বকুল

বকুল

ছেলেটার নাম ছিল বকুল। রাতে সবার অগোচরে ফুটে, দিনভর সুগন্ধ ছড়িয়ে গাছতলায় নির্বিবাদে পড়ে থাকবে, এ ধর্ম যে ফুলের- অন্তত তার নামে এ ছেলের নাম রাখা উচিৎ হয় নি, এটা শালিকতলী গ্রামের লোকেরা দিনে দিনে টের পেতে থাকে। বকুল সমবয়সীদের চেয়ে আকারে বেশ খানিকটা ছোট ছিল। উচ্চতাজনিত ত্রুটি’টি পরবর্তীতে সে সাহস দিয়ে পূরণ করে নেয়ার কাজে বেশ আগ্রহী- এটা বোঝা যায় যখন আমাদের বকুলের বয়স ছয়ে গিয়ে পড়ে। ইটাকুড়া বিলের পাশে শালিকতলী গ্রামের সবচেয়ে উঁচু যে সুপোরি গাছ, সেটায় এবছর চৈত্র মাসে ঠিক কয়টি টিয়াপাখি পরিবার নিয়ে বাস করতে শুরু করেছে- এ সকল হিসেব ছিল ছেলেটির নখের আয়নায়। বেত আর নিশিন্দার জঙ্গলে বকুল বাতাসের আগে দৌড়াতে পারতো। ওর সমবয়সী বাকি ছেলেরা থাকতো প্রায় তিন হাত পিছে। মাঝে মাঝে বেত ঝোপের কাঁটা ওর জামায় বিঁধে গতিতে যদিও’বা বাঁধা ফেলতো, তবে বকুলকে কখনো জামা নিয়ে বিশেষ মায়া করতে দেখা যায়নি। কিসের এক অজানা তাড়া বড় বেশী প্রকাশ্য ছিল ছয় বছর বয়সী এ বালকের মাঝে, সেটার কোন উদ্দেশ পাওয়া যায় না। দিনে দিনে বকুল যে আরেকটি কাজে বিশেষ ওস্তাদ হয়ে উঠতে শুরু করেছে, সেটা তাঁর সমবয়সী বাকি বন্ধুরা টের পায়, যেদিন সে প্রথম স্কুলের কাপড়ের ব্যাগ ভর্তি করে বনকাঁঠাল নিয়ে আসে! বস্তুত শালিকতলী গ্রামে অদ্ভুত এ ফলটির কোন গাছ ছিল না। সেটা নিয়ে গ্রামের ছেলেদের দারুণ একটা দুঃখ ছিল। তবে এ কথাও ঠিক যে, বিধাতা অতটা নির্মমও বোধহয় ছিলেননা। বনকাঁঠালের ঘন এক জঙ্গল ছেলেদের চোখে অভাবনীয় স্বপ্নরাজ্য হয়ে যদিও’বা ছিল; তবে ছিল সেটা জানাশোনা পরিধির ভেতরেই। আত্রাই নদীর কিনারা ধরে মাইল দুয়েক সোজা হেঁটে যেতে হবে। এরপর উঠানভাঙার মোড় পড়বে। আত্রাই নদী এখানে বড় প্রশস্ত, বেশ খানিকটা অহংকারী। ভীষণ দুর্বিনীত। তিন দিক থেকে স্রোত এসে এখানে মিলেছে। মাঝ নদীতে নিরন্তর ঘূর্ণায়মান স্রোতের তীব্র শব্দ কিনার থেকেই পাওয়া যায়। নদীর এ জায়গাটির ঠিক ওপারে মোড়লের ভিটা। বস্তুত একটি চর বিশেষ, তবে বড় দুর্গম চর। শুরু থেকেই মনুষ্য বসবাস এখানে গড়ে ওঠেনি। বালিয়াড়ি ছাড়িয়ে পানি থেকে খানিক দূর হেঁটে গেলে নটা ঘাসের ঘন জঙ্গল দেখা যায়। শত শত বাবুই পাখি বুক সমান ঘাসের মাঝে সে জঙ্গলে নিবিড় করে বাসা বেঁধেছে। তাই জলবোরা সাপেরও এদিকটায় বড় বেশী উৎপাত। বাবুই পাখির ডিমের লোভে হিসহিস শব্দ তুলে তারা দিনমান বালিয়াড়ি জুড়ে খেলে বেড়ায়। বালকের দলের এসকল তথ্য জানা ছিল। ওপাড় থেকে স্রোত ঠেলে সাঁতরে যদিও’বা আসা সম্ভবপর ছিল। কিন্তু বিষধর জলবোরা সাপের ভয় অতিক্রম করা- সেটা তাঁদের বালকবেলার কর্ম ছিল না। তবে তাঁরা এটাও জানতো যে, বুক সমান নটাঘাসের এই জঙ্গলটুকু পেরুলেই সেখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নিবিড় এক অরণ্যের দেখা মেলে। বড় স্বপ্নময় এ অরণ্য। দিনের বেলাতেও সে যেন সন্ধ্যার আঁধার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সারি সারি বনকাঁঠালের গাছ এখানে। তারই মাঝে মাঝে আছে কানাইলাঠির জঙ্গল। এ গাছ থেকে ও গাছে বেতের লতাগুলো যেন নিবিড় মমতায় এক অপরকে বেঁধে সমস্ত বনাঞ্চলকে যেন মানুষের অগম্য করে তুলেছে। সবচেয়ে অভাবনীয় ব্যাপারটি নির্জন এ বনভূমিতে তৈরি হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুর দিকে। সে সময় বনকাঁঠালের এ জঙ্গলে শত শত চিত্রকর যেন রংতুলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে! বনকাঁঠালের ডালে ডালে ঈষৎ সবুজাভ লাল বর্ণের পাকা ফলগুলো তখন মোহাবিষ্ট করবার মত সৌন্দর্য্য নিয়ে আসে। যেন কেউ একজন খানিক আগে বনদেবীর কপালে গাঢ় করে সিঁদুর পরিয়ে গিয়েছে। আর রয়েছে হিজলের বন। হিজলের তলায় অপ্রশস্ত কিঞ্চিৎ সরু পথ। জ্যৈষ্ঠ মাসে সে পথ ধরে যেতে ইচ্ছে করে না। রাশি রাশি হিজল ফুল এ সময় মাটিতে পড়ে সমস্ত বনভূমিকে যেন আলতা পড়িয়ে দেয়। এমনটা ঠাহর হয় যে, কোন এক অপরিসীম ক্ষমতাধর গোপন চিত্রকর বনের নিবিড়ে বসে বন কাঁঠালের লাল আর হিজলের ফুলের রং মিশিয়ে তাঁর সবচেয়ে সুন্দর ছবিটি এখানে এঁকে গিয়েছেন। এমনই এক দুর্গম স্বপ্নরাজ্য থেকে ছয় বছর বয়সী বকুল বন কাঁঠাল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে- বকুলের বন্ধুদের পক্ষে এমনটা বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব ছিল। করিম প্রশ্ন তুললো সবার আগে- – তুই এইগুলান মোড়লের ভিটা থেকে নিয়ে আইছিস? বকুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেয়। -কার নৌকা নিয়ে গেইছিস? তোক সাপে কাটে নাই? বকুল এসময় খানিক হাসে। সে কোন উত্তর দেয় না। কাপড়ের ব্যাগ থেকে বাকি বনকাঁঠাল বেঞ্চির উপর ফেলে রেখে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা আকস্মিক সে এসেছিল। করিম কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল। সে সুযোগ হয় না। বকুল ততক্ষণে স্কুলের সামনের মাঠ পেড়িয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠেছে। সেদিন থেকে বাকী বালকদের মাঝে বেশ একটা গুঞ্জনের ধরণ তৈরি হল। দিনে দিনে সেটা বাড়ে। একদল মতামত দিল, নদীর পাড়ে গিয়ে বকুল নিশ্চয়ই কোন মাঝিকে অনুনয় করে মোড়ল ভিটার চরে তাঁকে নামিয়ে দিতে বলে। আবার ফিরতি নৌকায় করে সে এপাড়ে ফেরে। করিম তখন খানিক প্রতিবাদ করে বলে ওঠে, বকুল জলের পোকা, সাঁতরে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সাহস দিলে সেও একদিন বকুলের ন্যায় সাঁতরে নদীর ওপাড়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। টুনু নামে আরেক বালক মতামত দিল যে, বকুলের কাছে নিশ্চই ইদ্রিস কবিরাজের সাপ বশীকরণ তাবিজ আছে! নাহলে যে সাপের উৎপাত ওইদিকে, বেঁচে সে ফিরে আসে কীভাবে? বাকি সবাই মাথা নেড়ে টুনুর এ মতামতটিতে সায় জানায়। বলাই বাহুল্য দিনে দিনে বালকদলের কৌতূহল যেন সীমা ছাড়ায়। বকুল কিন্তু মুখ খোলে না। আগের মতই যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে তাঁকে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু খানিকটা হাসতে দেখা যায়! ছয় বছর বয়সী এ বালকের মনের গহীনে যে অপ্রকাশিত মানচিত্রটির অবস্থান, তার বিস্তারিত রেখাপাঠ ক্লাসের বাকি বালকদের অজ্ঞাতেই থাকে। তবে একদিন সে শুধু এটুকু জানিয়ে যায়- আগামী সোমবার সে আবার মোড়লের ভিটায় যাবে। কেউ চাইলে তাঁর সাথে যেতে পারে। তবে একটি গামছা এবং সাথে একটি কঞ্চি রাখা আবশ্যক। গামছায় বনকাঁঠালের ফল বেঁধে নিয়ে আসতে হবে আর কঞ্চির প্রয়োজন যাত্রাপথে নটাঘাসের জঙ্গলে বাড়ি দেওয়ার জন্য। ঘাসের জঙ্গলে বাড়ির শব্দে সাপেরা দূরে সরে যায়। তাই হাতে একটি কঞ্চি থাকলে, বাকী পথটুকু যে মোটামুটি নিরাপদ হবে- সে তথ্যটুকু ক্লাসের বাকী ছেলেদের জানা প্রয়োজন। নির্ধারিত দিনে সকালবেলা শুধু করিম, টুনু আর একজনকে দেখা গেল। রহস্যসন্ধিৎসু ক্লাসের বাকি ছেলেরা নদীর এই ভীষণ স্রোতসম্বলিত বিপদসংকুল জায়গাটিকে সাঁতরে পার হবার সাহস দেখালো না। চারজনের এই ক্ষুদ্র দলটির দলনেতা হিসেবে অগ্রভাগে দেখা গেল এরফান মিয়াঁর পুত্র বকুলকে। তাঁর মনে আজকে আনন্দের সীমা নাই। আজ অভিযান শেষে তাঁর এতদিনের বীরত্বগাঁথা যে শুধু বালকমহলে প্রতিষ্ঠিত হবে- সেটাই নয়; সে হবে বালকদের অঘোষিত নেতা। আশ্বিন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। মাথার উপরে নীল সামিয়ানার মত প্রকাণ্ড আকাশ। দুপুর দ্বিপ্রহর। চিল উড়তে দেখা যায় আকাশের অনেক উপরে একটা-দুইটা। মাঝ দুপুরের রোদ যেন নদীর বুকে তির্যক হয়ে পড়ে রূপো ছড়াচ্ছে। শান্ত- নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতা চারদিকে। মনে হয়, কেউ একজন রুপোর শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়েছে পুরো আত্রাইের বুক জুড়ে। দূরে বড় কারবারি নৌকা দেখা যায় একটা দুইটা- যাদের অবয়ব খুব একটা স্পট নয়। আহসানগঞ্জের হাট থেকে ফিরছে এরা। জেলে নৌকা খুব একটা আসে না এদিকে। স্রোত ঠেলে বালকের দল ধীরে ধীরে সাঁতরে সামনে এগিয়ে যায়। বকুল এদের সবার আগে। বাকীরা খানিক পরে। চর আর বেশী দূরে নাই। এরা যখন প্রায় মাঝ নদী ছাড়ালো, ঠিক এ সময় করিম বেশ অবাক হয়ে সম্ভবত প্রথম আবিস্কার করে যে, সামনে বকুলকে আর দেখা যায় না! বালকের দল প্রথমে ভেবেছিল, বকুল বুঝি ডুবসাঁতারের নতুন কোন কৌশল শিখেছে। তাই সামনে বকুলকে না দেখেতে পেয়েও এরা খুব একটা চিন্তিত হয় না। খানিকটা পথ সাঁতরে সামনে চলে আসে। কিন্তু চরের যখন প্রায় কাছাকাছি আসার পরও যখন বকুলকে নদীর কোথাও দেখা গেল না- ঠিক তখন ভয়ের একটা শীতল স্রোত এদের সবার গায়ে যেন একসাথে আছড়ে পড়ে! মাঝ নদী ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর এরা প্রথম আবিস্কার করে, এরফান মিয়াঁর ছয় বছর বয়সী ছেলেটা বহুক্ষণ ধরে নিখোঁজ। বালকেরা কেউ চিৎকার করে। আবার কেউ বকুলের নাম ধরে বার বার ডাকে। কেউ মাথা তুলে ব্যাকুল হয়ে চারপাশ তাঁকে খোঁজে। কিন্তু বকুলের আর দেখা মেলে না। বিকেলের বোধহয় তখনও কিছুটা বাকী ছিল, সেদিন শালিকতলী গ্রামের যার যার নৌকা ছিল- এরা সবাই উঠানভাঙ্গার মোড়ের কাছে জমায়েত হয়েছিল। জমা হয়েছিল, গ্রামের সবচেয়ে দক্ষ সাঁতারু মন্তাজ সহ আরও অনেকেই। বিকেল বাড়তে থাকলে, তীরে ভিড় করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মাঝ নদীর দিকে তাকিয়ে সবাই যেন কিসের খোঁজ করে! দলবল নিয়ে করিমের হাত দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় লোকেরা নদীর জল আন্দোলিত করে এরফান মিয়াঁর ছোট ছেলেটাকে খোঁজে। টানা জাল ফেলা হয় তিনটা। মন্তাজ মিয়াঁ তাঁর ডুবুরী দল নিয়ে নদীর বুক প্রায় চষে ফেলে। আর যাদের নৌকা ছিল, তাঁরাও বকুলের খোঁজে নৌকা নিয়ে ভাটির দিকে চলে যায়। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে ভাটির দিকের নৌকাগুলোও ফিরে আসতে থাকে এক এক করে। কিন্তু আমাদের বকুল যেন তখনও কী এক অদ্ভুত দুরন্তপনায় মত্ত! সে যে কোথায় লুকালো সেটার উদ্দেশ সন্ধ্যার পরও পাওয়া গেল না। রাত নামলে তীরে ভিড় করা মানুষেরা সবাই কী এক আশ্চর্য নীরবতা বুকে নিয়ে একে একে ঘরে ফেরে। শুধু এরফান মিয়াঁ আর আর তাঁর স্ত্রীকে তখনও কূলে বসে থাকতে দেখা যায়। অন্ধকার কোলাহলহীন রাত্রি। এ জনপদের বুঝি ঘুমিয়ে পড়বার আর খুব বেশী দেরী নাই। মাইল খানেক দূরের খেয়া ঘাট থেকে এতক্ষণ ধরে যে ক্ষুদ্র আলোর রেখাটি জীবিত ছিল, রাত আরও গভীর হলে সেটাও যেন নিভে আসে। মৃত্যুর মত আঁধার যেন নদীটির বুকে ধীরে ধীরে নামে। নিকষ কালো সে আঁধার ছাপিয়ে শুধু স্রোতের শব্দ শোনা যায়।। কল-ছল-ছলাৎ। একটানা, অনেকক্ষণ! বকুল কিন্তু ফিরেছিল। দেরীতে হলেও সে ফিরে এসেছিল বড় অদ্ভুত এক রাতে। এ রাতের গল্প এখনও শালিকতলীর ছেলে-বুড়ো সকলের মুখে মুখে ফেরে। সে রাতের কথা ভুলবার নয়। সেবার সমস্ত দেশ জুড়ে বর্ষার শুরু থেকেই যেন বান ডেকেছে। পদ্মা, যমুনা আর ব্রহ্মপুত্রসহ আরও বাকি যারা ছিল- এদের সবার বুকে হঠাৎ করে যেন যৌবন ফিরে আসলো। দুকূল উপচে তাঁরা তীরবর্তী লোকেদের মুহুর্মুহু ভয় দেখায়। সাল ১৯৮৮। বাংলা তেরোশ পঁচানব্বই, শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি শালিকতলী গ্রামের লোকেরা আন্দাজ করে- আত্রাইে বহু বছর পর এবার বুঝি ভাঙন ধরেছে। ইটাখোলা, সালতার চর, আহসানগঞ্জ এসকল এলাকা ভাঙতে ভাঙতে নদী প্রায় তাঁদের কোলের কাছে। মল্লিকবাড়ি হতেই বড় বড় নৌকার পাল দেখা যেতে লাগলো। দিন তিনেক পরেই আত্রাই চর মাধবপুর গ্রামটিকে পুরোপুরি তাঁর বুকে নিশ্চিহ্ন করে যেন শালিতলীর পায়ের কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীটির সে কি শুষানী! রাত্তিরে ঘুম থেকে জেগে তীরবর্তী লোকেরা শুনতে লাগলো- ঢেউের পর ঢেউ এসে কূলে আঘাত করে। নদীর নিরন্তর বহমান শো শো শব্দে বহুদিন পর এ জনপদের লোকেরা যেন বুকের মাঝে শূন্যতাকে আরেকবার গভীর করে অনুভব করে। এক রাতে লোকেরা সবাই নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। সে রাতে তাঁরা ঠাহর করেছিল, এ রাত বুঝি শালিকতলীর শেষ রাত। নদীবুকের ঘূর্নিগুলো গোল চক্র হয়ে একটানা পাড়ে এসে আঘাত করে। ভীষণ এক একটি শব্দ করে গাছগাছালিসহ অনেকখানি জমি নদীর বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গ্রামের এতো বছরের পুরাতন পাকুড় গাছটি- যে কতকালের কত ঘটনার সাক্ষী হয়ে এই জনহীন প্রান্তে এতোদিন উন্নতশির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যার ছায়ার নীচে দূর গ্রামের কত শ্রান্ত পথিকেরা এসে শরীর জুড়াতো- সে গাছটিও এ রাতে অসহায়ভাবে আত্রাইের বুকে ভেঙে পড়লো। রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে নদীতীরে আতংকিত লোকদের জমায়েতটি বড় হতে থাকে। ঠিক এ সময় তাঁরা মাঝ নদীর দিকে তাকিয়ে সবাই অবাক হয়ে কী এক পরিবর্তন খেয়াল করে! এতো যে প্লাবন- প্রলয়ের মাঝে এতোদিন ধরে মোড়লভিটের সেই বনকাঁঠালের অদ্ভুত অরণ্যটি টিকে ছিল, আজ এ শূন্যতার সব হারানোর রাতে সেটিতেও ভাঙন ধরেছে! লোকেরা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দ্যাখে যে, ক্রমশ চরের উত্তরদিক থেকে মাটির ভাগ সরে যায়। যেতেই থাকে। দূর থেকে মোড়লভিটার ভাঙ্গনের শব্দ বাড়ে। বাড়তে থাকে। নদীর তুমুল গর্জনে আলোড়িত হয় চারপাশ। সে রাতে শালিকতলীর লোকেদের অবাক করে দিয়ে রাত্রি দ্বিপ্রহরের আগেই মোড়লভিটের সমস্ত জঙ্গলকে আত্রাই যেন তাঁর বুকে টেনে নিল! বস্তুত মোড়লভিটার জঙ্গল আত্রাইে পড়ার পর, সে রাতেই নদীর ভাঙনের পথ পাল্টে যায়। এ গ্রামের লোকেদের দূরের কোন চরে গিয়ে নতুন করে বসতি খুঁজতে হয়নি। নদী যেন তাঁর বুকে অযাচিত এই বাহুল্যটিকে সরিয়ে তাঁর বহু পূর্বের আপন গতিপথ ফিরে পায়। কলকল- ছলছল শব্দে কী ভীষণ প্রমত্ত যৌবন ভর করে আত্রাইের বুকে। দীর্ঘ প্রায় পাঁচটি বছর পর শালিকতলীর লোকেদের নিখোঁজ বকুলের আবার কথা মনে পড়ে। তাঁদের মনে পড়ে, বনকাঁঠালের এই জঙ্গলটি ছিল ছয় বছর বয়সী দুরন্ত এক বালকের খেলাঘর। দীর্ঘদিন সে খেলাঘর কারও চলাচল ছিল না। যে নিঃসীম একাকীত্ব মৃত্যুর মত কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলে যায় প্রতিনিয়ত, জঙ্গলটা এতোদিন সে একাকীত্বকে তাঁর বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুক্তি বোধহয় তারও ভীষণ প্রয়োজন ছিল। ভাঙনের সে রাতে জঙ্গলটিরও যেন মুক্তি ঘটে। শালিকতলীর লোকেরা সে রাতটির কথা ভুলতে পারেনি। এখনও তুমি যদি শালিকতলীতে যাও, তুমি গ্রামের ছেলে-বুড়ো সকলের মুখে সে রাতের গল্প শুনতে পাবে। শুনতে পাবে মোড়লভিটের সে অদ্ভুত জঙ্গলের কথা আর বকুলের গল্প। তাঁরা বিশ্বাস করে এরফান মিয়াঁর নিখোঁজ ছয় বছর বয়সী ছেলেটা ভাঙনের সে রাতে ফিরে এসেছিল। আত্রাইয়ের বুকে তাঁর যে খেলাঘর ছিল, নিবিড় যে অরণ্যটি ছিল, সেটার বিসর্জনে আজ গ্রামটি এখনও টিকে আছে। কোন কোন রাতে এ জনপদে অদ্ভুত জ্যোৎস্নার দেখা মেলে। নদী- ক্ষেত- ভিটে- দিগন্ত সব চন্দ্রালোকিত সে রাতে যেন মিলেমিশে একাকার হয়। অড়হরের ক্ষেত থেকে ভেসে আসতে থাকে নেশাধরা কোন সুবাস। এসব রাতে গ্রামের সবাই ধীরে ধীরে নদীতীরে জড়ো হয়। এ সময় তাঁরা কেউ কথা বলে না। ধবল জ্যোৎস্নার ফিনকি ফোটা এক রাত। চাঁদের শ্বেত শুভ্র আলোতে যেন উদ্ভাসিত হয় মাঠ-ঘাট, ফসলের ক্ষেত। সোলোক জ্বলা রাত্তিরের মোহময়তায় আবিষ্ট হয় চারিদিক। নদীকে এ সময় মনে হয় যেন অন্তহীন এক প্রান্তর। শালিকতলীর লোকেরা ধীরে ধীরে চোখে মেলে সামনে তাকায়। তাঁরা অবাক হয়ে দ্যাখে, আত্রাইের বুক যেন শত সহস্র বকুলের ফুল ফুটেছে। শুভ্র মায়াবী আলোয় ভেসে যেতে থাকে প্রান্তর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত