বাদশাহ নামদার ইতিহাস আশ্রিত ফিকশন। ইতিহাসের কোনো চরিত্রকে নিয়ে, সরাসরি নিয়ে, এই প্রথম (এবং এই শেষ?) কোনো উপন্যাস রচনা করলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেটা আবার হুমায়ূন মীর্জার মতো ‘বহু বর্ণে’র একজন সম্রাটকে নিয়ে। কবি, চিত্রকর, সংগীতরসিক, নেশাসক্ত, একসেনট্রিক এবং তীব্র আবেগপূর্ণ এই সম্রাটের চরিত্র। ‘রক্তের রঙের চেয়ে বৃক্ষের সবুজ রং কি কম সুন্দর?…’ গান শুনে মুগ্ধ হয়ে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে দিতে পারেন ইনি, ক্ষমা করে দিতে পারেন নিজের রক্তপিপাসু ভাইকে, কথা দিয়েছিলেন বলে, আধা দিনের জন্য সম্রাটের আসনে বসাতে পারেন সামান্য এক ভিস্তিঅলাকে।বাদশাহ নামদার বইয়ের ১৩৬ পৃষ্ঠায় স্ত্রী হামিদা বানু এই সম্রাটকে বলছেন, ‘আপনি দুর্বল সম্রাট; কিন্তু অত্যন্ত সবল একজন কবি।’ ৭৩ পৃষ্ঠায় শত্রু শের খাঁ (শের শাহ) বলছেন, ‘তিনি মহান মানুষদের একজন। এই মানুষটির অন্তর স্বর্ণ খণ্ডের মতো উজ্জ্বল। সেখানে কলুষতার কণামাত্রও নেই।’ হুমায়ূন আহমেদের সম্রাট হুমায়ূন মূলত এই ‘মহান মানুষদের একজন।’ সম্রাট হয়েও রক্ত-মাংসের অসাধারণ একজন মানুষ। কাহিনিতে চরিত্র অসংখ্য। সম্রাট হুমায়ূন এবং তাঁর আত্মীয়-পরিজন, সেনাপতি বৈরাম খাঁ, জওহর আবতাবচি, শত্রু শের শাহ, হেরেমের বাদী আসহারি, আচার্য হরিশংকর, পারস্য-সম্রাট, অম্বা…। কাহিনির শাখা-প্রশাখারও শেষ নেই। মনে রাখতে হবে, এই কাহিনি বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অধ্যায়। সিদ্ধ না হলে নাড়াচাড়া দুরূহ। এ ধরনের ঐতিহাসিক কাহিনি নিয়ে যখন উপন্যাস লেখেন কোনো লেখক, কী করেন? পুনর্নির্মাণ করেন আখ্যানের, পুনর্জন্ম দেন প্রতিটি চরিত্রের। পুনর্জন্ম। এ না হলে হয় না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না কাহিনির। আর সময়। সময়কেও পল অনুপল ধরে আবার নির্মাণ করতে হয় লেখককে। দূর অতীতকাল পুনর্নির্মাণ। সামান্য বিচ্যুতি হলেও মুশকিল। আর, পিরিয়ড পিসের সম্রাট আকবরকে সুদর্শন হূতিক রোশন হলেও হয় না। সে সিনেমা হোক কিংবা সাহিত্যে। বিশ্বস্ততা অতীব জরুরি। বাদশাহ নামদার-এ হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় সতর্ক এবং বিশ্বস্ত। চরিত্র-চিত্রণ, কাহিনি বিন্যাসে। সেই সময়ের পুনর্নির্মাণে। তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে বাদশাহ নামদার এ জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। ‘রং চড়াতে’ হয়নি বলেছেন কিন্তু রঙের প্লেট তাঁর হাতে এবং আশ্চর্য পরিমিত তিনি। চমৎকার উদাহরণ হতে পারে, সতীদাহ প্রথার দৃশ্যটি কিংবা অম্বা, আকিকার মৃত্যু, কিংবা জোছনা রাতে পত্নী হামিদা বানুর সঙ্গে সম্রাট হুমায়ূনের কথোপকথনের বিষণ্ন দৃশ্য। মনে হবে লেখক স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন সব দৃশ্যে। ভাষা নিয়েও এই উপন্যাসে যথেষ্ট নিরীক্ষাপ্রবণ হুমায়ূন আহমেদ। আলাদা আদলের এক ভাষায় লিখেছেন, সচরাচর যে ভাষায় তিনি লেখেন না। এটা কাহিনির প্রয়োজনেই। এবং অব্যর্থ হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর ভাষা এমনিতেই মায়াবী। গাঁওগেরামের মানুষেরা যে রকম, বকুল ফুলের গাছবাহিত চৈত্রের আশ্চর্য হাওয়ার কথা বলেন, তেমনি একটা মায়া থাকে তাঁর ভাষায়। বাদশাহ নামদার-এও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে বাদশাহ নামদার-এর ভাষা একই সঙ্গে রুদ্ধশ্বাসও। থ্রিলারের মতো। ঘটনার পর ঘটনা এবং চরিত্রের পর চরিত্র আসছে, একটা কোথাও তাল লয় কাটেনি একটুও। লক্ষণীয় আরেকটা বিষয়। সম্রাট হুমায়ূনের মৃত্যুদৃশ্য। লেখক এর বিতংবর্ণনায় যাননি। ‘পরিশিষ্টে’র একটা বাক্যাংশ শুধু, ‘সম্রাটের মৃত্যুর পর…।’ বিশেষ তাৎপর্য মণ্ডিত এটাও। বোঝা যায় লেখক নিশ্চিত যে কতটুকু তিনি লিখবেন এবং কতটুকু না লিখবেন। সব মিলিয়ে বাদশাহ নামদার একটা মোগল মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের মতো। সূক্ষ্ম, ডিটেইল। পরিমিত, পরিণত এবং দ্যুতিময়। বইয়ের ফ্ল্যাপে একটা শের আছে, ‘যদিও দর্পণে আপন চেহারা দেখা যায় কিন্তু তা পৃথক থাকে নিজে নিজেকে অন্যরূপে দেখা আশ্চর্যের ব্যাপার। এ হলো আল্লাহর অলৌকিক কাজ।’ সম্রাট হুমায়ূনের লেখা শের এটা। সম্রাট না, কবি হুমায়ূন। কবি, চিত্রকর, শিল্পের সমঝদার, মূলত একজন মানুষের কাহিনিই বিধৃত বাদশাহ নামদার-এ। মানুষের জয় হোক। আফসোস বইটি প্রকাশের পর হুমায়ূন আহমেদ পত্রিকায় মুদ্রিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ ধরনের লেখা আর তিনি লিখবেন না! যাক। কিছু আফসোসও আসলে মধুর। আপাতত এই আফসোস বাদ দিয়ে, ‘আসুন, আমরা বাদশাহ নামদারের জগতে ঢুকে যাই। মোগল কায়দায় কুর্নিশ করে ঢুকতে হবে কিন্তু। নকিব বাদশাহর নাম ঘোষণা করছে— “আল সুলতান আল আজম ওয়াল…।” কুর্নিশ বাদশাহ নামদার-এর লেখককে।’ আলোচনাটি লিখেছেন ধ্রুব এষ।
গল্পের বিষয়:
গল্প