আমাদের বাসায় আমরা বাস করি মিনির মায়ের মতো করে। মিনির মাকে আশা করি আপনারা চিনেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পের যে মিনি, তার মা। তার ধারণা ছিল, পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমাশ, আরশোলা-শুয়োপোকা, সাপ-বাঘ তার বাসার দিকেই ধেয়ে আসছে। আমাদের ধারণা ঠিক অতটা আন্তর্জাতিক নয়। পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে ধেয়ে না এলেও দেশের সব কুখ্যাত ভয়ঙ্কররা যে আসছে, তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। আমরা শুয়ে পড়ি রাত সাড়ে এগারোটায়, ওঠি সকাল সকাল। মেয়ের স্কুল, কর্ত্রীর অফিস।
এমনি এক বাসায় রাত সাড়ে এগারোটায় দোরঘণ্টি বেজে উঠল ভয়াবহ আর্তনাদের মতো।
আমাদের পিলে উঠল চমকে।
কে হতে পারে?
আমাদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ানকে বলা আছে, পরিচিত-অপরিচিত যে-ই আসুক, ইন্টারকম ফোনে কল করে জানাতে হবে, বাসায় মেহমান আসছেন। আর অপরিচিত হলে আমাদের অনুমতি ছাড়া কারও আমাদের ফ্ল্যাটের গেট অবধি পৌঁছানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
গেট থেকে কোনো ফোন আসেনি? তাহলে?
হতে পারে পাশের বাসার কেউ। হয়তো রাত-বিরেতে কোনো প্রেস রিলিজ দেওয়ার কথা মনে পড়েছে। সংবাদপত্রে চাকরি করি—এই এক অসুবিধা। যেকোনো খবর বা বিজ্ঞাপন ছাপানোর দরকার হলে লোকে সরাসরি বা ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। যেমন, যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম, তখন কারও কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র নষ্ট হওয়া মাত্রই আমাকে অনুরোধ করত, সেটা সারিয়ে দিতে। যেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে রেডিও বা টেলিভিশন যন্ত্রের মেরামতি শেখানো হয়!
আমার স্ত্রী কণ্ঠে উদ্বেগ আর চেহারায় আতঙ্ক ফুটিয়ে বললেন, দেখো তো কে?
আমি নিজের কাপুরুষতা অপ্রমাণের স্বার্থে দরজার ম্যাজিক হোলে চোখ রাখলাম, কিন্তু ওপাশের অস্পষ্ট আলোয় ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না, মধ্য রাতের আগন্তুকটা কে।
আমি গলায় জোর এনে বললাম, কে?
আনিস ভাই, আমি জাফর। জাফর আহমদ।
ও জাফর। আমাদের পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। জাফর, এত রাতে?
সম্পাদক সাহেবের নির্দেশ। তাই আসতে হলো।
সম্পাদক সাহেবের নির্দেশের কথা শুনে আমি মন্ত্রতাড়িতের মতো দরজা খুলে দিলাম।
আসো মিয়া। বসো। কী ব্যাপার?
জাফর হেসে বলল, আপনি শিব্রামের গল্প পড়েন নাই? সম্পাদকেরা কী করে লেখকদের কাছ থেকে গল্প আদায় করে। এভাবেই আসতে হয়। জাফর নিজের পায়ের জুতা খুলতে লাগল।
বসার ইচ্ছা। আমি বললাম, জুতা খুলতে হবে না। ঘটনা কী?
জাফর বলল, ঘটনা সামান্য। কিন্তু বসে বলি। আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করে সে ড্রয়িং রুমে ঢুকল এবং বসে পড়ল।
সোফায় নয়, মেঝেতে। যাকে বলে আসন পেতে বসা। বেটা মনে হচ্ছে মেলা রাত করে ফিরবে। আমার ঘুমের সময় হয়ে এল।
আমার মনের অনুভূতি মিশ্র। জাফর যদি গল্প চাইতে এসে থাকে, আর তা যদি সত্যি সম্পাদক মহোদয়ের আদেশের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে আমি খানিকটা শ্লাঘা বোধ করতেই পারি। কিন্তু সম্পাদক সাহেব যদি অন্য কোনো কারণে জাফরকে পাঠিয়ে থাকেন…যেমন জাফর যাও, রাত বেশি হয় নাই, আনিসের কাছে যাও, ওকে দেখিয়ে আনো, কালকের মধ্যেই এই গোলটেবিল বৈঠকটার বিবরণী আমি পুরো ছাপাতে চাই। শোনো, যাওয়ার সময় ওর জন্য এক কেজি টাঙ্গাইলের চমচম নিয়ে যেও। আনিস মিষ্টি পছন্দ করে। কী রকম ভুঁড়ি হয়েছে দেখো না। এ ধরনের কোনো কারণ হলে আমার খুব খুশি হওয়ার কারণ নাই। এখন জাফরকে বসিয়ে রেখে চার পাতা আমাকে দেখে দিতে হবে।
জাফর বলল, আনিস ভাই, আপনার সময় নষ্ট করব না। আমি একটা অন্য রকম পাতা করছি। আধিভৌতিক গল্প সংখ্যা। আপনি একটা ভূতের গল্প লিখে দেন।
আমি বললাম, মিয়া, রাত ১২টায় এসে তুমি গল্প চাও। ফোন করলেই তো হতো।
জাফর বলল, সম্পাদক সাহেবের নির্দেশ। আপনি ছাড়া এত রাতে কার কাছে যাব? জাফর ইকবাল স্যারকে ফোন করছি, উনি মনে হয় মোবাইল অফ করে রেখেছেন। আর সত্যি কথা বলতে কী, আপনি ছাড়া আর কেউ চাহিবা মাত্র লেখা দেয় না। আমাদের বিশ্বজিত্ চৌধুরীকে বললেও অন্তত সাত দিন। কেবল আপনিই পারেন এক রাতে গল্প লিখে দিতে। কালকে আমার পেস্টিং। আপনি আজ রাতেই লেখেন।
আমি বললাম, জাফর, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলা, তাই না। রাতে তো আমি গল্প লিখি না। আমি লিখি সকালে। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন ঘুমাব। ভোরবেলা উঠে তোমার গল্প ধরব। তোমার খাতিরে নয়। সম্পাদক সাহেবের খাতিরে।
আমার পাজামার পকেটে মোবাইল ফোন নড়ছে। ফোন হাতড়ে বের করে দেখলাম, তিনটা মিস্ড কল। তিনটাই কর্ত্রীর।
আমি রিং ব্যাক করলাম।
অ্যাই, কে? উনি বললেন।
আর বোলো না, জাফর।
কেন আসছে? এত রাতে?
গল্প চাইতে।
এত রাতে? আক্কেল নাই?
আক্কেল থাকলে কেউ সাহিত্য সম্পাদক হয়?
আরে বলতেছো কেন। ও শুনতেছে না?
না। সাহিত্য সম্পাদকের সব কথা শুনতে হয় না। আসো জাফরের সঙ্গে কথা বলো।
না, বলো, আমি ঘুমায়া পড়সি।
আচ্ছা বলতেছি। রাখো তুমি।
জাফর আমার ঘরের জিনিসপত্র দেখছে। ড্রয়িং রুমের দেয়ালে অনেক মুখোশ আছে। সেসবের দিকে তাকিয়ে সে মুচকি মুচকি হাসছে।
কী মিয়া, হাসো ক্যান?
জাফর যেন অন্য জগতে আছে। আমার কথা শুনতেই পাচ্ছে না।
আমি বললাম, জাফর, একটু কোল্ড ড্রিংকস দেব। ফ্রিজে আছে।
জাফর বলল, না দরকার নাই। বাইরে আজকে জোছনা। মহিনের ঘোড়াগুলো এখনো ঘাসের লোভে চরে, পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে।
আমি বলি, ওই মিয়া, কাব্য করার আর টাইম পাইলা না। রাইত বারোটায়?
জাফর বলল, আনিস ভাই, আমি কিন্তু ছোটবেলায় গান শিখতাম। রবি ঠাকুরের গান। শুনবেন?
এত রাতে? এইটা কি গান শোনার সময়?
অফিসে কাজের চাপে কোনোদিন একটা লাইন গানও গাইতে পারি না। আজকে আপনার বাড়িতে আসার পথে দেখি উথালপাথাল জোছনা।
মাত্র দুই দিন আগে কোরবানির ঈদ গেল। আজকে তো পূর্ণিমাই হবে। জোছনা থাকাই স্বাভাবিক।
আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের মাতাল সমীরণে। জাফর গান গাচ্ছে। তার গানের গলা আশ্চর্য রকমের ভালো।
আমি বললাম, জাফর খেয়াল করেছো ওয়ার্ডিংগুলা, আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে, ঘর মোছা নিয়া যে কেউ গান লিখতে পারে, তাও জ্যোত্স্নারাতের গানে কেউ ঘর ধোয়া-মোছা, ঝাড়ু দেওয়ার কথা লিখতে পারে, ভাবাই যায় না। কী মডার্ন!
গান কেমন লাগল?
ভালো। রীতিমতো গায়কদের মতো।
আমি আসলে গান শিখতাম। ওস্তাদ মিহির লালার কাছে আমি আঠারো বছর গান শিখেছি।
আচ্ছা। তোমার এ প্রতিভার কথা জেনে খুশি হলাম। মাঝে মধ্যে অফিসে তুমি গান শুনাবা। একজন গৃহপালিত গায়ক স্টকে থাকা সব সময়ই ভালো।
আমি এবার যাই। তবে একটা অনুরোধ। গল্পটা আপনি রাতের বেলাতেই লিখবেন। গল্পের ইলাস্ট্রেশন আমি করে রেখেছি।
ইলাস্ট্রেশন করে রাখছ মানে। আমি তো গল্প লিখিই নাই।
ইলাস্ট্রেশন করতে গল্প লিখতে হয় না। দেখেন, কেমন ফিট করে।
জাফর যাওয়ার সময় নেপালের কাঠমান্ডু থেকে আনা ১০টা নরমুণ্ডশোভিত ভয়ঙ্করদর্শন মুখোশটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হাসল।
ও চলে গেলে আমি হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়ে গেছে।
পরের দিন ভোরবেলাই উঠতে হলো। আমি সোজা লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম। জাফরের গল্পটা লিখে দেওয়াই উচিত।
ভূতের গল্প আমি লিখতে পারি না। আমার ভূতেরা সব হাসির কাণ্ড করে। খুবই ফ্রেন্ডলি প্রকৃতির হয়। আধিভৌতিক গল্প তো একেবারেই আসে না আমার হাতে। অযৌক্তিক কোনো কিছু এই পৃথিবীতে আমি ঘটতে দেখিনি।
গল্পটা লিখে ফেলে খুব একটা স্বস্তি হলো। প্রত্যেকবার লেখা শুরু করার আগে আমি ভাবি, লেখার প্রতিভা আমি হারিয়ে ফেলেছি। আর পারব না। পরে যখন লেখা শেষ হয়, তখন মনে হয়, নিজেকে ফিরে পেয়েছি। খুব আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই।
গল্পটা হাতে করে আমি অফিসে গেলাম অন্য দিনের চেয়ে একটু আগেই। গিয়ে দেখি জাফর নাই।
আমি পেস্টিং রুমে গেলাম। জাফর আসে নাই?
জাফর ভাই তো পাতার কাজ গত রাতেই শেষ করে দিয়ে চলে গেছেন।
কী বলে? ও না আমার কাছে গল্প চাইল। আমি লিখে নিয়া আসলাম। অযথা খাটাইলো।
পাতা তো প্রেসে রাতেই চলে গেছে। রাতের বেলাতেই ছাপা হয়ে গেছে। একটু পরে ছাপানো কপি দেখতে পাবেন।
আমি জাফরকে ফোন দিলাম। মোবাইলে। জাফর তুমি কই?
আমি। বাসায় আনিস ভাই। কালকে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ হয়েছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সেই দুইটা।
আমার কাছে যে গল্প চাইলা, এমন ভাব করলা, আমার গল্প ছাড়া তোমার পত্রিকাই ছাপা হবে না।
তাই তো। আপনার গল্প ছাড়া আমার পাতা হবে নাকি?
তাইলে এখন এই গল্প আমি কী করব।
আপনি আরেকটা গল্প লিখেছেন?
আরেকটা মানে। একটাই হয় না।
আপনার গল্প তো ছাপা হয়েছে। আমি নিজে মেকআপ করে পেস্টিং করে দিয়েছি।
আমি তোমাকে কবে গল্প দিলাম?
কালকে রাত ১২টা কি সাড়ে ১২টার দিকে আপনার মেইল এল। আমি চেক করে দেখি গল্প। খুব খুশি হইছি আনিস ভাই। রাতে নিজেই প্রুফ দেখে গল্প পেস্টিং করে ফেলেছি।
কী বলো তুমি। তুমি আমার বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে আসছ?
মানে কি?
তুমি কালকে রাতে আমার বাসা থেকে বের হয়ে আবার অফিসে গেছ?
আমি তো কালকে রাতে আপনার বাসায় যাই নাই।
জাফর ইয়ারকি কইরো না।
আনিস ভাই, আমি আপনার সাথে ইয়ারকি করব, আপনি ভাবতে পারলেন।
তাইলে আমি তোমার সাথে ইয়ারকি করতেছি?
সেই অধিকার আপনার আছে। আপনি সিনিয়র। ইয়ারকি করতে পারেন। আমি তো পারি না।
আমি খুবই রেগে যাচ্ছি। রেগে যাওয়া আমার স্বভাবের মধ্যে নাই। আর চাকরি করতে গেলে রাগ, মান-অপমানবোধ এই সব দূরেই রাখতে হয়। কিন্তু এইটা চাকরির বিষয় নয়। এটা হলো আমার লেখকতা নিয়ে বিদ্রুপ। জাফর আমার সাথে খুব বড় ফাজলামো করছে। এইটা আমি সহ্য করব না।
একটু পরে অফিসে শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী ছাপা হয়ে চলে এল। আমাদের সহকর্মী ও বন্ধু উত্পল শুভ্রর অভ্যাস আগেভাগে পত্রিকা পড়ে ফেলা। এখনো আমি দেখছি, ও পিয়নের হাত থেকে সাময়িকী ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। আগেভাগে পড়বে। পত্রিকা বাজারে যাওয়ার আগেই।
একটু পরে এল ও। বলল, চল, চা খাই। তোর গল্পটা পড়ি নাই। পড়ব।
আমার গল্প মানে?
তোর গল্প ছাপা হচ্ছে, জাফর তোকে বলে নাই।
বলছে, কী গল্প?
এই যে…‘ছাপাখানায় একটা ভূত থাকে’/আনিসুল হক…
আমি ওর হাত থেকে পত্রিকাটা নিয়ে পড়তে লাগলাম, আমাদের বাসায় আমরা বাস করি মিনির মায়ের মতো করে। মিনির মাকে আশা করি আপনারা চিনেছেন। উনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পের যে মিনি, তার মা। তার ধারণা ছিল, পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমাশ, আরশোলা-শুয়োপোকা, সাপ-বাঘ তার বাসার দিকেই ধেয়ে আসছে। আমাদের ধারণা ঠিক অতটা আন্তর্জাতিক নয়। পৃথিবীর সব চোর-ডাকাত আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে ধেয়ে না এলেও দেশের সব কুখ্যাত ভয়ঙ্কররা যে আসছে, তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। আমরা শুয়ে পড়ি রাত সাড়ে এগারোটায়, ওঠি সকাল সকাল। মেয়ের স্কুল, কর্ত্রীর অফিস।
এমনি এক বাসায় রাত সাড়ে এগারোটায় দোরঘণ্টি বেজে উঠল ভয়াবহ আর্তনাদের মতো…
আমার কপালে ঘাম জমছে। আমি তো গল্পটা জাফরের হাতে এখনো দিইনি। তাহলে?
আনিসুল হক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৪, ২০০৯