কথামুখ
নিজ হাতে কালকূট নিজের শরীরে সংক্রামিত করে যে কালো ভ্রমর স্বেচ্ছা-মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল মিয়াং মিয়াংয়ের মৃত্যুগুহায় ও যার প্রাণহীন (?) দেহ সাশ্রুনেত্রে ইরাবতাঁর জলে ভাসিয়ে দিয়ে কিরীটী ও সুব্রত পরম নিশ্চিন্তে আবার কলকাতায় ফিরে এসেছিল, সেই সমাপ্ত কাহিনীরই যে আবার নতুন করে জের টানতে হবে কে ভেবেছিল! সত্যিই কি বিচিত্র এই মানুষের চরিত্ৰ!
একটা অত্যাশ্চর্য প্রতিভা নিয়েই ডাঃ এস. সান্যাল-কালো ভ্রমর জন্মেছিল, কিন্তু যেন দুর্ভাগ্যের অভিশাপে রাহুগ্ৰস্ত হয়ে নিজের জীবনটাকে তো সে নিজে তছনছ করে দিলই, সেই সঙ্গে অত বড় একটা প্রতিভারও ঘটল অপমৃত্যু।
এবং সেই অপমৃত্যু তিলে তিলে তাকে যেন গ্রাস করছিল অজগর। যেমন তার ধৃত শিকারকে একটু একটু করে গ্রাস করে তেমনি করেই।
দুইটি বৎসরের ব্যবধান।
ইরাবতীকুলের সেই প্রভাতেরই যেন সন্ধ্যা!
সুদূর বর্মা থেকে এবারে কাহিনী শুরু হল কলকাতার পটভূমিকায়।
মৃত্যুগুহা হতে টালিগঞ্জে স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণের মাৰ্বল প্যালেসে।
সুব্রতর জবানীতেই এবারের কাহিনী।
শামুক যেমন খোলার মধ্যে আপনাকে মাঝে মাঝে গুটিয়ে নেয়, ঠিক তেমনি কিরীটীকেও মাঝে মাঝে দেখেছি বাইরের জগৎ থেকে যেন আপনাকে গুটিয়ে নিয়ে অদ্ভুত আত্মস্বতন্ত্র এক জগতের মধ্যে যেন সে নিজেকে নির্বাসিত করত।
কয়েক মাস থেকে লক্ষ্য করছিলাম কিরীটীর সেই অবস্থা। বাড়ি থেকে কোথাও বের হয় না। হয় নিজের ল্যাবরেটারী ঘরে, না-হয় বসবার ঘরে সমস্ত দিনটা তো কাটায়ই, এমন কি কোন কোন দিন গভীর রাত পর্যন্তও কাটিয়ে দেয়।
ঐ সময়টা ও বন্ধুবান্ধব কারো সঙ্গেই বড় একটা দেখা করে না। আমিও দুদিন এসে ফিরে গেছি, কিরীটীর সঙ্গে দেখা হয়নি।
দুদিন এসে জেনেছি কিরীটী ল্যাবরেটারী ঘরেই আছে। কিন্তু আমি জানতাম মনের মধ্যে বাইরের জগৎ থেকে সে যখন নিজেকে এভাবে নির্বাসিত করে, তখন কাউকেই সে সহ্য করতে পারে না। সেই কারণেই আমিও তাকে বিরক্ত করিনি।
দিন দশেক বাদে গেলাম।
সেদিনও জানতে পারলাম কিরীটী সকাল থেকে তার ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যেই আছে। জংলীর কাছে সংবাদ নিচ্ছি এমন সময় সহসা ল্যাবরেটারীর দরজা খুলে কিরীটী বের হয়ে এল এবং আমাকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেয়ে বলল, এই যে সু, খবর কি? হঠাৎ অনেক দিন এদিকে আসিস না!
আমি মৃদু হেসে বললাম, ঠিক উল্টোটি। আজকে নিয়ে তিনদিন বরং তোরই পাত্তা নেই।
পাত্তা নেই মানে! আমি তো দু মাস ধরে বাড়ি থেকে কোথাও বেরই হই না।
আবার বুঝি কোন জটিল মামলা হাতে নিয়েছিস?
মামলা নয়। মামলা-কাহিনী। বলে জংলীর দিকে তাকিয়ে বললে, এই, চা নিয়ে আয়।
জংলী আদেশ পালনের জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেল।
মামলা-কাহিনী মানে? বিস্মিত ভাবে ওর মুখের দিকে তাকালাম।
একটা আত্মচরিত লিখছি।
আত্মচরিত লিখছ?
হ্যাঁ তবে আত্মচরিত সাধারণত যে-রকমটি হয়, এ সে-রকম নয়। আত্মচরিত্যের আত্মটিকে বাদ দিয়ে কেবল জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে সাজিয়ে যাচ্ছি পর পর।
সত্যি?
হ্যাঁ।
০১.
কিছু দিনের ব্যাপার।
হাতে কোন কাজকর্ম নেই বলে কিরীটী তার বৈচিত্ৰ্যপূর্ণ আত্মজীবনী লিখছিল। রাত্রে সে লিখত এবং যতটুকু লেখা হত। পরদিন প্রত্যুষে সেটা পাঠিয়ে দিত আমাকে পড়তে।
আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই সমস্ত দুপুরে পড়ে সেটা আবার সন্ধ্যায় পাঠিয়ে দিতাম।
সত্যিই ডায়েরীটা পড়তে বেশ ভাল লাগছিল।
গতকাল সকালে কী একটা জরুরী কাজে কিরীটী রাণাঘাট গেছে। ডায়েরটা তাই আমার কাছেই রয়ে গেছে।
নতুন করে আর কিছু লেখা হয়নি।
বিকেলের দিকে সে আমাকে রিং করে জানিয়েছে।–রাত্রে আমাদের দুজনের কোথায় নাকি নিমন্ত্রণ আছে; সে এখানেই আসবে, তারপর সন্ধ্যার পর দুজনে একসঙ্গে বেরুবে; আমি যেন প্রস্তুত হয়ে থাকি। ঘড়িতে ঢং ঢেং করে ছটা বেজে গেল।
শীতের রাত্রি, তারপর আবার সন্ধ্যা থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছে। শীতের হিমেল হাওয়া মাঝে মাঝে উত্তর দিকের জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকছে বেপরোয়া। ঠাণ্ডা গায়ে যেন ছুচ ফোঁটাচ্ছে।
সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে কিরীটীর আত্মজীবনীটা আবার খুলে বসলাম।
গতকাল ডায়েরীর একটা জায়গা পড়তে পড়তে সত্যিই অদ্ভুত লেগেছিল।
সেই জায়গাটাই আবার পড়া শুরু করলাম।
এ জীবনে অনেক কিছুই বিচিত্র ও অদ্ভুত দেখলাম। কিন্তু নিশাচরদের মত ভয়ঙ্কর বোধ হয়। আর কিছুই নেই। আধুনিক সভ্য সমাজে নিশাচরের অভাব নেই। সাক্ষাৎ শয়তানের যেন প্রতীক এরা, দিনের আলোয় এদের দেখলে চিনতে পারবে না কেউ। অতি শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র, বিনয়ী, শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন, কিন্তু যত রাতের অন্ধকার একটু একটু করে পৃথিবীর বুকে ঘনিয়ে আসে, চারদিক হয়ে আসে নিঝুম, ক্ষুধিত হায়নার মতই ঐ তথাকথিত নিশাচরেরা তখন যেন হয়ে ওঠে রক্তলোলুপ ও হিংস্র ভয়ঙ্কর। তখন এদের দেখলে আঁতকে উঠবে নিশ্চয়ই। তাই বলছিলাম, যদি কোন গভীর রাত্রে, কখনো এই শহরেও ঘরের বদ্ধ দরজায় করাঘাত শোন, দরজা খুলো না। সাবধান, কে বলতে পারে.
এই পর্যন্ত লিখেই হয়তো সে রাতের মত শেষ করেছে। কেননা এর পর আর কিছু লেখা নেই।
গায়ের মধ্যে যেন কেমন সিরসির করে ওঠে। গায়ের লোমকূপগুলো খাড়া হয়ে ওঠে কি একটা দুর্জেয় ভয়ে।
একটা অশরীরী ছায়ার মত অদ্ভুত আশঙ্কা যেন মনের মধ্যে মাকড়সার বাঁকানো বঁকানো রোমশ সরু সরু কুৎসিত ঠ্যাং ফেলে ফেলে এগিয়ে আসে।
বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
কে? উঠে দরজাটা খুলে দিতেই কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল, সুব্রত, রেডি!
হ্যাঁ। মৃদুস্বরে জবাব দিলাম। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এক্ষুনি বের হবে তো!
না। বাড়িতে ঢুকেই মাকে বলে এসেছি। এক কাপ গরম কফি পাঠিয়ে দিতে। বলতে বলতে কিরীটী একটা সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিল, উঃ, কি ঠাণ্ডা পড়েছে দেখেছিস? এক কাপ স্ট্রং এবং গরম কফি না হলে আর যেন যুৎ হচ্ছে না!
অদূরে রক্ষিত টেবিল-ল্যাম্পের আলোর খানিকটা কিরীটীর মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। আজ কিরীটীর পরিধানে সার্জের অ্যাস-কালারের সুট, গলায় সাদা শক্ত উঁচু কলার ও বড় বড় রক্তলাল বুটি দেওয়া টাই, ব্যাকব্রাশ করা চুল। সূক্ষ্ম মৃদু একটা অতিমিষ্টি ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ ঘরের বাতাসকে আমোদিত করে তুলেছে।
কিরীটীর চিরকালের অদ্ভুত শান্ত মুখখানা যেন আজ আরো শান্ত ও গভীর মনে হচ্ছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এ বেশে কেন বন্ধু? একেবারে বিলিতী!
আজ আমরা কোথায় নিমন্ত্রণে চলেছি জানিস?
কোথায়? প্রশ্ন করলাম।
বিশালগড়ের কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণের জন্মতিথি উৎসব আজ।
কোন দীপেন্দ্রনারায়ণ? সকৌতুকে প্রশ্ন করলাম।
স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণকে নিশ্চয়ই ভুলিসনি! যার মাথা খারাপ হয়েছে বলে বছর দুয়েক আগে রাঁচির পাগলা-গারদে রাখা হয়েছিল!
কোন স্যার দিগেন্দ্র, বিখ্যাত সেই সায়েণ্টিস্ট, না? আমি প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ স্যার দিগেন্দ্র আর গণেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন দুই ভাই। গণেন্দ্রনারায়ণ বড়, আর দিগেন্দ্ৰ ছোট। দিগেন্দ্ৰ অবিবাহিত, আজন্ম ব্রহ্মচারী। গণেন্দ্রর একটি মাত্র ছেলে-ঐ দীপেন্দ্র। দীপেন্দ্রর যখন বছর ষোল বয়স তখন তঁর ভয়ানক অসুখ হয়। স্যার দিগেন্দ্র শহরের সমস্ত বড় বড় ডাক্তারকে ডাকলেন, অনেক চেষ্টা করা হল, কিছুতেই কিছু হয় না। এমন সময় এক সন্ধ্যায় ডাক্তারেরা শেষ জবাব দিয়ে গেলেন। বলতে বলতে কিরীটি থামল, বাইরে তখন সমগ্র আকাশ আসন্ন ঝড়ের ইশারায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
তারপর? রুদ্ধশ্বাসে কিরীটীর কথা শুনছিলাম।
তারপর সেই রাত্রেই দীপেন্দ্রনারায়ণ মারা গেলেন। সে রাত্রে ঝড়জলের বিরাম ছিল না। সেই ঝড়জলের মধ্যেই দাহকারীরা শবদেহ নিয়ে শ্মশানের দিকে রওনা হয়ে গেল।
ভূত্য এসে কাচের একটা প্লেটের ওপর ছোট একটা কাচের জাগে ভর্তি ধূমায়িত কফি দিয়ে গেল।
কিরীটী জাগটা তুলে নিল।
গরম কফিতে মৃদু চুমুক দিতে লাগল।
সারাটা শহর সে রাত্রে ঝড়জলে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। জনহীন রাস্তা, শুধু মাঝে মাঝে অল্প দূরে গ্যাসপোস্টগুলো একচক্ষু ভূতের মতই যেন এক পায়ে ঠােয় দাঁড়িয়ে ভিজছে। দাহকারীরা শবদেহ নিয়ে এগিয়ে চলল। নিঃশব্দে, দুর্যোেগ মাথায় করেই। কেওড়াতলার কাছাকাছি আসতে সহসা একটা প্রকাণ্ড কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি ওদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল আপাদমস্তক ওয়াটারপুফে ঢাকা একটা লোক, হাতে তার উদ্যত একটা রিভলবার। রিভলবারের ইস্পাতের চোংটা চকচক করে। ওঠে। লোকটা কঠিন আদেশের সুরে বললে, শবদেহ এখানে রেখেই তোমরা চলে যাও। লোকগুলো প্রাণের ভয়ে শবদেহ রাস্তার ওপরে ফেলে দিয়েই উধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল।
বাড়িতে যখন ওরা কোনমতে ফিরে এল, রাত্রি তখন অনেক। বাইরের ঘরে একাকী স্যার দিগেন্দ্র ভূতের মত পায়চারি করছিলেন। সব কথা ওরা স্যার দিগেন্দ্রকে একটু একটু করে খুলে বললে। স্যার দিগেন্দ্র ওদের মুখে সমস্ত কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন; পুলিসে সংবাদ দেওয়া হল, কিন্তু শবদেহের কোন কিনারাই আর হল না। শবদেহের অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটা আগাগোড়া একটা মিস্ট্রি হয়েই থেকে গেল।
কিরীটী নিঃশেষিত কফির কাপটা টিপয়ের ওপর নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে হাত-ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, ওষ্ঠ সু, সময় হয়েছে, বাকিটা গাড়িতে বসে বসে শেষ করব। পাশের ঘরেই দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটায় ঢং ঢেং করে রাত্রি আটটা ঘোষণা করল।
বাড়ির দরজাতেই রাস্তায় কিরীটির সদ্যক্রীত কালো রংয়ের সিডনবডি প্লাইমাউথ গাড়িখানা শীতের অন্ধকার বাদলা রাত্রির সঙ্গে মিশে গিয়ে যেন একপ্রকার নিশ্চিহ্ন হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। শিখ ড্রাইভার হীরা সিং আমাদের দরজার একপাশে নিঃশব্দে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা দুজনে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম; হীরা সিংও আমাদের পিছু পিছু এসে গাড়িতে উঠল। গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখলাম দুজন ভদ্রলোক আগে থেকেই গাড়িতে চুপ করে বসেছিলেন। আমি কোন প্রশ্ন করবার আগেই কিরীটী বললে, এঁরা দুজন আমাদের সঙ্গেই যাবেন।
বুঝলাম কোন বিশেষ উদ্দেশ্যেই ওঁরা আমাদের সঙ্গে চলেছেন। গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিরীটী হীরা সিংকে সম্বোধন করে বললে, বেহালা, কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণের মার্বেল হাউস। নিঃশব্দ গতিতে গাড়ি ছুটিল।
শীতের অন্ধকার রাত্রি কালো মেঘের ওড়না টেনে দিয়ে নিঃশব্দে টিপ, টিপ করে অশ্রুবর্ষণ করছে। এর মধ্যেই শহরের দোকানপাট একটি দুটি করে বন্ধ হতে শুরু হয়েছে। কিরীটী নিঃশব্দে গাড়ির সীটো গা এলিয়ে দিয়ে একটা চুরুট টানছিল। কিরীটীর ওষ্ঠ ধৃত চুরুটের জ্বলন্ত অগ্রভাগটা যেন একটা আগুনের চোখের মত অন্ধকারে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সহসা এক সময় সেই কঠিন স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটিই প্রথম কথা বললে, তারপর দীর্ঘ বারো বছর পরে সেই দীর্ঘ বারো বছর আগেকার শ্মশানরাত্রির স্মৃতি যেন আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। সহসা এক সন্ধ্যায় সেই মৃত দীপেন্দ্রনারায়ণ অকস্মাৎ সজীব হয়ে ফিরে এলেন। এসে বললেন, একদল নাগা সন্ন্যাসী সেই রাত্রিতে শ্মশান থেকে মৃত বলে পরিত্যক্ত তাঁর দেহ কুড়িয়ে এনে কি সব তন্ত্রমন্ত্র ও বন্য ঔষুধ খাইয়ে বঁচিয়ে তোলে। বছর পাঁচেক বাদে তাদের কবল থেকে কোনক্রমে তিনি পালিয়ে এসেছেন; কিন্তু দুৰ্ভাগ্য, হঠাৎ পথিমধ্যেই একদল দসু্যুর পাল্লায় গিয়ে পড়লেন। আট বছর তাদের কাছে বন্দী থাকার পর এক রাত্রে অদ্ভুত উপায়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। বিচিত্র রহস্যময় সে কাহিনী।
কিছুক্ষণ থেমে আবার কিরীটী শুরু করে, স্যার দিগেন্দ্র অবিশ্যি প্রথমে ভাইপোকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু ভাইপো অনেক কিছু প্রমাণের দ্বারা কাকার সমস্ত সন্দেহের নিরবসান করে দিলেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও অনেকেই তাকে নিঃসন্দেহে গণেন্দ্রনারায়ণের একমাত্র সন্তান “দীপেন্দ্র’ বলে মেনে নিলেন। এবং অতঃপর স্যার দিগেন্দ্ৰ ভাইপো দীপেন্দ্ৰকে প্রাসাদে স্থান দিলেন। এরপর কিছুদিন নির্বিয়ে কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল, স্যার দিগেন্দ্রর নাকি কেমন মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। দিনের বেলায় লোকটি ধীরস্থির, অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক; কিন্তু রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তঁর মাথায় খুন চাপে; ধারালো ছুরি ও ক্ষুর নিয়ে সামনে যাকে দেখেন তাকেই খুন করতে যান। ডাক্তার এল, বললে, রোগটা ভাল না। অত্যাধিক চিন্তার ফলে নাকি এরকমটি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিলেন রোগীকে এখন সর্বদা চোখে চোখে রাখতে হবে। এমনি করেই কিছুদিন চলল, সহসা এক রাত্রে স্যার দিগেন্দ্ৰ কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণকেই ধারালো একটা ক্ষুর দিয়ে কাটতে উদ্যত হলেন।
হ্যাঁ, আমিও খবরের কাগজে এ ব্যাপারটা পড়েছি। বললাম, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন কুমারসাহেব। এবং তারপরই স্যার দিগেন্দ্রকে রাঁচির পাগলা-গারদে ভর্তি করে দেওয়া श, न्यों?
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ।
এখনও রোধ হয় পাগলা-গারদেই আছেন? বেচারী! অত বড় একটা প্রতিভাসম্পন্ন লোক!
না, মোটেই না। কিরীটী মৃদু হেসে বললে, তোমরা জািন লক্ষপতি স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণকে রাঁচির পাগলা-গারদে একটা প্রাইভেট সেলে বছর তিন আগে যেমন রাখা হয়েছিল, এখনও বুঝি তেমন আছেন!
তবে? বিস্মিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।
বছর দুই হল সহসা এক রাত্রে স্যার দিগেন্দ্ৰ সবার অলক্ষ্যে পাগলা-গারদ থেকে পালিয়ে যান।
বল কি! তারপর?
তারপর,-তারপর আর কি? পুলিস ও আই. বি. ডিপার্টমেন্টের লোকেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর টিকিটের দর্শন আজ পর্যন্ত পাননি।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, কিন্তু মাত্র সপ্তাহখানেক হল একটা মজার সংবাদ পাওয়া গেছে। সংবাদটা অবিশ্যি অত্যন্ত গোপনীয়, আই. বি. ডিপার্টমেন্টের এক “কনফিডেনসিয়াল’ ফাইলেই মাত্ৰ টোকা আছে।
আমি রুদ্ধনিশ্বাসে প্রশ্ন করলাম, কী?
মাস দুই আগে খবরের কাগজে বিখ্যাত ডাঃ রুদ্রের অদ্ভুতভাবে নিহত হবার কথা পড়েছিলি, মনে আছে সু?
মৃদু স্বরে বললাম, মনে আছে বৈকি।
কিরীটী প্রায়-নিভন্ত চুরুটাটা গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর বলতে লাগল, সমগ্র ভারতবর্ষে ডাঃ রুদ্রের মত Plastic surgery-তে (গঠন-মূলক অস্ত্ৰ চিকিৎসা) অদ্ভুত পারদর্শিতা আর কারও ছিল না। তিনি দেহ ও মুখের ওপর অস্ত্ৰ দিয়ে সামান্য কিছু কাটাকুটি করে দেহ ও মুখের চেহারা এমন ভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারতেন যে, তাকে পরে আর আগেকার সেই লোক বলে চেনবারও কোন উপায় পর্যন্ত থাকত না।
কিন্তু ডাঃ রুদ্র যেমন একদিকে ছিলেন অদ্ভুত প্রতিভাসম্পন্ন, অন্যদিকে ছিলেন তেমনি একটু বেশ আধপাগলাটে ধরনের ও খামখেয়ালী প্রকৃতির। লোকটার একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল, প্রত্যেক রবিবার রাঁচির পাগলা-গারদে গিয়ে বেছে বেছে যারা criminal পাগল তাদের সঙ্গে নানারকম কথাবার্তা বলে বহু সময় কাটিয়ে আসা। ডাঃ রুদ্র আগে যখন কলকাতায় প্র্যাকটিস করতেন, শোনা যায়। তখনও তিনি নাকি বছরের মধ্যে প্রায় চার-পাঁচ বার রাঁচি ও বহরমপুরের পাগল-গারদে ছুটে যেতেন।
শেষটায় বছর দুই হল কলকাতার প্র্যাকটিস তুলে দিয়ে রাঁচিতে গিয়েই সুন্দর চমৎকার একটা বাড়ি তৈরী করে নানকুমে স্থায়ীভাবে বসবাস ও প্র্যাকটিস শুরু করেন। ডাক্তার রুদ্র ছিলেন আজন্ম ব্ৰহ্মচারী। মাস দুই আগে অকস্মাৎ একদিন অতি প্রত্যুষে ডাঃ রুদ্রের দেহহীন মস্তকটি তারই ল্যাবরেটারী-ঘরের কাচের টেবিলের ওপর রক্ষিত একটা কাচের জারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। পুলিস অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার দেহটি খুঁজে পায়নি। কাটা মাথাটা দেখে স্পষ্টই মনে হয়, কোন ধারালা অস্ত্ৰ দিয়েই নিখুঁতভাবে দেহ থেকে মাথাটা পৃথক করে নেওয়া হয়েছিল। কিরীটী আবার একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল। গাড়ি তখন কালীঘাট ব্রীজ ক্রস করে ছুটে চলেছে বেলভেডিয়ার রোড ধরে।
শীতের জলসিক্ত হিমেল হাওয়া চলন্ত গাড়ির মুক্ত জানলা-পথে প্রবেশ করে নাকে মুখে আমাদের যেন ছুচ ফোঁটাচ্ছিল। জ্বলন্ত সিগারের লাল আগুনের আভায় ঈষৎ রক্তাভ কিরীটীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চুপটি করে বসে রইলাম।
কিরীটী আবার বলতে লাগল, পুলিসের ধারণা স্যার দিগেন্দ্ৰই নাকি হতভাগ্য ডাঃ রুদ্রের হত্যার ব্যাপারে অদৃশ্যভাবে লিপ্ত।
কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
কেন, তা ঠিক বলতে পারব না, কিরীটী বলতে লাগল, পুলিসের লোকেরা ডাঃ রুদ্রের অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্রের কাছে কতগুলো কথা জানতে পারে। অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্ৰ বলেন, একটি পেসেন্ট নাকি ডাক্তারের নিহত হবার দিন দশেক আগে তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসে এবং ডাক্তার নিজেই একা একা পেসেন্টকে ক্লোরোফর্ম করে তার মুখে অপারেশন করেন-পেসেন্টেরই ইচ্ছাক্রমে ডাঃ মিত্রের কোন সাহায্য না নিয়ে। অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্র অবিশ্যি জীবনে কখনো স্যার দিগেন্দ্ৰকে দেখেননি বা চিনতেনও না এবং লোকটি যে ঠিক কেমন দেখতে তাও তিনি বলতে পারেননি। ডাঃ মিত্রের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, সেই পেসেন্ট ডাক্তারের সঙ্গে অন্ধকার ঘরে বসে নাকি কথাবার্তা বলত; তবে অপারেশনের পর রাত্রে একবার অ্যাসিস্টান্টটি পেসেন্টকে পথ্য ও ঔষধ খাওয়াতে কয়েকবার গিয়েছিল সামনে; কিন্তু তখন পেসেন্টের সমস্ত মুখে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, চিনবার উপায় ছিল না। অপারেশনের দিন দুই বাদে এক গভীর রাত্রে পেসেন্ট ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আগেই বলেছি, শহরের একাধারে ছিল ডাঃ রুদ্রের বাড়ি।
তারপর? আমি প্রশ্ন করলাম।
তারপর সেই রাত্রে একজন লোককে নাকি কালো একটা ওভারকেট গায়ে, মাথায় কালো একটা টুপি, চোখের পাতা পর্যন্ত নামানো, ডাক্তারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে একজন প্রহরারত পুলিস দেখেছিল। প্রহরারত পুলিসটা তখন নাকি সেই রাস্তা দিয়েই ফিরছিল। পুলিস যাকে সেই রাত্রে ডাঃ রুদ্রের বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছিল সেই লোকটি পুলিসের দিকে একটিবারও না তাকিয়ে তার পাশ দিয়েই রাস্তা ধরে নাকি চলে যায় খোসমেজাজে একটা গানের সুর শিস দিতে দিতে। পুলিস তাকে সন্দেহ করেনি, কারণ তাকে সে কোন একজন সাধারণ পথচারীই ভেবেছিল।
আগেই বলেছি। পরদিন ভোরবেলা ডাক্তারের মুণ্ডুটা তাঁরই ল্যাবরেটারী-ঘরে টেবিলের ওপর রক্ষিত একটা কাচের জারের মধ্যে পাওয়া যায়। সে যাই হোক, এই এতগুলো ঘটনাকে যদি এক সূত্ৰে গাঁথা যায়। তবে একটা কথা বিশেষভাবে মনের মধ্যে স্বতঃই উদিত হয়।
কী? আমি প্রশ্ন করলাম।
স্যার দিগেন্দ্ৰ বোধ হয় এখনও জীবিত। এবং তঁর সেই বিকৃত-মস্তিষ্কের কল্পনা—
কিরীটী হঠাৎ চুপ করে গেল।
কিরীটী কি বলতে বলতে থেমে গেল জানি না, তবে আমার মনে হল স্যার দিগেন্দ্র। এখনও যেন রাতের অন্ধকারে বিকৃত একটা রক্ত-নেশায় কুমার দীপেন্দ্রর পিছু পিছু ছায়ার মতই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
মনটার মধ্যে যেন সহসা কি একটা অজানিত আতঙ্কে ছাঁত করে উঠল।
একটা অদৃশ্য ভয় যেন অন্ধকারে অক্টোপাশের মতই ক্লেদাক্ত পিচ্ছিল অষ্টবাহু দিয়ে আমার চারপাশে ঘন হয়ে উঠছে।
গাড়ির মধ্যকার মৃদু নীলাভ আলোয় কিরীটীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম-কিরীটীর দুটি চক্ষু বোজা।
কি এক গভীর চিন্তায় যেন সে তলিয়ে গেছে।
বাকি দুজন ভদ্রলোক, যাঁরা ঠিক আমার পরেই সেই একই সীটে পাশাপাশি বসে অন্ধকারে তাদের মুখগুলো যেন পাথরের মতই কঠিন ভাবহীন।…
আমি চোখটা ফিরিয়ে নিলাম।
গাড়িটা একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। একটা মৃদু গোলমাল অস্পষ্ট গুঞ্জনের মত আমাদের কানে এসে বাজাল।
আমরা এসে গেছি সুব্রত। চল, নামা যাক। কিরীটী বললে।
আমরা দুজনে গাড়ি থেকে নোমলাম প্রথমে এবং আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বাকি দুজন
ভদ্রলোকও গাড়ি থেকে নামলেন।
কুমার দীপেন্দ্রর প্রাসাদতুল্য মার্বেল প্যালেস আজ নানা বর্ণের আলোকমালায় ফুল ও পাতাবাহারে সুশোভিত। সবুজ, নীল, লাল নানা বর্ণ-বৈচিত্ৰ্য আলোর নয়নাভিরাম দৃশ্য।
বহু সুবেশ ও সুবেশা নরনারীর কলকাকলীতে সমগ্র প্রাসাদটি মুখরিত।
দরজার গোড়ায় একজন ভদ্রলোক অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে সাদর আহ্বান জানালেন। বললেন, আসুন আসুন।
কিরীটি তার পরিচয় দিতেই সেই ভদ্রলোক বললেন, ওঃ, আপনি মিঃ কিরীটী রায়? কুমারসাহেব ওপরে আছেন,-সোজা ওপরে চলে যান।
সামনে একটা সুপ্ৰশস্ত মাৰ্ব্বেল পাথরে বাঁধানো টানা বারান্দা গোছের। ডানদিকে প্রকাণ্ড একটা হলঘর। সেখানে টেবিল চেয়ার পেতে আধুনিক কেতায় অতিথি-অভ্যাগতদের খাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেই হলঘরের বা দিকে একটা ছোট ঘর, কয়েকখানি সোফা পাতা, সাত-আটজন ভদ্রলোক খোসাগল্পে মগ্ন।
ঘরে ঘরে অত্যুজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো। বারান্দার এক পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি, সেটাও মার্কেল পাথরে তৈরী। ভদ্রলোকের নির্দেশমত আমরা সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতলের দিকে অগ্রসর হলাম।
দ্বিতলে উঠে কিরীটী সঙ্গের সেই দুজন ভদ্রলোকের যেন নিম্নকণ্ঠে কি বললে, তারা সঙ্গে সঙ্গে নীচে চলে গেল। আমরা অতঃপর দোতলায় উঠেই সামনে যে প্ৰকাণ্ড হলঘর, সেই হলঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম। প্রচুর সাজসজ্জায় ও আলোকমালায় যেন ইন্দ্রপুরীর মতই মন হচ্ছিল ঘরটাকে।
ঘরের মেঝেত দামী পুরু লাল রংয়ের কাশ্মীরী কর্পেট বিছানো। হলঘরের সংলগ্ন একটা নাতি-প্রশস্ত ঘর দেখা যায়। হলঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করে পর পর পাশাপাশি দুটি দরজায় দামী সবুজ রঙের পর্দা ঝুলছে; এবং পর্দা ভেদ করে সেই ঘর থেকে আনন্দ-কলরব কানে ভেসে আসে মাঝে মাঝে।–
হলঘরের মধ্যে ছোট ছোট সব গোলাকার টেবিল পেতে তার চারপাশে চেয়ার রাখা হয়েছে। ভদ্রলোকেরা সেই চেয়ারে বসে চা ও সরবৎ। সহযোগে খোসাগল্পে মত্ত।
একজন ভদ্রলোককে দেখে কুমারসাহেবের খোঁজ নিতেই, কুমারসাহেব ঐ সামনের ঘরে আছেন বলে ভদ্রলোকটি দুই-দরজাওয়ালা ঘরটি আমাদের দেখিয়ে দিলেন। আমরা এগিয়ে গেলাম।
ঘরের ঠিক নীচে দিয়েই ট্রাম-রাস্তা চলে গেছে। ট্রাম-রাস্তার দিকে মুখ করে ঘরে প্রায় পাঁচ-ছটি জানলা, প্রত্যেকটিতে দামী নেটের বাহারে পর্দা টাঙানো। ঘরের বা দিকে কতকগুলো দেওয়াল-আলমারির মত আছে। তাতেও পর্দা ঝুলানো। বোধ হয় সেগুলিতে জিনিসপত্র রাখা হয়। ঘরের ডান দিকের দেওয়ালটা ঘরের ছাদ থেকে ডিমের মত ঢালু। হয়ে যেন মেঝেতে নেমে এসেছে; মাঝখানে একটা দরজা। ঘরের মধ্যে সোফা ও চেয়ারে বসে কয়েকটি ভদ্রলোক গল্প করছেন। কুমারসাহেব সেখানে নেই।
মাঝে মাঝে উচ্চহাসির রোল উঠছে।
ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে দামী ফ্রেমের সব সুদৃশ্য ছবি ঝুলছে। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলের চারপাশে বসে চারজন ভদ্রলোক তাস খেলছেন।
ঘরে ঢুকে যেটাকে গা-আলমারি মনে হয়েছিল, হঠাৎ সেই দিকের পর্দার আড়াল থেকে একটা হাসির শব্দ শোনা গেল; কিরীটী আর আমি দুজনেই চমকে সেদিকে ফিরে তাকলাম।
ঐ যে কুমারসাহেবের গলা, চল, পর্দার ওধারে বসে আছেন বোধ হয়!
কিরীটী আমার হাত ধরে মৃদু আকর্ষণ করল।
দুজনে পর্দার দিকে এগিয়ে গেলাম।
কিরীটীর অনুমানই ঠিক। গা আলমারি না হলেও অনেকটা গা-আলমারি মত খানিকটা জায়গা। সেখানে অর্ধ-চন্দ্ৰাকৃতি একটা ভেলভেট মোড়া দামী সোফা পাতা। এবং তার সামনে ঐ আকারেরই একটি ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর নীল রংয়ের ঘেরা টোপে ঢাকা একটি ক্ষুদ্র টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু নীলাভ আলো সামনে ঝুলন্ত নীল রংয়ের পর্দার সঙ্গে যেন মিশে একাকার হয় গেছে—তাই ওদিক থেকে তেমন বিশেষ কিছু বোঝা যায়নি।
সোফার ওপর সাহেবী বেশ-পরিহিত চোখে কালো কাচের চশমা একজন ভদ্রলোক ও অন্য একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বসে মৃদুস্বরে গল্প করছিলেন, আমাদের দেখে সাহেবী বেশপরিহিত ভদ্রলোকটি উঠে দাঁড়ালেন এবং সসম্রামে বললেন, হ্যালো মিঃ রায়, গুড ইভনিং! ইনিই বোধ হয় মিঃ সুব্রত রায়? আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
কিরীটী নমস্কার করে বলল, হঁয়া কুমারসাহেব, ইনিই সুবিখ্যাত মিলিও-নিয়ার সুব্রত রায় আমার বিশিষ্ট বন্ধু ও সহকারী।–
কিরীটীর কথায় বুঝলাম বক্তাই কুমারসাহেব।
কুমারসাহেবের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলাম। নীতি-দীর্ঘ সবল দেহাবয়ব; মাথায় লম্বা কঁচা-পাকা চুল, মাঝখানে সিঁথি কাটা, পরিধানে দামী সার্জের সুট, চোখে একজোড়া রঙিন কাচের চশমা। তাছাড়া মুখের ভাব অত্যন্ত শান্তশিষ্ট প্রকৃতির।
এই সময় দ্বিতীয় প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা তিনজনে সোফার ওপর কুমারসাহেবের নির্দেশক্রমে উপবেশন করলাম।
ইনিই আমাদের কুমারসাহেব দীপেন্দ্রনারায়ণ, সুব্রত। কিরীটী বললে আমার দিকে এবারে তাকিয়ে।
একজন বেয়ারা ট্রেতে করে কাপ-ভর্তি ধূমায়িত চা ও প্লেটে করে কিছু প্লাম-কেক দিয়ে গেল। ট্রের ওপর হতে একটা ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিয়ে কাপে মৃদু চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বলল, জানিস, ভারী বৈচিত্ৰ্যপূর্ণ এর জীবন-কথা সুব্ৰত!
এমন সময় দামী সুট-পরা একজন বৃদ্ধ গোছের ভদ্রলোক পর্দা তুলে এসে সেখানে শু বেশ করলেন।
হ্যালো ডাঃ চট্টরাজ। কলকাতায় কবে ফিরলেন? কিরীটী সোল্লাসে বলে উঠল।
এই তো কদিন হল। তারপর রায়, তোমার সংবাদ কী বল? ডাঃ চট্টরাজ কিরীটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন এবং সহাস্যমুখে বললেন, দাও। হে রহস্যভেদী, একটা বিমর্ণ সিগার দও তোমার। অনেক দিন খাই না। খেয়ে দেখি!
কিরীটী মৃদু হেসে তার পকেট থেকে সুদৃশ্য হাতাঁর দাঁতের সিগার কেন্সটা বের করে ডাক্তারকে একটা সিগার দিল।
কুমারসাহব বললেন, মিঃ রায়, আপনারা ততক্ষণ আলাপ করুন, আমি ওদিকটা একটু দেখে আসি।
কুমারসাহেব চলে গেলেন।
তারপর ডাক্তার, আপনি এক সময় স্যার দিগেন্দ্রর চিকিৎসা করেছিলেন, না? কিরীটী প্রশ্ন করলে ডাঃ চট্টরাজের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
হ্যাঁ, সে প্রায় বছর তিন সাড়ে তিন আগেকার কথা। কিন্তু তাহলেও তার সম্পর্কে সব কিছুই আমার আজও বেশ স্পষ্ট মনে আছে।
একটা কথা আপনাকে আজ জিজ্ঞাসা করব ডাঃ চট্টরাজ?
বলুন!
আচ্ছা, স্যার দিগেন্দ্রর কি সত্যি সত্যিই মাথার কোন গোলমাল হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?
ডাঃ চট্টরাজ যেন অল্পক্ষণ কি একটু ভাবলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, দেখুন। আমার যতদূর মনে হয়, ভদ্রলোকের Hyperoes—thisia ছিল। তাঁর মধ্যে প্রায়ই একটা খুনোখুনি করবার যে tendency জেগে উঠেছিল তাতে ও ধরনের ব্যাপারকে Lust Murder বলা যায়, অর্থাৎ যাকে সহজ ভাষায় খুন করবার একটা ইচ্ছা বলা চলে এবং স্যার দিগেন্দ্রর মত ঠিক ঐ ধরনের ‘কেস’ আমার ডাক্তারী-জীবনে চোখে বড় একটা পড়েনি। ডাক্তারী শাস্ত্র ও নানা প্রকারের নজির থেকে বলা যায়, এধরনের মনের বিকৃতি যাদের হয় তারা প্রিয়জনের বড় একটা ক্ষতি করে না। অথচ আশ্চর্য, স্যার দিগেন্দ্র তার অতি প্রিয় ভাইপোকেই শেষটায় খুন করতে গিয়েছিলেন। ভাগ্যে বেচারা চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে; তা ছাড়া কুমারসাহেবের গায়েও অসীম ক্ষমতা ছিল। ভদ্রলোককে আমন হাবাগবা বোকাটে ধরনের দেখতে হলে হবে কি, গায়ে শুনেছি নাকি অসুরের মতই ক্ষমতা রাখেন।
ডাক্তার আবার বলতে লাগলেন, আমি তখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পুরী বেড়াতে গেছি, সেই সময় হঠাৎ একদিন সকালে কুমারসাহেবের বাড়ি থেকে call পেয়ে স্যার দিগেন্দ্রকে দেখতে যাই। সেও আজ বছর কয়েক আগেকার কথা। সকালবেলা রোগী দেখতে গেলাম, পুরীতে সমুদ্রের ধারেই ওঁদের সুন্দর একখানা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি আছে। স্যার দিগেন্দ্র তখন বারান্দায় একটা ডেকচেয়ারে বসে শেকস্পীয়র পড়ছিলেন; কুমারসাহেবও তাঁর কাকার পাশেই বসেছিলেন, আলাপ পরিচয় হবার পর স্যার দিগেন্দ্ৰ আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বললেন, দীপু আমার জন্য বডড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ডাক্তার চট্টরাজ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন?
স্যার দিগেন্দ্ৰ জবাবে বললেন, ওর ধারণা আমার কিছুদিন থেকে রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না বলে শীঘ্রই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়ব।
বলতে গেলে অতঃপর কুমারসাহেবের বিশেষ অনুরোধেই স্যার দিগেন্দ্রকে আমি পরীক্ষা করি এবং আশ্চর্য আমি স্যার দিগেন্দ্রকে খুব ভাল ভাবেই পরীক্ষা তো করলামই এবং অনেকক্ষণ ধরে সে রাত্রে তার সঙ্গে কথাবার্তাও বললাম, দেখলাম মাথার কোন গোলমাল নেই, চিন্তাশক্তিও স্বাভাবিক শান্ত ও ধীর; মস্তিষ্কের কোন রোগের লক্ষণই পাওয়া গোল না। তবে পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জানতে গিয়ে একটা জিনিস পাওয়া গেল।
কী? কিরীটী সাগ্রহে প্রশ্ন করল।
ডাক্তার বলতে লাগলেন, ওদের ফ্যামিলিতে নাকি কবে কোন এক পূর্বপুরুষের ‘এপিলেপিসি’ (অনেকটা ফিটের মত ব্যারাম) ছিল। যাহোক স্যার দিগেন্দ্রকে পরীক্ষা করে। দেখলাম, দেহ তার বেশ সুস্থ ও সবল এবং রোগের কোন লক্ষণমাত্রও নেই। তবে চোখের দৃষ্টি-শক্তি একটু কম ছিল। সম্ভবত অতিরিক্ত পড়াশুনার জন্যই সেটা হয়ে থাকবে। লোকটি উঁচু, লম্বা, বলিষ্ঠ গঠন। চোখের তারা দুটো অন্তৰ্ভেদী ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ। ভদ্রলোক বহু ভাষায় সুপণ্ডিত। কথায় কথায় একসময় স্যার দিগেন্দ্র বললেন, বিকেলের দিকে সমুদ্রের ধারে একটিবার আসবেন ডাক্তার, আপনাকে আরও গোটাকতক কথা বলব।
জবাবে বললাম, বেশ তো। এবং কথামত বিকেলের দিকে সমুদ্রের ধারে স্যার দিগেন্দ্রর সঙ্গে দেখা হল। খানিকটা ঘুরে বেড়াবার পরই সন্ধ্যা হয়ে এল। সমুদ্রের ধারে একটু অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থান দেখে নিয়ে বালুবেলার ওপরেই দুজনে পাশাপাশি বসলাম। নানা
মৃদুস্বরে বললেন, দেখুন ডাক্তার, দীপু যাই বলুক না কেন, আমার নিজের ব্যাপারটা আমি নিজেই আপনাকে বুঝিয়ে বলছি, শুনুন।
শান্ত গভীর কণ্ঠে স্যার দিগেন্দ্র বলতে লাগলেন, সত্যি বলতে কি, আমার মনে সত্যি সত্যি কোন abnormal idea বা instinct বা কোন কুৎসিত ভয়ঙ্কর গোপন ইচ্ছা লুকিয়ে আছে কিনা আমি নিজেই তা জানি না বা আজ পর্যন্ত ঘৃণাক্ষরেও কোনদিন টেরও পাইনি। আর এও আমি মনে করি না, যদি বা অমন কুৎসিত ভয়ঙ্কর কোন গোপন ইচ্ছা আমার মনের কোথাও থাকেই, সেটা আমার পুরুষানুক্রমে পাওয়া। আমার নিজের যতদূর মনে হয়, ছেলেবেলা হতেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব বই পড়ে পড়ে ও-রকম একটা কুৎসিত ভয়ঙ্কর ইচ্ছা আমার মনে মাঝে মাঝে আমার চিন্তাশক্তির অজ্ঞাতে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মানুষকে যেমন ভুতে পায় এও অনেকটা তেমনি। এটা আমার অবচেতন মনের একটা ক্ষণিক পাগলামিও বলতে পারেন; কিংবা দুর্বলতাও বলতে পারেন।
একটু থেমে আবার স্যার দিগেন্দ্র বলতে শুরু করলেন, ডাক্তার, শিশু বয়স থেকেই আমি চিরদিন অনুভব করেছি, আমার মনের চিন্তাশক্তি যেন একটু বেশী প্রখর। সেটাকে অবিশ্যি সাধারণ অকালপক্কতাও বলতে পারেন। যে বয়সে যা ভাবা উচিত নয় চিরদিন আমি সেই সব ভেবেছি। অদ্ভুত ছিল আমার মনের ভাবনাগুলি। অন্য সকলের কাছে যেটা মনে হবে অসংবদ্ধ অসম্ভব এলামেলো অর্থহীন, আমার কাছে সেগুলো ছিল একান্ত স্পষ্ট ও সত্য। যাহোক, কেন জানি না, ছোটবেলা হতেই মধ্যযুগের শক্তিমান ইংরেজ লেখকদের লেখা সব বই পড়তে আমার বড় ভাল লাগত। বিশেষ করে যেসব লেখকদের লেখা একটু বেশী রকম কল্পনাময়, সেইগুলির আমি বেশি পড়তাম। যেমন ধরুন ‘বডিলেয়ার’ ‘ডিকুইনসি’ ‘পোয়ে’ ইত্যাদি। এদের বইগুলো পড়তে পড়তে আমার কি মনে হত জানেন? যেন একটা অদৃশ্য দুৰ্নিবার অদ্ভুত ইচ্ছা আমার সমগ্র চিন্তা ও মনের ভিতরকার ভাল-মন্দের বোধশক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে ফেলছে। ধীরে ধীরে, যেমন করে সাপুড়ের হস্তচালনায় সাপ হয়ে পড়ে মন্ত্ৰমুগ্ধ! বিশেষ করে, রাত্রের ঘন অন্ধকারে যেন একটা অদম্য রক্ত দেখবার লালসা ভূতের মতই আমায় তাড়া করে ফিরছে। সেই অদ্ভুত তাড়নায় কতদিন আমি পাগলের মতই হয়ে উঠেছি। রক্ত! রক্ত চাই! টাটুকী, তাজা, লাল টকটকে রক্ত, তা সে মানুষেরই হোক বা পশু-পক্ষীরাই হোক-রক্ত। রক্ত চাই! মনে হয়েছে রক্তের জন্য আমার সমগ্ৰ দেহ ও মন যেন মরুভূমির মতই তৃষ্ণকাতর হয়ে উঠেছে। আমি যেন কতকালের তৃষ্ণগর্ত বুভুক্ষিত উপবাসী।
ডাঃ চট্টরাজ বলতে লাগলেন, আমরা সেই অন্ধকার সাগরকিনারে বালুবেলার ওপরে বসে, কেউ কোথাও নেই; শুধু মাথার ওপরে কালো আকাশপটে অগণিত তারা মিটমিটি জুলছে আর নিভছে। অদূরে উচ্ছসিত সাগর-তরঙ্গ সেই স্নান নক্ষত্ৰলোকে যেন কোন এক ক্ষুধার্ত হিংস্র ভয়ঙ্কর পশুর ধারালো দাঁতের মত মনে হয়। একটা অশরীরী ভয়ে যেন সহসা বুকের মধ্যে শির শির করে ওঠে।
দুই হাতে হ্যাঁটুটা জড়িয়ে স্যার দিগেন্দ্র বসে। অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে তাঁকে যেন কেমন অশরীরী ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছিল। সহসা এক সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্যার দিগেন্দ্ৰ কেমন যেন একপ্রকার কুৎসিত বীভৎস হাসি হাসলেন। অন্ধকারেও তার চোখের তারা দুটো ঝকঝাক করে জ্বলছিল। ভদ্রলোকের গায়ের রং ছিল অস্বাভাবিক রকম ফরসা। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
স্যার দিগেন্দ্র আবার বলতে লাগলেন, ডাক্তার, আপনার কাছে আমি গোপন করব না। খুন আমি অনেকগুলো করেছি, এবং প্রায় করি। রাত্রের নিঃশব্দ অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে আমার শিক্ষা, সংযম, সভ্যতা, কৃষ্টি সব কিছু নিঃশেষে লোপ পায়। আমি যেন পাগল হয়েই রক্ত-তৃষ্ণায় ক্ষুধিত হায়েনার মত ছুটে বেড়াই। ডাক্তার, ডাক্তার, তুমি পালাও, আমার কাছ থেকে শ্রীঘ্র পালাও। Get away! Get away from me!
এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সহসা পাগলের মতই বুকপকেট থেকে একটা ধারালো কালো হাড়ের বঁটওয়ালা ক্ষুর স্যার দিগেন্দ্ৰ টেনে বের করলেন। অস্পষ্ট আলোয় ক্ষুরের ইস্পাতের ধারালো ফলাটা যেন মৃত্যু-ক্ষুধায় লক্লক করে উঠল। আমি বিদ্যুৎগতিতে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়েই ছুটিলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা দুৰ্দমনীয় অট্টহাসির বেগ সমুদ্রের একটানা গর্জনকে ছাপিয়ে হা হা করে সাগর-কুল সচকিত করে তুলল। উঃ, সে কী হাসি! যেন শরীরের সমস্ত রক্ত জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাবে। সারারাত ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখলাম। ঐ দিনই গভীর রাত্রে আমার ঘরের দরজায় কার মৃদু করাঘাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন অতি মৃদু মিষ্টি কোমল স্বরে দরজার ওপাশ থেকে আমায় ডাকছে—দরজা খোল! দরজা খোল! আমি ভয়ে কাঠ হয়ে মড়ার মত বিছানায় চোখ বুজে পড়ে রইলাম। ঘামে সর্বাঙ্গ আমার ভিজে যেতে লাগল। পরের দিন ভোরেই পুরী থেকে রওনা হয়ে এখানে ফিরে আসি। এরই দু-তিন দিন বাদে শুনলাম, স্যার দিগেন্দ্র ধারালো ক্ষুর দিয়ে নাকি নিজের ভাইপোকেই কাটতে উদ্যত হয়েছিলেন।
ডাঃ চট্টরাজ চুপ করলেন। বডড গরম বোধ হচ্ছিল, তাই সামনের পর্দাটা তুলে দিলাম।
হঠাৎ আমার নজরে পড়ল, কুমার দীপেন্দ্ৰ আমাদের দিকেই ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন। যেন অনেকটা ঘুমক্কান্ত তন্দ্ৰাতুর। মাথাটা নীচু করে তিনি এগিয়ে আসছেন।
আমাদের কাছে এসে দাড়ালেন।
ঘরের আলো তাঁর মুখের ওপরে প্রতিফলিত হয়েছে। সমগ্র মুখখানি রক্তশূন্য ফ্যাকাশে, মনে হয় যেন অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছেন কোন কারণে।
বরাবর আমাদের সামনে এসে কুমারসাহেব একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন অত্যন্ত ক্লান্তভাবে।
আমি, কিরীটী ও ডাঃ চট্টরাজ ওঁর মুখের দিকে নিঃশব্দে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম।
হঠাৎ একসময় কঠিন স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কুমারসাহেব চাপা উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, মিঃ রায়, আপনাকে গতকাল ফোনে যা বলেছিলাম। সেই রকম ব্যবস্থা করেছেন তো!
কিরীটী স্নান একটু হেসে বলে, নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনাকে বড় উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কুমারসাহেব। আপনি কি অসুস্থ? বলতে বলতে কিরীটী হাতাঁর দাঁতের সিগার-কেসটা পকেট থেকে বের করে নিজে একটা তুলে নিয়ে কুমারসাহেবের দিকে খোলা কেন্সটা এগিয়ে দিল, সিগার প্লিজ!
নো, থ্যাংকস। বলে কুমারসাহেব নিজের পকেট থেকে বহুমূল্য সুদৃশ্য সোনার ওপর ডায়মণ্ডে নাম লেখা সিগারেট কেসটি বের করে তার থেকে একটি দামি সিগারেট তুলে ধরলেন।
টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু নীলাভ আলো কুমারসাহেবের মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। ডান হাতে সিগারেটটি ধরে বাঁ হাত দিয়ে কুমারসাহেব মাঝে মাঝে কপালটা বুলাতে লাগলেন।
সহসা কিরীটীই প্রথম প্রশ্ন করল, আপনার সেই নবনিযুক্ত প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ শুভঙ্কর মিত্র এখানেই আছেন, না?
কে শুভঙ্কর? হ্যাঁ। মৃদুস্বরে কুমারসাহেব বলতে লাগলেন, বেচারী বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছে। অবিশ্যি আমি তাকে দোষ দিই না। এক্ষেত্রে ওরকম না হওয়াটাই আশ্চর্য। আপনারা হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না। আজ আবার স্বচক্ষে আমি এই বাড়িতেই কাকাবাবুকে স্পষ্ট দেখেছি। তিন-তিনখানা চিঠি তাঁর কাছ থেকে আমি ডাকে পেয়েছি, আপনি তো সবই জানেন মিঃ রায়, আমাকে তিনি প্রত্যেক চিঠিতেই বারংবার সাবধান করে দিয়েছেন, আমার রক্ত তিনি দেখবেনই! এ নাকি তাঁর জীবন-পাণ!
কিরীটী অস্ফুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল, ঠিক বোঝা গেল না। কাকে দেখেছেন?
অস্ফুট স্বরে কুমারসাহেব বললেন, যেন মনে হল দিগেন্দ্রনারায়ণ, স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণকে! ওই যে, আমার সেক্রেটারী মিঃ মিত্র আমার প্রাইভেট রুমে ঢুকছেন।
আমরা তিনজনেই একসঙ্গে চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ডানদিককার দেওয়ালে যে ছোট দরজাটি ছিল, সেটার কপাট দুটো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। এবং যে ভদ্রলোক একটু আগে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল, তার শরীরের পিছন দিকের কালো রঙের কোটের খানিকটা অংশ দেখতে পেলাম। দরজার কপাট দুটো বন্ধ হয়ে গেল।
সহসা আবার কুমারসাহেবের কণ্ঠস্বর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল, মিঃ রায়, আজ সন্ধ্যার দিকে স্বচক্ষে আমি কাকাকে দেখেছি।
আমি বা ডাঃ চট্টরাজ কোন কথা বললাম না। কিরীটী শুধু মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করল, আপনি ঠিক জানেন কুমারসাহেব, দেখতে ভুল হয়নি তো?
আজ দুপুর থেকেই বাড়িতে আমার জন্মোৎসবের আয়োজন চলছিল। আমি আর আমার সেক্রেটারী মিঃ মিত্র বৈষয়িক কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। দুপুরের পর থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় চারিদিক থমথম করছিল, মাঝে মাঝে কাড় কড় করে মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। কােজ সারিতে বোধ করি সন্ধ্যা সাতটা হবে তখন-আমন্ত্ৰিত ভদ্রলোকেরা সব একে একে এখানে আসতে শুরু করেছেন, মিঃ মিত্রকে নীচে সকলের অভ্যর্থনার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে আমি নিজে পোশাক বদলাবার জন্য সাজঘরে গিয়ে ঢুকেছি, বাইরে তখন ঘন অন্ধকার, মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।…সাজঘরের ড্রেসিং টেবিলের। ওপরে একটা লাল ঘেরাটোপে ঢাকা টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। মিঃ রায়, আমি যা বলছি তার একবৰ্ণও মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত নয়, পোশাক পরা হয়ে গেছে; আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার টাইটা ঠিক করছি, এমন সময় দ্বারে মৃদু করাঘাতের শব্দ শোনা গেল, কুমারসাহেব!
দরজা খুলে দেখি সামনে দাঁড়িয়ে মিঃ মিত্র আর মিঃ কালিদাস শর্ম। মিঃ শৰ্মা এখানকার এক কলেজের প্রফেসার, কিছুদিন হল তাঁর সঙ্গে আমার বেশ আলাপ হয়েছে। মিঃ শৰ্মা মিঃ মিত্রের ছোটবেলার বিশেষ বন্ধু। তঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সহসা আমার মনে পড়ল বাথরুমে আমার মুখ ধোয়ার সময় হাতের অনামিকা থেকে হীরের আংটিটা খুলে সাবানের বাক্সের ধারে রেখেছিলাম, আসবার সময় নিয়ে আসতে ভুলে গেছি…
কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে কুমারসাহেবের হাতে সিগারেটটা শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটা তিনি আ্যসট্টেতে ফেলে দিলেন। পাশের হলঘর থেকে পিয়ানো সহযোগে সুমিষ্ট গানের লহরী ভেসে আসছিল।
কুমারসাহেব। আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু আপনাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না মিঃ রায়, সে দৃশ্য কী ভয়ানক! ভাবতে গেলে এখনও আমার সর্বাঙ্গ কীটা দিয়ে ওঠে, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো ঘরের কাচের জানলা দিয়ে হঠাৎ আলোর চমকনি লাগিয়ে যাচ্ছিল। মিঃ মিত্র ও মিঃ শম দুজনে আমার সামনেই ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে, তঁদের একটু অপেক্ষা করতে বলে আমি বাথরুমের দিকে অগ্রসর হলাম।
বাথরুমের আলো নেভানো ছিল-অন্ধকার। দরজাটা যেমন আমি খুলেছি, সহসা অন্ধকার বাথরুমটা বাইরের বিদ্যুতের আলোকে ক্ষণিকের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল; কড়কড় করে মেঘের গর্জন শোনা গেল, হঠাৎ চমকে উঠলাম। বিদ্যুতের আলোয় ঘরের জানালার দিকে চোখ পড়তেই… আমি স্পষ্ট দেখলাম…কাকা! হ্যাঁ, আমার কাকা স্যার দিগেন্দ্র জানালার কাচ দিয়ে রক্তচক্ষুতে চেয়ে দাঁতে দাঁত ঘষছেন। আমি সািভয়ে অস্ফুট চিৎকার করে চোখ বুজলাম।
কথা বলতে বলতে অধীর আগ্রহে কুমারসাহেব কিরীটীর হাত দুটো সজোরে চেপে হয়ে ফুটে উঠেছে। কপালে এই শীতের রাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, ঘন ঘন নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে।
জানালার ধারে, কুমারসাহেব। আবার বলতে লাগলেন, কাকা ছায়ার মত দাঁড়িয়ে ছিলেন মাথাটা একদিকে একটু হেলিয়ে, একটা হাত ঝুলছে। তখনকার তাঁর সেই চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা দানবীয় জিঘাংসা ফুটে বের হচ্ছিল।
ডঃ চট্টরাজ আমাদের মুখের দিকে তাকালেন।
কুমারসাহেব নিঝুম হয়ে মাথা নীচু করে বসে আছেন।
সহসা যেন এক সময় কুমারসাহেব কেঁপে উঠলেন।
কিরীটী ধীর স্বরে প্রশ্ন করলে, তারপর?
আমার অস্পপুট চিৎকার বোধ হয় পাশের ঘরে মিঃ মিত্র ও মিঃ শৰ্মার কানে গিয়েছিল, র্তারা এক প্রকার ছুটেই বাথরুমে এসে প্রবেশ করলেন এবং প্রশ্ন করলেন, ব্যাপার কি কুমারবাহাদুর?
তাড়াতাড়ি তাঁরা সুইচ টিপে বাথরুমের আলোটা জ্বেলে দিলেন; আশ্চর্য ঘরে কেউ নেই! একদম খালি, অথচ.
বাথরুমে অন্য কোন দরজা ছিল কী? কিরীটী প্রশ্ন করল।
না। আমি যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম সেটা ছাড়া বাথরুমে আর দ্বিতীয় দরজা নেই। যে জানালায় কাকাকে দেখেছিলাম, তারও সার্সি দুটো ঘরের ভিতর থেকে আটকানো ছিল।
ডাঃ চট্টরাজ বললেন, আপনার অবচেতন মনে আপনার কাকা সম্পর্কে যে অতীত দিনের আতঙ্ক সেটাই আপনার মনকে আচ্ছন্ন করে ছিল কুমারসাহেব এবং সেই চিন্তা থেকেই আপনার এ বিভীষিকার সৃষ্টি। এটা আপনার স্বগত কৃত্রিম নিদ্রাচ্ছন্নতা বা ইংরাজীতে যাকে বলে ‘self hypnosis”—আপনার স্নানঘরের মধ্যস্থিত আলো ও আয়নার সংমিশ্রিত প্রভাবেই ওটা সৃষ্টি হয়েছিল।
ডাক্তারের কথা শেষ হতে না হতেই কুমারসাহেব বলে উঠলেন, ডাক্তার, আপনাকে আমি আগেই বলেছি, আমি যা দেখেছি বা শুনেছি সেটা আমার ভ্রান্ত ধারণা বা মতিভ্ৰম, যাকে আপনারা ইংরাজীতে hallucination বলেন, সে রকম কোন কিছুই নয়, আমি কাকাকে স্পষ্ট দেখেছি। সত্যিই তাকে দেখেছি। কিন্তু তারপর কিন্তু আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন না; অদৃশ্য হয়ে যান। আমার সেক্রেটারী ও মিঃ শমা চারিদিকে আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। অবিশ্যি তাঁদের আমি তখন বলেছিলাম, ব্যাপারটা আগাগোড়াই হয়তো আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কেননা এ ব্যাপারে তাদের আমি, বিশেষ করে আজকের উৎসবের দিনে, চিন্তিত করতে চাইনি। কিন্তু আমি ভগবানের নামে শপথ করে বলতে পারি মিঃ রায়, আমার ভুল হয়নি। আমি তাঁকে দেখেছি, সুস্পষ্ট ভাবেই প্রত্যক্ষ দেখেছি।
কিরীটী বললে, ভাল কথা, আচ্ছা ডাঃ চট্টরাজ, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্রের মনোবিজ্ঞানে এ ধরনের ব্যাপারকে কি বলে?
ডাঃ চট্টরাজ প্রবলভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, কুমারসাহেব হয় আমাদের আষাঢ়ে গল্প শোনাচ্ছেন, না হয় তামাসা করছেন নিছক আনন্দ দেবার জন্য। কিন্তু সে যাই হোক, এ ধরনের তামাসা…না, উনি একেবারে অসম্ভব কথা বলছেন।
ঘরের আলোয় কুমারসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত ও ভীত হয়ে পড়েছেন।
ধীরে ধীরে এক সময় কুমারসাহেব বললেন, দেখুন ডাঃ চট্টরাজ, বিশেষ করে এ ব্যাপারে আপনাদের চাইতেও আমি বেশী বুঝি। একদিন আমি আমার কাকাকে কতখানি শ্রদ্ধা করতাম ও ভালবাসতাম। সে কথা কারও অজানা নেই; কাকার এই দুর্ঘটনার জন্য হয়তো জগতে আমার চাইতে আর কেউ বেশী দুঃখ পায়নি; শিশু বয়সে মা-বাবাকে হারাই, তারপর বারো বছর পর্যন্ত ঐ কাকার কাছেই আমি একাধারে মা ও বাবার স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে এসেছি। কাকা যে আমার কতখানি ছিলেন তা বুঝিয়ে আপনাদের বলতে পারব না। কিন্তু এখন তীকেই আমি পৃথিবীতে সব চাইতে বেশী ভয় ও ঘৃণা করি। আমার সুখ শান্তি সব গেছে। রাতের পর রাত আমি নিদ্রাহীন চক্ষে নিদারুণ ভয়ে বিছানার ওপরেই বসে কাটিয়েছি।
এমন সময় সুশ্ৰী দোহারা পাতলা চেহারার ডিপ ব্লু রঙের সুট-পরা একজন ভদ্রলোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মুহুর্তে যেন কুমারসাহেব আপনাকে সামলে নিলেন এবং ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে সহাস্য মুখে বললেন, আসুন মিঃ শৰ্মা, এদের সঙ্গে বোধ হয় আপনার পরিচয় নেই, ইনি মিঃ কালিদাস শৰ্মা,-সিটি কলেজের প্রফেসার। আর ইনি মিঃ কিরীটী রায়— বিখ্যাত রহস্যভেদী, ইনি মিলিওনিয়ার মিঃ সুব্রত রায়—ওঁর বিশেষ বন্ধু. আর ইনি ডাঃ চট্টরাজ, বিখ্যাত নিউরালজিস্ট (মনাবিজ্ঞান বিশারদ)।
আমরা প্রত্যেককে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার করলাম।
এতক্ষণ বরাবরই আমি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করছিলাম, ওদিককার যে দরজা দিয়ে অল্প আগে মিঃ মিত্র গিয়ে ঢুকেছেন কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে, সেইদিকেই কিরীটী যেন সৰ্বক্ষণ তাকিয়েছিল এবং সেদিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই একসময় মৃদুকণ্ঠে বলল, আচ্ছা! কুমারসাহেব, আপনি স্যার দিগেন্দ্রকে ঠিক চিনলেন কি করে? এক বছরে কি তাঁর দেহের কোন পরিবর্তনই হয়নি?
কি জানি তা বলতে পারি না ঠিক। কুমারসাহেব বললেন, ক্ষণিক আলোয় তাঁকে দেখেছি,
আঃ, থামুন কুমারসাহেব! মিঃ শৰ্মা বাধা দিলেন, ঐ সব আজগুবী ব্যাপার নিয়ে এখনও আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন? আশ্চর্য আপনার মত একজন শিক্ষিত আধুনিকের পক্ষে..উঠুন, মিঃ মিত্র কফির অর্ডার দিয়ে অনেকক্ষণ হল আপনার প্রাইভেট-রুমে গিয়ে হয়তো অপেক্ষা করছেন…একটু আগেই তিনি আপনার খোঁজে এদিকেই আসছিলেন। কি একখানা আপনার বিশেষ জরুরী চিঠি এসেছে, আপনাকে সেখানা এখুনি নাকি দেখানো দরকার। একজন বেয়ারাকে আমার সামনেই বলে গেলেন। আপনাকে সেখানে পাঠিয়ে দেবার জন্য। বেয়ারা কি আপনাকে কোন খবর দেয়নি?
কই, না! কুমারসাহেব ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালেন, আশ্চর্য, আমি নিজেই যে তাঁকে অনেকক্ষণ আগে আমার প্রাইভেট রুমে ঢুকতে দেখলাম। ভাবলাম হয়তো কোন বিশেষ জরুরী কাজে ওঘরে গেছেন তিনি!…ক্ষমা করবেন, আমি এখুনি আসছি। বলতে বলতে কুমারসাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
অ্যাসট্রেতে কুমারসাহেবের অর্ধদগ্ধ যে সিগারেটটি পড়েছিল, দেখলাম কিরীটী সেটা নিঃশব্দে হাত দিয়ে তুলে পকেটের মধ্যে রেখে দিল। কিরীটীর ব্যাপারটা ভাবছি, এমন সময় ঘরের মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, খুন! খুন!
চমকে আমরা সকলে একসঙ্গে সামনের দিকে চোখ তুলে তাকালাম। কুমারসাহেব তখনও ঘরের অর্ধেকটা গেছেন। কিনা সন্দেহ, অদূরে দাঁড়িয়ে মিঃ শৰ্মা, একজন সাদা উর্দিপরা বেয়ারা, হাতে কফির ট্রে-সে-ই কুমারসাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। ঘরের সকলে যেন সহসা সামনে ভূত দেখে চমকে থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
সকলের চোখেই উৎসুক ভয়ব্যাকুল দৃষ্টি।
কিরীটী ধীরে ধীরে ঘরের মাঝখানে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এগিয়ে গেল। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও অনুসন্ধানী হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে সে বেয়ারা ও কুমারসাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
শুনুন, আপনারা এখন গোলমাল করবেন না। এটা উৎসব-বাড়ি। আসুন কুমারসাহেব, আমার সঙ্গে আপনার প্রাইভেট ঘরে চলুন। এই বেয়ারা, তুমভি আও। এস সুব্রত, তুমিও এস। আর ডাঃ চট্টরাজ, আপনি ততক্ষণ লালবাজারে একটা আর বেহালা থানাতে একটা করে ফোন করে দিন।
আমরা তিনজনে দরজা ঠেলে ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। বেশ প্রশস্ত চতুষ্কোণ একটা ঘর। ঘরে ঢুকে আড়াআড়ি ভাবে চাইলেই দেখা যায়, ঘরের চারপাশে গদি-মোড়া সব চেয়ার পাতা। সিলিংয়ের বাতিটা নেভানো। অদূরে একটা টেবিলের ওপরে রক্ষিত লাল রংয়ের টেবিলল্যাম্পের আলোয় ঘরখানি আলোকিত। টেবিলটার ঠিক পাশেই একটা বড় সোফা। ঘরের দেওয়ালে ফিকে গোলাপী রং দেওয়া, এবং দেওয়ালের গায়ে এদের পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত সব অতীত যুগের ঢাল তলোয়ার ঝুলছে। ঘরের লাল আলো সেগুলোর ওপর প্রতিফলিত হয়ে যেন কেমন এক বিভীষিকায় প্রেত্যায়িত হয়ে উঠেছে। ঘরের মেঝেয় দামী পুরু। লাল রংয়ের কাপেট বিছানো। হঠাৎ টেবিলের ওপরে যে ল্যাম্পটি বসানো ছিল তার আলোয় সামনে নজর পড়তেই বিস্ময়ে আতঙ্কে যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
একজন কালো সুট পরা লোক উপুড় হয়ে কার্পেটের ওপর টেবিলের ঠিক সামনে পড়ে আছেন। তার হাতের আঙুলগুলো যেন ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছিলেন, মনে হয় যেন হাতের পাতায় দেহের ভর দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করেছিলেন। হ্যাঁটু মোড়া অবস্থায় তিনি পড়ে আছেন। কিন্তু ভদ্রলোকের দেহের সঙ্গে মাথাটি নেই। রক্তাক্ত গর্দানটা শুধু ভয়ঙ্কর বিভীষিকায় উঁচু হয়ে আছে। মাথাটা ঘরের ঠিক মাঝখানে কর্পেটের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে কাটা গলার ওপরেই। কে যেন মাথাটাকে দেহ থেকে কেটে বসিয়ে রেখে গেছে মেঝের কাপোটের ওপর। চোখের মণি দুটো সাদা, মুখটা হ্যাঁ করা। সহসা পাশের খোলা জানোলা দিয়ে এক ঝালকা ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকল। আমরা কেঁপে উঠলাম।
কিরীটী কুমারসাহেবের রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখের দিকে চেয়ে বললে, এ সময় আপনি নিজে এত নার্ভাস হয়ে পড়লে তো চলবে না। কমুরসাহেব, বুকে সাহস আনুন।
আর সাহস! কুমারসাহেব ক্লান্ত অবসন্ন স্বরে বললেন, আমার হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, মিঃ রায়। একি সাংঘাতিক ব্যাপার বলুন তো! উৎসব বাড়ি
কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, সুব্রত তুমি বাইরে গিয়ে ডাঃ চট্টরাজকে সঙ্গে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বাইরে যাবার সমস্ত দরজা এখুনি বন্ধ করে দাও। ওপরের কিংবা নীচের হলঘরের কেউ যেন এ ব্যাপারের একটুকুও না টের পায়। তারা গান-বাজনা স্ফূর্তি করছে তাই করুক।
আমি তখনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।
সমস্ত বন্দোবস্ত করে ফিরে আসছি, হলঘরে কুমারসাহেবের ম্যানেজার পঞ্চাননবাবুর সঙ্গে দেখা।
তিনিও আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এলেন। ম্যানেজারবাবু ঘরে ঢুকে প্রথমেই বেয়ারাটাকে ভাঙা কাচের টুকরোগুলো নিয়ে যেতে বললেন। এ ঘর থেকে ভয় পেয়ে ছুটে বাইরে যাবার সময় চাকরিটার হাত থেকে পড়ে ভেঙে ছড়িয়েছিল। চাকরিটা আদেশ পালন করে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা থেকে পুলিসের লোক এসে উপস্থিত হল। কিরীটী সংবাদ পেয়ে বাইরে গিয়ে তাঁদের যথোপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে আবার ঘরে ফিরে এল। তারপর আবার চুপচাপ সকলে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
কিরীটী এতক্ষণ পরে একটু একটু করে মৃতদেহটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কাটা মুণ্ডুটার দিকে চেয়ে বুকটার মধ্যে যেন কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলাম। দেহের গর্দানের ঠিক কাছেই, মৃতদেহের বাঁ-হাতে একটা তীক্ষ তরবারি ধরা আছে। তলোয়ারটা দেখতে অনেকটা দেওয়ালে টাঙানো তরবারিগুলোর মতই। মনে হয় যেন দেওয়াল থেকেই একটা নেওয়া হয়েছে, কেননা দেওয়ালের গায়ে এক-একটি ঢালের দুদিকে আড়াআড়ি ভাবে দুটি করে তলোয়ার টাঙানো আছে। দেখলাম কেবল ঠিক টেবিলের সামনে উপিরভাগের দেওয়ালে ঢালের সঙ্গে মাত্র একটি তলোয়ার দেখা যাচ্ছে। মৃতদেহের হাতে ধরা তরবারিটাতে রক্ত মাখা।
উঃ, ভদ্রলোককে কসাইয়ের মত জবাই করা হয়েছে! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, একেবারে পাশবিক হত্যা! দেখ দেখ সু, তরবারিটায় বোধ হয় খুব শীঘ্রই শান দেওয়া হয়েছিল। বলতে বলতে কিরীটি ঘরের একটিমাত্র জানালার দিকে এগিয়ে জানালাটিকে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে বাইরের দিকে ঝুকে দেখেশুনে বললে, প্রায় চল্লিশ ফিট নীচে ট্রাম রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে কারও লাফিয়ে নীচে যাওয়া বা প্রবেশ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কিরীটী কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে হাত দুটো ‘মুষ্টিবদ্ধ করে পায়চারি করতে লাগল, তারপর সহসা এক সময় কার্পেটের রক্ত এড়িয়ে মৃতদেহের কাছে হ্যাঁটু গেড়ে বসে ভাল করে কুঁকে কি যেন পরীক্ষা করতে লাগল। এমন সময় ওপাশের দরজাটা খুলে গেল। একটা লোকের মাথা দেখা গেল।
ম্যানেজারবাবু যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিরীটী বাধা দিল, ও আমার লোক-হরিচরণ। কী খবর হরিচরণ? ঐ পথ দিয়ে কেউ বেরিয়েছে?
আজ্ঞে না।
বেশ। নজর রাখ।
মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঐ দরজা দিয়ে এ-ঘর থেকে। হলঘরে যাওয়া যায়, না ম্যানেজারবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ম্যানেজারবাবু মৃদুস্বরে জবাব দিলেন। জানালায় একটা লাল রংয়ের সিস্কের পর্দা টাঙানো ছিল, হাওয়ায় সেটা পতপত করে শব্দ করছিল।
আসুন ডাক্তার, মাথাটা একটু পরীক্ষা করা যাক। বলতে বলতে কিরীটী চুলের গোছা ধরে কাটা মুণ্ডটা তুলে ধরল। তারপরে দুজনে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা পরীক্ষা করল। এটা এখানেই থাক। বলে আবার মুণ্ডুটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখল।
কুমারসাহেব একপাশে ভূতের মত নির্বক নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন; কিরীটী তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, দেখুন তো কুমারসাহেব, ঐ তরবারিখানা এই ঘরেরই একখানা কিনা?
কুমারসাহেব মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
মজার ব্যাপার, কিরীটী বলতে লাগল, এইরকম ধারালো চকচকে তলোয়ারগুলো দিয়ে ঘর সাজিয়ে রেখেছেন—এইভাবে খুনের সাহায্য করতেই নাকি কুমারসাহেব?
জবাবটা দিলেন ম্যানেজারবাবু, আজ্ঞে, উনি একজন উঁচুদরের আর্টিস্ট। পিতামহ ও প্রপিতামহের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিটা উনি এমনি ভাবে সাজিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
চমৎকার যুক্তি, একেবারে অকাট্য! মৃদুস্বরে কিরীটী শুধু বললে, কিন্তু সে যাক গে, এই হতভাগ্য মৃত ব্যক্তিকে চেনেন। আপনি?
আজ্ঞে হ্যাঁ ইনি আমাদের কুমারসাহেবের নবনিযুক্ত সেক্রেটারি মিঃ শুভঙ্কর মিত্র। ম্যানেজারবাবু জবাব দিলেন।
আজ রাত্রে আপনি একে এই ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন?
আজ্ঞে না, সন্ধ্যার পরে ওঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল, তারপর আর হয়নি।
কোথায় দেখা হয়েছিল?
কাছাকাছি অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ওঁর সঙ্গে আর কে কে ছিল?
প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা আর দীনতারণবাবু। দীনতারণবাবু তার একটু পরেই চলে যান।
বেশ, এবারে আপনি দয়া করে বাইরে গিয়ে প্রফেসার কালিদাস শর্মাকে একটু ডেকে আনুন। তিনি কিছু জানেন না, কোন কথা তাকে বলবেন না, শুধু বলবেন কুমারসাহেব একটিবার তাকে ডাকছেন।
ম্যানেজার ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।
তারপর ডক্তার, আপনার এ ব্যাপারটাকে কী মনে হয়? কিরীটী প্রশ্ন করল।
ডাঃ চট্টরাজ বললেন, দেখ রায়, এ ধরনের হত্যা করাটা এমন কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, হত্যাকারীর খুন করবার ইচ্ছা ছিল এবং ধারালো অস্ত্ৰ হাতের কাছে পেয়ে সেই ইচ্ছাই এই ভয়ঙ্কর হত্যায় পরিণত হয়েছে। কে বলতে পারে, হয়তো খুনীর মনে রক্ত দেখবার পিপাসা জেগেছিল! তারপরই এই খুন।
দয়া করে একটু ভেবে দেখুন ডাক্তার, যতদূর সব দেখেশুনে মনে হয়, এক্ষেত্রে খুনটা হঠাৎ একটা ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে হয়নি। খুব সাবধানের সঙ্গে এবং আগে থেকে ভেবেচিন্তেই এই খুন করা হয়েছে। চেয়ে দেখুন, মৃতদেহের positionটা দেখেও কি আপনার মনে কোন কিছুই আসছে না?
মৃত্যুদেহ দেখে এইটুকু কেবল বোঝা যায়, খুনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মধ্যে পরস্পরের কোন রকম হাতাহাতি বা ঝটাপটি হয়নি!
নিশ্চয়ই না, মৃতদেহের position থেকে স্পষ্টই মনে হয়। পিছন থেকে আচমকা কেউ ওঁকে ধারালো অস্ত্ৰ দিয়ে আঘাত করেছে, যে সময় হয়তো বেচারী কোন কারণে টেবিলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছু করতে যাচ্ছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে আর একটা জিনিস বিশেষ করে লক্ষ্য করবার আছে। টেবিলের ঠিক ওপরে দেওয়ালে ঝুলানো যে ঢাল-তলোয়ার আছে, মেঝে থেকে ওর উচ্চতা প্রায় আট-ন ফিট হবে এবং একথা যদি ধরে নেওয়াই হয় মৃতদেহের হাতে ধরা ঐ ধারালো তলোয়ারটা সামনের ঐ দেওয়ালে টাঙানো ঢালের অন্য পাশ থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই টেবিলের ওপরে উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল দেওয়ালে টাঙানো তলোয়ারটা হত্যাকারীকে নামাতে, কেননা অতখানি লম্বা কোন মানুষ হতে পারে না। শুধু তলোয়ারটা নামাতেই নয়, সেই তলোয়ার দিয়ে মিঃ মিত্ৰকে খুন করতে হলে মিঃ মিত্রকে নিশ্চয়ই সুবোধ শিশুটির মত গলাটা বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। আর তা যদি না হয়ে থাকে, অর্থাৎ মিঃ মিত্রের অজান্তেই যদি তাঁকে খুন করা হয়ে থাকে, তবে বলতে হয় মিঃ মিত্র অন্ধ ও কালা, চোখেও তিনি কোন কিছু দেখতে পাননি, কানেও কোন শব্দ শুনতে পাননি। কিন্তু কুমারসাহেবের মত একজন ধনী গণ্যমান্য লোকের প্রাইভেট সেক্রেটারী যে কালা ছিলেন এ কথাই বা বলা যায় কী করে? বলতে বলতে কিরীটী সহসা কুমারসাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী কুমারসাহেব, আপনিই বলুন না, আপনার সেক্রেটারি কি সত্যিসত্যিই অন্ধ আর কালা ছিলেন নাকি?
না। মৃদুস্বরে কুমারসাহেব জবাব দিলেন।
যাই হোক, বেচারীর যে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে, এ একেবারে অবধারিত। ডাঃ চট্টরাজ বললেন।
আরো দেখুন, কিরীটী ডাঃ চট্টরাজকে আহ্বান করলেন, এই টেবিলের পাশের সোফাটার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখুন। সোফার ওপরে এই বড় বড় বালিশগুলো দেখেছেন? এগুলো তুলে ধরছি দেখুন—এগুলোর গায়ে এখনো একটা লম্বালম্বি সরু চাপের দাগ রয়েছে। একটু ভাল করে পরীক্ষা করলেই বুঝতে কষ্ট হবে না যে এর তলাতেই তলোয়ারটা লুকানো ছিল। খুনী আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখেছিল এবং মনে হয়। মিঃ মিত্র এ ঘরে ঢুকবার আগেই খুনী এখানে এসে অপেক্ষা করছিল। মনে হয় সে জানত মিঃ মিত্ৰ নিশ্চয়ই এ-ঘরে আসবেন। আর এমন লোক খুন করেছে যে মিঃ মিত্রের বেশ পরিচিত। তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আপনার সন্দেহ অমূলক, স্যার দিগেন্দ্র মিঃ মিত্রের একেবারেই অপরিচিত, তা ছাড়া যে খুনী, তার এ-বাড়ীতে এবং কুমারসাহেবের এই প্রাইভেট রুমে বিশেষ রকম যাতায়াত আছে এবং সে এ ঘরে এলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না—এক কথায় খুনী কোন অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি নয়। জানাশোনার বা পরিচিতের মধ্যেই কেউ, যার পক্ষে অনায়াসেই, মিঃ মিত্র যখন কোন কারণে দেয়ালের এদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, সেই অবসরে বালিশের তলা থেকে লুকানো তলোয়ারটা টেনে বার করে মিঃ মিত্রের গলাটা এক কোপে দেহ থেকে আলাদা করে ফেলতে এতটুকুও বেগ পেতে হয়নি।
কিন্তু বন্ধু, তুমি একটা কথা ভুলে যােচ্ছ, ডাক্তার বললেন, মৃতদেহের position দেখে মনে হয় না কি যে মিঃ মিত্ৰ যেন কেপটা ঘাড়ে নেবার জন্যে ঝুঁকে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন?
হ্যাঁ, সেই তো হচ্ছে কথা, কিরীটী বলতে লাগল, এবং ঐ পয়েন্ট থেকেই ধরতে হবে খুনীকে। খুনী এখনও এই বাড়িতেই আছে। সে এখনো পর্যন্ত এ-বাড়ী ছেড়ে চলে যায় নি, যদি অন্ততঃ আমার সহকারীরা সজাগ থেকে থাকে।
হলঘরে যাবার ঐ দরজাটা খুলে যদি কেউ এ-ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে থাকে ইতিমধ্যেই? আমি প্রশ্ন করলাম।
অসম্ভব। হরিচরণ সাড়ে নটা থেকেই হলঘরে আছে, যদি কেউ গিয়ে থাকতই তার দৃষ্টিকে কোনমতেই ফাঁকি দিতে পারত না। জািন কটার সময় আন্দাজ মিঃ মিত্র এই ঘরে এসে ঢুকেছিলেন?
এবারে জবাব দিলাম। আমিই, হ্যাঁ, আমার মনে আছে, রাত্রি তখন ঠিক সাড়ে নটা হবে, কেননা তখন আমি আমার হাতঘড়িটায় সময় দেখেছিলাম। কিরীটী এবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল, ঠিক রাত্রি দশটা এখন। ঠিক যে সময় খুন হয়েছিল, অপরাধী সেই সময়টা যে অন্য জায়গায় উপস্থিত ছিল, এ কথাটা প্রমাণ করবার জন্য যদি সব কিছু আগে থেকেই বন্দোবস্ত করে থেকে থাকে, তা হলেও সে এই ফাকি দিতে পারত না। কিরীটী একটা সিগার বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। একগাল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিম্নস্বরে বলতে লাগল, আশ্চর্য, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। যতটুকু বুঝতে পারছি, কোন স্থিরমস্তিক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এই কাজ করেছে, কিন্তু মাথাটা দেহ থেকে পৃথক হয়ে মেঝের ঠিক মধ্যিখানেই বা এল কি করে? আর ঐভাবেই বা ঠিক ঘাড়ের ওপর বসে ছিল কি করে?
বাইরের হলঘর থেকে একটা মৃদু গানের সুরের রেশ তখনও ভেসে আসছিল। কিরীটী কুমারসাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ও-ঘরে যান কুমারসাহেব, অতিথিরা বেশীক্ষণ আপনাকে না দেখলে একটা গোলমালের সৃষ্টি হতে পারে।
আর গোলমাল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমারসাহেব বললেন, আমার মানসন্ত্রম, ইজণ্ডত সব গেল মিঃ রায়; উঃ, কী দুৰ্দৈব!..ভগবান, এ কি করলে প্ৰভু!
এমন অধীর হলে তো চলবে না। কুমারসাহেব। ডাঃ চট্টরাজ বললেন।
উঃ, কাল সকালে আমি মুখ দেখাব কী করে? কী লজ্জা!..চাঁপা স্বরে বলতে বলতে কুমারসাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কুমারসাহেবের গমনপথের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বললে, আহা বেচারী, বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছেন!
সত্যি, মাথাটা কী ভাবে মেঝের মাঝখানে এল বল তো রায়? ডাক্তার বলতে লাগলেন, গড়িয়ে এসে তো আর ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না!
অনেক সময় অবিশ্যি এর চাইতে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। কিরীটী জবাব দিল, কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখুন ডাক্তার, মাথাটা যদি গড়িয়েই এই জায়গায় আসত, তাহলে দেহ থেকে মাথাটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই পর্যন্ত একটা রক্তের ধারা থাকত। তা নেই। তাতেই এক্ষেত্রে স্পষ্ট মনে হয়, খুনী নিজেই দেহ থেকে মাথাটা কেটে ফেলবার পর মাথাটা ঐখানে বসিয়ে রেখে গেছে। আমার মনে হয় কি জানেন ডাক্তার?
একটা দানবীয় উল্লাসে এবং নিজের শক্তির ওপর একটা স্থির বিশ্বাসে খুনী মাথাটা এখানে রেখে গেছে-এই কথা বলত চাও তো? জবাব দিলেন ডাক্তার।
করতে করতে একটা পকেট থেকে কতকগুলো কাগজপত্র টেনে বের করল এবং সেগুলো টেবিলের ওপরে রাখবার সময় তার মুখে মৃদু একটুকরো হাসি জেগে উঠল। চেয়ে দেখলাম কাগজপত্রের মধ্যে আছে অনেকগুলো খবরের কাগজের কাটিং, ফটোগ্রাফ, গোটা দুই হলুদ রংয়ের ভাজকরা পুরু অনেকটা তুলেটি কাগজের মত কাগজ, একটা টাৰ্চ, একটা পেনসিল ও ব্যাঙ্ক নোট এবং কিছু খুচরো টাকা পয়সা। ফটোগুলো দেখতে দেখতে কিরীটী সহাস্যমুখে জবাব দিল, ফটোগুলো দেখছি ভদ্রলোকের নিজেরই। নানা কায়দায় নানা পোজে তোলা ফটো। কিন্তু এত ফটোই বা পকেটে কেন? আর আজকের রাত্রের এই উৎসবের পোশাকের পকেটেই বা এগুলো রাখার তাৎপর্য কী?
এতে তো আশ্চর্য হবার কিছুই নেই রায়! ডাক্তার বললেন, যারা নিজেদের সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন বা এক কথায় সোজা ভাবে বলতে পার দান্তিক, তাদের পক্ষে নিজেদের ড্রাম পিটবার-নিজেকে প্রচার করবার এও একটা কাঠি বৈকি।
না বন্ধু না, ব্যাপারটা অত সামান্য নয়। এর মধ্যে অন্য কোন ব্যাপার আছে। লক্ষ্য করেছেন, এর মধ্যে কিছু হারিয়েছে কিনা? কিরীটী ডাক্তারের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল।
তার মানে? তোমার কোন দেশী প্রশ্ন কিরীটী? আমি কি আগে থেকে জানতাম নাকি মিঃ মিত্রের পকেটে কি আছে না আছে। আশ্চর্য! রাগতভাবে ডাক্তার জবাব দিলেন।
হ্যাঁ দেখুন, আমরা জানি ভদ্রলোক এখন পর্যন্ত অবিবাহিত এবং এর নিজের ঘর-বাড়িও আছে। সেখানে নিশ্চয়ই চাকরিবোকরও আছে—এখানে তো আর উনি দিবা-রাত্ৰই উপস্থিত থাকেন না! এ কথাও হয়তো বললে নেহাৎ ভুল হবে না যে, ঘরের যাবতীয় চাবিই চাকরবাকারের হাতে দিয়ে তিনি আসেন না। অন্ততঃ দু-চারটে প্রাইভেট ঘরের চাবিও ওঁর পকেটে থাকা উচিত, যা হয়তো চাকরবাকারের হাতে বিশ্বাস করে রেখে আসা চলে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মিঃ মিত্রের পকেটে সে ধরনের কোন চাবিই পাওয়া যাচ্ছে না। এর পকেট থেকে কিছু হারিয়েছে কিনা বলতে আমি ঐ চাবির কথাই বলতে চাইছিলাম ডাক্তার!
তারপর সহসা কিরীটী আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললে, সুব্রত, অনুসন্ধানের ব্যাপারটা একটু চোখ মেলে সম্পন্ন করলেই অনেক কিছু গোলমাল চোখে পড়ে। একটা অনুসন্ধানের কাজে হাত দিলে সর্বদা চিন্তা করবে, কি থাকা উচিত ছিল, অথচ তা নেই বা পাওয়া যাচ্ছে না! এক্ষেত্রে আমার চাবির কথাটাই মনে হচ্ছে, সেটাই যেন চুরি গেছে। চাবি চুরি যাওয়াটা খুবই আশ্চর্যজনক। কিন্তু তার চাইতেও আশ্চর্যজনক অথচ সহজ একটা জিনিস হারিয়েছে বা পাওয়া যাচ্ছে না, এখুনি তোমাদের সেটা দেখােব। অথচ তোমরা দুজনেই অর্থাৎ ডাঃ চট্টরাজ ও তুমি অসাবধানতাবশতঃ লক্ষ্য করোনি, যা প্রত্যেক মানুষেরই পক্ষে, যাদের সামান্য একটু বুদ্ধি আছে এবং যারা সেটা খাটাবার চেষ্টা করে, এ ঘরে ঢোকামাত্রই লক্ষ্য করা উচিত ছিল এমন একটা জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না!
হত্যাকারীর সম্পর্কে কোন সূত্র কি? আমি প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ, হত্যাকারী নিজে।
এমন সময় ক্যাঁচ করে দরজা খোলার একটা মৃদু শব্দে আমরা সকলে চমকে চোখ তুলে তাকালাম। এ ঘরের সঙ্গে হলঘরের যোগাযোগ করে যে দরজাটি, তার ফঁােক দিয়ে সাধারণ পোশাক পরা একজন লোকের মুখ ও দেহের অর্ধেকটা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে এবং তাকে একপ্রকার এক পাশে ঠেলেই একটি যুবক ঘরে এসে প্রবেশ করল।
চোখের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি দেখলেই মনে হয় যুবক ভয়ানক ভীত হয়ে পড়েছে। যুবক ঘরে ঢুকেই থাপ করে একটা গদি আঁটা চেয়ারে বসে পড়ল, এসব ব্যাপার কী? বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরুতে যাচ্ছি, গেটম্যান বললে, যেতে দেওয়া হবে না, পুলিসের অর্ডার! কুমারসাহেবের দেখা পেলাম না। তাঁর সেক্রেটারী মিঃ মিত্রই বা কোথায়?
সাধারণ পোশাক পরা যে লোকটি আমাদের সঙ্গেই গাড়িতে এসেছিল, সে যুবকের পিছু পিছু এই ঘরে ঢুকল।
ইনি কে জান কালী? কিরীটী লোকটিকে প্রশ্ন করল।
না মিঃ রায়, তবে এঁকে মিঃ মিত্রের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিলাম। তখনই শুনেছিলাম এর নাম নাকি বিকাশ মল্লিক। এমন সময় আবার দরজার বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। পরীক্ষণেই প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা ঘরে প্রবেশ করলেন।
সহসা একটা অস্ফুট ভয়চকিত শব্দ প্রফেসারের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এল, উঃ কী ভয়ানক! এ কি? সমস্ত মুখ তাঁর ভয়ে রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
হঠাৎ একটা ভারী বস্তুর পতনশব্দে সকলে সচকিত হয়ে উঠে দেখি-বিকাশ মল্লিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে।
এই অপদার্থটাকে বাইরে রেখে এস। প্রফেসর শর্মা কালীকে আদেশ দিলেন।
কিরীটী আমাকে ইঙ্গিত করতেই আমি ও ডাক্তার দুজনে জ্ঞানহীন বিকাশ মল্লিকের অসাড় দেহটা ধরাধরি করে কোনমতে পাশের ঘরে নিয়ে এলাম।
এ ঘরের মধ্যেও মৃত্যুর মতই স্তব্ধতা বিরাজ করছে।
একটা সামান্য ভূঁচ পড়লেও বোধ হয় শব্দ শোনা যায়।
কিছুক্ষণ চোখেমুখে জল দিয়ে হাওয়া করতে করতে একসময় ধীরে ধীরে বিকাশ মল্লিক উঠে সোফার ওপরে হেলান দিয়ে বসল এবং ক্লান্তিভারে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিল।
ডাক্তার বললেন, এখন একটু সুস্থ বোধ করছেন কি?
হ্যাঁ মৃদু ক্লান্তস্বরে বিকাশবাবু জবাব দিলেন।
মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰ বুঝি আপনার অনেক দিনের পরিচিত? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
না, খুব বেশী দিনের নয়, মাত্র কয়েক সপ্তাহ হবে। বিকাশ বলতে লাগল, ভাল লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় অল্পদিনেই জমে ওঠে। মিঃ মিত্র একজন নামকরা স্পোর্টসম্যান ও শিকারী ছিলেন। প্রায়ই আমাদের দেশের বাড়ি ডায়মণ্ডহারবারে কি একটা কাজে যেতেন; সেখানেই প্রথম আলাপ হয়। তাছাড়া অনেকদিন থেকেই হিন্দীটাকে ভাল করে শিখবার আমার ইচ্ছা। শুভঙ্করবাবু চমৎকার হিন্দী বলতে ও লিখতে জানতেন। আমি ওঁর কাছেই একটু একটু করে হিন্দী শিখছিলাম। তারপর উনিই আমাকে একদিন এখানে এনে কুমারসাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং কুমারসাহেবের দয়াতেই একটা অফিসে আজ দিন দশ হল একটা কাজ যোগাড় করেছি। তিনিই আজকের এই উৎসবে আমাকে নিমন্ত্রণ করে আনেন।
কিন্তু একটা সংবাদ বোধ হয় এখনও আপনি পাননি বিকাশবাবু! আমি বললাম।
কি? বিকাশ প্রশ্ন করলেন।
আপনার বন্ধু অর্থাৎ মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰ খুন হয়েছেন।
সহসা যেন কথাটা শুনে বিকাশ মল্লিক অতিকে উঠলেন, অ্যাঁ…তবে কি—তবে কি যে মৃতদেহ দেখে এলাম একটু আগে…
হ্যাঁ, তাঁরই মৃতদেহ। এমন সময় কিরীটী ও প্রফেসর শর্মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
আপনি তাহলে এখন যেতে পারেন বিকাশবাবু, আমার লোকের কাছে আপনার ঠিকানাটা শুধু দয়া করে রেখে যাবেন।
বিকাশ মল্লিক কিরীটীর কথা শুনে একপ্রকার ছুটতে ছুটতেই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।–
সে ঘরে তখন আর কোন লোকজনই ছিল না, সেকথা আগেই বলেছি।
মাথার ওপর উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় ঘরখানি উদ্ভাসিত। একটু আগেও যে-ঘরটা কলহাস্যে মুখরিত ছিল, এখন সেটা শূণ্য খা-খাঁ করছে।
কিরীটী প্রফেসর শর্মাকে একটা চেয়ারে উপবেশন করতে বলে নিজেও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।–
মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের আপনিই সব চাইত বড় বন্ধু ছিলেন শুনেছি। সুতরাং এক্ষেত্রে আপনার কাছে যতটা সাহায্য পাব, আর কারও কাছ থেকেই তা পাব না। অবিশ্যি এত রাত্রে আপনাকে বেশী বিরক্ত করব না। সামান্য দু-চারটে কথা—বুঝতেই পারছেন, বিশেষ প্রয়োজনেই..
না না, সে কি, জিজ্ঞাসা করবেন বৈকি। বিশেষ করে এখানে যখন উপস্থিত আছি।
আচ্ছা, আজ কাঁটার সময় ঠিক আপনি এখানে এসে পৌছান মিঃ শৰ্মা?
সঠিক আমার মনে পড়ছে না, তবে রাত্রি আটটা থেকে সোয়া-আটটার মধ্যে।
বেশ, তারপর থেকে অর্থাৎ আপনার এখানে পৌঁছবার পর থেকে এখানে আপনার চোখে যা যা দেখেছেন বা ঘটেছে সব খুলে সংক্ষেপে আমায় বলুন।
সে আর এমন বিশেষ কঠিন কি! আমার নিজের যে এখানে আসবার খুব ইচ্ছা ছিল তা নয়, একপ্রকার দীনতারণের ইচ্ছাতেই এখানে আজ রাত্রে আমায় আসতে হয়; অথচ সে এসেই চলে গেল, তাছাড়া-হঠাৎ কথার মাঝে যেন একটু থেমে প্রফেসর শর্মা আমার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, তাছাড়া আমার ধারণা ছিল, দীনতারণের এখানে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার আগে থেকেই কথা ছিল।
কারও মানে কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে তো? কিরীটী বললে।
প্রফেসর শর্মা যেন একটু চমকে উঠলেন। পরীক্ষণেই কিরীটীর চোেখর ওপর চোখ রেখে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন।
না, আমি তা ঠিক জানি না। প্রফেসর শর্মা আবার বলতে লাগলেন, তাছাড়া এখানে পৌঁছেই আমি নীচের হলঘরে ঢুকি, সেইখানেই মিঃ মিত্রের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা দুজনে কথা বলতে বলতে একটা টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসে দু গ্লাস ‘জিনজার’ খেতে লাগলাম। হঠাৎ এক সময় “জিনজার’ খেতে খেতে শুভঙ্কর হাসতে হাসতে গ্লাসের লাল রঙের তরল পদার্থের দিকে চেয়ে আমায় বললে, দেখছিল কালিদাস, কী টুকটুকে লাল! সত্যি ভাই, আজ রাত্রে এই লাল রংটা যেন আমার মনে একটা নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে! Oh red, it is simply charming! It is nice!
হঠাৎ কিরীটী মুখটা ঘুরিয়ে আমাকে বললে, সুব্রত, বেল বাজিয়ে একটা বেয়ারাকে ডাক তো।
বেল বাজবার সঙ্গে সঙ্গেই, যে বেয়ারাটি প্রথম মৃতদেহ আবিষ্কার করে, সে এসে দাঁডাল।
কিরীটী তার মুখের দিকে চেয়ে বললে, আরে, তুমিই তো প্রথম মৃতদেহ দেখ, না? তুমি কফি নিয়ে যাবার ঘণ্টা শোন কখন?
আজ্ঞে, রাত্রি ঠিক সাড়ে-নটার সময়। কেননা আমি ঘড়ির দিকে নজর রেখেছিলাম।
তুমি তখন কোথায় ছিলে?
রান্নাঘরে হুজুর। রান্নাঘরের লাগোয়াই খবার ঘর, এবং রান্নাঘর ও খাবার ঘর কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের ঠিক পিছনেই।
কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের মধ্যে যে তোমাদের ডাকবার অন্য বেল আছে, সেই বেল বাজার দড়িটা কোথায়?
প্রাইভেট রুম থেকে। হলঘরে আসবার দরজার গায়েই হুজুর।
বেশ, বেল শোনা মাত্রই তুমি কফি নিয়ে চলে এলে, না?
না। বাবুর্চি কফিটা তৈরী করতে একটু সময় নেয়। মিনিট দশেক বোধ করি দেরি হয়েছিল। কফি নিয়ে আসতে।
কোন দরজা দিয়ে তুমি কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে ঢোক?
ওঘরে যাবার হলের মধ্য দিয়ে যে দরজা আছে সেই দরজা দিয়ে। দরজার ঠিক সামনেই একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন, বোধ হয় আপনারই লোক হবেন তিনি। আমি দরজায়। শব্দ করলাম, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ ভেতর থেকে পেলাম না। এবার জোরে দরজায় ধাক্কা দিলাম, কিন্তু তাতেও কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। তখন আমি সামনে দাঁড়ানো সেই … ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করি, ঘরে কেউ আছেন কি? তাতে তিন জবাব দেন, তার মানে? কারও ঐ ঘরে থাকবার কথা ছিল নাকি? আমি তাতে জবাব দিই, আজ্ঞে, সেক্রেটারী সাহেবের তো ঐ ঘরে থাকবার কথা। তাতে আমায় বললেন, তবে যাও। আমি তখন দরজা টেনে ভিতরে প্রবেশ করি। বেয়ারার গলার স্বর ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, সে কথা বলতে বলত ঘন ঘন আমাদের সকলের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল।
তারপর কিরীটী জিজ্ঞাসা করল।
আজ্ঞে, তারপর আমি কফি নিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকে প্রথমে কিছু দেখতে পাইনি।
ঘরের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ পায়ে বাধা পেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। পড়েই আমি চিৎকার করে উঠি ও তাড়াতাড়ি উঠে আপনাদের ঘরের দিকে যাই। আমি আল্লার নামে শপথ করছি, হুজুর এর চাইতে বেশী কিছুই আমি জানি না। আমি খুন করিনি। বলতে লিতে লোকটা হাউ হাউ করে কঁদতে কঁদিতে কিরীটীর পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পড়ল।
তোমাদের কোন ভয় নেই হে, তুমি উঠে বস। আমি জানি তুমি খুন করেনি। কিরীটির কথায় কতকটা আশ্বস্ত হয়েই যেন লোকটা চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল।
কিরীটী সম্মুখে উপবিষ্ট প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ প্রফেসার আপনি যা বলছিলেন এবার বলুন।
প্রফেসর শর্মা বললেন, জিনজার খাবার পর সেক্রেটারী শুভঙ্করকে নিয়ে আমি খাবার ঘরে যাই। সেখানে আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে শুভঙ্কর নীচে চলে যায়।
অনুমান তখন রাত্ৰি কটা?
প্রফেসর শর্মা মৃদু একটু হাসলেন, ক্ষমা করবেন মিঃ রায়, আগে তো বুঝিনি আজকের রাত্রের প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মিনিটের হিসেবনিকেস কারো কাছে দিতে হবে তাহলে না হয় ঘড়িধরে সব কাজগুলো করে রাখতাম। তবে যতদূর মনে হয়। রাত্রি তখন নটা হবে বা নটা বাজবার মিনিট চার-পাঁচ আগেও হতে পারে। তারপর হঠাৎ ব্যঙ্গ-মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা কি বলুন তো মিঃ রায়, গরীবকে ফঁাসাবার মতলবে জেরা করছেন না তো?
কিরীটী ও-কথার কোন জবাব না দিয়ে গভীর স্বরে প্রশ্ন করলে, আপনি তাহলে তারপর খাবার ঘরেই রয়ে গেলেন?
হ্যাঁ খাবার ঘরে পরিষ্কার টেবিল চেয়ার পাতা ছিল, কেননা আজ খাবার আয়োজন হয়েছিল নীচে। হঠাৎ আমার নজরে পড়ে, টেবিলের ওপর একখানি হিন্দী ভাষায় অনুদিত ছোটদের রূপকথা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে পড়ে আছে। আমি হিন্দী ভাষা বেশ ভালই জানি এবং হিন্দীতে অনুদিত ছোটদের একখানি রূপকথা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না; তাছাড়া রূপকথা পড়তে চিরদিনই বড় ভালবাসি। বইখানি হাতে পেয়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা চেয়ারের ওপরে বসে পড়লাম। বেশী লোকের গোলমাল আমি কোন দিনই পছন্দ করি না, ভাবলাম বাঁচা গেল। হাতের কাছে বইটা পেয়ে তাতেই মনঃসংযোগ করলাম। বইটা সত্যিই ভাল। রুপকথা পড়তে আপনার কেমন লাগে মিঃ রায়?
ব্রাভো! চমৎকার! কিরীটী চাপা উল্লাস ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, এ যে দেখছি। একটা মজার রহস্য উপন্যাস হয়ে দাঁড়াচ্ছে! চারদিকে উৎসবের কলোচ্ছাস, একজন ছায়ার মত এসে স্নানের ঘরে মাটি কোপানোর খুরপি ফেলে গেলেন; আর একজন খাবার ঘরে এসে সাত সমুদ্র তেরা নদীর পারে রুপকথা কুড়িয়ে পেলেন এবং তখনি সেই রূপকথা পড়ায় মত্ত হয়ে উঠলেন। এমন সময় এক সাংঘাতিক খুনী রক্ত দেখবার নেশায় পাশের ঘরে হায়েনার মত হিংস্র হয়ে উঠছে! সব কিছুর মধ্যেই একটা মানে থাকা দরকার। যদি এই পর পর ঘটনাগুলোর আদপে কোন মানেই না থাকে, তাহলে এই পৃথিবীতে কোন কিছুরই মানে श्ा না!
পরমুহুর্তেই যেন হঠাৎ কিরীটী আবার গভীর হয়ে প্রফেসার শমর্যকে পুনঃপ্রশ্ন করল, খুব ভাল, ঘড়ির সময় নিয়ে আপনি একটু আগে আমাদের ঠাট্টা করছিলেন, আবার কিছু সময়-সম্পৰ্কীয় অতি আবশ্যকীয় দু-চারটে কথা এসে যাচ্ছে! ক্ষমা করবেন প্রফেসার, আমি সিঁড়ির ও খাবার ঘরের ঘড়ি মিলিয়ে দেখেছি। আমার ঘড়ি আর ওই দুটো ঘড়ি একই সময় দিচ্ছে— আপনার ঘড়িতে এখন কটা প্রফেসার?
প্রফেসর শর্মা পকেট থেকে একটা মূল্যবান রৌপ্য-নির্মিত ঘড়ি বের করে হাতের ওপরে নিয়ে দেখে বললেন, ঠিক দশটা বেজে বারো মিনিট হয়েছে।
আমারও ঠিক তাই, কিরীটী আপন হাতঘড়ি দেখে বললে, তোমার ঘড়িতে কত সুব্রত?
দশটা বেজে চব্বিশ মিনিট। আমার ঘড়ি দেখে বললাম।
বেশ! প্রফেসার, আপনার যদি আপত্তি না থাকে। তবে দয়া করে যদি বলেন, রাত্রি ঠিক সাড়ে নটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন? কিরীটী প্রশ্ন করল প্রফেসারের মুখের দিকে চেয়ে, অর্থাৎ যখন মিঃ মিত্ৰ কুমারসাহেবর প্রাইভেট ঘরে গিয়ে ঢোকেন?
নিশ্চয়ই। বলে সহসা প্রফেসার হাঃ হাঃ করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন। তারপর কেনমতে হাসি চাপিতে চাপতে বললেন, সাড়ে নটার সময় হলঘরে দাঁড়িয়ে আমি আপনারই পাহারারত ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তারসঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় আট-দশ মিনিট কথাবার্তা বলেছি। তারপর তার সামনেই এই ঘরে এসে ঢুকি এবং কুমারসাহেব এইখানে দাঁড়িয়ে আপনাদের সকলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন, আশা করি আপনার মহামান্য তীক্ষ্মবুদ্ধি বন্ধুবর এত তাড়াতাড়ি সে কথা ভুলে যাননি!
কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম অসহ্য বিরক্তিতে সে এবার নিশ্চয়ই কোন কিছু বলে বসবে, কিন্তু হঠাৎ যেন সে নিজেকে সামলে নিয়ে সামনেই ঝোলানো ভৃত্যদের ডাকবার ঘণ্টার দড়িটায় ধীরে ধীরে একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিল।
আমরা সকলে নির্বক বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে উদ্গ্ৰীব হয়ে চেয়ে রইলাম।
হরিচরণ ঘরে এসে ঢুকল।
প্রফেসারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কি ইঙ্গিত করতেই ঘাড় হেলিয়ে বললে, হ্যাঁ, স্যার, ঐ ভদ্রলোক আমার কাছেই ছিলেন। এক সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মশাই, ঠিক এখন সময় কত বলতে পারেন? আমার মনে হচ্ছে আমার ঘড়িটা বোধ হয় একটু slow যাচ্ছে। আমি বললাম, আমার ঘড়ি ঠিকই আছে—সাড়ে নটা বেজেছে। আমরা দুজনে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ির ঘড়িটাও একবার দেখে নিজেদের ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম। কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের ঠিক সামনাসামনি ওঠবার সিঁড়ি, আমরা দুজনেই সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার ঘড়িটা সিঁড়ির সঙ্গে একই টাইম দিচ্ছে দেখে নিজের ঘড়িটি মিলিয়ে নিতে নিতে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
কিরীটী বাধা দিল, তাহলে তুমি তখন ঠিক সিঁড়ির মাথায় ছিলে, যখন মিঃ মিত্র কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে প্রবেশ করেন।
হ্যাঁ, সেই সময় প্রায় পাঁচ মিনিট উনি আমার সঙ্গেই ছিলেন। তারপর তিনি এই ঘরে এসে প্রবেশ করেন।
ঐ সময় তুমি নিশ্চয়ই হলঘর থেকে প্রাইভেট রুমে যাবার দরজাটার প্রতি বেশ ভাল নজর রেখেছিলে হরিচরণ, কী বল?
খুব কঠিন দৃষ্টিতে নজর না রাখলেও, মোটামুটি ভাল করেই নজর রেখেছিলাম স্যার। এবং বেয়ারা যখন ঘরে ঢেকে আমি তখনও তার পিছনেই দাঁড়িয়ে এবং আমি ওর সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে ঢুকে মৃতদেহ দেখতে পাই। আপনি না। আসা পর্যন্ত আমি একবারের জন্যও ওখান থেকে নড়িনি।
হঠাৎ প্রফেসর শর্মা বললেন, আচ্ছা, এবারে আমি আসতে পারি কী মিঃ রায়? রাত্রি অনেক হল। এই আমার নামের কার্ড রইল, যখন ইচ্ছা ফোনে একটু খবর দিলেই আমার দেখা পাবেন। বলতে বলতে একটা সুদৃশ্য কার্ড কিরীটীর হাতের দিকে প্রফেসর এগিয়ে ধরলেন। কিন্তু কিরীটী তাঁর কথায় কোন জবাবই দিল না, চুপচাপ বসেই রইল, যেন কথাগুলো কানেই যায়নি। তারপর নীরবে হাত বাড়িয়ে প্রফেসার হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে ভু কুঁচকে কী যেন ক্ষণেক ভােবল, তারপর মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললে, প্রফেসর শর্মা, আশা করি ও-ঘরের তলোয়ারটার কথা এর মধ্যেই একেবারে ভূলে, যাননি!
সহসা প্রফেসারের চোখের দৃষ্টিটা তীক্ষ ও উগ্র হয়ে উঠল। তিনি পলকহীন ভাবে কিরীটীর দিকে চাইলেন, কিরীটীও তার নিভীক দৃষ্টিতে প্রফেসারের দিকে চেয়ে রইল।
চারজোড়া তীক্ষ্ম চোখ পরস্পর পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ অপলকে চেয়ে রইল। দুজনেই ভয়ঙ্কর রকম যেন সজাগ হয়ে উঠেছে।
তারপর সহসা আবার প্রফেসার প্রবলভাবে হেসে উঠলেন এবং চিবিয়ে চিবিয়ে অদ্ভুত ভাবে বলে উঠলেন, চমৎকার! তাহলে মান্যবর ডিটেকটিভ বন্ধু আমার আমাকেই খুনী বলে সাব্যস্ত করলেন শেষটায়! ওয়ানডারফুল! অভাবনীয় চিন্তাশক্তি!
না। জলদগন্তীর স্বরে কিরীটী বলে উঠল, অন্ততঃ বর্তমানে আপনাকে খুনী বলে সন্দেহ করিনি। কোন মানুষ আগে থেকে চিন্তা করে খুন করতে পারে, কিন্তু আগে থেকে চিন্তা করে শয়তান হতে পারে না! আমি শুধু কয়েকটা আবশ্যকীয় প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করেছি মাত্র। ও-কথা যাক প্রফেসার, বলুন, মিঃ মিত্র কি হিন্দী ভাষা বলতে-কইতে পারতেন?
সত্যি কথা বলতে কি, প্রফেসার বলতে লাগলেন, মোটেই না। হিন্দী ভাষায় তার জ্ঞান, ‘করেঙ্গ’ ‘খায়েঙ্গা’ পর্যন্তই। শুভঙ্কর ছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু, তার নাড়ীনক্ষত্র আমি জানি। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে ছিল ও। লোক জানত ও বিলাতফেরত, উচ্চশিক্ষিত; আসলে ওর পড়াশুনা তেমন ছিল না। ম্যাট্রিক পর্যন্ত বিদ্যার দৌড়। চেহারাটা ছিল সুন্দর আর common sense ছিল প্রচুর, যার ফলে কিছু না জেনেও অনেক কিছুই জািনবার ভান করতে পারত। কিন্তু খেলাধূলায় ওর মত ওস্তাদ বড় একটা দেখা যেত না। টেনিস খেলতে, সাঁতার কাটতে, ঘোড়ায় চড়তে, তরবারি বা ছোরা খেলতে, বন্দুক ছুড়তে, বড় বড় জানোয়ার শিকার করতে ও ছিল একেবারে যাকে বলে অদ্বিতীয়। আচ্ছা, এবারে Good Night জানাচ্ছি। my friend! আশা করি ক্ষণিকের চেনা গরীব বন্ধুর কথাটা ভুলে যাবেন না।
নিশ্চয়ই না। বিশেষ করে না ভুলতে যখন আপনিই এত করে অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছেন! কিরীটী গম্ভীর স্বরে জবাব দিল।
ধীর মন্থরপদে জুতোর শব্দ তুলে প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
কিরীটী এক সময় বললে, দেখ হরিচরণ, তুমি একবার এখানে যাঁরা যাঁরা উপস্থিত আছেন প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে জানিবার চেষ্টা কর, তাদের মধ্যে কে কে আজ রাত্রে এখানে প্রফেসার কালিদাস শর্মাকে দেখেছেন! আর খাবার ঘরে গিয়ে একবার দেখ সেখানে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে নামে বইখানা পাও নাকি! আর চেষ্টা কর জানতে কে ঐ বইখানা এনেছিল সঙ্গে করে? হ্যাঁ, আর যাবার সময় কুমারসাহেবের ম্যানেজারটিকে একবার এখানে পাঠিয়ে দিও তো?
হরিচরণ ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী আমাদের দিকে তাকিয়ে বললে, আমি যতদূর জানি, এই কালিদাস শর্মারই বছর তিন-চার আগে কী একটা ব্যাপার নিয়ে দুর্নাম রটে, ফলে কলেজের চাকরি যায়, তারপর থেকেই লোকটা সম্পূর্ণ বেকার; কিন্তু বর্তমানে বেকার অবস্থায় এত বাবুয়ানা ওর আসে কোথা থেকে? খুব সম্ভব কুমারসাহেবকে ও নেশার বস্তু যোগায়!
আমারও যেন তাই মন হয়, ডাঃ চট্টরাজ চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, বোধ হয় সেইজন্যই কুমারসাহেব যখন আজ রাত্রে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে উঠে গিয়ে দ্বিতীয়বার ফিরে এলেন, তখন তাঁকে একরকম যেন অসুস্থের মত দেখাচ্ছিল। মাথাটা নিচের দিকে নামিয়ে শ্লথ মন্থর গতিতে হ্যাঁটছিলেন। তখনই আমার মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক বোধ হয় কোন একটা নেশাটেশায় অভ্যস্ত।
আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার, কিরীটী বলে উঠল, খুব সম্ভবত দ্বিতীয়বার তিনি যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন কোন একটা কিছু নেশা করে এসেছিলেন। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেননি।
আমি বাধা দিলাম, উনি না লক্ষ্য করলেও, আমার দৃষ্টিকে তুমি এড়াতে পারনি বন্ধু। কুমারসাহেব যখন আমাদের দেওয়া সিগার না খেয়ে নিজের সিগারেট খেয়ে উঠে যান, তখন তাঁর অ্যাসট্রের মধ্যে সেই নিক্ষিপ্ত নিঃশেষিত সিগারেটের টুকরোটা তুমি তুলে নিয়ে পকেটস্থ করেছা!
এতদিনে সত্যসত্যই সুব্রতর চোখ একটু সজাগ হতে আরম্ভ করেছে। কিরীটী হাসতে হাসতে বলতে লাগল, চেয়ে দেখুন ডাক্তার, কিরীটী পকেটে হাত চালিয়ে সিগারেটের টুকরো বের করে আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরল, একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, এ সিগারেট কেনা নয়, হাতে পাকিয়ে তৈরি করা, তাছাড়া সিগারেটের মসলা যেমন হয় এর মধ্যকার মসলা ঠিক তেমন নয়; একটু মোটা এবং কোনমতে কাগজ দিয়ে জড়িয়ে সিগারেট বানানো হয়েছে। শুকে দেখুন…। বলতে বলতে কিরীটী সিগারেটটা খুলে ফেললে।
তাছাড়া দেখুন, মসলাটা কেমন ফিকে ব্রাউন রংয়ের ‘মরিহুয়ানা’ (‘morihuanna) কিংবা ‘হ্যাসহিস’ (‘hashish’) ভাং সিদ্দি বা গাঁজা জাতীয় জিনিস। তবে আসলে কোন জিনিসটা দিয়ে যে এই সিগারেটের মসলা তৈরী হয়েছে তা রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষিত না হয়ে আসা পর্যন্ত সঠিক বলা চলছে না। তোমরা হয়তো জান না, ইজিপ্টের লোকেরা হ্যাসহিসের সবুজ বা কাঁচা পাতা খায়। তাতে নাকি নেশা হয়। মেক্সিকোতে যে হ্যাসহিস পাওয়া যায়, তার পাতা আরো তীব্র নেশা আনে। খুব সম্ভব প্রফেসর শর্মা এই ধরনের সিগারেট তৈরী করে কুমারসাহেবকে নেশায় পরিতুষ্ট করে থাকেন। প্রফেসর শর্মা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন বলে ওঁর সিগারেটের ওপরে সর্বপ্রথম আমার সন্দেহ জাগে, যে মুহুর্তে উনি আমার দেওয়া সিগারেটের অফার ফিরিয়ে দিলেন, অথচ ঠিক সেই সময়ই নিজের কেস হতে সিগারেট বের করে ধূমপান শুরু করলেন। কোন সভায় বা দুদশজন যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে কেউ সিগারেট কাউকে অফার করলে তাকে refuse করে পরমুহুর্তেই নিজের সিগারেট ব্যবহার করা এটিকেট-বিরুদ্ধ। একমাত্র সেই কারণেই আমি কুমারসাহেবের নিঃশেষিত ফ্যাগ end টা অ্যাসট্রে হতে তুলে নিয়েছিলাম। তারপর একটু থেমে আবার বললে, হ্যাঁ ভাল কথা ডাক্তার, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্ৰে ভাং সিদ্ধি প্রভৃতির নেশা করলে কি কি লক্ষণ দেখা যায় বলে?
চোখের মণিতে অবস্থিত আলো প্রবেশের ছিদ্রপথ pupil সঙ্কুচিত (contracted) হয়ে যায়। জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে শুরু করে, সামান্য একটু চলাফেরা করলেই exhaustion হয়ে গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কল্পনায় সব নানা রকম অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকে; যাকে আমরা ডাক্তারী শাস্ত্ৰে hallucination বলি! এখন বোধ হয় বুঝতে পারছ রায়, কুমারসাহেব যে অদ্ভূত গল্প আমাদের শোনাচ্ছিলেন তা ঐ নেশারই প্রভাবে।
অদ্ভুত আর তাকে বলা চলে না ডাক্তার, আজকের রাতের ঘটনার কথা ভাবতে গেলে কিছুই আর আশ্চর্য বা অদ্ভুত লাগে না। আমি এখনও স্থিরনিশ্চিত নই কুমারসাহেবের গল্পটা নেশা থেকেই উদ্ভূত না কল্পনা মাত্র। আপনি যে জিনিসটার প্রভাবের কথা বলছেন সেটাও ঐ গাঁজা বা ভাং জাতীয় গাছের পাতা থেকে হয়, এবং ঐ ধরনের নেশার বস্তু একটা সিগারেটের মধ্যে যতটুকু থাকে তাতে করে আমন নেশা হতে পারে বলে আমার কিন্তু মনে হয় না। সামান্য একটু উত্তেজকের কাজ করতে পারে মাত্র। আমার মনে হয় এ ধরনের নেশায় কুমার সাহেব অনেকদিন থেকেই বেশ অভ্যস্ত। না হলে তিনি এ ধরনের নেশা করে নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এই জাতীয় নেশায় অভ্যস্ত যেসব নেশাখের, তাদের এই সামান্য একটু নেশার দ্রব্য সেবন করলে আর যাই হোক অন্ততঃ কল্পনায় স্বপ্ন যে দেখতে শুরু করবে না এটাও ঠিক। অর্থাৎ আমি বলতে চাই, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্রে ঐ hallucination দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়তো না হওয়াটাই বেশী সম্ভব। আরো একটা কথা এই সঙ্গে আমাদের ভুললে চলবে না যে, এ জাতীয় জিনিসের লোককে মেরে ফেলবারও একটা ক্ষমতা আছে, তবে একটু দীর্ঘ সময় লাগে। যেমন ধরুন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত ভাবে ঐ ধরনের নেশা করে আসলে, অনবরত এগুলো slow poisoning-য়ের কাজ করতে পারে অনায়াসেই। এমনও হতে পারে যে, ঐভাবে নেশার মধ্য দিয়ে slow poisoning করে কেউ ঐ উপায়ে অনেক দিন ধরেই ওঁকে সবার অলক্ষ্যে এ জগৎ থেকে নিঃশব্দে সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা করছিল।
এমন সময় ম্যানেজারবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন। —এমন করে আর কুমারসােহবের সর্বনাশ করবেন না। স্যার, আপনার লোকেদের আদেশ দিন যাতে করে তঁরা এবার এখানে উপস্থিত সম্মানিত অতিথি-অভ্যাগতদের অন্ততঃ চলে যেতে বাধা না দেন। একেই তো তীরা সব নানা অদ্ভুত প্রশ্ন করে করে আমাদের প্রায় পাগল কর তোেলবার যোগাড় করেছেন। এমন কি এর মধ্যে কেমন করে না জানি প্রকাশও হয়ে গেছে যে কুমারসাহেবের সেক্রেটারীকে কে হত্যা করেছে। আমি যদিও তঁদের বুঝিয়ে বলেছি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন, কেউ তাঁকে হত্যা বা খুন করেনি, কিন্তু এ ধরণের কথা একবার রটলে কি কেউ আর কারও কথা বিশ্বাস করে বা করতে চায়?
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে বসুন। আপনার মনিবের সেক্রেটারী আত্মহত্যা করেছেন শুনলে নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর আত্মমর্যাদা বেড়ে যাবে, কি বলেন ম্যানেজারবাবু? কিন্তু সে কথা থাক, ব্যস্ত হবেন না, এখন বলুন তো দেখি, আজ রাত্রে এই উৎসবে এমন কি কেউ এখানে এসেছেন যাঁকে আপনি চেনেন না বা ইতিপূর্বে কোন দিন দেখেননি?
না, কই এমন কাউকে দেখছি বলে তো আমার আজ মনে পড়ছে না! ম্যানেজারবাবু বলে উঠলেন, তাছাড়া এ উৎসবে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেকেই নিমন্ত্রণ-লিপি দেওয়া হয়েছিল এবং নিমন্ত্রণ-লিপি ছাড়া আর কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সেক্রেটারীবাবুর এ বিষয়ে কড়া নজর ছিল।
সহসা আবার কিরীটী প্রশ্ন করল, আচ্ছা ম্যানাজারবাবু, বলতে পারেন, আপনাদের কুমারসাহেবের সেক্রেটারী মিঃ মিত্র কতদিন থেকে আফিং খাওয়াটা অভ্যাস করেছিলেন? দেখুন অস্বীকার করবেন না বা অস্বীকার করবার চেষ্টা করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই তীর অনেক কথাই জানেন, কেননা বেশীর ভাগ সময়ই দুজনে আপনারা সহকমী হিসাবে এখানে কাজ করছিলেন। বলুন না মশাই, চুপ করে আছেন কেন? খেতেন নাকি তিনি?
আজ্ঞে!
বলুন! কঠিন আদেশের সুর কিরাটীর কণ্ঠে ঝঙ্কত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ ম্যানেজারবাবু মাথা নীচু করে কি যেন ভাবলেন, তারপর একসময় মৃদুস্বরে বললেন, আজ্ঞে মাসখানেক হবে, তিনি আফিং একটু একটু করে গরম কফির সঙ্গে খেতেন। বলতেন, অন্য কোন বদ নেসার থেকে আফিং খাওয়াটা নাকি ভাল। তাছাড়া তার পেটের গোলমাল আছে বলে ডাক্তার নাকি পরামর্শ দিয়েছিল প্রত্যহ একটু একটু করে আফিং খেতে। আফিং ধরবার পর উপকারও নাকি পাচ্ছিলেন।
ভাল কথা! খুব ভাল কথা! কিন্তু আপনাদের কুমারসাহেবও কি ঐ সঙ্গে কোন নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নাকি?
আজ্ঞে, তিনি বোধ হয় ঐ একই সময় থেকে আফিং খাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হয় কুমারসাহেব আফিংয়ে অনেক দিন থেকে অভ্যস্ত।
বেশ। আচ্ছা আজ রাত্রে কুমারসাহেবকে আপনারা ভাং বা সিদ্ধি জাতীয় কোন জিনিস দিয়ে সিগারেট তৈরী করে দিয়েছিলেন?
আজ্ঞে–
বলুন, জবাব দিন!
আজ্ঞে হ্যাঁ। কেননা আমি ভেবেছিলাম সিদ্ধি খেলে তিনি একটু চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। জানি না কেন যেন আজ চার-পাঁচদিন একটা চিঠি পেয়ে অবধি তিনি অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সর্বদাই মনমরা, যেন কি কেবলই ভাবছেন তাই ভাবলাম, আজকের এই উৎসবের দিন, সাধারণ সিদ্ধির সরবত-টরবত দিলে হয়তো তিনি আপত্তি করতে পারেন, তাই সিগারেট তৈরী করে রেখেছিলাম। এ রকম মাঝে আরো দুবার সিগারেট করে খাইয়েছিও তাকে। সন্ধ্যার অল্প পরেই আমি তখন কুমারসাহেবের লাইব্রেরী ঘর বসে কয়েকটা হিসাবপত্র মিলিয়ে নিচ্ছি, কুমারসাহেব যেন খুব উত্তেজিত হয়েছেন এমন অবস্থায় এসে লাইব্রেরী ঘরে ঢুকলেন, বললেন, এক কাপ গরম কফি খাওয়াতে পারেন ম্যানেজারবাবু? আর আপনার সেই সিগরট কয়েকটা দিতে পারেন? তারপর তিনি আমাকে একটু আগে বাথরুমে কী দেখেছেন তাই বলতে লাগলেন। আমি নিজে তাকে কফি নিয়ে এসে দিলাম ও পকেট থেকে তৈরী করা গোটাপাঁচেক সিগারেটও দিলাম।
আজকেই আপনি তাহলে প্রথম তাকে ঐ ধরনের সিগারেট দিয়েছিলেন বোধ হয়?
আজ্ঞে না। দিন পাঁচেক আগে একবার গোটাপাঁচেক তৈরী করে দিয়েছিলাম।
তবেই দেখুন ডাক্তার, ভাং বা সিদ্ধির প্রভাবে কুমারসাহেব কল্পনার বিভীষিকা দেখেননি, সিগারেট পান করবার আগেই দেখেছেন। তারপর ম্যানেজারের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, বেশ। আচ্ছা ম্যানেজারবাবু কুমারসাহেবের সঙ্গে যখন আপনার দেখা হয় তখন ঠিক কত রাত্রি হবে বলতে পারেন? মানে রাত্রি তখন কটা বাজে?
আজ্ঞে রাত্ৰি নটা হবে।
আচ্ছা, তারপর আপনি কী করলেন?
তারপর আরও কিছুক্ষণ আমি ঐখানেই ছিলাম, কেননা কুমারসাহেব সিগারেট নিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন দ্রুতপদে। তারপর হিসাবপত্র দেখা হয়ে গেলে প্রায় রাত্ৰি সাড়ে নটার সময় আমি নীচে নেমে যাই।
এর পর ম্যানেজারবাবুকে কিরীটী বিদায় দিল।
ভদ্রলোকও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, কেননা তিনি একপ্রকার দৌড়েই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
ম্যানেজার ঘর থেকে চলে যাবার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কিরীটীও বোধ করি কি ভাবছিল।
ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম কিরীটীর দিকে চেয়ে এবারে আমিই প্রশ্ন করলাম, আজকের ব্যাপারের অনেক কিছুই যেন তুমি এখনো চেপে রাখছ বলে মন হচ্ছে কিরীটী? একটা সূত্র অবিশ্যি পাওয়া যাচ্ছে, মিঃ শুভঙ্কর মিত্র নেশা করতেন!
কিরীটী মৃদু হেসে বলে সেটা এমন বিশেষ একটা সূত্র নয়। কিন্তু এই case সম্পর্কে আপাতত যতটা জানতে পেরেছ, তাতে করে তোমার মতামতটা কী সুব্রত? যতটুকু জেনেছ বা শুনেছ। এর মধ্যে কোন অসামঞ্জস্য বা অবিশ্বাস্য মনে হয় কী?
একটা অসামঞ্জস্য খুব মোটা ভাবেই চোখে পড়েছে।
ডাঃ চট্টরাজ বাধা দিলেন, এক মিনিট সুব্রতবাবু! বলে হঠাৎ কিরীটীর দিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, একটা কথা রায়, তোমার ধারণা বোধ হয়। স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে আজ রাত্রের উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন?
যদি বলি ডাঃ চট্টরাজ তাই! এমন কোন বিশেষ ব্যক্তির ছদ্মবেশ নিয়ে তিনি এখানে আজ হয়েতো এসেছেন, যার সঙ্গে মিঃ মিত্রের বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তা ছাড়া কোন নিমন্ত্রণ-বাড়ির একটা কার্ড যোগাড় করে এখানে আসাটা এমন বিশেষ কিছুই একটা কঠিন ব্যাপার বলে কি মন হয় ডাঃ চট্টরাজ?
না। কিন্তু তাহলে তুমি স্থিরনিশ্চিত যে, স্যার দিগেন্দ্ৰই কারও ছদ্মবেশে এসে আজ রাত্রে হতভাগ্য শুভঙ্কর মিত্রকে খুন করেছেন? কিন্তু—
মৃদু হেসে সহজ স্বাভাবিক স্বরে কিরীটী জবাব দিল, নিশ্চয়ই। এতে আমার দ্বিমত নেই।
কিন্তু বন্ধু, এক্ষেত্রে মিঃ মিত্রের মত একজন তৃতীয় ব্যক্তিকে স্যার দিগেন্দ্রের খুন করবার কী এমন সার্থকতা থাকতে পারে সেটাই যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অবিশ্যি কুমারসাহেবকে হত্যা করলেও না হয় বোঝা যেত; কেননা তাঁর মুখে শুনেছি স্যার দিগেন্দ্র প্রায় তিন-চারখানা চিঠিতে একাধিকবার কুমারসাহেবকে শাসিয়েছেন তার প্রাণ নেবেন বলে। এবং যে কারণেই হোক কুমারসাহেবের ওপরে তাঁর একটা আক্রোশও আছে।
কিরীটী এবার বলে, জানেন কিনা আপনারা জানি না—গতকাল রাত্রে কুমারসাহেব শেষ চিঠি পেয়েছেন স্যার দিগেন্দ্রর কাছ থেকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের সেক্রেটারী সাহেবও একখান চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, বলতে বলতে একখানা চিঠি পকেট থেকে টেনে বের করে কিরীটী চিঠিটা পড়তে শুরু করে ঃ আমাদের সাত পুরুষের সঞ্চিত অৰ্থ নিয়ে তুমি যে এই দানধ্যানের ছেলেখেলায় মেতে উঠেছ, এর সকল ঋণ কালই তোমার আপন বুকের রক্ত দিয়ে কড়ায়গণ্ডায় পরিশোধ করত হবে। বুকের রক্ত ঢেলে অর্জিত এ অর্থ অপব্যবহার করে যে পাপ করেছ, তা বুকের রক্তেই শেষ হয়ে যাক। আঃ, তাজা টুকটুকে লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে ঠাণ্ডা মাটির বুকের ওপর ঢেউ খেলে যাচ্ছে! কী আনন্দ! লাল—লাল রক্ত I love it! I like it.
ইতি—
তোমার একান্ত শুভার্থী
কাকা দিগেন্দ্রনারায়ণ
তারপর এই হচ্ছে সেক্রেটারীবাবুকে যে চিঠি লেখা হয়। সেখানা, পড়ি শুনন ঃ পরের অর্থে পোদ্দারী করতে খুব আনন্দ, না? অন্যের বুকের রক্ত ঢেলে উপার্জন করা অর্থে হাসপাতাল গড়ে তুলতে চলেছ! Idea টা চমৎকার বন্ধু! বোকা ভাইপোটির মাথায় হাত বোলাবার চমৎকার উপায় একটি বের করেছ তো! প্রস্তুত থেকে, কাল তোমারও তামাম শোধের দিন ধার্য করেছি। —রক্তলোভী ‘দিগেন্দ্রনারায়ণ।
চিঠি দুখানা পড়া শেষ করে, আবার সে দুটো ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে কিরীটী বলে, এখন বোধ হয় সুব্রত বুঝতে পারছি, এখানে আসবার সময় কেন লোকজন সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলাম! এই চিঠি দুখানা আজ দুপুরেই কুমারসাহেব আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন।
বটে! এই ব্যাপার! ডাক্তার বলতে লাগলেন, ব্যাপারটা তো তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল রাত্রি সাড়ে নটায়। তারপর তিনি কফি চেয়ে পাঠান, এবং ঠিক রাত্রি সাড়ে নটায় তিনি কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে পূর্ববর্ণিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে গিয়ে উপস্থিত হন। কেমন তো?
হ্যাঁ, এবং তারই অল্পক্ষণ পরে ঘণ্টা বেজে ওঠে, সে কথাটা ভুলবেন না যেন। কিরীটী বলে ওঠে ওঁর কথার মধ্যে বাধা দিয়ে।
না, ঘণ্টা বেজেছিল তা ভুলিনি। খুনী ঘণ্টা বাজবার আগে থেকেই সে ঘরে উপস্থিত ছিল এবং তলোয়ারটা খুন করবার জন্য তৈরী করেই বড় সোফাটার নীচ লুকিয়ে রেখেছিল। Everything was kept ready – পূর্বপরিকল্পিত।
হ্যাঁ, কিন্তু এখন বলুন তো ডাক্তার, কোন দরজা দিয়ে খুনী তাহলে ঘরে গিয়ে ঢুকল?
কেন, দুটা দরজার যে কোনটা দিয়েই তো ঢুকতে পারে… ভুলে যাচ্ছ কেন এ কথাটা যে আমি বলেছি যে, খুনী ঢের আগে থেকেই সে ঘরে উপস্থিত ছিল।
বেশ। কিন্তু এবার বলুন তো ডাক্তার, তাহলে ঘরের কোন দরজা দিয়ে খুনী খুন করে বেরিয়ে গেল? কারণ যখন দেখতে পাচ্ছি। খুনের ঠিক পরই আমরা কেউ তাকে সে ঘরে গিয়ে খুঁজে পেলাম না!
কিরীটীর প্রশ্নে সহসা ডাক্তার চুপ করে গেলেন। মনে হল যেন তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েছেন। তাঁর এই বিব্রত ভাব দেখে আমি বললাম, ডাঃ চট্টরাজ, আমি এই কথাটাই আপনাকে তখন বলতে চাইছিলাম কিন্তু।
দাঁড়ান! দাঁড়ান! ডাক্তার অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন, খুনী হলঘরের সঙ্গে ওই ঘরে যাতায়াত করবার জন্য যে দরজা আছে, সে দরজা দিয়ে বের হয়নি; কারণ যেখানে আপনার নিযুক্ত লোক প্রহরায় ছিল এবং সেখানে থেকেই সে সর্বদা হলঘরের নজর রেখেছিল, কেমন এই তো আপনার যুক্তি?
খুনী এই ঘর অর্থাৎ এই ড্রয়িংরুমের দরজা দিয়েও বাইরে যায়নি। কারণ যেহেতু এ দরজার ওপর আমি নজর রেখেছিলাম, ঠিক যে মুহুর্তে আমি শুভঙ্কর মিত্রকে ঘরে ঢুকতে দেখি তারপর থেকেই সর্বক্ষণ, কেমন তো? আচ্ছা, তাহলে ডাক্তার এমন কি হতে পারে না যে, এই ব্যাপারটার মধ্যেই অর্থাৎ দরজার ওপর আমাদের নজর থাকা সত্ত্বেও একটা রীতিমত গোলমাল বা রহস্য লুকিয়ে আছে যা আপাতত আমাদের কারও দৃষ্টিতে আসছে না! কিন্তু আমি সত্যই আশ্চর্য হচ্ছি—এমন সহজ গোলমালটা আপনাদের বা সুব্রতর চোখে পড়ছে না কেন? কেন আপনার ধরতে বা বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে?
আমরা কিরীটী কথায় কোন জবাবই দিলাম না।
হাসতে হাসতে কিরীটী বলতে লাগল, তবে শুনুন। আপনারা জানেন ঐ ঘরে যাতায়াত করবার দু-ঘর দিয়ে দুটি দরজা আছে। একটি হলঘর দিয়ে, অন্যটি এই ঘর অর্থাৎ এই ড্রয়িং রুম দিয়ে, কেমন তো? এখন একটা দরজায় পাহার দিচ্ছিল হরিচরণ, অন্যটায় আমি নিজে। নিজেকে আমি যতটা বিশ্বাস করি, আমার সহকারী হরিচরণকে বা তার কথাও ঠিক ততখানিই আমি বিশ্বাস করি। ঐ দুটো দরজার কোনটি দিয়েই কেউ বের হয়ে গেলে, আমার বা হরিচরণের চোখকে ফাঁকি দেবার তার সাধ্য ছিল না। তাছাড়া ঐ প্রাইভেট ঘরের একটিমাত্র জানলাও আমি পরীক্ষা করে দেখেছি খুব ভাল করেই। নীচেই তার ট্রাম রাস্তা, এখনও হয়েতো সে পথে লোকজন যাতায়াত করছে, তখন তো করছিলেই। জানালার নীচে যে ধূলার পরত। জমে আছে, তাও আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। কোন সামান্য এতটুকু দাগ বা চিহ্ন পর্যন্ত সেখানে দেখতে পাইনি। আর বিশেষ করে জানালা থেকে ঘরের ব্যবধান প্রায় চল্লিশ ফিট হবে বলে মনে হয়। মানুষ তো দূরের কথা কোন বানরের পক্ষেও এই পথ দিয়ে যাতায়াত করা একেবারেই দুঃসাধ্য। অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। এবং ঘরেও কেউ লুকিয়ে ছিল না, সে তো আমারা নিজ চক্ষেই পরীক্ষা করে দেখেছি। অথচ সব চাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে খুনী অন্যের অলক্ষ্যে ঘরে প্রবেশ করে, তারপর খুন করে আবার অন্যের অলক্ষ্যেই বেমালুম গা-ঢাক দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল; ঠিক যেমন আজ সন্ধ্যায় কুমারসাহেবকে আবছা ছায়ার মত ভয় দেখিয়েই স্যার দিগেন্দ্ৰ হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেলেন—অনেকটা সেই রকম। এর পরেও কি ডাক্তার আপনি বলবেন বা আপনার স্থিরবিশ্বাস যে এই ব্যাপারটাও একটা কল্পনাপ্রসূত ছায়াছবি মাত্র, অর্থাৎ আপনাদের ডাক্তারী ভাষায় haliucination!
উঃ অসহ্য, ক্ষোভে দুঃখে ডাক্তার বলে উঠলেন, অসহ্য! কিন্তু আমিও নিশ্চয় করে বলছি। রায়, খুনী নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে লুকিয়েছিল। এবং আপনার অগাধ বিশ্বাসের পাত্র হরিচরণ হয় আসল ব্যাপার দেখতে পায়নি বা মিথ্যা বলছে, আর তা যদি না হয় বা আপনি তা মেনে নিতে না চান, তবে I must say, ঐ ঘরে নিশ্চয়ই কোন গুপ্তদ্বার আছে যে পথ দিয়ে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে খুন করে চলে গেছে।
না উত্তেজিত হবেন না ডাক্তার। ধীর গভীর আচঞ্চল স্বরে কিরীটী বললে, খুনী লুকোয়নি আদপেই। আমি যা দেখছি তাও যেমন মিথ্যা নয়, হরিচরণের কথাও মিথ্যা নয়; এবং ঐ ঘরে কোন গুপ্তদ্বার থাকাও একেবারেই সম্ভবপর নয়। আমার কথায় বিশ্বাস না হয় নিজে গিয়ে ভাল করে দেখে আসতে পারেন। আর একবার। ঘরের এক দিকে রাস্তা, আর একদিকে হলঘর, ওপরে তিনতলার ঘর, তার ওপরে খোলা ছাদ। এদিকে এই ড্রয়িং রুম, অন্যদিকে খাবার ও রান্নাঘর। তবে এর মধ্যে ভেবে দেখুন কোন গুপ্তপথ থাকা সম্ভব কিনা। এক কথায় ঘরের মধ্যে কোন গুপ্তপথ নেই। এবং সে জানলাপথেও পালায়নি, হলঘরের দরজা বা এই ড্রয়িংরুমের কোনটা দিয়েই বের হয়ে যায়নি। এবং এখনও ঘরের মধ্যে খুনী লুকিয়ে নেই। আসল কথা কি জানেন?
কিরীটীর মুখের দিকে সোৎসুকভাবে চেয়ে একই সঙ্গে আমরা দুজনেই উদ্গ্ৰীব কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, কী?
তবে শুনুন, আমরা যখন এখানে আসি তার ঢের আগেই খুনী তারকাজ শেষ করে গা-ঢাকা দিয়ে চলে গেছে। তাই আমরা কেউ তাকে দেখতে পাইনি ও-ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। এবং দেহ ও মণ্ডর position টা দেখে এটাও বুঝতে পারা কঠিন নয় যে, ব্যাপারটা আন্দীে আত্মহত্যা নয়। সহজ ও প্রাঞ্জল খুন—a murder! …হ্যাঁ খুন!
পরে অবশ্য বুঝেছিলাম কিরীটীর কথাটা কতখানি সত্য! …এবং কত কঠিন সত্য!
কিন্তু এ কি নিদারুণ বিস্ময়! চোখের ওপর যেন ভাসতে থাকে একটা অশরীরী ছায়া, যে ছায়া এ বাড়ির প্রতিটি লোকের কাছে সুপরিচিত। যাকে তিলমাত্র কেউ সন্দেহ করে না। যে যেন একটা মুখোশ এটে এই হৃদয়হীন কাজটা করে গেল। দয়া নেই, মায়া নেই। নেই। এতটুকু বিবেক বিবেচনা। নির্মম খুন। পাশবিক লালসা। কে, কে? অথচ এই সমস্ত পরিচিতের মধ্যেই সেও একজন। কিরীটী বলেছে সকলেরই পরিচিত সে। তবে সে কে? আমি? কিরীটি? ডাঃ চট্টরাজ? কুমারসাহেব নিজে? ম্যানেজারবাবু? বিকাস মল্লিক? দিনতারণ চৌধুরী? না প্রফেসর শর্মা? কে? কে? কে?
এমন সময় হরিচরণ ঘরে এসে প্রবেশ করল। কয়েকটা খোলা কাগজ ও একটা বই তার হাতের মধ্যে ধরা আছে। হরিচরণ বললে, এই নিন স্যার, এখানে আজ যাঁরা উপস্থিত। আছেন তাদের সকলেরই জবানবন্দি এই কাগজে টুকে এনেছি, এমন কি চাকরিবািকরদেরও। আর এই নিন বই। বাবুজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু সেও বলতে পারল না কে এই বইটা সেখানে ফেলে রেখে গেছে। কিন্তু একথা সে বললে হলফ করে যে বিকালে এই বই সে ঘরে দেখেনি। আমন্ত্রিত ভদ্রলোকদের এবারে আপনি ছেড়ে দিতে পারেন স্যার। আমার মনে হয় তাদের কাছ থেকে আর বিশেষ কোন খবর পাওয়া যাবে না।
হুঁ। আশ্চর্য! কিরিটী গম্ভীরভাবে বলতে লাগল, কিন্তু এই ছোট-একটা ‘রূপকথা’ কে এখানে নিয়ে এল? ভাল কথা হরিচরণ, এই বইটা যাঁরা এখানে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন তাঁদের কারও কিনা জিজ্ঞাসা করে একবার দেখেছিল কী?
হ্যাঁ, তাও করেছিলাম স্যার। কেউই বললেন না যে, এটা তার বই বা বইটা কেউ সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছেন!
অন্যমনস্ক ভাবে কিরীটী বইয়ের পাতাগুলো ওল্টাতে লাগল। কলকাতার ৫নং কলেজ স্কোয়ারের, আশুতোষ লাইব্রেরী কর্তৃক ছাপা বইয়ের প্রথম পাতায় যেন কার নাম হিন্দীতে লেখা ছিল; কিন্তু তারপর রবার দিয়ে ঘষে ঘষে আবার সেটা যেন বেশ যত্ন সহকারেই মুছে ফেলা হয়েছে।
সহসা ডাক্তারের দিকে ঝুকে পরে কিরীটী বললে, ডাক্তার, আপনি তো হিন্দী জানেন? দেখুন তো কি নাম লেখা ছিল বইটাতে? ইতিমধ্যে হরিচরণের জবানবন্দি নেওয়া কাগজগুলো একটু আমি উল্টেপাল্টে দেখে নিই।
কিরীটী হরিচরণের হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে মনোযোগের সঙ্গে পড়তে লাগল এবং মাঝে মাঝে নোট-বুকটা বের করে কী সব তাতে নোট করে নিতে লাগল। ডাক্তারের দিকে চেয়ে দেখলাম, ডাক্তার গভীর হয়ে চশমার ভিতর দিয়ে বইয়ের প্রথম পাতায় মুছে দেওয়া অস্পষ্ট নামের লেখাটাকে উদ্ধার করবার বৃথা চেষ্টা করছেন। ক্রমে যেন মনে হচ্ছিল একটা বিস্ময়ের ভাব তার চোখে-মুখে ফুটে উঠছে একটু একটু করে। তারপর সেই পাতাটা উল্টে কী যেন মনোযোগের সঙ্গে পাতার দিকে দেখতে লাগলেন।
কিরীটীর কাগজটা দেখা হয়ে গিয়েছিল, হরিচরণের দিকে চেয়ে বললে, হরিচরণ, আজি এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাদের প্রত্যেকের ওপরেই একজন করে লোক যেন আমার দ্বিতীয় আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত নজর রাখে। আর এখুনি একজন লোকের বন্দোবস্ত কর, টালার শুভঙ্কর মিত্রের বাড়িতে পাহারা দেবার জন্য। চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা থাকবে। কোনক্রমেই কোন লোককে সে বাড়িতে যেন ঢুকত বা বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া না হয়। কেউ যদি ঢুকতে চায় বা বের হতে চায় বাধা দেবে। বাধা না শুনলে গ্রেপ্তার করবে।
হরিচরণ মাথা হেলিয়ে বলল, তাই হবে স্যার।
এইবার কিরীটী তার এতক্ষণ লেখা নোটটা আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরলা, তাতে এইরূপ লেখা আছে ঃ
৮-১০ মিঃ রাত্ৰি—মিঃ শুভঙ্কর মিত্র, কুমারসাহেব, প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা, দীনতারণ চৌধুরী—এঁরা সকলে কুমারসাহেবের সয়নঘরে কী একটা পরামর্শ করছিলেন। বয় কফি দিয়ে আসতে গিয়ে দেখেছিল। ওঁদের সকলকেই ও ঘরে।
৮-২০ মি- রাত্ৰি-দীনতারণ চৌধুরী এখান থেকে চলে যান; ম্যানাজারবাবু ও দারোয়ান তাকে দেখেছে।
৮-২৫ মিঃ—৮-৫৫ মিঃ—মিঃ শুভঙ্কর মিত্র ও প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা দুজনে খাবার ঘরে বসে গোপনে কী সব কথাবার্তা বলছিলেন, বাবুর্চি তাদের দেখেছিল। কারণ সে সময় বেয়ারা না থাকায় বাবুর্চিই নিজে তাদের গরম কফি দিতে গিয়েছিল!
৮-৫০ কি ৫২ মিঃ—কুমারসাহেবের সঙ্গে সিঁড়িতে ম্যানেজারবাবুর দেখা হয়। ম্যানেজারবাবুই একথা বলেছেন আমাদের।
৮-৫০ মিঃ—৯-২৫ মিঃ—ম্যানেজারবাবু একাই ওপরের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, ম্যানেজারবাবুর স্বীকারোক্তি থেকে জানতে পারা যায়!
৮-৫৫ মিঃ-৯-৫৫ মিঃ মিত্র খাবার ঘরে থেকে বের হয়ে আসেন। সাক্ষী—বাবুর্চি ও প্রফেসার শর্মা।
৮-৫৫ মিঃ—৯-৩০ মিঃ—প্রফেসর শর্মা খাবার ঘরে উপস্থিত ছিলেন; সাক্ষীপ্রফেসর শর্মা নিজে। তাছাড়া একজন বয়ও সে কথা বলেছে।
৯-১৫ মিঃ সময়ে নাকি এক কাপ কফি বয় নিজে গিয়ে প্রফেসর শর্মাকে দিয়ে আসে। ৯-১৮ মিঃ রাত্রি-কুমারসাহেব নিজে আমাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষী—আমরা সকলে।
৯-৩০ মিঃ রাত্ৰি—মিঃ মিত্ৰ কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে ঢোকেন আমাদের সকলেরই চোখের সামনে দিয়ে।
৯-৩০ মিঃ রাত্রি-প্রফেসর শর্মা হরিচরণের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এবং প্রফেসর শর্মা যখন হরিচরণকে সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, হরিচরণ জবাব দেয় এবং তারই কিছু আগে সে ঐখানে আমার আগেকার নির্দেশমত পাহারা দিতে উপস্থিত হয়। সাক্ষী-হরিচরণ ও ম্যানেজারবাবু, কেননা উনি ঐ সময় সিঁড়ির ওপরেই দাঁড়িয়েছিলেন!
৯-৩০—৯-৩৬ মিঃ রাত্রি-প্রফেসর শর্মার সঙ্গে প্রাইভেট রুমের দরজার সামনে হরিচরণের দেখা ও কথাবার্তা হয়।
৯-৩৭ মিঃ রাত্রি-প্রফেসার শর্মা ড্রয়িংরুমে আমাদের সঙ্গে এসে আলাপ করেন। খুনের ব্যাপারটা বেয়ারার চিৎকার শুনে এ ঘরের সবাই আমরা জানতে পারি।
মতামত বা টীকা ১নং -এমন কোন লোকই পাওয়া যাচ্ছে না। যিনি অন্ততঃ স্মরণ করে বলতে পারেন যে, ঐ উপরিউক্ত ভদ্রলোকের মধ্যে কাউকেও ৮-২০ মিঃ থেকে ৯-৩০ মিনিটের মধ্যে অর্থাৎ এই এক ঘণ্টারও বেশী সময়ের মধ্যে ওপরের হলঘরে দেখেছেন। কিনা। আশ্চর্য!
২নং-এ বাড়িতে উপস্থিত যাঁরা আছেন তাদের কেউ বলেত পারছেন না যে, তারা কেউ মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰকে রাত্রি ৮-৫৫ মিঃ (যখন তিনি খাবার ঘর থেকে প্রফেসর শর্মার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসেন তখন কিংবা ৯-৩০ মিনিটের মধ্যে প্রাইভেট রুমে ঢুকতে দেখেছেন কিনা। এটাও আশ্চর্য!
৩নং —এটা হয়তো খুবই সম্ভব যে, এ বাড়ির পিছন দিকে অর্থাৎ ট্রাম-রাস্তার দিকে এ বাড়িতে প্রবেশের কোন গুপ্তপথ আছে, এবং সেই প্রবেশপথের কথা আমার নিযুক্ত লোক খুনের আগে পর্যন্ত অবগত না হওয়ার জন্য পাহারা দিতে পারেনি সেখানে।
কিরীটী হাসতে হাসতে নোট-খাতাটা ডাঃ চট্টরাজের দিকে এগিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বললে, এবারে বের করুন ডাক্তার, হত্যাকারী কে? যা কিছু জানিবার বা বোঝাবার সব এর মধ্যেই আছে।
এমন সময় একজন পুলিস এসে জানাল, পুলিস সার্জেন্ট এসেছেন। আমরা সকলে হলঘরের দিকে অগ্রসর হলাম।
হলঘরে ঢুকেই আমরা থমকে দাঁড়ালাম।
সমগ্র হলঘরটি তখন আমন্ত্রিত অভ্যাগতের কলগুঞ্জনে মুখরিত। কিরীটী একজন পুলিস অফিসারকে ডেকে তখনি আদেশ দিল, এদের সকলকে এবার ছেড়ে দিন।
আদেশ উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্ৰ জনতা যেন বাঁধভাঙা জলস্রোতের মত উন্মুক্ত দ্বারপথের দিকে হুড়মুড় করে অগ্রসর হল। পনেরো মিনিটের মধ্যেই জনস্রোত মিলিয়ে গেল।
সিঁড়ির মুখে প্রকাণ্ড ওয়াল ক্লাকটা ঢং ঢেং করে রাত্ৰি বারোটা ঘোষণা করল। এখন হলঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি, কিরীটী, ডাক্তার চট্টরাজ, থানার পুলিস অফিসাররা, কুমারসাহেব, পুলিস সার্জেণ্ট, খানসামা ও বেয়ারা-বাবুর্চির দল।
পুলিস সার্জেণ্টই প্রথম ঘরের স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, বললেন, চলুন মিঃ রায়, মৃতদেহটা আগে দেখে আসি।
সকলে আবার এসে কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে প্রবেশ করলাম। জমাট বাঁধা রক্তস্রোতের মধ্যে একই ভাবে বীভৎস মুণ্ডহীন মৃতদেহটা তখনও পড়ে আছে। এবং পাশেই মুণ্ডুটা।।
পুলিস সার্জেণ্ট মোটামুটি সব শুনে ও মৃতদেহ পরীক্ষা করে সঙ্গে একজন কর্মচারীকে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাবার আদেশ দিলেন।
পুলিস সার্জেণ্ট বললেন, এবার মিঃ রায়, আমাকে ব্যাপারটা একটু বলুন তো?
কিরীটী তখন পুলিস সার্জেণ্টকে মোটামুটি সব ব্যাপারটাই সংক্ষেপে আবার বললে তীর জ্ঞাতার্থে।
তারপর আমার দিকে ফিরে বললে, সুব্রত, তুমি তেতলায় গিয়ে ঠিক এই ঘরের ওপরের ঘরটা একবার ভাল করে দেখে এস তো দেখি। আর হরিচরণ, তুমি এর নীচের ঘরটা পরীক্ষা করে এস। হ্যাঁ, দেখ সুব্রত, তুমি এই ঘরের ঠিক ওপরের তলার ঘরে গিয়ে ঘরের মেঝেতে কোন কিছু দিয়ে ঠুকে শব্দ করবে, তা হলেই এই ঘরে দাঁড়িয়ে সে শব্দ আমরা শুনতে পাব। আর তুমি নিজেও ঘরের মেঝেতে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করবে। আমাদের কথাবার্তা শুনতে পাও কিনা। ঘরের দেওয়ালে ঘা দিয়ে দেখবে কোথাও ফাঁপা-টাপা কিছু টের পাও কিনা। হরিচরণ, তুমিও ঐ একই ভাবে নীচের ঘরটা পরীক্ষা করে দেখবে! আমি ততক্ষণ এই ঘরটা আবার একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে সন্দেহ ভেঙে দিই। সবার। যিনি যাই বলুন, আমার নিশ্চিত ধারণা, ওঘরের মধ্যে কোথাও কোন গুপ্তদ্বার নেই। শুধুই নিম্ফল, চেষ্টা এ, তবু আর একবার দেখব। প্রত্যেকটি ঘটনা যদি ভাল করে বিচার করা যায়। তবে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কোন বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তির দ্বারা এভাবে খুন করা সম্ভবপর নয়।
ধীরে ধীরে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম।
কুমারসাহেবের আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। এ সংসারে। তিনতলার ঘরগুলো তাই খালিই পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে কোন দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় এলে তেতলায় থাকেন। তা সেও ক্কচিৎ কখনো।
তিনতলার হলঘরে ঢোকবার মাথায়ই সিঁড়ি। সিঁড়ির দরজাটা ভেজানো! দরজার হাতল ঘুরিয়ে ঠেলতেই নিঃশব্দে দরজার কপাট দুটো ফাক হয়ে গিয়ে খানিকটা জমাট বাঁধা অন্ধকার চোখকে যেন অন্ধ করে দিল মুহুর্তের জন্য।
হাতের টর্চ জ্বালিয়ে চারদিকে একবার চেয়ে দেখলাম। এ হলঘরখানিও অবিকল নীচের হলঘরেরই অনুরূপ।
নিঃশব্দে একাকী সেই অন্ধকার নির্জন হলঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। চারদিক হতে জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন অদৃশ্য হাতে আমাকে এসে বেষ্টন করে এধরছে, অনুভব করছি। অন্ধকারের হিমশীতল স্পর্শ। আশ-পাশে কোথাও এতটুকু গোলমাল বা শব্দ পর্যন্ত নেই। যেন যুগযুগান্তরের তন্দ্রাচ্ছন্নতা এইখানে এসে জমাট বেঁধে আছে অতলান্ত অন্ধকারের মধ্যে।
নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটুকু পর্যন্ত শোনা যায়।
এরপর কতকটা আন্দাজে ভর করে, যে ঘরটা ঠিক প্রাইভেট রুমের ওপরে হবে বলে মনে হল, সেই ঘরের দরজাটার হাতল ঘুরিয়ে খুলে ফেললাম। নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল।
ভরা শীতের আকাশের একটুকরো চোখে পড়ল। যেন একটুকরো স্বপ্ন। দূরদূরান্তের মায়ায় ঘেরা। নাগালের বাইরে।
সহসা একটা মৃদু নিশ্বাসের চাপা শব্দ আমার সজাগ কানে এসে যেন আঘাত দিল। দেহের সমগ্ৰ লোমকূপ পর্যন্ত যেন অভাবনীয় একটা পরিস্থিতির জন্য হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল।
হাতে ধরা টর্চন্টার বোতাম আবার টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের বুকে সেই টর্চের আলোয় যে অভাবনীয় দৃশ্য সহসা আমার চোখে পড়ল তার জন্য ক্ষণপূর্বেও এতটুকু আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সত্যিই চমকে উঠেছিলাম।
দেখলাম ঘরের এক কোণে একটা সোফায় মুখ নীচু করে নিঃশব্দে একটি অল্পবয়সী। যুবক বসে আছে।
আমার মত সেও বোধ হয় আমার অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে চমকে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে।
কে? কে আপনি? কী চান এ ঘরে? বলতে বলতে ভীত ত্ৰস্তভাবে যুবকটি উঠে দাঁড়াল।
ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে এ ঘরে আসিনি। তা ছাড়া আমি ভাবতেও পারিনি এই নির্জন অন্ধকার ঘরে এমনি করে ভূতের মত চুপটি করে কেউ বসে থাকতে পারে। সত্যিই আমি একান্ত লজ্জিত। দুঃখিত মিঃ…। আমি কেবল এ ঘরের মেঝেটা একবার পরীক্ষা করে দেখবার জন্য শুধু এসেছিলাম। মানে…
কিন্তু কে আপনি? হঠাৎ এ ঘরের মেঝোঁটাই বা আপনি দেখতে এসেছেন কেন?
বর্তমানে আমি একজন পুলিসের সহকারী। আমি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।
পুলিস! পুলিসের সহকারী! কিন্তু এখানে কেন? সে কি মরে গেছে নাকি।
যুবকের অসংলগ্ন কথায় মুহূর্তে সমগ্র ইন্দ্ৰিয় আমার যেন সজাগ হয়ে উঠল। কোনমতে নিজেকে সংযত করে বললাম, কার কথা বলছেন? কে মরেছে?
কে আবার, কুমারসাহেবের সেক্রেটারী মিঃ শুভঙ্কর মিত্ৰ! একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে কতকটা থেমে থেমে যুবক কথাগুলো বললে।
হ্যাঁ, মারা গেছেন তিনি সত্যি! কিন্ত। আপনি যখন এতটা জানেনই, আপনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা না করে সুস্থির হতে পারছি না যে!
আমি কথাটা বলতে বলতে আলোটা আবার নিভিয়ে দিলাম। ঘর পূর্বের মত অন্ধকারে জমাট বেঁধে উঠল। অন্ধকারে সোফার ওপর নড়েচড়ে বসবার খসখস আওয়াজ কানে এল.
কী জিজ্ঞাসা করবেন শুনি? কণ্ঠস্বরে পরিষ্কার অসহিষ্ণুতার আভাস যেন ঝরে পড়ল, কে আপনাদের খুন হয়েছে বা মারা গেছে সেই সম্পর্কেই আপনি আমাকে আবোলতাবোল কতকগুলো অবান্তর প্রশ্ন করবেন তো? কিন্তু কেন বলুন তো? আমাকে একা একা এই অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে দেখে নিশ্চয়ই আপনার মনে ঐ জঘন্য ইচ্ছা জেগেছে, না?
রাগ করবেন না। যদিও আপনি রাগলেও, আমার কথার জবাব আপনাকে দিতেই হবে।
দিতেই হবে কথার জবাব? কেন শুনি? জোর নাকি?
আপনাকে তো আগেই আমি বলেছি, আমি একজন পুলিসের লোক। কাজেই…।
যুবক যেন কি ভাবলে, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, বেশ, জবাব দেব। করুন, কি জিজ্ঞাসা করবার আছে আপনার! চটপট জিজ্ঞাসা করে ফেলুন। তারপর আবার একটু থেমে হঠাৎ বললে, আসুন না, চলুন। ঐ জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যাক; বলতে বলতে যুবক উঠে দাঁড়ায়। একটা মৃদু অথচ মিষ্টি গন্ধ সহসা আমার ব্ৰাণেন্দ্রিয়কে যেন আলোড়িত করে তুলল। যুবক নিজেই এগিয়ে গিয়ে পথের ধারের জানলার কপাটটা খুলে দিল ধাক্কা দিয়ে।
মধ্যরাত্রির বর্ষণক্লান্ত শীতের আকাশ। অস্পষ্ট আলোছায়ার মধ্যে পাশ্বের দণ্ডায়মান যুবকের দিকে ফিরে তাকালাম। আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিত! অত্যন্ত ফিটফট; বয়স বোধ করি বাইশ-তেইশের মধ্যে হবে।
যুবকটিই প্রথমে কথা বললে, অন্ধকার রাত্রে নির্জন ঘরে একা এক চুপ করে বসে থাকতে আমার বড় ভাল লাগে। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক পুলিসের লোকের মত লাগছে। না! পুলিস আবার এরকম ভদ্র ও সভ্য দেখতে হয় নাকি? সত্যি চমৎকার চেহারা আপনার, যেন ঠিক গ্ৰীক দেবতা অ্যাপোলোর প্রতিমূর্তি। বাঙালীদের মধ্যে এত সুন্দর চেহারা বড় একটা আমি দেখিনি। সত্যি বলুন তো কে আপনি কি আপনার সত্য পরিচয়?
বলেছি তো আমি পুলিসের লোক। কিন্তু এখন আমার চেহারার বর্ণনা স্থগিত রেখে আপনার কথাগুলো বলবেন কি? আপনি এখানে কেন বসেছিলেন এমনি করে ভূতের মত একা একা? নিশ্চয়ই কারও জন্যে বসে অপেক্ষা করছিলেন, না?
বলছি। কিন্তু সত্যি বলছেন মিঃ মিত্র মারা গেছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, বললাম তো মারা গেছেন। মিথ্যে কথা আজ পর্যন্ত জীবনে একটাও বলিনি। মিথ্যাকে আমি আন্তরিক ঘূণা করি। এখন বলুন আপনার কথা।
আমিও জানি এবং টের পেয়েছি সে মারা গেছে। মৃদুস্বরে যুবকটি বললে।
কিন্তু তিনি যে মারা গেছেন, আপনি সেকথা জানলেন কি করে?
আমি যে অনুভব করছি সে মারা গেছে। হ্যাঁ, সমগ্র চেতনা দিয়ে অনুভব করছি সে মারা গেছে। আর তা না হলে–সি মারা না গেলে আমি পাগল হয়ে যাব। উঃ, কী ভালটাই তাকে একদিন আমি বেসেছি, নিজের ভাইয়ের মত অগাধ শ্রদ্ধা করেছি। যাক, সে মরেছে। অত বড় একজন ‘স্পোর্টসম্যান’ সে কিনা তার সব সম্মান প্রভুত্ব ছেড়ে দিয়ে শেষটায় কুমারসাহেবের মত একজন লোকের কাছে যেচে চাকরি নিল। কুমারসাহেব স্মাসকে দুচক্ষেও দেখতে পারেন না, অথচ তার কী একটা জরুরী কাজ নাকি আমার সঙ্গে আছে, তাই চুপে চুপে রাত্ৰি নটায় আমাকে এখানে আসতে বলেছিল। তাকে আমার বড় ভাল লাগত একদিন। অত চমৎকার আবৃত্তি করতে জীবনে আর কাউকে শুনিনি। বাংলা কবিতা কী চমৎকারই না আবৃত্তি করত, কিন্তু সেই সব আবৃত্তির মধ্যে সহসা যখন এক এক সময় এক একটা হিন্দি কবিতা থেকে আবার আবৃত্তি শুরু করত, শুধু তখনই আমার বিশ্ৰী লাগত। যাক সে কথা, আজ যখন সকালে আমাদের বাড়িতে সে এখানে আসবার জন্য আমাকে বলতে যায়, তার মুখের ওপরে যেন অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখেছিলাম–যেন মনে হচ্ছিল তার মুখের দিকে চেয়ে, সে বুঝি পাগল হয়ে উঠেছে। তার কথামত ঠিক রাত্ৰি নটা বাজবার কিছু আগেই এখানে এসে আমি তার অপেক্ষায় বসে আছি। এমন। সময় যেন মনে হল, আমারই ঠিক নীচের ঘরে কিসের একটা গোলমাল—
তারপর? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলাম।
তারপর-তারপর আমার ঠিক মনে নেই। এক সময় আস্তে আস্তে এই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। স্পষ্ট বুঝলাম, নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কে যেন অন্ধকারেই এই ঘরে এসে ঢুকেছে৷ একটা অজানিত ভয়ে সমস্ত শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। পদশব্দেই বুঝেছিলাম, আমি যার অপেক্ষায় এখানে বসে আছি। এ সেই শুভঙ্করদা নয়। অথচ ঘন অন্ধকারে বন্য পশুর মত আগন্তুক তখন ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। বরাবর আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই খপ করে সে আমার ডান হাতটা হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল; তারপর চাপাস্বরে উত্তেজিত ভাবে বললে, বন্ধু বৃথা এত রাত্রে এখানে এখনও বসে আছ। তোমার শুভঙ্করদার সঙ্গে আজ আর দেখা হবে না, কেননা তোমার সঙ্গে দেখা করবার চাইতেও তার ঢ়ের বড় কাজ কালো ভ্ৰমরে’র সঙ্গে আছে। তারপরই যেমন সে এসেছিল তেমনিই চলে গেল।
কী, কী বললেন? তীব্র উৎকণ্ঠায় যেন আমার কণ্ঠস্বর ভেঙে পড়ল।
হ্যাঁ, বললে কালো ভ্রমরের সঙ্গে কাজ আছে। চেনেন নাকি?
কালো ভ্রমর! কালো ভ্রমর! এ কি ভয়ানক আশ্চর্য! নিজের হাতে যার মৃতদেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম, সত্যই কি সে তাহলে সেদিন মরেনি? আমার মনের মধ্যে যেন ঝড় বইতে শুরু করল। পাঁচ-ছয় বছর আগেকার কতকগুলো ঘটনা ছায়াছবির মতই মানসপটে বার বার ভেসে উঠে মিলিয়ে যেতে লাগল পর পর।
তারপরই সে চলে গেল? আবার প্রশ্ন করলাম যুবকটিকে।
হ্যাঁ, আর দ্বিতীয় কথাটি সে বলেনি। এদিকে সে চলে যাবার পর মনে হল, যে হাতটা সে আমার চেপে ধরেছিল, সেটা যেন কেমন ভিজে-ভিজে লাগছে। ব্যাপার কী দেখবার জন্য পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালালাম। কিন্তু টর্চের আলোয় হাতের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আতঙ্কে মুহূর্তে যেন সর্ব-শরীর আমার ঝিম ঝিম করে উঠল। তাজা লাল রক্তে আমার হাতের কবজী ও জামার আস্তিনটা রাঙা টুকটুকে হয়ে গেছে। উঃ, মাথার মধ্যে এখনো আমার কেমন করছে!
বলতে বলতে সহসা মার সামনে তার হাত দুটো প্রসারিত করে বললে, এই দেখুন, এখনও সেই রক্তমাখা হাতের স্পর্শটুকু আমার জামার আস্তিনে সুস্পষ্ট ভাবেই বর্তমান।
আমি টর্চের আলো ফেলে দেখলাম, যুবকের দুধ-গরদের পাঞ্জাবির আস্তিনে রক্তের দাগ দারুণ বিভীষিকায় এখনো সুস্পষ্ট।
আচ্ছা, আপনি সেই লোকটিকে চিনতে পেরেছিলেন?
না, তাকে আমি জীবনে আর কোন দিনও দেখিনি। তাছাড়া ঘর অন্ধকার ছিল।
গলার স্বর আপনার কি পরিচিত বলে মনে হয়েছিল সেই লোকটার?
না, অমনি অস্বাভাবিক স্বর আমি জীবনেও শুনিনি। চাপা অথচ গমগম করছে, মনে ঐচ্ছিল যেন বহুদূর থেকে সমুদ্রের ক্রুদ্ধ অস্পষ্ট গর্জনের মত।
কাউকে সন্দেহও করেন না?
না, না, না। আপনাকে তো আমি বলেছি, তাকে আমি চিনি না!
এতক্ষণে আমি আমার গলার স্বর কোমল থেকে কঠিন করলাম, দৃঢ়ভাবে বললাম শুনুন, আপনার কোন ভয় নেই। আপনি যা জানেন সব কিছু কথা গোপন না করে আমাকে খুলে বলুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি, কেউ আপনাকে আঘাত করতে পারবে না। আপনার সমস্ত বিপদে আমরা বুক পেতে দাঁড়াব। আপনার কোন ভয় নেই।
দয়া করুন। অনুগ্রহ করে আমায় যেতে দিন। রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল। এরপর মামার বাসায় গেলে যদি ঘূণাক্ষরেও তিনি জানতে পারেন যে আমি এতক্ষণ বাইরে ছিলাম, তবে জুতো মারতে মারতে আমাকে তঁর বাসা থেকে দূর করে দেবেন। চিরদিনের মত। আর তাছাড়া বর্তমানে কথা বলবার মত আমার দেহ ও মনের অবস্থা এতটুকুও নয়। এখন আমায় যেতে দিন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আপনি যখনই ডাকবেন তখুনি আমি আপনার কাছে গিয়ে হাজির হব। আমার নাম অরুণ করা।. নং গ্রে স্ট্রীটে আমি থাকি। আমায় ছেড়ে দিন। আমি এখুনি পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাগান দিয়ে চলে যাব, কেউ দেখতে পাবে না, বাগানে আমার সাইকেল রয়েছে!
হ্যাঁ, আমি আপনাকে যেতে দিলেও পুলিস আপনাকে জেরা করতে ছাড়বে না, তারা আপনার জবানবন্দি নেবে। তবে ছাড়বে।
দুৰ্ভাগ্যক্রমে যখন এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিই, জবানবন্দি আমার পুলিসকে দিতে হবে বৈকি, আর না দিলেই বা শুনছে। কে? কিন্তু আজকে রাতের মত আমায় যেতে দিন।
বেশ, তাহলে আপনি এখন যেতে পারেন।
যুবক আমার নির্দেশ পাওয়া মাত্র নিঃশব্দে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কতক্ষণ সেই অন্ধকার হলঘরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই, সহসা কার মৃদু স্পর্শে চমকে ফিরে চাইলাম, কে?
ভয় নেই, আমি কিরীটী। নীচে চল, রাত অনেক হয়েছে। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।
কিরীটী বললে, এই বুঝি তোমার কর্তব্যজ্ঞান সব্ৰত! যে কাজের জন্য তোমাকে পাঠালাম, তা একেবারে দেখতেও বেমালুম ভুলে গেলে? যাক গে, গুপ্তদ্বার যে নেই। ওঘরে সে বিষয়ে আমরা স্থিরনিশ্চিত হয়েছি। সেই ঘরটায় আপাততঃ তালা দিয়ে রাখা হয়েছে! কিন্তু যুবকটি কে?
কিরীটীর কথা শেষ হবার পূর্বেই বললাম, যুবকটিকে আমার এভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি, এই কথাই তো এখন তুমি বলবে কিরীটী?
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু যাক, তুমি তার ঠিকানা তো রেখে দিয়েছ, সেই যথেষ্ট; যদিও ঠিকানা তার জানিবার তেমন দরকার ছিল না।
বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, তার মানে?
ছেলেটির এক সময় প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি ও নগদ টাকাকড়ি ছিল; এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দু-চারজনে যা নিয়েছে তা গিয়ে এখনও হয়তো যা ব্যাঙ্কে আছে অনেকেরই তা নেই। কিন্তু ছেলেটির এর মধ্যেই দশজনের কৃপায় জাহান্নামে গেছে। আমার চিন্তাশক্তির যদি গলদ না থাকে, তবে নিশ্চয়ই ছেলেটি আমাদের নবলব্ধ বন্ধুবর কালিদাস শর্মার বর্তমান মনিব্যাগ। অর্থাৎ ওরই ঘাড় ভেঙে বর্তমানে বেকার প্রফেসার বন্ধটির আমাদের খাওয়া থাকা ও বিলাস-ব্যসনের সমস্ত খরচ চলেছে।
অ্যা! বল কি?
তাই।
***
সে রাতের মত মার্বেল প্যালেস থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সকলে গাড়িতে এসে উঠে বসলাম।
রাত্রি শেষ হতে বড় বেশী দেরি নেই। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বিরবির করে বইছে। বর্ষণক্লান্ত মেঘমুক্ত আকাশটা যেন তারার মৃদু আলোয় ঝকঝক করছে।
নিঃশব্দ গতিতে জনহীন রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি হু-হু করে ছুটে চলল। গাড়িতে বসে আনমনে ভাবছিলাম। আজ রাত্রের সমগ্র ব্যাপারগুলো একটার পর একটা এখনো যেন চোখের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে ছায়াছবির মত। এবং আমার সমস্ত চিন্তাকে আবর্তিত করে একটা দৃশ্য মানসপটে কেবলই ভেসে উঠতে লাগল-লাল রক্তস্রোতের যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে, আর সেই রক্তের ঢেউয়ের মধ্যে কালো অক্ষরে একটা নাম মাথা তুলে জেগে উঠছে, আবার পরীক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে!…কালো ভ্ৰমর! কালো ভ্রমর!
আজ দীর্ঘ আট বছর ধরে একটা বিভীষিকার মতই ঐ নামটা যেন আমাদের পিছনে পিছনে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই।
কিরীটী আনমনে কি ভাবছে তা সে-ই জানে।
আমাকে আমহাস্ট স্ট্রীটে নামিয়ে দিয়ে ‘শুভরাত্ৰি’ জানিয়ে কিরীটী চলে গেল। নিজেকে কেন জানি বড় ক্লান্ত ও অবসন্ন লাগিছিল। কোনমতে গায়ের পোশাকগুলো খুলে সোজা এসে শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম, রাজু বোধ হয় জেগেই ছিল, আমার পদশব্দে সে শয্যায় পাশ ফিরে শুতে শুতে বললে, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি রে সুব্রত?
বিছানার ওপরে গা-টা এলিয়ে দিতে দিতে বললাম, বন্ধু, আমাদের পুরনো বন্ধু শ্ৰীযুক্ত কালো ভ্রমর আবার যে আবির্ভূত হলেন নাট্যমঞ্চে!
কে? চমকে রাজু শয্যার ওপরে উঠে বসল। —কে আবির্ভূত হয়েছে?
কালো ভ্ৰমর। কেন, এর মধ্যেই নামটা ভুলে গেলি নাকি?
রাজু আবার শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিল, ঠাট্টা করবার আর সময় পেলি না! এই শেষরাত্রে এসে…যা বাথরুম থেকে মাথায় চোখে মুখে ভাল করে ঠাণ্ডা জল দিয়ে আয়। কোথায় ঘুরিস এত রাত পর্যন্ত? বলতে বলতে রাজু বেশ ভাল করে পালকের লেপটা টেনে পাশ ফিরে বোধ করি চোখ বুজল।
আমিও আর কোন কথা না বলে খোলা জানলার দিকে ফিরে শুলাম। চোখের পাতায় যেন ঘুম আসছে না।
খোলা জানলাপথে শীতের অন্ধকার রাতের একটুকরো আকাশ চোখে পড়ল। শুকতারাটা দপদপ করে জ্বলছে।
ঝিরঝির করে রাত্রিশেষের শীতল হাওয়া ঘরে এসে ঢুকছে।
ঢং ঢেং ঢেং-দালানের ওয়াল-ক্লকটা রাত্রি তিনটে ঘোষণা করল।
উঃ, রাত্রি তিনটে বাজে!
চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলাম।
কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, পরদিন—
এই সুব্রত, ওঠু ওঠু! কিরীটীর ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল।
কখন এলে কিরীটী? লজ্জিত স্বরে বললাম।
***
আকাশে বাতাসে নাকি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এক মহাযুদ্ধের কালো ইশারা জেগে উঠেছে। ইংলণ্ড, জার্মান ও রাশিয়ার যে যুদ্ধ আজ সমগ্র ইউরোপকে তোলপাড় করছে, শীঘ্রই নাকি সারা পৃথিবীতে সেই যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়বে। রাজু আর সনৎদা তাই ব্যবসায় নেমেছে। এত বড় সুবৰ্ণ সুযোগ!
বড়বাজারের মোড়ে প্রকাণ্ড লোহার কারবার-রায় অ্যাণ্ড রায় কোম্পানী। দিবারাত্র ওরা দুজন তাই নিয়েই ব্যস্ত।
আমার ওসব ব্যবসা-ট্যাবসা ভালও লাগে না, আনন্দও পাই না ওতে, তাই কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গেই ফিরি।
বসবার ঘরে এসে আমি আর কিরীটী দু কাপ চা ঢেলে নিলাম। চা পানের পর কিরীটী আমার দিকে তাকিয়ে বললে, চল সুব্রত, আমার সঙ্গে একটু বেরুতে হবে।
কোথায়? চলই না দেখবেখন। আচ্ছা সুব্রত গত রাত্রের ঘটনা সম্পর্কে তোমার নিজস্ব মতামত কী।
গত রাত্রে ঘটনাটা যে আমি তেমন বুঝে উঠতে পেরেছি একথা বললে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথাই বলা হবে কিরীটী। তাছাড়া আমার যেন কেমন সন্দেহ হয়, গত রাত্রের ঘটনার মধ্যে এমন কোন একটা ব্যাপার সত্যিই লুকিয়েছিল যা হয়তো আমাদের কারও নজরে পড়েনি এবং অনেক ঘটনাই থাকা সম্ভব যা কারও নজরে পড়ছে না। আপাততঃ।
তাহলে নিশ্চয়ই এমন ধরনের কোন একটা ব্যাপার তোমার মনে উকি দিয়েছে সুব্রত কালকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে—বল না-বলছি না কেন?
কাল রাত্রে মিঃ মিত্রের হত্যা সম্পর্কে যাদের জেরা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন বলেছেন—একজন বিকাশ মল্লিক, আর একজন অরুণ কর, যে মিঃ শুভঙ্কর মিত্র হিন্দী ভাষা জানতেন; লিখতে, পড়তে বলতে র্তর আটকাত না। প্রফেসার কালিদাস শর্মাকেও তুমি ঐ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে, কিন্তু তিনি স্পষ্টই বললেন, শুভঙ্করবাবুর হিন্দী-জ্ঞান ‘করেঙ্গ’ ‘খায়েঙ্গার বেশী নয়। অর্থাৎ তার মতে মিঃ মিত্রের হিন্দী-জ্ঞান আমাদেরই মত। এদের মধ্যে হয়। অরুণ ও বিকাশবাবু, নয় প্রফেসর শর্মা মিথ্যে কথা বলেছেন নিশ্চয়ই!
চমৎকার! বাঃ সুব্রত, সত্যই আমি দেখে সুখী হয়েছি যে দিন দিন তোমার দেখবার ও বোঝবার শক্তি প্রখর হয়ে উঠছে। তুমি একদিন সত্যিকারের রহস্যভেদী হতে পারবে বন্ধু-কিন্তু এবার বল তো বন্ধু আমার, সত্যিই যদি তোমার মতে ওদের কেউ একজন মিথ্যা কথাই বলে থাকে—কেন, কী কারণে সে মিথ্যা বললে? উদ্দেশ্য কী ছিল তারা?
কী জানি ভাই, তা তো বলতে পারছি না! সত্যি সত্যি একজন ভদ্র ব্যক্তি কি করে যে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেন তা সহজ বুদ্ধির বাইরে। তবে আমার যা মনে হয়েছে তাই বললাম।
কিন্তু তোমার মনে হয় কি কে এদের মধ্যে মিথ্যা কথা বলতে পারে বন্ধু?
মনে হয় প্রফেসারই যেন মিথ্যা কথা বলেছেন। তারপর ধর, হিন্দী ভাষায় অনুদিত সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বইখানা…
চমৎকার! সত্য সত্যই যে সুব্রত তুমি ভাবতে শিখেছি! বল বল! কিরীটী উৎসাহিত হয়ে ওঠে।
দেখ আমার অনুমান হয়, কুমারসাহেবের বাড়ির খাবার ঘরটায় গতরাত্রে আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের মধ্যে বলতে গেলে কেউই একপ্রকার ঢোকেননি। কেননা খাবার বন্দোবস্ত গতরাত্রে নীচের হলঘরেই হয়েছিল এবং সে অবস্থায় দু-একজন কেউ সে ঘরে ঢুকলেও পাশের ঘরে যে বাবুর্চি ছিল তার নজরে পড়ত; আর হয়েছিলও তাই। শুভঙ্করবাবু যখন খাবার ঘর থেকে বের হয়ে যান, বাবুর্চি দেখেছিল। সেখানে এমন বেশী লোক থাকতে পারে না যারা হিন্দীতে অনূদিত বই পড়তে সক্ষম। তাছাড়া সকলেই একবাক্যে অস্বীকার করেছেন, ও বইটা সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না। অথচ প্রফেসার ও শুভঙ্করবাবু দুই বন্ধু খাবার ঘরে অনেকক্ষণ উপস্থিত ছিলেন। আমার যতদূর মনে হয় শুভঙ্করবাবুই নিজে ঐ বইখানা খাবার ঘরে একটা চেয়ারের ওপর ভুলে ফেলে আসেন এবং অরুণ করের সঙ্গে দেখা করবার সময় ঐ বইখানা নিয়ে যেতেন, অরুণ করাকে উত্তেজিত করে মজা দেখবার জন্য; কেননা অরুণ কর হিন্দী ভাষা মোটেই পছন্দ করে না। সে যাই হোক, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না, সত্যি ব্যাপারটা যদি আমার অনুমান মতই হয়ে থাকে, তবে প্রফেসার শৰ্মা কেন বললেন না যে শুভঙ্কর মিত্ৰই বইখানা ঐ ঘরে ফেলে গিয়েছিলেন!
তাছাড়া আরও ভেবে দেখ, সত্যিই যদি মিঃ মিত্ৰই বইখানা সে ঘরে ফেলে গিয়ে থাকেন প্রফেসর শর্মা নিশ্চয় তা জানতেন, কিন্তু তিনি তা স্বীকার করলেন না, কিংবা এমনও হতে
কিরীটী কোন জবাব দিল না। চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, দেখ সুব্রত, আমরা যতদূর জানি ও শুনেছি শুভঙ্করবাবু একটুও ঘোর-পাঁচের লোক ছিলেন না। কিন্তু ঘটনাগুলো পর পর এমন ভাবে দাঁড়াচ্ছে যে, লোকটা অত্যন্ত প্যাচোয়া ছিলেন মনে হচ্ছে। আপাততঃ চল, একবার দীনতারণ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে আসি।
বেশ চল।
দুজনে আমরা উঠে দাঁড়ালাম।
টালিগঞ্জেই দীনতারণ চৌধুরীর বাড়ি।
ফটকওয়ালা একটা দোতলা বাড়ি। সামনেই গেটে কালো পাথরের ওপর সোনার জলে দীনতারণ চৌধুরীর নাম লেখা।
Mr. D. C. Chowdhury
M. A. Bar-at-law.
ছোটখাটো একটা ফুলের বাগান, তারপরই বৈঠকখানা। দীনতারণবাবু বৈঠকখানা ঘরেই টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে একরাশ কাগজপত্র চারপাশে ছড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে যেন কি সব দেখছিলেন। মাঝারি গোছের দোহারা চেহারা, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথা ভর্তি সুবিস্তীর্ণ টাকা চকচক করছে। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
আমাদের পদশব্দে চোখ তুলে চাইলেন, কী চাই? কে আপনারা?
সুপ্রভাত। আমরা বোধ হয় মিঃ চৌধুরীর সঙ্গেই কথা বলছি! কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, বসুন। আপনারা?
আমার নাম কিরীটী রায়; আর ইনি আমার বন্ধু ও সহকারী সুব্রত রায়। আমরা গতরাত্রে কুমারসাহেবের সেক্রেটারীর হত্যার ব্যাপারে প্রাইভেট তদন্তভার নিয়েছি।
ও বেশ, নমস্কার। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম। আজ সকালের কাগজেই কুমারসাহেবের সেক্রেটারীর নিষ্ঠুর হত্যা ব্যাপার সম্পর্কে পড়েছি, ভাবছিলাম আর একটু বেলায় কুমারসাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব। তারপর একটু থেমে আবার বললেন, আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই আপনারা মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের হত্যা সংক্রান্ত কোন কিছুর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই আমার এখানে এসেছেন মিঃ রায়!
হ্যাঁ। আমিই জবাব দিই। কিরীটী বলে, আপনার সঙ্গে মিঃ মিত্রের অনেকদিন থেকেই আলাপ পরিচয় ছিল তাই না মিঃ চৌধুরী?
আজ্ঞে ঠিক তা নয়, তবে শুভঙ্করের বাপ ছিলেন আমার পরম বন্ধু। বরানগরে একসময় তঁর মত ধনী দ্বিতীয় আর ছিল না। তার বিষয়-সম্পত্তির লিগাল অ্যাভূভাইসার আমিই ছিলাম। শুভঙ্করের পিতার মৃত্যুর পর থেকে আমি শুভঙ্করেরও লিগাল অ্যাড়ভাইসার’ ছিলাম বটে, কিন্তু ইদানীং তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ আমার বড় একটা হত না, কারণ আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়েছিল। তবে কানাঘুষায় শুনেছিলাম, কয়েক বছর ধরে সে অত্যন্ত যা-তা ভাবে টাকাকড়ি খরচ করতে শুরু করায় সম্পত্তি নীলামে ওঠে এবং সে প্রায় পথের ফকির হয়ে পড়ে। অবিশ্যি এ সংবাদ সঠিক কিনা তা জানি না।
আচ্ছা, সেদিন সন্ধ্যায় আপনার তীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কুমারসাহেবের বাড়িতে? হয়েছিল, মানে সে আমায় নিমন্ত্রণ করেছিল, আর কী সব জরুরী কথা-বার্তা বলবে বলছিল।
কথাবার্তা কী হল তার সঙ্গে?
সে বলেছিল ভবিষ্যতে আর যাতে তাকে দুঃখ পেতে না হয়। সেই বন্দোবস্তই এবার সে করবে। মনস্থ করেছে। সেই সব কারণেই তার হাজার দশেক টাকার দরকার। সে একটা ব্যবসা শুরু করবে। সে ব্যবসায় নাকি এই যুদ্ধের বাজারে খুবই লাভের সম্ভাবনা। সেই টাকাটা আমি তাকে কারও কাছ থেকে ধার করে দিতে পারি। কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছিল।
কিন্তু আপনিই তো একটু আগে বলছিলেন, বর্তমানে নাকি তঁর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আপনি কি জবাব দিলেন?
বলেছিলাম চেষ্টা করে দেখতে পারি, কারণ বরানগরে তাঁর পৈতৃক আমলের যে ঘরবাড়ি এখনও আছে, তা বাঁধা রেখে হাজার দশেক কেন হাজার কুড়ি টাকা পাওয়াও এমন কিছু কঠিন ব্যাপার হত না মিঃ রায়।
মিঃ চৌধুরী, আপনি জানেন মিঃ মিত্রের বাগানের শখ ছিল কিনা?
না তো! হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন মিঃ রায়?
জানেন গত সন্ধ্যায় কুমারসাহেবের বাথরুমে একটা মাটি কোপানো খুরপি পাওয়া গেছে।
তবে একটা কথা মিঃ রায়— মাস পাঁচ-ছয় আগে শুভঙ্কর তখন সবে কুমারসাহেবের বাড়িতে চাকরি নিয়েছে, সেই চাকরি উপলক্ষ্যেই সে একদিন রাত্রে তার বাড়িতে বিশিষ্ট বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে এক বিরাট ভোজ দেয়। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর সকলেই প্রায় তখন চলে গেছেন। যাইনি শুধু আমি ও শুভঙ্করের শিশু বয়সের বন্ধু প্রফেসার কালিদাস শর্মা। এখানে চাকরি নেবার আগে শুভঙ্কর বছরখানেক প্রায় দেশভ্রমণ করে বেড়ায়। সে রাত্রে আমাদের কাছে শুভঙ্কর তার ভ্রমণ-কাহিনী বলছিল তার শয়নঘরে বসেই এবং কথায় কথায় সাহিত্যও এসে পড়ল। কালিদাস একসময় বললে, আগে থেকেই চিন্তা করে চমৎকার উপায়ে যেসব খুনী খুন করে তাদের খুনের ধারাটা পরীক্ষা করে দেখলে মনে হয় যেন একটা রহস্যপূর্ণ উপন্যাস পড়ছি। বলে সে হাসতে লাগল।
সামনেই বসে শুভঙ্কর বরফ দিয়ে জিনজার খাচ্ছিল। মনে হল সে যেন একবার কেঁপে উঠল কথাটা শুনে। কথায় কথায় ক্ৰমে ইতিহাস ও রহস্যময় উপন্যাসের কথা উঠল। বক্তা প্রফেসারের বলবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে, সে বলতে লাগল, বিখ্যাত লেখক পোয়ের মত কল্পনা-শক্তি আমি কোন বাংলা সাহিত্যিক কেন, ইংরাজী সাহিত্যিকদের মধ্যেও পাইনি। ‘অ্যামনটিলাভোর গল্পটা হয়তো পড়েননি আপনি মিঃ চৌধুরী! যখনই পোয়ের সেই গল্পটা আমার মনে পড়ে, কল্পনায় দৃশ্যটা আমার চোখের ওপর ভাসতে থাকে-—সেখানে মনট্রেসর ‘ফরচুনোটো’কে নিয়ে মাটির নীচে কবরঘরের দেওয়ালের তলায় সমাধি দিতে চলেছে। চিরজন্মের মত। শুভঙ্কর সে গল্পটা তো একদিন তোমাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম, মনে নেই! সেই যেখানে হতভাগ্য ‘ফরচুনেটো৷ তার অবশ্যম্ভাবী ভয়ঙ্কর বিপদের কথা ঘূণাক্ষরেও টের না পেয়ে তাঁর সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করছে, বল না। সত্যি সত্যিই কি তুমি ম্যামকের মাতৃসঙ্ঘের একজন মেম্বার। তার জবাবে মনট্রেসর বললে, হঁয়া। এবং তাতে ফরচুনেটো প্রশ্ন করলে, সেই সঙ্ঘের চিহ্ন কি বল তো? জবাবে মনট্রেসর বিদ্যুৎগতিতে তার জামার ভিতর থেকে একটা খুরপি’ চাটু করে বের করে দেখাল।
বলতে বলতে সে সহসা শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে বললে, কি এর মধ্যেই সে গল্পটা ভুলে গেলে? শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে দেখি, যেন একটা ভয়ঙ্কর উদ্বেগে তার সমস্ত মুখটা কালো হয়ে উঠেছে। সহসা এমন সময় শুভঙ্কর টলতে টলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কিন্তু পরীক্ষণেই আবার সে টলে পড়ে গেল। পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে টেবিলের ওপরে যে ল্যাম্পটা জ্বলছিল সেটা গড়িয়ে পড়ে ভেঙে গেল। একটা বিশ্ৰী ঝন ঝন শব্দ হয়ে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে শুভঙ্করকে তুলতে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে শুভঙ্কর নিজেই কোনমতে আবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার ঘরের মধ্যে বাইরের খানিকটা চাঁদের আলো যেন একান্ত অনাহূত ভাবেই এসে প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে একটা অস্পষ্ট আলো-ছায়ার সৃষ্টি করেছে। সেই আলোছায়াচ্ছন্ন ঘরে মুখোমুখি অন্তর পর্যন্ত দেখছে।…
মিনিট দু-তিন এরকম কাটবার পর দুজনে আবার স্থির হয়ে যে যার চেয়ার টেনে নিয়ে। বসল।
মিঃ চৌধুরী চুপ করলেন। আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর তখনকার মত আমরা মিঃ চৌধুরীর নিকট হতে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
সন্ধ্যার অল্প পরেই কিরীটী, আমি ও ডাঃ চট্টরাজ বরানগরে শুভঙ্কর মিত্রের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম।
বাজার ছাড়িয়ে গঙ্গার ধারে প্রকাণ্ড চাকমিলান প্রাসাদতুল্য বাড়ি। লোহার গেটটা ভেজানেই ছিল। মৃদু একটা ঠেলা দিতেই খুলে গেল।
সামনেই অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা নানা জাতীয় দেশী বিদেশী মরসুমী ফুলের বাগান।
বাড়ির কোথাও একটা আলোর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অন্ধকারে নিঃশব্দে ভূতের মতই যেন বাড়িটা একটা বিভীষিকার মত স্তুপ বেঁধে আছে। ভয় করে। গায়ের মধ্যে ছমছম করে ওঠে।
দরজার কড়া নাড়তেই দরজাটা খুলে গেল! সামনেই আধাবয়েসী একটি ছোকরা দাঁড়িয়ে।
কিরীটিই জিজ্ঞাসা করল, কি রে, তোর নাম কি?
আজ্ঞে, মাধব, বাবু।
এ বাড়িতে কতদিন চাকরি করছিস?
মাত্র কয়েক সপ্তাহ হল বাবু আমাকে তঁর কাজে বাহাল করেছিলেন। আমি তার বেয়ারার কাজ করতাম।
বেশ, বাড়ির আর সব চাকরেরা কোথায় মাধব?
আজ্ঞে, অন্য চাকরবাকর তো কেউ আর নেই। কর্তা অনেকদিন আগেই তাদের ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
কেন?
তিনি বলেছিলেন মাস-চার-পাঁচেকের জন্য তিনি কুমারসাহেবের সঙ্গে সিঙ্গাপুর যাবেন কী একটা কাজে।
ও, তাহলে তুই তীর খাস-চাকর ছিলি বল?
আজ্ঞে সাধ্যমত র্তার সুখ-সুবিধার দিকে নজর রাখতে কোনদিনই আমি কসুর করিনি কর্তা। আমারও আপাততঃ চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার কথা কিছুদিনের মত। তারপর তিনি বলেছিলেন, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এলে আবার আমাকে সংবাদ দেবেন।
কাল রাত্রে তুই তাহলে এখানেই ছিলি মাধব?
আজ্ঞে। এত বড় একটা বাড়িতে একা একা—শেষে রাত্রি একটার সময় ফোনে খবর পাই—আমাদের বাবু মারা গেছেন। বড় ভাল লোক ছিলেন কর্তা, কিন্তু বাবু আশ্চর্য, তারই ঠিক কিছুক্ষণ আগে যেন মনে হল শব্দ পেলাম সদর দরজায় চাবি দিয়ে যেন কে দরজা খুলছে …বাবু কখনো কখনো অনেক রাত্রে বাসায় ফিরতেন বলে আর একটা চাবি তীর কাছে থাকত। রাত্রে তিনি সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেন। আমি তাড়াতাড়ি নীচে গেলাম, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। ভাবলাম আমার শুনবারই ভুল হবে হয়তো।
ডাক্তার একবার মাথাটা দোলালেন কথাগুলো শুনে।
কটা চাবি তোর কর্তার সঙ্গে থাকত মাধব?
আজ্ঞে, তাঁর শোবার ঘরের, লাইব্রেরী ঘরের, বাইরের দরজার, অন্যান্য ঘরের ও সিন্দুকের কয়েকটা চাবি একটা রিংয়ে ভরা সর্বদাই কর্তার কাছে থাকত বাবু। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বাবু?
কাল দুপুরে যখন তিনি বাড়ি থেকে যান, তখনও তীর কাছে চাবির সেই রিংটা ছিল কিনা তুই জানিস মাধব?
আজ্ঞে জামা-কাপড় পরিবার পর আমিই র্তার অন্য একটা কোটের পকেট থেকে চাবির রিংটা এনে তার হাতে দিই।
কাল কত রাত্রে তোর মনে হয়েছিল তোর বাবু ফিরে এসেছেন? ডাক্তার প্রশ্ন করলেন।
রাত প্রায় দেড়টা হবে বাবু বোধ করি!
আচ্ছা তুই যে বলছিলি বাবুর সিন্দুক আছে, কোন ঘরে সেটা?
আজ্ঞে দোতলায় বাবুর শোবার ঘরে।
একবার দেখাতে পারিস সে ঘরটা?
চলুন না।
আমরা সকলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এলাম। লম্বা একটা টানা বারান্দা, তার উত্তর দিকে এক কোণে শুভঙ্করবাবুর শয়নঘর। কিন্তু ঘরের সামনে এসে আমরা সকলেই বিস্মিত হয়ে গেলাম! দরজার গা-তালায় তখনও একটা চাবি সমেত চাবির রিং ঝুলছে।
মাধব বললে, তাই তো বাবু, ঐ কর্তার চাবির রিং, কিন্তু এটা দরজার গা-তালায় ঝুলছে দেখছি! এখানে কী করে এল ওটা, আশ্চর্য! তবে কি.সত্যিই বাবু ফিরে এসেছিলেন রাত্রে?
তুই সকলে আর ওপরে আসিসনি মাধব, না? কিরীটী জিজ্ঞাসা করল।
আজ্ঞে না।
তোর অনুমান ভুল হয়নি মাধব! এখন বোঝা যাচ্ছে সত্যই কাল রাত্রে কেউ এ বাড়িতে এসেছিল।
কিরীটী চাবি ঘুরিয়ে ধাক্কা দিয়ে শয়নঘরের দরজাটা খুলে ফেললে এবং মৃদুস্বরে বলতে লাগল, সুব্রত, ডাক্তার, এখন বুঝতে পারছেন বোধ হয় কেন কাল রাত্রে মৃত শুভঙ্কর মিত্রের পকেট সার্চ করে আমার সন্দেহ হয়েছিল! একজন অবিবাহিত অল্পবয়স্ক যুবকের কাছে অন্তত তার প্রাইভেট চাবিটা থাকা দরকার, কিন্ত সেটা নেই। এখন বুঝতে পারছেন, সবার অলক্ষ্যে কেমন করে খুনী মৃতব্যক্তির পকেট থেকে চাবি চুরি করে সরে পড়েছিল এবং চাবি নিয়ে সে যখন বরাবর এখানেই এসেছে, নিশ্চয়ই কান উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিল। কিন্তু সেটা কী? সেটা কী?
মিঃ মিত্রের শয়নঘরটি বেশ প্রশস্ত। দামী মেহগনী কাঠের তৈরী একটি খাটে পাতা বিছানা চমৎকার একটি লাল রংয়ের বেডকভার দিয়ে ঢাকা। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের তেমন বিশেষ কোন বাহুল্য নেই।
ঘরের দেওয়ালে বড় বড় সব অয়েল পেন্টিং টাঙানো। দরজার সামনেই শিকারীর সুট পরা মিঃ মিত্রের কয়েক বছর আগেকার তোলা বোধ হয় একটি ফটো। মিঃ মিত্র যেমন একজন পাকা শিকারী ছিলেন, তার শিকারের শখও ছিল তেমনি ভয়ানক প্রবল। কিরীটী কিছুক্ষণ ফটোটার কাছে দাঁড়িয়ে তীক্ষ দৃষ্টিতে ফটোটা দেখতে লাগল। তারপর একসময় আবার মাধবের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলে, ওই ঘরের দরজার ওদিকে একটা ঘর আছে, না রে মাধব?
আজ্ঞে বাবু! ওই ঘরেই বাবুর লেখাপড়া করবার টেবিল ও সিন্দূকটা আছে। চলুন। আমরা সেই দরজা দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম। অল্প-পরিসর একখানি ঘর। এক পাশে একটা মাঝারি সাইজের সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও গোটা দুই গন্দিমোড়া চেয়ার। অন্যদিকে একটা প্রকাণ্ড বহুদিনের পুরনো লোহার সিন্দূক। চাবির রিংয়ের মধ্যেই সিন্দুকের চাবি ছিল। কিরীটী আলগোছে অতি সন্তৰ্পণে চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুলে ফেললে; কিন্তু আশ্চর্য, সিন্দুক একদম খালি, একটি কাগজের টুকরো পর্যন্ত নেই তার মধ্যে।
কিরীটী বললে, তোর বাবুর সিন্দুক যে একেবারে খালি দেখছি মাধব! ব্যাপার কি, এর মধ্যে কি কিছু থাকত না?
আজ্ঞে, সে কি বাবু —সিন্দুকের মধ্যে যে অনেক দরকারী দলিলপত্র ছিল! কালও যাওয়ার আগে আমার সামনে সিন্দুক খুলে কী একটা কাগজ নিয়ে আবার সিন্দুক আটকে রাখলেন?!…বাবু, আর সন্দেহ নেই। আমার, নিশ্চয়ই কাল রাত্রে কেউ এসেছিল। এ বাড়িতে। তা না হলে—আর বাকি কথাগুলো সে শেষ করে না।
খুব সম্ভব। দেখ, এই সিন্দুকের গায়ে হাত দিস না। আচ্ছা মাধব, দেখ তো চাবির রিংয়ের মধ্যে তোর মনে পড়ে এমন কোন চাবি খোয়া গেছে। কিনা? মানে সব চাবিই ঠিক আছে কিনা?
চাবির রিংটা মাধব হাতে নিয়ে মনে মনে এক-একটা চাবি দেখে কী যেন হিসাব করতে করতেই সহসা সবিস্ময়ে বলে উঠল, বাবু, অস্ত্ৰঘরের সেই বড় পিতলের চাবিটা তো এর মধ্যে কই দেখছি না।
অস্ত্ৰঘর! এ বাড়িতে আবার অস্ত্ৰঘরও আছে নাকি?
আজ্ঞে। মাটির নীচে এ বাড়িতে একটা ঘর আছে বাবু, সেখানে নানা-রকম অস্ত্রশস্ত্র সব দেওয়ালে সাজানো আছে। কত সব পুরোনো দিনের অস্ত্ৰ! কী অদ্ভুত সব দেখতে একএকটা অস্ত্ৰ! কর্তা আমাদের একদিন সবাইকে ডেকে নিয়ে দেখিয়েছিলেন। বাবুদের পূর্বপুরুষের মধ্যে নাকি কে একজন অত্যাচারী জমিদার ছিলেন, তিনিই ঐ ঘরটা দুষ্ট প্রজাদের কায়েদ করে রেখে শাস্তির দেবার জন্য বানিয়েছিলেন বলেছিলেন; পরে আমাদের বাবু সেটাকে অস্ত্রঘর করেছিলেন। শুধু যে সে ঘরে অস্ত্রই আছে। বাবু তা নয়, নানারকম পশুপক্ষীর হাড়-চামড়া, কত কী! দেখবেন, চলুন না!
চল।
আমরা সকলে অগ্রসর হলাম।
মাধবই আমাদের অস্ত্রঘর দেখাবার জন্য নীচের তলায় চলল। জমিদারি আমলের বাড়ি। এর গঠন-কৌশলই সম্পূর্ণ আলাদা। বাড়ির একটা রান্নাঘর এবং রান্নাঘরের পাশ দিয়েই একটা দরজা। সেই দরজা খুললেই একটা সিঁড়ি, সেখানে কোন আলোর বন্দোবস্ত নেই। ওপরের ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে যতটুকু আলোর প্রবেশাধিকার দিয়েছে। তাও অতি সামান্য। এবং সেই আলো-অাঁধারে আধো-আলোয় বহুকালের তৈরী মাটির নীচের কুঠরীর সন্ধানে আমরা সিঁড়ি বেয়ে চললাম। সুদূর এক অতীতে এই নির্জন কুঠরীতে কত হতভাগ্যের মর্মদ্ভদ কান্নার অশ্রুত বিলাপধ্বনি হয়তো আজিও নিশীথ রাতের আঁধার বায়ুলেশহীন মাটির তলায় এই গুপ্ত কক্ষের দেওয়ালে দেওয়ালে নিরুপায়ে আছাড়ি-পিছাড়ি করে মারে। কত খুন-খারাপি, কত নির্মম অত্যাচার এই নির্জন অন্ধ কুঠরীতে একদিন অবাধে অনুষ্ঠিত হয়েছে। গোটা কুড়ি সিঁড়ি ডিঙিয়ে একটা ছোট বারান্দার মত জায়গায় এসে সকলে আমরা দাঁড়ালাম। সামনেই প্রকাণ্ড একটা লোহার দরজা; দরজার গায়ে দেখা গেল একটা ভারি জার্মান তালা ঝুলছে। কিরীটী সামনের দেওয়ালে টর্চের আলো ফেলল; মনে হল বারান্দার একপাশের দেওয়ালে যেন খুব শ্ৰীঘ্ৰ চুনকাম করা হয়েছে।
অস্ত্রঘর দেখে আবার আমরা সকলে এক সময় ফিরে এলাম ওপরে।
কিরীটী ও ডাক্তার আবার ওপরে চলে গেল। আমি রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম। রান্নাঘরের পিছনেদিককার দরজাটা খোলা দেখে সেইদিকে এগিয়ে গেলাম।
সামনেই প্রকাণ্ড একটা আম, কঁঠাল, জাম, জামরুল ও অন্যান্য, ফল ও ফুলের বাগান। বহুকালের অব্যবহারে প্রচুর আগাছা জন্মেছে। ঘন সন্নিবিষ্ট গাছপালার ফঁাকে ফঁাকে খুব সামান্যই সূর্যের আলো বাগানে প্রবেশ লাভ করেছে। এক পাশে একটা প্রকাণ্ড দীঘি—প্রকাণ্ড পাথরের বাঁধানো রাণা। একটা বকুল গাছ তার ডালপালার একটা অংশ রাণার দিকে হেলিয়ে দিয়েছে।
বাঁধানো রাণার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ও কি! রাণার ওপর ডান হাতের ওপরে চিবুক রেখে গভীর চিন্তামগ্ন কে ও?
চিনতে কষ্ট হল না, গত রাত্রে কুমারসাহেবের বাড়িতে স্বল্প-পরিচিত সেই ভীতকােতর যুবক অরুণ করা।
আরো একটু এগিয়ে গিয়ে ডাকলাম, এ কি, অরুণবাবু যে! নমস্কার।
অরুণবাবু একান্ত নির্লিপ্তভাবে আমার দিকে চোখ তুলে একবার তাকালেন। আমি এগিয়ে গিয়ে তার পাশেই রাণার ওপর বসে পড়লাম। তিনি আমাকে প্রতি-নমস্কারও জানালেন না, যেমন চুপ করে বসেছিলেন তেমনিই রইলেন।
আজ দিনের আলোয় ভাল করে ভদ্রলোককে দেখলাম আবার।
সত্যই অতি সুন্দর আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা। আজও পরনে একটা দামী শান্তিপুরী ধূতি ও গরদের পাঞ্জাবি। মাথার চুল এলোমেলো বিস্রস্ত। মুখে সুস্পষ্ট একটা বিষঃ চিন্তার ছায়া যেন ফুটে উঠেছে।
অরুণবাবু! আবার ডাকলাম।
হঠাৎ আমার দিকে ফিরে রীতিমত রুক্ষগলায়। ভদ্রলোক বলে ওঠেন, যান যান মশাই, খুব আপনার কথার ঠিক! বললাম। আমাকে চুপিচুপি যেতে দিন, সারাটা পথ দুজন লোক আমার পিছু পিছু ছায়ার মত আমার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে গেছে—ভাবেন আমি কিছু টের পাইনি! কেন মশাই, আমি কি খুন করেছি নাকি যে আমার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছিলেন?
ও, এই কথা! আমি হাসতে লাগলাম, তা ওরা তো আমার লোক নয়। অরুণবাবু! বোধ হয় পুলিসের লোক কেউ আপনাকে অনুসরণ করে দেখছিল, সত্যই আপনি আপনার বাড়ির যে ঠিকানাটা তাদের দিয়েছেন সেটাই আপনার আসল ঠিকানা কিনা। কিন্তু সে কথা যেতে দিন। পুলিসের লোকগুলোই অমনি ধরনের, কিন্তু বলুন তো, এ সময়ে এ-বাড়িতে এমন জায়গায় আপনি এমনি করে ভূতের মত একা এক চুপচাপ বসে বসে কি এত ভাবছিলেন?
কি আর ভাবব! মনটা খারাপ লাগছিল শুভঙ্করদার মৃত্যুর কথা ভেবে ভেবে। বাসায় মন বসল না, তাই কখন এক সময় হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছি। ভদ্রলোকের চোখের কোণ দুটো সহসা যেন উপচীয়মান অশ্রুধারায় সজল হয়ে এল, মনে পড়ছিল কতদিন এই নির্জন পুকুরের রাণায় আমরা দুজনে বসে তার জীবনের কত সব রোমাঞ্চকর শিকারের অদ্ভূত গল্প শুনেছি। কত ভালবাসতেন। আমাকে শুভঙ্করদা! বলতে বলতে হঠাৎ আবার অরুণ কর চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আবার একসময় আবার বললেন, হ্যাঁ ভাল কথা, জানেন আজ সকালের দিকে আমি একবার কুমারসাহেবের ওখানে গিয়েছিলাম! কথায় কথায় ওঁর সঙ্গে মিঃ মিত্রের কথা উঠতে কুমারসাহেব কী বললেন জানেন?
কী? আমি প্রশ্ন করলাম।
কুমারসাহেব বলছিলেন, শুভঙ্করদার পক্ষে নাকি মরণই মঙ্গল হয়েছে। কি নিষ্ঠুর অথচ কি আশ্চর্য দেখুন! যে লোকটা কুমারসাহেবের জন্য এত করল, তীর মৃত্যুতে তীর চোখে একটু জল পর্যন্ত নেই। অথচ আর কেউ না জানুক আমি তো জানি, এক মূহুর্ত র্তার শুভঙ্করদাকে না হলে চলত না, প্রতি কাজে তাকে তার প্রয়োজন হত। এরপর অরুণ কর কিছুক্ষণ আবার একেবারে চুপচাপ বসে রইলেন; বােধ হয়। অতীত স্মৃতির বেদনায় মনটা ওঁর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল খুব বেশীই! আমিও নীরবে ওঁর পাশে চুপচাপ বসে রইলাম। এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আচ্ছা এখন চললাম—সেই সকালে বের হয়েছি। যাবেন না। আজ রাত্রে আমার বাসায়! কেউ নেই, মামা-মামী পরশু মধুপুর গেছেন, একদম খালি বাড়ি; সেখানেই খাওয়া দাওয়া করবেন। আসবেন কিন্তু, আসবেন তো?
যাব। মৃদু স্বরে জবাব দিলাম।
অরুণবাবু তাড়াতাড়ি উঠে। গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমিও উঠলাম।
গাড়িতে বসে ফিরবার পথে কিরীটীকে প্রশ্ন করলাম, অনুসন্ধানের মত কিছু পেলে?
না। একটা হাতের লেখার মত কিছু খুঁজছিলাম, কিন্তু পেলাম না। লোকটা দারুণ চালাক, আগে থেকেই সাবধান হয়ে যা কিছু প্রয়োজনীয় সব সরিয়ে ফেলেছে। তবু দুটো জিনিস পাওয়া গেছে। –
কি? কিরীটির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
একটুকরো কাগজ আর এইচ, এইচ, এইচ মার্কা একটা জন ফেবারের ‘লোড’ পেনসিল।
একটা দ্রব্য সেখানে সে বহু যত্নে লুকিয়ে রেখেছে।
ডাক্তার আগেই চলে গিয়েছিলেন। কথা ছিল তিনি পুলিস সার্জেনের ময়নাতদন্তের রিপোর্টটা নিয়ে তার বাসাতেই আমাদের জন্ম: দাপেক্ষা করবেন।
তাই গোটা তিনেকের সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা একবার লালবাজার থানায় পুলিস কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
বর্তমান কেস সম্পর্কেই কমিশনার সাহেবের সঙ্গে কিরীটীর নানা কথাবার্তা হল। কিরীটীর সঙ্গে পুলিস কমিশনারের খুব বেশী বুন্ধত্ব, অন্যান্য কথাবার্তার পর সাহেব একসময়ে বললেন, কুমারসাহেব এ ব্যাপারে অত্যন্ত ত্ৰিয়মান হয়ে পড়েছেন মিঃ রায়। তিনি গভর্ণমেণ্টকে দশ হাজার টাকার একটা চেক দিয়ে গেছেন—যে খুনিকে ধরিয়ে দিতে পারবে সে-ই ঐ পুরস্কার লাভ করবে।
তা বৈকি, কিরীটী বললো, তার মত একজন সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে এ বড় কম অসম্মানকর কথা নয়! আজি সংবাদপত্রে দেখছিলাম, বর্তমানে শ্ৰীপুরে যে টি-বি হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে গঙ্গার ধারে লক্ষ টাকা ব্যয়ে এবং যার সব কিছু ব্যয়ভার তিনিই নিয়েছেন— সেটা নাকি তার কাকা স্যার দিগেন্দ্রর নামেই ‘দিগেন্দ্র স্যানাটোরিয়াম’ নাম দেওয়া হবেতিনি ঘোষণা করেছেন।
পুলিস কমিশনারের ওখান হতে বিদায় নিয়ে আমরা ডাঃ চট্টরাজের বাসায় গিয়ে দেখি, তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন। তাকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। এবং সকলে আমরা বরাবর কুমারসাহেবের ওখানে গিয়ে হাজির হলাম। কথায় কথায় একসময় কিরীটী প্রশ্ন করল কুমারসাহেবকে, আচ্ছা, প্রফেসর শর্মা সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন বলুন তো কুমারসাহেব?
প্রফেসর শর্মার নামে কুমারসাহেবের সমস্ত শরীরটা যেন সহসা একবার কেঁপে উঠল মনে হল। পরীক্ষণেই উত্তেজিত স্বরে তিনি বললেন, প্রফেসর শর্মা মানুষের দেহে একটি শয়তান মিঃ রায়! He is a dirty snake Blood-sucking Vampire!
প্রফেসর শর্মা আপনার মৃত সেক্রেটারী শুভঙ্কর মিত্রের পরম বন্ধু ছিলেন, তা জানেন বোধ হয় কুমারসাহেব?
ভগবানকে ধন্যবাদ যে সে বন্ধুত্বের অবসান হয়েছে। ভয়ঙ্কর লোক! লোকটা নাকি কি একটা নাটক লিখেছে এবং চেষ্টা করছিল নিরীহ শুভঙ্করকে দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটা থিয়েটার-পার্টি খুলতে।
শুনলাম ওরা দুজনে পরস্পর পরস্পরকে নাকি চিনতেন?
একটা মৃদু হাসি কুমারসাহেবের ওষ্ঠ্যপ্রান্তে জেগেই মিলিয়ে গেল, বুঝতে পেরেছি। মিঃ রায়, আপনি কি সন্দেহ করছেন—প্রফেসর শর্মাই ছদ্মবেশী আমার কাকা স্যার দিগেন্দ্র কিনা, না? কিন্তু আমি বলছি তা নয়, তবে সে একজন ভয়ঙ্কর শয়তান বটে। তারপর যেন একটু থেমে আবার আত্মগতভাবে বললেন, কিন্তু কাকার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না মিঃ রায়। মনে হচ্ছে। এ বাড়ির কোথাও না কোথাও তিনি এখনও মৃত্যু-তৃষ্ণায় ওৎ পেতে বসে আছেন। হ্যাঁ, he is somewhere here! Somewhere here!
কুমারসাহেব। আবার বলতে লাগলেন, এখন আর অবিশ্যি আমার বলতে বাধা নেই মিঃ রায়-কাল সন্ধ্যায় আমার সেক্রেটারী শুভঙ্কর আমাকে বলছিল শীঘ্রই নাকি সে কোথায় টাকা পাচ্ছে! আর সেই টাকা দিয়ে সে নাকি শীঘ্রই একটা থিয়েটার খুলছে, planও প্রায় তৈরী।
আচ্ছা, সন্ধ্যার পরে প্রফেসর শর্মার বাসায় গেলে তাঁকে পাওয়া যেতে পারে বলে আপনার কি মনে হয় কুমারসাহেব?
তা ঠিক বলতে পারি না, তবে শুনেছি। দমদমার একটা বাগানবাড়িতে তলোয়ার সঙ্ঘ মানে একটা নাকি গুপ্ত সঙঘ আছে; সেইখানে সে ও আমার মৃত সেক্রেটারী প্রত্যহ সন্ধ্যার পর তলোয়ার খেলতে যেত। সন্ধ্যার পর তার বাসায় না পেলেও, সেখানেই হয়তো তাকে পেলেও পেত পারেন। ঠিকানা দিতে পারি। যদি চান।
আমাদের অনুরোধে কুমারসাহেব ঠিকানাটা দিয়ে দিলেন।
কুমারসাহেব, আপনি অরুণ কর বলে কাউকে চেনেন?
আমার মৃত সেক্রেটারীর একজন পরম ভক্ত ছিল শুনেছি। বেশ ছেলেটি। তেমন বিশেষ কিছু নয়, সামান্য একটু-আধটু জানাশোনা হয়েছিল একবার।
দেখুন কুমারসাহেব, কিরীটী বলতে লাগল, একটা খুনের মাওলার তদন্ত করতে গেলে অনেক অপ্রিয় ব্যাপারের সামনে আমাদের যেতে হয়; সেই জন্যই আগে বলে দিচ্ছি, যদি কোন সময়ে অপ্রিয় কিছু বলি তো মনে কিছু করবেন না যেন। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যে, আপনার কাকা এমন কারও ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন, যিনি হয়তো মিঃ শুভঙ্কর মিত্রের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন? এমন কি হয়তো আপনার সঙ্গেও পরিচয় ছিল সেই লোকটির?
না, সম্ভব নয়।
অবিশ্যি একথা খুবই সত্যি যে, আপনার নিজের কাকাকে আপনি যতটা চেনেন, আর কারও পক্ষে ততটা চেনা একেবারেই সম্ভবপর নয়। আচ্ছা আপনার মনে কি হয়, এমনভাবে কোন পরিচিত ব্যক্তির ছদ্মবেশে আপনার কাকা স্যার দিগেন্দ্র এখানে আসতে পারেন বলে?
না, বললাম তো, একেবারেই তা অসম্ভব। তাছাড়া আমার চোখকে তঁর পক্ষে ফাঁকি দেওয়া সম্ভবপর নয়। মিঃ রায়। এ চিন্তাও বাতুলতা।
যাহোক, কুমারসাহেবের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে তীরই দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী আমরা দমদমায় তলোয়ার সঙ্ঘ অভিমুখে যাত্রা করলাম।
ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ওপর সিঁথির কাছাকাছি এক পুরাতন বাগান-বাড়িতে ঐ সঙ্ঘ।
লোহার গেটের মাথায় একটা কেরোসিনের বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। বাগানের মধ্যে বড় বড় আমি ও ঝাউ গাছ। অন্ধকারে সো সো করে ঝাউপাতার একঘেয়ে কান্না শোনা যায়।
সঙ্ঘের কর্তা রাম সিং একজন যুদ্ধ ফেরত পাঞ্জাবী হাবিলদার সৈন্য।
কিরীটী ভৃত্যকে দিয়ে তাঁর কাছে কার্ড পাঠাতেই রাম সিং পাশের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
দানবের মতই উঁচু লম্বা চেহারা, অন্ধকারে যেন মূর্তিমান বিভীষিকার মতই প্রতীয়মান হয়।
রাম সিং আমাদের নিয়ে গিয়ে একটা ছোট কামরার মধ্যে বসলেন। তারপর আমাদের পরিচয় জেনে বললেন, আমিও মিঃ মিত্রের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেয়েছি। বাবু। বাঙালীর মধ্যে আমন চমৎকার তলোয়ার খেলতে আজ পর্যন্ত বড় একটা রাম সিংহের চোখে পড়েনি বাবু। মনটা আমার বড় খারাপ হয়ে গেছে। বহুৎ আচ্ছা আদমি থা।
আমি আপনার যে ঘরে খেলা হয়, সে ঘরটা একবার গোপনে দেখতে চাই রাম ਸੇਲੇ!
আসুন না।
পাশের বারান্দা দিয়ে আমরা একটা প্ৰকাণ্ড হলঘরের খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘরের আলো বারান্দায় এসেও খানিকটা পড়েছে।
ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে তীক্ষ্ণ সব তলোয়ার টাঙানো।
ঘরের মেঝেতে প্রফেসর শর্মা দাঁড়িয়ে। পরিধানে দামী কালো সার্জের লংস ও ঝোলা একটা জামা গায়ে। মাথার চুলগুলো ব্যাকব্রাস করা। দেহের প্রতিটি মাংসপেশী যেন সজাগ শক্তির অহমিকায় সুস্পষ্ট। ঘরের পরিবেশে আজ প্রফেসর শর্মাকে যেন চমৎকার মানিয়েছে।
হাতে একটা তীক্ষ্ণ তরবারি নিয়ে তিনি চারপাশে বনবান শব্দে ঘোরাচ্ছেন। হঠাৎ এদিকে চোখ পড়তেই আমাদের সকল গোপনতা সত্ত্বেও তীর সঙ্গে চোখাচে্যুখি হয়ে গেল। কিন্তু তিনি কোন ইঙ্গিত দিলেন না।
এমন সময় একজন ভৃত্য একটা থালায় করে বড় বড় সব কাচের গ্লাসে বাদামের সরবৎ নিয়ে ঘরে ঢুকল।
উপস্থিত যাঁরা ছিলেন সকলেই এক-একটা গ্লাস থালার ওপর থেকে তুলে নিলেন।
প্রফেসার শর্মা একটা সরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে, সেটা মাথার ওপর তুলে ধরে আনন্দবিহুল কণ্ঠে বললেন, এস, যে বন্ধু আমাদের মারা গেল তাঁর আত্মার কল্যাণে ও যে এর পরে মরবে তার শুভ কামনায় এই সরবত আমরা প্রাণভরে পান করি। হুররে!
সমস্ত সরবতটা এক চুমুকে পান করে, শূন্য গ্লাসটা সামনের একটা টেবিলের ওপরে শৰ্মা নামিয়ে রাখলেন সশব্দে। তারপর এক পাক ঘুরে আবার বললেন, উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ, আমার কথা আপনারা অবিশ্বাস করবেন না; শীঘ্রই আর একজনের মৃত্যু আসন্ন হয়ে এসেছে আমি স্পষ্ট সেটা যেন অনুভব করছি। বলতে বলতে প্রফেসর শর্মা হস্তধৃত তলোয়ারটার বঁটিটা শক্ত করে চেপে ধরলেন, বন্ধু সকল, আপনাদের মধ্যে কেউ আজ আমার সঙ্গে অসিমুখে শক্তি পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত? আসুন তবে! একদিন তলোয়ার না খেললে যেন শরীর আমার ঝিমিয়ে আসে।
প্রফেসার শর্মার চোখে যখন আমরা পড়েই গেছি, তখন আর গোপনতার প্রয়োজনও নেই; তাই আমরা সকলে ঘরের মধ্যে গিয়েই প্রবেশ করলাম।
ওর বুকে একটা সত্যিকারের শক্তি ঘুমিয়ে আছে। বাবু। ও সত্যি বীর! সাবাস রোটা! রাম সিং বললে।
যাক গে, আপনাদের মধ্যে আমার সঙ্গে আসি খেলতে কারও সাহস নেই দেখছি। এই যে আমার নতুন বন্ধু মিঃ কিরীটী রায় এখানে উপস্থিত রয়েছেন, আসুন না, আপনার সঙ্গেই এক হাত খেলা যাক। অবিশ্যি আপনাকে যথেষ্ট সুযোগ দেব।
অশেষ ধন্যবাদ প্রফেসর শর্মা। ওটায় আমি তেমন রপ্ত নই। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব निळा।
তাহলে আর কি হবে, হতাশ হতে হল। আজ তবে আসি সর্দার। গ্রে স্ট্রীটের দিকে একটা জরুরী কাজ আছে…এখুনি যেতে হবে একবার। প্রফেশার শর্মা বলে ওঠেন।
আরে তাই নাকি, আমার বন্ধুরাও তো রাত্রে আজ ও পাড়াতেই নিমন্ত্রণ! কি হে সব্রত, অরুণ করের বাড়িতে আজ তোমার নিমন্ত্রণ না? কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সহস্যে বললে।
কিরীটীর কথায় প্রফেসর শর্মার চোখ দুটো সহসা একবার তীক্ষ হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে এল।
এরপর আমরা সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাম সিং-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে এসে উঠে বসলাম। রাত্রির অন্ধকারে হেডলাইট জ্বলিয়ে গাড়ি ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ছুটে চলল।
কিরীটী একসময় হীরা সিংকে ডেকে আদেশ দিল, হীরা সিং, পথে মেছুয়াবাজারে একবার ডাঃ রুদ্রের ল্যাবরেটরীর সামনে থেমে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললে, আচ্ছা সুব্রত, এককালে তো তুমি কলেজ-জীবনে শুনেছি। একজন খুব নামকরা ‘অ্যাথলেট’ छिटुब्न? –
কেন বল তো হঠাৎ এ প্রশ্ন?
আচ্ছা তোমরা যখন কোন জায়গায় শো দেখাতে যেতে, তোমাদের সঙ্গে বড় বড় লাগেজ থাকত না?
তা থাকত বৈকি! আমি জবাব দিলাম।
কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, হুঁ, এবারে পাকা বন্দোবস্ত। সন্দেহ হবার যেটি নেই। কিরীটী অন্যমনস্ক ভাবে কী যেন ভাবতে লাগল এর পর।
যথাসময়ে আমাদের গাড়ি ডাঃ রুদ্রের ল্যাবরেটরীর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
ডাঃ রুদ্র ল্যাবরেটরীতে ছিলেন না। তাঁর একজন সহকারী আমাদের এসে অভ্যর্থনা করে সমাদরের সঙ্গে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল, বললে, বসুন, ডাক্তার একটা জরুরী কাজে বের হয়েছেন, ফিরতে একটু দেরী হবে।
সহকারীর হাতে কিরীটী পকেট থেকে একটা লেড পেনসিল বের করে দিয়ে বললে, ডাঃ রুদ্রকে এই পেনসিলটা একটিবার পরীক্ষা করে দেখতে বলবেন তো অমিয়বাবু!…আমি শুধু জানতে চাই পেনসিলটা কোন গ্রুপের। হ্যা ভাল কথা, যে বইটা দিয়ে গিয়েছিলাম, তার থেকে ফটো নিয়ে ডেভলাপ করে দেখবার কথা ছিল, সেটা করা হয়েছে কি?
আজ্ঞে, ফটোর নেগেটিভটা শুকোচ্ছে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, সাধারণ লেখবার কালি দিয়েই বইয়ের ওপর নামটা লেখা হয়েছিল। বইয়ের ওপর পড়া গেছে পরিষ্কার।
খুব সুখবর! প্লেটটা এখনি দেখবখন। হ্যাঁ, পুলিসের রিপোর্টটা সার্জেন দিয়ে যায়নি?
হ্যাঁ, ডাক্তার বলছিলেন মৃত মিঃ মিত্রের রক্ত ও হৃৎপিণ্ড পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিনি আফিংয়ের নেশায় নাকি অভ্যস্ত ছিলেন, প্রায় অন্তত বছর খানেক ধরে।
হ্যাঁ। কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের জানালার কাছে যে আঙুলের ছাপের ফটো তোলা হয়েছিল সেটার রিপোর্ট কী?
হুবহু স্যার দিগেন্দ্রর আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেছে স্যার।
বেশ। যে তলোয়ারটা সেই ঘরে পাওয়া গিয়েছিল তার গায়ে কোন আঙুলের ছাপ পাননি, না?
আজ্ঞে না।
সবাই আপনারা ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন তো অমিয়বাবু?
হ্যাঁ স্যার, সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখেছি।
এবারে কিরীটী আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, আমাদের কথাবার্তা শুনে সুব্রত বোধ হয় খুব আশ্চর্য হয়ে গেছ, না? ডাক্তারও হয়তো হয়েছেন। কিন্তু একটা কথা কি জানেন? একটা ‘ক্রাইমকে অনুসন্ধান করে তার গোপন কথা জানতে হলে অনেক ছোটখাটো ব্যাপারেরও সাহায্য নিতে হয়। কারণ অনেক সামান্য ব্যাপারের মধ্যে কত সময় যে আমরা প্রয়োজনীয় সূত্রের সন্ধান পাই ভাবলেই বিস্মিত হতে হয়। একজন খুনী বা দোষীকে খুঁজে বের করতে হলেই যে টনটনে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতেই হবে তার কোন মানে নেইসামান্য বিচার বুদ্ধি ও common sense থাকলেই যে কেউ খুনীকে অনায়াসেই খুঁজে বের করতে পারেন.I.অন্তত আমার বিশ্বাস তো তাই।
এরপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, জানি জীবনে শত পরাজয় আছে এবং সেইজন্যই হঠাৎ পাওয়া একটি দিনের জয়ের আনন্দ অতীতের সমস্ত পরাজয়ের বেদনায় যেন শান্তিবারি ছিটিয়ে দেয়। ঐ ধৈর্য, অধ্যবসায় ও সহজ বিচার-বুদ্ধি আছে বলেই জীবনে আজ পর্যন্ত আমি কখনো হতাশ হইনি। যে কোন রহস্যই আমার কাছে বিচার ও বিশ্লেষণে অল্প সময়ের মধ্যে সহজ হয়ে গেছে। যা হোক, এবার আমাদের উঠতে হয়, রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটা হল। বলতে বলতে কিরীটী আমার ও ডাক্তারের চোখের সামনে একটা টাইপ করা কাগজ মেলে ধরলা, তাতে এই কটা কথা লেখা।
“প্রফেসার কালিদাস শর্মা,-খোঁজ নিয়ে দেখলাম লোকটার বাড়ি ও জন্মস্থান কাশীতে। ওইখানেই এবং পরে পাটনায় ও কাশীতে ওঁর জীবনের চব্বিশটা বছর কাটিয়েছেন। ওঁর পিতার নাম স্বৰ্গীয় জ্ঞানদাস শৰ্মা। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে এম. এ. ডিগ্ৰী নেন। তার পর কলকাতায় ১৯৩৬ সন থেকে প্রফেসারী শুরু করেন। কিন্তু একটি বৎসর না যেতেই ১৯৩৭ সালে কলেজ সংক্রান্ত কতকগুলো কী ব্যাপার নিয়ে চাকরী যায়। বর্তমানে তিনি কোথাও কোন কাজ করেন না, তবে প্রায়ই দেখা গেছে অরুণ করের নাম সই করা চেক ব্যাঙ্ক থেকে উনি ভাঙিয়ে নিয়েছেন।”
কিরীটী আমাদের দিকে একবার চেয়ে অদ্ভুত একটু হেসে কাগজটা মুড়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল। চল, আশা করি এর পর আর রহস্যের মূল সূত্রটি খুঁজে পেতে তোমাদের কারও কষ্ট হবে না।
গাড়িতে বসে কিরীটী বললে, তাহলে সুব্রত, তুমি তো অরুণ করের বাড়িতেই যাবে, না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা। আমার একটা জরুরী কাজ আছে। অন্য জায়গায়, আমি আপাতত সেইখানেই যাব।
আমার গাড়িটা আজ ক’দিন হতে বিগড়ে আছে, অগত্যা বাসে চেপেই অরুণ করের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চললাম। রাত্রি তখন সাড়ে আটটা হবে, গ্রে সন্টীটের মোড়ে বাস থেকে নামলাম। অরুণ করের দেওয়া ঠিকানা মত র্তার বাড়িটা খুঁজে নিতে আমার বিশেষ কোন বেগ পেতে হল না। ট্রাম রাস্তার পিছনে একটা গলির মধ্য দিয়ে একটু এগিয়ে গেলে অরুণ করের বাড়ি। চমৎকার আধুনিক প্যাটানের কংক্রীটের তৈরী মাঝারি গোছের একখানা দ্বিতল স্বাড়ি; লোহার গেট পার হলেই সামানেই একটা ‘লন’—লাল সুরকি ঢালা রাস্ত বরাবর দরজা পর্যন্ত গেছে; দু’পাশে কেয়ারী করা মেহেদির বেড়া ও নানাজাতীয় প্রচুর মরসুমী ফুলের সৌন্দর্যের সমারোহ। তারপরই সাদা ধবধবে বাড়িখানি একটা সুমিষ্ট ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে আনে।
করিডোরের সামনেই বোধ করি ড্রয়িং রুম। সূক্ষ্ম সিঙ্কের নেটের সবুজ পর্দা ভেদ করে ঘরের আলোর আভাস এদিকে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
ড্রয়িং রুমে নিশ্চয় কারা বসে আছে মনে হল আমার, কারণ মৃদু কথা-বার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
সহসা একটা তীক্ষা গলার স্বর শোনা গেল, না, না—এ আমি সহ্য করব না। কিছুতেই সহ্য করব না। বুঝে দেখ অরুণ, ভেবে দেখ!
চমকে উঠলাম। প্রফেসর শর্মার গলা। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ম্রিয়মাণ কণ্ঠস্বরে অতি কষ্টে অরুণবাবু যেন জবাব দিলেন, কেন এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন মিঃ শৰ্মা? এর চাইতে একটুও বেশী আমি জানি না। আর জানতামও না।
তাহলে এই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, কর?
হ্যাঁ। কিন্তু প্রফেসার এবারে আপনাকে যেতে হবে। আমার একজন বন্ধুর এখানে আজ রাত্রে নিমন্ত্রণ আছে। হয়তো এখুনি তিনি এসে পৌঁছবেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম।
ভিতর থেকে আহ্বান এল, আসুন ভিতরে।
ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম, চমৎকার আধুনিক কেতায় সুসজ্জিত একখানি ড্রয়িং রুম, চারদিকে সোফা-কাউচ। মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের টেবিলে প্রকাণ্ড একটা জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে এক থোকা শুভ্র রজনীগন্ধা। বাতাসে তার মিষ্ট গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আসুন, আসুন সুব্রতবাবু। অরুণবাবু বললেন, এঁকে চেনেন তো? প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা—আমার বিশেষ বন্ধু।
হ্যাঁ, চিনি বৈকি।
নমস্কার সুব্রতবাবু। তারপর প্রফেসার নিঃশব্দে টুপিটা হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আচ্ছা শুভরাত্রি অরুণ, শুভরাত্রি সুব্রতবাবু! আমার গাড়ি গলির মুখেই আছে, আমি পিছনের দরজা দিয়েই চললাম।
প্রফেসার নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ অরুণবাবু চুপচাপ বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ একসময় বললেন, চা আনতে বলি সুব্রতবাবু?
না, থাক। এত রাত্রে আর চা খাব না।
আপনিও একজন ডিটেকটিভ, না সুব্রতবাবু?
না।
ভয়ঙ্কর চরিত্রের লোকগুলোকে আমার চিরকালই খুব ভাল লাগে, জানেন সুব্রতবাবু।
কেন বলুন তো?
আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। অরুণবাবু, চুপচাপ বসে রইলেন, তারপর সহসা একসময় বললেন, চলুন, পিছনের বাগানে আমাদের খাবার আয়োজন করেছি। বাগানের মধ্যে টেবিল-চেয়ার পাতা, মাথার উপর চীনা-লণ্ঠনের পীতাভ আলো। চলুন। চমৎকার আইডিয়া, না?
আমরা দুজনেই উঠলাম।
বাড়ির পিছনে ছোটখাটো একটি ফুলের ও ফলের বাগান আছে। একটা কামিনী গাছের তলায় টেবিল-চেয়ার পেতে খাবার আয়োজন করা হয়েছে।
শীতের রাত্রে এই খোলা বাগানে বসে খাওয়া…হাসি পাচ্ছিল। মাথার ওপরে গাছের ডালে ঝুলছে গোটাচারেক চীনা-লণ্ঠন। একটা পীতাভ আলোয় চারিদিক যেন স্বপ্নাতুর হয়ে উঠেছে।
এও এক অভিজ্ঞতা।
বাবুর্চি এসে টেবিলে খাবার দিয়ে গেল। গল্প করতে করতে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। কথায় কথায় সাহিত্য নিয়ে তর্ক উঠল।
অরুণবাবু বলতে লাগলেন, রূপকথা পড়তে আমার বড় ভাল লাগে সুব্রতবাবু, একজন বন্ধুর মুখে একদিন আমি ‘সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে, রূপকথাটা শুনেছিলাম, বন্ধু আমাকে বইখানা এনে দেবেও বলেছিল। এনেও দিয়েছিল, অথচ বইখানা হিন্দীতে অনুদিত। উঃ, কি বিচ্ছিরি ঐ হিন্দী ভাষাটা! আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। শেষটা আমি নিজেই একটা বাংলায় লেখা বই কিনি।
অরুণ করের কথায় আমার সহসা যেন তরতর করে দেহের সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়ে উঠেছে বলে মনে হতে লাগল। তারপর আবার একসময় আত্মগতভাবেই তিনি বলতে লাগলেন, মানুষ মরেই, তার জন্য দুঃখ নেই। কিন্তু আমি গোলমাল ভালবাসি না। শান্তি চাই। সম্পূর্ণ শান্তি।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর আমারা দুজনে বাগানে নানা গল্প করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। মাথার উপরে নিঃশব্দ শীতের রাত্রি। রাতের চোরা হাওয়ায় বাগানের গাছপালার পাতায় পাতায় মাঝে মাঝে সিপি সিপ শব্দ জাগে। চারিদিকে একটা অদ্ভুত থমথমে ভাব।
বাগানের এক দিকে কৃত্রিম ফোয়ারা থেকে ঝিরঝির করে জল পড়ছে। ফোয়ারার চার পাশ শ্বেতপাথরে গোল করে বাধানো।
ক্ষীণ অষ্টমীর চীদ মৃদু আলো বিকীরণ করছে শীতের আকাশের গায়ে। একটা বড় শিশু গাছের তলায় আসতেই সহসা অরুণবাবু পায়ে কি বেধে হোঁচটি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে উঃ বলে নিজেকে যেন কোনমতে সামলে নিলেন।
আমি শশব্যস্ত তাঁকে ধরে সামলাতে গিয়ে মৃদু চাঁদের আলোয় সামনের দিকে চেয়ে বিস্ময়ে আতঙ্কে নির্বক হয়ে গেলাম। রক্তাক্ত একটা মৃতদেহ বাগানের মধ্যে ঘাসের ওপর উপুর হয়ে পড়ে আছে। গলাটা ধড় থেকে প্রায় দু ভাগ হয়ে এসেছে সামান্যর জন্য একেবারে পৃথক হয়নি।
সেই অস্পষ্ট আলো আঁধারিতেও চিনতে আমাদের কষ্ট হয়নি মৃতদেহটি কার। মৃতদেহটি প্রফেসার কালিদাস শর্মার।
একটা আর্ত চিৎকার করে হঠাৎ অরুণবাবু অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
অদৃশ্য আততায়ীর মরণ পরশ আবার নিঃশব্দে একজনকে গ্রাস করল।
উঃ কী ভয়ানক দৃশ্য! কী নিষ্ঠুর হত্যা! কী দানবীয় কাণ্ড!
একটা অশরীরী আতঙ্ক যেন মৃদু পদবিক্ষেপে বাগানের গাছের আড়ালে আড়ালে অন্ধকারে এগিয়ে আসছে। প্রথমটায় বেশ একটু যেন হকচকিয়েই গিয়েছিলাম, তারপর ঝরনা থেকে জল এনে জ্ঞানহীন অরুণবাবুর চোখে-মুখে ঝাপটা দিতে লাগলাম; কিছুক্ষণ বাদে অরুণবাবুর জ্ঞান ফিরে এল। তারপর অরুণবাবু খানিকটা সময় গুম হয়ে বসে থেকে একসময় হঠাৎ পাগলের মতই হাঃ হাঃ করে অদ্ভুতভাবে হাসতে শুরু করলেন।
উঃ, সে কী তীব্ৰ হাসি! কবর ভেঙে যেন কোন অশরীরী প্রেতাত্মা এসে এখানে উন্মাদের মত হাসছে।
আমি অরুণবাবুর হাত ধরে প্রবল এক ঝাকুনি দিয়ে বললাম, কী হাসছেন পাগলের মত! থামুন, থামুন অরুণবাবু! অরুণবাবু, শুনছেন? আপনি কি পাগল হলেন? অরুণবাবু পূর্বের মতই উন্মাদ হাসি হাসতে হাসতে অদূরে একটা ঝোপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগলেন, আমি দেখেছি তাকে সন্ধ্যাবেলা ঐ ঝোপের ধারে। আমি দেখেছি। জানি সে কে। সে মরে গিয়েও আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্ৰতিহিংসা! প্রতিহিংসা! হাঃ হাঃ হাঃ!
আঃ, অরুণবাবু! থামাবেন আপনার হাসি?
এবারে যেন অরুণ করা হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফেললেন।
থেমেছি। আর হাসব না। কিন্তু আমি জানতাম যে সে মরবে। কিন্তু আমার বাড়িতেই বাগানের মধ্যে এমনি করে নিজেকে নিজে হত্যা করল!
কী পাগলের মত বকছেন যা-তা? আত্মহত্যা করলে মাথা ওরকম দেহ থেকে প্রায় পৃথক হয়ে আসতে পারে নাকি?
সহসা যেন অরুণবাবু আমার কথায় চমকে উঠলেন। কী বললেন সুব্রতবাবু…তবে সতি্যু কি সে আত্মহত্যা করেনি? তবে কে তাকে এত রাত্রে খুন করে গেল আমন করে? সে নিজে নিজেকে তবে হত্যা করেনি? খুন করেছে। ওকে! না, না, আত্মহত্যা করেছে ও; হ্যাঁ, আত্মহত্যাই করেছে, আপনি জানেন না।
না। আত্মহত্যা নয়, কেউ খুনই করেছে। ভাল করে দেখুন না।
তবে কে হত্যা করলে তাকে আমন করে? কে? কে?
তা কী করে জানিব? নিশ্চয়ই কেউ করেছে।
সহসা যেন অরুণবাবুর সমস্ত মুখখানা রক্তহীন পাংশু হয়ে গেল। অর্থহীন দৃষ্টিতে অদূরে অন্ধকার ঝোপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অদূরে ঝোপের অন্ধকারে হঠাৎ একটা যেন সিগারেটের লাল আগুন দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের শব্দও শুনতে পেলাম যেন। তারপরই পরিচিত গলার আওয়াজ কানো এল।
সুব্রত, এখানে উপস্থিত থেকেও তুমি এমন করে খুন হতে দিলে? একটু বাধা দিতে त्र्ङ्ग(ब्ल नां?
কালো সার্জের সুট পরা, সিগারেট ফুকতে ফুকতে ঝোপের আড়াল থেকে ধীরপদে কিরিটী বের হয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল।
কিরীটী, তুমি এখানে! অস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, হত্যাকারীকে তাহলে তুমি দেখতে পেয়েছ নিশ্চয়ই?
না, দেখিনি। কিন্তু অরুণবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আগে ওঁকে ঘরে নিয়ে যাও। তারপর বলছি কেমন করে এখানে এলাম।
আমি অরুণবাবুকে তখন চাকরীদের সাহায্যে তীর শোবার ঘরে পৌঁছে দিলাম।
কিরীটীও পিছনে পিছনে এসে ঘরে ঢুকল।–বেচারী অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন এবং অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। পাশের ঘরে ফোন আছে, একজন ডাক্তারকে ফোন করে দাও আগে সুব্রত। ইতিমধ্যে আমি একবার বাইরেটা ঘুরে আসি। ওঁর শ্বাসপ্রশ্বাস যে রকম ভাবে পড়ছে, এখুনি একজন ডাক্তার ডাকা দরকার!
কিরীটী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। আমি অরুণবাবুর পাশেই বসে রইলাম।
একসময়ে চেয়ে দেখি, অরুণবাবু ক্লান্তিভরে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
পাশের ঘরেই টেলিফোন ছিল, গাইড দেখে একজন ডাক্তারকে কল দিলাম, তারপর কিরীটির খোঁজে বাইরে গেলাম।
বাগানে ঢুকে দেখি অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে কিরীটী বাগানের মধ্যে কিসের সন্ধানে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পদশব্দে কিরীটী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। অস্থির অসংযত চাপা স্বরে বললে, উঃ সুব্রত, আমি একটা আস্ত গাধা! সত্যি বলছি, আমি একটা গাধা। আমি ভুল লোককে পাহারা দিচ্ছিলাম এতক্ষণ। সত্যি এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নেই। কিন্তু কাল রাত্রেও আমি জানতাম না সত্যিকারের খুনী কে। আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি সুব্রত, কাল রাত্রের আগেই খুনীকে আমি ধরিয়ে দেব। আর তা যদি না পারি, আমি কিরীটী রায়ই নই। এস। উত্তেজনায়। কিরীটীর কণ্ঠস্বর শেষের দিকে যেন কাঁপাছিল।
কিছু বুঝতে পারলে? আমি প্রশ্ন করলাম।
এস তোমাকে দেখাই।
চল।
আমরা দুজনে মৃতদেহের কাছে দাঁড়ালাম বাগানে।
কিরীটী বলতে লাগল, ভাল করে চেয়ে দেখ, অস্ত্ৰ দিয়ে গলা কেটে একে খুন করা হয়নি। প্রথমে কেউ প্রফেসারকে দুবার ছোরা মেরেছে, একবার পিছন দিকে পিঠে, আর একবার পাশের পাঁজরায়। তারপর কোন ধারালো অস্ত্ৰ দিয়ে দেহ থেকে মাথাটা পৃথক করে ফেলেছে। চেয়ে দেখ, দুটি কশেরুকার (vertibra) মধ্যবর্তী তরুণাস্থির (cartillage) মধ্য দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। সাধারণ লোক এভাবে আঘাত করতে পারে না। যে আঘাত করেছে, মানবদেহের গঠন-প্ৰণালী সম্পর্কে তার সম্পূর্ণ জ্ঞান আছে। অস্ত্রবিদ্যায় (surgery) সুপণ্ডিত না হলে এভাবে হত্যা করা একেবারেই অসম্ভব। আর wound দেখে মনে হয় এক ইঞ্চি পরিমাণ চওড়া কোন ভারী অস্ত্ৰ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অনেকটা বৰ্মার একপ্রকার অস্ত্রের মত। তারপর কিরীটী টর্চের আলো ফেলে দেখােল, ঐ যে সরু রাস্তাটা বরাবর বাগানের মধ্য দিয়ে বাগানের পিছনের দরজা পর্যন্ত গেছে, দেখ ওখানে রক্তের দাগ রয়েছে। খুব সম্ভব দরজার কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে জানালা-পথে প্রফেসার তোমাদের লক্ষ্য করেছিলেন, এমন সময় হত্যাকারী পিছনের দরজা দিয়ে এসে পিছন থেকে প্রফেসারকে ছোরা বসায় পিঠে। ছোরার আঘাত খেয়ে প্রফেসার সামনের দিকে চলে আসেন। সেই সময় পিছন থেকে হত্যাকারী হতভাগ্যের গলা কেটে ফেলবার চেষ্টা করে।
উঃ আর কয়েক সেকেণ্ড আগেও যদি বাগানে আসতাম। কিরীটী, তবে হত্যাটা হত না। কিন্তু আশ্চর্য কোন চিৎকার বা শব্দও তো শুনতে পাইনি! দুঃখিত স্বরে বললাম।
পাওনি তার কারণ আহত ব্যক্তি চিৎকার করবারও সময় পায়নি—it was so sudden! কিন্তু সে কথা থাক। যা হয়ে গেছে তার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই। চল আর একবার সব ঘুরে ভাল করে দেখা যাক।
বাগানের পিছনের দরজা দিয়ে গলিপথে এসে দাঁড়ালাম দুজনে।
সামনেই একটা পোড়ো মাঠ। তার ওদিকে কতকগুলো খোলার বস্তি।
অনেক দূরে দূরে এক-একটা কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। সাধারণতঃ এই অপ্রশস্ত পথটা কুলি-কামিন ছাড়া আর কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয় না।
গতরাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এই গলিপথের কাদা এখনও শুকোয়নি। ঐ দেখ অন্ধকারে এখনও প্রফেসারের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানতাম খুনী আজ এখানে আসবে, কিন্তু কেন? খুনী এখানে নিশ্চয়ই কোন ট্যাক্সিতে চেপে এসেছে, কিন্তু বাগানের দরজা পর্যন্ত আসেনি। পাছে তার ড্রাইভারের মনে কোনপ্রকার সন্দেহ জাগে। চল, এগিয়ে গিয়ে দেখা
কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরই আমরা গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পেলাম ভিজে রাস্তার ওপর। তাহলে কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়!
কিরীটী আবার বলতে লাগল, আজ রাত্রে খুনী যখন এখানে আসে তখন সে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল; কিন্তু যে অস্ত্ৰ দিয়ে সে হত্যা করেছে সেটা রক্তাক্ত অবস্থায় সঙ্গে নিয়ে যায়নি, পাছে ড্রাইভারের মনে সন্দেহ জাগে। ফেলে রেখে গেছে সে সেটা নিশ্চয়ই, কিন্তু কোথায়? চল বাগানটা খুঁজে দেখি। থানায় খোঁজ নিলেই ট্যাক্সি এসোসিয়েশন থেকে আজ এমন সময় কোন ট্যাক্সি ভাড়া করা হয়েছিল। কিনা অনায়াসেই জানতে পারব।
সত্যিই বাগানে খুঁজতে খুঁজতে একটা বকুল গাছের গোড়ায় ছুরিটা পাওয়া গেল।
কিরীটী বললে, থাক, ছুরিটা ধরো না; চল অরুণবাবুর ঘরে যাই। এখুনি থানায় গিয়ে আমি হরিচরণকে এখানে পাঠাব। ভিজে মাটির বুকে অপরাধীর পায়ের দাগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কেননা ট্যাক্সি থেকে নেমে বাকি পথটা সে হেঁটেই বাগানে এসেছিল!..এবারে চল, ভিতরে যাওয়া যাক। ঘরে ঢুকে দেখি একজন ডাক্তার এসেছে; অরুণবাবুকে পরীক্ষা করে ওষুধের ব্যবস্থা দিয়ে তিনি বিদায় নিলে আমরা চলে এলাম।
***
পরের দিন সন্ধ্যার দিকে কিরীটী ফোনে আমায় একবার ডাকল, এখুনি তার ওখানে একবার যেতে হবে, খুব জরুরী। ডাঃ চট্টরাজও তার ওখানেই অপেক্ষা করছেন।
কিরীটীর ওখানে গিয়ে তার গাড়িতেই আমরা সোজা কুমারসাহেবের বাড়িতে গেলাম। দরজার গোড়াতেই ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, কুমারসাহেব বাড়ি নেই, আজ দুপুরের ট্রেনে নাকি মধুপুর গেছেন কী একটা জরুরী কাজে। কাল রাত্রের ট্রেনে ফিরবেন।
একসময় কিরীটী বললে, শুনেছেন ম্যানেজারবাবু, প্রফেসার শর্মা কাল রাত্রে খুন হয়েছেন?
অ্যাঁ! সে কি—কেন? কেন খুন হলেন? লোক তো খারাপ ছিলেন না নেহাৎ, তবে—; তারপর হঠাৎ কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল স্বরে বললেন, খুনীকে নিশ্চয় ধরেছেন, মিঃ রায়!
হ্যাঁ আচ্ছা প্রফেসর শর্মা সম্পর্কে আপনাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই–আশা করি সঠিক জবাব পাব।
মৃদু হেসে ম্যানেজারবাবু জবাব দিলেন, কিরীটীবাবু কি মনে করেন, প্রফেসার শর্মার হত্যা সম্পর্কে কোন কিছু আমি জানি!
না, সেজন্য নয়, তার সম্পর্কে কয়েকটা কথা জানা প্রয়োজন, তাই। আচ্ছা শুনেছি নাকি ভদ্রলোকের জন্ম ও জন্মাবার পর অনেক দিন তার কাশীতেই কেটেছিল? অথচ তিনি বলতেন, তিনি বহুকাল বাংলা দেশেই আছেন এবং জন্মও নাকি তার এই দেশেই! তাছাড়া অরুণবাবু যে সমস্ত চেক শর্মাকে দিতেন, আপনি নাকি সেগুলো আপনার অ্যাকাউন্টেই ব্যাঙ্ক থেকে ভাঙ্গিয়ে দিতেন? একথা কি সত্যি ম্যানেজারবাবু?
সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা মশাই। আমার নিজের ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে কারও চেক আমি কোনদিনই ভাঙাইনি।–
বেশ। শুনেছি। তিনি একটা নাটক লিখেছিলেন এবং সেই নাটক নিয়ে থিয়েটার খুলবোর
এ কথা কি সত্যি?
হ্যাঁ, আমিও তা শুনেছি বটে।
আমরা মার্বেল হাউস থেকে বের হয়ে গাড়িতে চেপে বিকাশ মল্লিকের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম।
বিকাশবাবু তখন বের হবার আয়োজন করছেন, আমাদের দেখে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন।
তারপর কিরীটীবাবু, কি মনে করে? আপনার ‘কেস’, কতদূর এগুলো?
আপনি প্রফেসর শর্মাকে চিনতেন, বিকাশবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করল।
সামান্যই চেনা-পরিচয় ছিল। তার সম্পর্কে প্রায়ই আমি অনেক কথা শুনতাম। উনি বেশ চমৎকার ‘হিন্দী’ বলতে কইতে পারতেন। শুভঙ্করবাবুর বাড়িতেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। নেহাৎ মন্দ লোক বলে তাঁকে আমার কোনদিন তো মনে হয়নি! তবে একটু যেন ‘হামবাড়া’ গোছের লোক ছিলেন। …এরপর আরো কিছুক্ষণ কথাবাতাঁর পর আমরা বিদায় নিলাম।
***
গাড়ি কীলীঘাট ব্রীজ পার হতেই কিরীটী হীরা সিংকে বললে, টালিগঞ্জে ব্যারিস্টার চৌধুরীর বাড়ি।
ময়নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
পুলিস সার্জেন ও একটা ডোম আমাদের জন্যে ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল।
পুলিস সার্জেন আমাদের আহ্বান জানালেন, শুভসন্ধ্যা, মিঃ রায়!
আপনার মৃতদেহগুলো কোন ঘরে থাকে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
ঠাণ্ডি ঘরে।
শুভঙ্কর মিত্রের মৃতদেহটাও আছে বোধ হয় সেইখানেই।
হ্যাঁ, চলুন। এই কাল্লু, পরশুকার সেই গলাকাটা দেহটা ও মাথাটা স্ট্রেচারে করে বাইরে নামা!
কাল্লু চলে গেল।
সার্জেনের পিছু পিছু আমরা একটা অল্প পরিসর ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলাম। একটা বিশ্ৰী উৎকট গন্ধে নাড়ি পাক দেয়। সামনেই একটা সেলফের মত আলমারিতে পার পর কতকগুলো মৃতদেহ সাজানো। কাল্প স্ট্রেচারে করে শুভঙ্কর মিত্রের মৃতদেটা সামনে এনে নামাল আর একজন ডোমের সাহায্যে।
কিরীটী মৃতদেহটার আপাদমস্তক বেশ ভাল করে দেখে নিয়ে মৃদু হেসে বললে, না ঠিক আছে। দেহটা lock up করে রাখুন। এই নিন পুলিস কমিশনারের অর্ডার। একটা বেলে রঙের ছাপানো কাগজ সার্জেনের হাতে কিরীটী এগিয়ে দিল।
***
ময়নাঘর থেকে বের হয়ে আমরা সকলে সোজা বরানগরে মিঃ মিত্রের বাড়িতে এসে হাজির হলাম।
কড়া নাড়তেই মাধব এসে দরজা খুলে দিল।
ভিতরে চল মাধব। একটা শাবল যোগাড় করে আনতে পার মাধব এখুনি? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, কেন পারব না বাবু! চলুন।
শাবল! শাবল দিয়ে কী হবে মশাই? বিস্মিত চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
দরকার আছে, চলুন না। এস সুব্রত। হ্যাঁ, আর একটা লণ্ঠন জ্বলিয়ে নিয়ে এস মাধব।
আমিও ভেবে পেলাম না কিরীটী হঠাৎ শাবল আনতে বললে কেন আর শাবল দিয়ে কী এমন কাজ হবে! যাহোক, একটু পরেই মাধব একটা শাবল ও একটা লণ্ঠন নিয়ে সেই ঘরের মধ্যে ফিরে এল। শাবলটা হাতে নিয়ে একটা টর্চ হাতে আমরা কিরীটীর পিছু পিছু রান্নাঘরের দিকে চললাম।
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে শুভঙ্কর মিত্রের অস্ত্ৰঘরের দিকে চললাম। ব্যাপার কি? কিরীটী কোথায় চলেছে? সে বলেছিল। আজ সন্ধ্যার আগেই খুনীকে ধরিয়ে দেবে, কিন্তু এখানে কোথায় চলেছে? তবে কি খুনী ঐ বদ্ধ ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নাকি কোথায়ও? ঘরের সামনে এসে কিরীটী সদ্য চুনকাম করা দেওয়ালটার দিকে এগিয়ে গেল।—আলো উঁচু করে ধর সুব্রত, এই দেওয়ালটা খুঁড়তে হবে।–
দেওয়ালটা সাত্যসত্যই সে শাবল দিয়ে খুঁড়তে লাগল। অল্পক্ষণ পরেই কতকগুলো ইট ঝুরঝুর করে পড়ে গেল। পাগলের মত শাবল দিয়ে কিরীটী চারপাশের ইট খুলতে লাগল। দেওয়ালের খানিকটা ভেঙে একটা গর্ত মত দেখা গেল।
সেই গর্তের মধ্যে পা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, কিরীটী শাবল দিয়ে কিসের ওপর আঘাত করল। ঠিক করে একটা শব্দ হল। শাবলের সাহায্যেই চাড় দিয়ে কি যেন ভেঙে ফেলল। তারপর পকেট থেকে টৰ্চটা বের করে সেই গর্তের মুখে ফেলে আমাদের ডাকল, আসুন মিঃ চৌধুরী, চেয়ে দেখুন। ঐ কাঠের বাক্সর মধ্যে। চেয়ে দেখুন তো, আপনার মক্কেল সত্যিকারের শুভঙ্কর মিত্রকে চিনতে পারেন কি না? ঐ—ঐ হচ্ছে সত্যিকারের শুভঙ্কর মিত্র। আর একটু আগে ময়নাঘরে যাকে দেখে এলাম, সে কে জানেন? কিরীটী আমাদের মুখের দিকে চেয়ে বলতে লাগল, কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণের কাকা-রাঁচি পাগলা গারদের পলাতক। স্যার দিগেন্দ্ৰ নারায়ণ।
মিঃ চৌধুরী একপ্রকার চিৎকার করে উঠলেন, অসম্ভব! আপনি কি পাগল হলেন, মিঃ রায়?
না, পাগল আমি হইনি।
একটা ভীষণ দুর্গন্ধে সেখানকার সমস্ত বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। একটা পচা গলা মৃতদেহ বাক্সের মধ্যে বীভৎস আকারে পড়ে আছে। কিন্তু বিকৃত হলেও বুঝতে কষ্ট হয় না যে, একটু আগে যে দেহটা ময়নাঘরে দেখে এলাম তার সঙ্গে এই মৃতদেহের খুব সামান্যই পার্থক্য আছে। হুবহু একেবারে মিল, যেন দুটি যমজ ভাই!
এই কি তবে বিশ্বাস করতে বলেন মিঃ রায় যে, মিঃ চৌধুরী বলতে লাগলেন, স্যার দিগেন্দ্র আসল শুভঙ্করকে হত্যা করে এইখানে তার মৃতদেহ লুকিয়ে রেখে এতদিন ধরে
আমারও যেন সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। আমি বললাম, তাহলে অন্য কেউ স্যার দিগেন্দ্রকে খুন করেছে এবং তারপর প্রফেসর শর্মাকে সে-ই খুন করেছে?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, চলুন, সব কথা এবারে খুলে বলব।-ওপরে চলুন।
আমরা সকলে ওপরে এসে শুভঙ্কর মিত্রের শয়নঘরে বসলাম। মাধব একটা টেবিলল্যাম্প জেলে দিয়ে গেল।
কিরীটী মাধবকে বললে, গাড়িতে আমার একটি অ্যাটাচি-কেস আছে, ড্রাইভারের কাছ থেকে সেটা নিয়ে এস তো মাধব।
মাধব কিরীটির নির্দেশ পালন করতে চলে গেল।
এবারে কিরীটী বলতে লাগল, আপনারা সকলে খুব আশ্চর্য হয়েছেন না? প্রথম থেকেই হত্যার ব্যাপারে আপনারা ভুল পথে ছুটে চলেছিলেন, কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন।
স্যার দিগেন্দ্ৰ কোন একটা কারণে শুভঙ্কর মিত্রের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। পাটনায় যখন আসল স্পোর্টসমান মিঃ শুভঙ্কর মিত্র ছিলেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে দিগেন্দ্রর কোন সূত্রে হয়তো আলাপ হয়। স্যার দিগেন্দ্ৰ অত্যন্ত চতুর এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অবিকল তার মত দেখতে এমন একটি লোককে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় মিঃ মিত্রের সঙ্গে তার বোধ হয় আলাপ-পরিচয় হয় এবং স্যার দিগেন্দ্ৰ লক্ষ্য করলেন মিঃ মিত্র অবিকল র্তারই মত দেখতে শুধু তাঁর নিজের নাকটা একটু ভোঁতা। আর মিঃ মিত্রের নাকটা চোখা। স্যার দিগেন্দ্রর ফ্রেঞ্চকটি কালো দাড়ি আছে, মিঃ মিত্রের তা নেই। নাকের খুঁতটা স্যার দিগেন্দ্ৰ ডাঃ রুদ্রের সাহায্যে অপারেশন করে ঠিক করে নিলেন এবং চেহারা বদলাবার আগে স্যার দিগেন্দ্রর পক্ষে মিঃ মিত্রের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তাঁর স্বভাব্যচরিত্র, ভাবগুলো অনুকরণ করে নিতে এতটুকুও বেগ পেতে হয় নি। কিন্তু এত করেও একটা জিনিস স্যার দিগেন্দ্রর চোখে ধরা পড়েনি, সেটা হচ্ছে মিঃ মিত্রের ডান কনের কাছে ছোট সিকি-ইঞ্চি পরিমাণ লাল জড়ুল-চিহ্ন। এই ঘরে মিঃ মিত্রের ফটো দেখে সেইটা আমার নজরে পড়ে, আমি তখনি মিলিয়ে দেখবার জন্য ময়নাঘরে ছুটে যাই। কিন্তু মৃত ব্যক্তির ডান ক্যানের নীচে কোন জড়ুল-চিহ্ন পাই না। এতেই বুঝলাম যে কুমারসাহেবের বাড়িতে যে খুন হয়েছে সে মিঃ মিত্ৰ নিশ্চয়ই নয়, জন্মের দাগ কখনও মিলায় না। তখন ভাবতে লাগলাম মৃতব্যক্তি যদি মিঃ মিত্ৰ নাই হয়, তবে আসল মিঃ মিত্ৰই বা কোথায় এবং এই মৃত ব্যক্তিই বা কে? এদিকে এই বাড়ির অস্ত্রঘরের সামনে গিয়ে দেখলাম, একটা দেওয়ালে নতুন চুনকাম করা হয়েছে। সন্দেহ হল সমস্ত দেওয়াল বাদ দিয়ে এক জায়গায় মাত্র চুনকাম করা হয়েছে কেন? তবে কি ঐ চুনকাম করা দেওয়ালের আড়ালে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে?
ভাবতে লাগলাম। এদিকে মিঃ মিত্র খুব ভাল হিন্দী জানতেন। অথচ স্যার দিগেন্দ্র হিন্দী জানতেন না। তিনি কয়েক মাস হয়তো পাটনায় থেকে কোন একজন মাস্টার রেখে হিন্দীটা আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন মাত্র, কিন্তু তাতে করে কাজ চললেও ছদ্মবেশের কাজ চালানো যায় না।
তবে কি হিন্দীভাষায় অনূদিত সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বইখানা তাঁরই? আমি এবারে উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ। কিরীটী আবার বলতে লাগল, এসব ছাড়াও তিনি নতুন করে আফিং খেতে শুরু করেছিলেন, কেননা মিঃ মিত্রের নাকি আফিংয়ের নেশা ছিল। তাছাড়া এই ঘটনা ঘটবার আগের দিন নকল মিঃ মিত্র ও কুমারসাহেব স্যার দিগেন্দ্রর বেনামীতে দুজনে দুখানা চিঠি পান। সে হাতের লেখাও মিলিয়ে দেখছি, সেই লেখা স্যার দিগেন্দ্রর হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। পুলিশের ফাইলে স্যার দিগেন্দ্রর হাতের লেখার নমুনা ছিল। সেই চিঠিগুলো একপ্রকার সবুজ কাগজে পেনসিল দিয়ে লেখা। পেনসিল পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পেনসিল সাধারণত চার শ্রেণীর হয়। কারবন’, ‘সিলিকেট’ ও ‘লোহা’ দিয়ে মিশিয়ে যে পেনসিলের সীসা তৈরী হয় তার লেখা সাধারণত ধূসর কালো রংয়ের হয়। গ্রাফাইট’, সিলিকেট’ ও ‘লোহা দিয়ে যে পেনসিলের সীসা তৈরী হয় তার লেখা সাধারণত বেশ ঘন কালো রংয়ের হয়। রংয়ের পেনসিলগুলো সাধারণত ওর সঙ্গে রং মিশিয়ে তৈরী হয়। আর কপিং পেনসিল তৈরী হয়। অ্যানিলিন রং’, ‘গ্রাফ্রাইটু ও কেওলিন দিয়ে। পেনসিল দিয়ে লেখা সেই চিঠিটার গায়ে ‘অ্যাসিটিক এসিডের’ ও ফেরোসায়োনাইডের একটা সলুশন ঢেলে দেওয়া হয়–তার ফলে লেখাগুলো একটা রাসায়নিক ক্রিয়ায় রঙীন হয়ে যায়। মাইক্রোসকোপ দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝতে পারা গেছে, ঐভাবে লেখা সাধারণত রঙীন হওয়া উচিত নয়। ঐ সলুশন দিয়ে এবং ঐ রং দেখেই আমরা ধরতে পেরেছি। কোন শ্রেণীর পেনসিল দিয়ে চিঠিটা লেখা হয়েছিল। বোঝা যায় লেখাটা কপিং পেনসিল দিয়েই লেখা হয়েছিল এবং সাধারণত এইচ. এইচ. কপিং পেনসিল দিয়ে লিখলে ঐ ধরনের লেখা হয়। সুব্রত, বোধ হয় মনে আছে, ঐ ধরনের একটা পেনসিল এ বাড়িতেই আমি পেয়েছি ডেস্কে, গতকাল বলেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, সেই পেনসিলটা দিয়েই ওই দুখানা চিঠি লেখা হয়েছিল।
এই পর্যন্ত বলে কিরীটী মাধবের আনীত অ্যাটাচি কেস থেকে সাত সমুদ্র তোরো নদীর পারে বইখানা বের করল। এই বইখানা নিয়ে মিঃ মিত্র প্রায়ই অরুণ করের সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং এই বইখানা কুমারসাহেবের খাবার ঘরে চেয়ারের ওপর পাওয়া যায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রথম পাতায় একটা নাম লেখা ছিল, তারপর রবার দিয়ে ঘষে সেটা তুলে ফেলা হয়েছে। আমরা এটারিও ফটোগ্রাফ নিয়ে পরীক্ষা করেছি। ফটো নেওয়া হয়েছিল ‘অরথোক্রোম্যাটিক প্লেটে’; একটা নেগেটিভ তোলা হয় এবং তাকে ছোট করে ‘পারক্লোরাইড অফ মারকারি’ দিয়ে জোরালো করা হয়। তারপর সেটা শুকোলে ফ্রেমে বসিয়ে তার সঙ্গে লাগিয়ে আর একটা প্লেটে ফটো নেওয়া হয়। এইভাবে প্রায় ছ-সাত বার ফটো নেওয়া। ফটোয় কি নাম পাওয়া গেছে দেখুন!
আমরা সকলে নেগেটিভের দিকে বিস্ময়ে হ্যাঁ হয়ে গেলাম! পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাতে লেখা—দিগেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। এরপরও অবিশ্বাস করা চলে না যে, স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণই স্বয়ং আমাদের ছদ্মবেশী মৃত মিঃ শুভঙ্কর মিত্র! তবে এখন প্রশ্ন ওঠে, আসল শুভঙ্কর মিত্র কোথায়? স্যার দিগেন্দ্র তাকে খুন করেন। কিন্তু কোথায় তবে মিঃ মিত্র খুন হলেন? বিকাশবাবু গত ডিসেম্বর মাসে পাটনা থেকে মিঃ শুভঙ্কর মিত্রকে পাঞ্জাব এক্সপ্রেসে ফিরে আসতে দেখেছিলেন। এবং পাটনা থেকে ফিরে এসেই কিছুদিন পরে মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্ৰ কুমারসাহেবের কাছে চাকরি নেন। তাহলে বোধ হয় ট্রেনের মধ্যেই স্যার দিগেন্দ্র কােজ সারেন এবং আসল মিঃ মিত্রের মৃতদেহটা খেলাধুলার সাজ-সরঞ্জাম রাখবার বড় বোক্সর মধ্যে ভরে সঙ্গে নিয়ে আসেন।
বিখ্যাত শিকারী ও স্পোর্টসম্যান হিসাবে মিঃ মিত্র সর্বত্রই সুপিরিচিত। অতএব বিনা হাঙ্গামায় বাক্সবন্ধ হতভাগ্য মিত্রের মৃতদেহটা নিয়ে আসতে তাঁকে এতটুকুও বেগ পেতে হয়নি। মৃতদেহ রাস্তায় ফেলতে পারেননি পাছে তাঁর প্ল্যান ভেস্তে যায়। মৃতদেহ সঙ্গে করেই এনেছেন। কিন্তু কোথায় রাখবেন—এই হল তাঁর সমস্যা। এইখানেই তিনি সব চাইতে বুদ্ধির খেলা দেখালেন, মিঃ মিত্রের মৃতদেহ মিঃ মিত্রের বাড়ীতে লুকিয়ে রাখলেন। এখানে এসেই আগে তিনি পুরাতন চাকরীদের বিদায় করে মাধবকে রাখলেন, পাছে তাকে কেউ সন্দেহ করে। তারপর এখানে এসে যখন তিনি মিঃ মিত্রের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে গেলেন তখন তিনি দেখলেন—সেদিনকার ঘটনা আমরা মিঃ চৌধুরীর মুখেই শুনেছি, কেননা মিঃ চৌধুরী সেদিন উপস্থিত ছিলেন, এবং সে রাত্রে প্রফেসর শর্মার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ মিঃ মিত্র কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ে যান তাও আমরা জানি। মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্র নিমেষে। বুঝতে পারলেন সে রাত্রে অসাধারণ চতুর আসল মিঃ মিত্রের শিশুকালের বন্ধু প্রফেসার শৰ্মার চোখে তিনি ধূলো দিতে পারেননি। তিনি তাকে চিনে ফেলেছেন। এখানে এসে অরুণ করের সঙ্গে আলাপ হয়ে স্যার দিগেন্দ্র ঠিক করেন অরুণের মাথায় হাত বুলিয়ে বেচারীর টাকা কটা বাগাতে হবে, কেননা মিঃ মিত্রের অনুসন্ধান নিয়ে দেখলেন মিঃ মিত্রের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। খুনের রাত্রে বোধ করি টাকার কথা বলবার জন্যই তাঁকে লুকিয়ে ওপরের ঘরে এসে দেখা করতে বলেন এবং টাকা ধারের কথা মিঃ চৌধুরীকেও বলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল আর একটা কোন জায়গা থেকে প্রচুর অর্থ নিয়ে এবং অরুণ কর ও হতভাগ্য মৃত মিঃ মিত্রের ঘরবাড়ি বন্ধক রেখে প্রভূত অর্থ নিয়ে এদেশ ছেড়ে চিরতরে চম্পট দেবেন।
মিঃ চৌধুরী কিরীটীর কথায় কেঁপে উঠলেন। কিরীটী বলতে লাগল, কিন্তু এর মধ্যে তার চাইতেও চতুর আর এক চতুর চূড়ামণি এসে দেখা দিলেন। তিনি হচ্ছেন আমাদের হতভাগ্য প্রফেসর শর্মা!
সেইজন্য প্রায়ই প্রফেসার শর্মা এখানে আসতে লাগলেন মৃতদেহের খোজে। কেননা তখনও তিনি বুঝতে পারেননি যে স্যার দিগেন্দ্ৰ মৃতদেহ কোথায় কী ভাবে লুকিয়ে রাখতে পারেন। একটু ভাবলেই বোঝা যায় এবং তাই ভেবেই হয়তো মিঃ শৰ্মা অনুমান করেছিলেন নিশ্চয়ই, এ বাড়িরই কোথায়ও তাঁর মৃতদেহ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, কেননা সেটাই হবে সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কোথায়? বাগানে? না, তাতে লোক-জানাজানি হবে। সবচাইতে ভাল হবে অস্তুগারে। কেননা সেটা সব চাইতে নির্জন।
মিঃ মিত্র যে আসল নয় জাল এবং খুঁজতে খুঁজতে অস্ত্ৰঘরেই যে সে লুকানো আছে প্রফেসর শর্মা এই ঠিক করলেন এবং দেখলেন এ মজাই হল—তিনি কোন কিছু না ভেঙে সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন, কেননা তাঁরও অবস্থা তখন চাকরিবাকরি না থাকার দরুন ‘অদ্যভক্ষো ধনুৰ্গণঃ’। তাছাড়া অরুণ করের টাকায় তাঁর মত একজন অতি বিলাসী লোকের চলাও সম্ভবপর ছিল না।
কিরীটী অল্পক্ষণের জন্য এবারে একটু থামল। তারপর সহসা চেয়ার ছেড়ে উঠে হাসতে হাসতে বললে, এবার চলুন বন্ধুরা, কুমারসাহেবের মার্বেল প্যালেসের দিকে যাওয়া যাক। অকুস্থানে বসেই আমার রহস্যের ওপর যবনিকা টানব।
তখুনি আমরা গাড়িতে চেপে রওনা হলাম। এবং রাত্রি প্রায় সোয়া বারোটায় আমরা সকলে বেহালায় কুমারসাহেবের মার্বেল প্যালেসের সামনে এসে নোমলাম। একটা সুমধুর হাওইন গিটারে সুরের আলাপ কানে ভেসে এল। চকিত অতীতের অন্ধকারে যেন আলোর রশ্মি এসে পড়ল। এই সুর কোথায় শুনেছি! এ যে বহুকালের চেনা! আশ্চর্য এত রাত্রেও নীচের হলঘরে আলো জ্বলছে দেখতে পেলাম।
ঘরে ঢুকে আরও আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
কুমারসাহেব!
অথচ শুনেছিলাম আজই বিকেলে যে, তিনি আজ দুপুরে মধুপুর চলে গেছেন।
একটা সোফার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে কুমারসাহেব হাওইন গিটার বাজাচ্ছেন।
কিরীটী ঘরে ঢুকেই উল্লাস ভরা কণ্ঠে বললে, শুভরাত্রি ডাঃ স্যান্যাল।
আমাদের এতগুলো লোককে এত রাত্রে ঘরে ঢুকতে দেখে বাজনোটা হাতেই কুমারসাহেব সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর সহসা কিরীটীর হাতের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন যেন।
হাত তুলুন! কিরীটীর গলা শুনে তার হাতের দিকে চেয়ে দেখি কিরীটীর হাতে চকচক করছে একটা রিভলবার।
সুব্রত, এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারের পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে নাও। আর এই নাও, এই সিন্ধা-কর্ডটা দিয়ে ওঁর হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে ফেলো।
আমি এগিয়ে গিয়ে কুমারসাহেবের পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে হাত দুটো কিরীটীর দেওয়া সিল্ক-কর্ড দিয়ে বেঁধে হোেললাম।
এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? ক্ষুঃস্বরে কুমারসাহেব বললেন।
বসুন আপনারা সবাই। শুনুন ডাক্তার সান্যাল ওরফে কালো ভ্রমর, ওরফে ছদ্মবেশী কুমারসাহেব। স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণ ও প্রফেসর শর্মার হত্যাপরাধে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করলাম। কিন্তু ডাক্তার, এতখানি জঘন্যতা আপনার কাছে আমি আশা করিনি কোন দিনও। বরাবর একটা শ্রদ্ধা আপনার ওপরে আমার ছিল। আপনারা হয়তো ভাবছেন ওঁকে আমি চিনলাম কী করে, না? মাত্র দুটি কারণে, এক নম্বর ওঁর হাতের লেখা দেখে, যার নমুনা এখনও আমার কাছে আছে। মনে পড়ে তোমাদের, মৃত স্যার দিগেন্দ্রর পকেটে হলুদে রংয়ের তুলট কাগজ গোটা দুই পাওয়া গিয়েছিল? এই দেখ সেই কাগজ। আর এই দেখ এতে ভ্রমর আঁকা। এই চিঠি পেয়েই গতরাত্রে মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্র ওঁকে চিনতে পারেন যে উনি কালো ভ্রমর।
উনি যে কুমার দীপেন্দ্র নন, স্যার দিগেন্দ্র প্রথম দর্শনেই তা টের পেয়েছিলেন, পাঁচ বছর আগে প্রথম যেদিন উনি ভাইপোর পরিচয়ে তার কাছে আসেন। কিন্তু তখন তিনি কোন কথা প্রকাশ করেননি। ইচ্ছা ছিল গোপনে একদিন তিনি একে শেষ করবেন, কিন্তু তার সে চেষ্টা নিস্ফল হয় এবং পাগলা গারদে তাকে যেতে হয়। এরই প্রচেষ্টায়। সেই থেকে তিনি উপায় খুঁজছিলেন কেমন করে সে অপমানের প্রতিশোধ নেবেন! তাঁর ইচ্ছা ছিল একে সরিয়ে টাকা হাতিয়ে সরে পড়বেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য র্তার, যে পরিচয়ে তিনি এখানে এসেছিলেন আমাদের তীক্ষ্ণবুদ্ধি অসাধারণ চতুর ও কৌশলী কালো ভ্রমরের চোখে তা ধরা পড়ে গেল। কিন্তু প্রফেসর শর্মাও এর আসল পরিচয় পাননি। তার ফলেই তিনি একে উৎসাহিত করেছিলেন মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্ৰকে হত্যা করবার জন্যে। তিনি স্যার দিগেন্দ্রর আসল পরিচয় এঁর কাছে বলেছিলেন; এবং এও তার ধারণা ছিল ইনি অর্থাৎ কুমারসাহেব নিজেও আসল কুমারসাহেব নন; এবং সে কথা এক দিগেন্দ্র ও প্রফেসর শর্মা ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু কেউই জানতেন না যে ইনি ছদ্মবেশী স্বয়ং কালো ভ্ৰমর। তাহলে হয়তো কেউ এতটা উৎসাহিত বোধ করতেন না। ভেবেছিলেন ইনি সামান্য একজন প্রতারক মাত্র। প্রফেসারের ইচ্ছা ছিল একে দিয়ে স্যার দিগেন্দ্রকে খুন করিয়ে একে হাতে রেখে যখন-তখন blackmail করে প্রচুর, অর্থলাভ করবেন, অথচ নিজে এর মধ্যে জড়াবেন না।
প্রথম থেকেই আমি জানতাম খুনী স্বয়ং কালো ভ্রমর। এবং তিনি ছদ্মবেশী কুমারসাহেব! কিন্তু সেই চিঠি থেকে প্রমাণ হল কী করে ইনি স্বয়ং কালো ভ্রমর! এর হাতের লেখা এদের স্টেটের ফাইলে পেয়েছি, তা ছাড়া গতকাল উনি যে কমিশনার সাহেবকে দশ হাজার টাকা পুরুস্কার ঘোষণা করে ফর্ম সই করে এসেছেন, সেই লেখার সঙ্গে কালো ভ্রমরের চিঠির হুবহু মিল হয়ে গেছে। উনি বর্ময় থাকতেই hashish সিগারেট খেতেন তা আমি জানতাম।
দু নম্বর কারণ সেই ছুরিটা, যেটা আমরা অরুণ করের বাগানে দেখি। সেটা বর্মী অস্ত্ৰ। সেখানকার লোকেরা ঐ ধরনের অস্ত্ৰ খুনখারাপি করতে ব্যবহার করে। কিন্তু কথা হচ্ছে, একে অপরাধী বলে মনে হল কেন? মনে আছে তোমাদের, মৃত স্যার দিগেন্দ্রর আঙুলের নখে একটা জিনিস পাওয়া গিয়েছিল, সে হচ্ছে কালো রংয়ের সার্জের প্যান্টের সুতো। সেই সুতো এর প্যান্টের কাপড়ের সুতোর সঙ্গে অবিকল মিলে গেছে। গতকাল উনি যখন প্রফেসর শর্মাকে খুন করে রক্তাক্ত জামা-কাপড়ে। এখানে ফিরে আসেন, সেই কেট-প্যান্ট উনি সরিয়ে ফেলবার অবকাশ পাননি। হরিচরণ ওঁর শয়ন ঘরের সোফার নীচে পেয়ে নিয়ে গেছে। ওঁর অবর্তমানে ম্যানেজারকে ঘুষ দিয়ে আজ দ্বিপ্রহরে এখানে এসে। সেই প্যান্টের সুতোর সঙ্গে মৃত স্যার দিগেন্দ্রর নখের মধ্যে আটকে ছিল যে সুতো দুটো অবিকল মিলে গেছে।
ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে ধরে জানা গেছে সে এই বাড়িতে একজনকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল কাল রাত্রে। তা ছাড়া সেই বাগানের ছুরিটার হাতলে যে আঙুলের ছাপ ছিল এবং এর আঙুলের ও কালো ভ্রমরের আঙুলের যে ছাপ আমার কাছে আছে, তার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। তাছাড়া তোমার মনে পড়ে সুব্রত, প্রফেসর শর্মাকে যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে, সে সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব নয়, ডাক্তার বলেই ওভাবে হত্যা করা এর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল! স্যার দিগেন্দ্ৰ যে মুহুর্তে চিনতে পেরেছিলেন তাঁর ভাইপো আসলে কে, তখনই তিনি প্রাণভয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ইনিও তখন বুঝতে পেরেছেন, জীবনে যে জঘন্য কাজ কোন দিনও করেননি। আজ তাই তাকে করতে হবে। স্যার দিগেন্দ্ৰ যদি একবার হাতের বাইরে চলে যান। তবে তাঁর পক্ষে এই ছদ্ম পরিচয়ে বাঁচা আর সম্ভব হবে না। তাই চির-জীবনের মত স্যার দিগেন্দ্রকে পথ থেকে সরিয়ে দেবার মনস্থ করেছিলেন। এইবার ডাক্তার সান্যাল দয়া করে বলুন, মিঃ মিত্ৰকে কিভাবে খুন করেছিলেন সে রাত্রে? কেননা ও ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।
ডাঃ সান্যাল মৃদু হাসলেন, চমৎকার বুদ্ধি আপনার মিঃ রায়! সম্পূর্ণ হার মানলাম আপনার বুদ্ধির কাছে। সত্যিই আমি কালো ভ্রমর, ডাঃ এস. সান্যাল। কুমারসাহেব আমি নই, কোনদিন ছিলামও না। আপনি অনেক কিছু জানেন বা জানতে পেরেছেন, কিন্তু একটা কথা এখনও জানেন না। সেটা হচ্ছে এই, দিগেন্দ্রর অতীত ইতিহাস। এই দিগেন্দ্র। এতকাল এই কলকাতায় থেকে আমারই দলে কাজ করত। সে ছিল আমার কলকাতার দলের প্রতিভূ। সেবার আপনাদের যখন আমি বর্ময় নিয়ে যাই, দিগেন্দ্র তখন সেখানে। সে-ই বনমালী বসু (‘কালো ভ্ৰমর’ দ্বিতীয় ভাগ দ্রষ্টব্য।—লেখক) নাম নিয়ে সনৎবাবুকে তঁদের আমহাস্ট স্ট্রীটের বাসা থেকে চুরি করে আনে। মৃত্যুগুহায়’ সে রাত্রে আমি একজাতীয় বুনো গাছের তৈরী ঔষধ শরীরে ফুটিয়ে পাঁচ ঘণ্টার জন্য অজ্ঞান থেকে আপনার হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টা পাই এবং আপনারা আমাকে ইরাবতাঁর জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসেন। আমার অন্যতম বিশ্বস্ত অনুচর রামু ইরাবতাঁর মধ্যেই খানিকটা দূরে নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছিল, আমায় তুলে বাঁচায় সে। আমার পরিধানে তখন ছিল রবারের পােশাক। তাই জলে ভেসেছিলাম, ড়ুবিনি। আর ঐ ঔষধটার এমন গুণ ছিল যে, জল মুখে ঢুকলে তার কাজ নষ্ট হয়ে যায়। আমি সব রকম কিছু ভেবে আগে থেকেই সে রাত্রে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম, সবই pre-arranged.
কয়েক দিন পরে একটু সুস্থ হয়ে ধনাগারে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি ধনাগার শূন্য, একটা কপর্দকও নেই। বর্ময় ফিরে এসে দেখি দিগেন্দ্ৰ উধাও। ব্যাপার সব বুঝলাম। প্রতিশোধের হিংসায় জ্বলে।পুড়ে মরতে লাগলুম। তারপর সেখান থেকেই দিগেন্দ্রকে একটা চিঠি দিই, ওই চিঠিটা এইজন্য দিয়েছিলাম, যাতে দিগেন্দ্ৰ জানতে পারে। আমি বেঁচে উঠেছি এবং ভয়ে ধনরত্নগুলো ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু he was clever, তাই চুপচাপ রয়ে গেল, আমার চিঠির কোন জবাবই দেওয়া প্রয়োজন বোধ করলে না।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে, আমরা পরের দিন ধনাগারে ধনরত্ন আনতে গিয়ে দেখি ধনাগার শূন্য, কিছুই নেই। কিরীটী বললে।
তখন ডাক্তার আবার বলতে লাগলেন, কিন্তু মুখ সে, তাই আমার কথায় কান দিল না। ওর সব ইতিহাস আমি জানতাম, সুতরাং ওর মৃত ভাইপের পরিচয়ে এখানে এসে ঢুকলাম। বুঝলাম ও আমায় সন্দেহ করেছে, এবং পরে টের পেলাম ও আমাকে মারবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু মারতে এসে একদিন সে ধরা পড়ে গেল, ও নিজেকে সাফাই করবার জন্য পাগলের ভান করলে। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।
ধরা পড়ল এবং ওকে গারদে পাঠালাম। কিন্তু আবার গারদ ভেঙে ও পালাল। খুন করা আমি চিরদিন ঘৃণা করি। কিন্তু নরাধম। আমাকে বাধ্য করলে ওকে খুন করতে। কিন্তু প্রফেসর শর্মা একদিন আমাকে এসে বললে মিঃ মিত্রের আসল পরিচয় কী। কিন্তু নির্বোধ জানত না। এ সংবাদ তার ঢের আগেই আমার জানা হয়ে গেছে। আমিও দেখলাম, ও যখন জেনেছে তখন ওকে বাদ দিয়ে কাজ করা তো চলবে না! এইখানেই আমার সব চাইতে বড় ভুল হল। মুর্থ আমাকে পেয়ে বসল। আমিও নিরুপায় হয়ে কিল খেয়ে কিল হজম করতে লাগলাম। প্রায়ই ও আমার কাছ থেকে টাকা নিত। কেননা আমি যে আসল কুমার নই সে ও টের পেয়েছিল। আসল কাজ হবে না ভেবে ওকে টাকা দিয়ে আমি নিরস্ত রেখেছিলাম। ভবিষ্যতে একদিন ওর পাওনা মেটাব বলে। প্রফেসার যখনই জানতে পারে আসল মিঃ মিত্র আমার সেক্রেটারী নয় এবং আসলে যে স্যার দিগেন্দ্র, তখন থেকেই সে উল্লাসে নাচতে লাগল। আমার জন্মোৎসবের রাত্ৰে সকলেই এখানে আমরা উপস্থিত, ছদ্মবেশী স্যার দিগেন্দ্র, আমি, প্রফেসর শর্মা।
এবার হয়েছে, আমাকে বলতে দিন ডাক্তার। কিরীটী সহসা বলে উঠল।
বলুন। ডাক্তার মৃদু হেসে জবাব দিলেন, কিন্তু হাতের বাঁধনটা খুলে দিতে বলুন। ভয় নেই, পালিয়ে বাঁচবার ইচ্ছা আর আমার নেই। পর পর দু-দুটো খুন করে এ জীবনে আমার ঘৃণা হয়ে গেছে। কুমারসাহেব ও আমার নিজের উপার্জিত সমস্ত সম্পত্তি আমি গতকালই উইল করে জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য দান করে দিয়েছি, আর তার অছি নিযুক্ত করেছি কাকে জানেন?
কিরীটী অধীর স্বরে বললে, কাকে?
আমার জীবনের সব চাইতে বড় শত্রু ও সবার বড় বন্ধু আপনাকে ও সুব্রতবাবুকে।
ধন্যবাদ ডাক্তার। কিরীটী বললে।
এর পর ডাক্তারের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। মূহুর্তকাল কিরীটী চুপ করে রইল। তারপর আবার ধীরস্বরে বলতে লাগল, তাহলে এঁদের কৌতূহলটা মিটিয়ে দিই। হ্যাঁ শুনুন আপনার সেক্রেটারী অর্থাৎ স্যার দিগেন্দ্ৰ ৮.৫৫ মিনিট পর্যন্ত আপনার খাবার ঘরেই ছিলেন। তারপর সেখান থেকে তিনি বের হয়ে আসেন বোধ করি ঠিক ৮.৫৫ মিনিটে এবং সাড়ে নটার সময় আমাদের ধারণা ও দেখা অনুসারে তিনি প্রাইভেট রুমে ঢোকেন। এই যে ৩৫ মিনিট সময়-এই সময়টা কেউ তাকে দেখতে পায়নি। এই সময় তিনি খাবার ঘর, ড্রইংরুম, হলঘর, শোবার ঘর, লাইব্রেরী ঘর বা নীচে বা সিঁড়িতে কোথাও ছিলেন না। তবে নিশ্চয়ই তিনি ঐ সময় আপনার প্রাইভেট রুমে ছিলেন এবং খাবার ঘর থেকে বের হয়ে সোজা তিনি ঐখানেই গিয়ে ঢুকেছিলেন।
এটাও ঠিক ডাক্তার যে, ৮.৫০-৮.৫২ মিনিটের সময় আপনার ম্যানেজারের সঙ্গে দোতালার সিঁড়িতে আপনার দেখা হয়। তাহলে নিশ্চয়ই ধরা যায় ঠিক ঐ সময়ই মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্র যখন আপনার খাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসেন, দোতলার হলঘরে আপনাদের দুজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কেমন কিনা, am I right?
হ্যাঁ, আপনার কথাই ঠিক মিঃ রায়। আমি সন্ধ্যার সময়েই ঠিক করেছিলাম মনে মনে, স্যার দিগেন্দ্রকে আজ শেষ করব। কেননা ও যা ভয়ানক লোক, সুযোগ পেলেই আমাকে অনায়াসে খুন করবে। তাই সন্ধ্যার অল্প পরেই আমার নিজ স্বাক্ষরে ওকে চিঠি দিলাম ঃ তোমার সময় উপস্থিত, আজই–প্রস্তুত থাক।-ইতি। ‘কালো ভ্রমর’। সারা বাড়িতে তখন উৎসবের হুল্লোড়ি; নটা বাজবার কয়েক মিনিট আগে ম্যানেজারের কাছ থেকে এসে hashish দিয়ে তৈরী কয়েকটা সিগারেট চেয়ে নিই। কেননা আপনি জানেন আমি বাড়িতে মরফিয়া ইনজেকশন নিতাম। এখানেও ওটা অভ্যাস করে ছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে মরফিয়া বন্ধ করবার জন্য অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ হত। রাতে ভালো ঘুম হত না। প্রফেসর শর্মাকে এ কাজে নিয়েছিলাম, কেননা দুজনে না হলে এতগুলো লোকের চোখে ধুলো দেওয়া যাবে। না। শৰ্মা আমায় বলে গেল, ওকে নিয়ে আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি। তুমি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর। যখন সে খাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসবে ওর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু সাবধান, তোমাকে যেন কেউ লক্ষ্য না করে।
৮.৫৫ মিঃ কি ৯টার সময় দিগেন্দ্ৰ খাবার ঘর থেকে বের হয়ে এল। ওপরের হলঘরে তখন বড় একটা কেউ ছিল না। যে দু-চারজন ছিল তারা তখন তাঁস খেলায় মত্ত। বাকি অভ্যাগতরা নীচের হলঘরে গান-বাজনায় জমে উঠে। প্রফেসার যখন খাবার ঘরে দিগেন্দ্রকে নিয়ে যায়, আমি সেই ফাকে এক সময় প্রাইভেট রুমে ঢুকে দেওয়াল থেকে তলোয়ারটাকে নামিয়ে সোফার ওপর গদির তলায় রেখে আসি। হলঘরে দাঁড়িয়ে আছি সিঁড়ির কোণায়। দিগেন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ওকে ইশারায় ডেকে প্রাইভেট রুমে গিয়ে ঢুকি, কেউ দেখেনি। আমার মুখে একটা জ্বলন্ত সিগারেট ছিল। একসময় দুজনে কথা বলতে বলতে টুপ করে সেটা মেঝোয় ফেলে দিই। ইচ্ছা করে। দিগেন্দ্র সেটা যেমন কুড়িয়ে নিতে নীচু হয়েছে, চক্ষের নিমেষে গদির তলা থেকে ভারী তলোয়ারটা টেনে নিয়ে তার গলা দু ভাগ করে দিই। তারপর মাথাটা নিয়ে মাঝখানে রেখে দিই। এখন বুঝতে পারছেন আপনারা, মৃতদেহের position ওরকম ছিল কোন!
তারপর ৯.১০ মিনিটের সময় আমি একটা চাদর জড়িয়ে ওঘর থেকে বের হয়ে সোজা শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকি। সেখানে দেড় থেকে দু মিনিটের মধ্যে পোষাক বদলে আপনাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি। আমি আগেই আপনাকে দিগেন্দ্রর লেখা চিঠি পাঠিয়ে এখানে এনেছিলাম। অত্যধিক অহঙ্কারেই ঐ কাজ করতে গিয়ে এইভাবে ধরা পড়লাম। নাহলে এ জগতে কারও সাধ্য ছিল না। আমাকে ধরে। কিন্তু শর্মাকে যখন বললাম। সে ভয়ে শিউরে উঠল। মনে মনে আমি হাসলাম এবং আমাদের পরামর্শমত ঠিক রাত্রি সাড়ে নটায় আমাদের চোখের সামনে দিয়েই শর্মা প্রাইভেট রুমে গিয়ে ঢুকলো। এবং ঠিক যখন প্রায় সে অদৃশ্য হয়েছে, তখন আপনার দৃষ্টি ওদিকে আকর্ষণ করলাম। এদিকে শর্মা ঘরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে হলঘরের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবার সময়ে খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চাকরীদের ডাকার ঘণ্টার দড়িটা টেনে, চকিতে খাবার ঘরের দরজার সামনে দিয়ে ঘুরে একেবারে আপনার হরিচরণের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে। বেয়ারাকে আগে থেকেই শর্মা ওঘরে যাবার জন্য বলে রেখেছিলর
কিন্তু মিঃ মিত্রের পকেট থেকে চাবিটা চুরি করেছিল কে?
আমি। আমিই খুন করে আসবার সময় নিয়ে আসি। শর্মা আমাকে এগুলো নিয়ে আসতে বলেছিল।
তারপর কী হয়েছিল সে চাবি নিয়ে জানেন?
হ্যাঁ, জানি। শর্মা ঐ রাত্রেই মিঃ মিত্রের ওখানে গিয়ে তার সমস্ত কাগজপত্র সরিয়ে ফেলে; আর তার ধারণা ছিল অস্ত্রঘরে আসল মিঃ মিত্রের মৃতদেহ লুকানো আছে, তাই সে অস্ত্ৰঘরের চাবি চুরি করে রেখেছিল।
প্রফেসারকে কেন সন্দেহ করেছিলাম সর্বপ্রথম জানেন ডাক্তার? উনি আমার লোক হরিচরণের কাছে সময়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন বলে। হরিচরণকে জিজ্ঞাসা করবার মানেই তার কাজের মিথ্যে সাফাই একটা রেখে দেওয়া। তাছাড়া আপনিই নিজে গিয়ে তিনতলায় অরুণের সঙ্গে ঐ ভাবে দেখা করেছিলেন।
হ্যাঁ, আমিই। আমার ইচ্ছা ছিল এতে যদি ভয় পেয়ে ও শর্মার মত লোকেদের পাপচক্রে আর না ভোলে। বড় ভাল ছেলেটি, দেখলে মায়া হয়।
হলঘরের ঘড়িতে ঢং ঢেং করে রাত্ৰি বারোটা ঘোষণা করল। এক ঝলক হাওয়া খোলা জানালা-পথে ঘরে এসে যেন সবার চোখে-মুখে শান্তির প্রলেপ দিয়ে গেল।
আমরা সকলে নিঃশব্দে বসে রইলাম।
হতভাগ্য শর্মাকে হয়তো আমি খুন করতাম না, কিন্তু ও আস্ফালন দেখালে, আমায় নাকি টিপে মারতে পারে; সে বিনিময়ে চার লক্ষ টাকা চায়। তার টাকার সাধা চিরতরে কাল অরুণ করের বাড়িতে মিটিয়ে এসেছি। ওদের মত জঘন্য প্রবৃত্তির লোক এ দুনিয়ায় যত কম থাকে ততই ভাল, তার জন্য আমি এতটুকুও অনুতপ্ত নই।
ডাক্তার সান্যাল চুপ করলেন।
হলঘরের ঘড়িতে ঢং ঢেং করে রাত্রি পাঁচটা ঘোঘণা করল।