কুলসুমনামা

কুলসুমনামা

আমাদের সলতাপুর গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবের জমিজমার পরিমাণ গ্রামের চল্লিশ শতাংশ জুড়েই। এছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন জমি প্রসব তো আর থেমে থাকছে না। সেই সকল সদ্যপ্রসূত জমিগুলো প্রসবের পরপরই খাজনা দেওয়া জমির তালিকায় নিজেদের নাম লিখে ফেলে। কড়কড়ে নতুন নোটের আগমনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নতুন নোটগুলি চেয়ারম্যান সাহেবের কোষাধ্যক্ষ সলিমুদ্দিনের হাতের ওপর চকচক করে আলো ছড়াতে থাকে। শেষমেশ এর গন্তব্য হয় চেয়ারম্যান বাড়ির সিন্দুকের অভ্যন্তরে।

চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র কন্যা কুলসুম গত বসন্তে পনের পেরিয়েছে। সদ্য কৈশোর অতিক্রম করা কুলসুম বেগম শ্রেণীর হিসেবে দশমে অবস্থানরত। তার রূপের কথা বিশেষ করে বলার কোন প্রয়োজন পরে না। তবুও তাকে গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরতম মেয়েছেলে হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কুমারী নারীর রূপের ছটা দেখে পুরুষ আকর্ষিত হবে এটাই বোধহয় সৃষ্টির কলমে প্রথম থেকেই লেখা রয়েছে। তেমনি আজকের এই কুলসুম তার রূপের ছটা দেখিয়ে গ্রামের সহস্র মায়ের ছেলে সন্তানকে, রেখেছে তার আপন কারাগারে বন্দী করে। ছেলেগুলোও বিনা অপরাধে বন্দী জীবন যাপন করছে।

গত কয়েক বছর যাবত সলতাপুর গ্রামে পনের থেকে পঁচিশ বছর অবধি কোন ছেলেসন্তানের বিয়ে হচ্ছে না। বিয়ে হচ্ছে না, এটা বলে নিজেকে বোধহীন প্রমাণ করতে চাই না। মূলত তারা বিয়ে করতে চাচ্ছে না। ছেলেগুলোর মা-বাবা বিয়ে না করার কোন হেতু খুঁজে না পেয়ে অবশেষে মৌলবির নিকট তাবিজের উদ্দেশ্যে যায়। তাদের ধারণা- এসবের পেছনে কোন দুষ্ট পরীর হাত রয়েছে। তবে গ্রামের বয়োবৃদ্ধ সম্প্রদায় এই যুক্তি মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট করে বলে বেড়াচ্ছে যে, এই বিয়ে না করার পেছনে কুলসুম বেগমের সংযোগ রয়েছে। কথায় আছে, একশ যুবক আর এক প্রবীণ সমানে লড়ে। এক্ষেত্রেও প্রবীণগণের জয় হলো। গ্রামের প্রতিটা ঘটনা বিন্দু বিন্দু করে বিশ্লেষন করলে বিষয়টা প্রমাণ হয়। গ্রামের তরুণ এবং যুবকেরা কুলসুমকে বিয়ের উছিলা খুঁজে বেড়ায়। তারা চায় গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে কুলসুম তাদের ঘর আলো করে আসুক। কিন্তু এতশত আকাঙ্খিত পুরুষের ঘর আলো করা তো কুলসুমের একার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ এই কঠিন সত্য অপেক্ষমাণ আকাঙ্খিতদের কে বুঝাবে?

প্রেমের ক্ষেত্রে যত বাঁধাই আসুক না কেন, তা প্রেমিকপুরুষদের কোনভাবে দমাতে পারবে না। বাংলা সিনেমা অধিক দেখার ফলে সলতাপুর গ্রামের রনি ভাই উক্ত বিষয়টা অন্তরে মহাসত্যরুপে লালন করে আসছেন। গ্রামের সকল তরুণ ও যুবকদের মাথার ওপর দিয়ে চলা বুদ্ধিমান রনি ভাইও সেই মহাক্রান্তিকালের সময়ে কুলসুমের প্রেমের অনলে পুড়ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি তরমুজ ক্ষেতে নিজ বর্জ্য ত্যাগ করার সময় আক্ষেপের সুরে গাইতেন,
“বিধি তুমি বলে দাও কুলসুম কার?
একটিমাত্র মেয়ে তার কতশত দাবীদার!”

বহুকাল পূর্বে কোরিয়ান পুরুষেরা হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে একটা খেলা আবিস্কার করেছিলেন। এই খেলা আত্মরক্ষার কাজে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া নামক এক দেশের জাতীয় খেলা হলো এই হাত-পা ছোড়াছুড়ি খেলা। এই খেলার মূল লক্ষ্য হলো লাথি। বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে এই খেলাটা দেশের অনেকগুলো স্কুলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সলতাপুর গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও একজন প্রশিক্ষকের আগমন ঘটে। তিনি ঢোলাঢোলা জামা-কাপড় পরে স্কুল ছুটির পর বিকেলবেলা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায় লাফালাফি করেন। তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দশ-বারজন মেয়েও লাফালাফিতে অংশগ্রহন করে। তাদের লাফালাফির প্রতি গ্রামবাসীর তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। তবে এই দশ-বারোজন মেয়ে যথেষ্ট পরিশ্রম করেই লাফালাফি করে। দুইমাস পর এই দশ-বারোজন মেয়ে কালো কোমড়বন্ধনী নিয়ে প্রশিক্ষণের সমাপ্তি ঘটায়। এই দলের মধ্যে ২য় স্থান অধিকারিণী মেয়েটি হলো কুলসুম বেগম। চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে মার্শাল আর্টে ব্লাকবেল্ট পেয়েছে এই মর্মে একটি সনদপত্রও চেয়ারম্যান সাহেব দেখলেন। কিন্তু তার মাথায় ধরে না, একটা কালো কোমড়বন্ধনীর জন্য তো তার মেয়ের এতো পরিশ্রম করার কথা না। তিনি ইচ্ছে করলে মেয়েকে সোনায় বাঁধানো কোমড়বন্ধনীও দিতে পারেন। তাহলে এই কোমড়বন্ধনীতে এমন কি আছে? তিনি রাবেয়াকে দিয়ে কোমড়বন্ধনীটা আনালেন। ঘন্টা দুয়েক যাবত কোমড়বন্ধনীর খুঁটিনাটি দর্শন করে বুঝতে পারলেন, এটা একখানা কালো কাপড় ব্যতীত অন্য কিছুই নয়।

রাজু ভাই গ্রামের সকলের মধ্যে কুলসুমকে পাবার তীব্র বাসনা দেখে মনে মনে হতাশ হলেন। সবাই যদি তার প্রিয়া হিসেবে কুলসুমকে কল্পনা করে তাহলে তো কার্যসিদ্ধি হবে না। তিনি ভেবে দেখলেন যে, যদি কিছু পেতে হয় তবে কিছু ছাড়তে হবে। এখানে পাওয়ার জিনিসটা যদি কুলসুম হয়, তাহলে ছাড়ার জিনিসটা হবে ভয়। চেয়ারম্যানের মেয়ে বলে কি তাকে ভালবাসা অপরাধ? মোটেই না। এই প্রত্যয় নিয়েই রাজু ভাই কুলসুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রথম দুইদিন কুলসুমের পেছন পেছন স্কুলে গেলেন এবং ফেরার সময়ও তার শরীররক্ষী হিসেবেই ফিরলেন। তথাপিও তিনি কুলসুমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেন না। এরপর তিনি কুলসুমের নিকট প্রেমপত্র প্রেরণ করলেন। প্রেমপত্রে ইনিয়ে বিনিয়ে সাহিত্যালাপের মাধ্যমে ভালবাসার কথা লিখে দিলেন। প্রেমপত্র দেয়ার সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল কিন্তু ফেরত চিঠি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না। তবে কুলুসুমের রাগী চোখ তার দিকে মুহুর্তের জন্য হলেও তাকিয়েছিল। এই প্রেমপত্র দেওয়ার পর রাজু ভাইয়ের ভাবনা অনুযায়ী কুলসুমের উচিত ছিলো রাজু ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশিত হলো না। তবে অন্যদিকে কুলসুম বেচারির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে উঠলো। রাজু ভাই হলেন সলতাপুর গ্রামের শয়তানের মাথা। গ্রামসুদ্ধ শয়তানের চেলা চুমুন্ডাগণ, মাথার কর্মের সাথে মিল রেখে নিজ কর্ম সাধন করবে এটাই স্বাভাবিক। ঘটনার স্বাভাবিকতায় তারাও কুলসুমের শরীররক্ষী হিসেবে তার পশ্চাৎে ঘুরঘুর করতে লাগল। এই সময়ে কুলসুমদের বাড়ির চারপাশ, স্কুলের দেয়ালের পেছনে, শহীদ মিনারে, চলাচলের রাস্তায় উঠতি বয়সের তরুণ ও যুবকদের ভীড় ক্রমেই বেড়ে চলছিল। চেয়ারম্যান সাহেব যদি অসুস্থ হয়ে ঘরে পরে না থাকতেন তবে তিনি অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করতেন, গ্রামে প্রবীণদের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে কমে গিয়েছে এবং তরুণ ও যুবকদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

রাজু ভাই যখন দেখলেন পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন তার মাথায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট বুদ্ধি হিসেবে নতুন একখানা বুদ্ধির উদয় হলো। তিনি সংকল্প করলেন, তার এই ভালবাসার কথা সরাসরি কুলসুমের সামনে গিয়ে বলবেন। এভাবে বললে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কুলসুমের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পরবে। আর চেয়ারম্যান সাহেব অসুস্থ থাকায় সময়টাও ছিল তার অনুকূলে। যেই ভাবা সেই কাজ, একদিন বিকেলে স্কুলফেরত কুলসুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন রাজু ভাই। সরাসরিই বলে দিলেন তার ভালবাসার কথা। কুলসুম তার এই মহান ভালবাসাকে অল্প কথায় সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলো। এমনিতে রাজু ভাই নামক মানুষটির মাথার তাপ একশ ডিগ্রীর বেশীই থাকে। আজ এই সবিনয় প্রত্যাখানে সেখানে হঠাৎ করে তাপমাত্রা আড়াইশ ডিগ্রী ছাড়িয়ে গেল। তিনি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কুলসুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। কুলসুম তার প্রশিক্ষিত পা-টা দুলিয়ে মুহুর্তের মধ্যে পুরুষদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ গোপন অঙ্গে আঘাত করলো। রাজু ভাই কুঁ কুঁ জাতীয় শব্দ করে এক পা পিছিয়ে এলেন। হাঁটুদুটি এক করার আগেই আবার নাক বরাবর হাত চালিয়ে দিলো কুলসুম। প্রচন্ড আঘাতে রাজু ভাইয়ের মনে হলো তার বোঁচা নাকটি ঠিক হয়ে গেছে। নাকের ফুটো দিয়ে গলগল করে তরল যোজক কলা বেরিয়ে আসতে লাগলো। এভাবেই হৃদয়বিদারক ঘটনা দিয়ে আরেকটি উঠতি প্রেমের গল্পের সমাপ্তি হলো।

এই ঘটনার পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। রাজু ভাই নামক বস্তুর আধিপত্য ধুলোয় মিশে গেছে। রাজু ভাইকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে এলাকার তরুণ ও যুবকেরা ঘটনার নির্মমতা খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছিল। তাই তারা আবার আগের মতোই চুপি চুপি একরোখা ভাবে কুলসুমকেই ভালবাসলো। এই ঘটনার বিবর্তনে রাজু ভাইয়ের নামও পরিবর্তিত হয়ে গেল। নতুম নাম “হারবাল রাজু” হওয়ার পেছনেও চমকপ্রদ কাহিনী রয়ে গেছে। এভাবেই বুঝি কিছু মানুষ কাহিনী রচনা করে। কুলসুমের হাতে নির্যাতিত হওয়ার একুশ দিনের মাথায় রাজু ভাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরূপে এখন পর্যন্ত তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কিন্তু অতি দুঃখের সহিত প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিবারই বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এই ঘটনাতেও প্রবীণদের আপত্তি আছে। তারা মনে করেন, বউগুলি রাজুকে ছেড়ে চলে যায়নি বরং তারা পালিয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার ও মঙ্গলবার রাজু ভাইকে “কলিকাতা হারবাল” এর দোকানে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি সিরিয়াল অনুযায়ী অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন আসবে যৌনবিষয়ক ডাক্তারটি। বিধাতা বোধহয় কুলসুমকে রাজু ভাইয়ের মনের জন্যই তৈরী করেছিলেন। তা না হলে কুলসুমের একটা লাথি ও একটা ঘুষি তাকে রাজু ভাইয়ের মনে সারাজীবন বাঁচিয়ে রাখতো না।

অবশেষে বিয়ে হতে যাচ্ছে কুলসুমের। চেয়ারম্যান সাহেব নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দিচ্ছেন তাঁর মেয়েকে। ছেলে ভেটেরনারি ডাক্তার। গরু, ছাগল, মহিষ, মুরগী ইত্যাদির চিকিৎসা করে। বলদ বলদ চেহারার সাথে মোটা গোল ফ্রেমের চশমায় ডাক্তারের মতোই লাগে হবু জামাইকে। গোবেচারা ধরণের ছেলেটি প্রথম দশায় মেয়ের পূর্ব কাহিনী শুনে মারাত্মক ভয় পেয়েছিল। কিন্তু রুপসী কুলসুম বেগমকে দেখে তার পূর্ব ইতিহাসকে বিষাক্ত মনে হলো। এইরূপ সুন্দরী রমণী কারো ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছে বলে তো মনে হয় না।
ছেলে সুদর্শন, সরকারী পশু হাসপাতালে চাকরি করে। এইরকম একটা পাত্র চেয়ারম্যান সাহেবও হাতছাড়া করতে চান না। তাঁর অনেকদিনের শখ অবশেষে পূরণ হলো। এখন আর তাকে মেয়ের চিন্তায় অস্থির হতে হবে না। কারো কাছে সমর্পণ করে তিনি এই দায় হতে মুক্তিলাভ করলেন।

কুলসুমের বিয়ের খবর গ্রামের কারোই অজানা নয়। প্রেমিক পুরুষেরা নিজেদের মাথার চুল ছিড়তে লাগল। তাদের মতো এতগুলো ছেলেকে অগ্রাহ্য করে কোন গ্রামের কোন পশু ডাক্তার কুলসুমকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, এটা তারা কোনভাবে মেনে নিতে পারছে না। আবুল ফার্মেসীর সকল কীটনাশক শেষ হয়ে যায়। রশির দোকানের ফাঁস উপযুক্ত মোটা দড়িও রমরমা ব্যবসা করে ফেলে। এই কীটনাশক কিংবা দড়ি মূলত সাহসী পুরুষেরাই কিনে ফেলেছিল। ভীরুদের মরবার সাহস হয় না। তাই তারা মৃত্যুর থেকে সহস্র হাত দূরে থেকেই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল। মরবার ক্ষেত্রে সাহসী পুরুষগণ কুলসুমের বিবাহের দিনকেই উত্তম দিন বলে বেছে নিল। তারা সবাই নিজেদের মতো করেই মরতে চায়। সবার জন্য তো আর আলাদা গাছের ব্যবস্থা করা যায় না। তাই কেউ কেউ ঘরের আড়াকেই উপযুক্ত স্থান বলে ধরে নিলো।

কুলসুমের বয়স পনের পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। বিষয়টা গ্রামের লোকসকলের চিন্তার উদ্রেককারী ঘটনা না হলেও শিক্ষিত সমাজের নিকট এটা মারাত্মক অপরাধ। কুলসুম এ বিষয়ে অনেক কিছুই জানত। কুলসুম ছোটবেলা থেকেই অতি বুদ্ধিমান মেয়ে, কোনভাবেই হার মানার পাত্র হতে রাজি না। শেষ মিনিটে এসে গোল দেওয়া কুলসুমের পুরাতন অভ্যাস। এইবারেও যে সে শেষমুহুর্তে এসে গোল দিবে এটা কে জানত? সবাই যেখানে তার বিয়ে নিয়ে আনন্দে মাতামাতি করছে সেখানে কুলসুম দূরভাস যন্ত্রের সাহায্যে শহরে একটি ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ করলো। উপজেলা মহিলা অধিদপ্তরের সেকেন্ড অফিসার নুরুন্নাহার বেগমের কাছে কুলসুম অল্পবিস্তর পরিচিত মুখ। তাই বিষয়টা নির্বাহী অফিসারের নিকট যেতে খুব বেশী একটা দেরী হলো না। যথা সময়ে তারা উপস্থিত হবে বলেই জানাল। কুলসুম হাসতে হাসতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দিলো। কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারলো না যে, কর্ম সংঘটিত হয়ে গেছে। এখন তারা শুধু কিছু পুতুলমাত্র। চূড়ান্ত সময় এবছরে আর দৃষ্টিগোচর হবে না।

বিয়ের দিন সকালবেলা হতেই লোকজন চেয়ারম্যানবাড়ীতে আসতে লাগলো। মজার ব্যাপার হলো মৃত্যুকামী প্রেমিক পুরুষেরাও খেতে চলে আসলো। তাদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুর চিন্তা দূর করেছে। আবার অনেকে শেষ বেলায় কিছু উৎকৃষ্ট খাবার খেয়ে মৃত্যুবরণ করাকে সমীচিন মনে করলো। ওইদিকে ডাক্তার সাহেব হাতির পিঠে চড়ে বিবাহ করতে আসছিল। হাতির পিঠের ওপরে চড়ার অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি। তাই প্রতিটা দুলুনিতে তার মুখ থেকে গোঁ গোঁ জাতীয় শব্দ বের হতে লাগল। অধিক উৎকন্ঠায় ডাক্তার সাহেবের নতুন পাজামা আদ্র হয়ে গেল। নতুন কেনা শেরওয়ানীর পেছনের অংশে ভেজা দৃশ্যমান হলো। সেইদিন সকালে হালকা বৃষ্টিপাত হওয়ার দরুণ কেউই একে মূত্র বলে সন্দেহ করলো না।

বিবাহের খানাপিনা রান্না করা শেষ হয়েছে। বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবার পরে সবাইকে খানা বিতরণ করা শুরু হবে। কাজী সাহেব দাড়িতে হাত বুলিয়ে মনে মনে কি যেন ভাবতেছিল। চেয়ারম্যান সাহেবের তাগাদা শুনে সে তার কাবিনের খাতা বের করে সেখানে লেখা শুরু করলো। পাত্রের নামধাম কেবলমাত্র লিখা শেষ হয়েছে এমন সময় দু’খানা গাড়ী ও কিছু লোক কোথা থেকে যেন উপস্থিত। এটা মূলত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও তাঁর সৈন্যদলের আগমন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা বিবাহকার্যে বাঁধা দিলো। ডাক্তার সাহেবের বাবা ও ডাক্তার সাহেবকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ফেলল। চেয়ারম্যান সাহেব ইঁতিউঁতি করে তাকিয়ে কাজীর অস্তিত্ব খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু ধুরন্ধর কাজী সাহেবকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বাল্যবিবাহের অপরাধে ডাক্তার সাহেব, তার বাবা এবং চেয়ারম্যান সাহেবের ২০,০০০ টাকা জরিমানা হলো, এই জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয়মাস কারাদন্ড ভোগ করতে হবে। এইসমস্ত বিভিন্ন দন্ড ভোগ করে তারা তিনজন মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেল। নির্বাহী অফিসারের উপস্থিতিতে গ্রামের লোকজন সেই দুপুরবেলা ভরপেট খাওয়াদাওয়া করলো। যে খাবারের অধিকাংশ থেকে যাবার কথা ছিল সে খাবারই শেষ পর্যন্ত টেনেটুনে চালাতে হলো। এই অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহনের পেছনে প্রেমিকপুরুষদের ভূড়িভোজের সংযোগ রয়েছে, এটা শুধুমাত্র প্রবীন ব্যাক্তিত্বরাই টের পেয়েছে।

ঘটনার সমাপ্তি এখানেই ঘটতে পারত। কিন্তু নিজের বিবাহ নিজেই প্রতিরোধ করে কুলসুম অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করলো। সারা বাংলার কাছে পরিচিত মুখ হয়ে কুলসুম বেগম সগর্বে নিজের স্থান করে নিলো পাকাপোক্ত। এখন আর সলতাপুর গ্রামের কোন ছেলে মেয়েদের দিকে তাকানোর সাহস পায় না। সবাই দুইমাস লাফালাফি করে গোপন স্থানে আঘাত করার সক্ষমতা লাভ করেছে। আঠার বছর হওয়ার আগে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার যে নিয়ম সলতাপুর গ্রামে ছিল তা বিলুপ্ত হয়ে গেল। সবাই এখন কুলসুমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা গর্বিত বোধ করে কুলসুমকে নিয়ে। গ্রামের সবারই আলাদা একটা ভক্তি কাজ করে কুলসুমের প্রতি। কিন্তু একটিমাত্র মানুষ- রাজু ভাই, কুলসুমকে দারুণ অপছন্দ করেন। কুলসুমের একটা লাথি খেয়েই ভবিষ্যত নষ্ট হওয়া রাজু ভাই কি করে কুলসুমকে ক্ষমা করতে পারেন? এটা তো সম্ভব নয়। এখন নাকি তার মূত্রত্যাগেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। দিনে তিন থেকে চারবার তাকে এই অসহ্য কাজটি করতে হয়। এই তিন চারবারই তার কুলসুমের কথা মনে পরে যায়। গ্রামের অন্যসকলের মনে কুলসুমের প্রবেশ না ঘটলেও রাজু ভাইয়ের মনে অহরহ ঘটে। একমাত্র মনুষ্য হিসেবে তিনি কুলসুমকে সারাজীবন মনে রাখবেন- এই কথা নিশ্চিত করে আমি আপনাদের নিকট বলতে দ্বিধাবোধ করবো না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত