শোভনের মনটা খারাপ। কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না। বাড়িতে মা একা। ভীষণ অসুস্থ তিনি। মাকে দেখার মতো কেউ নেই। তার ওপর তিনি অসুস্থ। এক গ্লাস পানি ঢেলে খাবেন তেমন শক্তি নেই। কাউকে ডেকে পাবেন তেমনটা হবার নয়। গ্রামের মানুষ এখন আর আগের মতো অভাবী নেই। প্রতি বাড়ির কর্মক্ষম দু’চার জন ঢাকা থাকে। তাদের উপার্জন কম নয়। তাছাড়া এই তমালপুরের অনেকে বিদেশে থাকে। তাদের পাঠানো টাকায় মোটামুটি চলে সংসার। যে বাড়িতে ছনের ছাপড়া ঘর ছিল সেখানে এখন নিদেনপক্ষে উঠেছে টিনের ঢকমতো ঘর। আবার কোন কোন বাড়িতে উঠেছে একতলা দালান। তাতে বিভিন্ন রঙ করা। আগে সন্ধ্যা ৭টার পরেই সবাই ঘুমিয়ে যেত। এখন রাত দশটা বারটা পর্যন্ত তারা জেগে থাকে। গ্রামে কারেন্ট গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে ডিশের লাইন। তাতে বেশির ভাগই চলে বিদেশী সিরিয়াল। এতে যে পারিবারিক ফিকশন দেখানো হয় তাতে সহজেই দর্শকের মন গলে। তবে এর ফাঁকে ফাঁকে যে পরকীয়া দেখানো হয় তার প্রভাবও পড়ছে সমাজ জীবনে।
কারো কোন অভাব নেই তো কে কার কথা শুনবে। সারা গায়ে আপনি মোড়ল এমন একটা নাক উঁচু ভাব রয়েছে। সেখানে কে কার বিপদে এগিয়ে আসে! শোভন আর তার বড় ভাই সুমন চাকরি করে ঢাকায়। সুমন ইঞ্জিনিয়ার। শোভন সাংবাদিক। তাদের বাড়ি গিয়ে থাকার উপায় নেই। একেবারে সীমিত ছুটি। ঈদে ছুটি তিন দিন। একদিন বাড়ি যাওয়া। মাঝের দিন ঈদের নামাজ আদায়। পরের দিন আবার সেই ঢাকায় ফেরা। মাকে শোভন অনেকবার বলেছেÑ মা চলো আমার সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে থাকবে। বাসায় তোমার দাদুভাইরা আছে। ওদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাবে।
মা গ্রামের মানুষ। গ্রামের মুক্ত বাতাস, আলো, পানি ছেড়ে যেতে তার মন সায় দেয় না। একবার গিয়েছিলেন ঢাকায় থাকার জন্য। কিন্তু দু’দিন পরেই সুর তুললেন বাড়ির জন্য। অস্থির হয়ে পড়লেন বাড়ি ফিরতে। বার বার বলেনÑ শোভন তুই আমারে বাড়ি দিয়ে আয় বাপ।
কেন মা কি হয়েছে? এখানে তোমার ভাল লাগছে না?
নারে বাপ। মনে হয় কোন জেলখানায় আটকে রাখছে আমারে।
জেলখানা কই মা, এই তো আমরা আমি আছি। তোমার দাদু ভাইরা আছে।
নারে বাজান। জেলখানা মানে আটকা জায়গা। বাড়ির আমগাছের পাতার খচর খচর শব্দ পাই না। পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদের ঝিকিমিকি খেলা দেখতে পাই না। উঠোনময় ছুটে বেড়ানো মুরগি আর তার বাচ্চাদের দেখতে পাই না। মেঘ দেখতে পাই না। কখন জোছনা ওঠে কিছুই বুঝতে পারি না। পুকুরের পানিতে গ্রামের ন্যাংটো ছেলেদের ডুব-সাঁতার দেখতে পাই না। দেখতে পাই না সবুজ কাশবনে বাতাসের উন্মাতাল নাচানাচি। কচি পাটগাছ একবার মাথা নোয়ানো আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানো এর কিছুই দেখতে পাই না। দূরের গ্রামে রোদের মরিচিকা খেলা দেখতে পাই না। রাতে শুনতে পাই না ডাহুকের ডাক। কোন এক কানাকুয়োর ডানা ঝাপটানি আর কাতর ডাকÑ কিছুই নেই এখানে। একে জেলখানা না তো কি বলবো!
মার কথার কোন উত্তর নেই শোভনের কাছে। সত্যি তো, মা ঠিক বলেছেন। এখানে এই শহর জীবনে মাটির ছোঁয়া নেই। আছে বিলাসিতা। ভোগ। কিন্তু সেই ভোগেও আজকাল প্রচণ্ডভাবে ঝঁুঁকি। খাবার বলতে যা খাচ্ছে শোভনরা তাকে কি খাবার বলা যায়। দোকানে থরে থরে সাজানো মৌসুমি ফল। দেখে লোভ লাগে। কিন্তু এগুলোতে বিষ। সবজি চাষ হয় সার দিয়ে। তাড়াতাড়ি ফলন পাওয়ার জন্য সবজির ক্ষেতে দেয়া হয় সার। সেই সার টেনে নিয়ে রাতারাতি সবজি হয় পুষ্ট, লকলকে। মুড়ি ভাজা হয় সার দিয়ে। তেলে পামওয়েলের মিশ্রণ। নুডুলসেও ভোজাল। মাছে ভয়াবহ মাত্রায় ফরমালিন। কি খাচ্ছে শোভনরা!
মার কাকুতি মিনতিতে একদিন মাকে বাড়ি দিয়ে আসে শোভন। তারপর থেকে আস্তে আস্তে মার শরীর খারাপ হতে থাকে। তাকে বার বার ঢাকা আসার অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি আসবেন না। তার এক কথাÑ ও্ই জেলখানায় আমি যাব না। মরতে হয় এখানেই মরব। এই আলোবাতাসে মরব। এটা আমার ¯^ামীর ভিটে, বউ হয়ে এ বাড়িতেই আমি পা রেখেছিলাম। এ ভিটে আমি ছেড়ে যেতে পারবো না।
শোভনরা চার ভাইবোন। দু’ভাই ও দুবোন। ভাই দুটি থাকে শহরে, মানে ঢাকা। আর দুবোনকে বিয়ে দেয়া হয়েছে পাশের গ্রামে। ছোটবোন আনিকা পড়াশোনা করেছে। এমএ পাস করে চাকরি করছে শ্বশুরবাড়ির কাছেই একটি স্কুলে। বড়বোন হুমায়রার তেমন পড়াশোনা হয় নি। সে গৃহিনী। সংসার ধর্ম ছাড়া তার আর তেমন কাজ নেই। একছেলে ও এক মেয়ে তার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে থাকে বিদেশে। বাড়ি এখন সে আর তার ¯^ামী। তেমন কোন ঝামেলা নেই। আগে সংসারে ভাতের কষ্ট ছিল অনেক। এখন তা নেই। মোটামুটি খেয়েপড়ে চলে যায়।
বাড়িতে মা একা একা। চিন্তায় কিছু ভাল লাগে না শোভনের। একবার ঈদে বাড়ি গিয়ে সব ভাইবোনকে ডাকল সে। তাদের কাছে জানতে চাইলোÑ মার এই অবস্থা। তাকে একা বাড়ি রাখা নিরাপদ নয়। কে তাকে রান্না করে দেয়, কে রাতে শোয়ার পরে তার বিপদ-আপদ দেখে তার কোন ঠিক নেই। গ্রামেও কোন লোক পাওয়া যাচ্ছে না। টাকা দিয়ে মার কাছে থাকার জন্য শুধু একটা মেয়ে বা কোন বিধবাকে খুঁজেছি, বিনিময়ে বেতন দেব, কিন্তু কেউ রাজি হয় নি। এখন আনিকা ও হুমায়রার ঠিকানা শ্বশুরবাড়ি। তারাও সংসার ফেলে মার কাছে এসে থাকতে পারে না। এ অবস্থায় কি করা যায়?
এক একজন এক এক রকম মত দিল। সুমন বললো- মাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। আমি দেখব তাকে।
সুমন চাকরি করে। দিনে বড়জোর তিন-চার ঘন্টা বাসায় থাকে। বাকি সময় তার বউ তার মার সঙ্গে কি ব্যবহার করবে তা জানে শোভন। মাও ভাল করে জানেন তার বড় বউয়ের ব্যবহার। হাজার বার ডাকলে ্একবার কাছে আসে। এক খাবার দিয়ে বার বার খোটা দেয়। তার সামনে সুমনকে বাবা-মা তুলে যা ইচ্ছে তাই বলে গালি দেয়। এমনকি তার গায়েও হাত তোলে। মা তা দেখেছেন অনেক দিন। তিনি কি করে এসব সহ্য করবেন! তাই সুমনের কথা শেষ হতেই মা বললেনÑ নারে বাপ ঢাকার ভাত আমার সহ্য হবে না। ওখানে থাকে শিক্ষিতরা। আমি গ্রামের মেয়ে মানুষ। আমি কি করে ঢাকা গিয়ে থাকবো। তার চেয়ে বড় কথা হলো- ঢাকার জীবন বন্দিখানার মতো। ওর মাঝে কোন সুখ নেই। আনন্দ নেই। আমি ¯^ামীর ভিটে কামড়ে পড়ে আছি। এখানেই কাটাতে চাই সারাটা জীবন।
শোভনের বাসায়ও থাকতে রাজি হলেন না মা।
অগত্যা, আনিকা বললো- মা তুমি আমার কাছে চল। আমার বাড়ি তো গ্রামে। সেখানে তুমি ভাল থাকবা। আমার শাশুড়ি, কাকি শাশুড়ি সব সময় তোমার সঙ্গে গল্প করবে। যদি বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগে তাহলে বাড়ি নিয়ে যাব। তোমার মন ভাল লাগবে।
প্রথম প্রথম মা রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি বললেন না তা হয় না। জামাই বাড়ি গিয়ে থাকলে মানুষ কি বলবে? আমার ছেলেদেরকেই মানুষ খারাপ বলবে। আমাকে মানুষ মুখভরে নানা কথা বলবে।
আনিকা বললো- মা তুমি আমার কাছে যাবে তো শখে না। তুমি যাবে ঠেকায় পড়ে। সবাই তো জানে তোমার দুটি ছেলে ঢাকায় থাকে। তারা চাকরি করে। তাদের তো বাড়ি এসে থাকা সম্ভব না। এ অবস্থায় তুমি কার কাছে যাবে। মেয়ের কাছে থাক। সে তো তোমাকে ফেলে দিতে পারবে না। তোমার যতœ নেবে। তোমার পেটের সন্তান মা। সে তোমার সঙ্গে কোন খারাপ আচরণ করতে পারবে না। তোমাকে বেহেশতে থাকার মতো করে দেখে রাখবে।
এ কথায় সায় দিল হুমায়রাও। বললো- মা আনিকা তো ঠিক্ই বলেছে। তুমি ওর কাছে যাও। ওর কাছে যদি তোমার খারাপ লাগে তাহলে তুমি আমার কাছে চলে আসবা। আমিও তো আছি। আমার বাড়ি থেকে আনিকার বাড়ি বেশি দূরে নয়। আমিও মাঝে মাঝে গিয়ে তোমাকে দেখে আসতে পারবো। আর যদি চাও তাহলে আমার কাছে গিয়েও থাকতে পার।
আনিকা ও হুমায়রার কথায় অগত্যা রাজি হয়ে গেলেন মা।
একদিন সকালে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রওনা দিলেন আনিকার বাড়ি। প্রথমে তিনি আনিকার বাড়িই বেছে নিলেন। কারণ, আনিকা সবার ছোট। তার প্রতি মা একটু বেশিই দুর্বল। তাই তাকেই বেছে নিলেন। আনিকার বাড়িতে মার সময় ভালই যাচ্ছে। সবাই নজর রাখে। গোসল করিয়ে দেয় পাড়ার এক কাজের মেয়ে। মা এখনও হাত দিয়ে একা একা খেতে পারেন। তবে একা একা হাঁটতে পারেন লাঠি ভর দিয়ে। জামাই কবিরও শাশুড়িকে ভাল জানে। কানাইপুর বাজার থেকে তার জন্য এটা ওটা কিনে আনে। রাতে বাড়ি ফিরেই শাশুড়ির কাছে গিয়ে সেগুলো এগিয়ে ধরে বলেÑ মা দেখেন আপনার জন্য এনেছি, খান।
মা অবাক হয় জামাইয়ের কাণ্ড দেখে। বলেন- বাবা রে আমার জন্য এত্তসব করতে গেছ কেন?
মা, আপনিও তো আমার মা। আমার একই সঙ্গে দুটি মা। আমি যখন আমার মাকে মা বলে ডাকি তখন এক রকম শান্তি পাই। আপনাকে যখন মা বলে ডাকি তখন আরেক রকম প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে আমার বুকে। আমার মায়ের যেমন সেবা করা আমার দায়িত্ব, তেমনি এই মাকেও সমান সেবা করা আমার দায়িত্ব। ভাইয়েরা ঢাকা থাকে সেটা তো আমি জানি। তাদের অবর্তমানে আমাকেই আপনার ছেলে বলে মনে করেন। মনে করেন আমি আপনার আরেকটি ছেলে।
মা’র চোখ ভিজে ওঠে। তিনি কিছু বলতে পারেন না। তার বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন কায়মনোবাক্যে। সে প্রার্থনার ভাষা দুনিয়ার কেউ জানে না, কেউ বোঝে না।
দুই.
একদিন অফিস শেষে রাতে বাসায় ফিরেছে শোভন। মুখ হাত ধুয়ে রাতের খাবার খাওয়ার পরে তার স্ত্রী স্নেহা বলল- তোমার কি মন খারাপ?
এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম। আজ কি বাড়ি মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছ?
না। কেন?
মার শরীরটা খারাপ।
খারাপ? ভীতিকর এক অনুভ‚তি নিউরন বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা গায়ে। শোভন স্থির হয়ে যায় কয়েক মুহ‚র্তের জন্য। মার শরীর খারাপ। সে খবর এভাবে বলার মধ্যে কিন্তু আছে। কেমন খারাপ? খুব কি বেশি।
না। ছোটখাট স্ট্রোক করেছিল। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল আনিকা। ডাক্তার দেখে ওষুধ দিয়েছেন।
কি বল?
হ্যাঁ, তবে আশঙ্কামুক্ত। কোন ভয় নেই। চল আমরা কাল সকালে গিয়ে দেখে আসি।
শোভন কথা বলতে পারে না। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবটুকু জড়তা তার ওপর ভর করে আছে। সে এক চুল নড়তে পারছে না।
তোমার কাছে টাকা আছে?
হ্যাঁ আছে অল্প দু’হাজারের মতো।
তাহলে আমি পাশের বাসার ভাবির কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করি। এসে দিয়ে দেব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
শোভন এ কথা বলার পরই শুরু হয়ে গেল বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি। ভোরে আযান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল শোভন, স্নেহা। শহরের কোলাহল থেকে বেরুতে বেরুতে সূর্যের কচি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তে। ঢাকা-পাটুরিয়া সড়কের দুপাশের গ্রামগুলোকে ছবির মতো মনে হচ্ছে। এমনই এক গ্রামে কোন এক ক্ষণে জন্ম হয়েছিল শোভন ও তার তিন ভাইবোনের। সেই গ্রাম ছেড়ে এখন সে শহরবাসী। সাঁ সাঁ করে বাস চলছে। সাভার, নবীনগর, ধামরাই, মানিকগঞ্জ হয়ে বাস থামে পাটুরিয়া ঘাটে। বাস ফেরিতে উঠছে। কিছুক্ষণ পরই ছেড়ে দেবে। লাইন দিয়ে উঠছে অন্য গাড়িও। সাইরেন বাজাচ্ছেন সারেং। কয়েক মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দিল ফেরি। পদ্মা-যমুনার মিলন ঘটেছে এখানে। সেই মিলিত স্রোতের ওপর দিয়ে ফেরি এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বর্ষাকাল। নদীতে এমনিতেই অনেক পানি। দক্ষিণা জোয়ারের পানি আর উত্তর থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পরিপূর্ণ যৌবনা পদ্মা। বাতাসও বইছে বেশ। প্রচণ্ড ঢেউ উঠেছে নদীতে। তার ওপর দিয়ে চলছে ফেরি। এত্তবড় যান। তবুও বার বার দুলে উঠছে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ফেরির গায়ে। প্রচণ্ড শক্তিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের পানি ছিটকে পড়ছে পুরো ফেরির মধ্যে। বাইরের দিকে যারা দাঁড়ানো ছিল তারাও এখন বাসে গিয়ে উঠেছে। এই উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে দুলতে দুলতে শোভনের কবিমন নানা হিসাব মিলাতে থাকে। জীবনও তো এই ঢেউয়ের মতো। একবার ডোবে। একবার ভাসে। একবার আনন্দে আছড়ে পড়ে। আবার কান্নায় অবনমিত হয়। এমনি করে চলতে থাকে মানবজীবন।
ওপাড়ে দৌলতদিয়া ঘাট। ফেরি ঘাটে ভিড়তে ভিড়তেই শুরু হয়ে গেল তাড়াগুড়ো, কোন গাড়ির আগে কোন গাড়ি নামবে ফেরি থেকে, সেই প্রতিযোগিতা। দুপুর গড়াতে গড়াতে শোভনরা পৌঁছে গেল ফরিদপুর। বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোরিক্সা রিজার্ভ করে মালপত্র ও বউ, ছেলেদের উঠালো তাতে। তারপর বহু স্মৃতিমাখা পথ ধরে অটোরিক্সা এগিয়ে যেতে থাকে কানাইপুরের দিকে। ফরিদপুর জেলার সবচেয়ে বড় বাজার কানাইপুর। শুক্রবার ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। সে হাটে এ জেলার সমস্ত প্রান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষ। যার যা বিকিকিনি করার সবই এখানে পাওয়া যায়। অন্য দিনগুলোতে বসে বাজার। কিন্তু সবচেয়ে বড় বাজার হলো হাটবার। সেদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় এই কানাইপুরে। এই বাজারে ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কত এসেছে শোভন। সেই যে তরতাজা রসগোল্লার রসে ভিজিয়ে পাউরুটি খাওয়া আজও তা যেন মুখে লেগে আছে। ইচ্ছে করে আবার গিয়ে সেই মিষ্টির দোকানে গিয়ে সেই ছোটবেলার মতো রসগোল্লার রসে ভিজিয়ে পাউরুটি খেতে। কিন্তু সময় বড্ড বেয়াড়া। তার তাড়াতেই কিচ্ছু হয় না শোভনের। এসব স্মৃতিকে পাশ কাটিয়ে এখন বরং বেশি করে মনে পড়ছে মার মুখখানি। মা কি কথা বলতে পারে? মা হাঁটতে পারে? মা কি শয্যাশায়ী? মার মুখটা কি খুব বেশি মলিন হয়ে গেছে? মা কি তাকে চিনতে পারবে? না কি এর চেয়েও কঠিন কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য?
তিন.
অটোরিক্সা এসে থেমেছে কবিরের বাড়ির সামনে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দেখতে এগিয়ে এসেছে। গ্রামের এই একটি অভ্যাস এখনও মানুষের যায় নি। শহর থেকে কেউ বাড়ি গেলে তারা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। এতে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। ওরা আসে আন্তরিকতা নিয়ে। কাছের মানুষগুলো শহরে যেয়ে পাল্টে গেছে কিনা, কার চেহারা কেমন হয়েছে, এসব দেখতে এগিয়ে আসে। কেউবা ডাবের পানি এগিয়ে ধরে। শহর থেকে এসেছে তাদের সেবা যতœ করতে হবে। তাদের এই আন্তরিকতা যেন আবহমান বাংলার এক ঐতিহ্য। এত মানুষের ভিড়েও শোভন একটি মুখ খুঁজে পাচ্ছে না। সে হলো তার মা, পরীবানু। তবে কি মা বিছানা থেকে উঠার শক্তি হারিয়েছেন! শোভন কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে ঘরের ভিতর চলে যায়। সত্যি তো, মা তার বিছানায় সটান শুয়ে আছে। শোভন মা বলে ডাক দিতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন পরীবানুÑ বাজান এসেছিল? ওরে আমার বাজান। আমার পাশে বস।
মা কেমন আছ তুমি?
ভাল আছি বাপ। বলেই শোভনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন পরীবানু।
সে কান্না দেখে পাড়ার অন্য যারা দেখতে এসেছিলেন তারা পর্যন্ত কান্না শুরু করলেন। গ্রামের মানুষের এই একটি অভ্যাস এখনও মানুষের যায় নি। এই যে আন্তরিকতা, ভালবাসা, একের কষ্টে অন্যের এগিয়ে আসা- এই পাওয়া তো শহরে নেই। সেখানে প্রকাশ্যে রাজপথে একজন আরেকজনকে মেরে ফেললে কেউ আহ বলে না। অসুস্থ হয়ে কেউ রাস্তায় পড়ে থাকলে তার কাকে মানুষ এগিয়ে যায় না। এক ফ্লাটের মানুষ পাশের ফ্লাটের মানুষকে চেনে না। নানা বিপদের ভয়ে হয়তো মানুষের মাঝে ঘটে চলেছে এই বিবর্তন।
মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে শোভনের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। মার মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তা সোজা করতে পারল না শোভন। সে বুঝে গেল- কত বড় বিপদের হাত থেকে আল্লাহ তার মাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করে সে। মা শোভনের প্রতি ও আনিকার প্রতি সবচেয়ে বেশি দুর্বল। এটা অনেক আগেই ঠাহর করতে পেরেছে শোভন। মার কাছে গিয়ে বসলে তিনি যেন সারা দুনিয়ার শান্তি খুঁজে পান। মা একভাবে তাকিয়ে থাকেন শোভনের দিকে, দেখেন তার শোভনের চেহারায় কোন মলিনতার ছাপ পড়েছে কিনা। কোন অমঙ্গলের ছায়া পড়েছে কিনা। এই দেখা একজন মা-ই দেখেন। আর কারো চোখে পড়ে না। সন্তানের বয়স যত বেশিই হোক না কেন তার কাছে সে সেই ছোট্ট বেলার শিশুটি রয়ে যায়। তাই তার সন্তানের চুলে, দাড়িতে পাক ধরলেও মা বা বাবা তাকে নাম ধরেই ডাকেন।
সেই মা আজ বিছানায়। শোভন কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। স্ত্রী স্নেহা গিয়ে যোগ দিল তার সঙ্গে। নাতি, ছেলে, ছেলের বউকে কাছে পেয়ে মা যেন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করছেন উঠে বসতে, পারছেন না। এ দু’দিনে অনেক মানুষ এসেছে তাকে দেখতে। কিন্তু এতটা সুস্থ দেখা যায় নি তাকে। বিপদের সময়, অসুস্থতার সময় আপনজন কাছে থাকলে বোধকরি মানুষ আলাদা একটু শক্তি পায়। তার দুর্বল চিত্ত সজীব হয়ে ওঠে, শক্তি যোগায়। তাই বুঝি মানুষ অসুস্থ হলে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-¯^জনকে দেখতে চায়। মৃত্যু শয্যায় একান্ত আপনজনকে দেখার জন্য মন আকুলিবিকুলি করে।
পরীবানু গ্রামের মানুষ। তিনি দাদু ভাইদের কাছে পেয়ে আরও খুশি হলেন। মেয়ে আনিকাকে ডেকে বললেন, ওদের খাবার দে। সেই কোন সকালে কি খেয়ে বেরিয়েছে। দেখ তো আমার দাদু ভাইদের মুখের দিকে তাকাবার জো আছে নাকি!
আনিকা খাবার রেডি করেছে আগেই। ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে সেখানেই খাবার দেয়া হয়েছে। চারপাশের জানালা খুলে দেয়ায় যে আলো এসেছে তাতে বিদ্যুতের আলো বিলিন হয়ে যায়। এমন পরিবেশে, মাটিতে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা। এখানেই মাটির মানুষদের ¯^ার্থকতা।
সারাটা দিন কেটে গেল। শোভন বসে আছে মায়ের পাশে। দু’চোখ ভরে দেখছে মাকে। এই মা যখন হারিয়ে যাবে তখন কি করে থাকবে সে, কার কাছে গিয়ে এই মা ডাক দেবে, কে তাকে বাজান বাজান বলে মুখভরে ডাকবে? এসব ভাবতে ভাবতে চলে যায় বেলা। পরদিন সকালেই তাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। সাংবাদিক বলে কথা! তার আবার কিসের মা, কিসের বাবা, কিসের সংসার, কিসের ভালবাসা! তার তো এসব বলে কিছু থাকতে নেই। ডাক পড়েছে তো অমনি হাজির হতে হবে।
সকালে যখন সবকিছু রেডি করে শোভন মার কাছে বিদায় নিতে গেল তখন সৃষ্টি হল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। পরীবানু তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন। একবার জাপটে ধরেন। আবার ছেড়ে দেন। একবার ভাবেন ওকে যেতে দেবেন না। জীবনের আর যে কয়টা দিন আছে ওকে নিজের কাছেই রাখবেন। কিন্তু আরবার ভাবেন ওরও তো সংসার আছে। তার কাছে বসে থাকলে ওর তো চাকরি থাকবে না। এই ভেবে তিনি শোভনকে বিদায় জানান। শোভনের দু’গণ্ড বেয়ে ঝরতে থাকে অঝোর বৃষ্টি। কিন্তু নিয়তির লেখন। কিছুই করার নেই। তাকে ফিরতেই হবে। আনিকার বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে। পিছনে বসে মা পরীবানু শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। শোভন পিছন ফিরে আর সেদিকে তাকায় না। সে জানে পিছন ফিরে তাকালেও সে দুর্বল হয়ে যাবে। তা হৃদয়কে বাঁধ মানাতে পারবে না। তাই ছলছল চোখে অস্পষ্ট হয়ে আসা রাস্তায় এক পা দু’পা করে এগিয়ে যেতে থাকে।