নদীপথে

নদীপথে

মিঙ্গিন স্টিমার

২৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪
সোমবার। সন্ধ্যা

শনিবার রাত দশটায় ছেলেরা স্টিমার থেকে নেমে গেলে অল্পক্ষণ পরেই শুয়ে পড়া গেল। রাত দুটোয় একবার উঠেছিলাম। চার দিকে আলো। স্টিমার পুল খোলার প্রতীক্ষা করছে।

রবিবার প্রাতে উঠে স্টিমার কতদূর এল খোেজ নেবার জন্য বাইরে এসে দেখি, সামনেই জগন্নাথ ঘাটৈর সিন্টমারের গুদাম ও আপিস। ব্যাপার কী? সারেং এসে খবর দিল যে, শনিবার শেষরাত্রে পুল খোলার সময় বিলাতি ডাক এসে পড়ায় তখন পুল খোলা যায়নি, এবং পরে আর খোলা সম্ভব ছিল না, সুতরাং রবিবার শেষরাত্রের পূর্বে স্টিমার ছাড়বে না। আবার বাড়ি যাওয়া ও ফিরে আসার হাঙ্গামা মনে করে রবিবার সমস্ত দিন ও রাত জগন্নাথ ঘাটের সামনে গঙ্গার মাঝে কাটিয়ে দেওয়া গেল–যখন তোমরা মনে করছিলে যে আমি বহু দূর চলে গেছি। কলকাতার নীচের গঙ্গার উপর যে একটা বিচিত্র জীবনযাত্রা প্রতিদিন চলে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল। ভোর হতেই নদী জুড়ে নানারকম নৌকার ও নানা চেহারার বাষ্পপীয় জলযানের ব্যস্ত গতায়াত আরম্ভ হয়–লোক নিয়ে, মাল নিয়ে এবং বাহ্যিদৃষ্টিতে অকারণে। দুপুরের পর এ গতি কিছু মন্দা হয়ে আসে; আবার বিকাল হতে-না-হতেই নদী যেন গা-মোড়ামুড়ি দিয়ে আলস্য ভেঙে ওঠে। নৌকার দলের গতি দ্রুত হয়, বাষ্পীয় যানগুলি গম্ভীর ও তীক্ষু আওয়াজ করতে করতে জলচর প্রাণীর মতো উজান ভাটিতে ছুটতে থাকে। মধ্যাহ্নের জনবিরল নদী লোকসমাগমে ভরে ওঠে। একটা দিন এই দেখে কাটল।

রবিবার রাত সাড়ে চারটেয় হাওড়া-পুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে স্টিমার ছেড়েছে। একখানা ফ্ল্যাট বা পাশে প্রথম থেকেই বাধা ছিল। সোমরা সকাল ছাঁটায় বজবজে ডান দিকেও আর-একখানা ফ্ল্যাট বাঁধা হয়েছে। দু’দিকে দুই ফ্ল্যাট নিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে আমাপের স্টিমার চলেছে। স্টিমারখানি ভাল ও নূতন। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জল ও পাট দিয়ে প্রতিদিন ডেক মাজা হচ্ছে। আমিই একমাত্র যাত্রী। সুতরাং সবগুলি কেবিন যাদৃচ্ছি ব্যবহার করছি।

সারেংটির বাড়ি নোয়াখালি। মাথায় একটু ছিট আছে। পয়ত্ৰিশ বছর স্টিমারে কাজ করছে, এখন মাইনে একশো আশি টাকা। আমাকে জানালে যে, চামড়া কালো বলে মাইনে এত কম; সাদা চামড়া হলে পাঁচ-ছাঁশো হত। এবং এই চামড়ার তফাতের জন্যই নাকি, যদিও তার স্টিমারে একজন ভারী বাবু যাচ্ছে, তবুও স্টিমার-কোম্পানি সামনের ডেকে একটাও ইজিচেয়ার দেয়নি, দুটো বেতের কুর্সি দিয়েই সেরেছে। আগের বছর এই স্টিমারেই এক সাহেব গিয়েছিল, বিশেষ ভারী নয়; তখন ইজিচেয়ার, পারদা এবং পাঁচ মন বরফ ছিল। পাঁচ মন না হলেও বরফ এবারও আছে। সেই বরফে তরিতরকারি তাজা রাখা হচ্ছে। এই যে দুদিকে দুই ফ্ল্যাট বেঁধে দেওয়া, সারেঙের মতে এও একটা সাদা-কালোর ভেদবুদ্ধির ব্যাপার। আমাদের স্টিমারের সঙ্গে আরও একখানা সুন্দরবনগামী স্টিমার ছেড়েছে। বজবজের ফ্ল্যাটখানি নাকি তারই নেবার কথা। কিন্তু তাতে তিন-চারটি সাহেব যাচ্ছে বলে এই উলটো ব্যবস্থা হয়েছে।

বেলা সাড়ে দশটায় ডায়মন্ড হারবার ছড়িয়েছি। সেখান থেকেই নদী বেশ প্রশস্ত। স্টিমার বা পাড় ঘেঁষে এসেছে। ঢালু পাড়; অনেক জায়গায় প্রায় জল পর্যন্ত ঘাস ও ছোট ছোট গাছ-গাছড়া কোথাও কাছে, কোথাও দূরে লোকের বসতি। অন্য পাড়ে গাছের ঘন সবুজ সরু রেখা ছাড়া কিছু দেখা যায় না।

বেলা প্রায় চারটেয় স্টিমার বড় নদী ছেড়ে একটি সরু খালে ঢুকেছে৷ খালের নাম ‘নামকানা’ খাল। এত সরু যে, দুই ফ্ল্যাটসমেত আমাদের স্টিমার তার প্রায় সবটাই জুড়ে থাকে। এই খাল দিয়ে অতি আস্তে আস্তে চলে ঘণ্টাখানেক পরে একটি মোটের উপর প্রশস্ত নদীতে পড়া গেল, নাম সপ্তমুখী’। কিন্তু এমন অগভীর যে সূৰ্যান্তের সঙ্গে সঙ্গে স্টিমার নোঙর করতে হল। জোয়ার এলে তবে চলবে। নামকানা খােলই সুন্দরবনের আরম্ভ। কিন্তু খালের দুই পাশে এবং সপ্তমুখী নদী যতটা এসেছি তার পড়ে এখন আর বন নেই। চাষ-আবাদ ও লোকালয়। সারেং বললে, আরও চার ঘণ্টা চলার পর সুন্দরবনের বন আরম্ভ হবে।

শীত যেমন ভাবা গিয়েছিল তেমন কিছু নয়। আজ সমস্ত দিন স্টিমার দক্ষিণে চলেছে, সুতরাং উত্তরের হাওয়া লাগেনি। সামনের ডেকে সারাদিন রোদ। আরামে চলে এসেছি।

জোয়ার এসেছে। নোঙর তুলে স্টিমার চলতে আরম্ভ করল। রাত প্রায় আটটা। খুলনা পৌঁছনো পর্যন্ত রাতদিন স্টিমার চলবে, কোথাও থামবে না।

 

২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৪
মঙ্গলবার। সন্ধ্যা

আজ ভোর থেকে এবং কাল রাত্রে যখন ঘুমিয়ে ছিলুম তখন থেকেই স্টিমার চলেছে আঁকাবাঁকা সব ছোট ছোট নদী দিয়ে। মাঝে মাঝে বেশ প্রশস্ত নদী পাওয়া যাচ্ছে। … … চোখ চলে ডালপালা-বিরল সোজা সরু গাছ ও আগাছার ঘন জঙ্গল। … … ও জনমানবের চিহ্ন নেই। আকাশে পাখি নেই, কাকও নয়। মাঝে … … গাঙচিল উড়ে যাচ্ছেল আর দুটো-একটা বক জলের ধারে স্তব্ধ তন্ময় … … মৎস্যচিন্তা করছে। বনের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট সব খাল এসে নদীতে পড়েছে। আমরা যে-সব নদী দিয়ে যাচ্ছি তা ছাড়া বহু ছোট-বড় নদী চারদিকে বয়ে চলেছে। কোনও জায়গায় একখণ্ড বনে ঢাকা জমির তিন দিকেই নদী–দেখতে চমৎকার। এ-সব নদী-নালার মধ্য দিয়ে পথ চিনে স্টিমার চালানো অভ্যাসের কাজ। সারেং বললে যে, এ পথ সম্বন্ধে সারেংদের পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। বনের ধারে ধারে টিনে সাদা রং দিয়ে পথের চিহ্নও অনেক জায়গায় দেওয়া আছে।

বেলা আন্দাজ সাতটায় সুন্দরবন ডেসপ্যাচ-সার্ভিসের একখানা কলকাতাগামী স্টিমারের সঙ্গে দেখা হল। নাম ‘বুরানওয়ালি’। দু’খানা ফ্ল্যাট দু’দিকে নিয়ে চলেছে। সেখানে নদী এত ছোট যে আমাদের স্টিমার একপাশে দাড় করিয়ে তাকে পথ দিতে হল।

বেলা প্ৰায় সাড়ে এগারোটার সময় একখানা ছোট নৌকা দেখা গেল। বোঝা গেল লোকালয় কাছে এসেছে। অল্পক্ষণ পরে নদীর ধারে গাছের তলায় কয়েকটা বানরের দেখা পাওয়া গেল। শুনলুম অনেক ভাগ্যবান লোক আমার মতো সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে স্টিমারে যেতে হরিণের দল ও রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ দেখতে পেয়েছে। আমার ভাগ্য বানরের উপর আর উঠল না।

মুসলমানদের এটা রোজার মাস। স্টিমারের দোতলার পিছনের ডেকে যেখানে মাল বোঝাই আছে তার কতকটা পরিষ্কার করে তেরো-চোদ্দোজন স্টিমারের খালাসি ও কর্মচারী সূৰ্যাস্তের পর নামাজ পড়ে। একসারে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ওঠাবসা করে; দেখতে বেশ। এর অনেকটাই যে আমাদের পূজা-অৰ্চার মতোই বাহ্যিক কসরত মাত্র তা মনে করতে ঠিক এখন ইচ্ছা হচ্ছে না। নমাজের পর সকলে গোল হয়ে বসে রোজা ভাঙে অর্থাৎ খেতে আরম্ভ করে। এক-এক থালায় দু-তিনজন খাচ্ছে। খাদ্য ডাল ভাত এবং একটা কিছু তরকারি। এরা সমস্ত দিন উপবাসী থেকে স্টিমারের খালাসির হাড়ভাঙা খাটুনি মুখ বুজে সমানে খেটে যাচ্ছে। পূর্ব-বাংলার এই মুসলমান খালাসিদের দেখে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটু ভরসা হয়।

সারেং বলছে, আজ রাত আন্দাজ দশটা-এগারোটায় স্টিমার খুলনা পৌঁছবে। তারপর খুলনা থেকে বরিশাল যাবে চার-পাঁচ জায়গায় থেমে মাল নামাতে নামাতে। স্টিমারের কেরানিবাবু (বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক) বললেন যে, বৃহস্পতিবারের পূর্বে বরিশাল পৌঁছানো যাবে না। আমার রবিবার কলকাতা পৌঁছতেই হবে। সুতরাং এবার আর গৌয়ালন্দ পর্যন্ত যাওয়া হল না। বরিশাল থেকেই বরিশাল-খুলনা এক্সপ্রেস স্টিমারে খুলনা হয়ে কলকাতা ফিরব।

 

২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বুধবার। ভোর ৭টা

কাল রাত দশটায়, যখন খুলনা পৌঁছতে মাত্ৰ ঘণ্টা দুই দেরি, তখন কুয়াশার জন্য স্টিমার নোঙর করতে হল। কুয়াশা কিছু বেশি নয়; জ্যোৎস্নায় নদীর পারের গাছপালা বেশ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কুয়াশার জন্য সার্চলাইটের আলো ভাল না খোলায় শেষে নৌকা চাপা পড়ে এই ভয়ে সারেং স্টিমার নোঙর করে রাখে। আজ ভোররাত্রে ছেড়ে এই মাত্র খুলনা পৌঁছল। বেলা বারোটা আন্দাজ বরিশাল রওনা হবে। এখন নেমে তোমাদের একটা টেলিগ্রাম করতে ও এই চিঠি পোস্ট করতে যাচ্ছি। এ-সব কাজ স্টিমারের লোকেরাই করত, কিন্তু শহরটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছা।

 

২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪

বুধবার। সন্ধ্যা

বেলা দশটার মধ্যেই স্টিমার খুলনা ছেড়ে রওনা হল। এখন চলেছি মানুষের ঘরকন্নার সাথি ছবির মতো ছোট নদী দিয়ে। দুই পাড়ে ধানক্ষেত। ধান কাটা শেষ হয়েছে। বাদামি রঙের ফাকা মােঠ; গোরু চরছে। মাঝে মাঝে চৌকো সরষেক্ষেত, হরিত-কপিশ–সব ফুল এখনও ফোটেনি। একটু পর-পরই লোকালয়; খোড়ো ঘর, ঢেউ-তোলা টিনের ঘর–আম, নারকেল, কলাগাছে ঘেরা। কচিৎ একটা পাকা বাড়ি, সম্ভব জমিদাববাবুদের। স্নানের ঘাটে লোকের ভিড়; পাড়ের উপর ছাগলছোনা লাফাচ্ছে। কোথাও নদীর ধারে হাটের জায়গা; বেড়াহীন ছোট ছোট টিনের চালা, গোটকয়েক টিনের চাল টিনের বেড়ার ঘর–স্থায়ী দোকান ও মহাজনদের গুদাম৷ উজান-ভাটিতে নৌক চলেছে নানা ধরনের–পাল তুলে, দাড় টেনে, লাগি ঠেলে। পাড়ের উপর দিয়ে লোক-চলাচলের পথ, নানা বেশের লোক চলেছে–কারও মাথায় ছাতি, কারও কঁধে মোট। নদীর দুই পারে দূর দিয়ে চলেছে শ্যামল গাছের সার। এ নদীর যাঁরা নাম দিয়েছিল মধুমতী, তাদের রুচির প্রশংসা করতে হয়।

ক্ৰমে দুপুর গড়িয়ে গেল। স্নানের ঘাট সব খালি হয়ে এসেছে। এক-এক জন লোক তাড়াতাড়ি এসে চট করে দুটো ডুব দিয়ে তখনই উঠে যাচ্ছে।

আমাদের সারেং রহমত আলির নৌক চাপা দেবার ভয় অত্যন্ত বেশি। বোধহয় কোনওদিন ও কাজ করে বিপদে পড়েছিল। কিন্তু খোঁড়ার পা-ই খানায় পড়ে। বেলা যখন দুটো, আর স্টিমার এসেছে কালিয়া গ্রামের কাছাকাছি, তখন স্টিমারের বাঁ দিকের ফ্ল্যাটের সঙ্গে একখানা বড় পাট-বোঝাই নৌকার একটা মৃদু-রকম ঠোকাঠুকি হল। ফলে নৌকখানি হল কিঞ্চিৎ জখম, তবে বেশি কিছু নয়। দোষ কাকেও বড় দেওয়া যায় না। দুই ফ্ল্যাট সমেত আমাদের স্টিমারের এই ছোট নদীতে ঘোরাফেরা একটু সময়সাধ্য, আর জোর বাতাস থাকতে চেষ্টা করেও নৌকাখানা সময়মতো সরে যেতে পারেনি। এরকম ঘটনা ঘটলে সারেংকে নিকটবতী পুলিশ-থানায় রিপোর্ট পাঠাতে হয়। স্টিমারের লোকজনদের মধ্যে অনেক জেলার লোক ছিল–চাটগাঁ, নোয়াখালি, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিং।। দেখলুম। সকলে একমত যে, এ অঞ্চলের লোক বড় সহজ নয়; তিলকে তাল করে তোলার মতো কল্পনার জোর নাকি এদের প্রচুর আছে। সারেঙের ইচ্ছ, তার রিপোর্টটা ইংরেজিতে লেখা হয়। স্টিমারে চলনসই। ইংরেজি লেখকের অভাব, সুতরাং ঘটনার রিপোর্টটা লিখে দিতে হল। কালিয়া স্টেশনে স্টিমার থামিয়ে স্টেশনমাস্টারবাবুকে সেই রিপোর্ট দেওয়া হল থানায় পাঠিয়ে দেবার জন্য। তার মুখে শুনলুম, এখানে ইতিমধ্যেই রটে গিয়েছে যে, স্টিমার একখানা পাঁচশো-মনি বোঝাই নৌক চাপা দিয়ে একবারে ডুবিয়ে দিয়েছে। কালিয়া ছাড়বার অল্পক্ষণ পরে স্টিমারের কেরানিবাবু এলেন একটা লেখার খসড়া নিয়ে। তিনি নাকি স্টিমারের নিবপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তি; এরকম ঘটনার একটা রিপোর্ট তাকেও লিখে রাখতে হয়। যা লিখেছেন তা তাঁর মনঃপূত হচ্ছে না। লেখার উপর চোখ বুলিয়েই কারণটা বুঝলাম। সেটা আমার লেখা সারেঙের রিপোর্টেব্য হুবহু নকল। কী করা যায়–ওকেই অদল-বদল করে নিরপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তির রিপোর্ট করে দেওয়া গেল।

 

২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বৃহস্পতিবার

খুলনা ছাড়িয়ে এখন বরিশাল জেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আজ ভোর থেকেই নদীর দুই পাড়ে নারকেল-সুপারির সার চলেছে অবিচ্ছেদে। কিন্তু নদীর চেহারা গেছে বদলে। দুই পাড়ের সুস্পষ্ট সীমারেখার মধ্যে বহতা নদীর যে সুষমা। এ নদীর তা নেই। খুলনার নদীর চেয়ে এ নদী প্রশস্ততর, কিন্তু এর দুই পাড়ই ঢালু, আর সে পাড় বালুর নয়, কাদার। নদীতে স্নানের ঘাট বড় দেখছিনে। গ্রামগুলি সব নদীর থেকে দূরে দূরে। কালকের খুলনার নদী ছিল তরুণী কলহাসিনী গৃহলক্ষ্মী, আর এ যেন ঈষৎস্কুলাঙ্গী প্রৌঢ়া গৃহিণী–সিঁথিতে সিন্দূর, পরনে চওড়াপাড় শাড়ি, কিন্তু কপোলে কপালে কৰ্কশ বলিরেখা দেখা দিয়েছে।

আমাদের সারেঙের মতে বরিশালের লোকের মতো সুখী লোক কোথাও নেই। এদের সকলেরই যথেষ্ট ধানের জমি আর নারকেলের বাগান আছে, যাতে ধান ও নারকেল ফলে অসম্ভব রকম। এদের নাকি ধারকর্জে নেই। আর প্রায় সকলের বাড়ির কাছ দিয়েই নদী কি নালা গিয়েছে, তাতে মাছের যেমন ভাবনা নেই, যাতায়াতেরও তেমনি সুবিধে। যে বাড়ির পাশ দিয়ে নদী কি নালা যায়নি সে বাড়িতে নাকি লোকে সহজে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। এই সঙ্গে সারেং আরও একটা খবর জানালে। খুলনার মেয়েরা নাকি লঙ্কামরিচ বাটে না; তাদের রান্না যে কী করে হয় তা রহমত আলির বুদ্ধির অতীত।

আমাদের এ স্টিমার সব স্টেশনে থামে না; যেখানকার মাল আছে কেবল সেখানেই থামে। আর একশো মনের চেয়ে কম হলে সে স্টেশনের মাল এ স্টিমারে বোঝাই হয়নি। কিন্তু যে স্টেশনে থামছে সেখানেই দেরি হচ্ছে অনেক। কারণ স্টিমারকে স্টেশনে ভিড়তে হচ্ছে আগে ফ্ল্যাট-দুখানি মােঝ-নদীতে খুলে রেখে; আবার যাবার মুখে ও-দুখানিকে দু’পাশে বেঁধে নিতে হচ্ছে। এইরকম কসরত করতে করতে বেলা দশটার পর পৌঁছলুম হুলার হাট স্টেশনে। স্টেশনটি একটু বড় এবং এর মালও আমাদের স্টিমারে আছে যথেষ্ট।

 

২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা

সাড়ে-তিনশো মন মাল নামিয়ে হুলার হাট ছাড়তে বেলা বারোটা বেজে গেল। বেলা প্ৰায় দেড়টার সময় পৌঁছলুম কাউখালি বলে এক স্টেশনে। ছোট স্টেশন, মালও নামল অল্প। আর সৌভাগ্যক্রমে এবারে ফ্ল্যাট নিয়েই স্টিমার পাড়ে লাগতে পারল। ভাবলুম কাউখালি ছেড়ে রওনা হতে দেরি হবে না। এমন সময় সারেঙের অ্যাসিস্ট্যান্ট এক ছোকরা জানালে যে, স্টিমার এখন এইখানেই নোঙর করে থাকবে যতক্ষণ না ভাঁটা আরম্ভ হয়। আর খুলনাগামী বরিশাল এক্সপ্রেস স্টিমার পাস না করে–অর্থাৎ রাত প্ৰায় সাড়ে আটটায়। সারেং এসেও সেই খবর দিল। এখান থেকে বরিশাল যেতে, কতক দূর যেতে হয় একটা সরু খাল দিয়ে। সেইজন্য নিয়ম যে, ফ্ল্যাটগ্ৰস্ত স্টিমারগুলি বরিশালের দিকে যাবে ভাটার সময়, আর বরিশাল থেকে আসবে যখন জোয়ার।

কাউখালির স্টেশনমাস্টারবাবু দেখা করতে এলেন। পরিচয় দিলেন তিনি আমার স্বজাতি। অবশ্য সারেঙের কাছে উপাধিসমেত আমার নামটা শুনেছেন। তার বাড়ি এই জেলাতেই ঝালকাটির কাছে; গ্রামের নামটা ভুলে গেছি। এখানে পাঁচ বছর আছেন। স্টেশনের লাগাও কোয়ার্টার্স, গোলপাতার। কাছেই একটা বন্দর, স্টিমার থেকে দেখা যায়। কাছাকাছি লোকজন অনেক আছে। কিন্তু এ জায়গায় নাকি খাবার জিনিসের ভারী অসুবিধা। বাঙালির খাবার দুধ আর মাছ, তা এ নদীতে মাছ বেশি পাওয়া যায় না; আর দুধের সের যখন অন্য সব জায়গায় পাঁচ-ছ’ পয়সা তখন এখানে, ঠিক কত বললেন মনে নেই, তবে তিন আনার কাছাকাছি একটা মারাত্মক সংখ্যা। নেমে গিয়ে চারটে ডাব পাঠিয়ে দিলেন। একটা খেয়ে দেখলুম। অতি চমৎকার মিষ্টি জল। রোজা ভাঙার পর শরীর ঠান্ড করবার জন্য সারেংকে একটা দিলুম। সে বলছে তার মন ভাল নেই। তিনজন খালাসির জ্বর, একজনের হাতে চোট লেগেছে। শর্ট হ্যান্ডে কাজ চালাতে হচ্ছে। বোধহয় কালকের কালিয়ার কাছের ব্যাপারটারও মন খারাপের সঙ্গে কিছু সম্পর্ক আছে।

স্টেশনের কিছু পুবে পশ্চিম-মুখ হয়ে স্টিমার নোঙর করল। এই নদীর নাম কাউখালির খাল। বয়ে যাচ্ছে এখানে পুবে-পশ্চিমে। অল্পদুর পুবে নদীটি দু’ভাগ হয়ে এক ধারা গেছে উত্তরে বানারিপাড়ার দিকে, আর দক্ষিণে সরু। ধারাটি পার হয়ে আমরা যাব বরিশাল। ডাইনে সুপারি-নারকেলের দেয়ালে ঘেরা অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি দুটি ধানক্ষেত। সব ধান কাটা হয়নি, বোধহয় শুকিয়ে গেছে; কেমন একটা শুষ্ক নিস্ফল চেহারা। বানারিপাড়ার বাঁকের কাছটিতে গাছপালাগুলি বুকে পড়ে নদীর আয়নায় মুখ দেখছে। তার উলটো দিকে নদীর ঠিক পাড়ের উপরেই একটা বড় সুপারি।-বাগান। নদীর ধার দিয়েই রাস্তা, বোধহয় যাচ্ছে বন্দরের দিকে। বড় বড় নৌকা গুণ টেনে চলেছে সেই রাস্তা দিয়ে।

সূৰ্য পশ্চিমে ঢলতে আরম্ভ করেছে। ডেক রৌদ্রে ভরা। সামনের নদীর জল গলানো সোনা, চোখ ঝলসে যায়।

বেলা পড়তে শুরু হল। নদীর পাড়ের রাস্তাটি দিয়ে লোক-চলাচল আরম্ভ হয়েছে। খানিকটা ফাঁকা জায়গাতে অনেকগুলি ছেলে জুটে হাডু-ডু খেলছে। ছোট ছেলেদের এক দল, আর তার চেয়ে বড়দের এক দল। তাদের চেয়ে বড় চার-পাঁচটি ছেলে খেলছে না; নানা রঙের র্যাপাব। গায়ে, দাঁড়িয়ে গল্প করছে ও খেলা দেখছে। এরা সম্ভব মাতকাবর বনে গেছে। সুপারিনারকেল বনের ওপারে সূর্য অস্ত গেল। পশ্চিম-আকাশে আর নদীর জলে গোলাপি আভা। ক্রমে সন্ধ্যা ঘোর হয়ে আসছে। উত্তর-পারে খানচারেক বড় নৌকা এক সার বেঁধে নোঙর করল। দক্ষিণের রাস্তায় একজন একটা হ্যাসাক জ্বালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বন্দর থেকে বোধহয় গ্রামের দিকে। আমাদের স্টিমারের পিছনের ডেকে নমাজের আজান দিচ্ছে। চারদিক ক্ৰমে স্তব্ধ অন্ধকার হয়ে এল। কেবল মাঝে মাঝে নৌকার দাঁড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

 

২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৪
শুক্রবার

কাল রাতে এক্সপ্রেস স্টিমার চলে গেলে রাত দশটায় আমাদের স্টিমার নোঙর তুলে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু কয়েকশো গজ গিয়েই বানারিপাড়ার বাঁকের মুখটার অল্প দূরে আবার নোঙর করল। কুয়াশায় সার্চলাইট খেলছে না। সেখানেই সারারাত কাটল, সকালটাও কেটে যাচ্ছে। কারণ বরিশাল-খুলনা মেল স্টিমার পাস না করলে যাবার জো নেই। সে স্টিমার এখানে পৌঁছবার কথা সকাল ন’টায়, কিন্তু দশটা বেজে গেলেও তার দেখা নেই। খুলনা থেকে বরিশাল এক্সপ্রেস স্টিমার এখান দিয়ে রাত তিনটেয় যাওয়ার কথা, গেল বেলা প্ৰায় নটায়। কুয়াশার খেলা। ‘আলোরে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে।’

গেল মাছ কিনতে। স্টিমার যেখানে নোঙর করে আছে তার কাছেই বাজার। সূর্যোদয়ের কিছু পর থেকেই বহু ছোট নৌকা বাজারের দিকে চলেছে পসরা নিয়ে। তরিতরকারির নৌকা, বোধহয় অল্প মাছের নৌকা, আর বেশির ভাগ নৌকার জিনিস হচ্ছে ধান ও খেজুরের রস। খেজুরের রস নৌকা করে স্টিমারে বিক্রি করতে এনেছে।

বাটলার ও উপেন মাছ কিনে ফিরল। একটা ছোট রুই মাছ ও একটা ইলিশ মাছ এনেছে। মাছ নাকি বাজারে বেশি নেই। কাউখালির স্টেশনমাস্টারবাবু কালই সে অভিযোগ করেছিলেন। স্টিমার সরু খালটিতে ঢুকলা। খালের নাম বারুশী কি বারণী তা নােয়াখালি জেলার সারেং ও চাটগাঁ জেলার তার অ্যাসিস্ট্যান্টের উচ্চারণে ঠিক বোঝা গেল না। যা হোক, ফ্ল্যাটসমেত স্টিমারের পক্ষে খাল যে বারণী তাতে সন্দেহ নেই। খালে ঢুকেই এতে চলাফেরায় এত বিধি-নিষেধের কারণ বোঝা গেল। খালটি এত সরু যে দু’ফ্ল্যাট-সুদ্ধ আমাদের স্টিমার তার প্রায় সবটাই জুড়ে চলেছে। খালে ঢোকার অল্প পরেই খুলনা-যাত্রী মেল স্টিমারের সঙ্গে দেখা। আমাদের স্টিমার দাড় করিয়ে কোনও গতিকে তাকে পথ দেওয়া হল।

লোকালয়ের ভিতর দিয়ে খালটি বেঁকে বেঁকে চলেছে। বরিশালের সব জায়গার মতো দু’ধারে নারকেল খেজুর সুপারির বন। ঘরের চালে লাউ-এর লতা, আশেপাশে কলাগাছ। খাল থেকে সরু সরু সব নালা বেরিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে গেছে। তাদের উপর বাঁশের বঁকানো উচু সাঁকো, কচিৎ কাঠের পুল।

খাল যখন এসে বড় নদীতে পড়ল তখন বোলা প্ৰায় একটা। সেই বড় নদীর একরকম মুখেই ঝালকাটির স্টেশন ও বন্দর। এই ঝালকাটি স্বদেশির যুগে যে খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল তা সম্ভব মনে আছে। ফ্ল্যাট দুখানি খুলে রেখে স্টেশনে লাগতে লাগতে প্ৰায় দুটো বাজল। এ স্টিমার বরিশাল পৌঁছতে রাত প্ৰায় নটা-দশটা হবে। বরিশাল থেকে এক্সপ্রেস স্টিমার ছেড়ে আসে সন্ধ্যা ছাঁটায়। সুতরাং এবার আমার বরিশাল-দর্শন বরিশালের সৌভাগ্যে হল না। ঝালকাটিতেই নেমে পড়া গেল। বরিশাল থেকে খুলনা এক্সপ্রেস স্টিমার এখানে রাত আটটায় পৌঁছবে। ততক্ষণ ঝালকাটিতেই অপেক্ষা করব।

স্টিমারের লোকের ও স্টেশনের লোকের উপদেশে এখানকার ডাকবাংলায় এসে উঠেছি। সারেং ও স্টিমারের পাঁচ-ছ’জন খালাসি সঙ্গে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল। এখানকার স্টিমারআপিসের লোকেরাও খোঁজ-খবর নিচ্ছে। এইমাত্র একজন মুসলমান কর্মচারী ডাকবাংলায় এসে জিজ্ঞাসা করে গেলেন, কোনও কিছুর প্রয়োজন আছে কি না, এবং বলে গেলেন সময়মতো আমার জিনিসপত্র নিতে লোক পাঠিয়ে দেবেন, আমি যেন কোনও চিন্তা না করি। ডাকবাংলাটি স্টিমার-ঘাট থেকে বেশি দূর নয়। দু’কামরা টিনের ঘর, বাঁশের সিলিং ও বেড়া। মেঝে সিমেন্ট করা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে এই চিঠি লিখছি। সামনে রাস্তাব ওপারেই একটা বড় ধানক্ষেত। ধান পেকেছে, এখনও কাটা হয়নি। তারপর নদী। নৌকার চলমান পাল দেখা যাচ্ছে। ওপারের সুপারি-নারকেল-বনের নীচ দিয়ে চলন্ত বড় নৌকার ছই দেখতে পাচ্ছি। উত্তর দিকটায় নদীর জল অনেকটা দেখা যাচ্ছে–রৌদ্রে গলা ইস্পাতের মতো ঝকঝকি করছে। তার এক পাশে স্টেশনের ফ্ল্যাটের কুশ্ৰী দেহটা।

ডাকবাংলার সামনের ছোট মাঠটায় দুটি খঞ্জন নেচে বেড়াচ্ছে। রোগা একটা বাছুর ঘাস খাচ্ছে। সামনে রাস্তার পাশে চারটে ঝাউগাছ। একটার গা ঘেঁষে এক খেজুরগাছ, হাঁড়ি বঁধা রয়েছে। একটা কাক হাঁড়ির মুখে গলা ঢুকিয়ে রসাকর্ষণের বৃথা চেষ্টা করছে। ডাকবাংলার উত্তর ঘেঁষে এক ঘোলা জলের ডোবা। তার ওপারে মিউনিসিপ্যাল আপিস, তার পর পুলিশের থানা। তারপরে বাজারের সব টিনের চাল দেখা যাচ্ছে। ছ’দিন জল-প্রবাসের পর ডাঙার জীবের ডাঙা মন্দ লাগছে না।

 

‘মুলতানি’ স্টিমার

২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৫
সন্ধ্যা

এবারে কাল যখন স্টিমার ঝালকাটি পৌঁছল তখন সন্ধ্যা ঘোর হয়েছে। দু’খানা ফ্ল্যাটের একখানাকে এখানেই খুলে রাখা হল; ওতে নাকি কাছাড়ের মাল আছে, অন্য স্টিমারে টেনে নিয়ে যাবে। সুমামাদের এ স্টিমার কলকাতা থেকে বরাবর কোথাও না-থেমে এসেছে; কেবল খুলনাতে আড়কাঠি তুলে নেবার জন্য নদীর মধ্যেই অল্পীক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। আমার বাটলারের এবং স্টিমারের লোকজনদের কাঁচা রসদের পুজি ফুরিয়ে এসেছে। সুতরাং তা সংগ্রহের চেষ্টা ঝালকাটিতে স্টিমার লাগানো হল। এ অসময়ে তরিতরকারি কিছু পাওয়া গেল না। বাটলার মাছ ও মুগের ডাল কিনে আনল। পথে আমার খাদ্য সংগ্রহের জন্য স্টিমার-কোম্পানি কিছু-কিঞ্চিৎ অবশ্য বাটলারের হাতে দিয়েছিল। সেটাকে উপেক্ষা করে বাটলারের নামবার সময় সে জন্য তাকে কিছু দিয়ে দিয়েছিলুম। মনে হচ্ছে বুড়ো বাটলারের কর্মে উৎসাহ ও সেলামের বহর দু-ই বেড়েছে।

ফ্ল্যাট খোলার জন্য আমাদের স্টিমার যেখানে থেমেছিল সেখানে মিরভি’ নামে একখানা স্টিমার যাত্রার জন্য প্ৰস্তুত হয়ে ধোয়া ছাড়ছিল। আমাদের সারেং ডাকাডাকি করে তথ্য সংগ্ৰহ করলে যে, সে স্টিমার চাদপুর হয়ে ঢাকা যাবে। আমাদের এ স্টিমারে গুটি-পনেরো-ষোলো যাত্রী আছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন যাবে চাদপুর। মরভি স্টিমারের সারেঙের সঙ্গে কথা বলে চাদপুর-যাত্রীদের ওই স্টিমারে তুলে দেওয়া হল। বন্দোবস্তাটি সম্ভব ঘরোয়া; স্টিমার-কোম্পানির সঙ্গে সম্বন্ধ নেই।

এবারেও এখন রোজা চলছে। এই যাত্রীরা দিনের উপবাসের পর সন্ধ্যায় নামাজের শেষে কোনওদিন চিড়েভাজা, কোনওদিন ছোলাভাজা দিয়ে রোজা ভাঙে। রাত একটু হতে-না-হতেই খাওয়া শেষ করে–ভাত, ডাল, একটা কিছু ভাজা কি তরকারি। সকলে সার দিয়ে বসে যায়, একজন পরিবেশন করে। রাত একটু গভীর হলেই সমবেত কষ্ঠে ধর্মসংগীত গাওয়া হয়। গানের মধ্যে ‘আল্লা রসুল’ এই কথাটা মাত্র ধরতে পেরেছি। কাল আর গান হল না; বোধহয় মূল গায়েন চাদপুরের যাত্রী ছিল।

স্টিমার বরিশাল পৌঁছেছিল রাত প্ৰায় বারোটায়, আজ ভোরে সারেঙের মুখে শুনলুম। সেখানে স্টিমার বাধেনি। সারেং নবাব আলির বাড়ি চট্টগ্রাম, খাস শহর চট্টগ্রামে। এ কথা নবাব আলি একটু গর্বের সঙ্গে প্রথম দিনই আমাকে জানিয়েছিল। স্টিমারে আর যাঁরা সব চট্টগ্রামের লোক আছে তাদের কারও বাড়ি শহরে নয়, শহর থেকে অন্তত বিশ-পাঁচিশ মাইল দূর দূর। নবাব আলি লোকটির বয়স বছর-পঞ্চাশ হবে। বেশ গোলগাল চেহারা। খাবার হজম হয়, এবং অধিকাংশ খাদ্যকে চর্বিতে পরিণত করার রাসায়নিক ব্যবস্থা শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে আছে।

বরিশাল ছাড়িয়ে কিছু পরেই কুয়াশার জন্যে স্টিমার নোঙর করে রাখতে হয়েছিল। সকালেও এমন ঘন কুয়াশা ছিল যে, বেলা প্রায় আটটার আগে স্টিমার রওনা হতে পারেনি। দুপুরের আগে থেকেই নদী প্রশস্ত হতে আরম্ভ করেছে। দুপুর যখন গড়িয়ে গেল তখন নদী বেশ চওড়া, আকাশের অনেকখানির ছায়া জলের মধ্যে পড়েছে। খুলনা-বরিশালের মানুষের ঘর-গৃহস্থলির সঙ্গে মিশে-থাকা ছোট সব নদী ছাড়িয়ে এসেছি; এ নদীতে উদার পদ্মার মুক্তির ডাক এসে পৌঁছেছে। এক পাড় উচু, ভাঙন-ধরা। মাঝে মাঝে ছোট-বড় চর। সেখানে কলাগাছ-ঘেরা মানুষের বসতি। যেতে যেতে ডাইনে বাঁয়ে একেবেঁকে সব নদী বেরিয়ে চলেছেঃ নৌকার পালে অনেক দূর পর্যন্ত তাদের গতিপথ বোঝা যাচ্ছে। নদীতে ভারী হালকা বহুরকমের নৌকা। এক-একখানা ছোট নৌকার গড়নে ছবির রেখার সুষমা। মাঝে মাঝে প্ৰকাণ্ড সব ফ্ল্যাট টেনে স্টিমার চলেছে। কাচিৎ একখানা প্যাসেঞ্জার স্টিমার।

বেলা তিনটেয় স্টিমার মাদারিপুর ছাড়াল। নদী থেকে দেখা গেল, ঢেউ-তোলা টিনের ঘর ও অল্প গুটিকয়েক পাকা বাড়ির সমষ্টি।

বরিশাল এক-ফসলের দেশ। ধান কাটা শেষ হয়েছে, কাজেই নদীর পাডের মাঠ সব ফাঁকা, কেবল সুপারি-নারকেলের শ্যামলতায় প্ৰসন্ন। মাদারিপুরের পর থেকে নদীর পাড় বিচিত্র। একটু পরে পরেই হলদে সবুজ সরষেক্ষেতের সার চলেছে। মাঝে মাঝে অল্প আখের চাষ। আর তিসির ক্ষেতের চিকন ঘন সবুজে চোখ জুড়িয়ে যায়। কাছে দূরে সব গ্রাম, আম জাম ও বাঁশের কুঞ্জে ঢাকা।

বিকেল বেলা স্টিমারের কেরানি এলেন আমার টিকিটের পরিচয় তাঁর খাতায় টুকে নিতে। বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোক, কৃষ্ণলেশহীন। শুভ্ৰ শ্মশ্রু; রোমান সেনেটারের চেহারা। তেত্রিশ বছর স্টিমার-কোম্পানির কেরানিগিরি করছেন। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ভদ্রলোকটির একটু আইনের পরামর্শ দরকার। বাড়ির কাছে একখানি জমি কিনেছেন। এখন প্রকাশ হচ্ছে যে, সাধু বিক্রেতাটি ও-জমি ও অন্য জমি পূর্বেই একজনের কাছে রেহান দিয়েছিল, আর সে কথা ফাস না করে ভদ্রলোককে ও অন্যান্য লোককে সেই রেহানি জমিগুলি বিক্রি করেছে। এখন রেহানাদার রেহানি দলিলটি ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি করতে রাজি আছে, তার কেনা উচিত কি না এবং কিনলে কীরকম নালিশ রুজু করতে হবে। ব্যাপারটি কিছুই অসাধারণ নয়; এ রকম হামেশা ঘটছে। ভদ্রলোককে তার করণীয় সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া গেল।

আটটা বেজে গেছে, আমার খাবার তৈরি। এ রাত্রে স্টিমার যখন পদ্মায় পড়বে তখন সম্ভব ঘুমিয়ে থাকব। আর যদি জাগি-ও, অন্ধকারে কিছু দেখা যাবে না। আজ অমাবস্যা। খুব ভোরে কেবিন থেকে বেরিয়েই পদ্মার সঙ্গে চোখাচে্যুখি হল। আকাশ নীলাভ ধূসর, পুবে অল্প লাল রং, ভোরের অস্পষ্ট আলোতে তার সমস্তটার ছায়া পদ্মার জলের উপর রহস্যের যবনিকার মতো কঁপিছে। স্টিমার ডান পাড় ঘেঁষে চলেছে; বায়ে চক্রাকারে শীতের পদ্মার প্রশান্ত বিস্তার, বহুদূরের তরুশ্রেণির আবছায়া কালো রেখায় সীমানা টানা। কুয়াশা প্ৰায় নেই। নৌকার চলাচল আরম্ভ হয়েছে। সামনে কিছু দূরে একখানা নোঙর-করা স্টিমার দেখা যাচ্ছে। সূর্যোদয়ের পর থেকেই কিছু কিছু কুয়াশা জমতে আরম্ভ করেছে। বেলা সাতটার পর সাদা কুয়াশা এতটা ঘন হয়ে এল যে, বা পাড়ে একটা জায়গায় স্টিমার বাঁধতে হল। উচু পাড়। সামনেই একটা ছোট বসতি। খান সাত-আটেক খড়ের ঘর; দু’খানা টিনের। কয়েকটা খড়ের গাদা। গোটা-দশেক গোরু গোল হয়ে খুব নিবিষ্টমনে জাব খাচ্ছে। নদী আর বসতির মাঝের জমিটুকুতে দুটি কলাঝোপ, ছোট একখানি সরষেখেত আর অল্প গোটা-কয়েক তামাকের চারা। কয়েকজন ছেলেমেয়ে ও দু-তিনটি বয়স্ক লোক স্টিমার দেখতে দাঁড়িয়ে গেল, যদিও স্টিমারের যাতায়াত এখানকার নিত্য বহুবারের ঘটনা।

স্টিমারের পাশ দিয়ে ক্ৰমাগত জেলে-নৌকা চলেছে। স্টিমারের লোকেরা মাছ কেনার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। ‘হালদার, মশায় প্রভৃতি অনেক সম্মানের সম্বোধনে জেলেদের ডাকা হল; কিন্তু কারও নৌকাতেই নেই, তাঁরা সবে মাছ ধরতে বেরিয়েছে। হালের কাছে এক-একজন জেলের আত্মসমাহিত গভীর মুখ দেখে, শেকসপিয়রের কোন একটা সংস্করণে ‘কোরিয়লেনাস’-এর এক ছবি দেখেছিলাম, তাই হঠাৎ মনে পড়ে গেল।

বেলা আন্দাজ ন’টায় কুয়াশা কেটে গেলে স্টিমার চলতে শুরু করল। দু’পাশে দূরে কাছে অসংখ্য নৌকা চলেছে–জেলে-ডিঙি, যাত্রীর নৌকা, বোঝাই কিস্তি। দু-তিনখানা নামজানা যাত্রী-স্টিমার বেগে বিপরীত দিকে চলে গেল।

মাঝে মাঝেই লম্বা নিচু কাঁচি চর জলের ওপর ভেসে উঠেছে। কতক বালু ভেজা, ধূসর, কতক সাদা ধবধবে–ভোরের রৌদ্রে চিকচিক করছে। অল্প পরেই গোয়ালন্দের স্টিমার-ঘাট দেখা গেল। স্টিমারের সাের তিন-চার থাকে ঘাটে লেগে আছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে ধোঁয়া উঠছে। বড় বড় ফ্ল্যাট মাঝ-নদীতে ছেড়ে দেওয়া। এক পাশে নৌকার সার। পাড়ের উপর গোয়ালন্দ-চরের বাজারের হালকা ছাউনি ও ততোধিক হালকা বেড়ার দোকানঘর; আর সেই রকমেরই রেলের টিকিট আপিস ও পোস্ট-টেলিগ্ৰাফ আপিসবাবুদের কোয়ার্টার্স-সমেত।

নেয়ে-খেয়ে স্টিমার থেকে নামার সময় বাটলার মীেলা বক্স অনুনয় জানালে যে, মাছ-তরকারি কেনার পয়সা যে আমি দিয়েছি। এটা যেন স্টিমার কোম্পানির কর্তৃপক্ষ না জানে। তাকে অভয় দিলুম।

দোয়ারি স্টিমার

২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৬
শুক্রবার

ঢাকা মেল ভোর পাঁচটায় গোয়ালন্দ পৌঁছল। অর্থাৎ তখনও ভোর হয়নি, বেশ অন্ধকার। নারায়ণগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের যাত্রীদের হাকডাক আরম্ভ হল, কিন্তু আমার তাড়া নেই। যদিও স্টিমার-কোম্পানির জগন্নাথ ঘাটের সাহেব জানিয়েছিল, তাদের যে স্টিমার ১৯শে কলকাতা থেকে রওনা হয়েছে সুন্দরবন ঘুরে তার ২৩শে গোয়ালন্দ পৌঁছবার কথা, কিন্তু আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতুম, ২৪শে পর্যন্ত যে স্টিমার পৌঁছলেই মঙ্গল। সুতরাং পাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করছি, এমন সময় তোমার চাকর অনন্ত নিজেকে রাস্তাঘাটে চটপটে প্রমাণ করার জন্য, আমি নেমে না-ডাকতেই বিছানা বঁধতে হাজির। তার এই অভূতপূর্ব কর্মপ্রবণতায় বাধা না দিয়ে উঠে পড়া গেল। বেশ ফরসা হলে গাড়ি থেকে নামব এবং নেমে দিনটা এবং সম্ভব রাত ও তার পরদিন দুপুর পর্যন্ত কোথায় কাটাব ভাবছি, এমন সময় দুটি টিকিট-চেকার ভদ্রলোক উপস্থিত হলেন, একটি হিন্দু অন্যটি মুসলমান। টিকিট দেখানো গেল, কিন্তু তখনই বুঝলুম টিকিট দেখা একটা অছিলা মাত্র। মুসলমান ভদ্রলোকটি একটি খাজনার মোকদ্দমা প্ৰথম আদালতে হেরেছিলেন। কিন্তু আপীলে জিতেছেন; প্রতিপক্ষ হাইকোর্ট করেছে। মোকদ্দমার হাইকোটে ফলাফল সম্বন্ধে আমার মতটা জানলে বাধিত হবেন। অবশ্য অনন্তের কাছে আমার ব্যবসায়ের পরিচয়টা সংগ্ৰহ হয়েছে। শুকনো ডাঙায় মাছ ও আরও একটা জিনিসের লোভ সামলানো কঠিন–কবিকঙ্কণ বলেছেন; উকিল দেখলে মোকদ্দমার পরামর্শ লিস্টে জুড়ে দেওয়া যেতে পারে।

এদের কাছে জানলুম, গোয়ালন্দে দিন-রাত কাটাবার ও সুসানাহারের প্রশস্ত জায়গা হচ্ছে চাঁদপুর মেল স্টিমার। চাঁদপুরগামী স্টিমােরখানি ঘাটে লেগেই আছে, বেলা একটার আগে ছাড়বে না। এবং সেখানি রওনা হবার অল্প সময়-মধ্যেই কলকাতাগামী চাটগা মেলের যাত্রী নিয়ে চাঁদপুর থেকে স্টিমার পৌঁছবে এবং পরদিন বেলা একটায় ছাড়বে। নিশ্চিন্ত হয়ে বেলা সাতটা আন্দাজ চাদপুর মেল স্টিমারে গিয়ে ওঠা গেল। যে ফ্ল্যাট দিয়ে ওঠার পথ সেখানেই ঘাট-সুপারভাইজারবাবুর আপিস। তার কাছে যেতেই তিনি অত্যন্ত ভদ্রতা দেখালেন এবং জানালেন, আমার আগমনবার্তা পূর্বেই হেড-আপিস থেকে পেয়েছেন। আমার স্টিমার ‘দোয়ারি’ এখনও পৌঁছয়নি। পৌঁছনোমাত্র আমাকে খবর দেবেন।

চাদপুর মেল স্টিমারগুলি, যা ঢাকা মেল স্টিমারও বটে, বেশ আরামের। এ স্টিমারখানির নাম ‘গুরুখা’। দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে স্টিমার থেকে নেমে পড়া গেল। অভিপ্ৰায়, মেঠো রাস্তা দিয়ে প্রাতভ্ৰমণ ও কিঞ্চিৎ কবিত্ব করা। একটা রাস্তা ধরে অনেকটা দূর যাওয়া গেল, কিন্তু রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে দু-এক জায়গায় সরষে-ফুল ফুটলেও চার দিকে কেমন একটা অগ্ৰাম্য নীরস ভাব। গোয়ালন্দের নদীর ধারের যাত্রী ও মাল-চলাচলের ক্ষিপ্ৰ জীবন ও তার আনুষঙ্গিক দরমার-বেড়া-দেওয়া টিনের চালের বাজার তার পিছনের গ্রাম্য প্রকৃতির রস শুষে নিয়েছে। বিরক্ত হয়ে ফিরে এসে বাজারে ঢোকা গেল। অগ্ৰাম্য গ্রামের চেয়ে বাজারের জীবনাচাঞ্চল্য অনেক ভাল। মনে হল একটি নাপিত পেলে নিজের হাতে কামানোর দায় থেকে একটা দিন রেহাই পাওয়া যেত। লুঙ্গিপরা চেকদার কোটি গায়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলুম। এখানে নাপিত পাওয়া যায় কি না। লোকটি বোধহয় গোয়ালন্দের অধিবাসী; তার ‘পেট্রিয়টিজমে’ আঘাত লাগল। বিজ্ঞ তাচ্ছিল্যের ভাবে জানালে, গোয়ালন্দ শহরে আবার নাপিতের ভাবনা। একটা দিক দেখিয়ে বললে, সেদিকে অনেক নাপিত দেখতে পাব। গিয়ে দেখি দুজন নাপিত রয়েছে; একজন নিজ ব্যবসায়ের কাজে ব্যস্ত, অন্যটি যন্ত্রপাতি শানাচ্ছে। বেকার নাপিতৃটিকে স্টিমারে এনে ক্ষৌরি হওয়া গেল। লোকটির বাড়ি মুঙ্গের জেলায়, বাইশ বছর গোয়ালন্দে নাপিতি করছে। নাপিত-ভাবনাহীন গোয়ালন্দ শহরে কোনও বাঙালি নাপিত চোখে পড়েনি।

নেয়ে-খেয়ে গুরখা স্টিমারে বসে বসে গোয়ালন্দের শীতের পদ্মা দেখছি। সামনে একটা প্রকাণ্ড চর পড়েছে। ওপরের জল দেখা যাচ্ছে না, দূর-গাছের কালো রেখায় তার প্রসারটা অনুমান করছি। দুপুরবেলা স্টিমার-নৌকার চলাচল অনেকটা কম। ক্রমে গুরখার ছাড়বার সময় হল; কলকাতা থেকে চাটগা মেল এসে পৌঁছেছে। স্টিমার থেকে নেমে সুপারভাইজারবাবুর ফ্ল্যাটে মালপত্র রেখে, উপরে এক টুকরো ঘাসের জমি ছিল সেখানে আস্তানা করা গেল। চাঁদপুর থেকে স্টিমার পৌঁছল বেশ একটু দেরি করে। খুব ভিড়। সাদা সাহেব ও পোশাকি কালো সাহেবদের সংখ্যাও কম নয়। লোকজন নেমে গেলে ধীরে সুস্থে সে স্টিমারে ওঠা গেল। নাম ‘এমু, অর্থ যা-ই হোক। কেবিনে মালপত্র রেখে সেখানেই রাত কাটাব স্টিমারের লোকজনদের জানাচ্ছি, এর মধ্যে সুপারভাইজারবাবুর লোক এসে খবর দিল, আমার স্টিমার ‘দোয়ারি’ এসে ঘাটে লেগেছে এবং আমাকে নেবার জন্য তাঁরা এখনই স্টিম-লঞ্চ আনছেন। একটু পরেই। ‘হাতি’ নামধেয় লঞ্চ ‘এমু’র পাশে এসে লাগল। এ লঞ্চখানিকে ইতিমধ্যে বহুবার উজান-ভাটি করতে দেখেছি। হাতি-আরোহণ যে আমার ভাগ্যেও ছিল তা তখন মনে করিনি। দু-চার মিনিটের মধ্যেই হাতি আমাকে দোয়ারিতে পৌঁছে দিলে। দূর অতি সামান্য, এর জন্য স্টিম-লঞ্চ আনবার কোনও দরকার ছিল না। স্টিমার-কোম্পানির অতিরিক্ত সৌজন্যে তাদের শুভকামনা না করে পারছি না। তাদের ব্যাবসা বর্ধিত হোক। যত কমে হয় তাঁরা যেন এদেশি লোকদের খাটিয়ে নিতে পারে। এখানে ওখানে ছোটখাটো দেশি স্টিমার-কোম্পানি গড়ে উঠে তাদের মুনাফার অঙ্কে যেন ঘাটতি না ঘটায়।

 

‘দোয়ারি’ বেশ বড় স্টিমার। উঠে সামনের ডেকে আসতেই জানা গেল, আমার এ বাহনটি বড় কেউকেটা নয। সেলুনের সামনে এক পিতলের ছোট প্লেট আঁটা, তাতে খোদা রয়েছে। যে, যুদ্ধের সময়, ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ সাল, এ স্টিমার নিজের স্টিমে (‘under her own steam’) ৩৪২৬ মাইল চলে বসরা পৌঁছে টাইগ্রিস নদীতে ‘rendered invaluable transport service’–সৈন্য ও মাল টানার অমূল্য কাজে নিজেকে লাগিয়েছিল; এবং যুদ্ধশেষে নিজ বাষ্পবলেই আবার কলকাতায় ফিরে আসে। সুতরাং যে সেলুনে বসে আমি খাচ্ছি ও লেখাপড়া করছি, সার্জেন্টি-মেজর ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট প্রমুখ বীরেরা ছোট বড় ‘পেগ’ পার করে নিশ্চয়ই তাকে ধন্য করেছেন, এবং তাদের কেউ কেউ কুট-আল-আমারায় তুর্কিদের হাতে ধরাও বোধহয় পড়েছিলেন। স্টিমারটির উপর সন্ত্রম জন্মাল।

বাটলার সাদের আলির বয়স কম, হাসিমুখ ও চটপটে। লোকটিকে দেখে খুশি হলুম। বাড়ি বিক্রমপুর। অসমে চা-কর সাহেবদের বাটলারি অনেকদিন করেছে। বছরখানেক নানা সাংসারিক গোলযোগে বাড়ি বসেছিল। স্টিমার-কোম্পানির বাবুরা গোয়ালন্দ থেকে তাকে আমার জন্য জুটিয়েছেন, কারণ সে নাকি দেশি ও ইংলিশ খানা দুই-ই রাঁধতে ওস্তাদ। পরীক্ষায় দেখছি সাটিফিকেটটা ভুয়ো নয়। লোকটা রাধে ভাল। কোম্পানির এক বাবু এসে আমার তদবির করে গেলেন এবং যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সে বিষয়ে স্টিমারের লোকদের সতর্ক করলেন।

চারটে-আন্দাজ বেলায় দোয়ারিতে উঠেই শুনলুম, স্টিমার এখনই ছাড়বে। ছাড়তে ছাড়তে হল সন্ধ্যা সাতটা। দু’খানা ফ্ল্যাট দু’দিকে বেঁধে রওনা হওয়া গেল। আশা ছিল ভূতপূর্ব তারিণীগঞ্জ স্টেশনের ঝাউগাছের সার ও তেওতা ইস্কুলের নদীর ধারের বোর্ডিং দেখতে পাব। কিন্তু রওনা হওয়ার আগেই রাত্রি এসে গেল, চোখে আর কিছু পড়ল না।

 

ভোরবেলা উঠে খবর নিয়ে জানলুম, আমাদের টাঙ্গাইল যাওয়ার স্টিমার-স্টেশন পোড়াবাড়ি ছাড়িয়ে এসেছি এবং সিরাজগঞ্জের দিকে চলেছি। আমাদের এ স্টিমার ফুলছড়ি ঘাটের আগে কোথাও ভিড়বে না, কারণ তার পূর্বের কোনও জায়গার মাল এতে নেই এবং এটা প্যাসেঞ্জার স্টিমার নয়। বেলা এগারোটায় সিরাজগঞ্জ ছাড়ালুম। শহর থেকে অনেক দূরে এক চরের নীচে স্টেশনের ফ্ল্যাট; চারের উপর কয়েকখানা মালগাড়ি রেল-স্টিমারের সংগমস্থল ঘোষণা করছে। বিকােল তিনটের পর স্টিমার জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে একটু থামল, কোনও মাল দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে নয়, বোধহয় নিজেকে রিপোর্ট করতে।

স্টিমারে একলা চলেছি; এ পর্যন্ত স্টিমারের বা দুই ফ্ল্যাটের বাবুদের কেউ আলাপ-পরিচয় করতে আসেননি। কিন্তু একটু পরেই জানলুম তাদের মধ্যে গুণী লোকের অভাব নেই। সন্ধ্যার একটু আগে অনন্তের হাত দিয়ে আমাকে একটুকরো কাগজ পাঠিয়ে একটি ভদ্রলোক একটু সরে দাড়ালেন। কাগজখানি দেখলুম একটি বিজ্ঞাপন, লাল কালিতে ইংরেজি হরফে ছাপা। ‘Very nice Very nice!! Horbolla Sound’– অতি চমৎকার! অতি চমৎকার!! হরবোলার বোল’। এবং তারপর বিড়াল, মুরগি, দাড়কাক, দুই বিড়ালের ঝগড়া, শেয়াল-কুকুরের কলহ প্রভৃতি দ্বাদশ দফার উল্লেখ করে বলা হয়েছে ‘that’s all? — ‘এই শেষ’। নীচে নাম ‘হেমেন্দ্রমোহন রায়, Sounder— শব্দোৎপাদক’। গ্রাম ও পোস্ট আপিস বিঝারি, জেলা ফরিদপুর।

এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করে পরিচয় দিলুম। গোলগাল কালো চেহারা, মুখে পাকা-কাঁচা দাড়িগোঁফের খোঁচা, মাথায় একটি নাতিকৃশ টিকি, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। স্টিমারের ডাইনে যে ফ্ল্যাটখানি বাঁধা আছে তার কেরানি; ছব্বিশ বছর স্টিমার-কোম্পানির কাজ করছেন। ঠিক হল আগুমীকাল সুকালে, খ্রিস্টমাসের দিনে, হরবোলার বৈঠক বসবে।

রাত দুটোয় ফুলছড়ি ঘাটে স্টিমার পৌঁছল এবং মালপত্ৰ নামিয়ে উঠিয়ে ছাড়ল ভোরা-রাত সাড়ে চারটেয়। লােগবার ডাকাডাকি ও ছাড়বার হাঁকাহীকিতে আমারও ঘুম ভেঙেছিল।

বৃহস্পতিবার সমস্ত দিন এসেছি শীতের যমুনার পরিচিত রূপ দেখতে দেখতে। ভাঙন-ধরা উচু পাড়, কলাগাছ আমগাছে ঘেরা খোড়ে চালের বসতি; সাদা বালুর নিচু চর রৌদ্রে ঝিকি ঝিক করছে; সাদা পাল তুলে, কচিৎ রঙিন পালের, নৌকা চলেছে; মাঝে মাঝে জেলে-ডিঙি’। গোয়ালন্দের দিকে ছোট বড় স্টিমার যাচ্ছে, স-ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাটহীন। ব্ৰহ্মপুত্রের এ অংশকে আমাদের দেশে বলে যমুনা। একসময় এখােন দিয়ে যমুনা নামে ছোট এক নদী ছিল, ব্ৰহ্মপুত্ৰ চলত ভিন্ন ধারায় ময়মনসিংহ শহরের নীচ দিয়ে। উনবিংশ শতাব্দীর আরম্ভকালে কি-এক নৈসৰ্গিক বিপ্লবে, ব্ৰহ্মপুত্রের মূলধারা নিজের পথ ছেড়ে এই যমুনার খাদ দিয়ে বহতা হল। ব্ৰহ্মপুত্রের পুরনো খাদ আজ হীনস্রোত। লাঙলবন্দের অষ্টমীমান তার পূর্ব-গৌরবের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছে।

 

8

আজ সকাল ন’টায় সেকেন্ড ক্লাস কেবিনের পিছনে হাওয়া থেকে একটু আড়ালের জায়গায় হরবোলার মজলিস বসল। স্টিমারের বাবু ও খালাসিদের অনেকে এবং ডেকযাত্রীদের প্রায় সকলেই উপস্থিত হল। কেবল এলেন না হেমেন্দ্রবাবুর সহকমী তার ফ্ল্যাটের বাবুরা কেউ। ঈর্ষা এমনি জিনিস! গায়ের র্যাপারে মাথা-মুখ ঢেকে দু-একটা বাদে বিজ্ঞাপনের লিস্ট-মাফিক সব ডাক হেমেন্দ্রবাবু আমাদের শোনালেন। প্রতি ডাকের প্রস্তাবনা করলেন ইংরেজি শব্দে বা ছোট ইংরেজি বাক্যে এবং কেন জানি না, তার ব্যাখ্যা দিলেন হিন্দিতে, যদিও তার শ্রোতাদের সকলেই ছিল বাঙালি। বোধহয় হেমেন্দ্রবাবু দূরদর্শী লোক, ভবিষ্যতের রাষ্ট্রভাষায় এখন থেকেই নিজেকে অভ্যস্ত করছেন। মজলিস ভাঙলে তাকে কেবিনে ডেকে এনে কিছু দক্ষিণা দিলুম; বললেন, টাকার জন্য কিছু নয়, শুনিয়েই তার আনন্দ। একেবারে খাঁটি গুণীর কথা। বাড়ির পরিচয় নিয়ে জানলুম, তাঁরা পাঁচ ভাই, চারজন নানা জায়গায় চাকরি করেন, একজন বাড়িতে থাকেন। চারটি মেয়ে, দুটি ছেলে। বড় ছেলেটির বয়স চোদো, ইস্কুলে পড়ে। একটি মেয়ের বিয়ে দিতে বাকি। বাপ অনেক সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন, কীসব মামলা-মোকদ্দমায় বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। বললেন, সবই অদৃষ্ট। আমার কলকাতার ঠিকনােটা নিলেন। জানালেন, যদি কলকাতায় যান (র্তার এক ভাই সেখানে চাকরি করে) তবে আমার বাড়ির ছেলেমেয়েদের একবার হররোলার বোল শুনিয়ে আসকেন। বোধহয় সন্দেহ হয়েছে, আমি হরবোলার ডাকের তেমন রসজ্ঞ শ্রোতা নাই।

ফুলছড়ি ঘাটের পর থেকে ধুবড়ি পর্যন্ত আমাদের স্টিমার প্রতি স্টেশনে থেমে থেমে যাবে। কারণ, এই জায়গাটা চলাচলের রাজ্যে নন-রেগুলেটেড প্ৰভিন্স। কোনও রেল নেই এবং স্টিমার-সার্ভিস যা আছে তা আমাদের সময়কার ‘সবুজপত্রের চেয়েও তারিখের শাসন কম মানে। অসম-সুন্দরবন ডেসপ্যাচ সার্ভিসের অনিয়মগামী স্টিমারগুলিই (যা স্টিমার-কোম্পানির টাইম-টেবলের ভাষায় ‘are not run to a timing—কোনও নির্দিষ্ট সময় মাফিক চলে না) এখানকার দূর-গমনের একমাত্র বাহন। সেইজন্য এ স্টিমারগুলি উজান-ভাটিতে এ জায়গাটায় প্রতি স্টেশনে প্ৰায় থামে, মালও নেয়, লোকও নেয়। এবং কাপড়ের গাট, কেরোসিন তেলের টিন, রঙের ড্রাম, হালকা জাপানি মালের কাঠের বাক্স (দেখলুম একটা প্ৰকাণ্ড বাক্স একজন মুটেই স্টিমার থেকে নামাচ্ছে), লোহার শিক, তার, কড়াই, গ্যালভানাইজড় বালতি প্রভৃতি সভ্যতার উপকরণ ব্ৰহ্মপুত্রের দুই কুলে ছড়িয়ে চলে। বেলা একটায় চিলমারি এলুম। চিলমারির কাঁসা-পিতলের বাসন, বিশেষ এখানকার অতি সুডৌল গাভু, একসময় বিখ্যাত ছিল। এখন কিছু নেই। চিলমারির বন্দরে এখন যে কারবার চলে সে শুধু পাট ও অন্য কৃষিবস্তু চালান দেবার। দেশ হয়তো industrialized হচ্ছে, কিন্তু বাংলার গ্রামগুলিকে আমরা খুব দ্রুতগতিতে বিশুদ্ধ Agriculturize করছি। সঙ্গে যে দুই ফ্ল্যাট এসেছিল তার একখানিকে এখানে রেখে যাওয়া হল; ওতে পাট বোঝাই হয়ে চালান যাবে। চিলমারি থেকে গারো পাহাড়ের সার আকাশের সীমান্তে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে।

চিলমারি থেকে অল্প দূরে ব্ৰহ্মপুত্রের অন্য পারে রৌমারি স্টেশন। সেখানে পৌঁছতে হল ফ্ল্যাটখানি খুলে রেখে দুই চরের মাঝ দিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত অপ্রশস্ত ধারায় অনেক দুর উজিয়ে গিয়ে। এখানে-ওখানে তার মধ্যে বহু নিচু কাঁচি চর। নদীর কালো জল ও চারের শুভ্র বালু পাশাপাশি অপরাহের রৌদ্রে অপূর্ব মায়ার সৃষ্টি করেছে। একটু দূরে একটা চর প্রায় ঢেকে চখাচখির বাঁেক বসেছে। তাদের ধূসর চঞ্চল পাখায় চারটি যেন কঁপিছে, মনে হয় পন্মের পাতায় ঢাকা পদ্মকন। একদিকের উচু কায়েম চরে একটা তাঁবু পড়েছে, অনেক লোক আনাগোনা করছে; নীচে একখানা বড় নৌকা বাঁধা। হাকিমের সফর না জমিদারবাবুর শিকার ঠিক বোঝা গেল না।

রাত প্ৰায় এগারোটায় স্টিমার যাত্রাপুর পৌঁছল। যাত্ৰাপুর রংপুর জেলায় এবং বাংলাদেশের শেষ স্টিমার-স্টেশন। এরপর থেকে অসমের গোয়ালপাড়া জেলার এলাকা।

 

২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৬
রবিবার

শনিবার ভোর সাতটায় ধুবড়ি আসা গেল। ধুবড়ি গোয়ালপাড়া জেলার হেড কোয়ার্টার্স এবং স্টিমার-লাইনের একটা অংশের হেড-আপিস। নদীর ধারে ধারে ছোটখাটো সুন্দর শহরটি। বছর-কয়েক পূর্বে এক মোকদ্দমায় ধুবড়ি এসে অনেকদিন ছিলুম, বোধহয় মনে আছে। ব্ৰহ্মপুত্রের পাড়ের উপরে যে রাস্তা দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বেড়াতে যৌতুম সে রাস্তার ধারে ফরেস্ট-আপিসের দোতলা টিনের বাংলো, এস ডি ও-র (যিনি এখানকার combined hand–একাধারে ম্যাজিষ্ট্রেট, সাবিজজ, রেভিনিউ অফিসার) বাংলো, নদীর খাড়া পাড়ের উপর তিন দিক জলে ঘেরা, বেশ কবিত্বপূর্ণ কিন্তু একটু আশঙ্কাজনক অবস্থিতির উকিল-লাইব্রেরি, ধুবড়ি ছাড়ার পথে স্টিমার থেকে সব দেখতে দেখতে গেলুম। ভিক্টোরিয়া গার্ডেনের লগাও নদীর ধারেব যে বাংলোটিতে ছিলুম সেটি কিন্তু চোখে পড়ল না।

ধুবড়িতে স্টিমার প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়াল। স্টিমার থেকে লোকজন নেমে গেল বাজার করতে। আমার বাটলার একটা বড় কাতলা মাছ কিনে নিয়ে এল। অতি সুস্বাদু টাটকা মাছ। ধুবড়ি থেকে আমাদের স্টিমার চলল। ফ্ল্যাট-বিনির্মুক্ত হয়ে। বাকি ফ্ল্যাটখানি হেমেন্দ্ৰবাবুকে নিয়ে এখানেই রয়ে গেল এবং সম্ভব দু-একদিন থাকবে। আশা করি ধুবড়ি শহরে গুণজ্ঞ লোকের অভাব নেই।

ধুবড়ি ছাড়ার পর থেকেই নদীর দুই ধারে পাহাড়ের সারা দেখতে দেখতে এসেছি। ব্ৰহ্মপুত্রের মতো প্ৰকাণ্ড নদীর মাঝ থেকে দুই তীরে এমন পাহাড়ের দৃশ্য পৃথিবীতে নাকি খুব কম দেখা যায়। গাছে-গুলো ঢাকা কৃষ্ণাভ সবুজ সব পাহাড়। নন-কো-অপারেশনের সময় মহাত্মা যখন অসমে এসেছিলেন তখন এক অভিনন্দনের উত্তরে অসমবাসীদের বলেছিলেন, ‘Your bewitchingly beautiful ountry–জাদুকরী সৌন্দর্যের দেশ তোমাদের। ব্ৰহ্মপুত্র ও তার দুই কুলে নীল পাহাড়ের এই সারা দেখলে এ বর্ণনার যাথার্থ্য বোঝা যায়।

বিকাল তিনটেয় স্টিমার বিলাসীপাড়া এল। শীতের ব্ৰহ্মপুত্ৰ নিস্তরঙ্গ, মনে হয় যেন স্থির। কেবল পূর্ব-বাংলার ধানখেতের দিকে দ্রুতধাবমান কচুরিপানার ছোট বড় ঝাড় তার অন্তরের গতিবেগ জানান দিচ্ছে। এই জলের উপর রৌদ্রের খেলা ও স্টিমারের সামনের ডেকের ছাদে তার আলোছায়ার কঁপিন-লীলা সারা দুপুর দেখতে দেখতে এসেছি। বিলাসীপাড়ার স্টেশন-ফ্ল্যাটের ঠিক পিছনেই এক সারা পাহাড় এবং বিলাসীপাড়ার পর অনেক পাহাড় নদীর বেশ কাছাকাছি। একটা তিন-চুড়াওয়ালা পাহাড়ের দিকে আমাদের স্টিমার এগিয়ে চলেছে। নদীর জলে তার অকম্পিত ছায়া বহুক্ষণ ধরে দেখছি, যেন কোনও মন্দিরের ছায়া।

স্টিমারের পিছনে সূর্যস্ত হল। পশ্চিম-আকাশের সোনার রং নদীর এদিকের জল রাঙিয়ে রাখল অনেকক্ষণ।

রাত আটটায় স্টিমার গোয়ালপাড়া পৌঁছল।

 

আজ রবিবার সকাল থেকেই আকাশে মেঘ, নদীর উপর কুয়াশা এবং প্রচণ্ড শীত। সমস্ত দিন সূর্যের অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কেবল দুপুরকেলার কাছাকাছি দু-চার মিনিটের জন্য এক ঝলক রোদ, আর বিকালে সূৰ্যাস্তের সময় পশ্চিম-আকাশের কালো মেঘে। গলানো সোনার একটা চওড়া রেখা।

নদী ও তার পাড়ের দৃশ্যও বদলে গেছে। পাহাড় বড় চোখে পড়ছে না। নদীতে নৌকা বিরল এবং দক্ষিণের যে উচু পাড়ের কাছ ঘেঁষে প্রায় সারাদিন স্টিমার চলেছে তাতে লোকালয় খুব কম। কেমন একরকম শুকনো চেহারার লম্বা ঘাস সে পাড়ের উপর। আকাশের ধূসর মেঘে ঢেউশূন্য ঘোলাটে নদী। মনটা দমে গেল। সারা দুপুর একটামাত্র জানিলা খোলা রেখে কেবিনে শুয়ে শুয়ে জে বি প্রিস্টালির একটা উপন্যাস পড়ছি। ইয়র্কশায়ারের নিম্ন-মধ্যশ্রেণির তরুণ-তরুণীর লন্ডনে প্রণয়লীলার কাহিনিতে ব্ৰহ্মপুত্রের উপর কেমন মন বসছে না।

বিকাল চারটেয় পলাশবাড়ি স্টেশন এল। পাড়ে অনেকগুলি বড় নৌকা বাঁধা। ঘাটের উপর কমললেবু, ডিম ও পায়রা বিক্রি হচ্ছে। পলাশবাড়ি থেকে আবার উত্তরদিকে পাহাড়ের সার দেখা দিল এবং ঘণ্টাখানেক পর পলাশবাড়ি ছাড়লে এক পশলা অল্প বৃষ্টি হয়ে ভাঙা মেঘের মধ্যে দিয়ে চাঁদের দেখা পাওয়া গেল। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। পাতলা মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোতে তীরের পাহাড় ও নদীতে তার ছায়া কেমন একটু অবাস্তব মনে হচ্ছে। সাড়ে ছাঁটার মধ্যে স্টিমার পাণ্ডুঘাট এসে পৌঁছেছে। শিলংযাত্রীদের পারাপারের স্টিমার অনেক আলো জ্বলিয়ে ঘাটে লেগে আছে। রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল, এখনও পাণ্ডুঘাটেই আছি। সামনে গৌহাটি শহরের আলো দেখা যাচ্ছে।

 

২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৬
সোমবার

কাল সমস্ত রাত স্টিমার পাণ্ডুঘাটেই নোঙর করেছিল। আজ ভোর ছাঁটায় সেখান থেকে রওনা হল। স্টিমার ছাড়ার শব্দ পেয়ে ওভারকোট চাপিয়ে সামনের ডেকে এলুম। গৌহাটি ও শিলং যাত্রাপথের অল্পবিস্তর পরিচিত পাহাড় নদীর দু’ধারে; তাদের মাথায় মাথায় কালচে সাদা মেঘের মতো কুয়াশা জমে আছে। স্টিমার উমানন্দভৈরবের কাছ দিয়ে গেল। ব্ৰহ্মপুত্রের মাঝখানে গ্রানাইট পাথরে ধার-বঁধানো উচুভিতের উপর বড় বড় গাছের ঘন বন, তার মধ্য দিয়ে ভৈরবের মন্দিরের চুড়া দেখা যাচ্ছে। গৌহাটি শহরের তখনও ঘুম ভাঙেনি, নদীর ধারের রাস্তায় লোক-চলাচল নেই। শহরের একদিকটার প্রায় সমস্ত দৈর্ঘ্য উজিয়ে গৌহাটির বাজার-ঘাটে স্টিমার লাগল। বেলা তখন সাতটা।

গৌহাটি শহর কামরূপ জেলার সদর; অসমীয়াদের রাষ্ট্র, শিক্ষা ও সাহিত্য-প্রচেষ্টার কেন্দ্র। কিন্তু প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ের শৈলচুড়ায়, যা না উত্তর-অসমের অসমীয়াদের, না। দক্ষিণ-অসমের বাঙালিদের জায়গা। সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে বোধহয় রাজপুরুষেরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে উত্তর-দক্ষিণ দেখেছেন, অসমীয়া ও বাঙালি কেউ কারও চেয়ে প্রবল হয়ে না ওঠে।

প্রাচীন পুথিপত্রে ও শিলালেখ-তাম্রশাসনে গৌহাটির নাম দেখা যায় গুবাকহট্ট, বোধহয় গোরুর হাট নয়, সুপারির হাট। মেধাতিথির মনুভাষ্যে দেখেছি, দেশের একটা নির্দিষ্ট ভূভাগকে বলত হাট্ট। বোধহয় ওটা ছিল ইকনমিক ইউনিট’-এর নাম, যে ভূখণ্ডের লোকেরা বড় বড় বেচাকেন। একজায়গায় করত এবং সম্ভব হাটবাজারের হাট কথাটা সেখান থেকেই এসেছে। যা হোক, শব্দের প্রত্নতত্ত্বে আর দরকার নেই। ক্ৰমে বেলা বাড়তে লাগল। স্টিমার থেকে মাল নামছে বিস্তর। ডাকহাঁকে জনছি গৌহাটি ও শিলং দু’জায়গার মাল নামছে, আর তাদের তফাত করে রাখা হচ্ছে। ক্ৰমে বাজারঘাটে ধোপাদের কাপড় কাচা শুরু হল। একটা ছোট ফ্ল্যাটের সামনে বসে একটি খালাসি খুব মনোযোগ দিয়ে একটা নীল কোর্তায় সাবান ঘািষছে। রাস্তা দিয়ে দু’খানা মোটরগাড়ি চলে গেল। আজ পাঁচদিনের পর মোটরগাড়ি দেখে মনটা একটু খুশি হয়ে উঠল। নাগরিক জীবনের অভ্যাসের এমনি ফল!

 

গৌহাটি থেকে রওনা হতে বেলা বাজল এগারোটা। বেলা দুটোরও পর পর্যন্ত ডাইনে পাহাড়ের সার চলছে নদীর প্রায় পাড় ঘেঁষে। নিবিড বনে ঢাকা পাহাড়; হঠাৎ মাঝে মাঝে এক-একটা পাহাড়ের খানিকটা অনাবৃত কালে পাথরে মোড়া, প্ৰকাণ্ড ঐরাবতের পাশের মতো। এক সার পাহাড়ের পিছনে আর-এক সার তারপর আবার এক সার, দূরে দূরে আরও সব সারের মাথা দেখা যাচ্ছে, অতি পাতলা নীল ওড়নার মতো ফিকে নীল কুয়াশায় Tাকা। এক জায়গায় একটা পাহাড় তার সঙ্গীদের ছেড়ে আড়াআড়ি সোজা চলে এসেছে জলের মধ্যে, নদীর সঙ্গে পরিচয় নিবিড় করতে। উলটোদিকের পাড় একটা চরের জিহ্বা অনেকদূর নদীর মধ্যে এগিয়ে দিয়েছে। এ জায়গাটা স্টিমার পর হল অতি ধীরে ও সাবধানে। পাশ দিয়ে যাবার সময় নদীর এই দুঃসাহসী প্রণয়ীর রূপটি দেখতে পেলাম। প্রকাণ্ড প্ৰকাণ্ড পাথরে মোড়া পা, তার উপর পালিশ-কালো পাথরের চওড়া বুক খাড়া উঠে গেছে, রুদ্ধদুয়ার মন্দিরের কপাটের মতো।

বাঁদিকের পাহাড় সব দূরে দূরে। তৃণলেশহীন উচু চর চলেছে মাইলের পর মাইল— ব্ৰহ্মপুত্রের তরঙ্গলাঞ্ছনা পাশে আঁকা। অনুজ্জ্বল রৌদ্রে মনে হচ্ছে যেন চুনারি পাথরে তৈরি। আজও আকাশে মেঘ আছে, তবে রোদকে ঢাকতে পারেনি, শুধু নিষ্প্রভ করেছে।

ডানদিকের পাহাড়ের প্রাচীরটা যখন একটু একঘেয়ে বোধ হচ্ছে এমন সময় হঠাৎ পাহাড়

গেল দূরে সরে। পূর্ব-বাংলার শীতের নদীর পরিচিত রূপটি ফুটে উঠল। এখানে ওখানে ছড়ানো চরের শুভ্ৰ বালু কেটে কালো নীল জলের ধারা, দিকচক্রবালে গাছের ঘন সবুজ রেখা।

বেলা পড়ে আসছে; কেবিনের সামনে বেতের কুর্সিতে রোদে বসে আছি। সম্মুখে একটা গোল চর, চারদিকে নীল পাহাড়; যাঁরা ছিল নদীর পাশে, বাঁেক ঘুরে মনে হচ্ছে তাঁরা যেন নদীর মাঝ থেকে উঠেছে। একখণ্ড কালো মেঘ। সূর্যকে আড়াল করেছে–রুপালি জরির পাড়-দেওয়া নীলাম্বরীর আঁচল; মাঝখানে একটা চোখ-ঝলসানো গোল ফুটো দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে; নদীতে রঙের স্রোত। সব মিলে মনে হচ্ছে যেন টার্নারের একখানা छदि।

একটা চরের ওপারে নদীর মধ্যে সূৰ্য অস্ত গেল; আগুনের প্রকাণ্ড গ্লোব। ঘড়িতে পাঁচটা ছ’ মিনিট। অনেকটা পুবে চলে এসেছি। শুক্রবার দিন সূৰ্যাস্তের সময় ঘড়িতে ছিল পাঁচটা পনেরো মিনিট। তবে আমার এ হাতঘড়িকে বৈজ্ঞানিক পৰ্যবেক্ষণের ভিত্তি করা চলে না। ওর তিনদিনের গতিবিধির ফল। অনেক সময় চমকপ্ৰদ।

স্তব্ধ ব্ৰহ্মপুত্রের বুকের উপর সন্ধ্যা নেমে এল। পুবে প্রতিপদের সোনালি চাঁদ, পশ্চিম-আকাশে বৃহস্পতি জ্বলজ্বল করছে।

 

ইন্দ্র ফ্ল্যাট, তেজপুর

২৯ ডিসেম্বর ১৯৩৬
মঙ্গলবার

ভোরে কেবিন ছেড়ে বাইরে এসেই দেখি, বাঁয়ে তেজপুর শহর দেখা যাচ্ছে। স্টিমার ঘাটে লগতে দেরি হল না। মালপত্র গুছিয়ে স্টিমারের লোকদের বিদায়সম্ভাষণ জানিয়ে এখানকার স্টিমার-স্টেশনের ওয়েটিং ফ্ল্যাট ইন্দ্ৰ’তে এসে ওঠা গেল। ফ্ল্যাটের এক কেবিন দখল নিয়ে নীচে নেমে অর্থাৎ ব্ৰহ্মপুত্রের চর ভেঙে উপরে উঠে গেলুম শহরে। পোস্ট আপিস থেকে তোমাদের টেলিগ্রাম পাঠিয়ে একটা ঝরঝরে রকম ফোর্ড ট্যাক্সিতে সমস্ত শহর ঘুরে বেড়ালাম। ট্যাক্সিওয়ালার বাড়ি সিলেট, ছেলেবেলা থেকে এখানেই আছে। কিন্তু তেজপুর শহরের উপর তার অসীম অবজ্ঞা; বললে এটা শহর না শহরের আকার! সিলেট শহরে ট্যাক্সি চলে ষাটখানা, এখানে পাঁচখানা চলা কঠিন।

ইন্দ্ৰ ফ্ল্যাটে নাওয়া-খাওয়া সোরে, সামনের ডেকে একটা আরাম-কেদারায় রৌদ্রে পা ছড়িয়ে প্রিস্টলির সেই উপন্যাসটা পড়ছি, আর ব্ৰহ্মপুত্রের স্রোত ও নদীর পড়েটিলার উপর টিনের বাংলোগুলি চেয়ে দেখছি।

তেজপুর শহরের গল্প মুখেই শুনো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত