নূরালী গ্রামের বেশ কয়েকজন আমার পরিচিত। এর কারণ, আত্মীয়তাসূত্রে বছরের দুই ঈদের যেকোনো একটি আমাকে এই গ্রামে পালন করতে হয়। আমাকে মানে আমাকে, আমার স্ত্রীকে এবং আমাদের দুই সন্তানকে। ওরা যদিও অন্যত্র তেমন একটা যেতে চায় না, নূরালী আসার ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই; বরং বলা যেতে পারে, বেশ একটু উৎসাহই দেখায় তারা। এর প্রধান কারণ, আমার ধারণা, তাদের যা ইচ্ছা তা করার অবাধ স্বাধীনতা। দ্বিতীয় কারণটি এ রকম–শহরের রোজকার জীবনে দেখে ও ব্যবহার করে অভ্যস্ত না, এ রকম বেশ কিছু ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততা লাভ করা। বলে রাখা দরকার, এ দেশের অনেক গ্রামেরই বাইরের চেহারাটা এখন আর গ্রামের মতো না। বিশেষ করে শহরঘেঁষা গ্রাম যেসব, সেসব গ্রাম বাইরে-বাইরে অনেকটাই বদলে গেছে। টেলিভিশন কিংবা ফ্রিজ–এসব অনেক পুরনো ব্যাপার। ডিশের লাইনও পুরনো হতে চলল; এসবের বাইরে গ্রামের অবস্থাপন্নরা এমন কিছু জিনিস ব্যবহার করে, যা অবাক, আর সত্যি কথা বলতে কী, একটু ঈর্ষাকাতরও করে তোলে। তবে আমার ঈর্ষাটা তারা বুঝতে পারে না, আমরা গাড়ি নিয়ে শহর থেকে যাই, আমাদের পকেটে তেমন পয়সা না থাকলে পরনে ঝলমলে পোশাক থাকে, আমাদের দুই সন্তান ফুটফাট কথা বলে, তার অধিকাংশই ইংরেজিতে, আবার কথা বলার বদলে তারা মাঝেমধ্যেই উপেক্ষা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকায়–এতসব কিছু মিলিয়ে গ্রামের যারা যথেষ্ট অবস্থাপন্ন, তারা আমাকে বেশ ধনী লোক ভেবেই বসে আছে। আর এ তো জানা কথাই, ধনী লোকের প্রতি একধরনের আসক্তি প্রায় সবারই থাকে।
এই যে এতসব কথা বলা, তার কিছুটা প্রাসঙ্গিক, কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক। যেটুকু প্রাসঙ্গিক, সেটুকুর কথা বলি। যদিও গ্রামের বাইরের চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে, নাগরিক বিলাসিতার অনেক কিছুই সহজলভ্য এবং বহু ঘরে তা উপস্থিত। আমরা যে বাড়িতে উঠি, সে বাড়িটাও কম-বেশি এ অবস্থার বাইরে নয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ব্যবস্থা ও জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে আমার দুই সন্তান অভ্যস্ত না, তার কিছুই এ বাড়িতে বা গ্রামের অন্য কোনো বাড়িতে অবশিষ্ট নেই। প্রচুর গাছপালা আছে, ফসলের ক্ষেত আছে, ছোট হলেও একটা নদী আছে, হরেক রকম পাখি আছে, বাড়িতে চাপকল আছে, আর একটা পুকুরও, এবং এ রকম আরও অনেক কিছুই। ওসব আমাদের দুই সন্তানকে টানে। ফলে এখানে আসার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ যথেষ্ট, আর তাদের আগ্রহ ছাপিয়ে যায় আমার স্ত্রীর আগ্রহ। উৎসাহের পরিমাণ যদি দাঁড়িপাল্লায় তুলতে হয়, তবে আমার দিকেরটাই উঁচুতে উঠে যাবে। এ কথা ঠিক না যে আমি এখনকার জীবন পছন্দ করি না। এ কথাও ঠিক না, যে আত্মীয়ের বাড়িতে আমি উঠি, সেখানে আমাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়; বরং শহরের আপাত উজ্জ্বল জীবনের বাইরে, এখানে সবুজের কিছু ছোঁয়া নিয়ে দেখে কয়েকটা দিন পার করে দেওয়া এক আনন্দেরই ব্যাপার। কোনো দায়িত্ব পালনের ব্যাপার নেই, কোনো মানসিক চাপ নেই, হাত-পা ছড়িয়ে কয়েকটা দিন পার করে দাও। এ বাড়িতে মাচা আছে, এ গাছ থেকে ও গাছে বাঁধা ঝোলানো দোলনা আছে। আমার কিছু বই পড়ার অভ্যাস, মাচায় বা দোলনায় শুয়ে-বসে বই পড়ার ব্যাপারটা যে চমৎকার, স্বীকার করতেই হবে। বাড়িতে আমার সম্মানও যথেষ্ট, ফুট-ফরমাস খাটার লোক দাঁড়িয়েই থাকে। যদি লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে বসে বা শুয়ে বলি ‘আই, তেল মাখিয়ে শরীরটা খুব করে দাবিয়ে দে তো,’ তাও চলবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাড়ির রান্নাও চমৎকার। যদিও খাবারের প্রতি আমার আসক্তি কম, তরকারিতে তেল-নুন বা জিরা-হলুদের কিছু একটা কম-বেশি হলে আমার তেমন কিছু আসে যায় না, তবে এ কথাও আবার ঠিক–মাঝেমধ্যে স্বাদ বদলানো ভালো। আমার ধারণা, আমার স্ত্রী আমার এ কথায় কোনোই আপত্তি তুলবেন না।
এতসব সুযোগ-সুবিধার পরও আমার যে অনাগ্রহ, তার পরিমাণ সামান্য। তবে সামান্য হলেও তার কিছু ওজন আছে। এ বাড়িতে এসে হীনম্মন্যতায় ভুগি। এই হীনম্মন্যতা আমার অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে সূচিত। দুই ঈদের যে ঈদেই আমরা আসি না কেন, মূলত কোরবানির ঈদেই বেশি আসা হয়, দেখা যায়, যে আত্মীয়তার সূত্র ধরে আমি এ বাসায় আসি, সেই সূত্র ধরে আরও অন্তত দুজন সে ঈদে এ বাড়িতে এসে পড়ে। তারা কী করে, অর্থাৎ কী চাকরি বা কী ব্যবসা, সে সম্পর্কে আমার ধারণা আছে, তবে তাদের উপচানো অর্থের উৎস সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই। আমি আলাভোলা বা নিরাসক্ত দার্শনিক টাইপ মানুষ না এবং এ বাড়িতে তারা যখন দেদার খরচ করে, আর আমি যখন তা পারি না, কষ্ট করে সামান্য কিছু করি মাত্র, নিজেকে আমার ছোট মনে হয়। আমি আমার স্ত্রীকে দেখেও বুঝি, তিনিও একধরনের অস্বস্তিতে ভুগছেন। এই দৃশ্য আমাকে বিচলিত করে। আমি, আমার স্ত্রীও, আমরা কেউই কাউকে বোঝাতে পারি না, আমরা যদিও একটি গাড়ির মালিক, ভালো অঙ্কের টাকাই আমরা বাড়িভাড়া দিই, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমার দুই সন্তানের পেছনে খরচও কম নয়, তা ছাড়া আমরা বেশ গোছানো ও টিপটপ থাকি; আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা ভেতরে-ভেতরে ভালো নয়, বরং বাইরের চিত্রটি যতটা উজ্জ্বল, ভেতরের চিত্রটি সেই, কিংবা আরও কিছুটা বেশি পরিমাণেই বর্ণহীন। এটা কাউকে বোঝানো বা বিশ্বাস করানো যায় না বলে অস্বস্তি যেমন বাড়ে, বিব্রত হওয়ার ঘটনাও কম ঘটে না। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা নিশ্চয় অনেক স্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে। ধরা যাক, ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়তে গেছি আমরা। নামাজ শেষে খুতবা পাঠ চলছে আর মসজিদ উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে টিনের কৌটায় বা গামছায় উপস্থিতজনের কাছ থেকে কাতার ধরে দান তোলা হচ্ছে। দুই টাকাও দিচ্ছে অনেকে, হয়তো পাঁচ-দশ টাকা দেনেওয়ালার সংখ্যাই বেশি, বেশি দিয়ে বেশি সওয়াব হাসিলের সুযোগ কে-ই বা ছাড়তে চায়। তা, আমাদের কাতারে যখন আসে টিনের কৌটা বা গামছা, আমাদের সামনে, আমি একশ’ টাকার বেশি ম্যানেজ করতে পারি না, আর বিবাহসূত্রে আমার দুই আত্মীয় পাঁচশ’ টাকার নিচে নিজেদের নামায় না। একজনকে আমি একবার এক হাজার টাকাও দিতে দেখেছিলাম। তাদের এই প্রাচুর্য এবং মহানুভবতার কথা উপস্থিত আর প্রায় সবার জানা আছে বলে সবারই নজর থাকে, এদিকে। পাঁচশ’ টাকার বদৌলতে তারা তখনই নায়ক বনে যায়, আর একশ’ টাকার আমি নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখি। আমি জানি, এ রকম বলাবলি হয় যে সোবাহান সাহেবের এই জামাইয়ের হাত মোটেও খোলা না। মসজিদেও যেমন, তেমনি গ্রামের দরিদ্র লোকদের মধ্যে দান-খয়রাতের ব্যাপারে যথেষ্ট কৃপণ-প্রকৃতির। এসব কথা কানে এলে আমার হীনম্মন্যতা বাড়ে, আমি সেই হীনম্মন্যতা ভুলে থাকার জন্য নিজেকে গুটিয়ে রাখি। মাচা বা দোলনায় শুয়ে-বসে বই পড়ে আমার সময় কাটে, সন্তানদের সঙ্গেও বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। এলাকার অধিকাংশ মানুষের সঙ্গেও, যাদিও বছরে অন্তত একবার দিন কয়েকের জন্য আসা হয়, আমার তেমন সখ্য নেই। অচেনা মানুষের সঙ্গে মিশতে আমি তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। তবে শহর থেকে যাওয়া আমার অন্য আত্মীয়রা এই কাজে বেশ পটু। ‘হে হে’ করে তারা সবার সঙ্গে মিশে যায়। ফলে গ্রামজুড়ে তাদের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ব্যাপক ও বিশাল। আমার এটা নেই, এটা যে আমার নেই, স্বভাবমতো এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও থাকার কথা নয়। হীনম্মন্যতার কথা অবশ্য আলাদা, ওটা আছে চুপচাপ। তবে চুপচাপ থাকলে, ইদানীং আমার ধারণা, নিশ্চুপ নিঃশব্দ হীনম্মন্যতার এক ক্ষতিকর ক্ষমতা আছে। সে মানুষের ভেতর প্রতিশোধপ্রবণতা বা স্পৃহা তৈরি করে। আমি টের পাই, সম্প্রতি এটা আমার ভেতর তৈরি হয়েছে। আমি হয়তো দোলনায় শুয়ে স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, আমার ভেতর কাজ করছে বৈবাহিক সূত্রে আমার আত্মীয় এবং এই গ্রামের বেশ কয়েকজনকে দেখে নেওয়ার প্রবণতা। কিন্তু কী সামর্থ্য আমার, আর কী-ই বা আমি প্রতিশোধ নেব! কেনই বা নেব–এটা অবশ্য আমার মনে হয় না।
২.
এই প্রতিশোধস্পৃহা আমার ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে যখন থিতু ও পোক্ত হয়, তখন আমার মনে হয়, একটা গল্প আমাকে বানাতে হবে। গল্প তৈরি করা ছাড়া আমার পক্ষে লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হবে না। গল্প তৈরির কথা ভাবতে গিয়ে আমার মনে হল, গল্পের জন্য চাই চরিত্র। এই বা এসব চরিত্র, বাস্তবের হতে পারে, কাল্পনিকও হতে পারে। আরও একটু ভেবে আমি দেখলাম, কিছু কাল্পনিক বা অনুমান করে নেয়া, আরও সহজ করে বললে–কিছু ধরে নেওয়া ব্যাপার ছাড়া গল্প হয় না।
এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। এই একটু আগে পর্যন্ত আমি যা বলে এসেছি, সেখানে অতিরঞ্জন বা কল্পনার কোনো মিশেল নেই। যে চরিত্রগুলোর কথা বলা হয়েছে, তারা সশরীরে বিদ্যমান। তাদের যে আচরণ এবং আনুসঙ্গিক অন্য বিষয়ে যা বলা হয়েছে, তা আমার জানা ও দেখামতে সত্য। এখন এই জানা ও দেখা চরিত্রগুলো নিয়ে কী গল্প বানাব আমি? এরা আমার এত কাছের, গল্প বানাতে হলে যেটুকু দূরে না গেলেই নয়, সেটুকু দূরেও আমার পক্ষে এদের কাছে থেকে যাওয়া কঠিন। একটা চেষ্টা, আমার মনে হল, একটু আগে যে রকম বলেছি আমি, নতুন চরিত্র, কাল্পনিক বা বাস্তব, আমার তৈরি করতে হবে। আর আমার ধরে নিতে হবে, এই কাজগুলো নতুন চরিত্রগুলো করছে।
এ রকম একটা সিদ্ধান্তে স্থির হওয়ার পর আমার মনে হল–এটাই ভালো হয়, নতুন যে চরিত্রগুলো আসবে, তারা হবে বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে তৈরি। যেমন, নমুনা হিসেবে বাদশা মিয়ার কথা আমি উল্লেখ করতে পারি। বাদশা মিয়া স্থানীয় লোক, তাকে আমি চিনি, দেখা হলে সালাম বিনিময় ছাড়াও কিছু কথা তার সঙ্গে আমার হয়। প্রতিবারই যখন দেখা ও কথা হয় তার সঙ্গে, সে তার নতুন উদ্যোগের কথা আমাকে জানায়। নানা ধরনের উদ্যোগে সে সম্প্রতি, এই বছর ছয়-সাত হলো, আমি যত দূর শুনেছি, সে বিস্তর অর্থের মালিক হয়েছে। অর্থপ্রবাহ অবিরাম থাকার বেশকিছু ব্যবস্থা সে করে ফেলেছে, ফলে ওদিকে তাকে আর তেমন নজর দিতে হয় না। তার এখনকার উদ্যোগগুলো হচ্ছে গ্রামবাসীর মঙ্গলের জন্য। এটা অবশ্য আমার কথা নয়, সে, বাদশা মিয়া নিজেই এ রকম বলে আমি শুনেছি–‘হামিই যদি কিছু না করি, আর কে আছে এই গ্রামত…।’
শুধু বাদশা মিয়াকে দিয়ে হবে না। গল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে একজন শক্ত প্রতিপক্ষ দরকার। এই প্রতিপক্ষের গল্পে দ্বন্দ্ব তৈরি হবে, তখন গল্পের পথটি সহজ হবে। তা, এই প্রতিপক্ষ তৈরির ব্যাপারে আমরা আবদুস সামাদের কথা ভেবে দেখতে পারি। আবদুস সামাদও এই এলাকার মানুষ। বাদশা মিয়ার সঙ্গে তার মিল আছে, তারা দু’জনই প্রায় সমান-সমান অবস্থাপন্ন, আর অমিলের দিকটা এ রকম–বাদশা মিয়া নব্য ধনীলোক, আবদুস সালাম তিন পুরুষ ধরে ধনী। তাদের দু’জনের মধ্যে মিল থাকলেও থাকতে পারত। কিন্তু বাদশা মিয়া যেমন বলে, সে না থাকলে এই গ্রামে আর কে কী (ভালো কাজ) করবে, তেমন আবদুস সামাদও বলে, ‘আরে জোলার ব্যাটা, এটিউটি দু’পয়সা কামাসে, এখন ফাল পাড়ার জায়গা খুঁজিচ্ছে।’ শুধু যে ধনী আর গরিবে দ্বন্দ্ব থাকে তা তো নয়, দ্বন্দ্ব ধনী আর ধনীতেও থাকে, সে দ্বন্দ্ব কখনো খুবই আক্রমণাত্মক (কখনো আত্মঘাতীও বৈকি), এই যেমন বাদশা মিয়া ও আবদুস সামাদের দ্বন্দ্ব। তারা দু’জন দু’জনকে দেখে নেওয়ার সামান্য সুযোগও হাতছাড়া করতে রাজি না।
পরে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে, একবার বলেছি যদিও, আরও একবার বলে রাখি–এই যে দুই চরিত্র বাদশা মিয়া ও আবদুস সামাদ, এরা আমার কাছে আধা বাস্তব আধা কাল্পনিক। শরীরগতভাবে এরা বাস্তব, দু’জনই ধনী এটাও বাস্তব, আমার সঙ্গে দু’জনেরই পরিচয়–এটা বাস্তব, তবে পরিচয় এত ঘনিষ্ঠ নয় যে, এদের সবকিছু আমার জানা। এই না-জানা ব্যাপারগুলো আমি আমার মতো করে ধরে নেব। সেটা যে পুরোপুরি কাল্পনিক হবে, তা আমি বলব না। কারণ, ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও, কাউকে দেখতে দেখতে এবং তার সম্পর্কে শুনতে শুনতে ধারণা জন্মায়। আর সে ধারণা থেকে অনুমান ধরেই নেওয়া যায়।
আচ্ছা, এতসব ফিরিস্তিতে না গিয়ে, আমরা ধরেই নিই না কেন, এ দু’জনের ভেতর মসজিদ কমিটির কর্তৃত্ব নিয়ে যথেষ্ট লড়াই আছে। ধরা যাক, এখন মসজিদ কমিটির প্রধান রহিম শেখ। তারা এ গ্রামের পুরনো পরিবারগুলোর একটি। গ্রামের লোক স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে মসজিদ কমিটির প্রধান বানিয়েছিল। তবে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি গত দুই-তিন বছর হলো এই দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি চাচ্ছেন। মসজিদ কমিটির প্রধানকে শুধু দুই ঈদে দায়িত্ব পালন করতে হয় তা নয়, বছর জুড়েই তাঁর কিছু না কিছু কাজ থাকে, আশি ছুঁই ছুঁই রহিম শেখের জন্য তার ভার অনেক। বারবার তিনি তা-ই বলছেন– নতুন লোক নেওয়া হোক, নতুন লোক নেওয়া হোক।
এ আমরা বুঝতেই পারছি, নতুন লোক আর কে হবে– বাদশা মিয়া বা আবদুস সামাদ ছাড়া। আমরা গ্রাম থেকেই উঠে আসা, আর যদি তা না-ও হই, এ আমাদের জানা আছে, গ্রামে মসজিদ উন্নয়ন কমিটির প্রধান হওয়া অনেক সম্মানের ব্যাপার। সম্মানপ্রাপ্তির পাশাপাশি ওই ব্যক্তি বেশ কিছু কাজ করার সুযোগও পায়, লোকজন তাতে খুশি হয়। এমন আকর্ষণীয় পদের জন্য বাদশা মিয়া আর আবদুস সামাদ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামবে না, তা হয় না। আমরা দেখব, গত ঈদের নামাজ শেষে রহিম শেখ যখন চুড়ান্ত করে জানান, তিনি কোনোমতেই আর পারবেন না, নতুন কমিটি করতেই হবে, গ্রামবাসী তা মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং তখন থেকে আবদুস সামাদ ও বাদশা মিয়া নতুন কমিটি গঠনের জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে।
দেখা যাবে গ্রামটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এই বিভাজন কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র অবশ্য ধারণ করবে না। যেমন গ্রামের যারা বয়স্কজন আছে, বহুদিনের ধনীলোক বলে তারা সবাই আবদুস সামাদের পাশে দাঁড়াবে, এমন না। আবার এমনও না, গ্রামের যারা অল্পবয়সী, যাদের অনেক সময়ই স্থানীয় ভাষায় ‘চ্যাংড়া পোলাপান’ বলা হয়, তারা নব্য ধনী বাদশা মিয়ার অন্ধ সমর্থক বনে গেছে। দুই পক্ষই যে যার মতো করে প্রচারণা চালিয়ে যাবে, তারা ঘরে-ঘরে, জনে-জনেও যাবে তাদের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য। তবে কোনোরকম নির্বাচনে আমরা যাব না। দুই পক্ষ নিজ নিজ কমিটি গঠন করবে, একটা দিন ঠিক করা হবে, সেদিন গ্রামের না,-প্রাপ্তবয়স্ক লোকজন গিয়ে দুই কমিটির এক কমিটির পক্ষে ভোট দেবে সিলেকশনেই যদি কাজ হয়, তবে-ব্যবস্থা এ রকম না। একটা কথা আছে এ রকম ইলেকশনের কী দরকার! হ্যাঁ, আমরা যাব সিলেকশনে। আমার ধারণা, গ্রামের বয়স্ক ও সম্মানিতজন যাঁরা, তাঁরাও এই সিলেকশন ব্যাপারটাই বেশি পছন্দ করবেন।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে সিলেকশনের কাজটি সম্পন্ন হলো। যে হেরে গেল, অর্থাৎ মনোনীত হতে পারল না, তার এবং তার সমর্থকদের মুখ কালো হয়ে গেল। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই। রহিম শেখ এবং গ্রামের অন্যান্য মুরব্বি এই মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় ছিলেন। তাঁদের বিরোধিতা করা প্রায় কেউই ভালো চোখে দেখবে না। তাছাড়া দুই পক্ষ তো এই মর্মে অঙ্গীকারবদ্ধই ছিল যে মুরব্বিরা যা বলবেন, তারা মেনে নেবে।
এখন প্রশ্ন, মসজিদ উন্নয়ন কমিটির লোকজন হিসেবে কারা মনোনীত হলো, তাদের নেতা কে? এই তথ্য প্রকাশ আমার কাছে খুব একটা জরুরি মনে হচ্ছে না। আমি ভেবে দেখেছি, আবদুস সামাদই মনোনীত হোক কিংবা বাদশা মিয়া, যে কেউই হোক, আমার যে পরিকল্পনা, তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না; বরং ব্যাপারটা অস্পষ্ট রেখে, আমি নিজের মতো করে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাব।
একজন মনোনীত হয়েছে-সুতরাং আমরা ধরে নিলাম, বাদশা মিয়া বা আবদুস সামাদ এবং মনোনীত হওয়ার পরপরই সে কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। যদিও আমি বলেছি যে মসজিদ উন্নয়ন কমিটির বছর জুড়ে কাজ থাকে, সে কথা আমি অস্বীকার বা প্রত্যাহার করছি না, শুধু এটুকু স্পষ্ট করছি যে মসজিদ উন্নয়ন কমিটির যে প্রধান, সে তার কর্মদক্ষতা দেখানো ও জানানোর সবচেয়ে বড় সুযোগটা পায় ঈদের জামাতে। গ্রামে এসব মসজিদেই হয়।-মসজিদ আছে, ঈদগাহও আছে। রোজকার নামাজ, জুমার নামাজ মসজিদের দেখভালও কমিটি-প্রধানকেই করতে হয়। তবে ঈদের দিন এলাকার প্রায় সব মানুষই মসজিদ ছেড়ে ঈদগাহমুখী হয়। ঈদগাহ সেদিন থাকে সুসজ্জিত, দেয়ালে নতুন করে চুনকাম হয়, শামিয়ানা টানানো হয়, ইমাম ও তাঁর সহযোগীদের নামাজ পড়ানো, খুতবা পাঠের জায়গাটা করা হয় বাহারি। সবাইকে এক চকমকে, ঝলমলে, চোখ জুড়ানো অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকে। এ রকম বহুদিন ধরে হয়ে আসছে, এটা নতুন কিছু না; রহিম শেখের সময় এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, শুনেছি তার আগেও এই চেষ্টাটা ছিল।
এটা নতুন কিছু নয়, সাজসজ্জা আর কতই বা বাড়ানো যাবে, আর মানুষ তাতে কতই বা মুগ্ধ হবে, এ রকম ভাবল আবদুস সামাদ বা বাদশা মিয়া। এবার তেমন একটা চমক দিতে না পারলে আগের কমিটির সঙ্গে তাদের কমিটির কী পার্থক্য থাকল! ভাবতে হ্যাঁ, একটা কাজ করা যায়।-বসল বাদশা মিয়া কিংবা আবদুস সামাদ। ভাবতে, দেখল কাজটা যদিও কঠিন ও পরিশ্রমসাপেক্ষ, কিছুটা ভাগ্যের ওপরও নির্ভর করতে হবে, তবে যদি করেই ফেলা যায়, গ্রাম জুড়ে একটা হইহই পড়বে। সুতরাং সে চেষ্টাই খোঁজখবর নেওয়ার। তারপর আরও কয়েকটি পর্ব আছে। কিন্তু এই-চলল। প্রথম পর্ব প্রথম পর্বটিই যথেষ্ট পরিশ্রমের। এটা যে এত কঠিন হতে পারে, জানা ছিল না আবদুস সামাদ বা বাদশা মিয়ার। নানজনের খোঁজ এল বটে, তাদের কেউই চমকে দেওয়ার ও বিমোহিত করার মতো নয়। অবস্থা একসময় হলো হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো।
কিন্তু অনেক দূর চলে এসেছি আমি। এখন আমার ফিরে আসার উপায় নেই। বাস্তবে আবদুস সামাদ কিংবা বাদশা মিয়া যা খুঁজছে, তা পেল কি পেল না, সে আমি দেখতেও হ্যাঁ, তারা শেষ পর্যন্ত পেল।-যাব না। আমি ধরে নেব
খবর এল ঈদের মাস দেড়েক আগে। ঘোষণাটা অবশ্য তখনই দেওয়া হলো না, দেওয়া হ্যাঁ, তিনি-হলো আরও দিন পনের-বিশ পর, যখন যোগাযোগ করে নিশ্চিতই হওয়া গেছে আসবেন। এই ঘোষণার পর গ্রামজুড়ে একই সঙ্গে আনন্দ ও প্রশান্তি নেমে এল। জীবনে এমন একটা বড় সুযোগ পাওয়া যাবে, গ্রামবাসী কি জানত! তারা বাদশা মিয়া অথবা আবদুস সামাদের নামে ধন্য করতে লাগল। ফলে আবদুস সামাদ বা বাদশা মিয়া খুবই আনন্দ ও গর্ব বোধ করল, আবার বাদশা মিয়া কিংবা আবদুস সামাদ খুবই মর্মাহত হলো। কিছু করার নেই, শক্রতা যখন প্রবল, একজন আনন্দিত হওয়ার উপলক্ষ পেলে অন্যজন মর্মাহত হবেই। যাক এসব কথা, ঘটনাটা বলা দরকার। ঘটনাটা এ এমন এক হুজুরের সন্ধান পাওয়া গেছে, তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, ইন্ডিয়া-রকম ও পাকিস্তানের অনেক নামকরা মসজিদে ইমামতি করেছেন। মাইল তিন-চার দূরের এক গ্রামে এক পীর বাস করেন। বাদশা মিয়া কিংবা আবদুস সামাদের সুবিধার জন্য আমাদের ধরে নিতে হবে, এই পীরের সঙ্গে ওই ইমামের ভালো সম্পর্ক। আমরা এও জানব, বিখ্যাত ওই ইমাম পীরের বাসায় আসবেন এবং মাস দুয়েক থাকবেন। এখন শুধু পীর সাহেব কি ওই বুজুর্গ ব্যক্তিকে রাজি-একটি বিষয়েই নিশ্চিত হওয়া বাকি করাতে পারবেন এই গ্রামে এসে ঈদের নামাজ পড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে? আমার জানা নেই, তিনি পারবেন কি না। তবে আমি ধরে নেব, তিনি পারবেন, পীর সাহেব আবদুস ব্যাপারটা অবশ্যই তিনি-সামাদ বা বাদশা মিয়াকে এই বলে নিশ্চিন্ত করবেন এই শব্দের ওপর খুব বেশি নির্ভর করা যায় না। ফলে আবদুস-দেখবেন। ‘দেখবেন’ সামাদ অথবা বাদশা মিয়া মরিয়া হয়ে উঠবে এবং একপর্যায়ে পীর সাহেব কথা দেবেন। তিনি বলবেন, যদিও আশপাশের দশ-বিশ গ্রাম হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, তবে এক অজানা কারণে (কারণের কথা তিনি জানাবেন না) তিনি অবশ্যই এই ব্যবস্থা করে দেবেন, যেন হুজুর ঈদের নামাজে আবদুস সামাদ কিংবা বাদশা মিয়ার গ্রামেই ইমামতি করেন। আবদুস সামাদ অথবা বাদাশা মিয়ার বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি আরও কিছু ব্যাপার জানান। এই যেমন, হুজুর এখনই নয়, আসবেন ঈদের দিন দশেক আগে। তিনি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন। সুতরাং আবার এসে ওনাকে বিরক্ত করার দরকার নেই। তিনি, অর্থাৎ পীর সাহেব ঈদের দিন ভোরে, নামাজ আরম্ভ হওয়ার বেশ আগেই হুজুরকে পাঠিয়ে দেবেন।
‘হুজুরকে ঈদের আগে পাঠালে হয় না, কিছু হলেও দূরের পথ, সকালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে যদি কোনো কারণে দেরি …।’
পীর সাহেব বললেন, ঈদের দিন সকালে হুজুরের ঘুম তাঁর বাড়িতেই ভাঙুক, এটা তিনি চান।
‘তবে কি ঈদের রাতে তাদের গ্রাম থেকে কেউ এসে থাকবে এখানে, সকালে হুজুরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। না হলে সেটা বড় বেয়াদবি হয়ে যাবে।’
পীর সাহেব জানালেন, না, এরও কোনো প্রয়োজনীয়তা তিনি দেখছেন না।
‘তবে কি ভোররাতে কেউ এসে পৌঁছাবে, গাড়িসহ? হুজুর নিজে কী করে যাবেন! এটা কেমন দেখায়!’
পীর সাহেব জানালেন, দায়িত্ব যখন তিনি নিয়েছেন, দায়িত্ব যা যা আছে, তিনিই পালন করবেন। সুতরাং ভোরবেলা হুজুরকে সম্মানের সঙ্গে গাড়িতে করেই পাঠিয়ে দিতে তাঁর কোনো ভুল বা অসুবিধা হবে না। আবদুস সামাদ বা বাদশা মিয়া পুরো নিশ্চিত হয়েই ফিরে যেতে পারে। এই বলে পীর সাহেব তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরটিও দিয়ে দিলেন, প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য।
এরপর আর কথা চলে না। সুতরাং আবদুস সামাদ কিংবা বাদশা মিয়াকে উঠতেই হলো। পীরের পা ছুঁয়ে দোয়া নিল এবং বলল, পীর সাহেবের মহানুভবতার কথা সে সব সময়ই মনে রাখবে এবং এত বড় এক সম্মানের অংশীদার করার জন্য পীর সাহেব যেকোনো প্রয়োজনে তাকে পাশে পাবেন।
আবদুস সামাদ কিংবা বাদশা মিয়ার পক্ষ এই ব্যবস্থার মধ্যে কোনো খুঁতই খুঁজে পেল না। তবে বাদশা মিয়া অথবা আবদুস সামাদের পক্ষ অবশ্যই খুঁত খুঁজে পেল এবং আরও খুঁত খুঁজে বের করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠল। তবে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। কারণ, গ্রামবাসী তখন প্রায় সবাই এ রকম বলাবলি করছিল যে, পীর সাহেব তো ঠিকই বলেছেন। তিনি যে অমন একজন বড় মাপের ইমামকে এ গ্রামে ঈদের দিন সকালে আসার এবং ঈদের নামাজে ইমামতি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, এ তো বিশাল এক ব্যাপার। এর বেশি আশা করাটাই অন্যায় হবে।
গ্রামজুড়ে এ ধরনের বলাবলি যখন পোক্ত হলো, গ্রামবাসী তখন আনন্দ করতে লাগল।
৩.
এখন মোহাদ্দেসের কথা বলার সময় এসেছে। এই মোহাদ্দেসকে আমি একেবারেই চিনি না। তার নাম আদৌ মোহাদ্দেস কি না, তা-ও আমার জানা নেই। জানা না থাকায় কোনো অসুবিধাও হবে না। কারণ তার নাম এ গল্পে কোনো বিচারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওটুকুই, যা সে করবে, কিংবা এভাবেও বলা যায়–গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওটুকুই, যা সে করবে বলে আমরা ধরে নেব এবং যা আমরা তাকে দিয়ে করাব।
মোহাদ্দেসের নাম সোলায়মান হতে পারত কিংবা যা কিছু; সম্পূর্ণ কাল্পনিক যে চরিত্র, তার কী নাম, তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়। তবে মোহাদ্দেস হিসেবেই তাকে ডেকে ফেলা হয়েছে, সুতরাং এ নামটাই চলুক। এই মোহাদ্দেস পেশায় প্রতারক। সে বুদ্ধিমান এবং বেশ কিছুটা শিক্ষিতও। প্রতারণার নানা রকম কৌশল তার জানা আছে, এও তার ভালো জানা আছে–আমজনতা এবং কখনো কখনো এই আমজনতার কিছু উঁচুস্তরের মানুষকে ঠকাতে হলে কী কী ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। মেহেদির রঙে রাঙানো তার দাড়ি। না, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি না, ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে মানুষের তেমন বিশ্বাস নেই, তার দাড়ি মুখভরা এবং কণ্ঠদেশ ছাড়িয়ে নেমে আসা। তার চোখে সুরমা এবং কপালে কালো দাগ। সে নামাজ পড়ে না, যদিও প্রতিটি নামাজের নিয়ম, দোয়া সে জানে। কপালের দাগটি সে করেছে সেজদার ভঙ্গিতে মেঝেতে কপাল ঘষে ঘষে। চেহারায় একধরনের, একই সঙ্গে গাম্ভীর্য ও সারল্য সে আনতে পেরেছে। এই সব মিলে প্রতারক হিসেবে তাকে বুঝে ওঠা নিতান্তই কঠিন। ফলে যদিও অনেক দিন ধরে লোক-ঠকানোর কাজ সে করে যাচ্ছে, তাকে একবারও ধরা পড়তে হয় নি। এমনকি লোকজন তাকে সন্দেহও করে নি, তার কথায় দ্বিধায় পড়ে নি, অর্থাৎ–তার জন্য এ পর্যন্ত সবকিছু সহজ ও সরল। অবশ্য তাকে নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করতে হয়, নিত্যনতুন কৌশল ছাড়া প্রতারণা চলে না, আর আমরা প্রথমেই বলে নিয়েছি যে সে বুদ্ধিমান এবং বেশ কিছুটা শিক্ষিতও।
এমন অনেক প্রতারক আছে, যারা শেষ দিনটি পর্যন্ত সফলভাবে উতরে যায়। যদিও তাকে বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত বলেছি, মোহাদ্দেসের ক্ষেত্রে শত ভাগ সাফল্য আমি দেখাতে পারব না। ওই যে, সেই কবে থেকে একটা-দুটো কথা প্রচলিত–চোরের দশ দিন গৃহস্থের এক দিন, কিংবা বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান…। না, তার প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ আমার নেই। কাল্পনিক চরিত্রের প্রতি তা থাকার কথাও না। আমি শুধু যা করব, তা হলো, আমার প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে আমি পরিচালনা করব।
তাহলে বিলম্ব না করে এই এখনই ধরে নিই, এই এবারই সে, জীবনে প্রথমবারের মতো ফেঁসে গেছে। ধরে নিই দিনটা ঈদের এবং মোহাদ্দেসও ধরে নিয়েছিল, ধরে নেওয়াটাই স্বাভাবিক, ঈদের দিন–মানুষ থাকবে খুশিতে মশগুল, আনন্দে বিভোর, মন থাকবে নরম এবং আনন্দে পূর্ণ। খুব সকালেই সে তাই কাজে নেমে পড়েছিল। তার আছে মেহেদি রাঙানো মনোরম দাড়ি, চোখে সুরমা, কপালে কালো দাগ, মাথায় কারুকাজ করা টুপি, পরনে মচৎকার শেরোয়ানি। এ ছাড়া তার চেহারায় গাম্ভীর্য ও সারল্যের যুগল অবস্থান তো আছেই। কিন্তু এতসব কিছুর পরও, কপালে দুর্ভোগ ছিল তার, সে ধরা পড়ে গেল। ধরা পড়ে গেল মানে তার কোমরে রশি পড়ল– এ রকম হলে আমি গল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না; বরং এ রকম দেখাই যে তার প্রতারণা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তার যখন আক্ষরিক অর্থে ধরা পড়ার উপক্রম, সে ভিড় ঠেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে লাগল। ছুটে পালানোর অভ্যেস নেই তার, কিন্তু মানুষের প্রাণের ভয়, কী যে ভয়! মোহাদ্দেস ছুটতে লাগল। প্রাণপণে। আর তাকে ধরার জন্য তার পেছনে পেছনে ছুটল অনেক অনেক লোক। ঈদের দিনে, আনন্দের দিন তো, এও এক মজা।
যে গ্রামের কথা বলতে বলতে আমি মোহাদ্দেসের কথায় চলে গিয়েছিলাম, মোহাদ্দেস ছুটছে, ছুটুক না; সে গ্রামের কথা আবার কিছু বলি। আবদুস সামাদ কিংবা বাদশা মিয়া–এ দুজনের একজনের অবস্থা সুবিধার নয়, দুজনের একজন নানা রকম উৎসবের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সে কিছু সঙ্গী নিয়ে ঈদগাহের সাজসজ্জায়, যদিও প্রয়োজন নেই, তদারক করছে, বারবার ঘড়ি দেখছে, সঙ্গীদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তার পক্ষের বেশকিছু লোক চলে গেছে গ্রাম ছাড়িয়ে আরও সামনে, হুজুর যে গাড়িতে আসবেন, সে গাড়ির চালক পথ ভুল করতে পারে, তা ছাড়া তাঁকে যত দূর সম্ভব এগিয়ে থেকে বরণ করাই ভালো।
আবদুস সামাদ বা বাদশা মিয়ার একজন চিন্তিত বা উৎকণ্ঠিত হলে, আরেকজনের আনন্দিত ও উৎফুল্ল হওয়ার কথা। সত্যি কথা বলতে, যতটা তার উৎফুল্ল হওয়ার কথা, যতটা তার আনন্দ বোধ করার কথা, ততটা হচ্ছে না। বেশ মজাই লাগছে, তার, প্রতিপক্ষ বিপদে পড়েছে, বুঝুক এবার, এ রকম প্রায়ই সে ভাবছে। আবার এ রকম একটা ভাবনাও সে এড়িয়ে যেতে পারছে না–ঈদের এই আনন্দের দিনে অমন এক মশহুর হুজুরের ইমামতিতে নামাজ পড়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে!
গ্রামের লোকজনও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। পীর সাহেব বারবার নিশ্চিন্ত করার পরও এমন কেন ঘটবে! কেন হুজুর, সময় প্রায় পেরিয়ে যেতে বসেছে, এসে পৌঁছাবেন না! আমি এ গ্রামে যে বাড়িতে উঠি, সে বাড়িতেও উৎকণ্ঠা। বাড়ির মুরব্বি ধৈর্যশীল মানুষ এবং বিচলিত হওয়া ঘটনায়ও বিচলিত খুব কমই হন। তাঁকেও কেমন কেমন দেখাচ্ছে। বৈবাহিক সূত্রে যে দুজন আমার আত্মীয়, তারা অবশ্য যথেষ্টই অস্থির। নানা রকম মন্তব্য করে তারা পরিবেশ গরম করে রেখেছে এবং মিনিট দুই-তিন পরপরই বাড়ির ছোট কাউকে পাঠাচ্ছে সামনের দিকে, নতুন কোনো খবর থাকলে তা জোগাড় করে আনার জন্য। কেউ কেউ এ সময় জিজ্ঞেস করে বসতে পারে, সবার যখন ও রকম অবস্থা, আমার অবস্থা কী। ধরে নিই, সবার মতো আমিও তখন অস্থির। এ গেল আমার তখনকার অবস্থা। বলা ভালো, আমার কিন্তু এখনো অস্থির অবস্থা। গল্পটা ঠিকমতো শেষ করতে পারব তো?
গল্প অবশ্য শেষ করেই দেওয়া যায়। যে পর্যন্ত লেখা হয়েছে, সে পর্যন্তই গল্প। ঈদের নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, মশহুর এবং হুজুর আসবেন বলে সবার মধ্যে প্রবল উৎসাহ; সেই হুজুর আসছেন না বলে সবাই অস্থির এবং সেই অস্থিরতা একটু একটু করে বাড়ছে। এমন এক অবস্থায় এসে কি গল্প শেষ করা যায় না? অবশ্যই যায়। তবে তার আগে মোহাদ্দেস তখন কী করছে, সেটাও আমরা একটু চেয়ে দেখতে পারি।
ততক্ষণে ধাওয়া করা লোকজনের নাগালের অনেক বাইরে চলে এসেছে মোহাদ্দেস। তবে সে যে নাগালের বাইরে এ কথাটা সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এর একটাই কারণ, সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। এর আগপর্যন্ত শত ভাগ সাফল্য তাকে এতটাই আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল, প্রথম ব্যর্থতাটি তাকে ততটাই দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। ভয়, ব্যর্থতার গ্লানি–এসব মিলেমিশে এমন অবস্থা হয়েছে, সে ঠিকমতো চিন্তাও করতে পারছে না। অনেকটা পথ পার হয়ে আসার পরও সে বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। পেছনে বহুদূর পর্যন্ত সন্দেহজনক কেউ নেই, আক্রোশে ও আনন্দে যারা তার পিছু নিয়েছিল, তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে অনেক আগেই ফিরে গেছে, তবু মোহাদ্দেস এ রকম ভাবছে–লোকজন এখনো, হয়তো বেশ দূরেই তারা, তার পেছনে পেছনে আসছে। এই ভয় তাকে সুস্থির হতে দিচ্ছে না, সে থামছে না, সে চাইছে, দূরে, যত দূর সম্ভব দূরে যেতে। তা, তাকে আমরা সে সুযোগটা, দূরে সরে যাওয়ার, যদি না দিই, গল্প শেষ করতে অসুবিধা হবে।
মোহাদ্দেস যখন নিতান্তই ভালো মানুষের চেহারা নিয়ে ধীরে ধীরে ঘটনাস্থল থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে আসছে, তখন আমরা ফিরে যাই আমাদের ফেলে আসা গ্রামে। ওই গ্রামে তখন উত্তেজনা বেড়েছে। আবদুস সামাদ কিংবা বাদশা মিয়া যথেষ্ট বিপাকে। গ্রামের মানুষ নামাজের জন্য আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে! তাদের অস্থিরতা ক্রমশ দানা বাঁধছে। এটা বুঝতে পেরে বাদশা মিয়া অথবা আবদুস সামাদ বার কয়েক মাইকে গ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু গুছিয়ে সে কিছুই বলতে পারে নি, গ্রামবাসীও তার কথা শোনার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
আবদুস সামাদ অথবা বাদশা মিয়া এই হিসাবটা কিছুতেই মেলাতে পারছে না–পীর সাহেব অমন বারবার বলার পরও কেন এমন হলো! হুজুর কি তবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? নাকি ওই গ্রামের লোকজন হুজুরকে আটকে রেখেছে, তাদের গ্রামে নামাজ পড়িয়ে তবে হুজুর অন্য কোথাও যাবেন? হুজুরকে নিয়ে যে গাড়িটি রওনা দিয়েছে, তার চালক কি অনেক আগেই পথ এলোমেলো করে ফেলেছে? নাকি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে পথে? না না, এমন খারাপ চিন্তা অনুচিত হবে, এটুকু অবশ্য ভাবা যেতে পারে যে দুর্ঘটনা ঘটে নি, পথের কোথাও গাড়িটি বিকল হয়ে পড়েছে।
আসল খবরটা পাওয়া যেত, যদি পীর সাহেব তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত যে নম্বরটি দিয়েছিলেন, সেই নম্বরে যোগাযোগ স্থাপন করা যেত। কিন্তু পীর সাহেবের ওই মোবাইল ফোন সেটটিও অফ করা। বহুজনের বহু সেট থেকে বহুবার চেষ্টা করার পরও পীর সাহেবের ওই নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তা হলে?…কিছুক্ষণ পর গ্রামবাসী আওয়াজ তুলল, নামাজটা হয়ে যাক।
ঈদগাহে থাকা নিরাপদ মনে করল না আবদুস সামাদ কিংবা বাদশা মিয়া। সে কেশে গলা পরিষ্কার করে মাইকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তার মন বলছে হুজুর এই এখনই এসে পড়বেন। বড়জোর পাঁচ, আরও বেশি হলে দশ মিনিট লাগবে, তার পরই নামাজ আরম্ভ হয়ে যাবে। মশহুর এক ইমামের ইমামতিতে ঈদের নামাজ আদায়ের যে দুর্লভ সুযোগ পাওয়া গেছে, তা হেলায় না হারানোর জন্য তার বিনীত আবেদন থাকছে। সে এখন নিজেই যাচ্ছে হুজুরকে বরণ করার জন্য।
ওদিকে বেশ অনেকটাই সময় গেছে, মোহাদ্দেসের ভয় অনেকটাই দূর হয়েছে। সে মহাসড়কে উঠে রিকশা নিয়েছে। তার মন ভালো নেই। ভয় অনেকটা দূর হলেও দিনটা মাটি হলো বলে তার মন খারাপ। তার মন খারাপ, সে ক্লান্ত, তার ভেতর কাজ করছে ব্যর্থতার গ্লানি–এতসব মিলে সে ছিল পুরোপুরি অন্যমনষ্ক। ফলে প্রথম আওয়াজটা আমরা তার কানে পৌঁছে দেব না। দ্বিতীয় আওয়াজটা অবশ্য তার কানে এসে পৌঁছাবে। সে সভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখবে, নানা রকম কথা বলতে বলতে বেশ কয়েকজন লোক তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে দিয়েছে। মোহাদ্দেস তাদের অনেক কথার একটাই স্পষ্ট শুনবে, ‘ওই যে, ওই যে।’ মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাবে তার। হায়! তবে কি সে ধরা পড়েই গেল! তবু শেষ চেষ্টা করে মানুষ। সে চেষ্টারই অংশবিশেষ হিসেবে মোহাদ্দেস ভাবল, রিকশা থেকে লাফিয়ে নামবে সে এবং সামনে কিংবা ডাইনে বা বাঁয়ে, যেদিকেই হোক, দৌড়াতে আরম্ভ করবে। কিন্তু তার আগেই আমরা দেখব, তার রিকশা ঘিরে ফেলেছে সামনে থেকে আসা বেশ কয়েকজন লোক। এদের সে আগে লক্ষ্য করে নি। এরা কি সেই অত দূর থেকে তাকে তাড়িয়ে এনে দুদিক থেকে তার পথ বন্ধ করে অপেক্ষায় ছিল? এই প্রশ্নের একটি উত্তর তার ভেতর তৈরি হওয়ার আগেই ভিড়ের ভেতর থেকে একজন তাকে সালাম দিয়ে নরম গলায় বলল, ‘হুজুর, পথে কি ঝামেলায় পড়েছিলেন? আমরা সেই কখন থেকে…’