এক
ষ্টেশনের চায়ের স্টলটাতে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কলিমুদ্দীন। দোকানি সুরুজ আলীর সাথে খোশগল্প করতে করতে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খাচ্ছিলো সে। আহ্, ব্যাটা জব্বর চা বানায়। মন খালি আরো খাই আরো খাই করে। কাঁচের চ্যাপ্টা বয়ামের ভেতরে সাজানো বিস্কুটগুলোকে বড়ই লোভনীয় দেখাচ্ছিলো। আলগোছেই দু’টা বিস্কুট হাপিস করার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো। সুরুজ আলীর সাথে কথোপকথনটাও চালু রেখেছে। ভাবখানা এমন যেন মনের ভুলেই হাতটা ঐদিকে চলে গিয়েছে, অন্য কিছু নয়। সুরুজ আলী খুব যত্নের সাথে হাতটা টেনে সরিয়ে দেয়।
‘কলিম ভাই, আইজগা চা খাইয়্যাই খুশি থাহো। তুমার আগের দেনাই কইলাম পঞ্চাশ ট্যাহা হইছে।’
মনে মনে কষে একটা গালি দেয় কলিমুদ্দীন। ব্যাটা শকুনের চোখ নিয়ে দোকানদারি করে।
‘আরে সুরুজ ভাই, দুইখান বিস্কুট খাইলে ফকির হইবা নি? আচ্ছা থাউক। দিয়া দিমুনি তুমার ট্যাহা…’
কথা বলতে বলতেই তার চোখ চলে যায় ষ্টেশনের শেষ মাথায় পলায়নোদ্যোত এক নারী মূর্তির দিকে। শিউলী না? এই সময় এমন ভাবে কোথায় থেকে আসছে? নাকি যাচ্ছে? ভাবসাবে তো মনে হচ্ছে কলিমুদ্দীনকে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি পালাচ্ছে।
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেই সোজা সেই দিকে হাঁটা দেয় কলিমুদ্দীন। সুরুজ আলী পেছন থেকে ডাকতে থাকে,
‘চললা কই? চায়ের দাম দিবা না? তুমার ট্রেন তো আইয়া পড়বো এহন।’
‘এহুনি আইতাছি। আইয়া ট্যাহা দিতাছি।’ হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয় কলিমুদ্দীন।
‘হুঃ! আর দিছো!’ শ্লেষাত্মক উক্তিটি ছুড়ে দিয়ে কাজে মন দেয় সুরুজ আলী। ব্যাটা অকর্মা কোথাকার! সাত সকালে এসে দুনিয়ার আজাইরা প্যাচাল জুড়ে দিয়েছে। চা টাও খেয়ে গেলো মুফতে। কাজের সময়ে এইসব ‘ডিস্টাব’ একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না সে।
এদিকে শিউলীকে ধরার জন্য পড়িমড়ি করে ছুটেও লাভ হলো না কলিমুদ্দীনের। শিউলী একেবারে হাওয়া। ঠিক আছে, সমস্যা নাই। দুপুরে বাড়িতে ফিরে এর হিসাব নেওয়া হবে।
ষ্টেশনে ফিরে আসলো সে। শুনশান নীরবতা ভাঙতে শুরু করেছে। হকার থেকে শুরু করে যাত্রী, কুলি, এমনকি ষ্টেশনের দোকানগুলো পর্যন্ত আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। একটা চটজলদি প্রাণচাঞ্চল্য যেন পেয়ে বসেছে সবাইকে। প্রতিবার ট্রেন আসার আগের মুহুর্তের এই হই-হুল্লোড় খুব ভালো লাগে কলিমুদ্দীনের। জীবন যে থেমে যায়নি এই অনুভূতিটা সে টের পায় এই সময়। আজ প্রায় কুড়ি বছর যাবত সে এই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। এক্কেবারে বাচ্চা বয়সে অল্প কিছুদিন ট্রেনে হকারের কাজ করেছে। সেই কাজটা বড় ভালো লাগতো তার। অন্যরকম একটা উদ্দীপনা ছিল। কাঠি লজেন্স আর চানাচুর বিক্রি করতো সে। ষ্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে যাত্রীদের ভীড় ঠেলে উঠে যেতো ট্রেনে। তার সহকর্মী অন্য হকারেরা পেরে উঠতো না তার সঙ্গে। ফুড়ুৎ করে সবার আগেই তার ট্রেনে উঠে পড়া চাই। বিক্রিও ছিলো ভালো। কাঠি লজেন্স দেখে বাবা-মা’র কাছে বায়না ধরতো না এমন কোন ছোট বাচ্চা ছিলো না। আর তার চানাচুরও ভালো বিকোতো। কিন্তু তার বাপ তাকে এই কাজ বেশিদিন করতে দিলো না। ছোটবেলা থেকেই সে ছিলো তাগড়া ধরনের। হাতে পায়ে জোরও ছিলো প্রচুর। হকারের কাজে আর কয়টাকা মুনাফা থাকে? তার বাপ তাকে কুলিগিরিতে লাগিয়ে দিলো। নিজেও সে এই কাজ করতো । বাচ্চা কুলিদের উপর মানুষের একটা সমবেদনা থাকে। অপেক্ষাকৃত কম বোঝা তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়। কিন্তু পয়সার বেলাতে আবার দু’পয়সা বেশিই দেওয়া হয়। কাজেই শূন্য পুঁজি, ডাবল মুনাফা।
কিন্তু কলিমুদ্দীনের ভালো লাগতো না এই কাজ করতে। বাচ্চা কুলিদের ওপর সব যাত্রীই যে সমবেদনা দেখাতো, এমনটা মোটেও ঠিক না। কেউ কেউ বেশ দু’পয়সা ঠকিয়েও দিতো। বাচ্চা বলে প্রতিবাদের কোনো সুযোগও তো ছিলো না। এই কাজ বেশি করতো বয়ষ্ক মানুষেরা। আপাতদৃষ্টিতে যাদের প্রাণে দয়া মায়া বেশি আছে বলে মনে হয়। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরাই বরং ঠিকঠাক টাকা দিয়ে দিতো। একবার মধ্যবয়ষ্ক একজন মানুষ তাকে ভাড়া দেবার নাম করে একেবারে বাসা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। খালি বাসায় দরজা বন্ধ করে…। তারপর সেই লোক কলিমুদ্দীনকে ভয় দেখিয়েছিলো এই বলে যে, কাউকে বললে পুলিশ উল্টো তাকেই ধরে নিয়ে যাবে। আর পুলিশ ষ্টেশনে তার উপর কী কী হতে পারে তার একটা বর্ণণাও দিয়েছিলো সেই লোক। ভয়ে কাউকে বলেনি কলিমুদ্দীন। দু’দিন কাজেও যেতে পারেনি। বাবার কাছে শরীর খারাপের অযুহাত দেখিয়েছে। এরপর থেকে সেই বাচ্চা কলিমুদ্দীনও বুঝে গেছে, দুনিয়াটা সাপ খোপে ভরা। ঠিকমত পা ফেলে চলতে না পারলে নিজের প্রাণটাই বেঘোরে চলে যাবে।
কাজ করার ব্যাপারেও একটা ঢিলেমি এসে গেছে এর পরে থেকে। একটুও মন চাইতো না পরিশ্রম করতে। কীভাবে বসে বসে টাকা পয়সা কামানো যায়, সেই বয়সেই তার উপায় রপ্ত করতে শুরু করে সে। কেউ তাকে ঠকিয়ে দু’পয়সা নিয়ে যাবে, এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। প্রয়োজনে আরেকজন কে ভেঙে খাবে, কিন্তু অহেতুক খাটা-খাটনি করে মরার ইচ্ছা নাই তার।
দুই
শিউলী আজ জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। আরেকটু হলেই পড়েছিলো বাঘের মুখে।
উত্তর পাড়ার টিপু শাহের বউ আজ অনেকদিন যাবত তাকে একটা কাজের কথা বলছিলো। সকাল সকাল তার বাড়িতে গিয়ে উঠোনটা লেপে দেওয়া, গোয়ালের গরু বাছুরগুলোর খাওয়ার জোগাড়যন্ত্র করে দেওয়া আর আসার আগে উঠোনে ধান-কলাই শুকাতে দিয়ে আসা। বিকেলে এক ফাঁকে গিয়ে সেই ধান-কলাই আবার তুলে রেখে আসা। এইতো এতটুকুন কাজ। আর এটুকু কাজের জন্যই গৃহস্থ তাকে নগদ পাঁচশো টাকা করে মাসে মাসে দিবে। অতি লোভনীয় কাজ। শিউলীর বড় ইচ্ছে কাজটা করার। কিন্তু তার ‘লাটসাহেব’ স্বামীর জন্য কোন কাজের নামই সে মুখে আনতে পারে না। শুনলেই একেবারে খেকিয়ে উঠে।
‘খুব কাম করনের হাউশ লাগছে মনেত, তাই না? মাইনষের বাড়িত কাম করবার যাইয়া ইজ্জত নিয়া আর বাঁচন লাগবো না। দুইডা কম খাও ক্ষতি নাই, ইজ্জত ডুবানের কাম নাই।’
হাঃ ইজ্জত! একা একা অনেক দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে শিউলী। ইজ্জতের সংজ্ঞাটা যে কী তা সে বুঝতে পারে নাই। স্বামীর কুলিগিরি’র টাকায় সংসার চলে না। ঠিকমত কুলির কাজ করলে সংসার না চলার কোনোই কারণ নাই। কিন্তু তার স্বামী পরিশ্রম করার চেয়ে শুয়ে বসে আরাম করতেই ভালোবাসে বেশি। আর জানে বড় বড় গপ্পো ছাড়তে। তার দাদা-পরদাদারা কেউ এসব বেগার খাটতো না। তাদের ছিল বিঘা বিঘা জমি। ক্ষেত ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। সেই ক্ষেতের ধান আর পুকুরের মাছ তারা নিজেরা খেয়ে কখনোই শেষ করতে পারতো না। যুদ্ধের সময় তাদের সেই বিপুল সম্পদ চলে গেছে অন্য মানুষের দখলে। এরপর থেকেই এই গরীবি দশা।
হু, বিপুল সম্পদ না ঘোড়ার ডিম! বিয়ের পর প্রথম প্রথম শিউলী স্বামীর চিকনাচাকনা সব কথাই বিশ্বাস করতো। ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে, সব কথাই ভুয়া। কোন সম্পত্তি ছিল না তার শ্বশুরকূলে। এরা সাত পুরুষই ষ্টেশনে কুলিগিরি করে আসছে। রেলওয়ে জংশনের কাছে বাড়ি হওয়ায় অন্তত খাওয়া পরার একটা বন্দোবস্ত জুটেছে। না হলে যে কর্মঠ স্বামী তার! হালচাষ তো তাকে দিয়ে জীবনেও হতো না।
কিন্তু এতদিন তাও যা হোক কিছু একটা করে দিন চলে যেতো। গতবছর ছেলেটা জন্মাবার পরে থেকে খরচ বেড়ে গেছে। ছেলের দুধ কিনতে হয়। ঠিকমত বুকের দুধ পায় না, দু’মাসের পর থেকেই বাচ্চাকে তোলা খাওয়াতে হয়। তাই খরচে আর কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। এখানে ওখানে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। শিউলী জানে, তার স্বামী কোনদিনই এসব দেনা মিটাতে পারবে না। এখনো লোকজন ধার দিতে অপারগতা জানাচ্ছে না, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সেই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হবে না। এই তো, গত মাসে ট্রাক ড্রাইভার কুতুব মিয়া এসেছিলো ধারের টাকা ফেরত চাইতে। কলিমুদ্দীন বাড়িতে ছিল না বলে রক্ষা। থাকলে মনে হয় ভালোই একটা ঝামেলা বাঁধতো। কুতুব মিয়া আবার আসবে বলে সেদিনের মতো বিদায় নিয়েছে। যাওয়ার সময় চোখের আশ মিটিয়ে একটা নির্লজ্জ দৃষ্টি দিয়ে গেছে শিউলীর দিকে। শিউলীর ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে সেই চোখের চাউনি। এই লোক তো মনে হয় না সহজে পিছু ছাড়বে। তাছাড়া তার স্বামী আর মানুষ পেলো না? একজন ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হবে!
সেদিনের কথা শিউলী স্বামীকে বলতে ভোলে নাই। সেই চোখের চাউনী পর্যন্ত। কিন্তু কলিমুদ্দীন নির্বিকার। এসব নাকি শিউলীর মনের ভুল। একটা বড় কাজ পেলেই সব দেনা চুকিয়ে দেবে, এমন আশ্বাস বাণীতে ভরসা পায়নি শিউলী। চব্বিশ ঘণ্টা ভয়ে থেকেছে কখন না জানি আবার কুতুব মিয়া চলে আসে! বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নাই। গত পরশুদিনই আবার হানা দিয়েছে সে। এবার একেবারে ঝেড়ে কেশেছে কুতুব মিয়া।
‘জামাইরে কও হয় ট্যাহা দিক, নয়তো বাড়িত বন্ধক দেওনের কিছু থাগলে হেইডা দিক। হেহ্ হে…।’
সেদিনের পর থেকে আর শান্তিতে নাই শিউলী। তার স্বামীর উপর ভরসা করে কাজ নাই। যা করার তাকেই করতে হবে। তাই সে আজ গিয়েছিল টিপু শাহের বাড়ি। সকাল সকাল কাজ করে চলে আসবে। সেই সময়ে তো কলিমুদ্দীন বাসায় থাকে না। তার স্বামী জানতে না পারলেই হলো। বাচ্চাটাকে সাথে নিয়েই যাবে। ছেলেটা বড় শান্ত হয়েছে তার। কান্নাকাটি একেবারেই করে না। যেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেই বসে থাকে।
টিপু শাহের বউ তাকে কাজে রেখেছে। দুইশো টাকা অগ্রিমও দিয়েছে। সবকিছুই ঠিক ছিল। ফেরার পথে ষ্টেশনের ভেতর দিয়ে শর্টকাট মারতে গিয়েই ভেজালটা বেঁধেছে। কেন যে এত বড় ভুলটা করতে গেলো! তবে মনে হয় কলিমুদ্দীন তাকে দেখতে পায়নি। এই যাত্রায় বেঁচে গেছে সে।
কাজটা করবে শিউলী। একটু একটু করে টাকা বাঁচিয়ে মিটিয়ে দেবে কুতুব মিয়ার সব পাওনা। ঘরের বাইরে গিয়ে ইজ্জত হারানোর আশংকা করছে তার স্বামী। কিন্তু ঘরে বসে থেকে ইজ্জত বাঁচারও তো কোন সম্ভাবনা দেখছে না শিউলী।
তিন
গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে একটা কথাও বলে না কলিমুদ্দীন। আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। তারপর আয়েশ মতো একটা বিড়ি ধরিয়ে ডাক দেয় শিউলীকে।
‘আইজ কই গেছিলি?’
চমকে ওঠে শিউলী। ও, তাহলে নজর এড়ায় নাই। এইসব দিকে নজর ঠিকমতো আছে। জানে সে, মিথ্যা বলে লাভ নেই কোনো। তাই মাথা সোজা রেখেই বলে,
‘টিপু শাহের বাড়িত গেছিলাম। কামডা নিছি আমি।’
‘এঃ! কামডা নিছি আমি! তুই নেওনের মালিক হইলি কুন্দিন থনে? আমি করবার দিমু ভাবছোস? ঐ টিপু শাহ্ লোক কেমুন জানোস কিছু?’
‘হেইডা জাইন্যা আমার কী? আমি আমার কাম কইর্যান চইল্যা আইমু।’
‘এঃ! কাম কইর্যাস চইল্যা আইমু! তোরে আইবার দিলে তো! আমের আঁঢির লাহান চুইষ্যা খাইবো, বুঝছোস?’
‘আর, ঘরেত বইয়্যা থাহলে আপনের ডেরাইভার আমারে চুইষ্যা খাইবো।’
‘খালি মুহে মুহে কতা। আমি করবার দিমু না। ব্যস, এইডা আমার শ্যাষ কথা। এর পরেও যুদি করার ইচ্ছা থাহে, তোরে আমি তালাক দিমু।’
এইটা শুনে আর কথা সরে না শিউলী’র মুখ থেকে। একেবারে বোবা হয়ে যায় সে। ওদের চেঁচামেচিতে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে বাচ্চাটা। শিউলী দৌঁড়ে গিয়ে বুকে নেয় তাকে। মায়ের বুকের ওমে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে।
কলিমুদ্দীন দুমদাম দাম্ভিক পা ফেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
সেদিন বিকেলেই একটা ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটে। চলমান ট্রেন থেকে যাত্রীর কাছ থেকে মাল-সামান নিতে গিয়ে অসাবধানে কলিমুদ্দীনের একটা পা চলে যায় ট্রেনের চাকায়। চোখের পলকেই পা টা একেবারে থেঁতলে যায় তার।
ষ্টেশনের বিপুল কোলাহল আর শোরগোলের মাঝেই ভীষণরকম বেমানানভাবে অসার, নিঝুম হয়ে আসে কলিমুদ্দীনের জগতটা।
চার
ডান পা টা কেটে ফেলতে হয় কলিমুদ্দীনের। শুরু হয় তার অন্য জীবন।
হাতে সামান্য যে ক’টাকা গচ্ছিত ছিল, চিকিৎসা বাবদ সেটাও চলে যায়। পুরোপুরি পথে বসে যায় পরিবারটি। এক কামরার ছোট্ট যে বাসায় তারা থাকতো তার যৎসামান্য ভাড়া মেটানোও আর সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। বাকী পড়ে যায় বেশ কয়েক মাসের ভাড়া। বাড়িওয়ালা প্রথম কিছুদিন এসে উহুঁ আহা করে যায়। আস্তে আস্তে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একসময় ভাড়া দেওয়ার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে।
বাচ্চাটার দুধ কেনা হয় না। ঠিকমত ভাতই জুটে না এখন, আর দুধ! ভাতের ফেন, একটু সুজি….যখন যা পারে তাই খাওয়াতে শুরু করে বাচ্চাটাকে। একবছরের শিশুও বুঝি বুঝে যায় যে, এখন মর্জি করলে চলবে না। তাই যা পায়, সেটুকুই চেটেপুটে খেয়ে নেয়।
এর মধ্যে গজবের মতো একদিন এসে উপস্থিত হয় ড্রাইভার কুতুব মিয়া। কলিমুদ্দীনকে পেয়ে খিস্তি খেউড়ের মাতম উঠায়। এতদিন ধরে ধার নিয়ে বসে আছে। তার টাকা মেরে খেলে সে কলিমুদ্দীনকে জানে মেরে ফেলবে এই হুমকিও দিয়ে যায়। ফেরার পথে উঠোনে একা পেয়ে শিউলীর কানে কানে বলে যায়,
‘ল্যাংড়া জামাই লইয়্যা আর কী ঘর করবা গো সুন্দরী? কুপ্রস্তাব দিতাছি না। ভাইব্যা দেহো। বিয়্যা করমু তুমারে। রাজি থাগলে কও। তুমার জামাইয়ের দেনাও মাফ কইর্যা দিমু তাইলে। এই লও আমার ঠিহানা। বাচ্চা নিয়্যা আইলেও রাজি আছি।’
শিউলী ছুটে ঘরে এসে জামাইয়ের অবশিষ্ট পা টা চেপে ধরে।
‘আপনার দুহাই লাগে। আমারে এইবার কাম করনের অনুমতি দ্যান। নাইলে আমরা কেও বাঁচবার পারুম না। আপনি আমার লাইগ্যা চিন্তা করবেন না। আমি বাঁইচ্যা থাকতে আমার ইজ্জত খুইতে দিমু না। আমারে আপনি কাম করবার দ্যান। আমার বাচ্চাডারে বাঁচাইবার দ্যান।’
কলিমুদ্দীন দার্শনিকের মতো বলে,
‘বউ, ইজ্জত হইলো বেবাকের আগে। এইডা বুঝোন লাগবো। মাইনষ্যের বাড়িত কাম করলে হেই ইজ্জতের কিছুই বাকি থাগবো না। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি উপায় ভাইব্যা থুইছি। কাল থিইক্যা ইস্টেশনে বসমু আমি। গ্যাদারে লগে দিও। মাইনষ্যে ছোডো বাচ্চা দেহলে ট্যাহা দিইয়্যা ভরাইয়্যা দেয়। তুমি বাড়িত বইস্যা ট্যাহা গুইন্যা শ্যাষ করবার পারবা না।’
শিউলী বিষাক্ত চোখে তাকায় কলিমুদ্দীনের দিকে। ভাগ্যিস, সেই দৃষ্টির ভাষা পড়বার মতো যোগ্যতা কলিমুদ্দীনের নেই।
পরদিন সকাল বেলাতেই কলিমুদ্দীন একটা মাদু্র আর টাকা রাখবার একটা ডিব্বা নিয়ে ষ্টেশনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। চিকিৎসার সময় সদর হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব তাকে দয়া করে একজোড়া পুরনো স্ক্র্যাচ দিয়েছিলেন। সেটার সাহায্যেই সে বেশ একা একা চলতে পারে। যাওয়ার আগে শিউলীকে বলে যায়,
‘ও বউ, আমি যাইতাছি। তুমি এট্টু পরে গ্যাদারে লইয়্যা যাইয়ো।’
শিউলী তাকিয়ে তাকিয়ে তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখে। পরাজিত, জীবন থেকে পলায়নকারী একজন মানুষ। অথচ, তার চালচলনে এখনো কেমন ইজ্জতের বড়াই! ঠিকই তো, ইজ্জতটা চলে গেলে আর কী থাকবে?
শিউলী নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। বিয়ের সময়ের টিনের ট্রাঙ্কটা বের করে ওর কাপড়গুলো গুছিয়ে নেয়। বাচ্চাটার কাপড়গুলোও ভরে নেয়। শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখে স্বামীর বাড়ির দিকে। ওর নিজের হাতে গোছানো সংসার, হাড়িকুড়ি, চুলার পাড়, দেয়াল ঘেঁষে ওরই হাতে লাগানো পুঁইয়ের চারা।
অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে। তিনরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে যায় শিউলী। রাস্তা ঘুরে গেছে তিন দিকে। তার বাপের বাড়ির পথ চলে গেছে ডানদিকে। আসা যাওয়া নাই কতদিন! কী জানি! রাস্তাটা আগের মতোই হাঁটার যোগ্য আছে, নাকি খানাখন্দে ভরে গেছে!
বাঁয়ের সরু পথটা যে গন্তব্যে গেছে সেই ঠিকানা তার হাতে্র মুঠোয় ধরা। এই পথে কোনোদিন চলেনি সে। ঠিকঠাক পথের দিশা খুঁজে পাবে কিনা তা তার অজানা।
সামনের সোজা পথটা অনেক চওড়া, সমতল…এতটুকুও বন্ধুর নয়। হাতছানি দিয়ে শিউলীকে যেন ডাকছে সে পথ। কিন্তু শিউলীর জানা নেই সেই পথের শেষে সে কোন গন্তব্যের দেখা পাবে।
উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে সে। পথচলতি দু’চারজন মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে। একেকজনের চোখে একেকরকম প্রশ্ন। সব প্রশ্নের ভাষা একেবারে অজানা নয় শিউলীর।
বাচ্চাটার মুখের দিকে পূর্ণচোখে একবার তাকায় সে। একটা কোনো ইঙ্গিতের আশায়।
বেশি সময় নেওয়া যাবে না। খুব তাড়াতাড়িই একটা পথ তাকে বেছে নিতে হবে।