সিন্দাবাদের ঈগল

সিন্দাবাদের ঈগল

মৌখিক সাহিত্য বলে যেসব সাহিত্য ইতিহাসে ধরা হয়, সেগুলোর মধ্যে কবিতা যেমন আছে তেমনি কিসসা কাহিনী বর্ণনাও আছে। বিভিন্ন এলাকার মানুষের ভাষা যেহেতু বিভিন্ন ঢঙের সেজন্যে কিসসাগুলোও মুখে মুখে সেই ভাষাভঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়েছে। কবিতার ধারাটি ইরানী জনগণের মাঝে বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। এগুলোকে ‘ফাহলাভিয়াত’ বলা হতো। কবিগান যারা করতেন তারা এই ফাহলাভিয়াত হাটে মাঠে বাজারে অলিতে গলিতে গেয়ে বেড়াতো। মানুষ এগুলো শুনে শুনে মুখস্থ করতো আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেগুলো এভাবেই বর্ণিত হয়ে এসেছে। কে বা কারা যে এগুলো রচনা করেছেন জানা যায় না, তবে কোনো কোনো কবিগানের ভেতরে নাম এসেছে।

এর বাইরে এক ধরনের ছোটো ছোটো গল্পেরও একটি ধারা ছিল। মা নানী দাদীরা বাচ্চাদেরকে এগুলো শুনাতেন। বাচ্চারাও বড় হয়ে তাদের উত্তর প্রজন্মকে শুনিয়ে গল্পগুলোকে জারি রেখে গেছেন। এই গল্পগুলোর রচয়িতার একেবারেই হদিস মেলে না। মুখে মুখেই সেগুলো বর্ণিত হয়েছে।

আরেক ধরনের গল্প ছিল মজার। এগুলো রাজা বাদশাদের বিনোদনের জন্যে বিখ্যাত ছিল। এই গল্পগুলোর দুটি শাখা রয়েছে। একটি একেবারেই কল্পনা প্রসূত। যাদু টোনা, দৈত্য দানব, জ্বীন পরী ইত্যাদি এসব গল্পে স্থান পেয়েছে বেশি।

অপরটি মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ। সেজন্যে বাস্তবতার একটি চিত্র সেগুলোতে পাওয়া যাবে। এই শ্রেণীর গল্পের চরিত্রগুলো সাধারণত মানুষ। এই মানুষের মধ্যে রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে নিম্ন জাতের মানুষেরাও রয়েছে। তবে গল্পগুলোতে শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। এসব বিষয়ে আরো কথা বলার ইচ্ছে রইলো সময় সুযোগমতো। এখন চলুন আজকের গল্প শুরু করি। এ গল্পটিও নেওয়া হয়েছে ‘সহস্র এক রজনী’ থেকে।

সিন্দাবাদ নামে এক বাদশার কথা অনেকেই শুনে থাকবেন। এই সিন্দাবাদের একটা পোষা ঈগল ছিল। পোষা না বলে বরং শিকারী বলাই ভালো। বাদশা ঈগলটাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ঈগলও ঠিক তাই। একজন আরেকজনের কাছ থেকে আলাদা হবার চিন্তাই করতো না। বাদশা সিন্দাবাদের আদেশে স্বর্ণ দিয়ে ছোট্ট একটা বাটি তৈরি করা হলো। ঐ বাটিতে পানি ভরে ঈগলের গলায় ঝুলিয়ে রাখা হতো যেন ঈগলের পানির পিপাসা লাগলেই সেখান থেকে পানি খেতে পারে।

একদিন বাদশা সিন্দাবাদ তার মন্ত্রী এবং গোলামদের নিয়ে শিকার করতে গেল। যথারীতি ঈগলটাও ছিল বাদশার সাথে। যাই হোক শিকার করতে গিয়ে যে ফাঁদ বা জাল পেতেছিল বাদশা, ঐ জালে একটা হরিণ আটকা পড়লো। বাদশার সাথে সহযোগিতা করার জন্যে যারা এসেছিল তারা হরিণটির চারপাশে বৃত্ত তৈরি করে দাঁড়ালো যাতে কোনোভাবেই জাল কেটে হরিণটা বের হয়ে যেতে না পারে। কিন্তু হরিণটা ঠিকই জাল ছিঁড়ে ফেললো এবং পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলো। বাদশা তখন চীৎকার মেরে বললোঃ খবরদার হরিণটা যে কোনোভাবেই পালাতে না পারে। যদি হরিণ পালিয়ে যায়, তাহলে যার সামনে দিয়ে পালাবে তাকে হত্যা করা হবে।

বাদশার কথা শেষ হতে না হতেই স্বয়ং বাদশার মাথার উপর দিয়েই লাফ দিয়ে হরিণটা পালিয়ে গেল। সিন্দাবাদের গোলামেরা চুপ মেরে গেল। তারা কোনো কথা না বলেই মন্ত্রীর দিকে তাকাতে লাগলো। মন্ত্রী আস্তে আস্তে বাদশা সিন্দাবাদের কানে কানে গিয়ে বললোঃ ‘হরিণ তো আপনার মাথার ওপর দিয়ে পালিয়ে গেছে হুজুর! এখন কী করবো’। বাদশা সিন্দাবাদ মন্ত্রীর কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো। সাথে সাথে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো। চীৎকার করে বললো ‘আমি হরিণের সন্ধানে ছুটলাম। যতক্ষণ না তাকে পাকড়াও করতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত ফিরছি না’। এই বলে বাদশা ঘোড়া ছুটালো পালিয়ে যাওয়া হরিণের খোঁজে।

বলছিলাম পালিয়ে যাওয়া হরিণের খোঁজে ছুটলো বাদশা। তাঁর যে শিকারী ঈগলটা ছিল কাঁধে বসা, সে তার বিশাল পাখা মেলে দ্রুত আগে আগে উড়ে যেতে লাগলো। উড়তে উড়তে হরিণটার নাগাল পেলো এবং তার তীক্ষ্ণধার নখর দিয়ে হরিণের চোখে আঘাত হানলো। হরিণের চোখ নষ্ট হয়ে গেল। ফলে আর পালাতে পারলো না। ততক্ষণে সিন্দাবাদও এসে পৌঁছে গেল। সিন্দাবাদ হরিণটাকে ধরে জবাই করে মাথাটা কেটে ফেললো আর মাথাহীন হরিণটাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে কিছুপথ গিয়ে একটা গাছের নিচে খানিক বিশ্রাম নিলো।

কিছুক্ষণ পর দেখলো ঐ গাছটির ওপরের শাখা থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। সিন্দাবাদ এমনিতেই ক্লান্ত ছিল তদুপরি তৃষ্ণাও লেগেছিল ভীষণরকম। সেজন্যে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে দেখে খুশি হয়ে গেল। বাদশা তার ঈগলের গলায় ঝুলানো সোনার বাটিটা খুলে নিয়ে পানির ফোঁটাগুলো জমালো। জমতে জমতে যখন বাটি ভরে গেল বাদশা তখন খাওয়ার জন্যে মুখের কাছে নিতেই ঈগল দ্রুত তার পাখা ঝাপটে বাটিভর্তি পানি ফেলে দিলো। সিন্দাবাদ ঈগলের দিকে তাকিয়ে সদয় কণ্ঠে বললোঃ বুঝতে পেরেছি তুমিও খুব তৃষ্ণার্ত, না..? ঠিকাছে, একটু অপেক্ষা করো! এই বলে সিন্দাবাদ বাটিটা আবার পূর্ণ করলো। এবার বাদশা বাটিটাকে ঈগলের সামনে রেখে বললোঃ আগে তুই খা, আমি পরে খাবো।

কিন্তু এবারও ঈগল একই কাজ করলো। পাখার ঝাপটায় বাটির পানি ফেলে দিল। সিন্দাবাদ এবার মনে মনে ভাবলো নিশ্চয়ই তুমি চাচ্ছো সবার আগে আমাদের ঘোড়ার তৃষ্ণা নিবারণ করি, তাই না? ঠিক আছে। সিন্দাবাদ আবারো সোনার বাটিটা ঐ ফোঁটা ফোঁটা পানিতে পূর্ণ করলো। এবার পানিভর্তি বাটিটা নিয়ে রাখলো ঘোড়ার সামনে। ঘোড়া পানিতে মুখ দেওয়ার আগেই ঈগল আবারো তার পাখার ঝাপটায় বাটি ফেলে দিলো। পানি এবারো পড়ে গেল মাটিতে। পরপর তিনবার বাটিভর্তি করেছে সিন্দাবাদ। তিনবারই ঈগল পানিভর্তি বাটি ফেলে দেওয়ায় সিন্দাবাদের ভীষণ রাগ হলো। এবার সে ঈগলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চীৎকার করে উঠে তলোয়ার দিয়ে ঈগলের পাখায় মেরে বললোঃ এই শয়তান ঈগল! তুই না নিজে পানি খেলি, না আমাকে খেতে দিলি না ঘোড়াকে। কী পেয়েছিস তুই, আমার কষ্ট হয় না বাটি ভর্তি করতে।

ঈগলের পাখা রক্তে ভিজে গেল। তবু তার চোখদুটো কেমন যেন উদ্বিগ্ন উদ্বিগ্ন দেখালো। সেই চোখে ঈগল সিন্দাবাদের দিকে তাকালো এবং ঘাড় ফিরিয়ে গাছের দিকে ইশারা করলো। বারবার এরকম ইশারা করায় সিন্দাবাদ সেদিকে তাকালো এবং গাছের শাখায় দৃষ্টি দিলো। গাছের শাখায় দৃষ্টি দিতেই সিন্দাবাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য দেখলো সে। ভয়ংকর এক বিশাল সাপ গাছের শাখাটিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধরে আছে। আর তার মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বিষ চুঁইয়ে পড়ছে নীচে। সাপটির দিকে তাকিয়ে এক ভয়ংকর আতঙ্কে শিউরে উঠলো সিন্দাবাদ। সাথে সাথে অনুতাপে চীৎকার করে উঠলোঃ আহ।! এ আমি কী করলাম।

অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ঈগলটাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে তার রক্তাক্ত পাখায় চুমু খেয়ে বললোঃ হে আমার প্রিয় সহচর পাখি! তুই আমার জীবন বাঁচালি আর আমি তোকে কীরকম আঘাতটাই না করলাম। এই বলে ঈগলটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত গতিতে প্রাসাদে ফিরে গেল। ক্লান্ত শ্রান্ত সিন্দাবাদ প্রাসাদে পৌঁছে হরিণটা রান্নার কাজে নিয়োজিতদের কাছে দিয়ে দিলো। আর নিজে ঈগলটাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। ঈগল তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাসগুলো নিচ্ছিলো। সিন্দাবাদ রাগে ক্ষোভে আর অনুশোচনাপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো আর তার পাখাগুলোতে হাত বুলাতে লাগলো। অবশেষে সিন্দাবাদের হাতেই ঈগল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। আর সিন্দাবাদ এক জীবনের অনুতাপ বুকে নিয়েই বেঁচে থাকলো। চোখ থেকে তার ঝরে পড়লো রক্তের মতো বিন্দু বিন্দু অশ্রুর ফোঁটা।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত