জয়ন্ত চৌধুরী যখন প্রথম চিঠিটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়েছিল কিরীটী চিঠিটা একবার পড়েছিল—যেমন কোন মানুষ কোন চিঠি পড়ে ঠিক তেমনি করেই এবং সত্যিই তার মনে কোন কৌতূহলের উদ্রেক করেনি।
সে চিঠিটা ভাঁজ করে যে বইটা তখন সে বসে বসে পড়ছিল সেই বইটার মধ্যে ভাজ করে রেখে দিতে দিতে বলেছিল, কাল-পরশু একসময় একবার আসবেন তখন কথা হবে।
জয়ন্ত চৌধুরী কিরীটীকে কিছুটা চিনত তাই দ্বিতীয় আর কোন অনুরোধ করেনি—সেদিনকার মত বিদায় নিয়েছিল।
হাতের লেখাটা সামান্য একটু কাঁপা কাঁপা হলেও স্পষ্ট, পড়তে কষ্ট হয় না আদৌ। লেখিকার হাতের লেখা যে কোন একসময় মুক্তোর মত পরিষ্কার ও ঝরঝরে ছিল, আজও সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না যেন। পাতলা নীল রঙের চিঠির কাগজে লেখা চিঠিটা। চিঠির কাগজটা দামী এবং বিলিতি। চিঠির কাগজের ডানদিকে ওপরে মনোগ্রাম করে লেখা ইন্দ্ৰালয়।
খুব দীর্ঘ নয়—এক পৃষ্ঠার একটা চিঠি।
লেখিকা মনে হয় কিরীটীর চিঠিটা লিখতে লিখতে কখনো যেন থেমে গিয়েছে, কখনো আবার দ্রুতই কয়েকটা লাইন লিখে গিয়েছে। অক্ষরগুলোও সব সমান নয়, লাইনগুলোও মধ্যে মধ্যে বেঁকে গিয়েছে। ঠিক যেন সোজা হয়নি।
স্পষ্টই বোঝা যায়, একটা মানসিক উদ্বেগের মধ্যে যেন লেখিকা চিঠিটা কোনমতে লিখে শেষ করেছে। এবং সে-উদ্বেগটা লেখিকাকে বেশ একটু যেন বিচলিত করেছে। বিশেষ করে চিঠির মাঝামাঝি জায়গায় যেখানে সেই মানসিক উদ্বেগটা যেন বেশ স্পষ্টই হয়ে উঠেছে।
যত দিন যাচ্ছে ব্যাপারটা যেন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ওদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই আমাকে হত্যা করবার একটা স্পাহা—সম্পূহা না বলে বোধ হয়। ইচ্ছাই বলা উচিত—অ! গু স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। এবং তাতেই আমার মন হচ্ছে ওরা যেন প্রত্যেকে আমাকে হত্যা করবার জন্য ওৎ পেতে সুযোগের অপেক্ষা করছে। সেই জন্যই আমি স্থির করেছি, ওদের সে সুযোগটা দেবো। এভাবে মনের সঙ্গে অহৰ্নিশি যুদ্ধ করতে সত্যিই আর আমি পারছি না জয়ন্ত। মনে হচ্ছে যা হবার তা হয়ে যাক। আমি ভাল করে খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না—এভাবে এ বয়সে আমার নাভের সঙ্গে এই যুদ্ধ করার চাইতে মনে হচ্ছে যা ওরা চাইছে, আমি বোধ হয়। সেই অবশ্যম্ভাবীকে এমনি করে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তাই আমি মনে মনে স্থির করেছি। ওরা যদি হত্যা করে আমায় শান্তি পায় তো করুক ওরা আমাকে হত্যা। সত্যি এইভাবে সর্বক্ষণ বসে বসে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে আর আমি পারছি না। ওদূের কারো হাতেই যদি আমার মৃত্যু আমার ভাগো লেখা থাকে তো তাই হোক।
আমিও নিষ্কৃতি পাই, ওদের ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়।
পরের দিনই জয়ন্ত এসে আবার উপস্থিত হল।
কিরীটী আরাম-কেন্দারাটার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে চিঠিটার কথা ভাবছিল।
বসুন জয়ন্তবাবু—
কি ঠিক করলেন? জয়ন্ত প্রশ্ন করে।
কিরীটী সামনে উপবিষ্ট জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকাল।
ভদ্রলোকের বয়স বেশি হবে না-ত্রিশের নীচে নয়, পয়ত্ৰিশের উদ্ধের্ব নয়। সাধারণ দোহারা চেহারা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা বুদ্ধির দীপ্তি। পরনে গরম সম্মুট-স্যাটটা দামী, দেখলেই বোঝা যায়।
ভদ্রলোক মাকুন্দ-দাড়ি-গোঁফের চিহ্নমাত্রও চোখে পড়ে না। ভদ্রলোকের ডান চোখটা সামান্য টেরা—ভাল করে লক্ষ্য করে না দেখলে চট করে সেটা বুঝবার উপায় নেই অবিশ্যি।
এ চিঠিটা আপনি কবে পেয়েছেন মিস্টার চৌধুরী? কিরীটী প্রশ্ন করে।
দিন তিনেক হল।
চিঠির লেখিকা ভদ্রমহিলা, মানে চিত্রাঙ্গদা দেবী আপনার কে হন যেন বলছিলেন?
জেঠিমা।
বয়স কত হয়েছে তার?
আটষট্টি-ঊনসত্তর হবে। কিন্তু অত বয়স হলে কি হবে, দেহের বাঁধুনি এখনো এমন আটসঁটি যে, দেখলে মনে হয়। পঞ্চাশের বেশি নয়। তাছাড়া এখনো রীতিমত কর্মঠ। দুদুটো কলিয়ারী, ব্যাপার-অত বড় বিরাট দুটো অফিস, একটা ধানবাদে একটা কলকাতায়— সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে, কোথায় কি হবে না হবে—সব কিছুর তিনি খবর রাখেন ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।
হুঁ। আচ্ছা, ওই যে চিঠির মধ্যে উনি লিখেছেন—জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্ৰ, স্বাতী প্রভৃতির কথা, ওরা কারা? ওদের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদা দেবীর কি সম্পর্ক?
ওরা সব আমার মেজ জেঠামশায় হীরেন্দ্ৰ চৌধুরীর ছেলেমেয়ে।
তার মানে, ওঁর দেওরের ছেলেমেয়ে? কিরীটী শুধাল।
হ্যাঁ। আমাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রিটা আপনার বোধ হয় একটু জানা দরকার মিস্টার রায়। জয়ন্ত চৌধুরী বলে।
সংক্ষেপে বলুন।
হ্যাঁ, সেটা আপনার বোধ হয় জানা দরকার।
অতঃপর জয়ন্ত চৌধুরী বলতে শুরু করে।
পৌষের শেষ। শহরে শীতটা যেন বেশ দাঁত বসিয়েছে। তার ওপরে দিন দুই হল আকাশটা মেঘলা-মেঘলা, এবং টিপটপ করে মধ্যে মধ্যে বৃষ্টিও পড়ছে। আর থেকে থেকে এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে লাগল—কিরীটী চুরুটটায় আবার অগ্নিসংযোগ করে নিল। জেঠামশাইরা তিন ভাই ছিলেন, জিতেন্দ্ৰ, হীরেন্দ্র ও নীরেন্দ্ৰ চৌধুরী। ঠাকুরদা তাঁর ছেলেদের সাধ্যমত লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবার চেষ্টা করেছিলেন।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে লাগল একটু থৈমে, চিরদিনের জেদী ও ডানপিটে স্বভাব ছিল বড় ছেলে জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর। পড়াশুনায় আন্দীে মন ছিল না, দিবারাত্র গান-বাজনা নিয়েই থাকত।
বাপের সঙ্গে তাই নিয়ে প্রায় খিটিমিটি, চেঁচামেচি চলত। তার। অবশেষে একদিন সেই খিটমিটি চরমে ওঠায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যান জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী। বয়স তখন তাঁর মাত্র আঠারো বছর। বয়সের আন্দাজে দেহের গঠনটা ছিল বলিষ্ঠ। প্রায় ছ’ ফুটের কাছাকাছি লম্বা। টকটকে গায়ের রঙ। দুর্দান্ত স্বাস্থ্য। যেমন সাহসী, তেমনি দুর্দান্ত বেপরোয়া প্রকৃতির।
ঘুরতে ঘুরতে বিহার অঞ্চলে গিয়ে হাজির হন একসময় ভােগ্যান্বেষণে জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী। এবং সেখানেই শিল্পপতি রায়বাহাদুর হরপ্রসাদ ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। প্রাণচঞ্চল, বলিষ্ঠ চেহারার কন্দৰ্পসদৃশ যুবকটিকে দেখে কেন যেন রায়বাহাদুর হরপ্রসাদের ভারী ভাল লেগে যায়।
চমৎকার হিন্দীতে কথা বলছিলেন জিতেন্দ্র, তাই বোধ হয় একটু সন্দেহ হওয়ায় রায়বাহাদুর জিজ্ঞাসা করেন, তুমি বাঙালী?
হ্যাঁ।
কি জাত?
ব্ৰাহ্মাণ।
কতদূর লেখাপড়া করেছ?
বলতে পারেন, কিছুই না।
কেন?
ভাল লাগেনি কখনো লেখাপড়া করতে, তাই।
হরপ্রসাদ একটু হাসলেন তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, কিছুই শেখনি? বলার মত কিছুই নয়—তা নামধামটা লিখতে পার তো?
তা অবিশ্যি জানি। বলছিলাম, লেখাপড়া বলতে যা বোঝায়—আপনারা যা বোঝেন— কোন পাসটাস নই।
রায়বাহাদুর মৃদু হাসলেন আবার।
হুঁ-তা কে কে আছেন?
আছেন সবাই-মা বাবা, দুই ভাই। কিন্তু—
কি?
তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
কেন?
মতের মিল হল না।
রায়বাহাদুর আবার হাসলেন।
তা লেখাপড়া তো করেনি, আর কিছু পার?
দৌড়তে পারি, সাঁতরাতে পারি, বন্দুক, লাঠি চালাতে জানি। যে কোন রকম দৈহিক পরিশ্রম করতে পারি। আর একটু-আধটু গান গাই।
আমার কয়লার খনি আছে। খনি থেকে সাঁওতালদের সঙ্গে কয়লা কেটে তুলতে পারবে? চেষ্টা করলে যে পারব না তা নয়। কিন্তু—
রায়বাহাদুর যুবকের সরলতায় ও স্পষ্টতায় আবার হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, এখন আপাততঃ চলে আমার বাড়িতে, তারপর ভেবচিন্তে দেখা যাবে-তোমার উপযুক্ত একটা কাজ যোগাড় করা যায় কিনা।
রায়বাহাদুর হরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচুর অর্থ ও সম্পত্তি এবং বিরাট কলিয়ারীর বিজনেস। ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের সমারোহ, কিন্তু খাবে কে? ভোগ করবে কে? আপনার জন বলতে একটিমাত্র মেয়ে—চিত্রা অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদা ব্যতীত আর কোন আপনজনই নেই। নিজে, স্ত্রী—সারদা ও একমাত্র সন্তান ওই চিত্রা।
চিত্রাঙ্গদার বয়স তখন বারো কি তেরো-কিশোরী চিত্ৰঙ্গদা। কন্দপের মত দেখতে তরুণ জিতেন্দ্ৰকে দেখে চিত্রাঙ্গদার কেন যেন ভারী ভাল লাগে-বোধ হয় প্রথম যৌবনেরই নেশা।
সে যাই হোক জিতেন্দ্র থেকে গেলেন ইন্দ্ৰালয়ে।
জয়ন্ত চৌধুরী থামল।
তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।
জয়ন্ত চৌধুরী আবার শুরু করে ঃ তারপর একদিন বছরখানেক বাদে প্রচুর ঘটা করে রায়বাহাদুর ওই ঘর-থেকে-পালানো যুবকটি জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর সঙ্গেই তাঁর একমাত্র কন্যার বিবাহ দিলেন। তবে–
কিরীটী জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকায় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।
জয়ন্ত চৌধুরী বলে, একটা কথা—একটু ইতস্ততঃ করে বলে জয়ন্ত চৌধুরী, পরে জানা যায় অবিশ্যি কথাটা–চিত্রাঙ্গদা রায়বাহাদুরের মেয়ে হলেও সে কিন্তু তঁর বিবাহিত স্ত্রীর কন্যা ছিল না।
আপনার জেঠামশাইও জানতেন না কথাটা?
জানতেন।
তবে তিনি সব জেনেশুনেই বিয়ে করেছিলেন বলুন?
হ্যাঁ।
মানে বলতে চান। ওর স্ত্রী সারদা দেবীর কন্যা নয়?
সারদা দেবীর কন্যা
তবে?
যদিও সবাই জানত সারদা দেবী হরপ্রসাদের বিবাহিতা স্ত্রী-পশ্চিমে একবার বেড়াতে গিয়ে বিয়ে করে এনেছিলেন। কিন্তু আসলে তা নয়।
তবে কি?
সারদা ওঁর আসল নামও নয়—আসল নাম যমুনা। লক্ষ্ণৌর এক বিখ্যাত বাইজীর মেয়ে।
বাইজীর মেয়ে?
হ্যাঁ। বাইজী-মায়ের গান শুনতে গিয়ে সেখানে তার যুবতী বাইজী-কন্যা যমুনাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান হরপ্রসাদ, এবেং কল্ক টাকার বিনিময়ে যুমনাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। যখন দেশে ফেরেন, সবাই জানল পশ্চিম থেকে বিয়ে করে এলেন। হরপ্রসাদ।
রায়বাহাদুরের সত্যিকারের কোন বিবাহিত স্ত্রী ছিল না?
না।
হুঁ, বলুন।
আবার বলতে লাগল জয়ন্ত চৌধুরী ঃ যমুনার নতুন নাম হল সারদা। কিন্তু হরপ্রসাদ সারদার সত্য পরিচয়টা জিতেন্দ্রর কাছে কিন্তু গোপন করেননি, সে কথা তো একটু আগেই আপনাকে আমি বললাম—স্পষ্ট করেই সব কথা বলেছিলেন বিবাহের পূর্বে তাঁকে।
তবু বিবাহ আটকায়নি। কারণ হয়তো হরপ্রসাদের মতই জিতেন্দ্ৰও চিত্রার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি সানন্দেই বিবাহ করলেন চিত্রাঙ্গদাকে। এবং শ্বশুরের মৃত্যুর পর তাঁর বিরাট সম্পত্তির মালিকও হয়ে বসলেন।
তারপর?
জেঠামশাই কিন্তু বেশিদিন বাঁচোননি। মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বয়সে বাঘ শিকার করতে গিয়ে একদিন হাজারীবাগের জঙ্গলে বাঘের হাতে জখম হয়ে সেপটিক হয়ে মারা যান।
ওঁদের কোন সন্তানাদি হয়নি?
না
তারপর?–
এদিকে জিতেন্দ্রর অন্য দুই ভাই হীতেন্দ্র ও নীরেন্দ্ৰ চৌধুরী—একজন তখন ওকালতি করেন, ও একজন অধ্যাপনা করে জীবন কাটাচ্ছিলেন। দুজনেই বিবাহ করেছিলেন। ছোট ভাই নীরেন্দ্ৰ চৌধুরীও জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী মারা যাবার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান। তাঁর একটিমাত্র ছেলে আমি—বি. এ. পাস করে জীবনবীমা অফিসে চাকরি করছি সেও তো আপনি জানেন। শ’তিনেক টাকা মইনা পাই। বিয়ে-থা করিনি। একা মানুষ, মোটামুটি সচ্ছলতার মধ্যেই দিন কাটছে। কিন্তু যাক যা বলছিলাম-জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর মেজ ভাই হীরেন্দ্ৰ, চৌধুরী ওকালতি করে তেমন একটা কিছু উপার্জন করতে কোন দিনই পারেননি।
তাঁরই পাঁচটি ছেলেমেয়ে—জগদীন্দ্র, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র ও শচীন্দ্ৰ—চার ছেলে এবং একটিমাত্র মেয়ে স্বাতী।
তাঁরও অকালেই মানে নীরেন্দ্ৰ চৌধুরীর মৃত্যুর বৎসর দুয়েকের মধ্যেই মৃত্যু হয়। ওদের মা আগেই মারা গিয়েছিলেন। এদিকে হীরেন্দ্ৰ চৌধুরীর মৃত্যুর পর জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা দেবী দয়াপরবশ হয়ে ওদের নিজের কাছে নিয়ে যান ইন্দ্ৰালয়ে।
সেও আজ বারো-তেরো বছর আগেকার কথা।
হীরেন্দ্রর একটি ছেলে ও বলতে গেলে মানুষ হয়নি-মেয়ে ওই স্বাতী বি. এ. পাস করেছে।
অতঃপর জয়ন্ত চৌধুরী তার জোঠতুতো ভাই-বোনদের একটা মোটামুটি পরিচয় দিল।
বড় জগদীন্দ্র, বয়স ত্রিশ-একত্ৰিশ হোর—চিরদিনই রুগ্ন—ক্রনিক হ্যাঁপানীর রোগ। ম্যাট্রিক পরীক্ষা বার দুই দিয়েছিল, পাস করতে পারেনি।
বাড়িতে সৰ্ব্বক্ষণ বসে থাকে—এবং বসে বসে পেসেন্স থেলে তাস নিয়ে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে একটু বিলাসী ও লোভী।
দ্বিতীয় মণীন্দ্ৰ চৌধুরী-বড় ভায়ের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে। জগদীন্দ্ৰ তবু ম্যাট্রিক পরীক্ষণ দিয়েছিল, সে তাও দেয়নি। খেলাধূলায় খুব নেশা। ওই অঞ্চলের একজন নামকরা ফুটবল প্লেয়ার। সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলে। স্বাস্থ্য ভাল এবং সৌখিন প্রকৃতিরবেশভূষা ও সাজসজ্জার দিকে বিশেষ নজর।
তৃতীয় ফণীন্দ্ৰ—ডান পা-টা খোঁড়া। চলার সময় পা-টা একটু টেনে টেনে চলে। ফণীন্দ্রর নেশা গান-বাজনায়। ভাল তবলা বাজায়। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য মোটামুটি—এবং সেও তার দাদার মতই ভোজনবিলাসী।
চতুর্থ শচীন্দ্ৰ—ভাইদের মধ্যে সেই দেখতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর। ভাইদের মধ্যে ও-ই ম্যাট্রিকটা পাস করেছে। কবিতা লেখা ও রহস্য-রোমাঞ্চের বই পড়া তার একটা নেশা।
স্বাতী-বোন; স্থানীয় কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেছে—গত বছর। এম. এ. পড়ার ইচ্ছা। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, না-যথেষ্ট হয়েছে।
চিত্রাঙ্গদা দেবী তার বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান করছিলেন, এমন সময় হঠাৎ প্রকাশ পেলো চিত্রাঙ্গদা দেবীর ধানবাদ অফিসের যে তরুণ অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজারটি বছর দুই হল তার ধানবাদ অফিসে যোগ দিয়েছে।–অনিন্দ্য চক্রবর্তী—তাকেই নাকি স্বাতী বিয়ে করতে চায়।
অনিন্দ্যও সেকথা চিত্রাঙ্গদা দেবীকে জানিয়েছিল।
কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবী রাজী হননি; শোনামাত্রই কথাটা নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন, অসম্ভব-হতে পারে না।
তবু স্বাতী জিজ্ঞাসা করেছিল তার বড়মাকে, (চিত্রাঙ্গদা দেবীকে সকলে ‘বড়মা’ বলে ডাকে বরাবর) কেন, অসম্ভব কেন?
‘কেন’র জবাব তোমাকে আমি দেবো না। অসম্ভব—এইটাই শুধু মনে রেখো।
তবু তর্ক তুলেছিল স্বাতী। বলেছিল, অনিন্দ্য তোমার আফিসে চাকরি করে বলেই কি এ বিয়ে হতে পারে না?
তর্ক করো না স্বাতী। চিত্রাঙ্গদা দেবী বলেছিলেন।
ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে সেটা তোমার ভুয়ো অর্থহীন ভ্যানিটিতে লাগবে, তাই কি—
চুপ কর, ডেপোমি করো না-দুটো পাস করে ভাব যেন কি একটা হয়ে গিয়েছ, তাই না?
ডেঁপোমি আমি করছি না—বরং তুমিই অন্যায়। জুলুম করবার চেষ্টা করছ।
স্বাতী?
তোমার ঐ চোখরাঙানোকে আর যে ভয় করুক আমি করি না তুমি জান—
অকৃতজ্ঞ।
কেন আশ্রয় দিয়ে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছ বলে? কিন্তু ভুলে যেও না পায়ে ধরে আশ্রয় দিতে আমরা তোমাকে সাধিনি—তুমিই—
হ্যাঁ, অন্যায় হয়েছে আমার। পথে ভেসে বেড়ানোই তোমাদের উচিত ছিল।
সেটা হয়ত সুখেরই হত।
ক্ৰোধে যেন অতঃপর একেবারে ফেটে পড়েছিলেন চিত্রাঙ্গদা দেবী। বলেছিলেন যেমন অপদাৰ্থ আমানুষ ছিল বাপ তেমনিই হবে তো তোমরা—একপাল ভেড়া জন্ম দিয়ে গিয়েছে–
হ্যাঁ, বাপ আমাদের অপদাৰ্থ অমানুষ তো হবে—কারণ তুমি যে তার সন্তানদের প্রতি কৃপা দেখিয়ে আশ্রয় দিয়ে বাহাদুরী কুড়োবার সুযোগ পেয়েছ!
স্বাতী, তুমি স্পর্ধার সীমা লঙঘন করছ। চাপা কণ্ঠে তর্জন করে উঠেছিলেন চিত্রাঙ্গদা দেবী অতঃপর।
ভাগ্যে মণীন্দ্র ওই সময় সামনে এসে পড়েছিল, সে কোনমতে বোনকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কিরীটী প্রশ্ন করে, আপনি কার কাছে শুনলেন এসব কথা? আপনি তো সেখানে থাকেন না?
না, স্বতীই আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল সব কথা।
তারপর কি হল?
কি আর হবে, ব্যাপারটা ওইখানেই চাপা পড়ে গেল। জয়ন্ত চৌধুরী বললে।
আর ওই অনিন্দ্য চক্রবর্তী—তার কি হল?
সে এখনো চাকরি করছে।
তা আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন মিস্টার চৌধুরী এবার বলুন তো?
কেন, আপনি চিঠিটা পড়েছেন তো। বড়মার ধারণা হয়েছে এই মাসের পনেরো তারিখে তার জন্মদিন-এবং তার কোষ্ঠীতেও আছে নাকি এই সময়টা তাঁর অপঘাতে মৃত্যুযোগ; কাজেই তিনি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।
কোষ্ঠীতে মৃত্যুযোগ আছে বলে?
হ্যাঁ, তার কোষ্ঠীতে যা যা ছিল, সব ফলে গিয়েছে আজ পর্যন্ত একেবারে ঠিক ঠিক। তাই
কিন্তু এক্ষেত্রে আমি তাকে কি সাহায্য করতে পারি?
দেখুন কথাটা তাহলে আপনাকে আমি আরো একটু স্পষ্ট করে বলি—জেঠিমার ঐ চিঠিটা পাবার পর থেকেই আমারও মনে হচ্ছে সত্যিই হয়ত জেঠিমকে ঘিরে একটা ষড়যন্ত্র ঘন হয়ে উঠছে—
ষড়যন্ত্র!
হ্যাঁ। আর তাই আমি আপনার কথা জেঠিমাকে ফোনে জানিয়েছিলাম—বলেছিলাম আপনার সাহায্য নিলে হয়ত সব ষড়যন্ত্র ফাস হয়ে যেতে পারে।–
কিন্তু–
মিঃ রায়, তাই জেঠিমা ও আমার দুজনেরই ইচ্ছে বিশেষ করে ঐ সময়টা সেখানেই আপনি উপস্থিত থাকুন—আপনি অমত করবেন না।
কিরীটী অতঃপর কি যেন ভাবে কয়েক মূহুর্ত, তারপর বলে, আপনার কথা হয়ত মিথ্যে নয়। কিন্তু সেখানে আমি কি ভাবে যেতে পারি?
সেটা আপনিই ভেবে বলুন।–
আচ্ছা জয়ন্তবাবু, কোষ্ঠীর ব্যাপারে বুঝি চিত্রাঙ্গদা দেবীর খুব বিশ্বাস? কিরীটী মৃদু হেসে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কিন্তু মিস্টার চৌধুরী, সত্যিই যদি তাঁর এই সময় অপঘাতে মৃত্যুযোগ থাকে, কারো সাধ্য আছে কি তাকে রক্ষণ করার?
সে কি আর আমি বুঝি না! তাছাড়া তারও ধারণা–
কি?
তাঁর মৃত্যু যদি ঘটেই তো ওরাই তাঁকে হত্যা করবে। তাই আরো বেশি করে ওদের গতিবিধির ওপর সর্বক্ষণ প্রখর দৃষ্টি রাখবার জন্যই একজনের সাহায্য আমরা চাই।
কিরীটী আবারও হাসল। তারপর বলল, ঠিক আছে মিস্টার চৌধুরী, আমি যাব। অন্য কোন কারণ নয়—ব্যাপারটা সত্যিই বিচিত্র, তাই যাব। কিন্তু আপনার কি ধারণা বলুন তো?
আমার?
হ্যাঁ।
খুব একটা অসম্ভব নয় কিছু।
কি?
বড়মাকে ওদের কারো পক্ষে হত্যা করা।
কিন্তু কেন বলুন তো?
একটা কথা আপনোক বলা হয়নি মিস্টার রায়–
কি বলুন তো? আমার যে পাঁচজন জোঠতুতো ভাইবোনের কথা একটু আগে আপনাকে বললাম তাদের অবস্থাও আজ কোণঠাসা জন্তুর মত।
কি রকম?
বড়মাকে আপনি দেখেননি—কিন্তু দেখলে বুঝবেন স্ত্রীলোক হলেও তার অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব আছে। এবং আছে প্রত্যেকের উপরে প্রভুত্ব করবার একটা অদ্ভুত লিন্সা।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তাঁর ধারণা চিরদিন, ধারণাই বা বলি কেন মনে হয় স্থির বিশ্বাস যে তার মত সুন্দরী নেই-তাঁর মত বুদ্ধিমতী নেই-তিনি যা করবেন বা করেন, সেটাই ঠিক। তিনি যা বোঝেন, সেটাই শেষ বোঝা। সবাইকে তারই নির্দেশ মেনে চলতে হবে। বলতে পারেন। তীরে এটাই বিচিত্র একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স—তাঁর যে গুণ নেই তা নয়—বরং অনেক গুণাই আছে—তাছাড়া মনে স্নেহ-মমতাও আছে। তবু ঐ কমপ্লেক্সটুকুই তাঁর যা কিছু রাহুর মত গ্রাস করেছে—শোনা যায়, ওই কারণেই জেঠামশাইয়ের সঙ্গেও কোন দিন যাকে বলে সত্যিকারের মিল তো হয়নি—দুজনের মধ্যে কোন দিন সত্যিকারের একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি।
Interesting! তারপর?
কিরীটীর চুরুটাটা একসময় নিভে গিয়েছিল, পুনরায় সে তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে লাগল, এবং আমার কি মনে হয় জানেন মিস্টার রায়?
কি?
আমার ধারণা আমার মেজ জেঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে বড়মা তার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তার মধ্যেও বড়মার অসহায়দের জন্য মমতা বা দায়িত্ববোধের চাইতেও হয় বেশি ছিল কতকগুলো অসহায় ছেলেমেয়ের উপর তার সেই আধিপত্য বিস্তার বা dominate করবার লিন্সটাই। কিন্তু হাজার হলে ওরাও তো মানুষ-দুর্ভাগ্যের জন্যে ওদের বড়মার আশ্রয়ে যেতে হলেও দিনের পর দিন তাঁর ঐ নিষ্ঠুর বিলাস তাদের সহ্যশক্তির ওপর মর্মান্তিক ভাবে পীড়ন করেছে হয়ত এবং যার ফলে আজ তারা সত্যিই মরীয়া হয়ে উঠেছে; এবং সত্যিই হয়ত ওরা আজ বড়মাকে হত্যাও করতে পারে তাঁর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যেই। হয়ত আমারও অবস্থা ওদেরই মত হত। আমার বাবার মৃত্যুর পর ওঁর ইচ্ছাক্রমে ওঁর ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে, কিন্তু thank God—ভগবান আমায় বঁচিয়েছেন। মামারা আমাকে আশ্রয় দিয়ে মানুষ করে তোলেন।
কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না মিস্টার চৌধুরী, একদিন না হয় ওরা অসহায় ছিল। কিন্তু আজ তো ওদের বয়স হয়েছে, আজও তাহলে ওরাই বা কেন দিনের পর দিন ওইভাবে পীড়ন সহ্য করে ওখানে পড়ে আছেন?
সেটা তো খুবই স্বাভাবিক—জেঠিমার সম্পত্তির লোভে। শুনলেন তো সব কটাই অপদার্থ-নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবার মত কোন শক্তি নেই।
কিন্তু আপনাদের বড়মা যে ওদেরই তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে যাবেন, তারই বা স্থিরতা কোথায়? তিনি যেরকম বিচিত্র প্রকৃতির স্ত্রীলোক-হয়ত একটি কপর্দকও কাউকে দেবেন। না তাঁর বিপুল সম্পত্তির—
না, তিনি already উইল করে দিয়েছেন।
কি উইল করেছেন?
শুনেছি। ওদের প্রত্যেকের জন্যেই একটা মোটা মাসোহারা ও নগদ টাকার ব্যবস্থা করেছেন তার উইলো।
ওঁরা কি সেকথা জানেন?
নিশ্চয়ই জানে।
কিরীটী অতঃপর চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, কিন্তু সত্যিই কি আপনি মনে করেন জয়ন্তবাবু—তারা তাদের আশ্রয়দাত্রী জেঠিমাকে শেষ পর্যন্ত মাত্র ঐ কারণেই হত্যা করতে পারেন!
অন্ততঃ আমি হলেও পারতাম মনে হয়—
ঠিক আছে। কবে সেখানে যেতে হবে বলুন?
আজ আপনি পারলে কাল নয়।
বেশ। আমি সামনের শনিবার যাব।
আমি এসে আপনাকে তাহলে নিয়ে যাব।
না, আমি একাই যাব। আপনি কেবল আপনার বড়মাকে গোপনে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবেন।
গোপনে!
হ্যাঁ আমার সেখানে যাবার ব্যাপারটা যেন তারা কেউ না জানতে পারেন।
কিন্তু—
কি ভাবে, কি পরিচয়ে যাব বুধবার আপনাকে জানাব।
বেশ। জয়ন্ত চৌধুরী উঠল।
ধানবাদ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ইন্দ্ৰালয়।
পাহাড়ের মত একটা উঁচু জায়গায় ইন্দ্ৰালয়! বাড়িটা যেন দূর থেকে অবিকল একটা দুর্গের মত মনে হয়। বড় রাস্তা থেকে পাথরের তৈরী একটা চওড়া রাস্তা ঘুরে ঘুরে সোজা রাস্তা যেন ইন্দ্ৰালয়ের গেটের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়িটা। তিনতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে বাগান, তার মধ্যেই রেস্ট-হাউস, আস্তাবল, গ্যারাজ ও চাকর-দারোয়ানদের থাকবার আস্তানা।
বাড়ির চতুষ্পার্শ্বস্থ সীমানা প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
একতলা, দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর। নিচের তলায় অফিস ও বসবার একটা বড় হলঘর। ওপরে দোতলায় চার ভাই থাকে চারটি ঘরে, এবং একটা ঘরে থাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
তিনতলার একটা ঘরে থাকে স্বাতী একা। স্বাতী বরাবর তার বড়মার লাগোয়া পাশের ঘরটাতেই ছিল, বছরখানেক আগে সে তিনতলায় চলে গিয়েছে।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর আদৌ ইচ্ছা ছিল না, স্বাতী তিনতলায় গিয়ে থাকে। বাধাও দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু স্বাতী শোনে নি। বলেছিল, না, তোমার পাশের ঘরে আর আমি থাকব না।
কেন থাকবি না শুনি?
সত্যি কথাটা শুনতে চাও?
হ্যাঁ, বল, কেন থাকবি না?
সৰ্বক্ষণ আমার ওপরে তোমার ওই শকুনের মত চোখ মেলে থাকাটা আমার সহ্য হয় না।
কি বললি!
হ্যাঁ, তাই। আমি চলাব ফিরব কথা বলব—জেগে থাকি বা ঘুমোই তুমি যে তোমার ঐ শকুনের দৃষ্টি দিয়ে আমাকে আমার সামনে পিছনে আড়ালেও খবরদারি করবে—সেটা আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে।
তা হবেই। আমার চোখের সামনে থাকলে বজ্জাতি করার সুবিধে হয় না কিনা।
কি বললে, বজ্জাতি?
হ্যাঁ—নষ্ট মেয়েমানুষ, তোর চরিত্রের কথা তো জানতে কারো বাকি নেই!
তুমি অতি নোংরা, অত্যন্ত ছোট মন কিনা তোমার।
কি বললি? আমি নোংরা, আমার ছোট মন?
একশবার বলব, হাজারবার বলব।-অত্যন্ত ছোট মন।
মুখ তোর থেতো করে দেব হারামজাদি!
চেষ্টা করেই দেখ না একবার-কে কার মুখ থেতো করে দেয় দেখবে।
পিছমোড়া করে ঘরের মধ্যে বেঁধে রাখা উচিত—তোর মত হারামজাদি নষ্ট মেয়েমানুষকে। আমাকে নয়-বাঁধা উচিত তোমাকে। জবাব দিয়েছিল স্বাতী।
কি, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা!
দেখ, বেশি বাড়াবাড়ি করো না—আমাকে তুমি আমার ওই ম্যান্তামুখে ভীতু দাদারা পাওনি।
চুপ কর হারামজাদি-ছেনাল
কোন চুপ করব, শুনি? তোমার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি, আর করব না। আজই আমি তেতলায় চলে যাব, দেখি তুমি কি করতে পার।
ঠ্যাং ভেঙে দেব—একবার গিয়ে দেখা না!
আমিও তোমার ঠ্যাং ভাঙব তাহলে।
উঃ দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি। সব—
সে তো পুষেছই। সেটা আরো ভাল করে টের পাবে, যখন সেই কালসাপের ছোবল খাবে।
কথাগুলো বলে স্বাতী গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল। এবং সত্যি সত্যি সেইদিনই সে তেতলায় চলে যায়। চাকরদের ডেকে জিনিস-পত্ৰ সব তার তেতলার ঘরে নিয়ে যায়।
জগদীন্দ্র বলেছিল বোনকে, বড়মা খুব চটেছেন স্বাতী।
বয়েই গেল তাতে আমার। আমি ওই ডাইনী শকুনি বুড়ীকে একটুও পরোয়া করি না।
ছিঃ, ওকথা বলে না।
ডাইনীকে ডাইনী বলব, শকুনিকে শকুনি বলবী—তাঁর আবার ছিঃ! কি! দেখ দাদা, তোমরা কেন পুরুষ হয়ে জন্মেছ বলতে পার?
কিন্তু–
তোমাদের গলায় দড়ি দেওয়া উচিত।
তা কি করব বল?
করবে। আর কি! আর করবার কিছু সাধ্যই কি আছে নাকি তোমাদের কারো অবশিষ্ট? যাও যাও, বড়মার পা চাটো গিয়ে। তোমাদের মত যদি পুরুষ হয়ে জন্মাতাম, তাহলে দেখতে ঠিক ওই ডাইনী বুড়ীকে এতদিনে আমি খুন করতাম।
স্বাতী! চিৎকার করে উঠেছিল। জগদীন্দ্র সভয়ে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে।
চার-চারটে পুরুষ তোমরা রয়েছ, পার না একদিন ওই শকুনি ডাইনী বুড়ীটাকে গলা টিপে শেষ করে দিতে?
মেজ ভাই মণীন্দ্ৰ যে ওই সময় দ্বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, ওরা টের পায়নি।
হঠাৎ মণীন্দ্ৰ বলে ওঠে, পারব না কেন, খুব পারি।
পার, পার মেজদা?
খুব পারি।
মণীন্দ্র বলতে বলতে ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে।
জগদীন্দ্র তখন যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এসেছে,
মণীন্দ্র আরো বলে, তুই দেখে নিস স্বাতী, একটু সুযোগ পেলেই—
হঠাৎ শুকনো গলায় ওই সময় কোনমতে জগদীন্দ্ৰ ধমকে ওঠে ছোট ভাইকে, মণি, কি হচ্ছে কি!
আমাকে চোখ রাঙােচ্ছ কি দাদা, আমি জানি তুমিও—
মণি!
হ্যাঁ—তুমিও সুযোগ পেলে ওঁকে হত্যা করবে।
কি বললি, আমি
হ্যাঁ, তুমি।
ভুলে যাস না মণি, বড়মা না থাকলে আজ আমরা কোথায় ভেসে যেতম!
সেও বোধ হয় এর চাইতে ভাল হত দাদা। এর নাম বাঁচা বল তুমি? স্বাতী তো মিথ্যা বলেনি, ঠিকই বলছে—এর চাইতে জেলের কয়েদীদের জীবনেও স্বাধীনতা আছে। একবার ভেবে দেখ তো? আমাদের আশ্রয় দেবার ছল করে কিভাবে আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে বড়মা বন্দী, পঙ্গু করে রেখেছে! শোন দাদা, তোমাকে আমি শেষবারের মত বলে রাখছি—
কি?
ভয়ে ভয়ে তাকায় জগদীন্দ্র ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে।
তোমরা এখানে পড়ে থাকতে পার কিন্তু আমি এখান থেকে চলে যাব।
চলে যাবি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
যেখানে হোক, পথে-ঘাটে।
কিন্তু খাবি কি?
কলের জল খাব।
বোকার মত কথা বলিস না মণি, কলের জল খেয়ে মানুষ বাঁচে না।
বাঁচে-বাঁচবে না কেন, এ রাজভোগের চাইতে সে অনেক ভাল—অনেক সম্মানের। বলে ওঠে স্বাতী।
পাগলামি করিস না মণি-ওসব গল্প-কবিতাতেই লেখা থাকে। জগদীন্দ্ৰ বলে।
স্বাতী বড় ভাইয়ের সে কথায় কান না দিয়ে মেজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, যাবেযাবে মেজদা, সত্যি চল এখান থেকে আমরা চলে যাই।
যাব।—সুযোগ এলেই যাব। মণীন্দ্র বলে।
ছেলেমানুষি করিস না মণি-জগদীন্দ্র বলে ওঠে আবার ভীতিকষ্ঠে, পৃথিবীটা এত সোজা নয়। ভুলে গেছিস? মনে নেই, বাবার সেই রোজগারের জন্য উদয়-অস্ত পরিশ্রমতবু দুবেলা পেট ভরে আমাদের আহার জুটত না, মা’র সেই কান্না—
তবু সে কান্নার মধ্যে ইজ্জত ছিল, সম্মান ছিল দাদা। এরকম গ্লানি আর অপমানের জ্বালা ছিল না। স্বাতী বলে।
চতুর্থ ভাই শচীন্দ্র ওই সময় এসে ঘরে ঢেকে ঃ ব্যাপার কিরে স্বাতী, হঠাৎ ওপরে চলে এলি কেন? বড়মা ভীষণ রেগে গেছে মনে হল—
তাই বড়মার জন্য বুঝি ওকালতি করতে এসেছী। ছোটদা!
তার মানে?
মানে আর কি, তুমি বড়মাির ভয়ে যেমন সর্বদা জুজুবুড়ী হয়ে আছ, তেমনিই থাক না। গিয়ে-এখানে কেন?
স্বাতীর কথাবার্তাগুলো আজকাল কেমন শুনিছ বড়দা? শচীন্দ্র বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
সত্যি কথা বলছি কিনা তাই শুনতে খারাপ লাগছে ছোটদা!
ওঃ, দুটো পাস করে যে একেবারে ধরাকে সারা জ্ঞান করছিস রে! শচীন্দ্র টিল্পনী কাটে।
তা তো করবই-এ তো আর গদ্য-কবিতা লেখার মত সহজ নয়!
আগে লিখে নে একটা—তারপর আমন বড় বড় কথা বলিস, শচীন্দ্ৰ বলে ওঠে।
ও যত খুশি তুমিই বসে বসে লেখা গে। আর দু বেলা বড়মার দেওয়া রাজভোগ খাও গে।
তুই নিমকহারাম ছোটলোক কিনা—তাই বড়মার সব উপকার ভুলে গেছিস আজ! তারপর একটু থেমে বলে, গলাধাক্কা দিয়ে যখন বড়মা এ বাড়ি থেকে বের করে দেবে, তখন বুঝবি।
বুঝতেই তো আমি সেটা চাই। বল গে না তোমার বড়মাকে কথাটা।
দেখ স্বাতী, এত তেজ মেয়েমানুষের ভাল না।
যাও যাও, আর উপদেশ দিতে হবে না। কবিতা লেখ গিয়ে, আর তোমার বড়মায়ের পায়ে তেল দাও গে—অপদাৰ্থ কাপুরুষ!
ঘৃণাভরে কথাগুলো বলে স্বাতী মুখ ফিরিয়ে নেয় তার ভাইয়ের দিক থেকে।
কিন্তু আশ্চর্য, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল চিত্রাঙ্গদা দেবী যেন স্বাতীর তিনতলায় যাবার ব্যাপারটা মেনেই নিলেন।
প্রথমটায় যতই হ্যাঁকডাক করুন না কেন, স্বাতী ওপরে চলে যাবার পর যেন হঠাৎ চুপ করে গেলেন।
বরং বাড়ির বুড়ি ঝি লখিয়ার মাকে বলে দিলেন, রাত্রে স্বাতীর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে শুয়ে থাকতে।
স্বাতী যেন তিনতলায় গিয়ে কতকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, প্রতি মুহূর্তে এখন আর চিত্রাঙ্গদা দেবীর মুখোমুখি হতে হবে না।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর দুই চোখের সন্দিগ্ধ কুটিল দৃষ্টি তাকে কীটার মত বিধবে না। বাতের জন্য বেশি হাঁটা-চলা আর এখন করতে পারেন না চিত্রাঙ্গদা দেবী—সিঁড়ি বেয়ে যখন-তখন তিনতলায় উঠে আসাটা তো এক-প্রকার দুঃসাধ্যই তাঁর পক্ষে।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর আসন্ন জন্মদিন উৎসব উপলক্ষ্যে ইন্দ্ৰালয়ের সবাই ব্যস্ত।
খুব হৈ-চৈ করে রীতিমত সমারোহের সঙ্গেই চিত্রাঙ্গদা দেবীর জন্মোৎসব পালন করা হয়—৩রা মাঘ।
আর উৎসবটা রায় বাহাদুর হরপ্রসাদের আমল থেকেই হয়ে আসছে। একমাত্র সন্তান— আদরিণী কন্যার জন্মদিনটা খুব সাড়ম্বরেই যেন স্মরণ করিয়ে দিতেন সকলকে প্রতি বছর।
ইন্দ্ৰালয়ের পিছনে যে বাগান, সেখানেই পর পর সব তাবু পড়তো—চারদিকে নানারঙের আলোর উৎসব-যাত্ৰা থিয়েটার পুতুলনাচ ছাড়াও আর একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল।
হরপ্রসাদ নিজে বরাবর গানবাজনা ভালবাসতেন-নিজে গাইতে ও বাজাতে পারতেনতাই তিনি মেয়ের জন্মদিনটিকে উপলক্ষ্য করে এক বিরাট জলসার ব্যবস্থা করতেন প্রতি বছর-নানা জায়গা থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনতেন গুণীদের, আট-দশ দিন ধরে একটানা গান-বাজনার আসর চলত—আনন্দের স্রোত বইতো।
হরপ্রসাদ তাঁর যেখানে যত আত্মীয় আছে, সকলকেই সেই উৎসবে যোগ দিতে আহ্বান জানাতেন। তাদের যাতাযাত ও ওই কদিন ইন্দ্ৰালয়ে থাকার সব ব্যবস্থা করতেন, এবং ওই উৎসবের ব্যাপারটা হরপ্রসাদের মৃত্যুর পরও চলে এসেছে-চিত্রাঙ্গদার স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর প্রচেষ্টাতেই এবং সেটা আরো বেশি জাক-জমকের হয়েছে। জিতেন্দ্রর মৃত্যুর পর বৃদ্ধ সরকার যোগজীবনবাবু—যাকে চিত্রাঙ্গদা বরাবর জীবনকাকা বলে ডেকেছে, তিনিই করে এসেছেন।
অবশেষে জগদীন্দ্রদের আমলে জগদীন্দ্ৰই সেটা নিজের হাতে তুলে নেয়।
কটা দিনের ওই উৎসবে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়। আর বিশেষ একটা ব্যাপার হচ্ছে, ওই উৎসবের কাঁটা দিনের জন্য চিত্রাঙ্গদা দেবী তাঁর আভিজাত্য ও দাম্ভিকতার সকল ব্যবধান। ঘুচিয়ে অত্যন্ত সহজ সরল স্বাভাবিকতার মধ্যে যেন নেমে আসেন। প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেন, সহজ ভাবে হাসেন, আনন্দ করেন—সকলের মধ্যে তাদেরই একজন যেন হয়ে যান।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর সে যেন সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ। এ যেন সকলের পরিচিত চিত্রাঙ্গদাই নয়। হাসিখুশি ভরা সম্পূর্ণ অন্য একটি মানুষ।
একটি ছোট মেয়ে—যে তার জন্মতিথি উৎসবে আনন্দে মেতে উঠেছে।
কিরীটী যখন ইন্দ্ৰালয়ে এসে পৌঁছল। সোজা কলকাতা থেকে তার গাড়িতেই, ইন্দ্ৰালয় তখন আলোয় আলোয় ঝলমল করছে চিত্রাঙ্গদা দেবীর আসন্ন জন্মতিথি উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়ে।
যোগীনবাবু করিডরের একপাশে দাঁড়িয়ে একজন কস্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তার পাশে ছিল জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র।
কিরীটীর পরিধানে ইউ. পি.র পোশাক ছিল-চোস্ত পায়জামা, গ্রে কলারের শেরওয়ানী, মাথায় কালো টুপি। চোখে চশমা। মুখে পাইপ।
যোগীনবাবুই সর্বাগ্রে এগিয়ে এলেন কিরীটী গাড়ি থেকে নামতেই তার সামনে।
নমস্তে। কিরীটী বলে যোগীনবাবুকে সম্বোধন করে।
নমস্তে। যোগীনবাবু বলেন, অৰ্জ্জুনপ্রসাদ মিশ্র বোধ হয় আপনি!
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ।
জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র চেয়েছিল কিরীটীর দিকে।
দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা-মাথার চুলে রাগের দুপাশে রুপালী ছোঁয়া লেগেছে। যদিও, তবু মনে হয় বার্ধক্য যেন ঠিক আজও ওর দেহকে ছুঁতে পারেনি।
মিসেস চৌধুরীর সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।
নিশ্চয়ই। আপনি বসবেন চলুন, আমি খবর দিচ্ছি ভিতরে।
চলুন।
জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্ৰই প্রশ্ন করে, ইনি?
যোগীনবাবু তাড়াতাড়ি থেমে বলেন, পরিচয় করিয়ে দিই—এরা স্বৰ্গত মিঃ চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের দুই ছেলে—জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্ৰকুমার চৌধুরী।
ও, নমস্কার। কিরীটী হাত তুলল।
ওরা দুই ভাইও প্রতিনমস্কার জানায় ঃ নমস্কার।
আর ইনি—অৰ্জ্জুনপ্রসাদ মিশ্র—আমাদের বিজনেস অ্যাডভাইসার হয়ে শীগগিরই আসছেন—উনি–
জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু কেউ কোন কথা বলে না।
নিচের তলাতে গেস্ট রুমেই কিরীটিার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল।
যোগীনবাবু যেতে যেতে গেস্ট রুমের দিকে তাকিয়ে একসময় কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন, কিছুদিন আপনি এখানেই থাকবেন তো?
হ্যাঁ, বুঝতেই পারছেন, সব কিছু বুঝে নিতে হবে সর্বপ্রথম মিসেস চৌধুরীর কাছ থেকে। এত বড় বিজনেস বুঝতে হলে মাসখানেক খুব কম করেও সময় তো লাগবেই।
তা তো লাগবেই।
হ্যাঁ, ভাল কথা, যে গাড়িটা করে আমি এলাম, সেটা আমার গাড়ি নয়-আমার এক বন্ধুর গাড়ি। কাল সকালেই আবার গাড়ি নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাবে।
আপনি কিছু ভাববেন না, সব ব্যবস্থা আমি করব।
গাড়ির ক্যারিয়ারে আমার দুটো স্যুটকেস আছে–
সে আমি নামিয়ে নেবার ব্যবস্থা করছি।
কথা বলতে বলতে দুজনে এসে ইন্দালয়ের গেস্টরুমে প্রবেশ করল।
পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি বড় সাইজের, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজের। একটিতে শয়ন ও অন্যটিতে বসবার ব্যবস্থা। দুই ঘরে যাতায়াত করবার জন্য মধ্যবতী একটি দরজা। আছে, এবং ওই দরজাটি শয়নকক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া যায়।
সর্বপ্রকার আধুনিক ও আরামদায়ক আসবাবপত্রে ঘর দুটি সুন্দর করে সাজানো, ঠিক যেন কলকাতা শহরের কোন বড় হোটেলের সুইট। শয়নকক্ষের সঙ্গে অ্যাটাচড় বাথরুম।
যোগীনবাবু ওই কক্ষে কিরীটীকে পৌঁছে দিয়ে বললেন, আপনি ততক্ষণ একটু বিশ্রাম করুন, চা পান করুন, ভেতরে আমি খবর দিচ্ছি।
যোগীনবাবু চলে গেলেন।
একটু পরে একজন ভৃত্য কিরীটীর সুটকেস দুটো ঐ কক্ষে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।
কিরীটী শয়নকক্ষে প্রবেশ করে কক্ষের মধ্যবর্তী দরজাটা বন্ধ করে পথের বেশভূষা বদল করে নিল। পায়জামা ও পাঞ্জাবির ওপর একটা গরম শাল গায়ে জড়িয়ে নিল।
বেশভূষা বদল করে একটা সোফায় বসে সবে পাইপটায় নতুন করে অগ্নিসংযোগ করেছে, মধ্যবয়সী একটি ভূত্য কক্ষে এসে প্রবেশ করল চায়ের ট্রে হাতে। ট্রের ওপরে শুধু চায়ের সরঞ্জামই নয়, ঐ সঙ্গে দু-তিনটে প্লেটে বিস্কিট, পেস্ট্রি, স্যাণ্ডউইচ, দু-চার রকম মিষ্টি এবং কিছু ড্রাই ফুটস। লোকটির চেহারা দেখে কিরীটীর বাঙালী বলেই মনে হয়, তবু হিন্দিতেই জিজ্ঞাসা করে তাকে, কেয়া নাম তুমারা?
বাবুজী, আমি বাঙালী, আমার নাম গণেশ সরকার। একটু থেমে শুধোয়, চা ঢালি বাবুজী?
ঢালো।
আপনি বাঙালী?
না গণেশ, তবে বহু বছর বাংলাদেশে আছি, বলতে পারো এক প্রকার বাঙালীই বনে গিয়েছি।
গণেশ মৃদু হাসল। হাসিটা যেন খুশিরই মনে হয়।
বয়েস গণেশের পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয়। মাথার ২/৩ অংশ চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। সামনের দিকে অনেকটা টাকা।
বেঁটে গোলগাল চেহারা। পরিষ্কার একটা ধুতি ও হাফসার্টের ওপর মোটা একটা সোয়েটার গায়ে।
ক’ চামচ চিনি দেবো বাবুজী?
দু’ চামচ দাও।
রাণীমা আমাকেই বলেছেন। আপনাকে দেখাশোনা করতে। আপনি তো এখন কিছুদিন এখানে থাকবেন?
হ্যাঁ, কিন্তু রাণীমা কে?
আজ্ঞে, এ বাড়ির কর্ত্রী।
তাঁকে বুঝি তোমরা রাণীমা বলে ডাকো? কিরীটী চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
আজ্ঞে, চাকরিবাকির, দারোয়ান, ড্রাইভার আমরা সকলেই ওঁকে রাণীমাই বলি।
আর সরকারবাবু?
তিনি শুধু মা বলেই ডাকেন।
আর দাদাবাবুরা?
তারা ডাকে সবাই বড়মা বলে।
ওরা তো সকলে তোমাদের রাণীমার দেওরের ছেলেমেয়ে, তাই না গণেশ?
আজ্ঞে।
গণেশ।
আজ্ঞে?
এ বাড়িতে তুমি কতদিন কাজ করছো?
তা বাবুজী, জীবনটা তো একরকম এখানেই কেটে গেল। কুড়-বাইশ বছরের সময়। এসেছিলাম
ও, তবে তো তুমি তোমাদের কর্তবাবুকেও দেখেছ?
দেখেছি বৈকি। যেমন চেহারা তেমনি রূপ আর তেমনি ছিল দরাজ মন, ঠিক রাজামহারাজাদের মতই।
তোমাকে খুব ভালবাসতেন মনে হচ্ছো!
শুধু আমাকে কেন বাবুজী, সকলের প্রতিই তাঁর সমান। দয়া ছিল। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কারো কখনো এতটুকু ভয় করেনি।
আর তোমাদের রাণীমা?
রাণীমা! ওরে বাবা, না ডাকলে কারো সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস আছে নাকি!
খুব ভয় করো বুঝি সবাই তাকে?
শুধু ভয়! বাঘের মত সবাই ভয় করে তাঁকে। তবে আমাকে খুব স্নেহ করেন।
ওই সময় জয়ন্ত চৌধুরী এসে ঘরে প্রবেশ করল।
নমস্কার, মিস্টার মিশ্র।
নমস্কার।
জয়ন্তকে ঘরে ঢুকতে দেখে গণেশ ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।
বসুন মিঃ চৌধুরী। কিরীটী জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, বসুন—দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?
না, বসব না। আপনাকে ডাকতে এসেছি।-বড়মা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। চলুন, ওঠা যাক। জয়ন্ত চৌধুরী বললে।
তাহলে চলুন, দেখা করেই আসি। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
দরজার দিকে এগোচ্ছিল কিরীটী; কিন্তু জয়ন্ত চৌধুরী বাধা দিলে, বললে, না, ও দরজা দিয়ে নয়। আসুন, এইদিকে।
কিরীটিকে নিয়ে জয়ন্ত শয়নঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল।
শয়নঘরের মধ্যে আর একটি দরজা ছিল।
কিরীটী ভেবেছিল, সে দরজাটা বুঝি পাশের ঘরে যাবার জন্য, কিন্তু দরজাটা খুলতেই দেখা গেল, তার অনুমান ভুল-ঘর নয় সরু একটা বারান্দা। বারান্দাটা অন্ধকার ছিল— সুইচ টিপে বারান্দার আলোটা জুেলে দিল জয়ন্ত চৌধুরী।
জয়ন্ত চৌধুরী আগে আগে চলল, কিরীটী তাঁকে অনুসরণ করে নিঃশব্দে। বারান্দার শেষপ্রান্তে সিঁড়ি। সিঁড়িটাও অন্ধকার ছিল। সিঁড়ির আলোটা জেলে দিল জয়ন্ত চৌধুরী।
সিঁড়িটা খুব চওড়া নয়। এবং দেখলেই বোঝা যায় সিঁড়িটা বহুদিন ব্যবহৃত হয়নি— ধাপে ধাপে ধুলো জমে আছে, আর বদ্ধ হাওয়ায় একটা ভ্যাপসা গন্ধ।
আগে আগে জয়ন্ত চৌধুরী, পশ্চাতে কিরীটী ধাপের পর ধাপ বেয়ে উঠতে থাকে। জয়ন্ত চৌধুরীই একসময় বলে, যে-ঘরে আপনাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেটা আগে গেস্টরুম ছিল না। ওই ঘরেই যে সব বাঈজী ইন্দ্ৰালয়ে মুজরা নিয়ে আসত, রায় বাহাদুর হরপ্রসাদের আমলে তাদের থাকবার ব্যবস্থা ছিল। এবং এই সিঁড়িপথেই রাত্রে প্রয়োজন হলে হরপ্রসাদ শোনা যায় নাকি সবার চোখের আড়ালে ওই ঘরে যাতায়াত করতেন।
এবং এখন আর ব্যবহার হয় না—তাই না? কিরীটী মৃদু হেসে বলে।
না। রায় বাহাদুরের মৃত্যুর দুবছর আগেই ও-পাট শেষ হয়ে গিয়েছিল।
কেন?
জীবনের শেষ দুটো বছর তো পক্ষাঘাতে একেবারে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে ছিলেন তিনি যে!
পক্ষাঘাত?
হ্যাঁ। সারাটা জীবন ধরে যেমন প্রচুর অর্থে পার্জন করেছিলেন ব্যবসা করে, তেমনি উচ্ছঙ্খলতারও চরম করে গিয়েছেন। গানের নেশা ছিল—নিজে যেমন গাইতে পারতেন, তেমনি শুনতেও ভালবাসতেন, আর সেই সঙ্গীতের নেশার পথ ধরেই দুটি জিনিস তাঁর জীবনে এসেছিল—সুরা আর নারী।
কিরীটী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে থাকে।
এবং সেই সুরা আর নারী শেষটায় তঁকে বুঝি গ্রাস করেছিল এবং পরবতীকালে একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর বেলাতেও।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে থাকে; তবু একটা কথা কি আমার মনে হয় জানেন মিস্টার রায়?
কি? কিরীটী তাকাল জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে।
জয়ন্ত চৌধুরী বলে, মনে হয় জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী যা হয়েছিলেন, হয়তো তিনি তা হতেন না—সম্পূর্ণ অন্য মানুষ একজন হতে পারতেন, যদি না রায় বাহাদুরের কন্যা চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হত।
একথা বলছেন কেন?
কিরীটীর প্রশ্নের আর জবাব দেওয়া হল না—সিঁড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিয়ে জয়ন্ত বলে, এই যে আমরা এসে গিয়েছি।
জয়ন্ত চৌধুরীর কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর নজরে পড়লো—সিঁড়ির শেষ সরু একটা ল্যাণ্ডিং আর তার পরেই বন্ধ একটা দরজা।
পকেট থেকে একটা চাবি বের করে জয়ন্ত চৌধুরী দরজার ফোকরে চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল।
সরু একফালি বারান্দা সামনেই।
আসুন!
কিরীটী এগিয়ে গেল। জয়ন্ত চৌধুরী পুনরায় আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলে।
বারান্দাটা অন্ধকার।
একটু এগুতেই বাড়ির পশ্চাৎভাগ চোখে পড়ল।
অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ির পশ্চাৎভাগে বাগান—তার মধ্যে মধ্যে যে খোলা জায়গা, সেই সব জায়গা জুড়ে সব তাঁবু পড়েছে।
তাঁবুতে তাঁবুতে আলো জ্বলছে।
বাগানের মধ্যে ওই সব তাঁবু কেন?
কিরীটী প্রশ্ন করে। বড়মার জন্মতিথি উৎসবের জন্য সব তাঁবু খাটানো হয়েছে, আসুন।
বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে সামনেই একটা বন্ধ দরজার গায়ে ঠক ঠক করে কয়েকটা মৃদু টোকা দিল জয়ন্ত চৌধুরী।
সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজাটা খুলে গেল।
জয়ন্ত চৌধুরী আহ্বান জানাল, আসুন মিস্টার রায়।
কিরীটী ভেতরে পা দিল।
পায়ে চপ্পল থাকলেও পায়ের তলায় একটা নরম কোমল স্পর্শ পায় কিরীটী। দামী পুরু কর্পেটে পা যেন ড়ুবে গিয়েছে।
উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। ঘরের মধ্যে। সেই আলোতেই ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল। কিরীটী। মনে হল তার ঘরটা বসবার ঘর।
চারদিকে পুরনো আমলের ভারী ভারী সব সোফা ও কাউচ। গোটা দুই আধুনিক ডিভানও আছে সেই সঙ্গে। জানলায় জানলায় সব হাফ গোলাপী রঙের পর্দা ও ভারি পর্দা ঝুলন্ত ক্রীম রঙের।
ঘরের আবহাওয়া বেশ উষ্ণ ও আরামদায়ক-কিরিটী চেয়ে দেখলো ঘরের মধ্যে ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বলছে।
পাশেই একজন বয়স্ক দাসী দাঁড়িয়ে ছিল। সে-ই ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিল। তার দিকে তাকিয়েই জয়ন্ত প্রশ্ন করল, সুরতিয়া, বড়মা কোথায়?
আপনারা বসুন, রাণীমা গোসলঘরে ঢুকেছেন—গোসল হয়ে গেলেই আসবেন।
অদ্ভুত মিষ্টি ও সুরেলা কণ্ঠস্বর যেন সুরতিয়ার। কথা তো বলল না, কিরীটীর মনে হল, যেন সে গান গেয়ে উঠল। কারো সামান্য কথাও এমন মিষ্টি সুরেলা হতে পারে এ যেন কিরীটীর ধারণার বাইরে এবং সেই কারণেই বোধ হয় সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সুরতিয়ার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
সুরতিয়ার বয়স হয়েছে। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের নীচে নয় বলেই মনে হয়। গায়ের বর্ণ শ্যাম হলেও দেহের গড়নটি কিন্তু ভারি চমৎকার। এবং এখনো বেশ আটসঁটি। মুখের কোথায়ও যেন এখনো বয়সের ছাপ তেমন পড়েনি। বেশভুষা, রাজপুতানী মেয়েদের মত।
সুরতিয়া ওদের বসতে বলে মধ্যবতী দরজাপথে অন্তৰ্হিত হল।
বসুন মিস্টার রায়।
কিরীটী বসে না। ঘরের দেওয়ালে যে খানতিনেক বড় বড় অয়েল-পেন্টিং ছিল, সেইগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
ওই অয়েল-পেন্টিংগুলো কাদের?
কিরীটীর প্রশ্নে জয়ন্ত চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে একটি ছবির সামনে দাঁড়াল এবং বললে— এ হচ্ছে রায় বাহাদুর হরপ্রসাদ ব্যানার্জির তৈলচিত্র। দক্ষিণ দিককার দেওয়ালে ওটা চিত্রাঙ্গদা দেবীর মা-সারদা দেবী। আর ওই যে উত্তরের দেওয়ালে উনি আমাদের বড় জেঠামশাই জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী।
ওদের কথাবাতাঁর মধ্যে চিত্রাঙ্গদা দেবী ঘরে এসে ঢুকলেন।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর দিকে তাকিয়ে কিরীটী যেন সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যায়। গায়ের রঙটা একেবারে টকটকে গৌর। মুখের ও দেহের গঠনটি যেন সত্যিই অনিন্দনীয়। পরনে শ্বেতশুভ্র দামী সিল্কের থান। অনুরূপ ফুলহাতা ব্লাউজ গায়ে। সম্পূর্ণ নিরাভরণা। কিন্তু তথাপি তাঁর চেহারার মধ্যে এমন একটা আভিজাত্য আছে যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
চোখে সোনার ফ্রেমের সৌখীন চশমা। চোখের দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী।
বাঁ হাতে একটা সাদা হাতাঁর দাঁতের বাঁটওয়ালা লাঠি।
গত কয়েক বছর ধরে বাতে ভুগছেন, বেশী হাঁটা-চলা করতে পারেন না। এবং হাঁটাচলা যতটুকু করেন, তাও ওই লাঠির সাহায্যেই।–
বড়মা!
জয়ন্ত চৌধুরীই সসম্রামে ডাকে।
চিত্রাঙ্গদা দেবী কিরীটীর মুখের দিকে চেয়েছিলেন।
বড়মা, ইনিই মিস্টার রায়। জয়ন্ত চৌধুরী কথাটা শেষ করে—মানে, অর্জন মিশ্র। নমস্কার। হাত তুলে নমস্কার জানালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
কিরীটীও প্রতিনমস্কার জানায়।
বসুন। বসো জয়ন্ত।
সকলেই উপবেশন করে, মুখোমুখি সোফায়।
জয়ের কাছে শুনেছেন নিশ্চয়ই সব কথা, মিস্টার মিশ্র?
হ্যাঁ।
আপনি অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে এসেছেন, আমি খুব খুশী হয়েছি মিস্টার মিশ্র। বলে চিত্রাঙ্গদা দেবী জয়ন্তর দিকে তাকালেন ঃ ওরা যেন কোন রকম অসুবিধা না হয়, তুমি কিন্তু দেখো জয়ন্ত।
আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। বড়মা। জয়ন্ত বলে।
তুমি কটা দিন এখানে থাকাছ তো? চিত্রাঙ্গদা দেবী শুধালেন।
উৎসব পর্যন্ত আছি।
কেন, কটা দিন বেশি থাক না?
না বড়মা, ঐ সময় আমার পক্ষে বেশি দিন থাকা—
জয়ন্ত চৌধুরীর কথা শেষ হল না, সুরতিয়া এসে ঘরে ঢুকল, রাণীমা!
কি? ভু কুঁচকে তাকালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী সুরতিয়ার দিকে।
সুধন্য এসেছে।
কে-কে এসেছে?
সুধন্য। বললাম, রাণীমা এখন ব্যস্ত আছেন, দেখা হবে না। কিন্তু কিছুতেই আমার কথা শুনছে না
সুরতিয়ার কথা শেষ হল না, খোলা দরজাপথে একজন এসে ঘরে ঢুকে পড়ল ঐ সময়।
সকলেরই দৃষ্টি একসঙ্গে গিয়ে আগস্তুকের ওপর পড়ে।
আগস্তুকের চেহারা ও বেশভূষা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রোগা পাতলা চেহারা। এককালে গায়ের রঙটা হয়ত অত্যন্ত ফর্সাই ছিল, এখন কেমন যেন তামাটে বর্ণ হয়েছে।
একমাথা ঝাঁকড়া ঝাকড়া চুল-লালচে তৈলহীন রুক্ষ। কতকাল যে তেলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই কে জানে! ছোট ছোট পিঙ্গল চোখ, উন্নত নাসা, ঠোঁট দুটো একটু পুরু। মুখভর্তি খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ও দাড়ির রঙ তামাটে। পরনে একটা কালো গরম প্যান্ট ও গায়ে গলাবন্ধ খয়েরি রঙের গরম কোট। হাতে একটা ফেল্ট ক্যাপ। পায়ে বুট জুতো।
নমস্তে রাণীমা। আগন্তুকই প্রথমে কথা বললে।
আবার কেন এসেছি? তীক্ষ্ম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন আগন্তুককে চিত্রাঙ্গদা দেবী।
কি করি বলুন, পকেট যে খালি হয়ে গেল!
কথাগুলো বলত বলতে আগন্তুক হাসল। ময়লা একসারি দাঁত যেন বিকিয়ে উঠল। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে চিত্রাঙ্গদা বললেন, তুমি না বলেছিলে সেদিন টাকা নেবার সময় আর ছমাসের মধ্যে টাকা চাইতে আসবে না?
বলেছিলাম তো। লেকিন টাকা যে সব ফুরিয়ে গেল।
একটি পয়সাও আর তোমাকে আমি দেব না। যাও বের হয়ে যাও।
গোসা করছেন কেন রাণীমা! সুধন্য is a poor man—তার ওপর গোসা করে কি ফায়দা বলুন! তাছাড়া আপনার কাছে দু-পাঁচশ তো nothing-কিছুই না। কিছু টাকা দিয়ে দিন, চলে যাই। জানি, আমার এ সুরৎ আপনি দেখতে চান না। টাকা দিন কিছু চলে যাই।
একটা পয়সাও আর দেব না তোমাকে আমি। কঠিন কণ্ঠে বলে ওঠেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
দেবেন—দেবেন। আমি জানি, শেষ পর্যন্ত আপনি দেবেনই।
সুরতিয়া? চিত্রাঙ্গদা দেবী ডাকলেন।
রাণীমা! সুরতিয়া এগিয়ে এল।
সুধন্য তাড়াতাড়ি সুরতিয়ার দিকে চেয়ে বলে ওঠে, তুমি যাও সুরতিয়া—অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, বহুত পিয়াস লেগেছে, এক কাপ গরম চা তৈরী করে আনো। আরো কিছু মিঠাই—ভুক ভি লেগেছে।
ব্যাপারটাকে যেন অত্যন্ত লঘু করে সুধন্য সুরতিয়ার দিকে চেয়ে কথাগুলো বললে।
ওকে এখান থেকে বের করে দে সুরতিয়া! চিত্রাঙ্গদা দেবী সুরতিয়ার দিকে চেয়ে বললেন।
সুরতিয়া কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে। বিব্রত, কেমন যেন মুহ্যমান তাকে মনে হয়।
যাও সুরতিয়া, চা আর মিঠাই নিয়ে এস। সুধন্য আবার বলে সুরতিয়ার দিকে চেয়ে।
সুরতিয়া! তীক্ষ কষ্ঠে আবার ডাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী। কি বললাম শুনতে পাচ্ছিস না!
সুধন্য এবার হঠাৎ এগিয়ে এসে একটা সোফার ওপর বসে পড়ল। এবং এতক্ষণে বোধ হয় তার ঘরের মধ্যে উপস্থিত কিরীটী ও জয়ন্তর দিকে নজর পড়ল।
তাড়াতাড়ি সে আবার সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল, ওঃ, আপনারা এখানে আছেন! আচ্ছা, তাহলে আমি পাশের ঘরেই যাচ্ছি। আপনার কাজ সেরে আপনি আসুন রাণীমা।
সুধন্য কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুরতিয়া আর চিত্রাঙ্গদা দেবী দুজনেই যেন পাথর। অদ্ভূত একটা স্তব্ধতা যেন ঘরের মধ্যে থমথম করে।
কারো মুখে কোন কথা নেই। আকস্মিক ঘটনাটা যেন সকলকেই কেমন স্তব্ধ করে দিয়েছে।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন চিত্রাঙ্গদা দেবীই। বললেন, মিস্টার মিশ্র, আপনারা একটু বসুন, আমি আসছি—
কথাগুলো বলে চিত্রাঙ্গদা দেবী সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং লাঠি হাতে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী বুঝতে পারে, চিত্রাঙ্গদা দেবী যেন বেশ একটু বিচলিত। বিব্রত।
মিস্টার চৌধুরী!
এই লোকটি কে?
চিনতে পারলাম না ঠিক। জয়ন্ত চৌধুরী মৃদু কণ্ঠে জবাব দিল।
আগে কখনো ওকে এখানে দেখেননি? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
না, এই প্রথম দেখলাম।
কিন্তু মনে হল লোকটার এ বাড়িতে আসা-যাওয়া আছে!
আমারও সেই রকম মনে হচ্ছে, তবে আমি তো এখানে থাকি না।
এবং আপনার বড়মার বিশেষ পরিচিতও মন হল। কিরীটী আবার বলে।
বিশেষ পরিচিত। বিস্মিত হয়েই তাকাল জয়ন্ত চৌধুরী কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, দেখলেন না–কেমন করে এ ঘরের মধ্যে এসে সোজা ঢুকে পড়ল, ঢুকে টাকা চাইল। ওর এ ঘরে ঢোকা ও চাওয়ার ধরনটা দেখে মনে হল মধ্যে মধ্যে এসে ও ওইভাবে আপনার বড়মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়—আর আপনার বড়মার কথা শুনেও তো মনে হল।
সেই রকমই তো মনে হল! জয়ন্ত চৌধুরী মৃদু কণ্ঠে বলে।
মনে হল না মিস্টার চৌধুরী, তাই-কিন্তু কেন? আপনার বড়মা ওকে মধ্যে মধ্যে টাকা দিন কেন?
শেষের কথাগুলো যেন কতকটা স্বগতোক্তির মতই মনে হল জয়ন্তর।
কি বললেন? জয়ন্ত চৌধুরী প্রশ্ন করে।
না, কিছু না। কিন্তু লোকটা কে হতে পারে? আপনাদের পরিচিত বা আপনজন কেউ নয়; তাহলে তো আপনারা চিনতেনই। অথচ একেবারে নিঃসম্পর্কীয় বাইরের কেউ হলেই বা ওইভাবে অন্দরে এই রাত্রে সোজা একেবারে রাণীমার খাসমহলে এসে প্রবেশ করেই বা কি করে, আর আমন করে নিঃসঙ্কোচে টাকার দাবিই বা করে কি করে?
দাবি!
নয় কি-ওর টাকা চাওয়ার ধরনটা দেখলেন না! শুধু দাবিই নয়, ও যে মধ্যে মধ্যে টাকা পেয়েও থাকে, তা তো শুনলেন। আপনার বড়মার মুখেই। হ্যাঁ, তাই তো শুনলাম।
এই সময় সুরতিয়া এসে আবার ঘরে ঢুকল। হাতে তার ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম। ট্রেটা সামনের একটা গোল টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে সে জিজ্ঞাসা করল, চা তৈরী করে দেব বাবুজী?
কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দাও।
সুরতিয়া চা তৈরী করতে থাকে। ঝুকে পড়ে নীচু হয়ে সুরতিয়া কাপে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞাসা করে, কত চিনি দেব বাবুজী?
দু’ চামচ। কিরীটী বলে।
সুরতিয়া জানে জয়ন্ত চায়ে কতটুকু চিনি খায়, তাই হয়ত ও সম্পর্কে কোন প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাবাদ করল না।
সুরতিয়া চা তৈরী করছে নীচু হয়ে ঝুঁকে। মুখটা তার ভাল করে স্পষ্ট দেখা ধাচ্ছে না। কিন্তু তার হাত নাড়া দেখে কিরীটীর মনে হয় সুরতিয়া যেন একটু চিন্তিত—একটু বিচলিত।
চা সে তৈরি করছে বটে ওদের জন্য, কিন্তু মনটা তার বোধ হয়। চা তৈরি করার মধ্যে নেই। অন্য কোথাও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
কিরীটী তীক্ষ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল সুরতিয়াকে।
চা তৈরি করে দিয়ে সুরতিয়া আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটীর চোখের তীক্ষ দৃষ্টি সুরতিয়াকে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত লক্ষ্য করে। কিরীটীর মনে হল যেন একটু দ্রুত এবং চঞ্চল পায়েই ঘর ছেড়ে গেল সে।
কিরীটী এবার জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আবার ডাকল, মিস্টার চৌধুরী!
কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ। এই দাসীটি অনেকদিন ইন্দ্ৰালয়ে আছে, না? মানে ঐ সুরতিয়া—
হ্যাঁ, অনেক দিনকার দাসী।
আপনার স্বৰ্গীয় জেঠামশাইয়ের আমলের বোধ হয়?
মৃদু কণ্ঠে এবার জবাব দেয় জয়ন্ত, হ্যাঁ, ওর যখন ভরা যৌবন, তখন ও এখানে আসে।
এখন বয়স কত হবে ওরা?
তা ধরুন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ তো হবেই।
সেই রকম আমারও মনে হল।
একটা কথা বোধ হয় আপনাকে আমার বলা উচিত—একটু ইতস্তত করে যেন জয়ন্ত চৌধুরী।
কি বলুন তো? আপনাকে তো একটু আগেই বলছিলাম, শ্বশুরের মত জামাইয়ের—অর্থাৎ আমার জেঠামশাইয়ের স্ত্রীলোকের ব্যাপারে একটু দুর্নাম ছিল—
কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকাল।
জয়ন্ত চৌধুরী বলে, ওই সুরতিয়া কিন্তু এ দেশের মেয়ে নয়, একদিন এসেছিল ওর স্বামীর সঙ্গে রাজপুতানা থেকে।
রাজপুতানা!
হ্যাঁ, জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ঘোড়ার শখ ছিল। সেই ঘোড়ার দেখাশোনা করবার জন্য জশলমীর থেকে ভূপৎ সিং আসে, সঙ্গে আসে তার তরুণী বউ সুরতিয়া। তখন সে উদ্ভিন্নযৌবনা। সুরতিয়া এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলা বাহুল্য জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর নজরে পড়ে গেলি-সঙ্গে সঙ্গে অন্দরের কাজে বহাল হল সে।
তারপর?
ভূপৎ সিং কৃতাৰ্থ হয়ে গেল। বেচারা জানত না তো যে জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ওই বানান্যতার অন্তরালে কি উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে! যা হোক, সুরতিয়া অন্দরে এসে ঢুকল একেবারে চিত্রাঙ্গদা দেবীর খাস চাকরাণী হয়ে—
বলেন কি!
হ্যাঁ কিন্তু তার আগে থেকেই জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী পৃথক ঘরে শয়ন করতেন।
কেন, চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে কি তার সদ্ভাব ছিল না?
না, এবং সেটা বিবাহের কিছুদিন পর থেকেই।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর বাবা জানতেন না সে-কথা?
মৃত্যুর বৎসর দুই পূর্বে জানতে পেরেছিলেন এবং মেয়ে-জামাইয়ের মনো-মালিন্যটা মিটিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। আর তার কারণও বড়মা—
কি রকম?
সে তো আপনাকে আগেই বলেছি—আমার ধারণা, তার মানে বড়মার চিরদিনের ঐ উদ্ধত দাম্ভিক প্রকৃতি ও অন্যকে সর্বক্ষণ দাবিয়ে রাখবার সেই বিচিত্র complex-এর জন্যই—
মনোমালিন্যের কারণটা কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, সেটাই আপনি মনে করন?
তাছাড়া আর কি হতে পারে?
হুঁ, তারপর?
তারপর বড়মার বাবা তার সমস্ত সম্পত্তি স্থাবর-অস্থাবর একমাত্র মেয়ের নামে লিখে দেন।
আপনার জেঠামশাই তাতে কিছু বলেননি?
না।
আশচর্য!
ব্যাপারটা শোনার পর আমরাও কম আশ্চর্য হইনি। যাই হোক, তারপর বড়মার বাবা রায় বাহাদুরের মৃত্যুর পর জেঠামশাই আরো বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন। তিনি তঁর শিকার, মদ্যপান, গান-বাজনা ও মেয়েমানুষ নিয়েই থাকতেন-বিজনেস বা সংসারের কোন ব্যাপারে কোনদিন মাথা গলাননি। সব কিছু থেকে দূরে থেকেছেন। নীচের মহলেই জেঠামশাই থাকতেন শুনেছি-কদাচিৎ কখনা কলে-ভদ্রে হয়ত ওপরে আসতেন।
কিরীটীর কাছে যখন জয়ন্ত চৌধুরী অতীত ইতিহাস বলছিল, চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়নঘরে তখন অন্য এক পর্ব চলছিল।
চিত্রাঙ্গদা সুধন্যকে নিয়ে তাঁর শয়নঘরে এসে ঢুকলেন।
গতবার টাকা নেওয়ার সময় কি বলেছিলে তুমি? ঘরে ঢুকেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চিত্রাঙ্গদা। সুধন্যকে প্রশ্ন করেন।
কি জানি, ঠিক মনে পড়ছে না কি বলেছিলাম! কি বলেছিলাম বলুন তো রাণীমা? সুধন্য স্মিতহাস্যে প্রশ্নটা করে চিত্রাঙ্গদার মুখের দিকে তাকাল।
ভুলে গেছে, না?
হ্যাঁ-মনে পড়ছে না। সত্যিই বিশ্বাস করুন—
বলেছিলে আর এক বছরের মধ্যে টাকা চাইতে আসবে না।
বলেছিলাম নাকি? তা যদি বলেও থাকি—এক বছর নিশ্চয়ই হয়ে গেছে।
তিন মাসও পার হয়নি।
সত্যি! আমি তো ভাবছিলাম এক বছরেরও বেশী হয়ে গেছে।
শোন, তোমার সঙ্গে আমার এবার একটা শেষ বোঝাপড়া দরকার
তার মানে?
মানে, আজ যা হবার হয়ে যাক শেষবারের মত। আর কখনো জীবনে এ বাড়িতে তুমি
পা দেবো না।
বাঃ, তা কি করে হবে! আমার চলবে কি করে? আমার তো আর আপনার মত কাঁড়িকাঁড়ি টাকা নেই।
কি করে তোমার চলবে না চলবে, সেটা আমার ভাববার কথা নয়—সেটা সম্পূর্ণ তোমার। তুমি কি করবে না করবে, কিভাবে তোমার চলবে, না চলবে সে তুমিই ভাববে।
আমিই ভাববো!
হ্যাঁ।
কিন্তু তা কি সম্ভব হবে?
আমি তোমার ঠাট্টার পাত্রী নই। সুধন্য।
ছিঃ, ছিঃ, তা কি আর আমি জানি না!
শোন, তোমাকে আজ আমি শেষবারের মত কিছু টাকা দেবো একটি শর্তে, ভবিষ্যতে কোন দিন আর একটি আধলাও তুমি আমার কাছে পাবে না-একটি কপৰ্দকও তোমাকে আর কখনো আমি দেব না। আর তুমি যদি ভবিষ্যতে কখনো এ বাড়ির ত্রিসীমানায় পা দাও তো সেই মুহুর্তে তোমাকে আমি গুলি করে মারব।
মারবেন!
হ্যাঁ, মেরে বাগানে পুঁতে রাখব মাটির নীচে।
সুধন্য যেন কি ভাবল কিছুক্ষণ, তারপর বললে, বেশ তাই হবে। কিন্তু কত দেবেন?
আপাতত এই মুহুর্তে তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা দেবো।
পাঁচ হাজার!
হ্যাঁ আর যদি দেখি দু বছর এ বাড়ির ত্রিসীমানায় তুমি আসোনি তাহলে আরো পাঁচ হাজার টাকা তোমাকে আমি পাঠিয়ে দেবো।
বেশ, তাই হবে। তাহলে এখান থেকে যাবার দিনই টাকাটা নেবো।
এখুনি তোমাকে টাকা নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
এখুনি চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ।
আপনার জন্মদিন-উৎসব কাল থেকে। কত লোকজন আসবে, কত খাওয়া-দাওয়া নাচগান হবে-আর এ সময় আমাকে আপনি তাড়িয়ে দেবেন রাণীমা?
সুধন্যর কথাটা হঠাৎ যেন চিত্রাঙ্গদার মনকে নাড়া দেয়। মনে হয়, সত্যিই তো, এই উৎসবের মুখে লোকটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন! কিন্তু পরীক্ষণেই মনে হয়। আবার, ওর মত একটা জঘন্য প্রকৃতির লোক বুঝি তার সে অনুকম্পােরও যোগ্য নয়।
চুপ করে থাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
থাকি না দুটো দিন?
না।
কতদিন ভালমন্দ দুটো খাইনি রাণীমা—
আর আপত্তি করতে পারলেন না চিত্রাঙ্গদা দেবী। বললেন, ঠিক আছে, থাক। কিন্তু মাত্র দুদিন, তার বেশি নয়।
বেশ, তাই।
কিন্তু বাড়ির ভেতরে আসবে না, বাইরে বাগানে তাঁবুতে থাকবে।
তাই থাকব।
যাও, এখন তাহলে নীচে যাও।
সুধন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুধন্য ঘর থেকে চলে যাবার পর চিত্রাঙ্গদা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো তাঁর স্বামী জিতেন্দ্রর বিরাট অয়েল-পেন্টিংটার দিকে তাকান।
জিতেন্দ্ৰ যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটমিটি হাসছেন।
চিত্রাঙ্গদার চোখ দুটো যেন জ্বলতে থাকে।
উঃ, কি লজ্জা, কি লজ্জা! তাঁর জন্মমুহূর্ত থেকে যে লজ্জা তাঁর সমস্ত জীবনের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোত হয়ে গেছে, তার হাত থেকে বুঝি সত্যিই কোন দিনই আর মুক্তি নেই।
এতকাল বয়ে এসেছেন সে লজ্জা, এবং যতদিন বাঁচবেন তাঁকে টেনে যেতে হবে।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, জিতেন্দ্রর দোষ কি? তার জন্মের জন্য তো জিতেন্দ্ৰ দায়ী নন?
দায়ী যদি কেউ হন তা তার জন্মদাতা। —তাঁর বাবা হরপ্রসাদ। যার জঘন্য লালসা এক।
হঠাৎ মনে পড়ে, পাশের ঘরে কিরীটী আর জয়ন্ত এখনো তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই মুহুর্তে আর তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না চিত্রাঙ্গদা দেবীর।
চিত্রাঙ্গদা ডাকে, সুরতিয়া!
সুরতিয়া ঘরে এসে ঢুকল, ডাকছিলে রাণীমা?
হ্যাঁ শোন, ওঘরে গিয়ে জয়ন্তকে বলে দে, শরীরটা ভাল লাগছে না। আমার, আজ আর ও ঘরে যাব না।
সুরতিয়া মাথা হেলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পাশের ঘরে গিয়ে যখন ঢুকল, জয়ন্ত আর কিরীটী তখনো গল্প করছে।
রাণীমা বললেন, তার শরীরটা ভাল লাগছে না, এখন আর আসবেন না।
জয়ন্ত আর কিরীটী পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল নিঃশব্দে।
সুরতিয়া সংবাদটা দিয়ে আর অপেক্ষা করে না, ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
কিরীটী জয়ন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তাহলে চলুন মিস্টার চৌধুরী, ওঠা যাক।
হ্যাঁ, চলুন।
জয়ন্ত উঠে দাঁড়াল।
পূর্বের সেই সিঁড়িপথেই পুনরায় দুজনে নীচে নেমে এল। এবং কিরীটীকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে জয়ন্ত চলে গেল।
কিরীটী পাইপটা ধরিয়ে একটা আরাম-কেদারার ওপর গা ঢেলে দিল—মনের মধ্য তখন তার একটি মুখ বার বার ভেসে ভেসে উঠছে।
সুধন্য!
কে ওই ছেলেটি? চিত্রাঙ্গদা দেবীর কাছ থেকে বোঝা গেল প্রায়ই এসে কিছু কিছু টাক নিয়ে যায়, চিত্রাঙ্গদা দেবীও ওকে টাকা দেন।
মুখে দেবো না বললেও শেষ পর্যন্ত ওকে দেন।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর মত লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে—কোন গুঢ় কারণ না থাকলে নিশ্চয়ই চিত্রাঙ্গদা দেবী ওকে আমন করে বার বার টাকা দিতেন না।
কোন দেন ওকে চিত্রাঙ্গদা দেবী টাকা?
ভয়ে যে টাকা দেন না, তা বোঝা যায়। ভয় পাবার স্ত্রীলোক চিত্রাঙ্গদা দেবী নন। তাঁকে ভয় দেখিয়ে অর্থাৎ ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিচ্ছে সুধন্য, মনে হয় না কিরীটীর।
কিন্তু তার কারণটা কি? কি কারণ থাকতে পারে?
আর একটা মুখও মধ্যে মধ্যে কিরীটীর মনের পাতায় আনাগোনা করছিল। চিত্রাঙ্গদা। দেবীর বসবার ঘরে দেওয়ালে টাঙানো ওঁর স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ফটোর মুখখানা।
জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী জেনেশুনেই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে একদিন বিবাহ করেছিলেন। এক বাঈজী কন্যার ঔরসজাত চিত্রাঙ্গদা দেবী-কথাটা হরপ্রসাদ গোপন করেননি জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর কাছে। লোকটাও একেবারে শান্তশিষ্ট গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসী পাতাটি ছিলেন না। গানবাজনার শখের সঙ্গে নারীপ্রীতিও ছিল তাঁর—প্রীতি না বলে নারীর প্রতি দুর্বলতা বললেই বোধ হয় ভাল হয়। তার প্রমাণ এখনো ইন্দ্ৰালয়েই রয়েছে-ওই বিগত যৌবনা ভূপৎ সিংয়ের স্ত্রী সুরতিয়া-রাজপুতানী।
এখনো যার দেহের গড়ন আমন, সে যে যৌবনে সত্যিকারের আকর্ষণীয় ছিল বুঝতে কষ্ট হয় না। জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ওর যৌবনের প্রতি আকর্ষণ হওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়।
কে জানে ওই সুরতিয়া শেষ পর্যন্ত জিতেন্দ্র ও চিত্রাঙ্গদা-স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ কিনা!
হঠাৎ-হঠাৎই যেন একটা সম্ভাবনা কিরীটীর মনের পাতায় উঁকি দেয়। আশ্চর্য! হ্যাঁ— সত্যিই তো, আশ্চর্য রকমের একটা মিলও আছে দুটো মুখে। তবে—তবে কি ওইটাই কারণ?
গণেশ এসে ঘরে ঢুকল।
বাবুজা!
কে?
খাবার দেব কি?
খাবার? রাত কটা হল?
রাত সোয়া নটা।
তাহলে একটু পরে।
গণেশ কিন্তু তথাপি ঘর থেকে যায় না, দাঁড়িয়েই থাকে।
কিছু বলবে গণেশ?
আজ্ঞে—কোন ড্রিঙ্ক দেব কি?
ড্রিঙ্ক!
হ্যাঁ।
হুইস্কি আছে?
আছে।
দাও এক পেগ। সোডা দিয়ে দিও।
গণেশ চলে গেল।
পরের দিন কিরীটীর ঘুম ভাঙল সানাইয়ের শব্দে। ভৈরো রাগে সানাই বাজছে। মনে পড়ল।রাণীমার জন্মতিথি-উৎসব আজ থেকেই।
সত্যই চিত্রাঙ্গদা দেবীর জন্মতিথি উৎসব রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গেই সানাইয়ের মাঙ্গলিক দিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল।
বিখ্যাত সানাই বাজিয়ে রহিম এসেছিল।
ভোর হল, চিত্রাঙ্গদা দেবী তার ঘরে স্নান করে একটা দুধ-গরদের থান পরে এসে বসলেন—একে একে সকলে তাঁকে শুভকামনা জানিয়ে যায়।
সকলকেই হাসি মুখে চিত্রাঙ্গদা দেবী সম্ভাষণ জানান—এ যেন এক নতুন চিত্রাঙ্গদা। প্রশান্ত সৌম্য সুন্দর হাস্যময়ী —আভিজাত্য ও দম্ভের খোলসটা যেন আজ তিনি খুলে ফেলে দিয়েছেন।
সকাল থেকে সারাটা দিন দলে দলে কত যে লোক আসে চিত্রাঙ্গদাকে শুভকামনা জানাতে! কেউ কিছু ফুল, কেউ অন্য কোন উপটৌকন, কেউ কিছু মিষ্টি। চিত্রাঙ্গদাও উদ্যানে বড় বড় দুটো তাঁবুতে অতিথি অভ্যাগতদের জলযোগ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। দুদিন ধরে হালুইকরেরা সব মিষ্টান্ন তৈরি করেছে—ভারে ভারে সব মিষ্টান্ন।
তারপর ক্রমশঃ সন্ধ্যা নামল। লাল-নীল সবুজ হলুদ-হরেক রকম আলোয় সারা ইন্দ্ৰালয় যেন ইন্দ্রপুরীর মতই ঝলমল করে ওঠে।
প্রথম দিন যাত্রার ব্যবস্থা ছিল। সারটা রাত ধরে যাত্রাগান হল। দ্বিতীয় দিনও অতিথি-অভ্যাগতদের ভিড়। রাত্রে বসল। গানের আসর। অনেক সব বড় বড় ওস্তাদ গাইয়েরা এসেছে।
পর পর তিন রাত্ৰি এবার গানের জলসা চলবে।
প্রথম রাত্রে আধুনিক, দ্বিতীয় রাত্রে রাগসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, তৃতীয় রাত্রে ওস্তাদদের আসর।
রাত আটটা থেকেই আসর বসেছিল। কিরীটিও উপস্থিত ছিল আসরে।
চিত্রাঙ্গদা দেবীকেও কিরীটি দেখেছে। আসরে বসে গান শুনতে। তারপর যে কখন একসময় আসর ছেড়ে উঠে গেছেন, টের পায়নি। কিরীটী—গানের সুরে বোধ হয় তন্ময় হয়ে গিয়েছিল।
রাত তখন বোধ হয় এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট হবে
বড়ে গোলাম আলি মাত্র কিছুক্ষণ আগে আসরে নেমেছেন—গণেশ এসে কিরীটীর পাশে দাঁড়াল।
বাবুজী!
ফিস ফিস করে ডাকে গণেশ।
কে, গণেশ! কি খবর?
জয়ন্ত দাদাবাবু আপনাকে এখুনি একবার ডাকছেন!
জয়ন্তবাবু! কোথায় তিনি?
রাণীমার ঘরে।
কিরীটী নিঃশব্দে সঙ্গীতের জমাটি আসর ছেড়ে উঠে পড়ল। প্রায় শতাধিক শ্রোতাসবাই গানের সুরের মধ্যে ড়ুবে রয়েছে।
কিরীটীর পূর্বেই স্বাতী ও তার ছোটদা শচীন্দ্র ছাড়া মণীন্দ্র, জগদীন্দ্র ও ফণীন্দ্র আসরেই উপস্থিত আছে। তারাও তন্ময় হয়ে গান শুনছিল।
চিত্রাঙ্গদা দেবীও তাঁর আসনে বসেছিলেন, কিন্তু আসর ছেড়ে যাবার সময় তাঁকে দেখা গেল না। তাঁর আসনটি শূন্য। কখন যে এক সময় তিনি উঠে চলে গেছেন, সে জানতে পারেনি।
আগের দু-রাত্রিতেও চিত্রাঙ্গদা দেবী যাত্রাগান শেষ হবার আগেই মাঝামাঝি সময় উঠে চলে গিয়েছিলেন যাত্রাগানের আসর ছেড়ে।
আজও হয়তো গেছেন—
যেতে যেতে লক্ষ্য পড়ল, সুধন্যও একপাশে শ্রোতাদের মধ্যে বসে গান শুনছে।
কিরীটী চিন্তা করতে করতে অগ্রসর হয়, এত রাত্রে চিত্রাঙ্গদা দেবীর ঘরে কেন তার ডাক পড়ল!
জয়ন্ত চৌধুরী ডেকে পাঠিয়েছে তাকে।
আজ সন্ধ্যার সময় জয়ন্ত চৌধুরী একবার তার ঘরে এসেছিল, বলেছিল কাল সকালেই সে নাকি কলকাতা ফিরে যাবে।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে সেই যে প্রথম দিন। এখানে পৌঁছবার পর সন্ধ্যায়। তাঁর ঘরে আলাপ শুরু হতেই ঘরে সুধন্যর আবির্ভাব ঘটল এবং চিত্রাঙ্গদা দেবী একটু পরে ঘর ছেড়ে হঠাৎ চলে গেলেন, তারপর আর চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে কোন আলাপ বা কথাবাত হয়নি। যদিও গত দুদিন যাত্রার আসরে ও আজ সঙ্গীতের আসরে দূর থেকে তাঁকে সে দেখেছে।
সাধারণের সিঁড়িপথেই কিরীটী গণেশকে অনুসরণ করে দোতলায় গিয়ে হাজির হল একসময়। সিঁড়ির আলোতে ও বারান্দার উজ্জ্বল আলোয় সব কিছু চোখে পড়ে-নির্জন, একেবাবে খাঁ খাঁ করছে চারদিক।
দূর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে।
বসবার ঘরের দিকে নয়, গণেশ চিত্রাঙ্গদার শয়নঘরের দিকেই এগিয়ে গেল—
কিরীটিও এগোয়।
দরজাটা ভেজানো ছিল।
গণেশ হঠাৎ ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে কিরীটীর দিকে চেয়ে নিম্নস্বরে বললে, ভেতরে যান, জয়ন্ত দাদাবাবু ভেতরেই আছেন।
কিরীটী দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে পা দিল।
ঘরের মধ্যেও আলো জ্বলছিল—এবং ঘরে পা দিয়ে সামনের দিকে ভূমিতলে দৃষ্টি পড়তেই কিরীটী যেন আচমকা নিজের অজ্ঞাতেই থমকে দাঁড়ল। তার গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হয়ে এল শুধু-তারপরই সে যেন বোবা হয়ে গেল।
ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের মসৃণ মেঝের ওপর পড়ে আছে চিত্রাঙ্গদার দেহটা। পরনে সেই সন্ধ্যার দুধ-গরদ থান। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝের অনেকটা জায়গা ও পরনের দুধ-গরদ থান রক্তে একেবারে লাল-যেন রক্তস্রোতের মধ্যে ভাসছে একটি শ্বেতপদ্ম।
উপুড় হয়ে মেঝের ওপর পড়ে আছেন মুখ থুবড়ে চিত্রাঙ্গদা দেবী। ডান হাতটা সামনের দিকে ছড়ানো, বঁ হাতটা ভাঁজ করা বুকের কাছে।
মাথার কেশভার খানিকটা পিঠের ওপর পড়ে ও খানিকটা দুপাশে ছড়িয়ে আছে। আর অদূরে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত চৌধুরী।
দৃশ্যটা এমনি মর্মদ্ভদ ও আকস্মিক যে কিরীটী কয়েকটা মুহুর্ত বিহ্বল বোবাদৃষ্টিতে সামনের দিকে কেমন যেন অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে।
কোন শব্দই তার মুখ দিয়ে বের হয় না। তারপর একসময় নিজের সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে এগিয়ে ভূপতিত রক্তাক্ত দেহটার সামনে কুঁকে পড়ে প্রথমে শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করে, যদিও ভূপতিত দেহটার দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল চিত্রাঙ্গদা দেবী আর বেঁচে নেই।
তবু একবার ক্ষণেকের জন্য ভূপতিত দেহটা পরীক্ষা করে ধীর ধীরে উঠে দাঁড়াল কিরীটী।
কখন জানতে পারলেন। আপনি মিস্টার চৌধুরী?
কিছুক্ষণ আগে ঘরে ঢুকেই। মৃদুকণ্ঠে বললে জয়ন্ত চৌধুরী।
কখন আপনি এ ঘরে এসেছেন?
এগারোটা বাজবার বোধ হয় মিনিট কয়েক আগে—কারণ ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখবার একটু পরেই বারান্দার ঘড়িতে এগারোটা বেজেছিল। আমিও ঠিক আপনার মত প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেছলাম, মিস্টার রায়। কি করব বুঝতে পারিনি, তারপর হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়ল—গণেশকে দ্বিয়ে আপনাকে ডাকতে পাঠাই।
গণেশ কোথায় ছিল?
গণেশ আমাকে ডাকতে গিয়েছিল।
আপনি কোথায় ছিলেন?
ঘরে। সন্ধ্যেবেলা থেকেই মাথাটা ধরেছিল, তাই দোতলায় নিজের ঘরে শুয়েছিলাম।
আপনি গানের আসরে যাননি?
না।
হুঁ। গণেশ আপনাকে ডাকতে গিয়েছিল কেন?
বড়মা ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে। শুয়ে শুয়ে বোধ হয় একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল, গণেশের ডাকাডাকি ও দরজার গায়ে ধাক্কার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ি।
তারপর?
আমার আসতে বোধ হয় মিনিট দশ বারো লেগে থাকবে। এসে দেখি, ঘরের দরজাটা ভেজানো। দরজা ঠেলে ঘরে পা দিয়েই দেখি ওই বীভৎস দৃশ্য। তখনো প্ৰাণটা একেবারে বের হয়ে যায়নি, মাঝে মাঝে মৃদু মৃদু আক্ষেপ করছেন যন্ত্রণায়। ঝুকে পড়ে ওঁর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু বার দুই ঠোঁটটা কাঁপাল, তারপরেই সব শেষ হয়ে গেল।
গণেশ জানে ব্যাপারটা?
জানে।
তাকে ডাকুন তো একবার। কোথায় সে? বোধ হয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জয়ন্ত ডাকল অতঃপর, গণেশ-গণেশ—
গণেশ ভেতরে এল। তার দু চোখে জল। বেচারী কাঁদছিল তখনো।
গণেশ! কিরীটী ডাকল।
বাবুজী–
সব কথা আমাকে বল গণেশ, তোমাকে তোমার রাণীমা কেন জয়ন্তবাবুকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন এবং কখন?
গণেশ কঁদতে কাঁদতে ধরা গলায় যা বললে, তার সারার্থ হচ্ছে ঃ গানের আসর থেকে আধঘণ্টাটাক আগে রাণীমা উঠে আসেন। এসে সুরতিয়াকে দিয়ে গণেশকে ডেকে পাঠান নীচের থেকে। গণেশ এলে তাকে বলেন জয়ন্তকে ডেকে আনতে। গণেশ প্রথমে ভেবেছিল, জয়ন্ত দাদাবাবু বুঝি নীচে গান শুনছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে খোঁজ করে না পেয়ে তাঁর ঘরে এসে তাকে ডাকে।
তুমি এই ঘরে এসেছিলে?
হ্যাঁ, ঘরে ঢুকে দেখি,-গণেশ বলে, রাণীমা জানলার কাছে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
তারপর?
রাণীমা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলেন জয়ন্ত দাদাবাবুকে ডেকে দিতে।
সুরতিয়া কোথায়? তাকে দেখছি না কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
কেন, সে তো রাণীমার কাছেই ছিল!
কোথায় গেল সুরতিয়া-দেখ তো। ডেকে আনো তাকে।
তাহলে বোধ হয় নীচে গেছে গান শুনতে। রাণীমা ফিরে এলে তো সে নীচে যেত। গান শুনতে।
যাও, দেখ-তাকে ডেকে আনো জলসা থেকে।
গণেশ চলে গেল।
মৃদু কণ্ঠে জয়ন্ত বলে, শেষ পর্যন্ত বড়মার আশঙ্কটাই সত্যি হল।
কিরীটী জয়ন্তর কথায় কোন জবাব দেয় না। সে তখন আবার নীচু হয়ে মৃতদেহটা পরীক্ষা করছিল।
পিঠের বঁদিকে একটা গভীর ক্ষত। বোঝা যায় কোন ধারাল তীক্ষু অস্ত্র দ্বারা অতর্কিতে পিছল দিক থেকে আঘাত করা হয়েছে। মনে হয় ছোরা জাতীয় কোন ধারাল তীক্ষ অস্ত্ৰ।
মিস্টার রায়!
উঁ!
এখন কি করা যায় বলুন তো?
কিরীটী সে কথার জবাব না দিয়ে কতকটা যেন আপন মনেই বলে, মনে হচ্ছে অতর্কিতে পিছন দিক থেকে কেউ ছোরা জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করেছে—
আপনার তাই মনে হয়?
হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে আবার কিরীটী বলে, রাত তখন কত হবে? যদি এখন থেকে আধাঘন্টা আগে গানের আসর থেকে চিত্রাঙ্গদা দেবী উঠে এসে থাকেন, তাহলে রাত সোয়া দশটা মত হবে।–
কিরীটী কথাগুলো কতকটা যেন আপন মনেই উচ্চারণ করে কি যেন চিন্তা করতে থাকে।
মিস্টার চৌধুরী?
বলুন।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল জয়ন্ত।
আজ। আপনার সঙ্গে শেষবার কখন ওঁর দেখা হয়েছিল?
সন্ধ্যার সময়।
আন্দাজ কটা হবে তখন?
বোধ হয় ছটা—আমাকে ডেকে পাঠান সুরতিয়াকে দিয়ে।
তারপর? ঘরে ঢুকে দেখি বড়মা যেন অত্যন্ত উত্তেজিত-বিচলিত—
কেন?
তা তো জানিনা, তবে আমাকে বললেন, মণিদা-মানে মেজ জেঠামশাইয়ের মেজ ছেলেকে তিনি এক কপর্দকও দেবেন না ঠিক করেছেন এবং তাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে। যেতে বলেছেন।
কেন?
তা জানি না। আরো বললেন, আমি যেন আপনাকে বলে দিই তার ওপর একটু নজর রাখতে
আর কিছু?
না। এ কথাটা বলার জন্যই বোধ হয় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু গতকাল তো আপনি বলছিলেন, ওই মণীন্দ্রবাবুকেই চিত্রাঙ্গদা দেবী চার ভাইয়ের মধ্যে একটু বেশী পছন্দ করতেন ও স্নেহ করতেন!
আমার ধারণা তো তাই ছিল। হঠাৎ যে কেন মণিদার ওপর চটে গেলেন জানি না।
ঘরে সেই সময় আর কেউ ছিল?
সুরতিয়া ছাড়া আর কেউ ছিল না।
ওই সময় কে যেন মনে হল দরজাপথে উঁকি দিয়েই সরে গেল। কিরীটী চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, কে—কে ওখানে?
কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না, শোনা গেল একটা দ্রুতপায়ের শব্দ। কিরীটী ক্ষিপ্ৰপদে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় পড়ে।
কে যেন সিঁড়ির দিকে দ্রুত চলে যাচ্ছে।
এ কি সুধন্যবাবু!
ছেড়ে দিন-ছেড়ে দিন আমাকে। সুধন্য কিরীটীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।
দাঁড়ান। আসুন আমার সঙ্গে ঘরে।
ঘরে?
হ্যাঁ-চিত্রাঙ্গদা দেবীর শোবার ঘরে।
জয়ন্ত চৌধুরীও ততক্ষণে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল বারান্দায়।
কি ব্যাপার! কে ও-এ। কি, সুধন্য না?
হ্যাঁ। চলুন-ঘরে চলুন।
না না, ও-ঘরে আমি যাব না। ছেড়ে দিন-ছেড়ে দিন আমাকে।
চলুন।
কিরীটী একপ্রকার জোর করেই টানতে টানতে যেন সুধন্যকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। এবং সুধন্য ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর রক্তস্রোতের মধ্যে শায়িত চিত্রাঙ্গদা দেবীর মৃতদেহটা দেখে আস্ফুট। চিৎকার করে ওঠে।
কিরীটীর হাত থেকে মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়াবার আবার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ श्श।
ছেড়ে দিন—ছেড়ে দিন আমাকে—যেতে দিন।
আর ঠিক সেই মুহুর্তে গণেশের সঙ্গে সুরতিয়া এসে ঘরে পা দিল। সেও সঙ্গে সঙ্গে চিত্রাঙ্গদা দেবীর রক্তাঞ্ছত মৃতদেহটা দেখে অস্ফুষ্ট ভয়ার্ত কণ্ঠে একটা চিৎকার করে ওঠে।
সুধন্য তখনো নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে।
দাঁড়ান। পালাবার চেষ্টা করলে এখুনি আপনাকে পুলিসে খবর দিয়ে,ধরিয়ে দেব। কিরীটী কঠিন কণ্ঠে বলে।–
কেন, কেন—পুলিসে ধরিয়ে দেবেন কেন আমাকে? আমি তো খুন করিনি ওঁকে।
সুরতিয়া হঠাৎ ওই সময় বলে ওঠে, না না, ও খুন করেনি। ওকে ছেড়ে দিন আপনারা, ওকে ছেড়ে দিন।
কিরীটী ফিরে তোকাল সুরতিয়ার মুখের দিকে তার কণ্ঠস্বরে। সুরতিয়ার সমস্ত মুখটা যেন রক্তশূন্য-ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে আতঙ্কে।
কি করে তুমি জানলে যে ও খুন করেনি?
ও তো নীচে গান শুনছিল।
একটু আগে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
তারপরই সুধন্যর দিকে তাকিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করে, কেন একটু আগে ঘরে উঁকি দিচ্ছিলে?
আমি-আমি–
বল-কেন এসেছিলে?
আমি রাণীমার কাছে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
এত রাত্রে কথা বলতে এসেছিলো! সত্যি বল, কেন এসেছিলে?
টাকা–
টাকা!
হ্যাঁ-টাকা চাইতে এসেছিলাম রাণীমার কাছে।
এত রাত্রে টাকা চাইতে এসেছিলে?
হ্যাঁ সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন, কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাব বলে টাকা চাইতে এসেছিলাম।
তাই যদি হবে তো, টাকা না চেয়ে ঘরের দরজা থেকে আমন করে উঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলে কেন?
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সুধন্য মেঝেতে পড়ে থাকা চিত্রাঙ্গদা দেবীর রক্তাক্ত মৃতদেহটার দিকে তাকাল।
বল?
ভয় পেয়ে। আমি-আমি জানতাম না—
মিস্টার চৌধুরী! কিরীটী জয়ন্তর মুখের দিকে তাকাল।
বলুন।
এ বাড়িতে ফোন আছে তো?
হ্যাঁ-পাশের ঘরেই আছে।
যান, থানায় একটা ফোন করে দিন।
জয়ন্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
শোন সুধন্য, তুমি পাশের ঘরে গিয়ে বসে থাক, পালাবার চেষ্টা কোরো না।
আমাকে ছেড়ে দিন—সত্যি বলছি, আমি কিছু জানি না। স্যার।
যাও। যা বললাম পাশের ঘরে গিয়ে বসে থাক। পালাবার চেষ্টা করো না-কারণ পালিয়ে তুমি বাঁচতে পারবে না জেনো। তাহলে পুলিস তোমাকে ঠিক খুঁজে বের করে এনে একেবারে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবে মনে রেখো।
ফাঁসি!
হ্যাঁ, মনে থাকে যেন! যাও, পাশের ঘরে গিয়ে বসে।–
সত্যিই ফাঁসি দেবে?
যদি পালাও বা পালাবার চেষ্টা কর।
সুধন্য আর কোন কথা বলে না, নিঃশব্দে পাশের ঘরে চলে যায়। দু-ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে ধীরে ধীরে ভূপতিত দেহটার দিকে তাকাতে তাকাতে।
কিরীটী এবার ফিরে তাকাল সুরতিয়ার দিকে, সুরতিয়া!
বাবুজী!
তুমিই তো বরাবর রাণীমার খাস দাসী ছিলে?
জী।
সব সময় তার কাছে কাছেই থাকতে?
তবে আজ থাকিনি কেন?
রাণীমা বলল, গণেশকে ডেকে দিয়ে নীচে গিয়ে গান শুনতে। তাই গণেশকে ডেকে দিয়ে গান শুনতে গিয়েছিলাম।
তার আগে পর্যন্ত তো তুমি রাণীমার কাছো-কাছেই ছিলে?
জী।
আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কে কে রাণীমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল মনে করে বলতে পার?
কোন পারব না!
বল কে কে এসেছিল?
সকাল নটায় প্রথম আসেন। এখানকার অফিসের ম্যানেজারবাবু-চক্রবর্তী সাহেব।
কে, অনিন্দ্য চক্রবর্তী?
নাম তো জানি না। তাঁর—সবাই বলে তাকে চক্রবর্তী সাহেব-আমিও তাই বলি।
তারপর কতক্ষণ ছিলেন চক্রবর্তী সাহেব রাণীমার ঘরে?
তা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক।
অফিসের কাজে এসেছিলেন বোধ হয় চক্রবর্তী সাহেব?
না।
তবে?
তিনি আর চাকরি করবেন না, তাই বলতে এসেছিলেন।
তাতে রাণীমা কি বললেন?
তাদের সব কথাবার্তা তো শুনিনি। তবে একবার রাণীমাকে বলতে শুনেছিলাম, চাকরি ছেড়ে দিলেও দিদিমণির সঙ্গে তাঁর বিয়ের কোন আশা নেই।
তাতে চক্রবর্তী সাহেব কি জবাব দিলেন?
বলেছিলেন, বিয়ে তাদের হবেই-রাণীমার সাধ্য নেই তাদের বিয়ে আটকান
বলতে বলতে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
চক্রবর্তী সাহেব ছাড়া আর কে এসেছিল আজ রাণীমার কাছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
বড়দাদাবাবু এসেছিলেন দুপুরে—খাওয়ার পর রাণীমা যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বড়দাদাবাবুর সঙ্গে রাণীমার কি কথা হচ্ছিল জানি না, তবে মনে হয়েছিল।রাণীমা বড়দাদাবাবুকে খুব বকাবিকি করছেন, দাদাবাবু একসময় ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
আর কেউ আসেনি?
ওই সময় জয়ন্ত চৌধুরী এসে ঘরে ঢুকল। মিস্টার চৌবেকে ফোন করে এলাম, তিনি এখুনি আসবেন বললেন।
কিরীটী সুরতিয়ার দিকে আবার তাকাল, আর কে এসেছিল?
মেজদাদাবাবু আর জয়ন্তদাদাবাবু।
আর কেউ আসেনি?
ঠিক করে মনে করে দেখ!
না-আর কেউ আসেনি।
দিদিমণি!
হ্যাঁ, দিদিমণি আসেননি?
না তো!
হুঁ, আচ্ছা, মণিদাদাবাবুর সঙ্গে রাণীমার কি কথা হয়েছিল, কিছু শুনেছিলে?
না। তবে–
কি?
একটা কথা কানে এসেছিল। রাণীমা চিৎকার করে মেজদাদাবাবুকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছিলেন।
আর কেউ আসেনি রাণীমার সঙ্গে দেখা করতে, তোমার ঠিক মনে আছে?
কিরীটী আবার প্রশ্নটা করে।
ঠিক মনে আছে। তবে—
কি?
আসর থেকে রাণীমা ফেরবার পর আমি যখন গণেশকে ডেকে বাগানে যাচ্ছি, তখন সিঁড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছিল কে যেন ওপরে ম্যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে।
মনে হয়েছিল কেন, দেখনি?
দেখছি।
তবে?
পিছন থেকে দেখেছি। ঠিক চিনতে পারিনি। পুরুষ, না স্ত্রীলোক? পুরুষই —গায়ে একটা কালো রঙের ওভারকেট ছিল। আর—
আর?
লম্বা লম্বা পা ফেলে একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি টপকে টপকে যেন লোকটা ওপরে চলে গেল।
তুমি দেখলে না কেন, কে ওপরে যাচ্ছে?
না, দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম
কি-কি ভেবেছিলে? সুরতিয়া জয়ন্তর মুখের দিকে তাকাল, যেন ইতস্তত করছে একটু— কি, বল! কি ভেবেছিলে?
ভেবেছিলাম বুঝি জয়ন্তদাদাবাবুই ওপরে যাচ্ছেন! জয়ন্তবাবু! কিরীটীর মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হয়। জয়ন্তও সবিস্ময়ে বলে ওঠে, আমি!
হ্যাঁ। আশ্চর্য! তা হঠাৎ তোমার মনে হল কেন যে সে আমিই? জয়ন্তই আবার প্রশ্ন করে সুরতিয়াকে।
আপনার ছাড়া তো কালো ওভারকেট এ বাড়িতে কারো নেই! তাই মনে হয়েছিল।
কিরীটী এবার জয়ন্তর মুখের দিকে তাকাল। জিজ্ঞাসা করল, আপনার কালো রঙের ওভারকেট আছে নাকি সত্যিই মিস্টার চৌধুরী?
হ্যাঁ। গ্রেট কোট আমি একটা বড় ব্যবহার করি না, তবে এখানে এ সময় খুব শীত বলে কোটটা সঙ্গে এনেছিলাম। কিন্তু একদিনও এসে পর্যন্ত ব্যবহার করিনি—হুকে দেওয়ালে ঝোলানোই রয়েছে।
হুঁ। কি যেন এক মুহুর্তে ভাবল কিরীটী তারপর জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললে, যান, দেখে আসুন তো কোটটা আছে কিনা?
এখুনি দেখে আসছি।
জয়ন্ত দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুরতিয়া!
বাবুজী!
য়ন্তবাবুর সঙ্গে তোমাদের রাণীমার কি কথা হয়েছিল, জান?
শুনিনি। তবে একটা কথা কানে এসেছিল।রাণীমার।
কি কথা?
জয়ন্ত, আমি তোমাকেও এখন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না!
বলেছিল ওই কথা রাণীমা?
হ্যাঁ আরো বলেছিল।রাণীমা, মনে হচ্ছে—এখন মনে হচ্ছে, তোমরা সবাই আমাকে মারতে পার। মারবার জন্য সবাই তোমরা আমাকে ওৎ পেতে বসে আছে।
জয়ন্তবাবু তার কি জবাব দিলেন?
জয়ন্তদাদাবাবু বললেন, তোমাকে দেখছি সত্যিসত্যিই মৃত্যু-বিভীষিকায় পেয়েছে বড়মা। তোমার মাথা সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল বলে আমার মনে হচ্ছে।
জয়ন্ত ওই সময় হস্তদন্ত হয়ে ফিরে এল, আশ্চর্য—strange—
কি হল?
কোটটা ঘরে নেই!
নেই?
না।
সারাদিন কোটটা ছিল। কিনা মনে আছে আপনার?
মনে আছে স্পষ্ট, দিনের বেলায় দেখেছি। তরে সন্ধ্যার পর বড়মার ঘর থেকে ফিরে এসে মনে পড়ছে না দেখেছি কিনা।
কিরীটী কেটটা সম্পর্কে আর কোন কৌতূহল প্রকাশ করে না বা কোন প্রশ্ন করে না। মনের মধ্যে তখন তার অন্য একটা চিন্তা ক্রমশ যেন একটা নির্দিষ্ট রূপ নেবার চেষ্টা করছে।
রাত সোয়া দশটা নাগাদ চিত্রাঙ্গদা দেবী গানের আসর থেকে উঠে ভেতরে চলে আসেন। তারপর চিত্রাঙ্গদা দেবী তাঁর খাস দাসী সুরতিয়াকে বলেন গণেশকে ডেকে দিতে। গণেশ সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় রাণীমার এই ঘরে যদি এসে থাকে, তাহলে সেটা দশটা কুড়ি-পঁচিশ খুব জোর হবে। চিত্রাঙ্গদা দেবী তখনো বেঁচে ছিলেন। কারণ গণেশ এসে এই ঘরে ঢুকবার পর তাকে চিত্রাঙ্গদা দেবী বলেন, জয়ন্তকে গানের আসর থেকে ডেকে আনবার জন্য। গণেশ বের হয়ে যায়। ধরা যাক সময় তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা মত হবে।
গণেশ প্রথমে জয়ন্তবাবুকে ডাকতে গানের আসরে যায়—সেখানে খোঁজ না পেয়ে ফিরে আসে আবার বাড়ির মধ্যে। জয়ন্ত চৌধুরীর ঘরে যায়, তাকে ডাকাডাকি করে তোলে— যেহেতু জয়ন্ত চৌধুরী তখন ঘুমোচ্ছিল।
জয়ন্ত চৌধুরী এসে মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যেই এই ঘরে ঢেকে এবং ঢুকে দেখতে পায়-চিত্রাঙ্গদা দেবী মৃত।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটা-ওই পনেরো মিনিট সময়ের মধ্যেই কোন একসময় হত্যাকারী এই ঘরে ঢুকে তার কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে।
রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটা!
শেষের কথাটা কিরীটী মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করে কতকটা বুঝি স্বগতোক্তির মতই।
কিছু বলছেন মিস্টার রায়? জয়ন্ত চৌধুরী প্রশ্ন করে।
বলছি চিত্রাঙ্গদা দেবীকে সম্ভবত রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে কোন এক সময় হত্যাকারী পিছন দিক থেকে অতর্কিতে ছোরার দ্বারা আঘাত করে সরে পড়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। অর্থাৎ সে সময় দোতলায় একমাত্র চিত্রাঙ্গদা দেবী তার ঘরে ও আপনি আপনার ঘরে ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তি ছিল না বাড়ির মধ্যে। কাজেই—
কি?
যদি অতর্কিতে আঘাত পেয়ে একটা চিৎকার করেও উঠে থাকেন সেই মুহূর্তে চিত্রাঙ্গদা দেবী, একমাত্র আপনি ছাড়া আর কারো কানে পৌঁছবার কথা নয়-কিন্তু আপনিও ঘুমিয়ে ছিলেন।
জয়ন্ত কোন জবাব দেয় না।
নিঃশব্দে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কিরীটী কি তাকে সন্দেহ করছে নাকি! কিরীটী আবার বলে, গণেশ গানের আসরে আপনাকে খুঁজে না পেয়ে যখন ওপরে এসেছে, তখন আততায়ী তার কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে। গণেশ কি চিত্রাঙ্গদার এই ঘরে আর ঢোকেনি? হয়েতো ঢুকেছিল-চুকে এই দৃশ্য দেখে ভয়ে তাড়াতাড়ি আপনার কাছে ছুটে যায়।
কিন্তু গণেশ তো—
বলেনি সে ধরণের কোন কথা জানি। আমিও সেই রকমই যে কিছু ঘটেছে তা বলছি না। আমি বলছি, ওই রকমও কিছু হয়ে থাকতে পারে মাত্র।
বাইরে দালানে ওই সময় ঘড়িতে ঢং করে রাত সাড়ে বারোটা ঘোষণা করল।
গানের আসর। তখনো পুরোদমে চলেছে। মধ্যরাত্রির স্তব্ধতায় এতদূর থেকেও গানের লাইনগুলো যেন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
কিরীটীর মনে হয়, কি বিচিত্র পরিবেশ!
বাড়ির একাংশে যখন সঙ্গীতের সুধা ঝরে পড়ছে, অন্য অংশে তখন বাড়ির কর্ত্রী নিহত হয়ে রক্তস্রোতে ভাসছেন!
জীবন ও মৃত্যু!
গণেশ! কিরীটী ডাকে।
গণেশ নিঃশব্দে একপাশে ঘরের মধ্যেই তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। গণেশ কিরীটীর ডাকে ফিরে তোকাল তার মুখের দিকে!
তুমি একবার নীচে যাও, গানের আসর থেকে জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্র ও ফণীন্দ্রবাবুকে ডেকে নিয়ে এস।
কি বলব তাদের? গণেশ জিজ্ঞাসা করে।
কি বলবে? বল-বল-হ্যাঁ বল, তাদের বড়মার বিশেষ জরুরী ব্যাপার, তাদের ডাকছে। হ্যাঁ শোন, একসঙ্গে নয়, পাঁচ-ছ মিনিট পর পর এক একজনের কাছে গিয়ে কথাটা বলবে, বুঝলে?
আজ্ঞে।
যাও ওদের ডেকে দিয়ে সরকারমশাইকে ডেকে দেবে। সুরতিয়া, আপাতত তুমি এ ঘরে থাক।
গণেশ বের হয়ে গেল।
কিরীটী আবার জয়ন্তর দিকে ফিরে তাকাল।
মিস্টার চৌধুরী!
বলুন।
ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলুন পাশের ঘরে যাই, ওখানেই কথাবার্তা হবে। চলুন।
মৃতদেহ যেমন ছিল তেমনই পড়ে রইল, সুরতিয়াকে ঘরে রেখে দুজনে মধ্যবর্তী দরজার দিকে অগ্রসর হল।
ঘর ছেড়ে যাবার আগে কিরীটী আর একবার চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়ন—ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
নিভাঁজ শয্যা-বোঝা গেল সেরাত্রে খাটের ওপরে বেচারী শয়নেরও আর সুযোগ পাননি। ঘরের মেঝেতে কেবল খাটের কাছে দামী পুরু একটা কর্পেট বিছানো, বাকি মেঝেটা এমনি-আ-ঢাকা।
এক কোণে একটা বিরাট দু-পাল্লার আলমারি-সেকেলে সেগুন কাঠের তৈরী এবং কারুকার্য করা। তার পাশেই একটা গোলাকার বেশ বড় সাইজের শ্বেতপাথরের টপ টেবিল—টেবিলের ওপরে নানা টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
উল্টোদিকে ঘরের সংলগ্ন বাথরুম।
কিরীটী ইতিমধ্যে বাতিরুমটাতে পরীক্ষা করে দেখছিল। বাথরুমের দরজা, যেটার বাইরের ঘোরানো লোহার সিঁড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে, সেটা ভেতর থেকে বন্ধই ছিল। বাথরুমটাও বেশ প্রশস্ত। আগাগোড়া ইটালিয়ান গ্লেজটাইলের দেওয়াল-মেঝেও ইটালিয়ান মোজাকের। বাথটাব, শাওয়ার, বেসিন—সব ঝকঝকে তকতকে।
ঘরের মধ্যে শ্বেতপাথরের গোলাকার টেবিলটা ছাড়াও একটা মাঝারি আকারের টেবিল আছে। কিছু বই ও নানা ধরনের ফাইল খাতপত্র টেবিলের ওপরে সাজানো।
সামনে একটা দামী কুশন মোড়া চেয়ার। একটা আরাম-কেদারাও ধরের মধ্যে আছে। আর একটা লোহার দেওয়ালে গাঁথা সিন্দুক। সিন্দুকটার একেবারে গা থেকে শোবার খাটটা।
আগে আগে চলেছিল জয়ন্ত-পিছনে কিরীটী, হঠাৎ কিরীটীর নজরে পড়ে ঘরের মেঝেতে মধ্যবতী দরজার একেবারে গা থেকে কি একটা পড়ে আছে-চিকচিক করছে।
কিরীটী কুঁকে নীচু হয়ে জিনিসটা মেঝে থেকে তুলে নিল। রঙিন কাচের চুড়ির একটা ভাঙা টুকরো।
কি হল? জয়ন্ত ঘুরে দাঁড়ায়।
না, কিছু না। চলুন।
দুজনে এসে পাশের ঘরে ঢুকল।
সুধন্য একা একা ঘরের মধ্যে বসেছিল—ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল।
আমি নীচে যেতে পারি? সুধন্য জিজ্ঞাসা করে।
পালাবার চেষ্টা করবে না তো?
না।
তাহলে যাও। ডাকলেই যেন পাই।
হ্যাঁ, নীচে গেস্টরুমের পাশের ঘরেই আমি থাকব।
যাও তাহলে। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
সুধন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মনে হল সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওকে যেতে দিলেন মিস্টার রায়, যদি পালিয়ে যায়? জয়ন্ত চৌধুরী বলে কিরীটীকে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, না, পালাবে না। তাছাড়া পালালে তো ক্ষতি নেই কিছু।
ক্ষতি নেই!
না। সুধন্য হত্যা করেনি।
কি করে বুঝলেন?
স্বর্ণডিম্বপ্রসূ হংসীকে হত্যা করবে নিজের হাতে, অন্তত এত বড় গদর্ভ সুধন্য নয়।
স্বর্ণডিম্বপ্রসূ হংসী!
হ্যাঁ-চিত্রাঙ্গদা দেবী তো ওর কাছে তাই ছিলেন। এলেই টাকা পেত-তা সে যে কারণেই হোক। আর সেই টাকাই যে ওর ভরসা, সেও আমি জানি।
কিন্তু—
না মিস্টার চৌধুরী, হত্যাকারী শুধু ক্ষিপ্ৰগতিসম্পন্নই নয়, অসম্ভব তার নার্ভ এবং বুদ্ধি। এবং তার হত্যার পিছনে বড় রকমের কোন মোটিভ রয়েছে জানবেন।
কিন্তু—
হ্যাঁ—আপাততঃ যা আমার মনে হচ্ছে, হত্যাকারী পূর্ব হইতে প্রস্তুত হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র এতটুকুও দেরি করেনি। আর —সঙ্গে সঙ্গে চরম আঘাত হেনেছে, তারপর সরে পড়েছে।
বাইরে ওই সময় পদশব্দ পাওয়া গেল।
দেখুন তো কে এল!
জয়ন্তকে উঠে দেখতে হল না, থানার অফিসার মিঃ চৌবে ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর সরকার যোগেন বা যোগীন মিত্র ঘরে এসে ঢুকল।
এই যে জয়ন্তবাবু,-যোগেন মিত্ৰই প্রথমে কথা বলে, কি ব্যাপার? আমাকে ডেকেছেন কেন? আর মিস্টার চৌবেই বা–
কথা বললে এবারে কিরীটী, প্রয়োজন ছিল মিত্রমশাই।
কি বলুন তো? একটু যেন বিস্মিত হয়েই যোগেন মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
বিস্ময়ের তার কারণ ছিল, কারণ কিরীটীর সত্যি পরিচয়টা সে জানে না এখনো। অথচ এত রাত্রে এ ঘরে–
কিরীটী আবার বলে, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনা!
হ্যাঁ। মিসেস চৌধুরী অর্থাৎ আপনাদের রাণীমা—
কি-কি হয়েছে তার? ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে যোগেন মিত্র।
তিনি খুন হয়েছেন।
সে কি!
হ্যাঁ।
কিরাটাই তখন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বিবৃত করে।
চৌবেজী এবার বলে, কিন্তু আপনি কে?
এবারে জয়ন্ত তার পরিচয় দিল, উনি বিখ্যাত রহস্যসন্ধানী কিরীটী রায়।
সত্যি! নমস্তে—নমস্তে বাবুজী। চৌবেজীর কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় একেবারে বিগলিত, কি সৌভাগ্য, আপনার দেখা পেলাম!
যোগেন মিত্র বলে, তাহলে আপনি যে বলেছিলেন জয়ন্তবাবু—
জয়ন্তবাবু তখন সংক্ষেপে কিরীটীর এখানে আসার ব্যাপারটা বলে গেল, বড়মার ইচ্ছাক্রমেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মৃতদেহ পরীক্ষা করল চৌবে।
চেয়ে বললে, তাজ্জব কি বাত— এইসা কেইসে হো সেকতা মেরে সমঝ মে নেহি আতা রায় সাহাব! আপকে রায় কেয়া হ্যায়?
কিরীটী বলে, যতদূর বুঝতে পারছি, আততায়ী মিসেস চৌধুরীর কোন অপরিচিত জন নন—কোন বাইরের লোকও নয়।
তব কৌন হো সেকতা?
সেটা এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না—সকলের সঙ্গে কথাবার্তা না বললে—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, জগদীন্দ্ৰ প্ৰথমে ও তার পশ্চাতে মেজ মণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল, এবং ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ ওদের কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট আর্তচিৎকার নিৰ্গত হয়, এ কি!
তারপরই যেন দু ভাই বোবা হয়ে গেল। প্রস্তরমূর্তির মত ভূপতিত প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহতার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গানের আসর। তখনো ভাঙেনি। গানের সুর তখনো শোনা যাচ্ছে।
একপাশে সুরতিয়া তখনো পাথরের মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে।
চৌবেজীই কথা বলে, চলিয়ে সাব, ও কামরামে চলিয়ে।
চৌবেজীর সঙ্গে সঙ্গে জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্র, যোগেন মিত্র ও জয়ন্ত পাসের ঘরে চলে গেল। কিরীটী চৌবেজীকে সম্বোধন করে বললে, আপ যাইয়ে চৌবেজী, ম্যায় আতা হুঁ।
সুরতিয়া!
কিরীটীর ডাকে সুরতিয়া ওর মুখের দিকে তাকাল। ফ্যাকাশে বিবৰ্ণ মুখ।
সুরতিয়া!
বাবুজী!
তুমি তো ভূপৎ সিংয়ের স্ত্রী, তাই না?
কথাটা শুনে হঠাৎ যেন চমকে ওঠে সুরতিয়া, কয়েকটা মুহুর্ত কোন জবাব দিতে পারে না। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
শোন সুরতিয়া, আমি তোমার অনেক কথাই জানি—
সুরতিয়ার দুচোখের দৃষ্টিতে যেন একটা অজানিত আশঙ্কা ঘনিয়ে ওঠে। নিঃশব্দে চেয়ে থাকে ও।
কিরীটী আবার বলে, তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, তার ঠিক ঠিক জবাব দাও। জবাব না দিলে জানবে যাকে তুমি বাঁচাবার চেষ্টা করছ, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
সুরতিয়া তথাপি নীরব।
রাজাবাবুর সঙ্গে তোমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, সত্যি কিনা?
সুরতিয়া নীরব। নিঃশব্দে সে কেবল চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে।
আমি জানি ছিল—কিরীটী বলতে থাকে, আর সে ঘনিষ্ঠতার কথা রাণীমা জানত, তাই না?
সুরতিয়া পূর্ববৎ নীরব।
এবার বল ওই সুধন্য কে?
আ—আমি জানি না বাবুজী!
জান—বল কে?
আ-আমি জানি না।
তুমি বলতে চাও তুমি জান না কেন রাণীমা অমন করে সুধন্য এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেই তাকে টাকা দিতেন?
রাণীমা ওকে পেয়ার করতেন, তাই—
কিরীটী হেসে ফেলে, কি বললে পেয়ার!
হ্যাঁ
মিথ্যে কথা—ঝুট। উসসে রাণীমাকো বহুৎ নফরৎ থি।
নেহি বাবুজি-নেহি, সাচমুচ—রাণীমা—
শোন সুরতিয়া, তুমি যাই বল আমি জানি রাণীমা ঐ সুধন্যকে দুচক্ষে একেবারে দেখতে পারত না-বল, সত্যি কথা বল— রাণীমা কেন সুধন্যকে আমন করে টাকা দিতেন বল?
বিশ্বাস করুন, বাবুজী, আমি জানি না।
আমি কিন্তু জানি কেন রাণীমা ওকে টাকা দিতেন!
আ—আপনি জানেন? গলার স্বরে যেন একটা চাপা আতঙ্ক ফুটে ওঠে স্পষ্ট হয়ে সুরতিয়ার হঠাৎ।
তুমি বলছ রাণীমা সুধন্যকে পেয়ার করত—কিন্তু কেন? কি সম্পর্ক ছিল সুধন্যর সঙ্গে রাণীমার? কে ও রাণীমার?
কেউ না।
তবে?
কিন্তু বাবুজী—
যাক সেকথা, এবার সত্যি করে বল তো, সিঁড়ি দিয়ে কোট গায়ে যে লোকটা ওপরে উঠছিল, সে কে?
তাকে আমি চিনতে পারিনি।
আবার মিথ্যে কথা বলছি, তাকে তুমি চিনতে পেরেছ।
না, না, আমি চিনতে পারিনি।
তোমার কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। ঠিক আছে, এই ঘরেই তুমি থাক। কোথাওঃ যে ও না যেন।
কিরীটী কথাগুলো বলে মধ্যবর্তী দরজাপথে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল।
চৌবেজী তখন জবানবন্দি নিচ্ছেন এক এক করে ঘরে যারা উপস্থিত ছিল।
জগদীন্দ্র ও মণীন্দ্ৰ চিত্রাঙ্গদা দেবীর আকস্মিক মৃত্যুতে যেন কেমন মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল। তারা যেন কিছু ভাল করে ভাবতেও পারছিল না।
তারা তাদের জবানবন্দিতে বলেছে, সন্ধ্যা থেকেই তারা গানের আসরে গিয়ে বসেছিল। এবং বাগানে গেস্টদের জন্য যে খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানেই কয়েকজন পরিচিত স্থানীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে খেয়ে নিয়েছিল। খাবার জন্য বাড়ির মধ্যে পর্যন্ত আসেনি। গানের আসর ছেড়ে তারা একবারের জন্যও উঠে আসেনি। কিছুই তারা জানে না-কিছুই তারা বলতে পারে না।
আর জয়ন্ত কিরীটীর কাছে যা বলেছিল, চৌবেজীর প্রশ্নের জবাবেও তাই বলেছে— অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি করেছে।
বাইরে গানের আসর। তখনো পুরোদমে চলেছে। রাতও প্রায় পৌনে দুটো হল।
কিরীটী মণীন্দ্রর দিকে তাকিয়ে তাকে এবার প্রশ্ন করে, কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই মণীন্দ্রবাবু!
মণীন্দ্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
আজ সন্ধ্যার সময় আপনি আপনার বড়মার ঘরে এসেছিলেন, না?
হ্যাঁ
কি কথা হয়েছিল। আপনার চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে?
এমন বিশেষ কিছু না—
কিন্তু আমি যতদূর জানি, আপনাদের পরস্পরের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিল এবং তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তেমন বিশেষ কিছুই যদি না হবে, তো
হ্যাঁ-স্বাতীর বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমাদের মধ্যে একটু কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।
আর কিছু না!
না। অনিন্দ্য আমার পরিচিত—বন্ধু, স্বাতী তাকে বিয়ে করতে চায়, অনিন্দ্যও স্বাতীকে বিয়ে করতে চায়। অথচ বড়মা কিছুতেই রাজী নন। আমি কথাটা উত্থাপন করতেই বড়মা আমাকে যা-তা বলতে শুরু করেন।
তিনি আপনাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন?
হ্যাঁ
হুঁ। আচ্ছা মণীন্দ্রবাবু, আপনাদের ভাইদের মধ্যে কাকে বেশি চিত্রাঙ্গদা দেবী পছন্দ করতেন বলে আপনার মনে হয়?
সত্যি কথা বলতে গেলে কাউকেই তিনি আমাদের সত্যিকারের পছন্দ করতেন না। ভালবাসতেন বলে আমার মনে হয় না।
আপনাদের ছোট ভাই শচীন্দ্রবাবুকে?
না।
জয়ন্তবাবুকে?
ওকে তো তিনি দুচক্ষে দেখতে পারতেন না।
জগদীন্দ্ৰও মণীন্দ্রর কথার পুনরাবৃত্তি করল।
গণেশ!
কিরীটী এবারে গণেশের দিকে ফিরে তাকাল।
গণেশ একপাশে দাঁড়িয়েছিল। জবাব দিল, আজ্ঞে?
শচীন্দ্রবাবুকে ডেকে নিয়ে এস তো। আর শোন, তোমাদের স্বাতী দিদিমণিকেও একটা খবর দাও।
গণেশ বের হয়ে গেল।
জগদীন্দ্রবাবু, মণীন্দ্রবাবু, আচ্ছা আপনাদের বড়মার কোন শত্ৰু ছিল কি?
শত্ৰু!
হ্যাঁ।
মণীন্দ্ৰই এবার বলে, না-তাঁর আবার কোন শত্ৰু থাকতে পারে?
কিন্তু এটা তো ঠিক মণীন্দ্রবাবু, আপনারা ভাইবোনেরা কেউ আপনাদের বড়মাকে পছন্দ कट्ठत না?
পছন্দ করতাম না!
হ্যাঁ-কেউ আপনারা সুখী নন।
না না-তা কেন হবে?
কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি। কেউ আপনারা তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট ছিলেন না।
জগদীন্দ্র জিজ্ঞাসা করে, কে বলেছে সেকথা আপনাকে? জয়ন্ত?
না।
তবে?
বলেছেন আপনাদের বড়মা।
বড়মা?
হ্যাঁ-আর তার ধারণা হয়েছিল–
কি?
তাকে আপনারা হত্যাও করতে পারেন।
এসব আপনি কি বলছেন?
যা বলছি তা যে মিথ্যা নয়। সে আপনারা সকলেই জানেন—আপনি, মণীন্দ্রবাবু, শচীন্দ্রবাবু, স্বাতী দেবী-কেউ আপনারা আপনাদের বড়মাকে সহ্য করতে পারতেন না।
শচীন্দ্র আর স্বাতী একই সঙ্গে ঐ সময় এসে ঘরে ঢুকল। গণেশ কোন কথা তাদের বলেনি। দুজনেই ঘরের মধ্যে অত লোক ও থানা-অফিসারকে দেখে একটু যেন অবাকই হয়।
শচীন্দ্র বলে, কি ব্যাপার, কি হয়েছে রে বড়দা? জগদীন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে শচীন্দ্র।
আমি বলছি শচীন্দ্রবাবু,-কিরাটাই বলে, আপনাদের বড়মাকে কে যেন একটু আগে খুন করেছে।
খুন!
হ্যাঁ। কি বলছেন। আপনি? ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর হলেও সত্যি সত্যিই তাই ঘটেছে। She has been brutally murdered.
স্বাতী এতক্ষণ চুপ করে ছিল; সে হঠাৎ বলে, এই রকমই যে কিছু একটা শেষ পর্যন্ত ওর ভাগ্যে ঘটবে সে আমি জানতাম।
কি বললেন? কিরীটী স্বাতীর মুখের দিকে তাকাল।
বলছি। ওর বরাতে যে শেষ পর্যন্ত এমনি একটা কিছু ঘটবে, সে তো জানাই ছিল।
কেন?
অমন দাম্ভিক, হৃদয়হীন স্ত্রীলোকের পক্ষে ওই রকম একটা কিছু ঘটাই তো স্বাভাবিক। আপনি তো জানেন না—কতটুকু পরিচয় ওর আর এ দুদিনে পেয়েছেন? আমরা দীর্ঘদিন ধরে ওর কাছে থেকে বুঝতে পেরেছি, কি টাইপের স্ত্রীলোক ছিল আমাদের বড়মা।
আপনাদের ওপর বুঝি খুব অত্যাচার করতেন?
কিন্তু আপনাকে তো আমি ঠিক চিনতে পারছি না, যদিও দুদিন থেকে এ বাড়িতে আপনি আছেন। আমি জানতে পেরেছিলাম। আজই সকালে গণেশের কাছ থেকে—
জয়ন্ত চৌধুরীই তখন পুনরায় কিরীটীর পরিচয়টা ওদের কাছে ব্যক্ত করে।
স্বাতী সব শুনে বলে, ও আপনি ওই ডাইনি বুড়ীর আমন্ত্রণ নিয়েই এখানে এসেছিলেন। আমাদের ওপর খবরদারী করতে যখন, তখন তো তার সত্য পরিচয়টা নিশ্চয়ই আপনার সর্বাগ্রে জানা দরকার বিশেষ করে আমি নিশ্চয় জানি, সে পরিচয়টা আপনি তার পাননি–
বেশ তো, বলুন না শুনি।
এক জঘন্য প্রকৃতির নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন প্রকৃতির স্ত্রীলোক ছিলেন তিনি।
কি রকম?
সে ইতিহাস বর্ণনা করতে গেলে পুরো দিন লেগে যাবে। কিন্তু জয়ন্তদাও তো তাকে চিনত, তার কাছেও কিছু আপনি আগে শোনেননি?
শুনেছি কিছু কিছু, আপনিও বলুন না।
এই যে দেখছেন আমার সহোদর ভাই কাটিকে, এদের চারটেকে একেবারে ভেড়া করে রেখেছিল মহিলা। এই যে বাড়িটা-ইন্দ্ৰালয় যার নাম—এর আসল নাম কি হওয়া উচিত ছিল জানেন? নরকালয়। কতকগুলো জ্যান্ত মানুষকে অনুকম্পা ও সাহায্য করার ভান করে দিনের পর দিন রাতের পর রাত চরম জঘন্য নির্যাতন চালিয়েছে, আর তার ফলে যা হবার ঠিক তাই হয়েছিল, এরা সকলে মুখে যতই শ্রদ্ধা ও প্রীতি জানাক না কেন, মনে মনে করত প্রচণ্ড ঘৃণা।
ঘৃণা!
হ্যাঁ, ঘৃণা। অথচ মজা কি জানেন, তবু এরা কেউ বিদ্রোহ করতে পারেনি—এই বিচিত্র বন্দীশালা ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। এর চেয়ে দুঃখ, লজ্জা ও ভীরুতার আর কি থাকতে পারে বলতে পারেন?–
একটু থেমে স্বাতী আবার বলে, কাজেই আজ যা ঘটেছে, সে তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে আমার, আমি যখন এই বন্দীশালা ছেড়ে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছি, ঠিক সেই মুহুর্তে ব্যাপারটা ঘটল।
আপনি কি
হ্যাঁ, সকালেই অনিন্দ্যর আসার কথা—আমাকে সে নিয়ে যাবে। এখান থেকে বলে গিয়েছে।
আপনার চলে যাবার কথাটা আপনার বড়মা জানতেন?
হ্যাঁ।
আপনি বলেছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ, কাল দুপুরেই জানিয়ে দিয়েছিলাম।
তিনি কি বলেছিলেন?
বলেছিল, তাহলে তার সম্পত্তির একটা কপর্দকও আমি পাব না। আমিও সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিলাম তাকে-চাই না।
তাহলে দুপুরে আপনার সঙ্গে আপনার বড়মার দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ।
আপনার মেজদা কথাটা জানতেন কি?
হ্যাঁ, তাকে বলেছিলাম।
কিরীটী এবার শচীন্দ্রর দিকে ফিরে তাকাল, আপনার নামই শচীন্দ্ৰ চৌধুরী?
হ্যাঁ।
আপনি আপনার ঘরেই ছিলেন এতক্ষণ বোধ হয়?
হ্যাঁ।
গানের আসরে যাননি?
না, ওসব আমার ভাল লাগে না।
আচ্ছা শচীনবাবু, শেষ আপনার বড়মার সঙ্গে কখন দেখা হয়?
গতকাল সন্ধ্যায়।
কি কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আপনার?
বিশেষ কিছুই না।
ক্রমশ রাত শেষ হয়ে আসে।
আসর ইতিমধ্যে ভেঙে গিয়েছিল, অতিথি-অভ্যাগতরাও একে একে ইন্দ্ৰালয় ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
দুঃসংবাদটা চাপা থাকে না। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ-কান ও-কান হতে হতে সংবাদ সমস্ত ইন্দ্ৰালয়ে ছড়িয়ে যায়।
কিরীটীর অনুরোধে চৌবেজী ইন্দ্ৰালয়ে পুলিস-প্রহরা মোতায়েন করেছিলেন ইতিমধ্যে এবং নির্দেশ জারি করে দিয়েছিলেন তাঁর বিনানুমতিতে কেউ ইন্দ্ৰালয় ছেড়ে আপাততঃ যেতে পারবে না।
সকলকেই আপাততঃ নজরবন্দী থাকতে হবে। রীতিমত এক অস্বস্তিকর পরিবেশ।
উৎসব আরো কদিন হবার কথা ছিল, কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবীর আকস্মিক মৃত্যু আততায়ীর হাতে হঠাৎ যেন সব কিছুর ওপর একটা পুর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছিল। আনন্দ-কোলাহল মুখরিত ইন্দ্ৰালয়ের ওপরে হঠাৎ যেন শোকের একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে।
উৎসব থেমে গিয়ে যেন একটা শ্মশান-স্তব্ধতা নেমে এসেছে ইন্দ্ৰালয়ের ওপর।
দুটো দিন আমনি করে কেটে গেল আরো।
কিরীটী মধ্যে মধ্যে এক-একজনকে আলাদা করে তার ঘরে ডেকে এনে আরো কিছু কিছু প্রশ্ন করেছে এবং সবাই জানতে পেরেছে কিরীটীর কথায়, পুলিস এবং তার ধারণা, বাইরের কেউ চিত্রাঙ্গদা দেবীর নৃশংস হত্যার জন্য দায়ী নয়।
হত্যা করেছে। চিত্রাঙ্গদা দেবীকে বাড়ির মধ্যে যারা সে-রাত্ৰে উপস্থিত ছিল, অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদা দেবীর কোন আপনজনই, বিশেষ করে যাদের অন্দরে ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর ঘরে অবাধ গতিবিধি ছিল।
কথাটা শোনা অবধি সকলেই যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে গিয়েছে। সকলেই পরস্পর মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে সর্বক্ষণ। একের অন্যের প্রতি কেমন যেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের দিকে কেমন সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছে।
কে—তাদের মধ্যে কে? কে হত্যা করল চিত্রাঙ্গদা দেবীকে?
জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র ও জয়ন্ত, বিশেষ করে ওই পাঁচজন—পাঁচ ভাইয়ের মনেই যেন ওই কথাটা ঘুরে ফিরে উদয় হয়।
স্বাতীও তাকায় তার ভাইদের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে।
কে-কে হত্যা করল?
আর ওদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে সুধন্যও।
কেউ কারো সঙ্গে মন খুলে কথা পর্যন্ত যেন বলতে পারছে না, কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে।
সবাই যেন নিজের নিজের মনের মধ্যে গুমরোচ্ছে। বিশ্ৰী অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি।
সেদিন দুপুরে কিরীটী তার ঘরের মধ্যে বসেছিল, বাইরে ফণীন্দ্রর গলা শোনা গেল।
মিস্টার রায় আসতে পারি?
আসুন—আসুন! ডান পা-টা খোঁড়া ফণীন্দ্রর। ডান পা-টা একটু টেনে টেনে আস্তে আস্তে চলে সে। পা টেনে টেনে ফণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল।
বসুন।
মিস্টার রায়!
বলুন?
এরকম করে তো আর পারছি না মিস্টার রায়—এই যে সৰ্বক্ষণ এক সন্দেহের দুঃসহ যন্ত্রণা-সত্যি বলছি, আর কাঁটা দিন এভাবে থাকলে হয়ত পাগল হয়ে যাব।
আমি তো আপনাদের প্রত্যেককেই বলেছি। ফণীন্দ্রবাবু, আপনারা যে যা জানেন—কোন কথা গোপন না করে অকপটে আমাকে জানতে দিন। তাহলে এভাবে আপনাদের কষ্ট পেতে হয় না। —আমিও ব্যাপারটার একটা মীমাংসায় পৌঁছতে পারি।
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, সব কথাই আপনাকে অন্ততঃ আমি বলেছি।
না।
কি বললেন?
আপনি সব কথা বলেননি।
বলিনি!
না।
কি কথা আপনার কাছে আমি গোপন করেছি?
গোপন করেছেন সে-রাত্রে—মানে দুর্ঘটনার রাত্রে, রাত সোয়া নটা থেকে রাত পৌনে। এগারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কি করেছিলেন।
আমি তো আমার ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। ওই সময়টা।
না।
হ্যাঁ, আপনি বিশ্বাস করুন—
বিশ্বাস আমি করতে পারছি না।
পারছেন না?
না।
কেন?
কারণ রাত দশটা নাগাদ আপনাকে আমি গানের আসরে দেখেছি।
না না, মানে০০
অস্বীকার করবার চেষ্টা করছেন কেন? আমি আপনাকে দেখেছি—বলুন, সেরাত্রে আসরে আপনি যাননি?
হ্যাঁ—গিয়েছিলাম, বড়ে গোলাম আলি যখন গান ধরেন।
হ্যাঁ, রাত ঠিক দশটায়—আমার মনে আছে তিনি গান ধরেছিলেন।
হ্যাঁ, মিস্টার রায়, অস্বীকার করব না-গিয়েছিলাম। আমি। কিন্তু শরীরটা ভাল না থাকায় একটু পরে চলে আসি।
তাহলে আপনি যে বলছিলেন, সেদিন সন্ধ্যা থেকে আপনাকে ডাকা পর্যন্ত আপনি ঘরে শুয়েছিলেন, সত্যি নয়?
ফণীন্দ্র মাথা নীচু করে।
কথাটা আপনি সেদিন স্বীকার করেননি কেন?
ভয়ে। কিন্তু, আপনি বিশ্বাস করুন, বড়মাকে খুন আমি করিনি। কেন করব—কি স্বার্থ থাকতে পারে আমার?
সেকথা যদি বলেন তো স্বাৰ্থ আপনার আছে বৈকি।
স্বাৰ্থ আছে? কি স্বাৰ্থ? বড় বড় চোখ করে তাকায় ফণীন্দ্র কিরীটীর চোখের দিকে।
প্রথমত ধরুন, বড়মার মৃত্যু হলে আপনি নিয়মিত মোটা একটা মাসোহারা পাবেন তঁর উইল অনুযায়ী। অন্যান্য সম্পত্তির ভাগ ছাড়াও—আর সব চেয়ে বড় কথা, দিবারাত্র বড়মার মুখের দিকে চেয়ে তাঁর ভয়ে জুজুর মত থাকতে হবে না—এই বন্দী-জীবন কাটাতে হবে না-এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন।
যন্ত্রণা থেকে মুক্তি!
নয়? ভেবে দেখুন, আপনারা প্রত্যেক ভাইবোনেরাই কি আপনাদের বড়মার প্রতি, নিরন্তর শাসন আর বিধিনিষেধ, সৰ্ব্বক্ষণ তাঁর শাসনের ঝাপটা সয়ে সয়ে ভেতরে ভেতরে হ্যাঁপিয়ে ওঠেননি? মানুষ তো কেবল মাথা গোঁজবার একটা ঠাই ও সেই সঙ্গে দু-বেলা নিশ্চিন্ত আহার কিংবা খানিকটা অর্থের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিশ্চিন্ততা নিয়েই তাঁর জীবনের যা কিছু কাম্য পেয়ে যায় না বা তার মনটা সব দিক দিয়ে ভরে ওঠে না।–তার সব অভাব অভিযোগ মিটে যায় না। সে চায়—শুধু সে কেন, প্রতিটি মানুষই চায়, তার ব্যক্তিস্বাধীনতা সবার ওপরে; এখানে সকল প্রকার স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের মধ্যে থেকেও সেই স্বাধীনতাটুকুর–অভাবেই কি আপনার প্রত্যেকে দিনের পর দিন এই ইন্দালয়ের দেওয়ালে মাথা কুটে। মরেননি? এই চার দেওয়াল থেকে মুক্তি চাননি?
চেয়েছি—চেয়েছি মিস্টার রায়-প্রতি মুহুর্তে চেয়েছি। কিন্তু—হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ফণীন্দ্র বলে ওঠে।
তার চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে।
কিরীটী বাধা দিল, কিন্তু পারেননি-এই বন্দীশালার চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে যেতে পারেননি। কারণ এখানকার এই স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম দিনের পর দিন যেমন করে খাঁচায় পাখির ডানাকে অনভ্যস্ত থাকায় অবশ করে দেয়, আপনাদের ঠিক সেই অবস্থা হয়েছিল বলে।
তবু-তবু মাঝে মাঝে মনে হয়েছে —
বের হয়ে পড়েন, তাই না? তবু পারেননি। কারণ পা দুটোই যে আপনাদের অরশ হয়ে গিয়েছিল, তাই নয়? চৌকাঠ ডিঙোবার জন্য মনের যে সাহসের দরকার, সে সাহসের মেরুদণ্ডটাও ভেঙে দিয়েছিলেন আপনাদের ওই বড়মা। আর সেই অক্ষমতা ক্রমশ আপনাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যে বড়মার প্রতি যে একটা প্রচণ্ড ঘৃণা, পুঞ্জীভূত করে তুলেছিল, তাতে করে কেবলমাত্র আপনি কেন, আপনাদের চার ভাইয়ের মধ্যে যে কারুর পক্ষেই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করা শেষ পর্যন্ত আদৌ অসম্ভব ছিল না।
ফণীন্দ্ৰ যেন বোবা হয়ে যায়। সে মাথা নীচু করে বসে থাকে।
যে আমি বুঝিনি তা নয়। ফণীন্দ্রবাবু—মানুষ সহ্যের শেষ সীমাটুকু যখন অতিক্রম করে যায়, আমি জানি, তখন সে মরীয়া হয়ে ওঠে—আর তখন তার পক্ষে কোন কাজই অসাধ্য থাকে क्रा।
কিরীটীবাবু!
বলুন?
সত্যিই কি আপনি–
কি?
মনে করেন আমাদের মধ্যেই কেউ–
এই বাড়ির মধ্যে সে-রত্রে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যেই একজন।
কে?
আপনিই ভেবে দেখুন না কে হতে পারে!
ফণীন্দ্ৰ অতঃপর হঠাৎ যেন চুপ করে গেল। একটু পরে যেন কেমন চোরের মত নিঃশব্দে ফণীন্দ্র ঘর থেকে বের হয় গেল।
কিরীটী চেয়ে থাকে তার গমনপথের দিকে।
ডান পা-টা টেনে টেনে ফণীন্দ্র ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এসেছিল একটা প্রতিবাদ জানাতে, এখন যেন ভীত চোরের মত মাথা নীচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কালো রঙের গ্রেট কোটটা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল বাগানের মধ্যে।
বাগানে একটা গাছের ডালের সঙ্গে বুলিছিল, একজন পুলিসেরই বাগানটা অনুসন্ধান করতে করতে চোখে পড়ে। কোটটা হাতে পুলিসটা কিরীটীর ঘরেই এসে ঢুকল।
চৌবেজীও ওই সময় কিরীটীর ঘরের মধ্যে বসেছিল। চিত্রাঙ্গদা দেবীর হত্যার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিল।
ইতিমধ্যে আরো একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল। পুলিস-প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে হঠাৎ গতরাত্রে সুধন্য ইন্দ্ৰালয় থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেচারা বেশি দূরে যেতে পারেনি। কাতরাসগড় ছাড়িয়ে তেতুলিয়া হল্টের কাছাকাছি পরের দিনই সন্ধ্যায়ই সুধন্য ধরা পড়ে যায়।
সুধন্যকে পুলিস ধরে নিয়ে এসেছে।
চৌবেজীর ইচ্ছা ছিল সুধন্যকে নিয়ে গিয়ে একেবারে হাজতে পোরেন; কারণ তাঁর ধারণা চিত্রাঙ্গদা দেবীর হত্যাকারী আর কেউ নয়—এই সুধন্যই।
কিন্তু কিরীটী বলেছে, না চৌবেজী, তাড়াহুড়ো করে কিছু করবেন না।
আপনি বুঝতে পারছেন না মিস্টার রায়,–চৌবেজী বলেছিলেন, ওকে ছেড়ে রাখলে বিপদ হবে।
কিছু হবে না। আমি বলছি। কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে।
কিন্তু গ্যারান্টিই বা কি?
গ্যারান্টি ওর নিজের চরিত্র।
বুঝলাম না। আপনার কথাটা মিস্টার বায়!
ও পালিয়ে যেতে পারে না-পালাবার মত শক্তি ওর নেই।
কিন্তু–
আমি আপনাকে আগেই বলেছি। চৌবেজী—আবারও বলছি, হত্যাকারী ও নয়।
তাই যদি নয় তো ওকে ছেড়ে দিলেই তো হয়, নজরবন্দী করে রাখবারই বা দরকার কি?
দরকার আছে। যে দাবাখেলা আমরা শুরু করেছি, সেই দাবার ছকেরই ও জানবেন মোক্ষম একটি ঘুটি—একটি বোড়ে। সেই বোড়ের চালটি ঠিক সময়মত যখন দেব, দেখবেন সমস্ত কুয়াশা কেটে গেছে।
কুয়াশা!
হ্যাঁ—লক্ষ্য করেছেন, আজ কদিন থেকেই ভোরের দিকে কি ঘন কুয়াশা নামছে! হঠাৎ কিরীটী বলে ওঠে।
হ্যাঁ, দেখেছি। কথাটা বলে চৌবেজী কেমন যেন বোকার মত ফ্যালি-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কিরীটীর মুখের দিকে।
আজও চৌবেজী আবার এসেছিল সুধন্যকে হাজতে নিয়ে গিয়ে পোরবার জন্য, কারণ ধরা পড়বার পর সুধন্যকে আবার এনে ইন্দ্ৰালয়ের মধ্যে নজরবন্দী রাখা হয়েছিল কিরীটীরই অনুরোধে। যদিও চৌবেজীর এতটুকু ইচ্ছা ছিল না। সুধন্যকে আবার ইন্দ্ৰালয়ে ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করতে তিনি পারেননি। ওখানকার এস. পি. মিঃ সুন্দরায় চৌবেজীকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, কিরীটী যেমন বলবে, তাই যেন চৌবে করেন।
চৌবেজী বলেছিলেন, খুনীকো এই কোঠিমে রাখনা আচ্ছা নেহি!
লেকিন চৌবেজী, ম্যায়নে ত বহুত দফে কহা চুকা, উয়ো মুজলিম নেহি হ্যায়। কিরীটী বলে।
ম্যায়নে ভি ত ইতনা সাল বহি কাম কর রাহা হ্যায়—আগর উয়ো মুজলিম নেহি হোগা তো—ম্যায় পুলিসকো নোকরি ছোড় দুঙ্গা।
কিরীটী হাসে।
আর ঠিক সেইসময় পুলিসটা কোটটা নিয়ে ঘরে ঢোকে, হুজুর, দেখিয়ে ইয়ে পেরকা উপর সে মিলা!
চৌবেজী বিশেষ কোন আগ্রহ দেখান না ব্যাপারটায়। ওভারকেটটা কিরীটী যখন অনুসন্ধানের কথা বলেছিল, তখনো বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করেননি চৌবেজী।
চৌবেজী বলেন, রাখি দো-আভি—
পুলিসটি চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কিরীটী বাধা দিল। ডাকল, দেখি, দাও তো কোটাটা।
পুলিসটা কোটা কিরীটীর হাতে তুলে দিল।
কিরীটী প্রথমেই কোটটার পকেটগুলো ভাল করে পরীক্ষা করে একটার পর একটা–উল্লেখযোগ্য কিছুই মেলে না।
মেলে–একটা রুমাল, একটা দেশলাই আর একটা সিগারেট-কেস।
চৌবেজী চেয়ে চেয়ে কিরীটির ব্যাপারটা দেখছিলেন-ঠোঁটের কোণে একটা অবজ্ঞার হাসির ক্ষীণ বিদ্যুৎ যেন।
কেয়া রায় সাহাব, কুছ মিলা?
কিরীটী কোন জবাব দেয় না। ওভারকেটটার কলারের কাছ থেকে একটা চুল টেনে বের করছে তখন সে।
চুলটা টেনে বের করে নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ সোঁকে।
কি দেখছেন চুলটা নিয়ে অত রায় সাহেব,-চৌবেজী আবার বলে ওঠেন, বহি বালসেই কেয়া আপকো মালুম হো জায়গা খুনী কৌন?
কিরীটী ফিরে তোকাল এবার চৌবেজীর মুখের দিকে। কিরীচীর দু-চোখের দৃষ্টিতে যেন বিদ্যুতের আলো ক্ষণেকের জন্য ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
শান্ত গলায় সে বলে, বেশখ, এই চুলটা থেকেই খুনীর পাত্তা আমি পেয়ে গেছি। চৌবেজী।
সাচ?
হ্যাঁ, মুঝে মিল গিয়া।
কোন থা উয়ো?
দো দিন বাদ আপকো বাতায়েঙ্গে।
সাচ?
জরুর।
কেয়া ম্যায়নে হ্যাণ্ডকাফ লাউ?
আগর আপকো দিল চাহে ত— আচ্ছা চৌবেজী, আমার একটু কাজ আছে। বলতে
চৌবেজীকেও অগত্যা উঠে দাঁড়াতে হয়।
তাহলে ওই কথাই রইল, কাল আসবেন—সকলেই-আচ্ছা নমস্তে।
কিরীটী আর দাঁড়াল না, মধ্যবর্তী দরজাপথে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। চৌবেজী তারপরও কয়েক সেকেণ্ড ঘরের মধ্যে একা একা দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে দরজার দিকে অগ্রসর হল।
ওই দিনই সন্ধ্যার দিকে কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে বসে একটা বই পড়ছিল, মণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল।
এদিকে ওদিকে চাইতে চাইতে মণীন্দ্র ঘরে এসে ঢুকল।
মিস্টার রায়!
আসুন মণীন্দ্রবাবু, আমি গত দুদিন ধরে আপনারই অপেক্ষা করছিলাম। কিরীটী হাতের বইটা মুড়তে মুড়তে মণীন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল।
আমার অপেক্ষা করছিলেন?
মণীন্দ্র কেমন যেন একটু বিস্মিত হয়েই প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ, আপনারই পথ চেয়ে ছিলাম বলতে পারেন। কিন্তু দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
মণীন্দ্র বসে না, কেমন যেন ইতস্তত করে।
আমি জানতাম মণীন্দ্রবাবু, আপনি আসবেন—বসুন।
আপনি জানতেন আমি আসব?
হ্যাঁ, জানতাম। কিন্তু–
বসুন। মণীন্দ্র মুখোমুখি বসল চেয়ারটায়। সে যেন কেমন চিন্তিত মনে হয়।
কি ভাবছেন—যা বলতে এসেছেন, বলুন। ভয় নেই। আপনার, নিৰ্ভয়ে বলুন।
মিস্টার রায়, ফণী এসেছিল আপনার কাছে, তাই না?
হ্যাঁ
কি বলেছে সে?
অনেক কিছুই বলেছেন, যা পুলিসের কাছে জবানবন্দিতে সে-সময় তিনি বলেননি। তাহলে সে সব কিছু বলে দিয়েছে। আপনাকে?
হ্যাঁ, সব।
উইল বদলের কথা?
উইল!
হ্যাঁ, বড়মা যে সেদিন তাকে বলেছিলেন, তিনি তঁর আগের উইল বদলে ফেলবেন! বলেছেন বৈকি।
কথাটা অবিশ্যি বড়মা আমাদের তিন ভাইকেই জানিয়েছিলেন।
কিরীটীর চোখের মণি দুটো সহসা যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু মণীন্দ্রর সেটা নজরে এড়ায় না।
আপনাকে কবে বলেছিলেন কথাটা তিনি?
যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে, সেদিনই সন্ধার সময়, যখন স্বাতীর জন্য আমি বড়মাকে অনুরোধ জানাতে যাই—
কি বলেছিলেন তিনি ঠিক?
স্বাতীর বিয়ের কথা বলতেই হঠাৎ তিনি চটে উঠলেন। বললেন, তোমাদের যার যা খুশি তোমরা করতে পার—যেখানে যার খুশি তোমরা এই মুহুর্তে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পার। পথের ভিখারী—তোমাদের এনে ক্ষীর আর ঘিয়ের বাটি মুখে তুলে দিয়েছিলাম। এখন দেখছি সে দয়াটা তোমাদের প্রতি দেখানেই আমার ভুল হয়েছে। পথের কুকুর চিরদিন পথের কুকুর থাকে—তাই সব থাকো গে। দূর হয়ে যাও সব এখান থেকে, তোমাদের কারো সঙ্গেই আমার কোন সম্পর্ক নেই—“কালই আমি নতুন উইল করে তোমরা কেউ যাতে একটি কপর্দকও না পাও সে ব্যবস্থা করছি।
তারপর?
আমারও হঠাৎ রাগ হয়ে গেল—আমিও কড়া কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলাম বড়মাকে।
কি বলেছিলেন তাতে তিনি?
বলেছিলেন, তোমাদের সব চাবুক মারা উচিত থামের সঙ্গে বেঁধে, নিমকহারাম কুত্তার দল! তাতে আমি বলেছিলাম–
কি?
তাহলে তোমাকে জ্যান্ত রাখব না জেনো।
বলেছিলেন আপনি?
হ্যাঁ—যা কোনদিন হয় না—হঠাৎ যেন মাথার মধ্যে আমার আগুন জ্বলে উঠেছিল। পরে নিজেই অবাক হয়েছি কি করে বলতে পারলাম ও কথাগুলো বড়মাকে!
মারতে মারতে নিরীহ একটা বিড়ালছনাকে কোণঠাসা করলে, সেও শেষ পর্যন্ত থাবা তুলে নখর বের করে শেষবারের মত ঝাঁপিয়ে পড়বার চেষ্টা করে মণীন্দ্রবাবু, আপনিও ঠিক তাই করেছিলেন।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে আমার মনের কথা নয়-রাগের মাথায় যাই বলে থাকি না কেন—
কিরীটী মৃদু হাসে।
মণীন্দ্র বলে, তাকে হত্যা করব আমাদের স্বপ্নেরও অতীত।
মণীন্দ্রবাবু, একটা কথা–
মণীন্দ্র কিরীটীর দিকে তাকাল।
সে-সময় ঘরে আর কে ছিল মনে আছে আপনার?
সুরুতিয়া ছিল।
আর কেউ না?
না, তবে বের হয়ে যাবার মুখে জয়ন্তদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে দরজার কাছেই। দাঁড়িয়েছিল, তাই মনে হয়–
কি?
সেও আমাদের সব কথা শুনেছিল।
ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন।
কিরীটীবাবু!
বলেন?
আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, আমাদের ভাইদের মধ্যেই কেউ একজন–
সেটা ভাবাই তো স্বাভাবিক।
কেন?
কারণ তাঁর পূর্বের উইল বদল করবার ইচ্ছাটা। সেই আশঙ্কায় তাঁকে আপনাদের হত্যা করাটা খুবই তো স্বাভাবিক।
না না, তাই বলে হত্যা করব?
মানুষ মানুষকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, একমাত্র দুর্ধর্ষ ক্রিমিন্যাল ছাড়া, চরম কোন উত্তেজনার মুহুর্তেই হত্যা করে বসে বা চরম আঘাত হেনে বসে।
মণীন্দ্র আর কোন কথা বলে না।
ধীরে ধীরে একসময় নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
আর কিরীটীও যেন নিজের চিন্তায় নিজে ড়ুবে যায়।
তার পরদিনই ভোরবেলা কিরীটী কলকাতায় চলে গেল এবং একদিন পরে আবার সন্ধ্যায় ফিরে এল।
কাল—আগামী কালই, কিরীটী চৌবেজীকে বলেছে আততায়ীকে ধরিয়ে দেবে।
কিরীটী ফিরে এসেছে শুনে জয়ন্ত চৌধুরী তার ঘরে এসে ঢোকে।
আসুন জয়ন্তবাবু।
মিস্টার রায়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এলাম।
কি বলুন তো?
এভাবে কতদিন আর নজরবন্দী হয়ে এই ইন্দ্ৰালয়ে থাকতে হবে?
দুঃখের রাত্রি অবসান-প্রায়?
অবসান-প্রায়?
হ্যাঁ। বসুন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
তারপর কিরীটী ও জয়ন্তর মধ্যে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে কথাবার্তা হল এবং রাত পৌনে আটটা নাগাদ জয়ন্ত কিরীটীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী তার ক্লান্ত দেহটা আরামকেদারার ওপর শিথিল করে দেয়।
পরের দিন রাত্রে।
রাত তখন বারোটা বেজে গিয়েছে।
সমস্ত ইন্দ্ৰালয় যেন একেবারে নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে গিয়েছে। কিরীটী আলো জ্বেলেই শুয়ে ছিল শয্যার ওপর চোখ বুজে। ঘুমোয়নি। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে দেখে শয্যা হতে উঠে পড়ল।
প্রস্তুত হয়েই ছিল সে। উঠে প্রথমেই ঘরের আলোর সুইচটা টিপে নিভিয়ে দিল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
বাইরের বাগানে ঝি ঝি ডাকছে। একটানা বিবির শব্দ নিযুতি রাতের কান্নার মতই যেন মনে হয়।
অন্ধকারেই কিরীটী তার শয়নঘরের মধ্যস্থিত গুপ্ত দরজা খুলে—যে দরজাপথে জয়ন্ত তাকে প্রথম রাতে গোপনে অন্য একটা সিঁড়ি দিয়ে চিত্রাঙ্গদা দেবীর বসবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যায়।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর বসবার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কিরীটী।
দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কিরীটী বন্ধ দরজাটার গায়ে টুক টুক টুক করে পর পর তিনটি মৃদু টোকা দিল। ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল।
ঘর অন্ধকার।
কিরীটী চট করে ঘরের দরজা খুলতেই ভেতর ঢুকে যায়।
কে?
কিরীটি সে-কথার কোন জবাব না দিয়ে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
সামনেই দাঁড়িয়ে সুরতিয়া।
বাবুজী আপ?
হ্যাঁ সুরতিয়া, তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
কেয়া আপ পুঝনে চাহতে হে বাবুজী মুঝসে?
কিরীটী সুরতিয়ার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত, তারপর তার জামার পকেট থেকে সেদিন চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়নঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পাওয়া ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরোটা বের করে সামনে মেলে ধরে বলে, দেখ তো সুরতিয়া, এটা কি।
সুরতিয়া একটু যেন অবাক হয়ে কিরীটীর হাতের পাতায় ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরোটার দিকে তালিয়ে পালটা প্রশ্ন করে, কেয়া!
বুঝতে পারছ না?
মালুম হোতা হ্যায় চুড়িয়া কি টুকরা!
ঠিক। কিন্তু কোথায় পেয়েছি জান এটা?
কোথায় বাবুজী?
সে-রাত্রে রাণীমার ঘরের মেঝেতে। রাণীমার হাতে তো কাচের চুড়ি ছিল না। আর তোমার দিদিমণির হাতেও নেই—আছে দেখছি তোমার হাতে।
কেয়া মতলব?
বুঝতে পারছি না। সুরতিয়া?
নেহি তা!
এটা তোমারই হাতের একটা ভাঙা চুড়ির টুকরো।
আমার?
হ্যাঁ যেটা সে-রাত্রে ভেঙে ঘরের মধ্যে পড়েছিল হয়তো।
আমার চুড়ি-ভাঙা!
হ্যাঁ, তোমারই। আর এটা কখন ভেঙেছিল জান?
কখন?
সে-রাত্রে-গণেশকে ডেকে দেবার পর, গণেশ তোমার রাণীমার ঘরে ঢুকে জয়ন্তবাবুকে ডাকতে বের হয়ে যাবার পর। এখন বল সে-রাত্রে রাণীমার নির্দেশে গণেশকে ডেকে দেবার পর তুমি কোথায় গিয়েছিলো।
কেন, নীচে বাগানে যেখানে গানবাজনা হচ্ছিল–
না।
বিশোয়াস কিজিয়ে বাবুজী–
নেহি, তুম ঝুট কহোঁতে হো।
ঝুট!
হ্যাঁ বুট—সাচ্ সাচ্ বাতাও।
লেকেন বাবুজী–
সাচ্ বাত ছুপানেসে কুছ ফায়দা নেহি হোগা—বাতাও—
সুরতিয়া বোবাদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী বলে চলে, গণেশকে ডেকে দিয়ে সোজা তুমি বাগানে যাওনি সে-রাত্রে। কোথায় গিয়েছিলে বল?
সুরতিয়া চুপ।
আমার ধারণা যদি মিথ্যে না হয় তো সে-রাত্ৰে তুমি নীচে আমার ঘরে ঢুকে যে পথ দিয়ে এইমাত্র আমি এসেছি, সে পথ দিয়ে গোপনে ওপরে উঠে আসো—, তারপর বল তুমি কি করেছ?
আপনার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না বাবুজী। আমি কেন আবার ওপরে আসব?
এসেছিলে তোমার কাজে এবং তার প্রমাণও আছে।
লোকেন। কিউ?–
কিউ? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, সুধন্য কে?
সুধন্য!
বল সে কে?
ওকে আমি চিনি না।
চেন।
নেহি!
আমি তাহলে বলি সুধন্য তোমার কে, তোমার ছেলে।
বাবুজী!
হ্যাঁ-রাজাবাবুর ঔরসে তোমার গর্ভে ওর জন্ম।
না, না–
আর্ত চিৎকার করে ওঠে সুরতিয়া।
হ্যাঁ, তোমার ছেলে। আর সেকথা তোমার রাণীমাও জানতেন বলেই নিজের স্বামীর লজ্জাকে ঢাকবার জন্য-নিজের আভিজাত্যকে বাঁচানোর জন্য তোমার এবং পাছে তুমি সব কথা প্রকাশ করে দাও, সেই ভয়ে সুধন্যকে থেকে থেকে টাকা দিয়ে এসেছেন বারবার। কেমন, তাই নয় কি!
সুরতিয়া একেবারে নিশ্চুপ।
সুধন্য তোমার ছেলে অবিশ্যি সে কথাটা এখনো জানে না। কিন্তু তোমার ব্ল্যাকমেলিং ক্রমশঃ যখন দিনের পর দিন বেড়েই চলতে লাগল, তখন তিনি আক্রোশের মাথায় বলে বসেন উইল তিনি বদল করবেন—যে উইলে সুধন্যরও একটা মোটা শেয়ারের ব্যবস্থা ছিল তার সম্পত্তির–
কিরীটীর কথা শেষ হল না—একে একে ওই সময় ঘরে এসে ঢুকল জগদীন্দ্র, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র, স্বাতী, যোগেনবাবু, চৌবেজী ও সবশেষে জয়ন্ত।
এই যে আসুন আপনারা।
হঠাৎ জয়ন্তকে ঘরে ঢুকতে দেখে যেন একটা ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতই কোমর থেকে ধারালো একটা ছোরা বের করে জয়ন্তর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুরতিয়া।
বেইমান।
সকলে মিলে সুরতিয়াকে ধরে ফেলবার আগেই ছোরাটা জয়ন্তর হাতে বিঁধে গিয়েছিল তবে বেশী আঘাত লাগেনি।
চৌবেজী ও মণীন্দ্র দুজনে সুরতিয়াকে দু হাতে শক্ত করে ধরে ফেলেন।
সুরতিয়া তখনো ক্ষিপ্ৰ বাঘিনীর মত চেঁচাচ্ছে, ছোড় দো—ছোড় দো মুঝে-ও বেইমানকে হাম খতম কর দুঙ্গি।
চৌবেজীর ইঙ্গিতে দুজন পুলিস এসে ধরে সুরতিয়াকে।
কিরীটী বলে, বলেছিলাম চৌবেজী, আততায়ীকে আজ ধরিয়ে দেব। হাতকড়া লাগান, সে-রত্রে সুরতিয়াই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করেছিল আর ঐ ছোরাটা দিয়েই।
ঘরের মধ্যে যেন সহসা বজ্রপাত হল।
সকলেই স্তম্ভিত, নির্বাক।
আরো কিছুক্ষণ পরে—সুরতিয়াকে পুলিস-ভ্যানে তুলে হাজতে পাঠাবার পর চিত্রাঙ্গদা। দেবীর ঘরে বসেই কিরীটী ওদের সকলকে সমস্ত কাহিনী বিবৃত করে।
কিরীটী বলতে থাকে, প্রথম দিনই চিত্রাঙ্গদা দেবী সুধন্যকে নিয়ে তাঁর শয়নঘরে চলে যাবার পর চিত্রাঙ্গদা দেবীর স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ফটোটার দিকে আমার নজর পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের পাতায় ভেসে ওঠে সুধন্যর মুখটা।
দুটো মুখের মধ্যে আশ্চর্য মিল!
তারপরই সুধন্যকে ওইভাবে চিত্রাঙ্গদা দেবীর কাছে বার বার এসে টাকার দাবি করা ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা মনের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকে আমার।
বুঝতে পেরেছিলাম আমি—কোন গূঢ় কারণ না থাকলে চিত্রাঙ্গদা দেবীর মত মানুষ সুধন্যকে টাকা দেয় না। বিশেষ করে যাকে তিনি সবচাইতে বেশী ঘৃণা করতেন।
ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কি সে কারণ-কি?
তারপর শুনলাম ভূপৎ সিং ও তার স্ত্রী সুরতিয়ার কথা ও সুরতিয়ার প্রতি জিতেন্দ্র চৌধুরীর আকর্ষণের কথাটা।
সঙ্গে সঙ্গে যেন দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
জয়ন্ত প্রশ্ন করে, কিন্তু ওকে আপনি সন্দেহ করলেন কি করে?
কিরীটী বলে, নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, আমি বার বার বলেছি সে-রাত্রে বিশেষ কোন পরিচিত জন, যার এ বাড়ির মধ্যে অবাধ গতিবিধি, তাদেরই কেউ একজন চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করেছে!
হ্যাঁ।
এবারে মনে করে দেখুন, সেরকম এ বাড়িতে কে কে ছিল—ওঁরা চার ভাই ও আপনি ছাড়া আর একজন, সে হচ্ছে ঐ সুরতিয়া—যে রাণীমার একপ্রকার প্রত্যক্ষ সহচরী ছিল সৰ্বক্ষণের। মণীন্দ্রবাবু ও জগন্দ্রীবাবুকে অনায়াসেই বাদ দিয়েছি, কারণ ওই সময় তারা গানের আসরে ছিলেন। অর্থাৎ যে সময় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শচীন্দ্র ও ফণীন্দ্রবাবুকে পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাদ দিই সন্দেহের তালিকা থেকে।
তাছাড়া ওঁরা চারজন আর যাই করুন, হত্যা করবার মত নাৰ্ভ বা মনের জোর তাদের কারোরই ছিল না। তাহলে বাকি থাকে দুজন—জয়ন্তবাবু ও সুরতিয়া। এবং ওদের দুজনের মধ্যে সবচাইতে সে-রাত্রে হত্যা করবার সুবিধা কার বেশী ছিল! সেটা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল সুরতিয়ার একটা কথা, কালো কোট পরিহিত যে লোকটিকে সুরতিয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে দেখেছিল তাকে নাকি তার জয়ন্তবাবু বলে মনে হয়েছিল।
তারপর? জয়ন্তই জিজ্ঞাসা করে।
অসাধারণ বুদ্ধিমতী ও দুঃসাহসিকা ছিল সুরতিয়া। কিন্তু সে একটা মারাত্মক ভুল করে— জয়ন্তবাবুর নাম করে ও কালো কোটের কথা বলে তার উপরে সন্দেহটা ফেলার জন্য। ওই কালো কোটের কথা না বললে, তত শীঘ্র সুরতিয়ার ওপরে গিয়ে সমস্ত সন্দেহ আমার হয়ত পড়ত না। বুঝলাম, কোটটার সঙ্গে রহস্য জড়িয়ে আছে। আর সুরতিয়াও ভেবেছিল, কেটের কথা বললে কোটের অনুসন্ধান আমরা করব, এবং পরে যদি প্রমাণিত হয় কোটটা জয়ন্তবাবুর তাহলে তারই ওপর গিয়ে সকলের সন্দেহ পড়বে। সেই জন্যেই বা সেই উদ্দেশ্যেই সুরতিয়া ওইদিন হয়তো কোনো একসময় জয়ন্তর ঘরে ঢুকে কোটটা চুরি করে নিয়ে এসে গোপনে সিড়ির ঘরে লুকিয়ে রেখে দেয়।
উ, কি শয়তানী! মণীন্দ্ৰ বলে।
শয়তানির চাইতেও সে রাণীমার উইল বদলের কথা শুনে যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলকারণ সে বুঝতে পেরেছিল। আপনাদের কারো জন্যই নয়—ঐ সুরতিয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই তিনি পূর্বের উইল বদলাতে মনস্থ করেছিলেন—যে উইলে হয় তা ঐ সুরতিয়ার চাপে পড়েই বাধ্য হয়ে একদিন তাকে উইলের মধ্যে সুধন্যর একটা ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তার লজ্জার গোপন কীটা ঐ সুধন্য—যে লজ্জা চিরদিন তার মনের মধ্যে গোপন রক্তক্ষয় করিয়েছে।
সুরতিয়া অস্থির হয়ে উঠলো। হয়ত রাণীমাকে সে নিরস্ত করবারও চেষ্টা করেছে, তারপর, কিন্তু পারেনি—তখনই হয়ত মনে মনে রাণীমাকে সে হত্যার সংকল্প নেয় এবং সুযোগও এসে গেল তার অপ্রত্যাশিত ভাবে ঐ উৎসবের রাত্রেই।
অন্যান্য রাত্রের মত রাণীমা যে শেষ পর্যন্ত উৎসবে না উপস্থিত থেকে রাত দশটা নাগাদ ফিরে আসবেন তা সে জানত ও প্রস্তুত হয়েই ছিল—হলও তাই। রাণীমা রাত সোয়া দশটা নাগাদ যখন ফিরে এলেন—সুরতিয়া তখন দরজার আড়ালে ছোরা হাতে ওৎ পেতে আছে। রাণীমা যেই ঘরে ঢুকেছেন, সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে রাণীমাকে ছোরা মারে সুরতিয়া।
জয়ন্ত প্রশ্ন করে, তাহলে গণেশ কার সঙ্গে দেখা করে কথা বলল?
গণেশ ভয়ে মিথ্যে কথা বলেছে। আন্দেী সে রাণীমার সঙ্গে দেখা করেনি। ঘরের ভিতর থেকেই সুরতিয়াই রাণীমার গলার স্বর নকল করে জয়ন্তকে ডেকে আনতে বলে আমার ধারণা। তাই না গণেশ? তুমি ঘরে ঢুকেছিলে কি?
আঙ্কে না, বাবু।
কিরীটী আবার শুরু করে, গণেশ চলে যাবার পরই ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সুরতিয়া বাগানে চলে যায়, রাণীমাকে হত্যা করে গোপন সিঁড়িপথ দিয়ে নীচে নেমে গিয়ে গণেশকে ডেকে দিয়ে আবার গোপন সিঁড়িপথ ধরেই তাড়াতাড়ি সুরতিয়া ফিরে এসেছিল, গণেশ রাণীমার ঘরের সামনে পৌঁছবার আগেই—আমার ঘর দিয়ে।
জয়ন্তবাবুকে কাল সন্ধ্যায়ই সব কথা আমি খুলে বলি। এবং এও বলি, সুরতিয়া এখন পালাবার চেষ্টা করছে এবং করবেই। কিন্তু পুলিসের জন্য সে পারছে না পালাতে। জয়ন্তবাবুকে বলে দিই, সুরতিয়ার সঙ্গে গিয়ে প্রেমের অভিনয় করে তাকে বলবেন সুরতিয়াকে তিনি ভালবাসেন—পুলিস তাকে সন্দেহ করছে—তারা পালাবে। সুরতিয়া হাতে স্বৰ্গ পেল-রাজী হয়ে গেল। জয়ন্তবাবুর অভিনয়মত সুরতিয়া প্রস্তুত হয়েই ছিল—কথা ছিল রাস্ত বারোটায় এসে জয়ন্তবাবু ঘরের দরজায় টোকা দেবেন। তিনবার।
সুরতিয়া টোপটা সহজেই গিলে ফেলে। তার পরের ব্যাপারও সবই আপনারা জানেন।
জয়ন্ত এবারে প্রশ্ন করে, কিন্তু সুরতিয়া যে আমার কোটটা ব্যবহার করেছিল, জানলে কি করে?
কোটের কলারে একটা স্ত্রীলোকের চুল লেগেছিল, সেই চুলে ছিল সুরতিয়ার মাথার তেলের গন্ধ। একটা উগ্র তেল সুরতিয়া ব্যবহার করত। গন্ধটাতেই আমি ধরতে পারি ব্যাপারটা।
কিরীটী থামল।
কিন্তু সুধন্য কোথায়?
বাড়িতে এত কাণ্ড-সে কি জানতে পারেনি?
গণেশকে খোঁজ নিতে পাঠাল কিরীটী।
একটু পরে গণেশ এসে বলল, সুধন্য ঘুমোচ্ছে।
কিরীটী মৃদু হাসল।