উর্বশী

উর্বশী

দোকানের ধুলো পড়া কাঁচের দরজা দিয়ে তাকে দেখতে পেল আনন্দ। ভেতরে নানা রঙ আর চেহারার ফ্লাওয়ার ভাস, মূর্তি, নস্যি র কৌটা সহ টুকিটাকি আরও হরেক জিনিস। সে বসে রয়েছে একটা চেয়ারে, মাথাটা সামান্য ঝুঁকে আছে সামনের দিকে, কোলের ওপর ভাঁজ করা হাত জোড়া, তার গোটা অবয়ব থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সৌন্দর্য আর আভিজাত্য। এত সুন্দর মেয়ে জীবনেও দেখেনি আনন্দ। খুব ইচ্ছে করছে ভেতরে ঢুকে ভাল করে দেখে মেয়েটিকে। তবে লজ্জাও লাগছে। আনন্দ অবশ্য এমনিতেই খুব লাজুক স্বভাবের, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঘেমে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোতলাতে থাকে। এ জন্যেই বেচারা জীবনে প্রেম করতে পারল না। তবে দোকানের মেয়েটি সাংঘাতিক টানছে আনন্দকে। যেভাবে চুম্বক আকর্ষণ করে লোহাকে। সম্মোহিতের মত এগিয়ে গেল আনন্দ। খুলল দরজা। ঢুকল ভেতরে। সাথে সাথে দোকানের মধ্যে মিষ্টি শব্দে বেজে উঠল ঘণ্টা। মেয়েটির মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। সে যেমন ছিল, বসে রইল সেভাবে। এ দোকানের সেলস গার্ল নয়, ভাবল আনন্দ। বোধহয় অপেক্ষা করছে কারও জন্যে। রোগা-পাতলা এক লোককে দেখতে পেল আনন্দ, কাউন্টারের পেছনের একটা দরজা খুলে ঢুকলেন ভেতরে। ভদ্রলোক বয়সে প্রৌঢ়, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। মুখখানা শুকনো, ফেকাসে। যেন রক্তশূন্যতায় ভুগছেন। আনন্দের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি, ‘বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি?’ ভদ্রলোক ঘরে ঢোকার পরেও মেয়েটি স্থির বসে আছে, আড়চোখে লক্ষ করল আনন্দ। ‘না, কিছু করতে হবে না,’ জবাব দিল ও। ‘আমি এমনি এসেছি। দোকানটা একটু ঘুরে দেখব।’ ‘অবশ্যই। দেখুন।’ আনন্দ তাকগুলো দেখার ভান করে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল মেয়েটির দিকে। মেয়েটির ঝলমলে চুল কোমর ছুঁয়েছে, নিয়ন বাতির আলোতে ঝলকাচ্ছে। তার গায়ের চামড়া যেন মোম দিয়ে তৈরি। পরনে নীল শাড়ি। ধবধবে শরীরের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে গেছে। ওই, কী সুন্দর! মেয়েটির খুব কাছে চলে এসেছে আনন্দ। একটা স্টাফ করা পাখির মূর্তি দেখার জন্যে শুঁকল, হাতটা ঘষা খেল মেয়েটির বাহুর সঙ্গে। ‘সরি,’ বলে ঘুরল আনন্দ। এবং এই প্রথম সরাসরি তাকাল মেয়েটির মুখের দিকে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেল একটা। সুন্দরী এই নারী কোন জ্যান্ত মানবী নয়, লাইফ-সাইজ একটা মূর্তি! ‘ঈশ্বর!’ হাঁপিয়ে ওঠার মত শব্দ বেরুল আনন্দ’র গলা দিয়ে। ‘আমি ভেবেছিলাম এ মানুষ।’ হাসলেন দোকানের মালিক। ‘দোকানে ঢুকে এ ভুলটা অনেকেই করে। অবশ্য তাদের দোষ নেই। খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই এ মানুষ নয়, মূর্তি।’ আনন্দ এখনও হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে নারী-মূর্তিটির দিকে। ফিসফিস করে জানতে চাইল, ‘একে কি বিক্রি করবেন?’ ‘না,’ মাথা নাড়লেন প্রৌঢ়। ‘কিন্তু মূর্তিটা কিনতে চাইছেন কেন?’ মন্ত্রমুগ্ধ স্বরে জবাব দিল আনন্দ। ‘কারণ একে আমার চাই। এ আমার স্বপ্নের নারী। সুন্দরী-ভদ্র-শান্ত। ওকে দেখেই প্রেমে পড়ে গেছি আমি।’ ‘বেশ,’ বললেন দোকানের মালিক। ‘তাহলে আপনি ওকে নিয়ে যেতে পারেন। আপনার চোখের দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পেরেছি আপনার কাছে ভালই থাকবে উর্বশী।’ ‘উর্বশী?’ প্রতিধ্বনি তুলল আনন্দ। ‘হ্যাঁ।’ মাথা ঝাঁকালেন অপরজন। ‘স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীর নামে নাম ওর।’ আনন্দ পাঁজাকোলা করে বুকের মধ্যে তুলে নিল উর্বশীকে। মুগ্ধ চোখে দেখছে অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানাকে। ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। একটা ট্যাক্সি ক্যাব ডেকে উঠে বসল তাতে। পেছন ফিরলে দেখতে পেত প্রৌঢ় দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাকিয়ে আছেন ওদের দিকেই। চিকচিক করছে তাঁর চোখের কোণ। আনন্দ শহরতলীতে, একতলা একটা বাড়িতে থাকে। একা। বাবা-মা-ভাই-বোন কেউ নেই। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ জীবনে এই প্রথম কারও আবির্ভাব ঘটল। উর্বশীকে সে পরম যত্নে একটা আর্মচেয়ারে বসাল, ভেলভেটের একটা কুশনে এলিয়ে দিল মাথা। হাতজোড়া আড়াআড়ি ভাবে রাখল কোলের ওপর, অবিন্যস্ত শাড়ির ভাঁজগুলো সমান করে দিল আঙুলের চাপে। ‘আমার বাড়িতে সুস্বাগতম, প্রিয়তমা,’ মৃদু গলায় বলল আনন্দ। পরদিন শুক্রবার। সারাদিন কোথাও বেরুল না আনন্দ। উপভোগ করল উর্বশীর সঙ্গ। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলল ও। মনে হলো উর্বশী মনোযোগ দিয়ে শুনছে ওর কথা। সন্ধ্যার পরে ক্যাসেট পেয়ারে রবি শঙ্করের সেতারের বাজনা ছেড়ে দিল। উর্বশী যেন চুপচাপ শুনতে লাগল মিষ্টি যন্ত্রসঙ্গীত। মেয়েটি আনন্দর যথার্থ সঙ্গিনী। এতদিন যেরকম সঙ্গিনীর স্বপ্ন দেখে এসেছে আনন্দ, ঠিক তেমনটি। অফিসের মেয়েগুলোকে পছন্দ নয় আনন্দর। ওরা সারাক্ষণ বকবক করে আর খাই খাই করতে থাকে। সুন্দরী কলিগদের কারও প্রতি কোন রকম দুর্বলতা নেই আনন্দর । নিজে সারাক্ষণ চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। এ জন্যে আড়ালে ওকে ‘রাম গড়ুরের ছানা’ ডাকা হয়, জানে আনন্দ। মনে কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলে না সে। আনন্দ শুধু স্বপ্ন দেখে আসছিল, এমন কেউ একজন তার জীবনে আসবে সব দিক থেকেই যে হবে আনন্দের মনের মত। অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে আনন্দর। উর্বশীকে পেয়েছে সে। শনিবার সকালে অফিসে যাবার সময় সে বলল, ‘গুডবাই, উর্বশী। সন্ধে বেলায় দেখা হবে।’ মূর্তির গালে চুমু খেল ও। ভারী মসৃণ আর নরম চামড়া। অবিকল মানুষের মত। সেদিন অফিসে বসে সারাক্ষণ উর্বশীর কথাই ভাবল আনন্দ। কি দিয়ে বানানো হয়েছে উর্বশীকে? মোম, ধাতব, পাস্টিক কিংবা সিল্ক নয়। তবে কি ও কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়? ও কি-সত্যিই কি তা সম্ভব? সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে উর্বশীর গা থেকে আস্তে আস্তে শাড়িটা খুলে ফেলল আনন্দ। ওর শরীরে কোন খুঁত নেই, শুধু দুটো দাগ আছে: বাম কাঁধে ছোট্ট একটা আঁচিল আর অ্যাপেনডিক্স অপারেশনের অস্পষ্ট শুকনো একটা ক্ষতচিহ্ন। আনন্দ’র মনে পড়ল প্রৌঢ়ের দোকানে স্টাফ করা নানা রকম মূর্তি দেখেছে সে। বইতে পড়েছে ও মৃত পশু বা পাখির চামড়ার মধ্যে খড়-কুটো ভরে স্টাফ করে রাখা হয়। অবিকল জীবন্ত লাগে। এ কাজটাকে বলে ট্যাক্সিডামি। আর যারা এ কাজ করেন তাঁরা হলেন ট্যাক্সিডামিস্ট। ভদ্রলোক তাহলে এদেরই একজন! কিন্তু এমন সুন্দর একটি মেয়েকে স্টাফ করলেন কেন তিনি? একে পেলেনই বা কোথায়? উর্বশীর ব্যাকগ্রাউন্ড কি? এ সব প্রশ্নের জবাব না পেলে অস্থির হয়ে থাকবে মন। পরদিন, লাঞ্চ ব্রেকে আনন্দ গেল ভদ্রলোকের দোকানে। তিনি আনন্দকে দেখেই চিনে ফেললেন। সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন, ‘কেমন আছে উর্বশী?’ ‘আমি জানতে এসেছি উর্বশী কে?’ প্রশ্ন করল আনন্দ। ‘স্বর্গের সবচে’ সুন্দরী নারী,’ হাসি মুখে জবাব দিলেন প্রৌঢ়। ‘যার জন্যে দেবতা-দানব-মানুষ সবাই পাগল ছিল।’ ‘আমি আপনার উর্বশীর কথা বলছি। সে এমন ভরা বয়সে মারা গেল কিভাবে?’ কাটা কাটা গলা আনন্দর। হাসিটা মুছে গেল প্রৌঢ়ের মুখ থেকে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর জবাব দিলেন, ‘ব্রেন হেমারেজে। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মারা গেছে উর্বশী,’ চোখ তুলে তাকালেন আনন্দের দিকে। ‘আপনি তাহলে বুঝে গেছেন যে ও কোন পুতুল নয়। ব্যাক রূমে চলুন। উর্বশীর গল্প শোনাব আপনাকে।’ পেছনের ঘরে আনন্দকে নিয়ে ঢুকলেন তিনি। সুসজ্জিত ঘর। জানালেন এ দোকান আসলে তাঁর বাড়ির একটা অংশ। তারপর শুরু করলেন, ‘উর্বশী আমার স্ত্রী। একে অন্যকে খুব ভালবাসতাম আমরা। একদিন নিউমার্কেটে শপিং করে ফেরার পথে একটা টেম্পু পেছন থেকে ধাক্কা দেয় উর্বশীর রিকশাকে। উর্বশী ছিটকে পড়ে যায় রাস্তায়। মাথাটা প্রচণ্ড জোরে বাড়ি খায় একটা লাইট পোস্টে। অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় উর্বশীকে। ব্রেন হেমারেজে ‘‘কোমা’’র মধ্যে চলে গিয়েছিল। আর জ্ঞান ফেরেনি। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ওর লাশ আমি চুরি করি। কফিনে আরেকটা ডামি ভরে রেখে দিই। তারপর কাজ শুরু করে দিই।’ ‘কি কাজ?’ জানতে চাইল আনন্দ। ‘আমি ট্যাক্সিডামি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি একজন পেশাদার ট্যাক্সিডামিস্ট। দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে আমার কাজের প্রচুর নমুনা রক্ষিত আছে। বেশিরভাগই পশু-পাখির স্টাফ করা মূর্তি। অনেকের ব্যক্তিগত কাজও আমি করে দিয়েছি। কারও পোষা বেড়াল বা কুকুর মারা গেলে আমার কাছে আসত। আমি তাদের পোষা প্রাণীগুলোকে স্টাফ করে দিতাম। ট্যাক্সিডামি কারও কারও কাছে গা ঘিনঘিনে একটা ব্যাপার, কিন্তু আমার কাছে নয়। আমি আমার জীবনের সমস্ত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি উর্বশীকে স্টাফ করার সময়। ও আমার মাস্টারপীস। উর্বশীর পরে ট্যাক্সিডামির কাজটা আমি ছেড়ে দিই। তারপর এ দোকানটা খুলে বসি। এখানে যে সব স্টাফ করা মূর্তি আপনি দেখেছেন, সব আগে বানানো।’ একটু বিরতি দিলেন ভদ্রলোক, তারপর আবার বলতে লাগলেন, ‘উর্বশীকে নিয়ে ভালই ছিলাম আমি। আমার বয়স বাড়ছিল। যদিও উর্বশীর বয়স এক জায়গায় থেমে আছে। কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি আমার বাড ক্যান্সার হয়েছে। লাস্ট স্টেজ। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন আর বেশিদিন আয়ু নেই আমার।’ ‘সরি,’ বিড়বিড় করল আনন্দ। ‘সরি হবার কিছু নেই। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। ভয় পাচ্ছিলাম মৃত্যুর পরে আমার উর্বশীর কী হবে ভেবে। কারণ আমি মরে গেলে ওকে কে দেখবে? তখন ওকে দোকানে এনে বসাই আমি। এমন এক তরুণকে খুঁজছিলাম যার চোখে উর্বশী স্রেফ কোন মূর্তি বলে বিবেচিত হবে না। দয়াবান, হৃদয়বান যে যুবক ভালবাসবে আমার উর্বশীকে, রক্ষকের ভূমিকা পালন করবে। তারপর একদিন মিরাকলের মত এলেন আপনি। উর্বশীর দিকে যেভাবে গভীর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন, দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উর্বশী আপনার কাছে নিরাপদে থাকবে। ওকে ভালবাসবেন আপনি।’ ‘হ্যাঁ। বাসব,’ বলল আনন্দ। ‘ধন্যবাদ। আমার বিশ্বাস আমার চেয়েও বেশি ভালবাসতে পারবেন আপনি উর্বশীকে।’ এমন সময় বেজে উঠল দোকানের ঘণ্টা। খদ্দের এসেছে। উঠে দাঁড়াল দু’জনেই। আনন্দ চলে গেল। অপরজন ব্যস্ত হয়ে পড়ল খদ্দের নিয়ে। কয়েক দিন পরে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আনন্দ, দেখল প্রৌঢ়ের দোকান বন্ধ। পাশের দোকানদার জানাল মারা গেছেন ভদ্রলোক। আনন্দের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। মনে হলো অবশেষে উর্বশী সত্যি তার হয়ে গেছে। মেয়েটির জন্যে সে জীবনও দিতে পারবে। তারপর থেকে যেন পাগলামিতে পেয়ে বসল আনন্দকে। উর্বশী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। অফিস কামাই শুরু করল। ফলে চাকরিটা হারাতে হলো ওকে। উর্বশী খেতে পারে না বলে সে-ও একটা পর্যায়ে বন্ধ করে দিল খাওয়া-দাওয়া। আমার ভালবাসার মানুষ না খেলে আমি খাই কি করে? নিজেকে যুক্তি দিয়ে বোঝাল সে। সারা দিন ঘরে বসে দিন কাটে আনন্দর উর্বশীর মুখের দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যাবেলায় মাঝে মাঝে বেরোয়। ফুল কিনে আনে উর্বশীর জন্যে। এভাবে তার জমানো টাকাও শেষ হয়ে গেল। উর্বশীর প্রতি আনন্দ’র ভালবাসা স্বর্গীয়। এর মধ্যে কামনা-বাসনার কোন স্থান নেই। উর্বশীকে সে স্পর্শও করে না। শুধু সাবধানে গোসল করিয়ে দেয়, ফ্যান চালিয়ে শুকোয় গা এবং চুল। তারপর শাড়ি পরিয়ে বেঁধে দেয় চুল। আনন্দ উত্তেজিত হয়ে লক্ষ করে ওর যত্নে আর ভালবাসায় যেন ধীরেধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে উর্বশী। চুলের রঙ চকচক করছে, চামড়ার ফেকাসে ভাবটা চলে গিয়ে ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, পাতলা ঠোঁটে ধরেছে রঙ। উর্বশীর জন্যে উন্মাদ আনন্দর নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিল না। সে বুঝতে পারছিল না এই উন্মাদনা নিজের ধ্বংস ডেকে আনছে। ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে শরীর। কিন্তু ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিল না সে। বাইরে যাওয়া বাদ দিল আনন্দ, আর খাওয়া-দাওয়া একেবারেই বন্ধ। ভূতের মত সে নিজের ঘরে পায়চারি করে, কথা বলে উর্বশীর সঙ্গে, প্রেমের কবিতা লেখে উর্বশীকে নিয়ে। পড়ে শোনায়। না খেতে খেতে দুর্বলতার চরম সীমায় পৌঁছে গেল আনন্দ। একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরল, হামাগুড়ি দিয়ে এগোল আর্মচেয়ারের দিকে। বহু কষ্টে উঠে বসল। এই প্রথমবারের মত চুমু খেল উর্বশীর ঠোঁটে। পরের মুহূর্তে মারা গেল আনন্দ। ঘরটা এখন অদ্ভুত নীরব। তারপর দ্রুত এবং হালকা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে এল, গভীর এবং ঘন হয়ে উঠল আওয়াজ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল উর্বশী, কোমরে গোঁজা সাদা সিল্কের রুমালটা দিয়ে ঢেকে দিল লাশের মুখ। উর্বশীর গালে রঙ ধরল, ফাঁক হয়ে গেল কমলা কোয়া অধর, মৃদু একটা ঝাঁকি দিতেই খোপা খুলে পিঠময় ছড়িয়ে পড়ল কালো কুচকুচে চুলের বন্যা। নাচের ভঙ্গিতে বার কয়েক পা ফেলল সে ঘরের মেঝেতে, তারপর এগোল দরজার দিকে। দোর খুলতেই সূর্যের সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত হলো উর্বশীর ফর্সা শরীর। বুক ভরে শ্বাস নিল সে। আহ্, আবার বেঁচে ওঠা কি আনন্দের!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত