সিংহ ও খরগোশ

সিংহ ও খরগোশ

প্রাচীন গল্পে জন্তু-জানোয়ার, পশুপাখিগুলো কথা বলে। এসব কথা আসলে পশুপাখি বলে না, তাদের মুখ দিয়ে লেখকরাই বলে। সেজন্যে পশুপাখি যেসব ঘটনা ঘটায় সেগুলোর মাধ্যমে লেখকরা মূলত পাঠক কিংবা শ্রোতাকেই ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে রাজা বাদশা বা সমকালীন শাসকের কানেও ইঙ্গিতে সমাজের দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরতে কিংবা পরিবেশ পরিস্থিতির ধারণা পৌঁছাতে এ ব্যবস্থা নেয়া হতো বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

অন্তত ত্রিশ শতক বা তিন হাজার বছর আগে থেকে পশুপাখিগুলো সাহিত্যের জগতে এভাবে বিচরণ করে আসছে। ভারতীয়, ইরানী এবং গ্রিক সাহিত্যে অন্তত দুই হাজার বছর আগের সেইসব সাহিত্যের নমুনা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। আর এগুলোই মৌখিক কথা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন। যুগে যুগে এইসব গল্প কাহিনী কখনো গল্পের আকারে কিংবা কখনো কবিতার আদলে সাহিত্যে প্রবেশ করেছে। ফার্সি সাহিত্যেও তাই। এ পর্বে রয়েছে ‘সিংহ ও খরগোশ’-এর কাহিনীকে উপজীব্য করে একটি গল্প।

এক বনে বাস করতো হিংস্র সব জন্তু জানোয়ার। তাদের পাশাপাশি নিরীহ পশুরাও বাস করতো সেই বনে। ওই বনের রাজা ছিল সিংহ। আসলে রাজাপ্রজা তো নয়, বরং সিংহ বনের অন্যান্য পশুদের শিকার করে করে খেতো বলে সবাই সিংহকে ভয়ে সমীহ করে চলতো। এ কারণে সিংহ নিজেকে রাজা রাজা ভাবতো। আর নিরীহ পশুরাও সিংহের অত্যাচারের ভয়ে প্রজার মতো থাকতো। বনের রাজার জুলুমে প্রজা প্রাণীগুলোর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। কখোন যে কোন দিক থেকে সিংহ আক্রমণ করবে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। বেচারা পশুরা তাই নিজেদের ভেতর একটা বৈঠক করলো। বৈঠকে তারা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সিংহের কাছে গেল।

সিংহের কাছে গিয়ে তারা ব্যাপক প্রশংসা করে সিংহকে রাজি করানোর চেষ্টা করলো। তারা সিংহকে বলল: আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে আমরা নিজেরাই আপনার জন্যে উপযুক্ত ভাবার পাঠিয়ে দেব। ফলে আপনার আর লুকিয়ে লুকিয়ে ওঁৎ পেতে শিকার করার দরকার নেই। এতে করে আপনার কষ্ট করতে হবে না বরং বাসাতেই রাজকীয় সব খাবার আপনার সামনে এনে হাজির করা হবে। আর আমরাও বনের ভেতর নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারবো। কেউ আর ভয়ে ভয়ে থাকবে না, তিক্ত কোনো অভিজ্ঞতারও শিকার হবে না।

সিংহ বলল: এরকম বহু প্রতারণা আর ফাঁদ আমি দেখেছি। সুতরাং তোদের কথা আর কাজের প্রতি আমার আস্থা রাখা কঠিন। তবে হ্যাঁ, যদি তোরা সত্যিই কাজে সেটা প্রমাণ করতে পারিস তাহলে অসুবিধা নেই, আমি রাজি।

বনের পশুরা বলল: হে বনের বাদশা! আপনি অনেক গণ্যমান্য। আল্লাহ আপনার জন্যে দৈনিক যে রুজির ব্যবস্থা করে রেখেছেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকুন। আল্লাহ হলেন মূল রিযিকদাতা। অতএব রুযির জন্যে অ্যাতো উদগ্রিব হওয়া কিংবা চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন নেই। চাহিদার কূপে পড়ে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ঠিক নয়।

সিংহ বলল: আল্লাহ যেহেতু আমাকে হাত পা দিয়েছেন, শিকারের জন্যে নখ দাঁত দিয়েছেন, সেহেতু বসে না থেকে রিযিকের জন্যে চেষ্টা চালানো উচিত।

এভাবে অনেক বাক বিতণ্ডার পর শেয়াল, হরিণ, খরগোশ সিংহের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হলো যে তারা তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করে যাবে। প্রতিদিন তার জন্যে খাবার পাঠিয়ে দেবে। সিংহ রাজি হলো।

চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন বনের পশুদের মাঝে লটারি হতো এবং যার নাম উঠতো সে-ই খাবার হিসেবে সিংহের কাছে যেতে শুরু করল। সিংহও বিনা পরিশ্রমে মজার মজার খাবার খেয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। এভাবে লটারিতে একদিন উঠলো খরগোশের নাম। খরগোশ এমনিতেই এই চুক্তির ব্যাপারে রাজি ছিল না। সেজন্যে সারাক্ষণই একটা উপায় খুঁজে বের করার ধান্ধায় ছিল। সে যেতে অস্বীকার করল। অন্যান্য পশুরা বলল তু্ নিা গেলে সিংহের সাথে চুক্তি ভঙ্গ হবে। আর চুক্তি ভাঙলে সিংহ ক্ষেপে গিয়ে আগের চেয়েও বেশি বেশি হিংস্র আচরণ শুরু করবে। তাই সিংহ না ক্ষেপতেই তাড়াতাড়ি যা।

খরগোশ বলল: আমাকে একটু সময় দাও দেখি কী করতে পারি। কীভাবে এরকম স্বেচ্ছামৃত্যু থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি।

অন্যান্যরা বলল: তুই এত্তোটুকু একটা খরগোশ, লড়বি সিংহের সাথে! বাজে বকিস না তো! সিংহের সাথে প্রতারণার ফল ভালো হবে না, বুঝলি!

খরগোশ বলল: আল্লাহর ইচ্ছায় আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবো সিংহের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার একটা উপায় খুঁজে বের করতে। আল্লাহ অনেক মহান এবং শক্তিমান।

অন্যান্য পশুরা জানতে চাইল: তোর মাথায় আসলে কী প্ল্যান আছে খুলে বল!

খরগোশ বলল: সব রহস্য খুলে বলা যায় না। দেখো, কী হয়। পশুরা অগত্যা মেনে নিল।

খরগোশ চলে গেল বনের ভেতর। সারা বন ঘুরে ফিরে দেখে তারপর গেল সিংহের কাছে। সেখানে গিয়েই সে হাঁপাচ্ছিল। ভাবখানা এমন যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে। সিংহ তো এমনিতেই ক্ষুধার যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত, তার উপর ছোট্ট একটা খরগোশ, তাও এলো দেরি করে।

সিংহ রেগেমেগে বলল: দেরি করলি কেন, তোর মতো পিচ্চি খরগোশ চাচ্ছিস আনুগত্য না করতে?

খরগোশ বলল: আপনি একটু শান্ত হোন, কেন দেরি হয়েছে আমি ঘটনা খুলে বলছি। আমি আমার মটকু বন্ধুকে নিয়ে সেই ভোরে ভোরে বেরিয়েছি আপনার কাছে আসবো বলে। কিন্তু পথে আরেকটা সিংহ আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসলো। আমরা বললাম, আমরা তো আমাদের বনের রাজার খাবার, তুমি কেন হামলা করছো আমাদের ওপর?

ওই সিংহটা তখন ক্ষেপে গিয়ে বলল: কোন্‌ রাজার কথা বলছিস? আমি তোকে এবং তোর রাজাকে একসাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাব। আমি বললাম: তুমি আমাদেরকে একটু সময় দাও, আমাদের আমাদের রাজাকে খবরটা দিয়ে চলে আসব।

সিংহটা তখন বলল: ঠিক আছে, তোর বন্ধুকে রেখে যা।”

এসব শুনে বনরাজ সিংহ চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলো: কোথায় সে?

খরগোশ বলল: চলেন, আমি আপনাকে নিয়ে যাই।

খরগোশ সিংহকে নিয়ে গেল একটা কূপের পাড়ে। সেখানে নিয়ে গিয়ে খরগোশ বলল: এই কূপের ভেতরে আছে সে। দেখুন! কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে। নাজানি সিংহটা আপনার কোনো ক্ষতি করে বসে!

সিংহ কূপের ভেতরে তাকাতেই তার নিজের চেহারা পানিতে দেখতে পেলো এবং খরগোশের চেহারাটাও।

সিংহ বলল: ভয় পাসনে! আমি তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। এই বলে সিংহ আবারো কূপের ভেতর তাকালো, সঙ্গে খরগোশও। পানির ভেতর তাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে সিংহ মনে মনে ভাবলো খরগোশ ঠিকই বলেছে। আরো ভাবলো, এই সিংহটাকে না মারলে তো তার রাজাগিরি আর নিশ্চিন্ত খাবারের আয়োজন সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই খরগোশকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত সিংহ কূপের ভেতরের শত্রুর ওপর আক্রমণ করে তার খাবার খরগোশটিকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাল। আর যায় কোথায়! কূপের ভেতর পড়ে সিংহ গেল মরে। আর ছোট্ট খরগোশের বুদ্ধিতে বনের সকল পশু মুক্তি পেয়ে গেল এবং স্বাধীনভাবে, নিশ্চিন্ত মনে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত