শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভাড়ার গাড়ির নরম গদিতে হেলান দিয়ে বন্ধ কাচের ওপারটাকে দেখছিল অন্তরা। না, কলকাতার এ অঞ্চলটা মোটেই বদলায়নি। ওয়েলিংটন বউবাজারের মোড় ঠিক একই রকম ঘিঞ্জি। ট্রামলাইনের দুধারে পুরনো বাড়িগুলো এখনো বহাল তবিয়তে বর্তমান। ভগ্নপ্রায় দশায়। হতশ্রী চেহারায়। সেই তখনকার দোকানপাটগুলোও যেন একই রূপে বিরাজ করছে এখনো। মেডিক্যাল কলেজের লাল লাল বাড়িও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। একে কি সময়ের থেমে থাকা বলে? হয়তো বা।
ড্রাইভারের গলা শোনা গেল, কলেজ স্ট্রিট এসে গেছে ম্যাডাম। গাড়ি কোথায় রাখব?
— দেখুন না, কোথায় পার্ক করা যায়। আমাদের কলেজের…। বলেই থমকাল অন্তরা, মানে— প্রেসিডেন্সির উল্টোদিকের রোডটায়…
— ওখানে খুব ভিড় হবে ম্যাডাম, জায়গা মেলবে না।
— তবু…দেখুন না চেষ্টা করে…
সত্যি রাস্তাটা মানুষে মানুষে থইথই। ঠিক যেমনটা থাকত তখন। কিংবা তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। সার সার বইয়ের দোকান থেকে লোক যেন উপচে পড়ছে পথে। তাদের কাটিয়ে কুটিয়ে অবিরাম হর্ন দিতে দিতে কোনোক্রমে কলেজ স্কয়ারের কোণটায় এলো ড্রাইভার। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ি বেরোচ্ছিল, সুযোগ বুঝে দখল করে নিয়েছে ফাঁকটুকু।
অন্তরা নামল গাড়ি থেকে। সালোয়ার-কামিজের দোপাট্টাখানা গুছিয়ে নিল কাঁধে। মানুষের জঙ্গল ভেদ করে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে কফি হাউসের দিকে। বুকে টিপটিপ উত্তেজনা। আপন মনে হেসেও ফেলল একটু। এমন উদ্ভট খেয়ালের কোনো মানে হয়? কাল ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাবে, তার আগে আজ দুপুরে দিব্যি চষে বেড়াচ্ছিল এলগিন রোডের শপিং মলখানা, দুই হাত উপুড় করে কেনাকাটাও চলছিল বেশ, হঠাৎ যে কেন স্মৃতি রোমন্থনের বাই চাপল? মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এসব কি শোভা পায়? কিংবা কে জানে, হয়তো এই বয়স থেকেই ফের চাগাড় দিতে শুরু করে স্মৃতিরা। লোভ হয় পুরনো দিনগুলোকে আবার ছুঁয়েছেনে দেখতে। ভাগ্যিস এবার সৌমাল্য আসেনি সঙ্গে, এলে হয়তো কফি হাউসে পাড়িই জমাতে পারত না অন্তরা। সৌমাল্য যে ধাতের মানুষ, বউয়ের এ ধরনের শখ জেগেছে শুনলে সে ভিরমি খেত নির্ঘাত।
কফি হাউসের গেটে পৌঁছে অন্তরা পলক থামল। বিড়ি-সিগারেটের দোকানটা অটুট; কিন্তু সেই বুড়ো দোকানিটা নেই। তার জায়গায় এক ছোকরা। বুড়োর ছেলে? অসম্ভব নয়। একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙছিল অন্তরা। কান খাড়া করে শুনছিল সেই পুরনো গমগম আওয়াজটা আসে কি না। উঁহু, নেই তো! ওমনি কপালে পলকা ভাঁজ। ছেলেমেয়েদের আনাগোনা কি কমে গেছে কফি হাউসে?
দোতলায় উঠে কফি হাউসের অন্দরে পা রেখে ভুল ভাঙল অন্তরার। নাহ্, আছে তো ছড়িয়েছিটিয়ে, টেবিলে টেবিলে। তবে তেমন একটা উচ্চকিত নয় যেন। কফি হাউসের ভোলও তো বদলে গেছে আমূল। অ্যালবার্ট হলের সেই প্রাচীন অভিজাত রূপে এখন হালফ্যাশনের ঝাঁচকচকে পরিপাট্য। ঝকঝকে দেয়াল, চকচকে টেবিল-চেয়ার, লম্বাডাঁটি ফ্যানগুলোর মলিন লুকটাও কোথাও উধাও। যে টেবিলটায় তারা নিয়মিত আড্ডা জমাত, সেখানে এক তরুণ ল্যাপটপ খুলে কী দেখাচ্ছে এক তরুণীকে। নিশ্চয়ই লিটল ম্যাগাজিনের পাতা নয়, কিংবা কোনো কবিতার লাইনও নয়…। সেই পাগলটার মতো দুই হাত নাড়িয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে কোনো টেবিলে কথা বলছে কি কেউ? উঁহু, গোটা হলটাই বড় বেশি শান্তশিষ্ট। সিগারেটের ধোঁয়া নেই, আড্ডাখানার মিশ্র কোলাহল নেই, নেহাতই একটা আটপৌরে রেস্টুরেন্ট। দূর দূর, স্মৃতির সঙ্গে কিছুই মেলছে না, এতটা ছুটে আসা বৃথা হলো অন্তরার। স্রেফ সময়ের অপচয়।
আইফোন বাজছে। ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে তাড়াতাড়ি মনিটরে চোখ রাখল অন্তরা। মা।
ঈষৎ উদ্বিগ্ন স্বরে অন্তরা জিজ্ঞেস করল, কী হলো?
— কিছু না। তোর কেনাকাটা শেষ?
— মোটামুটি। বুবাই ঠিক আছে?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওকে নিয়ে সমস্যা নেই। ও তো লক্ষ্মী ছেলে।
— কী করছে ও?
— চুপটি করে বসে আছে বারান্দায়। লেক দেখছে।
— কথা বলছে কিছু? নিজে থেকে?
— ওই একটা…দুটো…।
— বিকেলে কিছু খেয়েছে?
— হ্যাঁ। ওর যা বাঁধাধরা খাওয়া। ম্যাগি নুডল্স। ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না। ধীরেসুস্থে বাজার সেরে আয়।
মার শেষ বাক্যটি আশ্বাসের মতো শোনাল কি? ফোন রেখে অন্তরা ক্ষণিক বিমনা। মা যে তার অতি শান্ত নাতিটিকে নিয়ে খুব স্বস্তিতে নেই, এ তো মার ফোন করা থেকেই টের পাওয়া যায়। মার এই অস্বচ্ছন্দ অনুভূতিটাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। অটিস্টিক নাতিটিকে নিয়ে দাদু দিদা যে যথেষ্ট মনঃকষ্টে থাকে, এ তো অন্তরার অজানা নয়। কতবার তো বাবা-মাকে সে বুঝিয়েছে, বুবাইয়ের অটিজম কোনো অসুখ নয়, এটা একটা বিশেষ ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা মাত্র। সারাক্ষণ আত্মমগ্ন হয়ে থাকা, কিংবা লোকজনের সঙ্গে মিশতে না পারা কিংবা এলোমেলো কথা বলা, এ ধরনের বাচ্চার স্বভাব। যা কি না আস্তে আস্তে একদিন কেটেও যায়। শুধু তার প্রতি সারাক্ষণ বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়, এই যা।
— দিদি, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।
অন্তরা চমকে তাকাল। উর্দি পরা এক বেয়ারা।
সামনেই একটা ফাঁকা টেবিল দেখে চেয়ার টেনে বসে পড়ল অন্তরা। বেয়ারাটিও এসেছে সঙ্গে সঙ্গে— কী নেবেন দিদি?
অন্তরা বিড়বিড় করে বলল, মেন্যুকার্ড নেই?
— হ্যাঁ। ওই তো টেবিলেই।
— দিচ্ছি অর্ডার। আগে একটু জল।
সরে গেছে বেয়ারা। অন্তরা মেন্যুকার্ডটা টানল, খুলল না। ছোট্ট একটা শ্বাস পড়ল। মা-বাবাকে সে যা বোঝায়, নিজে সে কি তা মানে? ১১ বছর হয়ে যাওয়া ছেলেকে এখনো সে যে চোখের আড়াল করে না, সে কি এমনি এমনি? স্নায়ুবিদ মনোবিদ শিশুবিশেষজ্ঞদের দরজায় দরজায় সে কি অকারণে ঘুরে বেড়াচ্ছে? বুবাইয়ের জন্যই না সে চাকরি ছেড়েছে, বুবাইয়ের জন্যই না সে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন? বুবাইয়ের জন্যই না তার আর সৌমাল্যর মধ্যে আজ বড়সড় চিড়ের আভাস? বুবাই যখন বোস্টনে জন্মাল, অন্তরা নাকি বুবাইয়ের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি, আর তাতেই নাকি বুবাইয়ের অটিজম ধরা পড়তে অনেক দেরি হয়ে গেছে! সৌমাল্যর এহেন অভিযোগের পাল্টা নালিশ তো অন্তরারও তূণে মজুদ। দিনরাত অফিস অফিস অফিস। ছেলের পেছনে কতটা সময় দিয়েছে সৌমাল্য? বোস্টনের ওই বাড়িটা তো ছিল নৈঃশব্দ্যের এক খাঁচা, সারা দিনে সেখানে একটা শব্দও উচ্চারিত হত কি না সন্দেহ। এমন গৃহে সন্তান যে অটিস্টিক হবে, এ আর কী এমন আশ্চর্যের।
যা-ই হোক, অন্তরা কারুকে দোষারোপ করতে চায় না। তার কপালটাই মন্দ, এ তো সে মেনেই নিয়েছে। এখন ছেলের সঙ্গে লেগে থেকে থেকে তাকে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক করে তোলাটাই অন্তরার একমাত্র লক্ষ্য। কী যে হবে বুবাইয়ের!
বেয়ারা জল রেখে গেছে, গ্লাসে চুমুক দিল অন্তরা। গ্লাস নামিয়ে রাখতেই ঈষৎ সচকিত। অদূরে এক টেবিলে একটি মেয়ে, একদৃষ্টে তাকিয়ে তার দিকে। কে রে বাবা? শ্যামলা শ্যামলা মুখখানা চেনা চেনা লাগছে যেন! মেয়েটি প্রায় তারই বয়সী, চোখে চশমা, পরনে তাঁতের শাড়ি, চেহারা একেবারেই বিশেষত্বহীন…; কিন্তু পরিচিত। কোথায় দেখেছে?
মেয়েটি দূর থেকেই হাসল একটু। অন্তরাও বোকার মতো ঠোঁট ফাঁক করেছে।
টেবিল ছেড়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটি। সামনে এসে সপ্রতিভ স্বরে বলল, চিনতে পারছ?
মিহি কণ্ঠস্বর। ওই গলার আওয়াজেই অন্তরার মনে পড়ে গেছে। কফি হাউসে মাঝে মাঝেই তাদের টেবিলে আসত মেয়েটা। জয় তখন সবে দিগ্বলয় পত্রিকাটা বার করতে শুরু করেছে। সেখানে ছাপার জন্য কবিতা দিয়ে যেত মেয়েটি, আর তাদের হৈচৈয়ের মাঝে মুখে কুলুপ এঁটে বসেও থাকত কখনো সখনো। কী নাম যেন মেয়েটার? কী নাম যেন?
স্মরণে আসামাত্র অকৃত্রিম হাসি ফুটেছে অস্তরার ঠোঁটে — তুমি তো সাহানা।
— যাক চিনেছ তাহলে। সাহানাকে একটু যেন উৎফুল্ল দেখাল। অনুমতির অপেক্ষা না করেই চেয়ার টেনে বসেছে। হাসি হাসি মুখেই বলল, আমি তো তোমার মতো সুন্দরী নই, নেহাতই খেঁদিবুচি। ভাবছিলাম আমাকে তোমার মনে পড়বে কি না কে জানে।
রূপের প্রশংসায় খুশিই হলো অন্তরা। তবু মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব ফুটিয়ে বলল, যাহ্, কী যে বলো না…বুড়ি হতে চলেছি, এখন আবার সুন্দর অসুন্দর।
— বয়স তোমায় ছুঁতেই পারেনি। এখনো তিরিশ-টিরিশ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
হৃষ্ট মুখে অন্তরা বলল, বাজে কথা রাখ। তারপর বল, আছ কেমন?
— আমাদের আবার থাকা। সংসার নিয়ে নাজেহাল হচ্ছি। এই তো ছেলের বই কিনতে…
— কত বড় তোমার ছেলে?
— সতেরো পুরে আঠারো চলছে। বারো ক্লাসে উঠল। আর্টস নিয়ে পড়ছে। ওর বাবা কয়েকটা রেফারেন্স বইয়ের নাম নিয়ে এসেছিল, সেগুলো কিনতেই আজ এ পাড়ায়।
অন্তরা পলক বিমনা। তার প্রথম বাচ্চাটা মিসক্যারেজ না হলে সতেরো-আঠারোই হতো, নয় কি? সেও নিশ্চয়ই স্কুলের শেষ ধাপেই থাকত এখন। বুবাইকে তো সেভাবে স্কুলেই দেওয়া গেল না এখনো। কী যে হবে বুবাইয়ের!
সাহানা নিজের মনেই বলছে, আজ স্কুলের ছুটি, ভেবেছিলাম একটু বিশ্রাম পাব। ঠিক একটা কাজ চেপে গেল ঘাড়ে।
অন্তরা কথায় ফিরল— তুমি বুঝি স্কুলে পড়াও?
— হ্যাঁ গো। সেই কুদঘাট পেরিয়ে। দু-দুখানা বাস বদলে যেতে হয়…যাতায়াতেই প্রাণ বেরোনোর জোগাড়।
অন্তরা স্মিত মুখে বলল, তা বই কেনাকিনির ঝামেলাটা তোমার বর করলেই পারত।
— হুঁহ, তাহলেই হয়েছে। যা খেয়ালি মানুষ। অফিসে যায় রোজ, তাতেই না আমি ধন্য হয়ে গেছি।
বিরক্তি নয়, একটা সূক্ষ্ম গর্ব যেন উঁকি দিচ্ছে সাহানার চোখে। অন্তরার মজা লাগছিল। ভুরু নাচিয়ে বলল, কোথায় চাকরি করেন তিনি?
— রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। তবে ওটা নামকাওয়াস্তে। আসল চাকরি তো তার লিটল ম্যাগাজিন। ওই নিয়েই মেতে থাকে দিনরাত। প্রেসে ছুটছে, বিজ্ঞাপনের জন্য দৌড়াচ্ছে, লেখা জোগাড় করছে…
— অর্থাৎ সাহিত্যপাগল।
— পুরোপুরি। বিয়ের আগে যেমনটা ছিল, এখনো তেমনটাই আছে।
বেয়ারা এসেছে আবার। অন্তরা সাহানাকে জিজ্ঞেস করল, কী খাবে বল?
— শুধু কফি।
— যাহ্, তা হয় নাকি? চিকেন ওমলেট নিই?
— হেভি হয়ে যাবে। অনেক দেরিতে খেয়েছি আজ…
— তা হোক। চিকেন ওমলেটই নিই। দেখি, পুরনো স্বাদটা পাই কি না।
সাহানা হেসে উঠল। বেয়ারা অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই বলল, তুমি বুঝি পুরনো স্বাদ খুঁজতে এসেছ?
— যতটুকু মেলে।…তা তুমি এখন থাক কোথায়?
— কাছেই। কৈলাস বোস স্ট্রিটে।
মগজে ফের পলকা টোকা। জয়ও কৈলাস বোস স্ট্রিটে থাকত না? এখনো কি আছে সেখানে? সাহানা কি তার খবর রাখে? জিজ্ঞেস করবে সাহানাকে?
প্রশ্ন করার আগেই সাহানা বলে উঠল, আমার কথা ছাড়ো। তোমার খবর বলো তো। বিয়ের পরই তো তুমি আমেরিকা চলে গিয়েছিলে, তাই না?
— হ্যাঁ। বোস্টনে। গত বছর অবশ্য দেশে চলে এসেছি। ব্যাঙ্গালোরে সেটল করেছি।
— তা হঠাৎ কলকাতায়?
— বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না, তাই একবার দেখে গেলাম।
— ও। ছেলেমেয়ে কটি? তারা কত বড় হলো?
— একটিই ছেলে। লেট ইস্যু। এখন ইলেভেন প্লাস।
— বাহ্, বাহ্, চমৎকার সংসার। আমার শ্বশুরবাড়ির মতো রাবণের গুষ্টি নয়। দেওর ভাশুর জা ননদ কাচ্চাবাচ্চা ক্যালরব্যালর…বাড়িতে থাকলেই মাথা ঝিমঝিম করে। এই যে একটু বেরিয়ে এসেছি, অনেক শান্তিতে আছি।
অন্তরার হালকাভাবে মনে হলো, এমন একটা ভিড়ের সংসারে থাকলে কি বুবাইয়ের পক্ষে ভালো হতো না? হয়তো অটিজমের সমস্যাতেই পড়ত না ছেলেটা!
বেয়ারা খাবার দিয়ে গেছে। অন্তরা প্লেট টানল। সাহানাও। চিকেন ওমলেটে নুন গোলমরিচ ছড়াতে ছড়াতে সাহানা বলল, তোমাকে দেখে আজ কিন্তু আমি সত্যিই খুব অবাক হয়ে গেছি।
— কেন?
— মাঝে মাঝেই তোমার কথা আলোচনা হয় কি না। এই তো পরশুই ও কী যেন প্রসঙ্গে বলছিল…
— ও মানে?
— আমার বর। ও তো প্রায়ই বলে, অন্তরা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে, নিশ্চয়ই সুখী হয়েছে, গুছিয়ে সংসার করছে…
অন্তরা সংশয়ভরা স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমার হাজব্যান্ড আমায় চেনেন নাকি?
— ও মা, জয় কি কখনো তোমাকে ভুলতে পারে? সাহানার মুখের হাসিটি অমলিন। একটু যেন কৌতুকের স্বরে বলল, জয় আমায় সব বলেছে গো। কিছু লুকোয়নি।
কাঁটায় গাঁথা চিকেন ওমলেটের টুকরো অন্তরার মুখ অবধি পৌঁছল না, আগেই থেমে গেছে হাত। জোর বিষম খাচ্ছিল, সামলেছে কোনো মতে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, কী লুকোয়নি?
— তোমরা পরস্পরকে কেমন পাগলের মতো ভালোবাসতে, একদিন দেখা না হলে জয় কী রকম ছটফট করত, কিভাবে তোমাদের ছাড়াছাড়ি হলো…
কফি হাউসের আলোটা যেন ঝপ করে কমে গেল। একরাশ পাঁশুটে অন্ধকার যেন ঘিরে ফেলেছে অন্তরাকে। জয়কে অবহেলার উপাখ্যান, প্রত্যাখ্যানের কাহিনী, সবই জানে সাহানা? তার পরও উপযাচক হয়ে তার সঙ্গে এসে গল্প করছে? হেসে হেসে? কী ভয়ংকর মেয়ে!
আপনা আপনি কেমন একটা আত্মরক্ষার সুর এসে গেল অন্তরার গলায়। কেঠো স্বরে বলল, আমি কোনো অন্যায় করিনি। জয়কে আমি যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছিলাম।
— জয়ও তো সেই কথাই বলে। তুমি তো ওকে বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছিলে। শুনেই ও নাকি এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল, আর তোমার ছায়াও মাড়ায়নি।
এভাবেই বলেছে নাকি জয়? অর্ধসত্যের মোড়কে পরিবেশন করেছে ঘটনাটা? জয়কে সে বিয়ের কথা বলেছিল ঠিকই, কিন্তু সে ছিল নেহাত দিখাওয়া। সৌমাল্যর সঙ্গে সম্বন্ধটা তখন শুধু আসেইনি, প্রায় পাকা হওয়া পর্যায়ে, জয়কে কাটাতে অন্তরাও তখন মরিয়া। বাউণ্ডুলে বাস্তববোধহীন জয়ের সঙ্গে সম্পর্কতে যে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এ তো অন্তরা তখন বুঝেই ফেলেছে। তাই না জয়কে আচমকা বলল, হয় সাত দিনের মধ্যে আমাকে বিয়ে করো, নয় আমাকে স্রেফ ভুলে যাও! বলেও ভরসা পায়নি, পাছে জয় কোনো খ্যাপামি করে বসে, অন্তরা আর যোগাযোগই রাখেনি তার সঙ্গে। এক নিশ্চিন্ত নিরাপদ উড়ানের কল্পসুখে অন্তরা তখন বিভোর। কেন সে তখন পেছন ফিরে তাকাবে? জয় মোটেই বোকা নয়, নিশ্চয়ই অন্তরার মনোভাব টের পেয়েছিল, তবে দিব্যি সে কথা চেপে গেছে সাহানার কাছে। উল্টো সে নিজেই যেন দায়ী এমন একটা নাটক খাড়া করেছে। কেন? কী প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল জয়? নিজের হেরে যাওয়াটাকে মহিমান্বিত করার বাসনা? কিংবা এমন নয় তো সাহানা নিজেই তাকে বাজিয়ে দেখতে চাইছে?
অন্তরা তেতো গলায় বলল, আমি কতটা খারাপ, তাও বলেছে নিশ্চয়ই?
— ও মা, না না, জয় তো শুধু তোমার প্রশংসাই করে। বলে, জীবনের সবচেয়ে ইমপর্ট্যান্ট মোড়টায় এসে তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলে। তোমার যা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, যে ধরনের জীবনে তুমি অভ্যস্ত, তাতে ভুল করেও জয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে একটা বিশ্রী ম্যাসাকার হতো। তুমি যে আবেগের ঝোঁকে বোকামি করে বসোনি, এতেই ও খুশি।
— বটেই তো। জয়কে বিয়ে করাটা তো স্টুপিডিটি হতো। কেন যে হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল অন্তরা? চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, জয়কে জানিয়ে দিও, আই অ্যাম ফাইন। আমার বর বছরে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা মাইনে পায়। ব্যাঙ্গালোরে আমরা একটা আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের ভিলা কিনেছি। চাইলে দুনিয়ার এনি লাক্সারি আইটেম আই ক্যান পারচেজ নাউ। আমি সুখের সাগরে ভাসছি, বুঝলে।
অন্তরার আকস্মিক উত্তেজনায় সাহানা থতমত। তবু যেন সহজ সুরেই বলল, আমরাও সে রকমটাই আন্দাজ করেছিলাম। শুনে যে কী ভালো লাগছে। তুমি আমার যা উপকার করেছ, তুমি তো সুখী হবেই।
— আমি? উপকার? তোমার?
— নয় তো কী? তুমি না সরে গেলে আমি থোড়াই পেতাম জয়কে। মধ্য চল্লিশের সাহানার মুখে ব্রীড়ার আভাস— আমি তো প্রথম দর্শনেই জয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই তোমরা যখন কফি হাউসে আসতে, তখনই। মুখ ফুটে তখন কিছু বলতে পারিনি। তোমাদের ব্যাপারটা জানতাম যে।
— বুঝেছি। অন্তরার গলার পাতলা শ্লেষ— আমি চলে যেতেই তোমাদের মধ্যে একটা ইয়ে হয়ে গেল, তাই তো?
— ঠিক তা নয়। ও তখন খুব মনমরা থাকত। কারোর সঙ্গে মিশত-টিশত না। আমার সঙ্গে তো নয়ই। ওই সময়েই মরিয়া হয়ে একদিন বলে ফেললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুনেই জয় চটে কাঁই। সোজা বলে দিল, কেটে পড়ো। অন্তরা ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে এ জীবনে সম্ভব নয়। আমি তখন বললাম, বেশ তো, অন্তরা যেমন আছে থাক না, তাতে তো তোমাকে ভালোবাসাটি আমার আটকাচ্ছে না। একটা সম্পর্ক গড়তে গেলে দুজনকেই যে দুজনকে ভালোবাসতে হবে, এমন তো কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই।
— বললে এ কথা? অন্তরার চোখ বড় বড়, আর জয় তা মেনে নিল?
— ওই আর কী। মন থেকে না মানলেও আর খুব একটা দূরছাই করত না। তারপর স্কুলের চাকরিটা পেয়ে যখন বিয়ের কথা পাড়লাম, ও নিমরাজির মতন হলো। সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়েও রাখল, যদি ভেবে থাকি আমি ওর মন থেকে অন্তরাকে রিপ্লেস করছি, তাহলে সেটা হবে নেহাতই মূর্খামি।
ক্ষণপূর্বের রাগটা জুড়িয়ে আসছিল অন্তরার। জয় তাকে এত ভালোবাসে? সহসাই এক অচেনা পুলকে তিরতির করছে বুকটা। ভেতরের খুশি গোপন রেখে অন্তরা বলল, তুমি সেই শর্তে রাজি হলে বিয়ে করতে? হাইলি ইনসাল্টিং।
— আমার অত মান-অপমানবোধ নেই। সত্যি সত্যি কাউকে ভালোবাসলে মান-অপমানজ্ঞান আর থাকেও না। কী বলো?
জবাব ফুটল না অন্তরার। ঘাড় নাড়ল কি? অন্তরা জানে না।
সাহানাই ফের বলল, তবে বিয়েটা হয়ে খুব মজা হয়েছে, জানো। প্রথম দিকে খুব ভয় পেতাম, ওর মেজাজ-মর্জি বুঝেশুনে চলতাম, এখন আর একদম আমল দিই না। বরং ওর কাণ্ডকারখানা দেখে মাঝে মাঝে বিরক্তিই প্রকাশ করি। তখন হয় চুপ করে থাকে, নয়তো আমাকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমিও তখন দিব্যি টের পাই, জয়ের মধ্যে একটা বড়সড় বদল ঘটে গেছে।
— কী রকম?
সাহানা লজ্জা লজ্জা মুখে বলল, ও বোধ হয় আমায় ভালোবেসে ফেলেছে। অজান্তেই।
শুনে হাসবে, না বিরক্ত হবে, না রাগবে, ভেবে পাচ্ছিল না অন্তরা। অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বুকের গভীরে। একটা ভিজে ভিজে বাতাস যেন বইছে কোথাও। এ কিসের অনুভূতি? ক্ষোভ? হতাশা? বেদনা?
চিকেন ওমলেট শেষ। বেয়ারা প্লেট নিয়ে গেছে। সামনে এখন কফির পেয়ালা।
কাপে চুমুক দিয়ে সাহানা বলল, ব্যাক ব্যাক করে অনেক বকে ফেললাম। তুমি নিশ্চয়ই খুব বোর হলে।
অন্তরা অস্ফুটে বলল, না।
— তোমার বরের কথা এবার বলো। নিশ্চয়ই তোমায় খুব ভালোবাসেন?
একটু আগে হলেও অন্তরা হয়তো কৃত্রিম উচ্ছ্বাসভরা কাঁড়ি কাঁড়ি মিথ্যে আওড়ে যেত অবলীলায়। এখন যেন স্বরই ফুটছে না। এই সাদাসিদে আপাত নিরীহ বিস্ফোরক সাহানা কিভাবে যেন তার বাকশক্তি হরণ করে নিয়েছে। অতি কষ্টে মাথা অল্প হেলাল অন্তরা। বুঝি বা একটু হাসলও। তারপর চোখ নামিয়েছে। কবজিঘড়িতে। আচমকাই গলা উঁচিয়ে ডাকল বেয়ারাকে। বিল মেটাবে। এক্ষুনি।
সাহানা বিস্ময়ের সুরে বলল, অ্যাই, তুমি এখনই উঠবে নাকি?
— হ্যাঁ। যাই।
— না, না, আর একটু বোসো। জয় এবার এসে পড়বে। …তোমাকে হঠাৎ দেখে ও যা চমকাবে না…
অন্তরা যেন ছেঁকা খেল। চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছে। ভারি ব্যস্ত মুখে বলল, না গো, অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাল ফিরব, প্রচুর গোছগাছ করতে হবে।
যুক্তিটা নিজের কানেই হাস্যকর ঠেকল যেন। তবু আর অপেক্ষা করল না অন্তরা। সরাসরি কাউন্টারে বিল মিটিয়ে ছেড়েছে কফি হাউস। নামছে সিঁড়ি বেয়ে। হঠাৎই মনে হলো, বই কিনতে এসে সাহানা কফি হাউসে বসে আছে কেন? হয়তো এমনি এসেছিল, অন্তরাকে দেখতে পেয়ে কতগুলো আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে খানিক মজা লুটল না তো? জয়ের মতো খ্যাপা ধরনের লোক অমন একটা আটপৌরে মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে, ভাবতেও কেমন লাগে।
ফাল্গুনে বিকেল প্রায় শেষ। ফুটপাত ধরে দ্রুত ফিরছিল অন্তরা। হঠাৎই হৃৎপিণ্ডে ধনুকের টংকার। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা কাঁচা-পাকা দাড়ি, কে আসে ওই? চারপাশের পৃথিবীকে ভ্রূক্ষেপ না করে হাঁটছে হেলেদুলে। হে ঈশ্বর, যেন অন্তরাকে না দেখে ফেলে। যেন মুখোমুখি হতে না হয়।
নাহ্, জয় তাকে খেয়ালই করল না। সে এখন কফি হাউসে চলেছে যে। সাহানার কাছে।
হাঁটার গতি কমে গেল অন্তরার। অবসন্ন পায়ে ফিরল গাড়িতে। কাচটা নামাতে যাচ্ছিল, কী ভেবে তুলে দিল আবার। বড় করে একটা শ্বাস ফেলল। জয় সাহানা কফি হাউসে মোড়া অলীক বিকেলটা কাচের ওপরেই থাক না হয়।