ঘুম পাগলী

ঘুম পাগলী

বাসের টিকেটটা নিয়ে ভিতরে গেলাম।আমার সিটের সামনে গিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল,একটা মেয়ে বসে রয়েছে।তাই কিছু না ভেবেই বললাম:
আমি:এই যে মিসেস,এই সিটটা আমার।আপনি আপনার সিটে গিয়ে বসুন।
মেয়ে:আপনি অন্য সিটে বসুন,আমার জানালার পাশে বসতে ভালো লাগে।

মেয়েটার কথা শুনে মাথাটা খারাপ হয়ে গেল,তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু করে দিলাম।অবশেষে সুপারভাইজর এসে আমার সিটটা আমাকে ফিরিয়ে দিল।আর মেয়েটি রাগে গজ গজ করতে করতে পাশের সিটে বসে পরলো।

বাস ছেড়ে দিয়েছে।যাবো বেশি দূরে না,মোহম্মদপুর থেকে কলাতিয়া(কাল্পনিক,কারন এই রাস্তায় স্থায়ী বাস চলেনা),৩০ মিনিটের রাস্তা।গাড়ি ছেড়েছে ৫ মিনিটও হয় নি,মেয়েটি আমার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে,মেয়েটি যে বেশি ঘুম কাতুরে।মেয়েটির মাথাটা ভালো করে আমার কাধে রাখলাম,যেন ঘুমের কোন সমস্যা না হয়।মেয়েটির মায়াবী মন্ডলখানা দেখছি,কি মায়াবী লাগছে।বাসের সবাই অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।একজনোতো বলেই বসলো:”ভাই,আপনি না ইনার সাথে একটু আগে ঝগরা করলেন?”
আমি:হুম,তো?
সে:তাহলে সে আপনার কাধে মাথা রাখছে আর আপনি কিছু বলছেন না যে?
আমি:উনি কে জানেন?উনি আমার স্ত্রি।আমার উপর রাগ করে বাড়ি চলে যাচ্ছে।

এবার সবাই আসল কাহিনি বুঝতে পারছে।আশা করি আপনারাও বুঝতে পারছেন আমাদের পরিচয়টা।হ্যা,আমরা স্বামি-স্ত্রি।

আমি #সাজিদুল ইসলাম আহাদ।পড়ালেখা শেষ করে এখন একটা বেসরকারি অফিসে ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করছি,যা দিয়ে আমার আর আমার বউ এর দিব্বি চলে যাচ্ছে।বউয়ের পরিচয়টা দিয়ে দেই,আমার বউ এর নাম সুমাইয়া আক্তার।সে এর আগের বছর অনার্স শেষ করেছে।

গাড়ির হর্নের কারনে বাস্তবে ফিরে এলাম।কলাতিয়া বাজারে এসে পড়েছি।দেখি ঘুম কাতুরে মেয়ে মানে সুমাইয়া এখনো ঘুমাচ্ছে।তাই তাকে ডাক দিলাম।সে উঠে কিছুক্ষন আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রইলো।তারপর হন হন করে বাস থেকে নেমে পড়লো।আমিও নামলাম কিন্তু তার আগেই সে রিকশায় উঠে পরেছে।তাই আমি অন্য রিকশা ডাক দিলাম:
আমি:মামা,সৈয়দপুর,লেচুবাগান যাবেন?
রিকশাওয়ালা মামা:হ মামা যামু,আহেন।

উঠালাম রিকশায়।একটু পর বাড়ির সামনে নামলাম।উনি আগেই ভিতরে ঢুকে পরলো।আমি দু রিকশাওয়ালা মামার ভারা দিয়ে ভিতরে গেলাম।দেখি আব্বু-আম্মুকে সাথে নিয়ে উনি দাঁড়িয়ে রইছে।মানে সব বলে দিয়েছে।আমি ঘরের দিকে আর না গিয়ে বাহিরের দিকে হাটা দিলাম।এখন শ্বশুর বাড়ি যাওয়াই সবচেয় ভালো।তাই সেদিকেই যাওয়ার জন্য বের হতে যাবো তখনি আব্বুর হুংকার:
আব্বু:আহাদ,এই আহাদ?এদিকে আয়।

আমার হাটু কাপতেছে,আব্বুকে জমের মত ভয় পাই।আর শয়তানটা মুচকি মুচকি হাসছে।আব্বুর সামনে গেলাম।উনি কিছুক্ষন আমাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দিলেন।

সুমাইয়া সবার সাথে দেখা করে ওর বাবার বাড়ি চলে গেল।আমিও সবার সাথে দেখা করলাম।ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে গেলাম।খাওয়া শেষ করে রুমে এসে শুয়ে পরলাম।

আমার আর সুমাইয়ার লাভ ম্যারিজ।তিন বছর রিলেশন করে বিয়ে করেছি আমরা।ওর সাথে রিলেশন করতে যে আমার কি কি করতে হয়েছে তা লিখলে আজ ইতিহাস হয়ে যেত।অনার্স কমপ্লিট করার পর চাকরীটা পাবার পরেই সুমাইয়ার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেই।শিক্ষিত,ভদ্র,চাকরী আছে বলেই ওর পরিবার থেকে রাজী হয়েছে।তাছাড়া সবচেয় বড় কথা হলো ওর বড় ভাই আমার বন্ধু।বিয়ের পরে চাকরীর সুবিধার জন্য ওকে নিয়ে মোহম্মদপুর চলে আসি।

মেয়েটি যেমন রুপবতী তেমনি সংসারী।কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে মেয়েটি একটু বেশিই ঘুমায়।আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার অফিসের সময় হয়ে গেছে কিন্তু উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে।তাই আমি তাকে ডাক দিয়ে উঠিয়ে কিছুক্ষন ঝারলাম।একটু পর সে অভিমান করে আমার জন্য নাস্তা তৈরি করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরলো বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে।আর বাকিটাতো আপনারা দেখছেন।

ঘুম ভাজ্ঞলো ফোনের শব্দে।আপনাদের সাথে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি মনেই নেই।মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি আমার শ্বাশুরি আম্মা ফোন করেছে।তাই ধরলাম:
আমি:আসসালামু ওয়ালাইকুম
শ্বাশুরি আম্মা:ওয়ালাইকুম আসসালাম।বাবা,একটু আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে?
আমি:কেন আম্মা,কি হয়েছে?
শ্বাশুরি আম্মা:সুমাইয়া এখনো কিছুই খায় নি,ছাদে গিয়ে দোলনায় বসে রয়েছে।
আমি:কি!!!এখনো খায় নি?আমি এক্ষুনি আসছি।
শ্বাশুরি আম্মা:আচ্ছা,রাখি তাহলে।
আমি:ওকে

রেডি হয়ে বেরিয়ে পরলাম শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।মাত্র ২ মিনিটের রাস্তা তাই পৌছে গেলাম খুব তারাতারি।গিয়ে সবার সাথে দেখা করে খবার নিয়ে ছাদে গেলাম,দেখি সুমাইয়া দোলনায় ঘুমিয়ে পরেছে।মেয়েটি আসলেই ঘুম পাগলি।

আমি গিয়ে দোলনায় বসলাম।তারপর সুমাইয়ার মাথাটা আমার কোলে রাখলাম আর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি।

থম থমে পরিবেশ,চারদিকে নিরবতা,হালকা মৃদ্যু বাতাস,মাঝে মাঝে পাখিরা উরে যাচ্ছে,আম গাছ থেকে মূকুলের ঘ্রান,সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ পরিবেশ।আর এই পরিবেশে মেয়েটির মায়াবী মুখখানা দেখতে বেসম্ভব ভালো লাগছে।তার কপালে আমার ঠোট জোরা লাগাতে ইচ্ছে হলো।তাই একটু নিচু হয়ে তার কপালে আমার ঠোটটা লাগিয়ে দিলাম।

অনেকক্ষন হয়ে গেছে মেয়েটি এখনো জাগেনি,এখন জাগিয়ে তুলে খাইয়ে দিতে হবে।তাই আমি তাকে ডাকতে শুরু করলাম।কিছুক্ষন ডাকার পর সে পিটপিট করে আমার দিকে তাকালো।আমি তাকে শুয়া থেকে উঠিয়ে দিলাম।আমি বললাম:
আমি:ভাতটা খেয়ে নাও?
সুমাইয়া:না,খাবো না।
আমি:খেয়ে নাও,সোনা?
সুমাইয়া:তুমি আমাকে বকেছ কেন?আমি খাবো না,না,না।য(চিৎকার করে)
আমি:আর কখনো বকবো না,এবার খেয়ে নাও,প্লিজ?
সুমাইয়া:বকবে নাতো?
আমি;না আর বকবো না।
সুমাইয়া:তাহলে তুমি খাইয়ে দাও
আমি:আচ্ছা।

মেয়েটি খাচ্ছে,আমি খাইয়ে দিচ্ছি আর প্রেমে পরছি।বাচ্চা মেয়েদের মত খাচ্ছে আর আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।
রাতের আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম আর অতিতের কিছু মধুর স্মৃতি স্মরন করতেছিলাম।স্মৃতিগুলা স্মরন করতে করতে কখন যে দুচোখ বেয়ে দুফোটা নোনা জল গড়িয়ে পরলো তা খেয়াল করি নি।না নেই,আজ আর নেই আমার সেই ঘুম পাগলী।চলে গিয়েছে এক গভীর অন্তহীন পথে।যেখান থেকে কেউ ফিরে আসতে পারে না,পারেনা হাজার আপন সত্ত্বেও দেখা করতে।হ্যা,সেটা হচ্ছে মরন।

দুদিন বাড়িতে থেকে তিন দিনের বেলায় মোহম্মদপুর যাওয়ার জন্য দুজনে গিয়ে বাসে উঠলাম।তখনো জানতাম না যে সেটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা।বাস আপন গতিতে চলছিল,গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছিল।হঠাৎ অন্য একটা বাসের সাথে খুব জোরে ধাক্কা খায়।আমি মাথায় আঘাত পাই।সুমাইয়ার দিকে তাকাই,দেখি তার মাথা বেয়ে রক্ত বের হচ্ছে আর সে লুটিয়ে পরছে।আমি ওকে ধরতে যাই,কিন্তু পারি না।আমার পুরো পৃথীবি অন্ধাকার দেখতে থাকি।তারপর যখন জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালে।হাসপাতাল থেকে উঠে পাগলের মত সুমাইয়াকে খুজি।কিন্তু পাই না।তার প্রায় এক সাপ্তাহ পরে জানতে পারি সে আর এই পৃথীবিতে নেই,চলে গেছে না ফেরার দিকে।আমি তখন কান্না করতে পারি নি,পারি নি চিৎকার করে কাঁদতে।তারপর থেকে প্রতি রাতে ছাদে গিয়ে তারার সাথে কথা বলি,ছোট বেলায় শুনেছিলাম মানুষ মারা গেলে তারা হয়ে যায়।আমি তারার মাঝে খুজি সুমাইয়াকে,আমার সুমাইয়াকে।

এখন চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছে করছে ইমরান মাহামুদের সেই গানটি;
“ফিরে আসোনা,আরতো পারি না।চল বাচি না আবার একসাথে”।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত