[ময়ূরাক্ষী নদীটি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সৃষ্ট চরত্রি হিমুর নদী। নদীটিকে নিজের করে নিতে চেয়েছি এই গল্পে, এই দুঃসাহস দেখানোর জন্য স্যারের কাছে আজ আর ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ নেই। উনি আমাদের এই ইহজগত ছেড়ে চলে গেছেন গত ১৯ শে জুলাই, ২০১২ তারিখে। আমার এই ক্ষুদ্র দুঃসাহসটি তাই হুমায়ূন স্যারকে উৎসর্গ করলাম।]
এক.
ছেলেটা হাসছে। শুকনো কিন্তু মিষ্টি হাসি। নির্জন একটা পথ, সে একা দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। খোলা রাস্তায় সন্ধ্যার আঁধার ছুটে আসছে। সেই আঁধারের পথ ধরেই সূক্ষ্ম তীরের ফলার মত হঠাৎ নেমে এল ঝমঝম বৃষ্টি। আশেপাশে কোন ছাউনি নেই। আধোয়া নোংরা লাল- হলুদ রঙা টি-শার্টটার আড়ালে কোমরে প্যান্টের ভেতর গোঁজা বইটার কাছে পৌছে যাচ্ছে বৃষ্টির পানি। ছেলেটা ভাবছে… তবুও হাসছে এবং সে থমকেই আছে। বইটির পাতায় পাতায় পানির ধারা নদীর মত এঁকেবেঁকে ছুটছে। হঠাৎ একটা হাত এসে ছেলেটার হাত ধরল। কেউ ছিলনা আশেপাশে, তবুও কেউ এসে হাত ধরল, সে হাতটা আমার। আমিই তাকে টেনে নিয়ে ছুটতে লাগলাম। হঠাৎ সামনে সেই স্বচ্ছ নদীটা, সেই বইয়ের পাতায় যার নাম ছিল, যে কাহিনীটি শেষ করব বলে বইটি কেনার মত পয়সা ছিলনা কাছে বহুদিন। নদীটির নাম ভেসে উঠল চোখের সামনে -ময়ূরাক্ষী।…
হঠাৎ কোন গর্তে চাকা পড়ে ভীষনভাবে দুলে উঠল বলেই ঝিমুনি কেটে গেলো। পয়সা খরচ করে রোলার কোষ্টারে চড়তে যেতে হয়না নন্দন কিংবা ফ্যান্টাসিতে। ঢাকায় লোকাল বাসে চড়লেই হয়। তারোপর যদি সিট না পাওয়া যায় তবে তো কথাই নেই। হিমু হওয়া সম্ভব হয়না বাস্তবে যদিবা কারোরই কিন্তু আমি হিমুর নদীটি দেখতে শুরু করেছি। রোলার কোষ্টারের দুলনী না হয়ে যদি সেই ময়ূরাক্ষীতে কোন নৌকার দুলনী হয়ে উঠত। হলোনা আর…
কেবল অবস্থানগত তফাতের কারনে দ্ইু মানুষে আচরণে কত পার্থক্য! এ বিষয়টা আমি খুব বুঝি। বাসে ঝুলে থাকার কঠোর কসরত নিয়মিতই করে চলছি আমরা এই ঢাকা শহরের খেটে খাওযা মানুষগুলো। মাঝে মাঝে কদাচিৎ সিটে বসার সুযোগ হয়। এই যেমন এখন বসে আছি। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর বিরক্তির মাত্রা এবং সে মাত্রার ডালপালা আমার ঠিক বোঝা আছে। বর্ষাকাল, আকাল রাজধানীর পথে পথে অযুত নিযুত ধর্ষনের ফলে যে কাদাময় ক্ষত তার ছাপ জুতোয় জুতোয় ঘোরে ফেরে। দাঁড়িয়ে থাকা পাশের ব্যাক্তিটির কাঁধে একটা বড় আকারের ব্যাগ, বেচারা একটু ঘুরে মাংসপেশীগুলোকে শান্তি দেয়ার চেষ্টা করছিল, পাশেই কারও প্যান্টের উপর দিয়ে কাদামাখা স্যন্ডেলটা স্পর্শের দুঃখ ছোঁয়া লাগাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন-‘চোখের মাথা খাইছেন নাকি, বাস থাইমা রইছে আপনের ঘুরনের কি দরকার, ঘুরছেন ভালো , দেইখ্যা ঘুরবার…’
ওদিকে কান দিয়ে লাভ নেই, এসব রোজকার বিষয়। বসার সুযোগ হয়েছে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা দরকার। একটু গতি আবার একটু অনঢ় অবস্থা-এইতো ক্রমাগত, মাথাটা দুলে ওঠে, লেখক প্রাণটা জেগে ওঠে। দাঁড়িয়ে থাকলে শরীরের পেশীগুলো ব্যালেন্স বজায় রাখতে এতটাই শক্তিক্ষয় কওে, মাথা আর তখন কাজ করেনা। বসে থাকলে কাজ করে। এখন কাজ করছে। নতুন একটা গল্পের ভেতর সে ঢোকার পরিকল্পনা করছে। চোখ দুটোও বন্ধ হতে চাইছে। ঝিমুনিটি উপভোগ করতে চাইছে মন। গল্প না আসুক , হিমুর নদীটও আসতে পারে , কিন্তু সাথে ছেলেটা যার কোমড়ে বইয়ের পাতা ভিজছিল, সে আসুক আমি চাইনা। অনেকদিন ভুলে ছিলাম। ইদানীং কেনো আবার সেই ছেলেটা আসছে আধোস্বপ্নে? আগে যখন আসত তখনই ভেবেছিলাম একটা গল্প লিখব, কিন্তু মন সাড়া দেয়নি। লিখবনা। বরং মন থেকে তাড়াব। তাড়িয়েছিলামও, লেখালেখির প্রতি ঝোঁক আর ভাবনা ক্রমাগত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তা সে উভয় ক্ষেত্রেই- সাহিত্য চর্চা আর অফিসের গদবাধা রিপোর্ট আর চ্যানেলের স্ক্রিপ্ট। মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারে যাক আমার মত বাউন্ডুলেদের খেয়ে পড়ে বাঁচার মত কিছু সুযোগ হয়েছে।
অকারণ হর্ণ বাজাচ্ছে গাড়িগুলো। ফ্লাইওভারের কাজে রাস্তার কিংদাংশতো অকেজোই , মড়ার উপা খড়ার ঘা হয়েছে দুধার দিয়ে পাইপ বসানোর হিড়িত পড়ে যাওয়ায়। গর্ত থেকে উঠানো মাটির সাথে বৃষ্টির পানি এসে মিশে থিকথিকে ক্ষীর রেঁধেছে। কি দুর্বিসহ কষ্টে, দূর্দান্ত কসরতে রাস্তা পার হচ্ছে সকলে। স্কুল ফেরত ছেলেমেয়েগুলোও। জীবন হাতের মুঠোয় সবার। মুঠো খুললেই প্রাণ বায়ু উড়ে যাবে। এইসব বিসদৃশ্য নিয়ে খুব লিখতে ইচ্ছে হয়। চেষ্টাও করেছি কত। তারপর এগুতে এগুতে বৃত্ত আর পূরণ হয়না।
আচ্ছা এই বৃষ্টিতে মানুষের কষ্ট নিয়েই একটা গল্পের প্লট শুরু করা যায়। বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়া পথের সমস্যা নিয়ে শুরু হবে। কিন্তু সাথে আসতে থাকবে রাস্তার বেহাল অবস্থার করুন চিত্র, রাস্তা মেরামতের নামে টাকা লুটপাটের এক মহোচ্ছব, বিদেশি অর্থ সহায়তা রাস্তার মেরামতে বাস্তবে সামান্যই ঢালা হচ্ছে আর আছে মন্ত্রী মিনিষ্টারদের শকনুী দৃষ্টি, দলীয় নেতা কর্মীদের আগ্রাসন–সমস্যার ডালপালা ছড়াতে থাকে, কোন স্থানে থামেনা, গল্পের নৌকা কোন নদীর ঘাটে ভেড়েনা। তাইতো শেষমেষে বরাবরই সমস্যা দিয়ে শুরু করেও গল্প প্রেমের জালে পা দেয়। গল্প লেখা হয়ে যায়, লেখা হয়ে যায় একসময় উপন্যাসও। প্রকাশকরা সমস্যা তুলে ধরার দিকে মাথা ব্যাথ্যা করেন না। প্রেমের উপন্যাস ভালো চলে, ‘পরকীয়ায় পঙ্তিহারা ’-উপন্যাস তাই প্রকাশের লগ্নির অর্থ উঠে আসার মত বিক্রি হয়। প্রকাশক আবারও সামনের বইমেলার জন্য দুটো প্রেমের উপন্যাস লিখে দিতে বলেছেন। পরকীয়া যেন থাকে সেটা বলতে ভোলেন নি। উনি শিক্ষিত প্রকাশক বলেই বই পড়েছেন। পরকীয়ার উৎকণ্ঠা বুঝেছেন। অনেক প্রকাশকতো লেখাপড়াই জানেনা। তারা আবার কেবল রগরগে বই চান। আমি লেখক হতে চাই। দু’একটা বই বেঁচে কিছু টাকা প্রকাশকের কাছ থেকে খসাতেও চাই। সমস্যা নিয়ে, দেশের মানুষকে বইগুলো আর লেখা হয়না, যা লেখা হয় দু’একটা বৃত্ত খোলা গল্পে, তাও পড়ে থাকে মেসের টেবিলে ডায়েরীর পাতায়।
দুই.
বড় লেখক হয়ে উঠতাম যদি কোনদিন সমস্যা নিয়ে লেখা গল্পগুলোও প্রকাশকদের দিয়ে ছাপানো যেত। সেদিন হয়তো মন উজাড় করে কিছু গল্প লিখে ফেলতাম। হিমুর ময়ূরাক্ষী নদীটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখা সেই ছেলেটাকে ময়ূরাক্ষী নদীটিতে নৌকায় চড়াতে চেয়েছিলাম। গল্পটার সূচনা করতে পারিনি। ছেলেটা বারবার কষ্ট দেয়, চোখে পানি নিয়ে আসে। লেখক হবার যাতনা আর সুখ ঘিরে ধরে। প্রিয় লেখক হুমায়ূন স্যারের সাথে দেখা করব ভেবেছি। হিমুর মযূরাক্ষী নদীটি তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হবে। তারপর ছেলেটাকে শিকলবন্দী করে গল্পটা লিখে ফেলতে হবে। স্যারকে দেখাতে হবে। কিন্তু স্যারতো এখন আমেরিকায় চিকিৎসারত। শুনেছি শরীরের অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে ইদানিং। স্যারের জন্য পরাণ কাঁদে। দেশে এলেই এবার আমি ছুটে যাব। কিন্তু উনি কি আমার মত ছোট লেখকের সাথে দেখা করবেন? মযূরাক্ষী নদীটি কিছুটা ক্ষনের জন্য হিমুর কাছ থেকে নিয়ে ধার দেবেন? অবশ্যই দেবেন-উনি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ। আমি ওনাকে সেই ছেলেটির কথা বলব। বলব, স্যার সেই ছেলেটি আমি। আপনার ‘ময়ূরাক্ষী’ বইটি লুকিয়ে দোকান থেকে আমি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। দোকানের কর্মচারী ছিলাম, কাজের ফাঁকে বইটি শেষ করতে পারিনি। বৃষ্টি এলো তখনই । …স্যারকে বাকীটুকুও বলব। উনি নিশ্চয় আমার কষ্টটা বুঝবেন। উনি মানুষের সহজাত কষ্ট খুব ভালো বোঝেন বলেই তো সেগুলো এত সুন্দর প্রকাশ করেন লেখায়। অথচ আমি লিখি ঘোড়ার ডিম।
তবুও কেউ মজেছে। মজাও হতে পারে। তবুও আমি রিস্কটা নিতে চাচ্ছি। অতীত বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। ইদানীং বৃষ্টি হলেই আমার অতীতের সেই সন্ধ্যা ফিরে আসছে। একজন নারীর সঙ্গ কি তবে আসলেই প্রয়োজন? সেটাও ভেবেছি। বন্ধনে বন্দী হতে চায়না আজও মন। কিন্তু তবুও বোধহয় প্রয়োজন।
সে আমার মোবাইল নম্বর যোগাড় করেছিল। বলেছিল, আমি আপনার ফ্যান। ‘পরকীয়ায় পঙ্তিহারা’ আমার দ্বিতীয় উপন্যাস। দ্বিতীয় উপন্যাসে সুকণ্ঠী নারী ফ্যানের ফোন। আমি মুহূর্তে আকাশে মেঘে চড়ে বসেছিলাম। কেনো জানি তবুও বলে ফেলেছিলাম, আপনি কি আমার বই পড়ে মনে কষ্ট পেয়েছেন, তিক্ত কোন বাক্য শোনাবেন বলে কি এই ফোন কল?
সুকণ্ঠী প্রতি উত্তরে বলেছিল, না, আমি মুগ্ধ হয়েছি , আমি আপনার প্রেমে পড়েছি।
আমি বোকার মত বললাম, প্রেমে!
হুম! তবে আপনার নয় কিন্তু , আপনার বইয়ের।
তারপর কিছুক্ষণ হাসাহাসি। অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। কথা বৃষ্টির মত। যতক্ষণ ঘনীভূত মেঘ থাকে সে ঝরবেই। আমাদের দু’জন নরনারীর মস্তিষ্কে মেঘ দ্রুত এবং ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছিলই। আমিও আমার প্রথম ফ্যানের প্রতি নিজেই মোহাচ্ছন্ন হচ্ছিলাম। প্রায়ই কথা হয় আজকাল।
নারী তার নাম বলেছে রূপা। বিশ্বাস করেছি আবার করিনিও বলা যেতে পারে। হিমুর ভক্ত নারী, হিমুর নায়িকা রূপার নাম সে কারনেই বলে থাকবে হয়তো। জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে ভূবন ভুলানো হাসি শুনিয়ে বলেছিল, নামটা নাকি সত্যিই। আমি বিশ্বাস করেছিলাম। নামটা আমাকে অগোচরে নারীর প্রতি আলাদা একটা মোহ সৃষ্টির ঘটনায় পর্যবসিত করেও থাকতে পারে। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সৃষ্ট রূপা চরিত্রটির প্রতি আমারও আলাদা একটা মোহ আছে। রূপা নামে মজব সেটাই তাই স্বাভাবিক।
রাতে কখনও কথা হয়নি। আমি ছ্যাবলামি করে একদিন রাতে মোবাইল বন্ধ রাখার কারন জানতে চেয়েছিলাম । অকপটে বলেছিল, পরকীয়া নিয়ে বইয়ে এত বিশ্লেষন করেছো আর আমি বিবাহিত সেটা বুঝলেনা।
ততদিনে আমরা দু’জন দু’জনার প্রতি তুমি সম্বোধনে চলে গিয়েছিলাম। বিবাহিত শব্দটা একটা প্রচন্ড নাড়া দিলেও আমি সামলে নিলাম। কেনো যেন এবার সত্যিকার ভাবে সম্পর্কটাতে একটা প্রশান্তি পেলাম। হতে পারে বন্ধনের বাধ্যবাধকতা মুক্ত হলাম বলে। তবে নিজের মাঝে নষ্ট একটা আপন ভূবন টের পেলাম। পরকীয়া নিয়ে উপন্যাস যখন লিখছিলাম, ভাবনার সূতো মুক্ত আকাশে অবারিত ছড়াচ্ছিলাম তখন এই ভূবনটা সাড়া দেযনি। এখন দিচ্ছে। রূপা বলেছিল, কী? বিবাহিত দেখে কি বন্ধুত্ব করবেনা? পরকীয়াতো করতে বলছিনা। শুধু লেখকের একটু সান্নিধ্য চাচ্ছি। সেটা কি খুব অন্যায়?
কেনো যেন আবার ছ্যাবলামি করে বলেই ফেলেছিলাম, পরকীয়া করতে চাইলেই কি করা যায়, সে যে হইয়া যায়…হো হো হো।
সম্পর্ক কতদূর কি এগিয়েছে ভাবিনি। একা মানুষ। মুক্ত বিহঙ্গ। কল্পনার জগত আমার জীবনের অনেকাংশ জুড়ে। তারোপর সেই বৃষ্টি ভেজা বই -সেই কষ্টের দৃশ্য। আমি ভুলতে চাই।
রূপা বলেছিল, দুপরের সময়টাতে বাসায় সে সবসময় একাই থাকে। লেখক চাইলেই এসে দেখা করে যেতে পারে।
থার্ড পার্সনে বলা বাক্যের সে আমন্ত্রণে সাড়া দিতেই ছুটেছি আজ।
তিন.
আমি এলাকাটা চিনি। দক্ষিণ দনিয়া । শুনে রূপা বলেছিল, তাই নাকি, আর কোন পরকীয়া সম্পর্ক আছে নাকি এদিকে …
থাকলে কি হবে?
নেই সেটা জানি, লেখায় তুমি যত পটু নারীদের সাথে কথা বলায় তত পটু কিন্তু নও।
তবে তুমি যে পটলে!?
পটেছি নাকি? আমিতো পটালাম।
…আমার কিন্তু চিরন্তন পুরুষালি আতে ঘা লেগেছিল। তারপরও কেনো আমন্ত্রনে ছুটে এলাম! জ্যাম এখন অসহ্য লাগছে। বোজা চোখে কত কিছু ভাবছিলাম। নেমে চলে যাব নাকি। যদি রূপার হাসবেন্ড চলে আসে। যদি ধরা পড়ে যাই। আসলেই কি আমার মনে কোন নষ্ট ইচ্ছে সাড়া দিচ্ছে, নাকি কেবলই কৌতূহল। লেখকদের কত পাগলামী থাকে। আমি লেখক হতে চাই, একটুখানি হয়েছিও বটে, একটু পাগলামী করলে কিই বা যায় আসে। তবুও…এতো ঠিক নয়। ফোনের সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থাকনা। যদি দেখতে খুবই কদাকার হয়। যদি একাবর তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। যদি বেশ বয়স্কা হয়। যদি মজা করার জন্য আরও দু’চারটে বান্ধবীকে নিয়ে বসে থাকে…
মোবাইল বাজছে। কিন্তু পকেট থেকে এই চাপাচাপির সিটে বসে সেটা বের করাটাই কষ্টসাধ্য। পাশের লোকটির সাথে কুনইয়ের গুতো লাগায় আড়চোখে তাকালে সে একবার। সে তাকানোর উত্তরে আমার কি ভয় পেয়েছি এমন কোন ভাব করা দরকার? আচ্ছা হিমু হলে কি করতো…সে আমার ভাবনায় আসার নয়, হুমায়ূন স্যারই ভালো জানেন । স্যারের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতে হবে। হিমুর পরকীয়া বিশ্বাস নিয়েও স্যারকে একটা বই লেখার অনুরোধ করতে হবে।
…রূপার কণ্ঠ ভেসে এল মোবাইলের তরঙ্গে, তোমার জন্য রাঁধতে রাঁধতে ঘেমে একাকার। তা কতদূর পৌঁছালে?
এই তো যাত্রাবাড়ী । প্রচন্ড জ্যাম।
সে জানি। বাস থেকে নেমেই দেখোনা। সকালের বৃষ্টিতে রাস্তার কি যে অবস্থা ভেতরে ঢুকলেই বুঝবা।
ভয় দেখাচ্ছ। অচেনা নারীর সাথে দেখা করতে তার বাসাতেই আসছ। কাদাপানির ভয় তুমি পাবে, সে আমি বিশ্বাস করিনা। তবে তোমার কণ্ঠ কিন্তু কাঁপছে।
সেটা কিন্তু বাসের দুলুনির কারনে রূপা। ভয় পেলে কি আর আসতাম!
সত্যি তুমি আসছো তো?
আসছি। এখন রাখ, বাস ব্ডড বেশি দুলছে। কখন যে উল্টেই যায়।
উল্টে গেলে আমার কি হবে, কে দেবে আমার বুড়ো হাবড়া বরের হাত থেকে মুক্তি?
হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিলাম। আরেকবার ভাবলাম, সত্যি কি আমি যাচ্ছি। হ্যাঁ যাচ্ছিই।
জ্যামে থেমেছে বাস আবার। চোখ বন্ধ করলাম। অনেক নষ্টালজিক স্মৃতি মনে পড়ছে। প্রতিটি স্মৃতির পরতে পরতে ফিরে আসে সেই বৃষ্টি ভেজা বই। বইটির নাম ছিল ময়ূরাক্ষী। ১৯৯০ সালের কথা, সম্ভবত ঐটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের হিমুকে নিয়ে লেখা প্রথম বই। জব্বার হোসেন সাহেবের লাইব্রেরিতে কর্মচারী ছিলাম। বস্তির ঘরে অসুস্থ মা। খুব কষ্টে আমার দু পয়সার আয়ে চলে যেত কিন্তু চিকিৎসা মার ঠিক মতো হতোনা। তারোপর রাতে নৈশ স্কুলে পড়তাম। পড়ালেখাটা ছাড়তে পারতাম না, কেনো জানি সেটা আমার নেশা ছিল। জব্বার সাহেবের সেই ভয়াবহ মার-এখনও যেন পিঠে ব্যাথা অনুভত হয়। অনেক কষ্টে কেটেছে চাকরিটা চলে যাবার পরবতী অনেকটা দিন। মা’ও মারা গেলেন সেই সময়। একর পর এক যাতনা। দনিয়া এলাকার বস্তি ছেড়ে চলে গেলাম। কৈশোরের স্মৃতি কত এই এলাকার। জব্বার হোসেনও তখন এই এলাকায় থাকতেন। ভাড়া থাকতেন। শুনেছিলাম এখানে তার একটা কেনা জায়গাও আছে।
ভাড়া বাড়িটাতে গিয়ে এসে অনেকদিন আগে একবার খুঁজেছিলাম। থাকেনা সে এখন আর। কেউ খোঁজও দিতে পারলনা। তার কেনা জায়গাটা চিনতামনা। দোকানটা ছিল পুরান ঢাকায়। এখন আর নেই। সেখানে এখন সুইচ্চ দালান উঠেছে। জব্বার হোসেনকে আমি খুঁজি পথে ঘাটে। এত এত মানুষ, তাকে কোথায় পাব? তাকে খুঁজে পেলে কি করতে পারব জানিনা। কিন্তু মনে হয় ঐ যাতনার স্মৃতিটা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।…বইটা সন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ করার সময় কোমরে গুজে নিয়েছিলাম। দোকানের সব বই দোকানেই প্রতিদিন একটু একটু করে পড়ে ফেলতাম অন্যদের অগোচড়ে সময় সুযোগে। জব্বার সাহেবের আরও ব্যবসা ছিল। উনি কমই আসতেন। ‘ময়ূরাক্ষী’ খুব টেনেছিল। চার পাতা পড়ে তাই লোভ সামলানো সম্ভব হয়নি। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই বৃষ্টি চলে এসেছিল। জব্বার হোসেন সেই সময়ই সে দিক দিয়ে যাবেন কে জানত। কাকতলীয় ঘটনা এই ভাবেই বোধহয় ঘটে।
চার.
রূপা কমই বলেছে। ধোলাইপার থেকে রিক্সা নেয়ার পর বুঝলাম রাস্তা কতটা ভয়াবহ। দনিয়ার এ.কে হাই স্কুল পর্যন্ত পাকা হয়েছে, তারপর পুরোটা কাঁচাপথ। কাদা থিকথিক করছে। থলথলে ক্ষীরের মোটা স্তর যেন। একটু পরপরই বড় বড় গর্ত। কেউ বুঝি দেখার নেই এ দেশে এসব। সবাই মেনে নিচ্ছে। রিকশাওয়ালার অবর্ননীয় কষ্ট হচ্ছে। রিক্সা ওয়ালার কষ্ট দেখে আমারও কষ্ট হচ্ছে। নেমে যাব কিনা ভাবলাম। কিন্তু তাতে কার লাভ, বরং ক্ষতিটাই বেশি, হাঁটার মত জায়গা তো নেই। পায়ে কাদা লাগবেই, রিকশাওয়লাও ভাড়া থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু বেচারা টানতে পারছেনা।
একটু শুকনো মত বালুচর দেখে নেমেই গেলাম । পুরো ভাড়াই দিলাম। অনেকদিন পরে এলেও এদিকের রাস্তা ঘাট আমার চেনা মোটামুটি। গোয়ালবাড়ির খুব কাছেই রূপার বাসা, সে তেমনই জানিয়েছে। কাছাকাছি গিয়ে ফোন দিলেই হবে। কানে আযানের ধ্বনি শুনতে পেলাম। সময় খেয়াল ছিলনা। এতক্ষণে খেয়াল হলো। মগবাজার থেকে আসতে দুই ঘন্টার বেশি লেগে গেলো।
এই যা! সামনে একটা রিকশা উল্টেই গেলো। মা মেয়ে দু’জনেই কাদায় মাখামাখি। গিয়ে যে উঠাব তাতে কাদায় তো মাখামাখি হয়ে যাব আমিও। অবশ্য আমি ভাবার আগেই আশপাশথেকে সাহায্যকারীর অভাব হলোনা। মেয়েটা স্কুল পড়ে , গায়ে স্কুল ড্রেস। গ্রোথ ভাল, নাইন টেনে পড়ে বোধহয়। কিছু লোক তার কাদা লেপ্টানো পোষাকের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমিও তাকালাম। মা’টা দ্রুত তাকে টেনে নিয়ে পাশের দোকানের দিকে সরে দাঁড়াল। আর তাকালাম না। নষ্ট মনটার প্রতি একটা গালি দিলাম । কিন্তু এইবার কেনো জানি রূপার গৃহে একটা নষ্ট দৃশ্য ঘটানোর ইচ্ছেতে মন সাড়া দিতে চাইল। হর্ষ এল। ঠোঁটটা কী এত সহজেই রূপা স্পর্শ করতে দেবে? মনেতো হয়।
গোয়ালবাড়ি মোড়ে গিয়ে ফোন দিলাম। তারপর ফোনে রূপার নির্দেশনা অনুযায়ী খুব সহজেই বাড়িটি চিনে ফেললাম। চারতলা বাড়ি। চোখে লাগার মত নীল সবুজ রং করা। এটা রূপার স্বামীর বাড়ি। লোকটা নাকি বেশ বড় ব্যবসায়ী। ওষুধ আর কাপড়ের ব্যবসা। অনেক টাকা। তবুও রূপা অসুখী। কারন বলতে চায়নি প্রথমে। পড়ে বাধ্য হয়েছিল বলতে, লোকটার আগের পক্ষের আরেক স্ত্রী আছে , সেই স্ত্রী আর তার সন্তানেরা অন্য আরেকটা বাড়ীতে থাকে, সেটা সম্ভবত পুরান ঢাকার কোথাও। রূপার প্রতি একটা সহানুভূতি জেগেছেলি। কিন্তু রূপা গ্রামের মেয়েও হলেও এসএসসি পাশ করেছিল। সে সহানুভূতি চায়নি। সে সান্নিধ্য চেয়েছিল, মানসিক সাপোর্ট চেয়েছিল। কিন্তু আমার বই সে কেনো কিনেছিল সে কথা কোনদিন বলেনি। আমার খুব রাগ হয়েছিল।
প্রথম দর্শনে কি বলব, একটা জড়তা কাজ করবে সেটা টের পাচ্ছিলাম। সিঁড়ির কলাবসিবল গেইট আমার জন্য খুলেই রেখেছিল। আমি আশেপাশের দৃষ্টি এড়িয়ে সোজা তিন তালায় উঠতে উঠতে ভাবছিলাম সামনে গিয়ে বলব, আজ বলতেই হবে আমার বই তুমি কেনো কিনেছিলে।
কিন্তু বলা হলোনা। ফোনে সে বলেছিল দেখতে খুব একটা সুন্দর সে নয়। বয়স একত্রিশ বছর। আমার থেকে বছর পাঁচেক ছোট। আমাদের মধ্যে কমিটমেন্ট হয়েছিল আমরা সত্য গোপন করতে পারব তবে মিথ্যে বলতে পারবোনা। তাই রাগ হলো, সে মোটেও অসুন্দর নয়। আবার অত বিশেষণ যোগ করা মত সুন্দরী বলবোনা, তবে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয়তো বটেই। তার কিঞ্চিৎ স্থূল দেহেরর অভ্যন্তরে জ্বলন্ত সব উত্তেজক লাভা এতই অধিক যেন শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশ দিয়ে সেই লাভা পরিপূর্ণভাবে বের হবার প্রচন্ড প্রয়াস চালিয়েই চাচ্ছে। কোন পুরুষ না বিগড়াবে! আমিও মুহূর্তে বিগড়ালাম কিন্তু বেসামাল হলাম না মোটেও ।
আমার রাগের কথায় সে হাসল। সত্যি তার হাসি সুন্দর। শ্যামলা বর্ণের মুখশ্রীতে তার পুরুষ্ট ঠোঁটদুটো ঠিক কি রঙের বুঝব কি করে, যতসামান্য সাজ সে নিয়েছিল, যদিও সেটা মানা ছিল। সে কথা রাখেনি। হালকা লিপিস্টিক লাগানোর দক্ষতায় মনেই হবে না গ্রামের কোন হতভাগা নারী ছিল এই নারী একদা।
আমাকে বসতে বলতে বলতে অকপটে রূপা বলে উঠল, আমি জানি পুরুষের কোন দৃষ্টি আমাকে খোঁজে।
আমি একটু লজ্জিত হলাম। এটা আমার স্বভাব জাত।
তোমার লজ্জিত হবার দরকার নেই,তোমাকে আমি এত নির্জনে, এত রিস্ক নিয়েও বাসায় ডেকেছি আর এতটুকু দৃষ্টি দেয়ার অধিকার দেবোনা তা কি হয়। একটু বসো, তোমার জন্য শরবত নিয়ে আসি। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিতে পার। কাদা তো ভালোই লেগেছে । ভেতরে আমার বেডরুমের বাথরুমে যাও।
আমি এইবার একটু আনইজি বোধ করি। বলেই ফেলি, বেডরুমে!
না, আসলে এ বাসায় লোকজনতো খুব কম আসে। বাইরের বাথরুমটা একটু অপরিষ্কারই বলা যেতে পারে। তাই ভেতরেই …
আচ্ছা, ঠিক আছে , বেডরুমটা কোন দিকে?
পাঁচ.
ভাগ্যিস বেডরুমে ঢুকেছিলাম। অতি ভদ্র হয়ে কাচুমাচু করে ড্রইং রুম পর্যন্তই বসে থাকলে এত দিনের প্রচেষ্টা হঠাৎ সফলতার মুখ দেখতোনা। বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘরের পরিচ্ছন্ন মেঝেতে পা রেখে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। বোঝা যায় টাকার জোর আছে। চারদিকে দামী দামী জিনিসের মাঝে তারই ছাপ।
কিন্তু পরক্ষণেই আমার চোখ সামনের দিকে তাকিয়ে ছানাবড়া হয়ে গেলো। আমি চিনেছি। ঠিকই চিনেছি। সোনালী ফ্রেমে রূপার সাথে বিয়ের সাজে যে লোকটি ঐ তো সেই লোক, ও ব্যাটাকেই তো আমি খুঁজে ফিরছি আজ এত বছর। ঐ তো সেই আমার পুরাতন মনিব জব্বার হোসেন। চোখের সামনে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই। কিন্তু এত টাকার মালিকতো সে ছিলনা। এ দেশে অবশ্য তার মত অমানুষের পক্ষে রাতারাতি বিশিষ্ট বণিক বনে যাওয়া খুব কঠিন নয়। সেই কিশোর কালে যখন তার দোকানে কাজ করতাম জানতাম তার একটা ওষুধের দোকানও ছিল। সেখানে গোপনে মাদকের ব্যবসাও সে চালাত এমন আলাপ শুনতাম লাইব্রেরির অন্যান্য কর্মচারীদের কণ্ঠে। হয়তো সেটাই সত্যি হয়ে থাকবে।
কিন্তু এখন আমি কি করব। এতদিন খুঁজেছি। খুঁেজ পেলে কি করব সেটা তো ভাবিনি। আমার প্রকাশিত বইগুলো তার সামনে নিয়ে ছুঁড়ে মারব। ঐ বুড়ো কী সেটার যোগ্য? সে কী আমার লেখক হওয়াকে আরও উপহাস করবে না? ২২ বছর আগে এক সন্ধ্যায় যখন কি ভীষণ মারটাই না মেরেছিল। একটা মাত্র বই দোকান থেকে নিয়ে আসার কি করুন শাস্তি। আমিতো বইটা ফেরতও দিতাম।
টানতে টানতে দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। স্কেলের সপাৎ সপাৎ শব্দ…পিঠ কেটে রক্ত বেরিয়েছিল। বৃষ্টি ভেজা বইটা একটানে কোমড় থেকে টেনে নিয়ে ড্রেনে ছুড়ে মেরেছিল। সে কি দুর্বিষহ গালাগালি। রাগ হচ্ছিল, বইটা ড্রেনে ফেলে দিল! এত সুন্দর একটা বই, হিমুর প্রথম বই, প্রিয় লেখকের বই। লোকটা তার কালো ঠোঁটটাকে বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘হারামীর পুত বিদ্বান হইছো, বই পড়ান মারাইতাছো, ফকিরনীরপুত লেখক হইবো।’
‘একদিন আমি নিজেই লেখক হমু দেইখ্যান, সেদিন আপনের মুখের উপর এই বইয়ের দাম ছুইড়া মারবু।’
একটা বইয়ের দাম ছুঁড়ে মারার জিদ সেই কিশোর বয়সে মানায়। এখন তো পরিণত মন। বেডরুমেরই একটা সোফা এক কোনায় । রূপা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সেখানেই বসতে বলে। হাতের ট্রেটা সামনে রাখে। শরবত আর মিষ্টি।
আমি তোমার জন্য কিছু আনতে পারিনি, এই কাদা…,
তুমি এসেছো, প্রিয় লেখক। আর কি চাই। এই নাও তোমার বইয়ে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দাও। সেরা উপহার হবে।
ভাবলাম উপন্যাসের ডায়ালোগের মত সিনেমাটিক ভাবে বলি, কেনো তোমাকে দেয়ার মত আরও অনেক উপহার আছে, দেবো নাকি? কিন্তু বলতে ইচ্ছে হয়না। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, জব্বার হোসেনই যদি এই রূপার স্বামী হয়, তবে সেই অতীতের প্রতিশোধ নেয়ার এই তো কম সুযোগ নয়। রূপা আমার প্রতি অনুরুক্ত সেটা তো স্পষ্ট। আমি চাইলে তাকে আরও উদ্বেলিত করতে পারি। তার এই লোভাতুর দেহটা নিয়ে খেলতে পারি। সেটা কি জব্বার মিয়ার জন্য শাস্তি স্বরূপ হবে না। কিংবা আরও একধাপ এগিয়ে ভাগিয়ে বিয়েও করে ফেলতে পারি। তারপর ব্যাটার সামনে গিয়ে পরিচয়টা দেবো। নিশ্চয় খুব দেখার মত হবে তার সেই প্যাচার মত মুখটা।
কি ভাবছ লেখক?
হুম, না, তোমায় দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবালু হয়ে উঠেছি।
নাকি , আমার দেখে খুব বিমর্ষ হয়ে উঠেছো, মনকে অন্যদিকে রেখে আমাকে এড়াতে চাইছ। চাইলে বলতে পার। খাবার রেডি আছে, খেয়ে চলে যাও। এখনই খাবে নাকি?
কি খাবার? ভালোবাসার খাবার নাতো?
এইবার দেখি সত্যিকারের লেখকের মত কথা বলছো। বইয়ের সুর আর কথার সুর মিলছে। মোবাইলে তবে কেনো এত গম্ভীর?
তাই নাকি? আচ্ছা এই ছবির লোকটাই কি তোমার স্বামী?
হুম।
নাম কি?
কেনো, চেনো নাকি?
চিনতেও পারি।
জব্বার হোসেন।
মনে মনে ভাবলাম, বলে দেবো নাকি ইতিহাস…বলা ঠিক হবেনা। সময় যাক। বললাম, লোকটার তো অনেক বয়স। তুমি রাজী হলে কেনো?
হুম। মামার বাড়ীতে মানুষ হচ্ছিলাম। জব্বার হোসেনে গ্রামে একটা মসজিদ দিছে। তার হেভি নাম ডাক। আগের ঘরে কুনো পোলা হয়নাই। চারডা মাইয়্যা। পোলার জন্য বিয়ে করেছে আমাকে। তার বড় মেয়ে কিন্তু আমার সমান।
তাই বইলা, তোমার মামারা তোমার মত সুন্দরী শিক্ষিতা স্মার্ট মেয়েকে আরও কত ভালো বিয়ে দিতে পারত।
মামাতো টাকা পেয়েছে মেলা। কিন্তু বিয়া কে করত-তুমি করতে বিয়ে আমাকে? করবা, এখনও সময় আছে। আমার বাচ্চা কাচ্ছা হয়নাই কিন্তু এখনও। করবা?
মানে?
তাইলে। আমি কিন্তু ভাল আছি। দেখনা কত সুখ। জব্বার মিয়ার এখন আর বাচচা পয়দা করার ক্ষমতাও নাই। মজা না!
সুখ! দেখ লেখক মানুষ, সুখের পরিমাণ আমি মাপতে শিখেছি কিঞ্চিৎ হলেও। খিদে লেগেছে, খাব চল।
লেখক, আমি একটু মজা করি এবার-খিদে! এত বয়স হলো বিয়ে থা করনি, তোমার কি অন্য ক্ষুধাও লাগেনা?
পেটের ক্ষুধা মেটাতে মেটাতেই জীবন পার হয়ে গেলো।
ছয়.
একটা সুন্দর দুপুর কাটল। বেশ গল্প করতে জানে রূপা। ওর নামটা আসলেই রূপা। ও আমাকে ওর এসএসসির সার্টিফিকেট দেখিয়েছি নাম বিশ্বাস করানোর জন্য। পুরো নাম দেখলাম-রূপালী আত্তার রূপা। কিন্তু কিছুতেই আমার বই কেনার রহস্য সে জানালো না। বলল, যদি এটা জানার জন্য কিছুদনি হলেও আমাকে সঙ্গ দাও। জোর করোনা জানার জন্য। আমিই জানাবো একদিন।
দরজা সীমনা পার হবার আগে হাতটা ধরেছিল টেনে বলেছিল, লেখক তুমি খুব ভালো । অন্তত আর দশটা পুরুষের মত তোমার মনটা নষ্ট হয়ে যায়নি।
আর নষ্ট হওয়া হলো না এই যাত্রায়। এত বড় কম্লিমেন্টের পরে আর কি নষ্ট হওয়া যায়। অনেকের কাছে কম্লিমেন্টটাই বড় , একজন লেখকের কাছেতো বটেই।
…বাসায় ফিরতে ফিরতে বারবার রূপার মুখটা মনে পড়ছিল। সেই বৃষ্টি ভেজা কিশোর, বইয়ের পাতায় পাতায় বৃষ্টির জল …কিছুটা বোধহয় ভুলে থাকা যাচ্ছে। জব্বার হোসেনকে খুঁজে পেলাম। কি চরম ধরনের কাকতালীয়। রূপার হাসবেন্ড! সেলুকাস! কি করব ভেবে পাচ্ছিনা। লোকটাকে একটা শাস্তি দিতেই হবে। রূপা কি আমার তুরুপের তাস, নাকি সত্যিই তাকে ভালবেসেছি? নাকি ভালবাসা নয়-করুনা? কি জানি? ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে বৃষ্টির মাঝে আমি আমি রূপাকে পেলাম চোখ বোজা কল্পনায়। আমি যেন প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের অমর সৃষ্টি হিমুর মযূরাক্ষী নদীকে আজ নিজের করে পেয়ে গেলাম।
সেই ১৯৯০ সাল। জব্বার মিয়ার তখন বয়স কত হবে? চল্লিশের কমতো নয়ই। বাইশ বছর কেটেছে, আজ ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই। ব্যাটা ভালবেসে বিয়ে করলে এক কথা, সেতো এতিম রূপার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে। মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে টাকার জোরে কেবল বিয়ে করা, ভালবাসার জোর ছাড়া বিয়ে করে কি লাভ আমি বুঝিনা। দেহ ভোগটাই কি গুরুত্বপূর্ন? যেখানে ভালবাসা থাকে সেখানে কিন্তু আবার বয়সও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা তো কাছাকাছি বয়সী। আমরা মানে আমি আর রূপা কী সত্যি একে অপরকে ভালবাসতে শুরু করেছি? আমরা কী বিয়ে করতে পারব?
পুরো সন্ধ্যায় রূপাকে নিয়ে ভেবেছি। একবার কথা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন রাতেই ওর বর আছে এই বাসায়। সে কারনে রাতে কথা বলেনা। তবে কথা দিয়েছে এখন থেকে যে সব রাতে বর আসবে না রূপা আমার সাথে কথা বলবে। আসলে রূপার সাথে কথা না বললে কিছু ভাল লাগেনা। মনের জট খোলেনা। আটটার দিকে একবার কল দিলাম , জানালো ওর স্বামী আসতেছে, পথে আছে। রাতে ফোন করতে মানা করলো।
আমি নিজেই রাঁধি। নিজেই খাই। একার সংসার। দুপুরে রূপার হাতের এত মজার খাবার খেয়ে এখন আর নিজের রান্না মুখে উঠছেনা। দু’মুঠো মুখে পুরেই পত্রিকা অফিসে ছুটলাম। রাতের কাজ আছে আজকে।
অনলাইনেই প্রথম খবরটা জানলাম। মুহূর্তে বিমর্ষ হয়ে উঠলাম। মনের ভেতর হাহাকার হয়ে বাজল হুমায়ূন আহমেদ স্যারের প্রয়ানের খবর। রাত এগারোটার দিকে স্যার আমাদের সকলকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অচেনা কোন নদীর ওপারে। আর ফিরবেন না। আমার আর স্যারের কাছ থেকে মযূরাক্ষী নদীটি চেয়ে নেয়া হলোনা। স্যারের পা ছুঁয়ে বলতে চেয়েছিলাম, স্যার আশীর্বাদা করেন আমি যেন আপনার নখের তুল্য লেখক টুকুও হয়ে উঠতে পারি। আমার আশীর্বাদ নেয়া হলোনা।
রূপার কাছে ফোন করতে ইচ্ছে করছে। তীব্র ইচ্ছা। রূপা গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সেটাও সম্ভব নয়। কিন্তু সেটাকে সম্ভব করতে ইচ্ছে করছে। বাইরে এখন ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। চোখ বুজেতেই দেখলাম ময়ূরাক্ষী নদীটির তীরে আমি আর রূপা ঝিরঝিরি বৃষ্টিতে হাঁটছি। আমরা হাসছি । নদীর ওপারে হারিয়ে যাচ্ছে নৌকাটা , নৌকায় সেই আমার কিশোর স্মৃতি। রূপার হাত ধরেছি, আমি ময়ূরাক্ষী নদীকে আমার মাঝে ধারন করতে চাইছি রূপার মাধ্যমে। আমার ঠোঁটটা নড়ে ওঠে, আমি বলে উঠি, ‘হুমায়ূন স্যার আপনার মযূরাক্ষী নদীটি কি আমাকে দিয়ে দেবেন…?’