অচেনা পাহাড়

অচেনা পাহাড়

কথা ছিল গুলসাখালি গিয়ে নৌকো ধরা হবে। সন্ধের আগে হঠাৎ চমৎকার দক্ষিণা বাতাস পেয়ে পাল তুলে দিয়েছিল ওরা। ঢেউ ভেঙে নৌকো তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। নাইয়ারা দাঁড় টানায় বিরতি পেয়ে গলুই আর ছইয়ের ওপর বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। কাপ্তাই থেকে কাঠ বোঝাই করার জন্যে বুড়িঘাট যাচ্ছে নৌকো। দুপুরে রাঙামাটি ধরে ঘণ্টাখানেক রিজার্ভ বাজারে বেড়িয়ে ভাত টাত খেয়ে জোহরের শেষ ওয়াক্তে ফের ছেড়েছে। দিনে দিনে বুড়িঘাট পৌঁছা সম্ভব নয়, তাই গুলসাখালি গিয়ে রাত কাটানোর ইচ্ছে তাদের।

চৈত্রের শেষ। শীত চলে গেছে। গরম পড়তে শুরু করেছে। তবে শেষ বিকেলে বাতাস ঠাণ্ডা। আরামের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে। নাইয়ারা বিড়ি খাচ্ছে, একজন গলুইয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে গান জুড়ে দিয়েছে, ‘ন’ মাতাই ন’ বোলাই গেলি রে বন্ধুয়া, মনর আশা ন’ পুরালি…’
বাতাসের টানে নৌকো দাঁড়টানার চেয়ে দ্রুত চলে। গুলসাখালি পৌঁছে গেল তাই সন্ধের আগেই। গুলসাখালির পর একটা মাঝারি রকমের ফাড়ি। ফাড়ি পেরিয়ে দু’দিকের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ঘণ্টাখানেক গেলেই বুড়িঘাট।
ঝিরি ঝিরি বাতাসে তর তর করে এগিয়ে চলেছে নৌকো। গুলসাখালি ছোটখাট একটা বাজারের মতো। পাহাড়ীরা প্রতিদিন কলা বেচে এখানে। রাঙামাটি থেকে ব্যাপারীরা এসে কলা কিনে নিয়ে যায়। সকাল বেলাটায় গম গম করে। পাহাড়ীদের কলা বয়ে আনা ছোট ছোট নৌকো আর রাঙামাটিতে বোঝাই করে নেয়ার জন্যে আসা অসংখ্য সাম্পান। স্পিড বোট টোটও আসে দু’চারটা। বেচাকেনার হৈ চৈ, সাম্পানের ক্যাঁক্কোরোৎ আর স্পিডবোটের ভট ভট মিলে জায়গাটা একটা বাজারের রূপ নেয়। দুপুরের দিকে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে, আবার বিকেলের দিকে জেগে ওঠে। এসময়টায় বড় বড় সরঙ্গা আর কিস্তি নৌকো এসে ভেড়ে। ওপর থেকে কাপ্তাইগামী মালবোঝাই আর কাপ্তাই-রাঙামাটি থেকে বুড়িঘাট, নানিয়ার চরগামী খালি নৌকো। রাতটা এখানেই কাটায় নাইয়া-মাঝিরা। খান দু’তিনেক দোকান তাই ভালই চলে।
চমৎকার দক্ষিণা বাতাসে পাল উড়ছে পেট ফুলিয়ে। সন্ধের সোনালি রঙ ধরেছে পশ্চিম আকাশে। পুব আর পশ্চিম দিকে মাথা তুলে আছে বড় বড় পাহাড়। সন্ধে তারাটা সবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নৌকো চলে এল গুলসাখালি বাজারের পাশে।
হালে বসা মাঝি বিড়ি টানছে ফুক ফুক করে। গুলসাখালি বাজারে রাত কাটাতে হলে নৌকো পশ্চিম দিকে মোড় নেয়ার কথা। কিন্তু নৌকো চলছে সোজা। উত্তর দিকে।
‘কী ব্যাপার, গুলসাখালি ফেলে যাচ্ছি তো!’ নাইয়াদের একজন মাঝির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ‘বুড়িঘাট চলে যাবা নাকি?’
‘দেখ,’ হাসল মাঝি। আধখাওয়া বিড়িটা ফেলে দিয়ে ফস করে ম্যাচ মেরে আরেকটা ধরাল। ‘এমন সুন্দর বাতাস। এরকম টানলে ফাড়ি পেরোতে লাগবে বড়জোর ঘণ্টা দেড়েক। ফাড়ি পেরিয়ে চাউম্যা মাস্টারের টিলায় গিয়ে নৌকো ধরব। সেখান থেকে একটু সকাল সকাল উঠে নাও ছাড়লে আটটা বাজার আগেই বুড়িঘাট। সকালে গরম গরম পরোটা আর চা। আর এখানে থাকলে কাল সকালে উঠে দাঁড় টানতে টানতে গরমে জান বেরিয়ে যাবে।’
নাইয়ারা দেখল, মাঝির কথায় যুক্তি আছে। তাই তারাও একমত হয়ে গেল। নৌকো তর তর করে এগিয়ে চলল। মিনিট পনেরো পরেই ফাড়িতে গিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে দু’দিকের পাহাড় দূরে সরে যেতে লাগল। সন্ধে মিলিয়ে গিয়ে নেমে এল রাতের আঁধার। চাঁদ নেই। আকাশে মেলা বসাতে শুরু করেছে তারারা। পশ্চিম দিকের আকাশ লাল রঙ হারিয়ে এখন ধূসর কালো। বাতাস কমে এসেছে কিছুটা। পেট ফুলিয়ে ওড়া পালের রশিতে ঢিলে ভাব। নৌকোর গতি পড়ে গেছে অনেকটা। তবে ফাড়ির অর্ধেকটা চলে এসেছে। আর মিনিট বিশেক চললেই ফাড়ি পেরিয়ে যাবে।
নাইয়াদের একজনের নাম গোলাপ। সবার আগে সেই খেয়াল করল উত্তর-পশ্চিম কোনায় জমে ওঠা মেঘটা। ডাক দিল হালে বসে গুন গুন করে বিরহের গান গাইতে থাকা মাঝিকে। ‘কালাভাই, অবস্থা ভাল না কিন্তু।’
‘কেন, কী হয়েছে?’ গান থেমে গেল মাঝির।
‘দেখো,’ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকা মেঘটার দিকে হাত উঁচাল গোলাপ। ‘মনে হয়, তুফান ছুটবে।’
দেখল মাঝি। মুখ শুকিয়ে গেল তারও। তবে পাত্তা দিল না নাইয়ার কথায়। ‘দূর, ওই মেঘে কিছু হবে না। তুফান ছুটতে ছুটতে আমরা ফাড়ি পেরিয়ে যাব দেখিস।’
বলতে না বলতে হুট করে বাতাস পড়ে গেল। চুপসে গেল এতক্ষণ ধরে পেট ফুলিয়ে উড়তে থাকা পাল। মাঝি হুকুম দেয়ার আগেই দাঁড়ে গেল নাইয়ারা। টানতে শুরু করল।
আচমকা আকাশ চিড়ে বিজলী চমকাল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে শুরু হলো দমকা বাতাস। গলুই থেকে মাঝির উদ্দেশে চেঁচাল গোলাপ, ‘কালাভাই, পশ্চিম দিকে চলো। একটা ঘোনা টোনা ধরে নাও। নইলে কইলাম…’
ওর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই হলদেটে আগুনের চাবুক হানল যেন কেউ কালো মেঘের বুকে। গুড়–ম করে গর্জে উঠল আকাশ। হাল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মাঝি। বিড় বিড় করে কলেমা পড়ল, ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু….’
নাইয়াদের মধ্যে আরেক জনের নাম ছগীর। একটু মোল্লা টাইপের ছেলেটা। সেও বিড় বিড় করে উঠল, ‘লা হাওলা অলা কুওয়াতা…’
নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে কালা মাঝি। উত্তর দিক থেকে প্রচ- বাতাস শুরু হয়ে গেছে। বাতাসের ঝাপ্টায় উড়িয়ে নেবে মনে হচ্ছে। শক্ত করে হাল ধরে আছে সে। প্রকা- কিস্তি নৌকো দাঁড়িয়ে গেছে বাতাসের বাধার মুখে। মনে হয় পেছাতে শুরু করেছে। ‘টান!’ দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল সে। জানে, নৌকো একবার পেছাতে শুরু করলে আর সামলানো যাবে না। স্পিডবোটের গতিতে ছুটে গিয়ে ডুবো কোনো পাহাড়ে গিয়ে চড়ে বসবে। নইলে পেছনে যে পাহাড়গুলো ফেলে এসেছে, সেগুলোর কোনো একটায় গিয়ে আছড়ে পড়বে।
বলার দরকার নেই। নাইয়ারা কেউ নতুন নয়। কাপ্তাই লেকে নৌকো নিয়ে ঘোরে বারোমাস। জানে আচমকা তুফানে পড়লে কী করতে হয়। নৌকো তিন দাঁড়ের টানে পিছু হটা থামিয়ে ইঞ্চি করে এগোতে শুরু করেছে। সরাসরি উত্তর-পশ্চিম কোণ বরাবর মুখ করে হাল ধরে আছে মাঝি। আস্তে আস্তে পশ্চিমের পাহাড়ের কোলে গিয়ে ভেড়ানোর চেষ্টা। অন্ধকারে পাহাড়গুলোকে একাকার মনে হলেও অসংখ্য ফাঁকফোঁকর রয়েছে তাতে। সেগুলোর কোনো একটা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত। বাইরে টর্নেডো বয়ে গেলেও পাহাড়ের ভেতরের পানি পুকুরের মতো শান্ত।
বাতাসের গতি কমছে না। তার সাথে এখন শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বজ্র-বাতাসে ফাড়ির পানিতে বিশাল বিশাল ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। বৃষ্টির ছাট ছুরির ফলার মতো এসে লাগছে মুখে, পিঠে। মাঝি হাল থেকে হেঁকে উঠল, ‘আল্লা আল্লা আল্লা! এ–হে…’
গলুইয়ে জান পানি করে দাঁড় টানতে থাকা নাইয়ারা দোহার ধরল তার সাথে, ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু…মুহাম্মাদুর রাছুলুল্লা……
ছগীর দাঁড়ের টানে টানে জিকির শুরু করেছে, ‘ ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু… ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু…’
আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে। কতক্ষণ আগেও তারাজ্বলা আকাশটাকে এখন দেখে মনে হচ্ছে আলকাতরার প্রলেপ দেয়া বিশাল শ্লেটের মতো। বৃষ্টির ছাটে চোখ মেলতে পারছে না কালা মাঝি। পুব-পশ্চিমের পাহাড়গুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কালা মাঝি জানে না কোথায় যাচ্ছে নৌকো। কিন্তু যেখানেই যাক, হালটা সোজা করে ধরে আছে। জানে, একটু এদিক ওদিকে করা যাবে না। হাল সোজা করে ধরে রাখতে পারলে নৌকো একসময় পশ্চিমের পাহাড়ের কোলে গিয়ে থামবেই।
খাটানো পাল গোটানোার সময় পায়নি ওরা। বাতাসে ছিড়ে ফেঁড়ে গেছে সুতোর তৈরি পাল। ছিঁড়ে গেছে রশি। এখন বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে ঝুলছে মাস্তুল থেকে।
চৈত্র কিংবা বৈশাখী ঝড় এই আসে এই চলে যায়। আধঘণ্টার মধ্যে ঝড় থেমে গিয়ে আকাশে তারা ফুটে ওঠে ফের। কিন্তু আজ কী যেন হয়েছে। বাতাস-বৃষ্টি থামছেই না। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছে কালা মাঝি। গলুইয়ে ছগীরের কণ্ঠে জিকির, বিরাম নেই।
আস্তে আস্তে পশ্চিমের পাহাড়গুলোর আবছা অবয়ব দেখা যেতে শুরু করেছে। দোয়া পড়ার গতি বাড়িয়ে দিল কালা মাঝি। কোনোমতে পাহাড়ের কাছে যেতে পারলেই হয়। সামনে যে ঘোনাটা আগে চোখে পড়বে, ওখান দিয়েই ঢুকিয়ে দেবে নৌকো।
কাপ্তাই লেকে মাঝিগিরি করছে কালা মাঝি প্রায় পনেরো বছর ধরে। কাপÍাই থেকে ওপরে মাইনি, মারিস্যা, বরকল, নানিয়ার চর, সাজেক, যমুনাছড়িসহ অসংখ্য জায়গায় তার যাতায়াত। বুড়িঘাট গিয়েছে কতবার তার হিসেব নেই। কিন্তু বুড়িঘাটের আগে এই ফাড়িটার পশ্চিম দিকের পাহাড়গুলোর ভেতরে কখনো ঢোকেনি। গুলসাখালি বাজারের কাছাকাছি অনেকগুলো চাকমা পাড়া। নৌকো বোঝাই করার জন্যে সেসব পাড়ায় অনেক বার গিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমের এই পাহাড়গুলো তার সম্পূর্ণ অচেনা। অসংখ্যবার এই ফাড়ি পেরোনোর সময় পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থেকেছে। ছোট-বড় কোনো ধরনের নৌকো-সাম্পানকে কখনো দেখেনি এসব পাহাড়ের ধারে কাছেও। কিন্তু এখন অজানা ওই পাহাড়গুলোর দিকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না সে। তাতে অবশ্য ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পুরো হিলট্রাক্টস তার চেনা। অনেক নির্জন জায়গায়, পাহাড়ের গভীর ঘোনায় রাত কাটিয়েছে নৌকো নিয়ে।
বৃষ্টির বিরাম নেই। তার সাথে কলজে কাঁপানো ঠা-া বাতাস। কাঁপছে কালা মাঝি। দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে ঠক ঠক করে। চৈত্র মাস প্রায় শেষ হয়ে এলেও প্রকৃতিতে শীতের ভাব লুকিয়ে আছে এখনো। অন্য সময় টের পাওয়া যায় না। কিন্তু এখন বৃষ্টি আর বাতাসের সাথে মিতালী পাতিয়েছে যেন।
ঝপাঝপ দাঁড় পড়ছে পানিতে। দাঁড়ের চ্যাপ্টা পাতা পানিতে খাড়া করে ফেলে পেছনে হেলে গিয়ে হ্যাঁচকা টান। উল্টে গিয়ে পাক খেয়ে ওঠে পানি। নৌকো সামনে এগোয়। কিন্তু এখন এগোচ্ছে কি না বুঝতে পারছে না গোলাপ। তবে এগোক না এগোক, দাঁড় টানায় ক্ষান্ত দেয়া যাবে না। তাহলে নৌকো পেছাতে শুরু করবে। আর একবার পেছাতে শুরু করলে আয়ত্তে থাকবে না। সুতরাং সামনে এগোনো চালু রাখতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড় টানছে তারা তিন নাইয়া। মাঝির এখানে কিছু করার নেই।
ওরা জানে, নৌকো সামনে এগোচ্ছে না। পাশে চলেছে। লাইলাহা ইল্লাল্লাহু জিকির করছে ছগীর দাঁড় টানতে টানতে। আরেক নাইয়া কেরামত মাঝে মধ্যে সাবাস বলে উৎসাহ দিচ্ছে সহকর্মীদের। দাঁড় টানতে টানতে পশ্চিম দিকে তাকাচ্ছে ওরা। দেখতে চাইছে পশ্চিমের পাহাড়গুলো আর কতদূরে। কোনো মতে ওই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে আর ভয় নেই। একটা ঘোনায় ঢুকে নৌকো বেঁধে ফেলতে পারলে স্বস্তি।
স্পষ্ট হয়ে উঠছে পাহাড়শ্রেণী। তীর বেগে তাদের দিকেই ছুটে আসছে যেন। এর মানে হলো বাতাসের ঠেলায় নৌকোই ছুটেছে ওই পাহাড়ের দিকে। হাল থেকে মাঝি চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই কেরামত্যা, লগি ল’, লগি ল’। গোলাপ, তুই পাছায় চলে আয়। ছগীর, মাঝখান দিয়ে ধর লগি। সাবধান নৌকো পাহাড়ের সাথে যেন ধাক্কা না খায়। তাইলে কইলাম ফেটে যাবে।’
তিনজনে দাঁড় ছেড়ে দিয়ে তিনটা লগি নিয়ে তৈরি হলো। নৌকো পাহাড়ের কাছে আসতে লগি ফেলল পানিতে। এরই মধ্যে অবশ্য বাতাস পড়ে এসেছে কিছুটা। তিন লগির প্রতিরোধে বেগ কমে এল নৌকোর। ধীরে ধীরে ভিড়ে গেল পাহাড়ের সাথে।
‘সামনে, সামনে,’ আবার চেঁচাল মাঝি। ‘পেছনে ঘোনার মুখ নেই। সামনে এগো।’
লগি তুলে নিয়ে এবার পেছনে ফেলল তিন নাইয়া। তিন লগির ঠেলায় নৌকো সামনে এগোতে লাগল। কিছুদূর যেতেই দেখা গেল ঘোনার মুখ। বাম পাশ থেকে এবার ডান পাশে লগি ফেলল গলুইয়ে দাঁড়ানো কেরামত। কিন্তু অঠাঁই পানিতে লগি ধরার সুবিধে হলো না। লগি ফেলে ডানদিকের দাঁড়ে টান দিল সে। বাম দিক থেকে লগির ঠেলায় নৌকোর পাছা ঘুরে গেল, ডানদিকের দাঁড়ের টানে গলুই ঢুকে গেল ঘোনার মুখে। একটু পরে তিন দাঁড়ের টানে ঢুকে গেল ভেতরে।
‘উহ্! আল্লাই বাঁচাইছে।’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ছগীর। ‘আর ভয় নাই।’ জিকিরে বিরতি দিয়ে হাঁফাচ্ছে সে। ‘কী কও, গোলাপ ভাই?’
গোলাপ কিছু বলার আগেই ছইয়ের ওপর থেকে সায় দিল মাঝি। ‘হরে ছগীর, ঠিক কইছস। কাপ্তাই নৌকো বাইছি আজ পনেরো বছর। আর কখনো এমন তুফানে পড়ি নাই। আল্লা বাঁচাইছে। এখন চল, আরেকটু ভেতরে ঢুকে যাই। নৌকো ধরব। উহ্! ঠা-ায় আমার অবস্থা কাহিল রে। টান টান।’

২.

ভেতরের দিকে সরু হয়ে গেছে ঘোনাটা। তারপর সোজা চলে গেছে আরো ভেতরে। অন্ধকার। ঘোনার মুখ থেকে ভেতরে কতদূর গেছে বোঝা যাচ্ছে না। বেশি ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই। মুখের কাছাকাছি আরেকটা ছোটখাট ঘোনা খুঁজছে মাঝি। ঘোনার ভেতরে নৌকো ঢুকিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। আরেকটু সামনে যেতে বামপাশে মিলল সেটা। নৌকোর মুখ ওদিকে ঘুরিয়ে দিল মাঝি। নৌকো বাঁধার জন্যে যুত মতো জায়গা খুঁজছে। কিন্তু ঘোনার দু’পাড়েই ঘন জংলা। অন্ধকারে অদ্ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। পাড়ের মধ্যে খালিমতন কোনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। নৌকো ভেড়ানো যাচ্ছে না তাই। আরো সামনে এগোচ্ছে ওরা। শেষে ঘোনার বাম পাড়ে পানির দিকে সেজদার ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়া একটা গাছ দেখে ওটার ডালের সাথে নৌকো বাঁধল।
নৌকো বেঁধে ভেতরে এসে বাতি জ্বালাল ওরা। কেরামত পাছায় রাখা টিনের চুলোয় রান্না চড়াল। গোলাপ, ছগীর আর মাঝি ছইয়ের ওপর বসে বিড়ি ধরাল।
চারদিকে তাকাচ্ছে ওরা। পশ্চিম দিকের এসব পাহাড়ে কখনো নৌকো ধরার কথা ভাবেনি। কারণ ফাড়ির যে অংশ দিয়ে কাপ্তাই থেকে বুড়িঘাট যাওয়া আসা হয়, সে অংশটা ফাড়ির মাঝামাঝি। এদিকে তাই আসার কোনো দরকার পড়ে না কোনো নৌকো-সাম্পানের। একটা জিনিস তারা সবাই খেয়াল করছে। এখানে কাছে পিঠে কোনো পাহাড়ী পাড়া আছে বলে মনে হয় না। পাড়া থাকলে বাতি টাতি দেখা যেত। কিন্তু ঘোনায় ঢোকার পর থেকে একটা বাতিও চোখে পড়েনি। পুরো ঘোনাটা কেমন নিস্তব্ধ, প্রাণহীন যেন। রাতচরা কোনো পাখি কিংবা ঝিঁঝিঁর ডাক টাকও কানে আসছে না। ঝোপে ঝাড়ে ভরা ঘোনার কোথাও একটা জোনাকিও জ্বলছে না।
অস্বস্তি বোধ করছে কালা মাঝি। কেন সেটা বুঝতে পারছে না। কাপ্তাই লেকে নৌকো চালানোর সুবাদে রাত বিরেতে অনেক পাহাড়ের ঢালে, অন্ধকার ঘোনায় নৌকো বেঁধে রাত কাটিয়েছে সে। কখনো তেমন কিছু মনে হয়নি। এই কাপ্তাই হ্রদের প্রায় প্রতিটি পাহাড় তার চেনা। রাত বিরেতে নৌকো চালাতে চালাতে যেখানে সুবিধে বুঝেছে, সেখানে নৌকো বেঁধে ঘুমিয়েছে। কখনো কোথাও সামান্যতম অস্বস্তি বোধ করেনি সে। কিন্তু এই ঘোনাটায় ঢোকার সাথে সাথেই যেন কেমন এক ধরনের অস্থিরতা পেয়ে বসেছে ওকে। অস্বস্তির কথাটা কাউকে বলছে না। অবশ্য একটা কথা ভেবে অস্বস্তি দূরে ঠেলে রাখছে। কাপ্তাই লেকের নাইয়া-মাঝিরা একটা কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, যতক্ষণ তুমি নৌকোয় আছ, ভূত-প্রেত দেও-দানো কোনো কিছুই তোমার কাছে আসার সাহস পাবে না। কারণ নৌকো হলো মায়ের মতো। মার বুকে যেমন সন্তান নিরাপদ, তেমনি নৌকোয়ও নৌকোর বাসিন্দারা নিরাপদ। কারণ নৌকোয় তৈরি হয় পেরেক দিয়ে গেঁথে। পেরেক মানে লোহা। এই লোহাকে ভয় করে জীন-পরী কিংবা ভূত-প্রেতরা।
‘উহ্, এত অন্ধকার কেন, কালাভাই?’ বলে উঠল ছগীর। ‘দেখো, কেমন কুয়াশা নেমেছে। এখন কুয়াশা আসবে কোত্থেকে? শীতকাল তো চলে গেছে।’
ব্যাপারটা খেয়াল করেছে মাঝি আর গোলাপও। ঘোনার ভেতরটা কেমন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। একটু আগেও দু’একটা তারা দেখেছে আকাশে। এখন আকাশটাও দেখতে পাচ্ছে না ওরা।
‘এটা এমন কিছু না,’ বলল কালামাঝি। ‘বৃষ্টির পর এরকম কুয়াশা নামে কখনো কখনো। আরো দেখেছি আমি। একবার সাজেকে এরকম দেখেছিলাম…’
‘ধেস শালার বিলাই!’ আচমকা খেঁকিয়ে উঠল পাছায় বসে ভাত রান্নায় ব্যস্ত কেরামত। ‘দূরো! দূরো!’
‘বিলাই মানে?’ অবাক হয়ে বলল কালা মাঝি। ডাকল, ‘বিলাই কি রে, ও কেরামত? বিলাই কই পাইলি, অ্যাঁ? এখানে বিলাই আসবে কোত্থেকে? ভূত দেখছস না কিরে?’
জবাব দিল না কেরামত। কিন্তু মিনিট খানেক পরেই ‘ধেস শালার বিলাই!’ বলে লাফিয়ে উঠল ও। চুলোর ভেতর থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে ঘুপ্পুস করে পানিতে ছুঁড়ে মারল। ‘ধেস শালার বিলাই! গেলি?’
উঠে দাঁড়াল মাঝি। ছইয়ের পেছনে গিয়ে মুখ বাড়াল। ‘ঐ কেরামত, কী কস তুই? বিলাই কই পাইলি? এখানে পানিতে বিলাই আসল কই থিক্যা? মাথা খারাপ অইছেনি তোর?’
চুলোয় ভাত ফুটছে বগ বগ করে। ভাতের পাতিলের ওপর দিয়ে পানিতে চোখ কেরামতের। ‘একটু আগে দেখছিলাম। এখন লাকড়ি ছুঁড়ে মারতেই পালাইছে। শালার বিলাই পানির ওপর দিয়া হাঁটতাছে। আবার আমার দিকে চাইয়া গাল ভেওডাইয়া কইতাছে মেআঁও।’
‘যা ব্যাডা!’ খেঁকিয়ে উঠল মাঝি। ‘পানির উপরে বিলাই হাঁটে! গাঞ্জা খাইছস নি শালা?’
চুপ করে রইল কেরামত। একটু পরে বলল, ‘তাই তো! কিন্তু আমি যে দেখলাম?’
‘হ, তোর মুণ্ডু দেখছস।’
আর কিছু বলল না কেরামত। কাঠি দিয়ে তুলে ভাত দেখল। ফুটে গেছে মনে হয়। আতপ চালের ভাত, মাপা পানি দিয়ে বসানো। ভাত ফুটতে ফুটতে পানি টেনে গেছে। ফ্যান গালার দরকার হলো না। ভাত নামিয়ে ছইয়ের ভেতর রেখে এল কেরামত। এবার তরকারি রাঁধবে। ভেতরে বসে তারই আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফিরে এল মাঝি চিন্তিত মুখে। কেরামতকে ধমক ধামক দিলেও ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না তার। কেরামত নতুন নাইয়া নয়। তার সঙ্গে কাজ করছে প্রায় দু’বছর ধরে। এরকম উল্টাপাল্টা তার মুখে আর কখনো শোনেনি। পানির মধ্যে বেড়াল হাঁটছে। ওর দিকে চেয়ে আবার মুখও ভেঙচাচ্ছে। এসবের মানে কী? বেড়াল আবার মানুষ দেখে মুখ ভেঙচায় নাকি? সবচেয়ে বড় কথা, এই পাহাড়ে বেড়াল আসবে কোত্থেকে? ধারে কাছে চাকমা পাড়া টাড়া থাকলেও না হয় কথা ছিল। পাড়া থেকে একটা বেড়াল চলে আসতেই পারে। কিন্তু বেড়াল আবার পানির ওপর দিয়ে হাঁটে কী করে? কী হলো ওর? তুফানে পড়ে মাথা টাথা বিগড়ে গেল নাকি? বুঝতে পারছে না। ফস করে ম্যাচ মেরে বিড়ি ধরিয়ে গোলাপদের কাছে এসে বসল আবার।
‘কী হইছে, কালাভাই? কেরামইত্যা এমন করতাছে ক্যা?’ জানতে চাইল ছগীর। ‘পানির মধ্যে লাকড়ি ছুঁড়ে মারল ক্যা? কী দেইকছেও?’
‘ওর মু-ু দেইকছে,’ জোর করে হাসল কালা মাঝি। ‘পানির মইধ্যে বিলাই হাঁটে। ওরে আবার মুখও ভেঙচায়।’
গলা ছেড়ে হেসে উঠল ছগীর আর গোলাপ। গোলাপ ঠাট্টা করল, ‘কী রে, কেরামত ভাই। বিলাই তোরে ছেলাম দেয় নাই? হের লাইগা বুঝি লাকড়ি ছুঁইড়া মারছস, অ্যাঁ? শালার বিলাই ওস্তাদ চেনে না আর কী?’
কোনো জবাব দিচ্ছে না কেরামত। ব্যাপারটা নিয়ে সেও চিন্তা করছে। একটা বেড়াল সে দেখেছে, এতে কোনো ভুল নেই। কুচকুচে কালো বেড়ালটা। চোখ দুটো কেবল কমলা রঙের। অন্ধকারে ঝিলিক মারছে যেন। কালো রঙের বেড়ালের চোখ কমলা রঙেরই হয়। অথবা সব বেড়ালের চোখই কমলা রঙের। কিন্তু কালো বেড়ালের রঙের মাঝে কমলা রঙটা হয়তো একটু বেশিই ফোটে। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ওর অবাক লাগছে, বেড়ালটা পানির ওপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল। আর তার দিকে তাকিয়ে কেমন ভেঙচি কাটা মুখ নিয়ে ডাকছিল ‘মেআঁও’ করে। এ ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না ওর। বেড়াল কেমনে পানির ওপর দিয়ে হাঁটে। শুধু বেড়াল কেন? কোনোই প্রাণীই পানির ওপর দিয়ে হাঁটতে পারবে না। কিন্তু ওর স্পষ্ট মনে আছে, বেড়ালটা গুটি গুটি পায়ে পানির ওপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল।
‘মেআঁও!’ চমকে উঠল কেরামত। আরে, বেড়ালটা দেখছি আবার এসেছে! ওই তো দাঁড়িয়ে আছে পানির ওপর। কিন্তু এটা তো আগেরটা নয়। এটার রঙ সাদা। বেড়ালটা ওর দিকে চেয়ে আছে। ও চোখ এখন আর কমলা রঙের নয়। কেমন যেন সবুজাভ।
ছুরি শুটকি দিয়ে আলু রাঁধছে কেরামত। চুলোয় ডেকচি বসিয়ে তেল দিয়েছে। পেঁয়াজ কুচি করে নিয়েছে। তেলটা গরম হয়ে উঠলেই পেঁয়াজ ছেড়ে দেবে। একটা প্লেটে হলুদে-মরিচে মাখানো শুটকি। বেড়াল তাকিয়ে আছে শুটকির প্লেটের দিকে। যেভাবে লেজ নাড়াচ্ছে মনে হয় ঝাঁপ দিয়ে পড়বে শুটকির ওপর। ‘ধেস শালার বিলাই!’ ধমকে উঠল ও। ‘শালা, ঠ্যাঙ ভাইঙা দিমু কইলাম। গেলি!’
প্র¯্রাব করতে নৌকোর মাঝামাঝি কাঁড়ায় বসেছিল ছগীর। আচমকা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটু আগেও সামান্য বাতাস শরীরে একরকম আরামদায়ক ঠাণ্ডা পরশ বুলাচ্ছিল। এখন কেমন যেন লাগছে। ও যেদিক ফিরে বসে প্র¯্রাব করছে. সেদিক থেকে কাদের যেন গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যেন বহুদূরে একদল লোক হৈ হল্লা করছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না ও। এখানে তো কারো বাড়িঘর নেই। এটা পাহাড়ীদের পাড়ার কাছাকাছি কোনো জায়গা নয় যে, দূর থেকে পাড়ার মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসবে।
প্রসাব শেষ করে উঠে দাঁড়াল ছগীর। আচমকা মাথার ভেতর কেমন করে উঠল যেন। আচ্ছা ভাল কথা, ও কোথায়? এটা কোন জায়গা?
গুটি গুটি পায়ে নৌকোর কাছা বেয়ে ছইয়ের দিকে এগোচ্ছে সে। নৌকোর ছইয়ের ওপর দু’জন মানুষ বসে আছে। কারা এরা? তীক্ষè চোখে তাকাল মানুষ দু’জনের দিকে। মস মস করে উঠে গেল ছইয়ের ওপর। আরেকটু এগোতেই চিনল ওদের। আরে, এরা তো মাঝি আর গোলাপ! কী ব্যাপার? হুট করে এমন অচেনা লাগল কেন ওদের? ঘটনা কী?
শীত লাগছে না এখন আর। আগের মতো আরামদায়ক অনুভূতি। কথা বলছে মাঝি আর গোলাপ।
‘ধেস শালার বিলাই! গেলি!’
আগের মতো বেড়ালকে ধমকে উঠেছে কেরামত। এবার কেরামতকে ধমকে উঠল মাঝি। ‘তোর কী হয়েছে রে কেরামইত্যা? আবার বিলাই পাইলি কই? পানিতে নাকি?’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল মাঝি। ছই থেকে নেমে কেরামতের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কই রে তোর বিলাই?’
‘কিসের বিলাই?’ পাল্টা প্রশ্ন করল কেরামত। বিলাই কই থিক্যা আইব এইহানে?’
‘আমিও তো হেইডা জিগাই। তুই শালা, বিলাই বিলাই করে মরছ ক্যা?’
‘আমি কি বিলাই বিলাই করতাছি? কালাভাই, তুমি এসব কী কও?’
‘শালা, ঠাট্টা করো, না?’ খেঁকিয়ে উঠল মাঝি। ‘এক লাত্থি দিমু কইলাম। বিলাইর লগে পানিত যাই পড়বি।’
জবাব দিল না কেরামত। তরকারি হয়ে গেছে ওর। নামিয়ে ফেলে চুলো নিভিয়ে দিল পানি মেরে। খেতে বসল ওরা।
ছুরি শুটকির তরকারি দারুণ স্বাদ হয়েছে। চাকুম চাকুম করে খাচ্ছে ওরা। কেরামতটা রাঁধে ভালই। ওর হাতের আলুভর্তা শুঁকে শুঁকেই দুই প্লেট ভাত খেয়ে নেয়া যায়। ছুরি শুটকি দিয়ে রাঁধা আলুর তরকারির প্রশংসা করছে গোলাপ প্রাণ খুলে। দ্বিতীয়বার প্লেটে ভাত নিয়ে ঝোল মাখতে মাখতে একগাল হাসল। ‘কেরামত ভাই, সুযোগ পাইলে সারাজীবনই তোমার লগে এক নৌকোয় চাকরি করতাম। এমন সোয়াদের রান্না তুমি কেমনে রাঁধো রে ভাই। আমারে একটু শিখাইবা? বোন বিয়া দিমু তোমার কাছে।’
ওর ঠাট্টায় মজা পেল কেরামত। হেসে উঠে বলল, ‘তুমি শালা পাতিলার তলার মতো কালা। নইলে বিবেচনা করে দেখতাম, তোমার বোন বিয়া করা যায় কি না।’ ছগীরের দিকে চাইল চোরা চোখে। ‘ওর বইন হলে অবশ্য আপত্তি নাই। ওর অর্ধেক রঙ পাইলেও ওর বইন হবে বিশ্বসুন্দরী। কী কও, কালা ভাই?’
ছগীর আসলে টকটকে ফরসা। চেহারা সুরতও খারাপ নয়। কেরামতের ঠাট্টায় হাসল সেও। ‘যদ্দিন তোমার লগে আছি, তদ্দিন আপত্তি নাই আমার। তোমার কাছ থেকে চলে গেলে অন্য চিন্তা।’
ভাত খেয়ে গোল হয়ে বসল ওরা ছইয়ের তলায়। বিড়ি খাচ্ছে। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ছগীর বলল, ‘এমন নিঝুম জায়গা আর কোথাও দেখি নাই। দেখো, কোথাও কোনো সাড়াশব্দ পর্যন্ত নাই। একটা ঝিঁঝিঁও ডাকে না। কালাভাই, এ জায়গার নাম জান নাকি?’
‘এ জায়গায় আগে কখনো আসিনি। নাম জানমু কেমনে?’
‘কিন্তু আমি একটা জিনিস ভাবতাছি। প্রসাব  করার নৌকোর কাছায় গিয়ে বসলাম। আচমকা সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠল। হঠাৎ শুনলাম, অনেক মানুষ হৈ-হল্লা করছে। তারপর উঠে দেখি ছইয়ের ভেতর দু’জন লোক বসে কথা বলছে। চিনি না। তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে দেখি, তুমি আর গোলাপ। আশ্চর্য, তোমাদের কিনা চিনতে পারছিলাম না আমি। কা- কিছু বোঝো?’
‘হ, বুঝছি,’ খেঁকিয়ে উঠল কালা মাঝি। ‘তরেও কেরামইত্যার ভূতে পাইছে। বিলাই দেখছ নাই?’

৩.

ধোঁয়াটে ভাব কেটে গেছে। আধখাওয়া পাউরুটির মতো একখানা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে পুব থেকে। তার আলো এসে পড়েছে পাহাড়ের গাছগাছড়ার ওপর। চিক চিক করছে ভেজা পাতা। বাতাসও বইতে শুরু করেছে। ঘোনার পানিতে আঁচড় কাটছে যেন। তাতে সামান্য ঢেউ। চাঁদের আলো পড়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। গোলাপ মোহিত হয়ে দেখছে। পশ্চিম দিকের আকাশে তারা। মরা মানুষের চোখের মতো। আচমকা শিউরে উঠল ও। হুট করে মরা মানুষের কথা মনে এল কেন?
অবশ্য মরা মানুষের কথা মনে আসতেই পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু গোলাপের কাছে কেন যেন ভাল লাগল না। ওরা যাচ্ছিল বুড়িঘাট। নৌকো ধরার কথা ছিল গুলসাখালি। সেটা অবশ্য ধরা হতোই। কিন্তু হঠাৎ অনুকূল বাতাস পেয়ে পাল তুলে দিল ওরা। নৌকো তর তর করে এগিয়ে চলল। আচমকা ওই কাল বৈশাখী ঝড়টা না এলে তারা ফাড়ি পার হয়ে যেত। ঝড়ের কারণে শেষ পর্যন্ত এই ঘোনাটায় এসে নৌকো বাঁধতে হলো। এটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেক রাত অনেক অচেনা ঘোনায় রাত কাটিয়েছে ও। কখনো কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এ ঘোনাটায় ঢোকার পর থেকে এমন লাগছে কেন কে জানে? কেন যেন ওর মনে হচ্ছে ঘোনাটায় ওরা একা নয়। আরো কিছু যেন আছে। কিন্তু কী আছে? অশরীরী কিছু?
অশরীরী কথাটা ভাবতে আবার গা শিউরে উঠল গোলাপের। তলপেটে শীতল ভাব টের পেল। আচ্ছা, তাদের কি এ ঘোনাটায় নিয়ে আসার জন্যেই আচমকা ঝড়টা এসেছিল?
চিন্তাটাকে জোর করে তাড়াল গোলাপ মন থেকে। কীসব আবোল তাবোল ভাবছে সে। মনে মনে ‘কুল হুয়াল্লাহ’ পড়ে তিনবার বুকে ফুঁ দিল সে। মনে জোর এল। বাবা, কুল হুয়াল্লাহু’ পড়লে ভূত-প্রেত কাছে ঘেঁষতে পারে না।
‘এই সুন্দর ফুল, এই সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি,’ আচমকা গান ধরল ও। ‘খোদা, তোমার মেহেরবানী….’
ওর গানের সুরে মেতে উঠল বাকিরাও। কালা মাঝি বলে উঠল, ‘সাবাস….’
‘তুমি কত দিলে রতন, ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন, ক্ষুধা পেলে অন্ন জোগাও মানি চাই না মানি……’
আচমকা হাত তুলল কালা মাঝি। ‘এই, থাম তো রে!’
‘কী হলো, কালাভাই?’ আচমকা বাধা পেয়ে থেমে গেল গোলাপ।
‘তোরা কিছু শুনস নাই?’ অদ্ভূত চোখে চাইল কালা মাঝি।
‘কী শুনব?’
‘ছগীর, কেরামত! তোরা হুইনছস?’
‘আরে দূর! কী শুনব বলো না?’
প্রায় তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে রইল কালা মাঝি। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘তোর লগে কেউ একজন গান গায়। আমি পষ্ট হুনছি। পুরা গান নয়, তোর গানের শেষ অংশের লগে গলা মিলায়। যখন তুই কইলি, পানি, তখন কেউ একজন যেন পানির ‘নি’টাকে অনেকক্ষণ ধরে টাইনা টাইনা গাইল।’
‘হ্যঁ।’ মাথা দুলিয়ে সায় দিল ছগীর। ‘আমারও যেন মনে অইল কেউ একজন ‘নি- নি- নি- নি- নি-’ কইরা টানল।’
আচমকা এক সাথে সবাই তলপেটে ঠা-া ভাব অনুভব করল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
নীরব নিথর পাহাড়ী প্রকৃতি। ঘোনার ভেতরটা আরো নিস্তব্ধ যেন। কোথাও সামান্যতম শব্দও নেই। রাত কত হয়েছে কে জানে? ১০টার ওপরে হবে নিশ্চয়। কাপ্তাই জেটীঘাটে কিংবা রাঙামাটির রিজার্ভ বাজারে এখনো মানুষজন গম গম করছে। কিন্তু অন্ধকার নীরব পাহাড়গুলোতে আদিম নৈঃশব্দ্য। রাতের বাতাস বইছে শির শির করে। পাড়ের লতাপাতায় তার পরশ। দু’একটা ঝিঁঝিঁর ডাকও শোনা যাচ্ছে এখন। আগের সে ঝিমধরা ভাবটা আর নেই।
‘নি- নি- নি- নি- নি-’! কালা মাঝির কথা শোনার পর সবাই যেন এখন টানটা শুনতে পাচ্ছে। ছগীর বিড় বিড় করে কী যেন বলে উঠল। সম্ভবত দোয়া-দরুদ পড়ল।
প্রসাব ধরেছে কেরামতের। ছইয়ের নিচ থেকে পাছায় গিয়ে বসল। একটু পর পানির ওপর ওর প্রসাব পড়ার শব্দ শোনা গেল।
প্রসাব করতে করতে ঘোনার পাড়ের দিকে তাকাল কেরামত। জঙলা ঝোপ আর লতাপাতায় চাঁদের আলো পড়ে অদ্ভূত আলো-ছায়া। হঠাৎ ওর চোখের সামনে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক জলাধারের সামনে। চারধারে কেউ নেই। ভীষণ গরম লাগছে। ইচ্ছে করছে, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতে। একই সঙ্গে তীব্র পিপাসা বোধ করল। সে ভাবল, পানি খাবে। জলাশয়ে নেমে আঁজলা ভরে পানি খেয়ে পিপাসা মেটাবে।
ঠিক এই সময় দেখল বেড়ালটাকে। ওর সামনে পানির ওপর দিয়ে হাঁটছে। ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ তুলে চাইছে ওর দিকে। তারপর ডেকে উঠল, মেআঁউ…’
ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না কেরামত। পানির ওপর দিয়ে বেড়াল কীভাবে হাঁটে?
আরে! বেড়ালটা দেখছি হেঁটে ওর দিকেই আসছে। আর বেড়ালটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। ফুলে উঠছে ওটার ঘাড়, পিঠ, পেট। কমলা রঙের চোখ জ্বলছে যেন। কেরামত তাকিয়ে আছে ওটার চোখের দিকে। ধক ধক করছে চোখগুলো। ভয়ে কেঁপে উঠল ও, পালাতে চাইল বেড়ালটার চোখের সামনে থেকে। কিন্তু পারছে না। পাদুটো যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। গলা ছেড়ে ধমকে উঠতে গেল সে বেড়ালটাকে।
গলা চিড়ে বেরিয়ে আসা ফ্যাঁসফেঁসে আওয়াজটা শুনল কালা মাঝি। পর মুহূর্তে মত্ত হাতির মতো হুড়মুড় করে ছইয়ের নিচে এসে ঢুকল কেরামত। গোঁ গোঁ করে আওয়াজ বেরোচ্ছে ওর মুখ দিয়ে। দড়াম করে উপুড় হয়ে পড়ল কাঠের পাটাতনের ওপর।
গোলাপ আর ছগীর কেরামতকে নিয়ে পড়ল। দু’জনে মিলে ওর পিঠে থাবড়া লাগাল। ‘এই কেরামত ভাই, কী অইছে রে? কী দেখছস?’
কালা মাঝির মনে হলো, এই ঘোনাটায় কিছু একটা সমস্যা আছে। ছগীরের ‘অনেক মানুষের হৈ-হল্লা’ শোনা আর কেরামতের ‘বিড়াল দেখা’ পুরোটায় আজগুবি। প্রথমত এখানে ওর জানামতে, কাছে পিঠে কোনো মানুষজনের বসতি নেই, সুতরাং কারা হৈ-হল্লা করবে? আর কেরামত শুধু বেড়ালই দেখেনি, ওর বেড়াল আবার পানির ওপর দিয়ে হাঁটেও। আবার সে বেড়াল তাকে মুখ ভেঙচায় আর সে রাগের চোটে বেড়ালের দিকে চুলো থেকে জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারে। না, কেরামত বা ছগীরের বিড়ি খাওয়ার নেশা আছে বটে। কিন্তু তারা দু’জনেই গাঁজা খায়, এমন লক্ষণ সে কখনো দেখেনি। অন্তত নৌকোয় তো নয়ই। তাহলে কি ঠাট্টা করছে? কিন্তু এধরনের ঠাট্টা-মশকরারও তো কোনো কারণ নেই। এ তিন জন নাইয়া নিয়ে তো সে অনেক দিন নৌকো বাইছে। এরা তিনজনেই সমবয়সী। মাঝি হিসেবে এবং বয়সে কিছুটা বড় হিসেবে তাকে যথেষ্ট ইজ্জত-সম্মানও দিয়ে থাকে। এমন ফালতু মশকরা ওর সঙ্গে ওরা করবে না, এ বিশ্বাস ওর আছে।
তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছে না কালা মাঝি। কেরামত আর ছগীর কিছু একটা টের পাচ্ছে, কিন্তু সে আর গোলাপ পাচ্ছে না। এর মানেটা কী? ঘোনায় যদি খারাপ কিছু থাকে, সেটা তো সবারই এক সাথে টের পাওয়ার কথা। আরেকটা ব্যাপার হলো, কেরামত আর ছগীরের বেড়াল দেখা আর অনেক মানুষের হৈ-হল্লা শোনার ব্যাপারটা ঘটেছে তারা ছইয়ের বাইরে থাকার সময়। ছইয়ের ভেতর ঢুকতে আবার ঠিক হয়ে গেছে। তাইলে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা ঘোনায়। কালা মাঝির সন্দেহ এবার দৃঢ়মূল হলো। তবে অবাক হওয়ার ব্যাপার হলো, ঘোনায় যা-ই থাকুক, নৌকোর ছইয়ের ভেতরে বিচিত্র কোনো কারণে সেটার প্রভাব পড়ছে না। সে আর গোলাপ একা একা ছইয়ের ভেতর থেকে একবারও বেরোয়নি বলে তারা কিছু দেখেনি কিংবা কোনো শব্দ শোনেনি। অর্থাৎ মনে হয় ছইয়ের ভেতরেই তারা নিরাপদ।
আর গোলাপের গানের ‘পানি’র সঙ্গে যে ‘নি-নি’ শব্দটা শোনা গেছে, সেটা মনে হয় প্রতিধ্বনি। পাহাড়ী ঘোনায় কথা বলতে গিয়ে এরকমটা আগেও শুনেছে কালা মাঝি। সেটা মনে পড়ল এখন। তবে নাও হতে পারে। অনেক মানুষের হৈ-হল্লা আর কালো বেড়াল দেখার ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটাও তো সত্যি হতে পারে।
যা-ই হোক, নৌকোর ছইয়ের ভেতর থেকে বেরোনো যাবে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কালা মাঝি। যে কোনো অবস্থাতেই ছইয়ের নিচে থাকতে হবে। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে কাপ্তাইয়ে আছে সে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক ভৌতিক কাহিনি শুনেছে। তবে একটা কথা সবাইকে বিশ্বাস করতে দেখেছে যে, নৌকোর হলো মায়ের মতো। মা মানে ঘর। আর ঘরের ভেতরে কাউকে ভূতে ধরে না, ধরতে পারে না।
ধাতস্থ হয়ে উঠে বসেছে কেরামত। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখ ফ্যাকাসে, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। চাটগাঁইয়া ভাষায় বিড় বিড় করছে, ‘অ বুক লে বুক, ই’ন আঁই কী দেখিলাম… কী দেখিলাম… ’
চারজনের মধ্যে কেবল কেরামতের বাড়িই চট্টগ্রামে। ‘বিলাই!’ ডান হাতে বুকে চাপড় মারল সে। ‘হালি ফুলেদ্দে…. ফুলেদ্দে। ফুইলতে ফুইলতে,’ দু’হাত দু’দিকে বাড়িয়ে দিল। ‘এত’র অ বাজি। লাল টকটইক্যা চোখ, ধক ধক গরি জ্বলেদ্দে অইনের হইলার ডইক্যা। অবুক, অবুক লে বুক, ই’ন আঁই কী দেখিলাম…’
ভালই ভয় পেয়েছে ছেলেটা। ঠাট্টা-মশকরায় এতটা নিখুঁত ভান করা সম্ভব নয়। তবে একে একটা ধমক দেয়া দরকার। ধমক দিলে মানুষ যেমন ভয় পায়, তেমনি ধমক দিলে অনেক সময় ভয় কমেও। এখন কেরামতকে ধমক দিলে তার ভয়ও কমবে। তার মাথায় এখন কী দেখেছে, সেটাই ঘুরছে। ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হলে একটা কড়া ডোজের ধমক চাই।
‘কেরামত,’ মৃদুস্বরে ডাকল সে। পর মুহূর্তে খেঁকিয়ে উঠল, ‘অই শালা কেরামইত্যা! ব্যাডা, লাথির চোডে শোনকায়ার তুন পানিত যাই হড়বি।’
কালা মাঝির বাড়ি ফেনী। অনেকদিন চট্টগ্রাম থেকে থেকে চট্টগ্রামের ভাষা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে। কেরামত অবশ্য এমনিতে তাদের সঙ্গে নিজের আঞ্চলিক ভাষা বলে না। শুদ্ধ ভাষা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু এখন তার মুখ দিয়ে শুদ্ধ ভাষা বেরোতে চাইছে না। কালামাঝির দিকে চেয়ে হাউ মাউ করে উঠল, ‘অ কালাভাই, বিলাই…বিলাই…’
‘ধ্যাততেরি তোর বিলাই। শালা তুই নিজেই একটা বিলাই। শালা কী দেখছস না কী দেখছস, এখন আসি ম্যাও ম্যাও লাগাইছস। চুপ কর।’
চুপ করল কেরামত। গোলাপ তাকে একটা বিড়ি বাড়িয়ে দিল। ম্যাচ মেরে ওটা ধরিয়ে দিল ছগীর।
বিড়ি ধরাল কালামাঝি নিজেও। চুপচাপ টানতে লাগল।

উনে উনে… উনে উনে… উনে…
প্রথমে একটা গলা। তারপর কোরাস ধরল আরো কয়েকটা গলা, ‘উনে উনে…’
খুব চিকন আর অসম্ভব সুরেলা। যেন কয়েকটা বাচ্চা মেয়ে এক সাথে বসে আপন খেয়ালে দুর্বোধ্য কোনো এক ভাষায় গান গাইছে।
এক সাথে কান পাতল চারজনেই। কী ব্যাপার! এটা কিসের সুর? কারা গান গায়? কোন ভাষার গান? আচমকা ঝাপটা বাতাস এসে নিভিয়ে দিল ছইয়ের ভেতর টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাতিটা। অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেতরে। চমকে উঠল ওরা। শির শির করে উঠল মেরুদ-। কী হচ্ছে এসব? কাঁপা কাঁপা গলায় বিড় বিড় করে উঠল ছগীর, ‘লা হাওলা ওলা কুওয়াতা…’
কেরামত চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোলাপ ভাই, বাত্তি জ্বালা…ম্যাচ লও।’
আর ঠিক সে সময় নারীকণ্ঠে গান ধরল কেউ।
চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা
ক্রুং ক্রাকালে
চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা
মাথার ভেতর কী যেন হয়ে গেল অন্ধকারে ম্যাচ হাতড়াতে ব্যস্ত গোলাপের। হাতড়ানো বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল সে। বাকিরাও কান পাতল।
‘কে গান গায়, কালাভাই?’ ফিস ফিস করে জানতে চাইল ছগীর। ‘এত সোন্দর গান! এইডা কোন ভাষা?’
এবার একা নয়, সমবেত কণ্ঠে শোনা গেল
চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা
ক্রুং ক্রাকালে
………………………………………
আন্ধার ঘরে রাইত হাডাইয়ুম হারে লই
বন্ধু গেলে গৈ…
চমকে উঠল কালা মাঝি। আরে, এ কী! গোলাপও তো দেখি তাদের সাথে সুর মিলায়। আর এই দুটো গানেরই দেখি একই সুর!
আন্ধার ঘরে রাইত হাডাইয়ুম হারে লই…
‘ও কালা ভাই, এসব কী?’ রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ছগীর। ‘গোলাইপ্যা ক্যা গান গাইতেছে? ও গোলাপ, গোলাপরে…. লাইলাহা ইল্লা আনতা ছোবহানাকা…’
‘খাড়াও, আমি আইতাছি গো।’ আচমকা বসা থেকে নড়ে উঠল গোলাপ। নিজের ভাষা রেখে অজানা ভাষায় সেও গান ধরল এবার, ‘চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা…ক্রুং ক্রাকালে…’
গাইতে গাইতে উঠে দাঁড়াতে গেল। জাপটে ধরল তাকে কেরামত। ‘না গোলাপ ভাই, না। খবরদার বাইর অবানা কইলাম। এই গান মানুষ না, জীন-পরীয়ে গায়। তুমি গেলে তোমারে নিয়ে উইড়া যাইব গোলেস্তা এরোম দেশে। আর কোনো দিন ফিরে আসতে পারবা না।’
কেরামত পুঁথি পড়–য়াদের মুখে শুনেছে, দুনিয়াতে এমন এক দেশ আছে, যার নাম গোলেস্তা এরোম। সেখানে জীন-পরী, দেও-রাক্ষসরা থাকে। সে দেশে কোনো মানুষ যাইতে পারে না। যাইতে পারে, যদি কোনো পরীয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু একবার গেলে আর কোনো দিন ফিরে আসতে পারে না। পরীরা তারে সারাজীবন গোলাম বানাইয়া রাখে।
গোলাপের গানের গলা ভাল। গান গাইতে ভালবাসে। তাই বোধ হয় তাকে নিয়ে যেতে এসেছে। একটু আগে ও গান গেয়েছে। সেটা এরা শুনেছে। তাই তাদের সঙ্গে গান গাওয়ানোর জন্যে তারা নিজেরা এসে গান গাইছে।
ধস্তাধস্তি করছে গোলাপ। ‘এই ছাইড়া দে আমারে, ছাইড়া দে কইলাম। চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা…’
এরে থাপ্পড় দরকার। মনে মনে ভাবল কালা মাঝি। তারপর যেই চিন্তা সেই কাজ। ঠাস ঠাস দুই চড় লাগিয়ে দিল গোলাপের দুই গালে।
ব্যথা পেয়েছে গোলাপ। ধস্তাধস্তি বন্ধ হয়ে গেল। কালা মাঝির দিকে চেয়ে ফুঁসে উঠল, ‘মারলা ক্যান, কালাভাই?’
‘তোমার চ্যাংড়ামি বন্ধ করার লাইগা মারলাম। শালা কালাভূত! কই যাবা তুমি? শ্বশুড়বাড়ি? শোনকায়া থেকে একপাও বাইরে দেবা না কইলাম। ঠ্যাঙ ভাইঙ্গালামু। কেউ বাইরে যাবা না। মুততে গেলেও এক লগে দুইজন যাবা। একা যাবা না কইয়া দিলাম।’
কালা মাঝির মনে আছে, কেরামত যখন পানিতে বেড়াল হাঁটতে দেখেছিল, ও পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আর বেড়াল দেখার কথা বলেনি। এর মানে হলো, ছইয়ের বাইরে একা গেলেই আবোল তাবোল দেখতে শুরু করে। ছগীরেরও সে অবস্থা। নৌকোর কাছায় বসে প্র¯্রাব করতে বসে চাকমা পাড়ার হৈ-হল্লা শুনে এসেছে।
গান বন্ধ হয়ে গেছে। কখন বন্ধ হয়ে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। সম্ভবত গোলাপকে নিয়ে ধস্তাধস্তির সময়।

……বিশাল এক মাঠে দাঁড়িয়ে আছে কালামাঝি। মাথার ওপর কড়া রোদ। চান্দিফাটা গরম। দর দর করে ঘামছে। এক ফোঁটা বাতাসও নেই।…..
……আচমকা কড়া রোদ মিলিয়ে গেল। সূর্য ঢাকা পড়ে গেল কালো মেঘে। গুড়–ম করে ঠাটা পড়ল। প্রবল বাতাস শুরু হয়ে গেল। এমন বাতাস, যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। শক্তহাতে হাল ধরে আছে সে। নৌকো এগোচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তিনটা কালো বেড়াল জ্বলজ্বলে চোখ মেলে দাঁড় টানছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে বেড়ালগুলো। কালা মাঝি নিজেও ভিজছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। বিশাল এই ফাড়িতে এমন কোনো টিলা নেই যেখানে নৌকো বেঁধে তুফান শেষ হওয়ার অপেক্ষা করা যাবে। এটার নাম কাট্টলী ফাড়ি। ফাড়ির রাজা। এপার থেকে ওপার ঠাহর করা যায় না।……
……প্রবল বাতাসের তাড়নায় ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠছে। নৌকোর সামনে আছড়ে পড়ছে। পানির ঝাপ্টা এসে পড়ছে নৌকোর ভেতর। ‘টান!’ দাঁত-মুখ খিঁচে বলল কালা মাঝি। ‘জোরসে…’
বেড়ালগুলো দাঁড় টানতে টানতে গান গাইছে, ‘চাংগ্রারিমা রিকুং ক্রিয়ে ক্রুকালা…’
তাদের সঙ্গে গলা মেলাল কালামাঝিও, ‘আন্ত্রাকিলা আটুং গ্র্রিসে প্র্রিসালা…’
সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালগুলো লাফিয়ে পড়ল পানিতে। অমন তুফানেও ঢেউয়ের মাথায় চড়ে লাফালাফি শুরু করল।
কালামাঝি গান থামিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, ‘ওই শালা কেরামইত্যা, পানির ওপর লাফাস ক্যান?’……
…..কেরামত হাসছে। বিশাল একটা কালো বেড়ালকে গরুর মতো রশিতে বেঁধে টেনে আনছে। হাঁটতে চাইছে না বেড়ালটা। ওটার পেছন থেকে পিটাচ্ছে গোলাপ। লেজ মুচড়ে দিচ্ছে। ছগীর গম্ভীর মুখে দোয়া পড়ছে, লাইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা…..
……মাথায় পাগড়ি বেঁধেছে কালা মাঝি। আজ ওর বিয়ে। কন্যার বাড়ি গোলেস্তা এরোম দেশে। নাম বদিউজ্জামাল পরী। সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশ থেকে নেমে আসবে বদিউজ্জমাল।…..
…..আকাশ থেকে নেমে আসছে হুমা দেও। বিশাল বিশাল দু’হাত মেলে পাখির মতো উড়ে উড়ে। কে একজন বলে উঠল, ‘আমরা নই। ওই-ওই যে কালা মাঝি সে বদিউজ্জামাল পরীকে বিয়ে করবে।’
ছুটছে কালা মাঝি। পেছনে তাকে তাড়া করছে হুমা দেও। কালা মাঝিও উড়ছে। হুমা দেও গান গাইছে গোলাপের মতো চমৎকার গলায় :
উমছেগ্রুমা উমছেগ্রা কাবুচ
উমছেগ্রুমা উম
উমছে তাতা উমস মিলুং
উমতে কালুং তুম
উংরি রিকু বালা উম।
আর কী আশ্চর্য গোলাপও উড়ছে তাদের সাথে। সেও গাইছে :
ঘুম যা রে আদুইরগা বাছা
ঘুম যা রে তুই
ঘুমত্তুন উডিলে রে বাছা
বচ্চু দিয়ুম মুই, বাছা ঘুম যা রে তুই
…..হঠাৎ দেওটা একটা বিশাল কালো বেড়াল হয়ে গেল। ‘মিয়াও’ করে মেঘের মতো ডেকে উঠল ওটা। পুবদিকের পাহাড় থেকে নেমে মহীপালের দিঘির পানির ওপর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। বেড়ালটার চোখদুটো ধক ধক করছে আগুনের গোলার মতো। বাঘের মতো মুখ করে ভয় দেখাচ্ছে তাকে।
কালা মাঝি দৌড়াচ্ছে। ওর হাতে বাজারের ব্যাগ। পশ্চিম দিকে ছুটছে ও। ওদিকে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড। রোডে উঠে বাসে চড়ে পালাবে বেড়ালের কাছ থেকে।……
…..ছইয়ের ওপর গল্প করছে ওরা চারজন। গোলাপ আর কেরামত শুয়ে আছে, ছগীর আর কালামাঝি বসে। ছগীরের কী একটা কথায় হেসে উঠল কালা মাঝি। হাসতে হাসতে শোয়া থেকে উঠে বসল গোলাপ আর কেরামতও। গোলাপ বলতে গেল, শালা ছগীরা, তরে….
আচমকা দুলে উঠল নৌকো। তারপর এপাশে ওপাশে দুলতে থাকল ভীষণভাবে। আশ্চর্য! পানিতে ঢেউ নেই নৌকো দুলছে কেন? ছইয়ের ওপর বসে থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়ল। হাঁচড়ে পাঁচড়ে নেমে এল ওরা ছইয়ের ভেতর। নৌকোর আগার দিক থেকে ডেকে উঠল বেড়ালটা, মেয়াঁও!
চমকে উঠল তাকাল চারজনে ওটার দিকে। আগার যে জায়গাটায় তারা দাঁড় টানে, তার পুরোটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকাচ্ছে জ্বলজ্বলে চোখে। বাঘের মতো বিশাল হাই তুলে লাল জিভের পুরোটাই দেখাল।
কেরামত চেঁচিয়ে উঠল, ‘কালা ভাই, এইটা। এইটার কথাই কইছিলাম আমি।’
ছগীর বুকে ফুঁ দিয়ে সুরা ফালাক পড়তে শুরু করল। কুল আউজু বিরাব্বিল…..
কালা মাঝি লাফিয়ে উঠল। নৌকোর দাওখানা হাতে নিয়ে কড়া গলায় ধমক লাগাল, ‘হুশ শালার বিলাই……
ধমক দিতে গিয়েই ঘুম ভেঙে গেল কালা মাঝির। চোখ মেলে বাইরে তাকাল। রাত শেষ। চারদিক ফরসা হয়ে গেছে। ওরা তিনজন ঘুমোচ্ছে। বেমক্কায় শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে ছগীর।
ফস করে ম্যাচ মেরে বিড়ি ধরাল। ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবল, এতক্ষণ যা দেখেছে সব তাহলে স্বপ্ন। কালো বেড়াল টেড়াল এসব কিছু না। কিন্তু…যতদূর মনে পড়ে কালামাঝির, সে স্বপ্ন টপ্ন এসব একটু কম দেখে। শেষবার কখন দেখেছে সেটা চেষ্টা করেও মনে করতে পারবে না। তাহলে আজ এরকম স্পষ্ট পরিষ্কার স্বপ্ন দেখার মানে কী? আর এতো স্বপ্ন নয়, রীতিমতো দুঃস্বপ্নই।
ছইয়ের নিচ থেকে বেরোল সে। ছাতের ওপর গিয়ে দাঁড়াল। আকাশ পরিষ্কার। কোনোদিকে একটুকরো মেঘের চিহ্নও নেই। গতকাল কালবোশেখির বৃষ্টিতে ঘোনার দু’পাশের গাছপালা আর লতাপাতা ধুয়ে মুছে একদম পরিষ্কার। তবে ঘোনার পানির রং কালো। স্বাভাবিক পানির মতো রংহীন নয়। পুবের বড় পাহাড়গুলোর মাথার ওপর কালো আকাশ ধীরে ধীরে সোনালি আভা পেতে শুরু করেছে।
দূরে ভোরের পাখিরা কলরব করছে। কোকিল ডাকছে। আচমকাই ব্যাপারটা খেয়াল কালা মাঝি। এই ঘোনাটির কোথাও কোনো পাখি ডাকছে না। তার মানে এই ঘোনায় কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। যে কোনো কিছুর ভয়ে এই ঘোনাকে এড়িয়ে চলে তারাও। গতরাতেও তারা একটিবারের জন্যে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে শোনেনি। একটা জোনাক পোকাও জ্বলতে দেখেনি। উঁহুঁ, এই ঘোনাটা খারাপ। এই ঘোনাটায় কিছু একটা অসুবিধে আছে। এই ঘোনার পানিতে মুখ ধোয়াও ঠিক হবে না।
দুদ্দাড় করে নেমে গেল সে ছইয়ের ছাত থেকে। ভেতরে ঢুকে তিনজনকে তিন ধাক্কা দিল। ‘এই শালারা! উঠ উঠ। সকাল হয়ে গেছে। নৌকো ছাড়। খবরদার! কেউ এখানে মুখ টুখ ধুবি না। আর সব কাজও বাইরে করবি। উঠ না শালারা! বলদের মতো ঘুমায়!’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত