(১)
ঢং ঢং ঢং। দেয়াল ঘড়িটা তিনবার সংকেত দিল। রাত তিনটা। একালে দেয়ালঘড়ি খুব কম বাড়িতেই আছে। অ্যান্টিক্সের এক দোকান থেকে কেনা হয়েছে এটা। অবশ্য খরচ করতে হয়েছে অনেকগুলো টাকা। মানুষের মন, আর এর সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক বড় অদ্ভুত। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ পুরনো জিনিস ফেলে দিয়ে নতুন জিনিস কেনে। তারপর আবার অনেক দিন পরে পুরনো জিনিসের কথা মনে পড়লে কয়েকগুন বেশি দাম দিয়ে খুঁজেখুঁজে পুরনো জিনিস কেনে। তা শুধু এসব জিনিস কেন, আরো অনেক কিছু যখনতখন কেনার মত টাকা বদিউজ্জামান সাহেবের আছে।
রাজধানী শহরের নিকটেই বিঘাখানেক জমি নিয়ে সম্পত্তির মধ্যে বিশাল বাড়ি তার। সাথে বড়সড় বাগান। ঢাকা শহরে আরো আটখানা ফ্ল্যাট আছে, যেগুলো ভাড়া দেওয়া। ব্যাংক-ব্যালেন্সের হিসেব তার ভালোমত জানাই নেই। অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, খ্যাতি কোন কিছুই তার না-পাওয়া নেই। আপাতদৃষ্টিতে তার মত সুখী মানুষ খুব কম আছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিই কি সব? বদিউজ্জামান সাহেব বিছানা থেকে নামেন, আরো একটা রাত নির্ঘুম কাটছে। ইদানীং মাঝেমাঝেই হচ্ছে এরকম। চাকুরী থেকে অবসরের পর ধীরেধীরে বিষণ্ণতা তাকে পেয়ে বসতে থাকে। এখন তা প্রকট আকার ধারন করছে।
ঘুমটা ধরে আসার আগ মুহুর্তে আসতেই বদিউজ্জামান সাহেবের চোখের সামনে কতগুলো মুখ ভেসে ওঠে। সেই মুখগুলো কখনো দুঃখী, অভিমানী, আবার পরক্ষনেই রাগী এবং হিংস্র চেহারায় রুপ নেয়, আর তা শেষ হয় বিদ্রুপাত্মক হাসির মাধ্যমে। আধো ঘুম আধো জাগরণের মুহুর্তে কতগুলো মানুষের ক্ষনেক্ষনে মুখের ভাব পরিবর্তনের এই স্বপ্ন বদিউজ্জামান সাহেবকে চীনের বিখ্যাত সিচুয়ান অপেরার ‘বিয়ান লিয়ান’ (মুখোশ পরিবর্তনের মাধ্যমে মনের বিভিন্ন ভাব প্রকাশের কৌশল) এর কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই ‘বিয়ান লিয়ান’ ধরনের স্বপ্ন কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে। বছর চারেক আগে অবসর গ্রহনের পরে সে প্রথম এই স্বপ্ন দেখে। তারপর মাঝেমাঝেই দেখে। ধীরেধীরে স্বপ্ন দেখার হার বেড়ে যায়। এখন প্রায় প্রতিদিন। আর একবার স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গা মানেই পুরো রাত নির্ঘুম কাটানো!
সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে আসেন বদিউজ্জামান সাহেব। ছাদের উপর শুয়ে নক্ষত্র-খচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে দির্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। দু এক ফোটা অশ্রুও কি গড়িয়ে পড়ল চোখের থেকে? মনে মনে মিনতি করে বলেন “খোদা, আমার কি কোন ক্ষমা নেই? আমি কি আর কোনদিন শান্তি পাবোনা?”
(২)
বদিউজ্জামান সাহেব, যিনি সকলের কাছে ডক্টর বদিউজ্জামান নামে পরিচিত, ছিলেন প্রথম সারির সরকারী কর্মকর্তা এবং সেই সাথে নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষক। কলাম লিখতেন নিয়মিত খ্যাতনামা কিছু পত্রিকায়। বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তাই তার বেশ সমাদর ছিল। সরকারী বিভিন্ন নিয়োগবোর্ডের সদস্য এবং পরবর্তীতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ ক’বছর। ডক্টর বদিউজ্জামান সাহেব বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেননা, যে তার উপস্থিতিতে কিংবা সভাপতিত্বে নিয়োগবোর্ডের সব নিয়োগ যথাযথ হয়েছে। তার হাত দিয়ে অনেক মেধাবী এবং যোগ্য মানুষ বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ পেয়েছেন, এটা ঠিক, কিন্তু এও ঠিক যে, তার হাত এ মাটির বহু সন্তানকে বঞ্চিত করেছে যারা কিনা অনেক নিয়োগপ্রাপ্তদের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য ছিল।
বদিউজ্জামান সাহেবকে এটা করতে হয়েছে। জেনে বুঝেই করতে হয়েছে। এটা না করলে আজকের এই বিশাল সম্পত্তি, ব্যাংক ব্যালেন্স তার হতনা। আর এই যুগে টাকা ছাড়া কেউ দাম দেয়না। তারই সহকর্মী ডক্টর হাসান সাহেব তার চেয়েও অনেক বেশি বিদ্বান। কিন্তু ‘সততা’ নামক একটা খোলসে আবদ্ধ হয়ে সারাজীবন অতি সাধারন জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি অবসর গ্রহনের পরে গ্রামের দিকে ছোট একটা বাড়ি করে তাতেই বাস করছেন। তাকে তেমন কেউ চেনেনা। কোন টিভি চ্যানেল তাকে ডাকেনা, কোথাও কোন অনুষ্ঠানে তাকে কেউ সভাপতিত্ব করতেও ডাকেনা। চাকুরী জীবনেও বদিউজ্জামান সাহেব তাকে ডিঙ্গিয়েই প্রমোশন পেয়েছিলেন। নিয়োগবোর্ডের সাধারন সদস্য হিসেবেই হাসান সাহেবকে বছরের পর বছর পার করতে হয়েছে।
তবে এসব নিয়ে বদিউজ্জামান সাহেবের কোন অনুতাপ ছিলনা। যার হাতে ক্ষমতা থাকে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছার একটা মুল্য থাকেই। যেহেতু তার হাতে ক্ষমতা ছিল, সেই ক্ষমতা নিজের ইচ্ছেমত ব্যাবহার করার অধিকার তার থাকবেই। এটাই তার বিশ্বাস ছিল। আর এই বিশ্বাস এখনকার সময়ে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হল, নিয়মিত দেখা ঐ স্বপ্নটাই তাকে ঈদানিং ধাক্কা দিচ্ছে। কয়েকমাস আগে, এক গভীর রাতে এমনি করে ছাদে শুয়ে থাকতে থাকতেই বদিউজ্জামান সাহেব তার স্বপ্ন রহস্য উদঘাটন করতে পারলেন।
নিয়োগবোর্ডের সভাপতি থাকাকালীন কয়েকজন নিয়োগপ্রার্থী, যাদের তিনি বিভিন্ন সময়ে বাদ দিয়েছিলেন, অথচ তারা ছিল সময়ের সেরা, সেই বঞ্চিত মানুষগুলোর মুখগুলোই স্বপ্নের মাধ্যমে এসে তার প্রতি রাগ, ঘৃনা এবং পরিশেষে করুনা প্রদর্শন করে। বদিউজ্জামান সাহেবের আজ মনে হচ্ছে, তাদের নিয়োগ না দিয়ে তিনি শুধু তাদেরই ক্ষতি করেননি, তিনি এই মাটির সাথে, এই দেশের সাথেও বেঈমানী করেছেন।
নিদারুন এই স্বপ্ন, এই দুঃসময়, এই মানসিক অবস্থার কথা বদিউজ্জামান সাহেব কারো সাথে শেয়ার করতে পারেননা। জীবনসঙ্গী হিসেবে যাকে পেয়েছিলেন সেই ফারজানা বেগম তার এই মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করতে পারবেননা। স্বামীর টাকা আর ক্ষমতার অহংকারে আর প্রতাপে পরিপুর্ন এই রমনী নাক ডাকিয়ে ঘুমায় যখন শয্যাপার্শে বদিউজ্জামান সাহেব মানসিক অবসাদে নির্ঘুম রাত কাটান। তার দিকে তাকালে এখন সমারসেট মমের ‘দ্য লাঞ্চন’ গল্পের সেই রমনীর কথাই মনে হয় বদিউজ্জামান সাহেবের।
টাকার কোন অভাব বদিউজ্জামান সাহেবের ছিলনা। মেয়েকে তিনি পাঠিয়েছিলেন আমেরিকার স্টানফোর্ডে। পড়াশুনা অসমাপ্ত রেখে সে সেখানে বিয়ে করে এক হিপ্পিকে। বছরখানেক পরে ডিভোর্স নিয়ে সে এখন সর্বদাই অ্যালকোহলে নিমজ্জিত। পাঁড় মাতালের মত জীবন যাপন করে। ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন অক্সফোর্ডে। সেও পড়াশুনা শেষ করতে পারেনি। ব্যাবসার নাম করে টাকাপয়সা ওড়াচ্ছে সে ইংল্যান্ডে। সব থেকেও তাই কিছুই নেই আজ বদিউজ্জামান সাহেবের।
অতীত জীবনের জন্য কিছু অনুতাপবোধ যখন বদিউজ্জামান সাহেবের মনে তৈরি হল, এদেশের আরো অনেক মানুষের মতই পাপ কাটাতে তিনি এবছর হজ্জে গিয়েছিলেন। দু’মাস আগে হজ্জ থেকে ফিরে এসে তিনি দাড়ি রাখা শুরু করলেন। মাথায় টুপি পড়াও শুরু করলেন। এলাকার মসজিদে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলেন। মোটা অংকের দান খয়রাতও শুরু করলেন। আগে ছিলেন শুধু ‘বুদ্ধিজীবী’। ধর্ম থেকে দূরে থাকা মানুষেরা তাকে বেশি সম্মান করত। এখন তিনি ধার্মিকদেরও সম্মান পাওয়া শুরু করলেন। তিনি এখন আলহাজ্জ এবং ডক্টর। কিন্তু মনে শান্তি আসেনি। বরং দিনদিন মানসিক অবসাদ, অস্থিরতা বেড়েই চলছে।
হায়রে জীবন! ‘জিন্দেগী এক পিয়াস বান কার র্যাহ গায়ী।” আগে ছিল টাকা আর ক্ষমতার ‘পিয়াস’ আর এখন শান্তির ‘পিয়াস’।
(৪)
নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে বদিউজ্জামান সাহেব ভাবতে লাগলেন। দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক অন্যায় অপরাধ করে থাকি অন্যের সাথে। কাউকে মেরে ফেলা, কারো সম্পত্তি দখল করা ইত্যাদি বড় অপরাধ যেমন অন্যায়, তেমনি অন্যায় অন্য ব্যাপারগুলো যা ছোট ছোট মনে হয় কিন্তু অন্যের হক নষ্ট করে। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি মহা অন্যায় করেছেন। সেদিন এক ধর্মীয় বক্তার কাছ থেকে শুনেছিলেন, মৃত্যুর আগে তওবা করতে পারলে আল্লাহপাক তাঁর সাথে করা বড়বড় অপরাধও ক্ষমা করবেন, কিন্তু অন্যের হক নষ্ট করলে, যার হক নষ্ট করা হয় সে ক্ষমা না করলে, আল্লাহপাকও ক্ষমা করবেননা!
আমরা অধিকাংশ মানুষ অবশ্য ক্ষমা চাওয়ার এক পদ্ধতি বের করে ফেলেছি, অন্যায় করে ‘স্যরি’ বলে ফেলা। কিন্তু এতই কি সহজ ক্ষমা পাওয়া! অনেকে সমাজের সামনে চক্ষুলজ্জায় কিংবা সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষার্তে ক্ষমা করে দেন প্রকাশ্যে। কিন্তু আসলে অন্তর থেকে ক্ষমা কি করেন? ক্ষমা চাওয়ার এবং পাওয়ার শর্তই হল, যার হক নষ্ট করা হয়েছে তার হক ফিরিয়ে দিতে হবে (সম্ভব না হলে ক্ষতিপুরন দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে) এবং এ জীবনে আর একই অন্যায় করা যাবেনা। যেমন, কারো জমি অবৈধ ভাবে দখল করেছেন। অনেক বছর পরে মনে হল পাপ করেছেন। হজ্জ করে আসবেন আর মুখে ‘স্যরি’ বলবেন, সব মাফ? তাই কি হয়? যা করতে হবে তা হল, যার জমি অন্যায় ভাবে দখল করেছেন, তার জমি তাকে ফিরিয়ে দেবেন, তার কাছে চোখের পানি ফেলে ক্ষমা চাইবেন, তওবা করবেন আল্লাহর কাছে। এর পরে আপনি হয়ত ক্ষমা পেতে পারেন। বদিউজ্জামান সাহেব নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ঘুষ দিতে না চাওয়ায় যে যোগ্য লোকটিকে একদিন চেয়ারের গরমে চাকরীবঞ্চিত করেছেন, তার কথা মনে করে শুধু মনে মনে ক্ষমা চাইলে হবে, নাকি তার কাছে যেতে হবে, এবং ঘুষের টাকায় বানানো নিজের বিশাল সম্পদ থেকে তাকে ক্ষতিপুরন দিতে হবে?
রাত শেষ হতে চলল। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আযান ভেসে আসছে, ফজরের। বদিউজ্জামান সাহেব উঠলেন। তিনি অন্ধ ছিলেন। অন্ধকারে পথ চলেছেন। তার অন্ধত্ব আজ দূর হয়েছে। তিনি ফেরার পথ খুজে পেয়েছেন। কিন্তু আলোকের পথে তিনি কি ফিরতে পারবেন? নাকি বড্ড দেরী হয়ে গেল? উত্তর জানা নেই। তিনি চেষ্টা করবেন। তিনি দ্বারে দ্বারে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন যাদের সাথে তিনি একদিন অন্যায় করেছেন।