ভূমিকা:
অনুমান করে কথা বললে লোকে তা বিশ্বাস করতে চায় না, চায় যুক্তি ও প্রমাণ। কিন্তু বলবার সাথে সাথে সকল কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কেননা হাট-বাজার ও পথে-ঘাটে লোকে তো কতো কথাই বলে থাকে, সংগে তো কারো কোন প্রমাণপত্র থাকে না। তবে বক্তব্যের যুক্তিটা থাকা দরকার সর্বত্রই। কোনো তত্ত্বমূলক বিষয়ে তো নয়ই, যুক্তিহীন (আন্দাজী) কথা বাজারেও চলে না। তাই আমি যুক্তির সাহায্যে কতিপয় বিষয়ের সত্যের সন্ধান করতে চেয়েছিলাম এবং সে জন্য লিখেছিলাম সত্যের সন্ধান নামীয় একখানা পুস্তিকা ১৩৫৮ (১৯৫১) সালে। আর তার অপর একটি নামও দিয়েছিলাম ‘যুক্তিবাদ’। পরিতাপের বিষয় এই যে, সেই যুক্তিবাদ-এর কঠিন দেয়াল ডিঙিয়ে আমাকে নেয়া হয়েছিলো পবিত্র হাজতখানায়। তাই এবারে সত্যের সন্ধান না করে মিথ্যার সন্ধান করতে চেষ্টা করছি এবং ‘যুক্তিবাদ’-এর আশ্রয় না নিয়ে আমি আশ্রয় নিচ্ছি ‘অনুমান’-এর। তাই এ পুস্তিকাখানার নামকরণ করা হলো – মিথ্যার সন্ধানে অনুমান। এতে যুক্তিবাদের কঠিন দেয়াল নেই, আছে স্বচ্ছ কাচের আবরণ।
মূলত অনুমান তুচ্ছ বিষয় নয়। এর আশ্রয় না নিয়ে মানুষের এক মুহূর্তও চলে না। অনুমান করবার শক্তি ক্ষীণ বলেই ইতর প্রাণী মানুষের চেয়ে এত পিছনে এবং মানুষ এত অগ্রগামী তার অনুমান করবার শক্তি প্রবল বলেই। ভবিষ্যতের চিন্তা মাত্রেই অনুমান, কতক অতীতেরও। আর ভবিষ্যৎ ও অতীত বিষয়ের চিন্তা ও অনুমান করতে পারে বলেই মানুষ মানুষ হতে পেরেছে।
অনুমান-এর বাস্তব ও অবাস্তব দুটি রূপ আছে। তবে ভবিষ্যৎ যাবত বর্তমান-এ পরিণত না হয়, তাবৎ সে ‘রূপ ধরা পড়ে না। আবার এমন অনুমানও আছে, যার বাস্তব রূপ কোনো কালেই ধরা পড়তে চায় না।
পরমেশ্বর বলে কেউ আছেন কি-না, এ প্রশ্নটির মীমাংসা অনুমানসাপেক্ষ। প্রশ্নটি অতীতেও ছিলো, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে ; সুমীমাংসা হয়নি আজও, হয়তো হবেও না কোনোদিন। মীমাংসা হলে – আস্তিক ও নাস্তিক, এ দুটাে সম্প্রদায় থাকতো না বা থাকবে না। কিন্তু সে আশা দুরাশা মাত্র।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের বহু খবর আজ আমরা পাচ্ছি — ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে। আবার কতক খবর জানা যায় কেচ্ছা-কাহিনী ও পৌরাণিক পুথি-পত্তরের মাধ্যমে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই কাহিনীকাররা ঘটনার বাস্তব রূপটি পরিবেশন করেননি। পৌরাণিক কতোগুলো কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বহু গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণেই। সে সমস্ত কাহিনীর বাস্তবরূপ অনুধাবন করার একমাত্র উপায় অনুমান। আর তারই সামান্য চেষ্টা করা হয়েছে এ পুস্তিকাখানার মাধ্যমে।
এ পুস্তিকাখানায় উল্লিখিত প্রসঙ্গসমূহে আরোপিত আমার অনুমানগুলো যে অন্য কারো অনুমানের সাথে মিলবে, এমন আশা আমি করি না। তবে প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে আমার অনুরোধ যে, তারা যেনো আমার আলোচ্য বিষয়সমূহ নিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং ওগুলোর যাথাথ্য নির্ণয়ের চেষ্টা করেন।
এ পুস্তিকাখানা প্রণয়নে আমাকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা দান করেছে শিক্ষামোদী তরুণ যুবক প্রিয় মো. ফিরোজ সিকদার। আমি তার উন্নত জীবন ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
রচনাকালীন আমার এ লেখাগুলোর প্রতিটি শব্দ ধন্য হয়েছে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেবের শুভদৃষ্টির পরশে। কিন্তু সেজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি না। কেননা আমার লেখার কলমটাই তার।
এ ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানার মুদ্রণকালে যথারীতি প্রুফ সংশোধনের অভাবে এতে ভুলের পরিমাণ এতই বেশী রয়ে গেলো যে, শুদ্ধিপত্রেও তা শুদ্ধ হবার নয় এবং তা একান্তই লজ্জাকর। প্রিয় পাঠকবৃন্দের বিরক্তিজনক সে সব ভুলের জন্য তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।
০১. রাবণের প্রতিভা
রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক রামচন্দ্র রাজপুত্তর, ধর্মপরায়ণ, বীর, ধীর, সুসভ্য, সুকান্ত, জ্ঞান, গুণী ইত্যাদি শত শত গুণাত্মক বিশেষণে ভূষিত। পক্ষান্তরে রাবণ—বিললাঙ্গ (দশমুণ্ডু), স্বৈরাচারী, অসভ্য, রাক্ষস, কামুক ইত্যাদি শত শত দোষাত্মক বিশেষণে দুষ্ট। কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই? হয়তো আর্য-ঋষি বাল্মীকি—আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষ বশত শ্রীরামকে প্রদীপ্ত ও রাবণকে হীনপ্রভ করার মানসে একের প্রোজ্জ্বল ও অন্যের মসিময় চিত্র অংকিত করেছেন নিপুণ হস্তে রামায়ণের পাতায়। কিন্তু তাঁর তুলির আঁচড়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ পাচ্ছে রাবণের কৌলিন্য, শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আসল কান্তির ছিটেফোঁটা; যার ঔজ্জ্বল্য রামচরিত্রের উজ্জ্বলতার চেয়ে বহুগুণ বেশী।
রামচন্দ্র ছিলেন ক্ষত্রকুলোদ্ভব, চার বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণের মানুষ। সেকালের ক্ষত্রিয়রা ছিলো বংশগত যোদ্ধা, অর্থাৎ নরখাতক। আর রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশীয়। এ কথাটা শুনে রামুভক্ত হিন্দু ভাইয়েরা হয়তো আঁতকে উঠতে পারেন। ‘ব্রাহ্মণ’-এর সাধারণ সংজ্ঞা হলো—ব্রহ্মাংশে জন্ম যার, অথবা বেদ জানে যে, কিংবা বেদ অধ্যয়ণ করে যে, নতুন ব্রহ্মের উপাসনা করে যে—সেই-ই ব্রাহ্মণ। ঋষিগণ সর্বত্রই উক্ত গুণের অধিকারী। তাই ঋষি মাত্রেই ব্রাহ্মণ। রাবণের দাদা পুলস্ত্য ছিলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র এবং স্বনামধন্য ঋষি। কাজেই তিনি ছিলেন বংশে ও গুণে উভয়ত ব্রাহ্মণ। পুলস্ত্য ঋষির পুত্র অর্থাৎ রাবণের পিতা বিশ্রবাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ঋষি। কাজেই তিনিও ছিলেন বংশগত ও গুণগত ব্রাহ্মণ। তাই ব্রাহ্মণ ঋষি বিশ্রবার পুত্র রাবণ গুণগত না হলেও কুলগত ব্রাহ্মণ ছিলেন নিশ্চয়ই। এতদ্ভিন্ন নিম্নলিখিত আলোচনাসমূহে রাম ও রাবণের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার তুলনামূলক কিঞ্চিৎ পরিচয় পাওয়া যাবে।
১. রাবণের রাজমহলকে (কখনো লঙ্কাকেও) হলা হয়েছে ‘স্বর্ণপুরী’। এতে রাবণের ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ ইত্যাদি বহু গুণের পরিচয় মেলে। কিন্তু রামচন্দ্রের বাড়িতে এমন কিছুর উল্লেখ দেখা য্যা না, যার দ্বারা তাঁর ওসব গুণের পরিচয় পাওয়া যায়।
২. লঙ্কায় সীতাদেবী রক্ষিতা হয়েছিলেন রাবণের তৈরী অশোক কাননে। তা ছিলো রাবণের প্রমোদ উদ্যান, যেমন আধুনিক কালের ইডেন গার্ডেন। সে বাগানটিতে প্রবেশ করলে কারও শোকতাপ থাকতো না। তাই তার নাম ছিলো অশোক কানন। সে বাগানটির দ্বারা রাবণের সুরুচি ও সৌন্দর্যপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। অধিকন্তু তিনি যে একজন উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ ছিলেন তা-ও জানা যায়। তার প্রমাণ মেলে একালের সুপ্রসিদ্ধ খনার বচনে। খনা বলেছেন—
“ডেকে কয় রাবণ,
কলা-কচু না লাগাও শ্রাবণ।”
শত শত জাতের ফল-ফুল ও লতাগুল্মের বৃক্ষরাজির একস্থানে সমাবেশ ঘটিয়ে তা লালন-পালন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু জানা যায় না রামচন্দ্রের বাড়িতে কোনো ফুল-ফলের গাছ আদৌ ছিলো কি-না।
৩. রামচন্দ্র লঙ্কায় গিয়েছিলেন কপিকুলের (বানরের) সাহায্যে মাটি-পাথর কেটে বাঁধ নির্মাণ করে, দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায়। কিন্তু লঙ্কা থেকে ভারতের দণ্ডকারণ্য তথা পঞ্চবটী বনে রাবণ যাতায়াত করেছিলেন “পুষ্পক” বিমানে আরোহন করে অতি অল্প সময়ে। রাবণ যে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা বৈমানিক এবং কারিগরিবিদ্যা-বিশারদ ছিলেন, তা তার জ্বলন্ত প্রমাণ! এ ক্ষেত্রে রাবণের সহিত শ্রীরামের তুলনাই হয় না।
৪. রামচন্দ্র যুদ্ধ করেছেন সিএ মান্ধাতার আমলের তীর-ধনু নিয়ে। আর রাবণ আবিষ্কার করেছিলেন এক অভিনব যুদ্ধাস্ত্র, যার নাম ‘শক্তিশেল’। তা শক্তিতে ছিলো যেনো বন্দুকের যুগের ডিনামাইট। নিঃসন্দেহে এতে রাবণের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় মেলে।
৫. রামচন্দ্রের নিক্ষিপ্ত শরাঘাতে রাবণের মুমূর্ষু সময়ে তাঁর কাছে গিয়ে রামচন্দ্র রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর উপদেশপ্রার্থী হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি রামচন্দ্রের সে প্রার্থনা পূর্ণ করেছিলেন ধীর ও শান্তভাবে, সরল মনে। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাবণ সে যুগের একজন রাজনীতি-বিশারদ ছিলেন। অধিকন্তু ছিলেন ধৈর্য, সহন ও ক্ষমাশীল এবং প্রতিহিংসাবিমুখ এক মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
৬. রামায়ণ মহাকাব্যে রাবণকে বলা হয়েছে ‘দশানন’। কিন্তু বাস্তবে রাবণের দশটি মুণ্ডু নিশ্চয়ই ছিলো না। তবে তাঁর মাথায় মজ্জা অর্থাৎ জ্ঞান ছিলো দশটা মুণ্ডুর সমান। তা-ই রূপকে বিদ্রুপে অংকিত হয়েছে ‘রাবণ দশমুণ্ডু’ রূপে।
৭. রাক্ষস বা নরখাদক বলা হয়েছে রাবণকে। উপরোক্ত আলোচনাসমূহের পরে এ বীভৎস বিশেষনটি সম্বন্ধে আর কিছু সমালোচনা আবশ্যক আছে বলে মনে হয় না। তবুও প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে একটি প্রশ্ন না রেখে পারছি না। রাবণের দাদা হচ্ছে পুলস্ত্য, পিতা বিশ্রবা, ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ, বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবের এবং পুত্র ইন্দ্রজিৎ (প্রসিদ্ধ বৈমানিক); এঁরা সকলেই ছিলেন সভ্য, ভব্য, সুশিক্ষিত, গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এঁরা কেউই ‘রাক্ষস’ বা কাঁচামাংসভোজী মানুষ ছিলেন না। রাবণও তাঁর শৈশবকালাবধি মাতা-পিতার রান্না করা খাবারই খেয়েছেন নিশ্চয়। অতঃপর যৌবনে হঠাৎ করে একদিন তিনি খেতে শুরু করলেন জীবের কাঁচামাংস! বিমান বিহার, শক্তিশেল নির্মাণ ও অশোক কানন তৈরী করতে জানলেও তিনি রান্নার পাকপাত্র গড়তে বা রান্না করতে জানেন নি। বেশ ভালো। কিন্তু তিনি কোথায় বসে, কোন দিন, কাকে খেয়েছেন—তার একটিরও নামোল্লেখ নাই কেন?
৮. রাবণের সন্তানাদি সম্বন্ধে একটি প্রবাদ আছে—
“একলক্ষ পুত্র আর সোয়ালক্ষ নাতি,
একজন না থাকিল বংশে দিতে বাতি।”
আর অপর একটি প্রবাদ আছে—
“যাহা কিছু রটে
তার কিছু বটে।”
প্রবাদবাক্যের লক্ষ পুত্র না হোক তার শতাংশ সত্য হলেও রাবণের পুত্রসংখ্যা হয় এক হাজার এবং তার অর্ধাংশ সত্য হলেও সে সংখ্যাটি হয় পাঁচশ’। আর তা-তো বিস্ময়ের কিছু নয়। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রও ছিলেন একশ’ এক পুত্রের জনক। আর রাম? তাঁর পুত্রের সংখ্যা কথিত হয় মাত্র দু’টি, বলা চলে একটি। কেননা তারা ছিল সীতার এক গর্ভজাত, যমজ সন্তান। তদুপরি সে পুত্রযুগল জন্মেছিলো নাকি রামচন্দ্রের বিবাহের তেপ্পান্ন বছর পর (বাস্তব ১২+১৪=২৬ বছর পর)। বছরের এ হিসেবটা প্রিয় পাঠিকদের কাছে একটু বেমানান বোধ হতে পারে। তাই বছরগুলোর একটা হিসাব দিচ্ছি। বিবাহান্তে রামচন্দ্র গৃহবাসী ছিলেন ১২ বছর, বনবাসী ১৪ বছর এবং গৃহে প্রত্যাবর্তন করে রাজাসনে কাটান নাকি বাকি ২৭ বছর (ঐ ২৭ বছর উদ্দেশ্যমূলক, কাল্পনিক)। এর পর ‘কলঙ্কিণী’ বলে প্রাথমিক অন্তঃসত্ত্বা সীতাদেবীকে নির্বাসিত করা হয় বাল্মীকির তপোবনে, সেখানে জন্মে সীতার যুগল সন্তান কুশ ও লব।
সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না এবং উক্ত তেপ্পান্ন বছরের মধ্যে বনবাসকালের দশ মাস (অশোক কাননে রাবণের হাতে সীতা বন্দিনী ছিলেন ১০ মাস) ছাড়া বায়ান্ন বছর দু’মাস সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অঙ্কশায়িনী। তথাপি এ দীর্ঘকাল রতিবিরতি রামচন্দ্রের বীর্যহীনতারই পরিচয়, নয় কি?
৯. রামচন্দ্রের কাহিনীকারের মতে চোদ্দ বছর বনবাসান্তে রামচন্দ্র দেশে প্রত্যাবর্তন করে নির্বিঘ্নে সংসারধর্ম তথা রাজ্যশাসন করেছিলেন দীর্ঘ ২৭ বছর। অতঃপর প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিলো। কেননা লঙ্কার অশোক কাননে বন্দিনী থাকাকালে রাবণ সীতাদেবীর সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন এবং অসতীকে গৃহে স্থান দেওয়ায় প্রজাগণ ছিলো অসন্তুষ্ট।
উপরোক্ত বিবরণটি শুনে স্বতই মনে প্রশ্নের উদয় হয়ে যে, মরার দু’যুগের পরে কান্না কেন? বনবাসান্তে রামচন্দ্র স্ববাসে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর বনবাসের বিবরণ তথা লঙ্কাকাণ্ড দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিলো তাঁর দেশে ফেরার সংগে সংগেই এবং সীতাকলঙ্কের কানাকানিও চলছিলো দেশময় তখন থেকেই। আর গুজবের ভিত্তিতে সীতাদেবীকে নির্বাসিত করতে হলে তা করা তখনই ছিলো সঙ্গত। দীর্ঘ ২৭ বছর পর কেন?
রামচন্দ্র সীতাদেবীকে গৃহত্যাগী করেছিলেন শুধু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য, স্বয়ং তাঁকে নাকি ‘নিষ্কলঙ্কা’ বলেই জানতেন। এইরূপ পরের কথায় নিষ্কলঙ্কা স্ত্রী ত্যাগ করার নজির জগতে আছে কি? এই তো সেদিন (১৯৩৬) গ্রেট বৃটেনের সম্রাট অষ্টম এডোয়ার্ড মিসেস সিম্পসনকে সহধর্মিনী করতে চাইলে তাতে বাধ সাধলো দেশের জনগণ তথা পার্লামেণ্ট ‘মিসেস সিম্পসন হীনবংশজাত’ বলে। পার্লামেণ্ট এডোয়ার্ডকে জানালো যে, হয় মিসেস সিম্পসনকে ত্যাগ করতে হবে, নচেৎ তাঁকে ত্যাগ করতে হবে সিংহাসন। এতে এডোয়ার্ড সিংহাসন ত্যাগ করলেন, কিন্তু তাঁর প্রেয়সীকে ত্যাগ করলেন না। শুধু তা-ই নয়, তাঁর মেঝ ভাই ডিউক-অব-ইয়র্ককে সিংহাসন দিয়ে তিনি সস্ত্রীক রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন বিদেশে। রামচন্দ্রেরও তো মেঝ ভাই ছিলো।
সীতাদেবীর অসীত্ব রক্ষার জন্য রামায়ণের কাহিনীকার চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। যেখানে তিনি লৌকিক অবলম্বন খুঁজে পাননি, সেখানে অলৌকিকের আশ্রয় নিয়েছেন। দু’-একটি উদাহরণ দিচ্ছি—
ক. রাবণের অশোক বলেন সীতার সতীত্ব রক্ষার কোনো অবলম্বন তিনি খুঁজে পাননি। তাই সেখানে বলেছেন যে, জোরপূর্বক কোনো রমণীর সতীত্ব নষ্ট করলে রাবণের মৃত্যু হবে, এই বলে কোনো ঋষি তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। কাজেই মৃত্যুভয়ে রাবণ সীতাকে স্পর্শ করেননি। সুতরাং সেখানে সীতার সতীত্ব বেঁচে আছে।
খ. সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌঁছুলে সেখানে যখন সীতাকলঙ্কের ঝড় বইছিলো, তখন বলেছেন যে, সীতাদেবীকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলে তাঁর সতীত্বের পরীক্ষা করা হয়েছিলো, তাতে তাঁর কেশাগ্রও দগ্ধ হয়নি। সুতরাং সীতার সতীত্ব বেঁচে আছে।
গ. বহুবছর বাল্মীকির তপোবনে কাটিয়ে শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞে কুশ-লবসহ বাল্মীকির সাথে সীতাদেবী রামপুরীতে উপস্থিত হলে পুনঃ যখন তিনি-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভোগ করতে থাকেন, তখন কবি বলেছেন যে, সীতাদেবীর অনুরোধে ধরণী দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল এবং সীতাদেবী সে গর্তমধ্যে প্রবেশ করে স্বর্গে বা পাতালে গিয়েছেন ইত্যাদি।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো হয়তো এরূপও ঘটে থাকতে পারে। যথা—
ক. রাবণের রূপলাবণ্য ও শৌর্যবীর্য দর্শনে প্রীতা হয়ে সীতাদেবী রাবণকে স্বেচ্ছায় করেছেন দেহদান এবং তাঁকে রাবণ করেছেন বীর্যদান। সীতাদেবীর প্রতি রাবণ বলপ্রয়োগ করেন নি, তাই তিনি মরেননি। হয়তো এমনও হতে পারে যে, রাবণ যেদিন সীতার প্রতি বলপ্রয়োগ করেছেন, সেদিন তিনি রামের হাতে মরেছেন। আর সেইদিন সীতাদেবী হয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা।
খ. সীতাদেবীকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌঁছুলে লঙ্কাকাণ্ড প্রকাশ হওয়ায় সেখানে তখন সীতাকলঙ্কের ঝড় বইছিলো নিশ্চয়ই। হয়তো সীতার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য প্রথমত জেরা-জবানবন্দি, কটুক্তি, ধমকানি-শাসানি ও পরে মারপিট ইত্যাদি শারীরিক নির্যাতন চালাহয়ে হচ্ছিলো তাঁর প্রতি। কিন্তু তিনি নীরবে সহ্য করেছিলেন সেসব নির্যাতন, ফাঁস করেননি কভু আসল কথা। আর সেটাই হচ্ছে সীতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া।
গ. শ্রীরামের রাজপ্রসাদে সীতা প্রসঙ্গে অতঃপর থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো কিছুদিন (২৭-২৮ দিন বা এক রজোমাস যাকে বলা হয় ২৭ বছর)। পরে সীতাদেবীর মাসিক পরিক্রমায় রামচন্দ্র যখন আসল খবর পেয়েছিলেন, তখনই তিনি অন্তঃসত্ত্বা সীতাদেবীকে নির্বাসিতা করেছিলেন বাল্মীকির তপোবনে এবং সেখানে জন্মেছিলো তাঁর যুগল সন্তান কুশ-লব।
সন্তান কামনা করে না, এমন কোনো লোক বা জীব জগতে নেই। কারো সন্তান না থাকলে তার দুঃখের অবধি থাকে না; বিশেষত ধনিক পরিবারে। আর রাজ্যেশ্বর রামচন্দ্রের বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ ২৬ বছর পরে আসন্ন সন্তান পরিত্যাগ করলেন শুধু কি প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্যে? নিশ্চয়ই তা নয়। তিনি জানতেন যে, সীতার গর্ভস্থ সন্তান তাঁর ঔরসজাত নয়, ঔরসজাত রাবণের। আর সঙ্গত কারণেই সীতার গর্ভজাত সন্তানের প্রতি তাঁর কোনো মায়ামমতা ছিলো না, বরং ছিলো ঘৃণা ও অবজ্ঞা। তাই তিনি সীতা-সুতের কোনো খোঁজখবর নেননি বহু বছর যাবত। বিশেষত ঋষি বাল্মীকির আশ্রম অযোধ্যা থেকে বেশি দূরেও ছিলো না, সে আশ্রম তিনি চিনতেন।
অতঃপর সীতাসহ কুশ-লব বিনা নিমন্ত্রণে (বাল্মীকির নিমন্ত্রণ ছিলো) ঋষি বাল্মীকির সাথে শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যেদিন রামায়ণ কীর্তন করে, সেদিন কুশ-লবের মনোরম কান্তি ও স্বরে-সুরে মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্র তাদের ‘দত্তক’রূপে গ্রহণ করেন। হয়তো তখন তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, ঘটনাক্রমে ফেলনা হলেও ছেলে দুটো (কুশ-লব) রাজপুত্র তো বটে।
কুশ-লবকে গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়তো আশা করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার তিনি সমাদর পাবেন। কিন্তু তা তিনি পান নি, বিকল্পে পেয়েছিলেন যতো অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি ক্ষোভে-দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারীহত্যার অপবাদ লুকানোর উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাবার ভয়ে শ্মশানে দাহ করা হয়নি সীতার শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে প্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে, পুরীর মধ্যেই। আর তা-ই প্রচারিত হয়েছে ‘স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ’ বলে।
সে যা হোক, অযোধ্যেশ্বর রাম ও লঙ্কেশ্বর রাবণের সন্তান-সন্ততি সম্বন্ধে পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাবণ ছিলেন শত শত সন্তানের জনক, আর রামের ছিলো না একটিও পুত্র। তিনি ছিলেন বন্ধ্য (আঁটকুড়া)।
লঙ্কেশ্বর রাবণের যাবতীয় গুণগরিমা ও সৌরভ-গৌরব গুপ্ত রাখার হীন প্রচেষ্টার মুখ্য কারণ—তিনি অধ্যাত্মবাদী ছিলেন না, ছিলেন জড়বাদী বিজ্ঞানী। বিশেষত তিনি আর্যদলের লোক ছিলেন না, ছিলেন অনার্যদলের লোক। এরূপ ‘অনুমান’ করা হয়তো অসঙ্গত নয়।
আর একটি কথা। শুধুমাত্র রাম ও রামণকে নিয়ে রামায়ণ হতে পারে না, হনুমানকে বাদ দিয়ে। তাই এখন হনুমান প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করছি।
ঋষি বাল্মীকি ছিলেন প্রচণ্ড রামভক্ত। কৃত্তিবাসী রামায়ণে তার কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়। কৃত্তিবাসী রামায়ণে কথিত হয়েছে যে, বাল্মীকি যৌবনে রত্নাকর নামে একজন দস্যু ছিলেন। পরে নারদের উপদেশে দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে ছয় হাজার বছর একস্থানে উপবিষ্ট থেকে রামনাম জপ করেন। সেই সময় তাঁর সর্বশরীর বল্মীকে সমাচ্ছন্ন হয়। পরে তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে বল্মীক হ’তে উত্থিত হওয়ায় তিনি বাল্মীকি নামে খ্যাত হন।
এক্সিনি আহার-নিদ্রা ও চলাফেরা পরিত্যাগ করে ছয় হাজার বছর বা ছয় বছরও রামনাম জপ করতে পারেন, রামের শৌর্য, বীর্য, গুণ-গরিমা ও ইজ্জৎ বৃদ্ধির জন্য তিনি কি না করতে পারেন? শ্রীরামের প্রাধান্য রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি গুণী, জ্ঞানী ও সুসভ্য রাবণকে রাক্ষস বানিয়েছিলেন, ভাগ্যিস পশু বানান নি। রামায়ণ মহাকাব্যের বনপর্বে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে হনুমান, জাম্ববান, সুগ্রীব ও তার ভ্রাতা বালীরাজ। রামায়ণের কাহিনীকার তাদের সদলে অঙ্কিত করেছেন পশুরূপে। বিশেষত হনুমান, সুগ্রীব ও বালীরাজকে সদলে বানর বানিয়েছেন এবং জাম্ববানকে বানিয়েছেন ভালুক। কিন্তু তারা কি আওলেই পশু ছিলো?
সে যুগে স্বর্গাগত দেবতাদের কেউ কেউ মর্ত্যবাসী কোনো কোনো মানবীর সাথে যৌনাচারে লিপ্ত হতেন এবং তৎফলে কোনো সন্তানের জন্ম হলে সে ‘দেবতা’ হতো না বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষও হতো না, হতো অসাধারণ মানুষ। যেমন—সূর্যদেবের ঔরসে কুমারী কুন্তির গর্ভে জন্ম নেন কর্ণ। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত যোদ্ধা ও দাতা। দেবতা যমের ঔরসে পাণ্ডুপত্মী কুন্তির গর্ভে জন্মলাভ করেন যুধিষ্ঠির। তিনি ছিলেন ধার্মিক চূড়ামণি, যার ফলে তাঁর নাম হয়েছিল ধর্মরাজ। ইন্দ্রদেবের ঔরসে কুন্তির ক্ষেত্রে জন্ম নেন অর্জুন। তিনি ছিলেন সে যুগের ভারতবিখ্যাত যোদ্ধা ইত্যাদি। কিন্তু কোনো দেবতা কখনো কোনো পশুর সাথে যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছেন এবং তাতে পশুরূপী সন্তান জন্ম নিচ্ছে, এমন কাহিনী কোথাও কোনো পুরাণশাস্ত্রে দেখা যায় না। পৌরাণিক মতে এখানে হনুমানের কিঞ্চিৎ পরিচয় দিচ্ছি। এতে দেখা যাবে যে, হনুমানরা সবাই ছিলো মানুষ। এবং ওদের আভিজাত্যও রামের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
প্রথমত হনুমান—পবনদেবের ঔরসে মানবী অঞ্জনার গর্ভে এর জন্ম। কাজেই হনুমান দেব-মানবের বংশজাত একজন বীর্যবন্ত মানব।
দ্বিতীয়ত জাম্ববান—এ হচ্ছে দেবতা ব্রহ্মার পুত্র। জাম্ববানের কন্যার নাম জাম্ববতী এবং তাকে বিয়ে করেন হিন্দুদের পরম পূজনীয় শ্রীকৃষ্ণ। সুতরাং জাম্ববান হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের শ্বশুর। কাজেই সে ভালুক বা পশু হতে পারে না, সে ব্রহ্ম-বংশের মানুষ; সুতরাং ব্রাহ্মণ।
তৃতীয়ত বালী ও সুগ্রীব—দেবরাজ ইন্দ্রের (মতান্তরে সূর্যের) ঔরসে ও ব্রহ্মার মানসকন্যা রক্ষরজার গর্ভে বালী ও সুগ্রীবের জন্ম হয়। সুতরাং বালী ও সুগ্রীব হচ্ছে ইন্দ্রের বা সূর্যের পুত্র এবং ব্রহ্মার দৌহিত্র (নাতি)। বিশেষত ব্রহ্মার বংশজাত বলে তারা ব্রাহ্মণত্বের দাবীদার।
উপরোক্ত আলোচনাসমূহের দ্বারা অনুমান হয় যে, রামায়ণোক্ত বানররা পশু ছিলো না, তারা ছিলো ভারতের ‘কিষ্কিন্ধ্যা’ নামক অঞ্চলের আদিম অধিবাসী এবং আলোচ্য ব্যক্তিরা ছিলো সেকালের বিশিষ্ট ব্যক্তি। কেননা রামায়ণ মহাকাব্যে অজস্র বানরের আভাস থাকলেও প্রাধান্য পেয়েছে এরাই।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী মর্গানের মতবাদ অনুধাবনযোগ্য। মর্গানের মতে—বেঁচে থাকার তাগিদেই মানুষকে জোট বাঁধতে হয়েছে। জোট মানে দল। কিন্তু কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে দল বাঁধবে? মর্গানের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, সে সময় মানুষ দল বেঁধেছিলো জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জ্ঞাতি, একই পূর্বপুরুষ থেকে তাদের জন্ম। মর্গান এমনি এক একটি দলের নাম দিয়েছিলেন গেনস্ (Gens)। মর্গানের পরের যুগের নৃবিদরা গেনস্ শব্দের বদলে ক্লান (Clan) শব্দের ব্যবহার করেছেন এবং ক্লান শব্দটিই চলছে।
কয়েকটি ক্লান একসঙ্গে জোট বাঁধলে যে বড়ো দলটি গড়ে ওঠে, তার নামে দেয়া হয়ছে ট্রাইব (Tribe)। আবার অনেকগুলো ট্রাইব মিলে আরো বড়ো একটি সংগঠন, তার নামে কন্ফেডারেসি অব ট্রাইবস্।
সাধারণ জন্তু-জানোয়ারের নাম থেকেই ক্লানের নাম হ’তো। যেমন—ভালুক, নেকড়ে বাঘ, হরিণ, কাছিম ইত্যাদি। আবার ফুল, ফল, লতাপাতার নাম থেকেও ক্লানের নামকরণ হতো। এধরণের নামকরণের মূলে যে বিশ্বাসটি রয়েছে, তাকে বলা হয় টোটেম বিশ্বাস।
পাক-ভারত উপমহাদেশের সাঁওতাল উপজাতির শতাধিক গোত্র বা টোটেম আছে, হো উপজাতির আছে ৫০টিরও বেশী। এরূপ মুণ্ডা উপজাতির প্রায় ৬৪টি, ভীল উপজাতির ২৪টি, ছোটো নাগপুরের খারিয়া উপজাতির ৮টি এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ‘দৌড়ি’ উপজাতির মধ্যে ৪টি গোত্র বা টোটেম রয়েছে। এদের প্রত্যেক গোত্রই—পশু, পাখী, গাছপালা অথবা কোনো বস্তুর নামে পরিচিত। আমাদের দেশেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এরূপ বহু গোত্রের বাম দৃষ্ট হয়, যদিও এগুলোকে ঠিক টোটেম বলা যায় না। যেমন—সেন (শ্যেন = বাজপাখী), নাগ (সর্প), সিংহ (পশুরাজ) ইত্যাদি। গোত্রের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে তার গোত্রের টোটেমের নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। যেমন—সিংহ গোত্রের সবাই সিংহ, বাঘ গোত্রের সবাই বাঘ, হরিণ গোত্রের সবাই হরিণ ইত্যাদি।
মর্গানের মতে বিশেষত আধুনিক বহু নৃতত্ত্ববিদের মতে—রামায়ণোক্ত জাম্ববান ও হনুমানাদি ভালুক ও বানররা পশু ছিলো না, তারা ছিলো সেকালের কিষ্কিন্ধ্যার (ভারতের দণ্ডকারণ্যের অংশবিশেষ, আধুনিক নাম নাশিক) অনার্য অধিবাসী (মানুষ)। বানরাদি ছিলো তাদের টোটেম বা বংশগত উপাধি মাত্র। অধিকন্তু এ-ও অনুমান হয়ে যে, হয়তো হনুমান ও সুগ্রীব ছিলো কোনো ‘ক্লান’ ও ‘ট্রাইব’-এর অধিকর্তা এবং বালী ছিলো কোনো ‘কন্ফেডারেসী অব ট্রাইবস্’-এর অধিপতি, অর্থাৎ রাজা।
পরিশেষে—রামভক্ত ভাইদের সবিনয়ে বলছি যে, মানুষ ও পশু-পাখীর চেহারা, চরিত্র ও ভাষা—এ তিনে প্রকাশ পেয়ে থেকে তাদের স্বকীয়তা বা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ‘ভাষা’র ক্ষেত্রে মানুষের সমকক্ষ অপর কোনো জীব নেই। কেননা মানুষের মতো অন্য কোনো জীবের—দন্ত, ওষ্ঠ, তালু, জিহ্বা ইত্যাদি স্বরযন্ত্র নেই। তাই রামায়ণে কবি কিষ্কিন্ধ্যাবাসীদের চেহারা বদলিয়া বানরাদি বানিয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের ভাষা ও চরিত্র বদলাতে পারেননি, তা রেখেছেন সর্বত্রই মানুষের মতো। রামায়ণ গ্রন্থই তার সাক্ষী।