নিরালা প্রহর

নিরালা প্রহর

ঘটনাটা যেমন নৃশংস তেমনি বীভৎস।

পুলিস ইন্সপেক্টর সুদৰ্শন মল্লিক ঘরের মধ্যে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল।

সমস্ত ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত।

তার মধ্যে পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ।

একটি বছর ত্রিশ-একত্রিশের তরুণীর মৃতদেহ আর অন্যটি একটি বছর চারেকের শিশুর। দুজনকেই কোন ধারালো অন্ত্রের সাহায্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়।

তরুণীর দেহে অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন-চোখে মুখে গলায় পেটে বুকে—মনে হয় বুঝি কোন উন্মাদ কোন তীক্ষ ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে বার বার আঘাত করেছে—যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

শিশুটিকেও ঠিক অনুরূপভাবে হত্যা করা হয়েছে।

পাশাপাশি ঘরের মেঝেতে দুটি মৃতদেহ পড়ে আছে।

দেহটা নৃশংসভাবে ক্ষতবিক্ষত হলেও দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না তরুণী সত্যিই সুন্দরী ছিল। টকটকে গৌর গাত্ৰবৰ্ণ-টানা টানা দুটি চোখ-মাথাভর্তি মেঘের মত একরাশ কালো চুল ছড়িয়ে আছে।

পরনে একটা দামী ঢাকাই শাড়ি—গায়ে লাল সিস্কের ফুলহাতা ব্লাউজ। মাথায় সিঁদুর— দু-হাতে ছয় গাছা করে বারো গাছা সোনার চুড়ি-গলায় হার, কানো হীরার টাব।

তাতেই মনে হয় ব্যাপারটা কোন চোর-ডাকাতের কাজ নয়, কোন বাগালারি নয়। তাহলে নিশ্চয়ই গহনাগুলো গায়ে তারা রেখে যেত না হত্যা করার পর!

শিশুটির খালি গা পরনে ইজের-মাথাভর্তি কেঁকড়া কেঁকড়া চুল—হাতে সোনার বালা। গলায় সোনার বিছোহার।

শিশুটি মেয়ে।

দুৰ্ঘনটা ঘটেছে একেবারে প্রখর দিবালোকে।

কলকাতা শহরে সি আই টি-র কল্যাণে যেসব এলাকা নতুন করে গড়ে উঠেছে-বড় বড় চওড়া পীচঢালা রাস্তা আর তারই দু’পাশে নানা ধরনের সব নতুন বাড়ি—সেই এলাকাতেই অর্ধসমাপ্ত একটা চারতলার বাড়ির ফ্ল্যাটে ঘটনাটা ঘটেছে।

একতলায় একটা ব্যাঙ্ক।

ব্যান্ধে ঐ সময় পুরোদস্তুর কাজকর্ম চলছিল।

বাড়িটা এখনো কমপ্লিট হয়নি। দোতলা ও তিনতলার গোটাচারেক ফ্ল্যাটে মাত্র ভাড়াটে এসেছে।

তিনতলা ও চারতলার কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, চলছে। সামনে ও পিছনে বাঁশের ভারা বাঁধা। চার-পাঁচ জন রাজমিস্ত্রী ও জনাচারেক মজুর কাজ করছিল। ঐ সময়।

অথচ আশ্চর্য!

ব্যাপারটা কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারেনি।

জানাও যেত। কিনা সন্দেহ সন্ধ্যার আগে যদি না স্ত্রীলোকটির স্বামী ডালহৌসীর অফিসে বসে কাজ করতে করতে জরুরী একটা ফোন-কাল পেয়ে তখুনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় এসে না হাজির হত!

মণিশঙ্কর ঘোষাল, মেয়েটির স্বামী, বেলা দুটো নাগাদ একটা ফোন-কাল পায়।

অফিসের পি. বি. এক্স. থেকে ফোনের কানেকশনটা টেলিফোন অপারেটার তার টেবিলে দিয়েছিল।

মিঃ ঘোষাল, আপনার ফোন! অফিসেরই ব্যাপারে হয়তো কেউ ফোন করছে ভেবে মণিশঙ্কর ঘোষাল ফোনটা তুলে নিয়েছিল।

হ্যালো—আপনি কি মণিশঙ্কর ঘোষাল? মণিশঙ্করের মনে হয়েছিল গলার স্বরটা কোন পুরুষের-মোটা, কর্কশ ও কেমন যেন সর্দিধারা গলার মত ভাঙা-ভাঙা।

হ্যাঁ, কথা বলছি। মণিশঙ্কর জবাব দেয়।

আপনি একবার এখুনি আপনার বাসায় যান।

বাসায় যাব! কেমন যেন বিস্মিত হয়েই প্রশ্নটা করে মণিশঙ্কর।

হ্যাঁ, দেরি করবেন না—এখুনি চলে যান। সেখানে বিশ্ৰী একটা ব্যাপার ঘটেছে—

কিন্তু কেন—কী হয়েছে বাসায়?

আপনার স্ত্রী ও মেয়ে—

কি? কি হয়েছে তাদের?

উৎকণ্ঠায় যেন ভেঙে পড়ে মণিশঙ্করের গলার স্বর।

গেলেই দেখতে পাবেন-চলে যান।

কিন্তু আপনি কে? কে কথা বলছেন?

অপর প্রান্তে গলার স্বর তখন থেমে গিয়েছে—আর কিছু শোনা যায়নি।

মণিশঙ্কর কিছুক্ষণ তারপর কেমন যেন হতভম্ভ হয়ে চেয়ারটার উপর বসে ছিল—ব্যাপারটা তখনো যেন ঠিক তার মাথার মধ্যে থিতোয়নি।

কে ফোন করলে তাকে-কি হয়েছে তার স্ত্রী ও কন্যার!

শেষ পর্যন্ত উঠেই পড়ে মণিশঙ্কর!

ম্যানেজারকে বলে ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে পড়ে।

বেলা তখন দুটো বেজে মিনিট দশেক হয়েছে। রাস্তায় নেমে একটা খালি ট্যাক্সিও পেয়ে গেল মণিশঙ্কর-সোজা চলে যায় বেলেঘাটায়। ট্যাক্সি থেকে যখন নামল সেখানে কোনরকম কিছু অস্বাভাবিক তার নজরে পড়েনি।

ব্যাঙ্কের মধ্যে নিয়মমত কাজকর্ম চলেছে সে-সময়।

ভিতরে ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা যে যার আপনি আপনি কাজে ব্যস্ত।

রাস্তায়ও দু-চারজন লোক নজরে পড়ে। একটা বাস চলে গেল। গোটা দুই ট্যাক্সি চলে গেল। একটা রিকশা চলে গেল–

দুজন মিস্ত্রী ভারায় বসে কাজ করছে।

অবিশ্যি এই তল্লাটে সাধারণতঃই লোকজনের ভিড় বা চলাচল একটু কম সব সময়ই। এখানো তেমন কলকাতা শহরের অন্যান্য অংশের মত জনবহুল ও ঘিঞ্জি হয়ে উঠতে পারেনি বলেই হয়তো।

বাড়িতে ফোন নেই।

অবিশ্যি নীচের তলায় ব্যাঙ্কে ফোন আছে। ইচ্ছে করলে বা প্রয়োজন হলে সেখান থেকে ফোন করা যেতে পারে।

বিজিতা দু-একবার সেখান থেকে অফিসে প্রয়োজনে ফোনও করেছে মণিশঙ্করকে।

কিন্তু আজ যে তাকে অফিসে কে ফোন করল—এখনো ভেবে পাচ্ছে না মণিশঙ্কর!

নানা কথা ভাবতে ভাবতেই মণিশঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে তার দোতলার ফ্লাটে উঠে এসেছিল। দরজাটা বন্ধ।

ধাক্কা দিয়ে দরজার গায়ে ভৃত্য শম্ভুকে ডাকতে যাবে কিন্তু হাতের সামান্য ঠেলাতেই দরজার পাল্লা দুটো খুলে গেল আপনা থেকেই।

তিনখানা ঘর-পর পর। পিছনের দিকে দুটো পর পর ল্যাভেটরি।

একটা বাথরুম—রান্নাঘর বা কিচেন, ছোট্ট মত একটা স্টোররুম।

তারই ভাড়া তিনশ টাকা।

অফিস থেকে ভাড়ার অর্ধেক টাকা দেয়, বাকিটা দিতে হয় নিজের পকেট থেকে, তাই মণিশঙ্কর ফ্ল্যাটটা নিতে সাহস করেছিল মাসচারেক আগে।

নূতন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে মাত্র চার মাস। আগে ছিল শ্যামবাজার অঞ্চলে দেড়খানা ঘর নিয়ে একতলায়। দমবন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। মাত্র দেড়খানা ঘর, স্বামী স্ত্রী ওরা দুজন ছাড়াও একজন চাকর।

চাকর না হলে চলে না। বাজার আনাটা—টুকটাক ফাইফরমাশ কে করে। তার উপর মেয়েটাকে একটু বেড়াতে নিয়ে যাওয়া।

মণির তো সময়ই নেই। সেই সকাল নটায় অফিস যায়, ফিরতে সেই কোন সাড়ে ছাঁটাসাতটা। বিজিতাকেও একলা থাকতে হয়!

অনেক খুঁজে পেতে বছর বারোর একটা বাচ্চা চাকর পাওয়া গিয়েছিলশদ্ভুচরণ।

তা ছেলেটা ভাল। সব সময়ই হাসিমুখ। এক পায়ে খাড়া। শম্ভুকে পেয়ে যেন ওমা বেঁচে গিয়েছিল।

বাইরের বসবার ঘরটা বেশ সাজানো। ছিমছাম।

কিন্তু ঘর খালি।

শম্ভু এই শস্তু-দরজাটা খুলে রেখেছিস কেন? বলতে বলতে দ্বিতীয় ঘরে পা দিল মণিশঙ্কর। সে ঘরেও কেউ নেই–

শেষে শোবার ঘরে পা দিয়েই অকস্মাৎ একটা আতঙ্কে যেন থমকে দাঁড়িয়ে যায় মণিশঙ্কর।

নতুন মোজেকের ঘষা চকচকে ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত।

উঃ।

মাথাটা যেন সহসা কেমন ঘুরে উঠল মণিশঙ্করের।

শঙ্কিত বিহ্বল দৃষ্টির সামনে যেন দৃশ্যটা স্পষ্ট—বিজিতা আর রুণার রক্তাক্ত দুটো দেহ-কিছুটা ব্যবধানে চাপ-চাপ রক্তের মধ্যে পড়ে আছে।

বিজিতার পরিধেয় শাড়িটার আচিল স্খলিত গা থেকে।

বুকের কাছে বীভৎস চার-পাঁচটা ক্ষত—ঝলকে ঝলকে রক্ত বোধ হয় বের হয়ে এসেছিল সেই ক্ষতমুখ দিয়ে—জামা—শাড়ি-মেঝেতে খালি রক্ত আর রক্ত।

শুধু বুকেই নয়—মুখে, গালে, গলায় হাতে সর্বত্র ক্ষত। প্রত্যেকটি ক্ষতস্থান দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে।

হঠাৎ ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায়। মণিশঙ্কর—চিৎকার করবার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না।

সিঁড়ি দিয়ে নামছিল মণিশঙ্কর একপ্রকার পাগলের মতই যেন ছুটতে ছুটতে, ঐসময় দোতলার পাশের ফ্ল্যাটের অন্য ভাড়াটে ইঞ্জিনীয়ার গোপেন বসুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক গোপেনবাবু।

কি কি হয়েছে। মণিবাবু—

খুন–

খুন-কে? কে খুন হলো?

আমার স্ত্রী-আমার মেয়ে—তাদের মেরে ফেলেছে গোপেনবাবু—তাদের মেরে ফেলেছে—বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে মণিশঙ্কর।

কোথায়, কোন ঘরে।

উপরে শোবার ঘরে।

চলুন-চলুন দেখি

না, না—আমি যাবো না—রক্তের বন্যা বইছে-না, না—

গোপেন বসুই নীচে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে থানায় ফোন করে দিয়েছিল, শীঘ্ৰ আসুন স্যার— বেলেঘাটা নতুন সি. আই. টির ফ্ল্যাটে দুটো খুন হয়েছে।

আপনি কে? থানা-অফিসার রবীন দত্ত জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

আমার নাম গোপেন বসু, ঐ বাড়ির উপরের ফ্ল্যাটে আমি থাকি।

রবীন দত্ত ছুটে আসে জীপ নিয়ে। দেরি করে না।

অকুস্থানে দাঁড়িয়ে যখন সরেজমিন তদন্ত করছে ইন্সপেক্টর সুদৰ্শন মল্লিক লালবাজার হোমিসাইডাল স্কোয়াডের একটা পুলিস ভ্যানে চেপে হাজির হলো।

বাড়ির সামনে ও ভিতরে, সিঁড়ির নীচে পুলিস ছিল, তারা সুদর্শকে সেলাম করল।

কোথায় খুন হয়েছে? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।

দোতলার ফ্ল্যাটে স্যার—

সুদৰ্শন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে। প্রথম ঘরটাতে একজন লাল-পাগড়ি ছিল— সেই সুদৰ্শনকে ইঙ্গিতে ঘরটা দেখিয়ে বলে, ভিতরের ঘরে স্যার ডেড বডি।

সুদৰ্শন পরের ঘরটা পার হয়ে শেষের ঘরে পা ফেলেই দরজা-পথে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

সমস্ত ঘরের মেঝেতে চাপ-চাপ রক্ত। জমাট বেঁধে আছে রক্ত।

আর সেই চাপ-চাপ জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে দুটো মৃতদেহ।

একটি বছর ত্রিশ-একত্রিশের তরুণীর মৃতদেহ, অন্যটি একটি বাচ্চা মেয়ের—বছর চার বয়স হবে বড় জোর, গায়ে কোন জামা নেই, কেবল একটা ইজের পরা। তারও পেটে-বুকে নিষ্ঠুর আঘাতের চিহ্ন।

নৃশংস-বীভৎস ভাবে হত্যা করা হয়েছে দুজনকেই।

কোন উন্মাদ যেন এক হত্যা-লালসায় কোন তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্রের দ্বারা ওদের বার বার আঘাত করে হত্যা করেছে।

সত্যি কথা বলতে কি সুদৰ্শন মল্লিকেরও ঘরের মধ্যে পা ফেলে প্রথমটায় মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠেছিল।

মাত্র মাস দুই হবে সুদৰ্শন প্রমোশন পেয়ে লালবাজারে পোস্টিং পেয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে গত দুইমাসে আরো দুটি হত্যার ব্যাপারে তাকে দৌড়া-দৌড়ি করতে হয়েছে, কিন্তু এবারের হত্যা ব্যাপারটা যেন তার তুলনায় যেমনই নিষ্ঠুর তেমনি নৃশংস ও বীভৎস।

মুহুর্তের বিহ্বলতাটা কাটিয়ে ওঠবার পর সুদৰ্শন ভাল করে এককবার ঘরটার মধ্যে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করল।

সুন্দর ছিমছাম ভাবে শয়নকক্ষটি যেন সাজানো। জানলায় দরজায় দামী বম্বে প্রিন্টের রঙীন পর্দা। রাস্তার দিকের সব কয়টি জানলাই খোলা।

হাওয়ায় পর্দাগুলো উড়ছিল।

ঘরের একদিকে জানলা ঘেঁষে দুটি পর পর সিঙ্গল বেডে শয্যা—তার উপর দামী বেডকভার।

একধারে ছোট একটি স্টীলের প্রমাণ-আরাশি-বসানো আলমারি। তারই পাশে একটি ড্রেসিং টেবিল। দেওয়াল ঘেঁষে একটি কাবার্ডের উপরে একটি খাপে-ভরা তানপুরা ও একটি বেহালার বাক্স নজরে পড়ে। টেবিলের ওপরে সুন্দরভাবে সাজানো প্রসাধনদ্রব্যগুলি। সামনে ছে টি একটি বসবার টুল।

তার পাশে একটি মোড়া।

অন্যদিকে ঘরের নীচু একটি টেবিলের উপরে একটি দামী রেডিও সেট—তার উপরে কঁ চর ফ্রেমে পাশাপাশি দুটি ফটো।

একটি ফটো বিজিতা ও মণিশঙ্করের—হাসিখুশী দুটি তরুণ-তরুণী—অন্য ফটোটি তাদের একমাত্র সন্তান রুণুর।

ঘরের মেঝেতে চারিদিকে রক্তের ছিটে কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে।

ইতিমধ্যে থানা-অফিসার রবীন দত্ত যতটা সংবাদ মোটামুটি সংগ্রহ করতে পেরেছিল সুদৰ্শনকে বললে।

সুদৰ্শন নিঃশব্দে সব শুনে গেল।

ফ্ল্যাটে তাহলে ঐ তরুণী, ঐ বাচ্চাটা আর চাকরিটা ছাড়া কেউ ছিল না? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।

না। রবীন দত্ত বলে।

চাকরিটার কোন পাত্তা এখনো পাওয়া যায়নি?

না।

কতদিন কাজ করছিল। এখানে চাকরিটা?

মণিবাবু—মানে ভদ্রমহিলাটির স্বামী তো বলছিলেন, বছর কয়েক হবে চাকরাটা ওঁদের কাছে আছে।

কত বয়স?

বছর বারো-তেরো হবে!

দরজাটা তাহলে খোলাই ছিল?

হ্যাঁ—ভেজানো ছিল—মণিবাবু হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে গেলেই খুলে যায়।

মণিশঙ্করবাবু আর কাউকেই দেখেননি?

না।

সুদৰ্শন আবার ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলো। দুপুরেই কোন এক সময় ঐ নিষ্ঠুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে অথচ কেউ জানতে পারল না!

কেউ কোনরকম আশেপাশে শব্দ, আওয়াজ বা চিৎকার শোনেনি? সুদৰ্শন আবার প্রশ্ন করে।

রবীন দত্তর প্রশ্নে সুদৰ্শন ওর মুখের দিকে তাকাল, কি?

ঐ চাকর ব্যাটারই কীর্তি। খুন করে চুরিটুরি করে পালিয়েছে দলবল নিয়ে।

কিছু চুরি গেছে কিনা জানতে পেরেছেন?

না। এখনো সব অনিশ্চিত, ভাল করে সন্ধান করা হয়নি, তবে সঙ্গে যে বাৰ্গােলরি আছে নিশ্চিত।

তাই যদি হবে তো ভদ্রমহিলার হাতে সোনার চুরি — গলায় সোনার হার কানে টাব— বাচ্চটারিও গলায় হার, হাতে বালা হয়তো থাকত না। ওগুলো না নিয়েই কি তারা যেত! সুদৰ্শন বললে।

হয়তো কেউ এসে পড়েছিল বা তাড়াহুড়াতে সময় করে উঠতে পারেনি, সঙ্গে সঙ্গে পালিয়েছে–

আমার তা যেন ঠিক মনে হচ্ছে না মিঃ দত্ত।

কিন্তু স্যার—

যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে দুটো মানুষকে, যদি একটু চিন্তা করেন তো একটা কথা স্বভাবতই মনে হবে

কি স্যার?

ইট ইজ এ ডেলিবারেট, প্রিমেডিটেটেড মার্ডার! সুপরিকল্পিত হত্যা। এবং হত্যার জন্যই হত্যা—হত্যাকারী চুরি করতে এখানে আসেনি! এসেছিল হত্যা করতে এবং হত্যা করে চলে গিয়েছে—হয়তো কোন প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্যই হত্যা করে গিয়েছে।

প্রতিহিংসা!

সব কিছু দেখে তাই মনে হচ্ছে। হত্যার পিছনে হয়তো একটা আক্রোশ ও প্রতিহিংসার ব্যাপার জড়িয়ে আছে। তাহলেও বলবো হত্যাকারীর দুর্জয় সাহস আছে। দিনের বেলা আশেপাশে লোকজনের মধ্যে এসে হত্যা করে গিয়েছে।

আপনি বলছেন চাকরিটার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই!

তা ঠিক বলা যায় না। হয়তো থাকতেও পারে—

নিশ্চয়ই স্যার। নচেৎ পালাবে কেন?

এমনও তো হতে পারে মিঃ দত্ত, চাকরিটা বাড়িতে ছিল না সে-সময়—হয়তো সে কোন কাজে ঐ সময় বাইরে গিয়েছিল অথবা ঐ মহিলাই তাকে কোন কাজে কোথাও পাঠিয়েছিলেন আর ঐ সময়ই হত্যাকারী আসে। দরজায় ধাক্কার শব্দ পেয়ে ভদ্রমহিলা গিয়ে দরজা খুলে দেন-তারপর হত্যাকারী তার কাজ শেষ করে চলে যাবার পর হয়তো চাকরিটা ফিরে আসে এবং ঘরে ঢুকে ঐ দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়েছে।

সে তো থানায় একটা খবরও দিতে পারত!

একটা বারো-তেরো বছরের ছেলের ঐ দৃশ্য দেখে মাথা ঠিক রাখা সাধারণতঃ সম্ভব নয়–সে যাক-সে-সব তো তদন্তসাপেক্ষ।

সুদৰ্শন কথাগুলো বলে আবার ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল, পায়ে পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।

মাথা আঁচড়াবার চিরুনিটা হাত দিয়ে তুলল সুদৰ্শন-কয়েক গাছি চুল চিরুনিতে তখনো আটকে আছে

আরো একটা ব্যাপার নজরে পড়ল—ড্রেসিং টেবিলের উপরে কাচের উপরে সিঁদুর ও পাউডারের কিছু গুড়ো এদিক ওদিক পড়ে আছে।

সুদৰ্শন বললে, মনে হয় দুপুরে হয়তো প্রসাধন করেছিলেন ভদ্রমহিলা। প্রসাধনের পর টেবিলের কাঁচটা পরিষ্কার করেননি—করতে ভুলে গিয়েছেন বা করবার সময় পাননি।

তাই কি মনে হচ্ছে স্যার? রবীন দত্ত বলে।

তাছাড়া ভদ্রমহিলার পরনের দামী ঢাকাই শাড়িটা দেখে মনে হয় তো কোথাও বেরুবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন বা হয়েছিলেন, এমন সময় হত্যাকারীর আবির্ভাব ঘটেছিল।

রবীন দত্ত কোন কথা বলে না। সুদৰ্শন আবার বলে, দেওয়ালটা দেখুন। মিঃ দত্ত—

ঘরের দেওয়ালেও কয়েকটা রক্তের ছিটে নজরে পড়ল রবীন দত্তর। রক্ত শুকিয়ে আছে। অতঃপর সুদৰ্শন পাশের ঘরে এলো দুটি ঘরের মধ্যবর্তী দরজা-পথে।

এ ঘরটি মাঝারি সাইজের। এ ঘরেও একপাশে একটি শয্যা, একটি সিঙ্গল খাটে শয্যাটি নীল রংয়ের একটা বেডকভারে ঢাকা।

এক পাশে ডাইনিং টেবিল ছোট সাইজের একটি এবং খােন তিনেক চেয়ার। অন্য পাশে ছোট একটি মীট-সেফ ও একটি কাঠের আলমারি।

ঐ ঘরেরই সংলগ্ন বাথরুম ও কিচেন।

ঐ ঘরেই একটা চেয়ারের ওপরে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল মণিশঙ্কর।

রোগা পাতলা চেহারা।

পরনে দামী টেরিলিনের সুট-গলার টাইটার নাট লুজ, মাথার চুল সযত্নে ব্যাকব্রাশ করা।

সুদৰ্শন ও রবীন দত্তর পদশব্দে মণিশঙ্কর মুখ তুলে ওদের দিকে তাকাল।

চোখ দুটো তার লাল।

বোধ হয় কাঁদছিল?

মণিশঙ্কর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।

সুদৰ্শন বাধা দেয়, বসুন বসুন মিঃ ঘোষাল।

মণিশঙ্কর আবার চেয়ারটার ওপরে বসে পড়ল।

সুদৰ্শনও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। জিজ্ঞাসা করল, আপনি অফিস থেকে ফোন পেয়েই তো আসেন, তাই না?

হ্যাঁ।

ফোনে পুরুষের গলা শুনেছিলেন?

হ্যাঁ—মোটা, কর্কশ—সর্দিধারা গলার মতো, যেন কেমন ভাঙা-ভাঙা গলার স্বরটা ছিল।

চিনতে পারেননি কার গলা?

না।

আন্দাজও করতে পারছেন না কিছু?

না।

কখন ফোনটা পান?

ঠিক লাঞ্চের কিছু পরে—দুটো বাজতে দশ-পনের মিনিট তখনো বাকি।

তারপরই চলে এলেন। আপনি?

হ্যাঁ-সোজা একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসি।

কি বলেছিল ফোনে লোকটা?

তখুনি আমাকে বাসায় আসতে বলেছিল। বাসায় নাকি একটা বিশ্ৰী ব্যাপার ঘটেছে। তখন কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছি। আমার এত বড় সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে—

কথাগুলো বলতে বলতে মণিশঙ্করের গলার স্বরটা যেন কান্নায় বুজে আসতে চায়।

উঃ, এখনো আমি যেন ভাবতে পারছি না। অফিসার—একটু থেমে আবার বলে মণিশঙ্কর।

কাউকে কি আপনার এ ব্যপারে সন্দেহ হয়?

সন্দেহ!

হ্যাঁ-আচ্ছা চাকরটা–

যদিও বয়স অল্প—তবু কি করে বলি বলুন–

তা ঠিক-যা দিনকাল পড়েছে—তা চাকরিটার বাড়ির ঠিকানা-টিকানা কিছু জানেন না?

না। শুনেছি মেদিনীপুর জেলায় কোন এক গ্রামে থাকে–

গ্রামের নাম কি? শোনেননি কখনও কিছু?

পানিপারুল।

আচ্ছা আর কাউকে সন্দেহ হয়?

ভাবতে পারছি না।

আচ্ছা আলমারির চাবি, মানে স্টীলের আলমারিটার চাবি কোথায়?

আমার স্ত্রীর কাছেই থাকত। তার আচিলে বাধা সর্বদা।

দেখলাম না তো আঁচলে তাঁর

তবে হয়তো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বা মাথার বালিশের নীচে রেখে দিয়েছে, মণিশঙ্কর বললে।

হুঁ আচ্ছা আপনার স্ত্রী কি সাধারণতঃ বাড়িতেও দামী শাড়ি পারতেন?

অ্যাঁ-হ্যাঁ-ও একটু শৌখিন প্রকৃতির ছিল বরাবর। সর্বদা ছিমছাম সাজগোজ করে থাকতেই ভালবাসত।

কতদিন আপনাদের বিবাহ হয়েছে?

পাঁচ বছর—

নেগোসিয়েট করে বিয়ে হয়েছিল, না আপনাদের লাভ-ম্যারেজ?

আমরা পরস্পরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম।

এক জাত?

না-ওর বাড়ি কেরালায়—তবে দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনে পড়াশুনা করায় চমৎকার বাংলা বলতে পারত।

মদ্র দেশের মেয়ে ছিলেন তাহলে উনি?

হ্যাঁ।

আত্মীয়স্বজন বলতে আপনার কে কে আছেন? তারা কোথায় থাকেন-মানে মা বাবাভাই-বোন—

আমি বাবার একই ছেলে-চার বোন। বোনেদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে-মা বছর কয়েক হল মারা গেছেন। বাবা এখনো বেঁচে আছেন। রিটায়ার্ড রেলওয়ে অফিসার।

কোথায় থাকেন। তিনি?

আমার ছোট বোন বেনারসে থাকে—ছোট ভক্ষ্মীপতি সেখানকার হিন্দু ইউনিভার্সিটির প্রফেসার, তার কাছেই বাবা রিটায়ার করার পর থেকে থাকেন। অত্যন্ত নিষ্ঠাবান প্রকৃতির লোক।

আপনাদের বিয়েতে আপনার বাবার মত ছিল?

মত ছিল। কিনা জানি না, তবে কোন বাধা দেননি।

আপনার স্ত্রী আপনার বাবার কাছে যেতেন না?

প্রত্যেক পূজোর ছুটিতেই আমরা যেতাম— বাবা ওকে খুব স্নেহ করতেন।

মিঃ ঘোষাল, একটু ইতস্তত করে সুদৰ্শন বলে, যদিও কথাটা অত্যন্ত ডেলিকেট তবু জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছে আমাকে

কি কথা?

বিবাহের আগে আপনাদের পরস্পরের কতদিনের আলাপ ছিল?

বছর-খানেক—

উনি তখন শান্তিনিকেতনে থাকতেন?

না—

তবে?

ও কলকাতার একটা মিউজিক কলেজে কাজ করত।

আপনাদের শোবার ঘরে তানপুরা আর বেহালা দেখলাম

হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর তানপুরা—ও খুব ভাল গান গাইতে পারত-রেডিও-অ্যাটিস্ট ছিল একসময়-গানের রেকর্ডও আছে

আই সি! তা ঐ বেহালাটা–

ওটা আমার।

আপনিও তাহলে সংগীতানুরাগী?

তা ঠিক নয়—

তবে?

শিখছিলাম বেহালা।

কতদিন ধরে শিখছেন?

বছর-খানেক—

আপনাদের আলাপ কি করে হলো?

এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে আলাপ করি—আমাদের পরস্পরের এক বন্ধুই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। পরে সেই আলাপ—

বুঝেছি। আপনার সেই বন্ধুটি কোথায় থাকেন?

কলকাতাতেই-বালিগঞ্জে—

কি নাম?

সমীরণ দত্ত— নামকরা গাইয়ে রবীন্দ্ৰ-সঙ্গীতের–

যাঁর বহু রেকর্ড আছে?

হ্যাঁ।

আপনার স্ত্রীর সঙ্গেও তার খুব আলাপ ছিল?

হ্যাঁ—শান্তিনিকেতনে ওরা দুজনেই ছিল অনেকদিন, তখন থেকেই ওদের আলাপ।

সমীরণবাবু আপনাদের এখানে আসতেন না?

আগে মধ্যে মধ্যে আসত।

এখন আর আসেন না?

না।

কেন?

বোধ হয় সময় পায় না।

আপনার স্ত্রী তার ওখানে যেতেন না?

প্রায়ই যেত। বিশেষ করে রেকর্ডিংয়ের সময় রিহার্সেল যখন চলত।

তিনি বিয়ে-থা করেছেন?

না। ব্যাচিলির।

আপনি কোথায় কাজ করেন?

জন গ্রিফিথ অ্যান্ড কোম্পানিতে।

কতদিন কাজ করছেন?

বি. এ. পাস করবার বছরখানেক পরেই আমি চাকরি পাই।

মাইনে কত পান? সব মিলিয়ে আটশ’র মত।

নীচের ব্যাঙ্কের কর্মচারীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। কিন্তু তারা সবাই বললে, কেউ কিছু জুনে না—জানতেও পারেনি।

জনা ছয়েক মিস্ত্রী যারা ভারায় বসে প্লাস্টারিংয়ের কাজ করছিল তাদের মধ্যে একজন মিস্ত্রী—মকবুল বললে, বেলা তখন সওয়া বারোটা কি সাড়ে বারোটা হবে, একা সে বাড়িটার অদূরে একটা ছোট মিষ্টির দোকানের সামনে গাছতলায় বসে ছিল টিফিন সেরে—একটা কালো রংয়ের অ্যামব্যাসাড়ার গাড়িকে এসে ঐ বাড়িটার সামনে দাঁড়াতে দেখে—

তারপর? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।

গাড়ি থেকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক নামেন—ৰ্তার হাতে একটা চামড়ার সুটকেস ছিল হুজুর।

তারপর? ভদ্রলোক কি করলেন?

ভদ্রলোককে দেখলাম ঐ বাড়ির মধ্যে ঢুকতে–

ভদ্ৰলোক দেখতে কেমন?

দূর থেকে দেখেছি হুজুর, ঠিক ঠাহর করতে পারিনি।

সুদৰ্শন প্রশ্ন করে, তারপর কি হল?

আধঘণ্টাটাক বাদে দেখলাম। একজন সুট-পরা ভদ্রলোক বের হয়ে এলেন বাড়ি থেকে— গাড়িতে উঠে তিনি গাড়িটা চালিয়ে চলে গেলেন।

গাড়ির নম্বরটা দেখেছিলে?

দেখিনি ভাল করে—

তাঁর হাতে কিছু ছিল?

হ্যাঁ, একটা সুটকেস।

গাড়িটা নতুন না পুরনো?

নতুন গাড়ি বলেই মনে হল হুজুর।

আর কাউকে দেখনি?

আজ্ঞে আরো দুটো ট্যাক্সিতে লোক এসেছে—তারা ব্যাঙ্কে ঢুকেছে—তারপর ব্যাঙ্ক থেকে বের হয়ে গিয়েছে।

পথে লোকজন ঐসময় ছিল না?

ছিল—তবে খুব বেশী নয়।

মকবুল!

হুজুর?

তোমরা তো অনেকদিন ধরে ঐ ফ্ল্যাটে কাজ করছ?

আজ্ঞে তা মাস তিনেক হবে

ওই বাড়ির একটা চাকরকে দেখেছ?

হ্যাঁ বাবু-শম্ভুকেও জানি।

তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল?

হ্যাঁ-রোগা পাতলা ছেলেটা।

আজ তাকে দেখেছ?

দেখেছি।

কখন?

বেলা সাড়ে এগারটা নাগাদ, আমাদের টিফিনের কিছু আগে।

কোথায় দেখলে?

হাতে কিছু ছিল? একটা সাদা খাম ছিল বলে মনে হচ্ছে।

তাকে ফিরতে দেখনি?

না। নজরে পড়েনি।

মকবুলকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, মণিশঙ্করেরই ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরে বসে একজন সেপাই বারো-তেরো বছরের একটা ক্ৰন্দনরত রোগা ছেলেকে ধরে টানতে টানতে সুদৰ্শনের সামনে নিয়ে এল।

হুজুর, ছেলেটাকে পাকাড়াও করেছি।

শম্ভু কাঁদতে কাঁদতে বললে, ওরা সব কি বলছে সেপাইরা—দোহাই হুজুর আমি কিছু জানি না।

তোর নাম শম্ভু?

আজ্ঞা শম্ভুচরণ বেরা।

বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞা পানিপারুল—বড় পোস্টাপিস এগরা—মেদিনীপুর জিলা।

কোথায় গিয়েছিলি তুই?

আমার পিসের কাছে টালিগঞ্জে-জিজ্ঞাসা করেন না কেনে আমার বাবুকে—ঐ যে— আমি তো—পরশুই ছুটি চেয়ে রেখেছিলাম।

মণিশঙ্কর বললে, হ্যাঁ, ও আমাকে পরশু বলেছিল বটে—পিসির সঙ্গে দেখা করতে যাবে টালিগঞ্জে

তা কখন তুই গিয়েছিলি?

কেন, এগারটায়

তোর মাকে বলে গিয়েছিলি?

হ্যাঁ-মা তো বললেন যেতে–

সুদৰ্শনই আবার প্রশ্ন করে, যখন যাস দরজাটা খোলা রেখে গিয়েছিলি?

না-মা তো দরজা বন্ধ করে দিলেন, ভিতর থেকে আমার সামনেই।

তোর মা তখন কি করছিলেন?

মার তো তখনো স্নানই হয়নি।

আর খুকু?

সে তো খেলছিল। ঘরে। কি হয়েছে হুজুর—সত্যিই মা আর খুকুকে মেরে ফেলেছে!

সুদৰ্শন শম্ভুর কথার কোন জবাব দেয় না।

সে তখন মনে মনে ভাবছিল—শম্ভু এগারটায় চলে যায়। অর্থাৎ এগারটার পর থেকেফ্ল্যাটে মণিশঙ্করের স্ত্রী ও মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না-ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন মণিশঙ্করের স্ত্রী। অথচ মণিশঙ্কর ফোন পেয়ে অফিস থেকে এসে দেখে তার ফ্ল্যাটের দরজা ভেজানো এবং ঠেলতেই সেটা খুলে গেল।

সুদৰ্শন আবার প্রশ্ন করে, তুই যখন যাস তোর হাতে একটা চিঠি ছিল?

হ্যাঁ হুজুর–

ডাকে ফেলতে যাচ্ছিলি?

না।

তবে?

শম্ভু কেমন যেন ইতস্তত করে।

কিরে, কথা বলছিস না কেন?

আজ্ঞে–

চিঠিটা কার, কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলি সেটা?

আজ্ঞে–

তোর মা দিয়েছিল চিঠিটা?

আজ্ঞে–

পোস্ট করতে?

হ্যাঁ।

সত্যি কথা বলছিস?

হ্যাঁ হুজুর।

চিঠিটা ডাকে দিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

সুদৰ্শন আর কোন প্রশ্ন করে না।

রবীন দত্ত পাশের সোফায় বসে নীচু টেবিলের উপর কাগজপত্র রেখে রিপোর্ট লিখছিল। সে মুখ তুলে তাকাল, তাহলে ওর কি ব্যবস্থা করব স্যার?

কার, শম্ভুর?–

আপাততঃ ‘ওকে থানায় নিয়ে রাখুন। এদিককার কাজ শেষ হয়েছে। মিঃ দত্ত?

একরকম মোটামুটি-ডেড বডি দুটো মর্গে পাঠিয়ে দিতে পারলেই—, কিন্তু এ ফ্ল্যাটের কি ব্যবস্থা করব?

এটা আপাততঃ আনডার লক অ্যান্ড কী থাকবে, আর পাহারা রাখুন।

বেশ। তাহলে মিঃ ঘোষাল-দত্ত মণিশঙ্করের দিকে তাকাল।

সে অন্য একটা সোফায় বসে ওদের কথা শুনছিল। রবীন দত্তর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে তাকাল।

আপনি তাহলে এক কাজ করুণ—

কি বলুন?

এই ফ্ল্যাটটা আপনার আপাততঃ আন্ডার লক অ্যান্ড কী ও পুলিস প্রহরায় থাকবে— আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে—

সে আপনার বলবার কোন প্রয়োজন ছিল না—এরপর এখানে আমি রাত্রিবাস করতে পারব। আপনি ভাবতেই বা পারলেন কি করে? আমি এখুনি শম্ভুকে নিয়ে চলে যাব।

সুদৰ্শন বললে, ওর জন্য আপনার ভাবতে হবে না। মিঃ ঘোষাল—ও থানায় থাকবে। ওকে কি তাহলে আপনারা অ্যারেস্ট করছেন?

না।

তবে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন?

ওকে আমাদের প্রয়োজন আছে।

ওঃ, তাহলে তো আপনাদের আশ্রয়েই থাকল!

হ্যাঁ-কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

আজ রাত্রের গাড়িতেই মালদায় চলে যাব।

মালদায়?

হ্যাঁ আমার এক বন্ধু সেখানে থাকে-ভাবছি ছুটি নিয়ে তার ওখানেই কিছুদিন থাকব। কিন্তু আপনাকে যে আমাদের প্রয়োজন হবেমালদার ঠিকানা রেখে যাচ্ছি, যখনই তার করে দেবেন। আমি চলে আসব।

না।

তবে?

আপনি বরং আপাততঃ কিছুদিন কলকাতাতেই থাকবার ব্যবস্থা করুন।

কলকাতায়?

হ্যাঁ।

বেশ-তাহলে আমি ভবানীপুরেই, আমার একটা পরিচিত মেস আছে—কালিকা বোর্ডিং–সেখানেই থাকব।

কোথায় বোর্ডিংটা? সুদৰ্শন শুধায়। ৩৩/১২ কালীঘাট রোড। আমি তাহলে উঠি-কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে

যান।

মণিশঙ্কর উঠে পাশের ঘরে গেল। ইতিমধ্যে সুদর্শনেরই নির্দেশে দুটো বেডকভার দিয়ে ডেড বডি দুটো ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।

সুদৰ্শনের চোখের ইঙ্গিত পেয়ে রবীন দত্ত মণিশঙ্করের পিছনে পিছনে যায়, নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করে।

মণিশঙ্কর পকেট থেকে একটা চাবির রিং বের করে স্টীলের আলমারিটা খুলে কিছু জামা-কাপড় বের করে আলমারির মাথায় যে অ্যাঢাচি কেন্সটা ছিল তার মধ্যে ভরে নিল। ও যখন ব্যস্ত তখন হঠাৎ পেছন থেকে সুদর্শনের গলা শোনা গেল।

ও যে ইতিমধ্যে রবীন দত্তর পাশে এসে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল— মণিশঙ্কর জানতেও পারেনি।

মণিশঙ্করবাবু?

অ্যাঁ—

ফিরে তাকাল মণিশঙ্কর ওদের দিকে। ওরা দুজনে এসে ততক্ষণ ঘরের মধ্যে ঢুকেছে।

চাবিটা বুঝি আপনার প্যান্টের পকেটেই ছিল?

হ্যাঁ-মানে ওটা—আলমারির একটা ড়ুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে থাকত।

ড়ুপ্লিকেট কেন?

বিজির বড় ভুলো মন ছিল—কোথায় কি রাখত সব সময় মনে করতে পারত না, তাই তারই ব্যবস্থামত একটা চাবি আমার কাছে বরাবর থাকত।

ওতে বাইরের দরজার চাবিও আছে বোধ হয়?

হ্যাঁ—দরজায় গডরেজের লকের চাবি, একটা আমার কাছে থাকত একটা বিজির কাছে থাকত।

দেখলেন?

কি!

আলমারির ভিতর থেকে কিছু চুরি গেছে কিনা?

না-এখনো দেখিনি, দেখছি—

মণিশঙ্কর কথাটা বলে আলমারির ভিতরে সব কিছু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। সুদৰ্শন আর রবীন দত্ত দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলো।

মিনিট দশ-পনের পরে মণিশঙ্কর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝতে পারছি না। মিঃ দত্ত—কিছু চুরি গিয়েছে কিনা। মানে আমি তো ঠিক জানতাম না কোথায় কি আছে— সব কিছুই তো আমার স্ত্রীই রাখত—

সুদৰ্শন বললে, গহনাপত্র-টাকাকড়ি—সব ঠিক আছে—

গহনাপত্র যা ওর গায়ে দেখছেন, এছাড়া তো আর বিশেষ কিছু ছিল না। আর টাকাপয়সা তো ব্যাঙ্কেই রাখা হয়।

ও। তাহলে–

তাই তো বলছিলাম, ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে কিছুই হয়তো চুরি যায়নি। দেখুন তো—বালিশের তলায় বা ড্রয়ারে অন্য চাবিটা আছে কিনা! সুদৰ্শন আবার বললে।

মণিশঙ্কর অতঃপর সুদর্শনের কথামত ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারগুলো ও শয্যার কাছে গিয়ে বালিশের তলা হাতড়ে দেখলো কিন্তু কোথাও কোন দ্বিতীয় চাবির রিং পাওয়া গেল না।

কি হল-পাওয়া গেল না? দত্ত জিজ্ঞাসা করল।

না। দেখছি না তো—

গেল কোথায় তবে চাবির রিংটা যেটা আপনার স্ত্রীর কাছে থাকত?

বুঝতে পারছি না। হয়তো—

কি? যারা এসেছিল চুরি করতে তারাই নিয়ে গিয়েছে—তাড়াতাড়িতে কিছু নিতে পারেনি—

তাই হয়তো হবে—সুদৰ্শন মৃদু গলায় বললে।

একসময় সুদৰ্শন বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত হল। সুটকেসটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগুতে যাবে, তখন সুদৰ্শন বললে, চলুন মিঃ ঘোষাল, আমিই আমার জীপে আপনাকে পৌঁছে দেব।

আপনি দেবেন?

হ্যাঁ চলুন—তাহলে রবীন আমরা চলি—তুমি এদিককার ব্যবস্থা করে তারপর যেও–

তাই যাব স্যার–

সুদৰ্শন নিজের জীপে মণিশঙ্করকে কালীঘাট রোডে কালিকা বোর্ডিং হাউসে পৌঁছে দিয়ে লালবাজারে ফিরে এল।

লালবাজারে পৌঁছে দুজন প্লেন-ড্রেস সি. আই. ডির কর্মচারী সলিল ও সন্তোষকে ডেকে কিছু উপদেশ দিয়ে রবীনকে থানায় ফোন করল।

রবীন তখনো ফেরেনি জানতে পারল।

সেকেন্ড অফিসার ফোন ধরেছিল, সে শুধাল, মিঃ দত্ত এলে আপনাকে কি ফোন করতে

বলব স্যার?

হ্যাঁ, বলবেন।

ঠিক আছে স্যার—

সুদৰ্শন ফোনটা রেখে দিল।

ইতিমধ্যে বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। পথে পথে আলো জ্বলে উঠছে।

একটা সিগারেট প্যাকেট থেকে বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করে সুদর্শন।

সমীরণ দত্ত।

নামকরা রবীন্দ্ৰ-সংগীতশিল্পী। মণিশঙ্কর ও বিজিতার সঙ্গে বহুদিনকার আলাপ সমীরণ দত্তর।

থাকে বালিগঞ্জে, মণিশঙ্কর বলছিল।

একটিবার সমীরণ দত্তর সঙ্গে দেখা করে কথা বলা দরকার। কিন্তু তার ঠিকানা জানে না। সুদৰ্শন।

কোথায় পাওয়া যেতে পারে সমীরণ দত্তর ঠিকানাটা?

হঠাৎ মনে পড়লো সমীরণ দত্ত একজন রেকর্ড ও রেডিওর নামকরা আর্টিস্ট-রেডিও অফিস থেকেই তো তার ঠিকানাটা পাওয়া যেতে পারে।

কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুদৰ্শন লালবাজার থেকে রেডিও অফিসে নিজের পরিচয় দিয়ে ফোন করল।

স্টেশন-ডাইরেক্টর আছেন?

না-অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন-ডাইরেক্টর বোধ হয় আছেন।

তাঁকেই দিন ফোনটা।

সমীরণ দত্তর ঠিকানাটা পাওয়া গেল।

মনোহরপুকুর রোডে থাকে সমীরণ—তিনতলা একটা ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে। ফোনও সেখানে আছে, কিন্তু অনেকক্ষণ ফোনে রিং হল, কেউ ধরলে না।

হতাশ হয়েই একসময় সুদৰ্শন ফোনটা রেখে দিল।

আপাততঃ একবার বাসায় যেতে হবে—সেই সকাল সাড়ে সাতটায় বের হয়েছে, এখন রাত প্রায় পৌনে আটটা—একবার না ঘুরে আসলে সাবিত্রীর সঙ্গে অলিখিত চুক্তিটা ভঙ্গ হবে।

বিয়ের কিছুদিন পরেই সাবিত্রীর সঙ্গে সুদর্শনের অলিখিত চুক্তি হয়েছিল সকালে কাজে বেরুলে যেমন করেই হোক সময় করে সুদৰ্শনকে একবার মাঝখানে দেখা দিয়ে আসতেই হবে সন্ধ্যার আগে যদি ফেরা না সম্ভব হয়। [সুদর্শনের প্রথম কাহিনী পাওয়া যাবে ‘প্রজাপতি রঙ’ বইতে—লেখক।]

একবার সমীরণ দত্তর ওখানে যেতে হবে, কিন্তু তার আগে একবার যেতে হবে বাসায়। বাসা অবিশ্যি বেশী দূর নয়-শিয়ালদার কাছে—হ্যারিসন রোডের কাছাকাছি।

সুদৰ্শন বের হয়ে পড়ল।

জীপচালক সেপাই শুধায়, কোন দিকে যাব স্যার?

মোহন, একবার বাসায় চল তো-সেখান থেকে বালিগঞ্জ যাব।

বাসাটা একেবারে ঠিক বড় রাস্তার উপরে নয়, গলির ভিতর ঢুকতে হয়। তবে দক্ষিণ আর পুব দিকটা খোলা।

বাড়িটা নতুন।

দোতলার উপরে তিনখানা ঘর। হঠাৎ পেয়ে গিয়েছিল বাসাটা সুদৰ্শন।

বিয়ের পরে একটা ফ্ল্যাট খুঁজছে কলকাতা শহরে সর্বত্র যখন, তখনই এক অফিসার বন্ধু বাসাটার কথা সুদৰ্শনকে বলে। সেই অফিসারেরই মামাশ্বশুরের বাড়ি।

সুদৰ্শন একটু অন্যমনস্কই ছিল। নচেৎ জীপ থেকে শেষ গলিতে ঢুকবার মুখে কিরীটীর নতুন কালো রংয়ের ফিয়াটটা নজরে পড়ত।

বড় গাড়ি বিক্ৰী করে দিয়ে কিরীটী কিছুদিন হল ফিয়াট কিনেছে। অসুবিধা হয়েছে–ড্রাইভার হীরা সিংয়ের।

লম্বা মানুষ-চালাতে কষ্ট হয়।

তবে হীরা সিং মুখে কিছু বলেনি।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই নজরে পড়ল ঘরের দরজা খোলা। ঝুলন্ত পর্দার ওদিক থেকে আলোর আভাস আসছে—তারপরই একটা পরিচিত গলার স্বর কানে ভেসে আসতেই সুদৰ্শন হঠাৎ যেন খুশি হয়ে ওঠে।

সঙ্গে সঙ্গে পর্দা তুলে ঘরে পা দেয়।

দাদা! কতক্ষণ?

সুদৰ্শনের দিকে ফিরে কিরীটী বলে, তা ভায়া ঘণ্টাদেড়েক তো হবেই। ভাবছিলাম এবারে উঠব-তোমার সঙ্গে বুঝি দেখাই হল না।

সাবিত্রী উঠে পড়েছে ততক্ষণে। স্বামী সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে সাবিত্রী বললে, চা খেয়েছ? নিশ্চয়ই চা খাওয়া হয়নি—

সুদৰ্শন হেসে বলে, না—সময়ই পাইনি—

জানতাম আমি। দাদা, আপনিও খাবেন তো?

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তোমার দাদার চায়ে যে অরুচি নেই তা তো তুমি জান সাবিত্ৰী!

সাবিত্রী ভিতরের ঘরে চলে গেল।

সত্যি মেয়েটি বড় ভাল—তাই না সুদৰ্শন? কিরীটী মৃদু হেসে বলে।

সুদৰ্শন বললে, সত্যিই জহুরী আপনি দাদা—

স্বীকার করছ? কিরীটি হাসতে হাসতে বললে।

একবার কেন, হাজারবার স্বীকার করব।

আমার সঙ্গে গল্প করছিল বটে, সাবিত্রীর কিন্তু মনটা পড়ে ছিল সর্বক্ষণ দরজার দিকে–মাঝখানে একবার ঘুরে গেলেই তো পার!

আসি দাদা—নেহাত কাজে আটকে না পড়লে। আজ এক জোড়া খুনের ব্যাপারে এমন জড়িয়ে পড়লাম যে—

আরে ভায়া তোমার চাকরিই তো খুনজখম রাহাজানি নিয়ে—

তা জানি দাদা। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা এমন নৃশংস, এমনি বীভৎস যে—মনটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছে।

তাই নাকি! তা জোড়া খুন হল কোথায়?

খুন হয়েছে বেলেঘাটা অঞ্চলে দিনের বেলা—একেবারে ভরদুপুরে। ত্রিশ-একত্রিশ বছরের একটি সুন্দরী মেয়ে আর তার ফুলের মত বছর চারেকের বাচ্চাটা—মানুষ যে এত নিষ্ঠুর কি করে হয়—

ভালবাসার উল্টোদিকেই তো নিষ্ঠুরতা। —মানবচরিত্রের আলো অন্ধকার দুটি দিক।

জানি দাদা। তবু এক-এক সময় মনে হয় এটা কেমন করে সম্ভব হয় মানুষের পক্ষে!

আসল ব্যাপারটা কি জান ভায়া, প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই পশুবৃত্তি থাকে। ভালবাসা, স্নেহ, মমতা—সেই পশুবৃত্তিটাকে একটা পোশাক পরিয়ে চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু সব সময় তা সম্ভব হয় না-আর যখন সম্ভব হয় না। তখনই তার শিক্ষা কৃষ্টি রুচি সরে গিয়ে তার মুখোশটা হঠাৎ খুলে যায়—ভিতরের পশুটা বের হয়ে আসে নখদন্ত বিস্তার করে কুটিল হিংস্র হয়ে। আমরা চমকে উঠি তখন। কিন্তু সেটা মনুষ্য-চরিত্রের আলোর, অন্য দিক যে স্বাভাবিক অন্ধকার—সেটা ভুলে যাই।

সাবিত্রী ঐ সময় দু’কাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।

চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে সুদৰ্শন বলে, আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে ঘটনাটা দাদা। কিন্তু সাবিত্রী ঐ সব সহ্য করতে পারে না।

কিরীটী হেসে বলে, তা না সহ্য করতে পারলে হবে কেন? পুলিস অফিসারের বেী হয়েছে। যখন-সত্যি সাবিত্রী—এ কিন্তু অন্যায় তোমার—

বাঃ, আমি কখনও কিছু বলেছি নাকি? সাবিত্রী বললে।

না। মুখে বলোনি বটে। কিন্তু তোমার মুখের চেহারা যা হয়—আমার মায়া লাগে।— সুদৰ্শন বললে।

না, না—সুদৰ্শন। তুমি বলবে সাবিত্রীকে সব কথা। হয়ত দেখবে ওর অনেক পরামর্শ তোমার অনেক কাজে লাগবে—জান না তো মেয়েদের একটা বিচিত্র তৃতীয় নয়ন আছে। তুমি বল, আমরা শুনি আজকের ঘটনা।

শুনবেন?

নিশ্চয়ই, বল।

সুদৰ্শন সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকাল। সাবিত্রী বললে, কি হয়েছে?

কিরীটী বলে, কোথায় নাকি জোড়া খুন হয়েছে–

জোড়া খুন!

হ্যাঁ।

সুদৰ্শন তখন সংক্ষেপে ঐদিনকার ঘটনোটা আনুপূর্বিক বিবৃত করে যায়। কিরীটী একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে বসে শোনে ধূমপান করতে করতে।

সাবিত্রী বলে, কি নিষ্ঠুর।

কিন্তু সাবিত্রী, কিরীটী বলে, তোমার কি মনে হয় বল তো? মা ও মেয়েকে কে খুন করল—আর কেনই বা খুন হল? মানে খুনের সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে?

জানি না দাদা–

ব্যাপারটা বোধ হয় খুব একটা জটিল নয়—কিন্তু এবারে উঠব ভায়া। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।

এখুনি যাবেন দাদা?

হ্যাঁ-রাত প্রায় পৌনে নটা হল।

চলুন আমাকেও একবার ওদিকে যেতে হবে। সুদর্শনও উঠে দাঁড়ায়।

কোথাও যাবে?

ভাবছি। একবার মনোহরপুকুর রোডে যাব।

সমীরণ দত্তর ওখানে?

হ্যাঁ-সাবিত্রী, দরজাটা বন্ধ করে দাও। দুখনকে দেখছি না—কোথায় গেল?

দুখন তো বিকেলে বের হয়েছে তার এক দেশওয়ালী ভাইয়ের সঙ্গে—এখনো ফেরেনি। তুমি যাও না—সরলা তো আছে— ·

সাবিত্রীর কথা শেষ হল না, দুখন এসে ঠিক ঐ সময় ঘরে ঢুকল।

কিরে, এত দেরী হল তোর? সাবিত্রী শুধায়।

বছর কুড়ি বয়স হবে দুখনের। বেশ তাগড়াই চেহারা। পুলিসের চাকরির লোভে কলকাতায় তার কনস্টেবল কাকার কাছে এসেছিল, কিন্তু এখনো কোন সুবিধা না হওয়ায় তার কাকা রামনারায়ণের সুপারিশে সুদৰ্শন তাকে তার গৃহে স্থান দিয়েছে।

বাসন মাজা, ঘর বঁটি দেওয়া, ছোট কাজ ইত্যাদি কিছু করে না—তবে বাজার-হাট করা, অন্য ফাইফরমাশ সব করে। খুব বিশ্বাসী।

দুখন বললে, কি করি, দেরি হয়ে গেল ঝগড়া করতে করতে।

সে কি রে? ঝগড়া আবার কার সঙ্গে করছিলি? সুদৰ্শন জিজ্ঞাসা করে?

আমার ভাইয়ের সঙ্গে, দেশ থেকে সে এসেছে।

কেন?

দেখুন না—নোকরি-উকরি নেই, বলে কিনা সাদী করা—আমি তা রাজী নই, ওরা রাজী করাবেই আমাকে।

তা শেষ পর্যন্ত কি ঠিক হল?

কি আবার—আগে নোকরী তারপর সাদী।

সকলেই হাসতে থাকে।

রাস্তায় বের হয়ে সুদৰ্শন কিরীটীর গাড়িতেই উঠে বসল—এবং নিজের জীপটা তার পিছনে পিছনে চলতে লাগল।

একটা কথা বলব দাদা। একসময় সুদৰ্শন বলে।

কি?

আপনি তখন ওই কথাটা বললেন কেন?

কোন কথাটা ভায়া?

ব্যাপারটা বোধ হয় খুব জটিল নয়!

তোমার কাহিনী শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। কিরীটী বললে।

আপনি কি সমীরণ দত্তকেই তাহলে সন্দেহ করেন?

প্রেমের গতি বড় বিচিত্র, ভায়া।

কিন্তু–

বিশেষ করে যে প্রেম সর্বগ্রাসী। সামান্য একটু এদিক-ওদিক হলেও হিংসা তার কুটিল। নখর বিস্তার করে।

কিন্তু দাদা–

তাছাড়া ঠিক-অন্ততঃ মণিশঙ্কর ঘোষালের কথা যদি মিথ্যা না হয়-সামীরণ দত্তর ভালবাসা না হলেও বিজিতার ওপরে একটা দুর্বলতা ছিল।

তা তো বোঝাই যায়। সুদর্শন বললে।

অবিশ্যি তোমাকে জানতে হবে কথাটা কতখানি সত্য এবং যদি সত্যিই হয়ে থাকে। তবে সেই দুর্বলতাটা কোন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছিল। তবে এও ঠিক জেনো ভায়া

কি?

সমীরণ হয়ত অত সহজে মুখ খুলবে না।

কেন?

প্রথমতঃ আর্টিস্টরা একটু টাচি হয়–দ্বিতীয়তঃ দুর্বলতা বা ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও যে তার প্ৰেমাস্পদকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে তাদের পেট থেকে কথা বের করা খুব সহজ হবে না।–

আর মণিশঙ্কর?

সন্দেহের তালিকা থেকে সেও বাদ পড়ে না।

কিন্তু ঐভাবে নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করাটা—

যদি সে হত্যা করেই থাকে তাহলে যখন সে হত্যা করেছিল জানবে সে তখন স্বামী বা বাপ ছিল না। একটু আগে যে বলছিলাম মানুষের উদ্দাম মনের তলে চিরন্তন পশুবৃত্তির কথাটা-তখন জেনো সেই পশুটাই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে তো আরো পরের • কথা। তারও আগে তোমায় জানতে হবে–

কি?

কালো অ্যামবাসাডারে করে বেলা বারোটা সোয়া বারোটায় কে এসেছিল ঐ ফ্ল্যাট বাড়িটায়। তাছাড়া মকবুল মিস্ত্রীর কথাগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করেছ নিশ্চয়ই ঠিক তেমন একটা সামঞ্জস্য নেই!

সামঞ্জস্য নেই?

হ্যাঁ। সে কি বলেনি কালো অ্যামবাসাড়ার থেকে নামতে দেখেছে-হাতে সুটকেসএকজন ধুতি পাঞ্জাবি-পরা ভদ্রলোককে যিনি গাড়িটা ঐখানে রেখে ঐ ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢোকেন—তার কিছুক্ষণ বাদে স্যুট-পরিহিত এক ভদ্রলোক ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে গাড়িটা চালিয়ে চলে গেল।

সত্যিই তো। তখন তো আমার কথাটা ঠিক মনে হয়নি!

পোশাকের বিভিন্নতা বাদ দিলে কালো রংয়ের অ্যামব্যাসাডার গাড়ি—একজন ভদ্রলোক ও একটা সুটকেস ঠিকই আছে। এর থেকে একটা কথাও কি তোমার মনে হয়নি?

কি?

যে ব্যক্তি অ্যামব্যাসাডারে করে এসে ঐ ফ্ল্যাট বাড়িটায় ঢুকেছিল এবং যে ব্যক্তি ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে একটু পরে বের হয়ে এসে আ্যামব্যাসাডারটা চালিয়ে চলে গিয়েছে তারা একই ব্যক্তি, না দুজন! তাছাড়া মিস্ত্রীর কথাটাও কতখানি সত্য তারও যাচাই হওয়া দরকার, ঐ ব্যক্তির আইডেনটিটি ও গাড়িটার

হ্যাঁ-খোঁজ নিচ্ছি। আমি।

আরো আছে।

কি?

ঐ ইঞ্জিনীয়ার গোপেন বসু ভদ্রলোকটি—যিনি থানায় ফোন করেছিলেন—যিনি ঐ বাড়িরই আর একটা ফ্ল্যাটে থাকেন—তাকে তো তোমরা কোন জিজ্ঞাসাবাদই করনি!

ভুল হয়ে গিয়েছে দাদা।

খুনের ব্যাপারে এত বড় ভুল মারাত্মক ভায়া। তোমার জানা উচিত ছিল। বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত এক ঘণ্টা উনি কোথায় ছিলেন—কি করছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে তিনি নামছিলেন না। উঠছিলেন, যখন মণিশঙ্কর ঘোষালের সঙ্গে তার দেখা হয় সিঁড়িতে—।

আমি কালই সকালে তার সঙ্গে দেখা করব।

হ্যাঁ, ভুলো না। আর একটা কথা—

বলুন? মকবুল বলেছে সে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ শম্ভুকে দেখেছে বাজারের দিকে যেতে এবং তার হাতে ঐ সময় একটা সাদা খাম ছিল।

হ্যাঁ, বলেছিল।

তাকে সে সম্পর্কে তোমার জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলে ঠিকই, কিন্তু—

কি? শম্ভু যে সব সত্যি কথাই বলেছে তারই বা ঠিক কি!

তা অবিশ্যি ঠিক, তবে—শম্ভু তো এখন লক-আপেই আছে!…

বুদ্ধিমানের কাজই করেছ। তাকে লকআপেই রেখো। আরও আছে—

বলুন?

যে অস্ত্রের দ্বারা হত্যা করা হয়েছে সেটাও তোমরা ভাল করে খুঁজে দেখনি! হয়ত ওই ফ্ল্যাটের মধ্যেই কোথাও সেটা এখনও থাকতে পারে–

কাল সকালেই আর একবার ওখানে যাব।

ভাল কথা, বিজিতার আত্মীয়স্বজন কেউ আছে কিনা বাংলাদেশে সংবাদটা জানিবার চেষ্টা করনি?

না–

সেটাও অবিশ্যি প্রয়োজন।

করব।

কিরীটী মনোহরপুকুর রোডেই সুদর্শনকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সামনে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু দরজা বন্ধ।

দরজায় তালা দেওয়া।

সুদৰ্শন কি করবে ভাবছে এমন সময় একজন তরুণ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল। সুদৰ্শনকে দেখে জিজ্ঞাসা করে, কাকে চান?

সমীরণবাবুর কাছে এসেছিলাম-কিন্তু দেখছি। দরজায় তালা দেওয়া—

উনি তো আজ বিকেলের প্লেনে ম্যাড্রাস গেলেন

ম্যাড্রাস?

হ্যাঁ-কি গানের রেকর্ডিংয়ের ব্যাপারে—

কখন গিয়েছেন?

তা ঠিক জানি না। আমি যখন বের হই, সোয়া তিনটে, তখনো তাকে দেখেছি। কখন গিয়েছেন তা ঠিক বলতে পারব না।

আপনার সঙ্গে সমীরণবাবুর পরিচয় আছে?

হ্যাঁ—আমি তো এই পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। তাছাড়া ওঁর কাছে আমি রবীন্দ্ৰ-সংগীতের লেশেন নিই–

ও, তাহলে তো আপনি তঁর বিশেষ পরিচিতই—

আপনাকে তো চিনতে পারছি না, কখনো ওঁর কাছে আসতে তো দেখিনি।

না। আমি, মানে, কলকাতার বাইরে থাকি কিনা—

তাই—তা কি ব্যাপার বলুন তো? কোন কনফারেন্স নাকি?

সুদৰ্শন হাসে। বলে, না, অন্য একটু কাজ ছিল। তা উনি কবে আসবেন তা জানেন কিছু?

দিন পাঁচ-সাত দেরি হতে পারে।

আপনার নামটা কি জিজ্ঞেস করতে পারি?

দেবজ্যোতি আচার্য-তা সমীরণদা আসলে কি বলব? আপনার নাম, কোথা থেকে-, কিন্তু দেবজ্যোতির কথা শেষ হল না, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই নীচের দিকে ঘুরে তাকায়।

কে যেন উঠে আসছে-কান্ত শিথিল পদবিক্ষেপে।

আরে ওই তো সমীরণদা—এ কি সমীরণদা, আপনি ম্যাড্রাস যাননি?

সুদৰ্শন তাকিয়েছিল আগুন্তুকের মুখের দিকে। সিঁড়ির আলোটা শক্তিশালী না হলেও স্পষ্টই, সব কিছু দেখা যায়।

বছর তেত্রিশ-চৌত্ৰিশ হবে সমীরণ দত্তর বয়সী।

রোগা, লম্বা এবং যাকে বলে রীতিমত সুশ্ৰী চেহারা সমীরণ দত্তর।

পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি-মাথার চুল তৈলহীন রুক্ষ এবং কিছুটা এলোমেলো।

তীক্ষ্ণ নাসা—সুন্দর দুটি চক্ষু।

চোখে চশমা।

তার হাতে কালো রংয়ের একটা সুটকেস, মাঝারি সাইজের। দেবজ্যোতির পাশে সম্পূর্ণ অপরিচিত সুদৰ্শনকে দেখে সমীরণ দত্ত হঠাৎ যেন থমকে সিঁড়ির মাঝপথেই একটা ধাপের উপর দাঁড়িয়ে ছিল।

দেবজ্যোতি বললে, আমি তো ভেবেছিলাম। এতক্ষণে আপনি ম্যাড্রাস পৌঁছে গিয়েছেন প্লেনে। এই যে এই ভদ্রলোক, আপনাকে খুঁজছিলেন।

পাশেই দন্ডায়মান সুদৰ্শনকে দেখিয়ে দিল দেবজ্যোতি।

সমীরণের দিক থেকে কিন্তু কোন সাড়া এল না, সে যেন কেমন বোবার মতই দাঁড়িয়ে আছে তখনো।

কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।

সমীরণ তাকিয়ে আছে। সুদর্শনের মুখের দিকে। আর সুদৰ্শন তাকিয়ে আছে। সমীরণের মুখের দিকে। দুজনে যেন দুজনের সমস্ত দৃষ্টি দিয়ে পরস্পরকে যাচাই করছে।

দেবজ্যোতি কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিল না। তার কথাটা শেষ করেই সে তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গিয়েছিল।

সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সুদৰ্শন আর ধাপ-পাঁচেক নীচে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে প্রস্তর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে তখনো সমীরণ দত্ত।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল। সুদর্শনই। মৃদু হেসে বললে, আসুন সমীরণবাবু-আপনার কাছেই আমি এসেছিলাম—আমার নাম সুদৰ্শন মল্লিক। এসে শুনি আপনি ম্যাড্রাস চলে গিয়েছেন–

ম্যাড্রাস?

হ্যাঁ-দেবজ্যোতিবাবু বললেন—

সমীরণ দত্ত উঠতে শুরু করেছে তখন সিঁড়ি দিয়ে আবার। সিঁড়িগুলি অতিক্রম করে উপরে এসে মুখোমুখি হয়ে বলে, দেবজ্যোতি ভুল করেছে—

ভুল?

হ্যাঁ—আমার বোম্বাই যাওয়ার কথা ছিল ম্যাড্রাস নয়—

তা গেলেন না?

সুটকেসটা একপাশে নামিয়ে রেখে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তলাটা খুলতে খুলতে সমীরণ বললে, না—প্লেনটা মিস করলাম—আসুন—

সমীরণের আহ্বানে সুদৰ্শন ঘরের মধ্যে পা দিল।

ঘরটা অন্ধকার ছিল, সমীরণ সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বেলে দেয়।

ঘরটা আকারে বেশ বড়ই। মেঝেতে যদিও কাপেট পাতা কিন্তু কাপেটটায় যে অনেকদিন বঁটা পড়েনি সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। একদিকে একটা হারমোনিয়াম, তার পাশে বাঁয়া তবলা—একরাশ স্বরলিপির বই—গানের বই-খাতা-পেন্সিল, পানের ডিবে, পিকদানি অ্যাশট্রে—, রেকর্ড—সব ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে।

ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে কয়েকটি সোফা। তার পাশে একটা ভাসে কিছু শুকনো গোলাপ।

দেওয়ালে বড় বড় সব গাইয়েদের ফটো।

মধ্যিখানে রবীন্দ্রনাথের ছবি।–

সব কিছুর মধ্যেই যেন একটা অযত্ন—এলোমেলো বিশৃঙ্খলতা।

সমীরণ দত্ত সুদৰ্শনকে বললে—বসুন।

কথাটা বলে মধ্যবর্তী একটা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল এবং একটু পরে সুটকেসটা সেই ঘরে রেখে বের হয়ে এল আবার।

আপনি বললেন আপনার নাম সুদৰ্শন মল্লিক-আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না! আমার কাছে কি কিছু প্রয়োজন ছিল?

হ্যাঁ–বসুন না।

সমীরণ কিন্তু বসল না। সুদর্শনের মনে হচ্ছিল সমীরণ দত্ত যেন তাকে দেখা অবধি একটু বিব্রতই বোধ করছে। কেমন যেন একটু অস্থির—চঞ্চল।

বসুন সমীরণবাবু–

সমীরণ বসল। পাশের সোফায়।

সমীরণবাবু—আপনাকে আমার আসল পরিচয়টা ও আসার উদ্দেশ্যটা খুলে বলছি–

সমীরণ চেয়ে আছে। সুদর্শনের দিকে!

আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে আসছি—

কেন?

আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার আছে।

কেন?

হ্যাঁ—আপনি বিজিতা ঘোষালকে চিনতেন?

হঠাৎ যেন নামটা শুনে সুদর্শনের মনে হল সমীরণ কেমন একটু চমকে উঠল।

আপনি তাঁকে চিনতেন, মানে অনেকদিন, তাঁর বিবাহের আগে থেকেই, তাই না?

হ্যাঁ।

আপনি বোধ হয় একটা সংবাদ এখনো পাননি!

কি সংবাদ? সমীরণ যেন অতি কষ্টে কথাটা উচ্চারণ করল।

আজ দুপুরে তাঁকে এবং তঁর কন্যা রুণুকে সি. আই, টির ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।

সে কি? কে বললে?

মৃত বললেই সবটুকু বলা হবে না। দে হ্যােভ বীন ব্রটালি মার্ডারড্‌—নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের–

নৃশংসভাবে হত্যা!

হ্যাঁ—আর সেই ব্যাপারেই কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি আপনার কাছে।

আমি—

আপনি তো ওদের দুজনেরই বন্ধু ছিলেন। ওদের দুজনকেই ভাল করে জানবার ও চিনবার সুযোগ হয়েছিল। আপনার। তাই—

অতঃপর সুদর্শণ সমস্ত দুর্ঘটনাটা আনুপুর্বিক বলে গেল।

সমীরণ স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ যেন বসে থাকে।

মণিশঙ্কর কোথায় এখন? কেমন যেন মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করলে সমীরণ একটু পরে।

কাছেই আছেন তিনি-কালিকা বোর্ডিংয়ে।

আপনি বলছেন যখন ব্যাপারটা ঘটে তখন সে অফিসে ছিল?

হ্যাঁ-ফোনে সংবাদ পেয়ে এসে দেখতে পায়—

সে কিছুই জানে না?

না। অন্তত তাই তো তিনি বললেন।

কিছু অনুমানও করতে পারেনি?

না।

ও!

ওকথা বলছেন কেন সমীরণবাবু? আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?

আমি!

হ্যাঁ।

আমি কাকে সন্দেহ করব? তাছাড়া ইদানীং মাসকয়েক তাদের সঙ্গে আমার একদম দেখাসাক্ষাৎও হয়নি।

কাজে ব্যস্ত থাকার দরুনই বোধ হয়?

সমীরণ হাসল মৃদু। বললে, না—

তবে?

মণি পছন্দ করত না।

কি পছন্দ করত না-আপনাদের মেলামেশা?

হ্যাঁ-বিজিতার উপর সেজন্য সে টরচারও করত।

কি ধরনের টরচার?

ঠিক আমি জানি না।–তবে বিজিতার মুখ দেখে তাই মনে হয়েছিল।

তিনি কিছু বলেননি?

না। বিজিতার মত মেয়ে হয় না। এত ভদ্ৰ—এত নম্র-এত শান্ত-অথচ কেন যে মণি একটা কথা বুঝতে পারত না—

কোন কথা?

বিজিতার সমস্ত মন ভরে ছিল মণিশঙ্করই—

মণিশঙ্করের অত্যন্ত সন্দেহবাতিক মন ছিল তাহলে বলুন!

সমীরণ কোন জবাব দেয় না।

আর একটা কথা সমীরণবাবু—

সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে তাকাল।

আপনি যে সুটকেসটা এইমাত্র সঙ্গে নিয়ে এলেন সেটা একবার আনবেন?

সুটকেসটা!

হ্যাঁ।

কেন?

আনুন না-দরকার আছে–

কিন্তু

নিয়ে আসুন সুটকেসটা।

সমীরণ উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে সুটকেসটা নিয়ে এল। সুটকেসটা খুলতে গিয়ে দেখল। সুদৰ্শন—গা-তালা বন্ধ সুটকেসের।

সুটকেসের চাবিটা কোথায়? সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সুদৰ্শন।

চাবি!

হ্যাঁ চাবিটা দিন।

চাবি-মানে চাবিটা তো আমার কাছে নেই!

এই সুটকেসের চাবিটা আপনার কাছে নেই?

সমীরণের মুখটা যেন কেমন শুকিয়ে গিয়েছে–কেমন রক্তহীন ফ্যাকাশে।

এই সুটকেসটা আপনারই তো?

হ্যাঁ, মানে, —সমীরণ কেমন যেন তোতলাতে থাকে। তার কথা ভাল করে মুখ দিয়ে বের হয় না।

আপনার নয়। সুটকেসটা?

আপনি—আপনি বিশ্বাস করুন অফিসার—ওই সুটকেসটা সত্যিই আমার নয়।

আপনার নয়!

না। আগে কোন দিন সুটকেসটা আমি দেখিওনি।

তবে আপনার কাছে কি করে এল এটা?

জানি না।

জানেন না!

না। জানি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সত্যি বলছি-সুটকেসটা জীবনে কখনো আমি আগে দেখিনি। আজ বেলা দশটা নাগাদ আমি বের হয়েছিলাম-আমার রিহার্শেল ছিল—বেলা দুটো নাগাদ ফিরে আসি কারণ বিকেলের প্লেনে আমার বোম্বাই যাবার কথা—

বলুন, থামলেন কেন? তারপর?

কপালে সমীরণের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। ঠোঁট দুটো কেমন যেন কাঁপাছে। সমীরণ একটা ঢোক গিলে বলতে থাকে আবার, ঘরে ঢুকে দেখি মানে আমার শোবার ঘরে, বিছানার উপরে ঐ সুটকেসটা পড়ে আছে। একটু অবাক হই। কোথা থেকে এল সুটকেসটা? কে রেখে গোল—সুটকেসটা তো আমার নয়? সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখি তালা লাগানো।

তারপর?

আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করতে লাগল।

কেন?

সুটকেসের ভিতরে কি আছে তখনো জানি না, তবু কেন যেন আমার বুকের মধ্যে সিরসির করতে লাগল-সেই সময় ঘরের মধ্যে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল—তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোনটা ধরলাম, হ্যালো–

কে সমীরণবাবু?

হ্যাঁ—আপনি কে?

আমি যেই হই না কেন আপনার তাতে প্রয়োজন নেই-একটা কথা বলবার জন্য ফোন করছি। আপনার শোবার ঘরে একটা সুটকেস আছে—যদি বাঁচতে চান তো যত তাড়াতাড়ি পারেন সুটকেসটার একটা ব্যবস্থা করবেন–

ওই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই কানেকশনটা কেটে গেল। আমি যে তখন কি করব বুঝতে পারছি না। অবশেষে ঠিক করলাম সুটকেসটা বাইরে কোথাও গিয়ে ফেলে দিয়ে আসব–

সন্ধ্যার অন্ধকারে বের হলাম সুটকেসটা হাতে নিয়ে, কিন্তু কোন ট্যাক্সিতে চাপতে সাহস হল না— হ্যাঁটতে হ্যাঁটতে এগিয়ে চললাম।

তারপর?

ঘণ্টা তিনেক ধরে এ-রাস্তা সে-রাস্তা—লেক অঞ্চল রেল স্টেশন ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম সুটকেশটা হাতে ঝুলিয়ে। চারিদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। কোথায় সুটকেসটা ফেলব— কারো নজরে পড়ে যাব।—এই ভয়ে রাত্ৰিতে আবার বেরুব ঠিক করে ফিরে এলাম। আমি জানি, আপনি নিশ্চয় আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু যা বললাম এক বৰ্ণও তার মিথ্যে নয়। সুটকেসটা আমার নয়, জানিও না করি। জানি না কি ওর ভেতরে আছে, কোথা থেকে এল, কেমন করেই বা এল-বলতে বলতে সমীরণের গলার স্বরটা যেন বুজে এল।

আপনি যখন বাড়ি থেকে দশটা নাগাদ বের হয়েছিলেন, তখন দরজায় তালা দিয়ে যাননি? সুদৰ্শন জিজ্ঞাসা করে।

গিয়েছিলাম।

ফিরে এসে দরজায় তালা দেওয়াই আছে দেখেছিলেন?

হ্যাঁ।

গডরেজের লক?

না। সাধারণ একটা দেশী গা-তালা। তাহলেও তালাটা ভাল জাতের।

তবে? যদি কেউ এসেই থাকে। তবে সে খুলল কি করে?

জানি না।

আপনার কোন চাকর-বাকির দেখছি না-নেই নাকি?

চাকরিটা মাসখানেক হল ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। একটা ঠিকা-ঝি সব করে দিয়ে যায়।

রান্নাবান্না?

যাহোক কিছু ফুটিয়ে নিই-একা মানুষ–

বিয়ে-থা করেননি?

না।

মা-বাপ, ভাই-বোন নেই?

সবাই আছে।

কোথায় থাকে তারা?

এই কলকাতাতেই।

তবে?

কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি।

কেন?

ভালভাবে ইকনমিক্স-এ এম. এ. পাস করেও কোন চাকরি-বাকরি করলাম না-গানবাজনা নিয়েই আছি—বাবার সঙ্গে তাই মতবিরোধ হতে লাগল সৰ্ব্বক্ষণ, বাড়ি ছেড়ে তাই চলে এলাম।

কবে?

তা বছর পাঁচেক হবে।

বছর পাঁচেক এই বাসাতেই আছেন?

হ্যাঁ।

কিছু মনে করবেন না, আপনার ইনকাম কি রকম?

যা পাই—আমার তাতে ভাল ভাবেই চলে যায়। উদ্ধৃত্তিও থাকে না-অভাবও নেই।

ছুরি আছে?

ছুরি!

হ্যাঁ।

আছে—তবে কি হবে ছুরি দিয়ে?

নিয়ে আসুন একটা ছুরি।

সমীরণ একটা ছুরি নিয়ে এল—তারই সাহায্যে তালা ভেঙে সুটকেসটা খুলে ফেলল সুদৰ্শন।

আর খুলতেই যেন ও চমকে ওঠে।

রক্তমাখা কাপড়!

টেনে বের করল। সুদৰ্শন। রক্তমাখা ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি—আর কাপড়ের মধ্যে জড়ানো ছিল একটা ধারালো বড় ছোরা।

ছোরাটার গায়েও রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে।

সমীরণ যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে রক্তমাখা জামাকাপড়ের দিকে।

সুদৰ্শনের মুখ দিয়ে কয়েকটা মুহুর্ত কোন কথা বের হয় না।

এই ধুতি আর পাঞ্জাবি-চিনতে পারছেন?

কেমন যেন অসহায় বোবোদৃষ্টিতে তাকায় সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে। কোন কথায় বের হয় না তার মুখ দিয়ে।

চিনতে পারছেন না?

না তো–

আপনার ধুতি-পাঞ্জাবি কোথায় থাকে?

ওই যে আলমারির মধ্যে—হাত তুলে ঘরের মধ্যে একটা আলমারি দেখিয়ে দিল। সমীরণ।

আলমারিতে চাবি দেওয়া থাকে না?

না।

সুদৰ্শন উঠে গিয়ে আলমারির বন্ধ দরজা দুটো টানতেই খুলে গেল। একটা তাকে কিছু ধুতি-পাঞ্জাবি দলামোচা করে রাখা—অন্য তাকে কিছু ভাঁজ করা জামাকাপড়। হ্যাঙারে একটা কোট—একটা শাল। আলমারির থেকে একটা ভাঁজকরা ধুতি নিয়ে ফিরে এল সুদৰ্শন-। সেটা রক্তমাখা ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি সুটকেসের মধ্যে ভরল। সন্তৰ্পণে ছোরাটাও একটা রুমালে ভাজ করে সুটকেসের মধ্যে ভরে ডালটা বন্ধ করল।

সমীরণবাবু?

অ্যাঁ?

আমার সঙ্গে যে একবার আপনাকে যেতে হবে!

কেন?

চলুন, প্রয়োজন আছে—

আমাকে কি আপনি অ্যারেস্ট করছেন?

আই অ্যাম সরি সমীরণবাবু-ঠিক অ্যারেস্ট নয়, তবে আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।

কিন্তু কেন, আমাকে আপনি অ্যারেস্ট করছেন কেন?

না, না—সমীরণবাবু, অ্যারেস্ট আপনাকে আমি ঠিক করছি না—বললাম তো! আপাততঃ লালবাজারে আপনাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি—চলুন। আর দেরি করবেন না।

আপনিও কি সন্দেহ করছেন। আমিই বিজিতা আর তার মেয়েকে হত্যা করেছি?

চলুন আপনি আমার সঙ্গে।

কিন্তু কেন? কেন আমি আপনার সঙ্গে যাব? ঐ সুটকেসের ব্যাপারটা কিছুই আমি জানি না বিন্দুবিসর্গ। কোথা থেকে এল, কেমন করে এল

তবু সুটকেস আপনার কাছেই পাওয়া গিয়েছে। আপনি তাকে চিনতেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিচয় ছিল আপনাদের পরস্পরের, আপনি তাকে ভালবাসতেন—

ভাল যদি বিজিতাকে আমি বেসেই থাকি কোন দিন সেটা নিশ্চয়ই একটা অপরাধ নয়?

দেখুন সমীরণবাবু, তর্ক করতে আমি চাইনা। আপনি আমার সঙ্গে যাবেন কিনা সেটা কেবল আমি জানতে চাই—

যদি না যাই?

তবে বাধ্য হয়েই আপনাকে আমায় অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে হবে।

বেশ চলুন।

সুদৰ্শন সমীরণকে সঙ্গে করে লালবাজারে নিয়ে এল। এবং তাকে লক-আপে রেখে দেবার ব্যবস্থা করল।,

রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। প্রায় এগারোটা।

বাসায় ফিরবার আগে সুদৰ্শন কিরীটীকে ফোন করল।

কে? কিরীটীর গলা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল।

দাদা আমি সুদৰ্শন।

কি ব্যাপার, এত রাত্রে?

সেই সুটকেসটা পাওয়া গিয়েছে দাদা।

পেয়েছ?

হ্যাঁ। তার মধ্যে রক্তমাখা ধুতি, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি আর একটা ছোরাও পাওয়া গিয়েছে।

কোথায় পেলে?

সমীরণ দত্তর কাছে?

সমীরণকে অ্যারেস্ট করেছ?

নিশ্চয়ই।

কি বললে সে?

সংক্ষেপে সুদৰ্শন ঘটনোটা বলে গেল কিরীটীকে ফোনে। সব শুনে কিরীটী বলল, একটা কথা সুদৰ্শন—

বলুন দাদা?

মণিশঙ্করের ফ্ল্যাটে পুলিস-প্রহরা রেখেছতো?

রেখেছি।

কাল একবার ভোরেই গোপেনবাবুর ওখানে যেও—

যাব। কিন্তু গোপেনবাবুর এভিডেন্সটা কি খুব প্রয়োজনীয় দাদা?

নিঃসন্দেহে। হয়তো তিনি তোমার বর্তমান হত্যা-রহস্যের ব্যাপারে আলোক সম্পাত করতে পারেন।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে দাদা-সমীরণ দত্তকে যখন হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছি, হত্যা-রহস্যের কিনারা আমরা সহজেই করতে পারব।

তাহয়তো পারবে,কিন্তু তবু গোপেনবাবুকিছু জানেন কিনা জানা একান্তই প্রয়োজন।কিন্তু আর রাত করো না, এবার বাড়ি যাও—সাবিত্রী হয়ত তোমার জন্য বসে আছে। গুডনাইট।

কিরীটী অন্য প্রান্তে ফোনটা রেখে দিল।

সত্যিই সাবিত্রী জেগে বসেছিল সুদর্শনের জন্য।

রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা।

কলিংবেল টিপতে সাবিত্রীই এসে দরজা খুলে দিল, এত রাত হল যে!

খেয়েছে?

না।

কেন খেয়ে নিলে না! কতদিন বলেছি। রাত হলে আমার জন্যে বসে থেকে না।

সাবিত্রী মৃদু হাসে।

হাসলে যে? সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে।

হাত-মুখ ধুয়ে নাও-এত রাত্রে নিশ্চয়ই স্নান করবে না!

স্নান না করলে আমার ঘুমাই হবে না—চট্‌পট সেরে নিচ্ছি। আমি। জান সাবি—

কি?

কেসটার আরো ডেভলপমেন্ট হয়েছে। খেতে খেতে তোমাকে সব বলব-তুমি খাবাব রেডি কর-আমি আসছি!

খাবারের টেবিলে বসে খেতে খেতে সুদৰ্শন সব বলে গেল।

কি তোমার মনে হয় সাবি?

কিসের কি?

ঐ সমীরণ দত্তই নিশ্চয় খুন করেছে?

আমার কিন্তু তা মনে হয় না।

কেন?

কি জানি! আমার মন যেন বলছে সমীরণ দত্ত বিজিতাকে খুন করেনি।

কিন্তু কেন কেন তোমার ওকথা মনে হচ্ছে?

জানি না, তবে মনে হচ্ছে

তুমি একেবারে ছেলেমানুষ।

সাবিত্রী সে কথার জবাব না দিয়ে বললে, জান, ছোড়দা এসেছিল আজ!

অমলেন্দুবাবু?

হ্যাঁ।

তোমার মা-বাবা কেমন আছেন?

বাবার শরীরটা খুব খারাপ।

যাও না ওখানে গিয়ে কিছুদিন থেকে এস।

আমার লজ্জা করে।

লজ্জা কিসের তোমার—যা ঘটেছিল তার জন্য তো তুমি দায়ী নও—হলই বা মাধবী তোমার বোন।

সে আমার বোন বলেই তো যেতে পারি না।

তবে না হয় তোমার মা বাবাকে এখানে এসে কিছুদিন রাখ।

বাবা আসবেন না।

কেন?

সে তুমি বুঝবে না।

খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, সুদৰ্শন টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল।

সাবিত্রী যখন শুতে এল সুদৰ্শন নাক ডাকাচ্ছে। গভীরভাবে নিদ্রিত।

কয়েকটা মুহুর্ত সাবিত্রী গভীর মমতায় ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফ্যানের হাওয়ায় সুদর্শনের চুলগুলো উড়ে উড়ে তার চোখে-মুখে এসে পড়ছে।

মনে মনে স্বামীকে প্ৰণতি জানায় সাবিত্রী। তুমি আমাকে যে কি লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছ। তুমি জান না! আশীবার্দ কর আমাকে, যেন তোমার ভালবাসার যোগ্য হতে পারি আমি।

খুব ভোরেই উঠে-হাত-মুখ ধুয়ে, শেভ করে, চা পান করেই সুদৰ্শন লালবাজার চলে গিয়েছিল।

অফিস-ঘরে ঢুকতেই একজন সার্জেণ্ট এসে স্যালুট করে দাঁড়াল!

কি খবর বিশ্বনাথ?

একটু আগে এখানে একটা ফোন এসেছিল।

ফোন? কার?

আপনার কাছেই এসেছিল ফোন-কলাটা। তবে কে যে ফোন করেছিল জানি না। তবে কালকের সেই সি. আই. টি.-র ফ্ল্যাট বাড়িতে আর একটা খুন হয়েছে।

খুন! সে কি?

হ্যাঁ স্যার—বিকাশবাবু ফোন পেয়েই স্পটে চলে গিয়েছেন।

কিন্তু কে-কে খুন হয়েছে?

তা জানি না, স্যার।

সুদৰ্শন আর দেরি করে না। তখুনি বের হয়ে পড়ে।

অকুস্থলে পৌঁছে দেখল নীচে ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে পুলিসের একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে—চার-পাঁচজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।

সুদৰ্শন তাদেরই একজনকে প্রশ্ন করে, বিকাশবাবু কোথায়?

উপরে স্যার। দোতলায় উঠতেই সিঁড়ির মাথায় একজন সার্জেন্টির সঙ্গে দেখা হল। সুদৰ্শন তাকেই জিজ্ঞাসা করে, কোথায় খুন হয়েছে?

তিনতলার ফ্ল্যাটে, স্যার।

তরতর করে সুদৰ্শন তিনতলায় উঠে যায়।

দুটো ফ্ল্যাট সিঁড়ির ল্যানডিংয়ের দুই দিকে।

একটার দরজায় তালা দেওয়া।

অন্য দরজাটা খোলা—তার সামনে একজন সেপাই দাঁড়িয়ে। দরজার গায়ে ইংরেজীতে নেমপ্লেটে লেখা—শ্ৰীগোপেন বসু, বি. ই.।

ঘরে পা দিতেই চোখে পড়ল সুদর্শনের বীভৎস দৃশ্যটা।

বছর পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে একটি ভদ্রলোক-মাথার চুল অনেকটা সাদা হয়ে গিয়েছে— সামনের দিকে টাক-পরনে শ্লিপিং সুট, খালি পা—উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে দেহটা-কিছু দূরে একটা চশমা পড়ে আছে। ও-দুপটি চপ্পল।

মেঝেতে চাপ-চাপ রক্ত।

বিকাশ মধ্যবয়সী ভৃত্যশ্রেণীর লোকটিকে নানা প্রশ্ন করছিল, আর লোকটা কঁদেছিল।

সুদৰ্শনকে ঢুকতে দেখেই বিকাশ তাকে একটা স্যালুট করে, এই যে স্যার, এসে গেছেন। কাল রাত্রে–কোন এক সময় ব্যাপার ঘটেছে মনে হচ্ছে।

গোপেন বসু?

হ্যাঁ স্যার—

ঐ লোকটা কে?

গোপেনবাবুর চাকর দাশু!

আর কেউ নেই বাড়িতে?

না, গোপেনবাবুর স্ত্রী দিনসাতেক হল মুর্শিদাবাদে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছেন

ছেলেমেয়েদের নিয়ে।

বাড়িতে তাহলে আর কেউ ছিল না?

না। স্যার, ঐ দাশু আর গোপেনবাবু।

সুদৰ্শন মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল।

নীচু হয়ে বসে মৃতদেহের সামনেটা উল্টে দিল সুদৰ্শন। বুকে ও পেটের ক্ষতস্থান দুটো চোখে পড়ল। পেটের খানিকটা ইনটেসটিন বের হয়ে এসেছে—দুহাতের পাতায় রক্ত শুকিয়ে আছে। বুকের ক্ষতটাও প্রায় ইঞ্চি-দুই চওড়া।

চোখে-মুখে অসহ্য একটা বিস্ময় ও যন্ত্রণার চিহ্ন তখনো যেন স্পষ্ট।

সুদৰ্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না প্রথমে হয়তো পেটে কোন তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করা হয়েছিল, তারপর বক্ষস্থলে দ্বিতীয় আঘাত করা হয়েছে।

মোক্ষম দুটি আঘাত।

হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে।

ভদ্রলোক চেচাবার বা লোক ডাকবারও সময় পাননি।

ঘরের ঠিক দরজার সামনেই অনেকটা রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। হয়তো ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছিলেন বা ঘুমোবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, ঐ সময় আততায়ী এসে দরজায় ধাক্কা দেয়। ভদ্রলোক দরজার গায়ে ধাক্কা শুনে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই আততায়ী সঙ্গে সঙ্গে তাকে অতর্কিতে প্রথমে তার পেটে আঘাত করে, তারপর বুকে।

দেহে রাইগার মরটিস সেট-ইন করেছে।

ঘণ্টা ছয়-সাত আগেই হয়তো মৃত্যু হয়েছে।

নিষ্ঠুর নৃশংস বীভৎস হত্যা।

মাত্র কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে পর পর তিনটি বীভৎস হত্যা একই বাড়ির দুই ফ্ল্যাটে উপরের ও নীচের ফ্ল্যাটে। হত্যা-পদ্ধতিও এক। কোন ধারালো তীক্ষ্ণ অস্ত্রের সাহায্যে।

হঠাৎ মনে পড়ে সুদর্শনের পূর্বে যে অস্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে সেটা পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এবারে যে অন্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে সেটি কোথায়?

সুদৰ্শন আবার উঠে দাঁড়াল।

ঠিক দোতলার ফ্ল্যাটের মতই উপরের তলার ঐ ফ্ল্যাটটিতেও ব্যবস্থা—ততে চারটি ঘর এবং দুটি বেডরুম।

প্রত্যেক ঘরেই দামী দামী আসবাব।

একটি শোবার ঘরে পাশাপাশি দুটি শয্যা—একটি রাত্রে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয় না। সেই ঘরে একটি গডরেজের আলমারি-তার পাশে একটি দামী ড্রেসিং টেবিল। সেই ঘরটি একেবারে কোণের ঘর-তার আগের ঘরে একটি সিঙ্গল বেডে শয্যা।

সে শয্যাটি দেখলেই বোঝা যায় রাত্ৰে শয্যাটি ব্যবহৃত হয়েছে। ঐ ঘরটি বসবার ঘরের ঠিক পরের ঘর।

শেষোক্ত ঘরের মধ্যে একটি বুক-সেলফ-পাশে ইংরাজী ও বাংলা বই সাজানো।

সেলফের উপরে একটি ফটো। ফ্রেমে একটি ফ্যামিলি-ফটো। দেখলেই বোঝা যায় গোপেন, বসুর ফ্যামিলির ফটো।

গোপেনবাবু, তাঁর পাশে মোটাসোটা মধ্যবয়সী একটি ভদ্রমহিলা, পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ে, আঠার-উনিশ বছরের একটি যুবক ও দশ থেকে বারো বছরের মধ্যে দুটি ফ্রক পরা মেয়ে।

ব্যবহৃত শয্যার পাশে ছোট একটি ত্ৰিপায়ের উপর একটি টেবিল-ক্লক। এক প্যাকেট সিগারেট-একটা ম্যাচ ও ছাইভর্তি একটি কাচের অ্যাশট্রে ও একটা টেবিল ল্যাম্প।

ল্যাম্পটা তখনো জ্বলছিল।

বোতাম টিপে টেবিল-ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল সুদৰ্শন।

ঘরে দক্ষিণ কোণে একটি মাঝারি সাইজের রাইটিং-টেবিল।

কিছু ফাইলপত্ৰ—একটা ঝর্ণ কলম। আর একটা চাবির রিং। রিংয়ের মধ্যে একগোছা চাবি। টেবিলটার পাশেই একটা ষ্টীলের আলমারি।

রাইটিং-টেবিলের ড্রয়ারগুলো ও আলমারিটা সেই রিংয়ের চাবির সাহায্যে একে একে খুলে দেখল। সুদৰ্শন।–

একটা ড্রয়ারের মধ্যে একটা কালো মোটামত ডাইরি পাওয়া গেল। ডাইরির পাতায় সব হিসাবপত্র।

সংসার ও অন্যান্য জমাখরচের হিসাব।

কিছু ঠিকানাও লেখা আছে।

সেই ঠিকানার মধ্যেই গোপেন বসুর শ্বশুরমশাইয়ের মুর্শিদাবাদের ঠিকানা পাওয়া গেল।

একটা চামড়ার পার্সও পাওয়া গেল—

একগোছা নোট পার্সটার মধ্যে। গুনে দেখল। সুদৰ্শন প্রায় নাশ টাকা। একশ ও দশ টাকার নোট।

ড্রয়ার বন্ধ করে আলমারিটা দেখতে লাগল চাবি দিয়ে খুলে সুদৰ্শন।

হ্যাঙারে কিছু সুট—গোটাকতক টাই, রুমাল ও ভাজকরা ধুতি ও শ্লিপিং-সুট।

আলমারির ড্রায়ারে কিছু প্ল্যানের ব্লু-প্রিন্টও পাওয়া গেল।

আলমারিটা দেখা হয়ে গেলে সেটায় চাবি দিয়ে দিল সুদৰ্শন।

পাশের ঘরে গিয়ে গডরেজের আলমারিটা খুলবার চেষ্টা করল—কিন্তু খুলতে পারল না। চাবির রিংয়ের মধ্যে ঐ আলমারির চাবি নেই।

আবার বসবার ঘরে ফিরে এল সুদৰ্শন।

বিকাশ তখন একজন ভদ্রলোককে নানা প্রশ্ন করছিলেন।

ভদ্রলোকটির বেশ পেশীবহুল চেহারা। গায়ের রঙ কালো হলেও সুশ্ৰী, চোখ-মুখের গড়ন ও দু’চোখের দৃষ্টিতে বেশ একটা বুদ্ধিদীপ্তি আছে।

পরনে দামী সুট। হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট ধরা।

অল্প দূরে স্নান বিষণ্ণমুখে দাণ্ড দাঁড়িয়ে।

ইনি কে বিকাশ?

মিঃ স্বামীনাথন।

ইনি–

ঐ যে পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন।

তাই নাকি! তা একটু আগে দেখেছিলাম দরজায় তালা দেওয়া? সুদৰ্শন বললে।

স্বামীনাথনই জবাব দিল, হ্যাঁ, আমি এইমাত্র ফিরছি। কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম, এসে ট্যাক্সি থেকে নামতেই পুলিস দেখি। তাদের ব্যাপারটা কি জিজ্ঞাসা করতেই তো জানতে পারলাম।

কথায় কেমন যেন একটা অবাঙালী টান—এবং কথা বললে ইংরাজীতেই।

কোথায় গিয়েছিলেন। আপনি? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।

কলকাতার বাইরে—বলে স্বামীনাথন।

কোথায়? ·

দেশে গিয়েছিলাম।

দেশে!

হ্যাঁ, ত্ৰিচিনাপল্লীতে।

আপনি–

আমি একজন সাউথ-ইণ্ডিয়ান।

এখানে কি করেন?

এখানে একটা ইলেকট্রিকাল গুডস ফ্যাকট্রিতে চাকরি নিয়ে এসেছি-সুপারভাইজিং অফিসারের পোস্টে।

কি নাম কোম্পানির?

মরিসন অ্যাণ্ড আটারা।

কতদিন এখানে আছেন?

কলকাতায়?

হ্যাঁ।

মাস-দুই হবে।

এই ফ্ল্যাটে কতদিন আছেন?

জাস্ট এ ফিউ ডেজ বলতে পারেন-দিন-দশেকও হবে না।

আপনার ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই?

না, এখনো আমার ফ্যামিলি এসে পৌঁছয়নি-সামনের মাসে আসার কথা তাদের।

তাহলে এখানে আপনি নিউ কামার?

কতকটা তাই বলতে পারেন।

গোপেন বসুকে আপনি চিনতেন?

হ্যাঁ, পরিচয় হয়েছিল সামান্য-কয়েকদিনের পরিচয়-হি ওয়াজ এ নাইস ম্যান, আই অ্যাম রাদার শকড টু হিয়ার দ্য নিউজ। হাউ স্যাড!

মণিশঙ্করবাবুকে চিনতেন?

ওঁর স্ত্রী তো আপনাদেরই দেশের-ময়ে!

হ্যাঁ

তাঁকে চিনতেন?

আগে চিনতাম না-পরে চেনা হয়েছিল।

ওঁদের সংবাদ কিছু জানেন?

না তো। কিন্তু কেন? তারা তো নীচের ফ্ল্যাটেই থাকেন।

গতকাল দুপুরে মণিশঙ্করবাবুর স্ত্রী ও মেয়েটি নিহত হয়েছে।

হোয়াট? কি বললেন?

হ্যাঁ, ব্রটালি মোর্ডারড।

বাট হাউ?

সুদৰ্শন হেসে বলে? সেটা অবিশ্যি জানতে পারিনি এখনো।

এনিবডি অ্যারেস্টড।

না।

কেউ অ্যারেস্ট হননি?

না।

খুনীকে তাহলে ধরতে পারলেন না?

পারিনি এখনো, তবে ধরা সে পড়বেই।

উঃ, হাউ ফ্যানটাসটিক! একই বাড়িতে একই দিনে তিন-তিনটে মার্ডার! হাউ হরিবল! তা মিঃ বোসের ফ্যামিলিকে সংবাদটা দিয়েছেন?

দেওয়া হবে বৈকি।

কুড আই ইনফর্ম দেম?

না, পুলিসই দেবে ইনফরমেশন।

এত বড় সাংঘাতিক ব্যাপার-এরপর এখানে থাকতে আমি আর এক ঘণ্টাও সাহস পাচ্ছি না-আই মাস্ট ইনফর্ম দি ল্যাণ্ড লর্ড, আজই আমি বাড়ি ছেড়ে দেব-এক্সকিউজ মি-মাথাটার মধ্যে আমার যেন কেমন ফীল করছি।–কথাগুলো বলে স্বামীনাথন আর দাঁড়াল না, স্থলিত পদবিক্ষেপে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সুদৰ্শন ফিরে তোকাল দাশুর দিকে।

দাশু না তোর নাম?

আজ্ঞে দাশরথী তা।

বাড়ি কোথায়?

তমলুক।

বাবুর কাছে কতদিন কাজ করছিস?

আজ্ঞে হুজুর পনের বছর তো হবেই।

তুই কোন ঘরে রাত্রে ছিলি?

রান্নাঘরের পাশে ছোট ভাঁড়ার ঘরটা, তারই সামনে বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলাম। দোহাই হুজুরের, মা-বাপ—আমি কিছু জানি না, আমার দেবতার মত মুনিব—হায় হায়, এ কি হল ঈশ্বর–

বাড়িতে তোর কে কে আছে?

ছেলে মেয়ে পরিবোর—সবাই আছে হুজুর।

কাল কত রাত্রে ঘুমিয়েছিলি?

বাবু দশটা নাগাদ খেয়ে নিতেই, আমিও খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।

বাবু কাল অফিস থেকে কখন ফিরেছিলেন?

বাবু কাল অফিসেই যাননি।–কেবল বেলা বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ একবার বের হয়েছিলেন, কিন্ত একটু পরেই ফিরে আসেন—আর বের হননি।

কাল নীচের তলায় যে খুন হয়েছে জানিস?

জা-জানি হুজুর।

জানিস?

হ্যাঁ, আমরা তো তখন উপরে যখন পুলিস আসে—আমি, বাবু—

তুই আর তোর বাবু তখন উপরেই ছিলি?

আজ্ঞে হুজুর। বাবু ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

কেন? ভয় পেয়েছিলেন কেন?

কে জানে হুজুর—দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে ছিলেন।

হুঁ। তা নীচে কাল দুপুরে কোন চিৎকার বা চেঁচামেচির শব্দ শুনেছিলি?

না বাবু।

সত্যি কথা বল?

মা কালীর দিব্বি বাবু-কিছু শুনিনি।

তবে জানতে পারলি কি করে যে খুন হয়েছে। নীচের ফ্ল্যাটে —পুলিস এসেছে?

আজ্ঞে বাবু বললেন—

বাবু বললেন!

হ্যাঁ, বাবু ঐ সময় আবার জামাকাপড় পরে কোথায় যেন বেরুচ্ছিলেন—সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পুলিস দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন।

তা খুন হয়েছেন নীচে জানলেন কি করে?

তা জানি না বাবু—

তারপর কি হল?

বাবু উপরে উঠে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জামা কাপড় খুলে ফেললেন।

দাশু?

আজ্ঞে হুজুর—

তুই নেশা-টেশা করিস কিছু?

আজ্ঞে!

নিশা-টেশা করিস?

আজ্ঞে এই যৎসামান্য–

তা কিসের নেশা করিস?

দামী নেশা কোথায় পাব হুজুর—সামান্য একটু-আধটু বড় কলকে—

হুঁ। কাল বড় কলকে হয়েছিল?

আজ্ঞে।

যা বলছি তার জবাব দে।

আজ্ঞে–

কাল একটু বেশী নেশা তোর হয়েছিল, তাই না?

আজ্ঞে।

কখন বড় কলকে টেনেছিলি? সন্ধ্যায়?

আজ্ঞে না-বাবু তাহলে জেনে ফেলবেন-রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর—

তারপর?

তারপর তো কিছু জানি না হুজুর—

নীচের বাবুর সঙ্গে তোর আলাপ ছিল?

তা ছিল বৈকি হুজুর।

তোর বাবুর?

বাবুর! হ্যাঁ ছিল বৈকি।

নীচের চাকরিটা-মানে ঐ শম্ভুকে চিনিস না?

হ্যাঁ-একটি ঘুঘু, বয়েস ওর অনেক হুজুর। ও মিথ্যা বলে ওর বয়েস।

তাই নাকি?

আজ্ঞে।

তা বুঝলি কি করে শম্ভু একটি ঘুঘু? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।

ও আমরা দেখলেই চিনতে পারি।–দাশু বললে।

হুঁ। তা তুই আজ কখন জানতে পারিস যে তোর বাবু খুন হয়েছেন?

বাবুর ঘুম ভাঙার পরই এক কাপ চায়ের দরকার হয়, সেই চা নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি—শোবার ঘরে বাবু নেই, তখন ভাবলাম বাবু বোধ হয়। বাথরুমে, কিন্তু কেউ নেই— ঐ সময় দুধওয়ালা দুধ নিয়ে আসে—কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিতে গিয়েই দেখি—

সদর দরজা খোলা ছিল, না বন্ধ?

আজ্ঞে, বন্ধ।

ভিতর থেকে খিল দেওয়া ছিল?

না।

বিকাশ ঐ সময় বলে, দরজায় গডরেজের অটোমেটিক ডোরলক লাগানো স্যার।

তাই নাকি!

হ্যাঁ স্যার, আমার মনে হয়। হত্যাকারী হত্যা করার পর বাইরে থেকে দরজাটা টেনে হয়তো আবার লক করে দিয়ে গিয়েছিল। বিকাশ বললে।

তারপর তুই কি করলি দাণ্ড?

আজ্ঞে প্রথমটায় কি করব বুঝতে পারিনি, তারপর দোতলায় ছুটে গিয়ে যে সেপাইজী পাহারায় ছিল তাকে ডেকে আনি।

লালবাজারে কে খবর দিয়েছিল বিকাশ?

কারণ সিং—

সে-ই তো নীচের ফ্ল্যাটের সামনে পাহারায় ছিল?

হ্যাঁ স্যার—

সে কোন শব্দটব্দ উপরে শোনেনি?

না। স্যার।

আরো আধঘণ্টা পরে সুদৰ্শন ফিরে এল লালবাজারে, বিকাশের উপরেই বাকি কাজের ভার দিয়ে। নিজের ঘরে ঢুকেই একজন সার্জেণ্টকে বললে সমীরণকে তার অফিস-কামরায় নিয়ে আসবার জন্য। একটু পরে সমীরণ সার্জেণ্টর সঙ্গে এসে ঘরে ঢুকল।

এক রাত্রেই তার চেহারা যেন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।

চোখ-মুখ শুকনো-সমস্ত মুখে যেন একটা ক্লান্তি ও অবসন্নতা।

বসুন সমীরণবাবু।

সমীরণ বসল সুদর্শনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে।

চা বোধ হয় খাননি—বলে সুদৰ্শন একজন সেপাইকে ডেকে সমীরণকে চা দেবার জন্য বললে।

কাল ঘুমোতে পারেন নি মনে হচ্ছে!

সুদৰ্শনের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না সমীরণ।

সমীরণবাবু!

সমীরণ মুখ তুলে তাকাল। বিজিতা দেবীকে আপনি তো অনেক দিন থেকেই চিনতেন?

চিনতাম।

আপনি তাকে ভালবাসতেন, তাই না?

সমীরণ মাথাটা নীচু করল, তারপর মৃদু গলায় বললে, সে সব কথার আজ আর কাজ কি মিঃ মল্লিক।

বুঝতে পারছি ভালবাসতেন। আর এও বুঝেছি সত্যিই কত গভীর ভালবাসা ছিল তার প্রতি আপনার। আশ্চর্য, তা ভালই যদি বাসতেন তো তাকে বিয়ে করলেন না কেন?

বিজিত

বলুন।

কিন্তু সে সব কথা শুনে আপনার কি লাভ মিঃ মল্লিক।

বিজিতা দেবীর হত্যাকারীকে ধরতে হলে তাঁর সম্পর্কে সব কথাই জানা প্রয়োজন আমাদের সমীরণবাবু। আপনিও নিশ্চয়ই চান তাঁর হত্যাকারী ধরা পড়ুক—

কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন। মিঃ মল্লিক, সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকল, তার দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে, বিজিতাকে আমি হত্যা করিনি।

ও কথা থাক। আপনি মধ্যে মধ্যে ওঁদের ওখানে যেতেন?

আগে আগে যেতাম—তবে ইদানীং কয়েক মাস যাইনি।

কেন?

মণি পছন্দ করত না জানতে পেরেই যাওয়া বন্ধ করেছিলাম।

মণিবাবু কিছু আপনাদের কোনদিন বলে ছিলেন?

না।

তবে আপনি বুঝতে পারলেন কি করে?

বুঝতে পেরেছিলাম—

কি করে?

ঐ সময় একজন বেয়ারা এক কাপ চা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল।

চা-টা খেয়ে নিন।

চায়ের পিপাসা আমার নেই।

তবু খান না। সকালবেলাতে চা খাননি। নিন, কাপটা তুলে নিন।

সমীরণ কাপটা হাতে নিয়ে একটা ছোট চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা আবার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে দিল।

খেলেন না।

ভাল লাগছে না।

তবে থাক। যা বলছিলাম-মণিবাবু আপনার যাওয়াটা পছন্দ করতেন না তা জানতে পারলেন কি করে?

বিজিতা আমাকে একটা চিঠিতে জানিয়েছিল।

বিজিতা দেবী মধ্যে মধ্যে আপনাকে বুঝি চিঠি লিখতেন?

না।

কি লিখেছিলেন চিঠিতে বিজিতা দেবী আপনাকে?

মণি পছন্দ করে না আমার যাওয়া-আসাটা তাই—অথচ কেন ও সন্দেহ করত বিজিতাকে আজও আমি ভেবে পাইনি মিঃ মল্লিক!

ওকথা বলছেন কেন?

কারণ বিজিতার সমস্ত মন জুড়ে ছিল মণিই। সেখানে কারো স্থান ছিল না। সী ওয়াজ সো সুইট—সো টেনডার—বলতে বলতে আবার সমীরণের গলাটা বুজে এল। দু চোখে জল ভরে উঠল।

শেষ আপনি কবে তাদের ওখানে গিয়েছিলেন?

গতকাল।

কাল গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

কখন? কখন গিয়েছিলেন?

বেলা তখন পৌনে একটা হবে।

ওঃ, তা দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে?

না।

দেখা হয়নি?

না-গিয়ে দেখি সদর দরজা বন্ধ।

বন্ধ!

হ্যাঁ-বার বার কলিংবেল টিপলাম। বিজিতার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু—

কি?

সে দরজা খুলল না।

তারপর?

ফিরে এলাম। অথচ–

কি?

শম্ভুর হাত দিয়ে চিঠি লিখে বিজিতা আমাকে বিশেষ জরুরী প্রয়োজনে ডেকে পাঠিয়েছিল?

চিঠি লিখে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি আপনাকে?

হ্যাঁ।

কি লিখেছিলেন সে চিঠিতে?

বিশেষ কারণে সে আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়।

তারপর?

আমি অবিশ্যি একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। চিঠি লিখে ডেকে পাঠাল অথচ দেখা করল না! ফিরে এলাম। আমি বাসায়।

কখন ফিরেছিলেন বাসায়?

বেলা তিনটে নাগাদ হবে।

তবে যে কাল বলেছিলেন—

মিথ্যা বলেছি-কাল আমার কোন রিহার্শেল ছিল না।

হুঁ। বলুন, তারপর?

বাসায় ফিরে শোবার ঘরে ঢুকে দেখি বিছানার উপর সেই সুটকেসটা পড়ে আছে—

কয়েকটা চাবি দিয়ে সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন চাবির সাহায্যেই সুটকেসটা খুলতে পারলাম না।

আপনি সুটকেসটা খুলতে চেষ্টা করেছিলেন তাহলে?

হ্যাঁ।

তারপর?

কেমন যেন একটা ভয় ভূতের মত আমাকে পেয়ে বসেছিল ঐ সময়।

ভয়!

হ্যাঁ-আর সেই ভয়টা আরো চেপে বসল যে মুহুর্তে আমি টেলিফেনটা পোলাম। এবং টেলিফোনটা পাওয়ার পর–

হঠাৎ যেন সমীরণ আবার থেমে গেল।

তারপর? বলুন, থামলেন কেন?

ভয়টা ক্রমশঃই যেন কেমন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত

সুটকেসটা দূরে কোথাও ফেলে আসবার জন্য আমি সেটা নিয়ে বের হয়ে পড়ি। আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না মিঃ মল্লিক?

সুদৰ্শন কি যেন ভাবছিল। সমীরণের কথার কোন জবাব দিল না।

আচ্ছা সমীরণবাবু!

সুদৰ্শনের ডাকে সমীরণ মুখ তুলে তাকাল।

যাকে আপনি অত ভালবাসতেন সে সুখী হতে পারেনি জেনে নিশ্চয়ই মনটা আপনার খারাপ হয়ে গিয়েছিল?

হয়েছিল। কিন্তু আমি আর কি করতে পারি!

আপনি মণিশঙ্করবাবুকে আলাদা করে ডেকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন না কেন?

না। করিনি।

কেন?

মণি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করত না। তাছাড়া কে জানে ব্যাপারটা আরো বিশ্ৰী হয়ে দাঁড়াত না!—তাই ওদের কাছ থেকে দূরেই সরে গিয়েছিলাম।

ঠিক আছে সমীরণবাবু, আপাততঃ আপনি যেমন আছেন তেমনি এখানেই থাকুন। সুদৰ্শন বলতে বলতে বেল বাজাল বোতাম টিপে।

একজন সেপাই এসে সেলাম দিল।

সার্জেণ্ট চক্রবর্তীকে ডাক।

একটু পরেই সার্জেণ্ট চক্রবতী এল, স্যার আমাকে ডেকেছেন?

হ্যাঁ, এঁকে নিয়ে যান। যে ঘরে উনি ছিলেন সেখানেই রাখুন।

সমীরণ উঠে দাঁড়াল।

সুদৰ্শন একটা সিগারেট ধরিয়ে ধূমপান করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।

সমীরণ দত্ত একটু আগে যা বলে গেল তা কি সত্যি? না বানিয়ে বানিয়ে সব কিছু বলে গেল?

ঐদিনকার সংবাদপত্রটা টেবিলের উপর পড়ে ছিল—তাই কালকের সি. আই. টি.র ফ্ল্যাট-বাড়িতে হত্যার ব্যাপারটা প্রথম পৃষ্ঠাতেই প্রকাশিত হয়েছে। নজরে পড়ল সুদর্শনের।

সি. আই. টির ফ্ল্যাটে নৃশংস জোড়া খুন দিনের বেলা।

মা ও মেয়ে খুন হয়েছে।

আততায়ীকে পুলিস এখনো সন্ধান করতে পারে নি।

পরের দিন সকালে।

কে?

দাদা আমি সুদৰ্শন।

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কিরীটির গলা শোনা গেল–কি খবর?

দাদা, সেই ফ্ল্যাটে আর একটা খুন হয়েছে, শুনেছেন তো?

গোপেন বসু নিহত?

হ্যাঁ।

জেনেছি। ভাবছিলাম তুমি আমায় সংবাদটা দেবে। মনে হচ্ছে একই ভাবে খুন হয়েছে, তাই না?

হ্যাঁ, ঠিক একই ভাবে খুন হয়েছে—সুদৰ্শন সমস্ত ঘটনোটা ফোনেই বিবৃত করে গেল।

সব শুনে কিরীটী বললে, আমি জানতাম। এমনিই একটা কিছু ঘটবে—

আপনি জানতেন?

হ্যাঁ, মনই আমার বলেছিল-তাই তোমাকে গতকাল সকালেই ওর সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে বলেছিলাম। কিন্তু ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি কিছু ঘটে যাবে—

আমিও ভাবতে পারি নি। দাদা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ওখানে আরো একটা খুন হবে। সব যেন কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে–

শোন, এক কাজ কর সুদৰ্শন।

বলুন?

কালিকা বোর্ডিংয়ে পুলিস-পাহারা আছে তো?

হ্যাঁ, আছে।

মণিশঙ্করবাবুকে লোক পাঠিয়ে লালবাজারে নিয়ে এস।

এখুনি আনাচ্ছি।

আরো একটা কাজ তোমাকে করতে হবে।

কি।

স্বামীনাথনকে লালবাজারে নিয়ে এস।

স্বামীনাথনকে! আপনি কি তাকেও সন্দেহ করছেন?

ঐ ধরনের হত্যার ব্যাপারে আশেপাশে যারাই থাকে। কেউ সন্দেহের তালিকার বাইরে যেতে পারে না। সুদৰ্শন। তাছাড়া কয়েকটা কথাও তার কাছ থেকে আমাদের জানা দরকার।

বেশ-যা বললেন। তাই করছি-কিন্তু তারপর?

একটু খোঁজখবর নেওয়ার জন্য যদি কালকের দিনটা আমি নষ্ট না করতাম, তবে হয়তো মিঃ বোসকে আমন করে প্রাণ দিতে হত না। যাক-যা বললাম। তাই কর, ওদের দুজনকেই আমাদের প্রয়োজন।–তাছাড়া ওরা–

ওরা কি?

ওরা দুজনের একজনও সব সত্য কথা বলেনি।

মণিশঙ্কর যে বলেনি তা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু স্বামীনাথন—

একটা কথা ভুলে যাচ্ছ কেন ভায়া-বিজিতা মণিশঙ্করের স্ত্রী ছিল, দক্ষিণ দেশের মেয়ে—আর স্বামীনাথন সেই দেশেরই লোক। এবং ঐ ফ্ল্যাটেই এসে স্বামীনাথন উঠেছিল। দুজনের পরস্পরের মধ্যে কোথাও একটা যোগসূত্র থাকা এমন কিছুই বিচিত্র নয়।

আপনি কি তাহলে—

এর মধ্যে আর সন্দেহের কি ভায়া-হয়তো খোঁজ করতে গেলে এমনও দেখতে পাব ওদের পরস্পরের মধ্যে পরিচয় তো বটেই আত্মীয়তাও ছিল হয়তো।

হঠাৎ ওই সময় সুদৰ্শন বলে, আপনি একবার আসবেন দাদা?

কেন বল তো!

জিজ্ঞাসাবাদ যা করতে হয় আপনিই করবেন। ওদের।

কেন? সবই তো তোমাকে বলে দিলাম। এবারে তুমিই জিজ্ঞাসাবাদ কর না!

তা পারি, কিন্তু আপনার মনের মধ্যে ওদের ঘিরে কোন প্রশ্নের উদয় হয়েছে সেটা তো আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়—শুধু আমার পক্ষেই বা বলি কেন, স্বয়ং ঈশ্বরও হয়তো জানেন না।

টেলিফোনের অপর প্রান্তে হো-হো করে গলা খুলে হেসে ওঠে কিরীটী।

না না-হাসি নয় দাদা—আসুন–

আসতেই হবে?

হ্যাঁ

বেশ, আসছি।–

দেরি করবেন না যেন

না, না-দেরি হবে না।

সুদৰ্শন বুঝতে পেরেছিল বর্তমান রহস্যের ব্যাপারে সে অন্ধকারে হাতড়ে ফিরলেও কিরীচীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে কোন একটা কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই।

রহস্যের ব্যাপারে তার বিশেষ অনুভূতিটা কোন একটা পথ খুঁজে পেয়েছে।

সুদৰ্শন তাই আর দেরি করে না।

দুটো ভ্যানে দুজন পুলিস অফিসার তখুনি পাঠিয়ে দেয় মণিশঙ্কর ও স্বামীনাথনকে আনবার জন্য।

এক ঘণ্টার মধ্যেই দুজনকে নিয়ে পুলিস অফিসার দুজন লালবাজারে পৌঁছে গেল। কিন্তু তার আগেই কিরীটী পৌঁছে গিয়েছিল।

কি হল, এলেন তোমার সম্মানিত অতিথিরা? কিরীটী প্রশ্ন করে।

আনতে গেছে বসুন—

দুজনকে কিন্তু আলাদা ঘরে রাখবে।

আলাদা?

হ্যাঁ, আলাদা ভাবে প্রশ্ন করব–কেউ যেন কাউকে না দেখতে পায়।

বেশ তাই হবে।

সমীরণবাবুকেও প্রয়োজন হবে!

তাকে এ ঘরে আনাব?

না-এখন না, সময় হলে বলব।

সুদৰ্শন সেই মতই ব্যবস্থা করে।

প্রথমেই সুদৰ্শন কিরীটীর নির্দেশানুযায়ী মণিশঙ্করকে ডেকে পাঠাল।

মণিশঙ্কর ঘরে ঢুকেই বললে, কি ব্যাপার-এভাবে এখানে হঠাৎ পাকড়াও করে নিয়ে এলেন?

সুদৰ্শন নয়—জবাব দিল কিরীটী, বসুন মিঃ ঘোষাল। আমাদের কিছু জিজ্ঞাস্য আছে!

মণিশঙ্কর চোয়ারটা টেনে নিয়ে বলল, বলুন শুনি!

আমরা জানতে পেরেছি—ইদানীং বেশ কিছুদিন ধরেই আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার মনকষাকষি চলছিল, কথাটা কি সত্যি?

মূল্যবান এ খবরটি কার কাছ থেকে পেলেন?

যেখান থেকেই পাই না কেন, কথাটা মিথ্যে নিশ্চয়ই আপনি বলতে পারেন না।

কেন বলতে পারব না—একশোবার বলব মিথ্যে।

মিথ্যে?

হ্যাঁ, যে বলেছে সে সম্পূর্ণ মিথ্যাই বলেছে। We never had any misunderstanding or quarrel!

কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে, বেশ বেশ। আপনার স্ত্রীকে আপনি খুব ভালবাসতেন न्श्यािष्ट्राझे?

আপনি বোধ হয় জানেন না, আমাদের লাভ-ম্যারেজ!

জানি-আর এ-ও জানি অনেক ভালবাসার বিয়েতেই অনেক সময় চিড় ধরে, ধরছে হামেশাই—

আমাদের সেরকম কিছু হয়নি।

ইদানীং আপনার, মানে আপনার বন্ধু সমীরণবাবুকে ঘিরে আপনার স্ত্রীর প্রতি একটা সন্দেহের ধোঁয়া সৃষ্টি হয়নি। আপনি বলতে চান?

সমীরণ আমার বন্ধু—অত ছোট মন আমার নয়।

তবে সমীরণবাবু ইদানীং আপনার ফ্ল্যাটে আর যেতেন না কেন? আগে আগে তো খুব যাওয়া-আসা ছিল!

তা আমি কেমন করে বলব?

আপনি কিছুই জানেন না?

না।

ওঃ, ভাল কথা, কাল ও পরশু রাত্রে আপনার বেশ ভাল ঘুম হয়েছিল নিশ্চয়ই?

ঘুম! হঠাৎ যেন কেমন থতিয়ে যায়। মণিশঙ্কর।

হ্যাঁ, ঘুম। শুনলাম। আপনি দুই রাত্রিই বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন! কি, জবাব দিচ্ছেন না কেন? ঘুমেননি?

আমার কি ঘুমোবার মত মনের অবস্থা?

তবু বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন বলেই খবর পেয়েছি!

দেখুন আপনার প্রশ্নের মাথা-মুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না!

ভালবেসে যাকে বিয়ে করলেন—আর যে নিজের সন্তান কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র নৃশংসভাবে খুন হয়েছে সে দৃশ্য দেখার পরও ঘুমের ব্যাঘাত আপনার ঘটল না রাত্রে–আপনার ভালবাসারই অকাট্য প্রমাণ বটে!

ব্যঙ্গের মত যেন শোনাল কিরীটীর কণ্ঠস্বর।

মণিশঙ্কর কোন জবাব দেয় না। কেমন যেন অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।

বেশ, এবারে বলুন পরশু আপনার জবানবন্দিতে দু-দুটো মারাত্মক মিথ্যা কথা কেন বলেছেন?

মিথ্যা কথা বলেছি!

হ্যাঁ-প্রথমতঃ যে চাবিটা আপনার স্ত্রীর আঁচলে থাকার কথা সেটা আপনার পকেটে এল কি করে?

ওটা তো ড়ুপ্লিকেট চাবি!

মিথ্যা কথা।

না, মিথ্যা নয়-তার কারণ–

আপনার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, হত্যার দিন অর্থাৎ পরশু দুপুরে আপনি যখন ফ্ল্যাটে আসেন তখুনি কোন এক সময় আপনার স্ত্রীর আচল থেকে আপনি চাবির রিংটা খুলে নিয়েছিলেন।

কি করে বুঝলেন?

যা সত্য তাই বলছি—

বেশ, কেন-আমি তার অচল থেকে চাবির রিংটা খুলে নেব?

কারণ হত্যা-ব্যাপারটার সঙ্গে একটা বাৰ্গালারিও জড়িয়ে আছে, সেটাই প্রমাণ করাবার চেষ্টা ও ইচ্ছা ছিল আপনার।

আ—আমি—

তারপর আপনি বলেছেন, বেলা দুটো বেজে দশ মিনিটের সময় আপনি ফোন পেয়ে অফিস থেকে ছুটে যান ট্যাক্সি নিয়ে বাড়িতে—

বলেছি তো!

তাও মিথ্যা।

মিথ্যা?

হ্যাঁ, তার আগেই একবার আপনি ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন-বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে।

আপনার কি মাথা খাবাপ হয়েছে? ঐ সময় আমি অফিসে কাজ করছিলাম—

বের হননি। আপনি অফিস থেকে একবার গত পরশু বেলা এগারোটা নাগাদ বলতে চান?

কিরীটীর প্রশ্নটা এত স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ যে মণিশঙ্করকে যেন কয়েকটা মুহুর্তের জন্য কেমন থমকে দেয়।

হ্যাঁ-বের হয়েছিলাম মৃদু গলায় জবাব দেয় মণিশঙ্কর, গোটা এগারোর সময়।

কখন ফিরেছিলেন আবার?

বেলা বারোটা নাগাদ।

না তার অনেক পরে আপনি ফিরেছেন।–বেলা দেড়টায়।

মোটেই নয়-আমি অফিসেই ছিলাম।

না, ঐ সময়টা আপনি অফিসে ছিলেন না।

ছিলাম না বুঝলেন কি করে?

বুঝেছি। কারণ তার সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে। এবারে বলুন কোথায় গিয়েছিলেন ঐ সময় আর কেনই বা ফিরতে আপনার অত দেরি হল?

অফিসের কাজে-মানে অফিসের একটা কাজে আমায় একটু বেরুতে হয়েছিল, এখন মনে পড়ছে।

মনে পড়েছে তাহলে! তাহলে বলুন। এখন, কোথায় বের হয়েছিলেন?

ডালহৌসিতেই অন্য একটা অফিসে।

সেটা কোথায় এবং কোন অফিসে?

হাডসন অ্যাণ্ড মেটার অফিসে।

সেখান থেকে পনের মিনিট বাদেই তো আপনি বের হয়ে আসেন।

হঠাৎ মণিশঙ্কর যেন আর একটা ধাক্কা খেল। কেমন যেন বিব্রত ও হতচকিত মনে হয় তাকে।

পরম বিস্ময়ের সঙ্গে সুদৰ্শন কিরীটীর মণিশঙ্করকে প্রশ্ন ও তার জবাবগুলো শুনছিল। কিরীটী মণিশঙ্করের মুখের দিকে তার শেষ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে তখনো স্থির দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মিঃ ঘোষাল আমার প্রশ্নের জবাবটা এখনো পাইনি!

মণিশঙ্কর চুপ।

আমি জানি মিঃ ঘোষাল, পরশু গোটা এগারোর সময় আপনি অফিস থেকে বের হয়ে হাডসন অ্যান্ড মেটার অফিসে গেলেও সেখান থেকে আপনি আপনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন।

না আমি যাইনি।

গিয়েছিলেন। আপনি-বলুন কেন গিয়েছিলেন?

আমি যাইনি।

আপনার গলার স্বর—আপনার মুখ বলছে আপনি গিয়েছিলেন, আর আমাদের অনুমান যে মিথ্যা নয়। তার প্রমাণ একজন আপনাকে দেখেছিল। ঐ সময় ফ্লট থেকে বের হয়ে আসতে।

কে-কে দেখেছে!

মিঃ স্বামীনাথনকে এ ঘরে আনাও তো সুদৰ্শন।

সুদৰ্শন কিরীটীর নির্দেশে উঠে গিয়ে বাইরে দণ্ডায়মান সার্জেণ্টকে বললে পাশের ঘর থেকে স্বামীনাথকে ডেকে আনতে।

মিঃ ঘোষাল, কিরীটী আবার বলে, সত্য আর গরলকে কখনো চেপে রাখা যায় না। কোনদিন-না-কোনদিন তা প্রকাশ হয়ে পড়েই।

কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, মণিশঙ্কর বলে ওঠে, আমি আমার স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করিনি!

কিন্তু আপনি গত পরশু এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে আপনার সি. আই টির ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। কিরীটী শান্ত গলায় আবার বলে।

ঐ সময় স্বামীনাথন একজন সার্জেন্টের সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকল।

মণিশঙ্করবাবু, একে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ, চিনি?

কে উনি?

আমার স্ত্রীর দেশের লোক।

আপনার স্ত্রী অর্থাৎ বিজিতা দেবী তাহলে ওঁকে ভাল করেই চিনতেন?

চিনত।

মধ্যে মধ্যে আপনাদের ফ্ল্যাটে উনি আসতেন?

স্বামীনাথন তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানায়, ইট’স এ ড্যাম লাই! মিথ্যা–

মিঃ স্বামীনাথন!

ইয়েস!

আপনি কতদিন ওঁদের ফ্ল্যাটের উপরের তলায় আছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে স্বামীনাথনকে।

মাত্র দিন-পনের হবে।

তার আগে কোথায় ছিলেন।

পোলক স্ট্রীটের একটা ফ্ল্যাটে।

কতদিন ছিলেন সেখানে?

প্রায় বছর দুই হবে।

হঠাৎ সেখান থেকে ঐ সি. আই টির ফ্ল্যাটে উঠে এলেন কেন?

ফ্ল্যাটটা ভাল-ভাড়া কম—বেশ সুবিধা—তাই।

তাই, না বিজিতা দেবীর সঙ্গে যাতে সব সময় দেখাসাক্ষাৎ হতে পারে সেইজন্যই ওখানে উঠে এসেছিলেন?

না, সেজন্য নয়; যেজন্য উঠে এসেছিলাম। সে তো বললাম।

বিজিতা দেবীর সঙ্গে আপনার অনেক দিনের আলাপ?

একই শহরে পাশাপাশি বাড়িতে অনেকদিন আমরা ছিলাম।

কলকাতায় কতদিন আছেন?

বছর তিনেক।

তার আগে?

মাদ্রাজে একটা অফিসে চাকরি করতাম।

বিজিতা দেবী শান্তিনিকেতনে চলে আসার পর আপনাদের পরস্পরের মধ্যে চিঠিপত্রের দেওয়া-নেওয়া ছিল?

ছিল।

মধ্যে মধ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন?

গিয়েছি, দুবার।

সমীরণ দত্ত—বিখ্যাত গাইয়েকে আপনি চেনেন?

চিনি।

আপনি বিজিতা দেবীকে ভালবাসতেন—তাই না?

স্বামীনাথন মাথাটা নীচু করে।

বলুন, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। ভালবাসার মধ্যে কোন অপরাধ নেই।

স্বামীনাথন তবু কোন জবাব দেয় না।

কিরীটীর হঠাৎ নজরে পড়ল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মণিশঙ্কর ঘোষাল স্বামীনাথনের মুখের দিকে।

বলুন! কিরীটী আবার বলে।

বাসতাম। কিন্তু—, থেমে গেল স্বামীনাখন!

কি, থামলেন কেন, বলুন?

যেদিন জানতে পেরেছিলাম মণিশঙ্করকে সে ভালবাসে, সেইদিন থেকেই নিজেকে আমি গুটিয়ে নিয়েছিলাম।

তাই যদি হবে তো ঐ একই ফ্ল্যাটে অত কাছাকাছি আবার এসে উঠেছিলেন কেন মিঃ স্বামীনাথন? কিরীটী প্রশ্নটা করে ওর মুখের দিকে তাকাল।

আজ বুঝতে পারছি। ভুল করেছি।

ভুল?

তাই। হয়তো আমি ওইভাবে ওখানে এসে না উঠলে তাকে আজ আমন পৈশাচিক নৃশংস মৃত্যু বরণ করতে হত না।

মিঃ স্বামীনাথন, গত পরশু বেলা দশটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করল।

আগেই তো বলেছি, আমি পরশু কলকাতার বাইরে ছিলাম। স্বামীনাথন বললে।

কিন্তু আমি যদি বলি আপনি মিথ্যে বলছেন!

মিথ্যে?

হ্যাঁ, ওই সময়টা আপনি আপনার ফ্ল্যাটেই ছিলেন।

না, না-আই ওয়াজ আউট অফ ক্যালকাটা!

না—স্টীল ইউ আর ডিনাইং দি ফ্যাক্টস! এখনো সত্য বলুন?

আ-আমি আগের দিনই সকলে বের হয়ে যাই—

হয়তো গিয়েছিলেন, তবে আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো গত পরশু আবার ফিরে এসেছিলেন। দেখুন। মিঃ স্বামীনাথন, হাজারটা মিথ্যে দিয়েও একটা নিষ্ঠুর সত্যকে আপনি চাপা দিতে পারবেন না। পুলিসের পক্ষে জানা অসম্ভব হবে না। সত্যিই ওই সময়টায় আপনি কোথায় ছিলেন, আজ বা কাল তারা সেটা জানতে পারবেই। হত্যাকারী যে-সময় বিজিতা দেবী ও তার শিশুসন্তানকে হত্যা করে বের হয়ে যায়, আপনি তাকে সিঁড়িতে দেখেছিলেন। তাই নয় কি? চুপ করে থাকবেন না, বলুন speak out!

হ্যাঁ, একজনকে আমি দেখেছি।

তাহলে গত পরশু সময়টাতে আপনি ফ্ল্যাটেই ছিলেন?

না।

ছিলেন না?

না, আমি পৌনে একটা নাগাদ ফিরে এসে যখন সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠেছি তখন একজনকে দ্রুত আমার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখেছিলাম।

কে সে?

ঠিক চিনতে পারিনি।

তার পরনে কি ছিল?

সুট পরা ছিল।

লম্বা না বেঁটে?

লম্বাই হবে সে।

সত্যিই তাকে আপনি চিনতে পারেন নি?

না।
কিরীটী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললে, এবারে সমীরণ দত্তকে নিয়ে এস, সুদৰ্শন।–

সুদৰ্শন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

এবং একটু পরেই সমীরণকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।

মিঃ স্বামীনাথন!

স্বামীনাথন কিরীটীর ডাকে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল।

এঁকে চেনেন আপনি? সমীরণকে দেখিয়ে বললে।

না।

সমীরণবাবু?

সমীরণ তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

স্বামীনাথনকে দেখিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করল, একে আপনি চেনেন সমীরণবাবু?

না, চিনি না।

কখনো দেখেননি আগে?

কোন দিন উনি শান্তিনিকেতনে যাননি, যখন আপনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন?

দেখিনি যেতে।

বিজিতা দেবীর মুখে কখনো ওঁর কথা শোনেননি?

না।

ভাল করে ভেবে বলুন! সত্যিই কখনো ওঁকে আপনি দেখেননি?

সমীরণ চুপ করে থাকে।

কিন্তু আমার ধারণা ওঁকে আপনি দেখেছেন আগে—

ঠিক মনে পড়ছে না—তবে–

বলুন?

একবার যেন মনে হচ্ছে দেখেছিলাম।

কবে?

মাসখানেক আগে।

কোথায়?

বিজিতাকে আমার ফ্ল্যাটে উনি ওঁর গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন।

গাড়ি!

হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। কিরীটীর চোখের মণি দুটো যেন ঝকঝক করে ওঠে, বলে, কিরকম গাড়ি? কি রং ছিল গাড়িটার?

বোধ হয় একটা কালো রংয়ের অ্যামবাসাডার।

কালো রংয়ের অ্যামবাসাডার!

মিঃ স্বামীনাথন, আপনার গাড়ি আছে?

অফিস থেকে ব্যবহারের জন আমাকে একটা গাড়ি দিয়েছে।

গত পরশু তাহলে দুপুরে সেই গাড়িতে করেই আপনি সি. আই. টি. র ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন?

না, গাড়ি গত পরশু আমি ব্যবহার করিনি।

তবে কিসে গিয়েছিলেন?

ট্যাক্সিতে।

আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।

মিথ্যা আমি বলছি না—কিছুদিন ধরেই রিপেয়ারের জন্য গাড়িটা গ্যারেজে আছে।

কোন গ্যারেজে?

নিউ অটোমোবাইলস গ্যারেজে।

কিরীটী এবারে ফিরে তাকাল সুদর্শনের দিকে, ঐ গ্যারেজে ফোন করে একটা খবর নাও তো গাড়িটা সম্পর্কে!

সুদৰ্শন ফোন করল।

…কি বললেন? গাড়িটা পরশুই ডেলিভারি হয়ে গিয়েছে। আই সি, আচ্ছা। ধন্যবাদ।

দাদা, ওরা বলল গাড়িটা নাকি পরশুই সকালে ডেলিভারি দিয়ে দিয়েছে!

মিঃ স্বামীনাথন? কিরীটী তাকাল স্বামীনাথনের দিকে।

হতে পারে-অফিস হয়তো ডেলিভারি নিয়েছে—আমি জানি না।

কিরীটীর দৃষ্টি তীক্ষ—ও চেয়ে আছে স্বামীনাথনের মুখের দিকে।

মিস্টার স্বামীনাথন, আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে!

কেন বলুন তো?

বিজিতা দেবী ও তাঁর শিশুসন্তান এবং মিঃ বোসকে হত্যা করার অপরাধে।

কি পাগলের মত যা-তা বলছেন!

আমরা যে পাগলের মত যা-তা কিছু বলছি না-আদালতে সেটা প্রমাণ করতে পারব আমরা। সুদৰ্শন ওঁকে পাশের ঘরে নিয়ে যাও।

সুদৰ্শন স্বামীনাথনকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

কথাটা বলেই কিরীটী সমীরণের দিকে তাকাল, সমীরণবাবু, এবারে বলুন—বিজিতা দেবীর চিঠি পাওয়ার পর সেখানে গিয়ে তার ঘরের দরজা বন্ধ দেখে আপনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন-কাউকেই আপনি দেখেননি?

সমীরণ চুপ।

চুপ করে থাকবেন না, বলন। আই অ্যাম সিওর, ইউ মেটু সাম ওয়ান—

সমীরণ তথাপি চুপ।

ইউ মেটু সাম ওয়ান অ্যান্ড ইট ওয়াজ—আমি বলছি আপনি দেখেছিলেন মিঃ ঘোষালকে। ডিড নট ইউ! বলুন—স্পীক আউট দি ট্রথ!

হ্যাঁ-দেখেছি, কিন্তু একটা সুটকেস হাতে উনি এত তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন যে আমাকে হয়তো ভাল করে নজরই করেননি।

তাহলে সুটকেসটা তখন মিঃ ঘোষালের হাতে দেখেছিলেন!

হ্যাঁ!

হোয়াই ডিডনট ইউ টেল দি ট্ৰথ দেন?

আমি–

বলুন?

আমি ভেবেছিলাম মণিশঙ্করই হয়তো হত্যা করেছে—

কাকে?

বিজিতাকে।

আপনি তো তখনো জানেন না যে বিজিতা দেবী নিহত? আপনি তাহলে মিথ্যা বলেছেন? ঘরের দরজা বন্ধ দেখে এবং দরজা থেকে ডাকা সত্ত্বেও খুলল না দেখে যে ফিরে এসেছেন—সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা?

হ্যাঁ।

বলুন তাহলে কি দেখেছিলেন?

মণিশঙ্করের ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলাই ছিল—খোলা দরজার পাশেই সামনে দাঁড়াতেই মৃতদেহ দুটো রক্তে ভাসছে আমি দেখতে পেয়েছিলাম—

তারপর?

আমার ধারণা হয়েছিল মণিশঙ্কর ই

তার স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করেছে?

হ্যাঁ

তারপর?

দরজাটা টেনে দিয়ে লোক করে আমি চলে আসি।

কিরীটিৗ এবারে মণিশঙ্করের দিকে তাকাল, মণিশঙ্করবাবু, এবারে আপনি বলুন, যা সত্যি গতকাল ঘটেছিল—সব কথা।

আমি তো ঘরের মধ্যে ঢুকে–

হ্যাঁ। মাথা ঘুরে গেল আমার–

মণিশঙ্করবাবু, আপনি খুব উঁচুদরের অভিনেতা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমরাও কিছু কিছু নাটক সৃষ্টি করতে যেমন জানি তেমন অভিনয়ও করতে জানি।

কি বললেন?

নাটক আর অভিনয়ের কথা–

আমি ঠিক—

বুঝতে পারছেন না। আমার কথাগুলো, তাই না?

হ্যাঁ, মানে–

বুঝতে পারবেন যখন ফাঁসির দড়িটা গলায় এঁটে বসবে।

ফাসি!

হ্যাঁ, ডায়াবলিক্যাল মার্ডা কেসে আসামীদের জন্য ইনডিয়ান পেনাল কোডের পাতায় যে শক্তির বিধান লেখা আছে সেটা হচ্ছে টু বি হ্যাংড বাই নেক টিল। ডেথ—ফাঁসি— ভাবছেন নিশ্চয়ই। তবে এতক্ষণ কি শুনলাম—কি দেখলাম–

আমি–

হ্যাঁ, আপনি যেমন দেখেছেন শুনেছেন—তেমনি আমারও আপনার মনের ঐ মুহুর্তের কথাটা না শুনতে পেলেও আপনার দু চোখ যে উল্লাসের দৃষ্টি দেখেছি—স্বামীনাথনকে অ্যারেস্ট করবার সময়ে মার্ডার চার্জে, সেটা আমার কাছে নিষ্ঠুর সত্যকে উদ্‌ঘাটিত করে দিয়েছে–আর আমার অভিনয়টুকুও সেইজন্যেই করা-কিন্তু এখন আপনি বুঝতে পারছেন—হোয়াট এ ব্লান্ডার ইউ হ্যাভ ডান—কত বড় ভুল আপনি করেছেন!

মণিশঙ্কর ঘোষাল যেন একেবারে পাথর!

কিরীটী বলতে থাকে—যে ভিন্ন প্রদেশের মেয়েটি ভালবেসে আপনার হাতে সর্বস্ব তুলে দিয়েছিল, যার ভালবাসার মধ্যে এতটুক খাদ ছিল না, তাকে এবং সেইসঙ্গে আপনার নিজের ঔরসজাত সন্তানকে হত্যা করলেন কি করে? একটি বারের জন্যে হাত আপনার কাঁপল না?

না, কাঁপেনি—হঠাৎ মণিশঙ্কর বলে ওঠে, সী ওয়াজ এ হারলট-বিশ্বাসঘাতিনী, আর ঐ সন্তানও আমার নয়, সমীরণের-আমি জানি, আমি জানি—ঠিক সমীরণের গায়ের রঙ— ঠিক ওরই মত চোখ-মুখ—

মণিশঙ্কর!

অস্ফুট কণ্ঠে যেন আর্তনাদ করে ওঠে সমীরণ হঠাৎ।

হ্যাঁ—হ্যাঁ, তুমি-তুমিই, আমার ঘরে আগুন জ্বেলে দিয়েছ সমীরণ-তোমার জন্য বিজিতা কোন দিনই আমাকে ভালবাসতে পারেনি—আমার বুকে মাথা রেখে সে তোমারই কথা ভেবেছে–

না, না—মণি, না—আমি–

দিনের পর দিন তুমি তাকে চিঠি লিখেছ—আমার মানা সত্ত্বেও সে লুকিয়ে তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছে ফ্ল্যাটে—বল, বল সমীরণ সেও মিথ্যে—সেও ভুল!

ভুল হ্যাঁ, ভুল তোমার—সব মিথ্যা—

না, ভুল নয়—বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকে চিনতে কোন স্বামীরই ভুল হয় না কোন দিন। তুমি আমার মনের শান্তি—ঘুম সব কেড়ে নিয়েছিলে, কিন্তু পরশু আর কাল রাত্রে অনেকদিন পরে আমি ঘুমিয়েছি—আর জান, তোমারই একদা প্রেজেন্টেশান করা মহীশূর থেকে আমার জন্য আনা ছোরা দুটোর একটা দিয়ে তোমার বিজিতাকে আমি হত্যা করেছি!

কিন্তু মিঃ বোসকে আপনি হত্যা করলেন কেন? কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে।

সে আমায় বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিল—

তাই তাকেও হত্যা করলেন?

হ্যাঁ, ইচ্ছা ছিল ওকেও ঐ সমীরণকে হত্যা করব, সেই কারণেই অন্য ছোরাটা আমি–রেখে দিয়েছিলাম-কিন্তু ওর বাড়িতে গিয়ে শুনলাম ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসা হয়েছে; আমি যা করেছি। স্বেচ্ছায় করেছি—অ্যান্ড আই কিল্ড দেম ডেলিবারেটলি! ফাঁসির কথা বলছিলেন না? নাউ আই অ্যাম রেডি ফর দ্যাট!

সুদৰ্শন বলে ওঠে, হাউ ফ্যানটাস্টিক—হাউ হরিবল!

হাঃ হাঃ করে হঠাৎ ঐ সময় পাগলের মতই যেন হেসে ওঠে মণিশঙ্কর, তারপর বলে, খুব অবাক হয়ে গিয়েছেন ইন্সপেক্টর, তাই না?

কথাটা বলে মণিশঙ্কর সুদর্শনের দিকে তাকাল। মণিশঙ্করের চোখেমুখে তখনো হাসি।

সুদৰ্শন ভাবে, লোকটা বিকৃতমস্তিক নয় তো!

মে আই হ্যাভ এ সিগারেট? একটা সিগারেট খেতে পারি স্যার? মণিশঙ্কর বলল।

খান—সুদৰ্শন বলে। মণিশঙ্কর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো, কিন্তু গোটা দুই টান দিতেই টলে পড়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

মণিশঙ্কর বলে, চললাম স্যার, গুড বাই—মণিশঙ্করের চোখ বুজল।

সুদৰ্শন বাসাতে বসে পরের দিন সন্ধ্যায় সি. আই. টি. র ফ্ল্যাটের হত্যা-ব্যাপারটা নিয়েই কিরীটী আলোচনা করছিল। সামনে পাশাপাশি একটা সোফায় বসে সাবিত্রী ও সুদৰ্শন।

একসময় সুদৰ্শন বললে, প্রথম থেকেই কি আপনার মণিশঙ্করের ওপরে সন্দেহ পড়েছিল দাদা?

কিরীটী বললে, বলতে পার তোমার মুখে সব কথা শোনবার পরই মণিশঙ্করের ওপর আমার সন্দেহ জাগে মনে–

কেন?

প্রথমতঃ মণিশঙ্করের অতগুলো চাবিসমেত চাবির রিংটাই রীতিমত একটা খট্‌কা জাগায় আমার মনে, যেটা তার পকেট থেকে বের হয় ও সে বলে সেটা একটা ড়ুপলিকেট চাবির রিং। ঐ চাবির রিংয়ের মধ্যেই ছিল দুটো চাবি অর্থাৎ একটা আলমারির ও অন্যটা সদর দরজার। মনে করে দেখ–

হ্যাঁ, মনে পড়ছে–

মণিশঙ্কর বলেছিল, চাবি তার স্ত্রীর কাছেই থাকত। কথাটা হয়তো মিথ্যা নয়—সেটাই স্বাভাবিক। এবং ড়ুপলিকেট চাবি থাকলেও একমাত্র সদর দরজার চাবিই থাকত, তাই বলে রিংয়ের মধ্যে অন্যান্য চাবিও থাকবে কেন, বিশেষ করে ঘরের আলমারির চাবি-কাজেই ঐ চাবির রিং মণিশঙ্করের সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যাবার কোন যুক্তিও নেই। সেদিন অর্থাৎ দুর্ঘটনার দিন দ্বিপ্রহরে মণিশঙ্কর আসে তার ফ্ল্যাটে তার পূর্ব-পরিকল্পনা মত—বিজিতা দেবীর মনে তার ঐভাবে হঠাৎ আসার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নিশ্চয় জাগেনি এবং সে কল্পনাও করতে পারেনি যে তার স্বামী তাকে হত্যা করবার জন্যেই এসেছে, বিশেষ করে ঐ সময়, নিষ্ঠুর একটা সংকল্প নিয়ে। মণিশঙ্কর অতর্কিতে বিজিতাকে আঘাত করে হত্যা করে হয়তো পিছন থেকে—তারপর শিশুটি পাছে সব কথা প্রকাশ করে দেয়। সেই ভয়ে তাকেও হত্যা করে। হত্যার পর সে বেশ বদলিয়ে রক্তাক্ত জামা-কাপড় সুটকেসটায় নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়। সে স্বামীনাথনের গাড়িটা আগেই গ্যারেজ থেকে delivery নিয়েছিল— সব দোষটা তার ঘাড়ে চাপানোর জন্য—এবং তা না হলে সমীরণের ঘাড়ে চাপানোর জন্য সে সুটকেসটা তার ফ্ল্যাটে রেখে এসেছিল; কিন্তু একটা মারাত্মক ভুল সে করল যেটা আমার তাকে দ্বিতীয় সন্দেহের কারণ—

ভুল!

হ্যাঁ, চাবির রিংটা সঙ্গে নিয়ে গিয়ে! চাবির রিংটা যদি সে সঙ্গে না নিয়ে যেত, হয়তো ব্যাপারটা এত শীঘ্ৰ আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠত না। এবং ব্যাপারটা যে কোনরকম বার্গালারি নয় যখনই বুঝতে পারলাম তোমার কথায়, তখুনি বুঝেছিলাম এটা স্পষ্ট একটা নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপার। তোমারও সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, অবিশ্যি—

সন্দেহ যে একেবারে হয়নি তা নয়, হয়েছিল-কিন্তু—

তুমি ভাবতে পারনি যে স্বামী হয়ে নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করতে পারে কেউ, তাই না!

তাই, দাদা।

কিন্তু সন্দেহের মত বিষ আর নেই ভাই, বিশেষ করে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে এ দুনিয়ায়। মনের মধ্যে একবার সন্দেহ জাগলে কোন একজনের, তার বিষ সমস্ত মনকে বিষাক্ত করে তোলে-তাই যখন মণিশঙ্কর হত্যা করেছিল তার নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে তখন তার সমস্ত শুভবুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা লোপ পেয়েছিল। যার ফলে তার মধ্যে momentary insanity dovelop করেছিল—তারপরই সে ঐ নিষ্ঠুর কাজে লিপ্ত হয়।

কি জান ভাই, মানুষের শুভবুদ্ধি যখন তাকে ত্যাগ করে তখন সে কোনটা ন্যায়— কোনটা অন্যায় সে-বিবেচনাটুকুও হারিয়ে ফেলে। আর তার ফলে যে মানুষ তখন কোন স্তরে গিয়ে দাঁড়ায় আজকের দিনে তারও প্রমাণের অভাব নেই তোমার চারপাশে। কিন্তু আর ঐ প্রসঙ্গ নয়, মণিশঙ্কর তার পাপের মাসূল নিজেই হাত পেতে নিয়েছে সেই একজনের অলঙঘ্য বিচারে ও নির্দেশে—

সাবিত্রী এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, দু চোখে তার জল, স্নান কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য!

কিরীটী মৃদু হেসে বলল, মানুষের চরিত্র সত্যিই আশ্চর্য সাবিত্রী! আরো যত বয়স হবে দেখবে—আরো জানবে—আরো

দাদা! সাবিত্রী ডাকে।

বল? কিরীটী জবাব দেয়।

চা আনি?

নিশ্চয়ই। অবিলম্বে।-গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে।

সাবিত্রী উঠে গেল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত