ডমরু-চরিত

ডমরু-চরিত

প্রথম গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–সূচনা

ডমরুধর বলিলেন,—এই যে দুর্গোৎসবটি, এটি তোমরা সামান্য জ্ঞান করিও না। কিন্তু এখানকার বাবুদের সে বোধ নাই। বাবুরা এখন হাওয়াখোর হইয়াছেন। দেশে হাওয়া নাই, বিদেশে গমন করিয়া বাবুরা হাওয়া সেবন করেন, আর বাপপিতামহের পূজার দালান ছুঁচো-চামচিকাতে অপরিষ্কার করে।

লম্বোদর বলিলেন,—সত্য কথা! সেকালে পূজার সময় লোকে বিদেশ হইতে বাড়ী আসিত। বন্ধু-বান্ধবের সহিত মিলিত হইত। যাহার যেমন ক্ষমতা মায়ের পূজা করিত, গরীব-দুঃখীরা অন্ততঃ একরা খয়ে-মুড়কি ও দুইটি নারিকেল নাড়ু পাইত।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,—শুনিয়াছি যে, কলিকাতায় পূজা করা এক নূতন ব্যবসা হইয়াছে। একটি প্রতিমা খাড়া করিয়া বন্ধু-বান্ধবদিগকে লোক নিমন্ত্রণ করে, পরে তাহাদের কান মলিয়া প্রণামি আদায় করে। পূজা করিয়া অনেকে দুই পয়সা উপার্জন করে।

ডমরুধর বলিলেন,–তাহাতে আর দোষ কি? পূজার সময় আমি আমার প্রজাগণকে নিমন্ত্রণ করি। ভক্তিভাবে মায়ের পাদপদ্মে তাঁহারা যদি কিছু প্রণামি প্রদান করে, তাহাতে আর আপত্তি কি? যাহা, বিলক্ষণ ঠেকিয়া এই দুর্গোৎসব আরম্ভ করিয়াছি। আমি এখন বুঝিয়াছি যে, ভগবতীর আরাধনা করিলে ধনসম্পদ হয়।

পুরোহিত বলিলেন,–তে সম্মতা জনপদেষু ধনানি তেষাং, তেষাং যশাংসি ন চ সীদতি ধর্ম্মবর্গঃ। হে দেবী! তুমি যাহার প্রতি কৃপা কর, জনপদে সে পূজিত হয়; তাঁহার ধন ও যশ হয়, তাঁহার ধর্ম্ম অক্ষুণ্ণ থাকে।

কলিকাতার দক্ষিণে একখানি গ্রামে ডমরুধরের বাস। প্রথম বয়সে তিনি নিতান্ত দরিদ্র ছিলেন। অনেক কৌশল করিয়া সাধ্যমতে একটি পয়সাও খরচ না করিয়া তিনি প্রভুত ধনশালী হইয়াছেন। অন্যান্য সম্পত্তির মধ্যে সুন্দরবনের আবাদে তাঁহার এখন বিলক্ষণ লাভ হইয়াছে। ডমরুধর এখন পাকা ইমারতে বাস করেন। পূজার পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যার পর দালানে, যেস্থানে প্রতিমা হইয়াছে, সেই স্থানে গল্পগাছা প্রসঙ্গে এরূপ কথাবার্তা হইতেছিল।

ডমরুধর পুনরায় বলিলেন,–হাঁ! মা, আমাকে ঘোরতর বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। সেই বিপদে পড়িয়া, একান্ত মনে মাকে ডাকিয়া আমি বলিয়াছিলাম, মা! তুমি আমাকে এ সঙ্কট হইতে পরিত্রাণ কর। তাহা করিলে প্রতি বৎসর আমি তোমার পূজা করিব।

লম্বোদর বলিলেন,–তুমি তো কেবল তিন বৎসরের ভিতর তোমাকে তো কোন বিপদে পড়িতে দেখি নাই। বরং তিন বৎসর পূর্ব্বে এই বৃদ্ধবয়সে তুমি নূতন পত্নী লাভ করিয়াছ।

ডমরুধর বলিলেন,—তিন বৎসর পূর্ব্বে আমি ঘোরতর বিধ্বদে পড়িয়াছিলাম। তৃতীয় পক্ষ বিবাহের সময় আমি সঙ্কটাপন্ন হইয়াছিলাম। গ্রামের লোক, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব কেহই সে কথা জানে না। মুখ ফুটিয়া আজ পর্যন্ত কাহারও নিকট সে কথা আমি প্রকাশ করি নাই। মা জগদম্বা আমাকে সে বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছেন। দুর্গতিনাশিনী দুর্গার প্রতি লোকের ভক্তি ক্রমে তোপ হইতেছে। কলেরা ম্যালেরিয়া বসন্ত প্লেগ তো আছেই, মায়ের প্রতি ভক্তির অভাবে এখন আবার ফুলো রোগ দেখা দিয়াছে ঘুমন্ত রোগও আসিয়াছে। জগদম্বার প্রতি ভক্তি থাকিলে লোকের এসব বিপদ হয় না।

পুরোহিত অপরিস্ফুট স্বরে বলিলেন,–
দুর্গে! স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তোঃ,
স্বস্থৈঃ স্মৃতা মতিমতীব শুভাং দদাসি।।
দারিদ্র্যদুঃখ ভয়হারিণি! কা ত্বদন্যা,
সর্বোপকারকরণায় সদার্দ্র চিন্তা।।

হে দুর্গে! বিপদে পড়িয়া তোমাকে স্মরণ করিলে জীবগণের ভয় তুমি দূর কর। সুস্থ অবস্থায় তোমাকে স্মরণ করিলে তুমি তাহাদের মঙ্গল কর। হে দারিদ্র্যদুঃখহারিণি! সর্ব্বপ্রকার উপকার করিবার নিমিত্ত তুমি ভিন্ন দয়াচিন্তা আর কে আছে?

লম্বোদর বলিলেন,—কিন্তু বিপদটা কি? কি বিপদে তুমি পড়িয়াছিলে? ডমরুধর বলিলেন,–এতদিন পরে সে বিপদের কথা আজ আমি প্রকাশ করিতেছি, শুন।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ঠিক কন্দর্প পুরুষ কি

ডমরুর বলিলেন,—আমার তৃতীয় বিবাহের সময় এ বিপদ ঘটিয়াছিল। আমার বয়স তখন পঁয়ষট্টি বৎসর। এত বয়সে তোক বিবাহ করে না। তবে আমার ছেলে-বেটা মানুষ হইল না। আমি তাঁহাকে ত্যাজ্যপুত্র করিলাম। কোথায় সে চলিয়া গেল। সে একটি স্বতন্ত্র গল্প।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–সে গল্প আর একদিন হইবে।

ডমরুর বলিলেন,–তাহার পর বিবাহ না করিলে গৃহ শূন্য হইয়া থাকে। কিন্তু বিবাহ করিলেও কি হয়, তা জান তো লম্বোদর?

লম্বোদর উত্তর করিলেন,—খ্যাচ খ্যাচ, রাত্রি দিন খ্যাচ খ্যাচ।

ডমরুধর বলিলেন,–হাঁ, তুমি ভুক্তভোগী। ঘটনাচক্রে আমার এই বিবাহের কথা স্থির হইয়াছিল। আমডাঙ্গার মাঠে আমার যে বৃহৎ বাগান আছে, সে বৎসর বৈশাখ মাসে সেই বাগানে গিয়া আমি বেড়াইতেছিলাম। দুই চারি দিন পূর্ব্বে আমার পুরাতন উড়ে মালী দেশে গিয়াছিল, ভাইপোকে তাঁহার স্থানে রাখিয়া গিয়াছিল। সে আমাকে কখন দেখে নাই, আমি তাঁহাকে কখন দেখি নাই। ঘোষের জামাতা সেই ছোঁড়ার সহিত সড় করিয়া চোর বলিয়া আমাকে বাঁধিয়া ফেলিল। তাহার পর মারিতে মারিতে কুতবপুরের মহকুমাতে আমাকে লইয়া গেল। কিন্তু সে আবার একটি স্বতন্ত্র গল্প।

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন, এই বিপদ?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—রাম রাম! এ সামান্য কথা ইহা অপেক্ষা ঘোরতর সঙ্কটে আমি পড়িয়াছিলাম। সেই সঙ্কট হইতে মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিয়াছিলেন।

দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ডমরুধর পুনরায় বলিলেন,–কুতবপুরে ঘটকীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল, পুনরায় বিবাহ করিতে সে আমাকে প্রবলত্তি দিল। আমি বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। বিবাহের কথাবার্তা চলিতে লাগিল। টাকায় কি না হয়? বাঁশপুরে এক বয়স্কা কন্যার সহিত বিবাহ স্থির হইল। তিনিই আমার বর্তমান গৃহিণী।

লম্বোদর বলিলেন,—সে কথা আমরা জানি, আমরা বরযাত্ৰ গিয়াছিলাম।

ডমরুধর বলিলেন,–কন্যার মাতা-পিতা অর্থহীন বটে, কিন্তু আমার নিকট হইতে নগদ টাকা চাহিলেন না। তবে ঘটকী বলিল যে, বিবাহের সমুদয় খরচা আমাকে দিতে হইবে এবং কন্যার শরীরে যেখানে যা ধরে, সেইরূপ অলঙ্কার দিতে হইবে। তোমরা জান যে, আমি কখন একটি পয়সা বাজে খরচ করি না। তোক পাছে অলস হইয়া পড়ে সেই ভয়ে ভিখারীকে কখন মুষ্টিতিক্ষা প্রদান করি না। সেরার পেট ভরাইতে প্রথম আমি সম্মত হইলাম না। আমি বলিলাম যে, গহনার পরিবর্তে কন্যার আঁচলে নোট বাঁধিয়া দিব। কিন্তু কন্যার মাতা-পিতা সে প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। অবশেষে আমি ভাবিয়া দেখিলাম, যে, আমার বয়স পঁয়ষট্টি বৎসর, তাহার পর আমাকে দেখিয়া কেহ বলে না যে, ইনি সাক্ষাৎ কন্দর্প-পুরুষ। নিজের কথা নিজে বলিতে ক্ষতি নাই;–এই দেখ, আমার দেহের বর্ণটি ঠিক যেন দময়ন্তীর পোড়া শোউল মাছ। দাঁত একটিও নাই, মাথার মাঝখানে টাক, তাঁহার চারিদিকে চুল, তাহাতে একগাছিও কাঁচা চুল নাই, মুখে ঠোটের দুইপাশে সাদা সাদা সব কি হইয়াছে। এইসব কথা ভাবিয়া গহনা দিতে আমি সম্মত হইলাম! যতদূর সাধ্য সাদা মাটা পেটা সোনার গহনা গড়াইলাম; কিন্তু তাহাতেও আমার অনেক টাকা খরচ হইল। ফর্দ অনেক। একবাক্স গহনা হইল।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–তা বটে! কিন্তু বিপদটা কি?

ডমরুধর বলিলেন,–ব্যস্ত হইও না। শুন।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – গাছে-ঝোলা সাধু

ডমরুধর বলিলেন,–গ্রামের প্রান্তভাগে বিন্দী গোয়ালিনীর যে ভিটা আছে, সে জমি আমার। কিছুদিন পূর্ব্বে বিন্দী মরিয়া গিয়াছিল। তাঁহার চালাঘরখানি তখনও ছিল। দুইজন চেলা সঙ্গে কোথা হইতে এক সাধু আসিয়া সেই চালাঘরে আশ্রয় লইল। সে সাধুকে তোমরা সকলেই দেখিয়াছ, তাঁহাকে সকলেই জান। সাধুর দুইটি চক্ষু অন্ধ। চেলারা বলিল যে, তাঁহার বয়স পাঁচশত তিপ্পান্ন বৎসর। চালাঘরের সম্মুখে যে আমগাছ আছে, চেলারা তাঁহার ডালে সাধুর দুই পা বাঁধিয়া দিত। প্রতিদিন প্রাতঃকালে এক ঘণ্টাকাল নীচের দিকে মুখ করিয়া সাধু ঝুলিয়া থাকিত। চারিদিকে হৈ-হৈ পড়িয়া গেল। যাহারা বি-এ, এম-এ পাস করিয়াছে, সেই ছোঁড়ারা আসিয়া সাধুর কেহ পা টিপিতে লাগিল, কেহ বাতাস করিতে লাগিল, সকলেই পাদোদক খাইতে লাগিল। একখানি হুজুগে ইংরেজী কাগজের লোক আসিয়া সাধুকে দর্শন করিল ও তাহাদের কাগজে সাধুর মহিমা গান করিয়া দীর্ঘ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিতে লাগিল। ফল কথা, দেশের লোকের ভক্তি একেবারে উথলিয়া পড়িল। সাধুর মাথার নিম্নে চেলারা একটি ধামা রাখিল; সেই ধামায় পয়সা-বৃষ্টি হইতে লাগিল।

লম্বোদর বলিলেন,—তুমিও সেই হুজুগে দুপয়সা লাভ করিয়াছিলে!

ডমরুর বলিলেন,–সে জমি আমার, সে চালা আমার, সে আমগাছ আমার; কেন আমি লাভ করিব না? আমি সাধুকে গিয়া বলিলাম,—ঠাকুর! সন্ন্যাসী মোহান্তের প্রতি আমার যে ভক্তি নাই, তাহা নহে। তবে কি জান, আমি বিষয়ী লোক। তুমি আমার জমিতে আস্তানা গাড়িয়াছ। দুপয়সা বিলক্ষণ তোমার আমদানি হইতেছে। ভূস্বামীকে ট্যাক্স দিতে হইবে।।

সাধু উত্তর করিলেন,—আমরা উদাসীন। আমি নিজে বায়ু ভক্ষণ করি। চেলারা এখনও যৎকিঞ্চিৎ আহার করে। দীন দুঃখীকে আমরা কিছু দান করি। কোন পরিব্রাজক আসিলে তাঁহার সেবার কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় করি। সেজন্য পুণ্যাত্মা ভক্তগণ যাহা প্রদান করে, আমার শিষ্যদ্বয় এ স্থানে খরচের জন্য তাঁহার অর্ধেক রাখিয়া, অবশিষ্ট ধন প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তোমাকে দিয়া আসিবে। বলা বাহুল্য যে, আহ্লাদ সহকারে আমি এ প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। কোনদিন চারি টাকা কোনদিন পাঁচ টাকা আমার লাভ হইতে লাগিল। সন্ন্যাসীর প্রতি আমার প্রগাঢ় ভক্তি হইল। যাহাতে তাঁহার পসার-প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি হয়, দেশের যত উজবুক যাহাতে তাঁহার গোঁড়া হয়, সেজন্য আমি চেষ্টা করিতে লাগিলাম। মনে মনে সঙ্কল্প করিলাম যে, দুগ্ধবতী গাভীর ন্যায় সন্ন্যাসীটিকে আমি পুষিয়া রাখিব। কিন্তু একটা হুজুগ লইয়া বাঙ্গালী অধিক দিন থাকিতে পারে না। হুজুগ একটু পুরাতন হইলেই বাঙ্গালী পুনরায় নতুন হুজুগের সৃষ্টি করে। অথবা এই বঙ্গভূমির মাটির গুণে আপনা হইতেই নূতন হুজুগের উৎপত্তি হয়। এই সময় এ স্থান হইতে চারি ক্রোশ দূরে পাঁচগেছে রসিক মণ্ডলের সপ্তমবর্ষীয়া কন্যার স্কন্ধে মাকালঠাকুর অধিষ্ঠান হইলেন। রসিম মণ্ডল জাতিতে পোদ। মাকালঠাকুরের ভরে সেই কন্যা লোককে ঔষধ দিতে লাগিল। দেবদত্ত ঔষধের গুণে অন্ধের চক্ষু, বধিরের কর্ণ, পঙ্গুর পা হইতে লাগিল। বোবার কথা ফুটিতে লাগিল। কতকগুলি সুস্থ লোককে কানা খোঁড়া, হাবা কালা, জোরে অম্বুলে সাজাইতে হয়, তা না করিলে এ কাজে পসার হয় না। তুলসীর মালা গলায় দিয়া সেই ইংরাজী কাগজের লেখকও সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল। ভক্তিতে গদগদ হইয়া কত কি তাহাদের কাগজে লিখিয়া বসিল। বি-এ, এম-এ পাস করা ছোঁড়ারা আবার সন্ন্যাসীকে ছাড়িয়া সেই পোদ ছুঁড়ীর পাদক-জল খাইতে গেল। কাতারে কাতারে সেই গ্রামে লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল। রসিক মণ্ডলের ঘরে টাকা-পয়সা আর ধরে না। আমার সন্ন্যাসীর আস্তানা ভো ভো হইয়া গেল। রসিক মণ্ডলের মত আমার কেন বুদ্ধি যোগায় নাই, আমি কেন সেইরূপ ফন্দি করি নাই, আমি কেন একটা ছোট ছুঁড়ীকে বাহির করি নাই, সেই আপশোষে আমার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

এইরূপ দুঃখে আছি, এমন সময় একজন চেলা সন্ন্যাসীর হাত ধরিয়া আমার বাড়ীতে আনিয়া উপস্থিত করিল। সন্ন্যাসী বলিল যে, নিভৃতে তোমার সহিত কোন কথা আছে। আমি, সন্ন্যাসী ও তাঁহার চেলা এক ঘরে যাইলাম। সন্ন্যাসী বলিল যে, ট্যাক্স বন্ধ হইয়া গিয়াছে, সে জন্য নিশ্চয় তোমার মনে সন্দ হইয়াছে, কিন্তু দুঃখ করিও না, অন্য উপায়ে তোমাকে আমি বিপুল ধনের অধিকারী করিব। একটি টাকা দাও দেখি!

সন্ন্যাসীর হাতে আমি একটি টাকা দিলাম। সেই টাকাটিকে তৎক্ষণাৎ দ্বিগুণ করিয়া দুইটি টাকা আমার হাতে দিল। তাহার পর সন্ন্যাসীর আদেশে ভিতর হইতে একটি মোহর আনিয়া দিলাম, তাহাও ডবল করিয়া দুইটি মোহর সন্ন্যাসী আমার হাতে দিল। শেষে একখানি দশ টাকার নোটও ডবল করিয়া আমার হাতে দিল।

তাহার পর সন্ন্যাসী আমাকে বলিল,–এ কাজ অধিক পরিমাণে করিতে গেলে পূজাপাঠের আবশ্যক। তোমার ঘরে যত টাকা, মোহর, নোট, সোনা-রূপা আছে, পূজা-পাঠ করিয়া সমুদয় আমি ডবল করিয়া দিব।

আমি উত্তর করিলাম,–সন্ন্যাসীঠাকুর! আমি নিতান্ত বোকা নই। এরূপ বুজরুকির কথা আমি অনেক শুনিয়াছি। গৃহস্থের বাড়ী গিয়া দুই-একটি টাকা অথবা নোট ডবল করিয়া তোমরা গৃহস্বামীর বিশ্বাস উৎপাদন কর। তোমাদের কুহকে পড়িয়া গৃহস্বামী ঘরের সমুদয় টাকা-কড়ি গহনা-পত্ৰ আনিয়া দেয়। হাড়ী অথবা বাক্সের ভিতর সেগুলি বন্ধ করিয়া তোমরা পূজা কর। পূজা সমাপ্ত করিয়া সাত দিন কি আট দিন পরে গৃহস্বামীকে খুলিয়া দেখিতে বল। সেই অবসরে তোমরা চম্পট দাও। সাত আট দিন পরে গৃহস্বামী খুলিয়া দেখে যে হাড়ী ঢন ঢ। বাজিকরের ও-চালাকি আমার কাছে খাটিবে না।

সন্ন্যাসী বলিল,–পূজা-পাঠ করিয়া আমি চলিয়া যাইব না। তোমার ঘরে তুমি আমাকে বন্ধ করিয়া রাখিও। আর দেখ আমি অন্ধ। কাহারও সহায়তা ভিন্ন দুই পা চলিতে পারি না। পলাইব কি করিয়া? পূজার দিন কোন শিষ্যকে আমি এ স্থানে আসিতে দিক না। সাত দিন পরে তোমাকে টাকাকড়ি খুলিয়া দেখিতে বলিব না; পূজা সমাপ্ত হইলেই তৎক্ষণাৎ তুমি খুলিয়া দেখিবে যে, সমুদয় সম্পত্তি দ্বিগুণ হইয়া গিয়াছে।

সন্ন্যাসীর এরূপ প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম। সন্ন্যাসী শুভদিন ও শুভলগ্ন স্থির করিল। পূজা ও হোমের উপকরণের ফর্দ দিল। সে সমুদয় আমি সংগ্রহ করিলাম। বাড়ীর দোতলায় নিভৃত একটি ঘরে পূজার আয়োজন করিলাম। ঘরে টাকা, মোহর নোট যত ছিল ও বিবাহের নিমিত্ত যে গহনা গড়াইয়াছিলাম, সে সমুদয় বৃহৎ একটি বাক্সের মধ্যে বন্ধ করিয়া পূজার স্থানে লইয়া যাইলাম।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–চিত্রগুপ্তের গলায় দড়ি-মোটা দড়ি নয়

নির্ধারিত দিন সন্ধ্যার সময় কেবল সন্ন্যাসী ও আমি সেই ঘরে গিয়া উপবেশন করিলাম। সন্ন্যাসী পাছে কোনরূপে পলায়ন করে, সেজন্য ঘরের দ্বারে চাকরকে কুলুপ দিয়া বন্ধ করিতে বলািম এবং একটু দূরে তাঁহাকে সতর্কভাবে পাহারা দিতে আদেশ করিলাম। সন্ন্যাসী ঘট স্থাপন করিল। দধি, পিঠালি ও সিঁদুর দিয়া ঘটে কি সব অঙ্কন করিল। তার পর ফট বষট্‌ শ্রীং ঐং এইরূপ কত কিমন্ত্র উচ্চারণ করিল। অবশেষে হোম করিতে আরম্ভ করিল। কিছুক্ষণ পরে স্বাহা স্বাহা বলিয়া আগুনে ঘৃত দিয়া সন্ন্যাসী আপনার থলি হাতড়াইয়া একটি টিনের কৌটা বাহির করিল। সেই কৌটাতে এক প্রকার সবুজ রঙের গুড়া ছিল। হরিৎ বর্ণের সেই চূর্ণ সন্ন্যাসী আগুনে ফেলিয়া দিল।

ঘর সবুজ বর্ণের ধূমে পরিপূর্ণ হইল। আমার নিদ্রার আবেশ হইল। আমি ভাবিলাম যে, এইবার সন্ন্যাসী বেটা একটা কাণ্ড করিবে, আমাকে অজ্ঞান করিয়া আমার টাকাকড়ি লইয়া কোনরূপে পলায়ন করিবে। উঠিয়া, দ্বারে ধাক্কা মাবিয়া আমার চাকরকে ডাকিব এইরূপ মানস করিলাম। আমি উঠিতে পারিলাম না। আমার হাত-পা অবশ অষাড় হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আমার জ্ঞান ছিল। হঠাৎ আমার মাথা হইতে আমি বাহির হইয়া পড়িলাম। আমার শরীরটি তৎক্ষণাৎ মাটীর উপর শুইয়া পড়িল। শরীর হইতে আমি বাহির হইয়াছি, তাঁহার দিকে তখন চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে সে আমি অতি ক্ষুদ্র, ঠিক বুড়ো আঙ্গুলের মত, আর সে শরীর বায়ু দিয়া গঠিত। সেই ক্ষুদ্ৰশরীরে আমি উপর দিকে উঠিতে লাগিলাম। সূক্ষ্ম বা লিঙ্গশরীরের কথা পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম। মনে করিলাম যে, ঔষধের ধূমে সন্ন্যাসী আমাকে হত্যা করিয়াছে, মৃত্যুর পর লোকের যে লিঙ্গশরীর থাকে, তাহাই এখন যমের বাড়ী যাইতেছে।

ছাদ ফুঁড়িয়া আমি উপরে উঠিয়া পড়িলাম! সোঁ সোঁ করিয়া আকাশপথে চলিলাম। দূর-দূর-দূর—কতদূর উপরে উঠিয়া পড়িলাম, তাহা বলিতে পারি না। মেঘ পার হইয়া যাইলাম, চন্দ্রলোক পার হইয়া যাইলাম, সূৰ্য্যালোকে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে স্থানে আশ্চর্য ঘটনা দর্শন করিলাম। দেখিলাম যে, আকাশ-বুড়ী এক কদমগাছতলায় বসিয়া, আঁশবটি দিয়া সূর্যটিকে কুটি কুটি করিয়া কাটিতেছে, আর ছোট ছোট সেই সূখণ্ডগুলি আকাশ-পটে জুড়িয়া দিতেছে। তখন আমি ভাবিলাম,—ওঃ! নক্ষত্র এই প্রকার হয় বটে! তবে এই যে নক্ষত্র সব, ইহারা সূর্যখণ্ড ব্যতীত আর কিছুই নহে! যে খণ্ডগুলি বুড়ী আকাশপটে ভাল করিয়া জুড়িয়া দিতে পারে না, আলগা হইয়া সেইগুলি খসিয়া পড়ে। তখন লোকে বলে,–নক্ষত্র পাত হইল। কিছুক্ষণ পরে আমার ভয় হইল যে,সূর্যটি তো গেল, পৃথিবীতে পুনরায় দিন হইবে কি করিয়া? আকাশ-বুড়ী আমার মনের ভাব বুঝিয়া হাসিয়া বলিল,–ভোরে ভোরে উঠিয়া আকাশ ঝাড়ু দিয়া সমুদয় নক্ষত্রগুলি আমি একত্র করিব। সেইগুলি জুড়িয়া পুনরায় আস্ত সূর্য করিয়া প্রাতঃকালে উদয় হইতে পাঠাইব। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আঁশবটি দিয়া সূর্য কাটিয়া নক্ষত্র করি, সকালবেলা আবার জুড়িয়া আস্ত সূর্য প্রস্তুত করি। আমার এই কাজ।

আকাশ-বুড়ীর নিকট হইতে বিদায় হইয়া, আমি ভাবিলাম যে, নভোমণ্ডলের সমুদয় ব্যাপারটা ভাল করিয়া দেখিতে হইবে। এইরূপ ভাবিয়া পুনরায় আমি শূন্যপথে সোঁ সোঁ করিয়া ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। কিন্তু সর্ব্বনাশ! কিছুদূর গিয়া দেখি যে, দুইটা বিকটাকার যমদূত আমার আর একটা সূক্ষ্ম শরীরকে লইয়া যাইতেছে। আমার বড় ভয় হইল। সে স্থানে মেঘ নাই যে, তাঁহার ভিতর লুকাইব। পলাইবার সময় পাইলাম না। খপ করিয়া তাঁহারা আমাকে ধরিয়া ফেলিল। একজন জিজ্ঞাসা করিল,—তুই বেটা কে রে? সত্য যুগের রাজা হরিশ্চন্দ্র ভিন্ন বেওয়ারিশ হইয়া আর কাহারও এখানে বেড়াইবার হুকুম নাই। নিশ্চয় তুমি বেটা কুম্ভিপাক অথবা রৌরব নরকের ফেরারি আসামী। এই বলিয়া তাঁহারা আমাকে বাঁধিয়া ফেলিল ও ধাক্কা মারিতে মারিতে লইয়া চলিল।

ক্রমে আমরা যমপুরীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যম দরবার করিয়া সিংহাসনে বসিয়া আছেন। পাশে স্থূপাকার খাতাপত্রের সহিত চিত্রগুপ্ত, সম্মুখে ডাঙ্গস হাতে ভীষণমূর্তি যমদূতের পাল। আমাদের দুইজনকে যমদূতেরা সেই রাজসভায় হাজির করিল। প্রথমে অপর লোকটির বিচার আরম্ভ হইল।

চিত্রগুপ্ত তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,–তোমার নাম?

সে উত্তর করিল,—আমার নাম বৃন্দাবন গুঁই।

তাহার পর কোথায়, কি জাতি প্রভৃতি জিজ্ঞাসা করিয়া খাতাপত্র দেখিয়া যমকে চিত্রগুপ্ত বলিলেন,–মহাশয়! এ লোকটি অতি ধার্মিক, অতি পুণ্যবান। পৃথিবীতে বসিয়া এ বার মাসে তের পার্বন করিত, দীন-দুঃখীর প্রতি সর্ব্বদা দয়া করিত, সত্য ও পরোপকার ইহার ব্রত ছিল।

এই কথা শুনিয়া যম চটিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন,–চিত্রগুপ্ত! তোমাকে আমি বারবার বলিয়াছি যে, পৃথিবীতে গিয়া মানুষ কি কাজ করিয়াছে, কি কাজ না করিয়াছে, তাঁহার আমি বিচার করি না। মানুষ কি খাইয়াছে, কি না খাইয়াছে, তাঁহার আমি বিচার করি। ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা, স্ত্রী-হত্যা করিলে এখন মানুষের পাপ হয় না, অশাস্ত্রীয় খাদ্য খাইলে মানুষের পাপ হয়। তবে শিবোক্ত তন্ত্রশাস্ত্র মতে সংশোধন করিয়া খাইলে পাপ হয় না। তন্ত্রশাস্ত্রে শিব বলিয়াছেন,–

গো-মেষাশ্ব-মহিষন-গোখাজোষ্ট্র-মৃগোম্ভবম্‌।
মহামাংসাষ্টকং প্রোক্তং দেবতাপ্রীতিকার।।

গোমাংস, মেষমাংস, অশ্বমাংস, মহিষমাংস, গাধামাংস, ছাগমাংস, উষ্ট্রমাংস ও মৃগমাংস—এই অষ্টবিধ মাংসকে মহামাংস বলে। এই সকল মাংসই দেবতাদিগের তৃপ্তিদায়ক। ওঁ প্রতদ্বিষ্ণুস্তবতে অথবা ও ব্রহ্মর্পণমস্তু এই মন্ত্রে সংশোধন করিয়া লইলে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণও এই সমুদয় মাংস ভক্ষণ করিতে পারে। মৃগমাংসের ভিতর শূকরের মাংসও ধরিয়াও লইতে হইবে। তন্ত্রশাস্ত্রে যাহাকে কলামাংস বলে, শিব তাহা খাইতেও অনুমতি দিয়াছেন আর দেখ, চিত্রগুপ্ত! তুমি এ কেরাণীগিরি ছাড়িয়া দাও। পৃথিবীতে তোমার বংশধর কায়স্থগণ কি করিতেছে, একবার চাহিয়া দেখ। উড়ে গয়লার মত এক এক গাছা সূতা অনেকে গলায় পরিতেছে। ব্রাহ্মণকে তাঁহারা আর প্রণাম করে না। ইংরাজী পড়িয়া তাহাদের মেজাজ আগুন হইয়া গিয়াছে। তাই বলি হে, চিত্রগুপ্ত! তুমিও ইংরাজী পড়। ইংরাজী পড়িয়া তোমার হেডটি গরম কর। হেডটি গরম করিয়া তুমিও গলায় দড়ি দাও। মোটা দড়ি নয়। বুঝিয়াছ তো? গলায় দড়ি দিয়া চিত্ৰবৰ্মা নাম গ্রহণ কর।

এই কথা বলিয়া যম নিজে সেই লোকটিকে জেরা করিতে লাগিলেন,—কেমন হে বাপু! কখনও বিলাতি বিস্কুট খাইয়াছিলে?

সে উত্তর করিল,আজ্ঞে না।

যম জিজ্ঞাসা করিলেন,—বিলাতি পানি? যাহা খুলিতে ফট করিয়া শব্দ হয়? যাহার জল বিজবিজ করে?

সে উত্তর করিল,–আজ্ঞে না।

যম পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,–সত্য করিয়া বল, কোনরূপ অশাস্ত্রীয় খাদ্য ভক্ষণ করিয়াছিলে কি না?

সে ভাবিয়া-চিন্তিয়া উত্তর করিল,–আজ্ঞা একবার ভ্রমক্রমে একাদশীর দিন পুঁইশাক খাইয়া ফেলিয়াছিলাম।

যমের সর্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন,—সর্ব্বনাশ! করিয়াছ কি! একাদশীর দিন পুঁইশাক! ওরে এই মুহূর্তে ইহাকে রৌরব নরকে নিক্ষেপ কর। ইহার পূর্ব্বপুরুষ, যাহারা স্বর্গে আছে, তাহাদিগেকেও সে নরকে নিক্ষেপ কর। পরে ইহার বংশধরগণের চৌদ্দ পুরুষ পর্যন্তও সেই নরকে যাইবে। চিত্রগুপ্ত! আমার এই আদেশ তোমার খাতায় লিখিয়া রাখ।

যমের এই বিচার দেখিয়া আমি তো অবাক। এইবার আমার বিচার। কিন্তু আমার বিচার আরম্ভ হইতে না হইতে আমি উচ্চৈঃস্বরে বলিলাম,–মহারাজ! আমি কখন একাদশীর দিন পুইশাক ভক্ষণ করি নাই।

আমার কথায় যম চমৎকৃত হইলেন। হর্ষোৎফুল্ল লোচনে তিনি বলিলেন,—সাধু সাধু! এই লোকটি একাদশীর দিন পুইশাক খায় নাই। সাধু সাধু! এই মহাত্মার শুভাগমনে আমার যমালয় পবিত্র হইল। যমনীকে শীঘ্র শঙ্খ বাজাইতে বল। যমকন্যাদিগকে পুষ্পবৃষ্টি করিতে বল। বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া আন-ভুঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যলোক পারে ধ্রুবলোকের উপরে এই মহাত্মার জন্য মন্দাকিনী কলকলিত, পারিজাত-পরিশোভিত কোকিল কুহরিত, অপ্পারাপদ-নূপুর-ঝুনঝুনিত হীরা-মাণিক খচিত নূতন একটি স্বর্গ নির্মাণ করিতে বল।

চিত্রগুপ্তের—ও থুড়ি! চিত্রকর্মার হিংসা হইল। তিনি বলিলেন,–মহাশয়! পৃথিবীতে লোকটির এখনও আয়ু শেষ হয় নাই স্থূল দেহের রক্তমাংসের আঁসটে গন্ধ এখনও ইহার সূক্ষ্ম শরীরে রহিয়াছে।

এই কথা শুনিয়া যম চটিয়া আগুন হইলেন। আমার আদর লোপ হইল। তিনি বলিলেন,—কি! সাদা সাদা গোল গোল হাঁসের ডিমের গন্ধ গায়ে। মার ইহার মাথায় দশ ঘা ডাঙ্গস মার্‌।

যম বলিবামাত্র তাঁহার একজন দূত আমার মাথায় এক ঘা ডাঙ্গস মারিল। বলিব কি হে, মাথায় আমার যেন ঠিক বজ্রাঘাত হইল। যাতনায় ত্রাহি মধুসূদন বলিয়া আমি চীৎকার করিতে লাগিলাম। সেই এক ঘা ডাঙ্গসে যমপুরী হইতে আকাশপথে অনেক নিয়ে আসিয়া পড়িলাম। দমাস করিয়া আর এক ডাঙ্গসের ঘা! শূন্যপথে আরও নীচে আসিয়া পড়িলাম। আর এক ঘা! আরও নিম্নে আসিয়া পড়িলাম। এইরূপ দশম আঘাতে পৃথিবীতে আসিয়া আমার বাড়ীর ছাদ ফুঁড়িয়া আমার সূক্ষ্ম শরীর পুনরায় সেই পূজার ঘরে আসিয়া পড়িল।

নিজের বাড়ীতে সেই পূজার ঘরে আসিয়া ক্ষুদ্র মাথায় ক্ষুদ্র হাত বুলাইতে লাগিলাম। প্রহারের চোটে চক্ষুতে সরিষা-ফুল দেখিতেছিলাম। অনেকক্ষণ কিছুই দেখিতে পাইলাম না। অনেকক্ষণ পরে চাহিয়া দেখি যে, আমি বসিয়া আছি। অর্থাৎ আমার সেই বড় শরীর আসনে বসিয়া আছে, আর সন্ন্যাসীব শরীর মাটীতে পড়িয়া আছে। কি হইয়াছে, তখন বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলাম, যে সবুজ গুঁড়ার ধূম দিয়া আমার শরীর হইতে প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, আর সকল কোষ বাহির করিয়া, সন্ন্যাসী আপনার সূক্ষ্ম শরীর দ্বারা আমার স্কুল অম্নময় কোষ অধিকার করিয়াছে। আমার শরীর বটে, কিন্তু ঐ যে আসনে বসিয়া আছে, ও আমি নই, ও সন্ন্যাসী সূক্ষ্ম শরীরে মুখ দিয়া আমি সন্ন্যাসীর সহিত কথোপকথন করিতে পারিলাম না। সেজন্য নিরুপায় হইয়া আমি সন্ন্যাসীর দেহে প্রবেশ করিলাম।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের তপস্যা

সন্ন্যাসীর দেহে প্রবিষ্ট হইয়া আমি উঠিয়া বসিলাম। তাহার পর ক্রোধে আমি সন্ন্যাসীকে বলিলাম,ভণ্ড! আমার শরীর ছাড়িয়া নিজের শরীরে পুনরায় প্রবেশ কর।

সন্ন্যাসী উত্তর করিল,—এ পৃথিবীতে অন্ধ হইয়া দুঃখে কালযাপন করিতেছিলাম। ভোগবাসনা এখনও আমার পরিতৃপ্ত হয় নাই। মানস করিয়াছিলাম যে কোন যুবা ধনবান লোকের শরীরে আশ্রয় করিব। সেরূপ লোকের যোগাড় করিতে পারি নাই। কাজেই তোমার জীর্ণ শরীরে প্রবেশ করিতে বাধ্য হইয়াছি। তোমার এই শরীর দ্বারা এখন সুখাদ্য ভক্ষণ করিব, নানারূপ আমোদ-প্রমোদ করিব। তোমার বিবাহসম্বন্ধ হইয়াছে। তোমার শরীরে আমি বিবাহ করিব, তোমার গৃহিণীকে লইয়া ঘরকন্না করিব। মিছামিছি তুমি গোল করিও না। লোকের নিজের যেরূপ অভ্যাস হয় অর্থাৎ শরীরকে আত্মা বলিয়া মনে হয়, অন্য লোকেরও সেইরূপ হয়। তোমার শরীর দেখিয়া সকলে বলিবে যে, এই সন্ন্যাসী। কেহই বিশ্বাস করিবে না যে, আমার আত্মা তোমার শরীরে প্রবেশ করিয়াছে। শঙ্করাচার্য্য ও হস্তামলকের গল্প শুনিয়া থাকিবে। আজ তাই হইয়াছে। বেশীরভাগ কেবল একটু হেরফের।–ক্রোধে অধীর হইয়া হাতড়াইতে হাতড়াইতে আমি সন্ন্যাসীর গলা টিপিয়া ধরিলাম। কিন্তু তখন আমি পাঁচ শত তিপ্পান্ন বৎসরের পুরাতন সন্ন্যাসীর শরীরে ছিলাম। তাঁহার উপর আবার দুই চক্ষু অন্ধ। সন্ন্যাসীর আমি কিছুই করিতে পারিলাম না। হাসিয়া সে দূরে আমাকে ফেলিয়া দিল।

আমার দেহধারী সন্ন্যাসী পুনরায় বলিল,–যদি গোলমাল কর, তাহা হইলে তোমার ঘোরতর অনিষ্ট হইবে। তোমার চাকরের দ্বারাই তোমাকে আমি এই বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিব। ঐ অন্ধ ও বৃদ্ধ শরীর লইয়া তখন তুমি কি করিয়া দিনযাপন করিবে? আমার শিষ্যদ্বয় এ ব্যাপার অবগত আছে, তাহাদিগকে ডাকিতে পাঠাইয়াছি। তাহাদের সহিত আস্তে আস্তে আমার আস্তানায় গমন কর। প্রাতঃকালে একঘণ্টা কাল তাঁহারা তোমাকে নীচের দিকে মুখ করিয়া ঝুলাইবে। সমস্ত দিন তুমি বায়ু ভক্ষণ করিয়া থাকিবে। ঘোর রাত্রিতে চুপি চুপি আহার করিবে। যতদিন তোমার ঐ বর্তমান শরীর জীবিত থাকে, ততদিন তোমাকে আমি খাইতে দিব।

আর উপায় কি? আমি নীরব হইয়া বসিয়া রহিলাম। সন্ন্যাসীর দুই জন চেলা আসিয়া আমার দুই হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। অন্ধ দুইটি চক্ষু দিয়া দরদর ধারায় অশ্রুপাত হইতে লাগিল। বিন্দু গোয়ালিনীর চালাঘরে আমাকে লইয়া গেল। সে রাত্রি মাটির উপর পড়িয়া কাঁদিয়া কাটাইলাম। পরদিন প্রত্যুষে চেলা দুইজন আমার দুই পায়ে দড়ি বাঁধিয়া আমগাছের ডালে ঝুলাইয়া দিল। এক ঘণ্টাকাল অধোমুখে আমি ঝুলিতে লাগিলাম। সে যে কি যাতনা, তাহা আর তোমাদিগকে কি বলিব। অন্ধ তা না হইলে চক্ষু দুইটি ঘোর রক্তবর্ণে রঞ্জিত হইত। সন্ন্যাসীর গায়ের বর্ণও কাল ছিল, তা না হইলে মুখ লাল হইয়া যাইত। ঘোর কষ্ট! ঘোর কষ্ট! কেন যে দম আটকাইয়া মরিয়া যাই নাই, তাহাই আশ্চর্য্য।

লম্বোদর প্রভৃতি একবাক্যে বলিয়া উঠিল,—ঈশ! তুমি ত সামান্য বিপদে পড় নাই।

ডমরুর বলিলেন,–হাঁ আমি ঘোর বিপদে পড়িয়াছিলাম। কেবল মা দুর্গার কৃপায় আমি সে বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছিলাম।

.ডমরুর বলিতে লাগিলেন,এক ঘণ্টা পরে তাঁহারা আমাকে গাছ হইতে নামাইয়া লইল। তাহার পর সমস্ত দিন তাঁহারা আমাকে জলটুকু পৰ্য্যন্ত খাইতে দিল না। তাঁহারা কিন্তু একে একে আমার বাড়ীতে গিয়া আহার করিয়া আসিল। আসিয়া বলিল যে–ডমরুবাবুর বাড়ীতে আজ খুব ঘটা। পাঁচ ছয়টা খাসি কাটা হইয়াছে। নানা দ্রব্য প্রস্তুত হইয়াছে। গ্রামশুদ্ধকে তিনি নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। তিনি আরও বলিয়াছেন যে, তাঁহার বিবাহ পৰ্য্যন্ত প্রতিদিন মহাসমারোহের সহিত সকলকে ভোজন করাইবেন।

লম্বোদর বলিলেন,—হাঁ! সেই সময় দিনকত তোমার বাড়ীতে খুব ধূম হইয়াছিল। প্রতিদিন ষোড়শ উপাচারে তোমার বাড়ীতে আমরা ভোজন করিয়াছিলাম। তখন তোমার সেই শরীরটিকে তুমি বলিয়াই আমরা মনে করিয়াছিলাম। সহসা তোমার মতিগতির কিরূপে পরিবর্তন হইল, তাহা ভাবিয়া সকলে আমরা আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম। তোমার কোরাম চাকর ও চেলা দুইজন বলিল যে, সন্ন্যাসী ঠাকুর তোমার সমুদয় সম্পত্তি ডবল করিয়া দিয়াছেন, সেই আহ্লাদে তুমি মুক্ত হস্ত হইয়াছ। কেহ কেহ বলিল যে, নূতন বিবাহের আমোদে আটখানা হইয়া তুমি এত টাকা খরচ করিতেছ। কিন্তু এখন বুঝিলাম যে, সে তুমি নও, তোমার শরীরে অধিষ্ঠিত সন্ন্যাসী।

ডমরুর বলিলেন,—আমি বৃথা টাকা খরচ করিব? আমি সে পাত্র নই। আমি সাজিয়া সন্ন্যাসী বেটা আমার সম্পত্তি নষ্ট করিতেছে, তাহা ভাবিয়া বুক আমার ফাটিয়া যাইতে লাগিল। ঘোর রাত্রিতে একজন চেলা আমার জন্য খাবার লইয়া আসিল। পোলাও, কালিয়া, কুর্মা, কোপ্তা, কাটলেট, সন্দেশ, রসগোল্লা, খাজা, গজা, বেদানা, আঙ্গুর, সেব প্রভৃতি সামগ্রী! ঈষৎ হাসিয়া চেলা বলিল,–আপনার প্রতি ডমরুবাবুর বড় ভক্তি! উঠুন, আহার করুন। কিন্তু ছাই আমি আর খাইব কি। আমার সর্ব্বনাশ করিয়া সেই সমুদয় সুখাদ্য প্রস্তুত হইয়াছে তাহাই ভাবিয়া আমার প্রাণ আকুল হইয়া পড়িল।

পরদিন প্রাতঃকালে পুনরায় আমাকে তাঁহারা গাছে ঝুলাইয়া দিল। তাহার পর সমস্ত দিন অনশনে রাখিয়া গভীর রাত্রিতে আমাকে খাবার দিল। প্রতিদিন এই ভাবে চলিতে লাগিল। ওদিকে আমার নিজ বাটীতে ধূমধামের সীমা-পরিসীমা নাই। প্রতিদিন যজ্ঞ। দিনের বেলা সাধারণ লোকের ভোজন, রাত্রিতে বন্ধু-বান্ধবের ফিষ্টি। শুনিলাম, ঐ ফিষ্টিতে সন্ন্যাসী বন্ধুবান্ধবের সহিত কিছু উচ্চ রকমের স্ফুর্তি করিতেছিল। সেরি শ্যাম্পেন প্রভৃতি বহুমূল্য মদ চলিতেছিল। কেবল আমার টাকার শ্রাদ্ধ!

ক্রমে শ্রাবণ মাস আসিল। আমার বিবাহের জন্য যে শুভদিন স্থির হইয়াছিল, সেই দিন নিকটবৰ্ত্তি হইল। যে শরীরে আমি অবস্থান করিতেছিলাম, তাহা অন্ধ বটে, কিন্তু কান তো অন্ধ ছিল না; কয়দিন আগে থাকিতে রোশন চৌকির ব্যঞ্জনা আমার কানে প্রবেশ করিতেছিল। তাহার পর বিবাহের পূর্ব্ব দিনে ইংরাজি বাজনা, দেশী বাজনা, ঢাক ঢোল সানাইয়ের রোলে ও লোকের কোলাহলে আমার কান ছেদা হইয়া গেল। শুনিলাম যে ডমরুবাবু মহাসমারোহের সহিত বিবাহ করিতে যাইবেন।

পাছে কোন যমদূতের সহিত সাক্ষাৎ হয়, পাছে বেওয়ারিস আমাসী বলিয়া আমাকে ধরিয়া লইয়া যায়, পাছে পুনরায় আমার মাথায় ডাঙ্গস মারে, সেই ভয়ে এতদিন সন্ন্যাসীর শরীর হইতে আমার সূক্ষ্ম শরীর বাহির করিতে চেষ্টা করি নাই। কিন্তু একে আমার টাকার শ্রাদ্ধ তাঁহার উপর সন্ন্যাসী আমার শরীরে আমার জন্য মনোনীত কন্যাকে গিয়া বিবাহ করিবে এই দুঃখে মনের ভিতর দাবানল জ্বলিতে লাগিল। সে চেলা দুইজন যখন গাছ হইতে আমাকে নামাইয়া চলিয়া গেল, তখন আমি আর থাকিতে পারিলাম। সন্ন্যাসীর শরীর হইতে বাহির হইবার নিমিত্ত বার বার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। অবশেষে কৃতকাৰ্য্য হইলাম, সন্ন্যাসীর শরীর অন্ধ, কিন্তু আমার লিঙ্গ শরীর অন্ধ নহে। অনেক দিন পরে পৃথিবীর বস্তুসমূহ দেখিয়া মনে আমার আনন্দ হইল। সন্ন্যাসীর দেহ বিন্দীর চালাঘরে ফেলিয়া সূক্ষ্ম শরীরে আমি আমার নিজের বাটীতে গমন করিলাম। সে স্থানের ঘোর ঘটা দেখিয়া আমার প্রাণ ফাটিয়া যাইতে লাগিল। বাড়ীটি সুসজ্জিত হইয়াছে, কোন স্থানে বাজনাওয়ালারা বসিয়া আছে, কোন স্থানে রোশনাইয়ের বন্দোবস্ত হইতেছে, বরযাত্রীদিগের নিমিত্ত কলিকাতা হইতে অনেকগুলি ফাষ্টোকেলাস গাড়ি আসিয়াছে। আমাদের গ্রাম হইতে কন্যার গ্রাম সাত ক্রোশ পথ ভাল নহে—মেটে রাস্তা কিন্তু শুনিলাম যে, অনেক টাকা খরচ করিয়া ডমরুবাবু সে রাস্তা মেরামত করিয়াছেন।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ছাল-হাড়ান বাঘ

এইরূপে চারিদিকে আমি দেখিয়া বেড়াইলাম। বলা বাহুল্য যে, আমাকে কেহ দেখিতে পাইল না সূক্ষ্ম শরীর অতি ক্ষুদ্র, হাওয়া দিয়া গঠিত সূক্ষ্ম শরীর কেহ দেখিতে পায় না। একে যমদূতের ভয়, তাঁহার উপর আবার এই সমুদয় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সে স্থানে আমি অধিকক্ষণ তিষ্ঠিতে পারিলাম না। আমি ভাবিলাম,–দূর কর! বনে গিয়া বসিয়া থাকি। সুন্দরবনে মনুষ্যের অধিক বাস নাই, যমদূতদিগের সেদিকে বড় যাতায়াত নাই, সেই সুন্দরবনে গিয়া বসিয়া থাকি।

বায়ুবেগে সুন্দরবনের দিকে চলিলাম। প্রথম আমি আমার আবাদে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে স্থানে আমার কোন কর্মচারীকে দেখিতে পাইলাম না। কেহ মাছ, কেহ ঘৃত, কেহ মধু, কেহ পাঠা লইয়া তাঁহারা আমার, বিবাহে নিমন্ত্রণে গিয়াছিল। সে স্থান হইতে আমি গভীর বনে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম যে, এক গাঙের ধারে একখানি নৌকা লাগিয়া আছে, উপরে পাঁচ ছয়জন কাঠুরিয়া কাঠ কাটিতেছে। তাহাদের সঙ্গে মুগুর হাতে একজন ফকীর আছে। মন্ত্র পড়িয়া ফকীর বাঘদিগের মুখ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। নির্ভয়ে কাঠুরিয়াগণ কাঠ কাটিতেছে। সেই স্থানে গিয়া আমি একটি শুষ্ক কাঠের উপর উপবেশন করিলাম বলা বাহুল্য যে, তাঁহারা আমাকে দেখিতে পাইল না।

এই স্থানে বসিয়া মনে বেদনায় আমি দিতে লাগিলাম। অশ্রুজলে আমার বক্ষস্থল ভাসিয়া গেল। না এদিক, না ওদিক, না মরা না বাঁচা, আমার অবস্থা ভাবিয়া আমি আকুল হইলাম। আজ আমি সাজিয়া সন্ন্যাসী আমার কন্যাকে বিবাহ করিবে, বাসরঘরে সন্ন্যাসী গান করিবে, তাহার পর ফুলশয্যা হইবে,—ওঃ! আমার প্রাণে সয় না। হায় হায়! আমার সব গেল। হঠাৎ এই সময় মা দুর্গাকে আমার স্মরণ হইল। প্রাণ ভরিয়া মাকে আমি ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম,–মা! তুমি জগতের মা! তোমার এই অভাগা পুত্রের প্রতি তুমি কৃপা কর। মহিষাসুরের হাত হইতে দেবতাদিগকে তুমি পরিত্রাণ করিয়াছিলে, সন্ন্যাসীর হাত হইতে তুমি আমাকে নিস্তার কর। মনসা লক্ষ্মীর কখন পূজা করি নাই, ঘেঁটু পূজাও করি নাই, কোন দেবতার পূজা করি নাই। কিন্তু এখন হইতে, মা প্রতি বৎসর তোমার পূজা করিব। অকালে তোমার পূজা করিয়া রামচন্দ্র বিপদ হইতে উদ্ধার হইয়াছিলেন। আমিও মা! সেইরূপ অকালে তোমার পূজা করিব। তুমি আমাকে বিপদ হইতে উদ্ধার কর। ব্রজের নন্দ ঘোষের স্বজাতি কলিকাতার হরিভক্ত গোয়ালা মহাপ্রভুরা কসাইকে যখন নব প্রসূত গোবৎস বিক্রয় করুন, কসাই যখন শিশু বৎসে গলায় দড়ি দিয়া হিচড়াইয়া লইয়া যায় তখন সেই দুধের বাছুরটি নিদারুণ কাতরকণ্ঠে যেরূপ মা মা বলিয়া ডাকিতে থাকে, সেইরূপ কাতর স্বরে আমিও মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম।

জগদম্বার মহিমা কে জানে! প্রাণ ভরিয়া তাঁহাকে ডাকিলে তিনি কৃপা করেন। জগদম্বা আমায় কৃপা করিলেন। বন হইতে হঠাৎ এক বাঘ আসিয়া কাঠুরিয়াদিগের মাঝখানে পড়িল।

সুন্দরবনের মানুষখেকো প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র! শরীরটি হরিদ্রাবণের ললামে আচ্ছাদিত, তাঁহার উপর কাল কাল ভোরা। এ তোমার চিতে বাঘ নয়, গুল বাঘ নয়, এ বাবা, টাইগার ইংরাজিতে যাহাকে রয়াল টাইগার বলে, এ সেই আসল রয়াল টাইগার।

এক চাপড়ে একজন কাঠুরিয়াকে বাঘ ভূতলশায়ী করিল, ফকীরের মন্ত্রে তাঁহার মুখ বন্ধ ছিল, মুখে করিয়া তাঁহাকে সে ধরিতে পারিল না। সেই স্থানে শুইয়া থাপা দিয়া মানুষটাকে পিঠে তুলিতে চেষ্টা করিল। না মোটা না সরু নিকটে একটা গাছ ছিল। বাঘেরী দীর্ণ লাঙ্গুলটি সেই গাছের পাশে পড়িয়াছিল। একজন কাঠুরিয়ার একবার উপস্থিত বুদ্ধি দেখ! বাঘের লাঙ্গুলটি লইয়া সে সেই গাছে এক পাক দিয়া দিল তাহার পর লেজের আগাটি সে টানিয়া ধরিল।

বাঘের ভয় হইল। বাঘ মনে করিল,—মানুষ ধরিয়া মানুষ খাইয়া বুড়া হইলাম, আমার লেজ লইয়া কখন কেহ টানাটানি করে নাই। আজ বাপধন! তোমাদের একি নূতন কাণ্ড! পলায়ন করিতে বাঘ চেষ্টা করিল। একবার, দুইবার, তিনবার বিষম বল প্রকাশ করিয়া বাঘ পালাইতে চেষ্টা করিল। কিন্তু গাছে লেজের পাক, বাঘ পলাইতে পারিল না। অসুরের মত বাঘ যেরূপ বল প্রকাশ করিতেছিল, তাহাতে আমার মনে হইল যে, বাঃ? লেজটি বা ছিঁড়িয়া যায়। কিন্তু দৈবের ঘটনা ঘটিল। প্রাণের দায়ে ঘোরতর বলে বাঘ শেষকালে যেমন এক হ্যাচকা টান মারিল, আর চামড়া হইতে তাঁহার আর শরীরটা বাহির হইয়া পড়িল। অস্থি মাংসের দগদগে গোটা শরীর, কিন্তু উপরে চর্ম নাই! পাকা আমের নীচের দিকটা সবলে টিপিয়া ধরিলে যেরূপ অডিটা হড়াৎ করিয়া বাহির হইয়া পড়ে, বাঘের ছাল হইতে শরীরটি সেইরূপ বাহির হইয়া পড়িল, কলিকাতার হিন্দু কই মহাশয়েরা জীবন্ত পাঠার ছাল ছাড়াইলে চমবিহীন পাঁঠার শরীর যেরূপ হয়, বাঘের শরীরও সেইরূপ হইল। মাংস বাঘ রুদ্ধশ্বসে বনে পলায়ন করিল। ফকীর ও কাঠুরিয়াগণ ঘোরতর বিস্মৃত হইয়া এক দৃষ্টে হাঁ করিয়া সেই দিকে চাহিয়া রহিল। বাঘের লাঙ্গুল লইয়া গাছে যে পাক দিয়াছিল, লেজ ফেলিয়া দিয়া সেও সেই দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। বাঘশূন্য ব্যাঘ্রচর্ম সেই স্থানে পড়িয়া রহিল। আমার কি মতি হইল, গরম গরম সেই বাঘ ছালের ভিতর আমি প্রবেশ করিলাম। ব্যাঘ্র চর্মের ভিতর আমার সূক্ষ্ম শরীর প্রবিষ্ট হইবামাত্র ছালটা সজীব হইল। গাঝাড়া দিয়া আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। গাছ হইতে লাঙ্গুলটি সরাইয়া লইলাম। পাছে ফের পা দেয়। তাহার পর দুই একবার আস্ফালন করিলাম। পূর্ব্বে তো অবাক হইয়াছিলাম, তাহা অপেক্ষা এখন দশগুণ অবাক হইয়া ফকীর ও কাঠুরিয়াগুণ দৌডিয়া নৌকায় গিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি নৌকা নদীর মাঝখানে লইয়া দ্রুতবেগে ভাটার স্রোতে তাঁহারা পলায়ন করিল।

এখন এই নূতন শরীরের প্রতি একবার আমি চাহিয়া দেখিলাম। এখন আমি সুন্দরবনের কেঁদো বাঘ হইয়াছি—সেই যারে বলে রয়াল টাইগার ভাবিলাম যে,—এ মন্দ নয়, এখন যাই, এই শরীরে বিবাহ-আসরে গিয়া উপস্থিত হই। এখন দেখি সন্ন্যাসী বেটা কেমন করিয়া আমার কন্যাকে বিবাহ করে। এইরূপ স্থির করিয়া আমি দৌড়িলাম। সাঁতার দিয়া অথবা লম্ফ দিয়া শত শত নদী-নালা পার হইলাম। যে গ্রামে কন্যার বাড়ী, সন্ধ্যার সময় তাঁহার এক ক্রোশ দূরে গিয়া পৌঁছিলাম। দূর হইতে আলো দেখিয়া ও বাজনা-বাদ্যের শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম যে, ঐ বর আসিতেছে। সেই দিকে দ্রুতবেগে ধাবিত হইলাম। আলুম করিয়া এক লাফ দিয়া প্রথম বাদ্যকরদিগের ভিতর পড়িলাম, কালো কালো বিলাতী সাহেবরা কোট-পেন্ট পিধে যাহারা বিলাতী বাজনা বাজাইতেছিল, তাঁহারা আমার সেই মেঘগর্জনের ন্যায় আলুম শব্দ শুনিয়া আর আমার সেই রুদ্রমূর্তি দেখিয়া আপন আপন যন্ত্র ফেলিয়া যে যেদিকে পারিল পলায়ন করিল। ঢাকী ঢুলীদের তো কথাই নাই। তাহাদের কেহ পলাইল, কেহ কেহ সেই স্থানে মূর্হিত হইয়া পড়িল। যাহারা আলো প্রভৃতি লইয়া চলিয়াছিল, তাঁহারাও পলায়ন করিল। তাহার পর পুনরায় আলম করিয়া আমি বরযাত্রদিগের গাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম। টপ টপ করিয়া তাঁহারা গাড়ী হইতে লাফাইয়া পড়িল ও যে যেদিকে পারিল পলায়ন করিল।।

লম্বোদর বলিলেন,—আমিও বরযাত্র গিয়াছিলাম। আমি একটি গাছে গিয়া উঠিয়াছিলাম।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–গাড়ী হইতে লাফাইয়া পড়িতে আমার পা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। শেষে কেলেহাড়ী মাথায় দিয়া সমস্ত রাত্রি একটা পুষ্করিণীতে গা ড়ুবাইয়া বসিয়া রহিলাম।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ – ডমরুধরের গলায় কফ

ডমরুর বলিলেন,–তাহার পর লম্ফ দিয়া একেবারে আমি বরের চারি ঘোড়ার গাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। ঘোর ত্রাসে সন্ন্যাসীর হৃৎকম্প হইল। আমার শরীর হইতে ফট করিয়া সে সূক্ষ্মশরীর বাহির করিল। আপনার সুক্ষ্মশরীর লইয়া কোথায় যে পলায়ন করিল, তাহা বলিতে পারি না। সেই দিন হইতে তাঁহাকে অথবা তাঁহার চেলা দুইজনকে আর কখনও দেখিতে পাই নাই।

আমি দেখিলাম যে, গাড়ীর উপর আমার দেহটি পড়িয়া রহিয়াছে। বাঘছাল হইতে বাহির হইয়া তৎক্ষণাৎ আমি নিজদেহে প্রবেশ করিলাম। গাড়ীর গদিতে বাঘ-ছালখানি পাতিয়া তাঁহার উপর আমি গেট হইয়া বসিলাম। নিজের শরীর পুনরায় পাইয়া আনন্দে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিলাম। কন্যার জন্য যে সমুদয় গহনা প্রস্তুত করিয়াছিলাম, সম্মুখে দেখিলাম যে সেই গহনার বাক্সটি রহিয়াছে। পরে শুনিলাম যে ঘটকীর পরামর্শে সন্ন্যাসী এই গহনার বাক্স সঙ্গে আনিয়াছিল।

এখন বিবাহ-বাড়ীতে যাইতে হইবে। কিন্তু নিকটে জনপ্রাণী ছিল না। একেলা বিবাহ বাড়ীতে যাইতে পারি না। গাড়ী হইতে নামিলাম। পথ হইতে একটি ঢোল লইয়া নিজেই ঢ্যাং ঢ্যাংকরিয়া বাজাইতে লাগিলাম। যে তিন চার জন ঢাকী ঢুলী বাঘ দেখিয়া মূচ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল, ক্রমে তাহাদের চেতনা হইল। পিট পিট করিয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া তাঁহারা উঠিয়া বসিল। অন্য বাদ্যকর কেহ আসিল না। পরে শুনিলাম যে, তাঁহারা প্রাণপণে দৌড়িয়া একেবারে কলিকাতা গিয়া তবে নিঃশ্বাস ফেলিয়াছিল। ভালই হইয়াছিল। তাহাদিগকে টাকা দিতে হয় নাই। বিবাহের পরদিন, কন্যা লইয়া যখন নিজ গ্রামে আমি প্রত্যাগমন করি, তখন তাহাদের যন্ত্রগুলি আমি কুড়াইয়া আনিয়াছিলাম। কিছুদিন পরে যখন তাঁহারা আসিল, তখন অনেক কষ্টে আমার নিকট হইতে যন্ত্রগুলি বাহির করিল। টাকা আর চাহিবে কোন লজ্জায়?

আমার কেনারাম চাকর ও দুই চারিজন বরযাত্ৰ ক্ৰমে আসিয়া জুটিল। প্রথম তাঁহারা মনে করিয়াছিল যে, নিকটে মানুষ আনিবার নিমিত্ত বাঘ স্বয়ং ঢোল বাজাইতেছে। যাহা হউক, সেই দুই চারিজন বরযাত্র ও দুই চারিজন বাদ্যকর লইয়া আমি বিবাহ-বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। অধিক কথায় প্রয়োজন কি? প্রথম তো কন্যা সম্প্রদান হইল। তাহার পর আমাকে সকলে ছাদনাতলায় লইয়া গেল। এক পাল স্ত্রীলোক আসিয়া আমাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তাড়কা রাক্ষসীর মত এক মাগী প্রথম আমার এক কান মলিয়া দিল, আর বলিল,–বিবাহ তৃতীয় পক্ষে, সে কেবল পিত্তি রক্ষে। পুনরায় আর এক কান মলিয়া বলিল,–বিবাহ তৃতীয় পক্ষে; সে কেবল পিত্তি রক্ষে। এইরূপে একবার এ কান একবার সে কান মলিতে লাগিল এবং ঐ কথা বলিতে লাগিল। মাগীর হাত কি কড়া। আমি মনে করিলাম যে, সাঁড়াশি দিয়া বুঝি আমার কান ছিঁড়িয়া লইতেছে। তার দেখাদেখি, নয়-দশ বৎসরের একটা ফচকে হুঁড়ি ডিঙ্গি দিয়া আমার কান টানিতে লাগিল আর ঐ কথা বলিতে লাগিল। আমার আর সহ্য হইল না। আমি বলিলাম,–নে নে! তোর আর কচকুমিতে কাজ নাই, আমি তোর পিতেমোর বয়সি।

কিন্তু এই সময়ে আবার এক বিপত্তি ঘটিল। বরণডালা হস্তে আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী বরণ করিতে আসিলেন। আমার মুখপানে একবার কটাক্ষ করিয়াই তিনি অজ্ঞান। বরণ ডালা ফেলিয়া, কন্যার হাত ধরিয়া, প্রাঙ্গণের এক পার্শ্বে গিয়া মাটির উপর শুইয়া পড়িলেন। সেই স্থানে শুইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিলেন। কান্নার সুরে তিনি বলিলেন,–ও গো, মা গো, ও পোড়া বাঁদরের হাতে তোরে কি করিয়া দিব গো! ও গো মা গো! ও বুড়ো ডোর হাতে কি করিয়া তোকে দিব গোয় ঘরে যে কালীঘাটের কালীর পট আছে, যা এক পয়সা দিয়া কিনিয়াছিলাম, তার মত তোর যে মুখখানি গো! তুই আমার কেলেসোনা গো! ইত্যাদি। কালীঘাটের পটের মত মুখ বটে! কন্যাকে বাড়ী আনিয়া যখন ভাল করিয়া প্রথম তাঁহার মুখ দেখিলাম, তখন আমার মনে হইল যে, ইনি মানুষ নহেন, কালীঘাটের মা কালীর বাচ্চা।

হুড়তে পুড়তে এই সময় ঘটকী আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। ঘটকী বলিল,–শীঘ্র গহনার বাক্স লইয়া এস।

কেনা চাকরের নিকট গহনার বাক্স আমি রাখিয়াছিলাম। গহনার বাক্স সে লইয়া আসিল। আমার নিকট হইতে চাবি লইয়া বাক্স খুলিয়া ঘটকী কন্যার গায়ে গহনা পরাইতে বসিল। বাম হাতে তাগা, জসম, তাবিজ, বাজু চুড়ি ও বালা পরাইল। কন্যার কালো গায়ে সোনা ঝম করিতে লাগিল। শাশুড়ী ঠাকুরাণী চক্ষুর জলের ভিতর দিয়া আড়ে আড়ে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার কান্নার সুর ক্রমে ঢিলে হইয়া আসিল, আমার রূপবর্ণনাও কিঞ্চিৎ শিথিল হইল। এখন তিনি বলিলেন,–ওগো মা গো! কালীঘাটের কালী ঠাকুরের মত তোর যে মুখখানি গো! এবার এ পর্যন্ত হইল।

যখন অপর হস্তে সমুদয় গহনা পরানো হইল, তখন তিনি বলিলেন,–ওগো মা গো! কালীঘাটের কালী ঠাকুরের মত! এইবার এই পর্যন্ত হইল।

যখন গলার গহনা পরানো হইল, তখন চক্ষু মুছিয়া একবার ভাল করিয়া দেখিলেন। তাহার পর কান্নার সুরে বলিলেন,–ওগো মা গো! কালীঘাটের। এবার এই পর্যন্ত।

এইরূপে ক্রমেই কান্নার সুর মৃদু ও ছন্দ পাপড়িভাঙ্গা হইয়া আসিল। অবশেষে কন্যার যখন সমুদয় ভূষণে ভূষিত হইল, তখন তিনি উঠিয়া বসিলেন, দুইবার চক্ষু মুছিয়া বলিলেন,–তা হউক! আমার এলোকেশী সুখে থাকিবে।

শুভদিনে শুভক্ষণে আমার বিবাহ হইয়া গেল। পরদিন কন্যা লইয়া আমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা বলিব কি—সেই তাড়কা রাক্ষসীর-বোলে সকলে যেন লুফিয়া লইল। সেই দিন হইতে সকলে আমার স্ত্রীর নাম রাখিল পিত্তি রকে। কেবল শ্রী কেন? আমি একটু বুঝিয়া সুঝিয়া খরচপত্র করি বলিয়া কেহ আমার নাম করে না। আড়ালে সকলে আমাকেও পিত্তিরগে বলে। আমার গৃহিণী ঘোষেদের গলায় মান করিতে যাইতেন। ছোঁড়ারা তাঁহাকে পিত্তি রকে বলে পোইত। সে জন্য এখন ভোরে ভোরে তিনি বসুদের গঙ্গায় স্নান করেন। কিন্তু যাই বল আর যাই কও, আমাদের কাটা গঙ্গার যেমন মাহাত্ম্য, তেমন আর কোন গঙ্গার নয়; হরিদ্বার, এয়াগ, বৃন্দাবনের গঙ্গা কোথায় লাগে!

সন্ন্যাসী আমার কত টাকা নষ্ট করিয়াছিল? সে কথায় এখন আর প্রয়োজন কি? কিন্তু চিরকাল আমি কপালে পুরুষ, আমার সৌভাগ্যক্রমে এই সময় স্বদেশী হিড়িকটি পড়িল। আমি এক কোম্পানী খুলিলাম। পূর্ব্বদেশের এক ছোকরাকে চারিদিকে বক্তৃতা করিতে পাঠাইলাম। তাঁহার বক্তৃতার ধমকে শত শত গরীব কেরাণী স্ত্রীর গহনা বেচিয়া শেয়ার কিনিল; শত শত দীন দরিদ্র লোকও ঘটি বাটি বেচিয়া আমার নিকট টাকা পাঠাইল। তারপর— এঃ—এঃ—এঃ—এঁঃগলায় কিরূপ কফ বসিয়াছে। লম্বোদর বলিলেন,–কফ কাশীতে আবশ্যক কি? স্পষ্ট বল না কেন যে, সমুদয় টাকাগুলি তুমি হাত করিয়াছ। তাহার পর, দেশশুদ্ধ লোক এখন মাথায় হাত দিয়া কাঁদিতেছে।

ডমরুর বলিলেন,—ভাগ্যবান্ পুরুষদিগের টাকা একদিক দিয়া যায়, অন্যদিক দিয়া আসে। যাহা হউক, মা দুগা আমাকে সেই সন্ন্যাসী সঙ্কট হইতে উদ্ধার করিয়া ছিলেন। সেই অবধি প্রতি বৎসর আমি মা দশভুজার পূজা করি।

পুরোহিত বলিলেন,

যদি বাপি বরো দেয়োস্মাকং মহেশ্বরি।
সংঘৃতা সংস্মৃতা ত্বং নো হিংসেথায় পরমাপদঃ।।

দেবগণ বলিলেন,–হে মহেশ্বরি! যদি আমাদিগকে বর দিবে, তবে ঘোর বিপদে পড়িয়া তোমাকে স্মরণ করিলে, তুমি আমাদিগকে রক্ষা করিও।–সমাপ্ত

মন্তব্য। পিত্তিরক্ষে বলিয়াছেন যে—পাঠকদিগের যদি আমার গল্পের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে আমার নিকট পাঠাইয়া দিবেন। সে বাঘছাল আমার ঘরে আছে। আমি তাহাদিগকে দেখাইব। তাহাদের সন্দেহ দূর হইবে।

দ্বিতীয় গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ – পূর্ব্ব কাহিনী

ডমরুধর বলিলেন,—পূজার সময় সন্ন্যাসী সঙ্কটের গল্পে আমার সম্বন্ধে আরও দুইটি বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছিলাম। কিন্তু আমার একটু পূর্ব্ব কাহিনী না বলিলে তোমরা সমুদয় বিষয় বুঝিতে পারিবে না। আজ যদি কৃত্তিবাস, কাশীদাস না থাকিতেন তাহা হইলে আমার বুদ্ধি, আমার বীরত্ব, আমার কীর্তির বিষয়ে তাঁহারা ছড়া বাঁধিতেন। ঘরে ঘরে, লোকে তাহা পাঠ করিয়া কৃতার্থ হইত। আর, যাত্রায় যাহারা দূতী সাজে, হাত নাড়িয়া নাড়িয়া তাঁহারা আমার বিষয়ে গান করিত। এক দিন রেলগাড়ীতে যাইবার সময় শুনিয়াছিলাম যে, কে এক জন মাইকেল ছিলেন। কে এক জন আবার তাঁহার জীবন-চরিত লিখিয়াছিলেন। এ বৎসর আমার বাগানে অনেক কাঁচকলা হইয়াছে। খরিদদার নাই, যিনি মাইকেলের জীবনচরিত লিখিয়াছেন তিনি যদি আমার বিষয়ে সেইরূপ একখানি পুস্তক লেখেন, তাহা হইলে তাঁহাকে আমি তের পণ কাঁচকলা দিতে সম্মত আছি।

আমার পিতা জমিদারী কাছারিতে মুহুরিগিরি করিতেন। যৎসামান্য যাহা বেতন পাইতেন, অতি কষ্টে তাহাতে আমাদের দিনপাত হইত। মাতা-পিতা থাকিতে আমার প্রথম নম্বরের বিবাহ হইয়াছিল। তাহাদের পরলোক গমনে কলিকাতায় হর ঘোষের কাপড়ের দোকানে কাজ করিতাম। মাহিনা পাঁচ টাকা আর খাওয়া। যে বাড়ীতে বাবুর বাসা ছিল, তাঁহার নীচের এক সেতালে ঘরে আমি থাকিতাম। বাবুর এক চাকরাণী ব্যতীত অন্য চাকর ছিল না। তাঁহার গৃহিণী স্বয়ং রন্ধন করিতেন। রান্না হইত—অন্ততঃ আমার ও ঝিয়ের জন্য-মুসুর দাল ও বেগুন বা আলু বা কুমড়া ভাজা। মুসুর দালে কেবল একটু হলুদের রং দেখিতে পাইতাম, দালের সম্পর্ক তাহাতে থাকিত কি না সন্দেহ। তাহার পর বলিহারি যাই গৃহিণীর হাত! কি করিয়া যে তিনি সেরূপ ঝিঝির পাতের ন্যায় বেগুন কাটিতেন, তাহাই আশ্চৰ্য্য! অত্রের চেয়ে বোধ হয় পাতলা। বাজারে যে চিংড়ি মাছ বিক্রয় হইত না যাহার বর্ণ লাল হইয়া যাইত, বেলা একটার সময় কালেভদ্রে সেই চিংড়ি মাছ আসিত। তাঁহার গন্ধে পাড়ার লোককে নাকে কাপড় দিতে হইত। সেই চিংড়ি মাছের ধড়গুলি বাবু ও তাঁহার গৃহিণী খাইতেন! মাথাগুলি আমাদের জন্য ঝাল দিয়া রান্না হইত। যে দিন চিংড়ি মাছ হইত, সেদিন আমাদের আহ্বাদের সীমা থাকিত না। সেই পচা চিংড়ি অমৃত জ্ঞান করিয়া আমরা খাইতাম। দুইবার ভাত চাহিয়া লইতাম। অধিক ভাত খরচ হইত বলিয়া চিংড়ি কিছুদিন পরে বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর একগাঁট তেঁতুল ট্যাকে কবিয়া আমি ভাত খাইতে বসিতাম। তাহা দিয়া কোনরূপে ভাত উদরস্থ করিতাম। যাহা হউক, এক স্থানে তাহা আমি শিক্ষা পাইয়াছিলাম, পরে তাহাতে আমার বিশেষ উপকার হইয়াছিল। আমি বুঝিয়াছিলাম যে টাকা উপার্জন করিলেই টাকা থাকে না; টাকা খরচ না করিলেই টাকা থাকে।

আমার বোধ হয় রাক্ষসগণ। আমার যখন পঁচিশ বৎসর বয়স, তখন আমার প্রথম গৃহিণীর কাল হইল। তাঁহার সন্তানাদি হয় নাই। তাহার পর দশ বৎসর পর্যন্ত আমার আর বিবাহ হইল না। আমার অবস্থা সেই; ললাকে বিবাহ দিবে কেন?

এই সময় পাশের বাড়ী আমাদের এক স্বজাতি ভাড়া লইলেন। তাঁহার নাম প্রহ্লাদ সেন। দোতালায় সপরিবারে তিনি বাস করিলেন। একজন আত্মীয়কে নীচের দুইটি ঘর ভাড়া দিলেন। তাঁহার নাম গোলক দে। প্রহাদ বাবু কোন বণিকের আফিসে কাজ করিতেন। অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না, তবে টাকাকড়ি কি গহণাপত্র কিছু ছিল না। গোলোক বাবু সরকারী অফিসে অল্প টাকা বেতনে কেরাণিগিরি করিতেন। তাঁহার পুত্র পশ্চিমে কোথায় কাজ করিতেন, কলিকাতায় তিনি ও তাঁহার গৃহিণী থাকিতেন।

প্রহ্লাদবাবুর গৃহিণী, তাঁহার মাতা, এক বিধবা ভগিনী, দুই শিশু-পুত্র ও এক কন্যা, তাহার পরিবার এই ছিল। এই সময়ে কন্যাটির বয়স দশ কি এগার ছিল। আমি তাঁহাকে যখন প্রথম দেখিলাম, তখন অকস্মাৎ আমার মনে উদয় হইল—কে যেন আমার কানে কানে বলিয়া দিল যে,—ওমরুধর। এই কন্যাটি তোমার দ্বিতীয় পক্ষ হইবে। তোমার জন্যই বিধাতা ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু কি করিয়া কন্যার পিতার নিকট কথা উত্থাপন করি? বয়স তখন আমার পঁয়ত্রিশ বৎসর, রূপ আমার এই অবস্থা আমার এই কথা উত্থাপন করিলে তিনি হয়ত হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন। কিন্তু বিধাতার ভবিতব্য কে খাইতে পারে। এই সময় এক ঘটনা ঘটিল, কন্যাটি নিদারুণ রোগে দ্বারা আক্রান্ত হইল। এই সূত্রে পাশের বাড়ীতে আমি যাওয়া-আসা করিতে লাগিলাম। আপনার কন্যা আজ কেমন আছে? দুইবেলা প্রহ্লাদবাবুকে সেই কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। ক্রমে তাহাদের জন্য কিছু কাজকর্মও করিতে লাগিলাম। প্রয়োজন হইলে ঔষধ আনিয়া দিতাম ও ডাক্তারের বাড়ী যাইতাম। নিজের পয়সা দিয়া বড়বাজার হইতে ছাড়ানো বেদানা আনিয়া দিতাম। ডাক্তারের সঙ্গে বাড়ীর ভিতর গিয়া দুই তিনবার কন্যাটিকেও দেখিলাম। কন্যাটির রূপ ছিল না, তথাপি তাঁহাকে দেখিয়া আমার মন আরও মোহিত হইয়া গেল। এইরূপ আত্মীয়তার গুণে প্রহ্লাদবাবুর সহিত আমার অনেকটা সৌহার্দ্য জন্মিল। শুনিলাম যে, কন্যাটির নাম মালতী। কেমন সুন্দর নাম দেখিয়াছ? নামটি শুনিলে কান জুড়ায়।

ভগবানের কৃপায় মালতী আরোগ্যলাভ করিল। আমাদের ঝিকে মাঝে মাঝে দুই একটি সন্দেশ, দুই একটি রসগোল্লা, দুই একখানি জিলেপি দিয়া বশ করিলাম, ক্রমে তাঁহার দ্বারা প্রহ্লাদবাবুর মাতা, স্ত্রী ও বিধবা ভগিনীর নিকট কথা উত্থাপন করিলাম। প্রহ্লাদবাবুর ভগিনী সংসারের কত্রী। যা বলিয়াছিলাম,—সে কথা তিনি হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তিনি বলিলেন,–কি। ঐ জলার ভূতটার সঙ্গে মালতীর বিবাহ দিব? পোড়া কপাল!

কিন্তু কন্যার বিবাহের নিমিত্ত প্রহ্লাদবাবু বিব্রত ছিলেন? তাঁহার টাকা ছিল না। কি করিয়া কন্যাদায় হইতে তিনি উদ্ধার হইবেন, সর্ব্বদাই তাহা ভাবিতেছিলেন। সুতরাং ঝি যে প্রস্তাব করিয়াছিল, সম্পূর্ণরূপে তিনি তাহা অগ্রাহ্য করিলেন না। তিনি বলিলেন,–পুরুষমানুষের পক্ষে পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়স কিছু অধিক নহে। তাহার পর রূপে কি করে, গুণ থাকিলেই হইল। মালতীৱ পীড়ার সময় সে আমাদের অনেক উপকার করিয়াছে। তাহাতে বোধ হয় যে, ডমরুধর মন্দ লোক নহে। কিন্তু কথা এই যে, সে সামান্য বেতনে কাপড়ের দোকানে কাজ করে। পরিবার প্রতিপালন সে কি করিয়া করিবে?

এ বিষয়ে পূর্ব্ব হইতেই আমি ঝিকে শিক্ষা দিয়াছিলাম। আমার অবস্থা সম্বন্ধে যখন কথা উঠিল, তখন ঝি বলিল যে, দেশে ডমরুবাবুর অনেক জমি আছে, তাহাতে অনেক ধান হয়। আম-কাঁঠাল-নারিকেলেরও অনেক বাগান আছে। বলা বাহুল্য যে, এ সব কথা সমুদয় মিথ্যা। এ সময়ে আমার কিছুই ছিল না। কন্যার মাতা, পিতা ও পিতামহী এক প্রকার সম্মত হইলেন। কিন্তু প্রহ্লাদবাবুর ভগিনী ক্রমাগত আপত্তি করিতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি বলিলেন যে, হবু জামাতার যদি এত সম্পত্তি আছে, তাহা হইলে তাঁহাকে অন্ততঃ পাঁচশত টাকার গহনা দিতে হইবে। এ কথা শুনিয়া আমি হতাশ হইয়া পড়িলাম। পাঁচশত টাকা দূরে থাকুক, তখন আমার পাঁচশত কড়া কড়ি ছিল না।

কিন্তু মালতী পয়মন্ত কন্যা। এই সময় সহসা আমার ভাগ্য খুলিয়া গেল। অভাবনীয় ঘটনাক্রমে অকস্মাৎ আমি দেড় হাজারের অধিক টাকা পাইলাম। আমার আনন্দের পরিসীমা রহিল না। কিন্তু মুখ ফুটিয়া আমি আনন্দ প্রকাশ করিতে পারিলাম না। আমার সৌভাগ্যের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে পারিলাম না। আমি আমার গ্রামে যাইলাম। তেরশত টাকা কোন স্থানে লুকায়িত রাখিলাম। দুইশত টাকা লইয়া ফিরিয়া আসিলাম।

কলিকাতায় আসিয়া প্রহ্লাদবাবুর কন্যাকে আমি পাঁচশত টাকার গহনা দিতে স্বীকৃত হইলাম। বিবাহের সমুদয় আয়োজন হইল। এ বিবাহে কোন বিড়ম্বনা ঘটে নাই। শুভদিনে আমার দ্বিতীয় বারের বিবাহ-কার্য সম্পন্ন হইয়া গেল। সেইদিন সন্ধ্যাবেলা কন্যার নিমিত্ত পাঁচশত টাকার গহনা আমি পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। এই পাঁচশত টাকার গহনা আমি একশত টাকায় ক্রয় করিয়াছিলাম।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–একশত মোহর

ইহার ছয় মাস পরম সুখে অতিবাহিত হইয়া গেল। পাশেই শ্বশুরবাড়ী। সে স্থানে সর্ব্বদাই আমার নিমন্ত্রণ হইত। আমার আদরের সীমা ছিল না। যখন আহার করিতে বসিতাম, তখন এটা খাই কি সেটা খাই, সর্ব্বদাই এই গোলে পড়িতাম। এত দ্রব্য তাঁহারা আমার সম্মুখে দিতেন।

কিন্তু চিরদিন সমান যায় না। একদিন বেলা নয়টার সময় আহার করিয়া দোকানে যাইবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় আমার শ্বশুরবাড়ীর নীচের তলায় ঠিক আমার ঘরের পাশের ঘরে একটা ভয়ানক কোলাহল পড়িয়া গেল। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, আমার শ্বশুরবাড়ীর নীচের তলায় গোলোকবাবু নামে আমাদের একজন স্বজাতি বাস করিতেন। এ বাড়ীতে আমার ঘর, সে বাড়ীতে তাঁহার ঘর, ঠিক গায়ে গায়ে ছিল। এ বাড়ীতে আমার ঘর যেরূপ স্যাৎসেঁতে কদর্য ছিল, গোলোকবাবুর সেইরূপ ছিল না। তাঁহার ঘরটি খটখটে শুষ্ক ফিটফাট ছিল। তিনি নিজে সরকারী অফিসে কাজ করিতেন, পশ্চিমে কোথায় তাঁহার পুত্র কাজ করিত। তাঁহার অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না। গোলোকবাবুর বয়স হইয়াছিল। কলিকাতায় কেবল তিনি নিজে ও তাঁহার বয়স্কা গৃহিণী থাকিতেন। গোলোকবাবুর ঘরেই এই কোলাহল হইয়াছিল।

গোল শুনিয়া আমি আমার শশুরবাড়ীতে দৌড়িয়া যাইলাম, মনে করিলাম, হয় তো কোন বিপদ ঘটিয়া থাকিবে। সে স্থানে গিয়া দেখিলাম যে, আমার শ্বশুরবাড়ীর সমুদয় লোক নীচে আসিয়াছেন। আমাকে দেখিয়া মালতী উপরে পলায়ন করিল। অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা ঘোমটা দিলেন। আমার শ্বশুরমহাশয়ের নিকট শুনিলাম যে, গোলোকবাবুর পুত্র মাঝে মাঝে পিতার নিকট টাকা পাঠাইতেন। পিতা টাকার মোহর গাঁথাইয়া তাঁহার ঘরের প্রাচীরের গায়ে যে আলমারি আছে, একটি বগুলি অর্থাৎ থলি করিয়া তাঁহার ভিতর রাখিয়া দিতেন। ক্রমে ক্রমে তিনি একশত মোহর গাঁথাইয়া আলমারির ভিতর রাখিয়াছিলেন। ঘরের প্রাচীরের গায়ে আলমারি, তাহাতে চারিটি তক্তার খোপ ছিল, সম্মুখে কাঠের কপাট ছিল, কপাট সর্ব্বদা চাবি-বন্ধ থাকিত। গোলেকবাবুর এই একশত মোহর চুরি গিয়াছিল। তাঁহার জন্যই এ গোলমাল। গোলোকবাবু মনের দুঃখে নীরবে বসিয়া আছেন, তাঁহার স্ত্রী কাঁদিতেছেন। কবে চুরি গিয়াছে, তাহা তিনি বলিতে পারেন না। তিনি বলিলেন যে, এক বৎসর পূর্ব্বে ঐ মোহরগুলি তিনি আলমারির ভিতর রাখিয়াছিলেন। তাহার পর আর তিনি নূতন মোহর ক্রয় করিতে পারেন নাই। তিনি বলিলেন যে, এ ঘরে কেবল তিনি ও তাঁহার স্ত্রী থাকেন, অন্য কেহ এ ঘরে প্রবেশ করে না। সে জন্য কাহাকেও তিনি সন্দেহ করিতে পারেন না। আমার শ্বশুরমহাশয় পুলিশে খবর দিবার প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু আমি তাহাতে আপত্তি করিলাম। আমি বলিলাম যে, কখন কবে চুরি গিয়াছে, তাঁহার কোন ঠিক নাই, কাহারও প্রতি গোলোকবাবুর সন্দেহ হয়, তখন মিছিমিছি পুলিশে আর সংবাদ দিয়া কি হইবে? পুলিশে আর সংবাদ দেওয়া হইল না।

সন্ধ্যার পর যখন আমি দোকান হইতে ফিরিয়া আসিলাম, তখন আমার শ্বশুর প্রহ্লাদবাবু আমাকে ডাকিয়া বলিলেন,—ডমরুধর। বড় বিপদের কথা। পাশের বাড়ীতে তুমি যে ঘরে বাস কর, আর এ বাড়ীতে গোলোকবাবু যে ঘরে বাস করেন, এই দুই ঘরের কেবল একটি প্রাচীর, দুই ঘরের কড়ি সেই এক দেওয়ালের উপর। গোলোকবাবুর ঘরে Sweet যে স্থানে সে আলমারি আছে, সে স্থানের দেওয়ালটি কাজেই অতিশয় পাতলা। আজ তিনি আলমারির ভিতর ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিতেছিলেন, যে স্থানে তিনি মোহর রাখিয়াছিলেন, তাঁহার হাত লাগিতেই সেই স্থানের দেওয়ালটি ভাঙ্গিয়া গেল। তখন তিনি দেখিলেন যে, সে স্থানে দেওয়ালে ইট ছিল না, কেবল একটু বালি থাম ছিল। সেই বালি ভাঙ্গিয়া প্রাচীরের ফুটা হইয়া গেল। দুই ঘরের এক দেওয়াল, সুতরাং সেই ছিদ্র তোমার ঘরেও হইল। তোমার উপর এখন বিলক্ষণ সন্দেহ হইয়াছে। যদি মোহরগুলি তুমি বাপু লইয়া থাক, তাহা হইলে আস্তে আস্তে ফিরাইয়া দাও। তাহা হইলে সকল কথা মিটিয়া যাইবে। তা না হইলে বড় গোলমাল হইবে।

এই কথা শুনিয়া আমি যেন আকাশ হইতে পড়িলাম,–সে কি মহাশয়! আমি ভদ্র সম্ভান, আমি চোর নই। তাহার পর আপনি আমার শ্বশুর। আমাকে ওরূপ কথা বলিবেন না।–তাহার পর গোলোকবাবু নিজে এবং তাঁহার গৃহিণী আমাকে অনেক মিনতি করিয়া বলিলেন,—বাপু! ভুলভ্রান্তিক্রমে যদি মোহরগুলি তোমার হাতে পড়িয়া থাকে, তামাসা করিয়া যদি রাখিয়া থাক, তাহা হইলে ফিরাইয়া দাও, তোমার পায়ে পড়ি, মোহরগুলি ফিরাইয়া দাও।

তাঁহাদের উপর আমি রাগিয়া উঠিলাম যে,–আমাকে আপনারা চোর বলেন। আপনারা ভাল মানুষ নহে। ইত্যাদি।

ক্রমে এ কথা আমার মনিব হর ঘোষের কানে উঠিল। মোহর ফিরিয়া দিতে তিনিও আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম,–মহাশয়! আজ কয়েক বৎসর আপনার দোকানে কাজ করিতেছি, আর কয় বৎসর আপনার বাটীতে বাস করিতেছি। এক পয়সা কখন কি আপনার লইয়াছি? আমার প্রতি সন্দেহ হয় এমন কাজ কখন কি আমি করিয়াছি?

দিনকয়েক বিলক্ষণ গোল চলিল, দেখ, লম্বোদর! মানুষ হাজার বুদ্ধিমান হউক, এরূপ কাজে একটা না একটা ভুল করে। আমিও তাহাই করিয়াছিলাম। এ অনেক দিনের কথা হইল, এখন আর প্রকাশ করিতে দোষ নাই। প্রকৃত ঘটনা এই হইয়াছিল,–মশার দৌরাত্মে রাত্রিতে আমার নিদ্রা হইত না। অনেক কষ্টে পাঁচসিকা দিয়া একটি মশারি কিনিয়াছিলাম। মশারিটি খাটাইবার নিমিত্ত দেওয়ালে একটি পেরেক মারিতেছিলাম। পেরেক মারিতে হঠাৎ দেওয়ালের কতকটা বালি ভাঙ্গিয়া পড়িল। সেই স্থানটিতে একটি ছিদ্র হইল। ছিদ্রের ভিতর আমি হাত দিলাম। হাতে কি এক ভারী দ্রব্য ঠেকিয়া গেল। বাহির করিয়া দেখিলাম যে, মোহরপূর্ণ এক বগলি। তৎক্ষণাৎ আমি আমার ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া দিলাম। তাহার পর পুনরায় গর্তের ভিতর হাত দিয়া দেখিলাম যে, তাঁহার অপর পার্শ্বে কাঠ। হাতে সেই কাঠ ঠেকিয়া গেল। তখন ইহার অর্থ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু তাহার পর প্রকাশ হইলে যে, আমার ঘরের ও গোলোকবাবুর ঘবের এক প্রাচীর, প্রাচীবের অপর পার্শ্বে গোলোকবাবুর ঘবে আলমারি, আমার হাতে আলমারির কপাট ঠেকিয়াছিল।

বলা বাহুল্য যে মোহরগুলি পাইযা আমাব যেন স্বর্গলাভ হইল। চুপি চুপি সেইগুলি গণিতে লাগিলাম। পাছে শব্দ হয়, সেজন্য একটি একটি করিয়া গণিলাম একশত মোহর। চিরকাল পরিশ্রম করিলেও কখন আমি এত টাকা উপার্জন করিতে পারিতাম না। দেখিলাম যে, এ সেকালের মোহর নহে, বিলাতি মোহর, যাহাকে লোকে গিনি বলে। পরদিন একটু বালি ও চুণ আনিয়া দেওয়ালের চিত্রটি বুজাইয়া দিলাম। তাহার পর বাজারে গিয়া মোহরগুলি বিক্রয় করিলাম। পনর শত টাকার অধিক হইল। দেশে গিয়া তেরশত টাকা কোন এক নিভৃত স্থানে পুঁতিয়া রাখিলাম। বিবাহেব নিমিত্ত বাকী টাকা কাছে রাখিয়া দিলাম। মোহর যে গিযাছে, ভাগ্যে গোলোকবাবু ছয় মাস পর্যন্ত দেখেন নাই। যে সময় মোহর হস্তগত হইয়াছিল, সে সময় যদি তিনি খোঁজ করিতেন, তাহা হইলে আমার আর বিবাহ হইত না।

বলিতেছিলাম যে, এই মোহর সম্বন্ধে আমি একটি ভুল করিয়াছিলাম। বড়বাজারে আমাদের কাপড়ের দোকানের পার্শ্বে এক পোদ্দারের দোকান ছিল। সেই দোকানে আমি মোহরগুলি বিক্রয় করিয়াছিলাম। একটু দূরে গিয়া যদি এ কাজ করিতাম, তাহা হইলে আর বিশেষ কোন গণ্ডগোল হইত না। পাশেই দোকান, সেজন্য পোদ্দারের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে আমার মনিব হর ঘোষ মহাশয় আমি যে মোহর বেচিয়াছিলাম, তাহা জানিতে পারিলেন। প্রহ্লাদবাবুকে তিনি বলিয়া দিলেন। সকলে জটলা করিয়া আমাকে মোহর বিক্রয়ের টাকা গোলোকবাবুকে দিতে বলিলেন। আমি বলিলাম যে,–মোহর আমার মায়ের ছিল। মৃত্যুকালে আমাকে দিয়া গিয়াছিলেন। বিবাহে ও অন্যান্য বিষয়ে মোহর বিক্রয়ের টাকা আমি খরচ করিয়া ফেলিয়াছি। সে টাকা এখন আমি কোথায় পাইব, আর যদি থাকিত, তাহা হইলে কেনই বা দিব?

অবশ্য আমার এ কথা তাঁহারা বিশ্বাস করিলেন না। যখন নিতান্ত আমার নিকট হইতে তাঁহারা টাকা আদায় করিতে পারিলেন না, তখন আমাকে পুলিশে দিবার নিমিত্ত তাঁহারা স্থির করিলেন। আমি মনে মনে ভাবিলাম,—তাহাতে ক্ষতি কি? এক বৎসর কি দুই বৎসর যদি আমার জেল হয়, তাহা হইলে মেয়াদ খাটিয়া পরে সেই টাকা লইয়া কোনরূপ ব্যবসা করিব। আর এখন যদি টাকাগুলি দিয়া দিই, তাহা হইলে আমার দশা কি হইবে? ভগবান আমাকে মোহরগুলি দিয়াছেন। সে টাকা ফিরিয়া দিলে আমার মহাপাতক হইবে।

কিন্তু আমাকে পুলিশে দেওয়া হইল না। আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী কাঁদিয়া কাটিয়া কুরুক্ষেত্র করিলেন। অবশেষে সকলে মিলিয়া আমার নিকট হইতে গোলকবাবুর পুত্রের নামে এক হাজার টাকার হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া লইলেন। আর আমি মালতীকে যে গহনাগুলি দিয়াছিলাম, প্রহ্লাদবাবু সেগুলি গোলকবাবুকে দিয়া দিলেন। তাঁহারা আরও অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে, আমার বিবাহের সময় যে জমি-জোরাত বাগান-বাগিচার কথা বলিয়াছিলাম, সে সমুদয় মিথ্যা।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–সুন্দরবনের অদ্ভুত জীব

আমার নিকট হইতে ইঁহারা যখন হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া লইলেন, তখন আমি মনে মনে ভাবিলাম,–যত পার হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া লও। উপুড় হস্ত কখন আমি করিব না। নালিশ করিবে? ডিক্রি করিবে? ডিক্রী ধুইয়া খাইও। কি বেচিয়া লইবে বাপু?

বস্তুতঃ এ হ্যাণ্ডনোটর একটি পয়সাও আমাকে দিতে হয় নাই। ইহার কিছুদিন পরে গোলোকবাবু কর্মত্যাগ করিয়া কাশী চলিয়া গেলেন। সে স্থানে তাঁহার ও তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যু হইল। টাকা সম্বন্ধে তাঁহার পুত্র আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন। তাঁহার উত্তর আমি দিই নাই, তাহা নহে। দুইটা দুড়ী! সে কথা পরে বলিব।

হর ঘোষ আমাকে দোকান হইতে ছাড়াইয়া দিলেন। সেজন্য আমি দুঃখিত হইলাম না। মনে জানি যে, আমার সেই তেরশত টাকা আছে। পূর্ব্বেই মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম যে, সেই টাকা দিয়া হয় জামিদারী কিনিব আর না হয় ব্যবসা করিব, কিন্তু যতদিন ঐ হ্যাণ্ডনোটের ভয় থাকিবে, ততদিন কিছু করিব না।

আমার শ্বশুরমহাশয় বলিলেন,–তোমাকে আর আমার বাড়ীতে আসিতে দিব না। আজ হইতে জানিলাম যে, আমার কন্যা বিধবা হইয়াছে। তোমার মুখ দেখিলেও পাপ হয়, আর জন্মে অনেক পাপ করিয়াছিলাম, সেজন্য তোমা হেন ইতরের হাতে আমি কন্যা দিয়াছি। তোমার ঘরে আমি কন্যা পাঠাইব না।

আমি ভাবিলাম যে,–বটে, এখন আমার পুঁজি হইয়াছে, কি করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিতে হয়, হর ঘোষের বাড়ীতে তাহা আমি শিখিয়াছি। যেমন করিয়া পারি আমি ধনবান হইব, টাকা হইলে কেহ জিজ্ঞাসা করে না যে, অমুক কি করিয়া সম্পক্তিশালী হইয়াছে। জাল করিয়া হউক, চুরি করিয়া হউক, যেমন করিয়া লোক বড় মানুষ হউক না কেন, অমুকের টাকা আছে, এই কথা শুনিলেই ইতর-ভদ্র সকলেই গিয়া তাঁহার পদলেহন করে, সকলেই তাঁহার পায়ে তৈল মর্দন করে, একবার আমার টাকা হউক, তখন দেখিব যে, তুমি বাছাধন আমার বাড়ীতে ফ্যান চাটিতে যাও কি না। অবশ্য এসব মনের চিন্তা প্রকাশ করিলাম না, কিন্তু যথাকালে আমার সে ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হইয়াছিল।

আমার শ্বশুরমহাশয়ের রাগের আর একটি কারণ ছিল, মালতীকে আমি যে পাঁচশত টাকার গহনা দিয়াছিলাম, তাহা একশত টাকায় ক্রয় করিয়াছিলাম।দুইখানি ব্যতীত সমুদয় অলঙ্কার কেমিক্যাল সোনার অর্থাৎ গিল্টির গহনা ছিল। সুতরাং গহনাগুলি পাইয়া গোলোবাবুর বিশেষ লাভ হয় নাই।

হর ঘোষের দোকান হইতে বাহির হইয়া কিছুদিন আমি সুন্দরবনের এক আবাদে চাকরী করিয়াছিলাম। সেই সময় আবাদ সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা জন্মিল। কিছুদিন পরে যখন হাশুনোটের ভয় যাইল, তখন নিজের জন্য আমি একটি আবাদ খুঁজিতে লাগিলাম। খুঁজিতে খুঁজিতে শুনিলাম যে, দূরে নিবিড় বনের নিকট এক আবাদ সুলভমূল্যে বিক্রয় হইবে। যাঁহার আবাদ, তাঁহার নিকট গিয়া সমুদয় তত্ত্ব আমি অবগত হইলাম। তিনি বলিলেন যে, এই আবাদ তিনি পাঁচ হাজার টাকায় ক্রয় করিয়াছিলেন। নোনাজল প্রবেশ নিবারণের নিমিত্ত ইহাতে তিনি ভেড়ী অর্থাৎ বাঁধ বাঁধিয়াছিলেন, পানীয় জলের নিমিত্ত পুষ্করিণী খনন করিয়াছিলেন, দুই চারি ঘর প্রজাও বসাইয়াছিলেন, কিন্তু সহসা তাঁহার বাঁধ কয়েক স্থানে ভাঙ্গিয়া গেল, আবাদের ভিতর নোজল প্রবেশ করিল, প্রজাগণ পলায়ন করিল, সে আবাদ পুনরায় বনে আবৃত হইয়া পড়িল। পুনরায় উঠিত করিবার টাকা তাঁহার নাই। সেজন্য তিনি আবাদ বিক্রয় করিয়া ফেলিবেন। এই সম্পত্তি তিনি পাঁচ হাজার টাকায় ক্রয় করিয়াছিলেন। এক্ষণে এক হাজার টাকা পাইলে ছাড়িয়া দিবেন। আমি একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া সে স্থান দেখিতে যাইলাম। কিন্তু বাঘের ভয়ে নৌকা হইতে নীচে নামিলাম না। এ অঞ্চলে তখন অধিক আবাদ হয় নাই, চারিদিক আবৃত ছিল, সেজন্য বিলক্ষণ বাঘের ভয় ছিল। নৌকার উপর হইতে স্থানটি দেখিয়া আমার মনোনীত হইল। মনে ভাবিলাম যে একটু বিপদের আশঙ্কা না থাকিলে এরূপ সম্পত্তি হাজার টাকায় পাওয়া যায় না। মোহর প্রদান করিয়া ভগবান আমার প্রতি কৃপা করিয়াছেন। আমার পড়তা খুলিয়া গিয়াছে। একটু যত্ন করিলেই এই আবাদে পরে সোনা ফলিবে। আরও ভাবিলাম যে, আমার কাছে পূর্ব্ব হইতেই তেরশত টাকা ছিল। তাহার পর আবাদে কাজ করিয়া আরও পাঁচশত টাকা সঞ্চয় করিয়াছি। এক হাজার টাকা দিয়া সম্পত্তি ক্রয় করিলে আমার কাছে আটশত টাকা থাকিবে। ভেড়ি বাঁধিতে, বন কাটিতে, প্রজা বসাইতে এই আটশত টাকা খরচ করিব। তাহার পরে মাছের তেলে মাছ ভাজিব, অর্থাৎ ইহার আয় হইতেই বাকি ভূমি উঠিত করিব। এইরূপ ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে বিষয় আমি ক্রয় করিলাম। তাহার পর শুন বিপত্তির কথা।

আবাদে কাজ করিবার সময় একজন সাঁইয়ের সহিত আমার আলাপ হইয়াছিল। মন্ত্রবলে যাহারা বাঘ দূর করিতে পারে, এরূপ লোককে সাঁই বলে। বড়গোছের একখানি নৌকা ভাড়া করিলাম। তাহাতে ছয়জন মাঝি ছিল। আবাদে কোথায় কি করিতে হইবে, তাহা দেখিবার নিমিত্ত সই ও আমি যাত্রা করিলাম। আমাদের পাশেই এক গাঙ ছিল। এই নদী দিয়া পূর্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গের নৌকা যাতায়াত করিত। আমি, সাঁই ও তিনজন মাল্লা লাঠিসোটা লইয়া আবাদের এদিক-ওদিক কিয়ৎপরিমাণে ভ্রমণ করিলাম। অনেক ভূমি বনে আবৃত, সকল স্থান দেখিতে পারিলাম না। যে যে স্থানে বাঁধ ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল, তাহা দেখিলাম। পুষ্করিণীটি উচ্চ ভূমিতে ছিল, তবুও কতক পরিমাণে তাঁহার ভিতর জোয়ারের নোনাজল প্রবেশ করিয়াছিল। যে কয়জন কৃষক বাস করিয়াছিল, একখানি ব্যতীত আর সকলের ঘর ভূমিসাৎ হইয়া গিয়াছিল। সেই একখানি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে আমার ইচ্ছা হইল। কিন্তু একটু আগে গিয়া দেখিলাম যে, একটি মৃত ব্যাঘ্র সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। কিছুক্ষণ তাঁহার নিকট দাঁড়াইয়া আমরা দেখিতে লাগিলাম। আমার সাঁই বলিল যে, এ ব্যাঘ্ৰটিকে অন্য কোন সাঁই মন্ত্রবলে বধ করিয়া থাকিবে। কারণ, ইহার শরীরে গুলী অথবা অন্য কোন অস্ত্রচিহ্ন নাই।

তাহার পর কৃষকের ভগ্নগৃহ অভিমুখে আমরা গমন করিলাম। এ ঘরখানির চারিদিকে প্রাচীর ও উপরে চাল ছিল, কিন্তু ঘরের দ্বারে আগড় অথবা কপাট ছিল না, যেই আমরা দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়াছি, আর ঘরের ভিতরে বন্ বন্ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। প্রথমে মনে করিলাম যে, লক্ষ লক্ষ মৌমাছির গুনগুন্ রব। ভিতরে হয় তো বৃহৎ একটি চাক হইয়াছে। পরক্ষণেই যাহা দেখিলাম, তাহাতে ঘোরতর আশ্চর্যান্বিত হইলাম। কালো কালো চড়াই পাখীর ন্যায় শত শত কি সব দেওয়ালের গায়ে বসিয়া আছে। তাহাদের সর্ব্বশরীর কালো, কিন্তু পেটগুলি রক্তবর্ণের, তাহাদের দুইটি করিয়া ডানা আছে, উড়িবার নিমিত্ত ডানাগুলি নাড়িতেছে। তাহাতেই এরূপ বন্ বন্ শব্দ হইতেছে, রক্তবর্ণের কোন দ্রব্য খাইয়া পেট পূর্ণ করিয়াছে, সেজন্য উড়িতে পারিতেছে না। এ কি জীব? কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। যে জীব হউক, এই জীবই রক্তপান করিয়া ব্যাঘটিকে বধ করিয়া থাকিবে। সেই সময় সাঁই এক বড় নির্বোধের কাজ করিয়া বসিল, লাঠি দ্বারা মাটিতে আঘাত করিয়া শব্দ করিল। শুটিদশ জীব যাহারা সম্পূর্ণভাবে উদর পূর্ণ করিয়া রক্তপান করে নাই, প্রাচীরের গা হইতে উড্ডীয়মান হইল। সাঁই সকলের অগ্রে ছিল, জীব কয়টি তাঁহার গায়ে আসিয়া বসিল, প্রাণ গেল বলিয়া সাঁই ভূতলে পতিত হইয়া ছটফট করিতে লাগিল।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–মশার মাংস

ডমরুর বলিতে লাগিলেন,আমরা দেখিলাম যে, সাইয়ের গায়ে দশ-বারোটি কালো জীব বসিয়াছে। যাতনায় সাঁই ছটফট্‌ করিতেছে। লাঠি দিয়া আমি সেই জীবগুলিকে তাড়াইতে চেষ্টা করিলাম। আমার লাঠির আঘাতে সাঁইয়ের দেহ হইতে তিনটি জীব উড্ডীয়মান হইল। তাহাদের একটি আমার গায়ে বসিতে আসিল। সবলে তাঁহার উপর আমি লাঠি মারিলাম। লাঠির আঘাতে জীবটি মৃত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। আমি তাঁহার মৃতদেহ তুলিয়া লইলাম। ইতিমধ্যে আর দুইটি জীব একজন মাঝির গায়ে গিয়া বসিল। মাঝি চীৎকার করিয়া উঠিল। দশ-বারো হাত দৌড়িয়া গিয়া সেও মাটিতে পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিল। আমি বুঝিলাম যে, এ জীব কেবল যে রক্তপান করে, তাহা নহে, ইহার ভয়ানক বিষও আছে। তখন অবশিষ্ট দুইজন মাঝির সহিত আমি দৌড়িয়া নৌকায় গিয়া উঠিলাম ও তৎক্ষণাৎ নৌকা ছাড়িয়া দিয়া সে স্থান হইতে পলায়ন করিলাম।

নৌকায় বসিয়া আমি ভাবিতে লাগিলাম। মনে করিলাম যে, মোহর বিক্রয়ের টাকাগুলি বুঝি জলাঞ্জলি দিলাম, পাপের ধন বুঝি প্রয়শ্চিত্তে গেল। এখন বুঝিতে পারিলাম যে, পাঁচ হাজার টাকার সম্পত্তি কেন সে লোক এক হাজার টাকায় বিক্রয় করিয়াছে। যে জীবটিকে লাঠি দিয়া মারিয়াছিলাম, যাহার মৃতদেহ আমি তুলিয়া লইয়াছিলাম, তাহা এখন পর্যন্ত আমার হাতেই ছিল। নৌকার উপর রাখিয়া সেইটিকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ উল্টাইয়া পাল্টাইয়া আমি ঘোরতর আশ্চর্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম যে, সে অন্য কোন জীব নহে, বৃহৎ মশা! চড়াই পাখীর ন্যায় বৃহৎ মশা! মশা যে এত বড় হয়, তাহা কখন শুনি নাই। শরীরটি চড়াই পাখীর ন্যায় বড়, শুড়টি বৃহৎ জোঁকের ন্যায়। ডাক্তারেরা যেরূপ ছুরি দিয়া ফোড়া কাটে শুড়ের আগায় সেইরূপ ধারালো পদার্থ আছে। জীব-জন্তু অথবা মানুষের গায়ে বসিয়া প্রথম সেই ছুরি দিয়া কতক চর্ম ও মাংস কাটিয়া লয়। তারপর সেইস্থানে শুঁড় বসাইয়া রক্তপান করে! কেবল যে রক্তপান করিয়া জীব-জন্তুর প্রাণ বিনষ্ট করে তাহা নহে, ইহাদের ভয়ানক বিষ আছে, সেই বিষে অপর প্রাণী ধড়ফড় করিয়া মরিয়া যায়।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি করিয়া জানিলে যে, যে জীব কোন নূতন পক্ষী নহে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,পক্ষীদের দুইটি পা থাকে, ইহার ছয়টি পা; পক্ষীদের ডানায় পালক ছিল না; পক্ষীদের ঠোট থাকে, ঠোটের স্থানে ইহার শুঁড় ছিল। পক্ষীদের শরীরে হাড় থাকে, ইহার শরীর কাদার ন্যায় নরম। সেইজন্য আমি স্থির করিলাম যে, ইহা পক্ষী নহে, মশা।

লম্বোদর বলিলেন,—মশা যে এত বড় হয়, তাহা আমার বিশ্বাস হয় না।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–কেন বিশ্বাস হইবে না? হস্তী বৃহৎ মশা ব্যতীত আর কিছুই নহে। মশার শুঁড় আছে, হস্তীরও শুঁড় আছে। তবে হস্তী যদি রক্তপান করিত তাহা হইলে পৃথিবীতে অপর কোন জীব থাকিত না। সেই জন্য হস্তী গাছপালা খাইয়া প্রাণধারণ করে।

ডমরুর বলিলেন,–তাহা ভিন্ন আমি এ কথায় প্রমাণ রাখিয়াছি। যেমন সেই বাঘের ছালখানি ঘরে রাখিয়াছি, সেইরূপ এই মশার প্রমাণস্বরূপ আমি জোক রাখিয়াছি। আমাদের গ্রামের নিকট যে বিল আছে, মশার ঔড়টি কাটিয়া আমি সেই বিলে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। সেই শুঁড় হইতে এখন অনেক বড় বড় জোঁক হইয়াছে। আমার কথায় তোমাদের প্রত্যয় না হয়, জলায় একবার নামিয়া দেখ। প্রমাণ ছাড়া আমি কথা বলি না।

লম্বোদর বলিলেন,–মশার শুঁড় পচিয়া জোঁক হইতে পারে না।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–কেন হইবে না? স্বে হইতে স্বেদজ জীব হয়। বাদ বনের পাতা পচিয়া চিংড়ি মাছ হয়। কোন বি-এ অথবা এম-এ অথবা কি একটা পাশ করা লোক কৃষিকার্য সম্বন্ধে একখানা বাঙ্গালা স্কুলপাঠ্য পুস্তক লিখিয়াছিলেন। পুদিনা গাছ সম্বন্ধে তাহাতে তিনি এরূপ লিখিয়াছিলেন, একখণ্ড দড়িতে গুড় মাখাইয়া বাহিরে বাঁধিয়া দিবে। গুড়ের লোভে তাহাতে মাছি বসিয়া মলত্যাগ করিবে। মাছির মল-মুত্রে দড়িটি যখন পূর্ণ হইবে, তখন সেই দড়ি রোপণ করিবে। তাহা হইতে পুদিনা গাছ উৎপন্ন হইবে। মক্ষিকার বিষ্ঠায় যদি পুদিনা গাছ হইতে পারে, তাহা হইলে মশার শুঁড় হইতে জোঁক হইবে না কেন?

ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,–যাহা হউক, আমার বড়ই চিন্তা হইল। এত কষ্টের টাকা সব বৃথায় গেল, তাহা ভাবিয়া আমার মন আকুল হইল। কিন্তু আমি সহজে কোন কাজে হতাশ হই না। গ্রামে আসিয়া অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া বৃহৎ একটি মশারি প্রস্তুত করিলাম। কাপড়ের মশারি নহে, নেটের মশারি নহে, জেলেরা যে জাল দিয়া মাছ ধরে, সেই জালের মশারি। তাহার পর পাঁচজন সাঁওতালকে চাকর রাখিলাম। একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া সেই পাঁচজন সাঁওতালের সঙ্গে পুনরায় আবাদে গমন করিলাম। ধীরে ধীরে আমরা নৌকা হইতে নামিলাম। চারি কোণে চারিটি বাঁশ দিয়া চারিজন মাঝি ভিতর হইতে মশারি উচ্চ করিয়া ধরিল। তীর-ধনু হাতে লইয়া চারিপার্শ্বে চারিজন সাঁওতাল দাঁড়াইল। একজন সাঁওতালের সহিত আমি মশারির মাঝখানে রহিলাম। মশারির ভিতর থাকিয়া আমরা দশজন আবাদের অভ্যন্তরে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। অধিক দূর যাইতে হয় নাই। বৃহৎ মশকগণ বোধ হয় অনেক দিন উপবাসী ছিল। মানুষের গন্ধ পাইয়া পালে পালে তাঁহারা মশারির গায়ে আসিয়া বসিল। কিন্তু মশারীর ভিতর প্রবেশ করিতে পারিল না। সাঁওতাল পাঁচজন ক্রমাগত তাহাদিগকে তীর দিয়া বধ করিতে লাগিল। সেদিন আমরা আড়াই হাজার মশা মারিয়াছিলাম। সন্ধ্যাবেলা কাজ বন্ধ করিয়া পুনরায় নৌকায় ফিরিয়া আসিলাম। সাঁওতালগণ এক ঝুড়ি মৃত মশা সঙ্গে আনিয়াছিল। শুড়, ডানা ও পা ফেলিয়া দিয়া সাঁওতালরা মশা পোড়াইয়া ভক্ষণ করিল। তাঁহারা বলিল যে, ইহার মাংস অতি উপাদেয়, ঠিক বাদুড়ের মাংসের মত। আমাকে একটু চাখিয়া দেখিতে বলিল, কিন্তু আমার রুচি হইল না।

পরদিন আমরা দুই হাজার মশা বধ করিলাম, তাহার পরদিন যোলশত, তাহার পরদিন বারশত, এইরূপ প্রতিদিন মশার সংখ্যা কম হইতে লাগিল। পঁয়ত্রিশ দিনে মশা একেবারে নিঃশেষ হইয়া গেল। হয় আমরা সমুদয় মশা মারিয়া ফেলিলাম, আর না হয় অবশিষ্ট মশা নিবিড় বনে পলায়ন করিল। সেই অবধি আমাদের আবাদে এ বৃহৎ জাতীয় মশার উপদ্রব হয় নাই। মশার হাত হইতে অর্থাৎ ড় হইতে পরিত্রাণ পাইয়া আমি আবাদের চারিদিকে পুনরায় ভেড়ি বাঁধাইলাম। বন কাটিয়া ও পুষ্করিণীর সংস্কার করিয়া কয়েক ঘর প্রজা বসাইলাম। এই সমুদয় কাজ করিতে আমার আটশত টাকা খরচ হইয়া গেল। তখন দেখিলাম যে, আরও হাজার টাকা খরচ না করিলে কিছুই হইবে না। সে হাজার টাকা কোথায় পাই।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–শূন্যপথে লোহার সিন্দুক

আমাদের গ্রাম হইতে সাত ক্রোশ দূরে কচপুরের স্বরূপ সরকেলের সহিত আমার আলাপ পরিচয় ছিল। কাপড়ের দোকানে যখন কাজ করিতাম, তখন তিনি আমাদের খরিদ্দার ছিলেন। কাপড়ের দাম লইয়া তিনি বড় হেঁচড়া-হিচড়ি কচলাকচলি করিতেন না। তিন সত্য করিয়া ধর্মের দোহাই দিয়া আমি তাঁহাকে বলিতাম যে, আপনার নিকট কখনও আমি এক আনার অধিক লাভ করিব না। কিন্তু ফলে তাঁহাকে বিলক্ষণ ঠকাইতাম। আমি ব্যবসাদারের চাকর ছিলাম। দোকানদারের রীতি এই। আলাপী লোকেরা আমাদিগকে বিশ্বাস করে, আলাপী লোককে ঠকাইতে দোকানদারের বিলক্ষণ সুবিধা হয়। বড়বাজারে বসিয়া প্রতিদিন হাজার হাজার মিথ্যা কথা বলিতাম; শত শত লোককে আমরা ঠকাইতাম।

ঠকাইলে আমাদের কাজ চলে না। এই সূত্রে সরকেল মহাশয়ের সহিত আলাপ-পরিচয় হইয়াছিল। সরকে মহাশয়ের একটা জমিদারী আছে, তাহা ব্যতীত তিনি তেজারতি করেন। আমি ভাবিলাম যে, তাঁহার নিকট হইতে এক হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করিয়া আমি আমার আবাদের পতিত ভূমি উঠিত করিব।

এইরূপ মনে করিয়া আমি সরলে মহাশয়ের ভবনে গমন করিলাম। আবাদ বাঁধা রাখিয়া তাঁহার নিকট এক হাজার টাকা ঋণ চাহিলাম। তিনি বলিলেন যে, আবাদ না দেখিয়া টাকা দিতে পারি না। একজন গোমস্তাকে আমার আবাদ দেখিতে পাঠাইলেন। সাতদিন পরে পুনরায় আমাকে যাইতে বলিলেন। এই সময় আমি দেখিলাম যে, সেই গ্রামে দুইজন সন্ন্যাসী আসিয়াছেন। সরকেল মহাশয়ের বাড়ীর বাহিরে তাঁহারা আড্ডা গাড়িয়াছেন। তাহাদের সহিত তিনটি ঘোড়া ও বৃহৎ এক প্রস্তরনির্ম্মিত কালীর প্রতিমা আছে। দিনের মধ্যে তিনবার শখ ও শিঙ্গা বাজাইয়া তাঁহারা দেবীর পূজা করেন। সমস্ত দিন অনেক লোক আসিয়া প্রতিমা দর্শন করে। খুব ধুম। যে পর্যন্ত সন্ন্যাসী মহাশয়েরা এই গ্রামে আসিয়াছেন, সেই পর্যন্ত সরকেল মহাশয় তাহাদের সমুদয় ব্যয় নির্বাহ করিতেছেন। ইহার অনেক বৎসর পরে আমি নিজে সন্ন্যাসী-মাহাত্ম্য সম্বন্ধে তখন যদি কিছু অভিজ্ঞতা থাকিত, তাহা হইলে সরকেল মহাশয়কে সাবধান করিতাম।

সাতদিন পরে পুনরায় আমি সরকেল মহাশয়ের বাটী গমন করিলাম। সন্ধ্যাবেলা পোছিলাম। সেজন্য টাকাকড়ি সম্বন্ধে সে রাত্রি কোন কথাবার্তা হইল না। সরকেল মহাশয়ের দুই মহল কোঠাবাড়ী। পূর্ব্বদিকে অন্তঃপুর, পশ্চিমদিকে সদরবাটী। সদরবাচীর উত্তর দিকে পূজা দালান। আহারাদি করিয়া আমি পূজার দালানে শয়ন করিলাম, পথশ্রমে ঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। রাত্রি বোধ হয় তখন একটা এমন সময় ভিতরবাড়ীতে দুম দুম্ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। ডাকাত পড়িয়াছে মনে করিয়া আমি উঠিয়া বসিলাম। কিন্তু লোকের সাড়াশব্দ কিছুই পাইলাম না। শব্দটাও ডাকাতপড়া শব্দের ন্যায় নহে। আমার বোধ হইল, যেন একটা ভারী বস্তু এক সিঁড়ি হইতে অপর সিঁড়িতে সবলে লাফাইয়া উপরতালা হইতে নীচের তলায় নামিতেছে। প্রথম মনে করিলাম যে, সরকেল মহাশয় বুঝি কোন বস্তু এই প্রকারে উপর হইতে নীচে আনিতেছেন। রথের সময় পুরুষোত্তমে জগন্নাথের কোমরে দড়ি বাঁধিয়া উড়ে পাণ্ডারা যেরূপ মন্দিরের এক পৈঠা হইতে অপর পৈঠায় নামায়, সরকেল মহাশয় বুঝি সেইরূপ কোন ভারী বস্তু নামাইতেছেন।

কিছুক্ষণ পরে বাড়ীর ভিতর কোলাহল পড়িয়া গেল। সরকেল মহাশয় চীৎকার করিয়া বলিলেন যে, টাকাকড়ি পূর্ণ তাঁহার লোহার সিন্দুক কে লইয়া যাইতেছে। তাহার পর স্ত্রীলোকেরা চীৎকার করিয়া বলিল যে, ভূতে লোহার সিন্দুক লইয়া যাইতেছে। আমি স্বচক্ষে দেখি নাই, কিন্তু পরে শুনিলাম যে, সিন্দুক আপনা আপনি সিঁড়ির এক পৈঠা হইতে অপর পৈঠায় নামিতেছিল। লোহার সিন্দুক যখন উপর হইতে নীচে নামিতেছিল, তখন সরকেল মহাশয় একবার তাঁহার আংটা ধরিয়াছিলেন। পরমুহূর্তে পায়ের উপর লোহার সিন্দুক পড়িয়া তাঁহার পা ভেঁচিয়া গিয়াছিল। তখন সরকেল মহাশয় অজ্ঞান হইয়া মাটীতে পড়িয়া রহিলেন। সিন্দুক নীচে নামিয়া ভিতরবাড়ীর দরজায় সবলে দুম দুম শব্দে আঘাত করিল। ভিতরবাড়ীর দরজা ভাঙ্গিয়া গেল। সিন্দুক সদরবাড়ীর উঠানে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি দেখিলাম যে, মাটী হইতে চারি-পাঁচ হাত উপরে শূন্যপথে সিন্দুক আপনা আপনি সদরদ্বার অভিমুখে গমন করিতেছে। তাড়াতাড়ি দালান হইতে নামিয়া আমি একটা আংটা ধরিয়া টানিতে লাগিলাম। সেই সময়ে সরকেল মহাশয়ের দারোয়ান রামগোপাল সিংও আসিয়া সিন্দুকের অপর পার্শ্বের আংটা ধরিয়া ফেলিল। সিন্দুক তৎক্ষণাৎ ভূতলে পতিত হইয়া দারোয়ানের পা ছেচিয়া দিল। সে মাটীতে পড়িয়া, জান গিয়া জান গিয়া বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। ভাগ্যে আমার পায়ে পড়ে নাই। আমার পায়ে পড়িলে আমি মারা যাইতাম। এ নিশ্চয়ই ভৌতিক ব্যাপার, এইরূপ বুঝিয়া আমি আর সিন্দুক ধরিয়া রাখিতে চেষ্টা করিলাম না।

সদর দরজায় উপস্থিত হইয়া সিন্দুক গুরুভাবে তাহাতে আঘাত করিতে লাগিল। তিন ঘায়ে সদর দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। সদরদ্বার ভাঙ্গিয়া সিন্দুক শূন্যপথে গ্রাম পার হইয়া মাঠের দিকে যাইতে লাগিল। গভীর রাত্রিতে ভয়ানক শব্দ শুনিয়া গ্রামের লোক মনে করিল যে, সরকেল মহাশয়ের বাড়ীতে ডাকাত পড়িয়াছে। লাঠিসোটা লইয়া প্রতিবেশিগণ দৌড়িয়া আসিল, কিন্তু তখন সিন্দুক গ্রামের প্রান্তভাগে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। এই সময় আর একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটিল। সরকেল মহাশয়েরুগৃহে ও নিকটস্থ প্রতিবেশীদিগের গৃহে হাতা, বেড়ি, কড়া, দা, কুড়ুল, ছুরি, কাঁচি যাহা কিছু লোহার দ্রব্য ছিল, সমুদয় বাহির হইয়া সন্ সন্‌ শব্দে শূন্যপথে সিন্দুকের পশ্চাৎ ধাবিত হইল। তাহার পর যাহা হইল, তাহা বলিলে তোমরা হয় তো বিশ্বাস করিবে না, অতএব চুপ করিয়া থাকাই ভাল।

লম্বোদর বলিলেন,–বিশ্বাস করি না করি বলই না ছাই।

লম্বোধর বলিলেন,–বাঘের ছালের ভিতর প্রবেশ করিয়া যখন তোমাদের সম্মুখে লম্ফঝম্ফ করিয়াছিলাম, তখন তো বিশ্বাস করিয়াছিলে। তখন পুকুরে গিয়া কেলে হাঁড়ি মাথায় দিয়া সমস্ত রাত্রি বসিয়াছিলে।

লম্বোদর উত্তর করিলেন,—বাঘ দেখি নাই। বাঘ বাঘ বলিয়া একটা গোল পড়িয়াছিল, তাহা শুনিয়াই গাড়ী হইতে লাফাইয়া পলায়ন করিয়াছিলাম।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–না, না, বিশ্বাস করিব না কেন। তাহার পর কি হইল বল।

উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিগণও অনেক সাধ্য-সাধনা করিলেন। তখন ডমরুধর পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিলেন।

আমার কোমরে তখন বড় একথোলো চাবি থাকিত। কিন্তু তখন কেবল আমার দুইটি বাক্স ছিল। লোকে মনে করিবে যে, ইহার অনেক টাকা আছে, টাকা রাখিতে স্থান হয় না, তাই অনেক বাক্স করিতে হইয়াছে, ঐ চাবিগুলি সেই সব বাক্সের। দেখ লম্বোদর! সত্য সত্য লোকের টাকা না থাকুক, একটা জনরব উঠিলেই হইল যে, অমুকের অনেক টাকা আছে। কাহাকেও একটি পয়সা দিতে হয় না। মুখবন্ধ গুড়ের কলসীর কাছে কত মাছি থাকে। তাঁহারা একফোটাও গুড় খাইতে পায় না, তথাপি আশেপাশে ভ্যান ভ্যান করে? সেইরূণ যদি লোকে শুনিতে পায় যে, অমুকের অনেক টাকা আছে, তাহা হইলে দেশশুদ্ধ লোক তাঁহার পাশে পাইলাম, তাহা কি? পাশে আসিয়া ভ্যান ভ্যান করে, সেই হাই তুলিলে তুড়ি দেয়। বিশেষতঃ আমার হাই। আমার হাই তোলা দেখিলে মানুষের প্রাণ শীতল হয়। হাই তুলিয়া একবার সকলকে দেখাই।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–সন্ন্যাসীর কালীঠাকুর

সকলে মনে করিবে যে, আমার অনেক টাকা আছে, সেইজন্য বৃহৎ চাবির থোলো সর্ব্বদা আমি কোমরে পরিতাম। চারি-পাঁচটি ঘুনসী একত্র পাকাইয়া মোটা দড়ির ন্যায় করিয়া, চাবির থোলো তাহাতে বাঁধিয়া আমি কোমরে পরিয়াছিলাম।

যখন লোকের হাতা, বেড়ি, খন্তা, কুড়ুল সন্ স শব্দে আইরণচেষ্টের সঙ্গে সঙ্গে চলিয়া গেল, তখন আমার চাবির গোলোতে টান ধরিল। সহজ অবস্থায় চাবির থোলো ঝুলিয়া থাকে, এখন সোজা সটান হইয়া লোহার সিন্দুকের পশ্চাতে যাইবার নিমিত্ত চেষ্টা করিতে লাগিল। আমার পশ্চাৎদিকের কোমরের মাংসে ঘুনসি বসিয়া গেল, আমার ঘোর যাতনা হইল, আমি ভাবিলাম যে কোমর পর্যন্ত কাটিয়া আমার শরীর বা দুইখানা হইয়া যায়। একটু আলগা করিবার নিমিত্ত আমি চাবির থোলোটি ধরিতে যাইলাম। যেই দুইয়াছি, আর আমার হাতে যেন হাজার সূচ ফুটিয়া গেল। চাবি হইতে আমি হাত ছাড়াইয়া লইতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু তাহা পারিলাম না। চাবি আমাকে মাঠের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। আমার প্রাণ বাঁচাও, আমার প্রাণ বাঁচাও বলিয়া গ্রামের লোককে ডাকিতে লাগিলাম, কিন্তু এ ভূতের কাণ্ড এইরূপ মনে করিয়া সকলে পলায়ন করিল, আপন ঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

চাবির থোলো আমাকে মাঠের দিকে লইয়া চলিল। মাঠে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম যে, আগে অনেক দূরে তিনটি ঘোড়া যাইতেছে। জ্যোত্সা রাত্রি, সেজন্য অনেকটা স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। দুইটা ঘোড়ার উপর দুইজন সন্ন্যাসী চড়িয়াছে, তৃতীয় ঘোড়র উপর সেই প্রস্তরের কালীমূর্তি ও পূজার আসবাব বোঝাই আছে। তাঁহার পশ্চাতে প্রায় পাচশত হাত দূরে মাটী হইতে চারি-পাঁচ হাত উপরে শূন্যপথে লোহার সিন্দুক যাইতেছে। সিন্দুক হইতে প্রায় দুইশত হাত পশ্চাতে হাতা, বেড়ি, কড়া, খন্তা, দা, কুড়ুল লৌহনির্ম্মিত দ্রব্যসমূহ সেইরূপ শূন্যপথে যাইতেছে। তাঁহার প্রায় দুইশত হাত দূরে চাবির থোলো আমাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। কাণ্ডখানা কি, তখন আমি কিছুই বুঝিতে পারি নাই। তখন আমার প্রাণ লইয়া টানাটানি, কোমর কাটিয়া শরীরটি দুইখানা হইবার উপক্রম হইয়াছিল। ভাবিবার চিন্তিবার তখন সময় ছিল না।

মাঠের উপর দিয়া প্রায় এক ক্রোশ পথ এইভাবে আমাকে টানিয়া লইয়া চলিল। তাহার পর সহসা দুম করিয়া শব্দ হইল। চাহিয়া দেখিলাম যে দূরে সিন্দুকটি মাটীতে পড়িয়াছে, তাঁহার শব্দ। আরও নিরীক্ষণ করিলাম যে, সিন্দুকের অগ্রে ঘোড়া তিনটি স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, সন্ন্যাসী দুইজন ঘোড়ার পিঠ হইতে নামিয়াছে, আর তৃতীয় ঘোড়া হইতে কালীর প্রতিমাটিও নামাইয়া নীচে মাটীর উপর সিংহাসনে রাখিয়াছে।

সিন্দুকটি যেই মাটীতে পড়িল, আর তাহার পরক্ষণেই হাতা, বেড়ি, খন্তা, কুড়ুল প্রভৃতি ঝুপঝাপ ঠসঠাস করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। তাহার পরক্ষণেই আমার চাবি পূর্ব্বের ন্যায় কোমরে ঝুলিয়া পড়িল। কোমরে ঘুনসির টান আর রহিল না। তখন আমার ধড়ে প্রাণ আসিল, তখন যথানিয়মে নিঃশ্বাস খেলিয়া আমি সুস্থির হইলাম। সেই স্থানে আমি প্রায় এক ঘণ্টা পড়িয়া রহিলাম। এক ঘণ্টা পরে যখন আমি পুনরায় চাহিয়া দেখিলাম, তখন দেখিলাম যে, দূরে সে ঘোড়াও নাই, সে সন্ন্যাসীও নাই; অনেকক্ষণ পরে অতি সাবধানে, অতি ধীরে ধীরে, অতি ভয়ে ভয়ে আমি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম; দেখিলাম যে, সন্ন্যাসী দুইজন লোহার সিন্দুকটি কোনরূপে ভাঙ্গিয়াছে অথবা খুলিয়াছে। তাঁহার ভিতর টাকাকড়ি, গহনা-পত্র যাহা কিছু ছিল সে সমুদয় লইয়া গিয়াছে। চারিদিকে কাগজ-পত্র ছড়াছড়ি হইয়া আছে। দুই চারিখানি কাগজে স্ট্যাম্প দেখিয়া বুঝিলাম যে, সে সব দলিলপত্র। তাহাতে আমি হাত দিলাম না। অন্য একতাড়া কাগজ তুলিয়া দেখিলাম যে, সে কোম্পানীর কাগজ, তাহা আমি ফেলিয়া দিলাম। আর একতাড়া কাগজ, লম্বোদর। সেদিন তোমাদিগকে আমি বলিয়াছিলাম যে, আমি ভাগ্যবান পুরুষ। আজ তাঁহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখা কাগজ তাড়াটি একটু খুলিয়া দেখিলাম যে, সেসব নোট! তাহার পর দৌড়িয়া বেলা নয়টার সময় বাড়ীতে পৌঁছিয়া, তবে হাঁপ ছাড়িলাম।

লম্বোদর বলিলেন,—এ সমুদয় তোমার আজগুবি গল্প। এ অনেক দিনের কথা, কিন্তু আমরা সেই সময় শুনিয়াছিলাম যে, সরকেল মহাশয়ের বাড়িতে যথার্থই চুরি হইয়াছিল এবং সে চোরগণ তোমার অপরিচিত লোক ছিল না।

ডমরুর উত্তর করিলেন,—সমুদয় মিথ্যা কথা, হিংসায় লোক কি না বলে।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ–চুম্বকের সার

ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,—বাড়ীতে আসিয়া নোটগুলি গণিয়া দেখিলাম যে, দুইশত দশ টাকার নোট, মোট দুই হাজার টাকা। আর ঋণের প্রয়োজন কি? সরকেল মহাশয়কে আমি এক পত্র লিখিলাম যে,সেদিন আপনার বাড়ীতে গিয়া ভূতের হাতে প্রাণ হারাইতে বসিয়াছিলাম। আপনার টাকার আমার প্রয়োজন নাই।

তাহার পর সেই টাকা দিয়া আমি সমুদয় আবাদটি উঠিত করিলাম। আমি ছাইমুঠা ধরিলে সোনা-মুঠা হইয়া যায়। সে অঞ্চলে এখন অনেক লোকের আবাদ হইয়াছে। বহুদূর পর্যন্ত এখন লোকের বাস হইয়াছে। নদীতে খ্যি বসিয়াছে, মাঝে মাঝে হাট বসিয়াছে। গ্রীষ্মকালে কোন কোন স্থানে বরফের কুলফি বিক্রয় হয়। শীতকালে হিন্দুস্থানীরা ফুলুরি ফেরি করিয়া বেড়ায়। যে সাঁওতালগণ মশা মারিতে আমার সহায়তা করিয়াছিল, তাহাদিগকে আমি জমি দিয়াছি, তাঁহারা আমার প্রজা হইয়াছে। তাহাদিগের দেখাদেখি আরও অনেক সাঁওতাল নিকটস্থ আবাদসমূহে বাস করিতেছে।

এখন আমার কিরূপ সম্পত্তি হইয়াছে, কিরূপ জনসাধারণের নিকট আমি গণ্যমান্য হইয়াছি তাহা তোমরা অবগত আছ। শ্বশুর প্রহ্লাদবাবু সম্বন্ধে আমি যে ভবিষ্যদ্বাণী বলিয়াছিলাম, তাহা পূর্ণ হইয়াছে। মালতীকে আপনা হইতে তিনি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তাহার পর তিনি নিজে তাঁহার পুত্রগণ, তাঁহার ভগিনী কতবার যে আমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, তাঁহার সংখ্যা নাই। মালতী জীবিত নাই। এখন অবশ্য তাঁহাদের সহিত আমার কোন সম্বন্ধ নাই। শুনিয়াছি যে, এখন সংসারে তাহাদের আর কেহ নাই। দেশে গিয়া ম্যালেরিয়া জ্বরে সে সংসার মরিয়া-হাজিয়া গিয়াছে।

লম্বোদর বলিলেন,—অনেক কথা তো শুনিলাম। তুমি বলিলে যে, সরকেল মহাশয়ের বাড়ী চুরি হয় নাই, আর সে চোরগণকে তুমি দ্বার খুলিয়া দাও নাই। তবে সন্ন্যাসী দুইজন কি করিয়াছিল যে, লোহার সিন্দুক ও অন্যান্য লোহালড়ে টান ধরিয়াছিল?

ডমরুধর উত্তর করিলেন যে, আমি যখন কাপড়ের দোকানে কাজ করিতাম, তখন কোন কোন দিন সন্ধ্যার পর সে স্থানে পুঁথি পড়া হইত। মহাভারত রামায়ণের পর সে একজন আরব্য উপন্যাস পাঠ করিয়াছিলেন। তাহাতে এক রাজপুত্রের গল্প শুনিয়াছিলাম। জাহাজে চড়িয়া সমুদ্রপথে তিনি দেশ-বিদেশ পরিদর্শন করিয়াছিলেন। অবশেষে ঝড়ে তাড়িত হইয়া তাঁহার জাহাজ এক কৃষ্ণবর্ণের পর্ব্বতের সমীপে উপস্থিত হইয়াছিল। জাহাজের যত পেরেক ছিল, সব খুলিয়া সেই পর্ব্বতে গিয়া লাগিল। জাহাজ জলমগ্ন হইল। আমার বোধ হয় সন্ন্যাসীদের যে বৃহৎ কালীমূর্তি ছিল, তাহা চুম্বক পাথরে গঠিত। কিন্তু সে সামান্য চুম্বক পাথর নহে। চোলাই করা চুম্বক পাথরের সার। সিংহাসনটি এরূপ পদার্থে গঠিত, যাহা ভেদ করিয়া চুম্বক প্রস্তরের আকর্ষণশক্তি দূরে যাইতে পারে না। প্রথম কয়দিন সন্ন্যাসী দুইজন দেবীকে সেই সিংহাসনে বসাইয়া পূজা করিয়াছিল। সে নিমিত্ত সে কয়দিন লৌহদ্রব্যে টান ধরে নাই। শেষদিন গভীর রাত্রিতে তাঁহারা দেবীকে সিংহাসন হইতে নিম্নে রাখিয়াছিল, আর সেই সময় নিকটস্থ লৌহনির্ম্মিত দ্রব্য আকৃষ্ট হইয়াছিল। সে রাত্রিতে প্রথম আমি দেখিয়াছিলাম যে, তৃতীয় ঘোড়ার উপর বলদের ছালার ন্যায় তাঁহারা দুইদিকে দুই প্রকার বোঝ রাখিয়াছিল। বোধ হয়, একদিকে প্রতিমা, অপরদিকে সিংহাসন ও পূজার সামগ্রী রাখিয়াছিল। সিংহাসন হইতে মূর্তি পৃথক ছিল সেজন্য তখনও লোহার দ্রব্য টান ছিল; তাহার পর মাঠে প্রতিমার আকর্ষণশক্তি লোপ হইয়াছিল। তাহার পর সিংহাসনের উপর মূর্তি রাখিয়া ঘোড়ার উপর সেইভাবে বোঝাই দিয়া তাঁহারা পলায়ন করিয়াছিল। আমার বোধ হয়, লৌহদ্রব্যসমূহ এই কারণে শূন্যপথে ভ্রমণ করিয়াছিল।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–তুমি যে গল্পটি করিলে, উহার কোন প্রমাণ আছে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—প্রমাণ নাই? নিশ্চয় আছে। চাবির থোলো এখনও আমার ঘরে আছে। বল তো এখনি আনিয়া দেখাই।

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ–কুম্ভীর-বিভ্রাট

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,—শুনিয়াছি যে সুন্দরবনে নদী-নালায় অনেক কুমীর আছে। তোমার আবাদে কুমীর কিরূপ?

ডমরুর বলিলেন,–কুমীর! আমার আবাদের কাছে যে নদী আছে, কুমীরে তাহা পরিপূর্ণ। খেজুর গাছের মত নদীতে তাঁহারা ভাসিয়া বেড়ায়, অথবা কিনারায় উঠিয়া পালে পালে তাঁহারা রৌদ্র পোহায়। গরুটা, মানুষটা, ভেড়াটা, ছাগলটা, বাগে পাইলেই লইয়া যায়। কিন্তু এ সব কুমীরকে আমরা গ্রাহ্য করি না। এবার আমার আবাদের নিকট এক বিষম কুমীরের আবির্ভাব হইয়াছিল। গন্ধমাদন পর্ব্বতে কালনেমির পুকুরে যে কুম্ভীর হনুমানকে ধরিয়াছিল, ইহা তাহা অপেক্ষাও ভয়ানক, গঙ্গাদেবী যে মকরের পীঠে বসিয়া বায়ু সেবন করেন, সে মকরকে এ কুমীর একগালে খাইতে পারে! পর্ব্বত প্রমাণ যে গজ সেকালে বহুকাল ধরিয়া কচ্ছপের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল, সে-কচ্ছপকে এ কুমীর নস্য করিতে পারে। ইহার দেহ বৃহৎ, তালগাছের ন্যায় বড়, ইহার উদর এই দালানটির মত। অন্যান্য কুমীর জীবজন্তুকে ছিঁড়িয়া ভক্ষণ করে। কিন্তু এ কুমীরটা আস্ত গরু, আস্ত মহিষ গিলিয়া ফেলিত। রাত্রিতে সে লোকের ঘরে ও গোয়ালে সিঁদ দিয়া মানুষ ও গরু বাছুর লইয়া যাইত। লাঙ্গুলে জল আনিয়া দেওয়াল ভিজাইয়া গর্ত করিত। ইহার জ্বালায় নিকটস্থ আবাদের লোক অস্থির হইয়া পড়িল। প্রজাগণ পাছে আবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করে, আমাদের সেই ভয় হইল, তাহার পর লাঙ্গলের আঘাতে নৌকা ড়ুবাইয়া আরোহীদিগকে ভক্ষণ করিতে লাগিল। সে নিমিত্ত এ পথ দিয়া নৌকার যাতায়াত অনেক পরিমাণে বন্ধ হইয়া গেল।

এই ভয়ানক কুম্ভীরের হাত হইতে কিরূপে নিষ্কৃতি পাই এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় আমার আবাদের নিকট একখানি নৌকা ড়ুবাইয়া তাঁহার আরোহীদিগকে একে একে আমাদের সমক্ষে সেগিলিয়া ফেলিল। এই নৌকায় এক ভলোক কলিকাতা হইতে সপরিবারে পূর্ব্বদেশে যাইতেছিলেন। নদীর তীরে দাঁড়াইয়া আমরা দেখিলাম যে, তাঁহার গৃহিণী সর্বাঙ্গ বহুমূল্য অলঙ্কারে ভূষিত ছিল। তোমরা জান যে, কুমীরের পেটে মাংস হজম হয়, গহনা পরিপাক হয় না। কুমীর যখন সেই স্ত্রীলোককে গিলিয়া ফেলিল, তখন আমার মনে এই চিন্তা উদয় হইল,—চিরকাল আমি কপালে পুরুষ; যদি এই কুমীরটাকে আমি মারিতে পারি, তাহা হইলে ইহার পেট চিরিয়া এই গহনাগুলি বাহির করিব, অন্ততঃ পাঁচছয় হাজার টাকা আমার লাভ হইবে।

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি কলিকাতায় গমন করিলাম। বড় একটি জাহাজের নঙ্গর কিনিয়া উকো ঘষিয়া তাহাতে ধার করিলাম, তাহার পর যে কাছিতে মানোয়ারি জাহাজ বাঁধা থাকে সেইরূপ এক কাছি ক্রয় করিলাম। এইরূপ আয়োজন করিয়া আমি আবাদে ফিরিয়া আসিলাম। আবাদে আসিয়া শুনিলাম যে, কুমীর আর একটা মানুষ খাইয়াছে। চারিদিন পূর্ব্বে এক সাঁতালনী এককুড়ি বেগুন মাথায় লইয়া হাটে বেচিতে যাইতেছিল সে যেই নদীর ধারে গিয়াছে, আর কুমীর তাঁহাকে ধরিয়া বেগুনের ঝুড়ি সহিত আস্ত গিলিয়া ফেলিয়াছে, তাহাতে সাঁওতাল প্রজাগণ ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে; বলিতেছে যে, আবাদ ছাড়িয়া তাঁহারা দেশে চলিয়া যাইবে।

আবাদে আসিয়া নঙ্গরটিকে আমি বঁড়শী করিলাম তাহাতে জাহাজের কাছি বাঁধিয়া দিলাম, মাছ ধরিবার জন্য লোকে যে হাতসূতা ব্যবহার করে, বৃহৎ পরিমাণে এও সেইরূপ হাত-সূতার ন্যায় হইল। নঙ্গরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগে এক মহিষের বাছুর গাঁথিয়া নদীর জলের নিকট বাঁধিয়া দিলাম। কাছির অন্যদিকে একগাছে পাক দিয়া রাখিলাম, তাহার পর পঞ্চাশ জন সবল লোককে নিকটে লুক্কায়িত রাখিলাম। বেলা তিনটার সময় আমাদের এই সমুদয় আয়োজন সমাপ্ত হইল।

বড়শীতে মহিষের বাছুরকে বিধিয়া দিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু তাঁহার প্রাণ আমরা একেবারে বধ করি নাই। নদীর ধারে দাঁড়াইয়া সে গাঁ গাঁ শব্দে ডাকিতে লাগিল, তাঁহার ডাক শুনিয়া সন্ধ্যার ঠিক পূর্ব্বে সেই প্রকাণ্ড কুমীর আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহার লেজের ঝাঁপটে পর্ব্বতপ্রমাণ এক ঢেউ উঠিল, সেই ঢেউয়ে বাছুরটি ড়ুবিয়া গেল তখন আর আমরা কিছুই দেখিতে পাইলাম না, পরক্ষণেই কাছিতে টান পড়িল। তখন আমরা বুঝিলাম যে, নঙ্গরবিদ্ধ বাছুরকে কুমীর গিলিয়াছে, বঁড়শীর ন্যায় নঙ্গর কুমীরের মুখে বিধিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি সেই পঞ্চাশ জন লোক আসিয়া দড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল। ভাগ্যে গাছে পাক দিয়া রাখিয়াছিলাম, তা না হইলে কুমীরের বলে এই পঞ্চাশ জন লোককে নদীতে গিয়া পড়িতে হইত। আমরা সেই রাক্ষস কুমীরকে বঁড়শীতে গাঁথিয়াছি ঐ কথা শুনিয়া চারিদিকের আবাদ হইতে অনেক লোক দৌড়িয়া আসিল। প্রায় পাঁচশত লোক সেই রশি ধরিয়া টানিতে লাগিল। দারুণ আসুরিক বলে কুমীর সেই পাঁচশত লোকের সহিত ঘোর সংগ্রাম করিতে লাগিল। কখন আমাদের ভয় হইল যে, তাঁহার বিপুল বলে নোঙ্গর ভাঙ্গি য়া যায়, কখন ভয় হইল যে, তাঁহার জাহাজের দড়া বা ছিঁড়িয়া যায়। কখন ভয় হইল, গাছ উৎপাটিত হইয়া নদীতে গিয়া পড়ে। নিশ্চয় একটা বিভ্রাট ঘটিত, যদি না সাঁওতালগণ কুমীরের মস্তকে ক্রমাগত তীরবর্ষণ করিত, যদি না নিকটস্থ দুইটি আবাদের লোক বন্দুক আনিয়া কুমীরের মাথায় গুলী মারিত। তীর ও গুলী খাইয়া কুমীর মাঝে মাঝে জলমগ্ন হইতে লাগিল। কিন্তু নিঃশ্বাস লইবার জন্য পুনরায় তাঁহাকে ভাসিয়া উঠিতে হইল। সেই সময় লোক তীর ও গুলীবর্ষণ করিতে লাগিল। কুমীরের রক্তে নদীর জল বহুদূর পর্যন্ত লোহিত বর্ণে রঞ্জিত হইয়া গেল। সমস্ত রাত্রি কুমীরের সহিত আমাদের এইরূপ যুদ্ধ চলিল। প্রাতঃকালে কুম্ভীর হীনবল হইয়া পড়িল। বেলা নয়টার সময় তাঁহার মৃতদেহ জলে ড়ুবিয়া গেল। তখন অতি কষ্টে তাঁহাকে আমরা টানিয়া উপরে তুলিলাম।

বড় বড় ছোরা বড় বড় কাস্তে আনিয়া তাঁহার পেট চিরিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে রাক্ষস কুমীরের পেট অতি কঠিন ছিল। আমাদের সমুদয় অস্ত্র ভাঙ্গিয়া গেল। অবশেষে করাত আনাইয়া করাতের দ্বারা তাঁহার উদর কাটাইলাম। কিন্তু পেট চিরিয়া তাঁহার পেটের ভিতর যাহা দেখিলাম, তাহা দেখিয়াই আমার চক্ষুস্থির।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিল,–কি দেখিলে?

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি দেখিলে?

অন্যান্য শ্রোতৃগণ জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি দেখিলে?

ডমরুর বলিলেন,–বলিব কি ভাই, আর দুঃখের কথা, কুমীরের পেটের ভিতর দেখি যে সেই সাঁওতাল মাগী, চারিদিন পূর্ব্বে কুমীর যাহাকে আস্ত ভক্ষণ করিয়াছিল, সেই মাগী পূর্ব্বদেশীয় সেই ভদ্রমহিলার সমুদয় গহনাগুলি আপনার সর্বাঙ্গে পরিয়াছে, তাহার পর নিজের বেগুনের ঝুড়িটি সে উপুড় করিয়াছে, সেই বেগুনগুলি সম্মুখে উঁই করিয়া রাখিয়াছে। ঝুড়ির উপর বসিয়া মাগী বেগুন বেচিতেছে?

শঙ্কর ঘোষ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,–কুমীরের পেটের ভিতর ঝুড়ির উপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছিল?

ডমরুর বলিলেন,–হাঁ ভাই! কুমীরের পেটের ভিতর সেই ঝুড়ির উপর বসিয়া মাগী বেগুন বেচিতেছিল।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল? কুমীরের পেটের ভিতর সে খরিদ্দার পাইল কোথা?

বিরক্ত হইয়া ডমরুর বলিলেন,—তোমার এক কথা! কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল, সে খোজ করিবার আমার সময় ছিল না। সমুদয় গহনাগুলি সে নিজের গায়ে পরিয়াছিল, তাহা দেখিয়াই আমার হাড় জ্বলিয়া গেল। আমি বলিলাম,–মাগী! ও গহনা আমার। অনেক টাকা খরচ করিয়া আমি কুমীর ধরিয়াছি, ও গহনা খুলিয়া দে। কেঁউ মেউ করিয়া মাগী আমার সহিত ঝগড়া করিতে লাগিল। তাহার পর তাঁহার পুত্রগণ ও তাঁহার জাতি ভাইগণ কাড়বাঁশ ও লাঠিসোটা লইয়া আমাকে মারিতে দৌড়িল। আমার প্রজাগণ কেহই আমার পক্ষ হইল না। সুতরাং আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইল। সাঁওতালগণ সে মাগীকে ঘরে লইয়া গেল। দিনকয়েক শূকর মারিয়া ও মদ খাইয়া তাঁহারা আমোদপ্রমোদ করিল। পূর্ব্বদেশীয় সে ভদ্রমহিলার একখানি গহনাও আমি পাইলাম না। মনে মনে ভাবিলাম যে, কপালে পুরুষের ভাগ্য সকল সময় প্রসন্ন হয় না?

লম্বোদর বলিলেন,—এত আজগুবি গল্প তুমি কোথায় পাও বল দেখি?

ডমরুর বলিলেন,–এতক্ষণ হাঁ করিয়া এক মনে এক ধ্যানে গল্পটি শুনিতেছিলে। যেই হইয়া গেল, তাই এখন বলিতেছ যে, আজগুবি গল্প। কলির ধর্ম্ম বটে!

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,–এ কুমীরের গল্প যে সত্য, তাঁহার প্রমাণ আছে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—প্রমাণ? নিশ্চয় প্রমাণ আছে। কোমরের ব্যাথার জন্য এই দেখ সেই কুমীরের দাঁত আমি পরিয়া আছি।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—সে কুমীর যদি তালগাছ অপেক্ষা বৃহৎ ছিল, তবে তাঁহার দাঁত এত ছোট কেন? ঠিক অন্য কুমীরের দাঁতের মত কেন?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—অনেক মানুষ খাইয়া সে কুমীরের দাঁত ক্ষয় হইয়া গিয়াছিল।

তৃতীয় গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–নদীর ক্রোধ

ডমরুধরের পূজার দালান। প্রতিমা প্রস্তুত হইয়াছে। প্রতিমার সম্মুখে ডমরুধর, তাঁহার পুরোহিত ও বন্ধুবান্ধব বসিয়াছেন।

ডমরুর বলিলেন,–কলিকাতায় একবার এক খোলার ঘরের আগড়ের উপর একখানি কাগজ দেখিলাম। তাহাতে লেখা ছিল—ভাগ্যগণনা এক আনা।

গণৎকারের নিকট আমি গমন করিলাম। অনেক কচলাকচলি করিয়া শেষে এক পয়সায় রফা হইল। দৈবজ্ঞ হাত দেখিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময় আমার একবার হাই উঠিল। তোমরা আমার হাই অনেকবার দেখিয়াছ।

প্রথম হইতেই আমার রূপ দেখিয়া গণকার মোহিত হইয়াছিলেন। তাহার পর তাঁহার সহিত যখন দর কসাকসি করি, তখন তাঁহার মন আরও প্রফুল্ল হইয়াছিল। এখন আমার হাই দেখিয়া তিনি একেবারে আনন্দে অভিভূত হইয়া পড়িলেন।

অধিক আর গণিতে-গাঁথিতে হইল না। হাতটি ধরিয়াই তিনি বলিলেন,–মহাশয় কার্তিকেয়, যাহাকে ষড়ানন বলে, মা দুর্গার কনিষ্ঠ পুত্র! অবতার হইয়া পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।-আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—আমার প্রতি কি কোনরূপ অভিশাপ হইয়াছিল?

দৈবজ্ঞ উত্তর করিলেন,–না, তাহা নহে। বিবাহ করিবার নিমিত্ত একদিন আপনি মায়ের নিকট আব্দার করিয়াছিলেন। ভগবতী বলিলেন,–বাচ্চা, এ দেবলোকে তোমাকে কেহ কন্যা প্রদান করিবে না। যদি বিবাহ করিতে সাধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে পৃথিবীতে গিয়া অবতীর্ণ হও।–দৈবজ্ঞ আরও বলিলেন,–পৃথিবীতে আপনি আসিয়াছেন, কিন্তু একটু সাবধানে থাকিবেন। মা দশভূজা ভালবাসেন, সেজন্য আপনার প্রতি নন্দীর একটু ঈর্ষা আছে। ছল পাইলে সে আপনাকে দুঃখ দিবে।

দেখ লম্বোদর, ঐ যে ময়ূরের উপর যিনি বসিয়া আছেন, উনি আর কেহ নহেন, উনি আমি স্বয়ং। অবতার হইলে দেবতারা আত্মবিস্মৃত হইয়া থাকেন, আমিও সেই জন্য আত্মবিস্মৃতি হইয়া আছি। আর তোমরাও আমার মাহাত্ম বুঝিতে পারিতেছ না।

লম্বোদর বলিলেন,–হাঁ, কার্তিকের মত তোমার রূপ বটে!

ডমরুর বলিলেন,—ঠাট্টা কর, আর যাই কর। গণৎকার যাহা বলিয়াছে, তাহা ঠিক। নন্দীর কোপে পড়িয়া কয়মাস যে আমি ঘোরতর কষ্ট পাইয়াছিলাম, তাহা তো আর মিথ্যা নহে? লম্বোদর বলিলেন,–আবার বুঝি একটা আজগুবি গল্প হইবে?

ডমরুধর রাগিয়া বলিলেন,–তোমার যদি শুনতে ইচ্ছা না থাকে, তাহা হইলে কানে আঙ্গুল দিয়া থাক।

তাহার পর পাঁচজনের অনুরোধে ডমরুধর এইরূপে গল্পটি বলিতে লাগিলেন,–

গত বৎসর নবমী পূজার দিন। রাত্রি শেষ হইয়াছে। বাহির বাড়ীতে কিরূপ একটা খুটখাট শব্দ হইতে লাগিল। দুপয়সা আমার সঙ্গতি আছে। কাজেই আমাকে সর্ব্বদা সতর্ক ও শঙ্কিত থাকিতে হয়। আমি ধীরে ধীরে বাহিরে আসিয়া দেখি যে দালানের প্রতিমার সম্মুখে একটা বিকটাকার মর্দ পূজার দ্রব্যাদি লইয়া গাঠরি বাঁধিতেছে। পূজার সমুদয় উপকরণ যাহা তখন দালানে ছিল, মায় বেশ্যাবাড়ীর মৃত্রিকাটুকু পর্যন্ত, সমস্ত দ্রব্য সে বাঁধিয়া লইতেছে। তাঁহার নিকটে একটা ত্রিশূল পড়িয়া ছিল। কুঁচকি বাঁধিয়া ত্রিশূলের আগায় আটকাইয়া সে কাঁধে তুলিবার উপক্রম করিল।

রাগে আমার সর্ব্বশরীর জুলিয়া উঠিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, অবতার হইলে দেবতাদের আত্মবিস্মৃতি হয়। আমি যে ভগবতীর পুত্র কার্তিক, রাগের ধমকে সে কথা একেবারে ভুলিয়া যাইলাম। সেই লোকটাকে গালি দিয়া আমি বলিলাম,–বদমায়েস চোর! পূজার দ্রব্য চুরি করিতেছিস।

সে লোকটা একবার আমার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। পোঁটলার একদিক ধরিয়া আমি টানিতে লাগিলাম। ঈষৎ হাসিয়া পোঁটলার অপর দিক ধরিয়া সে টানিতে লাগিল। আমি তাঁহাকে বলিলাম,পোঁটলা ছাড়িয়া দে। সে উত্তর করিল,–দিয়া নিলে কি হয় তা জান? কালীঘাটের কুকুর হয়। আমি বলিলাম,–কবে তোকে এসব জিনিস আমি দিয়াছি?–দুইজনে বিষম টানাটানি চলিতে লাগিল। কিন্তু তাঁহার বল অধিক, তাঁহার সহিত আমি পারিলাম না। অবশেষে হতাশ হইয়া তাঁহার হাতে এক কামড় মারিলাম।

সে লোকটি বলিল,–ছি তোমার এখনও দুষ্টুমি যায় নাই। দেবতারা পৃথিবীতে আসিয়া পুনরায় ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছা করেন না। ইন্দ্র শূকর হইয়া ছানা-পোনা লইয়া সুখে কালযাপন করিতেছিলেন। অনেক সাধ্য-সাধনা করিয়া পুনরায় তাঁহাকে স্বর্গে লইয়া যাইতে হইয়াছিল। রামচন্দ্রকে অনেক কৌশল করিয়া বৈকুণ্ঠে লইয়া যাইতে হইয়াছিল। শ্রীকৃষ্ণের পুত্র-পৌত্রদিগের পদভরে মেদিনী টলটলায়মান হইয়াছিল আমার বাবাঠাকুরও অতিকষ্টে কোচিনীদিগের ক্ষেত্রে জলসেচন করিয়াছিলেন। সেজন্য কেঁচিনী হুঁড়িয়া টিটকারি দিয়া বলিয়াছিল,–

দুই শরা জল ঘেঁচিয়া কোমরে দিলে হাত।
এমনি করিয়া খাবে তুমি কোচিনী পাড়ার ভাত?

কৈলাসে মা আমার কাঁদিয়া কাটিয়া কুরুক্ষেত্র করিয়াছিলেন। অনেক কষ্টে বাবাকে আমরা পুনরায় স্বস্থানে লইয়া গিয়াছিলাম। দাদাঠাকুর, তোমাকেও একটু কষ্ট দিতে হইবে তবে তোমার বিবাহের সাধ মিটিবে। সেজন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিতেছি,—ছয় মাস কাল তুমি সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হইয়া থাকিবে। ছয় মাস কাল তুমি নানা বিপদে পতিত হইবে। তুমি যে ফোকলা মুখে আমার হাতে কামড় মারিলে, সেইরূপ আর একজনের হাতে কামড় মারিয়া তোমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হইবে।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – টাকে ঠোকর

এই মুহূর্ত হইতে আমি সম্পূর্ণভাবে আত্মবিস্মৃত হইয়া পড়িলাম। যে বুদ্ধির দ্বারা অসুরদিগকে জয় করিয়া দেবগণকে নির্ভর করিয়াছিলাম, সেই দেব-বুদ্ধি আমার লোপ হইয়া গেল। আমি ঠিক মনুষ্যের মত নিমেষপূর্ণ নয়নে চারিদিকে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া দেখিলাম। যাহা দেখিলাম তাহা দেখিয়া আমি হতভম্ব হইয়া পড়িলাম।

লম্বোদর প্রভৃতি জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি দেখিলে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–বলিব কি ভাই আর আশ্চর্য কথা! আমি দেখিলাম যে স্বয়ং মহাদেব গণেশের হাত ধরিয়া প্রতিমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার স্বন্ধে কিন্তু কার্তিক নাই। কি করিয়া শিব কার্তিককে লইবেন? ডমকরূপে এইমাত্র কার্তিক নন্দীর সহিত পোঁটলা কাড়াকাড়ি করিতেছিলেন। পশ্চাতে দেবী ছলছল নয়নে দণ্ডায়মানা আছেন। উঠানে সজ্জিত দোলা রহিয়াছে। উড়ে ভূতগণ দোলার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বলিতেছেনন্দী কোঠী, গলা, দের হউচি ঠিকে জলদি কর। ইত্যাদি।

দেবী মহাদেবের কানে চুপি চুপি কি বলিলেন। কি বলিলেন, তখন আমি বুঝিতে পারি নাই। কিন্তু বোধ হয় পৃথিবীতে আমাকে আরও অনেক দিন রাখিয়া শিক্ষা দিতে তাঁহারা পরামর্শ করিলেন। দুরন্ত বালককে শিক্ষা দিবার নিমিত্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাতা-পিতাকে কঠিন হইতে হয়।

আমি এখন সকল কথা বুঝিলাম, গত বৎসর নবমী পূজার দিন ৫৮ দণ্ড নবমী ছিল। দুই দণ্ড রাত্রি থাকিতে দশমী পড়িয়াছিল; সেই শুভক্ষণে মা কৈলাস পর্ব্বতে প্রত্যাগমন করিতেছিলেন। গত বৎসর মা দোলায় গমন করিয়াছিলেন। সেজন্য মহামারী হইয়াছিল। উঠানে দোলা রাখিয়া উড়ে বেহারা ভূতগণ সেই জন্য কিচির-মিচির করিতেছিল।

প্রথম আমি নন্দীদাদার পায়ে পড়িয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম। তখন অবশ্য নন্দীদাদা বলিল তাঁহাকে সম্বোধন করি নাই। তিনি বলিলেন,–একথাবা থুতু তুমি আমার হাতে দিয়াছ, তোমার সহিত কথা কহিতে ইচ্ছা হয় না।

তাহার পর শিবের পায়ে পড়িয়া আমি স্তব করিতে লাগিলাম। সন্তুষ্ট হইয়া শিব বলিলেন,–নন্দীর শাপ আমি মোচন করিতে পারি না। অন্য বর প্রার্থনা কর।

কি বর প্রার্থনা করিব, তখন আমি খুঁজিয়া পাইলাম না। আমি বলিলাম,–ভগবান। যদি বর দিবেন, তাহা হইলে আপনার একটি ভূত আমাকে প্রদান করুন।

হাসিয়া শিব বলিলেন,–ছোটখাটো ভাল মানুষ একটি ভূত আমি তোমার নিকট পাঠাইয়া দিব। কিন্তু তাঁহাকে তুমি অধিক দিন রাখিতে পারবে না।

তাহার পর দেবীর পাদপদ্মে পড়িয়া আমি স্তবস্তুতি করিতে লাগিলাম। সন্তুষ্ট হইয়া দেবী বলিলেন,–ডমরুধর! তুমি আমার পরম ভক্ত। সেজন্য সশরীরে তোমার পূজা গ্রহণ করিতে আমরা আসিয়াছিলাম। এ বঙ্গদেশে সহস্র সহস্র লোক আমার পূজা করে। কিন্তু তাহাদের অনেকে মুর্গি ভক্ষণ করে। সেজন্য তাহাদের পূজা আমি গ্রহণ করি না। তোমার মাথার মাঝখানে যদি টাক না থাকিত, তাহা হইলে তুমি টিকি রাখিতে। দেখ, আগামী বৎসরে তুমি অতি সংক্ষেপে আমার পূজা করিবে। এত দ্রব্যাদি দিলে নন্দী বহিয়া লইয়া যাইতে পারে না। এক্ষণে বর প্রার্থনা কর।

পুনরায় আমি ফাঁপরে পড়িলাম। কি চাহিব, তাহা খুঁজিয়া ঠিক করিতে পারিলাম না। অবশেষে আমি বলিলাম,–মা! সুন্দরবনে আমার আবাদে মৃগনাভি হরিণের চাষ করিবার নিমিত্ত স্বদেশী কোম্পানী খুলিব মনে করিতেছি। ভেড়ার পালের ন্যায় বাঙ্গালার লোক যেন টাকা প্রদান করে, আমি এই বর প্রার্থনা করি।

দেবী বলিলেন,–কৈলাস পর্ব্বতের নিকট তুষারাবৃত হিমাচলে কুস্তুরী হরিণ বাস করে। সুন্দরবনে সে হরিণ জীবিত থাকিবে কেন?

আমি বলিলাম,যে আজ সম্ভব, যে কাজে লাভ হইতে পারে, সে কাজে বাঙ্গালী বড় হস্তক্ষেপ করে না। উদ্ভট বিষয়েই বাঙ্গালী টাকা প্রদান করে।

দেবীর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় নন্দী তাঁহার দক্ষিণ হস্তের আঙ্গ লের উল্টা পিঠের গাঁট দিয়া আমার মাথায় টাকের উপর তিনটি ঠোকর মারিল। সেই ঠোকরের আঘাতে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।

ডমরুধরের দালানে চতুর্ভুজ নামক এক ব্রাহ্মণ যুবক বসিয়া গল্প শুনিতেছিলেন। লম্বোদর তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,–আচ্ছা চতুর্ভুজ! তুমি তো বি-এ পাস করিয়াছ, অনেক লেখাপড়া শিখিয়াছ। ডমরুধর শিব ও দুর্গার স্তবের কথা বলিলেন, তুমি একটা স্তোত্র বল দেখি, শুনি।

চতুর্ভুজ তৎক্ষণাৎ বলিলেন,–শিব-দুর্গার স্তোত্র এই, ওঁ অমৃতোপস্তরণমসি স্বাহা। ওঁ প্রাণায় স্বাহা। ওঁ অপানায় স্বাহা। ওঁ অপনায় স্বাহা।

পুরোহিত হাসিয়া বলিলেন,—ওঁ স্তোত্র নহে।

তাহার পর তিনি অস্পষ্টস্বরে বলিতে লাগিলেন,—প্রভুমীশরনীশমশেষগুণং, গুণহীনমহীশ-গরাভরণম্ রণনিজ্জিতদুর্জয়দৈত্যপুরং, প্রণমামি শিবং শিব কল্পতরুম্।। ইত্যাদি। পুনরায়–

নমস্তে শরণ্যে শিবে সানুকম্পে, নমস্তে জগদ্ব্যাপিকে বিশ্বরূপে। নমস্তে জগদ্বন্দ্যপদারবিন্দে, নমস্তে জগত্তারিণি ত্রাহি দুর্গে।। ইত্যাদি।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ঘরে গৌতম বাহিরে গৌতম

ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,—কিছুক্ষণ পরে আমার চৈতন্য হইল। আমি উঠিয়া বসিলাম। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, মহাদেব নাই, দুর্গা নাই, নন্দী নাই, দোলা নাই, সে স্থানে কেহই নাই। কিন্তু আশ্চর্য! আছে কেবল আর একটি আমি। সেই টাক, সেই পাকা চুল, সেই কৃষ্ণবর্ণ, সেই নাক, সেই মুখ, ফলকথা—হুবহু সেই আমি। প্রতিমার একপার্শ্বে একটি আমি বসিয়া আছি। কোন আমিটি প্রকৃত আমি, তাহা আমি ঠিক করিতে পারিলাম না। একদিকের আমি অন্য দিকের আমিকে জিজ্ঞাসা করিল,–মহাশয়ের নাম কি? সে উত্তর করিল,—ডমরুধর। পুনরায় অপর আমি এদিকের আমিকে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল। সেও এইরূপ উত্তর করিল, ফলকথা, এ আমিও যা করে ও যা বলে, ও আমিও তাই করে ও তাই বলে।

তখন আমার সকল কথা হৃদয়ঙ্গম হইল। সেবার সন্ন্যাসী-সঙ্কটে আমার লিঙ্গশরীর বাহির হইয়া যমালয়ে গিয়াছিল। শুনিয়াছি যে, আমাদের শরীর অময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ প্রভৃতি কয়েকটি কোষ দ্বারা গঠিত। একবার লিঙ্গশরীর বাহির হইয়াছিল বলিয়া কোষগুলির বাঁধন কিছু আলগা হইয়া গিয়াছিল। সেজন্য দুই একটি কোষ বাহির হইয়া আর একটি ডমরুধরের সৃষ্টি হইয়াছে। এখন উপায় কি? লোকে একটা আমির ভাত-কাপড় যোগাইতে পারে না। তা যোগাইবার যেন আমার সঙ্গতি আছে, কিন্তু একটা আমির পেট কামড়াইলে তোক ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ে। একসঙ্গে দুইটা আমির পেট যদি কামড়ায়, তখন আমি কি করিব?

একটা আমি অপরটাকে বলিল,–তুই চলিয়া যা, আমি প্রকৃত ডমরুধর, তুই জাল ডমরুধর। অপরটাও সেই সেই কথা বলিল। দুই আমিতে ঘোরতর কলহ উপস্থিত হইল। ক্রমে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল। এমন সময় প্রভাত হইল। প্রভাত হইবামাত্র আমি একটা হইয়া যাইলাম। তখন আমার ধড়ে প্রাণ আসিল।

পাছে পুনরায় দুইটা হইয়া যায়, সেই দুশ্চিন্তায় সমস্ত দিন আমি মগ্ন রহিলাম। বিজয়াদশমীর পূজার পর পুরোহিত ঠাকুর যখন আমাকে মন্ত্র পড়াইলেন,—আয়ুৰ্দেহি যশো দেহি ভাগ্য ভগবতি দেহি মে,তখন আমার সুবল ঘোষের কথা মনে পড়িল। দুর্গোৎসব করিয়া, ভক্তিতে গদগদ হইয়া সুবল নিজেই ঠাকুরের সামনে প্রাণপণ যতনে শঙ্খ বাজাইলেন। শঙ্খ বাজাইতে গিয়া সুবলের গোলগোল বাহির হইয়া পড়িল। সেজন্য দশমীর দিন সুবল অন্য বর প্রার্থনা না করিয়া, হাতযোড় করিয়া ঠাকুরকে বলিলেন,–

ধন চাই না মা, যশ নাই না মা,
চাই না পুত্তুর বর।
শঙ্খ বাজাতে গিয়া বেরিয়েছে গোলগোল
তাই রক্ষা কর।।

প্রতিমা বিসর্জন হইয়া গেল। সন্ধ্যার সময় আমি এক সহস্র দুর্গানাম লিখিলাম। পাড়ার ছেলেরা আমাকে নমস্কার করিয়া গেল। আহারাদি করিয়া যথাসময়ে দোতালায় আমার ঘরে গিয়া শয়ন করিলাম। সিদ্ধি খাইয়া শরীর একটু গরম হইয়াছিল। সেজন্য আমার নিদ্রা হইল না। বিছানা হইতে উঠিয়া জানালার ধারে দাঁড়াইলাম। জ্যোৎস্না রাত্রি। বাড়ীর বাহিরে বাগানে আমার জানালার নীচে ও কে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে? সেই আর একটা আমি। হাত নাড়িয়া তাঁহাকে আমি বলিলাম,–যা চলিয়া যা! নীচের আমিও উপরের আমিকে সেই কথা বলিল। উপরের আমি নীচে নামিলাম। খিড়কিদ্বার খুলিয়া আমি বাইরে যাইলাম। ও মা! দেখি না নীচের আমিটা উপরে গিয়া ঠিক আমার ঘরের জানালার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। এ আমিটা একবার উপরে, একবার নীচে, ও আমিটা একবার উপরে, একবার নীচে, কতবার যে এইরূপ হইল, তাহা বলিতে পারি না। তৃতীয় পক্ষে এলোকেশীর সহিত আমার কি প্রকারে বিবাহ হইয়াছিল, গত বৎসর সে কথা তোমাদের নিকট বলিয়াছি। আমি এলাকেশীকে জাগাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,–এইমাত্র আমি যখন নীচে গিয়াছিলাম, তখন তোমার ঘরে আর একটা কে আসিয়াছিল। এলাকেশী বলিল,–মুখপোড়া, বুড়ো ডেকরা! এখনি ঝটাপেটা করিব। এলোকেশীর স্বভাবটা উগ্র। তাহাতে তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী।

জানালা বন্ধ করিয়া আমি পুনরায় শয়ন করিলাম। পরদিন রাত্রিতেও সেইরূপ হইল। প্রতি রাত্রিতে সেইরূপ উপরে একটা, নীচে একটা, দুইটা আমির উপদ্রব হইল। আমি ভাবিলাম যে, প্রতি রাত্রিতে আমার ঘরে গৌতম বাহিরে গৌতম হইতে লাগিল, এ ভাল কথা নহে!–চতুর্ভুজ বলিলেন,–এবার আমাকে ঠকাইতে পারিবে না। আমি জানি–

অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দাদরী তথা।
পঞ্চকন্যাঃ স্মরেন্নিত্যং মহাপাতকনাশনম্‌।

পুরোহিত বলিলেন,—সকল প্রাণীর সৌন্দর্য লইয়া ব্রহ্মা অহল্যাকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।–যস্যা ন বিদ্যতে হল্যং তেনাহত্যেতি বিতা।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–কার্তিকের কাঁধে বাঘ

ডমরুর বলিতে লাগিলেন,দুইটা আমির উপদ্রবে আমি জ্বালানতন হইলাম। দিনকতক সুন্দরবনে আমার আবাদে গিয়া বাস করি, এইরূপ মনন করিয়া আমি সুন্দরবনে আবাদে গমন করিলাম। এই সময় সেই স্থানে এক বাঘের উপদ্রব হইয়াছিল। গরু বাছুর মানুষ খাইয়া সকলকে বড় জ্বালাতন করিয়াছিল। মন্ত্রবলে বাঘের মুখ বন্ধ করিবার নিমিত্ত একদিন বৈকালবেলা আমি এক ফকিরের কাছে গমন করিতেছিলাম। পথে নানা স্থানে শুষ্ক ঘাস ও বৃক্ষপত্র পড়িয়াছিল। একস্থানে শুষ্কপত্রের ভিতর ছিদ্রের ন্যায় কি একটা দেখিতে পাইলাম। নিকটে যাইবামাত্র হুস করিয়া আমি এক গভীর গর্তের ভিতর পড়িয়া যাইলাম। সর্ব্বনাশ! দেখি না, সেই গর্তের ভিতর প্রকাণ্ড এক কেঁদো বাঘ রহিয়াছে। মুহূর্ত মধ্যে সকল কথা আমি বুঝিতে পারিলাম। বাঘ ধরিবার নিমিত্ত ধাঙ্গড় রেওতগণ গভীর গর্ত করিয়া তাঁহার উপর পাতানাতা চাপা দিয়া রাখিয়াছিল। বাঘ সেই গর্তে পড়িয়া গিয়াছিল। আর উঠিতে পারিতেছিল না। আমিও সেই গর্তে পড়িয়া যাইলাম।

গর্তে পড়িয়া ব্যাঘ্রের বিকট বদন দর্শন করিয়া আমার আত্মাপুরুষ শুকাইয়া গেল। আমি মনে করিলাম যে, ক্ষুধার্ত বাঘ এইবার আমাকে ছিঁড়িয়া খাইবে। প্রাণ ভরিয়া আমি মাকে ডাকিতে লাগিলাম। করাতি কলে ইদুর পড়িলে যেরূপ ছটফট করে, প্রাণভয়ে গর্তের ভিতর আমি সেইরূপ ছটফট্‌ করিতে লাগিলাম। বলিব কি ভাই, আমার উপর মা দুর্গার কৃপা! এক আশ্চর্য উপায়ে তিনি আমাকে রক্ষা করিলেন। আমি যেরূপ ফাঁদে পড়িয়াছিলাম, ব্যাঘ্রও সেইরূপ ফাদে পডিয়াছিল। ফাদে পড়িয়া আমার যেরূপ ভয় হইয়াছিল, তাঁহারও সেইরূপ ভয় হইয়াছিল। আমাকে ভক্ষণ না করিয়া, এক লম্ফ দিয়া সে আমার কাঁধের উপর উঠিল। আমার কাঁধে চড়িয়া যখন সে কতকটা উচ্চ হইল, তখন আর একলাফে সে গল্পে উপর উঠিল। তাহার পর বনে পলায়ন করিল।

সন্ধ্যার পর ধাঙ্গড়েরা আসিয়া গর্তের ভিতর হইতে আমাকে উঠাইল। তাহাদের সঙ্গে আমি বাসায় গমন করিলাম। আমি তখনও বাহিরে, কিন্তু দূর হইতে দেখিলাম যে, আর একটা আমি বাসার ভিতর গেঁট হইয়া বসিয়া আছি। আবার বাহিরে একটা আমি, ভিতরে একটা আমি। আবার ঘরে গৌতম বাহিরে গৌতম।

বনবাসী হইয়াও আমি সে উৎপাৎ হইতে নিষ্কৃতি করিতে পারিলাম না। তবে আর এ স্থানে থাকিয়া কি হইবে? তাহা ছাড়া আর একটা আমি সহসা যদি এই বনে আসিতে পারে, তাহা হইলে সে আমার গৃহেও থাকিতে পারে। সে স্থানে সে আমিটা কি করিতেছি না করিতেছি, তাঁহার ঠিক কি? সেজন্য বাড়ী ফিরিয়া যাইতে আমি মানস করিলাম।

সুন্দরবন হইতে আমাদের বাড়ী আসিতে হইলে অনেক দূর নৌকায় আসিতে হয়, তাহার পর সালতি লাগে, সে স্থান হইতে আমাদের গ্রাম পাঁচ ক্রোশ। সন্ধ্যার সময় সেই স্থানে আসিয়া আমার সালতি লাগিল। বাকী পাঁচ ক্রোশ পথ আমি হাঁটিয়া চলিলাম। ভেড়িতে একজনেরা মাছ ধরিতেছিল। তাঁহাদের নিকট হইতে একটি ভেটকি মাছ চাহিয়া লইলাম।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ছোটখাটো ভালমানুষ ভূত

ভেটকি মাছটা হাতে লইয়া আমি পথ চলিতে লাগিলাম। সকলেই জানে যে, মাছ দেখিলে ভূতের লোভ হয়। দুই ক্রোশ পথ গিয়াছি, রাত্রি প্রায় একপ্রহর হইয়াছে। এমন সময় একটি ভূত আমার সঙ্গ লইল। দেনা, দেনা, মাছ নো বলিয়া আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতে লাগিল। বলা বাহুল্য যে, আমার বিলক্ষণ ভয় হইল। কিন্তু ভূতকে মাছ দিলে আর রক্ষা নাই। তৎক্ষণাৎ সে মানুষের প্রাণবধ করে। সেজন্য তাঁহার কথা আমি শুনিলাম না, তাঁহাকে আমি মাছ দিলাম না। কিছুদূর গিয়াছি, এমন সময় আর একটা ভূত আসিয়া জুটিল। একটা আমার ডানদিকে, আর একটা আমার বামদিকে, আমার দুইপাশে দুইটা ভূত,হাত পাতিয়া নো, নো বলিতে বলিতে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলিল। কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে আমি মাছ দিলাম না। অবশেষে তাঁহারা আর লোভ সামলাইতে পারিল না। মাছের মাথার দিক্ কাকোতে হাত দিয়া আমি ধরিয়াছিলাম, মাছের অপর দিক্‌ তাঁহারা খপ করিয়া ধরিয়া ফেলিল। অপর দিক্ ধরিয়া তাঁহারা মাছটি আমার হাত হইতে কাড়িয়া লইতে চেষ্টা করিল। আমি মাছের কাকো ধরিয়া, তাঁহারা মাছের লেজার দিক্‌ ধরিয়া; সেই মাঠের মাঝখানে ঘোরতর টানাটানি হইতে লাগিল। কিন্তু আমি একা, ভূত হইল দুইজন। দুইজনের সঙ্গে আমি কতক্ষণ টানাটানি করিতে পারি? ক্রমে আমি শ্রান্ত হইয়া পড়িলাম। তখন নিরূপায় হইয়া একটা ভূতের হাতে আমি কামড় মারিলাম। বলিব কি হে, ভূতের হাতের কথা। ঠিক যেন কাঠের উপর কামড় মারিলাম। তাহার পর দুর্গন্ধ। সেইরূপ দুর্গন্ধ মানুষের নাকে কখনও প্রবেশ করে নাই।

আমার দাঁত নাই সত্য, কিন্তু সেই ফোকলা মুখের এক কামড়েই ভূত দুইটি পলায়ন করিল। তখন আমার মুখে দুর্গন্ধ! দুর্গন্ধে আমি ক্রমাগত উদগার করিতে লাগিলাম। সেইখানে বসিয়া ন্যাকার ন্যাকার ন্যাকার! মনে হইল পেটের নাড়িভুড়ি বুঝি বাহির হইয়া গেল। নিশ্চয় বুঝিলাম যে, এইবার আমার আসন্নকাল উপস্থিত হইয়াছে। আমি সেই স্থানে চক্ষু বুজিয়া শুইয়া পড়িলাম ও নন্দীর অভিশাপের কথা ভাবিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে কে যেন আমার মাথায় ও মুখে জল দিতেছে এইরূপ বোধ হইল। তাহাতে শরীর কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। চক্ষু চাহিয়া দেখিলাম, কি আশ্চর্য্য, এ আবার কি? দেখিলাম যে, ছোটখাটো একটি নূতন ভূত আসিয়া সেবাশুশ্রূষা করিতেছে। আমি উঠিয়া বসিলাম। তৎক্ষণাৎ ভূতটি কিছুদূরে পলায়ন করিল। আমার মাছটি সে চুরি করে নাই। মাছটি সেই স্থানে পড়িয়া ছিল। মাছটি লইয়া ধীরে ধীরে আমি আমাদের গ্রাম অভিমুখে আসিতে লাগিলাম।

নূতন ভূতটি দূরে দূরে আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিতে লাগিল। সে আমার নিকট হইতে মাছ চাহিল না। কোন কথাই বলিল না। দেখিলাম, সে অতি ভালমানুষ ভূত। আর দেখিলাম যে, অতি ভীত স্বভাবের ভূত। একবার আমি ডাকিলাম, আর অমনি সে ভয়ে দূরে পলায়ন করিল। একবার আমি হচিলাম, আর অমনি সে পলায়ন করিল। একবার একখানি গ্রামে কুকুর ডাকিয়া উঠিল, অমনি সে গ্রাম হইতে অনেক দূরে গিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু সে একেবারে আমাকে ছাড়িয়া গেল না। ভয় পাইয়া একবার পলায়ন করে, তাহার পর পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হয়। এরূপ ভীরু স্বভাবের ভূত কখনও দেখি নাই। তখন আমি বুঝিলাম, মহাদেব যে আমাকে একটি ছোটখাটো ভালমানুষ ভূত দিবেন বলিয়াছিলেন, এটি সেই ভূত।

অবশেষে আমি তাঁহাকে বলিলাম,–দেখ ভালমানুষ ভূত! তুমি আমার উপকার করিয়াছ, তুমি আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছ। আমার সহিত তুমি চল, দুইখানা ভাজামাছ তোমাকে আমি প্রদান করিব।

ঘরে গিয়া এলোকেশীকে আমি মাছটি দিলাম। রান্নাঘরে এলোকেশী মাছ ভাজিতে লাগিল। কতকগুলি মাছ যেই ভাজা হইয়াছে, আর রান্নাঘরের ঘুলঘুলি দিয়া ভূতটি হাত বাড়াইল। তাঁহার হাতে চারিখানি মাছ দিলাম, আর তাঁহাকে আমি বলিলাম,–পুনরায় কাল এস, তোমাকে ভালমাছ দিব।

পরদিন বৈকালবেলা খুদিরাম মণ্ডলের পুষ্করিণীতে চুপি চুপি হাতসূতা ফেলিয়া একটি ইমাছ ধরিলাম! সন্ধ্যার সময় মাছটি আনিয়া এলোকেশীকে দিলাম। বলা বাহুল্য যে, আমি নিজের পুকুরের মাছ খরচ করি না, তাহা আমি বিক্রয় করি। সন্ধ্যার পর এলোকেশী যখন মাছ ভাজিতেছিল, তখন আমি রান্নাঘরে গমন করিলাম। আমার সাড়া পাইয়া ভূতটি ঘুলঘুলি দিয়া হাত বাড়াইল। তাঁহার হাতে আমি মাছ দিলাম। এইরূপে প্রতিদিন খুদিরামের পুকুর হইতে গোপনে মাছ ধরিয়া ভূতটিকে আমি খাইতে দিতে লাগিলাম।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–এলোকেশীর রূপমাধুরী

একদিন এলোকেশী সহসা আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,—মাছ ভাজিবার সময়, প্রতিদিন তুমি রান্নাঘরে এস কেন? দিনের বেলা না আনিয়া প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় পুকুর হইতে তুমি মাছ লইয়া এস কেন? ঘুলঘুলির নিকট গিয়া কাহার সহিত তুমি চুপি চুপি কথাবার্তা কর? দুর্লভীকে মাছ দাও বুঝি?

দুর্লভী বাঙ্গিনীকে তোমরা সকলেই জান। হাসিতে হাসিতে একদিন দুই একটা তামাসা করিয়াছিলাম। আমি এমন কার্তিক পুরুষ! সেজন্য আমার স্ত্রীর মনে সর্ব্বদা সন্দেহ।

আমি বলিলাম,—এলোকেশী! ও দুর্লভী নয়। আবাদ হইতে এবার আমি একটি ভূত আনিয়াছি। আমি মনে করিয়াছি যে, ভূতটি ভালরূপে পোষ মানিলে উহাকে কলিকাতায় লইয়া যাইব। যাহারা ঘোড়ার নাচ করে, তাহাদিগের নিকট ভূতটিকে বিক্রয় করিব। অনেক টাকা পাইব। কিন্তু এ ভূতটি ভীরু ভূত। তুমি ঘুলঘুলির নিকট যাইও না। তোমার চেহারা দেখিলে সে ভয়ে পলাইবে। গত বৎসর সন্ন্যাসীসঙ্কটের গল্প বলিবার সময় আমি এলোকেশীর রূপের পরিচয় দিয়াছিলাম। আমার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে তাই, তা না হলে এলোকেশীকে দেখিলে ভীমসেনও বোধ হয় আতঙ্কে পলায়ন করেন।

এলোকেশীর মুখ হাঁড়ি হইল। মাছ ভাজিতে লাগিল, আর গজর গজর করিয়া বলিতে লাগিল,–আমার রূপ দেখিলে ভূত ভয়ে পলাইবে! আমার রূপ দেখিলে ভূত পলাইবে। বটে!

পরদিন সন্ধ্যার সময় নবাই ঘোষের পুষ্করিণী হইতে বড় একটা মিরগেল মাছ ধরিয়া আমি এলোকেশীকে দিলাম। এলোকেশী সেই মাছ যখন ভাজিতেছিল, সেই সময় যথারীতি আমি রান্নাঘরে গমন করিলাম। ভূতটি যথারীতি ঘুলঘুলি পথে হাত বাড়াইল। মাছ লইয়া যেমন তাঁহাকে আমি দিতেছি, এমন সময় আমার পশ্চাতে গিয়া এলোকেশী বলিয়া উঠিল,—দুর্লভি। হারামজাদি! তোর আস্পর্ধা তো কম নয়!

ভূতটি একবার মাত্র এলোকেশীর মুখপানে চাহিয়া দেখিল। এলোকেশীর সেই অদ্ভুত মুখশ্রী দেখিয়া আতঙ্কে রুদ্ধশ্বাসে সে স্থান হইতে সে পলায়ন করিল।

করিলে কি! করিলে কি! এই কথা বলিতে বলিতে তৎক্ষণাৎ আমি ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম, তৎক্ষণাৎ বাটীর ভিতর হইতে বাহির হইলাম, তৎক্ষণাৎ বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। মনে করিলাম, বুঝাইয়া-সুঝাইয়া ভূতটিকে ফিরাইয়া আনিব। বাগানে গিয়া দেখিলাম যে, ভূতটি অতি দ্রুতবেগে আমার বাগানের ঈষাণ কোণের দিকে দৌড়িয়া যাইতেছে। সেই স্থানে খেজুর গাছের ন্যায় অপূর্ব্ব গাছ ছিল। সে গাছটিতে আমি রস কাটিতে দিতাম না, সে গাছটিকে স্বতন্ত্র ভাবে আমি ঘিরিয়া রাখিতাম। প্রাণভরে ভূতটি সেই গাছটির উপর উঠিল। আর আমি ভাবিলাম,—যাঃ! এইবার ভূতটির প্রাণ বিনষ্ট হইল। আমার সখের ভূত এইবার মারা গেল। মহাদেব হয় তো আমার উপর রাগ করিবেন।

বিস্ময়ে পুরোহিত জিজ্ঞাসা করিলেন,—ভূতের প্রাণ বিনষ্ট হইবে? খেজুর গাছে উঠিয়া ভূত মারা পড়িবে! ভূত মারা পড়িবে। ভূত কি কখন মারা যায়?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—পুরোহিতমহাশয় আপনি সাদাসিদে লোক, আপনি এ সব কথা বুঝিতে পারিবেন না। এ সামান্য খেজুর গাছ নহে। একবার একজন ধাঙ্গড়ের সঙ্গে আমি সুন্দরবনের ভিতর বেড়াইতে ছিলাম। এ স্থানে এক গাছের নিম্নে স্থূপীকৃত হাড় পড়িয়াছিল। প্রথম মনে করিলাম—মানুষের অস্থি, ব্যাঘ্রগণ বোধ হয় মানুষ ধরিয়া এই স্থানে আনিয়া ভক্ষণ করে। কিন্তু তাহার পর আরও নিরীক্ষণ করিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, সে সব বানরের হাড়। গাছটি দেখিলাম যে, হেঁতালও নহে, খেজুরও নহে, খেজুরের ন্যায় এক প্রকার বৃক্ষ। কিন্তু খেজুর গাছের পাতাগুলি যেমন উচ্চ হইয়া থাকে, ইহার পাতা সেরূপ ছিল না, ইহার যাবতীয় কাচা পাতা নিম্নমুখ হইয়া গাছের গায়ে লাগিয়াছিল। সেই ফল পাড়িতে ধাঙ্গড়কে আমি গাছের উপর উঠিতে বলিলাম। ধাঙ্গড় গাছে উঠিল; পাতার ভিতর দিয়া যেই গাছের মাথার নিকট উঠিয়াছে, আর পাতাগুলি তৎক্ষণাৎ সোজা হইয়া তাঁহাকে ঢাকিয়া ফেলিল। সেই সময় ধাঙ্গড়ও প্রাণ গেল প্রাণ গেল বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। তাহার পর ধাঙ্গড়ের চর্মাবৃত ভগ্ন হাড়গুলি নীচে পড়িতে লাগিল। তাঁহার পাতাগুলি পুনরায় নিম্ন হইয়া গাছের গায়ে আসিয়া লাগিল। এই ভয়ানক ব্যাপার দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া আমি দাঁড়াইয়া রহিলাম, তাহার পর নিকটে গিয়া দেখিলাম যে, এই ভয়াবহ বৃক্ষ ধাঙ্গড়ের রক্ত-মাংস মায় হাড়ের রস পর্যন্ত চুষিয়া খাইয়াছে।

চতুর্ভুজ বলিলেন,–পুস্তকে পড়িয়াছি যে, কয়েক প্রকার উদ্ভিদ আছে, তাঁহারা পোকা-মাকড় ধরিয়া ভক্ষণ করে। কিন্তু জীব-জন্তু ধরিয়া খায়, বানর ধরিয়া খায়, মানুষ ধরিয়া খায়, এরূপ বৃক্ষের কথা কখন শুনি নাই।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—আমি তাহা স্বচক্ষে দেখিছি। তলায় অনেকগুলি সে গাছের বীজ পড়িয়াছিল। আমি গুটিকতক বীজ আনিয়া আমার বাগানের এককোণে পুঁতিয়াছিলাম। তাহা হইতে একটি গাছ হইয়াছিল। সে গাছ আমি সর্ব্বদা ঘিরিয়া রাখিলাম, তাঁহাকেও তাঁহার নিকটে যাইতে দিতাম না। ভূত যখন সেই গাছের উপর গিয়া উঠিল, তখন আমি তার প্রাণের আশা ছাড়িয়া দিলাম।

ক্ৰমে যাহা ভয় করিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিল। যেই ভূত গাছের মাথার নিকট গিয়া উঠিল, আর সেই পাতাগুলি সোজা উচ্চ হইয়া দাঁড়াইল, ভূতের সর্ব্ব শরীর ঢাকিয়া ফেলিল, ভূতের কৃষ্ণবর্ণ রক্ত গাছের গা দিয়া দরদর ধারায় বহিয়া পড়িল। অবশেষে ভূতের খোসানি নিম্নে পতিত হইল।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ–মা তুমি কে

লোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—ভূতের খোলা! সে কিরূপ?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—ভূতের অস্থি-মাংস-রক্ত সমুদয় এই ভয়ঙ্কর গাছ চুষিয়া খাইয়াছিল। ছারপোকার খোসা দেখিয়াছ? মটর-মুসুরির খোসা দেখিয়াছ? ভূতের খোসাও সেইরূপ। তবে অনেক বড়। যাহা হউক, পরদিন এই দুরন্ত গাছটিকে আমি কাটিয়া ফেলিলাম, তা না হইলে তোমাদিগকে আমি দেখাইতে পারিতাম।

সে রাত্রে এলোকেশীর সহিত আমার তুমুল ঝগড়া হইল। আমি বলিলাম যে,–দুর্লভী দুর্লভী করিয়া তুমি পাগল হইয়াছ। এমন সুন্দর ভূতটিকে তুমি তাড়াইলে, ভূতয় পাপে তুমি কলুষিত হইলে, আমার টাকা তুমি লোকসান করিলেন।

এইরূপ ঝগড়া হইতেছে, এমন সময় একবার জানালার ধারে গিয়া দাঁড়াইলাম, দেখিলাম যে, দ্বিতীয় আমি যথারীতি বাগানে দাঁড়াইয়া আছি, তাঁহাকে দেখাইয়া আমি এলোকেশীকে গঞ্জনা দিবার নিমিত্ত বলিলাম,তুমি দুর্লভী দুর্লভী বল, দেখ দেখি ঐ নীচেতে কে? তোমারও যে—ঘরে গৌতম বাহিরে গৌতম।

এই কথা বলিবামাত্র এলোকেশীর সর্ব্ব শরীর রাগে জ্বলিয়া উঠিল। নিকটে এক মুড়া ঝাড়ু পড়িয়াছিল। তাহা লইয়া এলোকেশী আমাকে সবলে প্রহার করিতে লাগিল। আমার সর্ব্বশরীরে যেন বিষের জ্বালা ধরিল। গায়ে খেঙ্গরা কাটি ফুটিয়া যাইতে লাগিল। আর নয়, আর নয় বলিয়া আমি যত চীৎকার করি, এলোকেশী ততই আমাকে প্রহার করে। মাথার টাক হইতে পায়ের নখ পর্যন্ত প্রহারের চোটে ক্ষতবিক্ষত হইল। কিন্তু এই দুঃখের সময় এক সুখের বিষয় হইল। জানালা দিয়া একবার নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, সেই বাগানের আমিও ঝাঁটার আঘাতে ব্যথিত হইয়া গায়ে হাত বুলাইতেছি। তাহার পর দেখি না যে, দুই আমি একসঙ্গে ঘরের ভিতর রহিয়াছি। তাহার পর দেখি না যে, একটি আমি আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের ন্যায় ধোঁয়ার মত হইয়া গেল। তাহার পর সেই ধুমটি সোৎ করিয়া আমার নাকের ভিতর প্রবেশ করিল। এতদিন আমি দুইখানা হইয়াছিলাম। আজ এলোকেশীর ঝাঁটার আঘাতে পুনরায় আমি একখানা হইলাম।।

এলোকেশীর এই অমানুষিক কাজ দেখিয়া আমি ঘোরতর বিস্মিত হইলাম। প্রহারের জ্বালা আমি ভুলিয়া যাইলাম। গলায় কাপড় দিয়া যোড়হাতে এলোকেশীর পায়ে পড়িয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–মা, তুমি কে বল?

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ–অজাযুদ্ধে ঋষিশ্রান্ধে বাহারম্ভে লঘুক্রিয়া

আমার এইরূপ বিনয়বাক্যে এলোকেশী কিছুমাত্র সন্তুষ্ট হইল না। দ্বিগুণভাবে পুনরায় প্রহার আরম্ভ করিল। এই প্রহারে আর একটি আমার উপকার হইল। নন্দীর অভিশাপ মোচন হইয়া গেল। আমার আত্মবিস্মৃতি কিয়ৎপরিমাণে ঘুচিয়া গেল। আমি কে, তখন বুঝিতে পারিলাম। সোড়হাতে তখন আমি মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম।মা? আমি অপরাধ করিয়াছি। বিবাহের সাধ আমার মিটিয়া গিয়াছে। আর ঝাঁটা-পেটা সইতে পারি না। আমাকে কৈলাস পর্ব্বতে লইয়া চল। সেস্থানে চিরকাল আমি আইবুড়ো হইয়া থাকিব। চামুণ্ডা রূপিণী এলোকেশীর সহিত আর আমি সংসারধর্ম্ম করিতে চাই না।

মা কোন উত্তর দিলেন না। আমি শুনিয়াছিলাম যে, শৈশবকালে কৃত্তিকা প্রভৃতি ছয়টি নক্ষত্র আমাকে প্রতিপালন করিয়াছিলেন। এখন আমি তাহাদিগকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম,–জননীগণ! যখন নিঃসহায় অবস্থায় শরবনে আমি পড়িয়াছিলাম, তখন তোমরা আমাকে রক্ষা করিয়াছিলে। ছয় জনের স্তন্যপান করিবার নিমিত্ত ছয়টি মুখ আমি বাহির করিয়াছিলাম। দুর্দান্ত এলোকেশীর খেরার প্রহার আর আমি সহ্য করিতে পারি না। আমার শরীর জরজর হইয়া গেল। তোমরা আমাকে রক্ষা কর।

আশ্চর্যের কথা বলিব কি ভাই, তৎক্ষণাৎ আকাশবাণী হইল,–পৃথিবীতে তোমার আরও একশত বৎসর পরমায়ু আছে। বৎস! সুখে এই স্থানে এখন থাক। আরও একশত বৎসর এলোকেশীকে লইয়া ঘর্যা কর। তাহার পর কৈলাসে গমন করিও।

এলাকেশী এই সময় ক্লান্ত হইয়া পড়িল। আর তাঁহার হাত চলিল না। সেজন্য সে যাত্রা আমার প্রাণ বাঁচিয়া গেল। দেখ লম্বোদর ভায়া। মা দুর্গা বলিয়াছিলেন, তাহা তোমার মনে আছে তো? অতি সংক্ষেপে তিনি আমাকে পূজা করিতে বলিয়াছেন। এ বৎসর পূজার কোন উপকরণ আমি ক্রয় করব না। গণেশের ইদুরের কাপড়টুকু পর্যন্ত দিব না। সমুদয় গঙ্গাজল দিয়া সারিব। মায়ের আত্মা! তাহা ব্যতীত আমাদের এই ঘোষেদের কাটিগঙ্গার জল অতি পবিত্র। তাহা অপেক্ষা বহুমূল্য পদার্থ পৃথিবীতে আর কি আছে?

পুরোহিত বলিলেন, তোমার পূজা তাহা হইলে এ বৎসর ঋষিশ্রাদ্ধের ন্যায় হইবে।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–ঋষিশ্রাদ্ধ কিরূপ?

পুরোহিত উত্তর করিলেন,–অজাযুদ্ধে ঋষিশ্রাদ্ধে প্রভাতে মেঘডম্বরে। দপত্যোঃ কলহে চৈব বহুরম্ভে লঘুক্রিয়া। দুইটা ছাগলে বিবাদ হইলে যখন তারা আরক্ত নয়নে শৃঙ্গ তুলিয়া দণ্ডায়মান হয়, তখন বোধ হয়, এবার বুঝি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রসাতলে যাইবে। কিন্তু শেষে কেবলমাত্র একটি ঠু। ঋষিদিগের শ্রাদ্ধে বিশ জন ব্রাহ্মণে ক্রমাগত কলার খোলা কাটিতে থাকেন। মনে হয়, কত ধুমধাম না হইবে। কিন্তু ঐ খোলা কাটাই সার। এ দুর্গোৎসবেও দেখিতেছি, কেবল প্রতিমা, ঢোল ও গঙ্গাজল।

ডমরুধর বলিলেন,–মায়ের আজ্ঞা! ভাল মনে করিয়া দিয়াছেন। আমি আমার আবাদের দুইজন ধাঙ্গড়কে তাহাদের সেই চেপটা মাদল আনিয়া পূজার সময় বাজাইতে বলিয়াছি। তাহাদিগকে কিছু দিতে হইবে না। দুইবেলা দুইমুঠা ভাত দিলেই হইবে। পূজার কয়দিন আমার বাড়ীতে রান্না হইবে না। পূজার কয়দিন লোকের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ খাইয়া আমরা চালাইব। লম্বোদর ভাষা! তুমি সেই কয়দিন আমার ধাঙ্গড় দুইজনকে দুইটি করিয়া ভাত দিও। বুঝিয়াছ তো?

লম্বোদর উত্তর করিলেন,—বিলক্ষণ বুঝিয়াছি, কিন্তু এ পূজা তোমার না করিলে কি নয়? মুখ কুঞ্চিত করিয়া নাকিসুরে ডমরুধর উত্তর করিলেন,—তুমি তো বলিলে। কিন্তু পূজা না করি, তাহা হইলে লোকের কাছ হইতে প্রণামীটি কি করিয়া আদায় করি? পুরোহিত আতি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিলেন,

কার্ত্তিকেয়ং নমস্যামি গৌরীপুত্রং সূতপ্রদম্‌।
ষড়াননং মহাভাগং দৈত্যদর্পনিসূদনম্‌।।

চতুর্থ গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের শবসাধনা

ডমরুধরের পূজার দালান। প্রস্তুত। পঞ্চমীর দিন। পূর্ব্বের মতই প্রতিমার পার্শ্বে বসিয়া ডমরুর বন্ধুবর্গের সহিত গল্পগাছা করিতেছেন।

লোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—তোমার প্রতিমায় এ বত্সর ব্যাঘ্র উচ্চ কেন? কার্তিকের ওরূপ বেশ কেন?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—ও কথা আর কেন বল ভাই। যে বিপদে পড়িয়াছিলাম, তা আমিই জানি। সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন,–কি হইয়াছিল?

লম্বোদর বলিলেন,–আবার বুঝি একটা আজগুবি গল্পের সূচনা হইতেছে!

ডমরুধর বলিলেন,–তোমাদের শুনিয়া কাজ কি! আমি বলিতে চাই না।

সকলের কৌতূহল জন্মিল। বলিবার নিমিত্ত সকলে সাধ্য-সাধনা করিতে লাগিলেন। অনেক সাধ্য-সাধনার পর ডমরুর বলিতে আরম্ভ করিলেন।

সন্ন্যাসী-হাঙ্গামায় আমার সূক্ষ্ম শরীর আকাশে ভ্রমণ করিয়াছিল। অবশেষে যমালয়ে গিয়া প্রথমে মান্য পরে অমান্য হইয়াছিল। সে গল্প পূর্ব্বে আমি বলিয়াছি। সেই অবধি সশরীরে আকাশ-ভ্ৰমণ করিতে আমার সাধ হইয়াছিল।

যতদূর চলে, মায়ের পূজা আমি গঙ্গাজল দিয়া সারি। গঙ্গাজলে মা যত পরিতোষ লাভ করেন, এমন আর কিছুতেই নয়। বিশেষতঃ আমাদের কাটিগঙ্গার জল। কিন্তু পূজার জন্য প্রজাদের নিকট হইতে আমি ঘৃত, মধু, পাঁঠা প্রভৃতি আদায় করি। তাহা আনিবার নিমিত্ত এই আশ্বিন মাসে আমি সুন্দরবনে আমার আবাদে গিয়াছিলাম।

একদিন বাসায় বসিয়া আছি, এমন সময় দুইজন ফকির পীর গোরাঠাদের গান করিতে আসিল। গান গাহিয়া বার্ষিক চাহিল। আমার কাছারি হইতে পূজার সময় তাঁহারা চারি আনা বার্ষিক পায়। এবার সে বার্ষিক আমি বন্ধ করিয়া দিলাম। প্রথম তাঁহারা অনেক মিনতি করিল। শেষে যখন দেখিল যে, তাহাদের বচনে আমি ভিজিবার ছেলে নই, তখন আমাকে অভিশাপ দিয়া গেল,—পীর গোরাদের ব্যাঘ্ৰ তোমাকে গ্রাস করুক।

শুনিলাম যে, পীর গোরাচাঁদ এক সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। প্রকাণ্ড এক ব্যাঘ্র চড়িয়া সুন্দরবন অঞ্চলে তিনি ভ্রমণ করিতেন। তাঁহার অনেক ধন ছিল। যাহাকে তিনি যাহা বলিতেন, তাহাই ফলিত।

আমি মনে মনে ভাবিলাম যে, সিদ্ধ হওয়া ব্যবসাটি তবে মন্দ নহে। আমিও সিদ্ধ হইব। আমি ডমরুধর; আমার অসাধ্য কি আছে?

সিদ্ধ হইবার সহজ উপায় সকলের নিকট জানিয়া লইলাম। তাঁহারা বলিল, গভীর রাত্রিতে শশানে গিয়া মড়ার পিঠে বসিয়া জপ করিতে হয়। বাঘ ভাল্লুক ভূত প্রেত আসিয়া ভয় প্রদর্শন করে। ভয় করিলেই বিপদ, না ভয় করিলে দেবী স্বয়ং আসিয়া বর প্রদান করেন। ভূত প্রেতদিগের নিমিত্ত সঙ্গে মদ ও মুড়ি-কড়াই ভাজা লইয়া যাইতে হয়।

আমি ভাবিলাম, এ তো সহজ কথা। মড়াকে আমার ভয় কি? মড়া আমি গুলিয়া খাইতে পারি। বাঘকেও আমার ভয় নাই। মন্ত্রবলে আমি বাঘের মুখ বন্ধ করিয়া দিতে পারি। ভূতকে আমার ভয় নাই। মাছ লইয়া ভূতের সঙ্গে সঙ্গে একবার কাড়াকাড়ি করিয়াছিলাম। শেষে ভূতের হাতে কামড় মারিয়াছিলাম। আমার দাঁত নাই, তাই, দাঁত থাকিলে ভূতের হাতে এখনও ঘা থাকিত। তাহার পর একটি ভূত পুষিয়াছিলাম। এলোকেশী যদি সব পণ্ড না করিত, তাহা হইলে পোষা ভূতটি এখনও আমার কাছে থাকিত।

দুই চারি দিন পরে সেস্থানে একটি লোক মরিয়া গেল। সে মজুরি করিতে আসিয়াছিল; আপনার লোক কেহ ছিল না। তাঁহার মৃতদেহ লোকে গাঙে ফেলিয়া দিল। কুম্ভীরে খাইতে না খাইতে আমি মড়াটিকে টানিয়া উপরে তুলিলাম। তাহার পর যে স্থানে লোকে মড়া পোড়ায়, সেই স্থানে রাখিয়া আসিলাম। এক বোতল মদ ও কিছু মুড়ি-কড়াইভাজা সংগ্রহ করিলাম।

গভীর রাত্রিতে একাকী শ্মশানে গমন করিলাম। মড়াটির মুখে মদ ও মুড়ি কড়াইভাজা দিলাম। কুড় কুড় করিয়া খাইতে লাগিল। তাঁহাকে উপুড় করিয়া পিঠে বসিয়া আমি কঠোর তপ আরম্ভ করিলাম। তোমাদের ও সব জপের মন্ত্র আমি জানি না। হিড়িং বিড়িং আমি মানি না। কেবল দেবীর পাদপদ্ম আমি ধ্যান করিতে লাগিলাম।

প্রথম আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইল। অবিরত বিদ্যুতের ঝলকে পৃথিবী ঝলসিত হইতে লাগিল, ঘন ঘন বজ্রনিনাদে পৃথিবী কম্পিত হইল। আমি ভীত হইলাম না। চক্ষু বুজিয়া মায়ের পাদপদ্ম ধ্যান করিতে লাগিলাম।

তাহার পর বন্য মহিষ আসিল। আমার সম্মুখে লম্ফঝম্ফ করিতে লাগিল। শৃঙ্গাঘাতে পৃথিবী বিদীর্ণ করিল। আমি ভয় করিলাম না। চক্ষু মুদিত করিয়া মায়ের পাদপদ্ম ধ্যান করিতে লাগিলাম।।

ব্যাঘ্ৰ আসিল। তাঁহার গভীর গর্জনে বনে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। আমি চক্ষু চাহিলাম না। এক মনে দেবীর পাদপদ্ম ধ্যান করিতে লাগিলাম।

ভূত প্রেত দানা দৈত্য আসিল। আমার সম্মুখে নাচিতে লাগিল। খিল্ খিল হাসিতে চারিদিক পূর্ণ করিলাম। আমি ভয় পাইলাম না, চক্ষু চাহিলাম না, কেবল বলিলাম,ঐ মদ মুড়ি কড়াইভাজা আছে। খাও, খাইয়া ঘরে যাও। তাহার পর পুনরায় ধ্যানে মগ্ন হইলাম।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের সিদ্ধিলাভ

এইরূপ কত যে বিভীষিকা হইল, সে কথা তোমাদিগকে কি আর বলিব! অবশেষে আমার পরলোকগতা মাতা আসিলেন। তিনি বলিলেন,–বাছা ডমরুধর! অনেক তপ করিয়াছ, আর কাজ নাই, এখন ঘরে চল, এখানে বসিয়া থাকিলে অসুখ করিবে। আমি কোন উত্তর করিলাম না।

তাহার পর আমার স্ত্রী এলোকেশী আসিলেন। তিনি বলিলেন,–ঘরে চল্। না গেলে এখনি কান ধরিয়া লইয়া যাইব। তোমরা সকলেই জান যে, এলোকেশীকে আমি যমের মত ভয় করি। তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া প্রথম আমার হৃৎকম্প হইয়াছিল। কিন্তু আমার স্মরণ হইল যে, এ সব মিথ্যা। তখন আমি পুনরায় ধ্যানে প্রবৃত্ত হইলাম।

আমার সে কঠোর তপ কেহ কিছুতেই ভঙ্গ করিতে পারিল না, তখন মা দুর্গা স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মা বলিলেন,—ডমরুধর! তোমার কঠোর তপস্যায় আমি সন্তোষ লাভ করিয়াছি। এক্ষণে বর প্রার্থনা কর।

আমি চক্ষু চাহিয়া দেখিলাম যে, ঠিক যেমন এই প্রতিমা, দেবী সেই বেশে আমার নিকট আগমন করিয়াছেন। মা দশভুজা, দক্ষিণে গণেশ ও লক্ষ্মী, বামে সরস্বতী ও কার্ত্তিক, নিম্নে সিংহ ও অসুর।

মায়ের সেই উজ্জ্বল রূপ দেখিয়া আমি হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। চারিদিক আঁধার দেখিতে লাগিলাম। মনের উপরও যেন ছানি পড়িয়া গেল। কি বর চাহিব, তাহা খুঁজিয়া পাইলাম না। আমার দূরদৃষ্ট! তা না হইলে কাছে লক্ষ্মী ছিলেন। যদি ধন চাহিতাম, এত ধন তিনি দিতেন যে, রাখিতে ঘরে স্থান হইত না। কাছে সরস্বতী ছিলেন, যদি বিদ্যা চাহিতাম, তাহা হইলে আমিও একটা বি-এ, এমএ পাস করা ফোচকে ছোঁড়া হইতে পারিতাম। কিন্তু সে জ্ঞান আমার হইল না। কার্তিকের ময়ুরটি দেখিয়া আকাশ-ভ্রমণের সাধ আমার মনে উদয় হইল। আমি বলিলাম,–যদি বর দিবেই, তবে কার্তিকের ময়ুরটি আমাকে প্রদান কর। উহার পিঠে চড়িয়া আমি আকাশ-ভ্রমণ করিব।

দেবী বলিলেন,—ছি বাছা, ও কথা বলিও না। কার্ত্তিক ছেলেমানুষ। তাঁহার ময়ুরটি দিলে সে কাদিবে। আমি উত্তর করিলাম,–অন্য বর চাই না মা! নিদেন সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিনের জন্য ময়ুরটিকে দাও, মা! তাঁহার পিঠে চড়িয়া সমস্ত দিন আকাশ ভ্রমণ করিয়া সন্ধ্যাবেলা তোমাদের ময়ুর তোমাদিগকে ফিরাইয়া দিব। যদি না দাও তবে পুনরায় আমি এই তপে বসিলাম। –দেবীর ভয় হইল। তিনি বলিলেন,–না বাছা! আর তপস্যা করিও না। তোমার তপে পৃথিবী তাপিত হইয়াছে। আর তপ করিলে মহাপ্রলয়ের অনল উখিত হইয়া সমস্ত জগৎ ভস্ম হইয়া যাইবে।

এই কথা বলিয়া কার্তিকের সহিত দেবী চুপি চুপি কি পরামর্শ করিলেন। তাহার পর তিনি বলিলেন,—আচ্ছা বাছা, একদিনের জন্য কার্ত্তিক তোমাকে ময়ুরটি প্রদান করিবে। আমার সিংহের একটি বাচ্চা দিয়া কার্ত্তিককে আমি ভুলাইয়া রাখিব। কিন্তু ডমরুধর! সন্ধ্যা হইলেই ময়ূরকে তুমি ছাড়িয়া দিবে। না ছাড়িয়া দিলে, সে তোমাকে লবণ, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত, ক্ষীর, দধিসমুদ্র পারে স্বাদুসমুদ্রে লইয়া ফেলিবে। সে সমুদ্রে তুমি হাবুড়ুবু খাইয়া মরিবে।–এইরূপ সাবধান করিয়া দেবী আমাকে ময়ূরটি প্রদান করিলেন। কার্তিককে সিংহশাবক দিলেন। সিংহের বাচ্চাটি কোলে লইয়া কার্ত্তিক কৈলাসে গমন করিলেন। প্রতিমার যেরূপ গঠিত হয়, কার্তিকের ময়ূর প্রকৃত সেরূপ নহে। সে ময়ূর কিরূপ, খড়ি দিয়া এই শানের উপর আমি তোমাদিগকে আঁকিয়া দেখাই।

ময়ূরের ছবি দেখিতে সকলে তাঁহার উপর ঝুঁকিয়া পড়িলেন। ছবি দেখিয়া লম্বোদর একটু হাসিলেন, কুপিত হইয়া ডমরুর বলিলেন,–হাসিও না। এ তোমাদের পৃথিবীর কাক-কেঁকে প্যাকম-ধরা ময়ূর নহে। এ আসল কার্তিকের কেলাসি ময়ূর।

তাহার পর ডমরুধর পুনরায় গল্প আরম্ভ করিলেন,–গণেশ, লক্ষ্মী, দুর্গা ও সরস্বতী। প্রণাম করিয়া আমি ময়ূরের পিঠে চড়িয়া বসিলাম। তাঁহাকে আকাশের দিকে চালাইতে চেষ্টা করিলাম। ময়ূর উপরে উঠিল না। তখন দেবী হাসিয়া বলিলেন,–মন্ত্র না পড়িলে নরলোককে লইয়া ময়ূর উপরে উঠিবে না। শূন্যে আরোহণ করিবার সময় তুমি এই মন্ত্রটি পাঠ করিবে,–জয় কৈলাসবাসিনী মহেশগৃহিণী গণেশজননী।

তাহার পর সন্ধ্যাবেলা তোমার বাসার উপরে আসিয়া এই মন্ত্রটি বলিবে—জয় কৈলাসবাসিনী দ্বকগৃহিণী ষড়াননজননী।

দ্বিতীয় মন্ত্রটি অতি সাবধানে স্মরণ করিয়া রাখিবে। বাসার উপর আসিয়া এই মন্ত্রপাঠ করিলে ময়ুর তোমাকে সপ্তদ্বীপ সাত সমুদ্র তের নদী পারে লোকালোক পর্ব্বতের ওধারে সূর্যের অগম্য তিমিরপূর্ণ গভর গহ্বরে ফেলিয়া চলিয়া যাইবে।

আমি বলিলাম,–মন্ত্রটি অতি সহজ। কেন মনে করিয়া রাখিতে পারিব না? তবে দ্বিতীয় মন্ত্রে ঐ গুম্বজগৃহিণী কথাটা কিছু কঠিন।

দেবী হাসিয়া বলিলেন,–গুম্বজগৃহিণী নহে, ত্র্যদ্বকগৃহিণী।

আমি বলিলাম,–এইবার আমি ভাল করিয়া স্মরণ রাখিব, গুম্বজ নহে ত্র্যদ্বক। দেখ লম্বোদর, এই স্থানে তোমাদের একটা কথা আমি বলিয়া রাখি। প্রতিমার এই যে কার্তিক সকলে করে, এ-কেলে কার্তিক নহে এ সে-কেলে কার্ত্তিক। লম্বা কেঁচা গুফো ধেড়ে কার্তিক কি বাপু! এই কি তোমাদের ভক্তি! ছি! এখনকার কার্তিক ছেলেমানুষ। মোজা ইজের কোট টুপি পরা। সিংহশাবক কোলে কার্তিককে আমি এইরূপ দেখিয়াছিলাম।

প্রতিমারও তাই করিয়াছি।

প্রতিমা সহিত দেবী অন্তর্ধান হইলেন। আমি প্রথম মন্ত্রটি পাঠ করিলাম,–

জয় কৈলাসবাসিনী মহেশগৃহিণী গণেশজননী।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পিং মহাশয়

ময়ূর তৎক্ষণাৎ উপরে উঠিল। অনেক অনেক উপরে উঠিল। রেলগাড়ী বা কি? তড়িগতি বা কি? তাহা অপেক্ষা দ্রুতবেগে শূন্যপথে চলিতে লাগিল। চন্দ্রলোক সূৰ্য্যলোক ধ্রুবলোক পার হইয়া গেল। কোটি কোটি যোজন পরে শেষে আমি পিংয়ের আকাশে গিয়া উপস্থিত হইলাম। লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—পিং সে কি?

ডমরুধর উত্তর করিলেন, পিং কি? পিং এইরূপ—বলিয়া পিং-এর চিত্র অঙ্কিত করিয়া দেখাইলাম। লম্বোদর বলিলেন,–তা যেন দেখিলাম! কিন্তু পিং কে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—কি গেরো! পিং কে, তা আমি কি করিয়া জানিব? পিং আমার জাতি নয়, জ্ঞাতি নয় যে, তাহার পরিচয় আমি তোমাকে দিব। প্রাণ গেলেও আমি মিথ্যাকথা বলিব না। আমার সে স্বভাব নয়।

ছোট একখণ্ড কালো মেঘের উপর পিং বসিয়াছিলেন। আমি তাঁহার নিকট গমন করিলাম। দেখ লম্বোদর! তোমরা আমাকে কালো কুৎসিত কদাকার বলিয়া উপহাস কর। কিন্তু পিং আমার রূপের মর্যাদা জানেন। আমাকে দেখিবামাত্র পিং কি বলিলেন শুন।

পিং বলিলেন,–আহা, মহাশয়ের কি রূপ! ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তাঁহার ভিতর হইতে খড়ি মাটীর আভা বাহির হইতেছে। তাহা দেখিয়া আমার উস্কোখুস্কো পালক-আবৃত কাক ভূষণ্ডীকে মনে হইল। বহুকালের প্রাচীন ছেলাপড়া বাঁশের ঝোড়ার ন্যায় মহাশয়ের অস্থিপিঞ্জর দেখা যাইতেছে। দধিপুচ্ছ শৃগালের পর্ব্বত-গহ্বরের ন্যায় আপনার দন্তশূন্য মুখগহ্বর। তাঁহার দুই ধারে কি দুইটি কাক বসিয়াছিল? ঐ যে ঠোটের দুই কোণে শুভ্রবর্ণের কি রহিয়াছে? আপনার টোল-পড়া গাল দুইটি দেখিয়া হনুমানের চড়-প্রহরিত রাবণ মাতুল কালনেমির গণ্ডদেশ আমার স্মরণ হইল। পচুল পরিবেষ্টিত মস্তকের মধ্যস্থিত বিস্তৃত টাক দেখিয়া আমার মনে হইল, বিধাতা বুঝি পূর্ণচন্দ্রটিকে বসাইয়া তাঁহার চারিদিকে শুভ্রবর্ণের মেঘ গাঁথিয়া দিয়াছেন। ফলকথা, মহাশয়কে যখন দূরে দেখিলাম, তখন মনে করিলাম যে, ময়ূরে চড়িয়া টাক-চুড়ামণি কেলে-কার্ত্তিক জগৎ আঁধার করিয়া আসিতেছেন।

পিঙের সুমিষ্ট স্তবে প্রীতিলাভ করিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলাম,আমি আকাশে ভ্রমণ করিতে আসিয়াছি। ইহার পর দেখিবার আর কি আছে?

পিং উত্তর করিলেন,—সমুদ্রকুলে বালুকারেণুর ন্যায় ইহার পর আরও কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড আছে। কিন্তু ব্রহ্মার কোন অণ্ডই আপনার দেখিবার উপযুক্ত নহে। যাবতীয় ব্রহ্মাণ্ডের ওপারে আপনি গিয়া অশ্বাণ্ড দর্শন করুন।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—অশ্বাণ্ড! সে কিরূপ? সে কোথায়?

পিং উত্তর করিলেন,—অল্পদিন হইল ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের নিকট গিয়া যম আবেদন করিলেন যে—বঙ্গদেশের বিটলে কপট স্বদেশ ভক্তগণ শীঘ্রই প্রেতত্ব প্রাপ্ত হইবে। তাহাদের প্রেতকে আমার আলয়ে আমি স্থান দিতে পারি না। তাহাদের কুহকে পড়িলে আমি উৎসন্ন যাইব। ছেলেখেকো বক্তারাও শীঘ্র প্রেত হবে। তাহাদিগকে আমি স্থান দিব না। আমার ছেলেগুলি তাহা হইলে গোল্লায় যাইবে। স্বদেশী প্রবঞ্চকদিগের প্রেতকেও আমি স্থান দিতে পারিব না। আমার আলয়ে আসিয়া তাঁহারা হয়তো কোম্পানী খুলিয়া বসিবে। তখন যমনীকে হাতের খাড় বেচিয়া শেয়ার কিনিতে হইবে। তাঁহার মহাপ্রভুরা এককড়া কাণাকড়িও উপুড় হস্ত করিবেন না। আপনারা ইহার ব্যবস্থা করুন। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া ইন্দ্রের ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবাকে এক ডিম্ব প্রসব করিতে বলিলেন। বিশ্বসংসারের ওপারে এই অণ্ড আছে। ইহাতে বিটলে স্বদেশভক্ত ছেলেখেকো বক্তা ও স্বদেশী প্রবঞ্চকগণের প্রেত বাস করে। মহাশয় গিয়া অশ্বও দর্শন করুন।

পিং আরও বলিলেন যে, অশ্বারে দ্বারে এক প্রহরী আছে। প্রহরী যে কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবে ও তাঁহার উত্তরে কি বলিতে হইবে, পিং আমাকে শিখাইয়া দিলেন।

পিঙের নিকট হইতে বিদায় লইয়া পুনরায় আমি শূন্যপথে চলিতে লাগিলাম। সমুদ্রকুলে বালুকারেণুর ন্যায় কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড পার হইয়া যাইলাম। অবশেষে বিশ্বসংসারে ওপারে দূর হইতে অশ্বাণ্ড দেখিতে পাইলাম। পরে নিকটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম যে দ্বারে ভীষণ মূৰ্ত্তি প্রহরী বসিয়া আছে।

চীকার করিয়া প্রহরী আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,হু কামস দায়? (Who comes there?)–আমি উত্তর করিলাম,—ফ্রেণ্ড। (friend) প্রহরী বলিল,–পাস ফ্রেণ্ড, অল ওয়েল (Pass friend well)

এই বলিয়া প্রহরী দ্বার ছাড়িয়া দিল। অশ্বাণ্ডের ভিতর আমি প্রবেশ করিলাম। আমি দেখিলাম যে, ব্রহ্মাণ্ডের ন্যায় অশ্বাশু ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম দিয়া গঠিত নহে। ইহা সম্পূর্ণ অন্ধকার দিয়া নির্ম্মিত। দূর দূর বহু দূর গিয়া বিটলে স্বদেশ ভক্তদিগের দেশে গিয়া উপস্থিত হইলাম। এই প্রেতদিগের রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত এক প্রহরী নিযুক্ত আছে। প্রহরী তাহাদিগকে বৃহৎ অট্টালিকার ভিতর বন্ধ করিয়া রাখে। আমাকে দেখাইবার নিমিত্ত তাহাদিগকে সে বাহির করিল।

পৃথিবীতে ইহাদের শরীর নুদুর-নাদুর থাকে। এখানে ইহাদের এইরূপ মূৰ্ত্তি হইয়াছে। বঙ্গদেশের ইহারা সর্ব্বনাশ করিয়াছে। শত শত বাঙ্গালী যুবকের অন্নলাভের পথ রোধ করিয়াছে। সাধারণের টাকা আত্মসাৎ করিয়াছে। প্রহরী আমাকে বলিল,–সত্বর এ স্থান হইতে প্রস্থান করুন। আপনার যে এমন অপূর্ব্ব রূপ, ইহাদের বাতাস লাগিলে সে সব মাটি হইয়া যাইবে। আপনাকে আরও এক বিষয়ে সাবধান করি। কিছুদূরে আপনি ছেলেখেকো বক্তাদিগের প্রেতগণকে দেখিতে পাইবেন। তাহাদের বক্তৃতা যেন আপনার কর্ণকুহরে প্রবেশ না করে। গো অশ্ব মেষ মহিষ খর্ব্বুর শূকর বিড়াল কুকুর ইন্দুর বাঁদরের মৃত পচিত দেহ উদ্ভুত চর্বি-সত, অবিকৃত বিশুদ্ধ, পবিত্র, পুষ রূপে বিভূষিত গলিত মড়াগন্ধে আমোদিত, ময়রা মহলে সমাদৃত সর্ব্বত্র প্রচলিত ধৃত সদৃশ আপনার হৃদয় কোমল। তাহাদের বক্তৃতা-উত্তাপে আপনার হৃদয় গলিয়া যাইবে। তখন আপনি যা নয়—তাই করিয়া বসিবেন।

সভয়ে এ স্থান হইতে আমি পলায়ন করিলাম। দূরে কোটি কোটি যোজন দূরে আমি এক ছেলেখেকো বক্তা দেখিতে পাইলাম। একাকী দাঁড়াইয়া ইনি বক্তৃতা করিতেছিলেন।

বক্তা তাকালে ইনি অনেক অপোগণ্ড শিশুর ইহকাল-পরকাল ভক্ষণ করিয়াছিলেন। অনেক সংসারে ছারেখারে দিয়াছিলেন। কানে আঙ্গুল দিয়া ইহার নিকট আমি গমন করিলাম। ইহার অপর কেহ শ্রোতা ছিল না। কিন্তু একখণ্ড অন্ধকারের উপর দাঁড়াইয়া রাত্রিদিন ইনি বক্তৃতা করেন। শুনলাম যে পাতালে অসুরদিগের কানের পোকা হইলে, তাঁহারা ইহার বক্তৃতা শ্রবণ করিতে আগমন করে। পাঁচ মিনিট কাল ইহার বক্তৃতা তাহাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলেই কানের পোকা ধড়ফড় করিয়া বাহির হইয়া যায়।

এ স্থান হইতে বিদায় হইয়া আরও কোটি কোটি যোজন দূরে স্বদেশী প্রবঞ্চকদিগের দেশে উপস্থিত হইলাম। অনেকগুলো এই জাতীয় প্রেত দর্শন করিলাম। তাহাদের একজন পৃথিবীতে থাকিতে অনেক ব্যবসা করিয়াছিলেন, অনেক কোম্পানী খুলিয়াছিলেন, অনেক লোকের টাকা কি দিয়াছিলেন। অবশেষে এক বীমা-অফিস খুলিয়া মুটে-মজুরের টাকাও উদরস্থ করিয়াছিলেন। অনেকগুলি হাত ও পা বাহির করিয়া এই মহাপ্রভু এক্ষণে আমাকে ধরিতে আসিলেন।

ইহার বীমা অফিসে আমি অর্থ প্রদান করি,—সেই ইচ্ছায় তিনি আমাকে ধরিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু এ সব কার্যে আমিও একজন ঘুণ। আমি ধরা দিলাম না। সত্বর সে স্থান হইতে পলায়ন করিলাম।

বেলা তখন প্রায় তিনটা বাজিয়াছিল। সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমার বাসায় পৌঁছতে হইবে। তা

হইলে ময়ূর আমাকে সপ্তদ্বীপের ওপারে স্বাদুসমুদ্রে নিক্ষেপ করিবে। সেজন্য পৃথিবীর দিকে ময়ুরকে আমি পরিচালিত করিলাম।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–জিলেট জিলেকি সিলেমেল

নিম্নদিকে নামিতে-নামিতে আমি ভাবিতে লাগিলাম, আমিও দুই তিনবার স্বদেশভক্ত হইয়া সভা করিয়াছিলাম, বক্তৃতা করিয়াছিলাম, স্বদেশের হিতের নিমিত্ত চাঁদা সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তাহার পর চাঁদার টাকাগুলি নিজে হাম্‌ করিয়াছিলাম। সন্ন্যাসী বিভ্রাটের পর আমিও এক স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া অনেক হাঁড়ী বালতি গরীব কেরাণীর মস্তকে হস্ত বুলাইয়াছিলাম। তবে প্রেত হইয়া আমাকেও ঐ অশ্বাণ্ডে গমন করিতে হইবে? কিন্তু তাহার পর আমার স্মরণ হইল যে, যম অবগত আছেন, আমি মুরগী খাই না, একাদশীর দিন পুইশাক ভক্ষণ করি না। সুতরাং সেই পুণ্যবলে অনায়াসে আমি সত্য-লোক, ব্রহ্মলোক যেখানে ইচ্ছা সেইখানে গিয়া বাস করিতে পারিব। যদি ধর্ম্ম শিখিতে চায় তো টিকিদারেরা আমার কাছে আসুক।

হু হু শব্দে ময়ূর পৃথিবীর দিকে ধাবিত হইল। অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র পার হইয়া আমি ক্রমাগত নিম্নে নামিতে লাগিলাম। অবশেষে সূর্যমণ্ডল পার হইলাম। সে স্থান হইতে পৃথিবী দেখিলাম,অতি ক্ষুত্র এক নক্ষত্রের ন্যায় ঝিমিক করিতেছে। ময়ূরের দুই পার্শ্বে আমার দুইটি পা ঝুলিতেছিল। হঠাৎ কোথা হইতে কি একটা আসিয়া আমার বাম পায়ে কামড় মারিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ছাড়িয়া দিল। চকিত হইয়া আমি সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম! দেখিলাম যে, অতি বিরক্তিসূচক মুখভঙ্গিমা করিয়া চাকার ন্যায় কি একটা গড়াইয়া গেল।

আমি ভাবিতে লাগিলাম, চাকার ন্যায় ওটা কি? আমার পায়ে কামড় মারিল কেন? অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া শেষে বুঝিতে পারিলাম। আমার রূপে জগৎ আলো করিয়া শূন্যপথে আমি আসিতেছিলাম। চাকার ন্যায় ওটা রাহু। আমাকে পূর্ণিমার চন্দ্র মনে করিয়া সে আমাকে গ্রহণ লাগাইতে আসিয়াছিল। পূর্ণিমার পর প্রতিপদে চন্দ্রগ্রহণ হয়। কিন্তু আমার রূপে মুগ্ধ হইয়া সে লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। তারপর আমি যে পূর্ণচন্দ্র—তার আর প্রতিপদ হয় না। যাই হউক, হতজ্ঞান হইয়া সে আগে থাকিতে আমাকে গিলিতে আসিয়াছিল। ভাগ্যে আমার গায়ে মাংস নাই, কেবল হাড়, তাই সে কামড় বসাইতে পারিল না। মুখ সিঁটকে চলিয়া গেল। রাহুর দুই চারিটি দাঁত ভাঙ্গিয়া গেল কি না তা বলিতে পারি না। আমার শরীর যদি সুস্বাদু হইত, তাহা হইলে আমার গ্রহণটি সর্ব্বগ্রাস হইত। সাপ যেরূপ আস্তে আস্তে ভেককে ভক্ষণ করে, রাহুও সেইরূপ ক্রমে ক্রমে আমাকে পেট করিত। চন্দ্র-সূর্যের ন্যায় আমার আর মুক্তি হইত না। চিরকাল আমাকে রাহুর—সর্ব্বনাশ! রাহুর পেট নাই! আমাকে সর্ব্বগ্রাস করিয়া সে গালের ভিতর এক কৰে রাখিত কি কোথায় রাখিত, জানি না। কিন্তু লম্বোদর! তোমরা আর আমাকে দেখিতে পাইতে না। লম্বোদর বলিলেন,–ইস, তাই তো।

সকলে বলিলেন,–ইস, তাই তো।

ময়ুর এই ঘটনার পর নক্ষত্রবেগে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হইল। সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় আমি সমুদ্রের উপর আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে সুন্দরবনের উপর আসিলাম। ময়ূর আমার বাসার দিকে ধাবিত হইল। তখনও ভূমি হইতে প্রায় একক্রোশ উচ্চে শূন্যপথে ময়ূর উড়িতেছিল। আমি ভাবিলাম, এস্থান হইতে আমার বাসা প্রায় আর দুই ক্রোশ আছে, বাসার ঠিক উপরে যাইলেই সেই দ্বিতীয় মন্ত্রটি পড়িব। তখন ময়ূর আমাকে ধীরে ধীরে আমার বাসায় নামাইয়া দিবে।

কিন্তু সে দ্বিতীয় মন্ত্রটি কি? সর্ব্বনাশ! আমি সে মন্ত্রটি ভুলিয়া গিয়াছি। মন্ত্রটি মনে করিতে না পারিলে ময়ূরে আমাকে সাত সমুদ্র তের নদী পারে লইয়া লোকালোক পর্ব্বতের ওপারে অন্ধকার গহূরে ফেলিয়া স্বস্থানে চলিয়া যাইবে। তাহা ভাবিয়া আমার প্রাণ আকুল হইল। মন্ত্রটি কি? গম্বুজ? না, তা নয়! জলটুঙ্গী না, তা নয়, ঝাঁপড়দা-মাকড়দা? না, তাও নয়। তবে কি? এ কথা নয় সে কথা, নয় এ কথা—ক্রমাগত ভাবিয়া মন্ত্রটি স্মরণ করিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাঁহার একটি বর্ণও আমার মনে উদয় হইল না। এমন কি, হতভম্ব হইয়া আমি দুর্গা নামটি পর্যন্ত মনে করিতে পারিলাম না। আমি ভাবিলাম যে, যাঃ ডমরুধর! এইবার তোমার সব লীলাখেলা ফুরাইল। যাহা হউক, অনেক চিন্তা করিয়া অবশেষে আমার মনে হইল মন্ত্রটিতে জ আছে, ল আছে আর ক আছে। তাঁহার পব সেই অক্ষর কীটি যোড়তোড় করিয়া স্থির করিলাম যে, মন্ত্রটি বোধ হয় এইরূপ হইবে, জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকি।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি?

ডমরুধর পুনরায় বলিলেন,—জিলেন জিলেকি সিলেলে কিলেকিট কিলেকিশ।

লম্বোদর বলিলেন,–এতও তুমি জান। এ কোন ভাষা?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—তা জানি না ভাই, এ ভিন্ন আর কিছু তখন মনে হইল না। মন্ত্রটি এইরূপ ঠিক করিয়া আমি ভাবিলাম, একবার পরীক্ষা করিয়া দেখি; উচ্চৈঃস্বরে আমি বলিলাম, জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।

সেই কিচমচ শব্দ শুনিয়া ময়ূর ভাবিল,—কৈলাস পর্ব্বতে ভূত-প্রেত-দানা-দৈত্যের সহিত আমার বাস। অনেক তন্ত্র মন্ত্র শুনিয়াছি। এরূপ বিদঘুটে কখনও শুনি নাই। এ লোকটার ভাবগতিক ভাল নহে। বাসায় লইয়া গিয়া আমাকে হয়তো এইরূপ ভীষণ পালকহর্ষণ মন্ত্রবলে খাঁচায় পুরিয়া বন্ধ করিয়া রাখিবে। আগে থাকিতে সাবধান হওয়া ভাল। এইরূপ ভাবিয়া গাঝাড়া দিয়া ময়ূর আমাকে শূন্য দেশে ফেলিয়া দিল। তাহার পর শোঁ শোঁ করিয়া কৈলাস পর্ব্বতের দিকে উড়িয়া গেল। আমি তখন ভূমি হইতে প্রায় একক্রোশ উচ্চে আজকাল উডোকল হইতে মানুষ যেমন পড়ে, আমিও সেইরূপ হুহু শব্দে শিশার ন্যায় নীচে পড়িতে লাগিলাম। হু হু, হু হু, হু হু, কানে আমার বাতাস লাগিতে লাগিল। আমি ভাবিলাম যে, এইবার আমার দফা রফা হইল। হু হু হু হু শব্দে পড়িতে লাগিলাম, অবশেষে খপ করিয়া কাদার ন্যায় কি একটা কোমল বস্তুর উপর পড়িলাম।

কোমল বস্তুর উপর পড়িলাম, সেজন্য আমার অস্থি মাংস চূর্ণ হইয়া গেল না, সেজন্য আমার প্রাণ বিনষ্ট হইল না। যখন আমার হৃদয়ের ধড়ফড়ানি কিছু স্থির হইল, তখন আমি এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিলাম, তাহাতে আমার চক্ষুস্থির হইল। আমি দেখিলাম যে, পর্ব্বতপ্রমাণ প্রকাণ্ড এক ব্যাঘ্রের মুখগহ্বরে আমি পতিত হইয়াছি। ব্যাঘ্ৰটি বৃদ্ধ হইয়াছিল। সেজন্য তাঁহার দন্ত ছিল না। দাঁত থাকিলে শূলসদৃশ দন্তে বিদ্ধ হইয়া তৎক্ষণাৎ আমার মৃত্যু হইত। আমার সকল কথা মনে হইল। পীর গোরাচাঁদের ফকীরদিগের অভিশাপে আমি পড়িয়াছি। এ সেই পীর গোরাচাঁদের ব্যায়। যে বাঘ চড়িয়া তিনি দেশভ্রমণ করিতেন। তোমার যে-সে ব্যাঘ্র নহে। এ রয়েল টাইগারের বাবা! এ মহারাজ ব্যাঘ্র।

লোকে বলে যে ঘুমন্ত সিংহ হাঁ করিয়া থাকিলে, তাঁহার মুখে মৃগ প্রবেশ করে না। সে ঠিক কথা নহে। রাজসাপ নামে একপ্রকার সর্প আছে। সে সাপ হাঁ করিয়া থাকিলে তাঁহার মুখে অন্যান্য সাপ প্রবেশ করে। এ বৃদ্ধ ব্যাঘ্র তাহাই করে। আকাশ-পাতাল জুড়িয়া হাঁ করিয়া থাকে। আর ইহার মুখে মৃগ প্রবেশ করে। আমি বসিয়া থাকিতে থাকিতে একটা বন্য মহিষ, চারিটা হরিণ ও দুইটা বরাহ ইহার মুখের ভিতর প্রবেশ করিল। তখন ব্যাঘ্র একেবারে কোৎ করিয়া আমাদের সকলকে গিলিয়া ফেলিল।

ব্যাঘ্রের পেটের ভিতর ঘোর অন্ধকার। আমি বিরস বদনে তাঁহার এককোণে গিয়া বসিলাম। বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম—এখন করি কি? আর রক্ষা নাই। এখনি হজম হইয়া যাইব! আমার চিহ্নমাত্ৰ থাকিবে না। দুই চারিদিন পরে একছটাক মল হইয়া বাহির হইব।

নিতান্ত সঙ্কটে পড়িলে মানুষের অনেক বুদ্ধি জোগায়। একবার কোন ডাক্তারের নিকট শুনিয়াছিলাম যে, জীবের উদর হইতে একপ্রকার অশ্লরস বাহির হয়; তাহাতেই পরিপাক পায়। তোমরা জান যে, আমার অম্বলের রোগ আছে, আর সেজন্য আমি সর্ব্বদা কাচা সোডা ব্যবহার করি। ভাগ্যক্রমে আমার পকেটে কাগজে মোড়া খানিকটা সোডা ছিল, সেই সোড়া উত্তমরূপে আমি গায়ে মাখিয়া বসিয়া রহিলাম। ব্যাঘ্রের পেট হইতে অম্লরস বাহির হইয়া মহিষ, হরিণ, শূকর সব গলিয়া পরিপাক হইয়া গেল, কিন্তু সোডার প্রভাবে আমার শরীর গলিয়া গেল না, আপাততঃ আমার প্রাণ বাঁচিয়া গেল।

তা যেন হইল। কিন্তু সে আর কয়দিন? ব্যাঘ্রের উদর হইতে বাহির না হইতে পারিলে মৃত্যু নিশ্চয়, আজ হউক, কাল হউক, মৃত্যু নিশ্চয়। কিন্তু কি করিয়া বাহির হইব? মা দুর্গার নাম এখন আমার মনে হইল। একান্ত মনে তাঁহাকে ডাকিতে লাগিলাম। পীর গোরাচাঁদকে অনেক সিন্নি মানিলাম। মা ভগবতীর ও পীর সাহেবের আমার প্রতি কৃপা হইল। বাঘের পেটের ভিতর এককোণে বসিয়া গালে হাত দিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় হঠাৎ কে যেন আমাকে বলিয়া দিল,তোমার পকেটে কাগজ ও পেনসিল রহিয়াছে, আমাদের কর্মচারীকে পত্র লেখ না কেন?

আমার তখন ভরসা হইল। পকেট হইতে কাগজ পেনসিল বাহির করিয়া আমি আমার কর্মচারীকে এইরূপ এক চিঠি লিখিলাম,পীর গোরাঠাদের কোপে আমি পড়িয়াছি। তাঁহার ব্যাঘ্রের উদরে আমি আছি। যদি কোনরূপে আমাকে উদ্ধার করিতে পার তাঁহার চেষ্টা কর।

আমার কর্মচারী বুদ্ধিমান লোক। আমার চিঠি পাইবামাত্র সেই জোয়ারের পথে যে স্থানে ডাক্তারখানা আছে, সে স্থানে চলিয়া গেল। ডাক্তারের সহিত পরামর্শ করিয়া, যাহাতে কাজ হয়, এরূপ ঔষধ এক সের ক্রয় করিল। ইংরেজীতে ইহাকে টারটার এমিটিক বলে। আবাদে ফিরিয়া সেই ঔষধ কাপড়ে রাখিয়া এক ছাগলের গলায় বাঁধিয়া দিল। তাহার পর যে স্থানে পীর গোরাঠাদের ব্যাঘ্র বাস করে, সেই স্থানে ছাগল ছাড়িয়া দিল। বলা বাহুল্য যে, ভ্যা ভ্যা করিতে করিতে ছাগল আপনা আপনি ব্যাঘ্রের উদরে প্রবেশ করিল।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ধাঙ্গড়ের ঘরে কন্দর্প পুরুষ

প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ঔষধের ক্রিয়া আরম্ভ হইল। প্রথম ব্যাঘ্রের পেট কামড়াইতে লাগিল। পেটের কামড়ে ব্যাঘ্র অস্থির হইয়া ছটফট করিতে লাগিল। মাটিতে পড়িয়া গড়াগড়ি দিতে লাগিল। বৃদ্ধ হইলে কি হয়, পেটের কামড়ে সহস্র যুবা ব্যাঘ্রের বলে সে এখন লম্ফ ঝম্ফ করিতে লাগিল। ব্যথা যখন কিছুতেই নিবৃত্ত হইল না, তখন যে দিকে তাঁহার দুই চক্ষু গেল, সেই দিকে ঘোড়া-দৌড়ের অন্ধবেগে সে ছুটিয়া চলিল। ছোট ছোট গ্যাং লাফ দিয়া ও বড় বড় গাং সাঁতার দিয়া পার হইতে লাগিল ক্রমাগত দৌড়িতে লাগিল। হাঁ করিয়া দৌড়িতেছিল, সেজন্য পেটের ভিতর বসিয়া আমি কতক কতক দেখিতে পাইতেছিলাম। বন পার হইল, নদী নালা খাল বিল অনেক পার হইয়া গেল। পেটের কামড়ে সমস্ত রাত্রি দৌড়িল, সমস্ত দিন দৌড়িল, পুনরায় আর এক রাত্রি দৌড়িল। সুন্দরবনের এলাকা পার হইয়া গ্রামসমূহের নিকট মাঠ দিয়া ধাবিত হইল। অবশেষে দ্বিতীয় দিনের বেলা তিনটার সময় বমন করিতে আরম্ভ করিল। শৈশবকালে মাংস-অন্নপ্রাশনের সময় হইতে যত মহিষ হরিণ শূকর প্রভৃতি খাইয়াছিল, তাহাদের হাড়গোড় সমুদয় বমন করিয়া ফেলিল। উদগারের সহিত আমাকে সে বাহির করিয়া ফেলিল।।

কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া আমার দিকে সে দুই একবার কম করিয়া চাহিল। মনে মনে ভাবিল,–এ লোকটাকে গিলিয়া ভাল কুকর্ম করিয়াছিলাম। যেমন রূপ—তেমনি গুণ, না আছে রস না আছে কষ! কালো চামড়া মোড়া কেবল খানকতক হাড়। এর চেয়ে যদি দশ মণ পাথুরে কয়লা গিলিতাম, তাহা হইলে কাজ হইত।

এই প্রকার চিন্তা করিয়া ব্যাঘ্র দ্রুতবেগে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল। পশু! সে আমার রূপের মহিমা কি বুঝিবে?

লম্বোদর বলিলেন,—তা সব হইল। কিন্তু একটা কথা তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করি। ব্যাঘ্রের পেটের ভিতর হইতে তোমার কর্মচারীর নিকট সে চিঠি তুমি কি করিয়া পাঠাইলে?

কিয়ৎক্ষণের জন্য নীরব থাকিয়া ডমরুধর উত্তর করিলেন,–দেখ লম্বোদর। সকল কথার খোচ ধরিও না। এইমাত্র তোমাকে আমি বলিতে পারি যে, বাঘের পেটের ভিতর ডাকঘর নাই, সে স্থানে টিকিট বিক্রয় হয় না, সে স্থানে মনি-অর্ডার হয় না। তিরিক্ষি মেজাজ ডাকবাবু সেখানে বসিয়া নাই। পত্র প্রেরণের সমস্যা এইরূপে হেলায় মীমাংসা করিয়া ডমরুধর পুনরায় বলিতে লাগিলেন,বাঘের পেটে কয়দিন আমার উদরে অন্নজল যায় নাই। আমি অতিশয় দুর্বল হইয়াছিলাম। ব্যাঘ্ৰ চলিয়া গেলে কিছুক্ষণের নিমিত্ত সেই স্থানে নির্জীব হইয়া পড়িয়া রহিলাম। তাহার পর আস্তে আস্তে উঠিয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিলাম। নিকটে একখানি গ্রাম দেখিয়া তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। গ্রামখানি ছোট, কেবল ইতরললাকের বাস। গ্রামবাসীদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম যে, সে স্থান হইতে আমার আবাদ দূর, কেহ তাঁহার নামও জানে না। বরং আমার গ্রাম নিকট, সাতআট ক্রোশ মাত্র। তপস্যা করিতে যখন আমি বনে গমন করি, তখন টাকাকড়ি সঙ্গে লইয়া যাই নাই। সে নিমিত্ত নৌকা অথবা শালতি ভাড়া করিতে পারিলাম না। পদব্রজেই আমার গ্রাম অভিমুখে আমি চলিলাম।

আকাশভ্রমণে, অনাহারে, নানারূপ ভাবনা-চিন্তায় আমার পা আর উঠে না। তাহার পর বর্ষার শেষ। নদী-নালা জলে ও মাঠ-ঘাট কাদাকিফায় পরিপূর্ণ। বড়ই কষ্ট হইতে লাগিল। যাইতে যাইতে এক মাঠের মাঝখানে সন্ধ্যা হইয়া গেল। এখন কোথায় যাই। আর একটু আগে গিয়া মাঠের মাঝখানে নারিকেলপাতায় আচ্ছাদিত সামান্য একখানি চালা দেখিতে পাইলাম। সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। জনমানবকে সে নালায় দেখিতে পাইলাম না। প্রাঙ্গণে শসা গাছের এক মাচা ছিল। অনেকগুলি দুধে-শসা তাহা হইতে ঝুলিতেছিল। পেট ভরিয়া আমি সেই শসার আঁতি খাইলাম। কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া আমি চালার ভিতর প্রবেশ করিলাম। গোটাকতক মেটে হাঁড়ী ভিন্ন তাঁহার ভিতর আর কিছু দেখিতে পাইলাম না। চালার একপার্শ্বে হেঁচা বাঁশ দিয়া গঠিত একটি তক্তপোষের মত ছিল। তাঁহার উপরে একটা ছেচা মাদুর ও ময়লা বালিশ ছিল। ঘোর ক্লান্তিতে কাতর হইয়া আমি তাঁহার উপর শুইয়া পড়িলাম।

সন্ধ্যা হইল। অন্ধকার হইল। সেই সময় কে একজন চালার ভিতর প্রবেশ করিল। দিয়াশলাই জ্বালাইয়া একটা কেরোসিনের ডিবে প্রজ্জ্বলিত করিল। তখন আমি দেখিলাম যে, সে একটা কালো স্ত্রীলোক। তাঁহার হাতে শাঁখা আছে, পায়ে প্রায় পাঁচ সের ওজনের বাঁকমল আছে। মাঝে মাঝে এ অঞ্চলে অনেক ধাঙ্গড় মজুরি করিতে আসে। আমি বুঝিলাম যে, স্ত্রীলোকটা ধাঙ্গড়ানী। প্রথম আমি একটু গলার সাড়া দিলাম। সে আমায় দিকে চাহিয়া দেখিল। তাহার পর আমি উঠিয়া বসিলাম। তাঁহাকে বলিলাম যে, বাঘের মুখ হইতে আমি অতি কষ্টে বাঁচিয়া সে স্থানে আসিয়াছি। আর পথ চলিতে পারি না। রাত্রিযাপনের নিমিত্ত তাঁহারা যদি একটু স্থান প্রদান করে, তাহা হইলে আমার বড় উপকার হয়।

সাধে কি এলোকেশীর মনে সর্ব্বদা আমার প্রতি সন্দেহ। আমার গায়ের বর্ণটি কৃষ্ণঠাকুরের চেয়ে কালো। বাঘ মিথ্যাকথা বলে নাই—শরীরের ভিতর কেবল খানকতক হাড়। মাথার মাঝখানে কিন্তু এমন চকচকে টাক আর কার আছে? প্রকাণ্ড টাক। টাকের চারিদিকে পাকা চুল, মুখের দুই পার্শ্বে সাদা ফেকো। দাঁত একটিও নাই। তথাপি আমার কিরূপ একটা শ্রীছাদ আছে, কিরূপ একটা লাবণ্য আছে যে, তাতে রাহুল ও ভুল হয়। আর মাগীগুলোও আমার গায়ে যেন ঢলিয়া পড়ে। অবাক হইয়া ধাঙ্গড় মাগী আমার টাক পানে চায়, আর মুচকে মুচকে হাসে। শেষে সে কেবল দুইটি কথা বলিল,–মাঝি আসুক। তোমাদের যেমন বাবু ইহাদের সেইরূপ সম্মানসূচক উপাধি মাঝি!

কিছুক্ষণ পরে একটা হোঁৎকা মিনসে চালার ভিতর প্রবেশ করিল। তোমরা আমাকে কালো বল, কিন্তু তার রঙের তুলনায় আমি তো ফিটু গৌরবর্ণ। সে আসিয়া যেই আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল, আর বামহাতে আমার মাথা নোওয়াই,দক্ষিণ হাতে আমার পিঠে বজ্রসম দুইটা কিল বসাইয়া দিল। গন্ধ পাইয়া আমি বুঝিলাম যে, ধাঙ্গড় মদ খাইয়াছিল।

তাহার পর বলিল,–এতদিন পরে বেটাকে আজ ধরিয়াছি। ফাঁক পাইলেই আসে যায়, ধরিতে আর পারি না। আজ বেটাকে ধরিয়াছি ইয়ারকি দিতে জায়গা পাও না আমার ঘরে ইয়ারকি। হাড় গুড়া করিয়া ঐখানে আজ পুঁতিব?

এই কথা বলিয়া সে পুনরায় আর দুইটা কিল মারিল।

আমি বলিলাম,—আমি বিদেশী লোক। তোমার ঘরে আমি কখনও আসি নাই। আজ বিপদে পড়িয়া এ স্থানে আসিয়াছি।

ধাঙ্গড় বলিল,–বিদেশী লোক! গ্রীষ্মকালে মোড়লদের পুকুরে ফেটিজালে মাছ ধরিতেছিলে? মাঝিনীকে কে একরাশি চুনোমাছ দিয়াছিল? কেন দিয়াছিলে, কি আমি বুঝিতে পারি নাই?

এই কথা বলিয়া আবার দুইটা কিল মারিল।

আমি বলিলাম,আমি কখনও ফেটিজালে মাছ ধরি নাই। আমি ভদ্রলোক। মিছামিছি বিনা দোষে আমাকে মার কেন?

ধাঙ্গড় বলিল,–ভদ্রলোক! ভদ্রলোকের ঐ রকম টাক হয়! ভদ্রলোকের ঐ রকম কিস্তৃত কিমাকার চেহারা হয়। আর মাঝিনীর পসন্দ; আমাকে পসন্দ হয় না, তোকে পসন্দ।

এই কথা বলিয়া সে পুনরায় আরও দুইটা কিল মারিল।

আমি দেখিলাম যে, কথা কহিলেই দুইটা করিয়া কিল খাইতে হয়। তাহার পর, দারুণ প্রহার বরং সহ্য হয় কিন্তু সে যে আমাকে কুৎসিত বলিল, সে কথা আমার প্রাণে সহ্য হইল না। আমি চুপ করিয়া রহিলাম।

কিন্তু নীরব থাকিয়াও নিস্তার পাইলাম না। সে আমাকে উত্তমমধ্যম অধম বিলক্ষণ প্রহার করিল; তাহার পর আমার কাপড়-চোপড় কাড়িয়া লইয়া উলঙ্গ করিয়া গলা টিপিয়া সে স্থান হইতে বাহির করিয়া দিল। কেবলমাত্র প্রাণে সে আমাকে মারিল না। আমি উঠিতে পড়িতে উঠিতে পড়িতে মাঠের আল দিয়া চলিলাম। অতি ক্লেশে বহুদুর একখানি গ্রামের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। এক তো রাত্রি হইয়াছে, তাহার পর উলঙ্গ, এ অবস্থায় সে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলাম না। মনে করিলাম যে প্রাতঃকালে কাহারাও নিকট হইতে একখানি হেঁড়া-খোঁড়া গামছা চাহিয়া লইব। সেইখানি পরিয়া আপনার গ্রামে যাইব।

নিকটে একটি বাগান দেখিতে পাইলাম। নারিকেল গাছ-বেষ্টিত শান-বাঁধা ঘাট-বিশিষ্ট তাঁহার ভিতর একটি পুষ্করিণী ছিল। দারুণ প্রহারে শরীর আমার বিষম কোনা হইয়াছিল। ঘাটের চাতালে আমি শয়ন করিলাম। ঘোর ক্লেশে নিদারুণ প্রহারে শরীর আর আমার কিছু ছিল না। অল্পক্ষণ পরেই আমি নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। এখন রাত্রি অবসান হইয়াছিল তাহা আমি জানিতে পারি নাই। সহসা ভূত। ভূত! চীৎকার শুনিয়া আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। আমি চাহিয়া দেখিলাম যে, প্রাতঃকাল হইয়াছে; সূৰ্য্য উদয় হইয়াছে? অন্যদিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, জনকয়েক স্ত্রীলোক সেই পুষ্করিণীতে জল লইতে আসিয়াছিল। সেই উলঙ্গ অবস্থায় আমাকে দেখিয়া ভূত! ভূত! বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে পলায়ন করিতেছে। তাহাদের কোমর হইতে কলসী পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গেল। কিছুদূর মাঠ হইতে কয়েক জন পুরুষমানুষ কি হইয়াছে, কি হইয়াছে বলিয়া দৌড়িয়া আসিল।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–ডমরুরের মেমের পোষাক

আমি ভাবিলাম, আবার বা প্রহার খাইতে হয়। সেই ভয়ে আমি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়িলাম। ঐ যাইতেছে, ঐ যাইতেছে বলিয়া কেহ কেহ আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইল। কিছুদূরে গিয়া আমি আর দৌড়িতে পারিলাম না। এক স্থানে নিবিড় ভেরাস্তার বেড়া ছিল। তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিয়া আমি লুক্কায়িত রহিলাম। আমায় আর দেখিতে না পাইয়া তাঁহারা ফিরিয়া গেল। যাইতে যাইতে একজন বলিল,–ভূত কি কখন ধরা যায়? ভূত হাওয়া। এতক্ষণ কোন কালে বাতাসের সহিত মিশিয়া গিয়াছে।

বেড়ার পার্শ্বে আমি বসিয়া হাঁপাইতেছিলাম; কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিলাম। এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিলাম যে, বেড়ার বাহিরে ছোট একটি তাবু রহিয়াছে। তাঁহার ভিতরে ও বাহিরে জন দুই পুরুষ ও ঘাগরা-পরা তিনজন স্ত্রীলোক রহিয়াছে। নিকটে চার পাঁচটি বালক-বালিকা খেলা করিতেছে। একটু দূরে সম্মুখের পা বাঁধা কটা টাটু ঘোড়া চরিতেছে। যাহাদিগকে বেদিয়া বা হা-ঘোরে কঞ্জড় বলে, আমি বুঝিলাম যে, ইহারা সেই জাতি। ইহাদের ঘর-দ্বার নাই। আজ এখানে কাল সেখানে গিয়া ইহারা জীবনযাপন করে। ভিক্ষা করিয়া চুরি করিয়া অথবা জরী বটি বেচিয়া ইহারা দিনপাত করে। ইহারা খোটা কথা বলে। বাজারে তুমি একশত টাকায়ও রামচন্দ্রি অথবা আকবরি মোহর কিনিতে পারবে না। কিন্তু ইহাদের নিকট দুই তিন টাকায় পাওয়া যায়। সে মোহর পূজা করিলে ঘরে মা লরী আচলা-আঁটলা বিরাজ করেন। স্ত্রীলোকে রন্ধন করিতেছিল। বেলা দশটার সময়ে সকলে আহার করিয়া গ্রাম অভিমুখে চলিয়া গেল। ঘরে কেবল এক বুড়ি রহিল। বাহিরে বসিয়া বুড়ি আপনার মনে চুবড়ী বুনিতে লাগিল। যাইবার পূর্ব্বে এক স্ত্রীলোক তাঁহার কন্যার ছোট একটি সালুর ঘাঘরা শুরু হইবার নিমিত্ত আমার নিকটে ভেরা গাছে ঝুলাইয়া দিল।

সকলে চলিয়া গেলে সেই ঘাগরার দিকে আমার দৃষ্টি পড়িল। খুপ করিয়া ঘাগরাটি বেড়ার ভিতর টানিয়া লইলাম। ঘাগরাটি চুরি করিয়া আমি পরিধান করিলাম। আমার হাঁটু পর্যন্ত হইল। তাহার পর অন্যদিক দিয়া চুপে চুপে বেড়ার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আমি পলায়ন করিলাম। আমার গ্রাম কোন দিকে, দিনের বেলা এখন অনেকটা বুঝিয়াছিলাম। হন হন করিয়া সেই দিকে চলিতে লাগিলাম। কিন্তু শরীর দুর্বল, তাঁহার উপর প্রহারের বেদনা; অধিক দ্রুতবেগে যাইতে পারিলাম না। লাল ঘাগরা পরিয়া আমাকে মন্দ দেখায় নাই। যাহার শ্ৰী আছে, সে যা পরিধান করুক না কেন তাতেই তাকে ভাল দেখায়। যাহারা বাঁদর খেলায়, তাহাদের সহিত যেরূপ লাল ঘাগরা পরা একটা বাঁদরের মেম থাকে, আমাকেও সেইরূপ মেমের মত দেখাইল। আমার গায়ের রং একটু কালো, কেবল এই প্রভেদ। আমাকে ভাল দেখাইলে কি হয়, এরূপ মেম সাজিয়া পাঁচজনের সম্মুখে বাহির হইতে লজ্জা করে। সে জন্য আমি কোন গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলাম না। সেজন্য লোক দেখিলে তাহাদিগকে দূরে রাখিয়া আমি পথ চলিতে লাগিলাম। এই কারণে ক্রমে পৌঁছিতে আমার অনেক বিলম্ব হইল। বেলা প্রায় পাঁচটার সময় আমাদের গ্রামের নিকট মাঠে আসিয়া আমি উপস্থিত হইলাম।

আমি ভাবিলাম এ বেশে দিনের বেলা গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিব না। পাঁচজনে দেখিলে হাসিবে। দুর্লভী বাঘিনীতে তোমরা সকলেই জান। মন্দ নয়না? যাহার জন্য ও বৎসর গৃহিণী আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন? তাঁহার মেটে ঘরটি গ্রামের শেষে এককোণে। আমি মনে করিলাম কিছুক্ষণ তাঁহার ঘরে গিয়া বসিয়া থাকি। তাহার পর সন্ধ্যার সময় গা-ঢাকা অন্ধকার হইলে আস্তে আস্তে বাটী যাইব, এইরূপ মনে করিয়া চুপে চুপে তাঁহার ঘরে আমি প্রবেশ করিলাম, প্রথম সে আঁউমাউ করিয়া উঠিল। আমি তাঁহাকে বলিলাম,–ভয় নাই! চুপ কর, বড় বিপদে পড়িয়া তোর ঘরে আসিয়াছি। গোল করিসনে। পূজার সময় তোকে একখানা কাপড় দিব।

আমি ভাবিয়াছিলাম, কেহ আমাকে দেখিতে পায় নাই; কিন্তু তা নয়। পরীক্ষিৎ ঘোষের কেষ্টা নামে সেই দুষ্ট এঁচোড় পাকা ছেলেটা আমাকে দেখিতে পাইয়াছিল। পরীক্ষিৎ ঘোষ আমার নিকট হইতে দশ টাকা ধার লইয়াছিল। দেড়শত টাকা সুদ দিয়াছিল তাহার পর যখন সে আসল পরিশোধ করিল, তখন তাঁহাকে হাতে রাখিবার নিমিত্ত খতখানি ফিরিয়া দিলাম না। তাঁহার বিপক্ষে আদালতে একবার মিথ্যা সাক্ষ্যও দিয়াছিলাম। মোকামায় মিথ্যা বলিতে দোষ নাই। সেই অবধি আমার উপর তাঁহার আক্রোশ। তাঁহার ছেলেটাও পথে-ঘাটে আমাকে দেখিতে পাইলে দূর হইতে ক্ষেপায়, সে বলে—টাকা, টাক বাহাদুর, টাক টাক টাকেশর দুরু দুরু দুরু দুরু মানে ডমরু। আমার নামটা ছোড়া সংক্ষেপ করিয়াছে।

পরীক্ষিৎ ঘোষের কাছে তাঁহার ছেলের দৌরাত্ম্যের বিষয় একবার আমি নালিশ করিয়াছিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,–কেষ্টা কি আপনার দিকে চাহিয়া ও সব কথা বলে?

ছোঁড়া কি করে, মনে মনে চিন্তা করিয়া আমি উত্তর করিলাম,–না। সে আমার দিকে চাহিয়া বলে, কখনও বা গাছপালার দিকে চাহিয়া বলে, কখন বা আকাশপানে দুইটা পা করিয়া মাটীর দিকে মুখ করিয়া দুই হাতের উপর ভর দিয়া চলিতে চলিতে ঐ সব কথা বলে।

পরীক্ষিৎ ঘোষ বলিল,–তবে?

সে তবের আমি আর উত্তর দিতে পারিলাম না।

কেষ্টা তাড়াতাড়ি গিয়া আপনার বাপকে সংবাদ দিল। আমি তা জানিতাম না। পরীক্ষিৎ ঘোষ আসিয়া দুর্লভীর ঘরের দ্বারে শিকল দিয়া দিল দুর্লভীকে আর আমাকে ঘরের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিল। তাহার পর পাড়ার লোককে সংবাদ দিল। দুর্লভীর ঘরে আমাঠে দেখিবার নিমিত্ত মেয়ে-পুরুষ ছেলে বুড়ো সুদ্ধ লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল।

জাহ্নবী সাঁই বলিলেন,–আমিও দেখিতে গিয়াছিলাম।–গণপতি ভড় বলিলেন,–আমিও গিয়াছিলাম!–পুঢ়ীরাম চাকী বলিলেন,–আমিও গিয়াছিলাম।

লোদর বলিলেন,—আমি তখন বাড়ী ছিলাম না। বাড়ী থাকিলে আমিও যাইতাম। ক্রুদ্ধ হইয়া ডমরুধর বলিলেন,—যাইতে বই কি। তুমি না গেলে কি চলে?

দুর্লভীর ঘরের সম্মুখ দিকে দুইপার্শ্বে দুইটি ছোট ছোট জানালা আছে। ঘরের পশ্চাৎ দিকের প্রাচীরেও সেইরূপ ছোট জানালা আছে। সম্মুখ দিকের দুইটি জানালা দিয়া লোক সব উকি মারিয়া আমাকে দেখিতে লাগিল। সে দুইটি জানালায় ভিড় করিয়া লোকে ঠেলাঠেলি করিতে লাগিল। কেষ্টার বন্ধু জন পাঁচ ছয় ছোঁড়া চালে উঠিয়া খড় ফাঁক করিয়া উপর হইতে উকি মারিয়া আমাকে দেখিতে লাগিল। পশ্চাৎ দিকের জানালাটা কিছু উচ্চ ছিল। মাটীতে দাঁড়াইয়া তাহা দিয়া দেখিতে পারা যায় না। কেষ্টা ছোঁড়ার একবার বয়মায়েসি শুন। কোথা হইতে একটা টুল চাহিয়া আনিল। লোককে সেই টুলের উপর দাঁড় করাইয়া ঘরের ভিতর আমাকে ও দুর্লভীকে দেখাইতে লাগিল।

পুঁটিরাম চাকী বলিলেন,–অমনি দেখায় নি। এক পয়সা করিয়া টুলের ভাড়া লইয়াছিল। দেখিতে আমার একটু বিলম্ব হইয়াছিল বলিয়া আমার নিকট হইতে সে চারি পয়সা লইয়াছিল।

আধকড়ি ঢাক বলিলেন,–চারি পয়সা! আমাকে সাত পয়সা দিতে হইয়াছিল।

ডমরুধর মুখ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন,–কি দেখিবার জন্য পয়সা খরচ করিয়াছিলেন? আমাকে কি তোমরা কখনও দেখ নাই? আমি কি আলিপুরের বাগানের সিঙ্গি না বাঘ না কি, যে আমাকে দেখিবার জন্য তোমাদের এত হুড়াহুড়ি?

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ–এলোকেশী মুড়া থেঙরা

দেখিতে দেখিতে কে একজন বলিয়া বসিল,–এলোকেশী ঠাকুরাণীকে সংবাদ দাও। তিনি আসিয়া কর্তাটিকে একবার দেখুন।

তখন আমার হৃৎকম্প হইল। একে তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। তাঁহার উগ্রচণ্ডা-সর্ব্বদা রণমূৰ্ত্তি। আবার তাঁহার উপর আমি এক কন্দর্প পুরুষ। সর্ব্বদাই এলোকেশীর সন্দেহ। এ অবস্থায় আমাকে দেখিলে এলোকেশীর যে আমার কি হাল করিবেন, তা ভাবিয়া আকুল হইলাম। সেই হতভাগা ছোঁড়া কেষ্টা বলিতে না-বলিতে আমার বাড়ীতে সংবাদ দিল। এলোকেশীর গায়ের রং আমা অপেক্ষা কালো। রাগে এখন তাঁহার মুখটি অনেক দিনের ভূযোপড়া ধানসিদ্ধ হাঁড়ীর ন্যায় হইল। ভীম যেরূপ ঘণ্টাওয়ালা লোহার গদা লইয়া দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে দুৰ্য্যোধনের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়াছিলেন, এলোকেশীরও সেই রূপ মুড়ো খেরা লইয়া দুর্লভীর ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

এলোকেশীকে দেখিয়া লোকে পথ ছাড়িয়া দিল। দ্বারের শিকল খুলিয়া তিনি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন! তাহার পরবলিব কি ভাই, আর দুঃখের কথা। পোড়ার মুখ বুড়ো ডেকরা! রঃ! আজি তোর ভূত ছাড়াইব—এই কথা বলিয়া আমার মাথার টাক হইতে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত সেই মুড়ো খেঙরা দিয়া ঝাড়াইতে লাগিলেন। এলোকেশীর নব্য বয়স; ধাঙ্গড়ের কিল বা কি? এলোকেশীর এক এক ঘা খেঙরা ভীমের গদার ন্যায় আমার গায়ে পড়িতে লাগিল। আমি যত বলি—আর নয়! আর নয়! যথেষ্ট হইয়াছে, ততই খেরার প্রহারে আমার পিঠ ফাটিয়া যাইতে লাগিল। মাথার টাকে ও পিঠে সেই মুড়ো খেরার অনেক কাঠি ফুটিয়া গেল।

কেষ্টাকে মন্দ বলি, কিন্তু এই দুঃসময়ে আমার বন্ধু হইল। আমার নাকাল দেখিয়া আমোদে আটখানা হইয়া সে ও তাঁহার সঙ্গিগণ হাততালি দিয়া নাচিতে নাচিতে বলিতে লাগিল,–ট্যাক-দ, টাক-বাহাদুর, টাক টাক টাকেশ্বর দুরু দুরু দুরু।

তখন এলোকেশী আমাকে ছাড়িয়া—তবে রে আঁটকুড়ীর বেটারা। বলিয়া তাহাদের মারিতে দৌড়িলেন। আমি অব্যাহতি পাইলাম, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নয়। দুর্লভী তখন আপনার খেঙরা লইয়া আমাকে বলিল,–তুই যেমন ঠাকুর তোর তেমনি করিয়াছেন। আমার মন ভুলাইতে রাঙা ঘাঙরা পড়িয়া সাজ-গোজ করিয়া আসা হইয়াছে; এখন আমি একবার ঝাড়াই। এইকথা বলিয়া সেও ঘাকত আমার পিঠে বসাইয়া দিল।

কত কিল কত খেঙরা আর সহ্য করিব। আমার পিঠ তো আর পাথরের নয়। আমি সে স্থান হইতে পলায়ন করিলাম। দুর্লভীর ঘর হইতে যখন বাহির হই তখন এলোকেশী বিকে,–এখনও হইয়াছে কি। চল ঘরে চল। আজ তোর আমি হাড়ীর হাল করিব। শেভরার চোটে তোর ভূত ছাড়াইব।

সেই ভয়ে আমি বাড়ী যাইলাম না। আমার খিড়কির বাগানে একগাছে ঠেস দিয়া বিরস বনে বসিয়া রহিলাম। বসিয়া বসিয়া মা ভগবতীকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম,–মা! আমি তোমার ভক্ত, দুর্গোৎসব আসিতেছে মা। আমি তোমার পূজা করিব। তুমি কি আমার দালানে তোমার প্রতিমা গড়া হইতেছে। তবে কেন মা আমার উপর রাগ করিয়াছ?

সন্ধ্যা হইল, ক্রমে রাত্রি হইল। বাড়ী যাইতে আমার সাহস হইল না, গাছে ঠেস দিয়া বসিয়া রহিলাম মাঝে মাঝে একটু একটু তন্দ্রা আসে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভাঙ্গিয়া যায়। স্বপ্ন দেখি যে, এলোকেশী বুঝি শূর্পণখার বেশ ধরিয়া আমার নাক কাটিতে আসিতেছেন। অথবা তাড়কা রাক্ষসী হইয়া আমাকে চর্বণ করিতেছেন। প্রহারে শরীর জ্বর জ্বর হইয়াছিল। শেষ রাত্রিতে আর বসিয়া থাকিতে পারিলান না। ভিজা মাটীর উপরেই শুইয়া পড়িলাম। একটু নিদ্রা আসিয়াছে, এমন সময় কে যেন আমাকে ডাকিলেন,—ডমরুধর! বাছা ডমরুধর!

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ–অমৃত কুণ্ডের জল

চমকিত হইয়া আমি উঠিয়া বসিলাম। চক্ষু মুছিতে দেখিলাম যে, স্বয়ং মা দুর্গা একখাচ্ছি চৌকীর উপর আমার সম্মুখে বসিয়া আছেন। এ তোমার দশ-হেতে হরিতাল রঙে গর্জন তৈলে ব্যাড়বেড়ে রাঙতা-পরা দুর্গা নয়। এ কৈলাস পর্ব্বতের আসল মা দুর্গা; সুন্দর পরিচ্ছদে ও বহুমূল্য রত্ন-আভরণে ভূষিত করিয়া কুবের ইহাকে আমার নিকট পাঠাইয়াছেন।

জোড়হাতে মায়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমি স্তবস্তুতি করিতে লাগিলাম। মা বলিলেন,–ডমরুধর! তুমি অপরাধ করিয়াছ। যে মন্ত্র তোমাকে আমি শিক্ষা দিয়াছিলাম, তাহা ভুলিয়া ও কি উদ্ভট সব কথা বলিয়াছিলে? জিলেট জিলেকি সিলেমে কিলেকিট কিলেকি কি বাছা? এরূপ মন্ত্র বেদে কোরানে বাইবেলে কোন স্থানে আমি দেখি নাই। পিড়িং পিড়িং দুম বলিলেও একদিক কথা থাকিত। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তোমার এত দুর্গতি হইয়াছে। যাহা হউক, তোমাকে আমি ক্ষমা করিয়াছি। এক্ষণে হাঁ কর।

আমি হাঁ করিলাম। দেবী আমার মুখে একটু অমৃত কুণ্ডের জল ঢালিয়া দিলেন। তাহাতে আমার সর্ব্বশরীরের ব্যথা দূর হইল। যেন নূতন জীবন নূতন শরীর আমি প্রাপ্ত হইলাম। তাহার পর মা আমাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া বলিলেন,–যাও বাছা। এখন ঘরে যাও। এলোকেণী আর তোমাকে কিছু বলিবে না। এই কথা বলিয়া মা অন্তর্ধান হইলেন। আমি বাড়ী আসিলাম। মায়ের বরে এলোকেশীর প্রসন্ন বদন দেখিয়া পরম সন্তোষ লাভ করিলাম। ডমরুধারীর গল্প শুনিয়া সকলে চমৎকৃত হইলেন। পুরোহিত বলিলেন,–ধন্য ডমরুধর! তুমি ধন্য!গণপতি ভড় বলিলেন,—ডমরুকি বিপদেই না পড়িয়াছিলেন। পুঁটিম চাকী বলিলেন,–কেবল পুণ্যবলে ডমরুধর রক্ষা পাইয়াছেন।

আধকড়ি ঢাক বলিলেন,–চমৎকার গল্প। লম্বোদর বলিলেন,—অতি চমৎকার। বন্ধুদিগের পুস্তক সমালোচনা করিবার সময় কোন লোক লেখক যেরূপ প্রেমে মজিয়া রসে ভিজিয়া ভাবে গেজিয়া বলেন,মরি মরি! আহা মরি! এও সেই আহা মরিচকসঙ্গে ডমরুর একবার লম্বোদরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। কিন্তু কোন উত্তর করিলেন না।

অবশেষে ডমরুধর বলিলেন,–পীর গোরাচাঁদের ব্যাঘ্রের উদরে যখন ছিলাম, তখন মনে মনে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম যে, এ বিপদ হইতে মা যদি আমাকে পরিত্রাণ করেন, তাহা হইলে মাকে আমি ব্যাঘ্রবাহিনীরূপে পূজা করিব। আমার আদেশে সেই জন্য কারিগর সিংহ স্থানে ব্যাঘ্ৰ গড়িয়াছে। লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—তুমি যে গল্পটি করিলে, কি করিয়া জানিব যে, তাহা সত্য?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–এই আমার পায়ে এখনও রাহুর কামড়ের দাগ রহিয়াছে। সত্য সত্যই ডমরুধরের পায়ে একটা দাগ আছে, তা দেখিয়া সকলে অবাক!

তখন লম্বোদর বলিলেন,—জিলেট জিলোক সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।

পঞ্চম গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–স্বদেশী কোম্পানী

ডমরুধরের প্রথম উপাখ্যানে চিত্রগুপ্ত, যম, যমনী, পুইশাক, এলোকেশী, এলোকেশীর মাতা প্রভৃতির বিষয় বর্ণিত হইয়াছিল। এলোকেশী ডমরুধরের তৃতীয় পক্ষের পত্নী। সেই উপাখ্যান পাঠের ফল এইরূপ,–

ডমরুচরিত পড় রে ভাই করে একান্ত ভক্তি।
ইহকালে পাবে সুখ পরকালে মুক্তি।।
চিত্রগুপ্তর গলায় দড়ি যমনী বাজায় শাঁক।
পুইশাকের নামে যমের সিঁটকে উঠলো নাক।।
ঝক মক করে সোনার গহনা এলোকেশীব গায়!
আড়নয়নে শাশুড়ী ঠাকরুন পিটির পিটির চায়।।
পয়সা দিয়া ডমরুচরিত কিনে রাখ ঘরে।
ধৰ্ম্ম অর্থ কাম মোক পাবে ইহার বরে।।

বর্তমান ডমরু উপাখ্যানের ফলও সেইরূপ, বরং অধিক।

প্রতিবৎসর পূজার সময় ডমরুধর বন্ধুবান্ধবের সহিত নানারূপ গল্প করেন। পঞ্চমীর দিন বৈকালে তাঁহার পূজার দালানে লম্বোদর, গজানন, হলধর প্রভৃতি বন্ধুবান্ধবের সহিত প্রতিমার নিকট তিনি বসিয়া আছেন। ডমরুধরের মুখের দিকে চাহিয়া লম্বোদর বলিলেন,–একবার পুনরায় স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া তুমি অনেকগুলি টাকা উপার্জন করিয়াছ।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–হাঁ ভাই! স্বদেশী কোম্পানী বৃথা যায় না। কিছু না কিছু দিয়া যায়। কিন্তু ভাই, সম্প্রতি আমি এক ঘোর বিপদে পড়িয়াছিলাম। সে বিপদ হইতে মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিয়াছেন। আমার প্রতি মায়ের অসীম কৃপা। বলিতে গেলে আমি মা দুর্গার বরপুত্র।–সধোদর বলিলেন,—সেবার স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া তুমি অনেক বাড়ী ভুড়ি গরীব দুঃখীর টাকা হাম করিয়াছিলে। একবার মোকদ্দমা হইয়াছিল জানি। কি হইয়াছিল বল দেখি!

ডমরুর উত্তর করিলেন,–মোকদ্দমা স্বদেশী কোম্পানীর প্রধান অঙ্গ। স্বদেশী কোম্পানী খুলিলে সকলকেই মামলা-মোকদ্দমা করিতে হয়। যাহা হউক, এখন সব চুকিয়া গিয়াছে। এই নূতন স্বদেশী কোম্পানীর বৃত্তান্ত এখন আমি তোমাদিগকে বলিতে পারি, শুন।

ডমরুধর এইরূপ বলিতে লাগিলেন,–

গত বৎসর পূজার পর একদিন বেলা দশটার সময় আমি বাহিরে বসিয়া আছি, এমন সময় ব্যাগ হাতে করিয়া এক ছোকরা আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহার বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ বৎসর। রং অল্প গৌরবর্ণ। কালো গোঁপ আছে। দেখিতে সুশ্রী। ভদ্রলোকের ছেলে বলিয়া বোধ হইল।

ব্যাগ হইতে চারিটি শিশি সে বাহির করিয়া বলিল,–এইটি ম্যালেরিয়া জ্বরের আরক, এইটি অজীর্ণ বোগের ঔষধ, এইটি বহুমূত্র রোগের ব্রহ্মাস্ত্র; আর এইটি মুখে মাখিলে রং ফরসা হয়। প্রতি শিশির মূল্য একটাকা আমাকে প্রদান করুন।

আমি বলিলাম,—ঔষধে আমার প্রয়োজন নাই। তুমি বোকা লোকদিগের নিকট গমন কর। তোমার একটিও ঔষধ আমি ক্রয় করিব না।

আমার কথা শুনিয়া সে চলিয়া গেল না। অতি সুমিষ্ট স্বরে সে ঔষধের গুণ ব্যাখ্যা করিতে লাগিল। সে বলিল,–আমি তিনটা পাস দিয়াছি। যে বিদ্যা শিখিলে নানা পদার্থ মিশাইয়া উত্তম উত্তম নূতন বস্তু প্রস্তুত করিতে পারা যায়, আমি সেই বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছি। সেই বিদ্যাবলে আমি এইসব ঔষধ প্রস্তুত করিয়াছি! ইহাদের গুণ অলৌকিক। দিন কয়েক ব্যবহার করিলেই আপনার শরীরে কান্তি ফুটিয়া পড়িবে। আপনি নব-যৌবন প্রাপ্ত হইবেন।

উত্তর করিলাম,–আমার ম্যালেরিয়া জ্বর নাই, অজীর্ণ ও বহুমূত্র রোগ নাই। আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, রং ফরসা হইবার সাধ নাই। তাহা ব্যতীত আমি বৃথা একটি পয়সাও খরচ করি না। তোমার ঔষধ আমি ক্রয় করিব না।।

আমাদের দুইজনে এইরূপ তর্ক-বিতর্ক হইতে লাগিল। কিন্তু সে ছোকরা নাছোড়বান্দা। এমনি সুমিষ্ট ভাষায় সে বক্তৃতা করিতে লাগিল যে, ক্রমে আমার মন ভিজিয়া আসিল। অবশেষে সে বলিল,–আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন সত্য, কিন্তু মন আপনার বৃদ্ধ হয় নাই। মনটি আপনার নবযৌবনে ঢল ঢল করিতেছে। আর কোন ঔষধ লউন আর নাই লউন, আপনাকে এই রং ফরসা হইবার ঔষধটি লইতে হইবে। দিনকতক মুখে মাখিয়া দেখুন। আপনি ফুট গৌরবর্ণ হইয়া পড়িবেন। সুন্দর সুকুমার কুড়ি বৎসরের যুবক হইবেন।

ছোটবেলা হইতে ফরসা হইবার আমার সাধ ছিল। অনেক সাবাং মাখিয়াছিলাম। কিছুতে কিছু হয় নাই। মনে মনে ভাবিলাম,–এই ঔষধটা পরীক্ষা করিয়া দেখি না কেন? যদি আমার রং ফরসা হয়, তাহা দুর্লভী বাগদিনী আমার রূপ দেখিয়া মোহিত হইবে।

শিশির মূল্য একটাকা কিন্তু সে আমাকে আট আনায় দিল। মূল্য লইয়া সে কিছুর গিয়াছে এমন সময় আমার মনে এইরূপ চিন্তার উদয় হইল। আমি ডমরুর। সুমিষ্ট বক্তৃতা করিয়া আমাকে ঠকাইয়া এ আট আনা লইয়া গেল। এ সামান্য ছোকরা নয়। ইহা দ্বারা কি কোনরূপ কাজ করিতে পারা যায় না?

এইরূপ ভাবিয়া আমি তাঁহাকে ডাকিলাম। আদর করিয়া আমার নিকট বসাইলাম। আমি বলিলাম,—বাপু! তোমার নাম কি?

সে উত্তর করিল,–আমার নাম শঙ্কর ঘোষ।

তাঁহার বাড়ী কোথায়, সে কি কাজ করে, প্রভৃতি তাহার পরিচয় গ্রহণ করিলাম,–তুমি তিনটা পাস দিয়াছ। পাঁচ দ্রব্য মিশাইয়া নূতন বস্তু প্রস্তুত করতে পার। ঔষধ বেচিয়া কি হইবে? কোন একটা লাভের বস্তু প্রস্তুত করিতে পার না?

কিছুক্ষণ নীরবে সে চিন্তা করিয়া আমাকে বলিল,–কল্য আসিয়া আপনার এ কথার উত্তর দিব।

পরদিন সে ধবধবে চিকণ কাগজ আনিয়া আমাকে দেখাইল। সে বলিল,–এঁটেল মাটী হইতে আমি এই কাগজ প্রস্তুত করিয়াছি। এক টাকার এঁটেল মাটী হইতে দশ দশ টাকার কাগজ হইবে। নয় টাকা লাভ থাকিবে। প্রথম প্রথম যাহা অল্প খরচ হইবে, তাহা যদি আপনি প্রদান করেন তাহা হইলে আমরা এক স্বদেশী কোম্পানী খুলিব। লাভ অর্ধেক আপনার অর্ধেক আমার।

এঁটেল মাটী ও কাগজ দেখিয়া আমি মনে মনে একটু হাসলাম। স্বদেশী কোম্পানী সম্বন্ধে আমার একটু অভিজ্ঞতা আছে। ভাবিলাম যে এ কাজ হালাগুলো বাঙ্গালীর উপযুক্ত বটে। তাঁহার প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম।

চারি পাঁচ দিন পরে আমরা দুইজনে কলিকাতা গমন করিলাম। ভালরূপ একটা স্বদেশী কোম্পানী খুলিতে হইলে দুই-চারিজন বড়লোকের নাম আবশ্যক। আমরা তাঁহার যোগাড় করিলাম। একটি মিটিং হইল। এঁটেল মাটি ও কাগজের নমুনা দেখিয়া বড়লোকেরা ঘোতর আশ্চর্য হইলেন। তাহাদের মধ্যে কেবল একজন বলিলেন,–এঁটেল মাটী দিয়া কাগজ প্রস্তুত হইতে পারে, তাহা আমি জানিতাম না। আমি মনে করিতাম যে, খড়িমাটী দিয়া কাগজ প্রস্তুত হয়।

শঙ্কর ঘোষ উত্তর করিলেন-খড়িমাটী দিয়া হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে খরচ অধিক পড়ে।

কাগজ সম্বন্ধে ইহার এইরূপ গভীর জ্ঞান দেখিয়া অন্য সকলে তাঁহার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

সেই যাহারা ইংরেজীতে বক্তৃতা করেন, যাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া স্কুল কলেজের ছোঁড়াগুলো আনন্দে হাততালি দিয়া গগন ফাটাইয়া দেয়, আমরা সেইরূপ দুইজন বক্তার যোগাড় করিয়াছিলাম। তাঁহারা ইজের দিয়া কোমর আঁটিয়া রাখেন। তাহাদের একজন বক্তৃতা করিলেন—

আমাদের কোম্পানীর নাম হইল,–গ্র্যাণ্ড স্বদেশী কোম্পানী লিমিটেড। কয়েকজন বড়লোক ও উগ্র বক্তা ডাইরেক্টর বা পরিচালক হইলেন। কারণ, এই সকল বড়লোক ও বক্তারা সকল প্রকার কারুকার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে ধুরন্ধর। ইহারা নাম জানেন না, এমন বিষয় নাই। শঙ্কর ঘোষ ইংরাজী ও বাঙ্গলায় কোম্পানীর বিবরণ প্রদান করিয়া কাগজ ছাপাইলেন ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচার করিলেন। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, যে ব্যক্তি একশত টাকার শেয়ার বা অংশ কিনিবে, প্রতিমাসে লাভস্বরূপ তাঁহাকে পঁচিশ টাকা প্রদান করা হইবে।

দেশে ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। সকলে বলিতে লাগিল যে, আর আমাদের ভাবনা নাই। যখন এটেল মাটী হইতে কাগজ প্রস্তুত হইবে, তখন বালী হইতে কাপড় হইবে। বিদেশ হইতে কোন দ্রব্য আর আমাদিগকে আমদানি করিতে হইবে না। দেশ টাকায় পূর্ণ হইয়া যাইবে। এই কথা বলিয়া কলিকাতায় বাঙ্গালীরা একদিন সন্ধ্যাবেলা আপন আপন ঘর আলোকমালায় আলোকিত করিল।

প্রথম প্রথম শত শত লোক শেয়ার কিনিতে লাগিল। হুড় হুড় করিয়া টাকা আসিতে লাগিল। আমি কোষাধ্যক্ষ ছিলাম। টাকা সব আমার কাছে আসিতে লাগিল।

কয়েক মাস গত হইয়া গেল। এঁটেল মাটী দিয়া শঙ্কর ঘোষ একখানিও কাগজ প্রস্তুত করিলেন না। মাসে যে পঁচিশ টাকা লাভ দিবার কথা ছিল, তাঁহার একটি পয়সাও কেহ পাইল না। আসল টাকার মুখও কেহ দেখিতে পাইল না। জনকয়েক আমাদের নামে নালিশ করিল। শঙ্কর ঘোষ চমৎকার এক হিসাবের বহি প্ৰস্তুত করিয়া কাছারিতে দাখিল করিলেন। লাভ দূরে থাকুক, হিসাবে লোকসান প্রদর্শিত হইল। কোম্পানী লিমিটেড ছিল। মোকদ্দমা ফাস হইয়া গেল। আমাদের কাহারও গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগিল না।

অনেকগুলি টাকা লোকে দিয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, সে টাকাগুলি সমুদয় আমি লইলাম। শঙ্কর ঘোষ ভাগ চাহিল। আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলাম,–হিসাবের বহি তুমি নিজে হাতে প্রস্তুত করিয়াছ। তাহাতে তুমি লিখিয়াছ যে, লোকসান হইয়াছে। কোম্পানী ফেল হইয়া গিয়াছে। টাকা আর কোথা হইতে আসিবে। বরং যাহা লোকসান হইয়াছে, তাহা আমাকে দিয়া যাও।।

আমার কথা শুনিয়া শঙ্কর ঘোষ ঘোরতর রাগান্বিত হইল। তুমি আমাকে ফাকি দিলে; তোমাকে আমি দেখিয়া লইব,—আমাকে এইরপ ভয় দেখাইয়া সে চলিয়া গেল। আমার দ্বিতীয় কোম্পানীর বৃত্তান্ত এই।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–তুমি বলিলে যে সম্প্রতি বড় বিপদে পড়িয়াছিলে। আমরা পাড়ায় থাকি। কোন বিপদের কথা আমরা তো শুনি নাই।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–সে বিপদের কথা আজ পর্যন্ত আমি কাহারও নিকট প্রকাশ করি নাই। আজ তাহা তোমাদিগকে বলিতেছি শুন।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–ভিকু ডাক্তার

ডমরুর বলিতে লাগিলেন,—ফাঁকতালে অনেকগুলি টাকা লাভ করিয়া মন আমার প্রফুল্ল হইল। শরীরটি নাদুসনুদুস নধর হইয়া উঠিল। আমি মনে করিলাম দুর্লভীকে দেখাইয়া আসি। সেবার এই বাগদিনী সম্বন্ধে কি হইয়াছিল, তাহা তোমাদিগকে বলিয়াছি। সুন্দরবনের আবাদ হইতে আমি বাটী ফিরিয়া আসিতেছিলাম। পথে এক বেটা সাঁওতাল আমার কাপড় কাড়িয়া লইয়া আমাকে উলঙ্গ করিয়া ছাড়িয়া দিল। কোন স্থানে একদল বেদিয়া তাবু ফেলিয়াছিল। তাহাদের ছোট একটি লাল ঘাঘরা বেড়ায় শুকাইতেছিল। সেই ঘাঘরা চুরি করিয়া আমি পরিধান করিলাম। আমি মনে করিলাম যে, সন্ধ্যা পর্যন্ত দুলাভীর ঘরে লুকাইয়া থাকি। তাঁহার ঘরে যেই প্রবেশ করিয়াছি, আর কেষ্টা ছোঁড়ার বাপ আসিয়া দ্বারে শিকল দিয়া দিল। কেষ্টা গ্রামের লোককে ডাকিয়া আনিয়া, আমাকে দেখাইল। রাঙা ঘাঘরা পরিয়া পোড়ার মুখে ডেকরা বুড়ো আমার মন ভুলাইতে আসিয়াছে,—এইরূপ গালি দিয়া দুর্লভী আমাকে অনেক ভৎসনা করিল। তাহার পর এলোকেশী আসিয়া আমাকে ঝটার দ্বারা প্রহার করিলেন। এ সব কথা তোমাদিগকে আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি।

সেই অবধি দুর্লভী আমার সহিত কথা কয় না। পথে মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যায়। যখন কন্দর্প পুরুষের ন্যায় আমার নাদুসনুদুস নধর শরীর হইল, তখন আমি মনে করিলাম যে, চুপি চুপি দুর্লভীকে আনি,—যেন এলোকেশী জানিতে না পারেন।

দুর্লভীর ঘরে গিয়া দেখিলাম যে, সে কয়দিন জ্বরে পড়িয়া আছে। তাঁহার বোনঝির নাম চঞ্চলা। পাঁচ ক্রোশ দূরে ঝিঝিরডাঙ্গা নামক গ্রামে তাদের বাস। সে বিধবা। বয়স প্রায় ত্রিশ। রং কালো বটে, কিন্তু দেখিতে মন্দ নহে। আমি মনে করিলাম,ইহার সহিত ভাব করিতে হইবে। তাহা করিলে দুর্লভীর হিংসা হইবে। আমার উপর আর তাঁহার রাগ থাকিবে না। রং ফরসা হইবার জন্য শঙ্কর ঘোষ আমাকে যে ঔষধ বিক্রয় করিয়াছিল, তাহা আমি ব্যবহার করি নাই। সেই ঔষধ দুর্লভীকে আমি খাইতে দিলাম। তাহা খাইয়া দুর্লভীর পেট চাড়িয়া দিল, দুর্লভী মৃতপ্রায় হইল। গ্রামের সকলে আমাকে ছি ছি করিতে লাগিল। পুলিশে সংবাদ দিবে বলিয়া কেষ্টর বাপ আমাকে ভয় দেখাইল।

চঞ্চলা বলিল যে, তাহাদের গ্রামে ভিক্ষু ডাক্তার নামক এক ভাল চিকিৎসক আছেন, তাঁহাকে আনিলে তাঁহার মাসী ভাল হইবে। আমার ঔষধ খাইয়া দুর্লভীর প্রাণ যাইতে বসিয়াছে, সেজন্য ভয়ে আমি খরচ দিতে সম্মত হইলাম। ব্যাগ হাতে করিয়া পাঁচ ক্রোশ দূরে ঝিঝিরডাঙ্গা হইতে ভিক্ষু ডাক্তার পদব্রজে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইনি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রদান করেন।

শুনিলাম যে ভিকু কলিকাতায় কোন ডাক্তারখানায় ছয় মাস কম্পাউন্ডারি করিয়াছিলেন। একবার কোন রোগীকে কৃমির ঔষধের পরিবর্তে কুচিলা বিষ প্রদান করিয়াছিলেন। রোগীর তাহাতে মৃত্যু হইয়াছিল। সেজন্য ভিকুর ছয় মাস কারাবাস হইয়াছিল। এইরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া ভিকু এখন স্বগ্রামে আসিয়া ডাক্তার হইয়াছেন।

ভিকুর বয়স চল্লিশের অধিক। শরীর কাহিল। রং ময়লা, তবে কালো নহে। সচরাচর হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের বিশেষতঃ হাতুড়েদের যেরূপ হয়, ভিকুর মুখ দিয়াও সেইরূপ চড়চড় করিয়া কথার যেন খৈই ফুটিতে থাকে। দুর্লভীকে দেখিয়া ভিকু বলিলেন,–কোন ভয় নাই, সরিষাপ্রমাণ এক বড়িতে ইহাকে আমি ভাল করিব। এ বা কি করিব! আমি কত অসাধ্য রোগ ভাল করিয়াছি। কত মরা মানুষকে জীবন প্রদান করিয়াছি।

এইরূপ ভূমিকা করিয়া ভিকু নিজের বিদ্যার পরিচয় দিতে আরম্ভ করিলেন। ভিকু বলিলেন,–নেহালা গ্রামের ত্রিলোচন সরকেলের পেট ক্রমে ক্রমে ফুলিতে লাগিল; পেট ফুলিয়া ক্ৰমে জালার মত হইল। কত ডাক্তার কত বৈদ্য আসিল। কেহ বলিল উদরী, কেহ বলিল টিউমার। কত ঔষধ তিনি খাইলেন। কিছুতে কিছু হইল না। অবশেষে তাঁহার লোকেরা আমাকে লইয়া গেল। আমি অনেকক্ষণ ধরিয়া বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া তাঁহার পেটটি দেখিলাম। অবশেষে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা কবিলাম, তোমাদের ঘরে মাছ ধরিবার সূতা বঁড়শী আছে? বঁড়শীতে হোমিওপ্যাথিক গুলির টোপ করিয়া সূতার সহিত রোগীকে গিলিতে বলিলাম। মুখের বাহিরে সূতাটির অপর দিক ধবিয়া আমি একদৃষ্টে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। সূতা যেই একটু নডিয়া উঠিল, আর সেই সময় আমি টান মারিলাম। বলিব কি মহাশয়! ধামার মত প্রকাণ্ড একটা কচ্ছপ তাঁহার পেট হইতে আমি বাহির করিলাম! জলের সহিত সামান্য শিশু-কচ্ছপ সরকেলমহাশয় ভক্ষণ কবিয়াছিলেন। উদরে সেই কচ্ছপ ক্রমে বড় হইয়া তাঁহার জীবন সংশয় কবিয়াছিল। আমার চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হইলেন।

আর একবার রাত্রি দুপ্রহরেব সময় আমি ঝিল গ্রামের শ্মশানঘাটের নিকট দিয়া যাইতেছিলাম। দেখিলাম যে, সে স্থানে কয়েকটি ভূত কেহ দাঁড়াইয়া কেহ বসিয়া কমিটি করিতেছে। আমি একটু দূরে বসিয়া ব্যাগ হইতে হোমিওপ্যাথিক পুস্তক বাহির কবিলাম। দিয়াশলাই জ্বালিয়া তাঁহার আললাকে ভূতেব ঔষধ দেখিলাম। তাহার পর যেই ঔষধের শিশি বাহির করিয়াছি, আর তাঁহার গন্ধ পাইয়াই ভূতেরা রুদ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। একটু বিলম্ব করিলে আমার ঔষধের গুণে তাঁহারা ভস্ম হইয়া যাইত। ভূতের ছাই হিষ্টিরিয়া রোগের চমৎকার ঔষধ আমি প্রস্তুত করিতে পারিতাম।

ভিকু ডাক্তার আরও বলিলেন যে,–ভূতগণ যখন পলায়ন করিল, তখন আমি সেই স্থানে গিয়া দেখিলাম যে, তাঁহারা এক মড়া ভক্ষণ করিতেছিল। মড়ার হাত-পা সর্ব্ব শরীর তাঁহারা খাইয়া ফেলিয়াছিল, কেবল মুখটি অবশিষ্ট ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ দুইটি হোমিওপাথিক ঔষধের গুলি বাহির করিয়া তাঁহার মুখে দিলাম। মুখে গুলি দিবামাত্র সে চাহিয়া দেখিল, তাহার পর আশ্চর্য কথা কি বলিব মহাশয়। আমার ঔষধের গুণে তাঁহার শরীর গজাইতে লাগিল। প্রথম গলা হইল, তাহার পর বক্ষঃস্থল হইল, তাহার পর উদর হইল, তাহার পর হাত-পা হইল। সে উঠিয়া বসিল। তখন আমি বুঝিলাম যে, সে হিন্দুস্তানী, বাঙ্গালী নহে। সে বাত্রি আমি তাঁহাকে আমার বাটিতে অইয়া যাইলাম। পরদিন সে আপনার দেশে চলিয়া গেল। এখানে থাকিলে আপনাদিগকে দেখাইতাম। হোমিওপ্যাথিক ঔষধের গুণ আছে বটে, কিন্তু ঠিক ঔষধটি ধরা বড় কঠিন। অনেক দেখিয়া-শুনিয়া আমার বিষয়ে জ্ঞান হইয়াছে। রোগীর চেহারা দেখিলেই আমি ঠিক ঔষধ করিতে পারি। আমার হাতে একটিও রোগী মারা পড়ে না। সেজন্য কলিকাতার হোমরাচোমরা ডাক্তারগণ, যাঁহারা যোলো টাকা বত্রিশ টাকা ভিজিট গ্রহণ করেন তাঁহারা যখন হালে পানি পান না, তখন তাঁহারা বলেন, ঝিঝিরডাঙ্গার ভিকু ডাক্তারকে লইয়া এস, তিনি নাই হইলে এ রোগের ঔষধ কেহ ঠিক করিতে পারিবে না। সেজন্য মাঝে মাঝে আমাকে কলিকাতায় যাইতে হয়।

ভিকু পুনরায় বলিলেন,–আমি আর একটি চমৎকার ঔষধ বাহির করিয়াছি। যে ঔষধে প্রজাপতি দক্ষের গলায় ছাগলের মুণ্ডু জোড়া লাগিয়াছিল, ইহা সেই ঔষধ। হাতপা এমন কি মানুষের মাথা কাটিয়া দুইখানা হইয়া গেলেও, আমি এক বড়িতে পুনরায় জুড়িয়া দিতে পারি।

ভিকু নানারূপ গল্প করিলেন। অবাক হইয়া সকলে তাঁহারা গল্প শুনিতে লাগিল। সকলে মনে করিল যে, ইহার তুল্য বিচক্ষণ ডাক্তার জগতে নাই।

দুর্লভীর চিকিৎসার জন্য আমি তাঁহাকে এক টাকা দিতে চাহিলাম। কিন্তু প্রথমে কিছুতেই তাহা লইবেন না। তিনি বলিলেন,–আমি পাঁচ ক্রোশ পথ হইতে আসিয়াছি। চারি টাকা লইব।

অনেক কচলাকচলির পর আমি বলিলাম যে,—আপাততঃ আপনি এক টাকা লউন, রোগী ভাল হইলে পরে আর তিন টাকা দিব।

এ প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তিনি এক টাকা লইয়া প্রস্থান করিলেন। দুর্লভী ভাল হইল। কিন্তু তাহার পর ডাক্তারকে ঘোড়ার ডিম! রোগ ভাল হইলে অনেকেই ডাক্তার বৈদ্যকে

কলা দেখায়।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–চঞ্চলার গাই গরু

দুর্লভী ভাল হইলে চঞ্চলা আপনার গ্রামে চলিয়া গেল। কিন্তু চঞ্চলার সহিত সদ্ভাব করিতে আমার বাসনা হইয়াছিল। তাহাদের গ্রাম অনেক দূর। সর্ব্বদা আমি যাইতে পারিতাম না। কেবল মাঝে মাঝে যাইতাম। সেই গ্রামের পাশ দিয়া বড় রাস্তা গিয়াছে। তাঁহার উপর দিয়া গরুর গাড়ী সর্ব্বদা যায়। দুই চারিটা পয়সা দিয়া তাঁহার উপর বসিয়া কখন কখন কতক দূর যাইতাম। ফিরতি ঘোড়ার গাড়ীতেও দুই একবার গিয়াছিলাম। এ পথে দুই তিনবার মোটর গাড়ী দেখিয়াছিলাম। স্বদেশী কোম্পানী স্থাপনের সময় বড়লোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত শঙ্কর ঘোষ মোটর গাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন। সেই সময় আমি মোটর গাড়ি চড়িয়াছিলাম। কিন্তু অতি বেগে গমন করে। আমার ভয় হইয়াছিল। মোটর গাড়ি টানিবার নিমিত্ত ঘোড়া থাকে না। তবে ইহার ভিতর কোনরূপ বিলাতী জন্তু জানোয়ার থাকে কি না, তাহা আমি জানি না।

মাঝে মাঝে চঞ্চলাদের গ্রামে গিয়া তাহাদের দাওয়ার আমি বসিতাম। চঞ্চলার মা নাই, কেবল বাপ আছে। তাঁহার নাম সহদেব বাণী! সহদেব মজুরি করে। চঞ্চলার একটি গাই গরু আছে। তাঁহার দুধ সে বিক্রয় করে।।

চঞ্চলার দাওয়াতে বসিয়া আমি গল্প-গাছা করিতাম। কখন কখন দুই একটা রসের কথাও বলিতাম। তখন হাসিয়া সে লুটিপুটি হইত। পাড়ার মাগীদের সে ডাকিয়া আনিত। আমার দিকে চক্ষু ঠারিয়া সকলে লুটিপুটি হইত। আমাকে দেখিয়া লোকের আনন্দ হয়। আমার রূপ দেখিয়া তাঁহার মন ভুলিয়া যায়। মাগীগুলা আমার গায়ে যেন ঢলিয়া পড়ে।

চঞ্চলাকে দশ পয়সা দিয়া একখানি গামছা কিনিয়া দিলাম। গামছা পাইয়া তাঁহার আহ্লাদ হইয়াছিল, আমি মনে ভাবিলাম,দুর্লভী একবার এই কথা শুনিলে হয়। তাহা হইলে লে আর মুখ হাঁড় করিয়া থাকিবে না। লম্বোদর। এইবার ভাই সেই ঘোর দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল। এইবার সেই গ্রামে আমাকে প্রায় একমাস কয়েদ থাকিতে হইয়াছিল।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–সে কবে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–আজ পঞ্চমী, ইহার তিনটা পঞ্চমী আগে, প্রায় দুই মাসের কথা। লম্বোদর বলিলেন,–সে কি করিয়া হইবে। তুমি বলিতেছ যে দুই মাস পূর্ব্বে দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল। তাহার পর এক মাস তুমি সেই গ্রামে কয়েদ হইয়াছিলে। কিন্তু গত ছয় মাস ধরিয়া তুমি কোন স্থানে গমন কর নাই। এই ছয়মাস প্রতিদিন তোমাকে আমরা দেখিয়াছি।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–সকলই জগদম্বার মায়া! তাঁহার মায়াতে তোমরা আচ্ছন্ন হইয়াছিলে।–লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—দুর্ঘটনাটা কি?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—তাহা বলিতেছি শুন।

***

প্রায় দুই মাসের কথা হইল। একদিন রাত্রিতে আমি ঘরে শুইয়াছিলাম। শেষ রাত্রিতে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। আর নিদ্রা হইল না। এপাশ ওপাশ করিতে লাগিলাম। চঞ্চলার জন্য একখানি নয়হাতি কাপড় কিনিয়াছিলাম। মনে করিলাম, বিছানায় বৃথা পড়িয়া থাকিব না। কাপড়খানি তাঁহাকে দিয়া আসি। এলোকেশীর ভয়ে কাপড়খানি একস্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। কাপড়খানি লইয়া চঞ্চলাদের গ্রাম অভিমুখে আমি হাঁটিয়া চলিলাম। যাইতে যাইতে সকাল হইয়া গেল। সূর্যোদয়ের পরে বড় রাস্তায় গিয়া উঠিলাম। বেলা প্রায় নয়টার সময় চঞ্চলাদের গ্রামের নিকট উপস্থিত হইলাম। চঞ্চলার পিতা সহদেবের সহিত বড় রাস্তায় সাক্ষাৎ হইল। চঞ্চলার গাই গরুর দড়ি ধরিয়া বড় রাস্তার উপর দিয়া সে তাঁহাকে মাঠে লইয়া যাইতেছিল। তাঁহার সহিত কথা কহিতে কহিতে আমি কিছুর চলিলাম, অন্যমনস্ক হইয়া আমরা যে দুইজন যাইতেছি, পশ্চাতে যে ভো ভো শব্দ হইয়াছিল, তাঁহার কিছুই শুনিতে পাই নাই। সহসা পশ্চাৎ হইতে এক মোটর গাড়ি আমার উপর আসিয়া পড়িল। গাড়ির চাকায় আমার কোমর পর্যন্ত কাটিয়া দুইখানা হইয়া আমার দুইটা কাটা-পা গাড়ির চাকায় কিরূপে আটকাইয়া গেল। কোমর হইতে আমার পা দুইটি লইয়া মোটর গাড়ি অতি দ্রুতবেগে পলায়ন করিল।

লম্বোদর প্রভৃতি সকলে শিহরিয়া উঠিলেন। সকলে বলিয়া উঠিলেন,—বল কি হে? সত্য?–ডমরুধর উত্তর করিলেন,–হাঁ ভাই, সত্য।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–তাহার পর?

ডমরুর বলিলেন,–রাস্তায় ধূলায় আমার ধড়টি পড়িয়া কাটা ছাগলের ন্যায় ছটফট করিতে লাগিল। তখনও আমার প্রাণ বাহির হইয়া যায় নাই। তখনও সম্পূর্ণ আমি জ্ঞানহারা হই নাই। আমি এ-দিক ওদিক চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, সহদেব বাণী হতভম্ভ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। বোধ হয় যে, তাঁহাকে আঘাত লাগে নাই। সে চঞ্চলার গরুর দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। গরুটিও পথে পড়িয়াছিল। গাড়ীর আর একটি চাকায় তাঁহারও কোমর পর্যন্ত কাটিয়া দুইখানা হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার কোমর ও পা কিন্তু গাড়ীর চাকায় লাগিয়া যায় নাই। একদিকে গরুর ধড় ও অপরদিকে তাঁহার কোমর ও পা রাস্তার উপর পড়িয়াছিল। বিষণ্ণ বদনে সহদেব তাহাই দেখিতেছিল।

সেই পথ দিয়া ভিকু ডাক্তার ব্যাগ হাতে লইয়া চিকিৎসা করিতে যাইতেছিলেন। তিনি দৌড়িয়া আসিলেন। এ-দিক ওদিক চাহিয়া কোমর ও পা দেখিতে পাইলেন না। তখন সেই গরুর কোমর ও পা আমার শরীরে তিনি জুড়িয়া দিলেন। তাঁহার ব্যাগ খুলিয়া দুইটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের গুলি আমার মুখে দিলেন। ঔষধের গুণে সেই গরুর কোমর ও পা আমার শরীরে জুড়িয়া গেল। তাহার পর আর দুইটি বড়ি তিনি আমার মুখে দিলেন। তাহা দেখিয়া আমি শরীরে বল পাইলাম। কিন্তু মানুষের মত গরুর দুই পায়ে আমি সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারিলাম না। গরুর দুই পা আমার দুই হাত মাটীতে পাতিয়া পাতিয়া চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় আমাকে দাঁড়াইতে হইল।

ইতিমধ্যে সে স্থানে অনেক লোক একত্র হইয়াছিল। এই অবস্থায় সকলে আমাকে গ্রামের ভিতর লইয়া গেল। সে স্থানে গিয়া ভিকু ডাক্তার বলিলেন,–ডমরুবাবু তুমি আমার পাওনা টাকা দাও নাই। আমাকে ফাকি দিয়াছিলে। কিন্তু এখন তোমার এই শরীরটি আমার হইল। গরুর কোমর তোমার শরীরে যদি আমি জুড়িয়া না দিতাম, তাহা হইলে এতক্ষণ কোন কালে তুমি মরিয়া যাইতে। দুইদিন পরে তোমার ধড়টি পচিয়া যাইত, অথবা পুড়িয়া ছাই হইত। অতএব তোমার এই শরীর এখন আমার। আমার চাষ আছে। যতদিন বাঁচিবে, ততদিন আমার ক্ষেতে তোমায় কাজ করিতে হইবে।

এই কথা বলিয়া আমার গলায় গরুর দড়ি দিয়া তিনি টানিতে লাগিলেন।

চঞ্চলার পিতা সহদেব তাঁহার হাত হইতে দড়ি কাড়িয়া লইল। সে বলিল,–ভাল রে ভাল! ইনি তোমার? সে কিরূপ কথা? ইহার আধখানা চঞ্চলার গাই। এখনও ইহার দুধ হইবে। আমরা ইহাকে ছাড়িয়া দিব না।

আমাকে লইয়া দুইজনে বিবাদ বাধিয়া গেল। এ বলে ইনি আমার প্রাপ্য, ও বলে আমার প্রাপ্য। ক্রমে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল। অবশেষে গ্রামের লোক সমস্যার এইরূপ মীমাংসা করিয়া দিল। দিনের বেলা আমাকে ভিকু ডাক্তারের কাছে থাকিতে হইবে। সমস্ত দিন তিনি আমাকে খাটাইয়া লইবেন। রাত্রিকালে আমি চঞ্চলার গোয়ালে বাঁধা থাকিব। প্রাতঃকালে চঞ্চলা আমার দুধ দুহিয়া ভিকু ডাক্তারের বাড়ীতে আমাকে পাঠাইয়া দিবে। একবেলা ভিকু ডাক্তার আমাকে খাইতে দিবেন, অন্য বেলা সহদেব বাঙ্গী আমাকে খাইতে দিবে।

প্রথম দিন আর আমাকে কোন কাজ করিতে হয় নাই। সেদিন চঞ্চলার গোয়ালে খোঁটায় আমি বাঁধা রহিলাম, পাছে হাত দিয়া দড়ি খুলিয়া আমি পলায়ন করি, সেজন্য হাত দুইটিও তাঁহারা বাঁধিয়া রাখিল। ইহার পর প্রতি রাত্রিতে তাঁহারা এইভাবে আমাকে বাঁধিয়া রাখিত, স্যাবেলা চঞ্চলা আমাকে দুইটি মুড়ি খাইতে দিল। যতদিন ইহাদের নিকট ছিলাম, ততদিন দুইবেলা দুইটি মুড়ি আমার আহার ছিল। একবেলা ভিকু ডাক্তার দিত, অন্যবেলা চঞ্চলা দিত। আমার দাঁত নাই, মুড়ি চিবাইতে পারিতাম না। প্রাণধারণের নিমিত্ত কোনরূপে গিলিয়া ফেলিতাম।

পরদিন প্রাতঃকালে চঞ্চলা আমার দুধ দোহন করিল। প্রায় দুই সের দুধ হইল। তাহার পর সে বাছুর ছাড়িয়া দিল, বাছুর আমার দুধ খাইতে লাগিল ও মাঝে মাঝে বাছুর আমার পেটে মাথার তঁতো মারিতে লাগিল। তাঁহার গুতোতে আমি অস্থির হইয়া পড়িলাম। ভাগ্যক্রমে এই সময় ভিকু ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি বলিলেন,–ডমরুবাবুর ঐ পেট এখন আমার। পেট আমার ভাগে পড়িয়াছে। পেটে আমি বাছুরকে মারিতে দিব না। তাঁহার ছুঁতে, যদি ডমরুবাবুর নাড়িভূঁড়ি ছিঁড়িয়া যায়, তাহা হইলে তোমাদের নামে নালিশ করিব। সেইদিন হইতে চঞ্চলা বাছুরের দড়ি টানিয়া রাখিত। বাছুর আমার পেটে আর গুঁতো মারিতে পারিত না।

দুধ দোহন হইলে ভিকু ডাক্তার আমাকে তাঁহার ক্ষেতে লইয়া গেলেন। কৃষককে বলিলেন যে,–একটা গরুর সহিত ইহাকে লাঙ্গলে জুড়িয়া দাও।

কৃষক তাহাই করিল। মানুষের হাত কোমল তাহাতে ক্ষুর নাই। কিন্তু এখন আমাকে দুইটি হাত মাটিতে পাতিয়া গরুর ন্যায় চরিতে হইয়াছিল। আমার হাতে কাটা খোঁচা ফুটিয়া যাইতে লাগিল। ঘোরতর কষ্টে আমার চক্ষু দুইটি জলে ভাসিয়া গেল। আমি ভাবিলাম যে, আমার নাদুস-নুদুস নধর শরীরটি এইবার মাটি হইয়া গেল।

আমার সঙ্গে বলদের সহিত সমানভাবে আমি ক্ষেতের উপর লাঙ্গল কাধে করিয়া চলিতে পারিতেছিলাম না, সেজন্য কৃষক আমার আঙ্গুলে সবলে মোচড় দিতে লাগিল। এমন সময় সহদেব সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সহদেব বলিল,–ও কি। তুমি উহার লেজ মলিতে পারিবে না। লেজ তোমাদের নহে, লেজ আমাদের ভাগে পড়িয়াছে।

কৃষক আর আমার লাল মর্দন করিল না বটে, কিন্তু আমার পিঠে ছড়ি মারিতে লাগিল। ফলকথা, আমার দুঃখের আর সীমা রফি-না। সন্ধ্যাবেলা ভিকু ডাক্তার আমাকে চঞ্চলার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন। চঞ্চলা আমাকে তাঁহার গোয়ালে বাঁধিয়া রাখিল। পরদিন প্রাতঃকালে আমার দুধ দুহিয়া পুনরায় আমাকে ভিকু ডাক্তারের নিকট পাঠাইয়া দিল। পুনরায় আমাকে লাঙ্গল ঘাড়ে করিয়া ক্ষেত চষিত হইল।

প্রতিদিন এইরূপ হইতে লাগিল। মনের দুঃখে রাত্রিদিন আমি কাঁদিতেছিলাম। ভাবিতেছিলাম যে, হায় হায়! স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া দেশের লোকের মাথায় হাত বুলাইয়া যে টাকা উপার্জন করিলাম, সে সব বৃথা হইল। এলোকেশী অথবা তোমার বন্ধুবান্ধব কেহ আমার কোন সন্ধান লইল না সেজন্য আমার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

লম্বোদর বলিলেন,–আজ ছয়মাস প্রতিদিন দুইবেলা তোমাকে দেখিতেছি। তোমার আবার সন্ধান কি লইব? কিন্তু তুমি কি বলিতেছ যে, সে সব জগদম্বার মায়া। তবে আমরা আর কি বলিব?

ডমরুধর পুনরায় বলিতে লাগিলেন,—দিন দিন আমি দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিলাম। আমার সে নাদুন-নুদুস নধর শরীর শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেল। অস্থিচর্মসার হইয়া যাইলাম। ভালরূপ লাঙ্গলও টানিতে পারি না, দুধও দিতে পারি না। প্রায় একমাস কাটিয়া গেল। একদিন প্রাতঃকালে চঞ্চলা আমাকে যথারীতি দুহিতে আসিল। কিছুমাত্র দুধ হইল না। পিতাকে গিয়া সে সেই কথা জানাইল। সহদেব বলিল যে,–কাল প্রাতঃকালে আমি নিজে দুহিয়া দেখিব। পরদিন প্রাতঃকালে সে নিজে আমাকে দুহিতে আসিল। একফোটাও দুধ বাহির হইল না। তখন সে বিড় বিড় করিয়া আপনা-আপনি বলিল,পুনরায় বাছুর হইলে দুধ হইবে না, তাঁহার যোগাড় করিতে হইবে।

এই কথা শুনিয়া আমার প্রাণ উড়িয়া গেল। একে লাঙ্গল টানিয়া প্রাণ আমার ওষ্ঠাগত হইয়াছিল। তাঁহার উপর আবার বাছুরের যোগাড়।

সে রাত্রি আমার নিদ্রা হইল না। ক্রমাগত আমি মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম,–মা! চিরকাল তুমি আমাকে নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছ। সন্ন্যাসীর হাত হইতে, বাঘের মুখ হইতে তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়াছ। এখন কেন মা! তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছ?

এই স্তব-স্তুতি মিনতি করিয়া আমি কাঁদিতে লাগিলাম। সহসা কে যেন আমার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল,–ভয় নাই বাছা, ভয় নাই! শীঘ্রই তোমাকে আমি এ বিপদ হইতে পরিত্রাণ করিব। গত বৎসর তোমার পূজায় কিঞ্চিৎ ত্রুটি হইয়াছিল। সেই পাপের জন্য তোমাকে কষ্ট দিলাম।

মা যাহা বলিলেন, তাহাই করিবেন। পরদিন প্রত্যুষে শঙ্কর ঘোষ আসিয়া বলিল,–তুমি আমাকে টাকা ফাঁকি দিয়াছ। চল, তোমাকে আমি পুলিশে দিব।

এই বলিয়া সে আমার দক্ষিণ হস্ত ধরিয়া টানিতে লাগিল। সে সংবাদ পাইয়া ভিকু ডাক্তার দৌড়িয়া আসিলেন, তিনি বলিলেন,–বড়টি আমি রক্ষা করিয়াছি। এ ধড় আমার সম্পত্তি।

এই কথা বলিয়া তিনি আমার বাম হাত ধরিয়া টানিতে লাগিলেন। গোলমাল শুনিয়া চঞ্চলা সে স্থানে দৌড়িয়া আসিল। সে বলিল,–ইহার নীচের দিকটা আমার। আমার গাইগরু।

এই বলিয়া সে আমার পশ্চাৎ দিকের দক্ষিণ পায়ের খুর ধরিয়া টানিতে লাগিল। এমন সময় হু হু পালকির শব্দ হইল। আমি ও অপর সকলে সেইদিকে চাহিয়া রহিলাম। এলোকেশী ঠাকুরাণী উগ্রমূর্তি ধারণ করিয়া পালকি হইতে নামিলেন। আমার নিকট আসিয়া তিনি বলিলেন,–ইনি আমার স্বামী। তোমরা ছাড়িয়া দাও। ইহাকে আমি বাড়ী লইয়া যাইব। বাড়ী গিয়া ঝাঁটা-পেটা করিয়া ইহার ভূত ছাড়াইব।

এই কথা বলিয়া তিনি আমার পশ্চাৎ দিকের বাম পায়ের খুর ধরিয়া টানিতে লাগিলেন। আপন আপন দিক কেহই ছাড়িয়া দিল না। একদিকে শঙ্কর ঘোষ ও ভিকু ডাক্তার আমার দুই হাত ধরিয়া টানিতে লাগিল। অপর দিকে চঞ্চলা ও এলোকেশী দুই খুর ধরিয়া টানিতে লাগিল। তাহাদের টানাটানিতে আমার প্রাণ বাহির হইবার উপক্রম হইল। ছাড়িয়া দাও বলিয়া আমি চীৎকার করিতে লাগিলাম, কিন্তু কেহই ছাড়িল না।

অবশেষে তাহাদের টানাটানিতে আমার শরীর হইতে ফস্ করিয়া চঞ্চলার গাইগরুর কোমর ও পা খসিয়া পৃথক হইয়া গেল। আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।

***

কতক্ষণ অজ্ঞান হইয়াছিলাম, তাহা জানি না; যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন আমি চক্ষু চাহিয়া দেখিলাম যে, আমি আমার ঘরে শয়ন করিয়া আছি। আমি উঠিয়া বসিলাম। পায়ের দিকে চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, মানুষের দুইটি পা, গরুর পা নহে। তাহাতে লেজ নাই, খুর নাই, কেবল মানুষের পায়ের পাতা। ফলকথা, আমার পা। শরীর দিকে চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, আমার নাদুস-নুদুস নধর শরীর যেরূপ ছিল, সেইরূপ রহিয়াছে। শুষ্ক হইয়া যায় নাই। ঘরের ভিতর শঙ্কর ঘোষ অথবা ভিকু ডাক্তার অথবা চঞ্চলা, কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। কেবল দেখিলাম যে, এলোকেশী বার খুলিয়া কাপড় বাহির করিতেছিলেন।

আমি জাগরিত হইয়াছি দেখিয়া এলোকেশী বলিলেন,–কাল রাত্রিতে বিড় বিড় করিয়া ওরূপ বকিতেছিলে কেন? চঞ্চলা কে?

আমি কোন উত্তর করিলাম না। মনে মনে ভাবিলাম যে,সকলই জগদম্বার মায়া। সমুদয় মায়ের লীলা।

ষষ্ঠ গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–সাহেবের কাজ

ডমরুধরের বাস কলিকাতার দক্ষিণে, যেখানে অনেক কাটি গঙ্গা আছে। প্রথম অবস্থায় ইনি দরিদ্র ছিলেন। নানা উপায় অবলম্বন করিয়া এক্ষণে ধনবান হইয়াছেন। এলোকেশী ইঁহার তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। ডমরুর বৃদ্ধ, সুপুরুষ নহেন। তথাপি এলোকেশীর সর্ব্বদাই সন্দেহ। গত বৎসর দুর্লভী বাগজিনী ডমরুধরকে ঝটাপেটা করিয়াছিল। সেই উপলক্ষ্যে এলোকেশীও তাঁহাকে উত্তম-মধ্যম দিয়াছিলেন। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে ডমরুর সন্ন্যাসিবিভ্রাটে পড়িয়াছিলেন। সেই অবধি ইনি দুর্গোৎসব করেন। সুন্দরবনে ডমরুধরের আবাদ আছে। প্ৰজাদিগের নিকট হইতে চাউল, ঘৃত, মধু, মৎস প্রভৃতি আদায় করেন। প্রতিমাটি গড়া হয়, কিন্তু পূজার উপকরণ,—প্রায় সমস্তই কাটিগঙ্গার জল। আজ পূজার পঞ্চমীর দিন, দালানে প্রতিমার পার্শ্বে বন্ধুগণের সহিত বসিয়া ডমরুধর গল্প-গাছা করিতেছেন।

লম্বোদর বলিলেন,–এবার তুমি মরিয়া বাঁচিয়াছ, ঐ ভয়ানক রোগ হইয়াছিল, তাহাতে পূজার সময় তোমার গল্প যে আবার শুনিব, সে আশা আমরা করি নাই।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—হ ভাই। এবার আমি মরিয়া বাঁচিয়াছি। মা দুর্গার আমি বরপুত্র। সেবার সন্ন্যাসি বিভ্রাট হইতে তিনি আমাকে রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার কৃপায় গত বৎসর বাঘের মুখ হইতে আমি বাঁচিয়াছিলাম। এবার উৎকট রোগ হইতে তিনি আমাকে মুক্ত করিয়াছেন। সমুদয় দুর্ঘটনা নষ্টচন্দ্র দেখিয়া ঘটিয়াছিল।

আধকড়ি জিজ্ঞাসা করিলেন,–নষ্টচন্দ্র দেখিয়া কি হইয়াছিল?

ডমরুর উত্তর করিলেন,–সে কথা এতদিন আমি প্রকাশ করি নাই। কি হইয়াছিল তাহা শুন। একবার আমি নষ্টচন্দ্র দেখিয়াছিলাম। নষ্টচন্দ্র দেখিলে চুরি করিতে হয়। মনে করিলাম যে, দুর্লভীর উঠানে যে শসা গাছের মাচা আছে, তাহা হইতে শসা চুরি করিয়া আনি। বাহিরে যাহাই বলুক, কিন্তু দুর্লভীর মনটা আমার উপর আছে। শসা চুরি করিতে গিয়া যদি ধরা পড়ি, এলোকেশী যদি কিছু বলেন, তাহা হইলে আমি বলিব যে, নষ্টচন্দ্র দেখিয়া চুরি না করিলে কলঙ্ক হয়।

চুপে চুপে আমি শসা চুরি করিতে যাইলাম। কিন্তু দূর হইতে দেখিলাম যে, দুর্লভী কেরোসিনের ডিবে জ্বালাইয়া ঠেঙা হাতে করিয়া দাওয়াতে বসিয়া আছে। তাঁহার উগ্রমূর্তি দেখিয়া আর অগ্রসর হইতে আমি সাহস করিলাম না।

সে রাত্রিতে আমার চুরি করা হইল না। মনে করিলাম যে, আজ রাত্রিতে না হউক, তিনদিনের মধ্যে কিছু চুরি করিলেই নষ্টচন্দ্রের দোষ কাটিয়া যাইবে। কোথায় কি চুরি করি, রাত্রিতে শুইয়া শুইয়া তাহা ভাবিতে লাগিলাম। দুর্লভীর বাড়ীর পার্শ্বে গদাই ঘোষের পুষ্করিণী আছে। তাহাতে অনেক মাছ আছে। গদাই ঘোষ দুর্লভীর জিম্মায় পুষ্করিণী রাখিয়াছে। মনে করিলাম যে, কাল বৈকালবেলা ছিপ ফেলিয়া সেই পুষ্করিণী হইতে মাছ চুরি করিব।

সুন্দরবনে আমার আবাদের নিকট একবার জনকয়েক সাহেব শিকার করিতে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা একটি টুপি ফেলিয়া গিয়াছিলেন। টুপিটি কুড়াইয়া আমি বাড়ী আনিয়াছিলাম। পরদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে সেই টুপিটি বগলে লইয়া ছিপ হাতে করিয়া আমি গদাই ঘোষের পুষ্করিণীর পাড়ে উপস্থিত হইলাম; যে ধার দিয়া লোক যাতায়াত করে, তাঁহার বিপরীত দিকে এককোণ বনে পূর্ণ ছিল। ঝোপের ভিতর গিয়া আমি সাহেবদের সেই কালো রঙের ধুচুনির মত লম্বা টুপিটি মাথায় দিলাম। আজকালের বাবুদের মত গায়ে আমি জামা পরি না। কোমরে কেবল ধুতি ছিল। আমি ভাবিলাম যে, আমাকে কেহ চিনিতে পারিবে না। সকলে মনে করিবে সে সাহেব মাছ ধরিতে আসিয়াছে। সাহেব দেখিলে কেহ কিছু বলিবে না।

নিকটের জল–নাল-ফুল ও কলমি শাকের গাছে পূর্ণ ছিল। কেবল এক স্থানে একটু ফাঁক ছিল। ময়দার টোপ গাথিয়া আমি সেই পরিষ্কার স্থানে ছিপ ফেলিলাম। কিছুক্ষণ পর বোধ হইল যেন মাছে ঠোকরাইল। আমি টান মারিলাম। বঁড়শি জলের ভিতর নাল গাছে লাগিয়া গেল। অনেক টানাটানি করিলাম, অনেক চেষ্টা করিলাম, কিছুতেই খুলিতে পারিলাম না।

তখন বুঝিলাম যে, জলে নামিয়া না খুলিলে আর উপায় নাই। কিন্তু কাপড় ভিজিয়া যাইবে, জলে কি করিয়া নামি। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম-কেউ কোথাও নাই। কাপড় খুলিয়া উলঙ্গ হইয়া জলে নামিলাম। একবুক জল হইল। অতি কষ্টে নাল গাছের ডাটো হইতে বঁড়শি খুলিয়া উপরে উঠিয়া কাপড় পরিতে যাই—সর্ব্বনাশ! যে স্থানে কাপড় রাখিয়া গিয়াছিলাম সে স্থানে কাপড় নাই। বনের ভিতর চারিদিকে অনেক খুঁজিলাম, কাপড় দেখিতে পাইলাম না।

তখনও সম্পূর্ণ সন্ধ্যা হয় নাই। সে উলঙ্গ অবস্থায় আমি বাটী ফিরিয়া যাইতে পারি। কি করিব। চার করিয়া পুনরায় ছিপ ফেলিলাম। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম যে, এ সেই কেষ্টা ছোঁড়ার কর্ম, সে আমার টাকের বর্ণনা করিয়া আমাকে ক্ষেপায়। সে দূর হইতে আমাকে বলে-টাক-চাদ, টাক বাহাদুর, টাক টাক টাকেশ্বর।।

কেষ্টা ছোঁড়ার অগম্য স্থান নাই। যখন জলে নামিয়া পিছন ফিরিয়া এক মনে আমি বঁড়শি খুলিতেছিলাম, সেই সময় সে আমার কাপড় লইয়া গিয়াছে। কেবল তাহা নহে। সে দুর্লভীকে গিয়া সংবাদ দিয়াছিল। কারণ, অল্পক্ষণ পরেই দুর্লভী ও হিরী বাগদিনী আসিয়া পুষ্করিণীর অপর পাড়ে দাঁড়াইল।

কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে চাহিয়া দুর্লভী বলিল,–একটা সাহেব।

হিরী বাগদিনী বলিল,–সাহেবটার গায়ের রং কালো মিশমিশে। যাহারা পাখী মারিতে আসে, সেই সাহেব। দুর্লভী বলিল,–তা নয়। ওটা নেঙটা গোরা।

হিরী বলিল,–সর্ব্বনাশ! নেঙটা গোরা। তবে আমি পাই; যাকে বলে ব্রাখি, তাই উহারা খায়।–দুর্লভী বলিল,–চল গদাই ঘোষকে গিয়া বলি।

আমি ভাবিলাম,–ঘোর বিপদ হইল। সমস্ত গ্রামের লোককে সঙ্গে লইয়া গদাই ঘোব হয়তো এখনি আসিয়া উপস্থিত হইবে। আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথায় কেবল এক সাহেবি টুপি। এ অবস্তায় সকলে হয় তো আমাকে এলোকেশীর নিকট ধরিয়া লইয়া যাইবে। সাহেবের পোষাক পরিয়া দুর্লভীর নিকট আমি গিয়াছিলাম, তা নিলে এলোবেশী আয় রক্ষা রাখিবেন না।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–নারিকেলের বোরা

ছিপগাছটা আমি ফেলিয়া দিলাম। প্রথম বনের ভিতর দিয়া, তাহার পর পুকুরপাড়ের নীচে দিয়া দুর্লভীর ঘরের পশ্চাৎদিকে উপস্থিত হইলাম। ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া উকি মারিয়া দেখিলাম যে, তাঁহারা ঘরে কেহ নাই। দ্বারটি কেবল ভেজানো আছে। চুপ করিয়া আমি তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরের ভিতর অন্ধকার। চারিদিক চাহিয়া দেখিলাম। একখানি কাপড় কি একখানি গামছা দেখিতে পাইলাম না। কি করি টুপি মাথায় দিয়া উলঙ্গ অবস্থায় ঘরের এককোণে বসিয়া রহিলাম। মনে করিলাম যে একটু অন্ধকার হইলে পলায়ন করিব। আর যদি দুর্লভী দেখিতে পায়, তাহা হইলে আমার সাহেবের পোক দেখিয়া তাঁহার মনে আনন্দ হইবে।

ওদিকে যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই হইল। গদাই ঘোষ গ্রামের চৌকিদার ও অন্যান্য লোক লইয়া পুষ্করিণীর ধারে উপস্থিত হইল। মহা গোল পড়িয়া গেল। ঘরের ভিতর বসিয়া আমি তাহা শুনিতে পাইলাম। ভয়ে সর্ব্বশরীর আমার কাপিতে লাগিল। পুকুরের সেই কোণে বনের ভিতর তাঁহারা অনেক অনুসন্ধান করিল। ছিপ দেখিতে পাইল। কিন্তু সাহেবকে তাঁহারা দেখিতে পাইল না। হতাশ হইয়া সকলে বাড়ী ফিরিয়া গেল। তখন দুর্লভী আসিয়া আপনার দাওয়ায় পিড়িতে বসিল।

এমনসময় রসকের মা আসিয়া বলিল,–দুর্লভী। আমাকে শসা দিবি বলিয়াছিলি, কৈ দে।–দুর্লভী বলিল,–শসা তুলিয়া রাখিয়াছি। ঘরের বাম কোণে ডালায় আছে, গিয়া লও।

আমি ঘরের বাম কোণে বসিয়াছিলাম। আমার ভয় হইল। কোণের দিকে আরও ঘেঁসিয়া বসিলাম। রসকের মা ঘরের ভিতর আসিয়া কোণের কাছে অন্ধকারে হাতবাড়াইতে লাগিল। সহসা ঝনাৎ করিয়া কি একটা শব্দ হইল। সে চীৎকার করিয়া উঠিল, বাম হাত আমার দিকে বাড়াইয়া দিল। আমার গায়ে তাঁহার হাত ঠেকিয়া গেল।

সে চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল, ঘরের ভিতর একটা ভূত বসিয়া আছে। সে আমার হাতে কামড় মারিয়াছে। আমার আঙ্গুলগুলা চিবাইতেছে। এখন আমার সর্ব্বশরীর খাইয়া ফেলিবে।

পরে নিলাম, ঘরে যে দুর্লভীর রাতে ইরকল পাতিয়া রাখিয়াছিল, রসকের মায়ের হাত তাহাতে পড়িয়া গিয়াছিল। কি হইয়াছে, কি হইয়াছে বলিয়া দুর্লভী দৌড়িয়া আসিল। দ্বারের নিকট তাঁহাকে ঠেলিয়া আমি ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। তখন দুর্লভী আমাকে দেখিতে পাইল। কিন্তু চিনিতে পারিল না। সে চীৎকার করিয়া বলিল,–ভূত নহে ভূত নহে, এ সেই নেঙটা গোরা; আমার ঘরের ভিতর বসিয়াছিল।

তাঁহার চীৎকার শুনিয়া চারিদিক হইতে লোক ছুটিয়া আসিতে লাগিল। আমি আর বাটী পলাইতে অবসর পাইলাম না। কিছু আগে পথের বামদিকে বিন্দু ব্রাহ্মণীর ঘর। বিন্দু ব্রাহ্মণী তখন গোয়ালে বসিয়া ঘুঁটে ধরাইয়া ধোঁয়া করিতেছিল। তাঁহার সেই একখানি মেটে ঘরের দ্বার খোলা ছিল। তাড়াতাড়ি আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম।

ঘরের ভিতর মিটমিট করিয়া এক কেরোসিনের ডিবে জুলিতেছিল। বিন্দু ব্রাহ্মণীর কেহ নাই। একলা সে সেই ঘরে বাস করে। তাঁহার অনেকগুলি নারিকেল, আম, কাঁঠাল ও আতা গাছ আছে। তাঁহার ফল বেচিয়া সে দিনপাত করে।

আমি দেখিলাম যে, ঘরের এককোণে অনেকগুলি নারিকেল পাকার হইয়া আছে। তাঁহার পার্শ্বে পাঁচ বোরা বা গুণের থলি নারিকেল পূর্ণ করিয়া তাহাদের মুখ বন্ধ করিয়া বিন্দু সারি সারি উচ্চভাবে বসাইয়া রাখিয়াছে।

ইতিমধ্যে বাহিরে গোল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, নেঙটা গোরা এইদিকে আসিয়াছে। এস, বিন্দুর ঘরের ভিতর দেখি। হয় তো এই ঘরের ভিতর সে বসিয়া আছে। আমি তখন মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম যে,–মা। নষ্টচন্দ্র দেখিলে লোককে কি এত সাজা দিতে হয়? প্রতি বৎসর আমি তোমার পূজা করি, এ বিপদ হইতে তুমি আমাকে রক্ষা কর।

তোমাদিগকে আমি বার বার বলিয়াছি যে, আমার উপর মায়ের অপার কৃপা। মা তৎক্ষণাৎ আমার মনে বুদ্ধি দিলেন। নিকটে একটি খালি বোরা পড়িয়াছিল। সেই বোরার মুখে আমি আমার মাথা গলাইয়া দিলাম, তাহার পর টানিয়া আমার সর্ব্ব শরীর পা পর্যন্ত তাহা দিয়া ঢাকিয়া ফেলিলাম! অবশেষে নারিকেলপূর্ণ থলির ন্যায় অপর, পাঁচটি বোরার পার্শে আমিও বসিয়া রহিলাম। তিন চারিজন গ্রামবাসী ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। এদিকে-ওদিকে চাহিয়া দেখিল যে, নেঙটা গোরা ঘরের ভিতর নাই। কেবল হাট নারিকেলপূর্ণ থলি সারি সারি বসিয়া আছে।

ঘরের ভিতর নেঙটা গোরা দেখিতে না পাইয়া সকলের ভয় হইল। একজন বলিল,–তাঁহাকে এই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে আমি নিশ্চয় দেখিয়াছি। তবে এখন কোথায় গেল? এ নেঙটা গোরা নহে; এই বর্ষাকালে জল-কাদায় নেঙটা গোরা কোথা হইতে আসিবে? তাহার পর নেঙটা গোরা এত মিশমিশে কালো হয় না। এ নেঙটা গোরা নহে, এ নেঙটা ভূত।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–বলাই চিত্তির বিবরণ

ভূতের কথা শুনিয়া সকলে ভয়ে আপন আপন গৃহে চলিয়া গেল। বিন্দু আপনার দাওয়াতে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। সে বলিল যে, কি কপাল করিয়া যে পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। আজ রাত্রিতে ভূতে আমাকে খাইয়া ফেলিবে। যাহ হউক, এমন সময় একখানি গরুর গাড়ী লইয়া বলাই চিঙি বিন্দুর গৃহু আসিয়া উপর্ষিত হইল। বলাই জাতিতে সদগোপ। আমাদের গ্রাম হইতে আধক্রোশ মাঠ পরে আমডাঙ্গায় তাঁহার বাস। বিলুর ফল-পাকড় সে হাটে বিক্রয় করে।

বলাই বলিল,–মা ঠাকুরাণি। গাড়ী লইয়া আমি নিশ্চিন্তপুর গিয়াছিলাম। বাড়ী ফিরিয়া যাইতেছি। নারিকেল দিবে বলিয়াছিলে, কই দাও। আজ আমার বাড়ীতে রাশিয়া দিব। কাল ভোরে হাটে লইয়া যাইব।

বিন্দু বলিল,–ঘরের ভিতর বোরা করিয়া আমি একশত নারিকেল রাখিয়াছি। আজ তাহা লইয়া যাও। বাকী পরে দিব।

আমি সম্মুখেই বসিয়াছিলাম আমার থলিটি সে প্রথম তুলিয়া লইল। পা দুইটি আমি থলির ভিতর গুটাইয়া লইলাম। সব ঝুনো, একবার বোঁটা দেখে, এই কথা বলিয়া সে আমাকে গাড়ীর সম্মুখভাগে বসাইয়া দিল। তাহার পর আর পাঁচটি নারিকেলের থলি আনিয়া আমার পশ্চাতে উচ্চভাবেই বসাইয়া দিল।

নারিকেল লইয়া বলাই গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। বাড়ী যাইতেছে, সেজন্য গরু দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল। গ্রাম পার হইয়া মাঠে গিয়া উপস্থিত হইল। গাড়ীর ভিতর বসিয়া থলির ভিতর যে স্থানে আমার চক্ষু দুইটি ছিল, সেই দুইটি স্থানে আঙ্গুল দিয়া আমি অল্প ফাঁক করিয়া লইলাম। তাহার পর থলির ভিতর হইতে আমি আমার হাত দুইটি বাহির করিতে চেষ্টা করিলাম। এমন সময় আমার মাথা দিয়া বলাইয়ের পিঠে ঢু লাগিয়া গেল। বলাই আপনা-আপনি বলিল,–সম্মুখের থলিটা নড়িতেছে। এখনি পড়িয়া যাইবে। ভাল করিয়া রাখি।

এই কথা বলিয়া সে গাড়ী থামাইল ও বাম পার্শ্বে নামিয়া পড়িল। সেই অবসরে আমিও দক্ষিণ পাশ দিয়া নামিয়া পড়িলাম। বলাই ভাবিল যে, থলিটা পড়িয়া গেল। গরুর সম্মুখ দিয়া ঘুরিয়া সে আমাকে তুলিতে আসিল। তাহার পর সে যাহা দেখিল, তাহাতে তাঁহার আত্মা-পুরুষ শুকাইয়া গেল। নিশ্চয় সে মনে মনে ভাবিয়াছিল যে–এতকাল নারিকেল বেচিতেছি, নারিকেলপূর্ণ বোরার ভিতর হইতে কালো কালো দুইটা পা বাহির হইতে কখনও দেখি নাই। সেই কালো কালো পা দুইটা দিয়া নারিকেলের বোরা যে ছুটিয়া পালায়, তাহাও কখনও দেখি নাই।

কিছুকাল সে সেই পা-ওয়ালা বোরার দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। তাহার পর বাপু এইরূপ শব্দ করিয়া মাঠের মাঝখানে গাড়ী ফেলিয়া অ-পথ দিয়া ক্ষেতের আলি দিয়া পুনরায় আমাদের গ্রামের দিকে দৌড়িল। কিন্তু সে যে আমার ভয়ে সোজা পথ দিয়া আসিতে সাহস করে নাই, তখন তাহা আমি জানিতাম না। পাছে সে আসিয়া আমাকে ধরে, সেজন্য শরীর হইতে বোরা খুলিবার নিমিত্ত, আমি আর দাঁড়াইলাম না। গুণে আবদ্ধ শরীরেই যথাসাধ্য দ্রুতবেগে সোজাপথে আমি গ্রাম অভিমুখে দৌড়িলাম।

গ্রামে প্রবেশ করিলাম। ক্রমে নেকে পালের দোকানের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। গুণের ঈষৎ ফাঁক দিয়া দেখিলাম যে, তাঁহার দোকান খোলা রহিয়াছে, দোকানে আলো জ্বলিতেছে। অনেকগুলি লোকের কথাবার্তা আমার কানে প্রবেশ করিল। দেখিলাম যে, দোকানের সম্মুখে একখানি খালি পাক্তি রহিয়াছে। এমন সময় একজন মানুষের সহিত আমার ধাক্কা লাগিয়া গেল। সেও পড়িয়া গেল, আমিও পড়িয়া যাইলাম। তাড়াতাড়ি আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। সেও উঠিয়া পাছে চীৎকার করে, সেজন্য পথের দক্ষিণ পাশে একটা বনে গিয়া আমি প্রবেশ করিলাম। বন দিয়া আরও কিছুদূর গিয়া মেনী গোয়ালাবাড়ীর ঘরের পার্শ্বে গিয়া উপস্থিত হই। শরীর হইতে গুণটা খুলিয়া কোমরে জড়াইলাম। গুণ হইতে একটু সূতা বাহির করিয়া কোমরে বাঁধিলাম। এখনও আমার মাথায় সেই সাহেবী টুপী ছিল। তাহার পর হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া চারিদিক আমি দেখিতে লাগিলাম।

টুপিটি এখন আমি ফেলিয়া দিলাম। তাহার পর দেখিলাম যে, নেকোর দোকানের সম্মুখে সে পাক্তি নাই। কিন্তু সে স্থানে অনেকগুলি লোক একত্র হইয়াছে। তাঁহারা সকলেই বলাই চিন্তির বিবরণ শুনিতেছে। বলাই বলিতেছে,–বিন্দু ঠাকুরাণীর নারিকেলের বোরার ভিতর ভূত ছিল। ভূত লইয়া আমি গাড়ীতে বসিয়াছিলাম। মাঠের মাঝখানে সে আমার ঘাড় ভাঙ্গিয়া রক্ত খাইবার উপক্রম করিয়াছিল। অতি কষ্টে আমার প্রাণরক্ষা হইয়াছিল। এমন সময় কেষ্টা ছোঁড়া সেই স্থানে আসিয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিল, আমার ঠাকুরমা কোথায়? অনেকক্ষণ হইল তেল লইতে আমার ঠাকুরমা দোকানে আসিয়াছিলেন। আমার ঠাকুরমা কোথায়?

কিছুদিন পূর্ব্বে কেষ্টা আমার বাগানে বাতাবি লেবু চুরি করিয়াছিল। সেজন্য তাঁহাকে পুলিশে দিতে আমি উদ্যত হইয়াছিলাম। অনেক মিনতি করিলে তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু বলিয়া দিয়াছিলাম যে, পুনরায় যদি সে আমার কোন বস্তু চুরি করে, অথবা আমাকে ক্ষেপায়, তাহা হইলে তাঁহার নামে আমি নালিশ করিব। আজ আমার কাপড় লইয়া সে কোথায় ফেলিয়া দিয়াছিল। পাছে আমি নালিশ করি, সেই ভয়ে সে কাহারও নিকট আমার নাম করে নাই। ঐ পুকুরে কে মাছ ধরিতেছে দুর্লভীকে কেবল এই কথা বলিয়া সে সরিয়া পড়িয়াছিল।

এখন কেষ্টার ঠাকুরমা কোথায় গেল? কেষ্টার বাপ ও প্রতিবেশিগণ লণ্ঠন লইয়া চারিদিকে অনুসন্ধান করিতে লাগিল, ক্রমে হৈ হৈ পড়িয়া গেল। সকলে বলিল যে, নেঙটা ভূত কেষ্টার ঠাকুরমাকে লইয়া গিয়াছে। গোল শুনিয়া মেনী গোয়ালা-ড়ী ঘর হইতে বাহির হইল। মেনীর বয়স দশ বৎসর। ছয় বৎসর বয়স্ক একটি ভাই ব্যতীত সংসারে তাঁহার আর কেহ নাই। কয় বৎসর হইল, তাহাদের বাপ ও মা মরিয়া গিয়াছে। তাহাদের মাসী কলিকাতায় এক বাবুর বাড়ীতে চাকরাণী ছিল। মাসী ইহাদিগকে টাকা দিত। মাসীও এখন মরিয়া গিয়াছে।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–মেনী ও জিলে

মেনীর ছয় বৎসর বয়স্ক ভাইয়ের নাম ভিলে। ভিলের হাত ধরিয়া মেনী ঘর হইতে বাহির হইল। পথের ধারে গিয়া দাঁড়াইল। আমি যে বনের ভিতর বসিয়াছিলাম, কোর ঠাকুরমাকে অনুসন্ধান করিতে পাছে লোকে সেই স্থানে আসে, সেই ভয়ে মেনীর ঘর খালি পাইয়া আমি তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। মনে করিলাম যে, গোলটা এই মিছিলে মেনী ও তাঁহার ভাই নিদ্রিত হইলে আস্তে আস্তে আমি ঘরে ফিরিয়া যাইব; গুণ পরিয়া বাহির হইলে লোকে আমাকে সন্দেহ করিবে।

ভিলের হাত ধরিয়া মেনী পথের ধারে গিয়া দাঁড়াইল। সুগন্ধী গোয়ালিনী ও অন্যান্য লোক পথ দিয়া যাইতেছিল। মেনী জিজ্ঞাসা করিল,—গন্ধী মাসি। কি হইয়াছে? চারিদিকে এত গোল কেন?

সুগন্ধী উত্তর করিল,–আর বাছা, বলিব কি, সর্ব্বনাশ হইছে। কোথা হইতে একটা নেঙটা গোরা ভূত আসিয়াছে। বলাই চিন্তিকে সে খাইতে গিয়াছিল। তাঁহাকে খাইতে না পাইয়া কোর ঠাকুরমাকে লইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমি বলি যে, সে কেষ্টার ঠাকুরমাকে খাইবে না। সেটা গোরা ভূত, কেষ্টার ঠাকুরমাকে মেম করিবে, সেই জন্য তাঁহাকে লইয়া গিয়াছে।

স্কুলের নাম শুনিয়া মেনী তাড়াতাড়ি ভাইকে লইয়া ঘরে আসিল ও ঘরের দ্বার বন্ধ কী দুইজন শয়ন করিল। আমি ঘরের এককোণে বসিয়া রহিলাম। ভিলে বলিল,–দিদি। রায়েদের বাড়ী হইতে আর ভাত আন না কেন? কাল কেবল একটা তাল খাইয়া আমরা ছিলাম। আমাকে সমস্ত দিয়াছিলে, তুমি কেবল একটুখানি খাইয়াছিলে। আজ আমরা কিছুই খাই নাই। রায়েদের বাড়ী হইতে কবে ভাত আনিবে?

মেনী কেনারাম রায়ের শিশু-পুত্রকে লইত, তাঁহারা দুইবেলা দুইটি ভাত দিতেন। বাড়ীতে আনিয়া সেই ভাত ভাই-ভগিনীতে ভাগ করিয়া খাইত। আজ দুইদিন হইল রায়ের শিশুপুত্র এক সোঁ-পোকা ধরিয়াছিল, মেনী তাহা দেখে নাই, সেজন্য মেনীকে তাঁহারা ছাড়াইয়া দিয়াছেন।

মেনী উত্তর করিল,—রায়েদের খোকা সোঁ-পোকা ধরিয়াছিল। সেজন্য তাঁহারা আর আমাকে ভাত দিবেন না। —ভিলে বলিল,–তবে দিদি আমাদের কি হবে? ভাত কোথা হইতে আসিবে? ক্ষুধায় আমার পেট জুলিয়া যাইতেছে।

মেনী উত্তর করিল,–দেখ ভিলু। পাড়ার লোকের নিকট হইতে কাল তোমাকে দুইটি ভাত আনিয়া দিতে পারি। কিন্তু চাউলের দাম বাড়িয়াছে, বোজ বোজ লোকে দিবে কেন? আমাদের দশা কি হইবে, তাহাই ভাবিতেছি!

ভিলে বলিল,–তবে দিদি কি হবে, ভাত না খাইয়া আর আমি থাকিতে পারি না। আজ সমস্ত দিন কিছু খাই নাই, আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছে। স্কুথায় আমার পেট জুলিয়া যাইতেছে।

মেনী বলিল,–আর বত্সর ভড়েদের বাড়ী দুর্গা ঠাকুর দেখিয়াছিলে! সেই দশ হাত আর কত রাঙতা? ভড়েরা তোমাকে মুড়কি ও নারিকেল নাড়ু দিয়াছিল? পূজা হইয়া গেল বোসেদের গঙ্গার ভিতর আছেন। কাল যদি তোমাকে দুইটি ভাত দিতে না পারি, তাহা হইলে আমরা দুইজনে বোসেদের গঙ্গায় যাইব। তোমাকে কোলে লইয়া আমি জলে ঝাঁপ দিব: জলের ভিতর মা দুর্গা আছেন; তাঁহার কাছে আমরা যাইব। তিনি আমাদিগকে অনেক ভাত দিবেন, আমাদের সকল দুঃখ ঘুচাইবেন।

ঘরের কোণে বসিয়া ভাই-ভগিনীর কথোপকথন আমি শুনিতেছিলাম। অল্পক্ষণ পরেই দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িল। ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া আমি গৃহে প্রত্যাগমন করিলাম। রাত্রি তখন কেবল নয়টা হইয়াছিল, আমার বাড়ীর দ্বার বন্ধ হয় নাই। চুপি চুপি ঘরের ভিতর গিয়া গুণ ফেলিয়া কাপড় পড়িলাম। তাহার পর এলোকেশীর মুখে শুনিলাম যে, কোর ঠাকুরমাকে লোকে তখনও খুঁজিয়া পায় নাই।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের হীরক লাভ

মেনী গোয়ালা-ছুঁড়ীর ঘর ঠিক আমার বাগানের পাশে। ঐ স্থানটিতে আমার বাগানে একটু খোঁচ হইয়া আছে। মেনী ও তাঁহার ভাই মরিয়া গেলে ঐ ভূমিটুকু আমি লইব। তাহা হইলে আমার বাগানের খোঁচটি ঘুচিয়া যাইবে। তাঁহারা সত্য সত্যই বোসেদের গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়া মরিবে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত পরদিন প্রাতঃকালে বেলা দশটার সময় আমি ঘর হইতে বাহির হইলাম। পথে দেখিলাম যে, কেষ্টাদের বাড়ীতে হু হু করিয়া একখানা পাল্কী আসিয়া লাগিল, পাল্কীর ভিতর হইতে কেষ্টার ঠাকুরমা বুড়ী বাহির হইল; তাহার পর লাঠি ধরিয়া ঠুক টুক করিয়া গৃহে প্রবেশ করিল।

বুড়ী কোথায় গিয়াছিল ও কোথা হইতে আসিল, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমি সে স্থানে যাইলাম। শুনিলাম যে গোবর্ধনপুর হইতে একজনদের বৌ লইয়া একখানা পাখী নিশ্চিন্তপুর গিয়াছিল। বৌ রাখিয়া খালি পাল্কী সন্ধ্যার পর ফিরিয়া নেকোর দোকানে পাক্ষী রাখিয়া বেহারাগণ তামাক খাইতেছিল। সেই সময় কেষ্টার ঠাকুরমা তেল লইতে দোকানে আসিতেছিল। বোরার ভিতরে থাকিয়া যে নেঙটা ভূতটা বলাই চিন্তিকে খাইতে গিয়াছিল, সেই ভূতটা আসিয়া কোর ঠাকুমাকে ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া দিল। কিন্তু দোকানে অনেক লোক দেখিয়া কোর ঠাকুরমাকে লইয়া যাইতে পারিল না। তৎক্ষণাৎ সে বাতাসে মিশিয়া গেল। কেষ্টার ঠাকুরমা উঠিয়া ঘোরতর ভয়বিহুল হইয়া, সম্মুখে একখানা পাল্কী ও তাঁহার দ্বার খোলা দেখিয়া তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিল। তাহার পর দ্বার বন্ধ করিয়া পাকীর ভিতর সে অজ্ঞান হইয়া পড়িল। বেহারাগণ তাহা জানিতে পারে নাই। বলাই চিন্তির নিকট ভূতের গল্প শুনিয়া তাড়াতাড়ি পাঞ্জী তুলিয়া তাঁহারা চলিয়া গেল। রাত্রি দুই প্রহরের সময় তাঁহারা গোবর্ধনপুর পৌঁছিল। সেই স্থানে গিয়া পাকীর ভিতর বুড়ীকে দেখিতে পাইল। কিন্তু ভূতের ভয়ে সে রাত্রিতে বুড়ীকে ফিরিয়া আনিতে পারিল না। কারণ, এ সামান্য ভূত নহে, এ নেঙটা গোরা ভূত! আজ প্রাতঃকালে বুড়ীকে বাড়ী ফিরিয়া আনিল। আমি ভাবিলাম যে, সামান্য একটা সাহেবের টুপি পরিয়াছিলাম, তাহাতে কি কাণ্ড না হইল। এ সব নষ্টচন্দ্রের খেলা।

গোয়ালা-মুড়ী মেনীর বাড়ী গিয়া দেখিলাম যে, যাহারা শিশি বোতল ক্রয় করে, সেইরূপ একটা লোক সে স্থানে বসিয়া আছে। ঘরের ভিতর হইতে একটা বোতল ও একটা শিশি আনিয়া মেনী তাঁহাকে দেখাইতেছে। শিশির ভিতর ছোট একখণ্ড কাচের ন্যায় কি ছিল। ভিলে তাহা বাহির করিয়া খেলা করিতে লাগিল। আমি দেখিলাম যে, সেই ক্ষুদ্র কাচটাতে পল কাটা আছে, আর সেই পল হইতে নানা বর্ণের আভা বাহির হইতেছে। আমি ভাবিলাম যে এরূপ কাচ ইহাদের ঘরে কোথা হইতে আসিল, যে স্থান হইতে আসুক, এ সামান্য কাচ নহে। বোতল ও শিশির লোকটা মেনীকে চারিটি পয়সা দিল। ভিলের নিকট হইতে আমি কাচখণ্ড চাহিলাম। ভিলে দিতে সম্মত হইল না। এই পয়সা দিয়া তাহা আমি কিনিতে চাহিলাম। তখন মেনী বলিল,–দাও, দাদা, দাও। কাচটুকু লইয়া তুমি কি করিবে? ডমরুবাবু দুই পয়সা দিলে আমাদের ছয় পয়সা হইবে। ছয় পয়সার চাউল কিনিলে দুইদিন তোমাকে পেট ভরিয়া ভাত দিতে পারি।

ভিলে বলিল,–বড় ক্ষুধা পাইয়াছে। আমি কলাপাতা কাটিয়া আনি?

মেনী বলিল,–না ভাই, এখন নয়। রও, আগে নেকোর দোকান হইতে চাউল কিনিয়া আনি, ভাত রাঁধি তখন কলাপাতা কাটিয়া আনিও।

শিশি বোতল লইয়া লোকটা চলিয়া গেল। কাচখণ্ড লইয়া আমিও বাটী আসিলাম। মনে করিলাম, কখনই কাচ নহে। এবার কলিকাতা গিয়া কোন জহুরীকে দেখাইব।

কিন্তু সেই বৈকালবেলা আমি বিষম গোলযোগে পড়িলাম। কলিকাতা হইতে একটি লোক আসিয়াছিল। সে কেষ্টার বাপ, গ্রামের চৌকিদার, শিশি-বোতল ক্রেতা; মেনী ভিলে ও অন্যান্য গ্রামবাসীকে সঙ্গে করিয়া আমার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। কলিকাতার সেই লোকটা বলিল,—আমি যোগেশবাবুর সরকার। আমার বাবুর বাড়ীতে এই বালিকার মাসী চাকরাণী ছিল। যোগেশবাবুর স্ত্রী ঘোরতর পীড়িত হইয়াছেন। ইহার মাসী তাঁহার অনেক সেবা করিয়াছিল। যোগেশবাবুর স্ত্রীর কানে দুইটি হীরার টপ ছিল। কিছুদিন পূর্ব্বে একটি টপ হারাইয়া গিয়াছিল। ভালরূপ জোড়া মিলাইতে না পারিয়া অপর টপটি তাঁহার বাজতে তিনি ফেলিয়া রাখিয়াছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ ইহার মাসীকে তিনি সেই টপটি দিয়াছিলেন। তাঁহার সোনাটুকু ইহার মাসী বোধ হয় বেচিয়া ফেলিয়াছিল। কাচ মনে করিয়া হীরকখণ্ড শিশির ভিতর ফেলিয়া রাখিয়াছিল। তাঁহার মূল্য চারিশত টাকা। আপনি দুই পয়সায় তাহা ফাকি দিয়া লইয়াছেন। যে টপটি হারাইয়া গিয়াছিল, এক্ষণে তাহা মিলিয়াছে। সেজন্য জোড়া মিলাইবার নিমিত্ত এই বালিকা ও তাঁহার ভ্রাতাকে চারিশত টাকা দিয়া হীরকখণ্ড লইতে বাবু আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন। হীরকখণ্ড আপনি আমাকে প্রদান করুন।

পয়সা দিয়া কিনিয়াছি, কেন আমি দিব, এইরূপ বলিয়া প্রথম আমি দিতে সম্মত হই নাই। কিন্তু পরে বুঝিলাম যে, যোগেশবাবু আমাকে সহজে ছাড়িবেন না। চিরকাল মামলা মোকদ্দমা করিয়া আসিতেছি। মামলা মোকদ্দমা আমি বিলক্ষণ জানি। আমি বুঝিলাম যে, মোকদ্দমা হইলে হীরা আমি রাখিতে পারিব না, চাই কি আমার সাজা হইলেও হইতে পারে। ফলকথা, হীরা আমাকে ফিরিয়া দিতে হইল। যোগেশবাবু হীরার মূল্য চারিশত টাকা মেনী ও ভিলের নামে একস্থানে জমা রাখিয়াছেন। এক্ষণে প্রতি মাসে তিনি আহলিশকে পাঁচ টাকা করিয়া দিতেছেন।

হীরকও গেল, বাগানের খোঁচটিও ভাঙ্গিল না। মনে আমার ঘোরতর দুঃখ হইল। মা দুর্গাকে ভৎসনা করিয়া আমি বলিতে লাগিলাম,–মা! কেন আমার এরূপ হরিষে বিষাদ করিলে? চারিশত টাকা আমার হাতে দিয়া কেন আবার কাড়িয়া লইলে? এবার হইতে আর মা, তোমার আমি পূজা করিব না।

পূজা করিব না শুনিয়া মা দুর্গার বোধহয় রাগ হইল। আমাকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত পরদিন তিনি জরাসুরকে প্রেরণ করিলেন। কম্প দিয়া আমার জ্বর আসিল। একদিন গেল, দুই দিন গেল, জ্বর ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। তিন দিনে আমি বেচু ভুকে ডাকিতে পাঠাইলাম। বেচু জাতিতে কৈবর্ত। প্রথম সে চাষ করিত, এখন কবিরাজ হইয়াছে। চারি পাঁচখানা গ্রামে বেচুর বিলক্ষণ পসার হইয়াছে। আমার হাত দেখিয়া বেচু শ্লোক পড়িয়া বলিল,–

কম্প দিয়া জ্বর আসে কম্প দেয় নাড়ী।
ধড় ফড় করে রোগী যায় যম-বাড়ী।।

ইহাকে বিষ-বড়ি দিতে হইবে।

এলোকেশী নিকটে ছিলেন। তিনি বলিলেন,–সে কি! তিন দিনের জ্বরে বিষ-বড়ি?

বেচু বলিল,–এ সামান্য বিষ-বড়ি নয়। এ নূতন ঔষধ সম্প্রতি আমি নিজে মনগড়া করিয়া প্রস্তুত করিয়াছি। ইহাতে কোন দোষ নাই। ইহার গুণ অনেক। এই দেখ, আমি নিজে আস্ত দুইটা খাইয়া ফেলি।

এই কথা বলিয়া বেচু নিজে দুইটা বড়ি গিলিয়া ফেলিল। তাহার পর মধুর সহিত খলে মাড়িয়া আমাকে কটা বড়ি খাইতে দিল।

বেচু চলিয়া গেল। তিন ঘণ্টা পবে তাঁহার ঔষধের গুণ প্রকাশিত হইল। আমার চক্ষু দুইটি লাল হইয়া উঠিল। বুক ধড়ফড় করিতে লাগিল। শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল। প্রাণ যায় আর কি! এলোকেশীর মেজাজটা কড়া বটে, কিন্তু শরীরে অনেক গুণ আছে। মাটীতে পড়িয়া তিনি কাঁদিতে লাগিলেন।

ডমরুধরের বন্ধু আধকড়ি বলিলেন,হাঁ, সেই সময় আমি তোমার বাড়ীতে আসিয়াছিলাম। তোমার সেই অবস্থা দেখিয়া তাড়াতাড়ি আমি বেচু ভুকে ডাকিতে যাইলাম। বেচু ঘরে ছিল না। খুজিতে খুঁজিতে দেখিলাম যে, সে এক পানা-পুকুরের জলে গা ড়ুবাইয়া বসিয়া আছে। তাঁহার চক্ষু দুইটি জবাফুলের ন্যায় হইয়াছে। পানা-পুকুরের পচা পাক তুলিয়া মাথায় দিতেছে! আমি বলিলাম,–বেষ্ণু! করিয়াহ কি? ডমরুধরকে তুমি কি ঔষধ দিয়াছ? তোমার ঔষধ খাইয়া ডমরুর মারা পড়িতে বসিয়াছে। মাথায় কাদা দিতে দিতে বাজখাই স্বরে বেচু উত্তর করিল,–বড়ি খাইয়া আমিই বা কোন ভাল আছি। আমি বুঝিলাম যে সে অবস্থায় তাঁহাকে আর কোন কথা বলা বৃথা। পুনরায় তোমার বাটীতে আসিয়া মাথায় অনেক জল দিয়া সে যাত্রা তোমার প্রাণ আমরা রক্ষা করিলাম।

গুমরুর বলিলেন,–বেচুর ঔষধ হইতে প্রাণ রক্ষা হইল বটে কিন্তু জ্বর আমার গেল না। পীড়া কঠিন হইয়া উঠিল। তোমরা সকলেই আমাকে দেখিতে আসিতে। তোমরা সকলেই মনে করিয়াছিলে যে, সে যাত্রা আমি আর রক্ষা পাইব না। একদিন রাঘব ও নকুল ভট্টাচাৰ্য মহাশয় আমাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। বিছানার দুইপার্শ্বে দুইজনে বসিয়া আমাকে অনেক আশ্বাস ও ভরসা দিতে লাগিলেন।

রাঘব বলিলেন,–দেখুন ভট্টাচাৰ্য মহাশয়, অঙ্গদ মজুমদারকে আপনি জানিতেন? তাঁহার শরীরটি ঠিক ডমরুধরের মত ছিল। এইরূপ কাটি কাটি হাত, এইরূপ কাটি কাটি পা, শরীরে চর্বি একটুও ছিল না। তাঁহার পীড়াটিও ঠিক এইরূপ হইয়াছিল। চিতার উপর তাঁহাকে শোয়াইয়া যখন আমরা আগুন দিলাম, তখন সেই আগুনের তাতে তাঁহার শরীরটি শটকে উঠিল। ধনুকের মত হইয়া তাঁহার মাজাটা চিতার উপর উঠিয়া পড়িল। কাঠ সব পুড়িয়া গেল। কিন্তু অঙ্গ পুড়িল না।

তাঁহাকে আমরা জলে ফেলিয়া দিলাম। কিন্তু আমরা স্নান করিয়া উঠিতে না উঠিতে, পাঁচ ছয়টা কুকুর ও শৃগাল আসিয়া জলে ঝাপাঝাপি করিয়া তাঁহাকে খাইয়া ফেলিল। ডমরুবাবু তোমার শরীরটিও ঠিক সেইরূপ। কিন্তু তোমার ভয় নাই। আমরা অধিক কাঠ দিয়া দেখিব। তবে নিতান্তই যদি তুমি পুড়িয়া না যাও, তাহা হইলে কাজেই তোমাকে আধপোড়া করিয়া ফেলিয়া দিতে হইবে।

নকুল ভট্টাচার্য আমাকে বলিলেন,–তোমার পুববাহিতের বাড়ী এ স্থান হইতে দুই ক্রোশ। মন্ত্র পড়াইতে রাত্রিতে যদি আমাকে ঘাটে যাইতে হয়, তাহা হইলে শ্রাদ্ধ আমাকে দিয়া করাইতে হইবে। নিজের পুরোহিতকে দিয়া করাইতে পারিবে না। তুমি সে কথা বাড়ীতে বলিয়া রাখ। মৃত্যু হইয়া গেলে আর কথা বলিতে পারিবে না,–

মনে কর শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর।

অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।

এলোকেশী পাশের ঘরে বসিয়া এইসব কথা শুনিতেছিলেন। সহসা খেঙরা হস্তে উগ্রচণ্ডীর ন্যায় রণমূর্তিতে আসিয়া সস্ পরিয়া এক ঘা নকুলের পিঠে বসাইয়া দিলেন। তাহার পর আর এক ঘা রাঘবের মাথায়। ঘর হইতে দুইজনে পলাইলেন। এলোকেশী তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া আরও দুই চারি ঘা বসাইয়া দিলেন।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের বুকে প্যাঁচ

ঈষৎ হাস্য করিয়া আমি বলিলাম,এলোকেশী! তুমি যাহা করিলে, তাহাতে আমার অর্ধেক রোগ ভাল হইয়া গেল। আর আমাকে কোনরূপ ঔষধ খাইতে হইবে না। এলোকেশী সে কথা শুনিলেন না। পরদিন গোবর্ধনপুরে তিনি ডাক্তার আনিতে পাঠাইলেন।

ডাক্তার আসিয়া আমার নাড়ী দেখিলেন, জিয়া দেখিলেন, পেট টিপিয়া দেখিলেন। বুকের উপর বামহন্ত রাখিয়া দক্ষিণ হস্তের আলির ডগা দিয়া ঠাকুইকি করিলেন। তার পর আমার বুকে চোঙ বসাইলেন। চোঙের অন্যদিকে কান দিয়া তিনি বলিলেন,–এখানে একটা প্যাঁচ আছে। এইরূপ তিন চারিটা প্যাচের কথা বলিলেন। প্যাঁচ আছে শুনিয়া আমার মনে ভরসা হইল। আমি ভাবিলাম যে, আমার যখন এতগুলি প্যাঁচ আছে, তখন আমি মরিব না, বহুকাল আমি বাঁচিব।

ডাক্তার তাহার পর পুলটিস ও ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন। খাইবার নিমিত্ত আমাকে সাবু দিতে বলিলেন। সাবুর নাম শুনিয়া আমার সর্ব্বশরীর জুলিয়া উঠিল। আমি বলিলাম,–কি! সাবুদানা? বিলাতি জিনিষ। তাহা কখনই খাইব না। চিরকাল আমি পরম নিষ্ঠাবান হিন্দু। অখাদ্য খাইয়া আমি অধর্ম্ম করিতে পারিব না। ডাক্তারবাবু। আপনি বোধ হয় জানেন না যে, কয়েক বৎসর পূর্ব্বে সন্ন্যাসী-বিভ্রাটে পড়িয়া আমার সূক্ষ্ম শরীর যমের বাড়ী গিয়াছিল। যখন আমার বিচার হয়, তখন আমি যমকে বলিয়াছিলাম যে, একাদশীর দিন কখন আমি পুইশাক ভক্ষণ করি নাই। যম সেই কথা শুনিয়া প্রসন্নবদনে হর্ষোফুল লোচনে পুলকিত মনে বলিলেন,–সাধু সাধু সাধু! এই মহাত্মা একাদশীর দিন পুইশাক ভক্ষণ করেন না। ইহার পদার্পণে আজ আমার যমপুরী পবিত্র হইল। শীঘ্র তোমরা যুমনীকে শঙ্খ বাজাইতে বল। যমকন্যাগণকে পুষ্পবৃষ্টি করিতে বল। বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া আন। ভুঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যলোক পারে ধ্ৰুলোকের উপরে এই মহাত্মার জন্য মন্দাকিনী কলকলিত, পারিজাত-পরিশোভিত, কোকিল কুহরিত, ভ্রমর-গুঞ্জরিত, অপ্সরা পদ-নুপুর বুনিত, হীরা-মাণিক-খচিত, নূতন এক স্বর্গ নির্মাণ করিতে বল। শুনিলেন ডাক্তারবাবু! খাদ্যাখাদ্যের বিচার করিলে কত ফল হয়? আমি আশ্চর্য হই যে, টিকিনাড়ারা এখানেওখানে যায় কেন, ধর্ম্মকথা শিখিতে আমার কাছে আসে না কেন?

আমি পুনরায় বলিলাম,–ডাক্তারবাবু! বুকে আমি তোমারও জগদ্দল পাথর মনের পুলটিস চাপাইব না, তোমার ঔষধও আমি খাইব না। কেবল আমি মা দুর্গাকে ডাকিব, আর আমাদের কাটিগঙ্গার জল খাইব। আমাদের কাটিগঙ্গার জল মকরধ্বজের বাবা।

আমি কাহারও কথা শুনিলাম না। সেইদিন হইতে আমি কেবল কাটিগঙ্গার জল খাইতে লাগিলাম। সেই রাত্রিতে মা দুর্গা শিয়রে বসিয়া আমার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন,–ডমরুধর। বাছা! তুমি আমার বরপুত্র। কেন তুমি বলিয়াছিলে যে, আর আমার পূজা করিবে না? সেই জন্য তোমাকে এই রোগ দিয়াছি। কিন্তু ভয় নাই, তোমাকে রোগ হইতে মুক্ত করিলাম। তাহার পর আরও একটুও নূতন বুদ্ধি তোমাকে আমি দিলাম। এই বুদ্ধিটুকু তুমি খেলাইবে। তাহা হইলে হীরাখও হাতছাড়া হইয়া তোমার যে ক্ষতি হইয়াছে, তাঁহার দশগুণ তোমার লাভ হইবে। কিন্তু বাছা, তোমার পূজায় আমি যে তৃপ্তিলাভ করি, বঙ্গদেশে কাহারও পূজায় সেরূপ তৃপ্তিলাভ করি না।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ–ডমরক্সের নূতন বুদ্ধি

সেই দিন হইতে আমার রোগ দূর হইয়া গেল। জ্বর গেল। দিন দিন শরীরে বল পাইতে লাগিলাম। রোগের পর আমার যেন নূতন শরীর হইল। এখন মা যে নূতন বুদ্ধিটুকু আমাকে দিয়াছেন, তাহা খেলাইয়া হীরকের দশগুণ টাকা আদায় করিতে আমি চেষ্টা করিতে লাগিলাম।

একদিন বসিয়া বুদ্ধি খেলাইতেছি এমন সময় আমার মনে কোন বিষয় উদয় হইল। আমি একটু হাসিয়া ফেলিলাম। এলোকেশী জিজ্ঞাসা করিলেন,–হাসিতেছ কেন? আমি বলিলাম,–চুপ কর। বুদ্ধি পাকিয়া আসিতেছে।

খুলনা জেলায় বাঘেরহাটের নিকট নীলামে আমি এক মহল কিনিয়াছিলাম। তাহা লইয়া আজ কয়েক বৎসর ধরিয়া ত্রিশঙ্কুবাবুর সহিত মোকদ্দমা চলিতেছিল। অন্য বিষয়ে আমি টাকা খরচ করি না বটে, কিন্তু মোকদ্দমার জন্য টাকা খরচ করিতে কখনও কাতর হই না। এক একটা দলিল জাল করাইতে আমি পাঁচশত টাকা ব্যয় করি। এক এক জন মিথ্যা সাক্ষীকে আমি পাঁচ হইতে দশ টাকা দিয়া বশ করি। মিথ্যা মোকদ্দমা আমি যেমন সাজাইতে পারি, মিথ্যা সাক্ষীদিগকে আমি যেমন শিখাইতে পারি, এমন আর কেহ পারে না। আদালতে হলফ করিয়া আমি নিজে যখন মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করি, তখন কোন উকীল জেরা করিয়া আমাকে ঠকাইতে পারে না। ত্রিশঙ্কুবাবু আমার সহিত পারিবেন কেন? দুটো আদালতে তিনি হারিয়া গিয়াছিলেন।

মহলের একস্থানে বনের ভিতর প্রাচীন ইটে গাঁথা একটি প্রাচীর ও শানের চাতাল ছিল। সেই চাতালের কথা আমার মনে পড়িল। আমি কলিকাতায় যাইলাম। কোন লোককে টাকা দিয়া একখানি তামার পাতে সে কালের বাঙ্গালা ভাষায় অনেকগুলি কথা ক্ষোদিত করাইলাম। তাহা লইয়া ঘিটটু ধাঙ্গড়ের সহিত আমি বাঘেরহাট মহলে গমন করিলাম। ঘিটটুকে সেই চাতালের উপর সপরিবারে বাস করিতে বলিলাম! গাছের ডালপালা দিয়া তাঁহার উপর সে এক ঝুপড়ি প্রস্তুত করিল। ত্রিশঙ্কুবাবু বন্দুক লইয়া একটি কুকুরের সহিত প্রায় প্রতিদিন প্রাতঃকালে সেই পথ দিয়া গমন করেন। আমি টোপ ফেলিলাম। ত্রিশঙ্কুবাবু এখন কি করেন, তাহা দেখিবার নিমিত্ত আমি খুলনায় আসিয়া বাসা ভাড়া করিয়া বসিয়া রহিলাম।

একদিন প্রাতঃকালে ত্রিশঙ্কুবাবু মহলের নিকট সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি দেখিলেন যে, বিটটু ধাঙ্গড়ের বৃদ্ধ মাতা ছোট একখানি তামার পাত মাজিয়া পরিষ্কার করিতেছে। ত্রিশঙ্কুবাবু তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,–তোর হাতে ওটা কি?

চবৃদ্ধা উত্তর করিল,–জানি না বাবু কি! উনুন করিবার নিমিত্ত চাতালের শান খুড়িতে খুঁড়িতে এইটা আমি পাইয়াছি।

ত্রিশবাবু হাতে করিয়া দেখিলেন। পুরাতন বাঙ্গালা ভাষায় তাহাতে যে কথাগুলি লেখা ছিল তাঁহার একটু দেখিয়াই তিনি চমকিত হইলেন। এক টাকা দিয়া তামার পাতটি বৃদ্ধের নিকট হইতে তিনি কিনিয়া লইলেন। তাহার পরদিন খুলনার বাসায় তিনি আমার নিকট আসিয়া বলিলেন,—ডমরুধরবাবু সামান্য ঐ মহলটা লইয়া মিছিমিছি আর মোকদ্দমা কেন? আপনারও টাকা খরচ হইতেছে, আমারও টাকা খরচ হইতেছে। দুইশত টাকায় আপনি মহলটি কিনিয়াছেন, পাঁচশত টাকায় মহলটি আমাকে ছাড়িয়া দিন।

আমি উত্তর করিলাম,–মহলটির জন্য আমাকে অনেক কষ্ট পাইতে হইয়াছে। আমি উহা ছাড়িব না।।

ত্রিশঙ্কুবাবু মূল্য বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন। হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার, চারি হাজার পর্যন্ত উঠিলেন। তথাপি আমি সম্মত হইলাম না। চারি হাজার পর্যন্ত উঠিয়া তিনি বলিলেন,–আর আমি পারি না। আর আমার ক্ষমতা নাই।

অবশেষে সাড়ে চারি হাজার টাকায় আমি তাঁহাকে মহলটি বিক্রয় করিলাম। ধাঙ্গ ড়ুদিগকে লইয়া আমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলাম। পরে শুনিলাম যে, ত্রিশঙ্কুবাবু প্রায় বিশহাত গভীর করিয়া সেই চাতাল ও নিকটবর্তী স্থান খুঁড়িয়া ফেলিয়াছিলেন। তাহার পরিশ্রম বৃথা হইয়াছিল। মাটীর ভিতর হইতে একটি পয়সাও বাহির হয় নাই।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–কেন? কি পাইবেন তিনি আশা করিয়াছিলেন?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—পুরাতন বাঙ্গলা ভাষায় সেই তাম্রফলকে লেখা ছিল–

বিসমিল্লা। আমি মহম্মদ তাহির প্রথমতঃ ব্রাহ্মণ ছিলাম। এক্ষণে পীরখাঞ্জে আলি সাহেব হইয়া মুসলমান হইয়াছি। আমার পুত্রগণ ব্রাহ্মণ আছে। তাহাদের বংশধরগণের ভরণপোষণের নিমিত্ত এই চাতালের দশহাত নিচে আমি এক লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা পুঁতিয়া রাখিলাম। এই অর্থ জিন্দাগাজী সাহেবের আশ্রয়ে রাখিলাম। যখন আমার বংশধরগণ নিতান্ত দরিদ্র হইবে, তখন তিনি এই অর্থ তাহাদিগকে প্রদান করিবেন। ইতি ১৫ই জিলহিজ্জা ৮৬২ হিজরি। ঐ তাম্রপত্র আমি লেখাইয়া আনিয়াছিলাম। ত্রিশঙ্কুবাবুকে দেখাইবার নিমিত্ত আমি বাঙ্গড় বুড়ীকে দিয়াছিলাম। মায়ের কৃপায় বুদ্ধি খেলাইয়া হীরার দশগুণ মূল্য আমি লাভ করিলাম।

লম্বোদর বলিলেন,—ভাদ্র মাসে ভূত বলিয়া গ্রামে একটা গোল উঠিয়াছিল বটে, কিন্তু তুমি যে তার গোঁসাই, তাহা জানিতাম না।

সকলে বলিল,–ধন্য ডমরুধর, ধন্য তুমি।

ডমরুধর বলিলেন,–তাই তোমাদের সকলকেই আমি বলি, মা দুর্গাকে তোমরা ভক্তি কর। মা দুর্গা তোমাদিগকে ধন দিবেন, মান দিবেন আর হাওয়াখোর বাবুদের আমি বলি যে, মায়ের পূজা ছাড়িয়া বিদেশে তোমরা হাওয়া খাইতে যাইও না। ঘরে থাকিয়া ভক্তিভাবে মায়ের পূজা কর। যত হাওয়া চাও, মা তোমাদিগকে দিবেন। ঘরে বসিয়া স্বচ্ছন্দে পেট ভরিয়া হাওয়া খাইতে পারিবে।

সপ্তম গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–জিলেট মন্ত্র

পূজার পঞ্চমীর দিন ডমরুর যথারীতি বন্ধু-বান্ধবের সহিত প্রতিমার সম্মুখে বসিয়া আছেন। হাঁ করিয়া তিনি বলিলেন,–তোমরা একবার আমার মুখের ভিতরটা ভাল করিয়া দেখ। সকলে দেখিলেন। লম্বোদর বলিলেন,–তোমার মুখের ভিতর কি আছে? কিছুই নাই। ফোকলা মুখ। তিমির গিরিগরের ন্যায়। ডম উত্তর করিলেন,–তোমাদের পাপ চক্ষু তৈলপেষী বলদের ঠুলি দ্বারা আবৃত। তোমরা দেখিবে কেবল অন্ধকার।

গজানন জিজ্ঞাসা করিলেন,–তবে তোমার মুখের ভিতর কি আছে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–আমার জিহ্বা ও কণ্ঠে সরস্বতী দেবী অধিষ্ঠিতা আছেন। পূর্ব্বে বলিয়াছি যে, আমি মা দুর্গার বরপুত্র। তাহার পর তাঁহার সঙ্গে যে দেবতাগুলি আগমন করেন, একে একে সকলের আরাধনা করিয়া আমি সিদ্ধিলাভ করিয়াছি। কার্তিকের বরে আমার কন্দর্পের ন্যায় হইয়াছে। মা সরস্বতীর বরে আমি এত বড় বিদ্বান হইয়াছি। মেঘনাদবধ কে লিখিয়াছে জান?

লম্বোদর উত্তর করিলেন,–কেন? মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

ডমরুর বলিলেন,–হাঁ, সকলের তাই বিশ্বাস। কিন্তু কলিকাতায় যখন আমি চাকরি করিতাম, তখন সন্ধ্যার পর সাহেবী পোষাক পরিয়া কে আমার নিকট আসিত? দুই ঘণ্টাকাল আমি যাহা বলিতাম, কে তাহা লিখিয়া লইত? সে লোকটি অপর কেহ নয়। সে লোকটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মেঘনাদবধ কাব্য আগাগোড়া আমার দ্বারা রচিত। মাইকেল আমাকে অধিক টাকা দিতে পারিতেন না। টাকা দিতেন বঙ্কিম। কোনদিন পাঁচ, কোনদিন দশ। যেদিন দুর্গেশনন্দিনী শেষ করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম, সেদিন তিনি আমাকে একেবারে এতশত টাকা দিয়াছিলেন। অন্যান্য পুস্তকের জন্যও তিনি আমাকে অনেক টাকা দিয়াছিলেন। মাইকেল ও বঙ্কিম অনেক কাকুতি-মিনতি করিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন যে,মহাশয়! আপনি যে আমাদের পুস্তক লিখিয়া দিয়াছেন, আমরা বাঁচিয়া থাকিতে সে কথা প্রকাশ করিবেন না। সেই জন্য এতদিন চুপ করিয়াছিলাম। আর দেখ, এখন যত বড় বড় গ্রন্থকার জীবিত আছেন, অন্ততঃ সাধারণে যাঁহাদিগকে গ্রন্থকার বলিয়া জানে, তাহাদের সমুদয় পুস্তকের প্রণেতা এই শর্মা। হাসি পায়। নাম করিব না। নাম করিলে, তাহাদের মান-সম্রম একেবারে যাইবে। অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া নাম করিতে তারা আমাকে মানা করিয়াছেন। সেই জন্য চুপ করিয়া আছি। কিন্তু তাঁহারা যে গ্রন্থকার

বলিয়া লোকের নিকট পরিচয় দেন, তাই আমার হাসি পায়।

এই দেখ, আজকাল হোমরুল বলিয়া একটা হুজুগ পড়িয়াছে। সেই সম্বন্ধে বক্তৃত করিতেছেন। ইহা অপেক্ষা আমি শতগুণ বক্তৃতা করিতে পারি। আমার বক্তৃতা লোবে নানারূপ মুখভঙ্গী করিয়া অবাক হইয়া শ্রবণ করে।

আমার প্রতি মা সরস্বতীর সামান্য কৃপা নহে। সে বৎসর কার্তিকের ময়ুরে চড়িয়া আমি যখন আকাশ ভ্রমণে গিয়াছিলাম, তখন মায়ের কৃপায় আমার মুখ দিয়া মহামন্ত্র বাহির হইয়াছিল। এ তোমার হিড়িং বিড়িং মন্ত্র নহে। জিলেট মন্ত্র। আসল বীজমন্ত্র। এ মরে যে কি অদ্ভুত শক্তি, এতদিন তাহা আমি জানিতাম না? এইবার জানিতে পারিয়াছি। এই মন্ত্রের প্রভাবে আমি শুক্লাশ্বর ঢাককে ঘোর বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছি। প্রেতযোনি-প্রাপ্ত তাঁহার কন্যাকে উদ্ধার করিয়াছি। সমুদ্রযাত্ৰাজনিত পাপ হইতে তাঁহার জামাতাকে পরিত্রাণ করিয়াছি।।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–শুক্লাশ্বর ঢামমহাশয়ের কি হইয়াছিল?

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–ঢাকমহাশয়

ডমরুধর বলিলেন,—শুক্লাশ্বর ঢাকমহাশয় গুরুগিরি করেন। তাঁর অনেক শিষ্য আছে। গুরুগিরি করিয়া তাঁহার বিলক্ষণ দুপয়সা উপার্জন হয়। দোতলা কোঠা বাড়ীতে তিনি বাস করেন। মোকদ্দমা-মামলা সম্বন্ধে তাঁহার যেরূপ বুৎপত্তি, এরূপ ব্যুৎপত্তি প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না। নানা বিষয়ে ঢাকমহাশয় আমার সহায়তা করেন। তিনি আমার পরম বন্ধু। ঢাকমহাশয় অতি নিষ্ঠাবান পুরুষ। পূজা-আহ্নিক জপ-তপে তিনি অনেক সময় অতিবাহিত করেন। সেজন্য তাঁহার প্রতি আমার অগাধ ভক্তি। আজকাল ব্রাহ্মণেরা ত্রিসন্ধ্যা করে না। টিকিনাড়ারা সে উপদেশ কাহাকেও প্রদান করে না। কিন্তু ঢাকমহাশয় সে প্রকৃতি লোক নহেন। কাহাকেও চা বা বরফ খাইতে দেখিলে তিনি আগুনের ন্যায় জুলিয়া উঠেন। সন্ধ্যাআহ্নিকে যাহাতে লোকের প্রবৃত্তি হয়, সে বিষয়ে তিনি চেষ্টা করেন।

গত বৈশাখ মাসে একদিন ঢাকমহাশয় আমাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। সূর্য অগ্নিবৃষ্টি করিতেছেন। রৌদ্রে পুড়িয়া যাইতেছে। আমি তাঁহার বাড়ী গমন করিলাম। ঘোরপিপাসায় কাতর হইয়া আমি কোৎ কোৎ করিয়া একঘটি জল খাইয়া ফেলিলাম। কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলে ঢাকমহাশয় আমাকে বলিলেন যে, তাঁহার কন্যা কুন্তলার প্রখর জ্বর হইয়াছে। কুন্তলার বয়স নয় বৎসর। আট বৎসর বয়সে ঢাকমহাশয় তাঁহার বিবাহ দিয়াছিলেন। বিবাহের দুই মাস পরেই সে বিধবা হইয়াছিল। দোতলার উপর যে ঘরে কুম্ভলা শুইয়াছিল, ঢাকমহাশয়ের সহিত আমি সেই ঘরে গমন করিলাম।

জুরে কুতলার কাঠ ফাটিতেছে। আগুনের ন্যায় শরীরের উত্তাপ হইয়াছে। ক্রমাগত এ পাশ ওপাশ করিতেছে। মা একটু জল দাও, মা একটু জল দাও, ক্রমাগত এই কথা বলিতেছে। মা! পিপাসায় আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। একটু জল দাও মা! একটুখানি দাও। কেবল মুখটি ভিজাইয়া দাও। একটু জল না খাইয়া আর থাকিতে পারি না। জল, জল, জল।

বিরস বদনে মা নিকটে বসিয়া আছেন। মাঝে মাঝে বাতাস করিতেছেন। মাঝে মাঝে চক্ষুর জল মুছিতেছেন।

ঢামহাশয় আমাকে চুপি চুপি বলিলেন,–আজ একাদশী। বিধবা। সেইজন্য জল দিতে বারণ করিয়াছি। কিন্তু জল দিতে আমার গৃহিণীর ইচ্ছা। এখন করি কি? সেইজন্য তোমাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছিলাম।

নীচে গিয়া আমি বলিলাম,—বাপ রে! জল কি দিতে পারা যায়? ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা। একাদশীর দিন জল খাইতে দিলে তাঁহার ধমটি একেবারে লোপ হইয়া যাইবে।

ঢাকমহাশয় তাহাই করিলেন। কন্যাকে জল দিলেন না। রাত্রিতে কন্যা পাছে নিজে জল চুরি করিয়া খায়, অথবা তাঁহার কষ্ট দেখিয়া মাতা, ভগিনী কি অপর কেহ পাছে তাঁহাকে জল প্রদান করে, সেজন্য সন্ধ্যার সময় কুন্তলাকে তিনি নীচের তালার এক ঘরে বন্ধ করিয়া চাবি দিয়া দিলেন। সমস্ত রাত্রি পীড়িতা কন্যা একেলা সেই ঘরে রহিল। ধর্ম্ম রক্ষা সম্বন্ধে ঢাকমহাশয়ের এমনি দৃঢ়পণ।।

প্রাতঃকালে যখন তিনি ঘরের চাবি খুলিলেন, তখন সকলে দেখিল যে, বালিকা পিপাসা হতজ্ঞান হইয়া ঘরের ভিজা মেঝের একধার হইতে অপর ধার পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি বার বার চাটিয়াছে। অবশেষে অজ্ঞান হইয়া ঘরের এককোণে পড়িয়া আছে। মাতা তাঁহাকে। কোলে তুলিয়া লইলেন। কিন্তু তাঁহার মাথাটি লুটিয়া পড়িল। সেদিন দ্বাদশী। মাতা তাঁহার মুখে জল দিলেন, কিন্তু সে গিলিতে পারিল না। দুই কল দিয়া জল বাহিরে আসিয়া পড়িল। সে আর কথা কহিল না। শেষকালে একবারমাত্র বলিল,–জল-জল। এই কথা বলিয়া সে প্রাণত্যাগ করিল।

এই ঘটনার কথা যখন চারিদিকে প্রচারিত হইল, তখন দেশশুদ্ধ লোক ঢাকমহাশয়কে ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। সকলে বলিল,—কি দৃঢ় মন! কি ধর্মের প্রতি আস্থা এরূপ পুণ্যবান লোক কলিকালে হয় না। তাঁহার প্রতি লোকের এত ভক্তি হইল যে, এক মাসের মধ্যে তাঁহার এক শতের অধিক নূতন শিষ্য হইল।

কন্যার মৃত্যুতে ঢাকমহাশয়ের আনন্দ হইল। তিনি বলিলেন, বিধবা হইয়া চিরজীবন দুঃখে যাপন করা অপেক্ষা মরাই ভাল। কিন্তু মৃতকন্যা তাঁহাকে অধিক দিন আনন্দভোগ করিতে দিল না। একদিন রাত্রি দুই প্রহরের সময় সহসা জল, জল। হা জল! হা জল! এইরূপ ভীষণ চীৎকার করিয়া সে বাড়ীর চারিদিকে ছটফট করিয়া বেড়াইল। সকলের নিদ্রাভঙ্গ হইল। সকলে ঘোর ভয়ে ভীত হইল। ইহার চারিদিন পরে ঢাকমহাশয়ের পুত্রটি মরিয়া গেল। এইবার ঢাকমহাশয় শোকে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। পনের দিন পরে আবার কুন্তলার ভূত সেইরূপ জল জল করিয়া চীৎকার করিল। এবার মাতঙ্গিনী নামক দাসীর মৃত্যু হইল। * ফলকথা, যখনই কুন্তলার ভূত চীৎকার করিত, তখনই বাড়ীর একটা না একটা লোক মরিতে লাগিল। দাসীর মৃত্যুর পর ঢাকমহাশয় গয়াতে পিশু দিবার জন্য লোক পাঠাইলেন। কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। কারণ, কিছুদিন পরে পুনরায় যখন চীৎকার হইল, যখন ঢাকমহাশয়ের ছটু নামক চাকর মরিয়া গেল। বিধবা হইয়া একাদশীর দিন ভিজা মেঝে চাটা পাপটি সামান্য নহে। গয়াতে হাজার পিণ্ড দিলেও ইহা ক্ষয় হয় না।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–মোল্লা জামাতা

কুন্তলাকে কি উপায়ে উদ্ধার করা যায়, সেই সম্বন্ধে ঢাকমহাশয় আমার সহিত অনেক পরামর্শ করিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাকে কিছু বলিতে পারিলাম না।

ঢাকমহাশয়ের এক বালক দৌহিত্র আছে। তাঁহার নাম ভুলু। ভুলু ঢাকমহাশয়ের প্রাণস্বরূপ। এক মুহূর্ত তাঁহাকে চক্ষুর আড় করিয়া ঢাকমহাশয় থাকিতে পারেন না। বিশেষতঃ পুত্রহীন হইয়া তাঁহার যত স্নেহ মমতা ভুলুর উপর পড়িয়াছিল। পাছে কুন্তলার চীৎকারে ভুলুর কোন অনিষ্ঠ হয় সেজন্য ঢাকমহাশয় ঘোরতর ভীত হইলেন।

বিপদের উপর বিপদ। ঢামহাশয়ের জামাতা, ভুলুর পিতা, যাহার নাম কেশব, বোগদাদে গিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত ঢাকমহাশয়ের সদ্ভাব ছিল না। ঢাকমহাশয় আশা করিয়াছিলেন যে, তিনি লড়াইয়ে মারা পড়িবেন। ভুলু ও ভুলুর মাতা চিরকাল তাঁহার নিকট থাকিবে। ভুলুর মাতার নাম কালিকা। বাল্যকাল হইতে তাঁহাকে আমি কোলে-পিঠে করিয়াছি। কন্যার ন্যায় তাঁহাকে আমি স্নেহ করি। এত চুল কখন আমি কাহারও দেখি নাই। কিছুদিন পূর্ব্বে দোতলার ঘরে জানালার ধারে সে চুল এলো করিয়া বসিয়াছিল। সে যে কি অপূর্ব্ব শোভা হইয়াছিল, তাহা তোমাদিগকে আর কি বলিব।

ঢাকমহাশয়ের জামাতা, কালিকা দেবীর স্বামী। ভুলুর পিতা কেশব লড়াইয়ে মারা যান নাই। তিনি দেশে ফিরিয়া আসিলেন। দেশে আসিয়া তিনি কালিকা ও ভুলুকে লইতে পাঠাইলেন। ঢাকমহাশয়ের মাথায় ঠিক যে বজ্রাঘাত হইল। তিনি বলিলেন,–কিছুতেই আমি আমার কন্যাকে ও দৌহিত্রকে তাঁহার বাড়ী পাঠাইব না। সে সমুদ্র পার হইয়া বিদেশে গমন করিয়াছে। তাঁহার জাতি গিয়াছে।

কিন্তু ঢাকমহাশয়ের কয়েকজন শিষ্য যাহারা বি-এ, এম-এ পাশ করিয়াছে, তাঁহারা বলিল যে,—মহাশয়! এমন কাজ করিবেন না। আপনার জামাতা রাজকার্যে বিদেশে গমন করিয়াছিলেন। মহাসংগ্রামে পৃথিবী টলমল করিতেছে। জর্মণদিগকে যদি সম্পূর্ণ পরাজিত করা না যায়, তাহা হইল ভবিষ্যতে পৃথিবীর ঘোর অনিষ্ট ঘটিবে। আমাদেরও সর্ব্বনাশ হইবে। ইংরেজের প্রতাপে আমরা সুখে নিরাপদে বাস করিতেছি। আমাদের প্রাণপণে ইংরেজের সাহায্য করা উচিত। আপনি যাহা মনস্থ করিয়াছেন, তাহা করিলে রাজার বিরুদ্ধে কাজ করা হইবে। এমন কাজ কখন করিবেন না।

এইরূপ কথা শুনিয়া ঢাকমহাশয় আমাকে ডাকিতে পাঠালেন। আমি গিয়া বলিলাম, ইংরেজ প্রজার ধর্মে হস্তক্ষেপ করিবেন না। সাগর অতি ভয়ানক বস্তু। জগন্নাথে গিয়া আমি দেখিয়াছি তিনটা ঢেউ খাইয়া আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়াছিল। সে সাগর-পারে কেই যাইলে হিন্দুধর্মের গ্রন্থটি পর্যন্ত তাঁহার গায়ে থাকে না।

আমি পুনরায় বলিলাম,—আর দেখুন, ঢাকমহাশয়! বিলাতে গেলে বরং নিষ্কৃতি আছে। বিলাত গেলে সাহেব হয়, সাহেবি পোষাক পরে, সাহেবি খানা খায়। তা এখন বিলাত না গিয়াও লোকে এই কাজ করিতেছে। কিন্তু বোগদাদে গমন করিলে লোকে মোল্লা হয়। মোল্লা হইয়া পীরের গান করে। বলে,–

হুঁকো বন্দিলাম, কল্‌কে বন্দিলাম, আর বন্দিলাম টিকে।
আর তালগাছে বন্দিলাম প্রভু চামচিকে।

তাহার পর সে আরব্য উপন্যাসের দেশ। জিন, দৈত্য, ও দানবীতে পরিপূর্ণ। গুজব এই যে, আপনার জামাতা একটা দৈত্য সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে। অতএব এরূপ লোকের সহিত কোন সংস্রব রাখিবেন না। তাঁহার বাড়ীতে আপনার কন্যাকে পাঠাইবেন না। ঢাকমহাশয় তাহাই স্থির করিলেন।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–সন্দেশের হাঁড়ি

কিন্তু ঢাকমহাশয়ের কন্যা কালিকা তাহাতে সম্মত হইলেন না। তিনি শ্বশুরবাড়ী যাইবার নিমিত্ত মাতার নিকট কাঁদিতে লাগিলেন। স্বামীর নিকট তাঁহাকে পাঠাইবার নিমিত্ত মাতা ঢাকমহাশয়কে অনেক অনুরোধ করিলেন। কিন্তু ঢাকমহাশয় কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন যে,—সে পতিত পাপিষ্ঠ সমুদ্রপ্রত্যাগত নরাধমের নিকট পাঠাইয়া আমি কন্যার ইহকাল পরকাল নষ্ট করিতে পারি না। হতাশ হইয়া কালিকা স্বামীকে পত্র লিখিলেন। পত্র পাইয়া একদিন সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে কেশব আসিয়া ঢাকমহাশয়ের খিড়কির নিকট এক বন্য জামতলার স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। জামতলায় অল্প বন ছিল। সেই বনের আড়ালে দাঁড়াইয়া দুইজনে কথাবার্তা করিতে লাগিলেন। বনা জামগাছ। অসময়ে ইহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলা জাম হইয়াছিল। এখন কেষ্টা ছোঁড়া জাম গাছে উঠিয়া জাম খাইতেছিল। কেশব ও কালিকা তাঁহাকে দেখেন নাই। পতি-পত্নীর সকল কথা কেষ্টা শুনিতে পায় নাই। তবে, বুধবার সন্ধ্যায় সময়, ইত্যাদি গোটা কতক কথা কেবল শুনিয়াছিল। যখন স্ত্রী-পুরুষের পরামর্শ শেষ হইবার উপক্রম হইল, তখন গাছ হইতে কেষ্টা বলিয়া উঠিল,ঢাকমহাশয়কে বলিয়া দিব।

দুইজনেই চমকিত হইলেন। একটু স্তব্ধ থাকিয়া তাঁহাকে বলিলেন,–না, দাদা! তা কি বলিতে আছে? লক্ষ্মী দাদা! কাহাকেও কিছু বলিও না।

কেশবকে লক্ষ্য করিয়া কেষ্টা জিজ্ঞাসা করিল,—তুমি ইংরেজি জান?

কেশব উত্তর করিলেন,—হাঁ, একটু আধটু জানি। বিএ পাশ করিয়াছি।

কেষ্টা বলিল,–শীঘ্রই আমাদের পূজার ছুটী হইবে। পূজার সময় তুমি কি করিয়াছ এই মর্মে মাস্টার আমাদিগকে একটা প্রবন্ধ লিখিতে দিবেন। আমার এত কাজ যে, আমি লিখিতে অবসর পাইব না। তুমি যদি আমাকে লিখিয়া দাও, তাহা হইলে আমি বলিয়া দিব না।

কেশব স্বীকার করিলেন। কেষ্টা তাঁহাকে তিন সত্য করিতে বলিল। কালিকাকেও সত্য করিতে হইল। তখন কেষ্টা গাছ হইতে নামিয়া চলিয়া গেল। কেশবও আপনার গ্রামে চলিয়া গেলেন।

বুধবার সন্ধ্যার সময় এইরূপ দুই একটি কথা কেষ্টা সেদিন শুনিতে পাইয়াছিল। বুধবার সন্ধ্যাবেলায় কেষ্টা ভাবিল,—যাই, গিয়া দেখি, আজ তাঁহারা কি করে। এইরূপ মনে করিয়া সে সেই জামগাছে উঠিয়া বসিয়া রহিল। সন্ধ্যার পূর্ব্বে সে দেখিল যে, কালিকা শরা-ঢাকা এক নূতন হাড়ী লইয়া ঘর হইতে চুপি চুপি বাহির হইলেন। জামতলার বনের ভিতর হাঁড়ীটি লুকাইয়া রাখিয়া প্রস্থান করিলেন। কালিকা চলিয়া গেলে, কেষ্টা গাছ হইতে নামিল ও দেখিল যে, হাঁড়ীর মুখে শাখানি কালিকা ময়দা দিয়া আঁটিয়া দিয়াছেন। কিন্তু ময়দা কাঁচা ছিল না। শরা একটু উঠাইয়া কেষ্টা দেখিল যে, হাঁড়ীটি সন্দেশে পরিপূর্ণ। কেশববা আসিয়া কালিকা দিদির সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। সেই কথা ঢামহাশয়কে বলিয়া দিব না, আমি এই অঙ্গীকার করিয়াছি। সন্দেশ খাইব না,আমি এরূপ অঙ্গীকার করি নাই। অতএব আমি এই সন্দেশগুলি খাইব। এইরূপ মনে করিয়া কেষ্টা সন্দেশের হাড়ী লইয়া বন হইতে বাহির হইল। পথে দাঁড়াইয়া সে দেখিল যে, সম্মুখ দিকে দুইজন গ্রামের লোক আসিতেছে। পরবর্তী কে চাহিয়া দেখিল যে, প্রেম চাকি ধান বোকই গরুর গাড়ী লইয়া আসিতেছে। কেষ্টা ভাবিল যে, উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে দিই, তা না করিলে আমি ধরা পড়িব। এইরূপ মনে করিয়া সে সন্দেশের হাড়ীটি গাড়ীওয়ালাকে দিয়া বলিল,–প্রেমখুড়ো! কালিকা দিদি আমাকে সন্দেশ দিয়াছেন। আমি একলা খাইব না। তোমাতে আমাতে দুইজনে খাইব। তুমি ঘোষেদের গঙ্গার ঘাটে গিয়া গাড়ী রাখ। একটু পরে আমি যাইতেছি। (কলিকাতার দক্ষিণে এই সমুদয় ঘটনা ঘটিয়াছিল। এ স্থানে প্রাচীন গঙ্গার গর্ভ ললাকে ভাগ করিয়া লইয়াছে। এই ঘোষেদের গঙ্গা, বসুদের গঙ্গা ইত্যাদি) প্রেমচাকি সন্দেশের হাঁড়ী লইয়া গঙ্গার ঘাটে চলিল। কেষ্টাও অন্য পথ দিয়া সেই দিকে চলিল। প্রেমচাকি ঘাটে উপস্থিত হইয়া হাঁড়ীটি একটু খুলিয়া দেখিল যে, সন্দেশে পরিপূর্ণ। সে ভাবিল যে, আমার ছেলেদের জন্য সন্দেশ লইয়া যাইব! কেষ্টাকে ভাগ দিব না। কিন্তু এই সময় দেখিল যে, দূরে কেষ্টা আসিতেছে। অড়াতাড়ি হাঁড়ীটির মুখ পুনরায় বন্ধ করিল। গাড়ী হইতে একটি ঝুড়ি লইয়া হাঁড়ীটি ঝুড়ি চাপা দিয়া তাঁহার উপর সে বসিয়া রহিল। কেষ্টা আসিয়া সন্দেশের ভাগ চাহিল, আমি সব সন্দেশ খাইয়া ফেলিয়াছি। দুইজনে ঝগড়া বাঁধিয়া গেল। এমন সময় কেষ্টা দেখিল যে দুরে গজরাজ আসিতেছে। তাঁহাকে দেখিয়া কেষ্টা সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল।

এদিকে কালিকার মন সুস্থির নাই। জামতলায় সন্দেশের হাড়ী ঠিক আছে কি না, তাহা দেখিবার নিমিত্ত তিনি আর একবার বনের ভিতর গমন করিলেন। সে স্থানে গিয়া দেখিলেন যে, বনের ভিতর সন্দেশের হাঁড়ী নাই। কালিকা কাঁদিয়া উঠিলেন। আমার হাড়ী কে লইয়া গিয়াছে, এই বলিয়া ক্রমাগত কাঁদিতে লাগিলেন।

সেদিন বৈকালবেলা আমি ঢাকমহাশয়ের বাড়ী গিয়াছিলাম। ঢাকমহাশয় বলিয়াছিলেন যে, আমি নানা বিপদে পড়িতেছি। মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিতেছেন না, অতএব আর আমি দুর্গার পূজা করিব না। কথা শুনিয়া আমি থাকিতে পারিলাম না। আমি তাঁহাকে বুঝাইতে যাইলাম। আমি বলিলাম যে, দুর্গা পরম দয়াময়ী। যাহা হইবার, তাহা হইয়া গিয়াছে। ভক্তিভাবে ঘটা করিয়া দুর্গোৎসব করুন। তাহা হইলে আমাকেও যেরূপ তিনি নানা বিপদ হইতে রক্ষা করেন, আপনাকেও তিনি সেইরূপ নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিবেন।

কিন্তু প্রথম তিনি আমার কথায় কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তাহার পর যখন আমি বলিলাম যে, পূজা বন্ধ করিলে, শিষ্য-সেবক যে বার্ষিক প্রদান করে, তাঁহার কি হইবে? তখন কি হইবে? তখন তিনি পূজা করিতে সম্মত হইলেন। আমাদের দুইজনে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় কালিকা কান্নার শব্দ আমাদের কানে প্রবেশ করিল। আমরা সেই স্থানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,—কি হইয়াছে?

কালিকা উত্তর করিলেন যে,—আমার সন্দেশের হাঁড়ী কে লইয়া গিয়াছে।

আমি বলিলাম,—গোটা কত সন্দেশের জন্য এত কান্না কেন? ঢাকমহাশয় তোমাকে অনেক সন্দেশ কিনিয়া দিবেন।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – উড়ুখ্‌খ্‌ হাঁড়ী

ক্রমে সকল কথা প্রকাশ পাইল। পিতার অগোচরে কালিকা ঘর হইতে পলায়ন করিবেন, স্বামীর সহিত এইরূপ পরামর্শ করিয়াছিলেন। বুধবার সন্ধ্যাবেলা কেশব ঘোড়ার গাড়ীতে কাটিগঙ্গার ঘাটের নিকট লুক্কায়িত থাকিবেন। একটু অন্ধকার হইলে কালিকা ভুলুকে লইয়া সেই স্থানে গমন করিবেন। তাহার পর ঘোড়ার গাড়ীতে রেলস্টেশন যাইবেন। সে স্থান হইতে রেলগাড়ীতে কেশব স্ত্রী-পুত্র লইয়া আপনার গ্রামে গমন করিবেন? বাক্স লইয়া গেলে পাছে কেহ জানিতে পারে, সেজন্য কালিকা আপনার গহনাগুলি হাঁড়ীতে রাখিয়া তাঁহার উপর সন্দেশ চাপা দিয়া বনে রাখিয়াছিলেন। যাইবার সময় লইয়া যাইবেন, এইরূপ মানস করিয়াছিলেন।

যখন এইসব কথা প্রকাশ হইল, তখন একটা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। কে সে হাঁড়ী লইয়া গেল, তাঁহার অনুসন্ধান হইতে লাগিল। দুইজন গ্রামের লোক বলিল যে, সন্ধ্যার সময় তাঁহারা জামগাছের নিকট দিয়া যাইতেছিল। প্রেমা চাকি গরুর গাড়ী লইয়া সেই পথ দিয়া আসিতেছিল। কেষ্টা তাঁহাকে একটা হাঁড়ী দিল। ইহা তাঁহারা দেখিয়াছে।

তৎক্ষণাৎ একজন লোক প্রেম চাকির বাড়ীতে দৌড়িল। আর একজন লোক কেন্টার বাড়ীতে গেল। আমার চাকর গজরাজকে আমি গঙ্গার ঘাটে পাঠাইলাম। আমি তাঁহাকে আদেশ করিলাম যে,—সেস্থানে যদি তুমি প্রেমা চাকিকে দেখিতে পাও, তাহা হইলে গাড়ীশুদ্ধ তাঁহাকে ধরিয়া আনিবে।

গজরাজ তাহাই করিল। প্রেম চাকির গাড়ী আমরা অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম। হাঁড়ী পাইলাম না। কিন্তু যখন সে শুনিল যে, হাঁড়ীতে কেবল সন্দেশ ছিল না, তাঁহার ভিতর অনেক গহনা ছিল, তখন সে বলিল যে, যেস্থানে সে গাড়ী রাখিয়াছিল, তাঁহার নিয়ে ভূমিতে ঝুড়িচাপা সেই হাঁড়ী আছে। তখন আমরা সকলেই গঙ্গার ঘাটের দিকে দৌড়িলাম।

একদিকে সন্ধ্যার সময় কেশব রেলষ্টেশন হইতে ঘোড়ার গাড়ী করিয়া কাটিগঙ্গার ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একটু দূরে ঘোড়ার গাড়ী রাখিয়া তিনি ঘাটের নিকট গমন করিলেন। তখনও সে স্থানে কালিকা ও ভুলু আসে নাই। কিন্তু দেখিলেন যে, একটা বুড়ি উপুড় হইয়া রহিয়াছে। ঝুড়িটি তুলিয়া দেখিলেন যে, নিম্ন একটি হাঁড়ী রহিয়াছে। হাঁড়ির ভিতর সন্দেশ। কেশব মনে করিলেন যে, গাড়ীতে ভুলু খাইবে, সেই জন্য কালিকা এই সন্দেশগুলি কাহারও হাতে গোপনে পাঠাইয়া দিয়াছেন। হাঁড়ীটা কোলে লইয়া তিনি কালিকা ও ভুলুর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

অল্পক্ষণ পরে কেশব দেখিলেন যে, কিছুদূরে অনেক লোক ঘাটের দিকে আসিতেছে। ব্যাপারটা কি জানিবার নিমিত্ত তিনি অন্য পথে দ্রুতবেগে ঢাকমহাশয়ের বাড়ীর দিকে গমন করিলেন। সে স্থানে উপস্থিত হইয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। গোয়ালের কোণে হাড়ীটি রাখিয়া তিনি গোয়ালের পশ্চাতে লুকাইয়া রহিলেন।

সকলে গঙ্গার ঘাটে গিয়া গাড়ি দেখিতে পাইল। কিন্তু ঝুড়ি তুলিয়া দেখিল যে তাঁহার নিম্নে হাঁড়ী নাই। হতাশ হইয়া সকলে ঢামহাশয়ের বাড়ীতে ফিরিয়া আসিল। ক্রমে বিলক্ষণ একটা জনতা হইয়াছিল। কালিকাও সকলের সঙ্গে ঘাটে গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসিবার সময় তিনি একটু পশ্চাতে পড়িয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া কেশব লুক্কায়িত স্থান হইতে বাহির হইয়া গোলমালের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। কালিকা মুখে সকল বিবরণ শ্রবণ করিয়া তিনি বলিলেন,–কেন! হাঁড়ী আমি লইয়া আসিয়াছি। গোয়ালের কোণে তাহা আমি রাখিয়া দিয়াছি।

আহ্লাদিত হইয়া কালিকা মাতা-পিতার সঙ্গে গোয়ালে প্রবেশ করিলেন। আঁতিপাতি করিয়া গোয়ালের সকল কোণ, গোয়ালের সকল স্থান অন্বেষণ করিলেন। কিন্তু হাঁড়ী পাইলেন না। কালিকা পুনরায় কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন। তখন বিন্দি নামক ঢাকমহাশয়ের ঝি বলিল যে,–সে প্রতিদিন সকলের পাতের খাবার কুড়াইয়া তাঁহার বোনঝির নিমিত্ত গোয়ালের কোণে রাখিয়া দেয়। সন্ধ্যাবেলা তাঁহার বোনঝি লইয়া যায়। সে হয়তো হাঁড়ী লইয়া গিয়াছে।

বিন্দির বোঝিকে খুঁজিতে লোক দৌড়িল। সে অধিক দূর যায় নাই। হাঁড়ী সহিত সকলে তাঁহাকে ধরিয়া আনিল। ব্যস্ত হইয়া কালিকা হাঁড়ী খুলিয়া দেখিলেন। হরি হরি! তিনি দেখিলেন যে, সন্দেশের নিয়ে তিনি যে ভাবে গহনাগুলি সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন, সেইরূপ আছে। হাঁড়ী লইয়া আনন্দে তিনি মাতা ও ভুলোর সহিত দোতলায় আপনার ঘরে গমন করিলেন।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – আরব্য উপন্যাসের জিন

কেশব আর লুক্কায়িত হন নাই। ভিড়ের অন্য লোকের সহিত দাঁড়াইয়া তিনি সমুদয় ঘটনা দেখিতেছিলেন। ঢাকমহাশয়ের দৃষ্টি তাঁহার উপর পড়িল। ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া তিনি তাঁহাকে গাল দিতে লাগিলেন। তিনি বলিলেন,–দূর হঃ, দূর হঃ! বোগদাদি মোল্লা আসিয়া আজ আমার হিন্দুধর্ম্ম নষ্ট করিল। এইরূপ বলিতে বলিতে তাঁহার রাগ দাবানলের ন্যায় আরও জুলিয়া উঠিল। কেশবকে তিনি একপাটি জুতা ছুড়িয়া মারিলেন।

কেশব ধীরে ধীরে বলিলেন,–আপনি আমার পিতৃস্থানীয় গুরুজন। আমি প্রত্যুত্তর করিব না। চারিদিন পরে আপনার কন্যাকে ও আমার পুত্রকে আমি লইতে পাঠাইব, পাঠইয়া দিবেন। না পাঠাইলে আপনাকে অনুতাপ করিতে হইবে।

এই কথা বলিয়া কেশব চলিয়া গেলেন। কেশব তখনও বাড়ীর বাহির হন নাই। এমন সময় ঢাকমহাশয়ের সম্মুখে মাথায় পাগড়ী, বুক পর্যন্ত দাড়ি, ইজের পরা প্রকাণ্ড এক জিন আসিয়া দাঁড়াইল। জিন ঠিক দৈত্য নহে। আমাদের দেশে যেরূপ যক্ষ রক্ষ অপ্সর কিন্নর গন্ধর্ব আছে, বোগদাদ অঞ্চলে সেইরূপ জিন নামক এক প্রকার ভৌতিক বায়বীয় জীব আছে। জিনকে দেখিয়া সকলে ভয়ে রুদ্ধশ্বসে পলায়ন করিল। কেবল আমি ডমরুধর ভয় পাইলাম না। অনেক ভূত-প্রেতের সহিত আমি কারবার করিয়াছি। ঢাকমহাশয়ের নিকট গট্‌ হইয়া বসিয়া রহিলাম।

জিনটির কথা আমি এইরূপ শুনিলাম। একদিন কেশব ছিপ ফেলিয়া তাইগ্রিস নদীতে মাছ ধরিতেছিলেন। হঠাৎ তাঁহার বঁড়শীতে কি লাগিয়া গেল। সাবধানে উপরে তুলিয়া দেখিলেন যে, তাহা এক তাম্র-নির্ম্মিত হাঁড়ী। তামার ঢাকনা দ্বারা হাঁড়ীর মুখ বন্ধ। সেই ঢাকনের উপর হিজিবিজি লেখা আছে ও তাঁহার উপর সিলমোহর আছে। হাঁড়ীর ভাব দেখিয়া তাঁহার আরব্য উপন্যাসে বর্ণিত ধীবরের কথা স্মরণ হইল। তিনি ভাবিলেন যে, ঢাকনা খুলিলে হয় তো হাঁড়ীর ভিতর হইতে প্রথম ধূম বাহির হইবে। তাহার পর সেই ধূম জিনের আকার ধারণ করিবে, তাহার পর জিন আমাকে বধ করিতে চাহিবে। এই ভয়ে তিনি তিনদিন হাঁড়ীর ঢাকনা খুলিলেন না। ইচ্ছা তাঁহার মনে অতিশয় প্রবল হইল। ছুরি দিয়া অতিকষ্টে তিনি ঢাকনা খুলিলেন। তাহার পর যে ভয় করিয়াছিলেন, তাহাই হইল। হাঁড়ী হইতে প্রথম ধূম বাহির হইল; ধূম গাঢ় হইয়া প্রকাণ্ড জিনে পরিণত হইল। কেশব ঘোতর ভীত হইল। কিন্তু জিন তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আলাদিন কোথায়? প্রদীপের সে জিন কোথায়। আলাদিনের নিমিত্ত মুণিমুক্তাখচিত অট্টালিকা প্রস্তুত করিতে প্রদীপের জিন আমাকে নিযুক্ত করিয়াছিল। মজুরি হিসাবে তাঁহার নিকট আমার এক সহস্র দিনার বা টাকা পাওনা আছে। সেই কথা লইয়া তাঁহার সহিত আমার বিবাদ হইয়াছিল। সেজন্য প্রদীপের জিন আমাকে তামার হাড়ীতে বন্ধ করিয়া সিলমোহর করিয়া তাইগ্রিস নদীতে নিক্ষেপ করিয়াছিল। এখন তাঁহার নিকট হইতে আমি আমার টাকা আদায় করিব।কেশব বলিলেন,—আমি বিদেশী লোক। আরব্য উপন্যাসের সে আলাদিন কোথায়, তাঁহার সে প্রদীপের জিন কোথায়, তাহা আমি জানি না।

জিন বলিল,—আমি আলাদিনকে ও প্রদীপের জিনকে খুঁজিয়া বাহির করিব। কিন্তু প্রথম আমি তোমার উপকার করিব। কারণ, তুমি আমাকে জল হইতে তুলিয়াছ; হাঁড়ি হইতে বাহির করিয়াছ। তোমার সহিত তোমার দেশে আমি যাইব। নানা বিপদ হইতে তোমাকে আমি রক্ষা করিব। তাহার পর তোমাকে লইয়া এ দেশে পুনরায় ফিরিয়া আসিব। সেই হাজার দিনার আদায় করিয়া তোমাকে আমি দিব। কেশবের সহিত জিন সেই জন্য বঙ্গদেশে আসিয়াছে।

জিন ঢাকমহাশয়ের দিকে ভয়ঙ্কর কোপদৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। তাঁহার চকু দুইটি হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হইতে লাগিল। অবশেষে সে বলিল,–নরাধম কাফের! তুই আমার বন্ধুকে অপমান করিয়াছিস। একচক্ষু কাণা দামড়া গরুর আকৃতি ধারণ কর। তৎক্ষণাৎ ঢাকমহাশয় একচক্ষুহীন দামড়া গরু হইয়া গেলেন। সেই মুহূর্তে জিন অদৃশ্য হইয়া গেল।

ঘোর বিপদ দেখিয়া আমি দৌড়িয়া গিয়া পথে কেশবকে ধরিলাম। দুর্ঘটনার বিবরণ শুনিয়া তিনি বলিলেন,—শ্বশুরমহাশয়কে পুনরায় মানুষ করি, সে ক্ষমতা আমার নাই। জিন কেবল মাঝে মাঝে আমার নিকট আগমন করে। পুনরায় কবে আসিবে, তাহা জানি না। এইবার যেদিন আসিবে, তাঁহার হাতে-পায়ে ধরিয়া শ্বশুরমহাশয়কে ভাল করিতে চেষ্টা করিব।

এই কথা বলিয়া কেশব আপনার গৃহে চলিয়া গেলেন। এ স্থানে ঢাকমহাশয়ের বাড়ীতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। কালিকা কাঁদিতে লাগিলেন, সকলেই কাঁদিতে লাগিল। ঢাকমহাশয় হাঁ করিয়া দেখাইলেন যে, তাঁহার মুখ শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। আমি একহাড়ী ভাতের ফেন আনিয়া তাঁহার সম্মুখে ধরিলাম। ঢাকমহাশয় চো চো করিয়া তাহা খাইয়া ফেলিলেন। তাহা খাইয়া তাঁহার শরীর কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। আমরা তাঁহাকে ঘরের ভিতর লইয়া যাইতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তিনি পৈঠা উঠিতে সম্মত হইলেন না। অগত্যা তাঁহাকে গোয়ালে লইয়া যাইতে হইল। তাঁহার মুখের ভঙ্গী দেখিয়া আমি বুঝিলাম যে, তিনি আর সকলকে বলিয়া যাইতে বলিতেছেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া দর দর ধারায় অশ্রুপাত হইতে লাগিল। আমি তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া বলিলাম,–কিছু ভয় নাই, শীঘ্রই পুনরায় আপনি মনুষ্য-শরীর পাইবেন। আর যতদিন না পুনরায় আপনার মনুষ্য-শরীর হয়, ততদিন আপনাকে আমি ছাড়িয়া যাইব না।

রাত্রি নয়টার সময় আমি নিজহাতে খড় কাটিয়া তাঁহাকে জাব দিলাম। তার পর গোয়ালের দেয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া আমি ক্রমাগত মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম যে,–মা! তুমি আমাকে নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছ। আমার বুকে তুমি এ বিপদ হইতে রক্ষা কর। ইনি পূজা করিবেন না বলিয়াছেন। কিন্তু মা! ভাবিও না; যাহাতে ইনি এ বৎসর ঘটা করিয়া তোমার পূজা করেন, আমি সে ব্যবস্থা করিব।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ–আবার এলোকেশী

মা দয়াময়ী। মা আমার কান্না শুনিলেন। রাত্রি তিনটার সময় গোয়ালে অন্ধকারে বসিয়া আমি একটু চক্ষু বুজিয়াছি, এমন সময় মা আমাকে দর্শন দিলেন।

মা বলিলেন,–ডমরুধর! তুমি আমার বরপুত্র, কিছু ভয় নাই। সরস্বতীর কৃপায় তোমার মুখ হইতে জিলেট মন্ত্র বাহির হইয়াছিল, সেই মহামন্ত্রের প্রভাবে তুমি ঢাকের পশুত্ব মোচন কর। কুন্তলাকে উদ্ধার কর, কেশবকে সমুদ্রযাত্রাজনিত পাপ হইতে মুক্ত কর। সমুদ্রযাত্রা তো সামান্য কথা। জিলেট মন্ত্র প্রভাবে মানুষের সকল পাপ দূর হয়। এই মহামন্ত্রের মহিমা অপার। জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।

এইরূপ উপদেশ দিয়া মা অন্তর্ধান হইলেন। প্রাতঃকালে উঠিয়া আমি প্রথমে স্নান করিলাম, শুচি হইয়া গোয়ালে প্রবেশ করিয়া একচক্ষুহীন দামড়া গরুর অর্থাৎ ঢাকমহাশয়ের গায়ে হাত বুলাইয়া আমি জিলেট মন্ত্র পাঠ করিতে লাগিলাম।

জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ, সাতবার এই মহামন্ত্র পাঠ করিতেই ঢাকমহাশয়ের দামড়া রূপ ঘুচিয়া পুনরায় মনুষ্যরূপ হইল।

তাহার পর জিলেট মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে আমি ঢাকমহাশয়ের বাড়ী তিনবার প্রদক্ষিণ করিলাম। তৎক্ষণাৎ আকাশ হইতে পুষ্পক বথ নামিয়া আসিল। সেই রথে চড়িয়া কুন্তলা স্বর্গে গমন করিলেন। জিলেট মন্ত্রের এমনি প্রভাব।

জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিশ।

ঢাকমহাশয়ের পুনরায় মা দুর্গার প্রতি অসীম ভক্তি হইল। তিনি প্রতিমা গঠনের নিমিত্ত আদেশ করিলেন ও মহাসমারোহে পূজার আয়োজন করিতে লাগিলেন। জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।

জামাতা কেশবকে তিনি ডকিতে পাঠাইলেন। জিলেট মন্ত্রে তাঁহার গায়ে হাত বুলাইয়া আমি তাঁহাকে সকল পাপ হইতে মুক্ত করিলাম। শ্বশুর-জামাতায় অক্ষুণ্ণ অপরিসীম স্নেহমমতা ও সদ্ভাব হইল। জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।

দুই চারিদিন পরে জিন আসিয়া উপস্থিত হইল। সে বলিল,–এই যে ডমরুমহাশয়, মনুষ্য মধ্যে ইনি রত্নবিশেষ। ইনি জিলেট মন্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছেন। সেই মহামন্ত্রবলে ইনি না পারেন, এমন কাজ নাই। আজ রাত্রিতে ইহাকে আমি শাহাজাদি দিনারজাদি নাচ দেখাইব। পুস্তকে লেখা আছে যে, শাহারজাদি গল্প বলিয়া বাদশাহকে বশ করিয়াছিলেন। সে মিথ্যা কথা। দুই ভগিনীর নাচ দেখিয়া বাদশাহ বশ হইয়াছিলেন।

সেই রাত্রে আমি পুনরায় ঢাকমহাশয়ের বাড়ী গমন করিলাম। রাত্রি নয়টার সময় দুইজন পরমা সুন্দরী রমণীর সহিত জিন আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই দুইটি রমণী আমাদের সম্মুখে নানা ভাব-ভঙ্গী করিয়া নাচিতে লাগিল। কেবল ঢাকমহাশয়, কেশব ও আমি সে নাচ দেখিয়াছিলাম। রমণী দুইটির অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য ও অদ্ভুত নাচ দেখিয়া আমার মুণ্ডু ঘুরিয়া গেল। দুর্লভী বাগদিনীকে আমি ভুলিয়া যাইলাম।

নাচ সমাপ্ত হইলে জিন বলিল,–আজ রাত্রিতেই আমরা বোগদাদে গমন করিব। ডমরুমহাশয় ও কেশবকে সঙ্গে লইয়া যাইব। বায়ুরূপে উডিয়া মুহূর্ত মধ্যে আমরা সে স্থানে পৌঁছিব। সে স্থানে গিয়া ডমরুমহাশয়ের সহিত শাহারজাদির নিকা দিব ও দিনারজাদির সহিত কেশবের বিবাহ দিব। সে প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম। কিন্তু আমি বলিলাম যে, এলোকেশীর মত না লইয়া আমি যাইতে পারিব না। কারণ, তাঁহাকে যদি না বলিয়া যাই, তাহা হইলে পৃথিবী খুঁজিয়া তিনি আমাকে বাহির করিবেন। আর মাথার টাক হইতে পায়ের অঙ্গুলি পর্যন্ত তিনি আমাকে ঝাঁটা পেটা করিবেন।

জিন এলোকেশীকে ডাকিতে পাঠাইল। ঝাঁটা হাতে করিয়া নিবিড় তিমির দ্বারা গঠিত শরীরে জবাকুসুমসম লোহিত লোচনে এলোকেশী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়াই জিনের মুখ শুষ্ক হইয়া গেল। তাহার পর শাহারজাদির সহিত আমার নিকার প্রস্তাব শুনিয়া যখন এলোকেশী জিনকে ঝাঁটা পেটা করিতে দৌড়িলেন তখন জিন, শাহারজাদি ও দিনারজাদির শবীর গলিয়া ধূমে পরিণত হইল। ধূম বাতাসে মিশিয়া গেল। সেইদিন হইতে তাঁহারা কোথায় যে পলায়ন করিল, তাহা কেহ জানে না। কেশবের নিকট জিন আর আসে না।

যাহা হউক, ঢাকমহাশয় এ বৎসর ঘোর ঘটা করিয়া দুর্গোৎসব করিলেন।

লম্বোদর বলিলেন,—আচ্ছা আজগুবি গল্প তুমি বানাইতে পার।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—সকলই মহামায়ার মায়া।

জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত