হঠাৎ পাশের একটা গাছ থেকে পাখির ডাক ভেসে এল। একটু আশ্চর্য হয়ে ওপরে। তাকালাম। গত কয়েকদিন বনের ভেতর পাখিদের শব্দ শুনতে পাইনি। সেই অপার্থিব স্তব্ধতা কাটিয়ে প্রথম এই ডাক পরিবেশের বিষণ্ণতা অনেকখানি দূর করে দিল। হ্যাঁ, ওই যে পাতার আড়ালে বসে রয়েছে পাখিটা, কী পাখি বুঝতে পারা যাচ্ছে না, কিন্তু পাখি বটে। যাক্, তাহলে পাখিরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। ভাল।
মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম—বাহিরগাছিতে আর পরে জয়তলা গ্রামে তোমার নাম বলেছিলে অমরজীবন। নামটা বদলে গেল কী করে?
—দুটো নামের মানেই তো এক, তাই না? নাম একটা যা হোক হলেই হল—
তারপর চারদিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ বদলাবার ভঙ্গিতে বলল-ঝড়বৃষ্টি কিন্তু ধরে আসছে, দেখেছেন? আর বাড়বে না। বিকেলের দিকে সূর্যও বেরিয়ে আসবে।
বললাম তোমার বিষয়ে যে আমি আগে থেকেই জানি তা আর আমার কোম্পানির লোকেদের বললাম না, বুঝলে? এরা অবাক হয়ে যাবে, বুঝবে না। এটা গোপনই থাক।
আমরা ফিরে এলাম তাঁবুর কাছে। মেজকর্তা বললেন—আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে আসছে। কুলি পেলে একবার চেষ্টা করে দেখা যেত–
মৃত্যুঞ্জয় বলল—সেটা বোধহয় উচিত হত না। যিনি বাতাস কমিয়েছেন তার কাছে অবাধ্যতা করা ভাল নয়। তাহলে আবার দুর্যোগ ঘনিয়ে আসবে, আমিও আর একই ব্যাপার নিয়ে দুবার বলতে পারব না—
মেজকর্তা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন—আরে! তুমি কি পাগল নাকি? ঝড়বাদল তুমি কমালে?
—না, না! আমি কমাবো কেন? যে কমায় তাকে বললাম, সে যা করবার করল। নইলে আপনাদের খুব অসুবিধা হত।
মেজকর্তার মুখে ব্যঙ্গ আর অবিশ্বাস মেশানো হাসি ফুটে উঠল।
তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল—আপনার বিশ্বাস জন্মানোর দায়িত্ব আমার ওপরে নয়, আর ভেলকি দেখানো তো একেবারেই নিম্নমার্গের ব্যাপার। কিন্তু আপনি কর্তার ক্ষমতায় সংশয় প্রকাশ করছেন, আমার একটা কিছু তো করা উচিত–
মেজকর্তা বললেন–কর্তা কে?
—আমিও ঠিক জানি না। দেখিনি তো কখনও। তবে কর্তাই সব। আচ্ছা, আপনি। একটা সিগারেট ধরান না কেন—
—সিগারেট ধরাবো? কেন? হঠাৎ সিগারেট ধরাবো কেন?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—কোন কারণ নেই। আপনি চেষ্টা করলেও পারবেন না, তাই বলছি–
—সে কী! সিগারেট ধরাতে পারবো না কেন?
—দেখুন চেষ্টা করে।
মেজকর্তা ধরেই নিয়েছেন তিনি পাগলের সঙ্গে কারবার করছেন। তার সঙ্গে কিছু কৌতূহলও এসে মিশেছে। পাগলকে খুশি রাখাই ভালো এই সাব্যস্ত করে তিনি পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করলেন। কিন্তু কিছুতেই ধরাতে পারলেন না।
ঠোটের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে যতবার দেশলাই জ্বাললেন ততবারই একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে কাঠিটা নিভিয়ে দিল। দুবার…তিনবার..চারবার…প্রতিবারই কেবলমাত্র দেশলাই-এর কাঠি জ্বলবার মুহূর্তে বাতাসের ঝাপটা আসছে, পর মুহূর্তেই চারদিক আবার শান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মুখে বিস্ময় নিয়ে মেজকর্তা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে আর অবিশ্বাসের চিহ্ন নেই।
মৃত্যুঞ্জয় বলল—চমকাবেন না, এর মধ্যে যাদুর খেলা কিছুই নেই। কর্তার কাছে ঠিকমতো প্রার্থনা করতে পারলে এসব আপনা আপনিই হয়ে যায়।
এবার আর মেজকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন না—কর্তা কে?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—কাজে বাধা দিচ্ছি বলে আমাকে শত্রু ভাববেন না। এই যে আমার হাতের কাঠিটা দেখছেন, এটা হল ওই ওপরের বড়কর্তার সব কিছু মাপবার গজকাঠি। এ দিয়ে মাপলে যে কোন জায়গার ভালো-মন্দ দোষ-গুণ সব বলে দেওয়া যায়। তা আপনাদের কাজের জায়গা মাপতে গিয়ে দেখলাম মাপটা হারিয়ে যাচ্ছে। শুরু করছি এক। জায়গায়। কিন্তু কোথাও গিয়ে থামছে না। তাছাড়া এখানকার জমিও মানুষের কোলাহলকে বরদাস্ত করবে না।
মেজকর্তা বললেন—সেটা তুমি কী করে বুঝলে?
–বা রে, আমি মাটি শুকে দেখলাম যে! এ জায়গায় অতীতে কোন মানুষ কখনও বাস করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না। মাটি খুঁকে ওসব বোঝা যায়–
আমাদের খুব বেশি বোঝাবার দরকার ছিল না। ব্যাখ্যার অতীত ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। আশ্চর্য স্বপ্ন দেখা, বনস্পতির অন্তর্ধান, বিশুয়ার জীবন থেকে কয়েক ঘণ্টা সময় হারিয়ে যাওয়া—এসব আমাদের মনের ওপর একটা কালো ছায়া বিস্তার করে রেখেই ছিল, তার ওপরে কুলিদের পলায়ন কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব করে তুললো। এসব আবছা কথা কোম্পানিকে যে রিপোর্ট দেওয়া হবে তাতে লেখা যায় না। কিন্তু পুরনো এবং পাকা। কর্মচারীরা রিপোর্ট লেখার নানারকম কায়দা জানেন। বাস্তব অসুবিধেগুলোকে তুলে ধরে মেজকর্তা রিপোর্ট লিখে কাজ বন্ধ করে দিতে পারবেন, কিন্তু তার মুখ দেখে বড় মায়া লাগলো। দক্ষ ও বুদ্ধিমান মানুষ দুর্বোধ্য, ব্যাখ্যাহীন প্রহেলিকার মুখোমুখি হলে তার মুখভারের কী করুণ আর বিপন্ন অবস্থা হয় তা দেখলাম। মেজকর্তা নিজের তাবুতে ঢুকে গেলেন। আমরা আবার হাঁটা শুরু করে ওপাশের জঙ্গলে গিয়ে পড়লাম।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—মৃত্যুঞ্জয়, এত পাখি মারা পড়ছিল কেন বলতে পারো? সিমডেগাতে, আসবার পথে সাম পাহাড়টোলির কাছে–কী ব্যাপার বল তো? এর কি কোনো মানে আছে?
মৃত্যুঞ্জয় আমার দিকে তাকালো, বলল—মানে তো আছেই। ঠিক সময় থেমে না গেলে পাসাং মারার অনুচরেরা সব একসঙ্গে বেরিয়ে আসতো, কেউ তাদের সামলাতে পারতো না। খামোখা কিছু নিরীহ মানুষের প্রাণ যেত। আমি কর্তার কাছে দরবার। করেছিলাম, আপনারাও কাজ বন্ধ করা ঠিক করলেন, তাই ব্যাপারটা মিটে গেল, পাখি মরাও বন্ধ হয়ে গেল। পাসাং মারার অনুচরেরা সব আবার ফিরে গেছে মাটির তলার অন্ধকারে। এখানে ওখানে মাটিতে গর্ত দেখলেই বুঝতে পারবেন।
আমি বললাম—গর্ত? গর্ত কী রকম!
—অশুভ শক্তির সাঙ্গো-পাঙ্গরা বাধা পেলে তাড়াতাড়ি অন্ধকার পাতালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। যেখান দিয়ে তারা মাটিতে ঢোকে সেখানে একটা করে সাপের গর্তের মত ছোট গর্ত তৈরি হয়। দেখলে অবিকল ছুঁচো বা সাপের গর্ত বলে ভুল হবে—
সবই বুঝলাম, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় বিরাট ধাঁধা ধরিয়ে দিল। এরপর থেকে মাটিতে অত্যন্ত নিরীহ আর স্বাভাবিক গর্ত দেখলেও মনে হবে এইখান দিয়ে পাসাং মারার ছায়া-জগতের অনুচর মাটির তলায় প্রবেশ করেছে। বললাম—কিন্তু বিশুয়ার যে অনেকখানি সময় হারিয়ে গেল, তার কী হবে?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—সময় হারায় না, তার চলার একটা নিত্য ছন্দ আছে। বিশুয়ার ব্যক্তিগত সময়টা একটু ধীর করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে অন্য সবার সময় যতটা কেটেছে, বিশুয়ার ততটা কাটেনি। একে কালস্তম্ভন বলে। এমন করা যায়–
—কিন্তু বিশুয়ার সময়ের গতি ধীর করে দিল কে?
—আবার সেই একই বিপদে ফেললেন। এর সঠিক উত্তর আমি জানি না। হয়তো পাসাং মারা, হয়তো বা অন্য কোন শক্তি, যে শক্তি এখানে মানুষের অনুপ্রবেশ চায় না। এখানে যা যা ঘটেছে সবই মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করবার জন্য।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছু বলবার ছিল। ফাদার ও ব্রায়েন বলেছিলেন, পাখিকে ক্রিশ্চান বিশ্বাস অনুযায়ী কোথাও কোথাও ঈশ্বরের দূত বলে মনে করা হয়। পাখির মড়ক কোনো অমঙ্গলের আগাম সূচনা দেয়। কিন্তু সুদূর ইউরোপের মাটিতে জন্মানো এক লোকায়ত বিশ্বাসের সঙ্গে এই বিহার আর উড়িষ্যার প্রান্তবর্তী অরণ্যের কি যোগাযোগ আছে? কিংবা হয়তো প্রকৃতির কোনো কোনো নিয়ম পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই এক। সে জন্যই তারানাথের মুখে শোনা রাম গাঙ্গুলীর গল্পের মত এখানেও বিশাল বৃদ্ধ নারিকেল গাছ হঠাৎ হাওয়ায় উবে যায়।
মৃত্যুঞ্জয় তার হাতের ছড়িটা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে তাবুর দিকে। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে। কাঠিটা দিয়ে মাটিতে কী মেপে দেখছে। তার অপস্রিয়মাণ চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হল এই বিশাল জগতের তুচ্ছাতিতুচ্ছ তৃণখণ্ড থেকে অনাদ্যন্ত মহাকাশে জ্বলন্ত নক্ষত্রের দল পর্যন্ত একটা অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত বাস্তব আত্মীয়তার সূত্রে গ্রথিত। প্রাত্যহিকতার। মায়ায় সত্যের এই অগ্নিময় জ্বলন্ত রূপ আমাদের চোখে পড়ে না। কলকাতা শহরের উপগলির এঁদো মেসের ঘর নয়, সমস্ত বিশ্বের বিচিত্র বিস্ময়পূর্ণ পরিধিই আমারও জীবনের পরিধি, জ্বলন্ত নক্ষত্ৰবেষ্টিত সত্যের অলাতচক্র। মৃত্যুঞ্জয় অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে, এইবার সে ঝোপের ওধারে বাঁক ফিরবে। গলা একটু উঠিয়ে ডাকলাম—মৃত্যুঞ্জয়!
সে ফিরে তাকালো। বলল—কী?
বললাম—শুনে যাও! দরকার আছে।
মৃত্যুঞ্জয় এসে সামনে দাঁড়ালো। বললাম—একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তাই ডাকলাম।
—কী?
—সিমডেগা আসবার সময় রাউরকেল্লা এক্সপ্রেসে তুমি আমাদের সঙ্গে ছিলে, তাই? মাঝপথে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে? তোমার মুখ দেখতে পাইনি যদিও তবু আমি নিশ্চয় করে জানি সে অন্য কেউ নয়–
মৃত্যুঞ্জয় চুপ করে রইল।
মেঘ কেটে যাচ্ছে মাথার ওপরে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে সামান্য এক ফালি মেঘভাঙা রোদুর এসে পড়ল। এই অদ্ভুত আলোটা আমাকে ছোটবেলা থেকে ভারি। মুগ্ধ করে, যেন কোন্ রূপকথার দেশের ছবি ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। সে এমন এক জগৎ যেখানে সবই সম্ভব, যেখানে যুক্তি-তর্কের বিচারে সত্যের নির্ণয় হয় না। সেই আলোতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ।
আমার দিকে তাকিয়ে ছিল মৃত্যুঞ্জয়। এবার সে বলল–ঠিক ধরেছেন। জীবন আর জগৎ অনেক বড়, হিসেব কষে তার কূল খুঁজে পাবেন না। যুক্তি আর তর্ক তো সেই অনন্তকে মাপবার জন্য মানুষের একটা অসহায় প্রচেষ্টা। সত্যিকারের মাপকাঠি চাই–
—সে মাপকাঠি কী করে পাওয়া যায়?
–কারো কারো কাছে থাকে। যেমন এইটে–
মৃত্যুঞ্জয় তার হাতের লাঠিটা দেখাল। এইরকম সরু লাঠি বা কঞ্চি দিয়েই সে মাঝে মাঝে মাপ-জোক করে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে বটে। যেমন করেছিল বাহিরগাছি গ্রামে সেই কবে। বললাম—এটা কি বিশেষ কোনো গাছের ডাল?
মৃত্যুঞ্জয় হেসে বললনা না, তা কেন হবে! শাস্ত্রে ব্রহ্মস্ত্রের কথা পড়েছেন তো? ঐ নামে আসলে কোন অস্ত্র ছিল না। ব্রহ্মাস্ত্র একটা তেজ বা শক্তির নাম। উপযুক্ত লোক প্রয়োজন হলে এক টুকরো ঘাস তুলে নিয়ে মন্ত্র পড়ে তাতে ব্রহ্মাস্ত্রের অধিষ্ঠান ঘটাতেন। সেই তৃণখণ্ড শত্রুর দিকে ছুঁড়ে দিলে নিমেষে তা সবকিছু ছারখার করে দিত। এও তাই।
আবছা আবছা কিছু বুঝলাম, অনেক কিছুই পরিষ্কার হল না। বললাম—তুমি কে
মৃত্যুঞ্জয়?
সে হেসে বলল—তা কি আমি নিজেই জানি? কী যেন একটা কাজ আছে আমার, সেটাই করে বেড়াই। কাজ হয়ে গেলে ফিরে যাবো।
–কোথায় ফিরে যাবে?
—বিশ্বাস করুন, তা আমি ঠিক করে জানি না। এই যে এত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীতে, এরা কি জানে কোথা থেকে এসেছে বা কোথায় ফিরে যাবে? আমিও তাদেরই মতো। আচ্ছা, একটু ওদিকে যাই।
মুহূর্তে মুহূর্তে উন্নতি হচ্ছে আবহাওয়ার। এ যেন আরো বিস্ময়কর। মেঘ করে অন্ধকার ঘনিয়ে এসে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে দুর্যোগ শুরু হওয়াকে তবু কোনরকমে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সেই ঘনঘোর দুর্যোগ কাটবার যে স্বাভাবিক ছন্দ আছে তাকে অগ্রাহ্য করে এই অলৌকিক উন্নতি ভয় ধরিয়ে দেয়।
তাঁবুতে ফিরে এলাম। মেজকর্তা একটা টেবিল টেনে বসে কী লিখে চলেছেন। পাশেই দুটো চেয়ারে অসিতবাবু আর নির্মলবাবু বসে। আমাকে দেখে অসিতবাবু বললেনওয়েদার কী দারুণভাবে ইম্প্রুভ করে গেল, না?
লিখতে লিখতেই মেজকর্তা বললেন—তা করল বটে, কিন্তু এখানে আমরা কাজ করব না, বুঝলেন? তারই রিপোর্ট লিখছি।
বললাম—সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন?
—সিদ্ধান্ত নেবে কোম্পানি, আমি আমার মতামত জানাচ্ছি মাত্র। রিপোর্টে কী লেখা হচ্ছে জিজ্ঞাসা করতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমি অধস্তন কর্মচারী, ওপরওয়ালার রিপোর্টের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে প্রশ্ন করার অধিকার আমার নেই। মেজকর্তা কিন্তু নিজেই বললেন—এখানকার সব অভিজ্ঞতার কথা লেখা যাবে না, লিখলাম এখানে জলের অসুবিধা, নদী আর ঝরনা প্রায়ই শুকিয়ে যায়, কাজের জন্য কুলি পাওয়া কঠিন—কথায় কথায় তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়। ওইসঙ্গে জায়গাটার ভূপ্রকৃতির অসুবিধার কথা কিছু নির্মলবাবু ঢুকিয়ে দেবেন, যাতে রিপোর্ট বেশ মজবুত হয়। মোট কথা কাজ এখানে করা যাবে না।
সার্ভেয়ার সাহেব কী বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁবুর ঠিক বাইরে দ্রুত ধাবমান পায়ের শব্দ শোনা গেল। পরমুহূর্তেই বিশুয়া আর ডহরু লোহার একসঙ্গে তাঁবুতে ঢুকে হাঁপাতে লাগল। তাদের চোখমুখ রীতিমত উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
মেজকর্তা বললেন কী হয়েছে? এত দৌড়োদৌড়ি কীসের?
বিশুয়া বলল—জিপ স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে!
ডহরু বলল—বড় পাথরটা আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে।
দুটোই জবর খবর। মেজকর্তা দাঁড়িয়ে উঠে বললেন— জিপ স্টার্ট নিয়েছে সেটা খুব ভাল খবর, কিন্তু তাতে আমি অবাক হচ্ছি না। যন্ত্রপাতি মাঝে মধ্যে এরকম অদ্ভুত আচরণ করে থাকে। তবে পাথরটা ফিরে এসে থাকলে—আচ্ছা, চল, দেখি গিয়ে ব্যাপারটা–
জলধর পণ্ডাও খবর পেয়ে আমাদের সঙ্গে এসে জুটল। আমরা দল বেঁধে চললাম পাথর দেখতে।
সত্যিই অবাক কাণ্ড। মাটির ওপরে যে ঘসটানো দাগ তৈরি করে সরে গিয়েছিল পাথরটা, আবার সেই দাগ বরাবর আগের জায়গায় ফিরে এসেছে!
বিপুলকায় জগদ্দল পাথর। কে এমন অনায়াসে খেলা করছে এটাকে নিয়ে?
মেজকর্তা বললেন কী জলধর, তুমি তো অভিজ্ঞ লোক, তোমার কী মনে হয়?
জলধর হাতজোড় করে বলল—আমার কিছু মনে হয় না কর্তা। কর্তা, চলুন আজই। আমরা এখান থেকে চলে যাই। ডহরু ঠাণ্ডা মাথার লোক, তারও অবস্থা দেখুন–
সত্যিই, বিপদে অবিচল ডহরু লোহারেরও মুখ শুকিয়ে গিয়েছে।
নির্মলবাবু বললেন—আজ বিকেলের মধ্যে তুমি রওনা হতে পারবে?
—নিশ্চয় পারব কর্তা। সিমডেগা যাবার সময় প্রায় সবকিছুই গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। এ ক-টা তবু ভাঙতে আর কতটুকু সময় লাগবে?
তাই ঠিক হল শেষ পর্যন্ত। নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে আমাদের বেশিক্ষণ লাগল না। সব ঠিকঠাক করে আমরা খেতে বসলাম, খেয়ে উঠে পনেরো মিনিট বিশ্রাম করে রওনা দেওয়া যাবে।
খেতে খেতে মেজকর্তা বললেন—এই পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যেই অন্য কোথাও আবার আমাদের জায়গা খুঁজে নিতে হবে কারখানার জন্য। অসুবিধার জন্য জায়গা বদলাচ্ছি। কাজ বন্ধ করছি না–
হঠাৎ তিনি থেমে গিয়ে বললেন সেই লোকটা কোথায় গেল? মৃত্যুঞ্জয়? সে খেতে বসল না আমাদের সঙ্গে?
আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। সত্যিই তো! কোথায় গেল মৃত্যুঞ্জয়? তাকে তো দেখছি না।
অসিতবাবু বললেন-বোধহয় সে আলাদা খেতে বসেছে ডহরুদের সঙ্গে। যাবে আর কোথায়–
কিন্তু ডহরু তখনও খেতে বসেনি, জলধর আর বিশুয়াদের খেতে দিয়ে সে পরিবেশন করছিল। ডিমের ঝোল দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে আসতেই মেজকর্তা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন—ডহরু, মৃত্যুঞ্জয়কে খেতে দিয়েছ তো? ঐ যে, ঐ নতুন লোকটা–
—না বাবু। সে তত খেতে বসেনি। বনের মধ্যে বেড়াচ্ছে হয়তো। এরা উঠুক, সে ফিরে এলে আমি তার সঙ্গে বসবো।
, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় আর ফিরে এল না। সে যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল, অনেক দেরি হয়ে গেল আমাদের রওনা দিতে, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়কে পাওয়া গেল না। যেমন রহস্যময় তার আবির্ভাব, তেমনই রহস্যময় তার অন্তর্ধান।
সিমডেগার দিকে যখন আমাদের লরি আর জীপ ছাড়ল, বনের ফাঁকে ফাঁকে তখন ঝিকিমিকি বেলা। যেন কার নির্দেশে আকাশ থেকে দুর্যোগের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে গিয়ে বেশ ঝকঝকে নীল বেরিয়ে গিয়েছে। ভিজে মাটি এরই মধ্যে শুকিয়ে উঠেছে অনেকখানি। যে কোন জায়গায় কিছুদিন বসবাস করলে, এমন কি সেখানে অনেক দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে থাকলেও, সে জায়গাটা ছেড়ে চলে আসবার সময় মন কেমন করে। জিপ ছেড়ে দেওয়ার পর পেছন ফিরে শেষবার তাকিয়ে দেখলাম আমাদের কদিনের অস্থায়ী ঘর-গেরস্থালি।
জয় দেবতা পাসাং মারা! তুমি থাকো, আমরা চললাম।