মাধব – কি বলছেন মশাই আপনি, ভগবান কি নেই ?
নবীন — আমি শুনেছি যে, ভগবান নেই।
মাধব — ভগবান কোথায় গেছে?
নবীন — বোধ হয় যে, মারাই গেছে।
মাধব – কে বলেছে যে, ভগবান মারা গেছে, সংবাদদাতারা কেউ কি তার মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেছেন?
নবীন — না, তা কেউ দেখেনি, ভগবানের কোনো বন্ধু-বান্ধব এমনকি তার স্ত্রী-পুত্ররাও তার মৃত্যু দেখেনি। সকলেই বলে অনুমান করে, তবে অনুমানটা সত্যি।
মাধব – ঘটনার বিস্তারিত খবর কিছু শুনেছেন কি?
নবীন — শুনেছি বেচারা ডুবিয়ে বায়লা মাছ ধরতে গিয়েছিলো গাঙ্গে, আর ফিরে আসেনি। কতোদিন গত হলো, কেউ তাকে কোথাও দেখেনি এবং শোনেওনি কোথায়ও তাকে দেখেছে বলে। হয়তো ভগবান জগতে নেই।
মাধব — আহা, বেচারা যদি মাছ ধরতে গাঙ্গে না যেতো, তাহলে তাকে এভাবে কুমীরের হাতে প্রাণ দিতে হতো না।
নবীন — না, এভাবে বা এ সময় না হলেও অন্যভাবে বা অন্য সময় ভগবানের মৃত্যু হতো। এইতো কমাস আগে ঈশ্বর ধোপা কলেরা ও খোদা বকস বসন্ত রোগে মারা গেলো ঘরে বসেই।
ঘটনাটি বাস্তব, ঘটেছিল ১৩২০ সালের ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে, লামচরি গ্রামের নমঃ পাড়ায়। সেখানে নদীর পাড়ে অনেক নমঃশূদ্রের বাস। ভগবান হালদার ছিলো সে পাড়ার একজন অধিবাসী। পাড়ার লোকে তাকে ‘ভগবান বলে ডাকতো। একদিন ভগবান হালদার নদীতে গিয়ে বায়লা মাছ ধরবার জন্য জলে ডুব দিয়ে আর উপরে উঠলো না। সকলে স্থির করলে যে, নিশ্চয়ই ভগবানকে কুমীরে খেয়েছে। সে আর কখনো ফিরে আসবে না এবং আসেওনি আজ পর্যন্ত। প্রথমোক্ত আলোচনাটি সেই ভগবান হালদারের দূরবতী দুজন আত্মীয়বন্ধুর মধ্যে তার সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা।
সাধারণত হিন্দুরা ‘ভগবান এ নামটিকে ঈশ্বর-এর উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করে থাকে। আসলে ভগবান, ঈশ্বর, পরমেশ্বর বা নিরাকার ব্ৰহ্ম এক কথা নয়। ভগবান হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের একটি কুখ্যাত উপাধি মাত্র।
ইন্দ্র ছিলেন শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অতি উন্নত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। তাই তাঁর একনাম ‘দেবরাজ। কিন্তু দেবরাজ হলে কি হবে, তাঁর যৌন চরিত্র ছিলো নেহায়েত মন্দ। তিনি তাঁর গুরুপত্নী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করায় গুরুর অভিশাপে তাঁর সর্বাঙ্গে এক হাজার ‘ভগ স্ট্রেীযোনি) উৎপন্ন হয় এবং তাতে ইন্দ্রের নাম ‘ভগবান (ভগযুক্ত) হয়। অতঃপর উক্ত ভগ চিহ্নগুলো চক্ষুরূপ লাভ করলে ইন্দ্রের আর এক নাম হয় সহস্ৰলোচন। ভগবান শব্দটি হচ্ছে ইন্দ্রের ব্যভিচারের একটি স্মারকলিপি, নিন্দনীয় বিশেষণ। কিন্তু কুখ্যাত ভগবান আখ্যাটি পেয়েও তিনি তাঁর ব্যভিচারে ইস্তফা দেননি। কিকিন্ধ্যার (মধ্যভারত) অধিপতি রক্ষরাজের পত্নীর গর্ভে ‘বালী রাজের জন্ম হয়েছিলো ভগবান ইন্দ্রের ব্যভিচারের ফলে।
ভগবান ইন্দ্রের শেষ দেখা পাই আমরা পুরাণের পাতায় – হস্তিনাপুরে (পুরাতন দিল্লীতে) পাণ্ডুপত্নী কুস্তির গৃহে। সেখানে তাঁর অবৈধ যৌনাচারের ফলে কুস্তির গর্ভে জন্মলাভ করেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। এখানে ভগবান ইন্দ্রের আরো কিঞ্চিৎ পরিচয় দিচ্ছি।
ইন্দ্রের মাতার নাম অদিতি, পিতার নাম কশ্যপ এবং দাদা ছিলেন মরীচি। তাঁর ধর্মপত্নী শচীদেবী এবং ঔরসজাত সন্তান জয়ন্ত, ঋষভ ও সীদ্ধ। বাসস্থান ছিলো সুমেরু পর্বতের অমরাবতী নামক স্থানের এক রম্য বাগানে। স্থানটির নাম ছিলো নন্দন কানন (আলোচ্য সুমেরু পর্বত হচ্ছে হিমালয় পর্বতের অংশবিশেষ)।
পাণ্ডুপত্নী কুস্তিদেবীর বাসরঘর ছাড়া দীর্ঘ তিন-চার হাজার বছরের মধ্যে – আজ পর্যন্ত কোনো পুরাণে বা নতুনে কোথায়ও ভগবান ইন্দ্রের আর দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি তাঁর বাপ, দাদা, স্ত্ৰী-পুত্রেরও না। হয়তো ভগবান ইন্দ্রের মৃত্যু ঘটেছে সবংশে। নতুবা তেনজিং, হিলারী ইত্যাদি আধুনিক কালের পর্বতারোহীদের সাথে তাঁদের দেখা সাক্ষাৎ হতো। তবে ভগবান ইন্দ্র বা তার বংশাবলীর মৃত্যুও কেউ স্বচক্ষে দেখেনি, ভগবান হালদারের মৃত্যুর মতোই।
সহস্ৰ ভগ অঙ্গে থাকায় ইন্দ্রদেব ভগবান আখ্যা পেয়েছিলেন। কিন্তু মহাদেব শিবকেও ‘ভগবান বলা হয়, অথচ তার দেহে ‘ভগ ছিলো না একটিও। তত্ৰাচ তিনি ‘ভগবান আখ্যা প্রাপ্তির কারণ হয়তো এই যে, তিনি ছিলেন ভগবতীর স্বামী। স্বয়ং ভগযুক্তা বলেই দুর্গাদেবী হচ্ছেন ভগবতী এবং ভগবতী-এর পুরূেপে হয়তো শিব বনেছেন ভগবান। যদি তা-ই হয় অর্থাৎ ভগযুক্তা বলে দুর্গাদেবী ভগবতী হন এবং ভগবতীর স্বামী বলে শিব ভগবান হয়ে থাকেন, তাহলে জগতের তাবৎ নারীরাই ভগবতী এবং তাদের স্বামীরা সব ভগবান। কাজেই মানুষের জন্ম ও মৃত্যু মানে ভগবতী ও ভগবানেরই জন্ম-মৃত্যু। সুতরাং জগতে যতোদিন মানুষ আছে ও থাকবে, ততোদিন ভগবতী ও ভগবান আছেন ও থাকবেন। মানুষ না থাকলে থাকবে না জগতে ভগবতী বা ভগবান এবং ঘটবে তখন জগৎব্যাপী ভগবানের তিরোধান।
এতক্ষণ ‘ভগবান সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো। শব্দের অর্থ ও ব্যক্তি-রূপ যা-ই হোক না কেন, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করেই ভগবান শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু পুরাণ-শাস্ত্র ভগবান ইন্দ্রকে সৃষ্টিকর্তা বলে না, বলে ব্রহ্মাকে। আবার পৌরাণিক মতে ব্ৰহ্মার একজন স্ত্রী ও দুটি কন্যা ছিলো। স্ত্রীর নাম সাবিত্রী ও কন্যাদ্বয়ের নাম দেবসেনা ও দৈত্যসেনা। সুতরাং এ সৃষ্টিকর্তা ব্ৰহ্মাও ‘নিরাকার ঈশ্বর নন। এভাবে আদিমকাল থেকে সভাসভ্য মানব সমাজে কতো লোক যে কতোরূপে কতো সৃষ্টিকর্তা বা ভগবান সৃষ্টি করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এখানে কয়েকটি নমুনা দিচ্ছি।
১. প্রাচীন মিশরীয়দের কারো কারো মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন থোথ অর্থাৎ চন্দ্র এবং কারো মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন ‘রা বা ‘রে অর্থাৎ সূর্য দেবতা।
২ প্রাচীন ফিনিশীয়দের মতে সৃষ্টিকর্তার নাম ‘ক্ৰনস্থ। তার সামনে ও পেছনে চক্ষু এবং ছয়টি পক্ষ আছে। তার মধ্যে কয়েকটি সঙ্কুচিত ও কয়েকটি প্রসারিত।
৩. প্রাচীন ব্যাবিলনীয়দের মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন ‘অপসু ও তিয়ামত’। তারা হচ্ছেন জলদেবতা।
৪. আফ্রিকা মহাদেশের বন্য জাতিদের এক সম্প্রদায়ের লোকের বিশ্বাস — তাদের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন ‘মান্টিস জাতীয় পতঙ্গ। তারা ঐ জাতীয় কাগণ বা ‘ইকাগণ নামীয় পতঙ্গের পূজা করে থাকে।
৫. অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ভিক্টোরিয়া প্রদেশের আদিম অধিবাসীদের মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে পণ্ডজিল’ নামীয় পক্ষী।
৬. আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম তীরের থিলিঙ্কিট ইণ্ডিয়ানদের মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন ‘জেলা বা ‘জেলচ’ নামক দাড়কাক।
৭. উত্তর আমেরিকার আলগকিন জাতির মতে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন ‘মিকাবো’ নামক এক বৃহৎ খরগোস ইত্যাদি। কিন্তু ওদের এই সমস্ত সৃষ্টিকর্তা বা ভগবানগণের মধ্যে একমাত্র সূর্যদেব ছাড়া আর কেউই আজ পর্যন্ত জীবিত আছেন বলে মনে হয় না।
আদিম মানব সমাজে সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে উক্তরূপ শিশুসুলভ কল্পনা হাস্যকর হলেও ওর উৎপত্তির কারণ এখন আর অজ্ঞাত নয়। কোনো কোনো অবোধ শিশু যখন তার মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে, “মা আমি এলাম কোখেকে?” তখন তার মা একটু বেকায়দায় পড়ে যায়। কেননা শিশুর সৃষ্টি অর্থাৎ তার ভ্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে সে বিশেষ কিছুই জানে না, একমাত্র যৌনমিলন ছাড়া। আবার যেটুকু জানে, তা-ও প্রকাশ্যে বলতে পারে না। পক্ষান্তরে কিছু একটা না বললেও তার মুরুত্ববীয়ানা বজায় থাকে না। তাই আত্মমর্যাদা ও মুরুত্ববীয়ানা বজায় রাখার জন্য মা শিশুকে বলে – তুমি আকাশ থেকে পড়েছে, তোমাকে পড়ে পেয়েছি বাগানে, তোমার বাবা তোমাকে কিনে এনেছে বাজার থেকে ইত্যাদি। তখন সরলমনা শিশু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তার মায়ের বাণী। এভাবেই তৈরী হচ্ছিলো আদিম মানবদের ঐসব ঈশ্বর ও জগত সৃষ্টির উপাখ্যানগুলো মানুষের জাতীয় জীবনের শৈশবে। কিন্তু কোনো শিশু যদি মাতৃভক্তির আতিশয্যে যৌবনেও তার মায়ের ঐসব বাণী বিশ্বাস করে, তবে সে দুটি খেতাব পেতে পারে ; তার একটি হচ্ছে মাতৃভক্ত অপরটি ‘উন্মাদ।
মানুষের জাতীয় জীবনের শৈশবে তৎকালীন অঞ্চলবিশেষের গোষ্ঠিপতি, মোড়ল বা সমাজপতিরা শিশুর মায়ের মতোই বুঝিয়েছেন অবোধ জনসাধারণকে বিশ্বসৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে নানান কালপনিক কাহিনী, যা বিশ্বাস করেছে তারা মনেপ্রাণে শিশুদের মতোই। বিশেষত পরবর্তীরা তা উপভোগ করেছে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মতো।
মানুষের জাতীয় জীবনের কৈশোরে আগেকার মতবাদগুলো আর পুরোপুরি বজায় থাকলো না, কিছুটা মার্জিত রূপ নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করলে ধমীয় মতবাদরূপে। তখন সৃষ্টিকর্তা আবির্ভূত হলেন — পরমেশ্বর, পরমপিতা, যিহোভা, অহুরমযদা ইত্যাদি, শেষমেশ নিরাকার ব্রহ্ম। তা হলো যেনো ঝোপ কেটে জঙ্গল রোপণ করা। আর আজও মহান তপস্বীরা সগৌরবে বাস করেন (তাঁদের মনোরম) সেই জঙ্গলে।
মানুষের জাতীয় জীবনের যৌবনে বিংশ শতকের এ বিজ্ঞানের যুগেও বিজ্ঞানীরা যখন পদার্থের পরমাণু ভেঙ্গে তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন, মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছেন এবং প্রস্তুতি নিচ্ছেন গ্রহান্তরে যাবার জন্য, তখনো তপস্বীরা গবেষণা চালাচ্ছেন ‘মার্গ দিয়ে বদবায়ু বেরুলে তাতে ভগবানের আরাধনা চলে কি-না — এই জাতীয় ব্যাপার নিয়ে।