এক
অলস ভঙ্গিতে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে রায়ান। লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা। বিশাল বে ঘোড়াটা দুলছে চলার তালে তালে, তার সাথে তাল মিলিয়ে দুলছে ওর শরীরও।
গায়ে একটা লাল জামা, অ্যালকালি ধুলোর আস্তর পড়ে এখন ধূসরপ্রায়। ময়লা ঘাম শুকিয়ে স্থায়ী দাগ পড়ে গেছে। চিবুকের নিচে গলা জড়িয়ে ঢিলেভাবে বাঁধা একটা নীল রূমাল।
টেক্সাসের নিদাঘ দুপুর। রোদ যেন জিহ্বা মেলে লক লক করছে। সামনে তাকাতে গিয়ে তীব্র আঁচে চোখ কুঁচকে যাচ্ছে রায়ানের। কপাল বেয়ে চোখের কোনে ঘাম জমে জ্বালা করছে।
সামনে ছোট্ট একটা শহরের আবছা অবয়ব। শহরটার নাম জানে রায়ান। বাইসন। দূর থেকে শহরটাকে জরিপ করে নিচ্ছে ও।
‘থাম বাছা,’ আস্তে করে বাহনের লাগামে টান দিল। ‘একটু দাঁড়া দেখি। অবস্থাটা আগে বুঝে নেই।’ দু’পায়ের হাঁটু দাবিয়ে চাপ দিল ঘোড়াটার পাঁজরে। একটু দোনোমনো করে থামল কান্ত ঘোড়াটা। বোঝা যাচ্ছে, অতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে এখন তার খাবার ও বিশ্রাম দুটোই চাই। সামনে শহরটার অস্তিত্ব ওর চোখেও পড়েছে। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে না-পৌঁছে পথে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই ওর। তবে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। একটু অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখতে চাইল মালিককে। বোকা নাকি লোকটা!
‘দেখ ব্যাটা,’ হাসল রায়ান। বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। দেখছিস তো পৌঁছে গেছি। তবে বেশি কিছু আশা করে বসিস না যেন। দেখা যাবে হয়তো শহরটায় কেউ নেই গোটা ছয়েক ইনজুন আর একটা ডাহা মাতাল ছাড়া।’ নিজের রসিকতায় হাসল সে।
মাথা থেকে দুমড়ানো স্টেটসনটা সরিয়ে কপাল থেকে ঘাম ও অ্যালকালি ধুলো দুটোই মুছল। তারপর বার কয়েক ফুঁ দিল টুপির ভেতরটায়। যেন ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করতে চাইল।
মিনিটকয়েক ঘোড়ার পিঠে চুপচাপ বসে রইল ও। আবার শহরটাকে দেখল জরিপের ভঙ্গিতে। দূর থেকে ঘরগুলোকে দেখাচ্ছে ঘন সন্নিবেশিত, অনেকটা ওয়েদার বোর্ডের মতো।
ছবির মতো নিথর দেখাচ্ছে শহরটাকে। কোথাও কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে যেন আদৌ কেউ নেই শহরটায়। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। টেক্সাসের এ-অঞ্চলে দিনের এ-সময়টায় সবচেয়ে বেশি গরম। সুতরাং পাথরফাটা এ-গরমে খুব বেশি দায়ে না-পড়লে ঘর ছেড়ে এক পাও বেরোতে চাইবে না কেউ।
স্টেটসনটা আবার মাথায় চড়াল রায়ান। বে’র পেটে হাঁটুর গুঁতো লাগাল। তার দরকার ছিল না অবশ্য। এগিয়ে চলল বে।
সামনের শহরটায় কোনো ঝামেলা হতে পারে কিনা কিংবা হলে সেটা ঠিক কী ধরনের হতে পারে, সে-সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই রায়ানের। ও নির্বিরোধী মানুষ। যেচে কোনো ঝামেলায় যেতে চায় না। সম্ভব হলে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পপাতী। বাইসনে কোনো ঝামেলা আশা করছে না ও। তেমন সম্ভাবনা থাকলে শহরটাকে দূর থেকেই পাশ কাটিয়ে চলে যেত। কিন্তু এখন ওর খাদ্য, পানীয় আর বিশ্রাম দরকার। ওর ঘোড়াটারও ঠিক তা-ই পাওনা হয়েছে। বিশেষ করে ঘোড়াটার পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে।
* * *
টেক্সাসে একেবারে প্রথম দিককার সেটলারদের একজন ছিল রায়ানের দাদা। বুড়ো তার জীবনের মেয়াদ পুরোটাই কাটিয়ে গিয়েছিল। দাদার সান্নিধ্যে জীবনের বেশ কটি বছর কাটিয়েছিল রায়ান। নাতিকে ভাল বাসত বুড়ো ম্যাক রায়ান। যতদিন বেঁচেছিল, ততদিন নিজের আজীবন অভিজ্ঞতা থেকে সেরা জিনিসগুলো শেখানোর চেষ্টা করেছে। বুড়ো বারবার একটা কথা বলত রায়ানকে, ‘বাছা, একটা কথা কখনো ভুলবি না। তুই খাস না-খাস, তোর ঘোড়া আর অস্ত্রটাকে কখনো উপোস রাখবি না। তোকে হয়তো এমন জায়গায় যেতে হবে, যেখানে আইনের চেয়ে অস্ত্রের জোরই বেশি। তাছাড়া এমন এমন সময়ও আসতে পারে, যেখানে আইনের হাত পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। সেখানে অস্ত্রই রা করবে তোকে।
‘তোকে ওদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে ঘোড়ার পেটে যেন দানাপানি আর অস্ত্রের পেটে ছোঁড়ার মতো গুলি ভরা থাকে। তুমি যদি ওদের দিকে মনোযোগ না-দাও, ওরা তোমার প্রয়োজনের সময় কাজে আসবে না।’
দাদার কথাগুলো মনের ভেতর গেঁথে নিয়েছে রায়ান। তার বাবাও ছিল একজন সাবধানী মানুষ। বাবার মুখেও এই একই কথা শুনেছে সে বহুবার।
মূলত সে র্যাঞ্চার। তবে মার্শালের চাকরিও করেছে। কিন্তু বছর খানেক পরে ছেড়ে দিয়েছে ওটা। কাজটাকে উপভোগ করতে পারেনি। স্থানীয় মাইনার আর বোকাসোকা কাউবয়দের ওপর স্রেফ খবরদারি করার কাজটাকে বড্ড একঘেয়ে মনে হয়েছে। মাইনাররা শহরে এসে আকন্ঠ মদ গেলে, জুয়া খেলে। কাউবয়রাও তাই। শনিবার শহরে ওদের হৈ হৈ আর চিৎকারে কানপাতা দায়। সামান্য মতান্তর থেকে বড়জোর মারপিট পর্যন্ত চলে তাদের মধ্যে। তবে এদের সামলানো কোনো ব্যাপারই না একজন দ ল’ অফিসারের জন্যে। কিন্তু এদের প্রতি কঠোর হওয়াটা সম্ভব হয়নি ওর প।ে
সবচেয়ে বড় কথা হলো খুনোখুনিটা এখন ওর ধাতে সয় না। ত্যাঁদড় কোনো আউট ল’য়ের মোকাবিলা করতে গেলে ওকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকে না। কিন্তু ব্যাপারটাকে ঘৃণা করে রায়ান।
নিজের এ-পরিবর্তন হঠাৎ করেই ধরা পড়েছে ওর কাছে। ওর বউ রাইসা মারা যাওয়ার পর থেকেই। রাইসা মরে যাওয়ার সাথে সাথে ওর ভেতরও যেন কিছু একটা মরে গেছে। এমন এক শূন্যতায় ছেয়ে গেছে সারা বুক যে, কোনো কিছুতেই তা আর পূরণ হলো না। টেক্সাসের রোদে পোড়া শুকনো খটখটে মাটির মতোই যেন এখন তার ভেতরটা।
অনেক কষ্টে ছোট্ট একটা র্যাঞ্চ গড়ে তুলেছিল রায়ান। ছোট্ট, কিন্তু আশা আর আনন্দে তার পরিধি ছিল অনেক বড়। র্যাঞ্চের কাজে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল রাইসা। যত ছোটই হোক, র্যাঞ্চটা তাদের নিজেদের। নিজের মালিকানায় যে কোনো কিছু থাকাটা যে কেমন আনন্দের, সেটা মনে প্রাণে উপভোগ করতে শুরু করেছিল।
কিন্তু এক সময় ব্যাপারটায় কেমন যেন একঘেয়েমি এসে গেল রাইসার। দিনের পর দিন কান্ত আর বিষণœ দেখাতে লাগল ওকে। তাদের কোনো বাচ্চা ছিল না। থাকলে হয়তো অন্যরকম হতে পারত। মুখে রক্ত তোলা পরিশ্রমকেই তখন মনে হতে পারত পরম সার্থকতা।
র্যাঞ্চ কেনার তৃতীয় বছরেই রাইসার চোখ থেকে আনন্দের দ্যুতি নিভে যেতে দেখল রায়ান। তবে ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি ও। ভেবেছে এটা হয়তো সাময়িক কান্তি। যত কিছুই হোক, একজন মহিলার পে একজন পুরুষের মতো পরিশ্রম করা সম্ভব নয়।
সে নিজে সারাণ ব্যস্ত থাকত র্যাঞ্চের কাজে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ভূতের মতো খাটত। ঘরে ফিরত সারা গায়ে ধুলোবালি আর কালিঝুলির আস্তর নিয়ে। হাত-মুখ ধুয়ে কাঠের চেয়ারটায় বসে ঠাণ্ডা খাবার গিলত গোগ্রাসে। তারপর পরদিনের কাজের পরিকল্পনা করতে বসত। শেষ কয় বছরে রাইসাকে ঠিক মতো সময় দেয়াটাও হয়ে উঠত না ওর।
র্যাঞ্চিং শুরু করার আগে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল রায়ান। খনির কাজ, রেলরোডঅলা ও র্যাঞ্চগুলোর মাংসের যোগান দেয়ার জন্যে শিকারের কাজ, সেনাবাহিনীর গাইডের কাজ, স্টেজ কোচের গার্ড এবং মাঝে মধ্যে কাউবয়ের কাজÑকিছুই বাকি রাখেনি। কোনো কাজেই শেষ পর্যন্ত মন বসাতে পারেনি। সে চাইছিল এমন কিছু করতে, যা তাকে বুড়ো বয়সে স্থিরতা এনে দেবে। র্যাঞ্চিংটাকেই সে জন্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিল। প্রথম প্রথম রাইসা নিজেও র্যাঞ্চিং নিয়ে দারুণ উত্তেজনার মধ্যে ছিল। স্বামীকে সারাদিন র্যাঞ্চের কাজে ডুবে থাকতে দেখে ভেবেছিল, ভবঘুরের মতো এখানে ওখানে না-ঘুরে একটা চমৎকার কাজ করতে চাইছে লোকটা। সব চেয়ে বড় স্বস্তিতে ছিল যে, ওর স্বামী ল’ম্যান নয়। পশ্চিমে ওই পেশাটাই তখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভাবা হতো। রাইসা এই পেশাটাকে ঘৃণা করত। রায়ান কাজ থেকে ফিরে এলে তারা একত্রে বসে গল্প করতÑল’ অফিসারের চাকরি এবং তাতে ভালো বেতনের কথা বললেই ঠোঁট ওল্টাত রাইসা। ঘৃণাটা মোটেই গোপন করার চেষ্টা করত না।
কিন্তু তাদের সে-আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। র্যাঞ্চটা বড় সস্তায় পেয়েছিল রায়ান। ভেবেছিল খুব জিতে গেছে। কিন্তু আস্তে আস্তে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে শুরু করে সে। গ্রীষ্মে অসহনীয় গরম, আর শীতকালে টেক্সাসের প্রবল ঠাণ্ডা বাতাস তাকে বুঝিয়ে দিল যে, র্যাঞ্চ কেনার ব্যাপারে মোটেই সুবিবেচনার পরিচয় দিতে পারেনি। ওটা আসলেই একটা মরা জায়গা। পরিশ্রম করতে করতে নিজের জীবনপাত করলেও মরা গাছে ফুল ফোটানোর চেষ্টার মতো পণ্ডশ্রমই হবে শুধু। তবু কি পিছু হটত সে? মনে হয় না। রাইসা অমন অকালে চলে না-গেলে হয়তো শেষ না-দেখে ছাড়ত না।
আর এখন রায়ান চলেছে লুইসিয়ানার দিকে। উদ্দেশ্য অবশ্য সে একই। আরেকটা র্যাঞ্চ করবে সে। র্যাঞ্চিং তার পছন্দের কাজ। ফসল ফলানোর মধ্যে সে খুঁজে পায় সৃষ্টির স্বাদ আর বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু টেক্সাসের রসকষহীন বন্ধ্যা মাটি তাকে দিয়েছে অপূর্ণতা আর অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা। আর সারাণ ব্যস্ত থাকতে হয়েছে লড়াই আর সংগ্রামে। চারপাশের অসংখ্য স্বার্থপর আর নির্বোধ মানুষের সঙ্গে এক অর্থহীন লড়াই কান্ত করে ফেলেছে ওকে। ওর এ-পর্যন্ত জীবনটা যেন একটা কঠোর লড়াইয়ের অফুরন্ত অধ্যায়।
টেক্সাস জায়গাটা প্রকৃতিগতভাবে রু আর কর্কশ। আর এখানকার বাসিন্দারা হলো বুনো, বেপরোয়া। রায়ান চায় একটা শান্তশিষ্ট জীবন। দিনভর কাজ আর সন্ধেয় ঘরে ফিরে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে সময় কাটানো। তাদের নিয়ে বেঁচে থাকা। আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে সৎপ্রতিবেশীসূলভ। সে যেমন অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবে না, তেমনি নিজের ব্যাপারেও আর কারো মাথা ঘামানো পছন্দ নয় ওর।
কিন্তু তবু অনেক বার ওকে লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। লড়াই স্থায়ী দাগ রেখে গেছে ওর শরীরেও। বাঁ কাঁধের গভীর তচিহ্নটা তারই স্মৃতি। বুলেটটা আরেকটু নিচু হয়ে গেলে ওর পিঠ ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে লাগতে পারত। আর তাহলে এখন আর তাকে ভবঘুরের মতো টেক্সাস ছেড়ে বেরোতে হতো না নতুন আবাসের খোঁজে।
রাইসার কথা এখনো ভুলতে পারে না ও। বিশেষ করে মনে পড়ে ওকে কবর দেয়ার সময়টার কথা। যে-পাদ্রী ওকে শেষ শয়ানে রেখেছিল, ওর প্রতি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছিল সে। সবাই তাকে পাদ্রী ওয়াল্ট নামে ডাকত। রাইসাকে শেষ শয়ানে রাখার কাজটা খুব যতœ সহকারেই করেছিল ওয়াল্ট। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা ভুল করে ফেলেছিল। এমন কিছু করেছিল, যা রায়ানকে ভীষণ ুব্ধ করে তুলেছিল। জনাতিরিশেক মানুষ ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে। লাশটা কবরে শুইয়ে দিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়ে প্রার্থনা শুরু করেছিল লোকটা। প্রার্থনা করতে গিয়ে বলেছে, ‘জেসাস, রাইসাকে তুমি তার আসল ঠিকানায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যেয়ো। ওর এমন কাউকে দরকার ছিল যে ওর যতœ নিতে পারত। কিন্তু বেচারীকে কাটাতে হয়েছে নির্জন প্রেইরিতে প্রায় একা একা। আর ওর সে একাকিত্বের কথা তুমি নিশ্চয় অবহিত আছ। ও কেবল সারাণ অপোয় থেকেছে ওর স্বামী কখন কাজ থেকে ফিরে আসবে…’
কবর দেয়া শেষ হওয়ার পর শবযাত্রীরা সবাই চলে যাওয়া পর্যন্ত অপো করেছে রায়ান। তারপর ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে চড়াও হয়েছে লোকটার ওপর। বুকের কাছে জামা খামচে ধরে বলেছে, ‘এবার আসো, তোমাকে আচ্ছা করে একটা পিটুনি লাগাই। এটা তোমার পাওনা হয়েছে।’
আশ্চর্য ! অমন লম্বা চওড়া শক্তিশালী জওয়ান লোকটার মারমুখো ভাব দেখেও একটুও ভয় পায়নি ছোটখাট আর হালকা পাতলা গড়নের পাদ্রী। মৃদু হেসে বলেছে, ‘যে কোনো অপমানের প্রতিশোধ তুমি মারপিটের মধ্য দিয়েই নিতে চাও, তাই না?’
পাত্তা দেয়নি রায়ান। লোকটার মুখে প্রচণ্ড বেগে শক্ত হাতের দু’দুটো ঘুষি লাগিয়ে দিয়েছে।
মুখের এক পাশ কেটে রক্ত গড়াতে শুরু করেছে পাদ্রীর। সে অবস্থায় বলল, ‘মি. রায়ান, তুমি আমার ওপর রাগ ঝাড়ছ, কারণ আমি তোমাকে যা বলেছি, তা সত্যি। আর সত্যিটা তুমি বুঝতে পেরেছ, কিন্তু সেটা নিজের কাছে স্বীকার করতে চাইছ না। রাইসা আমার কাছে প্রায় সময় তার নিঃসঙ্গতার কথা বলত, তোমাকে নিয়ে তার ভয়ের কথা বলত। আমার চেয়ে বেশি বলত আমার স্ত্রীর কাছে।’
রায়ানের চোখে চোখে তাকিয়ে অবলীলায় কথাগুলো বলে গেল পাদ্রী। ওর গলায় সামান্য ভয়ের আভাসও দেখল না রায়ান।
এই ব্যাপারটা একটু চিন্তায় ফেলে দিল ওকে। থমকে গেল ও। কথাগুলো যেন ছুরির ফলার মতো ফালা ফালা করল তাকে। ওর মনে আছে, রাইসার মৃত্যুর পর সেই প্রথম কান্না পেয়েছিল ওর। একদম নিজেকে উজাড় করে দেয়া কান্না।
এর আগে আর কখন কেঁদেছে মনে ছিল না ওর। ওর শৈশবেও কখনো এতটা কান্না কেঁদেছে বলে মনে পড়ে না। এরপর ওই পাদ্রীসহ রাইসার কবরের পাশে বসে দীর্ঘণ ধরে চোখের পানি ফেলেছে রায়ান। মন খুলে কথা বলেছে ওর সাথে। নিজে যতটা বলেছে, শুনেছে তার চেয়ে বেশি।
গসপেল থেকে ওকে অনেক কথা বলেছে পাদ্রী ওয়াল্ট। বড় হওয়ার পর থেকে ওসব কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক চুকে বুকে গিয়েছিল ওর। ও চার্চে যায় না। যায় না বলে নিজের ভেতর তেমন কোনো অস্বস্তিও বোধ করে না। মনে আছে, অনেকদিন আগে বিরাট এক সমাবেশে এক লোকের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা শুনে শেষবার চার্চে ঢুকেছিল ও। ওই লোকের দরাজ গলার বক্তৃতা এখনো ওর কানে বাজে। চারদিন ধরে চলেছিল ওই সভা। রায়ান এর পরে কখনো আর কোনো ধর্মসভায় যায়নি।
রাইসার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে পাদ্রীর কথাগুলো শুনল রায়ান। পাদ্রী যীশুর কথা বলল। বলল, কীভাবে তিনি মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। মানুষ তাকে ভুল বুঝে শুলে চড়িয়েছিল। তাঁর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ক্রুশকাষ্ঠ। পাদ্রী বলল, আসলে ঈশ্বর তা-ই চেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তার প্রতিদানও দিয়েছিলেন। ওই রক্তে মানুষের পাপ ধুয়ে মুছে গিয়ে মানবজাতিকে তার স্রষ্টার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। ‘আসলে এটা ছিল মানুষের প্রতি তার সৃষ্টিকর্তার একটা উপহার। পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ মন নিয়ে তার কাছে ফিরে যাওয়ার সব চেয়ে সেরা উপায়,’ পাদ্রী নিজের বিশ্বাস থেকে বলেছিল এসব কথা। ওর পরিবর্তনের মূলে সে কথাগুলো কতটা প্রভাব ফেলেছিল, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় রায়ান।
পাদ্রী বলেছিল, একজন মানুষকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, তার নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়েই যীশু খ্রীস্টকে শুলে চড়তে হয়েছিল। এ জন্যে মানুষকে অনুতপ্ত হতে হয় আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয় যে, তার আত্মা যেন সর্বদা পবিত্র থাকে।
রায়ান তর্ক করেছিল পাদ্রীর সঙ্গে। বলেছে, একজন মানুষের নিজেকে রা করার ব্যাপারে অটল থাকা উচিত। তাকে অন্যের স্বার্থ ব্যাহত না-করে নিজের সহায়-সম্পত্তি রা করার কাজেও দৃঢ়তা দেখাতে হবে। তার উচিত হবে না একজন খুনিকে মা করা। কারণ যারা মানুষ খুন করে, ঈশ্বরও তাদের মাফ করেন না। এটা করতে হলে রায়ানের নিজেকেও বেঁচে থাকার জন্যে একজন খারাপ মানুষের দয়া-দােিণ্যর ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
পাদ্রীর কথাগুলো মেনে নেয়া সহজ হয়নি ওর প।ে তবে ওর রাগ আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে কৌতূহল জেগে উঠেছিল মনে। তারপর পাদ্রী যখন রাইসা সম্পর্কে বলতে শুরু করল, তখন মনোযোগ দিয়ে শুনল ওর কথা। পাদ্রী বলল, রাইসা আর তার বউ একত্রে হাঁটু গেড়ে বসে তার জন্যে প্রার্থনা করত। বিশেষ করে রাইসা প্রার্থনায় স্বামীর জন্যে কী চাইত, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলল। শুনতে শুনতে স্তব্ধ হয়ে গেল রায়ান। ওর ভেতরে আশ্চর্য এক অনুভূতির জন্ম নিল।
রাইসার মধ্যে ধীরে ধীরে আসা পরিবর্তনগুলোর কথা মনে পড়ল রায়ানের। এক রোববারের বিকেলে রাইসা চার্চ থেকে বাড়ি ফিরল। গুন গুন করে গান গাইছিল মেয়েটা। ওকে খুব সুখী আর পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছিল। রায়ান এর আগে আর কখনো ওর মধ্যে এমন ভাব দেখেনি। রায়ানের মনে পড়ল, রাইসা সেদিন ওর সাথে গল্প করতে গিয়ে বারবার ঈশ্বর নিয়ে কথা বলছিল। এক সময় ওকেও ওর সাথে চার্চে যেতে রাজি করানোর জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করেছিল।
রায়ান পাত্তা দেয়নি ওকে। রাইসা আর পীড়াপীড়ি করেনি। কিন্তু এর পর থেকে রাইসার মধ্যে একটা পরিবর্তন খেয়াল করল। কোনো ব্যাপারে সে আর আগের মতো উৎসাহ দেখাচ্ছে না। রাইসাকে খুব ধর্মপরায়ণ বলে জানত রায়ান। তাতে অবশ্য তার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু তাই বলে ওকেও তাতে জড়িয়ে ফেলতে চাইবে, এতটা ভাবেনি।
রাইসার পরিবর্তনটা বেশ আনন্দের সাথেই খেয়াল করল রায়ান। কোনো কিছু নিয়ে রেগে গেলে খুব বেশি চেঁচামেচি করার স্বভাব ছিল মেয়েটার। এমনকী ও কাজশেষে ঘামে গরমে অস্থির হয়ে ফিরে এসেছে মাত্র, তখনই ও শুরু করত চেঁচামেচি, রায়ানকে হাত-মুখ ধুয়ে সুস্থির হয়ে বসার সময়টুকু পর্যন্ত দিত না। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে রাইসার সে-অভ্যাসটা যেন একেবারেই চলে গেল। এর মধ্যে সে খেয়াল করল নতুন কিছু জিনিস। যেমন রায়ানের ফেরার আভাস পাওয়া মাত্র রাইসা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওকে অভ্যর্থনা জানাত, পানি এনে দিত প্রথমে হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে। এরকম আরো কিছু ছোটখাট পরিবর্তন চোখে পড়ল। রায়ান অবাক হলো এবং রাইসার এসব পরিবর্তন উপভোগ করতে শুরু করল।
পাদ্রী আরো কিছুণ থেকে চলে যাওয়ার পর রায়ান হাঁটু গেড়ে বসল রাইসার কবরের পাশে। অনেকণ বসে রইল। যখন উঠল, তখন চোখের পানিতে গাল আর চিবুক ভেসে গেছে ওর। আর নিজের বুকের ভেতর টের পেল একধরনের শূন্যতা আর উদাসীনতা। অবাক বোধ করল রায়ান। এর মানে বুঝতে পারল না। কারণ এধরনের অনুভূতির সঙ্গে আর কখনো পরিচয় হয়নি ওর। ওর ভেতরের সব রাগ আর বিদ্বেষ যেন মরে গেছেÑএবং সে প্রথম তার মনে হলো, তার টেক্সাস ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। কারণ টেক্সাসে থাকা মানে সারাণ দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় থাকা। তার মানে হলো আরো লড়াই এবং খুন-জখম। এর মানে হলো সে যেমন কাউকে খুন করবে, তেমনি কারো হাতে নিজেও হয়তো একদিন খুন হয়ে যাবে। সুতরাং টেক্সাস ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা ওর পে খুব বেশি কষ্টকর হলো না।
দুই
বে লিভারি আস্তাবলের সামনে এসে দাঁড়াতে বাস্তবে ফিরে এল রায়ান। ওর নির্দেশনা ছাড়াই শহরে পৌঁছে গেছে ঘোড়াটা। ওটার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াল ও। সূর্যের আলোয় পোড়া মাটিতে ধুলো উড়ল ওর বুটের ঘষায়। ছোট একটা ছেলে এক পাশে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। ইশারায় ওকে ডেকে দুটো মুদ্রা গুঁজে দিল হাতে। চোখ মটকে আশ্বাস দিল, একটু বেশি যতœ-আত্তি করা হলে আরো বেশি বখশিস দেয়া হবে।
বে’টাকে ছেলেটির হাতে গছিয়ে দিয়ে রাস্তায় নামল রায়ান। কাঠের বোর্ডওঅক ধরে হাঁটতে লাগল। এটা একটা নতুন শহর। সম্ভবত বড় বড় র্যাঞ্চের উপস্থিতির কারণে গড়ে উঠেছে শহরটা। আরো সামনে এগিয়ে গেল সে। হোটেল থেকে খাবারের গন্ধ এসে নাকে লাগতে খিদে চাগিয়ে উঠল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে আগে গোসল ও বিশ্রামের জায়গা দরকার ওর। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার পেট ভরে খাবার।
কিছুদূর গিয়ে সামনে যে-হোটেলটা পেল সেটায় ঢুকে পড়ল ও। ভেতরটা আশ্চর্য রকমের ঠাণ্ডা। কোনো আলো জ্বলছে না। দেয়ালে নানারঙের কাগজ সেঁটে দিয়ে ভেতরের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে সম্ভবত। তবে খানিকটা গরম যে ঠেকানো গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাইরের তুলনায় ঘরটাকে বেশ শীতলই লাগছে তার কাছে। কোণার দিকে একটা টেবিল, তার পাশে একটা চেয়ার। চেয়ারে বসে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বাম হাতের ওপর গালের ভর রেখে দিবানিদ্রায় মগ্ন মালিক। হালকা নাক ডাকার আওয়াজ কানে এল রায়ানের। ওর সশব্দে ঢোকার শব্দও নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।
গলায় খাঁকার দিল রায়ান, মেঝেয় পা ঘষল লোকটাকে ঘুম থেকে জাগানোর উদ্দেশ্যে। লোকটার ঘুম ভাঙল, তবে কাস্টমার দেখে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ঠাণ্ডা চোখে দেখল এক পলক। ওর প্রশ্নের অপো করল না রায়ান, জরুরি ভঙ্গিতে জানাল তার খাবার, গোসল ও বিশ্রাম তিনটেই চাই।
এবার হাসল বুড়ো দোকানদার। আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘জানি। মেরী টমাস যেখানে রাঁধে, লোকজন খাবার জন্যে সেখানেই আসবে। তবে,’ হাই তুলল মস্ত করে, ‘এ-মুহূর্তে ওর ভাণ্ডারে কতটা আছে ঠিক বলতে পারি না। তুমি আসলে সন্ধে হওয়ার অনেক আগেই চলে এসেছ। এখানকার লোকেরা এত তাড়াতাড়ি খায় না। কেবল আমি, মেরী, মেজর আর জনাদুয়েক লোক ছাড়া। ওরা অবশ্য ওদের নিজেদের ঘরে বসেই খায়…’
মৃদু হাসল রায়ান। ‘ওকে বলো, এখন রান্না করে দিলে ওকে দ্বিগুণ টাকা দেব। খুশি হয়েই দেব।’
নিজের সিট থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল বুড়ো। দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল পাশের ঘরের উদ্দেশে। পাশের ঘরে নিচু স্বরে আলাপের শব্দ কানে এল রায়ানের। ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল ও। এক পাশের দেয়ালের কাছে গোটা তিনেক টেবিল পাতা, মাঝখানে দুটো। সিলিংয়ের তিন জায়গায় ল্যাম্প ঝোলানোর জায়গা। কয়লার তেলের গন্ধে ভারী পুরো ঘর। ঘরের পেছনের অংশে বিশাল স্টোভ। তাতে কয়লার আগুন জ্বলছে।
পায়ের শব্দে ঘাড় ফেরাল রায়ান। উজ্জ্বল রঙের অ্যাপ্রনপরা বিশাল এক মহিলাকে দেখল। ওর আপাদমস্তক জরিপ করছে মহিলা। চোখে কৌতূহলী দৃষ্টি। বয়স ও পরিশ্রমের কারণে মুখের কমনীয় ভাবটুকু হারিয়ে গেছে। তবে ওর কণ্ঠস্বর শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল রায়ান। প্রায় তরুণীদের মতো সজীব গলায় মহিলা ওকে বলল, ‘স্টিক, বীনস, আরবিউকলস আর…অ্যাপল পাইয়ের আবদার করলে পাবে না। গত ছয়মাস ধরে এখানে আপেল টাপেল আসে না।’
মৃদু হাসল রায়ান। ‘ওটা চাই না, ম্যাম। আর যা যা আছে, তার সব থেকে একটা একটা করে দাও। আর স্টিকটা যেন অন্তত একটা বাছুরের সমান বড় হয়। নইলে পেট ভরবে না। ভীষণ খিদে পেয়েছে। মনে হয় গত এক মাস ধরে কিছু খাইনি।’
ঠাসা এক প্লেট বীন, দুটো স্টিক, গোটা সাতেক কেক আর পরপর পাঁচ কাপ কফি খেয়ে মেরীর গুণকীর্তন করতে করতে দোকান থেকে বেরোল রায়ান। মিথ্যে বলেনি ও মেরীকে। এত তৃপ্তি সহকারে গত একমাস ধরে এতটা ভালো খাবার খেতে পায়নি সে।
বুড়ো দোকানদার অ্যান্থনি যে একটা লিভারিও চালায় জানতে পেল রায়ান। আরও পঞ্চাশ সেন্টের বিনিময়ে ঘোড়াসহ আস্তাবলে রাত কাটাবার অনুমতি পেল সে। শোয়ার জন্যে অবশ্য আলাদা কোনো ঘর ছিল না। মেরী তাকে বলেছিল, সাপ্লাই রূমের মেঝেয় শোয়ার জন্যে। কিন্তু রায়ানের কাছে আস্তাবলে খড় বিছিয়ে নিজের ঘোড়ার কাছেই শোয়াটাকেই ভাল মনে হয়েছে। খাওয়া দাওয়াটা যুৎসই হলেও গোসলের কথা তুলল না ও। শহর থেকে মাইল দুয়েক পুবে একটা নদী আছে। সকালে শহর থেকে বেরিয়ে নদীতে গোসল করে নেবে ভাবল।
রাতভর প্রায় মরার মতো ঘুমোল রায়ান। সূর্য দিগন্ত রেখা থেকে অনেকটা উঁচুতে উঠে আসার পর ঘুম ভাঙল ওর। চোখ না-খুলেই হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল ও। দেখল লোকগুলেকে। চারদিক থেকে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সংখ্যায় ওরা পাঁচজন। ওর থেকে একটু দূরে স্টলের পেছনে আরো দু’জনকে দেখল। সবাইকে কাউবয় বলেই মনে হলো ওর। তবে এদের দু’জনকে কাউবয় ছাড়াও অন্য কিছু মনে হচ্ছে। বছর কয়েক আগে ডজ সিটিতে এধরনের লোক দেখেছিল সে। এই দু’জনের চেহারায় উগ্র ভাব, দু’ চোখে কঠিন দৃষ্টি। পিস্তল ঝুলিয়েছে কোমরে। সাধারণ কাউবয়ের ঢঙে নয়, মুহূর্তের নোটিশে যেন ড্র করতে পারে, সেভাবে।
রায়ান ওদের পিস্তলের বাঁটগুলোর দিকে তাকাল। চকচকে বাঁটগুলো নিয়মিত ব্যবহারে মসৃণ। চামড়ার তৈরি হোলস্টার একটু নিচু করে বাঁধা উরুর সাথে। তৈরি হয়েই দাঁড়িয়ে আছে লোকগুলো, যেন প্রতিপরে সামান্য নড়াচড়াকেই নিজেদের জন্যে চ্যালেঞ্জ বলে ধরে নেবে।
স্বাভাবিকভাবে মানুষ যখন দাঁড়ায়, তখন একটা ঢিলেঢালা ভাব থাকে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে। কিন্তু বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি পাল্টে যায়। ওই ভঙ্গিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভয়, সাবধানতা, বিরক্তি কিংবা তীব্র আনন্দের অভিব্যক্তি। এই লোকগুলোকে দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে রায়ানের। সোজা ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, একে অন্যের কাছ থেকে কিছুটা ফাঁক হয়ে। সাধারণ কৌতূহলী দর্শকমাত্র নয় এরা। এমনভাবে মাঝখানে ফাঁক রেখে দাঁড়িয়েছে যেন কোমরে ঝোলানো পিস্তলে হাত দেয়ার সময় একে অন্যের দ্বারা বাধাগ্রস্ত না-হয়। আর তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, ল্যবস্তু তাদের সামনেই। লোকগুলোর চোখে কোনো ভাব নেই। মরা মানুষের চোখের মতো ঘোলাটে।
রায়ান এদের কাউকেই চেনে না। কখনো দেখেছে বলেও মনে করতে পারল না। তবে লোকগুলোর জাত চিনতে ভুল করল না ওর অভিজ্ঞ চোখ।
দীর্ঘদিন টেক্সাসে কাটিয়েছে সে। ওখানকার প্রায় সবগুলো মানুষই ওর পরিচিত। প্রতিটি মানুষের নাড়ি-নত্রসহ জানে ও। গোলমেলে ও ঝামেলাবাজ লোকগুলেকে দেখলেই চিনতে পারে। এই লোকগুলোকে দেখে ওর মনে হলো, এরা সেধরনের লোক, যারা টাকা পেলে সবকিছুই করতে পারে। হাসতে হাসতে মানুষও খুন করতে পারে। এরা এদের অস্ত্র মানুষ মারার জন্যে ভাড়া খাটায়। কে মরল এবং কেন মরল, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।
আগন্তুকদের মধ্য থেকে গালের হনু ঠেলে বেরিয়ে আসা শুঁটকো মতন একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ওই বে’টায় চড়ে তুমিই এসেছ, না?’
উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল রায়ান। তারপর স্টলের রেইলের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা নিজের অস্ত্রের কাছে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কারণ ঘোড়াটা আমার।’
লোকটার চোখে স্থির দৃষ্টি; দেখেই মনে হয়, শুঁটকো হলেও প্রচণ্ড মতাধর, আশেপাশের সবাইকে হুকুম দিতে অভ্যস্ত, কারো হুকুম শুনতে নয়। তীব্র চোখে তাকিয়ে ধমকে উঠল, ‘তোমার অন্যের জিনিস চুরি করার বদ অভ্যাস আছে!’
লোকটার মধ্যে অশুভ কিছু আছে, ভাবল রায়ান। সামান্য বেচাল দেখালেই অনর্থ ঘটিয়ে দিতে পারে। সন্দেহ নেই, সামান্য সুযোগের অপোয় আছে লোকটা। হাতদুটো নিশপিশ করছে।
‘না,’ প্রতিবাদের সুরে বলল রায়ান। ‘এটা চোরাই ঘোড়া নয়। এই ঘোড়াটাকে আমি হোয়াইট মাউন্টিনস এলাকায় পেয়েছি। এটা একটা বুনো ঘোড়া ছিল। আমি পোষ মানিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি।’
‘ঘোড়ার কথা কে বলছে তোমাকে?’ ভেঙচি কাটল অস্ত্রধারী। সরু চোখে তাকাল রায়ানের দিকে। ‘আমি বলছি আমার সম্পত্তির কথা, আমার খড় আর স্টলের কথা। তোমার ওই বেতো ঘোড়াটা যা খাচ্ছে, সেটা আমার খড় আর যেটা থেকে খাচ্ছে, সেটা আমারই স্টল।’
মৃদু হাসল রায়ান। হালকা গলায় বলল, ‘আচ্ছা, এই ব্যাপার? আমি জানতাম না, মিস্টার। ঠিক আছে, ওটাকে সরিয়ে নিচ্ছি আমি।’ ঘোড়াটাকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে স্টলের দিকে পা বাড়াল রায়ান। কিন্তু চোখের কোণায় নড়ে উঠতে দেখে তাকাল লোকটার দিকে। ওর হাতে কখন যেন অস্ত্র চলে এসেছে। ওর মাথা বরাবর তাক করা। চালু, অসম্ভব চালু লোকটা। অবাক হয়ে ভাবল রায়ান। এতটা চালু লোক সহজে চোখে পড়ে না। অন্তত ওর চোখে আর পড়েনি।
থেমে গেল রায়ান। বিব্রত চোখে অন্য লোকগুলোর দিকে চাইল। ওদের চোখে অবশ্য অতটা ভয়াবহ ভাব দেখল না। বরং কিছুটা কৌতূহল ল করল। নীরবে অপো করল ও। একচুলও নড়াচড়া করল না।
অন্য লোকটা বলল, ‘তুমি ওই ঘোড়া নিয়ে কোথাও যেতে পারবে না, মিস্টার। ওই ঘোড়া আমার স্টল থেকে খড় খাচ্ছে। এটা তোমার নয়, এটা এখন আমার ঘোড়া।’ লোকটার গলা মেয়েদের মতো নরম আর মোলায়েম, খেয়াল করল রায়ান।
লোকটার ওপর একই সাথে ঘৃণা আর ক্রোধ টের পেল রায়ান নিজের ভেতরে। বুঝতে পারছে, সে নিজে চাক না চাক, একটা ঝামেলাই জড়িয়ে পড়তেই হচ্ছে তাকে। ব্যাপারটা অসহ্য ঠেকছে ওর। এই ব্যাপারটাকে সে ঘৃণা করে। সে চায় প্রতিটি মানুষ তার যোগ্যতানুযায়ী প্রাপ্যটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুক। এর বাইরে হাত বাড়ানোটা অন্যায়। কারণ তাহলে তাকে অবৈধ পথেই তা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর তখনই চলে আসে অন্য লোকের ওপর জোর-জবরদস্তি কিংবা নির্যাতন চালানোর ব্যাপারটা। কিন্তু একজন মানুষকে নির্যাতন করার কোনো অধিকারই নেই আরেকজন মানুষের। এখানে দলে বলে ভারী হয়ে সে-চেষ্টাটাই করতে এসেছে এই লোক।
তবু নিজের ভেতর থেকে ঠেলে উঠতে চাওয়া রাগটা দমন করার চেষ্টা করল রায়ান। নিজের এই রাগটাকে মাঝে মধ্যে নিজের কাছেই অপরিচিত মনে হয় ওর। তবে এও ঠিক, এটাই তাকে এ- পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। এটা এমন এক রাগ, যা অনেককে ধবংস করেছে, কিন্তু ওর বেলায় কাজ করেছে একটা জীবনদায়িনী ওষুধ হিসেবে। নিজের এ-রাগটাকে সে বুঝতে পারে না, কিন্তু চিনতে পারে।
নিজের কোমরে ঝোলানো পিস্তলটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে রায়ান। কিন্তু সে পিস্তল বের করার কথা ভাবছে না। ঝামেলাটা খুনোখুনি পর্যন্ত না-নিয়ে অল্পতেই চুকিয়ে ফেলা যায় কিনা দেখতে চাইছে। কাউকে খুন করার ইচ্ছে ওর নেই।
তবে ইচ্ছে করলে খুন করার কাজটা সে শুরুই করতে পারে।
ও একা। আর ওরা চার পাঁচজন। স্বভাবতই নিজেদের নিরাপদ ভাবছে ওরা। ওরা রায়ানকে চেনে না। মনে মনে নিশ্চয় ওকে নিজেদের খেলার পুতুল হিসেবে ভেবে নিতে পারে ওরা। ওর তরফ থেকে কোনো ঝামেলা আশা করছে না। চুপচাপ ওদের হুকুম মেনে সরে যাবে, এমনটাই ভাবছে হয়তো। সুতরাং রায়ান আচমকা অ্যাকশনে গিয়ে পিস্তলধরা লোকটার হাত থেকে থাবা মেরে ওটা ফেলে দিয়ে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের পিস্তল বের করে নিতে পারে। ওর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে, এমন দু’তিনজনকে চোখের পলকে গেঁথে ফেলতে পারে। এদের অবস্থা দেখলে বাকি লোকগুলো আর দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। আতঙ্কে ওদের মনোবল ভেঙে যাবে। কার আগে কে পালিয়ে বাঁচবে, সে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে ওদের মধ্যে। কাকে কাকে খুন করবে, তার একটা ছকও তৈরি করে ফেলল সে মনে মনে।
কিন্তু তারপরও দ্বিধায় ভুগল রায়ান। লোকগুলোকে খুন না-করে অন্যভাবে কিছু করা যায় কিনা ভাবছে।
ওর মনের ভাব মুখে ফোটেনি। তবু লোকটা কী করে যেন তা আন্দাজ করতে পেরে আচমকা লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল। তারপর ঘিনঘিনে হাসি হেসে বলল, ‘মিস্টার, যেহেতু এই ঘোড়ার মালিক আমি, সেহেতু তোমার উচিত এখানে আর ঝামেলা না-পাকিয়ে চুপচাপ সরে পড়া। আর ওই স্যাডলটাও রেখে যাবে। ওটা ওই ঘোড়ার পিঠে চাপানোর উপযোগী করে বানানো।’
রায়ানের বাম পায়ের কাছে থুতু ফেলল সে। তামাক চিবানো বাদামি রঙের থুতুর দলা দেখে গা ঘিন ঘিন করে উঠল রায়ানের। ‘কই, হাঁটা শুরু করো। এুনি।’ তাড়া দিল লোকটা।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রায়ান।
‘মন্ট,’ আরেকজন কঠিনদর্শন বলল। ‘আমার মনে হয় ও যাতে আর কখনো ওর ঘোড়ার জন্যে এদিকে না-আসে, সেটা ওকে বলে দেয়া উচিত। কেন আসবে না সেটাও বুঝিয়ে দেয়া উচিত।’ রায়ানের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করল লোকটা।
লোকটার দিকে চাইল মন্ট। মৃদু হাসল। ‘চমৎকার বলেছ, পিট। আমিও তা-ই ভাবছিলাম। ও সম্ভবত এখনো ঠিক বুঝতে পারেনি আমাদের গুরুত্ব।’
ঠিক এ-সময়টায় অ্যাকশনে গেল রায়ান। এক সেকেন্ডের জন্যে গা ঢিলা দিল। সবগুলো লোকের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ভেবে লোকগুলো মোটামুটি বিনোদনের ভঙ্গিতে আছে। পর মুহূর্তে যেন অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিস্ফোরিত হলো রায়ান। মন্ট নামের লোকটাকেই বেছে নিল টার্গেট হিসেবে। গলায় প্রচণ্ড ঘুসি খেয়ে পেছনে ছিটকে পড়ল লোকটা, একজন কাউবয়ের ওপর গিয়ে পড়ল। এক সেকেন্ডও না-থেমে পাঁই করে ঘুরল রায়ান। ওর মতো দশাসই লোকের জন্যে অসম্ভব দ্রুত অ্যাকশন এটা। হাতে উল্টো পিঠের মার লাগাল অন্য পাশে দাঁড়ানো পিটের মাথায়। লোকটার পিস্তল হাতেই ছিল। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশমাত্র সময় পেলে ওটা খালি করে ফেলত ও রায়ানের শরীরে। মারের চোটে ঘুরে গেল পিট। পিস্তল ফেলে দিয়ে আহত মাথা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আরেকজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রায়ান। জোরসে এক ঘুসি লাগাল। পর মুহূর্তে ঘুরল চরকির মতো। কনুইয়ের গুঁতোয় গুঁড়িয়ে দিল আরেকজনের চোয়াল। একজনকে লাথি হাঁকাল। হাতের উল্টো পিঠে চাঁটি লাগাল আরেকজনের মাথায়।
এদিকে বৃষ্টির মতো কিল-গুঁতো-ঘুষি সমানে চলছে ওর ওপর। তবে কোনো ব্যথা-বেদনা যেন অনুভব করছে না সে। আসলে ভেতরের তীব্র ক্রোধের অচেনা সে-অনুভূতিটা খানিকক্ষণের জন্যে যেন আর সব অনুভূতির ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে ওকে।
কিন্তু হঠাৎই ওকে জানান দিল ব্যথা। আচমকা মাথা ঘুরে গেল ওর। চোখে অন্ধকার দেখল। মুখ থুবড়ে পড়ল সামনের দিকে। খানিকক্ষণের জন্যে চেতনা হারাল।
ওর প্রতিপ সাতজন। এর মধ্যে দু’জন অচেতন হয়ে পড়ে আছে। একজন গলা উজাড় করে বমি করছে আর দু’জন ককাচ্ছে পড়ে পড়ে। কোনোমতে উঠে বসে ভাঙা চোয়াল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে একজন। সাত নম্বর যে, সে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মারের ভয়ে বিশাল প্রতিপরে কাছে আসার সাহস হয়নি ওর। রায়ান অচেতন হয়ে পড়ে যেতে এগিয়ে এল এবার। মাথার ওপর শাবল তুলে দাঁড়াল। তারপর নামিয়ে আনল ওটা লুটিয়ে পড়া লোকটার মাথায়।
তিন
টেক্সাসের সকাল বেলাটা সব সময় অন্য রকম। নয়নাভিরাম, মনোমুগ্ধকর। আজকের সকালটাও তার ব্যতিক্রম নয়। জন রায়ান টেক্সাসের এই মনোরম সকালটা সব সময় উপভোগ করে। মনে কেমন একটা উৎফুল্ল আর পবিত্র ভাব জাগে।
অথচ ধর্ম-কর্ম নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না ও। রাইসা যখন বেঁচেছিল, ওকে গির্জামুখো করার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কখনো ওর কথায় কান দেয়নি রায়ান। কিন্তু অন্য যে কোনো ব্যাপারে সে চেষ্টা করত রাইসা কোনো কথা বললে তা রাখার জন্যে। রাইসার সঙ্গে কখনো ঝগড়াঝাটির উপক্রম হলেও সকাল বেলাটায় সেটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত সে।
কিন্তু আজকের সকালটা রায়ানের জন্যে অন্যরকম। বার্নের ভেতর শুয়ে আছে ও। বেড়ার ফাঁকে সূর্যের আলোর ছটা এসে পড়েছে। তাপের মাত্রা বাড়ছে। অস্বস্তি বোধ করেছ রায়ান। সকালটা উপভোগ করতে পারছে না।
বার্নের ভেতরটা দিনের আলোয় উদ্ভাসিত। খড়ের ওপর শুয়ে আছে ও। ওর হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। ঘণ্টা দুই আগে জেগে উঠেছে ও। টেক্সাসের সকাল আস্তে আস্তে দুপুরের দিকে গড়াচ্ছে ওর চোখের ওপর দিয়ে। কিন্তু শক্ত দড়ির বাঁধনে বন্দি ও। ছাড়া পাওয়ার কোনো উপায় দেখছে না। তা ছাড়া ওর কাছাকাছি বসে পাহারা দিচ্ছে দু’জন কাউবয়। দু’জনেই অবশ্য কান্ত, ঢুলছে বসে বসে।
অস্ফুট আওয়াজ করল রায়ান। চোখ মেলে চাইল একজন। বন্দিকে আগের অবস্থায় দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে হাই তুলল। এরপর বলল, ‘মিস্টার, গত রাতে তুমি মারাত্মক এক ভুল করে ফেলেছ। না-জেনে শুনে একদল ভুল লোকের গায়ে হাত তুলেছ। এদের মধ্যে পিট তো চাইছে তোমাকে স্রেফ চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। আর মন্ট? সে যে কী করবে, তা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু যা করার তা ঠিকই করবে। বেয়াদবির শাস্তি হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে তোমাকে। ওকে আমি শপথ করে বলতে শুনেছি।’
লোকটার দিকে খানিকণ তাকিয়ে রইল রায়ান। নেহাত সাদাসিধে কাউবয়। মন্ট কিংবা পিটের দলের সাথে খাপ খায় না। মৃদু হাসল ও। বলল, ‘তোমাদের কিন্তু ওদের মতো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মায়-দয়া আছে মনে। ওরা তো ঘোড়াচোর। পরের ঘোড়া দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। তাই এই নাটক সাজিয়েছে। তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি কেটে পড়ি এখান থেকে।’
‘উঁহুঁ, সেটা পারব না।’ সজোরে মাথা দোলাল লোকটি। ‘তাহলে ওরা স্রেফ খেয়ে ফেলবে আমাদের। তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না, মিস্টার। উঁহুঁ, কখনোই না। তার চেয়ে ওরা র্যাঞ্চ থেকে ফিরে না-আসা পর্যন্ত চুপচাপ শুয়ে থাকো।’ নিজের হাতে ধরা রাইফেলটা একটু নাড়াল লোকটা। হেলাভরে উঁচিয়ে ধরল রায়ানের দিকে।
‘এই মন্ট লোকটা কে বলো তো?’ নিরীহ মুখে জানতে চাইল রায়ান। ‘তোমরা কোন র্যাঞ্চের হয়ে কাজ করছ?’
‘কে-বার।’ রাইফেলঅলা লোকটা জবাব দিল। ‘বুড়ো রেস্টনের আউটর্র্ফিট। মন্ট বেলারের ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিউ মেক্সিকোর লিংকন কাউন্টি থেকে এসেছে জানি। আমাদের এখানে রাসলারের উৎপাত ছিল। তাদের দমনের জন্যে আনা হয়েছিল তাকে। ও আর পিট কেলার এসে রাসলারের উৎপাত বন্ধ করেছে। বছর তিনেক আগে এসেছিল ওরা। তার পর থেকে এখানে।’
‘আমার পায়ের রশিটা একটু ঢিলে করে দেবে, ভাই?’ লোকটাকে অনুরোধ জানাল রায়ান। ‘রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘উঁহুঁ, আমাদের ওপর আদেশ হলো তোমাকে পাহারা দেয়ার। তোমাকে ছোঁয়াও যাবে না, এমনকী, তোমার কাছে যাওয়াও নিষেধ। তোমাকে তেড়িবেড়ি করতে দেখলে দূর থেকে তোমার বুকে স্রেফ একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিতে বলা হয়েছে।’
কঠিন চোখে লোকদুটোর দিকে তাকাল রায়ান। তারপর বলল, ‘এই ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, আমার জানা নেই। তবে তোমাদের সৌজন্যের কথা আমার মনে থাকবে। তোমাদের কিন্তু এদের সঙ্গে মানায় না।’
বিব্রত বোধ করছে দুই কাউবয়। রায়ান সম্পর্কে ওদের বলা হয়েছিল, লোকটা কঠিন ও বিপজ্জনক। লোকটা কঠিন ঠিকই আছে, কিন্তু ওদের কাছে আদৌ বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না। তবু লোকটার কঠিন আর ধূসর রঙের চোখদুটোর দিকে তাকানোর শক্তি পাচ্ছে না ওরা। চোখ ফিরিয়ে নিল। লোকটার মধ্যে যা আছে, তা হলো কঠিন পৌরুষ আর ব্যক্তিত্ব। এটা কিন্তু মন্ট বেলার আর পিট কেলারের চোখে কখনো দেখেনি ওরা। ওদের চোখে সারাণ অশুভ দৃষ্টি।
তবু কেমন যেন একটা ভীতিকর ব্যাপারও দেখতে পাচ্ছে তারা বন্দির চোখে। এমন ভাব তাদের সাদাসিধে কাউবয় জীবনে তেমন পরিচিত নয়। আচমকা শিউরে উঠল একজন। বিড় বিড় করল লোকটা। তারপর উঠে বেরিয়ে গেল। সঙ্গীকে বলল, সে একটু কফি খেয়ে গলা ভেজাতে যাচ্ছে। রাইফেলঅলা লোকটা একটু পিছিয়ে বসল। তারপর রায়ানের মাথার ওপর দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বন্দির চোখে তাকাতে চাইছে না সে।
ঠিক দুপুরের দিকে কয়েকটা ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনল রায়ান। মিনিটখানেক পর খোলা দরজায় মন্ট বেলারের হালকা পাতলা শরীরটা দেখতে পেল। ওর পেছনে আরো কয়েকজন এসে ঢুকল বার্নে। লোকগুলোকে চিনতে পারল রায়ান। গতরাতের ধুন্ধুমার লড়াইয়ের সময় এরাও ছিল। এদের অনেকের শরীরের নানা জায়গায় ব্যান্ডেজ করা। ব্যান্ডেজ ছাড়াও আছে দু’একজন। তবে তাদের গায়েও গত রাতের চিহ্ন কিছু কিছু দেখতে পেল রায়ান।
ভেতরে ঢুকে ভীষণ চোখে বন্দির মুখের দিকে তাকাল মন্ট বেলার। সামান্য ভীতির চিহ্নও নেই লোকটার মুখে। তার বদলে এমন এক কঠিন অভিব্যক্তি ফুটে আছে, যে-অভিব্যক্তির সঙ্গে ওর কোন পরিচয়ই নেই। লোকটা যেন ভয় পেতেই জানে না।
রায়ানকে বন্দি অবস্থায় জবুথবু হয়ে বসে থাকতে দেখবে আশা করেছিল মন্ট। কিন্তু লোকটার এই অকুতোভয় ভঙ্গি ওর ক্রোধ আরো বাড়িয়ে দিল। খেঁকিয়ে উঠে হুকুম দিল, ‘ওটাকে টেনে তোলো। পায়ের বাঁধন খুলে দাও।’
হুকুম পালন হতেই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল রায়ান। রক্ত চলাচল শুরু হওয়ায় দুই পায়ে ঝিন ঝিন অনুভব করল। মনে হলো দুই পায়ে একযোগে হাজার হাজার সূঁচ বিঁধিয়ে দিচ্ছে কেউ। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে রায়ান। ব্যথার ভাব মুখে ফুটে উঠতে দিচ্ছে না।
কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড আঘাত খেল ও। আচমকা সারা মুখ ও মাথায় ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল। সেখান থেকে পুরো শরীরে। ওর শরীর থর থর করে কাঁপতে শুরু করল। দুর্বল পা দুটো শরীরের ভর যেন সইতে পারছে না। আগায় সীসে মোড়ানো চাবুকটা ফের ঝলসে উঠল মন্টের হাতে। আবার আঘাত হানল ওটা রায়ানের শরীরে। এবার পেটে লাগল। এর পর যেন বৃষ্টির মতো শুরু হয়ে গেল চাবুকের আঘাত। মন্টকে দেখে মনে হলো রাগে স্রেফ পাগল হয়ে গেছে। সমানে চাবুক চালাচ্ছে ও, এক মুহূর্ত বিরাম দিচ্ছে না। সে সাথে গালাগালি আর অভিশাপের তুবড়ি ছুটছে মুখ দিয়ে। দু’হাত বাঁধা থাকায় বাধা দেয়ার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না রায়ান।
চাবুকের আঘাতে সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলছে। আস্তে আস্তে বোধের বাইরে চলে যাচ্ছে যন্ত্রণা। টেক্সাসের উজ্জ্বল দুপুরের রঙ মিলিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। অসহ্য কষ্টে শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল রায়ান বার্নের ভেতর।
* * *
চেতনা ফিরে পেতেই সারা শরীরে নরকযন্ত্রণা অনুভব করল রায়ান। জীবনে আর কখনো এমন যন্ত্রণা ভোগ করেছে কিনা মনে করতে পারল না। চাবুকের ঘায়ে মুখ কেটে ফালা ফালা হয়ে গেছে, ফুলে গিয়ে চোখের পাতা বুজে এসেছে প্রায়। এমন দিনের আলোয়ও সব কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে। ওর চারদিকে লোকের উপস্থিতি টের পাচ্ছে সে। লোকগুলো কথা বলছে। কিন্তু ওদের গলার স্বরকে মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা শব্দের মতো। ঝাপসা চোখে চারপাশে দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে নরক থেকে এই মাত্র উঠে আসা শয়তানের দল।
আচমকা মুখের ওপর ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা টের পেল ও। ঘোর কেটে গেল। আরো দ্বিগুণ হয়ে উঠল যেন শারীরিক যন্ত্রণা। একই সাথে টের পেল বুকফাটা তৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে ওর। মুখে পানির ফোঁটা পড়তে নিজের অজান্তে ঠোঁট ফাঁক করে লোভীর মতো জিভ বের করে চাটতে লাগল। ওর মুখের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল মন্ট বেলার। আহতকে ভিখিরির মতো ঠোঁট চাটতে দেখে খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল লোকটার।
বুটের গুঁতো লাগাল ও রায়ানের মাথায়। খুশিতে ঘোঁৎ করে উঠল, ‘মিস্টার! তুমি আস্ত বোকা। তাই মানুষ চিনতে পারোনি। ভুল লোকের গায়ে হাত তুলেছিলে। এখানে এমন লোকও আছে, যাদের গায়ে তোমার মতো খেঁকশিয়ালের হাত তোলার সাহস থাকা উচিত নয়। আমি সেধরনের মানুষদের একজন। আমি তোমাকে এখনো তেমন কিছু করিনি। তোমার আরো শাস্তি পাওনা আছে। আমার মতো লোকের গায়ে হাত তুলতে হলে আমাকে চিরতরে শেষ করে দিতে হবে। যেমন আমি তোমাকে শেষ করে দেব। তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচানোর সাধ্য কারো নেই।’
‘আমারও সে একই কথা, মিস্টার। তুমি লোক চিনতে ভুল করেছ। পিট কেলার এমন এক লোক, যার দিকে একটি আঙুল উঁচানো মানে নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করা।’ এ-কান থেকে ও-কানজোড়া হাসি নিয়ে পিট কেলার দাঁড়িয়েছিল বেলারের পাশেই। ভূমিশয্যায় শায়িত লোকটাকে দেখে দারুণ আনন্দ পাচ্ছে। বেলারের বক্তব্য শেষ হতেই জানিয়ে দিল নিজের বক্তব্যও। গলা খাঁকার দিয়ে সাড়ম্ভরে থুতু ফেলল। তামাকের রসমেশানো বাদামি রঙের নোংরা পদার্থটুকু গিয়ে পড়ল রায়ানের চিবুকের ওপর।
শায়িত বন্দির মাথার পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসল মন্ট। ওর চিবুকের ওপর সঙ্গীর ‘কীর্তি’র দিকে তাকাল এক নজর। হাসল। মজা পেয়েছে সেও। তারপর নেহাত আলাপের ভঙ্গিতে বলল রায়ানকে, ‘শোনো, স্ট্রেঞ্জার। তোমার হাত-পা গরুর চামড়া দিয়ে বাঁধা। কাঁচা চামড়া। তোমার কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে যদি জানতে চাও, তাহলে বলি। এই চামড়া যতই রোদে শুকোবে, ততই খিঁচে বসবে। এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবে যে তোমার মাও কোনোদিন তোমাকে অমন করে জড়িয়ে ধরে আদর করেনি। আমরা কদিন পরে দেখতে আসব, তোমার কী অবস্থা হয়েছে। এটা এমন কিছু না। অ্যাপাচিদের কাছ থেকে শেখা ছোট্ট একটা কৌশল মাত্র।’
উঠে সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। গট গট করে হেঁটে ঘোড়ার কাছে গেল। বন্দির দিকে আরেকবার তাকিয়ে লাফ দিয়ে চড়ে বসল বাহনের পিঠে। যুৎ হয়ে বসে আবার চাইল। ‘দিনকয়েক পরে আবার দেখতে আসব, স্ট্রেঞ্জার। কথা দিচ্ছি।’ হলুদ দাঁতের সারি দেখিয়ে হাসল আবার। ‘তবে তুমি আমায় দেখবে না। কারণ তুমি ততদিনে মরে কয়োটের খাদ্য হয়ে যাবে।’
রায়ান দেখল ওর ফ্যাকাসে ঠোঁটদুটো। এ-লোক নিষ্ঠুর। খুন করাই ওর আনন্দ। কাউকে কষ্ট দিয়ে মারতেই বেশি পছন্দ করে। অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণায় ধুঁকতে ধুঁকতে ভাবল ও।
ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল কেলার। ওর লোকেরাও চলল পিছু পিছু।
লোকগুলোর ঘোড়ার খুরের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পরও কয়েক মিনিট চুপচাপ পড়ে রইল রায়ান। তারপর শরীরের ব্যথা-বেদনার কথা ভুলে গিয়ে পরিস্থিতি বিচার করার চেষ্টা করল। ব্যাপারটা সহজ নয়। কিন্তু সে জানে, এখন মাথা না-ঘামালে আর কোনোদিনই সে-সুযোগ পাবে না।
বার্নের ভেতর প্রচণ্ড মারধরে সে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর তাকে এখানে নিয়ে এসেছে ওরা। জায়গাটা চিনতে পারল না ও। তবে মনে হচ্ছে মোটামুটি একটা মরুভূমি। শুকনো খটখটে মাটি। মাঝে মধ্যে বালিয়াড়িও দেখা যাচ্ছে। কাছেই ছোট ছোট পাহাড়-টিলা। আশে পাশে মানুষের বসতি আছে বলে মনে হয় না।
নিজের অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারছে রায়ান। গরুর কাঁচা চামড়া দিয়ে হাত-পা বাঁধা ওর। এ-চামড়া যতই শুকোবে, ততই শক্ত হয়ে এঁটে বসবে। একসময় চামড়া কেটে সেঁটে যাবে শরীরের সাথে। সেটা যে কেমন অমানুষিক যন্ত্রণা, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
এই অমানুষিক যন্ত্রণা সইতে সইতে এক সময় দুর্বল হয়ে পড়বে সে। খিদেয় শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসবে। সময় যতই বয়ে যাবে, ততই তার মুক্তি পাওয়ার আশা কমতে থাকবে। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে এবং সে-অবস্থায় মারা যাবে।
ওকে খুব খারাপভাবে মারধর করা হয়েছে। ও শরীরে যথেষ্ট শক্তি ধরে, এক কথায় অসাধারণ, তবু এখন সে দুর্বলতার চরমে পৌঁছেছে। এতটা দুর্বলতা সে আর কখনো অনুভব করছে কিনা মনে করতে পারছে না। ব্যাপারটা চিন্তা করতে অবাক লাগছে ওর। কিন্তু‘ সে যা-ই হোক, জীবনে এর চেয়ে আরো অনেক কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়েছে ওকে। কোনো সমস্যাই শেষ পর্যন্ত হারাতে পারেনি। প্রচণ্ড মনের জোর আর ইচ্ছাশক্তির বলে কাটিয়ে উঠেছে সেসব। ওর বিশ্বাস, এখানেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে মুক্ত করার একটা উপায় বের করে ফেলবে সে। কিন্তু শরীরের এরকম ভয়াবহ অবস্থায় কীভাবে তা করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
পুরো ব্যাপারটা শুরু থেকে ভাবতে চাইল সে। শারীরিক যন্ত্রণার কারণে ওর মাথা কাজ করতে চাইছে না। কিন্তু ও জানে, এই অমানুষিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে ওকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। সমস্যার ধরনটা বুঝতে হবে। ভয় পাওয়া কিংবা হতাশ হওয়া চলবে না।
বাইসনে ঢোকার আগে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। সে নির্বিরোধী মানুষ। কারো সাতে-পাঁচে থাকার স্বভাব ওর নয়। এক সময় ল’ম্যানের কাজ করেছে, কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী কখনো কখনো কারো গায়ে হাত তুলতে হয়েছে, কারো দিকে পিস্তল উঁচাতে হয়েছে। কিন্তু এসবই ছিল চাকরির অংশ। টেক্সাসে বেয়াড়া টাইপের কিছু লোক ওর হাতে নিকেশ হয়েছে, এটা সত্যি। তবে রায়ান কখনো আগ বাড়িয়ে কারো গায়ে হাত তোলেনি, খুন করা তো দূরের কথা।
রাইসাকে বিয়ে করে র্যাঞ্চিং শুরু করার পর থেকে ওকে আর পিস্তলের দিকে হাত বাড়াতে হয়নি। পশ্চিমের একজন সৎ ও কঠোর পরিশ্রমী র্যাঞ্চারের ধরনে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এটা আসলে ওর নিজেরই স্বভাব, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাইসার নিষেধ।
র্যাঞ্চিংয়ে লোকসান না-হলে এবং রাইসা অকালে মারা না-গেলে ওখানেই থেকে যেত ও। টেক্সাস ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হতো না।
কিন্তু সেটা অন্য ব্যাপার। তার সাথে ওর আজকের এ-অবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। এমন নয় যে, সে কোনো ভুল করেছে এবং ভুলের খেসারত হিসেবে তাকে আজকের এ-অবস্থায় পড়তে হয়েছে।
এ-লোকগুলোর কাউকে সে চেনে না। কোনোদিন দেখেছে বলে মনেও করতে পারছে না। এদের সাথে ওর কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তবু তা হয়ে গেছে। কিন্তু সে জন্যে সে মোটেই দায়ী নয়। লোকগুলো আসলেই খারাপ। নিরীহ কাউকে পেলে হয়রানি করা ওদের স্বভাব। ওর যথাসর্বস্ব লুটে নেয়াই ওদের ধর্ম। ওদের লোভের আগুনে পুড়ে এখন জীবন সংশয় হয়ে উঠেছে রায়ানের। ওর হাত-পা বেঁধে মরুভূমিতে ফেলে গেছে, যাবার সময় বলে গেছে, কদিন পরে দেখতে আসবে, ও মারা গেছে কিনা।
নিজের অবস্থাটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে রায়ান। ওর হাত-পা বাঁধা গরুর কাঁচা চামড়া দিয়ে। রোদের তেজে এই চামড়া আস্তে আস্তে শুকোতে থাকবে। যতই শুকোবে, ততই এঁটে বসবে বাঁধন। এক সময় হাত-পায়ে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাবে। চামড়া কেটে বসে যাবে মাংসের গভীরে। অসহায়ের মতো যন্ত্রণায় প্রাণফাটা আর্তনাদ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না বন্দির জন্যে। একসময় মরে গিয়ে কয়োটের খাবারে পরিণত হবে।
চার
কিন্তু জন রায়ান ভাঙে, কিন্তু মচকায় না। নিজের সম্পর্কে এমনি ধারণা ওর। জীবনে অনেক বড় বড় সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়েছে ওকে। জীবন সংশয় হয়েছে। তবে প্রত্যেকবারই সঙ্কট থেকে উতরে এসেছে নিজের কঠিন মনোবল আর চেষ্টার মাধ্যমে। যে কোনো বিপদেই মাথা ঠাণ্ডা রাখা ওর সহজাত অভ্যাস। অভ্যাসটা গড়ে ওঠার মূলে কাজ করেছে ওর বুড়ো দাদুর জীবনভর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে শোনা বিভিন্ন গল্প। দাদু ছিলেন পশ্চিমের একদম প্রথম দিককার সেটলার। বৈরী সময় আর পরিস্থিতির মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হয়েছে ওদের। লড়তে হয়েছে ইন্ডিয়ান, আউট ল’ আর দখলদারদের বিরুদ্ধে। দাদু সারা জীবন প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচেছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নাতিকে শিখিয়েছেন কীভাবে বৈরী পরিবেশের বিপরীতে বেঁচে থাকতে হয়। দাদুর একটা কথা খুব মনে পড়ে ওর। বুড়ো ঘাগু সব সময় বলতেন, ‘এমন কোনো সমস্যা নেই, যা সমাধান করা মানুষের পে সম্ভব নয়। দরকার শুধু সমস্যাটাকে ঠিক মতো বোঝার চেষ্টা করা আর সমাধানের উদ্যোগ নেয়া। সমাধানের উপায়টা আপনা আপনিই বেরিয়ে আসে।’
জন রায়ান বহুবার বহু বিপদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এমন সব বিপদ, যা একজন মানুষকে হতবিহ্বল করে দেয়। স্বাভাবিক বুদ্ধি নষ্ট করে দেয়। আত্মসমর্পণ করে বসে ভবিতব্যের কাছেÑÑএবং শেষে মারা যায়। ও জানে, এখন তার ঘোর বিপদ। এ রকম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া ধরতে গেলে অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবটাকেই সে সম্ভব করে তুুলবে। অত সহজে হার মানবে না।
একবার নিউ মেক্সিকোতে এমন ভয়ানক এক বিপদের মুখে পড়েছিল রায়ান। মরুভূমিতে তাকে এক নাগাড়ে তিন সপ্তাহ কাটাতে হয়েছিল। ওর সঙ্গে কোনো ঘোড়া ছিল না। এর মধ্যে নয়দিন তাকে অ্যাপাচিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়েছিল।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এক অ্যাপাচিকে ধাওয়া করার মধ্য দিয়ে। লোকটা মরুভূমিতে একা পেয়ে একটা পরিবারের সবাইকে খুন করে ওদের মালপত্র লুটে নিয়েছিল। ওই পরিবারটা ছিল রায়ানের পরিচিত। রায়ান খবর পেয়ে ওই অ্যাপাচির পিছু নেয় এবং ধাওয়া করে শেষ পর্যন্ত খুন করে বন্ধুহত্যার প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু এরই মধ্যে ওর পিছু নিয়েছিল ওই অ্যাপাচির গোত্রের সতেরো জন যোদ্ধা। প্রথম ধাক্কায় ওদের হাতে খুন হতে হতেও বেঁচে যায় রায়ান। অবশ্য ওর ঘোড়াটাকে গুলি করে মেরে ফেলে ওরা। এরপর শুরু হয়ে যায় এক অসম লড়াই। ঠিক লড়াই নয়, লড়াকু সতেরো জন অ্যাপাচির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর এক অবিশ্বাস্য, প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
আপাচিদের এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে লড়ে বেঁচে থাকাটা এক অসম্ভব ব্যাপার। আর সে লোক যদি হয় শ্বেতাঙ্গ, সে েেত্র সম্ভাবনাটা শতকরা একভাগও থাকে না। কিন্তু রায়ান সে-অসম্ভবটাকে সম্ভব করেছিল অবিশ্বাস্য মনের জোর আর প্রচণ্ড ক্রোধ দিয়ে। সতেরো জন অ্যাপাচিদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, বলা যায় লুকোচুরি খেলতে খেলতে সে যখন ুধা, পিপাসা আর কান্তিতে মর মর হয়েছে, ঠিক সে সময় মনের মধ্যে ভেসে উঠেছে মরুভূমিতে মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুর তীব্র যন্ত্রণায় কাতর মুখটি। ওর পেছনের ট্রেইলের কোনো এক জায়গায় পড়েছিল স্ত্রী আর শিশুসন্তানের মৃতদেহ। রায়ান কথা দিয়েছিল ওই অ্যাপাচিকে সে খুঁজে বের করে হত্যা করে এর বদলা নেবেই।
বন্ধুকে কবর দিয়ে ওর মৃত স্ত্রী-সন্তানের মৃতদেহ খুঁজে বের করে সে। তাদেরও কবর দেয়। তারপর পিছু নেয় ওই অ্যাপাচির। দুরন্ত ক্রোধে ধাওয়া করতে করতে ওর এলাকায় পৌঁছে ওর নাগাল পায় সে। তারপর খুন করে। এরপরই সতেরো জন অ্যাপাচি পিছু ধাওয়া করে ওকে। মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে কথা দিয়েছিল সে প্রতিশোধ নেবে। সে কথা রেখেছে ও। তারপর নিজেও বেঁচে এসেছে প্রায় অলঙ্ঘনীয় এক মৃত্যুর ঘেরাটোপ থেকে। যতটা না সাহস, শক্তি আর দতা দিয়ে, তার চেয়ে বেশি ইচ্ছাশক্তি বলে।
রায়ানের এখনকার অবস্থাও সেরকম ভয়াবহ। এখানে তাকে উদ্ধার করার জন্যে কেউ আসবে না। জনহীন মরুভূমিতে কারো সাহায্যের প্রত্যাশা করার কোনো কারণ নেই। এ-অবস্থায় মৃত্যুই শেষ পরিণতি। কিন্তু জন রায়ান কোনো কিছুর শেষ না-দেখে ছাড়ে না। যারা তার এ অবস্থা করেছে, তাদের সে চেনে না। ওদের কাছে কোনো ঋণ ছিল ন ওর। কিন্তু এরপরও সম্পূর্ণ বিনা-কারণেই ওরা তাকে অসহনীয় এক কষ্টকর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওদের এই ধৃষ্টতার শোধ না-তুলে সে মরে কেমন করে? এরকম দুরাচারের প্রতিকার না-করে মরাটাও তো অন্যায় হবে ওর।
নিজের ভেতর প্রচণ্ড ক্রোধ আর দুরন্ত এক ইচ্ছাশক্তি টের পাচ্ছে রায়ান। জীবন-মরণের সন্ধিণে দাঁড়িয়েও এই অর্থহীন মৃত্যুকে প্রবল তেজে অস্বীকার করতে চাইছে ওর মন। হাল ছেড়ে দেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সে এখান থেকে বেঁচে ফিরবে এবং যারা তার এ-অবস্থা করেছে, তাদের এর মাশুল কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবে। ওরা জানে না ওরা যার গায়ে হাত তুলেছে, তার নাম জন আব্রাহাম রায়ান।
কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু পাত্তা দিতে চাইছে না সে। প্রাণান্তকর চেষ্টায় মাথা ঘোরাচ্ছে চারদিকে। দেখতে চাইছে ঠিক কোন ধরনের জায়গায় ওরা ওকে ফেলে গিয়েছে। জায়গাটা উঁচু-নিচু নয়, সমতলই মনে হচ্ছে। এখানে সেখানে ভাঙাচোরা পাথরের চাঁই আর উস্কখুস্ক পাইনের ছড়াছড়ি। মাথার পেছনের অংশে কী আছে দেখার জন্যে এক অসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছে ও। অতি কষ্টে এপাশ-ওপাশ করল। মাথাকে যতটা সম্ভব ঘোরানো যায় ঘোরাবার চেষ্টা করল। তাতে অবশ্য খুব বেশি কাজ হলো না। তবে এটুকু আন্দাজ করতে পারল যে, বাঁচার জন্যে চেষ্টা চালানোর মতো কিছু না কিছু উপায় খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে। কথাটা বুঝতে পেরে মনে কিছুটা স্বস্তি পেল রায়ান।
জায়গা থেকে নড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ও। কিন্তু শরীরে অসহ্য ব্যথার কারণে খুব একটা সুবিধে করতে পারছে না। ব্যথা আবার নতুন করে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে ঢিলে দিল না সে। দাঁতে দাঁত কামড়ে সহ্য করছে। আস্তে আস্তে ইঞ্চি ইঞ্চি করে জায়গা থেকে নড়ার চেষ্টা করছে। অনেকণ চেষ্টা করে কয়েক ফুট সরে গেল জায়গা থেকে।
হাঁফাতে হাঁফাতে বিশ্রাম নিতে লাগল রায়ান। খাণিকণ পর আবার চেষ্টা চালাল। কয়েক ফুট এগিয়ে আবার বিশ্রাম নিল। আরো প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে পুরোটা ঘুরে গেল। এখন তার পা যেদিকে আগে মাথা ছিল সেদিকে।
‘হুঁ,’ কোলা ব্যাঙের মতো ঘোঁৎ শব্দ বেরোল ওর মুখ থেকে। ‘এবার মনে হয়, একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারব।’
ব্যথা, পরিশ্রম আর উদ্বেগে গলার স্বর বিকৃত হয়ে গেছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ। জিভ নড়তে চাইছে না। পিপাসায় বুকের ভেতরটা যেন খাঁ খাঁ করছে। তবে এসব অসুবিধেকে পাত্তা দিচ্ছে না সে। ওর কাছ থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে একটা অ্যারোয়ো। আর অ্যারোয়ো মানে হলো একটা ভালো আশ্রয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অ্যারোয়োর ভেতরে শুয়ে নিশ্চিন্তে মৃত্যুর জন্যে অপো করতে পারবে। খোলা মরুভূমিতে রোদে শুকিয়ে মরার চেয়ে ছায়াময় একটা জায়গা বেছে নিয়ে মৃত্যুর অপো করাটা কিছুটা হলেও আরামের। তবে রায়ান এখনই হাল ছেড়ে দিচ্ছে না। যতণ নাক দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস চলবে, ততণ হাল ছেড়ে দেয়ার কথা ভাববে না সে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রায়ান। ধীরে ধীরে গড়াতে শুরু করল অ্যারোয়োর দিকে। কিন্তু মিনিটখানেক গড়িয়ে যেতেই অসহযোগিতা শুরু করল শরীর ও মন দুটোই। মনে হচ্ছে স্রেফ পণ্ডশ্রম। সে কখনো ওই অ্যারোয়োর কাছে পৌঁছাতে পারবে না; তার আগেই জ্ঞান হারাবে এবং সে-অবস্থায় মারা যাবে।
কিন্তু বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছের কাছে হার মানল শারীরিক যন্ত্রণা আর মানসিক অনীহা। দাদু বুড়ো ম্যাক রায়ানের কথা মনে পড়ল। দাদু গল্প শেষ করে বলত, ‘বাছা, আশা ছাড়বি না কখনো। তাহলে দেখবি একটা না একটা উপায় বেরিয়ে পড়েছে।’
আস্তে আস্তে গড়াতে গড়াতে প্রায় মিনিট দশেক পরে অ্যারোয়োর পাড়ে গিয়ে পৌঁছাল রায়ান। তাকাল নিচের দিকে। পাড়টা খাড়া নয়, ঢালু। তবে অসংখ্য পাথরের টুকরো মাথা জাগিয়ে আছে। ধারাল পাথর গড়িয়ে নামতে গেলে শরীর কেটে ফালা ফালা হয়ে যাবে। কিন্তু নামার জন্যে আর কোনো উপায় দেখছে না সে।
ধারাল পাথর! সম্ভাবনাটা বিদ্যুৎ ঝলকের মতোই মাথায় এল রায়ানের। ওর দরকার এই ধারাল পাথরই।
তীক্ষ্ম চোখে পরখ করতে শুরু করল সে পাথরগুলোকে। বেশির ভাগই মাটিতে পোঁতা। ওর দরকার এমন একটি পাথর, যেটির এক প্রান্ত ধারাল এবং প্রান্তটি মাটি থেকে আলগা। আবার অন্য প্রান্তটি মাটিতে ভালোভাবে গাঁথা। শুধু তাই নয়, আলগা প্রান্তটি ভূমি থেকে বেশি উঁচু হলেও চলবে না। অনেক দেখে শুনে একটা পাথর বাছাই করল সে। পাথরটা একদম অ্যারোয়োর তলার কাছাকাছি। মাটি থেকে কতটা উঁচু ওপর থেকে সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে পাথরটির প্রান্ত দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওটায় ঘষে কোনো কিছু কাটা সম্ভব। এটা আসলে গ্রানিট পাথরের একটি চ্যাপটা টুকরো। এর বেশির ভাগ মাটিতে গেঁথে আছে আর ওপরের প্রান্ত দিনে দিনে বিভিন্ন কারণে য় হতে হতে বর্তমানের ধারাল আকার ধারণ করেছে।
পাথরটা একদম আরোয়োর তলায়। ওটার কাছে যেতে হলে অনেকগুলো পাথর ডিঙিয়ে যেতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় অ্যারোয়োর তলায় যাওয়া নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার কিছুই ছিল না। স্রেফ হেঁটে চলে গেলেই হতো। কিন্তু এখন ওর জন্যে সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। হাত-পা বাঁধা শোয়া অবস্থায় গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে হবে। পাড় থেকে তলা পর্যন্ত ঢালু। এই ঢালটুকু পেরোতে গিয়ে তাকে গড়াতে হবে অসংখ্য পাথরের ওপর দিয়ে। সেগুলোর চোখা মাথার ঘায়ে তার সারা রক্তাক্ত হবে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে গায়ের কাপড়চোপড়। কিন্তু উপায় নেই। এ-অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে ওই কাজটাই করতে হবে। তবু নতুন করে ব্যথা পাওয়ার কথা ভাবতে গা শিউরে উঠছে।
ইতোমধ্যে কাঁচা চামড়ার রশি শুকিয়ে আরো চেপে বসতে শুরু করেছে। হাত-পা টন টন করছে ওর। উত্তপ্ত টেক্সাস সূর্য যেন তার শরীর থেকে সব রস শুষে নিচ্ছে।
সব চিন্তা ঝেঁটিয়ে একপাশে সরিয়ে দিল সে। আরেকটু গড়িয়ে নিজেকে একদম কিনারে নিয়ে গেল। শরীরের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন বিস্ফোরিত হচ্ছে। গোঙাচ্ছে সে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। গড়াতে শুরু করল।
পাথরের প্রথম খোঁচাটা খেল ও নাকে। তীব্র ব্যথায় মনে হলো নাকের হাড় ভেঙে গেছে যেন। ফুঁপিয়ে উঠল ও। পরণেই আরেকটা খোঁচা খেল একই জায়গায়। চোখে অন্ধকার দেখল রায়ান। শরীর থেমে যেতে চাইছে। কিন্তু ঢালু জায়গা বলে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
পরের আঘাতটা পেল মাথায়। এরপরেরটা গলায়। তারপর ঘাড়ে। একের পর এক ব্যথায় জ্ঞান হারানোর মতো হলো ওর। যখন মনে হলো, ও আর পারছে না, মরে যাচ্ছে, তখনই থামল ওর শরীর। পড়ে পড়ে গোঙাতে লাগল ও, হাঁ করে নিঃশ্বাস টানতে লাগল। শরীরের ঝাপটায় উড়ন্ত ধুলো গলায় ঢুকে খক খক করে কাশতে শুরু করল। গলা এবং নাকে পাথরের খোঁচাটা বেশ গভীর হয়েছে। রক্ত বেয়ে পড়া টের পাচ্ছে সে। চোখ মেলল। যে-পাথরটা ল্য করে সে নেমে এসেছিল ওপর থেকে, সেটার পাশে এখন ওর শরীর।
পাথরটা দেখল রায়ান। ভূমি থেকে ফুটতিনেক ওপরে ওটার ধারাল প্রান্তটা। পাথরটা যেন ওকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে ওটার ধারাল প্রান্তটাকে রশি কাটার কাজে ব্যবহার করার জন্যে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে, ও মারা যাচ্ছে কিংবা মারা না-গেলেও যেভাবে আছে, সেখান থেকে একচুল নড়ার শক্তিও নেই। তাছাড়া অতটা উঁচু প্রান্তে সে কীভাবে শোয়া অবস্থায় হাতদুটো তুলবে বুঝতে পারছে না। এটা অসম্ভব। কিন্তু অসম্ভব কি সম্ভব তা নিয়ে ভাবছে না রায়ান। ওর মাথায় কেবল একটাই চিন্তা। ওই পাথর দিয়ে রশি কেটে ওকে মুক্ত হতে হবে। এবং সেটা এখনি। তা করতে না-পারলে নির্ঘাত মৃত্যু।
বন্ধনমুক্ত হওয়ার প্রবল ইচ্ছা তার শারীরিক যন্ত্রণাকে চাপা দিল যেন। শোয়া অবস্থায় পাথরের ওপরের প্রান্তের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। নানা রকম কসরত শুরু করল উঠে দাঁড়ানোর জন্যে। কাজটা কঠিন। কোনোভাবেই যুত করতে পারছে না রায়ান। ঘামছে দর দর করে। চোখ জ্বালা করছে। একেকবার মনে হচ্ছে সে কোনোভাবেই পাথরের প্রান্ত বরাবর হাতদুটো নিয়ে যেতে পারবে না। পাথরটা আরেকটু নিচু হলে অবশ্য এ-সমস্যা হতো না। অবশ্য শারীরিক ব্যথাটাও তাকে কাজটা সহজে করতে দিচ্ছে না।
তবে হাল ছাড়ছে না ও। দাঁড়ানোর আগে ওকে আগে উঠে বসতে হবে। কিন্তু হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উঠে বসাটাও কঠিন। বসতে হলে ওকে হাতের ভর দিতে হবে ভূমির ওপর। কিন্তু ওর হাতদুটো সামনে একত্র করে বাঁধা। ওদিকে পাদুটোকেও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বার কয়েক চেষ্টা করল মোচড় দিয়ে শরীরটাকে তুলে ধরতে। কিন্তু কাজটা অসম্ভব বোধ হওয়ায় সে চেষ্টা বাদ দিল।
কান্তি আর যন্ত্রণায় জান বেরিয়ে যাচ্ছে রায়ানের। তবে হতাশ হচ্ছে না। জানে, হতাশ হলে মাথা ঠিকমতো কাজ করবে না। সম্ভাবনার ছোটখাট দিকগুলো তাহলে দেখতে পাবে না। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে যত কঠিনই মনে হোক, ও জানে, কোথাও না কোথাও একটা উপায় বেরিয়ে আসবে। এখন সেটাই আগে খুঁজে বের করতে হবে। মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল রায়ান। সমস্যাটাকে খতিয়ে দেখা দরকার। সে সাথে নিজের অবস্থানটাও বুঝতে হবে।
সে এখন পাথরের গোড়ায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে। হাতদুটো বাঁধা বুকের ওপর। ওদিকে দু’পা একত্র করে বাঁধা। সুতরাং হাত বা পায়ে ভর দিয়ে চিৎ অবস্থা থেকে উঠে বসা সম্ভব হচ্ছে না। নিজেকে স্রেফ একটা উল্টে দেয়া তেলাপোকার মতো মনে হচ্ছে ওর। না, একটু পার্থক্য আছে। তেলাপোকা চিৎ হয়ে পড়লেও নিজের পাগুলো নাড়াতে পারে। কিন্তু চিৎ হয়ে থাকা রায়ান হাত-পা কোনোটাই কাজে লাগাতে পারছে না। ধরতে গেলে তেলাপোকার চেয়ে খারাপ অবস্থা ওর।
উপমাটা মনে আসায় এমন অবস্থায়ও হাসি পেয়ে গেল ওর। এতে অবশ্য কিছুটা লাভও হলো। মনে মনে কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল সে। হাসির কারণে সেটা কেটে গেল।
ঠিক পাঁচ মিনিট পর আবার চেষ্টা চালাল রায়ান। এতণ ধরে পাথরের সমান্তরালে পড়েছিল ও। এবার গড়ান দিয়ে সরে গেল কিছুটা। পিঠে ঘষটে ঘষটে পাগুলো সরিয়ে নিল পাথরের কাছ থেকে। মাথাটাকে এনে লাগাল পাথরের সাথে। আস্তে আস্তে আলগা করল মাথা। তারপর পিঠে ঘষটাতে ঘষটাতে পাথরের গায়ে রাখল মাথা। সেভাবে শুয়ে আবার কিছুণ বিশ্রাম নিল। মাথাটা আবার আলগা করল। আরেকটু উঁচিয়ে তুলে পাথরে গায়ে আবার ঠেক দিল। এবার ওর ঘাড় লাগল পাথরের গায়ে। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে কাজটা করতে। তবে আস্তে আস্তে আশাবাদী হয়ে উঠছে সাফল্যের ব্যাপারে। এভাবে বার কয়েকের চেষ্টায় পাথরের গায়ে পিঠ রেখে বসতে সফল হলো সে। বসে বসে হাঁফাতে লাগল কুকুরের মতো জিভ বের করে।
আচমকা যেন শারীরিক ব্যথা-বেদনা কমে গেছে রায়ানের। এতণ যে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছিল তার কিছুই যেন আর নেই। আসলে মুক্তির কাছাকাছি এসে ওর ভেতরে যেন অন্যরকম এক শক্তির প্রকাশ ঘটেছে। মৃত্যুর আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার পর এখন এক দুর্ধর্ষ মানুষ ও। এমন অভিজ্ঞতা অবশ্য ওর আগেও হয়েছে। আরো অনেক বার, বিপদ কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা টের পেতেই নিজের ভেতর অমিত এক শক্তির অস্তিত্ব টের পেয়েছে।
ওর পরবর্তী ল্য হলো উঠে দাঁড়ানো। এটা অবশ্য খুব বেশি কঠিন হলো। হাত-পা বাঁধা থাকা সত্ত্বেও পাথরের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর অতি কষ্টে নিজেকে ফেরাল পাথরের দিকে।
ওর জন্যে বসে থাকা অবস্থায় পাথরের প্রান্তটা উঁচু হয়ে যায়, আবার দাঁড়ানো অবস্থায় বেশ নিচু হয়ে যায়। সুতরাং পাথরের ধারাল আগাকে রশি কাটার কাজে লাগানোর জন্যে রায়ানকে কুঁজো হয়ে দাঁড়াতে হলো।
বেছে বেছে পাথরের আগার যে অংশটা সবচেয়ে ধারাল মনে হলো, সেখানে অনেক কষ্টে রশিবাঁধা হাতদুটো তুলল। তারপর ঘষতে শুরু করল।
কাজটা যে কতটা কঠিন, ঘষতে গিয়ে টের পেল রায়ান। গরুর কাঁচা চামড়ার রশি আস্তে আস্তে শুকোতে শুরু করেছে। চামড়া কেটে বসে গেছে প্রায়। পাথরে ঘষতে গিয়ে দেখল রশির আগে নিজের হাতের চামড়ায় কেটে ছিঁড়ে যাচ্ছে। অদ্ভূত ভাবে বাঁকানো শরীর কান্তিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাতের চামড়া কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। হাতের পেশী কুঁচকে আসছে। ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে হাত। কিন্তু তারপরও থামতে পারছে না। জানে, বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে গরুর চামড়ার রশি কাটতেই হবে। কাটতে না-পারলে এই পাথরের গোড়ায় পড়েই মরতে হবে।
মুক্ত হওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিই যেন ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ওর প্রাণান্তকর চেষ্টা ব্যর্থ হলো না। রশির একটা প্যাঁচ কাটতে পারল। এতণ ধরে বন্ধ করে রাখা নিঃশ্বাস সশব্দে বেরিয়ে এল নাক থেকে, অনেকটা ফোঁপানোর মতো করে।
মিনিট দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করল সে। এখন যেন আর আগের মতো কঠিন মনে হচ্ছে না কাজটা। এক ঘণ্টার মধ্যে হাতের বাঁধন কেটে ফেলল রায়ান।
হাতদুটো নিঃসাড় হয়ে গেছে। ডলে ডলে ওগুলোতে সাড়া আনার চেষ্টা করল রায়ান। হাতের পরিচর্যায় প্রায় মিনিট দশেক ব্যয় করল সে।
এবার পা। হাত দিয়ে পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করল সে প্রথমে। গিঁঠ খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু বাঁধন যেভাবে এঁটে বসেছে, বোঝা গেল অশক্ত দুর্বল হাতে তা খোলা কিছুতেই সম্ভব নয়। কাটতে হবে।
ছুরির মতো ব্যবহার করার জন্যে একটা আলগা পাথর খুঁজে বের করতে রীতিমতো বেগ পেতে হলো রায়ানকে। মুক্ত হাতদুটো ব্যবহার করে পা চেঁছড়াতে চেঁছড়াতে হামাগুড়ি দিতে লাগল ও। প্রায় আধা ঘণ্টা পর খুঁজে পেতে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা একটা মোটামুটি ধারাল একটা পাথর পেয়ে গেল ও।
হামাগুড়ি দিয়ে ফের আগের পাথরটার কাছে চলে এল ও। হেলান দিয়ে বসল। তারপর ধীরে সুস্থে পায়ের বাঁধনের দিকে নজর দিল।
ঘণ্টাখানেক পরে গরুর কাঁচা চামড়ার শেষ প্যাঁচটিও কেটে ফেলল সে। আহ্, এখন সে মুক্ত।
পাঁচ
দু’দিন পর। ডীপ টাউনের একটা ছোট্ট মুদি দোকানের ভেতর এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল রায়ান। ডীপ টাউনকে আসলে শহর বলা যাবে না। বাইসনের মাইল বিশেক আগে খান দু’তিন দোকান নিয়ে এটা টিকে আছে। আসলে বাইসন শহরটা গড়ে ওঠার আগে এদিকে এটাই ছিল মূল শহর। পরে সুবিধেজনক বিবেচনা করে শহরটা বাইসনের দিকে সরে যায়। ডীপ টাউন ছাড়া বাইসনের কাছে পিঠে একশ’ মাইলের মধ্যে আর কোনো শহর বা দোকানপাট নেই।
ডীপ টাউনের কথা জানত রায়ান। আসার সময় শহরটার পাশ ঘেঁষেই এসেছিল। ইচ্ছে করলে ওখানেই থামতে পারত। কিন্তু বড় শহরটায় থামবে বলে ওখানে থামেনি।
রায়ানের ফোলা, রক্তমাখা বীভৎস মুখ দেখে আঁতকে উঠল নিগ্রো দোকানদার। ‘সাহ্!’
ওর হাতে-পায়েও রক্ত। গরুর চামড়া থেকে লাগা রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। সারা শরীরে মারের দাগ, কালসিটে পড়ে গেছে। কোথাও কোথাও চামড়া কেটে গিয়ে দগদগে ঘা। পোশাক ছেঁড়াখোঁড়া, রক্ত আর কাদা মেখে নোংরা।
নিগ্রো দোকানদারের উৎকণ্ঠাকে পাত্তা দিল না রায়ান। প্রথমেই বলল, ‘গোসল। খাবার। এুণি।’
‘আইরিন,’ হাঁক দিল দোকানদার। একটা খালি গ্লাস হাতে তুলে নিল। তারপর কী করবে বুঝতে না-পেরে যেন ওটাকে মাজতে শুরু করল।
দরজার মুখে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, কারো এমন অবস্থা হতে পারে। মনে হচ্ছে, এই মাত্র নরক থেকে পালিয়ে এসেছে লোকটা। ‘আইরিন,’ আবার হাঁক দিল সে। ‘বেরিয়ে এসো এদিকে।’
ভেতর দিকের দরজা মুখে একটা ইন্ডিয়ান মেয়ে এসে দাঁড়াল। একটা পুরনো কম্বল কেটে পর্দার মতো করা হয়েছে ওখানে। রায়ানের দিকে স্থির চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকাল মেয়েটা। তারপর আবার অদৃশ্য হয়ে গেল পর্দার ওপাশে।
মিনিট কয়েক পর আবার দেখা গেল মেয়েটিকে। হাতে এক বালতি পানি। রায়ানের কাছে এসে নিঃসঙ্কোচে আরেক হাতে রায়ানের একটা বাহু ধরে মাঝখানের দরজা দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পেছনের খোলা জায়গাটায় দাঁড়াল। একটা গাছের কাটা গোড়াকে বসার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হয় ওখানে। ওই গোড়ার ওপর বসিয়ে দিল রায়ানকে।
একটু পরে বেরিয়ে এল দোকানদার নিজেও। রায়ানের একদম কাছে এসে বলল, ‘সাহ্, আপনার এ অবস্থা কেন? মনে হয় ইনজুনদের হাতে পড়েছিলেন? দেখে মনে হচ্ছে, আগে আপনার গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে তারপর আগুনে ঝলসানো হয়েছে!’
ওর উদ্বেগের জবাবে কিছু বলল না রায়ান। মেয়েটি তখন ওর গায়ের জামা খুলে নিয়ে ওকে গোসল করাতে শুরু করেছে। ওর সাবধানী হাতের সযতœ ডলায়ও ব্যথায় শিউরে উঠছে সে। মনে হচ্ছে, কথা বললে ব্যথা আরো বেড়ে যাবে।
চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছে মেয়েটি। মুখ দেখে মনে হচ্ছে যাকে সে গোসল করাচ্ছে, তার এ-অবস্থা কী করে হয়েছে, তা জানার কোনো কৌতূহলই ওর নেই।
ও আসলে একটা কথা ভাবছে। আজ বছর দুই ধরে নিগ্রো দোকানদার বায়েকের দোকানে কাজ করছে ও। লোকটার পরিবার নেই। বিয়েই করেনি। সেটা অবশ্য ওর অনুমান। তবে ওর স্ত্রী-পুত্র আছে, এমন কোনো আভাস পায়নি। কখনো লোকটা নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে ওর সাথে আলাপ করেনি। তবে আইরিন জানে, লোকটা ওকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। সেটা অবশ্য কোনোদিন মুখে বলেনি সে। কিন্তু আইরিন সেটা ঠিকই বুঝতে পারে।
বছর সাতেক আগে সে অ্যাপাচিদের হাতে বন্দি একজন শ্বেতাঙ্গকে দেখেছিল। লোকটাকে হরিণের চামড়ার রশি দিয়ে বেঁধে রোদে ফেলে রাখা হয়েছিল। দিনের পর দিন উত্তপ্ত রোদে চিৎ হয়ে পড়েছিল লোকটা। কোনো খাবার দেয়া হয়নি ওকে। এর বেশি অত্যাচার অবশ্য করেনি অ্যাপাচিরা। তারা আসলে দেখতে চেয়েছিল, একজন লোক অভুক্ত অবস্থায় কতদিন বেঁচে থাকতে পারে।
আইরিনের বয়স তখন বারো কি তেরো। নিজের লোকদের এমন নৃশংসতা সহ্য করতে পারেনি ও। শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে গোপনে খাবার দিত। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে আসত নিজের লোকদের চোখে না-পড়ে মতো করে। প্রথম যেদিন সে লোকটার জন্যে খাবার নিয়ে যায়, লোকটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিড় বিড় করে কী যেন বলেছিল, আইরিন বুঝতে পারেনি। তবে এটা বুঝেছে যে, লোকটা তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। খাবার অবশ্য তেমন কিছু না। তবে প্রাণ বাঁচানোর মতো।
শিগগিরই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। আইরিনের বাবা ছিল না। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে এক লড়াইয়ে মারা গিয়েছিল। আর মা তখন আরেকজনকে বিয়ে করে তার সঙ্গে চলে যায়। গোত্রের যুবকরা আইরিনকে প্রচুর নির্যাতন করল এ-অপরাধের জন্যে। লোকটাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কিন্তু আইরিন মস্ত বড় এক ছোরা নিয়ে শ্বেতাঙ্গ লোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হুমকি দিল, যে লোকটিকে মারতে আসবে, তাকে খুন করবে।
তবে অ্যাপাচি ছেলে ছোকরারা মাথাগরম করলেও তাদের দলপতি অবশ্য খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতির মোকাবিলা করল। প্রবীণ কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করে আইরিনকে বলল, সে শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে গোপনে খেতে দিয়ে মারাত্মক অপরাধ করেছে। খাদ্যের দেবতা এটা কখনো সহ্য করবে না। সে অ্যাপাচিদের মেয়ে হলেও এখন আর তাদের মধ্যে নেই। গোত্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে সবাইকে অমান্য করেছে। সুতরাং তাকে আর গোত্রের মধ্যে রাখা যাবে না। সিদ্ধান্ত হলো, বন্দি শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং আইরিনকেও গোত্র থেকে বের করে দেয়া হবে।
বন্দিকে তার কেড়ে নেয়া ঘোড়াটা দিয়ে দিল অ্যাপাচিরা। যাওয়ার সময় আইরিনকে সঙ্গে নিয়ে এল লোকটা। লোকটা ছিল একজন স্প্যানিশ।
আইরিনের নাম তখন আইরিন ছিল না। ওর নাম ছিল তে পিয়া। তে পিয়াকে নিয়ে মোরায় চলে এল আলেসান্দ্রো নামের ওই লোকটি। লোকটির পরিবার-পরিজন ছিল না। মোরায় সে তার এক বন্ধুর পরিবারে রেখে গেল সে তে পিয়াকে। বন্ধু লোকটাও ছিল ভদ্রলোক। তে পিয়াকে কাজের মেয়ে হিসেবে রাখা হলেও শিগগিরই ওর তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও বিনয়ী আচরণে মুগ্ধ হয়ে নিজের ছেলে- মেয়েদের মতো করেই মানুষ করতে শুরু করে। লেখাপড়াও শেখাতে থাকে। ওরাই ওর ইন্ডিয়ান নাম পাল্টে আইরিন রাখে। সেটা অবশ্য আইরিনকে জিজ্ঞেস করেই। আইরিন খুব দ্রুত স্প্যানিশ ভাষাটা শিখে ফেলে।
কাজের মেয়ে হিসেবে থাকলেও স্প্যানিশ কায়দা-কানুন শিখতে তার বেশি দিন লাগেনি। অবশ্য ওই পরিবারটির সহৃদয়তা ও সৌজন্যের কারণে সে যে আসলে কাজের মেয়ে এটা তার মনেও থাকত না। ওই পরিবারটির সঙ্গে বছর পাঁচেক ভালোই কেটেছিল আইরিনের।
ওই পরিবারের বড় ছেলের নাম ছিল পেদ্রো। বয়সে আইরিনের চেয়ে বছর পাঁচেক বড়। আইরিনের বয়স যখন সতেরো, বাইশ বছরের তরুণ যুবক পেদ্রো একদিন তাকে আড়ালে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল।
লম্বা চওড়া সুঠাম যুবক পেদ্রো। সুদর্শন। যে কোনো মেয়েরই ভালো লাগবে তাকে। আইরিনেরও ভালো লাগত। পেদ্রোর প্রগাঢ় চুমু শিহরণ জাগিয়েছিল ওর শরীরে। কিন্তু ছটফটিয়ে উঠে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘কাজটা তুমি ঠিক করনি, পেদ্রো। তোমার মা-বাবা এটা আশা করেন না নিশ্চয়?’
পেদ্রো তড়বড় করে বলেছিল, ‘আ-আমি তোমাকে বিয়ে করব।’
জবাবে কিছু বলেনি আইরিন। নিজেকে ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের কাজে চলে গিয়েছিল। এর দিন দশেক পরে ওই স্প্যানিশ পরিবারের মাকে একখানা চিঠি লিখে সবার অল্েয ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। চিঠিতে অবশ্য সে পেদ্রোর চুমু খাওয়া এবং তাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কথা উল্লেখ করেনি। শুধু লিখেছিল, দীর্ঘদিন পরে নিজের লোকদের কথা মনে পড়ায় ওদের কাছে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে।
পরিবারটিকে ছেড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে সে। কিন্তু না-এসেও উপায় ছিল না। ও জানত, পেদ্রো নাছোড়বান্দা। ওকে বুঝিয়ে শান্ত করা যাবে না। বেপরোয়া হয়ে উঠবে দিনের পর দিন। কিন্তু পেদ্রোর উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না ওর। ও জানত, এটা পুরুষের সাময়িক আবেগ। সামাজিকভাবে পেদ্রোরা এত ওপরে যে, সেখানে একটা ইন্ডিয়ান মেয়েকে নিয়ে ঘর করার কথা ভাবাই যায় না। তার ওপর ঘরের কাজের মেয়ে।
এভাবে না-বলে চলে আসায় পেদ্রোর মা-বাবা নিশ্চয় দুঃখ পেয়েছেন, তাকে হয়তো অকৃতজ্ঞও ভেবেছেন। কিন্তু আইরিনের আর কিছুই করার ছিল না। বলে কয়ে আসতে হলে তাকে একটা কারণ দেখাতে হতো। পেদ্রোর ব্যাপারটা কারণ হিসেবে কীভাবে নিতেন তারা কে জানে? তবে ওর মনে হয়, ভালো একটা সমস্যা তৈরি হতো স্প্যানিশ পরিবারটিতে।
মোরা থেকে স্টেজকোচে চড়ে আরো পশ্চিমে আলবেরো নামের একটা ছোট্ট শহরে চলে আসে আইরিন। সে একজন রেড ইন্ডিয়ান মেয়ে। শ্বেতাঙ্গদের শহরে তার অবস্থান ও চলাফেরা দুটোই অস্বাভাবিক। তবু স্প্যানিশ পরিবারে পাঁচ বছর থাকার দরুণ ওর আচার ব্যবহারে রেড ইন্ডিয়ানদের কোনো ছাপই আর ছিল না। বরং একটা স্প্যানিশ আভিজাত্যের আস্তর পড়েছিল ওর চরিত্রে। তাছাড়া স্প্যানিশ ভাষাটাও চমৎকারভাবে আয়ত্ত করেছিল সে। ফলে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। আর ওর অ্যাপাচি ধাঁচের মুখটা ছাড়া ওকে রেড ইন্ডিয়ান ভাবারও কোনো উপায় ছিল না। একজন চমৎকার স্প্যানিশ তরুণী হিসেবে অনায়াসেই নিজেকে চালিয়ে দিতে পারত সে।
আলবেরোয় একজন স্প্যানিশ বারটেন্ডারের সঙ্গে পরিচয় হয় আইরিনের। শ্বেতাঙ্গদের রান্নাটাও ভালোই শিখেছিল সে। স্প্যানিশ ধাঁচের ইনজুন মেয়েটার মুখে নিজের দেশের অভিজাত পরিবারের কেতাদুরস্ত ভাষা আর আচরণ দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল দোকানি আলবার্তোর। ওর দোকানেই রাঁধুনির কাজ পেয়ে যায় আইরিন।
ওখানেই হয়তো বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারত সে। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়। বছর দুয়েক পরে এক উচ্ছৃৃঙ্খল কাউবয়ের গুলিতে মারা যায় আলবার্তো। ওর দোকানের ভার পড়ে নিগ্রো কর্মচারী সিম বায়েকের ওপর। বায়েক বছর খানেক দোকান চালায়। পরে ওর হাত থেকে দোকানের ভার নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় আলবার্তোর পরিবার। বায়েক চাকরি ছেড়ে দেয়। ওর হাতে কিছু টাকা-পয়সা ছিল। আলবেরো ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয় সে। ইচ্ছে, নিজেই দোকানদারি করবে। আইরিনের আচার-ব্যবহারে ওর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল মধ্যবয়সী বায়েক। ওকে নিজের মেয়ের মতোই দেখত নিগ্রো লোকটা। চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইরিনকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানায় ও। দু’দিন পর আইরিন ওকে জানায়, বায়েক চাইলে সে তার নতুন দোকানে কাজ করতে আগ্রহী। বায়েক সানন্দে রাজি হয়ে যায়।
বছর দুয়েক আগে বাইসনের বিশ মাইলের মধ্যে ছোট্ট এই শহরটায় আসে বায়েক। দু’জনে মিলে এই দোকানটি চালাচ্ছে তারা। বেচাবিক্রি যা হয়. তাতে খানাখরচাটা হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের দু’চারটি ছোটখাট র্যাঞ্চই তাদের নিয়মিত খদ্দের।
রায়ানকে দেখে আইরিন যা ভাবছে তা হলো, নিষ্ঠুরতায় শ্বেতাঙ্গরাও কম যায় না। একজন অ্যাপাচি যখন একজন শ্বেতাঙ্গের ওপর নির্যাতন চালায়, সেটা যতটা না ক্রোধ, তারচে’ বেশি কৌতূহল। তারা জানতে চায়, তাদের বন্দি কতটা মতাবান। তাদের কাছে একজন মানুষের মতা যাচাই করার মাপকাঠি হলো, লোকটা কতটা নির্যাতন সইতে পারে তার ওপর। যে-লোক নির্যাতন সইতে পারে মুখের চামড়া একটুও না-কুঁচকে, তাকে অ্যাপাচিরা সমীহ করে; খুব বড় যোদ্ধা বলে স্বীকার করে নেয়। আর যে-লোক গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, তার প্রতি তাদের কোনো করুণা হয় না। তারা কাপুরুষকে মানুষ মনে করে না। তাকে হাসতে হাসতে খুন করে ফেলে।
কিন্তু এদিকে কোনো অ্যাপাচি নেই। সুতরাং শাদা চামড়ার এই লোকটার এই দুর্দশার জন্যে দায়ী তারই মতো কিছু শাদা চামড়ার লোক। লোকার ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েছে ওরা। তারপর কাঁচা চামড়া দিয়ে হাত-পা বেঁধে মরার জন্যে ফেলে রেখে গেছে। শাদা চামড়ার লোকদের সাথে আইরিন পাঁচ-ছয় বছর ধরে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, তারা কখনো অ্যাপাচিদের মতো নিষ্ঠুর নির্যাতন করে না।
পুরো পাঁচদিন প্রবল জ্বরে প্রায় অচেতন অবস্থায় কেটেছে রায়ানের। তবে অচেতন অবস্থার মধ্যেও মাঝে মাঝে একজন নারীর অস্তিত্ব অনুভব করেছে নিজের শিয়রে। মাঝে মাঝে জ্বরের ঘোরে খেয়াল করেছে, ওর কপালে শান্ত একটা হাত রাখা। কখনো সারা শরীরে পরশ বুলিয়েছে ওই হাত, ঠাণ্ডা কিছু একটার প্রলেপ দিয়েছে ব্যথার জায়গা জায়গাগুলোতে।
পাঁচদিন পর জ্বর নেমে যায়। শরীরের ব্যথা-বেদনাও কমে আসে অনেকটা। তবে শরীর পুরোপুরি ফিট হতে মনে হয় সময় লাগবে।
বাইসনে ওদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার পর থেকে এ-পর্যন্ত সময়টা নিয়ে ভাবছে রায়ান। ওরা ওকে সরাসরি খুন না-করে এক অসহনীয় নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছিল। এটা নিষ্ঠুরতা। মানুষ মানুষকে খুন করে ফেলতে পারে। সেটা একটা অপরাধ। কোনো মানুষেরই বিনা কারণে কোনো মানুষকে খুন করার অধিকার নেই। আইনত সেটা দণ্ডনীয়। কিন্তু অপরাধ হলেও সেটাকে অমানবিকতার পর্যায়ে ফেলা যাবে না। কিন্তু কাউকে নির্মম নির্যাতন করাটা আইন ও মানবিকতা কোনোটাই সমর্থন করে না। মানবসভ্যতায় এটা একটা ঘৃণিত কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এর পরেও এ-কাজটা মানুষ করে থাকে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন ও বিকৃত একটা আনন্দের চরিতার্থতার জন্যে। অবশ্য বর্বর সমাজে এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মতো বিবেচনাবোধ থাকে না। শিকারী রেড ইন্ডিয়ানরা শ্বেতাঙ্গদের তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশকারী ভেবে থাকে। তাদের প্রতিরোধের জন্যে লড়ে। বন্দিকে নির্যাতন করে ােভের প্রশমন ঘটায়। কিন্তু বাইসনে ওরা যা করেছে, তার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। ও তাদের কোনো তি করেনি যে, তারা প্রতিহিংসার বশে তাকে নির্যাতন করে এমন এক অমানুষিক যন্ত্রণার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। কিন্তু তারা তা করেছে এবং সেটা নেহাত বিকৃত আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে। রায়ান সে বিকৃত আনন্দের মাশুল গুণতে তাদের বাধ্য করবে।
ওর শরীরের যন্ত্রণা কমেছে। কিন্তু পেশী ও হাড়ের মধ্যে রয়ে গেছে তার ছাপ। শরীর আড়ষ্ট। নড়তে চড়তে ব্যথা জানান দেয়। পুরোপুরি ফিট হতে আরো সময় লাগবে।
ইন্ডিয়ান মেয়েটাকে গভীর আগ্রহে ল করে রায়ান। চুপচাপ কাজ করে যায় মেয়েটা। খুব কমই কথা বলে। ইংরেজি জানে খুব সামান্যই। দোকানদার বায়েকের সঙ্গে ঝরঝরে স্প্যানিশ ভাষায় ওকে কথা বলতে শুনেছে ও। বায়েকের কথা শুনে মনে হয়েছে, মেয়েটাকে যথেষ্ট সমীহ করে ও।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কী একটা ওষুধের মতো নিয়ে এল মেয়েটা। ওষুধটা দেখিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘হাড়ে ব্যথা। ভালো। বেশি ভাল…’
রায়ান স্প্যানিশে বলল, ‘তোমার নাম আইরিন। তুমি ইন্ডিয়ান। অ্যাপাচি। অ্যাপাচি মেয়ের নাম আইরিন হয় না।’
থেমে গেল মেয়েটি। তারপর বলল, ‘তাতে কী? অ্যাপাচিদের সাথে থাকলে তুমিও একটা অ্যাপাচি নাম পেয়ে যেতে পার।’
‘তার মানে তুমি স্প্যানিশদের সঙ্গে অনেকদিন ছিলে। তুমি ঠিক ওদের উচ্চারণেই কথা বলো।’
‘পাঁচ বছর। নাও এখন শোও। ওষুধটা দিতে দাও।’
‘এটা কী ওষুধ?’
‘এটা বন থেকে তুলে আনা উদ্ভিদের রস। আমরা ইন্ডিয়ানরা জানি, কোন গাছের রস শারীরিক ব্যথা সারানোয় কাজ করে। শ্বেতাঙ্গদের মতো আমাদের সমাজে পাসকরা ডাক্তার নেই।’
আরো দিন পাঁচেক বিশ্রাম নিল রায়ান। কীভাবে এ-অবস্থা হয়েছে আইরিনকে জানাল।
চুপচাপ সব কথা শুনে গেল আইরিন। তারপর জানতে চাইল, ‘রাইসা কে?’
’আমার স্ত্রী ছিল। এখন নেই।’ অবাক হলো রায়ান। ‘চার-পাঁচদিন জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান ছিলাম। প্রচুর বকাবকি করেছিলাম, না?’
‘এখন কোথায় তোমার বউ?’
‘টেক্সাসে। কেমন আছে জানি না। কারণ মৃত্যুর পর মানুষ কেমন থাকে, তা জানা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’
দীর্ঘ সময় ধরে চুপ করে রইল আইরিন। তারপর বলল, ‘তুমি সুস্থ হয়ে বাইসন যাবে, না?’
মেয়েটির দিকে অপলক তাকাল রায়ান। জবাব দিল না।
ছয়
বুটের ভেতর কিছু সোনার টুকরো লুকনো ছিল রায়ানের। টাকার হিসেবে নেহাত কম নয়। একটা পুরো আউটফিট কেনা যাবে। বেলারের দল ওগুলোর কথা জানত না। জানতে পারলে নির্ঘাত কেড়ে নিত। লোকগুলো আসলে নেহাত চেঁছড়া টাইটের। অপরিচিত একজন লোক দেখে নিজেদের বীরত্ব দেখানোর জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। মারধর করে নিজেদের দুর্ধর্ষ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে। আর মাঝখানে ফাও হিসেবে পেয়ে গেছে ঘোড়া আর হোলস্টারসহ পিস্তলটা।
অস্ত্র নিয়ে বিশেষ কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই ওর। ব্যবহারের জন্যে একটা পেলেই হলো। দেখতে হবে যেন ওটা দিয়ে গুলি ছোঁড়া যায়। একটা পুরনো, বহুল ব্যবহৃত পয়েন্ট ফোর ফোর কিনে নিল ও। ওটার হোলস্টারটাও চমৎকার মানিয়ে গেল ওর কোমরে। কোল্ট পয়েন্ট ফোর ফাইভ মডেলের নতুন একটা হ্যান্ডগান কেনার আগে বেশ কিছুদিন ব্যবহার করা যাবে পয়েন্ট ফোর ফোরটা।
একটা শটগান আর গুলি কিনল সে। ঘোড়াও কিনল একটা। ঘোড়াটা কেনার ব্যবস্থা করে দিল নিগ্রো দোকানদার বায়েক। বায়েকের এখনো ধারণা, অ্যাপাচিদের কবলে পড়েছিল রায়ান। রায়ান আইরিনকে বললেও ওকে জানাতে চায়নি। বায়েকের যদি খদ্দেরদের সঙ্গে মন খুলে গল্প করার অভ্যাস থাকে, তাহলে সে-গল্প বাইসনে পৌঁছাতে একদিনও লাগবে না। কিন্তু রায়ান চায় না, বেলার-কেলাররা আগে ভাগে ওর খবর পেয়ে যাক। সে চায় ওদের সামনে যমদূতের মতো হাজির হতে। ওরা ওকে বলেছে, সে নাকি ভুল লোকদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। রায়ান ওদের বুঝিয়ে দেবে মস্তানি করার জন্যে ওরাও ভুল লোককে বেছে নিয়েছিল।
দোকানদারকে বিশ্বাস করতে পারেনি রায়ান। কিন্তু লোকটার প্রতি ওর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ওর দোকানেই থেকেছে সে। ওখানেই খেয়েছে। রায়ান সুস্থ হয়ে হিসেব করে দাম মিটিয়ে দিয়েছে ওকে। কিন্তু এর পরও ওর মনে হচ্ছে নিগ্রো দোকানদারের ঋণ শোধ করা ওর পে কখনো সম্ভব হবে না। লোকটা ওর মুমূর্ষু অবস্থায় ওকে মানবিকতা দেখিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। আসলে অবিশ্বাস নয়, বরং সতর্কতার অংশ হিসেবেই সে প্রকৃত ব্যাপারটা ওকে জানায়নি।
তবে রায়ান সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ আইরিন নামের ওই ইন্ডিয়ান মেয়েটার ওপর। মেয়েটা অ্যাপাচি। কিন্তু চলনে বলনে যেন এক অভিজাত স্প্যানিশ মহিলা। অসুস্থ অবস্থায় পরম মমতায় ওর সেবা-যতœ করেছে। ওকে সঙ্গ দিয়েছে। মেয়েটা চমৎকার। বুদ্ধিমান, গম্ভীর। সজীব দু’ চোখ অতলস্পর্শী।
হপ্তাখানেক পরের এক সন্ধে। বাইসনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদী কিংবা ঝরনাটার পাশে বসে আছে রায়ান। ওর শরীর এখনো আগের শক্তি ফিরে পায়নি। তবে সে জন্যে একদম শুয়ে বসে বিশ্রাম নেয়ার দরকার মনে করছে না সে। যেটুকু শক্তি ফিরে পেয়েছে, তাতে কাজ চলবে বলে ভাবছে।
সন্ধে হওয়ার সাথে সাথেই ছোট্ট শহরটা মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। দু’একটা বাতি জ্বলছে মিট মিট করে। তবে আকাশ থেকে নেমে আসা কালো অন্ধকারের বিরুদ্ধে মনে হচ্ছে না লড়াই চালিয়ে খুব একটা সুবিধে করতে পারছে।
ছোট্ট পাহাড়ী ঝরনাটা কুল কুল করে বইছে। কিছুণ আগে ঠাণ্ডা পানিতে অনেকণ ধরে সারা গা রগড়ে রগড়ে গোসল করে নিয়েছে ও। ওর শরীর এখন ওই পাহাড়ী ঝরনাটার মতোই শীতল। ওটার মৃদু ঝিরঝিরে স্রোতের মতোই আরামের আবেশ তাতে। অপো করছে রায়ান। কাজে নেমে পড়ার আগে চূড়ান্ত হিসেব নিকেশ চলছে মনে মনে।
সেলুনের লোকগুলো নিজেদের পান-ভোজন আর গল্পগুজব নিয়ে ব্যস্ত। রায়ানের ঘোড়ার খুরের শব্দ তাদের কানে ঢুকল না। রাস্তায় কয়েকটি পোস্টের সঙ্গে ডজন খানেক ঘোড়া বাঁধা। ব্যাটউয়িং দরজার ফাঁক দিয়ে কোল অয়েল ল্যাম্পের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সেলুনের বাইরে একটা খুঁটির সাথে নিজের মেয়ারটাকে বাঁধল রায়ান। হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে পরখ করে নিল। তারপর চামড়ার থলে থেকে শটগানটা বের করে প্লাঙ্কওয়েতে পা রাখল। ওর হ্যাটটা কপালের দিকে নামানো। গত সাতদিন ধরে না-কামানো মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। ওর বুটগুলোয় এখনো রক্তের দাগ। ইচ্ছে করে ওগুলো ধোয়নি সে। ব্যাটউয়িং ডোরের সামনে পুরো এক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল ও।
সেলুনের ভেতরে পিয়ানোর টুংটাং। মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ, টেবিলে টেবিলে তাস পেটানোর পট পট আর গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকির টুং টাং শব্দ। থেকে থেকে দম ফাটানো হাসি আর হৈ হুল্লোড়।
ব্যাটউয়িং ডোর ঠেলে সেলুনের দরজা জুড়ে দাঁড়াল রায়ান। ছ’ফুট লম্বা লোকটাকে দেখে আচমকা নীরবতা নেমে এল গমগমে সেলুনটায়। এমনকী কারো মুখে ফিস ফিস শব্দটা পর্যন্ত শোনা গেল না। সবাই যেন মুহূর্তের নোটিসে বোবা হয়ে গেছে।
খদ্দেরদের ওপর চোখ বুলাল রায়ান। কাদের খুঁজছে সে জানে। ওই লোকগুলোর চেহারা ওর মনে একদম খোদাই হয়ে আছে। প্রথম যাকে শনাক্ত করল, সে একদম সামনের সারিতে বসা। পর মুহূর্তে ওর চোখ পড়ল আরেকজনের ওপর। পোকার খেলছে লোকটা। ওর খেলার সঙ্গী দু’জনকে চিনতে পারল না। ওদের মারধরের সঙ্গী ছিল না এরা।
এবং এর পরই পিট কেলার নামের লোকটাকে দেখতে পেল রায়ান। হ্যাংলা পাতলা কালো চোখের বন্দুকবাজ দাঁড়িয়ে আছে বারের সাথে হেলান দিয়ে। হাতে মদের গ্লাস। ছোট ছোট চুমুকে গ্লাস শেষ করছে। ওর পাশে একটা মেয়ে। নি®প্রভ চোখের কান্ত মেয়েটি। বেশ্যা সম্ভবত।
এক ঢোক হুইস্কি মুখে নিয়ে সবার সাথে সাথে চোখ তুলল কেলারও। দেখল দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে। লোকটাকে চিনতে পারল না। তবে একদম অচেনাও মনে হচ্ছে না। কোথাও যেন দেখেছে এর আগে।
ফিস ফিস শব্দ ছাপিয়ে আচমকা গম গম করে উঠল রায়ানের গলা, ‘সাতজন লোক আমাকে মারধর করেছে। আমার ঘোড়াটা চুরি করে নিয়ে গেছে। আমাকে গরুর কাঁচা চামড়া দিয়ে হাত-পা বেঁধে মরুভূমিতে ফেলে এসেছে, যাতে আমি মরে গিয়ে শেয়াল-শকুনের খোরাক হই।’
প্রতিটি শব্দের ওপর আলাদা করে জোর দিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করল রায়ান। থামল তারপর। তীক্ষ্ম চোখে চাইল ঘরের ভেতর। সামান্যতম নড়াচড়ার আভাস পাওয়ার জন্যে অপো করছে।
‘লোকগুলো ছিল কে-বার-এর। সেরকমই বলা হয়েছে আমাকে। আমি ওই ভদ্রলোকদের ঋণ চুকিয়ে দেয়ার জন্যে এসেছি। তারা ছাড়া বাকিরা সেলুন ছেড়ে বেরিয়ে গেলে খুশি হবো।’
আচমকা যেন এক সাথে নড়ে উঠল পুরো কটি। চেয়ার সরানোর শব্দ শোনা গেল। দরজা জুড়ে দাঁড়ানো বিশাল লোকটাকে চিনতে পেরেছে সবাই। গল্পটাও ওদের জানা। সবাই এক যোগে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এরা নেহাত কাউবয়। বিভিন্ন র্যাঞ্চে কাজ করে। অবসরটা ফুর্তি করে কাটানোর জন্যে এসেছে। এখানে অন্যের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে তাদের নেই।
রায়ানকে মারধরের সঙ্গে জড়িত তিনজনের মধ্যে একজন দরজার দিকে বেগে এগোল। রায়ান ওর দিকে তাকাল। তারপর মাথা নাড়ল। ‘উঁহুঁ, তুমি নও।’ পিস্তল উঁচাল লোকটার দিকে। ওর মনে আছে, এই লোকটা ওকে বুকে লাথি মেরে স্পারের খোঁচায় তবিত করে দিয়েছিল।
এবার কেলারের দিকে চোখ ফেরাল। যাকে বেরোতে বাধা দিয়েছিল, এটাকে একটা চমৎকার সুযোগ হিসেবে দেখল লোকটা। বিনা দ্বিধায় হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল।
ওর দিকে চাইবার কষ্টটুকুও স্বীকার করল না রায়ান। যেন মাছি তাড়াচ্ছে এভাবে হাত নাড়াতে দেখা গেল ওকে। চোখের পলক ফেলার আগেই শটগানটা উঁচিয়ে ধরল। পর মুহূর্তে বিকট শব্দে কেঁপে উঠল সেলুনের ভেতরটা। পিস্তলে হাত দিতে যাওয়া লোকটা যেন উড়ে গিয়ে পড়ল বারের ওপর। সেখান থেকে দেয়ালে আছড়ে পড়ল।
এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল, কিন্তু কেলারের ওপর থেকে এক পলকের জন্যেও চোখ সরেনি রায়ানের। ওর পেছনে টেবিলের কাছাকাছি বসা ছেলেটার দিকে চাইল এবার রায়ান। ‘এই যে, হ্যাঁ, তোমাকে.. তোমাকেই বলছি। এদিকে উঠে এসো। আমার সামনে এসে দাঁড়াও।’
একটু ইতস্তত করল ছেলেটা। কী করবে বুঝতে পারছে না। শেষে রায়ানের হাতের উদ্যত শটগান সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল ওকে। সঙ্গীর মৃতদেহের দিকে এক নজর তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠল সে। আস্তে আস্তে এগিয়ে এল বিশালদেহীর কাছে।
‘কাউবয়, সেদিন সকালে বার্নে তুমি আমার পাহারায় ছিলে। আমি তোমাকে কী বলেছিলাম তোমার মনে আছে?’
ছেলেটা মাথা নাড়ল, একই সাথে চোয়াল ঝুলে পড়ল ওর। রায়ান বলে চলল, ‘আমি কিছুই ভুলিনি, বাছা। আমার মনে আছে, তুমি কীভাবে আমায় মারধর করেছিলে। বলেছিলাম, আমি ছেড়ে দাও। আমি চলে যাই। তুমি তা করোনি। আমার কাকুতি মিনতি তোমার কানে ঢোকেনি। মনে আছে তোমার?’
কোনো জবাব দিচ্ছে না ছেলেটা। ভয়ে ছাইয়ের মতো শাদা হয়ে গেছে ওর মুখ।
‘আমি তোমাকে খুন করতে আসিনি। তবে তোমাকে আমি আঘাত করব। না, আঘাত নয়, প্রত্যাঘাত। তোমার ওটা পাওনা হয়েছে। এখানে কোনো আইন-কানুন নেই। সুতরাং আমি যা বলি, তা-ই এখন আইন।’
হাত থেকে শটগানটা ফেলে দিল রায়ান। মেঝেয় পড়ল ওটা ধাতব শব্দ তুলে। এটাকে বিরাট সুযোগ হিসেবে নিল ছেলেটা। হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে। ওর হাত কেবল পিস্তলের বাঁট ছুঁয়েছে, ঠিক সময় আঘাতটা অনুভব করল। পাঁজরার হাড় ভাঙার শব্দটাও যেন শুনতে পেল সে, পর মুহূর্তে চিবুকে মুগুরের আঘাতটা টের পেল। লুটিয়ে পড়ল ও মেঝেয়। ব্যথায় চেঁচাতে চেঁচাতে এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, বিশালদেহী কখন ওকে এমন মারাত্মক মারটা মারল।
দর্শকদের মধ্যে যারা নিরীহ কিংবা শান্তিপ্রিয় টাইপের, অবস্থা বেগতিক বুঝে আস্তে আস্তে সটকে পড়তে শুরু করল। যারা একটু বেশি কৌতূহলী, তারা আরো মজা দেখার আশায় দাঁড়িয়ে রইল।
এত কিছু ঘটছে, কিন্তু কেলারের মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। যেন যা ঘটছে, তার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। ওর মুখে ভয়ের কোনো চিহ্নই নেই।
ধীরে সুস্থে হুইস্কির গ্লাসটা শেষ করল সে। তারপর তাকাল রায়ানের চোখে। দীর্ঘ কয়েকটা সেকেন্ড কেটে গেল নীরবে। একে অন্যকে জরিপ করছে ওরা। তারপর মুখ খুলল কেলার, ‘তুমি কি আমাকে গুলি করতে চাও? তাহলে তোমার অবগতির জন্যে একটা কথা জানানো দরকার মনে করছি। তুমি পকেট থেকে আরেকটা গুলি বের করার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তার আগে কম পে দু’দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিতে পারব তোমার শরীরে।’
‘উঁহুঁ,’ মাথা নাড়ল রায়ান। ‘তুমি একটা খালি কলসি। তাই বেশি শব্দ করছ। তুমি নিরীহ কাউকে পেলে নিজেকে কঠিন আর দুর্ধর্ষ হিসেবে দেখাতে চাও। তোমার লোকেরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল আমি নাকি ভুল লোকের গায়ে হাত তুলেছি।’ থামল রায়ান এক সেকেন্ড, তারপর আচমকা ভীষণ কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি সে লোক, যাকে তোমরা পেছন থেকে বাড়ি মেরে কাবু করেছিলে এবং এরপর বাঘ সেজে বসেছিলে।’ হাতে ধরা শটগানটা একটা টেবিলের ওপর রাখল রায়ান। তারপর পিছিয়ে দাঁড়াল। ওর ডানহাত এখন কোমরে ঝোলানো পিস্তলের খাপের পাশে ঝুলছে।
‘সম্ভবত বেশ কিছু ভালো এবং নিরীহ লোককে তোমরা এর আগে খুন করেছ,’ নিচু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল রায়ান। ‘কাউকে কাউকে হয়তো প্রাণে না-মারলেও পিটিয়ে চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছ। এটা অন্যায়। সে-অন্যায় আমার ওপরও করেছ তোমরা। এখন তোমাদের যদি কেউ ব্যাপারটা বুৃঝিয়ে না-দেয়, তাহলে এটা চলতেই থাকবে। তোমরা আরো নিরীহ লোককে খুন করবে, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত করবে। কিন্তু এটা চলতে দেয়া যায় না।
‘তোমাদের সামনে এখন একজন কাউবয় মরে পড়ে আছে, আরেকজন মারাত্মক জখম হয়েছে। এদের এই পরিণতির জন্যে দায়ী তোমরা। তোমরা ওদের বিপথে টেনে এনেছ। কেলার, এর দাম তোমাদেরই শুধতে হবে।’
থামল রায়ান। তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। অপো করছে।
পাশে দাঁড়ানো মেয়েলোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল কেলার। তারপর বোতল থেকে আরেক গ্লাস হুইস্কি ঢালল। রায়ান তার বক্তব্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। ওকে সে খুন করবে। কিন্তু তাতে সামান্যতম বিচলিতও মনে হচ্ছে না কেলারকে। ওর আত্মবিশ্বাসে এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি প্রতিপরে হুমকি। সে কঠিন লোক, পিস্তলে অসম্ভব চালু হাত। সবার মুখে এরকমই শুনে এসেছে এতদিন ধরে। ওর নিজেরও তাই বিশ্বাস। রায়ানের হাতে শটগানটা দেখে প্রথমে কিছুটা দুশ্চিন্তায় ছিল। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। খালি শটগানটা পড়ে আছে একটা টেবিলে। ওটা ছাড়া এই বিশালদেহী বেকুবটা যদি ওর মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে স্রেফ মারা পড়বে।
পিস্তলহাতে পিট কেলার যে কীরকম ভেলকি দেখাতে পারে, লোকটা জানে না। একটু পরেই টের পাবে। কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকবে না। এর আগেও, যারা এটা বুঝতে পেরেছে, তখন কেউ আর বেঁচে থাকেনি। পিস্তলহাতে পিট কেলার, কিছু না, স্রেফ ভয়ঙ্কর।
ওর সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা এই গাধাটা জানে না যে, কেলার দ্রুত পিস্তল ড্র করতে শত শত ঘণ্টা সময় কাটিয়েছে প্র্যাকটিসে। এখন কোমরে ঝোলানো পিস্তলটা ওর শরীরেরই একটা অংশ। ওর হাতদুটোর মতোই।
‘স্ট্রেঞ্জার,’ এক ঢোক হুইস্কি গলায় ঢালল কেলার। ঢোক গিলে বাম হাতের পিঠে ঠোঁট মুছল। ‘তোমাকে আমি খুন করতে যাচ্ছি। তবে কাকে খুন করলাম, তার নামটা জানা দরকার। তোমার কবরের পাশে নামফলক লাগিয়ে দেব। যদিও,’ হাসল সে। ‘সেটা দেখার সৌভাগ্য তোমার হবে না।’
পর মুহূর্তে চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে উঠল কেলারের, রক্ত চলাচল বেড়ে গেল।
ওর চেখে চোখ রাখ রায়ানও। ‘জন রায়ানের কবরের ওপর নামফলক লেখার সৌভাগ্য তোমার হবে না, কেলার।’
‘ক্কী-ই?’
‘ঠিকই শুনেছ।’
এক মুহূর্তের জন্যে চোখ পিট পিট করল কেলার। বুকের ভেতর রক্ত ছলকে উঠেছে। তলপেটটা যেন ণিকের জন্যে শূন্য মনে হলো। ‘হোয়াইট মাউন্টিনসের জন রায়ান আর তুমি…’
‘একই লোক।’
বিষম খেল যেন কেলার। এই প্রথম ওর চোখে ছায়া ঘনাতে দেখল রায়ান। অবশ্য অমন ভয়ঙ্কর মারধরের পর গরুর কাঁচা চামড়া দিয়ে হাত-পা বেঁধে যে-লোককে ওরা মরার জন্যে মরুভূমিতে ফেলে এসেছিল, তাকে এভাবে অস্ত্রহাতে ফিরে আসতে দেখে প্রথমেই খটকা লেগেছিল ওর। তবে ভেবেছিল, কারো না কারো সহায়তায় লোকটা মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ওর ধারণা ভুল। হোয়াইট মাউন্টিনসের জন রায়ানকে সামান্য গরুর চামড়ায় বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। এই লোক ভয়ঙ্কর। ধারণা করা যায় না, এমন ভয়ঙ্কর।
ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে গল্প করার মতো চরিত্র জন রায়ান। বলা হয়, এই লোককে খুন করা সম্ভব নয়। অ্যাপাচিদের সঙ্গে ওর লড়াইয়ের কাহিনী কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে। ওর সম্পর্কে আরেকটা গল্প শুনেছে পিট নিজেও। জন রায়ান তখন একটা শহরের মার্শাল। কোনো একটা কাজে কিছুদিনের জন্যে শহরের বাইরে ছিল ও। এই ফাঁকে চার আউট ল’ এসে শহরে উৎপাত শুরু করে দেয়। রায়ান যখন কাজ সেরে শহরে এসে পৌঁছায়, তখন আউট ল’য়ের দল শহর ছেড়ে চলে গেছে। তবে যাবার আগে খুন করে যায় শহরের একজন বাসিন্দাকে। শহরের একটি মেয়েকে অসম্মান করতে গিয়ে চার আউট ল’ ওই লোকের প্রতিবাদের কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। শেষে রেগেমেগে প্রতিবাদকারীকেই গুলি করে মেরে শহর ছেড়ে চলে যায়।
সেদিন সন্ধেয় কাজ সেরে শহরে ফিরে আসে রায়ান। সেলুনে বসে খবরটা পায়। এরপর আর দেরি করেনি। ওই অবস্থায় পিছু ধাওয়া করে চার দুর্বৃত্তের। দু’দিন পর তিনজনের মৃতদেহ তাদেরই ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে শহরে ফেরে সে। নেহাত কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছিল চতুর্থ জন। তার মুখেই গল্পটা শুনেছিল কেলার। বলেছিল, জন রায়ান মার্শাল হিসেবে আছে, এমন শহরের ১০০ মাইলের মধ্যেও থাকবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে সে।
তলপেটের শূন্যতা যেন আগের চেয়ে বেড়ে গেছে কেলারের। হতাশা চেপে বসেছে বুকের ওপর। ওই লোকের গল্প যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে কেলার এখন স্রেফ মরা মানুষ। ওই লোকের নাম উইল স্টেট। কেলার চেনে ওকে। ওর বন্ধু মানুষ ধরতে গেলে। দারুণ গুলি ছুঁড়তে পারে। পিস্তলে শটগানে সমান দ। ও বলেছে, ওদের চারজনকে এক সঙ্গে পেয়ে গিয়েছিল রায়ান। একটা ঝরনার পাশে বসে সকালের নাশতার পর কফি খাচ্ছিল। লোকটা একদম আচমকা এসে পড়ে ওদের মাঝখানে। ঝোপঝাড়ের ফাঁক গলে এত চুপিসারে এসেছিল যে, টেরই পায়নি ওরা। না, সে ওদের অজান্তে গুলি করে মারেনি। আগে সবাইকে নিজেদের হোলস্টার পরে নিতে বলেছিল। তারপর ড্র করতে বলে। নিজেও ড্র করে।
ওদের মধ্যে সবচেয়ে চালু হাত জেমস হার্ডেনের। তাকেই প্রথম ঘায়েল করে রায়ান। গুলি করেই বসে পড়ে। সে-অবস্থায় গুলি করে বেন ল্যুলকে। ল্যুলের গুলি রায়ানের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। বসা থেকেই গড়ান দেয় লোকটা। তিন নম্বর দুর্বৃত্ত নিক পামের তিন চারবার চেষ্টা করেও গুলি লাগাতে পারেনি। লোকটা এত দ্রুত নড়াচড়া করছিল যে, ল্যই স্থির করা যাচ্ছিল না। নিজের তৃতীয় গুলিতে পামেরকে নিকেশ করেছিল রায়ান।
এদিকে ল্যুলকে পড়ে যেতে দেখে আর ভরসা পায়নি উইল স্টেট। ঝরনার ভেতর নেমে পালিয়ে এসেছিল। তবে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। রায়ান ওকে চিনে ফেলেছে। ভবিষ্যতে দেখামাত্র গ্রেফতার করবে।
উইলকে নিজের সমক কিংবা নিজেকে উইলের সমান দ মনে করে কেলার। তার মানে ওর সামনের এই লোকটার সঙ্গে পিস্তলবাজিতে পেরে ওঠার প্রশ্নই আসে না।
মেরুদণ্ডে শিরশিরে ভাব টের পাচ্ছে কেলার। তলপেটে শূন্যতা। এই প্রথম কোনো শত্র“র বিপে দাঁড়িয়ে নিজেকে তুচ্ছ, ুদ্রাতিুদ্র মনে হচ্ছে। ভয় পাচ্ছে ও। ভীষণ ভয় পাচ্ছে। মৃত্যুভয়। বুঝতে পারছে, সামনের এই লোকের সাথে পিস্তলের লড়াই কিংবা খালি হাতে মারামারিÑকোনোটাতেই পেরে উঠবে না সে। ওর হাত থেকে বাঁচতে হলে কৌশল খাটাতে হবে।
‘রায়ান,’ কোমল স্বরে বলল কেলার। ‘যা ঘটেছে, তার জন্যে আমি দুঃখিত। আমরা সম্ভবত একটু বেশি করে ফেলেছি। আমরা আসলে তোমাকে গরুচোর ভেবে বসেছিলাম। মানে এদিকে গরুচোরের খুব উপদ্রব কিনা…’
রায়ান সরাসরি তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তবে কেলারের মনে হলো, ওকে দেখছে না লোকটা। ওর চোখে অন্যরকম এক দৃষ্টি। ছুরির ফলার মতো সে-দৃষ্টি ওর বুকের ভেতরটা চেঁছে নিচ্ছে।
কেলারের জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। ওর মনে হচ্ছে, মৃত্যুকে এতটা কাছে ও আর কখনো দেখেনি।
‘তোমরা খারাপ লোক, কেলার।’ মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল রায়ান। ‘আমি তোমাদের চিনতে ভুল করিনি। কিন্তু তোমরা মস্তানি করার জন্যে এবার ভুল একজনকে বেছে নিয়েছিলে। তোমরা শুধু মস্তানি করেই ান্ত হওনি, একজন মানুষের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছ। তোমরা যা করেছ, এটা বর্বর রেড ইন্ডিয়ানদের মানায়, কোনো শ্বেতাঙ্গকে নয়। কোনো উপায় নেই, বাছা। প্রতিফল তোমাদের ভোগ করতেই হবে। শোনো, কোনো কোনো ভুল মানুষ একবারই করতে পারে, দু’বার করার সুযোগ সে আর পায় না।’
ওর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না কেলার। আচমকা বড় করে একবার নিঃশ্বাস নিল। তারপর চোখ ফিরিয়ে হুইস্কির বোতলের দিকে চাইল। ওর ইচ্ছে হলো, এক নিঃশ্বাসে ঢক ঢক করে বোতল থেকে সবটুকু হুইস্কি খেয়ে নেয়। তারপর যা হয় হোক…
তবে তা না করে রায়ানের দিকে তাকাল ফের। ওর ভেতরে এতণ ধরে গেলা হুইস্কি কাজ করতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে ওর বুক ভরে উঠল দারুণ আত্মবিশ্বাসে। লোকটার সম্পর্কে শোনা আগের সেসব গল্পের কথা মনে রইল না ওর। তার জায়গায় ভেসে উঠল লোকটাকে দল বেঁধে পেটানোর সে মজার দৃশ্যটি। পুরনো সে-দৃশ্যটি মনে আসতে মুচকি হাসল কেলার। ওর মনে হলো, দূর, শুধু চিন্তা করে মরছে ও। কদিন আগেই তো মাত্র হোয়াইট মাউন্টিনসের জন রায়ানকে কুকুরের মতো পিটিয়েছে সে।
এক মুহূর্তও দেরি না-করার সিদ্ধান্ত নিল ও। অভিজ্ঞতা থেকেই জানে, সামান্য ইতস্তত ভাব পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে। লড়াইয়ে যে আগে আক্রমণে যাবে, সেই জিতবে।
বিদ্যুদ্বেগে ড্র করতে গেল কেলার।
কিন্তু গ্রিজলির মতো বিশাল লোকটার অ্যাকশন যেন ওর চোখেই পড়ল না। বুঝতে পারল তখন, যখন পরপর দুটো গুলির শব্দ কানে ঢুকল এবং একই সাথে
বুকের একই জায়গায় হাতুড়ির ঘা খেল দু’বার। হোলস্টারে থাকা পিস্তলের বাঁট হাতে ধরা অবস্থাতেই মারা গেল নিজের আউটল’ ক্যারিয়ারে মোট বারো জন মানুষের হত্যাকারী পিট কেলার। এদের মধ্যে পাঁচজনকে সে মেরেছিল পেছন থেকে গুলি করে। প্রাণহীন শরীর বেঁকে গেল, মুখ থুবড়ে পড়ল লোকটা বারের ওপর।
চারদিকে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর ওপর কয়েক মুহূর্ত পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রায়ান। তারপর বলল, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ একজন কে-বারে গিয়ে বেলারকে খবর দাও। বলো, তার বন্ধুরা এখানে মরে পড়ে আছে। দুর্গন্ধ ছোটার আগে যেন এদের কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে। আর বোলো, আমি এখানে ওর জন্যে অপো করছি।’
ভীড়ের পেছন থেকে দু’জন বেরিয়ে গেল চট জলদি। একটু পরে বাইরে তাদের ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল।
বারের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কেলারের দিকে তাকাল রায়ান। ‘ওদের বন্ধুরা না-আসা পর্যন্ত লাশগুলো বাইরে নিয়ে রাখলে কেমন হয়?’
প্রস্তাব নয় যেন আদেশ। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল উৎসাহী কয়েকজন।
ব্যাটউয়িং ডোর খুলে রায়ান বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। তারপর ঘোড়ার পিঠে চড়ে শহর ছাড়ল।
সাত
রায়ান জানে, তাকে মোকাবিলা করার জন্যে মন্ট বেলার একা আসবে না। ওর সঙ্গে যারা থাকবে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর নির্যাতন চালানো বাকি তিনজনও থাকবে। তাদের নিয়ে অবশ্য খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছে না সে। ওরা বন্দুকবাজ নয়। স্রেফ উত্তেজনার আশাতেই বেলারের বিভিন্ন অপকর্মে অংশগ্রহণ করে। তবে তাদের সে উত্তেজনা চিরতরে মিটিয়ে দেবে রায়ান। আর কখনো যাতে নিরীহ মানুষের ওপর চড়াও হতে না-পারে সে-ব্যবস্থা করবে।
রাতের অন্ধকারে ছোট একটা ঝোপে ঢুকে গেল রায়ান। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জটলা পাকানো কিছু গাছের ঘন ছায়ায় লুকিয়ে ফেলল ঘোড়াসহ নিজেকে। তারপর অপো করতে লাগল।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল ওর। জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে ওরা। ঘোড়ার খুরের শব্দেই যেন ফুটে উঠছে তাদের উদ্দেশের গুরুত্ব। রাগে ও আতঙ্কে অন্ধ বেলার ও তার সঙ্গীরা পারলে ঘোড়াগুলোকে উড়িয়েই নিয়ে আসত। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গলা বাড়িয়ে লোকগুলোকে দেখার চেষ্টা করল রায়ান। কিন্তু নিকষ অন্ধকারে তাদের আবছা অবয়ব দেখা গেল শুধু, ক’জন লোক সেটা বোঝা গেল না।
ব্যস্ত সমস্ত দলটার নেতৃত্ব দিচ্ছে মন্ট বেলার। ওর লুকিয়ে থাকার জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপো করল রায়ান। তারপর বেরিয়ে এসে তাদের পেছনে ঘোড়া ছোটাল। শহরে ঢুকে সেলুনের সামনে ঘোড়া থামাল বেলার ও তার সঙ্গীরা। তিনজন বাদে বাকিরা সেলুনের ভেতরে ঢুকল। যারা ঢুকল না, তাদের দু’জন সেলুনের সামনে পাহারায় রইল।
মিনিট দশেক পরে সেলুনের কাছাকাছি এক জায়গায় নিজের ঘোড়াটা বাঁধল রায়ান। ব্যাটউয়িং দরজার সামনে দু’জনকে পাহারা দিতে দেখল। একজন উঁঁকি দিয়ে দেখতে চাইছে ভেতরে কী ঘটছে, আরেকজন নার্ভাস ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
আরো কিছুণ অপো করল রায়ান। দরজায় দাঁড়ানো লোক দু’জন একটু থিতু হয়ে দাঁড়াতে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আচমকা শটগানের হ্যামারের কিক করার কর্কশ আওয়াজে চমকে উঠল দু’জনেই। রায়ানকে দেখে জায়গায় জমে গেল যেন।
‘বাঁচতে চাও নাকি মরতে চাও?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল রায়ান।
বিশালদেহী লোকটার হাতে শটগান। জবাব দিতে এক সেকেন্ড সময়ও নিল না দুই পাহারাদার। মাথা নেড়ে নিজেদের আকাক্সার কথা জানাল। দেখা গেল অকালে মরে যাওয়ার ইচ্ছে দু’জনের কারোরই নেই।
শটগানের ব্যারেল দিয়ে ঠেলে দু’জনকে পেছনে নিয়ে গেল রায়ান। একপাশে দাঁড় করাল। তারপর শান্তস্বরে বলল, ‘এরা আমাকে মারধর করেছিল। তোমাদের দু’জনের কেউই সে-দলে ছিলে না। তাই তোমাদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। তবে আমার হুকুম মতো যদি এুনি নিজ নিজ ঘোড়া নিয়ে শহর ছেড়ে চলে না-যাও, তাহলে সেটাকে আমার সঙ্গে শত্র“তা হিসেবে দেখব।’
এক মুহূর্ত চুপ রইল দুই কাউবয়। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। আমরা চলে যাচ্ছি।’ একটু হাসার শব্দ করল। ‘সাতজনে মিলে একজনকে মারলে সেখানে অ্যাডভেঞ্চার থাকে না। কিন্তু একজন যখন সাতজনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সেটা দুঃসাহসের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে। তাকে সাহায্য করতে না-পারলেও সম্মান করা উচিত। বেলার লোক ভালো নয়।’
‘খাঁটি পুরুষের কথা বলেছ, ব্রাদার। কাজ শেষ হলে সেলুনে তোমাদের নিয়ে বসে মদ খাব। অফারটা দিয়ে রাখলাম। ভালো কথা, তোমাদের আরেকজন সঙ্গী আছে। ওকেও বুঝিয়ে নিয়ে যাও।’
ওখান থেকেই বিদায় হয়ে গেল দু’জন। একটু পরে তিনজনের ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনল রায়ান।
আরো মিনিট দুয়েক অপো করল রায়ান। তারপর সেলুনের সামনের দরজা দিকে এগোল সন্তর্পণে। দরজার সামনে গিয়ে আস্তে করে ঠেলা দিয়ে ভেতরে তাকাল। বারের কাছে গ্লাস হাতে দাঁড়ানো বেলারকে দেখল। বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে লোকটাকে। ওর পাশে আরো দু’জন। কথা বলছে ওদের সাথে। আরো দু’জনকে দেখা গেল ওর কাছাকাছি। তবে লিডারের মতো অতটা বেপরোয়া ভঙ্গি নেই ওদের চেহারায়। বারবার দরজার দিকে চাইছে লোকগুলো।
দরজার দু’পাশে দু’জন। হাতে উদ্যত পিস্তল। যে সাতজন ওকে মারধর করেছিল, তাদের একজনকে দেখল একজনের সঙ্গে বসে কথা বলতে। যার সাথে কথা বলছে, তাকে চিনল না।
দরজার দিকটা একটু অন্ধকার। সুযোগটা কাজে লাগাল রায়ান। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে অন্ধকারে দাঁড়াল। দীর্ঘ এক মুহূর্ত পুরো ঘরটায় নজর বুলাল। তারপর আচমকা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোতে দাঁড়াল। ওর এক হাতে শটগান, দরজার দিকে লোকদুটেকে কাভার করেছে। আরেক হাতে পিস্তল। বেলার আর তার দু’পাশের দু’জন ওটার আওতায়। টেবিলের কাছে বসা লোকটাকে অবশ্য কাভার করা গেল না। তবে বেচাল দেখালে শটগানের গুলিতে উড়িয়ে দেয়া যাবে।
‘সবাই উঠে দাঁড়াও! কোনো চালাকির চেষ্টা করবে না। তাহলে রক্তের বান ডাকবে এখানে।’
ওর কথাগুলো এত আচমকা, স্পষ্ট ও নিশ্চিত শোনাল যে, হঠাৎ নিñিদ্র নীরবতা নেমে এল সেলুনে। দরজার দু’পাশ দাঁড়ানো দু’জনের দিকে ইঙ্গিত করল ও। ‘তোমাদের অস্ত্র দরজার বাইরে ফেলে দাও।’
ইতস্তত করতে লাগল দুই অস্ত্রধারী। ‘এুণি!’ গর্জে উঠল রায়ান। শটগানের ট্রিগারে শক্ত হয়ে গেল ওর আঙুল।
আদেশ পালনে আর গড়িমসি করল না দুই পাহারাদার। দরজা খুলে দু’জনেই বাইরে ছুঁড়ে দিল নিজ নিজ অস্ত্র। তারপর ভদ্রলোকের মতো মুখ করে গিয়ে দাঁড়াল নিজের নিজের আগের জায়গায়।
রায়ান টেবিলের কাছে বসা লোক দু’জনের দিকে ফিরল। ‘তোমাদের একজনের হাত কিন্তু ধীরে ধীরে পায়ের দিকে এগোচ্ছে। আধা সেকেন্ডের মধ্যে যদি তোমাদের চারটে হাতই টেবিলের ওপর না দেখি, বাকি আধা সেকেন্ডেই দু’জনের লাশ পড়বে।’
উদ্যমী লোকটার হাতটা যেন আগুনের ছ্যাঁকা খেয়েছে, এভাবে ছিটকে উঠে এল ওপরে। দু’জনের চারটা হাতই এখন টেবিলের ওপর বিছানো। সন্তুষ্টি বোধ করল রায়ান।
অন্য লোকটি টেবিলের ওপর রাখা নিজের হাতদুটো উল্টে দিল। তারপর বলল, ‘দেখো মিস্টার, আমি তোমাদের ঝামেলায় নেই। আমি স্রেফ ওর সাথে কথা বলছি।’
‘তুমি যদি এসবের বাইরে হও, তাহলে সেভাবে আচরণ করো। হাতদুটো যেখানে আছে, সেখানে থাকে যেন।’ লোকটার দিকে তাকানোর দরকার মনে করল না রায়ান।
আগের জায়গা থেকে সরে ঘরের মাঝখানে চলে গেল ও। এভাবে দাঁড়াল যেন পেছন দরজা দিয়েও কেউ ওর চোখ এড়িয়ে ঢুকতে না-পারে। শটগানটা এভাবে ধরে রাখল যেন মুহূর্তের নোটিশে দরজার লোকটা ও বেলারের পাশের দু’জনকে কভার করা যায়। ‘আস্তে আস্তে জানালার দিকে সরে যাও জেন্টলমেন,’ বলল সে। ‘কিন্তু খবরদার, একদম তেড়িবেড়ি করবে না বলে দিচ্ছি।’ টেবিলের কাছে বসা লোকটার দিকে তাকাল। ওঠার কোনো লণ দেখাচ্ছিল না লোকটা। ‘এই যে, তুমিও। তুমিও ওঠো।’
বাকি লোকেরা পাথরের মতো জায়গায় জমে রইল যেন।
টেবিলের পাশের লোকটা উঠে অন্যদের সাথে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রায়ান হুকুম দিল, ‘তোমাদের দু’জনের কাছে এখনো এখনো পিস্তল। ওগুলো মেঝের ওপর ছুঁড়ে দাও। আমার হাতের শটগানটার কথা মাথায় রেখো কিন্তু।’
হুকুম তামিল হতে বেলারের দিকে চাইল। ‘নড়াচড়া কোরো না, বেলার। তাহলে শটগানের গুলিতে স্রেফ দু’ভাগ হয়ে যাবে।’
বেলারকে দেখে মনে হচ্ছে না, সে খুব বিচলিত। চোখে কৌতুকের ভাব ফুটিয়ে তুলে বিশালদেহী লোকটার কাজ-কর্ম দেখছে। আসলে সে অপো করছে। প্রতিপরে সামান্য একটু ভুল চোখে পড়লেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছিন্নভিন্ন করে দেবে লোকটাকে। তবে হতাশার সাথে দেখছে, এত বড় কাণ্ড ঘটিয়েছে লোকটা, অথচ একটু ভুলও ধরা পড়েনি ওর চোখে। বিশালদেহী লোকটার শরীরে চিতার প্রিতা, প্রত্যেকটি নড়াচড়াই যেন হিসেব করা।
বেলারের এখন একজন লোকের কথা মনে পড়ছে। বছর কয়েক আগে হিলটাউন নামের ছোট্ট একটি শহরে পাঁচজন দুর্ধর্ষ মস্তানকে স্রেফ খালিহাতে পিটিয়ে শায়েস্তা করেছিল ওই লোক। লোকটার চেহারা এখন আর মনে নেই । তবে এই লোক ওকে সে-লোকটার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওর ীণ সন্দেহ হচ্ছে নাকি এটাই সে-লোক?
লোকটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে থামানোর চেষ্টা করল সে। ‘শোনো,’ কেশে গলা পরিষ্কার করল। ‘আসলে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। তোমার ঘোড়াটা আমরা বার্নে রেখে দিয়েছি। স্যাডলটাও ওখানে পাবে। আর, স্বীকার করছি, তোমাকে অন্যায়ভাবে মারধর করা হয়েছে। ঠিক আছে, সেজন্যে আমি তোমাকে তিপূরণ হিসেবে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিচ্ছি।’ একটা হাত ভেস্টের পকেটে ঢোকাল সে। একটা ছোট চামড়ার তৈরি পাউচ বের করে আনল। তারপর ওটা বারের ওপর রেখে ঠেলে দিল রায়ানের দিকে।
টাকাটার দিকে তাকালও না রায়ান। গম্ভীর গলায় বলল, ‘বেলার, তোমাদের অপকর্মের শেষ নেই। জীবনে তোমরা বহু লোককে নিগৃহীত করেছ। সেটা তোমাদের স্বভাব। কিন্তু এবার তোমাদর হিসেবে ভুল হয়ে গেছে। তোমরা বাহাদুরি দেখাবার জন্যে ভুল লোককে বেছে নিয়েছিলে। সে-ভুলের মাশুল না-গুনে পার পাবে না। আমি এমন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি, যাতে তুমি আর কাউকে কখনো আঘাত করতে না-পার।’
‘না না, ঠিক আছে।’ আন্তরিকতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল বেলার গলায়। ‘আমি তো সে-ভুলটা শোধরানোর কথাই বলছি…আসলে..মানে, মানুষেই তো ভুল করে, তাই না!’ হাসির ভঙ্গি করল বেলার। ‘কী বলো?’
কঠিন চোখদুটো ফেরাল রায়ান লোকটার দিকে। সে-চোখে তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেখল না বেলার।
‘তুমি কি মানুষ?’ চাবুক ফোটানো গলায় বলল রায়ান। ‘তুমি খুব চালাক. তাই না বেলার? দিনের পর দিন কিছু লোককে বোকা বানিয়ে আসছ। কিন্তু আমি ভুলছি না। আমি হোয়াইট মাউন্টিনসের জন রায়ান। এরা বলেনি তোমাকে?’
‘না,’ মাথা নাড়ল বেলার। ‘কিন্তু আমি তোমাকে এখন চিনতে পেরেছি। ভুল হয়ে গেছে। সেদিনই চেনা উচিত ছিল। তাহলে মরুভূমিতে নিজ হাতে খুন করতাম তোমাকে।…কিন্তু…নিকুৃচি করছি তোর।’ আচমকা হুইস্কিভরা গ্লাসটা ছুঁড়ে দিল রায়ানের মুখে। পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল।
একই সাথে তিনটা কাজ করল রায়ান। শটগানটা ফেলে দিল হাত থেকে, পেছনে চিৎ হয়ে ঝাঁপ দিল এবং কোমরের দিকে হাত বাড়াল। গ্লাসটা ওর মাথার পেছনে মেঝেয় পড়ে ভাঙল ঝন ঝন করে।
বেলারের গুলিটা দেয়ালে গিয়ে বিঁধল। আর ওর কপালে সৃষ্টি হলো আরেকটা চোখ।
* * *
সকাল বেলা। সিম বায়েকের দোকানের সামনে এসে থামল বে। কাউন্টার থেকে সরু চোখে তাকাল নিগ্রো দোকানদার। তারপর কালো মুখে বিজলীর মতো ঝিকিয়ে উঠল শাদা দাঁত। বেরিয়ে এল ও। ‘সাহ্!’
‘আমি আইরিনকে আমার সাথে নিয়ে যাব, বায়েক। তোমার আপত্তি আছে?’
হাসি বন্ধ হয়ে গেল দোকানদারের। কপাল কুঁচকে নিচের দিকে তাকাল। যেন রায়ান কী বলছে, তা বোঝার চেষ্টা করল। যখন চোখ তুলল, তখন নির্মল কৌতুকে ঝক ঝক করছে ওগুলো। ‘আমার একটা প্রস্তাব আছে,’ আমুদে গলায় বলল। ‘তুমিই বরং এখানে থেকে যাও না। আইরিন আমার মেয়ের মতো। আমি ওকে সারাণ চোখে চোখে রাখতে চাই।’
পাঁচ সেকেন্ড লোকটার চোখে চোখে চেয়ে রইল রায়ান। তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘সেটা তোমার চেয়ে আইরিনের মুখে শুনতেই আমার ভালো লাগবে, বুড়ো।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়, সাহ্! অবশ্যই। আমি খুব ধুমধাম করে গির্জায় গিয়ে তোমাদের…’
পেছনের পর্দা দুলে উঠতে থেমে গেল। নিরীহ মুখ করে বলল, ‘ওই তো আইরিন। তুমি দুপুরে কী খেতে চাও ওকে বলে দাও, সাহ।