আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি পলাশীর মোড়ে। রাস্তা ক্রস করার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার সাথে আছে সোহেলী। সোহেলী আমার ছোটবেলার বান্ধবী। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক থেকে ছুটি কাঁটাতে এসেছে। নিউইয়র্ক এর একটা ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করছে। প্রচন্ড গরমে সে প্রায় অস্থির। তাই ভাবছে প্লেনের টিকেট এগিয়ে আনবে। সোহেলীর প্রতি আমার একটু বিশেষ দূর্বলতা আছে। তাই আমি চাচ্ছি সে কোন কিছুতে ব্যাস্ত হয়ে যায়, তাহলে আর গরম তাকে কাবু করতে পারবে না। সেজন্য তার মাথায় হিমুর ভূত ঢুকিয়ে দিলাম। এমনিতে সে বাংলাদেশের লেখকদের বই খুব একটা পড়ত না। হুমায়ূন আহমেদের কিছু বই অবশ্য পড়েছিল। তাই গতকাল তাকে হিমু সমগ্র কিনে দিলাম। সে ইতিমিধ্যে হিমুর দু’টি গল্প পড়ে রীতিমত মুগ্ধ। আমি তাকে আরো মুগ্ধ করে দেয়ার জন্য বললাম যে আমাদের দেশে কিন্তু অনেক ছেলেই আজকাল হিমু সেজে ঘুরে বেড়ায়। তাই সে ইচ্ছা করলে বিষয়টা নিয়ে আমেরিকার কোন পত্রিকায় নিউজ করতে পারে। আইডিয়াটা শুনে তাকে বেশ খুশী মনে হল। আমি আরো বললাম যে, হিমুর সন্ধানে আমরা যদি হলুদ পোষাক পড়ে বের হই তাহলে হয়ত হিমুদের খুঁজে বের করতে সুবিধা হবে। আশেপাশে হিমু জাতীয় কেউ থাকলে সে হয়ত কাছে এসে কথা বলতে চাইবে। আর আমরা তার ইন্টারভিউ নিতে পারব। আমার সাথে তাল মিলিয়ে সোহেলী বলল, আমরা ত ইচ্ছা করলে আমাদের হলুদ টি শার্টে ‘হিমুদের খুঁজছি’ কথাটা লিখে রাখতে পারি ( সোহেলী একটু বোকা টাইপ)। আমি কিছুক্ষন চিন্তা করে বললাম,
হ্যাঁ তা লিখা যেতে পারে, তবে আমার হাতে যেহেতু ক্যামেরা আর মোবাইল থাকবে তাই আমার হিমু সাজবার দরকার নেই। তানাহলে দেখা যাবে হিমুদের খুঁজে পেলে তারা ইন্টারভিউ না দিয়ে উল্টো আমার পোশাকের ভুল ধরার চেষ্টা করছে। বুঝিসই ত বাংলাদেশি হিমু। কথা একটু বেশি বলবেই।
-হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। হিমু হওয়া কি এত সোজা নাকি। দেখা যাবে আমাকে দেখে ইন্টারভিউর কথা ভুলে লাইন মারা শুরু করেছে।
-হ্যাঁ। আর তুই মেয়ে বলেই তোর পোশাকের ভুল ধরবে না। বেঁচে গেলি। তা নাহলে পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবী অর্ডার দিয়ে বানাতে হত। এখন টি-শার্ট দিয়েই চালিয়ে দিতে পারবি।
-কিন্তু হিমুদের কোথায় সহজে পাওয়া যাবে?
-বাজারে পাওয়াটা সহজ হবে। শুক্রবার অনেক হিমুরাই নাকি হলুদ পাঞ্জাবী পরে বাজার করে আর মসজিদের বাহিরে বাজার রেখে একসাথে নামাজ সেরে ফেলে।
-আল্লাহ কি বলিস? বাজার চুরি হয়ে যায় না?
-হিমুদের ত চুরির ভয় নেই।
-ও হ্যাঁ ঠিক বলেছিস।
অনেক কষ্ট করে রাস্তা পার হবার পর সোহেলী বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
এত বাজার থাকতে তুই এই বাজারে নিয়ে এলি কেন?
-অন্য বাজারের পরিবেশ ভালনা। পাশেই বুয়েট ত। তাই তোকে কেউ টিজ্ করলে বুয়েটের ছেলেপেলেরা তোকে সেইভ করবে।
-ভেরী এক্সাইটিং!
বাজারে ঢুকার সাথে সাথে সোহেলীকে দেখে সবাই রীতিমত মজা পেতে শুরু করল। মজার কারন একটাই, সেটা হল সোহেলীর পিছনে ‘হিমুদের খুঁজছি’ লেখাটা। লেখাটা না থাকলে হয়ত সবাই সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই নিত। আশপাশ থেকে বেশ কয়েকটা টোকাই এসে সোহেলীর পাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। সোহেলী বিরক্ত হয়ে বলল,
এই তোরা কি দেখছিস? যা এখান থেকে। হুশ!
-আফা আন্নে কি হাগল?
-পাগল হব কেন? যা এখান থেকে। যাহ্ যাহ্!
আমরা বাজারের সরু সারির দু’পাশের সবগুলা দোকানে একনজর দেখে নিলাম। হলুদ পোশাকে কাউকে দেখতে পেলাম না। সোহেলী মুদী দোকানে বসে থাকা একটা ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করল,
এই এখানে হলুদ জামা পড়া কাউকে দেখেছ?
-জ্বী আফা দেখছি।
-কোথায় সে?
-আমার সামনে খাড়ায় আছে।
এই বলে ছেলেটি হিহিঃ করে হাসতে শুরু করল। সোহেলী ছেলেটির কথা শুনে বেশ রেগে গেল। পাশের দোকান থেকে মাঝবয়েসি এক লোক সোহেলী কে উদ্দেশ্য করে বলল,
আফা আফনে ওর কথায় কিছু মনে লইয়েন না। তয় একটু আগে এক বুড়া ব্যাটা আমার কাছ থেইকা পাঁচ কেজি চাউল আর ময়দা কিন্না ওই মাছের দোকানের দিকে গ্যাছে। হলুদ শার্ট আছিল গাঁয়ে। আফনে কি তাঁরে খুঁজতাছেন?
সোহেলী লোকটির কথায় জবাব না দিয়ে মাছের দোকানের দিকে রওনা হল। আমি পেছন পেছন ক্যামেরা আর খাতা কলম নিয়ে এগুতে থাকলাম। মাছের দোকানে আসার পর ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম দূরের একটি দোকানে হলুদ শার্ট আর সাদা লুংগী পরা এক বয়স্ক লোক মাছ কিনছেন। সোহেলী দ্রুত লোকটির কাছে গিয়ে বলল,
চাচা স্লামালাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম।
-চাচা আমি আমেরিকার একটা নিউজ পেপারে বাংলাদেশের হিমুদের সন্মন্ধে একটা রিপোর্ট করতে চাই। আপনি কি চাচা হিমুদেরই একজন? তাহলে আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতাম।
সোহেলীর প্রশ্নের আগা মাথা লোকটি কিছুই বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকালেন। আমি উনাকে একটা চোখ টিপ দিলাম, এর অর্থ হল, চাচা আমেরিকার নিউজ পেপারে ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ আর কোনদিন পাবেন বলে মনে হয় না।
উনি তখন সোহেলী কে বললেন,
-আফনে কি আমার ইন্টারভিউ লইতে চান?
-জ্বী চাচা। আপনার নাম কি?
-গঁফূর। আব্দুল গঁফুর।
-পেশা?
-বুয়েটের রিটায়ার্ড পিওন।
-জীবনের লক্ষ্য?
-মাইয়ার বিয়া দেওন।
-হিমু হতে চান কেন?
-আফনের চাচীর ইচ্ছা।
-চাচীর ইচ্ছায় হিমু হতে চান? নিজের কোন ইচ্ছা নেই?
-জ্বীনা। হিমু হইবার চাই না। গঁফুর আছি, গঁফুরই থাকবার মন চায়।
-চাচী কি মহিলা হিমু?
-মনে হয়।
-চাচী কি হলুদ শাড়ী পড়েন?
-মাঝে মইধ্যে পড়ে দেহি।
-তখন কি উনি খাঁলিপায়ে হাঁটেন?
-হে সবসময়ই খাঁলিপায়ে থাহে। তয় বাইরে বেরুইলে স্পঞ্জ পায়ে দেয়।
-উহু চাচা। তাহলে ত হচ্ছে না। সবসময় খাঁলিপায়ে থাকতে হবে।
আমি তখন সোহেলীকে ফিসফিস করে বললাম, তুই ত এখানে আসল হিমু পাবি না। হিমু হওয়া কি এত সহজ নাকি? এরা সবাই পার্টটাইম হিমু। সোহেলী তার ভুল বুঝতে পেরেছে এমন একটা ভাব করল। ইন্টারভিউ আবার শুরু হল।
-চাচা আপনার কয় ছেলেমেয়ে?
-আমার তিন মাইয়া দুই পোলা।
-ছেলেমেয়েরা কি করছে সবাই?
-এইডা না লেখলে হয় না?
-আচ্ছা ঠিক আছে। চাচী কি করেন?
-কিছুই করে না। সারাদিন বাসাত বইয়া থাকে আর আমারে লম্বা লিস্টি দিয়া বাজারে পাঠায়।
-আপনি কি প্রতিদিন বাজার করেন চাচা?
-জ্বী।
-প্রতিদিন কেন বাজার করেন চাচা? একদিনে সপ্তাহের বাজার করে ফেললেই ত ঝামেলা চুকে যায়।
-আপনের চাচীর কই মাছ খুব প্রিয়। হের লেইগা ফেরেস কই মাছ লাগে। কই মাছ ছাড়া হেয় ভাত খাইতে পারে না।
-চাচা আপনি কি চাচী কে রান্নায় সাহায্য করেন? আই মিন্ হিমুদের ত রান্না জানতে হয়। আপনি নিশ্চয়ই রান্না জানেন?
-হিমুগো রান্না জানতেই হইব?
-জ্বী চাচা।
সোহেলী এই প্রশ্নের জবাব পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে না দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বুঝলাম মাত্র দুইটা বইয়ে অনেক কিছুই হয়ত সে জেনে উঠতে পারেনি। তাছাড়া আমারো সেই মুহুর্তে মনে পড়ছিল না হিমু রান্না জানে কিনা। আমি সোহেলীর দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিলাম হ্যাঁ হিমুদের রান্না জানতে হয়। ইন্টারভিউ চলতে থাকল।
-তাইলে আমিও রানতাম পারি
-আপনি কিভাবে কই মাছ রান্না করেন চাচা? বিশেষ কোন পদ্ধতি?
-হ আমার একটা বিশইষ পদ্ধতি আছে। আমি পরথমে কইমাছ ভাল কইরা সিদ্ধ কইরা ফেলি। তারপর নরম হইলে গোল মরিচের গুড়া দিয়া স্যুপ বানায় খাইয়া ফেলাই। আর কিছু জিগাইবেন? আমার একটু তাঁড়া আছে। নামাজের সময় হইয়া আইল।
-না চাচা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে আপনার একটা ছবি তুলতে হবে।
-কইমাছের লগে?
-তাহলে ত খুবই ভাল হয় চাচা।
এরপর উনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছবিতোলার জন্য হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন এবং ডান হাতে কই মাছটি উঁচু করে ক্যামেরায় দেখানোর ভংগি করলেন। আমি ক্যামেরার ভিতর দিয়ে উনাকে আর কই মাছটিকে দেখছি। মাছটি বেশ বড় আর মুখটা একটু হা হয়ে আছে। আমার মনে হচ্ছে উনার সাথে সাথে মাছটিও হাসছে।