পার্বত্য এলাকা। আশেপাশে গাছপালা ভর্তি। সেসব গাছপালার ভেতর বাস করতো কিছু বুনো পাখি। বুনো পাখি মানে গৃহপালিত পাখি নয়, শিকারী পাখি। তাদেরই মতো আরো কিছু পাখির কাছে বড়ো একটি গাছের মগডালে বাসা বেঁধেছিলো একটি কাক। কাকের বাসার পাশে ছিলো একটি তিতির পাখির বাসা। শাহী তিতির। কাক আর তিতির প্রতিবেশি হিসেবে দীর্ঘদিন বসবাস করার সুবাদে দুজনের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ভালোই কাটছিলো তাদের।
একদিন তিতির পাখিটা একা একা গিয়েছিলো মরুপ্রান্তরে। সেদিনই যে প্রথম একাকী প্রান্তরে গেছে তা নয়, প্রায়ই একাকী যেতো এবং সময়মতো ফিরে আসতো বাসায়। কিন্তু এদিন কেন যেন ফিরে এলো না। কাক তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবলো আসবে হয়তো। অপেক্ষা করা যাক। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে বেশ কদিন কেটে গেল। তবু তিতির ফিরে এলো না। কাক এবার মনে মনে বললো নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। নৈলে ফিরবে না কেন। সিদ্ধান্ত নিলো বন্ধুর খোঁজে বেরুবে।
এরি মাঝে তিতির প্রজাতির আরেকটি পাখি কোত্থেকে যেন কাকের বাসার পাশে উড়ে এসে বসলো। তার গায়ের রঙ তিতিরের চেয়ে আরেকটু গাঢ় খয়েরি। দেখেই বোঝা যায় বন্ধু তিতিরের স্বজাতি নয় সে। একটু পরে তার নজরে পড়লো তিতিরের খালি বাসা। সে উড়ে গিয়ে তিতিরের বাসার কাছে গেল। পরিত্যক্ত বাসা দেখে ভাবলো এখানে বোধ হয় কেউ থাকে না। সে বাসাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিলো এবং বসবাস করতে শুরু করে দিলো।
কাক দীর্ঘদিন একা একা থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সেজন্যে নতুন পাখিটির আগমনে সে খুশিই হলো মনে মনে। নতুন পাখি, নতুন প্রতিবেশি। বন্ধু বানিয়ে নিলে মন্দ কি! পুরোণো বন্ধুর তো কোনো খোজ খবরই নেই। কী আর করা। কাক আর কোথাও গেল না। পরেরদিন কাক খয়েরি তিতিরকে স্বাগত জানানোর জন্যে উড়ে গেল তার বাসায়। গিয়েই তাকে স্বাগত জানালো এবং বললো শাহী তিতির এখান থেকে চলে যাবার পর আমি দীর্ঘদিন একাকী হয়ে পড়েছিলাম। তুমি এসেছো, তাই ভালোই লাগলো। নিঃসঙ্গ থাকতে হবে না। তোমারও এই নতুন বাসায় ভালোই কাটবে আশা করি।
খয়েরি তিতির অত্যন্ত খুশি হলো কাকের স্বাগত বাণী শুনে। সেও বেশ আদব কায়দার সাথেই কাকের শুভেচ্ছা ও স্বাগত বাণীর জবাব দিলো। পরদিন খয়েরি তিতির পাল্টা সফরে কাকের বাসায় গেল। এভাবে বেশ কিছুদিন একত্রে কাটলো তাদের। ইতোমধ্যে তাদের মাঝে সখ্যতা গড়ে উঠলো। দুই বন্ধু সুখে শান্তিতেই কাটাতে লাগলো। হঠাৎ একদিন কোত্থেকে জানি শাহী তিতির ফিরে এলো তার বাসায়। এসে দেখে তার বাসা দখল করে আছে খয়েরি তিতির। কী আশ্চর্য ব্যাপার। শাহী তিতির তার বাসায় আরেকজনকে দেখে ক্ষেপে গেল। কর্কশ কণ্ঠে বললো: তোকে আমার বাসায় থাকার অনুমতি দিয়েছে কে?
খয়েরি তিতির বললো: তোমার মাথা কি ঠিক আছে। আমি আমার নিজের বাসায় বসবাস করবো না তো কী করবো? কে তুমি? আমাকে ডিস্টার্ব করছো কেন? আর এ রকম চীৎকার চেঁচামেচি করছো কেন?
শাহী তিতিরের মাথা এবার সত্যিই খারাপ হবার উপক্রম হলো। বিরক্তির সাথে সে বললো: এটা আমার বাসা। তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে চলে যা। খয়েরি তিতির জবাব দিলো: দখলিসূত্রে এই বাসার মালিক এখন আমি।
এভাবে জবাব পাল্টা জবাবে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠলো। তাদের চীৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের বিচিত্র পাখিও এসে জড়ো হলো। তাদের মাঝে শাহী তিতিরের বন্ধু কাকও ছিলো অন্য পাখিরাও ছিলো। তারা বহুভাবে চেষ্টা করলো দুই তিতিরের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে একটা ফয়সালা করে দিতে। কিন্তু তিতিরেরা রাজি হলো না। তারা ঝগড়া করেই চললো। অন্যান্য পাখি তো জানতো না এই বাসার প্রকৃত মালিক কে?
কিন্তু কাক তো জানতো। সেজন্যে কাক চেয়েছিলো দুজনের মাঝে মিটমাট করে দিতে। তাও কোনো কাজে এলো না। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো তৃতীয় কোনো বিচারকের কাছে যাবে। যে হবে নিরপেক্ষ। সে-ই দুজনের মধ্যে কার কথা সত্য ফয়সালা করে দেবে। কিন্তু কে হবে মধ্যস্থতাকারী? অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছিলো যেহেতু কাক তাদের নিকটতম প্রতিবেশি এবং সব ঘটনা আগে থেকেই জানে, সুতরাং কাকই তাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সবচেয়ে উপযুক্ত। কিন্তু কোনো পক্ষই তাতে রাজি হলো না। শাহী তিতিরের মনে তো ক্ষোভ আছে, কাক তার খোঁজে একটিবারও যায় নি, আবার দখলদার তিতিরকেও বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে সে, ফলে তার ওপর ভরসা করা যায় না।
অন্যদিকে খয়েরি তিতির ভাবলো কাক তো প্রকৃত সত্য সম্পর্কে জানে ফলে পুরোণো বন্ধুর দিকেই সে টানবে-সেটাই স্বাভাবিক। তাই কাকের ওপর ভরসা করা বোকামি। এবার তাই বিচারকের সন্ধান করতে লাগলো সবাই। বিচারকের সন্ধান করতে করতে পাখিদের মধ্য থেকেই একটি প্রস্তাব এলো। প্রস্তাবটি হলো এই ফয়সালা পাখিদের কেউ করতে পারবে না। অন্য জাতির কাউকে বিচারক বানাতে হবে যাদের বাসার কোনো প্রয়োজন নেই। এক পাখি তখন প্রস্তাব দিলো বেড়ালের বাসার প্রয়োজন নেই। সে মানুষের মাঝে বাস করতে করতে অনেক কিছু শিখেছে। কীভাবে বিচার আচার করতে হয় মানুষের কাছ থেকে সব জেনেছে। সে-ই সবচেয়ে উপযুক্ত। তাছাড়া বেড়াল খুবই নিরীহ একটি প্রাণী। কাউকে বিরক্ত করে না। সে পারবে ন্যায়বিচার করতে। তিতিরেরা এই প্রস্তাব মেনে নিলো এবং সবাই মিলে বেড়ালের কাছে গেল। কাকও গেল সবার সাথে কী ঘটছে তা দেখার জন্যে।
বেড়াল এ সময় তার ঘরেই বসে ছিল। সে খাবারের সন্ধানে ছিল। কী খাওয়া যায়, কোথায় পাওয়া যায়, তা-ই ভাবছিল। তিতিরদের পায়ের শব্দ শুনে চোখ বুঁজে মনে মনে বললো: বাহ বাহ! তাজা পাখির ঘ্রাণ পাচ্ছি..আ..হ!
পাখিরা বেড়ালকে বাসায় দেখতে পেয়ে খুশি হলো। অপেক্ষা করতে লাগলো কখোন বেড়ালের ঘুম ভাঙে। বেড়াল চোখ খুলতেই পাখিরা তাকে সালাম জানালো। তারপর বেড়ালের কাছে সব ঘটনা খুলে বললো এবং ন্যায়বিচার করে দিতে আবেদন জানালো। বেড়াল বিচার করে দিতে সম্মত হলো এবং দুপক্ষকেই জিজ্ঞাসাবাদ করলো। উভয় পক্ষই তাদের দাবীর পক্ষে যুক্তি দিলো।
বেড়াল হঠাৎ চীৎকার করে বললো: যেমনটা ভেবেছি..তোমাদের ঝগড়ার বিষয় হলো পার্থিব এই জগতের সম্পদ নিয়ে। আসলে দুনিয়াবি সম্পদ একেবারেই ভালো না, খালি ঝগড়াঝাটি আর মারামারি কাটাকাটি ডেকে আনে। আমি এখন বুড়ো হয়েছি, চোখেও ভালো দেখি না, কানেও ঠিকমতো শুনতে পাই না। তোমরা কে যে কী বলেছো, ঠিকমতো শুনতে পাই নি। আরো কাছে এসে একটু জোরে জোরে বলো যাতে ভালো করে শুনে ন্যায়বিচার করতে পারি।
বেড়ালের কথা শুনে পাখিরা আরো কাছে এলো। তিতিরেরা আবারো তাদের আর্জি পেশ করলো এবং উপযুক্ত বিচার প্রার্থনা করলো। বেড়াল বললো: তোমাদের মধ্যে কে প্রকৃতপক্ষে বাসার মালিক! একটু জোরে বলো যেন শুনতে পাই।
পাখিরা বেড়ালের কথা শুনে ভাবলো ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। তাই আরো কাছে এলো। পাখিরা বেড়ালের কথার জবাব দিতে যাচ্ছিলো অমনি বেড়াল লাফ মেরে দুই তিতিরকেই তার পায়ের নখে আটকে ফেললো এবং মজা করে দুপুরের খাবার খেলো। খাবার সেরে জিহ্বাটাকে দুই ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে লেগে থাকা পাখির পালকগুলো পরিষ্কার করে নিয়ে প্রশান্ত মনে বললো: দুই দুর্বল যখন নিজেদের অধিকার নিয়ে নিজেদের মাঝে ফয়সালা করতে রাজি হয় না, ফয়সালা করতে অভিযোগ করে তাদের চেয়ে শক্তিমানের কাছে……… তখন প্রকৃত ন্যায় হলো আগে নিজের পেট ঠাণ্ডা করা।