কথিত আছে, গল্পের সেই রাজা বিক্ৰমাদিত্যের নাকি মণিমাণিক্যখচিত একটি বহু মূল্যবান রত্ন-সিংহাসন ছিল, এবং সেই সিংহাসনটির নির্মাণ-কৌশলও ছিল অদ্ভুত। বত্রিশটি পুতুল চারদিক থেকে সিংহাসনটিকে বেষ্টন করে থাকত।
মহারাজ বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর বহুকাল পরে, ভোজরাজ মৃত্তিকাতল থেকে সেই সিংহাসনটি উদ্ধার করেন। কিন্তু ভােজরাজ বিক্ৰমাদিত্যের সমগুণসম্পন্ন ছিলেন না বলে তাঁর আর সে সিংহাসনে বসা হল না কোন দিনই।
সিংহাসনটি উদ্ধার করবার পর প্রথম যেদিন ভোজরাজ সিংহাসনের ওপরে উপবেশন করতে গেলেন সিংহাসনের প্রথম পুতুলটি তাকে নিষেধ করল; বললে, মহারাজ! এই সিংহাসনে উপবেশনের পূর্বে আমার কিছু বলবার আছে, শ্রবণ করুন।
পুতুলটি বিক্রমাদিত্যের অশেষ গুণরাশির একটি কাহিনী বললে, এবং গল্পটি শেষ হলে বললে, মহারাজ, আপনাকে বিক্রমাদিত্যের সম্পর্কে যে গল্পটি বললাম, আপনার যদি সেরকম কোন গুণ থাকে। তবে সিংহাসনে উপবেশন করুন।
সেদিন আর ভোজরাজের সে সিংহাসনে উপবেশন করা হল না।
পরের দিনও অনুরূপভাবে দ্বিতীয় পুতুলটি ভোজরাজকে সিংহাসনে উপবেশনে বাধা দিয়ে আর একটা গল্প শোনাল বিক্ৰমাদিত্য সম্পর্কে।
এইভাবে বত্ৰিশটা পুতুল একের পর এক—দিনের পর দিন সিংহাসনে বসতে ভোজরাজকে বাধা দিতে লাগল এবং ফলে ভোজরাজের আর কোনদিনও সেই সিংহাসনে বসাই হল না।
গল্পের ভোজরাজের মত শ্ৰীনগর রাজবাড়ির গৃহদেবতাদেরও তাঁরই জন্যই প্রস্তুত সুবর্ণনির্মিত কারুকার্যমণ্ডিত পান্নাচুনিহীরাখচিত বত্রিশ সিংহাসনটিতে বসাই হল না কোনদিন।
শ্ৰীনগর কোথায়, ভারতবর্ষের কোন জায়গায়—পূর্বে, পশ্চিমে, দক্ষিণে না উত্তরে সেটা আমাদের বর্তমান কাহিনীর প্রতিপাদ্য বিষয় নয়।
ধরে নেওয়া যাক বাংলাদেশেরই আশেপাশে কোথাও সেই শ্ৰীনগর, কলকাতা থেকে মাত্র একদিনের পথ।
পূর্ব কাহিনী যার সঙ্গে আমাদের বর্তমান কাহিনীর যোগসূত্র আছে, তা এই? শ্ৰীনগরের বর্তমান তরুণ রাজা ত্ৰিদীপনাথ রায়ের পুরুষানুক্রমে পাওয়া সম্পত্তির মধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান যে সম্পত্তিটি ছিল সেটি হচ্ছে ছোট একটি স্বর্ণ-নির্মিত রত্নখচিত সিংহাসন। সিংহাসনটিকে বত্রিশটি স্বর্ণনির্মিত পুতুল তাদের চৌষট্টি হাতে ধারণ করে আছে।
প্রায় সাত-আট পুরুষ আগে রাজবংশের সর্বেশ্বর রায় ঐ সিংহাসনটি নির্মাণ করে সোনার গোপাল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই হতেই সিংহাসনটিকে বত্রিশ সিংহাসন নামে অভিহিত করা হত। সোনার গোপাল প্রতিষ্ঠা করবার কিছুকাল পরে হঠাৎ অদ্ভুত উপায়ে কোন অদৃশ্য লুণ্ঠনকারী রাজবাড়ির অন্দরমহলে অবস্থিত ঠাকুরঘর থেকে গৃহদেবতা সোনার গোপালটি লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।
সমগ্র রাজবাড়িতে বিষাদের কালো ছায়া ঘনিয়ে এল অবশ্যম্ভাবী এক অমঙ্গলের দুশ্চিন্তয়! চারিদিকে অনুসন্ধান শুরু হল, কিন্তু বৃথা।
এখান সময় রাজমাতা কাত্যায়নী দেবী স্বপ্নে অপহৃত গৃহদেবতা সোনার গোপালের প্রত্যাদেশ পেলেন ঃ ভয়ের কিছু নেই। অপহৃত হয়েছি আমি, আবার তোদের গৃহে সময় হলেই আসব। যতদিন না তোদের ঘরে আবার আমি প্রত্যাবর্তন করি, ততদিন শূন্য সিংহাসন সিন্দুকে তালা বন্ধ করে রাখিস। ঐ বত্রিশ সিংহাসন যতদিন তোদের ঘরে থাকবে, কোন অমঙ্গলই তোদের স্পর্শ করতে পারবে না।
সেই থেকে এতদিন রত্নমণ্ডিত স্বর্ণনির্মিত বত্রিশ সিংহাসনটি রাজবাড়ির লোহার সিন্দুকেই তালাবন্ধ ছিল। গৃহদেবতাও আর প্রত্যাবর্তন করেননি, বত্রিশ সিংহাসনও আর কোন কাজে লাগেনি। রাজবাড়ির কোথাও কোন অমঙ্গলের চিহ্নও দেখা দেয়নি।
সেই সিংহাসনটিই অকস্মাৎ কেমন করে অভাবনীয়রূপে রাজবাড়ির অন্দরমহলে অবস্থিত লৌহ-সিন্দুক থেকে লুষ্ঠিত হয়েছে।
সিন্দুক থেকে সোনার বত্রিশ সিংহাসনটি বের করে আবার নতুন সোনার গোপাল নির্মাণ করে দেবতার প্রতিষ্ঠা করবেন।
স্বর্ণকারকে ডেকে মূর্তি গড়াবার আদেশও দেওয়া হয়েছিল এবং সোনার গোপালের নির্মাণকাৰ্যও প্রায় সুসম্পন্ন হয়ে এসেছে।
আসন্ন উৎসবের আয়োজন চলেছে। আত্মীয়স্বজনে রাজবাড়ি গমগম করছে, এমন সময় এই আকস্মিক বিভ্ৰাট। রাজা ত্ৰিদীপনাথ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। লোহার সিন্দুক থেকে বত্রিশ সিংহাসন চুরি গেছে। নির্মেঘ নীলকাশ থেকে যেন সহসা বজাপাত হয়েছে।
মাত্র কয়েক দিন হল কিরীটী এম. এস.সি.র শেষ পরীক্ষণ দিয়েছে। এখন অখণ্ড অবসর। কিরীটী শিয়ালদহের এক খ্যাতনামা অন্ধকার গলির মধ্যে অবস্থিত বাণীভবন মেসে থাকে।
শরৎ ঋতুর অবসানে শীতের প্রথম আবির্ভাবের রং লেগেছে। প্রকৃতির অঞ্চলে। ঝরা পাতার উৎসব দিকে দিকে শেষ হল; শুষ্ক ডালে সবুজের ইশারা।
মেসের তেতলার ঘরে একটা লোহার চেয়ারে বসে কিরীটী সেইদিনকার দৈনিকখানা আনমনে ওল্টাচ্ছে। হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি পড়তেই কিরীটী সচকিত হয়ে ওঠে। একটা বিজ্ঞাপন–
এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জ্ঞাত করা হইতেছে যে শ্ৰীনগরের রাজবাটির অন্দরমহলে অবস্থিত লৌহসিন্দুক হইতে রাজাদের পুরুষানুক্রমে রক্ষিত ইতিহাস-বিখ্যাত বহুমূল্য রত্নখচিত সুবর্ণনির্মিত বত্রিশ সিংহাসনটি কে বা কাহারা অত্যাশ্চর্য উপায়ে লুণ্ঠন করিয়াছে। যদি কোথাও এমন কেহ থাকেন, যিনি সেই সিংহাসনটি উদ্ধার করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে তঁহাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা পুরুস্কার দেওয়া হইবে; অনুসন্ধানেচ্ছ অবিলম্বে নিজ ব্যয়ে শ্ৰীনগরের রাজবাটিতে আসিয়া শ্ৰীনগরের রাজা ত্ৰিদীপনাথ রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। রাজবাটী ঃ শ্ৰীনগর।
অদ্ভুত বিজ্ঞাপন।
পাঁচ হাজার টাকাটা কিরীটীর কাছে এমন কিছু একটা মূল্যবান সংবাদ নয়। কিন্তু তার মধ্যে যে রহস্যটি ঘনীভূত হয়ে আছে কিরীটী তাতেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। পর্যাপ্ত সময়ের এমন চমৎকার সদ্ব্যবহার আর কিছুতেই হতে পারে না।
প্রিয় রাজা বাহাদুর,
…………তারিখের দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। আমার পরিচয় আপনি জানেন না। কারণ আমি সরকারী বা বেসরকারী গোয়েন্দা নাই, সাধারণ একজন ছাত্র মাত্র, বর্তমানে বেকার। হাতে কোন কাজকর্ম নেই। আপনি আপনার বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে যে রহস্যের অনুসন্ধান দিয়েছেন সেটা আমার রহস্যপ্রিয় মনকে একান্তভাবে আকর্ষণ করেছে। পারিশ্রমিকের কথা ছেড়ে দিন, অর্থের আমার অভাব নেই, তাই হয়তো লালসাও নেই। আমার একান্ত ইচ্ছা আপনার অপহৃত বত্রিশ সিংহাসনটির অনুসন্ধান একটিবার আমি করে দেখি। তবে আমার একটা শর্ত আছে ঃ আমি অনুসন্ধানভার গ্রহণ করলে কাউকেই আপনি সে কথা ঘৃণাক্ষরেও বলতে পারবেন না; বিশেষভাবে আমার ও আপনার মধ্যে গোপন থাকবে। আপনি যদি আমার প্রস্তাবে রাজী থাকেন, আমি নিজ ব্যয়ে গিয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি। আর একটা কথা মানুষের পক্ষে যদি সম্ভব হয় তবে আপনার অপহৃত বত্ৰিশ সিংহাসনটি নিশ্চয়ই আমি উদ্ধার করে দিতে পারব। মনে করবেন না এটা আমার আত্মম্ভরিতা, এটা আমার সংস্কার বলতে পারেন, কারণ অনুসন্ধানের ব্যাপারটা আমি মনে করি সম্পূর্ণ অঙ্কশাস্ত্রের মতই একটা জটিল সমস্যা মাত্র। বুদ্ধি থাকলেই যে কোন কঠিন সমস্যার সমাধান করা যায়; অবিশ্যি সে সমস্যা যদি উদ্ভাবিত হয়ে থাকে। আমাদের মত কোন এক মানুষের দ্বারা। অধিক বলবার কিছু নেই, সাক্ষাতেই বিশদ আলোচনা হতে পারবে। নমস্কার জানবেন।
ভবদীয়—কিরীটী রায়
নাম ঠিকানা খামে লিখে তখুনি কিরীটী চিঠিখনি ডাকবাক্সে ফেলে দেওয়ার জন্য মেসের ভৃত্যকে ডেকে পাঠিয়ে দিল।
দিন তিনেক বাদেই অপ্রত্যাশিত ভাবে জবাব এল :
আপনার চিঠিখানা পেলাম। আপনি এলে আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিশ্চয়ই আনন্দ পাব আশা করছি, সাক্ষাতে সব কথাবার্তা হবে।
শিয়ালদহ থেকে রাত্রি আটটায় একটা ট্রেন ছাড়ে, সেটা এখানে পরের দিন সকালবেলা সাতটায় এসে পৌঁছয়। স্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি ঘণ্টাখানেকের পথ। আগে সংবাদ পেলে টমটম পাঠাব। নমস্কার রইল।
নিবেদক—ত্ৰিদীপনাথ রায়
চিঠিখানি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার মধ্যেই অপরিচিত ত্ৰিদীপনাথ রায়ের সুস্পষ্ট একটা ছবি যেন ফুটে উঠেছে। বার দুই আদ্যোপােন্ত পড়ে কিরীটীর মনে হয়—লোকটি স্বল্পভাষী। কোন কােজই বেশ চিন্তা না করে করেন না। পূর্বপুরুষের বত্রিশ সিংহাসনটি চুরি যাওয়ায় ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বিশেষ রকম বিচলিত হয়ে উঠেছেন। এবং বিচলিত হয়েই ক্ষান্ত হননি, সেটি পুনরুদ্ধার করবার জন্যও দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ও সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে দিয়ে সেটা যেন সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হচ্ছে কিরীটীর কাছে! আর দেরি করা নয়, শুভস্য শীঘ্রম।
কিরীটী জামাটা গায়ে দিয়ে শিয়ালদহের দিকে বেরিয়ে পড়ল। সেখানে খোঁজ করে পরের দিনের গাড়িতে একটা সেকেণ্ড ক্লাস বার্থ রিজার্ভ করে, কিরীটী ডাকঘরে গিয়ে ত্ৰিদীপনাথকে তার করে দিল।
শীত এখনও ভাল করে মোটেই পড়েনি, সামান্য একটু শীতের আমেজ দেখা দিয়েছে মাত্র। স্টেশনে এসে কিরীটী দেখল, ছোট একটা সেকেণ্ড ক্লাস কুপেতে লোয়ার বার্থ সে পেয়েছে। উপরের বার্থে যিনি যাচ্ছেন তাঁর নাম বিনায়ক সান্যাল, বার অ্যাট-ল। কিরীটী গাড়িতে উঠে হোন্ড-অলটা খুলে বার্থের ওপরে বিছানাটা বিছিয়ে নিল। সঙ্গে করে কয়েকটা রহস্যোপন্যাস এনেছে, রাত্রের খোরাক। রাত্রের ট্রেনে সে কোনদিনই ঘুমোতে পারে না। ট্রেনের ঝাকুনি ও চাকার শব্দে ঘুম আসে না।
কিরীটী ব্লিপিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে বালিশের ওপরে আড় হয়ে শুয়ে একটা বই খুলে বসল। ট্রেন ছাড়তে বোধ করি আর মিনিট দু-তিন দেরী আছে।
সাহেবী পোশাক পরা একজন নধরদেহ পুরুষ, হাতে একটা অ্যাটাচি কেস, বগলে প্রকাণ্ড একটা খাপে ভর্তি বীণা জাতীয় তারের বাদ্যযন্ত্র ও কুলীর মাথায় বেডিং ও একটা মাঝারি গোছের সুটকেশ চাপিয়ে কামরার মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী একবার বই থেকে চোখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকাল।
আগস্তুকের বয়স তিরিশের উর্ধের্ব। মাথার ঘন চুল ব্যাক-ব্রাশ করা। নাকটা ভোঁতা। ফ্রেঞ্চকটি দাড়ি, বাটারফ্লাই গোঁফ। চোখে রিমালেস চশমা। চশমার লেন্সের অন্তরালে গোল গোল চোখের তীক্ষ অনুসন্ধানী দৃষ্টি। পরিধানে নেভি ব্ল কালারের দামী সার্জের সুট। জিনিসপত্র গোছগাছ করে বিছানাটা বার্থে পেতে আগন্তুক কুলীকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে, কিরীটীর বার্থের পাশে বসবার যে বেতের চেয়ারটা আছে, তাতে বসে পড়ে পকেট থেকে দামী টোবাকো পাইপ ও পাউচ বের করে ধূমপানের যোগাড় করতে লাগলেন। পাইপে টোবাকো ভরে লাইটার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে তীব্র এক টান দিয়ে একগাল পীতাভ ধোঁয়া ছেড়ে কিরীটীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা পড়ে গেছে; ট্রেন প্ল্যাটফরম ছেড়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে।
কতদূর যাবেন? ব্যারিস্টার সাহেব কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন।
বেশী দূর নয়, শ্ৰীনগর। আপনি?
আমি শ্ৰীনগর না হলেও কাছাকাছি—শ্ৰীনগরের আগের স্টেশনে।
টাইম-টেবিলে কিরীটী দেখেছিল, শ্ৰীনগরের আগের স্টেশনটি একটি বড় জংশন স্টেশন। একটি নামকরা ডিস্ট্রিক টাউন।
কোন মকদ্দমার ব্যাপারে বোধ হয়?
হ্যাঁ। তা না হলে আর কেন বলুন? ভদ্রলোক পাইপটা দাঁতে চেপে মৃদু একটু হাসলেন।
ট্রেন দমদম জংশনে এসে থামল।
যাত্রীদের গোলমাল, ওঠামানা। ঘণ্টা বাজল, ট্রেন আবার চলতে শুরু করল।
সান্যাল আবার প্রশ্ন করেন, হঠাৎ শ্ৰীনগরে চলেছেন যে?
এমনিই বেড়াতে যাচ্ছি। দেশ ভ্ৰমণ করাটা আমার একটা নেশা। শুনেছি জায়গাটা নাকি বেশ। পুরনো দিনের অনেক কিছু স্মৃতিচিহ্ন নাকি এখনও সেখানে অবশিষ্ট আছে।
হ্যাঁ, আমিও দু-একবার সেখানে গেছি। শ্ৰীনগরের রাজবাড়িই তো ইতিহাস প্রসিদ্ধ জিনিস একটা। পাল রাজত্বের সময়কার তৈরী সে প্রাসাদ। শুনেছি, সে নাকি এক রহস্যের খাসমহল।
আপনি দেখেছেন সে প্রাসাদ?
বাইরে থেকে যতটা সম্ভব, মানে বহিমহলটা সব ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। একবার। প্রাসাদের অভ্যন্তরে তো রাজারা কাউকে প্রবেশ করতে দেন না। রাজাদের একটা গেস্ট হাউস আছে, রাজবাড়ি থেকে কিছু দূরে। সেখানে অনেকেই গিয়ে অনেক সময় থাকেন। তা ছাড়া পাল রাজাদের সময়ে কৈবর্ত সর্দার ভীমের উপদ্রবে। রাজার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামপাল কিছুদিন নাকি ওখানে গিয়ে এক বাড়িতে ছিলেন, সেটাকে রামপালের দুর্গ বলে। হৃতসর্বস্ব রামপাল নাকি সেই বাড়িতে প্রায় দেড় বৎসর লুকিয়ে ছিলেন। ছোটখাটো একটা দুর্গের মত সে বাড়িটা। দুর্গের চারপাশে পরিখা, পরিখার চারপাশে প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু পাথরের প্রাচীর।
রামপাল নিজেই নাকি সে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন নিজের লোকজনদের দিয়ে এবং শোনা যায়, সেই দুর্গে বসেই তিনি সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন পরাক্রান্ত কৈবর্ত সর্দার ভীমের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার জন্য।
কৈবর্ত সর্দার সে কথা জানতে পেরে একদল দুর্ধর্ষ সৈন্য প্রেরণ করে রামপালকে বিধ্বস্ত করবার জন্য। দীর্ঘ আটচল্লিশ ঘণ্টা সেই দুর্গের মধ্যে আত্মগোপন করে রামপাল ভীমের প্রেরিত সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ চালান। শেষটাই কিছুতেই যখন আর দুৰ্গ রক্ষা করা সম্ভব হল না, তখন গোপনে পালিয়ে যান বর্তমান শ্ৰীনগরে যে রাজপ্রাসাদ তারই মধ্যে। আকারে ও চাকচিক্যে তখনকার সে প্রাসাদ বর্তমানের থেকে অনেক ছোটই ছিল, এবং মালিক ছিলেন সৰ্বেশ্বর রায়, সামান্য বিত্তশালী একজন ঐ সময়কার জমিদার মাত্র।
রামপাল সৰ্বেশ্বরের গৃহে পনেরো দিন আত্মগোপন করে থাকেন। পরে সৰ্বেশ্বরের ঢালীরা রাতের অন্ধকারে পালকিতে করে রামপালকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসে।
কিরীটী তন্ময় হয়ে মিঃ সান্যালের বর্ণিত কাহিনী শুনছিল। রূপকথার চমকপ্রদ, রহস্যঘন রোমাঞ্চকর।
মিঃ সান্যাল একজন শক্তিশালী কথক বটে। ভাষা ও বলবার টেকনিকও তার অপূর্ব।
অন্ধকারের নির্জন প্রকৃতির বুকখানাকে শব্দমুখর করে মেল ট্রেনখানা একটানা ছুটে চলেছে। থামবে গিয়ে একেবারে সেই রাণাঘাট জংশনে।
মাঝে মাঝে ট্রেনের তীব্র গতিবেগের দু পাশে ছোট ছোট স্টেশনের আলোগুলো চমক দিয়ে যায়, মসীকৃষ্ণ রাতের বুকে হঠাৎ জেগেই মিলিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎচমকের মত। রেল, লাইনের দু পাশে অন্ধকারে আবছা আগাছার ঝোপ-ঝাড়গুলো জোনাকির ফুলঝুরি জ্বলিয়ে যেন অভিসারে বের হয়েছে।
তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।
তারপর ঐ ঘটনার অনেক দিন পরে রামপাল যখন হৃতরাজ্য পুনরায় ফিরে পেলেন, সৰ্বেশ্বরের কাজের জন্য তাকে ইনাম দিলেন রাজা উপাধি ও অনেক নিষ্কর জমিজমা। সৰ্বেশ্বর তখন রামপালের সনদের জোরে রাজা উপাধি নিয়ে ঐ জায়গার নাম বদল করে শ্ৰীনগর’ নতুন নামকরণ করলেন। সর্বেশ্বরের ভাগ্যলক্ষ্মী তখন সুপ্ৰসন্ন, দিনে দিনে দেবতার আশীর্বাদে তার যশ, মান, প্রতিপ্রাত্তি ও অর্থ বাড়তে লাগল। বর্তমানের প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদ তৈরী হল অতীতের ক্ষুদ্র জমিদার ভবনের ভিতের উপরে। বর্তমান শ্ৰীনগর ও সেই সঙ্গে শ্ৰীনগরের রাজাদের উৎপত্তির এই হল মোটামুটি ইতিহাস।
গল্প বলতে বলতে পাইপটা নিভে গিয়েছিল। মিঃ সান্যাল পাইপটায় আবার অগ্নিসংযোগ করে একটা টান দিয়ে পীতাভ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, প্রায় বছর পাঁচেক আগে একবার শ্ৰীনগরে বেড়াতে গিয়ে ওখানকার এক বৃদ্ধের মুখে শ্ৰীনগরের এই ইতিহাস আমি শুনি।
উপন্যাসের মতই চমকপ্রদ এ কাহিনী। অতীত বাংলার যে কত শত কাহিনী আজও এমনি করে সুপ্ত রয়ে গেছে, কেই বা তার খোঁজ রাখে। পরদেশী ভাষায় পরের দেশের ইতিহাস মুখস্থ করে আমরা ডিগ্রীর নম্বর বজায় রাখি এবং সেই ডিগ্রীই হয় আমাদের শিক্ষার শীল-মোহর। অথচ ঘরের খবর আমরা রাখি না—কিরীটী মৃদুস্বরে খেদোক্তি করলে।
সত্যি যা বলেছেন! বাংলার ইতিহাসকারেরা যেন চোখ বুজেই ইতিহাস রচনা করেছেন।
নানা ধরনের কথাবাতাঁর মধ্য দিয়ে দুজনের ভিতর ক্রমশঃ বেশ গভীর আলাপ জমে ওঠে। কিরীটিার বেশ লাগে ক্ষণপরিচিত মিঃ সান্যালকে।
মিঃ সান্যালের ব্যারিষ্টারি ব্যবসা হলেও তার বেশী ঝোক ইতিহাস পড়ায়। কাজকর্মের বাইরে যতটুকু সময় তিনি পান, নানা ধরনের ইতিহাস পড়েই তিনি কাটান বেশির ভাগ সময়। এ ছাড়াও তার আর একটি নেশা আছে, সেটা হচ্ছে। যন্ত্র-সঙ্গীতের সাধনা। কাজেই যেখানেই তিনি যান, একটি সুটকেস-ভর্তি বই ও বীণা যন্ত্রখানি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফেরে।
শেষরাত্রের দিকে কিরীটীর চোখে কেমন একটু তন্দ্রার মত এসেছিল! ঘুম যখন ভাঙলি, চলমান গাড়ির কাচের শার্সির ফাঁকে প্রথম ভোরের ধূসর আলো ওর চোখে পড়ে। চেয়ে দেখল। সহযাত্রী মিঃ সান্যাল গাড়িতে নেই, বোধ হয় নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে গেছেন।
কিরীটী কঁচের শাসিটা নামিয়ে দিল; বিরবির প্রভাতী হাওয়া এসে রাত্রি-জাগরণ ক্লান্ত চোখেমুখে সুস্নিগ্ধ শীতল পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়।
নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টারও বেশি পরে গাড়ি শ্ৰীনগরের রেলওয়ে স্টেশনে এসে থামল।
স্টেশনটি ছোট্ট অখ্যাতনামা, ততোধিক অখ্যাতনামা স্টেশনের নামটি। আগে এখানে মেল ট্রেন থামত না। স্টেশন থেকে শ্ৰীনগর প্রায় মাইল আষ্টেক দূরের পথ।
স্টেশন থেকে রাজবংশেরই তৈরী প্রশস্ত কাঁচা সড়ক বরাবর শ্ৰীনগর পর্যন্ত চলে গেছে। মাত্র মাস আষ্টেক হল বর্তমান রাজা ত্ৰিদীপনাথের অনেক চেষ্টার ফলে আজকাল মেল ট্রেনটা এই স্টেশনে থামছে—তাও মাত্র আধ মিনিটের জন্য। আগে আগে রাজবাড়ির লোকেরা বড় জংশন স্টেশনটিতে নেমে সেখান থেকে ব্ৰহ্মপুত্র নদের একটা ছোট শাখানদী বেয়ে ভাউলিয়া করে শ্ৰীনগর যেত, তাতে বর্ষাকাল ও তার পরবর্তী কয়েক মাস নদীপথে যাতায়াত করা চলত। শীতকালে নদীর জল এত বেশি শুকিয়ে যেত যে, নদীপথে কোন বড় বা মাঝারি নৌকেই যাতায়াত করত না। তাই শীতকালটা পরের ছোট স্টেশনে নেমে, হাঁটাপথে গোরুর গাড়িতে চেপে শ্ৰীনগরে যাওয়া ভিন্ন আর অন্য উপায় থাকত না।
উঁচু বাঁধানো প্লাটফরমের ওপরে একতলা ছোট একটি বাড়ি-স্টেশন-ঘর ও গুদাম অফিস।
***
স্টেশন-ইনচার্জ রামসদায়বাবু। প্রায় চল্লিশের উৰ্ব্বে বয়স। মাথায় বাঁকড়া ঝাকড়া চুল। ইতিমধ্যে অর্ধেকের বেশী চুলে বয়সের নোটিশ জারি হয়েছে। চোখে পুরু লেন্সের নিকেল ফ্রেমের চশমা। কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করতে থাকে।
কে একজন এই দিকেই এগিয়ে আসছে। বয়স ত্রিশ-পয়ত্ৰিশের বেশী নয়। রোগী লম্বাটে গড়ন। অত্যন্ত সুশ্ৰী চেহারা। দীর্ঘ উন্নত নাসা। একজোড়া চোখে বুদ্ধির প্রখর দীপ্তি। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে সাদা ধুতি ও সাদা ভায়লার গরম পাঞ্জাবি, তার ওপরে সাদা শাল জড়ানো! পায়ে সাদা নাগরাই। সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনমাস্টার রামসদায়বাবুও এগিয়ে আসেন, টিকেট?
কিরীটী টিকেটটা পকেট থেকে বের করে দেয়।
কোথায় যাবেন? রামসদয় আবার প্রশ্ন করেন।
রাজবাড়ি।
আপনি কি মিঃ রায়? সুশ্ৰী যুবকটি প্রশ্ন করেন?
হ্যাঁ। আপনি?
আজ্ঞে, ইনি আমাদের রাজাবাহাদুর, রামসদয়বাবু বলে ওঠেন, মহাশয় ব্যক্তি প্রাতঃস্মরণীয়।
ওঃ! কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানায়।
প্রতিনমস্কার জানিয়ে ত্ৰিদীপনাথ সাদর আহ্বান জানান, বাইরে টমটম দাঁড়িয়ে আছে।
দুজনে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ান। অপ্রশস্ত কঁচামাটির সড়ক। ছোট একটি টমটম, গাড়ি। একটা তেজী সাদা ঘোড়া। কোন সহিস বা কোচম্যান নেই।
উঠুন।
কিরীটী গাড়ির পদানিতে পা দিয়ে উঠে বসে! দুলকি চালে ঘোড়াটা ছুটে চলে। দু পাশের ক্ষেতে সরিষার অজস্র হলুদ ফুল, ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় যেন খুশির ঢেউ জাগিয়েছে। চারিদিকে একটা শুচিস্নিগ্ধ আবহাওয়া।
কিরীটী বেশ একটু আশ্চর্যই হয়েছিল, রাজাবাহাদুর নিজেই তাকে নিতে এসেছেন। এতটা সে আশা করেনি। বিশেষ করে তার মত একজন সামান্য অপরিচিত ব্যক্তি!
রাজাবাহাদুরই প্রথমে কথা বললেন, মিঃ রায়, আপনার চিঠি পড়ে আমি যতটা না আশান্বিত হয়েছিলাম, তার চাইতে বেশী আনন্দিত হয়েছি আপনাকে দেখে এবং আশা করছি পরিচয় হলে আরো সুখী হব।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, হতাশও তো হতে পারেন!
বোধ হয় না, কারণ মানুষ চেনবার একটা অসাধারণ ‘ন্যাক’ আমার আছে। রাজাবাহাদুরের ওষ্ঠ্যপ্রান্তে হাসির রেখা দেখা দেয়।
আপনি বোধ হয় একটু আশ্চর্যই হচ্ছেন, রাজাবাহাদুর বলতে লাগলেন, এভাবে একা আমার শুমাপনাকে এগিয়ে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে; কিন্তু শ্ৰীনগরের রাজবাড়ির এইটাই চিরন্তন নীতি। অতিথি নারায়ণ, তাকে স্বয়ং গিয়ে অভ্যর্থনা না জানালে অতিথির প্রতি অসম্মান দেখানো হয়, তা ছাড়া…
রাজাবাহাদুর থামলেন। কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রাজাবাহাদুরের মুখের দিকে তাকায়।
তা ছাড়া আপনার চিঠি পড়ে আমি এতখানি বিস্মিত হয়েছিলাম যে আপনাকে চোখে দেখবার একটা দুৰ্দমনীয় লিন্সা মনে আমার জেগেছিল। এই দেখুন আমি সঙ্গে করে টাকা ঃ এনেছিলাম। রাজাবাহাদুর ডান হাতে ঘোড়ার লাগমটা ধরে বা হাত দিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে গোটা পাঁচেক নোট বের করে দেখালেন। তার পর বললেন, আপনার কথাবার্তা ও চেহারায় আমাকে না। যদি ইমপ্রেস করতে পারতেন, তবে স্টেশন থেকেই ধূলোপায়ে আপনাকে বিদায় করে ফিরে আসতাম।
কিরীটী আবার একটু হ্যাঁসলে, কোন জবাবই দিলে না বা একটি প্রশ্নও করলে না।
আপনাকে তো বলেছিই, আপনাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার আশা হচ্ছে এখন, আপনি হয়তো আমার হারানো সম্পত্তির একটা কিনারা করলেও করতে পারবেন। সরকারী বে-সরকারী অনেক গোয়েন্দার কাছ থেকেই আমি চিঠি পেয়েছি। সকলের চিঠির মধ্যেই যেন ফুটে উঠেছে একটা জঘন্য লালসার ছবি পাঁচ হাজার টাকার প্রতি।
এতক্ষণ পরে প্রথম কিরীটী সহসা একটা প্রশ্ন করল, রাজাসাহেব, আপনার বহুমূল্য রত্নসিংহাসনটি যে অপহৃত হয়েছে, এ সংবাদ কে কে জানে?
এখনও বাড়ির কেউই জানে না বলতে গেলে; কারণ এ সংবাদটা আমি সকলের কাছেই গোপন রেখেছি; এমন কি আমার স্ত্রী পর্যন্ত জানেন না এবং একটি ইংরাজী দৈনিক ছাড়া অন্য কোথাও আমি বিজ্ঞাপন দিইনি। ইংরাজী দৈনিকে ইংরাজীতে বিজ্ঞাপন দেওয়ারও দুটো কারণ আমার আছে। এক কারণ, চোরকে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে ব্যাপারটা আমি টের পেয়েও বিচলিত হইনি এবং ফিরে পাবার আশা রাখি। দ্বিতীয় কারণ, ব্যাপারটা বাড়িতে ঢাকঢোল না পিটিয়ে যথাসাধ্য গোপন করে অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়েছি।
আশ্চর্য! আচ্ছা আপনার কাউকে কি সন্দেহ হয়। এই চুরির ব্যাপারে?
কাউকে বলতে আপনি ঠিক কি mean করছেন?
মানে বাড়ির মধ্যে কোন বিশেষ লোককে বা বাইরে জানাশোনার মধ্যে কাউকে।
বাড়ির মধ্যে কাউকেই আমি সন্দেহ করতে পারছি না; কারণ আয়রন সেফটা আমার নিজের শয়নকক্ষে ছিল। তা ছাড়া তার চাবি সর্বদাই আমার নিজের শয়নকক্ষের ড্রয়ারে থাকে।
আপনার শয়নকক্ষ তো পুরাকালে নবাবী আমলের বেগমদের মহল নয় যে কারও পক্ষেই সেখানে প্রবেশ দুঃসাধ্য।
তা নয় বটে, তবে সে কক্ষে দু-চারজন ছাড়া অপরের যাওয়া নিষেধ আছে।
যেমন?
আমার স্ত্রী, আমার বৃদ্ধা মা ও বাড়ির বহুদিনের পুরাতন ভৃত্য ভজু। এরা ছাড়া সে ঘরে কেউই আর বড় একটা ঢোকে না বলেই আমি জানি! তবে যদি বলেন এ কাজ আমার স্ত্রী বা বিশ্বাসী বৃদ্ধ ভূত্য ভজুর তা হলে আমি নাচার।
কিরীটী হো হো করে হেসে ওঠে।
হাসছেন যে?
কতদিন আপনি বিয়ে করেছেন?
বছর সাতেক।
আপনার সন্তান?
এখনও পর্যন্ত হয়নি।
আপনার স্ত্রী? মাপ করবেন, অবশ্য যদি কিছু না মনে করেন।
না, না, অসঙ্কোচে আপনি যা জানতে চান বলুন! রাজবাড়ির অন্দরমহলে আপনাকে আমি নিয়ে চলেছি। রাজবাড়ির রীতিবিরুদ্ধ কাজ। আজ পর্যন্ত খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া রাজঅন্তঃপুরে বড় একটা কেউই প্রবেশ করতে পারেনি। অথচ পাল রাজত্বের সময় থেকে ইতিহাসবিখ্যাত বলে অনেকবার অনেক পর্যটক রাজবাড়ির অন্দরমহল দেখবার জন্য অনেক ইচ্ছা ও অনুরোধ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু নিয়ম নেই বলে কাউকেই আজ পর্যন্ত সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বলতে গেলে আপনিই সর্বপ্রথম সেখানে প্রবেশ করতে চলেছেন, এক্ষেত্রেই..
বলছিলাম আপনি কি রকম ঘরে বিয়ে করেছেন?
এককালে তারা যথেষ্টই ধনী ছিলেন, কিছুদিন হল অবস্থার একটু হেরফের হয়েছে, তবে পুরাতন বনেদী বংশ।
সহসা কিরীটীর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে রাজবাড়ি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। রাজবাড়িই বটে।
আরও বিস্মিত হল সে, যখন গাড়ি এসে রাজবাড়ির ফটকের মধ্যে ঢুকল। বন্ধুকধারী নেপালী দারোয়ান কুর্নিশ করে লাহার বিরাট গেট খুলে দিল। পাথরের নুড়িঢালা চওড়া পথ।
বর্হিমহলে এসে টমটম দাঁড়াতেই বৃদ্ধ নায়ব থাকহরিবাবু নত হয়ে নমস্কার জানিয়ে অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে এলেন। সহিস এসে ঘোড়ার রাশ ধরল। রাজাবাহাদুরের সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীও টমটম থেকে নেমে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।
কিরীটী বিস্মিত মুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল রাজবাড়ির ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কারুকার্য দেখে। বড় বড় পাথরের খিলান, মোটা মোটা থাম। একদা যে এখানে ঐশ্চর্য ও গরিমার প্রাচুর্য ছিল, এখনও যে তার অনেকখানিই অবশিষ্ট আছে তা প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়।
ত্ৰিদীপনাথ শৌখিন ও আধুনিক কেতা-দূরস্ত লোক। পুরাতনের সঙ্গে বহু জায়গায় আধুনিকের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন!
আসুন মিঃ রায়। রাজাবাহাদুর বলেন কিরীটীকে! সেই আহ্বানে কিরীটী এগিয়ে চলে।
বহির্মহলের অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে দুজনে এসে একটা নাতিপ্রশস্ত ঘরে প্রবেশ করেন। আসবাবের বিশেষ কোন বাহুল্য নেই। তবু যা সামান্য আসবাবপত্র আছে, সে সব মূল্যবান। সুন্দর একটি মেহগনি পালঙ্কের ওপরে শুভ্ৰ শয্যা বিছানো, মাথার ধারে শ্বেতপাথরের একটি গোল টেবিল, সাদা পাথরের গ্লাসে বোধ হয় পানীয় জল ঢাকা দেওয়া আছে। পুরনো আমলের দুটি আরামকেদারা। একটি আলমারি বই ভর্তি। জামা কাপড় রাখবার জন্য একটি আলনা। এ ঘরটাই আপনার জন্য ঠিক করে রেখেছি, কোন কষ্ট হবে না তো?
বরং বলুন এত বেশী প্রাচুর্য যে অসুবিধাই ভোগ করতে হবে প্রাচুর্যে।
রাজাবাহাদুর হাসলেন প্রত্যুত্তরে।
আপনি বিশ্রাম করুন, আহারাদির পর আবার সাক্ষাৎ হবে।
রাজাবাহাদুর নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
দ্বিপ্রহরের দিকে বোধ হয় কিরীটীর কেমন একটু তন্দ্ৰা মত এসেছিল। একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দে তার তন্দ্ৰা টুটে গেল।
খোলা জানলাপথে বৈকালী রৌদ্রের নিস্তেজ আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে।
দরজাটা সে শয়নের পূর্বেই ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল।
ঘুমের ঘোর তখনও চোখের পাতা থেকে ভাল করে মুছে যায়নি।
একটা অস্পষ্ট আওয়াজ ও শুনেছিল, ঘরের ভিতর চারদিকে ও একবার ভাল করে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
কিন্তু ও কি, বইয়ের আলমারিটার পাশে? ভাল করে কিরীটী চোখের পাতা দুটো একবার রগড়ে নিল। দেওয়ালের একটা অংশ ভিতরের দিকে সরে যাচ্ছে না! হ্যাঁ, তাই তো…
বিস্ময়ে যেন ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। একদৃষ্টে দেওয়ালের দিকে ও তাকিয়ে থাকে।
আরো ভিতরে—হ্যাঁ, ক্রমে দেওয়ালের একটা চৌকো অংশ ভিতরের দিকে ঢুকে বেশ প্রশস্ত দ্বারপথ প্রকাশ পেল।
আশ্চর্য! এসব কি ভোজবাজি? না, ও জেগে জেগেই দিনের বেলা স্বপ্ন দেখছে? না, স্বপ্ন যে নয়, পরমুহুর্তেই তা প্রকাশ পেল। ঘরে প্রবেশ করলেন রাজাবাহাদুর। কিরীটীর বিস্ফোরিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রাজাবাহাদুর হেসে বললেন, ও কি, আপনি জেগে নাকি? আমার ঘরের অদৃশ্য দ্বারপথ দিয়ে যে একটু আগে আমি দেখলাম। আপনি গভীর নিদ্রায় মগ্ন!
রাজাবাহাদুর ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়ালের গায়ে চোরা দ্বারটি অদৃশ্য হয়ে গেল। নিরেট পাথরের দেওয়াল, কোথাও দ্বারের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
রাজাবাহাদুর এগিয়ে এসে একটি আরাম-কেদারা অধিকার করে বললেন, আমি ভেবেছিলাম, এ গোপন দ্বারপথের রহস্য রাত্রে আপনার কাছে ভেদ করব। তা যাকগে, সকলের সামনে দিয়ে এ বাড়ির চিরন্তন নীতি ভঙ্গ করে আপনাকে অন্দরমহলে নিয়ে যেতে পারব না। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম, এই দ্বারপথ দিয়ে অন্দরমহলে আপনাকে নিয়ে যাব রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে। বিশ্রামের কোন ব্যাঘাত হয়নি তো?
না। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দিল।
দু-চারটে কথাবাতাঁর পর রাজাবাহাদুর গোপন দ্বারপথেই আবার বিদায় নিলেন।
রহস্যের খাসমহলাই বটে এ রাজবাটী। গতরাত্রে ট্রেনে সহযাত্রী ব্যারিস্টার মিঃ সান্যালের কথা কিরীটীর মনে উদিত হল।
***
গভীর রাত্রি। একটু আগে রাজবাড়ির পেটা ঘড়িতে রাত্রি একটা ঘোষণা করেছে। কিরীটী একাকী শয্যায় জেগে বসে আছে রাজাবাহাদুরের অপেক্ষায়। তিনি বলেছিলেন রাত্রি এগারটার পর আসবেন। কিন্তু এখনও তার দেখা নেই। কিরীটী চিন্তিত হয়ে ওঠে।
হঠাৎ এমন সময় সেই অস্পষ্ট খসখস শব্দ। ঘরের মধ্যে সুদৃশ্য বাতিদানে তেলের বাতি জুলছে। সমগ্র ঘরখানি তারই আলোয় আলোকিত।
সেই গুপ্ত দ্বার আবার ফুটে ওঠে চোখের সামনে এবং একটু পরেই সেই দ্বারপথে রাজাবাহাদুরকে দেখা গেল, হাতে তার শক্তিশালী পাঁচ সেলের টর্চ।
দেরি হয়ে গেল। এইবারে সব ঘুমিয়েছে, আপনাকে এবারে অন্দরমহলে নিয়ে যাব। বাড়িতে উৎসব আসন্ন। আর মাত্ৰ সাতদিন বাদেই সোনার গোপাল প্রতিষ্ঠিত হবে, আত্মীয়স্বজন ও বাড়ির প্রত্যেকেই জানে। মাত্ৰ সাতটা দিন। আপনার হাতে সময় মিঃ রায়, যা কিছু করবার এই সময়ের মধ্যেই আপনাকে করতে হবে। মূর্তি প্রতিষ্ঠার যে এতবড় বিঘ্ন উপস্থিত হয়েছে এখনও পর্যন্ত কেউ তা জানে না, কাউকে জানতে দিইনি। রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরা যেন কি এক অদ্ভুত উত্তেজনায় কাঁপিতে থাকে। সহসা এগিয়ে এসে কিরীটীর ডান হাতখানি আগ্রহের সঙ্গে চেপে ধরে ব্যাকুল উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলেন, বলুন মিঃ রায়, পারবেন তো আমার সিংহাসনটি উদ্ধার করে দিতে?
কিরীটী অবাক হয়ে রাজাবাহাদুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, এ যে স্টেশনে সকালের পরিচিত সে রাজা ত্ৰিদীপনাথ নয়; সেই দুৰ্জয় সকল্প ও মনোবল, কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই, ছোট একটি ভীরু শিশু!
চলুন রাজাবাহাদুর, আপনাদের শয়নকক্ষটা একবার দেখব।
আসুন।
সাঙ্কেতিক গোপন দরজা-পথে দুজনে—আগে রাজা ত্ৰিদীপনাথ, পশ্চাতে কিরীটী একটা অপ্রশস্ত অলিন্দে এসে প্রবেশ করল। অনেক দিনের বদ্ধ বায়ুতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অলিন্দপথে অনেকটা চলাবার পর সামনেই সিঁড়ি অতিক্রম করে আবার দুজনে এসে একটা বন্ধ দেওয়ালের সামনে দাঁড়াল। সেই দেওয়াল সরে গিয়ে দ্বারপথ প্রকাশিত হল এবং সেই দ্বারপথ দিয়ে দুজনে এসে যে প্রশস্ত সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করল, সেটাই রাজা ত্ৰিদীপনাথের শয়নকক্ষ।
রৌপ্যনির্মিত সুদৃশ্য বাতিদানে মোমবাতি জ্বলছে। প্রকাণ্ড পালঙ্কে নিৰ্ভাজ শয্যা বিছানো।
আমার স্ত্রী এখানে নেই। তিনি দিন দশেক হল তার ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি গেছেন, দিন তিনেকের মধ্যেই ফিরে আসবার কথা। উৎসবের বাড়ি, কিন্তু হঠাৎ তার মাষ্ট্রর শরীর অসুস্থ হওয়ায় তাকে যেতে হয়েছে।–
কিরীটি ঘরের চতুষ্পার্শ্বে তীক্ষ চোখে তাকাচ্ছিল।
পালঙ্ক থেকে হাত পাঁচেক দূরে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো মস্ত একটি আয়রন সেফ।
ঐ আয়রন সেফেই বুঝি আপনার সিংহাসনটি ছিল?
হ্যাঁ।
সিন্দূকটা একবার দেখতে পারি কি? নিশ্চয়, রাজাবাহাদুর এগিয়ে গিয়ে কটিদেশ থেকে একটা চাবির গোছা বের করে সিন্দুকের গা-ডালায় একটা চাবি লাগালেন।
কোন শব্দমাত্র হল না, নিঃশব্দে সিন্দুকটি খুলে গেল।
কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, আশ্চর্য তো।
কি আশ্চর্য মিঃ রায়?
কিছু না, ঐ সিন্দুকটা।
হ্যাঁ, মূল্যবান জার্মান সিন্দুক ওটি, আমার প্রপিতামহেরও আগেকার।
সিন্দুকে পর পর তিনটি সেলফ। ছোট বড় অনেক প্রকার কৌটো ও কাগজপত্রের বাণ্ডিল সেই তিনটি সেলফে সাজানো।
কোথায় ছিল সিংহাসনটি?
ঐ যে দেখছেন সুন্দর ঝাপিটি, ওর মধ্যেই ছিল।
সিংহাসনটি কত বড় ছিল?
তা ছ’ ইঞ্চি খাড়ায় হবে বৈকি। এক-একটা পুতুলই তো প্রায় আড়াই ইঞ্চি করে হবে।
কিরীটি রাজাবাহাদুরের হাত থেকে টৰ্চটা নিয়ে, তার আলোয় আয়রন সেফটি ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগল।
সিংহাসনটি চুরি যাওয়ার পর আপনি সিন্দুকের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করেন নি তো?
না, কেবলমাত্র ঝাঁপিটা একবার সিন্দুক থেকে বাইরে বের করেছিলাম।
কিরীটী সিন্দুকটার ভিতর থেকে ঝাঁপিটা বাইরে এনে, সেটাকে ভাল করে দেখতে লাগল। ঝাঁপিটার গঠনকৌশল সত্যই অপূর্ব। সাধারণ বেতের তৈরী নয়, সূক্ষ্ম রুপোর তারে তৈরী। যথেষ্ট মজবুত। ঝাঁপির ভিতরে অনেক কিছু এক সঙ্গে রাখা যেতে পারে।
ঝাঁপিটি আমি দিনের আলোয় একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে চাই। এটা আমি নীচে আমার ঘরে নিয়ে যাব, আপনার কোন আপত্তি নেই তো রাজাবাহাদুর?
না, আপত্তি কি! নিয়ে যান।
এবার কিরীটী ঘরটা ভাল করে দেখতে লাগল।
বেশ প্রকাণ্ড ঘর। মেঝে সুদৃশ্য চৌকো মার্বেল পাথরে গাঁথা, গুপ্তদ্বারটি ভিন্ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশের একটি মাত্রই দ্বার। তা ছাড়া ঘরে চারটি জানলা। দুটি অন্দরের দিকে, অন্য দুটি পূর্বে ও দক্ষিণে।
দক্ষিণের জানালাপথে দেখা যায় রাজবাড়ির বাগান। প্রকাণ্ড বাগান, বাগানের সুউচ্চ প্রাচীরের ওপারে দেখা যায় শীতের ম্রিয়মাণ চন্দ্রালোকে মূৰ্ছিতা বিশুষ্ক ক্ষীণকায়া নদী।
পূবের দিকে রাজবাড়ির সুউচ্চ গেট। দৃষ্টি প্রতিহত হয়ে আসে।
জানলাপথে মোটা সব লোহার শিক বসানো। দুটি শিকের ব্যবধান এক বিঘাতের বেশী নয়। সেই সামান্য পরিসরের মধ্যে দিয়ে কারো এই কক্ষে প্রবেশ করা একপ্রকার দুঃসাধ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না।
কক্ষের বাইরে একটা ঘোরানো বারান্দা। বারান্দার মাঝামাঝি স্নানঘর।
উপরের তলায় সর্বসমেত আটখানা ঘর।
রাজবাড়িতে কর্মচারী ও ভৃত্যদের বাদ দিলে রাজা ত্ৰিদীপনাথ তাঁর স্ত্রী, বৃদ্ধা মা জগত্তারিণী, প্রৌঢ় অবিবাহিত খুল্লতাত জ্ঞানদাশঙ্কর, এক বিধবা বোন শ্যামা।
শ্যামা নিঃসন্তান। দিন কুড়ি হবে গৃহদেবতা প্রতিষ্ঠা উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য দূরসম্পৰ্কীয় অনেক আত্মীয়ই এসেছেন, মেয়ে পুরুষ ছেলে যুবা বুড়ো বুড়ী।
অন্তঃপুরের তিনটি মহল। সর্বশেষের মহলের উপরে তিনখানি ঘর, একখানা রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষ, একখানা লাইব্রেরী, অন্যখানা বসবার জন্য নির্দিষ্ট। দ্বিতীয় মহলে শ্যামা থাকেন, তৃতীয়টিতে খুড়ো জ্ঞানদাশঙ্কর। উপরের টানা বারান্দা দিয়ে এক মহল থেকে অন্য মহলে যাতায়াত করবার দরজা আছে, তবে রাত্রে সে সব দরজা বন্ধ থাকে।
নীচে অমনি তিনটি মহল। প্রথম দুটি মহল অন্তঃপুরের সঙ্গে সংযুক্ত, বাকি মহলটি অন্তঃ পুরেরই শামিল—তবে সেখানে গণ্যমান্য অতিথিরা এলে বাস করেন।
তারই একটি ঘরে কিরীটিকে থাকতে দেওয়া হয়েছে।
কিরীটীর অনুরোধে রাজাবাহাদুর সিংহাসনটি চুরি যাবার আনুপূর্বিক ঘটনা বললেন।
সেদিন শনিবার, অমাবস্যা। তার উপরে সকাল থেকেই আকাশটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সারাটা দিন লাইব্রেরী ঘরে কাটিয়ে ত্ৰিদীপনাথ সন্ধ্যার দিকে অন্দরমহলে যাবেন বলে উঠেছেন, এমন সময় হঠাৎ যেন তঁর মাথাটা ঘুরে উঠল। তাড়াতাড়ি সোফার ওপরে বসে পড়লেন। শরীরটার মধ্যে কেমন যেন অস্থির-অস্থির করছিল। ঐ দিনই সকালের ট্রেনে তার শ্যালক মেডিক্যাল কলেজের পাস-করা ডাক্তার শশাঙ্ক তার দিদিকে নিতে এসেছিল। সে সংবাদ পেয়ে ছুটে আসে এবং সকলে মিলে তাঁকে নিয়ে গিয়ে তাঁর শয্যার ওপরে শুইয়ে দেয়। শশাঙ্ক তাঁকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলে। রাত্রে আর অন্য কিছু না খেয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়েই শুয়ে পড়েন; মাঝরাত্রে একবার ঘুম ভেঙেছিল, তাঁর মনে আছে যে রাজবাড়ির পেটা ঘড়িতে তখন রাত দুটো ঘোষণা করছে। বাকি রাতটা আর তঁর ঘুম হয়নি। পরের দিন তাঁকে একটু সুস্থ দেখে তাঁর স্ত্রী ও শ্যালক দুপুরের গাড়িতে কলকাতায় চলে গেলেন। বেলা চারটের সময় যে স্বর্ণকার সোনার গোপাল নির্মাণ করছিল, সে এসে সিংহাসনের মাপটা জানতে চায়। কেননা যে মাপ সে পূর্বে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা সে হারিয়ে ফেলেছে। তাঁর ধরণা হচ্ছে, সোনার মূর্তির নীচেকার অংশ যেন একটু বড় হয়ে গেছে। সেই সময় রাজাবাহাদুর আয়রন সেফ খুলে ঝাপি তুলে দেখেন ঝাপি শূন্য; সিংহাসন তার মধ্যে নেই অথচ তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, মাত্র দুদিন আগেও একবার যখন তিনি সেফ খোলেন, ঝাপি খুলে দেখেছিলেন সিংহাসন ঝাঁপির মধ্যে আছে।
সেফের মধ্যে যে ঝাঁপিতে সিংহাসন আছে সকলেই তা জানত, না?
হ্যাঁ, কিংবদন্তীর মতই সিংহাসনের অস্তিত্বটা কারো কাছেই গোপন ছিল না।
তবে ঝাঁপির মধ্যে যে ঐ সেফে সেটে থাকত, সেটা আমি, আমার স্ত্রী ও মা ছাড়া আর চতুর্থ ব্যক্তি কেউই জানত না।
আর কেউ জানত না। আপনি ঠিক জানেন?
নিশ্চয়ই।
আপনার মা বাইরের কারো কাছে কোনদিন গল্পচ্ছলেও কি বলে থাকতে পারেন না?
পারেন, কিন্তু আমি আমার স্ত্রী ও মাকে ভালভাবেই চিনি, তাঁদের কেউ অন্যের কাছে সে কথা বলতে পারেন না।
কথায় বলে স্ত্রীলোকের মন, গোপনকে গোপন না রাখাটাই তাদের ধর্ম। জানেন না মহাভারতে যুধিষ্ঠির তাঁর মা কুন্তী দেবীকে কি অভিসম্পাত দিয়েছিলেন!। কিন্তু যাক সে কথা। ওটা সামান্য একটা কিংবদন্তী মাত্র। হ্যাঁ ভাল কথা, আপনার ভৃত্য ভজু তো শুনেছি। এ বাড়িতে বহুকাল আছে, সেও জানত না?
না। তবে সে এ ঘরে প্রায়ই আসে।
কখনও কি মনে হয়েছে, আপনি সিন্দুক খুলেছেন সে এসে পড়েছে?
না, সিন্দুক খোলবার আগে বরাবরই আমি ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিই।
আচ্ছা, আপনার ঘরের এই গুপ্তদ্বারের কথা। আপনি ছাড়া আর কেউ জানে?
আমার মা আর আমার স্ত্রী।
হুঁ, আমার মনে পড়ছে সেই কিংবদন্তী। মনে মনেই কিরীটী কথাগুলো উচ্চারণ করলে।
আপনি যখন ঘুমোন, তখন আপনার সেফের চাবি কোথায় থাকে?
আমার লেখবার ড্রয়ারে।
ঘুমোবার সময় আপনার শয়নকক্ষের দরজা তো বন্ধই থাকে, না?
হ্যাঁ।
সে রাত্রেও ছিল? মানে যেদিন আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
হ্যাঁ। ঘুম ভেঙে উঠে তাই দেখেছিলাম, দরজা ভিতর থেকে বন্ধই ছিল।
আচ্ছা, এই গুপ্ত দ্বারের কথা তাপনার কাকামশাই জ্ঞানদাশঙ্করবাবুও জানতেন না?
না, আমার বাবাই জানতেন এবং মৃত্যুশয্যায় আমাকে বলে যান।
আপনার খুড়োমশাইয়ের সঙ্গে তো কই পরিচয় হল না? তিনি কি এখানে নেই?
আছেন। কাল পরিচয় করিয়ে দেব। চমৎকার লোক। আলাপ করে সুখী হবেন। আমায় অত্যন্ত স্নেহ করেন।
পরের দিন সকালে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে কিরীটী গত রাত্রের সেই ঝাঁপিটি কোলের ওপর নিয়ে দেখেছিল।
ঝাঁপির ভিতরটা দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জিনিস তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সূক্ষ্ম রুপাের তারের সঙ্গে সেটা আটকে আছে। আনন্দে উত্তেজনায় তার চোখের দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে উঠল। জিনিসটা সে ঝাঁপির মধ্যে থেকে বের করে পকেটে রেখে দিল।
এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেল। কিরীটী উঠে দরজা খুলে দিল। ঘরে প্রবেশ করলেন রাজাবাহাদুর এবং তাঁরই মত সুশ্ৰীগড়ন আর একজন প্রৌঢ়। প্রৌঢ়ের পরিধানে দামী মিহি ঢাকাই ধুতি, গায়ে দামী শাল।
ইনি আমার কাকা, জ্ঞানদাশঙ্কর রায়। রাজাবাহাদুর বললেন।
নমস্কার। কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানাল।
এ-কথা সে কথার পর কিরীটী সহসা প্রশ্ন করল, শেষরাত্রের দিকে সেতারের বাজনা শুনছিলাম, রাজাবাহাদুর!
হ্যাঁ, রাজাবাহাদুরই ভোররাত্রের দিকে সেতার বাজাচ্ছিলেন। উনি একজন নামকরা সেতার-বাজিয়ে। কথাটা বললেন জ্ঞানদাশঙ্কর।
সত্যি, চমৎকার হাত আপনার রাজাবাহাদুর!
হ্যাঁ, লক্ষ্মেীতে শিক্ষণ করেছিলাম। আমীর খাঁর কাছে। শুনেছেন বোধ হয় তার নাম?
হ্যাঁ, ওদিকটায় আমারও একটু ঝোক আছে কিনা। আমি কিছু কিছু চর্চা করি।
বটে! কি বাজান আপনি?
এস্রাজ ও ব্যাঞ্জো। সামান্যই শিখেছি।
রাজাবাহাদুর অত্যন্ত খুশী হয়ে উঠলেন। ঠিক হল সন্ধ্যার দিকে একটু গান-বাজনা করা যাবে। এরপর রাজাবাহাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিরীটী খুড়োমশায়ের সঙ্গে গল্প করতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে। খুড়োমশায়ের কাছে রাজাবাহাদুর বলেছিলেন, কিরীটী তার পরিচিত বন্ধু! শ্ৰীনগরে বেড়াতে এসেছেন দু-চার দিনের জন্য।
রাজাবাহাদুরের মুখেই কিরীটী শুনেছেন, সিংহাসনটার ওজন প্রায় তিন পোয়া হবে। খুব একটা ভারী জিনিস নয়। তার ইচ্ছা ছিল, বাড়ির অন্যান্য সকলকে ডেকে সে দু-চারটা কথাবার্তা বলে, কিন্তু রাজাবাহাদুর বলেছেন, আর দু-একদিন বাদে কৌশলে তাকে সে কাজ করতে হবে। ঘৃণাক্ষরে যেন কেউ তার এখানে উপস্থিতির উদ্দেশ্য না টের পায়। তা হলেই সমস্ত ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে।
পরের দিন দ্বিপ্রহরে রাণীসাহেবা শ্ৰীনগরে ফিরে এলেন। রাজাবাহাদুরের মুখে সেকথা শুনে কিরীটী তার নিকট এক অদ্ভুত প্রস্তাব উত্থাপন করল। সে বলল, সিংহাসন চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা রাণীসাহেবকে বলতে হবে এবং সেটা আমারই সামনে।
অনুরোধটা যেন কেমন! কিন্তু এই কদিনের আলাপেই রাজাবাহাদুরের কেমন একটা শ্ৰদ্ধা জন্মে গিয়েছিল কিরীটীর ওপরে। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন।
রাজাবাহাদুরের চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে কিরীটী বললে, আমি বুঝতে পারছি, আপনার কোথায় সঙ্কোচ হচ্ছে রাজাবাহাদুর! কিন্তু অনুসন্ধানের ব্যাপারে ওটা অপরিহার্য। তাছাড়া ভেবে দেখুন, আপনার উৎসবের দিন সমাগত, যেমন ভাবেই হোক আমাদের মিলিত চেষ্টা করতেই হবে হাত সিংহাসনটি পুনুরুদ্ধারের জন্য।
রহস্যের কোন সূত্র কি আপনি পেয়েছেন মিঃ রায়?
সামান্য কয়েকটা সূত্র ধরে একটা অসম্পূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছেছি মাত্র।
ঐদিনই সন্ধ্যায় রাজাবাহাদুর কিরীটীর প্রস্তাবমত রাণীসাহেবার কাছে কিরীটীর সামনেই ঘটনাটি প্রকাশ করবেন।
***
সন্ধ্যার অল্প পরেই কিরীটীর কক্ষে সকলে মিলিত হলেন।
রাণীসাহেবকে দেখে কিরীটী মুগ্ধ হয়েছিল, শুধু দৈহিক সৌন্দর্যের দিক দিয়েই নয়, তীক্ষবুদ্ধির সংযতস্বভাবা রাণীসাহেবা সত্যিই একটা রত্ন-বিশেষ। রাজকীয় সম্মানের উপযুক্তা।
দু-চার মিনিট সাধারণ আলাপ-আলোচনার পর সহসা কিরীটী তীক্ষ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে রাণীসাহেবার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, রাণীসাহেবা, আপনি এখনও শোনেননি, কেন আমি আপনাদের প্রাসাদে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি?
রাণীসাহেবা তাঁর পরিপূর্ণ দৃষ্টি কিরীটীর প্রতি তুলে ধরেন।
আপনি জানেন, আপনাদের গৃহদেবতার প্রতিষ্ঠার উৎসব সমাগত, কিন্তু একথা এখনও জানেন না যে, সেই উৎসবে কত বড় বিষ্ম এসে দাঁড়িয়েছে। আপনাদের পূর্বপুরুষের তৈরী আসন্ন উৎসবের প্রধান অঙ্গ মূল্যবান বত্ৰিশসিংহাসনটি আপনাদের শয়নকক্ষের আয়রন সেফ থেকে অপহৃত হয়েছে।
কিরীটী দেখলে, সংবাদটি শুনে রাণীসাহেবার সমগ্র শরীর যেন মূহুর্তে বংশপত্রের মত সহসা বারেকের জন্য কেঁপে উঠে পরীক্ষণেই আবার স্থির হয়ে গেল। সহসা তিনি যেন ঘটনার আকস্মিকতায় পাথরের মত স্তব্ধ অনড় হয়ে গেছেন! অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে ক্ষণকাল তিনি কিরীচীর সপ্রশ্ন কঠিন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার পর পার্শ্বে উপবিষ্ট স্বামীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ অথচ দৃঢ়স্বরে প্রশ্ন করলেন, একথা তো তুমি আমায় বলেনি? কণ্ঠস্বরের ভিতর দিয়ে যেন একটি কঠিন ভৎসনার সুর মূর্ত হয়ে উঠল। বললেন, একথা কি সত্যি?
হ্যাঁ মালতী, এ ঘটনায় আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।
কবে এ দুর্ঘটনা ঘটল?
সম্ভবত যেদিন তুমি তোমার বাপের বাড়ি যাও, তার আগের দিন রাত্রে।
মানে যে রাত্ৰে তুমি অসুস্থ হয়েছিলে?
হ্যাঁ।
সে রাত্রের কথা আপনার সব মনে আছে। রাণীসাহেবা? প্রশ্ন করল এবারে কিরীটী।
কি আপনি জানতে চান বলুন?
সে রাত্রের আনুপূর্বিক ঘটনা সব আমায় বলুন, যতটা আপনার মনে আছে।
সন্ধ্যার দিকে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার ভাই শশাঙ্ক সেদিন এখানে ছিল, তারই সাহায্যে ওঁকে আমরা ওঁর শয়নকক্ষে নিয়ে যাই। শয্যায় শুইয়ে দেওয়ার পর উনি যেন কেমন অজ্ঞানের মত রইলেন, ডাকলে সাড়া দেন না, চোখ দুটো বোজা, ক্ষীণ শ্বাস-প্রশ্বাস।
কতক্ষণ আমন অবস্থায় ছিলেন?
রাত্রি একটার পর আমি ঘুমাই, তখন পর্যন্ত ওই অবস্থায়ই ছিলেন। শেষের দিকে ঘুমের ওষুধ দেওয়ায় বোধ করি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
কে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল?
আমার ভাই শশাঙ্ক ডাক্তার। সে-ই দিয়েছিল।
রাত্ৰি কটা পর্যন্ত আপনার ভাই আপনাদের শয়নকক্ষে ছিলেন?
তীব্র দৃষ্টিতে রাণীসাহেবা কিরীটীর দিকে তাকালেন, পরে শান্ত স্বরে বললেন, তা রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হবে। তার পর তাকে আমি একপ্রকার ঠেলোঁঠুলে শুতে পাঠাই।
সে রাত্রে আপনার ভাই শুতে যাওয়ার পর, যতক্ষণ আপনি জেগে ছিলেন, আপনাদের শয়নকক্ষে কোনরকম অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন বলে আপনার মনে হয়?
না।
সে রাত্রে কখন আপনার ঘুম ভাঙে?
শেষ রাত্ৰে।
তখন রাজবাহাদুর জেগে ছিলেন?
হ্যাঁ, জেগে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন।
হঠাৎ কিরীটী রাজাবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে একটি অদ্ভুত অনুরোধ জানাল, রাজাবাহাদুর, আর একটি অনুরোধ আপনার কাছে আমার আছে।
বলুন।
আমি রাণীসাহেবকে একাকী কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই অর্থাৎ এ ঘরে আমি ও রাণীসাহেবা ছাড়া আর তৃতীয় কেউ থাকবে না।
বেশ তো, করুন। রাজাবাহাদুর উঠে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে কিরীটী বসে রইল। ঘরের মধ্যে অখণ্ড স্তব্ধতা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে ঘরখানি অবলুপ্ত হয়েছিল। কিরীটী উঠে পকেট থেকে দেশলাই বের করে ফস করে সামনের শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপরে রক্ষিত মোমবাতিটা জ্বালাল। নিমেষে। ঘরের অন্ধকার দূরীভূত হল।
রাণীসাহেবা মাথা নীচু করে বসে ছিলেন। কিরীটী রাণীসাহেবার দিকে একবার তাকিয়ে প্রশ্ন করল, রাণীসাহেবা, আপনার স্বামী কি সেদিনকার মত আর কখনও পূর্বে অসুস্থ হয়েছিলেন?
রাণীসাহেবা কিরীটীর দিকে চোখ তুলে চেয়েই, আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।
না।
এর আগে কখনও কোনদিনও আমনি অসুস্থ হন নি?
না।
আপনার ভাইয়ের পুরো নাম কি?
শশাঙ্কশেখর সান্যাল।
ডাঃ শশাঙ্কশেখর সান্যাল-আমি এক সান্যালকে জানি নামকরা ম্যাজিসিয়ান!
সেই ম্যাজিসিয়ানই আমার ভাই। আপনি তাকে চেনেন?
চিনি না, তবে দু-চারবার তাঁর মেসমেরিজম দেখেছি ইউনিভারসিটি ইনষ্টিটিউটে। তিনি একজন নামকরা বীণাবাদকও বটে, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনার স্বামীও শুনেছি চমৎকার সেতার বাজান!
হ্যাঁ।
আচ্ছা, আপনি এবার যেতে পারেন রাণীসাহেবা।
***
পরের দিন সন্ধ্যার দিকে কিরীটী কলকাতায় চলে গেল। বলে গেল, দিন দুয়েকের মধ্যেই ফিরবে, এবং সত্যি-সত্যিই দিন দুই বাদে আবার ফিরে এল। মূর্তি প্রতিষ্ঠার আর মাত্র দুদিন বাকি আছে।
এসে শুনল রাণীসাহেবার ভাই ডাঃ সান্যালও এসেছেন।
দ্বিপ্রহরের দিকে রাজাবাহাদুরই স্বয়ং রাণীসাহেবার ভাইকে কিরীটীর ঘরে এনে আলাপ করিয়ে দিলেন। সুশ্ৰী চেহারা, দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। বেজায় হাসি-খুশী ও আমুদে। কিরীটী ডাঃ সান্যালের সঙ্গে আলাপ করে মুগ্ধ হল।
কথায় কথায় কিরীটী ডাঃ সান্যালকে বললে, আপনার মেসমেরিজম করা দু-একবার আমি দেখেছি ডাঃ সান্যাল, আজ একবার দেখান না!
ডাঃ সান্যাল হাসতে হাসতে বললেন, বেশ তো, খাওয়াদাওয়ার পর হবে’খন আজি রাত্রেই। জামাইবাবু চমৎকার মিডিয়াম। চট্ট করে ওঁকে মেসমেরাইজ করা যায়।
তাই নাকি, রাজাসাহেব! আমিও এককালে যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি যাদুকর গণপতির কাছে মেসমেরিজম বিদ্যা শিক্ষা করেছিলাম।
সত্যি? আপনিও জানেন নাকি?
সামান্যই, তবে ভাল মিডিয়াম হলে কখনও কখনও কৃতকার্য হয়েছি।
***
রাত্রি তখন বোধ করি নটা সাড়ে নটা হবে।
ঠিক হল আগে কিছুক্ষণ গান-বাজনা হবার পর ম্যাজিক শুরু করা যাবে।
কিরীটীর ঘরেই সকলে সমবেত হয়েছেন; কিরীটী, রাজাবাহাদুর জ্ঞানদাশঙ্কর, ডাঃ সান্যাল ও রাণীসাহেবা মালতী দেবী।
প্রথমে সকলের অনুরোধে কিরীটী ব্যাঞ্জো বাজালে। সকলেই মুগ্ধ হল। তার পর রাজাবাহাদুর। তাঁরও বাজনার হাত চমৎকার।
সর্বশেষ পড়ল ডাঃ সান্যালের পালা। কিন্তু তিনি তার পার্শ্বস্থিত খাপে মোড়া প্রকাণ্ড বীণাখনির দিকে সন্দেহে একবার দৃষ্টিপাত করে সখেদে বললেন, আমার বীণার একটা অংশ গাড়িতে আসবার সময় ফেটে গেছে। আজ বীণা থাক। আপনাদের আজ আমি বঁশের বাঁশী শোনাব। ডাঃ বাঁশীতে সুর দিলেন। বাঁশীতেও তাঁর শক্তি অদ্ভুত। মূহুর্তের মধ্যে তিনি ঘরের মধ্যে অপূর্ব সুরের জাল সৃষ্টি করলেন সামান্য সেই বাঁশের বাঁশীতেই, বীণাখনি পাশেই পড়ে রইল। বাজানা থামবার পর আবার সকলের অনুরোধে ডাঃ সান্যাল বাঁশী তুলে নিলেন। এবার তিনি বাজালেন জয়-জয়ন্তী সুর। নিশীথের নিস্তব্ধতায় সামান্য বাঁশের বাঁশী থেকে যে সুরের ঝর্ণ প্রবাহিত হল তা সত্যই অপূর্ব।
বাজনা শেষ হতেই কিরীটী আচমকা উঠে দাঁড়াল, রাজাবাহাদুর, এবারে আমি আমার ম্যাজিক দেখাব। কিন্তু তার আগে আমি ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাখি। ঘরের মধ্যে এখন যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাদের মধ্যে দুজন, কাকাবাবু ও ডাঃ সান্যাল, আপনাদের কাছেই বিশেষ করে আমার ক্ষমা চাওয়া; কেন যে ক্ষমা চেয়ে রাখছি, এর পর যা ঘটবে, সেটা থেকেই আপনারা দুজনে সহজেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু যাক সে কথা। রাজাবাহাদুর, আপনি আমার সামনে এসে বসে, আমার চোখের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে থাকুন তো। আমার চোখে একটা অদ্ভুত নীল আলো লুকানো আছে। ম্যাজিকের প্রভাবে সেটা সকলের দৃষ্টিগোচর করতে পারি। একে একে আমি সকলকেই দেখােব। শুরু হোক রাজাবাহাদুর থেকে।
মৃদু হেসে রাজাবাহাদুর কিরীটীর সামনে এসে বসলেন, তাকালেন কিরীটীর চোখের দিতে।
ভালো করে আনন্যমনা হয়ে একদৃষ্টি তাকান। দেখতে পাবেন। শুধু ভাবুন আমার চোখ দুটি।-ভুলে যান জগৎ সংসার সব কিছু। ভুলে যান। আপনি কে, কোথায়, কেন? শুধু আমার চোখ-হ্যাঁ, আমার চোখ…
এক মিনিট, দু মিনিট করে মিনিট দশেক কেটে গেল। রাজাবাহাদুর ও কিরীটী পরস্পর চোখের দিকে তাকিয়ে। ঘরের সব কটি প্রাণী বাক্যাহারা।
সহসা কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। এ যেন সে কিরীটীর একটু আগে শোনা কণ্ঠস্বর নয়। বৰ্জগভীর নির্দেশ বের হয়ে আসে কিরীটীর কণ্ঠস্বরে, রাজাবাহাদুর।
মন্ত্ৰমুগ্ধ রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে শোনা গেল, বলুন! যেন বহু বহু দূর হতে ভেসে আসছে।
আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁ। ক্ষীণ উত্তর।
আপনাদের পূর্বপুরুষের বত্রিশ সিংহাসনটি চুরি গেছে না?
হ্যাঁ ঘরের একমাত্র জ্ঞানদাশঙ্কর চমকে উঠলেন, কিরীটীর ইঙ্গিতে চুপ করে রইলেন।
আপনি জানেন সেটা কোথায় আছে?
না তো।
নিশ্চয়ই জানেন। আজ থেকে ঠিক তেরো দিন আগে এমনি একটি রাত্রির কথা মনে করুন। মনে করে দেখুন। নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন। সে রাতের কথা মনে পড়ছে এখন?
হ্যাঁ, পড়ছে। সহসা এমন সময় অতর্কিতে দপ করে ঘরের মধ্যের একটিমাত্র মোমবাতি নিভে গিয়ে নিশ্চিদ্র আঁধারে সমগ্র ঘরখানি যেন দৃষ্টি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল! মালতী দেবী অর্ধস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন। আলো জ্বালাতেও বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।
রাজাবাহাদুর তেমনি ভাবেই স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছেন, মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে, চোখ দুটি অর্ধনিমীলিত, যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমুচ্ছেন।
অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরাটাই আবার সর্বপ্রথম বললে রাজাবাহাদুরকে সম্বোধন করে, আপনিই রুপোর ঝাঁপিটা আপনার শয়নঘরের আয়রন সেফ থেকে সে রাত্রে বের করে নিয়ে আসেন, কেমন তাই না? বলুন, কোথায় রেখেছেন সেটা?
হ্যাঁ—কিন্তু আমার মনে পড়ছে না কোথায় রেখেছি সেটা! না, মনে পড়ছে না।
এরপর ধীরে ধীরে কিরীটী রাজাবাহাদুরের মোহনিদ্রা ভাঙিয়ে দিল। ঘরের সব কয়টি প্রাণীই নির্বাক। কারো মুখে কোন কথা নেই। যাদুমন্ত্ৰে যেন সকলেই বাক্যহীন হয়েছে।
ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। দু পাশের শিরাগুলো দপদপ করছে। মোমবাতিটা পিটপিট করে জ্বলছে। খসখস একটা শব্দ।
কিরীটী সতর্ক হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, দেওয়ালের সেই গুপ্তদ্বার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই গুপ্তদ্বারপথে যার মূর্তি ভেসে উঠল, তাকে দেখে কিরীটী যেন ভূত দেখার মতই চমকে ওঠে।
মাথার ওপরে স্বল্প ঘোমটা, রাণীসাহেবা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী শয্যার ওপরে উঠে বসে বললে, আসুন রাণীসাহেবা।
কিরীটীবাবু!
বসুন রাণীসাহেবা। আপনি কেন এত রাত্রে এসেছেন তা আমি জানি।
আমাকে এ কলঙ্ক থেকে বাঁচান। কিরীটীবাবু! অসহ্য কান্নার দুর্দমনীয় বেগে রাণী যেন ভেঙে পড়লেন।
কিরীটি ঘরের মধ্যে ধীরভাবে পায়চারি করছিল, সহসা রাণীসাহেবার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর তীক্ষ্ণ অথচ চাপা কণ্ঠে বললে, আপনি যা বলছেন, তা কি সত্যি আপনার মনের কথা রাণীসাহেব? সত্যিই কি এই কলঙ্ক থেকে আপনি মুক্ত হতে চান?
হ্যাঁ।
কিন্তু দুদিন আগেও তো আপনার এ সদিচ্ছা ছিল না রাণীসাহেবা?
বিস্মিত দৃষ্টি তুলে রাণীসাহেবা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
তার মানে?
তা হলে সে রাত্রে এমনি করে আপনি আমার কাছে সত্যকে গোপন করতেন না।
আপনি কি বলছেন কিরীটীবাবু!
রাণীসাহেবা! এখনও আপনার মনে কিন্তু আছে। আমার কাছে আগাগোড়াই আপনি নিজেকে গোপনতার আড়ালে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু বৃথা আপনার সে প্রয়াস। আপনি-আপনি বুঝতে পারছেন না। রাণীসাহেবা, কত বড় কলঙ্ক আপনার মাথার ওপরে ঝুলছে! দেবতুল্য আপনার স্বামী। আপনার প্রতি অশেষ শ্ৰদ্ধা ও ভালবাসা। একবার যখন সমস্ত কথা প্রকাশ পাবে, বুঝতে পারছেন কি, আপনার প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধা ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে, আপনার সকল অহঙ্কার চুর্ণ হবে! সারাটা জীবন আপনাকে চোখের জলে ভাসতে হবে। এখনও ভেবে দেখুন রাণীসাহেবা, আমার কথা এখনও ভেবে দেখুন-এ কলঙ্ক হতে মুক্তি চান, না। সারা জীবন ধরে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান? সোনার সিংহাসনে আপনি আজ সমারাঢ়। মুহুর্তে আপনি ধুলোর ওপরে লুটিয়ে পড়বেন। শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।
রাণীসাহেবা দু হাতের মধ্যে মুখ গুজে ফুলে ফুলে কাঁদিতে লাগলেন।
কিরীটি রোরুদ্যমানা রাণীসাহেবার দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চল হয়ে।
অনেকক্ষণ কেঁদে রাণীসাহেবা কিছুটা শান্ত হলেন, অশুধৌত মুখখানি তুলে বললেন, বলুন, আমাকে কি করতে হবে কিরীটীবাবু? আমি প্রস্তুত।
আমার ওপরে যদি বিশ্বাস রাখেন, তবে সব কথা আমায় খুলে বলতে হবে।
জিজ্ঞাসা করুন।
সে রাত্রে, মানে যেদিন আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেদিন দ্বিপ্রহরে আপনার স্বামীকে মেসমেরাইজড করা হয়েছিল, কেমন, সত্যি কিনা?
হ্যাঁ।
কিন্তু মোসমেরাইজ তাঁর সেদিন ভাঙানো হয়নি।
না, না, তাকে আবার ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল।
না, আপনি জানেন না, তা হয়নি। মোসমেরাইজের ঝোকেই আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার সেই অবস্থাতেই আপনারা তাকে নিয়ে গিয়ে শয্যায় শুইয়ে দেন। বুঝতে পারছেন কি, কত বড় নিষ্ঠুরতা আপনার স্বামীর প্রতি সেদিন করা হয়েছিল! আপনার জেগে থাকা অবস্থাতেই আপনার স্বামী আপনার চোখের সামনে আয়রন সেফ খুলে ঝাপিসমেত সিংহাসনটি বের করে নিয়ে গুপ্তদ্বারপথে নীচে চলে যান, তাই না?
রাণীসাহেবা চুপ করে রইলেন।
কিরীটী আবার বলতে লাগল, কেমন করে সে কথা প্রথম আমার মনে উদয় হয় জানেন? এই মেরজাবটা (তারের যন্ত্র বাজাতে হলে আঙুলের মাথায় যে জিনিসটি পরে নিতে হয়) আমি ঝাঁপির মধ্যে পাই। কিরীটী সেটা পকেট থেকে বের করে দেখালে এবং বললে, এটা আপনার স্বামীরই, এটা প্ল্যাটিনামের তারে তৈরী। এ ধরনের মেরজাবি আপনার স্বামীই সেতার বাজাবার সময় আঙুলের মাথায় পরে থাকেন। সে কথা জ্ঞানদাশঙ্করবাবুর কাছ থেকে আমি জানতে পারি। অথচ আপনার স্বামী মেসমেরাইজড় অবস্থায় এ কাণ্ড করে ছিলেন বলেই পরে কিছুই তাঁর মনে ছিল না। কেন আমি আপনার স্বামীকে সন্দেহ করে ছিলাম তার একটি প্রধান কারণ ঐ।
দ্বিতীয়ত, আপনাদের অন্দরমহল এমনভাবে তৈরী যে বাইরের কোন লোকের পক্ষে সেখানে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য। তার পর আমি জেনেছি আপনাদের শয়নকক্ষে কেবল আপনি, আপনার স্বামী, পুরাতন ভৃত্য ভজু ও রাজমাতা ছাড়া আর কারুরই প্রবেশাধিকার নেই। আয়রন সেফের চাবিও আপনাদের শয়নকক্ষেই থাকে। সেক্ষেত্রে সে ঘর থেকে আপনাদের অজান্তে আয়রন সেফ খুলে সিংহাসনটি চুরি করে আনা, একমাত্র যাদের সে ঘরে গতিবিধি আছে তারা ছাড়া তৃতীয় কোন লোকের পক্ষে শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভব।
তাই যদি মেনে নিই যে, বাইরের কেউ এসে চুরি করতে পারে না, তবে চুরি করেছে। এমন কেউ যাদের ঐ ঘরে গতিবিধি আছে!
প্রথমত ধরুন আপনার স্বামী রাজাবাহাদুর। তিনি যদি জানতেন যে তিনিই চুরি করেছেন, তা হলে এভাবে তিনি সেটা অনুসন্ধান করবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ করে আনতেন না কখনও। অতএব তাঁকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যায়। বৃদ্ধ রাজমাতার দ্বারাও সম্ভব নয়। তৃতীয় রইলেন। আপনি।
বলতে বাধা নেই, তাই আপনার ওপরেই আমার সন্দেহ পড়ে এবং সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় যখন রাজাবাহাদুরের মুখে শুনলাম, চুরির পরদিনই আপনি বাপের বাড়িতে গেছেন। পূর্বদিন স্বামী অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও কোন স্ত্রী তার অসুস্থ স্বামীকে ফেলে এভাবে যেতে পারে না। আপনার সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তখন আপনাদের খুড়োমশাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করি।
তাঁর কাছে শুনলাম, আপনার স্নেহ ও মমতার নাকি তুলনা নেই। শতকণ্ঠে তিনি আপনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তখন আমার সন্দেহ হল, আপনি পাকেপ্রকারে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন এবং সেইজন্যই আপনি ঐভাবে পরদিন পালিয়ে বঁচবার চেষ্টা করেছেন।
তার পর? ক্ষীণ স্বরে রাণীসাহেবা প্রশ্ন করলেন।
তার পর আরও একটা দিক ভাববার ছিল। আপনিই যদি সিংহাসনটি চুরি করে ধাকেন, তবে কেন করলেন? আপনার কিসের অভাব? অতুল ঐশ্বর্য, মান-সম্মান, কিছুরই তো আপনার অভাব নেই! তবে? তা ছাড়া যদি আপনি চুরি করেই থাকেন, কিভাবে আপনি সেটা লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করবেন? ধরা পড়বার সম্ভবনা আছে প্রচুর। অথচ ঝাঁপির মধ্যে পেলাম। আপনার স্বামীর সেতার বাজাবার মেরজাবটি।
তখন মনে হল এর মধ্যে প্রকাণ্ড এক যড়যন্ত্র আছে, যার মধ্যে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক আপনি জড়িয়ে পড়েছেন। সেই কারণেই আপনার স্বামীর সামনে আপনাকে আমি প্রশ্ন করা শুরু করি। ঐ সময়কার আপনার হাবভাব দেখে আপনার ওপরে আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। আপনার মুখেই আপনার ভাইয়ের কথা আমি শুনি এবং সব কথা শুনে বুঝতে আর আমার কষ্ট হয় না যে, আপনার ভাই আপনাকে যন্ত্র-হিসাবে এ কাজে ব্যবহার করেছে, অথচ আপনি তা জানেন না বা জানিবার চেষ্টাও করেননি। শুধু তাই নয়, আপনি এও জানেন না, আপনার বিবাহের পর গত চার-পাঁচ বছরে আপনার ভাইয়ের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। বহু ধারকর্জ হয়েছে। আকণ্ঠ দেনার দায়ে তিনি এখন মুহ্যমান। আমি কলকাতায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসব জানতে পারি।
আশ্চর্য, আমার ভাই! এর মধ্যে আছে?
হ্যাঁ। তিনি আপনার স্বামীকে মেসমেরাইজ করে সিংহাসনটি চুরি করেন, আপনার স্বামীরই হাত দিয়ে। অদ্ভুত চাতুর্য। অভিনব চৌর্য-কৌশল! আপনি জানেন না, আপনাদের এখানে আসবার দিন গাড়িতে সহযাত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার ভাল করে পরিচয় হয়। নিজের প্রতি আসাধারণ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি শ্ৰীনগরের যে অত্যাশ্চর্য নির্ভুল কাহিনী আমার কাছে ব্যক্ত করেন, তাতেই তার প্রতি আমার বিশেষ সন্দেহ জাগে। ছদ্মবেশে এবং ছদ্মনামে তখন তিনি ছিলেন এবং সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই আবার তিনি আজ এ বাড়িতে আমার সমানে আসতে দুঃসাহসী হয়েছেন। তিনি জানেন না, একবার যে কণ্ঠস্বর আমি শুনি, এ জীবনে তা আর আমি ভুলি না। চিরদিন আমার তা মনে থাকে। তাছাড়া একজন সাধারণ তৃতীয় পক্ষের যে অমন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রাজবাড়ির সব কথা জানা অসম্ভব, সেকথাও তার মনে হয়নি সেদিন।
আমি ওঁকে সন্দেহ করেছিলাম বটে, কিন্তু…
সেই জন্যই আপনি স্বামীর অসুস্থতা সত্ত্বেও ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন, কেমন না?
হ্যাঁ, কিন্তু…
কিন্তু আপনি সিংহাসনটির খোঁজ পেলেন না!
না। আমার ভাই যদি সিংহাসনটি নিয়ে থাকবে, কোথায় গেল সেটা? আমি অনেক খুঁজেছি, তার প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টিও এ ক’দিন রেখেছি।
সেও আর এক মস্ত কেরামতি তাঁর। শুনে দুঃখ পাবেন না, আপনার ভাইটি শুধু চোরই নন, একজন পাকা চোর। হ্যাঁ ভাল কথা, আজ। আপনার ভাই কোথায় শুয়েছেন?
আমাদেরই পাশের ঘরে।
তার বীণাটি নিয়ে আসতে পারেন?
বীণাটি কেন?
নিয়ে আসুন না। যাঁরা সত্যিকারের বাজিয়ে তাঁরা কখনও তাদের নিজেদের ব্যবহৃত ভাঙা বাদ্যযন্ত্র আপনার ভাইয়ের মত অত যত্নসহকারে সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে বেড়ান না। আর একটা কথা, আপনি কোনদিন গল্পচ্ছলে নিশ্চয়ই আপনার ভাইয়ের কাছে আপনার বহু মূল্যবান সিংহাসনটির কথা বলেছিলেন!
হ্যাঁ!
এরপর রাণীসাহেবা গুপ্তদ্বারপথ দিয়ে তার ভাইয়ের বীণাযন্ত্রটি নিয়ে এলেন।
কিরীটী ইতিমধ্যে জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে ছিল।
ও কি, আপনি জামাকাপড় পরেছেন যে?
আমি এবার বিদায় নেব রাণীসাহেবা। আপনাদের পারিবারিক এ কলঙ্কের মধ্যে আর না থাকাই মঙ্গল। আপনি নিজে থেকে আজ রাত্রে আমার কাছে এভাবে না এলে ভেবেছিলাম চিঠিতেই আপনার কাছে সব লিখে রেখে ভোররাত্রের ট্রেনে চলে যাব।
কিন্তু স্টেশন তো এখান থেকে অনেক দূরের পথ!
শেষরাত্রের দিকে চাঁদ উঠবে। চাঁদের আলোয় হেঁটে চলে যাব, খুড়োমশাইকে বলে গেট খুলে রাখবার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছি। ঐ বীণার খোলের মধ্যেই খুব সম্ভব আপনার সিংহাসনটি আছে!
হঠাৎ রাণীসাহেবার হাত থেকে বীণাটি মাটিতে পড়ে গেল এবং বীণার খোলটি ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল। রাণীসাহেবা বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, সেই দ্বিখণ্ডিত বীণার খোলের মধ্যে বত্রিশ সিংহাসনটি মোমবাতির আলোয় ঝলমল করছে।
কিরীটী মৃদু হাসল।
হাতের ঘড়ি দেখে বললে, এবার না বের হলে রাত্রি পাঁচটার ট্রেন আমি ধরতে পারব না, রাণীসাহেবা। আপনার স্বামীকে আমার নমস্কার দেবেন। আপনাদের হৃত জিনিস আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি বিদায় নিলাম।
নমস্কার।
নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কিরীটী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।