ঘরটা অন্ধকার।
এখনও রাত্রি—বোধ করি আটটা হবে। দিনের বেলাতেও ডাঃ মনসিজ দাশগুপ্তের এই ঘরে আলো প্রবেশের কোন সম্ভাবনা নেই। সমস্ত জানালা দরজায় ভারী পর্দা ঝোলানো। পর্দার ওপাশে বাইরের কাঁচের শার্সিও বন্ধ। আলো তো নয়ই—শব্দও বড় একটা এ-ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে না। তা ছাড়া ঘরটা দোতলায়—নীচের রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচুতে। ঘরের এক কোণে দেওয়ালের গায়ে একটা ছোট্ট লাল ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছিল—আলোর চারপাশে অন্ধকার দেওয়ালে একটা ঝাপসা লাল আলোর ছায়াপথ যেন সৃষ্টি করেছে।
একটা হাইব্যাক চেয়ারের উপরে সেই অন্ধকার ঘরে বসেছিল গা এলিয়ে অনন্য। বয়স খুব বেশী নয়—চৌত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ হবে। মাঝারি সাইজ লম্বায়—বেশ বলিষ্ঠ গঠন, পরনে দামী একটা টেরিটের প্যান্ট ও গায়ে একটা টেরিলিনের হাওয়াই শার্ট। ডাঃ দাশগুপ্তের নির্দেশমতই অনন্য ঐ চেয়ারটার উপর বসে দূরের লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে ছিল। লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনন্যর দুচোখের পাতা যেন ভারী হয়ে বুজে আসতে চাইছিল। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। চোখ মেলে থাকতে পারছিল না অনন্য। অল্প দূরে একটা টুলের উপর বসে ডাঃ দাশগুপ্ত। কলকাতা শহরের নামকরা একজন মনোবিজ্ঞানী। নামের শেষে অনেকগুলো বিলাতী ডিগ্রীর লেজুড় আছে। বয়স প্রায় পঞ্চাশের মত, উঁচু লম্বা দেহের গঠন। ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। দৃঢ়বদ্ধ নাসা ও ওষ্ঠ। ধারালো চিবুক, বৃষ-স্কন্ধ। চওড়া বক্ষপট।
ডাঃ দাশগুপ্ত অনন্যকে প্রশ্ন করছিলেন, কেবল একটা কুয়াশা
হ্যাঁ—অনন্য জবাব দেয়, একটা কুয়াশা যেন আমার চারপাশে হঠাৎ এক সময় জমাট বেঁধে উঠতে থাকে—অনন্যর গলার স্বর যেন খুব ক্লান্ত। বলতে বলতে থেমে গেল।
বলুন তারপর—তারপর কি মনে হয় আপনার মিঃ বক্সী?
সেই কুয়াশাটা ক্রমশ জমাট ভারী হতে থাকে যেন সীসের মত। তারপরেই মনে হয় যেন। দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পাই–
কণ্ঠস্বর!
হ্যাঁ। সেই কণ্ঠস্বর যেন আমাকে কেবলই বলতে থাকে, যাও যাও—এগিয়ে যাও—কেমন যেন কথাগুলো বলতে বলতে হাঁপাতে থাকে অনন্য—আবার গলার স্বর বুজে আসে তার। ঝিমিয়ে আসে।
বলুন মিঃ বক্সী, থামলেন কেন-বলুন? থামবেন না।
আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি, দুকান বন্ধ করে থাকতে চাই—শুনবো না কিছুতেই শুনবো না আমি—কিন্তু পারি না—আমি উঠে পড়ি—সেই কণ্ঠস্বর আমাকে যেন সামনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়—
কোথায়?
উপরে ছাতের সিঁড়ির দিকে—
আপনি সিঁড়িতে ওঠেন?
হ্যাঁ, সেই সিঁড়ি চলে গেছে চারতলার ছাতে সোজা। আমিও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি পা ফেলে ফেলে। আর আমার সামনের সেই জমাট কুয়াশাটাও ঠিক হাত দুই তিন ব্যবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে আমার আগে আগে একটা কঠিন সংকেতের মত।
তারপর—বলুন–
একসময় চারতলার ছাতে গিয়ে উঠি—সেই কুয়াশা আর সেই কণ্ঠস্বর কখন যে আমাকে ছাতের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে যায়—জানতেও পারি না। হঠাৎ একসময় নজরে পড়ে
কি?
কুয়াশাটা যেন পাতলা হয়ে গিয়েছে—আর তার মধ্যে দুলছে আর দুলছে—
কি, কি দুলছে?
একটা পাকানো দড়ির ফাঁস—সেই ফাঁসটা–ফাঁসটা যেন আমার গলায় চেপে বসে আমার শ্বাসরোধ করেনা, না-হঠাৎ চিৎকার করে উঠল যেন অনন্য অন্ধকারের মধ্যেই, না–ঐ—ঐ যে সেই ফাঁসটা—
কোথায় কোথায় ফাঁস? চিৎকার করে ওঠেন ডাঃ দাশগুপ্ত।
ঐ—ঐ যে—দেখতে পাচ্ছেন না!
দপ্ করে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল—লাল আলোটা নিভে গেছে—উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে। কিছুই আর অস্পষ্ট নেই। সব স্পষ্ট তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল আলোয়।
ডাঃ দাশগুপ্ত দেখলেন অনন্য বক্সীর সারাটা দেহ তখনও কাঁপছে আর তার দুচোখের দৃষ্টিতে একটা আতঙ্ক—সারাটা কপাল জুড়ে ঐ শীতের রাত্রেও বিন্দু বিন্দু ঘাম।
মিঃ বক্সী–বক্সী, শুনছেন?
কে?
আমি ডাঃ দাশগুপ্ত–
অনন্য বক্সীর মুখের চেহারাটা একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসে। সুস্থ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকায় অনন্য বক্সী ডাঃ দাশগুপ্তের দিকে।
শুনুন মিঃ বক্সী, সবটাই আপনার মনের একটা ভ্রম। আমি বলছি, হ্যাঁ, ভ্রম—
ভ্রম?
হ্যাঁ—আমরা যাকে বলি হ্যালিউসিনেশন। সবটাই একটা, কল্পনা—বলতে পারেন একটা ড্রিম। ওর মধ্যে কোন সত্য নেই।
কল্পনা! হ্যাঁ কল্পনা। ড্রিম আপনার মনের সবটাই ড্রিম? হ্যাঁ, আপনার অবচেতন মনের একটা দুঃস্বপ্নই আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তবে সেই কুয়াশা, সেই কণ্ঠস্বর, চলমান কুয়াশা, সিঁড়ি ছাত ছাতের রেলিং—শুধু তাই নয় ডাঃ দাশগুপ্ত, ঐ সময় সেই কণ্ঠস্বর কেবলই যেন আমায় আমায় বলতে থাকে, ঝুলে পড়ো ঝুলে পড়ো-হ্যাঙ দাইসেলফ! হ্যাঙ হ্যাঙ
ওটাও আপনার একটা কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়—মনের বিকার। শুনুন, মনকে আপনার শক্ত করতে হবে। কিছু না—সব মিথ্যে। আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগাবার কথা ভাবেন—আত্মহত্যা করার কথা ভাবেন!
না, না, তা কেন ভাবব, কেন আমি আত্মহত্যা করব?
হয়ত—
কি?
আপনার মনের মধ্যে একটা দুঃখ আছে–কিছু না পাওয়ার ব্যথা আছে—
না, না—বিশ্বাস করুন ডাঃ দাশগুপ্ত, সেরকম কিছুই নেই–আমার স্ত্রী—সে আমায় ভালবাসে–
ঠিক আছে, একটা ওষুধ দিচ্ছি—রাত্রে শোবার আগে একটা করে ক্যাপসুল খেয়ে শোবেন।
ঘুমের ওষুধ?
হ্যাঁ।
ওতে কিছু হবে না ডাঃ দাশগুপ্ত—
কে বলল হবে না? ডাঃ দাশগুপ্ত বললেন।
হবে না আমি জানি। রাত ঠিক দুটোয় ঘুমটা আমার ভেঙে যায়—ওষুধ খেলেও এবং না খেলেও। ঘুমের ওষুধে কোন কাজ হবে না ডাঃ দাশগুপ্ত।
বেশ তো আপনি দেখুন না কটা দিন খেয়ে, আমি যে ওষুধ আপনাকে দিচ্ছি—
খেতে বলছেন খাব। কিন্তু আমি জানি কোন লাভ হবে না খেয়ে। অনন্যর কণ্ঠস্বরে কেমন। যেন একটা ক্লান্তি ও হতাশা।
চলুন বাইরের ঘরে যাওয়া যাক। ডাঃ দাশগুপ্ত চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন, আসুন—
ঐ ঘর থেকে দুজনে বের হয়ে এল।
একটা চেয়ারের উপরে চুপচাপ বসেছিল বিপাশা। অনন্যর স্ত্রী। চমৎকার সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী তরুণী, পাতলা ছিপছিপে গড়ন। পরনে একটা সাদা শাড়ি চওড়া জড়িপাড়-হাতে দু-গাছা করে সরু সোনার চুড়ি—গায়ে একটা স্কার্ফ জড়ানো।
বসুন মিঃ বক্সী—
ডাঃ দাশগুপ্তের নির্দেশে অনন্য তার স্ত্রীর পাশের খালি চেয়ারটার ওপর উপবেশন করল।
অনন্য বলল, এক গ্লাস জল পেতে পারি?
নিশ্চয়ই–বলে ডাঃ দাশগুপ্ত কলিংবেলটা টিপলেন। একজন বেয়ারা এসে ঘরে প্রবেশ করল। সুখলাল, এক গ্লাস পানি লাও–
সুখলাল ঘরের বাইরে চলে গেল।
বিপাশা ঐ সময় বলল, সব কিছু বলেছ তো ডাঃ দাশগুপ্তকে?
জবাব দিলেন ডাঃ দাশগুপ্তই বিপাশার প্রশ্নের, বললেন, হ্যাঁ।
ওর এমন কেন হয় ডাঃ দাশগুপ্ত? বিপাশা প্রশ্ন করে।
আপনাকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে মিসেস বক্সী।
বিপাশা ডাঃ দাশগুপ্তের মুখের দিকে তাকান, আমাকে!
হ্যাঁ।
বলুন–
আচ্ছা এ ধরনের মনের বিকারটা আপনি কতদিন লক্ষ্য করছেন আপনার স্বামীর মধ্যে মিসেস বক্সী?
মাস আষ্টেক ধরে। মানে বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই ওর ঐরকম হচ্ছে।
তার আগে ছিল না কিছু?
উনি তো বলেন ছিল না, বিপাশা বলল।
কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনাদের?
আট মাসের কিছু বেশী—
বিয়ের পর থেকেই তাহলে বলছেন?
কতকটা তাই–বিয়ের কুড়ি বাইশ দিন পর থেকেই–বিপাশা বলল।
সুখলাল ঐ সময় ট্রের ওপর জলভর্তি একটা কাঁচের গ্লাস হাতে ঘরে এসে ঢুকল।
অনন্য গ্লাসটা ট্রের ওপর থেকে তুলে নিয়ে চোঁ-চোঁ করে এক নিঃশ্বাসে জলটা খেয়ে নিল।
সুখলাল শূন্য গ্লাসটা নিয়ে ঘর থেকে বের করে গেল।
ডাঃ দাশগুপ্ত যেন কি ভাবছিলেন, অনন্যর দিকে আবার তাকালেন, অনন্যর মুখের উপরে যেন একটা ক্লান্তির হতাশার দুশ্চিন্তার ছায়া।
অনন্য কেমন যেন ঝিমানো গলায় বলল, প্রতিটি রাত যে আমার কাছে কি ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন বহন করে আনে—আপনাকে বোঝাতে পারব না ডাঃ দাশগুপ্ত। রাত্রি যেন আমার কাছে এক ভীতি!
বিয়ের আগে তাহলে আপনার ঐ দুঃস্বপ্নটা ছিল না মিঃ বক্সী!
কী বললেন? না, এমন স্পষ্ট ছিল না—
এখন যেরকম আপনার মনে হয়, বিয়ের আগে কখনও আপনার সেরকম মনে হয়নি?
একেবারে মনে হয়নি তা নয়, কদাচিৎ কখনও-সখনও হয়েছে—
আচ্ছা একটা কথা মিঃ বক্সী, কখনও কোন বিশেষ মুহূর্ত বা বিশেষ ঘটনা আপনার কি মনে পড়ে যার সঙ্গে মনের ঐ ব্যাপারটার কোন যোগাযোগ আছে বলে আপনার মনে হয়?
না, সেরকম কিছু মনে পড়ে না।
আপনি বলছিলেন, রাত ঠিক দুটোয় ঘুমটা আপনার ভেঙে যায়—
হ্যাঁ।
ঠিক আছে, ঐ সময় যাতে ঘুম না ভাঙে সেই ব্যবস্থা আমি করব—
আমি জানি ডাঃ দাশগুপ্ত, তা হবে না। যত চেষ্টাই আপনি করুন, রাত ঠিক দুটোয় ঘুম আমার ভেঙে যাবেই আমি জানি
সেরকম না হলেই তো হল!
পারবেন না—পারবেন না। অনেক ঘুমের ওষুধ দিয়ে আগেও অনেক ডাক্তার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেন নি। ডাঃ দাশগুপ্ত, একটা কথা কি জানেন?
কি?
আমি আর আমার জন্য ভাবি না—আর এও আমি জানি—
কি জানেন?
ঐ—ঐ ফাঁসটাই একদিন আমার গলায় চেপে বসবে, আমার শ্বাসরোধ করবে। যা হবার হোক, আমি আর ভাবতে পারি না—আপনি শুধু আমার স্ত্রী বিপাশাকে ওর মানসিক দুশ্চিন্তাটা যাতে যায় ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে তার একটা ব্যবস্থা করে দিন–
বিপাশা ঐ সময় বাধা দিয়ে বলে ওঠে, কেন, আমার কি হয়েছে? আমি তো সুস্থ স্বাভাবিক আছি।
না, তুমি নেই। ওর কথা বিশ্বাস করবেন না ডাঃ দাশগুপ্ত, আমার চিন্তায় ও সারারাত জেগে থাকে। আট মাস আগে ওর যা চেহারা ছিল, আজ তার আর কিছুই নেই। আট মাস আগে যারা
ওকে দেখেছে আজ তারা ওকে দেখলে বোধ হয় চিনতেও পারবে না।
না, না ডাঃ দাশগুপ্ত, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। বিপাশা, কেন তুমি অমন করছ, ওঁকে জানতে দাও তোমার কথাটা—ওঁর জানা দরকার
আমার কিছু হয়নি ডাঃ দাশগুপ্ত, আপনি ওকে সুস্থ করে দিন। বিয়ের আগে ও যেমন ছিল তেমনি করে দিন। ওর কষ্ট সত্যিই আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বিপাশার গলার স্বর যেন কান্নায় বুজে আসতে চায়।
ডাঃ দাশগুপ্ত বিপাশার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন—সত্যিই সুন্দর দেখতে ভদ্রমহিলা— কিন্তু তার সে সৌন্দর্য যেন মেঘে ঢাকা পড়েছে।
মিঃ বক্সী!
বলুন।
আপনি তো চাকরি করেন?
জবাব দিল বিপাশা, বলল, হ্যাঁ, উনি একটা ব্যাঙ্কের বড় অফিসার।
ডাঃ দাশগুপ্ত বললেন, তাহলে তো বেশ রেসপনসিবিল পোস্টেই আছেন উনি!
হ্যাঁ–বিপাশা বলল।
মিঃ বক্সী, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড—একটু পাশের ঘরে যাবেন, ওঁকে আলাদা ভাবে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
বেশ তো করুন। আমি যাচ্ছি।
অনন্য উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।
মিসেস বক্সী?
বলুন।
আমি কিছু প্রশ্ন আপনাকে করব, আপনি কিন্তু কিছু না লুকিয়ে আমার সব প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন—দেবেন তো?
দেব।
আপনাদের বিবাহিত জীবন কেমন?
আমরা খুব সুখী দম্পতি। উনি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন।
সেটা তো বুঝতেই পেরেছি। আচ্ছা বিয়ের আগে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ পরিচয় ছিল কি?
হ্যাঁ, ওকে আমি চার বছর ধরে জানি—
তার মানে আপনারা পরস্পর পরস্পরকে চার বছর ধরে জানেন?
হ্যাঁ।
খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল আপনাদের মধ্যে, তাই না?
তা ছিল বৈকি—
একটা অত্যন্ত ডেলিকেট প্রশ্ন করব—
বেশ তো করুন।
বিয়ের আগে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে মানে বুঝতেই পারছেন কি আমি জানতে চাই–
বুঝেছি–হ্যাঁ, আমরা তো জানতামই পরস্পর পরস্পরকে বিবাহ করব, তাই–কিন্তু তা হলেও আপনি যেটা মীন করছেন, দেহের দিক থেকে সেরকমের ঘনিষ্ঠতা কখনও আমাদের মধ্যে বিয়ের আগে হয়নি—
হয়নি?
না। ওর ধ্যান-ধারণাটা ঠিক আর দশজন পুরুষের মত নয়, ও বলত—
কি?
দেহের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে যে জানাজানি একজন পুরুষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যেও বলত, বিয়ের আগে সেটা কাম্য নয়, আনন্দেরও নয়—
কেন?
ওর ধারণা ছিল—তাহলে তো পরস্পর পরস্পরকে জানার আর কিছুই বাকি রইল না। দেহের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে যাবার মত বিয়ের আগে নির্বুদ্ধিতা নাকি আর কিছু নেই।
ডাঃ দাশগুপ্ত বিপাশার কথাগুলো শুনে মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এবং এবারে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিসেস বক্সী, ঐ মিঃ বক্সী ছাড়া আপনার আর কোন পুরুষ-বন্ধু মানে আর কারও সঙ্গে জানাশোনা ছিল না বিয়ের আগে?
হ্যাঁ, ছিল—
কে সে?
রজতশুভ্র–ভবানীপুরে আমাদের পাড়াতেই থাকত—তার সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি আমি একসময়।
অনন্যবাবু সেটা জানতেন?
জানতেন বৈকি।
রজতশুভ্রকে নিয়ে কোনদিন কোন কথা আপনার স্বামী বলেন নি?
না।
বুঝতে পারছি আপনার প্রতি অনন্যবাবুর বিশ্বাস খুব গভীর ছিল। আচ্ছা, আপনার স্বামীর আপনি ছাড়া অন্য কোন বান্ধবী ছিলেন?
বলতে পারব না।
মানে–জানেন না?
ছিল না বলেই আমার মনে হয়, আর থাকলে সেটা নিশ্চয়ই আমি জানতে পারতাম।
ওঁর আর কোন ভাই বোন আছেন?
না, বাপ-মায়ের ও একই ছেলে—
ওর মা-বাবা বেঁচে আছেন?
মা নেই আর ওর বাবা-মানে আমার শ্বশুরমশাই—বিপাশা হঠাৎ যেন থেমে গেল।
বলুন?
আমার শ্বশুরের মাথার গোলমাল আছে শুনেছি—
পাগল?
হ্যাঁ, রাঁচীতে মেন্টাল অ্যাসাইলামে আছেন—
কতদিন হবে?
শুনেছি আমার শাশুড়ির মৃত্যুর পরই ওঁর মাথার গোলমাল দেখা দেয়—একটা কথা আপনাকে বোধ হয় বলা আমার উচিত ডাঃ দাশগুপ্ত, আমার শাশুড়ির মৃত্যুর ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, যতদূর আমি শুনেছি–
কি হয়েছিল তাঁর–মানে কিসে মৃত্যু হয় আপনি নিশ্চয়ই জানেন!
বিশদভাবে ঠিক জানি না ব্যাপারটা–
জানেন না?
না। এইটুকু শুধু জানি—মানে ওর মুখেই একদিন শুনেছিলাম—বলতে বলতে বিপাশা যেন ইতস্তত করে থেমে যায়।
বলুন—থামবেন না!
আমার শাশুড়ির নাকি কি একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল।
দুর্ঘটনা!
হ্যাঁ। অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন নাকি আমার শাশুড়ি, ওর যখন বছর দশ এগারো বয়েস তিনি দুর্ঘটনায় মারা যান।
কি হয়েছিল ঠিক জানেন কিছু?
না।
আপনার স্বামীকে কথাটা কখনও জিজ্ঞাসা করেন নি?
না।
কেন?
কারণ বুঝতে পেরেছিলাম, মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুটা ওর মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আঘাত, হেনেছিল। তাই পারতপক্ষে ওর মার সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্নই আমি করিনি।
ডাঃ দাশগুপ্ত যেন কি ভাবছিলেন, আর কোন প্রশ্ন করলেন না।
বিপাশা প্রশ্ন করল, ডাঃ দাশগুপ্ত!
বলুন।
আমার স্বামী আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন তো?
মনে তো হয়—
মনে তো হয় বলছেন কেন?
কথাটা কি জানেন মিসেস বক্সী, ওঁর, মানে আপনার স্বামীর মনের মধ্যে কোন কিছুর প্রতিক্রিয়া খানিকটা কুয়াশার মত ঝাপসা হয়ে আছে—যে কুয়াশাটা উনি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, সেটার ঠিক ঠিক বিশ্লেষণে না পৌছানো পর্যন্ত—অবিশ্যি আমি চেষ্টা করব, যাতে উনি আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেন তবে আপনার স্বামীর কোঅপারেশন চাই সর্বাগ্রে এবং শুধু ওঁর নয়, আপনারও–
আমাকে কি করতে হবে বলুন?
কেসটা আমাকে একটু ভাবতে দিন মিসেস বক্সী, দিন পনেরো পরে আবার আসবেন আপনার স্বামীকে নিয়ে কিছুদিন পর পর আমি ওঁকে নিয়ে সিটিং দেবো!
আসব।
অতঃপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ডাঃ দাশগুপ্তর নিকট হতে বিদায় নিয়ে বিপাশা ওঁর ঘর থেকে বের হয়ে এল।
ওল্ড বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে একটা আটতলা ফ্ল্যাটবাড়ির পাশেই বক্সীর বাড়ি। চারতলা বাড়ি। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন অনন্য বক্সীর বাবার বাবা অরিন্দম বক্সী বার-এট-ল। অরিন্দম বক্সী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন নামজাদা ব্যারিস্টার। প্রচুর ইনকাম ছিল তাঁর। এক মেয়ে এক ছেলে—অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সী আর শ্রীমতী।
অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সীও বিলাত গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে, কিন্তু ব্যারিস্টার হয়েই ফিরে এসেছিলেন কয়েকটা বছর সেখানে স্ফুর্তি করে। অবিশ্যি ব্যারিস্টারি পাস করবার প্রয়োজনও ছিল না তার কারণ বাপের ঐ বাড়ি ছাড়াও প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ছিল এবং সেটা একজনের পক্ষে যথেষ্ট। অনন্যর মা প্রতিমা নামেও প্রতিমা ছিলেন, দেখতেও যেন প্রতিমার মত—যে কলেজে পড়তেন প্রতিমা, সেখানকার কলেজ-বিউটি ছিলেন তিনি।
অনিন্দ্য বক্সীর হবি ছিল গলফ আর পিংপংকলকাতা শহরের একটা নামজাদা ক্লাবের মেম্বার ছিলেন তিনি। অবিশ্যি সবই পরে ডাঃ দাশগুপ্ত একটু একটু করে প্রশ্ন করে করে অনন্য বক্সীর মুখ থেকেই শুনেছিলেন। আরও একটা ব্যাপার, অনিন্দ্য বক্সীর নেশা ছিল মদ্যপান। স্কচের একজন যাকে বলে কনোসিয়োর ছিলেন তিনি। বাড়ির মধ্যেই একটা বার তৈরি করেছিলেন। ক্লাবে তিনি কিন্তু মদ্যপান করতেন না—মদ্যপান করতেন গৃহে ফিরে। এবং একা নয়—সে সময় তার সঙ্গিনী হতেন তার স্ত্রী প্রতিমা। প্রতিমা অবিশ্যি দু-এক পেগের বেশী কোনদিনই পান করতেন না, কিন্তু মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চালিয়ে যেতেন অনিন্দ্য বক্সী।
ড্রাইভার রতন সিং গাড়ি চালাচ্ছিল।
পিছনের সীটে পাশাপাশি বসেছিল অনন্য আর বিপাশা। বিপাশার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে অন্ধকারে অনন্য বিপাশার সরু সরু নরম নরম আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করছিল নিঃশব্দে আপন মনে।
বিপাশা!
বল।
আমার এই ব্যাধি কি কোন দিনই সারবে না?
কেন সারবে না—ডাঃ দাশগুপ্ত অত বড় ডাক্তার—দেখো তুমি, ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে।
আচ্ছা উনি তো ঘুমের একটা ওষুধ দেবেন বলছিলেন—লিখে দিলেন না?
আমাকে বলে দিয়েছেন।
দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
ওষুধটা তাহলে দোকান থেকে নিয়ে নাও না।
দরকার হবে না আজই, আমাকে দুটো ক্যাপসুল দিয়ে দিয়েছেন–বলেছেন আজ আর কাল খাবার পর পরশু সকালে ফোনে জানাতে।
কিছুই হবে না—দেখো ঠিক রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে যাবে।
না, দেখো ভাঙবে না।
তুমি জান না বিপাশা—আমি জানি ঘুম ঠিক ভেঙে যাবে, আর সেই কুয়াশাটা চারপাশ থেকে অক্টোপাসের মত অষ্টবাহু মেলে আমাকে তার কুক্ষিগত করবে। তারপর সেই চাপা ফিসফিস কণ্ঠস্বর—যাও, যাও—এগিয়ে যাও–
না, কিছু আর হবে না দেখো, বিপাশা জোরগলায় যেন বলে কথাটা।
বিপাশা!
কি! একটা কথা এতদিন তোমায় কখনও বলিনি, আজ বলছি—
কি কথা?
আমি–আমিও বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বাবারই মত—
ছিঃ, কি আবোল-তাবোল চিন্তা কর বল তো!
আবোল-তাবোল নয়, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ধীরে ধীরে আমি সেই দিকেই এগিয়ে চলেছি—টু দ্যাট এন্ড–
ফের ঐসব আজেবাজে কথা যদি তুমি বল, আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।
রাগ করো না বিপাশা—আমার ওপরে তুমি রাগ করো না, তুমি রাগ করলে আমি কোথায় যাব!
কেন তুমি ঐসব তাহলে বল?
আর বলব না।
ওদের গাড়িটা একসময় এসে গেট দিয়ে ঢুকে পোর্টিকোর সামনে দাঁড়াল। দারোয়ান রামভরোসে এগিয়ে এল।
সাব—
কি হয়েছে?
একজন সাহেব সন্ধ্যের দিকে এসেছিলেন—
কে–কি নাম–কিছু বলেছে?
না। কেবল আপনার আর মাঈজীর খোঁজ করছিলেন—
বসতে বললি না কেন? অনন্য বলল।
বলেছিলাম কিন্তু বসলেন না, বললেন, আবার আসবেন।
অনন্য শুধায়, কিরকম দেখতে সাহেবকে?
খুব লম্বা-চওড়া চেহারা, চোখে চশমা, মুখে পাইপ—
ঠিক আছে, তুম গেট বন্ধ কর দো।
রামভরোসে চলে গেল সেলাম জানিয়ে।
ওদের আসার সাড়া পেয়ে পুরাতন ভৃত্য পরেশ এসে দরজা খুলে ইতিমধ্যে দাঁড়িয়েছিল।
দুজনে ভিতরে প্রবেশ করল।
চারতলা এই বিরাট বাড়িটায় স্বামী-স্ত্রী ছাড়া ঠাকুর-চাকর-আয়া জনা পাঁচেক ছিল। চাকরবাকরেরা নিচের তলাতেই কিছুটা অংশ অধিকার করে আছে। তাছাড়া নিচের তলায় বিরাট। একটা হলঘরের মত—তার এক পাশ দিয়েই চারতলা পর্যন্ত সিঁড়িটা উঠে গিয়েছে, হলঘরটার মধ্যে ঢুকলেই চারপাশে চোখে পড়ে স্টাফ করা কতকগুলো জন্তুজানোয়ার—বাঘ, রয়েল বেঙ্গল, চিতা আর শিংওয়ালা হরিণ। অরিন্দম বক্সীর শিকারের সখ যেমন ছিল, রাইফেল চালাতেও তেমনি ছিলেন তিনি সুদক্ষ। জীবনে অনেক শিকার করেছেন তিনি। আর তারই স্মৃতিচিহ্ন ঐ বাড়িটার মধ্যে চারিদিকে ছড়ানো। হঠাৎ ঐ হলঘরে, বিশেষ করে রাত্রিবেলা প্রবেশ করলে গা যেন কেমন ছমছম করে ওঠে। বিরাট বিরাট জানালাগুলো সব সময়ই প্রায় বন্ধ থাকায় দিনের বেলাতেও সেখানে একটা আলোছায়ার লুকোচুরি চলে যেন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে একটা চওড়া বারান্দা—তার সংলগ্ন পাশাপাশি খানচারেক বড় সাইজের ঘর এবং মধ্যে একটি হলঘর। ঐ দোতলার হলঘরটিই অরিন্দম বক্সীর পারলার ছিল। সেকেলে মেহগনি পালিশ সেগুন কাঠের ভারী ভারী সব ফার্নিচার বিরাট একটি টেবিল ডিম্বাকৃতি, ভারী ভারী খানকয়েক সেকেলে চেয়ার গদীমোড়া। তারই একপাশে অনন্য বক্সীর বাবা অনিন্দ্য বক্সী বার কাউন্টার তৈরি করেছিলেন। কাউন্টারের দুপাশে কাঁচের আলমারিতে এখনও কিছু বোতল সাজানো আছে—হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, শেরি, বার্গন্ডি।
অনিন্দ্য বক্সীকে রাঁচী মেনটাল হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পর থেকে ঐ আলমারি দুটো আর খোলা হয় না-চাবি দেওয়াই আছে। মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো। অনন্য ঐ ঘরে বড় একটা ঢোকে না—ঢোকবার তার প্রয়োজনও হয় না। পুরাতন ভৃত্য পরেশ প্রত্যহ ঐ ঘরটা ও ফার্নিচারগুলো ঝাড়পোঁচ করে, তাই সব ঝকঝক করে। অনন্য ও বিপাশার পিছনে পিছনে। পরেশও সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসে। দোতলায় খান-দুই ঘর নিয়ে স্বামী-স্ত্রী থাকে। একটা বেডরুম, অন্যটা তাদের সিটিংরুম। সিটিংরুমটা অনন্য আধুনিক কিছু ফার্নিচার কিনে সাজিয়ে নিয়েছিল। অন্য একটি ঘরে অনিন্দ্য লাইব্রেরি করেছিলেন। আলমারি ভর্তি সব দেশী-বিলাতী লেখকদের বই আর অনিন্দ্যর আইনের বই। ঐ লাইব্রেরি ঘরটাও বন্ধ থাকে সর্বদা। অন্য ঘরটিকে অনন্য ডাইনিংরুম করেছিল। তিনতলা ও চারতলার ঘরগুলো সবর্দা তালাবন্ধই থাকে। বিপাশা এ বাড়িতে আসবার পর মধ্যে মধ্যে ঘরগুলো খুলে ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখে পরেশকে দিয়ে। বাড়ির পশ্চাৎদিকে কিছুটা জমি আছে নানা গাছগাছালি আছে সেখানে। সামনের অংশে ছোট্ট একটি লন মত। সেখানেও কিছু ফুলের গাছ আছে—মালী নিতাই সব দেখাশুনা করে।
অনন্য ও বিপাশা এসে তাদের ঘরে ঢুকল।
পরেশ বললে, মা, গরম জল দেব কি বাবুর বাথরুমে?
বিপাশা বললে, হ্যাঁ, দাও।
ঐদিনই রাত্রির আহার শেষ করে অনন্য গিয়ে শয়নঘরের সংলগ্ন ব্যালকনিতে বসে ছিল একটা বেতের চেয়ারে। বিপাশা শাড়ি বদল করে সেখানে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়াল। মেন গেটের বাইরে সামনের রাস্তাটা ঐ ব্যালকনি থেকে অনেকটা চোখে পড়ে। রাত দশটা মত হবে—রাস্তার ইলেকট্রিক আললাগুলো দেখা যাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে একটা-আধটা গাড়ি এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে।
অনন্য অন্যমনে রাস্তার দিকে চেয়ে ছিল।
বিপাশা এসে স্বামীর কাঁধের উপর একখানি হাত রাখল।
বিপাশা!
শোবে না? বিপাশা শুধাল।
হ্যাঁ শোব, কিন্তু—
চল ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পড়বে চল।
আর একটু বসি। বোস না ঐ চেয়ারটায়।
বিপাশা স্বামীর পাশে বসল চেয়ারটা টেনে নিয়ে।
আচ্ছা বিপাশা, কে এসেছিল বল তো? অনন্য বলল হঠাৎ।
হয়ত তোমার চেনাশোনা কোন বন্ধু হবে—
বন্ধু বলতে তেমন আমার কেউ নেই, তুমি তো জান বিপাশা। আমি ভাবছি, তোমার কোন পরিচিত কেউ আসেনি তো!
আমার?
হ্যাঁ, তোমার—
আমারই বা তেমন কে আছে?
আচ্ছা বিপাশা–
কি?
বিয়ের আগে তোমার আমার সঙ্গে ছাড়া কারও সঙ্গে আলাপ ছিল না?
অন্ধকারে বিপাশা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, কি যেন মুহূর্তকাল ভাবল, তারপর বললে, সেরকম কেউ থাকলে কি তুমি জানতে না অনন্য?
বাঃ, সব কিছুই তোমার আমি জানি নাকি!
জান না?
না—আর তাই কি সম্ভব! তোমাদের বাড়ি ছিল ভবানীপুরে আর আমি থাকতাম এখানে এই বালীগঞ্জ সারকুলার রোডের বাড়িতে। তাছাড়া রোজ রোজ তোমার ওখানে যেতামও না। তোমাদের কলেজ ছিল কো-এড়ুকেশন—ছেলে-মেয়েরা সব একসঙ্গে পড়তে তোমরা কলেজলাইফে কারও সঙ্গে তোমার আলাপ পরিচয় হয়নি?
তা হবে না কেন!
তবে?
তবে সেরকম ঘনিষ্ঠতা একমাত্র তুমি ছাড়া কারও সঙ্গেই আমার হয়নি।
হয়নি না? ওঃ! অনন্য হঠাৎ চুপ করে যায়।
আশ্চর্য, অনন্য একটা কথা আজও বিপাশাকে বলতে পারেনি করতে পারেনি বিশেষ একটি প্রশ্ন—যে প্রশ্নটা বিবাহের পর থেকেই তার মনের মধ্যে উঁকি দিতে শুরু করেছে তার সঙ্গে বিপাশার যেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল, আর কারোর সঙ্গেই কি তেমনি ছিল না?
কলেজে লেখাপড়া করেছে বিপাশা আর তাদের বাড়িটাও ছিল রীতিমত আধুনিকভাবাপন্ন ছেলেমেয়েদের মেলামেশার অবাধ অধিকার ছিল। সেক্ষেত্রে আর কারও সঙ্গে বিপাশার আলাপ থাকাটাও খুব বিচিত্র নয়।
বিপাশাকে প্রশ্নটা করতে অনন্যর যেন কেমন সংকোচ হয়েছে। তাছাড়া মনের মধ্যে যে কথাটা আনাগোনা করছে—হঠাৎ ঐ ধরনের প্রশ্নটা তার মনের মধ্যে জাগছেই বা কেন ইদানীং? বিপাশাকে কি সে চেনে না, বিয়ের আগে ঐ প্রশ্নটা কোন দিনই তার মনে জাগেনিহঠাৎ বিয়ের কিছুদিন পর থেকে সে প্রশ্নটা তার মনের মধ্যে আসছেই বা কেন? বিব্রত বোধ করে অনন্য। রীতিমত যেন বিব্রত বোধ করে মধ্যে মধ্যে। অথচ ঐ চিন্তাটার হাত থেকে সে যেন নিষ্কৃতি পায় না—পাচ্ছে না কিছুতেই।
অনন্য!
বিপাশার ডাকে অনন্য ওর মুখের দিকে তাকাল।
গতমাসেও তুমি রাঁচী গেলে না, এ মাসেও এখন পর্যন্ত গেলে না একটিবার বাবাকে দেখতে–
ভাল আছেন খবর তো পেয়েছি, অনন্য বললে।
তাহলেও একটিবার যাওয়া তো উচিত!
জানি, কিন্তু–
কি?
ওখানে গেলে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই কেমন যেন একটা ভয়—
ভয় কিসের ভয়?
জানি না, কেমন যেন একটা ভয় একটা ক্লেদাক্ত ঠাণ্ডা সরীসৃপের মত আমার সর্বাঙ্গকে বেষ্টন করে ধরে
এসব কি বলছ তুমি অনন্য?
হ্যাঁ, তুমি জানতোমাকে কখনও আমি বলিনি–বাবার চোখ দুটো যেন মনে হয় সাপের চোখ, এমনভাবে উনি আমার দিকে চেয়ে থাকেন—আমি যেন কেমন সম্মোহিত হয়ে পড়ি।
কি যে তুমি আবোল-তাবোল বল না অনন্য!
অনন্য বিপাশার কথার কোন জবাব দেয় না।
তুমি বড্ড আজেবাজে চিন্তা কর অনন্য। ডাঃ দাশগুপ্ত বলছিলেন, শুনলে তোঐসব চিন্তা থেকেই তোমার মনে ঐসব জাগে!
জান বিপাশা–
কি?
কুয়াশার মধ্যে যে চাপা ফিস ফিস কণ্ঠস্বর আমি শুনতে পাই, ঠিক যেন মনে হয় বাবার গলার মত–
থাক ওসব বাজে কথা—
বাজে নয় বিপাশা, সত্যি মনে হয় যেন ঠিক বাবারই গলা শুনছি—তিনিই কথা বলছেন—
চল অনেক রাত হল, এবারে শোবে চল।
হ্যাঁ চল, অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে—
দুজনে এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল। বিপাশা ড্রয়ার খুলে একটা লাল রংয়ের ক্যাপসুল ও এক গ্লাস জল এনে দিল। বললে, নাও এটা খেয়ে শুয়ে পড় এবার।
হাত বাড়িয়ে ক্যাপসুলটা নিয়ে সেটা মুখে দিয়ে জল খেল অনন্য।
যাও এবারে শুয়ে পড়।
তুমি শোবে না?
আমার একটু কাজ আছে।
কি কাজ আবার তোমার এত রাত্রে?
বাঃ, তুমি জান না বুঝি—আমি রাত্রে শোবার আগে স্নান করি না!
স্নান?
হ্যাঁ।
রোজ স্নান কর?
করি তো।
অনন্য কিছুক্ষণ কেমন যেন চেয়ে থাকে বিপাশার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে।
কি দেখছ অমন করে আমার মুখের দিক চেয়ে?
কিছু না।
অনন্য এগিয়ে গিয়ে শয্যায় শুয়ে পড়ল।
ঘরের উজ্জ্বল আলোটা নিভিয়ে কম পাওয়ারের নীলাভ আলোটা জ্বেলে দিল বিপাশা। ঘরের মধ্যে যেন একটা নীলাভ প্রশান্তি নেমে আসে।
বিপাশা ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকল দরজাটা ভেজিয়ে দিল মাত্র ভিতর থেকে।
সত্যি রাত্রে শয়নের পূর্বে স্নান না করলে বিপাশার ঘুম আসে না। জামা কাপড় খুলে বিপাশা শাওয়ারের নিচে এসে দাঁড়াল।
অন্যমনস্ক ভাবে বিপাশা অনন্যর কথাই ভাবছিল তখনও।
আজ ঐ কথাগুলো বলল কেন অনন্য!
ঐ ধরনের কথা তো ইতিপূর্বে কখনও সে বলেনি! মনে হচ্ছিল অনন্যর কথাগুলো শুনে, তার মনের মধ্যে কোথায় যেন কিসের একটা সংশয় আছে, একটা সন্দেহ আছে। অনন্য কি তাকে সন্দেহ করে? আজ এত বছর এত ঘনিষ্ঠতার পর তার মনের মধ্যে সন্দেহ জাগল? অনন্য কি জানে না তার সমস্ত মন জুড়ে রয়েছে একজনই আর সে অনন্য। হ্যাঁ—অনেকের সঙ্গে হলেও কয়েকজনের সঙ্গে সে মিশেছে, তারা তাদের ভবানীপুরের বাড়িতে আসতও। বিশেষ করে একজন—রজতশুভ্র। মনের মধ্যে হাতড়াতে থাকে বিপাশা, রাজতশুভ্রের প্রতি তার কি। কোন দুর্বলতা ছিল কোন দিন? কই, মনে তো পড়ছে না। অবিশ্যি তার ওপরে রজতশুভ্রর যে দুর্বলতা ছিল সেটা সে বুঝতে পেরেছিল।
রজতশুভ্রর হাবভাবে কথায় বার্তায় সব সময়েই সেটা প্রকাশ হয়েই পড়ত—কিন্তু সতর্ক থাকত বিপাশা সর্বদা, রজতকে কখনও এতটুকু প্রশ্রয় দেয়নি। কথাটা কখনও তার মনেও হয়নি। রজতকেও সে-কথাটা জানিয়ে দিয়েছিল বিপাশা—অনন্যকে ভালবাসে সে, একদিন তাদের বিয়ে হবে। বিপাশার বাবা নিবারণ চক্রবর্তী ছিলেন অনিন্দ্য বক্সীর দীর্ঘকালের বন্ধু—সেই সূত্রেই দুই বাড়ির লোকেদের মধ্যে যাতায়াত ছিল। বিপাশার সঙ্গে ক্রমশ অনন্যর ঘনিষ্ঠতা যখন বেড়ে উঠতে থাকে—নিবারণ চক্রবর্তী কিন্তু একদিন মেয়েকে ডেকে একটা কথা বলেছিলেন। সেদিনের সেই কথাতেই বিপাশা বুঝতে পেরেছিল, অনন্যর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা নিবারণ চক্রবর্তী ঠিক পছন্দ করেন না।
খুকী, একটা কথা অনেকদিন থেকেই তোকে বলব বলব ভাবছি—
কি কথা বাবা?
তুই কি তোর মনস্থির করে ফেলেছিস?
কি বিষয়ে?
অনন্য সম্পর্কে?
হ্যাঁ, আমরা বিয়ে করব।
ঠিকই করে ফেলেছিস যখন—
কি তুমি বলতে চাও বল না বাবা?
না, থাক—
থাকবে কেন, বল?
ওর বাবা কেন পাগল হয়ে গেলেন জানিস?
না, ও কখনও বলেনি সেকথা আর আমিও জিজ্ঞাসা করি না।
জিজ্ঞাসা যখন করিস নি, থাক গে সেকথা—
বাবা!
কি রে?
তোমার কি ইচ্ছা নয় ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়?
ছেলের মত ছেলে ও, সব দিক দিয়েই সুপাত্র—
তবে?
নিবারণ চক্রবর্তী আর কোন কথা বলেন নি।
কথাটার ঐখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল।
আজ মনে পড়ছে বিপাশার, বিয়ের আগে অনন্য তার মায়ের মৃত্যুর কথাটা বলেছিল এবং বলেছিল একদিন কি, এক দুর্ঘটনায় নাকি তার মৃত্যু হয় তার বেশী সেও কিছু বলেনি, ও নিজেও জিজ্ঞাসা করেনি জিজ্ঞাসা করবার কথাও তার মনে হয়নি। কিন্তু আজ ডাঃ দাশগুপ্ত কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন কি দুর্ঘটনা। ডাঃ দাশগুপ্তের চেম্বার থেকে ফিরে আসা অবধি সেই কথাটাই কেন না জানি মনে হচ্ছে বিপাশার। কি এমন দুর্ঘটনায় তার শাশুড়ির মৃত্যু হয় আর কেনই বা স্ত্রীর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই অনিন্দ্য বক্সী—তার শ্বশুরের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটল? অনন্য তাকে একদিন কথায় কথায় বলেছিল, বাবা তার মাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন—সেরকম ভালবাসা নাকি সচরাচর বড় একটা দেখা যায় না, তাই তিনি স্ত্রীর অকালমৃত্যুর আঘাতটা সহ্য করতে পারেন নি এবং তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে!
অবিশ্বাস করবার মত কিছু নেই কথাটার মধ্যে–হতেও পারে অমন।
অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে বিপাশার যেন কেমন শীত-শীত বোধ হয়। বাথরুমে থেকে বের হয়ে এল বড় ভোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে। ঐ অবস্থাতেই শয্যার পাশে গিয়ে স্বামীকে লক্ষ্য করল—অনন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে কোন নতুন ঘুমের ওষুধ দেয়নি বিপাশা অনন্যকে, লিপাটন ক্যাপসুল একটা দিয়েছিল—ডাঃ দাশগুপ্তর পরামর্শ মতই ওষুধের নামটা বলেনি ওকে–ডাঃ দাশগুপ্ত যেমন বলে দিয়েছেন তেমনি বলেছে বিপাশা।
শাড়ি ব্লাউজ পরে বিপাশা এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। আবছা নীল আলোতেই সে চিরুনি দিয়ে চুলটা আঁচড়ায়, গায়ে একটু স্প্রে দিল।
ইদানীং রাত্রে বড় একটা ঘুমায় না বিপাশা। রাত দুটোর পরে ঠিক জেগে ওঠে, অনন্য–কয়েকদিন ঘুম-ঘুম চোখেই শয্যা থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে অনন্য ছাতে উঠে গিয়েছিল। ঐ সময়টা সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকে না ওর, তাই ডাক্তারের নির্দেশ ছিল বিপাশা যেন তার স্বামীকে যথাসম্ভব চোখে চোখে রাখে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে ওরা বন্ধ করেই শুত।
প্রথম যে-রাত্রে বিপাশা ব্যাপারটা জানতে পারে—হঠাৎ ওর ঘুমটা দরজার লক খোলার শব্দেই ভেঙে গিয়েছিল, ও দেখতে পায় অনন্য শয্যা থেকে নেমে দরজার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলছে; দরজা খুলতে দেখে ও প্রশ্ন করে, দরজা খুলে কোথায় যাচ্ছ অনন্য এত রাত্রে?
স্বামীর দিক থেকে কোন সাড়া এল না।
আবার ও বলে, কি হল, দরজা খুলছ কেন এত রাত্রে?
দ্বিতীয়বারেও স্বামীর দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ও সঙ্গে সঙ্গে শয্যা থেকে উঠে পড়ে, অনন্য ততক্ষণ দরজা খুলে বের হয়ে গিয়েছে ঘর থেকে।
বিপাশা রীতিমত বিস্মিত হয়। স্বামীর পিছনে পিছনে বিপাশাও ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
হাত পাঁচেক দূরে অনন্য।
অনন্য সিঁড়ির দিকে চলেছে এগিয়ে পায়ে পায়ে। কেমন যেন শ্লথ মন্থর গতি চলার। পা যেন ঠিক সমতালে পড়ছে না।
পিছন থেকে আবারও ডাকে বিপাশা, অনন্য-অনন্য!
অনন্য সাড়া দেয় না। অনন্য সোজা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে থাকে।
এত রাত্রে তিনতলায় কি করতে যাচ্ছে অনন্য? নিঃশব্দে অনুসরণ করে বিপাশা অনন্যকে।
অনন্য একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙেই চলেছে উপরের দিকে তিনতলা থেকে চারতলা তারপর ছাত। ছাতে পৌঁছে অনন্য সোজা রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে চলে।
রেলিংয়ের উপরে ভর দিয়ে অনন্য নিচের দিকে ঝুঁকে পড়তেই বিপাশা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অনন্যকে দুহাতে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, অনন্য?
অনন্যর শরীরে তখন যেন মত্ত হাতির শক্তি। দুহাতে প্রাণপণে বুকের ওপরে জাপটে ধরে বিপাশা চেঁচায়, অনন্য—অনন্য? কি–কি করছ–কি হয়েছে?
কে?
আমি—আমি বিপাশা।
বিপাশা!
হ্যাঁ!
ছাতে কেন?
তুমিই তো এলে। চল নিচে।
চল—
নিচে চলে আসে দুজনে।
খাটের ওপর বসে অনন্য। বলে, জল দাও।
এক গ্লাস জল পান করে একচুমুকে অনন্য যেন কতকটা সুস্থ হয়।
কি হয়েছিল—উপরে ছাতে গিয়েছিল কেন?
সেই কুয়াশাটা— কুয়াশা!
হ্যাঁ, সেই কুয়াশাটা যেন আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছিল—সেই দড়ির ফাঁসটা যেন আমার গলায় চেপে বসেছিল আর—সেই কণ্ঠস্বর আমাকে আমাকে বোধ হয় শেষ পর্যন্ত গলায় ফাঁস দিয়েই মরতে হবে বিপাশা–
সহসা দুহাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বিপাশা না, না—ওগো না।
সেই—সেই রাত্রির পর থেকেই বিপাশা রাত্রে ঘুমোয় না। সারাটা রাত জেগে থাকে। আর প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে সোজা সিঁড়ি বেয়ে অনন্য ছাতে চলে যায়-বিপাশা তখন ওর পিছনে পিছনে গিয়ে ধরে আনে। মাঝপথেও অনন্যকে ফিরিয়ে অনাবার চেষ্টা করেছে বিপাশা, কিন্তু পারেনিমত্ত হাতীর শক্তিতে যেন ঐ সময়টা বলীয়ান হয়ে ওঠে অনন্য—ঐ সময়টা অনন্যর কোন জ্ঞানই থাকে না যেন।
সেই থেকেই রাত জাগার অভ্যাস করেছিল বিপাশা। দিনে ঘুমোয় এবং রাত্রে জেগে থাকে। বিপাশা সর্বক্ষণ দুটি চক্ষু মেলে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হত—এখন আর হয় না। শেষরাত্রির। দিকে ঘুমায় বিপাশা।
স্বামীর দিকে আবার তাকাল বিপাশা। মনটা যেন তার কি এক মমতায় আপ্লুত হয়ে ওঠে। ঘুমোচ্ছে—গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অনন্য। পাখার হাওয়ায় মাথার চুলগুলো কপালের ওপর এসে পড়ছে। গভীর স্নেহে বিপাশা অনন্যর ললাটে একটি চুম্বন দিল—আলতো ফাঁক দুটি ওষ্ঠ ওর ললাট স্পর্শ করে। অনন্য জানে না যে বিপাশা ইদানীং সারাটা রাত জেগে অতন্দ্র দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের যে দরজাটা দক্ষিণের ব্যালকনির সঙ্গে সংযুক্ত সে দরজাটা খুলে রাখলে চমৎকার হাওয়া আসে ঘরে কিন্তু খুলে রাখে না বিপাশা দরজাটা—ঐ অনন্যর জন্যই। ঘড়ির দিকে তাকাল বিপাশা, রাত সাড়ে এগারোটা। দুটো বাজতে এখনও অনেক দেরি।
রাত দুটোর আগে অনন্যর ঘুম ভাঙবে না। বিপাশা বালকনির দরজাটা খুলে ব্যালকনিতে পা দিল। বিরাট একটা মাধবীলতার ঝাড় নিচ থেকে একেবারে ব্যালকনিতে এসে পড়েছে লতিয়ে।
ব্যালকনিতে পা দিতেই মৃদু একটা ফুলের সুবাস বিপাশার নাসারন্ধ্রে এসে ঝাপটা দেয়। সেই সঙ্গে এক ঝলক দক্ষিণের বাতাস যেন ওর সর্বাঙ্গে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্লান্ত দৃষ্টি তুলে বিপাশা তাকালো গেটের বাইরে রাস্তাটার দিকে।
মধ্যে মধ্যে রাত্রির ক্লান্ত মুহূর্তগুলি কাটাবার জন্য যখনই ও এসে ঐ ব্যালকনিতে দাঁড়ায়রাত্রির ঐ রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
গাড়ির চলাচল কমে যায়।
আজ ডাঃ দাশগুপ্তর কথাগুলো বিপাশার আবার মনে পড়ে। ডাঃ দাশগুপ্ত কেন ঐ প্রশ্নটা। করলেন—তারা বিবাহিত জীবনে সুখী কিনা। কেন মনে হল তার ঐ কথাটা? সত্যিই তো তাদের মত সুখী দম্পতিতার তো মনে হয় খুব কমই আছে। আরও জিজ্ঞাসা করছিলেন, ওদের বিবাহের আগে পরস্পরের মধ্যে আলাপ ছিল কিনা!
ওর বাবা নিবারণ চক্রবর্তীর অবিশ্যি এ বিবাহে খুব একটা মত ছিল না এবং সেটা তিনি প্রকাশও করেছিলেন তার কাছে, অনন্য তাকে বিবাহ-প্রস্তাব করবার পর। বলেছিলেন, খুকী, অনন্য আজ বলছিল সে তোকে বিবাহ করতে চায়—
তুমি কি বললে?
হ্যাঁ বা না কিছুই বলিনি। বলেছি—
কি বলেছ?
দুটো দিন ভাববার সময় চাই।
কেন ওকথা বললে?
আমার মনটা কেন জানি ঠিক পুরোপুরি সায় দিচ্ছে না মা এই বিবাহে।
কেন বাবা?
অনন্যর মাথার গোলমাল আছে, তা ছাড়া তার বাপেরও শুনেছি মাথায় বেশ ছি ছিল—
বাবা!
জেনেশুনে একটা পাগলের গুষ্ঠিতে—
অনন্য কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক—তুমি অমত কোরো না বাবা।
তুই সুখী হবি?
হ্যাঁ বাবা। রজতশুভ্র ছেলেটি—
না, বিয়ে করলে আমি অনন্যকেই করব—আর কাউকে নয়।
নিবারণ চক্রবর্তী অতঃপর আর অমত করেন নি। রজতশুভ্র-রজতশুভ্রর কথা আজ আবার মনে পড়ছে।
ছেলে হিসাবে রজতশুভ্র হয়ত অনন্যর চাইতে খারাপ ছিল না, বরং কোন কোন দিক ববেচনা করলে অনেক ভালই ছিল।
রজতশুভ্রকে বিপাশা পছন্দও করত। অনন্যর সঙ্গে আলাপ হবার অনেক আগে থাকতেই রজতশুভ্রর সঙ্গে বিপাশার আলাপ ছিল। একই পাড়ায় কাছাকাছি বাড়ি থাকায় আসা-যাওয়াও ফিল অনেক বেশী তাদের বাড়িতে রজতশুভ্রর।
অনন্য তাদের গৃহে প্রথম আসার দিনটি মনে পড়ল বিপাশার। তার বাবা সলিসিটার নিবারণ চক্রবর্তী ছিলেন অনিন্দ্য বক্সীর যাবতীয় ব্যবসা ও আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শদাতা। অনিন্দ্য বক্সীকে রাঁচীতে রেখে আসার বোধ হয় বছর খানেক পরে একদিন কতকগুলো আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ নেবার জন্যই অনন্য এসেছিল তাদের গৃহে। অনন্যকে সেইদিন সে প্রথম দেখে। অনন্য আর তার বাবা তার ঘরে বসে যখন কথাবার্তা বলছিলেন–কি একটা কাজে বিপাশা তার বাবার ঢুকতেই অনন্য তার দিকে তাকাল।
নিবারণ চক্রবর্তী প্রথমটা বুঝতে পারেন নি, কি একটা কথার জবাব না পেয়ে অনন্যর দিকে তাকাতেই নিবারণ চক্রবর্তী দেখতে পেলেন বিপাশাকে। নিবারণ চক্রবর্তী বললেন, অনন্য, এ আমার মেয়ে বিপাশা। ডিগ্রী কোর্সে থার্ড ইয়ারে পড়ে সামনের বার পরীক্ষা দেবে। খুকী, ওকে তুই দেখিস নি কখনও। আমার যে বন্ধুর কথা তোকে কতদিন বলেছি—অনিন্দ্য বক্সী, তারই ছেলে—একমাত্র ছেলে অনন্য বক্সী।
অনন্য তখনও বিপাশার দিকে চেয়ে ছিল।
পরে একদিন কথায় কথায় অনন্য বলেছিল, উভয়ের মধ্যে আলাপটা জমে ওঠার পর বিপাশার একটি প্রশ্নের জবাবে।
বিপাশা বলেছিল, আচ্ছা প্রথম দিন অমন নির্লজ্জের মত বাবার সামনেই আমার মুখের দিকে চেয়েছিলে কেন?
চেয়ে থাকব না—আমার প্রথম আবিষ্কার!
সে আবার কি? বিপাশা বলেছিল।
জান বিপাশা, তোমাকে দেখার আগে অনেক মেয়েকে দেখেছি—আলাপও হয়েছে, কিন্তু সেদিন তোমাকে দেখামাত্রই যেন মনে হয়েছিল–
কি মনে হয়েছিল?
এই সেই—আমার জীবনপাত্র যার আবির্ভাবে পূর্ণ হয়ে উঠবে, ধন্য হবে। এতদিনে তার দেখা পেলাম।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ বিপাশা, আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন বার বার সেদিন আমাকে বলতে লাগল, ও আমার ও আমার—ওকে না পেলে আমার সব মিথ্যা। আচ্ছা বিপাশা–
কি?
তোমার কিছুই মনে হয়নি—প্রথম দিন আমাকে দেখে?
না।
কিছুই মনে হয়নি?
তোমার দুচোখের মুগ্ধ দৃষ্টি কেবল—
আর কিছু না? সেই মুগ্ধ দৃষ্টির মধ্যে আর কিছু তুমি খুঁজে পাওনি?
বলতে পারেনি সেদিন বিপাশা এবং কেবল সেইদিনই কেন পরবর্তী কালেও কখনও বলতে পারেনি—তারও মন বলেছিল, কোথায় ছিলে এতদিন তুমি, আসোনি কেন? কেন এত দেরি করে এলে?
বিপাশা সেই প্রথম দিনে প্রথম দর্শনেই অনন্যকে ভালবেসেছিল।
অনন্য, তোমাকে আমি সেই প্রথম দেখার দিন থেকেই ভালবেসেছিলাম, বিপাশা বলেছিল। অনন্য খুব ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসত না, মধ্যে মধ্যে আসত আর আসত যখন তার বাবা নিবারণ চক্রবর্তী বাড়িতে থাকতেন না।
অনন্য যে তাদের বাড়িতে আসে রজতশুভ্রর দৃষ্টি এড়ায় নি এবং একদিন ও আর অনন্য যখন বসে গল্প করছে, হঠাৎ এসে ঘরে ঢুকল রজতশুভ্র। সন্ধ্যা নামছে, আলো নিভে আসছে, বাইরে দরজার গোড়ায় রজতশুভ্রর গলা শোনা গেল, বিপাশা! ডেকেই রজতশুভ্র ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল।
বিপাশা তাড়াতাড়ি উঠে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বেলে দেয়।
এঁকে তো চিনতে পারছি না! রজতশুভ্রর প্রশ্নের মধ্যে যেন একটা অসংশয়ের দাবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, চেয়ে আছে রজতশুভ্র অনন্যর দিকে।
ও অনন্য—অনন্য বক্সী!
দেখিনি তো ওকে আগে এ বাড়িতে কখনও?
বাবার বন্ধুর ছেলে–
হুঁ। বিপাশা, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল, রজতশুভ্র বললে।
বল না কি কথা–
রজত বিপাশার মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর বললে, ঠিক আছে, কাল সকালে একবার আমাদের বাড়িতে আসবে?
কাল সকালে কলেজ-ফাংশনের রিহার্সেল আছে–সময় হবে না। বিপাশা বললে।
কখন বেরুবে? রজতশুভ্রর প্রশ্ন।
সকাল আটটায়। বিপাশা বললে।
আচ্ছা চলি। রজতশুভ্র ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
অনন্য বললে, তোমাদের কলেজের ফাংশন কবে বিপাশা?
সামনের শনিবার, বিপাশা বললে।
আমায় নিমন্ত্রণ করবে না?
তুমি যদি আমার অভিনয় দেখে হাসো? বিপাশা মৃদু হেসে বললে।
অভিনয় করকে তুমি?
হ্যাঁ, অভিজ্ঞানশকুন্তলম নাটক—
তুমি নিশ্চয়ই শকুন্তলা!
কি করে বুঝলে?
বিপাশার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনন্য বললে, আমাকে কিন্তু একটা কার্ড দিয়ে আর টিকিট যদি হয় তো টিকিট কাটব।
টিকিট কাটতে হবে না। কার্ড দেব তোমাকে আমি।
অনন্য উঠে পড়ে। বললে, আজ চলি।
অনন্য কিন্তু রজত সম্পর্কে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেনি। রজতশুভ্র কিন্তু করেছিল দিন দুই পরেই দেখা হতে, খুব বড়লোকের ছেলে বুঝি!
কে? কার কথা বলছ?
ঐ যে অনন্য বক্সী না কে!
তা ঠিক জানি না, তবে শুনেছি ওর ঠাকুর্দা খুব বড় একজন ব্যারিস্টার ছিলেন, প্রচুর ইনকাম। ছিল তার, বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে বিরাট বাড়ি।
প্রায়ই যাও সেখানে—তাই না?
এখনও যাইনি। শান্ত গলায় বললে বিপাশা।
কেন, অনন্য বক্সী যাবার কথা বলেননি তোমাকে?
না।
যাক শোন, একটা কথা কয়েকদিন থেকেই তোমাকে বলব বলব ভাবছিলাম—
কি কথা?
আমাদের ব্যাপারটা এবারে পাকা করে ফেলতে চাই। আমি আর্মিতে জয়েন করছি, তাই ব্যাপারটা–
আমাদের ব্যাপার!
হ্যাঁ, বিয়ের ব্যাপারটা–
বিয়ে!
তুমি যেন আকাশ থেকে পড়লে বিপাশা?
কতকটা তাই–
কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে রজতশুভ্র বললে, যাক গে, এখন মাটিতে পা দিলে—এবার। জবাব দাও আমার কথাটার
কিসের জবাব—কোন কথার?
তোমার বাবার সঙ্গে ভাবছি দেখা করে বলব, কিন্তু তার আগে তোমারও জানা দরকার, তাই
না–
বিপাশা!
হ্যাঁ, বিয়ের কথা আমি এখনও ভাবিনি রজত!
তাইনা আমাকে বিয়ে করতে তোমার অমত?
রজত, ওসব কথা থাক। কথাটা এখানেই থামিয়ে দেবার চেষ্টা করে বিপাশা।
বিপাশা, কথাটা আমার জানা আজ দরকার।
তোমাকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেই পারছি না।
ভাবতেই পারছ না কেন, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
কেন আবার কিভাবতে পারছি না তাই বললাম—
অনন্য বক্সীকেই তাহলে তুমি বিয়ে করবে?
ওসব কথা আমাদের মধ্যে কখনও হয়নি আজ পর্যন্ত।
আমি কি তোমার অযোগ্য?
সেকথাও আমি বলিনি—
তবে?
রজত, আমার যা বলার ছিল আমি বলেছি—আর কিছুই আমার বলবার নেই।
কিন্তু আমি কথাটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না!
রজত, বন্ধুর মত এখানে আসতে পার তো এস, না হলে–
না হলে?
এস না।
তুমি বোধ হয় ভুল করলে বিপাশা—
ভাববার সময় তুমিও পাবে—আমিও পাব–কাজেই কার ভুল সেটা ধরা পড়বেই একদিন!
বেশ।
অতঃপর রজতশুভ্র চলে গিয়েছিল। পনেরো দিন আর আসেনি।
এবং ঐ পনেরো দিনে বিপাশার একবারও রজতশুভ্রর কথা মনে হয়নি।
দেখা হল আরও মাসখানেক পরে।
সেদিনটা আরও বিপাশার বিশেষ করে মনে আছে এই জন্য যে ঠিক ঐদিনই সন্ধ্যার কিছু আগে এসে অনন্য বলেছিল, একটা কথা বলব ভাবছি বিপাশা তোমাকে কয়েকদিন থেকেই–
বিপাশা কয়েকটা মুহূর্ত অনন্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপরই মৃদু হেবে বলে, কি কথা?
অনন্য ইতিপূর্বে যা কোন দিনই করেনি, ওর কাছেও খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে আসেনি এবং স্পর্শও করেনি—তাই করল। ও যে সোফাটায় বসেছিল অনন্য ঠিক তার পাশেই সোফাটার উপর এসে ওর একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে মৃদু কোমল কণ্ঠে বললে, কথাটা কিন্তু কিছু নতুন নয় বিপাশা।
নতুন নয়!
না, বহু পুরাতন এবং বহুবার ইতিপূর্বে বহু পুরুষ বহু নারীর সামনে উচ্চারণ করেছে কথাটা–
অনন্যর কথার ধরন ঐরকমই ছিল।
মৃদু হেসে বিপাশা বললে, তবু শুনি সেই বহু পুরাতন কথাটাই না হয়!
তোমাকে আমি ভালবাসি—
তাই বুঝি! তা কবে থেকে বুঝলে? পালটা হেসে বিপাশা প্রশ্ন করে।
কোন নির্দিষ্ট দিনে নয়—
তবে?
দিনে দিনে বুঝেছি, সমস্ত হৃদয় দিয়ে আমার বুঝেছি, আচ্ছা বিপাশা, তুমি?
কি, আমি?
তুমিও কি—
সেটা আজও যদি বুঝতে না পেরে থাক তাহলে আমার মুখের কথাটা শুনেই কি আর বুঝতে পারবে?
যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।
ভয় ছিল বুঝি?
না ভয় নয়—
তবে?
একটা ভীরু সংশয় ছিল—
এখন আর নেই তো?
না, আর সেইজন্যেই সাহস করে এতদিন তোমার কাছে উচ্চারণ করতে গিয়েও উচ্চারণ করতে পারিনি।
অনন্য বিপাশার আঙুলগুলো নিজের আঙুলের মধ্যে নিয়ে খেলা করছিল—বিপাশা বলল, কিন্তু বাবাকে কথাটা জানাতে হবে তো–
তা তো হবেই, আর আশঙ্কা সেখানেও একটা আছে—
আশঙ্কা!
হ্যাঁ, নিবারণ কাকা যদি না বলেন?
তা বললেই বা—
সত্যিই বলছ বিপাশা?
হুঁ।
আজ তাহলে আমি চলি।
অনন্য বিপাশার হাতের মুঠোয় মৃদু একটা চাপ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। বিপাশা কিন্তু যেমন বসেছিল তেমনিই সোফাটার উপর বসে রইল, এবং কতক্ষণ যে ঐভাবে বসে ছিল তার খেয়াল নেই, হঠাৎ রজতশুভ্রর কণ্ঠস্বরে তার চমক ভাঙল—যাক, একাই আছ তাহলে? আমি ভেবেছিলাম হয়ত–
এতদিন যে আসনি রজত! বিপাশা বললে।
বাঃ, সেদিন বলে গেলাম না—তোমাকে ভাববার সময় দিয়ে যাচ্ছি! রজতশুভ্র এসে সোফায় বিপাশার পাশে বসল, তারপর, মতি স্থির করেছ তো?
মতি স্থির আমার অনেক দিন আগেই হয়ে গিয়েছে–
অনেক দিন–কবে?
অনেক দিন আগে।
তাহলে কালই আমি তোমার বাবার কাছে কথাটা বলি? পরশু আমি ট্রেনিংয়ে যাচ্ছি—ফিরব। দুমাস বাদে, তারপর–
তুমি আর্মিতে জয়েন করলে?
হ্যাঁ কমিশনড অফিসার—সেকেন্ড লেফটেনান্ট হয়ে।
তা আর্মিতে গেলে কেন?
আর্মিতে ঢোকবার আমার বরাবরের ইচ্ছা তুমি তো জানতে বিপাশা। ওসব কথা থাক তাহলে কালই তোমার বাবাকে বলতে বলি কথাটা আমার বাবাকে?
আমার জবাব তো সেদিনই তোমাকে দিয়ে দিয়েছি আমি—
সে মত তোমার তাহলে এখনও বদলায়নি?
না।
অনন্য বক্সীকেই তাহলে তুমি বিয়ে করছ?
হ্যাঁ।
বিয়ের দিনটাও বোধ হয় ঠিক হয়ে গিয়েছে।
এখনও হয়নি।
একটা কথা বোধ হয় তুমি জান না—অনন্য বক্সীর বাবা পাগল, রাঁচির পাগলা গারদে আজ অনেক বছর ধরে আছেন।
জানি।
জান?
হ্যাঁ, অনন্যই তা আমায় বলেছে—
লোকে কি বলে জান?
লোকে তো লোকের সম্পর্কে অনেক কথাই বলে—সব শুনতে গেলে কি চলে?
অনন্য বক্সীর মায়ের কিসে মৃত্যু হয়েছিল বোধ হয় তুমি জান না—
জানব না কেন? একটা দুর্ঘটনায়—
সে দুর্ঘটনাটা হচ্ছে—ওর বাবা ওর মাকে হত্যা করেছিল!
না, না, এ মিথ্যে কথা–
অনন্য বক্সীকেই জিজ্ঞাসা করে দেখো কথাটা সত্যি কি মিথ্যে! যাক গে আমি যাচ্ছি, আর যাবার আগে একটা কথা বলে যাই—আমি তোমাকে ভুলতে পারব না। আর অন্যের অঙ্কশায়িনী তুমি হলেও প্রতি মুহূর্তে আমার মনে পড়বে—অন্য এক পুরুষ জোর করে তোমার ওপর বলাৎকার করছে, তোমাকে রেপ করছে।
কথাগুলো বলে রজতশুভ্র ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সেদিনকার রজতশুভ্রর সেই কথাগুলোর সঙ্গে কি অপরিসীম ঘৃণা আর আক্রোশ যে জড়িয়ে ছিল, সেটা কি বিপাশা বুঝতে পারেনি?
পেরেছিল। আর তাই যেন সে একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল।
কথাটা আজও ভুলতে পারেনি বিপাশা—আর সেই কথাটাই যেন আজ বিপাশার মনে পড়েছিল ডাঃ দাশগুপ্তের চেম্বারে বসে তার কথার উত্তর দিতে দিতে হঠাৎ রজতশুভ্রর কথাটা বলতে গিয়ে।
ঐ সঙ্গে বিপাশা বলে এসেছে, কি একটা দুর্ঘটনায় অনন্যর মার, মৃত্যুর কিছুদিন পরেই অনন্যর বাবার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে।
ডাঃ দাশগুপ্ত কি দুর্ঘটনা জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছে সে জানে না।
রজতশুভ্রর মুখে সেদিন সেই কথাটা শোনবার পর বিপাশার বহুবার মনে হয়েছে, অনন্যকে সে কথাটা জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু পারেনি।
একটা সংকোচ—যেন একটা দ্বিধা বার বার তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। সে আজও আশা করে আছে অনন্যই একদিন তাকে মার সব কথা বলবে। কি দুর্ঘটনা হয়েছিল কিভাবে সত্যি সত্যি তার মৃত্যু হয়েছে—আর অনন্য যে বলবেই সে বিষয়েও সে স্থিরনিশ্চিত।
বাইরে আকাশে মেঘ করছে হয়ত বৃষ্টি নামবে। একপশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না। বিশ্রী গুমোট চলেছে কদিন ধরে।
একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া বিপাশার চোখেমুখে এসে ঝাপটা দেয়—মনে হয় তার দূরে বোধ হয় কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। বিপাশা বারান্দা থেকে ভিতরে চলে এল ঘরে। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে দিল। মৃদু নীলাভ আলোয় শয্যায় নিদ্রিত স্বামীর মুখের দিকে তাকাল বিপাশা। অনন্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
এমনি করে যদি ও ঘুমোতে পারে, যদি ওর ঘুম আজ অন্যান্য রাত্রের মত না। ভাঙে-ভগবান তাই করো, তাই করো–
পায়ে পায়ে শয্যার একেবারে নিকটে এগিয়ে এল।
হঠাৎ অনন্যর ঘুম ভেঙে যায়—ঢং ঢং করে ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে রাত্রি দুটো ঘোষিত হল। চমকে ওঠে বিপাশা।
অনন্য শয্যা থেকে নামছে বিপাশা বুঝতে পারে ওর দিকে তাকিয়েই, অনন্যর চোখে ঘুমের ঘোর—ডাঃ দাশগুপ্তের পরামর্শমতই বিপাশা অন্যান্য রাত্রের মত প্রথমটায় নীরব সাক্ষীমাত্র না থেকে দুহাতে ওর একটা হাত চেপে ধরে বললে, কি কি হল অনন্য—অনন্য, ঘুম থেকে উঠে বসলে কেন অনন্য—অনন্য
ঝাঁকুনি দেয় বিপাশা স্বামীকে একটা।
আঃ—
অনন্য!
আঃ ছাড়—বিশ্বাস করি না আমি—সব—সব সমান–
কার কথা বলছ—কি বলছ?
কে?
আমি—আমি বিপাশা—
বিপাশা! কেমন বিস্ময়ের সঙ্গে অনন্য বিপাশার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বিপাশা—
এত রাত্রে তুমি–তুমি এখনও ঘুমাওনি?
না। কেন, ঘুমোও নি কেন—ঘুমোও নি কেন বিপাশা?
তুমি শুয়ে পড়ো, রাত এখনও অনেক আছে
তুমি জেগে আছ কেন এখনও? গলার স্বরটা যেন অনন্যর কেমন, প্রশ্নের ভঙ্গিটা যেন কেমন–বিপাশার মনে হয় যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়। বিপাশা ভাবে, হয়ত ঘুমের ঘোর এখনও ভাল করে কাটেনি।
অনন্য, শোও—শুয়ে পড়া। বিপাশা আবার বললে।
না। তুমি জেগে আছ কেন বিপাশা এত রাত্রেও তা তোকই বললে না। অনন্য আবার প্রশ্ন করল।
বিপাশা ভাবল একবার বলে, আমি তো আজকাল রোজ রাত্রেই এমনি করে জেগে থাকি–কিন্তু কথাটা বলল না বিপাশা, বললে, ঘুম আসছে না তাই–
ঘুম আসছে না, না—
বাঃ, ঘুম না আসলে কি করব?
কোথায় ছিলে?
কেন?
তাই জিজ্ঞাসা করছি—কোথায় ছিলে, এই ঘরে?
ব্যালকনিতে বসেছিলাম—
কটা রাত?
একটু আগে রাত দুটো বাজল।
অনন্য কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে বিপাশার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তারপর বলে, আমি, ঘুমোচ্ছিলাম
জানি।
আচ্ছা বিপাশা—
কি?
আজ কে এসেছিল আমাদের বাড়িতে বল তো?
কেমন করে জানব?
জান না তুমি?
বাঃ, দেখেছি নাকি তাকে!
আমি জানি কে এসেছিল—
কে?
রজতশুভ্রবাবু!
কি করে বুঝলে রজতই এসেছিল?
নিশ্চয়ই সে, তোমার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছিল—
তা আমার সঙ্গে সে হঠাৎ দেখা করতে আসবে কেন?
পুরানো দিনের বন্ধু, আসলে ক্ষতিই বা কি–ক্ষতি তো নেই কিছু, দোষের কিছু নেই–
না, সে আর কোন দিন আসবে না আমার সামনে।
কি করে বুঝলে?
আমি জানি—আচ্ছা একটা কথা বলব?
কি?
আজ এতদিন পরে হঠাৎ রজতের কথা কেন?
একসময় তো তোমার বন্ধু ছিল, তাই না?
রজতের কথা তো সব তোমাকে বলেছিলাম। বিপাশা বললে।
প্রতি রাত্রে যে কুয়াশাটা আমাকে ঘিরে ধরে, তার মধ্যে অস্পষ্ট একটা মুখ আমি দেখতে পাই মাঝে মাঝে–
মুখ!
হ্যাঁ, কার জান?
কেমন করে বলবো–তুমি তো কখনও বলনি।
না বলিনি, আজ বলছি–কার মুখ দেখি জান?
কার?
আমার বাবার! আচ্ছা কেন দেখি বল তো?
কেমন করে বলব! রাত অনেক হল—তুমি এবার ঘুমোও।
তুমি ঘুমোবে না?
না।
কেন?
ঘুম আসছে না–
অনন্য আর কথা বলে না—শুয়ে পড়ে। এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। বিপাশা চেয়ে থাকে ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে।
অনন্য হঠাৎ রজতের কথা বলছিল কেন? প্রশ্নটা বিপাশার মনের মধ্যে কেবলই ঘোরাফেরা করতে থাকে।
বাকি রাতটা বিপাশা একটা চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেয়।
অনন্যর যা কিছু অস্থিরতা, মানসিক চাঞ্চল্য—সবই রাত্রে। রাত যত বাড়তে থাকে ততই যেন। কেমন ছটফট করতে থাকে। বোঝা যায় সে যেন কেমন চঞ্চল, অশান্ত, অস্থির-যতক্ষণ না ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, ঐ একই অবস্থা চলতে থাকে। রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে যায়, সে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু বিপাশা জেগে থাকে বলে ঘর থেকে বেরুতে পারে না।
কিন্তু যতক্ষণ না অনন্য একটু সুস্থ হয়, ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়ে—বিপাশাকে যেন একটু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়, আবার ঘুমিয়ে পড়লে সে নিশ্চিন্ত, এবং মজা হচ্ছে সকালে ঘুম ভাঙার পর অনন্য যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
ধীর-স্থির-শান্ত-বিপাশার সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে কথা বলে, তাকে আদর করে, বার বার অকারণে ডাকে—বিপাশা! বিপাশা!
বিপাশা হয়ত পাশের ঘরে তখন কাজে ব্যস্ত, তবু স্বামীর ডাক কানে গেলেই সে ছুটে আসে। বলে, কি, ডাকছ কেন?
হাসতে হাসতে অনন্য বলে, না, এমনি–
এমনি ডাকছিলে?
হ্যাঁ, দেখছিলাম—
কি দেখছিলে?
তুমি কোথায়—
একদিন বলেছিল অনন্য, জান, বড় ভয় করে–
ভয়! কিসের ভয়?
তুমি যদি হারিয়ে যাও!
হারিয়ে যাব?
যদি যাও!
আচ্ছা পাগল তো—বিপাশা বলেছিল।
না, না–সত্যিই মনে হয়—হঠাৎ যদি তুমি কোথাও চলে যাও?
কোথায় আবার যাব?
যেতেও তো পার
না, যাব না।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ।
আজ চেয়ারে নিদ্রাহীন বসে বসে ঐ কথাগুলোই কেন যেন মনে পড়তে থাকে বিপাশার। তবু দিনের বেলাটা অনন্য যেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
একজন সুস্থ সবল মানুষ যেমন, ও যেন তেমনি।
অফিসে যায় ঠিক সময়ে।
অফিসের কাজকর্মের মধ্যে কখনও কোন অসংগতি ধরা পড়েনি। শোনাও যায়নি আজ পর্যন্ত সেরকম কোন কথা।
অন্তত বিপাশার কানে আসে নি।
মানুষের ঐ বয়সে কত বন্ধু থাকে—অনন্যর সেরকম কেউ নেই। মাত্র একজন প্রায়ই আসে তাদের বাড়িতে–নলিনাক্ষ সেন।
নলিনাক্ষ একটা মার্চেন্ট অফিসে সামান্য মাহিনায় চাকরি করে। বাবা-মা ভাইবোন অনেকগুলো পোষ্য নিয়ে নলিনাক্ষর সংসার। অনন্যর স্কুলের বন্ধু নলিনাক্ষ।
ধনীর পুত্র অনন্য আজ উচ্চশিক্ষিত এবং জীবনে নিজেও সুপ্রতিষ্ঠিত।
নলিনাক্ষ আজও জীবনযুদ্ধে পর্যদস্ত হয়ে চলেছে প্রতিদিন—প্রতি মুহূর্তে।
নলিনাক্ষ মধ্যে মধ্যে আসে এখানে—অনন্য ওকে পেলে খুব খুশি হয়। হৈ-চৈ করে গান গায়, হাসে-মজার মজার গল্প করে।
বিপাশারও খুব ভাল লাগে মানুষটাকে। তার মুখেই শুনেছে বিপাশা, অফিসে মানে ব্যাংকে অনন্য নাকি একেবারে অন্য মানুষ!
অনন্যর অসুস্থতার খবর নলিনাক্ষও জানে। কিছুটা অনন্য নিজেই বলেছে তাকে বিপাশাও কিছু কিছু বলেছে।
নলিনাক্ষ সব শুনে বলেছিল, তুমি কিছু ভেব না বৌদিও চিরদিনই একটু বেশী ভাবপ্রবণ, একটু সেন্টিমেন্টাল। তাছাড়া আর কোন দোষ নেই ওর মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক।
তবে রাত্রে ওরকমটা ওর হয় কেন?
ভাল ডাক্তার দেখাও, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
নলিনাক্ষই ডাঃ দাশগুপ্তের কথা বলেছিল তাকে একবার দেখাবার জন্য বলেছিল।
পরের দিন অনন্য অফিস চলে গিয়েছে।
বিপাশা স্নান সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় সিঁথিতে সিঁদুর দিচ্ছিল, পরেশ এসে দরজার সামনে দাঁড়াল।
কি রে, পরেশ?
বৌদিমণি, একজন মিলিটারি সাহেব এসেছেন—
মিলিটারী সাহেব!
হ্যাঁ।
বললি না কেন বাবু নেই?
বলেছিলাম–বললেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ।
বিপাশা অবাক হয়।
কে আবার মিলিটারী সাহেব এল আর তার সঙ্গেই দেখা করতে চায়!
বসতে দিয়েছিস?
না, নীচের হলঘরে দাঁড়িয়ে আছেন—উপরে এনে বসাব?
না, তুই যা আমি নীচেই আসছি।
পরেশ বললে, কি বলব বৌদিমণি?
বললাম তো, তুই যা আমি আসছি—
পরেশ এ বাড়িতে অনেক বছর আছে। বয়েস হয়েছে—অনিন্দ্যর আমলের লোক। বয়েস হয়েছে বলে আরও একজন ভৃত্যকে নিযুক্ত করেছিল অনন্য—সে যখন কলেজে পড়ে।
অনিন্দ্যকে যখন মস্তিষ্ক বিকৃতির জন্য রাঁচীতে পাঠান হল, সেই সময় ঐ গৃহে আরও– একজন ছিল—ভবানী দেবী। অনিন্দ্যর এক বিধবা শালী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনিন্দ্য ভবানী
দেবীকে এনেছিলেন, ঐ গৃহে অনন্যকে দেখাশোনা করবার জন্য।
অনন্যর বিবাহের আগে পর্যন্ত ভবানী দেবী ঐ গৃহে ছিলেন। সংসারের সবকিছু দেখাশোনা তিনিই করতেন। বিবাহ স্থির হবার পর অনন্য তাকে কাশীতে পাঠিয়ে দেয়।
বস্তুত অনন্যর ইচ্ছাতেই ভবানী দেবী একদিন ঐ গৃহ ছেড়ে চলে যান। বিপাশা এখানে এসে ভবানী দেবীকে দেখেনি। কিন্তু জানতে পেরেছিল তার কথা।
অনন্যকে একদিন বিপাশা বলেওছিল, তোমার মাসীমাকে নিয়ে এস না। এত বড় বাড়িতে একা একা আমরা থাকি–
অনন্য বলেছিল, তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে বিপাশা?
অসুবিধা হবে কেন! আর একজন থাকলে বাড়িটা এত শূন্য শূন্য মনে হত না। তাই বলছিলাম আর কি–
দরকার হলে রাত-দিনের জন্য একজন আয়া রেখে নাও না—অনন্য বলেছিল।
আয়া দিয়ে কি হবে–দুজন চাকর তো আছেই—
বিপাশা কথাটার আর জের টানেনি। কারণ সে বুঝেছিল ভবানী দেবীকে তাদের সংসারে আর ফিরিয়ে আনা তার স্বামীর ইচ্ছা নয়।
মনে মনে আরও ভেবেছে হয়ত অনন্য কোন কারণে ভবানী দেবীর ওপরে সন্তুষ্ট নয়। বিপাশা দ্বিতীয় বার আর ঐ মাসী-প্রসঙ্গের উত্থাপন করেনি।
সংসারের সবকিছু খুঁটিনাটি পরেশই দেখে।
অনন্য বলেছিল—পরেশ লোকটা খুব বিশ্বাসী। আর ওর একটা মহৎ গুণ হচ্ছে যে ব্যাপার ওর নয় তা নিয়ে কখনও ও মাথা ঘামায় না।
মাথা ঘামাক না ঘামাক, বিপাশা বিবাহের পর এ বাড়িতে এসে দেখেছিল—সর্বদা ছায়ার মত পরেশ ওদের আশেপাশে থাকলেও কথা খুব কম বলে। শান্ত, বিনয়ী, ভদ্র। তবু কেন যেন বিপাশার পরেশকে খুব ভাল লাগত না।
মানুষটার মুখখানা যেন পাথরে খোদাই করা। ভাবলেশহীন। সর্বক্ষণ অত বড় বাড়িটার মধ্যে যেন একটা ছায়ার মত বিচরণ করছে।
পরেশ অনন্যকে বলত কখনও দাদাবাবু—কখনও বাবু—আর বিপাশাকে বলত বৌদিমণি।
বিপাশার মনে হয়, পরেশ যখন এসে আগন্তুক সাহেবের কথা বলছিল—ওর দুচোখের দৃষ্টিতে যেন কি একটা ছিল।
বিপাশা নীচে নেমে এল সিঁড়ির নীচে সেই ছিমছাম আলোছায়ায় ভরা হলঘরটার মধ্যে। যেখানে পা দিলেই বিপাশার গা-টা যেন শিরশির করে ওঠে। বিরাট একটা স্টাফ করা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিপাশা দেখতে গেল, মিলিটারী পোশাক পরা এক দীর্ঘকায় পুরুষ পিছন ফিরে। শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করবার আগেই বিপাশা দেখতে পেল, আগন্তুককে।
বিপাশার চপ্পলের মৃদু শব্দে আগন্তুক ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বিপাশা আগন্তুককে চিনতে পারে ঐ আলোছায়াতেই চিনতে তার এতটুকুও কষ্ট হল না। সত্যিই সে যেন একটু বিস্মিতই হয়।—তুমি! অর্ধস্ফুট শব্দটা বিপাশার গলা থেকে বের হয়ে এল যেন তার নিজের অজ্ঞাতেই।
হ্যাঁ, বিপাশা আমি—আগন্তুক সোজাসুজি তাকাল বিপাশার মুখের দিকে। আকস্মিকতার ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে বিপাশা নিজেকে একটু যেন গুছিয়ে নেয়। সিঁড়ি থেকে নেমে সামনাসামনি এসে দাঁড়াল।
হঠাৎ কি মনে করে রজত? বিপাশা প্রশ্ন করল।
রজতশুভ্র মৃদু হাসল। বললে, আমি যে আবার আসব—আবার আমাদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা হবে তুমি কি তা জানতে না বিপাশা!
আশা করিনি—
আশা করনি বুঝি?
না।
কেন?
সেদিনকার পর আবার তুমি আমার সামনে আসবে আমি ভাবতে পারিনি।
কেন ভাবতে পারনি?
ভাবাটাই তো স্বাভাবিক ছিল।
তোমার ভদ্রতা, তোমার সৌজন্যবোধ ও তোমার রুচির ওপরে আমি বিশ্বাস করেছিলাম বোধ হয়—
এখন আর বোধ হয় রাখতে পারছ না, তাই না বিপাশা?
না। যাক গে সেকথা-বল এবারে কেন এসেছ? হঠাৎ কি প্রয়োজন পড়ল আমার কাছে আবার আসার?
প্রয়োজন ছিল বলেই তো এলাম।
তুমিই বোধ হয় কাল সন্ধ্যায় এসেছিলে?
হ্যাঁ–নামটা বলিনি, তবে জানতাম নাম না বললেও তোমার বোঝার অসুবিধা হবে না কে এসেছিল!
বিপাশা রজতশুভ্রর কথার কোন জবাব দেয় না।
দেড় বছরে ট্রেনিং শেষ করে নতুন পোস্টিং পেয়েই কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছি। রজতশুভ্র বললে।
আমার কাছে কি দরকার?
তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। কথাটা যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চারণ করল রজতশুভ্র। এতটুকু কম্পন বা দ্বিধা মাত্রও যেন তার গলার স্বরে বা উচ্চারণের মধ্যে নেই। কোথাও।
কি—কি বললে?
বললাম, তো, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি—
আমাকে নিয়ে যেতে! মানে?
হ্যাঁ। আমার কাছে আম্বালায় নিয়ে যাব বলেই এসেছি। কোয়াটার্সও পেয়ে গিয়েছি, সব সাজিয়ে গুছিয়ে এসেছি।
ওরা কেউ লক্ষ্য করে না, দোতলার একটা জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখের শ্যেনদৃষ্টি ওদের উপরে স্থিরনিবন্ধ হয়ে আছে। সে দুটো চোখ পরেশের।
তোমার স্পর্ধা তো কম নয়—চাপা বিরক্তিভরা কণ্ঠস্বরে বললে বিপাশা।
স্পর্ধার এর মধ্যে কি আছে! তুমি আমার—আর কারও নয়, তাই তোমাকে নিয়ে যেতে : এলাম।
আনি অনন্যর বিবাহিত স্ত্রী। আমাদের বিবাহ হয়েছে—কথাটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে।
মনে থাকবে না কেন, বিবাহ হয়েছে তাতে হয়েছে কি তুমি আমার, আর কারও না, আমি মানি না—আমি তা হতে দিতে পারি না।
রজত! চল আর দেরি কোরো না—তৈরী হয়ে নাওট্যাক্সি আমি বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
বিপাশা স্থির পাষাণমূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে, অপলক দৃষ্টিতে মাত্র হাত দুই-তিন ব্যবধানে দণ্ডায়মান রজতশুভ্রর মুখের দিকে চায়।
লোকটা তামাশা করছে না তো! নিছক একটা পরিহাস—কিম্বা লোকটা সত্যি সত্যিই পাগল। হয়ে গিয়েছে।
কি হল—বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এস—যেমন আছ তেমনিই চলে এস।
মনে হচ্ছে—
কি মনে হচ্ছে?
তোমার নিশ্চয়ই মাথা-খারাপ হয়ে গিয়েছে, মনে হচ্ছে আমার।
আর না না সম্পূর্ণ সুস্থনরম্যাল আমি। আমাদের বংশে কেউ পাগল নেই আর ছিলও না কেউ কোনদিন।…কি হল, এখনও দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
চলে যাও এখান থেকে–
চলে তো যাবই—অনন্য বক্সীর এই ভূতুড়ে বাড়িতে আমি থাকতে আসিনি—চল আমরা এখুনি বের হয়ে যাই।
চলে যাও রজত!
অবশ্যই যাব—তবে তোমাকে নিয়ে, এস—
তুমি যাবে না? চাকর-দারোয়ানকে ডাকব?
তাতে কোন লাভ হবে না। তোমাকে না নিয়ে এখান থেকে আমি যাচ্ছি না।
পরেশ! গলা তুলে ডাকল বিপাশা।
রজতশুভ্র পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করল, আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি বিপাশা-কারও বাধা দেবার সাধ্য নেই আমাকে। বাধা কেউ দিতে এলে তার নির্বুদ্ধিতাই প্রকাশ পাবে।
রজত! বিপাশার গলা ঋজু–কঠিন।
হ্যাঁ, তোমাকে নিয়েই আমি যাব। এস–লেট আস গো!
পরেশ প্রস্তুত হয়েই ছিল—তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল বিপাশার ডাক শুনে।
বৌদিমণি, আমাকে ডাকছ?
বাবুকে এখুনি একটা ফোন করে দে চলে আসবার জন্য–
পরেশ বোধ হয় ফোন করবার জন্যই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে, কিন্তু পশ্চাৎ থেকে বাধা। দিল রজত—ওহে পরেশচন্দ্র, দাঁড়াও—দেখছ এটা হাতে আমার কি—এগিয়েছ কি গুলি চালাব!
পরেশ! বিপাশা বললে, যা বললাম তাই কর—যাও—ফোন করে দাও।
পরেশ, যাবার চেষ্টা করলে গুলি চালাব! রজতশুভ্র বললে।
ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি, বলে বিপাশা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
বিপাশা, কেন একটা সিন ক্রিয়েট করবার চেষ্টা করছ! চলে এস আমার সঙ্গে—
যেতেই হবে আমাকে? বিপাশা বললে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায়। যেন কিছুই হয়নি।
হ্যাঁ, যেতেই হবে, বললে রজতশুভ্র।
কিন্তু এই মুহূর্তে এইভাবে তো তা সম্ভব নয় রজত
কেন সম্ভব নয়। কাপড়জামার তোমার অভাব হবে না—
একজন স্ত্রীলোকের কাপড়জামাই কি সব!
তবে আর কিসের প্রয়োজন তোমার?
যেতে হলে আমাকে একবার দোতলা থেকে ঘুরে আসতে হবে—
বোধ হয় অনন্য বক্সীকে একটা ফোন করতে হবে, তাই কি?
না, ফোন আমি করব না-তোমাকে কথা দিচ্ছি।
শোন বিপাশা, তোমার সঙ্গে আমি পরিহাস করছি না কিন্তু—
আমার একটা কথার জবাব দেবে রজত?
বল কি কথা!
জোর করে তুমি আমার দেহটা অধিকার করতে পার এই মুহূর্তে পিস্তলের হুমকি দেখিয়ে আমাকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে, কিন্তু আমার স্বামী তোমাকে মুক্তি দেবে না–তাকে তুমি জান না!
কি করবে—আইন আদালত—
হ্যাঁ। তুমি অস্বীকার করতে চাইলেও দেশে যখন আইন বলে একটা বস্তু এখনও আছে—
তাতে কোন লাভ হবে না–বলে হাসে রজতশুভ্র।
লাভ হবে না? না।
হাসতে হাসতেই বললে রজত, কারণ আমি জানি তুমি আমার স্বপক্ষেই সাক্ষী দেবে— তাও জান?
জানি বৈকি, সে বিশ্বাসটুকু না থাকলে কি এখানে তোমাকে নিতে আসতাম! চল মিথ্যে কেন দেরি করছ–
আমাকে তুমি বিশ্বাস কর?
তা করি।
তোমার সঙ্গে আমাকে যেতে হবে এই তো তোমার ইচ্ছা!
হ্যাঁ।
কোথায় তুমি আছ–তোমাদের বাড়িতে কি?
না—
তবে কোথায়?
এক বন্ধুর ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলার ফ্ল্যাটে পার্ক স্ট্রীটে—আপাতত সেখানে আমি একাই আছি।
ঠিক আছে সন্ধ্যার ঠিক পরেই তোমার ওখানে আমি যাচ্ছি–তুমি চলে যাও।
কথা দিচ্ছ?
হ্যাঁ, দিচ্ছি।
বেশ, আমি চললাম—ঠিক সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ফ্ল্যাটে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব মনে থাকে যেন। ফ্ল্যাট বাড়িটার নাম নীলাকাশ, চারতলায় ১৪নং ফ্ল্যাট–
ঠিক আছে—
রজতশুভ্র হাতের পিস্তলটা পকেটে রেখে বললে, মনে থাকে যেন, সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সময় দিলাম। হলঘর থেকে বের হয়ে গেল অতঃপর রজতশুভ্র।
বিপাশা তখন আর যেন দাঁড়াতে পারছে না সোজা হয়ে—তার মাথার মধ্যে কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে, সারা শরীরটা যেন কাপছে। হাত বাড়িয়ে বিপাশা সিঁড়ির রেলিংটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল। প্রাণপণে সিঁড়ির রেলিংটা চেপে ধরে নিজের পতনটা রোধ করবার চেষ্টা করে বিপাশা।
বৌদিমণি! পরেশ ডাকল।
কেমন যেন অসহায় শূন্য দৃষ্টিতে পরেশের মুখের দিকে তাকাল বিপাশা।
বাবুকে একটা ফোন করে দিন।
বিপাশা পরেশের কথার জবাব দিল না—অসংলগ্ন শিথিল পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে দোতালায় উঠে গেল। কিছুই যেন তখন সে আর ভাবতে পারছে না। এখন সে কি করবে? কি করা উচিত? নিজের শোবার ঘরে এসে ঢুকে একটা সোফায় অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। রজতকে সে কথা দিয়েছে আজ সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সে তার ফ্ল্যাটে যাবে। যদি সে না যায়, রজত কি করবে–কি সে করতে পারে? কিন্তু অনন্য–তার স্বামীকে সব কথা তার অবশ্যই বলা দরকার। আবার যদি রজত এখানে এসে হাজির হয়—অনন্যর ফিরতে ফিরতেও সেই রাত সাড়ে সাতটা পৌনে আটটা। অনেক দেরি হয়ে যাবে না কি!
পরের দিন শেষরাত্রের দিকে নীলাকাশ আটতলা ফ্ল্যাট বাড়িটার কমপাউন্ডের ধার ঘেঁষে প্রথম একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারই মৃতদেহটা আবিষ্কার করে রজতশুভ্রর, তার গাড়ির হেডলাইটের আলোয়। ভাল করে তখনও ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি। একটা আলো-আঁধারের অস্পষ্টতা পাতলা চাদরের মত যেন চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র।
রাউরকেল্লা এক্সপ্রেসটা নির্ধারিত সময়ের মিনিট কুড়ি আগেই হাওড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি পেয়ে সরিৎ সোজা নীলকাশে চলে আসে। ট্যাক্সি ড্রাইভার গেট দিয়ে সোজা কমপাউন্ডে ঢুকতেই ট্যাক্সির জোরালো হেডলাইটের আলোয় তার চোখে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে পাম গাছটার নীচে মৃতদেহটা, কমপাউন্ডের কিনারায়। সরিৎ কিন্তু দেখতে পায়নি ব্যাপারটা। তার দুচোখ তখন ঘুমে যেন জড়িয়ে আসছিল।
ফ্ল্যাট-বাড়িটার মেইন গেটের হাত-দশেক দূরে কমপাউন্ডের ধার ঘেঁষে যে এক সারি পাম গাছ ছিল তারই প্রথম গাছটার নীচে পড়ে ছিল মৃতদেহটা।
স্যার, একটা মানুষ পড়ে আছে ঐ দেখুনট্যাক্সি ড্রাইভার বললে।
মানুষ! কোথায়? সরিৎ বললে।
ট্যাক্সির দরজা খুলে সরিৎ তখন নেমে দাঁড়িয়েছে, পৌঁছে গিয়েছে বলে।
ঐ যে দেখুন না, ঐ গাছটার নীচে!
সরিৎও দেখতে পায়–তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় গাছটার সামনে। শানবাঁধানোে কমপাউন্ডের ধার ঘেঁষে মাটিতে কয়েকটা পাম গাছ—তারই নীচে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মাথাটা চূর্ণ হয়ে গিয়েছে, চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে কিন্তু–কে ও, কে লোকটা—চেনা-চেনা লাগছে সরিতের! সে ড্রাইভারকে বললে, গাড়ির হেডলাইটটা জ্বলুন তো? ড্রাইভার হেডলাইটটা অন করে দিল। সেই আলোয় সরিতের এবার চিনতে কষ্ট হয় না—হ্যাঁ, রজতশুভ্রই তো!
ড্রাইভারও ততক্ষণে সরিতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে বললে, মনে হচ্ছে স্যার, উপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছেন ভদ্রলোক!
সরিৎ তখন বোবা, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রজতশুভ্র উপর থেকে ঝাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছে, কিন্তু কেন? কেন সে সুইসাইড করবে? কয়েকদিন আগে আম্বালা থেকে সরিৎ রজতের একটা চিঠি পেয়েছিল বিশেষ কাজে দিন দুই-তিনের জন্য সে কলকাতায় আসছে এবং তার যদি কোন অসুবিধা না হয় তো সে তার ফ্ল্যাটেই উঠবে। বকুলকেও লিখেছে সে, কলকাতায় দু-চার দিনের জন্য আসতে। সেও বোধ হয় আসবে।
সরিৎও জানিয়ে দিয়েছিল রজতকে সঙ্গে সঙ্গে, মোস্ট ওয়েলকাম! তুমি আমার ফ্ল্যাটেই এসে উঠো রজত। গিন্নী আপাতত দিল্লীতে বেশ কিছুদিনের জন্য তার মা-বাবার কাছে গিয়েছে— সে সন্তান-সম্ভবা আর আমিও কোম্পানির কাজে দিন-সাতেকের জন্য রাউরকেল্লা যাচ্ছি। অতএব ফ্ল্যাট খালি। ভৃত্য পঞ্চানন রইল—তোমার কোন অসুবিধা হবে না, পঞ্চাননকে সে কথাটা জানিয়েও যাব। যদি কাজ শেষ হয়ে যায়—দেখা হবে, নচেৎ এযাত্রায় দেখা হল না। বকুল আসলে তো এখানেই উঠবে।
সব যেন কেমন এলোমেলো গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সরিতের।
ড্রাইভারের কথায় সরিতের সম্বিৎ ফেরে যেন, ফ্ল্যাটের কেউ বোধ করি এখনও ব্যাপারটা জানতে পারেনি স্যার!
লোহার গেট খোলার শব্দ শোনা গেল। নীচের গেটের দারোয়ান রামলক্ষণ কোলাপসিবল গেটের তালা খুলছে।
রামলক্ষণ সিঁড়ির নীচেই থাকে। ফ্ল্যাটটায় সিঁড়ি এবং লিফ্ট দুই আছে। রাত সাড়ে বারোটায় লিফ্ট বন্ধ হয়ে যায়—ঐ সঙ্গে মেইন গেটও, অবিশ্যি তারপরে লিক্ট পাওয়া যায় না—তবে রামলক্ষণকে ডাকলে উঠে সে গেট খুলে দেয়।
দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি নীলাকাশ। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতের লোক ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করে। ছত্রিশ রকম মানুষের আড়া। ইতিমধ্যে আলো পরিষ্কার হয়েছে—চারিদিক বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই আলোয়। মেইন গেট থেকে জায়গাটা হাত-দশ-পনেরোর বেশি দূর হবে না। দণ্ডায়মান ট্যাক্সি ও দুজন মানুষকে গাছের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতূহলী রামলক্ষণও এগিয়ে আসে ঐদিকে এবং রজতের মৃতদেহটার প্রতি তার নজর পড়তেই সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, হায় রাম, এ কেয়া!
সরিতের আর একটা ব্যাপার নজরে পড়ে, একটা সরু কালো কর্ড রজতের গলায় গিঁট দিয়ে বাঁধা। পরনে রজতের দামী টেরিটের প্যান্ট ও টেরিলিনের রঙ্গিন হাওয়াই শার্ট। হাতে সোনার ঘড়ি, কজিতে বাঁধা, আর পায়ে কাবলী চপ্পল। মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে প্রায়—চোখ দুটো যেন ঠেলে কোঠর থেকে বের হয়ে এসেছে—মুখটা সামান্য হাঁ করা—উপরের পাটির দাঁত সামান্য দেখা যাচ্ছে—জিভটাও যেন সামান্য বের হয়ে এসেছে। বীভৎস-ওদিকে তাকানো যায় না যেন! সরিৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল-–চেয়ে থাকা যায় না ঐদিকে।
সরিই পার্ক স্ট্রীট থানায় ফোন করে দিয়েছিল নিজের ফ্ল্যাটে এসে। ফ্ল্যাটের দরজা ভিতর থেকে ভেজানো ছিল। তিন কামরাওয়ালা ফ্ল্যাট দুটো বেডরুম, একটা বড় আকারের লিভিং রুম। সৌখীননা মানুষ সরিৎ। তাছাড়া ভাল চাকরি করে ভাল মাহিনা পায় বেশ ভাল করে সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট।
পঞ্চানন কিন্তু ছিল না ফ্ল্যাটে! একটু অবাকই হয়েছিল সরিৎ পঞ্চাননকে দেখতে না পেয়ে। ফ্ল্যাট অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র যেমন সাজানো ছিল তেমনিই সাজানো আছে—এতটুকু নাড়াচাড়া হয়নি। দুটি বেডরুমেই দরজা ভেজানো। কেবল একটা বেডরুমের বাইরের দিককার জানালা খোলা আর ব্যালকনির দরজাটা খোলা। শোবার ঘরে একটা সুটকেস–বোধ হয় রজতশুভ্রেরই।
সরিৎ একটা সোফার উপরে বসে ছিল একটা সিগ্রেট ধরিয়ে।
ভৃত্য পঞ্চানন এসে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল, সাহেব!
কোথায় ছিলি? সরিৎ প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে—
ছিলি কোথায়?
আজ্ঞে বৌবাজারে আমার শালার ওখানে ছিলাম।
আমার পারমিশন ছাড়া তুই ফ্ল্যাট ছেড়ে গিয়েছিলি কেন?
আজ্ঞে আপনার বন্ধু যিনি এসেছিলেন, কাল বিকেলে তিনি বললেন—
কি–কি বললেন?
আজ্ঞে শালার খুব অসুখ খবর পেয়েছিলাম, তাই ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি চেয়েছিলাম বাবুর কাছে তিনি বললেন, রাতের মত তিনি আমাকে ছুটি দিচ্ছেন—সকালে এলেই হবে—তিনি বাইরে রাত্রে খেয়ে নেবেন।
দিদিমণি বকুল আসেনি?
আজ্ঞে না, দিদিমণি তো আসেন নি!
তার তো গতকালই আসার কথা ছিল সকালের গাড়িতে গয়া থেকে!
ঠিক ঐ মুহূর্তে একটি ২৬।২৭ বৎসরের তরুণী এসে ঘরে ঢুকল, দাদা!
কে? বকুল?
হ্যাঁ। ট্রেনটা কিছু লেট ছিল, দাদা—রজতকে দেখছি না—রজত আসেনি? তার তো দুদিন আগেই আসার কথা ছিল তোমার এখানে, আমাকেও তাই লিখেছে চিঠিতে–
সরিৎ যেন বোবা। কি জবাব দেবে ছোট বোন বকুলের প্রশ্নের, বুঝতে পারে না।
বকুল আবার প্রশ্ন করে, রজত আসেনি দাদা?
বকুল!
ঐ সময় দোরগোড়ায় কয়েক জোড়া জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।—মিঃ সরিৎ ব্যানার্জি আছেন?
কে? আমি পার্ক স্ট্রীট থানার সেকেন্ড অফিসার-ভিতরে আসতে পারি? আসুন অফিসার।
পুলিশ অফিসার মিঃ অরুণ লাহিড়ী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। বয়েস ত্রিশ-বত্রিশের বেশী হবে না। বেশ উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা। পরনে সাদা ইউনিফর্ম। চোখে চশমা। একজন সার্জেন্ট সঙ্গে।
আপনিই ফোন করেছিলেন?
হ্যাঁ, আমিই সরিৎ ব্যানার্জী—আসুন।
নীচে ডেড বডি দেখলাম—তা আপনি ঐ ভদ্রলোককে চিনতেন নাকি? পরিচয় ছিল আপনাদের? এ ফ্ল্যাটবাড়ির কেউ কি?
না, বসুন।
এই ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকতেন না উনি? অফিসার একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন।
না। উনি একজন আর্মি অফিসার—আমার বন্ধু রজতশুভ্র চক্রবর্তী নাম।
দাদা! একটা অস্পষ্ট চিৎকার বের হয়ে আসে বকুলের কণ্ঠ চিরে।
যুগপৎ পুলিশ অফিসার ও সরিৎ ঐ চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে বকুলের দিকে তাকাল। বকুলের সমস্ত মুখটা যেন কেমন রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
কার—কার কথা বলছ তোমরা? কার ডেড বডি? দাদা কথা বলছ না কেন?
বকুল—কি বুঝি বলবার চেষ্টা করে সরিৎ, কিন্তু পারে না।
কি কি হয়েছে দাদা রজতের? বকুলের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ল।
ইনি? অফিসার প্রশ্ন করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন সরিতের দিকে।
আমার ছোট বোন বকুল ব্যানার্জী—গয়া থেকে এইমাত্র আসছে। বকুল, রজত চারতলা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছে!
না, না—
সরিৎ উঠে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে। ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারা যাচ্ছে না বকুল—রজতের রক্তাক্ত ডেড বডিটা নীচের কমপাউন্ডের ধারে পড়ে আছে—আমি একটুক্ষণ আগে রাউরকেল্লা থেকে ফিরে ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখতে পেয়ে থানায় ফোন করেছিলাম।
বকুল থরথর করে কাপছিল, সরিৎ তাকে ধরে সোফার ওপরে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসল।
নীচে কমপাউন্ডে তখন সমস্ত ফ্ল্যাটবাড়ির লোক ভিড় করেছে। পুলিস তাদের সরাতে ব্যস্ত। অস্ফুট একটা গুঞ্জন। রজতের মৃতদেহটা তেমনিই পড়ে ছিল।
সেকেন্ড অফিসার মিঃ লাহিড়ী প্রশ্ন করেন সরিৎকে, আপনার বন্ধু কবে এসেছিলেন এখানে?
আমি দিনপাঁচেক আগে কোম্পানির কাজে রাউরকেল্লা গিয়েছিলাম—আজই সকালে ফিরছি—ওর আসার কথা ছিল গত পরশু, মানে শনিবার–
পঞ্চানন তখন বললে, আজ্ঞে না, শুক্রবার ভোরেই উনি এসেছিলেন।
মিঃ লাহিড়ী বললেন, আজ সোমবার উনি তাহলে তিন দিন আগে এসেছিলেন। এখানেই ততা ছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ–সরিৎ বলে।
আর কেউ ছিল এখানে?
না। ঐ সারভেন্ট পঞ্চানন ছিল—পঞ্চাননকে দেখিয়ে দিল সরিৎ।
মিঃ লাহিড়ী পঞ্চালনের দিকে তাকালেন, তোমার নাম পঞ্চানন?
আজ্ঞে পঞ্চানন বেরা—
তুমি কিছু বলতে পার?
আজ্ঞে আমি গতকাল সন্ধ্যা ছটা নাগাদ চলে গিয়েছিলাম বৌবাজারে—
তুমি তাহলে ছিলে না এখানে?
না স্যার—
তাহলে দেখা যাচ্ছে কাল রাত্রে আপনার বন্ধু এই ফ্ল্যাটে একাই ছিলেন! পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকেন? কি তার নাম?
সরিৎ বললে, বাঁদিকে ১৩ নম্বরে থাকেন একজন দক্ষিণদেশীয় ভদ্রলোক—মিঃ পাঙ্গু, একটা অফিসের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট—তার স্ত্রী ও ছোট ছোট দুটি ছেলে আর ১৫নং ফ্ল্যাটে ডানদিকে থাকেন মিঃ গোয়েল—একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক—পাইলট, তার স্ত্রী ও দশ বছরের একটি মেয়ে–
হুঁ। আপনি কতদিন এই ফ্ল্যাটে আছেন?
বছর চারেক হবে।
আপনি একাই?
না, আমার স্ত্রী আছেন—
তিনি?
দিন-পনেরো হল দিল্লী গেছেন তার মা-বাবার কাছে।
রজতবাবুর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
দশ বারো বছরের পরিচয়—একসঙ্গে বঙ্গবাসী কলেজে আমরা চার বছর পড়েছিলাম— সেই থেকেই পরিচয়।
আর আপনার বোনের সঙ্গে?
তাও অনেক দিনের—
তবু কতদিন হবে?
ও বরাবরই আমার কাকার কাছে থেকে পাটনায় পড়াশুনা করত—মধ্যে মধ্যে ছুটিতে কলকাতায় আসত তখুনি পরিচয় হয়—তাও ধরুন বছর পাঁচেক তো হবেই
আপনার বন্ধু নিশ্চয়ই বিবাহিত ছিলেন না?
না। সামনের অগ্রহায়ণে—ওদের মানে বকুলের সঙ্গে রজতের বিয়ে হবে ঠিক হয়ে ছিল—
মিঃ লাহিড়ী আর একবার বকুলের দিকে তাকালেন।
বকুল প্রস্তর-প্রতিমার মত সোফাটার উপরে বসেছিল মাথাটা নীচু করে।
আচ্ছা মিঃ ব্যানার্জী, আপনার কি মনে হয় ব্যাপারটা?
মনে তো হয় সুইসাইডই, কিন্তু—
মৃতদেহের গলায় একটা সরু কালো কর্ড বাঁধা আছে গিট দিয়ে, নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন? করেছি।
এমনও তো হতে পারে—
কি?
কেউ ওঁর গলায় ফাঁস দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছে–মিঃ লাহিড়ী বললেন।
কিন্তু তা কে দেবে আর কেনই বা দেবে?
কেউ দিতেও পারে তো–ধরুন ওঁর কোন শত্রু! এটা হয়ত আদৌ সুইসাইড নয়—হোমিসাইড—মার্ডার!
কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না অফিসার!
কেন?
প্রথমত ও যে দুতিন দিনের জন্য এখানে আসছে—কারও তা জানবার কথা নয়। তাছাড়া ওর বিশেষ পরিচিত জন কেউ এখানে এ শহরে ছিল বলেও জানি না। তাছাড়া ওকে কে-ই বা মার্ডার করতে যাবে আর কেনই বা করবে!
কি জানি মিঃ ব্যানার্জী, ব্যাপারটা আত্মহত্যা বলে যেন আমার মনে হচ্ছে না। আচ্ছা রজতবাবুর আর কোন পরিচিতজন এ শহরে আছেন যাদের আপনারা জানেন?
দাদা!
বকুলের ডাকে সরিৎ বোনের মুখের দিকে তাকাল।
অনন্য চৌধুরী আর স্ত্রী বিপাশা—
বিপাশা!
হ্যাঁ, অফিসার এককালে শুনেছি বিপাশা ওর পাশের বাড়িতেই থাকত—পরিচয়ও ছিল ওদের পরস্পরের মধ্যে যথেষ্টবকুল বললে।
অনন্য চৌধুরী বিপাশার কে? অরুণ লাহিড়ী প্রশ্ন করলেন।
বিপাশার সঙ্গে রজতের একসময় যথেষ্ট পরিচয় ছিল–কিন্তু আট নয় মাস হবে, অনন্য চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি যতদূর জানি—ওদের পরস্পরের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি—
আচ্ছা বকুল দেবী?
বকুল তাকাল অরুণ লাহিড়ীর মুখের দিকে।
আপনার সঙ্গে শুনলাম রজতবাবুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল—আপনারা পরস্পরের পরিচিত অনেকদিনের—বিপাশার কথা আপনি কিছু জানেন, যে মেয়েটির কথা এইমাত্র শুনলাম।
শুনেছিলাম কয়েকবার রজতের মুখে বিপাশার নাম এবং একসময় ওদের সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠতাও রজতের হয়েছিল শুনেছি, কিন্তু বছর তিন-চার আগে অনন্য চৌধুরীর সঙ্গে বিপাশার আলাপ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হবার পর আগের সে সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যে ছিল না বলেই জানি।
অতঃপর অরুণ লাহিড়ী উঠে দাঁড়ালেন, চলি মিঃ ব্যানার্জী। হয়ত আবার আসব মানে আসতে হতে পারে কথাগুলো বলে অরুণ লাহিড়ী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
সরিৎ এতক্ষণে যেন ভাল করে তাকাল বোনের দিকে। বকুল কেমন যেন অসহায়ের মত বসে আছে সোফাটার ওপরে। শিথিল হাত দুটি কোলের ওপরে ন্যস্ত। জানালা-পথে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
বকুল! সরিৎ মৃদু কণ্ঠে ডাকল।
বকুল সরিতের ডাকে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল। বিষণ্ণ ক্লান্ত—কেমন যেন অসহায় দৃষ্টি।
তা কটা দিন এখানে থাকবি তো?
না।
কেন রে?
ভাল লাগছে না দাদা, ভাবছি কালই রাত্রের ট্রেনে ফিরে যাব। তুমি দেখ যদি একটা রিজার্ভেশন পাও—
ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্যে সেটা পেতে হয়ত কষ্ট হবে না কিন্তু ছুটি নিয়ে এসেছিস যখন, থাক না কটা দিন এখানে।
এখানে থাকলে রজতের কথা বেশী করে মনে পড়বে দাদা। আমাকে তুমি বাধা দিয়ো না দাদা, আমাকে যেতে দাও বকুলের চোখের কোল দুটো ছলছল করছে সরিৎ লক্ষ্য করে।
সরিৎ আর কোন কথা বলে না। তার মাথার মধ্যে তখন পুলিস অফিসারের কথাগুলোই যেন ঘোরাফেরা করছে। তার ধারণা রজতকে কেউ হত্যা করেছে! রজতের গলায় বাঁধা কালো। সরু কৰ্ডটা দেখেই হয়ত কথাটা অফিসারের মনে হয়েছে। সত্যিই তো, ঐ কর্ডটা গলায় কোথা থেকে এল? আর কর্ডটা তার গলায় অমন করে গিট দিয়ে বাঁধা ছিল কেন? রজত সুইসাইড যদি করে থাকে, ঐ কর্ডটার তাৎপর্য কি?
দাদা!
বকুলের ডাকে সরিৎ বোনের মুখের দিকে তাকাল।
তুমি দেখেছ কিনা জানি না কখনও, কিন্তু আমি দেখেছি—
কি দেখেছিস?
রজতের গলায় একটা সরু সিল্কের কর্ডে একটা মাদুলী বাঁধা ছিল—
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একবার ও জলে ড়ুবে যায়—ওর যখন পাঁচ বছর বয়স—ওর বাবার গুরুদেব অপঘাত মৃত্যুকে এড়াবার জন্য কালো কর্ডে একটা মাদুলী বেঁধে ওর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই থেকেই ওটা ছিল ওর গলায়। আমাকে ও বলেছিল। কিন্তু সেটা ওর গলায় পিছন থেকে অত টাইট করে গিঁট দিয়ে বাঁধা কেন?
না বকুল, অফিসার যা বলে গেলেন—আমারও সন্দেহ তাই, মনে হচ্ছে হয়ত তার কথাই ঠিক। কেউ ওকে হত্যাই করে গলায় ফাঁস দিয়ে হয়ত নীচে ফেলে দিয়েছে ব্যালকনি থেকে।
তাই যদি হয়ে থাকে, রজত কি বাধা দেয়নি সে-সময়?
হয়ত একাধিক লোক ছিল। ব্যাপারটা সত্যিই মাথার মধ্যে যেন আমার আসছে না।
অরুণ লাহিড়ী মৃতদেহটা হোমি-সাইডাল স্কোয়াড আসার অপেক্ষায় প্রহরায় রাখার একটা ব্যবস্থা করে তাঁর জীপে উঠে বসলেন। থানা দূরে নয়-কাছেই। থানায় পৌঁছে বড়বাবু ও. সি.-র ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
ঐ থানার ও. সি. সুবিনয় ঘোষ তখন লালবাজার হোমিসাইড স্কোয়াডের বড় অফিসার সুদর্শন মল্লিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
থানা থেকেই মিঃ মল্লিককে ফোন করা হয়েছিল।
এই যে অরুণবাবু আসুন-মল্লিকসাহেব স্পটে যাবার জন্য রওনা হচ্ছিলেন! স্পট থেকে চলে এলেন কেন?
আমি এতক্ষণ স্যার হোমিসাইডাল স্কোয়াডের অপেক্ষায় থেকে ডে বডিটা পাহারায় রেখে আপনাকে একটা খবর দিতে এলাম।
মল্লিক বললেন, যে অফিসারটিকে স্পটে পাঠাব ভেবেছিলাম—খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম সে গতকাল মাঝরাত্রে একটা রেইডের ইনফরমেশন পেয়ে সেই যে বেলঘরিয়ায় গিয়েছে এখনও ফেরেনি—তখন আমি নিজেই চলে এলাম। চলুন না আমার সঙ্গে স্পটে আর একবার।
চলুন।
দুজনে ও. সি.-র ঘর থেকে বের হয়ে জীপে গিয়ে উঠে বসলেন। অরুণ লাহিড়ী আর সুদর্শন মল্লিক।
জীপে যেতে যেতেই অরুণ লাহিড়ী মোটামুটি ভাবে সুদর্শন মল্লিককে ব্যাপারটা বলে গেলেন এবং তাঁর মতে ব্যাপারটা যে একটা হত্যাকাণ্ড তাও বললেন।
আপনার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এ কেস্ অফ মার্ডার, মিঃ লাহিড়ী?
হ্যাঁ স্যার, সুইসাইড বলে তো আমার মনে হচ্ছে না।
হুঁ। কর্ডের ব্যাপারটা সত্যিই সাস্পিসাস! কর্ডটা গলায় শক্ত করে গিঁট দিয়ে বাঁধা কেন?
জীপ এসে ওদের নীলাকাশের কম্পাউন্ডে প্রবেশ করল। সেখানে তখন আরও ভিড় জমেছে, প্রহরারত পুলিস ভিড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে যেন। সুদর্শন মল্লিকই এগিয়ে গিয়ে সকলকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন, অরুণ লাহিড়ীও সাহায্য করলেন তাঁকে। ক্যামেরাম্যান একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ভিড়ের জন্য। সেও এবারে এগিয়ে এল। তদন্ত শেষ করতে ও নানা অ্যাংগেলে ফটো তুলতে ঘণ্টাখানেক লাগল। সুদর্শন মল্লিক একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন, অত উঁচু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবার জন্য পড়লে, মাটিতে আছড়ে পড়বার পর দেহের যে পোজিশন থাকা উচিত তা নেই, যেমন তেমনি মাথার খুলিটা ফেটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন ইনজুরিও চোখে পড়ল না তার। সর্বশেষে ঐ ধরনের দুর্ঘটনায় যতটা রক্তপাত হওয়া উচিত তাও নজরে পড়ল না। সামান্য রক্ত জমাট বেঁধে আছে মাথার নীচে। উপরের তলায় গিয়ে সরিৎ ও তার বোনের সঙ্গেও কিছু কথাবার্তা বললেন সুদর্শন মল্লিক।
পরের দিন সকালের সংবাদপত্রে একটা নিউজ দেখা গেল চতুর্থ পৃষ্ঠায়—আর্মি অফিসার ক্যাঃ রজত চৌধুরী নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে সম্ভবত নীচের কম্পাউন্ডে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
সংবাদটা বিপাশারই প্রথমে নজরে পড়ে।
অনন্য উঠে বাথরুমে গিয়েছে একটু আগে। শোবার ঘরের সামনের ব্যালকনিতে পরেশ একটু আগে চায়ের ট্রের সঙ্গে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা রেখে গিয়েছে। অন্যমনস্ক ভাবে সংবাদপত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে সহসা চতুর্থ পৃষ্ঠায় নিউজটা বিপাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করে—আর্মি অফিসার রজতশুভ্র চৌধুরী নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
বিপাশা যেন অকস্মাৎ বিমূঢ় প্রস্তরীভূত।
রজত–রজতশুভ্র আত্মহত্যা করেছে। নীলাকাশের ফ্ল্যাট থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে!
রজতশুভ্র আত্মহত্যা করেছে—অক্ষরগুলো যেন ক্রমশ বড় হতে হতে তার চোখের সামনে আরও বড় আকার ধারণ করতে থাকে। বড় বড় আরও বড়—তারপর কেমন সব ঝাপসা!
অনন্য বাথরুম থেকে এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করল এবং সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে ও বিপাশার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে বিপাশা, অমন চুপচাপ বসে কেন?
কেমন শূন্য অসহায় দৃষ্টিতে যেন বিপাশা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল, হাতের মুঠোয় তখনও তার ধরা ঐদিনকার সংবাদপত্রটা।
সংবাদপত্রে কিছু—
অনন্যর প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বিপাশা সংবাদপত্রটা স্বামীর হাতে তুলে দিল।
সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে বুলাতে অনন্যরও সংবাদটার উপরে নজর পড়ল। সেও রুদ্ধশ্বাসে সংবাদটা পড়ে গেল।
রজতবাবু সুইসাইড করেছেন! অস্ফুট কণ্ঠে বললে।
বিপাশার মনের মধ্যে তখন মাত্র একটা কথাই আনাগোনা করছে—যেরাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে সেই দিন সকালে অনন্য বের হয়ে যাবার পর এখানে রজতশুভ্র এসেছিল এবং তাকে তার ফ্ল্যাটে সন্ধ্যায় দেখা করতে বলে গিয়েছিল। অবিশ্যি সেদিনের সে কোন কথাই সে তার স্বামীকে জানায় নি। পরেশকেও বার বার নিষেধ করে দিয়েছিল, সে যেন কোন কথা বাবুকে না জানায়। বিপাশার মনে পড়ছে, সে গিয়েছিল নীলাকাশে-রাত তখন পৌনে আটটা হবে—অনন্য তখনও ফেরেনি—এজেন্টের বাড়িতে একটা পার্টি ছিল—সে ব্যাংক থেকেই বিপাশাকে বিকেলে টেলিফোন করে জানিয়েছিল ফিরতে তার রাত হবে, বিপাশা যেন তার জন্য অপেক্ষা না করে রাত্রের আহার সেরে নেয়।
অনেক রাত্রে—প্রায় সোয়া বারোটা নাগাদ অনন্য ফিরেছিল ট্যাক্সিতে করে। বিকেলেই গাড়ি সে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল অফিস থেকে। এবং এসেই সে জামাকাপড় ছেড়ে শয্যায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত্রে কোন ঘুমের ওষুধ পর্যন্ত সে খায়নি। আশ্চর্য! সেরাত্রে একবারও অনন্যর ঘুম ভাঙেনি। রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে বসেছিল বিপাশা–কিন্তু অনন্যর ঘুম ভাঙেনি।
ঘুমের ওষুধের কথা বলেছিল বিপাশা, ওষুধ খাবে?
না।
ওষুধ খেলে পারতে–
না, প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া ভাবছি—
কি?
আর কোন ওষুধ খাব না।
খাবে না!
না। দেখি না ওষুধ না খেলে কি হয়, এতদিন তো খেলাম!
বিপাশাও আর পীড়াপীড়ি করেনি। বলছে যখন ওষুধ আর খাবে না-থাক না, দেখাই যাক না, ওষুধ না খেলে কি হয়।
দেখা গেল শেষ পর্যন্ত ওষুধ না খেয়েও চমৎকার ঘুমাল অনন্য সারাটা রাত। মনে মনে খুশিই হয়েছিল বিপাশা।
অনন্যর কথায় বিপাশা আবার চমকে ওঠে।
অনন্য বললে, নীলাকাশে রজতবাবু ছিলেন? হঠাৎ ওখানে কেন বল তো?
অ্যাঁ! কিছু বলছ?
রজতবাবুদের তো তোমাদের বাড়ির পাশেই নিজেদের বাড়ি ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
কথাটা বলে বিপাশা চায়ের কাপে পট থেকে চা ঢালতে থাকে।
সেই রাত্রেই বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল।
সেরাত্রেও অনন্য ঘুমের ওষুধ খেল না। শয্যায় গিয়ে শুতে শুতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, তুমি শোবে না?
তুমি শোও—আমি একটু পরে শোব।
অনন্য আর প্রতিবাদ জানাল না। শয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
বিপাশা একটু পরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল।
সারাটা দিন ধরে যে কথাটা তার মনের মধ্যে আনাগোনা করেছে সেই কথাটাই তখনও তার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। একটা অদৃশ্য কাঁটার মতই যেন কি কি করে বিধছে কেবল রজতশুভ্র সুইসাইড করল কেন?
তার সঙ্গে গতরাত্রে রজতের যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, তারপর সে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়েই গৃহে ফিরে এসেছিল।
রজত ঘরের মধ্যেই ছিল—ঘরের দরজাটা অবিশ্যি খোলাই ছিল। বেলটা বাজাতেই রজতের গলা শোনা গেল, ভিতরে আসুন–দরজা ভোলাই আছে!
বিপাশা ঘরে প্রবেশ করতেই রজত যে চেয়ারটায় বসেছিল সেটা থেকে উঠে দাঁড়ায়, মৃদু হেসে বলে, এই যে এসেছ—এস! তোমার জন্যই আমি বসে আছি! দাঁড়িয়ে কেন—বোস!
বিপাশা সামনের সোফাটায় বসল। একবার ভেবেছিলাম—
কি ভেবেছিলে বিপাশা? রজত বললে।
আসব না—
কিন্তু আমি জানতাম বিপাশা—
কি জানতে?
তুমি আসবেই—আর তুমি যদি না আসতে তো আমিও ফাইন্যাল ডিসিশনটা নিতে পারতাম। যাক আমি খুশি হয়েছি যে তুমি এসেছ–
রজত!
বল। তোমার যদি কিছু বলবার থাকে—
আমাকে এখুনি কিন্তু ফিরে যেতে হবে—
ফিরে যাবে!
হ্যাঁ। কারণ তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ—অনন্যকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না—যেতে পারি না।
যাবে না তুমি?
না।
তবে এলে কেন?
ঐ কথাটাই ভাল করে তোমাকে বুঝিয়ে দিতে, তুমি আমাকে মুক্তি দাও—
অনন্যকে সত্যিই তুমি ভালবাসো তাই না, বিপাশা?
সে কথা তো অনেক দিন আগেই তোমাকে বলেছিলাম রজত।
হ্যাঁ বলেছিলে–কিন্তু—
কিন্তু কি?
আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। ঠিক আছে তুমি যাও—
খোলা-মনে কথাটা বলছ তো রজত?
হ্যাঁ—তুমি যাও—তবে আমারও বোধ হয় আর অন্য পথ রইল না।
রজত!
তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষেও বাঁচা সম্ভব নয়—আমি—হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি—এখন আমার সামনে একটি পথই আর আছে–সুইসাইড।
না না! আর্ত চিৎকার করে উঠেছিল অস্ফুট কণ্ঠে বিপাশা।
হ্যাঁ–বিপাশা তাই।
না না—এসব তুমি কি বলছ রজত। ছিঃ ছিঃ, একজন পুরুষমানুষ হয়ে।
তুমি আর এখানে থেকো না বিপাশা, রজত বললে, যাও। বাড়ি যাও। একে আজকের সকালের ব্যাপারে আমি রীতিমত লজ্জিত হয়ে আছি—তারপর যদি তোমার স্বামী জানতে পারেন তুমি এখানে এসেছ—না, না—তুমি যাও বিপাশা। বাড়ি যাও। আমার মন বড় দুর্বল—আমার মত যদি আবার বদলে যায়—যাও তুমি।
আসি তাহলে
হ্যাঁ—এস। আমার একটা অনুরোধ রেখো। আজকের দিনটার কথা ভুলে যেয়ো।
বিপাশা আর কথা বাড়ায়নি। ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল এবং দরজা খুলতেই তার মনে। হল যেন কে একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল—চট করে সরে গেল। এবং করিডোর দিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে গেল সিঁড়ির দিকে।
গতরাত্রের ব্যাপারটার মধ্যে কোন গুরুত্ব দেয়নি বিপাশা কিছু মনেও হয়নি অন্যরকম। অন্যমনস্ক ছিল সেভেবেছিল আশেপাশের ফ্ল্যাটেরই কেউ হয়ত হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে। তা নয়–কেউ হয়ত ভেজানো দরজায় কান পেতে ঘরের মধ্যে তাদের কথা শোনবার চেষ্টা করছিল, আড়ি পেতেছিল। পিছন থেকে লোকটাকে যতটা দেখেছিল-লম্বা সুটপরা লোকটা। সত্যিই যদি ঐ ফ্ল্যাটবাড়ির কেউ না হয়ে থাকে তো–কে হতে পারে লোকটা–আর কেনই বা তাদের কথা শোনবার চেষ্টা করছিল আড়ি পেতে। বড় ঘুম পাচ্ছে।
বিপাশা আর ব্যালকনিতে দাঁড়ায় না। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। ঘরের উজ্জ্বল আলোটা নেভাললা—মৃদু নীলাভ রাত—বাতিটা জ্বলছে। মৃদু নীলাভ আলোয় ঘরের মধ্যে সব যেন কেমন ঝাপসা ঝাপসা।
শয্যার পাশে এসে দাঁড়াল। অনন্য গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।
বিপাশা এসে সোফাটার উপর বসল। ঘুমে যেন চোখের পাতা দুটো একেবারে সীসের মত ভারী হয়ে আসছে। ঘুমাব না—ঘুমাব না করতে করতেও কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বিপাশা বসেবসেই। হঠাৎ ঘুমটা তার ভেঙে যায়—গলার উপরে একটা চাপ পড়ছে। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল—যে হাত দুটো তার গলা টিপে ধরেছিল সেই হাত দুটো গলা থেকে সরিয়ে দেয়, কে–
এ কি! সামনে দাঁড়িয়ে তার স্বামী অনন্য। চট করে এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে ঘরের উজ্জ্বল আলোটা জ্বেলে দিল বিপাশা।
সত্যই অনন্য–স্লিপিং স্যুট পরিধানে অনন্য দাঁড়িয়ে।
বিপাশা! মৃদু ফিসফিস গলায় অনন্য যেন ডাকল।
তুমি-তুমি—
বিপাশা!
তুমি আমার গলা টিপে ধরেছিলে অনন্য? তুমি-তুমি—
আমিনা তো, না, না–না–
হ্যাঁ—জোরে গলা টিপে ধরেছিলে তুমি আমার—
অনন্য ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তখন স্ত্রী বিপাশার মুখের দিকে।
আ—আমি তোমার গলা টিপে ধরেছিলাম! অনন্য আমতা আমতা করে বললে।
হ্যাঁ—
মনে নেই—মনে নেই। মনে করতে পারছি না তো কিছু। বিশ্বাস কর বিপাশা—আমি—
বিপাশা অনন্যর হাত ধরে সোফাটার উপরে এনে বসাল আর দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে।
অনন্য—
বল।
একটা কথার জবাব দেবে?
কি কথার জবাব চাও?
বল আগে যা জিজ্ঞাসা করব তার সত্য জবাব দেবে।
দেব, বল এবারে কি তোমার প্রশ্ন, অনন্য বলল।
তোমার মার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?
কেন তুমি তো জান, একটা দুর্ঘটনায়।
কি সে দুর্ঘটনা?
আমি তখন ছোট ছিলাম—তোমায় তো বলেছি।
ছোট থাকলেও নিশ্চয়ই শুনেছ পরে—কারও না কারোর মুখে—সত্যি কি হয়েছিল, কি কারণে তার মৃত্যু হল?
না—শুনিনি।
শোন নি?
না, না—কেন এক কথা বার বার জিজ্ঞাসা করছ বিপাশা। বলছি তো শুনিনি।
আমি জানতে চাই—কি এমন দুর্ঘটনায় তোমার মার মৃত্যু হয়েছিল যাতে করে তোমার বাবা। পাগল হয়ে গেলেন, পরেশ হয়ত জানে–
জানি না। দেখ আমি জানলে তো বলব। জানি না। কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ অনন্য কেমন। যেন গম্ভীর হয়ে গেল। বাকি রাতটা কেউ আর কারও সঙ্গে কথা বললে না। দুজনে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে রইল। বাইরে রাত ঝিমঝিম করতে থাকে।
সকালবেলা—বেলা তখন সোয়া আটটা হবে। কিরীটী ঐদিনকার সংবাদপত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে দ্বিতীয় কাপ চায়ের আস্বাদ গ্রহণ করছিল, পাশে বসে সুব্রত। জংলী এসে বললে, মল্লিক সাহেব এসেছেন।
কে? সুদর্শন? যা নিয়ে আয়।
একটু পরে জংলীর পিছনে পিছনে এসে ঘরে প্রবেশ করল সুদর্শন।
আরে এস, এস ভায়া—তারপর বল কি খবর, অনেক দিন পরে এলে।
সুদর্শন বসতে বসতে বললে, আপনি তো দাদা আজকাল বড় একটা কারও সঙ্গে দেখাই করেন না শুনতে পাই।
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে।
সুদর্শন বললে, তাই অযথা বিরক্ত করতে আসি না।
বুঝতে পারছি, তা সাবিত্রীর খবর কি?
সে যথারীতি সংসার আর ছেলে নিয়ে আছে—সামনের বছরে ছেলেকে ভর্তি করতে হবে, কোথায় কেমন করে ভর্তি করবে সেটাই এখন তার সর্বক্ষণের চিন্তা।
হ্যাঁ—আজকাল ছেলেমেয়েদের পড়ানো যা একটা প্রবলেম হয়েছে। তা তোমার হঠাৎ আগমনের হেতুটা কি বল?
দিনপাঁচেক আগে একটা নিউজ বের হয়েছে কাগজে, দেখেছেন কিনা জানি না। পার্ক স্ট্রীটের একটা ম্যানসননীলাকাশ নাম, তার চারতলার ফ্ল্যাট থেকে–
মনে পড়ছে না, তা কি সুইসাইড বুঝি—
তাহলে তো গণ্ডগোল মিটেই যেত।
সুদর্শন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলে গেল কিরীটীকে। সব শোনার পর কিরীটী বললে, তাহলে তোমার ধারণা—ব্যাপারটার মধ্যে কোন ফাউল প্লে আছে।
হ্যাঁ—আমার মনে হচ্ছে, ওটা আদৌ সুইসাইড নয়—
হোমিসাইড!
হ্যাঁ—আমার মনে হয়, রজতবাবুকে ঐ কালো কর্ডের ফাঁস গলায় দিয়ে হত্যা করে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
হুঁ। তা তোমাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কি বলছে? মৃত্যুর কারণ কি বলছে রিপোর্টে?
গোলমালটা তো দাদা সেখানেই।
কি রকম!
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলছে—ফ্রাকচার অফ দি বেস-স্কালই নাকি মৃত্যুর কারণ—কজ অব ডেথ।
আর ঐ গলার ফাঁসটা?
বলছে তাদের মতে, ঐ সরু কৰ্ডটা গলায় চেপে বসলেও সেটা নাকি মৃত্যুর কারণ নয়–কারণ–
কি?
কোন অ্যাসফেসিয়ার চিহ্ন নাকি পাওয়া যায়নি মৃতদেহে।
কিরীটী বললে, তা কেসটা যে একটা মার্ডার—গলার ঐ কালো কর্ডের ফসটি ছাড়া আর কোন যুক্তি তোমার আছে কি?
উপর থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়লে দেহের ইনজুরি আরও বেশী থাকত অর্থাৎ যে রকম পাওয়া যেত তাও পাওয়া যায়নি। আর চারপাশে রক্তও বেশী থাকত।
হুঁ। আর কিছু—
তারপর ধরুন দাদা, মৃত্যু ঘটেছে, রিপোর্ট বলছে, রাত সাড়ে দশটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে কোন এক সময়ে। এবং তাই যদি হয় তো ঐ সময় ঐ অত বড় ফ্ল্যাটবাড়িটার মধ্যে কেউ কি এমন জেগে ছিল না যারা একটা মানুষের দেহ অত উঁচু থেকে নীচে পড়লে যে শব্দটা হওয়া স্বাভাবিক সেই রকম একটা শব্দ শুনতে পেত না! অথচ আমি ঐ ফ্ল্যাটবাড়ির প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, সেরকম কোন শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। ব্যাপারটা কি বেশ একটু সন্দেহজনক নয়?
তা তো ঠিকই।
ধরেই নিলাম না হয়, আবার সুদর্শন বলতে লাগল, ব্যাপারটা একটা সুইসাইড—কিন্তু লোকটা হঠাৎ দুতিন দিনের ছুটি নিয়ে এসে নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইসাইড করতে গেল কেন? সরিবাবু ও তার বোন বকুল দেবীর স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায়, বিবাহের দিন ঠিক করবার জন্যই সে আম্বালা থেকে এসেছিল—সেক্ষেত্রে বকুল দেবীর সঙ্গে দেখা হবার আগেই এমন কি ঘটে গেল যাতে করে তাকে ঐভাবে আত্মহত্যা করতে হল শেষ পর্যন্ত!
সুদর্শন থামে না। বলে চলে, অনন্য বক্সী ও তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর কথাটা তো ভুললে চলবে না—রজতবাবুর সঙ্গে একসময় বিপাশার ঘনিষ্ঠতা ছিল—এক পাড়ায় পাশাপাশিই বলতে গেলে বাড়িতে ওরা থাকত। আচমকা অনন্য বক্সী ওদের মাঝখানে এসে পড়ায় সব ওলটপালট হয়ে গেল—অনন্য বক্সীর সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিপাশার বিয়ে হয়ে গেল।
তুমি বলতে চাও, সেখানেও কোন গোলমাল থাকতে পারে—
পারে না কি! আপনিই বলুন!
খবর নিয়েছিলে এবারে কলকাতায় আসার পর বিপাশা ও রজতবাবুর মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা? কিরীটী বললে।
না—এখনও খবর নিইনি।
কেন নিলে না?
আমি এখনও অনুসন্ধান চালাবার মত কোন একটা নির্দিষ্ট পথ খুঁজে পাইনি। আর সেই কারণেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি–
কিরীটী একটু চুপ করে থেকে বললে, সুদর্শন, তোমার মুখ থেকে কেসটা সম্পর্কে যতটুকু শুনলাম তাতে আমার মনে হচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা ফাউল প্লে থাকা হয়ত বিচিত্র নয়। তুমি আপাতত এক কাজ কর।
বলুন দাদা–সাগ্রহে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল সুদর্শন।
তোমরা জানতে পেরেছ শনিবার সকালে রজতবাবু কলকাতায় এসেছিলেন এবং এসে উঠেছিলেন তাঁর বন্ধু সরিৎবাবুর নীলাকাশের চারতলায় ১৪নং খালি ফ্ল্যাটে এবং আরও জানা গেছে একমাত্র সরিৎবাবুর ভৃত্য পঞ্চানন—ঐ পঞ্চাননের কাছ থেকে এবং তার সঙ্গেই কেবল রজতবাবুর দেখা হয়েছিল—খোঁজ করে দেখ—আর কারও সঙ্গে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ঐ দিন সকাল থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত ঐ ১৩১৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ : হয়েছিল কিনা, অবশ্যই তার পরিচিতদের মধ্যে কারও। আচ্ছা পঞ্চানন তো সন্ধ্যার কিছু আগে ছুটি নিয়ে যায় রাত্রের মত—তাই না?
হ্যাঁ-রজতবাবু তাকে রাত্রের মত ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন।
এমনও তো হতে পারে সুদর্শন, সে ছুটি হয়তো রজতবাবু ইচ্ছা করেই দিয়েছিলেন পঞ্চাননকে–মানে কোন বিশেষ কারণে পঞ্চাননের ঐ সময়টা ফ্ল্যাটে উপস্থিতি চান নি বলেই সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত। আরও একটা খবর তোমায় জানতে হবে, নীলাকাশে আসার পর রজতবাবু বের হয়েছিলেন কিনা আর বের হলে কতক্ষণের জন্য বের হয়েছিলেন—পঞ্চাননকে কি বলে গেছেন কোথায় যাচ্ছেন বা কিছু। এবং ঐ সময়ের মধ্যে অর্থাৎ যতক্ষণ ফ্ল্যাটে ছিলেন এবং পঞ্চাননও ছিল—কেউ রজতবাবুর সঙ্গে ফ্ল্যাটে দেখা করতে এসেছিল কিনা। কথাটা তো তুমি পঞ্চাননকে প্রশ্ন করেও জানতে পার।
তা পারি।
হ্যাঁ মনে রেখো পঞ্চানন is a very important clue এই রহস্যের ব্যাপারে। তাকে sidetrack করে যেয়ো না। কারণ একমাত্র ঐ পঞ্চাননই তোমাকে বলতে পারবে—ঐদিন সকাল থেকে ঐ ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ পঞ্চানন ফ্ল্যাটে ছিল—ঐ সময়ে রজতবাবুর detail movements ও activities সম্পর্কে। ওটা জানা তোমার একান্তভাবেই দরকার। সেই সঙ্গে আরও একটা কাজ তোমাকে করতে হবে–
কি দাদা–বলুন?
অনন্য বক্সী ও তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর সঙ্গে দেখা করে তারা ওর এবার কলকাতায় আসা সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা সেটাও তোমার জানা দরকার।
অতঃপর তখনকার মত সুদর্শন বিদায় নিল।
সুব্রত এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবারে বললে, আচ্ছা কিরীটী, এমনও তো হতে পারে—সরিৎবাবু যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তা সব নয়—
কি রকম?
মানে সরিৎবাবু যা বলেছেন তার বন্ধু সম্পর্কে সেটা সব নয়-বন্ধু যখন, তখন আবার অনেক কিছুই হয়ত রজবাবু সম্পর্কে জানেন তিনি—জানাটাও স্বাভাবিক এবং ব্যাপারটা তারই ওখানে ঘটেছে বলে হয়ত অনেক কিছু বলেন নি–চেপে গেছেন অনেক কথা।
কথাটা তোর হয়ত মিথ্যা নয় সুব্রত—কথাটা আমার মনে হয় নি—তুই সুদর্শনকে বললি কেন! আমার মাথার মধ্যেকার গ্রে সেলগুলো সত্যিই বোধ হয় বয়সের দরুন অ্যাট্রফি করে গেছে। নচেৎ–
না—কিরীটী রায় এখনও কিরীটী রায়–casually ব্যাপারটা আলোচনা করছিলি বলেই হয়ত এতক্ষণ কথাটা তোর মনে হয়নি–
কৃষ্ণা এসে ঐসময় ঘরে ঢুকল। বললে, সুদর্শনবাবু এসেছেন?
হ্যাঁ, এসেছিল। এইমাত্র চলে গেল।
তা হঠাৎ এতদিন পরে!
সুব্রতই বললে, বেচারা একটা জটিল মামলায় জড়িয়ে পড়েছে।
খুনোখুনির কোন ব্যাপার নিশ্চয়ই!
সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, অবিশ্যি সুদর্শনের ধারণা তাই।
কি রকম?
এক ভদ্রলোক চারতলা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন—তার তদন্ত করতে গিয়ে সুদর্শনের ধারণা হয়েছে—ওটা তা নয়—একটা মার্ডার। হত্যা!
শকুনের দৃষ্টি সব সময় ভাগাড়ের দিকে, কৃষ্ণা বললে।
তুমি কি মনে কর কৃষ্ণা, কিরীটী মৃদু হেসে বললে, পুলিশ কেবল খুন-ডাকাতি খুঁজেই বেড়ায়!
তা ছাড়া কি? যত সব নৃশংস ব্যাপার!
না কৃষ্ণা, ওরা সদাসতর্ক চোখ মেলে আছে বলেই সমাজের আর দশজন নিশ্চিন্ত হয়ে আছে, ওরা যে সোসাইটির কত বড় উপকার করে
বুঝেছি আর ওদের গুণকীর্তন গাইতে হবে না! সুদর্শন তোমাকে সক্রিয় করে গেছে। তা ঘটনাটা সত্যি কি বল তো সুব্রত?
সুব্রত তখন সংক্ষেপে ঐদিনকার সকালবেলার আলোচনার সারাংশটা বিবৃত করে গেল। সব শুনে কৃষ্ণা বললে, সুদর্শন বোধ হয় ঠিকই অনুমান করেছে।
তোমারও ধারণা তাহলে—
হ্যাঁ খুন—পরিষ্কার মার্ডার। দুটি পুরুষ-দুটি নারী। গণ্ডগোেল ঐ চার মূর্তিকে নিয়েই।
কি রকম? সুব্রত শুধালে।
রজতশুভ্র, অনন্য বক্সী–বিপাশা আর বকুল। কি গো, তুমি যে একেবারে চুপচাপ? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে কৃষ্ণা।
ভাবছি—
কি, শুনি?
পুরুষ না নারী?
নারী কখনই নয়–
তা হলে তো তোমার মতে ঐ অনন্য বক্সীই রজতশুভ্রর গলায় ফাঁস দিয়ে চারতলার ব্যালকনি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।
আমি কি তাই বলছি! আমি বলেছি কেবল গোলমালটা ঐখানেই—
কিন্তু তাই যদি হয়ে থাকে–অর্থাৎ যদি অনন্য বক্সীই হয়—তার রয়েছে স্ট্রং অ্যালিবাই— বালিগঞ্জ সারকুলার রোড আর পার্ক স্ট্রীটে যেমন যথেষ্ট ব্যবধান—তেমনি সে ব্যবধান অতিক্রম করে গেলেও সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটে অত রাত্রে আকস্মিক প্রবেশ নিশ্চয়ই রজতশুভ্র (যদি অবিশ্যি তাই হয়ে থাকে) নিশ্চয়ই ভাল চোখে দেখেননি—হৃষ্টমনেও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন নি।
কেন শুনি? কৃষ্ণার প্রশ্ন।
বুঝলে না—পরস্পর তো পরস্পরের প্রেমের রাইভ্যাল ছিলেন!
কৃষ্ণা বললে, তাই হয়তো একটা ড়ুয়েল লড়ে গেছেন দুজনে সেই রাত্রে ঐ ফ্ল্যাটে—
সুব্রত বললে, ফলে একজনের মৃত্যু।
কৃষ্ণা ঝাঝিয়ে ওঠে, কেন–হতে পারে না?
পারবে না কেন, পারে পারে কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছ রজতশুভ্র ছিলেন একজন আর্মি অফিসার। আগ্নেয়াস্ত্র নিশ্চয়ই কিছু একটা তাঁর কাছে ছিল—সেক্ষেত্রে কিরীটী বললে, দেখ তুমি যাই বল—
কৃষ্ণা বললে, অনন্য বক্সীর উপরে আমার সন্দেহ হচ্ছে—
অর্থাৎ তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে, কিরীটী বললে, অনন্য বক্সীর মনের মধ্যে তার স্ত্রী বিপাশা দেবীর প্রণয়ীর সম্পর্কে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সে দ্বন্দ্বটা ধূমায়িত হতে হতে পর্বতের আকার ধারণ করেছিল—অ্যারাবিয়ান নাইটের সেই গল্প, কলসীর থেকে ধোঁয়া বেরুতে বেরতে এক দৈত্যের আকার ধারণ করেছিল–
কৃষ্ণা হেসে ফেলে।
হাসছ কি–কিছুই বিচিত্র নয়। মানুষের মন না মতি। তোমার ইঙ্গিতটা সত্যিই রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু আপাতত এক পেয়ালা কফি হলে মন্দ হত না।
সকাল থেকে ক’কাপ হয়েছে জান?
এত ভোলা মন নয় আমার—এবারে হলে হবে পঞ্চম।
সুদর্শনের মনের মধ্যে রজতশুভ্রর ব্যাপারটা কিছুটা সংশয়ের মধ্যে দোল খাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটীর ওখান থেকে বের হয়ে জীপে উঠে বসতে বসতে একটা সুস্পষ্ট কর্মপন্থা তার মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে থাকে। তাকে আবার নীলাকাশে যেতে হবে সি আই ডি অফিসার সুধাকান্তকে সঙ্গে করে। সুধাকান্ত লোকটার বয়েস খুব বেশী হয়নি, এখনও ৩৪ ৩৫ হবে—চাকরিতে বছর দশেক ঢুকেছে, কিন্তু যেমন বুদ্ধিমান তেমনি কর্মঠ ও করিৎকর্মা। লালবাজারে ফিরে এসে সুদর্শন প্রথমেই সুধাকান্তর খোঁজ নিল। সে ঐসময় তার ঘরেই ছিল।
সুদর্শন মল্লিক ডেকেছে শুনে সুধাকান্ত তার অফিস ঘরে এসে ঢুকল, ডেকেছেন স্যার?
হ্যাঁ, সুধাকান্ত—বোস। আমার সঙ্গে এক জায়গায় তোমাকে যেতে হবে।
কখন যেতে হবে বলুন।
আপত্তি যদি না থাকে তো এখুনি যেতে চাই—
বেশ চলুন।
দুজনে এসে আবার জীপে উঠে বসল। সুদর্শনই ড্রাইভারকে নীলাকাশে যেতে বলল।
সেদিন কি একটা পাবলিক হলিডে। অফিস-আদালত ছুটি।
সরিৎকে তার ফ্ল্যাটেই পাওয়া গেল।
সরিৎই নয় কেবল–বকুলও ছিল। বকুল পাটনায় তখনও ফিরে যায়নি। আগামীকাল রাত্রের ট্রেনে সে ফিরে যাবে কথা হয়েছে।
সরিৎ সুদর্শন ও সুধাকান্তর আগমনে একটু বিস্মিতই হয়। কিন্তু তা হলেও আহ্বান জানায়, আসুন মিঃ মল্লিক–
একটু বিরক্ত করতে এলাম সরিৎবাবু–সুদর্শন বললে।
কি ব্যাপার বলুন তো মিঃ মল্লিক।
দেখুন রজতশুভ্রবাবুর ব্যাপারটা আমাদের ধারণা সুইসাইড নয়—a clean case of murder!
হত্যা?
হ্যাঁ—
কে হত্যা করবে তাকে? আর কেনই বা করবে? সরিৎ বললে।
কেন করবে বা কেন করেছে, সেটা অবিশ্যি আরও তদন্তসাপেক্ষ, তবে কেউ যে হত্যা করেছে সে রাত্রে সেটা ঠিকই। আপনার চাকর পঞ্চানন আছে?
আছে।
একবার ডাকবেন তাকে?
নিশ্চয়ই সরিৎ পঞ্চাননকে ডাকল, সে কিচেন থেকে বের হয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। পঞ্চানন—
আজ্ঞে–
এঁরা লালবাজার থেকে আসছেন—পুলিস অফিসার—এঁরা কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান তোমাকে।
পঞ্চানন কেমন যেন ভীত ও বিহুল দৃষ্টিতে প্রথমে সুদর্শন তারপরে তার পাশে উপবিষ্ট সুধাকান্তর মুখের দিকে তাকাল!
পঞ্চানন! সুদর্শন ডাকল।
আজ্ঞে—
সেদিন—মানে যেদিন তোমার বাবুর বন্ধু রজতবাবু এখানে এসেছিলেন, কখন এসেছিলেন?
সকাল তখন সোয়া সাতটা হবে।
তুমি তো বিকেলে ছুটি নিয়ে যাও!
আজ্ঞে।
কখন কটার সময় গেছলে?
সাড়ে পাঁচটার পর–
তাহলে ঐ সোয়া সাতটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত তুমি ছিলে?
আজ্ঞে—
রজতবাবুও কি ছিলেন?
আজ্ঞে না। দশটা নাগাদ বের হয়ে যান—
ফিরলেন কখন?
বেলা পৌনে একটা তখন হবে।
তারপর আর বের হননি?
না।
কেউ ঐ সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল—কোন ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা?
না তো।
ঠিক মনে আছে?
আছে বই কি—কেউ আসেনি।
রজতবাবু ঐ সময়টা কি করছিলেন?
মধ্যে ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন—অনেকক্ষণ ধরে—আর একবার দেখেছিলাম অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে কেবল পায়চারি করছেন আর করছেন।
সেটা কখন?
বাইরে থেকে ফিরে আসবার পর–
তুমি একবার সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ঘুরে আসবার কথা বলতেই তিনি বুঝি তোমাকে সে রাত্রের মত ছুটি দিয়ে দিলেন। সুদর্শন পুনরায় প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে। বললেন—রাতের মত তোমাকে ছুটি দিচ্ছি আমি বললাম রাত নটা-দশটার মধ্যে ফিরে আসব তখন বললেন, না, না তুমি সকালেই ফিরে এস। তাতে আমি বললাম, আপনার রাত্রের খাবারের কি হবে? উনি বললেন, বাইরের হোটেলেই খেয়ে নেবেন বাবু। সত্যি বলছি, উনি যে অমন একটা কাণ্ড করবেন আমি ভাবতেই পারিনি।
ঠিক আছে পঞ্চানন, তুমি যাও—
পঞ্চানন চলে গেল।
সরিৎ ও বকুলকে সুদর্শন গোটাকতক প্রশ্ন করল, তারপর একসময় বললে, বকুল দেবী, আপনি করে পাটনায় ফিরছেন?
কাল রাত্রের ট্রেনে।
আপনি আর কয়েকদিন থেকে যান। সুদর্শন বললে।
কেন?
আমাদের আরও কিছু অনুসন্ধান বাকি আছে, সেটা শেষ হলে যাবেন।
বকুল বললে, কিন্তু আমাকে আপনাদের প্রয়োজন কিসের। ঐ ব্যাপারের তো কিছুই আমি জানি না–আমি এখানে ছিলামও না।
না ছিলেন না কিন্তু তা হলেও আপনার সঙ্গে রজতবাবুর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল—
সরিৎ বললে, তাতে কি হয়েছে। ওকে আটকাচ্ছেন কেন। বেচারা একেই সমস্ত ব্যাপারটার আকস্মিকতায় রীতিমত শক্ড্ হয়েছে—আদৌ থাকতে চাইছিল না—আমিই কয়েকটা দিন ওকে, ধরে রেখেছিলাম—
আমার কিন্তু মনে হয় সরিৎবাবু, ওঁর এখানে আরও কয়েকটা দিন থেকে যাওয়াই ভাল।
বকুল বলে ওঠে, ঠিক আছে দাদা–উনি যখন বলছেন আমি আরও দুচার দিন পরেই না হয় যাব।
ধন্যবাদ জানিয়ে তখনকার মত সুদর্শন ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিল।
সেখান থেকে ওরা এল অনন্য বক্সীর গৃহে।
ছুটির দিন হলেও অনন্য বক্সী ছিল না—ছিল বিপাশা। পরেশের মুখে লালবাজার থেকে আসছেন শুনে বিপাশা ওদের দোতলায় বসবার ঘরে ডেকে পাঠাল।
দুচারটে মামুলী কথাবার্তার পর সুদর্শন বললে, আপনি তো রজতবাবুকে বেশ ভালভাবেই চিনতেন!
হ্যাঁ—অনেকদিনের পরিচয় আমাদের।
রজতবাবু আপনাকে চিঠিপত্র লিখতেন?
না।
কখনও আসতেন?
না।
এ বাড়িতে কখনও আসেন নি?
এসেছিল।
কবে?
যেদিন দুর্ঘটনাটা ঘটে সেইদিনই সকালে।
সুদর্শন কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল। বললে, তাহলে সেই শনিবার তিনি সকালে এখানেই এসেছিলেন?
হ্যাঁ—কিন্তু আপনি কথাটা কার কাছে শুনলেন?
যেমন করে তোক শুনেছি। তা কতক্ষণ ছিলেন এখানে?
ঘণ্টাখানেক হবে।
কি কথাবার্তা হয়েছিল আপনাদের?
বিপাশা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর সেদিনকার সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল।
আপনি গিয়েছিলেন নীলাকাশে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
গিয়েছিলাম।
কখন?
রাত তখন পৌনে আটটার মত হবে।
দেখা হয়েছিল নিশ্চয়ই আপনার রজতবাবুর সঙ্গে?
হয়েছিল।
কি কথা হয়েছিল আপনাদের মধ্যে যদি বলেন বিপাশা দেবী!
ক্ষমা করবেন অফিসার। সেটা একান্তভাবেই আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
হুঁ। আপনার স্বামী জানেন ব্যাপারটা—মানে রজতবাবু তো এখানে এসেছিলেন—আপনি পরে নীলাকাশে গিয়েছিলেন!
না।
বলেননি তাঁকে কোন কথা?
না।
হঠাৎ ঘরের জানালার ওপাশ থেকে ঐসময় একটা মুখ চকিতে সরে যেতে দেখে সুদর্শন দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, কে-কে ওখানে?
বিপাশা বললে, কোথায় কে?
একটু আগে ঐ জানালা থেকে উঁকি দিচ্ছিল—মনে হচ্ছে আপনাদের সেই চাকরটা!
পরেশ?
হবে। ডাকুন তো একবার তাকে!
বিপাশা পরেশকে ডাকতেই সে ঘরে ঢুকল।
তোমার নাম পরেশ?
আজ্ঞে—
একটু আগে ঐ জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলে কেন?
আজ্ঞে আমি-কই না তো!
পরেশ—আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারনি। বল, কেন উঁকি দিচ্ছিলে? যদি সত্য কথা বল তো—আমি তোমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাব থানায়—বল কেন উঁকি দিচ্ছিলে— আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিলে, তাই না?
বিশ্বাস করুন বাবু, কালীর দিব্বি—
প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে উঠল সুদর্শন, এই চুপ রও! সুধাকান্ত, নীচের থেকে সার্জেন্টকে ডেকে আন, ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাক থানায়।
দোহাই বাবু আপনার—আমি আড়ি পেতেছিলাম—
কেন?
আজ্ঞে—
সুদর্শন বিপাশার দিকে তাকাল, লোকটা কতদিন আপনাদের এখানে আছে বিপাশা দেবী?
আমি আমার স্বামীর মুখে শুনেছি, বিপাশা বললে, আমার শ্বশুরমশাইয়ের আমলের লোক–
আপনাদের বিয়ে কতদিন হয়েছে?
মাস আষ্টেক—
আপনার শ্বশুরমশাই—
পরেশই জবাব দিল, আজ্ঞে তার তো মাথা খারাপ–রাঁচিতে পাগলাগারদে আছেন।
তাই নাকি বিপাশা দেবী! সুদর্শনের প্রশ্ন বিপাশাকে।
হ্যাঁ।
কতদিন আছেন তিনি সেখানে?
তা প্রায় শুনেছি উনিশ বছর।
বলেন কি—অনেকদিন তাহলে! তা কি হয়েছিল হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন কেন?
শুনেছি একটা দুর্ঘটনার কিছু পরেই তার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে—অনেক চিকিৎসা হয়, কিন্তু দিন দিন ক্রমশ অবনতি ঘটায়—আমার শ্বশুরের এক বোেন তাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেন।
কি দুর্ঘটনা—
বিপাশা তখন তার স্বামীর মুখে থেকে যা শুনেছিল সব বলে গেল।
তাহলে আপনার স্বামী কি দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যাতে আপনার শ্বশুরমশাইয়ের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে, তা বলেন নি?
তিনি বলেছেন—তিনি জানেন না।
হঠাৎ পরেশের দিকে তাকিয়ে ঐসময় সুদর্শন প্রশ্ন করল, তুমি তো এ বাড়ির অনেকদিনের পুরানো লোক, তুমি জান না?
আজ্ঞে শুনেছি গিন্নীমা হঠাৎ মারা যাওয়াতেই কত্তাবাবু যেন কেমন হয়ে যেতে লাগলেন দিনকে দিন চুপচাপ ঘরের মধ্যে অন্ধকারে বসে থাকতেন একা একা—আপনমনে বিড় বিড় করে কি সব বলতেন, তারপরই একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন, কেবল চেঁচাতেন–রাক্ষুসী—ডাইনী—বেশ্যা!
রাক্ষুসী, ডাইনী, বেশ্যা!
আজ্ঞে।
কাকে বলতেন?
তা তো জানি না বাবু—
তোমার গিন্নীমাকে দেখেছ?
আজ্ঞে না—আমি তার মারা যাবার এক বছর পরে এ-বাড়িতে এসেছি—
তা তুমি কার কাছে ঐ কথা শুনলে পঞ্চানন?
পিসিমার মুখে।
পিসিমা এখন কোথায়?
তিনি বছর কয়েক আগে মারা গেছেন। সেই থেকেই এত বড় বাড়ির মধ্যে আমি আর দাদাবাবুই ছিলাম—বৌদিমণিও সেদিন এলেন।
পরেশ!
আজ্ঞে—
যাও তুমি এবারে নীচে যাও—আমি না ডাকা পর্যন্ত আসবে না উপরে, মনে থাকে যেন–আবার আমাদের কথা শোনবার চেষ্টা করলে বা উপরে এলে সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে গ্রেপ্তার করে চালান দেব।
পরেশ মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ক্রমশ পরেশের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলা
বিপাশা দেবী—আপনার ও রজতবাবুর মধ্যে আলাপ পরিচয় ছিল বিবাহের পূর্বে সেকথা মিঃ বক্সী জানেন না?
জানে।
জানেন?
হ্যাঁ। বিবাহের পূর্বে চার-পাঁচ বৎসর আমাদের মধ্যে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা ছিল—
একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু আপনাদের ঐ পরেশ ভৃত্যটিকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না!
বিপাশা কোন কথা বলবার আগেই অনন্য এসে ঘরে ঢুকল ঐ মুহূর্তে।
বিপাশার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
এঁরা লালবাজার থেকে আসছেন সুদর্শনবাবু—সুধাকান্তবাবু—
ভ্রূ দুটো কুঞ্চিত করে অনন্য প্রশ্ন করে, লালবাজার থেকে কেন?
সুদর্শন বললে, বসুন মিঃ বক্সী, আমি বলছি—আমরা রজতবাবুর ব্যাপারে—
রজতবাবু তো সুইসাইড করেছেন–
না, তিনি খুন হয়েছেন।
কি বলছেন সুদর্শনবাবু—খুন? তাঁকে মার্ডার করা হয়েছে!
হ্যাঁ–ব্রুটালি মার্ডার! নিষ্ঠুর হত্যা। বিপাশা দেবী আপনি একটু এ ঘর থেকে যান—আপনার স্বামীকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
আমাকে?
হ্যাঁ—যান বিপাশা দেবী–
না—ওর যাওয়ার দরকার নেই—তুমি বোস বিপাশা—
বিপাশা একটু যেন বিব্রত বোধ করে—তাহলেও ঘর ছেড়ে চলে যায় না। অনন্য বললে, বলুন কি জিজ্ঞাসা আছে আপনার? কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না অফিসার, রজতবাবু যদি খুনই হয়ে থাকেন, আপনারা যা বলছেন তার সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
আপনাদের দুজনকেই রজতবাবু চিনতেন—
হ্যাঁ—সামান্যই পরিচয় ছিল।
সেটা হয়ত আপনার সঙ্গে ছিল, কিন্তু আপনার স্ত্রী তার দীর্ঘদিনের পরিচিত ছিলেন—
কে বললে?
আমরা শুনেছি।
কার কাছে শুনলেন?
সরিৎবাবু ও তার বোনের কাছ থেকে।
তাঁরা কে?
চেনেন না তাদের?
না।
সত্যিই বলছেন চেনেন না?
না। এই প্রথম নাম দুটো আপনার মুখ থেকে শুনলাম।
তাই বুঝি! শুনেছি আপনার মা নাকি কি এক দুর্ঘটনায় মারা যান! কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ–
তা কি দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি?
জানি না।
বেশ—এবারে বলুন তো—যে শনিবার রাত্রে রজতবাবু খুন হন–সেদিন যে সকালবেলা তিনি দশটা সোয়া দশটার সময় এখানে এসেছিলেন তা আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন!
না তো—
পরেশ আপনাকে বলেনি?
পরেশ!
হ্যাঁ–সে আপনাকে বলেছিল কথাটা।
Absurd! কে বললে? সে আমাকে কোন কথা বলেনি।
যদি বলি পরেশই বলেছে—
পরেশ বলেছে! অনন্যর গলার স্বরটা সহসা যেন কেমন মিনমিনে হয়ে আসে।
হ্যাঁ—পরেশ। কি, বলেনি সে?
হ্যাঁ—মানে ঐ রকমই কি যেন বলেছিল পরেশ?
কখন বলল?
অফিসে আমাকে গিয়ে বলে এসেছিল দুপুরে—
এবারে বলুন, আপনি নীলাকাশে গিয়ে রজতবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
বিপাশা স্থিরদৃষ্টিতে তখন স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে আছে, তার সমস্ত মুখটা তখন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
না, না—রজতবাবুর সঙ্গে আমি দেখা করতে যাব কেন? তাছাড়া লোকটাকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি।
ঘৃণা করেন?
হ্যাঁ–-ও কি একটা ভদ্রলোক—একটা ছোটলোক—
ছোটলোক?
নয়? ছোটলোক না হলে কেউ অপরের বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করে তার স্ত্রীর হাত ধরে টানাটানি করে—অসম্মান করে। ঘৃণায় আক্রোশে অনন্যর স্বরটা যেন রুক্ষ হয়ে ওঠে।
আপনি তাহলে মিঃ বক্সী শুনেছেন, রজতবাবু আপনার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন!
লোকটাকে হাতের কাছে পেলে আমি চাবকে তার পিঠের ছাল তুলে দিতাম–ভাগ্য ভাল তার যে সে সময় আমি অফিসে ছিলাম। এখানে উপস্থিত ছিলাম না!
মিঃ বক্সী—তাহলে পরেশের মুখে সংবাদটা শোনার পরও আপনি নীলাকাশে যান নি?
না।
আচ্ছা মিঃ বক্সী—আপনাদের বিরক্ত করবার জন্য আমি দুঃখিত—আজ তাহলে উঠি–সুদর্শন সুধাকান্তকে নিয়ে নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
লালবাজারে ফিরে এসে সুদর্শন দেখে সরিৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
সরিৎবাবু–কি ব্যাপার—
দেখুন মিঃ মল্লিক, একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি—অবশ্যই আমার বলা উচিত ছিল—
কি কথা?
সরিৎ পকেট থেকে কাগজ-মোড়া একটা ছোট রুমাল, দুটো টুকরো পোড়া সিগারেটের শেষাংশ ও লাল প্লাস্টিকের চুড়ির ভাঙা টুকরো বের করে সুদর্শনের সামনে টেবিলের ওপরে রাখল।
এ তো দেখছি দুটুকরো ভাঙা প্ল্যাস্টিকের চুড়ির অংশ, একটা লেডিজ রুমাল, আর দুটো পোড়া সিগারেটের অংশ! এসব কোথায় পেলেন সরিৎবাবু?
পরশু সকালে আমার বসবার ঘরে—পঞ্চানন ঝট দিতে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছে।
আপনার বসবার ঘরে?
হ্যাঁ।
সুদর্শন প্রথমেই রুমালটা তুলে নিল, রুমালে তখনও রয়েছে মিষ্টি একটা সেন্টের গন্ধ এবং আরও একটা গন্ধ-গন্ধটাকে ঠিক কিসের গন্ধ সুদর্শন বুঝে উঠতে পারে না। প্ল্যাস্টিকের চুড়ির ভাঙা টুকরো দুটো পরীক্ষা করল—শেষে সিগারেটের শেষাংশ দুটো—দামী বিলাতী সিগারেট–ক্যারাভান এ মার্কাটা তখনও পড়া যায়।
এগুলো মনে হল, সরিৎ বললে, আমার ঘরে পাওয়া গিয়েছে আপনাকে জানানো দরকার বলেই নিয়ে এলাম।
জিনিসগুলো আবার কাগজে মুড়ে সুদর্শন ড্রয়ার খুলে তার মধ্যে রেখে দিয়ে বললে, ধন্যবাদ সরিৎবাবু।
সরিৎ বললে, আমি কিন্তু সিগারেট খাই না, মিঃ মল্লিক!
আপনার বন্ধু রজতবাবু স্মোক করতেন না?
না।
কখনও সখ করেও না।
না, আগে তো কখনও দেখিনি—তবে ইতিমধ্যে যদি সে সিগারেট ধরে থাকে বলতে পারি।
কতদিন তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
তা ধরুন প্রায় বৎসরখানেক—
তিনি কতদিন আম্বালায় ছিলেন?
মাস চারেক আগে সে আম্বালায় পোস্টে হয়ে এসেছিল—
ঠিক আছে—আপনি এখন আসুন।
সরিৎ বিদায় নিল।
সুদর্শনও বসল না। কিরীটীর সঙ্গে একবার দেখা করা প্রয়োজন–উঠে পড়ল সুদর্শন। কিরীটীর ওখানে গিয়ে দেখল কিরীটী কোথায় বের হয়েছে–কৃষ্ণা বললে, সুব্রতকে নিয়ে বের হয়েছে ঘণ্টা দুই আগে—ফেরার সময় হয়েছে, তুমি বোস না।
ঠিক আছে বৌদি-আমি বসছি।
কিরীটী আর সুব্রত ফিরে এল আরও আধঘণ্টা পরে, ঘরে ঢুকে সুদর্শনকে দেখে বললে, সুদর্শন কতক্ষণ?
তা প্রায় আধ ঘণ্টা–
কিরীটী বসতে বসতে বললে, তোমার কেসটায় শেষ পর্যন্ত আমাকেও জড়িয়ে পড়তে হল ভায়া–
তাই নাকি।
হ্যাঁ-এরিয়া কমান্ড অফিস থেকে ব্রিগেডিয়ার শর্মা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই গিয়েছিলাম, শর্মার সঙ্গে আমার অনেক কালের পরিচয়—ভারি চমৎকার লোক।
তা হঠাৎ সেখানে—তার আবার আপনাকে কি প্রয়োজন পড়ল!
ক্যাঃ চৌধুরীর ব্যাপারটা নিয়েই—
ক্যাঃ চৌধুরী।
হ্যাঁ—তোমাদের রজতশুভ্র। হেড কোয়ার্টার থেকে জরুরী নির্দেশ এসেছে, রজতশুভ্রর মৃত্যুর ব্যাপারটা ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখবার জন্য।
তাই বুঝি ব্রিগেডিয়ার শর্মা–
হ্যাঁ, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ফোনে অবিশ্যি ব্যাপারটা বলেননি—কেবল। বলেছিলেন, বেচারী ভীষণ বিপদে পড়েছেন—আমি যদি তাকে একটু সাহায্য করি।
এ তো ভালই হল দাদা। কিন্তু তারাও কি ব্যাপারটা একটা হোমিসাইড বলে ধরেছে!
পুলিশের বড়কর্তা আই. জি. মিঃ গুপ্ত নাকি তাই বলেছেন শর্মাকে। শর্মা মিঃ গুপ্তকে অনুরোধ করেছেন আমাকে যথাসম্ভব মদৎ দেবার জন্য। মিঃ গুপ্তও সেখানে ছিলেন।
তাহলে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে বলুন দাদা!
তা কতকটা চিন্তিতই বলে যেন মনে হল এখানকার কমান্ড হেডকোয়ার্টারকে। তারপর তোমার কথা বল।
আমার কথা—
কতদূর এগুলে বল না, যেখানে ছিলে এখনও সেখানেই আছ?
সুদর্শন একে একে ঐদিনের ঘটনা সব বলে গেল এবং সবশেষে কাগজের মোড়কটা পকেট থেকে বের করে কিরীটীর হাতে দিয়ে বলল, এগুলো দেখুন দাদা। কিরীটী চুড়ির টুকরো, সিগারেটের টুকরো পরীক্ষা করে রুমালটা নাকের সামনে তুলে ধরে শুঁকতে শুঁকতেই একসময় সুদর্শনের মুখের দিকে তাকাল।
সুদর্শন!
বলুন দাদা—
রুমালে মাখা সেন্টের গন্ধ ছাপিয়ে যে একটা পরিচিত গন্ধ নাকে আসছে!
কিসের গন্ধ দাদা?
মনে হচ্ছে ক্লোরোফর্মের গন্ধ।
ক্লোরোফর্মের গন্ধ?
হ্যাঁ–ইয়েস—আবার একবার ভাল করে রুমালটার ঘ্রাণ নিয়ে কিরীটী বললে, হ্যাঁ ভায়া— it is chloroform! এই রুমালে যে ক্লোরোফর্ম মাখানো হয়েছিল, সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে এই ফেইন্ট গন্ধ থেকে। রুমালটা নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটের ঘরের মেঝেতে পাওয়া গিয়েছে যখন—কিরীটী আর কিছু বলল না। তবে সুদর্শনের মনে হল কিরীটী যেন কি ভাবছে।
সুদর্শন—
বলুন দাদা–
আমি এখন একেবারে নিশ্চিন্ত একটা ব্যাপারে। ক্যাঃ চৌধুরীকে সেরাত্রে হত্যাই করা হয়েছিল।
গলায় ফাঁস দিয়ে?
হয়ত ক্লোরোফর্ম আর ফাঁস দুটো একসঙ্গেই কাজ করেছে।
আপনি তাহলে বলতে চান দাদা, আগে ক্যাঃ চৌধুরীকে হত্যা করা হয়েছে, তারপর ডেড বডিটা চারতলার ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটা আত্মহত্যা দাঁড় করবার জন্য!
হয়ত তাই—তবু কিন্তু সব কিছুর মধ্যে একটা খটকা থেকে যাচ্ছে।
খটকা!
হ্যাঁ—ফাঁসটা খুলে নিল না কেন হত্যাকারী—আর ফাঁসই লাগিয়ে যদি হত্যা করা হয়ে থাকত-ক্লোরোফর্মের প্রয়োজন হল কেন? কেবলমাত্র ফাঁস লাগিয়ে বা কেবলমাত্র ক্লোরোফর্ম নিয়েই যখন ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যেত, তখন দুটোরই প্রয়োজন হল কেন?
হয়ত ফাঁস লাগাবার পরে struggle করছিল ক্যাঃ চৌধুরী, তখন ক্লোরোফর্ম দেওয়া হয়েছে!
তুমি যা বলছ তা হয়ত অসম্ভব কিছু নয় ভায়া–কিন্তু তাহলে—
কি দাদা?
He or She!
মানে?
মানে হত্যাকারী কোন পুরুষ না স্ত্রীলোক। সেই প্রশ্নটাই সর্বপ্রথম মনে জাগবে। নাহে, ব্যাপারটা গোলমেলে। Complicated!
কিরীটী একটু থেমে কতকটা যেন আপনমনেই বলতে লাগল, সত্যি মানুষের মন কি বিচিত্র। আর কি বিচিত্ৰই না মানুষের ভালবাসার টানাপোড়েন। কি জান ভায়া—এখন আমি প্রায়ই ভাবি—ভালবাসার সত্যিকারের সংজ্ঞাটা কি। প্রেম কাকে বলে। শুধু কি পরস্পরের প্রতি নারীপুরুষের পরস্পরের একটা দেহগত যৌনাত্মক আকর্ষণ, না ঐ স্থূল যৌন আকর্ষণের বাইরেও কিছু আছে!
সুব্রত এতক্ষণ ওদের কথা নিঃশব্দে শুনছিল, এবারে বললে, যৌনানুভূতিকে বাদ দিয়ে ভালবাসা বা প্রেম বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না কিরীটী।
না রে সুব্রত, আমি তোর কথাটা পুরোপুরিভাবে মেনে নিতে পারলাম না।
কেন?
এই বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে দুটি পুরুষ ও দুটি নারী আছে—অনন্য আর রজতশুভ্র-বিপাশা আর বকুল। বিপাশা যাই বিবৃতি দিন না কেন, তার হয়ত কোন এক সময় সত্যিই কিছু দুর্বলতা ছিল তার প্রতিবেশী রজতশুভ্রর উপরে এবং যেটা সে ভুলবার চেষ্টা করেছে তার জীবনে অনন্যর আবির্ভাবের পর এবং ভুললেও হয়ত একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি রজতশুভ্রকেনচেৎ সে ঐ রাত্রে নীলাকাশের ফ্ল্যাটে রজতের সঙ্গে দেখা করতে যেত না।
সে তো সে গিয়েছিল, সুব্রত বললে, নিছক প্রাণের দায়ে।
অত্যন্ত দুর্বল explanation!
মানে?
সেও অনায়াসেই তার স্বামীকে সব কথা জানাতে পারত এবং সেখানে না গেলেও পারত।
তবে সময় পেল কোথায়?
কেন, বাড়িতে ফোন তো ছিল।
তার স্বামী হয়ত অন্যরকম ভাবত–বিশ্বাস করত না তাকে হয়ত পুরোপুরি।
হ্যাঁ, সেও তাই ভেবেছিল—আর ভেবেছিল এই কারণে—
কি?
তার মনের মধ্যে তখনও রজতশুভ্রর প্রতি একটা অবচেতন স্বীকৃতি ছিল। কিম্বা—
কি বল?
স্বামীর দিক থেকে তার এমন কোন ভয়ের কারণ হয়ত ছিল, যেজন্য সে স্বামীকে শেষ পর্যন্ত জানাতে সাহস পায়নি। না রে—একটা গোলমাল কোথাও জট পাকিয়ে আছে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে!
গোলমাল?
হ্যাঁ—যেটা একমাত্র ওদের সঙ্গে কথা না বলে কোন মীমাংসায় পৌছানো সম্ভব নয়। সুদর্শন?
দাদা—
ওদের স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে না?
কেন পারবে না।
তাহলে সেই ব্যবস্থাই কর—আর—
আর কি দাদাসুদর্শন তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
বকুলের আপাতত তো পাটনায় ফেরা হতে পারে না। অনুরোধে না হলে তোমার পুলিশী অধিকার জারি করতে হবে।
আপনি বলতে চান দাদা, জোর করে বলে দেব সরিৎবাবুকে কথাটা—
প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। কারণ—
বলুন দাদা।
না, এখন থাকit is too early! তার আগে একবার নীলাকাশের ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখতে চাই।
কখন যাবেন বলুন?
আজ সন্ধ্যায়ই–
ঠিক আছে আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।
সেই রাত্রির পর থেকেই—যে রাত্রে অনন্য ঘুমের মধ্যে বিপাশার গলা টিপে ধরেছিল—স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে যেন একটা কোথায় সুক্ষ্ম চিড় ধরেছিল। মনে হচ্ছিল, দুজনই যেন দুজনার কাছ থেকে নিজেদের অজ্ঞাতেই একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে—একটা যেন পরস্পরের সম্পর্কের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান রচিত হচ্ছে। অথচ দুজনাই প্রাণপণে সব কিছু ভুলে পরস্পর পরস্পরের কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু পারছে না কিছুতেই পারছে না যেন। দুজনই দুজনার সঙ্গে কথা বলছে—কিন্তু ঠিক যতটুকু প্রয়োজন তার বেশী নয়। একটা প্রাচীর যেন ওদের দুজনার মধ্যখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে দুজনে এসে ব্যালকনিতে বসেছিল। বিপাশা চা করে এগিয়ে দিয়েছে কাপটা অনন্যর দিকে, কিন্তু অনন্য কেমন যেন অন্যমনস্ক। নিষ্ক্রিয়ভাবে দূরে সন্ধ্যার আলোকিত রাস্তার দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে আছে।
বিপাশা বললে, চা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
হ্যাঁ–হ্যাঁ, চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল অনন্য। দুটো চুমুক দিয়ে আবার সামনের টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল।
কি, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে তো চা! বিপাশা বললে।
না—ঠিক আছে। জবাব দিল অনন্য।
একটা কথা বলব?
কি বল না।
তোমাকে তো আমি বলেছি কেন রজতের সঙ্গে সেরাত্রে দেখা করতে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে তুমি যেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না—
না, না—তা কেন?
অনন্য–সত্যি যা তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও চাপা দেওয়া যায় না।
আমার একটা কথা তোমাকেও বলা বোধ হয় উচিত ছিল। তাই এই কটা দিন ধরে ভাবছি—
কি কথা?
আমার মায়ের ব্যাপারটা—
কোন কথা না বলে বিপাশা স্বামীর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।
মাকে আমার বাবা—
ছাড় ওসব কথা।
না—তোমার জানা দরকার—আর আমারও এতদিন কথাটা না এড়িয়ে গিয়ে তোমাকে বলা উচিত ছিল—মাকে আমার বাবা–
থাক না অনন্য—যা অতীত তা ভুলে থাকাই ভাল।
না শোন—বাবা মাকে হত্যা করে এই ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন—
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ—কারণ আমি ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছিলাম।
কি বলছ তুমি?
আমার বয়স তখন কতই বা হবে—দশ কি এগারো–পাশের ঘরেই আমি ছিলাম ঘুমিয়ে, হঠাৎ মার গলার স্বরে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। মার গলা কানে এল। শুনলাম মা বলছেন, তুমি বিশ্বাস কর, অবিনাশ আমার আপন খুড়তুতো ভাই-কোনদিন কোন পাপ আমাদের মনের– মধ্যে জাগেনি, বাবা চিৎকার করে উঠলেন, মিথ্যা কথা, ও ছেলে আমার নয়—তাই তাকে একটু আগে আমি গলা টিপে শেষ করে দিয়েছি
সে কি–ওগো এ তুমি কি করেছ–ছি ছি-আমার–
বাবা আবার চিৎকার করে উঠলেন, পাপের শেষ আমি রাখব না—
তারপর?
আমি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম—দেখলাম বাবা দুহাতে মার গলা টিপে ধরলেন। মা ছটফট করতে করতে একসময় এলিয়ে পড়লেন—আর বাবা তখন মার অচেতন দেহটা দুহাতে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরের বাইরে এসে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিলেন।
বিপাশা যেন একেবারে পাথর।
অনন্য একটু থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, পরের দিন পুলিশ এল—বাবার সঙ্গে সে-সুমকার পুলিশ কমিশনারের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। প্রায়ই তিনি আমাদের এখানে আসতেন, মার সঙ্গে বসে বসে গল্প করতেন–
তিনি–
তিনিই হচ্ছেন অবিনাশ মামা–মার আপন খুড়তুতো ভাই–যৌথ পরিবারে একসঙ্গে মানুষ হয়েছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত অবিনাশ মামাই ব্যাপারটা আত্মহত্যা বলে চাপা দিয়ে দেন বোধ হয়, অবিশ্যি সবটাই আমার ধারণা—আমি পুরোপুরি সব জানি না। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনার পর থেকেই বাবা ক্রমশ যেন কেমন হয়ে যেতে লাগলেন। বেশীর ভাগই চুপচাপ—একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতেন—আপনমনে বিড় বিড় করতেন আর ঘরের মধ্যে একা একা পায়চারি করতেন।
ভাবতে পার সে-সময়কার মনের অবস্থা আমার বিপাশা, রাতের পর রাত আমি ঘুমোতে পারতাম না, ঘুমোলেই দেখতাম এসে সামনে দাঁড়িয়েছে—মাথাটা ফেটে তার চৌচির হয়ে ঘিলু বের হয়ে পড়েছে—অনন্য দুহাতে মুখ ঢাকল।
বিপাশা নিঃশব্দ স্থির প্রস্তরমূর্তির মত বসে আছে।
অনন্য আবার বলতে লাগল, ক্রমশ বাবা যেন কেমন অ্যাবনরম্যাল হয়ে যেতে লাগলেন— ঐ সময় আমার পিসিমা এলেন আমাদের বাড়িতে পিসিমা আসাতে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বাবার ঐ একমাত্র বোন, বিধবা বিবাহের তিন বৎসর পর পিসেমশাই একটা ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন পিসিমা-বাবা তাকে নিয়ে এলেন এই বাড়িতে। কিন্তু বাবা আর ভাল হলেন না। আমি যেবারে ম্যাট্রিক দিই—বাবা একেবারে ঘোর উন্মাদ হয়ে গেলেন—তখন ডাক্তারদের পরামর্শেই তাঁকে রাঁচীতে রেখে আসা হল। বুঝতেই পারছ তখন আমি বেশ বড় হয়েছি—সব বুঝতে পারি। এই বিরাট বাড়িতে তখন আমি, পিসিমা আর কিছুদিন হল বাবাকে দেখাশুনা করবার জন্য পরেশকে রাখা হয়েছিল, সেই পরেশ। পরেশ কিন্তু বাবাকে রাঁচীতে পাঠাতে চায় নি। সে বলেছিল বাবার ভাবনা কাউকে ভাবতে হবে না। সেই সর্বক্ষণ তার দেখাশুনা করবে। কিন্তু বাবা তখন রীতিমত ভায়োলেন্ট।
সেখানকার চিকিৎসায়, অনন্য বলতে লাগল, বাবার অবস্থা ক্রমশ একটু একটু ভাল হয়ে উঠতে লাগল—অনেকটা শান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু তারপর আর কোন প্রােগ্রেসই হয়নি! চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। আলো একেবারেই সহ্য করতে পারেন না—অন্ধকার ঘরে থাকেন। ডাক্তাররা বললেন সুস্থ আর হবেন না আগের মত, আর স্বাভাবিক হবেন না। ব্রেনের কিছু সেলস্ অ্যাট্রফি করে গিয়েছে, বাবা সেই অবস্থাতেই এখনও আছেন—বি.এ. পড়ি যখন মধ্যে মধ্যে তাঁকে দেখতে যেতাম।
তোমাকে চিনতে পারেন?
না।
আচ্ছা, ঐ যে মণির কথা বললে—সে—
আমার ছোট একটি ভাই হয়েছিল, আমার থেকে আট বছরের ছোট-বাবা তাকে গলা টিপে হত্যা করেছিলেন। এই সব কথা কতদিন তোমাকে বলব ভেবেছি, কিন্তু পারিনি বলতে। কে যেন আমার গলা টিপে ধরেছে—আমার কণ্ঠ রোধ করেছে। বাবার কথা কোনদিনই আমি ভুলতে পারিনি। আমার মনের একটা অংশ যেন বাবা অধিকার করে রেখেছেন। তারপর দেখা দিল আমার মনের মধ্যে এক ভয়–
ভয়! কিসের ভয়?
বাবা যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ান। একমাথা কাঁচা-পাকা রুক্ষ এলোমেলো চুল—একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি—আর বড় বড় দুটো রক্তচক্ষু। রাত্রে শয্যায় গিয়ে শুলেই যেন বাবার আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করত। আর মনে হত কে যেন অন্ধকারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে চোখ বুজে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতাম। দিনের বেলাটা কোন ভয় আতঙ্ক থাকত না-রাত্রি হলেই হত শুরু সেই ভয়ের বিভীষিকা। এমনি করেই চলছিল—তোমার সঙ্গে আলাপ হল ঐ সময়–কেন যেন তোমার কাছে গেলে আমার সবর্ভয় চলে যেত।
বিপাশা চেয়ে আছে নিঃশব্দে তখনও অনন্যর মুখের দিকে। আশঙ্কা অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাস যেন তার দুচোখের দৃষ্টিতে।
অনন্য আবার একটু থেমে বলতে লাগল, তুমি এলে এ-বাড়িতে—ভাবলাম আর বুঝি আমাকে সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। দুঃস্বপ্নের পীড়ায় আমাকে বুঝি আর পীড়িত হতে হবে না। কটা দিন ভালই কাটল, কিন্তু ক্রমশ আবার যেন আগের সেই দ্বিধা, সংশয় ও ভয় আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল একটু একটু করে। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। ঘুমোবার চেষ্টা করতাম কিন্তু পারতাম না। মনে হত কে যেন দুহাতে ঠেলে আমাকে শয্যা থেকে তুলে দিচ্ছে। ঘরের বাইরে সিঁড়ির দিকে ঠেলছে—এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতাম উপরে—কে যেন ঠেলত আমাকে সামনের দিকে–
দাদাবাবু!
কে?
আজ্ঞে আমি পরেশ। পরেশ এসে সামনে দাঁড়াল।
ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকাল অনন্য পরেশের দিকে–বিরক্ত কণ্ঠে বললে, কি হয়েছে?
দুজন বাবু এসেছেন—
কে বাবু?
একজন মনে হল সেই পুলিশ অফিসার—অন্যজনকে চিনতে পারলাম না।
ব্যালকনির আলোটা তখনও জ্বালানো হয়নি—অন্ধকার। নীচের বাগানে অন্ধকারে ঝোপে ঝোপে একঝাক জোনাকি আলোর বিন্দু ছড়িয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
আপনমনেই অনন্য বললে, আবার পুলিশ কেন! যা এইখানেই ডেকে আন—
পরেশ চলে গেল।
একটু পরেই সুদর্শনের সঙ্গে কিরীটী এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করল। বিপাশা ইতিমধ্যে ব্যালকনির আলোটা জ্বেলে দিয়েছিল।
নমস্কার। সুদর্শন বললে, অনন্যবাবু, আপনাকে আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম।
বসুন—অনন্য বললে।
সুদর্শন বললে, এঁকে আপনি চিনবেন হয়তনাম হয়ত শুনে থাকবেন—কিরীটী রায়।
কিরীটী নামটা শুনেই বিপাশা যেন কেমন ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকাল।
সুদর্শন আবার বললে, পুলিশের বড়কর্তা মিঃ গুপ্তর নির্দেশেই উনি এখানে এসেছেন—
কেন? অনন্য শুধাল।
ক্যাঃ চৌধুরী যিনি কয়দিন আগে নীলাকাশের চারতলার ফ্ল্যাট থেকে–
বুঝেছি, তা আমার কাছে কেন মিঃ মল্লিক! তাছাড়া আপনি তো একবার এসেছিলেন—আমার যা বলবার সবই তো সেদিন বলেছি—
জবাব দিল কিরীটী, জানি অনন্যবাবু, সুদর্শন ও সুধাকান্তর মুখ থেকে সবই আমি শুনেছি—
তবে—তবে আবার এসেছেন কেন?
আমাদের আরও কিছু জানা দরকার, কিরীটী বললে।
কিন্তু আমি তো আর কিছু জানি না।
আপনার স্ত্রী বিপাশা দেবী—শুনেছি আমরা, যেদিন ক্যাঃ চৌধুরী মারা যান সকাল দশটা সোয়া-দশটা নাগাদ তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
হ্যাঁ।
কি কথাবার্তা হয়েছিল সে-সময় বিপাশা দেবীর তার সঙ্গে? কথাটা বলে কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল বিপাশার মুখের দিকে।
অনন্য যেন কি বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপাশাই বললে, আমাকে রজত জোর করে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছিল—
আঃ, বিপাশা থাম—অনন্য বাধা দেবার চেষ্টা করে।
অনন্য, ওঁদের জানা দরকার ব্যাপারটা—হ্যাঁ, শুনুন কিরীটীবাবু, অনন্যোপায় হয়েই তখন তাকে আমি নিরস্ত করি সন্ধ্যায় তার ওখানে যাব বলে—
গিয়েছিলেন আপনি? কিরীটীর প্রশ্ন। হারাত সোয়া আটটা নাগাদ
দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে আপনার?
হ্যাঁ—বলে, কি কথাবার্তা হয়েছিল উভয়ের মধ্যে বিপাশা একে একে বলে গেল এবং এও বললে, ঘর থেকে বেরুবার মুখে কাকে আড়ি পাততে লক্ষ্য করেছিল।
তাকে চিনতে পারেন নি?
না।
অনন্যবাবু?
কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল অনন্য।
আপনি তো পরেশের মুখ থেকেই জানতে পারেন ক্যাঃ চৌধুরীর আসার কথা!
হ্যাঁ।
তারপর আপনি কি করলেন?
আমি ব্যাপারটায় কোন গা দিই নি—
দেন নি?
না।
কেন?
কারণ ব্যাপারটায় কোন গুরুত্ব দেওয়া দরকার মনে করি নি।
আপনি সেরাত্রে কখন বাড়ি ফেরেন?
রাত সোয়া বারোটা নাগাদ বোধ হয়। একটা পার্টি ছিল, পার্টি সেরে ফিরি।
আপনি ক্যাঃ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন নি?
না।
কিন্তু আমাদের সংবাদ অন্যরকম—
মানে? আপনি গিয়েছিলেন নীলাকাশে—
না—না-অনন্য বলে ওঠে।
বিপাশার কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় ঐ সময়।
দেখুন অনন্যবাবু, অস্বীকার করে কোন লাভ নেই। আপনি গিয়েছিলেন আমরা জানি। কি, যান নি?
আমি–
বলুন কখন গিয়েছিলেন—নীলাকাশের দারোয়ান আপনাকে যেতে দেখেছে সাড়ে আটটা নাগাদ–
হ্যাঁ, আমি গিয়েছিলাম—
অনন্য–অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে যেন বিপাশা।
হ্যাঁ বিপাশা—তুমি তখন ঘরের মধ্যে রজতবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলে—
কেন—কেন গিয়েছিলে? বিপাশা বললে, তুমি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারনি অনন্য!
তোমাকে আমি বিশ্বাস করি বিপাশা–তুমি বিশ্বাস কর—
তবে–তবে কেন গিয়েছিলে সেখানে একটা চাকরের কথা শুনে?
অনন্য বললে, রজতের সঙ্গে একটা শেষ বোঝাপড়া করব বলেই গিয়েছিলাম, অন্য কোন কারণে নয়, তুমি বিশ্বাস কর—
দেখা হয়েছিল আপনাদের? কিরীটীর প্রশ্ন।
না।
কিরীটী বললে, দেখা হয়নি—দেখা না করেই চলে এসেছিলেন ক্যাঃ চৌধুরীর সঙ্গে?
তার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি। তাই আর দেখা করিনি শেষ পর্যন্ত।
তবে আবার দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন কেন, যদি আর দেখা করার কোন প্রয়োজনই বোধ করেন কি?
কে বললে আবার আমি গিয়েছিলাম? অনন্যর গলার স্বরে কেমন যেন একটা দ্বিধাসংকোচ।
ঐ দারোয়ানই বলেছে যে, আবার–হ্যাঁ, আবার অনেক রাত্রে সেখানে আপনি গিয়েছিলেন মিঃ বক্সী।
অনন্য একেবারে চুপ।
কি, জবাব দিন আমার প্রশ্নের। কখন গিয়েছিলেন আবার দ্বিতীয়বার সে রাত্রে নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটে?
রাত সাড়ে এগারোটায়—কিন্তু–
কি?
ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের মধ্যে নেই রজত, বাথরুমের দরজা খোলা—ব্যালকনির দরজাটাও খোলা—তা হলেও প্রথমটায় বাথরুমে ঢুকে দেখি, তারপর ব্যালকনিতে ঢুকে দেখি—
কি, কি দেখলেন?
রজত পড়ে আছে ব্যালকনিতে, সে—সে তখন মৃত। আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াইনি, ছুটে নিচে পালিয়ে আসি। বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবুরজতকে আমি হত্যা করিনি। হয়ত হয়ত বেঁচে থাকলে তাকে আমি হত্যাই করতাম, কিন্তু—
তারপর বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। হঠাৎ যেন একটা পাষাণভার স্তব্ধতা ঘরের মধ্যে জমাট বেঁধে ওঠে।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল পুনরায় কিরীটীই। সে বললে, অনন্যবাবু, আপনার মার কিভাবে মৃত্যু ঘটেছিল নিশ্চয়ই আপনি জানেন?
অনন্য যেন একেবারে পাথর। কেবল বিপাশার মুখের দিকে সে চেয়ে আছে। অসহায় বিষণ্ণ দৃষ্টি।
বিপাশা এ সময় বললে, একটা দুর্ঘটনায় আমার শাশুড়ি–
প্রশ্নটা আপনাকে করিনি, কিরীটী বললে, করেছি আপনার স্বামী অনন্যবাবুকে। জবাবটাও তার কাছ থেকে চাই। বলুন অনন্যবাবু, আমি যে প্রশ্ন করেছি তার জবাবটা দিন।
একটু আগে বিপাশাকে যে কথাগুলো বলেছিল অনন্য, কিরীটীকেও সেই কথাগুলোই বলে গেল ধীরে ধীরে।
সব শুনে কিরীটী বললে, এখন আপনার বাবা কেমন আছেন?
একেবারে শান্ত, তবে কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। কাউকে চিনতেও পারেন না। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে থাকেন সর্বক্ষণ সেলের মধ্যে। আর হাতে একটা সুতো নিয়ে কেবল পাকান।
কবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল?
আমাদের বিয়ের মাসখানেক আগে বিয়ে করছি কথাটা বলতে গিয়েছিলাম তাকে। কিন্তু বাবা আমার দিকে তাকালেনও না—একটা কথাও বললেন না।
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুমালটা আর প্লাস্টিকের চুড়ির টুকরোটা পকেটে থেকে বের করে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বললে, দেখুন তো বিপাশা দেবী, এ দুটো চিনতে পারেন?
না।
এগুলো কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন? নীলাকাশে সরিৎবাবুর ফ্ল্যাটের মেঝেতে! ভাল করে পরীক্ষা করে দেখুন আবার বিপাশা দেবী, এটা একটা লেডিজ রুমাল-এর এক কোণে ইংরাজী অক্ষরে লাল সুতো দিয়ে লেখা একটা ইংরাজী অক্ষর বি।
বিপাশা—অনন্য স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, তোমার রুমাল না ওটা?
না—শান্ত দৃঢ় গলায় জবাব দিল বিপাশা।
কিরীটী বললে, এই প্লাস্টিকের চুড়ির টুকরো–
আমি কখনও হাতে চুড়িই পরি না—দেখছেন না আমার হাতে সোনার বালা ছাড়া কোন চুড়ি নেই! আর কিছু আপনার জিজ্ঞাস্য আছে মিঃ রায়?
একটা প্রশ্ন আর করব—রজতবাবু আপনাকে চিঠি লিখতেন—আর আপনিও জবাব দিতেন
মধ্যে মধ্যে
সে লিখত কিন্তু আমি তার একটা চিঠিরও কোন জবাব দিইনি—হাতে এলেই ছিড়ে ফেলে দিতাম।
ধন্যবাদ—আর আপনাকে বিরক্ত করব না—চলি-নমস্কার—চল সুদর্শন—
দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ওখান থেকে সোজা সুদর্শন আর কিরীটী এল নীলাকাশে। রাত তখনও বেশী হয়নি, নয়টা হবে।
ডোর-বেল বাজাতেই ভৃত্য এসে দরজা খুলে দিল।
সুদর্শনের পরনে ছিল পুলিশের ইউনিফর্ম—পঞ্চানন একটু যেন হকচকিয়ে যায় ওদের দেখে।
সুদর্শন বললে, সরিৎবাবু আছেন?
আজ্ঞে না, তিনি তো এখনও ফেরেন নি। পঞ্চানন বললে।
তার বোন?
হ্যাঁ, দিদিমণি আছেন।
তাকেই তাহলে খবর দাও। বলবে লালবাজার থেকে মিঃ মল্লিক এসেছেন—
খবর দিতে হল না-বকুল ওদের গলা শুনেই বের হয়ে এসেছিল ঘর থেকে। বকুলের পরনে সাধারণ একটা মিলের শাড়ি-চুল রুক্ষ। চোখ দুটো যেন কিছুটা ফোলা-ফোলা।
বকুল দেবী, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। সুদর্শনই বললে।
আসুন—
কিরীটী আর সুদর্শন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
বসুন।
সরিৎবাবু এখনও ফেরেন নি?
না-দাদা তার এক বন্ধু আগরপাড়ায় খুব অসুস্থ তাকে দেখতে গেছে। ফিরতে রাত হবে বলে গেছে।
সুদর্শন নিজে সোফার উপরে বসতে বসতে বললে, বসুন বকুল দেবী।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বকুলকে লক্ষ্য করছিল। রোগা পাতলা চেহারা, বর্ণশ্যাম কিন্তু চোখেমুখে একটা চমৎকার আলগা শ্ৰী আছে। বিশেষ করে চোখ দুটি সত্যিই সুন্দর। বকুল কিন্তু বলা সত্ত্বেও বসে না–দাঁড়িয়েই থাকে।
বসুন বকুল দেবী।
দাদাও নেই—আপনারা কাল আসবেন, বকুল বললে।
কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত সুদর্শন বললে, কাল প্রয়োজন হলে আবার আসতেই হবে, তবে এসেছি যখন আপনার সঙ্গে কথাটা সেরে যাই—
আমার সঙ্গে—
হ্যাঁ-বসুন না।
বকুল সামনের সোফাটায় বসল। পঞ্চানন দাঁড়িয়ে তখনও। সুদর্শন তাকে চোখের ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে যেতে বললে। পঞ্চানন চলে গেল।
বকুল দেবী–কথা শুরু করল কিরীটী, আপনি আমাকে হয়ত চেনেন না—আমার নাম—
পূর্বে দেখা কখনও না হলেও আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি, বকুল বললে।
চিনতে পেরেছেন?
হ্যাঁ—আপনি কিরীটী রায়বকুলের গলাটা যেন কিরীটীর মনে হল একটু কেঁপে গেল।
বকুল দেবী-রজতবাবুর সঙ্গে তো আপনার বিবাহ স্থির হয়ে গিয়েছিল, তাই না? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, এই মাসেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
আপনি কলকাতায় কবে আসেন?
রবিবার সকালে।
কোন্ ট্রেনে?
কেন বলুন তো!
না, তাই জিজ্ঞাসা করছি—কোন ট্রেনে?
পাঞ্জাব এক্সপ্রেসে—
কটার সময় এসে হাওড়ায় পৌঁছান।
ভোর সাতটায়।
তারপর সোজা এখানে চলে আসেন বোধ হয়?
হ্যাঁ।
কিন্তু আপনি তো এখানে এসে পৌছান বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ। আপনার হাওড়া থেকে। এখানে ট্যাক্সিতে আসতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগল?
হ্যাঁ—মানে অন্য জায়গায় পথে একটু কাজ সেরে আসতে দেরি হয়ে গেছে—
আপনি কিন্তু ঠিক সত্য কথাটা বলছেন না বকুল দেবী, কিরীটী শান্ত গলায় বললে।
মানে–কি বলতে চান আপনি-আমি মিথ্যা বলছি!
মিথ্যা না বললেও সত্য কথাটা আপনি বলছেন না।
আমি মিথ্যা বলিনি—সত্যিই বলছি–
বকুল দেবী—আমার দুটো চোখ যদি মিথ্যা না দেখে থাকে তো–আপনি এসেছেন রবিবার নয়–শনিবার সন্ধ্যায় এবং ট্রেনে নয়—প্লেনে!
কি বলছেন কিরীটীবাবু?
আমি সে সময় এয়ারপোর্টে ছিলুম—যে প্লেনে আপনি এসেছেন শনিবার, সেই প্লেনেই। পাটনা থেকে আমার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল, তাকে রিসিভ করতে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে।
বকুল যেন একেবারে বোবা। পাথর।
কিরীটী বলতে লাগল শান্ত গলায়, হয়ত আপনিও লক্ষ্য করেছেন, একটা মোটামত ভারী গোঁফওয়ালা দামী স্যুট পরা হাতে একটা অ্যাটাচি কেস এক ভদ্রলোককে, যিনি ঠিক আপনার সঙ্গে সঙ্গে এসে প্লেন থেকে নেমে লাগেজের জন্য, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন কি মনে পড়ছে—আমার সেই বন্ধুটি দিল্লীর পুলিশের একজন বড়কর্তা এবং তিনিও আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করবেন, কারণ তিনিও একবার একজনকে দেখলে বড় একটা ভোলেন না।
বকুল পূর্ববৎ নীরব।
হ্যাঁ–আপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। কিরীটী আবার বললে।
হ্যাঁ—আমি শনিবার সন্ধ্যায় প্লেনেই এসেছি–মিনমিন গলায় বকুল বললে।
তারপর বোধ হয় সোজা এখানে আসেন, রজতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে–অবশ্য সবটাই আমার অনুমান।
না।
কি, না?
আমি পরের দিন দশটায় এখানে আসি।
কেন, আপনি তো জানতেন রজতবাবু এখানে আছেন! আপনার আগেই এসে পৌঁছে যাচ্ছেন। তবে সেদিনই এলেন না কেন? তার জন্যই তো কলকাতায়—তাই নয় কি–
বকুল আবার চুপ। মুখে কোন কথা নেই।
বকুল দেবী, আপনার ডান হাতের কবজিতে ছোট্ট একটুকরো অ্যাড়হিসিভ প্ল্যাস্টার লাগানো আছে দেখছি—কি হয়েছে, কেটে গেছে বুঝি কবজির কাছে?
হ্যাঁ—মানে—
তা কেমন করে কাটল? কিসে কাটল? হাতে তো দেখছি—এক হাতে একগাছা লাল রংয়ের—বোধ হয় প্ল্যাস্টিকের চুড়ি, অন্য হাতের চুড়িটা কোথায় গেল?
অন্যটা ভেঙে গেছে আজ সকালে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে—
কিরীটী পকেট থেকে লাল প্লাস্টিকের ভাঙা চুড়ির অংশটা কাগজের মোড়ক খুলে বের করে বললেন, দেখুন তো বকুল দেবী, এটা আপনার সেই ভাঙা চুড়িরই অংশ কিনা!
বকুলের দুচোখের দৃষ্টি ভাঙা প্লাস্টিকের চুড়ির অংশটার প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। বকুল যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে।
এটা কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন বকুল দেবী, এই ঘরেরই মেজেতে—আর কবে এটা পাওয়া গিয়েছে জানেন, সোমবার সকালে ঘর ঝাঁট দেবার সময় মেজেতে। বকুল দেবী, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন—আপনি আপনার চুড়িটার ভাঙা সম্পর্কে যা বললেন এইমাত্র, সেটা সত্য নয়! এবারে বলুন, কখন কেমন করে চুড়িটা আপনার ভেঙেছিল?
বকুল পূর্ববৎ স্তব্ধ।
এই ভাঙা চুড়ির টুকরা কি প্রমাণ করছে জানেন?
কিরীটীর কণ্ঠস্বর ঋজু ও কঠিন। সে বলতে লাগল, আপনি পরের দিন সকাল দশটা সাড়ে দশটায় নয়, অনুমান যদি আমার মিথ্যা না হয় তো—আপনি শনিবার রাত্রেই কোন এক সময় এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন–
না, না,—একটা চাপা আর্তনাদ যেন বের হয়ে এল অকস্মাৎ বকুলের কণ্ঠ চিরে।
হ্যাঁ, এসেছিলেন—আপনি এসেছিলেন সেই শনিবার রাত্রেই সত্যকে অস্বীকার করে কোন লাভ হবে না। সত্যকে চাপা দেবার চেষ্টা করলেও তা প্রকাশ পাবেই।
হ্যাঁ–হ্যাঁ—অস্ফুট চিৎকার করে বকুল বলে ওঠে, হ্যাঁ এসেছিলাম বকুলের সর্বশরীর তখন থর থর করে কাঁপছে।
রজতবাবুকে আপনি ভালবাসতেন—
বাসতাম। বাসতাম কিন্তু আমি জানতাম না—জানতে পারিনি মানুষটা এত নীচ—একটা জানোয়ারজানেন সে আমাকে একলা ফ্ল্যাটের মধ্যে পেয়ে হঠাৎ সে আমার উপরে বলাৎকার করবার চেষ্টা করে, আমি প্রাণপণে বাধা দেবার চেষ্টা করি—শেষটায় আমার এক প্রচণ্ড ধাক্কায় সে গিয়ে ছিটকে পড়ে সোফার ধারে লাগে মাথায়, জ্ঞান হারায়, আমি—আমি তখন তার গলায় যে কারে বাঁধা মাদুলীটা ছিল সেটা তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে তার শ্বাসরোধ করি—
হত্যা করলেন শ্বাসরোধ করে তাকে?
হ্যাঁ–হত্যা করে আমি বের হয়ে যাই—মৃতদেহটা মেঝের ওপর পড়ে থাকে।
কিন্তু আপনি জানেন না বকুল দেবী–রজতবাবুর তখনও মৃত্যু হয় নি—হি ওয়াজ সিম্পলি অ্যানকনসাস—নট ডেড!
না–না, সে মরে গিয়েছিল। আমি জানি সে মরে গিয়েছিল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে।
না, তার মৃত্যু ঘটে ওপর থেকে নীচে কমপাউন্ডে ফেলে দেবার জন্য এই চারতলা থেকে–
বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, আমি তাকে ফেলে দিইনি নীচে–
আমি তা বিশ্বাস করি, কিরীটী শান্ত গলায় বললে, সেটা আপনার পক্ষে আদৌ সম্ভবপর ছিল না। অত বড় একটা লাশকে তুলে নিয়ে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া আপনার ক্ষমতায় কুলাত না—
সুদর্শন ঐ সময় বললে, তবে কে-কে ফেলে দিল নীচে রজতবাবুর অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি থেকে নীচের কমপাউন্ডে?
বকুল দেবী ননস্যাম ওয়ান এলস্। অন্য অন্য কেউ।
পঞ্চানন কি? সুদর্শনের প্রশ্ন।
না। সে তো সেসময় ছিলই না—আমি তার মুভমেন্টস্ খোঁজ করে জেনেছি সে নয়। তবে কে বকুল দেবী জানেন সেটা উনিই বলুন কে সে? কিরীটী বললে।
আমি–জানি না।
জানেন। জানেন আপনি বকুল দেবী, বলুন কে—কে সে?
আমি চলে গিয়েছিলাম জানি না–
জানেন আপনি—আপনি সব দেখেছেন সেরাত্রে পরের ব্যাপারটা, কারণ আপনি তারও পরে এখান থেকে গিয়েছিলেন—
জানি না আমি জানি না। বকুল সহসা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বকুল কাঁদছে সোফার ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে।
চল সুদর্শন—কিরীটী বললে।
দাদা–
হ্যাঁ চল–লিভ হার অ্যালোন, লেট হার ক্রাই!
কিরীটী আর সুদর্শন ঘর থেকে বের হয়ে এল এবং নীলাকাশে পুলিশের প্রহরা রেখে এসে জীপে উঠে বসল।
জীপ ছেড়ে দিল। দুজনাই চুপ।
দাদা–সুদর্শন ডাকল।
কি, বল।
বকুল দেবীই তাহলে হত্যাকারিণী রজতবাবুর?
না।
কিন্তু–
বকুল দেবীর অবিশ্যি ধারণা শ্বাসরোধেই রজতশুভ্রর মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু তা নয়। জ্ঞান হারিয়েছিলেন মাত্র রজতশুভ্র-বকুল দেবী উত্তেজনার মাথায় রজতবাবুর গলার কারটা দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে চাইলেও রজতবাবুর মৃত্যু তাতে ঘটেনি।
তাহলে কে সে—কে হত্যাকারী?
বকুল দেবী রজতবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন হতভম্ব হয়ে হয়ত বসে ছিলেন, আর তখুনি জোরে বেলটা বোধ হয় বেজে ওঠে ভয় পেয়ে বকুল দেবী পাশের ঘরে সম্ভবত আত্মগোপন করলেন, পাছে ধরা পড়ে যান। দরজাটা খোলাই ছিল—সেই খোলা দরজাপথে এবারে হত্যাকারী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। লোকটা কে এবং কি করছে—অতঃপর আমার অনুমান, দরজার আড়ালে থেকে বকুল দেবী সবই দেখেছেন সেরাত্রে।
তবে—তবে তিনি তার নামটা প্রকাশ করছেন না কেন? আর হত্যাকারীই বা ঘরে কেউ আছে কিনা পরীক্ষা না করে না দেখে বাকি কাজটা করল কেন?
হয়ত-হয়ত দুজনার মধ্যে দেখা হয়েছিল—
দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ—আমার অনুমান তাই, এবং যেহেতু উভয়ে উভয়ের হয়তো পরিচিত বলেই কেউ মুখ খোলেনি।
আপনি তাহলে বুঝতে পেরেছেন দাদা, রজতবাবুর হত্যাকারী কে?
অনুমান করতে পেরেছি বৈকি। কিন্তু একটা জায়গায় বিশ্রী একটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে সুদর্শন–জটটা না খোলা পর্যন্ত হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারছি না। কাল তো রবিবার–
হ্যাঁ।
কাল সকাল দশটা নাগাদ এস আমার ওখানে একবার, ডাঃ দাশগুপ্তর ওখানে যাব—তারপর
তারপর কি?
অনন্য বক্সীর গৃহে।
সুদর্শন কিরীটীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডাঃ মনসিজ দাশগুপ্তের সঙ্গে কিরীটীর কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না—কিরীটী সুদর্শনকে বলেছিল পরের দিন সকালে তাকে নিয়েই ডাঃ দাশগুপ্তের ওখানে যাবে, কিন্তু কিরীটী সকালবেলাই ডাঃ দাশগুপ্তকে ফোন করে তার গৃহে চলে গেল সুদর্শন আসবার আগেই।
কিরীটীর নামই শুনেছিলেন ডাঃ দাশগুপ্ত, চাক্ষুষ পরিচয় ছিল না। বললেন, কি সৌভাগ্য আমার–কোন দিন ভাবিনি আপনার সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ আসবে—বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য?
আপনার এক রোগী সম্পর্কে কিছু জানবার জন্য আমি এসেছি ডাঃ দাশগুপ্ত—
রোগী?
হ্যাঁ, আপনি অনন্য বক্সীর চিকিৎসা করছেন শুনেছি—
ঠিকই শুনেছেন–কার কাছে শুনলেন?
তার স্ত্রীর কাছে। আপনাদের মনোবিজ্ঞানের সব দুরূহ রোগের সঙ্গে আমারও কোন পরিচয় নেই—আপনি যদি অনন্য বক্সীর ব্যাপারটা আমাকে একটু বলেন।
ইট ইজ এ কমপ্লিকেটেড কেস!
কি রকম।
বলতে পারেন সাধারণ কথায়—তার মধ্যে সর্বক্ষণ একটা ড়ুয়েল পার্সোনালিটির টানাপোড়ে চলেছে। আর সেটার মূলে, আমার ধারণা, তার মার একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু–
আপনি জানেন কিসে তার মার মৃত্যু ঘটেছিল?
না, কেবল ওঁরা বলেছেন একটা দুর্ঘটনায়—
তার মাকে তার বাবা গলা টিপে হত্যা করেছিলেন।
সত্যি?
হ্যাঁ। তারপর দোতলা থেকে নীচে ফেলে দেন মৃতদেহটা।
হরিবিল। তা আপনি জানলেন কি করে?
বিপাশা দেবীই বলেছেন।
তিনি তাহলে ব্যাপারটা জানতেন?
না, মাত্র গতকালই তাঁর স্বামীর মুখ থেকে সব শোনেন। অনন্যবাবু বললেন, ব্যাপারটা তাঁর। চোখের সামনেই ঘটেছিল।
তা হঠাৎ তাকে হত্যা করলেন কেন ভদ্রলোক?
স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ হওয়ায়, অথচ ভদ্রমহিলা ইনোসেন্ট ছিলেন।
হুঁ। এখন বুঝতে পারছি—সেটাই ক্রমশ অনন্যবাবুর মধ্যে একটা জটিল কমপ্লেকসের সৃষ্টি করেছিল-যার ফলে তার মধ্যে একটা সুইসাইডাল টেনডেনসি ডেভলাপ করেছে। কিন্তু সৌভাগ্য, তাঁর স্ত্রী সত্যিই তাকে ভালবাসেন তিনিই এযাবৎকাল তাকে রক্ষা করে আসছেন—তবে শেষ পর্যন্ত পারবেন কিনা জানি না।
আপনি নীলাকাশের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সংবাদপত্রে পড়েছেন ডাঃ দাশগুপ্ত?
পড়েছি।
তাকে হত্যা করা হয়েছে—
সুইসাইড নয় তাহলে ব্যাপারটা?
না। আচ্ছা আমি তাহলে উঠি—
এক কাপ চা খাবেন না?
পরে একদিন আসব—আজ নয়—আজ আমার একটু বিশেষ তাড়া আছে।
কিরীটী গৃহে প্রত্যাবর্তন করে দেখে সুদর্শন তার অপেক্ষায় বসে আছে।
কতক্ষণ ভায়া!
তা প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে। সুদর্শন বললে।
চল—অনন্য বক্সীর ওখানে যাওয়া যাক।
অনন্য বক্সীর গৃহে পৌঁছে কিরীটী জানতে পারল, অনন্য বক্সী কোথায় বের হয়েছেন।
বিপাশা ছিল।
কিরীটী পরেশকে বললে, মাকে বল কিরীটীবাবু এসেছেন–
পরেশ খবর দিতে গেল।
একটু পরে এসে বললে, উপরে চলুন বসবেন—
দুজনে উপরের হলঘরে গিয়ে বসল।
একটু পরে বিপাশা এল।
কিরীটী বললে, বসুন বিপাশা দেবী—
বিপাশার সমস্ত চোখেমুখে যেন একটা ক্লান্ত বিষণ্ণতা। চোখ দুটো বসে গেছে।
বিপাশা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল বিষণ্ণ ক্লান্ত দৃষ্টি তুলে।
আপনি আমাদের গতকাল সবটুকু সত্য প্রকাশ করে বলেন নি—
বলিনি! কি বলিনি? বিপাশার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত।
আপনি সে রাত্রে ঠিক কখন নীলাকাশ থেকে ফিরেছিলেন?
রাত দশটা নাগাদ।
না।
আমি–
না, তার আরও পরে আপনি ফিরেছিলেন সেরাত্রে—আর সেখানে আপনার সঙ্গে বকুল দেবীর দেখা হয়েছিল।
না, না,–বকুলকে আমি দেখিনি।
শুনুন—অবিশ্যি আমার অনুমান—আপনি বেরুবার মুখেই বকুলদেবী গিয়ে বোধ হয় ঘরে ঢোকেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আপনি পাশের ঘরে গিয়ে আত্মগোপন করেন–
আমি—
বলতে দিন আমায়-বকুল দেবী হয়ত আপনাকে ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন—আর সেটাই তার ক্রোধে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে রজতবাবুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাই না?
হ্যাঁ।
তারপর রজতবাবুর গলার কারটা দিয়ে বকুল দেবী রজতবাবুর গলায় ফাঁস দেন।
হ্যাঁ।
রজতবাবু শ্বাসরোধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। ঠিক সেই সময় আর একজন ঘরে এসে ঢোকে—তাকেও আপনি দেখেছেন—কেবলুন বলুন—তাকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন—
জানি না—আমি জানি না—চিনতে পারিনি। চিৎকার করে ওঠে বিপাশা।
পেরেছিলেন চিনতে বলুন—আমি বলছি, আপনি তাকে চিনতে পেরেছিলেন।
না-না-না-না–দুহাতে মুখ ঢাকল বিপাশা।
আপনার স্বামী অনন্যবাবু, তাই নয় কি! বলুন বিপাশা দেবী বলুন!
বিপাশা চুপ।
বকুল দেবী তখন ঘরের মধ্যেই—দুজনাই আপনারা ঘরের মধ্যে ছিলেন তখন—এবারে বলুন, রজতবাবুর অচৈতন্য দেহটাকে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেন আপনার স্বামীই কী?
না।
তবে?
সে রজতকে মৃত দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়-অনন্য নির্দোষ।
আপনারা—তাহলে কি আপনারাই দুজনে মিলে—
হ্যাঁ, আমরাই তখন দুজনে পরামর্শ করে রজতের মৃতদেহটা ধরাধরি করে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিই—
অথচ আপনি জানেন না, জানতেও পারেন নি রজতবাবু তখনও বেঁচেই ছিলেন।
বেঁচে ছিল রজত? নানা, তা হতেই পারে না।
হ্যাঁ, বেঁচে ছিলেন।
আমি—আমিই তাহলে রজতকে হত্যা করেছি, কারণ আমারই পরামর্শে বকুল সম্মত হয়ে আমাকে সাহায্য করেছিল-রজতকে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিতে–
আমার মতে কিন্তু তা নয়—
বিপাশা স্তব্ধ অনড় হয়ে বসেছিলেন।
তাঁর দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, আপনি চেয়েছিলেন রজতবাবুর হাত থেকে মুক্তি বিপাশা দেবী, আর বকুল দেবী চেয়েছিলেন তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসার প্রতি রজতবাবু যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তার সঙ্গে প্রেমের একটা অভিনয় করে চলেছিলেন এতদিন ধরে, তার বদলা নিতে ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে। আপনারা হয়ত রজতের দেহটা নীচে ফেলে দেবার পরামর্শও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারেননি—দুজনে আপনারা রজতকে ঐ অবস্থায় ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন—
বিপাশা যেমন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল, তেমনিই বসে রইল।
হঠাৎ কিরীটী বললে, চল সুদর্শন!
সুদর্শন একটা কথাও বলল না, কিরীটীর নির্দেশমত উঠে দাঁড়াল। দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আর বিপাশা যেমন বসেছিল তেমনি বসে রইল।
জীপে উঠে সুদর্শন প্রশ্ন করল, কে তাহলে রজতের অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি দিয়ে নীচে ফেলে দিল দাদা?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনও বুঝতে পারনি!
না।
বোঝা উচিত ছিল—আগাগোড়া সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখ, দেখবে হত্যাকারী কে–
সত্যি বলছি, এখনও ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ঠেকছে দাদা। তবে কি অনন্যবাবুই পরে আবার ফিরে এসে—
না।
তবে? কে ফেলল নীচে রজতবাবুর দেহটা?
মনে কর না, ব্যাপারটা নিছক একটা সুইসাইড ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি সুইসাইড করে বিপাশাকেও মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন এবং হয়ত সেই সঙ্গে অনন্যবাবুর কমপ্লেকস যেটা তার বাপমার ব্যাপারকে কেন্দ্র করে উঠেছিল, সেটারও অবসান করে দিয়ে গিয়েছেন—
কি রকম?
এবারে হয়ত অনন্যবাবু বুঝতে পারবেন, বিপাশা তাকে সত্যিই ভালবাসেন। রজতবাবু তাঁর জীবনের পাতা থেকে একেবারে মুছে গিয়েছে চিরকালের মত। এবং বকুল দেবীও একটা শয়তানের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বেঁচে গেছেন।
কিন্তু তাহলে কি রিপোর্ট দেবেন?
এটা একটা সুইসাইড—আমি তাই বলব।
তাহলে বিপাশা ও বকুল দেবী
না, ওঁরাই ধরাধরি করে রজতের অচৈতন্য দেহটা ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন–
তাহলে ঐ কথা আপনি বললেন কেন?
সুদর্শন, কেন যে ও-কথা বলে এলাম, আজ তুমি না বুঝলেও একদিন হয়ত বুঝতে পারবে বুঝতে পারবে ঐ কথা বলা ছাড়া কিরীটী রায়ের সামনে আর দ্বিতীয় কোন পথ ছিল না।
প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছে বুঝতে পারছি, সব কিছুর উপরে একজন আছেন–তিনি যেমন পাপীকে শাস্তি দেন, তেমনি ক্ষমাও করেন পাপীকে। তার এক চোখে অনুশাসনের প্রতিজ্ঞা, অন্য চোখে ক্ষমার অশ্রু। ভুলে যাও–ভুলে যাও সব ব্যাপারটা—
দাদা, এতদিন জানতাম কিরীটী রায়ের কাছে অন্যায়ের পাপের কোন ক্ষমা নেই কিন্তু আজ বুঝলাম, এত বড় ক্ষমা বোধ হয় একমাত্র কিরীটী রায়ের পক্ষেই সম্ভব।
ওরে না না—আমিও মানুষ—দোষ-গুণ-ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েই তোমাদের কিরীটী রায়।
গাড়ি তখন কিরীটী বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছে।
কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে গেল।
আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ মৃদু আলোর ঝরনা দিয়ে যেন পৃথিবীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল।