জিরো পয়েন্ট

জিরো পয়েন্ট

তাওয়াং থেকে ভোর সকালে বের হওয়া অনেক হিসেব কষেই। পুব আকাশে পাহাড়ের ওধারে তখন সবে আলোর

আভাষ। নতুন বোলেরো গাড়ি। ড্রাইভার বসন্ত ফুকন বয়সে ছোকরা হলেও আসবার সময়ই টের পেয়েছি,

স্টিয়ারিংয়ে হাত পাকা। আগের দিন যখন কথা হয়‚ ও জানিয়ে দিয়েছিল‚ ভোর পাঁচটার আগে বের হলে বিকেলের

মধ্যেই জিরো পয়েন্ট পার হয়ে যেতে পারবে।

আসলে আমাদের আতঙ্ক ওই জিরো পয়েন্ট নিয়েই। পাহাড়ি পথ হলেও উচ্চতা এমন বিরাট নয়। টিপি লজ থেকে

মাত্রই ঘণ্টা খানেকের পথ। ঝকঝকে রাস্তা। প্রতিনিয়ত আর্মির গাড়ি চলছে। কিন্তু পাহাড়ি পথে এমন কুয়াশা আগে

দেখিনি। বেলা তখন দুপুরে। জোরাল ফগ-লাইট জ্বালিয়েও অল্প দূরের জিনিস ভাল করে নজরে পড়ে না। অথচ ঘন

ঘন বাঁক। তারই ভিতর উলটো দিক থেকে ছুটে আসা আর্মির গাড়ি। অগত্যা অল্প সময়ের মধ্যে উৎকণ্ঠায় সবার বুক

হিম হবার জোগাড়। ভাগ্যিস‚ বসন্ত ফুকন এই পথে অনেক বার যাওয়া–আসা করেছে। তাই সমস্যা হয়নি।

সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতা মাথায় গেঁথে ছিল বলেই তাওয়াং থেকে রওনা হয়েছিলাম ভোর পাঁচটারও আগে। তবু গোল

হয়ে গেল টেঙা পৌঁছুবার পর। উঁচু পাহাড় থেকে তখন অনেকটাই নেমে আসা হয়েছে। পথের পাশে বিশাল

মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট‚ দোকানপাট। মানুষের ভিড়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নির্মলদা হঠাৎ বললেন‚ ‘বেজায় খিদে

পেয়ে গেছে কিন্তু। এর পর তো আর তেমন জায়গা নেই। গাড়ি দাঁড় করালে হয় না?’

ব্যাপারটা একবিন্দু মিথ্যে নয়। সেই ভোরে পথে সামান্য চা–জলখাবারের পর পেটে আর কিছুই পড়েনি। ব্যাপারটা

আগে একেবারেই ভাবা হয়নি। অথচ বমডিলায় সহজেই সেরে ফেলা যেত। রেস্ট হত ইঞ্জিনেরও। খুব দরকার ছিল

ওটা। আমাদের তাগাদায় বসন্তও কিছু বলেনি। অগত্যা বমডিলা ছাড়িয়ে ঘণ্টা খানেক নামার পরেই ঝামেলাটা হল।

আচমকা ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। রেডিয়েটার অত্যধিক গরম হয়ে গেছে। পাণ্ডব বর্জিত স্থানে গাড়ির

ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করার জন্য দাঁড়াতে হল বেশ কিছুক্ষণ। অথচ ক্ষুন্নিবৃত্তির কোনও ব্যবস্থাই করা গেল না।

পিছনে নির্মলদার পাশে বিভাস। আমি নীরবে ওর দিকে তাকালাম। বিভাস বলল‚ ‘থাক না নির্মলদা। অনেকটা সময়

চলে যাবে কিন্তু।’

‘তা ঠিক।’ কাঁচুমাচু মুখ নির্মলদার‚ ‘কিন্তু আর যে পারা যাচ্ছে না ভাই। পেটে কিছু দিতেই হবে এবার। কী হে বসন্ত‚

সামনে এখনো যা পথ‚ হাত চলবে তো?’

আমাদের মধ্যে নির্মলদাই সবচেয়ে বয়স্ক। অফিসেও পদমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। তাঁর ইঙ্গিতটাও স্পষ্ট। স্টিয়ারিং হাতে

বসন্ত ইতস্তত করে সামান্য ঘাড় নাড়ল। বুঝিয়ে দিল‚ পেটে কিছু পড়লে বরং সুবিধাই হয়। সুতরাং থামতেই হল

গাড়ি।

টেঙা শহর হলেও এই অবেলায় হোটেলে রেডি খাবার পাওয়া গেল না। সুতরাং অপেক্ষা করতে হল। পেটের ব্যবস্থা

করে ফের যখন গাড়ি ছাড়া হল বিকেল প্রায় চারটে।  নাগমন্দির ছাড়িয়ে গাড়ি উঠল টেঙা নদীর ব্রিজের উপর।

পাহাড়ি নদী হলেও টেঙা মোটামুটি সমতল জায়গা। নদী তাই এখানে বেশ চওড়া। বড় বড় বোল্ডারের ফাঁক দিয়ে

দুরন্ত জলধারা। ওপারে জমকালো নেজিনো রিসর্ট। এখানে বিদেশী টুরিস্টই বেশি। তাদের জনা কয়েক ছিপ ফেলে

মহাশোল মাছ ধরছিল। গাড়ি থেকে হাঁ করে দেখছি। আমরা ব্রিজে পার হবার আগেই একজনের ছিপে বড় একটা

মাছ পড়ল।

দেখে খুশিতে ফেটে পড়ল বসন্ত। কপালে হা্ত ছুঁইয়ে বলল‚ ‘ভাববেন না স্যার। সামনে সময়টা ভাল মনে হচ্ছে।

দাঁড়ান দেখেই যাই।’

আসলে ভয়ানক খিদেয় পেটে গরম চিকেন–পরোটা পড়ার পর সবার মনেই তখন কিছু স্ফূর্তি। আমরাও আপত্তি

করলাম না। বসন্তই জানাল‚ এসব পাহাড়ি নদীর মহাশোল মাছ খেলিয়ে তোলা দেখার মতো জিনিস। সত্যিই তাই।

ঘটনাস্থল ব্রিজ থেকে সামান্যই দূরে। অতঃপর দশটা মিনিট প্রায় রুদ্ধশ্বাসে পার হয়ে গেল। সদ্য তোলা বড়সড় এক

মহাশোল মাছসহ বিদেশী সাহেবকে চিয়ার করে বসন্ত অবশ্য এরপর দেরি করেনি। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল প্রায় সঙ্গে

সঙ্গে। জানিয়ে দিয়েছিল‚ আকাশে যা আলো‚ চিন্তার কারণ নেই।

অভিজ্ঞতায় জানি‚ অচেনা পথে গাড়ির ড্রাইভারই হল ভগবান। সেই ভগবান যদি খুশি থাকেন‚ যাত্রীরাও নিশ্চিন্ত

হবেন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই অবস্থা বেশিক্ষণ বজায় রইল না। জিরো পয়েন্ট জোন আসতে তখন বেশি দেরি নেই।

বসন্তর মানসিক প্রস্তুতি সম্ভবত শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় উলটো দিকে থেকে একটা ট্রাক কাছে আসতে বসন্ত

গাড়ি স্লো করে হাত তুলে জিজ্ঞাসা করল‚ ‘সড়ক কা হাল আজ ক্যা হ্যায় জনাব?’

‘বহোত বুরা। বহোত বুরা ভাই।’ ট্রাকের ড্রাইভার কপালে হাত ছোঁয়াল‚ ‘জেয়াদা কোহরা আজ। সামালকে যাইয়ে।’

ট্রাক চলে গেল। ততক্ষণে বসন্তর মুখ প্রায় ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সামনের সিটে ছিলাম আমি। প্রমাদ

গণলেও কিছু আর বলিনি। পিছনের দু’জন উদ্বিগ্ন মুখে বলল‚ ‘সেকী! ভালুকপং যে আজ পৌঁছুতেই হবে।’

গৌহাটির ছেলে বসন্ত বাংলাটা ভালই জানে। আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল‚ ‘ভাববেন না স্যার।

সন্ধের আগেই জিরো পয়েন্ট জোন পার হয়ে যেতে পারব।’

গাড়ির গতি বসন্ত অবশ্য এরপর বাড়িয়ে দিয়েছিল আরও। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি। কুয়াশা ইতিমধ্যে অল্প অল্প

করে বাড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশ কুয়াশায় প্রায় অন্ধকার। আসবার সময় যে অবস্থা

দেখেছিলাম‚ তার চাইতেও ভয়ানক। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। তখন ছিল ভর দুপুর। আর এখন পড়ন্ত বিকেল।

স্বভাবতই গাড়ির ভিতর ঘন অন্ধকার। কেউ কাউকে দেখতে পারছি না। পিছনের সিটে নির্মলদা আর বিভাস প্রায় থম

মেরে বসে আছে। বিভাস বসন্তকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। নির্মলদা চাপা গলায় বললেন‚ ‘থাক‚ এখন আর ডিস্টার্ব

করার দরকার নেই।’

অগত্যা থেমে গেল বিভাস। কিন্তু নির্মলদার গলার স্বরে বুঝতে অসুবিধা হল না ভয়ানক টেনশনে রয়েছেন তিনি।

অবস্থা যে মোটেই সুবিধার নয়‚ ততক্ষণে বুঝতে বাকি নেই কারও। ইতিমধ্যে গাড়ির দুটো ফগ–লাইটই জ্বেলে দেওয়া

হয়েছে। তাতে সামনে রাস্তার মাঝে হলুদ রঙের ডিভাইডার লাইন ছাড়া আর কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। ডানদিকের

পাহাড় বা বাঁদিকের গভীর খাদ‚ সবই ঘন কুয়াশায় ঢাকা। বসন্ত থম হয়ে সেই ডিভাইডার লাইন ফলো করে গাড়ি

চালাচ্ছে। পাকা হাত। তাই ম্যানেজ করে নিতে পারছে। কিন্তু সেটাও যে কতক্ষণ সম্ভব হবে বুঝতে পারছিলাম না।

সবে মাত্র জিরো পয়েন্ট জোনে ঢুকেছি। মূল জিরো পয়েন্ট এখনো অনেকটাই পথ। কুয়াশা ক্রমে আরও ঘন হবে।

সামনের ওই ডিভাইডার লাইন কতক্ষণ দেখা যাবে‚ সেটাই আশঙ্কা।

হঠাৎ পিছনে একটা ট্রাক দেখা গেল। বসন্ত গলা ঝেড়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল‚ ‘স্যার বাইরে একটু টর্চ মারুন তো।

ট্রাকটাকে ওভারটেক করার জায়গা দেওয়া যায় কিনা দেখি।’

বসন্তর মতলব টের পেয়ে কিছুটা যেন ভরসা পাওয়া গেল। টর্চ কাছে ছিল না। পিছনে বিভাসকে বলতে সে ব্যাগ

হাতড়ে টর্চ বের করে এগিয়ে দিল। বাইরে খাদের দিকে আলো ফেলে দেখা যাচ্ছিল সামান্যই। তবু বসন্তকে কিছু

নির্দেশ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা হল। বসন্ত তাতেই প্রায় অসাধ্য সাধন করে ফেলল। বাঁয়ে খাদের দিকে অনেকটাই

সরে পিছনের ট্রাকটাকে ওভারটেকের জায়গা করে দিল। কিন্তু একটু বাদেই বোঝা গেল‚ পিছনের ট্রাক আমাদের

ওভারটেক করতে রাজি নয়। সে পিছনেই চলতে চায়। অগত্যা গাড়ি ফের সেই রোড ডিভাইডার লাইনের উপর।

ভাগ্যিস‚ উলটো দিকে থেকে কোনও গাড়ি নেই‚ তাই রক্ষা ! যাওয়ার দিন এমন হয়নি। দিনের বেলা। উলটো দিক

থেকে হামেশাই গাড়ি পাওয়া গেছে। ভাবতে গিয়ে আতঙ্ক বুকের ভিতর আরও যেন চেপে বসল। পথের অবস্থা আজ

একেবারেই ভাল নয়। নিয়মিত ড্রাইভারেরা ব্যাপারটা জানে বলেই আগে থেমে গেছে কোথাও। কুয়াশা কিছু হালকা

হবার অপেক্ষায় রয়েছে।

গুম হয়ে বসে তাই ভাবছিলাম। অন্ধকারে ঘনঘন তাকাচ্ছিলাম পাশে বসন্তর দিকে। ইতিমধ্যে গাড়ির গতি আরও

কমিয়ে দিয়েছে ও। হঠাৎ চারপাশ কাঁপিয়ে হুড়মুড় শব্দে বিশাল এক আওয়াজ। ভিতরে অন্তরাত্মা পর্যন্ত যেন

কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। প্রায় সিটিয়ে গিয়েছিল সবাই। চারপাশের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত সেই আওয়াজের রেশ তখনও

কাটেনি। পিছনে নির্মলদা আর বিভাস আঁতকে উঠল‚ ‘ক–কী হল! কোনও গাড়ি খাদে পড়ে গেল নাকি?’

‘না বোধ হয়।’ স্টিয়ারিং হাতে বসন্ত বলল‚ ‘সম্ভবত ল্যান্ড স্লাইড। পাহাড়ে ধ্বস।’

যাওয়ার সময় টিপিতে এক রাত ছিলাম। বিকেলে অর্কিড রিসার্চ সেন্টার ঘুরে দেখছি‚ হঠাৎ সিয়াংয়ের ওধারে

পাহাড়ের দিকে থেকে আচমকা এমনই এক আওয়াজ কানে এসেছিল। কিন্তু সে দিনের বেলা। আমরাও পাহাড়

থেকে দূরে বাগানের সমতলে। বর্তমান অনুভূতি একেবারেই অন্য রকম। বিভাস ধরা গলায় বলল‚ ‘দিরাং বা টেঙায়

রাতটা কাটিয়ে দিলেই ভাল হত মনে হচ্ছে।’

বসন্ত তাই শুনে বলল‚ ‘তাহলে এক কাজ করি স্যার। জিরো পয়েন্টের টপে গাড়ি দাঁড় করাবার জায়গা রয়েছে।

তেমন বুঝলে অনেকেই ওখানে দাঁড়িয়ে যায়। বলেন তো সেখানে গাড়ি দাঁড় করাতে পারি। বুঝতেই পারছেন‚ অবস্থা

আজ খুব ভাল নয়।’

খোদ বসন্ত নিজেই যে বেশ ঘাবড়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কেউই উত্তর করল না। আসলে গুয়াহাটি থেকে

আগামী পরশু সকালে কলকাতার ফ্লাইট। একটা রাত নষ্ট মানেই ভালুকপংয়ের প্রোগ্রাম বাতিল। কী করব ভাবছি‚

পিছনের ট্রাকটা হঠাৎ ঘনঘন হর্ন দিতে শুরু করল। সাইড চাইছে।

আগের বারের মতোই অনেক কসরতে খাদের দিকে সরে গিয়ে তাকে সাইড দেওয়া হল। ট্রাকটা সামনে চলে

আসতেই প্রায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল বসন্তর। খুশিতে হালকা সিটি দিয়ে উঠল। মস্ত ট্রাক। পিছনে লাল ব্যাক লাইটটা

ঘন কুয়াশার ভিতর জ্বলজ্বল করছে। সেই আলো লক্ষ করে বসন্ত নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাতে লাগল। দেখে মাথাটা

অনেকটাই হালকা  হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই অবস্থা বেশিক্ষণ বজায় রইল না। মিনিট তিরিশের মধ্যে জিরো

পয়েন্টের টপে পৌঁছে সামনের ট্রাক সাইড করে দাঁড়িয়ে গেল। আর এগোবে না। সামান্য ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে গেল

বসন্তও। ‘স্যার‚ আর্মির ট্রাকই যখন ভরসা পাচ্ছে না‚ আর না এগোনোই ভাল।’

ইতিমধ্যে ভিতরে আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের দু‘জনের দিকে তাকালাম। কারো মুখে কথা

নেই। খোঁজখবর নিতে বসন্ত ইতিমধ্যে নেমে গেছে। হাতে টর্চ নিয়ে নেমে পড়লাম আমিও।

ঘড়িতে সবে আটটা। রাত এমন বেশি নয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতর আপ ডাউন দু’দিকেই সারি দিয়ে গোটা বিশেক

গাড়ি দাঁড়িয়ে। তবু সব প্রায় নিঝুম। কোথাও সাড়াশব্দ নেই। পথের ধারে ছোট এক পুলিশ বুথ। দু’জন পুলিশ জুবুথুবু

হয়ে বসে আছে। পাশেই এক চায়ের ঠেক। বেঞ্চে বসে নিঃশব্দে চায়ের গেলাস হাতে জনা কয়েক মানুষ। ঠাণ্ডায়

শরীর গরম করে নেবার চেষ্টা। কারও মুখে কথা নেই। পথের হদিশ নেবার জন্য আলাপ জমাবার চেষ্টা করেও বিশেষ

লাভ হল না। প্রায় থম হয়ে বসে রয়েছে সবাই। এক সর্দারজি শুধু বলল‚ ‘ইথে রুখ যাও।’

আজ বেশি রাতেও ভালুকপংয়ে পৌঁছোতে পারলে আগামী কালটা ইচ্ছেমতো কাটানো যেত ওখানে। পরের দিন খুব

ভোরে রওনা হয়ে যথাসময়ের মধ্যে গুয়াহাটি এয়ার পোর্ট। কী করা যায় ভাবছি‚ হঠাৎ পাশ থেকে পরিষ্কার বাংলায়

কেউ বলল‚ ‘কী ভাবছেন স্যার? আজ কুয়াশার যা অবস্থা‚ আগামী কাল সকাল আটটার আগে কেউ নড়বে না।’

 

টর্চের আলোয় তাকিয়ে দেখি পাশে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ। বয়স ষাটের কম নয়। তবে যথেষ্টই মজবুত চেহারা।

কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বিস্মিতই হলাম। মানুষটি বাঙালি নয়। স্থানীয় মনপা বা তিব্বতি আদল। কিন্তু তা নিয়ে

মাথা ঘামাবার মতো অবস্থা তখন নেই। বললাম‚ ‘কিন্তু আমাদের হাতে একেবারেই সময় নেই। এদিকে ড্রাইভার

সাহস পাচ্ছে না। বেশ বিপদেই পড়া গেছে।’

‘একটা কথা বলব স্যার।’ লোকটা সামান্য ঢোঁক গিলে বলল‚ ‘আমারও একই অবস্থা। ভাড়ার গাড়িতে আসছিলাম।

ড্রাইভার আর যেতে রাজি হচ্ছে না। যদি রাজি থাকেন‚ একটা সমাধানের ব্যবস্থা হতে পারে।’

লোকটি কী বলতে চাইছে‚ কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম। তবু কথা না বলে তাকিয়ে রইলাম। লোকটি বলল‚ ‘স্যার‚

আমার নাম জন লি। অ্যাংলো চাইনিজ। তেজপুরে বাড়ি। গাড়ি চালাতাম। এই পথে বহুবার গাড়ি ড্রাইভ করেছি।

তখন পথ এত ভালও ছিল না। যদি রাজি থাকেন‚ আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে পারি।’

চাকরির বাইরে নানা বিষয়ের বই পড়া অভ্যাস। তবে এ–ব্যাপারে সঙ্গী নির্মলদাও কিছু কম নয়। বাড়িতে বসার ঘরে

গোটা কয়েক আলমারি বইতে বোঝাই। তার মধ্যে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাও রয়েছে এক সেট। অনেক খরচ

করে আনিয়েছেন। ওই বইয়ের টানেই নির্মলদার বাড়িতে প্রায়ই হানা দেওয়া অভ্যাস। সেই দৌলতে জানি‚ তেজপুরে

একসময় বেশ কয়েক ঘর চিনা সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতেন। চিনের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়ীক যোগাযোগ ছিল।

এই পথেই তারা দুই দেশের পণ্য আনা–নেওয়া করত। বলা যায়‚ সেই কারণেই তেজপুর শহরের তখন এক অন্য

গুরুত্ব ছিল। চিনাদের সম্মানও ছিল শহরে। তাছাড়া তখন ‘হিন্দি–চিনি ভাই ভাই’ আমল। কিন্তু ১৯৬২–র চিন

আক্রমণের পরেই অবস্থা পালটে যায়। সেই যুদ্ধে চিনা বাহিনী পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছিল ঝড়ের বেগে। ভারতীয়

সৈন্য তেমন কোনও প্রতিরোধই খাড়া করতে পারেনি। বন্দি হয়েছিল হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য। পাহাড়ি শহর

তাওয়াং‚ বমডিলা‚ দিরাং তো যুদ্ধ শুরু হবার কয়েক দিনের মধ্যে চলে গিয়েছিল চিনা বাহিনীর দখলে। এরপর তারা

চলে এসেছিল আসামের সমতলে। দখল করে নিয়েছিল তেজপুর শহর।

চিনা বাহিনী অবশ্য এরপর একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে ‘আকসাই চিন’ নিজেদের দখলে রেখে তৎকালীন

নেফা তথা আজকের অরুণাচল প্রদেশ এবং তেজপুর ছেড়ে চলে যায়। আর তারই জেরে তছনছ হয়ে যায়

তেজপুরের চিনা পরিবারগুলি। ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় চলায় তেজপুর শহরে। চিনারা তো বটেই

গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার হয় আরও অনেকেই। পরে অন্যরা ছাড় পেলেও চিনা পরিবারগুলিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়

রাজস্থানের দেওলি ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখানে প্রায় ছয় বছর তাদের বন্দি রাখা হয়। তাদের কেউই পরে আর

তেজপুরে ফিরে আসেনি। অযাচিতভাবে হঠাৎ অন্য এক গন্ধ পেয়ে বললাম‚ ‘তেজপুরে চিনা পরিবার তাহলে কিছু

আছে এখনো?’

‘আছে স্যার।’ অল্প হাসলেন ভদ্রলোক। ‘অল্প দু’চারটি। আসলে ওই শহরেই জন্ম তো। মাটির টান ছাড়া সহজ নয়।

আমিও পারিনি।’

‘ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়ে চলে এসেছিলেন?’

‘ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে পারলে বোধ হয় ভালই হত স্যার। তবে সেদিনের জন লি’র সেই সৌভাগ্য হয়নি।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

‘সে অনেক কথা স্যার।’ সামান্য গলা নামিয়ে ভদ্রলোক বললেন‚ ‘আগেই বলেছি‚ আমাদের ট্রান্সপোর্টের কারবার

ছিল। গাড়ি ছিল গোটা কয়েক। তার একটা নিজেই ড্রাইভ করতার। মাল নিয়ে এই পথে চলে যেতাম বমডিলা‚

তাওয়াং পর্যন্ত। ওখানে চিন–তিব্বতের ওদিক থেকে যে মাল আসত‚ ফিরতি পথে নিয়ে আসতাম। তখন পথ এত

ভাল ছিল না। এই জিরো পয়েন্টের কথা তো না বলাই ভাল। তবু কত রাত এই পথ মাল বোঝাই গাড়ি নিয়ে পাড়ি

দিয়েছি। পরোয়া করিনি। আসলে হাতের তালুর মতোই পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। হানাদার চিনা বাহিনীর কাছে সেই

খবর পৌঁছে দিয়েছিল কেউ। তেজপুর ছেড়ে যাবার সময় তাই গাড়ি ড্রাইভের জন্য আমাকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।’

অল্প থামলেন ভদ্রলোক। সামান্য বিরতি দিয়ে বললেন‚ ‘তারপর সে এক ইতিহাস স্যার। শুধু বলি‚ মাস কয়েক পরে

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এদেশে ফিরে আসার একটা ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। নিজের আত্মীয়–স্বজন সবই তো এই

ভারতে। মন টিকবে কেন? কিন্তু বমডিলা পর্যন্ত এসে তেজপুরের যা খবর কানে এলো‚ তাতে আর ভরসা করা যায়নি।

ইন্ডিয়ান আর্মি তেজপুরে শুধু চিনাদেরই নয়‚ বন্দি করে নিয়ে গেছে সন্দেহভাজন আরও অনেককে। কোনও চিনা

পরিবারই আর শহরে নেই। অগত্যা ফিরেই যেতে হল।’

‘তারপর কবে ফিরলেন?’ প্রায় রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলাম।

‘সে অনেক দিন পরে স্যার। হাজার হোক নিজের শহর‚ নিজের দেশ। না ফিরে যাই কোথায়?’

থামলেন ভদ্রলোক। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও ব্যাপারটা আমার হাতে ছিল না। পথের মাঝে অপরিচিত কারো হাতে

ড্রাইভাররা স্বভাবতই গাড়ি ছাড়তে চায় না। বললাম‚ ‘আমারদের ভাড়া করা গাড়ি। তাই ইচ্ছে থাকলেও‚ ব্যাপারটা

ড্রাইভারের উপর নির্ভর করছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি ড্রাইভারকে নিয়ে আসছি।’

বসন্ত আমার আগেই গাড়ি থেকে নেমে গেছে। ঘন কুয়াশার ভিতর খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। দু’একবার ডেকেও

সাড়া পাওয়া গেল না। শেষে গাড়িতেই ফিরে গেছে ভেবে সেই দিকে পা চালালাম। কিন্তু নিরাশ হতে হল। বসন্ত

তখনও ফেরেনি। বিভাস আর নির্মলদা উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে নির্মলদা বললেন‚ ‘কিছু

হল?’

উত্তরে ঘাড় নেড়ে সদ্য পরিচিত জন লি–র কথা বলতে যাচ্ছিলাম‚ এমন সময় অন্ধকার ফুঁড়ে বসন্ত এসে হাজির।

তারপর বিনাবাক্যে দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসেই গাড়িতে স্টার্ট। তাই দেখে গোড়ায় ভেবেছিলাম‚ হয়তো গাড়ি

কিছু এগিয়ে নিয়ে সুবিধাজনক কোথাও সাইড করবে। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হল না। ঘন কুয়াশা ফুঁড়ে গাড়ি

ততক্ষণে ফুল স্পিডে চলতে শুরু করেছে। যে মানুষটিকে খানিক আগেও স্টিয়ারিং হাতে রীতিমতো নার্ভাস দেখেছি‚

তাকে হঠাৎ ওইভাবে গাড়ি চলাতে দেখে একসাথে সবাই হাঁ–হাঁ করে উঠলাম‚ ‘কী বসন্ত! পারবে তো?’

উত্তরে বসন্ত কোনও কথা বলল না। মৃদু ঘাড় নেড়ে সামান্য হাত তুলে আশ্বস্ত করল শুধু।

ইঙ্গিত বুঝে আমরাও কেউ আর কথা বাড়াইনি। ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে কুয়াশার ভিতর যেভাবে তখন পাহাড়ি পথে গাড়ি

ছুটছে‚ তাতে কথা বলার অবস্থাও ছিল না। আসবার দিন দিনের আলোতেও বসন্তকে এই পথে এভাবে গাড়ি চালাতে

দেখিনি। আতঙ্কে সবাই প্রায় কাঠ হবার জোগাড়। কিন্তু আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ঘড়ির কাঁটা ঘণ্টার ঘর পার হবার

আগেই গাড়ি সেসা এসে পৌঁছুল। জিরো পয়েন্ট জোন পার হয়ে এটাই প্রথম বড় জনবসতি।

রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট। খানিক উঁচুতে অর্কিড সেন্টার। কর্মচারীদের কোয়াটার। কুয়াশার সামান্য ছোঁয়া

থাকলেও এই সামান্য রাতে বাড়ি–ঘর আর দোকানপাটের আলোয় পথ ঝকঝকে। বুকে যেন প্রাণ ফিরে এলো সবার।

আর সেই সময় বড় একটা ব্রেক কষে থেমে গেল গাড়ি। ঝাঁকুনি সামলে তাকিয়ে দেখি স্টিয়ারিংয়ের উপর

বিপজ্জনক ভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে বসন্ত।

পাশে বসেছিলাম আমি। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে দেখি প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে বসন্ত। জলের ঝাপটা আর

আনুষঙ্গিক প্রচেষ্টায় তার জ্ঞান ফিরে আসতে মিনিট কয়েক সময় লাগল। তারপর চোখ মেলে বলল‚ ‘স–স্যার‚ আমি

কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধ হয়!’

বসন্তের সেই কথায় সবাই প্রায় আকাশ থেকে পড়লাম। নির্মলদা বললেন‚ ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে মানে। জিরো পয়েন্টের

টপ থেকে এতক্ষণ তো তুমিই গাড়ি চালিয়ে আনলে!’

‘আ–আমি!’ অবাক হয়ে বসন্ত বলল।

হাত তুলে নির্মলদাকে থামতে ইঙ্গিত করে আমি নরম গলায় বললাম‚ ‘বসন্ত কী হয়েছিল বলো তো?’

‘স্যার।’ বসন্ত ইতিমধ্যে কিছুটা সামলে নিয়েছে। ‘আমি তখন দাঁড়িয়ে‚ অন্ধকারে আপনার গলা শুনতে পেয়ে এগোতে

যাব কেউ পাশে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়াল। তারপর আর কিছুই মনে নেই। সেসা কখন এলাম? কে গাড়ি চালিয়ে আনল?

বাপরে কী ভয়ানক ফগ! আগেও এই পথে এসেছি‚ এমন দেখিনি।’

বিভাস আর নির্মলদা হাঁ করে তাকিয়ে আছে তখন। বসন্তকে ওদের জিম্মায় দিয়ে আমি নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে।

পথের পাশে অদূরে একটা চা–কফির দোকান। আসবার দিন এখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কফি খেয়েছিলাম। দোকানি

পরিচিত। কাছে যেতেই বলল‚ ‘আসুন স্যার। চা না কফি?’

কড়া করে চার কাপ কফি তৈরির অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়েছি। লোকটি গলা নামিয়ে বলল‚ ‘স্যার আজ সন্ধের পর ওদিক

থেকে কোনও গাড়ি নেই। আপনারাই প্রথম। ড্রাইভার ওস্তাদ বলতে হবে।’

‘আমদের ড্রাইভার কিন্তু হঠাৎই একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওর জন্য হয়তো পরে আর এক কাপ কফি লাগতে পারে।’

আমার ওই কথায় দোকানের লোকটি হঠাৎ কেমন থমকে গেল। গলা নামিয়ে বলল‚ ‘ড্রাইভারের জ্ঞান ফিরেছে স্যার।

জিরো পয়েন্টে কারও সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল নাকি? বলেছে কিছু?’

‘দেখা ড্রাইভারের সঙ্গে হয়নি। হয়েছিল আমার সঙ্গে। জন লি। চেনেন ওনাকে?’

‘না স্যার।’ সামান্য ইতস্তত করে দোকানি উত্তর দিল‚ ‘১৯৬২–র যুদ্ধের পর চিনা বাহিনী যখন তাঁকে ধরে নিয়ে যায়

তখনই তাঁর বয়স চল্লিশের কোঠায়। চিনব কী করে? তবে…।’

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল লোকটি। আমি রুদ্ধশ্বাসে বললাম‚ ‘তারপর ফিরে এসেছিলেন উনি?’

‘বলা মুশকিল স্যার। গত কয়েক বছর হল‚ এই ঘন কুয়াশার রাতে জিরো পয়েন্টে মাঝে মধ্যেই দেখা যায় তাঁকে।

যাঁদের কপাল ভাল থাকে‚ তাঁদের গাড়ি ড্রাইভ করে এই সেসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যান।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত