স্টেশনে দরিদ্র মানুষ

স্টেশনে দরিদ্র মানুষ

ঘড়ির কাটায় প্রায় রাত ১২ টা, স্টেশনে বসে আছি তবে একা নই, কয়েক জন হত দরিদ্র মানুষ বস্তা মুড়ি দিয়ে নিঘোর ঘুমে এবং অল্প কিছু দূরে একটা চায়ের দোকান যার একটা অংশ এখনো খোলা, সেখানে এক জন বৃদ্ধ লোককে দেখা যাচ্ছে, উনি কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। শীতকাল, চারিদিকে কুয়াশা আর সাথে হাড় কাঁপানো হিম বাতাসতো আছেই। ওয়েটিং রুমের জালানাটা যদিও লাগানো তবে নিচে কপাটগুলো ভাঙ্গা সেখান দিয়েই হু হু করে শীতল বাতাস আসছে। আমি এই স্টেশনে

পৌঁছেছি প্রায় ২ ঘন্টা আগে যদিও আমার পৌছার কথা বিকেলে । আমাকে রিসিভ করার কথা একজনের কিন্তু স্টেশনে নেমে উনাকে দেখতে পেলাম না। অবশ্য এতো রাতে উনাকে না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বেচারা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চলে গেছেন, উনি হয়তো ভেবেছেন আজ ট্রেন আসবে না। ট্রেনে এটাই আমার সবচেয়ে বিরক্তিকর ভ্রমণ। যাই হউক এখন ভোরের অপেক্ষায় আমি, আলো ফোটলেই উনার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো, যদিও এটাই আমার প্রথম যাত্রা উনার বাড়িতে তবে ঠিকই চিনে নিবো আমি।

আমার ফোনটা বন্ধ, চার্জ শেষ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস স্টেশনে নেমেই মায়ের সাথে কথা বলেছিলাম না হলে মা চিন্তা করতেন, যদিও উনাকে এই ঝামেলার কথা জানাইনি। হিম বাতাসে হাত-পা জমে যাওয়ার মতো অবস্থা প্রায়, একটু চা হলে মন্দ হয় না এখন। আমি ওয়েটিং রুমটা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কয়েকটা কুকুর গা এলিয়ে শুয়েছিলো আমার পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকালো । আমি তাদের পাশ কাটিয়ে চলে এলাম চায়ের দোকানটাতে। এক বার চোখ বুলিয়ে নিলাম দোকানটাতে, স্টল টা ছোট তবে মোটামুটি সব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আছে এতে। একটা বালিশ ও তোষক দেখলাম এক পাশে, উনি এখানেই থাকেন তা স্পষ্ট। স্টলটির এক পাশের কপাট ভেজানো শুধু একটা কপাট খোলা, এক মধ্যবয়সী লোক বসে আছেন। আমাকে দেখে উনি আধশোয়া থেকে উঠে বসলেন, বললেন

— ট্রেন লেইট করেছে তাই না?

– জ্বী

— কোথায় যাবে বাবা ?

– জনাব জগলু মাহমুদের বাড়িতে ।

— ও

উনার ” ও ” শব্দটাতে তাচ্ছিল্য ছিলো সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি তার পরেও কিছু না বুঝার ভান করে বললাম,
– আমি একটু চা খাবো চাচা।

এটা শুনার পর, উনি নিঃশব্দে কেরোসিনের চুলোর উপরে রাখা ভাতের হাড়িটা নামিয়ে চায়ের কেতলি বসালেন। এটা দেখে বললাম,

– চা শেষ

— না আছে, আসলে ভাত রান্না করতেছিলামতো তাই।

কিচ্ছুক্ষণ পর উনি কেতলি থেকে চা ঢেলে তাতে চিনি মিশাতে লাগলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনি এখানেই থাকেন?

— হ্যা বাবা, একা মানুষ এটাই বেঁচে থাকার এক মাত্র সম্বল এবং আমার চৌচালা।

উনি চা বানিয়ে যখন নিয়ে আসতে চাইলেন তখন ছোট দরজারটার পাশে রাখা ক্র্যাচটার দিকে আমার চোখ গেলো, উনার এক পা নেই। বিষয়টা আমি এতো সময় বুঝতেই পারিনি,

আমি উঠে গিয়ে নিজেই চা নিলাম উনার হাত থেকে। আমি নিঃশ্বব্দে চা খাচ্ছি, উনিও নিরব কিন্তু বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি উনার চোখে কিছু প্রশ্ন দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– চাচা কিছু বলবেন?

উনি কিছু বললেন না, ভাতের হাড়িতে উনার মন। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের দেখলেই ভিতরে একটা সম্মান জাগ্রত হয় এই মানুষটা ঠিক সেই রকম। কপালের মাঝখানের দাগটা জানান দিচ্ছে উনি কখোনই নামাজ ক্বাজা করেন না। হঠাৎ করেই উনি প্রশ্ন করলেন,

— আচ্ছা জগলু মাহমুদ আপনার কি হয়??

আমি উনার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম তবে কিছু বললাম না। উনি আবার প্রশ্ন করলেন,

— উনার সাথে কি কাজ বাবা তোমার?

আমি উনার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম, উনি বললেন,

— তোমাকে একটা জিনিস বলতে চাই

– জ্বী চাচা বলেন

— ১৩ই সেপ্টেম্বর, সালটা ১৯৭১। আমরা মোট ১৯ জন এগিয়ে চলেছি বাঁশখালির দিকে, আমাদের অপারেশন বাঁশখালির পাশের গ্রাম জমশেদ পুরের প্রাইমারি স্কুলে। ঐখানেই হানাদার কুত্তারা ঘাটি গেড়েছে।

– আপনি মুক্তিযুদ্ধা !!!!

আমার কথায় উনি কর্ণপাত করলেন না, উনি বলেই চলেছেন

— অপারেশনের সব কিছু প্ল্যান মতোই চলছিলো শুধু ওদের সৈন্য সংখ্যা আমাদের হিসাবের অনেক বেশি ছিলো আর ভারী অস্ত্রতো ছিলোই। আমাদের কয়েটা হালকা মেশিনগান, কয়েকটা এল.এম.জি এই ব্যস। আমাদের প্রথম আক্রমণে ওরা ইতস্তত হয়ে গেলো কিন্তু যখন পাল্টা আক্রমণ করলো প্রায় ১৫ মিনিট আমরা টিকে ছিলাম কিন্তু এর পর আর পেরে উঠতে পারিনি।

ঐ খানেই ১৩ জন শহীদ হলো, আমাদের ৬ জন ধরা খেলো। ঐ ৬ জনের আমিও একজন। ৪ দিন ওরা আমাদের টর্চার করা হলো,এর বর্ণনা আমি তোমাকে দিতে পারবো না বাবা। ৪দিন পর, আমাদের সারিবদ্ধভাবে নদীর তীরে দাড় করিয়ে গুলি করা হলো, কপাল খারাপ কারন আমার শরীরে লাগা গুলি গুলো আমার প্রাণ নিতে পারলো না তবে ডান পা উড়ে গেলো। জ্ঞান ফিরার পর দেখি নদীর ধারেই পরে আছি, তার বেশ কিছুক্ষন পর গ্রামের এক বৃদ্ধা মহিলা আমাকে উনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, আমি বেঁচে গেলাম।

আমি মুগ্ধ নয়নে উনাকে দেখছি, যেনো উনাকে দেখার জন্যই আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম। ভাবছি, উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা আর উনি কিনা চায়ের দোকান চালান। তখন উনি বলে উঠলেন,

— পাকিস্তানি ক্যাম্পে বেশ কয়েকজন রাজাকারারের আনাগোনা দেখেছিলাম তখন তার মধ্যে এক জন হচ্ছে রমিজ রাজাকার। সে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে যুদ্ধের সময়, অনেক মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে সে। অথছ আজ সে কতো ভালো আছে, জানো বাবা বর্তমান প্রজন্মটামে মাঝে মাঝে সার্থক মনে হয় আবার মাঝে মাঝে মনে হয় এরা অনেক অকৃতজ্ঞ।

– ঐ রাজাকার এখন কোথায়, মারা গেছে?

— তুমি তার কাছেই যাচ্ছো বাবা।

এটা বলেই তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তবে আমি অবাক হলাম না কারন আমি জানি জগলু মাহমুদ এক জন রাজাকার তবে তিনিই যে রমিজ রাজাকার হবেন তা ভাবিনি। উনার সাথে আরো অনেক কথা হলো, উনার স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক হলো আর কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। আমার সম্পর্কেও উনি অনেক কিছু জানতে চাইলেন, কি করি? কোথায় থাকি? ইত্যাদি, আমি প্রায় সবকথার উত্তর দিলাম উনাকে। একটা পর্যায়ে উনি আবার জানতে চাইলেন,

— জগলু মাহমুদের কাছে তুমি কি জন্য আসছো বাবা?

উনার প্রশ্নেটা এবার আর এড়িয়ে গেলাম না, সোজা উত্তর দিলাম,

– চাচা, আমি উনার কাছে এসেছি একটা প্রায়শ্চিত্ত করতে। বর্তমান প্রজন্মের একটু দায়ভার কমাতে।

উনি ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কথায় কথায় রাত কেটে গেলো, এক পর্যায়ে ফজরের আযান দিলো, উনি নামায নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমিও উনার ছোট স্টল ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। স্টেশনের চারিদিকে পাখির কলকাকলি চারিদিকে সাথে হিম হিম ঠান্ডা বাতাস। এর বেশ কিছু সময় পর কালাম ভাইকে দেখতে পেলাম, উনার গতকাল আমাকে রিসিভ করার কথা ছিলো তার পর আমি আমার গন্তব্যে পৌছালাম।

জগলু মাহমুদের বাড়িটা খুব সাজানো গোছানো আর নিরিবিলি। আমাকে ভিতরের একটা রুমে নেয়া হলো। কক্ষটা বেশ দামী দামী ফার্নিচারে সাজানো, দেয়ালে বড় বড় পেইন্টিং ঝুলানো আর বড় একটা বুক সেলফে দেশি বিদেশি লেখকদের অনেক গুলো বই। আমি বসে আছি, যতটুকু জানি উনি একজন মাতব্বর আর গ্রামের মাতব্বর হিসেবে যথেষ্ট প্রভাব উনার এই গ্রামে। দীর্ঘ সময় পর উনার সাক্ষাত পেলাম। আমাকে দেখে উনি বললেন,

— রূদ্র আসছিস তুই ??

– প্লিজ আমাকে ঐ নামে ডাকবেন না কারন এই নামটা আমার মায়ের দেয়া,এই নামটা আপনার মুখে মানায় না।

— তুই তোর মায়ের মতোই হয়েছিস প্রচন্ড একরোখা আর জেদী।

– হ্যা, আমি মায়ের ছেলে তাই মায়ের মতোই হবো স্বাভাবিক।

— কয়েক দিন থাকবিতো??

– না, আজই চলে যাবো। আপনাকে শুধু একটা প্রশ্ন করতে চাই

উনি আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন, আমি উনাকে সেই প্রশ্নটা করলাম যা ছোট বেলা থেকে লালিত আমার বুকের পাজরে,

– আপনার কাছে কি অপরাধ করেছিলো এই দেশের নিরীহ মানুষ গুলো? যাদের কুকুরের মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কি অপরাধ ছিলো সেই মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা আজ পুঙ্গ?

কি অপরাধ আমার, যে নিজের বাবার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি??

ছি ছি জগলু সাহেব ছি আমি উনার উত্তরের অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে এলাম। উনি আমার চলে আসার পথে হয়তো তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষন। আমার বুকটা হালকা লাগছে অনেকটা আজ, আমি সেই ছোট বেলা থেকে এই প্রশ্নগুলো করার জন্য অপেক্ষা করেছি। গত ২৩ টা বছর বয়ে বেড়িয়েছি এই অসয্য যন্ত্রনা আজ বিন্দু পরিমাণ হলেও ঋণ শোধ করলাম, পরবর্তী প্রজন্মকে এটাতো বলতে পারবো, যে একটা রাজাকার কে তার কৃতকর্মের জন্য কিছু প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু সে উত্তর দিতে পারেনি কারন সে উত্তরের অযোগ্য।

আমাকে আবার দেখে ঐ স্টলের চাচা অবাক হলেন বললেন,

— কি বাবা কাজ শেষ?

– জ্বী চাচা, একটা দায়ভার ছিলো আমার কাঁধে যা সারা জীবন বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আজ সেটা নেমে গেলো।

— তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না

– চাচা আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি।

— কি বাবা??

– জগলু মাহমুদ আমার বাবা।

উনি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আমি বললাম,

– চাচা, আপনাকে এক বার পা ধরে সালাম করতে চাই।

উনি কিচ্ছু বললেন না, আমি উনার অনুমতির অপেক্ষা না করে, স্টলের ভিতর ঢুকে পা ধরে সালাম করলাম।

– আসি চাচা, ভালো থাকবেন আপনি অনেক ভালো।

তার পর ফিরতে ট্রেনে ফেরা, ফেরার সময় উনার চোখে অশ্রু দেখতে পেয়েছি কিন্তু এই অশ্রু কিসের সেটা ঠিক বুঝলাম না তবে আমার চোখে যে জল ছিলো সেটা যে কিসের তা সহজেই বুঝতে পারলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত