হাতি ও খরগোশ

হাতি ও খরগোশ

সেই প্রাচীন কালের কথা। পৃথিবীর দূর কোনো প্রান্তে একটা পানির উৎস বা ঝর্ণা প্রবাহ ছিল। পানিভর্তি ওই প্রবাহের পাশেই পরম আনন্দে সুখে শান্তিতে বাস করত এক দল হাতি। এই যে ঝর্ণাধারার পানির প্রবাহ এই পানির মূল উৎস হলো বৃষ্টি। যতো বৃষ্টি বেশি হতো তত বেশি বরফ জমত। আর সেই বরফ গলা পানি থেকেই ঝর্ণাপ্রবাহের সৃষ্টি হতো। কিন্তু এক বছর তেমন একটা বৃষ্টি হলো না। বৃষ্টি না হবার ফলে ঝর্ণাধারার পানি কমতে কমতে একেবারে শুকিয়ে গেল। হাতিগুলো পড়ে গেল মহা দুশ্চিন্তায়। তারা এখন পানি খাবে কোত্থেকে। হাতিদের রাজা আদেশ দিল পানিময় আরেকটি উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বেড়াতে। হাতির দল খুঁজতে বেরিয়ে গেল এবং একটি সুন্দর জায়গাও বের করে ফেলল-পানিভর্তি ঝর্ণাধারার তীরে। সবাই সেখানে চলে গেল।

ঝর্ণাধারাটি ছিল ঠাণ্ডা পানির। চমৎকার ওই ঝর্ণাপ্রবাহের তীরে বাস করতো একদল খরগোশ। পানির পিপাসায় ক্লান্ত শ্রান্ত হাতিরা যখন ঝর্ণাধারাটি দেখতে পেল পানি খাবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে দৌড়ে গেল নালাটির দিকে। খরগোশের দিকে তাকানোরও ফুরসৎ হলো না তাদের। এদিকে বিশালদেহী হাতির মস্ত ভারি পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে মারা পড়লো বেশ কিছু বাচ্চা খরগোশ। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে খরগোশগুলো তাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পালিয়ে গেল। হাতিগুলো প্রতিদিনই পানি খেতে আসতো এই ঝর্ণাপ্রবাহেন কাছে। খরগোশেরা তাই ভীষণ বিরক্ত এবং অসন্তুষ্ট ছিল হাতিদের ওপর।

বিশেষ করে হাতিদের কারণে তারা তাদের সুখ শান্তি হারিয়েছে, হারিয়েছে তাদের স্বাধীন জীবন যাপন, হারিয়েছে নিশ্চিন্তমনে পানি খাবার প্রশান্ত পরিবেশ। যখনি তারা পানি খেতে ঝর্ণাধারার কাছে যাবার চেষ্টা করত, দেখতো সেখানে ঘুরঘুর করছে প্রকাণ্ড কটা হাতি। তারা তাই পানির কাছে যেতে ভয় পেত। তাছাড়া হাতিগুলো পানি খেতে গিয়ে পুরো পানিকেই ঘোলা করে ফেলত, দূষিত করে ফেলত। খরগোশেরা মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কী করা যায় ভাবতে শুরু করল। পরষ্পরে আলাপ আলোচনা, শলা পরামর্শ করতে লাগল। একটি খরগোশ ছিল বেশ বয়স্ক এবং চালাক চতুর। সে বলে উঠলো: ‘আমি একটা উপায় খুঁজে বের করেছি। অচিরেই এমন একটা কাজ করবো যে হাতিগুলো আর এই ঝর্ণাধারা ধারে কাছেও আসবে না’।

খরগোশেরা তো অবাক হয়ে জানতে চাইল: কীভাবে? তোমার মতো একটা দুর্বল হাতি কীইবা করতে পারে? তুমি কি পারবে ওই মস্তবড় এবং শক্তিমান হাতিগুলোর সাথে লড়ে তাদেরকে পরাজিত করে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে? বৃদ্ধ এবং চালাক খরগোশ কিছুই বলল না। একরাশ বিস্ময় আর রহস্যের আবরণে ঢেকে রাখল খরগোশদের কৌতূহলী মন।

সেই রাত ছিল চতুর্দশীর রাত। তার মানে পূর্ণিমার রাত। আকাশের চাঁদ একেবারে পুরো গোল, জ্বলজ্বলে। বৃদ্ধ এবং চালাক খরগোশটি রাতে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার করে উঠল। খরগোশের চিৎকার হাতিগুলোর কানে গিয়ে পৌঁছল। তারা পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা কী। হাতিগুলোকে জড়ের হতে দেখে খরগোশ বলল: “হে হাতির দল! সতর্কতার সাথে শোন! আমি হলাম চাঁদের দূত! চাঁদের পক্ষ থেকে আমি এসেছি তোমাদের সাথে কথা বলতে। চাঁদ বলেছে তোমরা এমন এক ঝর্ণার পাশে এসে অবস্থান নিয়েছো যা আসলে চাঁদের জন্যে নির্দিষ্ট। তোমরা যদি আরো কিছুদিন এখানে থাকো তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই ঝর্ণার পানি শেষ হয়ে যাবে। তাই চাঁদ চাচ্ছে তোমরা যতো দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যাও। চাঁদ তোমাদের ওপর ভীষণ বিরক্ত।”

হাতিদের সর্দার বলল: চাঁদ বিরক্ত! তা কী করে হয়! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

খরগোশ বললো: ঠিক আছে। বিশ্বাস না হলে চলো তুমি নিজেই দেখ!

হাতি এ কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠল এবং খরগোশের সাথে এগিয়ে যেতে লাগলো চাঁদের বিরক্তির ব্যাপারটা দেখার জন্যে। যেতে যেতে তারা ঝর্ণাপ্রবাহের কাছে গিয়ে পৌঁছলো। পূর্নিমার পূর্ণ চাঁদের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল পানির ভেতর।

খরগোশ হাতিকে বলল: ‘এখন যদি তুমি চাঁদের বিরক্তি দেখতে চাও তাহলে তোমরা শুঁড়টাকে ওই পানির ভেতরে দাও’।

হাতি তার শুঁড়টাকে পানিতে ঢোকাতেই পানিতে ঢেউ উঠল এবং চাঁদের প্রতিচ্ছবিটা এঁকেবেঁকে দুলতে শুরু করলো। হাতি ওই দৃশ্য দেখে ভাবল সত্যিই চাঁদ রেগে গেছে এবং ক্ষুব্ধ হয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। সে খরগোশকে বলল: “ঠিকই বলেছো তুমি। আমাদের উচিত যতো দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যাওয়া। আশা করি একটা ভালো জায়গা আমরা পেয়ে যাবো। আমি যাই, হাতিদেরকে বলব আজ রাতেই এখান থেকে চলে যেতে”।

সত্যি সত্যিই হাতি তার সঙ্গীদের কাছে গিয়ে বলল: শোনো তোমরা! খরগোশ ঠিকই বলেছে। আমাদের পানি খাওয়া কিংবা পানি দূষণ করার কারণে চাঁদ হাতিদের ওপরে খুবই অসন্তুষ্ট। তাই আমাদের উচিত আজই এই স্থান ত্যাগ করে অন্য কোনো স্থানে চলে যাওয়া। নৈলে এখানকার পানিও ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে।

হাতির সর্দার কথায় সব হাতিই ঝর্ণার তীর ছেড়ে চলে গেল অন্য কোনো স্থানে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত