গুরুদেব
রবীন্দ্রনাথের শিষ্যদের ভিতর সাহিত্যিক হিসাবে সর্বোচ্চ আসন পান শ্ৰীযুক্ত প্রমথনাথ বিশী। তিনি যে রকম রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি, তেমনি বিধিদাত্ত রসবোধ তার আগের থেকেই ছিল। ফলে তিনি সরস, হালকা কলমে রবীন্দ্ৰনাথের দৈনন্দিন জীবন, খুশ-গল্প, আড্ডা-মজলিস সম্বন্ধে যা লিখেছেন তারপর আর আমার কিছু লিখবার মত থাকতে পারে না। কারণ বিশীদা যে মজলিসে সবচেয়ে উচু আসন পেয়েছেন সে মজলিসে রবীন্দ্রনাথের শিষ্য হিসাবে। যদি নিতান্তই আমাকে কোনো স্তোকাসন দেওয়া হয় তবে সেটা হবে সর্বনিম্নে।
কিন্তু বহু শাস্ত্রে বিধান আছে সর্বজ্যেষ্ঠ যদি কোনো কারণে শ্রদ্ধাঞ্জলি না দিতে পারে, তবে দেবে সর্বকনিষ্ঠ। এই ছেলেধরার বাজারে কিছু বলা যায় না-গুরুদেবকে স্মরণ করার সময় আমরা সবাই একবয়সী ছেলেমানুষ, রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে আজকের শিশুবিভাগের কনিষ্ঠতম আশ্রমিক-কাজেই বিশীদার যদি ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে যায় তবে আমার আকন্দাঞ্জলির প্রয়োজন হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে মা ‘বসুমতীর’ কাছে এটি গচ্ছিত রাখছি।
ব্যাপকর্থে রবীন্দ্রনাথ তাবৎ বাঙালির গুরু, কিন্তু তিনি আমাদের গুরু শব্দার্থে। এবং সে গুরুর মহিমা দেখে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়েছি। ব্যক্তিগত কথা বলতে বাধো-বাধো ঠেকে কিন্তু এ স্থলে ছাত্রের কর্তব্য সমাধান করার জন্য বলি, শান্তিনিকেতন ছাড়ার পর বার্লিন, প্যারিস, লন্ডন, কাইরো বহু জায়গায় বহু গুরুকে আমি বিদ্যাদান করতে দেখেছি কিন্তু এ গুরুর অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে কারোরই তুলনা হয় না। কত বৎসর হয়ে গেল, কিন্তু আজও মনের পটের উপর রবীন্দ্রনাথের আঁকা কীটসের আটামের ছবি তো মুছে গোল না। কীটস হেমস্তের যে ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাকে যে আরও বেশি উজ্জ্বল করা যায়, এ কথা তো কেউ সহজে বিশ্বাস করবেন না। ইংরাজিতে প্ৰবাদ আছে, ‘You do not paint a lily’—তাই মনে প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। রবীন্দ্রনাথ কীটসের হেমন্ত-লিলিকে মধুরতর প্রিয়তর করতেন কোন জাদুমন্ত্রের জোরে?
তুলনা না দিয়ে কথাটা বোঝাবার উপায় নেই। ইংরেজি কবিতা পড়ার সময় আমাদের সব সময় মনে হয়, ইংরিজি কবিতা যেন রূপকথার ঘুমন্ত সুন্দরী। তার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করি, কিন্তু তার বাক্য-হাস্য-নৃত্য রস থেকে বঞ্চিত থাকি বলে অভাবটি এতই মৰ্মদ্ভদ হয় যে, শ্যামলী স্কুলাঙ্গী জাগ্ৰতা গীেড়াজার সঙ্গসুখ তখন অধিকতর কাম্য বলে মনে হয়।
রবীন্দ্রনাথের বর্ণনশৈলী ভানুমতী মন্ত্র দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃজনীশক্তি তাঁর সোনার কাঠির পরশ দিয়ে কীটসের হৈমন্তীকে জাগিয়ে দিয়েছিল আমাদের বিদ্যালয়ের নিভৃত কোণে। গুরুদেব কীটসের এক ছত্র কবিতা পড়েন, নিদ্রিতা সুন্দরীকে চোখের সামনে দেখতে পাই। তিনি তার ভাষার সোনার কাঠি ছোয়ান, সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তী নয়ন মেলে তাকায়। গুরুদেবের কণ্ঠে প্ৰাণ প্রতিষ্ঠার মন্ত্র উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, সুন্দরী নৃত্য আরম্ভ করে। গুরুদেব তাঁর বীণার তারে করাঙ্গুলিস্পর্শে ঝঙ্কার তোলেন, সুন্দরী গান গেয়ে ওঠে।
কীটস, শেলি, ব্রাউনিং, ওয়ার্ডসওয়ার্থকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এ ইন্দ্ৰজাল কতবার দেখেছি আর ভেবেছি, হায়, এ বর্ণনা যদি কেউ লিখে রাখত তাহলে বাঙালি তো তার রস পেতই, বিলেতের লোকও একদিন ওগুলো অনুবাদ করিয়ে নিয়ে তাদের নিজের কবির কত অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য দেখতে পেত। কিন্তু জানি ভানুমতীর ছবি ফটোগ্রাফে ওঠে না, গুরুদেবের এ বর্ণনা করো কলম কালিতে ধরা দেয় না। যেটুকু দিয়েছে সেটুকু আছে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের ভাণ্ডারে।
তারপর একদিন বেলজিয়মে থাকার সময় বিলেত যাবার দরকার হল। ইচ্ছে করেই যাওয়াটা পিছিয়ে দিলুম— তখন বসন্ত ঋতু। কীটসের ‘হৈমন্তী’র সঙ্গে দেখা হতে অনেক বাকি। সায়েব-মেমসায়েবরা অসময়ে দেখা করেন না।
বিলিতী হৈমন্তীকে দেখে মুগ্ধ হলুম, অস্বীকার করব না। কীটসের ফিরিস্তি মিলিয়ে নিখাঁশির বর্ণনা টায় টায় মিলে গেল, কিন্তু গুরুদেবের হৈমন্তীর সন্ধান পেলুন না। কীটসের সুন্দরীকে বার বার তাকিয়ে দেখি আর মনে হয়, আগের দিনের বেলাভূমিতে কুড়িয়ে-পাওয়া ঝিনুক ঘরের ভিতরে এসে স্নান হয়ে গিয়েছে। গুরুদেবের গীতিশৈলী পূর্বদিনের সূর্যাস্তের সময় যে লীলাম্বুজ নীলাম্বরের সৃষ্টি করেছিল, যার মাঝখানে এই শক্তিই ইন্দ্ৰধনু বৰ্ণচ্ছটা বিচ্ছুরিত করেছিল, গৃহকোণের দৈনন্দিনতার মাঝখানে সে যেন নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছে, ‘তুলসীর মূলে’ যে ‘সুবৰ্ণ দেউটি’ দশদিক উজ্জ্বল করেছিল। সেই দেউটি দেবপদস্পর্শলাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে স্নানমুখে আপন দৈন্য প্রকাশ করতে লাগল।
তারপর আরও কয়েক বৎসর কেটে গেল। হঠাৎ একদিন শ্ৰীযুক্ত অমিয় চক্রবতীর কাছ থেকে তার পেলুম, জর্মনির মারবুর্গ শহরে গুরুদেব আমাকে ডেকেছেন— জানতেন আমি কাছাকাছি আছি।
মারবুর্গের সে জনসভার বর্ণনা আমি অন্যত্র দিয়েছি। আজ শুধু বলি, গুরুদেব সেদিন যখন ‘ঘন ঘন সাপ খেলাবার বাঁশী’ বাজালেন তখন মারবুর্গের পরবে জমায়েত তাবৎ জার্মানির গুণী-জ্ঞানী মানী তত্ত্ববিদের সেরারা’ মন্ত্রমুগ্ধ সৰ্পের মত অপলক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। দীর্ঘ এক ঘণ্টাকাল গুরুদেব বক্তৃতা দিলেন,- একটি বারের মত সামান্যতম একটি শব্দও সেই সম্মিলিত যোগসমাধির ধ্যান-ভঙ্গ করল না। আমার মনে হল গুরুদেব যেন কোন এক অজানা মন্ত্রবলে সভাস্থ নরনারীর শ্বাস-প্ৰশ্বাস পর্যন্ত স্তম্ভন করে দিয়েছেন— ডাইনে বাঁয়ে তার শব্দটুকুও শুনতে পাই নি।
আমার মনে হয়েছিল, সভাগৃহ থেকে বেরুতে গিয়ে দেখব। সেই বিপুলকলেবর অট্টালিকা বাল্মীকিন্তুপে নিরুদ্ধ নীরন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সেই জনতার মাঝখানেই গুরুদেবকে প্ৰণাম করলুম- জানি নে তো কখন আবার দেখা হবে। এত সব গুণী-জ্ঞানীর মাঝখানে আমার জন্য কি আর বিশেষ সময় নির্দিষ্ট করা সম্ভবপর হবে? কিন্তু ভুলে গিয়েছিলুম গুরুদেবেরই কবিতা :–
আমার গুরুর পায়ের তলে
শুধুই কি রে মানিক জ্বলে?
চরণে তাঁর লুটিয়ে কাঁদে লক্ষ মাটি ঢেলারে।
আমার গুরুর আসন কাছে
সুবোধ ছেলে কজন আছে
অবোধ জনে কোল দিয়েছেন
তাই আমি তাঁর চেলারে।
বিশাল জনতার উদ্বেলিত প্ৰশংসা-প্ৰশস্তি পাওয়ার পরও, আমি যখন প্ৰণাম করে দাঁড়ালুম, তিনি মৃদুকণ্ঠে শুধালেন, ‘কি রকম হল?’
আমি কোনো উত্তর দিই নি।
শহরের উজির-নাজীর-কেটালরা গুরুদেবকে তার হোটেলে পৌঁছে দিলেন। আমি পরে সেখানে গিয়ে শ্ৰীযুক্ত চক্রবতীর কাছ থেকেই বিদায় নিতে চাইলুম। তিনি বললেন, ‘সে কি কথা, দেখা করে যান।’
আমি দেখা হবে শুনে খুশি হয়ে বললুম, ‘তাহলে আপনি গিয়ে বলুন।’
শ্ৰীযুক্ত চক্রবর্তী বললেন, ‘সে তো আর পাঁচজনের জন্য। আপনি সোজা গিয়ে নক করুন।’
গুরুদেব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবু হাসিমুখে বসতে বললেন। তারপর ভালো করে তাকিয়ে বললেন, ‘এত রোগ হয়ে গিয়েছিস কেন?’
আমি মাথা নীচু করে চুপ করে রইলুম।
কিছু কথাবার্তা হল। আমার লেখাপড়া সম্বন্ধে। যখন উঠলুম। তখন বললেন, ‘অমিয়কে ডেকে দে তো।’
চক্রবর্তী বলেন। গুরুদেব বললেন, ‘অমিয়, একে ভালো করে খাইয়ে দাও।’
জানি পাঠকমণ্ডলী এই তামসিক পরিসমাপ্তিতে ক্ষুব্ধ হবেন। কিন্তু সোক্রাতেসের চোখে যখন মরণের ছায়া ঘনিয়ে এল আর শিষ্যের কানের কাছে চিৎকার করে শুধালেন, ‘গুরুদেব, কোনো শেষ আদেশ আছে?’
তখন সোক্রাতেস বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। পরশুদিন যে মুরগিটা খেয়েছিলুম তার দাম দেওয়া হয় নি। দিয়ে দিয়ো।’ এই সোক্রাতেসের শেষ কথা।
সব দিকে যাঁর দৃষ্টি তিনিই তো প্রকৃত গুরু এবং তাও মৃত্যুর বহু পূর্বে।