ডিসেম্বরের শেষের শীতের রাত্রি।
কুয়াশার ধুসর ওড়নার আড়ালে আকাশে যেটুকু চাঁদের আলো ছিল তাও যেন চাপা পড়ে গেছে।
মিনিট কয়েক হয় মাত্র এক্সেপ্রেস ট্রেনটা ছেড়ে চলে গেল? গাড়ির পিছনকার লাল আলোটা এতক্ষণ যা দেখাচ্ছিল একটা রক্তের গোলার মত, এখন সেটাও কুয়াশার অস্বচ্ছতায় হারিয়ে গেছে।
স্টেশনের ইলেকট্রিক বাতিগুলো কুয়াশার আবরণ যেন ভেদ করে উঠতে পারছে না।
ধানবাদ স্টেশনের লাল কঁকর-ঢালা চওড়া প্ল্যাটফরমটা জনশূন্য।
একটু আগে ট্রেনটা থামার জন্য যে সামান্য চঞ্চলতা জেগেছিল এখন তার লেশমাত্রও নেই।
একটা থমথম করা স্তব্ধতা চারিদিকে যেন।
জুতার মচ্ মচ্ শব্দ জাগিয়ে দুই জন ভদ্রলোক প্ল্যাটফরমের উপর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে বেড়াচ্ছে।
একজন বেশ লম্বা বলিষ্ঠ চেহারার, পরিধানে কালো রংয়ের দামী সার্জের স্যুট। তার উপর একটা লং কোট চাপান। মাথায় পশমের নাইট্ কাপ, কান পর্যন্ত ঢাকা।
অন্যজন অনেকটা খাটো। পরণে ধূতি, গায়ে মাথায় একটা শাল জড়ান। মুখে একটা জ্বলন্ত বিড়ি।
চা-ভেণ্ডার তার চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে এল, বাবু, গরম চা। গরম চা?…
না, প্ৰথম ব্যক্তি বললে।
গলার স্বরটা বেশ ভারী ও মোটা।
চা-ভেণ্ডার চলে গেল।
দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে ফিরে প্রথম ব্যক্তি প্রশ্ন করলে, সুশান্তবাবু যেন খুন হলেন কবে?
গত ২৮ শে জুন রাত্রে।
আজ পর্যন্ত তাহলে তাঁর মৃত্যুর কোন কারণই খুঁজে পান নি?
না, খুনীকে খুঁজতেও তো কসুর করলাম না। আমাদের কুলী গ্যাং, কর্মচারীরা, মায় পুলিস অফিসাররা পর্যন্ত খুঁজে খুঁজে। সবাই হয়রাণ হয়ে গেছেন।
আশ্চর্য!
তা আশ্চর্য বৈকি! পর পর তিনজন ম্যানেজার এমনি করে কোয়ার্টারের মধ্যে খুন হলেন। আমরা তো ভেবেছিলাম, এরপর কেউ আর এখানে কাজ নিয়ে আসতেই চাইবেন না। হাজার হোক একটা প্যানিক (ভীতি) তো, বলে লোকটি ঘন ঘন প্ৰায়-শেষ বিড়িটায় টান দিতে লাগল।
শংকর সেন মৃদু হেসে বললেন, আমি লয়াবাদে একটা কোলিয়ারিতে মোটা মাইনের চাকরী করছিলাম। তাহলে কথাটা আপনাকে খুলেই বলিঐ যে ভয়ের কথা কি বললেন—আমাদের বড়বাবুর মুখে এখানকার ঐ ভয়ের ব্যাপারটা শুনে চার মাসের ছুটি নিয়ে এই চাকরীতে এসে জয়েন করেছি—।
কিন্তু—
ভয় নেই, পছন্দ হলো থেকে যাবো।
আপনার খুব সাহস আছে দেখছি শংকরবাবু!
শুধু আমিই নয়–শংকর সেন বলতে লাগলেন, আমার এক কলেজ ফ্রেণ্ডকেও লিখেছি আসতে। বর্তমানে সে সখের গোয়েন্দাগিরি করে। যেমন দুর্দান্ত সাহস, তেমন চুলচেরা বুদ্ধি। কেননা আমার ধারণা। এইভাবে পরপর আপনাদের ম্যানেজার নিহত হওয়ার পিছনে ভৌতিক কিছু নেই, আছে কোন শয়তানের কারসাজী।
বলেন কি সারা? আমার কিন্তু ধারণা এটা অন্য কিছু।
অন্য কিছু মানে? শংকর সেন বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।
যে জমিটায় ওঁরা অর্থাৎ আমাদের কর্তারা কোলিয়ারী শুরু করতে ইচ্ছা! করেছেন, ওটা একটা অভিশপ্ত জায়গা। ওখানকার আশে-পাশের গ্রামের সাঁওতালদের কাছে শুনেছি, ওই জায়গাটায় নাকি বহুকাল আগে একটা ডাকাতের আড্ডাখানা ছিল, সেই সময় বহু লোক ওখানে খুন হয়েছে। সেই সব হতভাগ্যদের অদেহী অভিশপ্ত আত্মা আজও ওখানে দিবারাত্ৰি নাকি ঘুরে বেড়ায়।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, কতদিন রাত্রে বিশ্ৰী কান্না ও গোলমালের শব্দে আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। আবছা চাদের আলোয় মনে হয়েছে যেন হালকা আবছা কারা মাঠের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অল বোগাস। দাঁতে দাঁত চেপে শংকর সেন বললে।
আমি জানি স্যার, ইংরাজি শিক্ষা পেয়ে আপনারা আজ এ সব হয়ত বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি। মরণই আমাদের শেষ নয়। মরণের ওপারে একটা জগত আছে এবং সে জগতের যারা বাসিন্দা তাদেরও প্ৰাণে ওই মাটির পৃথিবীর লোকেদের মতই দয়া, মায়া, ভালবাসা, আকাঙ্খা, হিংসা প্রভৃতি অনুভূতিগুলো আছে এবং মাটির পৃথিবী ছেড়ে গেলেও এখানকার মায়া সহজে তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না।
একটানা কথাগুলো বলে বিমলবাবু, একটা বিড়ি ধরিয়ে প্ৰাণপণে টানতে লাগলেন।
কই, আপনার বাসের আর কত দেরী?
এই তো আর মিনিট কুড়ি বাকী।
চলুন রেস্টুরেন্ট থেকে একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক।
আজ্ঞে চায়ে আমার নেশা নেই।
তাই নাকি? বেশ। বেশ। কিন্তু এই শীতে চা-বিনে থাকেন কি করে?
আজ্ঞে, গরীব মানুষ।
দুজনে এসে কেলনারের রেস্টুরেন্ট-এ ঢুকল, এবং চায়ের অর্ডার দিয়ে দুজনে দুখানা চেয়ার দখল করে বসল।
আপনি আপনার যে বন্ধুটির কথা বলছিলেন তাঁর বুঝি গোয়েন্দাগিরিতে খুব হুজুগ আছে?
হ্যাঁ, হুজুগই বটে। শংকরবাবু হাসতে লাগল।
হুঁ। ওই এক একজনের স্বভাব। নেই কাজ তো, খৈ ভাজ! তা বড় লোক বুঝি? টাকা কড়ির অভাব নেই, বসে বসে আজগুবি সব খেয়াল মোটান।
বেয়ারা চায়ের সরঞ্জাম রেখে গেল।
আসুন না বিমলবাবু। কেৎলি থেকে কাপে দুধ চিনি মিশিয়ে র চা ঢালতে ঢালতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে শংকর বললে, বড্ড ঠাণ্ডা, গরম গরম এক কাপ চা মন্দ লাগবে না।
আচ্ছা দিন, বিমলবাবু বলে, আপনার request মানে অনুরোধ।
শংকর বিমলবাবুকে এক কাপ চা ঢেলে দিল। চায়ের কাপে বেশ আরাম করে চুমুক দিতে দিতে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিমলবাবু শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তা আপনার সে বন্ধটির নাম কী?
নাম কিরীটী রায়।
কিরীটী রায়! কোন কিরীটী রায়? বৰ্মার বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্ৰমর প্রভৃতির যিনি রহস্য ভেদ করেছিলেন?
হ্যাঁ।
ভদ্রলোকের নাম হয়েছে বটে। কবে আসবেন তিনি?
আজই তো আসবার কথা ছিল, কিন্তু এলো না তো দেখছি। কাল হয়ত আসবে।
এমন সময় বাইরে ঘণ্টা বেজে উঠল।
বাস এসে গেছে।
বাস মানে একটা কমপার্টমেণ্ট এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়।
চা পান শেষ করে দাম চুকিয়ে নিয়ে দুজনে বাসে এসে উঠে বসল।
অল্পক্ষণ বাদেই বাস ছেড়ে দিল।
শীতের অন্ধকার রাত্রি কুয়াশার আবরণের নীচে যেন কুঁকড়ে জমাট বেঁধে আছে।
খোলা জানালা পথে শীতের হিমা শীতল হওয়া হু-হু করে এসে. যেন সর্বাঙ্গ অসাড় করে দিয়ে যায়। এতগুলো গরম জামাতেও যেন মানতে চায় না। দুজনে পাশাপাশি বসে চুপ চাপ।
কাতরাসগাড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি হচ্ছে ওদের গন্তব্য স্থান।
কাতরাসগড় স্টেশনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে যেতে হয় বেশ খানিকটা পথ।
রাত্রি প্রায় তিনটের সময় গাড়ী এসে কাতরাসগড় স্টেশনে থামল।
অদূরে স্টেশন ঘর থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে।
একটা সাঁওতাল কুলী এদের অপেক্ষায় বসেছিল।
তার মাথায় স্যুটকেশ ও বিছানাটা চাপিয়ে একটা বেবী পেট্রোমাক্স জ্বালিয়ে ওরা রওনা হয়ে পড়ল।
নিঝুম নিস্তব্ধ কনকনে শীতের রাত্রি।
আগে বিমলবাবু এগিয়ে চলেছে, হাতে তাঁর আলো, চলার তালে দুলছে।
আলোর একঘেয়ে সোঁ সোঁ আওয়াজ রাত্রির নিস্তব্ধ প্ৰান্তরে মৌনতা ভঙ্গ করছে। মাঝে মাঝে এক একটা দমকা হাওয়া হু-হু করে বয়ে যায়।
মাঝখানে শংকর। সবার পিছনে মোটঘাট মাথায় নিয়ে সাঁওতালটা।
একপ্রকার বেঁকের মাথায়ই শংকর এই কাজে এগিয়ে এসেছে। চিরদিন বেপরোয় জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। এ দুনিয়ায় ভয় ডর বলে কোন কিছু কোন প্রকার বিপদ আপদ তাকে পিছনটান ধরে রাখতে পারে নি। সংসারে একমাত্র বুড়ী পিসিমা। আপনার বলতে আর কেউ নেই। কে-ই বা বাধা দেবে?
বিমলবাবুর মুখ থেকেই শোনে কোলিয়ারীর ইতিহাসটা শংকর। বছর দুই আগে কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়ার মাঝামাঝি একটা জায়গার সন্ধান পেয়ে পুর্ববঙ্গের এক ধনী-পুত্র কোলিয়ারী করবার ইচ্ছায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই ম্যানেজার রামহরিবাবু একান্ত আশ্চর্যভাবে তার কোয়ার্টারে এক রাত্রে নিহত হন। দ্বিতীয় ম্যানেজার বিনয়বাবু কিছুদিন বাদে কাজে বহাল হন। দিন পনের যেতে না যেতে তিনিও নিহত হন। তারপর এলেন সুশান্তবাবু, তাঁরও ঐ একইভাবে মৃত্যু ঘটলো। পুলিশ ও অন্যান্য সবাই শত চেষ্টাতেও কে বা কারা যে এদের এমন করে খুন করে গেল তার সন্ধান করতে পারলে না। তিন তিন বারই একটি কুলি বা কর্মচারী নিহত হয়নি, তিনবারই ম্যানেজার নিহত হল। মৃত্যুও ভয়ঙ্কর। কে যেন ভীষণভাবে গলা টিপে হতভাগ্য ম্যানেজারের মৃত্যু ঘটিয়েছে, গলার দুপাশে দুটি মোটা দাগ এবং গলার পিছন দিকে চারটি কিলো কালো গোল ছিদ্র।
শংকর যেখানে কাজ করছিল। সেখানকার বড়বাবুর কাছে ব্যাপারটা শুনে একান্ত কৌতূহল বশেই নিজে এ্যাপ্লিকেশন করে কাজটা সে নিয়েছে চার মাসের ছুটি মঞ্জর করিয়ে।
এখানে রওনা হবার আগের দিন কিরীটিকে একটা চিঠিতে আগাগোড়া সকল ব্যাপার জানিয়ে, আসবার জন্য লিখে দিয়ে এসেছে।
কিন্তু এই নিশুতি রাতে নির্জন প্রান্তরের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে মনটা কেমন উন্মনা হয়ে যায়, কে জানে এমনি করে নিশ্চিত মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাল করল কি মন্দ করল।
অদূরে একটা কুকুর নৈশ স্তব্ধতাকে সজাগ করে ডেকে উঠল।
ওরা এগিয়ে চলে।
শংকর সেন কিরীটীর কলেজের বন্ধু, একই কলেজ থেকে ওরা বি, এস-সি পাশ করেছিল।
রসায়নে এম, এস-সি পাশ করে শংকর মামার বন্ধুর কোলিয়ারীতে কাজ নিয়ে চলে যায়। সেও দীর্ঘ পাঁচ বছরের কথা। কিরিটী তার আগেই রহস্যভেদের জালে পাক খেতে খেতে এগিয়ে গেছে অনেকটা। বছর দুই আগে কলকাতায় দুজনের একবার ইষ্টারের ছুটিতে দেখা হয়েছিল।
তারপর কেউ কারো সংবাদ পায় নি। হঠাৎ শংকরের চিঠি পেয়ে কিরীটি বেশ খুশীই হলো।
জংলীকে ডেকে সব গোছগাছ করতে বলে দিল। পরের দিন তুফান মেলে যাবে সব ঠিক, এমন সময় সুব্রত এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল।
একতলার ঘরে জংলীকে সব গোছগাছ করতে দেখে প্রশ্ন করলে, ব্যাপার কী জংলী?
বাবু কাঁত্রাসগড় চলেছেন। হঠাৎ? কী জানি বাবু! আপনাদের কয় বন্ধুর কি মাথার ঠিক আছে? বৰ্মা, লঙ্কা, হিল্পী, দিল্লীতে আপনারা লাফালাফি করতেই আছেন।
সুব্রত হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ােল। কিরীটী তার বসবার ঘরে একটা সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে। চুরুট টানছিল। সুব্রতর পায়ের শব্দে মুদ্রিত চোখেই বললে।
কিবা প্রয়োজনে
এ অকিঞ্চনে
করিলে স্মরণ?
সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দিল :-
আসি নাই সন্ধি হেতু,
ফাটাফাটি রক্তারক্তি
খুনো খুনী,
যাহা হয় কিছু!
পোঁটলা পুঁটলি বাঁধি;
জংলীরে সাথে লয়ে
কোথায় চলেছো;
দিয়ে অভাগা আমারে ফাঁকি?
কিরীটী বললে,
করিয়াছি মন
সুদূর কাতরাসগড়
বারেক আসিব ঘুরি।
নে নে, থামা বাবা তোর কবিতা। সত্যি, হঠাৎ কাতরাসগড় চলেছিস কেন?
কিরীটি সোফার ওপরে সোজা হয়ে বসে, হাতের প্রায় নিভন্ত সিগারটা অ্যাসট্রেতে ফেলে বললে।
হৈ হৈ ব্যাপার, রৈ রৈ কাণ্ড।
অর্থাৎ!
শোন। কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি একটা কোল্ডফিল্ড আছে! সেটার মালিক পূর্ববঙ্গের কোন এক যুবক জমিদার নন্দন।
তারপর–
কোলিয়ারী স্টার্ট করা হয়েছে; অর্থাৎ তোমার কোলিয়ারীর গোড়া পত্তন আরম্ভ করা হয়েছে মাস দুই হলো।
থামছিস কেন, বল না- ৷
কিন্তু মাস দুইয়ের মধ্যে তিন-তিনটে ম্যানেজার খুন হয়েছেন।
তার মানে!
আরে সেই মানেই তো solve করতে হবে।
বুঝলাম, তা কী করে ম্যানেজার তিনজন মারা গেলেন?
ময়না-তদন্তে জানা গেছে তাদের গলা টিপে মারা হয়েছে, এবং গলার পিছন দিকে মারাত্মক রকমের চারটি করে ছিদ্র দেখতে পাওয়া গেছে। তা ছাড়া অন্য কোন দাগ বা কোন ক্ষত পর্যন্ত নেই।
শরীরের অন্য কোন জায়গায়ও না?
না, তাও নেই!
আশ্চর্য!
তা আশ্চৰ্যই বটে। সত্যিই আশ্চর্য সেই চারটি কালো ছিদ্র। এবারকার নতুন ম্যানেজার হচ্ছেন আমারই কলেজ ফ্রেণ্ড শংকর সেন। সেও তোমার মতই গোয়ার গোবিন্দ ও একজন পাকা অ্যাথলেটু। সে সমস্ত ব্যাপার জানিয়ে আমায় সেখানে যেতে লিখেছে।
দেখ কিরীটী, সুব্রত বললে, একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে।
যথা—
এবারকার রহস্যের কিনারার ভারটা আমার ওপরে ছেড়ে দে। এতদিন তোমার সাকরেদি করলাম, দেখি পারি কিম্বা হারি।
বেশ তো! আমার সঙ্গেই চল না।
না। তা হবে না। পুরোপুরি আমার হাতেই সব কিছু ছেড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে তুই মাথা গলাতে পারবি না।
পুরাতন কলেজ ফ্রেণ্ড! যদি অসন্তুষ্ট হয়।
কেন? অসন্তুষ্ট হবেন কেন? আমি হালে পানি না পাই তবে না হয় তুই অবতীর্ণ হবি।
কিন্তু তখন যদি সময় আর না থাকে বিশেষ করে একজনের জীবন মরণ যেখানে নির্ভর করছে।
সব বুঝি কিরীটী। তার নিয়তি যদি ঐ কোলিয়ারীতেই থাকে। তবে কেউ তা রোধ করতে পারবে না। তুই আমি তো কোন কথা; স্বয়ং ভগবানও পারবে না!
তা বটে। তা বেশ, তুই তা হলে কাল রওনা হয়ে যা। শংকরকে একটা চিঠি ড্রপ করে দেবো সমস্ত ব্যাপার খুলে লিখে।
হ্যাঁ! তাই দে! ভয় নেই কিরীটী! সুব্রত রায়কে তুই এটুকু বিশ্বাস করতে পারিস; বুদ্ধির খেলায় না পারি দেহের সবটুকু শক্তি দিয়েও তাকে প্ৰাণপণে আগলাবই।
দেহের শক্তিতে সেও কম যায় না সুব্রত। একটু গোলমাল ঠেকলেই কিন্তু তুই আমায় খবর দিস ভাই! অবিশ্যি চিঠি থেকে যতটুকু ধরতে পেরেছি তাতে ব্যাপারটা যে খুব জটিল তা মনে হয় না! এক কাজ করিস তুই বরং প্রত্যেকদিন কতদূর এগুলি বিশদভাবে আমায় চিঠি দিয়ে জানাস, কেমন।
বেশ, সেই কথাই রইল!
কোলফিল্ডটা প্ৰায় উনিশ কুড়ি বিঘে জমি নিয়ে। ধু-ধু প্ৰান্তর। তার মাঝে একপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে কুলিবস্তী বসান হয়েছে। টেমপোরারী সব টালি ও টিনের সেড তুলে ছোট ছোট খুপরী তোলা হয়েছে। কোন কোনটার ভিতর থেকে আলোর কম্পিত শিখার মৃদু আভাস পাওয়া যায়। অল্প দূরে পাকা গাঁথনী ও উপরে টালির সে্ড দিয়ে ম্যানেজারের ঘর তোলা হয়েছে এবং প্রায় একই ধরণের আর দুটি কুঠী ঠিকাদার ও সরকারের জন্য করা হয়েছে। ম্যানেজারের কোয়ার্টার এতদিন তালা বন্ধই ছিল বিমলবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দেয়। কোয়ার্টারের মধ্যে সর্বসমেত তিনখানি ঘর, একখানি রান্নাঘর ও বাথরুম। মাঝখানে ছোট্ট একটি উঠান। দক্ষিণের দিকে বড় ঘরটায় একটা কুলি একটা ছাপর খাটের ওপরে শংকরের শয্যা খুলে বিছিয়ে দিল।
আচ্ছা, আপনি তা হলে হাতমুখ ধুয়ে নিন স্যার। ঠাকুরকে দিয়ে আপনার জন্য লুচি ভাজিয়ে রেখে দিয়েছি, পাঠিয়ে দিচ্ছি গিয়ে। বংশী এখানে রইল।
বিমলবাবু নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।
শংকর শয্যায় ওপরে গা ঢেলে দিল।
রাত্ৰি প্ৰায় শেষ হয়ে এল।
কিন্তু কুয়াশার আবছায় কিছু বুঝবার জো নেই।
একটু বাদে বিমলবাবুর ঠাকুর লুচি ও গরম দুধ দিয়ে গেল। দুচারটে লুচি খেয়ে দুধ টুকু এক ঢেকে শেষ করে শংকর ভাল করে পালকের লেপটা গায়ে চাপিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন বিমলবাবুর ডাকে ঘুম ভেঙে শংকর দরজা খুলে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের অরুণ রাগ তখন ঝিলিক হানছে।
সারাটা দিন কাজকর্ম দেখে শুনে নিতেই চলে গেল।
বিকালের দিকে সুব্রত এসে পৌঁছাল।
কিরীটি তার হাতে একটা চিঠি দিয়েছিল।
সুব্রতর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শংকর বেশ খুশীই হল।
তারও দিন দুই পরের কথা।
এ দুটো দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেছে।
সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আবশ্যকীয় কয়েকটা কাগজপত্ৰ শংকর টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বসে দেখছে।
সুব্রত বিকালের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছে, এখনও ফেরে নি! বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
শংকর উৎকৰ্ণ হয়ে উঠল, কে?
আমি স্যার। চন্দন সিং।
ভিতরে এসো চন্দন।
চন্দন সিং অল্প বয়সের পাঞ্জাবী যুবক।
এই কেলিয়ারীতে ম্যানেজারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজে বহাল হয়েছে।
কি খবর চন্দন সিং?
আপনি আমায় ডেকেছিলেন?
কই না! কে বললে? কতকটা আশ্চর্য হয়েই শংকর প্রশ্ন করলে।
বিমলবাবু অর্থাৎ সরকার মশাই বললেন।
বিমলবাবু বললেন! তারপর সহসা নিজেকে সামলে নিয়ে বললে : ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে! বসো ঐ চেয়ারটায়। তোমার সঙ্গে গোটা কতক কথা আছে।
চন্দন সিং একটা মোড়া চেয়ে নিয়ে বসল।
এখানকার চাকরী তোমার কেমন লাগছে চন্দন?
পেটের ধান্দায় চাকরী করতে এসেছি। স্যার, আমাদের পেট ভরলেই হলো স্যার।
না, তা ঠিক বলছি না। এই যে পর পর দুজন ম্যানেজার এমনি ভাবে
সহসা চন্দন সিংয়ের মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়াতে শংকর চমকে উঠলো। চন্দনের সমগ্র মুখখানি ব্যেপে যেন একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। কিন্তু চন্দন সিং সেটা সামলে নিল।
শংকর বলতে লাগল, তোমার কি মনে হয় সে সম্পর্কে?
চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে চেয়ে মনে হয় যেন কী একটা কিছু বেচারী প্ৰাণপণে এড়িয়ে যেতে চায়।
তুমি কিছু বলবে চন্দন?
সোৎসুকভাবে শংকর চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে তাকাল।
একটা কথা যদি বলি অসন্তুষ্ট হবেন নাতো স্যার?
না, না-বল কি কথা।
আপনি চলে যান স্যার। এ চাকরী করবেন না।
কেন? হঠাৎ একথা বলছে কেন?
না স্যার, চলে যান আপনি; এখানে কারও ভাল হতে পারে না।
ব্যাপার কি চন্দন? এ বিষয়ে তুমি কি কিছু জান? টের পেয়েছে কিছু?
ভূত!..আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ভূত!…
হ্যাঁ। অত বড় দেহ কোন মানুষ হতে পারে না!
আমাকে সব কথা খুলে বল চন্দন সিং।
আপনার আগের ম্যানেজার সুশান্তবাবু মারা যাবার দিন দুই আগে বেড়াতে বেড়াতে পশ্চিমের মাঠের দিকে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিকে অস্পষ্ট আঁধার; হঠাৎ মনে হলো পাশ দিয়ে যেন ঝড়ের মত কী একটা সন সন করে হেঁটে চলে গেল। চেয়ে দেখি লম্বায় প্রায় হাত পাঁচ ছয় হবে। আগাগোড়া সর্বাঙ্গ একটা বাদামী রংয়ের আলখাল্লায় ঢাকা।
সেই অস্বাভাবিক লম্বা মূর্তিটা কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ একটা পৈশাচিক অট্টহাসি শুনতে পেলাম। সে হাসি মানুষের হতে পারে না।
তারপর–।
তারপরের পর দিনই সুশান্তবাবুও মারা যান। শুধু আমিই নয়; সুশান্তবাবুও মরবার আগের দিন সেই ভয়ংকর মূর্তি নিজেও দেখেছিলেন।
কি রকম? রাত্রি প্রায় বারোটার সময়…সে রাত্রে কুয়াশার মাঝে পরিষ্কার না হলেও অল্প অল্প চাদের আলো ছিল–রাত্রে বাথরুমে যাবার জন্য উঠেছিলেন…হঠাৎ ঘরের পিছনে একটা খুক খুক কাশির শব্দ পেয়ে কৌতূহলবশে জানালা খুলতেই দেখলেন, সেই ভয়ংকর মুর্তি মাঠের মাঝখান দিয়ে ঝড়ের মত হেঁটে যাচ্ছে।
সে মুর্তি আমি আজ স্বচক্ষে দেখলাম শংকরবাবু! দুজনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখে বক্তা সুব্ৰত! সে এর মধ্যে কখন এক সময় ফিরে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।
কী দেখছেন?
ভূত। চন্দনবাবুর ভূত! সুব্রত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললে। তারপর চন্দন সিংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি আমাদের শংকরবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট?
চন্দন সিং সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় হেলাল।
এখানকার ঠিকাদার কে চন্দনবাবু?
ছট্টুলাল।
তার সঙ্গে একটিবার আলাপ করতে চাই! কাল একটিবার দয়া করে যদি পাঠিয়ে দেন তাকে সন্ধ্যার দিকে।
দেবো, নিশ্চয়ই দেবো।
আচ্ছা চন্দনবাবু! আপনাকে কয়টা কথা যদি জিজ্ঞাসা করি আপনি নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন না?
সে কি কথা। নিশ্চয়ই না। বলুন কি কথা?
আমি শংকরবাবুর বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছি জানো তো।
জানি–।
কিন্তু এখানে পৌঁছে ওঁর আগেকার ম্যানেজারের সম্পর্কে যে কথা শুনলাম তাতে বেশ ভয়ই হয়েছে আমার।
নিশ্চয়ই, এ তো স্বাভাবিক। আমিও ওঁকে বলেছিলাম। এখানকার কাজে ইস্তফা দিতে।
আমার মনে হয় ওঁর পক্ষে ও জায়গাটা তেমন নিরাপদ নয়।
আমারও তাই মত। সুব্রত চিন্তিতভাবে বললে।
কি বলছেন সুব্রতবাবু।
হাঁ—ঠিকই বলছি—
কিন্তু স্রেফ একটা গাঁজাখুরী কথার ওপরে ভিত্তি করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমার মন কিন্তু মোটেই সায় দেয় না। বরং শেষ পর্যন্ত দেখে তবে এ জায়গা থেকে নড়ব-তাই আমার ইচ্ছা সুব্রতবাবু; শংকর বললে।
বড় রকমের একটা বিপদ আপদ যদি ঘটে এর মধ্যে শংকরবাবু?…অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপার, কখন কি হয় বলা তো যায় না।
যে বিপদ এখনও আসেনি, ভবিষ্যতে আসতে পারে তার ভয়ে লেজ গুটিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকব এই বা কোন দেশী যুক্তি আপনাদের? শংকর বললে।
যুক্তি হয়ত নেই। শংকরবাবু, কিন্তু অ-যুক্তিটাই বা কোথায় পাচ্ছেন এর মধ্যে?–সুব্রত বললে।
কিন্তু-চন্দন সিং বলে :
শুনুন, শুধু যে ঐ ভীষণ মুর্তি দেখেছি তাই নয়। স্যার। মাঝে মাঝে গভীর রাতে কী অদ্ভুত শব্দ, কান্নার আওয়াজ মাঠের দিক থেকে শোনা যায়। এ ফিল্ডটা অভিশাপে ভরা।…কেউ বাঁচতে পারে না। বঁচা অসম্ভব। গত তিনবার ম্যানেজার বাবুদের উপর দিয়ে গেছে.কে বলতে পারে এর পরের বার অন্য সকলের উপর দিয়ে যাবে না।
সে রাত্রে বহুক্ষণ তিনজনে নানা কথাবার্তা হলো।
চন্দন সিং যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল রাত্রি তখন সাড়ে দশটা হবে।
শংকর একই ঘরে দুপাশে দুটো খাট পেতে নিজের ও সুব্রতর শোবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে।
শংকরের ঘুমটা চিরদিনই একটু বেশী। শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নাক ডাকতে শুরু করে দেয়।
আজও সে শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে শুরু করে দিল।
সুব্রত বেশ করে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথার কাছে একটা টুলের ওপরে বসে টেবিল ল্যাম্পটা বসিয়ে তার আলোয় কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল।
কিরীটী,
কাল তোকে এসে পৌছানর সংবাদ দিয়েছি; আজ এখানকার আশপাশ৷ অনেকটা ঘুরে এলাম। ধু-ধু মাঠ, যেদিকে তাকাও জনহীন নিস্তব্ধতা যেন চারিদিকে প্রকৃতির কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে।
বহুদূরে কালো কালো পাহাড়ের ইসারা; প্রকৃতির বুক ষ্টুয়ে যেন মাটির ঠাণ্ডা পরশ নিচ্ছে। বর্তমানে যেখানে এদের কোলফিল্ড বসেছে তারই মাইল খানেক দূরে বহু কাল আগে এক সময় একটা কোলফিল্ড ছিল। আকস্মিক ভাবে একরাত্রে সে খনিটা নাকি ধ্বসে মাটির বুকে বসে যায়। এখনো মাঝে মাঝে বড় বড় গর্ত মত আছে। রাতের অন্ধকারে সেই গর্তর মুখ দিয়ে আগুনের হল্কা বের হয়।
অভিশপ্ত খনির বুকে দুৰ্জয় আক্রোশ এখনও যেন লেলিহান অগ্নিশিখায় আত্মপ্ৰকাশ করে। আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়ে ফিরছি; অন্ধকাব চারিদিকে বেশ ঘনিয়ে এসেছে, সহসা পিছনে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে চমকে পিছন পানে ফিরে তোকালাম। আশ্চর্য! কেউ যে এত লম্বা হতে পারে ইতিপূর্বে আমার ধারণা ছিল না।
লম্বায় প্রায় ছয় হাত হবে। যেমন উঁচু লম্বা তেমনি মনে হয় যেন বলিষ্ঠ গঠন। আগাগোড়া একটা ধূসর কাপড় মুড়ি দিয়ে হন হন করে যেন একটা ঝোড়ো হাওয়ার মত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মাঠের অপর প্রান্তে মিলিয়ে গেল।
আমি নির্বাক হয়ে সেই অপসৃয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় একটা অদ্ভুত বাঘের ডাক কানে এসে বাজল।
এত কাছাকাছি, মনে হলো যেন আশপাশে কোথায় বাঘাট ওৎ পেতে শিকারের আশায় বসে আছে।
তুই হয়ত বলবি আমার শুনবার ভুল, কিন্তু পর পর তিনবার স্পষ্ট বাঘের ডাক আমি শুনেছি।
তাছাড়া তুই তো জনিস সাহস আমার নেহাৎ কম নয়, কিন্তু সেই সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে গুরুগম্ভীর সেই শার্দুলের ডাকে আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন অকস্মাৎ শির শির করে উঠল। দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম, বাসায় ফিরবার জন্য।
চিঠিটা এই পর্যন্ত লেখা হয়েছে, এমন সময় রাতের নিস্তব্ধ আঁধারের বুকখানা ছিন্ন ভিন্ন করে এক ক্ষুধিত শার্দুলের ডাক জেগে উঠল।
একবার, দুবার, তিনবার। সুব্রত চমকে শয্যা থেকে লাফিয়ে নীচে নামল। তাড়াতাড়িতে নামতে গিয়ে ধাক্কা লেগে টেবিল ল্যাম্পটা মাটিতে ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
আলোর চিমনিটা ভাঙার ঝন ঝন শব্দে ততক্ষণে শংকরের ঘুমটাও ভেঙে গেছে।
ত্রস্তে শয্যার ওপরে বসে চকিত স্বরে প্রশ্ন করলে, কে?
শংকরবাবু! আমি সুব্রত।
সুব্রতবাবু! হ্যাঁ, ধাক্কা লেগে আলোটা ছিটকে পড়ে ভেঙে নিভে গেল।
বাইরে একটা চাপা অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ কানে এসে বাজে।
অনেকগুলো লোকের মিলিত এলোমেলো কণ্ঠস্বর রাতের নিস্তব্ধতায় যেন একটা শব্দের ঘূর্ণাবর্ত তুলেছে।
বাইরে কিসের একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছে না, সুব্রতবাবু?
হ্যাঁ।
কিসের গোলমাল?
বুঝতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয়, গোলমালটা কুলি বস্তির দিক থেকে আসছে, সুব্রত বললে। চলুন। একবার; খবর নেওয়া যাক।
বেশ চলুন।
দুজনে দুটো লং কোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় উলের নাইট ক্যাপ পরে দুটো টর্চ হাতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হলো।
গোলমালটা ক্ৰমে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঘরের দরজা খুলে সুব্রত বেরুতে যাবে, এমন সময় আকাশ পাতাল
জেগে উঠল। আবার অকস্মাৎ।
এবং এবারেও একবার, দুবার, তিনবার।
সুব্রতর সমস্ত শরীর লোহার মত শক্ত ও কঠিন, মনের সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রীগুলি সজাগ হয়ে উঠেছে।
শংকর ঘরের মাঝখানে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেছে; যেন সহসা একটা তীব্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে ও একেবারে অসার পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। প্রথমটা কারো মুখে কোন কথাই নেই। কিন্তু সহসা সুব্রত যেন ভিতর থেকে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে সজাগ হয়ে উঠে ভিতর থেকে এক ঝটিকায় ঘরের খিল খুলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় টর্চটা ফেলে লাফিয়ে পড়ল।
আগাগোড়া সমগ্র ব্যাপারটা ঘটতে বোধ হয়। কুড়ি সেকেণ্ডও লাগেনি।
সুব্রতকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে প্রথমটা শংকর বেশ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই সেও সুব্রতকে অনুসরণ করলে।
বাইরের অন্ধকার বেশ ঘন ও জমাট। সুব্রতর হাতের টর্চের তীব্ৰ বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মি অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে ঘুরে এল; কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
বাঘ তো দূরের কথা, একটা পাখি পর্যন্ত নেই।
ততক্ষণে শংকরও সুব্রতর পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাঘের ডাক তো স্পষ্ট শোনা গেছে।
তবে?
বুঝতে পারছি না। সত্যি সত্যিই একি তবে ভৌতিক ব্যাপার?
বলতে বলতে শংকর আবার হাতের টর্চের বোতামটা টেপে। মাঠের মাঝখানে কুলিবস্তি ও কোলিয়ারীতে যাবার পথে কতকগুলি কাট্ যুঁই ও বাবলা গাছ চোখে পড়ে। সেইদিকে শংকরের হাতের অনুসন্ধানী বৈদ্যুতিক বাতির রশ্মি পড়তেই দুজনে চমকে উঠল…কে? কে ওখানে, একটা কালো মূর্তি…তার গায়ে সাদা সাদা ডোরা কাটা।
চকিতে সুব্রত কোমরবন্ধ থেকে আগ্নেয়-অস্ত্রটা টেনে বের করলে এবং চাপা গলায় বললে : ওই দেখুন বাঘ। সরে যান। গুলি করি।
শেষের কথাগুলো উত্তেজনায় যেন বেশ তীক্ষ্ণ ও সজোরে সুব্রতর কণ্ঠ ফুটে বের হয়ে এল।
স্যার আমি।…গুলি করবেন না। স্যার।…ইয়োর মোস্ট ফেইথফুল এণ্ড ওবিডিয়েণ্ট সারভেন্ট।
একটা চাপা ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর কানে এসে বাজল।
কে?
আমি বিমল দে।…কোলিয়ারীর সরকার।
বিমলবাবু! শংকরের বিস্মিত কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এল।
দুজনে এগিয়ে গেল। শংকর বিমলবাবুর গায়ের ওপরে টর্চের আলো ফেলে প্ৰশ্নসূচক দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, এত রাত্রে এখানে এই শীতে মাঠের মধ্যে কী করছিলেন?
আগাগোড়া একটা সাদা ডোরা কাটা ভারী কালো কম্বলে মুড়ি দিয়ে বিমলবাবু সামনে দাঁড়িয়ে…
আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম স্যার।
আমার কাছে যাচ্ছিলেন? শংকর প্রশ্ন করলে।
হ্যাঁ। কুলি ধাওড়ায় একটা লোক খুন হয়েছে।
খুন হয়েছে!..সুব্রত চমকে উঠল।
হ্যাঁ বাবু, খুন হয়েছে।
গোলমালটা এখন বেশ সুস্পষ্টভাবে কানে এসে বাজছে।
চলুন, দেখে আসা যাক।
সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শংকর বললে।
আগে শংকর, মাঝখানে বিমলবাবু ও সর্বশেষে সুব্রত টর্চের আলো ফেলে কুলিবস্তির দিকে এগিয়ে চলল।
মাথার উপরে তারায় ভরা রহস্যময়ী অন্ধকার রাতের আকাশ কী যেন একটা ভৌতিক বিভীষিকার প্রতীক্ষ্ণয় উদ্গ্ৰীব।
আজ রাতে-কুয়াশার লেশমাত্র নেই।
আবার ভয়ঙ্কর চারটি ছিদ্র
সকলেই নির্বাক। কারো মুখে কোন কথা নেই। শুধু রাতের স্তব্ধ মৌনতার বুকে জেগে উঠেছে কতকগুলো ভয়ার্তা লোকের একটানা গোলমালের এলোমেলো একটা ক্ৰমবৰ্দ্ধমান শব্দের রেশ।
সহসা সুব্রত কথা বললে, আপনার কোয়ার্টারটা কোথায় বিমলবাবু?
কেন, এখানেই তো থাকি!
এখানেই মানে? কোথায়? মানে লোকেশনটা চাচ্ছি!
কুলীদের ধাওড়ার লাগোয়া। আমি আর রেজিং বাবু একই ঘরে থাকি।
আপনাদের রেজিং বাবুর নাম কি?
রামলোচন পোদ্দার।
তিনি কোথায়?
তিনি ধাওড়ার দিকে গেছেন।
গোলমাল শুনবার আগে ঘুমোচ্ছিলেন বুঝি?
না। রামলোচনবাবুঘুমোচ্ছিলেন; আমি জেগে বসে হিসাবপত্র দেখছিলাম।
কথা বলতে বলতে ততক্ষণ তারা কোলফিল্ডের কাছাকাছি এসে পড়েছে। অদূরে অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে চানকের উপরের চাকাটা দেখা যাচ্ছে।
চারিদিকে একটা থমথমে ভাব এবং সেই থমথমে প্রকৃতির বুকে একটা অস্পষ্ট গোলমালের সুর কেমন যেন ভৌতিক বলে মনে হয়।
ধাওড়ায় তখন সাঁওতাল পুরুষ ও কামিন সকলেই প্ৰায় এক জায়গায় ভিড় করে মৃদু গুঞ্জনে জটলা পাকাচ্ছে। শংকরকে দেখে সকলে ভিড় ছেড়ে সরে দাঁড়াতে লাগল।
একটা ঘরের দরজার সামনে সকলে এসে দাঁড়াল।
একটা বলিষ্ঠ ২৪।২৫ বছরের সাঁওতাল যুবক চিৎ হয়ে পড়ে আছে। সামনেই একটা কেরাসিনের ল্যাম্প দপ দপ করে জ্বলছে প্রচুর ধূম উদগিরণ করে।
প্ৰদীপের লাল আলোর মলিন আভা মৃত সাঁওতাল যুবকের মুখের উপরে প্রতিফলিত হয়ে মৃতের মুখখানাকে যেন আরো বীভৎস, আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া কালো চুলগুলো এলোমেলো। গোল গোল বড় বড় চোখের মণি দুটো যেন চক্ষু কোটর থেকে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। জিভটা খানিকটা বের হয়ে এসেছে মুখ-বিবর থেকে। সমগ্ৰ মুখখানি ব্যাপী একটা ভয়াবহ বিভীষিকা ফুটে উঠেছে।
সুব্রত মৃতের মুখের ওপরে শক্তিশালী টর্চের উজ্জ্বল আলো ফেলল।
অত্যুজ্জ্বল আলোয় মৃত ব্যক্তির গলার দিকে নজর পড়তেই সুব্রত চমকে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি প্রখর করে দেখতে লাগল।
গলার দুপাশে আঙুলের দাগ যেন চেপে বসে গেছে।
নাকের নীচে হাত দিয়ে দেখলে, কোথাও আর শ্বাসপ্রশ্বাসের লেশমাত্র নেই।
অনেকক্ষণ মারা গেছে। হিমা কঠিন অসাড়।
টর্চের আলোয় মৃতদেহটাকে সুব্রত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। মৃতদেহটিকে উপুড় করে দিতেই ও লক্ষ্য করল রক্তে কলো কালো চারিটি ছিদ্র ঘাড়ের দিকে যেন কি এক বিভীষিকায় ফুটে উঠেছে। মনে হয় যেন কোন তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্রের অগ্রভাগ দিয়ে পাশাপাশি পর পর চারটি ছিদ্র করা হয়েছে।…
শংকর প্রশ্ন করলে, কী দেখছেন সুব্রতবাবু?…উঠে আসুন।…
সুব্রত টর্চটা নিভিয়ে দিল, হ্যাঁ চলুন।…কী ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু!…
সকলে বাইরে এসে দাঁড়াল।
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে ক্ষীণ চাঁদের একটুকরো জেগে উঠেছে যেন বাঁকানো ছোরা একখানি। সহসা কে এক নারী আলুলায়িতা কুন্তলা, পাগলিনীর মতই শংকরবাবুর পায়ের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, বাবুরে হামার কি হলো রে–
সকলে চমকে উঠল।
একজন বৃদ্ধ গোছের সাঁওতাল এগিয়ে এল, উঠ সোহাগী। কী করবি বল–
কে এই মেয়েটি বিমলবাবু? শংকরবাবু প্রশ্ন করলেন।
ঝন্টুর ইস্ত্রি বাবু। সোহাগী।
কে ঝন্টু?
যে লোকটা মারা গেছে।
তুই এখন যা সোহাগী।…তোর একটা ব্যবস্থা করে দিব রে। শংকর বলে। সান্ত্বনা দেয়।
ঝন্টুকে ছেড়ে আমি থাকতে লারব বাবুগে। ঝন্টুকে তুই আমার ফিরায়ে দে বাবু।–
কেঁদে আর কি করবি বল?–যা ঘরে যা।
না। না। ঘরকে আমি যাবো নারে।–ঘর আমার আঁধার হয়ে গেল।-ঝন্টু আমার নাইরে-ওরে ঝণ্টুরে।
চুপ কর। সোহাগী চুপ কর।–
সহসা বিমলবাবু প্ৰচণ্ড বেগে ধমক দিয়ে উঠলেন; এই মাগী থাম।-ভুতে তোর স্বামীকে খুন করেছে তার ম্যানেজার বাবুকি করবে।— যা ওঠ ওঠ।-যত সব নচ্ছার বদমায়েস এসে জুটেছে।—যা ভাগ!-যা! অন্ধকার রাতে আনমনে পথ চলতে চলতে সহসা একটা তীব্র আলোর ঝাপটা মুখে এসে পড়লে পথিক যেমন ক্ষণেকের জন্য বিভ্ৰান্ত হয়ে পড়ে, সোহাগীও তেমনি সহসা যেন তার সকল শোক ভুলে মুহূর্তের জন্য মৌন বাকহারা হয়ে ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং পায়ে পায়ে পিছন পানে হেঁটে সরে যেতে লাগল।
চলুন ম্যানেজারবাবু।-ওদিকে রাত প্ৰায় শেষ হয়ে এল।– পুলিশে খবর দিতে হবে, লাস ময়না তদন্তে যাবে – যত সব হাঙ্গামা। পোষাবে না। বাপু এখানে আর আমার চাকরী করা। ভূতের আড্ডা। কে জানে কবে হয়ত আবার আমারই ওপরে চড়াও হবে।-বাপ, মা, ছেলে পিলে ছেড়ে এই বিদেশ-বির্ভূয়ে প্ৰাণটা শেষে কী খোয়াব?—
চলুন শংকরবাবু। কোয়ার্টারে ফেরা যাক। সুব্রত বলে।
সকলে কুলী ধাওড়া ছেড়ে কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াল; সকলেই নীরবে: পথ অতিবাহিত করে চলেছে। কারও মুখে কোন কথা নেই–
পথ চলতে চলতে এক সময় বিমলবাবু বলল, বলছিলাম না, এই কোলফিল্ডটা একটা পরিপূর্ণ অভিশাপ। এখানে কারও মঙ্গল নেই। কিন্তু এবারে দেখছি আপনি স্যার বেঁচে গেলেন। এর আগের বারের আক্ৰোশগুলো ম্যানেজারবাবুদের উপর দিয়েই গেছে এবং আগেকার ঘটনা অনুযায়ী বিপদটা আপনার ঘাড়েই আসা উচিত ছিল। তা যাক, ভালই হলো একদিক দিয়ে।
তার মানে? সহসা সুব্রত প্রশ্ন করে বসল।
বিমলবাবু যেন সুব্রতর প্রশ্নে একটু থাতমত খেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মানে, মানে আর কি? ওই কুলীগুলোর জীবনের আর কী দাম আছে বলুন? ওদের দুদশটা মরলে কী এসে গেল?
সহসা স্তব্ধ রাতের মৌনতাকে ছিন্নভিন্ন করে সোহাগীর করুণ কান্নার আকুল রেশ ক্যানে এসে বাজল সবার। ঝন্টুরে-তু ফিরে আয় রে। ওরে আমার ঝন্টুরে।
সুব্রতর পায়ের গতিটুকু যেন সহসা লোহার মত ভারী হয়ে অনড় হয়ে গেল। বিমলবাবুর দিকে ফিরে শ্লেষমাখা সুরে সে বলল, তা যা বলেছেন বিমলবাবু। দুনিয়ার আবর্জনা ওই গরীবগুলো।—যাদের মরণ ছাড়া আর গতি নেই ও সংসারে তারা মরবে বৈকি।
নিশ্চয়ই। আপনিই বলুন না, ওই জংলীগুলোর প্রাণের দাম কিই-বা আছে? বিমল বলে ওঠে।
খাদে রহস্যময় মৃত্যু
বাকী রাতটুকু সুব্রতর চোখে আর ঘুম এল না। সে আবার অর্ধসমাপ্ত চিঠিখানা নিয়ে বসল।
কিরীটী। চিঠিটা তোর শেষ করেই রেখেছিলাম, কিন্তু সেই রাত্রেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাটা তোকে না লিখে পারলাম না। কুলী ধাওড়ায় ঝন্টু নামে এক সাঁওতাল যুবক রাত্রে খুন হয়েছে। বিমলবাবু প্রমাণ করতে চান ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভৌতিক। অর্থাৎ ভূতের কাণ্ড। তবে মৃতের গলার পিছন দিকে আগের মতই চারটি ভয়ঙ্কর কালো ছিদ্ৰ আছে দেখলাম। আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা যেন খুবই সহজ। জলের মতই সহজ।…তোর চিঠির প্রত্যুত্তরের আশায় রইলাম। চিঠি পেলেই ভাবছি শ্ৰীমানকে পুলিশের হাতে তুলে দেবো। কেন না। ওই ধরনের শয়তান খুনীদের এমন সহজভাবে দশজনার সঙ্গে চলে ফিরে বেড়াতে দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? আমার যতদূর মনে হয়। আর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ব্যাপারটার একটা সহজ মীমাংসা করে দিতে পারব। তোর উপস্থিতির বোধ হয়। আর প্রয়োজনই হবে না। আজ এই পর্যন্ত। ভালবাসা রইলো। তোর সুব্রত।
চিঠিটা শেষ করে সুব্ৰত চেয়ার থেকে উঠে একটা আড়মোড়া ভাঙলো। রাতের আকাশের বিদায়ী আঁধারের দিগ্ধলয়ের প্রান্তকে তখন ফিকে করে তুলেছে।
সুব্রত বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। শীতের হাওয়া ঝিরঝির করে সুব্রতর শ্রান্ত ও ক্লান্ত দেহ মনকে যেন জুড়িয়ে দিয়ে গেল।
ঘুমান নি বুঝি সুব্রতবাবু?
শংকরের গলার স্বর শুনে সুব্রত ফিরে দাঁড়াল।
এই যে আপনিও উঠে পড়েছেন দেখছি। ঘুমাতে পারলেন না বুঝি?
না, ঘুম এলো না। কিন্তু গত রাত্রের ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কি মনে হয়। সুব্রতবাবু?
দেখুন শংকরবাবু, ব্যাপারটা যে খুব কঠিন বা জটিল তা কিছু নয়, তবে এটা ঠিক যে, এর আগে যে সব খুন। এখানে হয়েছে তার সমস্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোন স্থির সিদ্ধান্তে চাটু করে উপনীত হতে পারছি না। যতদূর মনে হয় এর পিছনে একটা দল আছে অর্থাৎ একদল শয়তান এই ভয়ঙ্কর খুনখারাপি করে বেড়াচ্ছে।
বলেন কি?
হ্যাঁ। তাই। একজন লোকের ক্ষমতা নেই tactfully এতগুলো লোকের মধ্যে থেকে এমন পরিষ্কারভাবে খুন করে গা ঢাকা দিতে পারে।–
হাত মুখ ধুয়ে চা পান করতে করতে শংকর আর সুব্রত গত রাত্রের ঘটনারই আলোচনা করছিল, এমন সময় একটা কুলী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির, বাবু গো সর্বনাশ হয়েছে।.
কি হয়েছে—
১৩ নম্বর কাঁথিতে পিলার ধ্বসে গিয়ে কাল রাত্রে দশজন সাঁওতাল কুলী মারা গেছে।
শংকর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।
সর্বনাশ! এক রাত্রে দশটা লোকের একসঙ্গে মৃত্যু! কিন্তু রাত্রে তো এ মাইনে কাজ চালাবার কথা নয়। তবে? তবে কেমন করে এ দুর্ঘটনা ঘটলো?
রেজিংবাবু কোথায় রে টুইলা? শংকর কুলীটাকে প্রশ্ন করল।
রেজিং বাবু তো ওধার পানেই আসতেছে দেখলুম। বাবু!…দেখা গেল সামনের অপ্ৰশস্ত কঁচা কয়লার গুড়ো ছড়ান রাস্তােটা ধরে একপ্রকার দৌড়াতে দৌড়াতে রামলোচন পোদ্দার আসছে। রামলোচনবাবু এসে শংকরের সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। মোটাসোটা চর্বিবহুল নাদুসনুদুস চেহারাখনি, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট ও খাকি হাফসার্ট। ঠোঁটের ওপরে বেশ একজোড়া পাকান গোঁফ। মাথায় সুবিস্তীর্ণটাক চকচক করে। বয়েস বোধকরি ৪০।৪৫ এর মধ্যে।
এ কি শুনছি রামলোচনবাবু?
সর্বনাশ হয়ে গেছে, ঠিকই শুনেছেন স্যার-একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই খনি বুঝি আর চালানো গেল না।
সব খুলে বলুন—
কাল রাত্ৰে ১৩নং কাঁথিতে পিলার ধ্বসে গিয়ে দশজন কুলী চাপা পড়ে মারা গেছে।
কাল রাত্রে মানে।–অর্থাৎ আপনি বলতে চান রাত্ৰিতে কালি কয়লা খনিতে কাজ হচ্ছিল?
আজ্ঞে না!—
আজ্ঞে না! তার মানে? এই তো বললেন কাল রাত্রে ১৩নং কাঁথিতে দশজন মারা গেছে।
আজ্ঞে তা তো গেছেই—
খনিতে কয়লা কাটার কাজ না থাকলে কেন তারা সেখানে গিয়েছিল? নিশ্চয়ই খনির মধ্যে লুকোচুরি খেলতে নয়। এ খনির নিয়ম কি? পাঁচটার মধ্যে খনির সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায় তো?–রাত্রে কোন কাজ হয় না।
আজ্ঞে।
তবে তারা রাত্রে খনির মধ্যে কি করে গেল? চানক সন্ধ্যা পাঁচটার পর খাদে আর লোক নামায় না তো?–
না তা নামায় না। এবং রাত্ৰি সাতটা পর্যন্ত চানক খোলা থাকে খাদের লোক শুধু উঠাবার জন্য।
এমনও তো হতে পারে শংকরবাবু। সেই দশটি লোক গত রাত্রে খাদ থেকে মোটে ওঠেইনি, খাদেই ছিল? হঠাৎ সুব্রত বলে।
Impossible. খনির কুলীদের একটা লিস্ট আছে নামের। খাদে যারা নামে ও কাজ শেষে খাদ থেকে উঠে আসে নামের registry-র সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয় তাদের নাম। এতে ভুলচুক হওয়া সম্ভব নয় সুব্রতবাবু।
কিন্তু আগে সব কিছুর খোঁজ নেওয়া দরকার শংকরবাবু। চলুন দেখা যাক খোঁজ নিয়ে, আসলে ব্যাপারটা কি।
বেশ চলুন।
তখনি দুজনে রামলোচন ও টুইলারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
পথ চলতে চলতে সুব্রত শংকরকে জিজ্ঞাসা করল, নামের রেজিস্ট্রি খাতা কার কাছে থাকে। শংকরবাবু?
সরকার বাবু! আমাদের বিমলবাবুর কাছে থাকে।
তিনিই তো নাম মিলিয়ে নেন?
হ্যাঁ।
তবে আগে চলুন বিমলবাবুর খোঁজটা নেওয়া যাক, তিনি হয়ত এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
চলুন।
শীতের সকাল। পথের দুপাশের কচি দুর্বদলগুলির গায়ে রাতের শিশির বিন্দুগুলি সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই খনির সীমানা পড়ে। ট্রাম লাইনের পাশে একটা শূন্য কয়লা গাড়ির চারদিকে একদল সাঁওতাল জটলা পাকাচ্ছে, সকলেরই মুখে একটা ভয়চকিত ভাব।
শংকরকে আসতে দেখে দলের মধ্যে একটা মৃদু গুণগুণ ধ্বনি জেগে উঠল।
কুলীদের সর্দার রতন মাঝি এগিয়ে এল।
কি খবর মাঝি? কিছু বলবি?
আমরা আর ইখানে কাম করতে লারব বাবু।
কেন রে?
ই খনিতে ভুত আছে বাবু। ভূত।
ওসব বাজে কথা, তাছাড়া কাজ ছেড়ে দিলে খাবি কি?
কিন্তুক তুরাই বল কেনে বাবু। প্ৰাণটি হাতে লিয়ে এমনি করে কেন্নে কাজ করি?
চন্দন সিং ও বিমলবাবু এসে হাজির হলেন।
এই যে বিমলবাবু, কাল রেজিস্ট্রী খাতা। আপনি মিলিয়ে ছিলেন তো? শংকর প্রশ্ন করল।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সকলে খাদ থেকে উঠে এসেছিল working hours-য়ের পরে-মানে, যারা কাল দিনের বেলায় কয়লা কাটতে খাদে নেমেছিল তারা সকলে আবার খাদ থেকে ফিরে এসেছিল তো?
তা এসেছিল বৈকি!
তবে এইরকম দুর্ঘটনা ঘটলো কি করে? সব শুনেছেন নিশ্চয়ই। চানিক যে চালায় সে লোকটা কোথায়?
কে, আবদুল?
হ্যাঁ।
সে চানক এর মেসিনের কাছেই আছে।
তাকে একবার ডেকে আনুন।
বিমলবাবু আবদুলকে ডাকতে চলে গেলেন।
রতন মাঝি আবার এগিয়ে এল। বাবু, আমরা কুলিকামিনরা আজ চলে যাবো রে।
তোদের কোন ভয় নেই। দুটো দিন সবুর কর, আমি সব ঠিক করে দেবো। ভূতটুত ওসব যে একদম বাজে কথা এ আমি ধরে দেবো। যা তোরা যে যার কাজে যা।
কিন্তু দেখা গেল। শংকরের আশ্বাস বাক্যেও কেউ কাজে যাবার কোন গরজই দেখাচ্ছে না।
তু কি বলছিস বাবু, আমি বোঙার নামে কিরা কেটে বলতে পারি এ খনিতে ভূত আছে।
এমন সময় বিমলবাবু আবদুল মিস্ত্রিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
আবদুলকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত সন্ধ্যায়। সে যথারীতি আটটার মধ্যেই চানক বন্ধ করে চলে গিয়েছিল এবং যতদূর জানে খাদে আর কেউ তখন ছিল না।
চানিকের এনজিনে চাবী দেওয়া থাকে না মিস্ত্রি?
জিজ্ঞাসা করল সুব্রত।
হ্যাঁ সাব।
চাবী কার কাছে থাকে?
আজ্ঞে আমার কাছেই তো।
আচ্ছা, আজ সকালে চানিকের। এনজিনের কাছে গিয়ে এনজিনে চাবী দেওয়া দেখতে পেয়েছিলে তো?
হ্যাঁ সাব।
চলুন শংকরবাবু, খাদের যে কাঁথিতে পিলার ধ্বসে গেছে সে জায়গাটা একবার ঘুরে দেখে আসি।
বেশ চলুন। আসুন বিমলবাবু, চল চন্দন সিং।
তখন সকলে মিলে খাদের দিকে রওনা হলো।
নেকড়ার পুটলি
এক, দো, তিন!!
কয়লা খাদের মুখে অনুসেটার ঘণ্টা বাজালে, এক, দো, তিন।
ঠং ঠং ঠংl… ঘণ্টার অদ্ভুত আওয়াজ এক, দো, তিন বলবার সঙ্গে সঙ্গে গম গম ঝন ঝন করে চানকের গহ্বরের স্তরে স্তরে প্রতিধ্বনিত হলো।
পাতালপুরীর অন্ধ-গহ্বর থেকে যেন মরণের ডাক এলো, আয়! আয়! আয়!
এ যেন এক অশরীরী শব্দমুখর হাতছানি।
রেজিং বাবু রামলোচন পোদ্দার চানকের মুখে আগে এসে দাঁড়াল।
তিনটি ঘণ্টার মানে মানুষ এবারে খাদে চানকের সাহায্যে নামবে তারই সংকেত।
চানকের রেলিং ঘেরা খাঁচার মত দাঁড়াবার জায়গায় শংকর, রেজিং বাবু, সুব্রত, রতন মাঝি ও আরো দুই জন সর্দার গ্যাসল্যাম্প নিয়ে প্রবেশ করল।
অন্ধকার গহ্বর পথে ঘড়ি ঘড় শব্দে চানক নামতে শুরু করল।
বাইরের রৌদ্রতপ্ত পৃথিবী যেন সহসা সামনে থেকে ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।
উপরের সুন্দর পৃথিবী যেন খাদের এই বীভৎস অন্ধকারের সঙ্গে আড়ি করে দিয়ে দূরে সরে গেছে।
সকলে এসে খাদের মধ্যে নামল।
কঠিন স্তব্ধ অন্ধকার। কালো কয়লার দেওয়ালে দেওয়ালে যেন মিশে এক হয়ে গেছে।
মৌন আঁধারে, মধ্যে শীতটা যেন আরো জমাট বেঁধে উঠেছে। সর্দার তিনজন গ্যাসল্যাম্প হাতে এগিয়ে চলল পথ প্ৰদৰ্শক হয়ে, অন্য সকলে চলল। পিছু পিছু। সম্মুখে ও আশপাশে কালো কয়লার দেওয়ালে সামান্য যেটুকু আলো গ্যাসল্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়েছে, তা ছাড়া চারিদিকে কঠিন মৌন অন্ধকার যেন কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় হাঁ করে গিলতে আসছে। সকলের পায়ের শব্দ অন্ধকারের বুকে শুধু যেন জীবনের একমাত্র সাড়া তুলেছে। এবং মাঝে মাঝে দু একটা কথার টুকরো তার কাটা কাটা শব্দ।
সহসা রতন মাঝি এক জায়গায় এসে দাঁড়াল।
১৩নং কাঁথিতে যাবার মেন গ্যালারী এইটাই না হে মাঝি? প্রশ্ন করলেন বিমলবাবু।
আজ্ঞে বাবু—
চালটা এখানে একটু খারাপ আছে না?
আজ্ঞে।
এখানে একটু সাবধানে আসবেন ম্যানেজারবাবু। এ পাশের লোকেশনটার কি ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখেছেন স্যার? শংকর নীরবে পথ চলতে লাগল। বিমলবাবুর কথার কোন জবাব দিল না।
পথের মধ্যে জল জমে আছে। সেই জল আশে পাশে দেওয়ালের গা বেয়ে চুয়ে চুয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে। জলের মধ্য দিয়ে হাঁটার দরুন জলের শাপ শপি শব্দ হতে লাগল।
আরো খানিকটা এগিয়ে মাঝি একটা সরু সুড়ঙ্গ পথের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, সামনেই গ্যাস ল্যাম্পের ত্ৰিয়মান আলোয় এক অপ্রশস্ত গুহাপথ যেন হাঁ করে মৃত্যু-ক্ষুধায় ওৎ পেতে আছে।
এই ১৩ নম্বর কাঁথি সাব। রতন মাঝি বললে।
হাতের গ্যাস ল্যাম্পটা আরো একটু উঁচু করে সুড়ঙ্গ পথের দিকে মাঝি পা বাড়াল, যাইয়ে সাব।
সুড়ঙ্গ পথে বেশীদূর অগ্রসর হওয়া গেল না। প্রকাণ্ড একটা কয়লার চাংড়া ধ্বসে পড়ে পথটা বন্ধ করে দিয়েছে। এবং সেই চাংড়ার তলা থেকে একটা সাঁওতাল যুবকের দেহের অৰ্দ্ধেকটা বের হয়ে আছে। বুক পিঠ এক হয়ে গেছে। কান ও মুখের ভিতর দিয়ে এক ঝলক রক্ত বের হয়ে এসে কালো কয়লা ঢালা পথের ওপরে কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। পাশেই একটা লোহার গাইতি পড়ে আছে।
সকলে স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।
শুধু এক সময় শংকরের বুকখানা কাঁপয়ে একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
প্রথমেই কথা বললেন বিমলবাবু, Rightly served. কথাটা যেন একটা তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতই সকলের অন্তরে গিয়ে বিঁধল।
বেটারা নিশ্চয়ই চুরি করে রাত্ৰে কয়লা তুলতে এসেছিল। কথাটা বললেন রেজিং বাবু রামলোচন পোদ্দার।
কিন্তু কোন পথে কেমন করে ওরা এল বলুন তো? প্রশ্ন করলেন সুব্রত, চানকে তো চাবী দেওয়াই ছিল।
ভূতুড়ে মশাই। সব ভূতুড়ে কাণ্ড কারখানা। বললে তো আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করবেন না মশাই। ভূতের কখনও চাবির দরকার হয়? এখন দেখুন। চানকে চাবি দেওয়া রইল, অথচ এরা দিব্যি খাদের মধ্যে এসে ঢুকল এবং মারা গেল। বিমলবাবু বললেন।
হুঁ চলুন। এবারে ফেরা যাক। আর এখানে থেকে কী হবে? চল মাঝি, শংকর বললে।
সকলে আবার ফিরে চলল। সুব্রত সকলের পিছনে চিন্তাকুল মনে অগ্রসর হলো। সহসা অন্ধকারে পায়ে কী ঠেকতে তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে দেখতেই কী যেন অন্ধকারে পথের ওপরে হাতে ঠেকাল। সুব্রত নিঃশব্দে সেটা হাতে তুলে নিয়ে আবার পথ চলতে লাগল।
বস্তুটা কাপড়ের পুঁটলি।
সুব্রত পুঁটলিটা জামার পকেটে ভরে নিল।
সকলে এসে আবার চানকের মুখে উপস্থিত হলো।
অনুসেটার আবার ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে চানকের সাহায্যে খাদের উপরে তুলে নিল।
সেদিনকার মত খাদের কাজ বন্ধ রাখবার আদেশ দিয়ে শংকর বাংলোয় ফিরে এল।
এক রাতের মধ্যে এতগুলো পর পর মৃত্যু শংকরকে যেন দিশেহারা করে দিয়েছে।
কী এখন সে করবে?
কোন পথে কাজ শুরু করবে? ধাংলোয় ফিরে খনির কর্তা সুধাময় চৌধুরীর কাছে একটা জরুরী তার করে দিল।
পুঁটলি রহস্য
সুব্রত এসে বাংলোয় নিজের ঘরে ঢুকল।
নানা এলোমেলো চিন্তায় সেও যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা নিছক একটা অ্যাকসিডেণ্ট না অন্য কিছু। কিন্তু সবচাইতে আশ্চর্য, লোক গেল কি করে খাদের মধ্যে।
নাঃ ব্যাপারটাকে যতটা সহজ ভাবা গিয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে ঠিক ততটা নয়।
চাকরকে এককাপ গরম চা দিতে বলে শংকর ইজিচেয়ারটার ওপরে গাটা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগল।
চিন্তা করতে করতে কখন এক সময় জাগরণ-ক্লান্ত দুচোখের পাতায় ঘুমের চুলুনি নেমেছে তা ও টেরই পায়নি। ভৃত্যের ডাকে চোখ রাগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল।
বাবুজি, চা।
ভৃত্যের হাত থেকে ধূমায়িত চায়ের কাপটা নিয়ে সামনের একটা টিপিয়ের ওপরে সুব্রত নামিয়ে রাখল।
তৃত্য ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
খোলা জানোলা পথে রৌদ্র কলঙ্কিত শীতের সুন্দর প্রভাত। দূরে কালো পাহাড়ের অস্পষ্ট ইশারা। ওদিকে ট্রাম লাইনে পর-পর কয়খানা খালি টবগাড়ি-কয়েকটা সাঁওতাল যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। চা পান শেষ করে সুব্রত উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা এঁটে জামার পকেট থেকে খনির মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া ন্যাকড়ার ছোট্ট পুটলিটা বের করল।
একটা আধময়লা রুমালের ছোট পুঁটলি।
কম্পিত হস্তে সুব্রত পুঁটলিটা খুলে ফেলল।
পুঁটলিটা খুলতেই তার মধ্যকার কয়েকটা জিনিস চোখে পড়ল। একটা মাঝারি গোছের ডিনামাইট, একটা পলতে, একটা টর্চ!…
আশ্চর্য, এগুলো খনির মধ্যে কেমন করে গেল।
ডিনামাইট কেন?…সুব্রত ভাবতে লাগল। ডিনামাইট সাধারণতঃ খাদের মধ্যে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধ্বসাবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সঙ্গে পলতেও একটা দেখা যাচ্ছে। এই ডিনামাইটের সঙ্গে পলতের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধ্বসানোর সুবিধা হয়।
টর্চ।…এটা বোধ হয়। অন্ধকারে পথ দেখাবার জন্য। তবে কি কেউ গোপনে রাত্রে এই সব সরঞ্জাম নিয়ে খাদে গিয়েছিল কয়লার চাংড়া ধ্বসাতে?..নিশ্চয়ই তাই-কিন্তু ধ্বসাতেই যদি কেউ গিয়ে থাকবে। তবে, এগুলো সেখানে ফেলে এলো কেন?–তবে কি ধ্যবসায়নি? না ধ্বসিয়ে চলে এসেছিল?-কিন্তু এমনও তো হতে পারে আরো ডিনামাইট, আরো পলতে ছিল, একটায় যদি না হাসিল হয় তবে এটার দরকার হতে পারে এই ভেবে বেশী ডিনামাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? তারপর হয়ত একটাতেই কাজ হয়ে যেত, এটার আর দরকার হয়নি, তাড়াতাড়িতে এটা ফেলেই চলে এসেছে।—কিন্তু কোন পথ দিয়ে লোকটা খনির মধ্যে ঢুকল। ঢুকবার তো মাত্র একটিই পথ। চানকের সাহায্যে! চানকের চাবী কার কাছে থাকে? আবদুল মিস্ত্রি বললে তার কাছেই থাকে। চাবীটা এমন কোন মূল্যবান চাবী নয়, বা কোন প্রাইভেট ঘরের চাবী নয়, সামান্য চানকের চাবী।-চাবীটা রাত্রে চুরি করা এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এবং কাজ শেষ হয়ে যাবার পর যথাস্থানে চাবীটা আবার রেখে আসাও দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়…তাহলে দেখা যাচ্ছে ভূত নয়। মানুষেরই কাজ। কিন্তু এর সঙ্গে লোকগুলো মারা যাবার কী সম্পর্ক আছে? তবে কি।–সহসা চিন্তার সূত্র ধরে একটা কথা সুব্রতর মনের কোঠায় এসে উঁকি দিতেই, সুব্রতর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চয়ই তাই।–কিন্তু রুমালটা? রুমালটা কার?–সুব্রত রুমালখানি সজাগ দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করতে লাগল।
রুমালখানি আকারে ছোটই। হাতে সেলাই করা সাধারণ লংকুথের টুকরো দিয়ে তৈরী রুমাল। রুমালে একধারে ছোট অক্ষরে লাল সূতায় ইংরাজি অক্ষর S, C.
এক কোণে ধোপার চিহ্ন রয়েছে।…
সুব্রতর মাথার মধ্যে চিন্তাজাল জন্ট পাকাতে লাগল। কবি রুমাল! কার রুমাল! S, C নামের। initial যার তার পুরো নাম কি হতে পারে? শশাঙ্ক, শংকর, শশধর, শরদিন্দু, শরৎ, শশি, শচীন, শৈলেশ কিংবা সনৎ, সুকুমার, সমীর, সুধাময়। কে! কে! কিন্তু এমনও তো হতে পারে অন্য কারো রুমাল চুরি করে আনা হয়েছিল, তবে?
…সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যোগসূত্র এলোমেলো হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক…আসতেই হবে! সে আসবে! আসবে!
অবশ্যম্ভাবী একটা আশু ঘটনার সম্ভাবনায় সুব্রতর সর্বশরীর সহসা যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে!
সুব্ৰত চেয়ার ছেড়ে ওঠে, ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করে দেয় দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে।
বাইরে গোলমাল শোনা গেল।
পুলিশের লোক এসে গেছে অদূরবর্তি কাতরাসগড় স্টেশন থেকে।
চঞ্চলপদে পুঁটলিটা আবার পূর্বের মত বেঁধে সুব্রত সেটা নিজের সুটকেসের মধ্যে ভরে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল।
দারোগাবাবু সকলের জবানবন্দী নিয়ে, ধাওড়ার লাস ময়না তদন্তের জন্য চালান দিয়ে খাদের লাসগুলো উদ্ধারের একটা আশু ব্যবস্থা করবার জন্য শংকরবাবুকে আদেশ দিয়ে চলে গেলেন।
সুব্রত যাবার সময় তার পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে অনুরোধ জানাল : এখানে ইতিপূর্বে যে সব ম্যানেজারবাবু খুন হয়েছেন তঁদের ময়না তদন্তের রিপোর্টগুলো সংক্ষেপে মোটামুটি যদি জানান। তবে তার বড্ড উপকার হয়। দারোগাবাবু সুব্রতর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং যাবার সময় বলে গেলেন, নিশ্চয়ই, একথা বলতে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কত যে খুশী হলাম। কালই আপনাকে রিপোর্ট একটা মোটামুটি সংগ্রহ করে লিখে পাঠাব।
সুব্রত বললে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পুলিশের লোক হয়েও যে আপনি এত উদার, সত্যই আশ্চর্যের বিষয়। কিরিটী যদি এখানে আসে। তবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে সংবাদ পাঠাবো। এসে আলাপ করবেন। আচ্ছা! নমস্কার।
আঁধার রাতের পাগল
সুব্রত শংকরবাবুর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে অলক্ষ্যে চানকের ওপরে দুজন সাঁওতালকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করল।
বিকালের দিকে সুধাময়বাবুর সেক্রেটারী কলকাতা থেকে তার করে জবাব দিলেনঃ কর্তা বর্তমানে কলকাতায় নেই। তিনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। কর্তা কলকাতায় ফিরে এলেই তাঁকে সংবাদ দেওয়া হবে। তবে কর্তার হুকুম আছে কোন কারণেই যেন, যত গুরুতরই হোক খনির কাজ না বন্ধ রাখা হয়।
রাতে শংকর সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায় বলুন, সুব্রতবাবু। কাল থেকে তা হলে আবার খনির কাজ শুরু করে দিই?
হ্যাঁ দিন। দুচার দিনের মধ্যে আমার তো মনে হয়। আর খুনটুন হবে না।
শংকর হাসতে হাসতে বললে, আপনি গুণতে পারেন নাকি সুব্রতবাবু?
না, গুণতে ফুনতে জানি না মশাই। তবে চারিদিককার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি মাত্র। বলতে পারেন স্রেফ অনুমান।
যাহোক, শংকর খনির কাজ আবার পরদিন থেকে শুরু করাই ঠিক করলে এবং বিমলবাবুকে ডেকে যাতে আগামী কাল ঠিক সময় থেকেই নিত্যকার মত খনির কাজ শুরু হয়। সেই আদেশ দিয়ে দিল।
বিমলবাবুকঁচুমাচু ভাবে বললে,আবার ঐ ভূতপ্ৰেতগুলোকে চটাবেন স্যার। আমি আপনার most obedient servant, যা দেবেন, with life তাই করবো। তবে আমার মতে এ খনির কাজ চিরদিনের মতো একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু ভাল ছিল স্যার। ভূতপ্রেতের ব্যাপার। কখন কি ঘটে যায়।
শংকর হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ভূতেরও ওঝা আছে বিমলবাবু। অতএব মা ভৈষী। এখন যান সব ব্যবস্থা করুনগে যাতে কাল থেকে আবার কাজ শুরু করতে পারে।
কিন্তু স্যার।
যান যান রাত্রি হয়েছে। সারারাত কাল ঘুমুতে পারিনি।
বেশ। তবে তাই হবে। আমার আর কী বলুন? আমি আপনাদের most obedient and humble servant বইত নয়।
বিমলবাবু চলে গেলেন।
বাইরে শীতের সন্ধ্যা আসন্ন হয়ে এসেছে। সুব্রত কোমরে রিভলভারটা গুঁজে গায়ে একটা কালো রঙের ফারের ওভারকেট চাপিয়ে পকেটে একটা টর্চ নিয়ে বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়াল।
পায়ে চলা লাল সুরকির রাস্তাটা কয়লা গুড়োয় কালচে হয়ে ধাওড়ার দিকে বরাবর চলে গেছে।
সুব্রত এগিয়ে চলে, পথের দুপাশে অন্ধকারের মধ্যে বড় বড় শাল ও মহুয়ার গাছগুলো প্রেতিমূর্তির মত নিঝুম হয়ে যেন শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতায় পাতায় জোনাকির আলো, জ্বলে আর নিভে, নিভে আর জ্বলে। গাছের পাতা দুলিয়ে দূর প্রান্তর থেকে শীতের হিমের হাওয়া হিল হিল করে বহে যায়।
সর্বাঙ্গ শির শির করে ওঠে।
কোথায় একটা কুকুর শীতের রাত্রির স্তব্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে।
সুব্ৰত এগিয়ে চলে।
অদূরে পাঁচ নম্বর কুলি-ধাওড়ার সামনে সাঁওতাল পুরুষ ও রমণীরা একটা কয়লার অগ্নিকুণ্ড জেলে চারিদিকে গোলাকার হয়ে ঘিরে বসে কী সব শলা পরামর্শ করছে। আগুনের লাল আভা সাঁওতাল পুরুষগুলোর খোদাই করা কালো পাথরের মত দেহের ওপরে প্রতিফলিত হয়ে দানবীয় বিভীষিকায় যেন রূপায়িত হয়ে উঠেছে।
তারও ওদিকে একটা বহু পুরাতন নীল-কুঠির ভগ্নাবশেষ শীতের ধুম্রােচ্ছন্ন অন্ধকারে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই অস্পষ্ট মনে হয়।
চারিদিকে বোয়ান গাছের জঙ্গল, তারই পাশ দিয়ে শীর্ণকায় একটি পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদী, তার শুষ্কপ্রায় শুভ্র বালু-রাশির উপর দিয়ে একটুখানি নির্মল জলপ্রবাহ শীতের অন্ধকার রাতে এঁকে বেঁকে আপনি খেয়াল খুশিতে অদূরবর্তী পলাশ বনের ভিতর দিয়ে বির বির করে কোথায় বহে চলেছে কে জানে?
পলাশ বনের উত্তর দিকে ৬ ও ৭ নম্বর কুলি ধাওড়া। সেখান থেকে মাদল ও বাঁশীর আওয়াজ শোনা যায়।
সহসা অদূরবর্তী মহুয়া গাছগুলির তলায় ঝরা পাতার ওপরে একটা যেন সজাগ সতর্ক পায়ে চলার খস-সি শব্দ পেয়ে সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
বুকের ভিতরকার হৃদপিণ্ডটা যেন সহসা প্রবল এক ধাক্কা খেয়ে থমকে থেমে গেল।
পকেটে হাত দিয়ে সুব্রত টাৰ্চটা টেনে বের করল।
যে দিক থেকে শব্দটা আসছিল ফস করে সেই দিকে আলোটা ধরেই বোতাম টিপে দিল।
অন্ধকারের বুকে টর্চের উজ্জ্বল আলোর রক্তিম আভা মুহূর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অট্টহাসি হেসে ওঠে।
কিন্তু ও কে?…অন্ধকারে পলাশ গাছগুলোর তলায় বসে অন্ধকারে কী যেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে খুঁজছে।
আশ্চর্য। এই অন্ধকারে পলাশ বনের মধ্যে আমন করে লোকটা কী খুঁজছে?
সুব্ৰত এগিয়ে গেল। লোকটা বোধ করি পাগল হবে।
এক মাথা বঁকড়া বঁকড়া এলোমেলো বিস্রস্ত জট পাকান চুল। মুখ, ধূলো বালিতে ময়লা হয়ে গেছে এবং মুখে বিশ্ৰী দাড়ি। গায়ে একটা বহু পুরাতন ওভারকেট, শতছিন্ন ও শত জায়গায় তালি দেওয়া। পিঠে একটা ন্যাকড়ার ঝুলি, পরনেও একটা মলিন প্যান্ট।
সুব্রত টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।
এই, তুই কে রে? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে।
কিন্তু লোকটা কোন জবাবই দেয় না। সুব্রতর কথায় শুকনো ঝরে পড়া শালপাতাগুলো একটা ছোট লাঠির সাহায্যে সরাতে সরাতে কী যেন আপন মনে খুঁজে বেড়ায়।
এই তুই কে?
সুব্রত টর্চের আলোটা লোকটার মুখের উপর ফেলে। সহসা লোকটা চোখ দুটো বুজিয়ে চকচকে দুপাটি দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।
লোকটা কেবল হাসে।
হাসি যেন আর থামতেই চায় না। হাসছে তো হাসছেই। সুব্রতও সেই হাসিভরা মুখটার ওপরে আলো ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে নিতান্ত বোকার মতই চুপ করে।
সুব্রত আলোটা নিভিয়ে দিল।
সহসা লোকটা ভাঙ্গা গলায় বলে ওঠে, তু কি চাস বটে রে বাবু!
সুব্ৰত বোঝে লোকটা সাঁওতাল, বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে।
তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?
আমার নাম রাজা বটে …থাকি উই-যেথা মারাংবরু রইছে।
এখানে এই অন্ধকারে কি করছিস?
তাতে তুর দরকারডা কী? যা ভাগ।
সুব্রত দেখলে সরে পড়াই ভাল। পাগল। বলা তো যায় না। সুব্ৰত সেখান থেকে চলে এল।
পলাশ বন ছাড়ালেই ৬ নং কুলীর ধাওড়া।
রতন মাঝি সেখানেই থাকে।
পলাশ ও শালবনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কুলিধাওড়ার সামনে প্ৰজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের লাল রক্ত আভাস।
মাদলের শব্দ কানে এসে বাজে, ধিতাং! ধিতাং!
সঙ্গে সঙ্গে বাঁশীতে সাঁওতালী সুর।
সারাদিন খাদে ছুটি গেছে, সব আনন্দ উৎসবে মত্ত হয়ে উঠেছে।
ধাওড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা কালো কুকুর ঘেউ-উ-উ করে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি সাঁওতাল যুবক এগিয়ে এল, কে বটে। রে? আঁধারে ঠাওর করতে লারছি। রা করিস না কেনে?
রতন মাঝি আছে? সুব্রত কথা বলে।
আরে বাবু। ও পিনটু, বাবুকে বসবার জায়গা দে। বসেন আইজ্ঞ। রতন মাঝি সুব্রতর সামনে এগিয়ে আসে।
আধো আলো আধো আঁধারে মাঝির পেশল কলো দেহটা একটা যেন প্রেতের মতই মনে হয়।
কিছু সংবাদ আছে মাঝি?
না বাবু। সারাটি দিনমানই রইলাম বটে।
সুব্রত আরো কিছুক্ষণ রতন মাঝির সঙ্গে দুচারটা আবশ্যকীয় কথা বলে ফিরল।
অদৃশ্য আততায়ী
সেই আগেকার পথ ধরেই সুব্রত আবার ফিরে চলেছে। আকাশে কাস্তের মত সরু এক ফালি চাদ জেগেছে, তারই ক্ষীণ জ্যোৎস্না শীতার্ত ধরণীর ওপরে যেন স্বপ্নের মতই একটা আলোক ওড়না বিছিয়ে দিয়েছে। পলাশ ও মহুয়া বনে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো চাঁদের আলোর আলপনা। বনপথে যেন আলোর আলপনা ঢাকাই বুটি বুনে দিয়েছে। মাদল ও বাঁশীর শব্দ তখনও শোনা যায়।
সুব্রত অন্যমনস্ক ভাবেই ধীরে ধীরে পথ চলছিল, সহসা সোঁ করে কানের পাশে একটা তীব্র শব্দ জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই স্তব্ধ আলোছায়া ঘেরা বনতল প্ৰকম্পিত করে বন্দুকের আওয়াজ জেগে উঠলঃ গুড়ুম।…এবং সঙ্গে সঙ্গে করে যেন আর্ত চীৎকার কানে এল। সুব্রত থমকে হতচকিত হয়ে থেমে গেল।
প্রথমটায় সে এতখানি বিচলিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল যে ব্যাপারটা যেন ভাল করে কোন কিছু বুঝে উঠতেই পারে নি। পরক্ষণেই নিজেকে নিজে সামলে নিয়ে, কোমরবন্ধে লোডেড রিভলভারটা ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে যে দিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। কিছু দেখা যায় না বটে। তবে শুকনো পাতার ওপরে একটা ঝটপটির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সুব্রত রিভলভারটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে টর্চটা জ্বালল এবং টর্চের আলো ফেলে সন্তপণে এগিয়ে গেল, শব্দটা যে দিক থেকে আসছিল। সেই দিকে।
অল্প খুঁজতেই সুব্রত দেখলে একটা পলাশ গাছের তলায় কে একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছট্ফট্ করছে।
সুব্রত লোকটার গায়ে আলো ফেললে।
লোকটা একজন সাঁওতাল যুবক।
লোকটার ডানদিকের পাঁজরে গুলি লেগেছে।
তাজা লাল টকটকে রক্তে বনতলের মাটির অনেকটা সিক্ত হয়ে উঠেছে।
লোকটার পাশেই একটা সঁওতালী ধনুক ও কতকগুলো তাঁর পড়ে আছে।
সুব্রত লোকটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু সাঁওতালটাকে চিনতে পারল না।
লোকটা ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে প্ৰায় শেষ হয়ে এসেছে। দুএকবার ক্ষীণ অস্ফুট স্বরে কী যেন বিড় বিড় করে বলতে বলতে হতভাগ্য শেষ নিশ্বাস নিল।
সুব্রত নেড়ে চেড়ে দেখলে, শেষ হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস সুব্রতর বুকখানাকে কাঁপয়ে বের হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়াল। টর্চের আলো ফেলে ফেলে আশে পাশের বন ও ঝোঁপ ঝাড় দেখলে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
হতভাগা সাঁওতালটা বন্দুকের গুলি খেয়ে মরেছে এবং স্বকৰ্ণে সে বন্দুকের গুলির আওয়াজও শুনতে পেয়েছে।
কিন্তু কে মারলে? কেনই বা মারলে?
নানাবিধ প্রশ্ন সুব্রতর মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল। কিন্তু এটা ঠিক, যেই মেরে থাক সে সশস্ত্ৰ।
অন্ধকার বনপথে সুব্রতর কাছে লোডেড রিভলভার থাকলেও সে একা। তার উপর এখানকার পথ ঘাট তার তেমন ভাল চেনা নয়। অলক্ষ্যে বিপদ আসতে কতক্ষণ? আর বিপদ যদি আচমকা অন্ধকার আশপাশ থেকে এসেই পড়ে। তবে তাকে ঠেকানও যাবে না। অথচ এত বড় একটা দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এমনি করে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাও সমীচীন নয়। অতএব এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল।
সুব্রত সজাগ হয়ে উঠল।
টর্চের আলো জ্বলে সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে দেখতে দেখতে সে এগিয়ে চলল।
কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!
কেবলই একজনের পর একজন খুন হচ্ছে। কারা এমনি করে নৃশংসভাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
কিসের প্রয়োজনেই বা এমনি ভয়ঙ্কর খেলা? কিন্তু পথ চলতে একটু আগে যে সে করে শব্দটাকে সে কানের পাশে শুনেছিল সেটাই বা কিসের শব্দ?
কিসের শব্দ হতে পারে?
নানা রকম ভাবতে ভাবতে সুব্রত অন্ধকার শালবনের পথ ধরে যেন বেশ একটু দ্রুত পদেই অগ্রসর হতে থাকে। রাত্ৰি কটা বেজেছে কে জানে? আসবার সময় তাড়াতাড়িতে হাত-ঘড়িটা পর্যন্ত আনতে মনে নেই। খানিকটা দ্রুত হেঁটে শালবন পেরিয়ে সুব্রত পাহাড়ী নদীটার ধারে এসে নামল।
মাথার উপরে আকাশের বুকে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় যেন একটা সূক্ষ্ম রূপালি পর্দা থির থির করে কাঁপছে। কোথাও কুয়াশার লেশ মাত্ৰ নাই। দুরে সাঁওতাল ধাওড়া থেকে একটানা একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।
শীতের পাহাড়ী নদী, একেবারে জল নেই বললেই হয়। অনেকটা পর্যন্ত শুধু বালি আর বালি। নদীটা হেঁটেই সুব্রত পার হয়ে গেল।
সামনেই একটা প্ৰান্তর। প্রান্তর অতিক্রম করে সুব্রত চলতে লাগল। আনমনে চিন্তা করতে করতে কতটা পথ সুব্ৰত এগিয়ে এসেছে তা টের পায়নি; সহসা অদূরে আবছা চাঁদের আলোয় প্রান্তরের মাঝখানে দৃষ্টি পড়তেই সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
এখানে আসবার পরের দিন সন্ধ্যার দিকে প্ৰান্তরের মাঝে বেড়াতে বেড়াতে যে ভয়ঙ্কর মুর্তিটা দেখেছিল অবিকল সেই মূর্তিটাই যেন লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে জনহীন মৃদু চন্দ্রালোকে প্রান্তরের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলেছে। সুব্রত ক্ষণেক দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল, তারপরই কোমরের লেদার কেস থেকে অটোমেটিক রিভলভারটা বের করে অদূরের সেই চলমান মূর্তিটাকে লক্ষ্য করে রিভলভারের ট্রিগার টিপল।
নির্জন প্ৰান্তরের অন্ধকারে একঝলক আগুনের শিখা উদগিরণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে একটা আওয়াজ ওঠে-গুড়ুম।
সঙ্গে সঙ্গে প্ৰান্তরকে ভয়চকিত করে ক্ষুধিত শার্দুলের ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল। পর পর তিন বার।
চমকে উঠতেই সুব্রত চকিতের জন্য চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে ফেলেছিল; কিন্তু পরক্ষণেই যখন চোখের পাতা খুলল, দেখল। দ্রুত হাওয়ার মতোই সেই মূর্তি ক্ৰমে দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
মূর্তিটিকে যে জায়গায় দেখা গিয়েছিল। সেই দিকে লক্ষ্য করে সুব্রত রিভলভারটা হাতে নিয়ে দৌড়াল।
আন্দাজমত জায়গায় এসে পৌঁছে সুব্রত টর্চটা জেলে চারিদিকের মাটি ভাল করে লক্ষ্য করে দেখতে লাগল।
সহসা ও লক্ষ্য করলে প্ৰান্তরের শুকনো মাটির ওপরে তাজা রক্তের কয়েকটা ফোঁটা ইতস্তত দেখা যাচ্ছে।
রক্ত! তাজা রক্তের ফোঁটা! তাহলে সত্যিই ভূত নয়, দৈত্য দানব বা পিশাচ নয়। সামান্য রক্ত মাংসের দেহধারী মানুষ। কিন্তু জখম হয়নি। সামান্য আঘাত লেগেছে মাত্র। কিন্তু পালাবে কোথায়?
এই যে মাটির ওপরে রক্তের ফোঁটা ফেলে গেল এইটাই তার নিশানা দেবে। যেখানে যতদূর পালাক না কেন হাওয়ায় উবে যেতে পারবে না।
একদিন না একদিন ধরা দিতেই হবে। কেননা আঘাত যত সামান্য হোক না কেন, আহত হয়েছে। এ অবধারিত; এবং সেই জন্যই বেশী দূর পালান সম্ভব হবে না।
কিন্তু শার্দুলের ডাক!
ব্যাপারটা কী?
অবিকল শার্দুলের ডাক।
সহসা সোঁ-সাৎ করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ সুব্রতর কানের পাশে দিয়ে যেন বিদ্যুতের মত চকিতে মিলিয়ে গেল।
সুব্রত চমকে উঠে এক লাফে সরে দাঁড়াল। এবং সরে দাঁড়াতে গিয়েই পাশে অদূরে মাটির দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট তীরের ফলা অর্ধেক মাটির বুকে প্রোথিত হয়ে থির থির করে কাঁপছে।
সুব্রত নীচু হয়ে হাত দিয়ে তীরটা ধরে একটান দিয়ে মাটির বুক থেকে তুলে নিল।
তীরের তীক্ষ্ণ চেপটা অগ্রভাগে মাটি জড়িয়ে গেছে। এতক্ষণে সুব্রত বুঝতে পারলে একটু আগে শালবনের মধ্যে অতর্কিতে যে শব্দ শুনেছিল সেও একটা তীর ছোটারই শব্দ এবং সেই তীরটাও তাকে মারবার জন্যই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বুঝতে আর কষ্ট হয় না।
শত্রুপক্ষ তাহলে সুব্রতর ওপরে বিশেষ নজর রেখেছে এবং তাকে মারবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তীরটা হাতে নিয়ে সুব্রত সটান বাংলোর দিকে পা। চালিয়ে দিল।
সুব্রত এসে বাংলোয় যখন প্রবেশ করল, শংকর তখন ঘরে টেবিলের ওপরে এক রাশি কাগজপত্র ছড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন দেখছে।
শংকর বাবু! সুব্রত ঘরের মধ্যে পা দিয়ে ডাকিল।
কে?…ও, সুব্রত বাবু? এত রাত করে, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ—
একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম ঐ নদীর দিকটায়।
সামনেই একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়ে, সুব্রত পা দুটো টান করতে করতে বললে।
এতক্ষণ এই অন্ধকারে সেখানেই ছিলাম?
হ্যা–
কথাটা বলে সুব্রত হাতের তীরটা টেবিল ল্যাম্পের অত্যুজ্জ্বল আলোর সামনে উঁচু করে তুলে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল।
সুব্রতর হাতে তীরটা দেখে শংকর সবিস্ময়ে বললে, ওটা আবার কী? কোথায় পেলেন?
সুব্রত তীরটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করতে করতেই মৃদু স্বরে জবাব দিল, মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে পেলাম।
মাঠের মধ্যে তাঁর কুড়িয়ে পেলেন? তার মানে? শংকর বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করল।
মানে আবার কী? কেন মাঠের মধ্যে একটা তাঁর কুড়িয়ে পেতে নেই নাকি?
শংকর এবারে হেসে ফেলল, তা তো আমি বলছি না; আসল ব্যাপারটা কী তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার কী মনে হয় জানেন? সুব্রত বললে শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ।
কী?
এই তীরের ফলায় নিশ্চয়ই কোন তীব্ৰ বিষ মাখান আছে এবং সে বিষ সাধারণ কোন সুস্থ মানুষের শরীরের রক্তে প্ৰবেশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু অবধারিত।
কি বলছেন সুব্রতবাবু?
শংকর জিজ্ঞাসু সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
মনে হওয়ার কারণ আছে শংকরবাবু। সুব্রত গভীর স্বরে বললে।
বুঝতে পারছি না। ঠিক আপনার কথা সুব্রত বাবুকোন এক হতভাগ্যের উদেশে এই বিষাক্ত তাঁর নিক্ষেপ করে তার জীবনের ওপরে attempt করা হয়েছিল।
সর্বনাশ বলেন কী?
হ্যাঁ, কিন্তু তার আগে অর্থাৎ বিস্তারিত ভাবে আপনাকে সব কিছু বলবার আগে এক কাপ চা-দীর্ঘ পথ হেঁটে গলাটা শুকিয়ে গেছে।
O! Surely! এক্ষুনি। বলতে বলতে শংকর সামনের টেবিলের ওপরে রক্ষিত কলিং বেল টিপল।
ভৃত্য এসে খোলা দরজার ওপরে দাঁড়াল। সাহেব আমাকে ডাকছেন?
এই শীগগির সুব্রতবাবুকে এক কাপ গরম চা এনে দে।
আনছি। সাহেব। ভূত্য চলে গেল। ভৃত্যকে চায়ের আদেশ দিয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শংকর দখলে, চেয়ারের ওপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সুব্রত গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে।
ময়না তদন্তের রিপোর্ট
টেবিলের ওপর সুব্রতর আনীত তীরটা পড়েছিল। শঙ্কর সেটা টেবিলের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে দেখতে লাগল।
তীরটা ছুঁড়ে কোন এক হতভাগ্যের life-এর ওপর নাকি attempt করা হয়েছিল। কে attempt করল? কার life-এর ওপরেই বা attempt করল? কেনই বা attempt করল? আশ্চর্য!
সহসা একসময় সুব্রত চোখ খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে শংকরের হাতে তীরটা দেখতে পেয়ে চমকে বলে উঠলো, আরে সর্বনাশ!! করছেন কী? তারপর কি একটা বিপরীত কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন। রাখুন, রাখুন, তীরটা রেখে দিন। কে জানে কী ভয়ঙ্কর বিষ তীরের ফলায় মাখান আছে।
শংকর একপ্রকার থতিমত খেয়ে তীরটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল। এমন সময় তৃত্য গরম চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে কাপটা টেবিলের ওপরে সুব্রতর সামনে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। সুব্রত ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিল।
আঃ! একটা আরামের নিঃশ্বাস ছেড়ে সুব্রত শংকরের মুখের দিকে তাকল, ওই যে তীরটা দেখছেন শংকরবাবু, একটু আগে কোন এক অদৃশ্য আততায়ী ওটা ছুঁড়ে আমাকে ভবপারাবারে পাঠাতে চেয়েছিল।
বলেন কি? শংকর চমকে উঠল।
আর বলি কি? খুব বরাত এ যাত্রায় বেঁচে যাওয়া গেছে। শুধু এক বার নয়, দুবার তাঁর ছুঁড়ে আমার জীবন সংশয় ঘটানর সাধু প্রচেষ্টা করেছিল।
তারপর?
আতঙ্কে শংকরের সর্বশরীর তখন রোমাঞ্চিত।
তারপর আর কী? দুটোর একটা attempt ও successful হয় নি–প্রমাণ এখনও শ্ৰীমান সুব্রত রায় আপনার চোখের সামনেই স্ব-শরীরে বর্তমান।
তা যেন হলো-কিন্তু এ যে ব্যাপার ভয়ানক দাঁড়াচ্ছে ক্ৰমে সুব্রতবাবু। শেষকালে কি এলোপাথাড়ি হাতের সামনে যাকে পাবে তাকেই মারবে।
মারতে পারুক ছাঁই না পারুক সাধু প্রচেষ্টার অভাব যে হবে না, একথা কিন্তু হলফ করে বলতে পারি মিঃ সেন। সুব্রত বললে।
কিন্তু এ ভাবে একদল ভয়ঙ্কর অদৃশ্য খুনেদের সঙ্গে কারবার করাও তো বিপজ্জনক। মুখোমুখী এসে দাঁড়ালেও না হয় এদের শক্তি পরীক্ষা করা যেতো। কিন্তু এ গরিলা যুদ্ধের মত।
মেঘনাদ যিনি তিনি হয়ত সামনা সামনি দাঁড়িয়েই কল টিপছেন; আর কতকগুলো পুতুলকে কোমরে দড়ি বেঁধে যখন যেমন যে দিকে নাচাচ্ছেন তেমনি নাচছে; সুব্রত বলে।
কিন্তু মেঘনাদটি কে? শঙ্কর সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।
আরে মশাই সেটাই যদি জানা যাবে। তবে এত হাঙ্গামাই বা আমাদের পোহাতে হবে কেন? সুব্ৰত হাসতে হাসতে জবাব দিল।
তারপর সহসা হাসি থামিয়ে যথা সম্ভব গভীর হয়ে সুব্রত বললে, আজ আবার একটি হতভাগ্য প্ৰাণ নিতে এসে প্ৰাণ দিয়েছে।
সে কি!…
হাঁ। বেচারা আমাকে মারতে এসে নিজে প্ৰাণ দিয়েছে; সুব্রত বললে।
বলেন কী? … তা কেমন করে জানলেন?
হতভাগ্যের মৃতদেহ এখনও শালবনের মধ্যে পড়ে আছে।
পুলিশে একটা খবর দেওয়া তো দরকার। শংকর বললে।
তা দরকার বই কি। পুলিশ জাতটা বড় সুবিধার নয়। আগে থেকে সংবাদ একটা দিয়ে রাখাই আমার মতে ভাল; কেননা নয় কে হয় ও হয় কে নয় করতে তাদের জোড়া আর কেউ নেই।
কিন্তু এত রাত্রে কাকে থানায় পাঠান যায় বলুন তো? Bus তো সেই রাত্রে দেড়টায়। … ধারে কাছে তো থানা নেই? সেই একদম কাতরাসগড়, নয় তেঁতুলিয়া হল্টে।–তা ছাড়া ব্যাপার ক্রমে যা দাঁড়াচ্ছে, কোন চেষ্টাকেই যেন আর বিশ্বাস করা যায় না।
কিন্তু থানায় লোক পাঠাতে আর হলো না; তৃত্য এসে সংবাদ দিলে থানার দারোগাবাবুর কাছ থেকে একজন লোক এসেছে; সুব্রতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চায়।
আমার সঙ্গে? সুব্ৰত উঠে দাঁড়াল।
বাইরে এসে দেখলে, একজন চৌকিদার অপেক্ষা করছে।
তুমি? সুব্রত প্রশ্ন করলে।
আজ্ঞে, দারোগাবাবু আপনার নামে একটা চিঠি দিয়েছেন।
একটা মোটা মুখবন্ধ On His Majestys Service খাম লোকটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে ধরল।
সুব্রত খামটা হাতে করে ঘরে ঢুকতেই শংকর বললে, কী ব্যাপার সুব্রতবাবু?
দারোগাবাবু একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। ভাল কথা, দেখুন তো লোকটা চলে গেল নাকি?
কেন?
তাড়াতাড়ি চাকরিটাকে জিজ্ঞাসা করুন।
এই ঝুমন। শংকর ডাকল।
বাবু। … ঝুমন দরজার ওপরে এসে দাঁড়াল।
চৌকিদারটা কি চলে গেছে?
আজ্ঞে না। চুটিয়া খাচ্ছে।
তাকে একটু দাঁড়াতে বল।
কুমন চলে গেল।
ব্যাপার কী? … শংকর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
এই লোকটার হাতেই দারোগাবাবুকে শাল-বনের খুন সম্পর্কে একটা খবর দিয়ে দিন না। তা হলে আর লোক পাঠাতে হয় না।
ঠিক বলেছেন।
শংকর তাড়াতাড়ি একটা চিঠির কাগজে সংক্ষেপে শালবনের খুন সম্পর্কে যতটা সুব্রতর কাছে শুনেছিল লিখে চৌকিদারের হাতে দিয়ে দিল দারোগাবাবুকে গিয়ে দেবার জন্য।
চৌকিদার চলে গেল।
সুব্রত খামটা খুলে দেখলে গোটা তিন-চার পুলিশ মর্গের রিপোর্ট ও তার সঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট।
সুব্রতবাবু!
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাঠালাম। কাজ হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি পারেন ফেরত দিলে সুখী হবো। আর দয়া করে কিরীটীবাবু এলে একটা সংবাদ দেবেন। কতদূর এগুলো? নমস্কার।
কিসের চিঠি সুব্রতবাবু? শংকর প্রশ্ন করল।
এখানে ইতিপূর্বে যে সব ম্যানেজার মারা গেছেন তঁদের ময়না তদন্তের রিপোটি।
ঠাকুর এসে বললে, খাবার প্রস্তুত।
দুজন উঠে পড়ল।
খাওয়া দাওয়ার পর, সুব্রত মাথার ধারে একটা টুলের ওপরে টেবিল ল্যাম্পটা জুলিয়ে কম্বলে গা ঢেকে শুয়ে পড়ল।
তারপর আলোর সামনে রিপোর্টগুলো খুলে এক এক করে পড়তে লাগল।
মৃত্যুর কারণ প্রত্যেকেরই এক; প্রত্যেকেরই শরীর তীব্র বিষের ক্রিয়ায় রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যু হয়েছে এবং প্রত্যেকেরই গলার পিছন দিকে যে ক্ষত পাওয়া গেছে, সেখানকার টিসু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানকার টিসুতেও সেই বিষ ছিল। সিভিল সার্জেনের মতে সেই ক্ষতই বিষ প্রবেশের পথ। … তা হলে বোঝা যাচ্ছে ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে যে, নিছক গলা টিপেই খুনগুলো করা হয়নি। ময়না তদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে Chemical Examiner দের কোন report নেই। তাহলে জানা যেত কী ধরনের বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে এটুকু বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়, বিষ অত্যন্ত তীব্র শ্রেণির।
কিন্তু প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির গলার পিছন দিকে যে চারটি করে কালো কালো ছিদ্র বা ক্ষত পাওয়া গেছে সেগুলোর তাৎপর্যকী? কী ভাবে সেগুলো হলো? কেনই বা হলো? সুব্রত চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ল।
আরো বিস্ময়
এক সময় সুব্রতর মনে হলো, এমনও তো হতে পারে কোন একটা গভীর উদ্দেশ্য নিয়ে এইভাবে পরপর খুন করা হচ্ছে। কিন্তু তা হলেই বা সে উদ্দেশ্যটা কী?
সুব্রত চিঠির কাগজের প্যাড়ুটা টেনে নিয়ে কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল।
কিরীটী।
গত কালকের সমস্ত সংবাদ দিয়ে তোকে একখানা চিঠি দিয়েছি।
ভেবেছিলাম আজ আর বুঝি তোকে চিঠি দেওয়ার মত কোন প্রয়োজনই থাকবে না; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কতকগুলো ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়া আমার একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ আবার অতর্কিতভাবে এক হতভাগ্য সাঁওতাল কুলী আমাকে খুন করতে এসে নিজে অদৃশ্য এক আততায়ীর হস্তে প্ৰাণ দিয়েছে।
এই শত্রুর দেশে কে আমার এমন বন্ধু আছেন বুঝলাম না যিনি অলক্ষ্যে থেকে এভাবে আমার প্রাণ বাঁচিয়ে গেলেন।
এ ব্যাপারটার যে explanation আমি আমার মনে মনে খাড়া করেছি, আসলে হয়ত মোটেই তা নাও হতে পারে; হয়ত এটা আগাগোড়াই সবটা আমার উর্বর মস্তিষ্কের নিছক একটা অনুমান মাত্র। কিম্বা হয়ত এমনও হতে পারে তাদেরই দলের কেউ তার উপরে হিংসা পোষণ করে বা অন্য কোন গৃঢ় কারণ বশতঃ তাকে খুন করে গেছে অলক্ষ্যে থেকে। তবে ময়না তদন্তের একটা রিপোর্ট আজ কিছুক্ষণ আগে দারোগাবাবু, দয়া করে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাতে দেখলাম, হতভাগ্য ম্যানেজারদের মৃত্যুর কারণ বিষ।…
মাইনের মধ্যকার ব্যাপারটা এখনও জানা যায় নি। তবে রিপোর্ট দেখে মনে হয় দশজনই খুন হয়েছে।
বুঝতে পারি না এরকম নৃশংসভাবে একটার পর একটা খুন করে কী লাভ থাকতে পারে খুনীর। আর ম্যানেজারগুলো তো তৃতীয় পক্ষ। তাদের নিজস্ব কী এমন interest খনি সম্পর্কে থাকতে পারে যাতে করে তাদের এভাবে খুন হওয়ার ব্যাপারটাকে explain করা যেতে পারে।
তবে কী আসল ব্যাপারটা আগাগোড়াই একটা হুমকি বা চাল?
যা হোক এখন পর্যন্ত তোর বন্ধুটি নির্বিঘ্নে সুস্থে ও বহাল তবিয়তে খোস মেজাজেই আছেন। খবর কী? রাজুর খবর কী? মা কেমন আছেন?
তোদের সুব্রত।
পরদিন সকালে সুব্রতর যখন ঘুম ভাঙ্গল, চারিদিকে একটা ঘন কুয়াশার যবনিকা দুলছে।
শংকর খানিক আগেই শয্যা থেকে উঠে মাইনের দিকে চলে গেছে; কেননা আজ থেকে আবার মাইনের কাজ শুরু হবার কথা।
ঝুমন চায়ের জল চাপিয়ে দু। দুবার সুব্রতর ঘরের কাছে এসে ফিরে গেছে, সুব্রত নিদ্রিত দেখ
শয়ন ঘর থেকে বের হয়ে সুব্রত ডাকল, ঝুমন।
সাব, ঝুমন সামনে এসে দাঁড়াল।
কী রে, তোর চা ready তো?
ঝুমন হাসতে হাসতে জবাব দিল, জি সাব?
ম্যানেজারবাবু কোথায়?
খাদে গেছেন হুজুর।
চা খেয়ে গেছে? আজ্ঞে না। বলে গেছেন। আপনি ঘুমিয়ে উঠলে তিনি এর মধ্যে ফিরে আসবেন, তারপর এক সঙ্গে দুজনে চা খাবেন।
বেশ। তবে তুই চায়ের সব জোগাড় করা। আমি ততক্ষণ চটুপটু হাত পা ধুয়ে নিই, কি বলিস?
জি সাব—
ঝুমন নিজের কাজে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
সুব্রত বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে গরম ওভার কোটটা গায়ে চাপিয়ে চায়ের টেবিলের কাছে এসে দেখে শংকর এর মধ্যে কখন মাইন থেকে ফিরে চায়ের টেবিলের সামনে এসে বসে আছে।
তাহলে শংকরবাবু? মইনের কাজ শুরু করে দিয়ে এলেন?
অ্যাঁ। কে? ও সুব্রতবাবু? কী বলছিলেন?
মাইনের কাজ শুরু হবার আজ সকাল থেকে Order ছিল না? কাজ শুরু হলো?
হ্যাঁ হয়েছে। কিন্তু একটা বিচিত্র আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটেছে। মনে হচ্ছে এটা কী যেন ভেল্কী বাজীর খনি।
ব্যাপার কী? সুব্রতর দৃষ্টিটা প্রখর হয়ে উঠলো।
ঝুমন গরম চা, রুটি, মাখন, ডিমসিদ্ধ ও কেক সাজিয়ে দিয়ে গেল সামনের টেবিলের ওপরে।
একটা সিদ্ধ ডিমের অর্ধেকটা কঁটা দিয়ে ভেঙে নিয়ে সেটা গালে পুরে চিবোতে চিবোতে শংকর বলল, তা ছাড়া কি বলব বলুন? ১৩নং কাঁথিতে মরলো দশজন। কয়লার চাংড়া সরিয়ে মৃতদেহ পাওয়া গেল মোটে একটা।
তার মানে? সুব্রত বিস্মিত দৃষ্টিতে শংকরের মুখের দিকে তাকল।
হ্যাঁ মশাই, এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন? ১৩ নং কাঁথিতে মৃতদেহ মাত্র একটিই পাওয়া গেছে।
তবে যে শুনছিলাম দশজন মারা গেছে? সুব্রত রুদ্ধনিশ্বাসে বললে।
তাই তো শোনা গিয়েছিল এবং লিস্টমত দশ জনকে পাওয়াও যায়নি।– কিন্তু কয়লা সরিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করার পর দেখা যাচ্ছে মাত্র একটিই।
বলেন কি! —ভাল করে খুঁজে দেখা হয়েছিল তো? সুব্রত প্রশ্ন করলে।
আমি নিজে পর্যন্ত দেখে এসেছি। মানুষ তো দূরের কথা একগাছি চুলও দেখতে পেলাম না।
আশ্চর্য। …
তারপর, আবার সুব্রত জিজ্ঞাসা করলঃ ১৩নং কাঁথিতে কাজ চলছে নাকি? না।
১৩নং কাঁথিতে কাজ একদম বন্ধ করে রেখে এসেছি।
বেশ করেছেন। চলুন, চা খেয়ে আমি একবার সেই ১৩নং কাঁথিটা ঘুরে দেখে আসব।
বেশ তো চলুন। উদাসভাবে শঙ্কর জবাব দিল।
চা পান শেষ করে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে দুজনে বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়াল। … এমন সময় দেখা গেল বিমলবাবুর সঙ্গে অদূরে দারোগা -বাবু আসছেন।
দারোগাবাবুই আগে হাত তুলে নমস্কার জানালেন, নমস্কার সুব্রত-বাবু। নমস্কার মিঃ সেন।
ওরা দুজনেই প্রতি-নমস্কার জানোল।
দারোগাবাবুই প্রশ্ন করলেন, কোথায় মশাই আপনাদের শালবনে খুন হয়েছে?…
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খবরটা পেলেন কি করে? সুব্রত শুধায়।
এ দিকে আসছিলাম-পথেই চিঠিটা পেলাম। কিন্তু
কি?
এতক্ষণ প্ৰায় আধঘণ্টা ধরে আমি বিমলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তন্ন তন্ন করে। শালবন নদীর ধার পর্যন্ত খুঁজে এলাম। কিন্তু কোথাও তো মশাই লাসের টিকিটরও দর্শন পেলাম না…অন্ধকারে ভুল দেখেননি তো?
সুব্রত চমকে উঠল, আপনি বলছেন কী স্যার? —আমার চোখের সামনে ব্যাটা ছটফট করে মরল, আর আমি ভুল দেখলাম।
তবে বোধ হয় ব্যাটা মরে ভূত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সুব্রতবাবু। হাসতে হাসতে দারোগাবাবু বললেন।
দেখুন দারোগাবাবু। নেশা ভাঙের অভ্যাস আমার জীবনে নেই। তাছাড়া চোখের দৃষ্টি এখনও আমার খুবই প্রখর ও সজাগ।
কিন্তু লাসটা তাহলে কোথায়ই বা যাবে বলুন? কথাটা বললেন বিমলবাবু।
কোথায় যাবে তা কী করে বলব? পাওয়া যখন যাচ্ছে না। তখন নিশ্চয়ই কেউ রাতারাতি লাস সরিয়ে নিয়ে গেছে।
কিন্তু ওই শালবনে অত রাত্রে যে একটা লোক খুন হয়েছে সে-কথা লোকে জানলই বা কেমন করে যে সরিয়ে নেবে রাতারাতি? দারোগাবাবু বললেন।
এবার সুব্রত আর না হেসে থাকতে পারলে না। হাসতে হাসতে বললে, তা যা বলেছেন, তবে, যে খুনী সে তো জানতই লোকটা মারা গেছে, বিশেষ করে বন্দুকের গুলি খেয়ে যে বঁচা চলে না, এবং সে গুলি যখন পাঁজরা ভেদ করে গেছে।–
তবে কি আপনি বলতে চান সুব্রতবাবু, খুনীই লাস সরিয়েছে?—
বলতে আমি কিছুই চাই না। —লাস কেউ সরিয়েছে বা সরায় নি এ সম্পর্কে কোন তর্ক বিতর্ক করাই আমার ইচ্ছা নেই। আপনারা যে সিদ্ধান্তে ইচ্ছা উপস্থিত হতে পারেন এবং যেমন খুশী further proceed করতে পারেন। তবে এটা ঠিকই জানবেন কাল একজন কুলী শালবনে বন্দুকের গুলিতে খুন হয়েছিল।
আপনার কথাই যদি ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ খুনীই লাস সরিয়ে থাকে, তবে কোথায় সরালে? দারোগাবাবু সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
কেমন করে বলব বলুন? আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তো আর লাস সরায় নি।–
তাও তো ঠিক। তাও তো ঠিক। দারোগাবাবু মাথা দোলাতে লাগলেন পরম বিজ্ঞের মত।
মৃতদেহ
দারোগাবাবু ও যেন অতঃপর কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, চলুন না সুব্রতবাবু–আমার সঙ্গে একটিবার সেই শালবনে; কোথায় আপনি মৃতদেহ দেখে এসেছিলেন, exact locationটা দেখাবেন।
নিশ্চয়ই, চলুন।–
সকলে নদী পার হয়ে শালবনের দিকে এগিয়ে চলল।
প্ৰভাতের সোনালী রোদ শালবনের গাছের পাতার ফাঁকে ইতস্ততঃ উঁকি দিচ্ছে।
শীতের প্রভাতের ঝিরঝিরে হাওয়া শালবনের গাছে সবুজ কচিপাতাগুলিকে মৃদু মৃদু শিহরণ দিয়ে বহে যায়।
সকলে এসে শালবনের মধ্যে প্ৰবেশ করল।
কোথায় দেখেছিলেন কাল রাত্রে সেই মৃতদেহ সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু প্রশ্ন করলেন।
ওই শালবনের দক্ষিণ দিকে।
গতরাত্রের সেই জায়গায় সকলে সুব্রতর নির্দেশ মত এসে দাঁড়াল।
আশেপাশে কয়েকটা বড় বড় শালগাছ ছোট একটা জায়গাকে যেন আরো ছায়াচ্ছন্ন ও নির্জনতার করে ঘিরে রেখেছে।
এই সেই জায়গা দারোগাবাবু, সুব্রত বললে।
সেই জায়গার মাটিতে তখনও রক্তের দাগ জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে দেখা গেল।
সুব্রত সেই জমাটবাঁধা রক্তের দাগগুলোর দিকে অঙ্গুলি তুলে বলল, এই দেখুন দারোগাসাহেব, আমি যে গত রাত্রে স্বপ্ন দেখিনি বা আমার চোখের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেনি। তার প্রমাণ। এই মাটির বুকে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে।
সকলে তখন এক এক করে রক্তের দাগগুলো পরীক্ষণ করে দেখল এবং সুব্রতর কথা যে মিথ্যা নয়। এরপর সেটাই সকলে মেনে নিতে বাধ্য হলো।
তাই তো স্যার, এ যে তাজব ব্যাপার। দারোগাবাবু, বলতে লাগলেন; কিন্তু মৃতদেহটা। তবে কোথায় গেল?-
সুব্রত তখন চারিদিকে ইতস্তত অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চেয়ে কী যেন দেখছিল, দারোগাবাবুর কথার কোন জবাবই দিল না।
এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে দেখতে সহসা একসময় সুব্রতর চোখের দৃষ্টিটিা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সহসা সে চীৎকার করে বলে উঠলঃ ইউরেকা! ইউরেকা! সম্ভবতঃ আপনাদের লাস পাওয়া গেছে। দরোগা সাহেব। কিন্তু একটা শাবলের যে দরকার।
সুব্রতর উৎফুল্ল চীৎকারে সকলেই সুব্রতর দিকে ফিরে তাকাল।
ব্যাপার কী সুব্রতবাবু? শংকর বললে।
লাস পাওয়া গেছে শংকরবাবু? সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।
লাস পাওয়া গেছে? আপনার মাথা খারাপ হলো নাকি সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু বললেন।
দয়া করে একটা শাবল আনিয়ে দিন। আমি এখনই প্ৰমাণ করে দিচ্ছি।
তখনি বিমলবাবুকে খনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো একটা শাবল নিয়ে আসবার জন্য।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমলবাবু ছোট একটা মাটি খোঁড়া শাবল নিয়ে ফিরে এলেন। এই নিন স্যার শাবল।
সুব্রত বিমলবাবুর হাত থেকে শাবলটা নিয়ে একটা বড় শালগাছের গোড়া থেকে একটা ছোট শালগাছের চারা একটান দিয়ে অনায়াসেই শিকড় শুদ্ধ তুলে ফেলে দিয়ে ক্ষিপ্ৰ হস্তে মাটি খুঁড়তে লাগল। বেশি মাটি খুঁড়তে হলো না, খানিকটা মাটি উঠে আসবার পরই একটা মানুষের হাত দেখা গেল।
এই দেখুন দারোগাসাহেব, আমার কথা ঠিক কিনা?
এই দেখুন লাস।… সুব্রতর সমগ্র শরীর ও কণ্ঠস্বর প্রবল একটা উত্তেজনায় যেন কাঁপছে।
তারপর অল্প অনায়াসেই মাটি থেকে মৃতদেহ খুঁড়ে বের করা হলো। মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল, সুব্রত যা বলেছিল, ঠিক তাই। মৃতদেহের পাঁজরায় গুলির ক্ষতিও রয়েছে।
দারোগাবাবু এতক্ষণ একটি কথাও বলেন নি, যেন বোকা বনে গেছেন। এমন ব্যাপার যে একটা ঘটতে পারে এ যেন ইতিপূর্বে তাঁর ধারণার অতীত ছিল। তিনি একজন দারোগা। এক আধা বছর নয়, প্ৰায় দীর্ঘ এগার বছর এই লাইনে চুল পাকাচ্ছেন। অথচ এই সামান্য সম্ভাবনাটা তার মাথায় খেলে নি। খেলল। কিনা সামান্য একজন সখের গোয়েন্দার সহচরের মাথায়।
দারোগাবাবু একটু গম্ভীরই হয়ে গেলেন।
এবার বিশ্বাস হয়েছে তো স্যার আমার কথার পুরোপুরি? সুব্রত দারোগাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।
এখনও আর না বিশ্বাস করে কেউ পারে নাকি সুব্রতবাবু? বললে শংকর। কিন্তু আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে আমি পারছি না। সুব্রতবাবু।
বুদ্ধির কিছু নয়-common sense শংকরবাবু; বুদ্ধি যদি বলেন সে আমার বন্ধু ও শিক্ষাগুরু কিরীটী রায়ের আছে, সুব্রত বললে। শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় যেন রুদ্ধ হয়ে এল।
কিন্তু কেমন করে বুঝলেন বলুন তো সুব্রত বাবু, যে লাস এখানে লুকান আছে?
বললাম তো common sense। এই গাছটা লক্ষ্য করে দেখুন। গাছের পাতাগুলো যেন নেতিয়ে গেছে। এটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাকীটা আমার অনুমান-চারিদিকে চেয়ে দেখুন, চারা গাছ আরো দেখতে পাবেন, কিন্তু কোন গাছেরই পাতা এমন নেতান নয়। প্রথমেই আমার মনে হলো, ঐ গাছের পাতাগুলো অমন নেতিয়ে গেছে। কেন? তখনি গাছটার পাশে ভাল করে চাইতেই মাটির দিকে নজর পড়ল। একটু ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেই বোঝা যায় পাশের মাটিগুলো যেন কেমন আলগা। মনে হয় কে যেন চারপাশের মাটি খুঁড়ে আবার ঠিক করে রেখেছে। যেই এ কাজ করে থাকুন না কেন, লোকটার যথেষ্ট প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আছে বলতেই হবে। মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ পুঁতে এই গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে এনে এখানে পুঁতে দিয়ে গেছে যাতে করে কারও নজরে না পড়ে এবং স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে আনার ফলে এক রাত্রেই নেতিয়ে উঠেছে আরো ভেবে দেখুন এক রাত্রের মধ্যে যেখানে গাড়ি, মোটর বা ট্রেনের তেমন কোনো ভাল বন্দোবস্ত নেই সেখানে একটা লাসকে সরিয়ে ফেলা কত কষ্টসাধ্য। তাছাড়া একটা মৃতদেহ অন্য জায়গায় সরােনও বিপদসংকুল ব্যাপার! একে তো সকলের নজর এড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে, তার উপর ধরা পড়বার খুবই সম্ভাবনা। অথচ মৃতদেহটা এভাবে ফেলে রাখাও চলে না-তাই সরােনই এক মাত্ৰ বুদ্ধিমানের কাজ এবং আসে পাশে কোথাও পুঁতে ফেলতে পারলে সব দিকই রক্ষণ হয় এবং ব্যাপারটাও সহজ সাধ্যকর হয়ে যায়।
যা হোক সকলে তখন লাসের একটা বন্দোবস্ত করে বাংলোর দিকে ফিরল। কারও মুখেই কোন কথা নাই। সকলে নির্বাকভাবে পথ অতিক্রম করছে।
সকলে এসে বাংলোয় প্ৰবেশ করল।
বিমলবাবু বাংলো পর্যন্ত আসেন নি, খনির দিকে চলে গেছেন মাঝপথ থেকে বিদায় নিয়ে। W
টেনে বসল। দারোগাবাবুই প্রথম কথা বললেন, সুব্রতবাবু। ময়না তদন্তের রিপোর্টগুলো পড়েছেন নাকি?
হ্যাঁ, কাল রাত্রেই পড়ে ফেলেছি। কি বুঝলেন? সামান্যই। তার থেকে কোন সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়া চলে না। আচ্ছা দারোগাসাহেব, এই Case গুলোর Chemical examination এর report গুলো আপনার কাছে আছে কি?
না। তবে যদি বলেন তো চেষ্টা করে আনিয়ে দিতে পারি হেড়ু কোয়ার্টার থেকে; দরকার আছে নাকি?
হ্যাঁ, পেলে ভাল হতো। একটা কাজ করতে পারবেন দারোগাসাহেব?
বলুন।
একটু অপেক্ষা করুন। সুব্রত ঘরের মধ্যে চলে গেল এবং পরক্ষণেই কাগজে মোড়ান। গত রাত্রের সেই তীরটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
ব্যাপার কী? ওটা কী আপনার হাতে? দারোগাবাবু সুব্রতর হাতের কাগজে মোড়া তীরটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন।
কাগজের মোড়কটা খুলতে খুলতে সুব্রত বললে, এটা একটা তীর। এর ফলায় আমার মনে হয় কোন মারাত্মক রকমের বিষ মাখান আছে; দয়া করে এটা ধানবাদের কোন কেমিস্টের কাছ থেকে একটু একজামিন করে কি বিষ আছে জেনে আমায় জানাতে পারেন?
চেষ্টা করতে পারি, তবে কতদূর সফল হবো বলতে পারি না। তার চেয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিই না কেন? এক হস্তার মধ্যেই Chemical Examination এর report পেয়ে যাবেন।
দেখুন যদি ধানবাদে সুবিধা না হয়, তবে কলকাতায়ই পাঠাবেন।
তখনকার মত চা ও জলখাবার খেয়ে দারোগাবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
শংকর খাদের দিকে রওনা হল। সুব্রত চেয়ারটার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে সমস্ত ঘটনাটা চিন্তা করতে লাগল।
রাত্রি যখন গভীর হয়
প্রতি রাতের মত আজও রাত্রির অন্ধকার ধূসর কুয়াশার ঘোমটা টেনে পায়ে পায়ে শ্রান্ত ক্লান্ত ধরণীর বুকে নেমে এল। পাখীর দল কুলায় গেল ফিরে। সারাদিন খনিতে খেটে ক্লান্ত সাঁওতাল কুলী কামিনরা যে যার ধাওড়ায় ফিরে এসেছে। সুব্রত চুপটি করে বারান্দায় একটা বেতের ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে দুরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
কাল হয়ত কিরীটীর চিঠি পাওয়া যাবে। কিন্তু আজকের রাতটা?
একি নির্বিঘ্নে কাটবে?…
রাতের অন্ধকারে কী আজ তার বিভীষিকাময় মৃত্যুর কঠিন হিম পরশ কোন হতভাগ্যের ওপরে নেমে আসবে না?
দূর থেকে সাঁওতালী বাঁশী ও মাদলের সুর ভেসে আসে।
জীবনের কোন মূল্যই ওদের কাছে নেই। প্রকৃতির মেহের দুলাল ওরা মাটির ঘরে অযত্নে বর্ধিত, মাটি-মাখা সহজ ও সরল শিশুর দল। প্ৰাণ প্রাচুর্যে জীবনের পাত্র ওদের কানায় কানায় পূর্ণ।
শংকর এখনও খাদ থেকে ফেরে নি।
ঝুমন গরম চা, কেক ও ফল প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গেল।
সুব্রত একটুকরো কেক মুখে পুরে চায়ের কাপটা তুলে নিল। বাইরে আজ ঠাণ্ডাটা যেন একটু চেপেই এসেছে!
মাঝে মাঝে খোলা প্ৰান্তর থেকে আসন্ন রাতের স্তব্ধতা যেন বহন করে। আনে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা।
এক সময় চায়ের পাত্র নিঃশেষ করে সুব্রত পাশের টিপিয়ে সেটা নামিয়ে রেখে দিল।
কত রকম চিন্তাই একটার পর একটা মাথার মধ্যে এল মাকড়সার জলের মত।
এবং সেই জালের সূক্ষ্ম তন্তুগুলি বেয়ে বেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারিটি দাগের মত কী যেন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
কী ওগুলো?
ভূতের মত একাকী চুপ করে এই বারান্দায় ঠাণ্ডায় বসে বসে কী ভাবছেন?
চোখ তুলে তাকায় সুব্রত।
কে? শংকরবাবু? সুব্রত ধীরকণ্ঠে বলে।
কী এত ভাবছিলেন বলুন তো? এখানে এসে আপনার এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তবুও টের পাননি?
হাসতে হাসতে শংকর জিজ্ঞাসা করে।
এ বেলা কাজের অবস্থা কেমন? Peacefully work চলছে তো?
কতকটা, যদি কিছু দুর্ঘটনা আচমকা না এসে পড়ে।
হঠাৎ এ কথা কেন শংকরবাবু?
বলা তো যায়না। শংকর মৃদুকণ্ঠে বলে, বিমলবাবুর ভাষায় বলতে গেলে এই ভৌতিক ফিল্ড-এ যখন তখনই যে কোন ভয়ঙ্কর ব্যাপারই তো ঘটা সম্ভব সুব্রতবাবু। তা ছাড়া নূতন ম্যানেজারবাবু এখনও ভূতের হাতে আক্রান্ত হন নি যখন।
সুব্রত কোন কথা বলে না।
তারপর আপনার কাজ কতদূর এগুলো সুব্রতবাবু?
How far you have proceeded?
অনেকটা।
বলেন কী? শংকরের কণ্ঠস্বর উদ্গ্ৰীব হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ। -কিন্তু এখনও আমাদের দারোগাবাবু এসে পৌঁছালেন না।
দারোগাবাবুর এখন আসবার কথা আছে নাকি? শংকর উৎকণ্ঠিতভাবে প্রশ্ন করে।
তাঁকে সন্ধ্যার পরই যে বাসটা থামে, তাতে দুজন কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলে দিয়েছিলাম।
কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলেছিলেন? কেন? হঠাৎ কনেস্টবল নিয়ে আসবেন কেন? কাউকে গ্রেপ্তার করবেন নাকি?
শংকর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু চারিদিককার অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। আবার শংকর প্রশ্ন করে। আমি যে অন্ধকারেই থাকছি। সুব্রতবাবু! Please খুলে বলুন। কাকে গ্রেপ্তার করবেন?–
খুনীকে। –রহস্যের হোতাকে।
পেরেছেন বুঝতে তাহলে সত্যিই? পেরেছেন জানতে হত্যাকারী কে?
একরাশ উৎকণ্ঠ শংকরের গলার স্বরে ফুটে বেরুল।
হ্যাঁ-সুব্রত জবাব দেয়। আপনিই বলুন কে? সুব্রত স্মিতভাবে শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
আগে বলুন, এই খনির Areaর মধ্যে সেই লোকটি আছে কিনা? তারপর বলছি।
শংকর সুব্রতর মুখের দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
যদি বলি আছে? সুব্রত মৃদুস্বরে জবাব দেয়।
তা হলে বলব আমি একজনকে সন্দেহ করেছি, সুব্রতবাবু।
কে? বিমলবাবু-এই খনির সরকার?
হ্যাঁ। কিন্তু আশ্চর্য, how could you guess! আপনারা দেখছি সর্বজ্ঞ–am I right সুব্রতবাবু? অধীরভাবে শংকর সুব্রতকে প্রশ্ন করে।
You are right শংকরবাবু। ধীরভাবে সুব্রত জবাব দেয়।
আজ তাহলে বিমলবাবুকেই গ্রেপ্তার করছেন বলুন। শংকরবাবু আবার জিজ্ঞাসা করেন।
এমন সময় দারোগাবাবু দুইজন কনেস্টবল সমভিব্যাহারে এসে হাজির হলেন। বাংলোর বারান্দায় উঠতে উঠতে দারোগাবাবু বললেন, আমরা এসে গেছি সুব্রতবাবু।
Many thanks, আসুন আসুন! everything O. K.? একটু গলায় বলে ওঠে।
Yes! everything O. K. –দারোগাবাবু জবাব দিলেন।
আপনারা তা হলে একটু অপেক্ষা করুন। আমরা চট্ করে খাওয়া দাওয়া সেরে ready হয়ে নিচ্ছি। উঠুন শংকরবাবু, রাত হয়ে গেছে, চলুন খেতে যাওয়া যাক। চলুন।
সুব্রত ও শংকর দুজনে উঠে পড়ল।
রাত্রি গভীর হয়েছে। সুব্রত, শংকর, দারোগাবাবু তিনজনে নিঃশব্দে কালো কয়লার ওঁড়ো ও কঁকার ঢালা অপ্ৰশস্ত রাস্তাটা, যেটা বরাবর অফিসারদের কোয়ার্টারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে প্ৰেতের মত এগিয়ে চলে। সকলেরই পায়ে রবার সু। কাঁকর কয়লা বিছান রাস্তা দিয়ে চললেও কোন শব্দ পাওয়া যায় না।
সকলে এসে বিমলবাবুর কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়াল। এর মধ্যেই চারিদিকে কুয়াশা জমেছে। আশেপাশের সব কিছু আবছা অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিমলবাবুর কোয়ার্টারটা কুয়াশার ওড়না জড়িয়ে যেন আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আগে সুব্রত ও তার পিছনে দারোগাবাবু ও শংকর পা টিপে টিপে বিড়ালের মত সন্তৰ্পণে বারান্দা অতিক্রম করে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।–
ওকি! সুব্রত সবিস্ময়ে দেখল, দরজার দুপাশের দুটো ভেজান কবাটের ফাঁক দিয়ে ইষৎ ম্ৰিয়মান একটা আলোকরশ্মি যেন অতি সন্তৰ্পণে বাইরে উঁকি দিচ্ছে ভয়ে ভয়ে।
সুব্রত একবার চেষ্টা করলে দরজার ফাঁক দিয়ে কিছু দেখা যায়। কিনা। —কিন্তু কিছুই দেখা যায় না।
আঙ্গুলের চাপ দিতেই ভেজান দরজা আরো ফাঁক হয়ে গেল।
ঘরের এক কোণে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে
প্রচুর ধূম উদগিরণ করে হ্যারিকেনের চিমনিটা কালো হয়ে ওঠায় আলো অত্যন্ত মলিন বলে মনে হয়।
প্রথমটায় সেই মলিন আলোয় সুব্রত কিছুই দেখতে পেল না; কিন্তু পরক্ষণেই ভাল করে দৃষ্টিপাত করতেই সুব্রত ভয়ংকর রকম চমকে উঠলো।
ওকি! সেই শালবনে দেখা পাগলটা না?
কে একজন উপুড় হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। পাগলাটা সেই ভূপতিত দেহের ওপরে ঝুঁকে অত্যন্ত নীচু হয়ে কী যেন করছে।
ডান হাতে পিস্তলটা বাগিয়ে, বাঁ হাতে টর্চটা ধরে…বোতাম টিপাবার সঙ্গে সঙ্গেই সুব্রত আচমকা দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল।
টর্চের তীব্র আলোর কাপ্টা মুখের ওপরে পড়তেই পাগল্পটা চমকে লাফিয়ে উঠলো।
কিন্তু একি। পাগলটার হাতে একটা উদ্যত পিস্তল।
সুব্রত থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
কে তুই? বল শীগগির কে তুই?
সহসা একটা উচ্চ রোলের হাসির প্রচণ্ড উচ্ছাসে সমগ্র ঘরখানি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
পাগলাটা হাসছে।
হঠাৎ পাগলটা হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় ডাকল, সুব্রত।
সুব্রত চমকে উঠল।
কে?–
ভয় নেই। আমি কিরিটী।
অ্যাঁ। কিরীটী তুই। একি বিস্ময়।
সঙ্গে সঙ্গে শংকরও বলে উঠল, কিরীটী তুই।
হ্যাঁ। কেন, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমি শ্ৰীহীন কিরীটি রায়।
কিন্তু ব্যাপার কী? মাটিতে পড়ে লোকটা কে?
সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
বিমলবাবুর মৃতদেহ।
কার? কার মৃতদেহ? অস্ফুটিকণ্ঠে সুব্রত চীৎকার করে উঠল।
কোলিয়ারীর সরকার বিমলবাবু। যাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য তোমাদের আজকের রাত্রের এই দুঃসাহসিক অভিযান বন্ধু। চল বন্ধু। এবার বাসায় চল। … দারোগাবাবু আপনার সঙ্গে যে কনেস্টবল দুটি এনেছেন, এই মৃতদেহ তাদের জিম্মায় আজকের রাতের মত রেখে চলুন শংকরের বাংলোয় ফেরা যাক। চল। চল সুব্রত। … হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? … গাম ইলাস্টিক দিয়ে এক মুখ দাঁড়ি করে চুলকে চুলকে প্ৰাণ আমার ওষ্ঠাগত হবার জোগাড় হলো।
এর মধ্যে আবার কিন্তু কী হে ছোঁকরা। … চল। চল। রাত কত হলো তার খবর রেখেছিস? বাড়ীতে চল, ধীরে সুস্থে বলব।
তা হলে বিমলবাবু…
সুব্রতর কথা শেষ হলো না। কিরিটী বলে উঠল, আজ্ঞে না You are mistaken, বিমলবাবু খুনী নন।
তবে?
তবে আবার কি? অন্য লোক খুনী।
কে খুনী?
কাল সকালে বলব। এখন চল বাংলোয় ফেরা যাক।
কিন্তু আমার যে কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কিরীটী? সুব্রত বললে।
অর্থাৎ তুমি একটি হস্তীমুখ। শোন, কানে কানে একটা কথা বলি।
সুব্রতর কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে কিরীটী কি যেন ফিস ফিস করে বলতেই সুব্রত লাফিয়ে উঠলো, অ্যাঁ বলিস কি-আশ্চর্য! আশ্চর্য!!…
কিন্তু তার একটি ডান ও একটি বা হাত ছিল যন্ত্র স্বরূপ। কিরীটী বললে, এই হতভাগ্য বিমলবাবু হচ্ছে বঁ-হাত।
সে রাত্রে বাংলোয় ফিরে গরম জল করিয়ে কিরিটী ছদ্মবেশ ছেড়ে স্থির হতে হতে প্ৰায় আড়াইটা বেজে গেল।
রহস্যের মীমাংসা
ঝুমনকে ডেকে শংকর কিছু লুচি ও তরকারী করবার জন্য আদেশ দিতেই, কিরিটী বাধা দিলে, আরে ক্ষেপেছিস শংকর, এই রাত্রে মিথ্যে কেন ও বেচারীকে কষ্ট দিবি? তার চাইতে বল এক কাপ গরম গরম চা বানিয়ে দিক। আর তার সঙ্গে যদি কেক বা বিস্কিট কিছু থাকে তবে তাই দুচারটে দে, তাতেই হয়ে যাবে।
ঘরে কেক ছিল। কুমন একটা প্লেটে করে কয়েকটা plum cake ও এক কাপ চা এনে কিরীটির সামনে টিপিয়ে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললে, দিই না সাহেব কয়েকটা লুচি ভেজে, কতক্ষণ লাগবে?
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, ওরে না না। তুই শুতে যা। এতেই আমার হবে, কাল যদি এখানে থাকি তো বেশ করে পেট ভরে খাওয়াস।
ঝুমন চলে গেল।
কিরীটী জামার পকেট থেকে চুরোট বের করে তাতে অগ্নি সংযোগ করে মৃদু টান দিতে লাগল।…
কিছুক্ষণ ধূমপান করবার পর প্রায়-ঠাণ্ডা চায়ের কাপটা তুলে নিতে নিতে বললে। Cold tea with a Burma Cigar;
Is a joy for ever।
সকলে এক সঙ্গে হেসে উঠল, কিরীটীর নিজস্ব কবিতা শুনে।
কিন্তু আমার শরীর যে ঘুমে ভেঙে আসছে শংকর, শীঘ্ৰ কোথায় শুতে দিবি বল। কিরীটী শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
শংকর নিজের ঘরেই এক পাশে একটা ক্যাম্প খাটে কিরীটীর শোয়ার বন্দোবস্ত করে দিল।
কিরিটী শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে লেপটা টেনে নিল।
পরের দিন সকলে শংকর ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে।
এমন সময় একজন সাঁওতাল কুলী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির বাবু হুজুর মালিক এসেছেন গো।– মালিক, কখন এলেন তিনি?
কাল রাতে বাবু।
কে কাল রাতে এসেছেন শংকর?
চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি খোলা দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে কিরীটী?
খনির মালিক সুধাময়বাবু কাল রাত্রে এসেছেন।
যা তাড়াতাড়ি মনিবের সঙ্গে একবার মোলাকাত করে আয়।–
হ্যাঁ যাই।–
হাত মুখ ধুয়ে শংকর তখুনি মনিবের সঙ্গে দেখা করতে ছুটল।
খনির অল্প দূরে মাঠের মধ্যে একটা বাংলো প্যাটার্ণের বাড়ি।
খনির দুজন অংশীদার হনুমানপ্ৰসাদ কুন-ঝুন-ওয়ালা আর সুধাময় চৌধুরী? অংশীদারের মধ্যে কেউ কখন এলে ঐ বাংলো বাড়িতেই ওঠেন। অন্য সময় বাংলো তালা চাবি দেওয়াই থাকে।
শংকর যখন এসে বাংলো বাড়িতে প্ৰবেশ করল, সুধাময় বাবু তখন ঘুম ভেঙে উঠে বসে ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে গরম গরম লুচির সদব্যবহার করছেন।
ভৃত্যকে গিয়ে সংবাদ পাঠাতেই শংকরের ভিতরে ডাক এল। বহুমূল্য আসবাব পত্রে সাজান কক্ষখানি; গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।
একটা বেতের চেয়ারে বসে সুধাময়বাবু প্রাতরাশ খাচ্ছিলেন।
শংকর ঘরে ঢুকে হাতে তুলে নমস্কার জানাল, নমস্কার … স্যার।
নমস্কার। বসুন। আপনিই এখানকার নতুন ম্যানেজার শংকর সেন?
অজ্ঞে।
বেশ। বেশ।
শংকর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
ওরে কে আছিস, ম্যানেজারবাবুকে চা দিয়ে যা।
সুধাময়বাবু হাঁক দিলেন।
না না। ব্যস্ত হবেন না। এইমাত্র বাড়ি থেকে চা খেয়ে বেরিয়েছি।
তাতে আর কী? add a cup more, কোন harm নেই।
শংকর সুধাময়বাবুর দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।
উঁচু, লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা। মাথার মাঝখানে সিঁথি। চোখা নাক। চোখ দুটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু বেশ লালচে। শিকারী বিড়ালের মত সদা চঞ্চল, অস্থির ও সজাগ। গায়ের রং আবলুশ কাঠের মত কালো। ভদ্র বেশ না হলে সাঁওতালদেরই একজন ধরা যেতে পারে অনায়াসেই। গায়ে বাদামী রংয়ের দামী সার্জের গরম স্যুট।
ভৃত্য চা দিয়ে গেল। শংকর চায়ের কাপটা টেনে নিল।
তারপর মিঃ সেন, আপনাদের কাজকর্ম চলছে কেমন?
মন্দ না। তবে পরপর এমনভাবে খুন হওয়ায় এখানকার কুলী কামিনদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া কাল রাত্রে আমাদের সরকারমশাই বিমলবাবু অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।
কে নিহত হয়েছে?
বিমলবাবু?
The villain. Rightly served. I hated him most amongst my employees; but I am also determined to give up my shares. I am really fed-up with all this. ঝুন-ঝুনওয়ালাও আজই বিকালের দিকে এসে পৌঁছাচ্ছেন শুনলাম। তিনিও বেচে দেবেন। তাঁর share.
মনিবকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাজকর্ম দেখে, শংকরের বাংলোয় ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো বেজে গেল।
সন্ধ্যার ধূসর ছায়া ধরিত্রীর বুকে যেন রহস্যের যবনিকার মত নেমে এসেছে।
শংকরের ডাক-বাংলোয়, সকলে একত্রিত হয়েছে। খনির দুই অংশীদার, সুধাময় চৌধুরী ও হনুমান প্ৰসাদ ঝুন-ঝুন-ওয়ালা, সুব্রত, কিরীটী, দারোগাবাবু ছদ্মবেশে ও শংকর নিজে। কিরিটী বলছে আজ অপরাধী কে সকলের সামনে প্ৰকাশ করে বলবে এবং হাতে হাতে দারোগাবাবুর জিম্মায় দিয়ে দেবে। সুধাময়বাবু ও ঝুন-ঝুন-ওয়ালা দুজনেই বলেছেন। অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পারলে দুজনেই পাঁচ-হাজার করে দশ হাজার টাকা কিরীটীকে পুরস্কার দেবেন।
কিরীটী বলতে লাগল– Before I mention the name let me have my reward first of all with the promise that if I fail will return the same
সুধাময়বাবু ও কুন-বুন-ওয়ালা দুজনেই হাসতে হাসতে পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকার দু:খানা চেক লিখে দিলেন, এই নিন।
তা হলে আপনারা সকলে শুনুন।
এই খনি অভিশপ্তও নয়, ভূতের আস্তানাও নয়; প্রচুর লাভের খনি। …এবং আজ পর্যন্ত এই খনিতে যতগুলো খুন হয়েছে তার জন্য সর্বাংশে দায়ী খনির অন্যতম অংশীদার স্বয়ং সুধাময় চৌধুরী।…
ঘরের মধ্যে বজ্ৰপাত হলেও বোধ হয় এতটা কেউ চমকে উঠত না।
প্রবল ব্যঙ্গ মিশ্রিত স্বরে সুধাময়বাবু প্ৰচণ্ড হাসির তুফান তুলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তার এক হাত প্যান্টের পকেটে —সহসা পিস্তলের গর্জন শোনা গেল।
গুড়ুম।
উঃ! একটা বেদনার্ত চিৎকার করে সুধাময়বাবু একপাশে টলে পড়লেন, এক হাত দিয়ে ডানদিকে পাজরা চেপে ধরে অন্যহাত থেকে একটা রিভলভার ছিট্কে পড়ল।
শয়তান। কুকুর। তোকে কুকুরের মতই গুলী করতে বাধ্য হলাম, দারোগাসাহেব গর্জন করে উঠল—না হলে তুই-ই হয়ত এখনি আমায় গুলী করতিস। জীবনে আজ এই প্ৰথম সত্যিকারের গুলী করতে বাধ্য হলাম, কিন্তু তার জন্য আমার এতটুকুও অনুশোচনা হচ্ছে না। যে নৃশংস এতগুলো খুন পর পর করতে পারে—তার একমাত্র শাস্তিই পাগলা কুকুরের মত গুলী করে মারা।–
উঃ। কিরীটীবাবু। আপনার কথাই ঠিক। অতি লোভ সত্যিই শেষ পর্যন্ত আমার মৃত্যুর কারণ হলো।—হ্যাঁ স্বীকার করছি আমি-আমিই সব খুন করেছি। —উঃ –
ধীরে ধীরে হতভাগ্য সুধাময় চৌধুরীর প্রাণবায়ু বাতাসে মিশে গেল।
সহসা যেন নাটকের যবনিকাঁপাত ঘটল।
ঘরের সব কয়টি প্রাণীই স্তব্ধ।
কারও মুখে কোন কথা নেই।
কিরীটি এতক্ষণে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল, এবারে আমি আমার বক্তব্য সব সংক্ষেপে শেষ করব। কেন না, আজকের রাত্রের bus-ই আমার ধরতে হবে। একটা কথা সর্বাগ্রে আপনাদের কাছে খুলে না বললে আমার এই ব্যাপারে। explanationটা সহজবোধ্য হবে না। বর্তমানে এই যে এখানকার কোলিয়ারীটা দেখছেন, ৫০ বছর আগে এই কোলিয়ারীর পাশের ঐ একটা কোলিয়ারী হঠাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ ধ্বসে যায়। এরূপ কিংবদন্তী আছে। তারপর থেকেই এখানকার আশেপাশের লোকেরা এ জায়গাটা সম্পর্কে নানা প্রকার মনগড়া বিভীষিকার কথা তুলে এটাকে অভিশপ্ত করে তোলে। এমনি করে দীর্ঘ চল্লিশটা বছর কেটে যায়।
কেউ এর পাশে ঘেঁষে না।
এমন সময় কোলিয়ারী শুরু করবার ইচ্ছায় মিঃ ঝুন-ঝুন-ওয়ালা ও সুধাময় চৌধুরী এদিকে ঘুরতে ঘুরতে এই অভিশপ্ত ফিল্ডটার সন্ধান পান এবং অচিরে এটার লিজ নেন নব্বই বছরের জন্য খুব সামান্য টাকায়।
কিন্তু কাজ আরম্ভ করতে আরও বছর চারেক কেটে যায়।
তারপর কাজ শুরু হলো।
কাজ বেশ এগুচ্ছে এবং ফিল্ড থেকে প্রচুর কয়লা উঠছে। এই সময় শয়তান সুধাময়ের মনে কু-মতলব জাগল। তিনি মনে মনে বদ্ধপরিকর হলেন ঝুন-ঝুন-ওয়ালাকে ফাকি দিতে। কিন্তু কেমন করে ঝুন-কুনি-ওয়ালাকে সরান যায়। সেই চিন্তা করতে লাগলেন।
একদিন খনির কাজ পরিদর্শন করতে এসে সামান্য অজুহাতে খনির সরকার বিকাশবাবু ও ম্যানেজারের এ্যাসিসটেন্ট সত্যকিংকরবাবুকে বরখাস্ত করে নিজের লোক বিমলবাবু ও চন্দনসিংহকে নিযুক্ত করে গেলেন। চন্দনসিং ও বিমলবাবু ছিল সুধাময়বাবুর ডান ও বাঁ হাতের অপকর্মের প্রধান সঙ্গী ও সহায়ক। বিমলবাবু ও চন্দনসিং সুধাময়বাবুকে সকল সংবাদ সরবরাহ করত ও খনিটা ভৌতিক এই কিংবদন্তীকে আরো সুদৃঢ় করবার জন্য প্রোপাগাণ্ডা চালাত দিবারাত্র নানাভাবে।
সুধাময়বাবুর রং ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নিজে বহুকাল সাঁওতাল পরগণায় ঘুরে ঘুরে সাঁওতালদের সামাজিক রীতিনীতি আচারব্যবহার ও কথাবার্তাও পুরোপুরিভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন, এবং যাতে করে তিনি অনায়াসেই, সাঁওতাল কুলীদের মধ্যে তাদেরই একজন সেজে দিব্যি খোশ মেজাজে একের পর এক খুন করে চলেছিলেন। অথচ কেউ কোনদিন সন্দেহ করবার অবকাশ পায় নি।
সুব্রতকে পাঠিয়ে দিয়েই আমি গোপনে পরের দিন সকালেই পাগলের ছদ্মবেশে এখানে চলে আসি এবং চারদিকে নজর রেখে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করি।
আমার কেন যেন মনে হয়, যে খুন করেছে এইভাবে পরপর ম্যানেজারদের, সে এখানেই সর্বদা উপস্থিত থাকে। কিন্তু কীভাবে সে এখানে থাকতে পারে? কৰ্মচারীদের মধ্যে একজন হয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়; কেন না তাতে চাটু করে ধরা পড়বার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে কেমন করে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। অথচ এ কথা যখন অবধারিত এখানে সর্বদা উপস্থিত না থাকলে চারিদিকে দেখে শুনে তার পক্ষে খুন করা সম্ভব হয় না, তখন নিশ্চয়ই কুলীদের মধ্যেই তাদের একজন হয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে।
সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করে দিই।
এবং এখানে আসবার দিন রাত্রে যখন কুলীদের মধ্যে একজন খুন হলো, সে সময় আমি কুলীদের ধাওড়ার মধ্যেই কুলী সেজে উপস্থিত ছিলাম; কুলীটাকে খুন করে সুধাময় কুলীর ছদ্মবেশে যখন পালায় তখন আমি অন্ধকারে অনুসরণ করে তার ঘরটা দেখে আসি।
বিমলবাবু ও চন্দনসিং-এর সাহায্যে নয়জন কুলীকে রাতারাতি ধানবাদ কাজের অছিলায় হাঁটা পথে রেল লাইন ধরে প্রচুর টাকা ঘুস দিয়ে বিদায় করে। মাত্র একজন কুলি নিয়ে বিমলবাবুর সাহায্যে রামলোচনের জামার পকেট থেকে চাবি চুরি করে, খনির মধ্যে নেমে ডিনামাইট্র দিয়ে পিলার ধ্বসিয়ে ১৩নং কাঁথি ভাঙ্গা হয় তাও আমার নজর এড়ায় না। সুব্রত তুমি রুমালে বাঁধা পলতে ও ডিনামাইট্ পেয়েছ।
পরের দিন সকলে জানাল ১০জন লোক মারা গেছে। যদিও মারা গেল একজন মাত্র। এটা শুধু কুলীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করবার জন্য সাজিয়ে করা হয়েছিল।
ম্যানেজারদের মারা হয়। চারিদিকে সকলের মনে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক জাগাবার জন্য যাতে করে খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং খনির কাজ বন্ধ হয়ে গেলে নিজে শেয়ার ছেড়ে দেবার ভাণ। দেখিয়ে ঝুন-ঝুন-ওয়ালাকে দিয়ে তার শেয়ারও বিক্রয় করিয়ে বেনামীতে সমগ্র খনিটা কিনে নিলেই কাজ হাসিল হয়ে যায়।
সব কিছু প্ৰায় হয়ে এল, সুধাময় কুন-ঝুন-ওয়ালার সঙ্গে চিঠিপত্র লিখে যখন সব ঠিক করে ফেললে তখন তার অপকর্মের সহায়ক বিমলবাবু ও চন্দনসিংহকে সরাবার মতলব করল।
গতকাল বিমলকে মারলেও চন্দন সিং নাগালের বাইরে পালিয়ে গেল। কেন না প্রভুর মনোগত ইচ্ছােটা সে আগেই টের পেয়েছিল। Metalic mails, পরে তাতে বিষ মাখিয়ে হাতের আঙ্গুলে পরে, তার সাহায্যে গলা টিপে সুধাময় কাজ হাসিল করত। Strangle করবার সময় সেই Metalic mails গলার মাংসে বসে গিয়ে বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটাত। এখন কথা হচ্ছে শার্দুলের ডাক যেটা শোনা যেত সেটা আর কিছুই নয়; সুধাময় নিজেই মুখ দিয়ে বাঘের হুবহু অনুকরণ করতে পারত। তোমরা হয়ত শুনে থাকবে এক একজন অবিকল পশু পক্ষীর ডাক মুখ দিয়ে অনুকরণ করতে পারে। এটা একটা মানুষকে ভয় দেখাবার ফন্দি। তা ছাড়া খুব উঁচু হিলওয়ালা এক প্রকার কাঠের জুতো পরে গায়ে একটা ধূসরবর্ণের ওড়না চাপিয়ে সুধাময় মাঠের মধ্যে দিয়ে দ্রুতবেগে চলত। একে সে একটু বেশী রকম লম্বা ছিল, তার উপরে ওই কাঠের জুতো পরাতে তাকে বেশ অস্বাভাবিক রকম বলে মনে হতো। কাঠের জুতো ব্যবহার করবার মধ্যে আরো একটা মতলব তার ছিল; পায়ের ছাপ পড়ত না। সুব্রতকে মারবার জন্য একটা সাঁওতাল কুলীকে সুধাময়বাবুই, engage করেছিলেন; কুলীটা বিষাক্ত তাঁর চূড়লো কিন্তু unsuccessfull হলো; কিন্তু সুব্রতকে তাঁর ছোঁড়বার সঙ্গে সঙ্গেই সুধাময়ও লোকটাকে গুলী করে মারে; আমিই সেই সময় ওদের পিছনে follow করতে করতে উপস্থিত ছিলাম বলে সব ব্যাপারই নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। এই হল এখানকার খনির মৃত্যু রহস্য। কিরীটী চুপ করল।
আমাদের গল্পও এই খানেই শেষ হলো।