সী-মোরগ

সী-মোরগ

ইরানের ধ্রুপদী সাহিত্যে কিংবা রূপকথায় এই সী-মোরগ বিভিন্ন রূপে ও প্রতীকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে।

এক গরীব লোক তার বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে বাস করতো। কাজকর্ম ছিল না তার। ভবঘুরে জীবনযাপন করতো। কিন্তু এভাবে তো আর জীবন চলে না। অবশেষে তার স্ত্রী ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে গিয়ে একদিন তাকে বললো: “অনেক তো হলো! বেকার ঘুরে আর কতদিন কাটাবে। ভবঘুরে হয়ে কাটালে তো জীবন চলবে না। এভাবে কোনো ফায়দা নেই। বরং যাও! কাজকর্ম খুঁজে বেড়াও”! লোকটা ভাবলো কথা তো মন্দ না। বৌ তো ঠিকই বলেছে। বেচারা অগত্যা বেরিয়ে পড়লো কাজের খোঁজে। এখানে সেখানে কতখানে যে গেল, কোনো লাভ হল না। কাজের সন্ধান পেল না। কী করা যায়! এই বেকারমূর্তি কিংবা নিলাজ চেহারা কী করে বৌকে দেখানো যায়! ছি ছি করবে বৌ! বৌয়ের মুখের তিরস্কার কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। শুনতে চায় না তার মুখনিসৃত পবিত্র সুখহানিকর বাণী।

বিষন্ন মনে লোকটা গেল সমুদ্রের দিকে। তীরে দাঁড়িয়ে ভাবলো এই অপয়া জীবনের কোনো মূল্য নেই। মূল্যহীন জীবন না রেখে বরং ওই সমুদ্রের পানিতে আত্মাহুতি দেয়াই শ্রেয়। বৌয়ের যন্ত্রণা আর তিরস্কার শুনতে হবে না। কাজের খোঁজে বেকার ঘুরে ঘুরে হতাশার সাগরে ডুবতে হবে না। এই সাগরে একবার ডুবে মরলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। এই ভেবেই সে সোজা নেমে গেল সমুদ্রের তরঙ্গময় পানিতে। কিন্তু ডুবে মরা কি এতই সহজ! না। ডুবতে গিয়েও ডুবতে পারলো না। কেবলি ভেসে উঠছিল তার শরীর। এমন সময় সমুদ্রের উপর থেকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল একটি সী-মোর্‌গ। সী-মোর্‌গ দেখছিল একটা লোক ডুবে মরার চেষ্টা করছে। সে দ্রুত নীচে নেমে এলো এবং তার নখের পাঞ্জায় লোকটাকে আটকে তুলে নিয়ে গেল পানি থেকে।

সী-মোর্‌গ আশ্চর্য এক পাখি। ইরানি রূপকথার জগতে বহুকাল ধরে বিচরণকারী এই পাখিটি অদ্ভুতরকমভাবে কথা বলতে জানে এবং মানুষের অবস্থাও বুঝতে পারে। আমরা তাই রূপকথার অন্যতম উপাদান এই পাখিটির নাম পাল্টাবো না, সী-মোর্‌গই বলবো। তো পাখিটি লোকটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখলো তার আপাদমস্তক হতভাগ্যে পরিপূর্ণ। সী-মোর্‌গ দ্রুত উড়ে গিয়ে সমুদ্র থেকে একটা বড় মাছ ধরে নিয়ে এলো এবং মাছটা লোকটার হাতে দিলো। লোকটা খুশি হয়ে মাছটা নিয়ে ফিরে যেতে মনস্থির করল নিজ শহরের দিকে। সেখান থেকে বাসার দিকে যেতে পথে দেখা হলো বদমাশ ধরনের এক লোকের সাথে। দুষ্ট লোকটার নজর পড়লো সুন্দর ওই মাছের ওপর। সে দশ সির আটার বিনিময়ে মাছটা নিয়ে নিতে চাইলো। প্রাচীন পরিমাপে দশ সির এখনকার এক কেজি’র চেয়ে কিছু কম,পৌনে এক কেজির মতো হয়। কিন্তু হতভাগ্য লোকটা তাতেই খুশি হয়ে মাছটার বিনিময়ে ওই দশ সির আটা নিয়ে নিলো।

আটা নিয়ে বাসায় ফেরার পর তার বৌ বললো: “এই কাজটা আরও আগে করলে কী হতো! প্রতিদিন এই পরিমাণ আটা নিয়ে এলেই তো চলে। বাচ্চাদেরও খিদে মিটে যায় আর কান্নাকাটি করে না”। বৌয়ের কথা শুনে লোকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভালোভাবেই ঘুমিয়ে কাটালো রাতটা। পরদিন আবার সে গেল বাজারের দিকে কাজের সন্ধানে। কিন্তু আজও কোনো কাজ তার ভাগ্যে জুটলো না। অবশেষে আবারও সে অভিশপ্ত এই জীবন ধ্বংস করার জন্য মানে আত্মহত্যা করার উদ্দেশে সমুদ্রের দিকে গেল এবং গতকালের মতোই পানিতে যুবে মরতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আজও সৌভাগ্যক্রমে ওই সী-মোর্‌গ এসে তাকে উদ্ধার করলো। গতকালের মতো আজও একটা মাছ ধরে এনে দিলো তাকে।

কিন্তু আজও একই ঘটনা ঘটলো। দুষ্ট লোকটা পথের মোড়ে বসে ছিল এবং সামান্য আটার বিনিময়ে মাছটা নিয়ে গেল। বাসায় ফেরার পর আজও তার স্ত্রী যখন দেখলো স্বামি তার খালি হাতে ফেরে নি তখন তাকে বললো: একেই বলে পুরুষ! প্রতিদিন সন্ধ্যায় এতটুকু আটা এনে দিলেই তো বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়,আর কোনো টেনশন থাকে না। লোকটা মানে মহিলার স্বামী কোনো উত্তর দিলো না। বললো না কোত্থেকে কীভাবে এই আটার ব্যবস্থা হচ্ছে। রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে আবারও এক বুক আশা নিয়ে শহরের দিকে গেল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাজারের অলিগলি দোকানপাট সর্বত্র ঘুরেও একটা ছোটোখাটো কাজও জোটাতে পারলো না। অগত্যা চলে গেল সেই আগের দিনের মতো সমুদ্রের দিকে। গভীর পানিতে নেমে ডুবে মরতে চাইলো।

ঘটনাক্রমে আজও সেই সী-মোর্‌গ এসে দেখলো সেই লোকটাই ডুবে মরতে চাচ্ছে। সী-মোর্‌গ ভাবলো এই লোক মনে হয় তার জীবনের ভার সহ্য করতে পারছে না। সুতরাং তার মরে যাওয়াই ভালো। যে বারবার মরে যেতে চায় তাকে উদ্ধার করার কী দরকার। এটা বোধ হয় লোকটার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই মরতে আসে। যাক মরুক গে,আমার কী! কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবলো: যদি সত্যি সত্যিই লোকটা মরে যায়! তাহলে কী হবে। এই ভেবে লোকটার দিকে তাকাতেই দেখলো লোকটা সত্যিই আত্মহত্যাই করতে চাচ্ছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এভাবে তার চোখের সামনে যদি কেউ মরে যায় আর সে যদি তাকে না বাঁচায় তাহলে তো তার মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী থেকে যাবে! কারো মৃত্যুর দায়ভার সী-মোর্‌গ নিতে চায় না,তাই লোকটাকে আজও পানি থেকে তুলে নিয়ে বাঁচালো এবং আগের দিনগুলোর মতোই একটি মাছ তুলে এনে তার হাতে দিলো।

কিন্তু সী-মোর্‌গের মনে হলো এই হতভাগ্য বোধ হয় জানে না এই মাছের কী মাহাত্ম্য। সেজন্য বললো: নিজেকে কেন পানিতে ডুবিয়ে মারতে চাও? তোমাকে যে প্রথম মাছটি আমি দিয়েছিলাম ওই একটা মাছই তো তোমার সাত প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট ছিল! তারপরও কেন মরতে আসো?

সী-মোরগ: (২)

ইরানের ধ্রুপদী সাহিত্যে কিংবা রূপকথায় এই সী-মোরগ বিভিন্ন রূপে ও প্রতীকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। এক গরিব লোক সংসারের ভার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে ডুবে মরতে চাইলে সী-মোরগ পরপর কয়েকবার তাকে উদ্ধার করে একটি করে মাছও তার হাতে দিয়ে দেয়। লোকটির কাছ থেকে ধুরন্ধর এক ব্যক্তি সামান্য আটার বিনিময়ে ওই মাছ নিয়ে নেয়।

তৃতীয়বারের মতো এই ঘটনা ঘটলে সী-মোরগ বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করে: তোমাকে যে প্রথম মাছটি আমি দিয়েছিলাম ওই একটা মাছই তো তোমার সাত প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট ছিল! তারপরও কেন মরতে আসো?

সী-মোরগের প্রশ্নের জবাবে এবার আত্মহত্যা করতে যাওয়া লোকটি বললো: প্রথম মাছটির বিনিময়ে সামান্য আটা নিয়ে বৌয়ের হাতে দিয়েছি। দ্বিতীয় মাছটিও সেরকমই সামান্য আটার বিনিময়ে নিয়ে নিয়েছে এক লোক। সেই আটায় রুটি বানিয়ে বাচ্চাদের দিয়েছি। এটা কি কোনো জীবন হলো? আমার কপালটা এমন কেন!

সী-মোরগ বললো: কপালের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তোমাকে যে মাছগুলো দিয়েছি সেগুলোর পেট ছিল সোনা-রূপায় ভর্তি।

শুনেই লোকটির বুক থেকে দীর্ঘ একটি শ্বাস বেরিয়ে গেল আকাশের শূন্যতায়। এবার যে মাছটি তার হাতে আছে ভালো করে সেটিকে ধরলো এবং ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

কিন্তু আজও পথের মোড়ে সেই প্রতারক ধোঁকাবাজ লোকটি তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। যখনই সে দেখতে পেল আরেকটি মাছ নিয়ে লোকটি বাসার দিকে ফিরছে সামনে এগিয়ে গিয়ে আগের মতোই বললো: দাও, মাছটা দাও আর তার বিনিময়ে এক মুষ্টি আটা নিয়ে যাও। প্রস্তাব শুনে লোকটি আজ হাসলো। প্রতারক লোকটি বললো: ঠিক আছে,দুই মুষ্টি দেবো। এবারও হাসলো। প্রতারক এবার তিন মুষ্টি,চার মুষ্টি.. এভাবে বাড়াতে লাগলো। কিছুতেই আজ লোকটি তার মাছ দিতে চাইলো না। প্রতারক লোকটি বুঝতে পারলো যে আজ কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে। বললো: ঠিক আছে এক হাজার দিনার দেবো,দাও।

লোকটা তারপরও মাছ বিক্রি করতে রাজি হলো না। এবার প্রতারক লোকটা মাছওয়ালার কলার টেনে ধরলো। শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি থেকে মারামারি।

মারামারির এক পর্যায়ে টহলরত পেয়াদারা এসে দুজনকেই ধরে নিয়ে গেল বাদশার দরবারে। বাদশাহ তাদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনা দেখে জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে তোমাদের? চীৎকার করছো কেন? জবাবে মাছ হাতে লোকটি বললো: হুজুর! তিনটি মাছ আমি পেয়েছি। মাছগুলোর পেট সোনারূপায় পরিপূর্ণ। ঘরে খাবার নেই। বাচ্চারা অভুক্ত। এই প্রতারক আমার কাছ থেকে পরপর দুদিন দুটি মাছ নিয়ে আমাকে প্রথমদিন দিয়েছে এক মুষ্টি আটা। দ্বিতীয় দিন একটি মাছের বিনিময়ে দিয়েছে সামান্য আটা। আজও সে এই তৃতীয় মাছটিও নিতে চায়। আমি দিতে চাচ্ছি না বলেই সে আমাকে মারার চেষ্টা করছিল।

বাদশাহ এবার আগের দুটি মাছ নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিলেন। মাছগুলো নিয়ে আসার পর সেগুলোর পেট ফাঁড়তেই বেরিয়ে এল জ্বলজ্বল সোনারূপা। এগুলো দেখে তো বাদশাহ হতবাক। দুই ঠোঁটে আঙুল কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। মনে মনে বললেন: খোদার কী কুদরত! মাছের পেটে এতোসব সোনা-জহরত…!

বাদশাহ এবার লোকটাকে তার মাছগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বললেন: সত্যি করে বলো তো! এই মাছগুলোর রহস্য কী! কোত্থকে এনেছো এগুলো? লোকটি এবার তার সাংসারিক দুরবস্থার বিবরণ তুলে ধরলো এবং বললো খাবার জুটাতে না পেরে সমুদ্রে ডুবে মরতে চেয়েছিল। সী-মোরগ তখন তাকে বাঁচিয়েছিল এবং পরপর তিনদিন সী-মোরগ তাকে একটি করে মাছ এনে দিয়েছিল তার হাতে। এসব শুনে বাদশা বললো: যাও! ওই সী-মোরগটাকে নিয়ে আসো আমার কাছে।

মাছগুলো ফেরত পেয়ে যতটুকু আনন্দিত হয়েছিল লোকটি এবার তারচেয়েও বেশি কষ্ট পেয়ে ব্যথা বুকে লালন করে খালি হাতে ফিরে গেল বাড়িতে। মনে মনে ভাবলো, হায় কপাল! ভাগ্য আমার উন্নতির পথে আবারও বিশাল পাথর এনে ফেলে রেখেছে। কী যে করি!

বাসায় ফিরতেই তার বৌ রেগেমেগে জিজ্ঞেস করলো: কী হলো আবার! খালি হাতে ফিরলে যে! আটা কই! লোকটি বললো: শান্ত হও বৌ! সব বলছি।

এই বলে যা যা ঘটেছিল সব ঘটনা বৌ সে খুলে বললো। সবশেষে বললো: বাদশাহ এখন আমাকে ওই পাখিটাকে মানে সী-মোরগকে তার কাছে এনে দিতে বললো। এখন কী করি বলো! আমি সী-মোরগকে কী করে ধরবো আর বাদশার কাছে নিয়ে যাবো!

কথা শুনে বৌয়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে ভাবতেই চাইলো না তার স্বামীর কপালে কী দু:খ এসে ভর করেছে। সে বরং ভাবলো যাক এবার বুঝি তার কষ্টের দিন শেষ হতে যাচ্ছে। তার চোখেমুখে সোনার ঔজ্জ্বল্য চকমক করতে লাগলো।

বেচারা লোকটি কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে সকালে সূর্য উঠতেই বাড়ি থেকে বের হলো। ভেবে কুল পাচ্ছিলো না কী করবে সে। একবার ভাবে এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাবে। তাতে অন্তত এই জটিল পরিস্থিতি আর মানুষগুলোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু তারচেয়ে সহজ বুদ্ধি হলো আগের সিদ্ধান্তে ফিরে যাওয়া মানে সমুদ্রে ডুবে মরা। হয়তো তাতে কোনো উপায় বেরিয়ে আসবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। সোজা সমুদ্রে গিয়ে ডুবে মরতে চাইলো। ঘটনাক্রমে আজও নেই সী-মোরগ আকাশে উড়ছিল। সে দেখলো লোকটি ডুবে মরার চেষ্টা করছে। ভাবলো এর বদ অভ্যাস হয়ে গেছে। লোভে পেয়েছে ওকে। মরুক গে। এরকম মানুষের মরে জাহান্নামে যাওয়াই ভালো।

সী-মোরগ আর নীচে এলো না। উপর থেকেই দেখছিলো। যখন দেখলো বিশাল বিশাল ঢেউ তার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সী-মোরগ ভয় পেয়ে গেল এবং নীচে নেমে এসে তাকে উদ্ধার করলো এবং বললো: আবারও মরতে এসেছো তুমি? যাও! মরতেই যদি চাও এমন জায়গায় গিয়ে ডুবে মরো যেখানে আমি তোমাকে দেখতে পাবো না। লোকটি: আমি মাছের লোভে আসি নি। কেন এসেছি শোনো। এই বলে বাদশার পুরো ঘটনা সী-মোরগকে খুলে বললো।#

সী-মোরগ: (৩)

লোকটির সমস্ত ঘটনা শুনে সী-মোরগ আশ্চর্য হয়ে যায়। ভাবতে পারছিলো না কী করবে সে। মনে মনে ভাবলো যদি বাদশার দরবারে না যায় তাহলে বাদশা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা লোকটাকে ধরে তার গর্দান নিয়ে নেবে।

আর যদি যায় তাহলে তার নিজের বাচ্চা দুটো ক্ষুধায় মারা যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলো লোকটার সাথেই যাবে বাদশার দরবারে। লোকটা নীচে পায়ে হেঁটে পা বাড়ালো বাদশার দরবারে আর কান্নারত সী-মোরগ শূন্যেই বাদশার প্রাসাদের দিকে চললো।

কিছুদূর যাবার পর দেখা হয়ে গেল বাদশার ছেলে মানে রাজপুত্রের সঙ্গে। রাজপুত্র বা শাহজাদা যাচ্ছিলো শিকার করতে। লোকটাকে দেখে শাহজাদা বললো: কোথায় যাচ্ছো। লোকটা রাজপুত্রের প্রশ্নের জবাবে তার জীবনকাহিনী শুনিয়ে দিয়ে বললো: অনেক কষ্টে ওই সী-মোরগকে রাজি করিয়েছি প্রাসাদে যেতে। কিন্তু সমস্যা হলো সী-মোরগের দুটি বাচ্চা আছে। সে যদি এখন প্রাসাদে যায় বাচ্চা দুটো ক্ষুধায় মারা যাবে। সে জন্য সী-মোরগ ভীষণ উদ্বিগ্ন। বাচ্চাদের জন্য দুশ্চিন্তায় কাঁদছে সে। শাহজাদা সী-মোরগের চোখে অশ্রু দেখে কষ্ট পেলো। লোকটাকে বললো: তুমি সী-মোরগকে ছেড়ে দাও! রাজদরবারে গিয়ে বাদশাকে বলবে যে আমি সী-মোরগকে নিয়ে আসছিলাম কিন্তু শাহজাদার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার আদেশে আমি পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছি যেন সে বাসায় ফিরে গিয়ে বাচ্চা দুটোকে খাবার দেয়।

সী-মোরগ শাহজাদার নম্রতায় খুশি হয়ে তাকে তার দুটো পালক উপহার দিয়ে বললো: যখনই কোনো সমস্যায় পড়বে এবং সমাধানের কোনো কূলকিনারা পাবে না তখনই এই পালক আগুন দিয়ে পুড়বে আর তখনই আমি এসে হাজির হয়ে যাবো। এই বলে পাখি উড়ে চলে গেল তার বাচ্চাদের কাছে। শাহজাদা তার ঘোড়ায় চড়ে গেল শিকারের সন্ধানে আর লোকটা গেল রাজদরবারের দিকে। রাজদরবারে খালি হাতে যাওয়ায় বাদশাহ ভীষণ ক্ষেপে গেল। লোকটা বাদশাকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করার পর বাদশা এবার ক্ষেপলো শাহজাদার ওপর। বললো: এই ছেলে দেখতে পারে না তার বাবার কাছে একটা সী-মোরগ থাকুক। ওর হাতে বাদশাহির ভার ন্যস্ত করলে কী করবে,কে জানে! শিকার থেকে ফিরে আসুক! সোজা জল্লাদের হাতে তুলে দিয়ে বলবো গর্দান কেটে ফেলতে।

দুদিন পর শাহজাদা ঠিকই ফিরলো শিকার থেকে। সোজা বাবার কাছে গিয়ে হাজির হলো। বাদশাহ সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলো: সী-মোরগকে ছেড়ে দিলে কেন? ওই পাখির পরিবর্তে এখন তোমাকে হত্যা করা হবে।

ছেলে বললো: তুমি আমার পিতা। তোমার যা খুশি করবার অধিকার আছে। তবে আমাকে একটু সময় দাও, মরবার আগে দুই রাকআত নফল নামাজ পড়ে নিই।

বাদশাহ অনুমতি দিলো এবং শাহজাদা দ্রুত চলে গেল প্রাসাদের ছাদের ওপর। সেখানে সে দু রাকাত নামাজ পড়লো। সালাম ফিরিয়েই সে সী-মোরগের দেওয়া একটি পালকে আগুন ধরাতেই সী-মোরগ উড়ে এসে হাজির হয়ে গেল। শাহজাদা বললো: বাদশাহ মানে আমার বাবা চাচ্ছে আমাকে হত্যা করতে। কারণটা হলো তোমাকে মুক্তি দেওয়া। সী-মোরগ এ কথা শুনেই তার পাখা বিস্তার করে দিলো। শাহজাদা পিঠে সওয়ার হলো এবং পাখি উড়ে গিয়ে সোজা পার্শ্ববর্তী শহরের একটি বাড়ির দরোজার পাশে পৌঁছে তাকে নামিয়ে দিলো।

শাহজাদা এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। দেখলো এক বুড়ি বসে আছে ভেতরে। বুড়িকে বললো: আমি এখানে নতুন এসেছি,অপরিচিত মানুষ, কাউকে চিনি না জানি না। কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। আপনার ঘরে কি এই রাতটা কাটানোর সুযোগ হবে? সকালেই চলে যাবো।

বুড়ি বললো: না, জায়গা নেই। আমার ঘরটা পাখির বাসার মতোই ছোট। কটা দুম্বার বাচ্চা গরু আর গাধার বাচ্চাও আছে।

শাহজাদা কটা সোনার কয়েন বুড়ির হাতে দিতেই বুড়ির অবস্থা পাল্টে গেল। বললো: আমার ঘরে বাদশার এক বাহিনীর জায়গা হবে। আমি একা বৈ ত নই। শাহজাদা গেল বুড়ির ঘরের ভেতর। সেখানে কয়েকদিন কাটালো। একদিন গেল শহরের ভেতরের কী খবরাখবর,জানতে। বুড়িকে জিজ্ঞেস করলো: তোমাদের শহরে কি দুজন বাদশাহ?

বুড়ি বলল: হ্যাঁ! বাদশাহ এবং শাহজাদি দুজনই এই শহরের নিরীহ লোকজনের শাসক। আমরা হলাম বেচারা জনগণ-খাজনা দিতে দিতেই জীবন শেষ। একবার খাজনা দিতে হয় বাদশাহকে আরেকবার দেওয়া লাগে তার কন্যাকে। শাহজাদা একথা শুনে বলল: হে মা! তুমি তো অনেক করেছো,এবার আমাকে নিয়ে চলো ওই শাহজাদির কাছে। বুড়ি বলল: নিয়ে যেতে পারি। তবে বাদবাকি তুমি সামলাবে। শাহজাদি যদি তোমাকে পছন্দ করে তাহলে তো আর কথা নেই। কিন্তু যদি তার পিতা মানে বাদশাহ এসে পড়ে তাহলে কিন্তু তোমার রক্ষা নেই,তোমার গর্দান যাবে। শাহজাদা বলল: সমস্যা নেই। ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে।

বুড়ি বলল: ঠিক আছে নিয়ে যাবো তোমাকে, একেবারে শাহজাদির পালঙ্কের নীচে। তবে হ্যাঁ! তুমি রুমাল দিয়ে শাহজাদির হাত দুটো বেঁধে ফেলবে। যদি তোমাকে শাহজাদির পছন্দ না হয় রে বাপু! তাহলে কিন্তু খবর আছে! শাহজাদির চল্লিশজন নারী প্রহরী আছে, তারা তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ওই চল্লিশ প্রহরী প্রতিদিন সকালে শাহজাদিকে ফুল দিয়ে সাজায়। বুড়ি সব জানতো। কীভাবে এবং কখন শাহজাদির কাছে যাওয়া যাবে সেটা ভালো করেই জানতো বুড়ি। সে অনুযায়ী শাহজাদাকে ঠিকঠাকমতো শাহজাদির পালঙ্কের নীচে পৌঁছিয়ে দিয়ে বুড়ি চলে গেল। শাহজাদা সুযোগ বুঝে শাহজাদির হাত রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলল। শাহজাদি তার কক্ষে যুবকের আগমন দেখে তার রক্ষীদের ডাকলো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত