওয়াং-লোকটা শুধু ক্রিমিন্যালই নয়—মূর্তিমান শয়তান।

কিন্তু–

আপনি কিছু ভাববেন না।

হঠাৎ ঐ সময় সিজারের ক্রুদ্ধ ডাক শোনা গেল দূরে।

সিজার-সিজার অমন করে ডাকছে কেন, বলতে বলতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন মিঃ ডিবরাজ এবং দ্রুতপায়ে বাড়ির পিছনদিককার বাগানের দিকে চলে গেলেন।

কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে ওঁকে অনুসরণ করে।

সিজারের ডাক শোনা যাচ্ছে–

কিরীটী ডিবরাজকে বেশীদূর অনুসরণ করতে পারে না, তার আগেই একটা সিনামোনের ঝোপের আড়ালে তিনি চলে গেছেন।

তবু কিরীটী এগুতে থাকে।

মিঃ ডিবরাজ-মিঃ ডিবরাজ যাবেন না—ফিরুন! কিরীটী চেঁচিয়ে ডাকল।

কোন সাড়া পাওয়া গেল না মিঃ ডিবরাজের।

সিজারের কুদ্ধ গর্জন আর একবার শোনা গেল।

তারপরই হঠাৎ যেন সব স্তব্ধ।

কিরীটী তবু এগিয়ে যায়।

হঠাৎ ঐ সময় রাত্রির স্তব্ধতাকে দীর্ণ করে পর পর দুটো গুলির আওয়াজ শোনা গেল।

ইন্সপেক্টার মিঃ রামিয়াও ততক্ষণে তার পিস্তলটা মুঠোয় চেপে ঐদিকে ছুটে আসছেন।

গাছগাছালিতে একেবারে জায়গাটা যেন বেশী দুর্ভেদ্য।

মাথার উপর আবছা আলো থাকলেও নিবিড় গাছ-গাছালির জন্য ঐ জায়গাটায় একটা আবছা আলোছায়া।

ভাল করে নজরে পড়ে না।

কিরীটী তথাপি এগিয়ে যায়।

হঠাৎ সামনে পড়ল একটা দীঘি।

দীঘির চারপাশে বড় বড় ঘাস গজিয়েছে। দুরে সীমানায় তারের বেড়া।

কিরীটী এদিক-ওদিক তাকায়, কিন্তু কোথাও মিঃ ডিবরাজকে দেখতে পায় না।

কুকুরের ডাকও আর শোনা যাচ্ছে না তখন।

কেবল একটানা ঝিঁঝির ডাক।

হঠাৎ নজরে পড়ল কিরীটীর, ডানদিকের ঝোপ থেকে কে একজন বের হয়ে আসছে।

কে? মিঃ ডিবরাজ না? হ্যাঁ, তিনিই—

মিঃ ডিবরাজ? দুপা এগিয়ে গিয়ে কিরীটী ডাকল।

মিঃ রায়?

সিজার-সিজার কোথায়?

আসুন। ভাঙা গলায় মিঃ ডিরাজ জবাব দিলেন।

কোথায়?

He is dead!

Dead? কে?

সিজার। ডিবরাজের সঙ্গে এগিয়ে গেল কিরীটী সামনের দিকে কিছুটা।

একটা পাম-ট্রির নীচে এগিয়ে এসে মিঃ ডিবরাজ বললেন, ঐ যে—

কিরীটী দেখল, সিজারের দেহটা মাটিতে পড়ে আছে।

কিরীটী আরও এগিয়ে গেল।

নীচু হয়ে দেখল।

চাঁদের আলোয় এবারে তার নজরে পড়ল, মৃত সিজারের পেটে একটা লোহার সরু শলার মত কি বিঁধে আছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কিরীটী সিজারের মৃতদেহ থেকে শলাটা টেনে বের করে চাঁদের আলোয় চোখের সামনে তুলে ধরল।

দেড়বিঘৎ পরিমাণ, লোহার শলা নয়—একটা তীর, অগ্রভাগটা সামান্য চেপ্টা, কিন্তু ছুঁচলো।

কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে বিষের তীর এটা—

বিষের তীর! ডিবরাজ শুধালেন।

হ্যাঁ, খুব সম্ভব তীরের ফলায় কোন তীব্র মারাত্মক বিষ মাখানো ছিল, যে বিষের ক্রিয়াতেই আপনার সিজারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় মৃত্যু হয়েছে। চলুন, আর এখানে থেকে কি হবে, ভিতরে চলুন।

মিঃ ডিবরাজকে নিয়ে কিরীটী পশ্চিম দিককার বারান্দায় ফিরে এল।

মিঃ রামিয়া আর কৃষ্ণা দুজনেই বারান্দায় উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

কি হয়েচে ড্যাডি? কৃষ্ণা শুধায়।

কৃষ্ণা, সিজার মারা গেছে! কান্না-ধরা-গলায় মিঃ ডিবরাজ বললেন।

মারা গেছে?

হ্যাঁ।

কী করে?

কিরীটী হাতের তীরটা তুলে ধরে বললে, এই বিষাক্ত তীরে।

কোথা থেকে এল এটা?

সম্ভবত রক্তমুখী ড্রাগনের কোন অনুচরেরই কাজ এটা। কিরীটী বললে।

রক্তমুখী ড্রাগন!

হ্যাঁ কৃষ্ণা, মিঃ ডিবরাজ ভাঙা গলায় বললেন, তোমাকে জানাইনি, রক্তমুখী ড্রাগন আমাকে চিঠি দিয়েছে

কবে? কখন?

দিনকয়েক আগে।

আহারে আর কারুরই রুচি ছিল না।

সবাই খাদ্যবস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল যেন।

সিজারের আকস্মিক মৃত্যুর বিষণ্ণতা যেন সকলের মনকেই আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।

কিরীটী একসময়ে বললে, সিজার থাকলে তাদের সুবিধা হবে না, তাই তারা সিজারকে হত্যা করেছে মিঃ ডিবরাজ!

আর আমার সাহস হচ্ছে না মিঃ রায়। মিঃ ডিবরাজ বললেন।

মিঃ রামিয়া বললেন, ভয় পাবেন না মিঃ ডিবরাজ-আমাদের প্রহরা কাল থেকে আরো কড়া হবে।

কিরীটী কোন কথা বলে না, চুপ করে কি যেন ভাবে।

কৃষ্ণাও চুপচাপ একেবারে।

অনেক রাত্রে ওরা বিদায় নিল।

পরের দিন রাত্রে।

রাত তখন প্রায় এগারোটা হবে।

ফোনের একটানা ক্রিং ক্রিং শব্দে সর্বপ্রথম কিরীটীর ঘুমটা ভেঙে যায়।

ব্যাপার কি? এত রাত্রে কার ফোন?

পাশের ঘরেই ছিলেন জীবনবাবু-তারও ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তিনি রিসিভারটা তুলে নিলেন, হ্যালো, কে-মিঃ রামিয়া! কিরীটীকে ডেকে দেব? জরুরী? হ্যাঁ হ্যাঁ, এখুনি দিচ্ছি।

কিরীটী তার নামটা পাসের ঘরে কানে যেতেই শয্যা থেকে উঠে মধ্যবর্তী দরজাটা দিয়ে জীবনবাবুর শয়নকক্ষে এসে প্রবেশ করল, কে ফোন করছে জীবন?

তোমার ফোন। ইনসপেক্টার মিঃ রামিয়া—

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরল, কে মিঃ রামিয়া, আমি কিরীটী। কি—কি বললেন?

ওপাশ থেকে তখন মিঃ রামিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলে চলেছেন, এইমাত্র ডিবরাজের সামনে যে প্রহরীরা প্রহরায় ছিল তারা আমাকে ফোন করেছে-তিনি খুন হয়েছেন

কখন? কি করে হল?

জানি না—আমি সেখানে যাচ্ছি-আপনি কি আসবেন?

নিশ্চয়ই যাব।

তাহলে প্রস্তুত থাকুন, যাবার পথে আমি তুলে নিয়ে যাব।

কিরীটী চটপট প্রস্তুত হয়ে নেয়।

সুব্রত ও রাজুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। সব শুনে তারাও বললে যাব। কিরীটী বললে, না, সকলেই আমরা যাব না। তোরা থা—আমি একাই যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে তোদর জানাব।

সুব্রত বললে, কিন্তু কিরীটী–

ডাঃ ওয়াং-সেই হলুদ শয়তানের যতটুকু পরিচয় পেয়েছি, তার খরদৃষ্টি নিশ্চয়ই সর্বক্ষণ আমাদের ওপরে আছে। কেবল ডিবরাজকেই হয়ত হত্যা করেনি শয়তানটা, আমার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে কিনা ইতিমধ্যে সেখানে একটা কে জানে! যদি একটা কিছু ঘটেই দুর্ঘটনা–তোরা বাইরে থাকলে হয়ত কাজে লাগতে পারবি-পুলিস-চীফ মিঃ বন্দরনায়ককে সঙ্গে সঙ্গে জানাবি ব্যাপারটা। নিশ্চয়ই তিনি সবরকম সাহায্যই করবেন।

সুব্রত আর রাজু আপত্তি করল না।

কিরীটী পকেটে একটা শক্তিশালী পেনসিল টর্চ, একটা পাকানো কর্ড, একটা ছুরি ও অ্যানিয়া লোশনের একটা ছোট শিশি নিয়ে নিল।

বাইরে ঐ সময় মিঃ রামিয়ার গাড়ির হর্ন শোনা গেল।

চললাম—অ্যালার্ট থাকিস! কিরীটী বের হয়ে গেল।

ঘুমন্ত জনহীনপ্রায় রাস্তা ধরে ভিক্টোরিয়া পার্কটার দিকে মিঃ রামিয়ার গাড়ি পঞ্চাশ মাইল স্পীডে ছুটে চলেছিল।

কিরীটী শুধায়, আপনার প্রহরী আর কোন সংবাদ দিয়েছে?

না।

কিরীটী বললে, দোষটা আমারই মিঃ রামিয়া, আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তার আস্ফালন যে নিষ্ফল নয়, দুর্বলের বহ্রারম্ভ নয় জানা উচিত ছিল আমার—তাহলে হয়ত আজকের দুর্ঘটনা ঘটত না।

কিন্তু এ যে সত্যিই এক ভয়াবহ বিভীষিকার সৃষ্টি করল হলুদ শয়তানটা মিঃ রায়! মিঃ রামিয়া বললেন।

হ্যাঁ, তা করেছে। তারপর একটু থেমে বললে, তবে আজকের খেলাই তার শেষ খেলা!

বাংলোর মধ্যে গাড়িটা প্রবেশ করতেই পোর্টিকোর সামনে দেখা গেল দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরই একজন ফোন করেছিল মিঃ রামিয়াকে।

লাশ কোথায়? মিঃ রামিয়া জিজ্ঞাসা করলেন।

মিঃ ডিবরাজ তার শয়নঘরেই নিহত হয়েছেন।

কে ফোন করেছিল আমায়?

প্রথম প্রহরী বললে, আমিই।

আর চারজন প্রহরী কোথায়?

দুজন এখনো বাইরে-আমরা তিনজন ভিতরে—

কিরীটী ঐসময় প্রশ্ন করলে, তোমাদের দুজনকেই তো দেখছি, আর একজন কই?

সে ভিতরে মৃতদেহ পাহারা দিচ্ছে।

ওরা ভিতরের দিকে অগ্রসর হল।

পার্লার পার হয়ে অন্দরে পা দিতেই একটা মৃদু কান্নার আওয়াজ কিরীটীর কানে এল। কে যেন গুমরে গুমড়ে কাঁদছে।

কৃষ্ণা কি? কিরীটীর মনে হয়, কৃষ্ণাই হয়ত কাঁদছে। পুওর গার্ল। হ্যাঁ, দেখা গেল আর একটু এগুতেই, ঘরের সামনে বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে কাদছে কৃষ্ণা।

পরনে তার আজ একটা ক্ৰীম-কলারের জর্জেট শাড়ি ছিল। মাথার অপর্যাপ্ত কেশ তার অবিন্যস্ত।

মিঃ রামিয়া ডিবরাজের শয়নঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিরীটী কিন্তু কৃষ্ণার সামনে এসে দাঁড়াল, কৃষ্ণা!

কৃষ্ণা মুখ তুলে তাকাল। দুচোখ-ভরা লোনা টলটলে অশ্রু। কান্না-ভেজা গলায় বললে, মিঃ রায়, ড্যাডি–

আমারই বোধ হয় দোষ কৃষ্ণ—

আপনার দোষ! বিস্ময়ে কৃষ্ণা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, আমি-আমি যদি আর একটু সাবধান হতাম-কখন ব্যাপারটা ঘটেছে? কখন টের পেলেন?

ড্যাডি বের হয়েছিলেন সন্ধ্যার পর, তাঁরই পার্সোনাল সেক্রেটারী রাজীবলোচনের একটা ফোন পান অফিস থেকে, বেরুবার সময় বলে যান, ফিরতে যদি রাত হয় তো আমি যেন ডিনার সেরে নিই, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।

আর কিছু বলেন নি মিঃ ডিবরাজ?

না। তবে অধস্ফুট ভাবে বলেছিলেন যেন আমার মনে হল-বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে, রাজীবটা একটা অপদার্থ!

আর কিছু?

না।

রাজীব কতদিন আপনাদের এখানে আছেন?

নতুন লোক-বৎসরখানেক এসেছেন।

আগে কে ছিল?

কৃষ্ণাপ্পা।

সে কি কাজ ছেড়ে দিয়েছে?

না, বাবা তাকে বোম্বাইয়ের অফিসে পাঠিয়েছিলেন—সে সেখানেই আছে—

মিঃ ডিবরাজ কি আজ বাড়িতেই ছিলেন?

হ্যাঁ, আজ বাড়ি থেকে বের হননি।

কেউ আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?

না।

এমন কোন ঘটনা কি ঐ সময়ের মধ্যে ঘটেছে, যেটা আপনার মনে আছে?

না, তবে—

বলুন?

বিকেলের ডাকে ড্যাডির নামে একটা ছোট পার্সেল এসেছিল।

পার্সেল? কিসের পার্সেল?

ড্যাডির টেবিল-ক্লকটা হঠাৎ পড়ে গিয়ে টেবিল থেকে দিন-পনের আগে ভেঙে যায়, তাই ড্যাডি লণ্ডনের একটা ওয়া কোম্পানীতে চিঠি দিয়েছিলেন—ঠিক ঐরকম একটি টেবিল-ক্লক পাঠাবার জন্য—বোধ হয় সেটাই–

পার্সেলটা আপনার ড্যাডিকে খুলতে দেখেছিলেন?

না।

বাড়িতে আপনাদের কজন চাকর-বেয়ারা?

দুজন মাদ্ৰাজী ভৃত্য-কৃষ্ণান আর রামনাথন, আয়া কুডি, কুক আব্দুল, ড্রাইভার দেলোয়ার সিং আর দুজন পাঠান দরোয়ান-হামিদ খান আর হবিবুল্লা খান।

এরা সবাই বিশ্বাসী?

সবাই বিশ্বাসী।

কতদিন কাজ করছে এ বাড়িতে ওরা?

অনেক বছর।

আপনার ড্যাডির নতুন সেক্রেটারী রাজীবলোচনকে আপনার কি রকম মনে হয়?

ড্যাডি, তো ওর খুব প্রশংসা করত, বলত লোকটা যেমন স্মার্ট তেমনি কর্মঠ, তেমনি পরিশ্রমী ও বিশ্বাসী।

কত বয়েস হবে তার? তাকে তো দেখিনি আমি!

না, আপনারা যেদিন এসেছিলেন—রাজীব তখন বাংলোতে ছিল না।

এই বাংলোতেই কি সে থাকে?

যা, পারলারের পাশের ঘরটায়।
কিরীটী অতঃপর শুধাল, ব্যাপারটা কখন আপনি টের পেয়েছেন? আজ রাত্রে?

ড্যাডির শোবার ঘরের পাশেই আমার বেডরুম, কৃষ্ণা বলতে লাগল, রাত দশটা পর্যন্ত ড্যাডি এল না দেখে আমি তার অফিসে ফোন করেছিলাম।

ড্যাডি কি বললেন?

ড্যাডি অফিসে ছিল না—

ছিল না?

না। রাজীব ফোন ধরেছিল—সে বললে, ড্যাডি নাকি বিশেষ কি একটা মালের ডেসপ্যাচের ব্যাপারে পোর্টে গিয়েছেন-কাল সকালেই জাহাজ ছাড়বে, সেখান থেকেই বাসায় যাবেন বলে গিয়েছেন। একটু রাত হবে, আমি যেন না অপেক্ষা করি আর তার জন্য আমাকে খেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছেন।

হুঁ। রাজীব কোথায়?

এখনো তত ফেরেনি।

ঠিক জানেন?

হ্যাঁ।

আপনার ড্যাডি কখন ফিরেছেন জানেন?

না, আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তবে কৃষ্ণান বললে, রাত এগারটায় নাকি সে ড্যাডিকে ফিরে তার শোবার ঘরে ঢুকতে দেখেছে–

তারপর? জানলেন কখন ব্যাপারটা?

রাত তখন সোয়া এগারোটা হবে, কুট্টি এসে আমাকে ঘুম থেকে তোলেসে ড্যাডিকে ওঠাতে গিয়েছিল—ড্যাডি ডিনার করবে কিনা জানতে। কিন্তু গিয়ে দেখে ভিতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ। অথচ ঘরে আলো জ্বলছিল, সে তখন দরজায় নক্‌ করে, কিন্তু কোন সাড়া পায়। না। ডাকে সাহেবসাহেব বলে, তবু কোন সাড়া নেই। ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতরে দড়াম করে কিছু ভারী জিনিস পড়ার শব্দ শুনতে পায়। ব্যাপারটা কি বুঝতে না পেরে কুটি তখন কৃষ্ণানকে ডাকে।

তারপর দুজনে মিলে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে সাড়া না পেয়ে এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। আমি গিয়েও ডাকাডাকি করি, দরজায় ধাক্কা দিই, সাড়া পাই না। তখন ভিতরের জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পেলাম–

কি-কি দেখতে পেলেন?

ড্যাডি উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন, সামনেই টেবিলের ওপরে সেই পার্সেলের ডালাটা খোলা—আর

আর?

দেখলাম সেই পার্সেল থেকে একটা কি ধোঁয়ার মত বেরুচ্ছে। এবং একটা পাতলা সবুজবর্ণের কুয়াশার মত কি যেন ভাসতে ভাসতে ঘরের মধ্যে ক্রমশঃ একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে।

যা, হলুদ শয়তানের গ্যাসীয় মৃত্যুদূত-তীব্র বিষাক্ত কোন গ্যাসজাতীয় পদার্থ খুব সম্ভব ঐ পার্সেলের মধ্যেই ছিল, যেটা পার্সেল খুলতেই বের হয়ে মৃত্যুছোবল হেনেছে।

কিরীটী ততক্ষণে ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছে-সে আর ওখানে দাঁড়াল না। ডিবরাজের ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।

ছিমছাম সাজানো বেডরুমটি। আকারে বেশ বড়ই হবে। একটা সিঙ্গল খাটে শয্যা বিছানো–শয্যা দেখে বোঝা যায় সেটা কেউ তখনো স্পর্শও করেনি, এক পাশে টেবিলের উপরে একটা ভালা-খোলা পার্সেল।

মিঃ রামিয়া ঘরের চারিদিক পরীক্ষা করে দেখছেন।

কিরীটীকে ঢুকতে দেখে বললেন, funny! ভিতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল-কৃষ্ণান বলছে বাইরের বন্ধু জানলার সাসী ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে সে দরজা খুলেছে, বাথরুমের দরজাটাও ভিতর থেকে বন্ধ ছিল—তবে আততায়ী ঢুকল কি করে বলুন তো মিঃ রায়?

কোন মানুষ আততায়ী তো নয় মিঃ রামিয়া!

রামিয়া কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, তবে ওঁর মৃত্যু হল কি করে?

ডাঃ ওয়াংয়ের প্রেরিত বিষাক্ত কোন গ্যাসে—

গ্যাসে!

কেন, গন্ধ পাচ্ছেন না ঘরে-still thereis some smell! ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে আছে। তাই তো। দুবার নাক টেনে রামিয়া বলেন, একটা pungent smell যেন পাচ্ছি!

হ্যাঁ।

কিন্তু গ্যাস এলো কি করে ঘরে? সব তো বন্ধ ছিল।

গ্যাস এসেছিল আজই বিকেলে।

বিকেলে? কেমন করে?

আঙুল তুলে অদূরে টেবিলের উপরে রক্ষিত পার্সেলটা দেখিয়ে কিরীটী বললে, ঐ পার্সেলে এসেছে। চলুন দেখা যাক—

এগিয়ে গেল ওরা দুজনে। হোট একটা চৌকো বাক্স। তার মধ্যে কেটা ভাঙা কাঁচের কেস। তলায় কিছু জুয়েল্স্ চক করছে

এর মধ্যে ছিল গ্যাস? রামিয়া প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, কাঁচের কেসের মধ্যে কিছু জুয়েলের সঙ্গে বিষাক্ত গ্যাস সিল করে ভরে দেওয়া ছিল, কাঁচের কেসটা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই সে গ্যাস বের হয়ে মিঃ ডিবরাজকে মৃত্যুচুম্বন দিয়েছে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছে।

কি ভয়ঙ্কর! অস্পষ্ট কণ্ঠে বললেন মিঃ রামিয়া।

কিন্তু বিস্ময়ের তখনো আরও বাকী ছিল।

কিরীটী মৃতদেহটা ওল্টাতে অস্ফুটে বলে ওঠে, এ কে? এ কে?

কে! ঝুঁকে পড়েন মিঃ রামিয়া।

এ তো মিঃ ডিবরাজ নয়!

তাই তো!

কৃষ্ণান, দেখ তো এঁকে চিনতে পার কিনা—দেখেছো আগে কখনো কিনা?

কিরীটীর ডাকে কৃষ্ণান দরজার গোড়া থেকে এগিয়ে এসে মৃতদেহের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই অধস্ফুট কণ্ঠে বললে, এ যে সেক্রেটারি সাহেব।

রাজীবলোচন?

জী।

হঠাৎ কিরীটীর কি মনে হয়। সে মিঃ রামিয়াকে বলে, মিঃ রামিয়া, মিঃ ডিবরাজের অফিস কোথায় জানেন?

জানি।

Quick! এখুনি সেখানে চলে যান—গিয়েই আমাকে জানাবেন মিঃ ডিবরাজ সেখানে আছেন কিনা—

রামিয়া দ্রুতপদে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী মৃতের মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। মুখখানা যেন ফ্যাকাশে, একবিন্দু রক্ত নেই কোথাও বলে মনে হয়। মুখটা সামান্য যা করা, কশ দিয়ে রক্তের লালা গড়িয়ে পড়ছে, চক্ষু দুটি বিস্ফারিত।

কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে কৃষ্ণার কাছে যায়।

কৃষ্ণা!

কৃষ্ণা তখনও কাদছিল। মুখ তুলে তাকাল কিরীটীর ডাকে।

ও মৃতদেহটা তো মিঃ ডিবরাজের নয়!

নয়?

না।

তবে কার?

সেক্রেটারী রাজীবলোচনের—

তবে ড্যাডি-ড্যাড়ি কোথায়?

জানি না। মিঃ রামিয়াকে পাঠিয়েছি তার অফিসে খোঁজ নিতে।

আমি যাব—

বসুন, ব্যস্ত হবেন না, ব্যস্ত হয়ে কোন লাভ নেই, কারণ আমার সন্দেহ হচ্ছে—

কি-কি আপনার সন্দেহ হচ্ছে মিঃ রায়?

তাকে হয়ত তার অফিসেও পাওয়া যাবে না।

পাওয়া যাবে না?

সম্ভবতঃ। Still hope for the best!

ঠিক তাই।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মিঃ রামিয়া ফিরে এলেন, বললেন, না, অফিস-ঘরে আলো জ্বলছে, অফিস খোলা, ঘরের দরজায় বেয়ারাটা মরে পড়ে আছে-মিঃ ডিবরাজ অফিসে নেই, আর এই পোশাকগুলো সেখানে পেয়েছি-একটা প্যান্ট, একটা কোট।

হুঁ।

কি ব্যাপার বলুন তো মিঃ রায়? মিঃ ডিবরাজ কোথায় গেলেন?

খুব সম্ভবতঃ হলুদ শয়তানের খপ্পরে-তার হাতেই এখন তিনি।

হলুদ শয়তান তাহলে—

ঠিক বলতে পারছি না মিঃ রামিয়া, তবে আমার অনুমান–হলুদ শয়তান যে করেই হোক রাজীবকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়েছিল–

বলেন কি!

তাই। এবং রাজীবকে দিয়েই ফোন করিয়ে আজ সন্ধ্যার পর জরুরী কাজের কথা বলে মিঃ ডিবরাজকে তারা তার অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থাকতেই হলুদ শয়তানের অনুচরেরা প্রস্তুত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে মিঃ ডিবরাজকে গায়েব করে অন্যত্র নিয়ে যায়–

কিন্তু রাজীব।

ভগবানের দণ্ড-হ্যাঁ, ভগবানের দেওয়া পাপের দণ্ড তাকে মাথা পেতে নিতে হয়েছে। সে নিশ্চয়ই শুনেছিল বা দেখেছিল পার্সেলটার মধ্যে কাঁচের বাস্কের ভিতর জুয়েগুলো আছে। তার লোভ সে সামলাতে পারেনি, সে তাই পরে নিজের পোশাক ছেড়ে মিঃ ডিবরাজের পোশাক পরে সেগুলো হাতাতে এসেছিল। সে তো জানত না যে আমি বারংবার মিঃ ডিবরাজকে সাবধান করে দিয়েছিলাম, কাল কোনরকম পার্সেল বা প্যাকেট কারও হাতে বা ডাকে এলে আমার অনুপস্থিতিতে সেটা না খুলতে। তাই মিঃ ডিবরাজ বোধ হয় কাঁচের বাক্সটা খোলেননি, হয়ত আমাকে কাল সংবাদ দিতেন–

হঠাৎ ঐ সময় ঘরের ফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন করে।

মিঃ রামিয়া গিয়ে রিসিভারটা তুললেন।

মিঃ রামিয়া আছেন ওখানে?

কথা বলছি।

আমি পোর্ট থেকে প্রহরী কথা বলছি।

কি ব্যাপার?

আজ বিকেলের দিকেই একটা ছোট সাদা রঙের জাহাজ এসেছিল এবং এতক্ষণ নোঙর করে ছিল। এখন মনে হচ্ছে জাহাজটা ছেড়ে যাবে। আপনি বলেছিলেন নতুন কোন লঞ্চ বা জাহাজ দেখতে পেলে, সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ফোন করে জানাতে। তাই বাড়িতে আপনার ফোন করে জানলাম আপনি এখানে আছেন–

ঠিক আছে।

বস্তুত কিরীটীই রামিয়াকে গতকাল ঐ নির্দেশ দিয়েছিল, পোর্টে constant ওয়া রাখবার জন্য। রামিয়া বললেন ফোনের সংবাদ কিরীটীকে।

মিঃ রামিয়া, পুলিসের লঞ্চও আছে নিশ্চয়ই পোর্টে?

হ্যাঁ, জল-পুলিসের লঞ্চও আছে-দ্রুতগামী লঞ্চ গান-বোট।

এখুনি পোর্ট-পুলিসে ফোন করে ঐ সাদা জাহাজটার প্রতি নজর রাখতে বলুন—আমরা এখুনি আসছি। আরও বললেন, যেন গান-বোট রেডি থাকে।

মিঃ রামিয়া কিরীটীর নির্দেশমত ফোন করে দিলেন।

তারপরেই দুজনে গাড়ি নিয়ে বের হল।

গাড়িতে বসে কিরীটী শুধাল, সঙ্গে আর্মস আছে তো আপনার মিঃ রামিয়া?

হ্যাঁ, লোডেড পিস্তল আছে।

পোর্টে এসে ওরা জানতে পারল, তখুনি সেই সাদা জাহাজটা ছেড়েছে-বেশীদূর যেতে পারেনি। গান-বোট মেসেজ পেয়ে প্রস্তুতই ছিল।

গান-বোটের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন বালকৃষ্ণ ডেকের উপর দাঁড়িয়ে—একটা লঞ্চ করে ওরা তিনজন—কিরীটী, মিঃ রামিয়া আর রাজু গান-বোটে উঠে বোট ছাড়বার নির্দেশ দিল।

সঙ্গে সঙ্গে গান-বোট দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল—কিছু দূরে চলমান সাদা জাহাজটা লক্ষ্য করে।

যেমন করে হোক ক্যাপ্টেন, ঐ জাহাজটার গতি রোধ করতেই হবে।

ক্যাপ্টেন বললে, একটা ওয়ারলেস মেসেজ পাঠাব অগ্রবর্তী জাহাজটাকে থামাবার জন্য মিঃ রামিয়া?

কিরীটী বললে, কোন ফল হবে না। ওরা আমাদের মেসেস ইগনোর করবে।

কিন্তু জাহাজের কাছাকাছি হলে ওরা যদি কামান দাগে! মিঃ রামিয়া বললেন।

সম্ভবতঃ ঐ জাহাজে সেরকম কোন অ্যারেঞ্জমেন্ট নেই। সেরকম হলে আমাদেরই কামান দেগে জাহাজটা ড়ুবিয়ে দিতে হবে।

আপনার কি ধারণা মিঃ রায়, ঐ জাহাজেই ডাঃ ওয়াং আছে?

নিঃসন্দেহে। কিরীটী বললে, শুধু তাই নয়, মিঃ ডিবরাজকে ও মিঃ চিদাম্বরমকেও ঐ জাহাজেই বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে ডাঃ ওয়াং।

কিন্তু–

ওয়াং বুঝতে পেরেছিল এখানে আর তার সুবিধা হবে না—তাই ওদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা মোটা রকমের টাকা ওরা ডিমাণ্ড করবে। কিরীটী বললে।

গান-বোট জাহাজটার কাছাকাছি আসতেই কিরীটী চাঁদের আলোয় দেখতে পেল, জাহাজের ডেকে একটা দীর্ঘকায় মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে যেন ছায়ার মত।

কিরীটী বললে, মিঃ রামিয়া, ঐ যে ডেকের উপর একটা লোক দাঁড়িয়ে, দেখতে পাচ্ছেন?

ইয়েস!

ক্যাপ্টেন? এবারে কিরীটী ক্যাপ্টেনকে সম্বোধন করলে।

ইয়েস!

কিন্তু তার আগেই পর পর দুটো গুলি ওই জাহাজটা থেকে ছুটে এল।সাবধান! ওরা রিভলবার চালাচ্ছে। কিরীটী সকলকে হুশিয়ার করে দেয়।

ক্যাপ্টেন ততক্ষণে জাহাজ লক্ষ্য করে গুলি করেছে।

পর পর কয়েকটা গুলিবিনিময় হল দুপক্ষের মধ্যে, এবং গুলি করতে করতেই গানবোট জাহাজের গায়ে এসে ভিড়ল।

জাহাজের ডেকের উপরে তখন চার-পাঁচজন পিস্তল হাতে গুলি চালাচ্ছে, গানবোট থেকেও গুলি চলে।

একটা খণ্ডযুদ্ধের পর জাহাজের ডেক থেকে গুলি ছোঁড়া বন্ধ হল।

জাহাজটা তখনও চলেছে ধীরে ধীরে।

একটা দড়ি জাহাজের রেলিংয়ে গলিয়ে সেই দড়ির সাহায্যেই ওরা একে একে যখন জাহাজের ডেকে উঠে এল-সেখানে ডেকের উপরে চার-পাঁচটি মৃতদেহ পড়ে আছে।

কিরীটী ও মিঃ রামিয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলে, জাহাজের ডেকে আর জনপ্রাণী নেই, ইতিমধ্যে গান-বোট থেকে দশ-বারোজন সৈনিক উঠে এসেছে জাহাজে।

তাদের পাঁচজনকে প্রহরা দিতে বলে বাকী সৈনিক নিয়ে কিরীটী এগিয়ে চলল সিঁড়ি বেয়ে নীচের দিকে।

জাহাজটা কিন্তু তখনও চলেছে।

সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে-সামনেই একটা সরু প্যাসেজের মত—প্যাসেজে আলো ছিল, সেই আলোতেই ওরা এগিয়ে চলল—সর্বাগ্রে একজন সৈনিক রাইফেল হাতে, তার পিছনে কিরীটী ও মিঃ রামিয়া পিস্তল হাতে এবং বাকী সব তাদের অনুসরণ করে। হঠাৎওদের নজরে পড়ল একটা কাঁচের দরজা-কাজের ভিতর দিয়ে দৃষ্টিপাত করতেই বোঝা গেল–ওটা একটা কেবিনের দরজা। বেশ প্রশস্ত কেবিন-কেবিনের মধ্যে আলো জ্বলছে, আর–

আর সেই আলোয় দেখা গেল-কালো রঙের আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে এবং তার সামনে একটা চেয়ারে বসে মিঃ ডিবরাজ-তার হাত-পা বাঁধা।

ঐ–ঐ তো মিঃ ডিবরাজ! কাঁপা উত্তেজিত কণ্ঠে মিঃ রামিয়া কথাটা বলে শেষ করবার আগেই কিরীটী তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল, hush! চুপ।

ও লোকটা কে? দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে মিঃ রামিযা বললেন।

ডাঃ ওয়াং সম্ভবত। কিরীটী চাপাগলায় জবাব দিল।

কোণের আর একটা চেয়ারে আর একজন বসে না? দেখতে পাচ্ছেন মিঃ রায়?

যা, উনি হয়ত মিঃ চিদাম্বরম।

এখন আমাদের কি কর্তব্য? : ডাঃ ওয়াং সম্ভবত এখনও জানতে পারেনি যে জাহাজ আমরা অধিকার করেছি—কিরীটীর কথা শেষ হল না, ওরা দেখতে পেল, কেবিনের এক কোণ থেকে একটা ছোট বাঁদর লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এসে ডাক্তারের সামনে দাঁড়াল, ডাক্তার হাত বাড়াতেই বাঁদরটা তার হাত বেয়ে অবলীলাক্রমে ডাক্তারের কাধের উপর উঠে বসল।

ক্যাপ্টেন?

ইয়েস! কিরীটীর ডাকে সাড়া দিলেন ক্যাপ্টেন বালকৃষ্ণ, গান-বোটের কমাণ্ডার।

আপনার লোকদের বলুন জাহাজের ইঞ্জিন-ঘর দখল করতে—যান, চটপট অর্ডার দিয়ে আসুন।

ক্যাপ্টেন তখনি গিয়ে উপরের ডেকে অর্ডার দিয়ে মিনিট-তিনেকের মধ্যেই ফিরে এল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ডাঃ ওয়াং ঘুরে দাঁড়াল—

ওরা সকলে সঙ্গে সঙ্গে দরজার দুপাশে সরে দাঁড়াল।

দরজাটা খুলে ডাঃ ওয়াং বাইরে পা দিতেই কিরীটী ডাঃ ওয়াংয়ের উপরে ঝাপিয়ে পড়ল।

কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি ডাঃ ওয়াংয়ের শরীরে। তাছাড়া জায়গাটা অপরিসর—দুজনে জড়াজড়ি করে কেবিনের মধ্যে গিয়ে পড়ল।

রাজুও কিরীটীর সাহায্যে এগিয়ে এল।

এদিকে আরেক বিপত্তি। জাহাজটা যেন একপাশে কাত হয়ে পড়তে শুরু করে, আর কেবিনের আলোটা হঠাৎ দপ করে নিভে গেল কিসের একটা শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

অন্ধকার। নিকষ আলো অন্ধকার। কিছু চোখে পড়ে না।

তারই মধ্যে কিরীটী লোকটাকে নিয়ে জাপটাজাপটি করছে-জাহাজটা আরও একটু যেন কাত হয়ে পড়েছে ততক্ষণে।

একটা কিসের আঁঝাল গন্ধ নাকে আসছে। মিষ্টি কিন্তু ঝাঁঝাল–

কিরীটী তাড়াতাড়ি অন্ধকারেই লোকটাকে ছেড়ে তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, রাজু-মিঃ রামিয়া-quick! কেবিনের মধ্যে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে যাচ্ছে–কেবিন থেকে বের হয়ে যান—যান–

কিরীটী ছুটে কেবিনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। রাজুও। অন্ধকারে কিরীটী দেখতে পেল না মিঃ রামিয়া কেবিন থেকে বের হয়ে এসেছেন কিনা। কিরীটী ডাকে, রাজু-রাজু।

এই যে আমি-পাশ থেকে বলে রাজু!

দরজাটা কেবিনের তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেয়—গ্যাস ততক্ষণে বাইরের প্যাসেজেও আসতে শুরু করেছে।

শীগগির চল–ডেকে চল।

দুড়দাড় করে ওরা সিঁড়ি বেয়ে উপরের ডেকে চলে আসে।

সমুদ্রের হাওয়া এসে ওদের চোখেমুখে ঝাপটা মারে, আর ওরা প্রাণভরে শুদ্ধ হাওয়া টানতে টানতে হাঁপায়।

মিঃ রামিয়া-রামিয়া কোথায়? কিরীটী বললে?

মিঃ রামিয়া বোধ হয় মনে হচ্ছে কেবিন থেকে বেরুতে পারেননি।

প্রায় আধঘণ্টা পরে উপরের দিকে উঠে এসে গ্যাসটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। জাহাজ থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। সৈন্যরা সম্পূর্ণ জাহাজটা অধিকার করেছে। ইঞ্জিনের ঘর তারা আগেই দখল করেছিল।

মুখের রুমাল দুভাঁজ করে বেঁধে কিরীটী আর রাজু নীচে নেমে এল-হাতে টর্চ-টর্চের আলো ফেলে ফেলে।

প্যাসেজে ঝাঁজালো মিষ্টি গন্ধটা আর নেই।

কেবিনের খোলা দরজাপথে ওরা ভিতরে প্রবেশ করল-মিঃ রামিয়ার মৃতদেহটা ঠিক কেবিনের দরজার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে—আর চেয়ারের উপর উপবিষ্ট বদ্ধ অবস্থায় মিঃ চিদাম্বরণ ও মিঃ ডিবরাজ-দুজনেই মৃত।

তাঁদের মাথা বুকের উপর ঝুলছে। কিন্তু আর কোন দেহ দেখা গেল না।

All of them are dead, রাজু! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। কেবিনের চারপাশে আর একবার নজর করল, কিন্তু ডাঃ ওয়াং-ডাঃ ওয়াং কোথায়? He must be livingwe must find him out! এই জাহাজের মধ্যেই সে আছে কোথায়। নিশ্চয়ই পালাতে পারেনি। চল খুঁজে দেখি–

প্যাসেজ ধরে একটু এগুতেই আর একটা কেবিন চোখে পড়ল। ভিতরে অত্যন্ত মৃদু আলো জ্বলছে-ঐ কেবিনের দরজাটাও কাঁচের।

কাঁচের ভিতর দিয়ে কিরীটী ভিতরে দৃষ্টিপাত করল।

আলো বলে কিরীটী যেটাকে মনে করেছিল দেখলো সেটা আলো নয়—কেবিনের মধ্যে একটা কাঁচের পার্টিশান। তারই অপরদিকে সারা দেওয়াল থেকে ম্লান একটা আলোর জ্যোতি যেন ঠিক পড়ছে

আর-আর দীর্ঘকায় কালো আলখাল্লা পরিহিত সেই ব্যক্তি, যার সঙ্গে তার মল্লযুদ্ধ হয়েছিল-একটা চেয়ারে বসে–

কিরীটী সামান্য চেষ্টা করতেই কেবিনের কাঁচের দরজাটা খুলে গেল—দুজনে ভিতরে প্রবেশ করল।

সঙ্গে সঙ্গে কালো আলখাল্লা পরিহিত লোকটা মুখ তুলে তাকাল। মুখে একটা পাতলা রবারের মুখোশ আঁটা। পরিষ্কার ইংরাজীতে বললে, এস মিঃ কিরীটী রায়, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, একসঙ্গেই মরব বলে সবাই মৃত্যু-আসর পেতেছি। এই জাহাজটা ধীরে ধীরে জলের তলায় এবার তলিয়ে যাবে, তোমাদের সকলকে নিয়ে আর আমার মৃতদেহটা নিয়ে। কারণ আমি আমার শরীরে বিষ ইনজেকশন দিয়েছি, আর বিশ মিনিটের মধ্যেই আমার মৃত্যু হবে। ওদিকে চেয়ে দেখছ কি, ওপাশের দেওয়ালে রয়েছে ভাস্বর ছত্রাক–এ তারই আলো। নিজে কালচার করে আমি ঐ Empera ছত্রাকের জন্ম দিয়েছি- কেমন করে কালচার করেছি জান? মরা মাছির গায়ে একরকম সাদা বস্তু জড়িয়ে থাকে, তারই ডিম্বকোষের কালচার থেকে ঐ ভাস্বর ছত্রাকের জন্ম।

কিরীটী অবাক বিস্ময়ে শুনছিল ডাঃ ওয়াংয়ের কথা।

ডাঃ ওয়াংয়ের গলা আবার শোনা গেল, বাঁদিককার দেওয়ালে দেখ। ওগুলোও ছত্রাক, নীলবর্ণের অ্যামেনেশিয়া জাতীয় ছত্রাক-ওর এদিকে আর একটা চেম্বার আছে-বেশীমাত্রায় অক্সিজেনে ভরা চেম্বারটা, সেই অক্সিজেনের সাহায্যেই ঐ ছত্রাক কোটি কোটি সংখ্যায় জন্ম নেয়, আমার তৈরী সবুজ তরল মৃত্যু-বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস—তার পরিচয় তো পেয়েছ ডিবরাজের বাড়িতে। আমার রক্তলোভী লাল মাকড়সা-যার দংশনে সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত মৃত্যু-তারও পরিচয় পেয়েছ, Scolopindra গ্রুপের—

শেষের দিকে ক্রমশঃ গলার স্বরটা যেন নিজে অস্পষ্ট হয়ে আসছিল ডাঃ ওয়াংয়ের।

ওরা দুজনে মন্ত্রমুগ্ধের মত ডাঃ ওয়াংয়ের কথাগুলো শুনছিল—হঠাৎ পায়ের তলায় জলের স্পর্শ পেতেই ওরা চমকে উঠল।

রাজু, জল ঢুকতে শুরু করেছে জাহাজে! জাহাজ ড়ুবছে! চল, চল। দুজনে ছুটে কেবিন থেকে বের হয়ে এল।

হু-হু করে জল উঠছে। জল প্রায় একহাঁটু হয়ে যায়। কোনমতে ওরা দৌড়ে গিয়ে সিঁড়িতে ওঠে—তারপর ছুটে ডেকে।

গান-বোটের উপর দাঁড়িয়ে কিরীটী, রাজু আর গান-বোটের কমাণ্ডার বালকৃষ্ণ। ভোরের আলোয় চারিদিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

দিগন্তবিস্তৃত নীল সাগর আথালিপাথালি করছে।

ওদের চোখের সামনে ডাঃ ওয়াংয়ের সাদা জাহাজটা ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলের তলে তলিয়ে যাচ্ছে।

ধীরে মাস্তুলটা ড়ুবে গেল ডাঃ ওয়াংয়ের সব রহস্য নিয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিরীটী বললে, বিরাট একটা প্রতিভার অপমৃত্যু!

ঐদিনই বিকেলের দিকে কিরীটী গেল ডিবরাজের গৃহে।

কৃষ্ণা আগেই তার পিতার মৃত্যুসংবাদটা পেয়েছিল।

বাইরের ঘরে একটা চেয়ারে কৃষ্ণা বসেছিল স্তব্ধ হয়ে।

পরনে একটা কালো রংয়ের শাড়ি।

মাথার কেশ অবিন্যস্ত।

দুটি চক্ষু অশ্রুতে ফোলা, পাশে দাঁড়িয়ে আয়া কুট্টি।

কৃষ্ণা!

কিরীটীর ডাকে কৃষ্ণা অশ্রুভেজা দুটি চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল।

পারলাম না কৃষ্ণা তোমার ড্যাডিকে বাঁচাতে!

কৃষ্ণা কোন কথা বলে না—কেবল দু-ফোটা অশ্রু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।

আরও দুদিন পরে।

মিঃ ডিবরাজের পারলারে দুজনে বসে মুখোমুখি—কিরীটী আর কৃষ্ণা।

কৃষ্ণা বললে, তুমি কবে ফিরে যাচ্ছ?

কালকের জাহাজে। তুমি কি এখানেই থাকবে কৃষ্ণা?

কিছুদিন তো থাকতেই হবে-ড্যাডির ব্যবসা, এখানকার ঘরবাড়ির একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে–

তা হবে।

ব্যবসা বন্ধ করে দেব।

কেন?

কে দেখবে—আমার তো কোন ভাই নেই!

সেই ভাল। এই বাড়িটা?

এটা বিক্রী করব না-ড্যাডির স্মৃতি এটার মধ্যে রয়েছে।

তারপর বোধ হয় বম্বেতেই ফিরে যাবে?

হ্যাঁ।

তুমি বম্বেতে পৌঁছে আমাকে একটা কে করো।

করব।

তারপরেই কিরীটী উঠে দাঁড়াল—একটু যেন ইতস্তত করল, তারপর কৃষ্ণার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাধে একটা হাত রেখে গভীর স্নেহে ডাকল, কৃষ্ণা!

কৃষ্ণা কোন কথা না বলে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে কিরীটীর হাতটা চেপে ধরল।

কৃষ্ণা!

বল?

একটা কথা বলব, যদি অনুমতি কর।

কৃষ্ণা ওর মুখের দিকে তাকাল!

বলতে সাহস হচ্ছে না—

কেন?

যদি তুমি না বলে দাও?

ও-কথা তোমার মনে হল কেন।

কৃষ্ণা-সত্যি-সত্যি বলছ?

কৃষ্ণা মাথাটা নীচু করল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত