সামনে সমুদ্র নীল

সামনে সমুদ্র নীল

সরিৎশেখর কল্পনাও করতে পারে নি, পুরীতে এসে হঠাৎ ঐ অবস্থায় তার আবার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

অবিশ্যি আবার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হবার একটা প্রত্যাশা সরিশেখরের অবচেতন মনের মধ্যে কোথাও যেন ছিল। এবং দেখা যে হবেই সে বিশ্বাসও ছিল সরিশেখরের। পথে চলতে চলতে কতদিন অন্যমনস্কভাবে এদিক ওদিক তাকিয়েছে সরিৎশেখর নিজের অজ্ঞাতেই। তার মনটা যেন কার প্রত্যাশায় সর্বক্ষণই প্রতীক্ষা করেছে। তাই বুঝি আজ পুরীতে এসে অনুরাধাকে দেখে ও থমকে দাঁড়িয়েছিল। সত্যি, এমনি আকস্মিকভাবে দীর্ঘ দুই বৎসর পরে যে আবার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে সরিৎশেখর ভাবতেও পারেনি।

জীবনের দু-দুটো বৎসর তো নেহাৎই একটা কিছু কম সময় নয়। অকস্মাৎ একদিন অনুরাধা সরিশেখরের জীবন থেকে সরে গিয়েছিল। এবং যাবার আগে বলে গিয়েছিল—আজও সরিশেখরের অনুরাধার সে কথাগুলো মনে আছে—ভোলেনি ভুলতে পারেনি সরিৎশেখর।

ভেবে দেখলাম সরিৎ–

তখনও জানে না, কল্পনাও করতে পারেনি সরিৎশেখর কি বলতে চায় অনুরাধা তাকে!

সকাল থেকেই শরীরটা ভাল ছিল না বলে সরিৎশেখর কলেজে পড়াতে যায়নি। ডিকেন্সের একটা উপন্যাস নিয়ে শয্যায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিল। বাইরে সেদিন যেন বাতাসে একটা অগ্নির জ্বালা। একটি মাত্র জানালা খোেলা ঘরের, হঠাৎ অনুরাধা ঘরে ঢুকল।

সরিৎ!

এ কি, তুমি এই প্রচণ্ড গরমে দুপুরে?

শ্যা, কলেজেই গিয়েছিলাম তোমার, গিয়ে শুনলাম তুমি কলেজে যাওনি, তাই সোজা অফিস থেকে এখানেই চলে এলাম।

মনে হচ্ছে খুব জরুরী প্রয়োজন। তা দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বোস রাধা।

ঐ নামেই ডাকত সরিৎ অনুরাধাকে পরিচয় হবার কিছুদিন পর থেকে।

ভেবে দেখলাম—মানে—অনুরাধা যেন কেমন একটু ইতস্তত করতে থাকে।

যে তাগিদে কথাটা বলবার জন্য সরিতের কলেজ পর্যন্ত ছুটে গিয়ে সেখানে তাকে না পেয়ে এখানে এসেছে—সে তাগিদটা যেন আর অনুভব করছে না অনুরাধা।

মনের মধ্যে কি কোন দ্বন্দ্ব ছিল তার তখনও!

হয়ত ছিল। অনেকবার কথাটা মনে হয়েছে গত এই দুই বৎসরে সরিশেখরের—মনে হয়েছে সেদিন যে কথাগুলো বলেছিল তাকে অনুরাধা, তার জন্য কোন স্থির পূর্ব-সংকল্প ছিল না।

যা বলেছিল সে সেদিন, সেটাই তার সেদিনকার হয়ত শেষ কথা ছিল না।

অনুরাধা কিন্তু বসল না। একটু থেকে আবার বললে, ভেবে দেখলাম সরিৎ–

কি ব্যাপার কি আবার ভেবে দেখলে? মৃদু হাসি সরিতের ওষ্ঠপ্রান্তে।

তোমার আমার সম্পর্কের এইখানেই শেষ হয়ে যাওয়া ভাল।

কথাটা শুনেই সরিৎশেখর শয্যার উপর উঠে বসে, কয়েকটা মুহূর্ত অনুরাধার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুরাধা তখনও বসেনি, দাঁড়িয়েই আছে।

আজও মনে আছে স্পষ্ট সেদিনের অনুরাধার চেহারাটা, পরনে তার সবুজ-পাড় একটা দামী তাঁতের শাড়ি, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা গায়ের ব্লাউজ, মাথার চুলগুলো আলগা ভাবে একটা

খোঁপা করা। খোঁপাটা কাঁধের ওপর ভেঙে পড়েছে, ডান হাতটা খালি, বাঁ হাতে ছোট একটা রিস্টওয়াচ—চোখে সরু সোনালী দামী ফ্রেমের চশমা, পায়ে চপ্পল।

সরিৎশেখর চুপ করেই ছিল, অনুরাধা আবার বলল, ভেবেছিলাম একবার একটা চিঠি লিখে তোমাকে কথাটা জানিয়ে দেব, কিন্তু পরে মনে হল আমার, যা বলবার সামনাসামনিই তোমাকে জানিয়ে দেওয়া ভাল। আমি চললাম

এটুকু বলবার জন্যই কি এতটা পথ এই দুপুর রোদে ছুটে এসেছ?

তাই।

আর কিছুই তোমার বলবার নেই রাধা?

না।

কেন এভাবে এতদিনকার সম্পর্কটা শেষ করে দিয়ে যাচ্ছ, তাও বলবে না?

কোন প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন নেই?

না। কারণ তুমি তো সবই জান। জানা কথাটা নতুন করে আবার আমারই বা বলবার কি আছে, আর তোমারই বা শোনবার কি আছে বল।

কিন্তু বিশ্বাস কর—

থাক, মিথ্যা কতকগুলো কথা আর নাই বা বললে বানিয়ে বানিয়ে–

ঐ শেষ কথা অনুরাধার। আর সে দাঁড়ায়নি। ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর দীর্ঘ দুই বৎসর পরে আজ অকস্মাৎ পুরীর সমুদ্রতটে অনুরাধার মুখমুখি সে।

সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা হবে তখন।

হোটল থেকে বের হয়ে সরিৎশেখর সমুদ্রের দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ কানে এল তার একটা হাসির উচ্ছ্বাস, অনেক দিনের অনেক পরিচিত সেই হাসি, যে হাসি আজও ভোলেনি। তার কানের পর্দায় এসে ঝঙ্কার তুলতেই সে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সামনের দিকে তাকিয়েছিল।

পরনে সুইমিং কস্টিউম, একটা বিরাট টাওয়েল গায়ে জড়ানস্নান সেরে বালুর ঢালু পাড় ধরে অনুরাধা ও বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বা তারও হয়ত কিছু বেশীই বয়সের এক ব্যক্তি উপরের দিকে উঠে আসছিল সমুদ্রের জল থেকে। একেবারে মুখখামুখি—মাত্র কয়েক হাত ব্যবধান। অনুরাধার দৃষ্টি কিন্তু সামনের দিকে নয়, অন্য দিকে প্রসারিত।

সরিশেখরের অজ্ঞাতেই তার কণ্ঠ হতে বের হয়ে এসেছিল নামটা, অনুরাধা।

অনুরাধাও সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়েছিল, উচ্চারিত ডাকটা তার কানে যেতেই বোধ হয় সরিতের দিকে তাকিয়েছিল।

অনুরাধা! সরিতের অস্ফুট কণ্ঠস্বর। সরিৎ! অনুরাধার কণ্ঠেও বিস্ময়।

অনুরাধার সঙ্গী লোকটি সেই সময় সামনের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে সরিশেখরের মনে হয়, অনুরাধার সঙ্গীর সঙ্গে তার পরিচয় না থাকলেও, ভদ্রলোককে সে যেন ইতিপূর্বে দেখেছে। কোথায় দেখেছে অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে না সরিশেখরের, তবে তাকে পূর্বে দেখেছে।

অনুরাধা কিন্তু অতঃপর সরিশেখরের দিকে এগিয়েও আসে না বা তার সঙ্গে আর কোন কথাও বলে না।

সরিৎশেখরও সে চেষ্টা করে না। সরিৎশেখর অন্য পথ ধরে ধীরে ধীরে বালুবেলায় নেমে যায়। সমুদ্রে তখন অনেক জ্ঞানার্থীর ভিড়। নানা বয়েসী নারী পুরুষ সমুদ্রের জল তোলপাড় করছে। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউগুলো এসে বালুবেলায় একটার পর একটা অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে একটানা গর্জন তুলে।

সরিৎশেখর পাড়ের দিকে তাকাল—একটু আগে যেখান দিয়ে অনুরাধা ও সেই ভদ্রলোক হাত ধরাধরি করে চলে গেল তার দৃষ্টির সামনে দিয়েই।

সরিৎশেখর দেখল যে হোটেলে সে উঠেছে, ওরা সেই হোটেলেই গিয়ে ঢুকল। তাহলে অনুরাধা সে যে হোটেলে উঠেছে সেই হোটেলেই উঠেছে।

আজই সকালে পুরী এক্সপ্রেসে সরিৎশেখর পুরী এসে পৌঁছেছে। হোটেলে পৌঁছেই বের হয়ে পড়েছিল। সমুদ্রের জলে স্নান করার চাইতে ধীরে ধীরে ভেজা বালুর উপর দিয়ে হাঁটতে তার অনেক ভাল লাগে।

দীর্ঘ দুই বৎসর পরে আবার অনুরাধাকে দেখল সরিৎশেখর। হ্যাঁ, মনে মনে হিসাব করে সরিৎশেখর ঠিক দুই বৎসর পরই, সময়টা, না ভোলার কথা নয়, জীবনের একটা পরিচ্ছেদে অকস্মাৎ যেখানে দাঁড়ি পড়েছিল—সে সময়টা কি কেউ ভুলতে পারে!

সরিৎশেখরও পারে নি। সরিৎ ভেবেছিল, অনুরাধা নিশ্চয়ই কলকাতায় নেই। নচেৎ পথে কখনও না কখনও নিশ্চয়ই দেখা হত, বিশেষ করে কলেজে যাতায়াতের পথে। ঠিক ভেবেছিল নয়, মনে হয়েছিল বুঝি তার, অনুরাধা হয়ত কলকাতায় নেই। কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও হয়ত সে চলে গিয়েছে। কাউকে বিবাহ করে হয়ত সংসারও পেতেছে। অনুরাধা এখন অন্যের। তাছাড়া কলকাতায় থাকলে কখনও না কখনও নিশ্চয়ই তাদের একের সঙ্গে অন্যের দেখা হতই বিশেষ করে কলেজে যাতায়াতের পথে। কারণ ঐ পথ দিয়েই অনুরাধাও কলেজে যেত এবং প্রথম আলাপ তাদের ঐ পথ ধরে যেতে যেতেই এক হঠাৎ আসা দুর্যোগের মধ্যে।

তার আগেও অবিশ্যি সরিৎ দেখেছে অনুরাধাকে ঐ পথ ধরে যাতায়াত করতে। প্রথম আলাপের সেই দিনটাসময়টা জুলাইয়ের শেষাশেষি, কলকাতা শহরে বর্ষা নেমে গিয়েছে। যখন তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে আকাশ কালো করে। কখনও বা কম সময়, কখনও বা বেশি। সময় ধরে চলে সে বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে সরিৎ কখনও বড় একটা বের হত না, কারণ বেরুবার সময় ছাতার কথাটা তার মনেই পড়ত না। কিন্তু সেদিন ছাতা নিয়েই সরিৎ বের হয়েছিল। আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টির সম্ভাবনাও ছিল, বোধ করি সেই আশঙ্কাতেই। মাত্র দুটো ক্লাস ছিল সরিতের সেদিন। বেলা তিনটের মধ্যে কলেজ থেকে সে বের হয়ে পড়েছিল। গড়িয়াহাটার মোড়ে বাস থেকে নেমে ও লেকের দিকে হাঁটছিল রজনী সেন স্ট্রীটে তার বাড়ি। প্রচণ্ড গরম সেদিন। আকাশে, কেমন যেন একটা থমথমে মেঘলা-মেঘলা ভাব। বৃষ্টি যে কোন মুহূর্তেই নামতে পারে। রাস্তায় বড় একটা তেমন লোকজন নেই। দোকানপাট অবিশ্যি খোলা, মধ্যে মধ্যে বাস-প্রাইভেটকারগুলো এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ প্রবল ধারায় বৃষ্টি নামল। হাতে ছাতা থাকা সত্ত্বেও সরিৎ ছাতাটা খুলবার সময় পায় না, ভিজেই যায়। তাড়াতাড়ি একটা দোকানের মধ্যে উঠে পড়ে। কারণ ও বুঝেছিল, ছাতা দিয়ে ঐ বৃষ্টির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। তার পিছনে পিছনে অনুরাধাও উঠে পড়েছিল। ছাতা সঙ্গে ছিল না তার। একটা মোটা বই ও একটা মলাট দেওয়া খাতা হাতে। চোখে সরু সৌখীন সোনালী ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচে জলের ছিটে লেগে আছে।

দুজনের চোখাচোখি হতেই অনুরাধা মৃদু সলজ্জ হাসি হাসল। সরিৎশেখরের ওষ্ঠপ্রান্তেও হাসি জাগে। অনুরাধা চশমাটা চোখ থেকে খুলে শাড়ির আঁচলে কাচটা মুছতে থাকে।– আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে তখন। সরিৎশেখর ও অনুরাধা সেদিন তখন কেউ কারও নাম জানে না। জলের প্রবল ছাটে দুজনেই ভিজে যাচ্ছিল। আর একটু দোকানের ভিতরে ঢুকে গেল তারা। বৃষ্টি ধরবার নামগন্ধ নেই।

আপনাকে প্রায়ই দেখি এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতে সরিৎশেখরই প্রথমে কথা বললে।

অনুরাধা বললে, আপনাকেও দেখি আমি। আপনি বুঝি কাছেই থাকেন?

সরিৎশেখর বললে, রজনী সেন স্ট্রীটে–

ও মা, তাই নাকি! আমিও তো ঐ রাস্তাতেই থাকি। অনুরাধা বললে, আপনার বাড়ির কত নম্বর বলুন তো?

সরিৎ যে বাড়ির নম্বরটা বললে, তার পাঁচটা নম্বর পরের বাড়িতেই থাকত অনুরাধা। তার বাড়ি পাঁচটা নম্বর পরে হলেও, মাঝপথে একটা ছোট গলির বাঁক আছে। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িটা দেখা যায় না অবিশ্যি।

অনুরাধা আবার বললে, এ পথে যাতায়াতের সময় ছাড়াও আপনাকে আমি আর একটা বাড়িতে দেখেছি

কোথায় বলুন তো? সরিৎ শুধাল।

কেতকীদের বাড়িতে, ডোভার লেনে।

বুঝেছি—আমার পিসিমার বাড়ি। কেতকী আমার পিসতুতো বোন।

সেদিন কেতকীর জন্মদিন ছিল, অনুরাধা বললে, আমিও গেছিলাম। আপনার হাতে ছিল একটা বইয়ের প্যাকেট ও একগোছা রজনীগন্ধা।

রজনীগন্ধা কেতকীর ছিল খুব প্রিয় ফুল।

জানেন আমিও সেদিন রজনীগন্ধা নিয়ে গিয়েছিলাম। অনুরাধা বলল।

দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে হাসল।

বৃষ্টি থামার কিন্তু কোন লক্ষণই নেই। পথে বেশ জল জমেছে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অনুরাধাই প্রথম উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললে, তাই তো বাড়ি যাব কি করে বুঝতে পারছি না রাস্তায় তো দেখছি এক হাঁটু জল জমে গেল।

জল ভেঙে যাবেন কি করে, এখান থেকে বেশ কিছুটা পথ–সরিৎশেখর বললে।

বুঝতে পারছি না ঠিক কি করব। চিন্তিতভাবে অনুরাধা বললে।

সেদিন শেষ পর্যন্ত একটা রিকশা ডেকেই দুজনে উঠে বসেছিল। সরিৎ প্রথমে রিকশায় উঠতে চায়নি, কিন্তু অনুরাধা তার কোন কথা শোনেনি। সেই আলাপ এবং সেই দিনই ওরা জানতে পারে পরস্পরের নাম।

ডঃ সরিৎশেখর সেন। কলেজের প্রফেসার। ইকনমিক্সের। আর অনুরাধা সোম ডিগ্রী কোর্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। অনুরাধার সাবজেক্টও ছিল ইকনমিক্স।

তারপর থেকে দুজনার দেখা হলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পথের মধ্যে বা পথ চলতে চলতেই কথা চলত। কলেজে যাতায়াতের পথেই বেশীর ভাগ।

সেই আলাপই ক্রমশ উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এনে দিয়েছিল।

তারপর অনুরাধা বি. এ. পাস করে একটা অফিসে চাকরি পেয়ে গেল যেন হঠাৎই।

অনুরাধার চাকরির প্রয়োজন ছিল সত্যিই একটা। বিধবা মা, ছোট একটি বোন ও সে নিজে, তিনজনের সংসার। রজনী সেন স্ট্রীটের বাড়িটা ছিল দোতলা, উপরে নীচে খানচারেক মাত্র ঘর, অবিশ্যি রান্নাঘর ও বাথরুম আলাদা। অনুরাধার বাবা দ্বিজেন সোম চাকরি করতে করতে হঠাৎ পঙ্গু হয়ে পড়েন একটা অ্যাক্সিডেন্টে। কমপেনসেশান ও প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে যা পেয়েছিলেন রজনী সেন স্ট্রীটের ঐ বাড়িটি তাই দিয়ে তৈরি করেছিলেন। অনুরাধার বয়স তখন সতেরো। সবে কলেজে ঢুকছে। দ্বিজেন সোম মারা গেলেন।

অনুরাধার মা বাড়ির দোতলাটা ভাড়া দিতে কতকটা বাধ্য হলেন। হাতে সামান্য যা অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়েই সংসার চলতে লাগল, আর অনুরাধার কলেজের পড়া ও ছোট বোন মধুছন্দার স্কুলে পড়া। কিন্তু সঞ্চিত অর্থ তখন প্রায় শেষ। কাজেই পাস করার পর অনুরাধার একটা চাকরির প্রয়োজন ছিল।

পাস করার পরই চাকরি পাওয়া এত সহজ নয় আর পাবেও না হয়ত জেনেও, অনুরাধা একটার পর একটা চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক বিরাট ফার্মের অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার মিঃ সলিল দত্ত মজুমদারের কাছে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েই চাকরি হয়ে গেল তার। অনুরাধার খুশির অন্ত ছিল না সেদিন।

সংবাদটা এসে সেইদিনই সন্ধ্যার পর সরিৎশেখরকে সে দিয়েছিল।

সরিৎ, একটা surprise দেব তোমাকে।

সারপ্রাইজ?

হ্যাঁ–বল তো কি হতে পারে?

কেমন করে বলব—আমি তো আর গণৎকার নই!

তবু গেস্ কর—

তার চাইতে তুমিই বল রাধা।

পারলে না তো?

না।

জান আমার একটা চাকরি হয়ে গেছে আজ—

চাকরি! কোথায় চাকরি পেলে? কি চাকরি রাধা?

একটা মস্ত অফিসেজান, মাইনে আড়াইশো টাকা, আর মিঃ দত্ত মজুমদার বলেছেন, শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিংটা শিখে নিতে পারলে আরও বেশী মাইনে পাব—পারব না শিখে নিতে শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিংটা?

কেন পারবে না!

জান সরিৎ, ইন্টারভিউতে আমাকে কিছুই তেমন জিজ্ঞাসা করেননি মিঃ দত্ত মজুমদার। কেবল আমার বাড়িতে কে কে আছে-বাবা বারা গেছেন এবং আর্নিং মেম্বার আর ফ্যামিলিতে কেউ নেই শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিলেন। সত্যি ভদ্রলোক ভারি ভাল।

সরিৎশেখর চুপ করে ছিল।

ঐ চাকরিটা পাবারই মাস চারেক বাদে, হঠাৎ দ্বিপ্রহরে সরিতের বাড়িতে এসে পরস্পরের মধ্যে সমস্ত সম্পর্কের ছেদ করে দিয়ে গিয়েছিল অনুরাধা।

ভিজে বালির ওপর দিয়ে সাগরের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঐসব কথাই মনে পড়ছিল আজ সরিশেখরের। গত দুই বৎসরের মধ্যে আর তার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হয়নি কখনও। দুই। বৎসর পরে আজ আবার সাক্ষাৎ হল।

অনুরাধার সঙ্গের ভদ্রলোকটি কেকথাটা সরিতের মনের মধ্যে তখন আনাগোনা করছে। . বেশ মোটাসোটা ভারিক্কী চেহারা। ভদ্রলোকটির পরনেও ছিল সুইমিং কস্টিউম, গায়ে জড়ানো ছিল একটা বড় টাওয়েল। স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে অনেকটা হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক ভাবে চলে গিয়েছিল সরিৎশেখর। . হঠাৎ যেন তার মনে হল, মাথার উপরে রোদটা বড় চড়া। পায়ের নীচে বালিও গরম হয়ে। উঠছে। সরিৎশেখর ফিরল আবার হোটেলের দিকে।

দোতলায় একেবারে সমুদ্রের মুখখামুখি একটা ঘর নিয়েছে সরিৎশেখর। ১৮নং ঘর। ঘরটি একেবারে শেষপ্রান্তে। দোতলা সর্বসমেত চারটি ঘর ১৫, ১৬, ১৭, ও ১৮ নম্বর।

ঘরের চাবি খুলে ঢুকতে যাবে, ১৬নং ঘর থেকে বের হয়ে এল অনুরাধা। আবার দুজনে। চোখাচোখি। সরিৎশেখর থমকে দাঁড়ায় নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয়।

একবার সরিৎ ভাবল ডাকে অনুরাধাকে, কি ভেবে ডাকল না, ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দরজাটা কিন্তু খোলাই রইল।

জানালার সামনে এসে দাঁড়াল সরিৎশেখর।

হু হু করে খোলা জানালাপথে হাওয়া আসছে।

সরিৎ!

ফিরে তাকাল সে ডাকে সরিৎশেখর। দরজার উপরে দাঁড়িয়ে অনুরাধা। পরনে একটা হালকা সবুজ রঙের মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ি।

কি, আমাকে চিনতে পারছ না? অনুরাধা বললে।

চিনব না কেন—

তাহলে ভিতরে আসতে তোকই একবারও বললে না!

বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম। সরিৎশেখর বললে।

কেন? বললে অনুরাধা।

সেটাই কি স্বাভাবিক নয় অনুরাধা?

অনুরাধা অন্য কথা বললে, এভাবে এই হোটেলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে—আমি প্রায়ই তো পুরীতে আসি, আর এই হোটেলের এই ঘরটিতেই উঠি

তাই নাকি! যাক সে কথা, তা তুমি পুরীতে বেড়াতে এসেছ বুঝি?

হ্যাঁ!

তারপরই অনুরাধা হঠাৎ প্রশ্ন করল, আজ জুলাই মাসের কত তারিখ জান?

জানি-২৯শে জুলাই।

সেদিন কলকাতায় সেই বৃষ্টির সন্ধ্যায়—সেই তারিখটাও ছিল ২৯শে জুলাই।

সেদিন বুঝি ২৯শে জুলাই ছিল? সরিৎশেখর প্রশ্ন করল।

অনুরাধা রললে, হ্যাঁ। আচ্ছা, আজও যদি সেদিনকারও মত বৃষ্টি নামে।

তাতে কি হবে?

না, তাই বলছিলাম, যদি বৃষ্টি নামে—

তা দাঁড়িয়ে কেন অনুরাধাবসো না। সরিৎশেখর বললে।

ঐ সময় দরজার বাইরে থেকে একটি মোটা গম্ভীর পুরুষের গলা শোনা গেল, অনুরাধা।

তোমাকে ডাকছে যেন কে–সরিৎশেখর বললে।

অনুরাধা কোন জবাব দিল না। আবার ডাক শোনা গেল, অনুরাধা।

কি?

শুনে যাও। গলার স্বর রুক্ষ। সামান্য অসন্তোষও বুঝি প্রকাশ পায় সে কণ্ঠস্বরে।

আমি ঘরের মধ্যে আছি, ঘরে এস। অনুরাধা বললে।

সকালের সেই সমুদ্রের ধারে দেখা ভদ্রলোকটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সরিৎশেখরের দিকে না তাকিয়েই বললেন, বেড়াতে যাবে না?

না, তুমি যাও—অনুরাধা বললে।

সরিৎশেখর আড়চোখে দেখল, ভদ্রলোকের পরনে টেরিটের প্যান্ট, দামী টেরিলিনের হাওয়াই শার্ট গায়ে।

তুমি যাবে না?

না, বললাম তো তুমি যাও—

অকস্মাৎ যেন ভদ্রলোকের চোখের মণি দুটো ধক্ করে জ্বলে ওঠে। মুহূর্তকাল অনুরাধার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক সরিশেখরের দিকে তাকালেন এবং বললেন, এঁকে তো চিনলাম না।

চিনবে না তুমি, ওঁর নামটা তোমার জানা থাকলেও, কখনও ওঁকে তুমি দেখনি। জবাব দিল অনুরাধা।

তা আগে পরিচয় ছিল বুঝি?

অনেক দিনের পরিচিত—

তা তো বুঝতেই পারছি।

তবে ওঁকে না দেখলেও ইতিপূর্বে ওঁর নামটা তোমার ভাল করেই জানা—

তাই বুঝি!

হ্যাঁ, যার কথা তুমি দিনের পর দিন বলতে—যাঁর সম্পর্কে তোমার কৌতূহলের অন্ত ছিল। না–যাক, পরিচয় করিয়ে দিই, উনিই ডঃ সরিৎশেখর সেন—

অ—

আর সরিৎ, ইনিই—

বুঝতে পারছি মিঃ সলিল দত্ত মজুমদার।

সত্যিই তুমি বেড়াতে যাবে না?

না, বললাম তো—

যাবে না?

না, যাব না। অনুরাধার কণ্ঠস্বর দৃঢ়।

সরিৎ কেমন যেন বিব্রত বোধ করে। বলে, যাও অনুরাধা—

কি, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, তুমি যাও—অনুরাধা আবার বললে ভদ্রলোককে।

তাহলে তুমি যাবে না অনুরাধা-সলিল দত্তর কণ্ঠস্বর যেন একটা চাপা আক্রোশে ফেটে পড়ল।

বললাম তো যাব না।

অনুরাধা যাও না–সরিৎ বললে। সরিৎ সত্যিই যেন কেমন বিব্রত বোধ করছিল। আশ্চর্য, কেন অনুরাধা যেতে চাইছে না?

না, যাব না-অনুরাধা আবার বললে, তার গলার স্বরে দৃঢ়তা ফুটে ওঠে।

ঠিক আছে, আমিও জানি তোমার মত বেহায়া বজ্জাত মেয়েছেলেকে কি করে শায়েস্তা করতে হয়। কথাগুলো বলে সলিল দত্ত মজুমদার আর দাঁড়ালেন না, ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। অকস্মাৎ ঘরের আবহাওয়াটাই যেন কেমন ভারী হয়ে গেল। সরিৎশেখর আরও বেশী বিব্রত বোধ করে। কি বলবে যেন বুঝে উঠতে পারে না। বিব্রত স্বরে বলে, তুমি গেলেই পারতে অনুরাধা।

না। কিন্তু তুমি এখনও ওই লোকটার কথা ভাবছ? যেতে দাও—ব্যাপারটাকে যেন উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে অনুরাধা। সমস্ত পরিস্থিতিটাকে সহজ করে তুলবার চেষ্টা করে। অনুরাধার হাবেভাবে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি।

ভদ্রলোক মনে হল, অত্যন্ত চটে গিয়েছেন অনুরাধা।

কাকে ভদ্রলোক বলছ সরিৎ। ঐ অভদ্র আনকালচার্ড একটা ব্রুটকে! ভদ্রভাবে কথা পর্যন্ত বলতে জানে না!

কিন্তু উনিই—

আমাদের অফিসের জি. এম.—

উনিই একদিন ইন্টারভিউ নিয়ে তোমাকে চাকরি দিয়েছিলেন না? সরিৎ বললে।

হ্যাঁ তাই, তবে তার জন্য আমাকে পরবর্তীকালে যে মূল্য দিতে হয়েছিল—

মূল্য—

যাক সে কথা। চল, সমুদ্রের ধারে যাব—

এই দুপুরে-রৌদ্রে—

তাহলে আমি একাই যাই—অনুরাধা দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

আরে শোন শোন, কোথায় যাচ্ছ এই প্রচণ্ড রৌদ্রে, বসো–

বসব না, আমি যাচ্ছি—অনুরাধা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সরিৎশেখর অতঃপর কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। একটা কথা কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তখন তার কাছে, ওদের পরস্পরের সম্পর্কটা যতই একসময় ঘনিষ্ঠ থাকুক, এখন তাতে চিড় ধরেছে।

সলিল দত্ত মজুমদার অনুরাধার অফিসের বস। এবং হয়তো ঐ ভদ্রলোকের ইচ্ছাতেই একসময় তার অফিসে অনুরাধার চাকরি হয়েছিল—সেও বৎসর দুইয়ের কিছু আগেই হবে। এবং চাকরি পাওয়ার পরই কয়েক মাসের মধ্যে যে কোন কারণেই হোক অনুরাধার মনটা তার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল। যে কারণে অকস্মাৎ একদিন অনুরাধা এসে তাদের সমস্ত সম্পর্কের ওপর একটা ইতি টেনে দিয়ে গিয়েছিল।

তারপর এই দুই বৎসর অনুরাধা তার কাছে আর আসেনি, সেও যায়নি অনুরাধার কাছে। বস্তুত সরিৎ অনুরাধার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টাও করেনি।

সে ভুলতেই চেয়েছিল অনুরাধাকে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে ভুলতে সে পারেনি অনুরাধাকে। কিন্তু কেন? কেন ভুলতে পারল না অনুরাধাকে?

জানালাপথে বাইরে দৃষ্টিপাত করল সরিৎশেখর। সমুদ্রের জল যেন প্রখর সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় শুভ্র ফেনার মালা। একটার পর একটা ঢেউ বালুবেলার উপরে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রে মানার্থীর ভিড় আর এখন তেমন নেই।

অনেক দূরে দেখা গেল, মাথায় ঘোমটা তুলে তীর ধরে হেঁটে চলেছে অনুরাধা, স্বর্গদ্বারের দিকে।

অনুরাধা।

কত কত দিন পরে সে আজ আবার অনুরাধাকে দেখল।

এ সেই অনুরাধা যে একসময় তার জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।

তার মনের রেখাগুলো হতে হাসিটি পর্যন্ত তার একান্ত পরিচিত।

একদিন যার সম্পর্কে তার মনে হত—তার জীবন থেকে অনুরাধাকে বাদ দিয়ে একটা দিনও চলতে পারে না।

একটা দিন যার সঙ্গে দেখা না হলে তার মনে হতকতকাল যেন অনুরাধাকে সে দেখে নি।

সরিৎশেখর জানালা পথে চেয়ে থাকে—অনুরাধা হেঁটে চলেছে স্বর্গদ্বারের দিকে।

একবার মনে হয় সরিৎশেখরের অনুরাধা এখনও বেশীদূর যায় নি—ওর পিছনে পিছনে গিয়ে ডেকে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

সরিৎশেখর দুপা এগিয়েও যায় দরজাটার দিকে, কিন্তু আবার থেমে যায়।

মনে পড়ল একটু আগে সলিল দত্ত মজুমদারের কথাগুলো। এবং সলিল দত্ত মজুমদারের কথা ভেবেই ইচ্ছাটাকে দমন করল। অনুরাধার সঙ্গে তাকে দেখলে সলিলের মেজাজটা হয়ত আবার বিগড়ে যাবে। কি প্রয়োজন তার ওদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে মাথা গলানোর। ও আজ সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি, একান্ত ভাবেই অনভিপ্রেত। কিন্তু যতই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাব না মনে করুক সরিৎশেখর, অনুরাধার চিন্তাটা যেন মন থেকে কিছুতেই দূর করতে পারে না। ঘুরে-ফিরে কেবলই যেন অনুরাধা তার সামনে এসে দাঁড়ায়।

ঐ সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে সম্পর্কটা কি অনুরাধার? যেভাবে সলিল দত্ত মজুমদার কথা বলছিল, তার মধ্যে একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার সুর স্পষ্ট ছিল। কি সে অধিকার? আর সেই অধিকার সলিল দত্ত মজুমদার কেমন করে অর্জন করল? একটার পর একটা সিগ্রেট পুড়তে থাকে।

দরজার ওদিকে পদশব্দ শোনা গেল আবার একসময়।

ভিতরে আসতে পারি?

গলার স্বর থেকে মানুষটাকে চিনতে সরিতের অসুবিধা হয় না, সলিল দত্ত মজুমদার। সরিৎ বললে, আসুন।

সলিল দত্ত মজুমদার এসে ঘরে ঢুকলেন। একবার ভাল করে তাকাল সরিৎ। ভদ্রলোকের দিকে—আটত্রিশ-উনচল্লিশ বৎসর বয়স মনে হয় ভদ্রলোকের। সামনের দিকে মাথায় বিস্তৃত টাক, পাশ থেকে চুল টেনে এনে সযত্নে ঢাকা দেওয়া হয়েছে। চোখে চশমা, দামী ফ্রেমের চশমা। সকালবেলার সেই পোশাকই পরিধানে।

বসুন মিঃ দত্ত, সরিৎ বললে। আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে এলাম ডঃ সেন আমাকে! কি কথা?

আমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে আপনার সঙ্গে আলাপ ছিল অনুরাধার জানতাম। এবং আপনাদের পরস্পরের মধ্যে যে রীতিমত একটা ঘনিষ্ঠতা একসময় হয়েছিল তাও আমার জানা।

কতটুকু আপনি জানেন বা শুনেছেন আমি জানি না সলিলবাবু, তবে এমন কিছু ছিল না যা মনে রাখার মত।

কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম, বেশ একটু—

সেসব অনেক দিন চুকেবুকে গিয়েছে, আপনি যা বলতে এসেছেন তাই বলুন—

জানেন কি, ও একটা জঘন্য চরিত্রের মেয়েমানুষ—

এই কথাটাই কি বলতে এসেছেন?

হ্যাঁ। আমি ঠকেছি বলেই আপনাকে সাবধান করে দিতে এলাম।

ধন্যবাদ।

আমার আর একটা কথা আপনার জানা বোধ হয় দরকার ডঃ সেন। ওকে আমি বিয়ে করেছি—She is my wife!

বিয়ে করলে তো উনি স্ত্রীই হবেন, তার মধ্যে নতুনত্বের কি আছে?

মনে হচ্ছে আপনি যেন আমার কথাটা বিশ্বাস করলেন না ডঃ সেন!

কেন–বিশ্বাস করব না কেন?

তাই বলছিলাম একদিন ওর সঙ্গে আপনার যে সম্পর্কই থাক, ও আজ পরস্ত্রী।

কথাটা কেন বলছেন বুঝতে পারলাম না–

পারবেন, একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন। আচ্ছা চলিসলিল দত্ত মজুমদার যেমন হঠাৎ ঘরে এসে ঢুকেছিলেন তেমনিই হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

হোটেলের ম্যানেজার-প্রোপ্রাইটার দেবেশ অধিকারীর সঙ্গে তার ঘরে বসে কিরীটীর কথা

হচ্ছিল।

কিরীটীর বয়স হয়েছে, মাথার চুলে পাক ধরেছে।

দেবেশ বলছিলেন, সত্যি বলতে কি এবারে কিন্তু আপনাকে দেখে প্রথমটায় ভাল চিনতে পারিনি।

কিরীটী হেসে বললে, কেন, বয়েস হলেও আমার চেহারাটা তো খুব একটা পালটায়নি!

তা প্রায় বছর পাঁচেক বাদে এখানে এলেন, তাই না? দেবেশ বললেন।

পাঁচ বছর! বোধ হয় ঐ রকমই হবে—

তা কটা দিন থাকছেন তো পুরীতে?

থাকব বলেই তো এসেছিলাম, কিন্তু ১৮নং ঘরটা তো কে একজন দখল করে আছে দেখছি

হ্যাঁ সরিৎবাবু এসেছেন। উনি এখানে প্রায়ই আসেন, আর এলে ঐ ১৮নং ঘরেই ওঠেন। অবিশ্যি আপনি আসছেন জানতে পারলে ঘরটা ওঁকে দিতাম না। ১৫নং ঘরটা খালি আছে—দুদিক খোলা, প্রচুর হাওয়া পাবেন। ঘরটা দেখবেন?

না, ও ঘরেই আমার ব্যবস্থা করুন।

তা করছি। নিশ্চয়ই কোন কাজে এসেছেন কিরীটীবাবু, তাই না?

না, সেরকম কিছু না। তবে একটা অনুরোধ, আমি যে এসেছি যেন জানাজানি হয়।

সে কি আর চাপা থাকবে?

যতটা চেপে রাখা যায়।

দেবেশ অধিকারী বললেন, তা বলছেন যখন আমি কাউকে বলব না। তবে আপনি যে কেবলমাত্র সমুদ্রের হাওয়া খেতেই আসেননি তা আমি জানি।

সে কথা যাক, কিরীটী বললে, দোতলায় বুঝি ঐ ১৫নং ঘরটাই খালি আছে?

না, ১৭নং ঘরটাও খালি আছে। তবে ঐ ঘরটা ভাড়া দেওয়া হয় না।

কেন?

ঐ ঘরে একবার এক ভদ্রলোক নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।

গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন!

হ্যাঁ।

আত্মহত্যার কারণটা জানা যায় নি?

না।

কিরীটী আর প্রশ্ন করল না।

দেবেশ বলতে লাগলেন, সেই থেকে রাত্রে প্রায়ই ঘরের মধ্যে নানা রকমের আওয়াজ নাকি শোনা যায়। মধ্যে মধ্যে ঘরের মধ্যে চেয়ারের উপর এক ছায়ামূর্তিকে বসে থাকতে দেখা যায়। পর পর দুবার ঐ ঘরে যারা এসে উঠেছিলেন তারা ভয় পেয়েছিলেন।

তাহলে এক কাজ করুন—ঐ ১৭নং ঘরটাই আমাকে দিন।

কিন্তু–

আপনি তো জানেন, ভূতের ভয় আমার নেই। যদিও ভূত আমি দু-একবার দেখেছি এবং আমি ভূত বিশ্বাসও করি।

ভূত বিশ্বাস করেন।

হ্যাঁ। আপনি ঐ ১৭নং ঘরেই আমার থাকবার ব্যবস্থা করুন। আচ্ছা ১৬নং ও ১৮নং ঘরে কারা আছেন?

বললামই তো, ১৮নং ঘরে আছেন অধ্যাপক ডঃ সেন, ব্যাচিলার মানুষ। আর ১৬নং ঘরে মিঃ দত্ত মজুমদার ও তার স্ত্রী এসে উঠেছেন। ইউনিভারসাল ইলেকট্রিক কোম্পানির কলকাতা অফিসের জি. এম.।

ইউনিভারসাল ইলেকট্রিক কোম্পানির জি. এম.!

হ্যাঁ।

ভদ্রলোকের বয়েস কত হবে বলুন তো?

উনচল্লিশ-চল্লিশ হবে হয়ত।

মাথার সামনের দিকে টাক আছে?

আছে—চেনেন নাকি ভদ্রলোককে মিঃ রায়!

না, ঠিক চিনি না।

তবে এত কথা বলছেন কি করে?

কিরীটী পকেট থেকে একটা খাম বের করে খাম থেকে একটা ফটো বের করে বললে, দেখুন তো দেবেশবাবু, এই ভদ্রলোক কি?

দেখি। হ্যাঁ এই তো দেবেশ বললেন।

আপনি–

দেবেশের কথা শেষ হল না, সলিল দত্ত মজুমদারকে দেখা গেল তার অফিস ঘরে ঢুকতে। দত্ত মজুমদার ঘরে ঢুকে সোজা দেবেশের দিকেই এগিয়ে গেলেন। পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটীর দিকে তাকালেনও না।

দেবেশ বললেন, কিছু বলছিলেন মিঃ দত্ত মজুমদার?

হ্যাঁ, আজ বিকেলের দিকে আমাকে একবার ভুবনেশ্বর যেতে হবে। ট্রেনে যাব না, একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা হতে পারে কি?

কেন হবে না। আমার জানাশোনা একটা ট্যাক্সি আছে, যদি ভাড়ায় না গিয়ে থাকে—এখুনি খবর পাঠাচ্ছি। তা কখন যেতে চান?

বেলা পাঁচটা নাগাদ বেরুব ভাবছি।

আপনার স্ত্রীও যাবেন তত আপনার সঙ্গে?

না, সে থাকবে। আমি তো আবার কালই ফিরে আসছি। আপনি তাহলে খবরটা পাঠান, আমি আমার ঘরেই আছি। দত্ত মজুমদার চলে গেলেন।

কিরীটী বললে, এই ভদ্রলোক?

হ্যাঁ–দেবেশ বললেন।

তাহলে দেবেশবাবু ১৭নং ঘরটা খুলে দেবার ব্যবস্থা করুন।

হোটেলের চাকর ও ঝিকে ডেকে পাঠালেন দেবেশ।

গোপী সামনে এসে দাঁড়াল।

গোপী, ১৭নং ঘরটা খুলে দাও—

কাঁই কি বাবু, কঁড় হব?

এই বাবু থাকবেন—

কথাটা শুনে মনে হল গোপী যেন বেশ একটু বিস্মিত হয়েছে। সে প্রথমে দেবেশের মুখের দিকে তাকাল, তারপর কিরীটীর মুখের দিকে এবং মৃদুকণ্ঠে বললে, সে বাবু ১৭নং কামরাতে

রহিব?

জবাব দিল কিরীটী, হ্যাঁ গোপী, ঐ ঘরেই আমি থাকব, ভূতের ভয় আমার নেই। তুমি ঘরটা পরিষ্কার করে দাও।

গোপী বললে, সে গত বছরে আগের বাবুরও ভূতের ভয় ছিল না বলে ঐ ঘরে। থেকেছিলেন, কিন্তু মাঝরাত্রে সিঁড়ির কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

ভয় নেই, তোমার গোপী, আমি অজ্ঞান হব না। তুমি ব্যবস্থা কর।

দেবেশ ঘরের চাবিটা গোপীর হাতে তুলে দিলেন।

গোপী যেন কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গেই চাবি নিয়ে চলে গেল।

আচ্ছা দেবেশবাবু, ১৭নং ঘরে যে আত্মহত্যার কথা একটু আগে বলছিলেন, সেটা কতদিন। আগেকার ব্যাপার?

তা বৎসর তিনেক হবে, ঠিক এমনি এক জুলাই মাসে। হোটেলের প্রত্যেকটি ঘরে যাত্রীসে যে কী হুজ্জত কিরীটীবাবু, ভদ্রলোক আত্মহত্যা করলেন, তারপর থানা-পুলিস। ভদ্রলোক নাকি এসেছিলেন জামসেদপুর থেকে। টিসকোতে কাজ করতেন, রিটায়ার করার পর পুরীতে বেড়াতে এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। বয়স হয়েছিল—তা প্রায় বাষট্টি-তেষট্টি। একাই এসেছিলেন। পরে জানতে পেরেছিলাম সংসারে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আছে কিন্তু কারও সঙ্গেই ভদ্রলোকের বনিবনা হত না।

কেন—বনিবনা হত না কেন?

ভদ্রলোকের নিজের স্বভাবেরই জন্য নাকি সংসারের কারও সঙ্গে বনত না।

তা কেন হঠাৎ এখানে এসে আত্মহত্যা করলেন, কিছু জানা গিয়েছিল?

না। তবে তার স্ত্রী বলেছিলেন, বাড়ি থেকে নাকি ঝগড়া করে চলে এসেছিলেন। পুরীতে যে এসেছেন তাও তিনি জানতেন না। আসার সময় কিছু বলেও আসেননি কাউকে না বলেকয়ে হঠাৎ চলে এসেছিলেন।

আর কিছু জানা যায় নি—ঐ পারিবারিক কলহ ছাড়া?

না।

কোন চিঠিপত্র রেখে গিয়েছিলেন।

না। কোন চিঠি বা লেখা-টেখা কিছুই ঘরে পাওয়া যায়নি।

ভদ্রলোকের নামটা আপনার মনে আছে দেবেশবাবু?

মনে আছে বৈকি-ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নামটা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে।

আচ্ছা দেবেশবাবু, ভদ্রলোকের মাথায় বেশ বড় একটা টাক ছিল কি?

কই না তো, বরং মনে আছে আমার, ঘন চুলই ছিল ভদ্রলোকের মাথায়।

খুব বড় বড় কথা বলতেন কি? এবং রীতিমত ভোজনপটু ছিলেন?

হ্যাঁ। যে কদিন ছিলেন তা প্রায় দুজনের মিল একাই খেতেন। অবিশ্যি তার জন্য এক্সট্রা চার্জ দিতে চেয়েছিলেন—

খুব দরাজ গলায় যখন-তখন হাসতেন কি?

অতশত মনে নেই। তা ভদ্রলোক সম্পর্কে এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বলুন তো রায়মশাই? আপনি ভদ্রলোকটিকে চিনতেন নাকি?

দেবেশের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিরীটী বললে, সেটাই তো যাচাই করছি!

কি ব্যাপার? দেবেশ অধিকারীর কণ্ঠস্বরে রীতিমত আগ্রহ প্রকাশ পায়।

ভদ্রলোক নামের সঙ্গে যে পদবীটা এখানকার খাতায় লিখিয়েছিলেন তা সত্য নয়—কিরীটী বললে।

সে কি রায়মশাই! কিন্তু তাঁর স্ত্রী যিনি এসেছিলেন এখানে পরে—

তিনিও তার স্ত্রী নন।

এসব কি বলছেন রায়মশাই। তাই বোধ হয় ডেড বডির সৎকার না করেই ভদ্রমহিলা চলে গিয়েছিলেন! এখন বুঝতে পারছি

২৯শে জুলাই ঘটনাটি ঘটেছিল এই হোটেলে, তাই তো?

হয়ত তাই হবে, জুলাই মাস আপনাকে তো আগেই বললাম, তবে তারিখটা–

২৯শে জুলাই এবং ২৮শে জুলাই এখানে সেরাত্রে খুব একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তাপাঙ্ক নেমে যায় কিরীটী বললে।

কিন্তু কি ব্যাপার রায়মশাই? দেবেশ প্রশ্ন করলেন।

আরও একটা কথা আছে দেবেশবাবু। কি কথা বলুন তো?

দেবেশ ওর মুখের দিকে তাকালেন।

আমার মনে হয়, কিরীটী বললে, তিনি আত্মহত্যা করেননি, তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং তিনি আদৌ জামসেদপুর থেকে আসেননি, এসেছিলেন কলকাতা থেকে। আর তার আসল . পরিচয় ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নয়।

এসব কি বলছেন রায়মশাই!

আমার অনুমানের কথাটাই আপনাকে বলছি।

কিন্তু পুলিস—পুলিস কি কিছুই জানতে পারেনি?

কিরীটী বললে, জানতে পারত নিশ্চয়ই, যদি ভাল করে লোকটা সম্পর্কে খোঁজখবর করত। ব্যাপারটা এক ভদ্রলোকের, যিনি এখানকার হোটেলে এসে উঠেছিলেন, তাই কেসটা আত্মহত্যা বলে হাত ধুয়ে ফেলেছিল পুলিস। এবং পুলিসের ফাইলে আত্মহত্যাই থেকে যেত, যদি না বছরতিনেক পরে হঠাৎ ক্ষিতীন্দ্রবাবুর স্ত্রী মালতী দেবী তার তিন বছর নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর খোঁজখবর শুরু করতেন এবং শেষ পর্যন্ত আমার দ্বারস্থ হতেন। আর কিছু ছিন্ন সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালাতে চালাতে আমি এখানে এসে না উপস্থিত হতাম!

আপনি তবে রায়মশাই ঐ ব্যাপারেই—

হ্যাঁ, কলকাতা থেকে অনুসন্ধান শুরু করে এখানে এসেছি।

সমস্ত ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে করছে রায়মশাই।

পুলিশের খাতায় যা লেখা আছে তা হচ্ছে, তিন বছর আগে ক্ষিতীন্দ্রবাবু ঝগড়াঝাঁটি করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন, এই পর্যন্ত সত্যি, কিন্তু তারপর–

তারপর?

যে ক্ষিতীন্দ্রবাবু এখানে এসে এই হোটেলে ওঠেন, তিনি আদৌ ক্ষিতীন্দ্রবাবু নন, কোন তৃতীয় ব্যক্তি। এখন কথা হচ্ছে, কোন তৃতীয় ব্যক্তি কেন ক্ষিতীন্দ্রবাবুর পরিচয়ে এখানে এসে উঠলেন, তার পিছনে কি উদ্দেশ্য ছিল? আর সেই সময় আসল ক্ষিতীন্দ্রবাবুই বা কোথায় ছিলেন?

দেবেশ বললেন, এবং আত্মহত্যাও করলেন—

না, কেউ তাঁকে হত্যা করেছিল

কে সে? আপনি বলছেন মিঃ রায়, ক্ষিতীন্দ্রবাবুর পরিচয়ে যিনি এখানে এসে উঠেছিলেন। তিনি আদৌ আত্মহত্যা করেননিতাকে হত্যা করা হয়েছিল?

হ্যাঁ।

কিন্তু—কে তাকে হত্যা করল আর কেনই বা হত্যা করেছিল?

হয়ত ক্ষিতীন্দ্রবাবুই তাকে হত্যা করেছিলেন, না হয় অন্য কেউ।

বলেন কি!

বলছি তো সবটাই আমার একটা অনুমান মাত্র। যাক সে কথা, ঘটনাটা মনে করুন। হোটেলের ১৭নং ঘরে সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। পুলিস এল, তারা যতটুকু অনুসন্ধান করবার করল। জামসেদপুরে তার স্ত্রী মালতী দেবীকে সংবাদ দেওয়া হল। তিনি এলেন সনাক্ত করলেন তার স্বামী বলেই, কিন্তু সকার না করেই চলে গেলেন।

হ্যাঁ।

কিন্তু এর মধ্যে একটা কথা আছে দেবেশবাবু–

কি, বলুন?

যাঁকে হত্যা করা হয়েছিল তিনি আমার অনুমান আগেই বলেছি আসল ক্ষিতীন্দ্রবাবু নন, তাহলে সত্যিকারের ক্ষিতীন্দ্রবাবুর জামসেদপুরের ঠিকানা পুলিশ কেমন করে কোথা থেকে পেল!

সত্যিই তো।

রহস্যটা ঐখানেই জট পাকিয়ে আছে।

কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, এত দিন পরে হঠাৎ তার মনে সন্দেহ জাগল কেন যে যাঁকে তিন বছর আগে তিনি তার স্বামী বলে সনাক্ত করেছিলেন তিনি তার স্বামী নন? দেবেশ বললেন।

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো, অনুসন্ধান তিনি আবার করতেন না কখনও যদি না মোটা টাকার একটা ফিক্স ডিপোজিটের ব্যাপারটা অকস্মাৎ জটিল হয়ে উঠত। ক্ষিতীন্দ্রবাবুর পঁচাত্তর হাজার টাকার একটা ফিক্স ডিপোজিট ছিল জামসেদপুরে টিসকোর অ্যাকাউন্টে যে টাকাটা রিটায়ার করবার পর ক্ষিতীন্দ্র পেয়েছিলেন, ঐ পঁচাত্তর হাজার তারই একটা অংশ— ফিক্স ডিপোজিট করে রেখেছিলেন কোম্পানিতে পাঁচ বছরের মেয়াদে মোটা সুদে। কিরীটী বলতে লাগল, কিছুদিন আগে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ায় মালতী দেবী টাকাটা তোলার যখন ব্যবস্থা করছেন একটা চিঠি এল তাঁর নামে!

চিঠি!

হ্যাঁ।

কার কাছ থেকে চিঠি এল?

ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম সইকরা চিঠি। সেই চিঠিতে লেখা ছিল—আমি মরিনি। ঐ ফিক্স ডিপোজিটের টাকা তুলবার চেষ্টা কোরো না, তাহলে আমি জানিয়ে দেব পুলিসকে যে পুরীতে গিয়ে অন্য এক ব্যক্তির মৃতদেহ তোমার স্বামীর বলে মিথ্যা সনাক্ত করে এসেছ। ইতি ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

কি সর্বনাশ!

কাজেই বুঝতে পারছেন, মালতী দেবীর অবস্থাটা। টাকা তোলার আর চেষ্টা করলেন না। প্রথমে নানাভাবে স্বামীর অনুসন্ধান করলেন, কিন্তু কোন কিছুর হদিস করতে পারলেন না। তাঁর তখন মনে একটা জেদ চেপে গিয়েছে—যে ভাবেই হোক সত্য ব্যাপারটা তাঁকে জানতেই হবে। তিনি সোজা চলে গেলেন তখন তাদের পূর্ব-পরিচিত একটা রিটায়ার্ড পুলিস কমিশনারের কাছে। তিনি সব শুনে মালতী দেবীকে আমার কাছে আসতে পরামর্শ দিলেন। সব শুনে কিরীটী বলতে লাগল, আমার মনে হল বিচিত্র একটা রহস্য ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে আছে!

কবে এসেছিলেন তিনি আপনার কাছে? দেবেশ শুধাল।

তা দিন-কুড়ি আগে হবে।

কলকাতা শহরে তখন প্রচণ্ড তাপদাহ চলেছে কয়েক দিন ধরে একটানা। জুনের সেটা গোড়ার দিক। আটত্রিশ থেকে চল্লিশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। সকাল যেন দেখতে দেখতে গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়।

দুপুরের দিকে যেন পশ্চিমের মত লু চলে, রাস্তায় বেরুলে হাত পা মুখ ঝলসে যায়। কিরীটীর বাড়ির কলিং বেলটা ডিং ডিং শব্দে বেজে উঠল।

জংলীই এসে দরজাটা খুলে দিল। সামনে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি একটা, এক ভদ্রমহিলা নামছেন ট্যাক্সি থেকে। পরনে সরু কালোপাড় একটা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা টানা। দুহাতে তিনগাছা করে ক্ষয়ে যাওয়া সোনার চুড়ি, মাথায় বা সিঁথিতে সিঁদুর নেই। বয়স হয়েছে আগন্তুক ভদ্রমহিলার, তিপান্ন থেকে চুয়ান্ন হবে। কিরীটীর সঙ্গে দেখা করতে চায় শুনে জংলী তো প্রথমটায় কিছুতেই সম্মত হয় না। বলে, না, এখন দেখা হবে না।

মহিলা কাকুতিমিনতি করতে থাকেন। বিশেষ প্রয়োজনে এসেছেন, একটিবার তাকে দেখা করতেই হবে। জংলী অনিচ্ছাসত্ত্বেও মহিলাকে বাইরের ঘরে এনে বসাল।

কিরীটী জেগেই ছিল তার মেজোনিন ফ্লোরের বসবার ঘরে। ডিভানে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। জংলী এসে ঘরে ঢুকল।

বাবু!

কি রে?

একজন মেয়েছেলে এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

এই দুপুরের প্রচণ্ড রৌদ্রে কেউ যে দেখা করতে আসতে পারে, বিশেষ কোন প্রয়োজন না থাকলে বুঝতে পারে কিরীটী, তাই জংলীকে ঐ ঘরেই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আসতে বলল।

ভদ্রমহিলা ঢুকতেই কিরীটী তার আপাদমস্তকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তার বুঝতে কষ্ট হয় না, এখন বয়স হলেও আগন্তুক মহিলা যৌবনে মোটামুটি দেখতে সুন্দরীই ছিলেন। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, সামান্য লম্বাটে ধরনের মুখের গঠন, চোখেমুখে বয়সের ছাপ অনিবার্য ভাবেই পড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চেহারার প্রতি যে তার একটা সযত্ন প্রয়াস আছে সেটা ওর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

বসুন।

মহিলা সামনের সোফাটার উপরে বসে ব্যাগ থেকে ছোট একটি রুমাল বের করে তার মুখের ঘামটা মুছে নিলেন।

মিঃ রায়, আমি আপনাকে চিনি না, কেবল আপনার নামের সঙ্গেই আমার যা পরিচয়। একটা বিশ্রী রকম সংকটে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি, আপনি যদি দয়া করে আমাকে সাহায্য করেন।

কি হয়েছে?

ভদ্রমহিলা তখন সংক্ষেপে তার স্বামীর তিন বৎসর আগে পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যার কথা বললেন ও সেই সঙ্গে নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও দিলেন।

বললেন, তিন বৎসর আগে যে দুঃখের ও লজ্জার ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছিল, এত বছর পর যে আবার সেই ব্যাপারটায় এমনি করে একটা সঙ্কট সৃষ্টি হবে ভাবতেও পারিনি। যাকে এই তিনটে বছর জেনে এসেছি মৃত বলে, তারই কাছ থেকে যে এমন একটা চিঠি পাব কেমন করে ভাবব বলুন!

চিঠিটা আপনার সঙ্গে আছে?

আছে, এই যে—মালতী ব্যাগ থেকে মুখ-ছেড়া টিকিট লাগানো সাদা খাম বের করে কিরীটীর হাতে তুলে দিলেন।

জামসেদপুরের ঠিকানা ও মালতী দেবীর নাম লেখা খামটার উপরে হাতের লেখায়। খাম থেকে চিঠিটা বের করে কিরীটী পড়ল। সংক্ষিপ্ত একটা হাতে লেখা চিঠি লেখাটা পুরুষের হাতের বলেই মনে হয়।

এ চিঠি আপনি বলছেন আপনারই স্বামীর লেখা? প্রশ্নটা করে কিরীটী তাকাল মালতী দেবীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ, তারই হাতের লেখা।

লেখাটা চিনতে আপনার কোন রকম ভুল হয়নি তো মালতী দেবী?

না, ওটা আমার স্বামীরই হাতে লেখা। সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।

আপনার স্বামীর লেখা অন্য কোন চিঠিপত্র আপনার কাছে আছে?

আছে। আমি নিজেও মিলিয়ে দেখেছি, আপনিও দেখুন—বলে গোটা দুই পুরাতন চিঠি মালতী কিরীটীর হাতে তুলে দিলেন।

কিরীটী সব চিঠিগুলো দেখে বুঝতে পারে একই ব্যক্তির লেখা প্রত্যেকটি চিঠি। মালতী দেবী, আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন আপনার স্বামী আজও বেঁচে আছেন? অর্থাৎ তিন বছর পূর্বে পুরীর হোটেলে যিনি ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, তিনি অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তি!

মালতী দেবী বললেন, ঐ চিঠিটা পাবার পর তা ছাড়া আর অন্য কি ভাবতে পারি বলুন। আপনিও তো চিঠিগুলো দেখলেন, আপনারও কি তাই মনে হয় না?

হ্যাঁ, তাই মনে হয় বটে, তবে কথা হচ্ছে—

কি বলুন?

আপনি একটু আগে তিন বছর আগে পুরীর এক হোটেলের মধ্যে যে ঘটনাটা ঘটেছিল বললেন, সে-সময় আপনিই তো নিজে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে বলে এসেছিলেন মৃত ব্যক্তি আপনার স্বামী–

হ্যাঁ, বলে এসেছিলাম।

তাহলে কি ভাবব, আপনি যে কারণেই হোক সত্য কথাটা পুলিসকে বলেননি?

সত্যিই বলেছিলাম।

সত্য বলেছিলেন?

হ্যাঁ, সেদিন যেমন মৃতদেহ দেখে বলেছিলাম সে-ই আমার স্বামী, আজও ঐ চিঠি যে তারই লেখা তাও বলছি! সেদিন যেমন আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, আজও তেমনি আমি নিঃসন্দেহ।

মৃতদেহটা আপনার স্বামীরই ছিল?

হ্যাঁ। শান্ত দৃঢ় গলায় জবাব দিলেন মালতী দেবী।

কিন্তু এই চিঠি যদি সত্যি-সত্যিই আপনার স্বামীরই লেখা হয় তাহলে কি ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে না যে সেদিন যে মৃতদেহকে আপনার স্বামীর বলে সনাক্ত করে এসেছিলেন তিনি নিশ্চয় আপনার স্বামী নন, কারণ মৃত ব্যক্তি তো আর চিঠি লিখতে পারেন না। সুতরাং তিনি সম্পূর্ণ অন্য ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি অবিকল আপনার স্বামীর মতো দেখতে ছিলেন বলেই আপনার ঐ ভুলটা হয়েছিল।

মালতী দেবী কোন জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।

মালতী দেবী, আপনি সমস্ত ব্যাপারটা আর একবার ভেবে দেখুন–

চিঠিটা পেয়েছি আমি প্রায় মাস দেড়েক আগে, তারপর আমার স্বামী সত্যিই আজও বেঁচে আছেন কিনা—কিম্বা আমারই হয়ত সেদিন ভুল হয়েছিল সেই কথা ভেবেই সমস্ত রকম অনুসন্ধান করার পর ব্যাপারটার একটা মীমাংসায় পৌঁছবার জন্যই শেষ পর্যন্ত আপনার কাছে। এসেছি।

কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে হলে কতকগুলো আবশ্যকীয় প্রশ্নের জবাব আমার একান্ত দরকার।

বলুন কি জানতে চান?

আপনার স্বামীর সঙ্গে আপনার মানে বুঝতেই পারছেন, পরস্পরের সম্পর্কটা কেমন ছিল যদি বলেন।

কি বলব বলুন, বলতে লজ্জাও হয় দুঃখও হয়, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা সুখের বা শান্তির ছিল না। অথচ আপনি শুনলে হয়ত অবাকই হবেন, পরস্পরকে ভালবেসেই আমাদের বিবাহ হয়েছিল।

বিবাহের পূর্বেই আপনাদের জানাশোনা হয়েছিল তাহলে?

হ্যাঁ, আমার শ্বশুরমশাই এবং শাশুড়ি জীবিত থাকা সত্ত্বেও আমার স্বামী তার কাকার কাছেই মানুষ–

আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি আজও বেঁচে আছেন কি?

জানি না, তাদের কখনও দেখিনি। আমার স্বামীও তার মা-বাবা সম্পর্কে কখনও কোন কথা বলতেন না বলে আমিও কখনও সে সম্পর্কে প্রশ্ন করিনি। তাদের নিয়ে কখনও কোন আলোচনা করিনি। কারণ আমি বুঝতে পেয়েছিলাম, যে কারণেই তোক তিনি তার মা-বাবা সম্পর্কে কোন আলোচনা করতে চান না। অবিশ্যি আমারও কোন দিন কোন আগ্রহই ছিল না সে সম্পর্কে জানবার।

আপনার মা-বাবাও ক্ষিতীন্দ্রবাবুর মা-বাবা সম্পর্কে কোন খোঁজখবর নেননি?

মা-বাবা আমার ছিল না, আমি আমার বড়দিদির কাছেই মানুষ। খুব ছোটবেলায় তারা মারা যান। আমার জামাইবাবু অসুস্থ মানুষ ছিলেন, অল্প বয়সেই সব কাজকর্ম ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অ্যাক্সিডেন্টের পর, কলকাতা শহরের ওপর খান দুই বাড়ি ছিল, তার আয় থেকেই তাদের চলে যেত ভাল ভাবেই দিদির পক্ষেও অত খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব ছিল না।

হুঁ। আপনার স্বামীর কাকা বেঁচে আছেন?

না, বছর চারেক আগে তিনি মারা গেছেন।

তার ছেলেমেয়ে স্ত্রী

স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছিলেন, কোন সন্তানাদি ছিল না তাদের। তার যা কিছু জমি-জমা টাকাপয়সা আমার স্বামীই পেয়েছিলেন।

আপনার স্বামী তো টিসকোতে বেশ ভাল চাকরিই করতেন?

মালতী দেবী বলতে লাগলেন, তার এড়ুকেশন বা কোয়ালিফিকেশন বলতে যা বোঝায় তা ততা সে রকম ছিল না, সে আন্দাজে চাকরিজীবনে শেষের দিকে বেশ ভাল মাইনেই পেতেন। শুনেছি শুরু করেছিলেন ৭৩ টাকা হপ্তা থেকে, পরে মাহিনা বৃদ্ধি শেষজীবনে ঠিক কত হয়েছিল আমি ঠিক জানি না।

কত মাইনে পেতেন শেষের দিকে আপনি জানেন না তাহলে?

না। সত্যি কথা বলতে কি, অমন একটা বিচিত্র চরিত্রের মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। এক কথায় অমন স্বার্থপর, অমন লোভী ও আত্মকেন্দ্রিকতার ওপরে চোখে মুখে ডাইনে বাঁয়ে মিথ্যা বলতেন। অথচ যখন আমাদের আলাপ হয়, দেড় বৎসরের আলাপে এতটুকু বুঝতে পারিনি মানুষটাকে, বুঝতে পারলাম বিয়ের পরে একটু একটু করে। মানুষটাকে মানিয়ে নেবারই চেষ্টা করতে লাগলাম, মনকে বোঝাতাম, ভাগ্য আমারই, কি আর করা যাবে। একটার পর একটা সন্তান হতে লাগল আমাদের–

কটি ছেলেমেয়ে আপনাদের? কিরীটীর প্রশ্ন।

চার মেয়ে দুই ছেলে—মালতী একটু থেমে বললেন।

বড় ছেলের বয়স কত আপনাদের? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

ছাব্বিশ হবে।

ছোট ছেলে?

চব্বিশ বছর হবে।

তারা—মানে আপনার সন্তানদের বাপের প্রতি মনোভাব কেমন?

ঐ প্রকৃতির মানুষের প্রতি মনোভাব যেমন হওয়া উচিত স্বাভাবিক ভাবে তার সন্তানদেরও ঠিক তেমনি।

মেয়েরা?

তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

ছেলেমেয়েদের এই চিঠির কথা আপনি বলেছেন?

না। আমি ঠিক করেছি সমস্ত কিছু ভাল করে না জেনেশুনে তাদের আমি কিছু বলব না। মিঃ রায়, আপনার যোগ্য পারিশ্রমিক দেবার মত ক্ষমতা আমার নেই, তবু আপনার শরণাপন্ন হয়েছি–

টাকা পয়সার জন্য আপনি ভাববেন না। আমাকে দুটো দিন একটু ভাবতে সময় দিন। এই চিঠিগুলো আমার কাছে রাখতে পারি কি?

রাখুন।

দুদিন বাদে আপনার স্বামীর বর্তমানের কোন ফটো থাকলে সঙ্গে আনবেন।

ঠিক আছে। নমস্কার জানিয়ে মালতী দেবী প্রস্থান করলেন।

তিন-তিনটে বছর, কম নয়। কিরীটী মনে মনে ভাবতে শুরু করেছে তখন।

তিন বৎসর আগে যে মানুষটা আত্মহত্যা করেছে এবং যার মৃতদেহ তার নিজের স্ত্রী পর্যন্ত ঘটনাস্থলে গিয়ে সনাক্ত করে এসেছে, তিন বৎসর পরে তারই এক চিঠি এল এবং সে চিঠি তার স্বামীরই লেখা বলে গেলেন মালতী দেবী।

ব্যাপারটা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? যে মানুষটি পুরীর এক হোটেলে তিন বৎসর পূর্বে আত্মহত্যা করেছে বা মারা গিয়েছে এবং যার অবিংসবাদী প্রমাণও পুলিসের দপ্তরে আজও রয়েছে, সে আজ আবার কেমন করে চিঠি লিখতে পারে? যদি মৃত্যুটা তার সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে কি আগাগোড়াই ব্যাপারটার মধ্যে কোন সত্য নেই, সবটাই গোড়া থেকে সাজানো? নাকি ব্যাপারটার মধ্যে অবিশ্বাস্য কোন ভৌতিক রহস্য আছে? শেষের সম্ভাবনাটা যদি বাদ দেওয়া যায়, তাহলে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে না কি যে তিন বৎসর আগে যে মানুষটিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে, আদৌ সে মরেনি! সে আজও বেঁচে আছে! কিম্বা এমন কি হতে পারে সম্পূর্ণ কোন তৃতীয় ব্যক্তি ঐ পত্র-প্রেরক? যদি তৃতীয় কোন ব্যক্তিই হবে, তাহলে সে ফিক্স ডিপোজিটের কথাটা জানল কি করে? শুধু তাই নয়, সেই ফিক্সড় ডিপোজিটের মেয়াদ কবে পূর্ণ হচ্ছে তাও সে জানে!

আরও একটা কথা মনে হয় কিরীটীর, ভদ্রলোক সত্যি-সত্যিই যদি আত্মহত্যা না করে থাকেন এবং বেঁচেই ছিলেন—সে কথাটা কাউকে না জানতে দেবার কি কারণ থাকতে পারে। অন্য কাউকে না জানালেও স্ত্রীকেও অন্তত জানাতে পারতেন!

এমনও হতে পারে, স্ত্রীকে তার বেঁচে থাকার কথাটা জানতে দেবেন না বলেই হয়ত অন্য কাউকেই কথাটা জানতে দেননি।

স্ত্রীর সঙ্গে তার কোন দিন যাকে বলে মনের মিল তা ছিল না। বিবাহিত জীবনে ভদ্রলোক সুখী ছিলেন না, আর সেই কারণেই হয়ত চুপচাপ ছিলেন। তাই চিঠিপত্রও দেননি স্ত্রীকে হয়ত। ঐ সঙ্গে এই চিন্তাটাও মনের মধ্যে আসে—এতদিন চুপচাপ থেকে হঠাই বা আজ কথাটা স্ত্রীকে জানালেন কেন?

কোন নির্দিষ্ট কারণ ছিল কি এতদিন কথাটা চেপে রাখার? তার চাইতেও বড় কথা-ভদ্রলোক পুরীর হোটেলে গিয়ে আত্মহত্যাই বা করতে গেলেন কেন, যদি অবিশ্যি সত্যিসত্যিই আত্মহত্যা করেই থাকেন?

পারিবারিক জীবনে ভদ্রলোক সুখী ছিলেন না সত্যি। সেটাও তার স্ত্রীর মতে চরিত্রের জন্যই। মানুষটা বরাবর স্বার্থপর লোভী। প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়ে এসে প্রৌঢ় বয়সেই বা এমন কি ঘটনা ঘটল যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হবে। তাও নৃশংসভাবে গলায় ক্ষুর চালিয়ে, অবশ্য যদি ঘটনাটা সত্যি বলেই ধরে নেওয়া যায়! তাও সব যেন কেমন গোলমেলে।

না, কোন যুক্তিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ঐভাবে ভদ্রলোকের আত্মহত্যা করবার। কিম্বা এও হতে পারে, পুরী যাবার পর এমন কোন ঘটনা হয়ত ঘটেছিল যে লোকটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। কিন্তু কি-ই বা এমন এক প্রৌঢ়ের জীবনে ঘটতে পারে যে শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মহত্যা করতে হল? লোকটির অতীত জীবনে এমন কিছু ছিল না তো, যে কারণে তাঁকে প্রৌঢ় বয়েসে চাকরি থেকে রিটায়ার করবার পর আত্মহত্যা করতে হয়েছিল?

কিরীটী কোন সূত্রই খুঁজে পায় না—যে সূত্র ধরে সে এগুতে পারে।

দিন দুই বাদে মালতী দেবী আবার এলেন কিরীটীর গৃহে। কিরীটী বললে, আসুন মিসেস চ্যাটার্জী, বসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম এ দুদিন।

মালতী আসন গ্রহণ করলেন।

কিরীটী বললে, মিসেস চ্যাটার্জী, আমরা যদি ধরে নিই যে আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্রবাবু তিন বছর আগে পুরীর হোটেলে আত্মহত্যা করেননি, আজও বেঁচে আছেন এবং কোথাও আত্মগোপন করে আছেন, সেক্ষেত্রে স্বভাবতই যে প্রশ্নটা সর্বাগ্রে আমাদের মনে জাগে সেটা হচ্ছে, না-ই যদি মারা গিয়ে থাকেন তবে আত্মগোপন করে আছেন কেন? আচ্ছা, তার অতীত জীবনের এমন কোন ঘটনা কি আপনার জানা আছে যেটা বরাবর তিনি সকলের কাছ থেকে গোপন করে এসেছেন বলে আপনার মনে হয়?

না। আর সেরকম কিছু থাকলেও আমার জানা নেই। তা ছাড়া তিনি নিজের প্রয়োজন ছাড়া আমাদের কারও সঙ্গে বিশেষ কোন কথাই বলতেন না, নিজের জামাকাপড় আহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া পৃথিবীর আর কোন কিছু ভাবতেন বলে আমার মনে হয় না।

টাকাপয়সার প্রতি কেমন আকর্ষণ ছিল আপনার স্বামীর?

ছিল, তবে সেটা এমন কিছু একটা উল্লেখযোগ্য নয়।

আচ্ছা মিসেস চ্যাটার্জী, আপনার স্বামীর এই ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটা ছাড়া আর কোন টাকা ছিল না? অতদিন চাকরি করেছিলেন বলছেন এবং শেষের দিকে ভালই মাইনা পেতেন বললেন

মালতী কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, মনে হয় ছিল। তবে সে সম্পর্কে আমি কিছুই কোনদিন জানতে পারিনি। এমন কি ঐ যে ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটার কথা বললাম তাও তিনি যদি একদিন নিজের থেকে আমাকে না বলতেন তো জানতেও পারতাম না হয়ত।

কোন লাইফ ইনসিওরেন্স ছিল না ক্ষিতীন্দ্রবাবুর? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।

ছিল কিনা জানি না। আসলে ঐসব—মানে টাকাপয়সার ব্যাপারে কখনও আমি মাথা ঘামাইনি। উনি বরাবর ওর নিজের মর্জিমত চলতেন, আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকতাম।

কেন?

পারিবারিক জীবনটা ক্রমশ ওঁর স্বার্থপর ব্যবহারে এমন বিষিয়ে তুলেছিলেন যে আমার কোন প্রবৃত্তি হয়নি দুজন একত্রে বসে দুদণ্ড কথা বলবার।

স্নেহমমতা কেমন ছিল? ভালবাসা—

সাধারণত এগুলি ওঁর ছিল বলে আমার মনে হয় না, থাকলেও তা নিজের ওপরেই—

কিন্তু বিবাহের পূর্বে তো আপনি–

তাঁকে জানতাম ঠিকই—কিন্তু পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে, বিবাহের পূর্বে সেটা একটা অভিনয় ছিল বোধ হয়। ভালবাসার একটা অভিনয়। তাই প্রথমটায় না বুঝতে পারলেও, বলতে লজ্জা-ঘৃণা হয়, আমাকে তার বোধ হয় একমাত্র প্রয়োজন ছিল রাত্রে, কিছুক্ষণের জন্য আমার দেহটায়—

সংসারে তাহলে আপনাদের কোন শান্তি ছিল না বলুন!

কেমন করে থাকবে বলুন, এমন একটা মানুষের সঙ্গে ঘর করলে কোন শান্তি বা সুখ থাকে। কি?

মিসেস চ্যাটার্জী, এবারে বলুন তো, তিন বছর আগে পুরীর হোটেলে যে মৃতদেহটা আপনি সনাক্ত করেছিলেন, ভাল করেই ডেড বডিটা তো দেখেছিলেন, না কি স্বামীর প্রতি যে অবজ্ঞা ঘৃণা ও বিরক্তি দীর্ঘকাল পোষণ করে এসেছেন মনে মনে সেই সব নিয়েই, মানে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখেছিলেন—

মালতী দেবী চুপ করে রইলেন।

আমার কি মনে হয় জানেন, মৃতদেহটা সেদিন নিশ্চয় আপনি ভাল করে দেখেননি! দেখলে হয়ত চেনার মধ্যে আপনার সেদিন কোন ফাঁক থাকত না। মনে মনে যদি আমার বুঝবার না ভুল হয়ে থাকে ক্ষিতীন্দ্রবাবুর কাছ থেকে আপনি যে মুক্তি চাইছিলেন সেই আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি যখন আপনার সামনে এসে অকস্মাৎ দাঁড়াল আপনি সেই মুক্তিকেই স্বাগত জানালেন—এমন কি আপনার বৈধব্য পরবর্তী জেনেও।

আমি—

নচেৎ সেদিনকার তাঁর সেই মৃত্যু আর পরবর্তী কালের এই চিঠি জানবেন কোনটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঠিক আছে মালতী দেবী, এ রহস্যের মীমাংসা কষ্টসাধ্য হবে না বলেই মনে হয়।

তাহলে কি মিঃ রায়, আপনি বিশ্বাস করেন সে আজও জীবিত?

তাই আমার মনে হচ্ছে—

তাহলে—আমি, আমি সকলকে কি বলব?

দেখুন স্বামীর ভয়াবহ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে যে কোন স্ত্রীই ঐ ধরনের ভুল করতে পারে, অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া আপনি কেন একমাত্র আপনার দিকটাই ভাবছেন, ক্ষিতীন্দ্রবাবুর দিকটাও ভাবুন—same problem তো বেঁচে উঠলে তাকেও face করতে হবে। সেটা নিশ্চয় তার পক্ষে খুব একটা সুখের হবে না। কিন্তু তার মধ্যেও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অর্থাৎ তিনি যদি হঠাৎ আজ আবার সত্যিই বেঁচে উঠতে চান—তো কেন। আবার বেঁচে উঠবার নতুন করে তার কি কারণ থাকতে পারে, কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেবলমাত্র ঐ ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটার জন্য তিনি আজ আবার বেঁচে উঠতে চাইছেন, আমার মন মেনে নিতে পারছে না। নিশ্চয়ই আরও কোন কারণ আছে। সেটা কি, কি হতে পারে। তারপর একটু থেমে কিরীটী বলল, সে যাই হোক, আপনি জানতে চান সত্যি সত্যিই আজও আপনার স্বামী বেঁচে আছেন কিনা—মনে হয় আপনার সেই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব।

মালতী দেবী বললেন, আসল সত্যটুকু আমাকে জানতেই হবে মিঃ যায়। বলতে আমার কোন দ্বিধা বা লজ্জা নেই—যে মানুষটা দীর্ঘ একটা যুগ কেবল আমাকে মানসিক পীড়নই করে গিয়েছে, সে মরেও আবার বেঁচে উঠে আমাকে কেন যে অপদস্থ করতে চায় সেটা আমার জানা আজ খুব বেশী প্রয়োজন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কত বড় দুঃখে কোন এক স্ত্রীর মুখ থেকে তার স্বামী সম্পর্কে এই কথাটা বের হতে পারে–

যদি সত্যিই তিনি বেঁচে থাকেন, আপনাকে তিনি অপদস্থ করতে চাইছেন তাই বা ভাবছেন কেন মিসেস চ্যাটার্জী?

কেন ভাবছি—তাই না? আমি মানে আমার মত করে তো কেউ ঐ মানুষটাকে চেনেনি— চিনবার সুযোগও পায়নি। যাকগে সে কথা, আজ আমি উঠি। আপনি তার একটা ফটো চেয়েছিলেন, এই নিন—বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন দশেক আগে তোলা এই ফটোটা। চলিফটোটা কিরীটীর হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মালতী দেবী।

আসুন—

মালতী চলে গেলেন।

কিরীটী মনে মনে মানুষটাকে কল্পনা করবার চেষ্টা করে ফটোটা সামনে ধরে। বেশ বোঝা যায়, মাথার সামনের দিকে বিস্তৃত টাক কিন্তু টাকা ঢাকা দেওয়া হয়েছে এক দিককার বড় বড়। চুল অন্য দিকে সযত্নে এনে।

চোখ দুটো ছোট ঘোট, বর্তুলাকার। চোখের চাউনি দেখে মনে হয়, যেন অত্যন্ত সহজ সরল মানুষটি, কিন্তু স্ত্রী মালতী যে পরিচয় তাঁর দিয়ে গেলেন সেটা ঠিক বিপরীত। চোখের দৃষ্টি থেকে মনের গতিবিধি বোঝা সত্যই অনেক সময় দুষ্কর।

কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

কার ফটো নিয়ে তন্ময় হয়ে আছে গো?

কিরীটী মৃদু হেসে ফটোটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে ধরলো। দেখ তো কৃষ্ণা, মানুষটিকে কেমন বলে মনে হয় তোমার এই ফটো দেখে।

কৃষ্ণা স্বামীর হাত থেকে ফটোটা নিয়ে দেখতে দেখতে বললে, সযত্নে চুল দিয়ে টাক ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে, আত্মসচেতন—মনে হয় চোখ দুটো মিথ্যা বলছে—আদৌ সহজ সরল নয় মানুষটি। বরং একটু লোভী। তা এ কে?

ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাল রাত্রে তোমাকে যার কথা বলছিলাম। লোকে জানে বৎসর তিনেক আগে পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যা করেছেন–

বাজে কথা, আত্মহত্যা করেনি, করতে পারে না। তার প্রমাণ তো ঐ চিঠিটাই—

চিঠিটা অন্য কারও লেখাও তো হতে পারে, হাতের লেখা নকল করে চিঠি দিয়েছে।

না, একই হাতের লেখা চিঠিগুলো, আমি হলফ করে বলতে পারি।

আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত কৃষ্ণা। কিরীটী বলল।

তাহলে?

যদি অনুমান আমার না ভুল হয়ে থাকে, তাহলে এই তিন বৎসর চুপচাপ ছিল কেন ভদ্রলোক? কারণ কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই ঐ নিস্তব্ধতার পিছনে, হয়ত যে হোটেলে তিন বৎসর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল তারই সঙ্গে নিস্তব্ধতার কোন ঘনিষ্ঠ কার্যকারণ রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, আজও যদি সে বেঁচেই থেকে থাকে, মালতী দেবীর কাছ থেকে দূরে থাকলেও তার সমস্ত খবরাখবর ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রাখতেন বরাবরই।

এ কথা বলছ কেন?

নচেৎ মালতী দেবী টাকা তুলবেন সে কথাটা জানলেন কি করে ক্ষিতীন্দ্রবাবু। না কৃষ্ণা, প্রথম দিকে সব শুনে ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলাম এখন মনে হচ্ছে হয়ত তত সহজ নয়, সমস্ত ঘটনার মূল শিকড়টা মাটির নীচে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। আমি যখন হাত দেব স্থির করেছি, বর্তমান রহস্যের গিট আমি খুলবই। শোন, সর্বাগ্রে আমাকে একবার জামসেদপুর যেতে হবে।

জামসেদপুর?

হ্যাঁ। ওখানে আমার এক বিশেষ পরিচিত ভদ্রলোক আছেন। অনুসন্ধান আমাকে টিসকো থেকেই শুরু করতে হবে।

বঙ্কিম সুর বহুকাল জামসেদপুর-নিবাসী। চাকরির শুরু থেকেই জামসেদপুরে, যদিও দেশ তার হাওড়ায়। বঙ্কিম সুর টিসকোতেই চাকরি করত, বছর চার-পাঁচ হল রিটায়ার করে ওল্ড সারকিট হাউস এরিয়াতে বাড়ি করে বসবাস করছে।

দুই ছেলে, দুটি ছেলেই কৃতী। একজন কলকাতায় চাকরি করে বিরাট একটা ফার্মে, অন্যজন টিসকোতেই চাকরি করছে। ছোটখাটো রোগা পাতলা মানুষটি। দিবারাত্র যেমন পান চিবাচ্ছে তেমনি টানছে সিগ্রেট একটার পর একটা, চেন-স্মোকার। হাসিখুশি রসিক মানুষ। তার কাছ থেকে অনেক সংবাদ পাওয়া যাবে আশা করা যায়।

ট্রেন থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কিরীটী সোজা নটরাজ-এ গিয়ে উঠল, হোটেলটা বেশ বড় এবং সব রকম ব্যবস্থাই আছে।

হোটেলের ঘরে বসেই ফোন করল কিরীটী বঙ্কিমকে।

কে বঙ্কিম, আমি কিরীটী—

কিরীটী! কোথা থেকে কথা বলছ হে? বঙ্কিম জানতে চান।

নটরাজ হোটেল। একবার চলে এস না।

তা তুমি আমার বাসায় না উঠে হোটেলে উঠতে গেলে কেন হে?

তুমি হোটেলে এস, সব জানতে পারবে।

আধঘণ্টার মধ্যে বঙ্কিম এল, মুখে একগাল পান, হাতে সিগারেট। বললে, উঃ, অনেক দিন পরে দেখা। তা খবর কি বল, হঠাৎ এখানে?

কিরীটী সংক্ষেপে তার আসার উদ্দেশ্য বলে গেল।

সব কথা মন দিয়ে শুনল বঙ্কিম। তারপর বললে, ক্ষিতীন্দ্রকে আমি বেশ ভাল করেই চিনতাম। তা সে তো বছর তিনেক আগে সুইসাইড করেছে পুরীর এক হোটেলে। ব্যাপারটা কি বল তো?

সেই ভদ্রলোক সম্পর্কে কি জান বল। তুমি তো তাকে চিনতে বললে।

হ্যাঁ, প্রায় সন্ধ্যাতেই একটা ভাঙা সাইকেল নিয়ে আমার বাসায় আসত তাস খেলতে।

তাস খেলার নেশা ছিল বুঝি?

তা ছিল।

অন্য কোন নেশা?

দেখ ভাই, নেশা করতে হলে একটা দিল চাই। নেশা কি সকলে করতে পারে। তাছাড়া লোকটা ছিল স্বভাব-কৃপণ, আর সে কৃপণতার জন্য সে পারত না দুনিয়ার এমন কোন কাজই ছিল না। তার উপরে ছিল মুখে সর্বদা বড় বড় বোলচাল। অনেকটা বলতে পার বোকা চালিয়াৎ, বোকা এইজন্য বলছি, নিজের ভালটা যেমন বুঝতে পারত না, তেমনি ঐ চালিয়াতির জন্য তার যে ক্ষতিটা হত সেটা বুঝবার কোন চেষ্টা করত না। কিন্তু মানুষটার অন্তরটা ছিল পরিষ্কার, কিন্তু ঐ যে বললাম, বোকা, সমস্ত গুণই তার সেটা নষ্ট করে দিয়েছিল তা কি ব্যাপার বল তো?

দেখ বঙ্কিম, এবার একটা সত্যি কথা বল তো, তুমি লোকটার যে চরিত্র বর্ণনা করলে, তাতে করে কি মানুষটা সুইসাইড করতে পারে বলে তোমার মনে হয়? তাও গলায় ক্ষুর চালিয়ে? গলায় দড়ি দেওয়া যায়, বিষপানও করা যায়, কিন্তু গলায় ক্ষুর চালানোর জন্যে অন্য এক ধরনের নার্ভের দরকার, তাই নয় কি!

তা ঠিক, তবে momentary insanity-তে মানুষ—

কিন্তু সেটাই বা হঠাৎ তার হবে কেন? চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে, তারপর পুরীতে বেড়াতে গিয়েছে। ছেলেরা মানুষ হয়ে গিয়েছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে—

সবই ঠিক, কিন্তু পারিবারিক শান্তি তো ছিল না একেবারেই—তাছাড়া কেবল স্ত্রী কেন, ছেলেমেয়েদের ভালবাসাও মানুষটা কোন দিন পায়নি।

কেন?

সেও তার নিজের চরিত্রের জন্য। অমন আত্মসর্বস্ব মানুষ হলে সন্তানদের শ্রদ্ধা ভালবাসা পাওয়া যায় না কিরীটী। সংসারে থেকেও তো সে সংসারের কেউ ছিল না। একেবারে একা যাকে বলে।

কি জান বঙ্কিম, কম তো বয়স হল না, কম দেখলামও না। বেশীর ভাগই দেখেছি মানুষ নিজের দুঃখ নিজেই তৈরী করে নেয়। সংসারে বাস করতে হলে একটা সততা বজায় রাখতে হয়।

তা ঠিক, বঙ্কিম সুর হেসে বলল, কিন্তু তুমি ক্ষিতি সম্পর্কে এত সংবাদ জানতে চাইছ কেন তা তো বললে না।

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো ভদ্রলোক আজও বেঁচে আছেন।

কি বলছ তুমি!

বলছি তিন বৎসর পুরীর হোটেলে যে আত্মহত্যা করেছিল বা খুন হয়েছিল সে তোমাদের পরিচিত মালতী দেবীর স্বামী ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নন।

অসম্ভব। মালতী দেবী নিজে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে এসেছিলেন।

তার ভুলও তো হতে পারে।

ভুল! স্ত্রী স্বামীকে চিনতে ভুল করবেন?

ইচ্ছা করেও তো ভুলটা করতে পারেন। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।

ইচ্ছা করে। কিন্তু কেন?

সেই কেনর জবাবটা পেলেই তো সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যায় বঙ্কিম। তুমি জান না বঙ্কিম, কিছুদিন আগে মালতী দেবী তার স্বামীর হাতের লেখা একখানা চিঠি পেয়েছেন।

চিঠি! মানে ক্ষিতি চিঠি লিখেছে তার স্ত্রীকে?

হ্যাঁ। সে চিঠি আমি দেখেছি। অন্য দুখানা চিঠির সঙ্গে মিলিয়েও দেখেছি, সব চিঠিই যে একই হাতের লেখা সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই।

ব্যাপারটা যেন কেমন আমার গোলমেলে ঠেকছে–ক্ষিতি আজও বেঁচে আছে, তাছাড়া–কি?

এ ধরনের একটা ব্যাপার গড়ে তুলবার তার কি প্রয়োজন ছিল?

হয়ত ছিল কিছু একটা!

কিন্তু তার পরে আবার বেঁচে উঠবারই যখন ইচ্ছা ছিল তখন–

এই তিন বৎসর কেন সে চুপচাপ ছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

নিশ্চয়ই হিমালয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যায়নি।

না, সন্ন্যাসী হবার মত মানুষ সে নয়। তিনজনের খাবার না খেলে যেমন তার চোরা দ্বিতীয় পাকস্থলীটা ভরত না, তেমনি বড় বড় মিথ্যা বোলচাল না দিলে তার পেট ফাঁপে, মানে ফাপত—আচ্ছা, মালতী কি বলছেন?

মনে হল ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া একটু কষ্টকর হচ্ছে—

কেন, এ তো আনন্দের কথা, সত্যিই যদি ক্ষিতি আজও বেঁচে থাকে—

বমি, আমার তো মনে হয় সেটা আনন্দ সংবাদ বহন করে আনবে না। তুমি কি ভাবতে পার বঙ্কিম, ব্যাপারটা ক্ষিতীন্দ্রর পক্ষে কত বড় একটা নিষ্ঠুর পরিহাস!

সত্যি, মানুষটার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। সত্যিই বেচারা হতভাগ্য, যেটা হতে পারত সত্যিকারের একটা আনন্দ সংবাদ, সেটাই যদি–

তবু আমি মালতী দেবীকে কথা দিয়েছি বঙ্কিম, ঐ রহস্যের একটা মীমাংসা করে দেবার চেষ্টা করব, কারণ ব্যাপারটা জানতে তিনি অত্যন্ত উগ্রীব। যাক সে কথা, আমার আরও কিছু জানবার আছে ক্ষিতীন্দ্র সম্পর্কে।

বঙ্কিম বললেন, কি জানতে চাও বল?

প্রত্যেক মানুষেরই চরিত্রে কিছু দোষ ও গুণ থাকে, মানুষটার চরিত্রে কালো দিকটাই। তোমাদের কাছে শুনেছি, মানে তার স্ত্রী ও তোমার মুখ থেকে। তার চরিত্রে কোন ভাল দিকই কি ছিল না?

তোমার ঐ প্রশ্নের জবাবে একটা কথাই বলতে পারি কিরীটী, ওকে কেউ ভালবাসতে পারে না। এমন কি আমি যতদূর জানি, ওর নিজের বাপ-মাও বোধ করি ওকে কোন দিন ভালবাসতে পারেননি।

কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বললে, আচ্ছা, উনি তো শুনেছি, মানে ক্ষিতিবাবু মালতী দেবীকে ভালভাবেই বিবাহ করেছিলেন এবং মালতী দেবীও ভালবেসেছিলেন একদা ঐ মানুষটিকে–

গোড়ার কথাটা অবিশ্যি তাই। কিন্তু আমার মনে হয়, ক্ষিতিকে ঘিরে মালতী দেবীর স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেরি হয়নি। আমার কি মনে হয় জান, ঘটনাকে তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে যেতে দাও কিরীটী, তুমি দূরে সরে যাও।

কিন্তু আমি যে ভাই কথা দিয়েছি মালতী দেবীকে, কিরীটী বললে, তাছাড়া আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে বোধ হয় আমিও ফিরতে পারব না।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। বঙ্কিম একটু পরে উঠে দাঁড়াল, এবার আমি তাহলে চলি! রাত্রে তুমি কিন্তু আমার ওখানে খাবে কিরীটী।

না, বরং তুমিই হোটেলে এসো, একসঙ্গে ডিনার খাওয়া যাবে। ভাল কথা, একটা কথা বোধ হয় তোমার জানা প্রয়োজন কিরীটীকি বল তো? ক্ষিতি হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন দশেক আগেই বোধ করি, এক সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে দুজনে তাস খেলছিলাম, ঐ সময় এক ভদ্রলোক ক্ষিতির খোঁজে আমার বাড়িতে এসে হাজির—পরনে একটা দামী স্যুট, চোখে কালো চশমা। বেশ দীর্ঘকায় ব্যক্তি। নাম বললেন জীমূতবাহন। ক্ষিতি কিন্তু আগন্তুক ভদ্রলোককে চিনতে পারল না।

জীমূতবাহন বললেন, সে কি রে? সত্যি সত্যিই তুমি মনে করতে পারছ না ক্ষিতীন্দ্র— জীমূতবাহন ঘোষালকে তোমার মনে পড়ছে না? রাজসাহী কলেজে একসঙ্গে দুবছর পড়েছি থাকতামও একই হোস্টেলে পাশাপাশি ঘরে–

না, আমি দুঃখিত। সত্যিই মনে পড়ছে না। ক্ষিতি বলে।

বঙ্কিম বলতে লাগল, যে কারণে তোমাকে ঘটনাটা বলছি কিরীটী—আমি কিন্তু তখন অপার বিস্ময়ে আগন্তুকের মুখের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন আশ্চর্য মিল দুজনার চেহারার মধ্যে। অবিশ্যি আগন্তুকের চোখে কালো চশমা থাকায় তার চোখ দুটো আমি দেখতে পাইনি।

চশমা চোখ থেকে খোলেনি সে?

না। কেবল বেশভূষায় দুজনের পার্থক্য, ভদ্রলোকের পরনে দামী স্যুট, যে ধরনের দামী স্যুট ক্ষিতি জীবনে কখনও পরা তো দূরে থাক, তার কল্পনারও বাইরে, এবং দুজনের গলার স্বর ও দাঁড়াবার ভঙ্গিটাও সম্পূর্ণ এক।

তারপর? কিরীটীর কণ্ঠস্বরে বেশ একটা কৌতূহল।

ক্ষিতির সে-সময়কার চোখমুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল, ক্ষিতি বোধ হয় সত্যিই তাকে চেনে না। তার কথার মধ্যে মিথ্যা ছিল না! যাক তারপর যা বলছিলাম, মৃদু হেসে জীমূতবাহন বললেন, তাহলে আর কি হবে, চিনতেই যখন আমায় পারলে না, কি আর বলব। মিলিও হয়ত তোমারই মত আজ আমায় চিনতে পারবে না, আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি ক্ষিতীন্দ্র, আর তাকেও না। আচ্ছা চলি ক্ষিতীন্দ্র, গুড নাইট।

জুতোর শব্দ তুলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন আগন্তুক। এতক্ষণ আগন্তুককে একদৃষ্টে দেখছিলাম, এবার আমার সামনে চৌকির উপরে উপবিষ্ট ক্ষিতির দিকে তাকালাম। মনে হল ক্ষিতি যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক, তার দুচোখের দৃষ্টি যেন বাইরের অন্ধকারে নিবদ্ধ।

বাইরে শীতের রাত তখন ঝিমঝিম করছে। আর জামসেদপুরে শীতও সেসময় প্রচণ্ড। একেবারে যাকে বলে হাড় কাঁপানো শীত।

খেলা তো আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাসগুলো তখনও সামনে তেমনি ছড়ানো পড়ে আছে। হঠাৎ ক্ষিতি উঠে পড়ল, চলি রে বন্ধু

বললাম, সে কি! খেয়ে যাবি না? কড়াইশুটির খিচুড়ি, ফুলকপি ভাজা করছেন তোর বৌদি।

না, আজ থাক।

আমার স্ত্রী সেদিন খিচুড়ি বেঁধেছিল, বাড়িতে এটা-ওটা রান্না হলেই আমার স্ত্রী ক্ষিতিকে বলত, ক্ষিতিবাবু, রাত্রে আজ খেয়ে যাবেন। ক্ষিতিও সানন্দে সম্মত হয়ে যেত। তাই সেদিন। অবাক হলাম, আশ্চর্য ব্যাপার, ক্ষিতির আহারের ব্যাপার ঔদাসীন্য কখনও আগে দেখিনি।

না, না, সেকি! চল্ খাবি চল, বললাম।

না, আজ চলি। আর একদিন খাওয়া যাবে কথাগুলি বলে ক্ষিতি আর দাঁড়াল না। ঘর ছেড়ে চলে গেল।

তারপর? কিরীটী শুধাল।

তারপর যা ইতিপূর্বে কোন দিন হয়নি তাই হল, দিন দশেক ক্ষিতি আর এলোই না। আমার স্ত্রী একদিন বললে, তোমার বন্ধুর ব্যাপার কি, আর যে আসেন না!

সেইদিনই আমি ক্ষিতির বাসায় গেলাম খোঁজ নিতে। মালতী দেবী বললেন, সে তো নেই!

নেই! কোথায় গিয়েছে?

আমার মনে হয় কলকাতাতেই গিয়েছেন—

কলকাতায়!

হ্যাঁ, তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু শিশির গুপ্ত, বোধ হয় সেখানেই গিয়েছেন।

আমিও জানতাম-বঙ্কিম বলতে লাগলেন, ক্ষিতির দীর্ঘদিনের এক বন্ধু ছিল। ভদ্রলোক বোধ হয় সত্যিই ক্ষিতিকে ভালবাসতেন নচেৎ কতবার যে ভদ্রলোকের সঙ্গে ও ঝগড়া বাধিয়ে অকারণ অজুহাতে সম্পর্ক ছেদ করেছে তার গোনাগুনতি নেই। আবার নিজেই গিয়ে ভাব করেছে, কারণ বোধ হয় ক্ষিতি জানত ঐ একটিমাত্র মানুষ সত্যিই তাকে ভালবাসেন। এর দিন দুই পরেই ঐ দুঃসংবাদ পেলাম, ক্ষিতি পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যা করেছে গলায় ক্ষুর চালিয়ে—

কিরীটী থামল। দেবেশ অধিকারী এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। এবার ধীরে ধীরে বললেন; এ যে রীতিমত এক রহস্য রায়মশাই, আপনি তাহলে ঐ রহস্যের একটা কিনারা করতেই এসেছেন পুরীতে?

হ্যাঁ।

কিন্তু তিন বছর আগে যে ব্যাপার ঘটে গিয়েছে—

১৭নং, সেই ঘরের দেওয়ালে কান পাতলে আজও হয়ত অনেক কিছুই শোনা যাবে দেবেশবাবু! সেই রাত্রের সেই ঘটনার সাক্ষী ঐ ঘরের দেওয়ালগুলোই, আর সামনে ঐ সমুদ্র নীল!

এইসব আজগুবী আপনি বিশ্বাস করেন রায়মশাই?

করি বৈকি।

ঐ সময় গোপী এসে বললে, ১৭নং ঘর পরিষ্কার করে বেডিং পেতে দেওয়া হয়েছে। কিরীটীর সঙ্গে একটা সুটকেস ছাড়া বেশী কিছু মালপত্র ছিল না। সেটা গোপী হাতে তুলে নিল। কিরীটী তাকে অনুসরণ করল।

১৭নং ঘর। ঘরে পা দিতেই কিরীটীর কেমন যেন একটা বিচিত্র অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে ঘরটার চারিদিকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল কিরীটী। তিন বৎসর আগে এই ঘরেই এক রাত্রে একজন নিহত হয়েছিল বা আত্মহত্যা করেছিল। মোট কথা একজনের দেহান্ত হয়েছিল। তারপর এই তিন বৎসরে জনা দুই ঘরে রাত্রিবাস করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। এবং ঐ ঘটনার পর এ ঘরে আর কোন যাত্রীকে রাখা হয়নি।

ভূতের ভয়?

ভূত ইতিপূর্বে কিরীটী দেখেনি বটে তবে তার উপস্থিতি অনুভব করেছে। এবং কিরীটীর একটা বদ্ধমূল ধারণা, ভূতেরা কারও কোন অনিষ্ট করে না। ঘরটা আকারে বেশ বড়ই। সমুদ্রের দিকে পর পর দুটো জানালা। জানালায় মোটা মোটা শিক বসানো, বেশ একটু ফাঁক ফাঁক করেই। খোলা জানালাপথে সমুদ্র সারাটা দৃষ্টি জুড়ে যেন এক আদিগন্ত বিস্ময়কর ছবির মত ভেসে ওঠে! নীল আকাশ চক্ৰবালে নীল সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে নিজেকে নিজে দেখাচ্ছে আর দেখছে। দেখার বুঝি শেষ নেই। অজস্র সূর্যালোক। বহু মোচার খোলার মত দোদুল দুলছে ইতি উতি কয়েকটা জেলেডিঙি!

১৮নং ঘরে সরিৎশেখর জানালার কাছ থেকে সরে এল।

অনুরাধা দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছে। সরিৎশেখর একটা সিগ্রেট ধরালো। খুব বেশী ধূমপান করে না সরিৎশেখর, মধ্যে মধ্যে এক-আধটা সিগ্রেট ধরায়, তাও শেষ পর্যন্ত অর্ধেকের বেশী থাকতেই ফেলে দেয়। ভাবছিল সরিৎশেখর, অনুরাধা তাহলে বিবাহিতা। ঐ সলিল দত্ত মজুমদারকেই বিবাহ করেছে।

অনুরাধা পরস্ত্রী, একজনের গৃহিণী!

সুখী হয়েছে কি অনুরাধা সলিলকে বিবাহ করে?

প্রশ্নটা কেন জানি সরিতের মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। হাতে ধরা সিগ্রেটটা। পুড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।

অনুরাধা হেঁটে চলছিল।

পায়ের তলার বালি ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। তপ্ত বালুকা থেকে যেন একটা তাপ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, সমুদ্রের এলোমেলো হাওয়ায় গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না।

আজ ২৯শে জুলাই। যেদিন প্রথম সরিতের সঙ্গে ওর আলাপ সেদিনও ছিল ২৯শে জুলাই, প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়েছিল সেদিন কলকাতা শহরে। চলতে চলতে অন্যমনস্ক ভাবে অনুরাধা একবার আকাশের দিকে তাকাল, কয়েকটা পাতলা মেঘ ভাসছে আকাশে। ঐ ধরনের মেঘে বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি নামলে কিন্তু বেশ হত। নামবে কি বৃষ্টি কে জানে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছিল অনুরাধা।

কিন্তু তবু একবারও হোটেলে ফেরার কথাটা তার মনে হয় না।

কি হবে হোটেলে ফিরে? এতক্ষণে হয়ত মানুষটা ফিরে এসেছে। ঘরে ঢুকলেই তো তাকে সেই মানুষটার মুখখামুখি হতে হবে। অসহ্য-অসহ্য হয়ে উঠেছে যেন।

অথচ নিষ্কৃতি নেই তার, মুক্তি নেই ঐ মানুষটার বন্ধন থেকে। আজ বুঝতে পারছে যেন অনুরাধা, ঐ লোকটাকে কোন দিন সে কামনা করেনি। কোন দিন সহ্য করতে পারেনি, অথচ ওর হাত থেকে মুক্তিরও কোন পথও জানা নেই তার।

হোটেলের ম্যানেজার দেবেশ অধিকারী বড় একটা বাঁধানোে খাতায় ঝুঁকে পড়ে গত মাসের হোটেলের প্রত্যেক দিনের খরচ-খরচাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। রীতিমত লাভবান ব্যবসাটা, প্রতি বছর লাভের অঙ্কটা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আজকাল প্রায়ই একটা চিন্তা দেবেশের মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে—আর একটা হোটেল খুললে কেমন হয়। ছোট ভাই বারানসীতে এম. কম. পাস করে ব্যাংকে একটা চাকরি পেয়েছে বটে কিন্তু কি-ই বা এমন রোজগার করে, ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে বসলে অনেক উপার্জন করতে পারবে।

দেবেশ ভাইকে কথাটা অনেকবার বলেছেন কিন্তু সে কান পাতেনি।

একটা জুততার শব্দে মুখ তুলে তাকালেন দেবেশ।

দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি সামনে দাঁড়িয়ে! হাতে একটা ছোট চামড়ার সুটকেস, অনেক দিনের পুরাতন। একমাথা ঝাকড়া পাকা চুল, একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। পরনে একটা নোংরা টেরিলিনের প্যান্ট ও গায়ে অনুরূপ একটা টেরিকটের হলদে রঙের শার্ট।

কি চাই?

এ হোটেলে একটা আলাদা ঘর পাওয়া যাবে?

কোথা থেকে আসছেন?

কলকাতা থেকে ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন ভাঙা ভাঙা, একটু কর্কশও।

কিন্তু এ সময় কলকাতা থেকে কিসে এলেন?

কেন ট্রেনে?

এসময় কোন্ ট্রেনে?

এত, প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো, জায়গা আছে কিনা তাই বলুন।

কদিন থাকবেন? ভবেশ অধিকারী আবার প্রশ্ন করেন।

এক মাস থাকতে পারি, সাত দিনও থাকতে পারি, এক দিন বা এক ঘণ্টাও থাকতে পারি, আপনি ফু চার্জ করবেন দেব-ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে বিরক্তি।

দেবেশ অধিকারী তখনও তাকিয়ে আছেন আগন্তুকের দিকে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। ৬৪। ৬৫ তো হবেই—এক আধ বছর বেশী হওয়াও আশ্চর্য নয়। হাফহাতা টেরিটের শার্টের বাইরে দুটো রোমশ বাহুঁ। তামাটে বর্ণ, এককালে হয়ত ভদ্রলোকের গায়ের রঙ ফর্সাই ছিল, এখন পুড়ে গিয়েছে।

এক সপ্তাহের ভাড়া জমা দিতে হবে—শুধু থাকবেন না খাওয়া-দাওয়া করবেন?

রুম-সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে?

আছে।

তাহলে ফুডিং লজিং এক সপ্তাহের জন্য কত চার্জ পড়বে?

ত্রিশ টাকা করে রোজ—সাত দিনে–

দুশো দশ তো—এই নিন—ভিতরের পকেট থেকে একটা বহু পুরাতন ম্যানিব্যাগ বের করল আগন্তুক এবং তার ভিতর থেকে একশো টাকার দুটো ময়লা নোট ও ততোধিক ময়লা দশ টাকার একটা নোট বের করে দিল।

মালপত্র আর নেই? খাতায় টাকাটা জমা করে ভবেশ অধিকারী বললেন।

না।

গোপী, এই গোপী—ভবেশ অধিকারী চিৎকার করে ডাকলেন।

গোপী রান্নাঘরে বসে আলু কাটছিল, এসে সামনে দাঁড়াল। কহন্তু—

এই ভদ্রলোককে ১৫নং ঘরটা খুলে দে।

গোপী আগন্তুকের দিকে তাকাল, তারপর বলল, আসুচি–গোপী চলে গেল।

নামধামটা এই খাতায় লিখে দিন স্যার।

লিখতে আমি পারি না—ভদ্রলোক বলেন।

পারেন না, না লেখাপড়া জানেন না?

জানি, কিন্তু লিখতে পারি না।

কেন?

নিউরস্থানিয়ায় ভুগছি, গত তিন বৎসর থেকে কলম ধরতে পারি না। লিখে নিন না—চন্দ্রকান্ত ঘাঁই। পুরী ফ্রম ক্যালকাটা টু ব্যাক ক্যালকাটা।

আগন্তুকের দিকে একবার তাকিয়ে খাতায় লিখে নিলেন দেবেশ অধিকারী।

গোপী এসে বললে, চল বাবু।

ভবেশ অধিকারী খাতায় সময় লিখলেন, বেলা বারোটা চল্লিশ।

চন্দ্রকান্ত গোপীকে অনুসরণ করল। মাঝখানের বাঁধানো চত্বরটা পার হয়ে বাঁদিক দিয়ে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি—আগে আগে গোপী, তার পশ্চাতে চন্দ্রকান্ত সিঁড়িতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেবেশ অধিকারী কিন্তু তখনও ভাবছেন, কোন্ ট্রেনে ভদ্রলোক এলেন? জগন্নাথ এক্সপ্রেস খুব ভোরে এসে পৌছায়, পুরী এক্সপ্রেস সকাল আটটা সোয়া আটটায় পৌঁছায়, বড় জোর লেট থাকলে নটা। এখন পৌনে একটা বেজে গিয়েছে। ভদ্রলোক কি এ হোটেলে আসার আগে অন্যান্য হোটেলে ঢুঁ মেরে দেখছিলেন ঘর পাওয়া যায় কিনা।

সলিল দত্ত মজুমদার ১৬নং ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন আর বিরক্তির সঙ্গে চিন্তা করছিলেন।

ঐ সরিৎশেখর লোকটা হঠাৎ এখানে কেন এসে উঠল? অনুরাধার পূর্ব প্রণয়ী? ব্যাপারটা কি একান্ত আকস্মিক, না পূর্বের পরিকল্পনামতো লোকটা এখানে এসেছে, তাও রয়েছে ১৮নং ঘরে। অনুরাধা তো জানতই তারা পুরীতে আসছে, হয়ত অনুরাধাই জানিয়ে দিয়েছিল তাকে। এখন তো বোঝাই যাচ্ছে, এই দুই বৎসরেও অনুরাধা সরিৎশেখরকে ভোলেনি। আর সরিৎশেখরও অনুরাধাকে ভোলেনি।

একটা তিক্ত হিংসা যেন সলিল দত্ত মজুমদারের বুকের মধ্যে আঁচড়ে আঁচড়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এখনও সরিৎশেখরের ঘরেই অনুরাধা।

অনুরাধা যদি নাই জানত সরিৎশেখর আসবে—তবে তার ঘরে গেল কেন।

যাবে নাকি ১৮নং ঘরে, অনুরাধার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসবে?

এক সময় থমকে দাঁড়াল অনুরাধা।

সমুদ্রের নির্জন তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইতিমধ্যে কখন যেন সে হোটেল থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে, এখন বাঁয়ে অশান্ত কল্লোলিত সমুদ্র একটানা গর্জন করে চলেছে, অন্যদিকে ধু ধু বালিয়াড়ি, কোন লোকালয়ের চিহ্নমাত্রও নেই। ভিজে বালির উপর দিয়ে হাঁটছিল অনুরাধা। এবারে সেখানেই বসে পড়ল, পা দুটো ক্লান্ত। মধ্যে মধ্যে ঢেউগুলো এসে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মাথায় আঁচলটা ঘোমটার মত তুলে দিয়ে চপ্পলজোড়া পা থেকে খুলে হাতে তুলে। নিয়েছিল অনুরাধা। রৌদ্রের তাপটা যেন কেমন এখন ঝিমিয়ে এসেছে। আকাশের দিকে তাকাল অনুরাধা, সেই হাল্কা ইতস্তত ছড়ানো টুকরো টুকরো মেঘগুলো কখন যেন পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে আর অনেকখানি আকাশের গায়ে জুড়ে বসেছে। কি ভেবে ফিরল অনুরাধা। আর এগুনো হয়ত ঠিক হবে না।

এ দুই বৎসর অনুরাধাদের সংসারেরও অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আকস্মিকভাবেই বৎসরখানেক আগে মধুছন্দার বিয়েটা হয়ে গেল। রিটায়ার্ড জজ যোগেশবাবু হাঁটতে হাঁটতে লেক থেকে ফিরবার পথে অনেক দিন মধুছন্দাকে দেখেছেন, কারণ তার বাড়িও ছিল ঐ রজনী সেন স্ট্রীটেই! একমাত্র ছেলে তার ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ার, ভিলাইতে চাকরি করছিল, স্ত্রীর অনেক দিন আগেই মৃত্যু হয়েছিল, ছেলে যেবার আই. আই. টি.-তে ভর্তি হয়। সংসারে বাপবেটা ছাড়া কোন তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না। ছেলের বিবাহ দেবেন বলে যোগেশবাবু পাত্রী দেখছিলেন, মধুছন্দাকে দেখে তার ভাল লাগে, তিনি নিজে তার মা সরোজিনীর সঙ্গে দেখা করে বিবাহের প্রস্তাব তোলেন।

মা-ও হাতে স্বর্গ পান। তাছাড়া কিছুদিন থেকে পেটের একটা যন্ত্রণায় মা খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন, প্রায়ই শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হত তাকে এবং আরও একটা কথা—অনুরাধার কথা ভেবে তার মনের সমস্ত শান্তি চলে গিয়েছিল। মেয়ে অনু চাকরি নেবার কয়েক মাস পর থেকেই যেন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলেন ওদের মা সরোজিনী দেবী।

অনুরাধা প্রায়ই তার অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে আজ দিল্লী, পরশু বোম্বাই, তরশু মাদ্রাজ যেতে শুরু করল কখনও সাত দিন, কখনও দশ দিন পরে ফিরত। অবিবাহিতা বয়সের মেয়ে, আদৌ ভাল লাগছিল না ব্যাপারটা সরোজিনীর। একদিন আর না থাকতে পেরে প্রশ্নই করলেন, অনু, সরিৎকে আর দেখি না কেন রে? সেই যে যার সঙ্গে তোর পরিচয় ছিল, এখানে প্রায়ই আসত–

তা আসে না কেন আমি জানব কি করে।

সরিৎ তো তোকে বিয়ে করবে বলেছিল—

সে বিয়ে হবে না।

বিয়ে হবে না? কেন? সে বলেছে বিয়ে করবে না?

না—আমার বস দত্ত মজুমদার চান না তার সঙ্গে আমি কোন সম্পর্ক রাখি।

সে আবার কিরকম কথা?

মিঃ দত্ত মজুমদারকেই আমি বিয়ে করছি—

দত্ত মজুমদারকে বিয়ে করবি? লোকটার তো অনেক বয়েস হয়েছে বলছিলি!

তাতে কি হয়েছে, ব্যাচিলার এখনও।

সরোজিনীর ব্যাপারটা আদৌ ভাল লাগল না, কিন্তু তিনি আর কোন কথা বললেন না।

সরিৎশেখর যে গত দুই বৎসর অনুরাধাকে কখনও পথে যেতে আসতে দেখেনি তার কারণ সে দত্ত মজুমদারের গাড়িতেই সর্বদা যাতায়াত করত। সকালে দত্ত মজুদারের গাড়ি এসে তাকে নিয়ে যেত, ফিরে আসতে আসতে প্রায়ই রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা হয়ে যেত।

সরোজিনী মেয়েকে কখনও আর কোন প্রশ্নই করেননি। অনুরাধা অফিসে চাকরি করে, মোটা মাইনে পায়, নিত্য নতুন দামী দামী শাড়ি ব্লাউজ—সবই দেখতেন সরোজিনী, কিন্তু কোন কথা বলতেন না। তবে মেয়ের হালচাল দেখে অনেক কিছুই অনুমান করতে তার কষ্ট হয়নি। তাই যোগেশবাবুর প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হয়ে গেলেন সরোজিনী। পরের মাসেই মধুছন্দার বিবাহ হয়ে গেল। সে চলে গেল তার স্বামীর কাছে দিল্লীতে। সেই মধুছন্দাই দিন কয়েকের জন্য কলকাতায় এসে তার মাকে দিদি সম্পর্কে অনেক কথা বলে গেল।

বললে, সবাই জানে মা, দিদির দত্ত মজুমদারের সঙ্গে বিয়ে হয়নি।

বিয়ে হয়নি!

না। আমি ভাল করে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, দিদি দত্ত মজুমদারের রক্ষিতার মত আছে। দত্ত মজুমদারের স্ত্রী আছে। তাহলেই বুঝে দেখ ব্যাপারটা।

সরোজিনী অস্ফুট একটা চিৎকার করে উঠলেন, মধু!

হ্যাঁ মা, ঐ দত্ত মজুমদারটা একটা স্কাউড্রেল—

সরোজিনী যেন পাথর হয়ে গেলেন। অনুরাধা সে-সময় কলকাতায় ছিল না। দিল্লীতেই ছিল। চার দিন পরে অনুরাধা যখন ফিরে এল, ব্যথায় সরোজিনী শয্যাশায়ী। সলিল দত্ত মজুমদার সব শুনে অনুরাধাকে পরামর্শ দিলেন, মাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করে দাও-খরচপত্র যা লাগে। আমিই দেব।

কি জানি কেন অনুরাধা আর কোন আপত্তি করল না। সরোজিনীও আপত্তি করলেন না। কিন্তু নার্সিং হোমে পেট ওন করে দেখা গেল ক্যানসার। এবং রোগ তখন অনেক ছড়িয়ে গিয়েছে, করবার আর কিছু নেই।

তিন মাস বাদে ঐ নার্সিং হোমেই সরোজিনী শেষ নিঃশ্বাস নিলেন। এবং তারই কিছুদিন পরে সেই বিচিত্র ঘটনাটা ঘটল।

এক শনিবার বেলা তখন সোয়া তিনটে হবে, অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। অনুরাধা ঘরে একা বসে একটা চিঠি টাইপ করছিল। পাশেই দত্ত মজুমদারের ঘরে একটা তর্কাতর্কি চেঁচামেচি তার কানে এল। কড়া-গলায় দত্ত মজুমদার ও অন্য এক ব্যক্তি পরস্পরের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছেন।

আমি জানতে চাই সলিল, মুকুল কোথায়? পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন।

আমি তোমার প্রশ্নের কোন জবাব দেব না জীমূতবাহন—

দিতে তোমাকে হবে, মুকুল আমার বোন—তোমার বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে সে নেই, সেখানে অন্য ভাড়াটে–

সে আমার স্ত্রী, আমার স্ত্রী সম্পর্কে সব কিছু তোমার এক্তিয়ারের বাইরে—

হ্যাঁ, স্ত্রীর মর্যাদা তো তাকে যথেষ্ট দিয়েছ!

এখান থেকে চলে যাও—

জবাব না নিয়ে আমি যাব না। আমি জানতে চাই, তুমি আবার বিয়ে করেছ কিনা?

আমি আবার বিয়ে করেছি? হ্যাঁ করেছি।

তবে শুনে রাখ, I shall drag you to the court. পলিগেমির শাস্তি কি সেটা জানতে তোমার দেরি হবে না।

I say get out—দত্ত মজুমদারের হাতে পিস্তল, তার ড্রয়ারে সব সময়ই একটা পিস্তল থাকত, সেটা তখন তিনি বের করেছেন Get out of this room!

ঠিক আছে আমি যাচ্ছি, তবে আবার আমাদের দেখা হবে, লোকটা চলে গেল।

পাশের ঘরে অনুরাধার মাথাটা তখন ঘুরছে। পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। একটু একটু করে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা অফিস থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিল অনুরাধা।

রাত তখন দশটা।

রজনী সেন স্ট্রীটের বাড়িতে তার ঘরে ঝিম মেরে বসে ছিল অনুরাধা।

ঝি বেলার মা সেদিন আবার কাজে আসেনি, সে-ই রান্না করে রেখে যেত, ঐ দিন রাত্রে স্থির ছিল বাইরের হোটেলে সে ও দত্ত মজুমদার ডিনার করবে।

সিঁড়িতে জুতোর শব্দ।

ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। দত্ত মজুমদার এসে ঘরে ঢুকলেন, অনু—

ফ্যাকাশে অসহায় বোবা দৃষ্টি তুলে তাকাল অনুরাধা দত্ত মজুমদারের দিকে।

তুমি হঠাৎ অফিস থেকে আমায় না বলে চলে এলে কেন অনু? চল চল, ডিনার খেতে যাবে না?

না। তারপরই অনুরাধা বললে, তুমি–তুমি বিবাহিত?

কে বললে?

যেই বলুক কথাটা সত্যি কিনা তাই শুধু জানতে চাইছি!

না, সত্যি নয়—

সত্যি নয়? তুমি বিবাহিত নও—তোমার স্ত্রীর নাম মুকুল নয়?

হ্যাঁ, তার নাম মুকুলই ছিল। মানে অনেককাল আগে একজনকে বিয়ে ঠিক নয় লাইফ কম্প্যানিয়ান হিসাবে ছিল, সেই মুকুল।

ছিল মানে?

সে বেঁচে নেই। দুই বৎসর আগে তার মৃত্যু হয়েছে, She is dead.

আমি কথাটা বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যুক—

আমার কথা তুমি বিশ্বাস করো না রাধা?

না—না—না–করি না, তুমি চলে যাও–

কেন কেলেঙ্কারি করবে, নীচের ভাড়াটেরা সব জেনে যাবে, চল আমার পার্ক স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে চল।

না, যাব না আমি।

দুজনের মধ্যে মনোমালিন্যের সূত্রপাত ওখানেই।

যায়নি সেদিন অনুরাধা সলিল দত্ত মজুমদারের পার্ক স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে। কিন্তু তারপর কটা দিনই বা, নিজের অপমান লজ্জা ও কেলেঙ্কারির ভয়ে অনুরাধাকে কয়েকদিন পরেই আবার। সলিল দত্ত মজুমদারের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকতে হয়েছিল। কিন্তু মনের মধ্যে যে চিড় খেয়েছিল সেটা আর জোড়া লাগল না। ক্রমশ সেটা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে চলেছিল। একটা অজগর যেমন তার শিকারকে গ্রাস করে, দত্ত মজুমদার যেন তেমনি করেই তাকে গ্রাস করেছিল। বের হয়ে আর আসতে পারেনি অনুরাধা সেই গ্রাস থেকে।

কিন্তু আজ আজ আবার অনেক দিন পরে সরিৎকে দেখে অনুরাধার মনের মধ্যে যেন–একটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। সে যেন এই দুর্বিসহ বন্দী জীবন থেকে বেরুবার একটা ইঙ্গিত পেয়েছে। মনের কোথায় যেন একটা মুক্তির বাঁশি শুনতে পেয়েছে।

তার এই দুই বৎসরের বন্দীজীবনে কতবার ভেবেছে সরিৎশেখরের কাছে সে ছুটে যায়, কিন্তু কেন যেন সাহস হয়নি।

ঐ দত্ত মজুমদার মানুষটা হয়তো তাহলে সরিৎশেখরকেও নিষ্কৃতি দেবে না, ভয়ংকর চরিত্রের ঐ মানুষটা, ওকে বিশ্বাস নেই।

অনুরাধা মনে মনে স্থির করে, আজ সে বলবে, সরিৎকে সব কথা বলবে। বলবে, বাঁচাও আমাকে সরিৎ, আমাকে বাঁচাও। বালুর উপর বসেছিল অনুরাধা, উঠে দাঁড়াল, হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা একটা বেজে গিয়েছে। সূর্য দেখা যাচ্ছে না, আকাশে মেঘ জমেছে, একটা কালো শান্ত ছায়া যেন আকাশ ও সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুরাধা আবার হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

অনুরাধা যখন হোটেলের ১৬নং ঘরে এসে ঢুকল, সলিল দত্ত মজুমদার তখন একটা চেয়ারে বসে ঐ দ্বিপ্রহরে নির্জলা হুইস্কি পান করছিল। কাল রাত্রে যে বোতলটা খুলেছিল, আজ দুপুরের আগেই সেটা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।

অনুরাধাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সলিল দত্ত মজুমদার ওর দিকে চোখ তুলে তাকাল। চোখ দুটো লাল, মাথার চুল রুক্ষ।

এতক্ষণ কোথায় ছিলে? সলিল প্রশ্ন করল।

অনুরাধা কোন জবাব দিল না।

আমার কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন হারামজাদী! কথার জবাব দে—যেন একটা বিষাক্ত কেউটে রাগে হি হি করে।

অনুরাধা নির্নিমেষ চেয়ে আছে ঐ লোকটার দিকে।

পুরানো নাগর দেখে পীরিত উথলে উঠেছিল, তাই না? আবার গর্জে উঠল সলিল দত্ত মজুমদার, জবাব দে।

মনে রাখবেন এটা হোটেল। পাশের ঘরে লোক আছে।

Shut up! চেঁচিয়ে উঠল সলিল দত্ত মজুমদার।

অনুরাধা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সলিল দত্ত মজুমদার চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়া, এক পা এগুবি তো কুকুরের মত গুলি করে মারব। হারামজাদী, বেশ্যা!

কি কুৎসিত দেখাচ্ছিল দত্ত মজুমদারের মুখটা, যেন একটা কালো নেকড়ে বাঘ। রক্তাক্ত চোখের চাউনি থেকে যেন কুটিল হিংস্রতা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে অনুরাধা লোকটার মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়েছিল, ঘৃণায় লজ্জায় যেন অনুরাধা ঐ মুহূর্তে পাথর হয়ে গিয়েছে। এইটাই বোধ করি ঐ মানুষটার সত্যিকারের পরিচয়।..

পাশের ১৭নং ঘরে ছিল কিরীটী। পাশের ১৬নং ঘরের দেওয়াল ভেদ করে যেন সলিল দত্ত মজুমদারের প্রত্যেকটি কথা স্পষ্ট তার কানে যাচ্ছিল। আর একজনও শুনতে পাচ্ছিল—চন্দ্রকান্ত ঘাই, একটু আগে যে ১৫নং ঘরে এসে ঢুকেছে। তারও কানে যায় কথাগুলো। সে দেওয়ালে কান পেতে দাঁড়ায়। ঐ গলাটা তার চেনা। তাহলে এই হোটলের ঠিক পাশের ঘরেই ঐ লোকটা এসে উঠেছে! চন্দ্রকান্ত ঘাই মনে মনে হাসে। সংবাদটা তাহলে মিথ্যা নয়? চন্দ্রকান্ত ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল। তারপর পকেট থেকে একটা বিড়ি নিয়ে দেশলাই দিয়ে বিড়িটা ধরাল। তারপর যেন পরম নিশ্চিন্তে বিড়িটায় সুখটান দিতে লাগল।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনুরাধা বলল, আমি আজকের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরে যাব।

কি বললি! ফিরে যাবি?

ভদ্রভাবে কথা বলুন, অনুরাধা বলল! নতুবা এখুনি আমি নীচে গিয়ে তোক জড়ো করব—থানায় যাব।

জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হঠাৎ গুটিয়ে যায়, থানার নাম শুনে সেও যেন চুপসে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বার দুই কেবল হেঁচকি তুলল উ উ শব্দে।

আমি নীচে গিয়ে লোক জড়ো করে তাদের বলব, আপনি আমাকে জোর করে এখানে ধরে রেখেছেন—

তুমি আমার স্ত্রী-মিনমিনে গলায় সলিল দত্ত মজুমদার বললে।

না, কোন দিনই আপনার স্ত্রী ছিলাম না, আজও নই।

কিন্তু আমাদের বিয়ে হয়েছে–

সে বিয়ে আইনত অসিদ্ধ, আদালতে গেলেই তা প্রমাণ হবে। অনুরাধা যেন কুঁসছিল। আরও সে কিছু বলত কিন্তু বন্ধ দরজার গায়ে করাঘাত পড়ল।

দত্তবাবু, দত্তবাবু–

কে?

আমি চাদু, হোটেলের বেয়ারা।

সলিল উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল, কি চাই?

ম্যানেজারবাবু বলে পাঠালেন, আপনার ট্যাক্সি ঠিক হয়ে গিয়েছে। ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞাসা করছে আপনি কখন বেরুবেন।

চল, আমি নীচে যাচ্ছি।

অনুরাধা খোলা জানলাটার সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল।

কালো মেঘ ক্রমশ আকাশে স্থূপীকৃত ও ঘনীভূত হচ্ছে, মনে হয় এবারে হয়তো বৃষ্টি নামবে। একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাবও পাওয়া যাচ্ছিল সমুদ্রের বাতাসে।

একটা বিশ্রী তিক্ততায় অনুরাধার মনটা যেন ভরে গিয়েছে। একটা কথাই তার কেবলই মনে হচ্ছিল, এখানে এই মানুষটার সঙ্গে এক মুহূর্ত আর নয়, এখুনি এই মুহূর্তে চলে যেতে পারলে যেন ভাল হয়।

সলিল দত্ত মজুমদার এসে ঘরে ঢুকল। অনু—

গলার স্বর তার সম্পূর্ণ পালটে গয়েছে, এ যেন সে মানুষ নয়। সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। সলিল আরও একটু কাছে এগিয়ে এল অনুরাধার-I am really sorry অনু, আমাকে ক্ষমা কর।

অনুরাধা চেয়ে আছে নিঃশব্দে তখনও জানালা-পথে বাইরের দিকে। একেবারে যেন বোবা অনুরাধা। ফিরেও তাকাল না সলিলের দিকে!

হঠাৎ যেন কেমন রাগ চড়ে গেল অনু, কতকগুলো কটু কথা—

অনুরাধা পূর্ববৎ নীরব। জানলা-পথে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।

আমাকে ক্ষমা কর অনুরাধা, ক্ষমা চাইছি, তোমায় কথা দিচ্ছি আর এমনটি কখনও হবে না। তাকাও, please, আমার দিকে তাকাও।

অনুরাধা তথাপি ফিরে তাকায় না।

তুমি কেন ঐ লোকটার ঘরে গেলে, ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে—তাইতেই তো হঠাৎ রাগ চড়ে গেল আমার, সলিল দত্ত মজুমদার আবার বললে।

অনুরাধা এতক্ষণে ফিরে তাকাল, বলল, আমি আজকের এক্সপ্রেসেই ফিরে যেতে চাই

আমাদের রিটার্ন টিকিট তো কালকের, আজ ফিরব কেমন করে? তাছাড়া আমার অফিসের একটা জরুরি কাজ আছে, আমি ভুবনেশ্বরে যাচ্ছি। কাল দশটার মধ্যেই ফিরে আসছি, কালই যাব আমরা।

অনুরাধা কোন কথা বলল না।

আমি বেরুচ্ছি, নীচে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, আর আমার সঙ্গে যদি তুমি ভুবনেশ্বরে যেতে চাও তো–

না, আমি যাব না।

অনুরাধা তখন ভাবছে, অন্তত একটা রাত তাকে ঐ জানোয়ারটার পাশে শুতে হবে না, ওর পশু-কামনাকে চরিতার্থ করতে হবে না তাকে।

তাহলে থাক তুমি, আমি চললাম। সলিল দত্ত মজুমদার বের হয়ে গেল।

জানালা-পথে একটু পরেই অনুরাধা দেখতে পেল ট্যাক্সিটা হোটেলের সামনে থেকে চলে গেল সলিল দত্ত মজুমদারকে নিয়ে।

এতক্ষণে যেন বুকভরে একটা হালকা নিঃশ্বাস নিল অনুরাধা।

১৮নং ঘরে সরিৎশেখর নিঃশব্দে জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে, কালো মেঘের ছায়া পড়েছে সমুদ্রের বুকে। এবারে বৃষ্টি নামবে-সমস্ত আয়োজন তার শেষ। বিদ্যুৎ চমকাল। এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়া সনসন করে বয়ে এল ঘরের মধ্যে। মনে পড়ে গেল আবার সরিশেখরের অনুরাধার সেই কথাটা—আজ ২৯শে জুলাই। ২৯শে জুলাই তার পরিচয় অনুরাধার সঙ্গে, দুজন দুজনকে জেনেছিল প্রথম। মনে পড়ে সরিশেখরের সেদিনের সেই ২৯শে জুলাই ছিল মঙ্গলবার। সরিতের এক বন্ধু হিমাংশু, তার গণনার বাতিক ছিল, ওকে একদিন হিমাংশু বলেছিল, মঙ্গলবারটা সব সময় এড়িয়ে যাবি সরিৎ, মঙ্গলে তোর জন্ম, সেদিন ছিল রাহু আর শনি মুখখামুখি, কোন ভাল কাজ ঐ মঙ্গলবারে করবি না, তোর পক্ষে সবচাইতে ভাল রবিবারটা।

হেসেছিল সরিৎশেখর। বলেছিল, বোগাস!

আজ হঠাৎ মনে পড়ছে সেদিনের সেই ২৯শে জুলাই ছিল মঙ্গলবার।

একটা আবছা পর্দা দুলতে দুলতে সাগরের মাথা ছুঁয়ে এগিয়ে আসছে। বৃষ্টি নেমেছে, বৃষ্টির ধারা ছুটে আসছে। একটু আগে সরিৎ দেখেছে সলিল দত্ত মজুমদার একটা গাড়িতে চেপে বের হয়ে গেল।

অনুরাধা ভাবছিল, এই শেষ। সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে তার সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছাড়বে কি সলিল দত্ত তাকে? যেতে কি দেবে তাকে? অনুরাধা জানে, দেবে না সলিল—অত সহজে সলিল তাকে মুক্তি দেবে না। সে তার হিংস্র নিষ্ঠুর থাবা দিয়ে অনুরাধাকে তার কাছে রাখবার চেষ্টা করবে। ঐ মানুষটার সঙ্গে তার রাতের পর রাতের স্মৃতিসেই কামনাসিক্ত হিংস্র একটা জানোয়ারের মত রাতের পর রাত তার দেহটাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। যন্ত্রণায় সে কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠেছে। একটির পর একটি রাত গিয়েছে আর মনে মনে মুক্তির জন্য হাঁসফাঁস করেছে সে। একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎ অনুরাধার। কটক স্টেশন থেকে একটা ছুরি কিনেছে সে। সুদৃশ্য হরিণের সিংয়ের বাঁট আর ইস্পাতের ফলাটা চকচক করছে, সুটকেসেই আছে ছুরিটি। সুটকেসটা খুলে অনুরাধা ছুরিটা বের করল। ছুরিটা হাতে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। সলিল যদি আবার তার কাছে আসতে চেষ্টা করে, জোর-জার করে, এই ছুরিটা,সমূলে সে বসিয়ে দেবে তার বুকে না হয় পেটে।

টক্ টক্ টক্‌। দরজার কবাটে মৃদু আঘাত একবার দুবার–তিনবার।

কে? অনুরাধা প্রশ্ন করল।

অনুরাধা-আমি সরিৎ–

অনুরাধা দরজাটা খুলে দিল। হুহু করে একঝলক বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ছুটে এল। ঘরের মধ্যে ঝাপসা ঝাপসা আলো।

অনুরাধা—

এই যে আমি, এসো-অনুরাধা সরিতের দিকে এগিয়ে গেল।

এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দত্ত মজুমদার কোথায় গেলেন?

ভুবনেশ্বরে—

সেখানে কি?

বলে গেল তার অফিসের জরুরি কাজ আছে। মরুকগে সে, জান সরিৎ, একটু আগে তোমার কথাই ভাবছিলাম।

আমার কথা?

হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথাটা। সরিৎ, তুমি কি সত্যি সত্যিই আমাকে ভুলে গিয়েছ? মন থেকে তোমার একেবারে মুছে ফেলেছ?

তাই তো স্বাভাবিক অনুরাধা।

স্বাভাবিক, তাই না! আমি তো তোমাকে কই আজও ভুলতে পারিনি।

ঘরের মধ্যে ঝাপসা অন্ধকারটা আরও ঘন হয়েছে। বাইরের অন্ধকার যেন ঘরের মধ্যে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।

শুনবে আমার সব কথা? অনুরাধা বললে।

শুনে কি লাভ।

তবু বোধ হয় সব কথা তোমার জানা দরকার সরিৎ–

সরিৎশেখর কোন জবাব দিল না।

অনুরাধা বলে গেল তার কথা। একটু একটু করে থেমে থেমে।

সরিৎশেখর একেবারে নির্বাক বোবা।

আমাকে আমাকে তুমি মুক্তি দিতে পার না?

কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি সলিল দত্ত মজুমদারের বিবাহিতা স্ত্রী।

ও বিবাহ তো মিথ্যা, একটা প্রতারণা।

তাই যদি মনে কর তো মুক্তি তো তোমার নিজের ইচ্ছাতে।

না, তোমার হাতে সরিৎ। তোমার হাতে। আমাকে তুমি নিয়ে চল সরিৎ দূরে, অনেক দূরে কোথাও!

আজ আর তা হয় না অনু!

আবার তোমার সেই ভয়—সেদিন যে ভয় তোমার আমাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি, আজও সেই ভয়? কেন—কেন সেদিন তুমি জোর করে আমাকে ধরে রাখলে না? কেন বলতে পারলে– না, না, তোমাকে আমি যেতে দেব না। তবে তো এই আকণ্ঠ গ্লানির মধ্যে আমাকে ড়ুবে যেতে হত না।–

অনুরাধার গলার স্বরটা যেন কেমন হয়ে এল। সরিতের মনে হল, অনুরাধা যেন কাঁদছে।

হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনুরাধা ছুটে এসে সরিশেখরের বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুহাতে প্রাণপণ শক্তিতে আঁকড়ে ধরল।

ঝড়বৃষ্টি থামেনি। থেকে থেকে সোনালী একটা চাবুকের মত অন্ধকার আকাশটা চিরে দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, প্রবলধারায় বৃষ্টি, সোঁ সোঁ হাওয়ার গর্জন।

রাত কত হল কে জানে!

ইতিমধ্যে কিরীটী তার ঘরে বসেই কিছু খেয়ে নিয়েছে।

হাতঘড়িটার দিকে তাকাল কিরীটী। রাত দশটা পনেরো।

বোঝবার উপায় নেই এত রাত হয়ে গিয়েছে, জানলার কপাটগুলো থর থর করে কাঁপছে হাওয়ার ঝাপটায়। কি খেয়াল হল কিরীটীর, সমুদ্রের দিকের জানলাটা একবার খুলল। একটা বিদ্যুতের ঝলসানো আলোর চমক।

আর সেই ক্ষণিকের আলোয় কিরীটীর চোখে পড়ল—একটা মনুষ্যমূর্তি হোটেলে প্রবেশ করল। এই রাত্রে—এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে হোটেল থেকে কে বাইরে গিয়েছিল? নাকি কেউ এল?

কিরীটী তাড়াতাড়ি জানলার কপাট চেপে এঁটে দিল ছিটকিনিটা।

সারাটা রাত্রি বর্ষণ ও ঝড়ের বিরাম ছিল না। শেষরাত্রির দিকে ঝড় ও বৃষ্টির প্রকোপ কমে এল ধীরে ধীরে। কিন্তু বাতাস তখনও বেগে বইছে।

শেষরাতের দিকে বোধ করি সামান্য সময়ের জন্য চোখে একটু তন্দ্রামত এসেছিল কিরীটীর, তাটা ভেঙে গেল দরজায় করাঘাত শুনে–

রায়মশাই, রায়মশাই দরজাটা খুলুন।

হোটেলের মালিক ভবেশ অধিকারীর গলা, কিরীটী উঠে দরজাটা খুলতেই যেন একটা দমকা হাওয়ার মত ভবেশ অধিকারী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন।

কি ব্যাপার ভবেশবাবু?

খুন—

খুন! কিরীটীর বিস্ময়-প্রশ্ন।

হ্যাঁ, খুন। ১৬নং ঘরে—

মানে আমার এই পাশের ঘরে? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন কর।

হ্যাঁ।

কে খুন হয়েছে?

অনুরাধা দেবী।

সে কি!

চলুন–

মেঝেতে পড়ে আছেন ভদ্রমহিলা, গলাটা দুফাঁক করে কাটা। কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললে, আপনি কখন দেখলেন?

সবে ঘুম ভেঙে উঠে–ভবেশ অধিকারী বললেন, ঘরের বাইরে বের হয়েছি চাকরবাকরকে জাগাব বলে, হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাতে নজর পড়ল ১৬নং ঘরের দরজা খোলা, দরজার পাল্লা দুটো হাওয়ায় পড়ছে আর খুলছে। তাড়াতাড়ি ওপরে এলাম, ভদ্রমহিলার স্বামী নেই, কাল কাজে ভুবনেশ্বরে গিয়েছেন, উনি একা ছিলেন, তাই আমাকে বলে গিয়েছিলেন একটু নজর রাখতে ওঁর ওপরে! এখন কি হবে রায়মশাই!

ওঁর স্বামী রাত্রে ফেরেননি?

না, আজ দুপুরে ফিরবার কথা, আজকের এক্সপ্রেসেই চলে যাবেন ওঁরা।

ভবেশ অধিকারী আবার বলতে লাগলেন, এবারে আর হোটেলটা টিকিয়ে রাখতে পারব না। হোটেল এবার উঠেই যাবে। তিন বৎসর আগে এক ভদ্রলোক গলায় ক্ষুর চালিয়ে ১৭নং মানে এই ঘরে আত্মহত্যা করেছিলেন, সেই ঘটনার পর হোটেল প্রায় উঠেই যেতে বসেছিল, এবার হয়েছে খুন–

দুর্ঘটনার জন্য তো আর আপনি দায়ী নন ভবেশবাবু, কিরীটী বলল।

সে কথা লোক কি বুঝবে। হোটেলের নামে দুর্নাম রটে যাবে। এতদিনের ব্যবসা-সর্বনাশ হয়ে গেল আমার রায়মশাই!

চলুন একবার পাশের ঘরে কিরীটী বলল।

আকাশ তখনও মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টি না থামলেও হাওয়া বইছে এলোমেলো। সমুদ্র আথালিপাথালি করছে, বড় বড় ঢেউ তীরের উপর এসে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। হোটেলের বাসিন্দারা তখনও কেউ ওঠেনি। পাশের ঘরে অর্থাৎ ১৬নং ঘরে এসে ঢুকল কিরীটী খোলা দরজাপথে। হাওয়ার দাপটে দরজায় পাল্লা দুটো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে! ঘরের মধ্যে আলোটা জ্বলছে। সেই আলোতেই কিরীটীর ভয়াবহ সেই দৃশ্যটা নজরে পড়ল। ঘরের মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্তের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অনুরাধার দেহটা, ঘাড়ে একটা চারইঞ্চি পরিমাণ গভীর ক্ষত, —হাঁ হয়ে আছে। বুঝতে কষ্ট হয় না কোন ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে আততায়ী পশ্চাৎ দিক থেকে মেয়েটিকে মোক্ষম আঘাত হেনেছে। এবং সে আঘাতের ফলে মৃত্যু ঘটেছে।

পরনের শাড়িটা আগোছালো। ব্লাউজের পিঠের দিকে ছেড়া—শুভ্র পৃষ্ঠদেশ উন্মুক্ত অনেকটা। বাম হাতটা প্রসারিত, ডান হাতে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি মুঠো করে ধরা।

ঘরের চারপাশে তাকাল কিরীটী। একটা চেয়ার উলটে পড়ে আছে, শয্যাটা এলোমেলো, চাদরটা নীচের দিকে ঝুলছে। ঘরের সর্বত্র একটা ধস্তাধস্তির চিহ্ন।

কি নাম ভদ্রমহিলার? কিরীটী প্রশ্ন করল।

অনুরাধা দত্ত মজুমদারসলিল দত্ত মজুমদারের স্ত্রী।

করে এসেছিলেন এখানে?

চারদিন আগে। কথা ছিল দিন দশেক থাকবেন, কিন্তু হঠাৎ মত পালটান দত্ত সাহেব। আজই যাবার কথা ছিল, আমিই টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

আপনি বলছেন ভদ্রমহিলা দত্ত মজুমদারের স্ত্রী, কিন্তু মাথায় সিঁদুর দেখছি না তো! হাতেও শাঁখা বা লোহা দেখছি না। দুগাছা করে মাত্র সোনার চুড়ি।

হয়তো পরেন না। আজকাল তো অনেকেই ওসব ব্যবহার করেন না।

তা বটে, তা আপনি ঠিক জানেন তো ভবেশবাবু, ওঁরা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন?

খাতায় তো তাই লিখেছেন।

১৫নং ঘরে কেউ আছেন?

কালই এসেছেন এক ভদ্রলোক, নাম চন্দ্রকান্ত ঘাই–

আমি তো কাল রাত্রে পাশের ঘরেই ছিলাম, কোন চেঁচামেচি বা গোলমালও আমার কানে আসেনি। কিরীটী বলল।

যা ঝড়জল গিয়েছে রাত্রে—তা শুনবেন কি!

তা ঠিক। ভাল কথা, এখানকার থানা অফিসার কে? চেনেন তাঁকে?

খুব চিনি। হেমন্ত সাহু। বছরখানেক হল এখানে এসেছেন।

ঠিক আছে, থানায় একটা খবর পাঠান।

ভবেশ অধিকারী যেন একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কিরীটী বললে, এই ঘরটায় একটা তালা দিয়ে দিন।

আরও মিনিট কুড়ি পরে।

নীচের তলায় অফিসে কিরীটী বসে ছিল। সামনে এক কাপ চা।

ভবেশ অধিকারীও সামনে এক কাপ চা নিয়ে ঝিম মেরে চেয়ারটার ওপরে বসে। তার মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছিল। বোর্ডাররা এখনও কেউ ব্যাপারটা জানে না। কিন্তু আর কতক্ষণ, সাহু এসে পড়বেন হোটেলে, সঙ্গে সঙ্গে জানাজানি হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তারপর যে কি ঘটবে ভাবতেও ভবেশ অধিকারীর হাত-পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।

সরিৎশেখর এসে অফিসে ঢুকল।

এই যে ম্যানেজারবাবু, সরিৎ বললে, আপনি এখানেই আছেন, আমার বিলটা তৈরি রাখবেন, আমি আজই চলে যাব।

চলে যাবেন! কেন? কেমন যেন বোকার মতই প্রশ্ন করলেন ভবেশ আধিকারী।

এমন বিশ্রী ওয়েদার শুরু হল, এখানে থাকার আর কোন মানে হয় না। এক্সপ্রেসে তো রিজার্ভেশন পাব না, ভাবছি ভুবনেশ্বর থেকে প্লেনেই যাব।

এই দুর্যোগে প্লেন কি ছাড়বে? কিরীটী বলল।

ছাড়বে না? কিরীটীর কথায় ওর মুখের দিকে তাকাল সরিৎশেখর।

মনে হয় ছাড়বে না। দেখুন আবার বৃষ্টি শুরু হল, বলল কিরীটী!

তা আর কি করা যাবে। ভুবনেশ্বরেই না হয় একটা দিন থাকব। হোটেল তো সেখানে আছেই, আপনি বিলটা রেডি করে বরং আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন। কথাগুলো বলে সরিৎশেখর আর দাঁড়াল না, ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেল। কিরীটী সরিতের গমনপথের দিকে তাকিয়েছিল।

কেমন যেন একটা ব্যস্ততা, একটা অস্থিরতা ভদ্রলোকের কথাবার্তায়, হাবেভাবে। কেন জানি

কিরীটীর মনে হল, কেবল কি এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্যই ভদ্রলোক চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন?

ভবেশবাবু, ভদ্রলোক দোতলায় কোন্ ঘরে থাকেন?

১৮নং ঘরে, আপনার ঠিক পাশের ঘরে। দেখলেন তো রায়মশাই, আপনাকে বলেছিলাম, আমার সর্বনাশ শুরু হল, সবাই চলে যাবে—

ভদ্রলোক তো এখনও ব্যাপারটা জানেন না! কিরীটী বললে।

জানেন না কি, নিশ্চয়ই জেনেছেন, দোতলারই একটা ঘরে যখন খুন হয়েছে—

কিরীটী প্রত্যুত্তর মৃদু হাসলেন, আচ্ছা ভবেশবাবু, হোটেলের তো সবাই জাগছে, কিন্তু ১৫নং ঘরের ভদ্রলোকটি তো এখনও জাগেননি, এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছন নাকি?

ভবেশ অধিকারী কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, বলা হল না। হোটেলের সামনে সাইকেলরিকশা থেকে থানার দারোগা হেমন্ত সাহুকে নামতে দেখা গেল।

ঐ যে দারোগাবাবু—শুকনো গলায় বললেন ভবেশ অধিকারী।

হেমন্তবাবু রিকশা থেকে নেমে একটা কোলাব্যাঙের মত থপ থপ করে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের অফিস ঘরে এসে ঢুকলেন।

মোটা বেঁটে থলথলে চেহারা, ঠোটের ওপরে ভারী একজোড়া গোঁফ। চোখ দুটো ছোেট, বর্তুলাকার মুখ বসন্তের দাগে ভর্তি, পরনের ইউনিফর্ম টাইট হয়ে গায়ে বসেছে।

কি ব্যাপার ভবেশবাবু, কে খুন হল?

ভবেশ অধিকারীর গলার স্বর বসে গিয়েছে। তিনি বললেন, ১৬নং ঘর।

১৬নং ঘর খুন হয়েছে–

না, ঐ ঘরে এক ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন।

ঘরে আর কেউ ছিল না?

না, ওঁর স্বামী গতকাল জরুরি কাজে ভুবনেশ্বর গিয়েছেন, এখনও ফেরেনি, বললে কিরীটাই এবারে।

আপনি? কথাটা বলে সাহু তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

জবাব দিলেন ভবেশ অধিকারী, উনি স্যার, কিরীটী রায়–নামকরা একজন সত্যসন্ধানী, মানে ডিটেকটিভ।

হুঁ, তা উনি এখানে কেন?

আমি এই হোটেলেই গতকাল এসে উঠেছি।

হুঁ। চলুন ডেড বডি কোথায়? ১৬নং ঘরে বললেন না! কাল রাতে যখন অত ঝড়বৃষ্টি চলছিল তখনই বুঝেছিলাম একটা অঘটন কিছু ঘটবে! কে জানত একেবারে যাকে বলে আমার নাকের ডগাতেই, আপনার হোটেলেই সেটা ঘটে বসে আছে। আর শালার এস. পি.-ও কাল থেকে থানায় এসে বসে আছে—তা ১৬নং ঘরটি কোথায়?

দোতলায়, ভবেশ বললে।

চলুন, যত সব ঝুটঝামেলা, খুরদা রোডে বেশ ছিলাম, ছিচকে চোরের কিছুটা উৎপাত ছিল বটে কিন্তু এমন খুনজখম ছিল না।

কিরীটী মৃদু মৃদু হাসছিল নিঃশব্দে। সেদিকে নজর পড়ায় সাহু বললেন, হাসছেন যে, হাসির কথাটা কি হল জানতে পারি কি?

আপনাদের এস. পি. মিঃ নির্মল বড়ুয়া না?

চকিতে ফিরে তাকালেন সাহু-হ্যাঁ, তার নাম জানলেন কি করে?

তাঁর সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে, থানায় ফিরে গিয়ে আমার নামটা বললেই তিনি চিনতে পারবেন।

কি যেন আপনি করেন, ভবেশবাবু বলছিলেন?

তিন বছর আগে এই হোটেলেই ঐ দোতলায় ১৭নং ঘরে একটা খুন হয়েছিল, সেই ব্যাপারেই–

খুন হয়েছিল তিন বছর আগে এই হোটেলে?

হ্যাঁ, ওঁকেই মানে ভবেশবাবুকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিঃ সাহু! তাই এখানে আসার আগে, মিঃ বড়ুয়াকে ট্রাংককলে আমি কটকে আসার কথাটা জানিয়েছিলাম। তার এবং আপনার .. সাহায্যের হয়তো আমার প্রয়োজন হতে পারে। তিনি আমায় বলেছিলেন, আপনি একজন খুব কমপিটেন্ট অফিসার–

তা এসব কথা আমাকে আগে বলবেন তো!

সাহুর ব্যবহার তো বটেই, গলার স্বর কথাবার্তাও যেন পালটে গিয়েছে।

ভেবেছিলাম আজ সকালেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব থানায়–

হ্যাঁ হ্যাঁ, গতরাত্রেই সাহেব আমাকে বলছিলেন বটে–কিন্তু আপনি যে ঘটনার কথা বলছেন সেসব গতরাত্রেই থানার পুরাতন ডাইরি উলটে-পালটে আমি দেখছিলাম—সেটা তো একটা সুইসাইড কেস!

না, হোমিসাইড খুন—ডায়াবলিকাল মার্ডার, আর এখানে এই হোটেলে গতরাত্রে ১৬নং * ঘরে যা ঘটেছে সেটাও তাই, মার্ডার-নৃশংস খুন!

আপনি ডেডবডি দেখেছেন মিঃ রায়?

হ্যাঁ। পিছন থেকে আকস্মিকভাবে কোন ধারাল অস্ত্র চালিয়ে এমন আঘাত করা হয়েছে যে তাতেই ভদ্রমহিলার মৃত্যু হয়েছে বলে আমার ধারণা।

অস্ত্র কি–কাটারী?

না, ধান কাটা হয় যে কাস্তের সাহায্যে, আমার অনুমান সেই ধরনেরই কোন অস্ত্র আততায়ী ব্যবহার করেছিল। তারপর মৃতের হাতে একটা ধারাল ছুরি গুজে দিয়ে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

বুঝলেন কি করে?

ওটা উল্ডের পজিসন ও ডেপথ দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন মিঃ সাহু।

কিন্তু ভদ্রমহিলাকে কে খুন করল?

হত্যাকারীর মোটিভ বা উদ্দেশ্য একটা কিছু ছিল বৈকি। বিনা মোটিভে তত খুন হয় না। কিরীটী বললে।

আসুন না, চলুন উপরে আমার সঙ্গে। সাহু অনুরোধ জানালেন।

বেশ চলুন।

সেই ১৬নং ঘর, সেই রক্তাক্ত মৃতদেহ। চারপাশে মেঝেতে জমাটবাঁধা কালো চাপ চাপ রক্ত। সাহু সেই দৃশ্যটা দেখে যেন থমকে গেলেন। অস্ফুটকণ্ঠে বললেন, উঃ, কি ভয়ানক!

বাইরে তখন আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মেঘে মেঘে আকাশটা কালো হয়ে গিয়েছে।

মেয়েটার বয়স কত হবে বলুন তো মিঃ রায়? সাহুর প্রশ্ন।

বছর ২৮/২৯ তো হবেই–

বলছিলেন না ভবেশবাবু, মেয়েটি বিবাহিতা, কিন্তু মাথায় বা কপালেও সিঁদুর দেখছি না। বউ-টউ সাজিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে ফুর্তি করতে

না, না, ওঁরা স্বামী-স্ত্রীই—প্রফেসারও তাই বলছিলেন গতকাল সকালে। প্রফেসারও ভদ্রমহিলাকে চিনতেন। ভবেশ অধিকারী প্রতিবাদ জানালেন।

অধ্যাপক! কে অধ্যাপক?

অধ্যাপক সরিৎশেখর সেন, ঐ তো দোতলাতে ১৮নং ঘরে উঠেছেন—

আমার বাম দিককার ঘরে, কিরীটী বললে, আমি ১৭নং ঘরে আছি।

সাহু বললেন, এ ঘরের ডানদিকে ১৫নং ঘরে কেউ নেই ভবেশবাবু?

আছেন। গতকালই এসেছেন। চন্দ্রকান্ত ঘাই নামে এক ভদ্রলোক।

মিঃ রায়, আপনি তো বললেন আপনি ১৭নং ঘরে আছেন। কাল রাত্রে আপনি কিছু শোনেননি?

না। কাল–

কিরীটীর কথা শেষ হল না, ঘরের বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। সকলেই দরজার দিকে তাকাল। ঘরে এসে ঢুকল সলিল দত্ত মজুমদার। ঘরে পা রেখেই ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার, আমার ঘরে ভিড় কেন ভবেশবাবু?

কারও মুখে কোন কথা নেই।

আপনিই মিঃ দত্ত মজুমদার? প্রশ্ন করলেন সাহুই সর্বপ্রথম।

হ্যাঁ।

উনি আপনার স্ত্রী? ঐ যে মেঝেয় পড়ে–

মেঝের দিকে তাকিয়ে একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল সলিল দত্ত মজুমদার, how horrible! এ কি! অনুরাধাকে অমন করে খুন করল কে? নাকি অভিমান করে অনুরাধা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাই করল?

আত্মহত্যা নয় মিঃ দত্ত মজুমদার, its a simple case of murder—diabolical murder! কিরীটী ধীরে ধীরে দত্ত মজুমদারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে গেল।

কিন্তু কে—কে হত্যা করল? কাদাঁদ গলায় বলল সলিল দত্ত মজুমদার।

সাহু এবারে বললেন, উনি আপনার স্ত্রী?

স্ত্রী–না, মানে ঠিক

স্ত্রী নন! পুনরায় সাহুর প্রশ্ন।

মানে ঠিক বিবাহিত না হলেও…স্ত্রীর মত ছিল, we used to live together!

সাহু অত্যন্ত স্পষ্টবক্তা। বললেন, মানে উনি তাহলে আপনার রক্ষিতা ছিলেন বলুন?

হ্যাঁ, মানে–স্ত্রীর মতই—

ইতিমধ্যে অনেক জোড়া কৌতূহলী চোখ ১৬নং ঘরের দরজার সামনে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছিল।

সলিল দত্ত মজুমদার বললেন, এখন আমি কি করি—অসহায় গলার স্বর।

সাহু বললেন, ইনভেস্টিগেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি এ হোটেল ছেড়ে কোথাও এক পা বাইরে যাবেন না।

কেন?

কারণ মৃত্যুর সঙ্গী ছিলেন আপনি—একমাত্র কাছের মানুষ এবং আপনারা দুজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে এই হোটলে এসে উঠেছিলেন।

না না, আমি একাই নয়, সলিল দত্ত মজুমদার বললেন, আরও একজন এই হোটেলে আছে। ১৮নং ঘরে-অনুরাধার পূর্বতন প্রেমিক।

কার কথা বলছেন?

প্রফেসর সরিৎশেখর সেন। কাল তো সকালের দিকে অনেকক্ষণ ১৮নং ঘরে দুজনে ঢলাঢলি করছিল। আর কাল তো সারাটা দুপুর ও রাত্রের দিকে আমি হোটেলেই ছিলাম না—ওরাই ছিল।

কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল সলিল দত্ত মজুদমারকে, হঠাৎ এবার বলল, আপনার সারা জুততা ও প্যান্টের নীচে অত বালি এল কোথা থেকে?

সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে এসেছি তো, তাই বোধ করি—

আপনি তো গাড়িতে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলেন, ফিরে এসেছেন কি সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে?

না না, তা কেন! গাড়িতেই ফিরেছি, তবে হোটেলের কাছাকাছি এসে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এলাম।

কাল কখন ভুবনেশ্বর পৌঁছেছিলেন–কখন সেখান থেকে রওনা হয়েছেন?

ভোরবেলা রওনা হয়েছি—

এখানে আসতে কতক্ষণ সময় লাগল?

তা ঘণ্টা দুই প্রায়। কিন্তু এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আর আপনি বা কে?

সাহুই জবাব দিলেন সলিল দত্ত মজুমদারের কথাটার, বললেন, উনি আমাদের লোক। যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন ওঁকে।

কিরীটী বললে, ওঁকে আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই মিঃ সাহু। আপনার যদি কিছু জানবার থাকে—

না, আমি আর কি জিজ্ঞাসা করব—হেমন্ত সাহু বললেন।

ভবেশবাবু, ঘরের দরজায় তো দেখছি গডরেজের তালা লাগানো-কিরীটী বলল।

হ্যাঁ, এই হোটেলের সব দরজাতেই গডরেজের তালা লাগানো–ভবেশ বললেন।

দুটো করে নিশ্চয়ই চাবি আছে প্রত্যেক তালার?

হ্যাঁ। একটা অফিসে থাকে, অন্যটা বোর্ডারকে দেওয়া হয়।

একটা চাবি তো দেখছি তালায় লাগানো, অন্যটা—

নীচে অফিসে আছে, কি বোর্ডে টাঙানো-আনব?

নিয়ে আসুন। আর ঐ সঙ্গে সরিৎবাবুকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে যান।

ভবেশ অধিকারী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী আবার সলিল দত্ত মজুমদারের দিকে তাকাল-মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনি অনুরাধা দেবীর প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন?

মেয়েমানুষকে কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে কি? মেয়েমানুষ জাতটাই—

অবিশ্বাসিনী হয়—তাই কি আপনার ধারণা?

তাই। নচেৎ দেখুন না, হঠাৎ পুরানো প্রেমিককে দেখেই অনুরাধার পূর্ব স্মৃতি জেগে উঠল—

প্রফেসারকে কি আপনি সন্দেহ করেন?

ঠিক ঐ মুহূর্তে প্রথমে ভবেশ অধিকারী ও তার পশ্চাতে সরিৎশেখর ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরে পা দিয়েই সরিৎশেখর অস্ফুট কণ্ঠে বললে, এ কি! অনুরাধা এভাবে—ওকে কে খুন করলে? উঃ, কি ভয়ানক।

আপনি তো চেনেন সরিৎবাবু, ওঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল—

হ্যাঁ, এক সময় ছিল ঠিকই, পরে অনুরাধা মিঃ দত্ত মজুমদারকে বিবাহ করেছিল।

আপনি সেকথা কার কাছে শুনলেন—অনুরাধা দেবী বলেছিলেন নাকি?

না, সলিল দত্ত মজুমদারই বলেছিলেন কাল। শুধান না ওঁকে!

কিন্তু ওঁদের বিয়ে তো হয়নি। অনুরাধা দেবী ওঁর কিপিংয়ে ছিলেন—

এখন মনে পড়ছে বটে, অনুরাধা ঐরকম কিছু একটা গতকাল আমাকে বলেছিল এবং এও বলেছিল ওঁর স্ত্রী আছেন—

কি মিঃ দত্ত মজুমদার, কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ ছিল, বাট শি ইজ ডেড। অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছে মনে হয়।

কথাটা ঠিক বুঝলাম না–কিরীটী বলল।

মানে অনেক বছর সে নিরুদিষ্টা হঠাৎ প্রায় চার বছর আগে আমাকে ছেড়ে সে চলে যায়, তারপর থেকে তার অনেক সন্ধান করেছি আমি কিন্তু কোন সন্ধান তার পাইনি।

আচ্ছা তাঁকে আপনি কবে বিবাহ করেছিলেন?

লন্ডন থেকে ফিরে এসে চাকরিতে ঢোকার পর।

ঐ সময় সরিৎশেখর বললে, ওঁর পূর্বতন স্ত্রী, যাকে উনি লন্ডন থেকে ফিরে এসে বিবাহ করেছিলেন বলছেন, সেই মহিলা অর্থাৎ মুকুল রায়কে উনি আদপে বিবাহই করেননি—উনি মিথ্যা বলছেন!

চকিতে সলিল দত্ত মজুমদার সরিৎশেখরের মুখের দিকে তাকাল এবং বলল, নিশ্চয় আপনার প্রেমিকা অনুরাধা আপনাকে বলেছে কথাটা?

যে-ই বলে থাকুক, কথাটা সত্যি কিনা?

না, সত্য নয়।

জীমূতবাহন রায়কে আপনি চেনেন–না তাঁকেও চেনেন না? সরিৎশেখর আবার প্রশ্ন করেন।

কে জীমূতবাহন রায়?

মুকুল রায়ের দাদা, এককালে যার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল।

জীমূতবাহন বলেও কাউকে আমি চিনি না।

অথচ ঐ জীমূতবাহনসরিৎশেখর বললে, একদিন ওঁর অফিসে ওঁকে threaten করে গিয়েছিলেন-অনুরাধাই কথাটা আমাকে কাল বলেছিল।

শি ওয়াজ এ র্যাম্পস্বৈরিণী! চাপা ক্রুদ্ধস্বরে সলিল দত্ত মজুমদার বললে।

কিরীটী ওদের তর্ক-বিতর্ক শুনছিল, এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। এবার বললে, ডঃ সেন, আপনিও পুলিশের এনকোয়ারি-পর্ব সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই হোটেল ছেড়ে কোথাও যাবেন না।

কিন্তু আমি যে আজই চলে যাব। সরিৎশেখর বললে।

সাহু বললেন, আপনি যেতে পারবেন না!

কেন, আমাকে কি হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছেন? সরিৎশেখর বললে।

কিরীটী বললে, ঘটনা পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে কেউই আপনারা সম্ভাব্য সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না। আপনি ও মিঃ দত্ত মজুমদার তো বটেই, ১৫নং ঘরে যিনি আছেন তিনিও না।

ভবেশবাবু বললেন, হয়ে গেল। আমার হোটেলই এবার উঠে গেল।

কিরীটী বললে, আপনি এ ঘরের ড়ুপলিকেট চাবিটা এনেছেন ভবেশবাবু?

না। একটা ছোট্ট ঢোক গিলে হতাশার ভঙ্গিতে ভবেশ অধিকারী বললেন, চাবিটা কি-বোর্ডে নেই রায়মশাই।

নেই মানে কি?

খুঁজে পেলাম না। ভবেশ শুকনো গলায় বললেন, চাবিটা কাল সকালেও কি-বোর্ডে ছিল কিন্তু দেখতে পেলাম না–

তবে চাবিটা গেল কোথায়? চাকরবাকরদের জিজ্ঞাসা করেছেন?

না।

কিরীটী বললে, মিঃ সাহু, চলুন পাশের ঘরের ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলা যাক। ডঃ সেন, আপনি আপনার ঘরে যান।

প্রথমে সাহু ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে এল। সরিৎশেখর ও সলিল দত্ত মজুমদারও পিছনে পিছনে এল, সকলের পশ্চাতে ভবেশ অধিকারী। বাইরে আকাশ তখনও মেঘে কালো। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, তবে হাওয়াটা কিছুটা স্তিমিত। সূর্যের মুখ মেঘের আড়ালে চাপা পড়ে আছে।

১৫নং ঘরের দরজা বন্ধ তখনও।

সাহুই বন্ধ দরজার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে চেঁচালেন, দরজাটা খুলুন, শুনছেন মশাই, দরজাটা খুলুন!

কিন্তু সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সাহু আবার ধাক্কা দিলেন আরও জোরে।

প্রায় মিনিট তিনেক ধাক্কাধাক্তির পর ঘরের দরজা খুলে গেল।

কে? কি চাই? কিন্তু ঐ পর্যন্তই—আর কথা বেরুল না চন্দ্রকান্তর গলা থেকে!

একমাথা ঝাকড়া আঁকড়া কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, পরনে একটা মলিন স্ন্যাকস ও গায়ে একটা ততোধিক ময়লা ও ছেড়া গেঞ্জি। গেঞ্জিটা যে কতদিনের পুরানো ও ময়লা কে জানে!

সাহুই প্রশ্ন করলেন, কি নাম আপনার?

আপনার নাম দিয়ে কি হবে?

সাহু এবার বেশ একটু কড়া গলাতেই বললেন, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন বলে চন্দ্রকান্তকে আর জবাবের অবকাশ না দিয়ে তাকে ঠেলেই যেন একপ্রকার সকলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঘরের মধ্যে এলোমেলো একটা শয্যা, গোটা দুই ধেনো মদের শূন্য বোতল মেঝেতে গড়াচ্ছে, এখানে ওখানে মেজেতে আধপোড়া সিগারেটের টুকরো ছড়ানো।

একপাশে মেঝেতে একটা ছোট সুটকেস, দেওয়ালের আলনায় একটা ময়লা হাফ হাতা হলদে রংয়ের টেরিকটের শার্ট ঝুলছে।

সাহু আবার প্রশ্ন করলেন, কি নাম আপনার?

চন্দ্রকান্ত ঘাই। ভাঙাভাঙা কর্কশ কণ্ঠে জবাব এল।

কোথা থেকে আসেছেন?

কলকাতা থেকে।

তা কি করা হয়?

কাজকর্ম কিছু করি না, তবে পেলে করি—

কিছু করেন না!

রিটায়ার করেছি বছর কয়েক হল, রিটায়ার করার পর থেকে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াই।

কিরীটী একদৃষ্টে চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

একমুখ কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ থাকলেও কেন যেন তার মনে হচ্ছিল ঐ মুখের সঙ্গে কোথায়। একটা ক্ষীণ সাদৃশ্য আছে তার দেখা কোন একটা মুখের। কিন্তু কিরীটী ঠিক যেন স্মরণ করতে পারে না ঐ মুহূর্তে।

চন্দ্রকান্ত বললে এবারে, কিন্তু এভাবে ডাকাডাকি করে আমার ঘুমটা ভাঙালেন কেন দারোগা সাহেব, বলবেন কি?

আপনার ঠিক পাশের ঘরেই একজন ভদ্রলোক ও একজন স্ত্রীলোক থাকতেন, নিশ্চয়ই জানেন মিঃ ঘাই? সাহুর প্রশ্ন।

না।

জানেন না?

না। হোটেলে উঠেছি, আজ না হয় কাল চলে যাব, আমার পাশের ঘরে কে আছে না আছে। সে খবর জেনে আমার কি হবে—আর তার দরকারটাই বা কি!

আপনার পাশের ঘরের মহিলাটিকে কাল রাত্রে কেউ হত্যা করেছে—

কি–কি বললেন—খুন?

হ্যাঁ, খুন। নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, কিরীটী বললে। কথাটা বলে কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে। চন্দ্রকান্তর দুচোখের তারায় একটা স্পষ্ট ভীতি।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল চন্দ্রকান্ত, তারপর একটা ঢোক গিলে বলল, তা আমার কাছে কেন এসেছেন আপনারা?

কাল রাত্রে আপনি তো পাশের ঘরেই ছিলেন—

দোহাই আপনাদের, আমি কিছু জানি না।

কিরীটী ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে, হঠাৎ প্রশ্ন করল, ঐ সুটকেসটা আপনার?

হ্যাঁ, আমার—

কি আছে ওটার মধ্যে?

জামাকাপড়, বোধ হয় একটা রামের বোতল, আর কিছু টুকিটাকি জিনিস।

দেখতে পারি?

হ্যাঁ, দেখুন না।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সুটকেসের ডালাটা খুলতেই থমকে দাঁড়াল। জামা কাপড়ের ওপরে একটা তীক্ষ্ণধার রক্তমাখা ভোজালি।

এটা কার?

ভোজালি! সে কি? ওটা কোথা থেকে এল আমার সুটকেশের মধ্যে।

কিরীটী রুমাল বের করে সন্তর্পণে ভোজালিটা তুলে নিল। মিঃ সাহু, দেখুন! হেমন্ত সাহু কিরীটীর হাতের দিকে তাকালেন। মাঝারি সাইজের সুন্দর চমৎকার হরিণের শিঙেয়ের তৈরি বাঁটওয়ালা একটা ভোজালি।

কিরীটী বললে, দেখুন, এখনও রক্তের কালো দ্রাগ শুকিয়ে আছে ভোজালিটার গায়ে। আর দেখছেন–

হ্যাঁ, একটা কালো লম্বা চুল। সাহু বললেন।

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তো—কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, এই ভোজালিটার সাহায্যেই হত্যাকারী অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেছিল।

সাহু চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে এবার যেন পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

চন্দ্রকান্ত স্থির পাষাণের মত দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ফারিত দুটি চোখের দৃষ্টি স্থির, ঠোটটা যেন ঝুলে পড়েছে নীচের দিকে।

চন্দ্রকান্তবাবু—সাহু প্রশ্ন করলেন, এটা কার?

জানি না। শুকনো গলায় যেন ফিস ফিস করে জবাব দিল চন্দ্রকান্ত।

জানেন না?

না। একটু–একটু জল–

সাহুই এগিয়ে গিয়ে এক কোণে ছোট্ট একটা টুলের উপরে রাখা কাঁচের জাগ থেকে গেলাসে জল ঢেলে চন্দ্রকান্তর সামনে ধরলেন।

কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে চো চো করে সবটুকু জল পান করে নেয় চন্দ্রকান্ত, এবং তার পরমুহূর্তেই চন্দ্রকান্তর কম্পিত শিথিল হাত থেকে শূন্য কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।

চন্দ্রকান্ত কেমন বোকা বিহুল দৃষ্টিতে তাকাল ওদের মুখের দিকে।

তা যেন হল, কিন্তু অস্ত্রটা আপনার সুটকেসের মধ্যে কোথা থেকে এল?

কি করে বলব। আমি কিছুই জানি না।

আপনি তো ঘরের দরজার চাবি নিয়ে শুয়েছিলেন?

চাবি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, চাবি। দরজার গডরেজের তালার চাবিটা কোথায়?

কোথায় চাবিটা! কতকটা যেন স্বগতোক্তির মত চন্দ্রকান্ত উচ্চারণ করলে।

দেখুন তো, আপনার পকেটেই হয়তো আছে।

পকেটে হাত দিয়ে চন্দ্রকান্ত বললে, পকেটে? কই পকেটে তো নেই।

আরে এই তো চাবিটা, বলতে বলতে হেমন্ত সাহু দরজার একপাশে মেঝে থেকে গডরেজের চাবি তুলে নিলেন, দেখুন তো মিঃ রায়, এই চাবিটা বোধ হয়!

পরীক্ষা করে দেখা গেল ঐ চাবিটাই দরজার চাবি।

কিরীটী আবার বললে, তাহলে চন্দ্রকান্তবাবু, আপনি বলতে পারছেন না, আপনার সুটকেসের মধ্যে এই ভোজালিটা কি করে এল?

আমি আগে কখনও এটা দেখিনি, বিশ্বাস করুন। বিশ্বাস করুন আপনারা! চন্দ্ৰকান্তের গলার স্বরে করুণ মিনতি।

সাহু কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি স্থিরনিশ্চয় করে বলতে পারি মিঃ রায়, এই লোকটিই কাল রাত্রে কোন এক সময় পাশের ঘরে গিয়ে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেছে।

চন্দ্রকান্ত হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, না না, আমি কাউকে খুন করিনি।

সাহু উচ্চকণ্ঠে দরজার বাইরে প্রহরারত জমাদারকে ডাকলেন। রঘুনন্দন জমাদার ঘরের মধ্যে ঢুকে সেলাম দিল।

ইসকো হাতমে হাতকড়া লাগাও।

কেন কেন—আমার হাতে হাতকড়া পরাবে কেন, আমি কাউকে খুন করিনি। চন্দ্রকান্ত প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে কিন্তু তার প্রতিবাদে কর্ণপাত করা হয় না। পকেট থেকে একজোড়া হাতকড়া কথা বের করে চন্দ্রকান্তর হাতে পরিয়ে দিল জমাদার রঘুনন্দন!

যাও, একে নিয়ে নীচে অফিসঘরে গিয়ে অপেক্ষা কর রঘুনন্দন, আমরা আসছি। চন্দ্রকান্তকে নিয়ে রঘুনন্দন নীচে চলে গেল।

ভাগ্যে আপনি ছিলেন মিঃ রায়—হেমন্ত সাহু গদগদ ভাবে বললেন, খুনের ফয়সালা এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল—ঐ সুটকেস দেখার কথাটা কখনও আমার মনেই হত না।

কিরীটী বললে, আপনি সুটকেসটা ভাল করে লক্ষ্য করেননি, করলে নজরে পড়ত বন্ধ ডালাটার ওপাশ থেকে একটু কাপড়ের অংশ বের হয়েছিল—কিরীটী এগিয়ে গিয়ে একটা রক্তমাখা রুমাল তুলে বলল, এই দেখুন, এই রুমালের একটা অংশ আমার নজরে পড়েছিল।

এটা তো দেখছি একটা লেডিজ রুমাল।

কিরীটী রুমালটা পরীক্ষা করতে করতে বলল, হ্যাঁ, লেডিজ রুমাল, দেখুন এর এক কোণে ইংরেজী অক্ষর এ লাল সুতো দিয়ে লেখা আছে।

কার এই রুমালটা বলুন তো?

‘এ’ অনেকেরই নামের আদ্যক্ষর হতে পারে। কিরীটী বলল, অনুরাধা দেবীরও হতে পারে। একটা সূক্ষ্ম সেন্টের গন্ধ এই রুমালটা থেকে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

চলুন তো একবার পাশের ১৬নং ঘরে।

হেমন্ত সাহু ও কিরীটী এসে আবার পাশের ঘরে ঢুকল। ঘরের সামনে একজন সেপাই দাঁড়িয়ে ছিল, সে সরে দাঁড়াল ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রের দিকের জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক রৌদ্র এসে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।বাইরে ইতিমধ্যে মেঘ কেটে গিয়ে যে সূর্যের আলো প্রকাশ পেয়েছে। তা ওরা জানতে পারেনি।

কিরীটী আর একবার ঘরের চারপাশে তাকাল।

পাশাপাশি দুটো চামড়ার সুটকেস, দুটোই তালাবন্ধ। একটা সাইজে বেশ বড়, অন্যটি মাঝারি। সাইজের। ছোট সুটকেসটার গা-তালার সঙ্গে একটা চাবির রিং ঝুলছে। চাবি ঘোরাতে গিয়ে দেখা গেল চাবিটি খোলা। ডালা তুলতেই নজরে পড়ল কিছু দামী দামী শাড়ি, আরও কিছু স্ত্রীলোকের ব্যবহার্য টুকিটাকি, একপাশে একটা দামী সেন্টের সুদৃশ্য শিশি। সেটার ছিপি খুলে নাকের কাছে ধরতেই রুমালের গন্ধটা পাওয়া গেল। তার পাশে একটা লেডিজ ব্যাগ। ব্যাগটা খুলল কিরীটী।

একটা কমপ্যাক্টের সুদৃশ্য কৌটো-ছোট মিরার, একটা চিরুনি, একটা লেডিজ রুমাল, বেশ কিছু একশো টাকার নোট, খুচরো কয়েন।

কিরীটী অনুরাধার মতৃদেহটার দিকে তাকাল। বীভৎস, নৃশংস।

ডেড্‌ বডিটা এবার মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন মিঃ সাহু।

হ্যাঁ। চলুন এবারে থানায় যাওয়া যাক। হেমন্ত সাহু বললেন।

সরিৎশেখর আর সলিল দত্ত মজুমদারকে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে মিঃ সাহু–কিরীটী বলল।

চলুন না ওদের থানায় নিয়ে যাই, যা জিজ্ঞাসা করবার সেখানেই করবেন। তারপর না হয় ছেড়ে দেওয়া যাবে—খুনীই যখন ধরা পড়ে গিয়েছে!

আপনার তাহলে ধারণা ঐ চন্দ্রকান্ত ঘাই—

নিশ্চয়ই। ঐ ভদ্রলোকই মার্ডারার। কেন, আপনার কোন সন্দেহ আছে নাকি তাতে? কথাটা বলে হেমন্ত সাহু কিছুটা যেন গর্বিত ও উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে—এখন পর্যন্ত যে সব এভিডেন্স আমরা পেয়েছি, সেটাই কি প্রমাণ করে না!

তা হয়তো করে, কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন কি মিঃ সাহু, ১৫ নং ঘরের মেঝেতে দুটো ধেনোর শূন্য বোতল গড়াগড়ি দিচ্ছিল!

ধেনোর বোতল। কিছুটা যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই মিঃ সাহু তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

দু-বোতল ধেনো গিলে একটা মানুষের অবস্থা কি হতে পারে, নিশ্চয়ই আমাদের কথাটা একবার ভাবতে হবে–

নিশ্চয়ই ভেবেছি বৈকি। সাহু জবাব দিলেন, যা-তা ব্যাপার তো নয়, একটা লোককে মার্ডার করা—মনটাকে সেজন্য প্রস্তুত করবার জন্যই হয়তো দু-দুটো বোতলের প্রয়োজন হয়েছিল! .

তা বটে—কিরীটী মৃদু হাসল।

বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়, লোকটা একটা কোল্ড-ব্লডেড মার্ডারার।

আমার কিন্তু মনে হল–কিরীটী বলল, লোকটা অসম্ভব ভীতু–

ভীতু লোকেরা কি খুনখারাপি করে না মিঃ রায়? আমি তিন-তিনটে কেস জানি—অসম্ভব ভীতু—অথচ নৃশংসভাবে খুন করেছিল।

ঠিক আছে, আপনি লোকটাকে অ্যারেস্ট করুন, তবে একটা কাজ যদি করতে পারেন আপনি, মনে হয় আপনার identification-এর খুব সুবিধা হবে।

বলুন না কি করতে হবে?

একটা নাপিত ডাকিয়ে, থানায় নিয়ে গিয়ে লোকটার দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে হেঁটে দিতে পারেন?

কয়েকটা মুহূর্ত সাহু হাঁ করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হল ব্যাপারটা যেন তিনি আদৌ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি।

দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দেব। তার মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?

মনে হচ্ছে ওটা ওর স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, সযত্নে রক্ষিত ও বর্ধিত, এবং সেই সযত্ন প্রয়াসের মধ্যে কোন বিশেষ অভিসন্ধি–

ঠিক আছে, বলছেন যখন–

কি জানেন মিঃ সাহু, ভাল করে চেয়ে দেখবেন ওর মুখের দিকে, লোকটাকে ঐ দাড়িগোঁফ যেমন কুৎসিত দেখাচ্ছে ঠিক তেমনটি হয়তো লোকটা দেখতে নয়।

অতঃপর মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে থানা থেকে জীপ আনিয়ে চন্দ্রকান্তকে হাতকড়া পরিয়ে হেমন্ত সাহু প্রস্থান করলেন।

কিরীটী এসে অফিস-ঘরে ঢুকল। সলিল দত্ত মজুমদার একটা চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। সারামুখে তার বিরক্তি।

ভবেশ অধিকারী তার চেয়ারে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে নিঃশব্দে টানছিলেন। কিরীটীর পিছনে আট-দশজন বোর্ডার এসে ঘরে ঢুকলেন।

একসঙ্গে সবাই বলে ওঠেন, আমাদের বিল দিন, আমরা আর এ হোটেলে এক মুহূর্ত থাকব না।

ভবেশ অধিকারীর ধূমপান সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। জ্বলন্ত ও অর্ধদগ্ধ বিড়িটা মুখে চেপে ধরে থাকেন।

কিন্তু এই মুহূর্তে তো আপনাদের কারোরই এ হোটেল থেকে যাওয়া হবে না কথাটা শান্ত গলায় বললে কিরীটী।

যাওয়া হবে না! কেন? অনেকগুলো কণ্ঠস্বর যেন একঝাক তীরের মত কিরীটীর প্রতি বর্ষিত হল।

১৬নং ঘরে একজন ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন, দাবোগাবাবুর হুকুম, তার এনকোয়ারি শেষ হওয়া পর্যন্ত হোটেল ছেড়ে কেউ যেতে পারবেন না।

একজন বলে উঠলেন, দারোগাবাবুর কি ধারণা, আমাদের মধ্যে তাকে কেউ খুন করেছে।

সেটা আপনারা দারোগাবাবুকেই জিজ্ঞাসা করবেন, কিরীটী বললে।

কোথায় দারোগাবাবু?

থানায়।

চল হে, আমরা তাহলে থানায় যাই—একজন আবার বললেন।

কিন্তু এ অন্যায়, বেআইনী জুলুম–বললেন সলিল দত্ত মজুমদার।

কিরীটী সলিল দত্ত মজুমদারের কথায় কান না দিয়ে দোরগোড়ার সমাগতদের দিকে তাকিয়ে। বললে, থানায় আপনাদের কাউকেই যেতে হবে না। মনে হয় কাল-পরশুর মধ্যেই দাবোগাবাবুর। তদন্ত শেষ হয়ে যাবে, তারপর আর উনি আপনাদের যেতে বাধা দেবেন না। একটা বা দুটো দিন হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে, ম্যানেজারবাবু তো কিছু ইচ্ছা করে আপনাদের অসুবিধা সৃষ্টি করছেন না। তাছাড়া দেখছেন তো, উনি নিজেও কম বিব্রত হননি!

সমাগতদের একজন তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, জানতে পারি কি আপনি কে মশাই এ হোটেলে?

কৃষ্ণকায় এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, চিনতে পারছেন না—উনি কিরীটী রায়।

কিরীটীবাবু! অন্য একজনের প্রশ্ন।

হ্যাঁ, বিখ্যাত সত্যসন্ধানী—শোনেননি ওঁর নাম—

ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হয়ে গেল।

সলিল দত্ত মজুমদার তাঁরই সোনার সিগ্রেট কেসটা পকেট থেকে বের করে একটা লাইটারের সাহায্যে একটা সিগ্রেটে অগ্নিসংযোগ করলেন।

সরিৎশেখর ঐ সময় অফিস-ঘরে এসে প্রবেশ করল। সলিল দত্ত মজুমদার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সরিশেখরের দিকে তাকালেন।

বসুন বসুন ডঃ সেন, আপনি এসেছেন ভালই হল, ভাবছিলাম আপনার ঘরে যাব।

ডঃ সেন একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর বললে, আমিও আপনাকে কিছু বলব বলেই এসেছি মিঃ রায়।

সলিল দত্ত মজুমদার সহসা উঠে দাঁড়াল, ম্যানেজারবাবু, আমার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিন।

নীচের তলায় সিঁড়ির কাছে ১১নং ঘরটা খালি আছে—

থাকতে যখন হবে, যেখানেই হোক থাকবার একটা ব্যবস্থা করুন। আর কলকাতায় আর্জেন্ট একটা ট্রাংককল বুক করুন, বলে নম্বরটা বললেন সলিল দত্ত মজুমদার।

কিরীটী বললে, উনি তো আই. জি.–

হা মিঃ গুপ্ত, আমার বন্ধু-সলিল দত্ত মজুমদার গর্বিত কণ্ঠে বললেন, আপনারা আমাকে নিয়ে খেলা করবেন আর আমি তাই সহ্য করে যাব যদি ভেবে থাকেন তো ভুল করেছেন! আমি একটা বিরাট কনসার্নের জি. এম.!

মিথ্যে আপনি রাগ করছেন মিঃ দত্ত মজুমদার। কিরীটী বললে।

মিথ্যে? আমার কোন প্রেসটিজ নেই বলতে চান?

আচ্ছা মিঃ দত্ত মজুমদার, হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনাদের কোম্পানির কাজে আপনি জামসেদপুরে নিশ্চয়ই গিয়েছেন কখনও না কখনও?

বহুবার গিয়েছি, তাছাড়া আমার বাবা আর এল দত্ত মজুমদার টিসকোর একজন বড় অফিসার ছিলেন। রাঁচিতে আমি আই. এস-সি পড়েছি, তারপর বি. এস-সি পাস করে বিলেত যাই। তা হঠাৎ ও কথা কেন?

আপনি ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে জামসেদপুরের কাউকে চেনেন?

ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়! কেমন যেন একটু চমক দত্ত মজুমদারের গলার স্বরে। কিন্তু কথায় সেটা প্রকাশ পেল না।

হ্যাঁ, টিসকোতেই কাজ করতেন, পরে রিটায়ার করেন–কিরীটী বললে।

না, ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু কেন বলুন তো?

না ভাবছিলাম, আপনার বাবা তো ওখানেই থাকতেন আর আপনারও সেখানে যাতায়াত ছিল। জামসেদপুর বিহারের কতটুকুই বা একটা টাউন—চিনলেও হয়ত ভদ্রলোককে চিনতে পারেন। আরও একটা কথা, সেই ভদ্রলোক তিন বৎসর আগে এই হোটেলেই আত্মহত্যা করেছিলেন ঐ দোতলার ১৭নং ঘরে—

গোপী এসে দাঁড়াল দরজার সামনে, বললে, ১১ নং ঘর ঠিক করে দিয়েছি ম্যানেজারবাবু।

যান মিঃ দত্ত মজুমদার গোপীর সঙ্গে যান—ভবেশবাবু বলেন।

সলিল দত্ত মজুমদার আর মুহূর্তও দেরি করেন না। গোপীর সঙ্গে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন একটু যেন দ্রুতপদেই।

কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক। মনে হল সে যেন কি ভাবছে।

মিঃ রায়।

সরিশেখরের ডাকে কিরীটী ফিরে তাকাল।

গতকাল অনুরাধার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছিল, আমার মনে হচ্ছে আপনার সব কথা জানা প্রয়োজন।

কিরীটী উঠে দাঁড়াল। চলুন ডঃ সেন, আমার ঘরে চলুন। ভবেশবাবু দুকাপ চা পাঠিয়ে দেবেন আমার ঘরে ১৭ নম্বরে।

১৭নং ঘরে দুটো চেয়ারে কিরীটী আর সরিৎশেখর মুখখামুখি বসে।

অনুরাধার সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ও এক সময়ের ঘনিষ্ঠতার কথা সবিস্তারে বলছিল সরিৎশেখর, আমি এখানে আসবার আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি মিঃ রায়, এইভাবে হঠাৎ এতদিন পরে অনুরাধার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। সত্যি, অনুরাধার কথা যেন কিছুতেই আমি ভুলতে পারছি না!

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ডঃ সেন, আপনি যেমন অনুরাধা দেবীকে ভুলতে পারেননি, অনুরাধা দেবীও ঠিক তেমনি আপনাকে ভুলতে পারেননি।

আরও কি দুঃখ হচ্ছে জানেন আমার, অনুরাধা সেদিন ঝোকের মাথায় হঠাৎ যে ভুলটা করে বসেছিল এবং যে ভুলটা সে শোধরাবার জন্য এতখানি ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত সে ভুলটা শোধরাবার আর সুযোগ পেল না।

অনুরাধা দেবী সত্যিসত্যিই কি তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন বলে আপনার মনে হয় ডঃ সেন?

হ্যাঁ। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি সে অনুতপ্ত হয়েছিল, আর তাই ঐ মানুষটার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য একপ্রকার মরীয়া হয়ে উঠেছিল। শেষটায় হয়তো আর কোন পথ না খুঁজে পেয়েই আত্মহত্যা করে।

আত্মহত্যা নয় ডঃ সেন, তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে হয়েছে।

কিন্তু কে-কে তাকে অমন করে হত্যা করল?

একজন কেউ তাকে হত্যা করেছে নিশ্চয়ই!

শুনলাম চন্দ্রকান্তবাবুর সুটকেসে একটা রক্তমাখা ভোজালি পাওয়া গিয়েছে—তাই কি দারোগাবাবু ওঁকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেলেন?

ঠিক তাই।

আপনি কি মনে করেন চন্দ্রকান্তবাবুই–

মনে হওয়াটা তো আশ্চর্য না, উনি তো গতরাত্রে ঠিক ওঁর পাশের ঘরেই ছিলেন। সে যাক, আপনি কি কাউকে ঐ ব্যাপারে সন্দেহ করেন ডঃ সেন?

না, কাকেই বা সন্দেহ করব!

আচ্ছা আপনি আমার একটা কথার জবাব দিন তো-গতকাল ঐ সকালের পর অনুরাধা। দেবীর সঙ্গে আর আপনার সাক্ষাৎ হয়নি বা তার সঙ্গে কোন কথাবার্তা হয়নি?

ডঃ সেন চুপ করে রইলেন।

মনে হয় হয়েছিল, তাই নয় কি ডঃ সেন?

হয়েছিল। ম্লানকণ্ঠে ডঃ সেন বললে, কাল রাত্রে যখন খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তখন আমি ওর ঘরে গিয়েছিলাম।

রাত তখন কটা হবে?

বোধ করি সোয়া আটটা।

কতক্ষণ ছিলেন সেখানে?

অনেকক্ষণ। ঘণ্টা দু-তিন তো হবেই।

যদি আপত্তি না থাকে, আপনাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল বলবেন?

অনুরাধা গতরাত্রে সরিশেখরের বুকের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে ড়ুকরে কেঁদে উঠেছিল।

সরিৎ প্রথমটায় কি করবে বুঝে উঠতে পারেনি, তারপর একসময় বললে, কেঁদো না অনু, কেঁদো না, শোন

আমাকে তুমি বাঁচাও সরিৎ–

শোন আমার কথা–

না না, আগে বল এই যন্ত্রণা থেকে তুমি আমায় মুক্ত করবে।

শোন–সরিৎ সযত্নে অনুরাধার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললে, মুক্তি আজ তোমাকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে অনু। বাইরের কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না।

আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে? অনুরাধা বললে, জানো না ঐ মানুষটাকে তুমি? চেনো না?

একটা মিথ্যাকে মেনে নিতে নিতে তুমি আজ দুর্বল হয়ে গিয়েছ রাধা। এই দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠ, দেখবে মুক্তির পথটা তখন খুঁজে পেতে তোমার কষ্ট হবে না। মিথ্যে জুজুর ভয় মন থেকে যতদিন না দূর করতে পারবে

চল—তুমি আমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে চল।

তাতে করে তো তোমার এই প্রবলেমের কোন সমাধান হবে না!

তবে কি আত্মহত্যা করে ছাড়া আমার আর অন্য কোন উপায় নেই?

ছিঃ রাধা, ওকথা ভাবাও অন্যায়।

তাহলে বল, কি করতে হবে আমাকে?

কাল যখন দত্ত মজুমদার ফিরে আসবেন, তাকে সবকিছু স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে তুমি কলকাতায় চলে যাও।

তারপর?

আমি এখনও সেই বাসাতেই আছি। ভানুকে তুমি চেনোই, আমার সেই পুরাতন চাকর, তোমার কোন অসুবিধা হবে না—সেখানেই উঠো।

তুমি?

পরশু বা তার পরের দিন ফিরে যাব।

ঠিক তো?

ঠিক। আমি এবার চলি, কেমন? তুমি ভাল করে দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়।

কিরীটী শুধাল তারপর?

সরিৎশেখর বললে, আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে চলে এলাম। বাইরে তখনও প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টি। আমি সোজা আমার ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিলাম।

রাত তখন কটা হবে?

জানি না। ঘড়ি দেখিনি, তবে মনে হয় রাত সোয়া দশটা কি সাড়ে দশটা।

অনুরাধা দেবী কি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, আমি দরজার কবাট দুটো টেনে দিতে ভিতর থেকে দরজার লকটা পড়বার শব্দ পেয়েছিলাম।

অনেক ধন্যবাদ, আপনার স্টেটমেন্ট থেকে অন্তত এটা প্রমাণিত হল যে গতরাত্রে সোয়াদশটা পর্যন্ত অনুরাধা দেবী জীবিতই ছিলেন। যা ঘটেছে, ঘটেছে তারপর। রাত সাড়ে দশটার। পর কোন এক সময় হত্যাকারী তাকে হত্যা করেছে। এবং অনুরাধা দেবী নিজেই হত্যাকারীকে তার ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। অথচ তিনি জানতেও পারেননি, সাক্ষাৎ মৃত্যুকে তিনি ঘরে ঢুকিয়েছিলেন? অবিশ্যি তাতে করে এও প্রমাণ হচ্ছে যে হত্যাকারী তার অপরিচিত কেউ ছিল না। নচেৎ নিশ্চয়ই তিনি তাকে দেখে চেঁচামেচি শুরু করতেন, লোক ডাকতেন। আর ঘরেও আলো জ্বলছিল–

সরিৎশেখর কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল এবং বললে, আপনি কি অনুমান করতে পেরেছেন মিঃ রায়, কাল রাতে অনুকে কে হত্যা করেছে?

কিরীটী শান্ত গলায় বললে, এতক্ষণ সেটা অস্পষ্ট থাকলেও এখন আর নেই। দুএকদিনের মধ্যেই সেটা জানতে পারবেন। আচ্ছা ডঃ সেন, আপনি এবারে আসুন, আমি একটু বেরুব।

সরিৎশেখর ঘর ছেড়ে চলে গেল। কিরীটীও উঠে দাঁড়াল।

কিরীটী হোটেল থেকে বের হয়ে একটা সাইকেল-রিকশা নিল।

সকাল থেকে যে সন্দেহটা তার মনের মধ্যে ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট ছিল, এখন সেটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কৌণ্টি যিবে? রিকশাওয়ালা শুধায়।

থানায় চল। সাইকেল-রিকশা থানার দিকে চলল।

গতরাত্রে ঝড়-বৃষ্টির পর শহর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আকাশে এখানে ওখানে সামান্য ভাসমান মেঘ থাকলেও মোটামুটি পরিষ্কার।

থানার অফিস-ঘরেই হেমন্ত সাহু বসেছিলেন। কিরীটী ঘরে ঢুকতেই বললেন, এই যে আসুন মিঃ রায়। একটু আগেই এস.পি. সাহেব চলে গেলেন।

চলে গিয়েছেন?

হ্যাঁ, তবে বার বার করে বলে গিয়েছিল, আজকের কেসটার ব্যাপারে আমি যেন আপনার পরামর্শ নিই। এদিকেও মহা ঝামেলা

কি আবার ঝামেলা?

ঐ যে আমাদের চন্দ্রকান্ত ঘাই–দাড়িগোঁফ কামাবে না কিছুতেই।

কামায়নি?

কামিয়ে দিয়েছি।

কোথায় সে?

হাজতঘরে—

এখানে আনান লোকটাকে।

সাহু একজন সেপাইকে আদেশ করলেন চন্দ্রকান্তকে অফিস-ঘরে আনবার জন্যে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন সেপাই চন্দ্রকান্তকে ঘরে নিয়ে এল।

কিরীটী তাকাল চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে। আর তার কোন সন্দেহ নেই। তার অনুমান মিথ্যা নয়, মন তার মিথ্যা বলেনি। তবু কিরীটী পকেট থেকে একটা ফটো বের করে একবার মিলিয়ে নিল।

ওটা কার ফটো মিঃ রায়? হেমন্ত সাহু শুধালেন।

দেখুন না, চিনতে পারেন কিনা! কিরীটী ফটোটা এগিয়ে দিল সাহুর হাতে।

সাহু দেখতে দেখতে বললেন, আশ্চর্য! এ যে—

ঠিক তাই। দিন ফটোটা।

কিরীটী ফটোটা নিয়ে আবার পকেটে রাখল।

এবার একটা কাজ করতে হবে মিঃ সাহু কিরীটী বললে।

কি করতে হবে?

একটা ঠিকানা দিচ্ছি বলে একটা কাগজে নামধাম লিখে কাগজটা সাহুর হাতে তুলে দিল কিরীটী, এই ঠিকানায় একে একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে দিন, আর বিষ্ণুপুরের থানা অফিসারকেও একটা কেবল পাঠান, যেন অবিলম্বে এখানে তিনি চলে আসেন। মানে ওঁর এখানে আসবার ব্যবস্থা করে দেন।

এখুনি দিচ্ছি উঠে পড়লেন হেমন্ত সাহু।

হেমন্ত সাহু বের হয়ে যাবার পর কিরীটী আবার চন্দ্রকান্তর দিকে তাকাল।

এবার বলুন, আপনাকে কোন নামে ডাকব? কিরীটী চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে।

মানে? কুটি করে চন্দ্রকান্ত তাকাল কিরীটী মুখের দিকে।

মানে চন্দ্রকান্ত ঘাই তো আর আপনার আসল নাম নয়?

আপনি বলতে চান, আমি আমার নাম ভাড়িয়েছি? চন্দ্রকান্তর গলার স্বর রুক্ষ।

ক্ষিতীন্দ্রবাবু—

সঙ্গে সঙ্গে যেন চন্দ্রকান্ত চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

খুব আশ্চর্য হচ্ছেন, না? আপনি যে ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেটা আজ আর আমার কাছে অজ্ঞাত নেই।

কি বলছেন যা-তা?

যা বললাম আমি জানি তার চাইতে বড় সত্য আর নেই। কিন্তু এবারে বলবেন কি—এই। তিন-তিনটে বছর ঐ ছদ্মবেশের কি প্রয়োজন ছিল?

আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না!

খুব ভাল করেই বুঝতে পারছেন, কিন্তু স্বীকার করতে চাইছেন না। কিন্তু এটা তো বুঝেছেন, দারোগা সাহেব কেন আপনাকে এখানে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে এসেছেন—অনুরাধা দেবীর হত্যার অভিযোগ থেকে যদি নিজেকে এখনও বাঁচাতে চান তো সব কথা আমাকে খুলে বলুন।

আমি অনুরাধা দেবীকে হত্যা করিনি।

সাহুর পক্ষে খুব এটা কঠিন হবে না আপনার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করতে—ঐ রক্তমাখা ভোজালি যেটা আপনারই ঘরে আপনারই সুটকেসের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে, তার চাইতে আর মোক্ষম প্রমাণ কি হতে পারে এবং আরও একটা কথা, অনুরাধা দেবী কাল রাত্রে ছিলেন ১৬নং ঘরে এবং আপনি ছিলেন ঠিক তার পাশেই অর্থাৎ ১৫ নম্বরে।

না না, আমি বলছি আমি এর বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানি না। অনুরাধা দেবীকে আমি হত্যা করিনি, তাকে আমি চিনি না, কখনও আগে দেখিওনি।

কিন্তু circumstantial evidences যে আপনাকে কোণঠাসা করে ফেলবে, আদালতে কোন ক্রমেই তো আপনি benefit of doubt পাবেন না! আমি—একমাত্র কিরীটী রায়ই আপনাকে বাঁচাতে পারে—

দোহাই আপনার কিরীটীবাবু, আপনি আমাকে বাঁচান। বলতে বলতে ক্ষিতীন্দ্র হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।

হেমন্ত সাহু এসে ঘরে ঢুকলেন, পাঠিয়ে দিলাম কেবল দুটো।

কিরীটী বললে, এখন ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে নিয়ে কি করবেন মিঃ সাহু?

হেমন্ত সাহু বিস্ময়ের সঙ্গে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে, ক্ষিতীন্দ্রবাবু!

ওঁর আসল নাম চন্দ্রকান্ত ঘাই নয়, উনি আপনাকে একটা ধোঁকা দিয়েছিলেন!

কি বলছেন কি?

হ্যাঁ মিঃ সাহু, ওঁর আসল নাম ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিন বৎসর আগে ঐ হোটেলে যিনি নিহত হয়েছিলেন, এবং আপনাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, ইনি তিনিই—আদি ও অকৃত্রিম ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-জামসেদপুর-নিবাসী মালতী দেবীর স্বামী! গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সব আপনার মিঃ সাহু বুঝতে পারছি—its a long story!

ক্ষিতীন্দ্রবাবু তবে আত্মহত্যা করেননি? তাহলে–

তাহলে তিন বছর আগে ঐ হোটেলে কে খুন হয়েছিল, তাই তো? না, সেটা এখনওমানে সে রহস্য এখনও ধোঁয়া। সম্ভবত সেই তিন বৎসর আগেকার এক হত্যার জেরই—অনুরাধা দেবীকে হত্যা!

সত্যই মিঃ রায়, আমার সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। হেমন্ত সাহু বললেন।

কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসে বললে, তবে মনে হচ্ছে আমাদের হাতে যতটুকু প্রমাণাদি এসেছে, তার মধ্যে কিছু সূত্র আছে যে সূত্র ধরে এগুলেই হয়তো আমরা সমস্ত রহস্যের মীমাংসা খুঁজে পেয়ে যাবদুটো দিন অপেক্ষা করুন।

তবে কি অনুরাধা দেবীকে উনি হত্যা করেননি?

যদি বলি, না!

তাহলে ঐ ভোজালি, ঐ রুমাল—

বললাম তো, দুটো দিন অপেক্ষা করুন, আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব পাবেন।

ওঁর কি ব্যবস্থা করব? হেমন্ত সাহু শুধালেন।

কেন–যেমন হাজতে আছেন তেমনিই থাকবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হচ্ছে ক্ষিতীন্দ্রবাবু গতরাত্রে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেননি! আচ্ছা আমি এখন উঠব মিঃ সাহু–উঠে দাঁড়াল কিরীটী।

আপনি–

ভয় নেই, হোটলে থাকব-মালতী দেবী না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত। বলে থানা থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল কিরীটী।

কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর কিরীটী একটা খালি সাইকেল-রিক্শা দেখে তাকে হাতঈশারায় ডেকে উঠে বসল।

কৌটি যিবে বাবু?

স্বর্গদ্বার হোটেলে চল।

চলন্ত রিকশাতে বসে কিরীটীর হঠাৎ মনে পড়ল, বিশেষ একটা জরুরি কথা হেমন্ত সাহুকে বলে আসা হয়নি। আবার ফিরে গেল কিরীটী থানায়।

থানার সামনে পৌঁছে দেখল, হেমন্ত সাহু বেরুচ্ছেন একটা সাইকেল চেপে।

কি, আবার ফিরে এলেন যে? হেমন্ত সাহু শুধালেন।

ট্যাক্সি ড্রাইভার জগন্নাথ পাণ্ডাকে চেনেন মিঃ সাহু?

হ্যাঁ, তার নিজেরই একটা ট্যাক্সি আছে, নিজেই চালায়।

তাকে একটিবার আপনার থানায় বিকেলে ডাকিয়ে আনতে পারেন?

ভাড়া খাটতে যদি না বের হয়ে থাকে তো ডেকে পাঠাব।

আমি তো হোটেলেই আছি, এলে খবর পাঠাবেন।

ঠিক আছে।

কিরীটী আবার ফিরে চলল। হোটেলের সামনে নামতেই হোটেলের নুলিয়া আড়িয়ার সঙ্গে দেখা হল। তাকে ডেকে কিরীটী কি যেন বললে। সে ঘাড় নেড়ে বললে, বুঝেছি।

কিরীটী বললে, ২০ টাকা বকশিস পাবি, যা।

আড়িয়া চলে গেল।

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কিরীটী এসে তার নিজের ঘরে ঢুকতেই দরজার বাইরে সলিল দত্ত মজুমদারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি মিঃ রায়?

আসুন, আসুন।

সলিল দত্ত মজুমদার ঘরে এসে ঢুকলেন। পরনে তার পায়জামা পাঞ্জাবি।

মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, বোঝা গেল স্নানপর্ব শেষ হয়েছে।

বসুন মিঃ দত্ত মজুমদার।

সলিল দত্ত মজুমদার একটা চেয়ারে উপবেশন করলেন।

তারপর মিঃ দত্ত মজুমদার-I. G. মিঃ গুপ্তর সঙ্গে ট্রাংক কলে কথা হল?

না। তাকে এখনও ফোনে কনটাক্ট করতে পারিনি। এদিকে পরশু দুপুরে আমার একটা জরুরি মিটিং অ্যাটেন্ড করবার কথা, মিটিংটা অ্যাটেন্ড না করতে পারলে ভীষণ ক্ষতি হবে।

এখানকার ব্যাপারটাও তো কম জরুরি নয় মিঃ দত্ত মজুমদার।

আপনাদের কি ধারণা মিঃ রায়, অনুরাধাকে আমি হত্যা করেছি?

ব্যাপারটা ঠিক তা নয় মিঃ দত্ত মজুমদার, কিরীটী বলল, এমন কিছু সার্কাস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স আমাদের হাতে এসেছে যাতে করে আপনিও সন্দেহের তালিকার বাইরে যেতে পারছেন না!

ননসেন্স! আমি কেন অনুরাধাকে হত্যা করতে যাব?

আপনার দিক থেকে হত্যা করবার কারণ যেমন ছিল তেমনি প্রভোকেশানও ছিল। আপনি নিশ্চয়ই চাইতেন না অনুরাধা দেবী আপনার মুঠোর বাইরে চলে যাক!

সে চলে যেতে চাইলে নিশ্চয়ই আমি আটকাতাম না।

আমার প্রশ্নটার ঠিক জবাব নয় ওটা। আমি আপনার মনের ইচ্ছার কথাটা বলেছি কি, আপনি তা চাইতেন?

বললাম তো, আটকাতাম না।

কিরীটী মৃদু হাসল। তারপর বলল, গতকাল আপনি ভুবনেশ্বরে যাবার আগে অনুরাধা দেবীর সঙ্গে আপনার কথাকাটাকাটি হয়েছিল, তাই না?

কে বললে?

যেই বলে থাকুক–কথাটা সত্যি কিনা তাই বলুন।

না।

ভুবনেশ্বরে কখন গিয়ে পৌঁছেছিলেন?

বেশীক্ষণ লাগেনি, ঘন্টা দুই পরেই।

তারপর ফিরলেন কখন?

আজ সকালে প্রায় দশটা নাগাদ।

আচ্ছা মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনার ওয়াটারপ্রুফটা কি আসার সময় এখানে সঙ্গে করে এনেছিলেন?

এনেছিলাম। বৃষ্টির সময় এটা-ওয়াটারপ্রুফটা তাই সঙ্গে এনেছিলাম।

কাল বেরুবার সময় সেটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন?

নিয়েছিলাম বৈকি।

কিন্তু আজ সকালে যখন ফিরলেন, ওয়াটারপ্রুফটা তো আপনার সঙ্গে ছিল না?

সলিল দত্ত মজুমদার যেন একেবারে বোবা।

ভুবনেশ্বরে ফেলে আসেননি তো ভুল-টুল করে—

না, না।

তবে কোথায় ফেলে এলেন, মনে করার চেষ্টা করুন।

মনে হচ্ছে ট্যাক্সিতে ফেলে আসতে পারি—

ট্যাক্সিতে ফেলে আসলে কি আর সেটা পাবেন?

কেন পাব না, নিশ্চয়ই পাব। জগন্নাথ পাণ্ডা সেরকম লোক নয়।

তা বেশ। কিন্তু আপনি যে চলে যেতে চাইছেন, অনুরাধা দেবীর শেষ কাজটুকু কে করবে?

চুলোয় যাক অনুরাধা, I dont care!

সে কি! এতকাল ভদ্রমহিলাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন—

স্ত্রী না ছাই। একটা লোক-দেখানো বিয়ে না করলে—

ওঁকে ধরে রাখতে পারতেন না, তাই কি?

অফিসের মাইনে ছাড়াও কম টাকা ওকে আমি মাসে মাসে দিইনি। নেমকহারাম, ছোটলোক–

মিথ্যে রাগ করছেন মিঃ দত্ত মজুমদার, রক্ষিত রাখতে হলে টাকা খরচ করতে হয় বৈকি। যা সেকথা—মুকুল দেবী তত ছিলেন আপনার স্ত্রী, তাই না?

নিশ্চয়ই, রীতিমত রেজেস্ট্রি করে বিবাহ করেছিলাম তাকে।

তবে যে সরিৎশেখরবাবুর কাছে অনুরাধা দেবী বলেছিলেন, তিনিও আপনার বিবাহিত স্ত্রী নন–মানে আইনসঙ্গত স্ত্রী ছিলেন না?

বাজে কথা। মুকুলকে আমি রেজেস্ট্রি করে বিবাহ করেছিলাম।

তা হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশটা হলেন কেন? এমন কিছু আপনাদের মধ্যে ঘটেছিল কি?

না, কিছুই ঘটেনি।

আচ্ছা মুকুল দেবীর দাদার নাম জীমূতবাহন, না?

হ্যাঁ।

সেই যে একদিন অফিসে এসে তিনি আপনাকে থ্রেন করে গিয়েছিলেন, তারপরে আর তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

না।

আমি যদি বলি আপনি ঠিক সত্য কথাটা বলছেন না!

মিথ্যা কিসের জন্য বলতে যাব?

কারণ একটা মিথ্যা ঢাকতে গেলে আর একটা মিথ্যা এসে পড়ে, তারপর আর একটা মিথ্যার পাহাড় জমে ওঠে ক্রমশ। আর তখন সবটাই মিথ্যা হয়ে যায়। তাছাড়া ভুলে যাবেন না, মিথ্যাকে চিরদিন সত্য বলে চালানো যায় না, একদিন না একদিন অনিবার্য ভাবেই সত্য যা তা প্রকাশ হয়ে পড়ে।– সলিল দত্ত মজুমদার আর কিছু বললেন না, নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

ঐদিনই দ্বিপ্রহরে। কলকাতায় ট্রাংককলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে সবে এসে ঘরে ঢুকছে কিরীটী, চোরের মত এদিক ওদিক চাইতে চাইতে প্রৌঢ় নুলিয়া আঁড়িয়া এসে ঘরে ঢুকল, কাপড়ের তলায় কি যেন একটা বস্তু সযত্নে আড়াল করে।

–সাহাব।

কে, আঁড়িয়া—আয়, পেয়েছিস?

হ্যাঁ, পেয়েছি সাহেব। দেখ—সযত্নে কাপড়ের আড়াল থেকে একটা ওয়াটারপ্রুফ বের করে কিরীটী সামনে ধরল।

কিরীটীর চোখের দৃষ্টি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওয়াটার প্রুফটা উলটে-পালটে দেখে হৃষ্টচিত্তে বললে, কোথায় পেলি এটা?

স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে আরও এক মাইল দূরে-বালুর চরায় কাঁটাঝোপের মধ্যে।

কিরীটী ব্যাগ থেকে দশ টাকার দুটো নোট বের করে আঁড়িয়াকে দিল। আঁড়িয়া হৃষ্টচিত্তে, টাকাটা ট্যাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল।

বিকেলের দিকে থানা থেকে সাহু লোক পাঠালেন। জগন্নাথ পাণ্ডা থানায় বসে আছে। থানায় গিয়ে জগন্নাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিরীটী যখন ফিরে এল, সন্ধ্যার অন্ধকার চারদিকে ঘন হয়ে এসেছে তখন।

পরের দিনই রাত আটটা নাগাদ মালতী দেবী স্বর্গদ্বার হোটেলে এসে পৌঁছলেন। কলকাতা থেকে প্লেনে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন পুলিসের লোকই।

কিরীটী তার ঘরেই ছিল। বোধ করি মালতীর আগমনের প্রতীক্ষাতেই ছিল।

মালতী দেবী একজন সাধারণ পোশাকের পুলিস অফিসারের সঙ্গে অফিসে এসে কিরীটীর খোঁজ করতেই ভবেশ অধিকারী নিজে এসে মালতীকে কিরীটীর ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

এই ভদ্রমহিলা আপনার খোঁজ করছিলেন মিঃ রায়।

মালতী দেবী, আসুন আসুন–বসুন।

কি ব্যাপারমালতী বললেন, এত জরুরি তলব দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?

আপনার স্বামীর সন্ধান পেয়েছি—

পেয়েছেন?

হ্যাঁ।

মালতী কিছুক্ষণ অতঃপর গুম হয়ে বসে রইলেন, তারপর ক্ষীণগলায় প্রশ্ন করলেন, কোথায়

সে?

এখানেই আছেন। থানার হাজতে—

থানায়? কেন?

ওর মাথার ওপর একটা খুনের চার্জ ঝুলছে।

সে কি! কাকে আবার সে খুন করল?

অনুরাধা দেবীকে।

সে কে?

সব বলব, তার আগে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আপনাকে আপনার স্বামীর কি আর কোন ভাই ছিলেন?

কিরীটীর আচমকা প্রশ্নটা যেন মালতী দেবীকে একেবারে পাথরে পরিণত করে, কেমন যেন বোবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মালতী দেবী।

মালতী দেবী আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না তো!

আছে, তার এক সৎভাই—

সৎভাই!

হ্যাঁ আমার শ্বশুরের দুই বিয়ে—প্রথম যাকে বিয়ে করেছিলেন তার একটি ছেলে ছিল, তারপর তার হঠাৎ সর্পদংশনে মৃত্যু হওয়ায় দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন, তারও একটি মাত্র ছেলে, এবং বিবাহের দুই বৎসরের মধ্যে সেই স্ত্রীরও সর্পদংশনেই মৃত্যু হয়।

দুজনারই সর্পদশংনে মৃত্যু! কিরীটী প্রশ্ন করল, আশ্চর্য তো!

এর সবটাই পরবর্তীকালে আমার স্বামীর মুখ থেকে শোনা। প্রথমবারের ছেলেকে আমার শ্বশুরমশায়ের কাছ থেকে তার দিদিমা নিয়ে যান। কখনও আর তিনি তার বাপের কাছে আসেননি। শ্বশুরমশাইও যতদিন জীবিত ছিলেন সে ছেলের আর কোন সন্ধান নেননি তিনি। সে ছেলে দেখতে কেমন, কি করতেন, এখনও বেঁচে আছেন কিনা কিছুই জানি না।

কিরীটী ধীরে ধীরে বললে, মস্ত বড় একটা জট আমার খুলে গেল মিসেস চ্যাটার্জী। আমি যেন এখন সবকিছু অনুমান করতে পারছি।

কি অনুমান করতে পারছেন কিরীটীবাবু? প্রশ্ন করলেন মালতী।

বর্তমান রহস্যের গতিবিধি। ঠিক আছে, চলুন এবারে আমার সঙ্গে।

কোথায়?

থানায়। সেখানে আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্রবাবু আছেন।

মালতী যেন নেহাৎ অনিচ্ছার সঙ্গেই উঠে দাঁড়ালেন।

কিন্তু তাদের আর বেরুনো হল না।

ঝড়ের মতই থানা-অফিসার হেমন্ত সাহু এসে ঘরে ঢুকলেন।

মিঃ রায়–

কি খবর—এই যে ক্ষিতীন্দ্রবাবুর স্ত্রী মালতী দেবী জামসেদপুর থেকে এখানে এসে পৌঁছেছেন। ওঁকে নিয়ে আমি থানাতেই আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।

ক্ষিতীন্দ্রবাবু তো নেই—শুকনো গলায় উচ্চারণ করলেন হেমন্ত সাহু।

নেই, নেই মানে কি?

থানা থেকে পালিয়েছেন!

পালিয়েছেন? কেমন করে? তাকে তো হাজতে রাখা হয়েছিল?

বেলা চারটে নাগাদ হঠাৎ উনি পেটের ব্যথায় ছটফট করতে থাকেন। ক্রমশ ব্যথা নাকি বাড়তে থাকে। আমি থানায় ছিলাম না, সন্ধ্যানাগাদ ফিরে সব শুনে সিভিল সার্জেনকে কল দিই। ডাক্তার চৌধুরী এসে হাজতঘরে ঢুকে তাকে পরীক্ষা করছেন, হঠাৎ এক লাফে আমাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে খোলা দরজা-পথে ছুটে বের হয়ে গেলেন।

তারপর?

তারপর এই ঘণ্টাতিনেক আশেপাশে সর্বত্র খুঁজেছি—আমি নিজে ও সেপাইরা চারপাঁচজন, কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পেলাম না—তাই হোটেলে দেখতে এলাম, আপনাকেও কথাটা জানাতে এসেছি

পাগল নাকি! পালিয়েই যদি থাকেন তো হোটেলে আসতে যাবেন কেন?

এখন বুঝতে পারছেন তো মিঃ রায়, অনুরাধা দেবীর হত্যাকারী আর কেউ নয়—ঐ ক্ষিতীন্দ্রবাবুই?

না।

এখনও বলবেন, ক্ষিতীন্দ্রবাবু অনুরাধা দেবীর হত্যাকারী নন?

হ্যাঁ, তিনি নন। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে একটা সুস্পষ্ট দৃঢ়তা ফুটে ওঠে।

তবে তিনি পালালেন কেন?

মনে হচ্ছে মৃত্যুই তাকে টেনেছে, কি জানেন মিঃ সাহু, এইরকম কিছু যে একটা ঘটতে পারে সেটা পূর্বেই অনুমান করতে পেরেছিলাম বলেই তাকে অ্যারেস্ট করে হাজতে রাখায় কোন বাধা দিইনি—আপত্তি জানাইনি। কিন্তু ভাবছি কোথায় যেতে পারেন তিনি?

কিন্তু তিনি যদি হত্যাকারী নাই হবেন, তবে—

কিরীটী বললে, ভদ্রলোক কেবল নির্বোধ নন, প্রচণ্ড ভীতুও।

কিরীটী কথায় হেমন্ত সাহু যেন একটু বিরক্তই হলেন। বললেন, কি জানি মিঃ রায়, আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। তার ঐভাবে থানার হাজতঘর থেকে পালানোটাই প্রমাণ করে দিয়েছে অনুরাধা দেবীর হত্যাকারী তিনিই। আর কেউ নয়। খুঁজে তাকে আমি বের করবই, পালাবেন কোথায় তিনি! সর্বত্র তার চেহারার একটা ডেসক্রিপশন দিয়ে ওয়ারলেসে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। চললাম।

বের হয়ে গেলেন হেমন্ত সাহু ঘর থেকে একটু দ্রুতপদেই। আর একটু পরেই নীচে জীপের শব্দ পাওয়া গেল, বোঝা গেল, হেমন্ত সাহু প্রস্থান করলেন।

মালতী দেবী এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। চুপচাপ বসে সব শুনছিলেন। এবার তিনি কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন, সত্যিই আপনার ধারণা কিরীটীবাবু, ও খুন করেনি।

তাই। ক্ষিতীন্দ্রবাবু খুন করেননি।

তবে কে খুন করল মেয়েটিকে।

দুটি হত্যাই একই সূত্রে বাঁধা, তিন বৎসর পূর্বে এই হোটেলেই জীমূতবাহনকে যে হত্যা করেছিল, তিন বৎসর পরে সেই আবার ঘটনাচক্রে অনুরাধাকেও হত্যা করেছে। কেবল দুটি ঘটনার মধ্যে অলক্ষ্যে যে যোগসূত্রটা রয়ে গিয়েছে সেটা খুঁজে বের করতে পারলেই সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে।

কিরীটীর কথাগুলো শুনে মনে হল, মালতী দেবীর মুখের ওপরে যেন একটা হতাশা ফুটে উঠেছে।

কিরীটী বললে, একটা কথা বলব মালতী দেবী, মনে কিছু করবেন না, আপনি বার বার আমাকে বলেছেন আপনার স্বামী একান্ত স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, নিজের সুবিধা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না, নিজেকে ছাড়া দুনিয়ার কাউকে ভালোবাসেন না, নিঃসন্দেহে তার চরিত্রের ওটা একটা দিক, তার চরিত্রের সর্বাপেক্ষা বৈশিষ্ট্য যেটা সেটা হচ্ছে তার নির্বুদ্ধিতা। বুদ্ধি বলে কোন কিছুই তার মধ্যে নেই, একের নব্বরের নির্বোধ। তাই সর্বদা বড় বড় কথা বলে নিজের বিরাটত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে সকলের কাছে আরও হাস্যস্পদ হয়ে যান, আর এ সব কিছুর জন্যে দায়ী আপনিই।

আমি?

তাই। সে বিরাটত্ব প্রমাণ করার জন্য তিনি বার চরম নির্বুদ্ধিতা, প্রকাশ করে এসেছেন, অন্যের কাছে হাস্যাস্পদ হয়েছেন, সে বিরাটত্ব তার ওপরে আরোপ করেছেন আপনিই, এবং কার্যক্ষেত্রে তাঁর জীবনের ব্যর্থতার জন্য আপনিও বহুলাংশে দায়ী—আর তার মধ্যেই সুপ্ত ছিল তাঁর প্রতি আপনার বিরাগ, আপনাদের পরস্পরের মধ্যে অশান্তির অঙ্কুর। আপনি যদি সত্যিকারের স্ত্রীর মত স্বামীর ঐ নির্বুদ্ধিতাকে শোধরাবার চেষ্টা করতেন, তবে হয়তো আপনাদের জীবনের আজকের ট্র্যাজেড়িটাকে এড়াতে পারতেন।

মালতী দেবী মাথা নীচু করে বসে থাকেন।

যাক, অবশ্যম্ভাবীর গতিরোধ কেউ করতে পারে না।

কিন্তু লোকটা কোথায় গেল? ক্ষীণ স্বরে বললেন মালতী।

আমার মনে হয় এখনও তিনি পুরীতেই আছেন। আপনি কিন্তু হুট করে পুরী ছেড়ে চলে যাবেন না।

কিন্তু থাকব কোথায়?

এই হোটেলেই থাকুন, ম্যানেজারবাবুকে আমি বলে দেব।

পরের দিন প্রত্যুষে ক্ষিতীন্দ্রর মৃতদেহ পাওয়া গেল সমুদ্রের ধারে বালির উপরে, স্বর্গদ্বার থেকে মাইলখানেক দূরে, পৃষ্ঠদেশে তাঁর গুলির চিহ্ন।

বোঝা গেল কেউ তাকে পশ্চাৎ থেকে গুলি হত্যা করেছে। একদল বায়ুসেবী তরুণ মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। এবং তারাই থানায় সংবাদ দেয়।

ক্ষিতীন্দ্রর মৃতদেহটার আইডেনটিফিকেশনের জন্য থানা থেকে ডাক এল মালতী দেবীর।

কিরীটী থানাতেই ছিল। তারই পরামর্শনুযায়ী হেমন্ত সাহু মালতী দেবীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন হোটেল থেকে থানায়। অবিশ্যি মালতী তখনও জানেন না কেন তাকে থানায় যেতে বলা হয়েছে।

স্বভাবতই হেমন্ত সাহু বিশেষ চিন্তিত। সমস্ত ঘটনাটা যে ঐভাবে অকস্মাৎ মোড় নেবে হেমন্ত সাহুর কল্পনারও যেন বাইরে ছিল এবং উভয়ের মধ্যে ক্ষিতীন্দ্রর মৃত্যুকে নিয়েই আলোচনা চলছিল।

মৃতদেহের হাত-পাঁচেক দূরে একটা ছোট কাঁটাঝোপের মধ্যে একটা ছোট জার্মান-মেক পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল। তার ছয়টি চেম্বারের একটি চেম্বারে গুলি নেই। পিস্তলটা খুঁজে বের করেছে একজন সেপাই।

পিস্তলটা সামনের টেবিলের ওপরেই ছিল। কিরীটী বলছিল, ঐ পিস্তলটির সাহায্যেই আপনি হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারবেন মিঃ সাহু।

কেমন করে? বিরস বদনে প্রশ্ন করেন হেমন্ত সাহু।

ঐ পিস্তলে একটা নম্বর আছে—ঐ নম্বরের পিস্তলের লাইসেন্স যার নামে আছে, সেটা আলিপুরের লাইসেন্স ডিপার্টমেন্ট খুঁজলেই তো পেয়ে যাবেন।

যদি অন্য কোথাও লাইসেন্সটা করানো হয়ে থাকে?

কিরীটী বললে, না। সম্ভবত আলিপুরের কোর্টেই লাইসেন্স করানো হয়েছিল। আমার অনুমান, হত্যাকারী এবং ঐ পিস্তলের যিনি অধিকারী, ওঁর—

কিরীটীর কথা শেষ হল না, মালতী এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

আসুন মালতী দেবী। কিরীটী বললে।

আমাকে ডেকেছেন কেন? মালতী বললেন।

একটা মৃতদেহ সনাক্ত করবার জন্য।

মৃতদেহ! কার?

পাশের ঘরেই আছে, চলুন।

কিরীটী, হেমন্ত সাহু ও মালতী এসে পাশের ঘরে প্রবেশ করলেন।

মেঝের উপরে আগাগোড়া বস্ত্রাবৃত একটা মৃতদেহ পড়েছিল। হেমন্ত সাহুই নীচু হয়ে দেহের মুখের উপর থেকে বস্ত্রখণ্ড টেনে নিতেই মালতীর কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট চীৎকার নির্গত হল।

কিরীটী শান্ত গলায় মালতীর দিকে তাকিয়ে বললে, এবারে আর মিথ্যা নয়, সত্যি-সত্যিই ক্ষিতীন্দ্রবাবু এবারে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন তিনি আর বেঁচে নেই, সত্যি সত্যিই মারা গেছেন।

মালতী পাথরের মতই দাঁড়িয়ে থাকে।

কি—আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই তো? হেমন্ত সাহু প্রশ্ন করলেন।

মালতী দেবী পূর্ববৎ পাথরের মতই দাঁড়িয়ে রইলেন।

ঐসময় একজন সেপাই এসে ঘরে প্রবেশ করল।–স্যার!

কি খবর বৈজুপ্রসাদ, সেই ভদ্রলোক কোথায়? আসেননি?

তাকে হোটেলে পাওয়া গেল না। সে কি! হোটেলেই নেই?

না! দরজার লকটা বন্ধ ছিল, ড়ুপলিকেট চাবি দিয়ে লক খুলে দেখা গেল ঘরের মধ্যে কেউ নেই—ঘর খালি।

কিরীটী বললে, মিঃ সাহু, এখনি সর্বত্র ওয়ারলেস মেসেজ পাঠান চেহারার একটা ডেসক্রিপসন দিয়ে, কুইক, আর দেরি করবেন না। প্রত্যেক স্টেশনে ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট, সিকিউরিটি পুলিসকে।

হেমন্ত সাহু সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

আপনার মনের মধ্যে আজ আর কোন সন্দেহ নেই তো মিসেস চ্যাটার্জী, উনিই আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্রবাবু?

মালতী মাথা তুলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করলেন।

এবার বলবেন কি, তিন বৎসর আগে যে মৃতদেহটা সনাক্ত করবার জন্য এখানে এসেছিলেন। সে মৃতদেহটা যে আপনার স্বামীর নয় তা বুঝতে পেরেও কেন আপনার স্বামীর মৃতদেহ বলেই সনাক্ত করেছিলেন?

মালতী দেবী নীরব।

একটা মিথ্যার ভিতর দিয়ে মুক্তি পেয়ে গেছেন বলেই বোধ হয়, তাই নয় কি?

মালতী পূর্ববৎ নীরব।

সেদিন যদি মিথ্যাটাকে সত্য বলে না মেনে নিতেন, তবে হয়তো আজ এমনি করে মৃত্যুবরণ করতে হত না ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে আপনিই আপনার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মালতী দেবী।

মালতী তখনও নীরব।

আপনি হয়তো ছেলেমেয়ে ও অন্যান্য সকলের দিক থেকে বেঁচে গেলেন, কিন্তু নিজের মনের কাছে জবাব দেবার মত কিছুই তো রইল না। আপনার স্বামীর কোন দোষ ছিল না তা আমি বলছি না। ছিল—তার অনেক দোষ ত্রুটিই ছিল, এবং সব কিছুর উপরে ছিল তার নির্বুদ্ধিতা, তবু বলব আপনার কাছ থেকে একটু সহানুভূতি পেলে হয়তো আপনাদের দুজনারই

জীবনটা এইভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।

কিরীটী লক্ষ্য করল, মালতী দেবীর দুচোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

হেমন্ত সাহু ঘরে ঢুকলেন।

সিগন্যাল মেসেজ পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে এলাম মিঃ রায়।

ঠিক আছে, চলুন এবারে হোটেলের দিকে যাওয়া যাক। কিরীটী বললে!

আপনি কি মনে করেন মিঃ রায়, দত্ত মজুমদার হোটেলে ফিরে আসবেন?

কিরীটী মৃদু হাসল, বললে, তার জন্য ভাববেন না। পালিয়ে আর কোথায় যাবেন দত্ত। মজুমদার, ধরা তাকে পড়তেই হবে। একবার ক্ষিতীন্দ্রবাবুর—মানে আপনাদের মৃত চন্দ্রকান্তবাবুর সুটকেসটা ভাল করে উলটে-পালটে সবকিছু দেখতে হবে।

কিরীটী উঠে দাঁড়াল। চলুন মালতী দেবী।

কোথায়?

হোটেলে।

কেন?

ডেড বডির ময়নাতদন্ত না হওয়া পর্যন্ত আর ডেড বডি পাচ্ছেন না। পেতে পেতে হয়তো কাল পরশু–

আমি কিন্তু আজই ফিরে যেতে চাই, অবশ্যই আপনাদের অনুমতি পেলে–মালতী বললেন।

স্বামীর মৃতদেহের সক্কার না করেই চলে যাবেন?

মালতী মাথা নিচু করলেন।

ভদ্রলোক সত্যিই হতভাগ্য, ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন, বাপের স্নেহ কোন দিন পাননি, আপনিও সারাটা জীবন বিমুখ হয়ে ছিলেন, অন্তত শেষ কাজটুকু করুন। পরলোক বলে যদি কিছু থাকে তো, হয়তো একটু শান্তি পাবেন।

ক্ষিতীন্দ্রর সুটকেসের মধ্যেই একটা দীর্ঘ চিঠি পাওয়া গেল।

চিঠিটা দিনদশেক আগে তার স্ত্রী মালতী দেবীকেই লেখা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোস্ট করা হয়নি।

মালতী,

আমি বেঁচে আছি। তিন বৎসর পূর্বে পুরীর হোটেলে যে মৃতদেহকে তুমি তোমার স্বামী বলে সনাক্ত করেছিলে পুলিসের সামনে, সে আমি নই। আমার বৈমাত্রেয় ভাই জীমূতবাহন চট্টোপাধ্যায়।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ, আমরা দুভাই একই রকম দেখতে হয়েছিলাম। দুই মায়ের গর্ভে জন্মালেও। তুমি তো তাকে কোন দিন দেখইনি, আমিও ছোটবেলায় মাত্র একবার দেখেছিলাম তাকে!

দাদাকে তার মামারা আসতে দেননি কোন দিন বাবার কাছে, দাদাও আসেননি, মনের মধ্যে একটা ঘৃণা তার মামারা বাবার প্রতি সঞ্চার করেছিল।

আর তুমি হয়তো জান না দাদার এক বোনও ছিল।

তার নাম মুকুল। দাদার থেকে ১৮ মাসের ছোট, তার জন্মের পরই আমাদের সেই মা মারা যান। সেই মার জীবনের শেষের একটা বছর বাবার কাছ থেকে তিনি দূরেই ছিলেন, ছোট বোন, মুকুল তখন মার গর্ভে। বাবাও জানতেন না কথাটা, মা তো তাকে কথাটা জানতেই দেননি।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় দুজনে পৃথক হয়ে যান। মনোমালিন্যের কারণ যতদূর জানা যায়, বাবার অত্যধিক মদ্যপানের অভ্যাস।

আমি তোমাকে অতীতের সব কথা জানাচ্ছি, কারণ তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন তিন বৎসর পূর্বে জীবিত থেকেও আমাকে মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদকে মেনে নিতে হয়েছিল। কেন এই দীর্ঘ তিন বৎসর আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে আমাকে।

আমি আবার সংসারে তোমাদের সকলের মাঝখানে ফিরে যেতে চাই মালতী। নতুন করে আবার তোমাদের নিয়ে বাঁচতে চাই। তাই কিছুই গোপন করব না, সব বলব অকপটে।

সলিল দত্ত মজুমদার নামে এক ভদ্রলোককে মুকুল ভালোবাসে, এবং তাদের বিয়েও হয়। মুকুলের সঙ্গে সলিলের বিবাহে অবিশ্যি দাদার পূর্ণ মত ও সহযোগিতা ছিল। দাদা আর সলিল উভয়ে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রেই মুকুলের সঙ্গে সলিলের আলাপ।

দাদা আমারই মত ম্যাট্রিক পাস করে আই. এ. পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেয়। মামারা তখন তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়, কারণ ঐ বয়সেই দাদা স্মাগলারদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল।

আর ওই স্মাগলিংয়ের সূত্রেই সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে দাদার আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। সলিল দত্ত মজুমদার বিলাতফেরত ও একজন বড় অফিসার হওয়া সত্ত্বেও স্মাগলিংয়ে জড়িত ছিল।

লোকটার টাকার নেশা ছিল প্রচণ্ড। মুখোশ ছিল তার বড় একটা কোম্পানিতে বড় একটা পোস্টের চাকরি। তার অন্ধকারের জীবনটা বোধ করি ঐ চাকরি ও পজিশনের দরুণই ধরাছোঁয়ার বাহিরে ছিল।

বিবাহের পর মুকুল যখন তার ঘরে এল সে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও এই সব কিছু না জেনেই এসেছিল।

আগেই বলেছি মুকুল ছিল সত্যিই সুন্দরী। দলের একজন হোমরাচোমরা ছিল ইসমাইল খান, লোকটা জাতিতে পাঠান, একদিন মুকুলকে দেখে সে পাগল হয়ে উঠল।

সোজাসুজিই সে সলিলকে কথাটা বললে। সলিল দত্ত মজুমদারকে ইসলাইমের প্রস্তাবে রাজী হতে হল, কারণ তা ছাড়া তার উপায় ছিল না। এক রাত্রে ঘুমন্ত মুকুলের শয়নকক্ষে ইসমাইলকে ঢুকিয়ে দিল সলিল।

কিন্তু ইসমাইল খান জানত না মুকুল কি প্রকৃতির মেয়ে, সে ধর্ষিতা হল বটে কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত মুকুলের হাতেই প্রাণ দিতে হল পিস্তলের গুলিতে।

তারপর সেই পিস্তলের সাহায্যেই মুকুল আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। অবশেষে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। সব ব্যাপারটা ঘটে সলিল দত্ত মজুমদারের দেওঘরের বাড়িতে।

রাতারাতি ইসমাইলের মৃতদেহটা সলিল দত্ত মজুমদার পাচার করে দিল। আর মুকুলকে পাঠিয়ে দিল রাঁচীর পাগলা গারদে। সে এখন বদ্ধ উন্মাদ।

কোন প্রমাণই ছিল না। সলিল দত্ত মজুমদার রটিয়ে দিল মুকুল নিরুদ্দিষ্টা।

দাদা কিন্তু খুঁজে বেড়াতে লাগল মুকুলকে।

ঐ সময় অনুরাধা এল আকস্মিক ভাবে সলিল দত্ত মজুমদারের জীবনে। অনুরাধা একজনকে ভালবাসত কিন্তু সলিল দত্তর চাতুরিতে কিছুটা এবং কিছুটা একটা সাচ্ছল্যের জীবনের জন্য সে ভুলে গেল সব কিছু।

দাদা বরাবরই সলিল দত্তর উপর নজর রেখেছিল, হঠাৎ সে সংবাদ পেল সলিল দত্ত পুরীতে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে দাদা স্থির করে সে পুরীতেই যাবে এবং তার সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করবে। মুকলের ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করবে। কিন্তু একা সম্ভব নয়, তাই সে জামসেদপুরে গিয়েছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি সেরাত্রে বঙ্কিমের গৃহে তাকে চিনেও না চেনবার ভান করলাম। দাদা সেখান থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমিও উঠে পড়লাম। আমি বুঝেছিলাম আমার সঙ্গে দেখা না করে ও কথা না বলে দাদা যাবে না। ঠিক তাই হল, মাঝপথেই তার সঙ্গে আমার দেখা হল।

ক্ষিতি!

কে? দাঁড়ালাম আমি। থমথমে অন্ধকার রাত। পথে জনমিনিষ্যি নেই।

দাঁড়া। আমি জীমুত—

কি চাই? কেন এসেছ? আমি শুধালাম।

মুকুলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

কোথায় সে? বেঁচে আছে তাহলে?

হ্যাঁ, বদ্ধ উন্মাদ। আছে রাঁচীর পাগলা গারদে।

কি করে জানলে?

ইসমাইল খানের ব্যাপারটা আমাকে বলে গেল জীমূতবাহন।

শুধালাম, কি করে এসব কথা জানলে?

দলের লোকেদের কাছ থেকেই জেনেছি। শোন যেজন্য এসেছি, আজ শুক্রবার, সামনের বুধবার তুই চলে আয় পুরী। আমি ঐদিনই পুরী পৌছাব। সলিল পুরীতে যাচ্ছে, মুখোমুখি একটা মোকাবিলা করতে হবে ঐ শয়তানটার সঙ্গে। আমি একা থাকলে হবে না—তুইও আসবি।

আমি রাজী হয়ে গেলাম। আর তিন দিন বাদেই পুরী রওনা হলাম।

হোটেলে পাশাপাশি ঘরে আমরা ছিলাম। আমি ও দাদা ১৭নং ঘরে, আর ১৮নং ঘরে সলিল দত্ত মজুমদার। যে রাত্রে পুরীতে পৌঁছাই, সেই রাত্রেই ঘটনাটা ঘটল।

সলিলের হাতে ঘুমের মধ্যে জীমূতবাহন নিহত হল।

পিছন থেকে তার গলায় ধারাল অস্ত্র চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

সেরাত্রে খুব বেশী মদ্যপান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, দুই ভাইয়ে মিলে দুবোতল প্রায় শেষ করেছিলাম। তখনও জানি না, সলিল পাশের ঘরেই আছে। আমি জানতাম সে তখনও হোটেলে এসে পৌঁছায়নি।

শেষরাত্রের দিকে ঘুমটা ভেঙে যেতে দেখি ঐ বীভৎস দৃশ্য। দাদা নিহত।

ভয়ে পালালাম আমি। পাছে আমাকেই পুলিস খুনী বলে ধরে।

দাদার কথা শুনে পুরীতে এসে ভুল করেছিলাম, আবারও ভুল করলাম পালিয়ে গিয়ে সেই শুরু হল আমার অজ্ঞাতবাস। এই তিনটে বছর যে আমার কিভাবে কেটেছে বেঁচেও মরে আছি আমি।

শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারের একটা হেস্তনেস্ত—

ব্যাস, ঐখানেই চিঠি শেষ। চিঠিটা ঐ পর্যন্তই লেখা—আর লেখা হয়নি।

চিঠিটা হাতে করে কিরীটী বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর একসময় চিঠিটা পকেটে নিয়ে বের হয়ে এল। রাত তখন প্রায় সোয়া নটা।

১৭নং ঘরে মালতী ছিলেন। কিরীটী তার ঘরেই থাকবার ব্যবস্থা করেছিল মালতীর এবং নিজে নীচের একটা ঘরে শিট করেছিল।

দরজা বন্ধ দরজার গায়ে টোকা দিতেই সাড়া এল।

কে?

মালতী দেবী, আমি কিরীটী রায়–দরজাটা খুলুন।

মালতী দরজা খুলে দিল।

ঘরে আসতে পারি?

আসুন। দরজা ছেড়ে দিলেন মালতী।

এই চিঠিটা পড়ে দেখুন।

কার চিঠি? কিসের চিঠি? মালতী শুধালেন।

চিঠিটা আপনার স্বামীর লেখা আর আপনাকেই লেখা–চিঠিটা শেষ করতে পারেননি, তাই হয়তো পোস্ট করেননি।

কোথায় পেলেন এটা?

আপনার স্বামীর সুটকেসে। পড়ে দেখুন–আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর এর মধ্যে পাবেন।

মালতী হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন।

মালতী কিরীটীর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন বটে কিন্তু মনে হল তার জন্য যেন মনের মধ্যে। কোন তাগিদ ছিল না। কোন ইচ্ছা বা আগ্রহও না।

কিরীটী আর দাঁড়াল না।

কিরীটী স্থির করেছিল পরের দিনই সে চলে যাবে। মালতী দেবীর কাজটুকু যখন শেষ হয়ে। গিয়েছে, পুরীতে থাকা তো আর প্রয়োজন নেই।

কেবল একটা কাজ বাকি। হোটেলের বোর্ডারদের গতিবিধির উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, হেমন্ত সাহুকে বলে তার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া। হোটেল থেকে এখনও কেউ যাননি।

রাত্রে আহারাদির পর নিজের ঘরে বসে বসে কিরীটী সেই কথাটাই ভাবছিল। রাত তখন গোটা দশেক হবে।

থানা থেকে হেমন্ত সাহুর লোক এল তার একটা চিঠি নিয়ে।

সাব, হুজুর আপনাকে একবার থানায় যেতে বলেছেন।

কিরীটী আর দেরী করে না। উঠে পড়ল। লোকটা একটা সাইকেল-রিকশা এনেছিল। উঠে বসল কিরীটী সাইকেল-রিক্‌শায়।

শ্রাবণের আকাশটা আজ পরিষ্কার, কোথাও কোন মেঘের চিহ্নমাত্রও নেই। ঝকঝক করছে। আকাশভরা একরাশ তারা।

সমুদ্রের একটানা গর্জন, বাতাস হু-হু করে ভেসে আসছে। কালো কালো ঢেউগুলো শুভ্র। ফেনার মুকুট মাথায় বালুবেলার ওপরে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।

থানার অফিসঘরেই হেমন্ত সাহু বসেছিলেন, আর তার সামনে মুখখামুখি বসেছিল যে লোকটা তাকে দেখে কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা জেগে ওঠে-সলিল দত্ত মজুমদার।

এই যে আসুন মিঃ রায়, হেমন্ত সাহু বললেন।

কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

আমি জানতে চাই দারোগাবাবু-সলিল দত্ত মজুমদার বললে ভুবনেশ্বরের হোটেল থেকে আমাকে এখানে এভাবে ধরে আনা হল কেন?

জবাব দিল কিরীটীই, দাবোগাবাবুর কঠিন নির্দেশ সত্ত্বেও আপনি গতকাল কাউকে কিছু না। বলে হোটেল থেকে পালিয়েছিলেন কেন?

পালিয়েছিলাম। কে আপনাকে বললে?

যেভাবে চলে গিয়েছিলেন সেটা পালানো ছাড়া আর কি!

আমি কারও হুকুমের চাকর নই।

কিন্তু আইন যে কোন সময় আপনার গতি রুখতে পারে–

অন্যায় আইন—

ন্যায়-অন্যায়ের বিচারটা পরে হবে, আপনি পালিয়েছিলেন কেন তাই বলুন?

আবারও বলছি, আমি পালাইনি—চলে গিয়েছিলাম।

কিন্তু আপনার বোঝা উচিত ছিল ঐভাবে চলে গেলেই আইনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। শুনুন, আপনাকে অ্যারেস্ট করে আনা হয়েছে।

অ্যারেস্ট। শুনতে পারি কি কিজন্য?

আপনার বিরুদ্ধে তিন-তিনটি হত্যার অভিযোগ!

কি পাগলের মত আবোলতাবোল বকছেন?

তিন বৎসর আগে পুরীর হোটেলে এক রাত্রে জীমূতবাহন চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করেন আপনি, এবং তিন বৎসর পরে আরও দুজনকে পর পর হত্যা করেন—প্রথমে অনুরাধা দেবী ও পরে ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে–

মশাই গাঁজা-টাজা সেবন করেন নাকি?

আপনি বলতে চান আপনি ঐ হত্যাগুলি করেননি?

নিশ্চয়ই না–সলিল দত্ত মজুমদারের কণ্ঠস্বরে এতটুকু কোন দ্বিধা বা সংকোচমাত্রও নেই, শান্ত, নিরুদ্বিগ্নতা ঐ অদ্ভুত আজগুবি চিন্তাটা আপনাদের উর্বর মস্তিষ্কে কি করে এবং কেনই বা এল জানতে পারি কি?

নিশ্চয়ই। কিরীটীও অনুরূপ শান্ত গলায় জবাব দিল, জানতে পারেন বৈকি।

বক্র হাসি দেখা গেল সলিল দত্ত মজুমদারের ওষ্ঠপ্রান্তে, আমিই যে তাদের হত্যা করেছি তার কোন প্রমাণ কি আপনাদের কাছে আছে?

প্রমাণ ছাড়া কি দাবোগাবাবু আপনার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছেন?

তাই নাকি? তা কি প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে বলুন তো?

মোটামুটি যে চারটি প্রমাণ—

চারটি প্রমাণ।

হ্যাঁ। কিরীটী শান্তগলায় বললে, যে রাত্রে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করা হয়–

সেরাত্রে তো হোটেলের ত্রিসীমানায়ও আমি ছিলাম না। আমি ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলাম, ম্যানেজার ভবেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারতেন।

সে অ্যালিবাইটা আপনার ধোপে টিকবে না, কারণ সেরাত্রে আপনি আদৌ ভুবনেশ্বরে যাননি। আর জগন্নাথ পাণ্ডাই সে সাক্ষ্য দেবে। মনে হল আপনি যেন একটু চমকে উঠলেন : মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনার একটা কথা জানা প্রয়োজন, জগন্নাথ পাণ্ডা আপাতত নিরাপদ জায়গাতেই অবস্থান করছে—আদালতেই যা বলবার সে বলবে; তারপর ২ নং প্রমাণ আপনার ব্যবহৃত বিলেত থেকে আনা রেইনকোট, মানে ওয়াটারপ্রুফটা—যেটা আপনি সেরাত্রে জলঝড়ের মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন—তারপর আপনার কাজকর্ম চুকে যাবার পর হোটেল থেকে বের হয়ে গিয়ে সমুদ্রতীরে একটা কাঁটাঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন। সেটার স্থানে স্থানে এখনও যথেষ্ট রক্তচিহ্ন আছে—যে রক্ত কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে প্রমাণ করবে অনুরাধা দেবীরই রক্ত, সেটা এখন সেরাত্রের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রমাণ হিসাবে থানায়-ই আছে।

শেষের কথাগুলো শুনতে শুনতে কিরীটীর মনে হল যেন সলিল দত্ত মজুমদারের মুখের চেহারাটা কেমন পালটে যাচ্ছে।

এবার আসা যাক তৃতীয় প্রমাণে—আপনার পিস্তলটা, যেটার সাহায্যে তৃতীয় দিন রাত্রে আপনি আপনার হতভাগ্য নির্বোধ সম্বন্ধী ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে হত্যা করেছিলেন, সেই পিস্তলটা আজ শেষরাত্রে একজন জেলে সমুদ্রের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছে—ঐ পিস্তলের নম্বরটাই প্রমাণ দেবে, ঐ পিস্তলের লাইসেন্স হোল্ডার কে!

কিরীটীর মনে হল, সলিল দত্ত মজুমদারের থুতনীটা যেন ঝুলে পড়েছে।

বলছিলাম না চারটি প্রমাণ আপাতত আমাদের হাতে আছে, চতুর্থ প্রমাণ হল ক্ষিতীন্দ্রবাবুর অসমাপ্ত একখানা চিঠি। সারাটা জীবন ধরে নির্বুদ্ধিতা করে করে বোধ হয় মৃত্যুর আগে ঐ একটিমাত্র বুদ্ধির কাজ করতে উদ্যত হয়েছিলেন ক্ষিতীন্দ্রবাবু তার স্ত্রী মালতী দেবীকে ঐ চিঠিটা লিখতে বসে—এখন বুঝতে পারছেন দত্ত মজুমদার সাহেব, গরল আর পাপ কখনও চাপা থাকে না, তিন বৎসর আগেকার চাপা পাপও আজ এতদিন পরে প্রকাশ হয়ে পড়ল!

সলিল দত্ত মজুমদার একেবারে চুপ। কেমন যেন অসহায় বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কিরীটীর মুখের দিকে।

সেইদিনই হয়তো আপনি ধরা পড়তেন, যদি না নির্বোধ ক্ষিতীন্দ্রবাবু প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আত্মগোপন করে থাকতেন। অবিশ্যি আপনাকে পরোক্ষভাবে ক্ষিতীন্দ্রবাবুর অতি চালাক ও বুদ্ধিমতী স্ত্রী মালতী দেবীও কিছুটা সাহায্য করেছিলেন। তার নিজের স্বামী বলে জীমূতবাহনের দেহটা identify করে। যাক গে সেকথা, সে রাত্রে জীমূতবাহনের মুখ বন্ধ করবার জন্য তাকে কি ভাবে হত্যা করেছিলেন তা আমরা জানতে চাই না, জানবার আর প্রয়োজনও নেই, যে দুটি হত্যার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে তাই যথেষ্ট। কিন্তু আমার প্রশ্ন : আপনি তো ভাল করেই জানতেন, অনুরাধা দেবীকে ডঃ সেন ভালোবাসেন। তা জানা সত্ত্বেও ভদ্রলোকের কাছ থেকে অনুরাধাকে অমন করে ছিনিয়ে এনেছিলেন কেন?

হঠাৎ ঐ সময় সলিল দত্ত মজুমদার হাঃহাঃহাঃ করে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন।

মিঃ দত্ত মজুমদার–কিরীটী ডাকল।

কিন্তু দত্ত মজুমদার তখনও হাসছে হাঃ হাঃহাঃ! থানার ঘরের দেওয়ালগুলোতে যেন সেই হাসির শব্দ প্রতিহত হয়ে ঠিকরে ঠিকরে যেতে লাগল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত