রত্নমঞ্জিল

রত্নমঞ্জিল

আহারাদির পর দুই বন্ধু এসে বসবার ঘরে বসে।

শীতের রাত। শীতটাও কয়েকদিন ধরা যেন জাঁকিয়ে বসেছে। ঘরের কোণে ইলেকট্রিক হিটার জ্বলছিল, তারই উত্তাপে ঘকটা বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছিল। দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে টানছে —বামাদেব অধিকারী আর কিরীটী রায়। বামাদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষষেরা এককালে বহরমপুরের নামকরা জমিদার ছিলেন। এখনো জমিজমা কিছু আছে বটে কিন্তু তার প্রাচুর্যের আসল উৎসটা ব্যবসা-কঁচা মালের আমদানি রপ্তানির ব্যবসা দেশ-বিদশে। এবং বিরাট ফলোয়া ব্যবসা।

আর কিরীটী রায় তখনো হ্যারিসন রোডের মেস বাণীভবনে থাকে। একদা বামদেবের কলেজ-জীবনের সহধ্যায়ী বন্ধু।

কিরীটী হাতের সিগারেটটায় দীর্ঘ এক টান দিয়ে বললে, তারপর বল কিসের পরামর্শ করার জন্য আমায় ডেকেছিস? কোনরকম ভণিতা না করেই কিরীটী শুরু করল বলতে।

ব্যাপারটা হচ্ছে একটা সুবৰ্ণ হীরাখচিত কঙ্কন—বামদেব বললে।

কি রকম? কিরীটী কৌতূহলী হয়ে বলল।

আগে কঙ্কনটা দেখ, তারপর বলছি। সব কথা। বামদেব বললে।

উঠে গিয়ে আয়রণ সেফ থেকে পাশের ঘরের একটি সাবেককেলে লেদারের চৌকো। বাক্স নিয়ে এল বামদেব! বাক্সের ডালা খুলতেই দেখা গেল একখানি কঙ্কন—হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কন। সত্যিই অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত কঙ্কনটি-চোখ যেন ফেরানো যায় না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কঙ্কনের দিকে কিরীটী।

আরো আধঘণ্টা পরে।

কিরীটী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টেবিলের ওপরে রক্ষিত ডোমে-ঢাকা বৈদ্যুতিক টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মুগ্ধ বিস্ময়ে হস্তধৃত হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কনখানি দেখছিল। ওজনে তিন ভরি তো হবেই—সেকেলে জড়োয়া গহনা যাকে বলে, একেবারে খাঁটি পাকা সোনার তৈরী। ভিতরটা গালা ভরা নয়, একেবারে নিরেট।

হীরকখচিত কঙ্কন। দু’পাশে হতে দুটো হাঙ্গরের হিংস্র মুখ যেন পরস্পরের সঙ্গে এসে ঠেকেছে। আজকালকার হালফ্যাসানের যুগে এ ধরনের ভারী অথচ সুক্ষ্ম কাজ বড় একটা চোখেই পড়ে না। ছোট ছোট হীরা কঙ্কনটির সারা গায়ে বসানো, ল্যাম্পের আলোয় সব ঝলমল করছে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে সম্মুখে চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট বামদেব অধিকারীর হাতে সেটা এগিয়ে দিল কিরীটী এবং প্রশ্ন করল, কিন্তু একটি কঙ্কন কোন-আর একটি কোথায়?

বামদেব মৃদু কণ্ঠে বলল, জানি না।

জানিস না মানে?

সত্যিই জানি না। এর অন্য কঙ্কনটি কোথায়, কিরীটী!

ঠিক বুঝলাম না।

সেই কথা বলবার জন্যই এবং কি ভাবে অন্য কঙ্কনটি উদ্ধার করা যেতে পারে সেই পরামর্শ নেবার জন্যই তোকে ডেকে এনেছি–

সব কথা আমায় খুলে বল বাম। অন্য কঙ্কনটির কথা কিছুই তুই জানিস না—কিছুই জানিস না?

শুনেছি হারিয়ে গিয়েছে–

হারিয়ে গিয়েছে!

হ্যাঁ। সেই রকমই আমার পিসেমশাইয়ের মুখে শুনেছি। কঙ্কন জোড়া আমার পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। আমার প্রপিতামহী বিন্ধ্যবাসিনী দেবী তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্রবধু শরৎশশী দেবী আমার পিতামহীর হাতে আসে ঐ কঙ্কন জোড়া। আমার ঠাকুর্দার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে আমার পিসিমা মৃন্ময়ী দেবী ছিলেন আমার বাবার চাইতে বয়সে প্রায় চোদ্দ বছরের বড়।

বামদেব বলে চলে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার ঠাকুর্দার কোন পুত্রসন্তান না হওয়ায় মাত্র এগার বৎসর বয়সে কন্যা মৃন্ময়ীর বিবাহ দিয়ে পিসেমশাইকে ঘরজামাই করে রাখলেন— পুত্রের মতই! তের বৎসর বয়সে অর্থাৎ বিবাহের পরবৎসরই পিসিমার একটি পুত্র জন্মাল— আমার পিসতুত ভাই অনিলন্দা এবং অনিলন্দার জন্মের দেড় বৎসর পরে জন্মাল বাবা–

তাহলে তোর বাবা তোর পিসতুত ভাই অনিলদার থেকে বয়সে ছোট?

হ্যাঁ প্রায় দেড় বৎসরের ছোট।

তারপর?

বামাদেব অধিকারী পুনরায় শুরু করে তার কাহিনী, আমার পিসেমশাই শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সংসারের প্রতি কোনদিনই তেমন আকর্ষণ ছিল না। দিবারাত্ৰ জপতপ নিয়েই থাকতেন—শোনা যায় তিনি নাকি একজন রীতিমত সাধক ছিলেন।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ, দিবারাত্রি বেশীর ভাগ সময়েই জপ-তপ পূজাআর্চা নিয়েই থাকতেন। প্রথম যৌবনে শুনেছি আগুনের মত প্রখর রূপ ছিল আমার পিসেমশাইয়ের। বাবরী চুল, কটা চোখ, বিরাট দশাসই চেহারার পুরুষ আমার পিসেমশাইকে একবার দেখলে তাঁর দিক থেকে নাকি চোখ ফেরানো যেত না। প্রথম যৌবনে নাকি তিনি নিয়মিত কুস্তি ও ডনবৈঠক করায় দেহেও ছিল তাঁর অসুরের মতই বল। গরীব যজমোন পুরোহিতের একমাত্র সন্তান ছিলেন পিসেমশাই। সেই জন্যই এবং তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুর্দা তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিয়ে ঘরজামাই করে এনেছিলেন। কিন্তু পিসেমশাই সরল সাধক এবং সংসারের প্রতি ও সেই সঙ্গে স্ত্রীর প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণ না থাকায় বোধহয় বিবাহটা শেষ পর্যন্ত সুখের হলো না।

কেন? শুধু কি ঐ কারণেই বিবাহটা সুখের হয়নি?

না, আমার মনে হয় আরো কারণ ছিল। ধনশালী জমিদারের একমাত্র দুহিতা আমার পিসিমা ছিলেন যেমন গর্বিতা তেমনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্ত্রীলোক, আর আমার পিসেমশাই ছিলেন ঠিক ভিন্ন প্রকৃতির—শান্ত সহিষ্ণু ও সদাহাস্যময় পুরুষ। তা সত্ত্বেও শুনেছি পিসেমশাই যথাসাধ্য মানিয়ে চলবোরই চেষ্টা করেছেন দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু পিসিমার দিক থেকে বোধ করি কোন কমপ্রোমাইজের ইচ্ছা ছিল না—তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রতি মুহুর্তে বিবাদ-বিসম্বাদ লেগেই ছিল। এবং সেই বিসম্বাদ চরমে উঠল অনিলদার জন্মের পর হতেই এবং যার ফল হল অতিবড় সহিষ্ণু ও শান্তপ্রকৃতির লোক পিসেমশাইকেও বাধ্য হয়ে একমাত্র স্বামী-স্ত্রীর লৌকিক সম্পর্কটা ছাড়া অন্য সমস্ত সম্পর্কই তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছিন্ন করে জমিদারবাড়ির বাইরের মহলে নিজেকে একেবারে নির্বাসিত করতে হল। ঐ ঘটনার কিছুদিন পরেই আমার বাবার জন্ম। বাবার জন্মের কিছুদিন পর হতেই কিন্তু পিসিমা যেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ নিলেন—চেষ্টা করতে লাগলেন পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আবার নতুন করে সৌহার্দ স্থাপনের জন্য। কতদূর তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল জানি না, তবে পিসেমশাই কিন্তু অন্দরে আর ফিরে এল না। নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত বাইরের মহলেই রাত কাটাতে লাগলেন ও দিনের বেলাটা নির্জন একটা অন্ধকার ঘরে পূজাআচর্গ নিয়েই কাটাতে লাগলেন। যখন আমার বাবার বছর দেড়েক বয়স সেই সময় একদিন মা ও মেয়ে অর্থাৎ পিসিমা ও আমার পিতামহীর সঙ্গে প্রচণ্ড একটা বিবাদ হয়ে গেল।

বিবাদ হলো কেন?

এই কঙ্কনের ব্যাপার নিয়েই। আমার পিতামহী শরৎশশীর পুত্র না থাকায় পিসিমার বিবাহের সময় কঙ্কন জোড়া কন্যাকেই যৌতুক দিয়েছিলেন। পরে পুত্র জন্ম নেওয়ায় একদিন পিতামহী কথাপ্রসঙ্গে মেয়েকে বলেছিলেন—মীনু, এ বংশের নিয়ম কঙ্কন জোড়া এই বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূই পাবে। তোর যখন বিবাহ হয় তখন খোকা জন্মায়নি বলে এবং আর পুত্র হবার কোন সম্ভাবনা নেই ভেবেই কঙ্কন জোড়া তোকে যৌতুক দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এখন সে কঙ্কনের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হচ্ছে খোকারই স্ত্রী এই বাড়ির ভবিষ্যৎ বধু। উত্তরে পিসিমা বললেন, সে কি মা! যে বস্তু একবার আমার বিবাহের সময় যৌতুক দিয়েছ, এতদিন বাদে সেটা আর কেড়ে নেবে কোন যুক্তিতে? আমিই বা লোকের কাছে মুখ দেখাব কি করে আর তোমাদেরই কি লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না? মাতামহী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে পিসিমাকে বললেন, ভেবে দেখা তুই মীনু, সমস্ত ব্যাপারটাই একটা দৈবনির্দেশ ছাড়া কিছুই নয়। নিয়মানুযায়ী ও কঙ্কনের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী এই বংশের বধু। মৃত্যুর সময় আমার শাশুড়ী এই প্রতিজ্ঞই আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন। অন্যথায় তিনি বলেছিলেন, নাকি ভয়ানক অমঙ্গল দেখা দেবে। আমি বরং তোকে ওর চাইতেও দামী ও সুন্দর এক জোড়া কঙ্কন গড়িয়ে দেবো মা, ও কঙ্কন জোড়া তুই ফেরত দে।

কিন্তু পিতামহীর কোন যুক্তিই পিসিমা মানতে চাইলেন না এবং রীতিমত চেঁচামেচি ও ঝগড়া করে কড়া কড়া কতকগুলো কথা শুনিয়ে দিয়ে মাকে পিসিমা ঘর ছেড়ে হন।হন। করে চলে গেলেন। এসব কথা আমার মা’র মুখেই পরবর্তী কালে শোনা। মা শুনেছিলেন তার শাশুড়ী আমার পিতামহীর কাছ থেকে।

তারপর?

পিসিমার ঐ ধরনের ব্যবহারে পিতামহী অত্যন্ত মনে ব্যথা পান এবং পিতামহ ও দুঃখিত হন।

হুঁ, থামকি কেন বল্‌।

যা হোক, শোনা যায়। অতঃপর নাকি পিসিমা তাঁর মা’র ঘর থেকে বের হয়ে সোজা একেবারে বাইরের মহলে তার স্বামীর কাছে গিয়ে হাজির হলেন।

পিসেমশায় ঐ সময় তার নির্জন অন্ধকার কক্ষের মধ্যে প্রদীপের আলোয় বসে কি একখানি পুঁথি অধ্যায়ন করছিলেন, আচমকা স্ত্রীকে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে মাখ তুলে তাকালেন।

এই মুহুর্তে আমি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে চাই। যেখানে হোক অন্য কোথাও আমায় নিয়ে চল। পিসিমা বললেন তার স্বামীকে।

কি হল হঠাৎ আবার? এত উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন?

বিচলিত—উত্তেজিত হই কি সাধোঁ? তুমি যদি মানুষ হতে এতটুকু লজ্জা-সরমও যদি তোমার থাকত তো দুঃখ ছিল কি আমার!

কি হয়েছে শুনিই না। হাসতে হাসতে পিসেমশাই শুধান।

আমি এখানে এ বাড়িতে আর এক মুহুৰ্তও থাকব না।

কেন হল কি? হবে। আবার কি—বিবাহের পর স্ত্রীলোকের একমাত্র স্থান তার স্বামীর গৃহে তা সে পর্ণকুটিরই হোক বা গাছতলাই হোক। আমায় নিয়ে চল—

তুমি তো জান মৃন্ময়ী, আমি সহায়-সম্বলহীন, নিজের বলতে আমার একটি কুঁড়েঘরও নেই। করুণ কণ্ঠে পিসেমশাই বলেন।

তা জানি না, বিবাহ করেছি। স্ত্রীকে ভাতকাপড় মাথা গোঁজবার ঠাঁই দিতে পার না–পুরুষমানুষ হয়ে কথাটা বলতে লজ্জা করল না।

পুরুষমানুষ হলে হয়ত লজ্জা করত, কিন্তু আমি যে ঘরজামাই। পুরুষ হলে কি ঘরজামাই হতাম! করুণ হেসে জবাব দেন তিনি।

কোন কথা শুনতে চাই না, এই মুহুর্তে তুমি আমাকে অন্য কোথায়ও নিয়ে যাবে কিনা বল। নচেৎ তোমার সামনেই আমি গলায় দড়ি দেব।

তা না হয় হল, কিন্তু ব্যাপার কি তাও বলবে না?

নেহাৎ অনিচ্ছার সঙ্গেই স্বামীর পীড়াপীড়িতে মৃগীয় দেবী তখন সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে পিসেমশাইয়ের গোচরীভূত করলেন। সমস্ত শুনে পিসেমশাই বললেন—মিথ্যে তুমি রাগ করছো মৃন্ময়ী। তোমাকে নিয়ে অন্যত্র কোথায়ও আজই যাব, কিন্তু কঙ্কন জোড়া এখান হতে চলে যাবার পূর্বে তোমায় ফেরত দিয়ে যেতে হবে। অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা তার কণ্ঠে প্রকাশ পেল।

না, আমি ফেরত দেব না। একবার যা দান করেছে, তার ওপরে আর ওদের কোন অধিকার নেই। প্রতিবাদ জানালেন পিসিমা।

উঁহু, ফেরত তোমাকে দিতে হবেই। পিসেমশাইয়ের চিরদিন শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে যেন একটা বজের আভাস পাওয়া গেল।

না–দেবো না। কারণ আমি জানি এ কঙ্কন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক অমঙ্গল আমাকেই ঘিরে ধরবে। আমি ঠাকুরমার মুখে ছোটবেলায় শুনেছি, সন্ন্যাসীপ্রদত্ত আশীবাদী এই কঙ্কন জোড়া। কোন এক সন্ন্যাসীর পরামর্শেই নাকি এই হীরকখচিত কঙ্কন জোড়া গড়িয়ে সন্ন্যাসীর মন্ত্রপূত আশীৰ্বাদসহ এই বংশেরই কোন পূর্বপুরুষ তার স্ত্রীর হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই হতেই কঙ্কন জোড়া এ বাড়ির জ্যেষ্ঠ বন্ধুর হাতে থাকে এবং সন্ন্যাসী নাকি বলে গিয়েছিলেন-যতদিন এই কঙ্কন কোন নারীর হাতে থাকবে ততদিন তাকে কোনদিন বৈধব্য স্পর্শও করতে পারবে না, এমন কি কোন অমঙ্গলই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এবং একমাত্র মৃত্যু ভিন্ন এ কঙ্কন একবার হাতে পরে খুলে ফেললেও মহা। সর্বনাশ হবে।

পিসেমশাই নাকি অতঃপর শান্তকণ্ঠে পিসিমাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, শোনা মৃন্ময়ী, তোমার কথা হয়ত মিথ্যা নয়, কিন্তু সবটাই তো তোমার শোনা কথা—

না না-শোনা কথা নয়! পিসিমা বলেন।

তা ছাড়া কি? বংশপরম্পরায় ঐ কাহিনী মুখে মুখে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া একটা কথা কি জান, ভাগ্যে যা লেখা আছে তা কেউ জানতে কি আজ পর্যন্ত পেরেছে, না পারে? শোন আমি যা বলি, তুমি এখানে থাকতে চাও না। আর একটা মুহুৰ্তও বেশ-এখানে থেকে নিয়ে তোমাকে আমি যাব। কিন্তু তার আগে যা বললাম তা তোমায় করতে হবে–

কি?

ঐ কঙ্কন জোড়া তোমার মা যখন বলেছেন, ফিরিয়ে দেবে তুমি তাঁকে। তারপর এ বাড়ি থেকে আমরা বেরুব।

না না, তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। পারবো না-আমি তা পারবো না।

হঠাৎ এবার শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বরটা যেন বদলে গেল। তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে শান্ত কঠিন কণ্ঠে বললেন, শোনা মৃন্ময়ী, এ বাড়ি ছেড়ে যদি সত্যিই যেতে চাও তুমি তো আমার কথা তোমাকে সর্বাগ্রে মানতে হবে

আমি—

শোন আরো একটা কথা-যদি আমার কথা তুমি না রাখ, তাহলে জানবে কালই এ বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাব-এই আমার শেষ কথা।

মৃন্ময়ী অতঃপর বলে ওঠে, না না—ও কথা বলো না। আমার অমঙ্গলের কথা আন্দীে আমি চিন্তা করিনি। আমি আমাদের একমাত্র সন্তান আনিলের কথা ভেবেই বলেছি। যদি ওর কোন অমঙ্গল হয়–

কি জানি কেন শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী তাঁর একমাত্র পুত্রটিকে প্রাণের চাইতেও বেশী ভালবাসতেন। মৃন্ময়ীর কথায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, তারপর আবার একসময় বললেন, বেশ তবে এক কাজ কর—একটা কঙ্কন তোমার হাতে থাক, অন্যটা খুলে মাকে দিয়ে এস।

আশ্চর্য! মৃন্ময়ী তার স্বামীর প্রস্তাবটিকে মুহূর্তকালের জন্য ভাবলেন, তারপরই রাজী হয়ে গেলেন।

ঠিক হল ঐদিনই সন্ধ্যার পর রাত্রে তারা তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন একটি কঙ্কন ফিরিয়ে দিয়ে।

যাবার পূর্বে শ্যামসুন্দরের ইচ্ছামত মৃন্ময়ী একখানি কঙ্কন তার মা’র হাতে ফিরিয়ে দিলেন আর বললেন, অন্যটা তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ধারণ করবেন তার স্বামীর মঙ্গলের জন্য। শরৎশশী দেবী মেয়ের কথায় হ্যাঁ বা না কোন কথাই বললেন না। আর, কেবল হাত পেতে একখানা কঙ্কনীই মেয়ের কাছ থেকে নিলেন।

মৃন্ময়ী একটি কঙ্কন ফিরিয়ে দিলেন বটে কিন্তু তাঁর মাকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিলেন না যে, সেই রাত্রে ওঁরা ঐ গৃহ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

ঠিক ছিল রাত বারোটার পর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, চারদিক নিযুতি হয়ে গেলে শ্যামসুন্দর অন্দরে এসে তার স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে যাবেন।

নির্দিষ্ট সময়ে স্ত্রীকে ডাকতে এসে তাঁর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে শ্যামসুন্দর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

ঘরের মধ্যে তাঁর বালক পুত্রটি একাকী শয্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর মৃন্ময়ীর প্রাণহীন দেহটা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। হাতে তাঁর কঙ্কনটি নেই। আর মৃন্ময়ীর প্রাণহীন দেহের পাশে পড়ে আছে একটা খালি শিশি—তাতে লেখা বিষ। ঐ রাত্রেই শ্যামসুন্দর জমিদারবাড়ি ছেড়ে চলে যান এক বস্ত্ৰে।

তার পর? শ্যামসুন্দরের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি? কিরীটী শুধাল।

না।

মৃন্ময়ী তাহলে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছিলেন?

হুঁ।

কিন্তু এসব কথা তুমি জানলে কি করে? কিরীটীর প্রশ্ন।

পিসিমার এক বুড়ি ঝি ছিল, তারই মুখে সব কথা শোনা। সে পিসিমাকে বিষপান করতে দেখেনি বটে—তবে পিসেমশাইকে ঘরে ঢুকতে দেখেছিল।

তারপর কঙ্কনটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি?

না।

একটু থেমে বামদেব আবার বলতে লাগলেন।

অনিলদা আমার পিতামহের কাছেই মানুষ হতে লাগল। দীর্ঘ ষোল বৎসর পরে পিসেমশাই আবার একদিন আমাদের ওখানে ফিরে এলেন, এখনো তিনি বেঁচে আছেন। পরে অবশ্য এ গল্প তাঁর মুখেও আমার শোনা।

এই পর্যন্ত বলে বামদেব অধিকারী চুপ করলেন।

কিরীটীও স্তব্ধ।

বাইরে নিযুতি রাত্রি।

তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।

আজ পর্যন্ত পিসিমার হাতের সেই কঙ্কনটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেনই বা পিসিমা আত্মহত্যা করলেন আর কি করেই বা পিসিমার হাত হতে কঙ্কনটি চুরি হয়ে গেল—আজও সে রহস্য উদঘাটিত হল না। যা হোক, অপহৃত সে কঙ্কনটির কথা সকলে ভুলেই গিয়েছিল পিসিমার মৃত্যুর ব্যাপারের সঙ্গে সঙ্গে এবং এতদিন পর্যন্ত সে কঙ্কনটির কথা আর কারো মনেও পড়েনি। কিন্তু মাত্র মাসখানেক আগে আমাদের বহরমপুরের পৈতৃক বাড়িটা বিক্রির কথাবার্তা শুরু হবার পর হতেই আমাদের কলকাতায় এই বাড়িতে ঘন ঘন চোরের উপদ্রব শুরু হলো-?

চোরের উপদ্রব? বিস্মিত কিরীটী প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ এই গত মাসখানেক ধরে পাঁচ-সাতবার চোর এসেছে এই বাড়িতে এবং প্রত্যেক বারই আমার স্ত্রীর ঘরে। আমাদের কোন সন্তানসন্ততি নেই। একমাত্ৰ আছে আমাদের এক পালিতা পিতৃমাতৃহীন বন্ধু কন্যা সুজাতা। সুজাতা ও আমার স্ত্রী এক ঘরেই শোয়। কারবারের কাজে মধ্যে মধ্যে আমাকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়। দেখেছি। আমি বাইরে গেলেই বাড়িতে রাত্রে চোরের উপদ্রব হয়। সাধারণত—

আচ্ছা একটা কথা! কিরীটী প্রশ্ন করে।

কি?

চোর এসেছে কিন্তু কিছু চুরি যায়নি?

সেটাই আশ্চর্য; চোর এসেছে বটে কিন্তু কিছুই চুরি যায়নি।

কি রকম?

তাই। প্রথমটায়। তাই ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারিনি, পরে হঠাৎ একটা কথা মনে হয় ভাবতে ভাবতে—

কি?

চোর এসেছে বার বার আমার স্ত্রীর হাতের ঐ কঙ্কনটির লোভে।

বল কি। কিন্তু—

সেই কথাই বলছি। বামদেব বলতে লাগল, শেষবার চোর এসে প্রথমে আমার স্ত্রীর ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত থেকে কঙ্কনটি খুলে নেবার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থকাম হয়, তখন কঙ্কনটা আমার স্ত্রীর হাতসমেতই কেটে নিয়ে যাবার মতলবে ছিল বোধ হয়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু অন্ধকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ধারাল অস্ত্রের কোপটা পাশের বালিশে পড়তেই স্ত্রীর ঘুম ভেঙে যায়। পরের দিনেই সকালবেলা আমি ফিরে আসি। প্রথমটায় আমরা ধারণাও করতে পারিনি যে চোরের লক্ষ্য ঐ কঙ্কনটির উপরেই। পরে আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শেষবারের ঐ চেষ্টার পর অমঙ্গলের সম্ভবনা সত্ত্বেও আমার স্ত্রীর হাত হতে কঙ্কনটি খুলে বাধ্য হয়ে সিন্দুকে তুলে রাখি, কিন্তু তাতেও রেহাই নেই, গতরাত্রেও আবার চোর এসেছিল। এবং লোহার সিন্দুকটাই ভাঙবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জামান সিন্দুক খুলতে পারেনি। এতে আরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, চোরের লক্ষ্য ঐ হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কনই। তোমার কি মনে হয় কিরীটী? বামদেব কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল।

সেই রকম বলেই তো মনে হচ্ছে তোমার মুখে সব শুনে। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।

কিন্তু একটা কথা আমি বুঝে উঠতে পারছ না কিরীটী, আমার স্ত্রীর আরো বহু টাকার স্বর্ণালঙ্কার আছে কিন্তু চোরের এই কঙ্কনটির ওপরেই কেবল নজর কেন?

কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসে বলল, তাহলে তো কঙ্কন-রহস্যই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল বামদেব। আমার সব শুনে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই এই সুবর্ণ কঙ্কনের পশ্চাতে এমন কোন গোপন ইতিহাস আছে যেটা চোরকে বিশেষভাবে কঙ্কনটির প্রতিই লালায়িত করে তুলেছে।

আমার স্ত্রীও অবিশ্যি সেই কথাই বলছিল, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। পুরাতন দিনের আর অবিশ্যি পিসেমশাই ব্যতীত কেউ বেঁচে নেই, কিন্তু এমন কোন ইতিহাস ঐ কঙ্কনের সঙ্গে জড়িত থাকলে অন্ততঃ পিসেমশাইও কি সেকথা জানতেন না।

না জানতেও তো তিনি পারেন। সর্বদা তো তিনি বহির্বাটিতে জপতপ নিয়েই থাকতেন। শুনলাম?

হ্যাঁ। সংসারে থাকলেও কোনদিন তিনি সংসারী ছিলেন না।

আচ্ছা একটু আগে তুমি যে বলেছিলে, বহরমপুরের পৈতৃক বাড়িটা তোমার বিক্রির কথাবার্তা হচ্ছে!

হ্যাঁ, ওই বাড়িটা অৰ্থাৎ ‘রত্নমঞ্জিলে’র বিক্রির কথাবার্তা চালাচ্ছি। একপ্রকার পাকাই হয়ে গিয়েছে বলা যায়, বায়না নেওয়া হয়েছে।

বাড়িটা অনেক দিনের না?

হ্যাঁ। আমাদের পূর্বপুরুষ নবাব সরকারের চাকরি করতেন। আসলে আমরা চট্‌ য্যে, অধিকারী আমাদের বংশের নবাব-প্রদত্ত খেতাব। নবাব সরকারে ঐ চাকরির সময়েই বহরমপুরে তিনি একখানা গৃহ নির্মাণ করেন, পরে পূর্ববঙ্গ হতে এসে পরবর্তী পুরুষ বসবাস করতে শুরু করেন এবং ক্রমে জমিদারীও ক্রয় করেন। তারপর একদিন আমার পিতৃদেব কলকাতায় এই বাড়ি করে চলে আসেন। এখানে এবং সেই হতে বহরমপুরের বাড়িটা প্রায় খালিই পড়ে ছিল কিন্তু বাড়িটার মাল-মশলা খুব ভাল থাকায় ও গঠনকৌশল সেকেলে এবং মজবুত থাকায় বাড়িটা পুরাতন হয়ে গেলেও এখনও অটুট আছে। বাড়িটা দেখতে অনেকটা পুরাতন কেল্লার মত গঙ্গার একেবারে ধারে এবং গঙ্গাও মজে গিয়েছে এবং বহুদিনের অব্যবহারে চারিপাশে এখন ঘন জঙ্গল হয়ে গিয়েছে।

বাড়িটা মানে তোমাদের ঐ রত্নমঞ্জিল কিনছে কে?

এক গুজরাটি ভদ্রলোকে। নাম রতনলাল রাণা।

লোকটার অবস্থা কেমন-নিশ্চয়ই ধনী?

তা তো নিশ্চয়ই!

তা হঠাৎ অমন জায়গায় একটা অতদিনকার পড়ে পুরনো বাড়ি কেনবার তাঁর সখ হল যে!

শুনেছি কাঁসার জিনিসপত্র তৈরির একটা ফ্যাক্টরী নাকি খুলবেন তিনি।

হুঁ—দাম? তাও আশাতীত।

কি রকম?

পঞ্চান্ন হাজার টাকা।

বল কি!

কিরীটীর মনের মধ্যে তখন বহরমপুরে গঙ্গার ধারে নবাবী আমলের এক পুরাতন কেল্লাবাড়ি রত্নমঞ্জিল ছায়াছবির মত আকার নেবার চেষ্টা করছে। নবাবী আমলের পুরাতন কেল্লা বাড়ি।

সামনে টেবিলের ওপর রক্ষিত টাইমপিসটা একঘেয়ে টিকটিক শব্দ জাগিয়ে চলেছে নিযুতি রাতের স্তব্ধতার সমুদ্রে।

পুলিসেই সংবাদ দেওয়ার আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কিরীটী ব্যাপারটা এমন ধোঁয়াটে— পুলিস হয়ত বিশ্বাসই করবে না, কিন্তু চুপচাপ বসেও আর থাকতে পারলাম না—তাই তোমার শরণাগত হয়েছি। বামদেব আবার বললে।

কিরীটির মাথার মধ্যে তখনও রত্নমঞ্জিল ঘোরাফেরা করছে।

বহরমপুর! রত্নমঞ্জিল!

এখন তুমি কি পরামর্শ দাও কিরীটী?

একটু আমায় ভেবে দেখতে হবে। তবে প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, কাল সকালেই সর্বাগ্রে কোন ব্যাঙ্কে গিয়ে ঐ কঙ্কনটি তাদের সেফ কাস্টিডিতে তোমাকে রেখে আসতে হবে।

বেশ, তাই করব।

আচ্ছা আজ তাহলে আমি উঠি।

এস।

ভাল কথা, কত বায়না নিয়েছ, বলছিলে না বড়িটার জন্য?

নিয়েছি—দশ হাজার টাকা। কথা আছে সামনের মাসে দশ তারিখে বিক্রয়-কোবালা রেজিষ্ট্রি হবে।

মিঃ অধিকারীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে কিরীটী বাড়ি ফিরছিল। রাত বেশী নয়। কিন্তু শীতের রাত বলে এর মধ্যেই চারিদিক যেন নিযুতি হয়ে এসেছে। আর শীতও এবার যেন বেশ জাঁকিয়ে এসেছে শহরে। একেবারে হাড়কাঁপানো কনকনে।

যে ট্যাক্সীতে কিরীটী বামদেবের ওখানে গিয়ছিল, সেটা ছাড়েনি অত রাত্রে কোন ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না বলে। পাঞ্জাবী ড্রাইভার ট্যাক্সি চালাচ্ছিল। চলমান গাড়ির খোলা জানালা পথে শীতের রাত্রির কনকনে হাওয়া নাকে চোখে মুখে কিরীটির এসে ঝাপটা দিচ্ছে।

রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মধ্যে মধ্যে শুধু চোখে পড়ে কাচিৎ কখনো এক-আধটা পানের দোকান এখনও খোলা। তারই সামনে দেখা যায় এখনো দুচারজন শেষ খরিদ্দার। আর চোখে পড়ে এক-আধটা মিঠাঁইয়ের দোকান—তারাও একেবারে দরজা বন্ধ করার উদ্যোগ করছে।

দু-একটা ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়ি পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে!

কিরীটির মাথার মধ্যে তখনও পাক খেয়ে ফিরছিল গঙ্গার ধারে একখানা নবাবী আমলের পুরাতন বাড়ি। বিক্রয়-কোবালা—যার এখনো রেজিষ্ট্রি হয়নি। কিন্তু বায়না হয়েছে দশ হাজার টাকা।

কে এক রাণা বাড়িটা কিছুদিন আগে পঞ্চান্ন হাজার টাকায় বামদেবের কাছ হতে ক্রয় করে নেবে বলে বায়না দিয়েছে। কাঁসার বাসনের ফ্যাক্টরী খুলবে। কাসার বাসনপত্রের জন্য বহরমপুরের খাগড়া অঞ্চল অবশ্য বিখ্যাত। গুজরাটি ব্যবসায়ীর সেদিকটায় নজর পড়েছে। ব্যাপারটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তবে অত অধিক মূল্যে একটা পুরাতন আমলের বাড়ি ক্রিয় করেছে। যখন গুজরাটি ব্যবসায়ী, মিথ্যে সে নিশ্চয়ই অতগুলো টাকা ব্যয় করছে না।

এক-আধটা টাকা নয় তো–পঞ্চান্ন হাজার টাকা!

টাকাটাও অবশ্য এখনো সম্পূর্ণ পেমেন্ট হয়নি—হাজার দশেক বায়না নিয়েছে বামদেব এবং সামনের পনের তারিখে বাকি পেমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রয়-কোবালা রেজিস্ট্রি হবে। আগাম দশ হাজার টাকা নিয়েছে এবং কথাবাতাঁর যখন সব ঠিক-ঠাক, কেবল বিক্রয়কোবালা রেজিষ্ট্র করা বাকী, তখন একপ্রকার বিক্রয়ই হয়ে গিয়েছে ধরে নিতে হবে।

হঠাৎ কিরীটীর চিন্তাসূত্রে বাধা পড়লো।

গাড়ির মধ্যস্থিত দর্পনে বার দুই একটা গাড়ির সাইড হেডলাইটের আলো ওর সতর্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী ড্রাইভারকে বলে গাড়ির গতি আর একটু কমিয়ে দিতে। ট্যাক্সির স্পীড কমতেই কিরীটী সন্তপণে পিছনের দিকে তাকাল। সামান্য ব্যবধানে সাইডলাইট জ্বালিয়ে একখানা গাড়ি ট্যাক্সির পিছনে পিছনেই আসছে সমগতিতে।

কিরীটী তার সহজ বিচারবুদ্ধি দিয়েই বুঝতে পেরেছিল, সাধারণ কোন গাড়ি নিশ্চয়ই নয়, তাই ট্যাক্সির গতি কখনো একটু কমিয়ে কখনো একটু বাড়িয়ে বেশ কিছুটা পথ পরীক্ষা করে দেখল এবং বুঝতে দেরি হয় না। ওর পাশ্চাতের গাড়িখানা ওকে অনুসরণ করছে।

সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলী হয়ে ওঠে কিরীটী। এবং আরো কিছুটা পথ চলে কিরীটী সুস্পষ্টই লক্ষ্য করে পাশ্চাতের গাড়িটা ঠিক একই ভাবে তার ট্যাক্সিকে অনুসরণ করে আসছে। ব্যাপারটায় ও একটু বিস্মিতই হয়।

নিতান্ত বামদেব কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়েই কিরীটী বামদেবের ওখানে রাত্রের ডিনারে গিয়েছিল এবং বামদেবও প্রথমটায় আসল উদ্দেশ্যটা তার কিরীটীকে খুলে বলেনি। খাওয়াদাওয়ার পর সব বলল।

এ ক্ষেত্রে বাইরের কোন তৃতীয় পক্ষের তো ব্যাপারটা আঁচ করাও সম্ভব নয়। তবে?

এখন স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে বামদেবের ওখানে যাওয়াটা তার কারো-না-কারো শ্যেন সতর্ক দৃষ্টিকে এড়ায়নি। বামদেবের ওপরে কারো-না-কারো লক্ষ্যও আছে। অতঃপর কিরীটী সোজাপথে না গিয়ে ইচ্ছা করে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলে খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে লাগল।

কিরীটী মনে মনে বুঝি মৃদু হাসে এবং সে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয় মনে মনে তাঁর অনুমানটা মিথ্যে নয় বলে। সে ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে আদেশ দেয়, সদািরজী, সোজা পার্কসার্কাসের দিকে চল। সঙ্গে সঙ্গে সর্দারাজী গাড়ি ঘোরায়। পার্কসাকাস অঞ্চলে কিরীটীর এক শিল্পী বন্ধু থাকে। সবিতাব্রত সেন। কিরীটীর নির্দেশে সর্দারাজী সেই দিকে গাড়ি চালায়।

নির্জন রাস্তায় কেবল গ্যাসের আলোগুলো টিম টিম করে জুলছে। এদিক হতে। ওদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে রাস্তাটা শূন্য—একেবারে খাঁ খাঁ করছে।

সবিতাব্রতর বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে এসে কিরীটী সর্দারাজীকে থামতে বললে সর্দারাজীকে গাড়ির স্পীডটা স্লো করতে বললে এবং একসময় চলন্ত ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল, ট্যাক্সি আবার স্পীড নিল।

অন্য গাড়িটাও ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। পশ্চাতে গড়ির সাইডলাইট দুটো দপ করে হঠাৎ ঐ সময় নিভে গেল।

কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে একটা লাইটপোস্টের আড়ালে আত্মগোপন করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর এক সময় এগিয়ে গিয়ে সবিতাব্রতর বাড়ির দরজার গায়ে কলিং বেলটা টিপল।

কিরীটী বারিকয়েক বাজাবার পর দরজার ওপাশে পদশব্দ শুনতে পেল।

দরজা খুলে দিতে লোক আসছে, কিরীটী বুঝতে পারে।

দরজা খুলতেই সামনে সবিতাব্রতর সঙ্গে চোখাচৌখি হয়ে গেল কিরীটীর।

এত রাত্রে কিরীটীকে দেখে সবিতাব্রত কম বিস্মিত হয়নি। সবিতাব্রত ঘুমোয়নি, জেগে বসে একটা ছবিতে রিটাচ দিচ্ছিল সন্টুডিওর মধ্যে।

ব্যাপার কি রে! এত রাত্রে তুই? সবিতাব্রত প্রশ্ন করে।

কথা আছে—চল ভেতরে। কিরীটী বললে।

না করে কেবল আহ্বান জানল, আয়।

দরজা বন্ধ করে দুজনে ওপর উঠতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কিরীটী প্রশ্ন করে, জেগে ছিলি মনে হচ্ছে—

হ্যাঁ, একেটা ছবির রিটাচ দিচ্ছিলাম।

সবিতাব্রতর দোতলায় বসবার ঘরের মধ্যে ঢুকে ইজিচেয়ারটার ওপরে গাটা এলিয়ে দিতে দিতে আরাম করে চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বললে, এক কাপ কফি খাওয়াতে পারিস সবিতা?

করছি—

সবিতাব্রত বলতে গেলে একাই থাকে। দ্বিতীয় প্রাণী এক বৃদ্ধ ভৃত্য। ইলেকট্রিক স্টেভে দুইেকাপের মত কফির জল চাপিয়ে দিল সবিতাব্রত।

গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, বাকি রাতটুকু এখানে কটাব চেয়ারে শুয়েই-একটা বালিশ দে!

কিরীটী যে বিনা কারণে এই শীতের মধ্যরাত্রে তার বাড়িতে এসে ওঠেনি। সবিতাব্রত তা জানে। মনের মধ্যে কৌতূহল উঁকিঝুঁকি দিলেও ও সম্পর্কে এতক্ষণ কোন প্রশ্নই করেনি। আকারণ কৌতূহল কিরীটী পছন্দ করে না। কোন দিন প্রশ্রয়ও দেয় না।

কিন্তু কিরীটী নিজেই সবিতাব্রতর কৌতূহলের অবসান ঘটায়।

আচ্ছা জব্দ করা গেছে বেটাকে-বলতে বলতে কিরীটী নিঃশেষিত কফির কাপট একপাশে নামিয়ে রেখে ভাল করে হেলান দিয়ে শোয় চেয়ারের ওপরে।

কিরীটীর হাস্যোদীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সবিতাব্রত প্রশ্ন করে, কাকে আবার জব্দ করলি?

সে আছে। একজন। বামদেববাবুর ওখানে গিয়েছিলাম—সর্দারজীর ট্যাক্সিতে ফিরছি, দেখি বেটা আমায়। ফলো করছে। হঠাৎ মনে হল রাতটা তোর এখানে এসে কাটিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে। বেটা বোধ হয় এখনো ট্যাক্সিটা ফলো করছে।-বলতে বলতে কিরীটী হাসল।

আলোটা নিভিয়ে দেব? সবিতাব্রত প্রশ্ন করে।

তা দে।

ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে সবিতাব্রত এগিয়ে গিয়ে আবার ছবিটা নিয়ে বসল পাশের ঘরে। দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খোলাই রইল।

অন্ধকার ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা যেন হঠাৎ চাপ বেঁধে ওঠে।

লালবাজারে এল কিরীটী তার বিশেষ পরিচিত ইন্সপেক্টর সুভাষ দত্তর ঘরে গিয়ে ঢুকল।

সুভাষ দত্ত বললেন, কি ব্যাপার কিরীটীবাবু?

কিরীটী বলল, অ্যাটর্নি রমেশ দত্ত তো আপনার পরিচিত, না?

হ্যাঁ।

তার পার্টনার রাঘব সাহা লোকটা তেমন জানেন?

যেমন মোটা তেমনি কালো ও তেমনি কুটচক্রী। দত্ত অ্যাণ্ড সাহা অ্যাটর্নি ফর্মের ইদানীং যে দুর্নাম রটেছে বাজারে তা তো ঐ রাঘব সাহার জন্যেই শুনেছি। সুভাষ দত্ত বললেন।

আজ একবার দত্ত-সাহার ওখানে একজন কাউকে এখান থেকে পাঠাতে পারবেন?

কেন পারবে না! কিন্তু ব্যাপারটা কি?

শুনুন বহরমপুরে আমার এক বিশেষ পরিচিত ভদ্রলোক বামদেব অধিকারীর রত্নমঞ্জিল নামে একটা বাড়ি বিক্রি হচ্ছে—কথাটা আরো একটু পরিষ্কার করে বলি, কে এক রাণা বাড়িটা কিনবার জন্য দশ হাজার টাকা ইতিমধ্যে অগ্রিমও দিয়েছে। দাম ঠিক হয়েছে পঞ্চান্ন হাজার টাকা। সামনের মাসের পনেরই বিক্রয়-কোবালা-রেজিস্ট্রি হবার কথা।

বুঝলাম।

রাঘবকে সে বলবে তার হাতে একজন খদ্দের আছে। সে ষাট হাজার টাকা দাম দেবে। এবং কমিশন হিসাবে তাকে দেবে পাঁচ হাজার।

বাড়িটা যাতে রাণা কিনতে না পারে, এই তো?

না, ঠিক তা নয়—আসলে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা মাসখানেক পিছিয়ে দিতে চাই। এমনিতে দত্ত রাজী হলেও তার পার্টনার রাজী হবে না, তাই ঐ টোপ আর কি!

বেশ। কিন্তু ব্যাপারটা কি কিরীটীবাবু?

আসলে ঐ রত্নমঞ্জিলের সঙ্গে একটি অপহৃত সুবর্ণ-কিঙ্কন-রহস্য জড়িয়ে আছে।

সুবৰ্ণকিঙ্কন!

হ্যাঁ। পরে আপনাকে সব বলব। কিরীটী আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে একটা ফাইল টেনে নেয়।

ঐদিনই অ্যাটর্নি দত্ত-সাহার নিভৃত চেম্বারে সুভাষবাবু-প্রেরিত লোক যতীন ঘোষ ও রাঘব মুখোমুখি বসে দ্বিপ্রহরে কথা হচ্ছিল। পাশে দত্তও ছিল।

কিরীটীর অনুমান ভুল হয়নি।

রাঘব সাহা নির্বিবাদেই তার টোপ গিলেছে। কিন্তু আপত্তি তুলেছে তার পার্টনার দত্ত। দত্ত যতীন ঘোষকে বললে, এখন তা কি করে সম্ভব যতীনবাবু। দশ হাজার টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়ে গিয়েছে—এতে ব্রিচ অফ কনট্রাক্টের মামলায় পড়তে হবে যে!

চেষ্টা করলে আপনি ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবেন না-এ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। মিঃ দত্ত। এতে করে যদি দু-চার হাজার খরচও হয় আমার পার্টি দিতে রাজী আছে।

রাঘব সায় দেয়, চেষ্টা করে দেখতে একবার ক্ষতিটা কি দত্ত? পাঁচ হাজার টাকাও তো কম নয়!

কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কি বলুন তো মিঃ ঘোষ? ঐপুরাতন বাড়িটার প্রতিই বা আপনার ক্লায়েন্টের লোভ হল কেন? দত্ত যতীন ঘোষকে প্রশ্ন করে।

যতীন ঘোষ বললেন, আমার ক্লায়েন্ট কেন ঐ বাড়িটা কিনতে চান তা তো বলতে পারব না। তবে ডিলটা করে দিতে পারলে আমিও কিছু পাব।

রাণার তো এখনই আসবার কথা—তাকে আসতে বলেছি। দশ হাজার টাকা সুদ-সমেত দিলে যদি রাজী হয়ে যায়! রাঘব বলে ওঠে।

তা হলে অবিশ্যি কোন ঝামেলাই থাকে না। তবে ব্যাপার যা বুঝেছি তাতে অত সহজে সে রাজী হবে বলে মনে হচ্ছে না।

এমন সময় বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল।

কি রে?

আজ্ঞে, রাণা সাহেব এসেছেন।

ভেতরে পাঠিয়ে দে। দত্ত বলে।

একটু পরে রাণা এসে ঘর প্রবেশ করল চেম্বারের সুইংডোর ঠেলে, রাম রাম! দোত্তবাবু, কি ব্যাপার? এত জরুরী তোলব কেন?

বসুন—বসুন রানা সাহেব!

যতীন ঘোষ চেয়ে দেখছিলেন আগন্তুককে। মোটাসোটা ভূড়িয়াল চেহারা। গায়ে দামী সার্জের সেরওয়ানী, পরনে মিহি নয়নসুখের ধুতি।

চোখ দুটো ছোট, কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি। অতি মাত্রায় সজাগ।

খানিকটা ভণিতা করে অবশেষে সোজাসুজি দত্তই ব্যাপারটা রাণাকে বললে, একটা কথা ভাবছিলাম রাণা সাহেব, মিথ্যে কেন অতগুলো টাকা ঐ পুরাতন বাড়িটার পেছনে ঢালবেন! তার চাইতে আশে পাশে অন্য কোন বাড়ি—

মৃদু হাসিতে রতনলাল রাণার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলে বাত তো হাপনি ঠিকই বলিয়েছেন দোত্তবাবু—লেকেন একবার যখন টাকা হামি আগাম দিয়েসে, কন্ট্রাকটু ভি হইয়েসে, তোখন ও তো বিক্রিই হয়ে গিয়েসে—কি বোলেন অ্যাঁ!

তা অবিশ্যি বলতে পারেন। তবে যদি আপনাকে সুদের উপরেও কিছু বেশী ধরে দেওয়া যায়! কথাটা বললে রাঘব।

রতনলাল রাণাকে টাকা দেখলাবেন না দোত্তসাহেব। টাকার বাৎ থোড়াই আছে, চান তো আরো কিছু আগাম ভি হামি দিতে পারি। লেকেন ও বাড়িটা হামার চাই-ই।

কিন্তু কেন বলুন তো রাণা সাহেব? রাঘব সাহা প্রশ্ন করে।

সে কি দোত্তবাবু, হাপনাকে তো হামি বলিয়েসে কেন বাড়িটার হামার প্রয়োজন।

ফ্যাক্টরী করবেন তো? তা ওর চাইতে যদি ভাল একটা বাড়ি পাওয়া যায়— মানে আত পুরনো নয়।

না, ওহি বাড়ি হামি লিবে।

শুনুন তবে, আর একজন খরিদ্দার আছে—বলেন তো মাঝখান থেকে কিছু মোটা মতন পেতে পারেন–

না।

তাহলে আপনি ঐ বাড়িটাই নেবেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু আমি বলছিলাম কি–

দেখেন দোত্তবাবু, হামি রতনলাল। —সিধা বাতের লোক আছে। সিধা বাতই হামি পসন্দ কোরে। হাপনাদের কাছে ভি সিধা বাতই চাই দোত্তবাবু। রূপেয়া দেখলাচ্ছেন রতনলালকে-ও তো হাতের মোয়ালা আছে, আনা-যানা তো রূপেয়াকে দস্তুর আছে!

মিঃ রাণা, আপনি ঠিক আমাদের কথা ধরতে পারেননি—ও কথা আমি বলিনি। বলিছলাম একটা সেকেলে পুরাতন বাড়ির পিছনে মিথ্যে কেন অতগুলো টাকা ঢালবেন! তাছাড়া-বিনীত হাস্যের সঙ্গে রাঘব সাহা আরো বলবার চেষ্টা করে।

কিন্তু থামিয়ে দেয়। রাণী। বলে, আইনের কারবারী আপনি দোত্তবাবু, এ কেমন বাত করছেন? হামি যদি বলি, যে বাবুটি এখোন বাড়িটা কিনতে চাইছেন তিনিই বা কিনতে চান কেন? বোলেন—জবাব দেন। বলতে বলতে হা-হা করে রতনলাল হেসে ওঠে।

হাসির উচ্ছাসে তার মেদ ও চর্বিবহুল বিরাট শরীরটা দুলতে থাকে।

যতীন বুঝতে পারে রতনলালকে অত সহজে ঘায়েল করা যাবে না। সে গভীর জলের কাতলা। এবং তার অফিসের সুভাস দত্তর মুখ থেকে শোনা কহিনীটা আবার আগাগোড়া তার মনে পড়ে।

সুবৰ্ণকিঙ্কন আর রত্নমঞ্জিল এই দুটোর মধ্যে যে একটা রহস্য জড়িয়ে আছে এবং একে অন্যের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সে সম্পের্কেও আর সন্দেহের অবকাশ মাত্রও থাকে না।

আচ্ছা দোত্তবাবু, হামি এবারে উঠবে। আর হ্যাঁ, রূপেয়ার আউর জরুরৎ হোয় তো গদিতে একটা ফোন কোরে দেবেন, হামি রূপেয়া ভেজ দেবো। রাম রাম বাবু!

রতনলাল গাত্ৰোখান করল এবং ধীরপদে একবার আড়চোখে অদূরে চেয়ারে উপবিষ্ট যতীনের দিকে তাকিয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেল।

সুইং-ডোরটা ফাঁক হয়ে আবার স্বস্থানে ফিরে এল।

তাহলে এখন উপায়? প্রশ্নটা করে যতীন দত্তকে এবারে।

রেজিস্ট্রির দিনটা মাসখানেক পিছিয়ে দেওয়া ভিন্ন তো আর কোন উপায় দেখছি না! চিন্তিতভাবে দত্ত বলে।

বেশ, তবে অন্তত তাই করুন।

আরো মিনিট পনের পরে যতীন দত্ত-সাহার অফিস হতে বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে জীপগাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে স্টার্ট দিতে বললে।

ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট তখন অসংখ্য প্রাইভেট গাড়ি ও মানুষের ভিড়ে সরগরম।

একটা পান-সিগারেটের দোকানের সামনে লম্বা ঢাঙা মত একজন লোক মুখে একটা সিগারেট, আড়চোখে পুলিসের জীপগাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। যতীন দত্তকে গাড়ীতে উঠে চলে যেতে দেখে সেও চট্‌ করে একটা ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে বললে অগ্রবর্তী জীপগাড়িটা দেখিয়ে সেটাকে অনুসরণ করতে।

এদিকে দত্ত অ্যাণ্ড সাহা অ্যাটর্নির ফার্ম থেকে বের হয়ে রতনলাল সোজা নেমে এসে রাস্তায় অপেক্ষামান তার নিউ মডেলের ঝকঝকে সন্টুডিবেকার গড়িটার সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার কিষেণ হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল।

গড়ির মধ্যে অত্যন্ত ঢ্যাঙ ও রোগা একটি লোক, পরিধানে পায়জামা ও পাঞ্জাবি, তার উপরে সার্জের সেরওয়ানী, মাথায় একটা সালের টুপি, হাতে ধরা মাকোভিচের একটা টিন, নিঃশব্দে বসে ধূমপান করছিল।

রতনলালকে গাড়ির মধ্যে উঠে বসতেই সেই ঢাঙা লোকটি প্রশ্ন করলে, তোমার অ্যাটনি কেন ডেকেছিল হে?

প্রশ্নকারীর জবাব কোন কিছু না বলে রতনলাল ড্রাইভার কিষেণের দিকে তাকিয়ে বলল, অফিস চল। জোরে চালাও।

গাড়ি চলতে শুরু করে।

কোর্ট ভেঙেছে, এই সময়—ঐ রাস্তায় বেজায় ভিড়, তা সত্ত্বেও কিষেণ দক্ষ চালনায় অনায়াসেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে গাড়ি বেশ জোরেই চালিয়ে নিয়ে যায়।

রতনলাল গাড়ির নরম গদিতে বেশ আরাম করে হেলান দিয়ে বসে জামার পকেট থেকে সুদৃশ্য একটা রূপার কোটা বের করে, কোটা হতে দু-আঙুলের সাহায্যে খানিকটা সুগন্ধি মিষ্টি সুপারি বের করে মুখগহ্বরে ফেলে কৌটোটা আবার যথাস্থানে রেখে দিল।

আরাম করে সুপুরি চিবুতে চিবুতে এতক্ষণে রতনলাল কথা বললে, পিয়ারীলাল, আজ রাত্রেই তুমি একবার বামনদেব অধিকারীর সঙ্গে দেখা কেরবে। তোমার হাতে হামি কিছু নগদ টাকা দেবে—চেষ্টা কোরবে যাতে কোরে রত্নমঞ্জিলের বিক্রয়-কোবালাটা দু’তিনদিনের মধ্যেই রেজিষ্ট্রি করিয়ে নেওয়া যায়। দরকার। যেমন বুঝবে-পঞ্চান্ন হাজার টাকা ছাড়াও দু-চার হাজার যদি বেশীও দিতে হয়, কবুল করে আসবে। মোট কথা মনে রাখবে, রেজিস্ট্রিটা দু-তিন দিনের মধ্যেই করিয়ে নিতে চাই।

পঞ্চান্ন হাজার টাকার উপরেও আরো দু-চার হাজার!

হ্যাঁ, দরকার হলে আরো দশ-বিশ হাজার—

কিন্তু ব্যাপারটা কি শেঠ?

ও বাড়ির আরো খরিদ্দার জুটেছে। বল কি শেঠ।

হ্যাঁ—

কিন্তু অধিকারীকে তো আগাম দশ হাজার টাকা বায়না দেওয়া হয়ে গিয়েছে, এখন অন্য পার্টির কথা আসে কোথা থেকে?

সে যদি এখন খেসারত দিয়ে বায়না ফিরিয়ে দেয়, বলে বিক্রি করব না—আটকাবে কি কোরে? তাই ভেবেছি চাদির জুতি দিয়ে বেটার মুখ বন্ধ করব। আমিও রতনলাল রাণা। একবার যখন হাত বাড়িয়েছি, এত সহজে হাত গুটিবো না।

কিন্তু শেঠ, তুমি কি সত্যিই মনে কর সেই বেটা মালীর কথা সত্যি?

কিন্তু সোনার মোহরটা তো সত্যি! একেবারে খাঁটি বাদশাহী মোহর!

পিয়ারীলাল বললে, বহরমপুর এককালে নবাবদের লীলানিকেতন ছিল! সেখানকার মাটিতে এক-আধটা বাদশাহী মোহর কুড়িয়ে পাওয়া এমন কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়। স্রেফ একটি দুটি সোনার মোহর পাওয়ার ওপরে এতগুলো টাকা নিয়ে এমনি বাজি খেলাটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে শেঠ?

আরে জীবনটাই তো একটা বাজি খেলা! বাজি খেলায় হারজিত আছেই—জীবনে বহু বাজিতে জিতেছি, না হয় এ বাজিতে হারলামই। রতনলাল তার জন্য পরোয়া করে না!

সত্যি স্রেফ একটা বাজি খেলাই বটে।

রতনলাল রাণা বাজি খেলতেই নেমেছে!

মাস দেড়েক আগেকার কথা।

ব্যাপারটা প্রথম হতেই একটা দৈবাৎ ঘটনাচক্ৰ বলেই মনে হয়।

মাসখানেকের ছুটি নিয়ে হরিহর গিয়েছিল তার দেশে বহরমপুরে। অনেকদিনের বিশ্বাসী এবং প্রিয় ভৃত্য হরিহর রতনলালের। বহরমপুরে বামদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষদের বাড়ী রত্নমঞ্জিল এমনি খালিই বহুদিন হতে পড়ে আছে। হরিহরের এক ভাই মনোহর রত্নমঞ্জিল থাকে কেয়ার টেকার’ হিসাবে।

খাওয়া-পরা ছাড়া নগদ ত্রিশটি করে টাকা মাসান্তে বামদেব পাঠিয়ে দিতেন নিয়মিত মনোহরকে।,

প্রকাণ্ড দোমহলা বাড়ি রত্নমঞ্জিল, প্রসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাড়ির সামনে ও পশ্চাতে এখন অবিশ্যি দুর্ভেদ্য জঙ্গল। সেখানে বিষধরদের সর্পিল আনাগোনায় মধ্যে মধ্যে হঠাৎ কম্পন জাগে?

মনোহরের বয়স চল্লিশের মধ্যে। একা মানুষ, বিয়ে-থা করেনি। কালো কুচকুচে কষ্টিপাথরের মত গাত্রবর্ণ এবং বেঁটে গীটাগোটা চেহারা। প্রথম বয়সে মনোহর এক রাজপুত দারোয়ানের সঙ্গে দোক্তি পাতিয়ে লাঠি খেলা শিক্ষা করেছিল। এখনো তার সে রোগ যায়নি। রত্নমঞ্জিলের পশ্চাৎভাগে খানিকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে নিয়ে পাড়ার কয়েকটি উৎসাহী ছেলেকে যোগাড় করে লাঠি খেলা শেখায় ও কসরৎ করে প্রতিদিন বিকেলের দিকে। নিচের মহালের একটা ঘর পরিষ্কার করে নিয়ে সেখানেই থাকে।

নিজের হাতে দু’বেলা রান্নাবান্না করে আর পাঁচ হাত লম্বা তৈলমসৃণ লাঠিটা রাত্রে শিয়রের কাছে রেখে নিশ্চিন্তে নাক ডাকায়।

সপ্তাহের মধ্যে এক-আধাদিন ওপরের ও নীচের মহলের ঘরগুলি ঝাড়পোছ করে। নিচের মহলের খান দুই ঘর ও ওপরের মহলের দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে তালা দেওয়া। পুরাতন আমলের ভারী লোহার তালা প্রায় সৌর দেড়েক ওজনের হবে। কতকাল যে তালাগুলো খোলা হয় না—জং ধরে আছে। ঐ তিনটি বন্ধ ঘর ছাড়া অন্যান্য ঘরগুলোর তালার চাবি মনোহরের কাছেই থাকে।

গত ষোল-সতের বছর ধরে বামদেব অধিকারী রত্নমঞ্জিলে পা দেননি। মনোহরই এ বাড়ির একমাত্র বাসিন্দা। মনোহর প্রায় বছর আঠারো-উনিশ হয়ে গেল এ বাড়িতে ‘কেয়ার টেকার’ হয়ে আছে। মনোহরের জানিত কালে বার তিনেকের জন্য মাত্র বামদেব অধিকারী রত্নমঞ্জিলে এসেছিলেন। একবার দুদিন, তার পরের বার আটদিন ও শেষবার দিনচারক থেকে গিয়েছিলেন এবং সে সময়েও ঐ তালাবন্ধ ঘর তিনিটি খোলা হয়নি, কারণ বামদেবের কাছেও ঐ তালার চাবি ছিল না।

বহুকালের পুরাতন বাড়ি। নিচের তলার ঘরের মেঝেতে ফাটল ধরেছে। আচমকা একদিন মনোহর যে ঘরে বাস করত নিচের তলায় তারই মেঝের ফাটলপথে দেখা দেয় এক বিষধর কালকেউটে। সন্ত্রস্ত মনোহর কেউটের বাসা ধ্বংস করতে গিয়ে ঘরের মেঝের খানিকটা খুঁড়ে ফেলে এবং মাটি খুঁড়তে গিয়ে পায় দুটি বাদশাহী মোহর!

সোনার মোহর দুটি মনোহর সযত্নে তার প্যাটরার মধ্যেই রেখে দিয়েছিল, কারণ তার যথার্থ মূল্য সম্পর্কে মনোহর যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল তো না ই—এবং সে কোনদিন খুব বেশী অর্থ সম্পর্কে সচেতনও ছিল না বলেই আকস্মিকভাবে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া সোনার মোহর দুটি সম্পর্কেও বিশেষ কোন উত্তেজনা বোধ করেনি। কেবল যত্নের সঙ্গে প্যাটরার মধ্যে রেখে দিয়েছিল জামাকাপড়ের তলায় একফালি ন্যাকড়ায় বেঁধে।

ভুলেও গিয়েছিল বাদশাহী মোহর দুটোর কথা। তবে ইচ্ছা ছিল এবারে বাড়ির কর্তা এলে তার হাতে মোহর দুটি তুলে দেবে।

এমন সময় এলো কলকাতা হতে হরিহর! হরিহরেরও সংসারে এক মা-মরা বয়স্থ কন্যা ছাড়া কেউ ছিল না। তার বিয়েটা দিতে পারলেই সে নিশ্চিন্ত। প্ৰভু রতনলালকেও সে কথা বলেছিল। রতনলাল তার মেয়ের বিবাহে সাধ্যমত সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল।

হরিহরের এবারে ছুটি নিয়ে আসবার আরো একটা উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটিকে দেখেশুনে পাত্ৰস্থ করা। পাত্র একটি দেখা হল, কিন্তু টাকার খাঁকতি তার বড় বেশী। একদিন কথায় কথায় সেকথা মনোহরকে বলতে মনোহর তাকে আশ্বাস দিল তার হাতে জমানো যা আছে সে সব দেবে। এবং কথায় কথায় হঠাৎ সোনার মোহর দুটির কথা মনে পড়ায় সে দুটি প্যাটরা হতে বের করে হরিহরের হাতে দিয়ে বলে, মাটির তলায় মোহর দুটি সে পেয়েছে, সে ভেবেছিল বাড়ির মালিককেই মোহর দুটি দেবে—তা ঐ দুটোতে হরিহরের যদি কোন সাহায্য হয় তো সে নিতে পারে।

কলকাতায় শেঠের বাড়িতে চাকরি করে হরিহর, মোহর দুটি দেখেই সে বুঝেছিল তার মূল্য আছে এবং তার প্রভু শেঠকে মোহর দুটি দিলে বিনিময়ে সে বেশ মোটামত কিছু পাবে। সেই আশাতেই মোহর দুটি এনে সে মনিবের হাতে তুলে দেয়।

জহুরী রতনলাল মোহর দুটি পেয়ে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে হরিহরকে, কোথায় পেলি?

হরিহর মোহরের বৃত্তান্ত সব খুলে বলে।

হরিহরের মুখ থেকে মোহরের বৃত্তান্ত শুনে রতনলাল ব্যাপারটা গভীর ভাবে চিন্তা করে। পুরনো বাড়ির মেঝে খুঁড়ে মোহর পাওয়া গিয়েছে। ব্যাপারটার মধ্যে বিস্ময়কর কিছু নেই। আগেকার দিনে অমন অনেকেই তাদের ধনরত্ন ঘরের মেঝেতে—মাটির নীচে সংগোপনে লুকিয়ে রাখত, হয়তো ঐ রত্নমঞ্জিলের মাটির নীচেও তেমনি আছে!

সঙ্গে সঙ্গে একটা লোভের আগুন জ্বলে উঠে রতনলালের মনের মধ্যে।

রতনলাল হরিহর কে প্রশ্ন করে, এ মোহর দিয়ে তুই কি করবি?

কি করব আর বাবু—বিক্ৰী করে দেবো।

রতনলাল মোহর দুটি রেখে তখন হরিহরকে নগদ একশত টাকা দেয় হরিহর তাতেই খুশী।

দিন দুই বাদে কথা প্রসঙ্গে রাণী রতনলাল তার এক বাঙালী বন্ধুকে মোহরের কথা ঘলায় কৌতূহলী বন্ধু মোহর দুটো দেখতে চান।

মোহর দুটো দেখে এবং মোহর প্রাপ্তির কাহিনী রাণার মুখে শুনে বন্ধু বলেন, তাজ্জব ব্যাপার! শুনেছি আগেকার দিনে অনেক ধনীরা মাটির নীচে ঘড়া ঘড়া মোহর পুতে যখ করে রাখত। খবর নাও শেঠ, বাড়িটা কতদিনের পুরাতন এবং বর্তমানে মালিক কে!

হরিহর কিছু কিছু সংবাদ রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে তার ভাই মনোহরের মুখেই শুনেছিল— সবই শেঠকে বলেছিল।

শেঠের মুখে সেই কাহিনী শুনে বন্ধু বলেন, নিশ্চয়ই ঐ বাড়ির নীচে মাটির তলায় গুপ্তধন পোতা আছে। এক কাজ কর রতনলাল, তুমি ঐ বাড়িটা কিনে নাও!

রতন তখন বলে, আমারও তাই মনে হচ্ছে—

বন্ধু বলেন, মনে হচ্ছে কি হে! নিশ্চয়ই অনেক মোহর আছে। ঐ রত্নমঞ্জিলের মাটির নীচে!

অর্থের প্রলোভন বড় মারাত্মক। একবার সে প্রলোভন মনের মধ্যে এসে বাসা বঁধলে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর।

নশ্চিত গুপ্তধনের নেশায় মেতে ওঠে রতনলাল।

একদিন গিয়ে সে অধিকারীর সঙ্গে দেখা করলে। বাড়িটা সে কিনতে চায়, খাগড়ার বাসনের কারখানা খুলবে—কি দাম চান অধিকারী?

বামদেব কিন্তু বিস্মিত হন প্রস্তাবটা শুনে। প্রথমটায় তো তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি।

কিন্তু রাণার বারংবার বিশেষ অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বলেন ভেবে দেখি, পরে জানাব।

দিন কয়েক পরে ফের রাণা দেখা করে, কিন্তু সেবারও ঐ একই জবাব পায়।

রাণার কিন্তু সবুর সয় না। দিন দুই পরে আবার তাগাদা দেয়, কি মিঃ অধিকারী ভেবে দেখলেন? বাড়িটা তো আপনার পড়েই আছে! আপনার কলকাতায় বাড়ি আছে, আপনি আর যাবেনও না সে বাড়িতে–

তা ঠিক। তবে পূর্বপুরুষের বাড়ি—একটা স্মৃতি—

স্মৃতি দিয়ে কি হবে বলুন? শিক্ষিত লোক—আপনাদেরও যদি এসব সেন্টিমেন্ট থাকে—তা ছাড়া বাড়িটা তো ভাঙছি না, রইলই যেমন তেমন–

আমাকে আর কটা দিন ভেবে দেখতে দিন!

এর আর ভাববেন কি। চেক-বই আমি সঙ্গেই এনেছি, বলনে তো কিছু আগাম দিয়ে যাই—

ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! হবেখন। —তবু বামদেব বলে।

দিন দুই বাদে আবার রতনলালের তাগাদা, কি ঠিক করলেন?

বেশ তো হবে’খন! —সেই পূর্বের জবাব।

হবে’খন নয়, আমাকে কথা দিন–ও-বাড়ি আমাকে ছাড়া বেচবেন না!

বামদেব রতনলালের বাড়ি কেনার অতি মাত্রায় আগ্রহ দেখে কেমন যেন একটু বিস্মিতই হয়, সত্যি কথা বলতে কি।

একটা পুরাতন আমলের বাড়ি তাও দূর শহরে এবং লোকালয় থেকে দূরে তার জন্য রাণার এত আগ্রহই বা কেন?

স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেন বামদেব। স্ত্রী সাবিত্রী বলেন, দাও বিক্রি করে। পড়েই তো আছে। ঐ টাকা দিয়ে কলকাতায় না-হয় আর একটা বাড়ি কেনা যাবে।

ব্যবসায়ী লোক বামদেব। স্ত্রীকে বললে, ভেবে দেখি।

তারপর শুরু হল বাড়ির দর নিয়ে কষাকষি। এবং রাণার গরজ বুঝে বামদেব বাড়ির দাম হাকাতে শুরু করলে।–

শেষ পর্যন্ত দর কষতে কষতে পঞ্চান্ন হাজার টাকায় স্থির হল মূল্য এবং একদিন দশহাজার টাকা অগ্রিম বায়না দিয়ে একটা লেখাপড়াও হল; স্থির হলো পরের মাসের পনেরই বিক্রয়-কোবালা রেজিষ্ট্রি হবে।

উক্ত ঘটনারই দিন তিনেক পর হতে বামদেবের কলকাতার বাড়িতে চোরের উপদ্রব। শুরু হল হঠাৎ।

এবং সেই সূত্রেই বামদেব একদিন তার বন্ধু কিরীটীকে ডেকে পাঠায় তার ওখানে। তার পরামর্শ নেবে স্থির করে ও ঐ ব্যাপারে।

অফিস ঘরে ঢুকে রতনলাল পিয়ারীকে বসতে বললে।

তোমার গাড়িতে বসে যেমন বললাম, সেই ভাবে কাজ করবে পিয়ারী। অধিকারী রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফেরে, তুমি দু-চার মিনিট আগেই তাঁর বাড়িতে বসে অপেক্ষা করবে। আর কাল সকালেই রাঘবের সঙ্গে দেখা করবে।

বেশ। তবে এবারে আমি উঠি।

হ্যাঁ, যাও।

পিয়ারী বের হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই বেয়ারা এসে ঘরে প্রবেশ করল, ছট্ৰলাল হুজ্বরের সঙ্গে দেখা করবে বলে সেই দুপুর থেকে এসে বসে আছে।

ছট্টুলাল নামটা শুনেই রতনলালের ভু, দুটো কেমন কুঁচকে ওঠে, বলে বলগে যা আজ দেখা হবে না। কাল-পরশু আসতে।

বেয়ারা চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ রতনলালের একটা কথা মনে পড়ায় বলে, আচ্ছা দে ঘরে পাঠিয়ে।

একটু পরেই ছট্টুলাল এসে ঘরে প্রবোস করল। ছট্টুলালকে দেখে তার বয়স ঠিক কত নিরূপণ করা শক্ত। দড়ির মত পাকানো শরীর। ঘাড়টা লম্বা। একটা আলপাকার সবুজ রংয়ের রুমাল ফাস দিয়ে বাধা গলায়। পরিধানে ঢোলা অধমলিন পায়জামা, গায়ে একটা পাঞ্জাবি ও গরম জহর কোট। পায়ে ডার্বি সু।

সমগ্র মুখখানায় দীর্ঘ অত্যাচারের চিহ্ন যেন অত্যন্ত সুস্পষ্ট। অত্যধিক ধূমপানের ফলে কালো কুচকুচে ঠোঁট দুটো। ডান ভুর ওপর একটা দেড় ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা ক্ষতচিহ্ন।

সেলাম শেঠজী!

কি খবর ছোট্ট?

বত্রিশটা দাঁত বিকশিত করে ছট্টু বিনয়ে যেন বিগলিত হয়ে গেল, দিন-কাল আর তো চলছে না শেঠজী। পাকিট গড়ের মাঠ। ভোঁ ভোঁ।

কত টাকার দরকার?

হুজুর তো হাত ঝাড়লেই পর্বত! যা দেবেন। দয়া করে——

একটা কাজ করতে পারবি?

গোলাম তো সর্বদাই হুজুরে হাজির! বাতিলান কি করতে হবে! কারোর জান, কলিজা–

না, না—ওসব কিছু না। কিন্তু কাজটা শক্ত। পারবি তো?

বলেনই না। কি এমন শক্ত কাজ আছে!

বহরমপুরে যেতে হবে–

কবে?

আজকালের মধ্যেই, যত তাড়াতাড়ি হয়।

যাব। কিন্তু বহরমপুরে কেন হুজুর?

বলছি।

ছট্টুলাল তাকায় রতনলালের মুখের দিকে।

তোকে ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। একটা বাড়ির ওপরে নজর রাখতে হবে। কেউ আসে কিনা-কেউ এলে সে কেমন দেখতে, কি নাম, কোথা হতে আসছে। যতটা সম্ভব খবর দিবি। পারবি তো? ভেবে দেখ!

কেন পারব না হুজুর? এ আর এমন কাজটা কি—

পকেট থেকে দশ টাকার খান-দশেক নোট বের করে এগিয়ে দিল রতনলাল ছট্টুর দিকে, আপাতত এই টাকা রাখা। ফাস্ট ট্রেনেই যাবি।

শীর্ণ বাঁকানো লোভী আঙুলগুলো সমেত হাত বাড়িয়ে দেয় ছুট্টি, টাকগুলো নেবার জন্য। এবং একপ্রকার প্রায় ছোঁ। মেরেই টাকাগুলো মুঠি করে জামার পকেটে ঢোকায়।

সেলাম শেঠজী। চললাম, সব খরব এনে দেবো।

নিমেষে ছট্টুলাল ঘর হতে বের হয়ে গেল।

আরো ঘন্টাখানেক বাদে অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। কর্মচারীরা যে যার ঘরে চলে গিয়েছে।

রতনলাল এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে এটে দিয়ে চেয়ারের ওপরে এসে আরাম করে বসল। চাবি দিয়ে বাঁ পাশের ড্রয়ার খুলে একটা বেঁটে কালো বোতল, একটা গ্লাস ও জলের বোতল বের করল। খানিকটা তরল পদার্থ গ্লাসে ঢেলে কিছুটা জল মিশিয়ে বার দুই সবে চুমুক দিয়েছে, এমন সময় বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু টোকা পড়ল।

কে?

কোন জবাব নয়। আবার দুটো টোকা পড়ল।

বামদেব অধিকারীর পার্ক সার্কাসের বাড়ির দ্বিতলের একটি ঘর। রাত আটটা বাজে।

সোফায় বসে একটি মেয়ে কি একখানা বই পড়েছে। বছর কুড়ি বয়সের মেয়েটি ছিপছিপে দেহের গঠন। গায়ের রং গৌরবর্ণ না হলেও সমস্ত চেহারার মধ্যে যেন একটা অপূর্ব শ্যাম স্নিগ্ধতা। মুখখানি বয়সের অনুপাতে যেন কচি বলেই মনে হয়। টানা আয়ত দুটি সচকিত চঞ্চল ভাব। মাথার চুল ঘাড়ের দু’পাশে বেণীর আকার লম্বমান।

মেয়েটির নাম সুজাতা। বামদেবের পালিতা বন্ধুকন্যা। একটা ভয়াবহ মোটর দুর্ঘটনায় সুজাতার মা-বাবা ঘটনাস্থলেই মারা যান। সেই থেকে বামদেব ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী সুজাতাকে নিজ সন্তানের মত লালন করে এসেছেন। সুজাতা তখন মাত্র তিন বৎসরের বালিকা। সুজাতার তো মা-বোপকে মনেই নেই, বাইরের লোকেরাও জানে সাবিত্রী ও বামদেবেরই একমাত্র কন্যা সুজাতা; একমাত্র সন্তান। সুজাতা জানে সাবিত্রী দেবীই তার মা। বামদেবই তার বাপ। সুজাত কলেজের তৃতীয় বাৰ্ষিক শ্রেণীর ছাত্রী।

সাবিত্রীর ইচ্ছা তার বোনপো বিনয়ের সঙ্গে সুজাতার বিবাহ দেন। বিনয়ের সঙ্গে সুজাতার পরিচয় আছে। বিনয় যখন শিবপুরে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত, সেই সময় থেকেই বামদেবের বাড়িতে তার ঘন ঘন যাতায়াত ছিল।

শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বিনয় বিলেতে যায় এবং বছর দেড়েক হল সেখান থেকে ফিরে কলকাতার এক বিদেশী ফার্মে মোটা মাহিনায় চাকরি নিয়েছে এবং পূর্বের মতই এখনো ঐ গৃহে সে যাতায়াত করে। সাবিত্রীর ইচ্ছা ছিল বিনয় এবারে তারই বাড়িতে থাকুক। কিন্তু বিনয় কিছুতেই রাজী হয়নি। সে এক হোটেল ঘর নিয়ে আছে।

বিনয়ের প্রতি সুজাতার মনোগত ভাবটা ঠিক কিন্তু বোঝা যায় না। বিনয় ও সুজাতার সঙ্গে দেখা হলেও দু-চার মিনিটের মধ্যে খিটিমিটি লেগে যায়। বিনয়ের বাঁশীর মত টিকোল নাক-সুজাতা তাকে নাকু নাকেশ্বর’ নাকানন্দ প্রভৃতি বিশেষণ বিভূষিত করে। আর বিনয়ও সুজাতার গায়ের রং শ্যামবর্ণ বলে কখনো ‘কালোজিরে কালিন্দী’, ‘কালীশ্বরী’ ইত্যাদি ইত্যাদি ভূষণে অলঙ্কাত করে তাকে রাগাবার চেষ্টা করে।

আবার পরস্পরের যত শলাপরামর্শ পরস্পরকে বাদ দিয়েও হয় না।

সাবিত্রী কখনো কখনো বলেছেন, বিনয়ের সঙ্গে ঝগড়া করিস, ওর সঙ্গেই তো তোর আমি বিয়ে দেব ঠিক করেছি!

নাক সিটিকে ঘাড় দুলিয়ে সুজাতা বলেছে, মাগো, ঐ নাকুয়া নাকেশ্বর বোনপোকে তোমার কোন দুঃখে বিয়ে করতে গেলাম মা! সারা দেশে কি আর পাত্তর নেই!

আমন পাত্র কোথায়, বিলেত-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার, বড় চাকুরে—

রক্ষে কর মা জননী। তার চাইতে গেরুয়া বসন অঙ্গেতে ধরে যোগিনী হওয়াও ঢের ভাল।

আমন পাত্র তোর মনে ধরে না পোড়ারমুখী! বরাতে তোর তাই লেখা আছে—কৃত্রিম কোপের সঙ্গে বলেছেন সাবিত্রী দেবী।

সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে মায়ের গা জড়িয়ে ধরে সুজাতাও বলেছে :

মা আমার গণত্‌কার
ইয়া লম্বা ভাগ্যে দেছে গনে
বলতে দেখি আর কি আছে
ভাগ্যে আমার লেখা–
কপাল আমার গুণে?

অথচ এদিকে আবার দেখেন দু-তিনদিন পরপর বিনয় না এলে সুজাতা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কারণে অকারণে এঘর এঘর করে বেড়ায়। কেমন একটা চাঞ্চল্য।

সাবিত্রী শুধান, অমন ছট্‌ফট করছিস কেন রে?

আচ্ছা, নাকানন্দ স্বামীর কি হয়েছে বল তো মা! হিমালয়েই তপস্যা করতে গেলেন নাকি? টিকিট পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কদিন।

জানি না বাপু। মনে মনে হাসেন সাবিত্রী। কিন্তু একটা খোঁজ নেওয়া তো দরকার! গরজ থাকে নিজে যা না গাড়ি নিয়ে। বয়ে গিয়েছে তোমার নাকেশ্বর কুচুকুচের ওখানে যেতে! মরুক গে। যেমন গণ্ডারের মত নাক তেমনি হোঁৎকা বুদ্ধি তো। তাছাড়া খবর নেওয়া উচিত তো তোমারই, তুমি তো আর পর নিও-নিজের মায়ের পেটের বোন মাসী বলে কথা।

সাবিত্রী মেয়ের কথায় আবার না হেসে থাকতে পারেন না।

বামদেবের কিন্তু এসব খেয়াল নেই। নিজের কাজ-কারবার নিয়েই ব্যস্ত।

দিন-পাঁচেক বিনয় এ-বাড়িতে আসেনি।

সুজাতা সোফায় বসে বই পড়ছিল। নিঃশব্দ পায়ে পশ্চাৎ দিকে এসে এমন সময় দাঁড়ায় বিনয়। পায়ে ক্রেপ সোলের চপ্পল পরিধানে সাদা ট্রাউজার ও সাদা লিনেনের হাফ শার্ট।

টকটকে গোরাদের মত গায়ের রং-সমস্ত মুখখানার মধ্যে নাকটা যেন উদ্ধত ভঙ্গীতে উঁচিয়ে আছে। জোড়া ভ্রূ। কোঁকড়ানো চুল ব্যাকব্রাস করা করা। মাঝারি দোহারা গঠন। বিনয়কে সত্যিই সুন্দর বলা চলে।

হঠাৎ পিছন দিক হতে অধ্যয়নরত সুজাতার বইখানা ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, কাকেশ্বরী কোন্‌ দাঁড়কাক-কাহিনী পড়া হচ্ছিল দেখি!

দেখ, ভাল হবে না। কিন্তু—দাও, আমার বই ফিরিয়ে দাও বলছি। বলতে বলতে দুহাত বাড়িয়ে ওঠে সুজাতা।

দেবো-আগে চা খাওয়াও এক কাপ।

ইঃ, বয়ে গেছে নাকানন্দকে আমার চা খাওয়াতে! মুখ বেঁকিয়ে জবাব দেয় সুজাতা।

চা না হয় এক কাপ কোকো কিংবা এক কাপ কফি।

এক গ্লাস এঁদো পুকুরের পচা জলও নয়। কি আমার গুরুঠাকুর এলেন রে!

বোঝা যাবে দাও কি না। একবার সাতপাক ঘোরাই—

আমিও চোদ্দাপাক ঘুরিয়ে নাকচ করে না দিই তো আমার নাম সুজাতা নয়।

তাতে করে আরো শক্ত হবে বাঁধান। হা-হা করে হেসে ওঠে বিনয়।

ঘরে এসে প্রবেশ করলেন বামদেব ঐ সময়, এই যে বিনয়; কখন এলে?

এই কিছুক্ষণ।

সুজাতা দ্রুতপদে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

বস, আমি জামাটা ছেড়ে চলে আসি।

বিনয় সোফার ওপর একা একা বসে সুজাতার বইয়ের পাতা ওন্টাতে থাকে।

একটু পরে বামদেব ফিরে এলেন, তোমাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। একটা পরামর্শের জন্য বিনয়।

পরামর্শ!

হ্যাঁ!

কিসের পরামর্শ মেসোমশাই?

তুমি জান বহরমপুরে রত্নমঞ্জিলটা এক গুজরাটি ভদ্রলোককে বিক্ৰী করব বলে বায়না নিয়েছিলাম, আশাতীত মূল্য আবার পাওয়া যাচ্ছিলও—

হ্যাঁ, মনে আছে।

গতকাল ডাকে একটা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির চিঠি পেয়েছি! চিঠিটা অদ্ভুত। চিঠির নীচে কারো নাম সই নেই, কেবল লেখা আছে জনৈক ব্যক্তি। এই সেই চিঠি, পড়ে দেখ।

এগিয়ে দিলেন বামদেব চিঠিটা বিনয়ের দিকে। সংক্ষিপ্ত চিঠি।

শ্রীযুক্ত বামদেব অধিকারী সমীপেষু,

জানিলাম আপনি রত্নমঞ্জিল বিক্রয় করিতেছেন। পূর্বপুরুষের ভিটা এভাবে টাকার জন্য হস্তান্তর করিবেন না। করিলে সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন। মঙ্গল চান তো বায়না ফেরত নিন।

-ইতি

শুভাকাঙ্ক্ষী জনৈক ব্যক্তি

ব্যাবসাক্ষেত্রে ঐ শেঠ জাতটার একাধিপত্য থাকলেও এবং লোকগুলো প্রচণ্ড ধনী হলেও চিরদিন বিনয়ের ওদের প্রতি কেমন যেন একটা বিদ্বেষই ছিল। তাছাড়া অর্থই যে সর্বতোভাবে জীবনের একমাত্র মানদণ্ড নয়, স্বপ্নবিলাসী বিনয় সেটা বিশ্বাস করতো।

বিক্রয়ের ব্যাপারে যখন রতনলালের সঙ্গে বামদেবের দরকষাকষি চলছিল তখনই সে বলেছিল, কিছু ভাববেন না মেসোমশাই ও বোকা শেঠের যখন একবার মাথায় রত্নমঞ্জিল প্রবেশ করেছে, শেষ পর্যন্ত দেখবেন ঐ পঞ্চান্ন হাজারেই বেট টোপ গিলবে। স্রেফ চুপ করে থাকুন না এবং কার্যক্ষেত্রে হলও তাই।

কিন্তু আজ বামদেব-প্রদত্ত চিঠিটা পড়ে ওর পূর্বের সমস্ত চিন্তাধারা যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। রত্নমঞ্জিল ক্ৰয়ের ব্যাপারে রাণার জিদ ও শেষ পর্যন্ত পঞ্চান্ন হাজার স্বীকৃতি সব কিছুর মূলে যেন এখন ওর মনে হচ্ছে কোথায় একটা রহস্য লুকিয়ে আছে।

বিনয়কে নিঃশব্দে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বামদেব প্রশ্ন করেন, কি মনে হচ্ছে এখন বিনয়? চিঠিটার মানে কিছু বুঝতে পারলে?

না। তবে চিঠির মানে যাই হোক না কেন, আপাতত সামনের মাসের পনের তারিখে বাড়ি রেজিস্ট্রি করা হবে না এটা ঠিক।

কিন্তু জানি তো বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে।

তা হোক, তবু যে ভাবেই হোক আমাদের কিছুদিন সময় নিতেই হবে, যদি একান্তই বায়নার টাকা ফেরত না দেওয়া যায়—

কি তুমি বলতে চাও বিনয় খুলে বল!

এই চিঠির নিশ্চয়ই কোন অর্থ আছে—

অর্থ! বিস্মিত বামদেব বিনয়ের মুখের দিকে তাকালেন।

হ্যাঁ। অবশ্য এখুনি চট্‌ করে আপনাকে সঠিক কিছু আমি বলতে পারছি না, দুটো দিন ভাবতে দিন।

আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়?

বলুন!

তুমি হয়ত জান না, এ বাড়িতে গত দু-মাস ধরে চোরের উপদ্রবের ব্যাপারে আমার বন্ধু কিরীটী রায়কে পরশু রাত্রে আমি ডেকে এনেছিলাম—

সত্যি!

হ্যাঁ।

তিনি কি বললেন? ব্যগ্র কৌতূহল উৎকণ্ঠা বিনয়ের চোখেমুখে।

সঠিক কিছুই বলেনি, তবে যা বললে-তার ধারণা হচ্ছে হীরকখচিত সোনার আমাদের পূর্বপুরুষের সেই কঙ্কন, রত্নমঞ্জিল ও এখানে চোরের উপদ্রব গত কিছুদিন ধরে—সব কিছুর মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগাযোগ আছে।

বিনয় এবার বলে, মেসোমশাই, আপনার কথা শুনে আমারও কেমন যেন মনে হচ্ছে, আপনার বাড়িতে কিছুদিন ধরে যে চোরের উপদ্রব হচ্ছে সেটা সামান্য তুচ্ছ একটা ব্যাপার নয়। এর পিছনে কোন একটা গভীর উদ্দেশ্য আছে। আমারও মনে হচ্ছে কিরীটীবাবুর ধারণা হয়ত মিথ্যে নয়।

বামদেব বিনয়ের কথাগুলো শুনে এবাবে যেন সত্যিই একটু চিন্তিত হয়।

বিনয় আবার বলে এবং মনে হচ্ছে সব কিছুর মূলে সত্যিই ঐ রত্নমঞ্জিলই আর তাই ঐ শেঠজীর ঐ ভাঙা রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারে এত আগ্রহ-এত উৎসাহ!

তোমার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। যদিও কষ্টকল্প তা হলেও চোরের উপদ্ৰব ও কঙ্কনের সঙ্গে একটা যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে রত্নমঞ্জিলের যে কি সম্পর্ক থাকতে পারে সেটাই বুঝতে পারছি না!

ঠিক যে কি সম্পর্ক তা হয়ত এখনো বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু এটা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, কেনই বা শেঠজীর বহরমপুরের ঐ পুরাতন বাড়িটা সম্পর্কে এত আগ্রহ? খাগড়ার বাসনের ফ্যাক্টরী করবে। একটু অস্বাভাবিক নয় কি? তাছাড়া শেঠজী ঐ বাড়িটার খোঁজ পেলেই বা কি করে? এবং, ফ্যাক্টরীই যদি করবার ইচ্ছা ওর বহরমপুরে, একমাত্র ঐ রত্নমঞ্জিল ছাড়া কি আর কোন বাড়ি বা জায়গা নেই ঐ তল্লাটো? সবচাইতে বড় কথা, কেউ আত টাকা ঢালে ঐ পুরাতন একটা বাড়ির জন্য? শেষ পর্যন্ত আর একটা ব্যাপার ঐ সঙ্গে ভেবে দেখুন, বায়না নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ বাড়িতে চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছে–

এমনও তো হতে পারে, সব কিছুই একটা যোগসূত্রহীন আকস্মিক ব্যাপার!

হতে যে পারে না তা বলছি না মেসোমশাই, তবে ঐ সঙ্গে এও তো ভাবা উচিত, নাও হতে পারে। ব্যাপারগুলো যা পর পর ঘটেছে, কোনটাই তার আকস্মিক বা উদ্দেশ্যহীন নয়। না মেশোমশাই, কিরীটী রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিকই করছেন। ভাল কথা, এ চিঠির কথা তাঁকে জানিয়েছেন?

না। কাল সন্ধ্যার ডাকে অফিসের ঠিকানায় এই চিঠিটা পেয়েছি মাত্র। তারপর হঠাৎ থেমে কতকটা চিন্তান্বিত ভাবেই বললেন, না সত্যিই তুমি যে আমায় ভাবিয়ে তুললে বিনয়।

দাসীর হাতে ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে সুজাতা ঐ সময় কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করল।

সামনের ত্ৰিপয়ের ট্রে-টা নামিয়ে রেখে কাপে কাপে চা ঢালতে ঢালতে ঘাড় ফিরিয়ে বামদেবের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে চেয়ে আব্দারের সুরে সুজাতা বলে, অফিস থেকে ফিরে এসেই কি ফুসুর-ফুসূর গুজুর-গুজুর লাগিয়েছ বাবা।

তাই তো মা, বিনয় যে আমাকে বড় চিন্তায় ফেলে দিল—

বাঁকা দৃষ্টিতে একবার বিনয়ের দিকে তাকিয়ে সুজাতা জবাব দেয়, কে কি আবোল-তাবোল বাজে বকল, তাই নিয়ে মিথ্যে কেন মাথা ঘামোচ্ছ বাবা! তার চাইতে ওপরে চল, রেডিওতে আজ খুব ভাল রবীন্দ্র-সঙ্গীত আছে!

এমন সময় ভৃত্য এসে সংবাদ দিল বাইরে একজন বাবু এসেছেন দেখা করতে।

এ সময় আবার কে এল!

ভৃত্য বললে, নাম বললে পিয়ারীলাল—

রাণার দূত! বিনয়, আমার মনে হচ্ছে লোকটা—

আপনি যান নীচে। দেখুন। আবার কি সে বলে। কিন্তু কোন কথা দেবেন না। তারপর চলুন, আজই একবার কিরীটীবাবুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করি।

কোনমতে গরম গরম চা-টা গলাধঃকরণ করেই উঠে পড়লেন বামদেব। গায়ের ওপরে শালটা চাপিয়ে বললেন, তাহলে তুমি একটু অপেক্ষা কর। দেখি আমি হঠাৎ এ অসময়ে আবার রাণার দূত কেন! তারপর একসঙ্গেই না হয় বের হওয়া যাবে!

একটু যেন চঞ্চল পদেই বামদেব ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।

সুজাতা বিনয়ের ব্যবহারে একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল। ক্ষণপূর্বে ও বিনয়কে খোঁচা দিয়েই কথা বলেছে এবং ইতিপূর্বে কোনদিনই বিনয় খোঁচা খেয়ে খোঁচা নির্বিবাদে হজম করেনি, বিশেষ করে সুজাতার কাছ থেকে খোঁচা খেলে বরং দ্বিগুণ উৎসাহে দ্বিগুণ চোখা বক্রোক্তিই সে ফিরিয়ে দিয়েছে।

বিনয় বুঝতে পারে কৌতূহলে সুজাতা ফেটে পড়বার উপক্রম, তথাপি সে নির্বিকারভাবে শিস দিয়ে যায়। বেশীক্ষণ কিন্তু বিনয় নির্বিকার থাকতে পারে না। সামনে উপবিষ্ট মেয়েটিকে এবারে শান্ত করা দরকার!

ইঃ মেয়ের মুখখানা দেখ না।–বেজায় চটেছে।

হঠাৎ এমন সময় অন্যমনস্কভাবে পকেটে হাত যেতেই বিনয়ের একটা কথা মনে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ওষ্ঠ্যপ্রান্তে বিচিত্ৰ হাসি দেখা যায়। .

বিনয়-সুজাতার মধ্যে লৌকিক চক্ষে যত গরমিলাই থাক, পরস্পরের মধ্যে যে পরস্পরের একটা সত্যিকারের গাঢ় প্রীতির সম্পর্ক আছে। অন্য কেউ না জানলেও পরস্পরের নিকট সেটা অবিদিত নেই।

তৃতীয় কেউ না জানলেও পরস্পর পরস্পরকে মধ্যে মধ্যে দু-চার ছত্রের এক-আধখানা দেয়। অবশ্য সে চিঠিতে কোন সম্বোধন বা চিঠির নীচে ইতির শেষে কোন নাম বা পরিচয়সংজ্ঞা না থাকলেও, চিঠি যে যখন পায় এবং যে যখন চিঠি লেখে তারা উভয়েই বুঝতে পারে এবং জানেও কার চিঠি এবং কে কাকে লিখেছে। এবং ঐ ভাবে গোপনে চিঠি লেখালেখির ব্যাপারটা দুজনের মধ্যে একটা বিচিত্র আকর্ষণের সূত্র হয়ে দাঁডিয়েছিল এবং অমনি একখানা চিঠি মাত্র দিন দুই আগে বিনয় পেয়েছে এবং পকেটে হাত যেতে সেই চিঠিটাই হাতে ঠেকতে ওর ওষ্ঠ্যপ্রান্তে বিচিত্ৰ হাসি দেখা দিয়েছিল।

উৎসাহে এতক্ষণে বিনয় সোজা হয়ে উঠে বসে। এবং নিজের সঙ্গেই যেন নিজে কথা বলছে এইভাবে বলে ওঠে, তাই তো, সেই মেয়েটির একখানা চিঠি তো পরশু পেয়েছি! জবাব দেওয়া তো এখনো হয়নি। নাঃ, কি ছাই যে ভোলা মন হয়েছে আমার! মেয়েটি এত করে চিঠি লিখলে, অথচ একটা উত্তরও দেওয়া হল না!

কথা বলতে বলতে চিঠিখানা বের করে বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই এবারে বিনয় পড়তে শুরু করে।

সবুজ রংয়ের একটা চিঠির কাগজ। চিঠিটা পকেট থেকে বের করতেই মৃদু মিষ্টি একটা বিলাতী ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ পাওয়া যায়। পড়তে গিয়ে কিন্তু বিনয়ের মাথার মধ্যে একটা দুষ্টুমি চাড়া দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে নিজের মন থেকে কল্পনায় বানিয়ে বানিয়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে পড়তে শুরু করে :

ওগো, তোমার নীরবতা যে আর আমি সহ্য করতে পারছি না! তুমি কি নিষ্ঠুর-হৃদয় বলে কি তোমার কোন পদার্থই নেই! আমার এ রক্তাক্ত হৃদয় তোমার পদতলে লুণ্ঠিত করে–

এই পর্যন্ত বিনয় বলেছে, হঠাৎ মুখ ভেংচে সুজাতা বলে ওঠে বিকৃত কণ্ঠে, এঃ, রক্তাক্ত হৃদয় তোমার পদতলে-মিথ্যুক কোথাকার! বয়ে গিয়েছে লুষ্ঠিত হতে কারো হাতীর মতো গোদা পায়ে!

হো হো করে বিনয় গলা ছেড়ে এবার হেসে ওঠে।

আরো রেগে যায়। সুজাতা বিনয়ের হাসিতে, কোন মেয়ের তো খেয়েদেয় কাজ নেই, ঐ হোঁৎকা নাকেশ্বরের গোদা পায়ে লুষ্ঠিত হতে যাবে!

কিন্তু যদি এমন কোন মেয়ে থাকে–

ককখনো না। থাকতেই পারে না।

কিন্তু শ্ৰীমতী কালোজিরে বোধ হয় সম্যক জ্ঞাত নন যে, বিগত যুগে মুনিঋষিরাও বলে গিয়েছেন যে নারী-মন বিচিত্র! নচেৎ যে মেয়েটি আমার প্রেমে গদগদ হয়ে এই পত্ৰবাণ নিক্ষেপ করেছেন–

বয়ে গিয়েছে নাকানন্দ নাকেশ্বরের প্রেমে গদগদ হতে!

আহা রে! সত্যি বলছি কালিন্দী, ক্যামেরটা এসময় সঙ্গে নেই, নচেৎ ঐ মুখ-চন্দ্ৰিমার এই অবিস্মরণীয় মুহুর্তের একখানি ছবি তুলে নিতে পারলে-হায় হায়, কি ভয়ঙ্কর অপূরণীয় ক্ষতি! হায় পৃথিবীর মনুষ্যগণ, তোমরা কি হারাইলে তোমরা জান না! বাইবেলের ভাষার বঙ্গানুবাদে বলতে ইচ্ছা করছে, ঈশ্বর তোমাদের প্রেম দিতে চাহিয়াছিলেন–

খিলখিল করে এবারে সমস্ত কষ্টকল্পিত গাম্ভীর্য ও বিরাগের মুখোশটা খুলে ফেলে দিয়ে অভিমানের গুমোটটা কেটে যায়।

সুজাতার সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয় বিনয়ও। বিনয় জানত, বাইবেলের ঐ ধরনের অদ্ভুত বঙ্গানুবাদ সুজাতাকে কি ভাবে হাসায় —তাই বরাবরই কপট মান-অভিমানের কলহের শেষে ঐ ব্ৰহ্মাস্ত্র প্রয়োগেই সুজাতার সঙ্গে সন্ধি করত। আজও শেষ পর্যন্ত তাকে সেই আশ্রয়ই গ্রহণ করতে হল।

হসির মধ্যে দিয়েই ভাব হয়ে গেল।

সুজাতা অতঃপর প্রশ্ন করে, বাবার সঙ্গে কি আলোচনা হচ্ছিল?

সেই চিরাচরিত সহজাত নারীমনের কৌতূহল। বিনয় হাসতে থাকে।

না না, নাকু সত্যি বল না, কিসের চিঠি তোমাকে পড়তে বাবা দিয়েছিলেন?

জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির—

তার মানে?

সত্যিই তাই। জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি মেসোমশাইকে সাবধান করে দিয়েছেন, রত্নমঞ্জিল যেন বিক্রি করা না হয়। অন্যথায় তাঁকে নাকি সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

না, না–be serious!

এমন সময় সিঁড়িতে বামদেবের জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।

বামদেব আসছেন।

দুজনেই ঠিক হয়ে গুছিয়ে সরে বসে। বামদেব ঘরে এসে ঢুকলেন। মুখে তাঁর চিন্তার রেখা সুস্পষ্ট।

সোফার উপরে বসতে বসতে বামদেব বললেন, বোধ হয় তোমার কথাই ঠিক, বিনয়। পিয়ারীলাল কেন এসেছিল জান!

কেন?

পঞ্চান্ন হাজারের উপরে রাণা আরো কিছু বেশী দিতে প্রস্তুত এবং আরো দশহাজার অগ্রিম দিতে চায়। এবং বললে, সামনের মাসের পনের তারিখের আগে বিক্রয়-কোবলাটা রেজোষ্ট্ৰী হয় তাদের ইচ্ছা–

আপিন কি বললেন?—

আমার হাতে অনেক কাজ বর্তমানে—সেটা সম্ভব নয়। তাই বলে দিলাম। কাল-পরশুর। মধ্যে একবার রাণার অফিসে যেতে বলে গেল।

কি বললেন। আপনি? যাবেন নাকি?

তাই ভাবছি।

কিন্তু আমার মনে হয় না যাওয়াই আপনার ভাল। সত্যি আমি যেন ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না!

এদিকে আবার কি হয়েছে জান?

কি?

রাঘব সাহা যে আবার এইমাত্র ফোন করেছিল!

রাঘব সাহা-মানে ঐ অ্যাটর্নি?

হ্যাঁ।

সে আবার ফোন করেছিল কেন?

A new offer–

হ্যাঁ, কে এক নাকি আবার নতুন খরিদ্দার জুটেছে বাড়িটার–সে নাকি আরও কুড়ি হাজার বেশী দাম দিতে চায়।

বলেন কি!

তাই তো বললে সাহা।

হুঁ, আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন মেসোমশাই!

কি?

এই রত্নমঞ্জিলের মধ্যেই কোন একটা রহস্য আছে–

তাই তোমার মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, নচেৎ একটা ভাঙা বাড়ি নিয়ে এমন টানা-হ্যাচড়া শুরু হত না। তা নতুন খরিদ্দারটি আবার কে এলেন, শুনলেন কিছু?

তার নামধাম তো কিছু বলল না, কেবল বললে টাকার কথা—

বলছিলাম কি, একবার চলুন না। আপনার বন্ধু কিরীটী রায়ের ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক এখুনি!

আগে একবার ফোন করে দেখ। তাহলে উনি আছেন কিনা?

বামদেবের নির্দেশে বিনয় ফোন করবার জন্য ফোনের কাছে গিয়ে মাউথপিসটা তুলে নিল।

প্রায় মিনিট দশেক চেষ্টার পর কানেকশন পাওয়া গেল।

মিঃ রায় আছেন?

কথা বলছি, বলুন!

ধরুন, মিঃ অধিকারী আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

বামদেব এসে ফোনটা ধরলেন, কে কিরীটী নাকি?

হ্যাঁ, বল।

আমি বামদেব কথা বলছি–

ওপাশ হতে মৃদু হাস্যধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন এলো, কি ব্যাপার রত্নমঞ্জিলের আবার কোন নতুন offer এসেছে বুঝি অন্য কারো কাছ থেকে?

আশ্চর্য! ঠিক তাই, কিন্তু তুমি জানলে কি করে?

অনুমান! কিন্তু তোমার কাছে রাণার লোক যায়নি?

আশ্চর্য, তাও তো এসেছিল! তার চাইতেও একটা আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে গতকাল একটা চিঠি পেয়েছি—

চিঠি! কার?

কোন নাম-স্বাক্ষর নেই, লেখা আছে জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি–

চিঠিতে কি লেখা আছে?

বাড়ি বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। বিক্রি করলে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হব!

আমি জানতাম, জানতাম-I smelt it—অস্পষ্ট আত্মগতভাবেই যেন শেষের কথাগুলো উচ্চারণ করে কিরীটী।

অ্যাঁ, কি বললে!

দেখ, আমাদের একবার বহরমপুরে অবিলম্বে যাওয়া প্রয়োজন—

বহরমপুর?

হ্যাঁ। কালই চল, রওনা হওয়া যাক।

কিন্তু—

না, এর মধ্যে আর কোন কিন্তু নেই। প্রস্তুত থেকে-কালই।

বেশ।

তাহলে স্টেশনেই আমাদের দেখা হবে।

***

কালই বহরমপুর যাচ্ছি বিনয়—

আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব মেসোমশাই।

তুমি! কিন্তু। তোমার অফিস?

ছুটি পাওনা আছে, ছুটি নিয়ে নেব।

সুজাতা বলে, তাহলে আমিও কিন্তু যাব বাবা তোমাদের সঙ্গে—

তুই! তুই কোথায় যাবি?

ঐ তো বললাম, বহরমপুর তোমাদের সঙ্গে—

দেখি তোর মাকে তাহলে গিয়ে বলি। বামদেব ভিতরে চলে গেলেন।

উঁহু, পথে নারী বিবর্জিত–বিনয় বলে।

মুখ ভেংচে প্রত্যুত্তর দেয়। সুজাতা, কি আমার নির রে! নাকেশ্বর, নাকানন্দ, নাকসর্বস্ব!

তবু কালোজিরে যাচ্ছেন না—

যাচ্ছি—যাব!

উঁহু।

যাবই।

নৈব নৈব চ।

হুঁ, if নাকু goes–I go!

তবে বল বিয়ে করবে আমায়?

নৈব্য নৈব চ। এ জীবনে নয়।

বহরমপুর যাওয়ার সময় সুজাতাও ওদের সঙ্গী হল।

কন্যার প্রতি দুর্বলতায় বামদেবের শেষ পর্যন্ত ইচ্ছা না থাকলেও মুখে না করতে পারলেন না। এবং যাবার সময় বিনয় মুখখানা গভীর করে থাকলেও মনে মনে খুশি হল, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তার জিদ বজায় রেখেছে দেখে ও মেশোমশাই বামদেবেও কন্যার প্রতি দুর্বলতার খাতিরে সুজাতাকে সঙ্গে নিলেন দেখে।

যাহোক নির্বিবাদেই সকলে বহরমপুরে এসে পৌঁছল।

সারাটা দিন সুজাতা পুরাতন রত্নমঞ্জিলের সর্বত্র হৈচৈ করেই বেড়াল।

কলকাতার বদ্ধ জীবনের পর বহরমপুরের খোলা মুক্তির মধ্যে সুজাতা যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে এবং না হোক দশ-বারো বার বামদেবকে বললে, এই বাড়ি তুমি কেন বিক্রি করবে। বাবা! এ-বাড়ি তুমি কিছুতেই বিক্রি করতে পারবে না।

কিন্তু বায়না যে নেওয়া হয়ে গিয়েছে মা—

তাতে কি, ফেরত দিয়ে দাও! বায়না নিয়েছ তো কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে! বলবে ভেবেছিলাম বিক্রি করব কিন্তু ভেবে দেখলাম বিক্রি করতে পারছি না, ব্যাস!

বামদেব হাসলেন, পাগলী!

বারন্দায় একটা ইজিচেয়ারের উপর বসে বামদেব ও তাঁর মেয়ে সুজাতা রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে যখন কথাবার্তা বলছিল, বিনয় সেই সময় একা একা ঘুরে ঘুরে বাড়ির চারপাশ দেখছিল।

কিছুদিন ধরে বাড়িটার বিক্রয়-ব্যাপার নিয়ে যে সব ঘটনাগুলো ঘটেছে, বিনয়কে সেটা বেশ খানিকটা উত্তেজিত করে তুলেছিল। নিঃসন্দেহে এবং বহরমপুর পৌঁছে রত্নমঞ্জিলে পদার্পণ করবার পর থেকে কেমন যেন তার বার বার মনে হচ্ছিল, কোনক্রমেই এই রত্নমঞ্জিল বিক্রয় করা চলতে পারে না। টাকাই সব ক্ষেত্রে বড় কথা নয়, মানুষের সেন্টিমেন্টেরও একটা মূল্য আছে বৈকি।

পূর্ব ব্যবস্থামত ওদের সঙ্গে বহরমপুরে আসতে পারেনি। কিরীটী হঠাৎ শেষ মুহুর্তে বিশেষ একটা কাজে আটকা পড়ায় ওদের সঙ্গ নিতে পারেনি। তবে বলেছে। দু-চারদিনের মধ্যেই আসছে।

এখানে আসবার পূর্বে বিনয় কিরীটীর সঙ্গে দেখা করেছিল। সেই রাত্ৰেই। কিরীটী বলে দিয়েছে বিশেষ করে কয়েকটি কথা, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে-দিনে বা রাত্রে সর্বদা যেন তারা বিশেষ সাবধানে থাকে।

বিনয় শুধিয়েছিল, কেন বলুন তো? আপনি কি মনে করেন আমাদের আচমকা কোন বিপদ-আপদ ঘটতে পারে। সেখানে?

ঘটলে আশ্চর্য হবেন না বিনয়বাবু!

কিরীটীর সাবধান-বাণী বিনয় তখন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু এখানে পৌঁছাবার পর ও বাড়িটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মনের মধ্যে তার ঠিক শঙ্কা না হলেও কেমন একটা অসোয়াস্তি অনুভব করে যেন সে।

পুরাতন নবাবী আমলের বাড়ি।

বাড়িটার গঠন-কৌশলের মধ্যেও সেই নবাব আমলের স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় যেন। বহুদিনের সংস্কারের অভাবে বাড়িটা জীৰ্ণ হয়ে গেলেও, এর যা কাঠামো তাতে মনে হয় আরো ৬০-৭০ বৎসর অনায়াসেই এমনি দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রায় চোদ্দ কাঠা জায়গার উপরে বাড়িটা। সামনে ও পিছনে যে জায়গা আছে তাও প্রায় বিঘাঘানেক তো হবেই। বাড়িটা দোতলা এবং সর্বসমেত তিনটি মহলে ভাগ করা যায়।

নবাব আমলে অধিকারী বংশ ধন, প্রতাপ, শৌর্য ও পদমর্যাদায় যখন জমজমাটি ছিল, এই রত্নমঞ্জিল হয়ত মানুষজনের কোলাহলে তখন গমগম করত।

এখানো রত্নমঞ্জিলের বহিরাংশে জীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ হাতীশালা ঘোড়াশালা, নাটমন্দির, পাইক-পেয়াদাদের মহল একদা সেই অতীত শৌর্যেরই সাক্ষ্য দেয়।

বাইরের মহলেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিনয়।

চারিদিকে জঙ্গল ও আগাছা। প্রকাণ্ড নাটমন্দিরটার প্রশস্ত চত্বরের চারিদিকে সুউচ্চ বড় বড় থাম, শীর্ষে শীর্ষে কারুকার্য। সুউচ্চ খিলানের মাথায় কবুতর বাসা বেঁধেছে, নির্বিবাদে বংশবৃদ্ধি করছে।

মধ্যাহ্নশেষের নিস্তব্ধ নির্জনতায় কবুতরের কুজন চলেছে। মেঝেতে ধরেছে দীর্ঘ সর্পিল ফাটল।

শীতের সূর্য প্রায় অস্তগমনোন্মুখ। শেষ আলোর স্নান রশ্মি গম্বুজ-শীর্ষে শীর্ষে অস্ত পরশটুকু বুলিয়ে যাচ্ছে।

নাটমন্দিরের পাশ দিয়ে একটু সরু পায়ে-চলা পথ, দু’পাশে আগাছা জন্মে পথটাকে প্রায়। ঢেকে দেবার যোগাড় করেছে। সেই পথ ধরে বিনয় আরো পিছনে এগিয়ে যায়।

পথটা এসে শেষ হয়েছে একটা দিঘীর সামনে।

প্রশস্ত বাঁধানো রানা। কিন্তু তাতেও ফাটল ধরেছে, জন্মেছে আগাছা।

অতীতের ধ্বংসে জীর্ণ অবশেষ। ক্লান্ত বিনয় দিঘীর ভগ্ন রানার উপরেই বসে পড়ল।

দিঘীর চারপাশে অজস্র গাছপালা হুমড়ি খেয়ে যেন দিঘীর বুকের ওপরে পড়েছে, দিঘীর কালো জলে তারই ছায়া স্তুপ বেঁধে আছে।

দিঘীর নোংরা জল দেখলেই বোঝা যায় বহুদিন এদিকে মানুষের হাতের স্পর্শ পড়েনি অবহেলিত পরিত্যক্ত।

সর্বত্ৰ যেন অযত্ন ও অবহেলা।

অন্যমনস্কভাবে বিনয় কতক্ষণ ভগ্ন রানার উপরে বসে ছিল মনে নেই, হঠাৎ একটা অস্পষ্ট খসি খসি শব্দে চমকে পাশে তাকাল।

রানার ওপরে বিনয় যেখানে বসে ছিল তার প্রায় হাত দশেক তফাতে দিঘীর ঢালু পাড় ও ঘন জঙ্গলের সামনে প্রদোষের স্নান আলোয় দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় এক পুরুষ।

মাথায় বঁকড়া বঁকড়া চুল, মুখভর্তি দাড়ি-পরিধানে ধুতি, গায়ে একটা ধূসর রঙের চাদর।

বড় বড় দুটো চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিনয়ের প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। চক্ষু তো নয়, যেন। অন্তর্ভেদীদুটো জ্বলন্ত পাথর।

লোকটার সঙ্গে চোখাচৌখি হতেই চক্ষের পলকে লোকটা পিছনের ঘন জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। একটা দুঃস্বপ্ন যেন মিলিয়ে গেল।

বিনয় প্রথমটায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা সত্যি না তার দেখবারও ভুল বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু লোকটা পশ্চাতের ঘন জঙ্গলের মধ্যে চকিতে অন্তৰ্হিত হলেও তখনও সেখানকার গাছপালাগুলো দুলছিল।

গাছপালাগুলোর মধ্যে একটা আলোড়ন জাগিয়ে যে লোকটা অন্তৰ্হিত হয়েছে ক্ষণপূর্বে, দোদুল্যমান গাছপালাগুলোই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। স্বপ্ন নয়, দেখারও ভুল নয়।

বিনয় একবার ভাবলে এগিয়ে গিয়ে জায়গাটা অনুসন্ধান করে দেখে কিন্তু ঠিক সাহস হলো না, কারণ চারিদিকে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।

একাকী এই অচেনা জায়গায় ঐ রকম একটা লোককে অনুসরণ করাটা মনে হল ঠিক বিবেচনার কাজ হবে না। বরং কাল সকালে কোন এক সময় দিনের আলোয় এসে ঐ জায়গাটা ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। এখন ফিরে যাওয়াই সমীচীন হবে।

বিদায় যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে চলল।

কিন্তু চকিতে দেখা ক্ষণপূর্বের সেই দাঁড়িগোফ-ভরা মুখখানা কেবলই মনের মধ্যে এসে উঁকি দিতে লাগল বারংবার যেন।

কে লোকটা?

এই নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ দিঘীর ধারে কে লোকটা।

বিনয়কে দেখে হঠাৎ অমন করে অদৃশ্য হলই বা কেন? বিনয়কে হয় সে লক্ষ্য করছিল। আড়ালে থেকে, হঠাৎ চোখচোখি হয়ে গিয়েছে।

বিনয় পথ চলে। কিন্তু তার মনের মধ্যে অহেতুক একটা অসোয়াপ্তি তাকে যেন পীড়ন করতে থাকে।

মাঝের মহলের দোতলায় খান-দুই ঘর ওদের থাকবার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া হয়েছিল। এবং মাঝের মহলে যেতে হলে ‘কেয়ারটেকার’ মনোহরের এলাকা পার হয়ে যেতে হয়।

সিঁড়ির কাছেই মনোহরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বিনয়ের। মনোহর গোটা দুই হ্যারিকেন জ্বেলে উপর উঠছিলো।

বিনয়কে দেখে মনোহর প্রশ্ন করে, এই যে দাদাবাবু! কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? বড়বাবু আপনাকে খুঁজছিলেন!

বড়বাবু, দিদিমণি এঁরা সব কোথায় মনোহর?

উপরের দালনে বসে চা খাচ্ছেন।

বিনয় মনোহরের আগে-আগেই অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।

প্রকাণ্ড টানা বারান্দার একাংশে ছোট একটি বেতের টেবিলের দু’পাশে বসে সুজাতা ও বামদেব চা পান করছিলেন।

পাশেই আর একটা চেয়ার বোধ হয় বিনয়ের জন্যই খালি পড়ে ছিল। টেবিলের পাশেই একটা স্ট্যাণ্ডের উপরে একটি প্রজ্বলিত টেবিলল্যাম্প। জায়গাটায় একটা অস্পষ্ট আলোছায়া।

বিনয়ের পদশব্দে বামদেব ও সুজাতা দুজনেই এককসঙ্গে ফিরে তাকায়।

এই যে বিনয়, সারাদিন কোথায় ছিলে?

বিনয় খালি চেয়ারটার ওপরে গা ঢেলে দিয়ে বসতে বসতে বললে, আপনার রত্নমঞ্জিল সারভে করছিলাম মেসোমশাই।

সুজাতা কোন কথা না বলে ততক্ষণে বিনয়ের জন্য চায়ের কাপে চা ঢেলে চামচটা দিয়ে চিনি ও দুধ মেশাচ্ছিল। সে কেবল আড়চোখে বিনয়ের মুখের দিকে তাকাল।

বামদেব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, এখানকার বনজঙ্গলে শুনছি। নানা বিষধর সাপ আছে বিনয়। একটু সাবধানে চলাফেরা করো। বরং একা একা না ঘোরাফেরা করে মানোহরকে সঙ্গে নিও। এখানকার সব কিছু ও জানে।

মনোহর দুইহাতে দুটো জ্বলন্ত লণ্ঠন নিয়ে ততক্ষণে উপরে উঠে এসেছে।

বামদেবের কথাগুলো তার কানেও প্রবেশ করেছিল। সে বললে, হ্যাঁ দাদাবাবু, এখানে সাপের ভারি উপদ্রব।

বিনয় তৈরী চায়ের কাপটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে গরম চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আরামসূচক একটা শব্দ করে বললে, সাপের ভয় থাকুক। আর যাই থাকুক মেসোমশাই—

আপনার রত্নমঞ্জিলের উপরে কিন্তু ভারি একটা মায়া পড়ে গিয়েছে আমার।

বামদেব হাসতে হাসতে বললেন, কেন হে, এই পুরনো ভাঙা বাড়ির মধ্যে এমন কি পেলে?

আছে মেসোমশাই আছে, আমার মন বলছে আছে, নচেৎ–

বল কি বলছিলে!

নচেৎ ঐ ঝানু গুজরাটী ব্যবসাদার এই ভাঙা বাড়িটা কিনবার জন্য অমন করে হন্যে হয়ে আপনার পেছনে ছুটে বেড়াত না।

কি জানি বাবা, আমার তো মনে হচ্ছে মিথ্যে এ-বাড়িটা নিয়ে একটা সোরগোল করা হচ্ছে। জবাব দেন। বামদেব।

বেশ তাই যদি হবে, তাহলে ঐ চিঠিটারই বা কি অর্থ বলুন আর আপনার কলকাতার বাড়িতে আমন চোরের উপদ্ৰবই বা কেন ইদানীং হচ্ছিল?

বামদেব বললেন, চোরের উপদ্রবের চাইতেও ঐ চিঠিটাই গণ্ডগোলের সৃষ্টি করছে। বেশী।

কিন্তু গণ্ডগোল কি কেবল ঐ বেনামা চিঠিটাই সৃষ্টি করেছে মেসোমশাই, আপনার পূর্বপুরুষের সেই সোনার কঙ্কন!

তুমি কি সত্যিই মনে কর বিনয়, এই রাতত্বমঞ্জিলের সঙ্গে ঐ সোনার কঙ্কনের কোন যোগাযোগ আছে?

বিনয় এবারে হাসতে হাসতে জবাব দেয়, আমি কেন কিরীটীবাবুও তো সেই রকম সন্দেহ করছেন!

সুজাতা এবারে আলোচনার মাঝখানে বাধা দিল, কি হয়েছে তোমাদের বাবা বল তো? কেবল রত্নমঞ্জিল আর সুবর্ণ কঙ্কন! ঐ কথা ছাড়া কি তোমাদের আর কথা নেই?

বিনয় বুঝতে পারে সুজাতা চটেছে। তা চটবারই তো কথা। এখানে এসে পৌঁছনো অবধি সে রত্নমঞ্জিল নিয়েই ব্যস্ত সারাক্ষণ।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর যখন বের হচ্ছিল সুজাতা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, কোথায় যােচ্ছ বিনয়, বলেছিল সুজাতা।

যেখানেই যাই না কেন, কালোজিরে যাচ্ছে না!

নাকুর সঙ্গে যাচ্ছে কে! যেতে হয় একা যাব।

তাই যেও।

যাবই তো। একশবার যাব। মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল সুজাতা।

একা একা মজাসে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াব, কোথাও কালোজিরেকে সঙ্গে নেবো না। বলেই বিনয় এগিয়ে যায়।—চললুম।

বিনয় বুঝতে পারে সেই দ্বিপ্রহরের জের এখন ফের শুরু হবে।

টেবিলের একপাশে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা ছিল, সেটা হাতে করে বামদেব ঘরে চলে গেলেন।

বিনয় আর সুজাতা বসে রইল।

অন্য সময় হলে বিনয় এই সুযোগে সুজাতার অভিমান ভাঙাবার জন্য তৎপর হত, কিন্তু আজ তার মন ঐ মুহুর্তে অন্য চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল।

সে ভাবছিল দিঘীর ধারে ঘনায়মান বিকেলে আবছায়ায় দেখা সেই অদ্ভুত দাড়িগোঁফাওলা লোকটার কথাই। লোকটা কে? হঠাৎ তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় আমন করে পালিয়েই বা গেল কেন?

ছট্টলাল বহরমপুরে পরের দিনই এসে পৌঁছয়। যে কাজের ভার নিয়ে সে বহরমপুরে এসেছে সে-সব কাজে চিরদিনই সে পোক্ত। কারণ গত দশ বছর ধরে ঐ ধরনের কাজের দ্বারাই সে জীবিকানির্বাহ করে আসছে।

প্রথম একটা দিন ছট্টুলাল রত্নমঞ্জিলের আশেপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াল। কিন্তু বাইরে থেকে রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে কোন ধারণা করা সম্ভবপর হল না তার পক্ষে।

চট্‌ করে রত্নমঞ্জিলের মধ্যে ঢুকতেও সাহস হয় না।

দূর থেকে রত্নমঞ্জিলের ‘কেয়ারটেকার’ মনোহরের যণ্ডাগুণ্ডা চেহারা দেখেই বুঝতে পারে, লোকটা বিশেষ সুবিধের হবে না।

ছট্টুলাল তার আস্তানা নিয়েছিল স্টেশনের কাছে একটা হোটেল।

দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার দিকে ঘুরতে ঘুরতে ছট্টুলাল রত্নমঞ্জিলের পশ্চাৎদিকে গিয়ে হাজির হল।

অন্ধকারে বাড়িটা একটাকালো ছায়ার স্তুপ যেন।

আচমকা কঁধের ওপরে কার মৃদু স্পর্শ পেয়ে চমকে ফিরে তাকাল ছট্টু।

আবছা আলোছায়ায় দীর্ঘকায় একটা মূর্তি ঠিক তার পশ্চাতে দাঁড়িয়ে।

লোকটার মুখভর্তি দাড়িগোঁফ।

কে তুই, এখানে কি চাস? গম্ভীর চাপাকণ্ঠে লোকটা প্রশ্ন করে।

লোকটার আচমকা আবির্ভাবে প্রথমে ছট্টু একটু হকচকিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে সে সামলে নেয়।

রুক্ষকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়, তোর তাতে দরকার? তুই কে শুনি?

সহসা লোকটা তার ডান হাতের লৌহকঠিন বাঁকানো শীর্ণ আঙুলগুলো দিয়ে ছট্টুর কাঁধটা একটু টিপে দিতেই নিজের অজ্ঞাতেই ছট্টু একটা যন্ত্রণা-কাতর শব্দ করে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে আর তার বাকি থাকে না লোকটা দেহে প্রচুর শক্তি রাখে।

সোজা কথায় জবাব না দিস তো গলা টিপে শেষ করে দেবো।

এবার আর ছট্টু প্রতিবাদ জানাবার চেষ্ঠা করে না।

শক্ত ঠাঁই। এখানে চালাকি চলবে না বুঝতে পেরেছিল সে।

বল কাল থেকে এখানে কি মতলবে ঘোরাফেরা করছিস?

কি আবার মতলব! এমনিই দেখছিলাম বাড়িটা।

এমনি দেখছিলে চাদু! বেটা চালাকি করবার জয়গা পাওনি?

সত্যি বলছি দোস্ত—

এই থাম। দোস্ত! চোদ্দ পুরুষের দোস্ত আমার—খিঁচিয়ে ওঠে লোকটা।

শীর্ণ লোহার মত বাঁকানো ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে লোকটা ছট্টুর ডান হাতের কজিটা চেপে ধরে, চল আমার সঙ্গে। সত্যি কথা বলবি তো ছেড়ে দেব–নইলে ছাড়ছি না।

টানতে টানতে অন্ধকারে বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লোকটা ছট্টুকে নিয়ে চলে। এতটুকু প্রতিবাদ করবারও সাহস পায় না ছট্টু! আট-দশ মিনিট প্রায় অন্ধকারে বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টানতে টানতে একটা ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে এসে থামল।

দাঁড়া, পালাবার চেষ্টা করছিস কি মরবি!

ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল। লোকটা কোমর থেকে চাবি বের করে দরজার তালাটা খুললে।

ছট্টু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে তখন।

ঘন অন্ধকার বনজঙ্গল, বিশেষ করে অপরিচিত জায়গা, ছুটে পালাবারও উপায় নেই।

ডান হাতের কজিটা ব্যথায় টনটন করছে। ঘরের এক কোণে একটা প্রদীপ জ্বলছে। লোকটা এবারে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, ভিতরে আয়।

অজগরের চোখের সামনে বন্য জন্তুর যে অবস্থা হয়, ছট্টুরও সেই অবস্থা। সুড়সুড়ি করে একান্ত বাধের মত এক পা এক পা করে ছট্টু ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।

বোস।

সুজাতা ও বিনয় বসেছিল।

সামান্য ব্যবধান দুজনের মধ্যে। দুজনের মধ্যখানে মাত্র ছোট একটা বেতের টেবিল। টেবিলের ওপরে কাচের টিপটটার মধ্যে হয়ত খানিকটা ঠাণ্ড চায়ের তলানি ও ভিজে নিংড়ানো কতকগুলো চায়ের পাতা। গোটাতিনেক চায়ের তলানি সমেত চায়ের কাপ। সন্ট্যাণ্ডের ওপরে জ্বলছে ছোট টেবিলল্যাম্পটা।

রাগ করেছে সুজাতা। নিশ্চয়ই রাগ করেছে, যদিও সেই রাগের সঙ্গে মিশে আছে একটা উগ্র অভিমান। রাগ আর অভিমানের মেশামেশিতে মুখখানা একটু গভীরই মনে হচ্ছে সুজাতার। ঠোঁটের কোণে বিনয়ের বঙ্কিম একটা চাপা হাসির নিঃশব্দ প্রকাশ।

রাগ আর অভিমান যাই হোক, বিনয় জানে সুজাতা এখন চট্‌ করে উঠে যাবে না। মান ভাঙিয়ে কথা বলবার একটা অবকাশ দিচ্ছে সুজাতা বিনয়কে। সত্যিই তো, সুজাতা যে ওদের সঙ্গে বহরমপুর এসেছে সে তো ওরই সঙ্গ-আকর্ষণে। বিনয়ের সান্নিধ্যকে একটু ঘনিষ্ঠ, আরো একটু নিবিড় করে পেতেই। নয় কি! সেই বিনয়ই যদি তাকে অবহেলা জানায়, রাগ-অভিমান হয় বৈকি। না, সুজাতার দোষ নেই।

বিনয় এবারে আপন মনেই সুস্পষ্টভাবে হাসল, তবে নিঃশব্দেই।

তারপর শ্ৰীমতী কোকিললাঞ্ছিতা!

কিন্ত নতুন নামকরণেও সুজাতা ফিরে তাকায় না। যেমন নিঃশব্দে বসে ছিল বসে রইল।

শ্ৰীমতী কৃষ্ণা-শোন শ্ৰীমতী কালোজিরে, রাগ করে যদি কথাই না বলো তো আজ দুপুরে যা সব অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে কিছুই শোনা হবে না কিন্তু!

কে শুনতে চায়! গোড়া কেটে আগায় জল না ঢাললেও চলবে।

তা চলবে না বটে, তবে ঐ যে বললাম অত্যাশ্চর্য ঘটনা শোনা হবে না!

এবার ঘুরে মুখোমুখি বসল সুজাতা। বোঝা গেল মুখে না বললেও মনে মনে সুজাতা বিনয়ের কথা শোনার জন্য উদ্‌গ্ৰীব ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।

কি, বলব না বলব না!

কে বারণ করেছে বলতে!

শুনব বলেও তো কেউ সাড়া দিচ্ছে না!

ভণিতা না করে বলে ফেললেই তো হয়। কালা তো নাই যে শুনতে পাব না।

তা নয় বটে, তবে কানের সঙ্গে মনের একটা যোগাযোগ আছে কিনা। কথাগুলো বলে একান্ত নিম্পূহভাবে বিনয় সিগারেট-কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করতে তৎপর হয়ে উঠে। বিনয় আবার হাসে।

এবারে সুজাতাই তাগাদা দেয়, কই বললে না কি বলবে বলছিলে!

বিনয় আর বিলম্ব না করে দ্বিপ্রহরের তার সমস্ত অভিযান-কাহিনী যতটা সম্ভব সুষ্ঠভাবে বর্ণনা করে যায়। কোন কিছুই বাদ দেয় না।

লোকটা কে বলে তোমার মনে হয়! সুজাতা প্রশ্ন করে।

সেই থেকে তো সেই শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত মুখখানার কথাই ভাবছি। কে হতে পারেন। তিনি! বুঝতে পারছি না এখনো।

বাবাকে বললে না তো কিছু? না, বলিনি। ব্যাপারটা আগে ভাল করে খোঁজ না নিয়ে জানাজানি বা হৈচৈ করতে চাই না।

তোমার কোন কিছু সন্দেহ হয় নাকি?

নিঃসন্দেহই বা একেবারে হতে পারছি কই।

আচ্ছা কোন পাগল-টাগল নয় তো?

পাগল-টাগল হতে বাধা তো নেই, তবে আমন জায়গায় ঐ সময় হঠাৎই বা কেন আমনধারা এক পাগলের আবির্ভাব হল! আর হলাই যদি, আমন করে হঠাৎ আমার সঙ্গে চোখাচৌখি হতেই শ্ৰীমান পাগল নিজেকে অপসৃত করলেন কেন ভীতচকিত ভাবে?

তাই তো! তা হলে?

দাঁড়াও, ব্যস্ত হলে চলবে না। এটা রত্নমঞ্জিল—নবাবী আমলের ব্যাপার সব!

তার মানে? তুমি কি বলতে চাও বিনয়?

বলতে তো অনেক কিছুই চাই, তবে বলতে পারছি কই! সবই যে কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! সন্দেহ ও মিস্ট্রি যে ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠছে।

তুমি কি তাহলে বলতে চাও বিনয়, এ-বাড়ির সঙ্গে ঐ লোকটার কোন যোগাযোগ আছে?

আছে কিনা সত্যি জানি না, তবে থাকলে আশ্চর্য হব না! গোড়া থেকে এ বাড়ির সমস্ত ব্যাপারগুলো একবার ভেবে দেখ তো কালিন্দী। সেই সুবর্ণকিঙ্কন, তোমাদের বাড়িতে চোরের উপযুপরি উপদ্রব। কঙ্কনের পূর্ব ইতিহাস। তারপর এ-বাড়ি কেনবার জন্য রানার আবির্ভাব ও এ-বাড়ি ক্রয়ের ব্যাপারে তার জেদ্দাজেদি। ওরই মধ্যে আর এক ক্রেতার আবির্ভাব। টাকার অঙ্কও বাড়ে। সবশেষ সেই উড়ো চিঠি। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোকে যদি একসূত্রে গাঁথি তবে কোথায় আমরা পৌঁছই ভাব তো একবার!

সত্যি, আজ কিন্তু সমস্ত ঘটনাগুলো খাপছাড়া যোগসূত্রহীন বলে সুজাতার মনে হয় না।

কিন্তু কি রহস্য থাকতে পারে। এ সব কিছুর মধ্যে? সুজাতা প্রশ্ন করল!

আমিও তো সেটাই ভাবছি। কালী। কিন্তু কিছুই এ পর্যন্ত ধরতে পারছি না। অথচ এবাড়ির ব্যাপারে ক্রমেই যেন বেশ একটা উত্তেজনা বোধ করছি। অবশ্য একটা ব্যাপারে। আমি স্থিরনিশ্চিত হয়েছি।–

কি?

রত্নমঞ্জিল বিক্রি করা হবে না-লক্ষ টাকার বিনিময়েও না। মেসোমশাইকে এই রত্নমঞ্জিল বিক্রি করতে কিছুতেই আমি দেব না। শেষের দিকে বিনয়ের কণ্ঠে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেন। সুজাতা বিনয়ের মুখের দিকে তাকাল। ল্যাম্পের আলোয় মুখখানা যেন কি এক চাপা উত্তেজনায়। থমথম করছে, চোখের তারা দুটোয় একটা স্থির প্রতিজ্ঞার দীপ্তি ঝক ঝক করছে যেন।

মুহুর্তের জন্য বোধ হয় বিনয় চুপ করেছিল, হঠাৎ কিসের একটা স্পষ্ট শব্দে চকিতে পিছন ফিরে অন্ধকার সিঁড়ির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কে-কে ওখানে?

সিঁড়ির মুখে স্তুপীকৃত অন্ধকারের মধ্যে একটা অস্পষ্ট ছায়া যেন নড়ে ওঠে।

বিনয় ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।-কে ওখানে? বলতে বলতে এগিযে যায় বিনয়। সুজাতাও উঠে দাঁড়ায় কৌতূহলে, উতেজনায়।

আজ্ঞে আমি মনোহর দাদাবাবু–দ্বিধাজড়িত স্বলিত কণ্ঠে অন্ধকার হতে জবাবটা এল।

কে, মনোহর! অন্ধকারে ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছ?

আজ্ঞে–

এদিকে এস।

বিনয়ের ডাকে মনোহর পায়ে পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।

কি করছিলে ওখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মনোহর? বিনয়ের মনের মধ্যে সন্দেহ থাকলেও কিন্তু কণ্ঠস্বরে সেটা প্রকাশ পায় না।

আজ্ঞে নীচে ছিলাম, যেন আপনারা ডাকছেন শুনে উপরে আসছিলাম–

কোনমতে ঢোক গিলে একটা জবাবদিহি দেবার চেষ্টা করে যেন মনোহর। বিনয়ের ওর কথাগুলো শুনে ও বলবার ভঙ্গি দেখে তাইই মনে হয়।

বিনয় মনোহরের কথা শুনতে শুনতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। কিন্তু মনোহরের মুখটা যেন পাথরে খোদাই করা। কোনরূপ বৈলক্ষণ্যই তাতে যেন নেই। বোকাবোকা নিরীহ সরলতা যেন সমস্ত মুখখানা বোপে রয়েছে। চোখের তারায়ও অনুৎসাহিত সরল দৃষ্টি।

কিন্তু আমরা তো কেউ তোমাকে ডাকিনি মনোহর!

আজ্ঞে আমার যেন মনে হল, উপরে থেকে আপনারা আমায় ডাকলেন

না ডাকিনি, তুমি নীচে যাও।

মনোহর আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে নিঃশব্দে নীচের সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হল।

ক্ৰমে মনোহরের পদশব্দ সিঁড়িতে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

নির্বক বিস্ময়ে সুজাতা এতক্ষণ সমস্ত ব্যাপারটা শুনছিল।

মনোহরের কৈফিয়ত শুনে সুজাতা স্পষ্টই বুঝেছিল মনোহর মিথ্যা বলছে, কারণ চারদিকে একটা স্তব্ধতা, তার মধ্যে তারা কেউ ডাকলে স্পষ্টই শোনা যেত। তাছাড়া উপরের ডাক নীচে পৌঁছনোর কথা নয়। তাই মনে হল তার, বিনয়ের কথার জবাবে সম্পূর্ণ সে মিথ্যা বানিয়ে একটা জবাব দিয়ে গেল। সুজাতা বললে দেখ আমার যেন মনে হচ্ছে, লোকটা আমাদের কথা শোনার জন্যই উপরে এসেছিল, ধরা পড়ে গিয়েছে।

বুঝতে পেরেছি বৈকি সেটা। বিনয় বলে।

বললে না কেন মুখের ওপরে লোকটাকে?

উঁহু। এতে করে একপক্ষে আমাদের ভালই হল। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হল। নাgन्म? যদি সত্যিই লোকটার মধ্যে সন্দেহের কিছু থাকে, তাহলে প্রথমতঃ মিথ্যা দিয়ে লোকটা জানিয়ে দিয়ে গেল সে কি চরিত্রের লোক! দ্বিতীয়তঃ ওকে যে অবিশ্বাস করলাম। এটা ওকে না জানিয়ে বুঝিয়ে দিলাম। ওকে আমরা সন্দেহ করিনি? তাতে করে যদি সত্যিই লোকটার মনে কোন দুরভিসন্ধি থাকে তো নিঃসন্দেহে ও ওর পথে এগিয়ে যাবে।

কিন্তু—

না, ভয় নেই সুজাতা, আমরা ওকে চিনলাম এবং ওর ওপরে নজরও রাখতে পারব এবার থেকে। যদি তেমন কিছু থাকে–

তাহলে এ ব্যাপারের পরেও ওকে এ বাড়িতে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে কি! বাবাকে—

উঁহু। চট্‌ করে ছাড়িয়ে কোন লাভ হবে তো নয়ই, বিবেচনার কাজও হবে না। আরো কিছুদিন ওর ওপরে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেখতে হবে সত্যিই ওর মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে কিনা। শুধু তাই নয়, বহুদিন ধরে এ-বাড়ির ‘কেয়ারটেকার’ হিসাবে এ ওখানে আছে, ওকে খুব বিবেচনার সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে হবে।

কিন্তু তোমার এ যুক্তি মানতে পারছি না বিনয়!

ব্যস্ত হয়ে না। এতদিনের একটা বিশ্বাসী লোককে হঠাৎ সন্দেহ করে তাকে অবিশ্বাস করাটাই বরং যুক্তির ব্যাপার হবে না। তোমার বাবাকেও এ সম্পর্কে কিছু বলে না আপাতত।

দেখ একটা কথা বলি, লোকটাকে আমার কেন যেন প্রথম থেকেই ভাল লাগেনি—

বিনয় হেসে সান্তুনা দেয়। ভয় নেই, আমি সতর্ক থাকব।

আহারাদির পর বিনয় নিজের নির্দিষ্ট ঘরে শয্যার ওপরে এসে যখন গা ঢেলে দিল, চিন্তার ঘূর্ণাবর্তটা মন থেকে সরে গেল না, অবিশ্রাম পাক খেয়ে খেয়ে ফিরতে লাগল চিন্তাটা।

অন্ধকার রাত্রি। চাঁদ উঠবে সেই রাতের শেষ প্রহরে। শিয়রের ধারে খোলা জানালাপথে এক টুকরো স্বপ্নের মতো রাতের কালো আকাশের একটা খণ্ডাংশ ও কয়েকটি অনুজ্জ্বল তারা চোখে পড়ে।

নীচের বাগানের অন্ধকারের স্রোত পার হয়ে একটানা একটা বিবির শব্দ কানে আসছে। নিযুতি রাতের একতারা যেন বেজেই চলেছে ঝি বির রবে।

মনোহরের ব্যবহারটা বিনয়কে কেবল বিস্মিত করেনি ভাবিতও করে তুলেছে। সুজাতার সন্দেহ মিথ্যা নয়, সত্যিই মনোহর সিঁড়ির মাথায় অন্ধকারেও আত্মগোপন করে ওদের কথাবার্তা শোনবারই চেষ্টা করকছিল।

কিন্তু কেন?

এ-বাড়িতে অনেকদিনের লোক ঐ মনোহর। পাকানো বাঁশের মত পেটানো মজবুত শরীর। শরীরের কোথাও এতটুকু খুঁত নেই নির্ভেজাল। বলতে গেলে বাড়ির মালিকের অনুপস্থিতিতে মনোহরই দীর্ঘদিন ধরে হয়ে ছিল এ-বাড়ির সর্বেসর্ব। বামদেব ক্কচিত কালেভদ্রে এখানে এলেও এ-বাড়ি সম্পর্কে এতকাল তার কোনই আগ্রহ ছিল না। পিতৃপুরুষের নবাবী আমলের পুরাতন এই ভাঙা বাড়িটার ওপরে তার কোনরূপ আকর্ষণই ছিল না। এবং এ-বাড়ি এইভাবেই হয়ত পড়ে থাকত, যদি আচমকা গুজরাটী ব্যবসাদার রানা এই বাড়ি কেনবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করত।

কিন্তু হঠাৎ রানাই বা এ-বাড়িটা কেনবার জন্য এত আগ্রাহন্বিত হয়ে উঠল। কেন?

খাগড়াই বাসনের ফ্যাক্টরি খুলবে স্রেফ একটা বাজে কথা। এ-বাড়ি কেনবার পিছনে আসল উদ্দেশ্য যে তার অন্য, সেটা বুঝতে বিনয়ের অন্তত কষ্ট হয়নি।

বাড়িটা সে কিনতে ইচ্ছুকই শুধু নয়, বিশেষভাবেই ইচ্ছুক। উদ্দেশ্যটাই বা কি?

বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে নিশ্চয়ই। নচেৎ বাড়ির মূল্য বাবদ এই ভাঙা সেকেলে একটা বাড়ির পিছনে নিছক খেয়ালের বশে আজকালকার দিনে কেউই অতগুলো টাকা ঢালতে এগিয়ে আসবে না। বিশেষ করে রানার মত একজন ঝানু ব্যবসাদার। যারা প্রতি টাকার পিছনে অঙ্ক কষে লাভটা বুঝে চলে এবং শুধু রানাই নয়, আরো একজন খরিদ্দার এগিয়ে এসেছে বাড়িটার জন্য।

এতএব এর পশ্চাতে একটা যে রহস্য আছে সেটা বঝুতে কষ্ট হয় না।

সেদিন রাত্রে কিরীটীর সঙ্গে কথা বলেও সেই রকমই মনে হয়েছে বিনয়ের।

একটু তন্দ্ৰামতও যদি আসত! চোখের পাতা থেকে ঘুম যেন আজ একেবারে লোপ পেয়েছে।

সত্যি, আজ রাতে ঘুম আসবেই না নাকি! মাথার বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে হাতঘড়িটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরল। বিনয়।

অন্ধকারে রেডিয়াম ডায়ালের সময়-সঙ্কেতের অক্ষরগুলো জোনাকির আলোর মত জ্বলজ্বল করছে।

আশ্চর্য, রাত দশটা বেজে দশ মিনিট মাত্ৰ!

শয্যা হতে উঠে পড়ল বিনয়। চোখেমুখে একটু জল দিলে। যদি ঘুম আসে!

ঘরের কোণে মাটির সরাইয়ে ঠাণ্ডা জল ছিল, সেই জল হাতে ঢেলে বেশ করে চোখে মুখে ঘাড়ে ঝাপটা দিয়ে ভিজিয়ে দিল।

রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি যেন অনেকটা প্রশমিত হয়।

এগিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বিনয় শিয়রের ধারে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়ায়।

রাক্রির ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া সিক্ত চোখেমুখে একটা স্নিগ্ধ পরশ দেয়।

নীচের বাগানে অন্ধকারে গাছপালাগুলো এখানে ওখানে খণ্ড খণ্ড ভাবে যেন স্তুপ বেঁধে আছে।

অন্ধকার যেন জায়গায় জায়গায় একটু বেশী ঘন হয়ে উঠেছে। একটু বেশী স্পষ্ট।

এই বাগান অতিক্রম করেই নাটমন্দির এবং তার পশ্চাতে সেই মজা দিঘিটা।

অন্যমনস্ক বিনয় সিগারেটটায় মৃদু টান দিচ্ছিল, সামনের অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৰ্ষিত হয়। অনেক দূরে গাঢ় অন্ধকারের বুকে হঠাৎ একটা রক্তচক্ষুর মত লাল আলো দেখা যাচ্ছে যেন। আলোটা মাটি থেকে হাত-চার-পাঁচ উপরেই হবে বলে মনে হচ্ছে। বিস্মত বিনয় একদৃষ্টি লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ তার মনে হল, আলোটা এদিক ওদিক দুলছে না! হ্যাঁ, তাই তো। দুলছেই বটে। জমাট-বাঁধা গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একটা রক্তপদ্ম যেন ঢেউয়ে ঢউয়ে এদিক-ওদিক দুলছে। দু মিনিট সময় প্রায় লাল আলোটা শূন্যে অন্ধকারের মধ্যে এদিক-ওদিক দুলে দপ করে একসময় আবার নিভে গেল।

কয়েকটা মুহুর্ত বিনয় বোবা বিস্ময়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ইতিমধ্যে জ্বলন্ত সিগারেটটায় পুড়ে পুড়ে নিঃশেষিতপ্রায় হয়ে তর্জনী ও মধ্যমার বন্ধনীকে প্রায় স্পর্শ করে। তর্জনী ও মধ্যমায় একটা তাপ অনুভূত হয়।

হঠাৎ চমকে উঠে নিঃশেষিতপ্রায় দগ্ধ সিগারেটের শেষ জ্বলন্ত প্রান্তটুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে ঘষে নিভিয়ে দিল বিনয়।

দূরে হলেও লাল আলোটা নীচের বাগানের দক্ষিণ প্রান্ত থেকেই দেখা গিয়েছিল। দক্ষিণ প্রান্তে প্রাচীর। প্রায় একমানুষ সমান উঁচু প্রাচীর। আজই তো দ্বিপ্রহরে বিনয় ঘুরে ঘুরে দেখেছে ওখানে যাতায়াতের কোন পথ নেই।

শেষ সীমানায় প্রাচীর।

মন স্থির করে ফেলে বিনয় এবার আর কালক্ষেপ করে না।

বালিশের তলা থেকে পাঁচ-সেলের হান্টিং টর্চটা হাতে নিয়ে গায়ে একটা শার্ট চড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল বিনয়।

নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে চলে এল। নীচের সদর দরজাটা হ্যাঁ হ্যাঁ করছেখোলা, নজরে পড়ল তার। কোন কিছু ভাববার সময় আর নেই তখন। খোলা দরজাপথেই বের হয়ে গেল বিনয়। দ্রুতপায়ে ঘুরে বাড়ির পশ্চাতে বাগানে এল। অনুমানে যেদিকটা হতে অন্ধকারে লাল আলোটা ক্ষণপূর্বে দেখা গিয়েছিল সেই দিকেই অগ্রসর হল সন্তৰ্পণে।

বিশেষ সাবধানতার সঙ্গে মধ্যে মধ্যে হস্তধৃত টর্চের আলোর সাহায্যে এদিক-ওদিক খর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল বিনয়।

হঠাৎ মাটির আগাছার ওপরে একটা বস্তু ওর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। একটি বর্ম চুরুটের জ্বলন্ত শেষাংশটুকু।

একটা সূক্ষ্ম ধোঁয়ার রেখা জ্বলন্ত চুরুটের প্রায়-ভস্মাবশেষ থেকে তখনও সর্পিল গতিতে একেবেঁকে উপরের দিকে উঠছে এবং আশেপাশে দগ্ধ চুরুটের একটা উগ্র কটু গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তখনো।

তাহলে এখানে ক্ষণপূর্বে নিশ্চয়ই কেউ ছিল। ঐ জ্বলন্ত চুরুটের শেষাংশটুকুই তার অবিসংবাদিত প্রমান। কেউ ছিল এখানে এবং যে ছিল সে চুরুট-সেবনে অভ্যস্ত।

পোড়া চুরুটের জ্বলন্ত শেষাংশ মাটিতে ঘষে নিভিয়ে পকেটে ভরে নিয়ে বিনয় আবার এগিয়ে চলে। কিন্ত আর কিছুই চোখে পড়ে না।

অন্ধকারে ঘুরতে ঘুরতে অন্যমনা হয়ে অবশেষে বিনয় একসময় একটা জায়গায় এসে পড়ে যার আশেপাশে বেশ গভীর জঙ্গল। খেয়াল হতে আর পথ চিনে উঠতে পারে না বিনয়। সর্বনাশ! এ কোথায় ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল সে? যেদিকে পা বাড়াতে যায় আগাছা ও কাঁটাঝোপে বাধা পড়ে। এগুতে পারে না। এত ঘন কাঁটাজঙ্গল যে তার মধ্যে দিয়ে পথ করে নেওয়াই দুঃসাধ্য। বুনো লতায় পা জড়িয়ে জড়িয়ে ধরেছে। ক্লেদাক্ত সরীসৃপের মত।

বিনয় যেন গলদঘর্ম হয়ে ওঠে। এ কি ফ্যাসাদেই পড়ল সে!

এ কি গোলকধাঁধা? কোথায় নির্গমনের পথ? মাথা তুলে চারিদিকে তাকিয়ে রত্নমঞ্জিলেরও হদিস পায় না। ঘন আগাছা ও বুনো গাছপালায় দৃষ্টি ব্যাহত হয়।

হঠাৎ একটা সুমিষ্ট মেয়েলী হাসির খিলখিল শব্দে চমকে ওঠে। হাসির রেশটা অন্ধকারের বুকে একটা শব্দতরঙ্গ তুলে গেল যেন।

বিস্মিত হতচকিত বিনয় এদিক-ওদিক তাকায় অন্ধকার। কে? কে হাসলে আমন করে? কে?

আবার সেই মিষ্টি খিলখিল হাসির তরঙ্গ বয়ে গেল।

কে—কে হাসছ? চিৎকার করে বলে বিনয় যেন মরণীয়া হয়ে, কিন্তু চিৎকার করলেও শব্দটা যেন গলা দিয়ে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় না।

প্রত্যুত্তরে আবার সেই হাসি শোনা যায়।

কে? কে? আমি। মেয়েলী কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এল এবারে।

তুমি কে?

আমি রাত্রি।

রাত্ৰি!

হ্যাঁ, পথ হারিয়ে ফেলেছেন তো?

বিনয়ের মনে হয় যেন খুব কাছ থেকেই কণ্ঠস্বর ভেসে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়েও কিন্তু বিনয় কাউকে দেখতে পেলে না।

কোথায় তুমি?

কাছেই আছি। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তো! থাকুন। এখন বাকি রাতটুকু, পথ খুঁজে পাবেন না। মাথা খুঁড়ে মরলেও না।-কৌতুকে যেন উচ্ছসিত কণ্ঠ।

পথ খুঁজে পাব না! না। পথ জানলে তো পথ খুঁজে পাবেন। শুধু জঙ্গলই নয়, এটা হচ্ছে মা মনসার স্থান। ভীষণ সাপ ওই জায়গাটায়।

সাপ!

হ্যাঁ। আর বেশীক্ষণ পথ খুঁজতে হবে না, ওরা এলো বলে।

কারা?

কালসাপ সব। মা-মনসার চেলারা!

তুমিও তো আছে!

আমাকে ওরা চেনে, আমায় ছোবল দেবে না।

বিনয় অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মেয়েটির কণ্ঠস্বরও আর শোনা যায় না!

একসময় বিনয়ই আবার প্রশ্ন করে, আছ না চলে গেলে?

যাইনি, আছি। কিন্তু কেন বলুন তো? জবাব এল।

আমাকে একটু পথটা দেখিয়ে দাও না!

বা রে আব্দার! আমি পথ দেখাতে যাব কেন?

পথটা খুঁজে পাচ্ছি না যে

উঁহু। দেবো না।

দেবে না?

না ঠিক আছে, একটা শর্তে পথ দেখিয়ে দিতে পারি—

কি শর্তে?

রত্নমঞ্জিল ছেড়ে চলে যাবে বল! কথা দাও, তাহলেই পথ দেখিয়ে দেবো! রাজী আছ। আমার ঐ শর্তে?

না।

তবে থাকো। ভাবিছ দিনের বেলায় পথ খুঁজে পাবে! তা হচ্ছে না, তার আগেই তোমার মৃতদেহ রাণীদিঘির পাঁকের তলায় পুঁতে ফেলবে।

কে-কে পুঁতে ফেলবে?

কেন, দুর্বাসা মুনি!

দুর্বাসা মুনি? সে আবার কে?

এসে যখন ঘাড় টিপে ধরবে তখনই জানতে পারবে দুর্বস মুনি কে! তার চাইতে যাও না। কলকাতায় ফিরে। কেন মিথ্যে প্রাণ দেবে!

প্রাণের ভয় আমি করি না।

প্রাণের ভয় করো না!

না!

আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। কোন পক্ষেরই কোন সাড়া নেই। হঠাৎ আবার মেয়েটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এবারে একেবারে পাশে, এস, আমার হাত ধর।

আশ্চর্য!

নারীমূর্তি। প্রসারিত হাত।

হাত ধর! গুণ্ঠনবতী নারী আবার আহ্বান জানাল।

সে যেন হঠাৎ মাটি খুঁড়ে উঠেছে একটা চকিত বিস্ময়ের মত।

চল। আর দেরি করো না, টের পেলে বিপদে পড়বে।

মন্ত্রমুগ্ধের মত বিনয় হাতটি তার বাড়িয়ে দিল। একটি কোমল হাত তার মণিবন্ধ চেপে ধরল। স্পর্শ তো নয়, একটা পুলক-কোমল শিহরণ! রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শিকার এই পথ যে অত্যন্ত সুপরিচিত, চলতে চলতে বিনয় খুব ভাল ভাবেই সেটা বুঝতে পারছিল।

ফণীমনসা ও কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে অন্যথায় এই অন্ধকারে অক্লেশে সহজ গতিতে ঐভাবে কারো পক্ষেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

নিঃশব্দেই দুজনে অন্ধকারে কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছিল। এবং ঠিক ঐ মুহূর্তটিতে বিনয়ের সমস্ত মন জুড়ে একটিমাত্র স্পর্শের অনুভূতিই তার সমগ্র চেতনাকে যেন একটি মিষ্টি-স্নিগ্ধ সৌরভের মতই আমোদিত করে রেখেছিল, যে কোমল পেলাব মণিবন্ধটি সে পরম বিশ্বাসে ও আশ্বাসে নিবিড় করে ধরেছিল তারই স্পর্শটুকু।

মিনিট-পাঁচ-সাত ঐভাবে চলাবার পর হঠাৎ পথ-প্রদর্শিকা বলে উঠল, উঃ, হাতটা যে গেল আমার! কি শক্ত হাতের মুঠো আপনার!

লজ্জায় তাড়াতাড়ি বিনয় তার মুষ্টি ছেড়ে দিল। সত্যি, আমি দুঃখিত।

আচ্ছা এবার আমি বিদায় নোব। ঐ যে দেখুন সামনে রত্নমঞ্জিল। এবারে নিশ্চয়ই চিনে যেতে পারবেন!

বিনয় তাকিয়ে দেখল, এ সেই জায়গা উদ্যানের মধ্যে আজ রাত্রে যেখানে দোতলায় নিজের শোবার ঘরের জানালা থেকে সেই লাল আলোর নিশানা চোখে পড়েছিল। হ্যাঁ, এবারে সে চিনে রত্নমঞ্জিলে যেতে পারবে। পথ হারাবার ভয় নেই একটু এগিয়ে গেলেই সেই নাটমন্দির। তারপর তো সব তার চেনাই।

হ্যাঁ, পারব। ধন্যবাদ। আপনাকে-কথাটা বিনয়ের শেষ হল না, বিস্ময়ে তখন সে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছে।

আশেপাশে তার কোথাও সেই ক্ষণপূর্বের রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শিকা নেই। যাদুর মতই অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। তথাপি বৃথাই এদিক-ওদিক দু-চার পা অগ্রসর হয়ে অনুসন্ধিৎসু কণ্ঠে ডাকতে লাগল, কোথায় গেলেন? শুনছেন? কোথায় গেলেন?

কারো কোন সাড়া নেই। অকস্মাৎ সে স্বপ্নের মতই যেন মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। কেবল হাতের পাতায় ক্ষণপূর্বের সেই কোমল স্পর্শানুভূতিটুকু লেগে আছে অবশিষ্ট তখনো।

এদিকে রাতও প্রায় শেষ হয়ে এল।

রাত্রিশেষের হাওয়ায় কেমন একটা আলতো ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। আকাশের তারাগুলোও যেন সারাটা রাত জেগে থেকে এখন ঝিমিয়ে এসেছে। তাদের চোখেও বুঝি ঘুম লেগেছে।

বিনয় এক পা এক পা করে এগিয়ে চলল। সদর দরজাটা হাঁ-হাঁ করছে। খোলা।

নীচের এই সদর দরজাটা তো বন্ধ থাকার কথা। খোলা আছে কেন?

এখন মনে পড়লো, যাবার সময়ও দরজাটা এমনিই খোলা ছিল। দরজাটা বন্ধ করতে যাবে বিনয়, বাইরে কার মৃদু পদশব্দ পাওয়া গেল। থমকে দাঁড়াল সে?

মনোহর।

এত রাত্ৰে মনোহর বাড়ির বাইরে কোথায় গিয়েছিল?

মনোহর! ডাকে বিনয়।

মনোহরও বোধ হয় বিনয়কে দরজার গোড়ায় দেখবে প্রত্যাশা করেনি। ঐ সময়। বিনয়কে দরজার সামনে দেখে মনোহরাও থমকে দাঁড়িয়েছিল।

দাদাবাবু আপনি!

হ্যাঁ, কিন্ত তুমি! তুমি এত রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে মনোহর?

মনোহর তখন তার গায়ের চাদরের নীচে একটা কি যেন লুকোতে ব্যস্ত।

বিনয়ের সে ব্যাপারটা নজর এড়ায় না।

আজ্ঞে, এই একটু বাইরে গিয়েছিলাম।

কখন গিয়েছিলে?

এই তো কিছুক্ষণ আগে।

কিছুক্ষণ আগে মানে ঘণ্টা দু-তিন আগে বল?

আজ্ঞে না। এই তো মিনিট দশেক হবে।

কিন্তু এভাবে রাত্রে সদর খুলে রেখে গিয়েছিলে, যদি চোর-টোর ঢুকত!

মনোহর হেসে ফেলে, চোর। এখানে আসবে কোথা থেকে বাবু! মনোহর দাশের লাঠিকে ভয় করে না। এ তল্লাটে এমন কেউ নেই বাবু।

বিনয় বুঝতে পারে, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। দোতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। সিঁড়ি অতিক্রম করে নিজের নির্দিষ্ট কক্ষে এসে প্রবেশ করল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত প্রায় পৌনে-পাঁচটা। আর ঘুমোবার চেষ্টা করেও কোন লাভ নেই। একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বিনয় খোলা জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াল।

শেষরাতের হাওয়া বিরবির করে একটা স্নিগ্ধ পরশ দিচ্ছে। বার বার মনের মধ্যে এসে উদয় হচ্ছে ক্ষণপূর্বের সেই রহস্যময়ী কৌতুকপ্রিয় পথ-প্রদশিকার কথাই-কণ্ঠস্বরে ও সামান্য কিছুক্ষণের মৃদু কোমল একটি স্পর্শের মধ্যে দিয়ে যে তার অপূর্ব একটি ক্ষণ-পরিচয় মাত্র রেখে গিয়েছে।

সমগ্র ব্যাপারটা যেন এখনো বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। ঐ জঙ্গলের মধ্যে কোথা থেকে এলো ঐ মেয়েটি। আর সে জানলেই বা কি করে যে, বিনয় কাঁটাঝোপের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল! তবে কি আগে হতেই মেয়েটি তাকে অলক্ষ্যে থেকে অনুসরণ করছিল!

ওই জঙ্গলের মধ্যে সব কিছুই যেন মনে হলো মেয়েটির সবিশেষ পরিচিত।

মেয়েটি বলেছিল দুর্বাসা মুনির কথা। কে সে দুর্বাসা মুনি! মেয়েটি তাকেও ভয় করে। কিই বা সম্পর্ক দুর্বাসার সঙ্গে মেয়েটির!

সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল প্ৰায়। নিঃশেষিত-প্রায় সিগারেটটি জানলাপথে নীচে ফেলে দিয়ে বিনয় শয্যার উপরে এসে গা এলিয়ে দিল।

অজগরের চোখের সম্মোহনে যেমন শিকার সামনের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, ঠিক তেমনি করেই ছট্টুলাল এগিয়ে গিয়ে মাটিতেই বসে পড়লো।

হাত বাড়িয়ে লোকটা ঘরের কোণে প্ৰজ্বলিত প্রদীপের শিখাটা একটু উসকে দিল।

আলোর তাতে করে বিশেষ উনিশ-বিশ হল বলে মনে হয় না, তবে প্রদীপের সেই আলোয় এবার ছট্টুলাল যেন নিজের অজ্ঞাতেই লোকটার মুখের দিকে তাকাল। অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লোকটার চেহারা।

মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ। বয়েস হলেও লোকটার শরীরের বঁধুনি যেন এখনও অটুটাই আছে। পরিধানে একটা লাল রংয়ের কাপড়। খালি গা। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা। দেহের সমস্ত পেশী এখনও সজাগ ও স্পষ্ট। লোকটা দৈর্ঘ্যে প্রায় ছ। ফুটের কাছাকাছি হবে। চওড়া বক্ষপট। উন্নত সুদৃঢ় স্কন্ধ। কিন্তু চোখ দুটো হিংস্র জন্তুর মত যেন ঝকঝকে করে জ্বলছে দু খণ্ড জ্বলন্ত অঙ্গারের মত।

সে চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।

ছট্টুলাল দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে একবার তাকাল। ঘরের মধ্যে আসবাব বিশেষ কিছু নেই। এক কোণে একটা টিনের রং-ওঠা সুটকেস। একটা মলিন সতরঞ্চি জড়ানো বিছানা। একটা মাটির কুঁজে ও গোটা দুই অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস ও থালা।

হঠাৎ ছট্টুলাল পুনরায় লোকটার ভারী গলার প্রশ্নে চমকে উঠল, তোর নাম কি?

ছট্টুলাল যেন প্রশ্নটা শোনেনি এমনি ভাব দেখাবার চেষ্টা করল।

এই শুনছিস, তোর নাম কি?

আমার!

তোর নয় তো কি আমার?

আমার নাম গোবিন্দলাল।

মুহুর্তে হাত বাড়িয়ে বজ্রমুষ্টিতে ছট্টুলালের সামনেকার চুলের ঝুঁটি চেপে ধরে প্রবলভাবে দুটো ঝাঁকুনি দিল লোকটা।

সেই ঝাঁকুনির চোটে ছট্টুর মনে হল তার মাথাটাই বুঝি দেহ থেকে আলগা হয়ে এল। দু, চোখের তারায় যেন একরাশ সর্ষের ফুল ঝিকমিক করে উঠল।

ধাপ্পা দেওয়ার আর জায়গা পাসনি বেটা! তোর নাম আমি জানতে পারব না ভেবেছিস!

আমার নাম তো গোবিন্দলালই। তবু পুনরাবৃত্তি করে ছট্টুলাল।

নাম তোর আমি ঠিক জেনে নেব। রত্নমঞ্জিলের চারপাশে ক’দিন ধরে ঘুরঘুর করছিস কেন বল!

ঘুরঘুর তো আমি করিনি।

ফের মিথ্যে কথা!

আর একটা ধমক দিয়ে ওঠে লোকটা।

মিথ্যে কথা বলব কেন?

মিথ্যে কথা বলবি কেন! হুঁ, তোর চেহারা দেখেই মালুম হচ্ছে তুই জীবনে কটা সত্যি বলেছিস! শোন, সত্যি কথা বলিস তো তোকে ছেড়ে দেব। আর যদি মিথ্যে ধাপ্পা দেবার চেষ্টা করিস, খুন করে তোকে রত্নমঞ্জিলের ঐ রাণীদিঘির পাঁকের তলে পুতে রাখব। বল এখনো সত্যি কথা!

ছট্টুলাল সত্যি এবারে রীতিমতই ভাবিত হয়ে ওঠে।

লোকটার চেহারা ও কথাবার্ততেই মালুম হচ্ছে লোকটা মোটেই সুবিধার নয়।

মুখে যা বলছে কাজে করতেও হয়ত ওর বাধবে না। কিন্তু ছট্টুলালও জাত সাপ। যার কাজের ভার নিয়ে ছট্টুলাল এখানে এসেছে সেই রতনলাল রানাও খুব সহজ ব্যক্তি নয়।

তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে সেও ছেড়ে কথা বলবে না। বিশেষ করে তার অনুচর পিয়ারী একেবারে সাক্ষাৎ শয়তান বললেও অত্যুক্তি হবে না। পিয়ারীর অসাধ্য কিছুই নেই।

রতনলালের সামান্য ইঙ্গিতেই তার হাতের গুপ্ত ছোরা ঝিকমিকিয়ে উঠবে এবং নির্ভুলভাবেই ছট্টুর কলিজাটা ফাঁসিয়ে দেবে।

জলে বাঘ, ডাঙায় কুমীর।

তাছাড়া রতনলালকে এই জব্বর খবরটা দিতে পারলে মোটামত কিছু বকশিশও মিলত। তা সেও তো এখন সুদূরপরাহত। এই দুশমনটার হাত থেকে আপাততঃ কোন মুক্তির পথও ছট্টু ভেবেই পাচ্ছে না। চকিতে একটার পর একটা চিন্তাগুলো ছট্টুর মাথার মধ্যে খেলে যায়।

কিন্তু রতনলালের কথা পরে ভাবলেও চলবে, আপাততঃ এই দিকটা সামলতে হবে।

কিন্তু ছট্টুলাল ভেবে পাচ্ছে না, ঠিক কোন পথে এগুলে বর্তমানের এই সঙ্কটকে সে কাটিয়ে উঠতে পারে।

শক্তির প্রথম পরিচয়েই ছট্টুলাল বুঝতে পেরেছে, গায়ের শক্তিতে এই লোকটার সঙ্গে ছট্টু পেরে উঠবে না।

কি রে, জবাব দিচ্ছিস না কেন?

ছট্টুলাল জবাব দেবে কি, তখনও ভাবছে। সে চুপ করেই থাকে। লোকটাও বুঝতে পারে সহজে ছট্টুর মুখ থেকে জবাব বের করা যাবে না।

সেও এতক্ষণে মনে মনে অন্য উপায়ই ভাবছিল। ঘরের কোণে একটা মোটা দড়ি পড়ে ছিল, উঠে গিয়ে সেই দড়িটা যেমন লোকটা আনতে যাবে ছট্টু দেখল। এই সুযোগ, চক্ষের পলকে সে দাঁড়িয়ে উঠেই এক লাফে ঘরের বাইরে চলে এল এবং অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুট দিল।

অন্ধকারে কাঁটাঝোপে শরীর ও হাত-পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে লাগল ছট্টুর, কিছুতেই খেয়াল নেই। যেমন করে হোক পালাতে হবে। সে প্রাণ-পণে ছুটতে লাগল।

ঘরের মধ্যে সেই দাড়িগোঁফওয়ালা লোকটা কল্পনাও করতে পারেনি যে ছট্টু হঠাৎ উঠে পালাতে সাহস পাবে।

ছট্টু হঠাৎ উঠে লাফিয়ে ঘরের বাইরে যেতে সেই লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ঘরের বাইরে এল, কিন্তু অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারল না কোন দিকে ছট্টু ছুটে পালিয়েছে।

তথাপি আন্দাজের উপর নির্ভর করে কিছুদূর এগিয়ে গেল, কিন্তু পলাতক ছট্টুর সন্ধান করতে পারলে না। অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে।

ঐ ঘটনার দিন-দুই বাদে সন্ধ্যার দিকে রতনলালের অফিসে আবার ছট্টুলালকে দেখা গেল। রতনলাল চেয়ারে বসে, থমথম করছে তার মুখটা। সামনে দাঁডিয়ে ছট্টুলাল।

রতনলালের পাশেই অন্য একটা চেয়ারে উপবিষ্ট পিয়ারী নিঃশব্দে একটা সিগারেট টেনে চলেছে। হাতে ধরা একটা মার্কোভিচের টিন।

ছট্টুর মুখে সবই শুনেছে রতনলাল। বামদেব বিনয় প্রভৃতির রত্নমঞ্জিলে যাওয়াটার মধ্যে রতনলাল তেমন বেশী গুরুত্ব দেয়নি। চিন্তিত বিশেষভাবেই হয়ে উঠেছে সে কোন এক তৃতীয় দাড়িগোঁফওয়ালা শক্তিশালী লোকের সংবাদটা পেয়ে।

লোকটা কে? কেনই বা সেখানে গিয়ে আডিডা নিয়েছে? ঐ লোকটাও কি তবে ঐ রত্নমঞ্জিলের আশা নিয়েই ওখানে গিয়ে আড্ডা নিয়েছে, না ঐ লোকটাই সেই দুনম্বর পার্টি যে বেশী টাকার লোভ দেখিয়ে তার হাত থেকে রত্নমঞ্জিল ছিনিয়ে নিতে চায়!

পিয়ারীর দিকে তাকাল রতনলাল। পিয়ারী বুঝতে পারে রতনলাল তার সঙ্গে একটা কিছু পরামর্শ করেতে চায়। গুজরাটি বুদ্ধিতে আর কুলোচ্ছে না।

পিয়ারী ছট্টুর দিকে তাকিয়ে বললে, আচ্ছা ছট্টু তুই এখন যা। কাল এই সময় একবার দেখা করিস।

ছট্টু সেলাম দিল, যাচ্ছি। কিন্তু বহরমপুরে আর যেতে পারব না। শালা একেবারে সাক্ষৎ দুশমন।

ছট্টু চলে গেল।

কিছুক্ষণ অতঃপর দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। কারো মুখেই কোন কথা নেই।

রতনলালই প্রথমে স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, পিয়ারী, তোমার কি মনে হচ্ছে?

দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও। ক্রমেই সব জটিল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে?

যত জটিলই হোক—একটা কথা, যেমন করে যে উপায়ে হোক আমার কিন্তু পিয়ারী ঐ রত্নমঞ্জিল চাই-ই। শালা জান কবুল। তবু ঐ রত্নমঞ্জিল আমি কাউকে নিতে দেব না।

তা যেন হল, কিন্তু মাঝখান থেকে ঐ বেটা দাড়ি কোথা থেকে এল। তাই তো ভাবছি।

চল না পিয়ারী, একবার বহরমপুর ঘুরে আসা যাক।

উঁহু। সেখানে গিয়ে ভিড় করে কোন লাভ হবে না। তার চাইতে আমি বলি কি, এ গোলমালে কাজ কি বাবা! দাও না বাড়িটা ছেড়ে।

ছেড়ে দেব! কভি না। বললাম তো জান কবুল, শেষ পর্যন্ত দেখব।

শোন রতনলাল, এসব ব্যাপারে জলের মত টাকা খরচ করতে হবে। পারবে? রাজী আছ?

নিশ্চয়ই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িটা উদ্ধার করে যদি দেখা যায়, ওসব গুপ্তধন-টন স্রেফ সব ধাপ্পা, কিছুই নেই, তখন সে টাকার শোক সামলাতে পারবে তো বন্ধু!

মরদবাচ্চা আমি। টাকা বহু কামিয়েছি। জীবনে পিয়ারী—এক দু লাখ যদিই যায় তো পরোয়া করি না। মোদা কথা রত্নমঞ্জিল আমার চাই–

ঠিক?

ঠিক। রানা সজোরে টেবিলের উপরে একটা ঘুষি বসাল।

হুঁ, তাহলে শোন রানা। এসব ব্যাপারে টাকা তো খরচ করতেই হবে, কৌশলেরও দরকার, ওসব ছট্টুলালদের দ্বারা হবে না। আমি নিজে যাব বহরমপুর। সেখানে গিয়ে আগে সব ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে দেখি, তারপর—

কবে যাবে?

যত তাড়াতাড়ি পারি যাব। কিছু টাকা দাও।

টেবিলের টানা চাবি দিয়ে খুলে একমুঠো নোট বের করে পিয়ারীর সামনে রাখলে রানা। একান্ত নির্বিকারভাবেই পিয়ারী নোটগুলো নিয়ে পকেটে রাখল।

পিয়ারী রানার বহুদিনকার পরিচিত।

পিয়ারীর ক্ষমতার উপরেও রানার যথেষ্ট আস্থা আছে।

যুদ্ধের সময়ে ব্যবসার একটা অংশ যখন চোরাপথে বাঁকাভাবে চলছিল, সেই বাঁকাপথেই পিয়ারীর সঙ্গে আলাপ হয় রতনলাল রানার এবং সেই আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।

পিয়ারীর পদবী কি এবং কোথায় তার দেশ, কি তার জাত, কি মাতৃভাষা—কেউ কোনদিন জানতে পারেনি।

উর্দু, হিন্দি, বাংলা ও ইংরাজী চার-চারটে ভাষায় পিয়ারী এত সহজভাবে কথাবার্তা চালাতে পারে যে ওর মধ্যে কোনটা তার মাতৃভাষা বোঝাই দুষ্কর।

অত্যন্ত ঢ্যাঙ, রোগ। পরিধানে কখনো থাকে দামী সুট। প্রত্যেকটা ক্রিজ তার স্পষ্ট। আবার কখনো থাকে পায়জামা-পাঞ্জাবি, সেরওয়ানি অথবা ধূতি-পাঞ্জাবি ও তার উপরে জহরকেট। হাতে সর্বদা একটি মার্কোভিচের টিন ও সিগারেট-লাইটার।

কথাবার্তা বলে খুব কম। এমন একটা কঠিন গাম্ভীর্যের আবরণ দিয়ে সর্বদা নিজেকে আবৃত রাখে। যে আপনা হতেই তাকে যেন এড়িয়ে চলবার ইচ্ছা হয় সকলের।

পিয়ারী বা মিঃ পিয়ারী নামেই সে সর্বত্র পরিচিত।

পিয়ারীকে বিশ্বাস করবার রতনলালের কারণও ছিল, যেহেতু দু-তিনবার অত্যন্ত দুরূহ জটিল ব্যাপারে পিয়ারী তাকে উদ্ধার করে দিয়েছে।

তবে পিয়ারীর পলিসি হচ্ছে ফেল কড়ি মাখ তেল!

সেই পিয়ারী যখন স্বেচ্ছায় রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারটা নিজহাতে তুলে নিল, রতনলাল সত্যিই অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করল।

অর্থব্যয় হবে ঠিক, কিন্ত যাহোক একটা ফয়সালা পিয়ারী করে দেবেই শেষ পর্যন্ত একটা কিছু।

রতনলালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পিয়ারী তার অফিস-কামরা হতে বের হয়ে এল। সিঁড়ির সামনে এসে তার সর্বোচ্চ ধাপের ওপরে দাঁড়িয়ে হাতের টিন থেকে একটা সিগারেট বের করল।

ওষ্ঠ্যপ্রান্তে সিগারেটটা চেপে ধরে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। লাইটারের সাহায্যে। তারপর ধীরমন্থর পদে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।

এতদিন রানার রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারটা তার মাথার মধ্যে ভাল করে থিতোয়নি।

রানার মুখে দু-চারবার শুনেছে মাত্র। অবশ্য রত্নমঞ্জিলের মোটামুটি ইতিহাস তার অজ্ঞাত না।

রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে এতদিন সে বেশী মাথা ঘামায়নি, কারণ ওই ব্যাপারে তার এতদিন ততটা ইন্টারেস্ট ছিল না। কিন্তু এবারে তাকে ভাবতেই হবে।

রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারে খণ্ড খণ্ড ভাবে এতদিন যা সে শুনেছে এখন সেগুলো সব একত্রে গ্রথিত করে অখণ্ডভাবে চিন্তা করবার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে। সে সব কিছু একত্রে দেখলে দাঁড়াচ্ছে, যে কোন কারণেই হোক। ঐ পুরনো বাড়ি রত্নমঞ্জিলের একটা সিক্রেট বা রহস্য আছে। এবং সেই কারণেই রতনলাল ছাড়াও রত্নমঞ্জিলের দ্বিতীয় খরিদ্দার মাথা তুলেছে।

এই দ্বিতীয় খরিদ্দারটি কে?

তবে এও ঠিক লোকটা যে সম্পদশালী তা বোঝাই যাচ্ছে, নচেৎ রানার সঙ্গে টেক্কা দেবার সাহস হত না। এই হচ্ছে প্রথম কথা।

দ্বিতীয়তঃ বামদেব অধিকারী হঠাৎ ব্যবহমপুরে গেলেন কেন?

তৃতীয়তঃ শ্ৰীমান দাড়িটি কে?

একটা দিন ও রাত পুরো নিজের মনে মনে চিন্তা করল। পিয়ারী এবং নিজের কার্যপদ্ধতিও ছকে ফেলল একটা।

সুজাতা বা বামদেব কাউকেই ঘুণাক্ষরেও সেরাত্রের অভিযানের কথা বিনয় ইচ্ছা করেই জানাল না এবং তারপর পর পর দুটো দিন সারাটা দুপুর বিনয় একা একা বাড়ির পিছনে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াল।

কিন্তু সেরাত্রের সেই কাঁটাঝোপের কোন হদিসই পেল না। কোথায় গিয়ে যে সে পথ হারিয়েছিল বুঝতেই পারল না। জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা অগ্রসর হবার পর ফণীমনসা ও নানা জাতীয় বন্যগুল্ম কাঁটাঝোপ এমন দুর্ভেদ্য প্রাচীর তুলে দাড়িয়ে আছে যে তার মধ্যেই প্রবেশ করা একপ্রকার দুঃসাধ্য।

শুধু তাই নয়, রত্নমঞ্জিলের একটা ভগ্নাংশ যেটা গত ভূমিকম্পের সময় ধ্বসে গিয়েছিল, সেটাও ঐ জঙ্গলের মধ্যেই যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ভগ্ন দালান ও জঙ্গল দুটোতে মিলে জায়গাটা অগম্য ভয়াবহ করে রেখেছে। যত বিষধর সাপের আডিডা সেখানে এখন।

যাই হোক বার বার ব্যর্থ হলেও বিনয় দমল না। অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে এল। পরের দিন কলকাতায় গিয়ে। তারপর ঐ জঙ্গল ও ভগ্ন ধ্বংসাবশেষ দালানের আশেপাশে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যেমন করে যে উপায়েই হোক সেই রাত্রের রহস্যময়ী নারীকে খুঁজে বের করতেই হবে।

সেই মজা জঙ্গলাকীর্ণ দিঘিটার আশেপাশেও কম ঘোরাঘুরি করেনি বিনয়। সেই দাড়িগোফ শোভিত মুখখানার দেখাও আর মেলেনি যেমন তেমনি মেলেনি সেই তেমনি দেখা রহস্যময়ীর।

এদিকে দিনসাতেক হয়ে গেল কিরীটী রায়ের দেখা মিলল না।

এমনি করে আরো দুটো দিন কেটে গেল।

সেদিন সকালে সবে দোতলার বারান্দায় চায়ের আডডাটা জমে উঠেছে, এমন সময় মনোহর এসে বললে কে একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান কর্তবাবুর সঙ্গে। বিশেষ জরুরী প্রয়োজন, ভদ্রলোক নাকি কলকাতা থেকে আসছেন।

বামদেব বিস্মিত হলেন। কলকাতা থেকে এত দূরে কে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল!

বললেন, যা, উপরেই পাঠিয়ে দে।

মনোহর চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল।

আর কেউ নয়। আগন্তুক স্বয়ং পিয়ারী।

পরিধানে দামী মুগার সুট। মাথার চুল থেকে পায়ের দামী গ্লেসকীডের জুতোটি পর্যন্ত চকচকে ঝকঝকে পালিস করা হাতে মার্কোভিচের টিন।

মুখে একটা আলগোছে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট।

যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে আপনিই-বোধ হয় মিঃ অধিকারী?

হ্যাঁ আপনি?

গুড মর্নিং!

গুড মর্নিং! স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন বামদেব পিয়ারীকে, যদিচ তাকে চিনতে পারলেন না।

বামদেব যে পিয়ারীকে চিনতে পারবেন না সে তো জানা কথাই, কারণ ইতিপূর্বে কখনো তো তাকে তিনি দেখেননি।

বিনা আহ্বানেই একটা খালি চেয়ার টেনে বসতে বসতে পিয়ারী বললে, আমি আপনার পরিচিত নই। মিঃ অধিকারী, আপনি আমাকে তাই চিনতে পারছেন না।

না–

আমি আসছি। কলকাতা থেকে বিশেষ একটা কাজে আপনার কাছে। আমার নাম পিয়ারীলাল দেশমুখ। পিয়ারী বলেই লোকে আমায় জানে।

কিন্তু কাজটা কি বলুল তো?

এই রত্নমঞ্জিল আপনার কাছ থেকে আমি কিনতে চাই।

বামদেব সত্যিই এবারে চমকে উঠলেন।

আবার রত্নমঞ্চিলের নতুন ক্ৰেতা!

বিনয়ও বিস্মিত দৃষ্টি তুলে নতুন করে আবার পিয়ারীর দিকে তাকাল। আবার একজন ক্ৰেতা!

কিন্তু বাড়ি তো ইতিপূর্বেই বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে মিঃ পিয়ারী! বললেন বামদেব।

মৃদু হাসলে পিয়ারী।

বায়না নেওয়া হয়ে গেছে? তা যাক না!

কি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি। বায়না আমন হয়ই। নাকচ করতে কতক্ষণ লাগবে মশাই!

বিনয়ও অবাক হয়েছে যেন কথাটা শুনে।

নাকচ করব?

হ্যাঁ, সব সংবাদই আমি নিয়ে এসেছি। পঞ্চান্ন হাজার টাকা দর হয়েছে তো। আশি হাজার টাকা দাম আপনাকে আমি দেব। ঐ সঙ্গে বায়নার টাকাও দেব। বলুন, isn’t a fair offer! বক্তব্যের শেষে বিশেষ করে ঐ শেষ কটি কথার ওপর জোর দিয়ে পিয়ারী বামদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের অর্ধনিঃশেষিত জ্বলন্ত সিগারেটটা তর্জনী মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সাহায্যে বারান্দার বাইরে নিক্ষেপ করে টিন হতে আর একটি সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করল।

বামদেব ভাবছিলেন, পঞ্চান্ন হাজার থেকে একেবারে আশি হাজার!

লোভনীয় টোপ বটে নিঃসন্দেহে।

ভেবে দেখুন। মিঃ অধিকারী, আপনি যদি আমার terms-এ agree করেন তো এখুনি বায়না, বাবদ ষাট হাজার আমি অগ্রিম দিতে প্রস্তুত। বলতে বলতে পিয়ারী আলতোভাবে ধীরে ধীরে মুখের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।

টাকাটা যেন পিয়ারীর কাছে কিছুই নয়।

বামদেব নিশ্চুপ।

পিয়ারীই আবার কথা বলে, আমি অত্যন্ত সোজা এবং এক কথার মানুষ। বিজনেস যা করি। তার মধ্যেও গোলমাল রাখতে ভালবাসি না।

পার্শ্বে উপবিষ্ট বিনয় বুঝতে পেরেছিল বামদেবের কোথায় দ্বিধা হচ্ছে। লোভনীয় টাকার পরিমাণে শুধু বামদেব কেন, যে কোন মানুষের পক্ষেই এক্ষেত্রে লোভ সামলানো দুষ্কর।

বিশেষ করে এই জীর্ণ বাড়িটার—যার ন্যায্য দাম পচিশ-ত্রিশ হাজারের কখনই বেশী হতেই পারে না। সেক্ষেত্রে আশি হাজার টাকা একটা স্বপ্নাতীত ব্যাপার। শুধু তাই নয়, এ বাড়ির দাম আশি হাজার দিতে যে উদ্যত তার কাছ হতে এক লক্ষ টাকা পাওয়াও দুঃসাধ্য হবে না।

তাছাড়া আশি হাজার টাকা যখন বাড়িটার দাম উঠেছে, এর আসল মূল্যও নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশীই হবে। নচেৎ এই জীর্ণ একটা বাড়ির জন্য কোন পাগলও এত টাকা দিতে যেত না।

কিন্তু মিঃ পিয়ারী, তা তো হবার নয়! পরিষ্কার কণ্ঠে এবারে বিনয়ই জবাব দিল।

বিনয়ের কথা শুনে বঙ্কিম দৃষ্টিতে তাকাল পিয়ারী এবারে বিনয়ের মুখের দিকে।

আপনি?

আমার আত্মীয়। জবাব দিলেন বামদেব।

ওঃ, কিন্তু কেন সম্ভব নয় বলুন তো?

শুনলেন তো একটু আগেই মেসোমশাইয়ের কাছে, এ বাড়ি বিক্রয়ের জন্য বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে।

বললাম তো সে আর এমন একটা কঠিন ব্যাপার কি! ছেড়ে দিন না ব্যাপারটা আমার হাতেই, আমিই সব settle করে নেব। বাকি যা সামলাবার আমিই সামলাব।

না, তা আর হয় না মিঃ পিয়ারী। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, ক্ষমা করবেন। জবাব দিল আবার বিনয়ই।

অতঃপর পিয়ারী নিঃশব্দে কিছুক্ষণ ধুমপান করে।

তাহলে আমার অফারটা আপনারা নিচ্ছেন না!

দুঃখিত। বললে বিনয়।

মিঃ অধিকারী, আপনারও কি তাই মত? পিয়ারী বামদেবের দিকে তাকিয়ে এবারে প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ মিঃ পিয়ারী, ক্ষমা করবেন।

আচ্ছা তাহলে চলি। তবে একটা কথা যাবার আগে বলে যাই, আমার offerটা accept করলে ভালই করতেন।

পিয়ারী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার ছেড়ে।

পিয়ারীর কথার সুরাটাই যেন বিনয়ের ভাল লাগল না। সেও অনুরুপ কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে, কেন বলুন তো!

না, তাই বললাম–

আপনি যেন মনে হচ্ছে, আমাদের একটু থ্রেটেন করছেন মিঃ পিয়ারী!

যদি তাই মনে করেন মিস্টার তাই!

তাহলে আপনি জেনে যান দশ লক্ষ টাকা দিলেও এ বাড়ি আপনি পাবেন না।

তাই বুঝি! আচ্ছা-সোজা হয়ে দাঁড়ায় পিয়ারী।

হ্যাঁ, আপনি যেতে পারেন।

পিয়ারীর চোখের তারা দুটো বিনয়ের চোখের ওপরে স্থিরনিবদ্ধ। এবং সে দৃষ্টিতে কৌতুক ও ব্যঙ্গ যেন অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

তাহলে দশ লক্ষ পেলেও দেবেন না?

না।

তাহলে আপনিও শুনে রাখুন, আমিও পিয়ারীলাল। নামটার সঙ্গে হয়তো আপনাদের সঠিক পরিচয় নেই। Wel, I accept your challenge! হয় এ বাড়ি আমার হবে, আশি হাজারে নয় পঞ্চান্ন হাজারেই, অন্যথায় এ বাড়ি কেউ পাবে না। আপনাদেরও ভোগে আসবে না এ বাড়ি।

এই মুহুর্তে আপনি এখান হতে চলে যান!

বিনয়ের সমস্ত শরীর রাগে কাঁপছে তখন।

যাব বৈকি-আচ্ছা bye bye, আবার দেখা হবে। বলে দ্বিতীয় কোন বাক্যব্যয় না করে পিয়ারী জুতোর মচমচ শব্দ তুলে সিঁড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এবং পিয়ারীর ক্রমআপম্রিয়মাণ দেহটা সিঁড়ির পথে মিলিয়ে গেল।

বামদেব বিনয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি। এই এক বাড়ি নিয়ে! মিথ্যে তুমি লোকটাকে চটাতে গেলে কেন বিনয়!

কি বলছেন। আপনি মেসোমশাই, কোথাকার কে না কে, আমাদের বাড়িতে এসে চোখ রাঙিয়ে যাবে!

চটাচটি না করলেই হত। উপকার না করে করুক, অপকার করতে কতক্ষণ?

আপনি দেখছি ভয় পেয়ে গিয়েছেন মেসোমশাই!

ভয় নয় বিনয়, মিথ্যে ঝামেলায় লাভ কি?

তাই বলে ভয় দেখিয়ে যাবে?

কিন্তু বাবা এখানে আর নয়, চল আজই কলকাতায় ফিরে যাওয়া যাক!

না মেসোমশাই, এখন কলকাতায় যাওয়া হবে না।

কেন?

তবে শুনুন অনেক কথা আছে আমার বলবার।

আবার কি কথা!

শুনুন। এ কদিন আমি চুপ করে বসে থাকিনি।

অতঃপর সংক্ষেপে গত দ্বিপ্রহর ও রাত্রির সমস্ত কাহিনী একে একে বলে গেল বিনয়। বামদেব সব কথা শুনে তো নির্বাক।

ইতিমধ্যে পিয়ারীর সঙ্গে যখন বিনয়ের কথাবার্ত হয়, বিনয়ের কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে সুজাতাও একসময় সকলের পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেও সমস্ত কথা শুনে বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।

বিনয় বলে, নিশ্চয়ই এ বাড়ির পিছনে কোন জটিল রহস্য আছে, এখন তো বুঝতে পারছেন। এবং অন্যেও জানতে পেরেছে, তাই এ বাড়ি নিয়ে হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। নচেৎ আপনিই বলুন না, এমন কেউ কি পাগল আছে যে এ বাড়ি আশি হাজার টাকা দিয়ে কিনতে চাইবে! নিশ্চয়ই এর মূল্য অনেক বেশী। কাজেই সমস্ত ব্যাপারটা ভালভাবে না জেনে এ বাড়ি কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না। এবং সব ব্যাপারের একটা মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এ স্থানও আমাদের ত্যাগ করা উচিতও হবে না।

বামদেব কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন।

অবশেষে বললেন, এ যে বড় চিন্তার কথা হল বিনয়!

চিন্তার কথা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু বিচলিত হবার কি আছে! দেখাই যাক না কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!

বিনয় ঠিকই বলেছে। বাবা, এ বাড়ি আমাদের কিছুতেই বিক্রি করা চলবে না।

সুজাতার কথায় বিনয় ও বামদেব দুজনেই একসঙ্গে ফিরে তাকাল।

সুজাতা আবার বলে, বেটাকে গলাধাক্কা দিয়ে হাঁকিয়ে দিলে না কেন বিনয়! বেটার কি সাহস!

না মা না, ওসব কী চরিত্রের লোক কে জানে!

বাবা, তুমি দেখছি ভয়েই গেলে। যার যা খুশি তাই করলেই হল! দেশে আইন নেই আদালত নেই! প্রতিবাদ জানায় সুজাতা।

আপনি মিথ্যে ভাবছেন মেসোমশাই। এই ধরনের কুকুর সায়েস্তা করবার জন্য আমারও মুগুর জানা আছে। আবার যদি এখানে ও পা দেয়, সেই ব্যবস্থাই করব।

বিনয় আশ্বাস দেবার চেষ্টা করে বামদেবকে, কিন্তু বুঝতে পারে বামদেবের মনের চিন্তা তাতে দূর হয়নি, তিনি প্রত্যুত্তরে কোন কথাই বলেন না।

নিঃশব্দে উঠে বামদেব তাঁর ঘরের দিকে চলে যান।

বিনয় নিজেও চিন্তিত হয়নি তা নয়। কিন্তু তার চিন্তাধারাটা অন্য পথে। সে ভাবছিল এই রত্নমঞ্জিলকে কেন্দ্র করে ক্ৰমে যে একটা রহস্য ঘনিয়ে উঠছে তারই কথা।

সেই বাঁকড়া চুলদাড়িগোঁফওয়ালা লোকটা, চকিতে দিঘির ধারে দেখা দিয়েই যে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, কে সে লোকটা!

আর কেই বা সেই রাত্রের মধুকণ্ঠী পথ-প্রদর্শিকা! কেন সে তার পরিচয় দিল না? আর কেই বা সেই দুর্বাসা মুনি যার কথায় সেই মেয়েটিকেও শঙ্কিত বলে মনে হল! সেরাত্রে জানালা হতে দেখা সেই লাল আলো, সর্বশেষে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য মনোহরের সন্দিগ্ধ আচরণ—সব কিছু যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এই রত্নমঞ্জিলের সঙ্গে সব কিছুর নিশ্চয়ই একটা সম্পর্ক আছে।

সম্পর্কই যদি না থাকবে তো ওরা—ঐ বিচিত্রের দল এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে কেন? কেনই বা রহস্যজনক ওদের গতিবিধি? আর বিশেষ করে রত্নঞ্জিলের সঙ্গে যদি ওদের কোন সম্পর্কই না থাকবে তো এখানেই বা ওরা কেন?

তারপর এই পিয়ারী!

কোথা হতে ঘটল এর আবির্ভাব? এ কি কোন সম্পূর্ণ তৃতীয় পক্ষ, না পূর্বের দলেরই কোন একজন?

আশি হাজার টাকা। আশি হাজার টাকায় লোকটা এই রত্নমঞ্জিল কিনতে চায়!

কি ভাবছ বিনয়?

সুজাতার প্রশ্নে বিনয়ের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।

অ্যাঁ! কিছু বলছিলে সুজাতা?

বলছিলাম মুখ বুজে বসে আছ কেন?

এক কাপ চা হলে ভাল হত।

তা না হয়। আনছি, কিন্তু–

ভয় নেই। সুজাতা। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, এ ব্যাপারে যখন একবার জড়িয়েছি নিজেকে, এর শেষ না দেখে ছাড়ছি না।

কিন্তু যাই বল, ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠল দেখছি। সকৌতুকে বলে সুজাতা কথাটা।

হুঁ? গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয় বিনয় মাত্র একটি শব্দে।

কিন্তু তোমার কি মনে হয় বল তো বিনয়? বাড়িটার মধ্যে কোন গুপ্তধনটন নেই তো?

ব্যাপার দেখে সেই রকমই তো মনে হয় সুজাতা।

ভারী মজা হয়, না? যদি এই বাড়ির কোথাও ঘড়া ঘড়া যক্ষের ধন পাওয়া যায়!

যখের ধন থাক আর না থাক, মজা তো শুরু হয়েই গিয়েছে। কিন্তু চা কই!

আনছি। আবার হঠাৎ উধাও হয়ে না। কিন্তু। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে বিনয়।

ভয় নেই, চা পান না করে পাদমেকং ন গচ্ছামি! নিৰ্ভয়ে চা তৈরী করে আন।

লঘুপদে সুজাতা চলে গেল।

ব্যাপারটা যেমন আকস্মিক তেমনি অতর্কিতভাবেই ঘটে গেল। লোকটা যে আচম্‌কা অমনি করে হঠাৎ উঠ, ছুটে পালিয়ে যাবে আদপেই তা সে ভাবেনি, ভাবতে পারেনি।

ছট্টুলাল হঠাৎ উঠে এক দৌড়ে বাইরের অন্ধকারে অদৃশ্য হওয়ায় প্রথমটায় একটু হক্‌চকিয়ে যায়নি যে তা নয়, কিন্তু পরিস্থিতিটা হৃদয়ঙ্গম করে ছট্টুলালের পিছু পিছু বাইরে ছুটে আসতেও সে দেরি করে না।

কিন্তু ঘনান্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে কোন পথে যে সে পালাল বুঝতে পারা গেল না।

এই কুটীরে আসবার পথ তিন-চারটে আছে। অবশ্য জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দিয়ে কিন্তু সেও এক গোলকধাঁধার ব্যাপার।

ভাল করে না জানা থাকলে জঙ্গলের মধ্যে পথভ্রান্ত হওয়া কিছুই বিচিত্র নয়। সেই ভেবেই সে অগ্রসর হল ছট্টুলালের খোঁজে।

জঙ্গলের মধ্যে পূর্বে কোন রাস্তাই ছিল না। কষ্টেসৃষ্টে চলবার মত পথ সে নিজেই করে নিয়েছিল এবং সেই পথ ধরে চলাচল করলেও তাকে ঠিক পথ বলা চলে না। এবং পূর্ব হতে না জানা থাকলে সে পথ ধরে যে যাতাযাত করা চলতে পারে কারুরই বিশ্বাস হবে না।

অন্ধকারে শ্বাপদের চোখের মত যেন লোকটার অনুসন্ধানী চোখের তারা দুটো জ্বলছে। হাতের নিশ্চিন্ত মুঠোর মধ্যে এসে সে পালিয়ে গেল।

তার এখানে গোপন অবস্থিতি সম্পর্কে একবার জানাজানি হয়ে গেলে এখানে তার আর আত্মগোপন করে থাকা সুবিধে হবে না। লোকটার আসল পরিচয় জানা হল না।

কে এবং কোন দলের লোক তাই বা কে জানে? কি উদ্দেশ্যে যে রত্নমঞ্জিলের আশেপাশে আজি ক’দিন ধরে চোরের মত উঁকিঝুকি দিয়ে বেড়াচ্ছিল তাই বা কে জানে!

না, লোকটা সম্পর্কে আমন শৈথিল্য প্রকাশ করা আদপেই উচিত হয়নি।

ঐ শৈথিল্যের সুযোগেই ও পালাতে পারল।

আপসোসে নিজের হাত নিজেরই যেন চিবোতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তীর তুণ থেকে বের হয়ে গিয়েছে, আর উপায় নেই।

হঠাৎ একটা খসখস শব্দ শুনে ও থমকে দাঁডায়।

শ্বাস বন্ধ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকারে ও বুঝতে পারে অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে।

কাছাকাছি আসতেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে ছায়ামূর্তিকে জাপটে ধরতেই নারীকণ্ঠে ভয়চকিত সাড়া এল, কে?

আক্রমণকারীর বজ্ৰবন্ধনও সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হয়ে যায়। বিস্ময়-বিহ্বল কণ্ঠে বলে ওঠে, কে, বাণী!

হ্যাঁ।

এত রাত্রে এই জঙ্গলের মধ্যে তুমি কি করছিলে? ঘুমোওনি?

না, বাবা। ঘুম আসছিল না দেখে বাইরে একটু—

কতবার না তোমায় নিষেধ করে দিয়েছি বাণী, একা একা এমনি করে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে বের হবে না!

দিনরাত ঐ খুপরির মধ্যে কোন মানুষ বন্দী থাকতে পারে নাকি? বাণীর কণ্ঠে সুস্পষ্ট একটা অভিমানের সুর।

খুব পারবে। যাও ঘরে যাও।

বাণী কিন্তু নড়ে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কই গেলে না? যাও!

বাণী তথাপি নিরুত্তর এবং নিশ্চল।

বজ্ৰকণ্ঠে এবার ডাক এল, বাণী!

তারপরই এগিয়ে এসে বাণীর একখানা হাত বজমুষ্টিতে চেপে ধরে ও হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলে।-অবাধ্য মেয়ে! চল হাত-পা বেঁধে তোমাকে এরপর থেকে আমি ঘরের মধ্যে আটকে রেখে দেব!

রতনলাল উঠে দরজাটা খুলে দিল।

মিহি শান্তিপুরের সুরু কলোপাড় ধুতি, মুগার পাঞ্জাবি ও পায়ে চকচকে নিউকাট জুতো মাঝারি দোহারা চেহারার একজন মধ্যবয়সী সুপুরুষ কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল। হাতে মলাক্কা বেতের সুদৃশ্য একটা ছড়ি।

এ কি যোগানন্দ যে! হঠাৎ কি মনে করে? রতনলালই। আগন্তুককে প্রশ্ন করে।

আগন্তুক যোগানন্দ কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে কক্ষের মধে খালি দ্বিতীয় চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে নির্বিকার কণ্ঠে কেবল বললে, একটা পাত্রে কিছু ঢাল দেখি আগে বাবা, গলাটা একটু ভিজিয়ে নিই।

রানা ড্রয়ার থেকে আর একটা কাঁচের গ্লাস বের করে বোতল থেকে খানিকটা তরল পদার্থ জলে ঢেলে মিশিয়ে এগিয়ে দিল যোগানন্দের দিকে।

দীর্ঘ এক চুমুকে কঁচের পাত্রটি নিঃশেষ করে যোগানন্দ বললে, তারপর? তোমার রত্নমঞ্জিল কেনবার ব্যাপারটা কতদূর এগুলো বল?

ব্যাপারটা যে ক্রমেই একটু একটু করে ঘোরালো হয়ে উঠল। হে যোগানন্দ!

এর মধ্যে আবার ঘোরালো হয়ে উঠবার কি হল? বায়না পরশু তো হয়ে গিয়েছে?

তা তো হয়েই গিয়েছে। এই কিছুক্ষণ আগে দত্ত-সাহার ওখান থেকে আসছি। শালা রাঘব একটা নূতন পাঁচ কষবার মতলবে আছে।

কি রকম! মিটমিট করে তাকায় যোগানন্দ রানার মুখের দিকে।

হ্যাঁ, বলছে বাড়িটা ছেড়ে দাও, মোটা টাকা খেসারত দেবী—অন্য কে এক পাটি আছে—

বটে। তা তুমি কি বললে?

আমিও রতনলাল রানা! বললাম আরো দু-পাঁচ হাজার বেশী ছাড়তে হয় আমিই ছাড়ব। ওসব মতলব ছেড়ে দাও তো যাদু।

হুঁ, তা কত বেশী দিতে চায়?

ঠিক জানি না, তবে দশ-বিশ হাজার তো মিলবেই।

বল কি! তবে ছেড়েই দাও না, মুফৎসে দশ-বিশ হাজার যদি অমনি করে এসেই যায় তবে আর ক্ষতি কি? ঘরের টাকা ঘরে এসে গেল, সঙ্গে আবার ফাউ!

কি বলছি তুমি যোগেন? তুমিই না লোভ দেখিয়ে আমাকে এ ব্যাপারে নামিয়েছ! এখন বলছি ছেড়ে দিতে!

হ্যাঁ, তা বলেছিলাম বটে। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে আগাগোড়া সব কিছুই তো একটা অনিশ্চিতের ওপরে নির্ভর করছে। কিছুই একেবারে নাও তো মিলতে পারে। এতগুলো টাকা ঢেলে তখন স্রেফ বোকা বনে যেতে হবে,–কথাটা ভেবে দেখ!

উহুঁ, হাত একবার বাড়িয়েছি, ওর শেষ না দেখে ফিরছি না। ভাগ্যে যদি কেবল মাটিই ওঠে উঠবে।

কিন্তু ভেবে দেখ, পঞ্চান্ন হাজার টাকা—

লোটা কম্বল নিয়ে বাপ আমার এসেছিল এ মলুকে-ফের না হয় রাম সেই শুরু করব। শালা পুরুষের ভাগ্য ভুবতেও যতক্ষণ উঠতেও ততক্ষণ!

যোগানন্দ রানার সঙ্গে কথা বলছিল। আর মধ্যে মধ্যে কাচের পাত্র পূর্ণ করে গলাধঃকরণ করছিল। বোতলাটা প্রায় সে খালি করে আনে।

হঠাৎ বোতলের দিকে নজর পড়ায় রানা বলে, এই যোগেন, কত খাচ্ছিস।

ভয় নেই—যোগানন্দ মাতাল হয় না। মৃদু হেসে যোগানন্দ জবাব দেয়।

সত্যি যোগানন্দকে তার পরিচিতেরা কখনও যাকে বলে মদ খেয়ে মাতাল হতে দেখেনি। মদ খেয়ে মদ হজম করবার অদ্ভুত শক্তি আছে যোগানন্দের। বন্ধুবান্ধবমহলে কেউই যোগানন্দের আসল ও সত্যিকারের পরিচয়টা জানত না এমন কি তার পদবীটাও জানে না। কেউ জানে না কোথায় সে থাকে—কোন বাড়িতে বা কোন পাড়ায়! সংসারে কে তার আছে বা কিভাবে তার চলে!

পরিচিতজনদের আড্ডায় সে নিয়মিত হাজিরা দেয়। মদ্যপান করে হৈ হৈ করে অধিক রাত পর্যন্ত। তারপর একসময় দিব্যি আকণ্ঠ মদ্যপান করে (সর্বক্ষেত্রেই প্রায় পরের পয়সায়) এবং এতটুকু না। টলে বের হয়ে যায় শিস দিয়ে সুর ভাঁজতে ভঁজতে। কারোর সাহায্যের প্রয়োজন হয় না।

বন্ধুবান্ধবরাও যোগানন্দকে খুশিমনে মদ খাওয়ায়, বিশেষ করে ব্যবসায়ীমহল। ব্যবসায়ীমহলেই যোগানন্দের আনাগোনা এবং খাতিরও তার প্রচুর। যোগানন্দকে খাতির করবার প্রধান কারণই ছিল, সকলের খুঁটিনাটি, সমস্ত ব্যবসার বাজারদরটা সর্বদা থাকত যোগানন্দের ঠোটের আগায় এবং বাজারাদরের ওঠানামা সম্পর্কে আগে থাকতেই মতামত দেবার একটা অদ্ভুত দক্ষতা দূরদৃষ্টি ছিল যোগানন্দের। তার কথার উপরে নির্ভর করে বড় একটা কাউকেই ব্যবসায়ীমহলে তেমন ঠিকতে হত না।

ঐ দালালী করাটা ছিল তার প্রধান জীবিকা। অথচ ব্যবসায়ীমহলে ঐ শ্রেণীর লোকেরা দালাল বলে সাধারণতঃ যে ব্যবহার পায়, যোগানন্দ কারো কাছ হতে সে ধরনের ব্যবহার পায়নি। বরং সে পেয়ে এসেছে সকলের কাছ হতেই একটা বিশিষ্ট সম্মানের ও প্রীতির আসন। এবং সেই কারণেই হয়ত তাকে সকলেই প্রায় সানন্দে মদ খাওয়াত। যোগানন্দের বিশেষ মদ্য প্রীতিটা কারো কাছেই অজ্ঞাত ছিল না।

যোগানন্দই রতনলালকে ‘রত্নমঞ্জিল’টা কেনবার জন্য উৎসাহিত করে তোলে। রতনলাল মিথ্যা বলেনি। এবং খুব সম্ববত যোগানন্দের উৎসাহ না পেলে শেঠ রতনলাল এতদূর অগ্রসর হতো। কিনা সন্দেহ।

রানার অফিসঘরের ওয়াল-ক্লকটিয় রাত্রি আটটা ঢং ঢেং করে ঘোষণা করল।

যোগানন্দ উঠে দাঁড়ায়, তবে চললাম হে শেঠ!

এর মধ্যেই? বাস না—আর একটা বোতল খুলি! রানা বলে। না।

একটা কাজ আছে। এক জায়গায় যেতে হবে। যোগানন্দ মাথা নেড়ে বলে।

বল কি হে যোগানন্দ এত শীঘ্ৰ অমৃতে অরুচি! সবে তো শুরু করলে!

না হে, কাজ আছে। চলি—

সত্যি-সত্যিই যোগানন্দ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সিঁড়িপথে একটা টিমটিমে কম পাওয়ারের বালব জ্বলছে। স্বল্পালোকে সমস্ত সিঁড়িপথটা একটা আধো আলোছায়া, বিশ্ৰী স্তব্ধতায় যেন থমথম করছে।

যোগানন্দ বাইরের রাস্তায় নেমে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি চলে দেখে নিল। এ রাস্তটা ঐ সময় সাধারণতঃ একটু নির্জনই হয়ে পড়ে। ফুটপাত ধরেই যোগানন্দ এগিয়ে চলল। শ্লথমন্থর পদবিক্ষেপে। রানার কাছে রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে প্রাপ্ত সংবাদটা সত্যিই যোগানন্দকে যেন একটু চিন্তিত করে তুলেছে।

যে টোপ সে ফেলেছিল মাছ সে টোপ গিললেও বঁড়শীটা ঠিক মাছের গলায় গেঁথেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। টেনে তুলতে গেলে যদি ফসকে যায়। আশপাশে আবার এদিকে অন্য মাছ ঘাই দিচ্ছে, খবর পেয়েছে সে।

অনিলেরও বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। গত এক মাস ধরে হঠাৎ কোথায় যে সে ড়ুব? দিল, একেবারে কোন পাত্তাই নেই।

ঘটনাটা যে কোন দিকে গড়াচ্ছে ঠিক যেন বোঝা যাচ্ছে না।

হাঁটতে হাঁটতে যোগানন্দ বৌবাজারে এল। শিয়ালদার দিকে বৌবাজার স্ট্রট ধরে কিছুটা পথ এগিয়ে ডান দিককার একটা অপরিসর গলির মধ্যে একসময় ঢুকে পড়ল। গলিটা এত সরু যে দুজন লোকের স্বচ্ছন্দে রাত্রির অন্ধকারে পাশাপাশি হাঁটাই কষ্টকর। গলিটা ব্লাইন্ড। একটা মাত্র করপোরেশনের গ্যাসবাতি সমস্ত গলিপথটার জন্য। তাই আলোর চাইতে মনে হয়। অন্ধকার যেন বেশী। স্যাঁতসেঁতে নোংরা। হাওয়াটা বন্ধ হওয়ায় একটু ভাপসা ভাব। যোগানন্দ গলিটার মধ্যে প্রবেশ করে দ্রুতপদে এগিয়ে গিয়ে বাঁ-হাতি একটা তিনতলা পুরাতন বাড়ির বন্ধ কবাটের কড়াটা ধরে বার-দুই নাড়া দিতেই ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে সাড়া এল, কে?

যোগানন্দর ডাকে কোনরূপ সাড়া না দিয়ে আবারও দরজার কড়াটা ধরে বার-দুই নাড়া দিল এবং এবারে সঙ্গে-সঙ্গেই দরজাটা খুলে গেল।

বয়স বোধ করি ত্রিশ-পয়ত্রিশ হবে, একটি মহিলা দরজা খুলে দিতে এসেছিলেন। পরিধানে সাধারণ কালোপাড় একটি মিলের শাড়ি, হাতে একগাছি করে শাঁখা। রোগাটে একহারা দেহের গড়ন। সিঁথিতে সিন্দুর ও কপালে একটি গোলাকার সিন্দুরের টিপা।

ভদ্রমহিলার চেহারা এমনিতে কুশ্ৰী নয়, কিন্তু দারিদ্র্য যেন সমস্ত সৌন্দর্য ও শ্ৰীকে লেহন করে নিয়েছে। শুধু দারিদ্রই নয়, সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চোখে মুখে একটা ক্লান্তি! মহিলার হাতে একটি হ্যারিকেন বাতি ছিল। তিনি আগে আগে চললেন। যোগানন্দ তাকে অনুসরণ করে।

মহাবীর কোথায়? তাকে দেখছি না! যোগানন্দ প্রশ্ন করে।

বাজারে গিয়েছে। মহিলা জবাব দিলেন।

আর নারাণী?

নারাণী তো আজ চারদিন হল কাউকে না বলে চলে গিয়েছে কোথায়—

আমারই অন্যায় হয়েছে দিদি। কাজের ঝ ঞাটে কদিন এদিকে আসতে পারি নি। এক এক ঐ বাড়িতে মহাবীরকে নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার খুব কষ্ট হয়েছে!

না ভাই, কষ্ট আর কি–

ভয় করেনি?

ভয়! মহিলা মৃদু হাসলেন, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, না, ভয় কি! সারাদিন ধরে টিনের ফ্যাক্টরীতে কাজ চলে—ঠং ঠেং শব্দ। বরং সন্ধ্যার পর ফ্যাক্টরী বন্ধ হলে একটু আরামই পাওয়া যায়। তাছাড়া মহাবীর তো আছেই।

ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে দুজনে একটা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। বহু পুরাতন আমলের বাড়ির নিচের তলার ঘর। ছোট ছোট জানালা। অন্ধকার চাপা তাই আলো-বাতাসের অভাবে কেমন যেন! ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের বাহুল্যও তেমন নেই। একাধারে একটি চৌকির ওপরে সাধারণ একটি শয্যা বিছানো। আর এক কোণে একটি ছোট আকারের স্টীলের ট্যাঙ্ক।

একটি মাদুর পেতে দিয়ে মহিলা বললেন, বাস।

পরিধানে সুটি থাকায় কোনমতে কষ্টেসৃষ্টি পা গুটিয়েই যোগানন্দ মদুরের ওপরে বসে পড়ল।

এই দারিদ্র্যের মধ্যে তুমি আস—আমারই লজ্জা করে যোগেন!

ওকথা ভাবেন কেন দিদি? ভাই আসবে দিদির বাড়িতে, সেখানে দারিদ্র্য যদি কিছু থাকেই তাতে লজ্জার আবার কি! ওরকম ভাবলে কিন্তু আমার আর আসাই হবে না। কিন্তু মহাবীরটারও তো আচ্ছা আক্কেল! কতক্ষণ গিয়েছে?–

তা আধা ঘণ্টা তো হবেই—

এক আপনি বাড়িতে আছেন, সে খেয়ালও নেই নাকি?

না, ওর কোন দোষ নেই। ওর নিজের কি কাজ আছে, তাই বলে দিয়েছি। একেবারে কাজ সেরে আসতে।

মহাবীরকে বলেননি কেন দিদি একটা ঝি খুঁজে আনতে?

কি হবে! একা মানুষ কাজকর্মও বিশেষ কিছু নেই। আবার একটা ঝি দিয়ে কি হবে?

ঠিক সেজন্য নয় দিদি। মহাবীর পুরুষমানুষ, আর এক আপনি এখানে স্ত্রীলোক-অন্য একজন স্ত্রীলোকের থাকা খুবই প্রয়োজন।

চিরকাল তো এইভাবেই কাটিয়েছি বাণী আর আমি। তোমার দাদা কালেভদ্রে কখনও ক্কচিৎ। আসতেন—

দাদার আমলে যা হয়েছে হয়েছে—

কিন্তু থাক সেকথা। তাদের কোন সন্ধান পেলে?

না, এখনো কোন সন্ধানই পাইনি। তবে আপনি ভাববেন না, তারা ফিরে আসবেই। তারপর একটু থেমে বলে, চলুন না দিদি, আপনি আমার ওখানে গিয়ে থাকবেন।

না ভাই, তা হয় না।

কেন হয় না? একা একা এখানে পড়ে থাকেন—মহাবীর তো এখানে রইলই, তারা ফিরে এলে মহাবীরই তো আমাদের সংবাদ দিতে পারে। আপনি আমার ওখানে থাকলে আমিও নিশ্চিত থাকতে পারি।

তুমি আমার জন্যে চিন্তা করো না ভাই।

বাইরের দরজার কড়া নড়ে উঠল।—মহাবীর ফিরে এল বোধ হয়! সবিতা বললেন।

আমি যচ্ছি, দরজা খুলে দিয়ে আসছি। যোগানন্দ ওঠবার চেষ্টা করে। কিন্তু মহিলা বাধা দেন, না না, অন্ধকারে তুমি পথ ঠিক করতে পারবে না। তুমি বসো, আমি দরজা খুলে দিয়ে আসছি। সবিতা অন্ধকারেই দ্রুতপদে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

একটু পরেই মহাবীরের জুতোর শব্দ দরজার বাইরে শোনা গেল।

তোমার বাবু এসেছেন মহাবীর! শোনা গেল মহিলার কণ্ঠস্বর।

মহাবীরের বয়স হয়েছে। পঞ্চাশের উর্ধ্বে। কিন্তু দেহের গঠন এখনও অটুট আছে।

মহাবীরের গলার শব্দ পেয়ে যোগানন্দ বাইরে এসে দাঁড়ায়, একলা মাইজীকে রেখে এতক্ষণ তুমি বাইরে ছিলে মহাবীর!

আমি তো যেতে চেয়েছিলাম না হুজুর। কিন্তু মাইজী বললেন—

নারায়ণী চলে গেছে। একটা ঝি তো খুঁজে আনতে পারতে মহাবীর!

আমি তো বলেছিলাম, মাইজী বারণ করলেন।

কালই একটা ঝি খুঁজে আনবে।

মহাবীর ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে স্টেভ জ্বলিয়ে সবিতা চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছিলেন কেতলিতে।

ঘরে ঢুকে যোগানন্দ তাই দেখে বললে, এখন আবার চায়ের জল চাপালেন দিদি!

তা হোক, তুমি তো চা ভালবাস।

যোগানন্দ জানে, প্রতিবাদ জানালে দিদি মনে ব্যাথা পাবেন, তাই আর কোনরূপ প্রতিবাদ জানাল না।

জুতো খুলে হাঁটু মুড়ে আবার মাদুরের ওপরে বসল।

সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে এই গৃহকোণটি সম্পর্কে যোগানন্দের কি যেন দুর্বলতা—তার উচ্ছৃঙ্খল নিয়মকানুনহীন জীবনের এই গৃহকোণটি যে কতখানি অধিকার করে আছে, ভাবতে গেলে নিজেরই তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। যেদিন হতে এই গৃহকোণটি সে চিনেছে, সেইদিন হতেই যেন সে এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছে এখানে। ভালবাসা, স্নেহমমতা কোনদিনই এসবের কোন স্থান ছিল না যোগানন্দের জীবনে। জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই মাকে হারিয়েছিল। সতের বছর বয়সের সময় বোপকেও হারায়। এমন কিছু সঞ্চয় বাপ রেখে যাননি যোগানন্দের জন্য বা এমন কিছু শিক্ষাও দিয়ে যেতে পারেননি, যাতে করে সহজ স্বাভাবিক পথে জীবনটাকে যোগানন্দ কাটিয়ে দিতে পারত। অথচ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল যোগানন্দের।

পিতার মৃত্যুর পর যোগানন্দ মামার বাড়িতে এসে ওঠে। কিন্তু দুদিনেই বুঝতে পারল সেখানে স্থান তো হবেই না এবং কোনরূপ সাহায্যও মিলবে না।

যোগানন্দ কলকাতায় চলে এল। হাতে সামান্য যা ছিল তারই উপরে নির্ভর করে একটা মেসবাড়িতে এসে উঠল। পনের টাকায় খাওয়া থাকা। সেই মেস বাড়িতেই আলাপ হয় যোগানন্দের শেয়ার মার্কেটের দালাল যতীন মিত্রের সঙ্গে। যতীন মিত্রের পরামর্শেই যোগানন্দ বাজারে ঘোরাফেরা শুরু করল। মাস ছয়েক বাজারে ঘোরাফেরা করে শেয়ার সম্পর্কে বাজারদার ও তার ওঠানামা সম্পর্কে একটা মোটামুটি জ্ঞানলাভ করল এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই যোগানন্দ দালালী করে বেশ দু’ পয়সা উপার্জন করতে শুরু করে।

বছর দশেকের মধ্যে যোগানন্দ তার নিজের বিশিষ্ট আসনটি কায়েম করে নিল। যথেষ্ট অর্থাগম হতে লাগল। এবং অর্থাগমের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বিশেষ বস্তুর ওপরে তার আসক্তি জন্মাল। সুরা। কিন্তু সুরা তাকে ধ্বংস করতে পারেনি।

চা তৈরি করে সবিতা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলেন যোগানন্দের দিকে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যোগানন্দ বলে, আচ্ছা দিদি, বলতে পারেন চা তো আপনি বিশেষ খান না। কিন্তু এমন চা তৈরী করেন। কি করে?

সবিতা যোগানন্দের কথায় হাসেন।

নেহাৎ কাজের ঝঞ্ঝাটে রোজ আসতে পারি না, নচেৎ ইচ্ছা করে রোজ এসে আপনার হাতের তৈরী চা খেয়ে যাই–

তা বেশ তো, এলেই তো হয়।

দাঁড়ান, এখন আপনাকে জোর করছি না বটে, সব ঝামেলা মিটে যাক, তারপর আপনাকে আমার বাড়িতে যে নিয়ে যাব। আর ছাড়াছাড়ি নেই। কিন্তু রাত হল, এবারে আমাকে উঠতে হবে। বলতে বলতে যোগানন্দ উঠে দাঁড়াল।

হঠাৎ দরজার গোড়া পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়ায়, তার পর পকেটে হাত দিয়ে কয়েকটা নোট বের করে বলে, টাকা আপনার নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গিয়েছে দিদি—এই টাকা কটা রাখুন।

না না, গত মাসে যে টাকা তুমি আমাকে দিয়েছিলে সেই টাকাই তো এখনও শেষ হয়নি!

বলেন কি দিদি! মাত্র তো একশটা টাকা দিয়েছিলাম। সে টাকা এখনো আছে মানে! খরচ আর কি, দুজন মাত্র তো লোক— আজকালকার দিনে একজনেরই খেতে তো একশ টাকা লাগে। নিন রাখুন টাকাটা—

না, ভাই। এখন থাক। প্রয়োজন হলে আমিই চেয়ে নেব তোমার কাছ থেকে।

সে আপনি যা চাইবেন তা আমার জানা আছে। নিন। ধরুন তো টাকাটা! যোগানন্দ টাকা কটা একপ্রকার জোর করেই সবিতা দেবীর হাতে গুজে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

অন্ধকার গলিপথটা অতিক্রম করে বড় রাস্তায় যখন এসে পড়ল। রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা বেজে গিয়েছে। ট্রাম বাস প্রাইভেট কার ও জনপ্রবাহে আলো-ঝলকিত কলকাতা শহর তখনও প্রাণপ্রাচুর্যে ঝলমল করছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যোগানন্দ।

সবিতাদির স্বামী ও কন্যা বাণীকে খুঁজে বের করতেই হবে। যেমন করেই হোক তাদের খুঁজে বের করে সবিতাদিকে সুখী করতেই হবে। সবিতাদির মুখের দিকে যেন আর চাওয়া যায় না।

আশ্চর্য চরিত্র অনিলবাবুর!

সাবিতাদির মত স্ত্রী পেয়েও তিনি সংসার বেঁধে সুখী হতে পারলেন না। অথচ সাবিতাদির মত স্ত্রী সংসারে কজনের ভাগ্যে লাভ হয়! আর ওদের বিবাহটাও নাকি হয়েছিল পরস্পরে। পরস্পরকে ভালবেসে।

প্রফেসার বাপের শিক্ষিত মেয়ে, অনিলবাবু নিজেও উচ্চশিক্ষিত, তবু যে কেন সব এমনি হয়ে গেল!

সুখের সংসারই দুজনে পেতেছিলেন, মফস্বল শহরে এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপকের কাজ নিয়ে গিয়ে। দুটো বছর আনন্দেই কেটেছিল। তারপরই লাগল আগুন।

একটি ছাত্রীকে পড়াতেন, হঠাৎ একদিন সেই ছাত্রীকে নিয়ে হলেন পলাতক আনিলবাবু। সবিতাদি তখন পাঁচ মাস অন্তঃসত্ত্বা। ছোট মফস্বল শহরে একেবারে টি টি পড়ে গেল ব্যাপারটা নিয়ে।

লজায় অপমানে সবিতা পালিয়ে এলেন কলকাতায় বাপের কাছে। বাপ শশাঙ্কমোহন সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কেবল বললেন, যাক ভালই করেছিস। রাস্কেল! হাতের কাছে পেলে চাবুক মেরে পিঠের ছাল তুলে নিতাম। আজ থেকে জানবি তোর বিয়েই হয়নি।

কিন্তু বাবা, তার সন্তান যে আমার গর্ভে! দু হাতে মুখ ঢাকলেন সবিতা।

শশাঙ্কমোহন যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কথাটা শুনে!

তাঁর গলা দিয়ে কয়েকটা মুহূর্ত কোন শব্দই বের হয় না।

তারপর একসময় ধীরে ধীরে বললেন, ঠিক আছে, ঐ তার সন্তান-যে আসছে তাকে নিয়েই তুই বেঁচে থাক। ঐ অপদার্থটার কথা ভুলে যা—ভুলে যা সব কথা।

যাই হোক, সবিতা পিতা শশাঙ্কমোহনের কাছেই থেকে গেলেন। ঐ একমাত্র মেয়ে শশাঙ্কমোহনের। স্ত্রীর আগেই মৃত্যু হয়েছিল। বড় আদরের মেয়ে। কন্যা বাণী জন্মাল।

দশ বছর অনিলের আর কোন সংবাদই পাওয়া গেল না। সবিতা নিজেও জেনেছিলেন আর হয়তো জীবনে কোনদিনই তার সন্ধান পাওয়া যাবে না।

এমন সময় হঠাৎ একদিন শীতের মধ্যরাত্রে প্রাচীর টপকে অনিল শশাঙ্কমোহনের বাড়িতে এসে প্রবেশ করলেন।

পরিচিত গৃহ।

স্ত্রীর শয়নকক্ষটা চিনে নিতে তার কষ্ট হয়নি। সবিতা একাই তাঁর ঘরে শুয়েছিলেন।

পাশের ঘরে দাদুর সঙ্গে ঘুমিয়েছিল বালিকা বাণী, অনিলের মেয়ে।

সবিতার গাতে হাত দিয়ে ঠেলে তুললেন অনিল তীকে ঘুম থেকে।

কে!

চুপ। চেঁচিও না—আমি অনিল।

তুমি। বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে গেছেন সবিতা।

হ্যাঁ, আমি। আমি আবার ফিরে এসেছি সবিতা।

তুমি ফিরে এসেছ!

ডায়বিটিসের রোগী শশাঙ্কমোহন। রাত্রে ভাল করে ঘুম হয় না।

তিনি যে ইতিমধ্যে পাশের ঘরে আলো জ্বলা ও চাপা কথাবার্তার আওয়াজে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, দুজনের একজনও তা টের পাননি।

কে রে সাবি? বলতে বলতে শশাঙ্কমোহন ঘরের মধ্যে এসে একেবারে সোজা আচমকা প্ৰবেশ করেন।

বাবা! একটা আর্ত শব্দ বের হয়ে আসে সবিতার কণ্ঠ হতে।

জামাই অনিলকে চিনতে শশাঙ্কমোহনের কষ্ট হয় না।

রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করেন, এ বাড়িতে তুমি কোন সাহসে আবার ঢুকেছ? স্কাউনড্রেল! এখুনি বের হয়ে যাও–

বাবা! আর্তকণ্ঠে ডেকে ওঠেন সবিতা।

না। চরিত্রহীন লম্পটের আমার বাড়িতে কোন প্রবেশাধিকার নেই। যাও বেরিয়ে যাও!

আপনার বাড়িতে থাকতে আমি আসিনি। আমি এসেছি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিল বলেন।

তোমার স্ত্রী! কে তোমার স্ত্রী? সবিতার তুমি কেউ নও। তোমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।

সম্পর্ক আছে কি না আছে সেটা আপনার বিচারে সাব্যস্ত হবে না!

নিশ্চয়ই-একশ বার হবে। যাও বেরিয়ে যাও।

বেশ তো, সবিতারও যদি সেই মত হয়, নিশ্চয়ই বের হয়ে যাব।—সে-ই বলুক। সবিতা আবার কি বলবে! আমিই বলছি—

বলবার যদি কারো অধিকার থাকে তো একমাত্ৰ আছে সবিতারই। আপনি বলবার কে!

লজ্জা করছে না তোমার? নির্লজ্জ বেহায়া–

সবিতা!

সবিতা কিন্তু নিরুত্তর। পাথরের মতই যেন জমাট বেঁধে গিয়েছে। স্থির বোবা।

সবিতা তোমারও কি তাই মত? তাই যদি হয় তো বল, আমি চলে যাচ্ছি!

তবু সবিতার কোন সাড়া নেই।

বেশ তবে চললাম।

অনিল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই সবিতা ডাকলেন, দাঁড়াও আসছি। বাণী ঐ ঘরে ঘুমিয়ে আছে, তাকে নিয়ে আসি।

সবিতা! তীক্ষু কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন শশাঙ্কমোহন।

ক্ষমা করো বাবা, ওঁর অবাধ্য তো হতে পারব না—

সবিতা, তোর সঙ্গে যে নীচ জঘন্য ব্যবহার করেছে, তার পরেও—

কি করব বাবা, হিন্দুর মেয়ে-স্বামী তাদের যাই হোক না কেন স্ত্রীর তো তাকে ছাড়া অন্য পরিচয় নেই। তাছাড়া ওঁর ভুলকে যদি আমি ক্ষমা না করি, তবে উনি কোথায় দাঁড়াবেন? আমাকে যাবার অনুমতি দাও বাবা–

সবিতা, তুই কি ভুলে গেলি কি জঘন্য অপমান ঐ লোকটা তোকে করেছে, তবু তুই ওর সঙ্গে যাবি?

বাবা!

বেশ যা, কিন্তু এও জেনে যা আজ থেকে এ বাড়ির দরজাও তোর বন্ধ হয়ে গেল। আজ থেকে জানব সবিতা বলে কোন মেয়ে আমার ছিল না।

আজ তুমি আমাকে হয়তো ক্ষমা করতে পারছ না। বাবা, কিন্তু একদিন যখন জানবে কতখানি নিরুপায় হয়েই আমাকে আজ তোমার অবাধ্য হয়ে তোমার মনে আঘাত দিয়ে যেতে হল সেদিন হয়তো আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারবে।

শশাঙ্কমোহন আর একটি কথাও না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

সবিতা চিত্ৰাপিতের মতই দাঁড়িয়েছিলেন।

অনিলও চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

সমস্ত ব্যাপারটা যে হঠাৎ ঐভাবে ঘুরে যাবে। এ কথা তিনি আদপেই ভাবেননি। ঝোকের মাথায়ই তিনি সবিতাকে তার সঙ্গে চলে যাবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। নচেৎ সবিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার কোন মতলবই ছিল না।

তিনি এত রাত্রে সবিতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। তিনি এসেছিলেন সবিতাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছু টাকাকড়ি চেয়ে নিয়ে আপাততঃ চলে যাবেন মনে করে, কিন্তু ঘটনা দাঁড়িয়ে গেল অন্যরকম।

একটা দীর্ঘশ্বাস রোধ করে সবিতাই কথা বললেন, একটু দাঁড়াও, বাণীকে নিয়ে আসি।

বাণী!

হাঁ, আমাদের মেয়ে। একটু পরেই ঘুম হতে তুলে বাণীর হাত ধরে সবিতা এ ঘরে ফিরে এসে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, চল।

তিনজনে সেই মধ্যরাত্রে জনহীন রাস্তার উপরে এসে দাঁড়ালেন।

শীতের রাত-নির্জন রাস্তা। শুধু রাস্তার দুধারে ইলেকট্রিকের আলোগুলো নিঃসঙ্গ রাতে যেন এক চোখ মেলে বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তিনজন হাঁটতে শুরু করে।

মেয়ে বাণী শুধায়, আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?

ঘুরিয়ে মেয়ের প্রশ্নের জবাবটা দেন সবিতা, বাবার সঙ্গে যাচ্ছি মা।

বাবা!

হ্যাঁ উনিই তোমার বাবা।

বাণী ঘুরে দাঁড়ায় অনিলের দিকে, সত্যি তুমি আমার বাবা!

হ্যাঁ, মা।

তবে তুমি এতদিন আসোনি কেন বাবা?

কাজ ছিল যে মা।

শেষ পর্যন্ত বৌবাজারের ঐ পুরাতন বাড়ির একতলায় এনে অনিল স্ত্রী ও কন্যাকে তুললেন।

ধনী পিতার একমাত্ৰ আদরিণী কন্যা। চিরদিন সুখৈশ্বর্যের মধ্যে পালিতা, তবু একটি কথা বলেননি। সবিতা। মুখ বুজে। সব কিছুকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

শুধু যে ঐ জঘন্য পারিপাশ্বিকের মধ্যেই এনে অনিল ফেলেছিলেন স্ত্রী ও কন্যাকে তাই নয়—সেই সঙ্গে চালিয়েছেন তার অত্যাচার।

এক এক করে সবিতার গায়ের সমস্ত সোনার গহনাগুলো বিক্রি করে সেগুলো নষ্ট করেছেন। এবং যতদিন সবিতার গায়ে গহনা ছিল দু বেলা আহার জুটেছে কিন্তু গহনা শেষ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল চরম দারিদ্র্য ও অনাহার।

আর তখন থেকেই, মধ্যে মধ্যে অনিল বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত হতে লাগলেন। স্ত্রী ও কন্যার কোন খোজই রাখতেন না। অনন্যেপায় হয়ে সবিতা দু-চারটি টিউশনি যোগাড় করে কায়ক্লেশে নিজের ও মেয়ের জীবন চালাতে লাগলেন।

তাতেও বাদ সাধেন আনিল। মাঝে মাঝে ধূমকেতুর মত এসে আবির্ভূত হয়ে সবিতার সামান্য পুঁজি ও সম্বলের ওপরে রাহাজানি করে চলে যান।

নিজের জীবনের কথা ভেবে সবিতা মেয়েকে আর স্কুলে দেননি। বাড়িতে নিজেই লেখাপড়া শেখাতেন।

বাণী ক্ৰমে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে মা’র কষ্টটা দেখে সর্বদাই মা’র কাছাকাছি থাকত মাকে সুখী করবার জন্য। এবং তার বাপের প্রতি মারি যে ক্ষমা সেটা তাকে বরাবরই পীড়ন করত।

মা যে বাবার যথেচ্ছাচার সহ্য করে নির্বিবাদে শান্ত হয়ে, বাণীর মনে হত সেটাই তার বাপের উচ্ছৃঙ্খলতাকে যেন আরও প্রশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে বাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত মনের মধ্যে কোথাও এতটুকু জোর পেত না বাণী।

মায়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও সে বাপের যথেচ্ছাচারিতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে মন তার বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইত তার সহজ মনের রুচিবোধের সংঘাতে।

সবিতার জীবনে যোগানন্দের আবির্ভাবটা দৈব যোগাযোগ ছাড়া কিছুই নয়।

বাসায় ফিরতে যোগানন্দের প্রায়ই গভীর রাত হত।

বছর দেড়েক আগে এক শীতের রাত্রে যোগানন্দ পায়ে হেঁটে ফুটপাথ ধরে বাসায় ফিরছিল।

সেরাত্রে একটু বেশী মাত্রাতেই যোগানন্দ মদ্যপান করেছিল। সমস্ত শরীরটা তো হাল্কা বোধ করছিলই, মাথার মধ্যেও কেমন শূন্যতা বোধ করছিল।

শীতের মধ্যরাত্রি জনহীন রাস্তা। একটা কুকুর পর্যন্ত কোথাও জেগে নেই।

বৌবাজারের কাছাকাছি এসে একটা তিনতলা বাড়ির ঝুল-বারান্দার নিচে আধো আধো অন্ধকারের মধ্যে একটি পুরুষ ও একটি নারীকণ্ঠের কথাবার্তার কিয়দংশ তার কানে যেতেই আপনা হতেই যোগানন্দ থেমে গিয়েছিল।

নারীকণ্ঠে করুণ মিনতির সুর, রাগ করো না, ফিরে চল।

আঃ, কেন বিরক্ত করছ, সবিতা! একশবার তো বলছি, যাব না। এখানে এই ফুটপাতেই আমি শুয়ে থাকব। বিরক্তিপূর্ণ খনখনে পুরুষকণ্ঠ।

আর কতকাল এমনি করে আমাকে জ্বালাবে বলতে পার! এখনো কি বুঝতে পারিছ না, কোন সর্বনাশের পথে তুমি ছুটে চলেছ!

মেয়ে বড় হয়েছে এখন, সে-ই বা কি ভাববে বল তো! এইজন্যই কি তুমি সে রাত্রে বাবার আশ্রয় থেকে টেনে নিয়ে এসেছিলে?

যাও না–বাপের ঘরে ফিরে গেলেই তো পার। তোমার পায়ে তো আমি শিকল দিয়ে রাখিনি।

ফিরে যাবার মুখ কি তুমি রেখেছ?

কেন, পরপুরুষের সঙ্গে তো আর গৃহত্যাগ করেনি। তবে লজ্জাটা কিসের?

তা যদি তুমি বুঝতে—

থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে অ্যাকটিং না করে বাসায় ফিরে যাও।

না, তোমাকে আমি না নিয়ে যাব না।

আহা, কি কথাই বললে! এঁদো অন্ধকার ঘর মানুষ সেখানে থাকে! তার চাইতে এই রাস্তা ঢের ভালো।

ঠিক হয়ে উপার্জন করবার চেষ্টা কর, দেখবে সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। চেষ্টা করলেই তুমি সব পারবে। আবার তোমার সব হবে।

সে আর হয়না। এ শকুনির পাশা, দান আর ওল্টাবে না।

হবে–সব হবে, মনকে একটু শক্ত কর।

পুরুষকণ্ঠ একেবারে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।

আবার অনুনয় শোনা যায়, চল!

যাও তুমি–আমি আসছি।

না, আমার সঙ্গে চল। আর বাইরে থেকে না। দেখছি না কি ঠান্ডা বাইরে!

যাও না তুমি, আসছি।

যোগানন্দ এতক্ষণ একটা দোকানের কোলাপসিবল গেটের পাশে নিজেকে একটু আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ দেখল। অতঃপর নারীমূর্তি পাশের একটা গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

যোগানন্দ এবার এগিয়ে গেল।

যোগানন্দের পায়ের জুতোর রবার সোল থাকায় তার জুতোর শব্দ শোনা যায়নি।

সে সোজা গিয়ে একেবারে উপবিষ্ট পুরুষটির সামনে দাঁড়াল, শুনছেন?

কে! চমকে উপবিষ্ট পুরুষটি উঠে দাঁড়ায়।

ভয় নেই। চোরডাকাত নই। একটু মদ্যপান করেছি বটে। তবে মাতাল হইনি—অতএব মাতালও নই।

তা এখানে কি চাও?

বিশেষ কিছু না। ঘটনাচক্ৰে হঠাৎ আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর আলাপটা আমি শুনে ফেলেছি।

শুনেছো তো বেশ করেছ। এখন এখান থেকে সরে পড় দেখি।

আহা চটছেন কেন, শুনুনই না। হঠাৎ সংসারের প্রতি আমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন কেন?

কে তুমি জানতে পারি? কি মতলব বল তো?

অধীনের নাম যোগানন্দ। আর মতলব সেটা এখনো ভেবেচিন্তে ঠিক করে উঠতে পারিনি। ধরুন-মনে হচ্ছে আপনার যদি কোন কাজে লাগতে পারি। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়?

রসিকতা করছ নাকি!

আদপেই না। কারণ ওটা আমার ধাতে আদপেই সয় না। কিন্তু সেকথা যাক। এইভাবে রাত্রে ঠাণ্ডার মধ্যে এই ফুটপাতে বসে থেকে লাভ কি! যান না ঘরে ফিরে।

না।

আরে বাবা রাগ করছেন কার ওপর বলুন তো? ঐ নিরীহ ভদ্রমহিলাটির ওপরে! বেচারী হয়তো এখনো আপনার আশাপথ চেয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। যান–বাড়ি যান–

খুব তো উপদেশ দিচ্ছ! জান বাড়ির অবস্থা?

সে কতকটা অনুমানই করে নিয়েছি না জানলেও সঠিক। অভাব অভিযোগ এই তো! আমি আপনাকে না হয় কিছু টাকা ধার দিচ্ছি—পরে সময়মত শোধ দিয়ে দেবেন।

তুমি! তুমি আমাকে টাকা ধাব দেবে?

বিস্ময়ের একটা সীমা আছে, অনিল বিস্ময়ে একেবারে বোবা বনে যায়। এমন কথা তো কেউ গল্প-কাহিনীতেও শোনেনি। একটা অচেনা অজানা লোক—

খুব আশ্চর্য লাগছে কথাটা শুনে, না? তা হবারই কথা। আমি নিজেও মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয়ে যে যাই না তা নয়। রাতের বেলার আমিটাকে দিনের বেলার আমিটাই চিনতে পারে না তা পরে তো—যাকগে সে কথা, আপাতত কত দিলে আপনার বর্তমান Crisis টা কাটিয়ে উঠতে পারেন বলুন তো! কি নাম?

আমার নাম অনিল–

অনিল অর্থাৎ বায়ু-বাতাস! তা বেশ নাম। হ্যা বলুন তাে অনিলবাবু, আপাতত, কত হলে চলে? তবে হ্যাঁ, একটা অসম্ভব চাইলেও আমি দেব না। ঠিক যতটুকু আপনার বর্তমান পরিচয়ে পাওয়া উচিত তাই দেব। কারণ ফুটো কলসীতে জল ঢালা মানেই অপব্যয়।

লোকটার কথাবার্তায় অনিল উত্তরোত্তর বিস্মিত হচ্ছিল। এবং কৌতুকও বোধ যে করছিল না তা নয়।

অনেক প্রকার লোকই জীবনে অনিল দেখেছে। কিন্তু এরকম লোক বড় একটা তার চোখে পড়েনি, যে অচেনা অজানা পথের একটা লোককে অযাচিতভাবে এমনি করে টাকা ধার দিতে পারে সেধে!

কি ভাবছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তা বিশ্বাস করাটাও একটু শক্ত বৈকি।

একশ টাকা দিতে পার?

নিশ্চয়ই। দাঁড়ান। যোগানন্দ পার্স বের করে।

ঠিক এমনি সময় পশ্চাৎ হতে পূর্ব নারীকণ্ঠ প্রতিবাদ জানল, না-টাকা দেবেন না।

নারী সবিতা। সবিতা যায়নি, গলির মাথাতেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে উভয়ের সব কথা শুনছিল।

সবিতা!

না—টাকা তুমি নিতে পারবে না।

আঃ আপনি আবার এর মধ্যে এলেন কেন? যোগানন্দ বাধা দেয়।

চলে এস তুমি। সবিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে যোগানন্দর কথার কোন জবাব না দিয়ে।

বেশ, চলুন আনিলবাবু আপনাদের বাড়িতেই যাওয়া যাক। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, রাস্তায় থাকা আর উচিত হবে না। হঠাৎ কোন লাল পাগড়ীর উদয় হয় তো আমাদের তিনজনের কাউকে সে বিশ্বাস করবে না!

তাই চল। অনিল বলে।

কি জানি কেন সবিতা আর কোন প্রতিবাদ জানায় না। তিনজনে এসে অন্ধকার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।

হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে যোগানন্দ যেন মুগ্ধ হয়ে যায়। যদিও নেশা।টা তখনও মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে চনচন করছে।

যোগানন্দ ঘরে ঢুকতেই সবিতা মদের গন্ধ পেয়ে একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু যোগানন্দর কথায় সেটা কেটে গেল।

দিদি! কেন যেন আপনাকে দিদি বলতেই ইচ্ছে করছে। আপনি নিশ্চয়ই মদের গন্ধ পেয়েছেন। মদ আমি খেয়েছি দিদি, অস্বীকার করব না। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন। আপনার সঙ্গে আজ রাত্রে দেখা হবে জানলে মদ নিশ্চয়ই আমি খেতাম না। তবে মদ খেলেও, জানবেন মাতলামি আমি করি না।

কি জানি কেন, সবিতারও প্রথম হতেই যোগানন্দকে ভাল লাগে। তার সমস্ত অনুভূতি যেন বলে, লোকটা আর যাই হোক শয়তান বা দুষ্ট প্রকৃতির নয়। তাই আলাপ জমতে দেরি হয় না। যোগানন্দ সহজেই দু’দণ্ডে সবিতার মনে একটি স্থায়ী আসন করে নয়।

সে রাত্রে আর যোগানন্দর বিদায় নেওয়া হয় না।

রাত্রি ভোর হলে চা খেয়ে সে বিদায় নেয়। এবং যাবার সময় সবিতার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনিলের হাতে সত্যিই শ’খানেক টাকা গুঁজে দিয়ে যায়।

কিন্তু যে উচ্ছৃঙ্খলতার বীজ অনিলের রক্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল সেই উচ্ছৃঙ্খলতার পথেই সেই একশত টাকা উবে যেতে পাঁচ দিনও লাগল না।

তারপর যে অভাব সেই অভাব।

আবার নেয় টাকা অনিল যোগানন্দর কাছ থেকে এবং আবার তা ফুরিয়ে যায় একদিনে। ঐভাবে দুতিনবার চলে।

উপন্যাসের কল্পিত এক কাহিনীর মতই যেন যোগানন্দর আবির্ভাব সবিতা ও অনিলের জীবনে।

সেবারে কিছু দিন পরে আবার যখন এক রাত্রে ঘটল যোগানন্দর আবির্ভাব, অনিল বাসায় ছিল না।

সবিতাই যোগানন্দকে বসতে বললে বসুন, এসেছেন যখন যাবেন কেন?

তা বসছি। কিন্তু ঐ সম্বোধন, আপনি আজ্ঞেটা ছাড়তে হবে। দিদি বলে যখন ডেকেছি সে দাবিটা এই অধম জনের রাখতে হবে এবং শুধু রাখাই নয়, সেই সঙ্গে বড় বোন ছোট ভাইকে যেমন তুমি বলে ডাকে তেমনি বলবে তুমি এবার থেকে।

সবিতা হেসে বলে, তাই হবে।

তাই হবে না, বলুন তুমি!

বেশ বলব।

আঃ সত্যি কি যে আনন্দ পেলাম দিদি। আর বুঝতে পারলাম ভগবান এখনো এই হতভাগ্যটাকে একবারে ভোলেননি।

বোস, চা করে আনি।

চা নিশ্চয়ই হবে, আপনার হাতের চা না খেয়ে নড়ছিই না। কিন্তু অনিলবাবুকে দেখছি না কোথায়ও, বেরিয়েছেন বুঝি?

সবিতা চুপ করে থাকে।

দিদি!

সে নেই।

নেই?

দশ দিন বাড়িতে আসেন না।

সে কি!

ও আর এমন কি! সবিতা হাসে।

তাই তো—তাহলে—যোগানন্দ বলে।

কি ভাই?

একা একা আছেন–

অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

তা যেন হল। কিন্তু আপনাদের চলছে কি করে? কিছু মনে করবেন না দিদি—

যেমন করে আগে চলছিল। দুটো টিউশনি করি। কিন্তু দুজন স্ত্রীলোক একা একা এই বাড়িতে ভয় করে না তো দিদি?

এমন সময় হঠাৎ অনিল ফিরে এল, হাতে একটা পোটলা।

এই যে যোগানন্দ! কতক্ষণ? অনিল প্রশ্ন করে।

এই কিছুক্ষণ। কিন্তু এ দশ দিন ডুব দিয়েছিলে কোথায়? যোগানন্দ বলে।

বর্ধমানে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। অনিল বললে।

হঠাৎ বর্ধমানে দেশের বাড়িতে? প্রশ্ন করে এবারে সবিতা।

হ্যাঁ, অনেক দিন যাইনি। তাই দেখতে গিয়েছিলাম একবার। যা দেখলাম, বাড়িঘর অবশ্য ভেঙে গিয়েছে, কঁচা টিনের বাড়ি—একটা পাক ঘর ছিল, সেইটা কোনমতে টিকে আছে।

তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে সেখানে গিয়ে থাকলেই তো হয়! কিন্তু ঐ বাড়ির কথা তো কোন দিনও তুমি আমাকে বলনি? সবিতা বলে।

বলবার মত নয় বলেই বলিনি। সে যে এ বাড়ির থেকেও এক ডিগ্ৰী–

তা হোক, তবু তো নিজের ভিটে-পরের ভাঙা বাড়িতে ভাড়া টানার চাইতে নিজের পড়ো ভাঙা ভিটেও ঢের সুখের, ঢের সম্মানের। চল আমরা কালই সেখানে যাব।—

তাই যাও না অনিল—যোগানন্দ বলে।

ক্ষেপেছ তুমি যোগানন্দ! সেখানে কোথায় যাবে? কথাটা শুরুতেই চাপা দিয়ে দেয় অনিল।

কেন, একটা ঘর তো আছে বলছিলো! সবিতা বলে।

থাকাটাই তো কেবল সব নয়, সেখানকার ম্যালেরিয়া–

তা হোক–

না না, ওখানে যাওয়া হবে না। অনিল বলে ওঠে।

যোগানন্দ উঠে দাঁড়ায় ঐ সময়, অনিল তার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে যায় এবং যোগানন্দর কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নেয়।

যোগানন্দ টাকা দিতে গিয়ে এবারে বলে, এমনি করে বার বার পরের জমি থেকে মাটি কেটে এনে নিজের ঘরের গর্ত তো ভরাট করতে পারবে না। অনিল। যা হোক একটা কিছু করো না।

ঘাবড়াও মাৎ ভায়া! তোমার দেনা এবার বোধ হয়। শিগগিরি শোধ করে দিতে পারব আর সব অভাবও ঘুচিবে।

কি রকম?

দেখ না। অভাব বাধ হয় এবার সত্যিই ঘুচল!

ভাল। যোগানন্দ মৃদুকণ্ঠে বলে।

ভাল নয় হে, সত্যিই দেখো কেমন বরাতের চাকাটা ঘুরে যায়।

অনিলের চোখেমুখে একটা আনন্দােজজুল দীপ্তি ঝলমল করে।

যোগানন্দ একটু বেশ বিস্ময়ই অনুভব করে। বলে, ব্যাপার কি বল তো সত্যি করে! লটারিতে টাকা পাচ্ছ, না কোন গুপ্তধনটন আবিষ্কার করে ফেলেছে?

সে যাই হোক, সময়ে সবই জানবে।

সবিতাকে লুকিয়ে অনিল সে রাত্রে যোগানন্দর কাছ হতে টাকা নিলেও সবিতার নজর এড়ায়নি। যোগানন্দ যাবার পর সবিতা স্বামীকে বলে, আবার টাকা নিলে যোগানন্দর কাছ হতে?

ভয় নেই, ভয় নেই-এবারে সব শোধ করে দেব এক কিস্তিতে।

সব এক কিস্তিতে শোধ করে দেবে?

হ্যাঁ।

কেমন করে শুনি?

দেখই না! অনিল রহস্যপূর্ণ হাসি হাসতে থাকে।

এর পর কয়েকটা দিন অনিল আর কোথাও বের হয় না। এবং কোথাও বের হলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার ফিরে আসে। দিবারাত্র ঘরেই থাকে। আর মধ্যে মধ্যে একটা লাল-মলাট-বঁধানো জীর্ণ খাতার পাতা উল্টে পাল্টে পড়ে গভীর মনোযোগ সহকারে।

সবিতার কৌতূহল হল ব্যাপারটা কি জনবার জন্য কিন্তু সুযোগ পায় না।

সর্বদা যেন যখের ধানের মতই অনিল লাল মলাটওয়ালা খাতাটা ও পোঁটলাটা আগলে রেখেছে।

শুধু সবিতাই নয়, এবারে বাণীও বাপের ওপরে সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখে।

সে এবারে ঠিক করেছে বাপকে কিছুতেই নজরছাড়া করবেনা, কারণ তারও মনে একটা সন্দেহ জেগেছে। নিশ্চয়ই আবার তার বাপের মাথায় কোন দুরভিসন্ধি বাসা বেঁধেছে!

হঠাৎ একদিন অনিলের অনুপস্থিতির সুযোগে সবিতা পোটলা খুলে দেখে তার মধ্যে নেকড়া জড়ানো আছে একটি সোনার কঙ্কন, কিন্তু ব্যাপারটা ভাল করে বুঝবার আগেই হঠাৎ আবার অনিল ফিরে আসায় পোটলাটা যথাস্থানে রেখে দিতে বাধ্য হয় সবিতা। এবং পরদিনই প্রাতে ঘুম থেকে উঠে সবিতা দেখল তার স্বামী ও বাণী দুজনের একজনও ঘরে নেই।

প্রথমটায় সবিতা ভেবেছিল তারা বােধ হয় দুজনে কোথাও বের হয়েছে, কিন্তু দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল তখনও দুজনের একজনও ফিরল না দেখে সবিতা রীতিমত চিন্তিত হয়ে ওঠে। ঠিক ঐ সময় হঠাৎ তার রামায়ণটার ভিতরে বাণীর একটা চিঠি আবিষ্কার করে।

মা, বাবার সঙ্গে সঙ্গে চললাম—বাণী।

বুঝল সবিতা, দুজনেই একসঙ্গে গিয়েছে।

অন্যান্য বারের চাইতে এবারে সবিতার চিন্তা হল বেশী, কারণ সঙ্গে বয়স্থ মেয়ে বাণী।

এবং বাণী তার পিতার প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট নয়, জানে সবিতা।

দুর্ভাবনায় দুশ্চিন্তায় দু রাত্রি কেটে গেল। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় এল যোগানন্দ।

সবিতা একাকী ঘরের মধ্যে চুপটি করে আলো জ্বেলে বসে ছিল।

যোগানন্দ সবিতাকে ঐ অবস্থায় দেখে শুধাল কি ব্যাপার দিদি, চুপটি করে একা বসে যে! মেয়ে কোথায়? আনিলবাবু বুঝি আবার চলে গেছেন?

এস যোগেন। সবিতা যোগানন্দকে আহ্বান জানাল। এবং ধীরে ধীরে সব বৃত্তান্ত খুলে বলল।

তাই তো! মেয়েও তার বাপের সঙ্গে গেল? তা মেয়ে যখন তার বাপের সঙ্গেই গিয়েছে

নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম, কিন্তু আমার তা মনে হয় না ভাই। ওকে তো আমি চিনি— আর মেয়ে বাপের প্রতি কোনদিনই প্ৰসন্ন নয়।

ভাবছেন কেন, হয়তো একপ্রকার ভালই হল!

না যোগেন, সে যদি স্বেচ্ছায় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যেত ভাবতাম না। কিন্তু এ তো তা নয়, তাহলে তো–

কিন্তু আমারও মনে হয় আপনার এই চিন্তার কিছু নেই। চিন্তার নেই!

না।

সবিতা চুপ করে থাকে।

সে যাক, এভাবে এখন তো আর একা একা এখানে আপনার থাকা চলতে পারে না দিদি।

তা ছাড়া আর উপায় কি বল? যাব কোথায়?

যদি আপত্তি না থাকে তো আমার ওখানে চলুন না দিদি!

তা হয় না যোগানন্দ।

কেন?

সে তুমি বুঝবে না। তা ছাড়া এমনিতেই তো তোমার ঋণ এ জীবনে কোনদিন আমরা শোধ করতে পারব না। তার উপর আর ঋণ বাড়াতে চাই না।

ও কথা বলে আর লজা দেবেন না দিদি। আজকের দিনে সংসারে পরস্পরের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক বলে কোন বস্তুই নেই, এমনিভাবে আমরা সমাজের মধ্যে পরস্পর হতে পরস্পর পাশাপাশি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। জ্ঞান হওয়া অবধি সংসারে বা সমাজের মধ্যে একটি মাত্র সম্পর্কই সকলের মধ্যে দেখে আসছি—স্বার্থের সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্কের মধ্যেও সেই সম্পর্কটা টেনে এনে সেটাকে ছোট করে দেবেন না, এই আমার অনুরোধ।

যোগানন্দর মুখে কথাগুলো শুনে সবিতা মুগ্ধ হয়ে যায়।

কদিনেরই বা পরিচয় ঐ যুবকটির সঙ্গে তাদের।

সম্পূর্ণ অপরিচিত, পথের লোক-নিজে যে সবিতা একটু বিব্রতও বোধ করে না তা নয়।

না না-দুঃখ করো না ভাই। তোমাকে আমি অন্তত সেরকম কখনো ভাবিনি। সবিতা বললে, তোমার সঙ্গে পরিচয়টা জীবনে অক্ষয়ই হয়ে থােক, ধূলোর ওপর টেনে এনে তাকে আমি তো ছোট করতে পারব না ভাই। আজকের দিনে তুমিই তো আমার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেজন্য নয়, এখন হতে অন্য কোথায়ও যাবার আমার সত্যিই বাধা আছে–

বেশ, তবে আর কি বলব বলুন।

পরের দিনই সকালে যোগানন্দ তার দারোয়ান প্রৌঢ় মহাবীর ও একজন রাতদিনের ঝি সবিতাকে সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দিল। এবং নিজেও মধ্যে মধ্যে এসে সবিতার খোঁজ নিয়ে যেতে লাগল।

বাণীর হাত ধরে টানতে টানতে কক্ষের মধ্যে নিয়ে এল অনিল।

মাসখানেক একেবারে ক্ষৌরকর্ম না করায় একমুখ দাঁড়িগোফ গজিয়েছে আজ অনিলের মুখে। তাকে আজ আর চেনবার সত্যিই উপায় নেই।

ঘরের কোণে প্রদীপট জ্বলছে মিটমিট করে। প্রদীপের স্বল্প আলোছায়া অপরিসর ছোট ইট-বের করা ঘরের জীর্ণ দেওয়ালে যেন রহস্যের আলপনা বুনে চলেছে।

হতচ্ছাড়া মেয়ে, তোকে ইচ্ছে করছে গলা টিপে শেষ করে ফেলি! রাগতকণ্ঠে অনিল বলে।

বাণী বাপের কথায় কোন প্রতিবাদ জানায় না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

বাণীকে নীরব থাকতে দেখে কি জানি কেন আনিলের রাগটা বোধ হয় নরম হয়ে আসে। মৃদু চাপাকণ্ঠে এবারে বলে, কতবার না বলেছি ঝোপ-জঙ্গল সাপে ভর্তি, যখন তখন অমন করে ঘরের বাইরে যাস না!

তুমি তো সারাটা দিন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াও! তোমাকে বুঝি সাপে কাটতে পারে না?

আমার আর তোর কথা এক হল!

কেন এক নয়? তার চেয়ে চল না বাবা, কি হবে মিথ্যে আমন করে আর মাটি খুঁড়ে? আমরা ফিরে যাই।

ফিরে যাব? কখনোই না। জানিস তুই, কেন আমি এখানে এসেছি?

সবটা না বুঝলেও কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি বৈকি। স্মিতকণ্ঠে জবাব দেয় বাণী।

তুই কিছু জানিস না। জানিস যেজন্য এসেছি তা যদি পাই তাহলে এ জীবনে আমাদের আর কোন অভাবই থাকবেনা! রাজার হালে পায়ের উপর পা দিয়ে বসে-বসেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব!

ঐসব কথায় তুমি বিশ্বাস কর বাবা? পুরানো রাজবাড়ি জমিদারবাড়ি সম্পর্কে ওরকম অনেক কথাই রটে! যক্ষের ধন সত্যি কখনও থাকে! ও গল্পই!

হ্যাঁ, তুই তো সব জেনে একেবারে বসে আছিস। খিঁচিয়ে উঠল অনিল।

এই এক মাস ধরে তো তুমি কম খুঁজলে না, পেলে কিছুর সন্ধান? বল?

পাইনি এখনো ঠিক, তবে পাবই। নিশ্চয়ই আমি খুঁজে বের করব। আর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে এক পা আমি নড়ছি না। খুঁজে আমকে বের করতেই হবে।

সত্যি, বাপের জন্য দুঃখ হয় বাণীর।

মানুষের সমস্ত শিক্ষা ও রুচিকে কি ভাবে যে এক এক সময় তার দুর্ভাগ্য আচ্ছন্ন করে ভাবতেও বিস্ময় লাগে। নইলে তার শিক্ষিত বাপ দুর্ভাগ্যের টানে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ!

বাণী মুখে স্বীকার না করলেও তার মনের কোণার তার উচ্ছৃঙ্খল পথভ্রষ্ট বাপের জন্য যে একটা দর্বলতা ছিল, সেটাই সে বুঝতে পারত না।

দশ বৎসর বয়সের সময় সে তার ব্যাপকে প্রথম দেখে।

মায়ের সঙ্গে তার সর্বপ্রকার আলোচনাই হত, একমাত্ৰ বাপের সম্পর্কে কখনো কোন আলোচনা হত না।

মা যে কতকটা ইচ্ছা করেই একান্তভাবে তার বাপের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত, ঐ অল্প বয়সেও বাণী সেটা বুঝতে পেরেছিল। কারণ সাধারণের চাইতে ঐ অল্প বয়সেই বাণীর বুদ্ধিটা ছিল একটু বেশ প্রখরই।

এবং মা তার বাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেও মারা মনের কোণে যে তার স্বামী সম্পর্কে একটা বিশেষ দর্বলতা আছে, সেটাও কিন্তু বুঝতে বাণীর কষ্ট হয়নি।

কতদিন তার চোখে পড়েছে মা তার নিভৃতে স্বামীর ফটোখানির দিকে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তারপর বাপের সঙ্গে যখন এসে সেই বৌবাজারের ভাঙা অন্ধকার বাড়িতে ওরা উঠল একদিন তার হাত ধরে, তখন থেকেই কেন না-জানি ঐ বিচিত্র চরিত্রের লোকটির ওপরে এক অজ্ঞাত আকর্ষণ অনুভব করেছে সে।

একে একে তার চোখের সামনেই দেখেছে মায়ের গায়ের গহনাগুলো বেচে বাপ তার নষ্ট করেছে, তা সত্ত্বেও মায়ের নির্বিকার ক্ষমা মধ্যে মধ্যে বাণীকে বাপের প্রতি বিদ্রোহী করে তুললেও সেই সঙ্গে লোকটার প্রতি জেগেছে মনের কোথায় যেন একটা সহানুভূতি, অনুকম্পা।

মধ্যে মধ্যে বাপ তাকে পড়িয়েছে, সেই সময় বাণী দেখেছে লোকটির জ্ঞান কত গভীর, কত জানাশোনা!

তৎসত্ত্বেও জগতের সব কিছুর ওপরে অসীম একটা উপেক্ষা। ছন্নছাড়া জীবন-স্বভাবের উচ্ছৃঙ্খলতা।

তার মায়ের মত স্ত্রী পেয়েও যে লোকটা সুখী হয়ে ঘর বাঁধতে পারল না, তার জন্য মনে মনে বাণী দুঃখ বোধ করেছে।

এবং সেটাই বুঝতে পারেনি যে, ঐ দুঃখবোধের ভিতর দিয়েই ধীরে ধীরে কখন মনের মধ্যে জেগেছে তার সহানুভূতি, পথভ্রষ্ট সৃষ্টিছাড়া বাপের ওপরে জন্মেছে একটা আকর্ষণ, যার টানে সে অনায়াসেই সেদিন মধ্যরাত্রে পলায়নপর পিতার পিছু পিছু ঘর থেকে বের হয়ে তাকে অনুসরণ করেছিল।

তারপর বাপ টের পেয়ে তাকে ফিরে যাবার জন্য তার অনুরোধ, ভয়প্রদর্শন, রাগ কিছুই তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি সেদিন। এবং এখানে এসেও বাপের গালাগালি রাগ সব কিছুকে উপেক্ষা করে এই বনজঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়িতে পড়ে আছে।

অনিলও প্রথমটায় তাকে না জানিয়ে অকস্মাৎ চোরের মত গোপনে গোপনে বাণী তার পিছু নেওয়ায় বিশেষ রকম ক্ষেপে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েকে সঙ্গে করে বহরমপুর না নিয়ে এসে পারেনি।

প্রথমে সে জানতে পারে বাণী তাকে অনুসরণ করে এসেছে স্টেশনে পৌঁছে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য একটা চেঁচামেচি ও কেলেঙ্কারির ভয়েই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসতে অনিল একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল বললেও অত্যুক্তি হয় না।

কিন্তু রাগটা অনিলের দুদিনের বেশী থাকে না।

বাণী সঙ্গে আসতে তার কিছু সুবিধাও হয়েছিল। নিজ হাত পুড়িয়ে আর রান্না করে খেতে হয়নি।

প্রথম প্রথম জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়িতে থাকতে বাণীর খুবই খারাপ লাগছিল, কিন্তু বাপের একান্ত ঘনিষ্ঠতার মধ্যে এসে বাপের মধ্যে একটা স্নেহ-কোমল অথচ দুৰ্দান্ত বেপরোয়া মন আবিষ্কার করে কেমন একটা মায়াও পড়ে গিয়েছিল এই এক মাসের মধ্যেই তার মনে।

অনিল সারাটা দিন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

একটা লোহার শাবল নিয়ে এখানে ওখানে মাটি খোঁড়ে বা জঙ্গল কেটে সাফ করে আর রাত্রে একটা লাল মলাট দেওয়া খাতার জীর্ণ মলিন পাতা খুলে প্রদীপের আলোয় উল্টে উল্টে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়ে।

কলকাতাতেও এবারে বাণী বাবাকে ঐ খাতাটা পড়তে ও সযত্নে আগলে বেড়াতে দেখেছে।

কৌতূহল হয়েছে খাতাটার মধ্যে কি আছে জানিবার জন্য, কিন্তু সুযোগ বা সুবিধা পায়নি কলকাতাতে।

এখানে আসবার পর একদিন দ্বিপ্রহরে বাপের অনুপস্থিতিতে চুরি করে গোপনে খাতাটার কিছু অংশ পড়েছে।

জীর্ণ লালচে পাতায় কার ফোন ডায়ারী লেখা আছে।

সাল তারিখ দিয়ে নিয়মিত ডায়ারী নয়। এলোমেলা অসংলগ্ন ভাবে লেখা ঠিক ডায়ারী নয়, যেন কতকটা আত্মজীবনী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর।

মার কাছেই শুনেছিল বাণী একদিন, তার পিতামহের নাম ছিল শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী।

এবং প্রথম হতেই তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ। সংসারের প্রতি তীর কোন আকৰ্ণ ছিল না। এবং দৈবচক্রে আকস্মিক দুর্ঘটনায় সে রাত্রে তার পিতামহী মৃন্ময়ী দেবী নিহত হন। সেই রাত্রেই তার পিতামহ শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী সেই যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন, আর কোন সংবাদই পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি।

তিনি আজও জীবিত কি মৃত কেউ তা জানে না।

এবং পিতৃমাতৃহীন তার বাপ মানুষ হন তীর দিদিমার কাছে মামার বাড়িতেই।

অত্যন্ত আত্মভিমানী পুরুষ ছিলেন তাঁর বাপ। বছর কুড়ি বয়স যখন তাঁর, সেই সময় একদিন তার চেয়ে বয়সে ছোট মামার সঙ্গে কি কথায় রাগারাগি হওয়ায় সেই যে একবস্ত্ৰে মাতামহের গৃহ ছেড়ে চলে আসেন, আর ওমুখো এ জীবনে হননি।

একটা মফস্বল শহরে গিয়ে সেখানকার কলেজে পড়ে টিউশনি করে বি. এ. পাস করে কলকাতায় এসে এম. এ. পড়তে শুরু করেন। সেই সময়ই তার মাতামহের সঙ্গে ও তার মারি সঙ্গে আলাপ।

কিরীটী বামদেবের সঙ্গে বহরমপুর যায়নি ইচ্ছা করেই। বহরমপুরের রত্নমঞ্জিল ও সুবৰ্ণকিঙ্গনকে কেন্দ্র করে যে একটা রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা কিরীটীর কাছে আর অজ্ঞাত ছিল না।

আগাগোড়া গত ক’দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝতে কষ্ট হয় না। সব কিছুর মূলে ঐ রত্নমঞ্জিল।

কঙ্কনটা চুরি করার চেষ্টা। রানার রত্নমঞ্জিলটা ক্রয় করবার বিশেষ আগ্রহ এবং অসম্ভব মূল্যে স্বীকৃত হয়ে বায়না দেওয়া, তারপর কোন এক অপরিচিতের পত্র মারফৎ সাবধান বাণী রত্নমঞ্চিল না বিক্রয় করবার জন্য—সব কিছু জড়িয়ে একটি রহস্যই যেন দানা বেঁধে উঠছিল সব কিছুর মধ্যে।

ঐ রত্নমঞ্জিল!

কিরীটী বুঝেছিল তাকে ঐ রহস্যের কিনারা করতে হলে ভেবেচিন্তে বুঝে অত্যন্ত সাবধানে মাটি বুঝে অতঃপর প্রতিটি পা ফেলে ফেলে এগুতে হবে।

এবং যতটা সম্ভব নিজেকে আড়ালে রেখে কাজ করতে হবে। যেন কোন মতেই কারো না সন্দেহ জাগে এতটুকু যে কিরীটী রত্নমঞ্জিলের ব্যপারে জড়িয়ে পড়েছে।

কিরীটী আড়াল থেকে কাজ করবে। একপ্রকার স্থির করেছিল, যেদিন বামদেবের ওখান থেকে নিমন্ত্রণ সেরে ফিরবার পথে সে অনুসৃত হয়েছিল।

তাই পরের দিন যখন তার বন্ধু অফিসারকে বলে। লালবাজার থেকে দত্ত অ্যাণ্ড সাহার অফিসে রানার সামনে একটা টোপ ফেলবার ব্যবস্থা করেছিল, নিজে তখন চুপ করে বসে থাকেনি।

কিছু পরেই সাধারণ এক ভাটিয়ার ছদ্মবেশ ধারণ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তার উপরে এসে ভাবছে কোন পথে এখন অগ্রসর হওয়া যায়, হঠাৎ পাশ দিয়ে তার পরিচিত একটি ট্যাক্সিকে যেতে দেখে হাত-ইশারায় কিরীটী ট্যাক্সিটা থামাল।

ট্যাক্সি ট্রাইভার পরমেশ্বর কিরীটীর বিশেষ পরিচিত হলেও ছদ্মবেশধারী কিরীটীকে কিন্তু চিনতে পারে না প্রথমটায়।

ট্যাক্সিতে চেপে কিরীটী তাকে নির্দেশ দিতেই ট্যাক্সি ছুটল।

নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ট্যাক্সিটা থামিয়ে পরমেশ্বর ট্যাক্সির দরজা খুলে দিতে যেমন উদ্যত হয়েছে কিরীটী বাধা দিল, এখন নামব না, দরজা বন্ধ করে দাও পরমেশ্বর।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে ফিরে তাকায় পরমেশ্বর পশ্চাতে আরোহীর দিকে।

কি চিনতে পারছ না? কিরীটী বললে।

এতক্ষণে কিরীটীর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে পরমেশ্বর তাকে চিনতে পারে।

হেসে বলে, স্যার আপনি! ইস একদম চিনতে পারিনি স্যার!

সঙ্গে সঙ্গেই পরমেশ্বর বুঝতে পারে কোন গোপন তদন্তের ব্যাপারে নিশ্চয়ই কারো গতিবিধির উপর নজর রাখবার জন্য কিরীটীর এই ছদ্মবেশে অভিসার।

পরমেশ্বর রাস্তার একধারে গাড়িটা পার্ক করে রাখে। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে অপেক্ষা করে কিরীটী গাড়ি থেকে নামল। পরমেশ্বরকে অপেক্ষা করবার নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের বড় বাড়িটার গেটের দিকে।

মাস্তবড় পাচতলা একটা বাড়ি। অসংখ্য অফিস সেই বাড়িটার ঘরে ঘরে। এবং তখনও সেখানে কর্মব্যস্ততার একটা চাঞ্চল্য।

সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় দত্ত অ্যান্ড সাহার চেম্বারের দিকে এগিয়ে চলে কিরীটী একসময়।

এবং চেম্বারের সুইং ডোরের অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষা করে।

প্রায় কুড়ি মিনিট বাদে কিরীটী লক্ষ্য করে একজন হৃষ্টপুষ্ট ভাটিয়া লিফটে চেপে তিনতলায় এসে উঠল, সঙ্গে তার ঢ্যাঙামত একজন লোক, হাতে তার মার্কোভিচের একটা টিন ও ওষ্ঠে ধৃত সদ্য-জ্বালানো একটি সিগারেট।

আমার আর ভিতরে গিয়ে কি হবে শেঠ! ঢাঙা লোকটি ভাটিয়াকে বলে।

তাহলে তুমি গাড়িতেই গিয়ে অপেক্ষা কর পিয়ারী। দেখি শালা দত্ত আবার ডাকল কেন?

কিরীটির মনে হয় ঐ পিয়ারী লোকটা তার একেবারে অপরিচিত নয়।

তাই বসি গে। তুমি তাহলে কাজ সেরে এস। পিয়ারী নামধারী ঢাঙা লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

ভাটিয়া দত্ত-সাহার চেম্বারে ঢুকতে যাবে সুইংডোর ঠেলে, একজন ভদ্রলোক বের হয়ে এল মুখোমুখি হতেই বললে, রানা যে, কি খবর?

একটু কাজ আছে ভাই মুখুজ্জে।

ও।

রানা ভিতরে প্রবেশ করল এবং মুখুজ্জে চলে গেল।

তাহলে উনিই সেই স্বনামধন্য শেঠ রতনলাল রানা! কিরিটী মনে মনে ভাবে।

রত্নমঞ্জিল বায়না করেছে পঞ্চান্ন হাজার টাকায় কিনবার জন্য ও-ই!

ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন দেখা যাচ্ছে—লোকটির দেখা পাওয়া গেল!

কিরীটী অতঃপর সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ছকে ফেলে।

কিরীটীর মনে পড়ল। হঠাৎ ভাবতে ভাবতে, গোপন নোটবুকে তার ঐ পিয়ারী নামটি অনেকদিন আগে থেকেই টোকা আছে।

ক্রমশ সবই মনে পড়ে।

লোকটা গতিবিধি যে কেবল অত্যন্ত সন্দেহজনক শুধু তাই নয়, বছর খানেক আগে একবার ও মাসছয়েক আগে আর একবার দুটো জটিল নোট জাল ও ওপিয়াম স্মাগলিংয়ের কেসের সঙ্গে ঐ নামটি বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই জড়িয়ে ছিল কিরীটীর মনে পড়ল।

কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও লোকটাকে ধরা ছোঁয়া যায়নি সে সময়।

তেলা মাছের মত হাতের মুঠোর মধ্যে এসেও প্রায় প্রমাণের অভাবে পিছলে গিয়েছিল যেন।

তখনই বুঝেছিল কিরীটী লোকটি যেমনি ধূর্ত, ক্ষিপ্র ও তেমনি শয়তান। অসংখ্য ডেরা আছে লোকটার।

কোথায়ও এক দিন, কোথায়ও দুদিন বা বড়জোর দিন চারেকের বেশী এক নাগাড়ে থাকে না কখনো।

সর্বত্র গতিবিধি।

কি করে কি ভাবে চলে তাও সঠিক জানা যায়নি এখন পর্যন্ত।

তাতে করে আরো সন্দেহটা পিয়ারীর উপর ঘনীভূত হয়েছে কিরীটীর। এবং সেই থেকেই তীক্ষ্ণ নজর আছে পিয়ারীর উপর কিরীটিার। লোক-চরিত্র সম্পর্কে কিরীটীর যতটা জ্ঞান আছে, তাতে করে অন্তত এটুকু তার কাছে অস্পষ্ট নেই যে লোকটা গভীর জলের মাছ।

কিরীটী তাই রানার সঙ্গে পিয়ারীর ঘনিষ্ঠতা দেখে চমকে উঠেছিল।

পিয়ারী রানার সঙ্গে কেন? কতদিনের আলাপ ওদের আর কেনই বা ঐ ঘনিষ্ঠতা? এবং কোন সূত্রে আলাপ ওদের?

প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে রানা চেম্বার থেকে বের হয়ে এল।

কিরীটীও নিঃশব্দে অলক্ষ্যে রানাকে অনুসরণ করে।

রানা তার অফিসে পৌছে পিয়ারীকে সঙ্গে নিয়ে উপরে চলে গেল।

কিরীটী তখন গাড়ি থেকে নেমে পরমেশ্বরের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তাকে বললে, পরমেশ্বর, তুমি একটু দূরে গিয়ে তোমার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা কর।

ঐ যে ড্যাঙা লোকটা দেখলে ও যদি এসে তোমার ট্যাক্সি ভাড়া করে তো তাকে পৌঁছে দেবে ও ঠিকানাটা ওর মনে রাখবে। আর তা যদি না হয় তো আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। মোট কথা আমার সঙ্গে আজ তোমার দেখা হয় ভালই, নচেৎ কাল সকালে আমার সঙ্গে সকাল নটার মধ্যে দেখা করবে।

পরমেশ্বর সম্মতি জানিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল।

আধঘণ্টা পরে প্রায় পিয়ারীকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ের দিকে অগ্রসর হয়ে যেতে লক্ষ্য করলে কিরাটী। কিন্তু রানাকে বের হতে দেখল না।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন রানা বের হল না, কিরীটী রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে চলল।

মোড়ে এসে দেখল পরমেশ্বরের ট্যাক্সিটা সেখানে আশেপাশে কোথায়ও নেই।

খানিকটা আরও এগিয়ে গিয়ে হাত-ইশারায় একটা খালি ট্যাক্সি ডেকে কিরিটী উঠে বসল।

সোজা মেসে ফিরে এল কিরীটী।

রাত আটটা নাগাদ বামদেবের ওখান হতে টেলিফোনে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি লিখিত পত্রের কথা জানতে পারল কিরীটী।

বামদেবের সঙ্গে কথা শেষ করে কিরীটী সেফায় বসে একটা সিগার ধরাল।

নানা চিন্তা তার মাথার মধ্যে এসে ঘোরাফেরা করছে তখন।

হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়ায় উঠে গিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে লালবাজারে কানেকশন চাইল।

ফোন ধরেছিল যে তাকে কিরীটী জিজ্ঞাসা করে মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ সি. আই. ডি অফিসার আছে কিনা দেখ তো!

মৃত্যুঞ্জয় নতুন সি. আই. ডি. তে ঢুকলেও ছেলেটি খুব চালাক, চটপটে ও কর্মঠ।

মৃত্যুঞ্জয় ওই সময় লালবাজারেই ছিল। সে এসে ফোন ধরে। কে? আমি মৃত্যুঞ্জয় কথা বলছি।

কে, মৃত্যুঞ্জয়?

হ্যাঁ। আপনি কে?

আমি কিরীটী রায়। শোন একটা জরুরী কাজ করতে পারবে মৃত্যুঞ্জয় এখুনি?

কি ব্যাপার বলুন তো?

সংক্ষেপে তখন রানার অফিসের ঠিকানা ও চেহারার একটা বৰ্ণনা দিয়ে সেখানে গিয়ে বাড়িটার উপরে ও সেখানে অন্য কেউ আসা-যাওয়া করে। কিনা তাদের ওপরে নজর রাখবার জন্য মৃত্যুঞ্জয়কে বলল কিরীটী!

মৃত্যুঞ্জয় সব শুনে বললে, আমি এখুনি যাচ্ছি।

মৃত্যুঞ্জয় নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছবার মিনিট কয়েক বাদেই লক্ষ্য করল, যোগানন্দকে রাণার আফিসে গিয়ে প্রবেশ করতে।

ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকারে পাড়াটা তখন বেশ নির্জন হয়ে গিয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয় দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী একটা সরু গলিমত জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। স্থির সতর্ক দৃষ্টি তার থাকে রানার অফিস-বাড়িটার দিকে।

রানার গাড়িটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভারটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

রাত প্রায় সোয়া নটা নাগাদ যোগানন্দ বের হয়ে এল এবং সতর্ক অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে শ্লথ মন্থর পদে হেঁটে চলল। এবং প্রায় যোগানন্দ হাত দশবারো এগুবার পরই রানা নেমে এসে গাড়িতে উঠল।

গাড়ি ছেড়ে দিল।

মৃত্যুঞ্জয় তখন বেশ একটু দ্রুতপদেই এগিয়ে গেল রাস্তার মোড়ের দিকে। যোগানন্দ তখন বেশী দূর যায়নি, ফুটপাথ ধরে ধীরে শ্লথ গতিতে হেঁটে চলেছে।

মৃত্যুঞ্জয় অনুসরণ করে যোগানন্দকে একটা নির্দিষ্ট ব্যাবধান রেখে নিঃশব্দে।

হাঁটতে হাঁটতে যোগানন্দ বৌবাজার স্ট্রীট ধরে কিছুটা এণ্ডবার পর হঠাৎ বাঁয়ের একটা সরু অন্ধ গলির মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল।

মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়ে পড়ে।

রাত প্রায় পৌনে দশটায় দীর্ঘ অপেক্ষার পর যোগানন্দ আবার একসময় বের হয়ে এল।

আবার সে হেঁটেই চলল। মৃত্যুঞ্জয়ও তাকে অনুসরণ করে চলে।

হেঁটেই চলেছে যোগানন্দ।

স্পষ্ট বোঝা যায় লোকটি বেশ অন্যমনস্ক, কি যেন ভাবতে ভারতে চলেছে। রাত দশটা বাজাতে চলল। তবু কলকাতার রাস্তার জনপ্রবাহের এখনো যেন বিরাম নেই। শহরের কর্মব্যস্ততা তেমনি চলেছে যেন অব্যাহত। তবে বাসে ট্রামে ভিড়টা যেন কমে এসেছে।

দোকানপাট ক্রমে ক্ৰমে সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, একমাত্র খাবারের দোকান, পানসিগারেটের দোকান ও চায়ের রেস্তোরাঁগুলো ভিন্ন-বিশেষ করে শেষোক্ত জায়গায় খরিদ্দারের এখনো অভাব নেই।

মৃত্যুঞ্জয় লক্ষ্য করে—যোগানন্দ হেঁটে চলেছে। অন্যমনস্ক হয়ে এভিনু ধরে।

যোগানন্দ হেঁটে চলছিল। রানার ওখানেও আজ যোগানন্দ বিশেষ পান করেনি। সামান্য যা পান করেছিল তাতে শরীরটা একটু চনচন করে উঠেছিল বটে কিছুক্ষণের জন্য, তার চাইতে কিছুই হয়নি।

দুটো ডেরা যোগানন্দর। একটি কলেজ স্ট্রীটের উপরে সিটি হোটেলে তিনতলার নিভৃত একটি কক্ষ অন্যটি কালীঘাটে মহিম হালদার স্ট্রীটের উপর দোতলা একটা বাড়ি। আজকের রাতের মত যোগানন্দ আর কালীঘাটে ফিরবে না।

সিটি হোটেলের ঘরেই রাত কাটাবে ঠিক করেছিল ইতিমধ্যে মনে মনে। হোটেলে পেঁৗছে সোজা তিনতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাটা খুলে নিজের নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল যোগানন্দ।

দরজাটা ভিতর থেকে এঁটে দিল।

ঘরটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভাবে সাজানো।

একটি কাবার্ড, একটি ড্রেসিংটেবিল তার পাশে একটি আলনা।

এক পাশে একটি সিঙ্গল খাটে শয্যা বিছানো। একটি ছোট টেবিল ও একটি বেতের আরাম কেদারা।

জামাকাপড় খুলে ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করল যোগানন্দ।

স্নান করে একটা পায়জামা ও গেঞ্জি পরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল।

ঘুমে দু চোখ জড়িয়ে আসছে।

আরাম-কেদারাটার উপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝল যোগানন্দ।

মৃত্যুঞ্জয় তখন হোটেলের মালিক শশীকান্ত হাজরার সঙ্গে তার প্রাইভেট চেম্বারে বসে কথা বলছে।

মৃত্যুঞ্জয় পূর্বে কয়েকবার কিরীটীর সঙ্গে কাজ করেছে। এবং কিরাটীর সঙ্গে কাজ করে ভাবছে ঐ লোকটি সখের একজন গোয়েন্দা হলেও অদ্ভুত তার বিচার ও বিশ্লেষণশক্তি। কিরীটীর সঙ্গে কাজ করতে পারলে সে লাভবান হবে। তাই কিরীটীর নির্দেশ পেয়ে সে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল।

পরের দিন ঠিক বেলা নটায় পরমেশ্বর কিরীটীর সঙ্গে মেসে এসে দেখা করল।

লেক অঞ্চলে যে হঠাৎ-ধনী ও তথাকথিত অভিজাত শ্রেণীর উন্ন্যাসিক এক অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে ও গত মহাযুদ্ধে কালোবাজারে ফেঁপে-ওঠা সম্প্রদায়ের বসতি গড়ে উঠেছে—সেইখানেই একটা দোতলা ফ্ল্যাটের দুখানা ঘর নিয়ে পিয়ারী থাকে পরমেশ্বর বললে।

পরমেশ্বরের ট্যাক্সিতে চেপেই পিয়ারী ফিরে গিয়েছিল। এবং লেক অঞ্চলের সেই ফ্ল্যাটবাড়ির সামনেই তাকে নামিয়ে দিয়ে এসেছে পরমেশ্বর।

ইতিমধ্যে খুব ভোরে ফোন মারফৎ কিরীটী যোগানন্দর সংবাদও মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে পেয়েছিল।

হোটেলের ম্যানেজার হাজরার কাছ থেকে যোগানন্দ সম্পর্কে মৃত্যুঞ্জয় যেটুকু সংবাদ সংগ্রহ করতে পেরেছিল সেটা যেমনি অস্পষ্ট তেমনি ধোঁয়াটে।

যোগানন্দের পুরো নাম যোগানন্দ রায়।

নিয়মিত ঠিক ভাড়া দিলেও দিনের বেলায় তো কোন দিনই নয়—রাতেও কখনো কখনো হাপ্তায় এক-আধ-দিন কটায় মাত্র সেই ঘরে।

ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক। বিশেষ সজন বলেই মনে হয়।

কি করে, চাকরি না ব্যবসা তাও ম্যানেজার বলতে সক্ষম হয়নি। তবে অবস্থা বেশ সচ্ছল বলেই মনে হয়, বেশভুষা অত্যন্ত কেতাদুরস্ত ফিটফাট।

ভিজিটার্স কখনো কাউকে আসতে দেখা যায়নি। সঙ্গে করেও গত তিন-চার বছরে কাউকে কখনও তাকে কেউ আনতে দেখেনি।

লোকটা যে মদ্যপান করে সেটা হোটেলের চাকরের মুখেই শোনা।।

পরমেশ্বরকে বিদায় দিয়ে কিরীটী সোজা এল লালবাজার। এবং সুভায্যের ঘরে ঢুকল।

সুভাষ বললে, কিরাটী যে, কি ব্যাপার?

একটা কাজ করতে পারবে ভাই?

কি বল?

কি ব্যাপার বলা তো কিরীটী?

হরিদ্ধারে হরকি পিয়ারীর কাছে ভরদ্বাজ আশ্রমে শ্যামসুন্দর চক্রবতী নামে একজন সংসারত্যাগী ভদ্রলোক থাকেন। আমি শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর নামে একটা চিঠি দেব, তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বামদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষদের যতটা সম্ভব সংবাদ লোকটিকে সংগ্রহ করে আনতে হবে, আর জেনে আসতে হবে তিনি তাঁর পুত্র অনিল চক্রবর্তীর কোন সংবাদ রাখেন কিনা।

ব্যাপারটা খুলে বল ভাই। অতঃপর কিরীটী সংক্ষেপে রত্নমঞ্জিল ও সুবর্ণকিঙ্কন সম্পর্কে সমস্ত বললে সুভাষকে।

এবং পরিদিন কিরীটী বহরমপুর রওনা হয়।

অপমানে আক্ৰোশে ফুলতে ফুলতে পিয়ারী রত্নমঞ্জিল থেকে বের হয়ে এল।

বিনয়ের শেষের কথাগুলো তখনও যেন তাঁর সর্বাঙ্গে ছুঁচ ফোটাছিল।

বামদেব যে তার প্রস্তাবে রাজী হবেন না পিয়ারী সেটা কিছটা পূর্বেই অনুমান করেছিল, তাই সে আরো দুজনকে সঙ্গে এনেছিল, তার বিশ্বস্ত ও বহু পাপানুষ্ঠানের সহচর গুপীনাথ ও ছট্টুলালকে।

গুপীনাথের তাঁবে ছিল কলকাতার একদল নিম্নশ্রেণীর জঘন্য প্রকৃতির গুন্ডা।

নিজেও যে সে রাতের অন্ধকারে ও দিনের প্রকাশ্য আলোকে কত লোকের বুকে ছুরি বসিয়েছে তার সংখ্যা ছিল না।

গায়ে যেমন অসুরের মত শক্তি, প্রকৃতিও তেমনি ছিল দুর্ধর্ষ।

পয়সার বিনিময়ে গুপী করতে পারত না দুনিয়ায় এমন কোন কাজই ছিল না।

পিয়ারী বহরুমপুরে এসে কিন্তু কোন হোটেলে ওঠেনি।

ছট্টুর কাছ থেকে পূর্বাহ্নেই সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করে জেনেছিল। রত্নমঞ্জিল থেকে আধ মাইলটাক দূরে গঙ্গার ধারে নবাব আমলের একটা ভগ্ন অট্টালিকা আছে, লোকে বলে সেটাকে আরামবাগ। সেই আরামবাগেই এসে আশ্রয় নিয়েছিল তিনজনে গোপনে।

জঙ্গলাকীর্ণ বুনো আগাছায় ভরা বহু বৎসরের পরিত্যক্ত ভগ্ন জীর্ণ আরামবাগেরই একটা কক্ষ কোনমতে পরিষ্কার করে নিয়ে ওরা তাদের ডেরা বেঁধেছিল।

একটি ভগ্ন অট্টালিকা।

চারিপাশে ও মধ্যস্থলে একদা মনোরম উদ্যান ছিল, শোনা যায় কোন নবাবের বিলাসকেন্দ্র ছিল ঐ সুরম্য আরামবাগ।

বেগম ও তার সুন্দরী সহচরীদের নিয়ে একদা নবাবের হয়তাে কত আনন্দ মুখরিত দিনরাত্রি আরামবাগে কেটে গিয়েছে।

কত মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগের স্মৃতি আজও হয়তো আরামবাগের মন্থর বায়ু তরঙ্গে তরঙ্গে দীর্ঘশ্বাসের

আরামবাগের দেড় ক্রোশের মধ্যে কোন জনমানবের বসতি নেই। শহরের এদিকটা একপ্রকার পরিত্যক্ত বললেও অত্যুক্তি হয় না। নবাবী আমলের কলকোলাহল ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের আড়ম্বর আজ শান্ত ও লুপ্ত। কেবল এখনো সাক্ষ্য দিচ্ছে সব কিছুর ভগ্নজীর্ণ স্তুপে স্তুপে।

পিয়ারী রত্নমঞ্জিল থেকে বের হয়ে প্রথমে সোজা শহরের দিকে গেল। একটা বেস্টটুরেন্টে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার চিন্তায় সে ডুবে গেল।

কোন পথে এবারে সে অগ্রসর হবে? চিন্তা করতে করতে একটা বুদ্ধি তার মাথার মধ্যে এসে উদয় হল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

নিজের চিন্তায় মগ্ন পিয়ারী কিন্তু লক্ষ্য করল না ঠিক সেই সময় মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, পুরুষ্টু গোঁফ, মাথায় শালের টুপি, পরিধানে পায়জামা ও তসরের সেরওয়ানী একজন দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ ভদ্রলোক রেস্টুরেন্টের মধ্যে এসে প্রবেশ করে পিয়ারীর অদূরে একটি টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। ছোকরা চাকরিটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল নতুন আগন্তুকের।

এক কাপ চা! আগন্তুক বলে।

পিয়ারীর মুখের সিগারেটটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, হাতের মার্কোভিচের টিনটাি থেকে নতুন একটা সিগারেট বের করে দুই ওষ্ঠে চেপে ধরে, সমাপ্তপ্রায় সিগারেটটার সাহায্যে অগ্নিসংযোগ করে প্রথমটা ফেলে দিল নিঃশেষিত চায়ের কাপটার মধ্যে।

ফ্রেঞ্চকাট-দাড়ি শোভিত মুসলমানী পোশাক পরিহিত আগন্তুক আর কেউ নয়, কিরীটী। এবং মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে সে বহরমপুরে এসেছে।

পিয়ারী যে বহরমপুরে এসেছ কিরাটীর সেটা অজ্ঞাত ছিল না।

মিনিট দশেক বাদে চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে পিয়ারী রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল।

সাধারণ বেশে মৃত্যুঞ্জয় বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। তার সামনে এসে চাপাকণ্ঠে কয়েকটা উপদেশ উপদেশ দিয়ে কিরীটী আবার রেস্টুরেন্ট গিয়ে প্রবেশ করল।

পরের দিন রাত্রে অপেক্ষা করেও প্রায় সারাটা রাত বিনয় কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু হতাশ হল না সে।

তার পরের রাত্রেও বিনয় তার দোতলার শয়নঘরের খোলা জানলার সামনে অন্ধকারে একাকী দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তার নিবদ্ধ নীচের বাগানে। শুধু কি সেই লাল আলোর সংকেতটুকুই! রাত্রির মত মাধুর্যময়ী অথচ রহস্যময়ী সেই পথপ্রদর্শিকার মিষ্টি কৌতুক সেও ভুলতে পারছে না কিছুতেই।

আজকের রাতেও যে বিনয়ের চোখে ঘুম নেই, শোষোক্তগুলোও তার কারণ বৈকি।

নীচের বাগানে কাল রাত্রে যে পোড়া গিসারের শেষ টুকরোটা পাওয়া গিয়েছে। পরে সেটা পরীক্ষা করে দেখেছে বিনয়।

দামী দগ্ধ সিগারের শেষাংশ। সিগারের টুকরোটা যখন বিনয় বাগানের মধ্যে কুড়িয়ে পায় তখনও সেটা পুড়ছিল। অতএব ক্ষণপূর্বে কেউ নিশ্চয়ই ওখানে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল নিঃসন্দেহে।

কিন্তু কে?

তারপর এ বাড়ির কেয়ারটেকার মনোহর!

লোকটার গতিবিধি ও হাবভাব স্পষ্ট সন্দেহজনক। বিপক্ষ দলের সংবাদ সরবরাহকারী বলেই মনে হয়।

অঘোরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছেন শয্যার ওপরে বামদেব। ঘরের আলোটা নেভানো।

বদ্ধ দরজার মধ্যবর্তী সামান্য ফাঁক দিয়ে স্টিলের একটি পাতি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল, তারপর নিঃশব্দে সেই পাতের চাপে দরজার অগালটা উপরের দিকে উঠে যেতে থাকে।

দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে যায়-সেই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে কালো একটা হাত ধীরে ধীরে একটা সরীসৃপের মত।

অতি সহজেই অতঃপর সেই হাত দরজার অর্গালটা ধরে নীচের দিকে অৰ্গলাটা নামিয়ে। আনে—দরজার কপাট দুটো খুলে যায়।

নিঃশব্দে পা টিপে টিপে ছায়ার মত একটা মনুষ্যমূর্তি বামদেবের শয়নঘরে প্রবেশ করে।

তার পশ্চাতে আর একজন।

অন্ধকারে আগে পিছে সেই ছায়ামূর্তি দুটো এগিয়ে যায় বামদেবের শয্যার দিকে।

প্রথম ছায়ামূর্তি পকেট থেকে একটা ছোট শিশি ও রুমাল বের করে শিশির মধ্যস্থিত আরক ঢেলে রুমালটা ভিজিয়ে নিল।

প্রথম ছায়ামূর্তি রুমাল হাতে ঘুমন্ত বামদেবের শিয়রের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি দাঁড়াল এসে পায়ের কাছে।

রুমালটা ছায়ামূর্তি ঘুমন্ত বামদেবের নাকের কাছে ধরল। ঘরের বাতাসে একটা মিষ্টি কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

অজ্ঞান বামদেবকে কঁধের ওপরে তুলে ছায়ামূর্তি দুজন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বিনয় অপেক্ষা করেছিল। আজকেও আবার ঠিক সেই সময় লাল আলোর সঙ্কেত দেখা গেল নীচের অন্ধকারে।

বিনয় জানালার সামনে সতর্ক হয়েই দাঁড়িয়েছিল। সে আর মহুর্ত বিলম্ব করে না। টৰ্চটা নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে যায়।

গতরাত্রের মত আজও দরজাটা খোলা। কিন্তু নজর দেবার মত যেন বিনয়ের ফুরসত নেই।

দ্রুতপদে বিনয় বাগানের দিকে চলে।

কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছবার আগেই কার সঙ্গে যেন তার অন্ধকারেই ধাক্কা লাগে।

কে?

কিন্তু যার সঙ্গে বিনয়ের অন্ধকারে ধাক্কা লেগেছিল সে বিনয়ের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বিনয়ের হাতটা চেপে ধরে চাপাকণ্ঠে কেবল বলে, চুপ! আস্তে!

কে?

বিনয়বাবু, আমি কিরীটী।

বিস্ময়ে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খায় বিনয়। কয়েকটা মুহূর্ত তার মুখ দিয়ে কথাই সরে না।

কিরীটী রায়! এই মধ্যরাত্রে রত্নমঞ্জিলের বাগানের মধ্যে অন্ধকারে!

অদূরে এমন সময় একটা দ্রুতপলায়নপর পদশব্দ শোনা গেল। শুকনো ঝরা পাতার ওপর দিয়ে মচমচেয়ে কে যেন দ্রুত পালিয়ে গেল।

সব মাটি করে দিলেন। পালিয়ে গেল লোকটা। কিরীটী বললে।

কিরীটীর কথায় বিনয়ের বিস্ময় যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তবু প্রশ্ন করে, কে? কে পালাল?

তা আর জেনে কি হবে! কিন্তু আপনাকে কলকাতা থেকে আসবার সময় বার বার বলে। দিয়েছিলাম না, দিনেরাত্রে সর্বদা সাবধানে থাকবেন! অন্ধকারে রাত্রে একা এক নিরস্ত্ৰ ঐ জঙ্গলের মধ্যে এক লাল আলোর নিশানা দেখে ছুটছিলেন, যদি আচমকা বিপদে পড়তেন কে রক্ষণ করত আপনাকে! ছিঃ আপনি, একেবার ছেলেমানুষ!

কিন্তু—

পরশু রাত্রের ব্যাপারেও আপনার শিক্ষা হয়নি! আবার ঐ জঙ্গলের মধ্যে ছুটছিলেন!

আপনি—আপনি পরশু রাত্রের ব্যাপার জানেন?

জানি। কেন ভিচের সিগারের টুকরো পাননি?

Oh! It was then you? তা কবে এলেন আপনি?

চারদিন হল। যাক, এখন চলুন দেখা যাক মনোহর কি করছে।

দুজনে ফিরে এল রত্নমঞ্জিলে। দে

খা গেল মনোহরের ঘরের দরজা খোলা। আগে বিনয় ও পশ্চাতে কিরীটী মনোহরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।

মাটির শয্যায় শুয়ে মনোহর নাক ডাকাচ্ছে।

ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছেন যখন, আপাতত আর ওঁকে বিরক্ত করে প্রয়োজন নেই। চলুন বাইরে যাওয়া যাক।

বেশ একটু জোরে জোরেই কথাগুলো উচ্চারণ করে কিরীটী বিনয়কে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল এবং নিঃশব্দে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার কবাট দুটো বাইরে থেকে টেনে শিকল তুলে দিল।

ও কি!

এতকাল এ বাড়ির কেয়ারটেকার ছিল, তাই ওর সম্পর্কে একটু কেয়ার নেওয়া হল। এখন চলুন ওপরে যাওয়া যাক। কিরাটী মৃদু হেসে বললে।

দুজনে সবে ওপরের বারান্দায় পা দিয়েছে, সুজাতার শঙ্কিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বিনয়! বিনয়!

সুজাতা হন্তদন্ত হয়ে বিনয়ের ঘরের দিকেই আসছিল।

কি-কি হয়েছে সুজাতা? বলতে বলতে উৎকণ্ঠিত বিনয় এগিয়ে যায়!

বাবা–বাবাকে তার ঘরে দেখছি না! ঘরের দরজা খোলা!

সে কি! চল তো?

সুজাতা, বিনয় ও কিরীটী তিনজনেই এগিয়ে যায় বামদেবের শয়নকক্ষের দিকে।

সত্যি ঘর খালি।

বিনয় থমকে দাঁড়িয়ে যায়। কিরীটী কিন্তু ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে একটি মিষ্টি উগ্ৰ গন্ধ পেয়েছিল।

বার দুই জোরে জোরে ভ্ৰাণ নিয়ে কিরীটী বললে, হুঁ, ক্লোরোফরম!

সুজাতার মুখে যা শোনা গেল তার মর্মার্থ এই, হঠাৎ ঘুম ভেঙে সুজাতা বাইরে এসে বামদেবের শয়নঘরের দরজা খোলা দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে। বামদেবের চিরদিন শয়ন ঘরের দরজা বন্ধ করে যেমন শোওয়া অভ্যাস তেমনি রাত্ৰেও কখনও তিনি ওঠেন। না। বহুকাল থেকেই তিনি রাত নটায় শয্যাগ্রহণ ও ভোর পাঁচটায় শয্যাত্যাগ করেন।

তবু সুজাতা বাথরুমটা একবার দেখে এসেছে। কিন্তু সেখানেও বামদেব নেই।

কি হল কিছুই তো বুঝতে পারছি না কিরীটীবাবু! উৎকণ্ঠিত বিনয় বলে।

কিরীটীর চিন্তাশক্তি তখন অত্যন্ত সক্রিয়। ঘরের মধ্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তার নাসারান্ধে, যে মিষ্টি গন্ধের ঢেউ প্রবেশ করেছিল, সেটা যে ক্লোরোফরম ছাড়া আর কিছুই নয় এবং বামদেবের অদৃশ্য হওয়ার রহস্যটা যে সেইখানেই দানা বেঁধে আছে, কিরীটীর পক্ষে সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি।

আবার আজ রাত্রে সুযোগ পেয়েছে বাণী।

ঘুম আসছিল না চোখে কিছুতেই। চোখ বুজে একপ্রকার বাধ্য হয়েই শয্যার ওপরে শুয়েছিল, কেননা ঘরের মধ্যে তার বাবাও শুয়ে আছে।

বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া সোজা নয়।

কখনো দু চোখের পাতা বুজিয়ে, কখনো অন্ধকারে তাকিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাণী হঠাৎ একসময় দেখতে পেল ধীরে ধীরে তার বাপ শয্যা ছেড়ে উঠে বসল।

কিছুক্ষণ অন্ধকারেই তার শয্যার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে নিঃশব্দ পায়ে অনিল ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বাণী তথাপি কিছুক্ষণ শয্যার ওপরে শুয়ে রইল। তারপর উঠে বসে দেশলাইটা দিয়ে প্রদীপটা জ্বালল। গতকাল বাণী একসময় লক্ষ্য করেছিল। হঠাৎ মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে গিয়ে, ঘরের দেওয়ালে একটা ফোকরের মধ্যে বাবা তার পুঁটিলিটা রাখে আর সেই লাল মলাটের নোটবইটা রাখে ঘরের মেঝেতে একটা গর্তে ইট চাপা দিয়ে। নোটবইটা রাখবার জায়গাটার সন্ধান এতদিন বাণী পায়নি।

প্রদীপের আলোয় গতরাত্রের দেখা দেওয়ালের একটা ইট সরিয়ে ফোকরটার মধ্যে হাত গলিয়ে পুঁটলিটা টেনে বের করল।

পুরাতন লাল রংয়ের শালুতে বাঁধা একটা ছোট পুঁটলি।

প্রদীপের স্নান আলোর সামনে বসে কম্পিত হাতে বাণী পুঁটলিটা খুলে ফেলল।

পুঁটলিটা খুলতেই একটা ছোট চৌকো সাইজের কারুকার্য করা হাতীর দাঁতের তৈরী কৌটো বের হল। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কৌটোটার দিকে তাকিয়ে থাকে বাণী।

ধীরে ধীরে কৌটোর ঢাকনিটা খুলতেই স্নান প্রদীপের আলোয় তার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রকাশিত হল সযত্নে তুলোর ওপরে রাখা একটি সুবর্ণকিঙ্কন।

সেকেলে জড়োয়া একেবারে খাঁটি পাকা সোনার তৈরী কঙ্কনটি।

হাঙ্গরমুখী কঙ্কন। দু’পাশ হতে দুটো হাঙ্গরের হিংস্র মুখ যেন পরস্পরের সঙ্গে এসে ঠেকেছে।

কঙ্কনের গায়ে যে সুক্ষ্ম ছিলার কাজ তাও দেখবার মত।

নারীমনের সহজাত কৌতূহলেই বাণী কঙ্কনটা একবার হাতে নিয়ে দেখে।

বাইরে একটা মৃদু পত্রমর্মর শোনা গেল।

চমকে উঠে তাড়াতাড়ি কঙ্কনটি কৌটোয় ভরে পুঁটলির মধ্যে রেখে যথাস্থানে গিয়ে রেখে দিল।

সুবৰ্ণকিঙ্কন! লাল মলাটের নোটবই তার পিতামহ শশাঙ্কমোহন চৌধুরীর রোজনামচা–ডায়েরী!

নিশ্চয়ই ঐ নোটবইয়ের মধ্যে তাহলে ঐ কঙ্কন সম্পর্কে কোন কথা আছে। কার ঐ কঙ্কন?

অদম্য কৌতূহলকে নিবৃত্ত করে রাখতে পারে না আর বাণী। ঘরের মেঝে থেকে ইট তুলে গর্তের মধ্যে যেখানে লাল মলাটের নোটবইটা লুকোনো থাকে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বাণী নোটবইটা বের করে আনলে।

প্রদীপের আলোয় বসে দ্রুত একটার পর একটা ডায়েরীর পাতা উল্টে যেতে লাগল।

হঠাৎ মাঝামাঝি এক জায়গায় এসে তার চোখের দৃষ্টি আবদ্ধ হল।

মৃন্ময়ী জানে না যে ঐ সুবর্ণকিঙ্কনের কথা অনেকদিন আগেই আমি শ্বশুর মশাইয়ের কাছে শুনেছি। অনিলের জন্মের বছর দেড়েক আগে তিনি একদিন হঠাৎ সন্ধ্যেবেলায় বহিমহলে আমার ঘরে এসে হাজির হলেন। একথা সেকথার পর একসময় আমাকে বললেন, দেখ বাবা, তোমাকে আজ একটা কথা বলব। আমাদের পূর্বপুরুষদের কিছু সঞ্চিত হীরা জহরৎ ও বাদশাহী মোহর আছে। বাবা মৃত্যুর সময় আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ঐ ধনরত্ন রত্নমঞ্জিলের ঐ নৈঋত কোণে যে শিংশপা বৃক্ষটি আছে, তার গোড়া থেকে পূব কোণে এক জায়গায় মাটির নীচে একটি শিলাখণ্ড প্রোথিত আছে, সেই শিলাখণ্ডের নীচে একটি ছোট লোহার সিন্দুকে সেই ধনরত্ন লুকানো আছে, সিন্দুকটির কোন চাবি নেই। সিন্দুকের ওপরে পাশাপাশি অনেকটা দুটি বলয়ের আকারে খাঁজ কাটা আছে। ঐ বলয়াকার খাঁজের মধ্যে দুটি কঙ্কন বসিয়ে চাপ দিলেই আপনা হতেই তখন সিন্দুকের ডালাটি নাকি খুলে যাবে। মীনুর হাতে যে দুটি সুবর্ণকিঙ্কন দেখেছ, যা তোমার শ্বাশুড়ি তাকে দিয়েছেন, একমাত্র ঐ দুটি কঙ্কনের সাহায্যেই খোলা যায়। অন্য কোন কঙ্কন দিয়েই সিন্দুক খোলা যাবে না। শরীর আমার ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। কবে আছি কবে নেই—তই তোমাকে এই গোপন তথ্যটি বলে গেলাম। যদিচ এই বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই একমাত্র অধিকার আছে। ঐ ধনরত্নে, তবু তোমাকে বলে রাখলাম এইজন্য যে আর তো পুত্র আমাদের হবে না, তোমরাই হবে সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী।

কথাটা শুনে আমি চুপ করেই রইলাম।

শ্বশুরমশাই একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, মীনুকেই আমি একথা বলে যেতাম, কিন্তু ইচ্ছা করেই তাকে বলিনি, কারণ সে আমার নিজের সন্তান হলেও সে অস্থির চপল ও উগ্র প্রকৃতির। বিলাসব্যসনই দেখেছি তার জীবনের একমাত্ৰ কাম্য। সে হয়তো ঐ ধনরত্নের লোভ সামাতে পারবে না। পূর্ব-পুরুষের নির্দেশ আছে, অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া নিতান্ত অভাব না হলে কোন মতেই যেন ঐ সঞ্চিত গুপ্তধনে না হাত দেওয়া হয়। তুমি নির্লোভ, নীতিপরায়ণ। তুমি সে লোভকে জয় করতে পারবে, তাই তোমাকে আরো বলে গেলাম।

এতক্ষণে বাণীর কাছে সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পিতার এই জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ে থাকার উদ্দেশ্য তার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়।

পিতা তার তাহলে সেই গুপ্ত ধনৈস্বর্যের লোভেই এখানে এসেছে, তাই সে দিবারাত্র জঙ্গলের মধ্যে এখানে ওখানে মাটি খোঁড়ে, জঙ্গল সাফ করে।

বাণী আবার ডায়েরী পাতা ওল্টাতে লাগল। আর এক পাতায় লেখা আছে :

মৃন্ময়ীকে স্পষ্টই আজ বলে দিয়েছি, বামদেবের ভাবী স্ত্রীই ঐ কঙ্কনের যখন একমাত্র উত্তরাধিকারিণী তখন কঙ্কন তাকে এ বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে একটি ফিরত দিয়ে যেতেই হবে। মৃন্ময়ী শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত হয়েছে।

শেষ রাত্রির দিকে বামদেবের জ্ঞান ফিরে এল।

প্রথমটায় তো বামদেব বুঝতেই পারেন না, এ তিনি কোথায়! চিন্তাশক্তি ধোঁয়াটে দুর্বল। কিন্তু ক্ৰমে ক্রমে যখন জ্ঞান স্পষ্ট হয়ে এল, দেখলেন হাত-পা বন্ধাবস্তায় জীৰ্ণ পুরাতন একটা ঘরের মধ্যে মাটিতে পড়ে আছেন।

অদূরে ঘরের কোণে একটা হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে।

কিছুই মনে পড়ে না, কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না-এ তিনি কোথায় এলেন। কেমন করেই বা এলেন। ছিলেন তো রত্নমঞ্জিলের নিজের ঘরে শয্যায় শুয়ে!

তবে এখানে এলেন কেমন করে, কখনই বা এলেন!

মচমচে একটা জুতোর শব্দ শোনা গেল। তারপরই ভেজানো দরজা ঠেলে দুজন ঘরে প্রবেশ করল। প্রথম ব্যক্তিকে দেখেই কিন্তু বামদেব চমকে উঠলেন। পরন্তু সকালে ঐ লোকটিই রত্নমঞ্জিল কেনবার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিল।

নামটাও মনে পড়ে—পিয়ারী!

দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কিন্তু চিনতে পারলেন না বামদেব। গুপীনাথকে তো বামদেব ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি, চিনবেন কি করে!

জুতোর মচমচ শব্দ তুলে পিয়ারী বামদেবের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল, এই যে অধিকারী মশাইয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখছি! গুপী, ওঁকে তুলে বসিয়ে দাও।

গুপী পিয়ারীর নির্দেশ পালন করে, এক হ্যাঁচকা টানে তুলে বামদেবকে বসিয়ে দিল।

তারপর অধিকারী মশাই, এবারে রত্নমঞ্জিল বিক্রী করবেন তো?

পিয়ারীর কথায় বামদেবের সর্বাঙ্গ আক্ৰোশে যেন জ্বলে ওঠে রি-রি করে। অবজ্ঞাভরে জবাব দেন, শয়তান! তুই যদি ভেবে থাকিস, এইভাবে অত্যাচার করে তুইও আমার স্বীকৃতি পাবি তো ভুল করেছিস।

গর্তের মধ্যে পড়েও এখনো তড়পানি যায়নি!! শোন বামদেববাবু, রানার কাছে যা কবুল করে বায়না নিয়েছ। সেই পঞ্চান্ন হাজার টাকাই তোমাকে দেওয়া হবে, যদি ভালয় ভালয় এই স্ট্যাম্পযুক্ত বিক্রয়কোবালায় শান্ত সুবোধ ছেলের মতই সই করে দাও। আর ত্যাঁদাঁড়ামি যদি কর তো, বিক্রয়কোবালায় সই তো করতেই হবে—একটি কপর্দকও পাবে না। এখন ভেবে বল কোন পথ নেবে!

মরে গেলেও বাড়ি বিক্রি করব না। বুঝতে পারছি সেই শয়তান ঘুঘু শেঠ রানারই সব কারসাজি! তুই তারই লোক। তোর মনিবকেও বলিস, আর তুই শুনে রাখ, তোদের হাতে মরব। তবু সই করব না।

হুঁ সহজ পথে তুমি তাহলে এগুতে রাজী নও! বেশ, তবে সেই ব্যবস্থাই হবে। গুপী তিন দিন ওকে কিছু খেতে দিবি না। এক ফোটা জল পর্যন্ত নয়। থাক উপবাস দিয়ে, দেখি ও তেজ কদিন থাকে!

ঘর থেকে বের হয়ে গেলে পিয়ারী।

গুপী একবার এগিয়ে এসে বললে, কেন মিথ্যে ঝামেলা করছি বামদেববাবু! ভালয় ভালয় রাজী যদি হয়ে যাও তো, আটকে কটা দিন তোমাকে রাখলেও দিব্যি রাজার হালে আরামে থাকবে। দলিলটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই ড্যাং ড্যাং করে নিয়ে চলে যাবে।

বামদেব গুপীর কথায় কোন সাড়াই দেন না।

কেবল মনে মনে ভাবতে থাকেন, কিরাটীর পরামর্শে বহরমপুরে এসে তিনি কি ফ্যাসাদেই না পড়লেন!। এতদিনকার জানাশোনা কিরীটী-বন্ধু কিরীটী যে তাকে এই বিপদের মধ্যে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে দিব্যি কলকাতায় বসে রইল, দু’একদিনের মধ্যেই আসবে বলেছিল-নন্দিন আজ হয়ে গেল, হয়তো বেমালুম সব ভুলেই বসে আছে! বামদেবকে যে ঠেলে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে হয়তো মনেই নেই তার!

শয়তানের পাল্লায় পড়েছেন, সহজে এদের হাত থেকে নিস্কৃতি মিলবে বলেও তো মনে হচ্ছে না। কত দুর্ভোগ আছে বরাতে কে জানে!

বিনয় আর সুজাতা তারাই বা কি করবে! জানতেও পারবে না তারা কাল সকালের আগে যে, শত্ৰু হাতে তিনি বন্দী হয়েছেন!

আর জানলেই বা এই শয়তানদের হাত থেকে রক্ষা করবে। কেমন করে তারা তাঁকে!

ভোরের আলো একটু একটু করে আকাশপটে দেখা দেয়। সুজাতাকে সাস্তুনা দিয়ে কিরীটী বলে, বামদেববাবু শত্রুর হাতে পড়লেও চিন্তা করবার কিছু নেই। কারণ আমার ধারণা চট্‌ করে প্রাণে মারবে না তাঁকে তারা।

প্রাণে মারবে না কি করে আপনি নিশ্চিত জানলেন কিরীটীবাবু?

কারণ এ তো বোঝাই যাচ্ছে, এই রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারেই তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোন জায়গায় গুম করেছে। সেক্ষেত্রে তাকে প্রাণে মেরে ফেললে তো কোন সুবিধাই হবে না তাদের। তাহলে তো যেজন্য নিয়ে যাওয়া সেটাই ভেস্তে গেল।

সুজাতা না বুঝতে পারলেও বিনয় কিরীটীর কথার যুক্তিটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। এও বুঝেছে সে, এই বিপদে অস্থির হয়ে হা-হুতাশ করলেও কোন ফল হবে না। যা করবার ধীরেসুস্থে করতে হবে।

সত্যি, তুমি ব্যস্ত হয়ো না সুজাতা। কিরীটীবাবু যখন এসে পড়েছেন, মেসোমশাইকে যেমন করে হোক উদ্ধার আমরা করবই।

বিনয়ের আশ্বাস পেয়ে সুজাতা নিশ্চিন্ত না হলেও চুপ করে থাকে।

কিরীটী বিনয়কে সম্বোধন করে এবারে বলে, আমাদের সময় নষ্ট করলে চলবে না বিনয়বাবু। চলুন সবার আগে শ্ৰীমান মনোহরের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক তার কাছ থেকে কিছু বের করা যায় কিনা।

দুজনে আবার নীচে গেল।

কিন্তু ঘরের দরজা খুলে দেখা গেল ঘর শূন্য। ঘরের মধ্যে কেউ নেই।

আশ্চর্য! মনোহর গেল কোথায়?

খোঁজ করতে দেখা গেল, ঘরের জানালার একটা শিকা আলগা। সেই শিকটা তুলেই ইতিমধ্যে মনোহর পালিয়েছে তাহলে।

কিরীটী কিন্তু মনোহরের পলায়নের ব্যাপারে বিশেষ চিন্তিত বলে মনে হল না। সে বিনয়কে বললে, বিনয়বাবু, আপনি এখান থেকে কোথাও যাবেন না। আমি থানা থেকে এখুনি একবার ঘুরে আসছি।

থানায় গিয়ে কিরীটী দখল মৃত্যুঞ্জয় বসে আছে তারই অপেক্ষায়।

কি খবর মৃত্যুঞ্জয়?

পিয়ারীকে follow করছিলাম। শহর থেকে মাইল দুই দূরে গঙ্গার ধারে যে আরামবাগ আছে সেই দিকে তাকে যেতে দেখেছি।

থানায় দারোগা রহমৎ সাহেবও সেখানে বসেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয়ের কথা শুনে তিনি বললেন সে কি! সে তো একটা পোড়ো বাড়ি। চারিদিকে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। দিনের আলোতেও সেইখানে পা দিতে গা ছমছম করে, সাপে ভর্তি জায়গাটা।

কিন্তু রহমৎ সাহেবের কথায় কান না দিয়ে কিরীটী মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, কাল কতক্ষণ পর্যন্ত তার উপর তুমি চোখ রেখেছিলে মৃত্যুঞ্জয়?

বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। সেই সময় তাকে আরামবাগের দিকে যেতে দেখি। ঘণ্টা দুয়েক তার ফেরবার প্রতীক্ষায় আমি ছিলাম। কিন্তু তাকে আর ফিরতে দেখিনি। তাতেই আমার মনে হয়, ঐখানেই কোথাও পিয়ারী আডডা নিয়েছে।

কিন্তু সেখানে তো মানুষ থাকতে পারে না কিরীটীবাবু! আবার রহমৎ সাহেব বললেন।

তা না থাকুক, কিন্তু স্থানটিতে সাধারণের যাতায়াত যেমন নেই তেমনি নিরাপদও বটে। মৃদু হেসে কিরাটী বলে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, এদিকে কাল মাঝরাতে রত্নমঞ্জিল থেকে রামদেববাবুকে কারা যেন লোপাট করে নিয়ে গিয়েছে, শুনেছেন?

বলেন কি?

হ্যাঁ, ক্লোরোফরম করে নিয়ে গিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে ফিরে বাকি কথাটা বলে কিরীটী, তুমি স্টেশনটা watch করবে। রহমৎ সাহেব, আপনি স্টেশন মাস্টারকে একটা চিঠি দিয়ে দিন যদি প্রয়োজন হয় তো তিনি যেন ওকে সাহায্য করেন।

মৃত্যুঞ্জয়কে চিঠি দিয়ে স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে কিরীটী রহমৎ সাহেবকে বললে, বাছা বাছা সেপাইয়ের দরকার যে রহমৎ সাহেব!

কখন দরকার বলুন?

এখুনি। একবার আরামবাগে গিয়ে হানা দিতে হবে।

বেশ, এখুনি আমি ব্যবস্থা করছি।

বহরমপুর আসাবার আগের দিন সিটি হোটেলে রাত বারোটার পর গিয়ে যোগানন্দের সঙ্গে দেখা করেছিল কিরাটী পূর্বেই।

যোগানন্দ কিরীটীর পরিচয় পেয়ে খুশী হয়। যোগানন্দের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয় কিরীটীর।

অনিল চৌধুরীর মোটামুটি ইতিহাস যতটুকু যোগানন্দের জানা ছিল সে কিরীটীকে বলে, কিছু না গোপন করে। এবং কিরীটীর কাছ থেকে যোগানন্দও রত্নমঞ্জিল ও সুবর্ণকিঙ্কনের ইতিহাস শোনে।

যোগানন্দ আর দেরি করে না। কেন যেন তার মনে হয় আচমকা রহস্যজনক ভাবে নিরুর্দিষ্ট অনিলের বুঝি একটা হদিস মিলল, আর তাই পরের দিনই প্রত্যুষে সবিতার সঙ্গে দেখা করে সব কথা তাকে খুলে বলে।

যোগানন্দের মুখে সব কথা শুনে চকিতে সবিতার একটা কথা মনে পড়ে। অনিল ও বাণীর চলে যাবার দিন সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য অনিল বাইরে গেলে সবিতা কৌতূহলভারে পোটলটি খুলেছিল এবং তার মধ্যে একটা কঙ্কন ও লাল মলাটের একটা নোটবই দেখেছিল। কিন্তু ভাল করে সব কিছু দেখবার সুযোগ পায়নি। সেই রাত্রেই স্বামী চলে যায় এবং বাণীকেও আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রথম বিবাহের পর তখনও তার সুখের সংসারে ভাঙন ধরেনি। শিক্ষার, ভদ্রতার, রুচির গিলটির পাতটা ওপর থেকে খসে গিয়ে যখন অনিলের লোভী অসংযত, উচ্ছৃঙ্খল ও নির্লজ্জা পরবর্তী চরিত্রের দৈন্যটা প্রকাশ পায়নি, তখন একদিন কথায় কথায় তার স্বামীর মুখেই তার স্বামীর শৈশবের ইতিহাস শুনেছিল সবিতা। নবাব-অনুগৃহীত তার মাতামহদের শৌর্য ও ঐশ্বর্যের কথা, বহরমপুরে তাদের রত্নমঞ্জিলের গল্প অনেক কিছুই শুনেছিল।

কিরীটী কর্তৃক বিব্রত কাহিনী যোগানন্দের মুখে শুনে সবিতার কেন যেন ধারনা হল, হয়তো অনিল বহরমপুরেই গিয়েছে।

এবং সে স্বামীর সন্ধানে বহরমপুরে যাওয়াই স্থির করল।

যোগানন্দকে সেকথা বললেও। যোগানন্দ কিন্তু একই বহরমপুরে অনিলের খোঁজে যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু সবিতা রাজী হল না।

বাণীর জন্য মনটা তার সত্যিই বিশেষ চঞ্চল হয়ে ছিল।

সে বললে, আমি তোমার সঙ্গে যাব যোগেন। আমার স্থির বিশ্বাস, বাণী তার সঙ্গেই গিয়েছে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, সে যা খুশি তাই করুক। কিন্তু বাণীকে আমার ফিরিয়ে আনতেই হবে।

সেইদিনই যোগানন্দ ও সবিতা বহরমপুর যাত্রা করে।

কিরীটী থানায় গিয়েছে, এখনো সেখান থেকে ফেরেনি। বিনয় ও সুজাতা দোতলার ঘরে বসে সেই সম্পর্কেই আলোচনা করছে। এমন সময় যোগানন্দ ও সবিতা এসে সেখানে উপস্থিত হল।

সুজাতা বা বিনয় কেউ তাদের চেনে না। জীবনে কখনো তো দেখেনি। কিন্তু যোগানন্দর মধ্যস্থতায় পরস্পরের পরিচয় হল।

সবিতা এ বাড়ির ভাগ্নে-বৌ।

সবিতা কিন্তু সুজাতার মুখে গতরাত্রে বামদেবের আচমকা নিরুর্দিষ্ট হওয়ার কথা শুনে এখানকার ক’দিনের ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়।

বিনয়ও সংক্ষেপে রত্নমঞ্জিলের বিক্রয়-ব্যাপার নিয়ে গত মাসখানেকের ঘটনা ও সুবৰ্ণকিঙ্কনের সমস্ত ইতিহাস সবিতাকে বলে।

সবিতার চোখে যেন নতুন আলো ফুটে ওঠে। ইদানীংকার স্বামীর অধঃপতনের ইতিহাসটাও ঐ সঙ্গে সঙ্গে সবিতার চোখের উপর স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বুদ্ধিমতী সবিতার মনে হয় এই দুই ব্যাপারের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথায়ও একটা যোগসূত্র আছে একে অন্য হতে বিচ্ছিন্ন নয়।

আর তাই যদি সত্য হয় তো এদের কাছে লজ্জায় সে মুখ দেখাবে কেমন করে?

এই সুজাতা, এই বিনয় তারা তো অনিলের থেকে তাকে পৃথক ভাববে না। সত্যি হোক মিথ্যে হোক আনিলের কলঙ্কের দাগ তো তার গায়ে কালি ছিটোবে।

তবু মনে মনে সে বার বার বলে, হে ভগবান! যেন সত্য না হয়। এই জঘন্য ঘটনার সঙ্গে যেন তার স্বামী না জড়িয়ে থাকে।

কিন্তু সবিতা জানত না নির্মম ভাগ্যবিধাতা তাকে কোন পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে। নির্যাতন ও অপমানের এখনো কত বাকি।

তাড়াতাড়ি বাণী নোটবুকটার পাতার পর পাতা উল্টেপাল্টে পড়ে চলে। কিন্তু বিশেষ কিছুই আর চোখে পড়ে না। শেষের দিকে ছাড়া-ছাড়া পাতাগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা অসংলগ্ন, অস্পষ্ট, খেদোক্তিতে ভরা। একটা অনুশোচনা যেন বড় করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এমন সময় হঠাৎ দ্রুত পদশব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি বাণী খাতাটা যথাস্থানে রেখে ফু দিয়ে আলোটা নিভিয়ে শয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।

ঘরে এসে একটু পরেই তার বাবা অনিল যে প্রবেশ করল, বাণী তা বুঝতে পারে।

জেগে থাকলেও ঘুমের ভান করে কাঠ হয়ে শয্যায় পড়ে থাকে বাণী।

অনিল ঘরে ঢুকে দেশলাই দিয়ে প্রদীপটা জ্বালাল। প্রদীপের আলোয় ঘুরে একবার অদূরে শয্যায় শায়িত ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর পুটলি খুলে আলোর সামনে নোটবইটা নিয়ে বসল।

শেষরাত্রের দিকে বাণী কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেই জানে না।

একটা ফিসফাসে কথাবার্তার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়।

চমকে ওঠে বাণী রত্নমঞ্জিলের সেই ভৃত্য মনোহরকে ফিসফিস করে তার বাপের সঙ্গে কথা বলতে শুনে।

ঘরের মধ্যে আমাকে শিকল তুলে আটকে দিয়েছিল কর্তা। কিন্তু বেটারা তো জানত না ঘরের দক্ষিণের জানালার একটা শিকা আলগা। শিকটা তুলে পালিয়ে এসেছি। অনেক লোকজন এসে গিয়েছে রত্নমঞ্জিলে।–

ওরা কে বুঝতে পারলে মনোহর? বাধা দেয় অনিল।

না। তবে কথায় বার্তায় মনে হল পুলিসের লোক। আমি আর এখানে এক দণ্ডও থাকব না। ধরতে পারলেই ওরা আমাকে পুলিসে দেবে।

ভয় পাচ্ছ কেন মনোহর। পুলিসে দিলেই অমনি হল? ওরা জানতে পারবে না যে আমরা এখানে থাকতে পারি!

না কর্তা, কাল সকালে বিনয়বাবুর কথা শুনে বুঝেছি, আপনাদের সন্ধান এখনো না পেলেও ওরা টের পেয়েছে এই জঙ্গলের মধ্যে কেউ থাকে। পুলিস নিয়ে খোঁজে আসলে ঠিক সবাইকে খুঁজে বের করবে। সময় থাকতে আপনিও পালান। মনোহর উত্তেজিতভাবে কথাগুলো বলে যায়।

না। সেই সিন্দুক না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমি নড়ছি না।

আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে। কর্তা, সত্যি মাটির নীচে কোন রকম সিন্দুক পোঁতা থাকলে আমরা কি খুঁজে পেতাম না এতদিন! আমরা এই এক মাস ধরে বাড়ির আশপাশ কত জায়গাতেই তো মাটি খুঁড়ে দেখলাম। আমার মনে হয় যদি কিছু থাকে তো ঐ বাড়ির মেঝের নীচেই কোথায়ও পোঁতা আছে।

না, তা হতেই পারে না।

তাই যদি না হবে তো ঐ বাড়িটা কিনবার জন্য সবাই এত চেষ্টা করছে কেন! এই তো দিন দুই আগে আর একজনও বাড়িটা কিনতে এসেছিল, বিনয়বাবু লোকটাকে গালাগাল দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন!

মনোহরের যুক্তিটা কেন যেন আনিলের মনে লাগে।

হয়তো মনোহরের কথাই ঠিক। নচেৎ নোটবুকের নির্দেশমত কই কোন শিলাখণ্ডই তো এক মাস ধরে খুঁজে-খুঁজেও জঙ্গলের মধ্যে কোথাও পাওয়া গেল না!

তাছাড়া মনোহর যে বাদশাহী মোহর দুটি পেয়েছিল, সেও তো ঐ বাড়িরই মেঝের একটা ফাটলের মধ্যে সাপ মারতে গিয়েই!

অনিল বলে, মনোহর, তাহলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব, চল আজই রাত্রে ঘরের সেই মেঝেটা খুঁড়ে দেখি।

আমি আর ওর মধ্যে নেই বাবু। যা করবার আপনি করুন গে—আমার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিন, আমি চলে যাই।

নিশ্চয়ই, মিটিয়ে দেব বৈকি-আগে টাকা পাই, তবে তো! কথার খেলাপ আমি করি না। যা পাব তার অর্ধেক ভাগ তোমার।

না কর্তা, আধাআধি বাখরায় কাজ নেই। আর, আমাকে হাজারখানেক টাকা দিন যেমন আগে বলেছিলেন, আমি চলে যাই। মাটি খুঁড়ে যা পাবেন তা আপনিই সব নেবেন।

টাকা এখন আমি কোথায় পাব, টাকা কি আমার হাতে আছে নাকি?

ওসব বাজে কথা রাখুন। দেখি। যা দেবেন বলেছিলেন-হাজার টাকা, এখনি মিটিয়ে দিন। আপনার কথায় লোভে পড়ে এতদিনকার পুরনো মুনিবের সঙ্গে অনেক নেমকহারামি করেছি। আর নয়, দিন টাকাটা বের করে দিন, ভোর হয়ে এল, ছুটে গিয়ে আবার আমাকে শেষরাত্রের প্রথম ট্রেনটা ধরতে হবে।

বললাম তো, টাকা এখন কোথায় যে দেব!

আবার চালাকি খেলছেন কেন? বার করুন তো টাকাটা, চটপট!

বলেছি তো টাকা নেই, তা দেব কোথা থেকে?

টাকা নেই মানে! মনোহরের কণ্ঠস্বরটা এবারে বেশ স্পষ্ট ও ঝাকালো মনে হয়।

টাকা নেই মানে টাকা নেই। চলে যেতে হয় চলে যা। ঠিকানা রেখে যা, টাকা আমি ঠিক পৌঁছে দেব।

মাইরি। সোনার চাঁদ আমার!

মুহুর্তে অনিলের চোখ দুটো আগুনের মত দপ করে জ্বলে ওঠে। বাঘের চোখের মত তার চোখ দুটো জ্বলতে থাকে যেন।

চাপাকণ্ঠে গর্জন করে ওঠে, এই উল্লক! মুখ সামলে কথা বল!

ওঃ, আবার চোখরাঙানি! এক ঘায়ে এক্কেবারে ঠাণ্ডা করে দেব।

মনোহরের মুখের কথাটা শেষ হয় না-অকস্মাৎ যেন বাঘের মতই চোখের পলকে লাফিয়ে পড়ে অনিল মনোহরের ওপরে এবং লোহার মত শক্ত দু হাতে তার গলাটা টিপে ধরে।

ভয়ার্ত কণ্ঠে চেচিয়ে ওঠে এতক্ষণে বাণী, বাবা! বাবা!

অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে মনোহর টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায় এবং অনিল দু হাতে তার গলা টিপে বুকের ওপরে উঠে বসে।

বাণী ছুটে এসে বাপকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করে দু হাতে টেনে ধরে। কিন্তু বৃথা, অনিল তখন মরীয়া হয়ে উঠেছে।

আকস্মিক বেকায়দাভাবে আক্রান্ত হয়ে মনোহরাও সুবিধা করতে পারে না। অনিলের হাতের লৌহকঠিন আসুরিক পেষণে খুব শীঘ্রই কাহিল হয়ে পড়ে।

অনিল হয়তো মনোহরকে শেষই করে ফেলত, কিন্তু বাণী মরীয়া হয়ে বাধা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত মনোহরকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় অনিল।

দু পাশের শিরা ফুলে উঠেছে, রক্তচাপে সমস্ত মুখটা লাল হয়ে উঠেছে মনোহরের। হাঁপাচ্ছে সে তখন। একটা লাথি দিয়ে মনোহরকে ঘর থেকে বের করে দেয় অনিল।

মনোহরও একছুটে অদৃশ্য হয়ে যায়।

অনিল গর্জাতে থাকে, হারামজাদাকে শেষ করে ফেলাই উচিত ছিল। তুই বাধা দিলি কেন? টাকার সাধ ওর জন্মের মত মিটিয়ে দিতাম।

বাণী স্তম্ভিত নির্বাক।

বাপের এই মূর্তির সঙ্গে পূর্বপরিচয় তো তার কখনো ঘটেনি! এ যে তার কল্পনাতীত! এই তার বাপ!

হাত-পা যেন বাণীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। শব্দ বের হয় না গলা দিয়ে।

বেলা প্রায় নটা নাগাদ জনাদশেক পুলিশ নিয়ে কিরীটী ও রহমৎ সাহেব আরামবাগে এসে উপস্থিত হল।

অতীতের নবাবী ঐশ্বর্যের ভগ্নস্তুপ।

বেদনার্ত হাহাকারে যেন আজও স্মরণ করিয়ে দেয় এক হারিয়ে যাওয়া দিনকে।

দেখছেন তো মিঃ রায়! এই ভগ্নস্তুপের মধ্যে কোন মানুষ কি থাকতে পারে? রহমৎ সাহেব। আবার বলেন।

কিরীটী এবারও তাঁর কথার কোন জবাব দেয় না। এগিয়ে চলে নিঃশব্দে। পুলিশ বাহিনীকে সে অনুসরণ করতে বলে।

ঘরের পর ঘর।

কিন্তু কোন ঘরেই জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ধূলিতে আকীর্ণ—বদ্ধ বায়ুতরঙ্গে একটা ধূলো-বালির ভ্যাপসা গন্ধ। সকলে এসে একটা প্রশস্ত হলঘরের মত জায়গায় পৌঁছায়। এবং হঠাৎ ঐ সময় একটা পদশব্দ কানে আসে কিরীটিার। সতর্ক শ্রবণেন্দ্ৰিয় তার উৎকৰ্ণ হয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে।

রহমৎ সাহেবের কানেও পদশব্দটা প্রবেশ করেছিল। তিনিও থমকে দাঁড়িয়েছিলেন ইতিমধ্যে।

স্পষ্ট পদশব্দ যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে।

চারিদিকে বড় বড় কারুকার্য করা থাম! কিরীটীর চোখের ইঙ্গিতে মুহুর্তে সকলে একএকটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে।

পদশব্দ আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আরো এগিয়ে আসছে।

জায়গাটার দিনের বেলাতেও পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ না করায় আবছা একটা আলোআঁধারি।

কে ঐ এগিয়ে আসছে!

কিরীটীর চিনতে কষ্ট হয় না অস্পষ্ট আলো-আঁধারেও। লোকটা পিয়ারী।

তাহলে তার অনুমান ভুল হয়নি! পিয়ারী এই পড়ো আরামবাগেই এসে আশ্রয় নিয়েছে!

নিশ্চিত মনেই পিয়ারী এগিয়ে আসছে, ওষ্ঠ ধৃত তার একটি জ্বলন্ত সিগারেট।

কোমরের বেল্ট থেকে পিস্তলটিা বের করে কিরীটীর নির্দেশে রহমৎ সাহেব প্রস্তুত থাকেন।

এবং হাত পাঁচেকের ব্যবধান যখন তার পিয়ারী থেকে, আচমকা থামের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে, পিয়ারী, হাত তোল!

ভূত দেখবার মতই

সামলে নিয়ে পিয়ারী বলে, এসবের মানে কি? কে তুমি?

আশ্চর্য, আমাকে তো তোমার চেনা উচিত ছিল পিয়ারী! এর আগেও তো দু-দুবার আমাদের পরস্পরের সাক্ষাৎ হয়েছে। ব্যঙ্গভর কণ্ঠে এবারে কিরীটী বলে।

পিয়ারী চুপ করে থাকে প্রত্যুত্তরে। কারণ ইতিমধ্যে তার চারিপাশে সশস্ত্ৰ এক পুলিস বাহিনী নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে।

বামদেব অধিকারীকে কোথায় রেখেছ বল? কিরীটিই আবার প্রশ্ন করে।

বামদেব অধিকারী!

নামটা চেনো না বলে মনে হচ্ছে নাকি!

না, জীবনে কখনো ও-নাম আমি শুনিনি এর আগে এবং বুঝতে পারছি না, কেনই বা আপনি এভাবে এসে আমাকে ঘিরেছেন?

এমন চমৎকার জায়গাতে ধরা পড়েও বুঝতে পারছ না কেন তোমাকে আমরা ঘিরে দাঁড়িয়েছি!

না। আমি তো এখানে বেড়াতে এসেছি।

বেড়াতেই এসেছ বটে। ব্যঙ্গভরে কথাটা বলে কিরীটী। তারপর রহমৎকে বলে, তাহলে রহমৎ সাহেব, বাকি জায়গাগুলো খোঁজ করে দেখুন—এইখানেই কোথাও বামদেবকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

রহমৎ সাহেব তখন কিরীটীর নির্দেশে দুজন সশস্ত্ৰ পুলিসকে পিয়ারীর পাহারায় রেখে বাকী চারজনকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

বেশী আর খুঁজতে হল না বামদেব অধিকারীকে। তবে ছট্টুলাল ও গুপীনাথ আগেভাগেই সরে পড়ায় তাদের আর পাত্তা পাওয়া গেল না।

পিয়ারীকে গ্রেপ্তার করে ও বামদেব অধিকারীকে মুক্ত করে সকলে রত্নমঞ্জিলে ফিরে এল।

সেখানে তখন বাণী তার মা’র কাছে গত এক মাসের কাহিনী বলে চলছে আর সকলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছে।

বাণী একসময় ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

পিতার সান্নিধ্য সত্যিই সে আর যেন সহ্য করতে পারছিল না।

অনিল চিৎকার করে ডাকে, কোথায় যাচ্ছিস বাণী?

বাণী কোন জবাব দেয় না বাপের কথায়।

বাণী সোজা জঙ্গলের পথ ধরে রত্নমঞ্জিলের সামনে এসে দাঁড়াল।

স্থিরপ্রতিজ্ঞ তখন সে, বামদেব অধিকারীকে সব কথা খুলে বলবেই।

নিচে কাউকে না দেখতে পেয়ে বাণী সিঁড়ি দিয়ে সোজা একেবারে দোতলায় উঠে যায়। বিনয় ও সুজাতা তাকে চিনতে পারে না, কিন্তু সবিতা ও যোগানন্দ তাকে চিনতে পারে।

সবিতা চিৎকার করে ওঠে, এ কি, বাণী!

বাণী কম আশ্চর্য হয়নি। সে বলে মা!

বাণী ছুটে এসে দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে।

বামদেবকে নিয়ে কিরীটী ফিরে আসবার পর যেন একটা আনন্দ-কোলাহল পড়ে যায়।

বাণীর মুখে সমস্ত ইতিহাস শুনে তখনি সকলে মিলে জঙ্গলের মধ্যে পড়ো বাড়িতে অনিলের খোঁজে যায়। কিন্তু তার সন্ধান সেখানে ওরা পায় না।

হতাশ হয়েই সকলে ফিরে আসে।

বাণী কিন্তু একসময় তার মাকে আড়ালে ডেকে বলে, মা, বাবা নিশ্চয়ই এখনো আশেপাশে কোথাও আছে। আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো রাত্রে বাবা রত্নমঞ্জিলে আসবেই।

মেয়ের কথা শুনে সবিতা কিছু বলে না, চুপ করে থাকে।

দুপুরের ডাকে কিরীটী একখানা চিঠি পেল।

হরিদ্বার থেকে এসেছে চিঠিখানা।

তারপর এল রাত্রি।

সকলেই যে যার শয্যায় নিদ্রাভিভুত।

কেবল চোখে ঘুম ছিল না সবিতার। ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা তাকে যেন কিছুতেই সুস্থির হতে দিচ্ছিল না।

অনেক আশা নিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল সবিতা কিন্তু সব ভেঙে তছনছ হয়ে গেল।

নির্মম ভাগ্যবিধাতা তাকে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে বার বার কিন্তু সবিতা ভেঙে পড়েনি।

সমস্ত দুৰ্ভাগ্যকে সে বুক পেতেই গ্রহণ করেছিল। তবু সে শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারল বা। কেন?

আর একজনও সে রাত্রে জেগে ছিল। কিরীটী রায়।

হঠাৎ মধ্যরাত্রির সুগভীর সুপ্তি পীড়িত হয়ে ওঠে একটা যান্ত্রিক ঠং ঠং শব্দে। উঠে। পড়ল শয্যা হতে সবিতা।

অন্ধকারেই পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।

এগিয়ে চলে শব্দটাকে অনুসরণ করে।

ঘরের দরজাটা ভেজানো।

ভেজানো দরজাটা নিঃশব্দে ভিতরে পা দিল সবিতা।

পাগলের মতই একটা ছোট লোহার শাবল নিয়ে অনিল ঘরের মেঝেতে সর্বত্ৰ ঠুকে ঠুকে চলে।

কি করছ?

কে? চকিতে ফিরে দাঁড়াল অনিল। এ কি, সবিতা তুমি!

হ্যাঁ, কিন্তু কি করছে তুমি? সবিতা আবার প্রশ্ন করে শান্ত গলায়।

কিন্তু তুমি এখানে এলে কি করে?

সে প্রশ্নের জবাব পরে দেব। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বলতে বলতে সবিতা দরজার খিলটা তুলে দিয়ে বদ্ধ দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

সবিতার দাঁড়াবার ঋজু কঠিন ভঙ্গী, তার মুখের প্রত্যেকটি রেখা, তার কণ্ঠস্বরের অদ্ভুত তীক্ষ্মতা আনিলের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না।

এ যেন তার চেনা-পরিচিত সবিতা নয়। সেই চিরসহিষ্ণু, নির্বক নমনীয় সবিতা নয়।

এ সবিতাকে সে কোনদিন দেখেনি। কোনদিন চেনে না। এ তার বিবাহিত স্ত্রী সবিতা নয়। এ যেন অন্য কোন এক নারী।

কই জবাব দিচ্ছ না কেন? এখানে এত রাত্ৰে তুমি কি করছ?

আকস্মিক বিহ্বলতাটা অনিলের ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। দৃপ্ত ভঙ্গীতে ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিল বলে, যাই করি না কেন, সে জেনে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি এখান থেকে যাও।

না! তোমার জবাব না নিয়ে আমি যাব না।

সবিতা! চলে যাও বলছি। এখান থেকে।

না। বললাম তো আগে আমার কথার জবাব দাও।

সবিতা!

না, অনেক সহ্য করেছি। তোমার অত্যাচার, অন্যায়। জুলুম মুখ বুজে এতকাল। কিন্তু আর সহ্য করবা না। জেনো সহ্যেরও একটা সীমা আছে।

সবিতা, এখনো চলে যাও বলছি!

ছি, ধিক তোমাকে! একবার ভেবে দেখ তো কোথা থেকে কোথায় তুমি নেমে এসেছ আজ! একদিন কি তুমি ছিলে, আর আজ তুমি কি হয়েছ!

সবিতা, এখনো বলছি চলে যাও এখান থেকে! চিৎকার করে ওঠে অনিল স্থানকাল ভুলে।

চল—এখান থেকে আমরা চলে যাই চল। ওপরে কিরীটীবাবু ওৎ পেতে আছেন তোমাকে ধরবেন বলে। ধরা পড়লে মেয়ের কাছে তুমি মুখ দেখাবে কি করে! কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে যায় সবিতা স্বামীর দিকে। না, আর অন্যায় আমি তোমায় করতে দেব না।

এখান থেকে যাও সবিতা। আনিল বলে।

বললাম তো আমি যাব না। দৃঢ় শান্ত কণ্ঠে সবিতা বলে।

যাবে না!

না। যদি যাই তো, তোমায় সঙ্গে নিয়েই যাব-একা নয়।

তুমি যাবে না সবিতা?

না।

শাবলটা হাতে সামনে এসে দাঁড়ায় অনিল।

তার চোখের মণি দুটো যেন বাঘের মত জ্বলছে।

সবিতা!

শোন তুমি হয়তো জান না-ওপরে কিরীটীবাবু ওৎ পেতে আছেন। যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন যে তুমি এসেছ—তোমার হাতে হাতকড়ি পড়বে। আমি জানতাম—বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আসবেই। তাই না ঘুমিয়ে কান পেতে অপেক্ষা করেছিলাম!

কিরীটী রায় করবে আমার কচুটা!

আচ্ছা তোমার ঘৃণা লজ্জা বলেও কি কিছু নেই? নিজের সন্তানের কাছে আজ তুমি কত ছোট হয়ে গিয়েছ জান?

হিতোপদেশ!

না, হিতোপদেশ নয়—এ শুধু আমার অনুরোধ। এতকাল তো তোমার নিজের মত চলে দেখলে, এবারে না হয় ফেরো—

ফিরব বললেই আজ আর ফেরা যায় না!

যায়—খুব যায়। চল এখান থেকে আমরা পালিয়ে যাই।

পালিয়ে যাব! হ্যাঁ, দুজনে মিলে আমরা রোজগার করব। নতুন জায়গায় গিয়ে ঘর বাঁধব—যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।

ও নাটকে আর যে-ই বিশ্বাস করুক আমি করি না, শূন্য হাতে ভাগ্যের সঙ্গে দুনিয়ার সঙ্গে যে যুদ্ধ করা যায় না সে কথাটা আর কেউ না বুঝুক কিন্তু আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। সবিতা। শোন, যে কুবেরের ঐশ্বৰ্য আমি প্রায় মুঠোর মধ্যে এনেছি সেটা আমায় মুঠো ভরে নিতেই হবে।

আকস্মাৎ একটা মতলব যেন সবিতার মাথার মধ্যে খেলে যায়। সে বলে, কিন্তু সে তুমি কোনদিনই পাবে না।

পাব-পাব!

না। তার কারণ, তোমার কাছে যে কঙ্কনটা ছিল সেটা আমি সরিয়ে ফেলেছি।

সঙ্গে সঙ্গে তাড়াক করে লাফিয়ে ভাঠে দাঁড়ায় অনিল, সবিতা!

অনিলের চোখের মণি দুটো যেন হিংস্র শ্বাপদের চোখের মণির মত জ্বলছে।

সবিতা!

হ্যাঁ, সে কঙ্কন এখন আমার কাছে। আর শুধু তাই নয়, যে কুবেরের ঐশ্বর্যের জন্যে তুমি ক্ষেপে উঠেছ তাও তোমার আগেই দুটো কঙ্কনের সাহায্যে উদ্ধার হয়েছে।

সে কি! সে কঙ্কন—

পেয়েছি। তোমার ডেরায় বাক্সর মধ্যে পেয়েছি—তুলোর ওপর রাখা ছিল।

সে কঙ্কন তুমি ঐ বামদেবকে দিয়ে দিয়েছ?

হ্যাঁ, তার জিনিস—

সবিতার কথা শেষ হল না, কেন—কোন দিলি সে কঙ্কন হারামজাদী—বলতে বলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোহার মত শক্ত দু-হাতে সবিতার গলাটা চেপে ধরে অনিল।

বল বল-কেন?

নিষ্ঠুর লৌহকঠিন হাতের সেই পেষণে ক্রমশঃ সবিতার দেহটা শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়ে।

চোখের মণি দুটো কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসে।

অনিল যেন পেষণ করে চলেছে।

আর উন্মাদের মত বলে চলেছে, বল বল-কেন?

হঠাৎ ঐ ঘরের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল এবং কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল।

সবিতার অনুমান মিথ্যা নয়।

সত্যিই কিরীটী বাণীর মুখ থেকে আনুপূর্বিক সব শুনে জঙ্গলের মধ্যে আনিলের ঘরে গিয়ে হানা দেয় এবং সেই ডায়েরী ও কঙ্কন উদ্ধার করে।

এবং সেও বুঝতে পেরেছিল, শেষ চেষ্টা অনিল করবেই এবং অনিল রত্নমঞ্জিলে আসবেই, তাই সে ওৎ পেতে ছিল।

কিরীটী এল বটে, কিন্তু বড় দেরিতে।

তখন যা হবার তা হয়ে গিয়েছে।

সবিতার শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু ঘটেছে অনিলের নৃশংস নিষ্ঠুর পোষণে।

হাত তলুন আনিলবাবু! রহমৎ সাহেব বললেন। তিনিও কিরীটীর সঙ্গে এসেছেন। রহমৎ সাহেবের হাতে পিস্তল।

অনিলের হাত থেকে সবিতার শিথিল মৃতদেহটা ঝপ করে মাটিতে পায়ের সামনে পড়ে যায়।

এ কি আনিলবাবু-এ কি! কিরীটী চিৎকার করে ওঠে।

অনিলের সম্বিৎও বুঝি তখন ফিরে এসেছে।

সে প্রথমটায় হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল।

কিরীটীর দিকে ফিরেও তাকায় না—সে তাকিয়ে থাকে কয়েকটা মুহুর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে ভূপতিত তারই পায়ের সামনে সবিতার দিকে।

তারপরই নিষ্প্রাণ দেহটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে ওঠে, সবিতা-সবিতা—না—না—না–

কিরীটী স্থির নিস্পন্দ বোবা-পাথর যেন।

সবিতা-সবিতা-কথা বল সবিতা-সবিতা—আমি-আমি ওকে হত্যা করেছি—আমি আমার স্ত্রীকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছি! দারোগীবাবু গ্রেপ্তার করুন আমায়–ফাঁসী দিন।

এ কাহিনীর এখানেই শেষ।

ডাইরীর মধ্যে বর্ণিত সিন্দুকের কোন সন্ধানই কেউ জানতে পারেনি।

রত্নমঞ্জিলের রত্নভাণ্ডার মাটির নীচেই গুপ্ত থেকে গিয়েছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত