‘কী হে নিয়ামত, আছ কেমন ভায়া? নতুন খবর কী?’ বরাবরের অভ্যেস মত হইহই করে দোকানে ঢুকতে গিয়েই নজর আটকে গেল জিনিসটার দিকে! দোকানের মাঝখানে যে শ্বেত পাথরের টেবিলটা ছিল তার ওপরেই রাখা। রীতিমত চমকে উঠলেন অনুপবাবু! কোথায় যেন দেখেছেন এটা ? ভারী চেনা চেনা লাগছে।
নিয়ামতকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় পেলে এ জিনিস?’
জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা কলম। যাকে বলে ঝর্ণা কলম।
ফাউন্টেন পেন। গোটা শরীরটাই কারুকার্য করা। ড্রাগনের ছবিটা দেখে ঠাহর হচ্ছে এটা নির্ঘাৎ চাইনিজ না হয়ে যায় না। ঢাকনায় একটা সোনালি ক্লিপ লাগানো।
গায়ের সবজেটে আস্তরণ দেখে মালুম পড়ছে যে দীর্ঘদিন অযত্নে কোথাও পড়েছিল কলমটা। গত রবিবারও ‘আলাদিনে’ এসেছিলেন অনুপবাবু, কিন্তু এ জিনিস তো নজরে পড়েনি!
নিয়ামত বেতের সোফায় গ্যাঁট হয়ে বসে একটা পালক দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। ছোটুকে দুটো চা আনার ফরমায়েশ করে হেসে বলল, ‘আপনার পছন্দ হয়েছে বুঝি? তা রেখে দিন ওটা। দাম দিতে হবে না।
কোথাও একটা পুরনো বাড়ি ভাঙা পড়েছে। ব্যান্ডেল না দুর্গাপুর ঠিক বলতে পারব না। নানান হাবিজাবি জিনিসের সঙ্গে পরশু এটাও আমার কাছে এসেছে। তা আপনার কপাল ভালো বলতে হবে যে অন্য কারো নজরে পড়ার আগে আপনার হাতে পড়ল।’
প্রতি রবিবারই নিয়ম করে একবার নিয়ামতের দোকানে যান অনুপবাবু। বছর পাঁচেক ধরেই এই অ্যান্টিক শপে আসার অভ্যেস ওঁর।
কিছু যে কিনতে এমন নয়। এই একটু আধটু গল্প-গুজব করা। রাজা-উজীর মারা বেলা বারোটা অবধি। আর তারপর এক কাপ লিকার চা খেয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেওয়া। জ্বরজারি কী বেড়াতে যাওয়ার দরুণ কলকাতার বাইরে না থাকলে প্রত্যেক রবিবার সকালে ‘আলাদিনে’ একবার আসা চাইই চাই।
চাকরির বাইরে অনুপবাবুর সময় কাটে গল্পের বই পড়ে আর পুরনো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে। বিরাট কিছু সংগ্রহ যে ওঁর আছে তা নয়। তবু রেয়ার কালেকশন নিয়ে পড়াশোনা আছে বৈকি। নিয়ামতের সঙ্গে আলাপটাও সেই সূত্রেই। খবরের কাগজের একটা বিজ্ঞাপন দেখে প্রথম আসা এই দোকানটায়। রাসেল স্ট্রীটে নিয়ামতের বাবা ইয়াসিন এই দোকানটা খুলেছিলেন স্বাধীনতার পরপরই। ‘আলাদিন’ নামটা ওঁরই দেওয়া।
নিয়ামতের জন্ম তার প্রায় বছর কুড়ি পর। ওঁর বাবা কত কী যে দেখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। নিয়ামত গল্প করে,
ওর বাবা ছিলেন ইতিহাসের পুরো একটা খনি। বাবার মুখ থেকে শুনেছে কলকাতার বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস।
দরাজ দিল সায়েবদের গল্প।
নিয়ামতের বলার স্টাইলটিও চমত্কার। ইয়াসিন আর বেঁচে নেই,
কিন্তু তাঁর বলা সেই সব কাহিনী নিয়ামতের মুখ থেকে শুনতেই অনুপবাবু প্রতি রবিবার হাজির হন। এককালে এখানে হাজারো জিনিসপত্র আসতো।
নিলাম হত ইংরেজদের ফেলে যাওয়া নানান সামগ্রী — পিয়ানো,
কারুকার্য করা পিস্তল, দূরবীন,
গয়নাগাটি, গ্রামাফোন, রেকর্ড — কত কিছু। একবার একটা বাঁকানো হাতির দাঁতের লাঠির মধ্যে থেকে পাওয়া গিয়েছিল এক সায়েবের লুকোনো দলিল। মারা যাবার আগে তিনি তাঁর সব সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন এক অনামা কোনো হিন্দু কর্মচারীকে।
আত্মীয়-পরিজনরা পাছে সেই উইলটি নষ্ট করে দেয় সেই ভয়ে শেষ ইচ্ছাপত্রটি তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজের লাঠির মধ্যে।
সেই দলিলের সেদিন আর তেমন কোনো দাম না থাকলেও,
ঐতিহাসিকদের কাছে সেটি নাকি অমূল্য! আজকাল আর তেমন জিনিসের দেখা মেলে না।
আজ আর আড্ডায় মন বসলো না।
কাজের বাহানা দেখিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। কলমটার দাম হিসেবে শ তিনেক টাকা দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু নিয়ামত কিছুতেই নিতে চাইল না। বলল, ‘এটা আমার তরফ থেকে আপনাকে ভেট ধরে নিন।’
অনুপবাবু থাকেন ভবানীপুরে।
একলারই সংসার। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর অনুপবাবু বিয়ের ঝুটঝামেলার মধ্যে যান নি। অফিস থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে একটি গল্পের বই নিয়ে বেশ রাত অবধি আয়াসে সময় কাটান।
তারপর নিশ্চিন্তির একটি লম্বা ঘুম।
চাকরি, বই আর এই একটি শখকে সঙ্গী করেই দিব্যি আছেন। রান্নাবান্না,
ঘরের অন্যান্য দেখভাল করার জন্য তাপস রয়েছে। বাবার করে যাওয়া বেশ বড়সড় বাড়ির একটি ঘর ওকে দিয়েছেন। একটি শোবার ঘর, একটি বসার ঘর আর একটি ঘর বইপত্র আর শখের জিনিসপত্র রাখার জন্য নিজে ব্যবহার করেন। বাকি তো ফাঁকাই পড়ে থাকে। নিয়ামতের দোকানে গিয়ে অনেক চমকপ্রদ জিনিসই দেখেছেন অনুপবাবু। তবে সেসব কেনার সাধ্য ওঁর মত ছাপোষা সরকারী কর্মচারীর কোথায়? উনি কেনেন অল্পদামের মধ্যে ছোটখাটো জিনিস। যেমন খাস জার্মানির রুবিক কিউব, আদ্যিকালের পোলারয়েড ফিল্ম ক্যামেরা, ভূটানের তেকোনা ডাকটিকিট ইত্যাদি। কিন্তু সেসবের সঙ্গে এই কলমটার তুলনা হয় না।
রেয়ার স্পিসিজও নয় এটা, তবু মনটা খচখচ করতে লাগলো। কোথায় যে দেখেছেন কলমটা!
তাপসকে কলমে ভরার জন্য এক বোতল কালি কিনতে পাঠিয়ে সোফায় বসে দু’হাতে মাথার দু’পাশের রগ টিপে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ।
স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে লাগলেন।
কিন্তু কিছুই মনে পড়ল না।
‘এই নাও।’ এক ঘন্টা পর বাজার থেকে ফিরে তাপস ঠক্ করে কালির বোতলটা টেবিলে নামিয়ে রেখে একরাশ বিরক্তি উগরে দিল, ‘আজকাল আর এসব জিনিস পাওয়া যায়? এ দোকান ও দোকান এমনি করে হাজার জায়গা ঘুরে তবে পেলুম তোমার কালি! যত্তসব উদ্ভট শখ তোমার দাদাবাবু। লেখার জন্য তো ডট পেনই ভালো। কে আর আহ্লাদ করে হাতে কালি মাখতে চায়…’
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর কলমটা নিয়ে বসলেন। কালি ভরে একটা সাদা কাগজে আঁচড় কেটে দেখলেন।
প্রথমে লেখা পড়ল না। সে আশাও ছিল না অনুপবাবুর। কত যুগ আগে যে শেষবার কেউ এটা দিয়ে লিখেছিল তার ঠিক আছে? শুকিয়ে কালি বেরুবার পথটাই বন্ধ হয়ে যাবার কথা।
কিন্তু দু-চারবার ঝাড়াঝাড়ি করতেই লেখা পড়ল এবং বেশ সুন্দর ভাবে! অনুপবাবু ভারি খুশি হলেন। কয়েকটা এলোমেলো আঁচড় কাটার পর নিজের নামটা লিখতে চেষ্টা করলেন। লেখা গেল কিন্তু তারপর যেটা হলো তার জন্য অনুপবাবু মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না! পরিষ্কার ভাবে কাগজে ফুটে উঠলো, ‘অনুপ ভালো আছিস?’
অনুপবাবু চমকে উঠলেন! উনি মোটেই এটা লিখতে চাননি। উনি তো লিখতে গিয়েছিলেন শুধু নিজের নামটুকু। অথচ বাকি দুটো শব্দ আপনা আপনিই লিখে দিল কলমটা!
এটা কী হলো? অনুপবাবু গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকলেন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পেলেন না। অনুপবাবু শুনেছিলেন মানুষের মনের দুটো স্তর থাকে। একটি সচেতন আর অন্যটি অবচেতন। জেগে থাকার সময় সচেতন মনটি কাজ করে। ঘুমিয়ে থাকার সময় আমাদের অবচেতন মনটি কার্যকর অবস্থায় থাকে। বাস্তব জীবনে যেসব ইচ্ছে পূরণ হয় না সেগুলো অবচেতন মনে জমে থাকে। অনেক সময় সেই সব অপূরিত ইচ্ছেগুলো ঘুমের সময় স্বপ্নের আকারে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।
অনুপবাবুর সন্দেহ হলো এই ঘটনাটাও তাঁর অবচেতন মনের খেলা নয় তো? আনমনে নিজের নামটি লিখতে গিয়ে ‘ভালো আছিস’ শব্দ দুটোও লিখে ফেলেননি তো? সন্দেহটা ঝেড়ে ফেলতে একটু দ্বিধা জড়ানো হাতে কলমটা তুলে নিয়ে কাগজে আবার নিজের নামটি লিখতে গেলেন।
কী আশ্চর্য্য! এবারও ‘অনুপ’
শব্দটা লেখার পর কলম যেন জোর করেই ওঁর হাতটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে লিখিয়ে দিল, ‘ভুলে গেছিস সব?’
চমকে উঠে কলমটা ফেলে দিয়ে ছিটকে উঠলেন অনুপবাবু! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে লাগলো। এ তো রীতিমত ভৌতিক কাণ্ড!
জিনিসটায় আর হাত দেবার সাহস হলো না। না জানি আবার কী ফুটে ওঠে ও থেকে! একবার ভাবলেন বিকেলেই নিয়ামতের দোকানে গিয়ে কলমটা ফেরৎ দিয়ে আসবেন। এ ভয়ঙ্কর বস্তু কাছে না রাখাই শ্রেয়।
কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন কাল সুকল্যাণের সঙ্গে একবার পরামর্শ করে দেখবেন। দপ্তরে সুকল্যাণের সঙ্গে অনুপবাবুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
দুজনেই অবিবাহিত এবং পিছুটানহীন। বিয়ে না করার জন্য জীবনে ঝুটঝামেলা ব্যাপারটাই নেই,
তবু যখনই কোনো আতান্তরে পড়েন সুকল্যাণের সঙ্গেই পরামর্শ করার অভ্যেস।
সুকল্যাণ কথাটা শুনেই বললেন, ‘ও তোর মনের ভুল।’
অনুপবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘উঁহু।
বারবার দু’বার দেখলাম। একই ঘটনা ঘটল।’
‘তাই বুঝি?’ সুকল্যাণের চোখে কৌতুক, ‘তাহলে তো আজ সন্ধ্যেয় তোর বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসতে হচ্ছে।’
সন্ধ্যেয় অফিস ফেরত সুকল্যাণ এলেন অনুপবাবুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে।
কলমটা দেখে তাঁরও চক্ষু গোলগোল।
বলে উঠলেন, ‘বাহ, এ তো খাসা জিনিস! এমন পেন অনেকদিন চোখে দেখিনি রে! পেলি কোথায়?’
‘ওই নিয়ামতের কাছেই পেলাম।
কোনো একটা পুরনো বাড়ি থেকে অনেক জিনিস নিলামে উঠেছিল শুনলাম, তার থেকেই এটা পাওয়া গেছিল।’
কলমটা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ লেখালিখি করে দেখলেন সুকল্যাণ।
চমত্কার লেখা পড়ছে। কোনো অসুবিধা হলো না। শেষমেষ বিধান দিলেন, ‘তোর মাথাটা গেছে। যত্তসব গাঁজাখুরি গল্পের বই পড়ার ফল এটা।’
অনুপবাবুর একটু গল্পের বই পড়ার বাতিক, কথাটা মিথ্যে নয়। অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই কলেজ স্ট্রীট থেকে দু-একটা পুরনো গল্পের বই কিনে আনেন বটে, পছন্দের তালিকায় ভূত, রহস্য গল্প বেশি থাকে এটাও সত্যি, কিন্তু গাঁজাখুরি গপ্পো এই কথাটা একদমই মানতে পারলেন না অনুপবাবু। তবে মনের যা অবস্থা চলছে তাতে সহকর্মীর কথায় প্রতিবাদের পথে গেলেন না। বাস্তবিকই উনি মনে মনে চাইছিলেন যে এই ঘটনাটা কেউ মিথ্যে প্রমাণ করে দিক।
অনুপবাবু মিনমিন করে বললেন, ‘তাহলে কী করি এখন?’
‘ঘুরে আয়।’ কলমটা দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে সুকল্যাণ বললেন, ‘দিন কয়েক কোথাও থেকে ঘুরে আয়। লাগাতার কাজের চাপে মাথা জাম হয়ে গেছে তোর।’
কথাটা অনুপবাবুর বেশ মনে ধরল।
সত্যিই অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় নি। বছর তিনেক আগে একবার পুরী গিয়েছিলেন। আর তারপর তেমন করে কোথাও যাবার তাগিদ অনুভব করেন নি। কিন্তু যাব বললেই তো যাওয়া যায় না। তার গোছগাছ আছে, ট্রেন-হোটেল বুকিং আছে, আর সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হলো কোথায় যাওয়া যায়? বন্ধুকেই জিজ্ঞেস করলেন কথাটা।
সুকল্যাণ মুখে কিছু না বলে আনমনে কলমটা দিয়ে রাইটিং প্যাডে একটি গোল্লা কাটতে কাটতে খুব পরিষ্কার করে বড় বড় অক্ষরে লিখে ফেললেন, ‘বর্ধমান’।
‘বর্ধমান?’ সুকল্যাণের লেখা শব্দটা এক ঝলক দেখে নিয়ে অনুপবাবু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘বর্ধমানের কথায় মনে পড়ল, এককালে আমরা বর্ধমানে বেশ কিছুদিন ছিলাম।
বাবার রেলের বদলির চাকরি ছিল।
তারপর আমরা চলে যাই রামপুরহাট।
সেখান থেকে আসানসোল। তারপর আরও অনেক জায়গা ঘোরাঘুরির পর শেষকালে বাবা হাওড়ায় বদলি নিয়ে রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত ছিলেন।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যেন পুরনো অনেক কথা স্মৃতিচারণ করার মত করে ভেবে নিয়ে তারপর সুকল্যাণের দিকে চেয়ে বললেন, ‘বর্ধমান তো ঘরের কাছে। ওখানে ভালো লাগবে কি ? শুনেছি আজকাল নাকি খুব ঘিঞ্জি হয়ে গেছে…’
‘দিনকয়েক আগেই দাসবাবু আপিসে এসেছিলেন একটা চেকের ব্যাপারে। উনি ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে আছেন। ওঁদের একটা বাংলো আছে বর্ধমানে দামোদরের পাড়ে। সম্বচ্ছর খালিই পড়ে থাকে।
লোকাল লোকেরা ভাড়া নিয়ে মাঝে মাঝে পিকনিক-টিকনিক করে শুনেছি। উনি লিখে দিলে সস্তায় পাওয়া যাবে।’ সুকল্যাণ একটু থেমে অনুপবাবুর ম্লান মুখটির দিকে চেয়ে আবার বললেন, ‘নদীর তাজা হাওয়া আর টাটকা মাছের ঝোল-ভাত খেলে তোর এ রোগ আপসেই সেরে যাবে,
বুঝলি? আর আমরা তো শহরে থাকব না,
দামোদরের ধারে ফাঁকাফাঁকিতে ভালই লাগবে দেখিস।’
অনুপবাবু সোল্লাসে বললেন, ‘আমরা বলতে? তুইও যাবি নাকি? ওহো তাহলে তো সোনায় সোহাগা হয়! আমিও ভাবছিলাম একলা একলা গিয়ে বোর না হই।’
‘না হে, তোকে এই অবস্থায় একলা ছাড়াটা ঠিক হবে না।’
সুকল্যাণ ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘তোর ব্যামোটা একটু জটিল।’
‘তুইও ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস?’
অনুপবাবু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘ইয়ে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেব নাকি? বয়স হচ্ছে তো…’
সুকল্যাণ অট্টহাস্য করে বললেন, ‘আরে ধুর! ঠাট্টা করছি।
আচ্ছা শোন তুই গোছগাছ করে নে।
কাল আপিসে গিয়ে দুজনেই বিষ্যুদ-শুক্কুরবার ছুটির দরখাস্ত করে দেব।
শনি-রবি তো এমনিই ছুটি।
দিনচারেক ছুটি কাটিয়ে বেশ চনমনে হয়ে ফেরা যাবে। আর হ্যাঁ, তোর এই কলমটা আমার কাছেই রাখলাম এখন।
জিনিসটা সরেস। একটু নেড়েচেড়ে দেখব ’খন।’
অনুপবাবুকে দেখাবার জন্য মুখে হাসলেও সুকল্যাণ কপালের কোঁচকানো ভাঁজটা সোজা হলো না।
কেন জানি মনে হতে লাগল বর্ধমানের সঙ্গে এই কলমটার কোনো একটা যোগ আছে নির্ঘাৎ, নইলে উনি তো মোটেই বর্ধমানের কথা ভাবছিলেন না। বরং দীঘা,
দার্জিলিং, দেওঘরের মত জুতসই কোনো একটা জায়গার নাম বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কলমটা নিজে নিজেই বর্ধমান শব্দটা যে লিখেছে এই কথাটা অনুপবাবুকে বললে আর দেখতে হত না! তবে ব্যাপারটার শেষ দেখে তবে উনি থামবেন।
বাংলোটা ভারী চমত্কার জায়গায়। দামোদরের পাড়ে শহরের একদম বাইরে লোকালয় পেরিয়ে গাড়িঘোড়ার শব্দ ছাড়িয়ে এক নির্জন পরিবেশে। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাংলোর ভিতরে যত্ন করে কেয়ারী করা ডালিয়া,
চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, গাঁদা ইত্যাদি ফুলের বাহার। বাংলোর বাইরে তাকালেও নজরে পড়ে শুধুই সবুজের সমারোহ। একটু দূরেই দামোদরের বিশাল খাত। বাংলোর বারান্দা থেকে সেটা অবিশ্যি দেখা যায় না।
কিছুটা দূরেই উঁচু করে বাঁধ দেওয়া।
সেটাই নদীকে দৃষ্টির অন্তরালে রেখেছে। বিষ্যুদবার ওঁরা বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছলেন বাংলোতে। দাসবাবু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কলকাতা থেকেই বানিয়ে সনাতনকে ফোন করে দিয়েছিলেন।
ওঁদের দুজনের জন্য বাংলোর দুটি চমত্কার ঘর পরিষ্কার করে রাখা ছিল। চটপট স্নান করে আসতেই বাংলোর সামনের বারান্দায় পাতা টেবিলে গরম গরম খাবার পরিবেশন করে দিল সনাতন। ধোঁয়া ওঠা সরু চালের ভাত, ফুলকপি, মটরশুঁটি দিয়ে ঘন মুগের ডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা — বাদাম দিয়ে, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপির তরকারী আর কাতলা মাছের কালিয়া। শেষ পাতে আবার টম্যাটোর চাটনি, পাপড় আর লাল মিষ্টি দই। খুব তৃপ্তি করে খেলেন দুজনে। এমন চমত্কার রান্না অনেকদিনই খাননি। মনে মনে দাসবাবুর জন্য অনেকখানি সমৃদ্ধি কামনা করলেন ওরা।
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর অনুপবাবু ছোট করে একটা দিবানিদ্রা দিয়ে নিলেন। সুকল্যাণ ব্যাডমিন্টন খেললেন সনাতনের ছেলের সঙ্গে।
সনাতনের পরিবার বাংলো চৌহদ্দির মধ্যেই অন্য একটি বাড়িতে থাকে।
বিকালে ঘুম থেকে উঠে আদা দেওয়া চা খেয়ে দুজনে হাঁটতে বেরুলেন।
বাংলোর দক্ষিণ দিকে খানিকটা হাঁটলেই বাঁধ। বাঁধে উঠতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক অপরূপ দৃশ্য! দিগন্ত বিস্তৃত দামোদরের বেলাভূমি।
জল সামান্যই। ছোট ছোট কিছু নৌকো ভাসছে সেই জলে।বৈঠার ঘায়ে মৃদু ছলাৎ ছল শব্দ উঠছে। হাঁটু ডোবা জলের মধ্যে কয়েকটি ছোট ছেলে খ্যাপলা জাল হাতে ঘোরাফেরা করছে। মাছরাঙ্গা, বক, পানকৌড়ি আর নাম না জানা কিছু পরিযায়ী পাখি জলের সামান্য ওপর দিয়ে ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে মাছের আশায়।
অনুপবাবু যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে বাঁহাতে — পূর্ব দিকে কিছু দূরে রয়েছে একটি সেতু। তার ওপর দিয়ে ভারী ভারী ট্রাক-বাস চলাচল করছে। এই পাখির ডানা ঝাপটানি, ছেলেদের হইহই, জলের ছলছলানি, গাড়ির হর্নের মৃদু আওয়াজ – সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে একটা মনভোলানো পরিবেশ তৈরী করেছে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত দুজনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বাঁধের ওপর।
অনুপবাবুর মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে এলো একটাই শব্দ — ‘বাহ!’
‘জানিস সুকল্যাণ, আজ থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমরা এই শহরেই ছিলাম। খুব সম্ভব বছর তিনেক।
খুবই হালকা স্মৃতি রয়েছে। কিন্তু কখনো এই জায়গাটায় আসিনি।’
স্বগতোক্তির মত করে অনুপবাবু বললেন।
সুকল্যাণ নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলেন ওঁদের ডানদিকে অস্তগামী সূর্যের দিকে। আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। বাতাসে হালকা কুয়াশা।
অন্ধকার নেমে আসবে এবার।
সুকল্যাণের মনে হলো অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে এক রহস্যও যেন ডানা মেলে নেমে আসছে চরাচরে!
‘চল তো একবার ওই সেতুর দিকে যাওয়া যাক।’ অনুপবাবু বললেন।
সুকল্যাণ সায় দিয়ে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করে বললেন, ‘তুই এগো,
আমি আসছি।’
বাঁধের ওপর দিয়ে বেশ কিছুটা হাঁটার পর ঢালু সিঁড়ি বেয়ে সেতুর ওপর ওঠা গেল। পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে সেতুটির নাম — কৃষক সেতু।
সেতুর শুরুতেই রাস্তার দুপাশে দুটি পোড়ামাটির মূর্তি। একতারা হাতে বাউলের মূর্তি একদিকে, আর অন্য দিকে লাঙ্গল আর ঝুড়ি মাথায় কৃষক পরিবার। সেতুর ওপর দিয়ে ঘনঘন গাড়ি চলাচল করছে। এই রাস্তা ধরে আরামবাগ, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া যাওয়া যায়। এইখানে আসতেই অনুপবাবুর মনে পড়তে লাগলো বাবার সঙ্গে খুব ছোটবেলায়, তখন উনি সম্ভবত ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়তেন — শহর থেকে বাসে চড়ে একবার এসেছিলেন এই সেতুর কাছে। দামোদরের এপারে বর্ধমানের দিকের অংশটির নাম সদরঘাট আর ওপারে পলেমপুর।
অকস্মাৎ চোখের সামনে যেন ভেসে উঠতে লাগলো ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি।উনি তখন পড়তেন বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলে।
হেডমাস্টার মশাই খুব কড়া ছিলেন — নামটা ঠিক মনে পড়ল না।
তবে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যার মৃত্যুঞ্জয়বাবু ছিলেন আরও কড়া। উনি অঙ্ক করাতেন।অনুপবাবু অঙ্কটা ভালোই পারতেন। তাই মৃত্যুঞ্জয়বাবু ওঁকে পছন্দ করতেন; তাই নামটা মনে আছে। আর একজনের কথা মনে পড়ছে — চিত্তরঞ্জনবাবু।সংস্কৃত পড়াতেন। দুষ্টুমি করার জন্য একবার সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে ছিলেন।
অনুপবাবুর চশমা ছিটকে পড়েছিল মাটিতে। হুহু করে সব মনে পড়তে লাগলো। আর তখনই মনে পড়ে গেল ময়ূখের কথা। ময়ূখ কোনার। ওর বাড়ি তো এই সদরঘাটেই ছিল না? হ্যাঁ, তাই তো বলেছিল। ময়ূখ ছিল অনুপবাবুর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। স্কুলে ভর্তি হবার পর সেই প্রথম দিনটি থেকে ময়ূখ বসত ঠিক ওর পাশের বেঞ্চিতে।
দুজনের বন্ধুত্ব দেখে সবাই হিংসেয় জ্বলতো। কারণ ময়ূখের মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ছিল যে সবাই চাইত ওকে প্রিয় বন্ধু হিসেবে পেতে।
খেলাধুলো থেকে পড়াশোনা, ছবি আঁকা সব ব্যাপারেই যেমন ও ছিল চৌকস, দেখতেও তেমনি রাজপুত্তুরের মত। কিন্তু শিকে ছিঁড়ে ছিল অনুপবাবুর। না জানি কেন ময়ূখ ওকে ভারি পছন্দ করত। অনুপবাবুরও ময়ূখকে একদিন না দেখলে ভীষণ অস্বস্তি হত।
বর্ধমান ছেড়ে চলে যাবার সময় অনুপবাবুর আর কোনো কিছুর জন্য কষ্ট না হলেও শুধু মাত্র ময়ূখকে হারাবার ব্যথায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল।
রামপুরহাট গিয়ে নতুন স্কুলে ভর্তি হবার পর অনেকদিন ভালো করে কারো সঙ্গে মেলামেশা করতে পারেন নি। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব স্মৃতি ফিকে হয়ে গিয়েছিল। আজ এতদিন পর সমস্ত স্মৃতি তাজা হয়ে উঠলো।
বিদ্যুৎ চমকের মত এইবার অনুপবাবুর মনে পড়ে গেল, আরে,
রামপুরহাট চলে যাবার আগে বাবার একটা কলম উনি ময়ূখকে উপহার হিসেবে দিয়ে গিয়েছিলেন — আর সেটাই হলো নিয়ামতের দোকান থেকে আনা ওই কলমটা! হতেই হবে! ঠিক ওই রকম কলম আর কোথাও উনি দেখেন নি। বাবাকে কলমটা উপহার দিয়েছিলেন ওঁর এক প্রবাসী বন্ধু।
রামপুরহাট যাবার আগের দিন বাবার ব্যাগ থেকে কলমটা চুরি করেই উনি ময়ূখকে দিয়েছিলেন। পরে ব্যাপারটা ধরা পড়তে বেদম মার খেয়েছিলেন বাবার কাছে। তবে কখনো স্বীকার করেননি যে কলমটা নিয়ে উনি কী করেছেন। কী আশ্চর্য্য এতদিন কেন মনে পড়ল না কথাটা? ময়ূখকে উনি ভুললেন কী করে? তাহলে কি ওঁর অবচেতন মনে এই কলমচুরির ঘটনাটাই ঘোরাফেরা করছিল? তাই কি উনি কলমটা দিয়ে সেদিন লিখে ফেললেন ‘ভুলে গেছিস সব’ লাইনটা?
অনুপবাবু একবার একটা বইতে পড়েছিলেন, মানুষের মন বড় বিচিত্র জিনিস। কখন কোনটা মনে রাখবে আর কোনটা ভুলে যাবে সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে সচরাচর খারাপ স্মৃতি ভুলে যাবার চেষ্টা করে মানুষ। যেমন অনুপবাবুর বেশ মনে পড়ছে রামপুরহাটের স্কুলে ফার্স্ট বেঞ্চে বসা নিয়ে পিনাকীর সঙ্গে একবার দারুন ঝগড়া হয়েছিল।বচসা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে ক্লাস টিচার শেষমেষ ঠিক করে দিয়েছিলেন, সপ্তাহে তিনদিন পিনাকী বসবে ফার্স্ট বেঞ্চে আর বাকি তিনদিন অনুপবাবু। তারপর থেকে ওই স্কুলে থাকাকালীন আর কোনদিন পিনাকীর সঙ্গে কথা বলেন নি। অনেক পরে কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় একবার পিনাকীর সঙ্গে অনুপবাবুর দেখা হয় বাসে। পিনাকী নিজেই যেচে অনুপবাবুর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসে। রামপুরহাট স্কুলের ঘটনাটা পরিষ্কার মনে থাকলেও পিনাকীর নামটা কেন জানি সেদিন কিছুতেই মনে পড়েনি।
যেদিন বিকেলে বর্ধমান থেকে চলে যাবার কথা, অনুপবাবু ভীষণ জিদ করেই স্কুল এসেছিলেন। কারণ ময়ূখ বলেছিল, ‘একটি বারের জন্য হলেও আসিস স্কুলে। আমিও তোকে একটি উপহার দিতে চাই, যাতে আমাকে কখনো তুই ভুলে না যাস।’
তা এসেছিলেন অনুপবাবু, কিন্তু ময়ূখ আসেনি। শেষ দেখাটা আর হয় নি। ভারী অভিমান হয়েছিল। একটু ক্ষুব্ধ হয়েই সেদিন অনুপবাবু টিফিনের পর লোকো কলোনীর রেল কোয়ার্টারে ফিরে গিয়েছিলেন।
বিকেলের ট্রেনে রামপুরহাট যাত্রা।
আর বর্ধমান ফেরা হয়নি। ওর সঙ্গে ফের কখনো দেখাও হয়নি। তবে আশ্চর্য্য ঘটনা হলো এই যে, কলমটা নিয়ামতের দোকানে এলো কী করে? ওটা তো ময়ূখের কাছেই থাকার কথা!
এইসব ভাবতে ভাবতে রাস্তা পেরিয়ে পূর্ব দিকের ঢাল বেয়ে সদরঘাটের দিকে নামতে থাকলেন।
সেতুর এই দিকটায় খানিক নামলেই একটা চত্বর মত। খেলার মাঠ বলা যায়।
মাঠের শেষেই জমিটা আরও ঢালু হয়ে নদীর বালুকাবেলায় নেমে গিয়েছে।
মাঠটার দু’দিকে দুটো গোলপোস্ট পোঁতা। বিকেলে ছেলের দল এসে খেলা করে গেছে।এখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত।
তেমন কেউ নেই বললেই চলে। অনেক দূরে ঘরে ফেরা চাষী মাথায় খড়ের বোঝা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নদীতে মাছধরা নৌকোয় মৃদু আলোর রেখা।
গোলপোস্টের কাছে শুধু একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। তার পায়ের কাছে একটি ফুটবল রয়েছে বলে আন্দাজ হচ্ছে।
ছেলেটিকে দূর থেকেই অনুপবাবুর খুব চেনা চেনা লাগছিল। যেন অনেকদিনের পরিচয়! কাছে যেতেই চিনতে পারলেন – আরে! এ তো ময়ূখ! পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে – সেই কোঁচকানো চুল, টানাটানা চোখ,
খাড়া নাক, ধবধবে ফর্সা রং! এ ময়ূখ না হয়ে যায় না যে! কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব ? আজ এত বছর পরেও কি ময়ূখ একই রকম থাকবে? খানিক আগেই উনি ময়ূখের কথা ভাবছিলেন আর কয়েক মুহূর্ত পরই ওর মত কাউকে চোখের সামনে দেখাটা কি কাকতালীয়? ঘটনার আকস্মিকতায় অনুপবাবু এতটাই চমকে গেলেন যে কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেললেন।
হতবাক হয়ে ছেলেটির মুখের দিকে কতক্ষণ চেয়েছিলেন খেয়াল নেই, সম্বিত ফিরল সুকল্যাণের ডাকে।
ছেলেটি তখনও মিটিমিটি হাসছে।
হাসিটিও অবিকল সেই ছেলেবেলায় দেখা ময়ূখের মত।
‘কী রে এখানে কী করছিস?’ সুকল্যাণ জিজ্ঞেস করলেন।
বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে সুকল্যাণের দিকে ঘুরে অনুপবাবু বলে উঠলেন, ‘সুকল্যাণ! আমার সব মনে পড়ে গেছে রে! ওই পেনটা অনেকদিন আগে আমার বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের বন্ধু ময়ূখকে উপহার দিয়েছিলাম। কিন্তু…’
সুকল্যাণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই বাঁ-হাতটি গোলপোস্টের সামনে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করলেন অনুপবাবু।
‘কী বলছিস রে?’ সুকল্যাণ বিস্মিত সুরে বললেন।
অনুপবাবু ঢোঁক গিলে থেমে থেমে বললেন, ‘এই যে ছেলেটি ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে — হুবহু ময়ুখের মত দেখতে!’
সুকল্যাণ একটু চিন্তার সুরে বললেন, ‘কিন্তু ময়ূখ-ময়ূখ বলছিস যে,
কোথায় সে?’
অনুপবাবু মুখ ঘুরিয়ে গোলপোস্টের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। ছেলেটি নেই!
‘আরে! এই একটু আগেই তো ছিল এখানে… এখন আর নেই!’ অনুপবাবু উদভ্রান্তের মত বলে উঠলেন।
সুকল্যাণ বললেন, ‘তুই নিশ্চিত তো যে ছেলেটিকে একদম ময়ূখের মত দেখতে?’
‘আলবাত!’ অনুপবাবু প্রায় চিত্কার করে উঠলেন, ‘এক্কেবারে ময়ূখ বসানো মুখ! কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? আজ এতগুলো বছর পরও কি ময়ূখের বয়স বাড়বে না? আর এইটুকুর মধ্যে ও গেল কোথায়?’
অনুপবাবু উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছেন দেখে সুকল্যাণ ওঁর পিঠে হাত রেখে শান্ত সুরে বললেন, ‘উত্তেজিত হবার দরকার নেই অনুপ। হতে পারে ও ময়ূখেরই ছেলে। বাবার মত দেখতে।
আমাদের কথার মধ্যেই ও হয়ত পিছনের ঢালু জায়গাটা পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে গেছে। চল আমরাও বরং একবার গ্রামটা ঘুরে আসি। ময়ূখের সঙ্গে দেখা হলেই সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
‘বাহ এই সম্ভাবনাটার কথা তো ভেবে দেখিনি!’ বিভ্রান্তি কেটে গিয়ে ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পাবার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন অনুপবাবু, ‘ঠিক বলেছিস, ও নির্ঘাৎ ময়ূখেরই ছেলে! জানিস সুকল্যাণ, ওটা আমার বাবার পেন ছিল। তাই এত চেনা চেনা লাগছিল।
চল গ্রামের দিকে যাওয়া যাক।’
এগোতে গিয়েও সুকল্যাণ ভ্রূ কুঁচকে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন গোলপোস্টের দিকে তাকিয়ে।
অনুপবাবু ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দেখছিস?’
‘কিছু একটা পড়ে আছে মনে হচ্ছে…’
সত্যিই গোলপোস্টের কাছে মাটিতে কিছু একটা রয়েছে।
জিনিসটা চকচকে। এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিয়ে দেখলেন — সোনালী রঙের একটা গোল চাকতি। তাতে সোনালী ধাতুর শিকলি লাগানো। চাবির রিং হিসেবে এটি ব্যবহার করা যায়।
সোনালী রঙের বেষ্টনীর মাঝখানে একটা পুরনো বড় মাপের একটাকার কয়েনের আকারের পাতলা কাচের চাকতি। কাচের দিকে তাকালে অদ্ভুত সুন্দর একটি চোখের ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেন জীবন্ত। এই জিনিস আজকাল আর পাওয়া যায় না। অনুপবাবুর মনে পড়ল ওঁর ছোটবেলায় এই ধরনের চাবির রিং পাওয়া যেত বর্ধমানের কার্জন গেটের পাশে বসা ফুটপাথিয়া হকারদের কাছে।
‘নির্ঘাৎ এটা ময়ূখের ছেলের পকেট থেকে পড়ে গেছে।’ অনুপবাবু জিনিসটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ‘চল, ওদের বাড়ি গিয়ে এটা ওকে ফিরিয়ে দেব।’
পাকা রাস্তা থেকে নামা ঢালু মোরাম বিছানো রাস্তার শুরুতেই গুটিকয়েক দোকান। চা-পান, মুদি,
কৃষিজ জিনিসপত্রের বিপনি। ময়ূখের নাম ধরে জিজ্ঞেস করতে কেউ কিছু বলতে পারল না। অনুপবাবু প্রতিটি দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন।
কোনো সদুত্তর মিলল না। তবে একজন বললেন, ‘গ্রামের ভিতরে গিয়ে একবার দেখুন। এখানে বেশ কয়েকঘর “কোনার” আছে। তাদের কেউ হলেও হতে পারে।’
‘চল একবার গ্রামের ভিতরে ঢুকে দেখি।’ অনুপবাবু বললেন, ‘ওর ছেলেকে যখন দেখেছি তখন ও নির্ঘাৎ এই গ্রামে থাকে।’
সুকল্যাণের ভ্রূটা কুঁচকে রয়েছে।
সদরঘাট সরকারী খাতায় গ্রাম লেখা হলেও আজকাল শহরের হাওয়া লাগতে শুরু করে দিয়েছে। গ্রামের বাড়িগুলি পাকা-কাঁচা মিলিয়ে মিশিয়ে। মাটির দোতলা বাড়ির পাশাপাশি পাকা একতলা-দোতলা বাড়িও রয়েছে। পাকা রাস্তার দিকে এখান থেকে খানিক দূরে বেশ কয়েকটি তিন-চারতলা বাড়িও দেখা যাচ্ছে। একটি মাটির দালান বাড়ির উঠোনে বসে এক বৃদ্ধ থেলো হাতে তামাক খাচ্ছিলেন। অনুপবাবু এঁকেই ভরসা করে জিজ্ঞেস করে উঠলেন, ‘কাকা, এই গ্রামে ময়ূখ কোনার বলে কাউকে চেনেন কি?’
‘কোনার? ময়ূখ কোনার?’ বৃদ্ধ চশমার ভারী লেন্সের পিছন থেকে ঘোলাটে চোখ মেলে ভেবেচিন্তে বললেন, ‘উঁহু, তেমন কাউকে তো মনে পড়ছে না। এই সদরঘাটেরই তো? নাকি পলেমপুরের কথা বলছ?’
‘না না, যদ্দুর মনে পড়ে সদরঘাটই বলেছিল। তবে সে অনেকদিন আগের কথা। আমার সঙ্গে মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ত…’
‘হুম, দাঁড়াও বাপু, মুন্সিপ্যাল ইস্কুলের কথায় মনে পড়ছে… নালু’র ইস্কুলের নাম ময়ূখই ছিল বটে। হ্যাঁ,
কোনারদের বাড়ি ছিল এই রাস্তার একদম শেষটায় বড় রাস্তার ধারে। বেশ বড় ঘর।’
অনুপবাবু আশায় বুক বেঁধে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, ‘ময়ূখের একটা ছেলে আছে যে কিনা হুবহু তার বাপের মত দেখতে।’
‘রোসো রোসো!’ বৃদ্ধ হাত দেখিয়ে থামতে ইঙ্গিত করলেন, ‘কোনারদের বাড়ি তো গত মাসে ভেঙ্গে ফেলা হলো। বাড়ির জিনিসপত্র সব নিলেম হয়ে গেছে।
উত্তরপুরুষ বলতেও আর তেমন কেউ নেই। নালু ছিল বাপের একটি মাত্র পোলা। পোলার শোকে তেনারাও শেষ হয়ে গেলেন। যারা আছেন সব কলকেতার দিকে চলে গেছেন। গেল মাসে ওর এক কাকা এসে প্রোমোটারকে সব বেচেবুচে চলে গেল। এখন শুনছি সেখানে নাকি ফেলাট বাড়ি উঠবে।’
‘অ্যাঁ! কী বলছেন? ময়ূখ এখন কোথায়? ওর ছেলেকে তো বিলক্ষণ দেখলাম একটু আগেই …’
‘না হে বাপু, নালু’র আবার ব্যাটা আসবে কোত্থেকে?’
বৃদ্ধ গুড়ুক গুড়ুক করে হাতের থেলোতে টান দিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করার মত করে বলতে থাকলেন, ‘সে তো বছর তিরিশ-চল্লিশ হবে… কেলাস সেভেনে পড়ে… ইস্কুলে যাবার পথে… সাইকেলে হুড়োমুড়ি করে যাচ্ছিল… কোন এক বন্ধু নাকি বর্ধমান থিকে চলে যাবে, তার সাথে দেখা করার জন্য তাড়া ছিল তার।
পিছন থেকে একটা লরি এসে ধাক্কা মারে। ছিটকে পড়েছিল বাঁকা ব্রিজের আগে। খবর পেয়ে আমি গিয়েছিলুম। বন্ধুকে বড্ড ভালোবাসত বটে… পড়ে গিয়েও হাত দিয়ে পকেটে রাখা চাবির রিংটাকে চেপে ধরে ছিল। কেউ ছাড়াতেই পারে না।
বন্ধুকে দেওয়া আর হলো না।’
অনুপবাবু ধরা ধরা গলায় বললেন, ‘তাহলে একটু আগে যাকে দেখলাম…’
অনুপবাবুর কথাগুলো যেন বৃদ্ধের কানে ঢুকলোই না। চোখ দুটোকে সরু করে উনি অনুপবাবুর হাতের দিকে চেয়ে রয়েছেন। দাওয়া থেকে উঠে কাছে এগিয়ে এসে অনুপবাবুর অবশ হাতটা তুলে ধরে রিংটার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এটা কোত্থেকে পেলেন? এই রকমই একটা জিনিস সেদিন নালু’র হাতে ছিল বটে।’
………………………………………….(সমাপ্ত)…………………………………………..