এই গ্রামে যে সে আগে আসেনি এমন নয়, অনেকবারই এসেছে। এ গায়ের অলিগলি মেঠোপথ তার ভালোই চেনা, চেনা এ গায়ের কিছু অবস্থাপন্ন ঘর-গেরস্থের নামধামও। তবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় সে এসেছে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র, সাকল্যে তিন-চারবারের বেশি হবে না। তাও সে আসা ছদ্মবেশ ধরে। আজও পুরো না হলেও সে রকমই খানিকটা ঢেকেঢুকে নদীতীরে এসে পৌঁছাল সে।
তার মূল কাজ যদিও বিষ্যুদবারে, আজ সে যাচ্ছে আগেভাগে নতুন কয়েকটা পথ চিনে নিতে। এবার আর তাকে পুরোনো পথে ফিরলে চলবে না। এক পথ দুবার ব্যবহার করার নিয়ম নেই। কিন্তু এ নিয়ম সে এরই মধ্যে কয়েকবার ভেঙেছে, কিন্তু আর দুঃসাহস দেখাতে মন সায় দিচ্ছে না। বরং আজ মন কেবলই কু ডাক ডাকছে। এ গায়ের সীমানায় আসার পর থেকেই কেমন যেন একটা অচেনা অনুভূতি ছেঁকে ধরেছে তাকে। আগে এ রকম কক্ষনো হয়নি! তাই এখন একবার ইচ্ছে হচ্ছে ফিরে যায়; কিন্তু সে উপায়ও নেই। গেল দিন ধানতারার হাটে কপাল খুব খারাপ গেছে। সামনে এখন হাট বলতে মঙ্গলবারের ওই কুশুরা আর তারপর বিষ্যুদবারের কালামপুরের হাট। কুশুরার হাটে গিয়ে তেমন ফায়দা হবে না, সে ভালোই জানে। ওটা ছোট হাট, ওখানে গরুর হাট নামে যেটা বসে তাকে ঠিক হাট বলা যায় না। দূরের ব্যাপারীরা কেউই আসে না ওই হাটে। আশপাশের দু-চার গায়ের গেরস্তের গরু নিয়েই ওই ছোট আকারের নামকাওয়াস্ত হাট। কাজেই এখন ভরসা বলতে ওই কালামপুরের হাটই। তবে মাশাআল্লা, হাট যদি বলতে হয় তো ওই ধানতারাকে পয়লা নম্বরেই রাখবে সে, তার পরই নাম করবে কালামপুরের। এই দুই হাটেই কম আর বেশি-চারপাশের গেরস্তরা তো আসেই, আসে দূর-দূরান্ত থেকে ব্যাপারীর দল, বেণিপুর, সুয়াপুর, বোলভাদ্দর, সখিপুর, দৌলতপুর—কত জায়গার নাম করবে সে।
কিন্তু গতকাল ধানতারার হাটবারটা তার এমনধারা হলো কেন, বড় অপয়া একটা দিন গেছে। কাল কী যে হলো, কত রকম কায়দা-কসরত করেও সে কোনো একটা ব্যাপারী দলের সঙ্গে ভিড়তে পারল না। সে এখন আর কোনো ঠিগ দলে নেই ঠিক। নিজেকে ঠিগও মনে করে না, তাও ঠিক। কারণ সর্দার নওশেরা জমাদারের খুনের পর দল বলে তাদের যা টিকে ছিল তা কি আর ঠিগ দল ছিল? নওশেরা জমাদারের সময় তাদের দল চলেছে বড় দাপে, যমুনাজুড়ে তাদের অবাধ বিচরণ ছিল। নৌকায় নৌকায় তারা ভাটিতে-উজানে কতজনের গলায় যে আঙ্গুছা পরিয়ে দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে সটকে পড়েছে। কতজনের যে পেছন থেকে ফাঁসের হেঁচকা টানে শিরদাড়া ভেঙে দিয়েছে। তখন তবিলে, তহবনের উল্টো ভাঁজে লুকানো থাকত তাদের মেস্টাপাটের চিকন ফাঁস। কিন্তু সে দিন গেছে নওশেরার সঙ্গে সঙ্গেই।
তবে কি, ঠিগ দল আর নেই ঠিক, কিন্তু মনে-প্রাণে এখনো তো সে ঠিগই। আর ঠিগ শুধু খুনি নয়, ঠিগ তো এক বিশ্বাসও। যে কারণে পুরোনো সেই অভ্যাসে আজও সে চারদিক দেখেশুনে পথে নামে, চোখ কান খোলা রেখে পথ চলে।
কিন্তু কাল ধানতারার হাট তার জন্য বড় যে খারাপ গেল, বড় উল্টাসিধা রকম গেল তার আরেকটা কারণ কি তার সর্দার নয়! জীবনে এ রকম কিছু ঘটতে পারে তা কি সে ঘুণাক্ষরেও কোনো দিন ভেবেছিল: যে নওশেরাকে সে নিজে দেখেছে কালামপুর থেকে দেড় ক্রোশ পুবে, বংশি নদীর কুমে বলরামের ছুরি বুকে নিয়ে ডুবে যেতে সে-ই কাল কী করে ধানতারার হাটে হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে উদয় হলো, এই হিসাব সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। নওশেরাকে দেখেই সে চিনেছে, স্বাস্থ্যটা সেই আগের মতোই আছে, বরং আরও যেন বলশালী হয়েছে, তবে পাঁচ বছরে একটা পরিবর্তন নওশেরার চেহারায় পড়েছে—মাথার অতি অহংকারের বাবরি চুল, যা একসময় কাঁধ পর্যন্ত নামত, সেই বাবরি যেন এখন কগোছা শনের নড়িমাত্র, নওশেরার সেই চুলের বাহার পুরোই গেছে, সেই জায়গায় নিষ্ঠুরভাবে কপালের টাক বিস্তৃত হয়ে মাথার অনেকখানিরই দখল নিয়ে ফেলেছে প্রায়। নওশেরার সেই পাকানো তেল চকচকে গোঁফ, তাও নেই; কিন্তু সেই সিংহের মতো তীব্র চোখ আছে এখনো, হাটের ভিড়ে আচমকা দুজনে মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার পর, নওশেরা মুখটা সামান্য তুলে সেই যে তাকাল, সেই যে তার কলজে হিম করা পুরোনো দিনের মতো দৃষ্টি, সেটা মনে করে তার বুকের ভেতরটা এখনো কেমন হিম হয়ে আসল।
নওশেরার খুনের পর তাদের দলেরই এক ছুপা-রুস্তমের ছুরিকাঘাতে যেবার বলরাম মারা পড়ল, তখনই সে বুঝেছিল দল আর টিকবে না। টেকেওনি। নওশেরার কর্তৃত্ব অমান্য করার সাহস রাখত একমাত্র বলরাম, নওশেরা সেটা জানতও, কিন্তু পেশিশক্তির চেয়ে নওশেরার আস্থা ছিল মাথার শক্তিতে, সেটাই যে ঠিক ছিল, তার প্রমাণ নওশেরা বহুবার দিয়েছেও। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানও ভুল করে। বলরাম সেই ভুলেরই সুযোগ নিয়েছিল বংশি নদীর কালো জলের কুমে। নেপথ্যে থেকে সে বলরামের এই কাজে সমর্থন জুগিয়েছিল ঠিক। কিন্তু যা ভেবেছিল তা হয়নি। বরং বলরাম মারা যাওয়ার পর দলটা আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। আয়-রোজগার নেই, দলে থাকা না থাকা তখন তার কাছে সমান হয়ে গেল, তাই একদিন নিঃশব্দে দল ছাড়ল সে। এবং কেউ সেদিন তার পথ আগলে দাঁড়াল না। নওশেরা জমাদার থাকলে এমন হতো না কোনো দিন।
দল ছাড়ায় তার ক্ষতি হয়নি, একলা চলেছে এত দিন। কিন্তু নওশেরা ফিরে এসে কি একটা ঝামেলা তৈরি করল না এখন? প্রশ্নটা ঘুরেফিরেই তার মনে আসছে। নিহত নওশেরাকে সে পছন্দই করত, সে পছন্দের সুবাদেই কি সে তার নিজের মধ্যে, নওশেরাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি! তার আজকের বেশবাস, চলাফেরা সবই তো নওশেরা জমাদারের। গোপনে সেও নওশেরা হতেই চেয়েছে। এখন জীবিত নওশেরার পুনরাবির্ভাবে তাকে, বদলে যেতে হবে আবার। একটু মুশকিল হলো। তাতে কি! সে তো নওশেরা না। তবে নিজেকে নওশেরা জমাদার ভাবতে বেশ লাগত, কাজেকর্মে বেশ একটা স্ফূর্তি বোধ করত সে। লোকে যখন তাকে দেখে সভয়ে সরে গিয়ে, ফিসফিস করে কথা বলে, সে বড় মজা!
তার কারণেই কি রহস্যময় নওশেরা কারও কারও কাছে এখনো জীবিত না! কালামপুর, ধানতারা, গোয়াইলবাড়ির হাটে পাকানো গোঁফের, বাবরি চুলের নওশেরাকে নাকি এখনো দেখা যায়! এসব কথা, ফিসফাস যখন তার কানে আসে সে একাকী নিঃশব্দে হাসে আর ভাবে: নওশেরাকে এখনো দেখা যায়! দেখা তো যাওয়ারই কথা…বেশ ছিল এসব দিন।
আসল নওশেরা জমাদার মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসেছে। সে ভুল দেখেনি।
কিন্তু কী দরকার ছিল নওশেরার ফিরে আসার! তার অনুপস্থিতিতে বেশ তো চলছিল, দল ছেড়ে নিজের মতো করে নকল নওশেরার বেশে গরু ব্যাপারীদের নিয়ে ভালোই ছিল সে। আজও ওই একই উদ্দেশ্য নিয়েই তো এসেছিল এই বংশি নদীর পাড়ে, পরিকল্পনা ছিল, নদী পেরিয়ে বান্নাখোলা গ্রাম পর্যন্ত যাবে, তারপর উল্টোবাগে ঘুরে শিমুলিয়া হয়ে নদী পেরিয়ে ধামরাই দিয়ে উঠে চলে যাবে হম্ভাগ অবধি। বিষ্যুদবারে পুবের বেণিপুর থেকে আসা গরুর ব্যাপারী দলই ছিল তার মূল লক্ষ্য। হাট শেষে গরুর পাল নিয়ে ব্যাপারীরা রওনা দেবে দশ ক্রোশ দূরের গোয়াইলবাড়ির হাটের দিকে। তার আগে কালামপুরের হাট শেষে বান্নাখোলা আর ওলুনিয়া গ্রামের বিভিন্ন গেরস্তবাড়িতে রাতের খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের বন্দোবস্তে যাত্রাবিরতি করার কথা ওদের। গেরস্ত বাড়ির পাগাড়ঘেঁষা খোলা হালটে গরু রেখে রাতটুকু ঘুমিয়ে পুব থেকে আসা এই গরুর ব্যাপারী দল কাকডাকা সেই ভোরে আবার বেরিয়ে পড়বে পথে। এদের স্থানীয় পরিচয় পুবা। পশ্চিম থেকে এসে বরাবর পুবে যায়।
কোনো পুবাকেই একেবারে সর্বস্বান্ত সে করেনি কখনো, নওশেরা এটা খুব মেনে চলত। সাধারণত বাছাই করে তিনটে-চারটে গরু হাতিয়েই সটকে পড়ে সে। দল থেকে একটা-দুটো গরু খোয়া যাওয়ার ব্যাপারটা সকালের আগে পুবারা ঠিক ধরতেও পারে না। তবে যখন বুঝতে পারে তখন আসলে কিছু করারও থাকে না ওদের। ততক্ষণে সে চলে গেছে ওদের নাগালের বাইরে। গরুর পাল রেখে, সীমিত লোকবলের কারণে তাকে পিছু ধাওয়া করে ধরার আর কোনো উপায় নেই পুবাদের। দু-তিনটে গরুর ক্ষতি তখন বাধ্য হয়েই মেনে নেয় ওরা।
খানিকটা বিভ্রান্ত, অন্যমনস্ক মনে ঝকঝকে রোদ গায়ে মেখে বংশির কিনারে এসে দাঁড়াল সে। পারাপারের গুদারা-নৌকাটা মাত্র ঘাটে ভিড়ল। দুজন কামলা-কিষাণ চেহারার লোক লাফিয়ে নেমে তার পাকানো গোঁফের দিকে তাকিয়েই সভয়ে চোখ নামিয়ে গাঙের ঢাল বেয়ে উঠে গেল মাথা নিচু করে।
গুদারার নলখাগড়া বিছানো পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে গলুইয়ের কাছে এসে বসল সে। নৌকার পাটনি, বয়সে একেবারে ছোকড়া। তাকে একবার অপাঙ্গে দেখে নিয়ে কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘কনে যাইবেন?’
জবাব দেওয়ার আগেই পাড় থেকে এ সময় খিল খিল করে হাসির হররা তুলে নৌকায় এসে উঠল কম বয়সী দুটো মেয়ে। ঝলকে একটা মেয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল তার, হাঁ করা মুখ বন্ধ করতেও যেন ভুলে গেল সে। চোখের পলক পড়ল না পর্যন্ত।
মেয়ে দুটো তার বিপরীত দিকে গুদারায় আড়াআড়ি পাতা তকতায় বসতে বসতে, একটা মেয়ে তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া মেয়েটাকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ, বেডায় কিমুন ড্যাবড্যাবাইয়া তর দিকে চাইয়া রইছে!’
‘দেখছি, বেডার বাবরি চুল দ্যাখ!’
‘বেডা কিমুন বেশরম…কিমুন ডাকাইত্যা চেহারা!’
‘কী সন্দুর মোছ! যেন্ চুবচুবা তেল বাইয়া পড়তাছে!’
সে এবার মুখে হাসির ঝিলিক তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনারা কোন বাড়ির?’
এটা নিয়মবিরুদ্ধ, তার পেশায় স্থানীয় কারও সঙ্গে কোনো রকম বাতচিতে যাওয়ার নিয়ম নেই। কারও নজরে পড়া যাবে না, বিশেষ করে সে যখন কাজে বেরিয়েছে। কিন্তু নিয়মটা জেনেও সে ভঙ্গ করল আজ।
সব ভুলে বান্নাখোলার নবা মুন্সীর মেয়েকে মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে দেখল সে—পলকহীন: সবুজ কলাপাতা রঙের শাড়ি-পরা এক অপ্সরী।
পরিকল্পনা ছিল: বান্নাখোলা গ্রামে সে ঢুকবে। হাটুরে মানুষের মতো কারও মনে কোনো রকম সন্দেহের উদ্রেক না করে একটু-আধটু আশপাশে ঘোরাঘুরি…তারপর গরু নিয়ে কোন পথে গেলে দ্রুত হম্ভাগের পথ পাওয়া যাওয়া যাবে—চিনে নিয়েই সেÊফ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। কিন্তু নদী পেরিয়ে এসে মেয়ে দুটোর পিছু নিয়ে তিনরাস্তার মাথায় ছোটগোলাঘর নামে পরিচিত মনিহারি দোকানটার সামনে এসে ফিরে না গিয়ে, বাঁশের বেঞ্চিতে বসে দোকানি লোকটার সঙ্গে অকারণ কথা চালাচালির চেষ্টা করল সে, যা সে কখনো করে না, গাঁটের পয়সায় দু-তিনটে পান কিনেও চিবাল। এসব কী করছে? নিজেকে নিজে সে চোখ ঠাউরে শাসন করলেও বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল যে মেয়েটাকে আরেকবার না দেখে এই গা ছেড়ে তার যেতে ইচ্ছে করছে না।
দুপুরের দিকে মনোবাসনা মিটল তার, আবারও দেখা পেল সে সকালের সেই কলাপাতা-রঙা শাড়ির মেয়েটির। গোলাঘর ছেড়ে আরেকটু উজিয়ে এসে পথের পাশের বিশাল বড় দিঘির পাড়ের আমগাছের নিচে বসে দ্বিধান্বিত সে যখন নিজের সঙ্গে সওয়াল-জবাব করছে, আর কিছুক্ষণ দেখবে না রওনা হয়ে যাবে—এই ভাবনায় সে যে মুহূর্তে দ্বিখণ্ডিত, সে মুহূর্তেই দিঘির পাড়ে মেয়েটাকে আরেক দফা দেখে যেন তার বিষণ² দুপুর আবার ঝলমলিয়ে উঠল। ভেজা কাপড়ে পাড় বেয়ে উঠে এল মেয়েটা। ভেজা ল্যাপটানো কাপড়ে মোড়ানো যেন এক তরবারি। মেয়েমানুষ এত সুন্দর হয়!
আর তখুনি সিদ্ধান্তটা নিল সে।
মুখে হাসি ফুটিয়ে, আমগাছের নিচ থেকে সরে এসে দাঁড়াল মেয়েটার সামনে।
নবা মুন্সীর এই মেয়েটার নাম আল্লাদী। বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে। তাই কথাবার্তায়ও বেশ ঠোঁটকাটা। ডাকাবুকোও। গুদারায় দেখা লোকটাকে এবার চোখ তুলে ভালো করে নজর করে দেখল সে। তখন পাশ থেকে দেখা বাবরি চুলের এই লোকটার মুখ দেখে কেমন এক ঘোর লাগা অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল—এই তো সকালের কথা। আর এখন কাছ থেকে, মাত্র এক হাত দূর থেকে লোকটাকে দেখে সে হতাশই হলো। কই, খুব মর্দ ধরনের পুরুষ তো একে মনে হচ্ছে না? বিশালদেহী, এক সুপুরুষের যে ছবি তার মনে গাঁথা হয়েছিল, এ তো কিছুতেই সে রকম না! বরং সুপুরুষ তো এ না-ই, এখন কাছ থেকে দেখে নিতান্তই সাদামাটা একজন বলে মনে হচ্ছে।
‘এখানে আইলে আবার তোমার দেখা পামু? না, তুমি আমার লগে যাইবা?’ হঠাৎ কথা বলে ওঠে লোকটা।
‘দেখা পাইতে পারেন, বড় দিঘি নাওনের জায়গা…কিন্তু আপনের লগে যামু ক্যান?’ ধারালো গলায় জবাব দেয় আল্লাদী।
নড়তে যেন ভুলে গেছে সে। তার শরীরজুড়ে বয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত এক কাঁপন। একই সঙ্গে শুকিয়ে আসছে গলা। অস্থির লাগছে। এই এলাকা ছেড়ে অনেক আগেই তার সরে পড়া উচিত ছিল—এই সতর্কবার্তা মনে এলেও আরও একবার একে উপেক্ষা করল সে।
এগিয়ে এল দুপা। বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে চলো। সোহাগ দিয়া ভইরা দিমু তোমারে।’
‘আপনে কেডা? আপনারে আমি চিনি?’
এই জবাবে আচমকা বেভুল এক রাগ উসকে ওঠে তার বুকের ভেতর, ঝটিতে হাত বাড়িয়ে মেয়েটার ডান হাত খামচে ধরল সে, ‘আমার সঙ্গে গেলেই চিনবা! চলো…!’
কথা শেষ করতে পারে না, তখনই চোখের কোনায় ধরা পড়ে আরেকটা দৃশ্য: দেখে উল্টো দিক থেকে ঝোলা কাঁধে শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে একটা লোক। এই দৃশ্যে পুরো শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠল তার। দীর্ঘদেহী, নওশেরা জমাদারকে চিনতে তার কষ্ট হলো না একটুও।
আচমকা অসুস্থ বোধটা যেন পুরোই গ্রাস করল তাকে। মাথাটা কি একটু টলে উঠল!
এদিকে মেয়েটা তার হাত ছাড়িয়ে খানিক দূরে সরে গিয়ে তাকিয়ে আছে বিস্ময়ে। লোকটা হঠাৎ যেন পাথর বনে গেছে। ভূত দেখার মতো মুখচোখ সাদা হয়ে গেছে একদম। চোখাচোখি হলো। কিন্তু লোকটা এখন আর তাকে দেখছে না। ভয়ানক এক অবিশ্বাস নিয়ে সে তাকিয়ে আছে তার পেছনে আগোয়ান নতুন আগন্তুক লোকটার দিকে।
এরপর যেন সবকিছু খুব দ্রুত ঘটল। মেলায় গোল চোঙার ভেতর দিয়ে দেখা দশ-বারো বছর আগের বায়োস্কোপের কথা মনে পড়ল, দৃশ্যগুলো যেন দ্রুত একটার পর একটা দৌড়ে সামনে চলে আসছে।
ঢোলা জোব্বা গায়ে আগন্তুকটি প্রায় নিঃশব্দে লোকটার কাছে চলে এসেছে কখন। এক হাত দূরত্বে এসে থামল সে, এর মধ্যে কখন যেন ঝোলা থেকে তার হাতে উঠে এসেছে কালো, বাঁকানো, দীর্ঘ একটা ছুরি।
‘সবাই কি আর নওশেরা হইতে পারে রে!’ চাপা এই মন্তব্যের পরই একটা অস্ফুট আর্তনাদের মতো শুনল তরুণীটি। তারপর দেখল আগন্তুকের ছুরির পোচে পেট চেপে ধরে পড়ে যাচ্ছে লোকটা, ভুড়ি বেরিয়ে এসেছে তার হাতে। ‘মাগো’ বলে একটা চাপা আর্তচিৎকার করেই ভেজা কাপড়ে দৌড়াতে শুরু করল আল্লাদী।
আগন্তুক তখন ঝুঁকে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলছে, ‘ভাবছিলি পিঠে ছুরি মারলেই শ্যাষ নওশেরার, আবার নওশেরা সাজন!’
লোকটার চোখ উল্টে এসেছে, সে শুধু বলতে পারে, ‘আমি না ছুরি মারছে…বলরাম…’
তারপর বান্নাখোলার বড়পুকুরের রাস্তার ধারে নাম-পরিচয়হীন এক লাশ হয়ে পড়ে রইল সে। জোব্বা পরা আগন্তুকটি ততক্ষণে আবার হাঁটতে শুরু করেছে, যে পথে সে এসেছিল সেই পথেই মিলিয়ে যাচ্ছে আবার।