নাড়িরটান

নাড়িরটান

আড়াই বছরের ছোট্ট শিশু সানিম…
সবে মাত্র হাটতে শিখেছে…
বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান…
তাই, সানিমের আদরের কোনো ঘাটতি হয়না…
দেখতে দেখতে সানিমকে নিয়ে তার বাবা-মায়ের দিনগুলি খুব ভালোই যাচ্ছিল…
বাবা চাকরির কারণে বাসার বাইরে থাকায় সানিম তার মাকেই বেশি সময় কাছে পায়…
সানিম একটু বেশিই ভালোবাসে তার মাকে…
তাই, একটু চোখের আড়াল হলেই শুরু হয়ে চায় তার ওয়া ওয়া গান…
যে গান শুনে মা যেখানেই থাকুকনা কেনো,,, নাড়ির টানে ঠিকি ছুটে আসে তার কাছে…
বেশ কিছুদিন ধরেই সানিমের মায়ের শরীর খারাপ…
তিনি ঔষধ খেতে ভয় পেতো বলে,, খুব বেশি অসুস্থ না হলে ডাক্তারের কাছে যেতোনা…
তাই এখনো যাচ্ছেনা…
সামান্য নাফা জাতীয় ঔষধ খেয়েই চালিয়ে নিচ্ছে দিন…
ক্রমশ তার অসুস্থতার পরিমাণ বাড়তেই আছে….
শেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে তাকে তার পরিবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো…
কিন্তু ততক্ষণে সামান্য অসুখটাও বড় হয়েগেছে…

ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালো,,সানিমের মায়ের জন্ডিস হয়েছে…
সেদিনের মতো এক গাধা ঔষধ দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো..
এবং রেস্ট এ থাকতে বলল…

হাই পাওয়ারের ঔষধ খাওয়ার কারনে সানিমের মায়ের শরীর এখন অনেক দুর্বল থাকে…
তাই, দিনের অনেকটা সময়ই তাকে এখন ঘুমিয়ে কাটাতে হয়…
যখন ঘুম ভাঙ্গে,, তখন সে সানিমের টুকটাক খবর নেয়…
বাকি সময়টা সানিম তার নানু আর খালামোনির সাথেই কাটায়…

ছোট্ট শিশু সানিমও হয়তো এতদিনে বুঝেগেছে তার মায়ের অবস্থার কথা…
তাই সেও এখন আর মা আড়াল হয়েগেলে ওয়া ওয়া গান ধরেনা…
কারন সে জানে, মা ঘুমাচ্ছে… ঘুম ভাংলে ঠিকি আবার তার কাছে আসবে… তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করবে…
তাই আর মাকে সে ডিস্টার্ব করেনা…
একা একাই খেলে যায় মায়ের আশে-পাশে…

যখন কেউ তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়, সে আনমনে হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে…
কোনো শব্দ করেনা…
মাঝে মাঝে নরম হাতে আলতো করে মায়ের মুখটি স্পর্শ করে…
মুখে, নাকে, চোখে, গালে হাত দেয়…
কিন্তু মা তার দিকে ফিরেও তাকায়না…

হয়তো তার কাছে সেই আগের মা আর নেই…
তাই,,আগের মতো এখন আর মায়ের আদরও পায়না সে…
সারাক্ষণ মায়ের আশপাশ ঘুরঘুর করে মায়ের একটু আদরের জন্য..
কিন্তু মা ফিরেও তাকায়না…
মাঝেমাঝে একটু কোলে তুলে নিয়ে আদর করে আবার ঘুমিয়ে যায়…
এতে খুব অভিমান হতো সানিমের…
হয়তো ইচ্ছে করতো আর মায়ের কাছে আসবেনা…
কিন্তু নাড়ির টান যে তাকে বারবার মায়ের কাছেই ফিরিয়ে আনে…

এভাবেই চলছিল সানিমের মান-অভিমান…
দিনে দিনে তার মায়ের অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো…
শেষে আবারো পরীক্ষা করে দেখা গেলো তার মায়ের লিভার জন্ডিস….
লিভারের সিংহ ভাগ অংশই নষ্ট হয়েছে….
মানে, তার জীবনের সময় দিনে দিনে ঘনিয়ে আসছে…
ডাক্তারাও হাল ছেড়ে দিয়েছে…

হাসপাতালের বেডে মুমূর্ষু অবস্থায় শুয়ে সানিমের মা…
মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো…
আর সানিম রয়েছে বাড়িতে…
কিন্তু আজকে কেনো জানি সানিম খুব ওয়া ওয়া গান গাইছে…
থামছেইনা কিছুতে…
শেষে তার কান্না আর থামাতে না পেরে তার খালামোনি তাকে তার মায়ের কাছে হাসপাতালে নিয়ে যায়…
যখন সানিমকে তার মায়ের পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো,, সাথে সাথেই তার কান্না বন্ধ হয়েগেলো…
যেখানে ওয়া ওয়া গানে চারিদিক মুখরিত ছিল,,, সেখানেই এখন নিস্তব্ধতারা গান ধরেছে…
চারিদিক নিরব হয়ে আছে…
সবাই দেখছে মা-ছেলের কাহিনী…

সানিম আলতো করে ছুয়ে দিচ্ছে তার মাকে…
সে যেনো বলছে,, ” মা উঠো… আর কত ঘুমাবা…. অনেকতো ঘুমালা… এবার আমাকে একটু আদর দাও…”
কিন্তু না,,, তার মায়ের কোনো সারা নেই….
সবার চোখেই পানি টলমল করছে…
এত নাড়ানোর পরেও কোনো সাড়া না পেয়ে সানিম আবারো ওয়া ওয়া গান ধরেছে…
আর সেই গানেই ঘুম ভাংলো তার মায়ের…
চোখ খুলেই ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগলো…
এমন ভাবে আদর করতে লাগলো,, যেনো এইটাই তার ছেলের প্রতি তার শেষ আদর…
আর কখনো কাছে পাওয়া হবেনা তার আদরের মানিক প্রিয় সানিমকে…
হয়তো সানিমও তা বুঝতে পেরেছি,, এইটাই ছিল তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শেষ আদর…
তাই সেই নাড়ির টানেই আজ বাড়ি থেকে ছুটে এসেছে হাসপাতালে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মায়ের কাছে….

হঠাৎ,,আদর করতে করতেই তার মায়ের নিঃশ্বাস ভারি হতে লাগলো..
জোড়ে জোড়ে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে পাড়ি জমালো পরপারের সেই অচিনপুরে…

সানিমের হাত ছেড়ে দিল তার মা…
সানিম ভাবছে তার মা আবারো ঘুমিয়ে গেছে…
তাই সেও হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে এলো খালামোনির কোলে…
সবাই কাঁদছে….
তা দেখে সানিমেরও কান্না পাচ্ছে…
কিন্ত সে জানেনা কেনো সবাই কান্না করছে…
কিন্তু নাড়ির টানে যেনো সে ঠিকি বুঝতে পেরেছে,,তার মা তাকে বলছে,,”আমি চলে যাচ্ছি বাবা…. ভালোথাকিস তোরা…!”

কিন্তু তারপরেও সে আজো অপেক্ষায়,, আবারো তার মার ঘুম ভাংবে…
ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আদর করবে তাকে…

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত