০১. ম্যাজিক সম্বন্ধেও ফেলুদার যথেষ্ট জ্ঞান আছে
অন্য অনেক জিনিসের মতো ম্যাজিক সম্বন্ধেও ফেলুদার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এখনও ফাঁক পেলে তাসের প্যাকেট হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতসাফাই অভ্যাস করতে দেখেছি। সেইজন্যেই কলকাতায় সূৰ্যকুমারের ম্যাজিক হচ্ছে দেখে, আমরা তিনজনে ঠিক করলাম এক’দিন গিয়ে দেখে আসব। তৃতীয় ব্যক্তিটি অবশ্য আমাদের বন্ধু রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু যারা ম্যাজিকের আয়োজন করেছে তারা ফেলুদার খুব চেনা, তাই চাইতেই তিনখানা প্রথম সারির টিকিট পাওয়া গেল।
গিয়ে দেখি হল প্রায় ছআনা ফাঁকা। ম্যাজিক যা দেখলাম নেহাত খারাপ নয়, কিন্তু ম্যাজিশিয়ানের ব্যক্তিত্বে কোথায় যেন ঘাটতি আছে। ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ির সঙ্গে একটা চুমকি বসানো সিল্কের পাগড়ি, কিন্তু গলার আওয়াজটা পাতলা। গোলমালটা সেখানেই। অথচ ম্যাজিশিয়ানকে অনর্গল কথা বলে যেতে হয়।
সামনের সারিতে বসার ফলে হল কী, হিপিনেটিজম দেখাতে ভদ্রলোক লালমোহনবাবুকে স্টেজে ডেকে নিলেন। এ-জিনিসটা ভদ্রলোক ভালই জানেন। লালমোহনবাবুর হাতে পেনসিল দিয়ে, সেটাকে কামড়াতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, চকোলেট কেমন লাগছে? লালমোহনবাবু সম্মোহিত অবস্থায় বললেন, খাসা চমৎকার চকোলেট।
লোকেও উপভোগ করল খুব। লালমোহনবাবু জ্ঞান ফিরে পাবার পরে হাততালি আর থামে না।
পরদিন ছিল রবিবার। লালমোহনবাবু তাঁর সবুজ অ্যামবাসাডারে ঠিক ন’টার সময় চলে এসেছিলেন তাঁর গড়পারের বাড়ি থেকে আড়া মারতে। তখনও ম্যাজিকের কথা হচ্ছে।
ফেলুদা বলল, ঠিক জমাতে পারছে না লোকটা। কালকেও সিটি খালি ছিল দেখেছিলি?
লালমোহনবাবু বললেন, কিন্তু যাই বলুন মশাই, আমাকে যেভাবে বোকা বানানো, তাতে বলতেই হবে কৃতিত্ব আছে। পেনসিল চিবিয়ে চকোলেট, পাথর কামড়ে কড়াপাকের সন্দেশের স্বাদ-এ ভাবা যায় না।
শ্ৰীনাথ সবে চা এনেছে, এমন সময় বাইরে গাড়ি থামার শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় টোকা পড়ল। অথচ কারুর আসার কথা নেই। খুলে দেখি, বছর ত্ৰিশোকের ভদ্রলোক।
এটাই প্রদোষ মিত্তিরের বাড়ি?
ফেলুদা বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি ভেতরে আসুন।
ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। ফরসা, রোগা, চোখে চশমা। বেশ সপ্রতিভা চেহারা।
সোফার একপাশে বসে বললেন, টেলিফোনে অনেক চেষ্টা করেও আপনার লাইনটা পেলাম না। তাই এমনিই চলে এলাম।
ঠিক আছে। বলল ফেলুদা, আপনার প্রয়োজনটা যদি বলেন।
আমার নাম নিখিল বৰ্মন। আমার বাবার নাম হুয়াতে আপনি শুনে থাকবেন।–সোমেশ্বর বৰ্মন।
যিনি ভারতীয় জাদু দেখাতেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আজকাল তো আর নাম শুনি না। রিটায়ার করেছেন বোধহয়?
হ্যাঁ, বছর সাতেক হল আর ম্যাজিক দেখান না।
উনি তো স্টেজে ম্যাজিক দেখাতেন না বোধহয়?
না। এমনি ফরাসে দেখাতেন। ওঁর চারদিকে লোক ঘিরে বসত। সাধারণত নেটিভ স্টেটগুলোতে ওঁর খুব নাম ছিল। বহু রাজাদের ম্যাজিক দেখিয়েছেন। তা ছাড়া বাবা নানান দেশ ঘুরে ভারতীয় ম্যাজিক সম্বন্ধে নানান তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলো একটা বড় খাতায় লেখা আছে। বাবা ইংরিজিতে লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান ম্যাজিক। ওটা একজন কিনতে চেয়েছেন। বাবার কাছে। কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্ত আফার করেছেন। বাবা চাচ্ছিলেন। আপনাকে একবার লেখাটি দেখাতে। কারণ বাবা ঠিক মনস্থির করতে পারছেন না।
কুড়ি হাজার টাকা দিতে চেয়েছে কে জানতে পারি?
জাদুকর সূৰ্যকুমার নদী।
আশ্চর্য! কালই আমরা সূৰ্যকুমারের ম্যাজিক দেখে এসেছি! একেই ফেলুদা বলে টেলিপ্যাথি। ফেলুদা বলল, বেশ, আমি লেখাটা নিশ্চয়ই দেখব। তা ছাড়া আপনার বাবার সঙ্গে আমার আলাপ করারও যথেষ্ট ইচ্ছে আছে।
বাবাও আপনার খুব গুণগ্রাহী। বলেন, অমন শার্প বুদ্ধি বাঙালিদের বড়-একটা দেখা যায় না। আমার মনে হয়, এর মধ্যেই এক’দিন এসে পড়ুন না। বাবা সন্ধ্যায় রোজই বাড়ি থাকেন।
ঠিক আছে। আমরা আজ সন্ধাতেই তা হলে আসি।
বেশ তো। এই সাড়ে ছটা নাগাত?
তাই কথা রইল।
০২. রামমোহন রায় সরণিতে
রামমোহন রায় সরণিতে সোমেশ্বর বর্মনের পেল্লায় বাড়ি। এরা আগে পূর্ববঙ্গের জমিদার ছিলেন, অনেকদিন থেকেই কলকাতায় চলে এসেছেন। এখন বাড়িতে অধিকাংশ ঘরই খালি পড়ে আছে। বাড়িতে চাকর বাদে লোক মাত্র পাঁচজন। সোমেশ্বর বর্মন, তাঁর ছেলে নিখিল, মিঃ বৰ্মনের সেক্রেটারি প্রণবেশ রায়, মিঃ বৰ্মনের বন্ধু অনিমেষ সেন, আর রণেন তরফদার বলে এক শিল্পী। ইনি নাকি সোমেশ্বরবাবুর একটা পোট্রেট করছেন। এসব খবর আমরা সোমেশ্বরবাবুর কাছ থেকেই পেলাম। ভদ্রলোকের বয়স ধরা যায় না। কারণ চুল এখনও তেমন পাকেনি, চোখ দুটো উজ্জ্বল, যেমন জাদুকরের হওয়া উচিত। আমরা একতলায় সোফায় বসেছিলাম। নিখিলবাবু আমাদের জন্য চায়ের অর্ডার দিলেন।
আমার বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার! বললেন সোমেশ্বরবাবু, ভাল পসার ছিল। আমি ল পড়েছিলাম, কিন্তু সেদিকে আর যাইনি। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন তান্ত্রিক। হয়তো তাঁরই কিছুটা প্রভাব আমার চরিত্রে পড়েছিল। আমি ছোটবেলা থেকেই ভারতীয় জাদুবিদ্যায় ঝুঁকি। এলাহাবাদে একটা পার্কে এক বুড়োর ম্যাজিক দেখেছিলাম। তার হাত-সাফাইয়ের কোনো তুলনা নেই। মঞ্চের ম্যাজিকের অর্ধেকই আজ যন্ত্রপাতির সাহায্যে হয়, সেইজন্য তাতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। ভারতীয় ম্যাজিক হল আসল ম্যাজিক, যেখানে মানুষের দক্ষতই সম্পূর্ণ কাজটা করে। তাই আমি কলেজের পড়া শেষ করে, এইসব ম্যাজিক সংগ্ৰহ করতে বেরিয়ে পড়ি। সুবিধে ছিল বাবা এসব বিষয়ে খুব উদার ছিলেন। আমি একটা নতুন কিছু করছি, এটাতে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। আসলে আমাদের পরিবারে নানান লোকে নানান কাজ করে এসেছে চিরকালই। ডাক্তার, উকিল, গাইয়ে, অভিনেতা, সাহিত্যিক—সবরকমই পাওয়া যাবে আমাদের এই বৰ্মন পরিবারে, আর তাদের মধ্যে অনেকেই রীতিমতো সফল হয়েছেন। যেমন আমি হয়েছিলাম জাদুতে। আমার সব রাজা-রাজড়াদের কাছ থেকে ডাক আসত। প্রাসাদের ঘরে ফরাসের উপর বসে ম্যাজিক দেখাতাম—সব লোক হাঁ হয়ে যেত। রোজগারও হয়েছে ভাল। কোনও ধরাবাঁধা ফি ছিল না। আমার। কিন্তু যা পেতাম, সেটা প্ৰত্যাশার অনেক বেশি।
চা এসে গিয়েছিল। ফেলুদা একটা কাপ তুলে নিয়ে বলল, এবার আপনার পাণ্ডুলিপির কথা বলুন। শুনেছি, ভারতীয় জাদু নিয়ে আপনি একটা বড় কাজ করেছেন।
তা করেছি, বললেন সোমেশ্বর বর্মন, আমি যা করেছি, তেমন আর-কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। এ-নিয়ে আমি প্ৰবন্ধ-টবন্ধও লিখেছি, এবং তার ফলেই আমার পাণ্ডুলিপির ব্যাপারটাও জানাজানি হয়ে গোসল। সেই কারণে সূৰ্যকুমার আমার কাছে আসে। নইলে তার তো জানার কথা নয়। অবিশ্যি জাদুকর হিসেবে সে আমার নাম আগেই শুনেছে।
সে কি আপনার পাণ্ডুলিপিটা কিনতে চায়?
তই তো বলে। সে সোজা আমার বাড়িতে চলে এসেছিল। আমার বেশ ভাল লাগে। ছেলেটিকে, দেখেছি কেমন একটা স্নেহ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর অফারটায় আমি ঠিক রাজি হতে পারছি না। আমার ধারণা আমার কাজটা খুব জরুরি কাজ, এবং তার মূল্য বিশ হাজারের চেয়ে অনেক বেশি। সেইজন্যেই চাচ্ছিলাম পাণ্ডুলিপিটা আপনি একটু পড়ে দেখুন। আপনার তো নানান বিষয় পড়াশোনা আছে। সেটা আপনার কেসগুলো সম্বন্ধে পড়ে দেখলেই বোঝা যায়।
বেশ তো। আমি সাগ্রহে পড়বা আপনার লেখা।
সোমেশ্বরবাবু তাঁর সেক্রেটারির দিকে ফিরে বললেন, প্ৰণবেশ, যাও তো খাতাটা একবার নিয়ে এসো।
সেক্রেটারি চলে গেলেন আজ্ঞা পালন করতে।
ফেলুদা বলল, আমরা কাল সূৰ্যকুমারের ম্যাজিক দেখতে গিয়েছিলাম।
কেমন লাগল?
মোটামুটি বলল ফেলুদা, তবে ভদ্রলোক হিপনোটিজমটা বেশ আয়ত্ত করেছেন। আর যা ম্যাজিক, সবই যন্ত্রের কারসাজি।
সোমেশ্বরবাবু হঠাৎ সামনের প্লেট থেকে একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে, সেটা হাতের মুঠোয় বন্ধ করে, পরমুহূর্তেই হাত খুলে দেখালেন বিস্কুট হাওয়া। তারপর সেটা বেরোল লালমোহনবাবুর পকেট থেকে।
ফেলুদা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আপনি ম্যাজিক বন্ধ করে দিলেন কেন? আপনার তো অদ্ভুত হাত!
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, আমি এখন পাণ্ডুলিপিটা নিয়েই কাজ করব। বইটা ছাপাতে
রলে মনে হয় কাজ দেবে। এ নিয়ে তো বই আর লেখা হয়নি।
তা হলে আমি খাতাটা নিলাম! বলল ফেলুদা, আমি পরশু ফেরত দেব। এইরকম সন্ধ্যাবেলা।
বেশ, তাই কথা রইল।
ফেলুদা পরদিন সকালেই বলল, তার নাকি পাণ্ডুলিপি পড়া শেষ হয়ে গেছে। সে সারারাত পড়েছে। ভদ্রলোকের হাতের লেখা মুক্তোর মতো—অ্যান্ড ইট্স এ গোল্ডমাইন। ছেপে বেরোলে, একটা প্রামাণ্য বই হয়ে থাকবে। বিশ কেন, পঞ্চাশ হাজার দিলেও এ পাণ্ডুলিপি হাতছাড়া করা উচিত নয়।
সন্ধ্যাবেলা সোমেশ্বরবাবুকে গিয়ে আমরা সেই কথাটাই বললাম। ভদ্রলোক শুনে যেন অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। বললেন, আপনি আমার মান থেকে একটা বিরাট চিন্তা দূর করে। দিলেন। আমি দোষ্টানার মধ্যে পড়েছিলাম, কিন্তু আপনি যখন পড়ে এত প্রশংসা করলেন, তখন আবার আমি মনে বল পাচ্ছি। প্ৰণবেশ পাণ্ডুলিপিটাকে টাইপ করছে–ও-ও অনেকবার বলেছে। যে এতে আশ্চর্য সব তথ্য আছে। আমার বন্ধু অনিমেষও সেই একই কথা বলেছে। এবার নিশ্চিন্তে সূৰ্যকুমারকে না বলে দিতে পারব। ভাল কথা, কাল আমার ঘরে চোর এসেছিল।
সে কী?
আমার ঘুমটা ভেঙে যায়! আমি কে? বলতেই পলায়।
এর আগে কখনও চুরি হয়েছে কি?
কক্ষনও না।
আপনার ঘরে কোনও ভ্যালুয়েবল জিনিস আছে কি?
আছে। কিন্তু সেটা আমার সিন্দুকে থাকে। সিন্দুকের চাবি আমার বালিশের নীচে থাকে। আর সেটা সম্বন্ধে আমার বাড়ির লোকেরা কেউ জানে না।
আমি জানতে পারি কি? আমার অদম্য কৌতুহল হচ্ছে।
নিশ্চয়ই পারেন।
ভদ্রলোক উঠে দোতলায় গেলেন। তারপর মিনিট তিনেক পরে এসে একটা ছাঁইঞ্চি লম্বা জিনিস আমাদের সামনে টেবিলের উপর রাখলেন। সেটা একটা বংশীবাদক শ্ৰীকৃষ্ণের মূর্তি।
পঞ্চরত্নের তৈরি! বললেন সোমেশ্বরবাবু, তার মানে হিরে, পদ্মরাজ, নীলকান্ত, প্রবাল আর মুক্তো এর কত দাম জানি না।
অমূল্য, বলল ফেলুদা। এবং অপূর্ব জিনিস। এ-জিনিস কবে থেকে আছে?
এটা পাই রঘুনাথপুরের রাজা দয়াল সিং-এর কাছে। নাইনটিন ফিফটি সিক্সে। আমার ম্যাজিক দেখে খুশি হয়ে দেন। আমাকে জিনিসটা।
আপনাদের বাড়িতে দারোয়ান নেই?
তা আছে বইকী। তা ছাড়া চারজন চাকর আছে। চোরের মনে হয়। চাকরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।
যদি না চোর বাড়ির লোক হয়।
এ যে আপনি সব্বনেশে কথা বলছেন!
আমরা গোয়েন্দারা এরকম কথা বলে থাকি। সেটা সিরিয়াসলি নেবার কোনও দরকার নেই।
তাও ভাল।
আপনি বোধহয় বিপত্নীক?
হ্যাঁ।
আপনার ওই একটিই ছেলে?
না। নিখিল আমার ছোট ছেলে। বড়টি-অখিল-উনিশ বছর বয়সে বি. এ. পাস করে বিদেশে চলে যায়।
কোথায়?
সেটা বলে যায়নি। আমাদের ফ্যামিলিতে ভবঘুরেও রয়েছে কিছু কিছু। অখিল ছিল তাদের মধ্যে একজন। অস্থির চরিত্র। বলল, জার্মানি গিয়ে চাকরি করবে। তারপর বেরিয়ে পড়ল। এ হল নাইনটিন সেভেনটির কথা। তারপর আর কোনও যোগাযোগ করেনি। ইউরোপেই কোথাও আছে হয়তো, কিন্তু জানিবার কোনও উপায় নেই।
আপনার সেক্রেটারি প্রণবেশ এই কৃষ্ণটার কথা জানেন?
হ্যাঁ। সে তো আমার ঘরের ছেলের মতোই। আর তাকে তো আমার সব কাগজপত্র, করেসপন্ডেনস ঘাঁটতে হয়।
যাই হাক, এবার এটা তুলে রেখে দিন। এমন চমৎকার জিনিস। আমি কমই দেখেছি।
আমি তা হলে সূৰ্যকুমারকে না বলে দিই।
নির্দ্ধিধায়।
ফেলুদা উঠে পড়ল।
আমি একবার বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখতে চাই। চোর কোন কোন জায়গা দিয়ে আসতে পারে, সেটা একবার দেখা দরকার।
সবচেয়ে সুবিধে বারান্দা দিয়ে! আসলে আমার দারোয়ান একটু কর্তব্যে টিলে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
বাড়ির বারান্দা যে দিকে, সে দিকেই একটা বাগান রয়েছে। তবে সেটাকে খুব যত্ন করা হয় বলে মনে হল না। বাড়ির চারিদিকে বেশ উঁচু কম্পাউন্ড ওয়াল, সেটা টপকে পেরোনো সহজ নয়। দেয়ালের দুধারে গাছপালাও বিশেষ নেই।
ফেলুদা মিনিট পনেরো ঘোরাঘুরি করে বলল, চোর সম্বন্ধে ঠিক শিওর হওয়া গেল না। বাড়ির চোর না বাইরের চোর, সে-বিষয়ে সংশয় রয়ে গেল।
০৩. সোমেশ্বরবাবু টেলিফোনে জানালেন
পরদিন সোমেশ্বরবাবু টেলিফোনে জানালেন যে সূৰ্যকুমারের সঙ্গে ওঁর কথা হয়ে গেছে। উনি খাতাটা বিক্রি করবেন না বলে দিয়েছেন।
ভাল কথা। বললেন লালমোহনবাবু, আমার জাদুকর নিয়ে একটা ভাল প্লট মাথায় এসেছে। ভাবছিলাম, সূৰ্যকুমারের সঙ্গে কী করে একটু কথা বলা যায়।
ওকে হোটেলে ফোন করুন। বলল ফেলুদা, কোন হোটেলে আছে সে তো যারা আমাদের টিকিট দিয়েছিল, তারাই বলে দেবে।
তা বটে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে লালমোহনবাবু সূৰ্যকুমারের সঙ্গে কথা বলে, তার সঙ্গে একটা অ্যাপায়েন্টমেন্ট করে নিলেন আমাদের বাড়িতেই। ভদ্রলোক আগামীকাল সকালে সাড়ে নটায় আসবেন।
আপনি কিন্তু আমাকে দেখলেই চিনবেন। বললেন লালমোহনবাবু, আমি সেদিন আপনার দ্বারা হিপনোটাইজড হয়েছিলাম।
পরদিন একটা মারুতি গাড়িতে ঠিক সাড়ে নটার সময় সূৰ্যকুমার এসে হাজির। লালমোহনবাবু অবিশ্যি মিনিট কুড়ি আগেই চলে এসেছিলেন। সূৰ্যকুমার ফেলুদাকে দেখে কেমন হক্চকিয়ে গেলেন। বললেন, আপনার পরিচয়টা পেতে পারি কি? আপনাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
ফেলুদা বলল, আমার নাম প্রদোষ মিত্র। হয়তো খবরের কাগজে ছবি দেখে থাকবেন।
প্রদোষ মিত্ৰ মানে গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্ৰ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমার পরম সৌভাগ্য।
সৌভাগ্য তো আমারও। আপনার মতো একজন দক্ষ ম্যাজিশিয়ানের পায়ের ধুলো পড়ল আমাদের বাড়িতে, সেও কি কম সৌভাগ্য?
চায়ের পর লালমোহনবাবু প্রশ্ন আরম্ভ করলেন।
আপনি কদ্দিন ম্যাজিক দেখাচ্ছেন?
তা বারো বছর হল।
কারুর কাছে শিখেছেন কি?
আমি নক্ষত্র সেন ঐন্দ্ৰজালিকের সহকারী ছিলাম পাঁচ বছর। তাঁর বয়স হয়েছিল-স্টেজেই ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে ষ্ট্রোক হয়ে মারা যান। তাঁর সব ম্যাজিকের সরঞ্জাম আমার হাতে পড়ে। আমি তাই দিয়েই শুরু করি।
আপনাকে কি সারা ভারতবর্ষ ঘুরে খেলা দেখাতে হয়?
হ্যাঁ। শুধু ভারতবর্ষ কেন, আমি জাপান আর হংকংও গিয়েছি।
বটে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আগামী বছর সিঙ্গাপুর থেকে নেমন্তগ্ন আছে।
আপনার ফ্যামিলি নেই?
না। আমি ব্যাচেলার।
এখনও ম্যাজিক অভ্যাস করতে হয় আপনাকে, না। আর দরকার হয় না?
এখনও সকালে দুঘণ্টা হাত-সাফাই প্র্যাক্টিস করি। ওটা থামালে চলে না।
এবার ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল।
আপনার সঙ্গে সোমেশ্বর বর্মনের বোধহয় আলাপ হয়েছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি তো ভারতীয় জাদুবিদ্যার পাণ্ডুলিপিটা কিনতে চেয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কেন?
আমি ভেবেছিলাম আমার বিলিটি ম্যাজিকের মধ্যে কয়েকটি দিশি আইটেম ঢোকাতে পারলে অ্যাট্রাকটিভ হবে। কিন্তু ভদ্রলোক বই বিক্রি করলেন না। আমি বিশ হাজার অফার করেছিলাম। তবে বিক্রি না করলেও, ওঁর সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কারণ আমি ওঁকে সত্যিই শ্রদ্ধা করি। উনি আমার শো শেষ হলে পর ওঁর বাড়িতে গিয়ে আমাকে কয়েকদিন থাকতে বলেছেন।
আপনার শো শেষ হচ্ছে কবে?
এই রবিবার।
এর পর কোথায় যাওয়া?
দিন সাতেক বিশ্রামের পর পাটনা যাব।
লালমোহনবাবুর আরও দু-একটা প্রশ্ন ছিল, তারপরেই ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। আমারও ভদ্রলোককে খারাপ লাগল না।
ফেলুদা বলল, বিদেশি জামাকাপড় জুতো পরেছে। বোধহয় জাপান কি হংকং-এ কেনা। এমনিতে বেশ শৌখিন লোক, যেমন ম্যাজিশিয়ানরা সাধারণত হয়।
সোমেশ্বরবাবুদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছেন বলুন? বললেন লালমোহনবাবু, নইলে আর বাড়িতে এসে থাকতে বলে!
০৪. একেবারে বজ্রপাত
এ সপ্তাহটায় আর কোনও ঘটনা ঘটল না। তারপর যেটা হল, সেটা একেবারে বজ্রপাত! মঙ্গলবার দিন সোমেশ্বরবাবু ফোন করে জানালেন যে তাঁর বাড়িতে খুন হয়েছে তাঁর বহুদিনের বেয়ারা অবিনাশ, আর সেইসঙ্গে সিন্দুক থেকে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ হাওয়া! একসঙ্গে ডবল ট্রাজেডি।
ফেলুদা তৎক্ষণাৎ লালমোহনবাবুকে ফোন করে বলে দিল সোমেশ্বরবাবুর বাড়িতে আসতে, আর আমরা ট্যাক্সি করে চলে গেলাম।
গিয়ে দেখি, পুলিশকেও খবর দেওয়া হয়েছে। ইনস্পেক্টর ঘোষ ফেলুদার চেনা, দেখে বললেন, স্রেফ ডাকাতির কেস। খুন করার মতলব ছিল না; সামনে বাধা পেয়ে খুন করেছে। আসল উদ্দেশ্য ছিল সিন্দুক থেকে ওই কৃষ্ণটা নেওয়া। এ বাইরের লোকের কাজ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই সেদিন একটা ডাকাতির কেস হয়ে গেছে।
ওই কৃষ্ণের কথা কিন্তু এ বাড়ির লোক ছাড়া কেউ জানত না।
তা হলে এ বাড়ির ভেতর থেকেই ব্যাপারটা হয়েছে। সোমেশ্বরবাবুর ছেলে আছেন, সেক্রেটারি আছেন, বন্ধু আছেন, আর্টিস্ট রণেন তরফদার আছেন, সূর্যকুমার বলে সেই ম্যাজিশিয়ান কাল থেকে এখানে রয়েছেন; এর মধ্যেই কেউ গিলটি। আর যদি তাই হয়, তা হলে তো আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে।
খুনটা কখন হয়েছে?
রাত একটা থেকে তিনটের মধ্যে।
বেয়ারা কি চোরকে বাধা দিতে গোসল?
তাই তো মনে হচ্ছে।
আমরা বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। একতলার বৈঠকখানায় সোমেশ্বরবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। ঘরে আর সকলেই রয়েছে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ চেয়ারে বসে।
ফেলুদা সোমেশ্বরবাবুকে বলল, ঘটনাটা একটু বলবেন? এই বেয়ারা কি আপনার অনেকদিনের বেয়ারা?
ত্রিশ বছর। অবিনাশের মতো ভাল লোক পাওয়া খুব দুরূহ।
খুনটা কোথায় হয়?
একতলায়।
চোর সিন্দুক থেকে কৃষ্ণটা নিয়ে পালাচ্ছিল, সেই সময় হয়তো অবিনাশের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোরের সামনে পড়ে, হয়তো তাকে ধরতে যায়; সেই সময় চোর তাকে ছুরি মেরে খুন করে।
আপনারা কে কোথায় শোন, জানতে পারি?
আমার ঘর তো আপনি দেখেইছেন। আমি আর অনিমেষ দোতলায় শুই বাকি সকলে একতলায় শোয়। কাল সূৰ্যকুমার এখানে এসেছেন। ক’দিনের জন্য, তাকে একতলায় একটা গেস্টরুম দিই।
কিন্তু আপনার এই কৃষ্ণর কথা তো বাইরের কেউ জানত না?
তা তো না-ই। অথচ বাড়ির কেউ এমন কাজ করে থাকতে পারে, সেটা ভাবা অসম্ভব মনে হচ্ছে।
আপনার বালিশের নীচ থেকে চাবি নিল, আর আপনি টের পেলেন না?
আমি যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোই। সে গভীর ঘুম।
সিন্দুকের চাবিটা কি রেখে গেছে?
হ্যাঁ। সেটা তালাতেই ঝুলিছিল।
যে অস্ত্রটা দিয়ে খুন হয়েছিল, সেটা পাওয়া গেছে?
না।
ইনস্পেক্টর ঘোষ এ সময় এসে বললেন, তিনি সকলকে জেরা করতে চান।
ফেলুদা বলল, আপনার জেরার পর আমি যদি একটু জেরা করি, তা হলে আপনার আপত্তি নেই তো?
মোটেই না। আপনার কীর্তিকলাপের সঙ্গে আমি বিলক্ষণ পরিচিত। নইলে প্রাইভেট ডিটেকটিভকে আমরা বিশেষ পাত্তা দিই না।
ইনস্পেক্টর ঘোষ সোয়া ঘণ্টা ধরে সকলকে জেরা করলেন। আমরা ততক্ষণ চা-টা খেলাম। সোমেশ্বরবাবু যথেষ্ট আঘাত পেয়েছেন—খুনের ব্যাপারেও, চুরির ব্যাপারেও। কিন্তু তাতে আতিথেয়তার কোনওরকম ত্রুটি হল না।
আমরা চা খেয়ে বাইরে বাগানে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ইনস্পেক্টর ঘোষ এসে বললেন, আমার কাজ শেষ; এবার আপনি টেক-ওভার করুন।
ফেলুদা ভিতরে গিয়ে প্রথমেই সোমেশ্বরবাবুর ছোট ছেলে নিখিলবাবুকে নিয়ে পড়ল। আমরা নিখিলবাবুর ঘরেই বসলাম।
ফেলুদা প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করেন?
আমার একটা অকশন-হাউস আছে। মিরজা গালিব স্ট্রিটে।
কী নাম?
মডার্ন সেলস ব্যুরো।
জানি, দোকানটা দেখেছি।
তা দেখে থাকতে পারেন। ওখানে আমি সকাল দশটা থেকে ছটা পর্যন্ত থাকি।
ব্যবসা কী রকম চলে?
ভালই।
আপনি আর্ট সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড?
আমার কাজের মধ্যে দিয়ে তো অনেক রকম আর্টের জিনিসপত্র আমাদের ঘাঁটতে হয়। সেই সূত্রে বেশ কিছু জানা হয়ে গেছে।
কত বছর হল আপনি এ কাজ করছেন?
সাত বছর।
আপনার বয়স কত?
তেত্রিশ চলছে।
আপনার দাদা আপনার চেয়ে কত বড়?
তিন বছর।
দাদার সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?
দাদা মিশুকে ছিলেন না। কথাও বেশি বলতেন না, বন্ধু-বান্ধবও বেশি ছিল না। সত্যি বলতে কী, দাদার কারুর উপরেই টান ছিল না—এমনকী আমার উপরেও না।
নিখিলবাবুর কথা শুনে আমার কেন যে একটু অদ্ভুত লাগছিল, সেটা কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলেন না।
বিদেশে গিয়ে দাদা আপনাকে চিঠি লেখেননি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
না। শুধু আমাকে না, কাউকেই লেখেননি।
বাবার ম্যাজিকে আপনার কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না?
নিশ্চয়ই ছিল। তবে বাবা তো বেশির ভাগ ম্যাজিক বাইরে দেখাতেন; সেগুলো আর আমার দেখা হত না।
নিজে ম্যাজিক করার শখ হয়নি?
ত হয়নি। শুধু দেখতেই ভাল লাগত।
এই যে অঘটনটা ঘটল, এটার জন্য কে দায়ী, সে সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে?
না। একেবারেই নেই। তবে বাবাকে আমি অনেকবার বলেছি কৃষ্ণটা বাড়িতে না রেখে ব্যাঙ্কে রাখা উচিত। বাবা আমার কথায় কান দেননি।
নিখিলবাবুর সঙ্গে কথা শেষ করে, আমরা সোমেশ্বরবাবুর বন্ধু অনিমেষবাবুর কাছে গেলাম।
খাট আর চেয়ার ভাগ করে আমরা বসলাম ভদ্ৰলোকের ঘরে।
ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করেন?
আমি কিছুই করি না। বললেন অনিমেষবাবু, আমার বাবা ছিলেন উকিল। তিনি অনেক তলার একটা বাড়ি তৈরি করে গেসলেন, সেটার ভাড়া থেকেই আমার চলে যায়।
সোমেশ্বরবাবুর সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব কত দিনের?
তা প্রায় বিশ বছর।
কী করে সূত্রপাত হয়?
আমি এককালে জ্যোতিষ করতাম। সোমেশ্বর আমার কাছে এসেছিল তার ভাগ্য গণনা করাতে। ও তখন সৰ্ব্বে মাজিক দেখাতে শুরু করেছে। আমি ওর ভবিষ্যতের খ্যাতির কথা বলে দিই। এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে ও আমার বাড়িতে আবার আসে, এবং আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তখন থেকেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। সোমেশ্বরের স্ত্রী মারা যাবার পর ও আমাকে ওর বাড়িতে এসে থাকতে বলে–বোধহয় একাকিত্ব খানিকটা কাটবে বলে। তখনই আমি চলে আসি। সে আজ পনেরো বছর হল।
পঞ্চরত্নের কৃষ্ণটা আপনি কবে দেখেন?
ওটার কথা তো আমি আমার গণনায় বলি। ওটা পাওয়া মাত্র ও আমাকে দেখায়।
এই চুরি এবং খুন কে করতে পারে, সে বিষয়ে আপনার কোনও ধারণা আছে?
বাড়ির চাকরের সঙ্গে যোগসাজশ আছে, এমন কোনও চোর বলেই আমার বিশ্বাস। আমার ধারণা, ও সিন্দুক খুলে টাকা নিতে গোসল। তারপর সামনে ওই ঝিলমলে কৃষ্ণটা দেখে, সেইটে নিয়ে নেয়। বাড়ির কোনও লোক এ ব্যাপারে জড়িত, এ বিশ্বাস করতে আমার মন চায় না।
০৫. সোমেশ্বরবাবুর সেক্রেটারি প্রণবেশবাবু
সোমেশ্বরবাবুর সেক্রেটারি প্রণবেশবাবু বললেন, উনি পাঁচ বছর থেকে সেক্রেটারির কাজ করছেন। ওঁর নিজের বাড়ি একটা ছিল ভবানীপুরে, কিন্তু এ-বাড়িতে এত ঘর আছে দেখে, সোমেশ্বরবাবুই প্রস্তাব করেন এই বাড়িতে এসে থাকার জন্য। প্ৰণবেশবাবুও আপত্তি করেননি।
চমৎকার। সেদিক দিয়ে আমার কিছু বলার নেই।
কাজটা কেমন লাগে?
সোমেশ্বরবাবু যে-সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো আশ্চর্য। টাইপ করতে করতে আমি যে কত কী নতুন জিনিস জানতে পারছি, তা বলতে পারি না।
আপনি কটা পৰ্যন্ত করেন?
রাত আটটা, নটা…
আপনি ত একতলায় শোন।
হ্যাঁ।
ঘুম কেমন হয়?
ভালই।
কাল কোনও কারণে–কোনও শব্দে বা ওই জাতীয় কিছুতে আপনার ঘুম ভেঙে যায়নি?
না। আমি ঘটনাটা জেনেছি। সকালে উঠে।
এ-বাড়ির কাউকে আপনার সন্দেহ হয়? কৃষ্ণটার বিষয় যখন শুধু এ-বাড়ির লোকেরাই জানত, তখন হয়তো অপরাধীও এ-বাড়িতেই রয়েছে।
সে হতে পারে। আমিও তো সাসপেক্টদের মধ্যে পড়ছি।
তা পড়ছেন বইকী।
পুলিশ অবিশ্যি পুরো বাড়ি সার্চ করবে, কিন্তু অতটুকু জিনিস লুকোনোর জায়গার তো অভাব নেই। তারপর সুযোগ বুঝে বার করে নিলেই হল।
সোমেশ্বরবাবুর যিনি অয়েল পেন্টিং করছিলেন, তিনিও এই বাড়িতেই থাকেন। অন্তত যতদিন না। ছবি শেষ হচ্ছে, ততদিন থাকবেন। এই ভদ্রলোককে আমার কেন জানি একটু অদ্ভুত লাগে। প্রথমত চেহারাটা অদ্ভুত-চাপ-দাড়ি, চুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। তারপর ভদ্রলোক কথা অত্যন্ত কম বলেন। কাজ অবিশ্যি ভালই করেন, কারণ সোমেশ্বরবাবুর যেটুকু ছবি আঁকা হয়েছে সেটা আমি দেখেছি, আর সেটা ভালই হয়েছে।
ইনিও একতলায় থাকেন। ফেলুদা তাঁর দরজায় গিয়ে টোকা মারল।
ভদ্রলোক দরজা খুলে ফেলুদার দিকে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।
আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। বলল ফেলুদা।
বেশ তো, ভেতরে আসুন!
অগোছালো ঘর, যেটা হবে বলে আমি আন্দাজ করেছিলাম। আমরা মোড়া চেয়ার বিছানা মিলিয়ে বসলাম।
আপনার নাম তো রাশেন তরফদার?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি ক’দিন হল এ-বাড়িতে আছেন?
যেদিন থেকে ছবিটা আঁকা শুরু করেছি। তার মানে দেড় মাস।
আপনার একটা পোট্রেট করতে কত সময় লাগে?
ফুল ফিগার হলে, এবং দিনে অন্তত দুঘণ্টা সিটিং পেলে, মাস দেড়েক হয়ে যায়।
তা হলে এখানে এতদিন লাগছে কেন?
এখানে সোমেশ্বরবাবু দিনে এক ঘণ্টার বেশি সিটিং দেন না। তারপর আমাকে ওঁর ভাল লেগেছে বলে, উনি চান আমি এখানেই থাকি। আসলে সোমেশ্বরবাবু বেশ সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে থাকতে ভালবাসেন। ওঁর এক ছেলে বিলোতে। মেয়ের বিয়ে এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পরে, উনি ভয়ানক একা হয়ে গেসলেন। এ-বাড়িটাকে উনি খানিকটা ভরাট করতে চান, এটা আমার ধারণা।
আপনি পেন্টিং কোথায় শিখেছিলেন?
আমি ফ্রান্সে শিখি তিন বছর। তা ছাড়া প্রথমে কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টে শিখেছি।
পোর্ট্রেট করে রোজগার ভাল হয়?
এখন আর হয় না। ফোটাগ্রাফির যুগে আসল-পোট্রেটের কদর অনেক কমে গেছে। আমিও তাই অ্যাবস্ট্র্যাক্ট পেন্টিং-এ চলে যাচ্ছি। সোমেশ্বরবাবুর পৃষ্ঠপোষকতা না-পেলে, আমার অবস্থা খুবই কাহিল হত।
আপনি পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ সম্বন্ধে জানতেন?
হ্যাঁ। ওটা আমাকে সোমেশ্বরবাবু দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি আর্টিস্ট, তুমি এর কদর করতে পারবে।
কালকের খুন এবং ডাকাতি সম্বন্ধে আপনার নিজের কোনও থিওরি আছে?
বাড়ির লোক এ-কাজ করতে পারে না। আমার মনে হয়, চোর সিন্দুক থেকে টাকা নিতে গিয়ে কৃষ্ণটা দেখে সেটা নিয়ে নেয়। তারপর নীচে বেয়ারার সামনাসামনি পড়ে, ওকে খুন করে। আত্মরক্ষা ছাড়া খুনের আর কোনও মোটিভ আছে বলে আমার মনে হয় না।
অনেক ধন্যবাদ।
ফেলুদা উঠে পড়ল। আর দুজন বাকি রইল—সূৰ্যকুমার আর সোমেশ্বরবাবু। আমরা সূৰ্যকুমারের কাছেই আগে গেলাম! ভদ্রলোক কেমন যেন গুম মেরে গেছেন। তিনি এ-বাড়িতে আসার দিনই ঘটনাটা ঘটল, এই জন্যই বোধহয়।
ফেলুদা বলল, আপনার ভাগ্যটা খুব খারাপ দেখছি।
আর বলবেন না। বললেন ভদ্রলোক, সোমেশ্বরবাবু এত আপ্যায়ন করে আমায় থাকতে বললেন, আর প্রথম রাত্রেই কী কাণ্ড! আমি একবারে থ মেরে গেছি!
রাত্রে কোনওরকম শব্দ-টব্দ পাননি?
একেবারেই না। আমি এমনিতে খুব ভাল ঘুমোই। এক ঘুমে রাত কাবার হয় আমার।
কাজেই আমি কিছুই শুনিনি।
এ-বাড়ির সকলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?
যা হয়েছে, তাকে আলাপ বলা যায় না। একমাত্র সোমেশ্বরবাবু ছাড়া।
যে জিনিসটা চুরি হয়েছে, সেটা আপনি দেখেননি?
কী করে দেখব? প্রথমত ঠিক করে জানি না জিনিসটা কী। শুধু কৃষ্ণ শুনেছি, এই পর্যন্ত।
কৃষ্ণই বটে, তবে পঞ্চরত্বের তৈরি। যেমন সুন্দর, তেমন ভ্যালুয়েবল লাখখানেকের উপর দাম হবে।..আপনি কি এখনও এখানেই থাকবেন?
সোমেশ্বরবাবু তো তাই বলছেন। বলছেন, আপনাকে ডেকে এনে, চলে যেতে বলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে আপনার থাকাটা আপনার পক্ষে তেমন সুখকর হতে পারল না, এই যা দুঃখ!
আপনি যখন আছেন, তখন প্রয়োজনে আপনাকে আবার প্রশ্ন করা চলবে তো?
নিশ্চয়ই। এ নিয়ে তো কোনও কথাই উঠতে পারে না।
এরপর আমরা সোমেশ্বরবাবুর কাছে গেলাম। ভদ্রলোক এখনো মুহ্যমান অবস্থায় রয়েছেন।
ফেলুদা বলল, আপনি কতটা ঘা খেয়েছেন, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি যখন এখানে উপস্থিত রয়েছি, তখন কৌতুহলবশত আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন না-করে পারছি না।
তা তো করবেনই। আপনার তো পেশাই এটা।
আপনি কোনওরকম টের পাননি, না?
টের পাইনি, তবে আঘাত পেয়েছি প্ৰচণ্ড। প্রথমত আমার অবিনাশ বেয়ারার এই দশা। লোকটা যে কী কাজের ছিল, তা বলতে পারি না। আর আমাকে কতটা মান্য করুত, সেও বলে বোঝাতে পারব না। দ্বিতীয়ত, আমার পঞ্চরত্বের কৃষ্ণ। দয়াল সিং নিজে হাতে তুলে দিয়েছিলেন জিনিসটা আমায়। বললেন, তুমি শিল্পীর সেরা শিল্পী-তোমাকে এর চেয়ে কম পারিশ্রমিক দেওয়া যায় না। আর সেই পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ চলে গেল!! আর তা ছাড়া— সোমেশ্বরবাবু কী যেন বলতে গিয়ে, অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।
তারপর কয়েক মুহূর্ত পরে প্রায় আপন মনেই বললেন, আমি কি ভুল করলাম? আশা করি ভুল করেছি। কারণ জিনিসটা সত্যি হলে, আমার পক্ষে আরও দ্বিগুণ বেদনাদায়ক হবে।
আপনি কীসের কথা বলছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
সে আপনি জানতে চাইবেন না, কারণ আপনাকে বলতে পারব না।
আপনি কিছু টের পাননি?
টের পেয়েছি, কিন্তু পেয়েও কিছু করতে পারিনি।
আপনার কথায় একটা রহস্যের সুর রয়েছে, সেটা আপনি উদঘাটন করবেন কি? করলে, আমাদের অনেক সুবিধে হত।
সে অনুরোধ আমায় করবেন না, মিঃ মিত্তির। আপনি যদি এবার আমাকে রেহাই দেন, আমি বাধিত হব।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই-।
আমরা তিনজন উঠে পড়লাম। তবে আমি নিজের স্বার্থে তদন্ত করতে চাই আপনার বাড়ির এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে। তাতে আশা করি আপনার আপত্তি হবে না।
মোটেই না, অপরাধী যেই হোক না, তাকে ধরা কর্তব্য।
০৬. তস্করের শিরোমণি
বাড়ি এসে লালমোহনবাবু বললেন, সোমেশ্বরবাবুর কথাগুলো ভারী রহস্যজনক মনে হচ্ছিল, তাই না?
ঠিকই বলেছেন। বলল ফেলুদা।
আমার মনে হয়, ভদ্রলোক বেশ কিছু কথা লুকিয়ে গেলেন।
আমারও সেই রকমই মনে হয়েছে।
আপনি নিজে কী বুঝেছেন?
একেবারে অন্ধকারে আছি, তা নয়। তবে ম্যাজিকের জগৎ নিয়ে একটু অনুসন্ধান চালাতে হবে। তা ছাড়া অকশন-হাউসও একটা ব্যাপার আছে। আমি বরং একটু ঘুরে আসি। আপনারা দুজনে আড্ডা মারুন।
আমি একটা কথা এই বেলা ফেলুদাকে না বলে পারলাম না। আচ্ছ ফেলুদা, নিখিলবাবুর কথা শুনে কি তোমার কিছু মনে হয়েছিল?
সেটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেন নয়, সেটা অবিশ্যি তোকে ভেবে বার করতে হবে। ফেলুদা বেরিয়ে গেল।
লালমোহনবাবু বললেন, আমার কিন্তু এই আর্টিস্ট ভদ্রলোককে মোটেই ভাল লাগছে না। অবিশ্যি চাপ-দাড়ির বিরুদ্ধে আমার একটু প্রেজুডিস আছে এমনিতেই।
সূর্যকুমার ভদ্রলোকটিকে আপনার ভাল লাগছে?
ও-ও কেমন যেন পিকিউলিয়ার। তবে প্রথম দিন এসেই ও সিন্দুক খুলবে বলে মনে হয় না। ওই বাড়ির সঙ্গে তো ওর বিশেষ পরিচয় নেই। কোনটা কার ঘর, কোথায় সিন্দুক আছে, কোথায় সিন্দুকের চাবি আছে~—এসব জানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে এ চার খুনি-চার। ওকে যখন বেয়ারা দেখে ফেলল, তখন তো ও ওকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিতে পারত। পালানো নিয়ে তো কথা, আর বেয়ারার বয়সও ষাটের কাছাকাছি। বোঝা যাচ্ছে যে চার ছুরি হাতে নিয়েই কুকীর্তিটা করতে বেরিয়েছিল।
এটা আপনি ঠিকই বলেছেন।
সোমেশ্বরবাবুও কী বলতে গিয়ে বললেন না, সেটা জানতে ইচ্ছা করে। আমার মনে হয়। ওখানে একটা ইম্পট্যান্ট কু লুকিয়ে আছে।
ঠিক এই সময় একটা ফোন এল। তুলে হ্যালো বলতে ওদিক থেকে প্রশ্ন এল, মিঃ মিত্তির আছেন?
ইনস্পেক্টর ঘোষ। বললাম, ফেলুদা একটু বেরিয়েছে।
ভদ্রলোক বললেন, ওঁকে বলে দেবেন। যে কালপ্রিট ধরা পড়েছে। গোপচাঁদ বলে এক চোর—রিসেন্টলি জেল থেকে বেরিয়েছে। অবিশ্যি লোকটা স্বীকার করেনি এখনও, কিন্তু সেদিন রাত্রে ও বেরিয়েছিল, সে খবর আমরা পেয়েছি। এটা আপনি জানিয়ে দেবেন। আর স্বীকারোক্তি পেলে, আবার আপনাকে টেলিফোন করব। আপনার দাদাকে নিশ্চিন্ত হতে বলে দেবেন।
আমি ফোন রেখে দিলাম। মনটা কেমন জানি দমে গেল। এ তো ঠিক জমল না।
ঘণ্টা দেড়েক পরে ফেলুদা আসাতে, আমি প্রথমেই ওকে ইনস্পেক্টরের কথাটা বললাম। ফেলুদা যেন গা-ই করল না। বলল, সূর্যকুমারের ম্যাজিক খুব ভাল চলছে না, নিখিলবাবুর দোকানের অবস্থাও ভাল নয়। আর আমাদের আর্টিস্ট রণেন তরফদার গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টের ছাত্র ছিলেন না। প্যারিসে আঁকা শিখেছিলেন। কিনা, সেটা অবিশ্যি জানতে পারিনি।
তা হলে এখন কী করণীয়? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
আমার দিক থেকে মোটামুটি কাজ শেষ। এখন রইল। শুধু রহস্য উদঘাটন। দাঁড়ান, আগে ইনস্পেক্টর ঘোষকে একটা ফোন করি।
ফেলুদা ফোনে প্রথমেই বলল, আপনার সমাধান যে মানতে পারছি না, মিঃ ঘোষ।
ঘোষের উত্তরের পর ফেলুদা বলল, আমার ধারণা খুনি ওই বাড়িরই লোক। আপনি এক কাজ করুন। আমার সমাধান রেডি। আমি আজ বিকেলে সেটা ঘোষণা করতে চাই সোমেশ্বরবাবুর ওখানে। আপনিও আসুন। আমার কথা শুনে আপনার যদি কিছু বলার থাকে বলবেন। আমার এ অনুরোধটা আপনাকে রাখতেই হবে। তা ছাড়া আপনাকে খুনিকে গ্রেপ্তার করার জন্য তৈরি হয়ে আসতে হবে।… থ্যাঙ্ক ইউ।
ফেলুদা ফোন রেখে বলল, ভদ্রলোক রাজি। গোপচাঁদ-ছাঁ! এইজন্যই মাঝে মাঝে পুলিশের উপর থেকে ভক্তি চলে যায়।
এরপর ফেলুদা সোমেশ্বরবাবুকে একটা ফোন করে, বিকেলে ওঁর ওখানে যাবার কথাটা বলে দিল। সেই সঙ্গে এ-ও বলে দিল যে সবাই যেন উপস্থিত থাকে।
বিকেল পাঁচটায় আমরা সোমেশ্বরবাবুর নীচের বৈঠকখানায় জমায়েত হলাম। ইনস্পেক্টর ঘোষ আর দুজন কনস্টেবল এসে গিয়েছিল আগেই।
সকলে যো-যার জায়গায় বসলে পর, ফেলুদা শুরু করল।
প্রথমেই আমাদের যে প্রশ্নটার সামনে পড়তে হচ্ছে, সেটা হল চোর বাইরের লোক না। ভেতরের লোক। এখানে প্রথম যেদিন চোর আসে, তার পরদিন আমি এসেছিলাম। বাড়ির চারদিকে ঘুরে মনে হয়েছিল—এখানে বাইরে থেকে চোর ঢোকা খুব মুশকিল। বারান্দার থাম বেয়ে উঠলেও, জিনিসপত্তর চুরি করে থাম বেয়ে নামার সুবিধে নেই। কাজেই আমার বাড়ির লোকের কথাই বেশি করে মনে হয়েছিল, এবং চোরের দৃষ্টি যে কীসের দিকে, সে সম্বন্ধেও আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।
এবার চুরি এবং খুনের পর আমি সকলকে জেরা করি। সোমেশ্বরবাবুকে জেরা করতে জানতে পারলাম। তিনি এটা টেক্স পেয়েছিলেন, কিন্তু বাধা দেবার কোনওরকম চেষ্টা করেননি। এতে মনে হয় তিনি চোরকে দেখে একেবারে হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু চুরির পর যে খুন হবে, সেটা তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। চুরির মোটিভ অবশ্য একটাই হতে পারে; চোরের হঠাৎ বেশ কিছু টাকার দরকার পড়ে গেসল।
এ-বাড়িতে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যে রণেন তরফদার ছবি এঁকে রোজগার করছিলেন, সাময়িকভাবে তাঁর অবস্থা স্বচ্ছন্দই বলা যেতে পারে। এ অবস্থায় তাঁর পক্ষে চুরি করাটা অস্বাভাবিক। অনিমেষবাবু ভালই আছেন বন্ধুর আতিথেয়তায়, কাজেই তাঁকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
এবার নিখিলবাবুতে আসা যাক। নিখিলবাবুর একটা অকশন-হাউস আছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে অকশন-হাউসের অবস্থা খুব ভাল না। সুতরাং নিখিলবাবুর পক্ষে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণটা পাওয়া খুবই লাভজনক হবে। কারণ তিনি নিজের অবস্থা সামলে নিতে পারবেন। আমার ধারণা, প্রথম দিন নিখিলবাবুই চুরির চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন।
নিখিলবাবু বলে উঠলেন, আপনি বিনা প্রমাণে দোষী সাব্যস্ত করছেন?
ফেলুদা বলল, এখানে শেষ তো হয়নি–আপনি তো চুরি করতে পারেননি। কাজেই আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি বলছি না যে আমার যুক্তি অকাট্য। আমি শুধু অনুমান করছি। আপনি আপত্তি করতে চান তো করতে পারেন, কারণ আসল ঘটনা হল দ্বিতীয় দিনের।
প্রথম আর দ্বিতীয় দিনের ঘটনার মধ্যে একটি নতুন লোক এসে এ বাড়িতে উঠেছেন, তিনি হলেন জাদুকর সূৰ্যকুমার! এটাও আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে সূৰ্যকুমার তাঁর প্রদর্শনীতে লোকসান দিচ্ছে। আমরা যেদিন তাঁর ম্যাজিক দেখতে যাই, সেদিনও হলে অনেক সিট খালি ছিল। এই সূৰ্যকুমার কি চুরি করে থাকতে পারেন? কারণ তাঁর টাকার দরকার ছিল অবশ্যই। সূৰ্যকুমার বলে উঠলেন,ভুলে যাচ্ছেন মিঃ মিত্তির, আমি সোমেশ্বর বর্মনের সিন্দুক ও তার মধ্যে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না।
সূর্যকুমারবাবু, ফেলুদা বলল, এবারে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। সোমেশ্বরবাবুর আপনাকে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল, তাই না?
তা লেগেছিল নিশ্চয়ই, তা না হলে আর আমাকে এখানে থাকতে বলবেন কেন? কেন ভাল লেগেছিল, সে বিষয় আপনার কিছু বলার আছে?
না।
আমি যদি বলি যে আপনি তাঁকে তাঁর প্রথম সন্তানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ইন ফ্যাক্ট তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। আপনিই তাঁর বড় ছেলে? সোমেশ্বরবাবু, আমি কি খুব ভুল বলেছি?
কিন্তু আমার ছেলেই আমার শত্ৰু হল শেষ পর্যন্ত?
সূৰ্যকুমারবাবুর গলার আওয়াজ একটু পাতলা, যার ফলে তাঁর ব্যক্তিত্বের কিছুটা হানি হয়। আমি নিখিলবাবুর কণ্ঠস্বরেও ঠিক একই পাতলা ভাব পেয়েছি। চেহারা দাড়ি-গোফ লাগিয়ে যতই পরিবর্তন করা যাক না কেন, কণ্ঠস্বর তো আর বদলানো যায় না। আমার মনে হয়। এই কণ্ঠস্বরেই সোমেশ্বরবাবু চিনেছিলেন।
ঠিকই বলেছেন মিঃ মিত্তির, অখিলের গলার আওয়াজ আমি চিনেছিলাম।
তা হলে সূৰ্যকুমারও পঞ্চরত্নের কৃষ্ণের কথাটা জানতেন?
আমি জানতে পারি, বললেন সূৰ্যকুমার ওরফে অখিল বৰ্মন, কিন্তু সে কৃষ্ণ সিন্দুকে ছিল না। আমি কিছুই চুরি করিনি।
ঘরের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেল। আমিও অবাক! কৃষ্ণ ছিল না। সিন্দুকের মধ্যে, তবে সেটা কোথায় গেল?
না, কৃষ্ণ ছিল না ঠিকই! বলল ফেলুদা, আপনি চোর নন, কিন্তু আপনি খুনি।
কিন্তু আমার কৃষ্ণ কোথায় গেল? চেঁচিয়ে উঠলেন সোমেশ্বরবাবু।
এই যে আপনার কৃষ্ণ। ফেলুদা তার কোটের পকেট থেকে জিনিসটা বার করে তার সামনে টেবিলের উপর রেখে দিল।
আপনাদের বাড়িতে দুবার চোর আসেনি। তিনবার এসেছিল। আমি যখন খবর পাই সূৰ্যকুমার এ-বাড়িতে এসে থাকছেন, তখনই আমার সাবধানতা অবলম্বন করার ইচ্ছেটা জাগে। নিখিলবাবুর সঙ্গে গলার আওয়াজ আর কথা বলার ঢং-এ মিল পেয়ে, আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল যে সূৰ্যকুমার আসলে অখিল বৰ্মন। উনি যখন নিজের পরিচয় গোপন করে রাখলেন, তখনই আমার মনে হল যে ওঁর কোনও এক দুরভিসন্ধি আছে। তারপর জানতে পারলাম ওঁর রোজগার ভাল যাচ্ছে না-উনি দেনা করে বসে আছেন, প্রতিবারই লোকসান দিচ্ছেন। তখনই আমি স্থির করি যে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণটা আর সিন্দুকে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। দারোয়ানকে মোটা ঘুস দিয়ে আমি বাড়িতে ঢুকি। তারপর বারান্দার থাম বেয়ে ওপরে উঠে, আমার হাতসাফাইয়ের জোরে সোমেশ্বরবাবুর বালিশের তলা থেকে চাবিটা নিয়ে সিন্দুক খুলে, তার থেকে কৃষ্ণটা বার করে নিই। তারপর আবার একই পথে ফিরে আসি। দুঃখের বিষয়, আমি অবিনাশের হত্যাটাকে রুখতে পারলাম না।
ইনস্পেক্টর ঘোষ ততক্ষণে এগিয়ে গেছেন। সূৰ্যকুমারের দিকে। ফেলুদা বলল, এই একটা ব্যাপার, যেখানে আপনার ম্যাজিক খাটবে না, অখিলবাবু!
সোমেশ্বরবাবু উঠে এসে ফেলুদার হাতটা আঁকড়ে ধরলেন। আপনার জন্য আমার কৃষ্ণ বেঁচে গেল। আপনাকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা আমার নেই।
বাড়ি ফিরে এসে লালমোহনবাবু ফেলুদাকে বললেন, মশাই, এতদিন আপনার ওপর ভক্তির ভাবই ছিল; এবার ভয় ঢুকল। আপনি যে তস্করের শিরোমণি, সেটা তো জানা ছিল না!