একেবারে হঠাৎ করে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কমোডর তসলিম কোবিদ মারা গেলেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হলো, গ্যাসট্রাইটিসের মারাত্মক আক্রমণ থেকে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে। খবরটা ছড়িয়ে পড়তে রাজধানীতে তো বটেই, সারা দেশেও শোকের ছায়া নেমে এলো।
খুব নামকরা একজন মানুষ অকালমৃত্যুর শিকার হলেন। মাত্র ৫৫ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর, মেনে নিতে সবারই কষ্ট হবে। ছোটখাটো কাঠামো, কিন্তু সুঠাম স্বাস্থ্য আর প্রাণচাঞ্চল্য দেখে মনে হতো, তাঁর বয়স আরো অনেক কম।
ঢাকার বহু লোকের কাছে একটা দৃশ্য খুবই পরিচিত : ছাদখোলা প্রকাণ্ড গাড়ির পেছনের সিটে শিরদাঁড়া খাড়া করে বসে আছেন, চোখের দৃষ্টিতে সাফল্যের গর্ব আর মুখের ভাবে বিজয়ীর অহংকার, ঠিক যেন সেই আগেকার দিনের একজন প্রতাপশালী রাজা, সামনের সিটে বসে তাঁর সতর্ক দেহরক্ষী।
খবরটা পরদিন সকালে পেলাম আমি, আমার বস ডাক্তার আজাদুল কান্তিক যখন অফিসে এলেন। নামের আগে এখনো আমরা ডাক্তার ব্যবহার করলেও তিনি আসলে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিয়ে হাত পাকিয়েছেন গোয়েন্দাগিরিতে। প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগী মারছিলাম, গোয়েন্দাগিরি করতে এসে নির্দোষ লোকের প্রাণ আর মান বাঁচাচ্ছি। কোনটা ভালো?’ তাঁর এই যুক্তির সঙ্গে তর্ক চলে না। আমি অতেব সরকার, তাঁর সেক্রেটারি।
আমার গোয়েন্দা শিরোমণি বস কোবিদ পরিবারের একজন বন্ধু। অফিসে ঢুকে নিজের কামরার দিকে এগোচ্ছেন, হাতের কাগজটা আমার ডেস্কে ছুড়ে দিলেন, সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তসলিম চলে গেলেন। বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়তো কী! মাত্র দুই রাত আগে ওঁদের ওখানে আমি ডিনার খেয়েছি।’ আমাকে খবরটা পড়তে দিয়ে তিনি তাঁর খাসকামরায় ঢুকলেন।
দেখলাম, শিরোনাম করা হয়েছে তিন কলামজুড়ে। খবরের পাশেই ছাপা হয়েছে তসলিম কোবিদ আর তাঁর পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। বংশবৃক্ষ অনুসারে তিনি চতুর্থ প্রজন্মের একজন কোবিদ, যিনি প্রথম প্রজন্মের মাথা ছিলেন, নিজ এলাকায় জ্ঞান ও গরিমায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করায় তাঁকে এই খেতাব দেওয়া হয়- কোবিদ; অন্তত লোকমুখে সেটাই প্রচারিত হয়েছে।
চতুর্থ কোবিদ অর্থাৎ কমোডর তসলিম কিঞ্চিৎ লেখালেখি করলেও তাঁর কৃতিত্ব ও অর্জন সাগরে, সৈকতে, জাহাজে, ডকইয়ার্ডে তথা অর্থনীতিতে। শুরু সাম্পান তৈরি করে বিক্রি, তারপর লঞ্চ-স্টিমার-টাগ, সব শেষে নানা ধরনের ইয়ট আর প্রমোদতরী বানিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি। নৌযান সম্পর্কে তাঁর নেশা আর পেশাগত দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ বিদেশি ইয়ট ক্লাবগুলো শখ করে খেতাব দিয়েছে তাঁকে কমোডর; আর সেটাই তাঁর নামের আগে এ রকম অচ্ছেদ্য হয়ে জুড়ে গেছে।
কমোডর তসলিম দেশি-বিদেশি অভিজাত মহলে ওঠাবসা করতেন। ব্রিটিশ রাজপরিবার গত বছর তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছে। ভারত, নেপাল ও ভুটানের অনেক সাবেক রাজা, রাজপুত্র আর রাজকন্যা রমনা এলাকার ওই প্রাসাদতুল্য বাড়িতে তাঁর আমন্ত্রিত অতিথি হতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন।
তবে গর্ব আর মর্যাদা উথলে পড়ার মতো এতসব বিষয়ের মধ্যে একফোঁটা গরলও আছে, প্রিন্ট মিডিয়া যেটাকে বিষাক্ত কাঁটা বলতেই বেশি পছন্দ করে। সেই কাঁটার নাম সলিম কোবিদ, তসলিম কোবিদের একমাত্র সন্তান। কাগজে তো কত কিছুই লেখে, সব তার আমি বিশ্বাস করি না; তবে বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জেনেছি, মুকুটবিহীন রাজপুত্রের মতো আচরণ তাঁর, দুই হাতে টাকা ওড়ান, প্রতিদিন নতুন নতুন প্রেম করেন। আবার এও কানে এসেছে, বাবার সঙ্গে যতই ঝগড়া থাক, ব্যবসায় জনককে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রতিজ্ঞা আছে তাঁর মধ্যে।
তখনো কাগজ পড়া শেষ হয়নি আমার, বসের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সিআইডি চিফ আন্দেশা কাফি ঢুকলেন অফিসে। তিনি সাদা পোশাকে এসেছেন, দেখে খটকা লাগল আমার। তারপর যখন দেখলাম তাঁর চেহারা থমথম করছে, তখন ঘাবড়ে গেলাম। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াচ্ছি, বললাম, ‘কী ব্যাপার, স্যার?’
আমার কথার জবাব না দিয়ে চোখ ইশারায় পাশের কামরার দরজাটা দেখালেন। ‘উনি কি এসেছেন?’
‘জি,’ বললাম আমি। ‘আপনি ঢুকুন।’
‘তোমাকেও ঢুকতে বলছি,’ বললেন তিনি। ‘কান্তিক চাইবেন তুমিও সব শোনো।’
বাইরের কামরায় তালা দিলাম, কেউ যাতে আমাদের বিরক্ত করতে না পারে। তারপর সিআইডিপ্রধানের পিছু নিয়ে ঢুকে পড়লাম বসের অফিস কামরায়।
লম্বা ডেস্কে কনুই রেখে একটা ফাইলে চোখ বোলাচ্ছেন ডাক্তার কান্তিক। তাঁর এক হাতে জ্বলন্ত পাইপ, আরেক হাতে বড় একটা মিছরির টুকরো- ওই টুকরোয় মাঝেমধ্যে কামড় দিচ্ছে এইপ মনু। মনুকে অনেকে বানর বলে ভুল করে। ও আসলে বানরের আগের প্রজাতি।
প্রিয় বন্ধুর চেহারাটা একবার দেখামাত্র চেয়ারে সিধে হলেন ডাক্তার কান্তিক। মিছরির টুকরো পুরোটা একসঙ্গে পেয়ে গেল মনু। ‘আসুন। আবার কী ঘটল?’ জানতে চাইলেন।
‘যা ঘটেছে, নিজেকে আমার আহা বেচারা বলতে ইচ্ছে করছে,’ তিক্ত স্বরে বললেন আন্দেশা কাফি। ‘বিলিভ মি, মতিঝিলে বসে পড়া হেফাজতও আমাকে এতটা বিচলিত করতে পারেনি।’
‘বায়ুতে যাদের ভিত তাদের কথা বাদ দিন,’ হাত ঝাপটা দিয়ে ওই প্রসঙ্গ বাতিল করে দিলেন আমার বস। ‘আপনার কী হয়েছে তাই বলুন, আমি সাহায্য করতে পারি?’ ডাক্তার কান্তিক জানতে চাইলেন।
‘আপনি যদি না পারেন,’ আন্দেশা কাফির সরল স্বীকারোক্তি, ‘কেউ পারবে না।’ বুক পকেট থেকে একটা এনভেলপ বের করে বসের হাতে ধরিয়ে দিলেন। বসের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছি আমি। সাধারণ একটা এনভেলপ, সব জায়গায় কিনতে পাওয়া যায়। এসেছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। এনভেলপের গায়ে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে বেশ কষ্ট করে সাজানো হরফ দিয়ে, প্রতিটি হরফ অলংকৃত এবং হাতে আঁকা।
প্রযত্নে : সিআইডি চিফ
ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট, শান্তিনগর, ঢাকা
খামের ভেতর একটা কাগজ, তাতেও ওই একই ভঙ্গিতে হরফ এঁকে লেখা হয়েছে একটি বাক্য :
কমোডর তসলিমকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে
কেউ কথা বলছি না। অন্তত ৩০ সেকেন্ড কামরার সব কিছু এতটা স্থির হয়ে থাকল, খুদে দাঁত দিয়ে মনুর মিছরি খাওয়ার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমরা। আমাদের সামনে যে সম্ভাবনাগুলো ঝুলে আছে, সব কয়টা সত্যি খুব ভয়ংকর।
নীরবতা ভেঙে সিআইডি চিফ বললেন, ‘এটা হয়তো কিছুই না। মানে কোনো পাগলের প্রলাপ হওয়া অসম্ভব নয়।’
‘অথচ আপনি পালাতে চাইছিলেন,’ শান্ত সুরে মনে করিয়ে দিলেন ডাক্তার কান্তিক।
‘হ্যাঁ। এটাই তো সবচেয়ে খারাপ দিক! হয়তো এর ভেতরে সত্যি কিছু আছে। পরে যদি জানা যায় আমাকে সাবধান করা হয়েছিল, কিন্তু আমি কোনো অ্যাকশন নিইনি, ভাবতে পারেন তখন কী হবে?’
‘কী করতে চাইছেন আপনি, ওল্ড থিং?’ জানতে চাইলেন ডাক্তার কান্তিক।
‘আমি কী করতে চাইছি? প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সেক্রেটারি, অ্যাম্বাসাডর, শিল্পপতি অর্থাৎ গণ্যমান্য সবাই সশরীরে গিয়ে শোক বইতে সই করছেন, তাঁদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলব, লাশ নিয়ে যাচ্ছি, ময়নাতদন্ত করতে হবে?’
‘ভালো হ্যাপাতেই পড়েছেন দেখছি,’ বিড়বিড় করলেন ডাক্তার কান্তিক।
‘রিপোর্টাররা চাকভর্তি মৌমাছির মতো ভিড় করে আছে ওখানে,’ বললেন সিআইডি চিফ। ‘এমনকি এ রকম একটা সময়ে ওই বাড়িতে আমার চেহারা দেখানোটাও কুৎসিত একটা কেলেঙ্কারি জন্ম দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি কিংবা আমার ডিপার্টমেন্টের কারো ওখানে আসলে যাওয়াই চলে না। কিংবা ধরুন, ময়নাতদন্ত করতে পারলাম, প্রমাণ হলো সব ঠিক আছে, তার পরও স্ক্যান্ডাল ছড়াবে। পাবলিক বিশ্বাসই করবে না কমোডর তসলিমকে বিষ খাওয়ানো হয়নি, তারা বরং কোরাস ধরবে, ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য একটা ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছি আমরা।’
‘চিফ, ওল্ড থিং, আমি বুঝতে পারছি আপনি কী ভাবছেন।’ শুকনো হাসি দেখা গেল ডাক্তার কান্তিকের মুখে।
‘আপনি, স্যার,’ বললেন আন্দেশা কাফি, প্ররোচিত করার নরম সুরে, ‘মিসেস জারিনা কোবিদের বন্ধু। শোক জানাতে ওই বাড়িতে আপনি গেলে কেউ কোনো মন্তব্য করবে না। আমার ধারণা, আজ সকালে এমনিতেও ওখানে একবার আপনাকে যেতে হবে।’
ডাক্তার কান্তিক মাথা ঝাঁকালেন।
‘এই চিরকুটটা আপনি তাঁকে গোপনে দেখান,’ বললেন সিআইডির প্রধান কর্তা। ‘আমার তরফ থেকে বলুন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি ময়নাতদন্ত না করে আমরা পারব না। ওই বাড়িতে দুজন ডাক্তারকে পাঠাব, কেউ জানে না আমার ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ আছে- মিসেস জারিনের নির্বাচিত সময়ে। কাজটা নিখুঁত গোপনীয়তার মধ্যে সারা হবে। যদি প্রমাণ হয় সব ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গে মিডিয়ার কানে ফিসফাস করার কোনো প্রয়োজন হবে না।’
ডাক্তার কান্তিক চেয়ার ছাড়লেন। তাঁর ভ্রুতে গিঁট। ‘সত্যি স্যার, এটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে!’ বললেন তিনি। ‘নিজেকে একটা গর্তের ভেতর দেখতে পেয়ে আমার ঘাড়ে পা দিয়ে ওপরে উঠতে চাইছেন আপনি! আমরা বন্ধু, ঠিক আছে, কিন্তু…’
‘আমাকে বাদ দিন, প্লিজ,’ বললেন সরকারি কর্মকর্তা। ‘আমি নিজের কথা ভাবছি না, স্যার, ভাবছি কোবিদ পরিবারের কথা। এ রকম অভিজাত পরিবারের সুখ্যাতি মূল্যবান শিল্পকর্মের মতো, যেটার রিপ্লেসমেন্ট হয় না। ওই শিল্পকর্ম বিকৃত করার কাজে আমি হাত দিতে চাইছি না, বিশেষ করে এখন, যখন বাড়িতে তাঁর লাশ পড়ে রয়েছে। ওই সুখ্যাতি জনগণের সম্পত্তি; আর আমি জনগণের চাকর। এক অর্থে আপনিও তা-ই, ঠিক কি না?’
বন্ধুর এ রকম দার্শনিকসুলভ ভাষণ শুনে আড়ষ্ট একটু হাসি ফুটল ডাক্তার কান্তিকের ঠোঁটে। ‘এভাবে বললে আপনাকে আমি না বলি কী করে। কাজটায় দেরি করা চলে না। অতেব, তুমিও আমার সঙ্গে যাচ্ছ হে।’
দুই
কাচ আর মার্বেল পাথরে মোড়া কোবিদ ভবন-সংশ্লিষ্ট এভিনিউ প্রায় অর্ধেকটা দখল করে রেখেছে, একটু তির্যক ভঙ্গিতে পার্কের দিকে মুখ করা। শহরে যত প্রাচীন বাড়ি আছে, এটা তার একটা; তবে কয়েক বছর পর পর মেরামত এবং নতুন কিছু সংযোজন করার ফলে দেখে মনে হবে হালফ্যাশনের দর্শনীয় স্থাপত্যশিল্প।
আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছলাম, বাড়ির সামনে আর পাশের রাস্তায় দামি গাড়ির লম্বা লাইন দেখে আমার একটু লজ্জাই লাগছে। ডাক্তার কান্তিক অবশ্য নির্বিকার। উর্দি পরা বাড়ির একজন চাকর গাড়ির দরজা খুলে দিল, কাচ লাগানো ইস্পাতের গ্রিল খুলল আরেকজন, আমরা ভেতরে ঢুকতে তৃতীয়জন ভিজিটিং কার্ড সংগ্রহ করে ভেড়ার দল থেকে ছাগলদের আলাদা করছে, আরো কিছু উর্দি দেখিয়ে দিল কোন পথ ধরে কোথায় আমাদের যেতে হবে। তাদের সবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সুদর্শন ও সুপুরুষ সায়েবকে, কোবিদ পরিবারের পুরনো কাজের লোক, চাকরদের হেড। পুরুষ চাকর সবাই যে যার উর্দিতে এক টুকরো করে কালো কাপড় আটকে রেখেছে।
অনুষ্ঠান চলছে দৃষ্টিনন্দন মার্বেল হলে, সেটা দালানের মাঝামাঝি জায়গায়, ঘিরে রেখেছে দুই সারি অ্যান্টিক মার্বেল স্তম্ভ, শেষ মাথায় পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছে ফার্নগাছ। হলরুমের মাঝখানে মিসর থেকে আনানো লাল স্ফটিক পাথর দিয়ে তৈরি একটা ছোট ফোয়ারা। ওটার ডান দিকে সিঁড়ি, ইস্পাতের তৈরি ধাপ ওপরে উঠে গেছে। অতিথিদের মধ্যে যারা কোনো রকমে গুরুত্বপূর্ণ তাঁরা শোক বইয়ে সই করে বা নিজের ভিজিটিং কার্ড জমা দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন, তবে যাঁরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের পথ দেখিয়ে সাজানো ড্রইংরুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানে তাঁদের স্বাগত জানানোর জন্য উপস্থিত আছেন তসলিম কোবিদের এক ভাই। আর যাঁদের সঙ্গে উষ্ণ পারিবারিক সম্পর্ক বা যোগাযোগ আছে তাঁদের পথ দেখিয়ে বাড়ির আরো ডান দিকে কোথাও পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
আমরা এগুলোর কোনোটাতেই পড়ি না, তবে ডাক্তার কান্তিক কিভাবে যেন সায়েবের নজর কাড়লেন; সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে এলো সে, এটাকে আমি সম্মান জানানোর একটা সংকেত বলব। ডাক্তার কান্তিক তার কানে ফিসফিস করলেন, ‘এ রকম একটা সময়ে মিসেস জারিনার সঙ্গে অবশ্যই আমাকে দেখা করতে হবে। তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও।’
‘আম্মা ম্যাডাম কারো সঙ্গে দেখা করছেন না,’ খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে জবাব দিল সায়েব, ‘স্যার।’
‘আমি তাঁকে একটা মেসেজ পাঠাতে পারি?’
‘জি, অবশ্যই তা পারেন, স্যার।’
নিজের কার্ডে কিছু লিখে সায়েবের হাতে ধরিয়ে দিলেন ডাক্তার কান্তিক। আমাদের একটা নির্জন অফিস কামরায় বসিয়ে রেখে চলে গেল সায়েব। খানিক পর এক চাকর আমাদের নিতে এলো। সিঁড়ি নয়, আমরা ওপরে উঠলাম দেয়ালে লুকানো ছোট একটা এলিভেটরে চড়ে। লক্ষ করলাম, ওঠার সময় কেউ আমাদের দেখতে পেল না। দোতলায় উঠে আরেকটা হলরুমের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা, গায়ে পালিশ করা কাঠের প্যানেল, মাথার ওপর খানিক পর পর ঝুলছে প্রকাণ্ড আকারের ঝাড়বাতি, চারদিকে ডজনখানেক অলংকৃত দরজা। ওগুলোর পেছনে কী আছে ভেবে আমি খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। আমাদের গাইড তারই একটা খুলল, ভেতরে ঢুকে দেখলাম আরো একটা বড় কামরায় পৌঁছেছি আমরা, এখানেও চারদিকে দরজা আর দরজা। ভেতরটা আসলে গোলকধাঁধা, মাথায় প্রশ্ন জাগল এ বাড়ির বাসিন্দারা কখনো হারিয়ে যায় কি না।
কাজের লোক আরেকটা দরজা খুলল, আমরা মিসেস জারিনার খাসকামরায় পৌঁছে গেলাম। এখানে কোনো বিছানা নেই, আছে কয়েক সেট সোফা, ডিভান, ইজি চেয়ার, দেয়াল আলমারি। জানালা-দরজা বাদে বাকি দেয়াল সিল্ক পরদা দিয়ে আড়াল করা। দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট আটকানো, আঙুল দুটো একটু একটু কাঁপছে- হ্যাঁ, প্রথমে এটাই আমার চোখে পড়ল; মিসেস জারিনা একটা সোফায় কুশনের ওপর ভর দিয়ে খানিকটা কাত হয়ে বসে আছেন। তিনি স্বাস্থ্যবতী, পরে আছেন সিল্কের ওপর হাতের কাজ করা সালোয়ার-কামিজ আর দোপাট্টা। রঙিন জরি লাগানো প্রশস্ত একপ্রস্থ প্রায় স্বচ্ছ মসলিন দিয়ে মাথার অর্ধেকটা ঢাকা, বাকি অর্ধেকে দামি পাথর বসানো মুকুট আকৃতির অলংকার। আমার আন্দাজ, শুধু মাথায়ই তিনি ভরি দশেক সোনা বহন করছেন- গলার হার, বাজুবন্দ, চুড়ি আর দশ আঙুলে পরা আংটির কথা না হয় বাদই দিলাম। পরে শুনেছি, মাথায় ওই মসলিন না পরে দিনের বেলা কখনো তিনি কাউকে দেখা দেন না। দেখতে ভালো, তবে ওটা তাঁর মুখের খানিকটা ঢেকে রেখেছে, দায়ী ওই জরি। কামরার ভেতর একদল চাকর-চাকরানি সারাক্ষণ আসা-যাওয়া করছে, চেহারায় জোর করা একটা শান্ত ভাব ধরে রেখে তাদের এটা-সেটা নানা নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি।
ডাক্তার কান্তিক তাঁর দিকে এগোলেন। আমি দরজার পাশে অপেক্ষা করছি। ওদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না, তবে যা ঘটছে তার সবই দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করতে পারছি। ডাক্তার কান্তিক এ রকম একটা সময়ে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করায় মিসেস জারিনা স্পষ্টতই বিস্মিত হয়েছেন। আমার উপস্থিতিও তিনি ভালো চোখে দেখছেন না, বুঝতে পারলাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকানোর ভঙ্গিতে। এ রকম একটা অপ্রীতিকর কাজ করতে ডাক্তার কান্তিকের ভালো লাগছে না, সেটা তাঁর থমথমে চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে তিনি সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেলেন। একটু পরই তাঁর হাতে এনভেলপটা দেখা গেল। ভেতর থেকে কাগজটা বের করে মিসেস জারিনার হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি।
সদ্য বিধবা ভদ্রমহিলা কাগজের লেখাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেলেন তিনি একজন অভিজাত নারী। গলা থেকে আহত পশুর মতো একটা কান্নার শব্দ বেরিয়ে এলো, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নিজের মুখে বাড়ি মারলেন। কয়েকজন মহিলা দ্রুত এগোল তাঁর দিকে, কিন্তু হাত নেড়ে সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখলেন তিনি।
‘যাও তোমরা! সবাই চলে যাও!’ তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন মিসেস জারিনা। ‘একা শুধু তুমি থাকো!’ লালচে চুল, ধবধবে ফরসা, মায়াভর্তি পটোলচেরা চোখ, রোগা-পাতলা এক তরুণীকে আঁকড়ে ধরলেন তিনি। ডানাকাটা পরি বললেই হয় তাঁকে, কালো ড্রেসে অসম্ভব মানিয়েছে। পরে জেনেছি ওই তরুণী তাঁর পারসোনাল সেক্রেটারি, শিলা শরণি। ‘দেখো শিলা, দেখো!’ বিড়বিড় করলেন তিনি, হাতের কাগজটা দেখালেন।
মেয়েটি ককিয়ে কেঁদে উঠল, ভাব দেখে মনে হলো এখনই জ্ঞান হারাবে। ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না। বেতনভুক একজন কর্মচারীই তো। এ রকম প্রতিক্রিয়া বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
দলটার আরেকটু কাছাকাছি গেলাম আমি। মিসেস জারিনাকে বলতে শুনলাম, ‘কিন্তু ডাক্তার, এটা মিথ্যেও হতে পারে, তাই না? কেউ হয়তো আমাদের কষ্ট দিতে চাইছে।’
‘আমরা তা-ই মনে করছি,’ ডাক্তার কান্তিক বললেন।
‘তাহলে এটা নিয়ে আমাকে অস্থির করতে আসার কী দরকার ছিল?’
ধৈর্য ধরে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করলেন বস।
‘ও আল্লাহ, সলিম কেন এখানে নেই!’ ছেলের খোঁজে কাতর হলেন মিসেস জারিনা। দেখা গেল, কেউ জানে না তিনি কোথায়। তাঁর সব কয়টা ফোন নম্বরে ডায়াল করা হয়েছে, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
অবশেষে আবার ডাক্তার কান্তিকের দিকে ফিরলেন তিনি, রাগের সঙ্গে ময়নাতদন্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। আমার বস অসীম ধৈর্য আর কোমল সুরে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে ব্যাপারটা এড়ানোর তাঁর আসলে কোনো উপায় নেই, ক্ষেত্রবিশেষে কোবিদ পরিবারকেও আইন মেনে চলতে হবে, এবং, তা ছাড়া, আমরা সবাই তাঁর পরিবারের সম্মান আর স্বার্থ রক্ষারই চেষ্টা করছি। একসময়, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে, রাজি হলেন মিসেস জারিনা। কান্না তাঁর মনটাকে হালকা করতে পেরেছে বলে মনে হলো। তাঁর রূপসী ব্যক্তিগত সহকারী মেয়েটি কাঁদল না, তবে পুরোটা সময় রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বিধবার চেয়ে তার চেহারাতেই যেন বেশি শোক লেগে রয়েছে।
এই মুহূর্তে ডাক্তার কান্তিকের একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন মিসেস জারিনা। ‘ডাক্তার সাহেব, প্লিজ, আপনি সব ম্যানেজ করুন,’ বললেন তিনি, যেন মিনতি করছেন। ‘আপনার যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বিশ্বাস করার মতো আর কাউকে আমি চিনি না। ও, আরেকটা কথা, এসব যেন খবর না হয়। কাগজগুলো যেন কিছুই ছাপতে না পারে। চ্যানেলগুলো যেন আভাস পর্যন্ত না পায়। আরেকটা অনুরোধ, আমার স্বামীর তরফের সবার কাছে এটা গোপন রাখতে হবে।’
‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব,’ কথা দিলেন ডাক্তার কান্তিক। সেলফোন বের করে সিআইডি চিফের সঙ্গে আলাপ করলেন তিনি। ২০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ বিভাগের তিনজন ডাক্তার বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। কী করতে হবে তাঁরা জানেন, ব্যাপারটা কেন গোপন রাখতে হবে তাও তাঁদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কমোডর তসলিমের লাশ এখনো তাঁর বেডরুমে, এবং সেখানেই ময়নাতদন্ত অনুষ্ঠিত হলো। ওই তিন ডাক্তার ছাড়া ভেতরে আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমার ধারণা, চাকরবাকররা নিশ্চয়ই সন্দেহ করেছে, তবে শুনেছি তারা নাকি এই পরিবারের প্রতি অসম্ভব বিশ্বস্ত। কেউ যদি কিছু জেনেও থাকে, কখনো তা ফাঁস হবে না।
অপেক্ষার সময়টা মিসেস জারিনা আর তাঁর সহকারী শিলা শরণির সঙ্গেই থাকলাম আমরা। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন আর তিনি আমাকে অতটা অপছন্দ করছেন না, বিশেষ করে ডাক্তার কান্তিকের মুখে এ কথা শোনার পর যে ক্রিমিনোলজিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে অনার্স পাস করেছি আমি, করপোরেট অফিসের লোভনীয় সব চাকরির প্রস্তাব ফেলে দিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে হাতে-কলমে অপরাধী ধরার কলাকৌশল শিখছি।
আঙুল যতই কাঁপুক, একের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছেন মিসেস জারিনা। দু-একটা টান দিচ্ছেন কি দিচ্ছেন না, অ্যাশট্রেতে গুঁজে রাখছেন। কেউ কিছু বলছে না, গতি হারিয়ে সময় এখন প্রবাদের সেই কাছিম। শিলা শরণি অসম্ভব সুন্দর, খানিক পর পর তাঁর দিকে তাকাচ্ছি আমি। মেয়েটি কাতর, তবে সেটা শোকে নাকি ভয়ে, বলতে পারব না; লক্ষ করলাম আমার তাকানোটা তিনি লক্ষ করছেন না। আমি যে ঘরে আছি তাও বোধ হয় এখনো তাঁর জানা হয়নি।
একসময় ডাক্তারদের নেতা, ডক্টর খুশনসিব, ভেতরে ঢুকলেন। মুখ নয়, মুখোশ, কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। একদম মাপা বাক্যে বললেন, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিষ প্রয়োগের কারণে কমোডর তসলিম কোবিদ মারা গেছেন। এই বিষ তাঁর ওপর প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে, আবার তিনি নিজেও গ্রহণ করে থাকতে পারেন। এটা অ্যালকালয়ড জাতের একটা বিষ, সম্ভবত অ্যাকনাইট, যেটি অ্যালকালয়ডের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। তবে নিশ্চিতভাবে জানার জন্য বিশ্লেষণ করতে হবে।’
শিশুর মতো হাই তোলার একটা ভঙ্গি করতে দেখলাম মিসেস জারিনাকে, একপাশে কাত হয়ে শিলা শরণির দুই হাতের মধ্যে ঢলে পড়লেন তিনি। সাক্ষাৎ মৃত্যুর চেহারা নিয়ে স্থির বসে থাকলেন তরুণী, একচুল নড়লেন না।
তিন
ডাক্তার খুশনসিব খুব সহজেই মিসেস জারিনার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারলেন। এরপর অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লেন অসহায় গৃহকর্ত্রী। তবে নিজের মর্যাদা আর কর্তৃত্ব না হারানোর চেষ্টা লক্ষ করলাম তাঁর মধ্যে। তিনি জানেন স্বামীর অকালমৃত্যুর পর তাঁকেই পরিবারের হাল ধরতে হবে। সহকারী মেয়েটি, শিলা শরণি, সত্যি খুব বড় আঘাত পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি তিনি। তবে তাঁর অনুভূতিটা কোন শ্রেণীর তা তখনো আমার জানার সুযোগ ঘটেনি- তিনি কি ভয় পাচ্ছেন, নাকি অপরাধবোধে ভুগছেন?
এরপর দেখা গেল মিসেস জারিনা মাত্র একটা ব্যাপারে উদ্বিগ্ন : ‘ডাক্তার কান্তিক, কোথাও যেন কিছু ছাপা না হয়- এ ব্যাপারে আমি আপনার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে চাই।’ এখন আবার একটু কাঁদবেন তিনি, ডাক্তার কান্তিকের হাতটা তাঁকে শক্ত করে ধরতে দেখে বুঝলাম।
‘আমি নিজের গরজেই চাই এটা গোপন থাকুক,’ শুকনো গলায় তাঁকে বললেন বস। ‘অপরাধী যাতে পালানোর চেষ্টা না করে। তবে, সিদ্ধান্ত নেবে পুলিশ।’
‘পুলিশ!’ আঁতকে উঠলেন মিসেস জারিনা। ‘না না, ওদের আপনি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেবেন না! আমি তাহলে স্রেফ মারা যাব! ডাক্তার কান্তিক, আপনি সব কিছু নিজের কাঁধে তুলে নিন। আপনাকে আমি নিয়োগ দিচ্ছি। আপনি শুধু বলুন কত টাকার চেক লিখতে হবে।’
‘কিন্তু, মিসেস জারিনা, আমি তো এ রকম শর্তে কাজে হাত দিতে পারি না,’ ডাক্তার কান্তিক বললেন। ‘আমার আর পুলিশের লক্ষ্য একই হবে, সত্য আবিষ্কার।’
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই!’ ক্রন্দসী ভদ্রমহিলার গলা চড়ে গেল। ‘তবে দায়িত্বটা আপনি নিন। ওদের উচিত আপনাকে দায়িত্ব নিতে দেওয়া। আপনি আর সবার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। পুলিশকে আপনি বাড়ির বাইরে রাখুন!’
‘সে সিদ্ধান্ত নেবে সিআইডি,’ বললেন ডাক্তার কান্তিক। ‘আমি আপনার বিবেচনার জন্য একটা পরামর্শ দিতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাবলিককে নিয়ে দাফন-কাফনের অনুমতি দেওয়া উচিত হবে না। সব আয়োজন বাতিল করে দিন। এবং সবাইকে জানিয়ে দিন পবিত্র কাজটা পরিবারের সুবিধেজনক সময়ে নিভৃতে করা হবে।’
‘সেটাও নির্ঘাত স্ক্যান্ডাল ছড়াবে,’ প্রতিবাদ করলেন মিসেস জারিনা।
‘তবে বাকিগুলোর মতো অত ভয়ংকর নয়।’
একমুহূর্ত চিন্তা করে মিসেস জারিনা চাকরবাকরদের উদ্দেশে বললেন, ‘ঠিক আছে, তা-ই সবাইকে জানিয়ে দাও!’
ডাক্তার খুশনসিব কামরা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বস আমাকে বললেন, ‘ওঁকে বাইরে আটকে রাখো, আমি আসছি।’
দুই মিনিট পর কামরার বাইরে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন তিনি, প্রশ্ন করলেন ডাক্তার খুশনসিবকে, ‘ওখানে যা বললেন তার বাইরে আর কিছু বলার আছে আপনার?’
‘এখনই আর কিছু বলার নেই। পেটে শক্তিশালী এক ডোজ বিষ পড়ায় কমোডর তসলিম মারা গেছেন, সম্ভবত অ্যাকনাইট।’
‘খুব বড় ডোজ।’
‘হ্যাঁ, ডাক্তার কান্তিক। খুব তাড়াতাড়ি মারা গেছেন তিনি। এই আধা ঘণ্টার মধ্যে…খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা।’
‘আত্মহত্যার সম্ভাবনা আপাতত বাদ দিলে, ওই বিষ কিভাবে তাঁর পেটে যেতে পারল?’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত করলেন ডাক্তার খুশনসিব। ‘সেটা কিভাবে বলি! এটা ঠিক যে সব অ্যালকালয়ডের মধ্যে অ্যাকনাইট সবচেয়ে বিস্বাদ, তবে আবার পরিমাণে অতি সামান্যই যথেষ্ট। কমোডর তসলিমকে কতটা খাওয়ানো হয়েছে বলতে পারব না; হয়তো হাফ গ্রেইন।’
‘চা বা কফির সঙ্গেও তো খাওয়ানো যায়।’
‘যায়।’
‘লক্ষণগুলো এমন, গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা বলে মনে হতে পারে,’ বললেন ডাক্তার কান্তিক। নিজে ডাক্তার হওয়ায় সবই তাঁর জানা আছে, তবু ডাক্তার খুশনসিবের সঙ্গে আলাপ করে তিনি যেন নিশ্চিত হতে চাইছেন।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই,’ জানালেন ডাক্তার খুশ, তারপর জানতে চাইলেন, ‘তিনি মারা যাওয়ার সময় কি মাত্র একজন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন?’
‘শুধু ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার, পারিবারিক চিকিৎসক।’
‘খুব নামডাক তাঁর।’ গম্ভীর হলেন খুশনসিব। ‘ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে, তবে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাইছি না।’
‘তোমার কোনো মন্তব্য বা প্রশ্ন, অতেব?’ আমাকে উৎসাহিত করার জন্য একটু হাসলেন ডাক্তার কান্তিক।
‘জি, স্যার!’ খুক করে কেশে একটা প্রশ্ন করলাম, নির্দিষ্ট কাউকে লক্ষ করে নয়, ‘অ্যাকনাইট পয়জনিংয়ের অ্যান্টিডোট নেই?’
‘অ্যাট্রপিন,’ দুজন ডাক্তার একযোগে বললেন, তবে আমার বস তাঁর সঙ্গে একটু যোগ করলেন : ‘বিষে বিষক্ষয়।’
‘এতটা জমাটবাঁধা ফর্মে কি অ্যাকনাইট সহজে পাওয়া যায়?’ আমার পরবর্তী প্রশ্ন।
‘যে বইয়ে প্রতিক্রিয়া ও দিকনির্দেশনাসহ ওষুধের তালিকা থাকে তাতে এটা পাবে তুমি,’ ডাক্তার কান্তিক বললেন। ‘একসময় লেখা থাকত কিভাবে তৈরি করতে হয়। রোগ সারানোর কাজে এখন আর এটা ব্যবহার করা হয় না। সংগ্রহ করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তোমার আর কোনো প্রশ্ন আছে, অতেব?’
‘আর মাত্র একটা, স্যার,’ বললাম আমি। ‘এ ধরনের বিষ প্রয়োগের ক্ষেত্রে, ভিকটিম কি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বা প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সচেতনতা ধরে রাখতে পারেন?’
‘পারেন, প্রায় ক্ষেত্রেই পারেন,’ জবাব দিলেন ডাক্তার খুশ।
‘অসংখ্য ধন্যবাদ।’
ডাক্তার খুশনসিব বিদায় নিয়ে চলে যেতে আমরা আবার মিসেস জারিনার খাসকামরায় ঢুকলাম। আমাদের পিছু নিয়ে ঢুকল এক কিশোর চাকর, মিসেস জারিনাকে সে জানাল, ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার এসেছেন, জানতে চেয়েছেন আম্মা ম্যাডাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান কি না। আমি আর ডাক্তার কান্তিক দৃষ্টি বিনিময় করলাম। এ সময় তাঁর আগমন, তিনি যেন বাতাসের মাধ্যমে ধারণা পেয়েছেন কী ঘটছে এখানে। ডাক্তার কান্তিকের পরামর্শে নিজের বেডরুমে ফিরে গেলেন মিসেস জারিনা, তাঁর খাসকামরায় ডাক্তার নিমেষ সরওয়ারের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম আমরা দুজন। একটা ব্যাপার আমার খুব কৌতূহল জাগাচ্ছে, এ রকম বিশাল বাড়ির পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন আমার বসের মুঠোয়। মিসেস জারিনা থেকে শুরু করে নিচের দিকে বাকি যারা আছে, সবাই এখন তাঁর একান্ত অনুগত।
ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার খুবই দক্ষ একজন হার্ট স্পেশালিস্ট। সুদর্শন তিনি, হাঁটাচলায় সপ্রতিভ, আচরণে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়, বয়স ষাট, সব সময় হাসিখুশি। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম, ডাক্তার কান্তিকের নাম শুনে তাঁর মুখের রং একটু বদলে গেল। লুকিয়ে লাভ নেই, আমি তাঁর কপালে মিহি ঘাম জমে উঠতে দেখলাম। তাঁর বিরুদ্ধে আমার একটা মনোভাব তৈরি হলো।
সোজা প্রসঙ্গে চলে গেলেন বস। ‘আমি ডাক্তার কান্তিক, ব্যক্তিগত গোয়েন্দা। মিসেস জারিনা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে বলেছেন আমাকে। ইতিমধ্যে জানা গেছে, কমোডর তসলিম মারা গেছেন বিষক্রিয়ায়। আপাতত আমিই পুলিশের কাজ করছি।’
‘বিষক্রিয়া’ শব্দটা শোনামাত্র একটু টলে উঠে পিছিয়ে গেলেন ডাক্তার সরওয়ার, মুখের চেহারা হলো সাদা নিউজপ্রিন্ট। ‘ওহ, মাই গড!’ হাঁপিয়ে উঠলেন। ‘পুলিশকে কে খবর দিল?’
সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে তাঁর ধারণা আছে, এই উত্তর থেকে সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়; তবে আপাতত আমার গুরু ভান করলেন তিনি তা লক্ষ করেননি। বললেন, ‘সেটা প্রকাশ করার অনুমতি আমাকে দেওয়া হয়নি।’
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন ডাক্তার সরওয়ার। ‘বিষ,’ বললেন তিনি, শিরদাঁড়া খাড়া করলেন। ‘এ অসম্ভব!’
‘আমি আপনাকে ময়নাতদন্তের ফলাফল জানালাম।’
শিউরে উঠলেন ডাক্তার সরওয়ার। ‘ময়নাতদন্ত!’ হকচকিত দেখাল তাঁকে। ‘আমাকে না জানিয়ে।’
‘পুলিশের হুকুমে,’ বললেন বস।
আমরা তাঁর কাছে মৃত্যুশয্যার বর্ণনা শুনতে চাইলাম। দুই মিনিট পর শুরু করলেন তিনি। ‘কাল বিকেল ৫টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি থাকতে কমোডর তসলিমের খাসচাকর শেখ শরাফত আমাকে ফোনে জানাল তার মালিক খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন; বলল, সে তাঁকে বেডরুমের মেঝেতে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে; এবং তার মনে হচ্ছে এও আগের মতো সেই পেটের ব্যথা, তবে এটার মাত্রা খুব বেশি। কাজেই ডিজিটেইলিস আর কিছু ওষুধপত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম আমি…’
‘ডিজিটেইলিস?’ বাধা দিলেন ডাক্তার কান্তিক, অবাক হয়েছেন। ‘কেন?’
‘হার্ট অ্যাটাক ঠেকাতে,’ জবাব দিলেন ডাক্তার সরওয়ার। ‘ওটাকেই আমি বিপদ বলে মনে করছিলাম…’
‘না, আমি জানতে চাইছি,’ আবার তাঁকে থামিয়ে দিলেন ডাক্তার কান্তিক, ‘ডিজিটেইলিস এখানে কোথায় পাবেন আপনি? তা ছাড়া, আজকাল ওসব উদ্ভিদ…’
‘আমি ওগুলো এখনো সংগ্রহ এবং ব্যবহার করি, আর কেউ না-ই করুক। ওটা যে হৃৎপিণ্ডকে শক্তি জোগায়, আশা করি একজন ডাক্তার হিসেবে এটা আপনি স্বীকার করবেন?’
‘হুম। বলে যান।’
‘আমি আমার সেক্রেটারিকে বললাম, স্টমাক স্পেশালিস্ট ডাক্তার হিমেলকে ফোন করো, তারপর ছুটে এলাম এখানে। এই তো, কাছেই থাকি, ফোন পাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেছি। কিন্তু দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম বন্ধুর সময় শেষ, মারা যেতে আর বেশি দেরি নেই।’
‘তাঁর সঙ্গে আর কে ছিল?’
‘শরাফত আর সায়েব, পুরনো দুজন কাজের লোক। আমি মিসেস জারিনাকে ডেকে পাঠালাম, কিন্তু ওদের একজন ফিরে এসে জানাল তিনি বাড়িতে নেই। ওই কামরায় সবার ঢোকা নিষেধ করে দিলাম আমি। একটা জিনিস বাদে বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য যা যা করা দরকার তার সবই করা হয়েছে…কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।’
‘একটা জিনিস বাদে?’
‘অসুস্থ হয়ে পড়ার পরও তো কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন, তাই না? কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি।’
‘কেন নিয়ে যাওয়া হয়নি?’
‘শুনেছি কমোডর তসলিম হাসপাতালে যেতে রাজি হননি। তিনি নাকি বারবার বলছিলেন, এটা সেই পুরনো পেটব্যথা, এখনই সেরে যাবে।’
‘হু। তারপর কী করলেন বলুন।’
‘শরাফতকে আমি আমার বাড়িতে পাঠালাম অ্যাট্রপিন আনতে, আর সায়েবকে পাঠালাম বরফ আনতে। ওরা ফিরে আসার আগেই কমোডর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।’
‘অ্যাট্রপিন?’ বললেন ডাক্তার কান্তিক, নরম গলায়, তবে তাতে বিদ্রূপের সুর অস্পষ্ট নয়। ‘ওটা কি গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা কমাতে পারে?’
‘আমি তাঁর হার্টবিট বাড়ানোর কথা ভাবছিলাম।’
‘এই আধুনিক যুগে এসব উদ্ভিতজাত বিষ আপনি চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করছেন?’ ডাক্তার কান্তিক হতভম্ব।
‘আমার রোগী কমোডর তসলিম আমার এই চিকিৎসা পদ্ধতি পছন্দ করতেন, আসলে চীন থেকে ঘুরে এসে তিনিই আমাকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করেন। তা ছাড়া, মাত্রা ঠিক থাকলে এটা পয়জন নয়, তখন সেটা মেডিসিন।’
‘ওটা আপনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেননি কেন?’
‘সব কিছু তো আগে থেকে বোঝা যায় না।’
‘তাহলে মারা যাওয়ার সময় তাঁর কাছে একা শুধু আপনি ছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি সায়েবকে কেন কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে দিলেন? এ বাড়িতে চাকরবাকর তো অসংখ্য।’
‘আপনাকে আমি সত্যি কথাটাই বলি, সেটা আপনি যেভাবেই নিন। অমন একজন অভিজাত ব্যক্তির চরম অবস্থা চাকর শ্রেণীর কাউকে আমি দেখতে দিতে চাইনি, কোথায় যেন বাধছিল আমার।’
‘তখন তাঁর জ্ঞান ছিল?’
‘নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে তাঁর কথা বলার ক্ষমতা ছিল না।’
‘তার মানে মৃত্যুর আগে তিনি কিছু বলে যাননি?’
‘না, একটা শব্দও না।’
‘হুম!’ বললেন ডাক্তার কান্তিক। আমি জানি আমার আর বসের মাথায় একই চিন্তা খেলা করছে : সুমার্জিত, সুশিক্ষিত এবং দৃঢ়চেতা একজন মানুষ যখন একটা মিথ্যেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, সেটা দেখতে কষ্ট হয়। ভাবলাম কমোডরের মৃত্যুশয্যায় ঠিক কী ঘটেছিল কে জানে!
‘তাঁর মৃত্যুর সময় আর কোনো সাক্ষী না রাখাটা কি বোকামি হয়ে গেল না?’ ডাক্তার কান্তিক প্রশ্ন করলেন।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার সরওয়ার। ‘শুনুন, তখন মাথায় এই চিন্তা আসেনি যে কেউ অভিযোগ করবে আমি আমার বন্ধুকে বিষ খাইয়েছি,’ বললেন তিনি, সুরটা যেন নিজের যথাযোগ্য মর্যাদা দাবি করছেন।
‘সে অভিযোগ কেউ করছে না,’ হালকা সুরে বললেন, ডাক্তার কান্তিক। ‘ডেথ সার্টিফিকেটে সই করার সময় মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আপনার মনে কোনো রকম সন্দেহ ছিল না?’
‘সন্দেহ থাকলে তাতে আমি সই করতাম না। ডাক্তার হিমেল আসার পর তিনিও সই করেছেন।’
‘তিনিও ময়নাতদন্তের পরামর্শ দেননি?’
‘না, আমার ব্যাখ্যায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি। আমরা সবাই ভুল করি।’
‘এই ভুলটা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল বয়ে আনতে পারে, ডাক্তার সরওয়ার,’ মৃদুকণ্ঠে বললেন বস।
‘হ্যাঁ,’ বললেন আমাদের প্রতিপক্ষ, প্রবল হতাশায় বিচলিত দেখাচ্ছে। ‘সর্বনাশের আর বোধ হয় কিছু বাকি থাকবে না।’
তাঁকে আমাদের জেরা করা শেষ হয়নি, বাড়ির মাঝামাঝি কোথাও একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, যেন বহু মানুষ ফিসফাস করছে। তারপর নতুন একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, তারুণ্যে ভরপুর, অনুরণিত হচ্ছে। ওই শব্দ শুনে ডাক্তার সরওয়ার যেন আরো ম্লান হয়ে গেলেন।
‘সলিম!’ হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। ‘ওহ্! এখন আমি ওর সামনে দাঁড়াব কিভাবে!’ বলতে বলতে একটা দরজা খুলে ঝট করে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ওই পথে কোনো ধরনের সার্ভিস প্যাসেজে পৌঁছানো যায়। ধরে নিতে হবে এ বাড়িতে ঢোকা বা বেরোনোর পথগুলো তাঁর চেনা।
গুরুর দিকে তাকালাম আমি। ‘ওঁকে আমাদের থামানো উচিত ছিল না, স্যার?’
‘পালাতে পারেন, এমন লোকদের দলে পড়েন না তিনি। যখন খুশি আমরা তাঁকে পাব।’
‘বিষটা কি তিনি…?’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন ডাক্তার কান্তিক। ‘তাহলে অ্যান্টিডোট আনতে কাউকে পাঠাতেন না।’
‘কিন্তু কে দায়ী তা তিনি জানেন!’
‘সে রকমই মনে হবে,’ হেঁয়ালি করে বললেন বস।
দরজার কবাট দড়াম করে ফাটিয়ে কামরায় ঢুকলেন এক তরুণ, তাঁর পিছু নিয়ে ঢুকল আরো কয়েকজন- নিশ্চয়ই তারা চাকরবাকরই হবে। ওই তরুণকে ঘিরে রেখেছে সবাই, আর তরুণটি এদিক-ওদিক ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন আর চিৎকার করছেন, ‘বেরিয়ে যাও! বেরোও!’
খোলা দরজা দিয়ে নিঃশব্দে তাদের ফিরে যাওয়ার সঙ্গে নিঃশেষে মোম গলার কোথায় যেন মিল আছে। দরজার কবাট বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেল।
কোবিদ পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকার, সলিমকে আমি চিনতে পারলাম। প্রকাণ্ডদেহী একটা দৈত্য বললেই হয়, মাথাভর্তি রাশি রাশি কোঁকড়া চুল, চোখ দুটো কুচকুচে কালো। তাঁর মধ্যে কী আছে জানি না, দেখামাত্র ভালো লেগে গেল আমার। আড়চোখে তাকাতে লক্ষ করলাম ডাক্তার কান্তিকের চোখমুখেও নরম একটা ভাব। এর কারণ আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। সুদর্শন তিনি, প্রাণবন্ত, কিন্তু সুদর্শন আর প্রাণবন্ত এমন তরুণও আছে, যাদের দেখামাত্র শিরার রক্ত বরফ হয়ে যায়। সলিমের মধ্যে শিশুসুলভ সরলতা আর তারুণ্যদীপ্ত বেপরোয়া একটা ভাবের সংমিশ্রণ ঘটেছে। তবে এটা সবটুকু ব্যাখ্যা করে না।
এই মুহূর্তে তাঁর দুই চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেও তাতে তিনি লজ্জা পাচ্ছেন না। এই আবেগ তাঁকে এতটাই বিচলিত করে তুলেছে যে মা জননীর খাসকামরায় দুজন অপরিচিত ব্যক্তির উপস্থিতি তাঁর কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছে না। এমন সুরে কথা বলতে লাগলেন আমরা যেন তাঁর খুব চেনা মানুষ।
‘আমার আব্বু!’ গুঙিয়ে উঠলেন, চোখ দুটো আমাদের মুখে তল্লাশি চালাচ্ছে, যদি একটু আশার আলো দেখতে পান। ‘কথাটা কি সত্যি? কথাটা কি সত্যি? তিনি মারা গেছেন?’
‘তিনি মারা গেছেন,’ বললেন ডাক্তার কান্তিক।
‘আহ্, কেউ জানবে না আমার কী হয়ে গেল!’ আবার কেঁদে উঠলেন সলিম, দুই হাত দিয়ে চাপড় মারলেন মাথায়। ‘আব্বুরা সব সময় মারা যাচ্ছেন, ঠিক আছে, কিন্তু এই ব্যাপারটা আলাদা!’ চোখভর্তি পানি নিয়ে আমাদের দিকে ঘুরলেন তিনি। ‘কারণ আমি তো ছিলাম তাঁর অবাধ্য সন্তান! এখন আর তাঁর কাছে আমার ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ থাকল না!’
ছেলের গলা পেয়ে নিজের বেডরুম থেকে ছুটে এলেন মা, পিছু নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী শিলা শরণিও এলেন। দুই হাত বাড়িয়ে মাকে নিজের বুকে টেনে নিলেন সলিম। তাঁর আগলে রাখার ভঙ্গি দেখে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক সে-ই যেন অভিভাবক।
‘আম্মুজান! ওহ্, বেচারি আম্মুজান!’ সুর করে বলছেন। ‘এটা আপনার মাথায় বাজ ফেলে দিয়েছে!’
কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। তিনি তাঁর মায়ের মাথার ওপর দিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শিলা শরণির সঙ্গে অসম্ভব বিষণ্ন ও কাতর দৃষ্টি বিনিময় করলেন। আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, ওই তাকানোর মধ্যে ওদের আত্মাও যেন অংশগ্রহণ করল, তারপর দুজনেই দ্রুত যে যার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন। ওঁদের ক্ষিপ্র দৃষ্টিবিনিময় আমার গুরুর চোখ এড়ায়নি, জানা কথা। সেটা আমি টের পেলাম তাঁর আচরণে আত্মভোলা একটা ভাব লক্ষ করে।
এ রকম একটা ঘনিষ্ঠ পারিবারিক দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়, সেদিকে তাকিয়ে থাকাটাও অশোভন, কাজেই আমি ওঁদের দিকে পেছন ফিরলাম। তবে কে কী বলছে সব শুনতে পাচ্ছি। শোক প্রকাশ করতে গিয়ে নিজের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তুলছেন সদ্য বিধবা গৃহকর্ত্রী, আনাড়ি ভঙ্গিতে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন একমাত্র সন্তান। মিসেস জারিনা একদম ভেঙে পড়লেন। অনেক কিছুই বলছেন তিনি, যেগুলোর কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে স্বামীর এই অকালমৃত্যু মেনে নিতে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। অবশেষে তরুণীটি কথা বলে উঠলেন, আশ্চর্য এক রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে : ‘সলিম, তোমার আব্বুকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। সরকারি ডাক্তাররা তাঁর ময়নাতদন্ত করে গেছেন।’
আম্মুকে ছেড়ে দিলেন সলিম, পিছিয়ে গেলেন। ‘বিষ! কী! কেন? কে? হে আল্লাহ, তুমি তাহলে…রক্ষা করো!’
এরপর হাত ধরে কামরা থেকে আমাকে বের করে আনলেন ডাক্তার কান্তিক। আমরা ওখানে ছিলাম কি ছিলাম না কেউ তাঁরা খেয়াল করেননি। বাইরে বেরিয়ে আসার পর জোর করে থামলাম আমি, বসকে বললাম, ‘ওখানে আমাদের থাকা উচিত ছিল না? ওঁদের আলাপ থেকে গোপন কোনো সত্য বেরিয়ে আসতে পারে না?’
‘যথেষ্ট সত্য বেরিয়ে এসেছে, আমার বর্তমান প্রয়োজন তাতে মিটে যাবে,’ শুকনো গলায় উত্তর দিলেন ডাক্তার কান্তিক।
চার
ইতিমধ্যে আমাদের জানা হয়ে গেছে, এ বাড়ির সব চাকরকে দুজনের হুকুমমতো কাজ করতে হয়, জবাবদিহিও করতে হয় তাদের কাছে, তারা হলো সায়েব আর শরাফত। শরাফত আমাদের পথ দেখাল, আমরা কমোডর তসলিম কোবিদের প্রাইভেট সুইট পরিদর্শন করতে বেরিয়েছি।
আশ্চর্য চেহারা নিয়ে মধ্যবয়স্ক এক লোক শরাফত, যেন প্রাচীন নাপিত, মান্ধাতার আমলের ছবি থেকে বেরিয়ে এসেছে- চোখমুখে বুদ্ধির ঝিলিক, হাবভাবে সবজান্তা, প্রবল আত্মবিশ্বাসী। ঘরবাড়ির যেকোনো কাজ দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে সারতে পারে এই লোক। জানা গেল, কোবিদ পরিবারে ২০ বছর ধরে আছে সে। মনিবের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিল, তবে বর্তমান পরিস্থিতিকে নিয়তির বিধান বলে ভাবছে সে। তার মধ্যে দার্শনিকসুলভ একটা ভাব লক্ষ করলাম, যেন জীবনে এত বেশি দেখেছে যে কোনো কিছুই এখন আর তাকে বিস্মিত করতে পারে না। ডাক্তার কান্তিক তাকে অনেক প্রশ্ন করলেন, ইতস্তত না করে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিল সে, ধরে নিতে হবে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গেই। কমোডর তসলিমকে যারা শেষ মুহূর্তে জীবিত অবস্থায় দেখেছে তাদের মধ্যে সে একজন, কাজেই সন্দেহের তালিকায় তাকে রাখা হয়েছে, কিন্তু তার আচরণে বোঝা গেল না এটা সে জানে।
প্রথমে আমরা তিনতলার উত্তর প্রান্তের সাজানো-গোছানো একটা কামরায় ঢুকলাম, শরাফত যেটাকে অফিস বলছে। এখানে এক তরুণী কম্পিউটারে বসে কী যেন কম্পোজ করছেন। আমরা ওই কামরা হয়ে অফিসের আরো ভেতর দিকে যাওয়ার সময় না তিনি মুখ তুলে তাকালেন, না হাতের কাজ থামালেন। আমার কাছে ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক ঠেকল না। ভাবলাম, এ রকম একটা সময়ে এত মন দিয়ে কী ছাই লিখছেন তিনি!
পাশেই কমোডরের পড়ার ঘর, বাড়ির শেষ প্রান্তে মিসেস জারিনার খাসকামরার সঙ্গে মিল রেখে সাজানো। চারদিকে অ্যান্টিক ফার্নিচার, দেয়ালে দেয়ালে দেশি-বিদেশি তৈলচিত্র। প্রথম দর্শনে ডাক্তার কান্তিক এই কামরার ওপর দ্রুত একবার দৃষ্টি বোলালেন মাত্র, তার পরও খুব কম জিনিসই তাঁর দৃষ্টি এড়াল। পড়ার ঘর, অথচ বই প্রায় নেই বললেই চলে। একটা ডেস্কের ওপর এটা-সেটা নানা কিছুর সঙ্গে এক টুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেন তিনি। নিচে একটা দেরাজ, তালায় চাবি ঝুলছে। সেটা খুলে কাগজটা তার ভেতর ফেললেন, চাবি ঘোরালেন, তারপর চাবির গোছা নিজের পকেটে ফেলে বললেন, ‘পরে পরীক্ষা করব।’
পড়ার ঘরের বাইরে গদিমোড়া সারি সারি চেয়ার নিয়ে আরেকটা ঘর, শরাফত বলল ওয়েটিং রুম। ওখান থেকে একটা প্যাসেজে বেরোনো যায়, সুইটের বাকি সব কামরার দিকে চলে গেছে। প্যাসেজ খুলে স্টোররুম, শরাফতের বেডরুম আর কমোডরের বাথরুমের দরজা। বাথরুমে ঢুকে একটা দেয়াল আলমারি খুললেন ডাক্তার কান্তিক। প্রতিটি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখ বোলালেন। দুটো ওষুধ তাঁর চোখ কাড়ল। তরল ও ট্যাবলেট।
‘তরলডা ডিজিটেইলিস, সর,’ বলল শরাফত। ‘ওইডা হাটের লাগি। পনরো ফুটা কইরা পানিতে মিশায়া খাইতে হয়। আর ওই টেবলেট হজমির কাম করে, একডা কইরা তিন বেলা।’
‘কমোডর এগুলো খাচ্ছিলেন?’
‘জি, সর, নিয়ম ধইরা।’
ডাক্তার কান্তিকের নির্দেশে ওষুধ দুটো নিলাম আমি, বিশ্লেষণ করার জন্য একজন কেমিস্টের কাছে পাঠাতে হবে। এরপর আমরা ড্রেসিংরুমে ঢুকলাম। নাম ড্রেসিং রুম হলেও এখানে অন্তত ৫০ জন মানুষ বসে আড্ডা দিতে পারবে, এত রকমের ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। ওটার পেছনে কমোডরের বেডরুম, যেখানে এখনো পড়ে আছে তাঁর মৃতদেহ। ডাক্তার কান্তিকের নির্দেশ অনুসারে পুলিশের তরফ থেকে কফিন এবং প্রচুর বরফের ব্যবস্থা করা হয়েছে, লাশে যাতে কোনোভাবেই পচন না ধরে। ওখানে একজন লোক পাহারা দিচ্ছে। আমি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, বিছানা বা কফিনের দিকে তাকাচ্ছি না। ডাক্তার কান্তিক মরদেহ পরীক্ষা করলেন, তবে কোনো মন্তব্য না করে শুধু জানতে চাইলেন পরবর্তী দরজার বাইরে কী আছে।
শরাফত জানাল, পাশেরটাই তার আম্মা ম্যাডামের বেডরুম, আর তারপর ওই সুইটের বাকি সব কামরা। দুটো সুইটই এভিনিউ বরাবর বিস্তৃত। এই দুজন ছোটখাটো মানুষ নিজেদের মাঝখানে, দুজনের কেউই পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির বেশি হবেন না, দখলে রেখেছেন আট কিংবা তারও বেশি প্রকাণ্ড আকারের সুসজ্জিত প্রাইভেট চেম্বার। জাগতিক ভোগবিলাস কাকে বলে!
পড়ার ঘরে ফিরে এলাম আমরা। ডাক্তার কান্তিক এখনো প্রশ্ন করছেন শরাফতকে। তার মুখ থেকে ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি চাকরদের হলঘরে বসে চা খাচ্ছিল সে, এই সময় ইন্টারকমে মনিবের কামরায় হাজির হতে বলা হয় তাকে। ওখানে গিয়ে সে দেখতে পায় ড্রেসিংরুমের মেঝেতে শুয়ে ব্যথায় ছটফট করছেন কমোডর। এখানে মৃত্যুযন্ত্রণার বর্ণনা আমি বাদ দিচ্ছি। মনিবকে তাঁর বিছানায় নিয়ে যায় শরাফত, তারপর ফোন করে ডাক্তার আর সায়েবকে। মিসেস জারিনাকেও খবর দিতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। ডাক্তার আসার আগে যে সময়টা পার করতে হয়েছে, সে তার অভিজ্ঞতা ও সাধ্য অনুসারে মনিবকে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
‘শরাফত, তোমার সন্দেহের মধ্যে কি বিষ ছিল?’ প্রশ্ন করলেন ডাক্তার কান্তিক, কী ঘটেছে তা ইতিমধ্যে এই লোক জেনেছে ধরে নিয়ে।
‘সর, চিন্তাডা বোধয় আমার মাতার পেছনে কুনোহানে আছিল। মাগর, হেইডা আমি চিনতাম পারি নাই। হুদা নওকর, তাই নিজের ভালা হইব ভাইবা চুপচাপ থাকছি আর কি। জানা আছিল বুদ্ধিমান আরো অনেক ব্যাডা-বেডি এহানে আছে, তারা সব বুইঝা লইব।’
একটা বিষয়ে শরাফতের বক্তব্য এবং ডাক্তার নিমেষ সরওয়ারের বক্তব্য একদম মেলে না। শরাফতকে অ্যাট্রপিন আনতে পাঠানোর আগে পর্যন্ত কমোডরের মাথা পুরোপুরি পরিষ্কার ছিল। রোগী নিজ স্ত্রী এবং ডাক্তার ছাড়া আর কাউকে ডাকার অনুমতি দেননি। তাঁকে এই আশঙ্কায় অস্থির হতে দেখা গেছে যে ডাক্তার হয়তো সময়মতো পৌঁছতে পারবেন না, তবে তার মানে এই নয় যে তিনি ভাবছিলেন তাঁকে বাঁচানো সম্ভব। তাঁর জানা ছিল তিনি মারা যাচ্ছেন।
‘তাঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে বা এ রকম কিছু বলেছেন?’
‘না, সর, না। মনিবের মুখে একডা কতাই বারবার হুনছি, গ্যাস্টিকের বেতা, গ্যাস্টিকের বেতা।’
‘হুম!’ গম্ভীর হলেন ডাক্তার কান্তিক।
‘তবে, সর, একডা অদ্ভুত কতা বলি হুনেন।’ ঠোঁট কামড়াচ্ছে শরাফত, এই প্রথম ছোটখাটো মানুষটার মধ্যে আমরা আবেগের প্রকাশ লক্ষ করলাম। ‘হুজুর মোরে কইলেন, শরাফত, আমার মাতা যুদি নষ্ট হয়া যায়, কেউরে ভুইলাও কবি না আমি কী কইছি! সব নিজের বুকের মইদ্যে কবর দিয়ে রাকবি!’ ঘুরে দাঁড়াল সে, ভাব দেখাল টেবিলের জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছে। ‘এইডা মোরে কষ্ট দিতাছে, সর,’ বিড়বিড় করল সে। ‘তবে মোরে কিছু জানানো হয় নাই। মুই শুধু হুজুরের হাত ধইরে বইসে ছিলাম। হুজুর মনে লয় ভাবতাছিলেন মুই হয়তো সব বইলা দিব! হায়, বিশ বছর পর…’
আরেকটু সিধে হলো, সে নিজের স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘মোরে দিয়া অ্যাট্রপিন আনানোর কোনো দরকার আছিল না, তয় ধারণা করলাম ডাক্তারেরে বোধয় গোপন কিছু কওনের ইচ্ছা আছে হুজুরের। মুই আগেও বহু মাইনষেরে মরতে দেকছি, বুইজা গেছিলাম কুনো অষুধে আর কাম হইবে না। দশ মিনিট বাদে ফিরা দেহি হুজুরে চইলা গেছেন।’
‘শরাফত, তিনি অসুস্থ হওয়ার আগে শেষবার কে তাঁর কাছে গিয়েছিল?’
‘মুই যতটুক জানি, ললিতান নেসা।’
‘ললিতান নেসা?’
‘হ, সর, মনিবের লেকালেকির সেকরেটারি। পাশের ঘরে যিনি কমপিউডারে বইসা আছেন, হেই লেডিস।’
‘ওকে তুমি লেখালেখির সেক্রেটারি বলছ কেন?’
‘হেরা মোড তেনজন, হুজুর। বাকি দুইজন পেরাইভেট আর ফেনানশাল। হেরা লেডিস না, জেনটেল। আমার মনিব সৃতি না কী জানি লেকতাছেলেন, হেই কাজে সাহাজজো করতেছিলেন লেডিস ললিতান নেসা। দুপুর দুইডা থন বিকাল চারডা পরযন্ত, হুজুরের জরুরি কিছু না থাকলে, তেনারা একলগে বইসা কাজ করতেন, হেরপরে চা খায়া ললিতান নেসা বাড়িত চইলা যাইতেন।’
‘কালও তাহলে রোজকার মতো চা দেওয়া হয়েছিল?’
‘হইছিল। আমি নিজে মর্জিনার কিচিন থন আইনা দিছি। মর্জিনা অইল গিয়া বড় চাকরানি। এই টেবিলে তো সব আমিই সাজায় দিলাম। হেরপর হুজুরকে ডাইকা দিয়া নিচে নামলাম নিজে চা খাওনের লাইগা।’
‘চায়ের সঙ্গে আর কিছু ছিল?’
‘কয় পিছ পাতলা পাউরুডি আর পেলেন কেক। আমার মনিব খুব কম খাইতেন, বুইজা-শুইনা খাইতেন, তবে চা খুব পছন্দ করতেন। বিকালে তার দুই-তিন কাপ লাগত।’
‘শরাফত, চায়ের ট্রেটা কিভাবে সাজানো হতো, কী কী থাকত সব আমাকে খুঁটিয়ে বলো,’ বললেন ডাক্তার কান্তিক, কান খাড়া করে উত্তরটা শোনার সময় পাইপে তামাক ভরছেন।
‘জি, সর। চা, রুডি আর কেক। দুধ দিলেও হুজুর নিজে লইতেন না। হের চা-পাতা আইত বিদেশ থন। চকচকে রুপার লাহান আলাদা কেটলি, ইলেকটিরিক। পরতি কাপ চা বানানো হইত আলাদা কইরা। রুপার খুদ্দরো গেলাসে চা পাতা ডালা হয়, তারপর গরম পানিভর্তি কাপের মধ্যে ওই গেলাস ডুবানো হয়…’
‘এটা কি কমোডর নিজে করতেন?’
‘না, সর। টেবিলে কুনো লেডিস থাকলে তিনি করতেন।’
‘কমোডর চা খেতেন কড়া, নাকি হালকা?’
‘এক্কেরে কড়া, হুজুর। তিতা পছন্দ করতেন।’
‘কমোডর আর ললিতান নেসা সব সময় একসঙ্গে বসে চা খেতেন?’
‘সব সম না। কুনো সম মেহমান থাকত। দু-একবার দেকছি লেডিস ললিতান হাউজকেপারের ঘরে চা নিয়া গিয়া খাইতাছেন।’
‘তোমাকে যখন ওপরতলায় ডাকা হলো, গিয়ে কী দেখলে, চায়ের সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে?’
‘হেইডা মুই কইতে পারি না, হুজুর। এমুন ঘাবড়ান ঘাবড়াইছি, কিছু খেয়াল করি নাই। মোর মনিব মারা যাওনের পর সব পরিষ্কার করছি, মাতায় খেলে নাই আর কী করার আছে মোর।’
পাইপে মাত্র এক কি দুবার টান দিয়ে খানিকটা নীলচে ধোঁয়া ছাড়লেন ডাক্তার কান্তিক, তারপর সেটা নিভিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, শরাফত, অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা এখন বরং মিস ললিতান নেসার সঙ্গে কথা বলি, যেহেতু তিনিই সবচেয়ে কাছে রয়েছেন।’
আমরা দ্বিতীয়বার অফিসে ঢুকতে কম্পিউটার ছেড়ে সিধে হলেন ললিতান নেসা, ঘুরে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, যেন আন্দাজ করতে পেরেছেন কেন আমরা ফিরে এসেছি। তাঁকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেয়ে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সন্দেহ নেই কোবিদরা, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই, অঢেল রূপ-সৌন্দর্য না দেখে কাউকে চাকরি দেননি। ললিতান যেন সাক্ষাৎ দেবী; অসম্ভব লম্বা, গায়ের রং দুধে-আলতা, টিকালো নাক, চোখ কটাক্ষ হানছে, চেহারায় এত গর্ব যেন মাটিতে পা পড়ছে না। সত্যি তুলনা হয় না! তবে, কিছু সময়ের জন্য রায় স্থগিত রাখছি, কারণ আমার জানা আছে এ ধরনের অনেক দেবীতুল্য খোলসের ভেতর বাস করে খুবই ছোট সব আত্মা। ভাবলাম রহস্যটার সমাধান এই সুন্দরী অপরূপার মধ্যে লুকিয়ে আছে কি না কে জানে। বাইরে থেকে তাঁকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে, তবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
পরিস্থিতি সম্পর্কে শরাফত যতটা জানে, সেও ততটা জানে, ফলে কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হলো না। আমার বস তাঁকে নিজের পরিচয় দিলেন, তারপর তাঁর মনটাকে শান্ত করার জন্য নিচু গলায় বললেন, খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা ঘটে গেছে…আমাদের সবাইকে শক্ত হতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে ইত্যাদি।
কথা বলতে গিয়ে মেয়েরা যেমন করে, ললিতানও তা-ই করলেন, যেন একটা শিশু তার পড়া পুনরাবৃত্তি করছে। দূরে নিবদ্ধ দৃষ্টি তাঁর কথার সঙ্গে তাল দিচ্ছে না। ভারি সুন্দর একটা পাথুরে মূর্তি, ভেতরে কলের গান বসানো আছে।
‘হ্যাঁ, এখানে আমি শুধু আমার চাকরি হারাইনি, তার চেয়ে বেশি কিছু হারিয়েছি,’ বললেন ললিতান। ‘তিনি আমার একজন সিনিয়র বন্ধু ছিলেন, ছিলেন স্নেহময় অভিভাবক। এখন আমার শুধু একটাই করণীয়, তাঁর কাজটা শেষ করা।’ হাত তুলে কম্পিউটারটা দেখালেন।
‘আপনি বসুন,’ নরম সুরে বললেন ডাক্তার কান্তিক। ‘আমাকে জানানো হয়েছে, কমোডর অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে আপনিই সম্ভবত শেষ ব্যক্তি, যিনি তাঁকে দেখেছেন। কাজেই আমি আশা করছি আপনার কাছ থেকে আমি অনেক সাহায্য পাব।’
‘হ্যাঁ, পাবেন,’ সায় দেওয়ার সুরে বললেন ললিতান, তবে বসলেন না। ‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তবে, আপনারা যাকে খুঁজছেন আমি সে নই।’
ললিতানের অদ্ভুত আচরণ ডাক্তার কান্তিককে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল। ‘নন?’ আধো হাসির সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, মেয়েটিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছেন।
লেখালেখির সেক্রেটারি সুরবিহীন গলায় বললেন, ‘আপনাকে বলা হয়েছে কাল বিকেলে কমোডরের সঙ্গে চা খেয়েছি আমি, কিন্তু তা সত্যি নয়। আমি কমোডরের সঙ্গে চা খাইনি।’
‘তাহলে কে খেয়েছে?’
‘গোপনীয়তা রক্ষা করব, এ রকম একটা প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছে আমার কাছ থেকে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন এক দিকে গড়াচ্ছে যে সব ফাঁস হয়ে যাওয়াই ভালো। কাল বিকেলে কমোডরের সঙ্গে চা খেয়েছেন প্রিন্সেস প্রমত্তা গঙ্গোত্রী।’
বসের চোখ থেকে সকৌতুক ভাবটা মিলিয়ে গেল। ‘তাই?’ শান্ত স্বরে বললেন। ‘পরিস্থিতিটা ঠিক কী রকম ছিল, একটু যদি ব্যাখ্যা করেন।’
‘কমোডর চেয়েছিলেন, বাড়ির কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে প্রিন্সেসের সঙ্গে নিভৃতে একটু আলাপ করবেন। সবই ফাঁস হয়ে যায়, নানা গুঞ্জন ছড়ায়, তাই। প্রিন্সেস বাড়িতেই থাকছিলেন। চা নিয়ে আসার পর, যেই শরাফত মিয়া নিজে চা খেতে নিচে নেমে গেল, অমনি আমাকে পাঠানো হলো প্রিন্সেসকে ডেকে আনার জন্য। তাঁর সুইট বাড়ির দক্ষিণ দিকে। ওখান থেকে তাঁকে আমি নিয়ে আসি কমোডরের পড়ার ঘরের কাছাকাছি। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিই আর কি, তারপর নিচে নেমে সিস্টার শাবানার ঘরে যাই চা খেতে।’
‘সিস্টার শাবানা মানে হাউজকিপার?’
‘পুরো বাড়ি দেখেশুনে রাখা তাঁর দায়িত্ব, হ্যাঁ। যত চাকরানি আছে, সবাইকে তার হুকুম মেনে কাজ করতে হয়।’
‘প্রিন্সেসের সঙ্গে কী বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন কমোডর?’
চেহারায় ভাব বলে কিছুই নেই, ললিতান জবাব দিলেন, ‘তা আমি জানি না। ওসব আমার নাগাল এবং অধিকারের বাইরে।’
এটা পরিষ্কার যে এখানে মিথ্যে কথা বলছেন ললিতান, তবে চাপ দিয়ে কোনো কাজ হবে বলেও মনে হলো না। ডাক্তার কান্তিক প্রশ্ন করলেন, ‘কমোডরের পড়ার ঘরে কতক্ষণ ছিলেন প্রিন্সেস গঙ্গোত্রী?’
‘তা আমার জানা নেই। পরে আর তাঁকে আমি দেখিনি। চা শেষ করে সোজা বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। সেটা কমোডর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এই খবর ছড়ানোর আগে। কাল আমি কিছুই জানিনি, জানলাম আজ সকালে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে।’
‘প্রিন্সেস এখন কোথায়?’
‘আমি শুধু জানি যে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, তবে কোথায় গেছেন তা আমি আপনাকে বলতে পারব না।’
‘সায়েবের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক সে কিছু জানে কি না।’ কামরার চারদিকে চোখ বোলালেন ডাক্তার কান্তিক। ‘ইন্টারকমে কথা বলতে পারি?’
‘ফোনে আরো তাড়াতাড়ি হবে।’ কম্পিউটারের পাশ থেকে মোবাইল তুলে নম্বর টিপলেন ললিতান। ‘ডাক্তার কান্তিক সায়েবকে ডাকছেন, কমোডরের অফিসে একটু আসতে বলো তাকে।’
আমরা যখন সায়েবের জন্য অপেক্ষা করছি, ডাক্তার কান্তিক পাইপ পরিষ্কার করে আবার তাতে তামাক ভরলেন। এবার সেটা ধরানোর পর টান দিয়ে প্রচুর ধোঁয়া গিলছেন, কে বলবে তিনি একজন ডাক্তার! ধোঁয়া গিলছেন আর অলস ভঙ্গিতে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছেন সুন্দরী ললিতানকে। লক্ষ করলাম তাঁর চোখ দুটো খুব অস্থির, খানিক পর পরই চোরা দৃষ্টিতে ললিতানের দিকে তাকাচ্ছেন। ললিতানকেও ঠিক তা-ই করতে দেখলাম। দুজনের কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, ফলে পরিবেশটা কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। এবার নিয়ে আজ অন্তত দশবার নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এই অভিজাত বাসগৃহে কে জানে কী গোপন কাহিনী লুকিয়ে আছে!
খুব দ্রুত দরজায় পৌঁছে গেল সায়েব। তার জানা আছে ডাক্তার কান্তিককে অগ্রাহ্য করা চলে না। তাকে দেখামাত্র বস জানতে চাইলেন, ‘প্রিন্সেস কোথায়?’
একমুহূর্ত দেরি না করে কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে সায়েব জবাব দিল, ‘হার হাইনেস কাল বিকেল চারটের খানিক পর বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, স্যার।’
‘তুমি তাঁকে চলে যেতে দেখেছ?’
‘না স্যার, তোরণ ছাড়া আর কেউ হার হাইনেসকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখেনি- গ্রাম থেকে মর্জিনার সুপারিশে এসেছে তোরণ, নতুন দারোয়ান। সে বাড়ির মূল গেটে ডিউটি দিচ্ছিল।’
‘কী জানিয়েছে সে, এই তোরণ?’
‘তোরণ জানিয়েছে, হার হাইনেস ছুটতে ছুটতে নিচতলায় নেমে আসেন, তাঁকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। আসলে তিনি কাঁদছিলেন। তোরণ ঘাবড়ে যায়, কারণ সে বুঝতে পারে হার হাইনেসকে এই অবস্থায় রাস্তায় বেরিয়ে যেতে দিলে নির্ঘাত তার চাকরি থাকবে না। তাই গেট খুলতে ইতস্তত করছিল সে। কিন্তু দেরি দেখে হার হাইনেস মাটিতে পা ঠুকতে শুরু করেন, বারবার হুকুম করতে থাকেন, গেট খুলে দাও। উপায় কী, তোরণ শেষ পর্যন্ত গেট খুলে দিতে বাধ্য হয়। তার পরই আমাকে রিপোর্ট করে সে। আমি প্রিন্সেসের সুইটে ছুটে যাই। ওখানে তাঁর লেডি-ইন-ওয়েটিং মিস ঝুমলা শিলিকে দেখতে পাই। প্রিন্সেস বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, এটা তাঁর জানা ছিল না। খবরটা শুনে সাংঘাতিক ঘাবড়ে যান তিনি। যা হোক…
‘এক মিনিট, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কী পরেছিলেন প্রিন্সেস গঙ্গোত্রী?’
‘স্যুট,’ জবাব দিলেন ললিতান।
‘অলংকার?’
‘আমি শুধু নেকলেস দেখেছি।’
‘মাথায় মুকুট ছিল না?’
‘না,’ বললেন ললিতান। ‘এমনিতেও তাঁকে আমি কখনো মুকুট পরতে দেখিনি। তবে পাথর বসানো সাদা হ্যাট ছিল মাথায়।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে সায়েব, তুমি বলো।’
‘তখনো আমি মিস ঝুমলা শিলির সঙ্গে কথা বলছি, তাঁর ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফোন করেছেন হার হাইনেস। শিলিকে তিনি হুকুম করলেন, তাঁর চাকরবাকরকে নিয়ে তিনি যেন এই মুহূর্তে হোটেল হিমালয়ায় চলে যান। তাড়াহুড়া করে নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে বিদায় নিলেন তাঁরা।’
‘তার মানে কমোডরের অসুস্থতা জানাজানি হওয়ার বেশ আগেই তারা সবাই বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল?’
‘জি, স্যার। ট্রাঙ্কগুলো আমি পরে হোটেলে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘প্রিন্সেসের এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? তোমার কোনো আইডিয়া আছে?’
‘না, স্যার।’
কে জানে সায়েব সত্যি কথা বলছে কি না!
ডাক্তার কান্তিক আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘চলো অতেব, প্রিন্সেসকেই জিজ্ঞেস করা যাক।’
খবর নিতে জানা গেল, সদর দরজায় রিপোর্টার আর ফটোগ্রাফারদের ঠেলাঠেলি ভিড় লেগে আছে। আমাদের আসা-যাওয়া গোপন রাখাটা সবচেয়ে জরুরি, তাই বাড়ির পেছনের উঠানে নিয়ে এসে আমাদের দুজনকে একটা প্রাইভেট কারে তুলে দিল সায়েব। জানালায় রঙিন কাচ, তার পরও আমরা পর্দা টেনে দিলাম, কাজেই সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কোবিদ ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসা গেল।
‘রহস্য বেশ জমাট বাঁধছে, অতেব,’ মুখে কৌতূহল জাগানোর মতো হাসি নিয়ে বললেন আমার বস। ‘নেপালে ১৯৯০ সালেই রাজতন্ত্র খতম হয়ে গেছে, কিন্তু ওই পরিবারের কেউ কেউ এখনো প্রিন্স আর প্রিন্সেস সেজে মানুষের কাছে নিজেকে বড় করে দেখাতে চান। এটা কেন হয়, জানো? ওদের নাগালে বিপুল সম্পত্তি আছে, তাই। সারা জীবন দুই হাতে ওড়ালেও বোধ হয় ফুরোবার নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে এর আগে কোনো প্রিন্সেসের সঙ্গে পরিচিত হইনি।’
‘জি, স্যার। ওই মেয়েটার কথা ভাবছি, স্যার, ললিতান নেসা। ওর আচরণ খুব অদ্ভুত না?’ প্রশ্ন করলাম আমি।
‘তবে সেটার আলাদা কোনো তাৎপর্য নেই,’ বস বললেন। ‘বাড়ির প্রত্যেকে অদ্ভুত আচরণ করছে। একা শুধু শরাফত বাদে। এই একটা লোক যে নিজের কাণ্ডজ্ঞান হারায়নি।’
যদিও তাঁকে আমার সিরিয়াস বলে মনে হলো না।
তিন মিনিটের মাথায় হোটেল হিমালয়ায় পৌঁছে গেলাম আমরা। রিসেপশনে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন বস। একটু দূরে সরে গিয়ে রেডিও মৌজ খুলেছি আমি, দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে তার খবর তো আমাদের রাখতেই হবে।
ডাক্তার কান্তিক আন্দাজ করলেন, হোটেলের খাতায় নিজের আসল পরিচয় দেবেন না প্রিন্সেস। ‘খুব উঁচু পজিশনের বিদেশি এক তরুণী,’ ম্যানেজমেন্টকে জানালেন তিনি। ‘কাল একা এসেছেন, পরে তাঁর সহচরী আসেন, সঙ্গে কয়েকজন চাকরানি নিয়ে।’
‘ও আচ্ছা, আপনারা প্রিন্সেস অব উদয়পুর সম্পর্কে বলছেন। তিনি এক ঘণ্টা হলো মেঘনা ঘাটে চলে গেছেন, ওঠার কথা সপ্তকোষীতে। সপ্তকোষী তাঁর ইয়ট, প্রমোদতরী।’ ‘জানি,’ বললেন ডাক্তার কান্তিক। ‘সপ্তকোষী নেপালের একটা নদীও।’
‘কিন্তু তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন একজন ভারতীয় হিসেবে।’
কান থেকে ফোন নামিয়ে আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘স্যার, আমরা বোধ হয় হেরে গেলাম।’
‘মানে?’
‘এইমাত্র রেডিওর খবরে শুনলাম সপ্তকোষী বিকেল ৪টার সময় নোঙর তুলে মেঘনা ঘাট ছেড়ে যাবে- প্রিন্সেস প্রমত্তা গঙ্গোত্রী তাঁর প্রমোদতরী নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছেন, খিদিরপুরে নোঙর ফেলবেন।’
ঝট করে হাতঘড়ি দেখলেন ডাক্তার কান্তিক। ৩টা বাজে। কিন্তু জানা কথা পথে কয়েক জায়গায় তীব্র যানজটে পড়তে হবে, এক ঘণ্টার মধ্যে মেঘনা ঘাটে পৌঁছনো সম্ভব নাও হতে পারে।
সিআইডি চিফ আন্দেশা কাফিকে মোবাইল থেকে মেসেজ পাঠানো হলো : ‘১০ মিনিটের মধ্যে রমনা পার্কে একটা হেলিকপ্টার নামানো যায়, আমাদের মেঘনা ঘাটে পৌঁছে দেবে?’
২ মিনিট পর উত্তর এলো : ‘কপ্টার যাচ্ছে।’
পাঁচ
কপ্টার থেকে মেঘনা ঘাটে নেমেই আমরা দেখলাম প্রকাণ্ড এক সাদা রাজহাঁস নোঙর তুলছে, ঘাটের কিনারায় গিয়ে বুঝলাম ওটাই প্রিন্সেস প্রমত্তা গঙ্গোত্রীর ইয়ট সপ্তকোষী।
প্রমোদতরীর প্রবীণ ক্যাপ্টেন কুরনাল দর্জিকে আমরা পেলাম তাঁর কেবিনেই, অস্থির পায়ে পায়চারি করছেন, হাতে একটা ঘড়ি ধরা। গটগট করে হেঁটে ভেতরে ঢুকে পড়লেন ডাক্তার কান্তিক, নিজের ভিজিটিং কার্ডটা দেখালেন তাঁকে।
‘আচ্ছা, আপনিই তাহলে ফোন করেছিলেন?’ জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন দর্জি। আমি ভাবছিলাম ভুয়া কল হবে হয়তো। তা সমস্যাটা কী?
‘আপনার ইয়টে এক ভদ্রমহিলা আছেন, যাঁকে পুলিশ খুঁজছে,’ বস বললেন।
ভ্রু কোঁচকালেন ক্যাপ্টেন। ‘কী নাম তাঁর?’ আরোহীদের তালিকা হাতে চলে এলো।
‘শেষবার নিজের পরিচয় দিয়েছেন, প্রিন্সেস অব উদয়পুর। আমরা জানি তিনি নেপালের প্রিন্সেস প্রমত্তা গঙ্গোত্রী, এই ইয়টের মালিক।’
‘গুড গড!’ শুধু বিস্ময়ে নয়, প্রবল হতাশায় গুঙিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন। ‘তিনি একজন রয়াল প্রিন্সেস! কী সাংঘাতিক স্ক্যান্ডাল ছড়াবে ভাবতে পারেন!’
‘বাধ্য হয়ে সেটা আমাকে ভাবতে হয়েছে,’ ডাক্তার কান্তিক শুকনো গলায় বললেন। ‘তিনি জাহাজে আছেন কি না?’
‘হ্যাঁ, আছেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে খুঁজছে কেন?’
‘আপাতত শুধু একজন সাক্ষী হিসেবে। এখনো কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি।’
‘আপনি পুলিশের হয়ে কাজ করছেন, আমি সেটা বুঝব কিভাবে?’
পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন কান্তিক স্যার। ‘এই যে, তাঁকে অ্যারেস্ট করার ওয়ারেন্ট। আরো শুনুন, আপনি যদি পোর্টহোল দিয়ে নদীর দিকে তাকান, পুলিশ লঞ্চে আমাদের সিআইডি চিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাবেন। জেটিতে রিপোর্টাররা থাকতে পারে ভেবে তাঁকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি। আমাকে তারা দেখেছে, তবে আমি বলেছি, প্রিন্সেস আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, তাঁকে আমি বিদায় জানাতে এসেছি।’
‘শুনুন, মিস্টার কান্তিক স্যার। আমরা নেপালের নাগরিক ঠিকই, কিন্তু বর্তমান নেপাল সরকার প্রিন্সেস বা সাবেক রাজপরিবারের কাউকে কূটনৈতিক বা আইনি সহায়তা দেবে না। কাজেই যতটা সম্ভব কম ঝামেলার মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে চাই আমি। কিন্তু এখন যদি আপনারা প্রিন্সেসকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান, সেটা হবে বোমা ফাটানোর মতো। এই খানিক আগে রিপোর্টাররা হার হাইনেসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।’
‘আমি এমন জাহাজে চড়েছি, প্যাসেঞ্জারকে তোলা হয় খোলের গায়ে তৈরি দরজা দিয়ে,’ বললেন কান্তিক স্যার। ‘আপনি যখন ইয়ট সোজা করে নেবেন, জেটি থেকে দেখা যাবে না এমন একটা দরজা খুলে প্রিন্সেসকে বের করে দিতে পারবেন না?’
একমুহূর্ত চিন্তা করে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘সম্ভব। কিন্তু কোথায় বের করে দেব? আপনি নিশ্চয়ই আমাকে বলছেন না আমি তাঁকে পানিতে ফেলে দিই?’
বস হাসলেন না। ‘বের করে দেবেন একটা টাগ বোটে। সেটা উজান ধরে কিছুদূর যাবে, চোখের আড়ালে পৌঁছে প্রিন্সেসকে তুলে দেবে পুলিশের লঞ্চে।’
ইতিমধ্যে ওয়ারেন্ট পড়া শেষ করেছেন ক্যাপ্টেন, বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। এটা করা যাবে।’
‘গুড। এসো অতেব, আমাদের আরো কাজ আছে…’
খুব সাহসী পুরুষও কোনো না কোনো ধরনের আতঙ্কে ভোগেন। বসের কথা শুনে ক্যাপ্টেন কুরনাল দর্জির চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ‘গুড গড, স্যার,’ আঁতকে উঠলেন তিনি, ‘আপনি আমাকে একা ওই মেয়ের খপ্পরে ফেলে যাবেন না, প্লিজ! ছবিটা কল্পনা করুন, অনবরত হাত-পা ছোড়া একজন রাজকুমারীকে আমি একটা টাগে তুলে দিচ্ছি!’
ডাক্তার কান্তিক হেসে উঠলেন। সারা দিনে এই প্রথম আমি একাধারে ভরাট এবং সুরেলা শব্দটা শুনতে পেলাম।
ক্যাপ্টেন দর্জি এর মধ্যে হাসির কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। ‘আমার সঙ্গে আসুন আপনারা, প্লিজ,’ আবেদনের সুরে বললেন তিনি। ‘প্রিন্সেসকে প্রস্তুত হতে দিন, তাঁকে জানতে দিন কিসের মুখোমুখি হতে হবে।’
‘ঠিক আছে,’ রাজি হলেন বস। ‘পথ দেখান।’
এক মিনিট পর বি ডেকে নেমে গিয়ে একটা কেবিনের দরজায় টোকা মারলাম আমরা। ছোটখাটো আকৃতির এক তরুণী, সুবেশী এবং মার্জিত, দরজা খুললেন- নিশ্চয়ই ম্যাডাম ঝুমলা শিলি। তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে একটা সাজানো সিটিং রুম দেখতে পেলাম, ডানে-বাঁয়ে খোলা দরজা।
‘শুভেচ্ছা,’ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সৌজন্য প্রকাশ করলেন ক্যাপ্টেন। ‘আমি একবার প্রিন্সেসের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
‘এখন? আমি দুঃখিত। হার হাইনেস কারো সঙ্গে দেখা করছেন না।’
‘আমার অবস্থা দুঃখিতের চেয়েও খারাপ,’ ম্লান সুরে বললেন ক্যাপ্টেন। ‘প্রিন্সেসকে বলুন, আমি এই জাহাজের কমান্ডার, তাঁর সঙ্গে কথা না বলে কোথাও যাচ্ছি না।’
পথ ছেড়ে সরে না দাঁড়িয়ে শিলির কোনো উপায় থাকল না। কামরার ভেতর ঢুকলাম আমরা। ডাক্তার কান্তিক আর আমার পথ আগলানোর চেষ্টা করলেন তিনি, জানতে চাইলেন, ‘এরা কারা?’
‘ওঁরা পুলিশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।’
‘হে ভগবান!’ কপাল চাপড়াতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন শিলি, তাড়াতাড়ি আমাদের পেছনে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ‘প্রিন্সেসকে আমি প্রস্তুত হতে বলি,’ বলে আরেক দরজার দিকে এগোলেন।
‘অত সময় নেই, দুঃখিত,’ বলে দরজার সামনে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন। ‘এই ভদ্রলোকেরা এই মুহূর্তে প্রিন্সেসের সঙ্গে দেখা করবেন। আমি এখানে অপেক্ষা করব।’
কাজেই আমাকে নিয়ে সোজা বেডরুমে ঢুকে পড়লেন কান্তিক স্যার। আমিও এই প্রথম একজন রাজকুমারীর এত কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছি, আমার গোটা অস্তিত্ব স্রেফ চোখ হয়ে উঠল। আমার জানা ছিল না নেপালিদের চুল এ রকম সোনালি হয়, হয়তো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফসল। আর, এই নারী আমার দেখা নেপালি তরুণীদের মতো মোটেও ছোটখাটো বা বেঁটে নন, রীতিমতো তালগাছই বলব আমি, পুরো ছয় ফুট যদি নাও হন। বয়স যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক কম, মাত্র কিছুদিন হলো কৈশোর পেরিয়েছেন। দেখতে চীনা পুতুল- নিখুঁত, ঝকঝকে, একহারা। একটা আর্মচেয়ারে বসে আছেন, চোখে রুমাল চেপে। তবে যেই মাত্র বুঝতে পারলেন আমরা আগন্তুক, লাফ দিয়ে সিধে হলেন।
‘এই অনধিকার প্রবেশের অর্থ কী?’ ডেকে পা ঠুকে জানতে চাইলেন। ‘কামরা ছেড়ে বেরিয়ে যান!…ম্যাডাম শিলি, এরা কারা?’
কিন্তু তাঁর খাস সহচরী চোখের জলে ভাসছেন, কিছু ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ। আবার পা ঠুকে আমাদের দিকে ঘুরে গেলেন প্রিন্সেস।
তাঁর দিকে এক পা এগোলেন কান্তিক স্যার, মুখে সকৌতুক হাসি, চোখে সহনশীল দৃষ্টি, নরম সুরে ব্যাখ্যা করছেন কেন তাঁকে ইয়ট ত্যাগ করতে হবে।
‘এ অসহ্য রকমের বাড়াবাড়ি! আমি প্রিন্সেস প্রমত্তা গঙ্গোত্রী। আপনারা কি জানেন না এটার কী মানে? আপনাদের আইন আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি আমাদের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করব!’
‘আমার ধারণা নেপাল এখন একটা প্রজাতন্ত্র,’ মৃদু গলায় বললেন বস।
প্রিন্সেস তাঁর কথা কানে তুলছেন না। ‘এই অপমানের জন্য আপনাদের এই রাজধানী ঢাকাকে চড়া মাসুল দিতে হবে!’ চিৎকার করছেন তিনি। ‘কী কারণে পুলিশ আমাকে আটক করবে?’
‘কাল বিকেলে কমোডর তসলিম কোবিদ মারা গেছেন,’ বস বললেন।
‘তাই নাকি, মারা গেছেন?’ প্রিন্সেসের সুর ঠাণ্ডা।
‘আপনি জানেন না?’
‘না।’
গম্ভীর হাসি ফুটল ডাক্তার কান্তিকের মুখে। ‘খবরের কাগজে…’
প্রিন্সেস গঙ্গোত্রী মাথাটা প্রবল বেগে ঝাঁকালেন। ‘আমি আপনাদের রাবিশ খবরের কাগজ পড়ি না!’
হায়, এই তাহলে রাজকীয় সততা! কাছাকাছি সোফায় আজকের একটা ইংরেজি দৈনিক পড়ে থাকতে দেখছি আমরা। ফটোসহ কমোডর তসলিমের মৃত্যুসংবাদ হেডিং করা হয়েছে তাতে। কথা না হলে সেদিকে একটা হাত তুললেন ডাক্তার কান্তিক।
তার পরও বিব্রত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না প্রিন্সেসের মধ্যে। ‘ওটা আমি দেখিনি,’ বললেন তিনি। ‘আর, তা ছাড়া, তাতে কী? আমি স্রেফ ওঁদের গেস্ট ছিলাম। যা ঘটে গেছে সে জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু তার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
‘কমোডরকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে,’ ডাক্তার কান্তিক বললেন, গলার আওয়াজ খাদে। ‘আর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে আপনিই শেষ ব্যক্তি, যিনি তাঁকে দেখেছেন।’
প্রিন্সেসের চেহারায় নিখাদ বিহ্বলতা, ডাক্তার কান্তিকের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ অপলক। অবশ্য হলফ করে কিছু বলা যায় না। ‘সেটা কাগজে ছাপেনি,’ অস্ফুটে বললেন তিনি।
‘না,’ বললেন ডাক্তার কান্তিক।
বিস্ময়ের ধাক্কায় শব্দ করে দম নিচ্ছেন প্রিন্সেস, কোনো রকমে কথা বলতে পারছেন। ‘আপনারা কি এত বোকা যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবেন আমি তাঁকে বিষ খাইয়েছি? ফর গডস সেক, একজন বাংলাদেশি মিলিয়নেয়ারকে কী কারণে আমি খুন করতে যাব?’
‘কেন কেউ খুন করবে তা তো আমার জানার কথা না, তবে দায়িত্ব যখন নিয়েছি, আমাকে জানতে হবে এই খুনটা কে করেছে।’ এরপর বস ব্যাখ্যা করলেন মিডিয়ার দৃষ্টি থেকে তাঁকে বাঁচাতে কী কী ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
‘আমি আমার ইয়ট ছেড়ে কোথাও যাব না!’ বললেন প্রিন্সেস, রাজকীয় পা আরেকবার ডেকে ঠুকলেন।
কাঁধ ঝাঁকালেন ডাক্তার কান্তিক। এভাবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। প্রিন্সেসকে রাজি করানোর দায়িত্ব ক্যাপ্টেন দর্জির ওপর ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। গম্ভীর মুখ নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন।
ছয়
দৃশ্যপট বদলে গেল, এখন আমরা ডাক্তার কান্তিকের বনানীর বাসায়। সিআইডিপ্রধান আন্দেশা কাফির সঙ্গে কথা হয়েছে বসের, প্রিন্সেসকে এখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন তিনি। তাঁর জন্য অপেক্ষার সময়টায় মরা খিদে মেটাতে লাঞ্চ সারলাম আমরা। আমার গুরু সব সময় খুব মন লাগিয়ে খান, আজও খাচ্ছেন, আমাকে উসখুস করতে দেখে বললেন, হাতের কেস নিয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না।
আরো প্রায় এক ঘণ্টা পর একটা ট্যাক্সি ক্যাবে করে প্রিন্সেস আর তাঁর সহচরী ঝুমলা শিলিকে নিয়ে এলেন সিআইডির সুপারিনটেনডেন্ট আরশাদুল হক। পিছু নিয়ে আরেকটা ট্যাক্সি এলো, তাতে সাদা পোশাকে দুজন পুলিশ আর কয়জন নেপালি চাকরানি। চাকরানি আর পুলিশকে ডাইনিং রুমে বসতে বলে প্রিন্সেসকে নিয়ে দোতলার একটা সাজানো কামরায় উঠে গেলাম আমরা। ইতিমধ্যে অনেক বদলে গেছেন তিনি। জোঁকের মুখে নুন পড়লে যা হয়, তাঁর রাজকীয় দাপট অদৃশ্য হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে একটা সাধারণ মেয়ে। সাধারণ, তবে নরম বা সরল নন। আমি তাঁর মধ্যে একটা শক্ত ভাব লক্ষ করলাম, যা মোটেও ‘মেয়ে’সুলভ নয়। তাঁর মধ্যে এমন একটা আবেদন আছে, আমার অভিজ্ঞতার একদম বাইরে। এক ধরনের উত্তেজনার নমুনা তিনি, তাই আমি তাঁকে বুঝতে পারছি না। নেপালি প্রিন্সেস তাঁর মাথা উঁচু করে রেখেছেন।
আমার বস তাঁর প্রতি নরম আচরণ করছেন। ‘বসুন,’ বললেন তিনি। ‘আসুন, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা শান্তভাবে কথা বলি। আপনাকে কোনো ব্যাপারে অভিযুক্ত করা হয়নি।’
‘আপনাদের দয়া, মিস্টার,’ বললেন প্রিন্সেস, গলায় একটু শ্লেষ। ‘একটা সিগারেট পেতে পারি?’
‘অতেব!’
বাধ্য হয়ে পকেট থেকে গোপন প্যাকেট বের করে সিগারেট দিতে হলো প্রিন্সেসকে। সেটা ধরিয়ে ঘন ঘন কয়েকটা টান দিলেন তিনি।
‘এবার দয়া করে বলুন কাল বিকেলে কমোডর আর আপনার মধ্যে কী ঘটেছিল।’
অসহিষ্ণু দেখাল প্রিন্সেসকে। ‘তা আমি বলতে রাজি নই। সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, তার সঙ্গে পাবলিক বা পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই।’
ধৈর্য ধরে রাখার জন্য বড় করে শ্বাস নিলেন কান্তিক স্যার। ‘মাফ করবেন,’ বললেন তিনি, ‘আপনারা আলাপ করার পরপরই যা ঘটেছে, সেটা পুলিশের জন্য বিরাট একটা উদ্বেগের বিষয়; কাজেই আপনাকে সব বলতে হবে।’
প্রিন্সেসের চোখে-মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ ফুটল। ‘হে ভগবান! এসব কাগজে ছাপা হলে আমি খুন হয়ে যাব,’ আপন মনে বিড়বিড় করছেন। ‘আমার অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। আপনারা জামাত, আপনারা শিবির!’
জামাত-শিবির শব্দ দুটো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও গালি হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়েছে দেখে বিস্মিত হলাম, তবে সামান্যই।
বস তাঁকে বললেন, ‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, কমোডরের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে আপনার একটা শব্দও মিডিয়ায় প্রচার হবে না।’
প্রিন্সেস বসবেন না। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, একটা শোকেসের গায়ে হেলান দিয়ে, একেবারে হঠাৎ করেই নিজের গল্প শুরু করলেন তিনি :
‘কোবিদ পরিবারের সঙ্গে গত শীতে ক্যানে পরিচয় হয় আমার, আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ওদের মতো আমিও গিয়েছিলাম- আমি আমন্ত্রিত হয়ে, ওঁরা বেড়াতে- ফ্রান্সের অনেক জায়গার মতো ওখানেও ওদের একটা বাড়ি আছে। পরিচয় হওয়ার পর রোজ আমার খবর নিচ্ছিলেন, দাওয়াত দিয়ে বাংলার সুস্বাদু সব খাবার খাওয়াচ্ছিলেন। আমার রাজপরিবার যেহেতু ধ্বংস হয়ে গেছে, বেশি বাছবিচার করার সামর্থ্য আমিও হারিয়েছি, তাই না? সে জন্যই তো নিজেকে আমি ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার অনুমতি দিয়ে বসলাম। তারপর একদিন বংশের গৌরব হিসেবে বাড়ির ছেলেকে আমার সামনে হাজির করা হলো- দেখলাম সুন্দর, সুপুরুষ, লেখাপড়ায়ও কম যায় না, তবে কেতা-কায়দা বেশ কম জানে, আচরণ একটু কর্কশ। দেখামাত্র আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল সে। এরপর সব জায়গায় আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা যেতে লাগল। আমার দুঃসময় চলছে, মা-বাবা মারা গেছেন, বেশির ভাগ সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, দেশে ফিরতে পারি না- তা না হলে তাকে আমার সুযোগ দেওয়ার প্রশ্ন উঠত না। নিজের ভালো হবে ভেবে আপস করছিলাম। আমার বড় বোন প্রিন্সেস অন্নপূর্ণাকে ওদের বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করলেন ওঁরা। মিসেস জারিনা প্রিন্সেস হিসেবে আমাদের অত্যন্ত গুরুত্ব আর মূল্য দিচ্ছিলেন, আভাস দিচ্ছিলেন আমাকে তিনি পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে দেখতে চান, তাতে আমার বড় বোন নিজের সম্মতিও দেন। নির্দিষ্ট করে কোনো প্রস্তাব দেওয়া না হলেও আমি নানা সূত্র থেকে জানতে পারছিলাম, বিয়ের সব আয়োজন দ্রুত সম্পন্ন করা হচ্ছে। ওদিকে সলিম কোবিদের আচরণ…কি জানি, আমি হয়তো বাঙালিদের রীতিনীতি ভালো বুঝি না…।’
প্রিন্সেস গঙ্গোত্রীর মুখে মুহূর্তের জন্য বেদনার ছাপ ফুটল। একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন তিনি :
‘বেড়ানো শেষ করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন ওঁরা, এই সময় প্রস্তাব দেওয়া হলো, আমিও যেন ওঁদের সঙ্গে আসি। কিন্তু আমার বোন বললেন, তা তোমার যাওয়া উচিত হয় না, একজন প্রিন্সেসের জন্য এটা বেমানান। ঠিক হলো, কদিন পর ঢাকায় পৌঁছব আমি, তখন কটা দিন ওঁদের বাড়িতে থাকা যাবে। বড় বোনের সাগরভীতি আছে, তাই সহচরী হিসেবে বান্ধবী ঝুমলা শিলি আমার সঙ্গে থাকলেন। আমরা ঢাকায় পৌঁছেছি এক সপ্তাহ আগে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, কোথাও একটা গিঁট দেখা দিয়েছে। কমোডর এবং মিসেস জারিনা- দুজনকেই খুব টেনশন করতে দেখলাম। দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকলাম, কিন্তু বাড়ির ছেলেকে একবারও আমি দেখতে পেলাম না। একসময় জানতে পারলাম সে বাড়িতেই ছিল, এবং আমার সঙ্গে দেখা না করে আবার চলে গেছে।’
এখানে একটু বিরতি। একটা রুমাল দিয়ে বান্ধবীর মুখটা মুছে দিলেন ঝুমলা শিলি।
‘কাল বিকেলে,’ আবার শুরু করলেন প্রিন্সেস, ‘তাঁর এক সেক্রেটারিকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কমোডর। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে আমাকে তাঁর পড়ার ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাঁকে আমি খুবই বিব্রত এবং কাতর অবস্থায় দেখতে পাই। অনেক কথা বললেন তিনি, কিন্তু আসল কথাটা আমাকে পরিষ্কার করে জানাতে তাঁর বিবেকে বাধছিল। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম কী সেটা। কথা সোজা করে বলাই আমার অভ্যাস, কাজেই তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়েটা কি আপনারা ভেঙে দিচ্ছেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, অসম্ভব দুঃখ আর বিষণ্নতার সঙ্গে, ‘হ্যাঁ, সব শেষ হয়ে গেছে।’ প্রিন্সেসের চেহারা লাল হয়ে উঠল। ‘হে ভগবান! এই ছিল আমার নিয়তি, একজন রাজকুমারীর নিয়তি! একটা সারমেয়কে মেনে নিতে রাজি হওয়ার পর! কমোডরের কথা শুনে মনে হলো, রাগে আমি মারা যাব। আর কী করার ছিল আমার? সেই মুহূর্তে ছুটে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, পরে খবর পাঠাই, যাতে আমার চাকরানিরাও বেরিয়ে আসে।’
গল্পটা শেষ হতে ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে এলো। ওখানে দাঁড়িয়ে একটু হাঁপাচ্ছেন প্রিন্সেস। আমরা সবাই বুঝতে পারছি যে তাঁকে খুব বাজেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
অবশেষে ডাক্তার কান্তিক শান্ত গলায় বললেন, ‘কামরা ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে আপনি আর কমোডর একসঙ্গে বসে চা খেয়েছিলেন।’ তাঁর কথার মধ্যে প্রশ্নের সুর নেই।
কপালের পাশে আঙুলের চাপ দিচ্ছেন প্রিন্সেস। ‘মনে করতে দিন! হ্যাঁ, মনে পড়ছে, চা বানানো হয়েছিল। খুদে কাচের গ্লাস দিয়ে আমিই বানিয়েছি।’
সরল মনে কথাটা স্বীকার করছেন প্রিন্সেস, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে ততটা সরল কুমারী তিনি নন।
‘চা বানানো হয়েছিল, কিন্তু ওই চা কি খাওয়াও হয়েছিল?’
‘আমি খাইনি,’ তাড়াতাড়ি বললেন প্রিন্সেস।
‘আর কমোডর?’
‘তা আমি বলতে পারব না…হ্যাঁ! এখন আমার মনে পড়ছে, তাঁকে আমি ঢোঁক গিলতে দেখেছি, দেখেছি ওই কাপ খালি হয়ে গেছে।’
‘সেটা আপনাকে দুঃসংবাদ দেওয়ার আগে, নাকি পরের ঘটনা?’ নরম সুরে জানতে চাইলেন কান্তিক স্যার।
‘তা আমার মনে নেই,’ বললেন প্রিন্সেস, তাঁর মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ করলাম আমরা। তারপর উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আগে! আগে! আগে!’
‘হুম!’ এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত একবার হেঁটে এলেন কান্তিক স্যার। তারপর হুট করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কোনো কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন কমোডর?’
উত্তর দেওয়ার সময় প্রিন্সেসের পিঠ আড়ষ্ট আর চিবুক উঁচু হয়ে থাকল। ‘হ্যাঁ, তিনি বললেন তাঁর ছেলে এতে মত দিচ্ছে না।’ কথাটা বলার সময় ঠিক থাকলেও পরমুহূর্তে শোকেসের মাথা বরাবর হাতটা লম্বা করে দিয়ে সেটার ওপর কপাল ঠেকালেন তিনি, তারপর ভেঙে পড়লেন অদম্য কান্নায়। ‘মনে হচ্ছিল আমার মরণ হোক!’ ডুকরে উঠলেন তিনি। অত্যন্ত করুণ একটা দৃশ্য।
ছুটে এসে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন ম্যাডাম শিলি, তারপর কাঁধের ওপর দিয়ে ডাক্তার কান্তিকের দিকে তাকালেন। ‘ওঁকে আমি এখন কোথায় নিয়ে যাব?’
‘প্যাসেজ ধরে সোজা আমার বেডরুমে,’ একটা দরজা খুলে দিয়ে বললেন স্যার।
ওঁরা চলে গেলেন। পাশের কামরা থেকে ভেতরে ঢুকলেন সিআইডি চিফ আন্দেশা কাফি। ‘ঘটনাচক্রে সবই শোনার সুযোগ হলো আমার। কী বুঝলেন, মিস্টার শার্লক হোমস?’
ডাক্তার কান্তিককে ম্লান ও গম্ভীর দেখাচ্ছে। ‘যতই গর্বিত হোক, যেকোনো সাধারণ মেয়ের মতোই একটা হৃদয় আছে তাঁর,’ বললেন তিনি। ‘সেটা ভুল করে সলিম কোবিদকে দিয়ে ফেলেছেন তিনি। ওদিকে সলিম কোবিদ সংখ্যায় এত বেশি হৃদয় পেয়েছেন যে সবগুলো ব্যবহার করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’
‘খুব বাজে একটা কেস! তাঁর বিরুদ্ধে কিছু দাঁড় করানো প্রায় অসম্ভব। কোনো সাক্ষী নেই, প্রত্যক্ষদর্শী তো নেই-ই।’
‘খুনটা তিনি করেছেন?’ পায়চারি করছেন বস। ‘না, স্যার, এতে আমি সন্তুষ্ট নই।’
‘কিন্তু তাঁর রাগ!’ বললেন কাফি স্যার। ‘তিনি এসেছেনও তো বাজে একটা বংশ থেকে। রাজরাজড়াদের এই পরিবারগুলো শত শত বছর ধরে ঠিক এই পদ্ধতিতেই শত্রু নিধনে অভ্যস্ত ছিল।’
‘তা ঠিক,’ কান্তিক স্যার বললেন, হঠাৎ আমরা তাঁকে হাসতে দেখছি। ‘তবে এর আগে কখনো আমি শুনিনি যে ছেলে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় বাপকে খুন হতে হয়েছে। মোটিভটা যথেষ্ট বা যথার্থ বলে মনে হচ্ছে না, ওল্ড থিং। তা ছাড়া এও বিশ্বাসযোগ্য নয় যে একজন প্রিন্সেস নিজের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে অ্যাকনাইট রাখবেন, যাতে কারো আচরণ পছন্দ না হলে সঙ্গে সঙ্গে ওটা খাইয়ে তাকে মেরে ফেলতে পারেন। অ্যাকনাইট আসক্ত হওয়ার মতো কোনো ড্রাগ নয়। এর মধ্যে কিক নেই, মজা পাওয়া যাবে মনে করে কেউ ওটা ব্যবহার করে না।’
‘খুনটা তাহলে কে করেছে?’ চ্যালেঞ্জের সুরে জিজ্ঞেস করলেন পুলিশ কর্মকর্তা।
‘আরে ভাই, এ কথা আমি বলছি না যে তিনি করেননি,’ ডাক্তার কান্তিক বললেন। ‘কে করেছে, সত্যি জানি না। আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি, এখন পর্যন্ত এই কেসের শুধু ওপরের সারফেসে একটু আঁচড় কাটা গেছে মাত্র। এখনো আমাদের সামনে কঠিন শাবলের প্রচুর কাজ পড়ে আছে। আমার জানার কথা হলো, স্যার, এখনো কি আপনি চান এই কেসে আপনার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করি আমি?’
‘অবশ্যই!’ বললেন কাফি স্যার। ‘এখন আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন না।’
‘ঠিক আছে,’ কান্তিক স্যার বললেন। ‘কোবিদ ভবনে ফিরে যাচ্ছি আমরা, ওখানে থাকব যতক্ষণ না আশার আলো দেখতে পাই। আপনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হবে। এদিকে আপনি খুঁজে বের করুন উড়ো চিঠিটা কোত্থেকে পাঠানো হয়েছিল।’
‘কাজ চলছে।’
‘প্রিন্সেস তাঁর সঙ্গিনীদের নিয়ে এখানেই থাকবেন, আমি ২৪ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। অতেব আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’
তখনো বাড়ির কাজের লোকজনকে নির্দেশ দিচ্ছেন কান্তিক স্যার, এই সময় তাঁর খাস চাকরানি ধরণীকে দোরগোড়ায় দেখা গেল, হাতে এনভেলপ। ‘এইডা সার অহনই এগ লোক দিয়া গেল। লিকা রইছে জরুরি, তাই তত্তরি নিয়া আইলাম।’
না তাকিয়ে হাত বাড়ালেন কান্তিক স্যার, খামটা ধরলেন। তারপর যখন তাকালেন, স্থির হয়ে গেলেন তিনি। ‘দেখো, কাণ্ড দেখো!’ উঁচু করে ধরলেন সেটা। সযত্নে আঁকা অলংকৃত হরফ ব্যবহার করে ঠিকানা লেখা হয়েছে, আন্দেশা কাফির নামে পাঠানো অজ্ঞাতনামার সেই চিঠিটার মতো।
খাম ছিঁড়লেন স্যার। ভেতরে এক টুকরো কাগজ, আঁকা হরফ ব্যবহার করে তাতে মাত্র একটা লাইন লেখা : খোঁজ নিন গতকাল সলিম কোবিদ কী করেছেন, কোথায় গেছেন।
সাত
কান্তিক স্যারের নিরিবিলি বৈঠকখানায় বসে তদন্তটা কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় তার একটা যৌথ প্ল্যান তৈরি করা হলো। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলো চিঠি দুটোর উৎস খুঁজে বের করাকে। সিআইডির নির্দেশে পুলিশ ফোর্স আগেই কাজ শুরু করেছে, ফোন করে আবার তাগাদা দেওয়া হলো।
কান্তিক স্যারও এই একই কাজ শুরু করবেন কোবিদ ভবনের ভেতর থেকে। এটা এখন প্রায় পরিষ্কার যে ওগুলো ওই বাড়ি থেকেই পাঠানো হয়েছে, যেহেতু কোবিদ ভবনের অল্প কিছু লোক ছাড়া আর কেউ জানে না কেসটা নিয়ে কাজ করছেন কান্তিক স্যার।
সিআইডি চিফ আরো একটি বিষয়ে একমত হলেন, সলিম কোবিদের সাম্প্রতিক গতিবিধি যতটুকু সম্ভব তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন আছে। শুধু তা-ই নয়, এই তরুণের সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার সম্পর্কে একটা রিপোর্ট সংগ্রহ করে কান্তিক স্যারের হাতে তুলে দেওয়া হবে- মিডিয়া, গোয়েন্দা সংস্থা, ভুক্তভোগী- কে কী বলেছে সব থাকবে তাতে। ইতিমধ্যে তাঁর নিযুক্ত ডাক্তাররা চূড়ান্ত রিপোর্টে জানিয়েছেন, অ্যাকনাইটের শক্তিশালী ডোজের কারণে মৃত্যু হয়েছে কমোডরের। সঙ্গে তানিনও পাওয়া গেছে। তাঁদের ধারণা, এই ড্রাগ খাওয়ানো হয়েছে কড়া চায়ের সঙ্গে, তবে এটা নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখছে অ্যাকনাইট বিক্রির কোনো খবর সংগ্রহ করা যায় কি না।
আমাদের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একজন অপারেটর আছে, নাম মীর, সিদ্ধান্ত হলো তাকে বাড়ির ভেতরে রাখা গেলে আমাদের অতিরিক্ত সহায়তা দিতে পারবে। ফাইফরমাশ খাটার একটা চাকরির জন্য সায়েবের কাছে আবেদন জানাল সে। পরে সায়েবের সঙ্গে কথা বলে চাকরিটা তাকে পাইয়ে দেবেন কান্তিক স্যার।
মিটিং শেষ করে কোবিদ ভবনে ফোন করা হলো গাড়ি পাঠানোর জন্য- সেটার জানালায় রঙিন কাচ আর পর্দার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেভাবে পেছনের উঠান দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম, আবার ঢুকলামও সেই পথ দিয়ে, বাড়ির সামনে এবং আশপাশে খবরের সন্ধানে থাকা মিডিয়ার লোকজনকে কিছু বুঝতে না দিয়ে।
আমাদের ফিরতে প্রায় ৬টা বেজে গেল। খবর নিয়ে জানলাম, মিস ললিতান, লেখালেখির সেক্রেটারি, কাজ শেষ করে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেছেন। আরো জানা গেল, সলিম কোবিদ এখনো তাঁর আম্মুর সঙ্গে আছেন, তবে আমার স্যার এখনো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী নন। তাঁর ব্যাপারটাও তদন্ত করা হচ্ছে, এটা তিনি তাঁকে বুঝতে দিতে চাইছেন না।
বাড়ির অনেককে আমরা জেরা করলাম, এখানে তাদের নাম বা পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি না, যেহেতু তারা কেউ এই কেসে এখন পর্যন্ত কোনো অবদান বা ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে আমার ওপর নির্দেশ আছে, প্রতিটি সাক্ষাৎকারের নোট রাখতে হবে।
শরাফতের সঙ্গে বস যখন দ্বিতীয়বার কথা বলতে বসলেন, টুকরোটাকরা মাল-মসলা আমাদের ব্যাগে জমা হতে শুরু করল। শান্ত, ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ; কেমন ভাবুক ভাবুক লাগে, আমার ধারণা চমৎকার সাক্ষী হতে পারবে, কিন্তু সে যে কত দূর সত্য কথা বলছে জিজ্ঞেস করলে আমি কিছু বলতে রাজি নই। আসলে এই লোক সম্পর্কে কিছু আন্দাজ করা অত্যন্ত কঠিন। তার মধ্যে কৌতূহল জাগানো এক ধরনের যুক্তি কাজ করে- বলতে চাইছি, মনিবের প্রতি এক দিকে নিবেদিতপ্রাণ, আরেক দিকে তাঁর সমালোচনা করতেও পিছপা নয় সে। আজ আমরা কমোডরের সুইটটা আরো ভালো করে পরীক্ষা করছি।
‘শরাফত,’ স্যার বললেন, ‘কমোডরের সঙ্গে তাঁর ছেলে সলিমের সম্পর্কটা কেমন ছিল বলো তো আমাকে।’
‘বালা না, সর, বালা না,’ বলল শরাফত। ‘দুনিয়ার হগলে জানে।’
‘ভালো নয় বলতে কী বোঝাতে চাইছ?’
‘ধন-দৌলত থাকলে বাপে-ব্যাডায় যেমুন হুটহাট লাগনের কতা, তিমুনই লাগতেন তাঁরা। একডাই পুলা না! এক্কেরে ছোডবেলা থনই সলিম সাবে বখাইড্ডা। কাউরে মানেন না!’
‘ছেলে বড় হওয়ার পর বাপের সঙ্গে কী নিয়ে লাগত?’
‘পাঁচ বচ্ছর আগে ঝামেলা শুরু অইছে, সলিম সাবে কলেজে পড়ার সম।’
‘কী নিয়ে? মেয়ে?’
‘হ। সলিম সাবে একদিন আমারে কইলেন, হের কুনো দুষ নাই, মাইয়াগুলানই হের মাথার ভেতর ঢুইক্কা পড়ে। মাশাল্লা, হের শরীল-স্বাস্থ্যও পাহাড়ের লাহান। হে তসলিম কোবিদের পুলা, এইডাই বড় কারণ, সর।’
‘তাই?’
‘নামজাদা মাইনসের পুলা, হেরে লোকে সব সম বেলাক করে।’
‘ব্ল্যাকমেল করে?’
‘করে না! বোকা বানায়া, নইলে ভয় দেখায়া টেহা চায়। মেলা টেহা দিতে হইছে বাপেরে। আমার মনিব বদনাম খুব বেশি ডরাইতেন। আম্মা মেডাম সব সম পুলার পক্ষ নেন, হেইডা ঠিক আছে, তয় এইডা নিয়া বাড়িতে মেলা অশান্তি লাইগাই থাকত। খুইলা কইতে পারুম না, মনে থাহে না…’
‘ঠিক আছে, অত খুলতে হবে না তোমাকে। তারপর?’
‘কাম না কইরা টেহা ওড়ান, এইডা নিয়ে পুলাকে বকাঝকা করতেন মনিব। হেরপর ছোড সাবে কলেজ যাওয়া বন্ধ কইরা দিলেন। কইলেন মোর ডিগরি লাগবে না, মুই নিজের ব্যবসা শুরু করতাছি। হক্কলে কইত, কেমিসটিতে হে খুব বালা…’
কান্তিক স্যার আর আমি দৃষ্টি বিনিময় করলাম। ‘কেমিস্ট্রিতে ভালো?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘হ, সর। ছোড থনই হের বিরাট ঝোঁক হেদিকে। তাই তিনি কেমিক্যাল বিজনেসে নাইমা পড়লেন। বিরাট একডা অষুদ তৈরির কারখানা কইরা দুনিয়ার মাইনসেরে তাক লাগাইতে হইবে। দুই কিলো লাম্বা ল্যাব থাহন চাই। হুইনা বেবাকতে যেমুন তাইজ্জব, তেমনি খুশি। আমার মনিব এক শর্তে টেহা দিতে রাজি হইলেন, ফ্যামিলির নাম বেবহার করা যাইবে না।’
‘বেশ।’
‘শুরুটা বালাই আছিল। তারপর কী জানি অইল কইতে পারুম না। ছোড সাবে কইতে লাগলেন, হের লগে প্রতারণ করা হইছে। এত বড় একডা কাম করনের জ্ঞান-বুদ্ধি কোত্থে পাইবেন, কন মোরে! মনিব গোস্যা হইলেন, এক্কেরে ফায়ার! কইলেন, আমার কুটি কুটি টেহা পানিতে ভাইসা গেল। তহন থে ছোড সাবেরে বাড়িতে খুব কম দেহা যায়। হুনি চুপি চুপি আম্মু মেডামের কাছে আহেন, আবার চুপি চুপি যান গা। গত বছর আম্মু মেডাম বাপ-পুলারে একখানে ডাইকা মিল করায়ে দিছিলেন, তারপর শীতে আমগো লগে ছোড সাবেও ফেরানসে বেড়াইতে গেলেন।’
‘এবার, শরাফত,’ স্যার বললেন, ‘সলিম আর প্রিন্সেসের সম্পর্ক। তুমি তো খুব কাছ থেকে ওঁদের দেখেছ। কী মনে হয়? খুব সিরিয়াস বা জোরদার সম্পর্ক ছিল?’
‘পিরিনসেস হেডাই ধইরা নিছিলেন,’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল শরাফত। ‘আম্মু মেডাম কী যে খুশি অইলেন! কিন্তু আমরা যারা হেরে ছোড থন বড় অইতে দেকছি তারা কেউ মাতি নাই। হেরে যেকোনো মাইয়া নিমেষেই জাদু করতে পারব। কিন্তু মোরা যহন দেশে ফিরনের পথ ধরছি, হের মাতা থন ওই মাইয়া গায়েব! দেহি আরেক মাইয়া…’
‘থাক আরেক মাইয়া,’ হাসিমুখে বললেন স্যার। ‘তুমি আমাকে বলো তোমার ছোট সাহেব তাঁর আব্বুর সঙ্গে শেষ কবে দেখা করেন?’
‘পরশু। আইজ বুধ, হ, সেদিন আছিল সুমবার।’
‘কী পরিস্থিতিতে ওঁদের দেখা হলো?’
‘বাড়িতে পিরিনসেস আওনের পর পুলার খোঁজে মনিব সারা দ্যাশের হাজার জায়গায় ফুন করতাছেন। হে নাই, কুতাও নাই! আমরা চাকরবাকররা আন্দাজ করি, পুলা আসলে সেচছায় লুকায়া আছেন। তারপর লোক পাঠান অইল, তখন না আইসা পারলেন না। আইলেন সুমবার বিকালে। পড়ার গরে এই তো বাপ-ব্যাডায় তুমুল লাগল! আমি ভাবলাম পিরিনসেসকে নিয়া লাগছে, কারণ মোর জানা আছিল মনিব এই বিয়াডা খুব চাইতাছেন। আমি এই গর ওই গর করতাছি, বুঝতাছি না কেমনে ঠাণ্ডা হই, এই সময় একটা দরজা খোলার আওয়াজ পাইলাম, শুনলাম মনিব কইতাছেন, আজ থেকে আমি আর তোমার মুখ দেখতে চাই না। ছোড সাবে জবাব দিলেন, তা তুমি দেখবে না। হেরপর দড়াম, দরজা বন্ধ অইল, ছোড সাবে চইলা গেলেন!’ নাটকীয় বিরতি নিল শরাফত।
‘তারপর?’
‘এরহম আগেও ঘটছে,’ বলল সে, ‘মুই সিরিয়াস দেই নাই। সিরিয়াস দিলাম কাইল, মনিবের উকিল সাবেরে বাড়িতে ডুকতে দেইখা। হুনলাম নতুন হেবানামা লেকা হইতাছে।’
‘নতুন হেবানামা। আচ্ছা।’
‘জি, সর। এইডাও আগে ঘটছে। কিন্তু আগে উকিল সাবে হুকুম শুইনা ফিরা যাইতেন, কাগজপত্র ঠিকঠাক কইরা সই লইতে আইতেন আরেক দিন। কাল দেকলাম দলিলডা ওইহানে বইসাই তৈরি করা অইতাছে। কাজেই বুঝলাম মনিব এইবার খুব খেপছেন। বেগম ললিতান নেসার কম্পিউটারে বইসা উকিল সাব নিজে লেকলেন সব। বেগম ললিতান নেসা আর আমারে পড়ার গরে ডাকা অইল, মোরা সাক্ষী হমু। ছোড হেবানামা, এক তা কাগজ লাগছে। মুই কাগের ঠ্যাং সই করলাম। কিন্তু হেতে কী লেকা আছে কইতে পারুম না।’
ঘুরতে ঘুরতে আমরা ইতিমধ্যে ছোট একটা প্যানট্রিতে চলে এসেছি, যেখানে বেশির ভাগ তৈজসপত্র, টেবিল ক্লথ ইত্যাদি রাখা আছে। সারি সারি সাজানো কাপ আর গ্লাস দেখছেন কান্তিক স্যার, হঠাৎ ঘুরে গিয়ে আমাকে বললেন, ‘তোমার কাছে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস হবে? রিডিং গ্লাস গোছের কিছু হলেও চলবে।’
কমোডরের পড়ার ঘর থেকে একটা নিয়ে এসে দিলাম স্যারকে। সেটা হাতে নিয়ে তিনি শরাফতের দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখান থেকে কটা কাপ নিয়ে কাল তুমি চায়ের টেবিল সাজিয়েছিলে?’
‘দুইডা, সর। মোরা জানতাম অতিথি কেউ নাই।’
লম্বা একসারি গ্লাস দেখালেন স্যার। ‘এগুলোর কোনোটা?’
‘না, সর। ওই গ্লাসে মোরা হুইসকি আর শামপেন খাওয়াই। চা খাওনের সময় ওইসব আমার মনিব নিতেন না।’
এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে ডাক্তার কান্তিক ওখান থেকে পড়ার ঘরে চলে গেলেন। পিছু নিলাম আমরা।
‘ঠিক আছে, বলে যাও,’ শরাফতকে বললেন তিনি। তারপর হঠাৎ করে, একদম অপ্রত্যাশিতভাবে, জিজ্ঞেস করলেন, ‘সলিম আবার কাল বিকেলে ফিরে এলেন?’
‘এইডা কী কন, সর, না!’ বেজায় বিস্মিত হয়ে প্রতিবাদ করল শরাফত। ‘ওরহম একডা ঝগড়া-বিবাদের পর কেমনে ফিরেন!’
‘না?’ উত্তরটা যেন চ্যালেঞ্জ করছেন কান্তিক স্যার। ‘ঠিক আছে, আপাতত আলাপ শেষ হয়েছে। ধন্যবাদ, শরাফত।’
দরজার কাছে পৌঁছে ইতস্তত করতে দেখলাম তাকে, চোখে উদ্বেগ নিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যারকে একটা প্রশ্ন করতে চায় সে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। কান্তিক স্যার তাকে দেখতে না পাওয়ার ভান করছেন। অগত্যা চলে গেল সে।
আট
নতুন করে কজন চাকরকে প্রশ্ন করছেন কান্তিক স্যার, এটা জানার জন্য যে কোবিদ পরিবারের একমাত্র সন্তান গতকাল বাড়িতে ছিলেন কি না। তারা সবাই নির্দ্বিধায় অস্বীকার করল, ফাঁদ পেতেও তাদের কাউকে দিয়ে তিনি কিছু স্বীকার করাতে পারলেন না।
‘ওরা গোপন করছে,’ সবাই বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর ঠাণ্ডা গলায় বললেন তিনি, ‘লক্ষ করেছ, কেউ বলছে না, আমি তাঁকে দেখিনি। বলছে, তিনি এখানে ছিলেন না।’
‘স্যার, মিসেস জারিনার সুন্দরী সেক্রেটারিকে আমরা জিজ্ঞেস করলে পারি, মানে মিস শিলা শরণিকে,’ বললাম আমি। ‘তিনি হয়তো বলবেন।’
‘ঠিক বলেছ,’ মাথা ঝাঁকালেন কান্তিক স্যার, ‘আর সঙ্গে সঙ্গে সলিমকে জানিয়ে দেবেন প্রশ্নটা আমরা করেছি। আমি চাইছি না সলিম সতর্ক হয়ে যান। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই…পরিবেশটা হতে হবে যেন হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে। এটা-সেটা নিয়ে গল্প করব। সেটা যখন ঘটবে, অবশ্যই তুমি নোটবুক বের করবে না। যতটুকু সম্ভব মনে রাখবে, পরে লিখো।’
সায়েবের সঙ্গে কথা বলার সময় একটু অন্য রকম পদ্ধতি ব্যবহার করলেন স্যার। বললেন, পুরো বাড়ির নকশা তাঁর মাথায় থাকা দরকার, বিশেষ করে তিনতলার। সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে আমাদের নিয়ে রওনা হলো সায়েব, ঘুরে ঘুরে একের পর এক অনেক কামরা দেখাচ্ছে।
ডাক্তার কান্তিক জানতে চাইলেন, ‘কমোডরের সুইট আর মিসেস জারিনার সুইট, এ দুটো পাশাপাশি এবং ওগুলোর পুরো সামনের অংশ এভিনিউ বরাবর বিস্তৃত- এটুকু আমি পরিষ্কার বুঝেছি। ওখানে আর কী আছে?’
‘দক্ষিণ দিকে আছে গেস্ট সুইট, যেখানে প্রিন্সেস ছিলেন,’ বলল সায়েব, হাত তুলে দেখাল। ‘ওটার পেছন দিকে একটা অতিরিক্ত বেডরুম আছে, যেটা লেডি-ইন-ওয়েটিংকে দেওয়া হয়েছিল। কামরাগুলো আপনি দেখতে চান, স্যার?’
‘না।’ হাসলেন স্যার। ‘ওঁরা কিছু ফেলে গেছেন বলে আমি মনে করি না।’
‘পেছনের ওই বেডরুমের পর মূল সিঁড়ি,’ বলে যাচ্ছে সায়েব, ‘আর সিঁড়ির এই বাম প্যাসেজটা ধরে এগোলে আমরা পৌঁছব এলিভেটরে। প্যাসেজ ধরে আরো এগোলে ফিরে যাব মূল সার্ভিস করিডর আর সার্ভিস সিঁড়িতে।’
সার্ভিস করিডরটা দেখলাম আমরা।
‘প্যাসেজের শেষে আরেকটা গেস্টরুম,’ পা বাড়িয়ে বলল সায়েব। ‘এখন সেটা খালি। বাড়ির উত্তর দিকে ছোট স্যারের সুইট- বেডরুম, বাথরুম, স্টাডি, লাইব্র্রেরি নিয়ে। এগুলো তিনি ছোটবেলা থেকে ব্যবহার করছেন। তাঁর সব জিনিসপত্র এখনো সব আগের মতো করে রাখা আছে, যদিও দুই বছর হলো বাড়ির বাইরে তাঁর একটা আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট আছে।’
‘এখন তিনি কোথায়?’ স্যার ভাব দেখালেন তাঁর জানা নেই।
‘ছোট স্যার এখন বাড়িতেই আছেন,’ বলল সায়েব। ‘কামরাগুলো আপনারা যে দেখছেন, শুনলে তিনি খুবই খুশি হবেন, আমি জানি।’
‘ধন্যবাদ, তবে তাঁকে বিরক্ত করার কোনো দরকার নেই।’
‘চারতলায়,’ বলল সায়েব, ‘পঁচিশটা কামরা- হাউসকিপার আর গেস্টদের জন্য কয়েকটা সুইট, চাকরানিদের জন্য কয়েকটা কামরাসহ। চাকরবাকররা ঘুমায় উঠানের শেষ মাথার দালানে, ব্রিটিশ আমলে ওখানে একটা আস্তাবল ছিল। আপনারা কি এখন ওপরতলায় যেতে চান, স্যার?’
‘না, ধন্যবাদ,’ ম্লান সুরে বললেন ডাক্তার কান্তিক। ‘সায়েব,’ তাঁর গলার স্বর হঠাৎ এত বদলে গেল, থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো সায়েব, ‘পেছনের কোণে, তোমার ছোট স্যারের সুইটের লাগোয়া, একটা দরজা আছে। যতবার ওখান দিয়ে যাচ্ছি আমরা, তুমি ওটাকে পাশ কাটাচ্ছ, কিন্তু খুলছ না। ওই দরজা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়?’
‘আরেক সিঁড়িতে, স্যার,’ বলল সে, গলার স্বর নির্বিকার, চেহারায় রাজ্যের নির্লিপ্ততা।
‘আর ওই সিঁড়ি কোথায় গেছে?’
‘নির্দিষ্টভাবে কোথাও না, স্যার, উঠানের একদিকে আর কি।’
‘ওই সিঁড়ি কে ব্যবহার করেন?’
‘এখন কেউ ব্যবহার করেন না, স্যার। ওটা ওখানে কেন তৈরি করা হয়েছিল, আমি বলতে পারব না।’
‘ঠিক আছে, চলো, আমরা একবার ব্যবহার করি।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের পিছু নিল সায়েব। সরু সিঁড়িটা আমাদের নামিয়ে নিয়ে গেল খালি একটা প্যাসেজে, সেখানে জানালা আছে, উঠানটা দেখা যায়। এই প্যাসেজ ডান দিকে এগিয়ে একটা দরজার সামনে শেষ হয়েছে, সেটা মূল সার্ভিস হল আর সিঁড়ির দিকে খোলে; আর বাঁ দিকে এগিয়েছে উঠানের উত্তর দিক বরাবর। এদিকে যে দরজাটা রয়েছে, সেটা দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যায়। কান্তিক স্যার পরীক্ষা করে দেখলেন, তালা দেওয়া।
পরিচারকদের গর্বিত সর্দার মন খুব খারাপ করে বলল, ‘ওই দরজা দিয়ে জলসাঘরে যাওয়া যায়, স্যার। কখনো কোনো উৎসব হলে বা আসর বসলে তখন ব্যবহার করা হয়, কিংবা নানা রকম সার্ভিসের কাজে। আমি কি চাবি চেয়ে পাঠাব?’
‘কোনো দরকার নেই,’ বলে হাঁটতে লাগলেন বস।
প্যাসেজটা শেষ হয়েছে মজবুত দেখতে খুব বড় একটা দরজার সামনে এসে, তাতে আমাদের দিকে স্প্রিং লক লাগানো। এর মানে হলো, শুধু হাতল ঘুরিয়েই দরজাটা আমরা খুলতে পারব, কিন্তু ল্যাচ কি ব্যবহার না করে এই পথে আর ফিরতে পারব না। এখানে যে পাঁচিলকে আমরা পাশ কাটালাম, সেটা এক ফুটেরও বেশি চওড়া। এ ধরনের পাঁচিল তৈরি করা হয় সীমানার ওপর, সংলগ্ন সম্পত্তির মালিকেরও সেটা ব্যবহার করার অধিকার থাকে।
দরজা টপকানোর পর দেখলাম, প্যাসেজটা আবার বাঁ দিকে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। এই অংশটা শেষ হতে চাইছে না, পুরোপুরি অন্ধকার, এক শ ফুট দূরে কাচ লাগানো একটা দরজা থেকে শুধু যা একটু আলোর আভা আসছে। ওই একটাই, এত লম্বা প্যাসেজে আর কোনো দরজা বা জানালা নেই, আধুনিক একটা দালানে যা কল্পনাও করা যায় না।
শেষ প্রান্তের দরজা রাস্তার দিকে খোলে; তবে স্তম্ভ, বেড়া আর লতানো গাছ দিয়ে একদম নিখুঁতভাবে আড়াল করা। বাইরে ভারী একটা লোহার গ্রিল আছে, বেজমেন্টের দরজা সুরক্ষিত করার জন্য যেমনটি থাকে। যে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি, সেটা আমাদের অচেনা, তবে বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এটা উত্তর দিকের একটা মোড়। এ বাড়ির মূল গেট যে রাস্তায় খোলে তার পাশের রাস্তা।
কান্তিক স্যার মুখে হাসি নিয়ে বিষণ্ন সায়েবের দিকে তাকালেন। ‘সায়েব,’ বললেন তিনি, ‘বাড়ির চাকরবাকরদের প্রধান তুমি। কাজেই এই প্যাসেজের অস্তিত্ব না জানার ভান করাটা খুব বিদঘুটে একটা ব্যাপার। কেন, কে এটা ব্যবহার করে?’
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত দুটো দুদিকে ছড়াল সায়েব। ‘স্যার, আমাকে আপনার মাফ করতে হবে। আদর্শ একজন চাকর কখনোই তার মনিবের ব্যক্তিগত বিষয় ফাঁস করবে না। এত বছরের পুরনো অভ্যাস, ভাঙা মোটেও সহজ কাজ নয়।’
তার ক্ষমা চাওয়ার ভাষা ও ভঙ্গি দুটিই আমার ভালো লাগল।
‘তোমাকে মাফ করা হয়েছে,’ হাসিমুখে বললেন কান্তিক স্যার। ‘এবার এই প্যাসেজের ইতিহাস বলো আমাকে।’
‘এটা তৈরি হয়েছে বাড়িটা শেষবার মেরামত করার সময়,’ বলল সায়েব। ‘এই বাড়ির পেছন দিকে আমার মনিবের কিছু জায়গাজমি আছে, এই প্যাসেজ তারই একটার ওপর বানানো, তিনি যাতে সবার চোখের আড়ালে নিজের খুশিমতো আসা-যাওয়া করতে পারেন। সদর দরজায় এত বেশি মানুষ ঘুরঘুর করে, মিডিয়ার লোকজন, ফটোগ্রাফার, সাহায্যপ্রার্থী…’
‘তোষামোদকারী, পদলেহী…’
‘আমার মনিব ওসব ফালতু লোকজনকে দূরে ঠেলে রাখতেন, স্যার,’ গর্বের সঙ্গে বলল সায়েব।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই, আমি তা জানি- তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এত এত টাকা থেকে কী লাভ, তুমি যদি খানিকটা প্রাইভেসি না পেলে?’ প্রশ্নটা তিনি করলেন আমার দিকে তাকিয়ে।
মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালাম আমি। সায়েবকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুনলাম। আমরা ফিরতি পথ ধরেছি।
‘সায়েব,’ বললেন বস, ‘আমার পরের প্রশ্নের জবাব তুমি একটু চিন্তা করে দাও। মনে রেখো, সত্য যত গোপনই হোক, বেরিয়ে আসতে বাধ্য। আমি সেই সত্য তাড়াতাড়ি জানতে পারলে এই পরিবার আরো সব ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সত্য জানতে আমাকে তুমি যদি সহায়তা করো, সেটা এই পরিবারকেই সহায়তা করা হবে। বলো, সলিম কোবিদও কি এই প্যাসেজ ব্যবহার করেন?’
মুখ খুলতে গিয়ে বিষম খেলো সায়েব, খকখক করে কাশতে লাগল, তার মধ্যেই কর্কশ স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যার। ছোট স্যারকেও দুই সেট চাবি দেওয়া হয়েছিল এই পথে আসা-যাওয়া করার জন্য।’
‘তাঁর আব্বু ব্যাপারটা জানতেন?’
‘মনে হয় না, স্যার। আমার ধারণা, আম্মু ম্যাডাম ওই চাবি ছোট স্যারকে দিয়েছিলেন।’
‘আচ্ছা, সায়েব, এবার তোমার মুখ থেকে আমি আরেকটা সত্য কথা শুনতে চাই! তোমার ছোট স্যার সলিম কোবিদ কি গতকাল এই পথ দিয়ে তাঁর আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে আসেননি?’
‘না, স্যার, না!’ যেন ভয়ে কাতর কেউ জবাব দিচ্ছে।
‘কিন্তু তিনি কি এই পথ দিয়ে আসতে পারেন না, এসে আবার চলে যেতে পারেন না, তোমাদের কারো চোখে ধরা না পড়ে?’
‘তিনি বাড়িতে থাকলে সে খবর অবশ্যই আমার কানে আসত, স্যার,’ বলল সায়েব। ‘বাড়ির সবখানে চাকর আছে, এবং তারা সব বিষয়ে সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।’
‘ওটা ঠিক আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। এটা সম্ভব কি না বলো, গতকাল এই পথ দিয়ে সলিম কোবিদ এসেছিলেন, তারপর তোমাকে দেখা না দিয়ে আবার এই পথ দিয়েই বেরিয়ে গেছেন?’
‘জি, তা সম্ভব, স্যার,’ মন খারাপ করে জবাব দিল সায়েব।
কমোডরের অফিসে ফিরে এসেছি আমরা। ‘ঠিক আছে, এখন যেতে পারো, আপাতত তোমার ছুটি,’ বলে তাকে বিদায় করে দিলেন কান্তিক স্যার।
নয়
আধঘণ্টা পর অফিসে ফিরে এসে সায়েব বলল, ‘আমাদের ছোট মনিব মিস্টার সলিম কোবিদ আপনাকে সালাম আর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, স্যার। নিচতলায় সাড়ে ৭টায় ডিনারে বসবেন তিনি, আমাকে জানতে পাঠালেন আপনারা তাতে অংশ নিয়ে তাঁকে সম্মানিত করবেন কি না।’
কেতাদুরস্ত সায়েবের সঙ্গে একটু কৌতুক করার লোভ আমার বস সামলাতে পারলেন না, একটু ঝাঁজ দেখিয়ে বললেন, ‘কিন্তু, সায়েব, আমার তো পরার কিছু নেই! এ রকম অভিজাত পরিবারের ডিনার, আমি এখন মানানসই কাপড়চোপড় পাব কোথায়!’
সায়েব হাসল না। ‘এখন যে পরিস্থিতি, সলিম স্যার ব্যাপারটা বুঝবেন।’
‘বেশ, তাহলে তাঁকে জানিয়ে দাও ডাক্তার কান্তিক এবং তাঁর সহকারী অতেব সরকার খুশিমনে তাঁর ডিনারে অংশ নেবেন।’
আমার নাম যুক্ত হওয়ায় সায়েবকে একটু দ্বিধায় ভুগতে দেখলাম। তবে কিছু না বলে ফিরে গেল সে।
‘সলিম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ষাঁড়কে কাবু করবেন শিং ধরে,’ মন্তব্য করলেন স্যার।
সময়মতো রওনা হলাম আমরা। এত বড় একটা বাড়ি কী সুন্দর সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়েছে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। প্রতিটি প্যাসেজ আর করিডরে সারি সারি টব থেকে অক্সিজেন সাপ্লাই দিচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের বাহারি গাছ। নিচে বলুন কিংবা ওপরে, প্রতিটি হলঘর শুধু দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে নয়, উচ্চতায়ও সমান। ঘরে বলুন বাইরে বলুন, মার্বেলের মেঝে আপনি একটু অসতর্ক হলেই পিছল খাইয়ে ফেলে দেবে আপনাকে। এ রকম একটা জায়গায় থাকলে সরাসরি অন্য একটা জগতে চলে এসেছেন বলে মনে হবে আপনার।
শেফ এবং ওয়েটারদের মতো সাদা উর্দি পরা কিছু লোককে দেখলাম, রান্না ও পরিবেশনার দায়িত্ব সম্ভবত এরাই পালন করে, তাদের মধ্যে দেখলাম মীরও রয়েছে। বোঝা গেল তাকে কাজে লাগিয়ে দিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়নি।
ওদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এলো, বলল, ‘সলিম স্যার গোল্ডরুমে আছেন।’ হলঘরের ভেতর দিয়ে পথ দেখাল সে, পৌঁছে দিল তিনটি ড্রইংরুমের একটায়, যেটার জানালাগুলো এভিনিউয়ের দিকে খোলে, প্রতিটি ফার্নিচার এবং দেয়াল সোনার মতো চকচক করছে। আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন সলিম কোবিদ।
‘এর আগেও আজ একবার আপনাদের দেখেছি,’ কান্তিক স্যারকে বললেন তিনি, ‘তবে তখন আপনাদের সম্পর্কে জানতাম না। এখন আম্মুর মুখ থেকে জেনেছি। বুঝেছি আমাদের জন্য কী করছেন আপনারা। আমরা কৃতজ্ঞ, মিস্টার কান্তিক!’
আমাকে একটু সামনে ঠেলে দিলেন বস। ‘আমার সেক্রেটারি, অতেব সরকার।’
আমার দিকে তাকালেন সলিম, কালো চোখে এত গভীরতা যে ডুবে যাওয়ার মতো অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো আমার। ভাবলাম, ও গড, তাহলে একটা মেয়ের কী অবস্থা হয়! যথেষ্ট সৌজন্য দেখিয়ে আমার সঙ্গে হাত মেলালেন তিনি, তারপর আর আমার দিকে খেয়াল রাখলেন না। এক সেট সোফায় বসলাম আমরা।
‘আপনি ডিনার খেতে ডাকায় আমরা সত্যি খুশি,’ ডাক্তার কান্তিক বললেন।
‘আহ!’ ব্যথায় কাতর একটা ভঙ্গি করলেন সলিম। ‘কেঁদে-ককিয়ে আর শোক বয়ে বেড়িয়ে এ রকম ক্ষতি কখনো পূরণ হয় না। কান্না আমি থামিয়ে দিয়েছি। আবার সব সচল করতে হবে। নিচতলায় ডিনারের ব্যবস্থা করতে বললাম এই আশায় যে আপনাদের অংশ নিতে রাজি করতে পারব। পরস্পরকে জানা দরকার, তাই না! কাজটা আমাদের একসঙ্গে করতে হবে।’
‘হ্যাঁ,’ বললেন বস।
তাঁর এই ঠাণ্ডা ভাব আমার পছন্দ হচ্ছে না। তিনি যেন চেষ্টা করছেন খুনি হেঁটে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াক।
ড্রইংরুম থেকে আবার হলঘরে বেরোলাম আমরা, এবার যাচ্ছি ডাইনিংরুমে। সেটা লম্বাটে, একপাশে সারি সারি অনেক জানালা, বাইরে আলোর বন্যা লেগে থাকা বাগান আর উঠান। তবে কামরায় কোনো বিদ্যুৎবাতি জ্বলছে না, ফলে চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে, আলোকিত শুধু লম্বা ডিনার টেবিল, সেখানে অসংখ্য মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে।
ডাইনিং টেবিলটা অ্যান্টিক মনে হলো, আর এ রকম ছায়া ছায়া পরিবেশ, গহ্বরের মতো এত বড় কামরার ভেতর নিজেকে আমার খুদে পোকা মনে হতে লাগল। একসময় জানলাম, এটাই পরিবারের একমাত্র ডাইনিংরুম। তবে গেস্টদের জন্য আরেকটা ডাইনিংরুম আছে অন্য কোথাও।
ডাক্তার কান্তিককে নিজের ডান দিকে বসালেন সলিম, আমাকে বাঁ দিকে। ‘ওদের আমি একটা ছোট টেবিলের কথা বলেছিলাম,’ বললেন তিনি, ‘কারণ এ রকম একটা ঘনিষ্ঠ পার্টির জন্য পারিবারিক মেহগনিটা স্নায়ুতে চেপে বসতে পারে। আপনার কি আরো বেশি আলো দরকার?’
‘এটাই ঠিক আছে।’
প্রথমে অ্যাপিটাইজার হিসেবে একটা ডিশ এলো। তারপর দুই রকম স্যুপ, চিকেন আর ভেজিটেবল। পিছু নিয়ে সালাদ, ফিশ ডিশ- সরষে ইলিশ, দই দিয়ে রুই, আনারস দিয়ে কাতলা মাছের মাথা। তারপর রেড মিট, সঙ্গে অল্প কিছু লুচি, রুটি আর কাপ ভর্তি ভাত। তারপর ফল, দই-মিষ্টি। দেখা গেল খাওয়ার ব্যাপারে সে রকম কোনো আগ্রহ নেই কারো। অনেক ডিশই স্পর্শ না করে ফেরত পাঠানো হলো।
তবে শুরু হওয়ার পর পর্বটা যেন কোনোমতে শেষ হতে চাইছে না। একসময় কান্তিক স্যার বললেন, ‘আচ্ছা, আমাদের কি আর কিছু খাওয়া উচিত হবে?’
‘না না!’ বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন সলিম। পেছনে দাঁড়ানো উর্দিকে বললেন, ‘চা, কফি, ব্র্যান্ডি, সিগারেট ছাড়া আর কিছু দিয়ো না।’
ওগুলো দিয়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সবাই। কান্তিক স্যারের দিকে একটু ঝুঁকে উদ্বিগ্ন স্বরে সলিম জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা…পরিস্থিতিটা আসলে কেমন বুঝছেন, স্যার?’
হাত দুটো দুদিকে মেলে দিয়ে বস বললেন, ‘প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছি আমরা, কিন্তু সমাধানের কোনো লক্ষণ এখনো দেখতে পাচ্ছি না। কাজের মধ্যে শুধু প্রিন্সেস গঙ্গোত্রীকে আটক করা হয়েছে।’
‘সে এই কাজ করতে পারে বলে মনে হয় না,’ আধো হাসির সঙ্গে বললেন সলিম। শোক আর ক্লান্তি তাঁকে যতই কাবু করুক, দুরারোগ্য মুচকি হাসিটা সব সময় খানিক তলাতে ঠিকই মজুদ থাকে। ‘আমার প্রৌঢ় আব্বুর বিরুদ্ধে ওর কোনো অভিযোগ ছিল না। আব্বুর বদলে আমি মারা গেলে…তাই না…সেটা আলাদা কথা ছিল!’
‘আমিও তা-ই মনে করি,’ স্যার বললেন, ‘তবে তাঁর চলে যাওয়াটা আমাকে ঠেকাতে হয়েছে।’
খুব সহজ ভাষা ও ভঙ্গিতে প্রিন্সেসের সঙ্গে নিজের সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করলেন সলিম। তাঁর স্বাভাবিক মিশুক আচরণ দেখে কমোডর ভয় পেতেন ওটা থেকে কলঙ্ক গজাবে। আব্বাকে তিনি বোঝাতে পারতেন না এটা এখন তরুণ প্রজন্মের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। ছেলেমেয়েরা এখন এভাবে মেলামেশা করবে। ‘আমাদের সোজা কথা, সেক্সবিহীন জীবন আর নয়। আগ্রহ, আকর্ষণ, যন্ত্রপাতি- সব প্রকৃতি দান করছে, কেউ মানা করলে কেন আমরা শুনতে যাব? মৌজ করার জায়গা, স্যার, এই দুনিয়া মৌজ করার জায়গা!’
‘এই ভাষায় এই বক্তব্য প্রথম শুনলাম।’ কান্তিক স্যার কৌতুক বোধ করছেন।
‘স্পষ্ট ভাষায়, যুক্তি দিয়ে আমাকে কিছু বলা হয়নি, তবে অবশ্যই আমি বুঝতে পারছিলাম সবাই চাইছে প্রিন্সেসকে আমি বিয়ে করি। আমিও করতে চাইছিলাম, ওর সঙ্গে আমি খুব সহজ হতে পারছিলাম। তা ছাড়া, আব্বুকে খুশি করার ইচ্ছে ছিল আমার- বড় হওয়ার পর থেকে তাঁর পাঁজরে একটা কাঁটা হয়ে বিঁধে আছি। ধরুন প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছিলাম আর কি।’
‘বেশ।’
‘শুরু তো হলো, কিন্তু আমার মনে থাকল না যে এটা নেহাতই একটা বানানো সম্পর্ক। জিনিসটা ব্যবস্থা, আয়োজন আর প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে আসল না? প্রিন্সেসের মতো কাউকে আগে কখনো আমার চেনা হয়নি।
সত্যি কথাই বলি, ওকে দেখে আমি একেবারে পাগল হয়ে গেলাম, কিন্তু একই সঙ্গে এও বুঝতে পারছিলাম, ব্যাপারটা বেশি গভীরতা পাচ্ছে না। ও আমাকে কতটা বিচলিত করে তুলছে, সেটা ওকে বুঝতে দিইনি। কারণ আমার সাহস হয়নি। কারণ প্রমত্তা একটা সাংঘাতিক মেয়ে। আশা করি বুঝতে পারছেন কী বলতে চাইছি… ছড়ি ঘোরানোর মেয়ে, নিজের ছোট্ট পা সঙ্গীর ঘাড়ে খুব শক্ত করে বসাতে চাওয়ার মেয়ে। কিন্তু সেটা তো সলিমউল্লাহ কোবিদ মানবে না। মাইরি বলছি, কী দৃষ্টিনন্দন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ! আমরা সময় কাটিয়েছি সাক্ষাৎ শয়তানের মতো ঝগড়া আর মিল করে। আনন্দ আর উল্লাসের বিশাল এক স্তূপ। কারণ, আপনি দেখুন, পাবলিকের কাছে সব সময় পুরো মাত্রায় একজন প্রিন্সেস সে। কিন্তু যেই আমরা দুজন একা হয়েছি অমনি স্যাঁৎ, উড়ে গেছে ঢাকনি, রাখঢাকের বালাই থাকেনি!’
‘ব্যাপারটা এ রকম না যে প্রিন্সেস প্রমত্তা আমাকে হতাশ করেছে। ও রকম খুদে একটা বন্য প্রাণীকে পোষ মানাতে আমার ভালোই লাগত। আমাকে হতাশ করেছে ওর জীবন, ওর বংশ, আশপাশের লোকজন- ও যা কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে, সব আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। জানি না, যা বলতে চাইছি আপনাকে তা ঠিক বোঝাতে পারছি কি না। পচন ধরা রাজকীয় আভিজাত্য পুরোটাই কৃত্রিম না? আমি রাজা, আমি রানি- এসব অনুভূতি ঘৃণ্য না? গোটা ব্যাপারটা স্রেফ নোংরা একটা কৌতুক। বদবু নিকাল গিয়া, মাই ডিয়ার! কিন্তু আব্বু এসব দেখতে বা বুঝতে চাননি। পারলে রাজপরিবারের খানসামাকেও বাড়িতে ডেকে এনে জামাই আদর করেন!’
‘কাজেই কয়েক দিন পরই বুঝতে পারি এখানে বিয়ের প্রশ্ন ওঠে না। কাজেই পরিস্থিতি থেকে শুধু ফানটুকু নিতে থাকি আমি। কসম খেয়ে বলতে পারি, প্রমত্তাও ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। দিনে এক শ বার আমাকে চাষা, ক্ষ্যাত, অসভ্য আর বর্বর বলছিল। বলছিল ওর জুতো পরিয়ে দেওয়ার বা কাপড় কেচে দেওয়ার যে লোক আছে, প্রয়োজনে তাদের মধ্য থেকে একজনকে বিয়ে করবে, তবু আমাকে করবে না। তবে বাংলাদেশে আসার পর ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে ওঠে প্রমত্তা।’
আগেই ব্র্যান্ডি পরিবেশন করা হয়েছে, নিজের হাতে নিজের জন্য ঢালার আগে আমাদের সাধলেন তিনি, কান্তিক স্যার মাথা নেড়ে এড়িয়ে গেলেন।
দুই ঢোক খেয়ে আবার শুরু করলেন সলিম। ‘আমার রাশিটা এমনই যে যখন যে কাজে হাত দিয়েছি, তার পরিণতি ভালো হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমার ভুলটা কোথায় জানেন? আব্বুর সঙ্গে সোজা ভাষায় আলাপ না করা। কিন্তু এ এমন একটা বিষয়, তাঁর সঙ্গে শুধু আলাপ করতে হলেও যুদ্ধংদেহি একটা মনোভাব থাকতে হবে। তার পরও যখন কথা বলতে চেষ্টা করলাম, প্রসঙ্গটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন তিনি। কাজেই সময় যেভাবে কাটছিল সেভাবেই কাটতে দিলাম। ইউরোপ যখন ছাড়ছি, আমি ভাবলাম ব্যাপারটা বাতিল হয়ে গেছে। আবার ভুল! খুঁটিনাটি কিছু বিষয় আমাকে বুঝিয়ে দিল, এটা একদম ঠিকঠাক। সংক্ষেপে, ওই মেয়েকে আমার বিয়ে করতে হবে। এটা আমাকে গোঁয়ার করে তুলল, আর আমি…’ হঠাৎ থেমে গ্লাসে আবার খানিকটা ব্র্যান্ডি ঢাললেন তিনি।
‘আপনি কী?’ কথাটা শেষ করতে উৎসাহ দিলেন কান্তিক স্যার।
‘না, মানে, আমি ঠিক করলাম প্রাণ থাকতে এই বিয়ে আমি করব না!’
জানা কথা এটা নয়, অন্য কিছু বলতে যাচ্ছিলেন সলিম। যাই হোক, কান্তিক স্যার ব্যাপারটাকে পাশ কাটিয়ে গেলেন। বললেন, ‘প্রিন্সেস ঢাকায় আসতে সব একেবারে চরম হয়ে উঠল?’
‘হ্যাঁ,’ অনুতাপে কাতর শোনাল সলিমের কণ্ঠস্বর। আমাকে বাধ্য হয়ে পালাতে হলো, বেশি করে মদ ধরলাম। কিন্তু আব্বু আমাকে টেনে মাটিতে নামিয়ে আনলেন। তাঁর কাছে ফিরতে হলো আমাকে। সোমবারে এখানে এলাম আমি, মানে পরশু। দুজনেই প্রতিশোধ গ্রহণের মনোভাব নিয়ে বসলাম। প্রথমে আমি তাঁকে যুক্তি দেখাতে চাইলাম, কিন্তু তিনি শুনতে রাজি হলেন না। জিদ ধরলেন, নিজের সঙ্গে আমাকে আপস করতে হবে। হেসে ফেললাম। ‘গুড গড, ড্যাড!’ বললাম আমি, ‘মেলামেশা করেছি এমন প্রতিটি মেয়েকে যদি আমার বিয়ে করতে হয়, আপনি তাহলে তাদের এই বাড়িতে জায়গা দিতে পারবেন না, এ রকম আরো পাঁচ-সাতটা বাড়ি বানাতে হবে।’ তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভারিক্কি ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইনি যেহেতু একজন প্রিন্সেস, তাঁর ব্যাপারটা আলাদা।’ আমি বললাম, ‘প্রিন্সেস না কচু! বহু বছর আগে ওর পরিবারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সিংহাসন থেকে নামানো হয়েছে!’ আমরা ষাঁড়ের মতো চেঁচাতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, আমি তাঁকে প্রতিশ্রুতিসহ এতটা দূর এগোনোর মৌন সম্মতি দিয়েছি যে সেখান থেকে এখন আর তাঁর পক্ষে পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়; আর আমি বললাম, ‘তিনি যদি কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন তো সেটা তাঁর ব্যাপার; বিয়েটা যেহেতু আমাকে করতে হবে, এখানে শুধু একা আমি সিদ্ধান্ত নেব। এরপর তিনি জিদ ধরলেন, এই মেয়েকেই আমার বিয়ে করতে হবে, এ নিয়ে কোনো তর্ক করা যাবে না, কাজেই আমি খেললাম আমার…’ আবার হঠাৎ থেমে বোতল আর গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালেন সলিম।
‘আপনি আপনার তুরুপের তাসটা খেললেন?’
‘না,’ মুখে বিব্রত হাসি নিয়ে সলিম বললেন, ‘আমার হাতে কোনো তুরুপের তাস ছিল না। বলতে যাচ্ছিলাম আমি খেললাম আমার শেষ তাসটা। জানিয়ে দিলাম, প্রিন্সেসকে আমি বিয়ে করব না এবং এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম।’
এখানে গুরুত্বপূর্ণ কী যেন একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু যেহেতু পরিস্থিতিটা এমন নয় যে ডাক্তার কান্তিক জেরা করছেন সলিমকে, তাই সেটা তাঁর খেয়াল না করতে পারাটাই ভালো দেখায়।
বাবার সঙ্গে তাঁর যে ঝগড়া, সেটার সর্বশেষ দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছেন সলিম। তা দিতে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললেন তিনি, গাল দুটো লাল হয়ে উঠল, চোখ দুটো থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। ‘তিনি আমাকে বললেন, সম্পত্তির একটা কণা পর্যন্ত আমাকে দেওয়া হবে না! আমি বললাম, ওই সম্পত্তি নিয়েই থাকুন আপনি!’
হঠাৎ আঁতকে উঠলেন সলিম। চোখে আশ্চর্য ফাঁকা দৃষ্টি ফুটল। ‘হে আল্লাহ!’ হাঁপাচ্ছেন। ‘এসব কী বলছি আমি! তিনি ওপরতলায় ঠাণ্ডা বরফ হয়ে শুয়ে আছেন!’ তড়াক করে লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়লেন, টলতে টলতে সরে গেলেন ছায়ার ভেতর। দেয়ালে হাত রেখে মাথা ঠেকালেন তাতে। সন্দেহ নেই বুক মোচড়ানো একটা দৃশ্য।
‘সে যা-ই হোক, কাল যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই,’ নরম গলায়, সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললেন ডাক্তার কান্তিক।
‘না,’ ভারী গলায় বললেন সলিম। ফিরে এসে আবার বসলেন চেয়ারে। মুখের আলো বা রং দুটিই মিলিয়ে গেছে। নিজের সামনে তাকিয়ে আছেন, ওয়াইনের গ্লাসে নড়াচড়া করছে কয়টা আঙুল, খেয়াল নেই কী করছেন। ‘ওটার সবটুকুই একটা রহস্য,’ বিড়বিড় করলেন। ‘নিশ্চয়ই ডাক্তাররা কোথাও ভুল করেছেন। আমার আব্বুকে কে খুন করতে চাইবে?’
‘তিনি কি আপনাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন কান্তিক স্যার, যদিও বিষয়টা তাঁর ভালো করে জানা আছে।
‘হ্যাঁ,’ বললেন সলিম, নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে। ‘কাল সকালে হেবানামা বা ওই ধরনের কিছু একটা করেছেন…’
‘সেটা আপনি কখন জানতে পারলেন?’
‘এই তো খানিক আগে, আম্মু বললেন। উকিল সাহেব আম্মুর সঙ্গে কথা বলেছেন।’
‘কাল বিকেলে কমোডরকে কেমন দেখলেন আপনি?’ আলাপের সুরে জানতে চাইলেন বস।
চেঁচিয়ে উঠে সলিমকে আমি সাবধান করতে পারতাম, তবে সেটাও অনেক দেরি হয়ে যেত। আমার বসের পাতা ফাঁদে সরাসরি পা দিয়ে ফেললেন তিনি। ‘আগের চেয়ে ঠাণ্ডা,’ ম্লান মুখে বললেন। ‘কিন্তু আমাকে কোনো কথাই বলতে দিলেন না।’
এক সেকেন্ড পর উপলব্ধি করলেন, নিজের সঙ্গে বেইমানি করে ফেলেছেন। বাঁকাচোরা একটা চেহারা তুলে কান্তিক স্যারের দিকে তাকালেন তিনি। ‘কিভাবে… আপনি কিভাবে জানলেন কা-কাল আমি এখানে এসেছিলাম?’ তোতলাচ্ছেন।
‘আমি জানি না,’ উত্তর দিলেন ডাক্তার কান্তিক। ‘এইমাত্র আপনি আমাকে বললেন।’
আমাদের তিনজনের ওপর গা শিরশির করা একটা নীরবতা নেমে এলো। আমি আমার বসের ওপর রেগে গেছি। এটা ঠিক ন্যায্য আচরণ হলো না, হাসিখুশির সঙ্গে ডিনার খাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা হয়েছে মেজবানকে শুধু ফাঁদে ফেলার জন্য। আবার একই সঙ্গে, একজন তরুণকে এ রকম একটা চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে দেখে তীব্র উল্লাস অনুভব করছি। এই পরিস্থিতি তাঁকে যেন আমার আরো কাছাকাছি এনে দিয়েছে। গোটা দুনিয়াও যদি তাঁকে পরিত্যাগ করে, তবু আমি তাঁর বন্ধু থাকব। অন্তত নিজেকে আমি এটাই শোনালাম।
খানিক পর মুখ তুলে তাকালেন সলিম, এক ধরনের ক্লান্ত প্রতিবাদের সুরে বললেন, ‘বেশ, ধরুন কাল বিকেলে আমি আমার আব্বুর সঙ্গে দেখা করেছি। তাতে কী হলো?’
‘কিছু না,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন কান্তিক স্যার। ‘আমি শুধু ভাবছিলাম কী কারণে ব্যাপারটা আপনি গোপন রাখার চেষ্টা করছিলেন।’
‘গোপন রাখা সহজ, আর এটাই আমাকে প্ররোচিত করে। বাড়ির ভেতর আমি গোপন একটা পথ দিয়ে ঢুকেছি, ফলে কারো সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমি যে এসেছি, এটা মাত্র দুজন জানে… দুজন মানে একজন আম্মু, অপরজন… আমি।’
‘না, অপরজন মিস শিলা শরণি,’ ডাক্তার কান্তিক বললেন।
তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন সলিম। ‘আপনি তো দেখছি ভয়ংকর একজন মানুষ!’ বিড়বিড় করছেন। ‘…হ্যাঁ, মিস শরণি আমাকে আসতে দেখেছেন, কারণ তিনি সব সময় আম্মুর সঙ্গে থাকেন। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে বেইমানি করবেন না।’
‘আপনার আম্মুর চাকরানিরা?’
‘না, তারাও কেউ মুখ খুলবে না। আমি অবশ্য জানি না তারা কেউ আমাকে আসতে দেখেছে কি না… আমার আসাটা লুকিয়ে রাখার পেছনে কী কারণ, তা যদি জিজ্ঞেস করেন, আমার ধারণা সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে পরিষ্কার। দেখা গেছে আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়েন আমি তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরই। যে কেউ আন্দাজ করতে পারবে, এটা থেকে কী জঘন্য গল্প তৈরি হবে। আল্লাহর মার খাওয়া ছেলে, বংশের কলঙ্ক ইত্যাদি। খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হবে আমার পুরোটা অতীত। আমার শুধু লক্ষ্য ছিল এই নোংরা লেজেগোবরে অবস্থা মিডিয়ার কাছ থেকে আড়াল করা। কী প্রকাশ হয়ে পড়বে, তা নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। কেন, কাণ্ডজ্ঞান আছে এমন কোনো মানুষ বিশ্বাসই তো করবে না যে কাজটা আমি করেছি। ছেলে কখনো তার বাবাকে বিষ খাওয়ায় না! আমি কি একটা দানব?’
ডাক্তার কান্তিক কোনো মন্তব্য করলেন না।
‘আর, তা ছাড়া, আমি যদি আব্বুকে বিষ খাওয়াই, ভেবে দেখুন আমাকে কেমন বোকা দেখাবে, যেখানে এইমাত্র তিনি লিখিতভাবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন আমাকে!’
‘কিন্তু সেটা আপনি জানতেন না,’ চোখে আঙুল দেওয়ার মতো করে দেখালেন কান্তিক স্যার। ‘আপনি আমাকে বলেছেন মাত্র খানিক আগে জেনেছেন। পরশু আপনি শুধু জানতেন আপনার বাবা হেবানামা পরিবর্তন করবেন। এর আগে কখনোই এত দ্রুত কাজটা সারা হয়নি।’
দুই হাতে ধরে মাথায় চাপ দিচ্ছেন কান্তিক স্যারের অনানুষ্ঠানিক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো তরুণ আসামি। ‘আল্লাহ রে, কী ভয়ংকর জালে আটকা পড়েছি আমি!’
‘কাল আপনি ফিরে এলেন কেন?’ প্রশ্ন করলেন স্যার।
‘দুনিয়ার সবচেয়ে স্বাভাবিক কারণে। আমার রাগ পড়ে গিয়েছিল। মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কিছু কথার জন্য দুঃখ হচ্ছিল। আশা করছিলাম আব্বুরও নিশ্চয় দুঃখ হচ্ছে।’
‘আপনি তখন প্রিন্সেস গঙ্গোত্রীকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন?’
‘না, তা না! ওটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না,’ তাড়াতাড়ি বললেন সলিম। ‘শুধু বলতে চেয়েছিলাম আমি দুঃখিত। জানা ছিল এটা বিশ্বাস করা হবে না, কিন্তু আমি আব্বুকে ভালোবাসতাম। তা ছাড়া, স্বীকার করি না কেন? আমি তো স্রেফ একটা মানুষ। হেবানামা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তবে আমার মাথাব্যথা টাকাপয়সা নিয়ে যতটা, তার চেয়ে কোটি গুণ বেশি আব্বুর এক ভাইপোকে নিয়ে, মানে মুসলিম কোবিদকে নিয়ে। সবার ধারণা, বিশেষ করে আব্বুর, একমাত্র সেই নাকি আমাদের বংশের ঐতিহ্য বহন করার যোগ্যতা রাখে। সে একজন সাহিত্যিক, বানিয়ে বানিয়ে দুনিয়ার মিথ্যে কথা লেখে আর দাবি করে সে একজন স্রষ্টা, সারা দিন গাঁজা-ভাং খায়, তার কুনজর থেকে অপ্রাপ্তবয়স্করাও রেহাই পায় না, তা সে ছেলে হোক বা মেয়ে। হে আল্লাহ, আরো যত খুশি বিপদে ফেল তুমি আমাকে, শুধু ওই কুকুরের লেজটাকে আমার ওপর ছড়ি ঘোরাতে দিয়ো না! বিশ্বাস করুন, ওটা একটা কীট। আমার মতো কুসন্তান জন্ম দেওয়ায় সান্ত্বনা জানানোর ছলে পাঁচ বছর ধরে আমার আব্বুকে শুষে খাচ্ছে ওই হারামখোর! একবার এক ঘুষিতে ওর থোঁতা মুখটা ভোঁতা করে দিয়েছিলাম, ও রকম আরেকটা সুযোগ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। মুসলিম বেটাকে ভাগানোর জন্য সব করতে পারি আমি। এসেছিলাম এ রকম একটা প্রস্তুতি নিয়ে যে রুশ এমবাসির পাঠানো কেভিয়ার খাব, ওই বিদেশি মেয়েটিকে বিয়ে করা ছাড়া বাকি সব কিছুতে রাজি হব।’
‘সরাসরি মিসেস জারিনার সুইটে চলে যান আপনি?’ নিজের অনুমান মেলানোর চেষ্টা করছেন ডাক্তার কান্তিক।
‘হ্যাঁ।’
‘কমোডরের কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন, আপনি বাড়িতে আছেন?’
‘না, জানাইনি তাঁকে, জানালে স্রেফ বলে দিতেন তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমি তাঁর পড়ার ঘরে চলে যাই। দুটো সুইটের অনেকগুলো ঘরের ভেতর দিয়ে যেতে হয় আমাকে, বাইরে থেকে যাতে আমাকে কেউ দেখতে না পায়।’
‘প্রিন্সেস গঙ্গোত্রী কি তখনো তাঁর সঙ্গে ছিলেন?’
‘না, আমরা যখন যাই তখন তিনি একা…’
‘আপনার সঙ্গে আর কে ছিল?’ বাধা দিলেন স্যার।
‘কেউ না,’ বললেন সলিম। ‘আ স্লিপ অব টাং। আমি আম্মুর কথা ভাবছিলাম। আম্মুর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল, তিনিও আমার সঙ্গে থাকবেন কি না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে একাই পাঠান।’
‘শুনুন, ব্যাপারটা মিলছে না,’ শান্ত ধৈর্যের সঙ্গে বললেন কান্তিক স্যার। ‘এটা কি প্রতিষ্ঠিত নয় যে পুরো সময়টা বাড়িতে অনুপস্থিত ছিলেন মিসেস জারিনা?’
‘উম্… হ্যাঁ,’ থমথমে মুখে বললেন সলিম। ‘আপনি যদি ইতিমধ্যে সবই জেনে থাকেন, আমাকে তাহলে প্রশ্ন করছেন কেন? আম্মু বাইরে ছিলেন। এটা কি গুরুত্বপূর্ণ?’
‘না,’ বললেন স্যার। ‘বলে যান।’
‘প্রমত্তা সম্ভবত সবেমাত্র বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তখন, আমি ওর পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিলাম। তখনো রাগে ফুঁসছেন আব্বু।’
‘তাহলে আপনার জন্য ব্যাপারটা আরো কঠিন হয়ে যায়।’
‘না, বরং উল্টো। যতই রেগে থাকুন, বিষয়টার ইতি ঘটে যাওয়ায় আমার ধারণা তিনি হালকা বোধ করছিলেন। তাঁর মাপকাঠিতে, আমি বলব, বেশ ভালোই ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে। তবে আড়ষ্ট ভাবটা ছিলই। ভুলেও কখনো স্বীকার করেননি তাঁর ভুল হয়েছে, তবে কাল মনে হলো একটু যেন মানছেন। ছোটবেলা থেকে হ্যান্ডশেক করতে শেখানো হয়েছে আমাকে, আমার বাড়ানো হাতটা তিনি দেখতে না পাওয়ার ভান করলেন না। আব্বু চা খেলেন, আমি দুটো বিয়ার… শরাফতই এনে দিল… সেই কি আমার কথা ফাঁস করে দিয়েছে?’
‘না,’ কান্তিক স্যার বললেন। ‘বাড়ির প্রতিটি চাকর জানত আপনি বাড়িতে এসেছেন। সবাই তারা মিথ্যে কথা বলেছে আমাকে।’
‘আল্লাহ তাদের ভালো করুন!’ সলিমের মুখে খানিকটা মোচড়ানো হাসি ফুটল। ‘দেখা যাচ্ছে সবাইকে আমি ভুল বুঝেছি। এ রকম একটা সন্দেহভরা মন নিয়ে আমার বোধ হয় না জন্মানোই উচিত ছিল!’
‘কমোডর কী বললেন আপনাকে?’
‘চুপিচুপি বাড়িতে ঢুকেছি বলে তিরস্কার করলেন। বললেন, এটা অপরাধপ্রবণ মানসিকতা লালন করার শামিল। ভয় পাচ্ছিলেন, কেউ আমাকে তাঁর পড়ার ঘরে দেখে ফেলবে। আমাকে বিদায় করে দিলেন, বললেন সব কিছু মিটে গেলে আমি যেন দেখা করি তাঁর সঙ্গে। সব কিছু মিটে যাওয়া বলতে তিনি বোঝাতে চাইছিলেন দেশ ছেড়ে প্রমত্তার চলে যাওয়া। আমাদের আলাপের মধ্যে ওর নাম একবারও মুখে আনা হয়নি। তারপর বললেন, এরপর যেন সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকি, তা ঢুকলে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।’
‘নতুন হেবানামা প্রসঙ্গে কিছু বললেন না?’
‘কিচ্ছু না! বলবেনও না, বুঝলেন, যেহেতু আমার ওপর কিছুটা নরম হচ্ছিল তাঁর মন। জানতাম পরে কেঁদে বুক ভাসাবেন। যা-ই হোক, সব মিলিয়ে, আমার হিসেবে অনেকটা নেমেছেন তিনি, কাজেই আমি খুশি মনে ফিরলাম। কুমিল্লায় ছুটন্ত ট্রেনে রয়েছি, হঠাৎ খেয়াল হলো বন্ধ রাখা মোবাইল খোলা হয়নি। খুলতেই একের পর এক মেসেজ দেখতে পেলাম। ট্রেন থামাতে হলো, কপ্টারে চড়ে ফিরে এলাম। সব শেষ হয়ে গেছে! আব্বু মারা গেছেন, মুসলিমের হাতে ছড়ি… অন্তত আমি যতটুকু বুঝি!’ আবার মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরলেন সলিম।
‘ট্রেনে করে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?’
‘নির্দিষ্ট কোথাও না। প্রমত্তা দেশ না ছাড়া পর্যন্ত দূরে সরে থাকতে চাইছিলাম।’
‘এটাকে আপনার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে বাবার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের সময় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না,’ মন্তব্য করলেন কান্তিক স্যার। কথাটার মধ্যে প্রশ্নের সুর রয়েছে।
এক নিমেষের জন্য ইতস্তত করলেন সলিম। চোখের পাতা একটু কাঁপল কি? তারপর রাগের সঙ্গে বললেন, ‘না, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না।’
দশ
একটু পর ডাইনিং রুম থেকে সেই বিশাল হলরুমে বেরিয়ে এলাম আমরা। খানিক আগে আমাদের মধ্যে যে সামান্য ভাবাবেগ দেখা গেছে, চেহারা থেকে তার সবটুকু মুছে সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে উঠেছি সবাই। এটা স্বতঃস্ফূর্ত। কান্তিক স্যারের আচরণে এমন কিছু থাকল না, যা দেখে মনে হতে পারে কিছু কথা স্বীকার করায় সলিম কোবিদকে তিনি সন্দেহ করছেন। সাধারণ সব ব্যাপারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। উত্তর দেওয়ার সময় সলিমের মধ্যে ভদ্রতা ও ভব্যতা বজায় থাকছে, তবে আমি তাঁর অস্বস্তিভরা দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারছি, স্যার সম্পর্কে কী ভাববেন সেটা তাঁর ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি চিন্তা করছেন, পুলিশের এই এজেন্ট তাঁকে ফাঁদে ফেলতে চাইছেন, নাকি সব কিছু সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়ে ইনি তাঁর একজন বন্ধু? আসলে দুটোই সত্যি।
‘লাইব্রেরি ওদিকটায়,’ সলিম বললেন, ‘বসে আরাম পাওয়া যাবে। চলুন যাই।’
এ বাড়ির বাকি সব কিছুর মতো লাইব্রেরিটাও দেখে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো, তবে কামরাটাকে ‘লাইব্রেরি’ বলা স্রেফ বানানো গল্প, কারণ চোখে পড়ে এমন একটা বইও কোথাও নেই। ঠাণ্ডা, কারণ গোটা বাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। চারদিকে ছড়িয়ে আছে যথারীতি অ্যান্টিক ফার্নিচার। আমরা আরামদায়ক কয়েকটা ইজি চেয়ারে বসলাম, আলাপ চলল বন্ধুত্বের অমায়িক ভাব নিয়ে, কারো মনে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। আমার স্যার আক্রমণের যে সূক্ষ্ম ধারাগুলো ব্যবহার করেন, এ ধরনের নিরীহ দর্শন আলাপ তার মধ্যে একটা। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, কান্তিক স্যারের খোশগল্প করার ভঙ্গি দেখে সলিম কোবিদের অস্বস্তির মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। নিশ্চয় তিনি প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছেন। শেড পরানো ল্যাম্পের অল্প আলোয় আমি যেন তাঁর কপালে ঘামের চকচকে একটা ভাব লক্ষ করলাম।
বললাম, আলাপ চলল, তবে তাতে আমার কোনো অংশগ্রহণ নেই, কথা বলছেন শুধু ওঁরা দুজন। আমি চুপচাপ বসে একজন সুদর্শন তরুণের দিকে মোহগ্রস্তের মতো তাকিয়ে আছি, দেখতে পাচ্ছি ভাবাবেগের প্রাবল্যে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে তাঁর মুখ। সবচেয়ে করুণ আর বিব্রতকর লাগছে তিনি যখন বেপরোয়া কিশোরসুলভ হাসি হাসছেন, সব কিছুকে হালকা করার ব্যর্থ চেষ্টায়।
হঠাৎ দোরগোড়ায় একজন উর্দি পরা কাজের লোককে দেখা গেল, হাতে একটা খাম। ভেতরে ঢুকে সরাসরি ডাক্তার কান্তিকের সামনে দাঁড়াল। ধারণা করলাম, অজানা কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে স্যারকে বার্তা পাঠিয়েছেন সিআইডিপ্রধান আন্দেশা কাফি।
খাম থেকে বের করে কাগজের লেখাটা পড়লেন স্যার, চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় থাকল না কী লেখা আছে তাতে। কাগজটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে অ্যাশট্রেতে ফেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন।
‘সিআইডি চিফ জানিয়েছেন,’ বললেন তিনি, ‘অ্যাকনাইট বিক্রির সাম্প্রতিক কোনো খবর তাঁরা সংগ্রহ করতে পারেননি।’
আন্দাজ করলাম ওই চিরকুটে অবশ্যই আরো কিছু ছিল। এই একই সন্দেহ সলিমও করছেন। অ্যাশট্রেতে ফেলা কাগজের ছেঁড়া টুকরোয় এক এক করে আগুন ধরছে, থমকানো চেহারা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি, চোখে অঢেল কৌতূহল।
আলাপ চলছেই। আপাত উদার ভঙ্গিতে কান্তিক স্যার এই কেসে নিজের কাজ সম্পর্কে বলছেন।
আরো কিছু সময় গড়াতে, চিরকুট আসার পর তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হলো না, বাড়ির তিনতলার নকশার কথা তুললেন তিনি। ‘কী ঘটেছে বোঝার জন্য ওটা আমার মাথায় থাকা দরকার,’ হাসিমুখে বললেন। ‘আজ আমরা বেশির ভাগ ঘরেই গেছি, তবে আপনাকে সঙ্গে না রেখে আপনার সুইটে ঢুকতে চাইনি।’
স্যারের এই কথার পর মাত্র একটা উত্তরই দিতে পারেন সলিম কোবিদ, আর দিলেনও তাই : ‘আমরা কি এখন যাব?’
‘যদি কিছু মনে না করেন।’
এ রকম একটা বাড়িতে কোনো কিশোরের সাজিয়ে রাখা কামরা পরীক্ষা করতে যাওয়াটা সামান্য হলেও রোমাঞ্চকর। আমার ধারণা হলো, সলিমের পনেরো কি ষোলো বছর বয়সের পর থেকে এখানে খুব একটা কিছু বদলানো হয়নি। স্কুল থেকে পাওয়া প্রতীকী সব পতাকা, ব্যাজ, স্টিকার, খুদে ব্যানার ইত্যাদি বহু জিনিস এখনো দেয়ালে সাঁটা, ওগুলোর পাশাপাশি রয়েছে একজন কিশোরের নানা তৎপরতার সব ফটো- জার্সি গায়ে ফুটবলে লাথি মারছে, ক্রিকেট ব্যাট চালাচ্ছে, সাঁতারের পোশাক পরে সুইমিং পুলে নামছে। হুকের সঙ্গে কয়েকটা মুখোশ ঝুলতে দেখা গেল। বেশ কিছু ট্রফি দেখতে পাচ্ছি, স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে জিতেছে। শোকেসের ভেতর কিছু বক্সিং গ্লাভস, একটা শটগান, তীর-ধনুক আরো কিছু ট্রফি। কামরার এক কোণে জড়ো করা রয়েছে অনেকগুলো ক্রিকেট ব্যাট আর হকি স্টিক। আরেক কোণে কয়েকটা ফুটবল। পরিষ্কার বোঝা যায় বিরাট ধনী পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কিশোর সলিমের মধ্যে শ্রমবিমুখতা ছিল না।
একটা পড়ার ঘর আছে, যেটার সঙ্গে তুলনা করলে নিচতলার লাইব্রেরি লজ্জা পাবে। এখানে বেশ বড় সাইজের দুটো শেলফ আছে, বই আর ম্যাগাজিনে ঠাসা। লক্ষ করলাম, সেগুলোর মধ্যে অনেক বই কেমিস্ট্রি আর ড্রাগ নিয়ে লেখা। সেগুলোর মধ্য থেকে মোটা একটা বই টেনে নিয়ে কান্তিক স্যার নামটা পড়লেন : ‘ফার্মাকোলজি অ্যান্ড থেরাপিউটিকস।’ তারপর পাতা ওল্টাতে শুরু করলেন। ‘সম্প্রতি এই বইটা আপনি নাড়াচাড়া করেছেন?’ জানতে চাইলেন তিনি।
‘অনেক বছর হয়ে গেল ছুঁয়েও দেখিনি,’ নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দিলেন সলিম।
এরপর স্যার এমন একটা কাজ করলেন, যা আমি তাঁকে আগে কখনো করতে দেখিনি, সহজ একটা চালাকি, অথচ বিস্ময়কর তার ফলাফল। বইটা শিথিলভাবে দুই হাতের মাঝখানে ধরলেন তিনি, তারপর ওটাকে নিজে থেকে খুলে যেতে দিলেন। একবার নয়, এ রকম তিনবার করলেন। ‘আপনি বলছেন ছুঁয়েও দেখেননি, অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি এই বই সম্প্রতি খোলা হয়েছে,’ শান্ত সুরে বললেন তিনি, ‘এবং একাধিকবার। এই দেখুন! বইটা নিজে থেকে প্রতিবার ৪২৫-এ খুলে যাচ্ছে।’
আমরা তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালাম, দুজন তাঁর দুই পাশে এবং দেখলাম ওই পরিচ্ছদের নাম লেখা রয়েছে : XXI–ACONITINE.
ওটা যেন ঘুষি মারল আমাকে। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন সলিম কোবিদও। তাঁর মুখের পেশিগুলো নিজে থেকেই যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। ‘ঠিক আছে… বেশ…’ কর্কশ গলায় বললেন তিনি, ‘এ-এটা কি কিছু প্রমাণ করে?’
‘না,’ কান্তিক স্যার বললেন, বইটা বন্ধ করে আগের জায়গায় তুলে রাখলেন।
‘তা ছাড়া,’ আবার বললেন সলিম, প্রায় মরিয়া হয়ে, ‘অ্যাকনাইটের অ্যাকশন সম্পর্কে খুব ভালো করে জানা আছে আমার। ওই বই দেখে সেটা ঝালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।’
উত্তরটা করাতের মতো, দুদিকেই কাটে।
কামরার পরবর্তী আকর্ষণ কাচঘেরা একটা আলমারি, তাতে একজন স্কুলছাত্রের দুষ্প্রাপ্য সব সংগ্রহ যত্ন করে সাজিয়ে রাখা। একটা তাকে কিছু শাঁখ, পাথর, ফসিল, তীরের মাথা ইত্যাদি। নিচের তাকে রয়েছে প্রজাপতি, মৌমাছি, পাখির ডিম, আর পাঁচ-সাত রকম স্যুভেনির। সাধারণত কিশোর একটা ছেলে যতটুকু সংগ্রহ করে, এখানে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে, গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভাবও বর্তমান, আর তার কারণ হলো, এই কিশোর ছেলেটাকে তার চাহিদামতো টাকা জোগান দেওয়া হয়েছে। আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি সুদর্শন কিশোর তার সম্পদ আর সম্পত্তি কত যত্ন করে গুছিয়ে রাখছে।
‘আপনার ড্রাগ কালেকশন,’ শান্ত সুরে জানতে চাইলেন কান্তিক স্যার, ‘ওগুলো দেখছি না যে?’
আঘাতটা এত তীব্র, স্পষ্ট ঝাঁকি খেলেন সলিম। কণ্ঠনালিতে নিঃশ্বাস আটকে গেল, বিষম খেতে গিয়ে কোনো রকমে সামলে নিলেন নিজেকে, তারপর কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চেষ্টা করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাধা দিয়ে কান্তিক স্যার বললেন, ‘উঁহু মিথ্যে কথা বলবেন না! তাতে দুজনকে অপমান করা হবে- নিজেকে এবং আমাকে। দোষটা আমারই। আপনাকে আর আমি ধোঁকা দেব না। সিআইডিপ্রধানের কাছ থেকে আমি যে কাগজটা পেয়েছি, সেটা পড়ে জানতে পারলাম আপনি যখন ড্রাগ ব্যবসা শুরু করেন তখন আপনার কাছে প্রতিটি ড্রাগের নমুনাসহ একটা কালেকশন থাকত। ওই কালেকশন রাখা হতো কাঠের ছোট একটা বাক্সে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই ড্রাগ বক্স বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ধরে নিতে হবে ওই নমুনার মধ্যে অ্যাকনাইটও ছিল, তবে সত্যি ছিল কি না, তা আমি এই মুহূর্তে যাচাই করতে পারছি না।’
‘এটা আপনার ভুল ধারণা, কী জন্য আপনাকে আমি মিথ্যে বলতে যাব!’ রুদ্ধশ্বাস গলায় দ্রুত বললেন সলিম। ‘ও রকম একটা কালেকশন আমার ছিল, তবে বছর দুয়েক আগে ওটা ধ্বংস করে ফেলি। যখন আর কারো ওপর বিশ্বাস আর আস্থা রাখতে পারলাম না, ব্যবসা শব্দটা আমার চোখে বিষ হয়ে উঠল। তা ছাড়া ও রকম মারাত্মক জিনিস আশপাশে ফেলে রাখা অত্যন্ত বিপজ্জনক।’
অত্যন্ত বিপজ্জনক তাঁর এই মিথ্যে বলাটাও। মিথ্যে যে তিনি বলছেন, সেটা পরিষ্কার। সলিম কোবিদের জন্য দুঃখ এবং মায়া হচ্ছে আমার।
‘বলছেন ধ্বংস করে ফেলেছেন, কিভাবে ধ্বংস করেছেন শুনি!’ কান্তিক স্যার জানতে চাইলেন।
‘কিভাবে আবার, নিচতলার ফার্নেসে বাক্সটা ঢুকিয়ে দিই।’
আর কিছু বললেন না স্যার, পথ দেখিয়ে সংলগ্ন বেডরুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের। এটা প্রায় খালি একটা কামরা, অল্প দু-তিনটা ফার্নিচার, যা আছে মাঝখানে প্রচুর ফাঁকা রেখে ফেলা, দেখতে হাসপাতালে একটা বড় কেবিনের মতো। এই বাড়ির প্রায় দম বন্ধ করা বিলাসিতার ভেতর এটা যেন একটু তাজা বাতাস। এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সরু সাদা খাট।
দোরগোড়া থেকে নিঃশব্দে কামরার ভেতর চোখ বুলাচ্ছেন কান্তিক স্যার। চোখের কোণ দিয়ে তাকালাম, সলিমের ফরসা মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, ঘামছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে আমিও একটু ভুগছি। একসময় আমার গুরু শান্ত গলায় বললেন, ‘অতেব।’
‘জি, স্যার!’
‘গদি তোলো।’
নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, পরিষ্কার গুঙিয়ে উঠলেন সলিম। ‘হে আল্লাহ! আমি শেষ!’
কাঁপা হাতে আমি আমার মহান শিক্ষকের আদেশ পালন করলাম। বিছানার ওপরে তোশক, তার নিচে গদি, সবশেষে স্প্রিং। গদি আর স্প্রিংয়ের মাঝখানে পড়ে থাকতে দেখা গেল ওটাকে- চৌকো আকৃতির কাঠের চ্যাপ্টা বাক্স, যে ধরনের বাক্সে ফেরিওয়ালারা চুলের কাঁটা, আলতা, কানের দুল ইত্যাদি ভরে বিক্রি করতে বেরোয়। দেখেই বোঝা যায়, বাক্সটা ওখানে তাড়াহুড়ো করে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে, যতক্ষণ ভালো একটা লুকানোর জায়গা কিংবা ধ্বংস করে ফেলার সুযোগ না পাওয়া যায়।
‘আপনার কিছু বলার আছে?’ জানতে চাইলেন কান্তিক স্যার।
তিক্ত কণ্ঠে হেসে উঠলেন সলিম। ‘বলার আছে? আমাকে দিয়ে আপনি আর কী বলাতে চান, মিস্টার শার্লক হোমস? আমার বিরুদ্ধে একটা কেস দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, এই তো? বেশ, ভালো কথা, ঠিক আছে। ওই কেস নিয়ে এগোন আপনি। আন্দাজ করছি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি আমি, ভালো একজন ব্যারিস্টারের সঙ্গে পরামর্শ না করা পর্যন্ত মুখ খোলা চলবে না।’ আধপাগল কোনো লোক যেন স্রেফ সাহস দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যে বাক্সটা আমি বিছানার আরেক দিকে নামিয়ে রেখেছি, তোশক আর গদিও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বাক্সটায় তালা দেওয়া।
‘চাবিটা দেবেন?’ প্রশ্ন করলেন বস।
‘কী লাভ?’ চেঁচিয়ে উঠলেন সলিম। ‘আমি স্বীকার করছি জিনিসটা ওখানে ছিল, এবং এখন নেই।’ তার পরও চাবির একটা গোছা বের করে নির্দিষ্ট চাবিটা আলাদা করতে দেখলাম তাঁকে।
‘এই চাবিটা সব সময় আপনার দখলে থাকে, নাকি অন্য কেউও ব্যবহার করে?’ জিজ্ঞেস করলেন কান্তিক স্যার।
‘সব সময় আমার কাছে থাকে।’
‘এ রকম চাবি আরেকটা আছে?’
‘না।’
আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ‘আপনি নিজেকে অভিযুক্ত করছেন?’
‘আরে, কী আসে যায় তাতে!’ উত্তর দিলেন তিনি।
আমার দিকে সামান্য ভ্রু কুঁচকে তাকালেন কান্তিক স্যার। তারপর কোণঠাসা হয়ে পড়া সলিমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওটা আপনি তোশকের তলায় কবে রেখেছেন?’
‘আজ বিকেলে। ভেবেছিলাম আজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে পুড়িয়ে ফেলব।’
ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলি, মুখ বন্ধ রাখুন! কিন্তু সেটা পাগলামিরও বেশি হয়ে যাবে।
‘তার আগে কোথায় ছিল ওটা?’
‘স্টাডি রুমের কেবিনেটে।’
‘আপনি ছাড়া ওই কেবিনেটের চাবি আর কার কাছে আছে?’
‘আর কারো কাছে নেই।’
ইতিমধ্যে বাক্সটা খোলা হয়েছে। ওটার ভেতর দিক ভেলভেটে মোড়া, অসংখ্য খুদে খোপে ভাগ করা, প্রতিটিতে ড্রাগভর্তি কাচের ফাইল, মোম বা ওই ধরনের কিছু দিয়ে বন্ধ করা। প্রতিটি ফাইলের চারদিকে নিখুঁতভাবে লেবেল সাঁটা, অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য প্রতিটি খোপের একটা করে নম্বর দেওয়া আছে, কোন খোপে কী ড্রাগ আছে তার একটা তালিকা সাঁটা রয়েছে বাক্সের মাথায়। একটা খোপ খালি দেখলাম। ওটার নম্বর ৬৩, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখ উঠে গেল ড্রাগের তালিকায়। ক্রমিক সংখ্যা ৬৩-র উল্টোদিকে লেখা : Aconitina.
সায়েবকে ডেকে পাঠিয়েছেন ডাক্তার কান্তিক। সলিম কোবিদকে তাঁর বেডরুমে বসিয়ে রেখে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই কামরার জানালা থেকে ৩০ ফুট নিচে হাঁটার জন্য পাথর দিয়ে বাঁধানো পথ আর উঠান দেখা যায়, এবং ডানা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তাঁর পালানোর সুযোগ নেই।
তবে এ বাড়িতে ওই তরুণের বন্ধুরও কোনো অভাব নেই, সব ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে তারা তাঁকে পালাতে সাহায্য করবে। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে উর্দি না পরা একজন লোককে পাঠাতে বলা হয়েছে, সে না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত খানিক পরপর কি হোলে চোখ রেখে ভেতরটা দেখে নিচ্ছি আমরা। মাথায় হাত দিয়ে বিছানার ওপর ঠায় বসে আছেন সলিম।
পুলিশের লোক, অটল হায়দার এসে পৌঁছল; তাকে ওই সুইটের দরজায় পাহারা দিতে বলা হলো। ঘটনার এই মোড় পরিবর্তনের কথা শুনে মর্মাহত এবং হতভম্ব হয়ে পড়ল সায়েব। তাকে ছাড়া আর কাউকে আমরা কিছু জানাইনি। মিসেস জারিনা যখন জানতে পারবেন তাঁর ছেলে একজন বন্দি, জানি তখন আমাদের ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে যাবে।
ডাক্তার কান্তিক আর আমি কমোডরের বাড়িতেই ঘুমালাম। পরদিন খুব ভোরে গোপনে গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁর মরদেহ, পারিবারিক কবরে দাফন করার জন্য। তবে তাতে বাধা দিল পুলিশ। বলা হলো পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শহরের একটা ক্লিনিকের হিমঘরে রাখতে হবে মরদেহ। নতুন হেবানামা কিংবা দলিল, যা-ই বলা হোক, আনুষ্ঠানিকভাবে একবারও সংশ্লিষ্ট কারো সামনে হাজির করা বা পড়া হয়নি, তবু কারো আর জানতে বাকি নেই যে কী আছে তাতে। ওটা ঠিক হেবানামা নয়। কমোডর বিরাট একটা ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করে রেখে গেছেন, সেটার একমাত্র বেনিফিশিয়ারি হবেন মিসেস জারিনা, যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ওটার সম্পদ তিনটি সমান ভাগে ভাগ হবে : একটা যাবে পুরান ঢাকা হসপিটালে, একটা মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টসে, আরেকটা ঢাকা ভার্সিটিতে। সলিম কোবিদের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্নটা বাস্তবে ফলেনি, যেহেতু এখানে কোথাও মুসলিম কোবিদের নাম দেখা যাচ্ছে না।
বাড়ির ভেতর ঘটতে থাকা নাটকীয় কাহিনীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বাড়ির বাইরে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের কথা ভুলে যাওয়া আমার উচিত হবে না। পুলিশের ছোট একটা দল এই কেস নিয়ে কাজ করছে। গোপনীয়তা অটুট রাখার স্বার্থে সিআইডি চিফ আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন, কোনো অবস্থাতেই প্রথম ২৪ ঘণ্টা এই দলের সদস্যদের অন্য কোনো কাজ দেওয়া হবে না। ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার আর ললিতান নেসার প্রতিটি নড়াচড়া মনিটর করা হচ্ছে। শিলা শরণির ওপর নজর রাখার কোনো উপায় বের করা যায়নি, কারণ তিনি বাড়ির ভেতর বাস করেন এবং খুনটা হওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে একবারও কোথাও বের হননি। চাকরদের সরদার শরাফত এবং অন্য যেকোনো কাজের লোক বাড়ির বাইরে বেরোনো মাত্র ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। এসব অনুসরণের ফল জানানো হচ্ছে আমাদের, কিছু রিপোর্ট আসছে মিসেস জারিনার মাধ্যমে।
বাইরের এসব লোকজন ছাড়াও আমাদের অত্যন্ত যোগ্য একজন এজেন্ট মীরকে বাড়ির ভেতরে কাজের লোক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি। মীর অভিযোগ করেছে, একেবারে শুরু থেকেই বাড়ির প্রতিটি চাকর-চাকরানি তাঁর পরিচয় জানত, এবং তাঁকে আসতে দেখামাত্র সবাই চুপ করে যায়। এ থেকে ধরে নিতে হয় সায়েব আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, কারণ একমাত্র তারই জানার কথা কোত্থেকে এসেছে মীর।
পুলিশের একজন এসআই মাত্র কয়েক ঘণ্টার তদন্তে বের করে ফেলেছেন সিআইডি চিফের নামে পাঠানো উড়ো চিঠিটা সংশ্লিষ্ট কুরিয়ার সার্ভিসের যাত্রাবাড়ী শাখায় জমা দেওয়া হয় মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে। কে জমা দিয়েছে, সে দেখতে কেমন, কর্মচারীরা এসব স্মরণ করতে পারেনি। এনভেলপে প্রেরকের নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, তবে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ওসব ভুয়া।
ওই একই কুরিয়ার সার্ভিসের মতিঝিল শাখায় জমা দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় চিঠি, বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার সময়। ওটা জমা দিয়েছে এক কিশোর, ওই এলাকার চায়ের দোকানে কাজ করে। কিন্তু অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানের মালিক জানিয়েছে, ছেলেটা কোথায় থাকে, তা তার জানা নেই। তবে চিঠি দুটোর অদ্ভুত হরফ প্রেরকের সন্ধান পেতে সাহায্য করল।
মঙ্গলবার রাতেই ডাক্তার নিমেষ সরওয়ারের চেম্বারে হানা দিয়েছে পুলিশ। চেম্বারসংলগ্ন একটি কামরায় ডিজিটেইলিস আর অ্যাট্রপিনসহ আরো অনেক রকম উদ্ভিদজাত ওষুধ পাওয়া গেছে, বেশির ভাগই চীন আর জার্মানি থেকে আমদানি করা। সেগুলো পরীক্ষার জন্য পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ল্যাবে পাঠানো হয়। সেখান থেকে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে লেবেল অনুসারেই ড্রাগ আছে প্রতিটি শিশিতে, সহজ ভাষায় উল্লেখ করা আছে কী লক্ষণে কী মাত্রা। পেটব্যথা কমানোর আর রক্ত জমাট না বাঁধার জন্য যেসব ওষুধ দেওয়া হয়েছে কমোডরকে, সেগুলোও পরীক্ষা করা হয়েছে। সবই পেটেন্ট করা ওষুধ, যেকোনো ফার্মেসির দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
ডাক্তার কান্তিক আর আমি কমোডর কোবিদের অফিসে আসন গেড়ে বসেছি। আমি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার সময় আমার বস বাড়ির একজন চাকরানিকে জেরা করেছেন, তাঁর মুখ থেকে শুনে সব আমি নোট করছি। এই চাকরানি, মর্জিনা, কমোডরের পড়ার ঘর থেকে চায়ের সরঞ্জাম সরিয়ে এনেছিল।
মর্জিনা বলছে, কমোডরের সুইটে আর কারো সঙ্গে তার দেখা হয়নি। সে আরো বলছে, শরাফতের কাছে আগেই নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল যে মনিব তাকে ডেকেছেন, কিন্তু মর্জিনা আর কমোডরের বেডরুমের মাঝখানে তিনটে দরজা রয়েছে, অথচ সে এমন কিছু দেখেনি বা শোনেনি যা দিয়ে বোঝা যায় যে মনিব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মর্জিনা খুব জোর দিয়ে দাবি করছে, মনিব মারা যাওয়ার পর প্রথম সে জানতে পারে যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
মর্জিনার ভাষ্য, পড়ার ঘরের নিচু টেবিলে চায়ের দুটো খালি কাপ দেখেছে সে, যেগুলোতে চায়ের অবশিষ্ট ছিল; আরেকটা কাপ দেখেছে সার্ভিস প্যানট্রিতে- চা বানিয়ে কাপে ঢালা হয়েছে, কিন্তু খাওয়া হয়নি। খুদে চারটে কাচের গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে, ইঙ্গিত দেয় চার কাপ চা বানানো হয়েছে। কাপগুলো একটা টি সার্ভিসের অংশবিশেষ, রাখা হয় কমোডরের সুইটে, প্যানট্রিতে নিয়ে গিয়ে ওগুলো ধুয়ে আবার তাকে সাজিয়ে রেখে আসার দায়িত্ব ছিল মর্জিনার ওপর। সুন্দর দেখতে এই তরুণী অস্বীকার করছে, বলছে এমন কোনো গ্লাস তার চোখে পড়েনি যাতে ঢেলে বিয়ার খাওয়া হয়েছে (আমরা ধরে নিলাম এখানে মর্জিনা সত্য কথা বলছে না)।
‘তৃতীয় কাপ চা কার জন্য?’ কিছু চিন্তা করিনি, প্রশ্নটা নিজে থেকে আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
‘ভাবো, অতেব,’ আমার গুরু বললেন, মুখে রহস্যময় হাসি লেগে রয়েছে। ‘কাল রাতে আমরা যখন সলিমকে জেরা করছিলাম, তখনই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে একা দেখা করতে যাননি। মিসেস জারিনা বাড়ির বাইরে ছিলেন, ভুলে যেয়ো না।’
লালচে চুল, রোগাপাতলা, ধবধবে ফরসা, রাজ্যের মায়া নিয়ে পটোলচেরা চোখ, ডানাকাটা পরী বললেই হয়- মিসেস জারিনার সেক্রেটারির চেহারাটা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। শিলা শরণি! বিহ্বল হয়ে ভাবছি। আরেকজন! ধনীর এই দুলাল নিজেকে সুন্দরী অপরূপাদের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়েছেন, একজন ছত্রীসেনা যেভাবে তার প্যারাস্যুটের রশির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে!
তখনো আমরা নিজেদের রুটিন কাজ শেষ করতে পারিনি, কামরায় ঢুকলেন ললিতান নেসা। আগেই বলেছি, ললিতান যেন সাক্ষাৎ দেবী; অসম্ভব লম্বা সে, গায়ের রং দুধে-আলতা, টিকলো নাক, চোখ কটাক্ষ হানছে, চেহারায় এত গর্ব যেন মাটিতে পা পড়ছে না। এই মুহূর্তে তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, শোকটা যেন কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। তাঁর উচ্চারণ তোতাপাখির মতো, শুনে মনে হয় শেখানো বুলি আওড়াচ্ছেন। তিনি যখন কথা বলেন, তাঁর ঘন কালো চোখ দুটো সেই কথার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। ওঁর কামরাটাই ব্যবহার করছি আমরা, সে জন্য বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিলেন কান্তিক স্যার।
‘না, তাতে কী,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ললিতান। ‘কমোডর স্যার চলে যাওয়ার পর মাথায়ই ঢুকছে না এখানে থাকার আর কোনো অধিকার আমার আছে কি না। সব কিছু থেকে তলা খসে পড়েছে। বলতে পারেন একটা অন্ধ ইন্সটিংকট এখানে আমাকে কাজটা শেষ করতে ফিরিয়ে এনেছে, যতটা শেষ করতে পারি আর কি। আপনাদের কাজে বিঘ্ন ঘটলে পড়ার ঘরে বসতে পারি আমি।’
‘না, তার দরকার নেই,’ কান্তিক স্যার বললেন। ‘আর যাকেই সরানো হোক, আপনার জায়গায় আপনি ঠিক থাকবেন। এখন আমরা শুধু রুটিন ওয়ার্ক করছি।’
পাইপে আগুন ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন স্যার, মেয়েটির সঙ্গে হালকা মেজাজে গল্প করছেন। ললিতানকে তিনি এই কেসের অনেক বিবরণ দিচ্ছেন, যেগুলো রাতারাতি আলোর মুখ দেখেছে, তবে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সাফল্য এসেছে ওগুলো সম্পর্কে একটা কথাও বলছেন না।
‘আমার ধারণা, খুব ইন্টারেস্টিং একটা বই হবে ওটা,’ বললেন স্যার, তাকিয়ে আছেন ললিতানের হাতে ধরা একগাদা প্রিন্ট-আউটের দিকে, এই মাত্র দেরাজ থেকে বের করেছেন তিনি।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই!’ হাসিমুখে সায় দিলেন ললিতান। ‘আমার তো ধারণা, এ রকম জীবনী দেশে খুব কমই লেখা হয়েছে। কমোডর স্যার তাঁর সময়ে সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব মানুষকে চিনতেন। এ রকম আরেকজন বাঙালি দেখান তো দেখি আমাকে!’
‘তবে তাঁর শেষ হেবানামা বা দলিল বইটাকে বিয়োগান্তক সমাপ্তি এনে দেবে।’
‘না, প্লিজ!’ কাঠের পুতুলের মতো আড়ষ্ট একটা ভঙ্গি করে বললেন ললিতান। ‘আপনার কথা সত্যি হলেও তা শুনতে সবারই খুব কষ্ট হবে!’
‘বইটা কি শেষ হয়ে এসেছে?’
‘হ্যাঁ, প্রায়। আগামী একুশে বইমেলায় বাজারে ছাড়তে চাই। কমোডর স্যারের জীবনে ইন্টারেস্টিং যা কিছু আছে, সব এখানে জায়গা পেয়েছে।’
‘এটা আপনি লিখছেন তাঁর ডায়েরি দেখে?’
‘ডায়েরি, অসংখ্য নোট আর তাঁর সাক্ষাৎকার- তিনটের সাহায্যে,’ বললেন ললিতান। ‘সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছি প্রায় প্রতিদিন স্যারের সঙ্গে কথা বলে।’
‘ডায়েরি আর নোট লেখা কবে নাগাদ শেষ করেন কমোডর?’
‘গত মে মাসে। আমাকে তিনি নিয়োগ দেন ঠিক এক বছর আগে।’
‘এক বছর!’ বিস্মিত হলেন কান্তিক স্যার। ‘একটা বই লিখতে এক বছর অনেক বেশি সময় হয়ে গেল না? আজকাল তো শুনি মানুষ রাতারাতি নাটক-নভেল লিখে ফেলে।’
‘এটা ও রকম সহজ কোনো বই নয়,’ কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটে টোকা দিয়ে বললেন ললিতান। ‘নিজের স্টাইল ধরে রাখার জন্য প্রচুর খাটাখাটনি করেছেন কমোডর। একেকটা পর্ব পাঁচ-সাতবারও কাটাকুটি করেছেন। তা ছাড়া অসম্ভব ব্যস্ততার মধ্যে থাকতেন, টানা সময়ও তো দিতে পারতেন না।’
‘গত শীতে তিনি যখন ইউরোপে গেলেন, তখনো কি এটার ওপর কাজ করেছেন তিনি?’
‘না। তা করার কোনো ইচ্ছে স্যারের ছিল না। সব বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন।’
‘ওই সময়টা কী করেছেন আপনি?’
‘আমি আমার বাড়িতে ছিলাম। ওই সময় আমাকে ছুটি দেওয়া হয়, তবে বেতনসহ। স্যার জানতেন, কাজটার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে গেছি আমি, নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন তিনি ফেরা মাত্র আবার যাতে কাজটা শুরু করা যায়।’
‘বাড়ির আর কারো কমোডরের এই বই সম্পর্কে আগ্রহ ছিল? সলিম কোবিদের?’
‘কী জানি, বুঝতে পারিনি। তবে সলিম স্যারের আগ্রহ ছিল বলে মনে করি না। ভ্রমণ বা সাহিত্য তাঁর ভালো লাগে বলে শুনিনি।’
‘তবে তিনি জানতেন যে একটা বই লেখার কাজ চলছে?’
‘হ্যাঁ, তা জানতেন। গত গ্রীষ্মে আমরা কিছুদিন পাহাড়ি এলাকায় ছিলাম, তখন ওখানকার বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন তিনি। তারপর জুন মাসে কমোডর স্যারের সঙ্গে তাঁর একটা সমঝোতা হলো, ওই সময় প্রায় এক মাস আমাদের সঙ্গে ছিলেন।’
আলোচনাটা অকস্মাৎ থামিয়ে দিল অত্যন্ত কর্কশ একটা চিৎকার। বাড়ির নকশা সম্পর্কে আমি যদি পরিষ্কার বর্ণনা দিয়ে থাকি, তাহলে সবারই মনে থাকার কথা যে কমোডর কোবিদের অফিস রুমের ঠিক পেছনেই সলিম কোবিদের স্টাডি বা পড়ার ঘর। দুটো কামরার মাঝখানে একটা দরজা আছে, তবে তা ব্যবহার করা হয় না। আমার ধারণা, কামরাগুলো প্রথম যখন ভাগ করে সুইটে পরিণত করা হয়েছিল তখনই ওটায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই পাশের কামরা থেকে আমরা একটা চাপা চিৎকার ভেসে আসতে শুনলাম।
আমি আর কান্তিক স্যার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়েছি, কিন্তু কিভাবে সম্ভব বলতে পারব না, আমাদের আগে সিধে হয়েছেন ললিতান। ওই আশ্চর্য নারী, শব্দটা যেন তাঁর শরীরে ইলেকট্রিক শক মেরেছে, দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন যেন ঝাপসা আলোর ঝলক, ঢুকে পড়লেন পরবর্তী দরজার ভেতর- আমরাও ঢুকলাম, কান্তিক স্যার তাঁর এক সেকেন্ড পেছনে, আমি কান্তিক স্যারের এক সেকেন্ড পেছনে। পড়ার ঘরের পরিস্থিতি একবার চোখ বোলাতেই পরিষ্কার হয়ে গেল। বেডরুমে ঢোকার পথ আটকে রেখেছেন ডিটেকটিভ অটল হায়দার। তাঁর মুখোমুখি দাঁড়ানো শিলা শরণি আতঙ্কে যেন জমে গেছেন, একটা হাত দিয়ে চেপে ধরে আছেন নিজের মুখ, যেন এখনো অদম্য একটা চিৎকার দেওয়ার প্রয়োজন তাঁর ফুরোয়নি। পরনের কালো ড্রেস তাঁর সৌন্দর্যকে আরো খানিক ভঙ্গুর করে তুলেছে। কান্তিক স্যারের দিকে ঘুরে গেলেন তিনি।
‘এই ভদ্রলোক আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না!’ রুদ্ধশ্বাসে বললেন। ‘…বলছেন তিনি নাকি একজন পুলিশ অফিসার! সলিমকে নাকি গ্রেপ্তার করা হয়েছে!…’
কান্তিক স্যার কিছু বলার আগেই শুরু করে দিলেন ললিতান। অকস্মাৎ রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করেছেন তিনি, তাঁর সুন্দর অবয়ব হিম হয়ে আছে তীব্র ঘৃণায়। উন্মাদিনীর মতো তাঁর ছুটে আসার সঙ্গে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার এখনকার সাফল্য মেলানো সত্যি খুব কঠিন। মোহে পড়া নারী যেকোনো বিচিত্র ভূমিকা নিয়ে ফেলতে পারে। আমার ধারণা হলো, ললিতান নেসা আরেকটা অসহায় শিকার মাত্র। তিনি শুধু ঘৃণা নয়, দারুণ কর্তৃত্বের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখানে কী করছ?’
লালচে চুল নিয়ে সামনে দাঁড়ানো তরুণী ললিতানের দিকে তাকালেনই না। তিনি আমার স্যারের দিকে তাকিয়ে থেকে আগের প্রশ্নটা পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘ওকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে?’
‘ওর কামরায় তুমি কী করছ?’ ধমকে উঠলেন ললিতান। ‘ওর বেডরুমে? তোমার কি লজ্জা বলে কিছু নেই?’
শিলা শরণি এবার ললিতানের দিকে ফিরলেন। দেখা গেল গভীর কালো দীঘির মতো চোখ থেকেও আগুনের ফুলকি ঝরে! ‘সেটা জানার তোমার এত গরজ কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি।
ললিতান চিৎকার করে বললেন, ‘কমোডর স্যার বেঁচে থাকতে তো এদিকে পা বাড়াতে সাহস পাওনি! তাঁর ডেডবডি এইমাত্র বাড়ি থেকে বের করা হয়েছে। ছিঃ, তুমি একটা নির্লজ্জ!’
‘চুপ করো!’ লাল চুল ঝাঁকিয়ে বললেন শরণি। ‘সবাই জানে তোমার সমস্যাটা কী!’
কী আশ্চর্য একটা দৃশ্য! দেখা যাচ্ছে সুন্দরী অপরূপাকে যতই দুর্বল বলে মনে হোক, তিনিও ফণা তুলতে পারেন। ত্বকের নিচে মেয়েরা আসলে সবাই সমান। আমার স্যার গোটা ব্যাপারটাকে গ্রহণ করছেন রহস্যময় স্ফিংকসসদৃশ্য শান্ত-সমাহিত ভাব নিয়ে। এ রকম একটা ডামাডোলের মধ্যে বেডরুমের ভেতর থেকে দরজায় ঘুষি মারতে শুরু করলেন সলিম কোবিদ। ‘আমাকে বেরোতে দিন! আমাকে বেরোতে দিন!’
ডিটেকটিভের দিকে ফিরে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন কান্তিক স্যার, সঙ্গে সঙ্গে বেডরুমের দরজা খুলে দিলেন তিনি। যেন মনে হলো ভেতরের কামরা থেকে ডিগবাজি খেয়ে বেরিয়ে এলেন সলিম কোবিদ। আমাদের কারো দিকে তাঁর নজর বা খেয়াল নেই, এক শুধু শিলা শরণি বাদে। দুই হাত বাড়িয়ে তাঁকে ধরলেন তিনি। ‘ওহ্, মাই ডার্লিং!’ বিড়বিড় করলেও, সবাই আমরা পরিষ্কার শুনতে পেলাম।
শরণি মেয়েটাও দুনিয়ার অস্তিত্ব পুরোপুরি ভুলে গেছেন। সলিমের ঘাড় আর গলা পেঁচিয়ে ধরল তাঁর পেলব বাহু। ‘সলিম… সলিম…’ ফিসফিস করছেন। আমার সন্দেহ হলো এখনই জ্ঞান হারাবেন।
আচ্ছা, অবশেষে এত সব নাটকের ভেতর দিয়ে উন্মোচিত হলো অসংখ্য রূপসী নারীর মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন সলিম। ললিতান নেসার পক্ষ নিয়ে শিলা শরণির বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। শুরু থেকেই আমি লক্ষ করেছি দুজনের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা কাজ করে। ললিতানের বিরুদ্ধেও আমি যাচ্ছি না। বর্তমান দৃশ্যটা ঠাণ্ডা কৌতুক মেশানো ঘেন্নার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি, তবে তাঁর বুকের দ্রুত উত্থান-পতন ফাঁস করে দিচ্ছে মনের ভেতর তিন শ কিলোমিটার গতিতে ঝড় শুরু হওয়ার খবরটা। মাত্র চারটে শব্দ উচ্চারণ করলেন তিনি : ‘প্রহসন আর বলে কাকে!’
এই বাক্যই সতর্ক করল সলিমকে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন তিনি। যখন তাঁর বোধগম্য হলো কথাটা কে বলেছেন, প্রিয় বান্ধবীকে এমন ভঙ্গিতে ছেড়ে দিলেন, তিনি যেন বিষধর সাপ বা জ্বলন্ত আগুন। প্রথমে লালচে হয়ে উঠল চেহারা, তারপর ম্লান। চোখ-মুখে লেখা হয়ে গেছে ললিতানের সামনে ইনি একজন পরাজিত মানুষ। তাঁর এই পরাজয় মেনে নেওয়াটা, তখনকার বিধ্বস্ত চেহারা, আপনাকেও ব্যথা দেবে তাঁর প্রতি আপনার যদি এতটুকু স্নেহ বা ভালোবাসা জন্মে থাকে। লম্বা ললিতানকে আরো বেশি লম্বা লাগছে, চোখে তীব্র কটাক্ষ; তাঁর এই দৃষ্টি আর রণরঙ্গিনী মূর্তির সামনে টিকতে পারলেন না সলিম, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার সাহসই হলো না তাঁর। ঘুরলেন, দ্রুত পালিয়ে গেলেন নিজের বেডরুমে।
‘সলিম!’ শরণির গলা থেকে আঁতকানোর শব্দ বেরিয়ে এলো, দেখে মনে হলো তাঁর পিছু নিতে যাচ্ছেন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরের দরজায় নক করল কেউ, শুনে থমকে গেলেন শরণি। সত্যি এটা দেখে আশ্চর্যই লাগে, কিভাবে আমরা সবাই প্রয়োজনের সময় যে যার মুখোশ পরে নিই। এই বাড়িতে একটা ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছে : সব কিছু চেপে রাখতে হবে। ডিটেকটিভকে বেডরুমের দরজায় তালা লাগানোর অনুমতি দিলেন শরণি। আরেকদিকে কান্তিক স্যার অন্য দরজাটা খুললেন। চেহারায় ব্যাকুল ভাব নিয়ে দরজায় সায়েব দাঁড়িয়ে। বোঝাই যাচ্ছে কিছু না কিছু শুনেছে সে, তবে অন্যান্য কাজের লোকদের দূরে সরিয়ে রাখতে সফল হয়েছে। দু-এক কথায় তাকে অভয় দিলেন স্যার, ফিরে গেল সে।
তবে বাধা পড়ায় দৃশ্যপটে অদ্ভুত একটা শান্ত ভাব চলে এসেছে। দুই তরুণীই চিন্তা করার সময় পেয়েছেন, বুঝতে পারছেন খুব বেশি প্রকাশ করে দিলে নিজের বিপদও কম নয়। পরস্পরকে এখন তাঁরা যথাসাধ্য অগ্রাহ্য করছেন, কেউ কারো উপস্থিতি সম্পর্কে যেন সচেতন নন। যেই মাত্র পথ ছেড়ে সরে গেল সায়েব, দীর্ঘকায় সুন্দরী যথাসম্ভব মাথা উঁচু করে এবং হাইহিলের খটাখট আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেলেন কামরা ছেড়ে। প্রতিদ্বন্দ্বী অদৃশ্য হয়ে যেতে দ্বিতীয় সুন্দরী ধীরে ধীরে মাথা নত করলেন, পরিষ্কার দেখা গেল তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। তিনি যেন বুঝতে পারলেন সলিমকে আবার দেখতে চেয়ে লাভ নেই কোনো। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসবে, তার আগেই বাইরের দরজা লক্ষ করে ছুটলেন তিনি।
এক সেকেন্ডের জন্য তাঁকে থামালেন ডাক্তার কান্তিক। ‘যতক্ষণ পারা যায় ব্যাপারটা মিসেস জারিনার কাছে গোপন রাখবেন,’ বললেন তিনি। ‘চেহারা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সামনে যাবেন না।’
কথা না বলে মাথা ঝাঁকালেন শরণি, তারপর ছুটে চলে গেলেন। আবার যখন আমরা পাশের ঘরে ফিরলাম, দেখি বিস্ময়কর সেই প্রাণী কম্পিউটারে বসে ঝড়ের বেগে কম্পোজ করছেন, ওটা ছেড়ে তিনি যেন একবারও ওঠেননি।
এগারো
এরপর যেটা ঘটল, সেটাও কম বিস্ময়কর নয়, সিআইডি চিফ আন্দেশা কাফি হাজির হলেন কোবিদ ভবনে। আন্দাজ করলাম আমার ঘুম ভাঙার আগেই তাঁকে আসার জন্য ফোন করেছিলেন কান্তিক স্যার। রঙিন কাচ লাগানো একটা কারে চেপে এলেন তিনি, পেছনের উঠানে থামল সেটা, সায়েব তাঁকে পথ দেখিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে এলো। আমরা তিনজন কমোডরের পড়ার ঘরে বৈঠকে বসলাম।
‘মিস্টার কাফি, এই দায়িত্ব থেকে আমি মুক্তি পেতে চাইছি,’ এভাবেই শুরু করলেন ডাক্তার কান্তিক।
‘গুড গড!’ আন্দেশা কাফি ভ্রু কোঁচকালেন। ‘কী ব্যাপার, স্যার?’
‘এখানকার পরিস্থিতির এত দ্রুত অবনতি ঘটছে, আমি তাল মেলাতে পারছি না,’ উত্তর দিলেন কান্তিক স্যার। ‘কাজেই পুলিশের কাছে আমি আর দায়বদ্ধ থাকতে রাজি নই। সেটা আমার হাত বেঁধে রাখছে। সেটা আমাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করছে, যাতে আমার বিবেচনা বোধ সায় দিচ্ছে না।’
‘কিন্তু মিস্টার কান্তিক, আপনার তো যেকোনো অ্যাকশন নেওয়ার পুরো স্বাধীনতা আছে,’ সিআইডি চিফ প্রতিবাদ করলেন।
‘না, তা আমার নেই। আপনি বসুন, মিস্টার কাফি, পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি আপনাকে একটা ধারণা দিই।’ যা যা ঘটেছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে শুরু করলেন বস, মাঝেমধ্যে আমি আমার নোট থেকে যখন যতটুকু প্রয়োজন পড়ে শোনালাম।
কান্তিক স্যার থামতে সিআইডি চিফ তাঁর প্রকাণ্ড মাথাটা এদিক-ওদিক নাড়লেন। ‘খুব খারাপ! খুব খারাপ!’ বললেন তিনি। ‘আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি, মিস্টার কান্তিক। তবে আমার কর্তব্য পরিষ্কার। সলিম কোবিদকে অবশ্যই আমি গ্রেপ্তার করব।’
‘জানতাম এ কথাই বলবেন আপনি,’ ক্ষীণ হাসির সঙ্গে বললেন আমার গুরু। ‘আর সে জন্যই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কেসটা আমি ছেড়ে দেব। কারণ, যতই মনে হোক সলিম কোবিদ তাঁর বাবাকে বিষ খাইয়ে খুন করেছেন, আমি এতে সন্তুষ্ট হতে পারছি না।’
কথাটা শুনে বুকের ভেতর আমার হৃৎপিণ্ড আনন্দে লাফিয়ে উঠল। অনুভব করলাম আমি আমার পুরনো বসকে আবার খুঁজে পেয়েছি। তিনি সঠিক পথে এগোচ্ছেন না, এ রকম সন্দেহ হওয়ায় নিজেকে তিরস্কার করলাম।
‘কিন্তু,’ প্রতিবাদ করলেন আন্দেশা কাফি, ‘কমোডর কোবিদ অ্যাকনাইটের একটা ডোজ খেয়ে মারা গেছেন; তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে ছেলে সলিম কোবিদ শেষ ব্যক্তি ছিলেন যিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন; সলিম নিজেই স্বীকার করেছেন বাবার সঙ্গে বসে বিয়ার খেয়েছেন এবং সলিমের কাছে অ্যাকনাইট ছিল। আরে, এটা তো স্ফটিকের মতো পরিষ্কার, শোনামাত্রই বোঝা যায় কেসটা কী!’
‘না, ঠিক তা বোঝা যায় না,’ জবাব দিলেন কান্তিক স্যার। ‘যা-ই হোক, কী বোঝা যায় না যায়, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি বরং বলতে পারি সলিমের বিরুদ্ধে আরো ক্ষতিকর এভিডেন্স আমি দিতে পারব। আমি জানি কোথায় আছে সেটা, তবে এখনো বের করে আনিনি। তাতে খুব একটা কিছু এসে যায় না। দুনিয়ার সমস্ত প্রমাণও আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না।’
‘আপনি অযৌক্তিক কথা বলছেন, স্যার,’ অভিযোগ করলেন আন্দেশা কাফি।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন কান্তিক স্যার, হাত দুটি খানিক উঁচু করলেন। ‘এই তো, এখানেই ঝামেলা! আপনার আর আমার মধ্যে এটাই আদি ও অকৃত্রিম পার্থক্য। আপনি কাজ করেন যুক্তির সাহায্যে, বন্ধু, আর আমি কাজ করি ইন্সটিংকটের সাহায্যে। জানি, সবাই আপনার পক্ষে- সবাই, শুধু আমার তরুণ সহকারী অতেব সরকার বাদে। উকিল, বিচারক, জনগণ আপনার মতোই শুধু প্রমাণ বা এভিডেন্স খুঁজবে। এভিডেন্সের ওপর এত বেশি আস্থা রাখা হয় যে সেটা হয়ে ওঠে দুনিয়ার সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য জিনিস।’
‘আপনি আপনার ইন্সটিংকট বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিয়ে আদালতে যেতে পারেন না,’ যুক্তি দেখালেন সিআইডি চিফ।
‘সে জন্য আপনি আদালতের গ্রহণক্ষমতার অভাবকে দায়ী করবেন,’ ঝাঁজের সঙ্গে বললেন আমার বস। ‘সে জন্যই অনেক বিচার একেকটা বিরাট প্রহসনে পরিণত হয়। আর দেখুন না, জিনিসটা আমাকে কেমন খাটিয়ে নেয়! আমার তিন ভাগের এক ভাগ সময় ব্যয় হয় এভিডেন্স খুঁজতে, তাতে যেটা প্রমাণ হবে তা যে কেউ একবার চোখ বুলিয়েই বলে দিতে পারে!’
এটা বুঝতে পারা কঠিন যে কথাগুলো আমার স্যার সত্যি সত্যি গুরুত্ব দিয়ে বলছেন কি না। এটা ওঁদের দুজনের মধ্যে অনেক পুরনো একটা বিতর্ক।
সিআইডি চিফ বললেন, ‘ঠিক আছে, আসুন সলিম কোবিদের প্রসঙ্গে ফিরি। কেন আপনার সন্দেহ হচ্ছে ক্রাইমটা তিনি নাও করে থাকতে পারেন?’
‘ওই ব্যক্তির পুরো চরিত্র এই রায় দেয় না, তাঁর অতীত জীবন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তার সঙ্গে মেলে না।’
‘আপনার এই যুক্তির সঙ্গে আমার যাওয়া চলে না,’ আন্দেশা কাফি বললেন। ‘আমার গোটা অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে হত্যার বীজ সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে গজায়।’
উত্তরে সম্ভবত কড়া কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কান্তিক স্যার, তবে শেষ মুহূর্তে সামলে নিলেন নিজেকে, সম্ভবত পুরনো বন্ধুর অনুভূতিতে আঘাত করা হবে এই ভয়ে। তারপর তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘মানলাম। সলিম যে নির্দোষ, এই সিদ্ধান্তে আমি পৌঁছেছি গত ২৪ ঘণ্টা তাঁকে পর্যবেক্ষণ করে যেটা বুঝেছি তার ওপর ভিত্তি করে। তিনি যা বলেছেন, বলার সময় তাঁকে কেমন দেখাচ্ছিল, তাঁর গলার স্বর ও সুর- এগুলোর ওপর ভিত্তি করে। এমন লোকজন আছে বৈকি যারা চেষ্টা করলে চেহারা আর স্বরে যেকোনো ছাপ ও ভাব আনতে পারে, কিন্তু সলিম তাদের দলে পড়েন না। তিনি নেহাতই সাধারণ একজন তরুণ, তাদের মতোই সামান্য ছিটগ্রস্ত, ঝোঁকের মাথায় চলেন, যিনি অতিমাত্রায় আদর-যত্ন ও প্রশ্রয় পেয়ে কিছুটা নষ্ট হয়েছেন, বিশেষ করে অপজিট সেক্সের দ্বারা, যিনি জীবনের কোনো জিনিসকে কখনো গুরুত্বের সঙ্গে নেননি।’
‘আমার তাঁকে দেখার সুযোগ হয়নি,’ শুকনো গলায় বললেন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান।
‘আপনি যা ভাবছেন তার কিছুটা সত্যি,’ বললেন স্যার। ‘আমি এই তরুণকে পছন্দ করি। তবে সেটা বাদ দিয়ে তাঁর অ্যাকশনগুলো বিবেচনা করুন। বিষ প্রয়োগে হত্যা কিন্তু রাগের মাথায় হয় না; তার জন্য প্ল্যানিংয়ের দরকার আছে। সে রকম কোনো প্ল্যান যদি তাঁর থাকত, চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য কি তিনি ট্রেনে উঠতেন বাড়িতে ড্রাগ স্যাম্পল ভরা অত বড় একটা প্রমাণ বোকার মতো নিজের ঘরে রেখে?’
‘ওরা সব সময় কিছু না কিছু ভুল করে।’
‘তা অবশ্যই করে! কিন্তু এত বড় ভুল করে না।’
‘আপনার ইন্সটিংকট কি জানাচ্ছে, খুনটা কে করেছে?’ আন্দেশা কাফির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো।
‘আমার কিছু অবজারভেশন তো অবশ্যই আছে,’ কান্তিক স্যার জবাব দিলেন। ‘কিন্তু প্রয়োজনীয় এভিডেন্স না পাওয়া পর্যন্ত সেগুলো আমি প্রকাশ করতে চাই না।’
‘তাতে আপনার কী রকম সময় লাগবে?’
‘তা কিভাবে বলব!’ হাত দুটো দুদিকে মেলে দিলেন আমার বস। ‘ওগুলো হয়তো চিরকালই আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। এমন অনেক কিছু আছে আপনার মুখে বসানো নাকের মতো পরিষ্কার, কিন্তু তা প্রমাণ করা যায় না।’
‘সলিম কোবিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত কী যেন এভিডেন্সের কথা তখন আপনি বললেন?’ প্রশ্ন করলেন আন্দেশা কাফি। ‘এই প্রশ্নের উত্তর চাওয়ার অধিকার নিশ্চয় আমার আছে।’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই!’ অসহায় একটা ভঙ্গি করে পেছন ফিরে দাঁড়ালেন কান্তিক স্যার। ‘ব্যাপারটা সত্যি খুব বেদনাদায়ক! তবে, সব কিছু প্রকাশ পেতে হবে, কোনো ব্যতিক্রম থাকা চলবে না।’ ঘুরে আবার আমাদের মুখোমুখি হলেন। ‘আপনি আমাকে কথা দিতে পারেন যে এই তথ্য অন্তত এক সপ্তাহ সলিম কোবিদের কানে যাবে না?’
‘কিন্তু কেন?’ ব্যাখ্যা চাইছেন আন্দেশা কাফি।
‘স্রেফ এই কারণে যে তাঁর বুকটা একদম ভেঙে যাবে।’
‘ঠিক আছে, বেশ,’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন সিআইডি চিফ, নিশ্চয়ই ভাবছেন তরুণ সলিমকে নিয়ে রীতিমতো পাগলামি শুরু করেছি আমরা।
‘আসুন খবর নিয়ে দেখা যাক ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার বাড়িতে আছেন কি না,’ কান্তিক স্যার বললেন। ‘তিনি খুব ঘন ঘন মিসেস জারিনার কাছে আসছেন বলে শুনেছি।’
নামটা শোনামাত্র আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। একেবারে শুরু থেকে আমার সন্দেহ হচ্ছে এ বাড়ির পারিবারিক ডাক্তার অবশ্যই আসল রহস্য জানবেন। সায়েবকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর খোঁজ নিতে বলা হলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো সে, তার পেছনে সুদর্শন, পরিশীলিত ও মার্জিত ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার।
ডাক্তার কান্তিক সিআইডি চিফের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি দেখলাম, আমরা সবাই দেখলাম ডাক্তার সরওয়ার ঘামতে শুরু করেছেন। ভদ্রলোককে এত ভালো মানুষ মনে হয়, তাঁর এই অবস্থা দেখতে খারাপ লাগছে। আমার বস অযথা সময় নষ্ট না করে সরাসরি কাজের কথা পাড়লেন।
‘ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার, কাল আমাদের খুব কঠিন একটা ইন্টারভিউ গেছে, আজ আবার তার চেয়েও কঠিন আরেকটা শুরু হতে যাচ্ছে। আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার ছিল যে আপনি, মাফ করবেন, মিথ্যে কথা বলছেন। হতে পারে এর পেছনে উদ্দেশ্যটা ছিল মহৎ, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওটা মিথ্যেই ছিল!’
ডাক্তার সরওয়ারের মুখ রাগে রীতিমতো ফুলে উঠল। ‘ডাক্তার কান্তিক,’ কঠিন সুরে বললেন তিনি, ‘আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন! আপনার এত সাহস হলো কী করে যে আমাকে আপনি মিথ্যেবাদী বলেন…’
‘এত রেগে যাচ্ছেন কেন?’ হাসিমুখে বললেন কান্তিক স্যার। ‘আমি ভুল প্রমাণিত হলে আমার মুখের ওপর আপনি হাসার সুযোগ পাবেন।’
ডাক্তার সরওয়ার কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন।
‘আমি এবং সিআইডি চিফ যেটা জানতে চাইছি,’ কান্তিক স্যার বললেন, ‘ওই ডেথ সার্টিফিকেটে আপনি সই করলেন কেন, যেখানে জানেন কমোডরকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে?’
‘আমি জানতাম না!’ গলায় জোর এনে বললেন নিমেষ সরওয়ার। ‘আপনাকে আমি আগেই বলেছি…’
‘শুনুন, ডাক্তার,’ নরম সুরে তাঁকে থামিয়ে দিলেন কান্তিক স্যার, ‘আপনার যে দক্ষতা, আপনার যে বিশাল অভিজ্ঞতা, আপনি আশা করতে পারেন না এ রকম একটা কথা কেউ বিশ্বাস করবে।’
‘কেউ বিশ্বাস করল কি করল না তাতে আমার বয়েই গেল!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন নিমেষ সরওয়ার। ‘কথাটা সত্যি!’
‘স্বভাবে আপনি একজন সত্যবাদী,’ গলার সুর আরো নরম করলেন বস। ‘আর মিথ্যে কথা বিশ্বাস করাতে হলে আগে প্রচুর প্র্যাকটিস করতে হয়।’ বড়সড় ড্রেসিং টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। ‘ওই আয়নায় নিজেকে দেখুন, ওই মুখ যদি অন্য কারো ওপর দেখতে পান, আপনি তখন বলবেন না ওটার পেছনের মানুষটা মিথ্যে কথা বলছে?’
তিনি তাকাবেন না, জানা কথা, তবে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করার সময় একপাশে সরে দাঁড়ালেন। আমরা কেউ তাঁকে বসতে বলিনি, এটা সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট, অপমানকর হয় যদি তো হলো!
‘মুহূর্তের জন্য বিবেচনা করুন,’ আমার স্যার বলে চলেছেন, ‘আমি আপনার বন্ধু, কারণ আমি বিশ্বাস করি মহৎ কোনো উদ্দেশ্য আপনাকে উৎসাহিত করেছে। আপনার কি উচিত হবে না খোলা আদালতে বদ ও একঘেয়ে একজন উকিলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করার চেয়ে আমার সঙ্গে গোপন কথাটা শেয়ার করা? এটা থেকে আপনার তো পালানোর উপায় নেই। সেই চেষ্টা যদি করেন, কিছুই আর নিজের বলে ধরে রাখতে পারবেন না : না মানসম্মান, না ধন-সম্পত্তি।’
ধপ করে একটা চেয়ারে বসে হাত দুটো উঁচু করলেন ডাক্তার নিমেষ সরওয়ার। ‘আচ্ছা, বেশ,’ বললেন তিনি। ‘আমি মিথ্যে কথা বলেছি।… ও আল্লাহ, কী স্বস্তি!’ রুমাল বের করে মুখ আর কপালের ঘাম মুছলেন।
‘কেন আপনি মিথ্যে কথা বললেন?’ কান্তিক স্যারের প্রশ্ন।
‘কমোডর আমাকে বলতে বলেছেন, তাই। তিনি আমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধু।’
‘বলতে বলেছেন!’ আন্দেশা কাফি হতভম্ব।
‘কমোডরকে দেখামাত্র আমি বুঝতে পারি তাঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে,’ বললেন ডাক্তার সরওয়ার। ত্বকে অসহ্য খোঁচা মারার অনুভূতি হচ্ছে, তাঁর এই অভিযোগ শুনে সন্দেহ করলাম বিষটা অ্যাকনাইট হতে পারে। অন্য কোনো বিষের এ রকম লক্ষণ নেই। সায়েবকে আমি দৌড়ে আমার চেম্বার থেকে অ্যাট্রপিন আনতে বলি ঠিকই, কিন্তু তার আগেই আমি জেনে গেছি ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, অ্যাট্রপিন বা আর কিছুতে কোনো কাজ হবে না। আমার উদ্দেশ্য ছিল কামরা থেকে তাকে বের করা, কারণ বুঝতে পারছিলাম আমার বন্ধু একা আমাকে কিছু বলতে চাইছেন। তিনি আমার হাত দুটো ধরলেন; তখনো তাঁর পুরোপুরি জ্ঞান রয়েছে, তবে কী বলছেন শোনার জন্য কানটা তাঁর ঠোঁটের কাছে নামাতে হলো। তিনি বললেন : ‘নিমেষ, আমাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে!’ আমি মাথা ঝাঁকালাম। তিনি আমার দিকে করুণ আবেদন ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এটা আপনি গোপন রাখবেন, নিমেষ। দুনিয়ার কেউ জানবে না। হে আল্লাহ, আমাকে যেন আতঙ্ক আর সম্মানহানির ভয় নিয়ে মরতে না হয়!’ কাজেই আমি তাঁকে কথা দিলাম, ব্যাপারটা গোপন থাকবে। তাঁর নিভে আসা চোখে আমি স্বস্তি দেখতে পেলাম। আমার কি অন্য কিছু করার ছিল?
‘না, অবশ্যই ছিল না,’ বললেন কান্তিক স্যার। ‘কিন্তু এটুকুই কি সব?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি একজন আলোকিত মানুষ,’ বললেন বস। ‘আপনি সেই দলে পড়েন যাঁরা সর্বক্ষেত্রে চিন্তার স্বাধীনতা এবং ন্যায়ের অনুকূলে পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার নিজেরা সংরক্ষণ করেন।’
‘তা বলতে পারেন।’
‘তাহলে, আপনার এই আইডিয়ার সঙ্গে এটা কি সংগতিপূর্ণ নয় যে জনগণের স্বার্থ দাবি করলে মরতে বসা বন্ধুকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আপনি ভাঙবেন?’
ডাক্তার সরওয়ার বুঝতে পারলেন এটা একটা ফাঁদ, তাই উত্তর দিতে রাজি হলেন না।
‘লক্ষ করুন,’ স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সুরে বললেন কান্তিক স্যার, ‘এখনো আমি জানি না কেন আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছেন।’
ডাক্তার সরওয়ার নীরব।
‘কমোডর কোবিদও একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, বিশ্বাস করতেন যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে, নিশ্চয়ই তিনি জানতেন যে আপনাকে আপনার পেশাদারি সুখ্যাতির সঙ্গে বেইমানি করতে বলা হচ্ছে, বেইমানি করতে বলা হচ্ছে দেশ ও দশের সঙ্গে। তাঁকে আপনার এ ব্যাপারে সচেতন বলে মনে হয়নি?’
‘না,’ জবাব দিলেন ডাক্তার সরওয়ার।
‘এ রকম একটা অদ্ভুত অনুরোধ করার কী কারণ, সেটা তিনি আপনাকে জানাননি?’
‘না!’
‘তিনি কি আপনাকে,’ খুবই নরম সুরে জিজ্ঞেস করছেন ডাক্তার কান্তিক, ‘তিনি কি আপনাকে বলেননি কে তাঁকে বিষ খাইয়েছে?’
ডাক্তার সরওয়ারের সুদর্শন চেহারায় আবার যন্ত্রণার অস্পষ্ট ছাপ ফুটল, কিন্তু তিনি আগের মতোই বললেন, ‘না!’
কান্তিক স্যার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘আমি যদি আপনাকে জানাই যে সলিম কোবিদকে কাল রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাহলে হয়তো পরিস্থিতিটা বুঝতে আপনাকে আমার সাহায্য করা হবে। তাঁর বিরুদ্ধে আমরা অত্যন্ত কঠিন একটা কেস দাঁড় করিয়েছি।’
চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলেন ডাক্তার সরওয়ার, কিন্তু তার পরই আবার ধপ করে বসে পড়লেন। মনে হলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে তাঁর চোখ। সেটা নিশ্চয় আতঙ্কেই হবে। তারপর তিনি দুই হাতে নিজের মুখ ঢাকলেন। ‘সলিমকে গ্রেপ্তার করেছেন!’ গুঙিয়ে উঠলেন। ‘তাহলে সব শেষ হয়ে গেছে!’
‘বুঝতেই পারছেন মিথ্যে কথা বলার আর কোনো প্রয়োজন নেই,’ সুর নরম করে বললেন কান্তিক স্যার।
‘না!’ হতাশ গলায় ফিসফিস করছেন ডাক্তার সরওয়ার। ‘না! আল্লাহ সহায় হোন!’
‘মারা যাওয়ার আগে কমোডর তাঁর শেষ কথাটা কী বললেন আপনাকে?’ প্রশ্ন করতে কান্তিক স্যারের কোনো ক্লান্তি নেই।
‘তিনি বললেন,’ খসখসে উত্তর পাওয়া গেল, ‘তিনি বললেন… সলিম আমাকে বিষ খাইয়েছে।’
এখন আর নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না। বাকি সবাই একটা মাত্রা পর্যন্ত ধরে রাখছেন, ধারণা করলাম। আমার স্যার যেমনটি বলেছেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
মাথায় যেন বাজ পড়েছে, এ রকম একটা চেহারা নিয়ে ডাক্তার সরওয়ার চলে যাওয়ার পর আমার বসের দিকে ফিরলেন সিআইডি চিফ, বললেন, ‘আর আপনি এটা প্রথম থেকেই জানতেন? জানতেন কী শুনতে হবে?’
‘হ্যাঁ, আমি জানতাম,’ মৃদুকণ্ঠে বললেন স্যার, ‘এক অর্থে।’
‘কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? কিভাবে আপনি জানবেন?’
‘ইন্সটিংকট, মিস্টার কাফি। কাল যখন আমি ডাক্তার সরওয়ারকে জেরা করছিলাম তখন তাঁর মনে যে দ্বন্দ্ব আর যন্ত্রণার স্রোত বইছিল তার খবর পাওয়ার অন্য কোনো উপায় ছিল না- ওই ইন্সটিংকটের সাহায্য নেওয়া ছাড়া।’
‘এখনো কি আপনি বলবেন যে এই তরুণ অপরাধী নয়? এ রকম অকাট্য প্রমাণের পরও আপনি সন্তুষ্ট নন?’ উত্তর চাইলেন সিআইডি চিফ।
‘আমি সন্তুষ্ট নই,’ জেদের সুরে বললেন কান্তিক স্যার। ‘সর্বশেষ যেটা উন্মোচিত হলো সেটাকে আমরা স্রেফ ভাবাবেগজনিত প্রতিক্রিয়া বলতে পারি, কোনো প্রমাণ নয়। একজন বাবার মৃত্যুর বিভীষিকা আপনাকে কাবু করে ফেলেছে, আপনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে তাঁর ছেলেই তাঁকে বিষ খাইয়েছে। ধরুন, তাঁর যদি ভুল হয়ে থাকে?’
‘অসম্ভব!’
‘ধরুন, ওই সময়ে এক এক করে কয়েক রকম জিনিস মুখে দিয়েছেন কমোডর, আপনি জানছেন কিভাবে কোনটার মধ্যে বিষ মেশানো ছিল?’
‘স্মৃতিতে থাকা স্বাদের সাহায্যে, পরে।’
‘সেটায় কারিগরি ফলানো হয়ে থাকতে পারে। ধরুন বিষটা খাওয়ানো হয়েছে চকোলেট দুধের সঙ্গে, কিন্তু গন্ধ আর স্বাদটা ছিল চায়ের।’
‘ইউ আর সিম্পলি হোপিং এগেনেস্ট হোপ,’ আন্দেশা কাফি বললেন। ‘আমার কর্তব্য পরিষ্কার। সলিম কোবিদকে অবশ্যই আমি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাব।’
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত দুটি দুদিকে প্রসারিত করলেন ডাক্তার কান্তিক।
বারো
তবে সলিম কোবিদকে ঠিক তখনই নিয়ে যাওয়া হলো না।
কান্তিক স্যার বললেন, ‘মিস্টার কাফি, স্যার, এই কেসে আমরা পরস্পরের প্রতিপক্ষ হওয়ার আগে…’
চেহারায় উৎকণ্ঠা, তাঁকে বাধা দিলেন সিআইডি চিফ, ‘প্রতিপক্ষ?’
‘কেন, আমি যতটুকু বুঝি এখন থেকে আপনি থাকবেন প্রসিকিউশনে, আর আমি থাকব ডিফেন্সে। তবে আসুন, তার আগে আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যাক প্রকৃত সত্য আমরা আবিষ্কার করতে পারি কি না।’
‘ঠিক কী করতে চাইছেন?’
‘আপনি তো জানেন, পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে ফ্রান্স আর ইতালিতে, কিভাবে বাদী আর বিবাদীকে মুখোমুখি বসিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে দেওয়া হয়- উদ্দেশ্য হলো, তাদের এই তুমুল ঝগড়া থেকে আসল সত্যটা বেরিয়ে আসবে। এটা নিখুঁত কোনো পদ্ধতি নয়, তবে এর কিছু ভালো দিক আছে। আমি প্রস্তাব করছি, সলিম কোবিদ আর তাঁর বিরুদ্ধে যিনি অভিযোগ এনেছেন, এই দুজনকে মুখোমুখি করা হোক।’
‘কিন্তু অভিযোগ তো করেছেন ওঁর বাবা,’ বললেন আন্দেশা কাফি, ‘তিনি মারা গেছেন।’
‘অভিযোগ আরেকজন করেছেন,’ কান্তিক স্যার বললেন। ‘আপনি অটল হায়দারকে ফোন করে এখানে আসতে বলুন, আমি হাজির করছি তাঁকে।’
আন্দেশা কাফি ফোন করছেন।
কান্তিক স্যার অফিস কামরার দরজার দিকে এগোলেন, সেটা তিনি খুলতেই আমরা সবাই কম্পিউটারে কম্পোজ করার আওয়াজ শুনতে পেলাম। স্যার বললেন, ‘ললিতান, প্লিজ, আপনি একটু এখানে আসবেন?’
চেহারায় বিনীত বিস্ময় নিয়ে কমোডরের পড়ার ঘরে ঢুকলেন ললিতান। তাঁকে দেখে আন্দেশা কাফির চোখ আরো একটু খুলে গেল, লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয় এমন কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটল তাঁর চেহারায়, যে পরিবর্তন একজন পুরুষের মধ্যে সব সময় দেখা যায় যখনই কোনো সুন্দরী অপরূপার আগমন ঘটে।
আমার হার্টবিট আবার বেড়ে গেল, ভয় পাচ্ছি ফের না কোনো বেদনাদায়ক দৃশ্য দেখতে হয়। ইচ্ছে হলো ওখান থেকে পালাই, কারণ মন বলছে এখন যা ঘটবে তা সহ্য করার মতো নাও হতে পারে।
এক মুহূর্ত পর সলিম কোবিদকে হাজির করা হলো। অটল চলে গেলেন নিজের জায়গায়, আবার না ডাকা পর্যন্ত ওখানেই থাকবেন। সিআইডি চিফ সাদা পোশাকে রয়েছেন, তার পরও সলিম সম্ভবত ধরতে পারলেন কামরায় উপস্থিত অচেনা ভদ্রলোক একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর চোখে মরিয়া একটা ভাব চলে আসাটা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। তারপর যখন ললিতানকে দেখলেন, তখনো তাঁর মুখের রং বদলে গেল, ফাঁদে পড়া বুনো পশুর মতো অস্থির হয়ে উঠলেন। সিআইডি চিফের দৃষ্টিতে এর সবই সন্দেহজনক বলে মনে হলো। তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না, সলিমকে দেখে যেকোনো লোক ভাববে তিনি অপরাধী।
তবে আরো কিছু বিষয় ভুলে গেলে চলবে না। বাবা খুন হওয়ার শোক তাঁর বুকটাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর আছে নিজেকে নিয়ে আতঙ্ক। কিভাবে আমরা আশা করি তাঁকে অন্য রকম দেখাবে? তাঁর জায়গায় আমি হলে, ঠিক এই আচরণই করতাম।
যত দূর বলতে পারি, ললিতান নেসা ভুলেও তাঁর দিকে একবার তাকাননি।
‘বসুন,’ ললিতানকে বললেন কান্তিক স্যার। আমার গুরু তাঁর অমায়িক চেহারায় এত সুন্দর একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন, সেখানে দুনিয়ার সব কিছু লুকিয়ে রাখা সম্ভব।
সলিমকে চেয়ারে বসার আহ্বান জানানো হয়নি, তবে তিনি নিজে থেকেই একটা টেনে নিয়ে বসলেন, এখনো নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে নিজেকে অভ্যস্ত করিয়ে নিতে পারেননি। হায়, একেই বলে নিঠুর নিয়তি, নিজেদের বাড়িতে তাঁকে বসতে বলার কেউ নেই।
কমোডরের পড়ার ঘরে সব মিলিয়ে আমরা পাঁচজন। কামরার একধারে ফেলা টেবিলের চারপাশে বসেছি। দুই দিন আগে এই টেবিলেই চা পরিবেশন করা হয়েছিল- ওটা ছিল কমোডরের শেষ চা পান। সিআইডি চিফ সরাসরি টেবিলের সামনে বসেছেন, আমি তাঁর একটু পেছনে। বস আমাকে নোট বই বের করতে নিষেধ করেছেন, কাজেই হাত দুটিকে ঊরুর ওপর ফেলে রেখে আমি শুধু দেখে যাচ্ছি কী ঘটছে। সলিম বসেছেন জানালার দিকে পিঠ দিয়ে, তাঁর পাশে আমার বস, বসের আরেক পাশে ললিতান। তবে কান্তিক স্যার এক জায়গায় স্থির থাকছেন না, খানিক পর পর চেয়ার ছেড়ে পায়চারি করছেন, আবার ফিরে আসছেন টেবিলে।
তারপর তিনি ললিতানকে সরাসরি বললেন, ‘আপনাকে আমি এখানে আসতে বলেছি, তার কারণ আমি জানি এই কেসটা নিয়ে খুব আগ্রহ আপনার। আমাদের তদন্ত আপাতত শেষ হয়েছে। এটা বলা আমার উচিত হবে না যে সলিম কোবিদ গিল্টি, তবে তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কেস সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যারেস্ট করা হবে।’
তাড়া খাওয়া পশুর মতো চেহারা নিয়ে কথাগুলো শুনলেন সলিম। সন্দেহ নেই, আমার বস নির্দয় একটা ভূমিকা পালন করছেন, তবে এটা তাঁর প্ল্যানের একটা অংশ।
‘আপনি আমাদের যে সাহায্য করেছেন, মিস ললিতান, সে জন্য আমরা আপনার প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমি এবং সিআইডি চিফ আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই,’ বললেন কান্তিক স্যার।
ললিতান তাকিয়ে থাকলেন। ‘আপনার কথা আমি ঠিক বুঝলাম না, স্যার।’
‘আমি আপনার লেখা ওই চিঠি দুটোর কথা বলছি,’ বস বললেন। ‘একটা লিখেছেন সিআইডি চিফকে। একটা আমাকে। প্রথম চিঠি এই তদন্তের জন্ম দেয়, দ্বিতীয় চিঠি সেটাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।’
আমার জন্য এটা একটা চমকপ্রদ খবর। আন্দেশা কাফির জন্যও তাই। তবে দুজনেই এমন ভান করছি, এটা যেন শুরু থেকেই জানতাম আমরা।
‘হ্যাঁ, আপনার নেপথ্যে থাকতে চাওয়ার কারণটা আমরা বুঝি,’ বন্ধুসুলভ হাসির সঙ্গে আবার বললেন আমার স্যার। ‘এটা আপনার একটা প্রশংসনীয় কাজ হয়েছে। তবে কথা হলো, আপনাকে আমাদের একজন সাক্ষী হিসেবে দরকার হবে।’
বিহ্বল চেহারা নিয়ে মাথা নাড়লেন ললিতান। ‘আপনি যে চিঠিগুলোর কথা বলছেন, কী কারণে ধরে নিচ্ছেন ওগুলো আমি লিখেছি?’ জানতে চাইলেন তিনি।
একটা রাইটিং ডেস্কের দিকে এগোলেন কান্তিক স্যার। দেরাজের তালা খুলছেন। গতকাল আমি তাঁকে ওই দেরাজে তালা লাগাতে দেখেছিলাম। তখন কাগজের যে পাতাটা ওখানে রেখেছিলেন, এখন বের করতে দেখছি। ওটার সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকানো একটা চিরকুট দেখতে পাচ্ছি, ক্লিপ খুলে আলাদা করলেন। ‘এটা একটা স্কেচ, কমোডর কোবিদের যে বই ছাপা হবে, এই স্কেচ থাকবে সেটার টাইটেল পেজে,’ স্যার বললেন। ‘এই বিশেষ নকশার হরফ দেখামাত্র আমি চিনে ফেলি- যে হাত এই হরফ এঁকেছে সেই একই হাত এঁকেছে চিঠি দুটোর হরফও। আমি দেখতে পাচ্ছি হরফ আঁকার একটা শখ আছে আপনার। কাজটায় সত্যি আমি খুব যত্ন লক্ষ করেছি।’
ললিতান এক চুল নড়লেন না। কাগজটার দিকে চোখ রেখে হাসিমুখে বললেন, ‘বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই সত্য বেরিয়ে আসায় আমি দুঃখিত, স্যার। কিন্তু আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, ওই নকশাদার হরফ এঁকেছেন কমোডর কোবিদ স্যার, মানে তসলিম কোবিদ স্যার, আমি না।’
‘উঁহু, তা হতেই পারে না,’ বললেন আমার বস, এখনো বিনয়ের অবতার। ‘হতে যে পারে না, তার প্রমাণ এই ছোট্ট চিরকুটটা। ওটা আমি পড়ছি। আমার তৈরি একটা স্কেচ আপনার বিবেচনার জন্য রাখলাম। আশা করি আপনার পছন্দ হবে। তারপর আপনার সংক্ষিপ্ত সই রয়েছে- এল.এন.।’
‘ও, আচ্ছা, আমি তাহলে ভুল করেছি,’ একদম ঠাণ্ডা সুরে বললেন তরুণী, যেন ভুল করাটা স্বাভাবিক। ‘বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য স্কেচ তৈরি করা হয়েছিল, কিছু তার আমার আঁকা, কিছু কমোডরের…যা-ই হোক, আমি কাউকে নাম-পরিচয় না দিয়ে কোনো চিঠি কখনো লিখিনি।’
‘না, এটা ঠিক নয়, বেশি ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে এভাবে আপনি নিজেকে নেপথ্যে লুকিয়ে রাখতে পারেন না।’ কান্তিক স্যার হাসছেন। ‘লুকোচুরি খেলার যে জাল আমরা পেতেছি তাতে আপনারও অংশগ্রহণ থাকতে হবে। এখানে বলে রাখি, আপনার গত ৩৬ ঘণ্টার গতিবিধি সম্পর্কে আমরা সব জানি। আপনি বনশ্রী এলাকার এক্স ব্লক, ১০ নম্বর রোড, ২১ নম্বর দালান, ২১ তলা একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। আপনার সঙ্গে চাকরিজীবী এক তরুণীও থাকেন, তবে ছুটি পাওয়ায় দিন কয়েক হলো গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন তিনি। যা-ই হোক, বাড়ির প্রৌঢ় দারোয়ানের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আপনি ফ্ল্যাটবাড়ির নিচে নামেন, তারপর রাস্তার মোড় থেকে সেদিনকার সান্ধ্য দৈনিক গোধূলি কেনেন, ওই পত্রিকাই সবচেয়ে আগে কমোডরের মৃত্যুসংবাদ ছেপেছে। ঘটনাটা দারোয়ানের মনে আছে, কারণ তাঁর মাথায় প্রশ্ন জেগেছিল কাজটা আপনি তাঁকে দিয়ে কেন করাননি। কী ঘটেছে, আমি আন্দাজ করতে পারি। কমোডরের মৃত্যুসংবাদ প্রথমে আপনি পান টিভির খবর শোনার সময়। আরো বিস্তারিত জানার জন্য সান্ধ্য দৈনিক কিনতে বেরোন। কাগজ পড়ে যখন নিশ্চিত হলেন যে কমোডরের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলা হচ্ছে, আপনি ভয় পেলেন যে সুবিচার পরাজিত হতে যাচ্ছে, বিচারের বাণী আরো একবার নীরবে-নিভৃতে কাঁদবে। ব্যাপারটা আপনি মেনে নিতে পারলেন না। তখনই বসে প্রথম চিঠিটা লিখে ফেললেন। ১০ কি সোয়া ১০টার দিকে ওই চিঠি নিয়ে আবার বাড়ি থেকে বেরোলেন, এবারও দারোয়ানের মাথায় প্রশ্ন জাগল আপনি তাঁকে দিয়ে কেন চিঠিটা পাঠাননি। তবে তা না পাঠানোর অবশ্যই ভালো একটা কারণ ছিল আপনার। ওটা আপনি একটা কুরিয়ার সার্ভিসের যাত্রাবাড়ী শাখার মাধ্যমে এই ঠিকানায় পাঠিয়েছেন : প্রযত্নে : সিআইডি চিফ/ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট, শান্তিনগর, ঢাকা। সংশ্লিষ্ট কুরিয়ার সার্ভিস থেকে আমরা জেনেছি মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে ওটা আপনি ওখানে জমা দেন।’
মুখে দুর্ভেদ্য এক টুকরো হাসি ধরে রেখে কথাগুলো শুনলেন ললিতান। পুরো ব্যাপারটা সলিমের কাছে রহস্যময় লাগছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চেয়ারে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে আছেন, চোখে-মুখে উদ্বেগ নিয়ে শুনছেন সব।
‘দ্বিতীয় চিঠিটা পেয়ে আমরা আপনার আরো কাছাকাছি পৌঁছে যাই,’ গোয়েন্দা শিরোমণি ডাক্তার কান্তিক বলে চলেছেন। ‘আপনার মনে পড়বে- আমি আর আপনি কাল দুপুর আড়াইটার দিকে পাশের ঘরে বসে কথা বলছিলাম, এই সময় আচমকা প্রিন্সেস প্রমত্তা গঙ্গোত্রীর নামটা এই কেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো এবং আমিও তাঁর খোঁজে উদভ্রান্তের মতো ছুটলাম। আবার আপনি চিন্তা করলেন আসল খুনি সম্ভবত পালিয়ে যাবে, তাই দ্বিতীয় চিঠিটা লিখতে হলো আপনাকে। আপনি এই বাড়ি ছেড়ে ৩টার দিকে বেরোন, রোজ যেমন বেরোন তার চেয়ে এক-দেড় ঘণ্টা আগে। সাদা পোশাক পরা একজন ডিটেকটিভ আপনার পিছু নেন। ওই একই কুরিয়ার সার্ভিসের মতিঝিল শাখায় জমা দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় চিঠি, বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার সময়। আপনি নিজের হাতে জমা দেননি, ওই এলাকার এক কিশোরকে দিয়ে কাজটা করিয়েছেন। কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে কাজ করে সে।’
‘বেশ, আমি হার মানলাম,’ শান্ত একটা ভঙ্গি নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন ললিতান। ‘এ রকম একটা ভয়ংকর কেসের সঙ্গে আমি মোটেও জড়াতে চাইনি, কিন্তু এখন দেখছি এটাকে এড়ানোর কোনো উপায় নেই।’
‘চিফ এবং আমি মাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর চাই আপনার কাছে,’ বললেন কান্তিক স্যার। ‘আপনি জানলেন কিভাবে কমোডর কোবিদকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে?’
‘আমি জানতাম না,’ বললেন ললিতান। ‘শুধু সন্দেহ করেছিলাম।’
“প্রথম চিঠিতে আপনি লিখেছেন : ‘কমোডর তসলিমকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে।’ ভাষা বলছে তখন আপনি এটাকে একটা ফ্যাক্ট হিসেবে দেখেছেন।”
‘জানি,’ বললেন ললিতান। ‘আমি ভেবেছিলাম একটা তদন্ত হওয়া দরকার। ভেবেছিলাম এভাবে লিখলে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক আছে। কী দেখে আপনার সন্দেহ হলো বিষ খাওয়ানো হয়েছে?’
ললিতান ইতস্তত করছেন। প্রজাপতির ডানার মতো চোখের পাতা বার কয়েক ঝাপটালেন, তারই ফাঁকে ঝট করে একবার দেখে নিলেন সলিমকে। ‘আমি যখন এসব কথা বলছি তখন কি এখানে তাঁর উপস্থিত থাকা উচিত হচ্ছে?’ জানতে চাইলেন তিনি।
যেন খুব চিন্তিত, এ রকম একটা ভঙ্গি নিয়ে সিআইডি চিফের দিকে তাকালেন কান্তিক স্যার। ললিতানের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের মধ্যে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় করলেন তাঁরা। ‘আপনি কী বলেন, চিফ?’ জানতে চাইলেন বস। ‘এসব কথা কি মিস্টার সলিমের শোনা উচিত হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে,’ রায় দেওয়ার সুরে বললেন আন্দেশা কাফি। ‘আসামির এটা অধিকার, তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে শোনা।’
সেই অধিকার তো থাকতেই হবে, তবে এভাবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। যা-ই হোক, ললিতান নেসারও এত সব জানা থাকার কথা নয়। বাধ্য হয়ে তিক্ত কর্তব্য পালন করতে হচ্ছে, এ রকম একটা ভাব নিয়ে তিনি উত্তর দিলেন, ‘মিস্টার সলিম বিষ সম্পর্কে যা কিছু জানার তার সবই জানেন। বিপজ্জনক বিষের একটা কালেকশন আছে তাঁর কাছে। অতীতে তাঁকে আমি মানুষকে বিষ খাওয়ানোর কথা বলতে শুনেছি…’
‘ও রে আল্লাহ, না!’ বিস্মিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন সলিম।
সুন্দরী অপরূপা চোখ ঘুরিয়ে কান্তিক স্যারের দিকে তাকালেন। ‘আমি জানতাম এটা কষ্টকর হবে,’ বিড়বিড় করলেন তিনি।
‘আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন,’ মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন সলিম। ‘এ কথা ঠিক যে ওঁর সঙ্গে আমি বিষ নিয়ে আলাপ করেছি। ওঁকে আমি বলেছি কী কী বিষ খেলে মানুষ মারা যায়- অ্যাকনাইট, স্ট্রিকনিন, হেমলক, আর্সেনিক ইত্যাদি; কিন্তু কাউকে বিষ খাওয়ানোর কথা কখনোই আমি বলিনি!’
‘সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়,’ নরম সুরে বললেন আমার স্যার। ‘আপনি বিষ সম্পর্কে কথা বলাতে তাঁর মনে সন্দেহ জেগেছে, এটা আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়।’ ললিতানের দিকে তাকালেন তিনি। ‘আপনি জানলেন কিভাবে মঙ্গলবার বিকেলে সলিম বাড়িতে ছিলেন?’
‘তাঁকে আমি দেখেছি,’ শান্ত উত্তর। ললিতান আরো বললেন, ‘এসব থেকে দূরে থাকার ব্যাকুলতায়, গতকাল আমি সত্যের অংশবিশেষ গোপন করে গেছি। কাল যেমনটি আপনাকে বলেছি, প্রিন্সেস প্রমত্তাকে কমোডরের পড়ার ঘরের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমি নিচে নেমে যাই, তা আসলে সত্যি নয়। আমার কিছু কাজ অসমাপ্ত ছিল, তাই ওখান থেকে অফিস কামরায় ঢুকেছিলাম। কয়েক মিনিট পর একটা পুরুষ কণ্ঠের গর্জন শুনতে পেলাম, এই কামরায় হচ্ছিল। আমার খুব অবাক লাগল, কারণ তখনো আমি প্রিন্সেস প্রমত্তার চলে যাওয়ার শব্দ পাইনি এবং জানতাম কমোডর স্যারের আর কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। আসলে আমি শুধু অবাক হইনি, আমার মধ্যে একটা সতর্কতা চলে আসে। সম্ভাব্য যেকোনো বিপদ থেকে কমোডর স্যারকে রক্ষা করাটাকে আমরা সবাই আমাদের কর্তব্যের একটা অংশ বলে মনে করি। কামরা দুটির মাঝখানের দরজায় পৌঁছে যাই আমি, কবাট সামান্য একটু ফাঁক করি। দেখতে পাই এই কামরায় বসে রয়েছেন সলিম স্যার।’
‘তিনি কি তাঁর বাবার সঙ্গে একা ছিলেন?’
হঠাৎ ক্লান্ত দেখাল ললিতানকে। ‘না,’ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বললেন তিনি। ‘তার সঙ্গে শিলা শরণিও ছিল- ওটাই যদি তার নাম হয়।’
‘অ্যা!’ আঁতকে উঠলেন কাফি স্যার।
‘আপনাকে আমি কী বলেছিলাম?’ কান্তিক স্যার বললেন।
‘আপনি স্রেফ আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু এটা তো সরাসরি এভিডেন্স।’
আমার গুরু মুচকি হাসলেন। সুন্দরী অপরূপাকে তিনি বললেন, ‘দয়া করে বর্ণনা করুন এই কামরায় কী দেখলেন আপনি।’ ‘না, মানে, যখন বুঝলাম যে ওটা একটা পারিবারিক ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম,’ বললেন ললিতান। ‘মাত্র এক সেকেন্ড দেখেছি আমি।’
‘ওই এক সেকেন্ড আপনাকে কী দেখাল?’
দরজা যখন ফাঁক করছি, শুনতে পেলাম কমোডর স্যার বলছেন, ‘এক পয়সাও না! এক পয়সাও না! বিয়েটা বাতিল ঘোষণা করা হলে আমি বিষয়টা দেখব!’
চমকে উঠলেন সলিম। চিৎকার করে বললেন, ‘আমার আব্বু কক্ষনো এ কথা বলেননি!’
‘চুপ করুন, প্লিজ!’ নির্দেশ দিলেন সিআইডি চিফ।
কান্তিক স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘কোন বিয়েটার কথা বলছিলেন কমোডর?’
‘কোন বিয়ে আবার!’ তীব্র ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন ললিতান। ‘সলিম স্যার আর ওই শিলা শরণির বিয়ে!’
দুই হাতের মাঝখানে নিজের মাথা নামালেন সলিম। ‘ইস, এসব থেকে ওকে আমি দূরে রাখতে চেয়েছিলাম!’ হতাশ সুরে খেদ প্রকাশ করলেন।
‘আচ্ছা? ওঁরা বিবাহিত? সত্যি নাকি?’ ঠাণ্ডা সুরে প্রশ্ন করলেন আমার স্যার।
সুন্দরী তরুণীর নাক কুঁচকে উঠল। ‘সলিম তো তাই বলেছেন। তবে সেটা এক দিন আগের কথা। সোমবার বিকেলে সলিম তাঁর বাবার সঙ্গে একা দেখা করেন, আর তখন ওঁদের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। দুজনেই এমন চেঁচাচ্ছিলেন যে আমি আমার নিজের কামরায় বসে অনেক কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবাকে সলিম বলছিলেন, তিনি শিলা শরণিকে বিয়ে করেছেন। কথাটা সত্যি কি না, তা আমি বলতে পারব না, হতে পারে প্রিন্সেস প্রমত্তার সঙ্গে বিয়েটা এড়ানোর জন্য এটা তিনি বানিয়েছেন। সে যা-ই হোক, কথাটা শুনে কমোডর স্যার সাংঘাতিক খেপে গেলেন, কারণ শিলা শরণিকে তিনি একটা সুযোগসন্ধানী মেয়ে বলে মনে করতেন। ছেলেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন তাঁর কাছ থেকে একটা পয়সাও যেন আশা করা না হয় এবং হুকুম করেন এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাও।’
‘এটা সোমবারের ঘটনা,’ কান্তিক স্যার বললেন। ‘এবার ফেরা যাক মঙ্গলবারে- এই কামরায় উঁকি দিয়ে কী দেখতে পেলেন আপনি?’
‘তাঁরা টেবিলে বসে ছিলেন, এই টেবিলে। ভাগ্যই বলতে হবে, দরজার ফাঁকে চোখ রাখলে সরাসরি সামনে এটাই পড়ে। ওই সময় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন কমোডর স্যার, ওদিকের ওই জানালার দিকে হাঁটছিলেন। তার মানে স্যারের পিঠ আমার দিকে ছিল। সলিম দাঁড়িয়ে ছিলেন টেবিল আর আমার মাঝখানে, তিনিও আমার দিকে পেছন ফেরা অবস্থায়। শিলা শরণি টেবিলে বসেছিলেন, ওর সামনে চায়ের ট্রে। আমি ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম …’ ললিতান ইতস্তত করছেন।
‘বলুন!’ দ্রুত তাগাদা দিলেন কান্তিক স্যার।
ললিতান ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছেন। ‘কিছুই ঘটেনি!’ ঝাঁকি খাওয়ার মতো একটা দেহভঙ্গি করে বললেন। ‘এমন কিছু ঘটেনি যা আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে বলতে পারব। ওটা ছিল স্রেফ একটা ঝলকের মতো… আমি শুধু দেখলাম আশ্চর্য, অস্বাভাবিক এক দৃষ্টিতে সলিমের দিকে তাকাল শরণি। আমি সলিমের হাত দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু তিনি টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে পড়লেন… আমার মনে হলো তাঁর হাতের নড়াচড়া সন্দেহজনক… ব্যস, এইটুকুই।’
গা শিউরানো একটা ছবি আঁকলেন ললিতান। মনে হলো আমরা সবাই একটু শিউরে উঠেছি। সলিম দুই হাতে মুখ ঢেকে রেখেছেন।
‘আর এসব দেখে আপনি ভাবলেন…?’ ডাক্তার কান্তিক ললিতানের পেট থেকে আরো কথা বের করতে চাইছেন।
‘না, মানে, আগের দিন যা ঘটেছে সেটা মনে থাকায়,’ ললিতান বললেন, ‘আমি জানতাম সলিম ভয় পাচ্ছিলেন যে হেবানামা বদলানো হবে। আসলে তো সেটা ততক্ষণে বদলে ফেলা হয়েছে, কিন্তু তা তাঁর জানার কথা নয়। আমি ভেবেছি মেয়েটাকে সঙ্গে করে তিনি নিয়ে আসেন কমোডর স্যারের মনটাকে খানিক নরম করার জন্য, কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি একদম বেপরোয়া হয়ে গেলেন।’
‘একদম ঠিক!’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কান্তিক স্যার। এবার তাঁকেও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।
দুজনকে মুখোমুখি করার কান্তিক স্যারের প্ল্যানটা দেখা গেল নতুন কিছু দিতে পারছে না, তবে ললিতানের বিবৃতি সলিম কোবিদকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কনুই দুটো হাঁটুর ওপর রেখে বসে আছেন সলিম, হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরেছেন। তাঁকে একটু নাড়া দেওয়ার জন্য কাফি স্যার ধমকের সুরে বললেন, ‘আপনার কি কিছু বলার নেই, মিস্টার সলিম?’
চেহারায় বুনো, মরিয়া একটা ভাব নিয়ে সিধে হলেন প্রকাণ্ডদেহী তরুণ। ‘ললিতান যা বলল তার প্রায় সবটুকুই সত্যি,’ রুদ্ধশ্বাসে বললেন তিনি। ‘কিন্তু সামান্য ওই পার্থক্যই আমার জন্য জীবন আর মৃত্যুর পার্থক্য!’
‘ইচ্ছে করলে আপনি তাঁকে প্রশ্ন করতে পারেন,’ কান্তিক স্যার বললেন।
শান্ত হলেন সলিম। ‘আমি ওকে কোনো প্রশ্ন করতে চাই না,’ বললেন তিনি, ‘তবে ওকে কিছু বলতে চাই।’ দুই পা হেঁটে সুন্দরী অপরূপার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টে। তাঁর চেহারায় নতুন কী যেন একটা ফুটেছে, দৃঢ় আর সূক্ষ্ম কিছু; এটা সেই ব্যক্তির দৃষ্টি যাকে চরমতম শোক আর বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং যিনি অকস্মাৎ নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন।
‘ললিতা, এতে কি তোমার কোনো লাভ হবে?’
চেহারায় বিতৃষ্ণা, এক পা পিছু হটলেন ললিতান। ‘আমি কি এ রকম অপমানকর পরিস্থিতি সহ্য করতে বাধ্য?’ নিচু গলায় বললেন তিনি, আবেদনটা কান্তিক স্যারের কাছে।
‘আপনার বক্তব্য খণ্ডন করা তাঁর অধিকার, যদি তিনি পারেন,’ জানালেন স্যার।
লম্বা করে শ্বাস টানলেন ললিতান, শক্ত করলেন নিজেকে। ‘তা তিনি পারবেন না,’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘কারণ নিষ্কলুষ সহজ সত্য ছাড়া আর কিছু আমি বলিনি। তবে তাঁকে চেষ্টা করতে দিন।’ সেই চেয়ারেই বসলেন, আগে যেটায় বসেছিলেন, সলিমের চোখে চোখ রাখলেন ঠোঁটে ঠাণ্ডা হাসি নিয়ে।
ললিতানের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় সলিমের চোখের পাতা এতটুকু কাঁপছে না; কথা বলছেন নিচু আর আবেগতাড়িত কণ্ঠে, ‘তোমার সঙ্গে যে আচরণ করেছি, সে জন্য আমি দুঃখিত। মেয়ে-সংক্রান্ত বিষয়ে আমি একটা কাপুরুষ। ওদের আমি কষ্ট দিতে পারি না। বড় হওয়ার পর থেকে আমি যেন সারাক্ষণ মেয়েদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। আমি মুখোমুখি হয়ে সমাধানে আসতে জানি না। কিন্তু এখন আমাকে সব কিছুর মুখোমুখি হয়েই এই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। সত্য কী, সেটা প্রকাশ করার মতো ভাষা যদি একবার পেতাম! ললিতান, আমি তোমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছি। সে জন্য আমাকে মরতে হবে?’
থামলেন সলিম, তাঁর চোখ ললিতানের মুখে তল্লাশি চালাচ্ছে কথাগুলো শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না জানার জন্য। ওই গভীর কালো চোখের মায়াভরা আবেদন কিভাবে ললিতান অগ্রাহ্য করবেন। জানি না, কী ঘটতে যাচ্ছে। জানি না কে খুনি। জানি না সত্য কতটুকু প্রকাশ পাবে। ললিতানের আচরণে অতি সামান্যই ভাবাবেগ প্রকাশ পেল, তাও সলিমের বিপক্ষে গেল- হঠাৎ চেয়ার ছাড়লেন তিনি, পিছু হটে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন, সলিমের কাছ থেকে যত দূরে সম্ভব সরে থাকাটাই যেন উদ্দেশ্য। তাঁর মুখ মার্বেল।
‘তুমি খুব ভালো করে জানো, যে গল্পটা বলছ, তার জন্য ফাঁসিতে ঝুলতে হবে আমাকে,’ আবার শুরু করলেন সলিম। ‘এটা সত্যের এত কাছাকাছি যে বিবেকের দংশন ছাড়াই তুমি বলে ফেলতে পারো। কিন্তু তাতে কি তুমি কিছু পাবে? তোমার অন্তর জানে আমি আমার আব্বুকে খুন করতে অক্ষম। তুমি আমাকে চেনো! স্মরণ করো আমাদের মধ্যে কী কারণে সমস্যা দেখা দিয়েছিল- আমার মন নরম, সহজ সব কিছু গ্রহণ করি, কিন্তু তুমি অসম্ভব অ্যামবিশাস। তুমি আমাকে তিরস্কার করেছিলে, মনে আছে, গাজীপুরে একটা কুকুরছানাকে আমি গুলি করিনি বলে? কিছুই করেনি ওটা, শুধু আমাকে একটু আঁচড়ে দিয়েছিল।’
ওই তরুণ কণ্ঠস্বর, কাঁপা কাঁপা ও নিচু, ওই থমথমে অবয়ব, করুণ আর্জিভরা ওই দৃষ্টি বর্ণনা করব, তেমন ভাষা আমি কখনো অর্জন করিনি। ভয় হচ্ছিল আমার চোখে পানি চলে আসতে পারে। দেখতে পাচ্ছিলাম আন্দেশা কাফি ও আজাদুল কান্তিককেও ব্যাপারটা ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু সুন্দরী অপরূপা তাঁর ফরসা মুখে বাঁকা এক চিলতে হাসি নিয়ে শুনছেন, এটা সেই জাতের এক নারীর হাসি যিনি নতি স্বীকার করার চেয়ে মরতেই বেশি পছন্দ করবেন।
‘আমি বলেছিলাম, তোমাকে আমি ভালোবাসি। যদি ভেবে থাকো আমি মিথ্যে কথা বলেছি, তুমি ভুল করেছ,’ বলে যাচ্ছেন সলিম। ‘তোমার রূপ আমাকে জাদু করেছিল। আমি ওই রূপের পুজো করতে চেয়েছি। তুমি আমাকে পুরোপুরি দখল করে নাও… কিন্তু তোমাকে আমার বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। আমাদের দুজনের প্রকৃতি অসম্ভব রকম আলাদা। পরস্পরকে আমরা পাগল বানিয়ে ছাড়ব। আমার উচিত ছিল এসব কথা তোমাকে বুঝিয়ে বলা, কিংবা সহজ ভাষায় লিখে জানানো, কিন্তু তোমাকে আঘাত করা হবে ভেবে কোনোটাই আমি করতে পারিনি। আশা করেছিলাম আমি চলে গেলে তুমি আমাকে ভুলে যাবে… তবে যত দিন টিকেছিল সম্পর্কটা আমরা উপভোগ করেছি, তাই না? আমি বেহেশতে ছিলাম। তোমার কারণে যদি আমার মৃত্যু হয়, আমার বিরুদ্ধে তোমার যত রাগ আর ক্ষোভ আছে সব মুছে যাবে, তোমার শুধু মনে থাকবে ওই মধুর সময়টার কথা, যখন আমরা সুখী ছিলাম। কেমন অনুভূতি হবে তখন তোমার? এটা কি তোমার করা সাজে? আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না এত যার রূপ-সৌন্দর্য তার হৃদয় এ রকম পাষাণ হয় কী করে… তোমার মনে পড়ে…’ ললিতানের দিকে দুই পা এগোলেন তিনি, ফিসফিস করে এমন কিছু বলছেন, যা আমাদের কারো শুনতে পাওয়ার কথা নয়, শোনা উচিতও নয়, কিন্তু কখন কিভাবে বলতে পারব না, চেয়ার ছেড়ে আমি ওঁদের এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছি তখন, সলিমের ফিসফিসানি শুনে ফেললাম, সবটুকু না হলেও অংশবিশেষ তো বটেই। ‘তোমার মনে পড়ে, আমি না চাইতেই নিজেকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে তুমি,’ গলা খাদে নামিয়ে ললিতানকে বললেন সলিম। ‘তোমাকে আমি পেলাম, দেখলাম তোমার শরীর একটা বিস্ময়কর শিল্পকর্ম- সবচেয়ে মূল্যবান এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তুমি আমাকে পথ দেখালে, উৎসাহিত করলে, আমি সেটার যথাবিহিত যত্ন নিলাম। তখনকার তোমার শীৎকার এখনো আমার কানে বাজছে, ললিতান। ওই ঘটনার পর,’ স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন সলিম, ‘তুমি কি সত্যি শপথ নিয়ে আমার জীবনটা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে?’
অকস্মাৎ রাঙা হয়ে ওঠা মুখ ফিরিয়ে নিলেন ললিতান। ‘আমি দুঃখিত,’ বললেন তিনি, গলার স্বর থেকে অস্বাভাবিক একটা অনুরণন ছড়াচ্ছে, ‘কিন্তু সত্য সত্যই! আমি যা বলেছি তার কিছুই বদলাতে চাই না!’
ধীরে ধীরে কাঁধ উঁচু করলেন সলিম, মেলে ধরলেন তালু দুটো, তাঁর গোটা শরীর বসে গেল। ‘বেশ, ঠিক আছে। আর কিছু বাকি থাকল না,’ বেসুরো গলায় বললেন। ‘বুঝতে পারছি, আমার সব শেষ।’ চোখে-মুখে একটা অভিমান। ‘আসুন, স্যার,’ সিআইডি চিফকে বললেন, ‘নিয়ে চলুন আমাকে! জানি না আপনারা কোথায় নিয়ে যাবেন, তবে আমি বেরিয়ে পড়লাম!’ পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়ালেন, সব হারানোর হাহাকার প্রতিধ্বনিত হলো। ‘হে আল্লাহ! ভালো হতো সরাসরি এখনই যদি ফাঁসির কাছে নিয়ে যেতেন আমাকে! এক মিনিটে সব শেষ, কিন্তু তার আগে মাসের পর মাস যে কষ্ট আমাকে পোহাতে হবে…’
সিআইডি চিফকে ইতস্তত করতে দেখলাম, তিনি যেন কান্তিক স্যারের সঙ্গে কথা বলে কিছু বিষয় আরো পরিষ্কার করতে চান। তাঁরা দুজন দরজার কাছে মিলিত হতে যাচ্ছেন, এই সময় নারীকণ্ঠের একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল। চিৎকারটা সম্পূর্ণ অচেনা, বেরিয়ে এলো যেন ললিতানের বুক ছিঁড়ে। ‘দাঁড়ান! দাঁড়ান! আমি আর সহ্য করতে পারছি না! আমি মিথ্যে কথা বলেছি!’
কাফি ও কান্তিক স্যার ঘুরে দাঁড়ালেন। তরুণীর অস্বাভাবিক আত্মনিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। মুখের প্রতিটি পেশি জ্যান্ত প্রাণীর মতো হয়ে ওঠায় সেটাকে কোনো রকমে মানুষের অবয়ব বলে চেনা যাচ্ছে। কাউকে এত বেশি অপদস্থ আর অপমানিত হতে দেখাটা কারো জন্য মোটেও সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।
‘আমি মিথ্যে বলেছি!’ ললিতান কাতরাচ্ছেন। ‘শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকু আমি মিথ্যে বলেছি। সলিম কাজটা করেনি। আমি, আমি- কমোডর স্যারকে আমি বিষ খাইয়েছি। আল্লাহ! কী জঘন্য একটা প্রাণী তুই ললিতান!’ মুঠো করা হাত দিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করলেন।
আতঙ্কে পাথর সলিম, স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন। ‘তুমি আমার আব্বুকে খুন করেছ!’ থেকে থেকে বিড়বিড় করছেন। ‘তুমি আমার আব্বুকে খুন করেছ!’
ঘটনার আকস্মিকতায় একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি আমি। কান্তিক স্যার আমার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন। যান্ত্রিক পুতুলের মতো আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কাগজের একটা পাতা টেনে নিয়ে কাঁপা হাতে লিখতে শুরু করলাম ললিতান যা বলছেন, কী লিখছি কোনো রকমে ধরতে পারছি।
সামনে-পেছনে সামান্য দোল খাচ্ছে তাঁর শরীর। শব্দগুলো হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসছে তাঁর ঠোঁট থেকে, যেন আতঙ্কিত করার মতো একটা শক্তি কিছু চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে সবটুকু একবারে উগরে দিতে বাধ্য করছে তাঁকে।
‘সবটুকু বলব! এটা অনেক দিন থেকে মনে পুষে রেখেছিলাম। তবে খুন করতে চেয়েছি সলিমকে। কারণ সে আমার বিশ্বাস হারিয়েছে, আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। প্রথমে ওই বিদেশি মেয়েটার সঙ্গে শুরু করল, তারপর শুরু করল নির্লজ্জ শরণির সঙ্গে। ওর ওই সংগ্রহ করা বিষই আমার মাথায় চিন্তাটা ঢোকায়। ওকে তুই না পেলে আর কেউও যেন ওকে না পায়! ওগুলো সব সময় পাশের ঘরে রাখা ছিল- আমাকে প্ররোচিত করত, আমাকে উৎসাহিত করত। একটা চাবি পেলাম, সেটা দিয়ে দরজা খোলা যাবে এবং কাউকে কিছু না জানিয়ে যখন খুশি সলিমের পড়ার ঘরে আসা-যাওয়া করতে পারব। ওখানে বইও পেয়ে যাই, যাতে বিভিন্ন বিষের গুণাগুণ সম্পর্কে লেখা আছে, লেখা আছে কোনটা কী রকম কাজ করে…
‘পুরনো অনেক চাবি সংগ্রহ করি। বাতিল লোহার দোকান থেকে কিনি। প্রচুর চাবি। এভাবে এমন একটা চাবি পেলাম যেটা দিয়ে ওই আলমারির তালা খোলা যায়, আরেকটা ছোট চাবি পেলাম যেটা দিয়ে ড্রাগের নমুনাভর্তি বাক্সটাও খুলতে পারলাম। আমি শুধু অ্যাকনাইটের ছোট্ট শিশিটা বের করলাম, তারপর আবার সব গুছিয়ে রেখে তালা মেরে দিলাম বাক্স আর আলমারিতে, চাবিগুলো ফেলে দিলাম রাস্তার পাশের ড্রেনে। এরপর সময় নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে সলিমকে বিষ খাওয়ানো সম্ভব। অনেক ভেবেও কোনো উপায় দেখতে পাইনি। ওর সঙ্গে আমার তখন আর দেখাই হচ্ছিল না। ফোন করলে ধরে না। অগত্যা চিঠি লিখে আসতে বললাম ওকে। কিন্তু চিঠিরও কোনো উত্তর দিল না…’
‘ওই খুন করেছে… ওই খুন করেছে!’ বিড়বিড় করছেন সলিম, যেন স্বপ্নের ঘোরে কথা বলছেন।
‘তারপর হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম সলিম কমোডর স্যারকে বলছে সে ওই লালচুলো মেয়েটাকে বিয়ে করেছে। শুনেই আমি পাগল হয়ে গেলাম… পাগল! পাগল! হ্যাঁ, সেই থেকে আমি পাগল! পাগলটা তার প্ল্যান বদলে ফেলল। বুঝল সলিমের নাগাল সে পাবে না, তবে প্রচুর সুযোগ আছে ওর বাপকে বিষ খাওয়ানোর। পাগলটা ওদের, এই পরিবারটাকে আঘাত করতে চেয়েছে- সে কে, কোন জন, তাতে তার কিছু আসে যায় না। সিদ্ধান্ত নিল কমোডর স্যার হেবানামা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, তারপর তাঁকে খুন করবে। ওটাই হবে তার প্রতিশোধ। তখন ভাবেনি খুনটা করে দায় চাপাবে সলিমের ঘাড়ে, ভেবেছে আরো পরে, ভেবেছে- বাহ্, তাহলে ব্যাপারটা তো খুব মিষ্টি হয়!’
‘আমার, পাগলটার, জানা ছিল কমোডর স্যার তিনবেলা তিনটে ক্যাপসুল খান, তার মধ্যে একটা খান বিকেলে, চা-নাশতার সঙ্গে। ওই ক্যাপসুলে ঠিক অ্যাকনাইটের মতোই সাদা পাউডার থাকে। কিছু খালি ক্যাপসুল জোগাড় করি, তারপর ওগুলোয় অ্যাকনাইট ভরি। পাউডার যতটুকু ছিল তাতে তিনটে ক্যাপসুল ভরতে পেরেছি। সলিম আর ওই মেয়েটা কমোডর স্যারের সঙ্গে যখন তাঁর পড়ার ঘরে রয়েছে, আমি তখন চুপিচুপি বাইরে বেরিয়ে যাই, সুইটের হল হয়ে ঢুকে পড়ি বাথরুমে। শিশি থেকে ক্যাপসুলগুলো বের করি, বিষাক্তগুলো ভেতরে রাখি, তারপর নিজের কামরায় ফিরে যাই। ওরা কে কী বলছে শুনতে থাকি আর চারদিকে সতর্ক নজর রাখি। একসময় দেখলাম মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল সলিম। কমোডর স্যার ওদের সম্পর্ক অগত্যা মেনে নেবেন, এ রকম আভাস দিয়েছেন। মনে মনে হাসলাম, কারণ ওরা তো জানে না ওদের সব কিছু আমি কিভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেব! কমোডর স্যার যখন পড়ার ঘর ছেড়ে বেরোলেন, আমি তাঁর পিছু নিলাম, দরজার সরু ফাঁকে চোখ রেখে দেখছিলাম কী করেন তিনি। বাথরুমে ঢুকলেন, তারপর বেরিয়ে এলেন। তখন আমি জানি কাজ হয়ে গেছে। নিজেকে বললাম পেটের ভেতর ক্যাপসুলটা গলতে কিছুটা দেরি হবে। পালানোর জন্য যথেষ্ট সময়। আবার তিনি পড়ার ঘরে ফিরে এলেন, তবে আমাকে একবারও দেখতে পাননি। ততক্ষণে আমি অফিসে ফিরে এসেছি। হল হয়ে আবার আমি বাথরুমে গেলাম। শিশিতে দেখলাম মাত্র দুটো ক্যাপসুল রয়েছে, কাজেই আমার জানা হলো কোথাও কিছু ভুলভাল হয়নি। ওগুলো হাতে রেখে ক্ষতিকর নয় এমন ক্যাপসুল দুটো শিশিতে ভরলাম, তারপর নেমে গেলাম নিচে।’
এটুকুই তাঁর গল্পের বাস্তব চিত্র। দুর্ভাগা তরুণীর পাগলামি সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করব না। ব্যাপারটা খুবই বেদনাদায়ক। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচণ্ড চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ডেকে নিয়ে আসে সব প্রতিরোধ শক্তির পতন, তারপর ভাবাবেগশূন্যতার শিকার হয়ে গড়গড় করে সব স্বীকার করে ফেলা। ডিটেকটিভ অটল হায়দারকে ডেকে পাঠানো হলো, ললিতানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। তখন ফিসফিস করা ছাড়া কথা বলতে অক্ষম, ললিতান অনুরোধ জানালেন, নিজের অফিস কামরায় ১০ মিনিট বিশ্রাম নিতে চান তিনি। সে অনুমতি তাঁকে দেওয়া হলো।
বাকি আমরা চারজন ওখানে রয়ে গেলাম পরস্পরের সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করার জন্য, যা ঘটে গেছে এখনো তার ধকল কেউ আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমি শুধু বিশাল একটা ক্লান্তি সম্পর্কে সচেতন, মনে হচ্ছিল ওখানেই ঢলে পড়ব। তবে এই ক্লান্তির ধরনটা ভারি ইন্টারেস্টিং, বিধ্বংসী একটা ঝড় থামার পর যে অনুভূতি হয় সেই রকম, কানে যখন আবার নীরবতা আবিষ্কার করি আমরা। আশীর্বাদধন্য, শান্তিময়। প্রথমে ব্যাপারটা আপনার বিশ্বাস হতে চাইবে না।
কিন্তু তারপর যখন ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম, ওই তো তরুণ সলিম কোবিদকে দেখতে পাচ্ছি- তিনি এখন নিরাপদ, আমার মনে শান্তি ও তৃপ্তি।
যত দূর মনে করতে পারি, তিনিই প্রথম নীরবতা ভাঙলেন। ‘আমাকে নিয়ে আপনাদের পালা শেষ হয়েছে?’ জানতে চাইলেন তিনি। ‘আমি কি মুক্ত?’
‘আপনি বাতাসের মতো মুক্ত,’ কান্তিক স্যার বললেন, একটা হাত রাখলেন তাঁর কাঁধে। ‘আপনার স্ত্রীর কাছে যান, সব বলুন তাঁকে। আর আপনার আম্মুকে। মনে হচ্ছে আপনি আপনার ধন-সম্পদ হারিয়েছেন, কিন্তু ওঁদের হারাননি।’
সলিম কোবিদের চোখে-মুখে মেঘের কোল থেকে সূর্য বেরিয়ে আসার মতো আনন্দ খেলা করছে। তিনি এরই মধ্যে পাশের ঘরে বসে থাকা করুণার পাত্রী এক বেচারির কথা ভুলে গেছেন। এও তারুণ্যের একটা দিক! ‘টাকা থাকল কি থাকল না, কে কেয়ার করে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘আমি যদি মুক্ত থাকি!’ কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
‘ধারণা করি,’ কান্তিক স্যার শুকনো গলায় বললেন, ‘আপনার মা আপনাকে না খাইয়ে রাখবেন না। আর দলিল বলুন, হেবানামা বলুন, চুক্তিপত্র বলুন, এসব এর আগেও বহুবার ভাঙা হয়েছে!’
‘তাহলে আপনার কথাই সঠিক প্রমাণিত হলো!’ উদারতা দেখিয়ে আমার স্যারকে বড় করছেন সিআইডি চিফ।
‘তাই তো দেখতে পাচ্ছি,’ বললেন কান্তিক স্যার। ‘তবে ভাবে-ভাষায় যতটা দেখিয়েছিলাম, আমি তার সিকি ভাগও নিশ্চিত ছিলাম না।’
আমাদের উত্তেজনার খোরাক কিন্তু তখনো ফুরোয়নি। হঠাৎ হতাশায় ভোঁতা চেহারা নিয়ে ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকলেন ডিটেকটিভ অটল হায়দার, চিৎকার করে বললেন, ‘ওই মেয়েটা আমাকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে গেলেন!’
সংক্ষেপে ব্যাপারটা হলো এ রকম : ডিটেকটিভ অটল যখন সরাসরি তাকিয়ে নেই, এ সময় তাঁর বন্দি অফিস কামরা থেকে সলিম কোবিদের পড়ার ঘরে ঢুকে পড়েন। অটল এমনকি এও খেয়াল করেননি যে ললিতান দরজার তালা খুলেছেন। তাঁর মুখের ওপর দড়াম করে ওটা বন্ধ করেন অভিযুক্ত নারী, তারপর মূল হলঘরে চলে যান। দুটি দরজা পার হয়ে অটল যখন সেখানে পৌঁছান, বন্দিকে তিনি চারপাশে কোথাও খুঁজে পাননি। চাকর-চাকরানিরাও কেউ তাঁকে দেখেনি।
আমরা ধারণা করলাম ঘেরা সিঁড়ি ব্যবহার করে নিচতলায় নেমে গেছেন ললিতান, সেখান থেকে গোপন প্যাসেজ ধরে বেরিয়ে গেছেন রাস্তায়। ওই সিঁড়ি বা গোপন প্যাসেজ সম্পর্কে অটলের কিছু জানার কথা নয়। সব শুনে রেগে কাঁই হলেন সিআইডি চিফ। কিন্তু আমার বস ব্যাপারটাকে গ্রহণ করলেন একদম শান্তভাবে।
‘একদিক থেকে ভালোই হলো,’ মন্তব্য করলেন তিনি।
‘ভালো হলো মানে?’ রাগ চেপে জিজ্ঞেস করলেন কাফি স্যার।
‘আমি ধরে নিচ্ছি তিনি নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গেছেন,’ গম্ভীর সুরে বললেন কান্তিক স্যার। ‘তবে যেখানেই যান না কেন, খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে। আমি তাঁর চোখে নিজেকে খুন করার সিদ্ধান্ত দেখেছি।’
এক সেকেন্ড বিস্মিত হয়ে থাকার পর আন্দেশা কাফি বললেন, ‘তাতে আইন ফাঁকিতে পড়বে! পরাজিত হবে বিচার!’
‘মানুষের আইন, মানুষের বিচার,’ অস্পষ্ট একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে যেন জনান্তিকে বললেন ডাক্তার কান্তিক।
‘তাঁর পিছু নিতে হবে!’ গর্জে উঠলেন কাফি স্যার।
‘না! ওখানে যেন আমাদের কেউ না দেখে,’ বললেন কান্তিক স্যার, বন্ধুর বাহুতে একটা হাত রাখলেন। ‘অটলকে পাঠান।’
তাই পাঠানো হলো।
পরে আমি আমার নোটবুকে এই লেখাটা পেয়েছি :
‘গতকাল সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে বনশ্রী এলাকার এক্স ব্লক, ১০ নম্বর রোড, ২১ নম্বর দালান, ২১ তলা একটি ফ্ল্যাটে মোসাম্মাৎ ললিতান নেসাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, সরাসরি হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হওয়া একটা বুলেটসহ। পিস্তলটা তাঁর হাতে শক্ত করে ধরা ছিল এবং পরনের কাপড়চোপড়ে পোড়া দাগ ও বারুদের নমুনা পাওয়া গেছে। শরীরের পজিশন দেখে ধারণা করা হচ্ছে, লক্ষ্য স্থির করার জন্য একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।’
‘তাঁর মরদেহ আবিষ্কার করেছেন ডিটেকটিভ অটল হায়দার। মাত্র কয়েক মিনিট আগে সিআইডি চিফ আন্দেশা কাফি রহস্যময় একটা ফোন কল পান, সেটা পেয়ে তাঁকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন তিনি। ফোনে অজ্ঞাতপরিচয় এক ভদ্রমহিলা ওপরের ওই ঠিকানা দিয়ে জনাব কাফিকে জানান, এখনই একজন ডিটেকটিভকে ওখানে তাঁর পাঠানো উচিত। কেন, কী ব্যাপার, এসব জানতে চাইলে যোগাযোগ কেটে দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে মোসাম্মাৎ ললিতান নেসা নিজেই ফোনটা করেছিলেন। ডিটেকটিভ অটল ওখানে পৌঁছে দেখেন ওই ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, যেন তাঁর সুবিধার জন্যই খুলে রাখা হয়েছে। তরুণীর লাশ তখনো গরম ছিল।’
‘ললিতান নেসা এক বছর ধরে মরহুম কমোডর কোবিদের জীবনী লেখার কাজে সহায়তা করছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, বসের মৃত্যুজনিত শোক আর অকস্মাৎ বেকার হয়ে পড়ার ধাক্কা সামলাতে পারেননি তিনি, মানসিকভাবে একদম ভেঙে পড়েন, তারই ফলশ্রুতি এই আত্মহত্যা। পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, কমোডর কোবিদের লাইসেন্স করা পিস্তলটা কোনো এক ফাঁকে চুরি করেছিলেন তিনি। তাঁর নিকটতম একমাত্র আত্মীয়, আপন ভাই, বগুড়ায় থাকেন- লাশ বুঝে নেওয়ার জন্য ঢাকার উদ্দেশে ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গেছেন।’
– বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে